Table of Contents
ভূমিকা
পৃথিবীটা বড়ই অদ্ভুত জায়গা। তাই না? এখানে মানুষ ভালোবাসে, ঘর বাঁধে, কবিতা লেখে, গান গায়, আবার এই একই মানুষ হিংসায় জ্বলে, যুদ্ধ করে, অন্যের দেশ দখল করে, লক্ষ লক্ষ মানুষকে অবলীলায় মেরে ফেলে। কেন এমন হয়? মানুষের এই দ্বৈত সত্তা, এই ভালোবাসা আর ঘৃণার অদ্ভুত মিশ্রণ—এসব নিয়ে ভাবতে বসলে মাথাটা কেমন যেন ধরে যায়। রাষ্ট্রগুলোও কি মানুষেরই একটি বড় সংস্করণ? মুখে তারা শান্তির কথা বলে, মানবাধিকারের বুলি আওড়ায়, কিন্তু পর্দার আড়ালে ভেতরে ভেতরে শক্তি অর্জনের এক তীব্র, আদিম নেশায় মত্ত থাকে?
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বা রাষ্ট্রচিন্তার জগতে এই অস্বস্তিকর প্রশ্নগুলোর এক সোজাসাপ্টা, কিছুটা নির্মম কিন্তু ভয়ানক বাস্তব উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে যে তত্ত্বটি, তার নামই হলো বাস্তববাদ (Realism)। বাস্তববাদীরা অনেকটা তেতো করলার মতো, যা খেতে ভালো লাগে না, কিন্তু শরীরের জন্য উপকারী। তারা কোনো রঙিন চশমা দিয়ে পৃথিবীকে দেখেন না; তাদের চোখে যা ধরা পড়ে, তা হলো শক্তি, স্বার্থ আর সংঘাতের এক বিশাল, অন্তহীন খেলার মাঠ। তারা আদর্শের ফানুস ওড়ান না, বরং ক্ষমতার কঠিন মাটিতে পা রেখে হাঁটেন।
চলুন, আজ আমরা এই বাস্তববাদের জগতে একটু ডুব দেই। কোনো জটিল সংজ্ঞার মারপ্যাঁচে না গিয়ে, বরং গল্প করতে করতে, ইতিহাসের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে, আর বর্তমান পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করব, কেন কিছু চিন্তাবিদ (thinker) মনে করেন যে পৃথিবীতে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করাটা আসলে একটা সুন্দর, কিন্তু অসম্ভব স্বপ্নমাত্র।
গল্পের শুরু: বাস্তববাদ আসলে কী?
ধরুন, আপনি একটি নতুন পাড়ায় বাড়ি করে এসেছেন। পাড়াটা অদ্ভুত, এখানে কোনো পুলিশ স্টেশন নেই, কোনো আদালত নেই, কোনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও নেই। প্রত্যেকেই নিজের এবং নিজের পরিবারের নিরাপত্তার জন্য পুরোপুরি নিজেই দায়ী। আপনার ডানদিকের প্রতিবেশী বেশ শক্তিশালী, ব্যায়াম করে শরীর বানিয়েছে, তার বাড়িতে অনেক লাঠিসোঁটা আর লোকজন আছে। বামদিকের প্রতিবেশীর হয়তো গায়ে জোর কম, কিন্তু তার অনেক টাকা, সে চাইলে মুহূর্তের মধ্যে ভাড়াটে গুন্ডা নিয়ে আসতে পারে। এই অবস্থায় আপনি কী করবেন? নিশ্চয়ই সারারাত দরজা-জানালা বন্ধ করে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারবেন না? আপনার মনে সারাক্ষণ একটা ভয় কাজ করবে। আপনি হয়তো ভাববেন, আমাকেও শক্তিশালী হতে হবে। নিজের নিরাপত্তার জন্য কিছু ব্যবস্থা তো করতেই হয়। কিছু লাঠি জোগাড় করতে হবে, বা উঁচু দেয়াল তুলতে হবে, কিংবা এলাকার সবচেয়ে শক্তিশালী লোকটির সাথে বন্ধুত্ব করতে হবে। কারণ আপনি হাড়েমজ্জায় জানেন, বিপদে পড়লে আপনাকে বাঁচানোর জন্য কেউ আসবে না। আপনার আত্মরক্ষার দায়িত্ব আপনাকেই নিতে হবে।
বাস্তববাদীরা বলেন, আন্তর্জাতিক বিশ্বটা ঠিক ওই আইনবিহীন, পুলিশবিহীন পাড়াটার মতোই। এখানে রাষ্ট্রগুলোই হলো এক-একটি বাড়ির মালিক। তাদের ওপর খবরদারি করার মতো কোনো বিশ্ব সরকার (World Government) বা বিশ্ব পুলিশ (World Police) নেই। এই সার্বিক অভিভাবকহীন অবস্থাকেই তারা বলেন নৈরাজ্য (Anarchy)। এখানে নৈরাজ্য মানে এই নয় যে সবাই সারাক্ষণ হানাহানি, মারামারি করছে। এর সহজ অর্থ হলো, রাষ্ট্রগুলোর মাথার ওপর ছড়ি ঘোরানোর মতো কোনো কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ (central authority) নেই। জাতিসংঘ আছে, আন্তর্জাতিক আদালত আছে, কিন্তু কোনো রাষ্ট্র যদি তাদের কথা না শোনে, তাকে বাধ্য করার মতো ক্ষমতা তাদের নেই। তাই প্রত্যেক রাষ্ট্রকে নিজের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হয়। এই দর্শনকেই বলা হয় আত্মরক্ষা (Self-help)।
এই মৌলিক ধারণার ওপর ভিত্তি করে বাস্তববাদের মূল কথাগুলো দাঁড়িয়েছে। চলুন, এগুলোকে আরেকটু বিস্তারিতভাবে দেখি:
- ১. রাষ্ট্রই মূল চরিত্র (The State is the Principal Actor): বাস্তববাদীদের কাছে, আন্তর্জাতিক রাজনীতির মঞ্চের প্রধান এবং একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ অভিনেতা হলো সার্বভৌম রাষ্ট্র (sovereign states)। জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বা রেড ক্রসের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর অস্তিত্ব থাকলেও, তাদের ক্ষমতা সীমিত। তারা মূলত শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটায় অথবা তাদের দেওয়া ক্ষমতার সীমার মধ্যে কাজ করে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, যুদ্ধ ঘোষণা করার ক্ষমতা বা চুক্তি বাতিল করার ক্ষমতা কেবল রাষ্ট্রের হাতেই থাকে।
- ২. নৈরাজ্যিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা (The International System is Anarchic): আগেই বলা হয়েছে, এটি বাস্তববাদের কেন্দ্রীয় স্তম্ভ। কোনো বিশ্ব সরকার না থাকায় আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাটি নৈরাজ্যিক। এই নৈরাজ্যই রাষ্ট্রগুলোর আচরণের মূল নির্ধারক। একটি ঘরোয়া রাজনৈতিক ব্যবস্থায় (domestic politics) সরকারের আইন নাগরিককে নিরাপত্তা দেয়, কিন্তু আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রগুলোকে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে সর্বদা চিন্তিত থাকতে হয়।
- ৩. আত্মরক্ষা হলো অপরিহার্য (Self-help is a Necessity): যেহেতু কোনো বিশ্ব পুলিশ নেই, তাই কোনো রাষ্ট্র বিপদে পড়লে ৯১১-এর মতো কোন নাম্বারে ফোন করতে পারে না। তাকে নিজের সুরক্ষার জন্য নিজের সামরিক বা অর্থনৈতিক শক্তির ওপরই নির্ভর করতে হয়। জোট (alliance) গঠন করা যেতে পারে, কিন্তু বাস্তববাদীরা মনে করেন, জোট বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ স্বার্থ ফুরিয়ে গেলে বা পরিস্থিতি বদলে গেলে জোট ভেঙে যেতে এক মুহূর্তও সময় লাগে না।
- ৪. শক্তিই হলো টিকে থাকার মুদ্রা (Power is the Currency of Survival): এই নৈরাজ্যিক পৃথিবীতে টিকে থাকার মূল উপাদান হলো শক্তি (Power)। বাস্তববাদীদের কাছে শক্তিই সবকিছু। শক্তি ছাড়া কোনো রাষ্ট্রের অস্তিত্ব, সম্মান বা প্রভাব—কিছুই নেই। শক্তি হতে পারে সামরিক (যেমন—সৈন্য, পারমাণবিক অস্ত্র), অর্থনৈতিক (যেমন—জিডিপি, বাণিজ্য), প্রযুক্তিগত, এমনকি সাংস্কৃতিক। একটি রাষ্ট্র কতটা প্রভাবশালী, তা নির্ভর করে তার আপেক্ষিক শক্তির (relative power) ওপর।
- ৫. জাতীয় স্বার্থই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার (National Interest is the Top Priority): প্রতিটি রাষ্ট্র তার নিজের জাতীয় স্বার্থ (National Interest) দ্বারা পরিচালিত হয়। আর সব স্বার্থের ঊর্ধ্বে যে স্বার্থটি থাকে, তা হলো রাষ্ট্রের টিকে থাকা বা অস্তিত্ব রক্ষা (Survival)। রাষ্ট্রনেতাদের প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব হলো রাষ্ট্রের সীমানা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। নৈতিকতা, আদর্শ বা মানবাধিকারের চেয়ে টিকে থাকাটাই সবসময় বড় কথা। একজন রাষ্ট্রনায়ক ব্যক্তিগতভাবে যত ভালো মানুষই হোন না কেন, রাষ্ট্রের স্বার্থে তাকে অনেক সময় কঠোর বা অনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতেই হয়।
এই মূল ভিত্তিগুলোর ওপর দাঁড়িয়েই বাস্তববাদের বিশাল অট্টালিকা তৈরি হয়েছে। এখন চলুন, এই অট্টালিকার আদি স্থপতিদের সাথে পরিচিত হওয়া যাক, যারা ইতিহাসের ধুলোমাখা পথ ধরে আমাদের জন্য এই চিন্তার রসদ জুগিয়ে গেছেন।
বাস্তববাদের শেকড়: ইতিহাসের তিন যুগপুরুষ
বাস্তববাদের ধারণা হুট করে বিংশ শতাব্দীতে জন্ম নেয়নি। এর শেকড় ছড়িয়ে আছে বহু পুরোনো ইতিহাসের গভীরে। তিনজন যুগান্তকারী চিন্তাবিদের লেখায় আমরা বাস্তববাদের আদি এবং অকৃত্রিম রূপ খুঁজে পাই।
১. থুসিডাইডিস (Thucydides): এক নির্মম ইতিহাসের সাক্ষী
সময়টা আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের। প্রাচীন গ্রিসে তখন দুটি প্রধান নগর-রাষ্ট্র (city-states)—গণতান্ত্রিক এথেন্স আর অভিজাততান্ত্রিক স্পার্টা। এই দুই শক্তির মধ্যে এক দীর্ঘস্থায়ী ও ভয়াবহ যুদ্ধ বেধেছিল, যা ইতিহাসে পেলোপনেসিয়ান যুদ্ধ (Peloponnesian War) নামে পরিচিত (আনুমানিক ৪৩১-৪০৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। থুসিডাইডিস ছিলেন সেই যুদ্ধের একজন এথেনীয় সেনাপতি এবং পরবর্তীকালে নির্বাসিত ঐতিহাসিক। তিনি তার বিখ্যাত বই ‘হিস্ট্রি অফ দ্য পেলোপনেসিয়ান ওয়ার’ (History of the Peloponnesian War)-এ এই মহাযুদ্ধের কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কোনো দেব-দেবীর ইচ্ছা, দৈববাণী বা নৈতিক অধঃপতনকে দায়ী করেননি। সেই যুগে এটাই ছিল এক বৈপ্লবিক চিন্তা। তিনি নির্মোহভাবে বলেছিলেন, এই যুদ্ধের আসল কারণ হলো এথেন্সের শক্তির ক্রমাগত বৃদ্ধি (the growth of Athenian power) এবং এই শক্তি বৃদ্ধি স্পার্টার মনে যে ভয় (fear) তৈরি করেছিল, তা-ই।
তার মানে, শক্তির ভারসাম্য (Balance of Power) নষ্ট হওয়াই ছিল যুদ্ধের মূল কারণ। থুসিডাইডিস দেখিয়েছেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ন্যায়বিচার (justice) বা নৈতিকতার (morality) স্থান খুব সীমিত। শক্তিমান যা চায়, তা-ই করে, আর দুর্বলকে তা নীরবে মেনে নিতে হয়। এর সবচেয়ে বিখ্যাত এবং মর্মান্তিক উদাহরণ হলো ‘মেলিয়ান ডায়ালগ’ (Melian Dialogue)। মেলোস ছিল একটি ছোট্ট, নিরপেক্ষ দ্বীপরাষ্ট্র। পেলোপনেসিয়ান যুদ্ধে তারা কোনো পক্ষে যোগ না দিয়ে নিরপেক্ষ থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু শক্তিশালী এথেন্স তাদের নিজেদের সাম্রাজ্যে যোগ দিতে বা কর দিতে চাপ দেয়। মেলোসের শাসকরা স্বাধীনতার আদর্শ, ন্যায়বিচার এবং দেবতাদের ওপর বিশ্বাসের কথা বলে এথেনীয়দের বোঝানোর চেষ্টা করেন। উত্তরে এথেনীয় দূতরা যে জবাব দিয়েছিলেন, তা হাজার হাজার বছর ধরে বাস্তববাদের এক ধ্রুপদী উক্তি হিসেবে পরিচিত: “The strong do what they can and the weak suffer what they must.” অর্থাৎ, শক্তিমান তার সাধ্যমতো কাজ করে, আর দুর্বলকে তার প্রাপ্য কষ্ট ভোগ করতেই হয়। আদর্শ বা ন্যায়বিচারের আলোচনা কেবল তখনই সম্ভব, যখন দুই পক্ষের শক্তি সমান হয়। শেষ পর্যন্ত এথেন্স মেলোস আক্রমণ করে, প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের হত্যা করে এবং নারী ও শিশুদের দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়।
থুসিডাইডিস আমাদের শিখিয়েছেন, রাষ্ট্রগুলো মূলত তিনটি জিনিস দ্বারা তাড়িত হয়: ভয়, সম্মান এবং স্বার্থ (fear, honor, and interest)। আদর্শ বা নৈতিকতার বুলি এখানে প্রায় অচল (Thucydides, trans. 1972)।
থুসিডাইডিস সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে যান এখানে – থুসিডাইডিসের রাজনৈতিক বাস্তববাদ: মানুষ, ক্ষমতা ও নিয়তির মহাকাব্য
২. নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি (Niccolò Machiavelli): শাসকের কানপড়াদাতা
সময়টা পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকের রেনেসাঁসকালীন ইতালি। সে সময় ইতালি কোনো একক রাষ্ট্র ছিল না, বরং মিলান, ভেনিস, ফ্লোরেন্স, নেপলস এবং পোপশাসিত রাজ্যের মতো অসংখ্য ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত ছিল। এই রাজ্যগুলোর মধ্যে প্রতিনিয়ত চলছিল ষড়যন্ত্র, যুদ্ধ আর ক্ষমতার দখল। এই উত্তাল সময়ে ফ্লোরেন্সের একজন উচ্চপদস্থ কূটনীতিক ছিলেন নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি। কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে তিনি ক্ষমতাচ্যুত ও কারারুদ্ধ হন, এবং মুক্তি পেয়ে নির্বাসনে যেতে বাধ্য হন। এই নির্বাসিত জীবনেই তিনি তার বিশ্ব কাঁপানো বই ‘দ্য প্রিন্স’ (The Prince) লেখেন (১৫১৩ সালে লেখা, ১৫৩২ সালে প্রকাশিত)।
এই বইয়ে তিনি কোনো আদর্শ শাসক কেমন হওয়া উচিত, তা বলেননি। বরং একজন বাস্তব শাসককে পরামর্শ দিয়েছেন, কীভাবে ক্ষমতা দখল করতে হয় এবং কীভাবে যে কোনো মূল্যে তা ধরে রাখতে হয়। ম্যাকিয়াভেলি কোনো রাখঢাক না করেই বলেছেন, শাসকের একমাত্র লক্ষ্য হবে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা রক্ষা করা। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজনে তাকে নিষ্ঠুর, প্রতারক, কৃপণ এবং ভণ্ড হতে হলেও সমস্যা নেই। কারণ রাজনীতির জগৎ আর ব্যক্তিগত নৈতিকতার জগৎ সম্পূর্ণ আলাদা। একজন সাধারণ মানুষের জন্য যা পাপ, একজন শাসকের জন্য তা-ই হতে পারে রাষ্ট্রের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় কৌশল।
তার বিখ্যাত উক্তি হলো, একজন শাসকের জন্য প্রজাদের ভালোবাসার পাত্র হওয়ার চেয়ে ভয়ের পাত্র হওয়া অনেক বেশি নিরাপদ। কারণ ভালোবাসা প্রতিদান ও প্রতিশ্রুতির ওপর নির্ভরশীল, যা ভঙ্গুর। কিন্তু ভয় শাস্তির আশঙ্কার ওপর নির্ভরশীল, যা সহজে দূর হয় না। তিনি আরও বলেছেন, লক্ষ্য যদি মহৎ হয় (যেমন—রাষ্ট্রের ঐক্য ও নিরাপত্তা), তবে সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর উপায় নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলবে না (“the ends justify the means”)। তিনি সিংহ (lion) ও শিয়ালের (fox) উপমা দিয়ে বলেন, শাসককে হতে হবে সিংহের মতো শক্তিশালী, যাতে সে নেকড়েদের ভয় দেখাতে পারে, আবার শিয়ালের মতো ধূর্ত, যাতে সে ফাঁদ চিনতে পারে।
ম্যাকিয়াভেলিই প্রথম স্পষ্টভাবে জাতীয় স্বার্থ (যা তিনি raison d’état বা ‘reason of state’—রাষ্ট্রের যুক্তি—অর্থে ব্যবহার করেছেন) এবং রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তাকে (political necessity) ব্যক্তিগত নৈতিকতা থেকে আলাদা করেছেন। তার কাছে রাষ্ট্রের টিকে থাকাটাই পরম ধর্ম, সর্বোচ্চ নৈতিকতা (Machiavelli, trans. 1998)।
ম্যাকিয়াভেলি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে যান এখানে – ম্যাকিয়াভেলি: শয়তানের দোসর, নাকি বাস্তবতার আয়না?
৩. টমাস হবস (Thomas Hobbes): নৈরাজ্যের দার্শনিক
সতেরো শতকের ইংল্যান্ড। তখন চলছে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ (English Civil War), রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংঘাত এবং চরম অস্থিতিশীলতা। এই ভয়ংকর সময়ে ইংরেজ দার্শনিক টমাস হবস তার বিখ্যাত বই ‘লেভায়াথান’ (Leviathan) লেখেন (১৬৫১)। হবস মানুষের প্রকৃতি (human nature) নিয়ে এক চরম হতাশাবাদী চিত্র এঁকেছেন। তিনি মনে করতেন, মানুষ স্বভাবতই স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক, ক্ষমতালোভী এবং একে অপরের প্রতি হিংস্র।
হবস একটি কাল্পনিক অবস্থার কথা বলেছেন, যাকে তিনি নাম দিয়েছেন ‘প্রকৃতির রাজ্য’ (State of Nature)। এই অবস্থায় কোনো সরকার, আইন বা পুলিশ নেই। ফলে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের শত্রু। এখানে জীবন হলো “একাকী, দরিদ্র, নোংরা, পাশবিক এবং ক্ষণস্থায়ী” (solitary, poor, nasty, brutish, and short)। হবসের মতে, এই অসহনীয় অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই মানুষ নিজেদের মধ্যে একটি সামাজিক চুক্তি (social contract) করে এবং একজন সার্বভৌম শাসকের (Sovereign) হাতে নিজেদের সব ক্ষমতা তুলে দেয়। এই সার্বভৌম শাসক বা রাষ্ট্রই হলো ‘লেভায়াথান’—বাইবেলে বর্ণিত এক বিশাল পৌরাণিক সামুদ্রিক দানব, যার শক্তিকে কেউ চ্যালেঞ্জ করতে পারে না। এই লেভায়াথান আইন প্রয়োগ করে সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে।
বাস্তববাদীরা হবসের এই ‘প্রকৃতির রাজ্য’-এর ধারণাকে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করেন। তাদের মতে, আন্তর্জাতিক বিশ্বটা ঠিক হবসের প্রকৃতির রাজ্যের মতোই—এখানেও কোনো একক সার্বভৌম শক্তি বা লেভায়াথান নেই। তাই রাষ্ট্রগুলো একে অপরকে ঠিক সেভাবেই ভয় ও অবিশ্বাস করে, যেভাবে প্রকৃতির রাজ্যের মানুষ একে অপরকে করত। টিকে থাকার জন্য তারাও অবিরাম ক্ষমতার সংগ্রামে লিপ্ত থাকে (Hobbes, 1651)।
হবস সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে যান এখানে – টমাস হবসের জগতের ভেতর-বাহির: লেভায়াথান, ভয় এবং আমরা
এই তিনজন চিন্তাবিদ—থুসিডাইডিস, ম্যাকিয়াভেলি এবং হবস—বাস্তববাদের দার্শনিক ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছেন। তারা সমস্বরে শিখিয়েছেন যে, পৃথিবীটা আদর্শ বা সদিচ্ছা দিয়ে চলে না, চলে শক্তি আর স্বার্থের কঠিন ও নির্মম সমীকরণে।
আধুনিক বাস্তববাদ: বিংশ শতাব্দীর প্রতিধ্বনি
বিংশ শতাব্দীতে দুটি বিশ্বযুদ্ধ পৃথিবীকে প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার পর তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের মতো নেতারা ভেবেছিলেন, লিগ অফ নেশনস (League of Nations) প্রতিষ্ঠা করে, আন্তর্জাতিক আইন, গণতন্ত্র আর পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে পৃথিবীতে স্থায়ী শান্তি আনা সম্ভব। এই চিন্তাকে বলা হয় আদর্শবাদ বা উদারতাবাদ (Idealism or Liberalism)।
কিন্তু তাদের স্বপ্ন খুব দ্রুতই দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। লিগ অফ নেশনস ব্যর্থ হলো, ইতালি ও জাপান আগ্রাসন চালাল, হিটলারের নাৎসি জার্মানির উত্থান ঘটল এবং বিশ্ব আরেকটি আরও ভয়াবহ যুদ্ধের সম্মুখীন হলো। এই ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকেই জন্ম নেয় আধুনিক বাস্তববাদ, যা আজ ধ্রুপদী বাস্তববাদ (Classical Realism) নামে পরিচিত। এটি ছিল আদর্শবাদের বিরুদ্ধে এক তীব্র বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিক্রিয়া।
ই. এইচ. কার (E. H. Carr) এবং ‘বিশ বছরের সংকট’
ব্রিটিশ ঐতিহাসিক ও কূটনীতিক এডওয়ার্ড হ্যালেট কার তার বিখ্যাত বই ‘দ্য টুয়েন্টি ইয়ার্স’ ক্রাইসিস, ১৯১৯-১৯৩৯’ (The Twenty Years’ Crisis, 1919-1939)-এ আদর্শবাদীদের কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, আদর্শবাদীরা বাস্তবতাকে অস্বীকার করে কেবল ‘কী হওয়া উচিত’ (what ought to be) তা নিয়ে ভেবেছেন, কিন্তু ‘আসলে কী হয়’ (what is) তা দেখতে ব্যর্থ হয়েছেন। তারা রাজনীতিকে ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল ভেবেছিলেন, কিন্তু বাস্তবতা হলো রাজনীতি ক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল।
কার যুক্তি দেন যে, রাজনীতিতে নৈতিকতা আপেক্ষিক। শক্তিমান রাষ্ট্রগুলো নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্যই ‘শান্তি’, ‘ন্যায়বিচার’, ‘আন্তর্জাতিক আইন’—এসব সুন্দর সুন্দর শব্দ ব্যবহার করে। যা স্থিতাবস্থা (status quo) বজায় রাখে, তাই তাদের কাছে ‘নৈতিক’। আর যারা এই স্থিতাবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে, তারাই ‘অনৈতিক’। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে শক্তি (power) এবং নৈতিকতার (morality) মধ্যে এক চিরন্তন দ্বন্দ্ব চলে, যেখানে প্রায় সবসময়ই শক্তি বিজয়ী হয়। তার মতে, আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে বুঝতে হলে ইউটোপিয়া (utopia) বা কল্পনাবিলাস এবং বাস্তবতা (reality) উভয়কেই স্বীকার করতে হবে (Carr, 2001)।
হ্যান্স জে. মরগেনথাউ (Hans J. Morgenthau): বাস্তববাদের বাইবেল
আধুনিক বাস্তববাদের সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং কেন্দ্রীয় প্রবক্তা হলেন জার্মান-আমেরিকান তাত্ত্বিক হ্যান্স জে. মরগেনথাউ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর লেখা তার বই ‘পলিটিক্স অ্যামং নেশনস: দ্য স্ট্রাগল ফর পাওয়ার অ্যান্ড পিস’ (Politics Among Nations: The Struggle for Power and Peace, 1948) কে বাস্তববাদীদের বাইবেল হিসেবে গণ্য করা হয়। মরগেনথাউ বাস্তববাদকে একটি সুসংহত এবং পদ্ধতিগত তত্ত্বে রূপ দিয়েছেন। তিনি তার বিখ্যাত ‘রাজনৈতিক বাস্তববাদের ছয়টি নীতি’ (Six Principles of Political Realism) তুলে ধরেন, যা আজও এই তত্ত্বের ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়।
চলুন, নীতিগুলো সহজ করে এবং বিস্তারিতভাবে বোঝার চেষ্টা করি।
- ১. রাজনীতি বস্তুনিষ্ঠ আইন দ্বারা শাসিত, যার শেকড় মানুষের প্রকৃতিতে: মরগেনথাউ হবসের মতো বিশ্বাস করতেন যে, মানুষের প্রকৃতি (human nature) অপরিবর্তনীয় এবং এর মূলে রয়েছে ক্ষমতা লাভের আকাঙ্ক্ষা বা animus dominandi (lust for power)। মানুষ যেমন ক্ষমতা চায়, তেমনি রাষ্ট্রও ক্ষমতা চায়। এই সত্যকে স্বীকার না করে রাজনীতি বোঝা সম্ভব নয়। এই আইনগুলো আবেগের ঊর্ধ্বে, বস্তুনিষ্ঠ। আমরা এগুলো পছন্দ করি বা না করি, এগুলো কাজ করবেই।
- ২. জাতীয় স্বার্থই মূল চালিকাশক্তি, যা শক্তির নিরিখে সংজ্ঞায়িত: এটি মরগেনথাউয়ের তত্ত্বের কেন্দ্রবিন্দু। রাষ্ট্রনেতারা ব্যক্তিগতভাবে কী ভাবছেন, তাদের আদর্শ কী, বা তাদের উদ্দেশ্য কতটা মহৎ, তা বড় কথা নয়। তারা জাতীয় স্বার্থ (national interest) রক্ষা করতে বাধ্য। আর এই স্বার্থের মূল কথা হলো শক্তি (power) অর্জন ও সংরক্ষণ। একটি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি বোঝার জন্য আমাদের রাষ্ট্রনেতার মনের ভেতর উঁকি দেওয়ার দরকার নেই; বরং তার রাষ্ট্র কী পরিমাণ শক্তি অর্জন করতে চাইছে, তা দেখলেই চলবে। এই ‘শক্তির নিরিখে সংজ্ঞায়িত স্বার্থ’ হলো একটি ধ্রুবতারা, যা আমাদের আন্তর্জাতিক রাজনীতির উত্তাল সমুদ্রে পথ দেখায়।
- ৩. স্বার্থের ধারণা চিরন্তন, কিন্তু তার অর্থ পরিবর্তনশীল: ‘জাতীয় স্বার্থ’ কথাটি সব দেশের জন্য, সব সময়ের জন্য সত্য। কিন্তু এর সুনির্দিষ্ট রূপ বা অর্থ পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপট অনুযায়ী বদলাতে পারে। যেমন, কোনো সময় হয়তো অর্থনৈতিক শক্তি বাড়ানোই জাতীয় স্বার্থ, আবার কোনো সময় সামরিক জোট গঠন করাটাই প্রধান স্বার্থ হয়ে দাঁড়ায়। উনিশ শতকে ব্রিটেনের জাতীয় স্বার্থ ছিল নৌ-শক্তিতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী থাকা, আর স্নায়ুযুদ্ধের সময় আমেরিকার স্বার্থ ছিল কমিউনিজমের বিস্তার রোধ করা। স্বার্থের মূল ধারণা (core concept) একই—টিকে থাকা ও শক্তি বৃদ্ধি—কিন্তু এর প্রয়োগ ভিন্ন ভিন্ন হয়।
- ৪. রাজনৈতিক কর্মের নৈতিক তাৎপর্য আছে, কিন্তু তা সর্বজনীন নয়: মরগেনথাউ বলছেন না যে রাজনীতিতে নৈতিকতার কোনো স্থান নেই। কিন্তু তিনি মনে করেন, ব্যক্তিগত নৈতিকতা (personal morality) আর রাষ্ট্রীয় নৈতিকতা (state morality) এক নয়। একজন রাষ্ট্রনেতাকে তার কাজের ফলাফলের কথা ভাবতে হয়। তাকে এমন কিছু কাজও করতে হতে পারে, যা ব্যক্তিগতভাবে অনৈতিক মনে হতে পারে, কিন্তু তা রাষ্ট্রের লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বাঁচাতে বা দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে জরুরি। একে বলা হয় ‘দায়বদ্ধতার নীতিশাস্ত্র’ (ethic of responsibility)। একজন সাধারণ নাগরিকের জন্য মিথ্যা বলা পাপ, কিন্তু একজন গুপ্তচরের জন্য দেশের স্বার্থে মিথ্যা বলাই তার দায়িত্ব (duty)।
- ৫. কোনো নির্দিষ্ট রাষ্ট্রের নৈতিক আকাঙ্ক্ষাকে মহাবিশ্বের নৈতিক আইনের সঙ্গে মেলানো যাবে না: এটি হলো আদর্শবাদের প্রতি মরগেনথাউয়ের সবচেয়ে বড় সতর্কবাণী। কোনো রাষ্ট্রই দাবি করতে পারে না যে, তার আদর্শ বা নৈতিকতাই একমাত্র সঠিক এবং সর্বজনীন (universal)। আমেরিকা যদি গণতন্ত্রকে সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করে, তার মানে এই নয় যে, চীন বা রাশিয়াকেও সেই আদর্শ গ্রহণ করতে হবে বা আমেরিকার অধিকার আছে গায়ের জোরে সেই আদর্শ চাপিয়ে দেওয়ার। মরগেনথাউ একে ‘জাতীয়তাবাদের নৈতিক ভণ্ডামি’ (moral pretense of nationalism) থেকে সাবধান করেছেন। রাষ্ট্রগুলো প্রায়শই নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য নিজেদের কাজকে ঈশ্বরের ইচ্ছা বা সভ্যতার অগ্রগতির নামে চালিয়ে দেয়।
- ৬. রাজনৈতিক ক্ষেত্রের স্বায়ত্তশাসন (Autonomy of the Political Sphere): রাজনীতির জগৎকে তার নিজস্ব নিয়ম দিয়ে বুঝতে হবে। একে অর্থনীতি, আইন বা নৈতিকতার মানদণ্ড দিয়ে বিচার করলে চলবে না। একজন অর্থনীতিবিদ দেখবেন কোনো একটি নীতি লাভজনক কি না। একজন আইনজীবী দেখবেন তা আইনসম্মত কি না। আর একজন রাজনৈতিক বাস্তববাদী দেখবেন, কাজটি রাষ্ট্রের শক্তি বাড়াচ্ছে, নাকি কমাচ্ছে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে তার রাজনৈতিক ফলাফলের ভিত্তিতেই বিচার করতে হবে।
মরগেনথাউয়ের এই ছয়টি নীতি ধ্রুপদী বাস্তববাদের মূল ভিত্তি স্থাপন করে। তার মতে, আন্তর্জাতিক রাজনীতি হলো ক্ষমতার জন্য এক নিরন্তর সংগ্রাম (a perpetual struggle for power), এবং এই সংগ্রাম থেকে মুক্তির কোনো সহজ পথ নেই (Morgenthau, 1948)।
কেনেথ ওয়াল্টজের নয়া-বাস্তববাদ বা কাঠামোগত বাস্তববাদ (Neorealism or Structural Realism): নতুন বোতলে পুরোনো মদ?
সময় গড়ানোর সাথে সাথে বাস্তববাদেরও বিবর্তন ঘটেছে। ১৯৭০-এর দশকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ‘আচরণবাদী বিপ্লব’ (Behavioral Revolution)-এর প্রভাব বাড়ছিল, যা সামাজিক বিজ্ঞানকে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মতো আরও কঠোর, পদ্ধতিগত ও ‘বৈজ্ঞানিক’ করতে চেয়েছিল। এই প্রেক্ষাপটে কেনেথ ওয়াল্টজ (Kenneth Waltz) নামে একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ধ্রুপদী বাস্তববাদকে অপর্যাপ্ত মনে করেন। তিনি মনে করেন, মানুষের প্রকৃতি বা রাষ্ট্রনেতার মনোবিজ্ঞানের মতো অস্পষ্ট বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হতে পারে না।
ওয়াল্টজ তার যুগান্তকারী বই ‘থিওরি অফ ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্স’ (Theory of International Politics, 1979)-এ বলেন, রাষ্ট্রগুলোর আচরণের জন্য মানুষের স্বার্থপর প্রকৃতি (human nature) ততটা দায়ী নয়, যতটা দায়ী আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার কাঠামো (structure of the international system) নিজে।
ব্যাপারটা কেমন? ধরুন, একটি ক্লাসের সব ছাত্রছাত্রীই খুব ভালো, ভদ্র এবং সহযোগী। কিন্তু পরীক্ষার নিয়ম যদি এমন হয় যে, মাত্র একজনই প্রথম হতে পারবে এবং বাকি সবাই ফেল করবে, তাহলে কী হবে? সেই ভালো ছাত্রছাত্রীরাও একে অপরের সঙ্গে এক তীব্র, অবিশ্বাসের প্রতিযোগিতায় নামতে বাধ্য হবে। এখানে সমস্যাটা ছাত্রদের স্বভাবে নয়, সমস্যাটা পরীক্ষার ব্যবস্থার কাঠামোতে।
ওয়াল্টজ বলেন, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার তিনটি প্রধান বৈশিষ্ট্য রাষ্ট্রগুলোর আচরণ নির্ধারণ করে দেয়:
- ১. আয়োজক নীতি (Organizing Principle): এটি হলো নৈরাজ্য (Anarchy)। অর্থাৎ, কোনো কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ নেই। এটিই ব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি।
- ২. এককগুলোর কার্যাবলীর অভিন্নতা (Functional Similarity of Units): আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় সব রাষ্ট্রই কার্যকরীভাবে একই রকম। প্রত্যেকেই সার্বভৌম এবং প্রত্যেকেরই মূল কাজ হলো টিকে থাকা। ছোট বা বড়, গণতান্ত্রিক বা স্বৈরাচারী—সব রাষ্ট্রেরই মূল লক্ষ্য এক। তাই ওয়াল্টজের তত্ত্বে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ চরিত্র বিবেচ্য নয়; রাষ্ট্রগুলো যেন বিলিয়ার্ড বলের মতো, যাদের আকার ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু চরিত্র একই।
- ৩. সক্ষমতার বণ্টন (Distribution of Capabilities): রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আসল পার্থক্য তৈরি হয় তাদের সক্ষমতা বা শক্তির বণ্টনের মাধ্যমে। কোনো রাষ্ট্রের সামরিক শক্তি বেশি, কারো অর্থনৈতিক শক্তি বেশি। এই শক্তির বণ্টনই আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার কাঠামো নির্ধারণ করে।
ওয়াল্টজের মতে, এই শক্তির বণ্টনের ওপর ভিত্তি করে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা তিন ধরনের হতে পারে এবং প্রত্যেকটির স্থিতিশীলতা ভিন্ন:
-
একমেরু ব্যবস্থা (Unipolar System): যেখানে একজন মাত্র মহাশক্তিধর রাষ্ট্র (hegemon) থাকে (যেমন, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কিছুকালের জন্য আমেরিকা)।
-
দ্বিমেরু ব্যবস্থা (Bipolar System): যেখানে দুটি মহাশক্তিধর রাষ্ট্র থাকে (যেমন, স্নায়ুযুদ্ধের সময় আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন)। ওয়াল্টজের মতে, এটিই সবচেয়ে স্থিতিশীল ব্যবস্থা। কারণ এখানে হিসাব-নিকাশ অনেক সহজ। শত্রু-মিত্র পরিষ্কার, ফলে ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনা কম। ভারসাম্য মূলত অভ্যন্তরীণ উপায়ে (internal balancing) হয়, অর্থাৎ প্রত্যেকে নিজের শক্তি বাড়ায়।
-
বহুমেরু ব্যবস্থা (Multipolar System): যেখানে তিন বা ততোধিক মহাশক্তিধর রাষ্ট্র থাকে (যেমন, দুই বিশ্বযুদ্ধের আগে ইউরোপ)। এটি সবচেয়ে অস্থিতিশীল ও বিপজ্জনক ব্যবস্থা। কারণ এখানে জোট গঠন (alliance formation) এবং জোট ভাঙার খেলা চলতে থাকে, যা পরিস্থিতিকে অত্যন্ত জটিল করে তোলে। কে কার বন্ধু আর কে শত্রু, তা বোঝা কঠিন হয়ে যায়।
সুতরাং, ধ্রুপদী বাস্তববাদীরা যেখানে রাষ্ট্রগুলোর আচরণের জন্য মানুষের প্রকৃতিকে দায়ী করেছেন (bottom-up approach), সেখানে নয়া-বাস্তববাদীরা দায়ী করেছেন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার নৈরাজ্যিক কাঠামোকে (top-down approach) (Waltz, 1979)।
বাস্তববাদের অন্দরমহল: রক্ষণাত্মক বনাম আক্রমণাত্মক
নয়া-বাস্তববাদের ছাতার নিচেও দুটি প্রধান ধারা তৈরি হয়েছে। ভাবুন, এরা যেন দুই ভাই, যারা বাবার (কেনেথ ওয়াল্টজ) সম্পত্তি ও দর্শনের ভাগাভাগি নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করে। উভয়েই স্বীকার করে যে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার কাঠামোই মূল চালিকাশক্তি, কিন্তু সেই কাঠামোর চাপে পড়ে রাষ্ট্রগুলো ঠিক কী করে, তা নিয়ে তাদের মধ্যে তীব্র বিতর্ক রয়েছে।
১. রক্ষণাত্মক বাস্তববাদ (Defensive Realism): এই ধারার প্রধান প্রবক্তা হলেন কেনেথ ওয়াল্টজ নিজেই, এবং তার অনুসারীদের মধ্যে রয়েছেন স্টিফেন ভ্যান এভেরা এবং রবার্ট জার্ভিস। রক্ষণাত্মক বাস্তববাদীরা মনে করেন, রাষ্ট্রগুলো মূলত নিরাপত্তা সর্বোচ্চকারী (Security Maximizers)। তারা টিকে থাকার জন্য শুধু ‘যথেষ্ট’ শক্তি (adequate power) চায়, তার বেশি নয়। তাদের মূল লক্ষ্য হলো নিজেদের অবস্থান বজায় রাখা, পুরো বিশ্ব দখল করা নয়।
কারণ, অতিরিক্ত শক্তি অর্জন করতে গেলে অন্য রাষ্ট্রগুলো ভয় পেয়ে যায় এবং একজোট হয়ে সেই আগ্রাসী রাষ্ট্রকে থামানোর চেষ্টা করে (balancing)। এর ফলে সেই রাষ্ট্রের নিরাপত্তা কমার ঝুঁকি তৈরি হয়। ইতিহাস দেখায়, নেপোলিয়ন বা হিটলারের মতো যারা অতিরিক্ত ক্ষমতা দখল করতে গিয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে বাকি সবাই একজোট হয়ে তাদের পতন ঘটিয়েছে। তাই বুদ্ধিমান রাষ্ট্রগুলো শক্তির ভারসাম্য (Balance of Power) বজায় রাখার চেষ্টা করে এবং স্থিতাবস্থা (status quo) পছন্দ করে। তাদের মূল মন্ত্র হলো: ‘বেশি বাড়াবাড়ি ভালো নয়, তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে।’
২. আক্রমণাত্মক বাস্তববাদ (Offensive Realism): এই ধারার সবচেয়ে বিখ্যাত এবং জোরালো প্রবক্তা হলেন জন মিয়ারশাইমার (John Mearsheimer)। তার বিখ্যাত বই ‘দ্য ট্র্যাজেডি অফ গ্রেট পাওয়ার পলিটিক্স’ (The Tragedy of Great Power Politics, 2001)-এ তিনি এক সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং আরও অন্ধকার চিত্র এঁকেছেন। মিয়ারশাইমার মনে করেন, রাষ্ট্রগুলো নিরাপত্তা নয়, বরং ক্ষমতা সর্বোচ্চকারী (Power Maximizers)।
তার যুক্তি হলো, নৈরাজ্যিক ব্যবস্থায় একটি রাষ্ট্রের পক্ষে নিশ্চিতভাবে বোঝা অসম্ভব যে, টিকে থাকার জন্য ঠিক কতটা শক্তি প্রয়োজন। ভবিষ্যতের হুমকি অজানা, প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্য বোঝা কঠিন। তাই সবচেয়ে নিরাপদ কৌশল হলো যতটা সম্ভব শক্তি অর্জন করা এবং চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে আঞ্চলিক আধিপত্য (Regional Hegemony) প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাৎ, নিজের ভৌগোলিক অঞ্চলে সবচেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠা এবং সেই অঞ্চলে অন্য কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী আধিপত্যকামী শক্তিকে মাথা তুলতে না দেওয়া। মিয়ারশাইমার বলেন, রাষ্ট্রগুলো সুযোগ পেলেই অন্যের শক্তি খর্ব করে নিজের শক্তি বাড়াতে চায়। তাদের কাছে সবচেয়ে ভালো প্রতিরক্ষা হলো আক্রমণ (the best defense is a good offense)।
মিয়ারশাইমারের মতে, এটাই হলো বৃহৎ শক্তিগুলোর রাজনীতির ‘ট্র্যাজেডি’—টিকে থাকার সরল এবং আত্মরক্ষামূলক ইচ্ছা থেকেই তারা একে অপরের সঙ্গে এক চিরন্তন, নির্মম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে বাধ্য হয়। শান্তি যদি কখনো আসে, তা কেবল অস্থায়ী বিরতি মাত্র (Mearsheimer, 2001)।
নয়া-ধ্রুপদী বাস্তববাদ (Neoclassical Realism): একটি সেতুবন্ধন
ধ্রুপদী এবং নয়া-বাস্তববাদের বিতর্কের মাঝে একটি তৃতীয় ধারার জন্ম হয়, যা এই দুই তত্ত্বের মধ্যে সেতুবন্ধনের চেষ্টা করে। একে বলা হয় নয়া-ধ্রুপদী বাস্তববাদ (Neoclassical Realism)। গিডিয়ন রোজ, র্যান্ডাল শোয়েলার, ফরিদ জাকারিয়ার মতো তাত্ত্বিকরা এই ধারার প্রবক্তা।
তারা মনে করেন, ওয়াল্টজের কাঠামোগত বাস্তববাদ ঠিকই বলেছে যে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার চাপ (systemic pressures) একটি রাষ্ট্রের আচরণের মূল কারণ। কিন্তু এই চাপ সরাসরি ফলাফলে রূপান্তরিত হয় না। এই চাপ ফিল্টার বা ছাঁকন হয় রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ কিছু বিষয়ের মাধ্যমে। এই অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো হলো:
-
রাষ্ট্রনেতাদের উপলব্ধি (Perception of Leaders): রাষ্ট্রনেতারা আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিকে কীভাবে দেখছেন বা ব্যাখ্যা করছেন।
-
রাষ্ট্রীয় শক্তি (State Power): রাষ্ট্রের আমলাতন্ত্র বা সরকারের ক্ষমতা কতটা শক্তিশালী এবং সমাজের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ কতটা।
-
অভ্যন্তরীণ রাজনীতি (Domestic Politics): দেশের ভেতরকার রাজনৈতিক দল, জনমত এবং প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলোর চাপ।
সহজ কথায়, নয়া-ধ্রুপদী বাস্তববাদীরা বলেন, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা একটি রাষ্ট্রকে একটি নির্দিষ্ট দিকে ঠেলে দেয়, কিন্তু রাষ্ট্রটি সেই দিকে কতটা বা কীভাবে যাবে, তা নির্ভর করে তার অভ্যন্তরীণ চালক এবং কাঠামোর ওপর (Rose, 1998)। এটি ধ্রুপদী বাস্তববাদের ‘রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ চরিত্র’ এবং নয়া-বাস্তববাদের ‘আন্তর্জাতিক কাঠামো’—উভয়কেই গুরুত্ব দেয়।
প্রাচ্যে বাস্তববাদীরা: কৌটিল্য, সান জু, ইবনে খালদুন
আমরা যখন রাষ্ট্রচিন্তা বা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে কথা বলি, আমাদের আলোচনার টেবিলটা কেমন যেন একপেশে হয়ে যায়। থুসিডাইডিস, ম্যাকিয়াভেলি, হবস, মরগেনথাউ—এই নামগুলোই ঘুরেফিরে আসে। মনে হয়, যেন রাষ্ট্রকে নিয়ে এই কঠিন, নির্মম আর স্বার্থপর চিন্তাভাবনাগুলো কেবল পাশ্চাত্যেরই একচেটিয়া সম্পত্তি। যেন ইউরোপের ঠান্ডা, মেঘলা আকাশের নিচেই কেবল এই নিরাসক্ত তত্ত্বের জন্ম হতে পারে।
কিন্তু ব্যাপারটা কি আসলেই তাই? ক্ষমতা, স্বার্থ, আত্মরক্ষা আর টিকে থাকার এই খেলা কি কেবল গ্রিস বা ইতালির মাটিতেই সীমাবদ্ধ ছিল? প্রাচ্যের বিশাল ভূখণ্ডে, যেখানে জন্ম নিয়েছে পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতাগুলো, সেখানে কি শাসকরা কেবল আদর্শ আর নৈতিকতার কথাই ভাবতেন?
চলুন, এখন আমরা আমাদের চেনা জগতের বাইরে একটু উঁকি দেই। পশ্চিমা চশমাটা খুলে রেখে প্রাচ্যের ধুলোমাখা, প্রাচীন পুঁথির পাতা ওল্টানো যাক। আমরা দেখব, ক্ষমতার রাজনীতি নিয়ে এমন কিছু সোজাসাপ্টা, বাস্তব আর ভয়ংকর কথা প্রাচ্যের চিন্তাবিদরা বলে গেছেন, যা শুনলে ম্যাকিয়াভেলিও হয়তো চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে সম্মান জানাতেন। এই গল্প শুধু কৌটিল্যের নয়, এই গল্প প্রাচ্যের বাস্তববাদী মননের।
কৌটিল্য: এক সম্রাটের মস্তিষ্ক
আজ থেকে প্রায় তেইশ’শ বছর আগের কথা। ভারতবর্ষ তখন ছোট ছোট মহাজনপদে বিভক্ত। নিজেদের মধ্যে সংঘাত, ষড়যন্ত্র আর হানাহানি লেগেই আছে। ঠিক এমনই এক সময়ে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট তার বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে ভারত আক্রমণ করে বসলেন। এই চরম রাজনৈতিক সংকটের মুহূর্তে তক্ষশিলার এক সাধারণ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত, চাণক্য বা কৌটিল্য, এক অসাধ্য সাধনের প্রতিজ্ঞা করলেন। তিনি শতধাবিভক্ত ভারতকে এক করে এক অখণ্ড সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখলেন এবং সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য খুঁজে নিলেন তার যোগ্য ছাত্র, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে।
এই কৌটিল্যই তার বিখ্যাত গ্রন্থ অর্থশাস্ত্র (Arthashastra) রচনা করেন। নামটি ‘অর্থশাস্ত্র’ হলেও এটি কেবল অর্থনীতি নিয়ে লেখা কোনো বই নয়। এটি রাষ্ট্র পরিচালনা, কূটনীতি, সামরিক কৌশল, গুপ্তচরবৃত্তি এবং আইনকানুন নিয়ে লেখা এক সম্পূর্ণ হ্যান্ডবুক। এই গ্রন্থে কৌটিল্য একজন রাজাকে যে পরামর্শ দিয়েছেন, তা কোনো ধর্মগুরুর উপদেশ নয়, বরং একজন কঠোর বাস্তববাদী রাষ্ট্রনায়কের কর্মপন্থা।
কৌটিল্যের বাস্তববাদের জগতটা কেমন? চলুন, একটু গভীরে প্রবেশ করি।
১. রাষ্ট্রের টিকে থাকাই পরম ধর্ম: ম্যাকিয়াভেলির মতোই কৌটিল্যের কাছে রাষ্ট্রের কল্যাণ, নিরাপত্তা এবং সমৃদ্ধিই ছিল সর্বোচ্চ লক্ষ্য। তিনি পরিষ্কারভাবে বলেছেন, “প্রজার সুখেই রাজার সুখ, প্রজার কল্যাণেই তার কল্যাণ” (In the happiness of his subjects lies his happiness; in their welfare his welfare)। কিন্তু এই সুখ আর কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য রাজাকে হতে হবে চরম বাস্তববাদী। রাষ্ট্রের স্বার্থে প্রয়োজন হলে তাকে ছলনা, প্রতারণা, এমনকি নিষ্ঠুরতার আশ্রয় নিতে হলেও তা করতে হবে। এখানে ব্যক্তিগত নৈতিকতার কোনো স্থান নেই। শাসকের একটাই ধর্ম—রাষ্ট্রধর্ম।
২. মন্ডল তত্ত্ব (Mandala Theory): প্রতিবেশীর ভূগোল: কৌটিল্যের বাস্তববাদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং মৌলিক ধারণা হলো ‘মন্ডল তত্ত্ব’। ‘মন্ডল’ শব্দের অর্থ হলো বৃত্ত বা চক্র। কৌটিল্য মনে করতেন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক হলো কতকগুলো বৃত্তের সমষ্টি, যার কেন্দ্রে থাকে একজন বিজয়ী হতে ইচ্ছুক রাজা বা ‘বিজিগীষু’ (Vijigishu – the would-be conqueror)।
ব্যাপারটা সহজ করে ভাবা যাক। ধরুন, আপনার রাজ্যটি হলো মন্ডলের কেন্দ্র। আপনার ঠিক পাশের প্রতিবেশী রাষ্ট্রটি, যার সাথে আপনার সীমানা ভাগাভাগি হচ্ছে, সে স্বাভাবিকভাবেই আপনার শত্রু বা ‘অরি’ (Ari – the enemy)। কারণ, সীমানা নিয়ে বিরোধ, সম্পদ নিয়ে সংঘাত—এসব লেগেই থাকবে।
এবার ভাবুন, আপনার সেই শত্রু প্রতিবেশীর পাশের রাষ্ট্রটি কে? সে তো আপনার শত্রুর শত্রু। আর পুরনো প্রবাদ অনুযায়ী, শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু। তাই সে হলো আপনার ‘মিত্র’ (Mitra – the friend)। আবার আপনার বন্ধুর পাশের রাষ্ট্রটি আপনার শত্রুর বন্ধু, তাই সে হলো ‘অরিমিত্র’ (Arimitra – the enemy’s friend)। এভাবে concentric circles বা সমকেন্দ্রিক বৃত্তের মতো বন্ধু ও শত্রুর এক জটিল জাল তৈরি হয়।
এই মন্ডল তত্ত্বে মোট ১২ ধরনের রাজার কথা বলা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে বিজিগীষু, অরি, মিত্র, অরিমিত্র, মধ্যম (Madhyama – the mediator king) এবং উদাসীন (Udasina – the neutral king)। কৌটিল্য দেখিয়েছেন, ভূগোলই (geography) মূলত একটি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির চরিত্র নির্ধারণ করে দেয়। আপনার প্রতিবেশীই আপনার সবচেয়ে বড় সম্ভাব্য হুমকি। এই ধারণা আধুনিক বাস্তববাদের ‘নিরাপত্তা উভয়সংকট’ (Security Dilemma) ধারণার কথা মনে করিয়ে দেয় (Kangle, 1965)।
৩. ষড়গুণ নীতি (Shat-gunya): কূটনীতির ছয় ভাঁজ: এই জটিল মন্ডল ব্যবস্থায় টিকে থাকার জন্য একজন রাজাকে ছয়টি কৌশল বা নীতি (Six-fold Policy) অবলম্বন করতে হবে। এগুলো হলো:
-
সন্ধি (Sandhi – Peace): যখন শত্রু আপনার চেয়ে শক্তিশালী, তখন তার সাথে চুক্তি করে বা সন্ধি করে সময় নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
-
বিগ্রহ (Vigraha – War): যখন আপনি শত্রুর চেয়ে শক্তিশালী, তখন যুদ্ধ ঘোষণা করাই শ্রেয়।
-
আসন (Asana – Neutrality): যখন দুই পক্ষের শক্তি সমান, তখন নিরপেক্ষ থেকে নিজের শক্তি সঞ্চয় করা উচিত।
-
যান (Yana – Marching): প্রতিপক্ষ দুর্বল কিন্তু আপনি পুরোপুরি প্রস্তুত নন, এমন অবস্থায় যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে এগোনো।
-
সংশ্রয় (Samshraya – Alliance): যখন শত্রু খুব বেশি শক্তিশালী এবং একা মোকাবেলা করা অসম্ভব, তখন অন্য কোনো শক্তিশালী রাজার আশ্রয় বা জোট গঠন করা।
-
দ্বৈধীভাব (Dvaidhibhava – Double Policy): একই সাথে এক শত্রুর সঙ্গে শান্তি এবং অন্য শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধের নীতি গ্রহণ করা।
কৌটিল্যের মতে, একজন বুদ্ধিমান রাজা পরিস্থিতি বুঝে এই ছয়টি নীতির সঠিক মিশ্রণ ঘটাবেন। তার মূল লক্ষ্য থাকবে একটাই—নিজের রাষ্ট্রের শক্তি বৃদ্ধি করা এবং শত্রুকে দুর্বল করা।
৪. গুপ্তচরবৃত্তি এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা: কৌটিল্য বিশ্বাস করতেন, একটি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির সাফল্য নির্ভর করে তার অভ্যন্তরীণ শক্তির ওপর। রাষ্ট্র যদি ভেতর থেকে দুর্বল হয়, তবে সে কখনোই বাইরে শক্তিশালী হতে পারে না। তাই তিনি রাষ্ট্রের ভেতরে শৃঙ্খলা রক্ষা, দুর্নীতি দমন এবং বিদ্রোহ দমনের ওপর চরম গুরুত্ব দিয়েছেন।
আর বাইরের শত্রুর খবর জানার জন্য গুপ্তচরবৃত্তির (espionage) কোনো বিকল্প নেই। কৌটিল্য বিভিন্ন ধরনের গুপ্তচরের কথা বলেছেন—যেমন সাধু, ব্যবসায়ী, বা পতিতার ছদ্মবেশে থাকা চর, যারা শত্রু রাষ্ট্রের সব গোপন খবর রাজার কাছে পৌঁছে দেবে। তার কাছে তথ্যই ছিল ক্ষমতার অন্যতম উৎস।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র পড়লে মনে হয়, তিনি যেন কোনো কল্পনার জগতে বাস করতেন না। তার পৃথিবী ছিল ষড়যন্ত্র, অবিশ্বাস আর ক্ষমতার দ্বন্দ্বে পরিপূর্ণ। এখানে টিকে থাকতে হলে শক্তি আর বুদ্ধির খেলা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এই দর্শন থুসিডাইডিস বা ম্যাকিয়াভেলির চেয়ে কোনো অংশেই কম বাস্তববাদী নয়, বরং অনেক বেশি প্রায়োগিক (Boesche, 2002)।
কৌটিল্যের রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে যান এখানে – কৌটিল্যের কুটিল দর্শন: এক রহস্যময় রাজগুরুর জবানবন্দি
সান জু (Sun Tzu): যুদ্ধের শিল্প, জেতার বিজ্ঞান
কৌটিল্যের প্রায় সমসাময়িক বা কিছুটা আগের আরেকজন প্রাচ্যদেশীয় চিন্তাবিদ হলেন চীনের সান জু। তার লেখা বই ‘দ্য আর্ট অফ ওয়ার’ (The Art of War) আজ হাজার হাজার বছর পরেও বিশ্বের সেরা মিলিটারি একাডেমি থেকে শুরু করে কর্পোরেট বোর্ডরুম পর্যন্ত সবখানে পঠিত হয়।
সান জু সরাসরি রাষ্ট্রের চরিত্র বা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা নিয়ে তত্ত্ব দেননি। কিন্তু তার যুদ্ধ কৌশলের মূলে যে দর্শন রয়েছে, তা নিঃসন্দেহে বাস্তববাদী।
-
যুদ্ধ হলো রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়: সান জু তার বই শুরুই করেছেন এই কথা দিয়ে: “The art of war is of vital importance to the State. It is a matter of life and death, a road either to safety or to ruin.” অর্থাৎ, যুদ্ধ হলো জীবন-মরণের প্রশ্ন, যা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা ধ্বংসের পথ নির্ধারণ করে। তাই একে হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
-
প্রতারণাই যুদ্ধের মূল ভিত্তি (All warfare is based on deception): সান জু মনে করতেন, যুদ্ধক্ষেত্রে শক্তি প্রয়োগের চেয়েও বড় অস্ত্র হলো প্রতারণা। শত্রুকে ধোঁকা দেওয়া, তার মনে বিভ্রান্তি তৈরি করা, তাকে দিয়ে ভুল চাল চালতে বাধ্য করা—এটাই হলো আসল কৌশল। যখন আপনি শক্তিশালী, তখন দুর্বলতার ভান করুন। যখন আক্রমণ করতে যাচ্ছেন, তখন নিষ্ক্রিয় থাকার অভিনয় করুন।
-
যুদ্ধ না করে জয়লাভই সেরা কৌশল: বাস্তববাদীরা যুদ্ধকে রাজনীতির একটি স্বাভাবিক অংশ মনে করলেও, সান জু’র বাস্তববাদ আরও সূক্ষ্ম। তিনি বলেন, “The supreme art of war is to subdue the enemy without fighting.” অর্থাৎ, যুদ্ধ না করেই শত্রুকে বশ মানানোই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ কৌশল। এর জন্য প্রয়োজন নিখুঁত পরিকল্পনা, প্রতিপক্ষের দুর্বলতা জানা এবং মনস্তাত্ত্বিক চাপ (psychological pressure) তৈরি করা। একজন সত্যিকারের দক্ষ সেনাপতি যুদ্ধক্ষেত্রে জেতেন না, তিনি যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই জেতার সমস্ত ব্যবস্থা করে রাখেন।
-
নিজেকে এবং শত্রুকে জানো: তার বিখ্যাত উক্তি, “If you know the enemy and know yourself, you need not fear the result of a hundred battles.” রাষ্ট্রের শক্তি শুধু তার সৈন্য সংখ্যার ওপর নির্ভর করে না, বরং নিজের শক্তি ও দুর্বলতা এবং প্রতিপক্ষের শক্তি ও দুর্বলতা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের ওপর নির্ভর করে।
সান জু-এর দর্শন হলো এক ধরনের হিসেবি বাস্তববাদ (calculated realism)। এখানে আবেগ বা বীরত্বের চেয়ে বড় হলো কৌশল, পরিকল্পনা এবং মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ। লক্ষ্য এখানেও রাষ্ট্রের টিকে থাকা এবং জয়লাভ করা, কিন্তু পথটা কিছুটা ভিন্ন (Giles, 1910)।
ইবনে খালদুন (Ibn Khaldun): ঐক্যের শক্তিতে উত্থান-পতন
এবার চলুন, সময় এবং ভূগোল পাড়ি দিয়ে আমরা চলে যাই চতুর্দশ শতকের উত্তর আফ্রিকায়। সে সময় মুসলিম বিশ্ব রাজনৈতিকভাবে ছিল অস্থিতিশীল। এই প্রেক্ষাপটে তিউনিসিয়ায় জন্ম নেন এক অসাধারণ ঐতিহাসিক ও সমাজবিজ্ঞানী, ইবনে খালদুন। তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘মুকাদ্দিমা’ (The Muqaddimah)-কে আধুনিক ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের অন্যতম ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ইবনে খালদুন সরাসরি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে লেখেননি। কিন্তু তিনি রাষ্ট্রের উত্থান ও পতনের কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এমন এক ধারণার জন্ম দিয়েছেন, যা বাস্তববাদের শক্তি (power) ধারণার এক অনন্য প্রাচ্য সংস্করণ। এই ধারণাটি হলো ‘আসাবিয়া’ (Asabiyyah)।
‘আসাবিয়া’ শব্দটির সঠিক ইংরেজি বা বাংলা অনুবাদ করা কঠিন। এর কাছাকাছি অর্থ হতে পারে ‘সামাজিক সংহতি’, ‘গোষ্ঠী চেতনা’ বা ‘ঐক্যের বন্ধন’ (group solidarity or social cohesion)। ইবনে খালদুনের মতে, একটি রাষ্ট্রের বা রাজবংশের শক্তির মূল উৎস হলো তার জনগণের মধ্যকার এই আসাবিয়া।
-
আসাবিয়ার শক্তি: যখন একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে আসাবিয়া শক্তিশালী থাকে, তখন তারা ঐক্যবদ্ধ থাকে, একে অপরের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত থাকে এবং একটি সাধারণ লক্ষ্যের জন্য কাজ করে। সাধারণত যাযাবর বা মরুবাসী উপজাতিদের মধ্যে এই আসাবিয়া খুব শক্তিশালী থাকে, কারণ কঠিন পরিবেশে টিকে থাকার জন্য তাদের ঐক্যবদ্ধ থাকা ছাড়া উপায় নেই। এই শক্তিশালী আসাবিয়ার জোরেই তারা কোনো পুরনো, বিলাসী এবং দুর্বল হয়ে পড়া রাজবংশকে ক্ষমতাচ্যুত করে নতুন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে।
-
রাষ্ট্রের উত্থান-পতনের চক্র: ইবনে খালদুন দেখিয়েছেন, রাষ্ট্রের একটি জীবনচক্র (life-cycle) আছে। নতুন প্রতিষ্ঠিত রাজবংশের শাসকরা শক্তিশালী আসাবিয়ার অধিকারী হন। কিন্তু প্রজন্মান্তরে, যখন তারা শহরে থিতু হন, বিলাসবহুল জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন, তখন তাদের মধ্যকার আসাবিয়া বা ঐক্যের বাঁধন ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকে। রাষ্ট্র হয়ে পড়ে ভেতর থেকে ফাঁপা। ঠিক তখনই মরুভূমি থেকে নতুন কোনো শক্তিশালী আসাবিয়া সম্পন্ন গোষ্ঠী এসে তাদের হটিয়ে দেয়। এভাবেই চলে রাজবংশের উত্থান-পতনের চক্র।
ইবনে খালদুনের তত্ত্বকে বাস্তববাদের চশমায় দেখলে আমরা কী দেখতে পাই? এখানে ‘আসাবিয়া’ হলো জাতীয় শক্তির (national power) এক অপরিহার্য উপাদান। একটি রাষ্ট্রের সামরিক বা অর্থনৈতিক শক্তি যতই থাকুক না কেন, তার জনগণ যদি ঐক্যবদ্ধ না থাকে, যদি তাদের মধ্যে সামাজিক সংহতি না থাকে, তবে সেই রাষ্ট্র ভেতর থেকেই ভেঙে পড়বে। এটি বাস্তববাদের সেই ধারণাকেই সমর্থন করে যে, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ শক্তিই তার আন্তর্জাতিক আচরণের ভিত্তি তৈরি করে (Khaldun, trans. 2015)।
প্রাচ্য বনাম পাশ্চাত্য: একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ?
কৌটিল্য, সান জু বা ইবনে খালদুনের চিন্তার সাথে পশ্চিমা বাস্তববাদীদের চিন্তার তুলনা করলে কিছু মজার সাদৃশ্য এবং বৈসাদৃশ্য চোখে পড়ে।
সাদৃশ্য:
-
রাষ্ট্রকেন্দ্রিকতা: উভয় ধারাই রাষ্ট্রকে (বা সাম্রাজ্য/রাজবংশ) রাজনীতির মূল কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দেখেছে।
-
টিকে থাকা (Survival): রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষা করা যে শাসকের প্রধান দায়িত্ব, এ বিষয়ে সবাই একমত।
-
শক্তির গুরুত্ব: ক্ষমতা বা শক্তিই যে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূল চালিকাশক্তি, এই ধারণাও সর্বজনীন।
-
নৈতিকতার সীমাবদ্ধতা: ব্যক্তিগত নৈতিকতা এবং রাষ্ট্রীয় নৈতিকতা যে এক নয়, এবং রাষ্ট্রের স্বার্থে অনৈতিক উপায় অবলম্বন করা যেতে পারে—এই শীতল সত্যটি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় ধারার চিন্তাবিদরাই স্বীকার করেছেন।
বৈসাদৃশ্য:
-
তত্ত্ব বনাম প্রয়োগ: পশ্চিমা বাস্তববাদ, বিশেষ করে নয়া-বাস্তববাদ (Neorealism), অনেক বেশি বিমূর্ত এবং তাত্ত্বিক। এটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার কাঠামো নিয়ে আলোচনা করে। অন্যদিকে, প্রাচ্যের বাস্তববাদ (বিশেষ করে কৌটিল্য ও সান জু) অনেক বেশি প্রায়োগিক (prescriptive)। এটি কোনো তত্ত্ব নয়, বরং রাজাকে দেওয়া সুনির্দিষ্ট পরামর্শ বা কর্মতালিকা।
-
অভ্যন্তরীণ বনাম বাহ্যিক: কৌটিল্য এবং ইবনে খালদুন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ শক্তি, শৃঙ্খলা এবং সামাজিক সংহতির ওপর যতটা জোর দিয়েছেন, পশ্চিমা বাস্তববাদীরা (বিশেষত নয়া-বাস্তববাদীরা) ততটা দেননি। তাদের কাছে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ চরিত্র একটি ‘ব্ল্যাক বক্স’।
-
সূক্ষ্মতা: সান জু-এর দর্শনে শক্তি মানে শুধু সামরিক শক্তি নয়, বরং মনস্তাত্ত্বিক শক্তি ও কৌশলের এক অপূর্ব মিশ্রণ। যুদ্ধ না করে জেতার এই ধারণা পশ্চিমা বাস্তববাদে ততটা গুরুত্ব পায়নি।
বাস্তববাদের চশমায় বিশ্ব: কিছু মূল ধারণা
বাস্তববাদকে আরও ভালোভাবে বুঝতে হলে এর কিছু মূল পরিভাষা বা যন্ত্রাংশের সঙ্গে পরিচিত হওয়া জরুরি। এগুলো হলো সেই চশমার কাঁচ, যা দিয়ে বাস্তববাদীরা বিশ্বকে দেখেন।
-
নিরাপত্তা উভয়সংকট (Security Dilemma): এটি বাস্তববাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং ট্র্যাজিক একটি ধারণা। তাত্ত্বিক জন হার্জ এবং রবার্ট জার্ভিস এই ধারণাটিকে জনপ্রিয় করেছেন। ধরুন, রাষ্ট্র ‘ক’ নিজের নিরাপত্তার জন্য কিছু নতুন মিসাইল কিনল। তার কোনো আক্রমণাত্মক উদ্দেশ্য নেই, সে শুধু আত্মরক্ষা করতে চায়। কিন্তু তার প্রতিবেশী রাষ্ট্র ‘খ’ এই সামরিক প্রস্তুতি দেখে আতঙ্কিত হয়ে গেল। সে ভাবল, ‘ক’ হয়তো তাকে আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ফলে, রাষ্ট্র ‘খ’ নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ‘ক’-এর চেয়েও দ্বিগুণ শক্তিশালী মিসাইল ব্যবস্থা তৈরি করল। এটা দেখে রাষ্ট্র ‘ক’ আরও বেশি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে শুরু করল এবং সে তার শক্তি আরও বাড়াল। এভাবেই এক অবিশ্বাস আর ভয়ের দুষ্টচক্র (vicious cycle) শুরু হয়, যেখানে আত্মরক্ষার চেষ্টাই উল্টো সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি করে। স্নায়ুযুদ্ধের সময় আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা ছিল নিরাপত্তা উভয়সংকটের এক ক্লাসিক উদাহরণ।
-
শক্তির ভারসাম্য (Balance of Power): এটি হলো আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার একটি স্বয়ংক্রিয় কৌশল। যখন কোনো একটি রাষ্ট্র বা জোট অতিরিক্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে, তখন অন্যান্য রাষ্ট্রগুলো ভয় পেয়ে তাকে প্রতিহত করার জন্য একজোট হয়। এই জোট গঠনকে বলা হয় ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা (Balancing)। যেমন, নেপোলিয়নের ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ব্রিটেন, রাশিয়া, প্রাশিয়া ও অস্ট্রিয়া একজোট হয়েছিল। অন্যদিকে, আরেকটি কৌশল হলো শক্তিশালী রাষ্ট্রের পক্ষে যোগদান (Bandwagoning)। দুর্বল রাষ্ট্রগুলো অনেক সময় শক্তিশালী আগ্রাসী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে না গিয়ে, তার সঙ্গে যোগ দেয় নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে বা লাভের ভাগ পেতে। বাস্তববাদীরা মনে করেন, রাষ্ট্রগুলো সাধারণত ব্যালেন্সিং বা ভারসাম্য রক্ষা করতেই বেশি পছন্দ করে।
-
আপেক্ষিক লাভ বনাম নিরঙ্কুশ লাভ (Relative Gains vs. Absolute Gains): উদারতাবাদীরা মনে করেন, রাষ্ট্রগুলো পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে সবাই লাভবান হতে পারে (নিরঙ্কুশ লাভ বা Absolute Gains)। যেমন, দুটি দেশ বাণিজ্য চুক্তি করলে উভয়েরই অর্থনৈতিক উন্নতি হতে পারে, তাই চুক্তিটি ভালো। কিন্তু বাস্তববাদীরা বলেন, রাষ্ট্রগুলো শুধু নিজের মোট লাভের কথা ভাবে না। তারা প্রতিপক্ষের সঙ্গে তুলনা করে দেখে যে কে বেশি লাভবান হচ্ছে (আপেঙ্কিক লাভ বা Relative Gains)। যদি কোনো চুক্তিতে শত্রু রাষ্ট্র বেশি লাভবান হয়, তবে একটি রাষ্ট্র কম লাভবান হয়েও সেই চুক্তি করতে রাজি হবে না। কারণ আজ যে অর্থনৈতিক লাভ প্রতিপক্ষকে দেওয়া হচ্ছে, কাল সেটাই সামরিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে নিজের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে। তাদের কাছে প্রশ্নটা শুধু ‘আমি কি লাভবান হচ্ছি?’ নয়, বরং ‘আমার শত্রু কি আমার চেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে?’
বাস্তববাদের সমালোচনা: চশমাটা কি একটু বেশিই কালো?
বাস্তববাদের তত্ত্ব শুনতে যতই যৌক্তিক এবং ইতিহাসের নিরিখে সঠিক মনে হোক, এর কঠোর সমালোচনাও রয়েছে। সমালোচকরা বলেন, বাস্তববাদীরা পৃথিবীকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি অন্ধকার, স্থির এবং সংঘাতময় করে দেখেন। তাদের চশমার কাঁচটা হয়তো একটু বেশিই কালো।
- ১. রাষ্ট্রকেন্দ্রিকতার সীমাবদ্ধতা: বাস্তববাদীরা রাষ্ট্রকেই একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র মনে করেন। কিন্তু আজকের বিশ্বায়নের যুগে বহুজাতিক কর্পোরেশন (MNCs) যেমন—গুগল, অ্যাপল; আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা (NGOs) যেমন—গ্রিনপিস, ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস; এমনকি আল-কায়েদা বা আইসিসের মতো সন্ত্রাসী সংগঠনও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রচণ্ড প্রভাব ফেলে। বাস্তববাদ এদের ভূমিকা সন্তোষজনকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না।
- ২. সহযোগিতার অবমূল্যায়ন: বাস্তববাদীরা সংঘাতের ওপর যতটা জোর দেন, সহযোগিতার ওপর ততটা দেন না। কিন্তু বাস্তবে রাষ্ট্রগুলো প্রতিনিয়ত বাণিজ্য, পরিবেশ রক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, যোগাযোগ, জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়ে একে অপরের সঙ্গে ব্যাপক সহযোগিতা করে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (European Union) এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ, যেখানে একসময়কার কট্টর শত্রু দেশগুলো (ফ্রান্স ও জার্মানি) আজ এক অভিন্ন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ছাতার নিচে এসেছে। উদারতাবাদ (Liberalism) এবং নয়া-উদার প্রাতিষ্ঠানিকতাবাদ (Neoliberal Institutionalism) এই সহযোগিতার দিকটি অনেক ভালোভাবে ব্যাখ্যা করে।
- ৩. অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে উপেক্ষা: বিশেষ করে নয়া-বাস্তববাদীরা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, যেমন—সরকারের ধরন (গণতন্ত্র না একনায়কতন্ত্র), জনমত, বা নেতার ব্যক্তিগত বিশ্বাসকে কোনো গুরুত্বই দেন না। তারা রাষ্ট্রকে একটি অভিন্ন ‘ব্ল্যাক বক্স’ হিসেবে দেখেন। কিন্তু বাস্তবে একটি গণতান্ত্রিক দেশের পররাষ্ট্রনীতি আর একটি একনায়কতান্ত্রিক দেশের পররাষ্ট্রনীতি একরকম হয় না। ‘গণতান্ত্রিক শান্তি তত্ত্ব’ (Democratic Peace Theory) অনুযায়ী, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধ করে না, যা বাস্তববাদের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে।
- ৪. পরিবর্তনকে ব্যাখ্যা করতে অক্ষমতা: বাস্তববাদ স্থিতাবস্থা (Status Quo) ব্যাখ্যা করতে খুব পারদর্শী, কিন্তু বড় ধরনের শান্তিপূর্ণ পরিবর্তন ব্যাখ্যা করতে প্রায়শই ব্যর্থ হয়। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো স্নায়ুযুদ্ধের শান্তিপূর্ণ অবসান এবং কোনো বড় যুদ্ধ ছাড়াই সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন। কোনো বাস্তববাদীই পূর্বানুমান করতে পারেননি যে, একটি মহাশক্তিধর রাষ্ট্র এভাবে ভেঙে পড়বে। গঠনবাদ (Constructivism) তত্ত্বটি এক্ষেত্রে অনেক ভালো ব্যাখ্যা দেয়। তারা বলে যে, গর্বাচেভের মতো নেতার নতুন চিন্তাভাবনা (new ideas) এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পরিচয়ের (identity) পরিবর্তনই এই পতনের জন্য দায়ী।
- ৫. আত্ম-সৃষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী (Self-fulfilling Prophecy): সবচেয়ে শক্তিশালী সমালোচনা হলো, বাস্তববাদ হয়তো একটি তত্ত্ব নয়, বরং একটি প্রেসক্রিপশন যা পৃথিবীকে আরও বিপজ্জনক করে তোলে। যদি সব রাষ্ট্রনেতারাই বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে, পৃথিবীটা এমনই স্বার্থপর, অবিশ্বাস ও সংঘাতময়, তাহলে তারা সেভাবেই আচরণ করবেন। তারা অস্ত্র বাড়াবেন, জোট গড়বেন এবং প্রতিবেশীকে সন্দেহের চোখে দেখবেন। ফলে তাদের এই অবিশ্বাস ও আগ্রাসী নীতিই পৃথিবীকে বাস্তবে আরও সংঘাতময় করে তুলবে। অর্থাৎ, বাস্তববাদ যে অন্ধকার পৃথিবীর কথা বলে, সেই পৃথিবী তৈরিতে বাস্তববাদ নিজেই ভূমিকা রাখে।
আজকের পৃথিবীতে বাস্তববাদ: ফুরিয়ে গেছে, নাকি আগের চেয়েও প্রাসঙ্গিক?
এত সমালোচনা সত্ত্বেও একবিংশ শতাব্দীতে এসে বাস্তববাদকে বাতিল করে দেওয়া প্রায় অসম্ভব। বরং সাম্প্রতিক অনেক ঘটনাই প্রমাণ করে যে, বাস্তববাদের কালো চশমাটা হয়তো এখনও সবচেয়ে কার্যকর।
-
মার্কিন-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা: আমেরিকা এবং চীনের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত ও সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে বাস্তববাদের চশমা দিয়ে খুব সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়। চীনের অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির উত্থান আমেরিকার বৈশ্বিক আধিপত্যকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। এটি যেন থুসিডাইডিসের সেই পুরনো সতর্কবার্তার প্রতিধ্বনি—যা হার্ভার্ডের অধ্যাপক গ্রাহাম অ্যালিসন ‘থুসিডাইডিস ফাঁদ’ (Thucydides Trap) নামে আখ্যায়িত করেছেন। যেখানে একটি উদীয়মান শক্তি (rising power) এবং একটি প্রতিষ্ঠিত শক্তি (established power)-র মধ্যে যুদ্ধ প্রায় অনিবার্য হয়ে ওঠে। দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI) এবং এর বিপরীতে আমেরিকার নেতৃত্বে কোয়াড (The Quad) জোট গঠন—এ সবই যেন শক্তির ভারসাম্য ও আধিপত্যের লড়াইয়ের বাস্তব উদাহরণ।
-
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন: ২০২২ সালে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ বাস্তববাদী যুক্তির এক টেক্সবুক উদাহরণ। জন মিয়ারশাইমারের মতো আক্রমণাত্মক বাস্তববাদীরা যুক্তি দেন, রাশিয়া তার প্রভাব বলয়ে (sphere of influence) ন্যাটোর (NATO) ক্রমাগত পূর্বমুখী সম্প্রসারণকে নিজের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে দেখেছে। জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার নামে একটি সার্বভৌম দেশকে আক্রমণ করা এবং শক্তির মাধ্যমে নিজের স্বার্থ আদায় করার চেষ্টা—এর চেয়ে নিখুঁত বাস্তববাদী আচরণ আর কী হতে পারে?
-
মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় ক্ষমতার লড়াই: মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে ছায়াযুদ্ধ (proxy war), ইয়েমেন ও সিরিয়ায় তাদের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা; বা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও চীনের সীমান্ত সংঘাত এবং ভারত-পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা—এ সবই যেন জাতীয় স্বার্থ, শক্তির ভারসাম্য এবং নিরাপত্তা উভয়সংকটের জীবন্ত উদাহরণ।
বাস্তববাদ হয়তো পুরো চিত্রটা তুলে ধরে না। পৃথিবীতে ভালোবাসা, সহযোগিতা, আদর্শ, নৈতিকতা—এগুলোরও নিঃসন্দেহে স্থান আছে। কিন্তু রাষ্ট্র যখন তার অস্তিত্বের সংকটে পড়ে, যখন তার সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে, তখন এই কঠিন ও নির্মম সত্যগুলোই সামনে চলে আসে।
শেষ কথা
তাহলে এই দীর্ঘ আলোচনার পর বাস্তববাদ আমাদের কী শেখাল? সে শেখাল, আন্তর্জাতিক রাজনীতির মঞ্চটা খুব পিচ্ছিল, এখানে কোনো স্থায়ী আসন নেই। এখানে আবেগের দাম কম, শক্তির দাম অনেক বেশি। এখানে স্থায়ী বন্ধু বা স্থায়ী শত্রু বলে কিছু নেই, আছে শুধু স্থায়ী স্বার্থ (permanent interests)।
বাস্তববাদ আমাদের হতাশ করতে পারে। পড়তে গিয়ে মনে হতে পারে, পৃথিবীতে শান্তি বুঝি কখনোই আসবে না, যুদ্ধ আর সংঘাতই কি মানুষের নিয়তি? কিন্তু হতাশ হওয়ার বদলে আমরা একে একটি সতর্কবার্তা হিসেবেও নিতে পারি। বাস্তববাদ আমাদের শেখায়, কেবল সদিচ্ছা, সুন্দর বক্তৃতা বা আদর্শের বুলি দিয়ে বিশ্বকে বদলানো যায় না। শক্তি ও স্বার্থের এই জটিল খেলাটাকে বুঝতে হয়। বিপদের সম্ভাবনাকে স্বীকার করেই শান্তির পথ খুঁজতে হয়। অবাস্তব স্বপ্ন না দেখে, বাস্তবতার কঠিন জমিতে দাঁড়িয়েই হয়তো একটি তুলনামূলকভাবে ভালো পৃথিবী গড়ার চেষ্টা করা সম্ভব।
পৃথিবীটা হয়তো পুরোপুরি বাস্তববাদীদের বর্ণনার মতো একটি অন্ধকার জঙ্গল নয়, আবার উদারতাবাদীদের কল্পনার মতো আলো ঝলমলে ফুলের বাগানও নয়। সত্যটা হয়তো এর মাঝামাঝি কোথাও লুকিয়ে আছে। তবে সেই মিশ্র সত্যকে খুঁজে বের করার জন্য বাস্তববাদের এই তেতো কিন্তু জরুরি ওষুধটির স্বাদ আমাদের নিতেই হবে। কারণ রঙিন স্বপ্ন দেখার আগেও, শক্ত মাটিতে পা রাখাটা ভীষণ জরুরি। নয় কি?
তথ্যসূত্র
- Boesche, R. (2002). The First Great Political Realist: Kautilya and His Arthashastra. Lexington Books.
- Carr, E. H. (2001). The Twenty Years’ Crisis, 1919-1939: An Introduction to the Study of International Relations. Palgrave Macmillan. (Original work published 1939)
- Giles, L. (Trans.). (1910). Sun Tzu on the Art of War: The Oldest Military Treatise in the World. Luzac & Co.
- Hobbes, T. (2017). Leviathan (C. B. Macpherson, Ed.). Penguin Classics. (Original work published 1651)
- Jervis, R. (1978). Cooperation Under the Security Dilemma. World Politics, 30(2), 167–214.
- Kangle, R. P. (1965). The Kautilīya Arthaśāstra: A Study. Motilal Banarsidass.
- Khaldun, I. (2015). The Muqaddimah: An Introduction to History (F. Rosenthal, Trans.; N. J. Dawood, Ed.). Princeton University Press. (Original work published 1377)
- Machiavelli, N. (1998). The Prince (H. C. Mansfield, Trans.). University of Chicago Press. (Original work published 1532)
- Mearsheimer, J. J. (2001). The Tragedy of Great Power Politics. W. W. Norton & Company.
- Mearsheimer, J. J. (2014). Why the Ukraine Crisis Is the West’s Fault: The Liberal Delusions That Provoked Putin. Foreign Affairs, 93(5), 77–89.
- Morgenthau, H. J. (2006). Politics Among Nations: The Struggle for Power and Peace (7th ed., revised by K. W. Thompson & W. D. Clinton). McGraw-Hill/Irwin. (Original work published 1948)
- Rose, G. (1998). Neoclassical Realism and Theories of Foreign Policy. World Politics, 51(1), 144-172.
- Thucydides. (1972). History of the Peloponnesian War (R. Warner, Trans.). Penguin Classics.
- Waltz, K. N. (1979). Theory of International Politics. Addison-Wesley Publishing Company.
- Wendt, A. (1992). Anarchy is what States Make of it: The Social Construction of Power Politics. International Organization, 46(2), 391-425.
Leave a Reply