আল্লামা ইকবালের স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের ব্যবচ্ছেদ

আল্লামা ইকবাল কিভাবে পাশ্চাত্য দর্শনকে ব্যবহার করে সংকীর্ণ ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদ নির্মাণ করেছিলেন তা নিয়ে জানতে যান এখানে – আল্লামা ইকবাল ও ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদ: যেভাবে পাশ্চাত্য দর্শন হলো বিভাজনের হাতিয়ার – বিবর্তনপথ

ভূমিকা

রাত গভীর। আপনি বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে আছেন। আকাশে থালার মতো গোল চাঁদ। চাঁদের আলোয় চারপাশ কেমন অপার্থিব, অলৌকিক লাগছে। এইরকম জ্যোৎস্না রাতে মানুষের মন উদাস হয়, পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ে। দার্শনিকেরা বলেন, এই মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় রহস্য মানুষ নিজেই। আচ্ছা, এমন রাতে কবিরা কী ভাবেন? ধরুন, একজন কবির কথা, যিনি শুধু ফুল, পাখি, প্রেম নিয়ে কবিতা লেখেননি। তিনি মানুষের আত্মা (Soul), আমিত্ব (Self), জাতি (Nation), রাষ্ট্র (State), সময় (Time), ঈশ্বর (God)—এইসব জটিল বিষয় নিয়ে ভেবেছেন। ভেবে ভেবে ক্লান্ত হয়েছেন। তার চিন্তার ঢেউ এক সাম্রাজ্যকে নাড়িয়ে দিয়েছে, জন্ম দিয়েছে নতুন দেশের। আবার সেই চিন্তাই হয়তো তৈরি করেছে এমন এক বিভেদের প্রাচীর, যা আজও রক্ত ঝরাচ্ছে।

আমরা আল্লামা ইকবালের কথা বলছি।

নামটা শুনলেই আমাদের মাথায় কয়েকটি ছবি ভাসে। পাকিস্তানের ‘আধ্যাত্মিক পিতা’ (Spiritual Father)। ‘সারে জাঁহা সে আচ্ছা’ কবিতার স্রষ্টা। মুসলিম পুনর্জাগরণের (Muslim Renaissance) সবচেয়ে বড় দার্শনিক। এই সবগুলো পরিচয়ই সত্যি, কিন্তু কোনোটিই পুরো সত্যি নয়। মানুষ তো আর সাদা-কালো হয় না। মানুষ হয় ধূসর। ইকবালের মতো মানুষেরা হন আরও বেশি জটিল, আরও বেশি বর্ণিল। তার চিন্তার জগতে এতগুলো বাঁক, এতগুলো স্তর যে, তাকে বুঝতে গেলে একটু ধৈর্য ধরে গভীরে ডুব দিতে হয়। তার মনোজগৎ যেন এক বিশাল গোলকধাঁধা, যার এক দরজা দিয়ে ঢুকলে মনে হয় তিনি বিশ্বমানবতার কবি, আরেক দরজা দিয়ে বের হলে দেখা যায় তিনি এক নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক মুখপাত্র।

চলুন, সেই ডুব দেওয়া যাক। তবে গাইডবুক ছাড়া অচেনা সমুদ্রে নামা ঠিক না। আমরা কয়েকটি ভাগে ভাগ করে তার জগৎটা ঘুরে দেখব। তার বেড়ে ওঠা, তার দর্শন, তার কবিতা, এবং সবশেষে তার সেই রাজনৈতিক চিন্তা—যা নিয়ে আজও তুমুল বিতর্ক।

সিয়ালকোটের সেই ছেলেটি এবং এক প্রতিভার নির্মাণ

সব গল্পেরই একটা শুরু থাকে। ইকবালের গল্পের শুরু পাকিস্তানের পাঞ্জাবের এক ছোট শহর সিয়ালকোটে, ১৮৭৭ সালের ৯ই নভেম্বর। তার পূর্বপুরুষরা ছিলেন কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ, ‘সাপ্রু’ গোত্রের। সপ্তদশ শতকে তারা ইসলাম গ্রহণ করেন। ব্যাপারটা বেশ মজার, তাই না? যে মানুষটি পরবর্তী জীবনে ইসলামী পরিচয়ের সবচেয়ে বড় প্রবক্তা হবেন, তার শেকড় ছিল হিন্দু ঐতিহ্যের গভীরে। এই তথ্যটি কেবল একটি ট্রিভিয়া নয়, এটি ইকবালের চিন্তার একটি গভীর দিককে উন্মোচিত করে। তার মধ্যে প্রাচ্যের সব ধরনের দর্শনের প্রতিই এক সহজাত আকর্ষণ ছিল, যা হয়তো তার এই মিশ্র উত্তরাধিকারেরই ফল।

তার বাবা, শেখ নূর মুহাম্মদ, পেশায় ছিলেন একজন সাধারণ দরজি। কিন্তু মানুষ হিসেবে ছিলেন অসাধারণ। তিনি অক্ষরজ্ঞানহীন হলেও ছিলেন একজন উঁচু স্তরের সুফি সাধক। স্থানীয় মানুষ তাকে ‘আনপড় দার্শনিক’ বা অশিক্ষিত দার্শনিক বলে ডাকত। বাবার কাছ থেকেই ইকবাল পেয়েছিলেন সুফিবাদের (Sufism) প্রথম পাঠ এবং আধ্যাত্মিকতার প্রতি গভীর অনুরাগ। তার মা, ইমাম বিবি, ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ ও স্নেহময়ী একজন নারী, যিনি তার সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে সবসময় চিন্তিত থাকতেন।

ছেলেবেলার একটা ঘটনা প্রায়ই বলা হয়, যা ইকবালের জীবনদর্শন নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ইকবালের বাবা দেখতেন, ইকবাল মাদ্রাসায় না গিয়ে প্রায়ই বাইরে আনমনে ঘুরে বেড়াতেন। একদিন তিনি ইকবালকে ডেকে বললেন, “তুমি যখন কুরআন পড়বে, তখন এমনভাবে পড়বে যেন এই আয়াতগুলো তোমার উপরেই নাজিল হচ্ছে। স্বয়ং আল্লাহ তোমার সাথে কথা বলছেন।” এই একটা কথাই হয়তো ছোট্ট ইকবালের মনে গেঁথে গিয়েছিল। তার পরবর্তী জীবনের সব কাজের মধ্যে এই ধারণাটি বারবার ফিরে এসেছে—সৃষ্টিকর্তার সাথে ব্যক্তির সরাসরি, জীবন্ত এবং ব্যক্তিগত সংযোগ। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানের চেয়ে এই ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতাই ছিল তার কাছে বড়।

সিয়ালকোটের স্কচ মিশন কলেজে পড়ার সময় তিনি এমন একজন শিক্ষকের দেখা পেলেন, যিনি তার জীবনকে একটি নির্দিষ্ট খাতে বইয়ে দিলেন। তার নাম শামস-উল-উলামা মীর হাসান। তিনি ছিলেন আরবি, ফার্সি ও উর্দু ভাষার এক চলমান বিশ্বকোষ। জহুরি যেমন আসল হীরা চিনতে ভুল করেন না, মীর হাসানও ইকবালকে চিনতে ভুল করেননি। তিনিই ইকবালকে ধ্রুপদী ফার্সি ও উর্দু কবিতার প্রেমে ফেলেন। রুমি, হাফিজ, সাদি, গালিবের মতো কবিদের বিশাল জগতের সাথে তার পরিচয় করিয়ে দেন মীর হাসান। ইকবাল যে পরবর্তীকালে তাদের ভাবশিষ্য হয়ে উঠবেন, তার বীজটা সেখানেই রোপণ করা হয়েছিল। মীর হাসানের প্রতি তার শ্রদ্ধা এত গভীর ছিল যে, ব্রিটিশ সরকার যখন ইকবালকে ‘স্যার’ উপাধি দিতে চায়, তখন তিনি বলেছিলেন, “আমার গুরু মীর হাসানকে কোনো উপাধি না দেওয়া হলে আমি এই উপাধি গ্রহণ করব না।” তার অনুরোধে ব্রিটিশ সরকার মীর হাসানকেও ‘শামস-উল-উলামা’ (বিদ্বানদের সূর্য) উপাধি দেয়।

১৮৯৫ সালে ইকবাল উচ্চশিক্ষার জন্য লাহোরে পাড়ি জমান। ভর্তি হন লাহোর সরকারি কলেজে। সেখানে তিনি দর্শন, ইংরেজি সাহিত্য ও আরবি ভাষা নিয়ে পড়াশোনা করেন। এই লাহোরই তার প্রতিভার পূর্ণ বিকাশের ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। এখানেই তিনি আরেকজন পথপ্রদর্শককে খুঁজে পেলেন—স্যার টমাস আর্নল্ড। আর্নল্ড ছিলেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় দর্শনেই সমান জ্ঞানী। তিনিই ইকবালের মধ্যে পশ্চিমা দর্শনের প্রতি আগ্রহ তৈরি করেন এবং তাকে ইউরোপে গিয়ে পড়াশোনা করতে উৎসাহিত করেন। এই সময়টা ইকবালের জন্য ছিল এক সন্ধিক্ষণ। একদিকে মীর হাসানের দেওয়া প্রাচ্যের জ্ঞান ও সুফিবাদ, অন্যদিকে টমাস আর্নল্ডের দেখানো পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদ—দুটোর সংমিশ্রণেই তৈরি হচ্ছিল ভবিষ্যতের ইকবাল। লাহোরের সাহিত্যিক আড্ডা বা ‘মুশায়েরা’গুলোতে তরুণ ইকবাল তার কবিতা পাঠ করে খুব দ্রুতই খ্যাতি অর্জন করেন।

১৯০৫ সাল। ইকবালের জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। তিনি পাড়ি জমালেন ইউরোপে। প্রথমে লন্ডনের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজে দর্শন বিভাগে ভর্তি হন। সেখানে তার শিক্ষক ছিলেন নব্য-হেগেলীয় দার্শনিক জন ম্যাকটাগার্ট (John McTaggart), যিনি সময়ের অবাস্তবতা (Unreality of Time) নিয়ে কাজ করতেন। ম্যাকটাগার্টের দর্শন ইকবালের চিন্তায় গভীর ছাপ ফেলেছিল, যদিও ইকবাল পরে সময়ের এক ভিন্ন, গতিশীল ধারণা দেন। কেমব্রিজ থেকে ডিগ্রি নেওয়ার পর তিনি জার্মানির মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে যান পিএইচডি করার জন্য। মাত্র তিন মাসের মধ্যে জার্মান ভাষা শিখে তিনি তার গবেষণাপত্র জমা দেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল ‘The Development of Metaphysics in Persia’ (পারস্যে অধিবিদ্যার বিকাশ)। এই গবেষণার মাধ্যমে তিনি প্রাচ্যের দার্শনিক ঐতিহ্য, বিশেষ করে পারস্যের সুফি ও আলোকময় দর্শনের (Illuminationist Philosophy) গভীরে প্রবেশ করেন।

এই তিন বছর (১৯০৫-১৯০৮) ইকবালের জন্য ছিল এক আত্ম-আবিষ্কারের অভিযাত্রা। ইউরোপে তিনি কান্ট, হেগেল, গ্যেটে, বার্গসঁ এবং বিশেষ করে ফ্রিডরিখ নিৎশের (Friedrich Nietzsche) দর্শনের সাথে নিবিড়ভাবে পরিচিত হন। নিৎশের ‘সুপারম্যান’ বা ‘Übermensch’-এর ধারণা, তার শক্তি ও ইচ্ছার দর্শন (Will to Power), তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। কিন্তু তিনি নিৎশের নিরীশ্বরবাদী (Atheistic) দর্শনের সঙ্গে একমত ছিলেন না। তিনি যেন নিৎশের সুপারম্যানের ধারণাটিকে ধার করে তাকে একটি আধ্যাত্মিক ও ঐশ্বরিক পোশাক পরাতে চাইলেন। নিৎশের সুপারম্যান ঈশ্বরের মৃত্যুর পর আসে, আর ইকবালের ‘ইনসান-ই-কামিল’ বা পূর্ণাঙ্গ মানব ঈশ্বরের সবচেয়ে অনুগত প্রতিনিধি।

ইউরোপের চাকচিক্য, তার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি ইকবালকে মুগ্ধ করেছিল। কিন্তু এর ভেতরের অন্তঃসারশূন্যতা, লাগামহীন বস্তুবাদ (Materialism) আর আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ (Aggressive Nationalism) দেখে তিনি যারপরনাই হতাশ হয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন, আত্মা ছাড়া এই সভ্যতা মানবজাতির মুক্তির পথ নয়, বরং ধ্বংসের পথ। তিনি লিখলেন:

“তুমহারি তহযিব আপনে খঞ্জর সে আপ হি খুদকুশি করবে,
যো শাখ-এ-নাযুক পে আশিয়ানা বনেগা, নাপায়েদার হোগা।”
(তোমার সভ্যতা নিজের ছোরা দিয়েই আত্মহত্যা করবে,
যা কিছু নরম ডালে বাসা বাঁধে, তা ক্ষণস্থায়ী হয়।)

এই সময়েই লেখা তার বিখ্যাত কবিতা ‘সারে জাঁহা সে আচ্ছা, হিন্দুস্তা হমারা’। তখনো তিনি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের একজন বড় সমর্থক। কিন্তু ইউরোপ থেকে ফেরার পর তার চিন্তায় এক বিরাট পরিবর্তন আসে। যে ইকবাল সমগ্র ভারতের কথা বলতেন, তিনি ধীরে ধীরে প্যান-ইসলামিজম বা মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের কথা, মুসলিম পরিচয়ের কথা বলতে শুরু করলেন। কেন এই পরিবর্তন? এই প্রশ্নের উত্তরই আমাদের নিয়ে যাবে তার দর্শনের মূল কেন্দ্রে।

যে মেঘ দেখে কবি লিখলেন বিভাজনের কবিতা

চিন্তা জিনিসটা ভারি অদ্ভুত, তাই না? অনেকটা ভাসমান মেঘের মতো। কোথা থেকে জলীয় বাষ্প জোগাড় করে সে এক জায়গায় জড়ো হয়, তারপর বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে যায় আরেক দেশে, সেখানে সে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে। সেই বৃষ্টিতে হয়তো কারও উঠোনের পেঁপে গাছটা সতেজ হয়ে ওঠে, আবার কারও খড়ের চাল ফুটো হয়ে সারা রাত পানি পড়ে।

আল্লামা মুহাম্মদ ইকবালের চিন্তার মেঘটাও ঠিক এমনই। সেই মেঘ জলীয় বাষ্প শুষে নিয়েছিল উনিশ শতকের পরাধীন, হীনম্মন্যতায় ভোগা ভারতবর্ষের মাটি থেকে। তাকে আকার দিয়েছিল জামালুদ্দিন আফগানির প্যান-ইসলামিজমের উত্তাপ। আর তাকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল জার্মানি আর ইংল্যান্ডের বাতাস, যেখানে হেগেল, নিটশে আর বার্গসোঁর মতো দার্শনিকদের চিন্তার বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত সেই মেঘ যখন কবিতার বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ল, তখন তা উপমহাদেশের বুকে এক নতুন চারাগাছেরও জন্ম দিল, আবার এমন এক গভীর ক্ষতেরও সৃষ্টি করল, যা আজও শুকায়নি।

চলুন, আজ সেই মেঘের যাত্রাটা একটু পেছন থেকে দেখি। কোন কোন হাওয়া তাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছিল, তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। কারণ, একজন বড় মাপের মানুষের চিন্তার উৎস না বুঝলে, তার কাজের মূল্যায়ন করাটা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।

সিপাহী বিদ্রোহের পরের সেই থমথমে সকাল

যেকোনো বড় ভাবনার পেছনে একটা গভীর বেদনা বা ক্ষতের গল্প থাকে। ইকবালের ভাবনার ক্ষতটা কোথায়? তার জন্য আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে ১৮৫৭ সালে। সিপাহী বিদ্রোহ (Sepoy Mutiny) ব্যর্থ হওয়ার পর ভারতীয় মুসলিমদের অবস্থাটা একবার কল্পনা করুন। যাদের পূর্বপুরুষেরা একদিন দিল্লির মসনদে বসে ভারতবর্ষ শাসন করত, তারা রাতারাতি হয়ে গেল এক পরাজিত, বিদ্রোহী ও ব্রিটিশদের চোখে ‘বিশ্বাসঘাতক’ এক সম্প্রদায়। ক্ষমতা নেই, সম্মান নেই, অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি নেই। আছে শুধু একরাশ হতাশা আর হীনম্মন্যতা (inferiority complex)।

এই থমথমে, ধূসর পটভূমিতেই প্রথম সাড়া দিলেন স্যার সৈয়দ আহমদ খান। তিনি ছিলেন একজন বাস্তববাদী মানুষ। তিনি বুঝলেন, বন্দুকের নল দিয়ে ইংরেজদের তাড়ানো যাবে না। টিকে থাকতে হলে, তাদের ভাষা শিখতে হবে, তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান আয়ত্ত করতে হবে। গড়ে তুললেন আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি। তার উদ্দেশ্য ছিল একটাই—ইংরেজদের সঙ্গে একটা আপস করে মুসলিমদের জন্য আধুনিক শিক্ষা ও চাকরির সুযোগ তৈরি করা। এটা ছিল এক ধরনের প্রতিরক্ষামূলক কৌশল (defensive strategy)।

কিন্তু ইকবাল যখন বড় হচ্ছেন, তখন তিনি দেখলেন, শুধু চাকরি বা আধুনিক শিক্ষাই যথেষ্ট নয়। একটা জাতির যদি আত্মসম্মানই না থাকে, তার মেরুদণ্ডই যদি সোজা না থাকে, তাহলে সে চিরকাল পরের দয়ায় বেঁচে থাকবে। স্যার সৈয়দের দেখানো পথটা ছিল টিকে থাকার, কিন্তু ইকবালের মন চাইছিল পুনর্জাগরণের (renaissance)। তিনি শুধু ব্রিটিশদের করুণা নয়, বরং ইতিহাসের মঞ্চে নিজেদের সম্মানজনক আসন পুনরুদ্ধার করতে চাইছিলেন। এই আকাঙ্ক্ষাটাই তার দর্শনের মূল চালিকাশক্তি।

বিশ্বজুড়ে মুসলিমদের কান্না ও প্যান-ইসলামিজমের ডাক

ইকবালের ভাবনার ক্যানভাসটা শুধু ভারতবর্ষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি যখন চোখ মেলে তাকাচ্ছেন, তখন দেখছেন গোটা মুসলিম বিশ্বই এক গভীর সংকটে। তুরস্কের বিশাল অটোমান সাম্রাজ্যকে ইউরোপীয় শক্তিগুলো ‘ইউরোপের রুগ্ন পুরুষ’ (The Sick Man of Europe) বলে ব্যঙ্গ করছে, তাকে একটু একটু করে ছিঁড়ে খাচ্ছে। উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য—সবই হয় ইউরোপীয় উপনিবেশ, না হয় তাদের প্রভাব বলয়ে।

এই সময়েই মুসলিম বিশ্বের আকাশে এক নতুন তারা হয়ে উদিত হলেন জামালুদ্দিন আফগানি। তিনি ছুটে বেড়াচ্ছিলেন দেশ থেকে দেশে—মিশর, তুরস্ক, পারস্য, ভারত। তার বার্তা ছিল খুব স্পষ্ট: তোমরা শিয়া, সুন্নি, আরব, তুর্কি, ভারতীয়—এসব ভুলে যাও। তোমাদের সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো তোমরা মুসলিম। তোমরা এক উম্মাহ (Ummah)। যতক্ষণ না তোমরা এই পরিচয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে, ততক্ষণ তোমাদের মুক্তি নেই।

এই প্যান-ইসলামিজম (Pan-Islamism) বা সর্ব-ইসলামবাদ ইকবালের তরুণ মনে গভীর ছাপ ফেলল। তিনি তার সংকীর্ণ ভারতীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে এক বিশ্বজনীন মুসলিম ভ্রাতৃত্বের ধারণা খুঁজে পেলেন। তিনি বুঝলেন, ভারতীয় মুসলিমদের সমস্যাটা বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, এটা একটা বৈশ্বিক সংকটেরই অংশ। তাই তার সমাধানও হতে হবে বিশ্বজনীন। ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদকে (territorial nationalism) তিনি সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করলেন। কারণ তার মনে হচ্ছিল, এই জাতীয়তাবাদ মুসলিম উম্মাহকে ছোট ছোট টুকরোয় ভাগ করে দুর্বল করে দিচ্ছে (Schimmel, 1963)। তার বিখ্যাত সেই লাইন—‘চীন ও আরব হামারা, হিন্দুস্তা হামারা / মুসলিম হ্যাঁয় হাম, ওয়াতান হ্যায় সারা জাহাঁ হামারা’ (চীন ও আরব আমাদের, হিন্দুস্তানও আমাদের; আমরা মুসলিম, সারা বিশ্বই আমাদের স্বদেশ)—এই ভাবনারই কাব্যিক প্রকাশ।

ইউরোপের পাঠশালায় নতুন দর্শনের পাঠ

১৯০৫ সাল। ইকবাল উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমালেন ইউরোপে। প্রথমে ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ, তারপর জার্মানির মিউনিখ। এই কয়েকটা বছর তার চিন্তার জগতে এক বিপ্লব ঘটিয়ে দিল। তিনি যেন এক নতুন জ্ঞানসমুদ্রের মুখোমুখি হলেন। এখানেই তিনি এমন কিছু দার্শনিকের মুখোমুখি হলেন, যাদের চিন্তার কিছু অংশ তিনি এমনভাবে নিজের দর্শনের সঙ্গে জুড়ে নিলেন, যা শেষ পর্যন্ত এক বিস্ফোরক মিশ্রণ তৈরি করেছিল।

১. হেগেলের ইতিহাসের আত্মা: জার্মান দার্শনিক গেয়র্গ ভিলহেল্ম ফ্রিডরিখ হেগেল (Georg Wilhelm Friedrich Hegel) ছিলেন এক জটিল চিন্তাবিদ। খুব সহজ করে বললে, তার মতে, ইতিহাস কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনার সমষ্টি নয়। ইতিহাস হলো এক পরমাত্মার (Absolute Spirit বা Geist) নিজেকে ধাপে ধাপে প্রকাশ করার কাহিনি। আর এই আত্মপ্রকাশের সর্বোচ্চ রূপ হলো রাষ্ট্র। রাষ্ট্র হলো পৃথিবীতে নৈতিকতা ও যুক্তির মূর্ত রূপ।

ইকবাল হেগেলের এই ধারণাটি নিলেন, কিন্তু তার মধ্যে একটা বিরাট পরিবর্তন আনলেন। হেগেলের ‘পরমাত্মা’ ছিল এক সর্বজনীন ধারণা। ইকবাল সেই জায়গায় বসিয়ে দিলেন ‘মুসলিম উম্মাহ’কে। তার কাছে মনে হলো, এই মুসলিম উম্মাহই হলো ইতিহাসের সেই বিশেষ সত্তা, যার একটি বিশেষ ঐতিহাসিক মিশন (historical mission) বা নিয়তি (destiny) আছে। এই উম্মাহর মাধ্যমেই পৃথিবীতে ঈশ্বরের ইচ্ছা পূর্ণতা পাবে। সুতরাং, মুসলিমদের জন্য একটি নিজস্ব রাষ্ট্র শুধু একটি রাজনৈতিক প্রয়োজন নয়, এটি ইতিহাসের এক অবশ্যম্ভাবী পরিণতি এবং আধ্যাত্মিক দায়িত্ব। হেগেলের একটি ধর্মনিরপেক্ষ (অন্ততপক্ষে আধুনিক অর্থে) রাষ্ট্রদর্শনকে ইকবাল এভাবে একটি ধর্মভিত্তিক প্রকল্পের কাঠামোতে পরিণত করলেন (Hegel, 1821/1991)।

২. নিটশের ‘অতিমানব’ ও ক্ষমতার গর্জন: ইকবালের ওপর সম্ভবত সবচেয়ে নাটকীয় প্রভাব ফেলেছিলেন আরেক জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিখ নিটশে (Friedrich Nietzsche)। নিটশে ছিলেন এক বিদ্রোহী, প্রথাভাঙা চিন্তাবিদ। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ‘ঈশ্বর মৃত’ (God is dead)। তিনি প্রচলিত খ্রিস্টীয় নৈতিকতাকে ‘দাসের নৈতিকতা’ (slave morality) বলে উপহাস করতেন এবং এক নতুন ধরনের মানুষের স্বপ্ন দেখতেন—‘উবারমেনশ’ (Übermensch) বা অতিমানব। এই অতিমানব হবে শক্তিশালী, সৃজনশীল, আত্মনির্ভর এবং নিজের মূল্যবোধ নিজেই তৈরি করবে। তার চালিকাশক্তি হবে ‘ক্ষমতার ইচ্ছা’ (Will to Power)।

ইকবাল নিটশের ঈশ্বরহীনতায় শিউরে উঠেছিলেন, কিন্তু তার শক্তির দর্শনে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি ভাবলেন, এই শক্তি আর আত্মবিশ্বাসের ধারণাটাই তো মুসলিমদের এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি দরকার। তাই তিনি নিটশের অতিমানবের আদলে তৈরি করলেন তার ‘মর্দ-ই-মুমিন’ (Mard-e-Momin) বা ‘ইনসান-ই-কামিল’ (Insan-i-Kamil) অর্থাৎ ‘পূর্ণাঙ্গ মানব’-এর ধারণা। কিন্তু নিটশের অতিমানব যেখানে ছিল ঈশ্বরবিমুখ, ইকবালের ‘মর্দ-ই-মুমিন’ সেখানে পুরোপুরি আল্লাহকেন্দ্রিক। সে আল্লাহর প্রতিনিধি। আর তার ‘ক্ষমতার ইচ্ছা’ কোনো ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা নয়, বরং তা হলো ‘খুদি’ (Khudi) বা আত্মসত্তার বিকাশ, যা দিয়ে সে পৃথিবীতে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করবে (Nietzsche, 1883-1885/1961)।

ইকবাল নিটশের দর্শনের খোলসটা নিলেন, কিন্তু তার ভেতরের আত্মাটাকে বদলে দিলেন। এর ফলে যা হলো, তা খুবই বিপজ্জনক। নিটশের শক্তি ছিল এক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী (individualistic)নৈরাজ্যবাদী (anarchistic) শক্তি। ইকবালের হাতে তা হয়ে উঠল একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সম্মিলিত রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের দর্শন।

৩. বার্গসোঁর জীবনের স্পন্দন: ফরাসি দার্শনিক অঁরি বার্গসোঁর (Henri Bergson) প্রভাব ছিল ইকবালের দর্শনে অনেক বেশি সূক্ষ্ম, কিন্তু গভীর। বার্গসোঁ বলতেন, জগৎটাকে শুধু যুক্তি দিয়ে বোঝা যাবে না। এর গভীরে আছে এক অফুরন্ত, সৃজনশীল, স্বতঃস্ফূর্ত জীবনীশক্তি, যার নাম ‘এলাঁ ভিতাল’ (Élan Vital)। এই শক্তি ঘড়ির কাঁটার মতো চলে না, এর আছে নিজস্ব সময় বা প্রবহমান সময়। একে বোঝা যায় শুধু স্বজ্ঞা (intuition) দিয়ে।

ইকবালের কাছে এই ধারণাটি অসাধারণ মনে হলো। তিনি দেখলেন, ইসলামে যে ‘ইশক’ (Ishq) বা ঐশ্বরিক প্রেমের কথা বলা হয়, যা যুক্তির ঊর্ধ্বে, তার সঙ্গে বার্গসোঁর দর্শনের একটা গভীর মিল আছে। তিনি তার ‘খুদি’ বা আত্মসত্তার ধারণাকে এই জীবনীশক্তির আলোকেই ব্যাখ্যা করলেন। খুদি কোনো স্থির বস্তু নয়, এটি এক সৃজনশীল, বিকাশমান শক্তি। এই ধারণাটি তাকে ইসলামের একটি গতিশীল (dynamic) ও সৃষ্টিশীল ব্যাখ্যা দিতে সাহায্য করেছিল, যা তাকে অন্ধ অনুকরণ (taqlid) থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীন চিন্তা বা ইজতিহাদের (Ijtihad) পথে হাঁটতে অনুপ্রাণিত করেছিল (Bergson, 1907/1911; Iqbal, 1934)।

সব নদীর জল যখন এক মোহনায়

এবার ভাবুন, এই সবগুলো প্রভাব—পরাজিত মুসলিমদের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের আকাঙ্ক্ষা, প্যান-ইসলামিজমের বিশ্বজনীন ডাক, হেগেলের ঐতিহাসিক নিয়তিবাদ, নিটশের শক্তি ও অতিমানবের ধারণা এবং বার্গসোঁর গতিশীল জীবনদর্শন—সবকিছু এসে মিশল এক ব্যক্তির মনে। সেই মনটি একজন কবির, যিনি তার ভাবনাকে আবেগ আর অসাধারণ চিত্রকল্প দিয়ে প্রকাশ করতে পারেন।

ফলাফল কী দাঁড়াল?

ইকবাল এমন এক দর্শন তৈরি করলেন যা ছিল:

  • ১. ঐতিহাসিকভাবে সচেতন: তিনি মুসলিমদের বোঝাতে চাইলেন যে, তাদের এক গৌরবময় অতীত আছে এবং ভবিষ্যতেও তাদের এক মহান ভূমিকা পালনের জন্য ঈশ্বর কর্তৃক নির্বাচিত করা হয়েছে।
  • ২. শক্তিতে বিশ্বাসী: তিনি দুর্বলতা, বিনয় ও সহনশীলতার চেয়ে শক্তি, আত্মবিশ্বাস ও শ্রেষ্ঠত্বের ওপর জোর দিলেন। তার ‘শাহিন’ বা ঈগল পাখি সেই শক্তিরই প্রতীক।
  • ৩. আধ্যাত্মিকভাবে গতিশীল: তিনি স্থবির, আচারসর্বস্ব ইসলামের বদলে এক গতিশীল, সৃষ্টিশীল ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে সমন্বয়সাধনে সক্ষম ইসলামের কথা বললেন।
  • ৪. রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদী: এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন যে, এই বিশেষ আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক সত্তার পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য একটি নিজস্ব ভৌগোলিক পরিসর বা রাষ্ট্র প্রয়োজন। একটি হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ, ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে মুসলিমদের এই বিশেষ ‘খুদি’ বা আত্মসত্তা বিকশিত হতে পারবে না, বরং তা দাবিয়ে রাখা হবে। এই চিন্তা থেকেই জন্ম নিল তার ১৯৩০ সালের বিখ্যাত এলাহাবাদ ভাষণ, যেখানে তিনি উত্তর-পশ্চিম ভারতে একটি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের ধারণা দিলেন, যা পাকিস্তান ধারণার বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি স্থাপন করেছিল (Pirzada, 1970)।

আল্লামা ইকবাল কিভাবে পাশ্চাত্য দর্শনকে ব্যবহার করে সংকীর্ণ ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদ নির্মাণ করেছিলেন তা নিয়ে জানতে যান এখানে – আল্লামা ইকবাল ও ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদ: যেভাবে পাশ্চাত্য দর্শন হলো বিভাজনের হাতিয়ার – বিবর্তনপথ

‘খুদি’র রহস্য, শাহীনের স্বপ্ন ও অনন্তের সাধনা

ইকবালের দর্শনের একেবারে কেন্দ্রে আছে একটি মাত্র শব্দ—‘খুদি’ (Khudi)। বাংলায় এর সহজ কোনো প্রতিশব্দ নেই। কেউ বলেন ‘আমিত্ব’, কেউ বলেন ‘আত্মশক্তি’, কেউ বলেন ‘আত্ম-উপলব্ধি’ (Self-realization)। কিন্তু এর অর্থ আরও গভীর। ইকবাল নিজেই এর অনুবাদ করেছেন ‘Selfhood’ বা ‘Personality’ হিসেবে।

ব্যাপারটা একটু সহজ করে ভাবা যাক। ধরুন, একটা বটগাছের বীজ। বাইরে থেকে দেখলে খুব সাধারণ একটা বীজ। কিন্তু তার ভেতরে লুকিয়ে আছে এক বিশাল মহীরুহ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা। সঠিক পরিচর্যা পেলে, মাটি, জল, আলো পেলে সেই বীজ একদিন ডালপালা মেলে আকাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। ইকবাল মনে করতেন, প্রত্যেক মানুষের আত্মাও ঠিক ওইরকম একটা বীজ। তার ভেতরে লুকিয়ে আছে অসীম সম্ভাবনা। সেই সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলাই হলো ‘খুদি’র সাধনা।

এই ধারণাটি তিনি পেয়েছিলেন ইসলামি ঐতিহ্য এবং পশ্চিমা দর্শন, উভয়ের কাছ থেকে। কুরআনের ধারণা অনুযায়ী, মানুষ পৃথিবীতে ঈশ্বরের প্রতিনিধি বা ‘খলিফা’ (Caliph)। আবার ফরাসি দার্শনিক অঁরি বার্গসঁর (Henri Bergson) ‘élan vital’ বা ‘প্রাণশক্তির স্ফূরণ’-এর ধারণাটিও তাকে প্রভাবিত করেছিল। বার্গসঁ মনে করতেন, জগৎ স্থির নয়, এটি একটি চলমান, সৃজনশীল প্রক্রিয়া। ইকবাল এই ধারণাটিকে তার দর্শনের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেন। তার কাছে, জগৎ এবং মানব-আত্মা, উভয়ই সদা পরিবর্তনশীল ও বিকাশমান।

ইকবালের মতে, মানুষ দুর্বল, অসহায় বা পাপী হয়ে জন্মায় না। মানুষ জন্মায় ঈশ্বরের সেরা সৃষ্টি হিসেবে, তার প্রতিনিধি বা ‘নায়েবে হক’ (Vicegerent of God) হয়ে। কিন্তু পৃথিবীর নানা প্রলোভন, ভয়, আলস্য এবং প্রচলিত সুফিবাদের নিষ্ক্রিয়তার দর্শনে সে তার ভেতরের ঐশ্বরিক শক্তিকে ভুলে যায়। সে নিজেকে তুচ্ছ ভাবতে শুরু করে। ‘খুদি’ হলো এই ভুলে যাওয়া শক্তিকে পুনরুদ্ধার করার দর্শন। এটা অহংকার (Ego) নয়, বরং আত্মসম্মান (Self-esteem), আত্মবিকাশ (Self-development) এবং আত্ম-অভিপ্রকাশের (Self-expression) কথা বলে।

তার বিখ্যাত ফার্সি কাব্যগ্রন্থ ‘আসরার-ই-খুদি’ (Asrar-i-Khudi বা The Secrets of the Self, ১৯১৫)-তে তিনি এই ‘খুদি’র বিকাশের তিনটি ধাপের কথা বলেছেন:

  • ১. ইতা’আত (Obedience): প্রথম ধাপে ব্যক্তিকে ঈশ্বরের আইন বা শরিয়ত মেনে চলতে হবে। এটা অনেকটা গাড়ি চালানো শেখার মতো। প্রথমে আপনাকে ট্রাফিক আইন জানতে ও মানতে হবে। শৃঙ্খলা ছাড়া স্বাধীনতা বিশৃঙ্খলায় পরিণত হয়। ইকবালের কাছে, এই আইন কোনো স্বৈরাচারী নির্দেশ নয়, বরং এটি প্রকৃতির নিজস্ব নিয়ম, যা ব্যক্তিকে তার সর্বোচ্চ সম্ভাবনায় পৌঁছাতে সাহায্য করে।
  • ২. জব্‌ত-ই-নফ্‌স (Self-Control): দ্বিতীয় ধাপে নিজের প্রবৃত্তি, আবেগ, লোভ ও ভয়কে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখতে হবে। যে নিজের ভেতরের রিপুগুলোর দাস, সে কখনো প্রকৃত অর্থে স্বাধীন হতে পারে না। এই আত্মনিয়ন্ত্রণই ব্যক্তিকে তার ‘খুদি’র ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব দেয়।
  • ৩. নিয়াবত-ই-ইলাহি (Divine Vicegerency): এই দুটি ধাপ পার করার পর ব্যক্তি এমন এক স্তরে পৌঁছায়, যেখানে সে পৃথিবীতে ঈশ্বরের সত্যিকারের প্রতিনিধি হয়ে ওঠে। তার কাজ তখন আর ব্যক্তিগত থাকে না, তার প্রতিটি কাজ সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের জন্য নিবেদিত হয়। সে তখন ঈশ্বরের সৃজনশীল কাজের অংশীদার হয়ে ওঠে। সে নতুন পৃথিবী নির্মাণ করে।

এই ‘খুদি’র দর্শন প্রচার করতে গিয়ে ইকবাল তৎকালীন প্রচলিত সুফিবাদের কঠোর সমালোচনা করেন। বিশেষ করে পারস্যের কবি হাফিজের কবিতার, যা মানুষকে নিষ্ক্রিয়তা, বৈরাগ্য আর ভাগ্যবাদের দিকে ঠেলে দেয় বলে তিনি মনে করতেন। তার মতে, যে সুফিবাদ ব্যক্তিকে দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে কেবল নিজের মুক্তির কথা ভাবতে শেখায়, তা ইসলামি নয়। প্রকৃত ইসলামি তাসাউফ হলো নিজের ‘খুদি’কে শক্তিশালী করে পৃথিবীর ভাগ্য পরিবর্তনে অংশ নেওয়া। এই নিয়ে তাকে তুমুল বিতর্কের মুখেও পড়তে হয়েছিল।

এই শক্তিশালী ‘খুদি’র আদর্শকে ফুটিয়ে তোলার জন্য ইকবাল একটি অসাধারণ প্রতীক ব্যবহার করেছেন—‘শাহীন’ (Shaheen) বা ঈগল পাখি। শাহীন অন্য পাখিদের মতো নয়। সে উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় বাসা বাঁধে, নিচুতে ওড়ে না। সে অন্যের ফেলে দেওয়া খাবার খায় না, নিজের শিকার নিজে করে। তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, তার ওড়া মেঘের উপরে। শাহীন হলো আত্মনির্ভর, স্বাধীনচেতা, উঁচু দৃষ্টিসম্পন্ন এবং গতিশীল মানুষের প্রতীক। ইকবাল মুসলিম তরুণদের এই শাহীনের মতো হতে বলতেন:

“নহী তেরা নশেমন কসরে সুলতানি কে গুম্বাদ পার,
তু শাহী হ্যায়, বসেরা কর পাহাড়ো কি চাটানো পার।”
(তোমার বাসা কোনো রাজপ্রাসাদের গম্বুজে নয়,
তুমি শাহীন, তুমি পাহাড়ের চূড়ায় বাস করো।)

তার আরেকটি বিখ্যাত বই ‘রুমুজ-ই-বেখুদি’ (Rumuz-i-Bekhudi বা The Secrets of Selflessness, ১৯১৭)। এটি ‘আসরার-ই-খুদি’র পরিপূরক। এখানে তিনি ‘খুদি’র অন্য পিঠের কথা বলেছেন। ব্যক্তি যখন তার ‘খুদি’কে বিকশিত করবে, তখন সে একা থাকবে না। সে নিজেকে একটি আদর্শ সমাজের বা ‘মিল্লাত’ (Millat)-এর অংশ হিসেবে বিলিয়ে দেবে। অনেকটা নদীর মতো। নদীর সার্থকতা সমুদ্রে মিশে যাওয়ার মধ্যেই। তেমনি বিকশিত ‘খুদি’র সার্থকতা হলো আদর্শ এক মানবসমাজে (Community) নিজেকে উৎসর্গ করা। ‘খুদি’ ও ‘বেখুদি’র এই দ্বান্দ্বিক সম্পর্কই ইকবালের সামাজিক দর্শনের মূল কথা। শক্তিশালী ব্যক্তি ছাড়া শক্তিশালী সমাজ হয় না, আবার আদর্শ সমাজ ছাড়া ব্যক্তির পূর্ণ বিকাশও সম্ভব নয়।

কবি ইকবাল: প্রাচ্যের বার্তা ও অনন্তের অভিযাত্রী

আল্লামা ইকবালকে যদি শুধু দার্শনিক বলা হয়, তাহলে তার প্রতি অবিচার করা হবে। তিনি প্রথমত এবং প্রধানত একজন কবি। তার জটিল দর্শনকে তিনি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন কবিতার ডানায় ভর করে। তার কবিতার ভাষা কখনো উর্দু, কখনো ফার্সি। তার চিন্তার গভীরতা আর শব্দের কারুকার্য এমনভাবে মিশে গেছে যে, একটাকে অন্যটা থেকে আলাদা করা প্রায় অসম্ভব। তিনি বলতেন, তার দর্শন প্রচারের জন্য ফার্সি ভাষা বেশি উপযোগী, কারণ এর শব্দভান্ডার ও প্রকাশক্ষমতা বেশি। আর সাধারণ মানুষের কাছে বার্তা পৌঁছানোর জন্য তিনি উর্দু ব্যবহার করতেন।

তার কাব্যজীবনকে মোটা দাগে দুই বা তিনটি পর্বে ভাগ করা যায়।

প্রথম পর্ব (১৯০৮-এর আগে)

এই পর্বের ইকবাল ছিলেন প্রকৃতি, স্বদেশ আর বিশ্বজনীন মানবতার কবি। এই সময়ে লেখা ‘তারানা-ই-হিন্দ’ (Tarana-e-Hindi) বা ‘সারে জাঁহা সে আচ্ছা’ কবিতাটি ভারতের জাতীয়তাবাদের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গিয়েছিল। তিনি লিখছেন:

“সারে জাঁহা সে আচ্ছা, হিন্দুস্তা হমারা,
হাম বুলবুলেঁ হ্যায় ইসকি, ইয়ে গুলিস্তা হমারা।”
(সারা বিশ্ব থেকে সেরা আমাদের হিন্দুস্তান, আমরা এর বুলবুলি পাখি, এ আমাদের ফুলের বাগান।)

একই কবিতায় তিনি বলছেন:

“মজহব নহীঁ সিখাতা আপস মেঁ বৈর রখনা,
হিন্দী হ্যায় হাম, ওতন হ্যায় হিন্দুস্তা হমারা।”
(ধর্ম শেখায় না পরস্পরের সাথে শত্রুতা করতে, আমরা সবাই হিন্দী, আমাদের ওয়াতন বা দেশ হলো হিন্দুস্তান।)

এই পর্বে তিনি ‘নয়া শিওয়ালা’ (নতুন মন্দির) নামে আরেকটি বিখ্যাত কবিতা লেখেন, যেখানে তিনি হিন্দু-মুসলমানের বিভেদ ভুলে ভারতে এক নতুন ঐক্যের মন্দির গড়ার আহ্বান জানান। তিনি লেখেন:

“আ গ़ৈরিয়ত কে পরদে এক বার ফির উঠা দেন,
বিছড়োঁ কো ফির মিলা় দেন, নক্শ-এ-দুই মিটা দেন।
… সুনী পড়ি হুঈ হ্যায় মুদ্দত সে দিল কি বসতি,
আ, এক নয়া শিবালা ইস দেশ মে বনা দেন।”
(এসো, বিচ্ছিন্নতার পর্দা আরেকবার তুলে দিই,
যারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে তাদের মিলিয়ে দিই, বিভেদের চিহ্ন মুছে দিই।
… অনেকদিন ধরে মনের বসতি শূন্য পড়ে আছে,
এসো, এই দেশে একটি নতুন মন্দির বানাই।)

এই ইকবাল কি সেই ইকবাল, যিনি পরে মুসলিমদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের কথা বলবেন? এই প্রশ্নটা আমাদের ভাবায় এবং তার চিন্তার জটিল বাঁকগুলোকে চিনিয়ে দেয়।

দ্বিতীয় পর্ব (ইউরোপ থেকে ফেরার পর)

ইউরোপের অভিজ্ঞতা তার চিন্তার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তিনি পশ্চিমা জাতীয়তাবাদের আগ্রাসী, বর্ণবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদী রূপ দেখে বীতশ্রদ্ধ হন। তিনি মনে করতে শুরু করেন যে, ভৌগোলিক বা ভাষাগত জাতীয়তাবাদ মানুষকে বিভক্ত করে এবং এটি একটি পশ্চিমা ধারণা যা মুসলিম বিশ্বের জন্য অনুপযুক্ত। এর বিকল্প হিসেবে তিনি ‘মিল্লাত’ বা ইসলামী ভ্রাতৃত্বের ওপর জোর দিতে শুরু করেন, যা দেশ-কালের ঊর্ধ্বে এক আধ্যাত্মিক বন্ধন। তার কবিতা হয়ে ওঠে মুসলিম বিশ্বের জাগরণের হাতিয়ার। তিনি লিখলেন ‘তারানা-ই-মিল্লি’ (মুসলিম উম্মাহর সঙ্গীত):

“চীন ও আরব হামারা, হিন্দুস্তা হামারা,
মুসলিম হ্যায় হাম, ওতন হ্যায় সারা জাঁহা হামারা।”
(চীন ও আরব আমাদের, হিন্দুস্তান আমাদের,
আমরা মুসলিম, সারা বিশ্বই আমাদের ওয়াতান বা দেশ।)

এই পর্বের কয়েকটি বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ হলো:

  • শিকওয়া ও জওয়াব-ই-শিকওয়া (Shikwa and Jawab-i-Shikwa, ১৯০৯-১৯১৩): ‘শিকওয়া’ (অভিযোগ) কবিতায় কবি যেন সাধারণ মুসলিমদের পক্ষ থেকে আল্লাহর কাছে নালিশ করছেন। মুসলিমরা একসময় পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ ছিল, তারাই পৃথিবীতে এক ঈশ্বরের বাণী ছড়িয়ে দিয়েছিল, আজ তাদের এই দুর্দশা কেন? এই দুঃসাহসিক অভিযোগ উর্দু কবিতার ইতিহাসে ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা। রক্ষণশীলরা তার বিরুদ্ধে কুফরির অভিযোগও এনেছিলেন। এর জবাবে তিনি লেখেন ‘জওয়াব-ই-শিকওয়া’ (অভিযোগের জবাব)। এখানে স্বয়ং আল্লাহ এর উত্তর দিচ্ছেন। তিনি বলছেন, মুসলিমরা তার পথ থেকে সরে গেছে, তারা আত্মশক্তি বা ‘খুদি’ হারিয়ে ফেলেছে, তারা কর্মবিমুখ ও বিলাসী হয়ে পড়েছে, তাই তাদের এই পতন। এই দুটি কবিতা তার কাব্যিক শক্তি এবং নাটকীয় আবেদনের এক অসাধারণ নিদর্শন।

  • পয়াম-ই-মাশরিক (Payam-i-Mashriq বা Message of the East, ১৯২৩): এটি ছিল জার্মান কবি গ্যেটের (Goethe) ‘West-östlicher Divan’ (প্রাচ্য-প্রতীচ্যের দেওয়ান)-এর জবাবে লেখা। গ্যেটে যেমন প্রাচ্যের জ্ঞান ও কবিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন, ইকবালও তেমনি প্রাচ্যের পক্ষ থেকে পাশ্চাত্যকে একটি বার্তা দিতে চাইলেন। তিনি দেখালেন যে, ইউরোপের জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রশংসার যোগ্য, কিন্তু আত্মা ছাড়া এই জ্ঞান মানবজাতির ধ্বংস ডেকে আনবে। প্রাচ্যের আধ্যাত্মিকতা (‘ইশক’) আর পাশ্চাত্যের কর্মশক্তি ও জ্ঞান (‘আকল’)-এর মিলনই পৃথিবীকে বাঁচাতে পারে।

  • জাভিদ নামা (Javid Nama বা The Book of Eternity, ১৯৩২): এটিকে ইকবালের শ্রেষ্ঠ কাজ বলে মনে করা হয়। এটি অনেকটা দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি’র (Dante’s Divine Comedy) আদলে লেখা। কবি তার পুত্র জাভিদের হাত ধরে এক আধ্যাত্মিক সফরে বেরিয়েছেন। তার পথপ্রদর্শক হলেন পারস্যের মহান কবি জালালউদ্দিন রুমি। এই সফরে তিনি চাঁদ, বুধ, শুক্র, মঙ্গল গ্রহ পার হয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও দার্শনিক ব্যক্তিত্বের আত্মার সাথে কথা বলেন। তিনি দেখা করেন বুদ্ধ, জরথুস্ত্র, গামালুদ্দিন আফগানি, নিৎশে, এমনকি বাংলার বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর ও দাক্ষিণাত্যের মীর সাদিকের আত্মার সাথেও। এই মহাকাব্যিক সফরের মাধ্যমে ইকবাল মানব ইতিহাসের উত্থান-পতন, দর্শনের নানা জটিল প্রশ্ন এবং মানুষের চূড়ান্ত নিয়তি নিয়ে আলোচনা করেছেন।

ইকবালের কবিতা নিছক বিনোদন নয়। তার কবিতা পাঠককে ভাবতে বাধ্য করে, প্রশ্ন করতে শেখায়, আত্মানুসন্ধানে উদ্বুদ্ধ করে। তিনি ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে তোলার জন্য কবিতা লিখেছেন। তার শব্দে আগুন ছিল, স্বপ্ন ছিল, আর ছিল এক গভীর বেদনা।

রাজনৈতিক দর্শন ও সেই বিতর্কিত ভাষণ

এতক্ষণ আমরা যে ইকবালকে নিয়ে আলোচনা করলাম, তিনি একজন মহান কবি ও দার্শনিক। তার ‘খুদি’র দর্শন বা ‘শাহীন’-এর রূপক যে কোনো তরুণের জন্যই অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারে। কিন্তু ইকবালের পরিচয়ের সাথে আরেকটি অধ্যায় জড়িয়ে আছে, যা সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত এবং সম্ভবত সবচেয়ে বেশি রক্তক্ষয়ীও। সেটি হলো তার রাজনৈতিক দর্শন এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের ধারণা।

একজন রাজনৈতিক দর্শনের বিরোধী হিসেবে এই অংশটি নিরপেক্ষভাবে কিন্তু কঠোর সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখা প্রয়োজন। কারণ, মহৎ চিন্তারও বিপজ্জনক পরিণতি থাকতে পারে।

পটভূমি: ব্রিটিশ ভারতে হিন্দু ও মুসলিমদের সম্পর্ক সবসময় সরল ছিল না। রাজনৈতিক ক্ষমতা, চাকরি, শিক্ষায় অংশীদারিত্ব নিয়ে দুই সম্প্রদায়ের অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। ১৯২০-এর দশকের শেষে এই দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হয়। সাইমন কমিশনের রিপোর্ট, নেহেরু রিপোর্ট (১৯২৮) এবং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর চৌদ্দ দফা (১৯২৯)-এর ব্যর্থতার পর মুসলিম লীগের নেতারা মুসলিমদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে ক্রমশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তারা ভয় পাচ্ছিলেন যে, ব্রিটিশরা চলে গেলে অখণ্ড ভারতে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে মুসলিমরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে কোণঠাসা হয়ে পড়বে। কংগ্রেসের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতিশ্রুতিতে তারা পুরোপুরি আস্থা রাখতে পারছিলেন না।

এই জটিল প্রেক্ষাপটে ১৯৩০ সালের ২৯শে ডিসেম্বর, এলাহাবাদে মুসলিম লীগের বার্ষিক সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে ইকবাল একটি প্রস্তাব দেন। এই ভাষণটিই ‘এলাহাবাদ ভাষণ’ (Allahabad Address) নামে পরিচিত এবং এটিকে পাকিস্তান সৃষ্টির আঁতুড়ঘর বলা হয়।

ইকবালের প্রস্তাব কী ছিল?
ইকবাল তার ভাষণে বলেন:

“I would like to see the Punjab, North-West Frontier Province, Sind and Baluchistan amalgamated into a single state. Self-government within the British Empire, or without the British Empire, the formation of a consolidated North-West Indian Muslim state appears to me to be the final destiny of the Muslims, at least of North-West India.” (Iqbal, 1930)

তিনি উত্তর-পশ্চিম ভারতে একটি মুসলিম-প্রধান রাষ্ট্র গঠনের কথা বলেন। তবে তার এই প্রস্তাবটি একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র (Sovereign State) ছিল, নাকি ভারতীয় ফেডারেশনের (Indian Federation) অধীনে একটি স্বায়ত্তশাসিত (Autonomous) প্রদেশ ছিল—তা নিয়ে বিতর্ক আজও শেষ হয়নি। অনেক বিশেষজ্ঞ, যেমন আয়েশা জালাল, মনে করেন যে ইকবাল আসলে একটি স্বাধীন পাকিস্তানের কথা বলেননি। তিনি চেয়েছিলেন ভারতের ভেতরেই মুসলিমদের জন্য একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ইউনিট, যা দর-কষাকষির মাধ্যমে তাদের অধিকার আদায় করতে পারবে (Jalal, 1985)। তার মূল লক্ষ্য ছিল মুসলিমদের সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষা করা।

কিন্তু তার উদ্দেশ্য যা-ই হোক না কেন, তার এই ভাষণটি ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ (Two-Nation Theory)-এর আগুনে ঘি ঢেলেছিল। এই তত্ত্বের মূল কথা হলো, হিন্দু ও মুসলিম দুটি আলাদা জাতি। তাদের ধর্ম, সংস্কৃতি, ইতিহাস, আইন, জীবনাচরণ সবকিছু এত ভিন্ন যে, তারা কখনো এক হয়ে একটি আধুনিক জাতি-রাষ্ট্র (Nation-State) গঠন করতে পারে না। অতএব, তাদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র বা ‘Homeland’ প্রয়োজন।

এখানেই ইকবালের রাজনৈতিক দর্শনের সবচেয়ে বড় দুর্বলতাগুলো এবং বিপজ্জনক দিকগুলো বেরিয়ে আসে।

১. পরিচয়ের সরলীকরণ (Oversimplification of Identity): দ্বিজাতি তত্ত্ব মানুষের জটিল ও বহুমাত্রিক পরিচয়কে শুধুমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে বিচার করে, যা একটি মারাত্মক ভুল। একজন মানুষের পরিচয় শুধু তার ধর্মে সীমাবদ্ধ থাকে না। তার ভাষা, তার আঞ্চলিক সংস্কৃতি, তার শ্রেণী, তার খাদ্যাভ্যাস, তার সঙ্গীত—এই সবকিছু মিলিয়েই তার পরিচয় তৈরি হয়। একজন বাঙালি মুসলমানের সাথে একজন পাঞ্জাবি মুসলমানের চেয়ে একজন বাঙালি হিন্দুর সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত মিল অনেক বেশি। দ্বিজাতি তত্ত্ব এই সহজ সত্যটিকে পুরোপুরি অস্বীকার করে এবং ধর্মের নামে এক কৃত্রিম, একরৈখিক পরিচয় চাপিয়ে দেয়।

২. ইতিহাসের ভুল পাঠ এবং সামষ্টিক ঐতিহ্যের অস্বীকৃতি: এই তত্ত্ব দাবি করে যে, হিন্দু ও মুসলিমরা হাজার বছর ধরে দুটি পৃথক ও বিবদমান স্রোতের মতো পাশাপাশি বাস করেছে, কিন্তু কখনো মেশেনি। এটি ইতিহাসের একটি খণ্ডিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পাঠ। বাস্তবে, ভারতের গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে শত শত বছর ধরে দুই সম্প্রদায়ের মানুষ মিলেমিশে থেকেছে, একে অপরের উৎসবে যোগ দিয়েছে, পীর-ফকির-সাধু-সন্ন্যাসীর মাজারে একসাথে মাথা নত করেছে। ভক্তি আন্দোলন ও সুফিবাদের প্রভাবে তাদের মধ্যে একটি মিশ্র বা সিনক্রেটিক (Syncretic) সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল। দ্বিজাতি তত্ত্ব হিন্দু-মুসলিম এর এই সামষ্টিক ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে একটি কৃত্রিম বিভেদ তৈরি করেছে এবং ইতিহাসকে শুধুমাত্র সংঘাতের চশমা দিয়ে দেখেছে।

৩. বাংলার অনুপস্থিতি ও ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা: ইকবালের এলাহাবাদ ভাষণের সবচেয়ে বড় সমালোচনার দিক হলো, এটি ছিল ভৌগোলিকভাবে অত্যন্ত সংকীর্ণ। তিনি কেবল উত্তর-পশ্চিম ভারতের (পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান, সীমান্ত প্রদেশ) মুসলিমদের নিয়ে ভেবেছিলেন। তৎকালীন ভারতের বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠী, অর্থাৎ বাঙ্গালী মুসলিমদের নিয়ে তিনি সেই ভাষণে একটি কথাও বলেননি! তার এই প্রাথমিক পরিকল্পনা থেকে বাংলা ছিল সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। এটি প্রমাণ করে যে, তার চিন্তা মূলত পাঞ্জাব-কেন্দ্রিক ছিল এবং তিনি সমগ্র ভারতীয় মুসলিমদের বাস্তবতা ও আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করতে পারেননি। এই চিন্তাগত সীমাবদ্ধতাই পরবর্তীকালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাঙনের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

৪. বিভাজনের ভয়াবহতা এবং দার্শনিকের দায়: ইকবালের এই দার্শনিক ভিত্তিই পরবর্তীকালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে ওঠে এবং ভারত ভাগের কারণ হয়। ইকবাল নিজে ১৯৩৮ সালে মারা যান, তাই দেশভাগের ভয়াবহতা তিনি দেখে যাননি। কিন্তু যে তত্ত্বের তিনি অন্যতম প্রবক্তা, তার পরিণতি ছিল ভয়াবহ। সেই বিভাজনের ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ নিহত হয়েছিল, কোটি মানুষ ভিটেমাটিছাড়া হয়েছিল, এবং যে পরিমাণ ঘৃণা ও অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছিল—তার দায় কি ইকবালের মতো স্বপ্নদ্রষ্টারা এড়াতে পারেন? তিনি হয়তো এই রক্তপাত চাননি, কিন্তু যে তত্ত্ব তিনি দিয়েছেন, তার পরিণতি ছিল এটাই। একটি দার্শনিক ধারণা যখন রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়, তখন তার ফলাফল প্রায়শই দার্শনিকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।

৫. পাকিস্তানের স্বপ্নভঙ্গ এবং তত্ত্বের অন্তঃসারশূন্যতা: সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। ইকবাল এবং জিন্নাহর পাকিস্তান ধর্মকে ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা যখন ভাষাগত ও সাংস্কৃতিকভাবে ভিন্ন পূর্ব পাকিস্তানের (আজকের বাংলাদেশ) ওপর অর্থনৈতিক শোষণ ও রাজনৈতিক নিপীড়ন শুরু করে, তখন ধর্মের বন্ধন তাদের এক রাখতে পারেনি। বাঙালিরা প্রমাণ করে দিল যে, ভাষা, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক সাম্যের দাবি ধর্মের চেয়ে কম শক্তিশালী পরিচয় নয়। বাংলাদেশের জন্মই হলো দ্বিজাতি তত্ত্বের অসারতার সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক প্রমাণ। যে তত্ত্বের ভিত্তিতে একটি দেশ তৈরি হয়েছিল, সেই তত্ত্বকেই ভুল প্রমাণ করে আরেকটি দেশের জন্ম হলো। এর চেয়ে বড় আয়রনি আর কী হতে পারে?

৬. ‘সারে জাঁহা সে আচ্ছা’ থেকে ‘মুসলিম হ্যায় হাম’: এক দুঃখজনক রূপান্তর: একজন সমালোচকের চোখে, ইকবালের এই রূপান্তরটি অত্যন্ত দুঃখজনক এবং স্ববিরোধিতায় পূর্ণ। যে কবি একদিন সমগ্র ভারতের জয়গান গেয়েছিলেন, যিনি ‘নয়া শিওয়ালা’ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, তিনিই পরে এমন এক রাজনৈতিক দর্শনের জন্ম দিলেন যা ভারতকে খণ্ডিত করল। কেন এই পরিবর্তন? তিনি কি ব্রিটিশদের ‘ভাগ করো ও শাসন করো’ (Divide and Rule) নীতির শিকার হয়েছিলেন? নাকি সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্যের ভয়ে তিনি সত্যিই একটি বাস্তবসম্মত সমাধান খুঁজেছিলেন? কারণ যা-ই হোক, তার এই রাজনৈতিক চিন্তা তার সার্বজনীন দর্শনের সাথে এক বিরাট স্ববিরোধিতা (Contradiction) তৈরি করে। যে ‘খুদি’র সাধক মানুষকে সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন, তিনিই মানুষকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করার কথা বললেন। এ যেন নিজের দর্শনের সাথেই বিশ্বাসঘাতকতা।

তার রাজনৈতিক দর্শন আলোচনা করতে গেলে এটা মনে রাখা জরুরি যে, তিনি একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন কবি ও দার্শনিক। তিনি একটি সমস্যার সমাধান খুঁজছিলেন। কিন্তু তার দেওয়া সমাধানটি সমস্যার চেয়েও ভয়ঙ্কর এক নতুন সমস্যার জন্ম দিয়েছিল, যার ক্ষত আজও শুকায়নি।

আল্লামা ইকবাল কিভাবে পাশ্চাত্য দর্শনকে ব্যবহার করে সংকীর্ণ ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদ নির্মাণ করেছিলেন তা নিয়ে জানতে যান এখানে – আল্লামা ইকবাল ও ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদ: যেভাবে পাশ্চাত্য দর্শন হলো বিভাজনের হাতিয়ার – বিবর্তনপথ

উত্তরাধিকারের টানাপোড়েন

তাহলে মৃত্যুর এত বছর পর আল্লামা ইকবাল আমাদের কাছে কী হিসেবে টিকে আছেন? তার উত্তরাধিকার বড়ই জটিল, বড়ই বিতর্কিত।

  • পাকিস্তানে: তিনি সেখানে ‘কওমি শায়ের’ (National Poet), ‘মুফাক্কির-ই-পাকিস্তান’ (The Thinker of Pakistan) এবং ‘হাকিম-উল-উম্মত’ (উম্মাহর চিকিৎসক)। তার দর্শন ও কবিতা রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রচারিত হয়। তার জন্মদিন সরকারি ছুটির দিন। কিন্তু প্রায়শই তার চিন্তার জটিলতা এবং স্ববিরোধিতাগুলোকে চেপে গিয়ে তাকে একটি নির্দিষ্ট, সরলরৈখিক ছাঁচে ফেলা হয়। তার ‘ইজতিহাদ’ (Ijtihad) বা ধর্মের নতুন, গতিশীল ব্যাখ্যার আহ্বানকে উপেক্ষা করে তাকে রক্ষণশীলতার প্রতীক বানানো হয়। যে ইকবাল চিন্তার স্বাধীনতাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন, তার নামেই চিন্তার স্বাধীনতাকে রুদ্ধ করা হয়। যে ইকবাল মোল্লাতন্ত্রের কঠোর সমালোচক ছিলেন, তার দেশেই মোল্লাদের দাপট। এটি এক বিরাট পরিহাস।

  • ভারতে: তার উত্তরাধিকার অনেক বেশি জটিল ও দ্বিখণ্ডিত। একদিকে, ‘সারে জাঁহা সে আচ্ছা’র জন্য তিনি আজও শ্রদ্ধার পাত্র। এটি ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় দেশাত্মবোধক গান। উর্দু কবিতার জগতে গালিবের পর তাকেই সেরা মনে করা হয় এবং তার কাব্যিক প্রতিভা নিয়ে কোনো সংশয় নেই। কিন্তু ভারত ভাগের অন্যতম তাত্ত্বিক রূপকার বা ‘খলনায়ক’ হিসেবেও তার একটি পরিচয় আছে। ভারতের জাতীয়তাবাদী বয়ানে তিনি একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী। ফলে তাকে একই সাথে ভালোবাসা ও ঘৃণা করা হয়। তিনি যেন একাধারে দেশপ্রেমিক এবং দেশদ্রোহী।

  • বাংলাদেশে: এখানে ইকবাল প্রায় বিস্মৃত এক নাম। এর কারণ স্পষ্ট। যে দ্বিজাতি তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে পাকিস্তান তৈরি হয়েছিল, সেই তত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করেই বাংলাদেশের জন্ম। তাই ইকবালের রাজনৈতিক দর্শন বাংলাদেশের জাতীয় চেতনার সম্পূর্ণ বিপরীত। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি সংগ্রাম ছিল কার্যত তার রাজনৈতিক দর্শনের বিরুদ্ধে এক দীর্ঘ প্রতিবাদ। ফলে বাংলাদেশে তার গ্রহণযোগ্যতা প্রায় শূন্যের কোঠায়। যদিও তার কবিতা ও দর্শন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে কিছুটা স্থান পেয়েছে, কিন্তু জাতীয় জীবনে বা সাধারণ মানুষের চেতনায় তার কোনো প্রভাব নেই।

  • বিশ্বজুড়ে: উপমহাদেশের বাইরে, বিশেষ করে পশ্চিমা অ্যাকাডেমিক জগতে এবং ইরানে তার পরিচয় ভিন্ন। পশ্চিমে তিনি বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুসলিম আধুনিকতাবাদী (Modernist) চিন্তাবিদ হিসেবে পরিচিত। তার বই The Reconstruction of Religious Thought in Islam আধুনিক ইসলামি দর্শনের এক মাইলফলক হিসেবে গণ্য হয়। ইরানে তিনি ‘ইকবাল-ই-লাহোরি’ নামে পরিচিত এবং ফার্সি ভাষায় তার অসাধারণ কাব্য প্রতিভার জন্য অত্যন্ত সম্মানিত।

শেষ পর্যন্ত আমরা কী সিদ্ধান্তে আসব?

ইকবাল ছিলেন এক বিশাল, উত্তাল সমুদ্রের মতো। তার মধ্যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, কবিতা ও দর্শন, আধ্যাত্মিকতা ও রাজনীতি এসে মিশেছিল। তার মতো মননশীল, বহুভাষী ও সৃষ্টিশীল কবি-দার্শনিক এক শতাব্দীতে হয়তো একজনই জন্মান। তিনি মুসলিম সমাজকে স্থবিরতা থেকে বের করে এনে আত্মবিশ্বাসী হতে শিখিয়েছেন, কর্মের পথে আহ্বান করেছেন। তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে একটি অর্থপূর্ণ সেতুবন্ধনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তার ‘খুদি’র দর্শন আজও মানুষকে আত্মশক্তিতে বলীয়ান হতে অনুপ্রাণিত করে।

কিন্তু মুদ্রার অপর পিঠও আছে। তার রাজনৈতিক চিন্তা বিভেদ তৈরি করেছে, একটি রক্তাক্ত ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে এবং এমন একটি তত্ত্বকে উস্কে দিয়েছে যা আজও দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে। তার মহৎ স্বপ্ন এক ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।

হয়তো কোনো মানুষই নিখুঁত নয়। মহান মানুষেরাও ভুল করেন। আর তাদের ভুলের প্রভাবও হয় সুদূরপ্রসারী এবং বিধ্বংসী।

সেই যে রাতের শুরুতে আমরা বারান্দায় বসেছিলাম, এখনো সেখানেই আছি। চাঁদটা হয়তো পশ্চিমে হেলে পড়েছে। ভোরের আলো ফুটতে আর বেশি দেরি নেই। আল্লামা ইকবালকে নিয়ে ভাবতে গেলে মনটা এমনই জটিল হয়ে যায়। একদিকে তার কবিতার জন্য, তার দর্শনের গভীরতার জন্য শ্রদ্ধা জাগে। অন্যদিকে, তার রাজনৈতিক দর্শনের করুণ পরিণতি দেখে এক ধরনের বিষণ্ণতা গ্রাস করে। মনে হয়, যে শাহীনকে তিনি আকাশে উড়তে বলেছিলেন, সেই শাহীন পথ ভুলে এক ভুল আকাশে উড়ে গিয়েছিল। সে এমন এক বাসা বানাতে চেয়েছিল যা তার নিজের জন্যই খাঁচা হয়ে দাঁড়ায়।

তথ্যসূত্র

  • Bergson, H. (1911). Creative Evolution (A. Mitchell, Trans.). Henry Holt and Company. (Original work published 1907).
  • Hegel, G. W. F. (1991). Elements of the Philosophy of Right (A. W. Wood, Ed.; H. B. Nisbet, Trans.). Cambridge University Press. (Original work published 1821).
  • Iqbal, M. (1934). The Reconstruction of Religious Thought in Islam. Oxford University Press.
  • Iqbal, M. (2013). The Reconstruction of Religious Thought in Islam. Stanford University Press. (Original work published 1930).
  • Iqbal, M. (1930, December 29). Presidential Address to the All-India Muslim League, Allahabad, 1930. In L. A. Sherwani (Ed.), Speeches, Writings and Statements of Iqbal. Iqbal Academy Pakistan.
  • Jalal, A. (1985). The Sole Spokesman: Jinnah, the Muslim League and the Demand for Pakistan. Cambridge University Press.
  • Majeed, J. (2009). Muhammad Iqbal: Islam, Aesthetics and Postcolonialism. Routledge.
  • Mir, M. (2006). Iqbal. I.B. Tauris.
  • Nietzsche, F. (1961). Thus Spoke Zarathustra (R. J. Hollingdale, Trans.). Penguin Books. (Original work published 1883-1885).
  • Pirzada, S. S. (Ed.). (1970). Foundations of Pakistan: All-India Muslim League Documents, 1906-1947 (Vol. II). National Publishing House.
  • Schimmel, A. (1963). Gabriel’s Wing: A Study into the Religious Ideas of Sir Muhammad Iqbal. E.J. Brill.
  • Sevea, I. (2012). The Political Philosophy of Muhammad Iqbal: Islam and Nationalism in Late Colonial India. Cambridge University Press.
  • Singh, I. (1951). The Ardent Pilgrim: An Introduction to the Life and Work of Mohammed Iqbal. Longmans, Green and Co.
  • Vahid, S. A. (1959). Iqbal: His Art and Thought. John Murray.

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.