মার্ক্সীয় দৃষ্টিতে ধর্ম: বিশ্লেষণ ও রণকৌশল

Table of Contents

ভূমিকা

ধরুন, এক বর্ষণমুখর অলস বিকেল। আপনি শহরের কোলাহল থেকে দূরে কোনো এক গ্রামের মেঠোপথ ধরে আনমনে হাঁটছেন। পথের পাশে জীর্ণ কিন্তু নিকোনো এক মাটির ঘরের দাওয়ায় বসে একজন বৃদ্ধ লোক চোখ বুজে তসবিহ পড়ছেন। তাঁর শীর্ণ শরীর, চেহারায় দারিদ্র্যের দীর্ঘ ছায়া, কিন্তু মুখে লেগে আছে এক অপার্থিব প্রশান্তি। যেন পৃথিবীর কোনো দুঃখ, কোনো অভাব তাঁকে স্পর্শ করতে পারছে না। তিনি হয়তো সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করছেন এই জনমের দুঃখকষ্ট থেকে মুক্তির জন্য, পরকালের অনন্ত শান্তির জন্য। দৃশ্যটা বড় মনোরম, বড় মায়াময়, বড় পবিত্র।

কিন্তু একটু থামুন। একজন চিন্তাশীল মানুষ হিসেবে আপনার মনে কি কাঁটার মতো একটি প্রশ্ন খচখচ করে ওঠে না? এই যে গভীর, অবিচল ধর্মবিশ্বাস, এর সাথে লোকটির হাড় জিরজিরে দারিদ্র্যের কোনো অদৃশ্য যোগসূত্র আছে কি? তার এই যে পার্থিব জীবনের প্রতি এক ধরনের নির্লিপ্তি এবং পরকালের দিকে নিবিষ্ট তাকিয়ে থাকা—এটা কি তার সামাজিক বা অর্থনৈতিক অবস্থাকে কোনোভাবে প্রভাবিত করছে? নাকি তার অর্থনৈতিক অবস্থাই তার এই ধর্মবিশ্বাসকে এমন শান্ত, সহনশীল রূপ দিয়েছে? সে কি এই বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে আছে বলেই তার শোষণকে সে নিয়তি বলে মেনে নিয়েছে? সে কি ঈশ্বরের কাছে আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে, নাকি ঈশ্বরের নামে তৈরি এক ব্যবস্থার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে?

এই প্রশ্নগুলো আপাতদৃষ্টিতে খুব ব্যক্তিগত বা আধ্যাত্মিক মনে হলেও এর গভীরে লুকিয়ে আছে সমাজ, অর্থনীতি ও মানুষের বিশ্বাসের এক জটিল, কুয়াশাচ্ছন্ন সমীকরণ। আর এই সমীকরণ সমাধানের জন্য সবচেয়ে বিখ্যাত, প্রভাবশালী এবং একই সাথে বিতর্কিত একটি চেষ্টা করেছিলেন কার্ল মার্ক্স (Karl Marx) নামের এক ঝাঁকড়া চুলের জার্মান দার্শনিক। তিনি এবং তাঁর আজীবনের বন্ধু ও সহযোদ্ধা ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস (Friedrich Engels) সমাজকে দেখার জন্য এমন এক চশমা তৈরি করেছিলেন, যা দিয়ে তাকালে ধর্মের মতো পবিত্র, বায়বীয় বিষয়কেও আর আগের মতো মনে হয় না। তাদের চোখে ধর্ম আর কেবল ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার থাকে না, হয়ে ওঠে ইতিহাসের এক বিশাল নাটকের চরিত্র—কখনো শোষকের হাতে থাকা ধারালো অস্ত্র, কখনো বা শোষিতের আশ্রয়ের শেষ সম্বল।

এই দীর্ঘ লেখায় আমরা সেই মার্ক্সীয় চশমা চোখে লাগিয়ে এক লম্বা সফরে বের হব। আমরা দেখব, ধর্ম আসলে কী? সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামোর (Economic Structure) ওপর এটি কীভাবে দাঁড়িয়ে থাকে? ধর্ম কি কেবলই অর্থনৈতিক ভিত্তির প্রতিচ্ছবি, নাকি এই ধর্মই কখনও কখনও উল্টো সেই ভিত্তিকেই নাড়িয়ে দিতে পারে? এই সফরে আমরা শুধু মার্ক্সেই আটকে থাকব না, তাঁর পরবর্তী সময়ের চিন্তাবিদদের হাত ধরে দেখব এই তত্ত্ব কীভাবে আরও জটিল ও আধুনিক রূপ পেয়েছে। চলুন, এই আকর্ষণীয় এবং সম্ভবত অস্বস্তিকর সফরে মন দেওয়া যাক।

দালানের ভিত্তি এবং তার উপরের তলা (Base and Superstructure)

মার্ক্সীয় চিন্তার জগতে প্রবেশ করতে গেলে প্রথমেই আমাদের একটি রূপকের সাহায্য নিতে হবে, যা মার্ক্সীয় দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু। মার্ক্স সমাজকে একটি বিশাল দালানের সাথে তুলনা করেছেন। আর যেকোনো দালানের মতোই সমাজের দুটি প্রধান অংশ আছে: এর ভিত্তি বা ‘বেইজ’ (Base) এবং তার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা কাঠামো বা ‘সুপারস্ট্রাকচার’ (Superstructure)। এই দুটি ধারণাকে পরিষ্কারভাবে না বুঝলে মার্ক্সের ধর্মবিষয়ক ভাবনা বোঝা প্রায় অসম্ভব।

বেইজ (Base) বা সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তি

যেকোনো দালানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো তার ভিত্তি বা ফাউন্ডেশন। এটি মাটির নিচে লুকিয়ে থাকে, চোখে দেখা যায় না, কিন্তু এর ওপরেই পুরো দালানটা তার সমস্ত ওজন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ভিত্তি দুর্বল হলে বিশাল অট্টালিকাও তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে। মার্ক্সের মতে, একটি সমাজের ভিত্তি হলো তার অর্থনীতি। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, ‘উৎপাদন ব্যবস্থা’ (Mode of Production)। এই উৎপাদন ব্যবস্থার আবার দুটি মূল উপাদান রয়েছে:

১. উৎপাদন শক্তি (Forces of Production): খুব সহজ ভাষায়, উৎপাদন করার জন্য যা যা লাগে, তার সবকিছু। এর মধ্যে আছে প্রাকৃতিক সম্পদ ও কাঁচামাল (যেমন: ভূমি, জল, তুলা, লোহা), যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি (যেমন: হাতকুড়াল, লাঙল, তাঁত, বাষ্পীয় ইঞ্জিন, আধুনিক রোবট, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, মানুষের শ্রমশক্তি (Labour Power) ও দক্ষতা। একটা সময় মানুষের উৎপাদন শক্তি ছিল পাথরের অস্ত্র আর নিজের দুই হাত, তারপর এলো লাঙল আর বলদ, এখন সেটা হয়েছে পারমাণবিক শক্তি আর জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং। উৎপাদন শক্তি স্থির নয়, এটি মানব ইতিহাসের সাথে সাথে ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকে।

২. উৎপাদন সম্পর্ক (Relations of Production): এটিই আসল চাবিকাঠি। উৎপাদনের এই উপকরণগুলোর মালিক কে? আর কারা কেবল গতর খেটে যাচ্ছে? এই মালিকানা এবং শ্রমের ওপর ভিত্তি করে সমাজে মানুষের সাথে মানুষের যে সম্পর্ক তৈরি হয়, সেটাই হলো উৎপাদন সম্পর্ক। এই সম্পর্কগুলোই সমাজে শ্রেণি (Class) তৈরি করে এবং এই সম্পর্কের চরিত্রই নির্ধারণ করে সমাজটি শোষক ও শোষিতের নাকি সাম্যের। যেমন:

  • সামন্তবাদী (Feudal) সমাজে: জমির মালিক ছিলেন জমিদার বা সামন্তপ্রভু (Lord)। ভূমিদাসরা (Serfs) সেই জমিতে চাষ করত, কিন্তু জমির মালিক ছিল না। তারা প্রভুর জন্য শ্রম দিতে বাধ্য ছিল, এবং বিনিময়ে পেত সামান্য বাঁচার রসদ ও নিরাপত্তা। এখানে সম্পর্কটা ছিল প্রভু-ভৃত্যের।
  • পুঁজিবাদী (Capitalist) সমাজে: কলকারখানা, যন্ত্রপাতি, অর্থাৎ পুঁজির (Capital) মালিক হলো পুঁজিপতি বা বুর্জোয়া (Bourgeoisie) শ্রেণি। আর যাদের এসব কিছুই নেই, সেই শ্রমিক বা প্রলেতারিয়েত (Proletariat) শ্রেণি বেঁচে থাকার জন্য তাদের একমাত্র সম্বল—শ্রমশক্তি—বিক্রি করতে বাধ্য হয়। কাগজে-কলমে তারা স্বাধীন, কিন্তু পেটের দায়ে তারা পুঁজিপতির কাছে শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য। এখানে সম্পর্কটা হলো মালিক ও শ্রমিকের।

মার্ক্সের মূল কথা হলো, এই উৎপাদন সম্পর্ক, অর্থাৎ কে মালিক আর কে শ্রমিক—এই বিভাজনটাই সমাজের আসল ভিত্তি। এই অর্থনৈতিক কাঠামোই নির্ধারণ করে দেয় সমাজের বাকি সবকিছু কেমন হবে। এই অর্থনৈতিক সম্পর্কই মানুষের চেতনা, তার জগৎ দেখার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে। মার্ক্স বলেছিলেন, “It is not the consciousness of men that determines their being, but, on the contrary, their social being that determines their consciousness.” (মানুষের চেতনা তার অস্তিত্বকে নির্ধারণ করে না, বরং তার সামাজিক অস্তিত্বই তার চেতনাকে নির্ধারণ করে)।

এখানেই মার্ক্সীয় দর্শনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা ‘বিচ্ছিন্নতাবোধ’ (Alienation) চলে আসে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমিক তার শ্রমের ফল থেকে বিচ্ছিন্ন, উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন, তার নিজের মনুষ্য-সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন, এবং পরিশেষে অন্য মানুষ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এই গভীর বিচ্ছিন্নতাবোধ, এই অর্থহীনতা থেকেই মানুষ এক ধরনের আশ্রয় খোঁজে, যা তাকে এই নিষ্ঠুর বাস্তবতা থেকে মুক্তি দেবে। ধর্ম সেই আশ্রয় জোগানোর একটি অন্যতম উপায়।

সুপারস্ট্রাকচার (Superstructure) বা উপরি-কাঠামো

দালানের ভিত্তির ওপর যা কিছু আমরা চোখে দেখি—দেওয়াল, ছাদ, জানালা, দরজা, এমনকি ভেতরের আসবাবপত্র, দেয়ালের রঙ, ঝুলন্ত ছবি—সেগুলোই হলো সুপারস্ট্রাকচার। মার্ক্সের মতে, সমাজের সুপারস্ট্রাকচার হলো সেইসব প্রতিষ্ঠান ও ধারণা, যা অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর জন্মায় এবং দাঁড়িয়ে থাকে। এর মধ্যে আছে:

  • রাষ্ট্র (The State) এবং তার দমনমূলক প্রতিষ্ঠান (যেমন: পুলিশ, মিলিটারি, আদালত, কারাগার)

  • আইনকানুন (Law)

  • রাজনীতি (Politics) ও রাজনৈতিক দল

  • দর্শন (Philosophy)নৈতিকতা (Ethics)

  • শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি (Art, Literature, Culture)

  • পরিবার, শিক্ষাব্যবস্থা

  • এবং আমাদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু, ধর্ম (Religion)

মার্ক্সের ক্লাসিক্যাল বা ধ্রুপদী তত্ত্ব অনুযায়ী, সম্পর্কটা মূলত একমুখী: বেইজ সুপারস্ট্রাকচারকে নির্ধারণ করে (The Base determines the Superstructure)। অর্থাৎ, যে সমাজে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেমন হবে, সেই সমাজের আইন, রাষ্ট্র, সংস্কৃতি ও ধর্মও ঠিক তেমনই হবে। এর কারণ সহজ। সমাজে যে শ্রেণি অর্থনৈতিকভাবে শাসক (Ruling Class), তারাই রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে শাসন করে। তারা তাদের সুবিধামতো আইন বানায়, রাষ্ট্রকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে এবং এমন সব ধারণা বা মতাদর্শ (Ideology) প্রচার করে, যা তাদের শোষণমূলক শাসনকে শুধু বৈধতাই দেয় না, বরং ‘স্বাভাবিক’, ‘শাশ্বত’ এবং ‘ঈশ্বরের বিধান’ বলে প্রতিষ্ঠিত করে।

একটা সহজ উদাহরণ দেওয়া যাক। সামন্তবাদী সমাজে যেখানে রাজা বা জমিদারই ছিলেন সব ক্ষমতার উৎস, সেখানে ‘রাজা ঈশ্বরের প্রতিনিধি’ (Divine Right of Kings)—এই ধারণাটি খুব জনপ্রিয় ছিল। এই ধর্মীয় বিশ্বাসটা আসলে জমিদারদের শোষণকে টিকিয়ে রাখার একটা চমৎকার আদর্শিক বর্ম হিসেবে কাজ করত। কারণ, ঈশ্বরের প্রতিনিধিকে প্রশ্ন করার বা তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সাহস ক’জনেরই বা থাকে? এইভাবে, সুপারস্ট্রাকচারের একটি অংশ (ধর্ম) অর্থনৈতিক বেইজকে (সামন্তবাদী শোষণ) রক্ষা করছে এবং টিকিয়ে রাখছে। একইভাবে, হিন্দুধর্মের বর্ণপ্রথা শ্রম বিভাজনের একটি অনড় কাঠামো তৈরি করে দিয়েছিল যা হাজার হাজার বছর ধরে সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণকে একটি ধর্মীয় ভিত্তি দিয়েছিল।

এটাই হলো মার্ক্সীয় তত্ত্বের মূল কাঠামো। এই কাঠামোটি একটি মানচিত্রের মতো। এই মানচিত্র হাতে নিয়েই আমরা এবার ধর্মের রহস্যময় জগতে প্রবেশ করব।

জনগণের আফিম এবং শোষিতের দীর্ঘশ্বাস (Opium of the People)

মার্ক্সের সবচেয়ে বিখ্যাত, সবচেয়ে বেশি উদ্ধৃত এবং সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ভুলভাবে বোঝা উক্তিগুলোর একটি হলো, “ধর্ম হলো জনগণের আফিম” (Religion is the opium of the people)। এই একটি লাইনের জন্য মার্ক্সকে ধর্মবিদ্বেষী, নাস্তিকতার চরম প্রচারক হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া হয়। অনেকেই মনে করেন, মার্ক্স ধর্মকে স্রেফ একটি নেশাদ্রব্য বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছেন, যা মানুষকে বাস্তব থেকে পালিয়ে এক ঘোরের জগতে বুঁদ করে রাখে।

এই ধারণাটি পুরোপুরি ভুল নয়, তবে এটি একটি খণ্ডিত এবং বিপজ্জনকভাবে সরলীকৃত সত্য। মার্ক্স ঠিক কী অর্থে এবং কোন প্রেক্ষাপটে কথাটি বলেছিলেন, তা বুঝতে হলে আমাদের তাঁর মূল লেখাটি দেখতে হবে। ১৮৪৪ সালে লেখা তাঁর ‘হেগেলের অধিকারের দর্শন বিষয়ক সমালোচনার ভূমিকা’ (A Contribution to the Critique of Hegel’s Philosophy of Right) বইতে তিনি লেখেন:

“ধর্মীয় যন্ত্রণা হলো একই সাথে বাস্তব যন্ত্রণার প্রকাশ এবং বাস্তব যন্ত্রণার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ। ধর্ম হলো নিপীড়িত জীবের দীর্ঘশ্বাস (sigh of the oppressed creature), এক হৃদয়হীন পৃথিবীর হৃদয় (the heart of a heartless world), ঠিক যেমন তা এক আত্মাহীন পরিস্থিতির আত্মা (the soul of soulless conditions)। এটি হলো জনগণের আফিম।” (Marx, 1844)

এখানে লক্ষ করুন, মার্ক্স ধর্মকে প্রথমে কয়েকটি প্রায়-কাব্যিক এবং সহানুভূতিশীল বিশেষণে ভূষিত করছেন। তিনি ধর্মকে সরাসরি বাতিল করে দিচ্ছেন না। তিনি বলছেন, ধর্ম হলো শোষিত, নিপীড়িত, অসহায় মানুষের একটা বুকফাটা দীর্ঘশ্বাস। যখন এই পৃথিবীটা নিষ্ঠুর আর হৃদয়হীন হয়ে ওঠে, যখন পুঁজিবাদী সমাজ মানুষের সব মানবিক অনুভূতি কেড়ে নিয়ে তাকে একটি যন্ত্রের অংশে (cog in the machine) পরিণত করে, যখন সবকিছুই আত্মাহীন মনে হয়, তখন ধর্মই সেই শূন্যস্থানে হৃদয়ের মতো কাজ করে, আত্মাহীন পরিস্থিতিতে আত্মার জোগান দেয়। এটি শোষিত মানুষকে সান্ত্বনা দেয়, আশ্রয় দেয়, জীবনের একটা অর্থ খুঁজে পেতে সাহায্য করে।

তাহলে আফিম কেন? এখানেই মার্ক্সের আসল যুক্তিটি লুকিয়ে আছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে আফিম আজকের মতো ভয়ঙ্কর মাদক হিসেবে পরিচিত ছিল না, বরং এটি ছিল একটি সহজলভ্য এবং বহুল ব্যবহৃত ব্যথানাশক ঔষধ। এর কাজ ছিল মানুষের শারীরিক কষ্টকে সাময়িকভাবে ভুলিয়ে দেওয়া, তাকে এক ধরনের ঘোর বা স্বপ্নের জগতে নিয়ে যাওয়া। ধর্মও, মার্ক্সের মতে, ঠিক এই কাজটিই করে, তবে সামাজিক ও মানসিক কষ্টের ক্ষেত্রে। এটি শোষিত শ্রমিক বা দরিদ্র কৃষককে তার বাস্তব জীবনের অবর্ণনীয় কষ্ট, বঞ্চনা, শোষণ আর অপমানকে ভুলতে সাহায্য করে। কিন্তু কীভাবে? মার্ক্স এবং এঙ্গেলস এর কয়েকটি কার্যকারণের কথা বলেছেন:

১. পরকালের অলীক পুরস্কার (Illusory Reward in the Afterlife): প্রায় সব ধর্মই এই জীবনের দুঃখকষ্টকে সাময়িক বলে বর্ণনা করে। তারা বলে, এই পৃথিবীতে যারা ধৈর্য ধরে সৃষ্টিকর্তার ওপর বিশ্বাস রেখে কষ্ট সহ্য করবে, মৃত্যুর পর তাদের জন্য অপেক্ষা করছে এক অনন্ত সুখের জীবন—বেহেশত, স্বর্গ বা মোক্ষ। এই বিশ্বাস একজন শোষিত মানুষকে তার বর্তমান দুরবস্থা মেনে নিতে মারাত্মকভাবে সাহায্য করে। সে ভাবে, ‘এই জীবনে মালিক আমার ওপর যতই অত্যাচার করুক, আমি তো পরকালে এর পুরস্কার পাব। আর মালিক পাবে তার শাস্তি।’ এই চিন্তা তাকে বিপ্লবী হওয়ার বদলে সহনশীল, নিষ্ক্রিয় এবং অদৃষ্টবাদী করে তোলে। সে তার শেকল ভাঙার চেষ্টা করার বদলে শেকল পরেই স্বর্গের স্বপ্ন দেখতে থাকে।

২. দুঃখকষ্টকে মহিমান্বিত করা (Sanctification of Suffering): অনেক ধর্মেই দারিদ্র্য, ত্যাগ বা কষ্টকে এক ধরনের আধ্যাত্মিক গুণ হিসেবে দেখা হয়। বলা হয়, গরিবরাই সৃষ্টিকর্তার বেশি কাছের, কারণ তাদের কোনো পার্থিব অহংকার নেই। যিশু বলেছেন, “Blessed are the poor”। ইসলামে সবর বা ধৈর্যের ওপর অসীম গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এই জাতীয় ধারণা শোষিত শ্রেণিকে তাদের দারিদ্র্য নিয়ে এক ধরনের বিকৃত সন্তুষ্টি দেয়। তারা ভাবতে শুরু করে, তাদের এই দুরবস্থা হয়তো সৃষ্টিকর্তারই একটি পরীক্ষা এবং এই পরীক্ষায় পাস করতে পারলেই পরকালে পুরস্কার মিলবে। ফলে, দারিদ্র্যকে তারা আর একটি সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যা হিসেবে দেখে না, দেখে আধ্যাত্মিক পরীক্ষা হিসেবে।

৩. শোষণের আসল উৎসকে আড়াল করা (Obscuring the Source of Exploitation): মার্ক্সের মতে, মানুষের দুঃখের মূল কারণ হলো শ্রেণিবিভক্ত সমাজ এবং অর্থনৈতিক শোষণ। পুঁজিপতি শ্রেণি শ্রমিকের উদ্বৃত্ত শ্রম (Surplus Labour) আত্মসাৎ করে ধনী হয়—এটাই দুঃখের মূল কারণ। কিন্তু ধর্ম এই দুঃখের কারণ হিসেবে মানুষের ভাগ্য, পূর্বজন্মের পাপ, কর্মফল বা সরাসরি ঈশ্বরের ইচ্ছাকে দায়ী করে। ফলে, শোষিত শ্রেণি তাদের আসল শত্রু—অর্থাৎ পুঁজিপতি বা শাসক শ্রেণিকে—চিনতে পারে না। তাদের সমস্ত ক্ষোভ ব্যবস্থার দিকে না গিয়ে এক অদৃশ্য, অলৌকিক শক্তির দিকে চালিত হয়। তারা ভাবে, ‘এ সবই আল্লাহর ইচ্ছা’, বা ‘আমার ভাগ্যই খারাপ’, বা ‘এটা আমার পূর্বজন্মের কর্মফল’। এই চিন্তার জন্ম দেওয়াটাই হলো ধর্মের সবচেয়ে বড় মতাদর্শিক কাজ। এটি এক ধরনের মিথ্যা চেতনা (False Consciousness) তৈরি করে, যা শ্রমিককে তার নিজের শেকলকেই ভালোবাসতে শেখায়।

এভাবেই ধর্ম আফিমের মতো কাজ করে—এটি যন্ত্রণার অনুভূতি কমায়, কিন্তু রোগের মূল কারণকে সারিয়ে তোলে না, বরং তাকে আরও বাড়তে দেয়। আর এই কারণেই এটি শাসক শ্রেণির জন্য একটি শক্তিশালী আদর্শিক হাতিয়ার (Ideological Tool)। রাষ্ট্র যেমন তার পুলিশ-মিলিটারি দিয়ে জোর করে শাসন করে (মার্ক্সের পরবর্তী তাত্ত্বিকরা একে বলবেন Repressive State Apparatus), ধর্ম তেমনি কোনো বলপ্রয়োগ ছাড়াই মানুষের মনকে শাসন করে (Ideological State Apparatus)। তাই এই সুপারস্ট্রাকচার (ধর্ম) তার নিচের বেইজ-কে (শোষণমূলক উৎপাদন সম্পর্ক) টিকিয়ে রাখতে ও পুনরুৎপাদন করতে একটি অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে।

বিতর্ক যখন উল্টো স্রোতের—সুপারস্ট্রাকচার কি বেইজ-কে ধাক্কা দিতে পারে?

মার্ক্সের এই ‘বেইজ-সুপারস্ট্রাকচার’ মডেলটিকে তাঁর অনেক সমালোচক, এমনকি পরবর্তীকালের কিছু মার্ক্সবাদীও, খুব বেশি যান্ত্রিক, সরল এবং একমুখী (Mechanical, Reductionist, and One-way) বলে সমালোচনা করেছেন। তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, মার্ক্স কি তাহলে বলতে চেয়েছেন যে মানুষের চিন্তা, চেতনা, সংস্কৃতি বা ধর্মের কোনো ক্ষমতাই নেই? সবকিছুই কি কেবল অর্থনীতির দাবার ঘুঁটি? সুপারস্ট্রাকচার কি কেবলই বেইজের একটি নিষ্ক্রিয় প্রতিচ্ছবি (Passive Reflection)?

এই সমালোচনাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিতর্ককে সামনে নিয়ে আসে। মার্ক্স বা এঙ্গেলস কেউই এতটা সরলভাবে ভাবতেন না, যদিও তাঁদের কোনো কোনো লেখায় অর্থনৈতিক দিকটির ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। তাঁদের দর্শনের মূলে রয়েছে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ (Dialectical Materialism), যার মূল কথাই হলো—সবকিছুই একে অপরের ওপর নির্ভরশীল এবং ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াশীল। কোনো কিছুই স্থির বা একমুখী নয়।

এঙ্গেলস তাঁর জীবনের শেষ দিকে জোসেফ ব্লখকে (Joseph Bloch) লেখা একটি বিখ্যাত চিঠিতে এই বিষয়টি পরিষ্কার করার চেষ্টা করেন। তিনি লেখেন:

“বস্তুবাদী ইতিহাসতত্ত্ব অনুযায়ী, বাস্তব জীবনের উৎপাদন এবং পুনরুৎপাদনই হলো ইতিহাসের চূড়ান্ত নির্ধারক শক্তি। এর চেয়ে বেশি কিছু মার্ক্স বা আমি কেউই বলিনি। এখন যদি কেউ এই কথাটিকে এমনভাবে বিকৃত করে যে অর্থনৈতিক উপাদানটিই একমাত্র নির্ধারক, তাহলে সে এই প্রস্তাবনাটিকে একটি অর্থহীন, বিমূর্ত এবং অযৌক্তিক বাক্যে পরিণত করে। … অর্থনৈতিক পরিস্থিতি হলো ভিত্তি, কিন্তু সুপারস্ট্রাকচারের বিভিন্ন উপাদান… শ্রেণী-সংগ্রামের গতিপথের ওপর তাদের প্রভাব ফেলে এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের রূপ নির্ধারণে প্রধান ভূমিকা পালন করে।” (Engels, 1890)

এঙ্গেলস এখানে একটি যুগান্তকারী ধারণা দিচ্ছেন। তিনি স্বীকার করছেন যে, চূড়ান্ত বিশ্লেষণে (in the last instance) অর্থনৈতিক ভিত্তিই নির্ধারক, কিন্তু এর মানে এই নয় যে সুপারস্ট্রাকচারের কোনো ভূমিকা নেই। সুপারস্ট্রাকচারেরও নিজস্ব আপেক্ষিক স্বায়ত্তশাসন (Relative Autonomy) আছে। অর্থাৎ, উপরি-কাঠামো কেবল ভিত্তির নিষ্ক্রিয় পুতুল নয়, এটি উল্টো ভিত্তিকে প্রভাবিত করতে, এর বিকাশকে ত্বরান্বিত বা মন্থর করতে, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে বদলে দিতেও পারে।

এই জটিল সম্পর্কটিকে বোঝার জন্য দুটি অসাধারণ ঐতিহাসিক উদাহরণ আমাদের সাহায্য করবে। একটিতে ধর্ম পুঁজিবাদের বিকাশে সহায়তা করেছে, আরেকটিতে ধর্ম পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে শক্তি জুগিয়েছে।

উদাহরণ এক: প্রোটেস্ট্যান্ট নীতি এবং পুঁজিবাদের আত্মা (The Protestant Ethic and the Spirit of Capitalism)

বিখ্যাত জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার (Max Weber), যাঁকে প্রায়ই মার্ক্সের সবচেয়ে বড় তাত্ত্বিক প্রতিপক্ষ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, তিনি তাঁর ক্লাসিক বই ‘The Protestant Ethic and the Spirit of Capitalism’-এ এক চমকপ্রদ তত্ত্ব দেন। ওয়েবার মার্ক্সের মতো বেইজ থেকে সুপারস্ট্রাকচারের দিকে না তাকিয়ে, উল্টো সুপারস্ট্রাকচার থেকে বেইজের দিকে তাকান। তিনি লক্ষ করেন, ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে ইউরোপে পুঁজিবাদের বিকাশ সেইসব দেশ ও অঞ্চলেই (যেমন: ইংল্যান্ড, হল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, জার্মানির কিছু অংশ) বেশি হয়েছিল, যেখানে প্রোটেস্ট্যান্ট, বিশেষ করে ক্যালভিনিস্ট (Calvinist) ধর্মের প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে, ক্যাথলিক দেশগুলো (যেমন: স্পেন, ইতালি), যারা অর্থনৈতিকভাবে তখন আরও শক্তিশালী ছিল, তারা পিছিয়ে পড়ছিল।

ওয়েবারের প্রশ্ন ছিল, এটি কি নিছকই কাকতালীয়? তিনি দেখান যে, ক্যালভিনিজমের কিছু ধর্মীয় বিশ্বাস এমন এক বিশেষ ধরনের মানসিকতা ও কর্মসংস্কৃতি তৈরি করেছিল, যা পুঁজিবাদের বিকাশের জন্য ছিল সারের মতো।

  • পূর্বনির্ধারণবাদ (Predestination): ক্যালভিনিজমের একটি কেন্দ্রীয় বিশ্বাস ছিল যে, কে স্বর্গে যাবে আর কে নরকে, তা সৃষ্টিকর্তা মহাকালের শুরুতেই নির্ধারণ করে রেখেছেন এবং মানুষের কোনো পুণ্যকাজই এই সিদ্ধান্ত বদলাতে পারবে না। এই বিশ্বাস মানুষের মনে এক গভীর, অসহনীয় উদ্বেগ (Anxiety) তৈরি করত—আমি কি ঈশ্বরের নির্বাচিতদের (elect) মধ্যে একজন, নাকি অভিশপ্তদের একজন?

  • একটি চিহ্ন হিসেবে পার্থিব সাফল্য: এই অসহনীয় উদ্বেগ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মানুষ একটি মনস্তাত্ত্বিক উপায় খুঁজে বের করে। তারা ভাবতে শুরু করে, যদিও ঈশ্বরের সিদ্ধান্ত বদলানো যাবে না, কিন্তু পৃথিবীতে কঠোর পরিশ্রম, শৃঙ্খলা এবং অর্থনৈতিক সাফল্য হয়তো একটি ‘চিহ্ন’ (Sign) হতে পারে যে, আমি ঈশ্বরের নির্বাচিতদের একজন। ফলে, কঠোর পরিশ্রম আর ব্যবসায়িক সাফল্য কেবল টাকা কামানোর উপায় রইল না, এটি একটি ধর্মীয় কর্তব্যে (Calling বা Vocation) পরিণত হলো।

  • ভোগবিমুখ কৃচ্ছ্রসাধন (Worldly Asceticism): প্রোটেস্ট্যান্ট নীতি অনুযায়ী, অর্জিত সম্পদ বিলাস-ব্যসনে বা আলস্যে উড়িয়ে দেওয়া ঘোরতর পাপ। তাই তারা লাভ করার পরও খুব সাধারণ, শৃঙ্খলাপরায়ণ জীবনযাপন করত। এর ফলে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ উদ্বৃত্ত থাকত, তা তারা আবার ব্যবসায় বিনিয়োগ করত।

এই তিনটি বিষয়—কঠোর পরিশ্রমকে ধর্মীয় কর্তব্য মনে করা, সাফল্যকে ঈশ্বরের আশীর্বাদের চিহ্ন ভাবা এবং লাভ পুনঃবিনিয়োগ করা—আধুনিক পুঁজিবাদের মূল কথাই তো! ওয়েবার দেখালেন, এখানে একটি ধর্মীয় বিশ্বাস (সুপারস্ট্রাকচার) এমন এক কর্মসংস্কৃতি তৈরি করল, যা পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার (বেইজ) জন্ম ও বিকাশে সরাসরি সহায়তা করেছে (Weber, 1930)। ওয়েবারের এই তত্ত্ব মার্ক্সের তত্ত্বের সরাসরি বিরোধিতা না করলেও, এটি দেখায় যে বেইজ ও সুপারস্ট্রাকচারের সম্পর্কটা কতটা জটিল ও দ্বিমুখী হতে পারে। এখানে সুপারস্ট্রাকচার (ধর্ম) বেইজ-কে (অর্থনীতি) শক্তিশালীভাবে প্রভাবিত করছে, তাকে একটি নির্দিষ্ট রূপ দিচ্ছে।

ম্যাক্স ওয়েবার সম্পর্কে জানতে যান এখানে – ম্যাক্স ওয়েবার: আধুনিকতার গোলকধাঁধায় এক পথপ্রদর্শক

উদাহরণ দুই: মুক্তির ধর্মতত্ত্ব এবং ল্যাটিন আমেরিকার বিপ্লব (Liberation Theology)

বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ল্যাটিন আমেরিকায় ধর্মের এক সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ আমরা দেখতে পাই, যা মার্ক্সের ‘আফিম’ তত্ত্বকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে। সেই সময় ল্যাটিন আমেরিকার অধিকাংশ দেশ তীব্র দারিদ্র্য, ভয়াবহ অসমতা এবং মার্কিন মদদপুষ্ট স্বৈরাচারী সামরিক শাসকদের দ্বারা নিপীড়িত ছিল। ঐতিহ্যগতভাবে, সেখানকার প্রভাবশালী ক্যাথলিক চার্চ বরাবরই শাসক শ্রেণি ও অভিজাতদের পক্ষ নিত এবং গরিবদের ধৈর্য ধরতে বলত—ঠিক যেন মার্ক্সের ‘আফিম’ তত্ত্বের পাঠ্যবইয়ের উদাহরণ।

কিন্তু ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে কিছু প্রগতিশীল যাজক, নান ও সাধারণ খ্রিস্টান, যেমন পেরুর গুস্তাভো গুতিয়েরেজ (Gustavo Gutiérrez), ব্রাজিলের লিওনার্দো বফ (Leonardo Boff) এবং শহীদ আর্চবিশপ অস্কার রোমেরো (Óscar Romero), বাইবেল ও খ্রিস্টধর্মকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করতে শুরু করেন। এই নতুন ধারার ধর্মতত্ত্বই ‘লিবারেশন থিওলজি’ (Liberation Theology) নামে পরিচিতি পায়। তাঁরা বলেন:

  • যিশু কেবল পরকালের মুক্তির কথা বলেননি, তিনি এই পৃথিবীতেই গরিব ও শোষিত মানুষের শারীরিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তির জন্য এসেছিলেন। বাইবেলের এক্সোডাস (Exodus) কাহিনী, যেখানে ঈশ্বর মোশির মাধ্যমে ইজরায়েলিদের মিশরীয়দের দাসত্ব থেকে মুক্ত করেন, তা হলো রাজনৈতিক মুক্তির এক রূপক।

  • ঈশ্বরের প্রতি সত্যিকারের ভালোবাসা মানে হলো গরিবদের প্রতি ভালোবাসা এবং তাদের মুক্তির জন্য সক্রিয়ভাবে সংগ্রাম করা। ঈশ্বর গরিবদের পক্ষ নেন (God’s preferential option for the poor)।

  • পাপ কেবল ব্যক্তিগত বিষয় (চুরি, মিথ্যা) নয়। সামাজিক শোষণ এবং অন্যায্য অর্থনৈতিক কাঠামোও একটি কাঠামোগত বা ‘সামাজিক পাপ’ (Social Sin)।

  • এই সামাজিক পাপের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা, প্রয়োজনে বিপ্লবী হওয়া, প্রত্যেক খ্রিস্টানের পবিত্র ধর্মীয় দায়িত্ব।

এই ব্যাখ্যায়, ধর্ম আর ‘আফিম’ রইল না, বরং হয়ে উঠল বিপ্লবের অনুপ্রেরণা, শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মতাদর্শিক হাতিয়ার। ধর্ম এখানে মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার বদলে জাগিয়ে তুলছে। লিবারেশন থিওলজি ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশের কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলন, মানবাধিকার আন্দোলন এবং এমনকি সশস্ত্র বিপ্লবেও (যেমন: নিকারাগুয়ার সান্দিনিস্তা বিপ্লব) ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করে। এখানে আমরা পরিষ্কার দেখতে পাই, কীভাবে ধর্ম (সুপারস্ট্রাকচার) বিদ্যমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে (বেইজ) সরাসরি চ্যালেঞ্জ করছে এবং পরিবর্তনের জন্য একটি শক্তিশালী শক্তি হিসেবে কাজ করছে। ধর্ম এখানে ‘আফিম’ নয়, বরং গরিবের জন্য এক কাপ কড়া ‘এসপ্রেসো’ (Espresso) হয়ে উঠেছে, যা তাকে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করে।

ইতিহাসের আয়নায় ধর্মের ভিন্ন ভিন্ন চেহারা

মার্ক্সীয় তত্ত্বের একটি মূল কথা হলো ঐতিহাসিক বস্তুবাদ (Historical Materialism), যা বলে যে মানব সমাজ কয়েকটি নির্দিষ্ট উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়েছে। যেহেতু উৎপাদন ব্যবস্থা (বেইজ) বদলায়, সেহেতু তার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা সুপারস্ট্রাকচারও বদলায়। তাই বিভিন্ন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ধর্মের রূপ, চরিত্র ও কাজও ভিন্ন ভিন্ন হওয়ার কথা। ইতিহাসেও আমরা তার চমৎকার প্রমাণ পাই।

আদিম সাম্যবাদী সমাজ (Primitive Communal Society): যখন মানুষ গোত্রবদ্ধ হয়ে পশু শিকার বা ফলমূল সংগ্রহ করে বাঁচত, তখন কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না, ছিল না কোনো শ্রেণিবিভাগ। তাদের জীবন ও জীবিকা সরাসরি প্রকৃতির খামখেয়ালিপনার ওপর নির্ভরশীল ছিল। তাই তাদের ধর্মও ছিল মূলত প্রকৃতি-কেন্দ্রিক। তারা সূর্য, চাঁদ, বৃষ্টি, নদী বা বনজঙ্গলের পূজা করত (সর্বপ্রাণবাদ বা Animism), কারণ এগুলোই ছিল তাদের উৎপাদনের মূল শক্তি। অনেক সময় তারা নির্দিষ্ট কোনো পশু বা উদ্ভিদকে তাদের গোত্রের প্রতীক (টোটেম) হিসেবে পূজা করত। এখানে ধর্ম ছিল মূলত সামাজিক সংহতি রক্ষা করার একটি উপায়, প্রকৃতিকে বোঝার একটি আদিম প্রচেষ্টা।

দাস সমাজ (Slave Society): প্রাচীন গ্রিস বা রোমের মতো দাস সমাজে প্রথম সুস্পষ্ট শ্রেণিবিভাজন দেখা যায়: দাস মালিক (Master) এবং দাস (Slave)। এই সমাজের ধর্মও এই শ্রেণিবিভাজনকে প্রতিফলিত করে। তাদের দেবতাদের জগতেও একটি পরিষ্কার স্তরবিন্যাস (Hierarchy) ছিল। অলিম্পাসের চূড়ায় থাকা জিউস বা জুপিটারের মতো প্রধান দেবতাদের আধিপত্য আসলে পৃথিবীতে অভিজাত দাস মালিক শ্রেণির আধিপত্যকেই বৈধতা দিত। মিশরীয় ফারাওরা নিজেদের সরাসরি ঈশ্বরের বংশধর বলে দাবি করত, যা তাদের সীমাহীন ক্ষমতাকে প্রশ্নাতীত করে তুলেছিল। রোমান সম্রাটদের অনেককেই মৃত্যুর পর দেবতা হিসেবে ঘোষণা করা হতো, যা রাজনৈতিক ক্ষমতাকে ঐশ্বরিক ক্ষমতার সাথে সরাসরি যুক্ত করে দিত।

সামন্তবাদী সমাজ (Feudal Society): মধ্যযুগের ইউরোপে সামন্তবাদী সমাজে ধর্ম (ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্ম) তার সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। এই সমাজের ধর্মের কাঠামোটি ছিল পৃথিবীর সামাজিক কাঠামোর এক নিখুঁত প্রতিচ্ছবি। স্বর্গে যেমন ঈশ্বর, দেবদূতদের একটি স্তরবিন্যাস আছে, পৃথিবীতেও তেমনি ছিল পোপ, কার্ডিনাল, বিশপদের একটি স্তরবিন্যাস, যা সমাজের রাজা, সামন্তপ্রভু ও ভূমিদাসদের স্তরবিন্যাসকে কেবল সমর্থনই করত না, বরং তাকে ‘ঈশ্বরের তৈরি ব্যবস্থা’ বলে পবিত্র করে তুলত। চার্চ নিজেই ছিল ইউরোপের বৃহত্তম জমিদার, অর্থাৎ এটি কেবল সুপারস্ট্রাকচারের অংশ ছিল না, অর্থনৈতিক বেইজেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। ধর্ম এখানে একই সাথে মতাদর্শিক এবং অর্থনৈতিক শোষণের যন্ত্র হিসেবে কাজ করত।

পুঁজিবাদী সমাজ (Capitalist Society): পুঁজিবাদের বিকাশের সাথে সাথে ধর্মের চরিত্রেও বড় ধরনের পরিবর্তন আসে।

  • প্রাথমিক পুঁজিবাদে আমরা প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মের উত্থান দেখি, যা (ওয়েবারের মতে) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, কঠোর পরিশ্রম ও সঞ্চয়ের ওপর জোর দিয়ে পুঁজিবাদের বিকাশে সহায়তা করেছিল।

  • আধুনিক পুঁজিবাদে ধর্ম আরও বেশি ব্যক্তিগত (Privatized) বিষয়ে পরিণত হয়। এখানে ব্যক্তির সাথে ঈশ্বরের সম্পর্কটা অনেক বেশি সরাসরি, কোনো যাজক বা চার্চের মধ্যস্থতার প্রয়োজন কম। এটি পুঁজিবাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী (Individualistic) সংস্কৃতিরই প্রতিফলন, যেখানে প্রত্যেকেই এক একজন বিচ্ছিন্ন পরমাণু।

  • সাম্প্রতিককালে আমরা পুঁজিবাদের সবচেয়ে নগ্ন ধর্মীয় রূপ দেখতে পাই ‘প্রসপারিটি গসপেল’ (Prosperity Gospel) বা সমৃদ্ধির ধর্মতত্ত্বের মধ্যে। মূলত আমেরিকায় এর উদ্ভব হলেও আজ এটি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। এর মূল কথা হলো—ঈশ্বর চান আপনি ধনী হোন! আপনার বিশ্বাস যত দৃঢ় হবে, আপনি যত বেশি চার্চে দান করবেন, ঈশ্বর আপনাকে তত বেশি বৈষয়িক সম্পদ দিয়ে পুরস্কৃত করবেন। এখানে পরকালের মুক্তি নয়, এই পৃথিবীতেই বিলাসবহুল গাড়ি, বড় বাড়ি আর ব্যাংক ব্যালেন্সই হলো ঈশ্বরের আশীর্বাদের চিহ্ন। এটি পুঁজিবাদের ভোগবাদী (Consumerist) সংস্কৃতিকে সরাসরি ধর্মীয় বৈধতা দেয়। এটি মার্ক্সের ‘আফিম’ তত্ত্বের এক ভয়ংকর আধুনিক সংস্করণ, যেখানে আফিম শুধু যন্ত্রণা ভোলায় না, বরং আরও বেশি করে সেই ব্যবস্থার প্রতি আসক্তি তৈরি করে যা যন্ত্রণা সৃষ্টি করছে।

  • ধর্ম ও জাতীয়তাবাদ: আধুনিক যুগে ধর্মকে প্রায়শই জাতীয়তাবাদের সঙ্গে মিশিয়ে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ভারতে ‘হিন্দুত্ববাদ’, আমেরিকায় ‘খ্রিস্টান জাতীয়তাবাদ’ বা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক ইসলাম—এগুলো সবই এমন উদাহরণ যেখানে ধর্মকে একটি নির্দিষ্ট জাতীয় বা রাজনৈতিক পরিচয়ের সঙ্গে একীভূত করে ফেলা হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায়, ধর্ম আর কেবল ব্যক্তিগত বিশ্বাস থাকে না, হয়ে ওঠে রাজনৈতিক ক্ষমতার লড়াইয়ের একটি উপকরণ, যা প্রায়শই সংখ্যালঘু বা ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর নিপীড়নের বৈধতা দেয়।

এই উদাহরণগুলো মার্ক্সের মূল থিসিসকেই জোরালোভাবে সমর্থন করে: অর্থনৈতিক ভিত্তি বদলানোর সাথে সাথে সমাজের প্রভাবশালী ধর্মীয় ধারণাগুলোও বদলে যায়, যাতে তা নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে বা বৈধতা দিতে পারে।

তত্ত্বের আধুনিকায়ন—গ্রামসি, আলথুসার এবং অদৃশ্য শেকল

মার্ক্সের মৃত্যুর পর বিংশ শতাব্দীতে অনেক মার্ক্সবাদী চিন্তাবিদ ‘বেইজ-সুপারস্ট্রাকচার’ মডেলটিকে আরও সূক্ষ্ম ও জটিল করে তোলার চেষ্টা করেছেন। তাঁরা বুঝতে চেয়েছিলেন, কেন উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোতে মার্ক্সের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী শ্রমিক বিপ্লব হচ্ছে না। তাঁদের মধ্যে দুজনের কথা না বললেই নয়।

আন্তোনিও গ্রামসি (Antonio Gramsci) ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য (Cultural Hegemony)

ইতালির মার্ক্সবাদী চিন্তাবিদ ও রাজনীতিবিদ আন্তোনিও গ্রামসি মুসোলিনির ফ্যাসিবাদী কারাগারে বসে তাঁর বিখ্যাত ‘প্রিজন নোটবুকস’ (Prison Notebooks) লেখেন। তিনি প্রশ্ন তোলেন, পুঁজিবাদী সমাজে শাসক শ্রেণি কেবল জোর বা ভয়ের মাধ্যমে শাসন করে না, তাহলে তারা টিকে থাকে কীভাবে?

গ্রামসি বলেন, শাসক শ্রেণি কেবল রাষ্ট্রযন্ত্র (পুলিশ, মিলিটারি) দিয়ে শাসন করে না, তারা জনগণের ‘সম্মতি’ (Consent) আদায়ের মাধ্যমেও শাসন করে। তারা তাদের নিজেদের দর্শন, নৈতিকতা ও সংস্কৃতিকে সমাজের সমস্ত প্রতিষ্ঠানের (স্কুল, পরিবার, চার্চ, মিডিয়া) মাধ্যমে এমনভাবে ছড়িয়ে দেয় যে, একটা সময় শোষিত শ্রেণি সেই শাসক শ্রেণির বিশ্ববীক্ষা বা ওয়ার্ল্ডভিউকেই ‘স্বাভাবিক’, ‘শাশ্বত’ বা ‘সাধারণ জ্ঞান’ (Common Sense) বলে মেনে নেয়। যেমন, “গরিবরা অলস বলেই গরিব থাকে” বা “সবার জন্য সমান সুযোগ আছে, যে চেষ্টা করে সে-ই সফল হয়”—এই ধারণাগুলো আসলে বুর্জোয়া মতাদর্শ, কিন্তু এগুলোকে ‘সাধারণ জ্ঞান’ হিসেবে প্রচার করা হয়। শোষিত শ্রেণি যখন এগুলো বিশ্বাস করতে শুরু করে, তখন তারা নিজেদের শোষণকে আর শোষণ বলে মনে করে না। এই যে সম্মতি আদায়ের মাধ্যমে মনোজগতে আধিপত্য কায়েম করা, এই প্রক্রিয়াটিরই নাম ‘সাংস্কৃতিক আধিপত্য’ (Cultural Hegemony)

গ্রামসির মতে, ধর্ম এই হেজেমনি বা আধিপত্য তৈরির একটি অন্যতম প্রধান ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। চার্চ, মসজিদ বা মন্দিরগুলো এমন সব মূল্যবোধ (যেমন: আনুগত্য, ধৈর্য, পরকালমুখিতা) প্রচার করে, যা মানুষকে বিদ্যমান ব্যবস্থা মেনে নিতে এবং প্রশ্ন না করতে শেখায়।

কিন্তু গ্রামসি এখানে একটি আশার আলোও দেখান। তিনি মনে করতেন, এই সাংস্কৃতিক আধিপত্য চিরস্থায়ী নয়। শোষিত শ্রেণি এর বিরুদ্ধে ‘প্রতি-আধিপত্য’ (Counter-Hegemony) গড়ে তুলতে পারে। তারা যদি তাদের নিজেদের বুদ্ধিজীবী (Organic Intellectuals) তৈরি করতে পারে, যারা তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাস, সমাজ ও ধর্মকে ব্যাখ্যা করবে, তাহলে তারা এই মতাদর্শিক লড়াইয়ে জিততে পারে। লিবারেশন থিওলজির যাজকরা ছিলেন ঠিক এই ধরনের ‘অর্গানিক ইন্টেলেকচুয়াল’, যারা ধর্মের প্রতি-আধিপত্যমূলক ব্যাখ্যা হাজির করেছিলেন (Gramsci, 1971)।

লুই আলথুসার (Louis Althusser) ও আদর্শিক রাষ্ট্রযন্ত্র (Ideological State Apparatuses)

ফরাসি মার্ক্সবাদী দার্শনিক লুই আলথুসার গ্রামসির ধারণাটিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যান। তিনি বলেন, পুঁজিবাদী রাষ্ট্র দুটি ভিন্ন কিন্তু পরস্পরের পরিপূরক যন্ত্রের মাধ্যমে তার শাসন টিকিয়ে রাখে:

  • ১. দমনমূলক রাষ্ট্রযন্ত্র (Repressive State Apparatus – RSA): এর মধ্যে আছে সরকার, প্রশাসন, পুলিশ, আদালত, মিলিটারি, কারাগার ইত্যাদি। এরা মূলত শারীরিক বলপ্রয়োগ বা দমনের ভয় দেখিয়ে শাসন টিকিয়ে রাখে। এটি রাষ্ট্রের ‘শক্ত’ বা দৃশ্যমান দিক।
  • ২. আদর্শিক রাষ্ট্রযন্ত্র (Ideological State Apparatus – ISA): এর মধ্যে আছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান (চার্চ, মসজিদ, মন্দির), শিক্ষাব্যবস্থা (স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়), পরিবার, গণমাধ্যম (টিভি, পত্রিকা), প্রকাশনা সংস্থা, সংস্কৃতি (সিনেমা, খেলাধুলা) ইত্যাদি। এরা সরাসরি বলপ্রয়োগ করে না, বরং আদর্শ বা মতাদর্শ প্রচারের মাধ্যমে, ‘ফিসফিস করে’ মানুষকে শাসক শ্রেণির ভাবধারায় গড়ে তোলে, যাতে তারা স্বেচ্ছায় নিয়ম মেনে চলে। আলথুসারের ভাষায়, RSA কাজ করে মূলত হিংসার দ্বারা, আর ISA কাজ করে মূলত মতাদর্শের দ্বারা (Althusser, 1971)।

আলথুসারের মতে, আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজে ISA অনেক বেশি কার্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি মানুষের মনে এমন এক অদৃশ্য শেকল পরিয়ে দেয়, যা সে দেখতে পায় না। একটি শিশু ছোটবেলা থেকেই পরিবার, স্কুল এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে আনুগত্য, দেশপ্রেম, ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে সম্মান করা ইত্যাদি এমন শিক্ষা পায়, যা তাকে ভবিষ্যৎ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার একজন আদর্শ, অনুগত নাগরিকে পরিণত করে।

ধর্ম এখানে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ISA, কারণ এটি মানুষের জীবনের সবচেয়ে গভীর প্রশ্নগুলো (জন্ম, মৃত্যু, দুঃখ, জীবনের অর্থ) নিয়ে কাজ করে এবং এর মাধ্যমে গভীর বিশ্বাস ও আবেগের জন্ম দিতে পারে। স্কুল বা মিডিয়ার চেয়েও ধর্মের প্রভাব অনেক ক্ষেত্রে বেশি স্থায়ী হয়।

আলথুসার ও গ্রামসির তত্ত্বগুলো আমাদের দেখায় যে, সুপারস্ট্রাকচার কেবল বেইজের নিষ্ক্রিয় প্রতিফলন নয়, এটি বেইজকে সক্রিয়ভাবে পুনরুৎপাদন (reproduce) করে, অর্থাৎ টিকিয়ে রাখে এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নতুন করে তৈরি করে। ধর্ম এখানে কেবল আফিম নয়, এটি একটি অদৃশ্য অপারেটিং সিস্টেম, যা আমাদের মস্তিষ্কে ছোটবেলা থেকে ইনস্টল করে দেওয়া হয়, যাতে আমরা এই সিস্টেমের নিয়মকানুনকে নিজেদের নিয়ম বলে মেনে নিই।

এক অসমাপ্ত বিতর্ক

তাহলে এই দীর্ঘ সফরের শেষে আমরা কোথায় এসে দাঁড়ালাম? মার্ক্সীয় দৃষ্টিতে ধর্ম কী?

এটি কোনো একটি সরল বাক্যে উত্তর দেওয়ার মতো প্রশ্ন নয়। আলোচনাটি অনেকটা জট পাকানো সুতার মতো, যার এক প্রান্ত ধরলে আরেক প্রান্ত আরও গুলিয়ে যায়।

একদিকে, ক্লাসিক্যাল মার্ক্সীয় তত্ত্ব আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, কীভাবে ধর্ম প্রায়শই একটি শক্তিশালী মতাদর্শিক হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে, যা শোষণের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখে। এটি গরিবের কষ্টকে ভুলিয়ে দেয়, তাকে পরকালের রঙিন স্বপ্নে বিভোর রাখে এবং তার দুঃখের আসল কারণ ও আসল শত্রুকে চিনতে দেয় না। এই অর্থে, ধর্ম সত্যিই ‘জনগণের আফিম’, শোষিতের দীর্ঘশ্বাসকে আকাশে মিলিয়ে দেওয়া এক সান্ত্বনা।

কিন্তু অন্যদিকে, ইতিহাস ও আধুনিক মার্ক্সীয় চিন্তাবিদরা আমাদের দেখান যে, গল্পটা এখানেই শেষ নয়। ধর্ম একটি দ্বিমুখী তলোয়ারের মতো। এর কোনো নির্দিষ্ট, চিরস্থায়ী চরিত্র নেই। এটি যেমন স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে পারে, তেমনই হতে পারে পরিবর্তনের এক প্রচণ্ড শক্তি। ম্যাক্স ওয়েবারের প্রোটেস্ট্যান্ট নীতি আমাদের দেখায়, একটি ধর্মীয় বিশ্বাস কীভাবে নতুন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ধাত্রী হিসেবে কাজ করতে পারে। ল্যাটিন আমেরিকার লিবারেশন থিওলজি আমাদের দেখায়, ধর্ম কীভাবে শোষিতের দীর্ঘশ্বাস থেকে শোষিতের গর্জনে পরিণত হতে পারে, আফিম থেকে হয়ে উঠতে পারে বিপ্লবের কফি।

গ্রামসি ও আলথুসারের তত্ত্ব আমাদের শেখায়, ধর্ম হলো মতাদর্শিক সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ময়দান (a key site of ideological struggle)। এই ময়দানে শাসক শ্রেণি যেমন তাদের আধিপত্য কায়েম করতে চায়, তেমনই শোষিত শ্রেণি পারে পাল্টা লড়াই চালাতে, নিজেদের মুক্তির জন্য ধর্মের নতুন ব্যাখ্যা হাজির করতে।

একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ এবং মার্ক্সীয় প্রাসঙ্গিকতা

আজকের পৃথিবীতে মার্ক্সীয় বিশ্লেষণ কি আগের মতোই প্রাসঙ্গিক? বিশ্বায়নের এই যুগে আমরা ধর্মের নতুন নতুন রূপ দেখতে পাচ্ছি। একদিকে, নব্য-উদারবাদী পুঁজিবাদের (Neoliberal Capitalism) সৃষ্ট বিচ্ছিন্নতা, নিরাপত্তাহীনতা ও অর্থহীনতার প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বজুড়ে ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান ঘটছে। এই মৌলবাদ প্রায়শই পশ্চাৎপদ, অসহিষ্ণু এবং হিংসাত্মক হলেও, এর উত্থানের পেছনে থাকা সামাজিক-অর্থনৈতিক কারণগুলোকে মার্ক্সীয় তত্ত্ব দিয়ে ভালোভাবে বোঝা যায়। অন্যদিকে, উন্নত বিশ্বে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের প্রভাব কমলেও ‘আধ্যাত্মিকতা’ বা ‘Spiritual but not religious’ ধারণার প্রসার ঘটছে, যা পুঁজিবাদের সৃষ্ট মানসিক চাপ মোকাবেলার একটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক উপায় মাত্র। এটিও এক ধরনের আধুনিক আফিম, যা সামাজিক পরিবর্তনের দিকে না গিয়ে ব্যক্তিগত শান্তির মধ্যেই সমাধান খোঁজে।

দিন শেষে, মার্ক্স যে আলোচনা শুরু করেছিলেন, তা আজও অসমাপ্ত। সেই গ্রামের মেঠোপথের ধারে বসে থাকা বৃদ্ধ লোকটির প্রার্থনার দিকে আমরা এখন আর একভাবে তাকাতে পারছি না। তাঁর সেই প্রার্থনা কি কেবলই এক পলায়নপরতা, আফিমের ঘোর? নাকি তাঁর সেই শান্ত, সমাহিত চেহারার গভীরে লুকিয়ে আছে কোনো এক অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক নীরব, আত্মিক প্রতিবাদ? তাঁর বিশ্বাস কি তাঁকে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে, নাকি এমন এক অভ্যন্তরীণ শক্তি দিচ্ছে, যা দিয়ে তিনি জীবনের সমস্ত প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করছেন?

মার্ক্সীয় চশমা দিয়ে দেখলে, এই প্রশ্নগুলোর কোনো চিরস্থায়ী উত্তর নেই। উত্তরটি নির্ভর করে সেই বিশ্বাসকে কে, কীভাবে, কোন ঐতিহাসিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্যবহার করছে তার ওপর। এই চশমায়, ধর্ম নিজে ভালোও নয়, মন্দও নয়, বরং এটি একটি শক্তিশালী সামাজিক শক্তি, যার গায়ে কোনো রঙ নেই। যে পক্ষ তাকে ব্যবহার করে, তার রঙই এর গায়ে লাগে। এটি কখনও পায়ে জড়ানো অদৃশ্য শেকল হয়ে ওঠে, আবার কখনও হয়ে ওঠে সেই শেকল ভাঙার ইস্পাত-কঠিন হাতুড়ি। এই তীব্র দ্বন্দ্বটিই হয়তো মানব সমাজ আর তার বিশ্বাসের ইতিহাসের সবচেয়ে জটিল এবং আকর্ষণীয় অধ্যায়।

আফিম থেকে হাতুড়ি—মার্ক্সীয় কৌশল ও ভবিষ্যৎ পথ

তো আমরা দেখতে পারছি, মার্ক্সীয় দৃষ্টিতে ধর্ম একটি দ্বি-ধারী তরবারির মতো। এটি একদিকে যেমন শোষণের মতাদর্শিক হাতিয়ার এবং জনগণের আফিম হিসেবে কাজ করে, তেমনই অন্যদিকে এটি শোষিতের দীর্ঘশ্বাস এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠতে পারে। এই জটিল বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে মার্ক্সবাদীরা ধর্ম নিয়ে কী করবে? তাদের কৌশল কী হওয়া উচিত? কেবল ধর্মকে ‘বুর্জোয়া কুসংস্কার’ বলে বাতিল করে দেওয়াই কি যথেষ্ট? নাকি এর চেয়েও গভীর ও সূক্ষ্ম কোনো পথের সন্ধান করা প্রয়োজন?

ইতিহাসের অভিজ্ঞতা এবং মার্ক্সীয় তত্ত্বের গভীরতর পাঠ আমাদের কয়েকটি সুস্পষ্ট কৌশলগত পথের দিকে নির্দেশ করে। একটি সফল বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তুলতে হলে ধর্ম বিষয়ে একটি যান্ত্রিক বা উগ্র নাস্তিকতাবাদী অবস্থান গ্রহণ করা মার্ক্সবাদীদের জন্য কেবল ভুলই নয়, আত্মঘাতীও হতে পারে। সেক্ষেত্রে তারা কৌশলগতভাবে সাধারণভাবে কোন পথ অবলম্বন করতে পারে তা নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক – 

রোগের চিকিৎসা, উপসর্গের নয় (Treat the Disease, Not the Symptom)

মার্ক্সীয় বিশ্লেষণের মূল কথাই হলো—ধর্ম শোষণের মূল কারণ নয়, বরং এটি শোষিত সমাজের একটি উপসর্গ বা প্রকাশ মাত্র। মানুষ স্বর্গে আশ্রয় খোঁজে কারণ তার জন্য পৃথিবীটা নরক হয়ে উঠেছে। পুঁজিবাদী সমাজে বিচ্ছিন্নতাবোধ (Alienation), নিরাপত্তাহীনতা, দারিদ্র্য এবং অর্থহীনতার যে গভীর যন্ত্রণা, ধর্ম সেই যন্ত্রণার উপশম করার একটি (অলীক) প্রতিশ্রুতি দেয়।

কাজেই, মার্ক্সবাদীদের প্রথম এবং প্রধান কাজ ধর্মকে আক্রমণ করা নয়, বরং সেই সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে আক্রমণ করা যা ধর্মের এই আফিম-সদৃশ ভূমিকার জন্ম দেয়। একজন ডাক্তার যেমন রোগীর জ্বর কমানোর জন্য কেবল জলপট্টি দেয় না, বরং জ্বরের কারণ যে সংক্রমণ, তার চিকিৎসা করে, তেমনি মার্ক্সবাদীদের লক্ষ্য হলো সেই শ্রেণিবিভক্ত সমাজের অবসান ঘটানো, যা মানুষকে অলৌকিক সান্ত্বনার দিকে ঠেলে দেয়।

ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস তাঁর ‘অ্যান্টি-ডুরিং’ (Anti-Dühring) বইতে এই বিষয়টি খুব পরিষ্কারভাবে বলেছেন। তিনি মনে করতেন, সমাজতান্ত্রিক সমাজে যখন উৎপাদনের উপকরণগুলো সামাজিক মালিকানায় আসবে, যখন মানুষ প্রকৃতির এবং সামাজিক শক্তির ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে, তখন ধর্মের বস্তুগত ভিত্তিই আর থাকবে না। মানুষ যখন পৃথিবীতেই তার জীবনকে অর্থপূর্ণ ও সুখী করতে পারবে, তখন তার আর পরকালের অলীক সুখের প্রয়োজন পড়বে না। এঙ্গেলসের ভাষায়, ধর্মকে আইন করে নিষিদ্ধ করা হবে না, এটি স্বাভাবিকভাবেই মরে যাবে বা ‘ মিলিয়ে যাবে’ (wither away)। তিনি বলেন:

“যখন এই কাজটি সম্পন্ন হবে, যখন সমাজ উৎপাদনের সমস্ত উপকরণের মালিকানা গ্রহণ করে এবং সেগুলোকে পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করে নিজেকে এবং সমাজের সকল সদস্যকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করবে… তখন মানুষের সামনে এমন কোনো বহিরাগত ও বিজাতীয় শক্তি থাকবে না যা এতদিন তাদের ইতিহাসকে শাসন করত… তখনই মানুষ পূর্ণ চেতনার সাথে তার নিজের ইতিহাস তৈরি করবে…। এটিই হলো মানবজাতির প্রয়োজনীয়তার রাজ্য থেকে স্বাধীনতার রাজ্যে উত্তরণ।” (Engels, 1878)

এই স্বাধীনতার রাজ্যে ধর্মের আর কোনো সামাজিক প্রয়োজন থাকবে না। সুতরাং, কৌশলগতভাবে প্রথম পদক্ষেপ হলো—ধর্মের বিরুদ্ধে আদর্শিক যুদ্ধ ঘোষণা না করে, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে শ্রেণি সংগ্রামকে তীব্র করা।

কৌশলগত সহনশীলতা ও শ্রমিক শ্রেণির ঐক্য (Strategic Tolerance and the Unity of the Working Class)

মার্ক্সীয় রাজনীতির মূল লক্ষ্য হলো শ্রমিক শ্রেণিকে ঐক্যবদ্ধ করে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি সফল বিপ্লব সংগঠিত করা। কিন্তু শ্রমিক শ্রেণির একটি বিশাল অংশই ধর্মপ্রাণ। যদি কোনো বিপ্লবী দল ধর্মকে তার প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে এবং সদস্যদের জন্য নাস্তিক হওয়া বাধ্যতামূলক করে, তবে তা শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে বিভেদ তৈরি করবে। এটি ধর্মপ্রাণ শ্রমিকদের বিপ্লবী আন্দোলন থেকে দূরে ঠেলে দেবে, যা শাসক শ্রেণির জন্যই সুবিধাজনক হবে।

এই কৌশলগত বিচক্ষণতার সবচেয়ে বড় প্রবক্তা ছিলেন ভ্লাদিমির লেনিন। ১৯০৫ সালে লেখা তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘সোশ্যালিজম অ্যান্ড রিলিজিয়ন’ (Socialism and Religion)-এ তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন যে, রাষ্ট্রের ধর্ম থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকা উচিত, কিন্তু বিপ্লবী পার্টির উচিত নয় ধর্মকে কেন্দ্র করে শ্রমিকদের বিভক্ত করা। তিনি বলেন:

“আমরা দাবি করি যে রাষ্ট্র থেকে চার্চ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হোক… কিন্তু এই দাবি করার পরেও আমরা কিছুতেই মনে করি না যে, ধর্মবিশ্বাসের মতো একটি গৌণ প্রশ্নের ওপর ভিত্তি করে প্রলেতারিয়েতদের বিভক্ত করা যায়… বিপ্লবী প্রলেতারিয়েত এটা নিশ্চিত করবে যে, ধর্ম যেন সত্যিই একটি ব্যক্তিগত ব্যাপারে পরিণত হয়। আর এই মধ্যযুগীয় আবর্জনা থেকে মুক্ত হয়ে তারা কোনো দ্বিধা ছাড়াই পুঁজিবাদী দাসত্বের বিরুদ্ধে এক মহান সংগ্রামের জন্য ঐক্যবদ্ধ হবে।” (Lenin, 1905)

লেনিনের মতে, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামই হলো প্রাথমিক। এই সংগ্রামের ময়দানে যখন ধর্মপ্রাণ এবং অধার্মিক শ্রমিকরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করবে, তখন বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই তাদের চেতনা বিকশিত হবে। তারা নিজেরাই বুঝতে পারবে যে, তাদের আসল শত্রু পুঁজিপতি শ্রেণি, পাশের ভিন্ন ধর্মাবলম্বী শ্রমিক ভাই নয়। তাই মার্ক্সবাদীদের কাজ হলো ধর্মীয় বিশ্বাস নির্বিশেষে সকল শোষিত মানুষকে শ্রেণি-সংগ্রামের পতাকাতলে একত্রিত করা।

প্রতি-আধিপত্যের লড়াই এবং প্রগতিশীল বিশ্বাসীদের সাথে মৈত্রী (The Struggle for Counter-Hegemony and Alliance with Progressive Believers)

আন্তোনিও গ্রামসির ‘সাংস্কৃতিক আধিপত্যের’ তত্ত্ব আমাদের শেখায় যে, মতাদর্শের ময়দানে লড়াইটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শাসক শ্রেণি যেমন ধর্মকে তাদের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য ব্যবহার করে, তেমনি শোষিত শ্রেণি ধর্মের প্রগতিশীল ও বিপ্লবী সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে একটি ‘প্রতি-আধিপত্য’ (Counter-Hegemony) গড়ে তুলতে পারে।

এর অর্থ হলো, ধর্মকে এককথায় বাতিল না করে, তার ভেতরের মানবিক, সাম্যবাদী এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের উপাদানগুলোকে খুঁজে বের করা এবং সেগুলোকে বর্তমানের সংগ্রামের সাথে যুক্ত করা। প্রায় সব ধর্মেই সাম্য, ন্যায়বিচার, গরিবের প্রতি সহানুভূতি এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কথা বলা আছে। মার্ক্সবাদীদের কাজ হলো, ধর্মের এই ‘বিপ্লবী শাঁসটিকে তার প্রতিক্রিয়াশীল খোলস থেকে আলাদা করা’ (to separate the revolutionary kernel from its reactionary shell)।

এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো ল্যাটিন আমেরিকার লিবারেশন থিওলজি, যেখানে খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্ববিদ ও কর্মীরা মার্ক্সীয় শ্রেণি বিশ্লেষণকে তাদের ধর্মীয় ব্যাখ্যার সাথে একীভূত করে স্বৈরাচার ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছিলেন। নিকারাগুয়ার সান্দিনিস্তা বিপ্লবের একটি বিখ্যাত স্লোগান ছিল: “খ্রিস্টধর্ম ও বিপ্লবের মধ্যে কোনো বৈপরীত্য নেই” (Between Christianity and revolution there is no contradiction)।

একইভাবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার আন্দোলনে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের মতো খ্রিস্টান যাজকদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। তাঁরা বাইবেলের সাম্যের বাণীকে কৃষ্ণাঙ্গদের মুক্তির সংগ্রামের সাথে যুক্ত করেছিলেন। সাম্প্রতিককালেও আমরা করনেল ওয়েস্টের (Cornel West) মতো ‘বিপ্লবী খ্রিস্টান’ দার্শনিকদের দেখি, যারা সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির সমর্থক।

সুতরাং, মার্ক্সবাদীদের উচিত প্রগতিশীল ধর্মীয় গোষ্ঠী ও ব্যক্তিদের সাথে মৈত্রী বা জোট (Alliance) গঠন করা। সম্মিলিত লক্ষ্য, যেমন—সামাজিক ন্যায়বিচার, বর্ণবাদ-বিরোধিতা, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা এবং পরিবেশ রক্ষার মতো বিষয়গুলোতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করা। এই প্রক্রিয়ায়, ধর্ম আর বিভেদের কারণ না হয়ে, হয়ে উঠতে পারে বৃহত্তর ঐক্যের সেতুবন্ধন।

একটি নতুন বিশ্ববীক্ষা নির্মাণ (Building a New Worldview)

মানুষ ধর্মকে আঁকড়ে ধরে কারণ এটি কেবল সান্ত্বনা দেয় না, এটি জীবনের একটি অর্থ দেয়, একটি নৈতিকতার কাঠামো দেয় এবং একটি সম্প্রদায়ের অংশ হওয়ার অনুভূতি জোগায়। মার্ক্সবাদ যদি কেবল অর্থনৈতিক তত্ত্ব বা রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে তা মানুষের এই গভীর আধ্যাত্মিক ও মানসিক চাহিদা পূরণ করতে পারে না।

কাজেই, মার্ক্সবাদীদের দীর্ঘমেয়াদী কাজ হলো একটি শক্তিশালী, আকর্ষণীয় এবং সামগ্রিক মানবতাবাদী (Humanist) বিশ্ববীক্ষা নির্মাণ ও প্রচার করা। এই বিশ্ববীক্ষা বিজ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে জগৎ ও জীবনকে ব্যাখ্যা করবে। এটি দেখাবে যে, জীবনের অর্থ কোনো পরলোকে নয়, বরং এই পৃথিবীতেই মানুষের সম্মিলিত সৃজনশীলতা, সংহতি এবং ভালোবাসার মধ্য দিয়ে নির্মাণ করা সম্ভব। এটি এমন এক নতুন নৈতিকতার জন্ম দেবে, যার ভিত্তি হবে মানুষের প্রতি মানুষের দায়বদ্ধতা, কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তির প্রতি ভয় নয়।

এই মানবতাবাদী বিশ্ববীক্ষা শূন্যস্থান পূরণ করবে। এটি কেবল বলবে না যে ধর্ম একটি ‘আফিম’, বরং এটি এমন এক সমাজ ও সংস্কৃতির স্বপ্ন দেখাবে যেখানে মানুষের আর কোনো আফিমের প্রয়োজনই পড়বে না। এটি হবে এমন এক জগৎ, যাকে মার্ক্স তাঁর তরুণ বয়সের লেখায় বর্ণনা করেছিলেন এমন এক অবস্থা হিসেবে যেখানে “মানুষই মানুষের জন্য সর্বোচ্চ সত্তা” (man is the highest being for man) (Marx, 1844)।

সংক্ষেপে, ধর্ম বিষয়ে মার্ক্সীয় কৌশল হওয়া উচিত একটি বহুমাত্রিক এবং দ্বান্দ্বিক কৌশল:

  • তাত্ত্বিকভাবে: ধর্মের সামাজিক-অর্থনৈতিক ভিত্তিকে বিশ্লেষণ ও সমালোচনা করা।

  • রাজনৈতিকভাবে: শ্রেণি সংগ্রামকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং শ্রমিক শ্রেণির ঐক্য অটুট রাখা।

  • কৌশলগতভাবে: প্রগতিশীল ধর্মীয় শক্তির সাথে জোট বাঁধা এবং একটি প্রতি-আধিপত্যমূলক বয়ান তৈরি করা।

  • সাংস্কৃতিকভাবে: একটি সামগ্রিক বৈজ্ঞানিক ও মানবতাবাদী বিশ্ববীক্ষা গড়ে তোলা যা ধর্মের শূন্যস্থান পূরণ করতে পারে।

এই পথটি সহজ নয়। এটি উগ্র ঘোষণার চেয়ে অনেক বেশি ধৈর্য, বিচক্ষণতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক গভীরতা দাবি করে। কিন্তু একটি শোষণহীন সমাজ নির্মাণের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে হলে, ঈশ্বরের অদৃশ্য হাতের বদলে শ্রমিকের দৃশ্যমান হাতুড়ি দিয়ে নতুন জগৎ গড়ার এই জটিল পথটিই মার্ক্সবাদীদের গ্রহণ করতে হবে।

আফিমের মনস্তত্ত্ব—কগনিটিভ বায়াস, অদৃশ্য শেকলের আধুনিক পাঠ ও করনীয়

মার্ক্সবাদীরা ধর্ম নিয়ে সাধারণভাবে কী করতে পারে তা নিয়ে আলোচনা হলো। এবারে একটু মনস্তত্ত্বে দৃষ্টিনিবদ্ধ করে মার্ক্সবাদীরা ধর্মের কোন কোন বিষয়গুলোতে বেশি ফোকাস করতে পারে তা নিয়ে একটু আলোচনা করব। মার্ক্স যখন ধর্মকে ‘আফিম’ বা ‘শোষিতের দীর্ঘশ্বাস’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন, তখন আধুনিক মনোবিজ্ঞান বা কগনিটিভ সায়েন্সের জন্ম হয়নি। তিনি মূলত সমাজতাত্ত্বিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করেছিলেন। কিন্তু বিস্ময়করভাবে, তাঁর বিশ্লেষণগুলো আধুনিক মনোবিজ্ঞানের বিভিন্ন তত্ত্ব, বিশেষ করে কগনিটিভ বায়াস (Cognitive Bias) বা জ্ঞানীয় পক্ষপাতের ধারণার সাথে গভীরভাবে মিলে যায়। এই অংশে আমরা দেখব, মার্ক্সের বর্ণিত তিনটি প্রক্রিয়া—‘পরকালের অলীক পুরস্কার’, ‘দুঃখকষ্টের মহিমান্বিতকরণ’ এবং ‘শোষণের উৎসকে আড়াল করা’—কীভাবে আমাদের মস্তিষ্কের অন্তর্নির্মিত কিছু জ্ঞানীয় দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে একটি শক্তিশালী মতাদর্শিক প্রভাব তৈরি করে।

মানুষ যুক্তিবাদী প্রাণী—এই ধারণাটি এখন আর আগের মতো অটুট নেই। মনোবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল কাহনেম্যান (Daniel Kahneman) এবং আমোস টভারস্কি (Amos Tversky)-র যুগান্তকারী গবেষণার পর আমরা জানি যে, আমাদের মস্তিষ্ক দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য অসংখ্য মানসিক শর্টকাট বা ‘হিউরিস্টিকস’ (Heuristics) ব্যবহার করে। এই শর্টকাটগুলো বেশিরভাগ সময় কার্যকর হলেও, অনেক ক্ষেত্রে এগুলো আমাদের চিন্তায় পদ্ধতিগত ভুল বা ‘বায়াস’ তৈরি করে। ধর্মীয় বিশ্বাস, বিশেষ করে এর সান্ত্বনাদায়ী রূপটি, এই বায়াসগুলোর ওপর ভিত্তি করেই শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

এই মনোবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ মার্ক্সবাদীদের জন্য কেবল তাত্ত্বিক অন্তর্দৃষ্টি দেয় না, বরং বিপ্লবী কৌশল প্রণয়নের জন্য নতুন কিছু দিকনির্দেশনাও দেয়। কগনিটিভ বায়াসগুলো যদি মানুষের চিন্তাকে প্রভাবিত করে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে সাহায্য করে, তবে মার্ক্সবাদীদের কাজ হলো সচেতনভাবে এমন কৌশল গ্রহণ করা যা এই বায়াসগুলোকে সরাসরি মোকাবেলা (Counter) করবে এবং একটি বিপ্লবী চেতনার বিকাশে সহায়তা করবে।

১. পরকালের অলীক পুরস্কার এবং ‘হাইপারবোলিক ডিসকাউন্টিং’ (Hyperbolic Discounting)

মার্ক্সীয় পর্যবেক্ষণ: ধর্ম শোষিত মানুষকে এই জীবনের দুঃখের বিনিময়ে পরকালে এক অসীম সুখের প্রতিশ্রুতি দেয়। এই ভবিষ্যতের পুরস্কারের আশায় মানুষ বর্তমানের কষ্টকে মেনে নেয়।

মনোবৈজ্ঞানিক সংযোগ: এই প্রক্রিয়াটি হাইপারবোলিক ডিসকাউন্টিং (Hyperbolic Discounting) বা বর্তমান পক্ষপাত (Present Bias) নামক একটি সুপরিচিত কগনিটিভ বায়াসের সাথে সম্পর্কিত, যদিও এখানে এটি একটি বিপরীত রূপে কাজ করে। সাধারণত, এই বায়াসের কারণে মানুষ তাৎক্ষণিক ছোট পুরস্কারকে ভবিষ্যতের বড় পুরস্কারের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। যেমন, এখন ১০০ টাকা পাওয়াকে এক বছর পর ১২০ টাকা পাওয়ার চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় মনে করে।

কিন্তু ধর্মীয় প্রতিশ্রুতির ক্ষেত্রে এই সমীকরণটি উল্টে যায়। কেন? কারণ এখানে ভবিষ্যতের পুরস্কারটি কেবল ‘বড়’ নয়, এটি অসীম, অনন্ত এবং নিশ্চিত (ঈশ্বরের দ্বারা প্রতিশ্রুত) হিসেবে উপস্থাপিত হয়। অন্যদিকে, বর্তমানের সুখ অনিশ্চিত, ক্ষণস্থায়ী এবং নাগালের বাইরে। যখন একজন শোষিত শ্রমিক দেখে যে, এই জীবনে তার ভালো থাকার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য, তখন তার মস্তিষ্ক একটি ভিন্ন হিসাব কষতে শুরু করে। এই জীবনে বিদ্রোহ করে সামান্য কিছু পাওয়ার (যার ঝুঁকি অনেক বেশি) চেয়ে পরকালে অনন্ত সুখের ‘নিশ্চিত’ পুরস্কারের দিকে ঝুঁকে পড়াটা তার জন্য এক ধরনের ‘যৌক্তিক’ বিনিয়োগ মনে হতে পারে। মনোবিজ্ঞানী এবং দার্শনিক জন মনটারোসো (Jon Monterosso) এবং জর্জ আইনসলি (George Ainslie)-র কাজ দেখায় যে, প্রতিশ্রুত পুরস্কারের বিশালতা এবং তাকে ঘিরে থাকা আখ্যান আমাদের ডিসকাউন্টিং প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে (Ainslie & Monterosso, 2003)। ধর্ম ঠিক এই কাজটিই করে। এটি পরকালের পুরস্কারকে এতটাই মহিমান্বিত এবং অকল্পনীয়ভাবে বড় করে তোলে যে, বর্তমানের সব কষ্ট তার তুলনায় তুচ্ছ হয়ে যায়। এটি এক ধরনের আধ্যাত্মিক বিনিয়োগ (Spiritual Investment), যেখানে বর্তমানের দুঃখ হলো প্রিমিয়াম আর পরকালের সুখ হলো তার চূড়ান্ত রিটার্ন।

মার্ক্সীয় কৌশল:

  • শুধু তথ্য নয়, শক্তিশালী আখ্যান: কেবল পরিসংখ্যান দিয়ে পুঁজিবাদের শোষণ তুলে ধরা যথেষ্ট নয়। মার্ক্সবাদীদের এমন একটি বিকল্প আখ্যান বা কাউন্টার-ন্যারেটিভ (Counter-Narrative) তৈরি করতে হবে যা একইসাথে যৌক্তিক এবং আবেগগতভাবে আকর্ষণীয়। এই আখ্যানে জগৎকে ‘অন্যায়’ হিসেবে দেখানোর পাশাপাশি সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একটি মহৎ পথ দেখাতে হবে।

  • শিকার থেকে সংগ্রামী নায়কে রূপান্তর: এই কাউন্টার-ন্যারেটিভে শোষিত মানুষটিকে ‘অসহায় শিকার’ (helpless victim) হিসেবে উপস্থাপন না করে, তাকে একজন ‘সংগ্রামী নায়ক’ (struggling hero) হিসেবে চিত্রিত করতে হবে। তার কষ্টকে আর ঈশ্বরের পরীক্ষা বা কর্মফল হিসেবে না দেখিয়ে, একটি শোষণমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামের অনিবার্য অংশ হিসেবে তুলে ধরতে হবে। এই আখ্যানটি তার কষ্টকে অর্থহীন হতে দেয় না, বরং তাকে একটি ঐতিহাসিক ও মহৎ লড়াইয়ের অংশীদারে পরিণত করে। এটি ‘জাস্ট-ওয়ার্ল্ড’ বিশ্বাসের শূন্যস্থানটি একটি নতুন, বিপ্লবী ন্যায়বিচারের ধারণা দিয়ে পূরণ করে, যেখানে ন্যায়বিচার অর্জন করতে হয়, অপেক্ষা করতে হয় না।

  • শত্রুকে মূর্ত করে তোলা: ‘পুঁজিবাদ’ একটি বিমূর্ত ধারণা। এই আখ্যানে শোষণের উৎসকে মূর্ত করে তুলতে হবে। নির্দিষ্ট কর্পোরেশন, নির্দিষ্ট মালিক বা নির্দিষ্ট নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করলে শত্রু আর অদৃশ্য থাকে না। এটি ‘ফান্ডামেন্টাল অ্যাট্রিবিউশন এরর’-কে চ্যালেঞ্জ করে, কারণ তখন সমস্যার কারণ আর ‘ভাগ্য’ বা ‘ঈশ্বরের ইচ্ছা’ থাকে না, বরং নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর শোষণমূলক কর্মকাণ্ড হয়ে ওঠে।

২. দুঃখকষ্টকে মহিমান্বিত করা এবং ‘জাস্ট-ওয়ার্ল্ড হাইপোথিসিস’ (Just-World Hypothesis)

মার্ক্সীয় পর্যবেক্ষণ: ধর্ম দারিদ্র্য ও কষ্টকে একটি আধ্যাত্মিক গুণ বা পরীক্ষা হিসেবে মহিমান্বিত করে, যা শোষিতকে তার দুরবস্থা নিয়ে এক ধরনের বিকৃত সন্তুষ্টি দেয়।

মনোবৈজ্ঞানিক সংযোগ: এই ধারণাটি জাস্ট-ওয়ার্ল্ড হাইপোথিসিস (Just-World Hypothesis) বা ‘ন্যায়পরায়ণ বিশ্ব প্রকল্প’ নামক একটি শক্তিশালী কগনিটিভ বায়াসের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এই বায়াসটি হলো মানুষের একটি অন্তর্নিহিত বিশ্বাস যে, পৃথিবীটা একটি ন্যায়সঙ্গত জায়গা এবং প্রত্যেকে তার যোগ্য পুরস্কার বা শাস্তি পায় (Lerner, 1980)। যখন একজন ভালো মানুষ কষ্ট পায়, তখন এই বিশ্বাসটি প্রচণ্ড ধাক্কা খায় এবং এক ধরনের জ্ঞানীয় পীড়ন (Cognitive Dissonance) তৈরি করে। এই পীড়ন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মস্তিষ্ক কয়েকটি উপায় খোঁজে:

  • শিকারকে দোষারোপ করা (Victim Blaming): ‘লোকটা নিশ্চয়ই কোনো ভুল করেছে, তাই তার এই দশা।’

  • পরিস্থিতিকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করা (Reinterpreting the situation): এখানেই ধর্ম একটি শক্তিশালী সমাধান দেয়। এটি বলে, ‘পৃথিবীটা হয়তো অন্যায়, কিন্তু মহাবিশ্ব বা ঈশ্বরের চূড়ান্ত বিচার ন্যায়পরায়ণ।’ এই জীবনের কষ্ট আসলে কোনো অন্যায় নয়, এটি একটি পরীক্ষা। অথবা, এটি পূর্বজন্মের পাপের ফল। এই ব্যাখ্যাটি জগৎকে আবার ‘ন্যায়পরায়ণ’ করে তোলে। শোষিত মানুষটি ভাবতে শুরু করে, ‘আমার এই কষ্ট অর্থহীন নয়, এর একটি মহৎ উদ্দেশ্য আছে। আমি ঈশ্বরের পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।’ এই চিন্তা তার আত্মসম্মানকে রক্ষা করে এবং তার কষ্টকে একটি মহিমান্বিত অর্থ প্রদান করে। এটি দারিদ্র্যকে আর একটি সামাজিক সমস্যা হিসেবে দেখতে দেয় না, বরং একটি ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিক যাত্রায় রূপান্তরিত করে।

মার্ক্সীয় কৌশল:

  • ছোট ছোট অর্জনযোগ্য লক্ষ্য নির্ধারণ: দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যের পাশাপাশি স্বল্পমেয়াদী, অর্জনযোগ্য এবং দৃশ্যমান লক্ষ্যের ওপর জোর দিতে হবে। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে বেতন সামান্য বৃদ্ধি, কর্মঘণ্টা কমানো, কর্মপরিবেশের উন্নতি, বা স্থানীয় পর্যায়ে কোনো দাবি আদায়—এই ছোট ছোট জয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

  • আত্মবিশ্বাস ও কার্যকারিতার মনোবিজ্ঞান: মনোবিজ্ঞানী অ্যালবার্ট বান্দুরার (Albert Bandura) ‘আত্ম-কার্যকারিতা’ (Self-efficacy) তত্ত্ব অনুযায়ী, মানুষ যখন দেখে যে তার কাজের একটি ইতিবাচক ফল আসছে, তখন তার আত্মবিশ্বাস বাড়ে এবং সে আরও বড় চ্যালেঞ্জ নিতে উৎসাহিত হয় (Bandura, 1977)। এই ছোট জয়গুলো শ্রমিকদের মধ্যে সংগ্রামের কার্যকারিতা বিষয়ে বিশ্বাস তৈরি করে। তারা হাতে-কলমে শেখে যে, ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম করলে পরিবর্তন সম্ভব।

  • বাস্তব পুরস্কার বনাম অলীক পুরস্কার: এই ছোট জয়গুলো ‘পরকালের’ অলীক পুরস্কারের ধারণার বিপরীতে ‘ইহকালের’ বাস্তব প্রাপ্তির একটি শক্তিশালী বিকল্প হিসেবে কাজ করে। এটি মানুষকে নিষ্ক্রিয় অপেক্ষা থেকে সক্রিয় সংগ্রামে নিয়ে আসে। যখন একজন শ্রমিক দেখে যে, প্রার্থনার চেয়ে পিকেটিং করে তার সন্তানের জন্য একবেলার খাবার বেশি জুটছে, তখন তার চেতনার রূপান্তর ঘটতে শুরু করে।

৩. শোষণের উৎসকে আড়াল করা এবং ‘ফান্ডামেন্টাল অ্যাট্রিবিউশন এরর’ (Fundamental Attribution Error)

মার্ক্সীয় পর্যবেক্ষণ: ধর্ম মানুষের দুঃখের কারণ হিসেবে ভাগ্য, কর্মফল বা ঈশ্বরের ইচ্ছাকে দায়ী করে এবং আসল কারণ—অর্থাৎ অর্থনৈতিক শোষণকে—আড়াল করে দেয়। এটি ‘মিথ্যা চেতনা’ তৈরি করে।

মনোবৈজ্ঞানিক সংযোগ: এই প্রক্রিয়াটি ফান্ডামেন্টাল অ্যাট্রিবিউশন এরর (Fundamental Attribution Error) নামক জ্ঞানীয় পক্ষপাতের সাথে গভীরভাবে জড়িত। এই বায়াসটি হলো আমাদের এই প্রবণতা যে, আমরা অন্যের আচরণের ব্যাখ্যা দেওয়ার সময় তার ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য বা ইচ্ছাকে (Dispositional Factors) বেশি গুরুত্ব দিই এবং পারিপার্শ্বিক বা কাঠামোগত কারণকে (Situational Factors) উপেক্ষা করি (Ross, 1977)।

যেমন, একজন গরিব মানুষকে দেখে আমরা সহজেই সিদ্ধান্ত নিই, ‘সে অলস বা অযোগ্য’। আমরা তার পারিপার্শ্বিক কারণগুলো—যেমন, সে কেমন পরিবারে জন্মেছে, কী ধরনের শিক্ষা পেয়েছে, সামাজিক কাঠামো তাকে কতটা সুযোগ দিয়েছে—এগুলো নিয়ে ভাবি না। ধর্ম এই বায়াসটিকে মহাজাগতিক স্তরে প্রসারিত করে। এটি বলে, মানুষের অবস্থার কারণ হলো তার ‘ভাগ্য’, ‘কর্মফল’ বা ‘ঈশ্বরের ইচ্ছা’—যা সবই বিমূর্ত এবং ব্যক্তিগত। এটি শোষণের মতো জটিল এবং কাঠামোগত কারণকে ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষা করে।

যখন একজন শ্রমিক তার নিজের দুর্দশার কারণ হিসেবে ‘ভাগ্য’ বা ‘ঈশ্বরের ইচ্ছা’কে দায়ী করে, তখন সে আসলে এই ফান্ডামেন্টাল অ্যাট্রিবিউশন এরর-এরই একটি রূপ প্রয়োগ করছে। সে ব্যবস্থার দিকে না তাকিয়ে একটি অদৃশ্য, বিমূর্ত সত্তার দিকে তাকাচ্ছে। এটি তাকে তার আসল শত্রু এবং তার মুক্তির আসল পথকে চিনতে বাধা দেয়, যা মার্ক্সের ‘মিথ্যা চেতনা’র ধারণার একটি নিখুঁত মনোবৈজ্ঞানিক প্রতিরূপ।

মার্ক্সীয় কৌশল:

  • বাস্তব ও সংগ্রামী সম্প্রদায় তৈরি: মার্ক্সবাদীদের কাজ হলো এমন একটি বাস্তব, সুনির্দিষ্ট এবং সংগ্রামী সম্প্রদায় তৈরি করা যা ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে শ্রেণি-পরিচয়কে প্রধান করে তুলবে। পার্টি সেল, স্টাডি সার্কেল, শ্রমিক সংগঠন, সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, সমবায়—এইসব প্ল্যাটফর্মগুলো মানুষকে কেবল রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করে না, এগুলো তাদের একাকিত্ব দূর করে এবং একটি সম্মিলিত পরিচয়ের অংশীদার করে তোলে।

  • নতুন ‘ইন-গ্রুপ’ নির্মাণ: এই প্ল্যাটফর্মগুলো একটি নতুন ‘ইন-গ্রুপ’ বা ‘আমাদের দল’ তৈরি করে, যার ভিত্তি হলো শ্রেণি-সংহতি। যখন একজন হিন্দু, মুসলিম এবং নাস্তিক শ্রমিক একই দাবিতে একসাথে লড়াই করে এবং জেতে, তখন তাদের মধ্যে যে বন্ধন তৈরি হয়, তা ধর্মীয় বিভেদের দেয়ালকে দুর্বল করে দেয়। তাদের ‘ইন-গ্রুপ’ তখন আর ধর্মীয় পরিচয় থাকে না, হয়ে যায় ‘আমরা শ্রমিক শ্রেণি’।

  • সংহতির আবেগগত শক্তি: এই সংহতির অনুভূতিই হলো ধর্মীয় সান্ত্বনার সবচেয়ে শক্তিশালী মানবতাবাদী বিকল্প। এটি কেবল রাজনৈতিক শক্তিই জোগায় না, এটি মানুষের একাকিত্ব, ভয় এবং অর্থহীনতার মতো গভীর মানসিক চাহিদাগুলোও পূরণ করে। এই সংগ্রামী সম্প্রদায়ের অংশ হয়ে মানুষ যে মানসিক শক্তি ও নিরাপত্তা পায়, তা তাকে আর কোনো অলীক সত্তার কাছে আশ্রয় খুঁজতে নিরুৎসাহিত করে।

শেষ পর্যন্ত, মার্ক্সের অন্তর্দৃষ্টি এবং আধুনিক মনোবিজ্ঞানের আবিষ্কার আমাদের একই সিদ্ধান্তে পৌঁছে দেয়: মানুষের চেতনা একটি জটিল এবং প্রায়শই অযৌক্তিক সংগ্রামের ক্ষেত্র। এই ময়দানে জিততে হলে কেবল অর্থনৈতিক যুক্তি বা রাজনৈতিক স্লোগান যথেষ্ট নয়। মানুষের গভীরতম ভয়, আশা এবং বিশ্বাসের মনস্তাত্ত্বিক শেকড়গুলোকে বুঝতে হবে। মার্ক্সবাদীদের কাজ হলো এমন এক আন্দোলন গড়ে তোলা, যা কেবল মানুষের পকেট নয়, তার হৃদয় ও মনকেও জয় করতে পারে। আর তা করতে পারলেই আফিমকে হাতুড়িতে রূপান্তরিত করার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হবে।

ধর্মগ্রন্থের দ্বান্দ্বিক পাঠ

মার্ক্সবাদীরা ধর্মের সাথে ডিল করার জন্য বিশেষভাবে কী করতে পারে তা নিয়ে মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু আলোচনা হলো। এবারে আসব ধর্মগ্রন্থ নিয়ে তারা কিভাবে ডিল করতে পারে সেই আলোচনায়। মার্ক্সীয় তত্ত্ব অনুযায়ী ধর্ম যদি সুপারস্ট্রাকচারের অংশ হয়, তবে ধর্মগ্রন্থগুলো (যেমন: বাইবেল, কুরআন, বেদ, ত্রিপিটক) কী? এগুলো কি কেবলই শাসক শ্রেণির মতাদর্শ প্রচারের দলিল? নাকি এর ভেতরেও লুকিয়ে আছে শোষিতের কণ্ঠস্বর, প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ এবং এক উন্নততর সমাজের আকাঙ্ক্ষা? একজন মার্ক্সবাদীর কাছে ধর্মগ্রন্থ নিছক ঐশী বাণী বা অলঙ্ঘনীয় সত্য নয়, বরং এটি একটি ঐতিহাসিক ও সামাজিক টেক্সট—নির্দিষ্ট শ্রেণি-সংগ্রামে জর্জরিত সমাজের দর্পণ। তাই ধর্মগ্রন্থ পাঠের ক্ষেত্রে মার্ক্সবাদীরা একটি দ্বান্দ্বিক (Dialectical) এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদী (Historical Materialist) পদ্ধতি অবলম্বন করে।

এই পাঠের মূল লক্ষ্য হলো ধর্মগ্রন্থের ভেতরের পরস্পরবিরোধী ধারাগুলোকে চিহ্নিত করা এবং সেগুলোকে তাদের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে স্থাপন করা। এর মাধ্যমে ধর্মগ্রন্থের বিপ্লবী সম্ভাবনাকে উন্মোচিত করা এবং তাকে প্রতি-আধিপত্যের (Counter-Hegemony) সংগ্রামে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব।

১. শ্রেণি-সংগ্রামের ময়দান হিসেবে ধর্মগ্রন্থ (Scripture as a Site of Class Struggle)

মার্ক্সবাদীরা মনে করেন, কোনো টেক্সটই শূন্য থেকে উৎপন্ন হয় না। প্রতিটি ধর্মগ্রন্থ জন্ম নেয় একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে—যেখানে থাকে বিশেষ সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং শ্রেণিসংঘাতের বাস্তবতা। তাই তাদের মতে বাইবেল কিংবা কুরআনের মতো ধর্মগ্রন্থেও একসাথে দেখা যায় দুটি বিপরীতমুখী ধারা: একদিকে শাসক শ্রেণির স্বার্থরক্ষা, অন্যদিকে নিপীড়িতদের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা:

আধিপত্যকামী বা হেজিমোনিক ধারা (The Hegemonic Strand): এই ধারাটি বিদ্যমান সামাজিক স্তরবিন্যাস, ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং শাসক শ্রেণির ক্ষমতাকে বৈধতা দেয়। এটি আনুগত্য, ধৈর্য এবং স্থিতাবস্থাকে সমর্থন করে। উদাহরণস্বরূপ:

  • বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টে রোমানদের উদ্দেশে পল বলছেন, “প্রত্যেকেই যেন শাসক কর্তৃপক্ষের অধীন থাকে, কারণ ঈশ্বরের স্থাপন করা কর্তৃপক্ষ ছাড়া আর কোনো কর্তৃপক্ষ নেই।” (রোমীয় ১৩:১)। এই উক্তিটি প্রায়শই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য প্রচারের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে।

  • হিন্দুধর্মের মনুসংহিতার মতো স্মৃতিশাস্ত্রগুলোতে বর্ণপ্রথাকে একটি ঐশ্বরিক ও অলঙ্ঘনীয় ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যা হাজার হাজার বছর ধরে শ্রম বিভাজন এবং শোষণকে ধর্মীয় বৈধতা দিয়েছে।

  • অনেক ইসলামি ব্যাখ্যায় শাসকের প্রতি আনুগত্যকে ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবে দেখা হয়, যা স্বৈরাচারী শাসনকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে।

প্রতি-আধিপত্যকামী বা বিপ্লবী ধারা (The Counter-Hegemonic Strand): এই ধারাটি গরিব, শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের পক্ষে কথা বলে। এটি সামাজিক ন্যায়বিচার, সাম্য এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ডাক দেয়। এই ধারাতে মার্ক্সবাদীরা সংগ্রামের রসদ খুঁজে পায়। উদাহরণস্বরূপ:

  • বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে নবী আমোস, যিশাইয়ারা ধনীদের তীব্র সমালোচনা করেছেন যারা “গরিবদের ধুলোয় পিষে দেয়” এবং “দরিদ্রদের বিচার থেকে বঞ্চিত করে”। আমোস বলছেন, “ন্যায়বিচার জলের মতো এবং ধার্মিকতা চিরপ্রবহমান স্রোতের মতো বয়ে যাক।” (আমোস ৫:২৪)।

  • যিশুর বাণী গরিব ও প্রান্তিকদের প্রতি সহানুভূতিতে পূর্ণ। তিনি বলেন, “ধনীর পক্ষে ঈশ্বরের রাজ্যে প্রবেশ করার চেয়ে বরং উটের পক্ষে সূঁচের ছিদ্র দিয়ে যাওয়া সহজ।” (মার্ক ১০:২৫)।

  • কুরআনে বারবার যাকাত (বাধ্যতামূলক দান) এবং সাদাকাহ (ঐচ্ছিক দান) এর মাধ্যমে সম্পদ পুনর্বণ্টনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। সুদ (রিবা) স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ, যা প্রাথমিক পুঁজিবাদের শোষণের একটি প্রধান রূপ ছিল। কুরআনে বলা হয়েছে, “যাতে সম্পদ কেবল তোমাদের ধনীদের মধ্যেই আবর্তিত না হয়।” (সূরা হাশর: ৭)।

বিখ্যাত মার্ক্সবাদী ধর্মতাত্ত্বিক আর্নস্ট ব্লখ (Ernst Bloch) তাঁর স্মরণীয় কাজ The Principle of Hope-এ দেখিয়েছেন যে, বাইবেলের মূলে রয়েছে একটি ‘ইউটোপিয়ান প্রেরণা’ (Utopian Impulse)—একটি শোষণহীন, ন্যায়ভিত্তিক পৃথিবীর স্বপ্ন, যা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। এই স্বপ্নই শোষিত মানুষকে যুগে যুগে অনুপ্রাণিত করেছে (Bloch, 1986)। মার্ক্সবাদীর কাজ হলো এই ইউটোপিয়ান ধারাটিকে খুঁজে বের করে তাকে একটি আধুনিক, বৈপ্লবিক রূপ দেওয়া।

২. ঐতিহাসিক বস্তুবাদী পাঠ (A Historical Materialist Reading)

মার্ক্সবাদীরা ধর্মগ্রন্থকে শাশ্বত বা ঐশী বাণী হিসেবে পাঠ করে না। তারা প্রশ্ন করে: এই নির্দিষ্ট বাণীটি কোন ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে, কোন শ্রেণির স্বার্থে রচিত বা প্রচারিত হয়েছিল?

উদাহরণস্বরূপ, ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস তাঁর The Peasant War in Germany বইতে দেখিয়েছেন, কীভাবে ষোড়শ শতকের জার্মানিতে কৃষক বিদ্রোহের সময় মার্টিন লুথার এবং টমাস মুন্টজার দুজনেই বাইবেল ব্যবহার করেছিলেন, কিন্তু সম্পূর্ণ বিপরীত উদ্দেশ্যে।

  • মার্টিন লুথার: তিনি উদীয়মান বুর্জোয়া এবং প্রিন্সদের স্বার্থ রক্ষা করছিলেন। তাই তিনি বাইবেলের সেই অংশগুলোকেই বেছে নিয়েছিলেন যা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রতি আনুগত্য সমর্থন করে। তিনি বিদ্রোহী কৃষকদের ‘পাগলা কুকুর’-এর মতো হত্যা করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

  • টমাস মুন্টজার: তিনি ছিলেন দরিদ্র কৃষক এবং কারিগরদের নেতা। তিনি বাইবেলের সেই বিপ্লবী ধারাকে আঁকড়ে ধরেছিলেন যা গরিবদের মুক্তির কথা বলে এবং ‘ঈশ্বরের রাজ্য’ পৃথিবীতেই প্রতিষ্ঠা করার ডাক দেয়। তাঁর কাছে ‘ঈশ্বরের রাজ্য’ ছিল একটি শ্রেণিহীন, সাম্যবাদী সমাজ।

এঙ্গেলসের এই বিশ্লেষণ দেখায় যে, ধর্মগ্রন্থ নিজে নিরপেক্ষ। কোন শ্রেণি তাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করছে, তার ওপরই এর রাজনৈতিক চরিত্র নির্ভর করে (Engels, 1850)।

একইভাবে, ইসলামি চিন্তাবিদ আলি শরিয়তি (Ali Shariati) দেখিয়েছেন, ইসলামের ইতিহাস হলো দুটি ধারার লড়াইয়ের ইতিহাস: একদিকে ‘সাফাভিদ ইসলাম’ বা রাজতন্ত্র ও অভিজাতদের ইসলাম, যা ধর্মকে ক্ষমতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে; অন্যদিকে ‘আলাভিদ ইসলাম’ বা হযরত আলীর অনুসারী বিপ্লবী ইসলাম, যা সামাজিক ন্যায়বিচার ও শোষিতের মুক্তির কথা বলে (Shariati, 1979)।

মার্ক্সবাদীরা ধর্মগ্রন্থ নিয়ে কী করতে পারে?

এই দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক পাঠের ওপর ভিত্তি করে মার্ক্সবাদীরা ধর্মগ্রন্থ নিয়ে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট কাজ করতে পারে:

১. ডিকনস্ট্রাকশন বা বিনির্মাণ (Deconstruction): শাসক শ্রেণি ধর্মগ্রন্থের যে ব্যাখ্যাকে ‘একমাত্র সঠিক’ বা ‘ঐতিহ্যবাহী’ বলে প্রচার করে, তার ঐতিহাসিক ও শ্রেণি-ভিত্তিকে উন্মোচিত করা। দেখাতে হবে যে, এই ব্যাখ্যাগুলো শাশ্বত নয়, বরং নির্দিষ্ট শাসক শ্রেণির স্বার্থে নির্মিত। এই বিনির্মাণ প্রক্রিয়াটি ধর্মগ্রন্থের ওপর থেকে প্রাতিষ্ঠানিক মোল্লা-পুরোহিতদের একচেটিয়া কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করবে।

২. পুনর্নির্মাণ বা মুক্তির ধর্মতত্ত্ব নির্মাণ (Reconstruction / Building a Liberation Theology): ধর্মগ্রন্থের ভেতরের প্রতি-আধিপত্যকামী, বিপ্লবী এবং সাম্যবাদী উপাদানগুলোকে খুঁজে বের করে সেগুলোকে একটি সুসংহত রূপ দেওয়া। ল্যাটিন আমেরিকার লিবারেশন থিওলজি যেমন বাইবেলের এক্সোডাস (দাসত্ব থেকে মুক্তি) এবং যিশুর বাণীকে মার্ক্সীয় শ্রেণি বিশ্লেষণের সাথে যুক্ত করে একটি শক্তিশালী মুক্তির ধর্মতত্ত্ব নির্মাণ করেছিল, তেমনি অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ থেকেও এমন তত্ত্ব নির্মাণ সম্ভব। এই তত্ত্ব শোষিত মানুষের ভাষায় কথা বলবে এবং তাদের সংগ্রামকে একটি আধ্যাত্মিক বৈধতা দেবে।

৩. জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে বিপ্লবী বয়ান তৈরি (Creating a Revolutionary Narrative in Popular Culture): ধর্মগ্রন্থের কাহিনী এবং চরিত্রগুলো সাধারণ মানুষের সংস্কৃতির গভীরে প্রোথিত। কারবালার ইমাম হুসাইনের আত্মত্যাগ, মোজেসের ফারাও এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম, বা যিশুর ধনীদের বিরুদ্ধে অবস্থান—এই কাহিনীগুলো নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের শক্তিশালী প্রতীক। মার্ক্সবাদীরা এই প্রতীকগুলোকে ব্যবহার করে নাটক, গান, কবিতা এবং জনপ্রিয় বক্তৃতার মাধ্যমে একটি বিপ্লবী সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারে, যা গ্রামসির ‘প্রতি-আধিপত্য’ তৈরির জন্য অপরিহার্য।

৪. বিশ্বাসীদের সাথে সংলাপ ও যৌথ সংগ্রাম (Dialogue and Joint Struggle with Believers): ধর্মগ্রন্থের এই বিপ্লবী পাঠ মার্ক্সবাদীদেরকে ধর্মপ্রাণ কিন্তু সংগ্রামী মানুষের সাথে একটি অভিন্ন ভাষায় কথা বলার সুযোগ করে দেয়। এর মাধ্যমে নাস্তিক বিপ্লবী এবং আস্তিক সংগ্রামীদের মধ্যে একটি কৌশলগত মৈত্রী গড়ে তোলা সম্ভব হয়। এই যৌথ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে উভয় পক্ষই একে অপরের থেকে শেখে এবং একটি বৃহত্তর ঐক্য গড়ে ওঠে।

সারসংক্ষেপে, একজন মার্ক্সবাদীর কাছে ধর্মগ্রন্থ একটি বন্ধ, মৃত টেক্সট নয়, বরং একটি জীবন্ত এবং বিতর্কিত ময়দান। এই ময়দানে আধিপত্য ও প্রতিরোধের লড়াই চলছে। মার্ক্সবাদীর কাজ হলো এই লড়াইয়ে শোষিতের পক্ষ নেওয়া, ধর্মগ্রন্থকে শোষকের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে তাকে শোষিতের মুক্তির হাতিয়ারে পরিণত করা। এটি করতে পারলেই ‘ঈশ্বরের বাণী’ হয়ে উঠতে পারে ‘মানুষের বিপ্লবের’ অনুপ্রেরণা।

উপসংহার: অদৃশ্য শেকল থেকে দৃশ্যমান হাতুড়ি

আমাদের দীর্ঘ সফরের সূচনা হয়েছিল গ্রামের মেঠোপথের ধারে এক ধর্মপ্রাণ বৃদ্ধের প্রশান্ত মুখচ্ছবি দিয়ে। সেই দৃশ্য থেকে জন্ম নেওয়া প্রশ্ন—বিশ্বাস ও দারিদ্র্যের এই জটিল সম্পর্কের রহস্য কী—আমাদের নিয়ে গেছে কার্ল মার্ক্সের দর্শন থেকে শুরু করে আধুনিক মনোবিজ্ঞানের পরীক্ষাগার পর্যন্ত। এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় আমরা ধর্মকে আর কেবল একটি সরল, বায়বীয় বিশ্বাস হিসেবে দেখতে শিখিনি; বরং তাকে দেখেছি ইতিহাসের এক বিশাল নাটকের চরিত্র হিসেবে, যার রূপ বদলায় অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে।

মার্ক্সীয় চশমা চোখে লাগিয়ে আমরা প্রথমে দেখেছি সমাজের সেই বিশাল দালানটিকে, যার ভিত্তি (Base) হলো অর্থনীতি আর উপরি-কাঠামো (Superstructure) হলো রাজনীতি, আইন এবং ধর্ম। এই ধ্রুপদী মডেলে, ধর্ম শোষণের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা অর্থনৈতিক ভিত্তিকেই টিকিয়ে রাখার জন্য একটি শক্তিশালী আদর্শিক হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। এটি ‘জনগণের আফিম’—শোষিতের যন্ত্রণা লাঘব করার একটি সান্ত্বনা, যা তাকে তার শেকল ভাঙার লড়াই থেকে বিরত রেখে পরকালের রঙিন স্বপ্নে বিভোর করে রাখে। ধর্ম দুঃখকষ্টকে মহিমান্বিত করে, শোষণের আসল উৎসকে আড়াল করে এবং এক ধরনের ‘মিথ্যা চেতনা’ তৈরি করে, যা শ্রমিককে তার নিজের দাসত্বকেই ভালোবাসতে শেখায়।

কিন্তু আমাদের যাত্রা এখানেই থেমে থাকেনি। আমরা দেখেছি, এই সম্পর্কটি একমুখী নয়। ম্যাক্স ওয়েবারের চোখে প্রোটেস্ট্যান্ট নীতি যেমন পুঁজিবাদের বিকাশে ধাত্রীর ভূমিকা পালন করেছে, তেমনি ল্যাটিন আমেরিকার ‘লিবারেশন থিওলজি’ দেখিয়েছে, ধর্ম কীভাবে আফিম থেকে বিপ্লবের কফিতে রূপান্তরিত হতে পারে। আন্তোনিও গ্রামসি ও লুই আলথুসার আমাদের শিখিয়েছেন, ধর্ম কীভাবে ‘সাংস্কৃতিক আধিপত্য’ এবং ‘আদর্শিক রাষ্ট্রযন্ত্রের’ অংশ হিসেবে আমাদের মনে অদৃশ্য শেকল পরিয়ে দেয়। কিন্তু তাঁরাই আবার দেখিয়েছেন, এই মতাদর্শের ময়দানেই ‘প্রতি-আধিপত্যের’ লড়াই সম্ভব।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, আমরা ধর্মের মনস্তাত্ত্বিক শেকড়ের সন্ধান করেছি। দেখেছি, কীভাবে ‘জাস্ট-ওয়ার্ল্ড হাইপোথিসিস’, ‘হাইপারবোলিক ডিসকাউন্টিং’ বা ‘ফান্ডামেন্টাল অ্যাট্রিবিউশন এরর’-এর মতো কগনিটিভ বায়াসগুলো মানুষের মনে ধর্মের সান্ত্বনাদায়ী রূপটিকে শক্তিশালী করে তোলে। এই আধুনিক পাঠ আমাদের শিখিয়েছে যে, চেতনা পরিবর্তন কেবল সঠিক তথ্য দিয়ে হয় না; এর জন্য প্রয়োজন একটি শক্তিশালী বিকল্প আখ্যান, ইহকালের ছোট ছোট বাস্তব জয় এবং সংগ্রামী সংহতির উষ্ণতা, যা পুঁজিবাদের সৃষ্ট বিচ্ছিন্নতাবোধকে মোকাবেলা করতে পারে।

আমরা ধর্মগ্রন্থের দ্বান্দ্বিক পাঠের মাধ্যমে দেখেছি, এগুলো কোনো একরৈখিক দলিল নয়, বরং শ্রেণি-সংগ্রামের এক ঐতিহাসিক ময়দান। এর ভেতরে যেমন লুকিয়ে আছে আনুগত্যের বাণী, তেমনই প্রোথিত আছে প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ। মার্ক্সবাদীর কাজ হলো সেই বিপ্লবী ধারাকে খুঁজে বের করে শোষকের হাত থেকে ধর্মকে কেড়ে নিয়ে তাকে শোষিতের মুক্তির হাতিয়ারে পরিণত করা।

তাহলে, সেই বৃদ্ধ লোকটির প্রার্থনার দিকে আমরা এখন কীভাবে তাকাব? তার বিশ্বাস কি কেবলই পলায়নপরতা, নাকি তার ভেতরের অদম্য মানবসত্তার এক ভিন্ন প্রকাশ? মার্ক্সীয় বিশ্লেষণ আমাদের কোনো সরল উত্তর দেয় না। এটি আমাদের একটি জটিল প্রশ্ন দেয় এবং সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার একটি বৈজ্ঞানিক ও দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি বাতলে দেয়। এটি শেখায় যে, ধর্ম নিজে ভালোও নয়, মন্দও নয়। এটি একটি শক্তিশালী সামাজিক শক্তি, যার গায়ে কোনো নির্দিষ্ট রঙ নেই। যে শ্রেণি তাকে ব্যবহার করে, তার রঙই এর গায়ে লাগে।

দিনশেষে, মার্ক্সীয় প্রকল্পের লক্ষ্য ধর্মকে উচ্ছেদ করা নয়, বরং এমন একটি শোষণহীন, ন্যায়ভিত্তিক এবং মানবিক সমাজ নির্মাণ করা, যেখানে মানুষের আর কোনো কাল্পনিক সান্ত্বনা বা অলীক পুরস্কারের প্রয়োজন পড়বে না। যে সমাজে মানুষ পৃথিবীতেই জীবনের অর্থ খুঁজে পাবে, যেখানে বিচ্ছিন্নতাবোধের বদলে থাকবে গভীর সংহতি এবং যেখানে ভয় বা অজ্ঞতার বদলে রাজত্ব করবে জ্ঞান ও ভালোবাসা। সেই সমাজে হয়তো ধর্ম স্বাভাবিকভাবে মিলিয়ে যাবে, যেমন রোগ সেরে গেলে ঔষধের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়।

যতদিন সেই সমাজ প্রতিষ্ঠিত না হচ্ছে, ততদিন ধর্ম বিষয়ে মার্ক্সবাদীদের পথটি হয়ে ওঠে দ্বিমুখী: একদিকে ধর্মের শোষণমূলক ভূমিকার নির্মোহ সমালোচনা, অন্যদিকে এর বিপ্লবী সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার নিরন্তর প্রচেষ্টা। এই পথেই ধর্মকে পায়ের অদৃশ্য শেকল থেকে রূপান্তরিত করা সম্ভব হাতের দৃশ্যমান হাতুড়িতে, যা দিয়ে গড়া হবে এক নতুন পৃথিবী। এই রূপান্তরই হলো মার্ক্সীয় দর্শনের সবচেয়ে বড় প্রতিশ্রুতি এবং সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ।

তথ্যসূত্র

  • Ainslie, G., & Monterosso, J. (2003). Building blocks of self-control: Increased tolerance for delay with bundled rewards. Journal of the Experimental Analysis of Behavior, 79(1), 37–48.
  • Althusser, L. (1971). Ideology and Ideological State Apparatuses. In Lenin and Philosophy and Other Essays. Monthly Review Press.
  • Bandura, A. (1977). Self-efficacy: Toward a unifying theory of behavioral change. Psychological Review, 84(2), 191–215.
  • Bloch, E. (1986). The Principle of Hope (N. Plaice, S. Plaice, & P. Knight, Trans.). The MIT Press. (Original work published 1954-1959).
  • Engels, F. (1978). Anti-Dühring: Herr Eugen Dühring’s Revolution in Science. (E. Burns, Trans.). Progress Publishers. (Original work published 1878).
  • Engels, F. (1890). Letter to J. Bloch in Königsberg. Retrieved from https://www.marxists.org/archive/marx/works/1890/letters/90_09_21.htm
  • Engels, F. (2010). The Peasant War in Germany. (M. J. Stern, Trans.). International Publishers. (Original work published 1850).
  • Gramsci, A. (1971). Selections from the Prison Notebooks (Q. Hoare & G. Nowell Smith, Eds. & Trans.). Lawrence & Wishart.
  • Gutiérrez, G. (1973). A Theology of Liberation: History, Politics, and Salvation. Orbis Books.
  • Kahneman, D. (2011). Thinking, Fast and Slow. Farrar, Straus and Giroux.
  • King, M. L. Jr. (1963). Letter from Birmingham Jail. Retrieved from https://www.africa.upenn.edu/Articles_Gen/Letter_Birmingham.html
  • Lenin, V. I. (1905). Socialism and Religion. Novaya Zhizn. Retrieved from https://www.marxists.org/archive/lenin/works/1905/dec/03.htm
  • Lerner, M. J. (1980). The Belief in a Just World: A Fundamental Delusion. Plenum Press.
  • Marx, K. (1844). A Contribution to the Critique of Hegel’s Philosophy of Right. Deutsch-Französische Jahrbücher.
  • Marx, K. (1976). Capital: A Critique of Political Economy, Volume 1. (B. Fowkes, Trans.). Penguin Books. (Original work published 1867).
  • Marx, K., & Engels, F. (1976). The German Ideology. In Marx/Engels Collected Works, Volume 5. Lawrence & Wishart. (Original work written 1845).
  • Ross, L. D. (1977). The intuitive psychologist and his shortcomings: Distortions in the attribution process. In L. Berkowitz (Ed.), Advances in experimental social psychology (Vol. 10, pp. 173–220). Academic Press.
  • Shariati, A. (1979). Red Shi’ism vs. Black Shi’ism. (H. Algar, Trans.). The Institute for Humanities and Cultural Studies.
  • Tajfel, H., & Turner, J. C. (1979). An integrative theory of intergroup conflict. In W. G. Austin & S. Worchel (Eds.), The social psychology of intergroup relations (pp. 33–47). Brooks/Cole.
  • Weber, M. (2001). The Protestant Ethic and the Spirit of Capitalism (S. Kalberg, Trans.). Roxbury Publishing Company. (Original work published 1905).
  • West, C. (1982). Prophesy Deliverance! An Afro-American Revolutionary Christianity. Westminster John Knox Press.

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.