Table of Contents
ভূমিকা
অনেক সময় অনেকের মাথায় প্রশ্ন আসে, আচ্ছা, মুসলমানরা একসময় জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্যে পৃথিবীকে নেতৃত্ব দিয়েছিল। বাগদাদ, কর্ডোবা, কায়রোর পাঠাগারগুলো ছিল পৃথিবীর জ্ঞানের বাতিঘর। সেই তারা আজ কোথায়? তাদের সেই সোনালি অতীত কোথায় হারিয়ে গেল? এই যে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস থেকে উঠে আসা প্রশ্ন, এই প্রশ্নটাই হলো ইসলামিক পুনর্জাগরণের (Islamic Renaissance) প্রথম, এবং সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
এটা কোনো একজন মানুষের গল্প নয়। এটা কোটি কোটি মানুষের গল্প। একটা বিশাল ঘুমন্ত দৈত্যের নড়েচড়ে বসার গল্প। যে দৈত্য কয়েক শতাব্দী ধরে গভীর ঘুমে অচেতন ছিল। এই ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা যারা করেছিলেন, তাদের নিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা। এই আলোচনার পথে আমরা অনেক জটিল প্রশ্নের মুখোমুখি হব, অনেক কঠিন বিতর্কে প্রবেশ করব। আমাদের পথ কখনও জামাল উদ্দিন আফগানির মতো বিপ্লবী চিন্তার অলিতেগলিতে ঘুরবে, কখনও স্যার সৈয়দ আহমদের মতো বাস্তববাদী পথের ধুলো মাখবে, আবার কখনও আল্লামা ইকবালের কবিতার দার্শনিক আকাশে উড়াল দেবে। চলুন, সেই ঘুমিয়ে থাকা দৈত্যের জেগে ওঠার গল্পটা শুরু করা যাক।
পুনর্জাগরণ জিনিসটা কী? এক ইউরোপীয় আয়না ও এক ইসলামি চেহারা
পুনর্জাগরণ বা রেনেসাঁস (Renaissance) শব্দটা শুনলেই আমাদের মনে ভেসে ওঠে ইউরোপের কথা। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, মাইকেলেঞ্জেলো, রাফায়েল, গ্যালিলিও—এইসব নাম। ইউরোপীয় রেনেসাঁস ছিল এমন এক মহাযজ্ঞ, যার মাধ্যমে ইউরোপ মধ্যযুগের ধর্মীয় গোঁড়ামি আর অন্ধকারের জাল ছিন্ন করে প্রাচীন গ্রিক ও রোমান জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকে নিজেদের নতুন করে আবিষ্কার করেছিল। তারা তাদের খ্রিষ্টীয় পরিচয়ের বাইরে এক ক্লাসিক্যাল বা ধ্রুপদী অতীতের সন্ধান পেয়েছিল, যা তাদের শিল্প, সাহিত্য, রাজনীতি এবং বিজ্ঞানকে আমূল বদলে দেয়।
ইসলামিক পুনর্জাগরণও অনেকটা তেমনই, তবে এর প্রেক্ষাপট, চরিত্র এবং উদ্দেশ্য ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। এটি ছিল মূলত ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীতে মুসলিম বিশ্বের চিন্তাবিদ, আলেম এবং নেতাদের একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা। এর চালিকাশক্তি ইউরোপের মতো অভ্যন্তরীণ ছিল না, বরং এর জন্ম হয়েছিল এক চরম বাহ্যিক আঘাত থেকে—আর তা হলো পশ্চিমা ঔপনিবেশিকতার (Western Colonialism) আগ্রাসন। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল দুটি:
- ১. মুসলিম বিশ্ব কেন জ্ঞান-বিজ্ঞান, সামরিক শক্তি এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায় পশ্চিমা বিশ্বের চেয়ে পিছিয়ে পড়ল, তার কারণ অনুসন্ধান করা। এটা ছিল এক নির্মম আত্ম-সমালোচনা (self-criticism)।
- ২. ইসলামকে আধুনিক বিশ্বের চ্যালেঞ্জগুলোর (যেমন: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, বিজ্ঞান, নারী অধিকার) সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য এর মূল উৎস—অর্থাৎ কুরআন ও সুন্নাহর নতুন ব্যাখ্যা দেওয়া (Esposito, 2010)।
সহজ ভাষায় বললে, এটা ছিল একটা পুরনো, ঐতিহ্যবাহী বাড়ির মেরামত কাজের মতো। বাড়ির ভিত্তিটা (ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস) ঠিক রেখে ক্ষয়ে যাওয়া দেয়াল (শিক্ষা ব্যবস্থা), মরচে ধরা জানালা (আইন ও বিচার) আর পুরনো আসবাবপত্রকে (সমাজ ও রাজনীতি) যুগোপযোগী করে তোলার এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। ইউরোপীয় রেনেসাঁস যেখানে তাদের ধর্মীয় পরিচয়ের আগের যুগে ফিরে গিয়েছিল, সেখানে ইসলামিক পুনর্জাগরণের প্রবক্তারা ফিরে যেতে চেয়েছিলেন তাদের ধর্মেরই একেবারে শৈশবে—নবী মুহাম্মদ এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগে, যাকে তারা ইসলামের সবচেয়ে বিশুদ্ধ রূপ বলে মনে করতেন (Hourani, 1983)।
ঘুমটা কেন এসেছিল? পতন এবং স্থবিরতার গভীর প্রেক্ষাপট
কোনো জাগরণের গল্প বলতে গেলে আগে ঘুমের কারণটা বলতে হয়। মুসলিম বিশ্ব কেন পিছিয়ে পড়ল? এর উত্তর এক কথায় দেওয়া কঠিন। এটি কোনো একটি কারণে ঘটেনি, বরং এটি ছিল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক—অনেকগুলো নদীর এক মোহনায় মিলিত হওয়ার মতো একটি ঘটনা।
রাজনৈতিক পতন: সাম্রাজ্যের ভাঙা মিনার
একসময় তিনটি বিশাল মুসলিম সাম্রাজ্য—তুরস্কের অটোমান, পারস্যের সাফাভি এবং ভারতের মুঘল সাম্রাজ্য—ছিল পৃথিবীর অন্যতম প্রধান শক্তি। তাদের বলা হতো ‘গানপাউডার এম্পায়ারস’ (Gunpowder Empires)। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর পর থেকে এই সাম্রাজ্যগুলো ভেতর থেকে দুর্বল হতে শুরু করে।
-
অটোমান সাম্রাজ্য: যাকে একসময় ইউরোপ সমীহ করে চলত, সেই অটোমান সাম্রাজ্য ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে পরিণত হয় ‘ইউরোপের রুগ্ন পুরুষে’ (The Sick Man of Europe)। একের পর এক যুদ্ধে (যেমন: রাশিয়া-তুর্কি যুদ্ধ) পরাজয়, বলকান অঞ্চলে জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহ, এবং সালতানাতের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও বিলাসিতা সাম্রাজ্যকে ভেতর থেকে খেয়ে ফেলছিল। নেপোলিয়নের মিশর আক্রমণ (১৭৯৮) ছিল মুসলিম বিশ্বের জন্য এক বিরাট মনস্তাত্ত্বিক ধাক্কা। তারা প্রথমবার বুঝতে পারে, ইউরোপের আধুনিক সামরিক সংগঠন ও প্রযুক্তির কাছে তারা কতটা অসহায় (Lewis, 2002)।
-
মুঘল সাম্রাজ্য: সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর (১৭০৭) পর থেকেই মুঘলদের পতন শুরু হয়। অভ্যন্তরীণ কোন্দল, মারাঠা ও শিখদের উত্থান এবং প্রাদেশিক শাসকদের স্বাধীনতা ঘোষণা—এই সবকিছু মিলিয়ে সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। এই সুযোগে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ধীরে ধীরে তাদের বাণিজ্যিক উপস্থিতিকে রাজনৈতিক ও সামরিক আধিপত্যে রূপান্তরিত করে। পলাশীর যুদ্ধ (১৭৫৭) এবং সিপাহী বিদ্রোহ (১৮৫৭) ছিল এই পতনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক, যার পর ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটিশ রাজের অধীনে চলে যায়।
-
সাফাভি সাম্রাজ্য: পারস্যের সাফাভি সাম্রাজ্য অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতেই অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ এবং আফগান আক্রমণের মুখে ভেঙে পড়ে। এর ফলে যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়, তা পারস্যকে রাশিয়া ও ব্রিটেনের প্রভাব বলয়ে নিয়ে আসে।
এই রাজনৈতিক পতন মুসলিমদের আত্মবিশ্বাসকে চুরমার করে দেয়। যারা একসময় বিজয়ী ছিল, তারা হয়ে গেল বিজিত। এই পরাজয়বোধই তাদের চিন্তাশীল মানুষদের মনে প্রথম প্রশ্ন তৈরি করে—‘কেন?’
বৌদ্ধিক স্থবিরতা (Intellectual Stagnation): ইজতিহাদের বন্ধ দরজা
মুসলিম সভ্যতার সোনালি যুগে (আনুমানিক ৮ম থেকে ১৩শ শতাব্দী) ইজতিহাদের (Ijtihad) বা স্বাধীন আইনি ও ধর্মতাত্ত্বিক গবেষণার দরজা খোলা ছিল। ইজতিহাদ মানে হলো, পরিবর্তিত পরিস্থিতি অনুযায়ী কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে নতুন সমস্যার সমাধান খোঁজা। ইমাম আবু হানিফা, ইমাম শাফিঈ, ইবনে সিনা, আল-বিরুনি, ইবনে রুশদ—এরা সবাই ছিলেন তাদের যুগের শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ, যারা জ্ঞানচর্চায় কোনো সীমানা মানতেন না।
কিন্তু ১২৫৮ সালে মোঙ্গলদের হাতে বাগদাদের পতনকে অনেক ইতিহাসবিদ একটি প্রতীকী মোড় হিসেবে দেখেন। এই ধ্বংসযজ্ঞ মুসলিম মননে এক গভীর নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করে। এরপর থেকে আলেমদের মধ্যে এক ধরনের রক্ষণশীল মনোভাব জন্মায়। তারা মনে করতে লাগলেন যে, ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো আগের মহান ইমামরা (ইজতিহাদকারী ইমামগণ) চূড়ান্ত করে গেছেন, তাই নতুন করে ভাবার কিছু নেই। তাদের কাজ হলো কেবল পূর্বসূরিদের ব্যাখ্যাকে অন্ধভাবে অনুসরণ করা বা তাকলিদ (Taqlid)। ফলে ইজতিহাদের দরজা কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। ফজলুর রহমানের মতো পণ্ডিতরা যুক্তি দেখান যে, এই চিন্তাগত স্থবিরতা মুসলিম সমাজকে নতুন জ্ঞান গ্রহণ এবং সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া থেকে বিরত রাখে (Rahman, 1982)।
অর্থনৈতিক বিপর্যয়: বদলে যাওয়া বাণিজ্য পথ
পঞ্চদশ শতাব্দীর পর ইউরোপীয় অভিযাত্রীরা নতুন সমুদ্রপথ আবিষ্কার করলে (যেমন: ভাস্কো দা গামার ভারতে আগমন) বিশ্ব বাণিজ্যের কেন্দ্র ভূমধ্যসাগর ও ভারত মহাসাগর থেকে আটলান্টিক মহাসাগরে সরে যায়। এর ফলে ঐতিহ্যবাহী সিল্ক রোড এবং মুসলিম বিশ্বের মধ্য দিয়ে যাওয়া বাণিজ্য পথগুলো তাদের গুরুত্ব হারায়। এতে অটোমান, পারস্য এবং মুঘল সাম্রাজ্যের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অর্থনৈতিক দুর্বলতা তাদের সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তিকেও দুর্বল করে দেয়। ইউরোপীয় শক্তিগুলো এই সুযোগে তাদের সস্তা শিল্পপণ্য দিয়ে মুসলিম বাজার দখল করে নেয় এবং তাদের কাঁচামাল শোষণ করতে শুরু করে, যা ছিল অর্থনৈতিক উপনিবেশবাদের প্রথম ধাপ (Chaudhuri, 1985)।
শিক্ষা ব্যবস্থার সংকট: আধুনিকতা থেকে বিচ্ছিন্নতা
মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা একটা সময় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিক্ষাব্যবস্থা ছিল। সেখানে ধর্মতত্ত্বের পাশাপাশি দর্শন, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাবিজ্ঞান—সবই পড়ানো হতো। কিন্তু পতনের যুগে এই শিক্ষাব্যবস্থা সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। পাঠ্যক্রম থেকে যুক্তিনির্ভর ও বৈষয়িক বিজ্ঞানগুলো (Rational and Worldly Sciences) প্রায় হারিয়ে যায় এবং এটি মূলত ধর্মতত্ত্ব ও আইনশাস্ত্রের পুনরাবৃত্তিমূলক চর্চায় পরিণত হয়। ফলে মাদরাসা থেকে বের হওয়া আলেমরা আধুনিক বিশ্বের জটিলতা বোঝার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হন। এর ফলে সমাজে দুই ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি হয়—একদিকে ঐতিহ্যবাহী মাদরাসা, অন্যদিকে ঔপনিবেশিক শাসকদের প্রতিষ্ঠিত আধুনিক স্কুল-কলেজ। এই দুই ধারার মধ্যে তৈরি হয় এক বিশাল মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দূরত্ব।
এই প্রেক্ষাপটেই মুসলিম বিশ্বের চিন্তাশীল মানুষদের মনে হলো, কিছু একটা করা দরকার। এই গভীর ঘুম থেকে জাতিকে জাগাতে হবে।
জাগরণের নানা সুর: প্রধান ধারাগুলো
ইসলামিক পুনর্জাগরণের প্রচেষ্টা কোনো একক, সরলরৈখিক আন্দোলন ছিল না। এটি ছিল বিভিন্ন ধারার চিন্তার এক জটিল মিশ্রণ। অনেকটা অর্কেস্ট্রার মতো, যেখানে প্রত্যেকে নিজের যন্ত্র বাজাচ্ছে, কিন্তু সবার লক্ষ্য একটাই—মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি নতুন, শক্তিশালী সুর তৈরি করা। প্রধানত তিনটি ধারা বা প্রবণতা আমরা দেখতে পাই, যদিও বাস্তবে এগুলোর মধ্যে অনেক লেনদেন ও মিশ্রণ ছিল।
সালাফিবাদ বা সংস্কারবাদ (Salafism/Reformism): “শেকড়ের দিকে ফিরে চলো”
এই ধারার মূল কথা ছিল—”ফিরে চলো শেকড়ের দিকে” (Return to the sources)। তাদের মতে, মুসলিমদের পতনের মূল কারণ হলো তারা ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে দূরে সরে গেছে এবং সময়ের সাথে সাথে ইসলামে অনেক অপ্রয়োজনীয় প্রথা, কুসংস্কার এবং বিদ’আত (بدعة – heretical innovation) প্রবেশ করেছে, বিশেষ করে সুফিবাদের কিছু লৌকিক চর্চা এবং পীরপূজা। তাই মুক্তি পেতে হলে প্রথম যুগের মুসলিমদের (সালাফ আস-সালেহীন: The Pious Predecessors) মতো করে ইসলামকে বুঝতে ও পালন করতে হবে।
কিন্তু এই ‘ফিরে চলো’র আহ্বানের মধ্যেও দুটি ভিন্ন সুর ছিল:
-
শুদ্ধতাবাদী ধারা (Puritanical Stream): এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো অষ্টাদশ শতাব্দীতে আরবে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাবের (Muhammad ibn Abd al-Wahhab) আন্দোলন, যা ওয়াহাবিবাদ নামে পরিচিত। এই আন্দোলন যেকোনো ধরনের বিদ’আতের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর ছিল এবং ইসলামের আক্ষরিক ও কঠোর ব্যাখ্যার ওপর জোর দিত। তারা মাজার, স্মৃতিস্তম্ভ এবং অনেক সুফি আচার-অনুষ্ঠানকে শিরক (شرك – polytheism) বলে মনে করত। এই ধারাটি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান বা পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিও ছিল সন্দিহান।
-
সংস্কারবাদী ধারা (Reformist Stream): ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে জামাল উদ্দিন আফগানি এবং তার ছাত্র মুহাম্মদ আবদুহ এই ধারার নেতৃত্ব দেন। তারা সালাফিদের মতোই কুরআন ও সুন্নাহর দিকে ফিরে যাওয়ার কথা বলতেন এবং তাকলিদের বিরোধিতা করতেন। কিন্তু তারা ওয়াহাবিদের মতো আধুনিকতা-বিরোধী ছিলেন না। বরং তারা বলতেন, শেকড়ে ফিরতে হবে ঠিকই, কিন্তু আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানকে বর্জন করে নয়। তাদের মতে, যুক্তিবাদ (Rationalism) এবং বিজ্ঞান ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারা ইজতিহাদের বন্ধ দরজা নতুন করে খোলার কথা বলতেন, যাতে ইসলাম আধুনিক যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারে (Hourani, 2002)।
ইসলামি আধুনিকতাবাদ (Islamic Modernism): “সমন্বয়ের পথে হাঁটা”
এই ধারার প্রবক্তারা ছিলেন মূলত পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত বা পশ্চিমা চিন্তাধারার সঙ্গে গভীরভাবে পরিচিত। তারা মনে করতেন, ইসলাম এবং আধুনিকতার (Modernity) মধ্যে কোনো মৌলিক সংঘাত নেই। পশ্চিমাদের শক্তি কেবল তাদের সামরিক ক্ষমতায় নয়, বরং তাদের যুক্তিবাদ, বিজ্ঞান, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং আইনের শাসনে নিহিত। তাই মুসলিমদের টিকে থাকতে হলে এবং উন্নতি করতে হলে এই বিষয়গুলোকে গ্রহণ করতে হবে, তবে ইসলামের নিজস্ব কাঠামোর ভেতরে।
-
ভারতের স্যার সৈয়দ আহমদ খান এই ধারার অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। তিনি মুসলিমদের জন্য আধুনিক ইংরেজি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়) গড়ে তোলেন। তার যুক্তি ছিল, মুসলমানরা যদি আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ না করে, তবে তারা হিন্দুদের তুলনায় এবং ব্রিটিশ শাসনে চিরকাল পিছিয়ে থাকবে।
-
মিশরে মুহাম্মদ আবদুহ (যাকে সালাফি-সংস্কারবাদী এবং আধুনিকতাবাদী—দুই দলেই ফেলা যায়) আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম সংস্কারের চেষ্টা করেন, যাতে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানেরও চর্চা হয়।
-
আধুনিকতাবাদীরা পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইসলামের আলোকে গ্রহণ করার কথা বলতেন। যেমন, গণতন্ত্রকে তারা ইসলামের ‘শূরা’ (الشورى – consultation) নীতির আধুনিক রূপ হিসেবে ব্যাখ্যা করতেন, যা আল্লাহ তায়ালা কুরআনে উল্লেখ করেছেন। তারা পশ্চিমা আইনের ইতিবাচক দিকগুলো গ্রহণ করে ইসলামি আইনের সংস্কার বা ‘তাকনিন’ (تقنين – codification) এর পক্ষে ছিলেন (Esposito, 2010)।
রাজনৈতিক ইসলাম বা ইসলামবাদ (Political Islam/Islamism): “ইসলামই সমাধান”
এই তৃতীয় ধারাটি মনে করত, মুসলিমদের সমস্যা কেবল চিন্তাগত বা সামাজিক নয়, বরং মূল সমস্যাটি রাজনৈতিক। তাদের মতে, মুসলিমদের উপর চাপিয়ে দেওয়া পশ্চিমা ঔপনিবেশিকতা এবং এর ফলস্বরূপ তৈরি হওয়া ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ (Secular Nationalism) হলো সব সমস্যার মূল। ইসলাম শুধু ব্যক্তিগত ইবাদত বা আধ্যাত্মিকতার বিষয় নয়, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা (দ্বীন- comprehensive way of life), যা সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি—জীবনের সব ক্ষেত্রকে দিকনির্দেশনা দেয়। তাই প্রকৃত পুনর্জাগরণ সম্ভব কেবল তখনই, যখন সমাজ ও রাষ্ট্রকে ইসলামের আইন বা শরিয়াহ (Sharia) দ্বারা পরিচালনা করা হবে।
-
মিশরে হাসান আল-বান্নার প্রতিষ্ঠিত ইখওয়ানুল মুসলিমিন (Muslim Brotherhood) বা ভারতীয় উপমহাদেশে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদীর জামায়াতে ইসলামী এই ধারার প্রধান উদাহরণ। তাদের লক্ষ্য ছিল একটি ইসলামি রাষ্ট্র (Islamic State) প্রতিষ্ঠা করা, যা মুসলিম উম্মাহর (Ummah) হারানো ঐক্য ও গৌরব ফিরিয়ে আনবে এবং পশ্চিমা সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্যের অবসান ঘটাবে (Mitchell, 1969; Nasr, 1996)। এই ধারাটি প্রায়শই পশ্চিমা উদারনৈতিক ধারণার (যেমন: ধর্মনিরপেক্ষতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য) তীব্র সমালোচক ছিল।
এই তিনটি ধারা প্রায়ই একে অপরের সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হতো। আধুনিকতাবাদীরা ইসলামিস্টদের পশ্চাৎমুখী মনে করতেন, ইসলামিস্টরা আধুনিকতাবাদীদের ‘পশ্চিমের দালাল’ বলে অভিযুক্ত করতেন, আর ঐতিহ্যবাহী আলেমরা উভয় দলকেই ইসলামের জন্য বিপজ্জনক মনে করতেন। কিন্তু তাদের সবার মধ্যেই একটি সাধারণ আকাঙ্ক্ষা ছিল—মুসলিম বিশ্বের পুনর্জাগরণ।
মঞ্চের কুশীলব: সেই সব স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষেরা
যেকোনো বড় পরিবর্তনের গল্পে কিছু নায়ক বা অনুঘটক থাকেন। ইসলামিক পুনর্জাগরণের মঞ্চেও এমন কিছু যুগান্তকারী ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যাদের চিন্তা ও কাজ গোটা মুসলিম বিশ্বকে নাড়া দিয়েছিল। তাদের প্রত্যেকের গল্পই যেন এক একটি মহাকাব্য।
জামাল উদ্দিন আফগানি (১৮৩৮-১৮৯৭): এক রহস্যময় আগুনের গোলক
আফগানিকে বলা হয় ইসলামিক পুনর্জাগরণের ‘প্যান্থার’। তিনি ছিলেন এক রহস্যময়, ক্যারিশম্যাটিক এবং অস্থির প্রকৃতির মানুষ। তার জন্মস্থান নিয়ে বিতর্ক আছে, কেউ বলেন আফগানিস্তান, কেউ বলেন ইরান (যা তাকে শিয়া প্রমাণ করে)। এই রহস্য তিনি নিজেও জিইয়ে রাখতেন, সম্ভবত প্যান-ইসলামিক ঐক্যের স্বার্থে সুন্নি-শিয়া বিভেদের ঊর্ধ্বে থাকতে। তিনি সারা জীবন এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন—ভারত, মিশর, তুরস্ক, পারস্য, রাশিয়া, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড। যেখানেই গেছেন, সেখানেই তিনি মুসলিম তরুণদের মনে ঔপনিবেশিকতাবিরোধী এবং প্যান-ইসলামিজমের (Pan-Islamism) বা সর্ব-ইসলামবাদের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছেন।
প্যারিসে বসে তিনি বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক আর্নেস্ট রেনানের সঙ্গে এক বিতর্কে জড়ান, যেখানে রেনান দাবি করেন যে ইসলাম তার প্রকৃতির কারণেই বিজ্ঞান ও যুক্তির বিরোধী। আফগানি এর উত্তরে যুক্তি দেন যে, সমস্যাটি ইসলামের নয়, বরং মুসলিমদের বর্তমান চিন্তাগত স্থবিরতার। তিনি বলেন, যেকোনো ধর্মই তার প্রাথমিক অবস্থায় যুক্তির পথ রোধ করে, কিন্তু পরে তা পরিবর্তিত হয়, যেমনটি খ্রিষ্টধর্মের ক্ষেত্রে হয়েছে। তার এই বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই ইউরোপেও আলোড়ন তোলে (Keddie, 1972)। তার মূল বক্তব্য ছিল: মুসলিম বিশ্ব এক উম্মাহ। জাতীয়তাবাদের নামে এই বিভেদ কৃত্রিম এবং পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের অংশ। পশ্চিমাদের অন্ধ অনুকরণ না করে তাদের শক্তির উৎস—বিজ্ঞান ও দর্শন—অর্জন করতে হবে। আফগানি নিজে খুব বেশি কিছু লিখে যাননি, কিন্তু তার প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা ‘আল-উরওয়াহ আল-উসকা’ (Al-Urwah al-Wuthqa – The Firmest Bond) এবং তার জ্বালাময়ী বক্তৃতার মাধ্যমে তিনি একটি প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। তিনি ছিলেন সেই স্ফুলিঙ্গ, যা থেকে দাবানলের শুরু হয়।
মুহাম্মদ আবদুহ (১৮৪৯-১৯০৫): সংস্কারের নীরব স্থপতি
আফগানি যদি হন ঝড়, তবে তার ছাত্র মুহাম্মদ আবদুহ হলেন শান্ত, গভীর নদী। আবদুহ ছিলেন মিশরের একজন আলেম এবং পরবর্তীকালে মিশরের প্রধান মুফতি। তিনি বুঝেছিলেন, কেবল জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন সম্ভব নয়। পরিবর্তন আনতে হলে শিক্ষাব্যবস্থা, আইন এবং মানুষের চিন্তার জগতে কাজ করতে হবে। আফগানির সঙ্গে নির্বাসনে থাকাকালীন তিনি পশ্চিমা জগৎকে কাছ থেকে দেখেন এবং এর শক্তি ও দুর্বলতা দুটোই উপলব্ধি করেন।
তার প্রধান কাজগুলো ছিল:
-
শিক্ষার সংস্কার: তিনি আল-আজহারের মতো ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানে আধুনিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করেন। তিনি বলতেন, “আমি পশ্চিমকে দেখলাম, সেখানে ইসলাম আছে কিন্তু মুসলিম নেই। আর পূর্বে এলাম, এখানে মুসলিম আছে কিন্তু ইসলাম নেই।” তার এই উক্তি মুসলিম সমাজের অধঃপতনের এক নিদারুণ চিত্র তুলে ধরে।
-
ইজতিহাদের পক্ষে লড়াই: তিনি তাকলিদ বা অন্ধ অনুকরণের তীব্র সমালোচনা করেন এবং কুরআন-সুন্নাহর যুক্তিবাদী ব্যাখ্যার ওপর জোর দেন। তিনি বলতেন, ইসলামে ধর্মগুরু বা পোপতন্ত্রের (priesthood) কোনো স্থান নেই। প্রতিটি মুসলমানের অধিকার আছে সরাসরি কুরআন বোঝার চেষ্টা করার।
-
আইনি সংস্কার: প্রধান মুফতি হিসেবে তিনি কিছু যুগান্তকারী ফতোয়া দেন। যেমন, তিনি নির্দিষ্ট কিছু শর্তে ব্যাংকের সুদকে জায়েজ বলেন এবং ইউরোপীয় পোশাক পরাকে অনুমোদিত ঘোষণা করেন, যা সেই সময়ে ছিল বৈপ্লবিক (Hourani, 2002)। আবদুহর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী এবং তার শিষ্যরা, যেমন রশিদ রিদা, তার চিন্তাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান।
রশিদ রিদা (১৮৬৫-১৯৩৫): আধুনিকতা থেকে রক্ষণশীলতার দিকে যাত্রা
মুহাম্মদ আবদুহর সবচেয়ে বিখ্যাত ছাত্র ছিলেন সিরীয় বংশোদ্ভূত রশিদ রিদা। তিনি কায়রোতে চলে আসেন এবং আবদুহর সঙ্গে মিলে ‘আল-মানার’ (Al-Manar – The Lighthouse) নামে একটি প্রভাবশালী পত্রিকা প্রকাশ করেন, যা ৩২ বছর ধরে চলেছিল। প্রথমদিকে তিনি আবদুহর আধুনিকতাবাদী চিন্তার একনিষ্ঠ প্রচারক ছিলেন। কিন্তু আবদুহর মৃত্যুর পর এবং পশ্চিমা ঔপনিবেশিকতার আগ্রাসন বাড়তে থাকায় রিদার চিন্তা ধীরে ধীরে রক্ষণশীলতার দিকে ঝুঁকে পড়ে। তিনি পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রতি সন্দিহান হয়ে ওঠেন এবং সৌদি আরবের ওয়াহাবি আন্দোলনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। তিনি এমন একটি ইসলামি রাষ্ট্রের ধারণা দেন, যা খিলাফতের আদলে গঠিত হবে এবং শরিয়াহ দ্বারা পরিচালিত হবে, তবে আধুনিক যুগের চাহিদা পূরণে সক্ষম হবে। রিদাকে তাই আবদুহর আধুনিকতাবাদ এবং পরবর্তীকালের ইসলামবাদের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু হিসেবে দেখা হয় (Hourani, 1983)।
স্যার সৈয়দ আহমদ খান (১৮১৭-১৮৯৮): বাস্তববাদী এক শিক্ষাবিদ
ভারতীয় উপমহাদেশে পুনর্জাগরণের চিন্তা কিছুটা ভিন্ন পথে হেঁটেছিল। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর ভারতে মুসলিমরা ব্রিটিশদের রোষানলে পড়ে এবং শিক্ষাদীক্ষা, চাকরি-বাকরি থেকে পিছিয়ে যেতে থাকে। এই অবস্থায় স্যার সৈয়দ আহমদ খান মুসলিমদের জন্য একজন ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন।
তিনি ছিলেন একজন কট্টর বাস্তববাদী। তিনি বুঝতেন, ব্রিটিশদের সঙ্গে লড়াই করে এই মুহূর্তে জেতা সম্ভব নয়। তাই তার কৌশল ছিল:
-
ব্রিটিশদের সঙ্গে সহযোগিতা: তিনি মুসলিমদের বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, ব্রিটিশদের শত্রু না ভেবে তাদের সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক তৈরি করতে হবে।
-
আধুনিক শিক্ষার প্রসার: তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি হলো ১৮৭৫ সালে মোহামেডান অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা, যা পরে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল এমন একটি মুসলিম প্রজন্ম তৈরি করা, যারা পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ব্রিটিশ প্রশাসনে নিজেদের জায়গা করে নিতে পারবে।
-
ধর্মের যুক্তিবাদী ব্যাখ্যা: আবদুহর মতোই তিনিও কুরআনের একটি যুক্তিনির্ভর ব্যাখ্যা দাঁড় করান, যা ‘নেচারি’ (Nechari) বা প্রকৃতিবাদী হিসেবে সমালোচিত হয়েছিল। তিনি অলৌকিক ঘটনা এর আক্ষরিক ব্যাখ্যা এড়িয়ে যেতেন এবং প্রকৃতির আইনের (Law of Nature) ওপর জোর দিতেন (Lelyveld, 1978)। অনেক ঐতিহ্যবাহী আলেম, বিশেষ করে দেওবন্দ মাদরাসার আলেমরা, তার এই অবস্থানের তীব্র বিরোধিতা করেন। কিন্তু তার প্রতিষ্ঠিত আলীগড় আন্দোলন ভারতীয় মুসলিমদের মধ্যে একটি নতুন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি করে, যা পরবর্তীকালে ভারতের রাজনীতিতে, এমনকি পাকিস্তান আন্দোলনেও, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল (১৮৭৭-১৯৩৮): কবির চোখে এক নতুন স্বপ্ন
ইকবাল ছিলেন একাধারে কবি, দার্শনিক এবং রাজনীতিবিদ। তিনি পশ্চিমা দর্শন (বিশেষ করে নিৎশে ও বার্গসঁ) গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছিলেন, কিন্তু তার মন পড়ে ছিল ইসলামের আধ্যাত্মিক এবং গতিশীল জগতে। তার চিন্তা ছিল আফগানি, আবদুহ বা স্যার সৈয়দের চেয়েও গভীর এবং দার্শনিক।
তার দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ‘খুদি’ (خودی – Selfhood) বা আত্ম-উপলব্ধি। ইকবালের মতে, মুসলিমদের পতনের কারণ হলো তারা নিজেদের ‘খুদি’ বা আত্মাকে হারিয়ে ফেলেছে। তারা নিজেদের ভেতরের সৃজনশীল শক্তিকে ভুলে গিয়ে অনুকরণ, অদৃষ্টবাদ (fatalism) আর দাসত্বকে বরণ করে নিয়েছে। তার কবিতা ছিল এই ঘুমন্ত আত্মাকে জাগিয়ে তোলার এক উদাত্ত আহ্বান।
তার বিখ্যাত ইংরেজি গ্রন্থ “The Reconstruction of Religious Thought in Islam”-এ তিনি ইসলামি ধর্মতত্ত্বকে আধুনিক দর্শনের আলোকে নতুন করে নির্মাণের এক দুঃসাহসিক চেষ্টা করেন। তিনি গতিশীলতাকে (Dynamism) ইসলামের প্রাণ হিসেবে দেখতেন এবং বিশ্বাস করতেন যে, ইজতিহাদের মাধ্যমে ইসলাম প্রতিটি যুগে নিজেকে নতুন করে প্রকাশ করতে পারে (Iqbal, 1930)। ইকবাল প্যান-ইসলামবাদে বিশ্বাসী হলেও ভারতীয় মুসলিমদের জটিল পরিস্থিতি উপলব্ধি করে তাদের জন্য একটি পৃথক আবাসভূমির স্বপ্নও দেখেছিলেন, যা পরবর্তীকালে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনে মূল দার্শনিক অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।
তুরস্কের ভিন্ন পথ: কামাল আতাতুর্ক এবং ধর্মনিরপেক্ষ বিপ্লব
ইসলামিক পুনর্জাগরণের গল্পের একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন অধ্যায় লেখা হয়েছিল তুরস্কে। অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক (Mustafa Kemal Atatürk) এক রেডিক্যাল পথ বেছে নেন। তিনি মনে করতেন, ইসলামের রাজনৈতিক ও সামাজিক ভূমিকাটাই তুরস্কের পিছিয়ে পড়ার মূল কারণ। তাই তিনি কেবল খিলাফতই (১৯২৪) বিলুপ্ত করেননি, বরং রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে ফেলেন। তিনি আরবি হরফের বদলে ল্যাটিন হরফ চালু করেন, মাদরাসা বন্ধ করে দেন, হিজাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন এবং পশ্চিমা আইনকানুন গ্রহণ করেন। আতাতুর্কের এই ধর্মনিরপেক্ষ (Secularist) বিপ্লব ছিল অন্য সব মুসলিম দেশের পুনর্জাগরণের প্রচেষ্টা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এটি ছিল অতীতকে বর্জন করে জোর করে আধুনিক হওয়ার এক প্রচেষ্টা, যা আজও তুরস্কে এক উত্তপ্ত বিতর্কের বিষয় (Zürcher, 2004)।
আরও গভীরে: কিছু জটিল বিতর্ক যা আজও জীবন্ত
ইসলামিক পুনর্জাগরণের আলোচনা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিতর্ক ছাড়া অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এই বিতর্কগুলো ঊনবিংশ শতাব্দীতে শুরু হয়েছিল এবং একবিংশ শতাব্দীতেও নানা রূপে আমাদের সামনে হাজির হয়।
-
ইজতিহাদ বনাম তাকলিদ (Ijtihad vs. Taqlid): এটা ছিল সবচেয়ে বড় বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধক্ষেত্র। সংস্কারকরা বলতেন, ইজতিহাদের দরজা খোলা না হলে ইসলাম একটি মৃত, জীবাশ্মীভূত (fossilized) ধর্মে পরিণত হবে। অন্যদিকে, ঐতিহ্যবাহী আলেমরা ভয় পেতেন যে, অযোগ্য ব্যক্তিদের হাতে অনিয়ন্ত্রিত ইজতিহাদ ধর্মকে বিকৃত করে ফেলবে এবং বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে। এই বিতর্ক আজও চলছে—ইসলামি আইনের সংস্কার কীভাবে হবে, তা নিয়ে।
-
জাতীয়তাবাদ বনাম প্যান-ইসলামিজম (Nationalism vs. Pan-Islamism): মুসলিমরা কি তাদের নিজ নিজ দেশের (মিশরীয়, তুর্কি, আরব, পাকিস্তানি) প্রতি অনুগত থাকবে, নাকি তাদের প্রথম আনুগত্য থাকবে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর প্রতি? আফগানি বা বান্নার মতো নেতারা প্যান-ইসলামিজমের কথা বলতেন। অন্যদিকে, কামাল আতাতুর্ক বা মিশরের সাদ জগলুলের মতো নেতারা জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র গড়তে চেয়েছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের উসকানিতে আরবদের তুর্কি খিলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ (Arab Revolt) ছিল এই দ্বন্দ্বের এক করুণ প্রকাশ। এই দ্বন্দ্ব আজও সৌদি আরব-ইরান বা তুরস্ক-মিশর সম্পর্কের মধ্যে ছায়া ফেলে।
-
নারী অধিকারের প্রশ্ন (The Question of Women’s Rights): পুনর্জাগরণের অন্যতম প্রধান বিষয় ছিল নারীর শিক্ষা ও সামাজিক অবস্থান। মিশরের কাসিম আমিন (Qasim Amin) তার বই “The Liberation of Women” (১৮৯৯) এ নারীর পর্দা প্রথা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং শিক্ষার অভাবের তীব্র সমালোচনা করেন, যা তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি করে। আধুনিকতাবাদীরা নারীর শিক্ষার পক্ষে জোরালো অবস্থান নেন, যদিও তাদের অনেকের যুক্তি ছিল যে শিক্ষিত নারী উন্নত মা ও স্ত্রী হতে পারবে। অন্যদিকে, রক্ষণশীলরা একে পশ্চিমা সংস্কৃতির আগ্রাসন এবং পরিবারের ভাঙন সৃষ্টির ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখেন। মিশরে হুদা শারাবি (Huda Sha’arawi)-র মতো নারীবাদীরা প্রকাশ্যে হিজাব খুলে ফেলে নারী মুক্তির আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করেন। এই বিতর্ক আজও মুসলিম বিশ্বে নারীবাদের স্বরূপ নিয়ে চলমান।
-
বিজ্ঞান ও ধর্ম (Science and Religion): মুসলিমরা কি আধুনিক বিজ্ঞানকে গ্রহণ করবে? সংস্কারকরা বলতেন, জ্ঞান অর্জন ইসলামের মৌলিক নির্দেশ। কুরআন মানুষকে বারবার প্রকৃতি নিয়ে ভাবতে এবং গবেষণা করতে উৎসাহিত করেছে। তাই বিজ্ঞানচর্চা ইসলামের অংশ। অন্যদিকে, কিছু রক্ষণশীল মনে করতেন যে, পশ্চিমা বিজ্ঞান বস্তুবাদী (materialistic) এবং এটি ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে। এই বিতর্কের একটি আধুনিক রূপ হলো ‘বুকাইলিজম’ (Bucailleism)—ফরাসি ডাক্তার মরিস বুকাইলের নামে প্রচলিত একটি ধারা, যা কুরআনের আয়াতে আধুনিক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার (যেমন: বিগ ব্যাং, ভ্রূণতত্ত্ব) খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। যদিও অ্যাকাডেমিকভাবে এটি সমালোচিত, সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে (Edis, 2007)।
র্যাডিকাল বা চরমপন্থী ধারার জন্ম: সাইয়েদ কুতুবের গল্প
ইসলামিক পুনর্জাগরণের বিতর্কের একটি পর্যায়ে এসে একটি চরমপন্থী (Radical) ধারারও জন্ম হয়, যা বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে বিশ্বকে প্রবলভাবে ঝাঁকুনি দিয়েছে। এর প্রধান তাত্ত্বিক ছিলেন মিশরের সাইয়েদ কুতুব (Sayyid Qutb, 1906-1966)। তিনি একসময় ইখওয়ানুল মুসলিমিনের প্রধান চিন্তাবিদ ছিলেন।
কুতুব ১৯৪০-এর দশকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বৃত্তি নিয়ে আমেরিকায় দু’বছর পড়াশোনা করতে যান। সেখানে তিনি পশ্চিমা সমাজের প্রযুক্তিগত উন্নতি দেখলেও এর বস্তুবাদ, নৈতিক অবক্ষয়, যৌন অনাচার এবং বর্ণবাদ দেখে প্রচণ্ড হতাশ ও বীতশ্রদ্ধ হন। মিশরে ফিরে এসে তিনি প্রেসিডেন্ট গামাল আবদেল নাসেরের ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী সরকারের সঙ্গে সংঘাতে জড়ান এবং বছরের পর বছর জেলে চরম নির্যাতনের শিকার হন। এই কারাজীবনের অন্ধকারেই তার চিন্তায় এক নাটকীয় পরিবর্তন আসে। জেলে বসে তিনি তার বিখ্যাত এবং বিতর্কিত বই “মা’আলিম ফি’ল-তারিক” (معالم في الطريق – Milestones) লেখেন।
এই বইয়ে তিনি মওদুদীর ‘জাহেলিয়াত’ ও ‘হাকিমিয়াহ’র ধারণাকে আরও চরম ও বিপ্লবী রূপে ব্যাখ্যা করেন। কুতুবের মতে:
-
আজকের মুসলিম সমাজসহ পুরো বিশ্ব আধুনিক জাহেলিয়াতে (جاهلية – state of ignorance) নিমজ্জিত। কারণ তারা আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে (الحاكمية – Hakimiyyah) অস্বীকার করে মানবসৃষ্ট আইন (গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র) দ্বারা শাসিত হচ্ছে।
-
যারা আল্লাহর আইন ছাড়া অন্য কোনো আইন মানে, তারা নামেমাত্র মুসলিম হতে পারে, কিন্তু কার্যত তারা মুসলমান নয়। এই ধারণাটি ‘তাকফির’ (تكفير – excommunication) নামে পরিচিত, অর্থাৎ অন্য মুসলিমকে কাফির ঘোষণা করা।
-
তাই সত্যিকারের মুসলিমদের প্রথম কাজ হলো এই জাহেলি সমাজ থেকে নিজেদের আদর্শিকভাবে বিচ্ছিন্ন করা এবং একটি বিপ্লবী অগ্রগামী দল (vanguard) গঠন করা। এই দলের চূড়ান্ত লক্ষ্য হবে সশস্ত্র সংগ্রামের (Jihad) মাধ্যমে জাহেলি রাষ্ট্রব্যবস্থাকে উৎখাত করে একটি সত্যিকারের ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।
নাসেরের সরকার ১৯৬৬ সালে কুতুবকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে ফাঁসি দেয়। কিন্তু তার মৃত্যু তার চিন্তাকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। তার লেখাগুলো পরবর্তীকালে অনেক জিহাদি গোষ্ঠীকে (যেমন: মিশরের আল-জিহাদ, আল-কায়েদা) অনুপ্রাণিত করেছে, যারা পশ্চিমা বিশ্ব এবং ‘ধর্মত্যাগী’ মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে (Calvert, 2010)। কুতুবের উত্থান দেখায় যে, পুনর্জাগরণের স্বপ্ন যখন রাজনৈতিকভাবে বারবার ব্যর্থ হয় এবং নিষ্ঠুর দমন-পীড়নের শিকার হয়, তখন তা কীভাবে হতাশা এবং চরমপন্থার জন্ম দিতে পারে।
ইরানে ভিন্ন সুর: আলী শরিয়াতির বিপ্লবী সমাজতত্ত্ব
ইরানে পুনর্জাগরণের গল্পটি ছিল কিছুটা ভিন্ন, কারণ ইরান একটি শিয়া-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ এবং এর একটি নিজস্ব ধর্মীয় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ছিল। এখানে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী চিন্তকদের একজন ছিলেন আলী শরিয়াতি (Ali Shariati, 1933-1977)। তিনি ছিলেন পশ্চিমা শিক্ষায় (ফ্রান্সের সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে) শিক্ষিত একজন সমাজতাত্ত্বিক।
শরিয়াতি মার্ক্সবাদ, অস্তিত্ববাদ এবং তৃতীয় বিশ্বের মুক্তিসংগ্রামের তত্ত্বের মতো পশ্চিমা দর্শনকে শিয়া ইসলামের বিপ্লবী চেতনার সঙ্গে মিলিয়ে এক নতুন, শক্তিশালী মতাদর্শ তৈরি করেন। তিনি ঐতিহ্যবাহী মোল্লাতন্ত্রের (clergy) তীব্র সমালোচনা করেন, যাদের তিনি মনে করতেন স্থবির এবং শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে আপসকামী। তিনি শিয়া ইসলামকে দুটি ভাগে ভাগ করেন:
-
“লাল শিয়াবাদ” (Red Shi’ism): এটি হলো ইমাম হোসাইনের কারবালার বিপ্লবী, আপসহীন এবং শাহাদাতের চেতনা। এটি হলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে চিরন্তন প্রতিবাদের ধর্ম।
-
“কালো শিয়াবাদ” (Black Shi’ism): এটি হলো সাফাভি আমল থেকে চলে আসা আনুষ্ঠানিক, শোক ও মাতম-সর্বস্ব এবং স্থবির ধর্ম, যা মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে রাখে।
শরিয়াতির লক্ষ্য ছিল তরুণ প্রজন্মকে এই ‘কালো শিয়াবাদ’ থেকে মুক্ত করে ‘লাল শিয়াবাদে’ ফিরিয়ে আনা এবং ইসলামকে গণমানুষের মুক্তির মতাদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। তার বক্তৃতা ও লেখা ১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লবের জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল। তবে বিপ্লবের পর আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে যে মোল্লাতান্ত্রিক রাষ্ট্র (Theocracy) প্রতিষ্ঠিত হয়, তা শরিয়াতির চিন্তার সঙ্গে পুরোপুরি মেলেনি। শরিয়াতি চেয়েছিলেন বুদ্ধিজীবী ও জনগণের বিপ্লব, মোল্লাদের শাসন নয় (Rahnema, 1994)।
পুনর্জাগরণের ব্যর্থতা ও সাফল্য: একটি চূড়ান্ত মূল্যায়ন
তাহলে এত আয়োজন, এত চিন্তা, এত রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ফলাফল কী দাঁড়াল? ঘুমন্ত দৈত্যটা কি পুরোপুরি জেগে উঠেছে? এর উত্তর হ্যাঁ বা না-তে দেওয়া যাবে না। এটি একটি মিশ্র এবং জটিল ছবি।
সাফল্যের দিক থেকে দেখলে:
-
আত্ম-সচেতনতার জন্ম: ইসলামিক পুনর্জাগরণ মুসলিম সমাজকে তার কয়েক শতাব্দীর স্থবিরতা থেকে বের করে এনেছে। এটি মুসলিমদের আত্মপরিচয় নিয়ে, তাদের ইতিহাস নিয়ে এবং বিশ্বে তাদের অবস্থান নিয়ে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। ‘আমরা কেন পিছিয়ে পড়লাম?’—এই প্রশ্নটিই ছিল সবচেয়ে বড় সাফল্য।
-
শিক্ষার প্রসার: আধুনিক শিক্ষা ও নারীর শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আজ প্রায় সব মুসলিম দেশেই কমবেশি স্বীকৃত। আলীগড় থেকে আল-আজহার, সর্বত্রই সংস্কারের হাওয়া লেগেছে, যদিও এর গভীরতা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে।
-
রাজনৈতিক জাগরণ: ইসলাম যে কেবল ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিষয় নয়, বরং এর একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক মাত্রা আছে – এই ধারণাটি আজ বিশ্বজুড়ে প্রতিষ্ঠিত। মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক সচেতনতা বেড়েছে এবং তারা ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সংগ্রাম করছে।
-
ইসলামী অর্থনীতির উত্থান: আধুনিক যুগে সুদবিহীন ইসলামী ব্যাংকিং এবং ফাইন্যান্সের বিকাশ এই পুনর্জাগরণমূলক চিন্তার একটি বাস্তব প্রয়োগ, যা আজ বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছে।
ব্যর্থতার দিক থেকে দেখলে:
-
মডেলের সংকট: পুনর্জাগরণের কোনো একক, সফল মডেল তৈরি হয়নি। আধুনিকতাবাদ, ঐতিহ্যবাদ এবং ইসলামবাদের মধ্যে বিতর্ক আজও অমীমাংসিত এবং প্রায়শই সংঘাতময়। তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ মডেল, সৌদি আরবের ওয়াহাবি রাজতন্ত্র, ইরানের মোল্লাতন্ত্র, নাকি মালয়েশিয়ার মিশ্র মডেল—কোনটি সঠিক পথ, তা নিয়ে কোনো ঐক্যমত্য নেই।
-
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা: অনেক মুসলিম দেশেই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। বরং পুনর্জাগরণের স্বপ্ন অনেক ক্ষেত্রে স্বৈরতন্ত্র, সামরিক শাসন বা চরমপন্থার উত্থান ঘটিয়েছে। আরব বসন্তের (Arab Spring) ব্যর্থতা এর সাম্প্রতিকতম উদাহরণ।
-
জ্ঞান-বিজ্ঞানে পশ্চাৎপদতা: মৌলিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে মুসলিম বিশ্ব এখনও পশ্চিমা বিশ্বের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। হাতে গোনা কয়েকটি ধনী দেশ ছাড়া গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ খুবই নগণ্য। ইজতিহাদের দরজা খোলার কথা বলা হলেও বাস্তবে উদ্ভাবনী চিন্তার পরিবেশ খুব কম দেশেই তৈরি হয়েছে।
-
উম্মাহর বিভক্তি: প্যান-ইসলামিজমের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। মুসলিম বিশ্ব জাতীয়তাবাদ, মাজহাব (মাযহাব), জাতিগত পরিচয় এবং রাজনৈতিক স্বার্থে শতধা বিভক্ত। আজ একজন আরব মুসলিমের কাছে তার আরব পরিচয়ই হয়তো মুখ্য, উম্মাহর পরিচয় নয়।
-
চরমপন্থার বিস্তার: সংস্কারের প্রচেষ্টা প্রায়ই সহিংসতা ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্ম দিয়েছে এবং এই শূন্যস্থানে সাইয়েদ কুতুবের মতো চিন্তাবিদদের দ্বারা অনুপ্রাণিত চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর বিস্তার ঘটেছে, যা ইসলামের ভাবমূর্তিকে বিশ্বব্যাপী ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
শেষ কথা: যাত্রা এখনো বাকি…
উনিশ শতকে ঔপনিবেশিকতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জামাল উদ্দিন আফগানি বা মুহাম্মদ আবদুহর মতো চিন্তাবিদরা যে সংস্কার আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন, তা আজ এক বহুমাত্রিক ও জটিল বাস্তবতায় রূপ নিয়েছে। তাঁদের মূল লক্ষ্য ছিল ইসলামকে আধুনিক বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত করা। কিন্তু বর্তমানে এই প্রক্রিয়াটি আরও অনেক বেশি বিস্তৃত ও স্তরবিশিষ্ট।
আজকের মুসলিম বিশ্ব একদিকে যেমন বিশ্বায়ন ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মুখোমুখি, তেমনই অন্যদিকে নিজের ঐতিহ্য ও আত্মপরিচয় রক্ষার দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ। ইসলামের ব্যাখ্যা নিয়ে অভ্যন্তরীণ মতপার্থক্য, বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং পশ্চিমা বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ার মতো বিষয়গুলো পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এই বহুমুখী চাপের ফলে ইসলামী পুনর্জাগরণের কোনো একক বা সরল গতিপথ নেই।
কাজেই, এই প্রক্রিয়াকে শুধু একটি “আধ্যাত্মিক জাগরণ” বা “চরমপন্থার উত্থান” হিসেবে দেখাটা অতিসরলীকরণ হবে। এর ভবিষ্যৎ কোনো নির্দিষ্ট ছকে বাঁধা নেই। এর গতিপথ সৃজনশীল ও প্রগতিশীল হতে পারে, আবার তা অভ্যন্তরীণ সংঘাত ও বিভেদের দিকেও মোড় নিতে পারে। এটি একটি চলমান ঐতিহাসিক অধ্যায়, যার পরিণতি এখনো লেখা হয়নি। তাই কোনো একপেশে সিদ্ধান্তে না পৌঁছে, এই জটিল ও জীবন্ত প্রক্রিয়াটিকে নির্মোহভাবে পর্যবেক্ষণ করাই সময়ের দাবি। এর শেষটা লেখা হচ্ছে আমাদের চোখের সামনে, প্রতিদিনের ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে।
তথ্যসূত্র
- Calvert, J. (2010). Sayyid Qutb and the Origins of Radical Islamism. Columbia University Press.
- Chaudhuri, K. N. (1985). Trade and Civilisation in the Indian Ocean: An Economic History from the Rise of Islam to 1750. Cambridge University Press.
- Edis, T. (2007). An Illusion of Harmony: Science and Religion in Islam. Prometheus Books.
- Esposito, J. L. (2010). Islam: The Straight Path (4th ed.). Oxford University Press.
- Hourani, A. (1983). Arabic Thought in the Liberal Age, 1798-1939. Cambridge University Press.
- Hourani, A. (2002). A History of the Arab Peoples. Faber & Faber.
- Iqbal, M. (1930). The Reconstruction of Religious Thought in Islam. Oxford University Press.
- Keddie, N. R. (1972). Sayyid Jamal ad-Din “al-Afghani”: A Political Biography. University of California Press.
- Lelyveld, D. (1978). Aligarh’s First Generation: Muslim Solidarity in British India. Princeton University Press.
- Lewis, B. (2002). What Went Wrong? The Clash Between Islam and Modernity in the Middle East. Oxford University Press.
- Mitchell, R. P. (1969). The Society of the Muslim Brothers. Oxford University Press.
- Nasr, S. V. R. (1996). Mawdudi and the Making of Islamic Revivalism. Oxford University Press.
- Rahman, F. (1982). Islam and Modernity: Transformation of an Intellectual Tradition. University of Chicago Press.
- Rahnema, A. (1994). An Islamic Utopian: A Political Biography of Ali Shariati. I.B. Tauris.
- Smith, W. C. (1957). Islam in Modern History. Princeton University Press.
- Zürcher, E. J. (2004). Turkey: A Modern History (Revised ed.). I.B. Tauris.
Leave a Reply