Table of Contents
ভূমিকা
মানুষের মন বড়ই অদ্ভুত। তাই না? এই যে আপনি এখন লেখাটি পড়ছেন, আপনার চারপাশে হয়তো পরিচিত দেয়াল, মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে, বাইরে হয়তো ঝুম বৃষ্টি বা কড়া রোদ। কিন্তু আপনি নিরাপদ। অন্তত আপনার এমনটাই মনে হচ্ছে। রাস্তায় বের হলে কেউ আপনাকে আচমকা আক্রমণ করবে না, দোকান থেকে কিছু কিনলে দোকানি আপনার ঘাড়ে চাপাতি বসিয়ে দেবে না—এমন একটা বিশ্বাস আপনার গভীরে কাজ করছে। আমরা প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠি এক প্রকার অলিখিত নিশ্চয়তা নিয়ে। বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে না, অফিসের সহকর্মী আমার চেয়ারটা দখল করে নেবে না, রাতের বেলা বাড়ি ফেরার পথে কেউ আমার সর্বস্ব কেড়ে নেবে না। এই বিশ্বাসগুলো ছাড়া আমাদের একটা দিনও কি চলত?
কখনো কি ভেবে দেখেছেন, এই বিশ্বাসের উৎস কোথায়? কেন আমরা একে অন্যকে অহেতুক খুন করে ফেলি না? কেন একটা সমাজ মোটামুটি নিয়ম মেনে চলে?
এই সহজ, কিন্তু ভয়াবহ প্রশ্নটি নিয়ে ভেবেছিলেন একজন মানুষ। আজ থেকে প্রায় চারশো বছর আগে। মানুষটির নাম টমাস হবস (Thomas Hobbes)। তার জীবনটা আমাদের মতো এতটা শান্ত, নিরাপদ ছিল না। তিনি জন্মেছিলেন ভয়কে সঙ্গী করে। কথিত আছে, স্প্যানিশ আর্মাডার আক্রমণের ভয়ে তার মা সময়ের আগেই তাকে প্রসব করেন। হবস নিজেই কৌতুক করে বলতেন, “আমার মা সেদিন যমজ সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন: আমি এবং ভয়।”
তার জীবন কেটেছিল এক ভয়ংকর সময়ে। ইংল্যান্ড তখন গৃহযুদ্ধের (English Civil War) আগুনে পুড়ছে। ভাই ভাইকে হত্যা করছে, রাজা আর পার্লামেন্টের দ্বন্দ্বে দেশ ছিন্নভিন্ন। রাজা প্রথম চার্লসের শিরশ্ছেদ তিনি দেখেছেন। দেখেছেন কীভাবে ধর্মীয় গোঁড়ামি আর রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা একটি দেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে পারে। চারদিকে শুধু ভয়, অবিশ্বাস আর মৃত্যু। এমন সময়ে জন্মালে, এমন পরিবেশে বেড়ে উঠলে মানুষের ওপর থেকে বিশ্বাস উঠে যাওয়াটা কি খুব অস্বাভাবিক?
হবস ভাবলেন, এই যে বিশৃঙ্খলা, এর কারণটা আসলে কী? মানুষ আসলে কেমন? সে কি স্বভাবতই ভালো, সামাজিক? নাকি সে এক ভয়ানক স্বার্থপর জন্তু, যাকে শুধু আইনের শিকল দিয়ে বেঁধে রাখলেই শান্ত থাকে? তিনি নিছক দর্শনের জন্য দর্শন করেননি। তিনি চেয়েছিলেন রাজনীতির একটি বিজ্ঞান তৈরি করতে। ইউক্লিডের জ্যামিতির মতো অভ্রান্ত, সুনিশ্চিত এক বিজ্ঞান, যা অনুসরণ করলে মানব সমাজকে গৃহযুদ্ধের হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব (Sorell, 1986)।
এই ভাবনা থেকেই জন্ম নিল তার বিখ্যাত, এবং কুখ্যাত, বই ‘লেভিয়াথান’ (Leviathan)। লেভিয়াথান হলো বাইবেলের ‘বুক অফ জব’-এ বর্ণিত এক বিশাল, অপরাজেয় সামুদ্রিক দানব। হবস এই দানবের রূপক ব্যবহার করলেন রাষ্ট্রকে (State) বোঝানোর জন্য। তার মতে, মানুষকে শান্তিতে রাখতে হলে এমনই এক ভয়ংকর শক্তিশালী, প্রায় সর্বশক্তিমান কৃত্রিম দানবের প্রয়োজন।
চলুন, আজ সেই দানবের গল্প শোনা যাক। হবসের চোখে পৃথিবীকে দেখার চেষ্টা করা যাক। ভয় পাবেন না, শেষে হয়তো নতুন কোনো ভাবনা নিয়ে ঘরে ফিরতে পারবেন।
এক দার্শনিকের জন্ম: আগুন, কালি আর ভয়
বড় কোনো শিল্পী বা লেখকের কাজ বুঝতে হলে শুধু তার সৃষ্টিকে দেখলেই চলে না, দেখতে হয় সেই শিল্পীকেও। জানতে হয়, কোন সময়ে তিনি জন্মেছিলেন, কেমন ছিল তার চারপাশটা, কোন মাটির গন্ধ মেখে তিনি বড় হয়েছেন। একটা দুর্দান্ত চিত্রকর্ম যেমন শুধু ক্যানভাসে আঁকা কিছু রঙের সমাহার নয়, তার পেছনে লুকিয়ে থাকে শিল্পীর আনন্দ, বেদনা আর তার সময়ের গল্প, তেমনি একজন দার্শনিকের চিন্তাও শূন্য থেকে জন্মায় না। তার দর্শনের ইট, কাঠ, সুরকি—সবই সংগৃহীত হয় তার চারপাশের পৃথিবী থেকে।
টমাস হবসের (Thomas Hobbes) কথাই ধরুন। তার সেই বিখ্যাত দানব ‘লেভিয়াথান’ (Leviathan) কেন এত ভয়ংকর, এত ক্ষমতাবান? কেন তিনি মানুষকে এতটা অবিশ্বাস করতেন? কেন তার কাছে বিশৃঙ্খলার চেয়ে স্বৈরাচারও শ্রেয় মনে হয়েছিল? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের ডুব দিতে হবে সেই সময়ে, যে আগুনঝরা সময়ে হবস চোখ মেলেছিলেন। আমাদের দেখতে হবে, কোন রাজনৈতিক আগুন তার চিন্তাকে পুড়িয়ে খাঁটি করেছিল আর কোন পূর্বসূরীদের কালি দিয়ে তিনি লিখেছিলেন তার দর্শনের অমোঘ বাণী।
চলুন, সেই গল্পে ফেরা যাক। যে গল্প এক দার্শনিকের জন্ম এবং তার ভয়ংকর সুন্দর সৃষ্টির পেছনের গল্প।
ইংল্যান্ডের আগুন: যে রাজনৈতিক চুল্লিতে দর্শন গলেছিল
ভাবুন তো একবার, আপনি এমন এক দেশে বাস করছেন যেখানে রাজা আর প্রজার মধ্যে কোনো বিশ্বাস নেই। যেখানে ভাইয়ের বুকে ভাই ছুরি বসাচ্ছে ধর্মের নামে, ক্ষমতার লোভে। যেখানে আজ যে রাজা, কাল তার ছিন্ন মস্তক গড়াগড়ি খাচ্ছে রাস্তার ধুলোয়। এটাই ছিল সপ্তদশ শতাব্দীর ইংল্যান্ড। টমাস হবসের ইংল্যান্ড। এই সময়টাকেই তার দর্শনের প্রধান সূতিকাগার বলা চলে।
গৃহযুদ্ধ এবং রাজার শিরশ্ছেদ
হবসের জীবনের সবচেয়ে প্রভাবশালী ঘটনা নিঃসন্দেহে ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধ (English Civil War, 1642-1651)। এই যুদ্ধ ছিল মূলত রাজা প্রথম চার্লস (King Charles I) এবং পার্লামেন্টের মধ্যে ক্ষমতার চূড়ান্ত লড়াই। রাজা বিশ্বাস করতেন ‘রাজাদের স্বর্গীয় অধিকারে’ (Divine Right of Kings), অর্থাৎ ঈশ্বর তাকে শাসন করার ক্ষমতা দিয়েছেন এবং তিনি কেবল ঈশ্বরের কাছেই জবাবদিহি করতে বাধ্য, কোনো মানুষের তৈরি পার্লামেন্টের কাছে নন। অন্যদিকে, পার্লামেন্ট নিজেদের জনগণের (বিশেষত ভূস্বামী এবং উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেণীর) প্রতিনিধি হিসেবে দাবি করে বলছিল, কর আরোপ বা আইন তৈরির মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তাদের হাতেই থাকা উচিত।
এই দ্বন্দ্বই শেষ পর্যন্ত দেশকে এক রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। হবস এই পুরো সময়টা খুব কাছ থেকে দেখেছেন। তিনি দেখেছেন কীভাবে একটি স্থিতিশীল সমাজ চোখের পলকে ভেঙে পড়তে পারে। কীভাবে আইন, শৃঙ্খলা, নৈতিকতা—সবকিছু অর্থহীন হয়ে যায় যখন সর্বোচ্চ ক্ষমতার উৎস নিয়েই বিরোধ তৈরি হয়। তার কাছে এই গৃহযুদ্ধ ছিল ‘প্রকৃতির রাজ্যে’ (State of Nature) ফিরে যাওয়ার এক বাস্তব উদাহরণ, যেখানে ‘সকলের বিরুদ্ধে সকলের যুদ্ধ’ (War of every man against every man) ছাড়া আর কিছুই নেই (Skinner, 2008)।
১৬৪৯ সালে রাজা প্রথম চার্লসের প্রকাশ্য শিরশ্ছেদ ছিল এক অভূতপূর্ব ঘটনা। এটি প্রমাণ করে দিয়েছিল যে, শাসকের ক্ষমতা আর পবিত্র বা অলঙ্ঘনীয় নয়। জনগণ চাইলে সেই ক্ষমতা কেড়ে নিতে পারে, এমনকি শাসকের জীবনও। এই ঘটনা হবসের মনে গভীর দাগ কেটেছিল। তিনি বুঝেছিলেন, সার্বভৌম ক্ষমতা (Sovereignty) যদি দুর্বল হয় বা বিভক্ত হয়ে যায়, তার পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে। তার লেভিয়াথান দর্শনের মূল উদ্দেশ্যই ছিল এমন একটি অবিভাজ্য ও পরম সার্বভৌম ক্ষমতার ভিত্তি তৈরি করা, যা দেশকে এ ধরনের গৃহযুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।
ধর্মীয় সংঘাত এবং বিভেদ
ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধের পেছনে শুধু রাজনৈতিক কারণই ছিল না, ছিল গভীর ধর্মীয় বিভেদ। অ্যাংলিকান (Anglicans), পিউরিটান (Puritans) এবং ক্যাথলিকদের (Catholics) মধ্যেকার দ্বন্দ্ব ছিল চরমে। প্রত্যেকেই দাবি করত, তারাই ঈশ্বরের বাণীর সঠিক ব্যাখ্যাকারী। এই ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো প্রায়ই রাষ্ট্রের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করত এবং নিজেদের ধর্মীয় নেতাদের आदेशকেই চূড়ান্ত বলে মানত।
হবস দেখেছিলেন, ধর্ম কীভাবে ঐক্যের বদলে বিভেদ তৈরি করছে এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্ম দিচ্ছে। তিনি বুঝেছিলেন, যদি রাষ্ট্রে দুই মাথা থাকে—একদিকে জাগতিক শাসক (Temporal Sovereign) আর অন্যদিকে আধ্যাত্মিক শাসক (Spiritual Sovereign)—তাহলে সংঘাত অনিবার্য। মানুষ দ্বিধায় পড়ে যাবে, কার আদেশ মানবে? রাজার নাকি পোপের/চার্চের? এই সমস্যা সমাধানের জন্যই হবস তার ‘লেভিয়াথান’-এ প্রস্তাব করেন যে, রাষ্ট্রের সার্বভৌম শাসকই হবেন চার্চের প্রধান। ধর্মীয় সব বিষয় জাগতিক শাসকের অধীনে থাকবে, যাতে ধর্মকে রাজনৈতিক বিভেদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা না যায় (Martinich, 1992)।
ইউরোপের ত্রিশ বছরের যুদ্ধ (Thirty Years’ War)
শুধু ইংল্যান্ড নয়, হবসের সময়ে পুরো ইউরোপই ছিল উত্তাল। ১৬১৮ থেকে ১৬৪৮ সাল পর্যন্ত চলা ত্রিশ বছরের যুদ্ধ ছিল এক ধ্বংসাত্মক মহাযজ্ঞ, যা মূলত ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যে শুরু হলেও পরে এক ভয়ংকর রাজনৈতিক রূপ নেয়। এই যুদ্ধ ইউরোপের জনসংখ্যাকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছিল। হবস যখন ইউরোপ ভ্রমণ করছিলেন, তিনি এই যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং এর ফলে সৃষ্ট অরাজকতা সম্পর্কে অবগত ছিলেন। এটি তার এই বিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করেছিল যে, মানুষের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো শান্তি ও নিরাপত্তা, যা কেবল একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষই দিতে পারে।
চিন্তার কারিগর: যে দার্শনিকদের ছাঁচে হবস নিজেকে গড়েছেন (এবং ভেঙেছেন)
হবস কেবল তার সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দিয়েই প্রভাবিত হননি, তিনি গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছিলেন পূর্ববর্তী এবং সমসাময়িক দার্শনিকদের কাজ। তবে তিনি অন্ধভাবে কাউকে অনুসরণ করেননি। কারও কাছ থেকে নিয়েছেন ভিত্তি, আবার কাউকে প্রত্যাখ্যান করেই তৈরি করেছেন নিজের পথের দিশা।
প্রাচীন গ্রিকদের প্রত্যাখ্যান
রাজনৈতিক দর্শনের কথা উঠলেই আমাদের চোখে ভাসে প্লেটো আর অ্যারিস্টটলের মুখ। অ্যারিস্টটল (Aristotle) বলেছিলেন, মানুষ স্বভাবতই এক ‘রাজনৈতিক প্রাণী’ (Zoon Politikon বা Political Animal)। অর্থাৎ, মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই সমাজবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্রে বাস করতে চায়। রাষ্ট্র হলো একটি স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠান।
হবস এই ধারণাকে সজোরে প্রত্যাখ্যান করলেন। তার কাছে মানুষ মোটেও সামাজিক প্রাণী নয়, বরং চূড়ান্তভাবে আত্মস্বার্থকেন্দ্রিক। আমরা সমাজ গঠন করি বাধ্য হয়ে, ভালোবাসার টানে নয়, বরং মৃত্যুর ভয়ে। রাষ্ট্র কোনো স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠান নয়, এটি একটি কৃত্রিম সৃষ্টি (Artificial Creation), একটি যন্ত্র যা আমরা তৈরি করেছি প্রকৃতির রাজ্যের ভয়াবহতা থেকে বাঁচার জন্য। অ্যারিস্টটলের এই প্রত্যাখ্যানই ছিল হবসের দর্শনের অন্যতম মৌলিক একটি ধাপ (Strauss, 1952)।
থুসিডাইডিসের বাস্তববাদ
হবস তার যৌবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিলেন—তিনি গ্রিক ইতিহাসবিদ থুসিডাইডিসের (Thucydides) লেখা ‘পেলোপনেশীয় যুদ্ধের ইতিহাস’ (History of the Peloponnesian War) ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেন। এই কাজটি তার চিন্তায় গভীর প্রভাব ফেলেছিল। থুসিডাইডিস কোনো আদর্শ বা নৈতিকতার মাপকাঠিতে ইতিহাস লেখেননি। তিনি দেখিয়েছিলেন, রাষ্ট্রগুলো কীভাবে ভয় (Fear), সম্মান (Honor) এবং স্বার্থের (Interest) দ্বারা চালিত হয়। তিনি দেখিয়েছিলেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে শক্তির ভাষাই শেষ কথা। থুসিডাইডিসের এই নির্মোহ, বাস্তববাদী (Realist) দৃষ্টিভঙ্গি হবসের রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিল। মানুষ এবং রাষ্ট্র যে মূলত আত্মস্বার্থ দ্বারা চালিত হয়, এই ধারণা তিনি থুসিডাইডিসের কাছ থেকেই পেয়েছিলেন (Tuck, 1989)।
নতুন বিজ্ঞানের বিপ্লব
হবসের সময়টা ছিল ইউরোপে বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের (Scientific Revolution) সময়। কোপার্নিকাস, কেপলার এবং বিশেষ করে গ্যালিলিও গ্যালিলেই (Galileo Galilei) বিশ্বকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিই পাল্টে দিচ্ছিলেন। হবস ইতালি ভ্রমণের সময় গ্যালিলিওর সাথে দেখাও করেছিলেন। গ্যালিলিওর দর্শন ছিল বস্তুবাদী (Materialist) এবং যান্ত্রিক (Mechanistic)। তার মতে, এই মহাবিশ্ব আর কিছুই নয়, কেবল বস্তু (Matter) এবং তার গতি (Motion)।
হবস এই ধারণা দ্বারা মন্ত্রমুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি ভাবলেন, যদি গ্রহ-নক্ষত্র গতির নিয়মে চলে, তাহলে মানুষ, সমাজ এবং রাষ্ট্র কেন চলবে না? তিনি মানব মনকে এক জটিল যন্ত্র হিসেবে দেখতে শুরু করলেন, যার সব অনুভূতি—ভালোবাসা, ঘৃণা, ভয়—হলো হৃদপিণ্ডের দিকে বা তার থেকে দূরে সরে যাওয়ার সূক্ষ্ম গতি (Appetite and Aversion)। তিনি চাইলেন রাজনীতির একটি জ্যামিতিক বিজ্ঞান (Geometrical Science) তৈরি করতে। যেমন করে ইউক্লিড (Euclid) কয়েকটি স্বতঃসিদ্ধ (Axioms) থেকে পুরো জ্যামিতি প্রমাণ করেন, তেমনি হবসও মানুষের স্বার্থপর প্রকৃতিকে স্বতঃসিদ্ধ ধরে নিয়ে সেখান থেকে ধাপে ধাপে একটি স্থিতিশীল রাষ্ট্রের যৌক্তিক প্রয়োজনীয়তা প্রমাণ করতে চাইলেন। এই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহারের প্রচেষ্টা তাকে মধ্যযুগীয় দর্শন থেকে পুরোপুরি আলাদা করে দিয়েছে (Sorell, 1986)।
ম্যাকিয়াভেলির পথ ধরে
যদিও হবস সরাসরি নিকোলো ম্যাকিয়াভেলির (Niccolò Machiavelli) নাম খুব বেশি উল্লেখ করেননি, কিন্তু তার দর্শনে ম্যাকিয়াভেলির ছায়া স্পষ্ট। ম্যাকিয়াভেলিই প্রথম আধুনিক চিন্তাবিদ যিনি রাজনীতিকে ধর্ম ও নৈতিকতা থেকে আলাদা করেছিলেন। তিনি তার বিখ্যাত বই ‘দ্য প্রিন্স’-এ বলেছিলেন, শাসকের মূল লক্ষ্য হলো ক্ষমতা ধরে রাখা এবং রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা রক্ষা করা। এই লক্ষ্য পূরণের জন্য প্রয়োজনে তাকে নিষ্ঠুর হতে হবে, প্রতারণার আশ্রয় নিতে হবে। কারণ মানুষেরা অকৃতজ্ঞ, ভীরু এবং স্বার্থপর। ম্যাকিয়াভেলির এই মানব প্রকৃতি সম্পর্কিত হতাশাব্যঞ্জক ধারণা এবং রাজনীতির নির্মোহ বিশ্লেষণ হবসের চিন্তার সাথে মিলে যায়। ভয় যে ভালোবাসার চেয়ে শক্তিশালী শাসনযন্ত্র, এই ম্যাকিয়াভেলীয় ধারণাকেই হবস তার দর্শনের কেন্দ্রে নিয়ে এসেছেন।
জঁ বোঁদার সার্বভৌমত্ব
ফরাসি আইনবিদ জঁ বোঁদা (Jean Bodin) ছিলেন আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, যিনি হবসের চিন্তাকে প্রভাবিত করেছিলেন। ফ্রান্সের ধর্মীয় গৃহযুদ্ধের (French Wars of Religion) প্রেক্ষাপটে বোঁদা প্রথম সার্বভৌমত্বের (Sovereignty) একটি আধুনিক ও সুসংহত ধারণা দেন। তিনি বলেন, একটি রাষ্ট্রে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য অবশ্যই একটি চূড়ান্ত, পরম (Absolute) এবং অবিভাজ্য (Indivisible) ক্ষমতার উৎস থাকতে হবে। এই ক্ষমতাই হলো সার্বভৌমত্ব।
হবস বোঁদার কাছ থেকে এই সার্বভৌমত্বের ধারণাটি গ্রহণ করেন এবং একে আরও ধারালো করে তোলেন। বোঁদা যেখানে সার্বভৌমত্বের আইনি দিকটি নিয়ে বেশি আগ্রহী ছিলেন, হবস সেখানে এর একটি দার্শনিক ভিত্তি তৈরি করেন। তিনি দেখান, কেন সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে জনগণ তাদের সমস্ত অধিকার এমন একজন পরম শাসকের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়। বোঁদা সার্বভৌমত্বের কাঠামোটি দিয়েছিলেন, হবস তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন (Skinner, 1996)।
আঁধার থেকেই আলোর জন্ম
তাহলে দেখা যাচ্ছে, টমাস হবসের দর্শন কোনো নিভৃতচারী দার্শনিকের অলস মস্তিষ্কের ফসল নয়। এটি ছিল এক রক্তাক্ত সময়ের আর উত্তাল চিন্তার জগতের সন্তান। একদিকে গৃহযুদ্ধের আগুন, রাজার ছিন্ন মস্তক আর ধর্মীয় হানাহানি তাকে দেখিয়েছিল বিশৃঙ্খলার ভয়াবহ রূপ। অন্যদিকে, থুসিডাইডিসের বাস্তববাদ, গ্যালিলিওর বিজ্ঞান আর বোঁদার সার্বভৌমত্বের ধারণা তার হাতে তুলে দিয়েছিল সেই বিশৃঙ্খলা থেকে মুক্তির নকশা তৈরির উপচার।
তিনি ছিলেন এক ভীত মানুষ। কিন্তু তার ভয় ব্যক্তিগত ছিল না। তার ভয় ছিল পুরো মানব সমাজকে নিয়ে। তিনি ভয় পেতেন সেই আদিম অন্ধকারে ফিরে যাওয়ার, যেখানে সভ্যতা, জ্ঞান, শিল্পের কোনো স্থান নেই। তার লেভিয়াথান সেই অন্ধকারের বিরুদ্ধে একটি দেয়াল। হ্যাঁ, সেই দেয়ালের ভেতরে হয়তো স্বাধীনতার বাতাস কিছুটা কম, আকাশটাও হয়তো ছোট দেখায়। কিন্তু দেয়ালের ওপারে যে নিশ্চিত মৃত্যু ওঁত পেতে আছে! হবসের কাছে এই দেয়ালটিই ছিল মানবজাতির জন্য সবচেয়ে বড় উপহার।
তার দর্শন কোনো লাইব্রেরির শান্ত, ধুলোমাখা শেলফে জন্ম নেয়নি। এর জন্ম হয়েছিল কামানের গর্জনে, তরবারির ঝনঝনানিতে আর মানুষের আর্তনাদে। আর তাই, চারশো বছর পরেও যখন কোনো দেশ গৃহযুদ্ধের আগুনে পোড়ে, যখন রাষ্ট্র ভেঙে পড়ে, তখন আমাদের টমাস হবসের কথাই মনে পড়ে। কারণ তিনি ভয়ের মনস্তত্ত্বকে যতটা গভীরভাবে বুঝেছিলেন, তেমনটা হয়তো আর কেউই বোঝেননি।
যেখান থেকে গল্পের শুরু: মানব প্রকৃতি (Human Nature) ও বস্তুবাদী দর্শন
যেকোনো রাজনৈতিক দর্শন বুঝতে হলে প্রথমে বুঝতে হয় সেই দার্শনিকের চোখে মানুষ আসলে কী। প্লেটো বা অ্যারিস্টটলের মতো হবস মানুষকে কোনো মহৎ উদ্দেশ্যে সৃষ্ট প্রাণী হিসেবে দেখেননি। তার কাছে মানুষ কোনো আত্মা বা ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গের ধারক নয়। বরং মানুষ, তথা সমগ্র বিশ্বজগৎ, বস্তু (Matter) আর গতি (Motion) দিয়ে তৈরি। এই হলো তার বস্তুবাদী (Materialist) দর্শন। তিনি ছিলেন তার সময়ের নতুন বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত, বিশেষ করে গ্যালিলিওর কাজ দ্বারা। যদি গ্রহ-নক্ষত্র গতির নিয়মে চলে, তাহলে মানুষ কেন নয়?
তার মতে, আমরা সবাই জটিল এক যন্ত্রের মতো, যা কিছু মৌলিক আবেগ আর ইচ্ছা দিয়ে চালিত হয়। এই যন্ত্রের নাম মানবদেহ। আর এর সব কার্যকলাপই হলো বিভিন্ন ধরনের গতি। বাইরের কোনো বস্তু যখন আমাদের ইন্দ্রিয়কে প্রভাবিত করে, তখন এক ধরনের গতির সৃষ্টি হয়। এই গতি মস্তিষ্কে ও হৃদপিণ্ডে পৌঁছে যে প্রতিক্রিয়া তৈরি করে, তা-ই হলো আমাদের অনুভূতি বা সংবেদন (Sensation)। আর সেই সংবেদনের রেশ যখন মিলিয়ে যেতে থাকে, তাকেই তিনি বলেছেন কল্পনা (Imagination) বা স্মৃতি (Memory)।
এই যান্ত্রিক মানবের মূল চালিকাশক্তি দুটি—কোনো কিছুর দিকে এগিয়ে যাওয়ার অভ্যন্তরীণ গতি, যাকে তিনি বলেছেন ‘আকর্ষণ’ বা ‘আকাঙ্ক্ষা’ (Appetite or Desire), আর কোনো কিছু থেকে দূরে সরে যাওয়ার অভ্যন্তরীণ গতি, যাকে তিনি বলেছেন ‘বিকর্ষণ’ বা ‘বিরাগ’ (Aversion)।
আমাদের যা ভালো লাগে, যা আমরা পেতে চাই, যা আমাদের জীবন ধারণে সহায়তা করে, তার দিকে আমাদের আকর্ষণ কাজ করে। আর যা আমাদের অপছন্দ, যা থেকে আমরা বাঁচতে চাই, যা আমাদের জন্য ক্ষতিকর, তার প্রতি কাজ করে বিকর্ষণ। ‘ভালো’ (Good) আর ‘মন্দ’ (Evil)—এই শব্দ দুটোর কোনো চিরন্তন বা স্বর্গীয় অর্থ নেই। এগুলো আপেক্ষিক। আমি যা চাই, তা-ই আমার কাছে ‘ভালো’। আমি যা এড়াতে চাই, তা-ই আমার কাছে ‘মন্দ’। আপনার ভালো আর আমার ভালো এক নাও হতে পারে। আপনার কাছে যা অমৃত, আমার কাছে তা বিষ মনে হতেই পারে। এখানেই শুরু হয় আসল গোলমাল (Tuck, 1996)।
হবস বলছেন, মানুষের প্রধান এবং সবচেয়ে মৌলিক ইচ্ছা হলো ‘অনাবিল সুখ’ (Felicity) অর্জন করা। কিন্তু এই সুখ মানে কী? কোনো একটা জিনিস পেয়ে শান্ত হয়ে বসে থাকা? পুকুরের স্থির পানির মতো জীবন? হবস বললেন, না। মানুষের জীবন নদীর স্রোতের মতো। বেঁচে থাকা মানেই আকাঙ্ক্ষা করা। মানুষের সুখ হলো এক ইচ্ছা পূরণ হওয়ার পর নতুন আরেক ইচ্ছার জন্ম হওয়া এবং তা পূরণের পথে এগিয়ে যাওয়া। আমাদের আকাঙ্ক্ষার কোনো শেষ নেই। একটা পেলেই আরেকটা চাই।
এর কারণ, আমরা শুধু বর্তমানের সুখ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকি না, ভবিষ্যতের সুখও নিশ্চিত করতে চাই। আর ভবিষ্যতের সুখ নিশ্চিত করার জন্য আমাদের কী দরকার? ক্ষমতা (Power)।
ক্ষমতা হলো ভবিষ্যতের ভালো জিনিসগুলো পাওয়ার একটা উপায় বা মাধ্যম (Present means to obtain some future apparent Good)। টাকা, খ্যাতি, বন্ধু, জ্ঞান, দৈহিক শক্তি—এ সবই ক্ষমতার ভিন্ন ভিন্ন রূপ। আর এখানেই হবসের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং ভয়ংকর উক্তিটি চলে আসে: মানুষের ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা এতই তীব্র যে এর শেষ হয় কেবল মৃত্যুতে।
“So that in the first place, I put for a general inclination of all mankind, a perpetual and restless desire of power after power, that ceaseth only in death.” (Hobbes, 1651/1994, Chapter XI)
ভাবুন তো একবার! আমরা সবাই আসলে ক্ষমতার পেছনে ছুটছি। অবিরাম, ক্লান্তিহীনভাবে। এই আকাঙ্ক্ষা কোনো নৈতিকভাবে খারাপ বিষয় নয়; এটা আমাদের যান্ত্রিক প্রকৃতিরই একটি অংশ। বেঁচে থাকার জন্যই আমাদের ক্ষমতা দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো, এই দৌড়ে আমরা সবাই মোটামুটি সমান।
সবাই সমান, তাই বিপদও সমান
হবস বললেন, প্রকৃতি আমাদের সবাইকে শারীরিক এবং মানসিক শক্তিতে প্রায় সমান করে তৈরি করেছে। শুনতে অদ্ভুত লাগতে পারে। রাস্তায় আমরা তো কত ভিন্ন ভিন্ন শক্তির মানুষ দেখি। কিন্তু হবস বলছেন, গভীরভাবে ভাবলে এই সমতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। হয়তো একজন দৈহিক শক্তিতে বেশি, কিন্তু আরেকজন বুদ্ধিতে বা গোপন কৌশলে তাকে হারিয়ে দিতে পারে। সবচেয়ে দুর্বল মানুষটিও ঘুমের মধ্যে বা কোনো ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষটিকে মেরে ফেলার ক্ষমতা রাখে।
মানসিক শক্তির ক্ষেত্রেও আমরা আরও বেশি সমান। জ্ঞান বা কলার ক্ষেত্রে পার্থক্য থাকলেও, প্রজ্ঞা (Prudence) বা প্রাত্যহিক বুদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে সবাই সমান সুযোগ পায়। কারণ প্রজ্ঞা আসে অভিজ্ঞতা থেকে, আর সব মানুষই কমবেশি অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যায়। প্রত্যেকেই নিজের বুদ্ধিকে সেরা মনে করে, যা থেকে বোঝা যায় যে বুদ্ধিটা আসলে সমানভাবেই বণ্টিত হয়েছে।
এই যে মৌলিক সমতা (Equality), এটাই সবচেয়ে বড় ভয়ের কারণ। কেন? কারণ সমতা থেকে জন্ম নেয় আশার সমতা (Equality of hope)। যেহেতু আমরা সবাই সমান, তাই আমরা একই জিনিস পাওয়ার আশাও করতে পারি। আর এখান থেকেই শুরু হয় সংঘাত।
হবস তিনটি প্রধান কারণে মানুষের মধ্যে ঝগড়া বা যুদ্ধ বাধে বলে চিহ্নিত করেছেন (Hobbes, 1651/1994, Chapter XIII):
১. প্রতিযোগিতা (Competition): লাভের জন্য। দুজন মানুষ যদি একই জিনিস চায়—এক টুকরো জমি, একটি হরিণ, বা কোনো সম্মান—যা তারা দুজনেই একসঙ্গে পেতে পারে না, তখন তারা একে অপরের শত্রু হয়ে ওঠে। তারা চেষ্টা করে একে অপরকে ধ্বংস করতে অথবা নিজের অধীনে আনতে।
২. পারস্পরিক অবিশ্বাস (Diffidence): নিরাপত্তার জন্য। যেহেতু আমি জানি যে অন্যরাও আমার মতো ক্ষমতালোভী এবং আমরা একই জিনিস চাইতে পারি, তাই আমি কাউকেই বিশ্বাস করতে পারি না। আমি সারাক্ষণ ভয়ে থাকি, কখন কে আমাকে আক্রমণ করে আমার সবকিছু কেড়ে নেবে। তাই আত্মরক্ষার (Self-preservation) সবচেয়ে ভালো উপায় কী? আগ বাড়িয়ে আক্রমণ করা (Anticipation)! অন্য কেউ আমাকে আঘাত করার আগেই আমি তাকে আঘাত করে দুর্বল করে দেব। এটা কোনো হিংস্রতা নয়, এটা একটা যুক্তিসঙ্গত কৌশল।
৩. গৌরব (Glory): খ্যাতির জন্য। মানুষ শুধু লাভ বা নিরাপত্তার জন্যই ঝগড়া করে না, খ্যাতির জন্যও করে। তাকে কেউ সামান্য অবজ্ঞা করলে, তার দিকে বাঁকা চোখে তাকালে, বা তার পরিবার, বন্ধু বা দেশের নামে কোনো অসম্মানজনক কথা বললেই সে ক্ষেপে ওঠে। সে চায় সবাই তাকে সমীহ করে চলুক, তার শ্রেষ্ঠত্বকে স্বীকার করুক।
এই সমতা, এই পারস্পরিক অবিশ্বাস, আর গৌরব অর্জনের আকাঙ্ক্ষা—এই তিনটি জিনিস মিলে তৈরি করে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। হবস যার নাম দিয়েছেন ‘সকলের বিরুদ্ধে সকলের যুদ্ধ’ (War of every man against every man)।
প্রকৃতির রাজ্য: এক দুঃস্বপ্নের নাম (The State of Nature)
আসুন, একটা চিন্তা পরীক্ষা (Thought Experiment) করা যাক। এই ধরনের পরীক্ষা দার্শনিকরা প্রায়ই করেন। কল্পনা করুন, এমন একটা পৃথিবী যেখানে কোনো সরকার নেই, পুলিশ নেই, আইন নেই, আদালত নেই। কোনো সাধারণ ক্ষমতা নেই যা সবাইকে ভয়ে শান্ত করে রাখবে। কিছুই নেই। প্রত্যেকে নিজের ইচ্ছামতো চলার জন্য স্বাধীন। কেমন হবে সেই পৃথিবী? স্বর্গের মতো শান্তিময়? যেখানে মানুষ তার আসল রূপে বিকশিত হবে?
ফরাসি দার্শনিক জঁ-জাক রুশো (Jean-Jacques Rousseau) হয়তো বলতেন, হ্যাঁ, মানুষ সেখানে ‘noble savage’ বা মহৎ অসভ্য হিসেবে শান্তিতেই থাকবে। কিন্তু হবস মুচকি হেসে বলবেন, একদমই না। ওটা হবে নরক।
এই আইনবিহীন, রাষ্ট্রবিহীন অবস্থাকেই হবস বলেছেন ‘প্রকৃতির রাজ্য’ (State of Nature)। তার বিখ্যাত বর্ণনা অনুযায়ী, এই অবস্থায় মানুষের জীবন হবে:
“Solitary, poor, nasty, brutish, and short.” (Hobbes, 1651/1994, Chapter XIII)
অর্থাৎ, “একাকী, দীন, নোংরা, পাশবিক এবং ক্ষণস্থায়ী।”
আসুন, এই শব্দগুলোর তাৎপর্য বোঝার চেষ্টা করি।
-
একাকী (Solitary): এই রাজ্যে কোনো সত্যিকারের সমাজ নেই। কারণ কাউকেই বিশ্বাস করা যায় না। যে কেউ হতে পারে আপনার শত্রু। তাই কোনো বন্ধুত্ব, ভালোবাসা বা সহযোগিতার স্থান সেখানে নেই। মানুষ একা, দ্বীপের মতো।
-
দীন (Poor): এখানে কোনো শিল্প (Industry), নৌ-চলাচল (Navigation), বাণিজ্য (Commerce), বা কৃষির (Agriculture) বিকাশ হবে না। কারণ এগুলোর ফল ভোগ করার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আপনি যা-ই উৎপাদন করবেন, অন্য কেউ এসে তা কেড়ে নিতে পারে। তাই কষ্ট করে কিছু করার কোনো প্রণোদনা কাজ করে না।
-
নোংরা (Nasty): জীবন হবে অপরিশীলিত, অপরিচ্ছন্ন। কোনো সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, বা আরামদায়ক জীবনের চিহ্নমাত্র থাকবে না।
-
পাশবিক (Brutish): মানুষের আচরণ হবে পশুর মতো। এখানে নৈতিকতার কোনো স্থান নেই।
-
ক্ষণস্থায়ী (Short): সবচেয়ে ভয়াবহ হলো, জীবন হবে ক্ষণস্থায়ী। কারণ সারাক্ষণই হিংস্র মৃত্যুর ভয় (Continual fear and danger of violent death) তাড়া করে ফিরবে।
এই অবস্থায় ন্যায় (Justice) বা অন্যায় (Injustice) বলেও কিছু নেই। যেখানে কোনো সাধারণ আইন নেই, সেখানে অন্যায় কীসের? চুরি, ডাকাতি, খুন—এগুলো কোনো নৈতিক অপরাধ নয়, এগুলো কেবল টিকে থাকার কৌশল। আপনার যা কিছু কেড়ে নেওয়ার শক্তি আছে, তা-ই আপনার। যতক্ষণ আপনি তা রক্ষা করতে পারেন, ততক্ষণই। প্রকৃতির রাজ্যে প্রত্যেকেরই সবকিছুর ওপর অধিকার আছে (Right to everything), এমনকি অন্যের শরীরের ওপরেও।
হবসের এই ‘প্রকৃতির রাজ্য’ কি প্রাগৈতিহাসিক সমাজে সত্যি সত্যি ছিল? হবস নিজেও হয়তো তা মনে করতেন না যে সারা পৃথিবী একসময় এই অবস্থায় ছিল। এটা একটা যুক্তির খেলা, একটি বিশ্লেষণাত্মক কাঠামো। তিনি দেখাতে চেয়েছেন, রাষ্ট্র না থাকলে আমাদের কী অবস্থা হতো বা হবে। তবে তিনি এর বাস্তব উদাহরণও দিয়েছেন। যেমন, আমেরিকার আদিবাসী সমাজ (তার সময়ের ইউরোপীয়দের চোখে), বা সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো গৃহযুদ্ধ, যখন একটি দেশের রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ভেঙে পড়ে এবং দেশটি কার্যত প্রকৃতির রাজ্যে ফিরে যায় (Malcolm, 2002)। আজকের দিনেও আমরা এর উদাহরণ দেখতে পাই সোমালিয়ার মতো ব্যর্থ রাষ্ট্রে (Failed States) বা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে, যেখানে এক রাষ্ট্র আরেক রাষ্ট্রের ওপর সার্বভৌম কোনো কর্তৃপক্ষ মানে না এবং সবাই নিজের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত।
বাঁচার উপায় কী? প্রাকৃতিক আইন ও সামাজিক চুক্তি (The Laws of Nature and the Social Contract)
এই দুঃস্বপ্ন থেকে কি মুক্তির কোনো পথ নেই? মানুষ কি চিরকাল এই পাশবিক অবস্থায় থাকতে বাধ্য? হবস বললেন, আছে। মুক্তির পথ দেখায় মানুষের দুটি জিনিস: তার আবেগ (Passion) এবং তার যুক্তি (Reason)।
প্রধান যে আবেগটি মানুষকে শান্তির দিকে ঠেলে দেয়, তা হলো মৃত্যুর ভয় (Fear of Death), বিশেষ করে হিংস্র মৃত্যুর ভয়। এর সাথে যোগ হয় একটি আরামদায়ক জীবনের আকাঙ্ক্ষা এবং পরিশ্রমের মাধ্যমে তা অর্জনের আশা। এই আবেগগুলো মানুষকে যুদ্ধ থেকে শান্তির পথে আসতে আগ্রহী করে তোলে।
আর যুক্তি তাকে বলে দেয়, কীভাবে সেই শান্তি পাওয়া সম্ভব। যুক্তি মানুষকে কিছু সাধারণ নিয়ম বা নীতি বাতলে দেয়, যেগুলোকে হবস বলেছেন ‘প্রাকৃতিক আইন’ (Laws of Nature)। এগুলো ঈশ্বরের দেওয়া পবিত্র আইন নয়, বা প্রকৃতির অন্তর্নিহিত কোনো নৈতিক বিধানও নয়। এগুলো হলো শান্তির জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত, যা বুদ্ধিমান মানুষ নিজের দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থেই খুঁজে বের করে। এগুলো হলো যুক্তির অনুশাসন (Dictates of Reason)।
এখানে হবসের দুটি ধারণার পার্থক্য বোঝা জরুরি: প্রাকৃতিক অধিকার (Right of Nature/Jus Naturale) এবং প্রাকৃতিক আইন (Law of Nature/Lex Naturalis)।
-
প্রাকৃতিক অধিকার: প্রকৃতির রাজ্যে প্রত্যেকের স্বাধীনতা আছে নিজের জীবন রক্ষার জন্য যা কিছু প্রয়োজন, তা-ই করার। এমনকি অন্যকে হত্যা করারও অধিকার। এটি হলো এক ধরনের স্বাধীনতা (Liberty)।
-
প্রাকৃতিক আইন: এটি হলো যুক্তির একটি সাধারণ নিয়ম যা মানুষকে এমন কিছু করতে নিষেধ করে যা তার জীবনের জন্য ধ্বংসাত্মক। এটি হলো এক ধরনের বাধ্যবাধকতা (Obligation)।
প্রথম এবং সবচেয়ে মৌলিক প্রাকৃতিক আইনটি হলো:
১. শান্তি খোঁজো এবং তা অনুসরণ করো (Seek peace and follow it)।
যুক্তি বলে, বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধ নয়, শান্তিই সেরা উপায়। কিন্তু যদি শান্তি পাওয়া সম্ভব না হয় (যেমন, অন্যেরা যদি যুদ্ধ করতে চায়), তখন যুদ্ধের সব সুবিধা গ্রহণ করে নিজেকে রক্ষা করার অধিকারও তোমার আছে।
এই প্রথম আইন থেকে দ্বিতীয় আইনটি সরাসরি বেরিয়ে আসে:
২. নিজের অধিকার ছেড়ে দাও (Lay down your right to all things)।
শান্তি তখনই সম্ভব, যখন সবাই তাদের ‘সবকিছুর ওপর অধিকার’ ছেড়ে দিতে রাজি হবে, এই শর্তে যে অন্যরাও তাই করবে। প্রকৃতির রাজ্যে আমার অধিকার ছিল আপনাকে মেরে ফেলার, আপনারও ছিল আমাকে মেরে ফেলার। আমরা যদি দুজনেই এই অধিকারটা ছেড়ে দিই, তাহলেই শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। তবে শর্ত হলো, সবাইকেই ছাড়তে হবে। আমি আমার অধিকার ছাড়লাম, কিন্তু আপনি ছাড়লেন না, তাহলে তো আমি আপনার শিকারে পরিণত হব। তাই এই ত্যাগটা হতে হবে পারস্পরিক।
তৃতীয় আইনটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা ন্যায়বিচারের ভিত্তি স্থাপন করে:
৩. চুক্তি মেনে চলো (Perform covenants made)।
একবার চুক্তি করে অধিকার ছেড়ে দিলে, সেই চুক্তি অবশ্যই পালন করতে হবে। চুক্তি ভঙ্গ করা হলো ‘অন্যায়’ (Injustice)। এখানেই প্রথম ন্যায়-অন্যায়ের ধারণার জন্ম হচ্ছে। চুক্তি মানাই হলো ন্যায়, আর ভাঙাই হলো অন্যায়। প্রকৃতির রাজ্যে কোনো চুক্তিই কার্যকর নয়, কারণ চুক্তি বলবৎ করার মতো কোনো শক্তি সেখানে নেই (Gauthier, 1969)।
হবস এরকম মোট ১৯টি প্রাকৃতিক আইনের কথা বলেছেন। যেমন, চতুর্থ আইনটি হলো কৃতজ্ঞতা (Gratitude), পঞ্চমটি পারস্পরিক মানিয়ে চলা (Mutual accommodation), নবমটি হলো অহংকার বর্জন করা (Against pride) এবং প্রত্যেককে নিজের সমান হিসেবে গণ্য করা।
কিন্তু এখানে একটা বড় সমস্যা আছে। এই আইনগুলো মেনে চলতে আমাকে কে বাধ্য করবে? প্রকৃতির রাজ্যে আমি হয়তো চুক্তি করলাম, কিন্তু পরে যদি দেখি চুক্তি ভাঙলে আমার লাভ বেশি, তখন আমি কী করব? যেহেতু কোনো পুলিশ বা বিচারক নেই, তাই চুক্তিভঙ্গের কোনো শাস্তিও নেই। ফলে, এই আইনগুলো আসলে এক ধরনের ইচ্ছার প্রকাশ মাত্র (binding in foro interno বা অন্তরের আদালতে), সত্যিকারের আইন নয় যা বাইরে থেকে প্রয়োগ করা যায় (binding in foro externo বা বাইরের আদালতে)।
এই সমস্যার সমাধান হলো ‘সামাজিক চুক্তি’ (Social Contract)।
মানুষেরা তাদের যুক্তি দিয়ে বুঝতে পারে, শুধু নিজেদের মধ্যে চুক্তি করলেই হবে না। এমন একজনকে বা একদল মানুষকে দরকার, যার হাতে অফুরন্ত ক্ষমতা থাকবে এবং যে সবাইকে শাস্তির ভয় দেখিয়ে চুক্তি মানতে বাধ্য করবে। তাই তারা সবাই মিলে একটা চূড়ান্ত চুক্তি করে। চুক্তিটা এমন:
“আমি আমার নিজেকে শাসন করার অধিকার এই ব্যক্তি বা এই সংসদকে অর্পণ করছি এবং তার সকল কাজের অনুমোদন দিচ্ছি, এই শর্তে যে তুমিও তোমার অধিকার একইভাবে অর্পণ করবে এবং তার সব কাজে সম্মতি দেবে।” (Hobbes, 1651/1994, Chapter XVII)
লক্ষ করুন, এই চুক্তিটা কিন্তু জনগণ আর শাসকের মধ্যে হচ্ছে না। চুক্তিটা হচ্ছে জনগণের নিজেদের মধ্যে। তারা প্রত্যেকে প্রত্যেকের সাথে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছে যে, তারা সবাই মিলে তাদের প্রাকৃতিক অধিকার (Natural Right) একজন সার্বভৌম (Sovereign) শাসকের হাতে তুলে দেবে। এই চুক্তির ফলেই জন্ম হয় এক কৃত্রিম মানব বা ‘মর্টাল গড’ (Mortal God) – রাষ্ট্র বা কমনওয়েলথ (Commonwealth)। আর এই রাষ্ট্রের যে আত্মা, সেই হলো সার্বভৌমত্ব (Sovereignty)। আর এই রাষ্ট্র নামক দানবের নামই হলো ‘লেভিয়াথান’।
লেভিয়াথান: পরম ক্ষমতার অধিকারী এক দানব (The Absolute Sovereign)
একবার সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে এই লেভিয়াথান বা সার্বভৌম শক্তি তৈরি হয়ে গেলে, তার ক্ষমতা হবে প্রায় অসীম, চূড়ান্ত এবং অবিভাজ্য। হবস বিশ্বাস করতেন, সার্বভৌম ক্ষমতাকে কোনোভাবেই ভাগ করা বা সীমাবদ্ধ করা যাবে না। যদি ক্ষমতা ভাগ হয়ে যায় (যেমন—আইন বানানোর ক্ষমতা একজনের হাতে, আর তা প্রয়োগের ক্ষমতা আরেকজনের হাতে), তাহলে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হবে এবং দেশ আবার গৃহযুদ্ধের দিকে, অর্থাৎ প্রকৃতির রাজ্যে ফিরে যাবে। তাই সার্বভৌম ক্ষমতাকে হতে হবে:
-
পরম (Absolute): সার্বভৌম শাসক কোনো আইনের অধীন নন। কারণ আইন তো তিনিই তৈরি করেন। তিনি যা বলবেন, তা-ই আইন। তিনি প্রজাদের সম্পত্তি কেড়ে নিতে পারেন, তাদের ওপর কর বসাতে পারেন, যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারেন, শান্তি স্থাপন করতে পারেন। প্রজারা তাকে প্রশ্ন করতে পারে না, কারণ প্রজারা নিজেরাই চুক্তির মাধ্যমে তার সব কাজের ‘লেখক’ (Author)। সার্বভৌম শাসক কেবল একজন ‘ অভিনেতা’ (Actor) যিনি প্রজাদের ইচ্ছাকেই প্রতিনিধিত্ব করছেন। তাই শাসকের কাজের সমালোচনা করা মানে নিজের কাজেরই সমালোচনা করা।
-
অবিভাজ্য (Indivisible): ক্ষমতাকে শাসন, আইন ও বিচার—এই তিন ভাগে ভাগ করা যাবে না, যা পরবর্তীতে মঁতেস্কুর (Montesquieu) দর্শনের মূল ভিত্তি ছিল। হবসের মতে, এই ক্ষমতাগুলো অবিচ্ছেদ্য। তরবারি চালানোর ক্ষমতা (শাসন বিভাগ), আইন তৈরির ক্ষমতা (আইন বিভাগ) এবং বিবাদের মীমাংসা করার ক্ষমতা (বিচার বিভাগ) একই হাতে থাকতে হবে।
-
অহস্তান্তরযোগ্য (Inalienable): সার্বভৌম শাসক তার ক্ষমতা কাউকে হস্তান্তর করতে পারেন না। কারণ তা করলে সার্বভৌমত্বের অবসান ঘটবে।
হবস তিন ধরনের রাষ্ট্রের কথা বলেছেন: রাজতন্ত্র (Monarchy), অভিজাততন্ত্র (Aristocracy) এবং গণতন্ত্র (Democracy)। তার ব্যক্তিগত পছন্দ ছিল রাজতন্ত্র। কারণ, একজন রাজার ব্যক্তিগত স্বার্থ আর জনগণের স্বার্থ এক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাছাড়া, একটি সংসদ বা অ্যাসেম্বলিতে বিতর্ক, দলাদলি আর সিদ্ধান্তহীনতার যে ঝুঁকি থাকে, একজন শাসকের ক্ষেত্রে তা থাকে না।
আপনি হয়তো ভাবছেন, এ তো রীতিমতো স্বৈরতন্ত্র! প্রজাদের কোনো অধিকারই কি নেই? হবসের উত্তর হলো, আছে। তবে সেটা খুব সীমিত।
প্রজার স্বাধীনতা: নীরবতার স্বাধীনতা (Liberty of the Subject)
আমাদের কাছে স্বাধীনতা মানে হয়তো নিজের ইচ্ছামতো কথা বলা, সরকারের সমালোচনা করা, যা খুশি তাই করা। কিন্তু হবসের কাছে স্বাধীনতা (Liberty) মানে হলো বাহ্যিক বাধার অনুপস্থিতি (Absence of external impediments)। একটি নদী স্বাধীনভাবে বয়ে চলে, যদি না তার পথে কোনো বাঁধ দেওয়া হয়। একইভাবে, আপনি স্বাধীন, যদি আপনাকে কোনো কিছু করতে কেউ শারীরিকভাবে বাধা না দেয়।
সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে প্রজারা তাদের অনেকখানি স্বাধীনতা সার্বভৌম শাসকের হাতে তুলে দিয়েছে। এখন তাদের স্বাধীনতা শুধু সেইসব ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ, যেসব বিষয়ে আইন নীরব (Silence of the law)।
অর্থাৎ, সার্বভৌম শাসক যে বিষয়ে কোনো আইন তৈরি করেননি, সেই বিষয়ে আপনি যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। যেমন—আপনি কী খাবেন, কোথায় থাকবেন, কার সাথে ব্যবসা করবেন, আপনার সন্তানদের কী শিক্ষা দেবেন—এসব বিষয়ে যদি কোনো আইন না থাকে, তবে আপনি স্বাধীন।
কিন্তু সার্বভৌম শাসকের বিরুদ্ধে কি বিদ্রোহ করা যায়? হবসের মতে, না। কারণ সার্বভৌম শাসককে আপনি নিজেই তৈরি করেছেন। তিনি চুক্তির অংশ নন, চুক্তির ফল। তাই তিনি চুক্তি ভঙ্গ করতে পারেন না। তাকে বিরোধিতা করা মানে নিজের বিরুদ্ধেই যাওয়া এবং রাষ্ট্রকে পুনরায় প্রকৃতির রাজ্যে ঠেলে দেওয়া।
তবে একটা মাত্র ক্ষেত্রে আপনি সার্বভৌমকে অমান্য করতে পারেন, যা আপনার ‘প্রকৃত স্বাধীনতা’ (True Liberty)। সেটা হলো—যখন তিনি আপনার জীবন কেড়ে নিতে চাইবেন। সামাজিক চুক্তির মূল উদ্দেশ্যই ছিল আত্মরক্ষা। যদি সার্বভৌম শাসক নিজেই আপনার জীবননাশের কারণ হয়ে দাঁড়ান, তাহলে চুক্তিটি আপনার জন্য বাতিল হয়ে যায়। তিনি যদি আপনাকে নিজেকে হত্যা করতে, বা নিজের অঙ্গহানি করতে, বা এমন কোনো কাজ করতে বলেন যা আপনার জীবন বিপন্ন করে (যেমন, স্বীকারোক্তি আদায় করতে নির্যাতন), তখন আপনি তাকে মানতে বাধ্য নন। এমনকি তিনি যদি আপনাকে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেন, আপনি ভয়ে পালিয়ে যেতে পারেন, যদিও সার্বভৌম আপনাকে এর জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার অধিকার রাখেন। কারণ, কেউ নিজের জীবন রক্ষার অধিকার ত্যাগ করতে পারে না (Skinner, 2008)। এই একটি জায়গায় এসে হবসের পরম ক্ষমতার তত্ত্বটি সামান্য নরম হয়ে আসে।
রাষ্ট্র ও ধর্ম: কার ক্ষমতা বেশি?
হবসের সময়ে ধর্ম ছিল রাজনীতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধের পেছনে ধর্মীয় সংঘাতের বিশাল ভূমিকা ছিল। ক্যাথলিক, অ্যাংলিকান, পিউরিটানদের দ্বন্দ্ব, এবং কে বাইবেলের সঠিক ব্যাখ্যাকারী—এই প্রশ্নগুলো দেশকে অস্থির করে রেখেছিল। অনেকেই পোপ বা চার্চকে রাজার চেয়ে বড় কর্তৃপক্ষ মনে করত।
হবস বুঝেছিলেন, শান্তি চাইলে ধর্মের লাগাম টেনে ধরতে হবে। তিনি বললেন, রাষ্ট্রে দুই মাথা থাকতে পারে না—একদিকে রাজা (temporal sovereign), আরেকদিকে পোপ বা চার্চ (spiritual sovereign)। এমনটা হলে সংঘাত অনিবার্য, কারণ মানুষ দ্বিধায় পড়ে যাবে কার আদেশ মানবে। এটি হলো ‘অন্ধকারের রাজ্য’ (Kingdom of Darkness) তৈরির একটি কৌশল।
তাই, জাগতিক বিষয়ের মতো ধর্মীয় বিষয়েরও সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হবেন সার্বভৌম শাসক। তিনিই হবেন রাষ্ট্রের প্রধান যাজক। বাইবেলের ব্যাখ্যা কী হবে, কোন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হবে, তা ঠিক করে দেবেন সার্বভৌম শাসক। এর উদ্দেশ্য ধর্মকে ধ্বংস করা নয়, বরং ধর্মকে ব্যবহার করে রাষ্ট্রের শান্তি ও ঐক্য বজায় রাখা (Martinich, 1992)।
তার যুক্তি ছিল, ঈশ্বরের রাজ্য (Kingdom of God) এই পৃথিবীতে নয়, পরকালে। যিশু খ্রিস্ট এসে মানুষের আত্মাকে বাঁচানোর পথ দেখিয়েছেন, কিন্তু জাগতিক শাসনভার গ্রহণ করেননি। এই পৃথিবীতে শান্তি বজায় রাখার জন্য আমাদের ‘মর্টাল গড’ বা লেভিয়াথানের আইনই চূড়ান্ত। একজন নাগরিককে প্রকাশ্যে রাষ্ট্রের নির্ধারিত ধর্ম পালন করতে হবে, কিন্তু তার ব্যক্তিগত বিশ্বাস কী, তা নিয়ে রাষ্ট্র মাথা ঘামাবে না। কারণ বিশ্বাসকে জোর করে পরিবর্তন করা যায় না।
হবসের দর্শনের সমালোচনা ও প্রাসঙ্গিকতা
হবসের দর্শন নিয়ে তার সময় থেকে আজ পর্যন্ত প্রচুর সমালোচনা হয়েছে এবং হচ্ছে। সমালোচকরা মূলত কয়েকটি বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন:
মানব প্রকৃতির ধারণা: হবস কি মানুষকে বড্ড বেশি নেতিবাচকভাবে দেখেছেন? মানুষ কি কেবলই স্বার্থপর আর ক্ষমতালোভী? মানুষের মধ্যে কি দয়া, মায়া, ভালোবাসা, পরোপকার—এসবের কোনো স্থান নেই? সমালোচকদের মতে, হবস মানুষের সামাজিক দিকটাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করেছেন। অ্যারিস্টটল থেকে শুরু করে অনেকেই মানুষকে ‘সামাজিক জীব’ (Social animal) হিসেবে দেখেছেন। হবস এই ধারণাকে বাতিল করে দিয়েছেন। তার মানুষ হলো এক বিচ্ছিন্ন পরমাণুর মতো (Macpherson, 1962)।
পরম সার্বভৌমত্ব: হবসের সমাধান, অর্থাৎ পরম ক্ষমতার অধিকারী এক শাসক, কি রোগের চেয়েও ভয়ঙ্কর নয়? এমন একজন স্বৈরাচারী শাসকের হাতে সব ক্ষমতা তুলে দিলে তিনি তো জনগণের ওপর অবর্ণনীয় অত্যাচার চালাতে পারেন। লর্ড অ্যাকটনের সেই বিখ্যাত উক্তি: “Power tends to corrupt, and absolute power corrupts absolutely.” জন লক (John Locke)-এর মতো পরবর্তীকালের দার্শনিকরা বলবেন, সরকারের ক্ষমতা সীমিত হওয়া উচিত এবং জনগণের জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির (Life, Liberty, and Property) মতো প্রাকৃতিক অধিকারকে সম্মান করা উচিত, যা সরকার কেড়ে নিতে পারে না।
প্রকৃতির রাজ্যের বাস্তবতা: হবসের বর্ণিত ‘প্রকৃতির রাজ্য’ কি আদৌ কোনোদিন ছিল? নাকি এটা কেবলই তার স্বৈরতন্ত্রকে ন্যায্যতা দেওয়ার একটা কৌশল? যদি এটি একটি কাল্পনিক অবস্থা হয়, তাহলে এর ভিত্তিতে তৈরি সামাজিক চুক্তি কীভাবে বাস্তব মানুষের ওপর প্রয়োগযোগ্য হতে পারে?
এসব সমালোচনা সত্ত্বেও হবসের গুরুত্বকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তিনি আধুনিক রাজনৈতিক দর্শনের অন্যতম জনক।
-
তিনিই প্রথম দেখিয়েছেন যে, রাষ্ট্রের ক্ষমতা কোনো স্বর্গীয় অধিকার (Divine Right of Kings) থেকে আসে না, বরং তা আসে জনগণের সম্মতি থেকে, যদিও সেই সম্মতি একবার দেওয়ার পর আর ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। এটি একটি বিপ্লবী ধারণা।
-
তিনি রাজনৈতিক কর্তৃত্বের একটি ধর্মনিরপেক্ষ (Secular) ভিত্তি তৈরি করেছেন।
-
তার দর্শন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক (International Relations) বিষয়ে ‘বাস্তববাদ’ (Realism) তত্ত্বের ভিত্তি স্থাপন করেছে। বাস্তববাদীরা মনে করেন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনটা আসলে হবসের প্রকৃতির রাজ্যের মতোই, যেখানে প্রতিটি রাষ্ট্র নিজের স্বার্থ ও নিরাপত্তা নিয়ে ব্যস্ত এবং কোনো উচ্চতর কর্তৃপক্ষ নেই।
-
তিনিই প্রথম ব্যক্তি, রাষ্ট্র, স্বাধীনতা, অধিকারের মতো ধারণাগুলোকে একটি সুসংহত তত্ত্বে রূপ দিয়েছেন।
আজকের দিনেও আমরা হবসের ছায়া দেখতে পাই। যখন কোনো দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ে, যখন সিরিয়া বা লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, যখন রাষ্ট্র তার নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, তখন আমরা বুঝি হবসের ভয়টা কতটা বাস্তব ছিল। আবার, যখন রাষ্ট্র নিরাপত্তার নামে আমাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে, আমাদের ফোনে আড়ি পাতে, ইন্টারনেটে নজরদারি চালায়, তখন আমরা হবসের লেভিয়াথানের সেই দানবীয় রূপটাও দেখতে পাই। নিরাপত্তা বনাম স্বাধীনতা (Security vs. Liberty) – এই বিতর্কটি আজও আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক বিতর্ক, যার মূলে রয়েছেন টমাস হবস।
শেষ কথা
টমাস হবসের পৃথিবীটা ছিল ভয়ের। তিনি ভয়কে জয় করতে চেয়েছিলেন আরেকটা বড় ভয় দিয়ে। ছোট ছোট হাজারো হায়েনার ভয়ে সারাক্ষণ আতঙ্কিত হয়ে থাকার চেয়ে একটা বিশাল, শক্তিশালী সিংহকে মেনে নেওয়া তার কাছে শ্রেয় মনে হয়েছিল। তার লেভিয়াথান হলো সেই সিংহ—ভয়ংকর, কিন্তু অন্তত তার শাসনে একটা নিয়ম আছে, একটা শৃঙ্খলা আছে। জীবনটা হয়তো খুব সুখের বা স্বাধীন হবে না, কিন্তু অন্তত ‘ক্ষণস্থায়ী’ এবং ‘পাশবিক’ হবে না। এটি একটি কঠিন আপস, কিন্তু হবসের মতে, এটিই একমাত্র যৌক্তিক আপস।
আপনি হয়তো তার সঙ্গে একমত হবেন না। হয়তো বলবেন, এমন পরাধীন জীবনের চেয়ে প্রকৃতির রাজ্যের বিশৃঙ্খলাও ভালো। অথবা হয়তো ভাববেন, নিরাপত্তা আর স্বাধীনতার মধ্যে একটা সুন্দর ভারসাম্য আনা সম্ভব, যেমনটা জন লক বা জন স্টুয়ার্ট মিল ভেবেছিলেন।
আপনার ভাবনা যা-ই হোক না কেন, হবস আপনাকে ভাবতে বাধ্য করবেন। রাষ্ট্র কেন দরকার? স্বাধীনতা মানে কী? ক্ষমতার চরিত্রটাই বা কেমন? মানুষ আসলে কী চায়—শান্তি নাকি স্বাধীনতা?
এই প্রশ্নগুলোর কোনো সহজ উত্তর নেই। হয়তো কোনোদিন পাওয়াও যাবে না। কিন্তু প্রশ্নগুলো টিকে থাকবে। ঠিক যেমন রাতের আকাশে ধ্রুবতারাটা টিকে থাকে। পথ দেখানোর জন্য নয়, পথের কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য। হবস আমাদের সেই পথের কথাই মনে করিয়ে দিয়ে গেছেন। ভয়, ক্ষমতা আর মুক্তির এক জটিল, কাঁটাভরা পথের কথা। সেই পথ ধরে হাঁটতে গেলে আমাদের আজও তার মানচিত্রের দিকে তাকাতে হয়।
তথ্যসূত্র
- Gauthier, D. P. (1969). The Logic of Leviathan: The Moral and Political Theory of Thomas Hobbes. Oxford University Press.
- Hobbes, T. (1994). Leviathan, with selected variants from the Latin edition of 1668 (E. Curley, Ed.). Hackett Publishing Company. (Original work published 1651).
- Macpherson, C. B. (1962). The Political Theory of Possessive Individualism: Hobbes to Locke. Oxford University Press.
- Malcolm, N. (2002). Aspects of Hobbes. Clarendon Press.
- Martinich, A. P. (1992). The Two Gods of Leviathan: Thomas Hobbes on Religion and Politics. Cambridge University Press.
- Skinner, Q. (1996). Reason and Rhetoric in the Philosophy of Hobbes. Cambridge University Press.
- Skinner, Q. (2008). Hobbes and Republican Liberty. Cambridge University Press.
- Sorell, T. (1986). Hobbes. Routledge & Kegan Paul.
- Strauss, L. (1952). The Political Philosophy of Hobbes: Its Basis and Its Genesis. University of Chicago Press.
- Tuck, R. (1989). Hobbes. Oxford University Press.
- Tuck, R. (1996). Hobbes: A Very Short Introduction. Oxford University Press.
Leave a Reply