মনোসমীক্ষণমূলক নৃবিজ্ঞান (Psychoanalytic Anthropology): মনের গহীনে সংস্কৃতি

Table of Contents

ভূমিকা

এই যে আমরা মানুষ, কী অদ্ভুত এক প্রাণী! আমরা ঘর বাঁধি, সমাজ গড়ি, রাষ্ট্র বানাই। আবার এই আমরাই একে অন্যকে ঈর্ষা করি, কারণে-অকারণে রেগে যাই, অর্থহীন সব স্বপ্ন দেখি। আমাদের একেকজনের একেক রকম বাতিক। কেউ হয়তো বারবার হাত ধোয়, কেউ একা থাকতে ভয় পায়, আবার কেউ হয়তো জনসমক্ষে কথা বলতে গেলে ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে যায়। আচ্ছা, কখনো কি ভেবে দেখেছেন, কেন আমরা এমন? কেন বাঙালি জাতির আবেগ প্রকাশের ধরণ একজন জাজল বা একজন মাসাই যোদ্ধার থেকে এতটা আলাদা? কেন কোনো সমাজে মৃতের জন্য হাহাকার করে কাঁদাটা স্বাভাবিক, আবার অন্য কোনো সমাজে পাথরের মতো নিশ্চুপ থাকাই নিয়ম?

এই ‘কেন’-এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা মাথার চুল ছিঁড়েছেন। সমাজবিজ্ঞানীরা বলেছেন সমাজের কাঠামোর কথা, ইতিহাসবিদরা খুঁজেছেন অতীতের ঘটনাপ্রবাহ, আর বস্তুবাদী তাত্ত্বিকেরা দেখিয়েছেন অর্থনীতির প্রভাব। কিন্তু একদল চিন্তাবিদ বললেন, আসল রহস্যটা বাইরে নয়, লুকিয়ে আছে আমাদের ভেতরে। একেবারে মনের গহীনে। সেই গহীন, অন্ধকার, কুয়াশাচ্ছন্ন জগতের একটা মানচিত্র প্রথম আঁকার চেষ্টা করেছিলেন ভিয়েনার এক ডাক্তার, নাম তার সিগমুন্ড ফ্রয়েড (Sigmund Freud)। আর তার সেই মানচিত্রকে পুঁজি করে নৃবিজ্ঞানীরা যখন মানুষের সংস্কৃতিকে বুঝতে চাইলেন, তখন জন্ম হলো এক অতি আকর্ষণীয় এবং একইসাথে তুমুল বিতর্কিত শাখার—মনোসমীক্ষণমূলক নৃবিজ্ঞান (Psychoanalytic Anthropology)।

আসুন, আজ আমরা সেই জগতে একটা ডুব দিই। দেখাই যাক না, মানুষের মনের ভেতরের তোলপাড় কীভাবে জন্ম দেয় আস্ত একটা সংস্কৃতির! এই যাত্রাটা সহজ নয়, কারণ এই পথে আলো-আঁধারির খেলা। কিছু ধারণা আপনাকে মুগ্ধ করবে, আবার কিছু ধারণা শুনে আপনার মনে হতে পারে—এও কি সম্ভব? কিন্তু রহস্যের কিনারা পেতে হলে তো আমাদের সব পথেই হেঁটে দেখতে হবে, তাই না?

যেখান থেকে গল্পের শুরু—ফ্রয়েড এবং তার অদ্ভুত সব ধারণা

মনোসমীক্ষণমূলক নৃবিজ্ঞান বুঝতে গেলে আমাদের গল্পের মূল চরিত্র সিগমুন্ড ফ্রয়েডকে একটু ভালোভাবে চিনে নিতে হবে। ফ্রয়েড ছিলেন একজন চিকিৎসক, স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ (Neurologist)। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে তার কাছে যেসব রোগী আসত, তাদের অনেকেই হিস্টিরিয়া (Hysteria) বা এমন সব শারীরিক সমস্যায় ভুগত, যার কোনো শারীরিক কারণ ডাক্তাররা খুঁজে পেতেন না। কেউ হয়তো হঠাৎ করে অন্ধ হয়ে যাচ্ছে, অথচ তার চোখ সম্পূর্ণ সুস্থ। কেউ হয়তো পক্ষাঘাতগ্রস্ত, কিন্তু স্নায়ুতন্ত্রে কোনো সমস্যাই নেই। ফ্রয়েড তখন ভাবতে শুরু করলেন, তাহলে কি সমস্যার উৎস শরীর নয়, মন? এমন কোনো গোপন যন্ত্রণা কি মনে লুকিয়ে আছে, যা শরীরকে আশ্রয় করে প্রকাশ পাচ্ছে?

এই ভাবনা থেকেই তিনি জন্ম দিলেন কিছু যুগান্তকারী ধারণার, যা কেবল মনোবিজ্ঞান নয়, পুরো পৃথিবীর চিন্তার ইতিহাসকেই নাড়িয়ে দিয়েছিল।

১. মনের মানচিত্র: চেতন, প্রাক-চেতন ও অবচেতন (Conscious, Preconscious, and Unconscious)

ফ্রয়েড বললেন, আমাদের মনটা একটা বিশাল হিমশৈলের (Iceberg) মতো। জলের উপরে যেটুকু মাথা উঁচু করে আছে, সেটা আমাদের চেতন মন (Conscious Mind)। এই মুহূর্তে আপনি যে এই লেখাটা পড়ছেন, আপনার নাম কী, এখন দিন না রাত—এইসব তথ্য এখানে থাকে। এটা মনের খুব ছোট একটা অংশ।

জলের ঠিক নিচে যে স্তর, যা একটু চেষ্টা করলেই উপরে আনা যায়, তা হলো প্রাক-চেতন মন (Preconscious Mind)। যেমন, গত জন্মদিনে কী খেয়েছিলেন, বা আপনার প্রথম স্কুলের নাম কী—এইসব তথ্য হয়তো এই মুহূর্তে ভাবছেন না, কিন্তু চেষ্টা করলেই মনে করতে পারবেন। এটা যেন একটা স্টোররুম, যেখানে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখা আছে, ডাক দিলেই পাওয়া যায়।

কিন্তু হিমশৈলের সবচেয়ে বড়, প্রায় ৯০ শতাংশ অংশই ডুবে থাকে জলের নিচে। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে। ওটাই হলো অবচেতন মন (Unconscious Mind)। আমাদের সমস্ত অবদমিত ইচ্ছা (Repressed desires), আদিম পাশবিক প্রবৃত্তি, শৈশবের ভুলে যাওয়া কষ্ট, ভয়, লজ্জা, ঘৃণা—সব এখানে বন্দী থাকে। আমরা সচেতনভাবে জানিও না যে তারা আছে, কিন্তু ফ্রয়েডের মতে, আমাদের জীবনের সব কলকাঠি নাড়ে এই অবচেতন মনই। আমাদের স্বপ্ন, মুখ ফসকে বেরিয়ে যাওয়া কথা (Freudian slip), আমাদের বাতিক, আমাদের অব্যাখ্যাযোগ্য রাগ বা দুঃখ—সবই নাকি এই অবচেতন মনের কারসাজি। সে-ই পর্দার আড়াল থেকে আমাদের পরিচালনা করে।

২. ব্যক্তিত্বের তিন ঘোড়া: ইড, ইগো, সুপারইগো (Id, Ego, Superego)

ফ্রয়েড আরও বললেন, আমাদের ব্যক্তিত্ব (Personality) কোনো একক সত্তা নয়, বরং তিনটি শক্তিশালী অংশের টানাপোড়েনে চলে। তিনি এদের নাম দিলেন ইড, ইগো ও সুপারইগো।

  • ইড (Id): এটা হলো আমাদের ভেতরের লাগামছাড়া বন্য ঘোড়াটা। সে শুধু চায়—আনন্দ, আনন্দ আর আনন্দ। তার কোনো নিয়ম নেই, কানুন নেই, সমাজ নেই। সে ক্ষুধা পেলে তক্ষুনি খেতে চায়, রাগ হলে মারতে চায়, বাসনা জাগলে পূরণ করতে চায়। ফ্রয়েড একে বলতেন প্লেজার প্রিন্সিপল (Pleasure Principle) বা সুখের নীতি। জন্ম থেকেই আমাদের ভেতর এই ইড থাকে। সে হলো আদিম শক্তির ভাণ্ডার।

  • সুপারইগো (Superego): এটা হলো আমাদের ভেতরের কঠোর অভিভাবক বা নীতি পুলিশ। সমাজ, ধর্ম, বাবা-মায়ের শেখানো নৈতিকতা, বিবেক, আদর্শ—এইসব দিয়ে সুপারইগো তৈরি। সে সারাক্ষণ ইডের কান ধরে বলে, “এটা কোরো না, ওটা পাপ। লোকে কী বলবে! ভালো ছেলেরা এমন করে না।” সে চায় নিখুঁত হতে, আদর্শবান হতে।

  • ইগো (Ego): বেচারা ইগো হলো এই দুই চরমপন্থীর মাঝখানে আটকে পড়া এক ম্যানেজার বা সারথী। তার কাজ হলো বন্য ঘোড়া (ইড) এবং নীতি পুলিশ (সুপারইগো)-এর মধ্যে একটা আপস রফা করা। সে ইডের দাবিও মেটাতে চায়, আবার সুপারইগোর রক্তচক্ষুকেও ভয় পায়। তাই সে বাস্তবতার নিরিখে (Reality Principle) একটা মাঝামাঝি পথ খোঁজে। যেমন, আপনার খুব আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছে (ইডের দাবি), কিন্তু আপনার পকেটে টাকা নেই (বাস্তবতা)। ইগো তখন বুদ্ধি আঁটবে, কীভাবে টাকা জোগাড় করে আইসক্রিম খাওয়া যায়, চুরি না করে (সুপারইগোর শাসন)। একজন মানুষের ইগো যত শক্তিশালী, সে তত বাস্তববাদী ও ভারসাম্যপূর্ণ হয়। তার মনোজগতে শান্তি থাকে। আর ইগো দুর্বল হলেই শুরু হয় মানসিক দ্বন্দ্ব।

৩. জীবনের মূল চালিকাশক্তি এবং ইডিপাস কমপ্লেক্স (Life Instincts and the Oedipus Complex)

ফ্রয়েডের সবচেয়ে বিতর্কিত কিন্তু তার তত্ত্বের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা ছিল মনোযৌন বিকাশের পর্বগুলো (Psychosexual Stages of Development)। তিনি বলেন, আমাদের জীবনের মূল চালিকাশক্তি হলো লিবিডো (Libido), যা মূলত এক ধরনের যৌন বা জীবনশক্তি (Life Instinct)। এই লিবিডো শৈশব থেকে কৈশোর পর্যন্ত শরীরের বিভিন্ন অংশে কেন্দ্রীভূত হয় এবং আমাদের ব্যক্তিত্বকে ধাপে ধাপে গড়ে তোলে।

  • মুখকেন্দ্রিক পর্ব (Oral Stage): ০-১ বছর। শিশুরা মুখ দিয়ে সব আনন্দ পায়। মায়ের বুকের দুধ খাওয়া, আঙুল চোষা। এই পর্যায়ে অতৃপ্তি বা অতিরিক্ত তৃপ্তি থাকলে (Fixation) বড় হয়ে মানুষ ধূমপায়ী, বাচাল, বা সারাক্ষণ চুইংগাম চিবানো স্বভাবের হতে পারে।

  • পায়ুকেন্দ্রিক পর্ব (Anal Stage): ১-৩ বছর। এই সময়ে শিশুরা মলত্যাগের মাধ্যমে আনন্দ পায় এবং টয়লেট ট্রেনিংয়ের (Toilet Training) মাধ্যমে প্রথম নিয়মকানুনের সম্মুখীন হয়। এই পর্বে অতিরিক্ত কঠোর শাসনের শিকার হলে বড় হয়ে মানুষ ভীষণ কৃপণ, গোছানো বা অবসেসিভ-কম্পালসিভ (Obsessive-compulsive) হতে পারে (Anal retentive)। আবার অতিরিক্ত শিথিলতার মধ্যে বড় হলে হতে পারে অগোছালো ও বেপরোয়া (Anal expulsive)।

  • শিশ্নকেন্দ্রিক পর্ব (Phallic Stage): ৩-৬ বছর। ফ্রয়েডের মতে, এই পর্বেই ঘটে সেই বিখ্যাত এবং কুখ্যাত ঘটনা—ইডিপাস কমপ্লেক্স (Oedipus Complex)

গ্রিক পুরাণের রাজা ইডিপাসের গল্প আমরা অনেকেই জানি, যিনি না জেনেই নিজের বাবাকে হত্যা করে মাকে বিয়ে করেছিলেন। ফ্রয়েড বললেন, এটা শুধু গল্প নয়, এটা প্রতিটি ছেলে শিশুর মনের ভেতরের এক সর্বজনীন নাটক। এই বয়সে ছেলে শিশু মায়ের প্রতি এক ধরনের যৌন আকর্ষণ অনুভব করে এবং বাবাকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শুরু করে। সে বাবাকে সরিয়ে মায়ের একচ্ছত্র অধিকার পেতে চায়। কিন্তু সে বাবাকে ভয়ও পায়, কারণ বাবা অনেক শক্তিশালী। তার মনে ভয় জাগে, বাবা যদি তার এই ইচ্ছার কথা জানতে পেরে তাকে শাস্তি দেয় বা লিঙ্গচ্ছেদ করে (Castration Anxiety)? এই তীব্র ভয় থেকে সে তার মাতৃপ্রেমী ইচ্ছাকে অবদমন (Repress) করে এবং বাঁচার উপায় হিসেবে বাবার সাথে নিজেকে আইডেন্টিফাই (Identify) করে বা তার মতো হওয়ার চেষ্টা করে। “বাবার মতো হতে পারলেই তো মায়ের ভালোবাসা পাওয়া যাবে”—এই সমাধান খুঁজে নেয় তার শিশুমন। এভাবেই ছেলে শিশুর মধ্যে পুরুষালি আচরণ এবং সুপারইগো (বাবার নৈতিকতা) গড়ে ওঠে।

মেয়েদের ক্ষেত্রে এর সমান্তরাল একটি ধারণার কথা বলা হয়, যা হলো ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্স (Electra Complex)। মেয়েরা প্রথমে মায়ের প্রতি আসক্ত থাকলেও পরে আবিষ্কার করে যে তার শিশ্ন নেই, এবং এর জন্য সে মাকে দায়ী করে (Penis Envy)। সে তখন বাবার প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং বাবার মাধ্যমে সেই ‘অভাব’ পূরণের চেষ্টা করে।

ফ্রয়েডের মতে, এই জটিল মনস্তাত্ত্বিক নাটকের সফল সমাধান না হলেই প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে নিউরোসিস (Neurosis) বা নানারকম মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। এই ইডিপাস কমপ্লেক্সের ধারণাটিই মনোসমীক্ষণমূলক নৃবিজ্ঞানের মূল ভিত্তিপ্রস্তর। কারণ ফ্রয়েড মনে করতেন, যা ব্যক্তির জীবনে ঘটে, তারই এক বৃহৎ সংস্করণ সমাজের জীবনেও ঘটে।

আর্মচেয়ারে বসে নৃবিজ্ঞানী ফ্রয়েড—‘টোটেম অ্যান্ড ট্যাবু’

ফ্রয়েড কেবল ব্যক্তির মন নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন না। তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল পুরো মানব সমাজ এবং সংস্কৃতির উৎস ব্যাখ্যা করার। এই চেষ্টা থেকেই তিনি লিখলেন তার বিখ্যাত এবং সমালোচিত বই—টোটেম অ্যান্ড ট্যাবু (Totem and Taboo, 1913)।

এই বইয়ে ফ্রয়েড যেন এক গোয়েন্দা গল্প ফেঁদে বসলেন। তিনি ডারউইনের ধারণার ওপর ভিত্তি করে কল্পনা করলেন, মানব ইতিহাসের আদিতে মানুষ বাস করত এক একটি আদিম দলে (Primal Horde), যেখানে একজন শক্তিশালী, ঈর্ষাপরায়ণ ও স্বৈরাচারী বাবা সমস্ত নারীর একচ্ছত্র অধিপতি ছিল। সে তার ছেলেদের বড় হলেই যৌন প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে দল থেকে তাড়িয়ে দিত।

একদিন সেই বিতাড়িত ভাইয়েরা হিংসায় ও ক্ষোভে একজোট হলো। তারা অতর্কিতে আক্রমণ করে বাবাকে হত্যা করল এবং তাকে খেয়ে ফেলল (Cannibalism)। ফ্রয়েডের মতে, খাওয়ার কাজটি ছিল বাবার শক্তিকে নিজের মধ্যে আত্মস্থ করার প্রতীকী চেষ্টা।

কিন্তু বাবাকে হত্যা করার পর তাদের মনে জন্ম নিল এক তীব্র অপরাধবোধ (Guilt)। তারা বাবাকে ভালোবাসত আবার ঘৃণাও করত। এই দ্বৈত অনুভূতি (Ambivalence) থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তারা দুটি যুগান্তকারী সামাজিক নিয়ম তৈরি করল:

১. টোটেমিজম (Totemism): তারা বাবার বিকল্প হিসেবে একটি পশুকে (টোটেম) পবিত্র বলে ঘোষণা করল এবং তাকে হত্যা করা বা খাওয়া নিষিদ্ধ করল। এই টোটেম একদিকে যেমন মৃত বাবার প্রতীক, তেমনই তাকে ঘিরে সবার একত্রিত হওয়াটা সামাজিক ঐক্যের ভিত্তি হয়ে উঠল। বছরে একবার তারা সেই টোটেম পশুটিকে উৎসব করে খেত, যা ছিল সেই আদিম হত্যার পুনরাবৃত্তি এবং সম্মিলিত অপরাধবোধ ভাগ করে নেওয়ার একটি আচার।

২. অজাচার ট্যাবু (Incest Taboo): যে নারীদের (মা ও বোন) জন্য তারা বাবাকে হত্যা করেছিল, অপরাধবোধ থেকে তারা নিজেদের জন্য সেই নারীদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করল। তারা নিয়ম করল, দলের কোনো পুরুষ দলের কোনো নারীকে বিয়ে করতে পারবে না, তাকে অন্য দল থেকে সঙ্গী খুঁজে নিতে হবে।

ফ্রয়েডের মতে, এই আদিম পিতৃহত্যার অপরাধবোধ এবং তার প্রায়শ্চিত্ত থেকেই জন্ম নিয়েছে পৃথিবীর প্রথম দুটি সার্বজনীন নিয়ম—টোটেম উপাসনা (যা থেকে পরে ধর্মের জন্ম) এবং অজাচার ট্যাবু (যা থেকে সমাজ ও পরিবারের জন্ম)। অর্থাৎ, পুরো মানব সংস্কৃতিটাই হলো ইডিপাস কমপ্লেক্সের এক বিশাল সামাজিক সংস্করণ! পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং তার পরের অপরাধবোধ—এই নাটকই বারবার বিভিন্ন রূপে আমাদের ধর্ম, শিল্পকলা, আর নৈতিকতার মধ্যে ফিরে ফিরে আসছে।

নৃবিজ্ঞানীরা অবশ্য ফ্রয়েডের এই তত্ত্বকে প্রায় সর্বসম্মতভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। নৃবিজ্ঞানী আলফ্রেড ক্রোবার (Alfred Kroeber) একে “Just-so story” বলে আখ্যা দিয়েছেন—অর্থাৎ, একটি বানানো গল্প যা শুনতে ভালো লাগলেও যার কোনো ঐতিহাসিক বা প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ নেই। এটি ছিল পুরোপুরি অনুমাননির্ভর, যাকে বলে “আর্মচেয়ার নৃবিজ্ঞান” (Armchair Anthropology)। কিন্তু এই তত্ত্বের গুরুত্ব অন্য জায়গায়। এটিই প্রথমবার দেখিয়েছিল যে, সমাজের নিয়মকানুন, ট্যাবু বা আচারের পেছনে গভীর, অবচেতন এবং মনস্তাত্ত্বিক কারণ থাকতে পারে। ফ্রয়েড একটি দরজা খুলে দিয়েছিলেন, যে দরজা দিয়ে পরবর্তীতে বহু নৃবিজ্ঞানী প্রবেশ করবেন এবং তার তত্ত্বকে মাঠে গিয়ে পরীক্ষা করার চেষ্টা করবেন।

মাঠে নামার পালা—প্রথম প্রজন্মের মনোসমীক্ষণমূলক নৃবিজ্ঞানীরা

ফ্রয়েডের তত্ত্বগুলো কি কেবল ভিয়েনার মধ্যবিত্ত সমাজের জন্যই প্রযোজ্য, নাকি এগুলো মানুষের সর্বজনীন মানসিকতার অংশ? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে একদল নৃবিজ্ঞানী পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ‘আদিম’ সমাজে মাঠের কাজ বা ফিল্ডওয়ার্ক করতে গেলেন।

গেজা রোহেইম: সংস্কৃতির উৎস শৈশবে

গেজা রোহেইম (Géza Róheim) ছিলেন ফ্রয়েডের একনিষ্ঠ ভক্ত এবং প্রথম পেশাদার মনোসমীক্ষক যিনি নৃবিজ্ঞানী হিসেবে ফিল্ডওয়ার্ক করেছেন। তিনি হাঙ্গেরি থেকে বেরিয়ে অস্ট্রেলিয়া, নিউ গিনি এবং আমেরিকার আদিবাসীদের মধ্যে বছরের পর বছর কাটিয়েছেন। রোহেইম বিশ্বাস করতেন, ফ্রয়েডের তত্ত্ব অক্ষরে অক্ষরে সত্য এবং সর্বজনীন।

তার মূল তত্ত্বটিকে বলা হয় “সংস্কৃতির অন্টোজেনেটিক তত্ত্ব” (“Ontogenetic” theory of culture)। খুব সহজ ভাষায় এর মানে হলো, সংস্কৃতি নতুন কিছু তৈরি করে না, বরং এটি আমাদের শৈশবের অতৃপ্তি, উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তাগুলোকে সামলানোর একটা উপায় মাত্র। রোহেইমের কাছে, সংস্কৃতি হলো প্রাপ্তবয়স্কদের তৈরি করা এক ধরনের সম্মিলিত দিবাস্বপ্ন (Collective fantasy)।

তিনি অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের মধ্যে গবেষণা করে দেখান, তাদের জটিল পুরাণ এবং আচার-অনুষ্ঠানগুলো আসলে শৈশবের দীর্ঘ অসহায়ত্ব (Prolonged infancy) এবং বাবা-মায়ের ওপর নির্ভরতা থেকে জন্ম নেওয়া উদ্বেগ (Anxiety) দূর করার একটি কৌশল। শিশুরা দীর্ঘকাল অসহায় থাকে, তাই বড় হয়ে তারা শক্তিশালী দেবতা বা পূর্বপুরুষের কল্পনা করে, যারা তাদের রক্ষা করবে। রোহেইমের কাছে, ধর্ম, শিল্প, সমাজ—সবকিছুরই মূল উৎস হলো শৈশবের সেই ভুলে যাওয়া অভিজ্ঞতা। তিনি ফ্রয়েডের মতোই সংস্কৃতিকে ব্যক্তির মনস্তত্ত্বের ওপর দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ফ্রয়েডের মতো অনুমাননির্ভর গল্প না বলে, মাঠের তথ্য দিয়ে তা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। (Róheim, 1943)

ব্রনিস্ল ম্যালিনোস্কি এবং ট্রোব্রিয়ান্ড দ্বীপপুঞ্জের চ্যালেঞ্জ

ফ্রয়েডের ইডিপাস কমপ্লেক্সের সর্বজনীনতার দাবিকে প্রথম এবং সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি দেন আধুনিক নৃবিজ্ঞানের অন্যতম জনক ব্রনিস্ল ম্যালিনোস্কি (Bronisław Malinowski)। তিনি মেলানেশিয়ার ট্রোব্রিয়ান্ড দ্বীপপুঞ্জে (Trobriand Islands) গবেষণা করে দেখেন, সেখানকার সমাজ ব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক (Patrilineal) নয়, বরং মাতৃতান্ত্রিক (Matrilineal)।

ট্রোব্রিয়ান্ড সমাজে শিশুর ওপর বাবার কোনো কর্তৃত্ব নেই। বাবা হলেন একজন স্নেহময় বন্ধু, খেলার সাথি। ক্ষমতার আসল উৎস হলেন মায়ের ভাই, অর্থাৎ মামা (Maternal Uncle)। মামাই ভাগ্নে-ভাগ্নিদের শাসন করেন, সম্পত্তি তার হাত দিয়েই ভাগ্নেদের কাছে যায়। অর্থাৎ, ফ্রয়েড কথিত ‘বাবা’ চরিত্রের যে দুটি দিক—স্নেহময় সত্তা এবং কঠোর শাসক—তা এখানে দুটি ভিন্ন মানুষের মধ্যে ভাগ হয়ে গেছে।

ম্যালিনোস্কি লক্ষ্য করলেন, এই সমাজে ছেলেদের অবদমিত ঘৃণা বা ভয় বাবার প্রতি নয়, বরং কঠোর শাসক মামার প্রতি। কারণ মামাই হলেন ক্ষমতার কেন্দ্র। অন্যদিকে, তাদের যৌন ঈর্ষা মায়ের প্রতি নয়, বরং বোনের প্রতি। কারণ মাতৃতান্ত্রিক সমাজে বংশ রক্ষা হয় বোনের মাধ্যমে, এবং বোনের সন্তানদের ওপরই ভাগ্নের ভবিষ্যৎ প্রতিপত্তি নির্ভর করে। তাই বোনের যৌন আচরণের ওপর ভাইয়েরা কড়া নজর রাখে।

অর্থাৎ, এখানে ফ্রয়েডের ক্লাসিক ইডিপাস কমপ্লেক্স (মা-বাবা-সন্তানের ত্রিভুজ) কাজ করছে না। এখানে মানসিক দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দু হলো মামা-বোন-ভাগ্নের ত্রিভুজ। ম্যালিনোস্কি একে বললেন, পারিবারিক কাঠামো দ্বারা নির্ধারিত এক ধরনের “নিউক্লিয়ার কমপ্লেক্স” (Nuclear Complex), যা প্রতিটি সমাজে তার আত্মীয়তার ধরণ (Kinship system) অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন রূপ নেয় (Malinowski, 1927)।

ম্যালিনোস্কির এই গবেষণা ছিল একটি মাইলফলক। এটি দেখাল যে, মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়াগুলো শূন্যে ভাসে না, সেগুলোকে নির্দিষ্ট সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে বুঝতে হয়। এটি ফ্রয়েডীয় তত্ত্বকে একবারে বাতিল করে দিল না, বরং তাকে আরও সমৃদ্ধ ও নমনীয় হওয়ার পথ খুলে দিল। এটি প্রমাণ করল, সংস্কৃতি কেবল মনের প্রতিফলন নয়, মনও সংস্কৃতির দ্বারা গঠিত হয়।

(Bronisław Malinowski নামের আসল উচ্চারণ ব্রনিস্লফ ম্যালিনফস্কি। এখানে বাঙ্গালিদের মধ্যে প্রচলিত পপুলার উচ্চারণটাই দেয়া হলো।)

স্বর্ণযুগ—‘সংস্কৃতি ও ব্যক্তিত্ব’ ঘরানা (The Culture and Personality School)

১৯৩০ ও ৪০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মনোসমীক্ষণমূলক নৃবিজ্ঞানের সবচেয়ে প্রভাবশালী ধারাটির জন্ম হয়, যা ‘সংস্কৃতি ও ব্যক্তিত্ব’ (Culture and Personality) নামে পরিচিত। এই ঘরানার মূল বক্তব্য ছিল খুব আকর্ষণীয়: প্রতিটি সংস্কৃতির একটি নিজস্ব ‘ব্যক্তিত্ব’ বা ধরণ আছে, ঠিক যেমন প্রত্যেকটি মানুষের থাকে। আর এই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব তার সদস্যদের ব্যক্তিত্বকে গড়ে তোলে, এবং সদস্যদের ব্যক্তিত্বই সেই সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখে।

এই ধারার মূল কাণ্ডারি ছিলেন রুথ বেনেডিক্ট, মার্গারেট মীড এবং তাদের তাত্ত্বিক গুরু আব্রাম কার্ডিনার।

আব্রাম কার্ডিনার এবং মৌলিক ব্যক্তিত্ব কাঠামো (Basic Personality Structure)

মনোচিকিৎসক (Psychiatrist) আব্রাম কার্ডিনার (Abram Kardiner) ছিলেন এই স্কুলের তাত্ত্বিক মস্তিষ্ক। তিনি নিজে মাঠে যাননি, কিন্তু রুথ বেনেডিক্ট, রালফ লিনটন (Ralph Linton) এবং কোরা ডু বোইস (Cora Du Bois)-এর মতো মাঠকর্মীদের তথ্য বিশ্লেষণ করে একটি চমৎকার কার্যকারণ মডেল তৈরি করেন।

কার্ডিনারের মতে, একটি শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠনের প্রক্রিয়াটি একটি শৃঙ্খল বা চেইনের মতো কাজ করে:

১. প্রাথমিক প্রতিষ্ঠান (Primary Institutions): এগুলো হলো সংস্কৃতির সেইসব দিক, যা একটি শিশুর একেবারে শৈশবের অভিজ্ঞতাকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে এবং যা শিশুর পক্ষে পরিবর্তন করা অসম্ভব। যেমন: শিশুকে কীভাবে খাওয়ানো হয়, কতদিন বুকের দুধ দেওয়া হয় (Weaning), কীভাবে টয়লেট ট্রেনিং দেওয়া হয়, কীভাবে শৃঙ্খলা শেখানো হয়, যৌনতার প্রতি সমাজের মনোভাব কেমন—এইসব। এই অভিজ্ঞতাগুলো সবার জন্য প্রায় একই রকম হওয়ায় ওই সংস্কৃতির সদস্যদের মধ্যে একটি সাধারণ বা গড় ব্যক্তিত্বের কাঠামো তৈরি হয়। কার্ডিনার একেই বলেছেন মৌলিক ব্যক্তিত্ব কাঠামো (Basic Personality Structure)। (Kardiner, 1939)

২. গৌণ প্রতিষ্ঠান (Secondary Institutions): এই মৌলিক ব্যক্তিত্ব কাঠামো নিজেকে প্রকাশ করার জন্য বা নিজের ভেতরের উদ্বেগ ও চাহিদা মেটানোর জন্য কিছু মাধ্যম খুঁজে নেয়। সেই মাধ্যমগুলোই হলো গৌণ প্রতিষ্ঠান। যেমন: ধর্ম, লোককথা, পুরাণ, শিল্পকলা, দর্শন, ট্যাবু ইত্যাদি। কার্ডিনার এগুলোকে বলতেন প্রক্ষেপণমূলক ব্যবস্থা (Projective Systems), কারণ মানুষ তার মনের ভেতরের ছাঁচটিকেই বাইরের জগতের ওপর প্রক্ষেপণ (Project) করে।

একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। নৃবিজ্ঞানী কোরা ডু বোইস ইন্দোনেশিয়ার আলোর (Alor) দ্বীপে গবেষণা করে দেখেন যে, সেখানকার মায়েরা জমিতে কাজ করার জন্য খুব দ্রুত শিশুদের একা ফেলে চলে যায়। শিশুদের যত্ন নেওয়া বা খাওয়ানোর কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই, তারা প্রায়শই অবহেলিত ও ক্ষুধার্ত থাকে। কার্ডিনার এই তথ্য বিশ্লেষণ করে বলেন, এই প্রাথমিক প্রতিষ্ঠান (শিশুর প্রতি অবহেলা) আলোর দ্বীপের মানুষের মধ্যে একটি মৌলিক ব্যক্তিত্ব তৈরি করেছে, যা নিরাপত্তাহীন, উদ্বেগপ্রবণ, এবং অবিশ্বাসী বা সন্দেহবাতিক। তারা সহজে কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না।

আর এই ব্যক্তিত্বই তাদের গৌণ প্রতিষ্ঠানে প্রতিফলিত হয়েছে। তাদের দেব-দেবীরাও ভীষণ খামখেয়ালি এবং অবিশ্বাসযোগ্য, যাদেরকে ঘুষ দিয়ে সন্তুষ্ট করতে হয়। তাদের লোককথায় কোনো মহান বা বিশ্বস্ত নায়ক নেই। অর্থাৎ, শৈশবের অতৃপ্তিকর অভিজ্ঞতা তাদের পুরো বিশ্ববীক্ষা বা ওয়ার্ল্ডভিউকেই অবিশ্বাস ও নিরাপত্তাহীনতায় পূর্ণ করে তুলেছে। (Du Bois, 1944) কার্ডিনারের এই মডেলটি ছিল খুব প্রভাবশালী, কারণ এটি সংস্কৃতি ও ব্যক্তিত্বের মধ্যে একটি কার্যকারণ সম্পর্ক (Causal relationship) দেখানোর চেষ্টা করেছিল।

রুথ বেনেডিক্ট এবং সংস্কৃতির নকশা (Patterns of Culture)

রুথ বেনেডিক্ট (Ruth Benedict) ছিলেন আরেকজন মহীরুহ। তার বিখ্যাত বই প্যাটার্নস অফ কালচার (Patterns of Culture, 1934)-এ তিনি দেখান যে, প্রতিটি সংস্কৃতি মানুষের আচরণের অসীম সম্ভাবনা (arc of human potential) থেকে কয়েকটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য বেছে নেয় এবং সেগুলোকে কেন্দ্র করে একটি সুসংহত নকশা বা প্যাটার্ন তৈরি করে। এই প্যাটার্নটিই ওই সংস্কৃতির সামগ্রিক ব্যক্তিত্ব বা ইথোস (ethos)।

তিনি তিনটি সংস্কৃতির উদাহরণ দেন:

  • জুনি (Zuni) ইন্ডিয়ান: আমেরিকার এই আদিবাসীরা শান্ত, সৌম্য, সহযোগিতাপূর্ণ এবং পরিমিতিবোধ সম্পন্ন। তারা কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি, আবেগপ্রবণতা বা ব্যক্তিগত ক্ষমতা প্রদর্শন পছন্দ করে না। তাদের আদর্শ হলো সংযম। বেনেডিক্ট গ্রিক দেবতা অ্যাপোলোর (যিনি শৃঙ্খলা ও পরিমিতির প্রতীক) নামে তাদের সংস্কৃতিকে বলেন অ্যাপোলোনিয়ান (Apollonian)

  • কোয়াকিউটল (Kwakiutl) ইন্ডিয়ান: কানাডার এই আদিবাসীরা ঠিক তার উল্টো। তারা আবেগপ্রবণ, উন্মত্ত, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং সবকিছুতে বাড়াবাড়ি করতে ভালোবাসে। পটলাচ (Potlatch) নামক এক আশ্চর্য অনুষ্ঠানে তারা একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার জন্য নিজেদের সমস্ত সম্পত্তি বিলিয়ে দেয় বা এমনকি ধ্বংস করে ফেলে। বেনেডিক্ট গ্রিক দেবতা ডায়োনিসাসের (যিনি উন্মত্ততা ও আবেগের প্রতীক) নামে তাদের সংস্কৃতিকে বলেন ডায়োনিসিয়ান (Dionysian)

  • ডাবু (Dobu) দ্বীপবাসী: মেলানেশিয়ার এই দ্বীপের মানুষেরা চরম সন্দিগ্ধ, ঈর্ষাপরায়ণ এবং একে অপরকে জাদু (Sorcery) করার ভয়ে সারাক্ষণ তটস্থ থাকে। তাদের সংস্কৃতি যেন প্যারানয়ার (ভ্রান্ত ভয়ভীতি, অতিসন্দেহপ্রবণতা, বা অত্যাধিক অবিশ্বাসমূলক মানসিক অবস্থা) ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। সেখানে যে সফল হয়, তাকেই সন্দেহ করা হয় যে সে নিশ্চয়ই জাদুর মাধ্যমে অন্যের ভালো জিনিস চুরি করেছে।

বেনেডিক্টের কাজ দেখিয়েছে যে, ‘স্বাভাবিক’ বা ‘অস্বাভাবিক’ আচরণের কোনো সর্বজনীন সংজ্ঞা নেই। যা একটি সংস্কৃতিতে আদর্শ বলে বিবেচিত (যেমন, জুনিদের সংযম), তা অন্য সংস্কৃতিতে চরম অস্বাভাবিক বলে মনে হতে পারে (যেমন, কোয়াকিউটলদের কাছে)।

মার্গারেট মীড: যৌনতা, কৈশোর এবং সংস্কৃতি

মার্গারেট মীড (Margaret Mead) ছিলেন এই ঘরানার সবচেয়ে বিখ্যাত এবং জনপ্রিয় মুখ। তার লেখার গুণে নৃবিজ্ঞানের জটিল সব ধারণা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল এবং আমেরিকার সমাজ সংস্কারে বিশাল ভূমিকা রেখেছিল।

তার প্রথম এবং সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী বই হলো কামিং অফ এজ ইন সামোয়া (Coming of Age in Samoa, 1928)। মীড গবেষণা করতে গিয়েছিলেন এই প্রশ্ন নিয়ে: পশ্চিমা সমাজে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে যে তীব্র মানসিক চাপ, বিদ্রোহ আর সংকট (Adolescent turmoil) দেখা যায়, তা কি সর্বজনীন ও জৈবিক (Biological)? নাকি এটি পশ্চিমা সংস্কৃতির কঠোর অনুশাসনের সৃষ্টি?

সামোয়া দ্বীপে গবেষণা করে তিনি দেখান যে, সামোয়ান সমাজে কৈশোর তুলনামূলকভাবে চাপমুক্ত ও মসৃণ। কারণ সেখানে যৌনতার প্রতি মনোভাব অনেক খোলামেলা, শিশুদের ওপর কঠোর নিয়মকানুন চাপিয়ে দেওয়া হয় না এবং জীবনের গতি অনেক ধীর। তার সিদ্ধান্ত ছিল, কৈশোরের সংকট কোনো জৈবিক অনিবার্যতা নয়, এটি পুরোপুরি সাংস্কৃতিক (Cultural)। এই বই আমেরিকার বাবা-মায়েদের সন্তান পালনের পদ্ধতি নিয়ে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছিল।

মীডের আরেকটি বিখ্যাত কাজ হলো সেক্স অ্যান্ড টেম্পারামেন্ট ইন থ্রি প্রিমিটিভ সোসাইটিজ (Sex and Temperament in Three Primitive Societies, 1935)। নিউ গিনির তিনটি পাশাপাশি সমাজে গবেষণা করে তিনি দেখান, যাকে আমরা ‘পুরুষালি’ (Masculine) বা ‘মেয়েলি’ (Feminine) স্বভাব বলি, তার সাথে লিঙ্গের (Sex) কোনো সম্পর্ক নেই, পুরোটাই সংস্কৃতি দ্বারা নির্মিত।

  • আরাপেশ (Arapesh): এখানে নারী-পুরুষ উভয়েই শান্ত, সহযোগিতাপূর্ণ এবং যত্নশীল—যা পশ্চিমা সমাজে ‘মেয়েলি’ গুণ বলে ধরা হয়।

  • মুন্ডুগুমোর (Mundugumor): এখানে নারী-পুরুষ উভয়েই আক্রমণাত্মক, নিষ্ঠুর এবং যৌনভাবে আগ্রাসী—যা পশ্চিমা সমাজে ‘পুরুষালি’ গুণ।

  • চাম্বুলি (Tchambuli): এখানে লিঙ্গীয় ভূমিকা (Gender roles) যেন পুরো উল্টে গেছে। নারীরা আধিপত্যশীল, কর্মঠ এবং সংসারের কর্তা। পুরুষরা আবেগপ্রবণ, শিল্পমনা, আলঙ্কারিক এবং সাজগোজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে।

মীডের এই কাজগুলো ছিল বৈপ্লবিক। তারা প্রমাণ করেছিল যে, আমাদের ব্যক্তিত্ব, আচরণ, এমনকি লিঙ্গীয় পরিচয়ও কতটা সংস্কৃতি দ্বারা নির্মিত। যদিও ১৯৮৩ সালে নৃবিজ্ঞানী ডেরেক ফ্রিম্যান (Derek Freeman) Margaret Mead and Samoa: The Making and Unmaking of an Anthropological Myth বইটি লিখে মীডের সামোয়া গবেষণাকে তীব্রভাবে আক্রমণ করেন। ফ্রিম্যান দাবি করেন যে, মীড সামোয়ান ভাষা ভালো জানতেন না, তার তথ্যের উৎস ছিল কয়েকজন তরুণী যারা তাকে মজা করে ভুল তথ্য দিয়েছিল, এবং সামোয়ান সমাজ আসলে বেশ প্রতিযোগিতামূলক ও সহিংস। এই বিতর্ক নৃবিজ্ঞানের জগতে ঝড় তুলেছিল এবং ‘সংস্কৃতি ও ব্যক্তিত্ব’ ঘরানার পদ্ধতিগত দুর্বলতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল।

একটি বিতর্কিত অধ্যায়—জাতীয় চরিত্র গবেষণা (National Character Studies)

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এবং তার পরে ‘সংস্কৃতি ও ব্যক্তিত্ব’ ঘরানার নৃবিজ্ঞানীরা এক নতুন ও অত্যন্ত বিতর্কিত কাজে হাত দেন। মার্কিন সরকার তখন শত্রু দেশ (যেমন জার্মানি, জাপান) এবং মিত্র দেশ (যেমন রাশিয়া) সম্পর্কে দ্রুত জানতে আগ্রহী ছিল। কিন্তু যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে ওইসব দেশে গিয়ে ফিল্ডওয়ার্ক করা অসম্ভব ছিল।

তাই রুথ বেনেডিক্ট, জিওফ্রে গোরার, মার্গারেট মীডের মতো নৃবিজ্ঞানীরা “দূরে বসে নৃবিজ্ঞান” (Anthropology at a distance) চর্চা শুরু করেন। তারা ওইসব দেশের সিনেমা, সাহিত্য, অভিবাসীদের সাক্ষাৎকার এবং ঐতিহাসিক নথি বিশ্লেষণ করে তাদের ‘জাতীয় চরিত্র’ (National Character) বোঝার চেষ্টা করেন।

এর সবচেয়ে কুখ্যাত উদাহরণ হলো জিওফ্রে গোরার (Geoffrey Gorer) এবং জন রিকম্যানের (John Rickman) রাশিয়ার জাতীয় চরিত্র নিয়ে গবেষণা। তারা বলেন, রাশিয়ান মায়েরা তাদের শিশুদের খুব শক্ত করে কাপড়ে জড়িয়ে রাখে (Swaddling)। এই অবস্থায় শিশুরা ঘন্টার পর ঘন্টা নড়াচড়া করতে না পেরে বন্দি থাকে, কিন্তু যখন তাদের বাঁধন খুলে দেওয়া হয়, তখন তারা প্রচণ্ড ক্রোধে হাত-পা ছোড়ে। গোরারের মতে, এই শৈশবের অভিজ্ঞতা রাশিয়ানদের মধ্যে এক ধরনের দ্বৈত ব্যক্তিত্ব তৈরি করেছে। তারা একদিকে যেমন দীর্ঘ সময় ধরে বিষণ্ণতা ও কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করে থাকতে পারে (কাপড়ে জড়ানো অবস্থার মতো), আবার হঠাৎ করেই প্রচণ্ড সহিংস ও বিপ্লবী হয়ে উঠতে পারে (বাঁধন খুলে দেওয়ার অবস্থার মতো)। এই ‘swaddling hypothesis’ দিয়ে তারা রাশিয়ার জারতন্ত্র থেকে বলশেভিক বিপ্লব পর্যন্ত সবকিছুর মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন! (Gorer & Rickman, 1949)

একইভাবে রুথ বেনেডিক্ট জাজল সংস্কৃতি নিয়ে লেখেন দ্য ক্রিসান্থেমাম অ্যান্ড দ্য সোর্ড (The Chrysanthemum and the Sword, 1946)। যদিও তিনি কখনো জাপানে যাননি, কিন্তু যুদ্ধবন্দী জাজলদের সাক্ষাৎকার ও জাজল সাহিত্য বিশ্লেষণ করে তিনি একটি অনবদ্য কাজ করেন। তিনি দেখান, জাজল সংস্কৃতি পশ্চিমা সংস্কৃতির মতো অপরাধবোধের (Guilt Culture) ওপর ভিত্তি করে নয়, বরং লজ্জার (Shame Culture) ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। একজন পশ্চিমা মানুষ খারাপ কাজ করলে তার ভেতরের বিবেক (সুপারইগো) তাকে দংশন করে। কিন্তু একজন জাজল মানুষ লজ্জা পায় যখন তার খারাপ কাজ সমাজের অন্য কেউ দেখে ফেলে। তার কাছে বাইরের সম্মান (Face) বাঁচানোটা খুব জরুরি।

এই জাতীয় চরিত্র গবেষণাগুলো ছিল মারাত্মকভাবে সরলীকৃত (Oversimplified) এবং প্রায়শই বর্ণবাদী ও পূর্বধারণামূলক (Stereotypical)। একটি গোটা জাতিকে শৈশবের একটিমাত্র প্রথা বা একটিমাত্র মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা ছিল অবৈজ্ঞানিক। এই কাজগুলো ‘সংস্কৃতি ও ব্যক্তিত্ব’ ঘরানার সুনামকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং এর পতনের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

ফরাসি ভিন্ন পথ—লাকাঁর মনোসমীক্ষণ ও নৃবিজ্ঞান

আমেরিকান ঘরানা যখন শৈশবের অভিজ্ঞতা আর ব্যক্তিত্বের কাঠামো নিয়ে ব্যস্ত, তখন ফ্রান্সে মনোসমীক্ষণের আরেক ধারা জনপ্রিয় হচ্ছিল, যার নেতৃত্বে ছিলেন জ্যাক লাকাঁ (Jacques Lacan)। লাকাঁ নিজেকে ‘ফ্রয়েডের কাছে প্রত্যাবর্তনকারী’ বললেও, তিনি ফ্রয়েডের তত্ত্বকে ভাষা ও দর্শনের সঙ্গে মিশিয়ে এক নতুন রূপ দেন। নৃবিজ্ঞানে, বিশেষ করে ক্লদ লেভি-স্ট্রসের স্ট্রাকচারালিজম বা কাঠামোবাদ (Structuralism) দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, লাকাঁর তত্ত্ব এক ভিন্ন ধারার মনোসমীক্ষণমূলক নৃবিজ্ঞানের জন্ম দেয়।

লাকাঁর মূল কথা হলো, মানুষের অবচেতন মন (Unconscious) কোনো আদিম ইচ্ছার ভাণ্ডার নয়, বরং “the unconscious is structured like a language”। অর্থাৎ, অবচেতন মন ভাষার নিয়মেই গঠিত। আমরা ভাষার জগতে প্রবেশ করার মাধ্যমেই সামাজিক মানুষ হয়ে উঠি এবং একই সাথে আমাদের আদিম সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই।

  • মিরর স্টেজ (Mirror Stage): লাকাঁ বলেন, ৬ থেকে ১৮ মাস বয়সে শিশু যখন প্রথম আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে, তখন সে নিজেকে একটি পূর্ণাঙ্গ সত্তা হিসেবে চিনতে শেখে। এর আগে সে নিজেকে খণ্ডিত ও বিচ্ছিন্ন অনুভব করত। এই চেনার আনন্দই তার ‘ইগো’ বা অহং-এর জন্ম দেয়। কিন্তু এই ‘ইগো’ একটি ভ্রান্ত চেনার ওপর ভিত্তি করে তৈরি, কারণ প্রতিবিম্বটি সে নিজে নয়, সেটি একটি বাইরের ছবি।

  • সিম্বলিক, ইমাজিনারি, রিয়েল (The Symbolic, The Imaginary, The Real): লাকাঁ মানুষের মনোজগতকে তিনটি স্তরে ভাগ করেন। ইমাজিনারি হলো প্রতিবিম্ব ও ছবির জগৎ (মিরর স্টেজ)। সিম্বলিক হলো ভাষা, আইন, নিয়মকানুন ও সংস্কৃতির জগৎ, যা পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতীক। আমরা এই সিম্বলিক জগতে প্রবেশ করেই সমাজবদ্ধ হই। আর রিয়েল হলো ভাষার অতীত এক জগৎ, যাকে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, যা হলো আদিম, খণ্ডিত ও ভয়ঙ্কর এক বাস্তবতা।

লাকাঁর এই তত্ত্ব ব্যবহার করে নৃবিজ্ঞানীরা দেখান, সংস্কৃতি কীভাবে ভাষার মাধ্যমে আমাদের ওপর আধিপত্য করে এবং আমাদের ‘স্বাভাবিক’ পরিচয় তৈরি করে। অক্তাভ মানোনি (Octave Mannoni)-র Prospero and Caliban: The Psychology of Colonization (1950) একটি ক্লাসিক উদাহরণ। তিনি শেক্সপিয়ারের ‘দ্য টেম্পেস্ট’ নাটকের চরিত্র দিয়ে দেখান যে, উপনিবেশকারী (Prospero) এবং উপনিবেশিত (Caliban) উভয়েরই এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক নির্ভরতা তৈরি হয়। উপনিবেশিত মানুষটির মধ্যে এক ধরনের হীনম্মন্যতা কমপ্লেক্স (Inferiority complex) তৈরি হয়, যা তাকে প্রভুর ওপর নির্ভরশীল করে তোলে। লাকানীয় নৃবিজ্ঞান ক্ষমতা, ভাষা এবং পরিচয়ের রাজনীতিকে বুঝতে সাহায্য করে।

পতন ও উত্তরাধিকার—মনোসমীক্ষণমূলক নৃবিজ্ঞান আজ কোথায়?

১৯৫০-এর দশকের পর থেকে মনোসমীক্ষণমূলক নৃবিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ শেষ হতে শুরু করে। এর আবেদন কমতে থাকে এবং এটি তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। এর পেছনে বেশ কিছু কারণ ছিল:

  • পদ্ধতিগত দুর্বলতা: এর গবেষণাগুলো প্রায়শই ছোট নমুনার ওপর ভিত্তি করে করা হতো এবং গবেষকের ব্যক্তিগত ব্যাখ্যার (Interpretation) ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল ছিল। এর সিদ্ধান্তগুলো বৈজ্ঞানিকভাবে যাচাই করা (Falsifiable) কঠিন ছিল।

  • সরলীকরণ (Reductionism): সব সাংস্কৃতিক প্রথাকে শৈশবের অভিজ্ঞতা বা ইডিপাস কমপ্লেক্স দিয়ে ব্যাখ্যা করার প্রবণতা ছিল বাড়াবাড়ি। সংস্কৃতি এর চেয়ে অনেক বেশি জটিল, যার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক মাত্রা রয়েছে।

  • জাতিগত স্টেরিওটাইপিং: জাতীয় চরিত্র গবেষণাগুলো পুরো ধারাটিকেই অনির্ভরযোগ্য ও রাজনৈতিকভাবে সন্দেহভাজন করে তোলে।

  • নতুন তত্ত্বের আগমন: নৃবিজ্ঞানে ক্লদ লেভি-স্ট্রসের স্ট্রাকচারালিজম বা কাঠামোবাদ (Structuralism), মার্ভিন হ্যারিসের সাংস্কৃতিক বস্তুবাদ (Cultural Materialism) এবং ক্লিফোর্ড গির্টজের প্রতীকী নৃবিজ্ঞান (Symbolic Anthropology)-এর মতো নতুন এবং আরও শক্তিশালী তত্ত্বের আগমন ঘটে, যা সংস্কৃতির ভিন্ন ভিন্ন দিককে আরও সফলভাবে ব্যাখ্যা করতে পারছিল।

তাহলে কি এই ধারাটি পুরোপুরি হারিয়ে গেছে? না। মনোসমীক্ষণমূলক নৃবিজ্ঞান হয়তো তার পুরনো রূপে আর নেই, কিন্তু তার ভূত এখনো নৃবিজ্ঞানের করিডোরে ঘুরে বেড়ায়। তার প্রভাব রয়ে গেছে এবং এটি বিবর্তিত হয়ে জন্ম দিয়েছে এক নতুন ও আরও পরিশীলিত শাখার, যার নাম মনস্তাত্ত্বিক নৃবিজ্ঞান (Psychological Anthropology)

আজকের মনস্তাত্ত্বিক নৃবিজ্ঞানীরা অনেক বেশি পদ্ধতি সচেতন। তারা মনোবিজ্ঞানের আধুনিক টুলস (Tools), পরিসংখ্যান এবং বড় আকারের নমুনা নিয়ে কাজ করেন। তারা সংস্কৃতির সরলীকরণের বদলে তার জটিলতাকে স্বীকার করে নেন। তারা মানুষের আবেগ (Emotions), মানসিক স্বাস্থ্য (Mental Health), জ্ঞান (Cognition), নৈতিকতা (Morality) এবং চেতনার (Consciousness) ওপর সংস্কৃতির প্রভাব নিয়ে অনেক সূক্ষ্ম ও গভীর গবেষণা করছেন।

মেলফোর্ড স্পিরো (Melford Spiro)-র মতো নৃবিজ্ঞানীরা ফ্রয়েডীয় তত্ত্বকে নতুন করে মাঠে পরীক্ষা করেছেন। যেমন, স্পিরো ইসরায়েলের এক কিবুটজ (Kibbutz)-এ গবেষণা করেন, যেখানে শিশুদের বাবা-মায়ের থেকে আলাদা করে সম্মিলিতভাবে বড় করা হতো। অনেকেই ভেবেছিলেন, সেখানে ইডিপাস কমপ্লেক্স থাকবে না। কিন্তু স্পিরো দেখান যে, শিশুরা তাদের বাবা-মায়ের অনুপস্থিতিতে আরও বেশি করে তাদের আদর্শায়িত করে এবং বাইরের জগতে তাদের সঙ্গীদের প্রতিই যৌন প্রতিদ্বন্দ্বিতা অনুভব করে। অর্থাৎ, ইডিপাস কমপ্লেক্সের মূল নাটকটি ভিন্ন রূপে হলেও সেখানে উপস্থিত ছিল (Spiro, 1958)।

শেষ কথা

তাহলে এই দীর্ঘ অভিযাত্রার শেষে আমরা কোথায় এসে দাঁড়ালাম?

মনোসমীক্ষণমূলক নৃবিজ্ঞানের যাত্রাটা ছিল এক রোমাঞ্চকর, সাহসী এবং প্রায়শই বেপরোয়া অভিযান। সিগমুন্ড ফ্রয়েডের সেই অন্ধকার ঘর থেকে শুরু করে মার্গারেট মীডের সামোয়ার সমুদ্রতীর, কার্ডিনারের তাত্ত্বিক মডেল থেকে গোরারের বিতর্কিত গবেষণা—এই পথচলায় অনেক ভুল ছিল, অনেক বাড়াবাড়ি ছিল, অনেক বিপজ্জনক সরলীকরণ ছিল।

কিন্তু এই ধারাটিই প্রথম সাহস করে বলেছিল, সংস্কৃতি কেবল বাইরে থেকে দেখার বিষয় নয়, তাকে বুঝতে হলে মানুষের মনের গভীরে ডুব দিতে হবে। আমাদের আচার, আমাদের বিশ্বাস, আমাদের শিল্প, আমাদের ট্যাবু—এগুলোর পেছনে লুকিয়ে আছে আমাদের শৈশবের স্মৃতি, আমাদের অবদমিত ভয় আর আমাদের অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা। ব্যক্তি আর সমাজ, মন আর সংস্কৃতি—এই দুইয়ের মধ্যে যে এক অদ্ভুত, জটিল ও দ্বান্দ্বিক লেনদেনের সম্পর্ক, সেই সত্যটিকে মনোসমীক্ষণমূলক নৃবিজ্ঞান আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।

এটি শিখিয়েছে যে, ‘মানব প্রকৃতি’ বলে স্থির কোনো বস্তু নেই; আমাদের আবেগ, আমাদের পরিচয়, আমাদের লিঙ্গীয় ভূমিকা—সবই সংস্কৃতির ক্যানভাসে আঁকা। এটি নৃবিজ্ঞানকে ‘ব্যক্তি’ (The Self) এবং ‘ব্যক্তিত্ব’ (Personhood) নিয়ে ভাবার ভাষা দিয়েছে।

তথ্যসূত্র

  • Benedict, R. (1934). Patterns of Culture. Houghton Mifflin.
  • Benedict, R. (1946). The Chrysanthemum and the Sword: Patterns of Japanese Culture. Houghton Mifflin.
  • Du Bois, C. (1944). The People of Alor: A Social-Psychological Study of an East Indian Island. University of Minnesota Press.
  • Freeman, D. (1983). Margaret Mead and Samoa: The Making and Unmaking of an Anthological Myth. Harvard University Press.
  • Freud, S. (1913). Totem and Taboo: Resemblances Between the Psychic Lives of Savages and Neurotics. (A. A. Brill, Trans.). Moffat, Yard and Company.
  • Gorer, G., & Rickman, J. (1949). The People of Great Russia: A Psychological Study. The Cresset Press.
  • Kardiner, A. (1939). The Individual and His Society: The Psychodynamics of Primitive Social Organization. Columbia University Press.
  • Kroeber, A. L. (1920). Totem and Taboo: An Ethnologic Psychoanalysis. American Anthropologist, 22(1), 48–55.
  • Lacan, J. (2006). Écrits: The First Complete Edition in English (B. Fink, Trans.). W. W. Norton & Company.
  • Malinowski, B. (1927). Sex and Repression in Savage Society. Kegan Paul, Trench, Trubner & Co.
  • Mannoni, O. (1990). Prospero and Caliban: The Psychology of Colonization (P. Powesland, Trans.). University of Michigan Press. (Original work published 1950)
  • Mead, M. (1928). Coming of Age in Samoa: A Psychological Study of Primitive Youth for Western Civilisation. William Morrow & Company.
  • Mead, M. (1935). Sex and Temperament in Three Primitive Societies. William Morrow & Company.
  • Róheim, G. (1943). The Origin and Function of Culture. Nervous and Mental Disease Monographs.
  • Spiro, M. E. (1958). Children of the Kibbutz: A Study in Child Training and Personality. Harvard University Press.

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.