আল্লামা ইকবাল ও ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদ: যেভাবে পাশ্চাত্য দর্শন হলো বিভাজনের হাতিয়ার

আল্লামা ইকবাল ও তার দর্শন নিয়ে জানতে যান এখানে – আল্লামা ইকবালের স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের ব্যবচ্ছেদ

Table of Contents

ভূমিকা: এক কাঁটাভরা নদীর বাঁকে দাঁড়িয়ে

কারো চিন্তাভাবনা নিয়ে লিখতে গেলে, বিশেষ করে এমন একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব যিনি একটা গোটা জাতির মনোজগতে গভীর ছাপ রেখে গেছেন, তার সম্পর্কে লিখতে গেলে দশবার ভাবতে হয়। তার ভাবনাকে ইতিবাচক আলোয় দেখা যেমন সহজ, তেমনি সেই একই ভাবনা যখন একটা বিশেষ দিকে ঝুঁকে পড়ে, তখন তার ভেতরের কাঁটাগুলোও তো চোখে পড়ে, তাই না? আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল নিঃসন্দেহে একজন বড় মাপের কবি ও দার্শনিক ছিলেন, কিন্তু তার রাজনৈতিক চিন্তা, বিশেষ করে যা কিনা পরবর্তীকালে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল, সেটা নিয়ে আজ একটু অন্যরকম চোখে তাকানো যাক। এমন চোখে, যা হয়তো কিছু অস্বস্তিকর প্রশ্ন তুলে ধরবে, যে প্রশ্নগুলো ইতিহাসের দীর্ঘ ছায়ায় আজও আমাদের তাড়া করে ফেরে।

দেখুন, পৃথিবীর সব বড় বড় নদীরই অনেক শাখা-প্রশাখা থাকে। কিছু শাখা উর্বর পলি বয়ে আনে, ফসলের মাঠ সবুজে ভরিয়ে দেয়, তৃষ্ণার্তকে জল দেয়। আবার কিছু শাখা হয়তো এমন দিকে বাঁক নেয়, যা দুটো গ্রামের মধ্যে বিভেদ তৈরি করে, বন্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, উর্বর ভূমিকে লবণাক্ত করে তোলে। চিন্তার জগৎটাও অনেকটা সেরকম। আল্লামা ইকবালের রাজনৈতিক চিন্তা-তরঙ্গিনীও নানা বাঁক নিয়েছে, নানা খাতে প্রবাহিত হয়েছে। একদিকে যেমন তিনি মুসলিম উম্মাহর আধ্যাত্মিক জাগরণের স্বপ্ন দেখেছেন, ঔপনিবেশিক নিগড় থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেছেন, অন্যদিকে সেই স্বপ্নকে একটা নির্দিষ্ট ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে বাঁধতে গিয়ে এমন কিছু উপাদানের আশ্রয় নিয়েছেন, যা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ থেকেই যায়। বিশেষ করে, যখন সেই কাঠামোটা একটা ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের (ethno-religious nationalism) জন্ম দেয়, তখন তার ভেতরের বিপদগুলোকেও চিনে নেওয়া দরকার, তার বিষাক্ত ফলগুলোকেও স্বীকার করে নেওয়া জরুরি। কারণ, ইতিহাসের ভুল থেকে শিক্ষা না নিলে সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকে, নতুন নতুন রূপে।

এই যে আমরা বলছি, ইকবাল পাশ্চাত্যের দর্শন থেকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন – কথাটা তো মিথ্যে নয়। তার ইংল্যান্ড ও জার্মানির জীবন, সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যয়ন, সমসাময়িক ইউরোপীয় দার্শনিকদের কাজের সঙ্গে তার নিবিড় পরিচয় – এগুলো তার মানসলোক গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু সেই অনুপ্রেরণা কি সবসময় সকলের জন্য মঙ্গলজনক পথে এগিয়েছে? নাকি সেই পাশ্চাত্য জ্ঞানকে তিনি এমনভাবে ছেঁকে নিয়েছেন, এমনভাবে নিজের ছাঁচে ফেলেছেন, যা শেষ পর্যন্ত একটা বিভাজনমূলক (divisive), বহিষ্কারমূলক (exclusionary) এবং আধিপত্যকামী (hegemonic) রাজনীতির জন্ম দিয়েছে? এই দীর্ঘ প্রবন্ধে আমরা সেই কাঁটাভরা পথেই হাঁটব। চেষ্টা করব বুঝতে, কীভাবে পাশ্চাত্যের কিছু মহৎ, উদারনৈতিক বা বিপ্লবী দার্শনিক ভাবনা ইকবালের হাতে পড়ে এক বিশেষ ধরনের জাতীয়তাবাদের মশলা হয়ে উঠল, যে জাতীয়তাবাদ শেষমেশ উপমহাদেশের বুকে একটা গভীর, রক্তক্ষয়ী ক্ষত তৈরি করে গেল – যে ক্ষত আজও শুকায়নি, বরং নানা রূপে নতুন করে পুঁজ জমছে সেখানে। 

ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ: এক পিচ্ছিল পথ, এক সর্বনাশা মোহ

শুরুতেই একটা কথা খুব স্পষ্ট করে, দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে নেওয়া ভালো। জাতীয়তাবাদ (nationalism) জিনিসটা নিজেই একটা জটিল ও প্রায়শই বিপজ্জনক ধারণা। যখন তা হয় ভাষার ভিত্তিতে, সংস্কৃতির ভিত্তিতে, কিংবা কোনো ভৌগোলিক অঞ্চলের মানুষের সম্মিলিত ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে – তখনও তার মধ্যে সংকীর্ণতা, ‘অপর’ এর প্রতি বিদ্বেষ এবং আগ্রাসী মনোভাবের উপাদান মিশে থাকার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। আধুনিক পৃথিবীতে জাতীয়তাবাদের নামে যত যুদ্ধ, যত রক্তপাত, যত গণহত্যা (genocide) হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু জাতীয়তাবাদ যখন ধর্মের নামে, ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তখন তা আরও ভয়ঙ্কর, আরও বিধ্বংসী রূপ নিতে পারে।

কারণ, ধর্ম যেখানে তার আদি রূপে মানুষকে ভালোবাসতে শেখায়, সহিষ্ণু হতে শেখায়, বৃহত্তর মানবতার সঙ্গে যুক্ত হতে বলে, সেখানে ধর্মের নামে তৈরি হওয়া জাতীয়তাবাদ প্রায়শই সেই ধর্মের মানবিক ও আধ্যাত্মিক আবেদনকে সংকীর্ণ করে ফেলে, তাকে একটি রাজনৈতিক মতাদর্শের হাতিয়ারে পরিণত করে। এটি এক ধরনের ‘আমরা’ বনাম ‘ওরা’র (us vs. them) বিপজ্জনক বিভাজন তৈরি করে, যেখানে ‘আমরা’ অর্থাৎ সমধর্মীরাই কেবল আপন, পবিত্র, ইতিহাসের সঠিক পথের অনুসারী, আর ‘ওরা’ অর্থাৎ ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা হয়ে যায় পর, অপবিত্র, ভ্রান্ত পথের যাত্রী, এমনকি শত্রু – যাদেরকে হয় নিজেদের পথে আনতে হবে, নয়তো নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে হবে। এই ধরনের জাতীয়তাবাদ মানুষকে মেলায় না, বরং দূরে ঠেলে দেয়; হৃদয়ে প্রেম জাগায় না, বরং ঘৃণা ও সন্দেহের বীজ বপন করে; সহাবস্থানের সেতু নির্মাণ করে না, বরং বিভেদের প্রাচীর উঁচু করে তোলে।

ইতিহাসের পাতা ওল্টালে এমন অসংখ্য উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে, যেখানে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ ডেকে এনেছে রক্তপাত, হানাহানি, জাতিগত সংঘাত (ethnic conflict), এবং সীমাহীন মানবিক বিপর্যয়। ইউরোপের মধ্যযুগের ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ, ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের ক্যাথলিক-প্রোটেস্ট্যান্ট সংঘাত, আধুনিক যুগে বলকান অঞ্চলের জাতিগত সহিংসতা, মধ্যপ্রাচ্যের ধর্মীয় উগ্রপন্থা, কিংবা আমাদের উপমহাদেশের ভারত-ভাগ – এগুলোর প্রতিটির পেছনেই ধর্মভিত্তিক পরিচিতি ও জাতীয়তাবাদের একটা বড় ভূমিকা ছিল। এই জাতীয়তাবাদ প্রায়শই এক ধরনের ঐতিহাসিক প্রতিশোধস্পৃহা (historical revanchism) এবং কাল্পনিক স্বর্ণযুগ (mythical golden age) পুনরুদ্ধারের স্বপ্নে বিভোর থাকে, যা বর্তমানের বাস্তব সমস্যাগুলো থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে দেয় এবং একটি হিংসাত্মক ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেয়।

আল্লামা ইকবালের রাজনৈতিক চিন্তার গভীরেও এই ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের একটা শক্তিশালী, প্রায় অপ্রতিরোধ্য স্রোত বহমান ছিল। তিনি যতই মুসলিম উম্মাহর (Ummah) বিশ্বজনীনতার কথা বলুন না কেন, যতই তিনি ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদের সমালোচনা করুন না কেন, তার প্রস্তাবিত সমাধান শেষ পর্যন্ত ভারতীয় মুসলিমদের জন্য একটি পৃথক, ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করেছিল। আর এই পৃথক রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি ছিল ধর্ম – ইসলাম। এখানেই লুকিয়ে আছে সেই পিচ্ছিল পথের হাতছানি, সেই সর্বনাশা মোহের ফাঁদ, যা একবার পা দিলে আর সহজে ফেরা যায় না। তার দর্শন যে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের জন্ম দিয়েছিল, তা শুরু থেকেই এক ধরনের ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ববোধ (religious supremacism) এবং অমুসলিমদের প্রতি অবিশ্বাস (distrust) ও বৈষম্যের (discrimination) ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। এই বিষয়টি বিস্তৃত আলোচনার দাবি রাখে।

হেগেল ও বার্গসোঁ: কার আত্মা কাঁদে ইতিহাসের কারাগারে, কার প্রাণের স্পন্দনে বাজে বিভেদের বিষণ্ণ সুর?

আমরা জানি, জার্মান ভাববাদের (German Idealism) অন্যতম পুরোধা গেয়র্গ ভিলহেল্ম ফ্রিডরিশ হেগেলের (Georg Wilhelm Friedrich Hegel) দর্শন, বিশেষত তার ‘আত্মার বিকাশ’ (Development of the Spirit/Geist) এবং ইতিহাসে চেতনার ক্রমবিকাশের ধারণা, আল্লামা ইকবালের ওপর গভীর ও স্থায়ী ছাপ ফেলেছিল। হেগেল যেমন মনে করতেন, ইতিহাস হলো এক পরম আত্মার (Absolute Spirit) নিজেকে ধাপে ধাপে, দ্বান্দ্বিকভাবে (dialectically) উন্মোচন করার এক মহাকাব্যিক মঞ্চ, এবং রাষ্ট্র হলো সেই আত্মারই এক সচেতন, নৈতিক ও যুক্তিসঙ্গত রূপ, ইকবালও তেমনি মুসলিম উম্মাহকে এক বিশেষ ‘ঐতিহাসিক জাতি’ (historical nation) হিসেবে কল্পনা করেছিলেন, যার এক বিশেষ নিয়তি (destiny), এক বিশেষ ঐতিহাসিক ভূমিকা (historical mission) রয়েছে। ইকবাল প্রায়শই তার লেখায় ও কবিতায় মুসলিমদের এই ঐতিহাসিক চেতনা জাগ্রত করার আহ্বান জানিয়েছেন।

কিন্তু এখানে কয়েকটি মৌলিক ও অস্বস্তিকর প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া যায় না, যদি আমরা ইকবালের চিন্তার সমালোচনামূলক পাঠ করতে চাই। হেগেলের ‘বিশ্ব-আত্মা’ (World-Spirit) বা ‘পরম আত্মা’ কি কোনো বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের একচেটিয়া সম্পত্তি ছিল? তার দর্শন কি কোনো একটি বিশেষ ধর্মকে ইতিহাসের মূল চালিকাশক্তি বা চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছিল? উত্তরটি হলো, না। হেগেলের দর্শন ছিল তার সমসাময়িক ইউরোপীয় প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এক সর্বজনীন মানবীয় চেতনার বিকাশের ইতিহাস নির্মাণের প্রচেষ্টা, যেখানে যুক্তি, স্বাধীনতা ও নৈতিকতার ধারণা ক্রমশ মূর্ত হয়ে উঠছে রাষ্ট্রের মাধ্যমে। হেগেল যখন রাষ্ট্রের কথা বলছেন, তখন তিনি একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের সকল মানুষের সম্মিলিত নৈতিক জীবনকে ধারণ করার কথা বলছেন, যেখানে ব্যক্তির স্বাধীনতা ও সার্বজনীন ইচ্ছার (universal will) সমন্বয় ঘটবে (Hegel, 1821/1991)।

কিন্তু ইকবাল যখন মুসলিম উম্মাহকে এই ‘ঐতিহাসিক জাতি’র আসনে বসাচ্ছেন, তখন তিনি কি প্রকারান্তরে এই বার্তাই দিচ্ছেন না যে, একটি বিশেষ ধর্মীয় গোষ্ঠীই ইতিহাসের মূল চালিকাশক্তি হওয়ার অধিকারী, তারাই ঈশ্বরের ‘নির্বাচিত’ প্রতিনিধি? একটি বহু-ধর্মীয়, বহু-সাংস্কৃতিক সমাজে, যেমন ভারতবর্ষ, যখন একটি মাত্র ধর্মীয় সম্প্রদায় নিজেদেরকে ইতিহাসের ‘কেন্দ্রীয় চরিত্র’ বা ‘নিয়তির দ্বারা চালিত’ বিশেষ সত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তখন অন্যান্য ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়? তারা কি ইতিহাসের পার্শ্বচরিত্র, নিছক দর্শক, নাকি ইতিহাসের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন, গুরুত্বহীন কোনো জনপদ? হেগেলের একটি জটিল, বহুমাত্রিক এবং মূলত ধর্মনিরপেক্ষ (অন্ততপক্ষে তার সমসাময়িক ইউরোপীয় অর্থে) দার্শনিক তত্ত্বকে এভাবে একটি সংকীর্ণ ধর্মীয় ছাঁচে ফেলাটা কি তার মূল চিন্তার প্রতি সুবিচার করে, নাকি তা এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক ছিনতাই (intellectual hijacking) ও সাম্প্রদায়িকীকরণ (communalization)?

এই সিলেক্টিভ অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন বা বেছে বেছে গ্রহণ এবং তাকে বিশেষ রাজনৈতিক-ধর্মীয় উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার প্রবণতা ইকবালের দর্শনে বারবার দেখা যায়। এর মাধ্যমে একটি উদারনৈতিক বা সর্বজনীন দর্শনকেও সাম্প্রদায়িকীকরণের হাতিয়ারে পরিণত করা সম্ভব হয়। ইকবাল হেগেলের কাছ থেকে ঐতিহাসিকতার ধারণা নিলেন, কিন্তু সেই ইতিহাসকে তিনি মূলত ইসলামী ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় এবং তার পুনর্জাগরণের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেললেন। ফলে, হেগেলের দর্শনের যে দ্বান্দ্বিক ও সমালোচনামূলক দিক ছিল, যা কিনা যে কোনো সমাজের আত্ম-উন্নতির জন্য জরুরি, তা ইকবালের হাতে পড়ে এক ধরনের আত্মতুষ্টি ও অতীতচারিতায় (nostalgia) পর্যবসিত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হলো।

একইভাবে, ফরাসি দার্শনিক অঁরি বার্গসোঁর (Henri Bergson) জীবনবাদী দর্শন, বিশেষত তার ‘এলাঁ ভিতাল’ (Élan Vital) বা ‘জীবনীশক্তি’ (Life Force/Vital Impetus) এবং ‘সৃজনশীল বিবর্তন’ (Creative Evolution) এর ধারণা, ইকবালের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। বার্গসোঁর ‘এলাঁ ভিতাল’ ছিল এক বিশ্বজনীন, স্বতঃস্ফূর্ত, অনির্দেশ্য, সৃজনশীল প্রাণের স্পন্দন, যা কোনো বিশেষ ধর্ম, জাতি বা মতাদর্শের গণ্ডিতে আবদ্ধ নয় (Bergson, 1907/1911)। বার্গসোঁর এই জীবনীশক্তি প্রকৃতির সর্বত্র পরিব্যাপ্ত, যা নতুন নতুন, অপ্রত্যাশিত রূপ সৃষ্টির মাধ্যমে সতত এগিয়ে চলেছে। এটি যুক্তির শৃঙ্খল ভেঙে স্বজ্ঞা (intuition) ও অভিজ্ঞতার ওপর জোর দেয়। ইকবাল তার বিখ্যাত ‘খুদি’ (Khudi) বা আত্মসত্তার ধারণাকে এই জীবনীশক্তির আলোকেই ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন মুসলিম ব্যক্তি ও সমাজ যেন এই ‘খুদি’কে জাগ্রত করে নিজেদের ভেতরের অসীম সম্ভাবনাকে উন্মোচিত করতে পারে, স্থবিরতা ও জড়তা ঝেড়ে ফেলে এক নতুন, সৃজনশীল জীবনের অধিকারী হতে পারে।

উদ্দেশ্য নিঃসন্দেহে মহৎ। কিন্তু এখানেও সেই একই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়: ইকবালের হাতে পড়ে বার্গসোঁর এই সর্বজনীন ‘এলাঁ ভিতাল’ কি আর তার বিশ্বজনীনতা বজায় রাখতে পারল? এটি কি মূলত ‘মুসলিম খুদি’ বা ‘ইসলামী জীবনীশক্তি’তে পর্যবসিত হলো না? ‘খুদি’কে শক্তিশালী করে যে আত্মিক ও জাগতিক শক্তি অর্জনের কথা তিনি বলছেন, সেই শক্তি কি শেষ পর্যন্ত একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও আধিপত্য (political power and dominance) অর্জনের হাতিয়ারে পরিণত হলো না? বার্গসোঁর দর্শনের এই খণ্ডিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যবহার কি তার মূল চিন্তার মর্মবস্তুকে অস্বীকার করে না, তার উদারনৈতিক ও বহুত্ববাদী আবেদনকে সংকীর্ণ করে না?

যখন একটি সর্বজনীন দার্শনিক তত্ত্বকে, যা কিনা সকল মানুষের ভেতরের সৃজনশীল সম্ভাবনাকে স্বীকৃতি দেয়, একটি সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক লক্ষ্যের সেবায় নিয়োজিত করা হয়, তখন তার সৃজনশীল ও মানবিক আবেদন অনেকটাই খর্ব হয়ে যায়। বার্গসোঁর ‘এলাঁ ভিতাল’ যেখানে ছিল সৃষ্টির অফুরন্ত আনন্দে মগ্ন এক বাঁধনহারা ঝর্ণার মতো, যা কোনো নির্দিষ্ট খাতে বইতে বাধ্য নয়, ইকবালের ‘খুদি’ সেখানে যেন একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক রথ টানার একটি সুশৃঙ্খল (disciplined) কিন্তু সীমিত (confined) শক্তিতে রূপান্তরিত হলো। এর ফলে, যে জীবনীশক্তি সকল মানুষের মধ্যে ঐক্যের সেতুবন্ধন রচনা করতে পারত, তা-ই হয়ে উঠল বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতার অন্যতম অনুঘটক। যে স্বজ্ঞা ও অন্তর্দৃষ্টির কথা বার্গসোঁ বলেছিলেন, তা ইকবালের হাতে পড়ে যেন একটি বিশেষ ধর্মীয় সত্যের দিকেই পরিচালিত হওয়ার বাধ্যবাধকতায় আবদ্ধ হয়ে গেল।

নিটশে ও ‘অতিমানব’: কার শক্তিতে কে বলীয়ান, কার বিরুদ্ধে এই লৌহ কঠিন আস্ফালন?

জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিখ নিটশে (Friedrich Nietzsche) ছিলেন তার সময়ের এক প্রথাভাঙা, আপসহীন, বিদ্রোহী কণ্ঠস্বর। তার দর্শন ছিল প্রচলিত মূল্যবোধ, খ্রিস্টীয় নৈতিকতা, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের প্রতি এক নির্মম সমালোচনা। তার ‘উবারমেনশ’ (Übermensch) বা ‘অতিমানব’ ছিল গতানুগতিক ‘পালের নৈতিকতা’ (herd morality), দুর্বলতা, সমবেদনা এবং গতানুগতিকতা থেকে মুক্ত এক শক্তিশালী, সৃজনশীল, আত্মনির্ভর ও আত্ম-অতিক্রমকারী (self-overcoming) সত্তা (Nietzsche, 1883-1885/1961)। এই অতিমানব ‘ঈশ্বরের মৃত্যু’ (death of God) পরবর্তী শূন্যতার যুগে নিজেই নিজের মূল্যবোধের স্রষ্টা, নিজেই নিজের নিয়তির নিয়ন্তা, পৃথিবীর প্রতি বিশ্বস্ত এক নতুন ধরনের মানুষ। ইকবাল নিটশের এই ধারণা থেকে গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং এর আদলে তার ‘ইনসান-ই-কামিল’ (Insan-i-Kamil – The Perfect Man) বা ‘মর্দ-ই-মুমিন’ (Mard-e-Momin – The Man of Faith) এর আদর্শ নির্মাণ করেছিলেন। ইকবালের কবিতায় ও দর্শনে এই ‘মর্দ-ই-মুমিন’ এক কেন্দ্রীয় চরিত্র, যিনি আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে পৃথিবীতে ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠা করবেন।

কিন্তু এখানেও ইকবাল নিটশের চিন্তার একটি খণ্ডিত, সুবিধাজনক এবং অনেকাংশে বিকৃত পাঠ গ্রহণ করেছিলেন। নিটশের অতিমানব ছিল চরমভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক (radically individualistic), সে কোনো ধর্ম বা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি নয়, বরং এক নিঃসঙ্গ, অভিজাত (aristocratic) আত্মার অভিযাত্রী। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, নিটশের দর্শন ছিল চূড়ান্তভাবে ঈশ্বরবিমুখ (atheistic) বা ঈশ্বরোত্তর (post-theistic)। ‘ঈশ্বরের মৃত্যু’র ঘোষণাই ছিল তার দর্শনের অন্যতম ভিত্তি। অন্যদিকে, ইকবালের ‘মর্দ-ই-মুমিন’ সম্পূর্ণরূপে আল্লাহকেন্দ্রিক, ইসলামের শিক্ষায় পরিপূর্ণ এবং মুসলিম উম্মাহর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। ইকবাল নিটশের নাস্তিকতাকে সচেতনভাবে পরিহার করেছিলেন, যা তার ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু নিটশের দর্শনের যে অংশটুকু ‘শক্তি’ (power), ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ (superiority), ‘প্রভুত্ব’ (dominance) এবং দুর্বলকে অতিক্রম করে যাওয়ার কথা বলে, সেটুকু তিনি সযত্নে গ্রহণ করে তার মুসলিম জাতীয়তাবাদী প্রকল্পের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জুড়ে দিয়েছিলেন।

নিটশের আরেকটি অত্যন্ত বিতর্কিত ও বহুল আলোচিত ধারণা হলো ‘উইল টু পাওয়ার’ (Wille zur Macht) বা ‘ক্ষমতার ইচ্ছা’। নিটশের কাছে এটি ছিল জীবনের এক মৌলিক, সর্বব্যাপী চালিকাশক্তি, যা সবকিছুকে আরও বিকশিত হতে, আরও শক্তিশালী হতে, নিজেকে অতিক্রম করতে, নিজের পরিধি বিস্তার করতে তাড়িত করে। এটি নিছক রাজনৈতিক ক্ষমতা বা অন্যের ওপর আধিপত্য নয়, বরং এক ধরনের সৃষ্টিশীল, প্রাণবন্ত শক্তি যা নিজেকেই ক্রমাগত অতিক্রম করে চলে। ইকবাল যখন এই ‘ক্ষমতার ইচ্ছা’কে তার ‘খুদি’র দর্শনের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর সম্মিলিত ইচ্ছাশক্তি ও রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষায় রূপান্তরিত করেন, তখন প্রশ্ন জাগে – এই শক্তি কার বিরুদ্ধে প্রযুক্ত হওয়ার কথা? একটি বহু-সাংস্কৃতিক ও বহু-ধর্মীয় সমাজে, যেমন ভারতবর্ষ, যখন একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠী নিজেদের ‘খুদি’কে জাগ্রত করে ‘অতিমানব’ বা ‘মর্দ-ই-মুমিন’ হয়ে ওঠার সাধনা করে এবং ‘ক্ষমতার ইচ্ছা’কে বাস্তবায়িত করতে চায়, তখন তাদের এই আকাঙ্ক্ষা কি অন্য গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই ভীতি, অবিশ্বাস, উদ্বেগ ও প্রতিরোধের জন্ম দেয় না?

নিটশের দর্শন ছিল মূলত উনিশ শতকের ইউরোপীয় সমাজের অবক্ষয়, নিহিলিজম (nihilism), মূল্যবোধের সংকট এবং ব্যক্তিসত্তার চরম বিকাশের এক গভীর, যন্ত্রণাদগ্ধ আত্ম-সমালোচনা। সেই দর্শনকে যখন একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক পুনরুত্থান, তাদের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার এবং অন্য সম্প্রদায় থেকে নিজেদের পৃথক ও উন্নততর প্রমাণ করার জন্য ব্যবহার করা হয়, তখন তার ফলাফল কেবল বিভেদ, সংঘাত ও আধিপত্যকামিতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য। ইকবালের ‘মর্দ-ই-মুমিন’ যদি হয় আদর্শ মানব, তাহলে যারা এই আদর্শের ছাঁচে পড়েন না, বিশেষত অমুসলিম কিংবা এমনকি ভিন্ন মতাবলম্বী মুসলমান (যেমন, শিয়া, আহমদিয়া বা সুফি ঘরানার মুসলমান), তাদের অবস্থান কোথায়? তারা কি ‘অপূর্ণ’, ‘দুর্বল’ বা ‘নিকৃষ্ট’ মানব হিসেবে পরিগণিত হবেন? এই ধরনের শ্রেষ্ঠত্বের দাবি অনিবার্যভাবে অন্যদের প্রতি অশ্রদ্ধা, অসহিষ্ণুতা এবং এমনকি হিংসার জন্ম দেয়।

ড. খলিফা আব্দুল হাকিম তার ‘ফিকর-ই-ইকবাল’-এ ইকবালের নিটশেপ্রীতি এবং উভয়ের চিন্তার সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য নিয়ে বিশদ আলোচনা করলেও, নিটশের চিন্তার এই ধরনের সিলেক্টিভ এবং তার বিপজ্জনক রাজনৈতিক পরিণতির দিকগুলো হয়তো ততটা গুরুত্বের সঙ্গে ও কঠোরভাবে তুলে ধরেননি (Hakim, 1957)। নিটশের চিন্তার এই খণ্ডিত ও উদ্দেশ্যমূলক ব্যবহার ইকবালের রাজনৈতিক দর্শনকে এক আগ্রাসী, পুরুষতান্ত্রিক (patriarchal) এবং আধিপত্যকামী চরিত্র দান করেছিল, যা একটি বহুত্ববাদী সমাজের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। যে ‘ঈগলের’ মতো উন্নত শির, অপরাজেয় শক্তির কথা ইকবাল বলেন, সেই ঈগল যে অন্য দুর্বল পাখিদের শিকার করে, সেই দিকটা তার দর্শনে প্রায়শই উহ্য থেকে যায়।

পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রচিন্তা বনাম সংকীর্ণ মুসলিম জাতীয়তাবাদ: আধুনিকতার নামে মধ্যযুগীয় পশ্চাদগমন?

আল্লামা ইকবাল ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের একজন কঠোর সমালোচক ছিলেন। তিনি মনে করতেন, এই জাতীয়তাবাদ সংকীর্ণ, ভৌগোলিক সীমারেখায় আবদ্ধ, বস্তুবাদী এবং মুসলিম উম্মাহর বিশ্বজনীন আধ্যাত্মিক চেতনার (universal spiritual spirit of the Ummah) পরিপন্থী। তার কবিতায় প্রায়শই ‘বতনিয়ত’ (wataniyat – patriotism based on territory) এবং ‘কওমিয়ত’ (qawmiyat – nationalism based on race or geography) এর সীমাবদ্ধতার কথা বলা হয়েছে, এবং এর বিপরীতে ‘মিলাত’ (millat – community based on faith) এর ধারণাকে তুলে ধরা হয়েছে, যা কোনো ভৌগোলিক সীমানা মানে না। বাহ্যিকভাবে, এই চিন্তা খুবই উন্নত ও মানবিক বলে মনে হতে পারে।

কিন্তু বিস্ময়কর এবং চরম স্ববিরোধিতামূলকভাবে (glaringly contradictory), এই ইকবালই ভারতীয় মুসলিমদের জন্য একটি পৃথক, ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের প্রস্তাব করেছিলেন, যার সুস্পষ্ট ভৌগোলিক সীমানা থাকবে, নিজস্ব সরকার থাকবে এবং যা মূলত মুসলিমদের দ্বারাই পরিচালিত হবে। তিনি যে ইউরোপীয় রাষ্ট্রধারণার (modern European concept of state) – অর্থাৎ, একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড (territory), সার্বভৌমত্ব (sovereignty), নিজস্ব সরকার ও আইন – তীব্র সমালোচনা করছেন, সেই ধারণার মূল কাঠামোটিই তিনি তার প্রস্তাবিত রাষ্ট্রের জন্য অবিকল গ্রহণ করলেন। শুধু তার ভেতরের আত্মাকে (spirit) বা মতাদর্শিক বিষয়বস্তুকে (ideological content) বদলে দিলেন। ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো যেখানে দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে ধর্মকে ব্যক্তিগত পরিসরে রেখে (separation of church and state) একটি ধর্মনিরপেক্ষ (secular), নাগরিককেন্দ্রিক (citizen-centric) এবং গণতান্ত্রিক (democratic) রাষ্ট্রব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, ইকবাল সেখানে যেন ঠিক তার উল্টো পথে হেঁটে রাষ্ট্রকে পুনরায় ধর্মকেন্দ্রিক (theocentric) বা ধর্ম-নিয়ন্ত্রিত (theocratic in essence, if not in name) করে তোলার পক্ষে সওয়াল করলেন।

১৯৩০ সালে এলাহাবাদে অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে (Allahabad Address) ইকবাল অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে উত্তর-পশ্চিম ভারতে (পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্তান) মুসলিমদের জন্য একটি একত্রিত রাষ্ট্র (amalgamated state) গঠনের প্রস্তাব দেন, যা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভেতরে বা বাইরে একটি স্বশাসিত ইউনিট হিসেবে কাজ করবে (Iqbal, 1930, cited in Pirzada, 1970)। এই প্রস্তাব ছিল কার্যত ধর্মভিত্তিক বিচ্ছিন্নতাবাদের (religious separatism) এক স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা। যখন ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, বিভিন্ন ধর্ম ও বর্ণের মানুষ, ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির জন্য একটি অখণ্ড, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের স্বপ্ন দেখছে, যখন মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, মাওলানা আবুল কালাম আজাদের মতো নেতারা একটি সম্মিলিত ভারতীয় জাতীয়তাবাদের (composite Indian nationalism) কথা বলছেন, তখন একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য আলাদা রাষ্ট্র দাবি করাটা সেই বৃহত্তর ঐক্যবদ্ধ স্বাধীনতা সংগ্রামের (liberation struggle) পিঠে ছুরি মারার শামিল ছিল। এটি কি ব্রিটিশদের ‘ভাগ কর ও শাসন কর’ (divide and rule) নীতিকেই প্রকারান্তরে সমর্থন জোগায়নি?

ইকবাল হয়তো আন্তরিকভাবেই বিশ্বাস করতেন যে, একটি হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ (Hindu-majority) অখণ্ড ভারতে মুসলিমদের স্বতন্ত্র ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিচয় (distinct religious, cultural, and political identity) রক্ষা করা সম্ভব হবে না, তারা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়বে। এই আশঙ্কা হয়তো অমূলক ছিল না, বিশেষত তৎকালীন হিন্দু মহাসভার মতো কিছু সংগঠনের কার্যকলাপ দেখলে। কিন্তু এই ‘পরিচয়’ রক্ষার নামে তিনি যে পথ দেখালেন, তা উপমহাদেশকে দ্বিখণ্ডিত (partitioned) করার পথ প্রশস্ত করল, যা ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ মানবিক ট্র্যাজেডির জন্ম দিয়েছিল। লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু, কোটি কোটি মানুষের বাস্তুচ্যুতি, অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা, নারী নির্যাতন ও অপহরণ, এবং দুটি (পরবর্তীকালে তিনটি) নবগঠিত রাষ্ট্রের মধ্যে চিরস্থায়ী সন্দেহ, অবিশ্বাস ও শত্রুতার এক বিষবৃক্ষ রোপণ করে গেল এই দেশভাগ। যে ‘উম্মাহ’র বৃহত্তর ঐক্যের কথা তিনি বলতেন, সেই উম্মাহ নিজেই তো এই বিভাজনের ফলে ভৌগোলিকভাবে ও রাজনৈতিকভাবে খণ্ডিত (geographically and politically fragmented) হয়ে পড়ল। ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মুসলমানরা তিনটি পৃথক রাষ্ট্রের নাগরিকে পরিণত হলো, যাদের মধ্যেকার সম্পর্ক প্রায়শই তিক্ততায় ও সংঘাতে পূর্ণ।

পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রচিন্তা, যা কিনা দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ (যেমন, ইউরোপের ত্রিশ বছরব্যাপী ধর্মযুদ্ধ), দার্শনিক বিতর্ক এবং সামাজিক-রাজনৈতিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে চার্চের বা ধর্মের প্রত্যক্ষ আধিপত্য থেকে মুক্ত হয়ে একটি নাগরিক সার্বভৌমত্বের (popular sovereignty) ধারণার দিকে বিকশিত হচ্ছিল, তাকে ইকবাল যেন এক লহমায় কয়েক শতাব্দী পিছিয়ে দিয়ে আবার ধর্মের অধীনে নিয়ে আসতে চাইলেন। এটা কি আধুনিকতার পথে অগ্রগতি, নাকি মধ্যযুগীয় চিন্তার পুনরাবৃত্তি, যা কিনা রাষ্ট্রকে কোনো একটি বিশেষ ধর্মীয় গোষ্ঠীর সম্পত্তি বলে মনে করে? যে জাতীয়তাবাদকে তিনি ‘ইউরোপীয় ব্যাধি’ (European disease) বলে অভিহিত করতেন, সেই ব্যাধিরই একটি বিশেষ ধর্মীয় সংস্করণ, যা কিনা আরও বেশি বিপজ্জনক, তিনি কেন ভারতীয় মুসলিমদের জন্য প্রস্তাব করলেন? এই প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই, যদি আমরা তার রাজনৈতিক চিন্তার প্রকৃত মূল্যায়ন করতে চাই এবং ইতিহাসের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে চাই। এই ধরনের রাষ্ট্রচিন্তা কেবল যে অমুসলিমদের জন্যই বিপজ্জনক ছিল তাই নয়, এটি স্বয়ং মুসলিমদের মধ্যেও বিভিন্ন ফেরকা (sect) ও মাজহাবের (school of thought) মধ্যে সংঘাতের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিয়েছিল, কারণ রাষ্ট্র যখন কোনো একটি বিশেষ ধর্মীয় ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করে বা প্রাধান্য দেয়, তখন অন্যান্য ব্যাখ্যাগুলো কোণঠাসা হয়ে পড়ে, এমনকি রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবেও চিহ্নিত হতে পারে।

‘খুদি’র আস্ফালন, সাম্প্রদায়িক আত্মশ্লাঘা এবং ‘অপর’ এর প্রতি অবজ্ঞা ও অস্বীকৃতি

ইকবালের ‘খুদি’ বা আত্মসত্তার দর্শন নিঃসন্দেহে ব্যক্তির মধ্যে আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদা, কর্মস্পৃহা এবং নিজের ভাগ্য নিজে গড়ার প্রেরণা জাগাতে পারে। এটি মানুষকে জড়তা, আলস্য ও পরনির্ভরশীলতা থেকে মুক্ত হয়ে এক সৃজনশীল ও সক্রিয় জীবনের দিকে আহ্বান জানায়। ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে হীনম্মন্যতায় ভোগা একটি সম্প্রদায়ের জন্য এই দর্শন উদ্দীপক হতে পারত। কিন্তু যখন এই ‘খুদি’ একটি ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে এক ধরনের সাম্প্রদায়িক আত্মপ্রেমে (communal narcissism) পরিণত হয়, তখন তা মারাত্মক রূপ ধারণ করে। যখন একটি সম্প্রদায় নিজেদের ‘খুদি’কে এতটাই বড় করে দেখে যে, অন্য সকল সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব, তাদের সংস্কৃতি, তাদের ইতিহাস, তাদের অবদান – সবকিছুই তার তুলনায় তুচ্ছ, নগণ্য বা এমনকি বিকৃত মনে হয়, তখন তা এক ধরনের জ্ঞানতাত্ত্বিক হিংস্রতার (epistemic violence) জন্ম দেয়, যা শারীরিক হিংস্রতার চেয়ে কোনো অংশে কম ভয়ঙ্কর নয়।

ইকবালের কবিতায় ও গদ্যে মুসলিমদের গৌরবময় অতীত, তাদের বিশ্বজয়ী ঐতিহ্য, তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শনের স্বর্ণযুগ, তাদের শৌর্যবীর্য এবং তাদের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের সম্ভাবনার কথা বারবার অত্যন্ত জোরালো, আবেগপূর্ণ ও কাব্যিক ভাষায় উচ্চারিত হয়েছে। এটি মুসলিমদের মধ্যে ঔপনিবেশিক আমলে হৃত আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হয়তো কিছুটা সাহায্য করেছিল, তাদের মধ্যে এক ধরনের আশার আলো জাগিয়েছিল। কিন্তু এর একটি অত্যন্ত বিপজ্জনক দিকও ছিল, যা প্রায়শই তার অনুসারীরা এড়িয়ে যান। এই ধরনের অতিমাত্রায় সম্প্রদায়গত আত্মশ্লাঘা (communal self-glorification) এবং অতীতচারিতা (romanticization of the past) কি প্রকারান্তরে অন্যান্য সম্প্রদায়, বিশেষত হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি এক ধরনের অবজ্ঞা (disdain), তাচ্ছিল্য (contempt), উপেক্ষা (neglect) বা এমনকি প্রচ্ছন্ন শত্রুতার (latent hostility) জন্ম দেয়নি? যখন একটি সম্প্রদায় কেবল নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের গান গায়, তখন তারা কি অন্যদের অবদানকে অস্বীকার বা খাটো করে দেখে না?

ইকবালের বিখ্যাত পঙক্তি ‘চীন ও আরব হামারা, হিন্দুস্তা হামারা / মুসলিম হ্যাঁয় হাম, ওয়াতান হ্যায় সারা জাহাঁ হামারা’ (চীন ও আরব আমাদের, হিন্দুস্তানও আমাদের; আমরা মুসলিম, সারা বিশ্বই আমাদের স্বদেশ) – এর মধ্যে এক ধরনের আধ্যাত্মিক বিশ্বজনীনতার আভা বা সাম্রাজ্যবাদী আকাঙ্ক্ষার (imperialistic ambition) গন্ধ পাওয়া গেলেও, বাস্তব রাজনীতির ক্ষেত্রে তা কি এক ধরনের সম্প্রসারণবাদী (expansionist) বা আধিপত্যকামী (hegemonic) মানসিকতার প্রতিফলন নয়? যে দেশে হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, খ্রিস্টান, পার্সি, ইহুদি এবং বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠী হাজার হাজার বছর ধরে পাশাপাশি বাস করছে, যেখানে বিভিন্ন সংস্কৃতির লেনদেন ও মিশ্রণে এক সমৃদ্ধ বহুত্ববাদী সভ্যতা গড়ে উঠেছে, সেখানে একটি মাত্র ধর্মীয় সম্প্রদায় যদি সমগ্র দেশ বা এমনকি সমগ্র বিশ্বকে নিজেদের ‘ওয়াতান’ বা স্বদেশ বলে দাবি করে, তখন তা অন্যদের অস্তিত্বকে, তাদের ভূমিপুত্র হিসেবে অধিকারকে (sons of the soil rights) অস্বীকার করার শামিল হয়। এই ধরনের চিন্তা একটি বহুত্ববাদী সমাজে (pluralistic society) সহাবস্থানের পরিবর্তে আধিপত্যের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যেখানে একদল হবে শাসক আর বাকিরা হবে শাসিত (ruled) বা অনুগ্রহপ্রাপ্ত (tolerated at best)।

তার পূর্ববর্তী একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় দেশাত্মবোধক গান ছিল ‘সারে জাঁহা সে আচ্ছা, হিন্দুস্তা হামারা’ (সারা বিশ্বের চেয়ে সেরা, আমাদের এই হিন্দুস্তান)। এই গানে একটি অখণ্ড ভারতীয় সত্তার, একটি সম্মিলিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জয়গান গাওয়া হয়েছে, যেখানে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের সহাবস্থানের চিত্র ফুটে ওঠে। কিন্তু পরবর্তীকালে তার চিন্তা যখন ক্রমশ মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদ (Muslim separatism) এবং পৃথক রাষ্ট্রগঠনের দিকে ঝুঁকে পড়ল, তখন তার সেই অখণ্ড ভারতীয় সত্তার ধারণা অনেকটাই ফিকে হয়ে গেল, এমনকি পরিত্যাজ্য বলে মনে হলো। এই যে একটি উদার, অন্তর্ভূক্তিমূলক জাতীয়তাবাদ থেকে সরে (আমি এটাকে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের চেয়ে উত্তম কিছু বলছি না) এসে একটি সংকীর্ণ, ধর্মভিত্তিক, বহিষ্কারমূলক (exclusionary) পরিচিতিকে আঁকড়ে ধরা – এটাই ছিল ইকবালের রাজনৈতিক চিন্তার মূল ট্র্যাজেডি, যা উপমহাদেশের ভবিষ্যৎ গতিপথকে এক অন্ধকার সুড়ঙ্গের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। তার ‘খুদি’ দর্শন শেষ পর্যন্ত একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা (political ambition) পূরণের, তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার এবং ‘অপর’কে নির্মাণ ও তার প্রতি বিদ্বেষ পোষণের এক শক্তিশালী মতাদর্শিক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিল। এর ফলে, যে আত্মবিশ্বাস সৃজনশীলতা ও মানবিকতার বিকাশে সহায়ক হতে পারত, তা-ই হয়ে উঠল বিভেদ, ঘৃণা ও আধিপত্যের উৎস।

গ্যোটে, রোমান্টিকতা এবং মিলনের নামে বিভাজনের বিষণ্ণ সুর ও শ্রেষ্ঠত্বের আরতি

জার্মান মহাকবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক ও দার্শনিক ইয়োহান ভলফগ্যাং ফন গ্যোটে (Johann Wolfgang von Goethe) ছিলেন বিশ্বসাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, এক রেনেসাঁস পুরুষ। তিনি তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ West–östlicher Divan (West-Eastern Divan)-এ প্রাচ্য (Orient) ও প্রতীচ্যের (Occident) মধ্যে এক গভীর সাংস্কৃতিক, আধ্যাত্মিক ও মানবিক সেতুবন্ধনের (cultural, spiritual, and humanistic bridge) স্বপ্ন দেখেছিলেন (Goethe, 1819/1998)। তিনি পারস্যের মহাকবি হাফিজের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে এই কাব্য রচনা করেছিলেন, যা ছিল দুই ভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, বোঝাপড়া এবং একে অপরের থেকে শেখার এক উজ্জ্বল নিদর্শন। গ্যোটে প্রাচ্যের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রতি গভীর অনুরাগ পোষণ করতেন।

আল্লামা ইকবাল গ্যোটের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং তারই অনুসরণে রচনা করেছিলেন তার বিখ্যাত ফার্সি কাব্যগ্রন্থ Payam-i-Mashriq (Message of the East) (Iqbal, 1923)। এই গ্রন্থে ইকবাল প্রাচ্যের, বিশেষত ইসলামী সভ্যতার, আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক বার্তা প্রতীচ্যের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, যা ছিল গ্যোটের Divan-এর এক ধরনের প্রত্যুত্তর। আপাতদৃষ্টিতে, এটি একটি মহৎ প্রচেষ্টা, প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মধ্যে সংলাপ (dialogue) ও সমন্বয়ের (synthesis) এক উদ্যোগ।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই তথাকথিত সমন্বয় বা সংলাপ কি সত্যিই আন্তরিক, খোলামেলা এবং সমতাপূর্ণ (equal, sincere, and open-ended) ছিল? নাকি এর আড়ালে প্রাচ্যের, বিশেষ করে ইসলামী সভ্যতার ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ (superiority) প্রমাণ করার, পাশ্চাত্যের বস্তুবাদ (materialism)আধ্যাত্মিক শূন্যতার (spiritual vacuum) সমালোচনা করার এবং ইসলামকেই মানবজাতির মুক্তির একমাত্র পথ হিসেবে তুলে ধরার এক প্রচ্ছন্ন আকাঙ্ক্ষা (hidden agenda) কাজ করছিল? যখন মিলনের কথা বলা হয়, তখন উভয় পক্ষের প্রতি সমান শ্রদ্ধা, একে অপরের ভালো দিকগুলো গ্রহণ করার মানসিকতা এবং নিজের সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা স্বীকার করার সাহস থাকাটা জরুরি। কিন্তু ইকবালের সমন্বয়ের ধারণায় কি পাশ্চাত্যের প্রতি এক ধরনের প্রচ্ছন্ন প্রতিদ্বন্দ্বিতা (rivalry), তাকে ‘সংশোধন’ (correct) বা ‘উদ্ধার’ (redeem) করার মনোভাব, অথবা নিজের সংস্কৃতি ও ধর্মকেই চূড়ান্ত সত্য ও পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রবণতা কাজ করেনি? এই ধরনের একপেশে সংলাপ কি আদৌ কোনো প্রকৃত মিলন বা বোঝাপড়া ঘটাতে পারে, নাকি তা কেবল নিজের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আধিপত্য বিস্তারেরই এক সু্ক্ষ্ম, বুদ্ধিবৃত্তিক কৌশল? গ্যোটের মধ্যে যে বিশ্বজনীন মানবতাবাদ (universal humanism) ও বিভিন্ন সংস্কৃতির প্রতি যে অকৃত্রিম আগ্রহ ছিল, ইকবালের প্রাচ্য-প্রতীচ্য ভাবনায় সেই উদারতা ও অকৃত্রিমতা ততটা প্রকট ছিল বলে মনে হয় না। তার কাছে প্রাচ্য মানেই ছিল মূলত ইসলামী প্রাচ্য, এবং প্রতীচ্যের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল মূলত প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ও সংশোধনমূলক।

ইকবালের কাব্যে ইউরোপীয় রোমান্টিক আন্দোলনের (European Romantic Movement) সুস্পষ্ট ও গভীর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ওয়ার্ডসওয়ার্থ (Wordsworth), শেলী (Shelley), কীটসের (Keats), বায়রনের (Byron) মতো ইংরেজ রোমান্টিক কবিদের মতো তার কবিতাতেও আত্মা (spirit), প্রকৃতি (nature), অসীম সত্তা (infinity), সৃষ্টি (creation), মুক্তি (freedom), আবেগ (emotion), কল্পনা (imagination) এবং অতীন্দ্রিয় জগতের (transcendental realm) প্রতি এক অবিনাশী আকাঙ্ক্ষা ও আকর্ষণ ফুটে উঠেছে। এই রোমান্টিক সংবেদনশীলতা তার কাব্যকে এক বিশেষ মাধুর্য, গভীরতা, আবেগীয় তীব্রতা ও দার্শনিক ব্যঞ্জনা দান করেছে।

কিন্তু এই রোমান্টিকতাও যখন একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় ঐতিহ্য, ইতিহাস ও সম্প্রদায়ের গৌরবগাথায় পর্যবসিত হয়, তখন তা তার সর্বজনীন আবেদন অনেকটাই হারিয়ে ফেলে এবং এক ধরনের সাম্প্রদায়িক রোমান্টিকতায় (communal romanticism) পরিণত হয়। তার কবিতার সিংহভাগ জুড়ে আছে মুসলিমদের উত্থান-পতনের কাহিনি, তাদের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের আকুতি, তাদের সোনালী অতীতের স্মৃতিচারণ, এবং তাদের ভবিষ্যৎ বিশ্বনেতৃত্বের স্বপ্ন। এই আকুতি যখন একটি সম্প্রদায়ের জাগরণের গান হয়ে ওঠে, তখন তা উদ্দীপক হতে পারে, তাদের মধ্যে আশার সঞ্চার করতে পারে। কিন্তু যখন তা অন্য জাতি বা সম্প্রদায়ের ইতিহাস, সংস্কৃতি, অবদান ও অস্তিত্বকে অস্বীকার করে, গৌণ করে তোলে, বা নেতিবাচকভাবে চিত্রিত করে, তখন তা হয়ে ওঠে বিপজ্জনক, বিভেদ সৃষ্টিকারী এবং অসহিষ্ণু। ইকবালের রোমান্টিসিজম শেষ পর্যন্ত কি একটি বিশেষ ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের জয়গান গেয়ে, একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের আবেগকে মহিমান্বিত করে, অন্য সকল পরিচয় ও অনুভূতিকে ম্লান করে দেয়নি? তার প্রকৃতির উপাসনা বা অসীমের প্রতি আকাঙ্ক্ষা কি শেষ পর্যন্ত একটি বিশেষ ধর্মীয় গোষ্ঠীর রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষার কাছেই আত্মসমর্পণ করেনি, যেখানে ‘ইসলামী শাসন’ বা ‘খিলাফত’ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নই হয়ে ওঠে মূল লক্ষ্য? এই প্রশ্নগুলো তার রোমান্টিক চেতনার সীমাবদ্ধতা ও সাম্প্রদায়িক ঝোঁককে নির্দেশ করে।

‘পুনর্গঠন’ এর নামে সাম্প্রদায়িক প্রকৌশল: এক বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রম ও রাজনৈতিক প্রকল্প

আল্লামা ইকবালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী কাজ হলো তার ইংরেজিতে লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ The Reconstruction of Religious Thought in Islam (ইসলামে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন) (Iqbal, 1934)। এই গ্রন্থে তিনি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন (বিশেষত বার্গসোঁ, হোয়াইটহেড প্রমুখের) ও পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতির আলোকে ইসলামের শাশ্বত নীতিগুলোকে নতুন করে বোঝা ও ব্যাখ্যা করার এক সাহসী ও উচ্চাভিলাষী প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। তার মূল লক্ষ্য ছিল ইসলামের মধ্যে গতিশীলতা (dynamism), সৃষ্টিশীলতা (creativity) এবং বুদ্ধিবৃত্তিক প্রাণচাঞ্চল্য (intellectual vitality) ফিরিয়ে আনা, যাতে মুসলিমরা আধুনিক বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে, স্থবিরতা ও অন্ধ অনুকরণ (taqlid) থেকে মুক্ত হতে পারে। তিনি ইজতিহাদ (Ijtihad – independent legal and theological reasoning) বা স্বাধীন চিন্তার ওপর সবিশেষ জোর দিয়েছিলেন এবং মুসলিমদের আহ্বান জানিয়েছিলেন ইসলামের মূলনীতির ভিত্তিতে নতুন নতুন সমস্যার সমাধানে ব্রতী হতে।

উদ্দেশ্য নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় এবং যুগোপযোগী বলে মনে হতে পারে। কিন্তু এই ‘পুনর্গঠন’ প্রক্রিয়ার প্রকৃত চরিত্র, তার অন্তর্নিহিত লক্ষ্য এবং তার বাস্তব ফল কী দাঁড়াল, সেই প্রশ্নগুলো গভীরভাবে বিচার করা প্রয়োজন। এই ‘পুনর্গঠন’ কি ইসলামকে আরও বেশি মানবিক, আরও বেশি সহনশীল (tolerant), আরও বেশি বহুত্ববাদী (pluralistic), আরও বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক (inclusive) এবং আত্ম-সমালোচনামূলক (self-critical) করে তুলেছিল? নাকি এই ‘পুনর্গঠন’ এর নামে তিনি এমন এক ইসলামী পরিচিতি, রাজনৈতিক দর্শন এবং আইনগত কাঠামো নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন, যা আধুনিক রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের একটি কার্যকর মতাদর্শিক হাতিয়ার (ideological tool) এবং একটি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি (intellectual foundation) হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে?

পাশ্চাত্য দর্শন থেকে তিনি যে উপাদানগুলো ধার করেছিলেন – যেমন হেগেলের ঐতিহাসিক নিয়তিবাদ, বার্গসোঁর প্রাণশক্তি ও সময় সম্পর্কিত ধারণা, নিটশের ইচ্ছাশক্তি, হোয়াইটহেডের প্রক্রিয়া দর্শন (process philosophy) – সেগুলোকে তিনি ইসলামী পরিভাষায় (যেমন, ইজমা, কিয়াস, ইজতিহাদ) মুড়ে এবং নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করে এমন এক রাজনৈতিক-ধর্মীয় দর্শন তৈরি করলেন, যা শেষ পর্যন্ত একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা (justification) ও অপরিহার্যতা (inevitability) নির্মাণ করল। এই প্রক্রিয়াকে নিছক ‘ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন’ না বলে, ‘ধর্মীয় চিন্তার সাম্প্রদায়িকীকরণ’ (communalization of religious thought), ‘ইসলামের রাজনৈতিকীকরণ’ (politicization of Islam), বা ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় প্রকৌশল’ (religious engineering for political ends) বলাই কি অধিকতর সঙ্গত ও নির্ভুল হবে না?

যেখানে আধুনিক পৃথিবীর প্রগতিশীল চিন্তাধারার মূল স্রোত ছিল ধর্মকে ব্যক্তিগত পরিসরে রেখে (privatization of religion), রাষ্ট্রকে ধর্ম ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রভাব থেকে মুক্ত করে (secularization of state), একটি ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, মানবাধিকার ভিত্তিক এবং সকল নাগরিকের সমান অধিকারভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা, সেখানে ইকবাল যেন ঠিক তার বিপরীত দিকে হেঁটেছিলেন। তিনি ধর্মকেই (অর্থাৎ, তার ব্যাখ্যাকৃত ইসলামকে) রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি, পরিচয়ের প্রধান নির্ণায়ক এবং আইনের চূড়ান্ত উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন। এর অবশ্যম্ভাবী ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে – পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, সংখ্যালঘু নির্যাতন (persecution of religious minorities like Hindus, Christians, Ahmadis, Kalash, and even Shias), এবং উগ্র মৌলবাদের (religious extremism and fundamentalism) উত্থানের এক উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। যে স্বপ্ন ইকবাল দেখিয়েছিলেন, তার বাস্তব রূপ কি এতটাই বিভীষিকাময়, আত্মঘাতী এবং ইসলামের মানবিক শিক্ষার পরিপন্থী হওয়ার কথা ছিল? যে ইজতিহাদের কথা তিনি এত জোর দিয়ে বলেছিলেন, তা কি একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রে অধিকতর বিকশিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল, নাকি রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত, সংকীর্ণ এবং বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিল? এই প্রশ্নগুলো আজ পাকিস্তানের দিকে তাকালে, তার রক্তাক্ত ইতিহাস ও বর্তমান দুর্দশার দিকে তাকালে, স্বাভাবিকভাবেই বিবেকবান মানুষের মনে উদয় হয়। ইকবালের ‘পুনর্গঠন’ শেষ পর্যন্ত একটি বিশেষ রাজনৈতিক প্রকল্পের বুদ্ধিবৃত্তিক সাফাই গাওয়ার কাজেই বেশি ব্যবহৃত হয়েছে, ইসলামের প্রকৃত আধ্যাত্মিক ও নৈতিক পুনর্জাগরণে ততটা নয়।

ইকবালের দর্শনে নারীর অবস্থান: নীরবতা, সীমাবদ্ধতা ও পুরুষতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদ

আল্লামা ইকবালের দর্শনে, বিশেষ করে তার ‘মর্দ-ই-মুমিন’ বা ‘খুদি’র ধারণায় এবং তার জাতীয়তাবাদী প্রকল্পে নারীর অবস্থান ও ভূমিকা কী ছিল, সেই প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুঃখজনকভাবে, ইকবালের চিন্তায় নারীর প্রসঙ্গ হয় অনুপস্থিত, নয়তো অত্যন্ত সীমাবদ্ধ ও গতানুগতিক পুরুষতান্ত্রিক (patriarchal) দৃষ্টিভঙ্গিতে উপস্থাপিত। তার ‘মর্দ-ই-মুমিন’ বা ‘ইনসান-ই-কামিল’ যে একজন ‘পুরুষ’ হবেন, তা তার ব্যবহৃত শব্দ (‘মর্দ’ মানে পুরুষ) এবং তার সার্বিক আলোচনা থেকে স্পষ্ট। নারীর ‘খুদি’ বা আত্মসত্তা কীভাবে বিকশিত হবে, সমাজে ও রাষ্ট্রে তার ভূমিকা কী হবে, সে বিষয়ে ইকবাল তেমন কোনো গভীর বা মৌলিক আলোকপাত করেননি।

তার কিছু কবিতায় নারীকে মাতা, ভগ্নী বা স্ত্রীর ভূমিকায়, অর্থাৎ পুরুষের পরিপূরক বা সহায়ক শক্তি হিসেবে দেখা হয়েছে, কিন্তু একজন স্বতন্ত্র, স্বাবলম্বী, চিন্তাশীল ও নেতৃত্বদানকারী সত্তা হিসেবে নারীর পূর্ণাঙ্গ বিকাশের কোনো সুস্পষ্ট রূপরেখা তার দর্শনে পাওয়া যায় না। জাতীয়তাবাদী অনেক প্রকল্পের মতোই, ইকবালের মুসলিম জাতীয়তাবাদের ধারণাতেও নারীকে মূলত জাতির ধারক, বাহক, সংস্কৃতির রক্ষক এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্মদাত্রী হিসেবেই দেখা হয়েছে, তার বাইরে তার নিজস্ব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক আকাঙ্ক্ষা ও অধিকারের বিষয়টি প্রায়শই উপেক্ষিত থেকেছে।

পাশ্চাত্যের যে নারীবাদী চিন্তা বা নারী মুক্তির আন্দোলন তার সময়ে দানা বাঁধছিল, সে বিষয়ে ইকবাল সচেতন ছিলেন বলে মনে হয় না, অথবা থাকলেও সেগুলোকে তিনি তার দর্শনের সঙ্গে অঙ্গীভূত করার প্রয়োজন বোধ করেননি। এর ফলে, তার ‘পুনর্গঠিত’ ইসলাম বা তার স্বপ্নের মুসলিম রাষ্ট্র যে একটি পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো ও সমাজব্যবস্থার দিকেই ঝুঁকবে, তা একপ্রকার অবধারিত ছিল। পাকিস্তানে পরবর্তীকালে নারীদের অধিকার যেভাবে সংকুচিত হয়েছে, যেভাবে তাদের ওপর ধর্মীয় অনুশাসন চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, তার বীজ হয়তো ইকবালের দর্শনের এই নীরবতা ও সীমাবদ্ধতার মধ্যেই নিহিত ছিল। একটি সত্যিকারের আধুনিক ও প্রগতিশীল দর্শন নারীকে বাদ দিয়ে বা তাকে গৌণ করে রেখে বিকশিত হতে পারে না। ইকবালের দর্শনে এই ঘাটতি অত্যন্ত প্রকট।

তিক্ত ফসল: ইকবালের স্বপ্নের রক্তাক্ত বাস্তবতা ও স্থায়ী বিভেদ

কোনো চিন্তাবিদের দর্শন, বিশেষ করে যদি তা রাজনৈতিক পরিবর্তনের ডাক দেয়, তাকে বিচার করতে হয় তার বাস্তব পরিণতির (real-world consequences) নিরিখেও। আল্লামা ইকবালের রাজনৈতিক চিন্তা, বিশেষত তার পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের ধারণা, যা কিনা পরবর্তীতে পাকিস্তান আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি জুগিয়েছিল এবং মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে বাস্তবায়িত হয়েছিল, তার ফল উপমহাদেশের জন্য কতটা মঙ্গলজনক হয়েছে, সেই হিসাব মেলানোটা আজ আর কোনো তাত্ত্বিক বিতর্ক নয়, বরং এক ঐতিহাসিক ও সমসাময়িক বাস্তবতা।

  • দেশভাগ ও মানবিক বিপর্যয়: ইকবালের দর্শনের সবচেয়ে প্রত্যক্ষ ও ভয়াবহ ফল হলো ১৯৪৭ সালের দেশভাগ – এক রক্তাক্ত, নির্মম, অপরিণামদর্শী অধ্যায়, যা লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে (আনুমানিক ১০ থেকে ২০ লক্ষ), কোটি কোটি মানুষকে (প্রায় দেড় কোটি) ভিটেমাটি ছাড়া করেছে, পরিবারগুলোকে ছিন্নভিন্ন করেছে, এবং ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ মানবিক বিপর্যয়ের (humanitarian catastrophe) জন্ম দিয়েছে। যে মানবিক মূল্য দিয়ে এই বিভাজন সাধিত হয়েছিল, তার দায় কি ইকবালের সেই বিভেদকামী দর্শন সম্পূর্ণভাবে এড়াতে পারে? যখন একটি ভূখণ্ডকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করা হয়, তখন এই ধরনের রক্তপাত, ঘৃণা ও প্রতিশোধস্পৃহা কি অনিবার্য হয়ে ওঠে না?

  • সংখ্যালঘু নির্যাতন ও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা: পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সেখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের (হিন্দু, শিখ, খ্রিস্টান, পার্সি, বৌদ্ধ, আহমদিয়া এবং এমনকি শিয়া মুসলমান) অবস্থা ক্রমশ সঙ্গীন হয়েছে। একটি রাষ্ট্র যখন নিজেকে ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র’ (Islamic Republic) হিসেবে ঘোষণা করে এবং তার আইনকানুন শরিয়তের ভিত্তিতে (অন্তত নামে) প্রণয়ন করার চেষ্টা করে, তখন অমুসলিম নাগরিকরা স্বাভাবিকভাবেই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে (second-class citizens) পরিণত হয়। তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা, সামাজিক নিরাপত্তা, রাজনৈতিক অধিকার এবং অর্থনৈতিক সুযোগ ক্রমাগত সংকুচিত হতে থাকে। ব্লাসফেমি আইনের (blasphemy laws) যথেচ্ছ অপব্যবহার, জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণ, উপাসনালয়ে হামলা, সম্পত্তি দখল, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড – এগুলো পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের (এবং ভিন্নমতাবলম্বী মুসলিমদের) দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য কি সেই ফাউন্ডেশনাল আইডিওলজি বা ভিত্তিমূলক ভাবাদর্শ দায়ী নয়, যা ইকবাল নির্মাণে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন?

  • অন্তঃমুসলিম সংঘাত ও মৌলবাদের উত্থান: একটি রাষ্ট্র যখন ধর্মের ভিত্তিতে গঠিত হয়, তখন সেই রাষ্ট্রে ‘কে প্রকৃত মুসলমান’ বা ‘ইসলামের সঠিক ব্যাখ্যা কোনটি’ – এই নিয়ে অন্তহীন বিতর্ক, সংঘাত ও রক্তপাতের জন্ম হয়। পাকিস্তানে শিয়া-সুন্নি সংঘাত, দেওবন্দি-বেরেলভি রেষারেষি, আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণা ও তাদের ওপর ধারাবাহিক নির্যাতন, বিভিন্ন ইসলামপন্থী দলের মধ্যেকার ক্ষমতার লড়াই ও সশস্ত্র সংঘাত – এগুলো সবই এই মৌলিক সমস্যারই প্রতিফলন। রাষ্ট্র যখন ধর্মের অভিভাবকত্ব (guardianship of religion) নিজের হাতে তুলে নেয়, তখন ধর্ম আর ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও আধ্যাত্মিকতার বিষয় থাকে না, তা হয়ে ওঠে রাজনৈতিক ক্ষমতার লড়াইয়ের অন্যতম হাতিয়ার এবং সামাজিক নিয়ন্ত্রণের উপকরণ। এর ফলে ধর্মীয় উগ্রপন্থা (religious extremism) ও জঙ্গিবাদের (militancy) উত্থানও সহজতর হয়, কারণ প্রত্যেকেই নিজেদেরকে ইসলামের ‘সঠিক’ ব্যাখ্যাকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায় এবং অন্যদের ওপর তা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে চাপিয়ে দিতে চায়।

  • গণতন্ত্রের সংকট ও সামরিক হস্তক্ষেপ: পাকিস্তান তার জন্মলগ্ন থেকেই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, গণতন্ত্রের অভাব এবং বারবার সামরিক শাসনের শিকার হয়েছে। একটি রাষ্ট্র যখন একটি বিশেষ ধর্মীয় মতাদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন সেখানে ভিন্নমত, বাকস্বাধীনতা, এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায় না। কারণ, ধর্মীয় মতাদর্শকে প্রশ্নাতীত (unquestionable) বলে মনে করা হয় এবং তার সমালোচকদের রাষ্ট্রদ্রোহী বা ধর্মদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এর ফলে, সামরিক বাহিনী বা অন্যান্য অগণতান্ত্রিক শক্তি সহজেই ক্ষমতা দখল করার সুযোগ পায়। পাকিস্তানে গণতন্ত্র আজও পর্যন্ত দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারেনি, যার অন্যতম কারণ হলো রাষ্ট্রের এই ধর্মভিত্তিক চরিত্র।

  • বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও জাতিগত সংঘাত: ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ যে একটি ভঙ্গুর ও অবাস্তব ভিত্তি, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং পাকিস্তানের ভাঙন। যদি ইসলামই হতো পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তি এবং ঐক্যের সূত্র, তাহলে পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) বাঙালি মুসলমানরা কেন পশ্চিম পাকিস্তানি মুসলিমদের ঔপনিবেশিক শাসন, অর্থনৈতিক শোষণ ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য থেকে মুক্তির জন্য এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করল এবং লক্ষ লক্ষ জীবনের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করল? এই ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা, অর্থনৈতিক সাম্য এবং রাজনৈতিক অধিকারের মতো বিষয়গুলো জাতীয়তাবাদের নির্মাণে ধর্মের চেয়ে কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে বেশি। ইকবালের দর্শন এই বিষয়গুলোকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়নি, বরং ধর্মকেই পরিচয়ের একমাত্র বা প্রধান মানদণ্ড হিসেবে তুলে ধরেছিল, যা ছিল এক মারাত্মক ভুল। এছাড়াও, পাকিস্তানে আজও বেলুচ, সিন্ধি, পশতুন প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও জাতিগত সংঘাত বিদ্যমান, যা প্রমাণ করে যে শুধু ধর্মের নামে একটি কৃত্রিম রাষ্ট্র গঠন করলেই তা টেকে না।

  • অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতা ও সামাজিক অচলায়তন: ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সংঘাতপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে পাকিস্তান আজও একটি স্থিতিশীল, সমৃদ্ধ ও প্রগতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি এবং মানব উন্নয়ন সূচকের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশটি পিছিয়ে রয়েছে। ধর্মীয় মৌলবাদ সামাজিক অচলায়তন তৈরি করে, সৃজনশীলতা ও মুক্তচিন্তার পথ রুদ্ধ করে দেয়, এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করে। যে ‘খুদি’র শক্তিতে বলীয়ান হয়ে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ মুসলিম সমাজ গঠনের স্বপ্ন ইকবাল দেখিয়েছিলেন, তার বাস্তব রূপ পাকিস্তানে আজও অধরা।

শেষের কথা: এক বিষণ্ণ প্রতিধ্বনি, এক অমীমাংসিত সংকট ও অসম্পূর্ণ আত্মানুসন্ধান

আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল নিঃসন্দেহে একজন অসাধারণ প্রতিভাধর কবি, একজন গভীর চিন্তাশীল দার্শনিক এবং তার সময়ের অন্যতম প্রভাবশালী মুসলিম বুদ্ধিজীবী ছিলেন। তার কবিতা লক্ষ লক্ষ মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে, তাদের মধ্যে আত্মমর্যাদা ও আত্মবিশ্বাসের বোধ জাগিয়ে তুলেছে, ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে শিখিয়েছে। তার দার্শনিক চিন্তাভাবনা ইসলামী বিশ্বে এক নতুন বুদ্ধিবৃত্তিক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এই অবদানগুলো অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

কিন্তু তার রাজনৈতিক চিন্তার যে ধারাটি পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের জন্ম দিয়েছে, যে দর্শন একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে সওয়াল করেছে, তা নিয়ে আজ আমাদের নির্মোহভাবে, কঠোরভাবে এবং সমালোচনামূলক দৃষ্টিতে আত্মসমালোচনা (critical introspection) করার সময় এসেছে। ধর্ম যখন সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের বাহন হয়, যখন তা রাজনৈতিক ক্ষমতার হাতিয়ারে পরিণত হয়, যখন তা ‘অপর’কে নির্মাণ ও বহিষ্কৃত বা মারজিনালাইজ করার মতাদর্শ জোগান দেয়, তখন তা মানবতার জন্য কতটা কল্যাণ বয়ে আনতে পারে, সেই প্রশ্নটি আজ আরও জোরালোভাবে, আরও সাহসের সঙ্গে উত্থাপন করা প্রয়োজন।

ইকবাল পাশ্চাত্যের জ্ঞানভাণ্ডার থেকে অজস্র মণিমাণিক্য আহরণ করেছিলেন, এ কথা অনস্বীকার্য। কিন্তু সেই মণিমাণিক্য দিয়ে তিনি যে রাজনৈতিক সৌধ নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন, তার ভিত্তি ছিল ধর্মীয় বিভাজন, সাম্প্রদায়িক শ্রেষ্ঠত্ববোধ এবং এক ধরনের ঐতিহাসিক প্রতিশোধস্পৃহার ওপর। আর যে সৌধ বিভাজনের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, তা যতই চাকচিক্যময় বা কাব্যিক সুষমামণ্ডিত হোক না কেন, তার ছায়া অনিবার্যভাবেই দীর্ঘ, অন্ধকারময় এবং রক্তস্নাত হয়। ইকবালের দর্শনের সেই অন্ধকার দিকটা, তার বিপজ্জনক সম্ভাবনাগুলো, তার বিধ্বংসী পরিণতিগুলো আজ আমাদের চিনতে হবে, যদি আমরা ভবিষ্যতে আরও মানবিক, আরও সহনশীল, আরও বহুত্ববাদী এবং আরও শান্তিপূর্ণ এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি।

তার রেখে যাওয়া দর্শন এক জটিল, প্রায়শই স্ববিরোধী এবং বিপজ্জনক উত্তরাধিকার। একদিকে যেমন তা মুসলিমদের মধ্যে আত্মজাগরণের প্রেরণা জুগিয়েছে, অন্যদিকে তেমনি তা বিভেদ, সংঘাত, অসহিষ্ণুতা এবং অগণিত মানুষের দুঃখ-দুর্দশার বীজও বপন করেছে। এই দ্বৈততার মধ্যেই ইকবালের চিন্তার শক্তি ও সীমাবদ্ধতা, তার মহত্ত্ব ও তার মারাত্মক ভুল – উভয়ই নিহিত। আজ আমাদের দায়িত্ব হলো, তার চিন্তার ইতিবাচক দিকগুলো থেকে (যদি কিছু থাকে যা আজকের দিনেও প্রাসঙ্গিক) অনুপ্রেরণা গ্রহণ করার পাশাপাশি তার নেতিবাচক ও বিপজ্জনক দিকগুলো সম্পর্কেও পরিপূর্ণরূপে সচেতন থাকা এবং সেগুলোর কঠোর, আপসহীন সমালোচনা করা।

কারণ, যে পথ কাঁটায় ভরা, সে পথে হেঁটে ফুলের সৌরভ পাওয়া যায় না, বরং রক্তক্ষরণই হয় সার। ইকবালের দেখানো ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের পথটিও যেন অনেকটা সেরকমই – স্বপ্নের মোড়কে এক বিষণ্ণ, রক্তাক্ত বাস্তবতা, যার করুণ প্রতিধ্বনি আজও উপমহাদেশের বাতাসে কান পাতলেই শোনা যায়, লক্ষ কোটি মানুষের দীর্ঘশ্বাসে যা আজও ভারী হয়ে আছে। এই আত্মানুসন্ধান অসম্পূর্ণই থেকে যাবে, যদি না আমরা এই তিক্ত সত্যকে স্বীকার করে, ইতিহাসের এই নির্মম শিক্ষা গ্রহণ করে, এমন এক ভবিষ্যৎ নির্মাণে ব্রতী হই, যেখানে ধর্ম আর বিভেদের কারণ হবে না, বরং মানবতার সেতুবন্ধনে সহায়ক হবে। আর সেই ভবিষ্যতে ইকবালের মতো চিন্তাবিদদের স্থান হবে ইতিহাসের পাতায়, বর্তমানের পথনির্দেশক হিসেবে নয়।

তথ্যসূত্র

  • Bergson, H. (1911). Creative Evolution (A. Mitchell, Trans.). Henry Holt and Company. (Original work published 1907)
  • Goethe, J. W. von. (1998). West-Eastern Divan (J. Whaley, Trans.). Peter Lang. (Original work published 1819)
  • Hakim, K. A. (1957). Fikr-i-Iqbal (The Thought of Iqbal). Bazm-i-Iqbal.
  • Hegel, G. W. F. (1991). Elements of the Philosophy of Right (A. W. Wood, Ed.; H. B. Nisbet, Trans.). Cambridge University Press. (Original work published 1821)
  • Iqbal, M. (1923). Payam-i-Mashriq (Message of the East). (Various editions and translations exist).
  • Iqbal, M. (1934). The Reconstruction of Religious Thought in Islam. Oxford University Press. (Later editions also exist, e.g., Stanford University Press, 2012, edited by M. Saeed Sheikh).
  • Nietzsche, F. (1961). Thus Spoke Zarathustra (R. J. Hollingdale, Trans.). Penguin Books. (Original work published 1883-1885)
  • Pirzada, S. S. (Ed.). (1970). Foundations of Pakistan: All-India Muslim League Documents, 1906-1947 (Vol. II). National Publishing House.
  • Ahmed, I. (2016). Pakistan: The Garrison State – Origins, Evolution, Consequences (1947-2011). Oxford University Press. (While not directly about Iqbal’s philosophy, it explores the consequences of the type of state he envisioned).
  • Jaffrelot, C. (Ed.). (2004). Pakistan: Nationalism without a Nation? Zed Books. (Provides critical perspectives on Pakistani nationalism).
  • Talbot, I. (1998). Pakistan: A Modern History. St. Martin’s Press. (Offers historical context on the formation and evolution of Pakistan, implicitly touching upon the outcomes of Iqbal’s ideas).

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.