Table of Contents
ভূমিকা
পৃথিবীর সব গল্পের শুরুটা বোধহয় একই রকম। সাদামাটা। তারপর সেই গল্পে চরিত্ররা আসে, ঘটনা মোড় নেয়, তৈরি হয় জটিলতা। আমাদের আজকের গল্পটাও অনেকটা সেরকমই। এই গল্পের কেন্দ্রে আছে মানুষ, তার পরিচয়, তার ভালোবাসা। আর আছে কিছু অদৃশ্য ফ্রেম, যা দিয়ে আমরা একে অপরকে দেখি, মাপি এবং বিচার করি। এই ফ্রেমগুলো অনেকটা চশমার মতো। কোনোটা গোলাপি কাঁচের, কোনোটা আবার কালো। যে যে রঙের চশমা পরে, পৃথিবীটাকে সে সেই রঙেই দেখে। কিছু ফ্রেম আসে দূর দেশ থেকে, চকচকে আর আধুনিক বলে আমাদের চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দেয়। আর কিছু ভয় জন্মায় আমাদের নিজেদের উঠোনে, খুব চেনা, খুব কাছের। সেই ভয়গুলো অনেকটা পুরনো আলমারিতে রাখা ন্যাপথলিনের গন্ধের মতো, যা আমাদের স্মৃতি আর সংস্কৃতির সাথে মিশে আছে।
ইউনিভার্সিটি অফ অ্যালাবামা ইন হান্টসভিল-এর কমিউনিকেশন আর্টসের সহকারী অধ্যাপক, ডক্টর নুর ই মকবুল, তাঁর একটি অসাধারণ উপস্থাপনায় এই জটিল গল্পের কিছু পাতা আমাদের সামনে মেলে ধরেছেন। তাঁর আলোচনার শিরোনাম ছিল, “গ্লোবাল ফ্রেম, লোকাল ভয়: লিঙ্গ, উন্নয়ন এবং কুইয়ার রাজনীতির দৃশ্যমানতা” (Global Frames, Local Fears: Gender, Development, and the Queer Politics of Visibility)। চলুন, আমরা আজ কোনো তাড়াহুড়ো না করে, একটু সময় নিয়ে সেই আলোচনার সুতো ধরে গভীরে ডুব দিই। চেষ্টা করি বুঝতে, যে ভালোবাসাকে প্রকৃতিতে এত স্বাভাবিক আর অবারিত বলে মনে হয়, তা কেন কিছু মানুষের জন্য এতটা বিপদসংকুল, এতটা কাঁটায় ভরা এক পথ হয়ে ওঠে। এই যাত্রায় আমরা কিছু কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হব, কিছু অস্বস্তিকর সত্যকে জানব, আর হয়তো নিজেদের ভেতরের কিছু অচেনা ভয়কেও আবিষ্কার করব।
যখন যৌনতা ছিল স্বাভাবিক এক জলপ্রপাত
আজ থেকে একশ-দেড়শ বছর আগে, কিংবা তারও বহু আগে, ‘যৌনতা’ (Sexuality) নিয়ে আমাদের ধারণাটা এমন ছিল না। এখনকার মতো এতটা সংকুচিত, এতটা আইন-কানুন আর পাপ-পুণ্যের হিসাবে বাঁধা ছিল না। এখন যেমন আমরা নারী-পুরুষের ভালোবাসাকেই একমাত্র ‘স্বাভাবিক’ বা ‘প্রাকৃতিক’ বলে ধরে নিই, ব্যাপারটা মোটেও তেমন ছিল না। পৃথিবীটা ছিল অনেক বেশি রঙিন, অনেক বেশি বৈচিত্র্যময়। ডক্টর মকবুল আমাদের সেই বিস্মৃতপ্রায় ইতিহাসের কথা মনে করিয়ে দেন, যখন যৌনতা ছিল নদীর মতো বহমান, নানা খাতে, নানা বাঁকে।
ভাবুন তো একবার, প্রাচীন আমেরিকায় এমন কিছু মানুষ ছিলেন যাদের ‘টু-স্পিরিট’ (Two-spirit) বলা হতো। বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠীর মধ্যে এই মানুষেরা অত্যন্ত সম্মানিত ছিলেন। বিশ্বাস করা হতো, তাদের শরীরে নারী ও পুরুষ—দুই সত্তাই একাত্ম হয়ে আছে। তারা ছিলেন জাগতিক ও আধ্যাত্মিক পৃথিবীর মধ্যে এক সেতুবন্ধন। তাদের পরামর্শ নেওয়া হতো, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তাদের বিশেষ ভূমিকা থাকত। তারা নিছক ‘ভিন্ন’ ছিলেন না; তারা ছিলেন বিশেষ, ঐশ্বরিক গুণের অধিকারী। তাদের কাজ ছিল নিরাময় করা, গল্প বলা, শিশুদের নাম রাখা এবং বিবাদ মেটানো। তারা ছিলেন সম্প্রদায়ের আঠা, যা সবকিছুকে একসাথে ধরে রাখত।
এবার আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশের দিকে তাকাই। এখানে ছিলেন হিজড়া (Hijra) সম্প্রদায়, যাদের ইতিহাস হাজার হাজার বছরের পুরনো। মোগল সাম্রাজ্যে তাদের ছিল বিশেষ মর্যাদা ও ক্ষমতা। রাজদরবারের অন্দরমহলের পাহারাদার থেকে শুরু করে শাসকের উপদেষ্টা পর্যন্ত ছিলেন তারা। সাধারণ মানুষ তাদের ভয় পেত না, বরং সম্মান করত। তাদের আশীর্বাদকে শুভ বলে মনে করা হতো। বিয়ে বা সন্তানের জন্মোৎসবে তাদের উপস্থিতি ছিল অপরিহার্য। প্রাচীন গ্রন্থাবলীতে, যেমন বাৎস্যায়নের কামসূত্রে, ‘তৃতীয়া প্রকৃতি’ বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের কথা বিশদভাবে বলা আছে, যেখানে বিভিন্ন ধরনের যৌনতার বর্ণনা পাওয়া যায়, যা আজকের দিনে আমাদের ‘অস্বাভাবিক’ মনে হতে পারে। কিন্তু তখনকার সমাজে সেগুলো ছিল জীবনেরই অংশ। শুধু হিজড়া নয়, এই উপমহাদেশে ‘কোঠি’ (Kothi), ‘জেনানা’সহ আরও নানা লিঙ্গীয় পরিচয়ের অস্তিত্ব ছিল, যাদের নিজস্ব সামাজিক জগৎ ও সংস্কৃতি ছিল।
প্রাচীন গ্রিসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই ‘পিডেরাস্টি’ (Pederasty)-র মতো একটি সামাজিক রীতি। এটি ছিল একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ এবং একজন কিশোরের মধ্যে একটি সম্পর্ক, যা শুধু শারীরিক ছিল না, ছিল শিক্ষামূলক ও পথপ্রদর্শকের। এর মাধ্যমে জ্ঞান, নৈতিকতা এবং সামাজিক দায়িত্ববোধ তরুণ প্রজন্মের কাছে হস্তান্তরিত হতো। প্লেটোর ‘সিম্পোজিয়াম’-এর মতো রচনায় আমরা দেখি, ভালোবাসার কত বিচিত্র রূপ নিয়ে দার্শনিকেরা আলোচনা করছেন, যেখানে নারী-পুরুষের ভালোবাসার পাশাপাশি পুরুষে-পুরুষে ভালোবাসাকেও উচ্চাসনে বসানো হয়েছে।
এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন উদাহরণ নয়। প্রাচীন রোম, সামুরাই শাসিত জাপান, কিংবা ফারাওদের মিশর—সবখানেই এমন নানা ধরনের সম্পর্ক ও পরিচয়ের অস্তিত্ব ছিল, যা আজকের বিষমকামী (heterosexual) কাঠামোর বাইরে। মানুষ তখন ভালোবাসাকে এতটা আইনের চোখে বা ধর্মের অনুশাসনে দেখত না, যতটা দেখত সামাজিক ও আত্মিক চোখে। প্রশ্নটা ‘সঠিক’ বা ‘বেঠিক’-এর ছিল না; প্রশ্নটা ছিল জীবনের বৈচিত্র্যকে উদযাপন করার। আকাশ যেমন নীল, ফুল যেমন লাল, তেমনি মানুষের ভালোবাসাও ছিল নানা রঙের। কেউ এই রঙ নিয়ে প্রশ্ন তুলত না।
‘পাপ’ ও ‘বিকৃতি’র জন্ম এবং একরঙা পৃথিবীর সূচনা
তাহলে এই সহজ, সরল, বহুবর্ণী ধারণাটা বদলে গিয়ে একরঙা হয়ে গেল কীভাবে? কীভাবে ভালোবাসার মতো একটি ব্যক্তিগত অনুভূতি পাপ, অপরাধ আর বিকৃতির বিষয় হয়ে উঠল? ডক্টর মকবুল এর পেছনে মূলত দুটো বড় ঐতিহাসিক শক্তিকে চিহ্নিত করেছেন: ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ এবং তার হাত ধরে আসা উপনিবেশবাদ (Colonialism)।
খ্রিস্টধর্ম যখন ধীরে ধীরে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে শুরু করে, তখন যৌনতা বিষয়ে কঠোর নৈতিক বিধিবিধান তৈরি হতে থাকে। আদি চার্চের ফাদাররা, যেমন সেন্ট অগাস্টিন, মনে করতেন, মানুষের মূল পাপের (original sin) উৎস হলো তার কামনা-বাসনা। তাই যৌনতাকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। যৌনতাকে সরাসরি পাপের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হলো, বিশেষ করে সেই সব যৌনক্রিয়াকে, যা সন্তান উৎপাদনের জন্য নয়। সেগুলোকে বলা হলো ‘অপ্রাকৃতিক’ (unnatural)।
কিন্তু কেন এই কঠোরতা? এর পেছনে ছিল গভীর সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণ। উদীয়মান ইউরোপীয় সমাজব্যবস্থায় সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠছিল। সম্পত্তির অধিকার রক্ষা, বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার নিয়ন্ত্রণ এবং একটি সুশৃঙ্খল সমাজব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য এটা জরুরি ছিল যে, কার সন্তান কে, তা যেন পরিষ্কারভাবে সুনির্দিষ্ট থাকে। এর সবচেয়ে সহজ উপায় ছিল বিষমকামী বিবাহকে (heterosexual marriage) একমাত্র বৈধ ও পবিত্র ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। এর ফলে কৌমার্য (Celibacy) এবং বিষমকামী বিবাহ সমাজের আদর্শ হয়ে উঠল। বাকি সব সম্পর্ক হয়ে গেল হয় অপ্রয়োজনীয়, নয়তো বিপজ্জনক।
ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো (Michel Foucault) তাঁর যুগান্তকারী বই ‘দ্য হিস্ট্রি অফ সেক্সুয়ালিটি’-তে (The History of Sexuality, 1978) দেখিয়েছেন এক অদ্ভুত বিষয়। ভিক্টোরিয়ান যুগে যৌনতাকে শুধু দমন করা হয়নি, বরং একে নিয়ে প্রচুর আলাপ-আলোচনা তৈরি করা হয়েছে। ডাক্তার, মনোবিজ্ঞানী, আইনবিদ, ধর্মগুরু—সবাই যৌনতা নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। উদ্দেশ্য ছিল একে সংজ্ঞায়িত করা, শ্রেণিবদ্ধ করা, কোনটি ‘স্বাভাবিক’ আর কোনটি ‘অস্বাভাবিক’ তা নির্ধারণ করা এবং পরিশেষে নিয়ন্ত্রণ করা। ফুকো একে বলেছেন ‘বায়োপাওয়ার’ (biopower)—অর্থাৎ, রাষ্ট্র যখন মানুষের জীবনকে (জন্ম, মৃত্যু, স্বাস্থ্য, যৌনতা) নিজের নিয়ন্ত্রণের আওতায় নিয়ে আসে। ‘হোমোসেক্সুয়াল’ বা সমকামী শব্দটি তখন আবিষ্কৃত হয় একটি প্রজাতি হিসেবে, একটি মানসিক ব্যাধি হিসেবে। আগে ‘সডোমি’ ছিল একটি কাজ, এখন সমকামী হয়ে গেল একটি পরিচয়—একটি বিকৃত পরিচয়।
একাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যে খ্রিস্টান ইউরোপে ‘সডোমি’ (sodomy) বা পায়ুকাম একটি গুরুতর নৈতিক ও আইনি অপরাধে পরিণত হয়। ‘সডোমায়েট’ (Sodomite) শব্দটি দিয়ে শুধু সমকামীদের বোঝানো হতো না, বরং সমাজের চোখে ‘অস্বাভাবিক’ বা নিয়মবহির্ভূত বলে বিবেচিত সব ধরনের মানুষকে চিহ্নিত করা হতো।
এরপর এলো উপনিবেশবাদের যুগ। ইউরোপীয় শক্তিগুলো যখন বন্দুক আর বাইবেল হাতে পৃথিবীজুড়ে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার করতে শুরু করল, তখন এই খ্রিস্টীয় নৈতিকতা তাদের একটি বড় অস্ত্র হয়ে উঠল। ‘সভ্য করার মিশন’ (civilizing missions)-এর নামে তারা উপনিবেশ স্থাপন করতে লাগল। তারা নিজেদের উপস্থাপন করল যুক্তিবাদী, সভ্য ও নৈতিকভাবে উন্নত এক জাতি হিসেবে, আর উপনিবেশের মানুষদের দেখাল অসভ্য, আবেগপ্রবণ ও নৈতিকভাবে অধঃপতিত হিসেবে।
ঔপনিবেশিক সরকারগুলোর সাথে হাত মিলিয়ে খ্রিস্টান মিশনারিরা স্থানীয় সংস্কৃতিতে তাদের নৈতিকতার বীজ বপন করতে শুরু করল। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর যেসব চর্চা—যেমন আদিবাসীদের টু-স্পিরিট, বা ভারতীয়দের হিজড়া—তাদের কাছে অচেনা ও অদ্ভুত মনে হলো, সেগুলোকে তারা ‘অনৈতিক’, ‘পৈশাচিক’ বা ‘পৌত্তলিক’ (pagan) বলে দাগিয়ে দিল। অনেক ক্ষেত্রে এসব ‘অনৈতিক’ মানুষদের জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে, তাদের সামাজিক ভূমিকা কেড়ে নেওয়া হয়েছে, এমনকি তাদের হত্যাও করা হয়েছে।
বিষয়টা কি অদ্ভুত না? একদল মানুষ হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে অন্য একদল মানুষকে শেখাতে এলো—কীভাবে ভালোবাসতে হয়, কীভাবে বাঁচতে হয়। আর তাদের শেখানো সেই ‘নৈতিকতা’র ভিত্তি ছিল তাদের নিজেদের ধর্ম, সংস্কৃতি আর রাজনৈতিক স্বার্থ। ঐতিহাসিক অ্যান স্টোলার (Ann Stoler) তাঁর ‘কার্নাল নলেজ অ্যান্ড ইম্পেরিয়াল পাওয়ার’ (Carnal Knowledge and Imperial Power, 2002) বইয়ে দেখিয়েছেন, উপনিবেশকে স্থায়ীভাবে শাসন করার জন্য স্থানীয় মানুষের ব্যক্তিগত ও যৌন জীবন নিয়ন্ত্রণ করাটা ছিল অপরিহার্য। এটা ছিল ক্ষমতার এক গভীর খেলা। শাসকের যৌন নৈতিকতাকে শাসিতের উপর চাপিয়ে দিয়ে তাদের মানসিকভাবেও পরাধীন করে তোলা হতো।
আইনের লৌহ-শৃঙ্খল: ধারা ৩৭৭ এবং প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ
মুখে বলে বা ধর্ম প্রচার করেই ঔপনিবেশিক প্রভুরা থেমে থাকেনি। এই নতুন ‘নৈতিকতা’কে তারা আইনের মাধ্যমে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দিতে চাইল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য তাদের প্রায় সমস্ত উপনিবেশে—ভারত থেকে শুরু করে নাইজেরিয়া, মালয়েশিয়া থেকে উগান্ডা—সডোমি-বিরোধী আইন চালু করে।
এর সবচেয়ে কুখ্যাত এবং দীর্ঘস্থায়ী উদাহরণ হলো ভারতীয় দণ্ডবিধির ধারা ৩৭৭ (Section 377), যা ১৮৬০ সালে লর্ড ম্যাকলের তত্ত্বাবধানে তৈরি করা হয়। এই আইনের ভাষাটি খেয়াল করুন:
“Whoever voluntarily has carnal intercourse against the order of nature with any man, woman or animal, shall be punished with imprisonment for life, or with imprisonment of either description for a term which may extend to ten years, and shall also be liable to fine.”
অনুবাদ: “যে কেউ স্বেচ্ছায় প্রকৃতির নিয়মবিরুদ্ধ যৌন সঙ্গম করে— তা কোনো পুরুষের সঙ্গে হোক, নারীর সঙ্গে হোক, বা পশুর সঙ্গে—তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, অথবা যে কোনো একধরনের কারাদণ্ডে (সশ্রম বা বিনাশ্রম) অনধিক দশ বছর পর্যন্ত দণ্ডিত করা যেতে পারে; এবং সে অর্থদণ্ডের জন্যও দায়ী থাকবে।”
এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং বিপজ্জনক অংশটি হলো “প্রকৃতির আদেশের বিরুদ্ধে” (against the order of nature)। প্রকৃতি কী, আর তার আদেশই বা কী? এটা কে নির্ধারণ করবে? ব্রিটিশ আইনপ্রণেতারা তাদের নিজেদের ভিক্টোরিয়ান খ্রিস্টীয় নৈতিকতাকে ‘প্রকৃতির নিয়ম’ বলে চালিয়ে দিলেন। যে যৌনতা শুধু সন্তান উৎপাদনের লক্ষ্যে নয়, সেটাই হয়ে গেল অপ্রাকৃতিক।
ভাবুন তো একবার, এই একটিমাত্র আইন দিয়ে পুরো একটি উপমহাদেশের হাজার হাজার বছরের সংস্কৃতি, বিশ্বাস আর বৈচিত্র্যকে এক ঝটকায় ‘অপরাধী’ বানিয়ে দেওয়া হলো। যে হিজড়া সম্প্রদায় একসময় সম্মানিত ছিল, তাদের অস্তিত্বই হয়ে গেল বেআইনি। যে সম্পর্কগুলো সমাজের আনাচে-কানাচে স্বাভাবিকভাবে টিকে ছিল, সেগুলোর ওপর নেমে এলো রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের খড়্গ। এই আইন শুধু দুটি মানুষের ব্যক্তিগত সম্পর্ককে অপরাধ হিসেবে দেখেনি, এটি একটি ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছে। এটি পুলিশকে দিয়েছে ব্ল্যাকমেইল করার, হয়রানি করার এবং টাকা আদায়ের এক অসীম ক্ষমতা। যে কোনো ‘ভিন্ন’ দেখতে বা আচরণকারী মানুষই এই আইনের শিকার হতে পারত। যে বৈচিত্র্য একসময় স্বাভাবিক ছিল, তা হয়ে গেল ‘অপ্রাকৃতিক’ এক বিকৃতি।
সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা চলে গেলেও তাদের তৈরি করা এই আইন কফিনের পেরেকের মতো আমাদের সমাজে গেঁথে রয়ে গেল। শুধু ভারত বা পাকিস্তানেই নয়, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, মিয়ানমারসহ ব্রিটিশদের সাবেক ৩৬টি উপনিবেশে এই আইন বা এর অনুরূপ আইন আজও টিকে আছে। এই আইনগুলোই এখন ব্যবহার করা হয় সমকামী, লেসবিয়ান, উভকামী বা রূপান্তরকামী (Transgender) মানুষদের ভয় দেখাতে, ব্ল্যাকমেইল করতে এবং দমন করতে।
ডক্টর মকবুল একটি গভীর প্রশ্ন রেখেছেন, “যুদ্ধ, আগ্রাসন, মিশনারি কার্যক্রম এবং পরিকল্পিত নিপীড়ন—এই সবকিছুর সম্মিলিত শক্তি ব্যবহার করে জমি ও মানুষ দখল করার কৌশলটি কি আপনি ধরতে পারছেন?”
উত্তরটা সম্ভবত আমাদের সবারই জানা। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য মানুষের ব্যক্তিগত জীবন, তার শোবার ঘর, এমনকি তার ভালোবাসাকেও নিয়ন্ত্রণ করা একটি পুরোনো এবং কার্যকর রাজনৈতিক খেলা।
২০১৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এক ঐতিহাসিক রায়ে ধারা ৩৭৭-এর সেই অংশ বাতিল করে দেয়, যা প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সম্মতিপূর্ণ সমকামী সম্পর্ককে অপরাধ হিসেবে গণ্য করত। আদালত তাদের রায়ে বলে, “ইতিহাস এই সম্প্রদায়ের কাছে ক্ষমা প্রার্থী।” (History owes an apology to the members of this community). আদালত আরও বলে, সামাজিক নৈতিকতা নয়, সাংবিধানিক নৈতিকতাই বড়। এটি ভারতে এলজিবিটিকিউ+ (LGBTQ+) অধিকারের জন্য একটি বিশাল পদক্ষেপ ছিল। কিন্তু আইন বাতিল হলেই কি মনের ভেতরের গেঁথে থাকা আইন বাতিল হয়? সমাজের মানসিকতা কি এক রায়ে বদলে যায়?
উপনিবেশের ভূত ও আমাদের মনের ভেতর বসত
সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হলো, ঔপনিবেশিক প্রভুরা আমাদের দেশ থেকে বিদায় নিলেও, তাদের চিন্তাভাবনা আমাদের মন থেকে বিদায় নেয়নি। এই ভূত আমাদের ঘাড়ে চেপে বসে আছে। একেই তাত্ত্বিকেরা বলেন অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিকতা (Internalized Colonialism)। এটা অনেকটা এমন যে, জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরেও কয়েদি জেলের নিয়মকানুন মেনে চলে, কারণ সেই নিয়মগুলো তার মজ্জার ভেতরে ঢুকে গেছে।
আজও বাংলাদেশসহ অনেক উত্তর-ঔপনিবেশিক (postcolonial) সমাজে সমকামিতাকে একটি ‘পশ্চিমা’ (Western) বা ‘বিদেশি’ ধারণা হিসেবে দেখা হয়। যেন এটা আমাদের সংস্কৃতিতে কখনো ছিলই না, বাইরে থেকে আমদানি করা হয়েছে! রাজনৈতিক নেতারা প্রায়ই ভোটের জন্য ‘নৈতিকতা’ ও ‘ধর্মীয় অনুভূতি’র দোহাই দিয়ে এলজিবিটিকিউ+ অধিকারের বিরোধিতা করেন। আফ্রিকার বা এশিয়ার অনেক চার্চ ও ধর্মীয় সংগঠন সমকামিতা-বিরোধী যেসব প্রচারণা চালায়, তার ভিত্তি কিন্তু তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি নয়, বরং ঔপনিবেশিক আমলে চাপিয়ে দেওয়া আইন ও নৈতিকতা।
মজার ব্যাপার হলো, যে পশ্চিমা দেশগুলো একসময় এই আইনগুলো আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছিল, তারা এখন নিজেরাই সমকামী অধিকারের পক্ষে কথা বলছে। আর আমরা, তাদের পুরনো আইনকে নিজেদের ‘ঐতিহ্য’ ও ‘সংস্কৃতি’ বলে আঁকড়ে ধরে আছি। কী অদ্ভুত এক ঐতিহাসিক পরিহাস! একেই বলে সময়ের খেলা।
ডক্টর মকবুল আমাদের সবার দিকেই একটি আয়না ধরে একটি অস্বস্তিকর প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন: “আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, নিজের অজান্তেই আপনি হয়তো সেই খ্রিস্টীয় ‘নৈতিক’ বা ‘পশ্চিমা’ কাঠামোকে নিজের ভেতরে ধারণ করে চলেছেন?”
এই যেমন ধরুন, বাংলাদেশে যখন কেউ কুইয়ার (Queer) অধিকারের কথা বলে, তখন অনেকেই রেগে গিয়ে বলেন, “এগুলো পশ্চিমা নোংরামি, আমাদের পবিত্র সংস্কৃতিতে এসব চলে না।” অথচ বাস্তবতা হলো, এই অঞ্চলে বৈচিত্র্যপূর্ণ যৌনতার ইতিহাস বহু পুরোনো। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য থেকে শুরু করে লোকগাথা পর্যন্ত এর অজস্র প্রমাণ আছে। বরং সমকামিতাকে অপরাধ গণ্য করার আইনটিই ছিল একটি ‘পশ্চিমা আমদানি’, একটি ঔপনিবেশিক চাপিয়ে দেওয়া ধারণা।
উপনিবেশবাদ ও খ্রিস্টধর্ম হাত ধরাধরি করে সারা বিশ্বে কীভাবে ‘বিকল্প যৌনতা’কে (alternative sexualities) ধ্বংস করেছে, তার উদাহরণ ভুরি ভুরি। আমেরিকার টু-স্পিরিটদের জোর করে বোর্ডিং স্কুলে পাঠানো হয়েছে, তাদের চুল কেটে, পশ্চিমা পোশাক পরিয়ে ‘সভ্য’ বানানোর চেষ্টা করা হয়েছে। তাদের সংস্কৃতিকে ‘শয়তানি’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার হিজড়াদের ব্রিটিশ শাসনামলে ‘ক্রিমিনাল ট্রাইবস অ্যাক্ট’-এর অধীনে অপরাধী হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। বিদেশি আইন, বিদেশি নৈতিকতা আর বিদেশি ধর্ম চাপিয়ে দিয়ে স্থানীয় সংস্কৃতিকে পরিকল্পিতভাবে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। আর আমরা আজ সেই হত্যার উত্তরাধিকারকেই নিজেদের ‘সনাতন ঐতিহ্য’ বলে দাবি করছি।
প্রতিরোধের আগুন: স্টোনওয়াল থেকে ঢাকা
তবে যেখানেই নিপীড়ন থাকে, সেখানেই ফিনিক্স পাখির মতো ছাই থেকে প্রতিরোধ জন্মায়।
১৯৬০-এর দশকে পশ্চিমা বিশ্বে সামাজিক পরিবর্তনের এক বিশাল ঢেউ লাগে। নাগরিক অধিকার আন্দোলন, নারীমুক্তি আন্দোলন, যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন—সব মিলিয়ে এক উত্তাল সময়। এই সময়েই মানুষ প্রশ্ন তুলতে শুরু করে যে, সমাজ বা রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো—যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইন, ধর্ম—কেন শুধু বিষমকামী সম্পর্ককেই সুবিধা দেয় এবং টিকিয়ে রাখে। এই ব্যবস্থার ফলে, যারা বিষমকামী নন, তাদের অস্তিত্ব কাঠামোগতভাবেই দুর্বল এবং অদৃশ্য হয়ে পড়ে। এই প্রেক্ষাপটেই আধুনিক এলজিবিটিকিউ+ অধিকার আন্দোলনের জন্ম।
স্টোনওয়াল দাঙ্গা (Stonewall Riots, 1969): ১৯৬৯ সালের ২৮ জুন, নিউইয়র্কের গ্রিনউইচ ভিলেজের স্টোনওয়াল ইন নামক একটি গে বারে পুলিশ রুটিনমাফিক হানা দেয়। কিন্তু সেদিনের ঘটনা ছিল ভিন্ন। বারের ভেতর থাকা মানুষেরা, যাদের অধিকাংশই ছিলেন সমাজের সবচেয়ে প্রান্তিক—যেমন ল্যাটিনো ও কৃষ্ণাঙ্গ রূপান্তরকামী নারী, হিজড়া, গৃহহীন যুবক—তারা আর মার খেতে বা অপমানিত হতে রাজি ছিলেন না। তারা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। সেই প্রতিরোধ ছড়িয়ে পড়ে রাস্তায়, কয়েক দিন ধরে চলে পুলিশের সাথে সংঘর্ষ। এই ঘটনাটিকেই আধুনিক এলজিবিটিকিউ+ অধিকার আন্দোলনের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বলে মনে করা হয়। স্টোনওয়ালের সবচেয়ে বড় বার্তা ছিল—আমরা আর লজ্জিত নই, আমরা আর লুকিয়ে থাকব না। এর পরপরই তৈরি হয় ‘গে লিবারেশন ফ্রন্ট’ (Gay Liberation Front)-এর মতো বিপ্লবী সংগঠন, এবং ১৯৭০ সালে প্রথম ‘প্রাইড মার্চ’ (Pride March) অনুষ্ঠিত হয়।
এইচআইভি/এইডস সংকট (HIV/AIDS Crisis): ১৯৮০-র দশকে এইডস মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়লে এলজিবিটিকিউ+ সম্প্রদায়, বিশেষ করে সমকামী পুরুষেরা, এক অভূতপূর্ব সংকটের মুখে পড়ে। রোগ, মৃত্যু আর সামাজিক ঘৃণার এক ভয়ংকর মিশ্রণ তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। এই রোগকে তখন ‘গে প্লেগ’ বা সমকামীদের মহামারী বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের মতো সরকারপ্রধানরা এই সংকটকে দেখেও না দেখার ভান করেন। এই চরম উদাসীনতার বিরুদ্ধে ACT UP (AIDS Coalition to Unleash Power)-এর মতো সংগঠন রাস্তায় নামে। তাদের শ্লোগান ছিল “Silence = Death” (নীরবতা = মৃত্যু)। তাদের আপোসহীন, সরাসরি আন্দোলনের ফলেই সরকার ও ওষুধ কোম্পানিগুলো এইডস নিয়ে গবেষণা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে বাধ্য হয়।
এই সংকটের একটি অপ্রত্যাশিত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ফল ছিল। আন্তর্জাতিক এনজিও, জাতিসংঘের সংস্থা এবং বিভিন্ন পশ্চিমা দাতা সংস্থা এইডস প্রতিরোধের জন্য গ্লোবাল সাউথ বা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিপুল পরিমাণ অর্থায়ন শুরু করে। ভারত, বাংলাদেশ, কেনিয়া, নাইজেরিয়ার মতো অনেক দেশে, যেখানে সমকামিতা নিয়ে কথা বলাই ছিল অসম্ভব, সেখানে প্রথম কুইয়ার সংগঠনগুলো গড়ে ওঠে এইডস বিষয়ক স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে, সরাসরি অধিকারকর্মী হিসেবে নয়। যেমন ভারতের নাজ ফাউন্ডেশন (Naz Foundation) বা বাংলাদেশের বয়েজ অফ বাংলাদেশ (Boys of Bangladesh)।
তবে এর একটি অন্ধকার দিকও ছিল। তাত্ত্বিক রাহুল রাও (Rahul Rao) তাঁর ‘থার্ড ওয়ার্ল্ড প্রোটেস্ট’ (Third World Protest, 2010) বইয়ে দেখিয়েছেন, এইডস প্রতিরোধের কাজে কুইয়ার সত্তাকে শুধুমাত্র একটি ‘রোগের ঝুঁকি’ (disease risk) হিসেবে দেখা হয়েছে। অর্থাৎ, কুইয়ার মানুষেরা তখনই আলোচনার যোগ্য, যখন তারা এইচআইভি-র সম্ভাব্য বাহক। এর ফলে কুইয়ার মানুষদের অসুস্থ বা বিপজ্জনক হিসেবে দেখার একটি ধারণা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই স্বাস্থ্য প্রকল্পগুলো আইনি বা সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলত না। তাদের লক্ষ্য ছিল স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া, মানুষের মর্যাদা বা রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা নয়।
বাংলাদেশের কুইয়ার আন্দোলন: আশা, রক্তপাত এবং নীরবতা
বাংলাদেশেও এলজিবিটিকিউ+ অধিকার আন্দোলনের একটি নিজস্ব, জটিল এবং রক্তস্নাত গতিপথ আছে।
বয়েজ অফ বাংলাদেশ (Boys of Bangladesh – BoB): ২০০২ সালে একটি ইয়াহু গ্রুপ বা অনলাইন ফোরাম হিসেবে এর যাত্রা শুরু। সে সময়ে ইন্টারনেট ছিল নতুন, এবং এটিই ছিল সমকামী ও উভকামী পুরুষদের জন্য নিজেদের মধ্যে কথা বলার, অভিজ্ঞতা বিনিময়ের এবং নিঃসঙ্গতা কাটানোর একটি গোপন আশ্রয়। ধীরে ধীরে এটি একটি সংগঠিত নেটওয়ার্কে পরিণত হয়।
রূপবান (Roopbaan): ২০১৪ সালে ‘রূপবান’ নামে বাংলাদেশের প্রথম এলজিবিটিকিউ+ ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়। এটি ছিল এক অভাবনীয় সাহসী পদক্ষেপ। এর মাধ্যমে কুইয়ার মানুষেরা প্রথমবারের মতো জনসমক্ষে তাদের শিল্প, সাহিত্য ও চিন্তাভাবনা তুলে ধরার একটি প্ল্যাটফর্ম পায়। ‘রূপবান’ নামটি নেওয়া হয়েছিল বাংলা লোককথা থেকে, যা সৌন্দর্য ও ভালোবাসার প্রতীক। এর উদ্দেশ্য ছিল ভালোবাসা ও বৈচিত্র্যকে উদযাপন করা।
রংধনু র্যালি (Rainbow Rally): ২০১৪ সালের ১৪ এপ্রিল, পহেলা বৈশাখে, বাংলা নববর্ষের দিনে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রার অংশ হিসেবে প্রথমবারের মতো একটি পাবলিক এলজিবিটিকিউ+ র্যালি অনুষ্ঠিত হয়। অংশগ্রহণকারীরা রঙিন পোশাক পরে, মুখে আলপনা এঁকে, হাতে রঙিন ব্যানার নিয়ে হাঁটছিলেন। মঙ্গল শোভাযাত্রার সাথে এই র্যালি আয়োজন করার মাধ্যমে একটি শক্তিশালী বার্তা দেওয়ার চেষ্টা ছিল—কুইয়ার সত্তা বাঙালি সংস্কৃতিরই অংশ, এটি কোনো বিচ্ছিন্ন বা বিদেশি বিষয় নয়।
এই সবকিছু মিলিয়ে মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশ হয়তো ধীরে ধীরে একটি নতুন দিগন্তের দিকে এগোচ্ছে। বাতাসে একটা আশার গন্ধ ছিল। কিন্তু এই দৃশ্যমানতার (visibility) একটি ভয়ঙ্কর মূল্য দিতে হয়েছিল।
২০১৬-এর ট্র্যাজেডি: ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল, ‘রূপবান’ পত্রিকার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক জুলহাজ মান্নান এবং তাঁর বন্ধু ও নাট্যকর্মী মাহবুব রাব্বী তনয়কে তাদের কলাবাগানের বাসায় ঢুকে চাপাতি দিয়ে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করে ইসলামপন্থী উগ্রপন্থীরা। জুলহাজ ছিলেন একজন স্পষ্টভাষী অধিকারকর্মী এবং বাংলাদেশে মার্কিন দূতাবাসের প্রাক্তন কর্মকর্তা। এই হত্যাকাণ্ডটি ছিল সুপরিকল্পিত। এটি শুধু দুটি প্রাণ কেড়ে নেয়নি, এটি বাংলাদেশের কুইয়ার আন্দোলনকে এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে এক গভীর ঘা দিয়েছিল। সম্প্রদায়ের মধ্যে নেমে আসে ভয়, আতঙ্ক আর নীরবতার এক দীর্ঘ ছায়া। বাতাসের সেই আশার গন্ধ মিলিয়ে গিয়ে সেখানে স্থান করে নেয় পোড়া বারুদের গন্ধ। অনেকেই দেশ ছাড়তে বাধ্য হন, অনেকে আবার নিজেদের গুটিয়ে নেন। যে অনলাইন পরিসর একসময় ছিল মুক্তির জায়গা, সেটাই হয়ে ওঠে নজরদারির ক্ষেত্র।
এই ঘটনাটি ডক্টর মকবুলের সেই অমোঘ উক্তিটিকে প্রমাণ করে: “গার্হস্থ্য সুরক্ষা ছাড়া দৃশ্যমানতা দুর্বলতা বাড়ায়, ক্ষমতায়ন নয়।” (Visibility without domestic protection increases vulnerability, not empowerment; Makbul, 2025).
যখন রাষ্ট্র বা সমাজ আপনাকে রক্ষা করতে প্রস্তুত নয়, যখন আইন আপনার বিরুদ্ধে, তখন নিজেকে সাহসের সাথে প্রকাশ করাটা বীরত্ব নয়, বরং মারাত্মক ঝুঁকি নেওয়া। জুলহাজ-তনয়ের রক্ত আমাদের এই কঠিন সত্যটিই শিখিয়ে দিয়ে গেছে।
উন্নয়নের রাজনীতি, বাংলাদেশের অবস্থান এবং অদৃশ্য সুতোর টান
আজকের পৃথিবীতে ‘উন্নয়ন’-এর একটি বড় শর্ত হলো ‘অন্তর্ভুক্তি’ (inclusion)। গ্লোবাল নর্থ-এর দাতা সংস্থাগুলো (যেমন USAID, UNDP, World Bank) এবং পশ্চিমা সরকারগুলো তাদের সাহায্য বা অনুদানের অন্যতম শর্ত হিসেবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী—যেমন লিঙ্গীয়, যৌন, জাতিগত বা ধর্মীয় সংখ্যালঘু—তাদের অন্তর্ভুক্তিকে দেখে। এটিকে সুশাসন (good governance) ও মানবাধিকারের প্রতীক হিসেবে প্রচার করা হয়।
এই উন্নয়ন মডেলের সমস্যা হলো, এটি মূলত পশ্চিমা উদারনৈতিক মানবাধিকারের (Western liberal human rights) ধারণার উপর ভিত্তি করে তৈরি। সেখানে আইনি সমতা (যেমন বিবাহের অধিকার), কর্মক্ষেত্রে সমান সুযোগ এবং বৈষম্যবিরোধী আইনকেই সাফল্যের চূড়ান্ত মাপকাঠি হিসেবে দেখা হয়। এই ফ্রেমটিকেই তারা গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোর ওপর চাপিয়ে দিতে চায়। অনেক ক্ষেত্রে পশ্চিমা দেশগুলো তাদের নিজেদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে এলজিবিটিকিউ+ অধিকারকে একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, যা ‘পিঙ্কওয়াশিং’ (Pinkwashing) নামে পরিচিত।
কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশের বাস্তবতা কি এত সরল?
ডক্টর মকবুলের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বাংলাদেশে এক ধরনের নীরব দর কষাকষি চলে। সরকার আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজেদের ‘প্রগতিশীল’ হিসেবে দেখানোর জন্য কিছু পদক্ষেপ নেয়। যেমন, ২০১৩ সালে হিজড়া জনগোষ্ঠীকে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কিন্তু এই স্বীকৃতি মূলত তাদের ভোটাধিকার বা কিছু সামাজিক সুরক্ষা দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এটি তাদের লিঙ্গীয় আত্মপরিচয়ের (gender identity) স্বীকৃতি, যৌন অভিমুখিতার (sexual orientation) নয়। অর্থাৎ, রাষ্ট্র হিজড়াদের করুণার পাত্র হিসেবে দেখতে রাজি, কিন্তু সমকামীদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে নারাজ।
এর ফলে যা হয়:
-
এলজিবিটিকিউ+ মানুষদের ‘স্বাস্থ্যসেবার গ্রহীতা’ (health subjects) বা ‘সাহায্যের পাত্র’ (aid recipients) হিসেবে গ্রহণ করা হয়, কিন্তু ‘পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক নাগরিক’ (political citizens) হিসেবে নয়।
-
অধিকার আন্দোলন প্রায়শই প্রকল্প-ভিত্তিক (project-based) হয়ে পড়ে, যা স্বল্পমেয়াদী বিদেশি ফান্ডিং-এর উপর নির্ভরশীল। ডোনারদের অগ্রাধিকার অনুযায়ী কাজ করতে হয়, যা সবসময় স্থানীয় সম্প্রদায়ের আসল চাহিদার সাথে মেলে না। এর ফলে দীর্ঘমেয়াদী, তৃণমূল স্তরের আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে না।
-
শহরের শিক্ষিত, ইংরেজি বলা, এলিট অ্যাক্টিভিস্টদের সাথে তৃণমূলের, যেমন গ্রামের বা মফস্বলের কুইয়ার মানুষ বা হিজড়া সম্প্রদায়ের, চাহিদা ও অগ্রাধিকারের মধ্যে এক বিরাট পার্থক্য তৈরি হয়।
এই জটিল গোলকধাঁধায় বাংলাদেশ ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছে? একদিকে আছে আন্তর্জাতিক চাপ এবং উন্নয়নের গ্লোবাল ফ্রেম, অন্যদিকে আছে সামাজিক ও ধর্মীয় রক্ষণশীলতার লোকাল ভয়। এর মাঝখানে পিষ্ট হয় সাধারণ কুইয়ার মানুষের জীবন, তাদের প্রেম এবং তাদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম।
দৃশ্যমানতার উভয় সংকট: আলো না মরীচিকা?
মিডিয়া বা জনসমক্ষে নিজেদের তুলে ধরা—অর্থাৎ ‘দৃশ্যমানতা’ (Visibility)—কি তাহলে ভালো না খারাপ? এই প্রশ্নের কোনো সহজ উত্তর নেই। এটি একটি ধারালো তলোয়ারের মতো, যার দুটো দিকেই ধার।
১. দৃশ্যমানতা যখন ক্ষমতায়ন (Visibility as Empowerment):
-
মানবিকীকরণ: যখন পর্দায়, গল্পে বা সংবাদে কুইয়ার মানুষদের জীবন দেখানো হয়, তখন তারা আর কোনো ‘তত্ত্ব’ বা ‘সমস্যা’ থাকেন না, রক্ত-মাংসের মানুষ হয়ে ওঠেন। তাদের আনন্দ, বেদনা, সংগ্রামের সাথে সাধারণ মানুষ একাত্ম বোধ করতে পারে।
-
অস্তিত্বের স্বীকৃতি (affirmation): একাকীত্বে ভোগা কোনো কুইয়ার তরুণ বা তরুণী যখন নিজের মতো আরেকজনকে দেখে, তখন সে বুঝতে পারে যে সে একা নয়। এটি তাকে বাঁচার সাহস যোগায়।
-
রাজনৈতিক চাপ: জনমত পরিবর্তন করতে এবং আইনি সংস্কারের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর উপর চাপ সৃষ্টি করতে দৃশ্যমানতা একটি বড় হাতিয়ার হতে পারে।
২. দৃশ্যমানতা যখন ঝুঁকি (Visibility as Exposure and Risk):
-
নজরদারি ও নিপীড়ন: যারা নিজেদের প্রকাশ করে, তারা খুব সহজে রাষ্ট্র, পুলিশ বা উগ্রবাদীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে পারে।
-
সামাজিক বর্জন: পরিবার, বন্ধু বা কর্মক্ষেত্রে একঘরে হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।
-
শারীরিক সহিংসতা: দৃশ্যমানতা সরাসরি শারীরিক আক্রমণ, এমনকি মৃত্যুর কারণ হতে পারে, যেমনটা জুলহাজ-তনয়ের ক্ষেত্রে হয়েছে।
-
মিডিয়া ব্যাকল্যাশ: মিডিয়া প্রায়ই কুইয়ারদের ‘অনৈতিক’, ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ’ বা ‘পশ্চিমা দালাল’ হিসেবে চিত্রিত করে সমাজে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়।
মিডিয়াতে কুইয়ার মানুষদের প্রায়ই কিছু নির্দিষ্ট, সরলীকৃত ছাঁচে (frame) ফেলা হয়। ডক্টর মকবুল কয়েকটি ফ্রেমের কথা বলেছেন, যা আমরা এখানে আরও বিস্তারিতভাবে দেখতে পারি:
ফ্রেমের ধরন (Frame Type) | বর্ণনা (Description) | প্রভাব (Implications) |
সম্মানজনক রাজনীতি (Respectability Politics) | কুইয়ারদের “সবার মতোই সাধারণ”, শিক্ষিত, ভদ্র, একগামী এবং বিষমকামীদের মতোই জীবনযাপনকারী হিসেবে দেখানো হয়। | এটি হয়তো মধ্যবিত্তের সহানুভূতি আদায় করতে পারে এবং আইনি অধিকার পেতে সাহায্য করে, কিন্তু যারা এই ‘সম্মানজনক’ ছাঁচে খাপ খায় না (যেমন দরিদ্র, লিঙ্গীয়ভাবে অ-প্রথাগত মানুষ, একাধিক সঙ্গী থাকা ব্যক্তি) তাদের আরও প্রান্তিক করে তোলে। এটি বলে, “আমাদের মেনে নাও, কারণ আমরা তোমাদের মতোই।” |
দুঃখী শিকার (Tragic Victimhood) | শুধু তাদের কষ্ট, সহিংসতা, একাকীত্ব বা আত্মহত্যার উপর আলোকপাত করা হয়। তাদের জীবনকে একটি দুঃখের আখ্যান হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। | এটি সহানুভূতি আদায় করে, কিন্তু তাদের পরিচয়কে শুধু কষ্টের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলে। তাদের আনন্দ, প্রতিরোধ, শক্তি, প্রেম বা দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ মুহূর্তগুলোর গল্প বলা হয় না। তারা কেবলই করুণার পাত্র হয়ে থাকে। |
ব্যতিক্রমী কুইয়ার (Exceptional Queer) | সফল, প্রতিভাবান, ধনী বা অসাধারণ কৃতিত্বের অধিকারী কুইয়ারদের দেখানো হয়। যেমন বিখ্যাত শিল্পী, বিজ্ঞানী বা সিইও। | এটি এক ধরনের আদর্শায়িত সমকামিতার ধারণা (homonormativity) তৈরি করে, যা বলে যে ‘গ্রহণযোগ্য’ হতে হলে তোমাকে অসাধারণ হতে হবে। সাধারণ, খেটে খাওয়া কুইয়ার মানুষের জীবনের কোনো স্থান এখানে থাকে না। |
সাংস্কৃতিক হুমকি (Cultural Threat) | কুইয়ারদের ঐতিহ্য, ধর্ম, পরিবার বা জাতির জন্য একটি বড় বিপদ হিসেবে দেখানো হয়। তাদের পশ্চিমা সংস্কৃতির এজেন্ট বা নৈতিক অবক্ষয়ের কারণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। | এটি সরাসরি কুইয়ার-বিরোধী সহিংসতা ও ঘৃণা উস্কে দেয় এবং সামাজিক বিভেদ তৈরি করে। এটি মানুষকে ভয় দেখিয়ে একত্রিত করে। |
ক্ষমতায়িত গল্প বলা (Empowered Storytelling) | কুইয়াররা নিজেরাই যখন তাদের বৈচিত্র্যময়, জটিল ও বহুমাত্রিক গল্প নিজেদের ভাষায় বলে। যেখানে তাদের শক্তি ও দুর্বলতা, আনন্দ ও বেদনা, সাধারণ ও অসাধারণ—সবকিছুরই স্থান থাকে। | এটিই সবচেয়ে খাঁটি ও শক্তিশালী প্রতিনিধিত্ব। এটি কোনো ছাঁচে বাঁধা নয়, জীবনের মতোই জটিল ও সুন্দর। এটি মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে শেখায়। |
মুক্তি তাহলে কোন পথে? শুধু পর্দায় বা সংবাদে মুখ দেখানোই কি মুক্তি? নাকি মুক্তি লুকিয়ে আছে আরও গভীরে, এই ছাঁচগুলো ভেঙে ফেলার মধ্যে?
সম্পূর্ণ ছবিটি দেখার চেষ্টা: ইন্টারসেকশনালিটির চশমা
এতক্ষণের আলোচনা থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার—মানুষের জীবন বা পরিচয় সরলরৈখিক নয়। এখানেই ডক্টর মকবুল আমাদের একটি নতুন চশমা দিয়ে পৃথিবীকে দেখতে বলছেন। সেই চশমার নাম ইন্টারসেকশনালিটি (Intersectionality)।
এই ধারণাটির প্রবক্তা আমেরিকান আইন বিশেষজ্ঞ ও কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদী কিম্বার্লি ক্রেনশ (Kimberlé Crenshaw, 1989)। সহজ ভাষায়, ইন্টারসেকশনালিটি মানে হলো, কোনো মানুষের পরিচয় বা তার ওপর ঘটা নিপীড়ন শুধু একটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে না। একজন মানুষ একই সাথে একাধিক পরিচয়ের অধিকারী হতে পারে এবং সমাজে তার অবস্থান এই পরিচয়গুলোর ছেদবিন্দুতে (intersection) নির্ধারিত হয়।
বিষয়টা একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝা যাক। একজন বাংলাদেশি, দরিদ্র, গ্রামের, মুসলিম, সমকামী নারীর অভিজ্ঞতা কেমন হবে?
-
তিনি নারী হিসেবে পিতৃতন্ত্রের (patriarchy) শিকার।
-
তিনি সমকামী হিসেবে সমকামভীতির (homophobia) শিকার।
-
তিনি দরিদ্র হিসেবে শ্রেণিবাদের (classism) শিকার।
-
তিনি গ্রামের হওয়ায় শহরকেন্দ্রিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
-
তিনি মুসলিম নারী হিসেবে ইসলামোফোবিয়ার শিকার হতে পারেন।
এই নিপীড়নগুলো আলাদা আলাদাভাবে কাজ করে না। এগুলো একসাথে, একে অপরের ওপর প্রভাব ফেলে এক জটিল, বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতা তৈরি করে। ক্রেনশ একে তুলনা করেছেন রাস্তার মোড়ের সাথে, যেখানে বিভিন্ন দিক থেকে আসা গাড়ি একে অপরকে ধাক্কা দিতে পারে। শুধু একটি রাস্তার দিকে তাকালে পুরো দুর্ঘটনার ছবিটা বোঝা যায় না। এই নারীর অভিজ্ঞতা ঢাকার একজন উচ্চবিত্ত, পুরুষ সমকামী অধিকারকর্মীর অভিজ্ঞতা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন হবে। দুজনেরই লড়াই আছে, কিন্তু লড়াইয়ের ধরণ, তীব্রতা এবং উপায় ভিন্ন।
ইন্টারসেকশনালিটি শুধু পরিচয়ের কথা বলে না, ক্ষমতার কাঠামোর কথা বলে।
-
ইন্টারসেকশনালিটি ছাড়া দেখলে: আমরা ভাবব, সব এলজিবিটিকিউ+ মানুষের সমস্যা একই—আইনি অধিকারের অভাব। আমরা শুধু আইনি সংস্কার বা প্রাইড প্যারেডের উপর জোর দেব। আমরা ভাবব, দৃশ্যমান হওয়াই মুক্তি। আমাদের ফোকাস থাকবে শহরের এলিট, শিক্ষিত কুইয়ারদের ওপর।
-
ইন্টারসেকশনালিটি দিয়ে দেখলে: আমরা বুঝব, একেকজনের অভিজ্ঞতা স্থানীয়, স্তরযুক্ত এবং জটিল। আমরা তখন আইনি অধিকারের পাশাপাশি দারিদ্র্য, ধর্মীয় গোঁড়ামি, গ্রাম-শহরের বিভেদ, জাতিবাদ, মানসিক আঘাতের মতো বিষয়গুলো নিয়েও কাজ করব। আমরা প্রশ্ন করব, কারা দৃশ্যমান হচ্ছে এবং তার জন্য কী মূল্য দিতে হচ্ছে? আমরা শহরের এলিটদের বদলে সবচেয়ে প্রান্তিক এবং কণ্ঠহীনদের কথা শোনার চেষ্টা করব।
শেষ কথা
গল্পের শুরুতে আমরা ফ্রেম বা চশমার কথা বলেছিলাম। ডক্টর নুর ই মকবুলের আলোচনা আমাদের সেই ফ্রেমগুলোকেই চিনতে, বুঝতে এবং প্রশ্ন করতে শেখায়। একটি ‘গ্লোবাল ফ্রেম’ আমাদের বলছে অন্তর্ভুক্তির কথা, আধুনিকতার কথা, মানবাধিকারের কথা। কিন্তু সেই চকচকে ফ্রেম যখন আমাদের ‘লোকাল’ বা স্থানীয় বাস্তবতার রুক্ষ মাটির উপর এসে পড়ে, তখন তৈরি হয় ভয়, সংঘাত আর অনিশ্চয়তা।
এই লড়াইটা শুধু সমকামী বা রূপান্তরকামী মানুষদের নয়। এই লড়াইটা আমাদের সবার। এই লড়াইটা হলো—পৃথিবীকে তার সমস্ত বৈচিত্র্যসুদ্ধ গ্রহণ করার লড়াই। এই লড়াইটা হলো—আমাদের মনের গভীরে বসে থাকা ঔপনিবেশিক ভূতকে তাড়ানোর লড়াই। এই লড়াইটা হলো—সব মানুষের সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে বাঁচার অধিকারকে নির্বিবাদে স্বীকৃতি দেওয়ার লড়াই।
এর কোনো সহজ সমাধান নেই। উত্তরটা হয়তো কোনো একটি নির্দিষ্ট তত্ত্বে বা মডেলে লুকিয়ে নেই। উত্তরটা লুকিয়ে আছে প্রশ্ন করার মধ্যে, শোনার মধ্যে এবং সহানুভূতি দিয়ে বোঝার চেষ্টার মধ্যে। জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব রাব্বী তনয়ের মতো মানুষেরা যে দৃশ্যমানতার জন্য নিজেদের জীবন দিয়ে গেছেন, তার আলো ও অন্ধকার—দুটো দিককেই আমাদের নির্মোহভাবে বুঝতে হবে।
কারণ দিনের শেষে, ভালোবাসা কোনো ‘গ্লোবাল প্রজেক্ট’ বা ‘লোকাল ট্যাবু’ নয়। ভালোবাসা শুধুই ভালোবাসা। মেঘের মতো, বৃষ্টির মতো, বাতাসের মতো স্বাভাবিক। আর সব মানুষের সেই ভালোবাসার অধিকার আছে—ভয়হীনভাবে, মর্যাদার সাথে।
তথ্যসূত্র
- Crenshaw, K. (1989). Demarginalizing the intersection of race and sex: A black feminist critique of antidiscrimination doctrine, feminist theory and antiracist politics. University of Chicago Legal Forum, 1989(1), Article 8.
- Foucault, M. (1978). The history of sexuality, Vol. 1: An introduction. (R. Hurley, Trans.). Pantheon Books.
- Makbul, N. E. (2025). [Presented concept, cited as forthcoming]. Global Frames, Local Fears: Gender, Development, and the Queer Politics of Visibility.
- Rao, R. (2010). Third world protest: Between home and the world. Oxford University Press.
- Stoler, A. L. (2002). Carnal knowledge and imperial power: Race and the intimate in colonial rule. University of California Press.
Leave a Reply