অমঙ্গলের সমস্যা বা প্রবলেম অফ ইভল: ঈশ্বর যদি থাকেন, তবে এত কষ্ট কেন?

ভূমিকা

যখন লেখাটা লিখছি তখন নিস্তব্ধতায়, পাশে রাখা চায়ের কাপ থেকে বের হওয়া চায়ের ধোঁয়ার কুণ্ডলীর সাথে মিশে গিয়ে স্মৃতির পাতাগুলোও কেমন স্যাঁতসেঁতে হয়ে ওঠে। মনে পড়ে যায় শৈশবের সেই ভয়, যখন বজ্রপাতের শব্দে মায়ের আঁচলের নিচে মুখ লুকাতাম, কিংবা কৈশোরের সেই অসহায়ত্ব, যখন প্রিয় বন্ধুকে এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে কষ্ট পেতে দেখেছিলাম, পরে সে মারা গেছিল। স্কুলজীবনে বেস্টফ্রেন্ড যে ছিল সে ক্লাস সেভেনে সুইসাইড করেছিল। সুইসাইড নোট লেখেনি, কিন্তু আমি জানি সে প্রচণ্ড বুলিইং এর শিকার হতো আর এখন বুঝি সে মেজর ডিপ্রেসিভ ডিজর্ডারে ভুগছিল। এই ব্যক্তিগত দুঃখগুলো আজ একাকার হয়ে যাচ্ছে এক বিশাল, সর্বজনীন প্রশ্নের সাথে।

কদিন আগে খবরের কাগজের ভেতরের পাতায় পড়েছিলাম একটা ছোট্ট খবর – মিয়াননারে ভূমিকম্পে একটা স্কুলবাড়ি ধসে গেছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছে অনেকগুলো শিশুর স্বপ্ন। তাদের মায়েরা এখন বিলাপ করছেন, বাবারা নির্বাক। সেটাও এখন মনে পড়ছে। চায়ের কাপটা ঠোঁটের কাছে এনেও নামিয়ে রাখলাম। একটা প্রশ্ন বুদবুদের মতো মন থেকে মস্তিষ্কে উঠে এসে আটকে গেল—কেন?

এই একরত্তি ‘কেন’ শব্দটি কেবল একটি প্রশ্ন নয়, এটি একটি আর্তনাদ। এটি সেই মায়ের আর্তনাদ যিনি তার সন্তানের নিথর দেহ বুকে জড়িয়ে রেখেছেন। এটি সেই কৃষকের আর্তনাদ যিনি খরার কারণে তার সর্বস্ব হারিয়েছেন। এটি সেই নির্যাতিত মানুষের আর্তনাদ যিনি ক্ষমতার দম্ভের শিকার। এই ‘কেন’-এর মধ্যেই যেন পৃথিবীর সব দর্শন, সব বিজ্ঞান, সব ধর্ম আটকা পড়ে আছে। এই প্রশ্নটি কোনো সাধারণ প্রশ্ন নয়। এটি একটি অন্তহীন ধাঁধা, এক মহাজাগতিক রহস্য। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের সবচেয়ে প্রখর মেধাগুলো এই ধাঁধার উত্তর খুঁজে ফিরেছে। দার্শনিক পরিভাষায় এই মহা-ধাঁধার নাম ‘অমঙ্গলের সমস্যা’ বা The Problem of Evil।

ধরুন, আপনি একজন সর্বশক্তিমান (Omnipotent) চিত্রকর। আপনার হাতে পৃথিবীর সেরা রঙ-তুলি, আপনার কল্পনাশক্তি অসীম। আপনি যা খুশি আঁকতে পারেন—সকালের সোনা রোদ, নীল আকাশ, শিশুর নির্মল হাসি, ভালোবাসার প্রথম স্পর্শ। আবার ধরুন, আপনি শুধু সর্বশক্তিমানই নন, আপনি পরম দয়ালুও (Omnibenevolent)। আপনার হৃদয়ে জগতের প্রতিটি প্রাণের জন্য অফুরন্ত ভালোবাসা ও করুণা। আপনার তুলির প্রতিটি আঁচড় কেবল সৌন্দর্য আর আনন্দই সৃষ্টি করতে চায়। এখন বলুন তো, আপনি কি এমন কোনো ছবি আঁকবেন যেখানে একটি শিশু ক্ষুধায় ধুঁকে ধুঁকে কাঁদছে? অথবা একটি অসহায় হরিণশাবক বনের আগুনে জীবন্ত পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে? যেখানে মানুষ মানুষকে পশুর মতো হত্যা করছে, যেখানে প্রকৃতি তার নিজের সৃষ্টিকে সুনামির জলোচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে?

আপনি আঁকবেন না। কারণ আপনি দয়ালু, আপনার মন কেঁদে উঠবে। আর আপনাকে কেউ আটকাতেও পারবে না, কারণ আপনি সর্বশক্তিমান; আপনার হাতেই সমস্ত ক্ষমতা।

তাহলে এই জগত, যা কিনা এক পরম করুণাময়, সর্বশক্তিমান এবং সর্বজ্ঞ (Omniscient) ঈশ্বরের সৃষ্টি বলে বিশ্বাস করা হয়, সেখানে এত দুঃখ, এত কষ্ট, এত বীভৎস অমঙ্গল কেন? কেন ১৭৫৫ সালে লিসবনের মতো একটি ধর্মপ্রাণ শহরে ভয়াবহ ভূমিকম্পে হাজার হাজার উপাসনাকারী প্রার্থনারত অবস্থাতেই গির্জার নিচে চাপা পড়ে মারা যায়? কেন ক্যান্সার বা এইডসের মতো ভয়াবহ রোগে মানুষ তিলে তিলে অসহ্য যন্ত্রণায় শেষ হয়ে যায়? আর সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রশ্ন—কেন একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে অবর্ণনীয় কষ্ট দেয়? যুদ্ধ, গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন—এই পাশবিকতার উৎস কোথায়? যদি ঈশ্বর থাকেন, তিনি কেন এই নীরব দর্শক?

এই প্রশ্নগুলোর মধ্যেই লুকিয়ে আছে অমঙ্গলের সমস্যার মূল ভিত্তি। সমস্যাটিকে সহজভাবে একটি ত্রিভুজের মতো করে ভাবা যেতে পারে, যার তিনটি বাহু একসঙ্গে থাকতে পারে না। অস্ট্রেলিয়ান দার্শনিক জে. এল. ম্যাকি (J. L. Mackie) এটিকে বিখ্যাত করেছেন ‘অসংলগ্ন ত্রয়ী’ বা Inconsistent Triad নামে (Mackie, 1955)। এই তিনটি বিশ্বাস হলো:

  • ১. ঈশ্বর সর্বশক্তিমান (God is Omnipotent): তার ক্ষমতা অসীম। তিনি যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। জগতের কোনো অমঙ্গলকে রোধ করা তার ক্ষমতার বাইরে নয়।
  • ২. ঈশ্বর পরম দয়ালু বা মঙ্গলময় (God is Omnibenevolent): তিনি নিখুঁতভাবে ভালো এবং তার হৃদয়ে জগতের জন্য অফুরন্ত ভালোবাসা। তিনি চান জগতের সবাই সুখে থাকুক।
  • ৩. জগতে অমঙ্গলের অস্তিত্ব আছে (Evil exists in the world): এটি একটি অনস্বীকার্য বাস্তবতা। প্রতিদিনের খবরের কাগজ, হাসপাতাল, যুদ্ধক্ষেত্র এর সাক্ষী।

ম্যাকি বললেন, এই তিনটি ধারণা একসাথে সত্য হতে পারে না। এদের মধ্যে যেকোনো দুটি সত্য হলে, তৃতীয়টি মিথ্যা হতে বাধ্য। যুক্তিটি এভাবে কাজ করে:

  • যদি ঈশ্বর সর্বশক্তিমান (১) এবং পরম দয়ালু (২) হন, তাহলে তিনি জগতের সব অমঙ্গল দূর করতে সক্ষম এবং ইচ্ছুক উভয়ই। এমন একজন ঈশ্বর থাকলে জগতে কোনো অমঙ্গলের অস্তিত্ব (৩) থাকার কথা নয়। কিন্তু যেহেতু অমঙ্গল আছে, সেহেতু এই দুটি গুণের অধিকারী ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই।
  • যদি ঈশ্বর পরম দয়ালু (২) হন এবং জগতে অমঙ্গলও (৩) থাকে, তাহলে বুঝতে হবে তিনি অমঙ্গল দূর করতে চাইলেও পারছেন না। তার মানে, তিনি সর্বশক্তিমান (১) নন।
  • যদি ঈশ্বর সর্বশক্তিমান (১) হন এবং জগতে অমঙ্গলও (৩) থাকে, তাহলে বুঝতে হবে তিনি অমঙ্গল দূর করতে পারলেও করছেন না। তার মানে, তিনি পরম দয়ালু (২) নন; হয়তো তিনি উদাসীন বা এমনকি নিষ্ঠুর।

এই যৌক্তিক ফাঁদ থেকে বেরোনোর পথ কী? আস্তিকদের হয় প্রমাণ করতে হবে এই তিনটি ধারণার মধ্যে কোনো যৌক্তিক অসংগতি নেই, অথবা কোনো একটি ধারণাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। আর নাস্তিকদের মতে, সবচেয়ে সহজ সমাধান হলো মেনে নেওয়া যে, এমন কোনো ঈশ্বরের অস্তিত্বই নেই এবং এই জগত এক উদ্দেশ্যহীন, যান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ফল।

এই ধাঁধার গলি-ঘুপচিতেই আমাদের আজকের দীর্ঘ যাত্রা। চলুন, এই প্রাচীন রহস্যের পর্দা একটু একটু করে উন্মোচন করার চেষ্টা করা যাক।

অমঙ্গলের ঐতিহাসিক ছায়া: এপিকিউরাস থেকে বুক অফ জোব

এই সমস্যাটি নতুন নয়। এটি মানুষের চেতনার মতোই প্রাচীন। প্রাচীন গ্রিসেও এই প্রশ্ন মানুষকে ভাবিয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দে দার্শনিক এপিকিউরাস (Epicurus) সমস্যাটিকে চারটি ধারালো প্রশ্নের আকারে সাজিয়েছিলেন, যা আজও আমাদের চিন্তাকে নাড়া দেয়:

ঈশ্বর কি অমঙ্গল দূর করতে ইচ্ছুক, কিন্তু সক্ষম নন? তাহলে তিনি দুর্বল, সর্বশক্তিমান নন।
তিনি কি সক্ষম, কিন্তু ইচ্ছুক নন? তাহলে তিনি অমঙ্গলকামী বা বিদ্বেষপরায়ণ।
তিনি কি সক্ষম এবং ইচ্ছুক উভয়ই? তাহলে অমঙ্গল আসছে কোথা থেকে?
তিনি কি সক্ষমও নন এবং ইচ্ছুকও নন? তাহলে তাকে ঈশ্বর বলার দরকার কী?

এপিকিউরাসের এই চতুর্মুখী আক্রমণ বা Epicurean paradox শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে দার্শনিকদের তাড়া করে ফিরেছে। শত শত বছর পর, অষ্টাদশ শতকের স্কটিশ দার্শনিক ডেভিড হিউম (David Hume) তার বিখ্যাত গ্রন্থ Dialogues Concerning Natural Religion-এ এই সমস্যাটিকে আরও শাণিত করে তোলেন। হিউমের চরিত্র ‘ফাইলো’ বলছেন, এই জগতের অমঙ্গল ও বিশৃঙ্খলা দেখে একজন পরম দয়ালু ও সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। বরং, জগতকে দেখে চারটি সম্ভাবনার কথা ভাবা যেতে পারে: (১) ঈশ্বর পরম দয়ালু নন, (২) তিনি সর্বশক্তিমান নন, (৩) এই জগত কোনো এক শিক্ষানবিশ বা নিম্নমানের দেবতার অসম্পূর্ণ কাজ, অথবা (৪) এটি এক উদ্দেশ্যহীন প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার ফল। হিউমের মতে, শেষের সম্ভাবনাটিই সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত ও তথ্যপ্রমাণ-নির্ভর (Hume, 1779)।

তবে এই সংকট শুধু দর্শনের আঙিনায় সীমাবদ্ধ ছিল না। আব্রাহামিক ধর্মগুলোর একদম গোড়াতেও এই প্রশ্নটি উপস্থিত। হিব্রু বাইবেলের ‘বুক অফ জোব’ (Book of Job) সম্ভবত অমঙ্গলের সমস্যা নিয়ে লেখা সবচেয়ে প্রাচীন এবং শক্তিশালী সাহিত্যিক দলিল। জোব ছিলেন একজন ধার্মিক, সৎ এবং ঈশ্বরভক্ত মানুষ। কিন্তু ঈশ্বর শয়তানের সাথে এক প্রকার বাজি ধরে জোবের বিশ্বস্ততা পরীক্ষা করার জন্য তার ওপর একের পর এক বিপর্যয় নামিয়ে আনেন। জোব তার সন্তান, সম্পত্তি, স্বাস্থ্য সবকিছু হারান। অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যে জোবের বন্ধুরা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, নিশ্চয়ই তিনি কোনো পাপ করেছেন, যার শাস্তি তিনি পাচ্ছেন। কিন্তু জোব জানেন তিনি নির্দোষ। তিনি ঈশ্বরের কাছে তার এই অবর্ণনীয় কষ্টের কারণ জানতে চেয়ে হাহাকার করেন। অবশেষে ঈশ্বর আবির্ভূত হন, কিন্তু তিনি জোবের ‘কেন’ প্রশ্নের কোনো সরাসরি উত্তর দেন না। পরিবর্তে, তিনি তার নিজের অসীম ক্ষমতা ও জ্ঞানের বর্ণনা দিয়ে জোবকে তার ক্ষুদ্রতা ও অজ্ঞতা সম্পর্কে সচেতন করেন। এই গল্পের বার্তাটি দ্ব্যর্থক— একদিকে এটি ঈশ্বরের দুর্বোধ্যতাকে তুলে ধরে, অন্যদিকে এটি প্রশ্ন তোলে যে, মানুষের বিশ্বস্ততা প্রমাণের জন্য এমন নিষ্ঠুর পরীক্ষার কি সত্যিই প্রয়োজন ছিল?

এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আমাদের বলে দেয়, অমঙ্গলের সমস্যাটি কেবল কোনো একটি বিশেষ ধর্ম বা বিশ্বাসের সংকট নয়, এটি মানুষের যুক্তিবাদী মনের এক চিরন্তন জিজ্ঞাসা, যা বিশ্বাস ও বাস্তবতার মধ্যে এক গভীর ফাটল তৈরি করে।

অমঙ্গলের প্রকারভেদ: প্রকৃতির নিষ্ঠুরতা এবং মানুষের পাপ

এই জটিল আলোচনার গভীরে যাওয়ার আগে, দার্শনিকেরা অমঙ্গলকে যেভাবে ভাগ করেছেন, তা বুঝে নেওয়া জরুরি। কারণ দুই ধরনের অমঙ্গলের জন্য ঈশ্বরকে দায়ী করার যুক্তি ও তার জবাব ভিন্ন ভিন্ন পথে চালিত হয়।

১. নৈতিক অমঙ্গল (Moral Evil): মানুষের সচেতন ও ইচ্ছাকৃত কাজ বা সিদ্ধান্তের ফলে যে অমঙ্গলের সৃষ্টি হয়, তাকে নৈতিক অমঙ্গল বলে। সোজা কথায়, এটি মানুষের পাপ। যেমন—হত্যা, চুরি, মিথ্যাচার, নির্যাতন, যুদ্ধ, গণহত্যা, ধর্ষণ, বিশ্বাসঘাতকতা, বর্ণবাদ, শোষণ। এর জন্য সরাসরি মানুষকে দায়ী করা যায়। হিটলারের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া গণহত্যা, রুয়ান্ডার গণহত্যা, কিংবা একজন সিরিয়াল কিলারের পাশবিক কার্যকলাপ—এগুলো নৈতিক অমঙ্গলের এমন ভয়াবহ উদাহরণ যা কল্পনাকেও হার মানায়। এখানে একজন বা একদল মানুষ তাদের স্বাধীন ইচ্ছাকে ব্যবহার করে অন্যের ওপর অবর্ণনীয় কষ্ট চাপিয়ে দিয়েছে। এই ধরনের অমঙ্গলের চালিকাশক্তি হলো মানুষের লোভ, ঘৃণা, হিংসা, ক্ষমতার লিপ্সা বা নিছকই অন্যের কষ্টে আনন্দ পাওয়ার বিকৃত মানসিকতা।

২. প্রাকৃতিক অমঙ্গল (Natural Evil): প্রকৃতির বিভিন্ন ঘটনা বা প্রক্রিয়া, যার ওপর মানুষের কোনো হাত নেই, তার ফলে যে দুঃখ-কষ্টের সৃষ্টি হয়, তাকে প্রাকৃতিক অমঙ্গল বলে। যেমন—ভূমিকম্প, সুনামি, বন্যা, খরা, রোগ-ব্যাধি (ক্যান্সার, প্লেগ, বর্তমানে কোভিড-১৯), দাবানল, হারিকেন। একটা নিষ্পাপ শিশু যখন জন্মগত কোনো মারাত্মক ত্রুটি নিয়ে জন্মায়, কিংবা সুনামিতে যখন উপকূলের হাজার হাজার মানুষ মুহূর্তের মধ্যে ভেসে যায়, তখন কাকে দোষ দেওয়া হবে? এখানে তো কোনো মানুষের ইচ্ছার ভূমিকা নেই। এই অমঙ্গল যেন প্রকৃতির এক নির্মম, নৈর্ব্যক্তিক ও উদাসীন খেয়াল। এই ধরনের অমঙ্গল আমাদের অসহায়ত্বকে সবচেয়ে বেশি প্রকট করে তোলে। এটি প্রশ্ন তোলে, একজন মঙ্গলময় স্রষ্টা কেন এমন এক জগত তৈরি করবেন যেখানে টেকটোনিক প্লেটগুলো নড়াচড়া করে শহরকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে, যেখানে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া সবল-দুর্বল নির্বিশেষে আক্রমণ করে?

নৈতিক অমঙ্গলের দায় মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে ঈশ্বরকে ডিফেন্ড বা রক্ষা করাটা তুলনামূলকভাবে সহজ। কিন্তু প্রাকৃতিক অমঙ্গলের দায় কার? এখানেই বিশ্বাসীদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটা তৈরি হয়। সর্বশক্তিমান ও দয়ালু স্রষ্টা কেন এমন এক প্রকৃতি তৈরি করলেন যা নিজেই এত নিষ্ঠুর আর বিধ্বংসী?

ঈশ্বরের সাফাই: থিওডিসি এবং ডিফেন্সের জগৎ

এই কঠিন অভিযোগের জবাবে আস্তিক দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিকেরা যেসব যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন, সেগুলোকে একত্রে থিওডিসি (Theodicy) বলা হয়। ‘থিওডিসি’ শব্দটি গ্রিক শব্দ ‘থিওস’ (ঈশ্বর) এবং ‘ডিকে’ (ন্যায়বিচার) থেকে এসেছে। এর আক্ষরিক অর্থ হলো ‘ঈশ্বরের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা’ বা ঈশ্বরের পক্ষে সাফাই গাওয়া। একটি থিওডিসি দাবি করে যে, জগতে অমঙ্গলের অস্তিত্ব থাকার পরেও ঈশ্বরের সর্বশক্তিমানতা এবং পরম দয়ালুতার ধারণাটি যৌক্তিকভাবে সঠিক এবং অমঙ্গলের অস্তিত্বের পেছনে ঈশ্বরের কোনো এক মহৎ উদ্দেশ্য আছে, যা আপাতদৃষ্টিতে বোঝা না গেলেও চূড়ান্তভাবে মঙ্গলের কারণ হবে।

থিওডিসির চেয়ে একটু নরম সুরের যুক্তিকে বলা হয় ডিফেন্স (Defense)। এর প্রধান প্রবক্তা হলেন আধুনিক দার্শনিক আলভিন প্ল্যান্টিংগা (Alvin Plantinga)। ডিফেন্সের মূল উদ্দেশ্য হলো এটা দেখানো যে, ঈশ্বর এবং অমঙ্গলের সহাবস্থান যৌক্তিকভাবে সম্ভব (logically possible)। এটি ঈশ্বরের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী, তা বলার দাবি করে না। বরং এটি বলে যে, এমন কোনো কারণ থাকতে পারে, যা আমরা না জানলেও, ঈশ্বরের জন্য অমঙ্গলকে জগতে থাকতে দেওয়াটা যৌক্তিক প্রমাণ করে। ডিফেন্সের লক্ষ্য নাস্তিকদের যৌক্তিক সমস্যাকে (Logical Problem of Evil) খণ্ডন করা, এটা প্রমাণ করা যে ম্যাকির ‘অসংলগ্ন ত্রয়ী’ আসলে অসংলগ্ন নয়।

চলুন, ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী কয়েকটি থিওডিসি বা ঈশ্বরের সপক্ষে দেওয়া যুক্তিগুলো একটু নেড়েচেড়ে দেখা যাক।

অগাস্টিনের স্বাধীন ইচ্ছার যুক্তি (Augustinian Free Will Theodicy)

সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং শক্তিশালী থিওডিসিগুলোর একটি হলো ‘স্বাধীন ইচ্ছার যুক্তি’। এর প্রধান প্রবক্তা ছিলেন চতুর্থ শতকের প্রভাবশালী খ্রিস্টান দার্শনিক সেন্ট অগাস্টিন (St. Augustine)

অগাস্টিনের যুক্তিটি খুব মানবিক একটি জায়গা থেকে শুরু হয়: ভালোবাসা। তিনি বলেন, ঈশ্বর মানুষকে ভালোবাসেন। সত্যিকারের ভালোবাসা কখনো জোর করে হয় না। আপনি যদি একটি রোবট তৈরি করেন এবং তাকে প্রোগ্রাম করে দেন যে সে আপনাকে ২৪ ঘণ্টা ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ বলবে, সেটা কি সত্যিকারের ভালোবাসা হবে? না। ভালোবাসা অর্থবহ হয় তখনই, যখন ভালোবাসার বা না-বাসার স্বাধীনতা থাকে। পছন্দ করার ক্ষমতা না থাকলে ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই।

ঈশ্বর মানুষকে ঠিক এই স্বাধীনতাটুকু দিয়েছেন—স্বাধীন ইচ্ছা (Free Will)। তিনি মানুষকে ভালো এবং মন্দের মধ্যে যেকোনো একটিকে বেছে নেওয়ার ক্ষমতা দিয়েছেন। মানুষ যদি সব সময় শুধু ভালো কাজই করতে বাধ্য থাকত, তাহলে তারা ঈশ্বরের হাতের পুতুল বা স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র হয়ে যেত। তাদের ভালো কাজের কোনো নৈতিক মূল্য থাকত না। একজন নায়ক তখনই নায়ক, যখন তার ভিলেন হওয়ার সুযোগ থাকে এবং সে স্বেচ্ছায় নায়ক হওয়াকে বেছে নেয়।

অগাস্টিনের মতে, ঈশ্বর মানুষকে এই মহামূল্যবান উপহার—স্বাধীন ইচ্ছা—দিয়েছেন বলেই মানুষ ভালোবেসে, স্বেচ্ছায় ঈশ্বরের দিকে যেতে পারে। কিন্তু এই স্বাধীনতার একটি ভয়ঙ্কর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও আছে। মানুষ এই স্বাধীনতাকে ব্যবহার করে মন্দকেও বেছে নিতে পারে। আর ঠিক এটাই ঘটেছে। মানুষ তার স্বাধীন ইচ্ছার অপব্যবহার করে ঈশ্বরের অবাধ্য হয়েছে, পাপ করেছে, যা জগতে নৈতিক অমঙ্গলের জন্ম দিয়েছে (Augustine, Confessions)।

অগাস্টিন আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেন যে, অমঙ্গল আসলে কোনো বস্তু বা সত্তা নয়। এটি মঙ্গলের অভাব বা অনুপস্থিতি মাত্র। তিনি একে বলেন Privatio Boni বা ‘মঙ্গলের বঞ্চনা’। যেমন, অন্ধকার আলোর অভাব ছাড়া আর কিছু নয়; ঠান্ডা হলো তাপের অভাব; অসুস্থতা হলো স্বাস্থ্যের অভাব। তেমনি, অমঙ্গল হলো সেই শূন্যতা যা সৃষ্টি হয় যখন কোনো সৃষ্টি তার স্রষ্টার দেখানো পথ থেকে সরে যায় বা তার প্রকৃত স্বরূপ থেকে বিচ্যুত হয়। সুতরাং, ঈশ্বর অমঙ্গল সৃষ্টি করেননি; তিনি কেবল মঙ্গলময় জগত সৃষ্টি করেছিলেন। মানুষের পাপ সেই মঙ্গলের মধ্যে একটি শূন্যতা বা ঘাটতি তৈরি করেছে।

সুতরাং, নৈতিক অমঙ্গলের (হত্যা, যুদ্ধ, হিংসা) জন্য ঈশ্বর দায়ী নন, দায়ী হলো মানুষ এবং অন্যান্য স্বাধীন ইচ্ছাসম্পন্ন সত্তা (যেমন, খ্রিষ্টীয় বিশ্বাস অনুযায়ী পতিত ফেরেশতা বা শয়তান)। ঈশ্বর চাইলে হয়তো এমন জগত বানাতে পারতেন যেখানে কোনো অমঙ্গল নেই, কিন্তু সেখানে মানুষের কোনো স্বাধীন ইচ্ছাও থাকত না। অগাস্টিনের মতে, স্বাধীনতা-বিহীন ভালো মানুষের জগতের চেয়ে স্বাধীনতা-যুক্ত জগত, যেখানে মন্দের সম্ভাবনা আছে, সেটিই শ্রেয়।

কিন্তু প্রাকৃতিক অমঙ্গলের কী হবে? ভূমিকম্প বা বন্যার জন্য তো মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা দায়ী নয়। এখানে অগাস্টিনের যুক্তি একটু জটিল। তিনি এবং তার অনুসারীরা বাইবেলের ‘পতনের’ (The Fall of Man) ধারণার ওপর নির্ভর করেন। তাদের মতে, প্রথম মানব-মানবী আদম ও ইভের পাপের কারণেই কেবল মানবজাতি নয়, সমগ্র সৃষ্টিই অভিশপ্ত হয়েছে এবং প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে। এই আদি পাপের ফলে জগতে মৃত্যু, রোগ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। কিছু আধুনিক দার্শনিক এই যুক্তিকে আরও এগিয়ে নিয়ে বলেন যে, হয়তো পতিত ফেরেশতা বা শয়তানের মতো অতিপ্রাকৃত সত্তারাই প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটায়।

সমালোচনা: স্বাধীন ইচ্ছার যুক্তিটি আকর্ষণীয় হলেও এটি নিস্তার পায়নি কঠোর সমালোচনা থেকে।

  • ট্রান্সওয়ার্ল্ড ডিপ্রেভিটি (Transworld Depravity): সর্বশক্তিমান ঈশ্বর কি এমন মানুষ সৃষ্টি করতে পারতেন না, যাদের স্বাধীন ইচ্ছা আছে, কিন্তু তারা কখনো মন্দকে বেছে নেবে না? দার্শনিক আলভিন প্ল্যান্টিংগা এর উত্তরে একটি জটিল যুক্তি দেন। তিনি বলেন, এটা যৌক্তিকভাবে সম্ভব যে, এমন কোনো স্বাধীন প্রাণী নেই যাকে ঈশ্বর সৃষ্টি করতে পারতেন এবং নিশ্চিত হতে পারতেন যে সে কখনো পাপ করবে না। যেকোনো স্বাধীন প্রাণীর ক্ষেত্রেই মন্দকে বেছে নেওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। এই অবস্থাকে তিনি ‘ট্রান্সওয়ার্ল্ড ডিপ্রেভিটি’ বলেন। যদি এটি সত্য হয়, তবে ঈশ্বরের পক্ষে এমন কোনো জগত তৈরি করা যৌক্তিকভাবে অসম্ভব, যেখানে স্বাধীন ইচ্ছাও থাকবে আবার কোনো নৈতিক অমঙ্গলও থাকবে না (Plantinga, 1974)। কিন্তু এটি একটি দার্শনিক অনুমান মাত্র, কোনো প্রমাণিত সত্য নয়।

  • প্রাকৃতিক অমঙ্গলের ব্যাখ্যা: পতিত ফেরেশতা বা শয়তান প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটাচ্ছে, এই ব্যাখ্যাটি আধুনিক বৈজ্ঞানিক মননের কাছে অনেকটাই অবিশ্বাস্য ও অপ্রমাণযোগ্য মনে হয়। ডাইনোসররা তো মানুষের বহু আগে পৃথিবীতে ছিল এবং তারাও প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিলুপ্ত হয়েছে। তাদের দুঃখ-কষ্টের জন্য কোন মানুষের বা ফেরেশতার পাপ দায়ী? এই যুক্তি বিজ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক।

  • স্বাধীনতার মূল্য: জগতে যে পরিমাণ ভয়াবহ এবং বীভৎস অমঙ্গল ঘটে (যেমন, হলোকাস্ট বা একটি শিশুকে দিনের পর দিন নির্যাতন), তার বিনিময়ে পাওয়া ‘স্বাধীন ইচ্ছা’ কি সত্যিই এত মূল্যবান? একটি শিশুকে ধর্ষণের স্বাধীনতা কি কোনো উচ্চতর মঙ্গলের জন্য অপরিহার্য? সমালোচকদের মতে, একটি নির্দিষ্ট মাত্রার পর অমঙ্গলের পরিমাণ এত বেশি হয়ে যায় যে, স্বাধীন ইচ্ছার যুক্তি তার আবেদন ও বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়। ঈশ্বর কি পারতেন না এমন জগত বানাতে যেখানে মানুষ মিথ্যা বলা বা ছোটখাটো চুরির মতো পাপ করতে পারে, কিন্তু গণহত্যা বা ধর্ষণের মতো চরম অমঙ্গল ঘটানোর ক্ষমতা তাদের থাকবে না?

ইরেনিয়াসের আত্মা-গঠন থিওডিসি (Irenaean Soul-Making Theodicy)

আরেকটি প্রভাবশালী থিওডিসি হলো ‘সোল-মেকিং’ বা ‘আত্মা-গঠন’ তত্ত্ব। এর আদি প্রবক্তা ছিলেন দ্বিতীয় শতকের বিশপ সেন্ট ইরেনিয়াস (St. Irenaeus) এবং আধুনিক যুগে একে অত্যন্ত জনপ্রিয় করেছেন দার্শনিক জন হিক (John Hick)। এই তত্ত্বটি অগাস্টিনের চেয়ে ভিন্ন এবং সম্ভবত আরও মানবিক একটি দৃষ্টিকোণ দেয়।

এই তত্ত্ব অনুসারে, এই পৃথিবীটা কোনো স্বর্গোদ্যান বা নিখুঁত আনন্দের জায়গা হিসেবে তৈরি হয়নি। অগাস্টিনের মতো তারা মনে করেন না যে, জগত নিখুঁত ছিল এবং মানুষের পাপে এর পতন ঘটেছে। বরং, এই জগতটি শুরু থেকেই একটি ‘আত্মা তৈরির কারখানা’ বা ‘Vale of Soul-Making’ (Hick, 1966) হিসেবে পরিকল্পিত। ঈশ্বর মানুষকে তার নিজের ‘সদৃশ’ (in his own likeness) করে তৈরি করতে চান—নৈতিকভাবে এবং আধ্যাত্মিকভাবে পরিপক্ক, দয়ালু, সহানুভূতিশীল, সাহসী ও প্রেমময় প্রাণী হিসেবে। কিন্তু এই চারিত্রিক গুণাবলী (Virtues) এমনি এমনি জন্মায় না। এগুলো কোনো প্যাকেজের মতো মানুষকে দিয়ে দেওয়া যায় না; এগুলো অর্জন করতে হয় কঠিন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে।

ভাবুন তো, এমন এক জগতে যদি আপনার জন্ম হতো যেখানে কোনো দুঃখ-কষ্ট, বিপদ বা চ্যালেঞ্জ নেই, তাহলে কি আপনি ‘সাহসী’ হতে পারতেন? সাহস দেখানোর জন্য তো বিপদের প্রয়োজন। যদি কেউ কখনো বিপদে না পড়ে, তাহলে ‘সহানুভূতি’ দেখানোর সুযোগ কোথায়? যদি কেউ কখনো আপনার সাথে অন্যায় না করে, তাহলে ‘ক্ষমা’ করার মহত্ব আপনি শিখবেন কীভাবে?

ইরেনিয়াস ও হিকের মতে, জগতের অমঙ্গল, দুঃখ এবং প্রতিবন্ধকতাগুলোই হলো সেই যন্ত্র, যা আমাদের আত্মাকে শক্তিশালী ও উন্নত করে। ব্যায়াম করলে যেমন শরীরের পেশি শক্তিশালী হয়, তেমনি দুঃখ-কষ্টের মোকাবেলা করলে আমাদের চরিত্র ও আত্মা বিকশিত হয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, প্রাকৃতিক অমঙ্গল (যেমন রোগ বা দুর্যোগ) মানুষকে একত্রিত হওয়ার, একে অপরকে সাহায্য করার এবং সহানুভূতির মতো গুণাবলী বিকাশের সুযোগ করে দেয়। নৈতিক অমঙ্গল আমাদের শেখায় ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য এবং মন্দকে প্রতিহত করার সাহস জোগায়।

ঈশ্বর এখানে একজন কঠোর কিন্তু স্নেহশীল পিতার মতো, যিনি তার সন্তানকে কঠিন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জীবনের জন্য প্রস্তুত করছেন, যাতে তারা অবশেষে ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের যোগ্য হয়ে ওঠে। হিক আরও বলেন যে, এই আত্মা-গঠন প্রক্রিয়ার জন্য ঈশ্বরের নিজেকে কিছুটা আড়ালে রাখা প্রয়োজন। তিনি একে বলেন এপিস্টেমিক ডিসটেন্স (Epistemic Distance) বা জ্ঞানতাত্ত্বিক দূরত্ব। ঈশ্বর যদি আমাদের সামনে সব সময় তার শক্তি ও মহিমা নিয়ে হাজির থাকতেন, তবে আমরা ভয়ে বা পুরস্কারের লোভে তার কথা মেনে চলতাম। সেটা হতো পুতুলের মতো আচরণ, সত্যিকারের নৈতিক বিকাশ নয়। তাই ঈশ্বর নিজেকে কিছুটা আড়াল করে রেখেছেন, যাতে আমরা স্বাধীনভাবে তাকে বেছে নিতে পারি এবং নৈতিকভাবে বিকশিত হতে পারি।

সমালোচনা: এই মানবিক আবেদনময় থিওডিসিও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়।

  • দুঃখের পরিমাণ ও ধরন (The problem of quantity and quality of suffering): আত্মা গঠনের জন্য কি এত পরিমাণ দুঃখ-কষ্টের প্রয়োজন আছে? একটি শিশু ক্যানসারে ভুগে তীব্র যন্ত্রণায় মারা যাওয়ার মধ্যে কী ধরনের ‘সোল-মেকিং’ বা আত্মার উন্নতি ঘটছে? তার কষ্টের মাধ্যমে হয়তো তার বাবা-মায়ের আত্মার উন্নতি হচ্ছে, কিন্তু শিশুটির কী লাভ হলো? এই যুক্তি কি অন্যের চরম দুর্ভোগকে নিজেদের আধ্যাত্মিক উন্নতির মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা নয়? এই ধরনের অমঙ্গলকে বলা হয় ডিস্টেলিওলোজিক্যাল ইভিল (dysteleological evil) বা উদ্দেশ্যহীন অমঙ্গল, যা কোনো মহৎ উদ্দেশ্যের দিকে চালিত করে বলে মনে হয় না।

  • ব্যর্থতার উদাহরণ: জগতে এমন অনেক মানুষ আছে যারা দুঃখ-কষ্টের কারণে উন্নত হওয়ার বদলে আরও বেশি হিংস্র, হতাশ এবং মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। তাদের ক্ষেত্রে এই ‘সোল-মেকিং’ প্রক্রিয়াটি তো ব্যর্থ হলো। একজন সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের পরিকল্পনা কি এভাবে ব্যর্থ হতে পারে?

  • পশুর কষ্ট (Animal Suffering): এটি এই থিওডিসির সম্ভবত সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। মানুষের আত্মা গঠনের জন্য পশু-পাখিরা কেন অবর্ণনীয় কষ্ট পাবে? একটি হরিণশাবক যে বনের আগুনে পুড়ে মারা গেল, তার কষ্টের মাধ্যমে কার আত্মার উন্নতি হচ্ছে? পশুদের তো মানুষের মতো নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বিকাশের ক্ষমতা নেই। তাদের এই অবর্ণনীয় কষ্টের কী ব্যাখ্যা? (Rowe, 1979)। তাদের দুর্ভোগ সম্পূর্ণ অর্থহীন বলে মনে হয়।

লিবনিজের সেরা সম্ভাব্য জগৎ (Leibniz’s Best of All Possible Worlds)

জার্মান দার্শনিক গটফ্রিড লিবনিজ (Gottfried Leibniz) এক অত্যন্ত আশাবাদী এবং বিতর্কিত সমাধান দিয়েছিলেন। তার মতে, ঈশ্বর যেহেতু সর্বজ্ঞ, তিনি সব ধরনের সম্ভাব্য জগত (possible worlds) সম্পর্কে জানতেন। তিনি যেহেতু সর্বশক্তিমান, তিনি যেকোনো একটিকে সৃষ্টি করতে পারতেন। আর তিনি যেহেতু পরম দয়ালু, তিনি নিশ্চয়ই সেই জগতটিকেই সৃষ্টি করেছেন, যেটি ‘সম্ভাব্য সব জগতের মধ্যে সেরা’ (the best of all possible worlds) (Leibniz, 1710)।

লিবনিজের যুক্তি হলো, আমরা যে জগতে বাস করছি, আপাতদৃষ্টিতে এতে অনেক ত্রুটি বা অমঙ্গল থাকলেও, সামগ্রিকভাবে এটাই সর্বশ্রেষ্ঠ জগৎ। এর চেয়ে কম অমঙ্গলযুক্ত কোনো জগত তৈরি করতে গেলে হয়তো আরও বড় কোনো মঙ্গল হারিয়ে যেত, অথবা জগতটি যৌক্তিক অসঙ্গতিতে পূর্ণ হয়ে যেত। যেমন, হয়তো স্বাধীন ইচ্ছা ছাড়া কোনো জগত সম্ভব, কিন্তু সেটা হতো রোবটের জগত, যা এর চেয়েও নিকৃষ্ট। অথবা এমন জগত সম্ভব যেখানে প্রাকৃতিক নিয়মগুলো ভিন্ন, কিন্তু তাতে হয়তো প্রাণের বিকাশই সম্ভব হতো না।

এই ধারণাটি অনেকটা দাবা খেলার মতো। একজন গ্র্যান্ডমাস্টার হয়তো সাময়িকভাবে তার একটি সৈন্য বা গজ হারাতে পারেন, কিন্তু সেটা খেলার শেষে জেতার একটি বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ। আমরা সাধারণ মানুষ হিসেবে পুরো ছকটা দেখতে পাই না। আমরা শুধু সৈন্য হারানোর কষ্টটাই দেখি। কিন্তু ঈশ্বর, সেই গ্র্যান্ডমাস্টারের মতো, পুরো খেলাটা দেখতে পান এবং তিনি জানেন যে এই আপাত ‘অমঙ্গল’ একটি বৃহত্তর মঙ্গলের জন্য অপরিহার্য।

সমালোচনা: লিবনিজের এই চরম আশাবাদী তত্ত্বকে ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার (Voltaire) তার বিখ্যাত স্যাটায়ার ‘ক্যান্ডাইড’ (Candide)-এ নির্দয়ভাবে ব্যঙ্গ করেছেন। ১লা নভেম্বর, ১৭৫৫ সালের লিসবন ভূমিকম্প, যেখানে প্রায় ৩০,০০০ থেকে ৫০,০০০ মানুষ মারা যায়, তার প্রতিক্রিয়ায় ভলতেয়ার এই তত্ত্বের অসারতা তুলে ধরেন।

  • অবাস্তব আশাবাদ: এই তত্ত্ব কি জগতের ভয়াবহতাকে অস্বীকার করে না? হলোকাস্ট, রুয়ান্ডার গণহত্যা বা লিসবনের ভূমিকম্পের মতো ঘটনাকে ‘সেরা সম্ভাব্য জগতের’ অংশ বলাটা কি এক ধরনের নিষ্ঠুর পরিহাস নয়?

  • কল্পনার অভাব: ঈশ্বর কি এর চেয়ে ভালো কোনো জগত কল্পনা করতে পারতেন না? যেখানে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাও থাকবে, আবার ক্যানসারের মতো ভয়াবহ প্রাকৃতিক অমঙ্গল থাকবে না? একজন সর্বশক্তিমান সত্তার জন্য এটা কি সত্যিই অসম্ভব? এই দাবিটিকে অনেকটা ঈশ্বরের কল্পনাশক্তিকে সীমিত করে দেখার মতো মনে হয়।

নাস্তিকদের পাল্টা আক্রমণ: যখন প্রমাণই বড় কথা

ক্লাসিক্যাল ‘অমঙ্গলের সমস্যা’ ছিল একটি যৌক্তিক সমস্যা (Logical Problem of Evil)—অর্থাৎ, ঈশ্বর এবং অমঙ্গল যৌক্তিকভাবে একসাথে থাকতে পারে না। কিন্তু আলভিন প্ল্যান্টিংগার ‘ফ্রি উইল ডিফেন্স’ দেখিয়েছে যে এদের সহাবস্থান যৌক্তিকভাবে অসম্ভব নয়। এর প্রতিক্রিয়ায় আধুনিক নাস্তিক দার্শনিকেরা, যেমন উইলিয়াম রো (William Rowe) এবং পল ড্রেপার (Paul Draper), এই সমস্যাটিকে একটি নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরেছেন, যার নাম ‘প্রামাণিক অমঙ্গলের সমস্যা’ (Evidential Problem of Evil)

তাদের যুক্তিটি এমন নয় যে ঈশ্বর এবং অমঙ্গলের সহাবস্থান যৌক্তিকভাবে অসম্ভব। তারা বলেন, জগতে যে পরিমাণ এবং ধরণের অমঙ্গল আমরা দেখি, তা ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রমাণ (evidence) হিসেবে কাজ করে। এটি ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অসম্ভব না বললেও, অত্যন্ত অসম্ভাব্য (highly improbable) করে তোলে।

রো তার বিখ্যাত প্রবন্ধে একটি উদাহরণ দেন, যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে: বনের গভীরে এক জায়গায় বজ্রপাতের কারণে আগুন লেগে গেল। একটি হরিণশাবক সেই আগুনে আটকা পড়ল এবং বেশ কয়েকদিন ধরে অসহ্য যন্ত্রণায় পুড়ে ধীরে ধীরে মারা গেল। এই ঘটনাটি থেকে কোনো মানুষের আত্মার উন্নতি হচ্ছে না, কারণ কেউ এটা দেখছেই না। এখানে কোনো স্বাধীন ইচ্ছার ভূমিকা নেই। এই হরিণশাবকের অবর্ণনীয় এবং সম্পূর্ণ অর্থহীন কষ্টকে কোনো উচ্চতর মঙ্গলের জন্য প্রয়োজন ছিল বলে মনে হয় না। একজন সর্বশক্তিমান ও দয়ালু সত্তা খুব সহজেই এই ঘটনাটি আটকাতে পারতেন—হয়তো বজ্রপাতটি অন্য কোথাও ফেলে, বা হরিণটিকে পালানোর সুযোগ করে দিয়ে। যেহেতু তিনি তা করেননি, এটা প্রমাণ করে যে এমন কোনো দয়ালু সত্তার অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনা খুবই কম (Rowe, 1979)।

এই ধরনের অমঙ্গলকে বলা হয় ‘অপ্রয়োজনীয় বা অর্থহীন অমঙ্গল’ (Gratuitous Evil)। নাস্তিকদের যুক্তি হলো, যদি একটিও অপ্রয়োজনীয় অমঙ্গলের ঘটনা জগতে ঘটে থাকে, তাহলে সর্বশক্তিমান ও দয়ালু ঈশ্বরের অস্তিত্ব থাকতে পারে না। আর আমাদের জগত এই ধরনের অর্থহীন অমঙ্গলের দৃষ্টান্তে ভরপুর।

রুশ ঔপন্যাসিক দস্তয়েভস্কির দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ উপন্যাসে চরিত্র ইভান কারামাজভ এই প্রামাণিক সমস্যাটিকে এক মর্মস্পর্শী রূপ দিয়েছেন। তিনি তার ভাই অ্যালিওশাকে বলেন যে, তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করছেন না, কিন্তু তিনি তার সৃষ্ট জগতকে গ্রহণ করতে পারছেন না। তিনি বলেন, যদি একটি নিষ্পাপ শিশুকে নির্যাতন করে তার চোখের জলের ওপর ভিত্তি করে জগতের সমস্ত সুখ ও সম্প্রীতি গড়ে তুলতে হয়, তাহলেও তিনি সেই সম্প্রীতি চান না। তিনি শ্রদ্ধার সাথে ঈশ্বরের কাছে তার ‘প্রবেশপত্র’ ফিরিয়ে দিতে চান। এই যুক্তিটি বলে যে, কোনো বৃহত্তর মঙ্গলের দোহাই দিয়ে একটি শিশুর অবর্ণনীয় কষ্টকে জাস্টিফাই করা যায় না।

পল ড্রেপার তার ‘হাইপোথিসিস অফ ইনডিফারেন্স’ (Hypothesis of Indifference)-এ বলেন যে, জগতে যে পরিমাণ আনন্দ ও কষ্ট আমরা দেখি, তা একজন দয়ালু বা শয়তান ঈশ্বরের চেয়ে বরং এক উদাসীন, নৈর্ব্যক্তিক প্রাকৃতিক শক্তির অস্তিত্বকেই বেশি সমর্থন করে (Draper, 1989)। একটি উদাসীন প্রকৃতির কাছে আনন্দ বা কষ্ট কোনো বিষয়ই নয়, তাই জগতে উভয়েরই অস্তিত্ব থাকবে—কখনো আনন্দ বেশি, কখনো কষ্ট। এই ব্যাখ্যাটি আমাদের অভিজ্ঞতার সাথে বেশি মেলে।

সংশয়ী আস্তিকতা এবং ঈশ্বরের নীরবতা

প্রামাণিক অমঙ্গলের সমস্যার জবাবে কতিপয় আস্তিক দার্শনিক ‘সংশয়ী আস্তিকতা’ (Skeptical Theism) নামক একটি অবস্থানের কথা বলেন। তাদের যুক্তি খুব সহজ এবং বিনয়ী: মানুষ হিসেবে আমাদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা এবং কল্পনাশক্তি অত্যন্ত সীমিত। আমরা একটি ঘটনার সাথে আরেকটি ঘটনার কার্যকারণ সম্পর্ক পুরোপুরি বুঝতে পারি না।

একটা পিঁপড়ে কি মানুষের বানানো বিশাল একটা ব্রিজ তৈরির উদ্দেশ্য বুঝতে পারে? পারে না। তার কাছে মানুষের কার্যকলাপ অর্থহীন মনে হতে পারে। ঠিক তেমনি, আমরা ঈশ্বরের বিশাল পরিকল্পনা বোঝার মতো ক্ষমতা রাখি না। যে ঘটনাটিকে আমাদের কাছে ‘অর্থহীন’ বা ‘অপ্রয়োজনীয়’ অমঙ্গল বলে মনে হচ্ছে (যেমন হরিণশাবকের মৃত্যু), ঈশ্বরের বৃহত্তর পরিকল্পনায় হয়তো সেটিরও কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে, যা আমাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় (Wykstra, 1984)। হয়তো সেই হরিণের মৃত্যু কোনো এক খাদ্য শৃঙ্খলকে বাঁচিয়ে রেখেছে, যা আবার অন্য কোনো বৃহত্তর প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করছে, যা আমরা কল্পনাও করতে পারি না।

সুতরাং, কোনো অমঙ্গলকে ‘অর্থহীন’ বলে দাবি করার আগে আমাদের নিজেদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে নেওয়া উচিত। আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না যে এর কোনো উদ্দেশ্য নেই, আমরা কেবল বলতে পারি যে আমরা কোনো উদ্দেশ্য দেখতে পাচ্ছি না

সমালোচনা: এই যুক্তিটি একদিকে যেমন ঈশ্বরকে রক্ষা করে, অন্যদিকে এটি ঈশ্বর সম্পর্কে কোনো কিছু জানার সম্ভাবনাকেই নষ্ট করে দেয়। যদি আমরা ঈশ্বরের উদ্দেশ্য কোনোভাবেই বুঝতে না পারি, তাহলে তিনি যে ‘দয়ালু’ বা ‘মঙ্গলময়’, এই দাবিটাই বা আমরা করি কোন যুক্তিতে? জগতের মঙ্গল দেখে যদি আমরা বলি ঈশ্বর দয়ালু, তাহলে অমঙ্গল দেখে কেন বলতে পারব না যে তিনি দয়ালু নন? সবকিছুই যদি এক অজ্ঞতার চাদরে ঢাকা থাকে, তাহলে বিশ্বাস আর অন্ধবিশ্বাসের মধ্যে পার্থক্য কী থাকে? এটি ঈশ্বরকে যেকোনো অভিযোগ থেকে মুক্তি দেওয়ার একটি সহজ উপায় হয়ে দাঁড়ায়, যা বিতর্ককে এগিয়ে নিয়ে যায় না।

প্রাচ্যের দর্শন: কর্মফল এবং এক ভিন্ন দৃষ্টিকোণ

এতক্ষণ আমরা মূলত আব্রাহামিক (ইহুদি, খ্রিস্টান, ইসলাম) ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্যাটি দেখেছি, যেখানে একজন একক, সর্বশক্তিমান, ব্যক্তিগত ঈশ্বরের ধারণা কেন্দ্রীয়। কিন্তু প্রাচ্যের ধর্ম ও দর্শন, যেমন হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম এবং জৈনধর্মে, সমস্যাটিকে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে দেখা হয়।

এখানে কেন্দ্রীয় ধারণাটি হলো কর্ম (Karma) এবং সংসার (Samsara) বা জন্মান্তরবাদ। এই দর্শন অনুযায়ী, জগতের প্রত্যেকটি প্রাণী তার নিজের কর্মের ফল ভোগ করে। এটি একটি স্বয়ংক্রিয় মহাজাগতিক নিয়ম, অনেকটা বিজ্ঞানের কার্যকারণ সূত্রের মতো। ভালো কাজ করলে ভালো ফল, খারাপ কাজ করলে খারাপ ফল। এই ফল এই জীবনে বা পরবর্তী জীবনে ভোগ করতে হয়।

এই কাঠামোতে, অমঙ্গলের জন্য ঈশ্বরকে (বা কোনো একক সত্তাকে) সরাসরি দায়ী করা হয় না। আজকের জীবনে আপনি যে দুঃখ বা কষ্ট পাচ্ছেন, তা আপনার এই জন্মের বা পূর্ববর্তী কোনো জন্মের কৃতকর্মের ফল। সুতরাং, একটি শিশু যদি বিকলাঙ্গ হয়ে জন্মায়, তার কারণ ঈশ্বরের নিষ্ঠুরতা নয়, বরং তার অতীত কর্মফল। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, জগতে কোনো ‘অর্থহীন’ অমঙ্গল নেই। প্রতিটি কষ্টের পেছনেই একটি কার্যকারণ সম্পর্ক রয়েছে, যা হয়তো আমাদের এই সীমিত জীবনে চোখে পড়ে না। ঈশ্বর এখানে একজন বিচারক বা হিসাবরক্ষকের ভূমিকা পালন করতে পারেন, কিন্তু তিনি দুঃখের মূল স্রষ্টা নন।

বৌদ্ধধর্মে দুঃখকে জীবনের একটি মৌলিক সত্য হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। এখানে মূল প্রশ্ন ‘কেন দুঃখ আছে’ নয়, বরং ‘কীভাবে এই দুঃখ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়’। বৌদ্ধধর্মের চারটি আর্যসত্য এবং অষ্টাঙ্গিক মার্গ এই দুঃখ মুক্তির পথই দেখায়। দুঃখের কারণ হলো তৃষ্ণা বা আসক্তি। এই তৃষ্ণাকে নির্বাপিত করতে পারলেই দুঃখের চক্র থেকে মুক্তি বা নির্বাণ লাভ সম্ভব। এখানে অমঙ্গলের জন্য ঈশ্বরের কাছে কৈফিয়ত চাওয়ার বদলে নিজের ভেতরের কারণগুলোকে অনুসন্ধান এবং পরিবর্তনের ওপর জোর দেওয়া হয়।

সমালোচনা: কর্মফল ও জন্মান্তরবাদ ভিত্তিক দর্শনের (মূলত হিন্দু ও জৈনধর্ম) দাবিসমূহের সমালোচনা রয়েছে:

  • ১. প্রমাণের অভাব: পূর্বজন্ম বা কর্মফলের কোনো পরীক্ষামূলক বা বস্তুনিষ্ঠ প্রমাণ নেই। এটি সম্পূর্ণভাবে একটি বিশ্বাসভিত্তিক ধারণা। আবার কেন একজন ব্যক্তির তার পূর্বজন্মের কথা মনে থাকে না, যার কারণে সে তার বর্তমান কষ্টের কারণ জানতে পারে না এবং নিজেকে শুধরে নেওয়ার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হয়? এই “মহাজাগতিক স্মৃতিভ্রংশ” তত্ত্বটিকে যৌক্তিকভাবে দুর্বল করে তোলে।
  • ২. প্রথম কারণের সমস্যা (The Problem of First Cause): এই কর্মের চক্র কবে, কোথায় এবং কেন শুরু হয়েছিল? প্রথম কে খারাপ কাজ করেছিল এবং তার কোনো পূর্ব কর্মফল ছাড়াই সে কেন মন্দকে বেছে নিল? যদি বলা হয় এই চক্র অনাদি বা অনন্ত, তবে তা মূল প্রশ্নের একটি যৌক্তিক সমাধান না দিয়ে তাকে এড়িয়ে যায় মাত্র।
  • ৩. সামাজিক অবিচারের ন্যায্যতা: এই তত্ত্বটি প্রায়শই সামাজিক অবিচার এবং স্থিতাবস্থাকে ন্যায্যতা দেওয়ার একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। একজন দলিত বা নিম্নবর্ণের মানুষ যে কষ্ট পাচ্ছে, সেটাকে তার ‘কর্মফল’ বলে দেগে দিলে তার প্রতি হওয়া কাঠামোগত অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রেরণা কমে যায়। এটি শোষককে তার দায় থেকে মুক্তি দেয় এবং শোষিতকে তার অবস্থার জন্য নিজেকেই দোষী ভাবতে শেখায়।

আবার বৌদ্ধধর্ম অমঙ্গলের সমস্যাটিকে ঈশ্বরের দায় থেকে সরিয়ে ব্যক্তির মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার ওপর স্থাপন করে, কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গিও কিছু কঠিন প্রশ্নের জন্ম দেয়:

  • ১. সমস্যাকে সংজ্ঞায়িত করা, সমাধান নয়: সমালোচকরা বলেন, বৌদ্ধধর্ম অমঙ্গলের সমস্যার (Problem of Evil) সমাধান করে না, বরং সমস্যাটিকেই এড়িয়ে যায় বা পুনঃসংজ্ঞায়িত করে। পশ্চিমা দর্শনে মূল প্রশ্ন হলো, “একজন মঙ্গলময় স্রষ্টা থাকলে জগতে অমঙ্গল কেন?”, যা একটি আধিভৌতিক বা অধিবিদ্যক (metaphysical) প্রশ্ন। বৌদ্ধধর্ম এই প্রশ্নকে সরিয়ে দিয়ে একটি মনস্তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক প্রশ্ন নিয়ে আসে: “কীভাবে দুঃখ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়?”। এটি ব্যক্তির জন্য একটি কার্যকরী পথ হতে পারে, কিন্তু মহাবিশ্বের প্রকৃতিতে অমঙ্গলের অস্তিত্বের কারণ কী—এই মৌলিক দার্শনিক জিজ্ঞাসার কোনো উত্তর দেয় না।
  • ২. বাহ্যিক বনাম অভ্যন্তরীণ অমঙ্গল: বৌদ্ধধর্ম দুঃখের মূল কারণ হিসেবে অভ্যন্তরীণ ‘তৃষ্ণা’কে চিহ্নিত করে। কিন্তু যে শিশুটি সুনামিতে ভেসে যায় বা যে ব্যক্তি স্বৈরাচারী শাসকের হাতে নির্যাতিত হয়, তার দুঃখের মূল কারণ কি সত্যিই তার নিজের ‘তৃষ্ণা’? নাকি এর কারণ হলো বাহ্যিক, নৈর্ব্যক্তিক প্রাকৃতিক শক্তি বা অন্য মানুষের পাশবিকতা? এক্ষেত্রে দুঃখের দায় ভুক্তভোগীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে মনে হতে পারে, যা এক ধরনের “victim-blaming”-এর সামিল। এটি কাঠামোগত এবং বাহ্যিক অমঙ্গলের ভয়াবহতাকে লঘু করে দেখতে উৎসাহিত করতে পারে।
  • ৩. সামাজিক নিষ্ক্রিয়তার ঝুঁকি: যদি সমস্ত জাগতিক বন্ধন ও আসক্তিই দুঃখের কারণ হয় এবং মুক্তির পথ হয় তা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া, তবে এটি কি সামাজিক ও রাজনৈতিক অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রেরণা কমিয়ে দেয় না? জগতের সমস্যাগুলোকে মায়া বা দুঃখের চক্রের অংশ হিসেবে দেখে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার প্রবণতা তৈরি হতে পারে, যা সামাজিক সংস্কার বা বিপ্লবের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। যদিও ইতিহাসে অনেক বৌদ্ধ ভিক্ষু ও অনুসারী সামাজিক কাজে অংশ নিয়েছেন, তবে দর্শনের মূলগত কাঠামোটি ব্যক্তি-কেন্দ্রিক মুক্তিকে প্রাধান্য দেয়, যা সমষ্টিগত জাগতিক উন্নতির চেয়ে ঊর্ধ্বে।

দর্শনের বাইরে: অস্তিত্ববাদের মুখোমুখি

বিংশ শতাব্দীর অস্তিত্ববাদী দার্শনিকেরা, যেমন আলবেয়ার কামু (Albert Camus) এবং জঁ-পল সার্ত্র (Jean-Paul Sartre), এই সমস্যাটিকে একটি ভিন্ন চোখে দেখেছেন। তাদের কাছে, অমঙ্গলের জন্য ঈশ্বরের কাছে কৈফিয়ত চাওয়ার কোনো মানে হয় না, কারণ জগতটাই অন্তর্নিহিতভাবে অর্থহীন ও অযৌক্তিক বা Absurd

কামুর বিখ্যাত উপন্যাস দ্য প্লেগ-এ আমরা দেখি, একটি শহরে প্লেগ মহামারী রূপে ছড়িয়ে পড়েছে। ডাক্তার রিউ (Dr. Rieux) দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন মানুষকে বাঁচাতে, যদিও তিনি জানেন তার এই লড়াই হয়তো শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হবে। তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না, কিন্তু মানুষের প্রতি ভালোবাসার কারণে তিনি এই অর্থহীনতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। কামুর কাছে, জীবনের অর্থ ঈশ্বর বা কোনো মহাজাগতিক পরিকল্পনা থেকে আসে না। অর্থহীনতার মুখে দাঁড়িয়ে বিদ্রোহ করা, ভালোবাসা এবং সংহতি প্রকাশ করার মধ্যেই জীবনের মহত্ব নিহিত (Camus, 1947)। উপন্যাসের আরেক চরিত্র ফাদার প্যানেলু প্রথমদিকে প্লেগকে পাপের শাস্তি হিসেবে ব্যাখ্যা করলেও, একটি নিষ্পাপ শিশুর যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু দেখে তার বিশ্বাস টলে যায়। তিনি তখন বলেন, হয় আমাদের ঈশ্বরকে পুরোপুরি ভালোবাসতে হবে, অথবা পুরোপুরি অস্বীকার করতে হবে, কিন্তু তার বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহই হয়তো সবচেয়ে খাঁটি বিশ্বাস।

‘দ্য মিথ অফ সিসিফাস’-এ কামু সিসিফাসের কথা বলেন, যাকে দেবতারা শাস্তি হিসেবে একটি বিশাল পাথরকে পাহাড়ের চূড়ায় ঠেলে তুলতে বাধ্য করেছেন, যা চূড়ায় পৌঁছানো মাত্রই আবার গড়িয়ে নিচে পড়ে যায়। এই অর্থহীন, অন্তহীন কাজের মধ্যেই কামু মানব অস্তিত্বের প্রতিচ্ছবি দেখেন। কিন্তু তিনি বলেন, “One must imagine Sisyphus happy”। কারণ সিসিফাস তার নিয়তিকে মেনে নিয়েছেন এবং এই অর্থহীন কাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেই তার স্বাধীনতা ও জীবনের অর্থ খুঁজে পেয়েছেন।

শেষ কথা: কৈফিয়ত নয়, বাস্তবতা

তাহলে আমরা কোথায় এসে দাঁড়ালাম? অমঙ্গলের এই ধাঁধা কি সত্যিই অমীমাংসিত? এত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে, এত মত ও যুক্তির গভীরে গিয়ে কি আমরা কোনো কূল-কিনারা পেলাম?

হ্যাঁ, আমরা একটি কূল-কিনারা পেয়েছি। আর সেটি হলো—এটি কোনো মহাজাগতিক রহস্য নয়, বরং একটি ভুলভাবে উপস্থাপিত প্রশ্ন। ‘অমঙ্গলের সমস্যা’ কেবল তাদের জন্যই একটি সমস্যা, যারা এক সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ এবং পরম দয়ালু ঈশ্বরের অস্তিত্বের পূর্বানুমানকে যে কোনো মূল্যে রক্ষা করতে চান। এই ধাঁধাটি ঈশ্বর-বিশ্বাসের কাঠামোর ভেতরেই তৈরি হওয়া এক যৌক্তিক অসঙ্গতি। একবার যদি আমরা সেই ঈশ্বর নামক অনুমানটিকে সরিয়ে দিই, তখন ‘সমস্যা’টিও বাষ্পীভূত হয়ে যায়। তখন যা অবশিষ্ট থাকে, তা কোনো ধাঁধা নয়, তা হলো জগতের নগ্ন, কঠিন বাস্তবতা।

যখন একজন দার্শনিক কফির কাপে ঝড় তোলেন ‘স্বাধীন ইচ্ছা’ বা ‘সোল-মেকিং’ নিয়ে, তখন তা নিছকই একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যায়াম। কিন্তু যখন একজন মা তার মৃত সন্তানের নিথর দেহের পাশে বসে থাকেন, তখন এই সব দার্শনিক তত্ত্ব ফাঁপা এবং অর্থহীন শোনায়। তার কাছে অমঙ্গল কোনো দার্শনিক সমস্যা নয়, এটি এক জীবন্ত, রক্তাক্ত বাস্তবতা। তার বুকের ভেতরের সেই হাহাকার, সেই ‘কেন?’—এর কোনো জবাব কোনো তত্ত্ব দিতে পারে না।

অমঙ্গলের অস্তিত্ব যেন আমাদের এই বার্তা দেয়, আমাদের এই জগত এক উদ্দেশ্যহীন, উদাসীন মহাজাগতিক প্রক্রিয়ার ফল। প্রাকৃতিক অমঙ্গল—যেমন ভূমিকম্প, সুনামি বা ক্যান্সার—কোনো উচ্চতর পরিকল্পনার অংশ নয়; এগুলো হলো পদার্থবিদ্যা এবং জীববিজ্ঞানের নৈর্ব্যক্তিক নিয়মের প্রকাশ। টেকটোনিক প্লেট সরে যায়, ভাইরাস রূপান্তরিত হয়, কোষ বিভাজনে ত্রুটি দেখা দেয়—এগুলোর পেছনে কোনো ইচ্ছা বা উদ্দেশ্য নেই। এগুলো শুধু ঘটে। আর নৈতিক অমঙ্গল—যুদ্ধ, গণহত্যা, ধর্ষণ—ঈশ্বরের দেওয়া ‘স্বাধীনতার’ ভয়ঙ্কর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নয়। এগুলো আমাদের বিবর্তনগত উত্তরাধিকার, আমাদের মস্তিষ্কের রসায়ন এবং আমাদের তৈরি করা সামাজিক কাঠামোর জটিল ফল। লোভ, ভয়, গোষ্ঠীপ্রীতি, ক্ষমতার লিপ্সা—এই বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের ইতিহাসের গভীরে প্রোথিত। এক দিক দিয়ে তাই এর দায় কোনো অদৃশ্য সত্তার ওপর চাপিয়ে দেওয়াটা আমাদের নিজেদের দায়িত্ব অস্বীকার করার একটি সহজ উপায়ও বটে।

এই আলোচনা থেকে আমরা একটা বিষয় দেখতে পাই, কোনভাবেই অমঙ্গল বা ইভলের সংকটটাকে কাটানো যায়না। আর অমঙ্গল আছে বললে ঈশ্বরকেও একই সাথে সর্বশক্তিমান ও পরম দয়ালু বলা যায়না। তবে এখানে আসল প্রশ্নটা হয়তো এটাই যে, এই অমঙ্গলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমরা কী করব। আমরা কি হতাশ হয়ে সবকিছু ছেড়ে দেব? আমরা কি একে অপরকে দোষারোপ করব? নাকি একে অপরের হাত ধরে এই দুঃখের সাগর পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করব? অন্যের কষ্টে সহানুভূতি জানানো, বিপদগ্রস্তকে সাহায্য করা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো—এগুলোই হয়তো অমঙ্গলের মুখে আমাদের সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে মানবিক জবাব। ডাক্তার রিউ-এর মতো, হয়তো আমরা জানি যে আমরা প্লেগকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করতে পারব না, কিন্তু তার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়াটাই আমাদের মানুষ হিসেবে পরিভাষিত করে।

এই লেখায় আমি অমঙ্গলের ধাঁধাটির যে সমাধান দিলাম তা অনেকের কাছেই হয়তো স্বস্তিদায়ক হবেনা। কিন্তু এই সমাধানটা কি আমাদের এক দিক দিয়ে আমাদের মুক্তও করে না? এটি আমাদের কৈফিয়ত খোঁজার দায় থেকে মুক্তি দিয়ে কি কাজ করার জগতে ফিরিয়ে আনে না? বলে না যে এখন আর এসব নিয়ে চিন্তা নয়, এখন আমাদের সামনে কেবল এক বিশাল কর্মযজ্ঞ? এই সমাধানটা আমাদের বলে, এই সুন্দর অথচ নিষ্ঠুর পৃথিবীতে আমাদেরই চেষ্টা করতে হবে একটুখানি মঙ্গল আনার, সংগ্রাম করতে হবে এই অন্ধকারে একটুখানি আলো তৈরি করার জন্য।

তথ্যসূত্র

  • Augustine. (2006). Confessions (H. Chadwick, Trans.). Oxford University Press. (Original work published c. 400 AD).
  • Camus, A. (1955). The Myth of Sisyphus and Other Essays (J. O’Brien, Trans.). Alfred A. Knopf. (Original work published 1942).
  • Camus, A. (1991). The Plague (S. Gilbert, Trans.). Vintage International. (Original work published 1947).
  • Dostoevsky, F. (2002). The Brothers Karamazov (R. Pevear & L. Volokhonsky, Trans.). Farrar, Straus and Giroux. (Original work published 1880).
  • Draper, P. (1989). Pain and Pleasure: An Evidential Problem for Theists. Noûs, 23(3), 331–350.
  • Hick, J. (1966). Evil and the God of Love. Macmillan.
  • Hume, D. (2007). Dialogues Concerning Natural Religion. Cambridge University Press. (Original work published 1779).
  • Leibniz, G. W. (1985). Theodicy: Essays on the Goodness of God, the Freedom of Man and the Origin of Evil (E. M. Huggard, Trans.). Open Court. (Original work published 1710).
  • Mackie, J. L. (1955). Evil and Omnipotence. Mind, 64(254), 200–212.
  • Plantinga, A. (1974). God, Freedom, and Evil. Harper & Row.
  • Rowe, W. L. (1979). The Problem of Evil and Some Varieties of Atheism. American Philosophical Quarterly, 16(4), 335–341.
  • Voltaire. (2006). Candide, or Optimism (T. Smollett, Trans.). Dover Publications. (Original work published 1759).
  • Wykstra, S. J. (1984). The Humean Obstacle to Evidential Arguments from Suffering: On Avoiding the Evils of “Appearance”. International Journal for Philosophy of Religion, 16(2), 73–93.

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.