ব্রিটিশ রোমান্টিসিজম: হৃদয়ের কথা যখন বিপ্লব আনে

Table of Contents

ভূমিকা

আচ্ছা, রোমান্টিসিজম (Romanticism) শব্দটা শুনলেই আমাদের মাথায় কী আসে? প্রেম, ভালোবাসা, একটুখানি বিরহ, জ্যোৎস্না রাত, আর খোলা আকাশের নিচে বসে থাকা প্রেমিক-প্রেমিকা – তাই না? সিনেমার পর্দায় দেখা সেইসব মিষ্টি দৃশ্যগুলো। কিন্তু সাহিত্যের ইতিহাসে, বিশেষ করে ব্রিটিশ রোমান্টিসিজম কিন্তু এর চেয়ে অনেক গভীর, অনেক ব্যাপক এবং বৈপ্লবিক একটি আন্দোলন। এটা শুধু নর-নারীর প্রেম নয়, বরং একটা গোটা যুগের মানুষের চিন্তা-ভাবনা, শিল্প-সাহিত্য আর জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গির এক আমূল পরিবর্তন। অনেকটা যেন বহুদিনের বদ্ধ ঘরের জানালা হঠাৎ খুলে দিয়ে হু হু করে তাজা বাতাস আসতে দেওয়ার মতো; যে বাতাসে মিশে ছিল স্বাধীনতার গন্ধ, প্রকৃতির স্নিগ্ধতা আর ব্যক্তির না-বলা আবেগের উত্তাপ।

চলুন, এই বিপ্লবের একেবারে গোড়ায় ফিরে তাকাই। আঠারো শতকের শেষ দিককার ইউরোপ। সময়টা ছিল জ্ঞানদীপ্তি বা আলোকায়নের যুগ (Age of Enlightenment) আর যুক্তির যুগ (Age of Reason)। এই যুগের মূল মন্ত্র ছিল—যুক্তিই পরম, বিজ্ঞানই শেষ কথা। রেনে দেকার্তের “আমি চিন্তা করি, তাই আমি আছি” থেকে শুরু করে আইজ্যাক নিউটনের মহাবিশ্বের নিয়ম আবিষ্কার পর্যন্ত, সবকিছুই ছিল এক নিঁখুত গাণিতিক শৃঙ্খলার অধীন। মানুষ তখন সবকিছু যুক্তি দিয়ে, বিজ্ঞান দিয়ে, কার্যকারণ সম্পর্ক দিয়ে বুঝতে চাইত। নিয়ম-কানুন, শৃঙ্খলা, পরিমিতিবোধ আর একটা পরিপাটি ভাব ছিল সমাজের ও শিল্পের পরম আরাধ্য।

সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এই যুক্তিবাদী মানসিকতার প্রতিফলন ঘটেছিল, যা ‘নব্য-ধ্রুপদী’ বা নিওক্ল্যাসিসিজম (Neoclassicism) নামে পরিচিত। আলেকজান্ডার পোপ, জন ড্রাইডেনদের মতো কবিরা প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সাহিত্যের (ক্লাসিক্যাল সাহিত্য) অনুকরণে, নির্দিষ্ট ছন্দে (বিশেষ করে হিরোয়িক কাপলেট), মেপে মেপে কবিতা লিখতেন। তাঁদের কাছে কবিতা ছিল এক ধরনের কারুকার্য, যেখানে আবেগের লাগামহীন প্রকাশের চেয়ে বুদ্ধির ছটা আর সামাজিক নৈতিকতার কথাই বেশি গুরুত্ব পেত। সবকিছুতেই একটা ‘কর্তৃত্ব’ বা অথরিটি (authority) মেনে চলার প্রবণতা ছিল—সেটা হতে পারে প্রাচীন সাহিত্যিকদের কর্তৃত্ব বা সমাজের প্রতিষ্ঠিত নিয়মকানুনের কর্তৃত্ব। ভাবুন তো, সবসময় যদি আপনাকে কেউ বলে এটা করো, ওটা কোরো না, এভাবে ভাবো, ওভাবে ভেবো না, এই ছন্দের বাইরে যেয়ো না—কেমন লাগবে? নিশ্চয়ই একটা সময় দমবন্ধ লাগবে, তাই না? মানব মনের গহীনে থাকা আবেগ, কল্পনা আর রহস্যের প্রতি যে চিরন্তন টান, তা যেন এই কঠোর নিয়মের বেড়াজালে হাঁসফাঁস করছিল।

ব্রিটিশ রোমান্টিসিজমের জন্ম ঠিক এই দমবন্ধ করা পরিস্থিতি থেকে মুক্তির এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। প্রায় ১৭৮০-এর দশক থেকে শুরু করে ১৮৩০-এর দশক পর্যন্ত এর ব্যাপ্তি ধরা হয়। এই সময়ের কবি-সাহিত্যিকরা যেন সমস্বরে বলে উঠলেন, “অনেক তো হলো নিয়ম আর যুক্তির বাড়াবাড়ি! এবার একটু হৃদয়ের কথা শোনা যাক, কল্পনার ডানায় ভর করে উড়ে বেড়ানো যাক।” তাঁরা ঘোষণা করলেন, মানুষের আবেগ (emotion), অনুভূতি (feeling), কল্পনা (imagination), আর স্বজ্ঞা (intuition)—এগুলো তুচ্ছ জিনিস নয়, বরং এগুলোই মানব অস্তিত্বের গভীরতম সত্যের সন্ধান দেয়। এগুলোকে অবহেলা করা মানে মানবতাকেই অস্বীকার করা। এই ঘোষণাটিই ছিল একটি বিপ্লব।

বিপ্লবের প্রেক্ষাপট: যে ঝোড়ো হাওয়া রোমান্টিসিজমকে উস্কে দিয়েছিল

কোনো সাহিত্যিক বা শৈল্পিক আন্দোলনই শূন্য থেকে জন্মায় না। তার শিকড় প্রোথিত থাকে সমকালীন সমাজ, রাজনীতি এবং দর্শনের গভীরে। ব্রিটিশ রোমান্টিসিজমও এর ব্যতিক্রম নয়। এটি নিছকই একদল কবির নতুন ধারার কবিতা লেখার প্রচেষ্টা ছিল না; এটি ছিল এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের প্রতিধ্বনি। আঠারো শতকের শেষভাগে ইউরোপের মানসিক মানচিত্র এক অভূতপূর্ব আলোড়নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। দুটি বিশাল বিপ্লব—একটি রাজনৈতিক, অন্যটি অর্থনৈতিক—পুরনো পৃথিবীর ভিত্তি নাড়িয়ে দিচ্ছিল এবং এর পাশাপাশি দর্শনের জগতেও চলছিল এক নীরব বিপ্লব। এই তিনটি শক্তিশালী স্রোত মিলেই সেই ঝোড়ো হাওয়া তৈরি করেছিল, যা নিওক্ল্যাসিক্যাল যুগের যুক্তিনিষ্ঠ, সুশৃঙ্খল পৃথিবীকে উড়িয়ে দিয়ে রোমান্টিসিজমের আবেগদীপ্ত, রহস্যময় এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক জগতের দরজা খুলে দিয়েছিল।

ফরাসি বিপ্লব (French Revolution, 1789-1799): আশা, মোহভঙ্গ এবং আত্মার বিপ্লব

ফরাসি বিপ্লব ছিল রোমান্টিক চেতনার প্রধানতম এবং প্রত্যক্ষ অনুঘটক। ১৭৮৯ সালে বাস্তিল দুর্গের পতন কেবল ফ্রান্সের রাজতন্ত্রের পতন ছিল না, এটি ছিল সমগ্র ইউরোপের পুরনো ব্যবস্থার (Ancien Régime) ওপর এক বজ্রাঘাত। ‘সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা’ (Liberty, Equality, Fraternity)—এই মূল স্লোগানটি ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে ইংল্যান্ডের তরুণ বুদ্ধিজীবী ও কবিদের মনে এক তীব্র আশার আগুন জ্বেলে দিয়েছিল। তাঁরা ভেবেছিলেন, মানব ইতিহাসের এক নতুন ঊষালগ্ন উপস্থিত হয়েছে, যেখানে বংশমর্যাদার পরিবর্তে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে, স্বৈরাচারের বদলে আসবে গণতন্ত্র এবং ধর্মীয় গোঁড়ামির জায়গায় স্থাপিত হবে যুক্তির শাসন।

তরুণ উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ, স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ, রবার্ট সাউদি-র মতো কবিরা এই বিপ্লবের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। ওয়ার্ডসওয়ার্থ স্বয়ং ফ্রান্সে গিয়েছিলেন বিপ্লবের উত্তাপ গায়ে মাখতে। তিনি তাঁর আত্মজৈবনিক মহাকাব্য “দ্য প্রিলিউড” (The Prelude)-এ সেই সময়ের উন্মাদনার কথা অমর করে রেখেছেন:

“Bliss was it in that dawn to be alive,
But to be young was very heaven!”

অর্থাৎ, সেই ঊষালগ্নে বেঁচে থাকাই ছিল পরমানন্দের, কিন্তু তরুণ হওয়া ছিল সাক্ষাৎ স্বর্গ। এই বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই কোলরিজ এবং সাউদি আমেরিকায় এক আদর্শ সমাজ বা ইউটোপিয়া গঠনের পরিকল্পনা করেছিলেন, যার নাম দিয়েছিলেন ‘প্যান্টিসোক্রেসি’ (Pantisocracy)—যেখানে সকলেই সমান হবে এবং কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকবে না। যদিও এই পরিকল্পনা বাস্তবে রূপায়িত হয়নি, এটি তাঁদের বিপ্লবী আদর্শবাদের তীব্রতার পরিচায়ক।

কিন্তু এই আশার সূর্য দ্রুতই মেঘে ঢেকে যায়। বিপ্লবের পরবর্তী অধ্যায়—‘সন্ত্রাসের রাজত্ব’ (Reign of Terror, 1793-94), যেখানে হাজার হাজার মানুষকে গিলোটিনে হত্যা করা হয়, এবং তার পরে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের একনায়কতন্ত্রের উত্থান—ইংল্যান্ডের আদর্শবাদী তরুণদের গভীরভাবে হতাশ করে। যে বিপ্লব স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তাই যখন রক্তগঙ্গা বইয়ে দিল এবং এক নতুন স্বৈরাচারীর জন্ম দিল, তখন ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও কোলরিজের মতো কবিদের মোহভঙ্গ হয়। এই রাজনৈতিক বিপর্যয় তাঁদের এক গভীর আত্ম-অন্বেষণের দিকে ঠেলে দেয়। তাঁরা বুঝতে পারেন যে, রাজনৈতিক বিপ্লব বাহ্যিক কাঠামো বদলাতে পারলেও, মানুষের আত্মার মুক্তি না ঘটলে প্রকৃত পরিবর্তন সম্ভব নয়।

এই মোহভঙ্গই রোমান্টিক সাহিত্যকে এক নতুন গভীরতা ও জটিলতা দান করে। রাজনৈতিক জগৎ থেকে মুখ ফিরিয়ে তাঁরা আশ্রয় খোঁজেন দুটি জায়গায়:

  • প্রকৃতি: তাঁদের কাছে প্রকৃতি হয়ে ওঠে এক চিরস্থায়ী, পবিত্র এবং নিরাময়কারী শক্তি, যা রাজনৈতিক বিশ্বের অস্থিরতা ও হিংসার ঊর্ধ্বে।

  • মানব মন: তাঁরা বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে, আসল বিপ্লব ঘটাতে হবে মানুষের অন্তরে, তার কল্পনা ও আবেগের শক্তিতে। ব্যক্তির আত্মিক মুক্তিই সমাজের মুক্তির পূর্বশর্ত।

সুতরাং, ফরাসি বিপ্লব রোমান্টিকদের জন্য একটি দ্বৈত ভূমিকা পালন করেছিল। এর প্রাথমিক সাফল্য তাঁদের মধ্যে অসীম আশাবাদ ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষা জাগিয়েছিল, যা তাঁদের লেখায় বিপ্লবী চেতনা হিসেবে ফুটে ওঠে। আবার এর ব্যর্থতা তাঁদের রাজনৈতিক জগৎ থেকে মুখ ফিরিয়ে প্রকৃতির কোলে এবং মানব মনের গভীরে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছিল, যা রোমান্টিসিজমের আত্মকেন্দ্রিকতা ও প্রকৃতি-প্রেমের মূল ভিত্তি স্থাপন করে। দ্বিতীয় প্রজন্মের কবি, বিশেষ করে শেলিবাইরন, এই হতাশার অধ্যায় পেরিয়ে বিপ্লবের মূল আদর্শকেই আরও তীব্রভাবে আঁকড়ে ধরেছিলেন।

শিল্প বিপ্লব (Industrial Revolution): যন্ত্রের আস্ফালন ও প্রকৃতির জন্য হাহাকার

ফরাসি বিপ্লবের রাজনৈতিক ঝড়ের পাশাপাশি ইংল্যান্ডের মাটিতে ঘটছিল আরেক নীরব অথচ অনেক বেশি সুদূরপ্রসারী বিপ্লব—শিল্প বিপ্লব। জেমস ওয়াটের বাষ্পীয় ইঞ্জিন, নতুন নতুন বস্ত্রকল, আর উৎপাদনের যান্ত্রিকীকরণ ইংল্যান্ডের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোকে আমূল পাল্টে দিচ্ছিল। শত শত বছর ধরে যে কৃষিভিত্তিক, গ্রামীণ জীবনযাত্রা চলে আসছিল, তা দ্রুত ভেঙে পড়ছিল। গ্রাম থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ কাজের খোঁজে ম্যানচেস্টার, লিভারপুল, লন্ডনের মতো নতুন শিল্প শহরগুলোতে ভিড় জমাচ্ছিল।

আপাতদৃষ্টিতে এটি ছিল প্রগতি ও উন্নতির লক্ষণ, কিন্তু এর একটি ভয়াবহ অন্ধকার দিকও ছিল, যা রোমান্টিক কবিদের সংবেদনশীল মনকে গভীরভাবে পীড়া দিয়েছিল।

  • নগরায়ণের অভিশাপ: নতুন শহরগুলো ছিল অস্বাস্থ্যকর, ঘিঞ্জি এবং দূষণে ভরা। উইলিয়াম ব্লেইক তাঁর “লন্ডন” কবিতায় এই যান্ত্রিক ও শোষক শহরের এক ভয়ংকর ছবি এঁকেছেন, যেখানে টেমস নদীও “charter’d” বা বন্দি, এবং প্রতিটি মানুষের মুখে তিনি দেখছেন দুর্বলতা ও যন্ত্রণার চিহ্ন (“Marks of weakness, marks of woe”)।

  • অমানবিক শ্রম: কলকারখানায় শ্রমিকদের জীবন ছিল দুঃসহ। দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, স্বল্প মজুরি, বিপজ্জনক কাজের পরিবেশ এবং শিশুশ্রম ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। মানুষ এখানে যন্ত্রের একটি অংশে পরিণত হয়েছিল, তার সৃজনশীলতা বা মানবিকতার কোনো মূল্য ছিল না। ব্লেইক এই কারখানাগুলোকেই বলেছিলেন “dark Satanic Mills” বা ‘অন্ধকারময় শয়তানের কারখানা’, যা মানুষের আত্মাকে পিষে ফেলছে।

  • প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্নতা: শিল্প বিপ্লবের সবচেয়ে বড় আঘাত ছিল প্রকৃতির ওপর। সবুজ মাঠের জায়গায় মাথা তুলছিল ধূসর চিমনি, নির্মল বাতাস ভরে উঠছিল কালো ধোঁয়ায়। মানুষ তার শিকড় থেকে, মাটির গন্ধ থেকে, ঋতুচক্রের স্বাভাবিক ছন্দ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিল। এই বিচ্ছিন্নতাই রোমান্টিকদের মনে প্রকৃতির জন্য এক তীব্র হাহাকার ও নস্টালজিয়া তৈরি করে।

  • মানবিক সম্পর্কের অবক্ষয়: এই নতুন পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সবকিছুই অর্থের নিরিখে মাপা হচ্ছিল। মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক হয়ে উঠছিল যান্ত্রিক ও স্বার্থকেন্দ্রিক। এই অবস্থাকেই পরবর্তীকালে টমাস কার্লাইল “cash-nexus” বলে অভিহিত করেছিলেন।

এই যান্ত্রিকতা, কৃত্রিমতা এবং প্রকৃতির ওপর মানুষের এই নির্লজ্জ আগ্রাসনের তীব্র প্রতিবাদ হিসেবেই রোমান্টিক কবিরা প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়ার ডাক দিয়েছিলেন। তাঁদের কাছে প্রকৃতি ছিল এক হারানো স্বর্গ, এক পবিত্র আশ্রয়, যা মানুষের আত্মাকে এই যান্ত্রিক জীবনের দূষণ থেকে আরোগ্য করতে পারে। ওয়ার্ডসওয়ার্থ তাঁর কবিতায় গ্রামের সাধারণ মানুষ—মেষপালক, কৃষক—ও তাদের সহজ-সরল জীবনকে তুলে ধরেছিলেন এই কৃত্রিম শহুরে জীবনের বিকল্প হিসেবে। প্রকৃতি তাঁদের কাছে কেবল সুন্দর দৃশ্য ছিল না, ছিল এক জীবন্ত সত্তা, এক নৈতিক শিক্ষক এবং আধ্যাত্মিক সান্ত্বনার উৎস।

দার্শনিক বিপ্লব: মনের মুক্তি ও কল্পনার জয়গান

তবে শুধু রাজনৈতিক বা সামাজিক বিপ্লবই নয়, আঠারো শতকের শেষ দিকে দর্শনের জগতেও এক বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটছিল, যা রোমান্টিকদের বিশ্ববীক্ষাকে একটি শক্তিশালী তাত্ত্বিক ভিত্তি দিয়েছিল।

জ্ঞানদীপ্তি বা এনলাইটেনমেন্ট যুগের প্রধান দার্শনিক ধারা ছিল অভিজ্ঞতাবাদ (Empiricism), যার প্রবক্তা ছিলেন জন লক। লকের মতে, মানুষের মন জন্মের সময় একটি “ট্যাবুলা রাসা” (tabula rasa) বা সাদা পাতার মতো থাকে, এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই তাতে জ্ঞান অঙ্কিত হয়। এই মতবাদে মন ছিল একটি নিষ্ক্রিয় গ্রাহক মাত্র। আইজ্যাক নিউটনের আবিষ্কার মহাবিশ্বকে একটি সুশৃঙ্খল, গাণিতিক যন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই যুক্তিনির্ভর, যান্ত্রিক বিশ্বদৃষ্টিতে রহস্য, আবেগ বা কল্পনার বিশেষ কোনো স্থান ছিল না। রোমান্টিসিজম ছিল এই যান্ত্রিক বিশ্ববীক্ষার বিরুদ্ধেই এক বিদ্রোহ।

এই বিদ্রোহের দার্শনিক রসদ জুগিয়েছিল মূলত দুটি উৎস:

  • জার্মান ভাববাদ (German Idealism): জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট (Immanuel Kant) দর্শনের জগতে এক ‘কোপার্নিকান বিপ্লব’ ঘটান। তিনি বলেন যে, আমাদের মন নিষ্ক্রিয়ভাবে জগৎকে গ্রহণ করে না, বরং আমাদের মনই সক্রিয়ভাবে তার নিজস্ব কাঠামো (যেমন—দেশ, কাল) দিয়ে জগৎ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানকে গঠন করে। এর অর্থ হলো, জগৎকে আমরা যেভাবে দেখি, তা আমাদের মনেরই সৃষ্টি। এই ধারণাটি রোমান্টিকদের জন্য ছিল যুগান্তকারী। এটি মনকে নিষ্ক্রিয় আয়নার (mirror) ভূমিকা থেকে মুক্ত করে একটি সক্রিয় প্রদীপের (lamp) মর্যাদায় উন্নীত করে, যা নিজের আলোয় জগৎকে আলোকিত ও নতুন অর্থ প্রদান করে। (Abrams, 1953) কান্টের এই দর্শনই রোমান্টিকদের কল্পনা (imagination) ও অন্তর্দৃষ্টির (intuition) ওপর জোর দেওয়ার প্রবণতাকে দার্শনিক বৈধতা দেয়। শিল্পীর কল্পনা আর নিছক অলীক স্বপ্ন নয়, তা জগৎকে নতুন করে সৃষ্টি করার এক ঐশ্বরিক ক্ষমতা।

  • ‘সাবলাইম’-এর ধারণা (The Concept of the Sublime): আইরিশ দার্শনিক এডমান্ড বার্ক (Edmund Burke) তাঁর “A Philosophical Enquiry into the Origin of Our Ideas of the Sublime and Beautiful” (1757) গ্রন্থে ‘সুন্দর’ (Beautiful) এবং ‘ভয়ংকর সুন্দর’ (Sublime)-এর মধ্যে পার্থক্য করেন। সুন্দর হলো যা ছোট, মসৃণ, সুশৃঙ্খল এবং আমাদের মধ্যে ভালোবাসার অনুভূতি জাগায়। অন্যদিকে, ‘সাবলাইম’ হলো যা কিছু বিশাল, শক্তিশালী, অসীম, অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং আমাদের মধ্যে ভয় ও বিস্ময়ের মিশ্র অনুভূতি জাগায়—যেমন উত্তাল সমুদ্র, বিশাল পর্বত, গভীর অরণ্য বা অনন্ত রাতের আকাশ। এই ‘সাবলাইম’ অনুভূতি আমাদের নিজেদের ক্ষুদ্রতা সম্পর্কে সচেতন করে এবং একই সাথে আমাদের আত্মাকে এক অসীম সত্তার সাথে যুক্ত করে প্রসারিত করে। নিওক্ল্যাসিক্যাল শিল্পীরা মূলত ‘সুন্দর’-এর উপাসক ছিলেন, কিন্তু রোমান্টিকরা প্রকৃতির এই রুদ্র, ভয়ংকর ও রহস্যময় রূপের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। শেলির “মন্ট ব্ল্যাঙ্ক” বা মেরি শেলির ফ্রাঙ্কেনস্টাইন-এর আল্পস পর্বতের বর্ণনায় এই ‘সাবলাইম’-এর ধারণা মূর্ত হয়ে উঠেছে।

এছাড়াও ফরাসি দার্শনিক জাঁ-জাক রুশো (Jean-Jacques Rousseau)-র চিন্তাও রোমান্টিসিজমকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। রুশোর মতে, সভ্যতা মানুষকে উন্নত করার পরিবর্তে দূষিত ও কৃত্রিম করে তুলেছে। মানুষ তার ‘প্রাকৃতিক’ অবস্থায় অনেক বেশি সুখী ও সৎ ছিল। এই ‘নোবেল স্যাভেজ’ (noble savage)-এর ধারণা এবং সভ্যতার প্রতি অবিশ্বাস রোমান্টিকদের প্রকৃতি, শিশু এবং গ্রামীণ জীবনের প্রতি অনুরাগের অন্যতম প্রধান কারণ।

এককথায়, ফরাসি বিপ্লবের রাজনৈতিক মুক্তি, শিল্প বিপ্লবের যান্ত্রিক শৃঙ্খল এবং জার্মান ভাববাদের মানসিক স্বাধীনতার ধারণা—এই তিনটি স্রোতধারা একবিন্দুতে মিলিত হয়ে ব্রিটিশ রোমান্টিসিজম নামক মহনদীর জন্ম দিয়েছিল। এটি ছিল পুরনো পৃথিবীর ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে এক নতুন, আরও মানবিক, আরও আবেগদীপ্ত এবং আরও রহস্যময় পৃথিবীর স্বপ্ন দেখার দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা।

রোমান্টিসিজমের আত্মার অন্বেষণ: মূল বৈশিষ্ট্যগুলির গভীরে

এবার আসুন, রোমান্টিসিজমের কিছু প্রধান বৈশিষ্ট্য বা মূল সুর চিনে নিই, যা তাদের সাহিত্যকে স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী করে তুলেছে।

১. আবেগ ও অনুভূতির উপাসনা (Worship of Emotion and Feeling): আগেই বলেছি, যুক্তির সিংহাসন থেকে আবেগকে নামিয়ে আনার যে নিওক্ল্যাসিক্যাল প্রবণতা ছিল, রোমান্টিকরা তাকে পুরোপুরিভাবে উল্টে দিয়েছিলেন। তাঁদের কাছে আবেগই ছিল সত্য ও সৌন্দর্যের উৎস। ভয়, আনন্দ, বিষাদ, বিস্ময়, ভালোবাসা—এই সবগুলো অনুভূতিই ছিল তাঁদের কাছে মূল্যবান এবং কবিতার কাঁচামাল। উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ, যাঁকে রোমান্টিক যুগের অন্যতম প্রধান পুরোহিত বলা হয়, তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ লিরিক্যাল ব্যালাডস-এর ভূমিকায় কবিতার এক যুগান্তকারী সংজ্ঞা দিয়েছিলেন: “Poetry is the spontaneous overflow of powerful feelings: it takes its origin from emotion recollected in tranquility.” (Wordsworth, 1802)। অর্থাৎ, কবিতা হলো শক্তিশালী অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ, যা কোনও শান্ত মুহূর্তে স্মরণ করা গভীর আবেগ থেকে জন্ম নেয়। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো দুটি অংশ—আবেগের ‘স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ’ এবং ‘শান্ত মুহূর্তে স্মরণ’। এর মানে হলো, রোমান্টিক কবিতা শুধু তাৎক্ষণিক আবেগের বিস্ফোরণ নয়, বরং সেই আবেগকে মননের গভীরে ধারণ করে, তাকে উপলব্ধি করে এক শৈল্পিক রূপে প্রকাশ করা।

২. কল্পনার সার্বভৌমত্ব (The Sovereignty of Imagination): রোমান্টিকদের কাছে কল্পনা ছিল ঈশ্বরের সমতুল্য এক সৃজনী শক্তি। এটা শুধু অলস স্বপ্ন দেখা নয়, বরং বাস্তবতাকে নতুন করে দেখার, ভিন্ন ভিন্ন উপাদানকে সংশ্লেষ করে নতুন কিছু সৃষ্টি করার ঐশ্বরিক ক্ষমতা। স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ, ওয়ার্ডসওয়ার্থের বন্ধু এবং আরেকজন দিকপাল কবি, তাঁর বায়োগ্রাফিয়া লিটারারিয়া গ্রন্থে কল্পনার দুটো রূপের কথা বলেছিলেন—প্রাইমারি ইমাজিনেশন (Primary Imagination) আর সেকেন্ডারি ইমাজিনেশন (Secondary Imagination)। প্রাইমারি ইমাজিনেশন হলো আমাদের সাধারণ প্রত্যক্ষণ ক্ষমতা, যা দিয়ে আমরা জগৎকে বুঝি—এটা সব মানুষের মধ্যেই আছে। আর সেকেন্ডারি ইমাজিনেশন হলো কবির অনন্য সৃজনী ক্ষমতা। এটি প্রাইমারি ইমাজিনেশনের উপাদানগুলোকে ভেঙে, গলিয়ে, নতুন করে সাজিয়ে এক অভূতপূর্ব জগৎ তৈরি করে, যা বাস্তবতার ঊর্ধ্বে উঠে যায়। কোলরিজের “কুবলা খান” (Kubla Khan) কবিতাটি এই সেকেন্ডারি ইমাজিনেশনের এক নিখুঁত উদাহরণ। আফিমের ঘোরে দেখা এক স্বপ্নের জগৎ—জাদু প্রাসাদ, পবিত্র নদী, আর বরফের গুহা—যেন তাঁর কল্পনার শক্তিতে জীবন্ত হয়ে উঠেছে কবিতার পাতায়। (Coleridge, 1817)

৩. প্রকৃতির নতুন আবিষ্কার (The Rediscovery of Nature): প্রকৃতি ছিল রোমান্টিক কবিদের প্রধান আশ্রয়, তাদের অনুপ্রেরণার অফুরন্ত উৎস এবং তাদের দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু। তাঁরা প্রকৃতির মধ্যে শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্যই দেখেননি, দেখেছেন এক জীবন্ত সত্তা, একজন শিক্ষক, একজন বন্ধু, এবং ঈশ্বরের মূর্ত প্রকাশ। শিল্প বিপ্লবের যান্ত্রিকতা থেকে পালিয়ে তারা প্রকৃতির নির্মল কোলে মানসিক ও আধ্যাত্মিক শান্তি খুঁজেছেন। প্রকৃতির এই উপাসনা বিভিন্ন রূপে প্রকাশ পেয়েছে:

  • শান্ত ও নিরাময়কারী প্রকৃতি (The Pastoral and Healing Nature): ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতায় আমরা প্রকৃতির এই স্নিগ্ধ রূপটি পাই। তাঁর “টিনটার্ন অ্যাবে” (Tintern Abbey) কবিতায় তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে প্রকৃতির স্মৃতি শহুরে জীবনের ক্লান্তি ও হতাশায় মানুষকে সান্ত্বনা দেয় এবং তার আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে নৈতিকভাবে উন্নত করে তোলে। “ড্যাফোডিলস” কবিতায় একঝাঁক সোনালী ড্যাফোডিল ফুলের দৃশ্য কবির একাকীত্ব ও বিষণ্ণতার মুহূর্তে আনন্দের উৎস হয়ে ওঠে।

  • ভয়ংকর সুন্দর বা সাবলাইম (The Sublime): পার্সি বিশি শেলি (Percy Bysshe Shelley)-র কবিতায় আমরা প্রকৃতির রুদ্র, ধ্বংসাত্মক অথচ সৃজনশীল রূপ দেখি। তাঁর “ওড টু দ্য ওয়েস্ট উইন্ড” (Ode to the West Wind) কবিতায় পশ্চিমী বাতাস একই সাথে ধ্বংসকারী ও রক্ষাকর্তা। “মন্ট ব্ল্যাঙ্ক” (Mont Blanc) কবিতায় আল্পসের বিশালতা ও শক্তি মানুষের ক্ষুদ্রতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, যা একই সাথে ভয় ও বিস্ময়ের জন্ম দেয়। এই ‘সাবলাইম’ অনুভূতি মানুষকে তার নিজের অস্তিত্বের সীমার বাইরে এক অসীম শক্তির সাথে সংযোগ স্থাপন করতে সাহায্য করে।

  • ছবির মতো সুন্দর (The Picturesque): এটি ছিল প্রকৃতির এমন এক রূপ, যা দেখতে নিখুঁত একটি ছবির মতো। অমসৃণ গাছপালা, ভাঙা দুর্গ, আর অসমতল ভূদৃশ্যের এই নান্দনিকতাও রোমান্টিকদের আকৃষ্ট করত।

৪. ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও ‘জিনিয়াস’-এর উত্থান (Individualism and the Rise of the ‘Genius’): রোমান্টিকরা ব্যক্তির অনুভূতি, অভিজ্ঞতা আর চিন্তার স্বাধীনতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতেন। সমাজের চাপিয়ে দেওয়া নিয়মের চেয়ে নিজের ভেতরের কণ্ঠস্বর শোনাকেই তাঁরা শ্রেয় মনে করতেন। এই আত্ম-উপলব্ধি ও আত্ম-প্রকাশের ওপর জোর দেওয়ার ফলেই এই সময়ে ‘জিনিয়াস’ বা প্রতিভাবান ব্যক্তির ধারণাটি খুব জনপ্রিয় হয়। জিনিয়াস হলেন তিনি, যিনি সমাজের সাধারণ নিয়মকানুন মানেন না, যিনি নিজের প্রতিভায় ও কল্পনার শক্তিতে নতুন পথ তৈরি করেন। লর্ড বাইরন (Lord Byron) তাঁর নিজের জীবন আর কবিতার মাধ্যমে এই ‘বাইরনিক হিরো’ (Byronic Hero) বা বিদ্রোহী নায়কের এক আদর্শ তৈরি করেছিলেন। এই নায়ক একাকী, বিষণ্ণ, রহস্যময়, নিজের অতীতে করা কোনো পাপের জন্য অনুতপ্ত, সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী, কিন্তু অসম্ভব প্রতিভাবান ও আকর্ষণীয়। এই চরিত্রটি সমগ্র ইউরোপের তরুণদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। (Thorslev, 1962)

৫. অতীতের মায়াবী জগৎ, বিশেষত মধ্যযুগ (Interest in the Past, especially the Middle Ages): যুক্তির যুগ অনেক সময় অতীতকে, বিশেষ করে মধ্যযুগকে ‘অন্ধকার যুগ’ (Dark Ages) বলে তাচ্ছিল্য করত। কিন্তু রোমান্টিকরা সেই অতীতের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছিলেন রহস্য, রোমাঞ্চ, বীরত্ব আর অতিপ্রাকৃতের হাতছানি। লোকগাথা (folklore), কিংবদন্তি (legends), আর মধ্যযুগের নাইটদের কাহিনি তাদের খুব টানত। জন কীটসের (John Keats) “লা বেল ডেম স্যান্স মার্সি” (La Belle Dame sans Merci) কবিতায় আমরা এক রহস্যময়ী পরী আর একাকী নাইটের মধ্যযুগীয় বিষণ্ণ প্রেমের গল্প পাই। কোলরিজের অসমাপ্ত কবিতা “ক্রিস্টাবেল” (Christabel)-এ গথিক দুর্গের রহস্যময় আবহ তৈরি করা হয়েছে। স্যার ওয়াল্টার স্কট (Sir Walter Scott) তো ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখে এই ধারাকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যান।

৬. সাধারণ মানুষ ও গ্রামীণ জীবনের জয়গান (Focus on Common People and Rural Life): ১৭৯৮ সালে প্রকাশিত ওয়ার্ডসওয়ার্থ এবং কোলরিজের যৌথ কাব্যগ্রন্থ লিরিক্যাল ব্যালাডস (Lyrical Ballads)-কে ইংলিশ রোমান্টিসিজমের সূচনাপত্র বা ম্যানিফেস্টো বলা হয়। এর ভূমিকায় ওয়ার্ডসওয়ার্থ ঘোষণা করেছিলেন যে, তাঁরা সাধারণ মানুষের মুখের ভাষায়, তাদের দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ ঘটনা ও সুখ-দুঃখ নিয়ে কবিতা লিখতে চান। শহরের কৃত্রিম জীবনের পরিবর্তে গ্রামের সহজ-সরল, অনাড়ম্বর জীবন তাদের কাছে অনেক বেশি মানবিক ও খাঁটি মনে হতো। এটি ছিল এক বৈপ্লবিক পদক্ষেপ, কারণ এর আগের নিওক্ল্যাসিক্যাল যুগে সাহিত্যের বিষয়বস্তু ছিল মূলত রাজা-মহারাজা ও অভিজাত শ্রেণীর জীবন।

৭. অতিপ্রাকৃত ও রহস্যময়তার প্রতি ঝোঁক (Interest in the Supernatural and the Mysterious): যা কিছু অদ্ভুত, রহস্যময়, ভৌতিক, এবং যুক্তির নাগালের বাইরে—সেগুলোর প্রতি রোমান্টিকদের একটা তীব্র আকর্ষণ ছিল। তাঁরা মনে করতেন, এই রহস্যময় জগৎটিই আমাদের অস্তিত্বের গভীরতর সত্যকে ধারণ করে। কোলরিজের “দ্য রাইম অফ দি এনশিয়েন্ট মেরিনার” (The Rime of the Ancient Mariner) এই ধারার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। এখানে এক বৃদ্ধ নাবিকের অভিশপ্ত সমুদ্রযাত্রার এক অতিপ্রাকৃত কাহিনি বর্ণিত হয়েছে, যেখানে প্রকৃতির বিরুদ্ধে করা একটি পাপের জন্য তাকে অলৌকিক শাস্তি ভোগ করতে হয়। গথিক উপন্যাস (Gothic novels) যেমন মেরি শেলির (Mary Shelley) ফ্রাঙ্কেনস্টাইন (Frankenstein) বা হোরেস ওয়ালপোলের (Horace Walpole) দ্য ক্যাসেল অফ অট্রান্টো (The Castle of Otranto) এই সময়েই খুব জনপ্রিয় হয়েছিল, যেখানে ভয়, রহস্য, মনস্তাত্ত্বিক আতঙ্ক আর অতিপ্রাকৃত ঘটনার ছড়াছড়ি। (Punter, 1996)

৮. বিপ্লবী চেতনা ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা (Revolutionary Spirit and Desire for Freedom): ফরাসি বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে রোমান্টিকরা সব ধরনের শোষণ, স্বৈরাচার আর সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। তারা ব্যক্তির স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার কথা বলেছেন। শেলি ছিলেন এই ধারার সবচেয়ে শক্তিশালী এবং আপোসহীন কণ্ঠস্বর। তাঁর “ওড টু দ্য ওয়েস্ট উইন্ড” কবিতায় তিনি পশ্চিমী বাতাসকে আহ্বান জানিয়েছেন পুরনো জীর্ণ সমাজব্যবস্থাকে উড়িয়ে দিয়ে নতুন সৃষ্টির বার্তা নিয়ে আসতে। তাঁর বিখ্যাত কবিতা “ইংল্যান্ড ইন ১৮১৯”-এ তিনি তৎকালীন ইংল্যান্ডের রাজা, রাজপুত্র আর শাসকদের তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছেন। বাইরন শুধু কবিতায় নয়, বাস্তবেও স্বাধীনতার পূজারী ছিলেন। তিনি গ্রিসের স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন এবং সেখানেই জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

ব্রিটিশ রোমান্টিসিজমের মূল কাণ্ডারীরা

রোমান্টিক আন্দোলনের মূল কাণ্ডারীদের কথা বলতে গেলে, আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে কয়েকটি স্বতন্ত্র অথচ পরস্পর সংযুক্ত নক্ষত্রের ছবি। একদিকে যেমন ছিলেন প্রথম প্রজন্মের পথপ্রদর্শকেরা, যাঁরা নিওক্ল্যাসিক্যাল যুগের যুক্তিনিষ্ঠ শৃঙ্খলার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রথম সুরটি বেঁধে দিয়েছিলেন; অন্যদিকে ছিলেন দ্বিতীয় প্রজন্মের অগ্নিশিখারা, যাঁরা সেই সুরকে আরও তীব্র, আরও আবেগদীপ্ত এবং আরও বিদ্রোহী করে তুলেছিলেন। এঁদের পাশাপাশি ছিলেন সেইসব নারী ও স্কটিশ লেখকেরা, যাঁরা নিজস্ব ধারায় এই আন্দোলনকে সমৃদ্ধ করেছিলেন।

প্রথম প্রজন্মের কাণ্ডারীরা: পথপ্রদর্শক ও দ্রষ্টা

রোমান্টিক কবিদের সাধারণত দুটো প্রজন্মে ভাগ করা হয়। প্রথম প্রজন্মকে বলা যেতে পারে এই আন্দোলনের তাত্ত্বিক ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনকারী। তাঁরা ফরাসি বিপ্লবের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন এবং শিল্প বিপ্লবের কদর্য রূপ দেখে ব্যথিত হয়েছিলেন। তাঁদের লেখায় ছিল প্রকৃতির প্রতি গভীর আধ্যাত্মিক অনুরাগ, সাধারণ মানুষের জীবনের প্রতি সহমর্মিতা এবং কল্পনাশক্তির অসীম ক্ষমতার ওপর বিশ্বাস। এই প্রজন্মের প্রধান তিন কাণ্ডারী হলেন উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ, স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ এবং উইলিয়াম ব্লেইক।

উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ (William Wordsworth, 1770-1850): প্রকৃতির মহাপুরোহিত

ওয়ার্ডসওয়ার্থকে প্রায়শই রোমান্টিক আন্দোলনের ‘মহাপুরোহিত’ বা ‘High Priest of Nature’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। তাঁর কবিতা ছিল প্রকৃতির প্রতি এক গভীর ও আধ্যাত্মিক প্রেমপত্র। ইংল্যান্ডের মনোরম লেক ডিস্ট্রিক্ট-এর প্রাকৃতিক পরিবেশে তাঁর শৈশব কেটেছিল, যা তাঁর কবি-মানসকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রকৃতিই মানুষের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। শৈশবে প্রকৃতির সাথে মানুষের যে নির্মল ও স্বতঃস্ফূর্ত সম্পর্ক তৈরি হয়, তা সারাজীবন তার নৈতিক সত্তাকে পথ দেখায় এবং কঠিন সময়ে সান্ত্বনা জোগায়।

ফরাসি বিপ্লবের প্রাথমিক পর্বে ওয়ার্ডসওয়ার্থ ছিলেন এক উৎসাহী সমর্থক। তিনি ফ্রান্সে গিয়ে বিপ্লবের উত্তাপ গায়ে মেখেন, কিন্তু পরবর্তীকালের ‘সন্ত্রাসের রাজত্ব’ তাঁকে গভীরভাবে হতাশ করে। এই আশা ও হতাশার দ্বন্দ্ব তাঁর আত্মজৈবনিক মহাকাব্য “দ্য প্রিলিউড” (The Prelude)-এর অন্যতম প্রধান উপজীব্য। এই বিশাল কবিতাটি, যার উপশিরোনাম ছিল “Growth of a Poet’s Mind” (এক কবির মনের বিকাশ), তাঁর শৈশব থেকে শুরু করে কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ পর্যন্ত মানসিক ও আধ্যাত্মিক যাত্রার এক অসামান্য দলিল। এখানে তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে প্রকৃতি, স্মৃতি আর কল্পনা মিলে তাঁর কবিসত্তাকে নির্মাণ করেছে। তিনি “spots of time” বা “সময়ের বিন্দু”-র কথা বলেছেন—শৈশবের এমন কিছু তীব্র আবেগঘন মুহূর্ত, যা পরবর্তী জীবনেও আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করে।

ওয়ার্ডসওয়ার্থের সাহিত্যিক জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো ১৭৯৮ সালে স্যামুয়েল টেলর কোলরিজের সাথে যৌথভাবে “লিরিক্যাল ব্যালাডস” (Lyrical Ballads) প্রকাশ করা। এই কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণের (১৮০২) ভূমিকা বা “Preface” হয়ে ওঠে রোমান্টিক আন্দোলনের অঘোষিত ইশতেহার। এই ভূমিকায় ওয়ার্ডসওয়ার্থ প্রচলিত নিওক্ল্যাসিক্যাল কাব্যরীতির বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন:

  1. বিষয়বস্তু: কবিতার বিষয়বস্তু হবে “humble and rustic life” বা গ্রামের সাধারণ, নম্র জীবন। কারণ, সাধারণ মানুষের আবেগ অনেক বেশি অকৃত্রিম ও শক্তিশালী।

  2. ভাষা: কবিতার ভাষা হবে সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা, কোনো কৃত্রিম ‘কাব্যিক ভাষা’ (poetic diction) নয়।

  3. সংজ্ঞা: তিনি কবিতার সেই বিখ্যাত সংজ্ঞাটি দেন: “Poetry is the spontaneous overflow of powerful feelings: it takes its origin from emotion recollected in tranquility.” অর্থাৎ, কবিতা হলো শক্তিশালী অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ, যা শান্ত মুহূর্তে স্মরণ করা আবেগ থেকে জন্ম নেয়।

তাঁর বিখ্যাত কবিতা “লাইন্স কম্পোজড আ ফিউ মাইলস অ্যাবাভ টিনটার্ন অ্যাবে” (Lines Composed a Few Miles above Tintern Abbey)-তে তাঁর প্রকৃতি-দর্শন চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। পাঁচ বছর পর আবার টিনটার্ন অ্যাবের কাছে ওয়াই নদীর তীরে ফিরে এসে কবি প্রকৃতির সাথে তাঁর সম্পর্কের তিনটি পর্যায়কে স্মরণ করেছেন। শৈশবে প্রকৃতি ছিল তাঁর কাছে এক খেলার মাঠ, যেখানে ছিল শুধুই শারীরিক আনন্দ। কৈশোরে প্রকৃতি ছিল তাঁর কাছে এক তীব্র আবেগ ও উত্তেজনার উৎস। আর পরিণত বয়সে এসে তিনি প্রকৃতির মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন এক শান্ত, গভীর ও আধ্যাত্মিক শক্তি—”a motion and a spirit, that impels / All thinking things, all objects of all thought, / And rolls through all things.” এই উপলব্ধিই তাঁকে জীবনের দুঃখ-কষ্ট সহ্য করার শক্তি জোগায়।

ওয়ার্ডসওয়ার্থের “আই ওয়ান্ডারড লোনলি অ্যাজ আ ক্লাউড” (I Wandered Lonely as a Cloud) বা “ড্যাফোডিলস” কবিতাটি তাঁর ‘শান্ত মুহূর্তে আবেগ স্মরণ’ তত্ত্বের নিখুঁত উদাহরণ। হ্রদের ধারে একঝাঁক সোনালী ড্যাফোডিল ফুলের দৃশ্য কবির মনে যে আনন্দের সঞ্চার করেছিল, তা তাঁর স্মৃতিতে সঞ্চিত থাকে। পরবর্তীকালে যখনই তিনি একাকী বা বিষণ্ণ বোধ করেন, সেই স্মৃতি তাঁর “inward eye” বা অন্তর্দৃষ্টিতে ভেসে ওঠে এবং তাঁর হৃদয় আনন্দে নেচে ওঠে।

যদিও জীবনের শেষ দিকে ওয়ার্ডসওয়ার্থ ক্রমশ রক্ষণশীল হয়ে পড়েন এবং তাঁর কাব্যপ্রতিভাও ম্লান হয়ে আসে, তবুও ইংরেজি সাহিত্যে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি কবিতাকে অভিজাতদের বৈঠকখানা থেকে বের করে এনে প্রকৃতির মুক্ত বাতাসে এবং সাধারণ মানুষের হৃদয়ে স্থান দিয়েছিলেন।

স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ (Samuel Taylor Coleridge, 1772-1834): কল্পনার জাদুকর ও দার্শনিক

ওয়ার্ডসওয়ার্থের ঘনিষ্ঠ বন্ধু কোলরিজ ছিলেন এক বিস্ময়কর, জটিল এবং ট্র্যাজিক প্রতিভা। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, দার্শনিক, সাহিত্য সমালোচক এবং অসাধারণ বক্তা। যেখানে ওয়ার্ডসওয়ার্থের বিচরণ ছিল চেনা পৃথিবীর চেনা প্রকৃতিতে, সেখানে কোলরিজের জগৎ ছিল স্বপ্ন, রহস্য, অলীক কল্পনা আর অতিপ্রাকৃতের মায়াবী জগৎ। দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা এবং আফিমের প্রতি আসক্তি তাঁর জীবন ও সৃষ্টিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।

কোলরিজের প্রধান কাব্যিক অবদান হলো তাঁর তিনটি অসাধারণ কবিতা—“দ্য রাইম অফ দি এনশিয়েন্ট মেরিনার” (The Rime of the Ancient Mariner), “কুবলা খান” (Kubla Khan), এবং “ক্রিস্টাবেল” (Christabel)। “দ্য রাইম অফ দি এনশিয়েন্ট মেরিনার” লিরিক্যাল ব্যালাডস-এর প্রথম কবিতা। এটি এক বৃদ্ধ নাবিকের অভিশপ্ত সমুদ্রযাত্রার এক অতিপ্রাকৃত কাহিনি, যা ব্যালাড বা গাথাকাব্যের আঙ্গিকে লেখা। নাবিকটি কোনো কারণ ছাড়াই একটি অ্যালবাট্রস পাখিকে হত্যা করে, যা ছিল প্রকৃতির প্রতি এক অযাচিত হিংসা। এই পাপের ফলে তার ওপর নেমে আসে ভয়াবহ অভিশাপ। তার সঙ্গীরা সবাই মারা যায়, এবং সে এক জীবন্মৃত অবস্থায় সীমাহীন সমুদ্রে ভাসতে থাকে। অবশেষে, যখন সে সমুদ্রের জলজ প্রাণীদের প্রতি ভালোবাসা অনুভব করে (“O happy living things!”), তখন তার মুক্তি মেলে। এই কবিতাটি শুধু একটি রোমাঞ্চকর ভৌতিক গল্প নয়, এটি পাপ, অনুতাপ এবং প্রকৃতির সকল প্রাণের প্রতি ভালোবাসার এক গভীর নৈতিক রূপক।

“কুবলা খান” কবিতাটি, যার উপশিরোনাম “A Vision in a Dream. A Fragment”, কোলরিজের সৃজনী কল্পনার এক চূড়ান্ত নিদর্শন। আফিমের ঘোরে দেখা এক স্বপ্নের জগৎ—মোঙ্গল সম্রাট কুবলা খানের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ ‘জানাডু’, পবিত্র নদী আলফ, আর বরফের গুহা—যেন তাঁর কল্পনার জাদুতে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। কবিতাটি অসমাপ্ত, কারণ এক দর্শনার্থীর আগমনে তাঁর স্বপ্নের ঘোর কেটে যায় এবং তিনি বাকিটা ভুলে যান। এই অসমাপ্তিই যেন সৃজনশীলতার ভঙ্গুরতা ও অলৌকিকতার প্রতীক।

কোলরিজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গদ্য রচনা হলো তাঁর সাহিত্য সমালোচনা গ্রন্থ “বায়োগ্রাফিয়া লিটারারিয়া” (Biographia Literaria)। এখানেই তিনি কল্পনা (Imagination) এবং খেয়াল (Fancy)-এর মধ্যে তাঁর বিখ্যাত পার্থক্যটি তুলে ধরেন। তাঁর মতে, ‘ফ্যান্সি’ হলো যান্ত্রিক; এটি কেবল পুরনো উপাদানকে নতুন করে সাজায়। কিন্তু ‘ইমাজিনেশন’ হলো সৃজনশীল ও ঐশ্বরিক। তিনি ইমাজিনেশনকে আবার দুই ভাগে ভাগ করেন:

  • প্রাইমারি ইমাজিনেশন: এটি আমাদের সাধারণ প্রত্যক্ষণ ক্ষমতা, যা দিয়ে আমরা জগৎকে একটি সুসংহত রূপ দিই। এটি সব মানুষের মধ্যেই আছে।

  • সেকেন্ডারি ইমাজিনেশন: এটি কবির অনন্য সৃজনী ক্ষমতা। এটি বাস্তব জগতের উপাদানকে ভেঙে, গলিয়ে, নতুন করে সংশ্লেষ করে এক অভূতপূর্ব শৈল্পিক জগৎ তৈরি করে।

কোলরিজ দেখিয়েছেন যে, শিল্পীর মন একটি নিষ্ক্রিয় আয়না নয় যা কেবল বাস্তবকে প্রতিফলিত করে, বরং এটি একটি সক্রিয় প্রদীপ যা নিজের আলোয় জগৎকে আলোকিত ও নতুন অর্থ প্রদান করে। তাঁর এই তত্ত্ব রোমান্টিক শিল্পতত্ত্বের ভিত্তি স্থাপন করেছিল।

উইলিয়াম ব্লেইক (William Blake, 1757-1827): দ্রষ্টা ও বিদ্রোহী

ব্লেইক ছিলেন এক স্বতন্ত্র, আপোসহীন এবং রহস্যময় প্রতিভা, যাঁকে ঠিক কোনো সাহিত্যিক গোত্রে ফেলা যায় না। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, চিত্রকর, খোদাইশিল্পী এবং ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। তাঁর সমসাময়িকরা তাঁকে প্রায় উন্মাদ মনে করলেও, পরবর্তী প্রজন্ম তাঁকে রোমান্টিক চেতনার এক অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

ব্লেইক ছিলেন প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস, সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং যুক্তিনির্ভর জ্ঞানদীপ্তির কঠোর সমালোচক। তাঁর কাছে শিল্প বিপ্লবের কারখানাগুলো ছিল “dark Satanic Mills” এবং প্রতিষ্ঠানিক ধর্ম ছিল ভণ্ডামির নামান্তর। তিনি বিশ্বাস করতেন, কল্পনা বা “Divine Imagination”-ই হলো ঈশ্বরের আসল রূপ এবং মানুষের মুক্তির একমাত্র পথ।

তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ হলো “সংস অফ ইনোসেন্স” (Songs of Innocence, 1789) এবং “সংস অফ এক্সপেরিয়েন্স” (Songs of Experience, 1794)। এই দুটি গ্রন্থকে তিনি একত্রে প্রকাশ করেন “Shewing the Two Contrary States of the Human Soul” (মানব আত্মার দুটি বিপরীত অবস্থা প্রদর্শন) শিরোনামে।

  • “সংস অফ ইনোসেন্স”-এর কবিতাগুলোতে ফুটে উঠেছে শৈশবের সারল্য, বিশ্বাস, নিরাপত্তা আর প্রকৃতির সাথে একাত্মতার জগৎ। “দ্য ল্যাম্ব” (The Lamb) কবিতায় এক শিশু একটি মেষশাবককে প্রশ্ন করে তার স্রষ্টা কে, এবং নিজেই উত্তর দেয় যে, যে স্রষ্টা তাকে সৃষ্টি করেছেন, তিনিই যিশুরূপে নিজেকেও ‘মেষশাবক’ বলেছেন। এখানে জগৎ সরল, সুন্দর এবং ঈশ্বর করুণাময়।

  • “সংস অফ এক্সপেরিয়েন্স”-এর জগৎ ঠিক তার বিপরীত। এটি অভিজ্ঞতালব্ধ পৃথিবীর কঠিন বাস্তবতা, শোষণ, ভণ্ডামি, হিংসা আর বেদনার ছবি। “দ্য টাইগার” (The Tyger) কবিতায় কবি এক ভয়ংকর বাঘকে দেখে প্রশ্ন করেন, “Did he who made the Lamb make thee?” (যিনি মেষশাবককে সৃষ্টি করেছেন, তিনিই কি তোমাকেও সৃষ্টি করেছেন?)। এই প্রশ্নটি পৃথিবীর ভালো-মন্দের রহস্য এবং স্রষ্টার দ্বৈত চরিত্র নিয়ে এক গভীর দার্শনিক সংকট তুলে ধরে। ইনোসেন্স-এর “দ্য চিমনি সুইপার” কবিতায় এক শিশু শ্রমিক স্বপ্নে দেখে যে একদিন দেবদূত এসে তাকে মুক্তি দেবে, কিন্তু এক্সপেরিয়েন্স-এর “দ্য চিমনি সুইপার” কবিতায় শিশুটি বুঝতে পারে যে তার বাবা-মা এবং পাদ্রীরা ধর্মের নামে তাকে শোষণ করছে।

ব্লেইক তাঁর কবিতাগুলোকে নিজের আঁকা ছবি দিয়ে অলংকৃত করতেন, যা তাঁর ‘illuminated printing’ পদ্ধতির এক অনন্য উদাহরণ। এছাড়াও তিনি নিজস্ব এক জটিল পৌরাণিক জগৎ (mythology) তৈরি করেছিলেন তাঁর দীর্ঘ prophetic book-গুলোতে, যেমন “দ্য ম্যারেজ অফ হেভেন অ্যান্ড হেল” (The Marriage of Heaven and Hell) এবং “জেরুজালেম” (Jerusalem)। ব্লেইকের কাজ তাঁর সময়ে প্রায় অচিহ্নিত থাকলেও, তাঁর আপোসহীন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা এবং কল্পনার প্রতি অবিচল বিশ্বাস তাঁকে একজন সত্যিকারের দ্রষ্টা কবির মর্যাদা দিয়েছে।

দ্বিতীয় প্রজন্মের অগ্নিশিখা: বিদ্রোহ, সৌন্দর্য ও অকালমৃত্যু

প্রথম প্রজন্মের কবিরা যখন ধীরে ধীরে স্থিতিশীল এবং রক্ষণশীলতার দিকে ঝুঁকছেন, তখন রোমান্টিকতার মঞ্চে আবির্ভাব ঘটল দ্বিতীয় প্রজন্মের অগ্নিশিখাদের—লর্ড বাইরন, পার্সি বিশি শেলি, আর জন কীট্স। এঁরা ছিলেন আরও বেশি বিদ্রোহী, আরও বেশি আবেগপ্রবণ, তাঁদের জীবন ছিল সংক্ষিপ্ত ও নাটকীয়তায় ভরা, এবং তাঁরা প্রত্যেকেই ইংল্যান্ডের বাইরে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁরা প্রথম প্রজন্মের দর্শনের ওপর ভিত্তি করলেও, তাঁদের প্রকাশভঙ্গি ছিল আরও তীব্র ও ব্যক্তিগত।

লর্ড বাইরন (George Gordon Byron, 1788-1824): বিদ্রোহী নায়ক ও সেলিব্রিটি

বাইরন ছিলেন তাঁর সময়ের এক জীবন্ত কিংবদন্তি, এক আধুনিক সেলিব্রিটি। তাঁর অভিজাত বংশ, ক্লাবের মতো খোঁড়া পা, সুদর্শন চেহারা, বিতর্কিত ব্যক্তিগত জীবন (অজাচার ও উভকামিতার গুজবসহ), আর কবিতার অসামান্য জনপ্রিয়তা তাঁকে এক কিংবদন্তিতে পরিণত করেছিল। তিনি নিজেই ছিলেন তাঁর সৃষ্ট ‘বাইরনিক হিরো’ (Byronic Hero)-র মূর্ত প্রতীক। এই নায়ক হলেন এমন এক চরিত্র যিনি:

  • অত্যন্ত বুদ্ধিমান, আকর্ষণীয় কিন্তু বিষণ্ণ ও আত্মমগ্ন।

  • সমাজের প্রচলিত নিয়মকানুনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী।

  • নিজের অতীতে করা কোনো ভয়াবহ পাপ বা ভুলের জন্য অনুতপ্ত ও একাকী।

  • বাইরে উদ্ধত ও আবেগহীন মনে হলেও ভেতরে ভেতরে তীব্র আবেগে জর্জরিত।

১৮১২ সালে তাঁর দীর্ঘ আখ্যানকাব্য “চাইল্ড হ্যারল্ড’স পিলগ্রিমেজ” (Childe Harold’s Pilgrimage)-এর প্রথম দুটি সর্গ প্রকাশের সাথে সাথে বাইরন রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যান। তিনি নিজেই বলেছিলেন, “I awoke one morning and found myself famous.” এই কবিতায় চাইল্ড হ্যারল্ড নামক এক ক্লান্ত ও বিষণ্ণ তরুণের ইউরোপ ভ্রমণের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে, যার মাধ্যমে বাইরন নিজের অনুভূতি ও চিন্তাভাবনা প্রকাশ করেছেন।

তবে বাইরনের শ্রেষ্ঠ কাজ সম্ভবত তাঁর অসমাপ্ত ব্যঙ্গাত্মক মহাকাব্য “ডন জুয়ান” (Don Juan)। প্রচলিত ধারণার বিপরীতে, এই কবিতার জুয়ান কোনো ধুরন্ধর প্রেমিক নন, বরং এক নিষ্পাপ তরুণ যিনি বিভিন্ন দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক ভণ্ডামির শিকার হন। এই কবিতার মাধ্যমে বাইরন তৎকালীন সমাজের কপটতা, যুদ্ধ, প্রেম এবং রাজনীতির এক তীক্ষ্ণ ও হাস্যরসাত্মক সমালোচনা করেছেন। এর স্বচ্ছন্দ, আলাপচারিতাধর্মী ভঙ্গি এবং ottava rima ছন্দের দক্ষ ও নৈপুণ্যময় ব্যবহার—এ কবিতাটিকে ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যঙ্গকাব্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বাইরন ছিলেন স্বাধীনতার এক আপোসহীন পূজারী। তিনি শুধু কবিতায় নয়, বাস্তবেও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়েছেন। জীবনের শেষ দিকে তিনি গ্রিসের স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেন এবং সেখানেই জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে মারা যান, যা তাঁর বিদ্রোহী ইমেজের সঙ্গে এক ট্র্যাজিক মহিমা যোগ করে।

পার্সি বিশি শেলি (Percy Bysshe Shelley, 1792-1822): আদর্শবাদী বিপ্লবী ও আশার কবি

শেলি ছিলেন এক আপাদমস্তক বিপ্লবী এবং চরম আদর্শবাদী (Idealist)। তিনি ছিলেন নাস্তিক, নিরামিষাশী এবং মুক্ত প্রেমের সমর্থক—যা সেই যুগের সমাজে ছিল অভাবনীয় এবং কলঙ্কজনক (scandalous)। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে “দ্য নেসেসিটি অফ এথিজম” (The Necessity of Atheism) নামক পুস্তিকা লেখার জন্য তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রেম এবং কল্পনা পৃথিবীর সমস্ত স্বৈরাচার, অবিচার আর ধর্মীয় গোঁড়ামিকে দূর করে এক নতুন আদর্শ জগৎ (Utopia) প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

শেলির কবিতায় মুক্তি, আশা আর প্রকৃতির অসীম শক্তির জয়গান গাওয়া হয়েছে। তাঁর বিখ্যাত লিরিক কবিতাগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • “ওড টু দ্য ওয়েস্ট উইন্ড” (Ode to the West Wind): এখানে তিনি পশ্চিমী বাতাসকে আহ্বান জানিয়েছেন, যা একই সাথে ধ্বংসকারী (শুকনো পাতা উড়িয়ে নিয়ে যায়) এবং রক্ষাকর্তা (নতুন বীজ ছড়িয়ে দেয়)। তিনি চান এই বাতাস যেন তাঁর বিপ্লবী চেতনাকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়, যেমনটা তিনি কবিতার শেষে প্রার্থনা করেন: “If Winter comes, can Spring be far behind?”

  • “টু আ স্কাইলার্ক” (To a Skylark): এখানে এক স্কাইলার্ক পাখির অবিরাম গান শুনে কবি মানুষের দুঃখ, কষ্ট আর সীমাবদ্ধতার কথা ভাবেন এবং সেই পাখির মতো বিশুদ্ধ ও স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দের উৎস হতে চান।

  • “ওজিম্যান্ডিয়াস” (Ozymandias): এই সনেটটি ক্ষমতার দম্ভ ও কালের নিষ্ঠুরতার এক অসামান্য চিত্র। এক পর্যটকের বর্ণনায় আমরা মিশরের এক প্রাচীন রাজার ভাঙা মূর্তির কথা জানতে পারি, যার পাদদেশে লেখা: “My name is Ozymandias, King of Kings; / Look on my Works, ye Mighty, and despair!” কিন্তু সেই ‘ওয়ার্কস’-এর কিছুই আর অবশিষ্ট নেই, চারপাশে শুধু অনন্ত মরুভূমি।

শেলির শ্রেষ্ঠ কাজ তাঁর দীর্ঘ কাব্যনাট্য “প্রমিথিউস আনবাউন্ড” (Prometheus Unbound)। গ্রিক পুরাণের চরিত্র প্রমিথিউস দেবতাদের রাজা জিউসের কাছ থেকে আগুন চুরি করে মানবজাতিকে দিয়েছিলেন বলে শাস্তি পাচ্ছিলেন। শেলির নাটকে প্রমিথিউস কেবল মুক্তই হন না, তিনি তাঁর অত্যাচারী জিউসকে ক্ষমা করে দেন। এই ক্ষমা ও প্রেমের শক্তিই স্বৈরাচারী জিউসের পতন ঘটায় এবং পৃথিবীতে এক নতুন প্রেম ও সাম্যের জগৎ প্রতিষ্ঠা করে। এটি শেলির বিপ্লবী আদর্শবাদের চূড়ান্ত প্রকাশ। মাত্র ২৯ বছর বয়সে ইতালির সমুদ্রে নৌকাডুবিতে তাঁর মৃত্যু হয়, যা ছিল রোমান্টিক যুগের আরেক ট্র্যাজেডি।

জন কীট্স (John Keats, 1795-1821): সৌন্দর্যের উপাসক ও ইন্দ্রিয়ের কবি

সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া এবং চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করা সত্ত্বেও কীটসের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান ছিল কবিতা। তিনি ছিলেন বিশুদ্ধ সৌন্দর্যের উপাসক। তিনি মনে করতেন, এই দুঃখময়, ক্ষণস্থায়ী জীবনে একমাত্র শিল্প ও সৌন্দর্যই পারে আমাদের চিরন্তন আনন্দ দিতে। তাঁর বিখ্যাত উক্তি, “Beauty is truth, truth beauty”—অর্থাৎ, সৌন্দর্যই সত্য, সত্যই সৌন্দর্য, তাঁর এই গভীর বিশ্বাসের পরিচায়ক।

কীটসের কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর তীব্র ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য চিত্রকল্প (sensuous imagery)। তিনি এমনভাবে শব্দ ব্যবহার করতেন, যা পাঠকের পঞ্চইন্দ্রিয়কে—চোখ, কান, নাক, জিহ্বা, ত্বক—জাগ্রত করে। তাঁর কবিতা পড়লে মনে হয় আমরা যেন সেই দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি, সেই শব্দ শুনতে পাচ্ছি, বা সেই গন্ধ অনুভব করছি।

যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ২৫ বছর বয়সে রোমে তাঁর মৃত্যু হয়। কিন্তু এই স্বল্প কর্মজীবনে তিনি ইংরেজি সাহিত্যের কিছু শ্রেষ্ঠ ওড (Ode) রচনা করে গেছেন:

  • “ওড টু আ নাইটিঙ্গেল” (Ode to a Nightingale): এক নাইটিঙ্গেল পাখির অমর গান শুনে কবি নিজের মরণশীলতা, দুঃখ ও কষ্টের জগৎ থেকে পালিয়ে যেতে চান। তিনি মদের সাহায্যে বা কল্পনার ডানায় ভর করে সেই পাখির জগতে পৌঁছাতে চান। কবিতাটি জীবন ও মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষা, শিল্পের অমরত্ব এবং বাস্তবতার কঠিন সত্যের মধ্যে এক তীব্র দ্বন্দ্বের আলেখ্য।

  • “ওড অন আ গ্রিসিয়ান আর্ন” (Ode on a Grecian Urn): একটি প্রাচীন গ্রিক পাত্রের গায়ে খোদাই করা ছবি দেখে কবি ভাবেন। পাত্রের ওপরের প্রেমিক-প্রেমিকা বা সঙ্গীতশিল্পীরা চিরকালের জন্য ঠাণ্ডায় জমাটবদ্ধ বা ফ্রোজেন হয়ে আছে। তারা অমর, কিন্তু তাদের জীবন নেই, আবেগ নেই। এই কবিতাটি শিল্পের চিরস্থায়ী সৌন্দর্য এবং জীবনের ক্ষণস্থায়ী উত্তাপের মধ্যে এক গভীর দার্শনিক টানাপোড়েন তুলে ধরে।

  • “টু অটাম” (To Autumn): এটি প্রকৃতির সৌন্দর্যের এক নিখুঁত ও শান্ত বন্দনা। শরৎ ঋতুকে এখানে ফল পাকার, ফসল কাটার এবং আসন্ন শীতের প্রস্তুতির এক পরিপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। এতে কোনো বিদ্রোহ নেই, আছে কেবল গ্রহণ করার এক গভীর প্রশান্তি।

কীটসের চিঠিপত্রগুলোও তাঁর কাব্যতত্ত্ব বোঝার জন্য অমূল্য। এখানেই তিনি তাঁর বিখ্যাত তত্ত্ব ‘নেগেটিভ ক্যাপাবিলিটি’ (Negative Capability)-র কথা বলেছিলেন। এর অর্থ হলো একজন সৃজনশীল মানুষের সেই ক্ষমতা, যা তাকে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য ব্যগ্র না হয়ে অনিশ্চয়তা, রহস্য ও সন্দেহের মধ্যে স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করতে সাহায্য করে। তাঁর মতে, একজন কবির কাজ উত্তর দেওয়া নয়, বরং সঠিক প্রশ্ন তোলা এবং জীবনের জটিলতাকে তার সমস্ত রহস্যসহ গ্রহণ করা।

নারীকণ্ঠ: বিস্মৃত অধ্যায়ের উন্মোচন

রোমান্টিক যুগকে প্রায়শই ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোলরিজ, বাইরন, শেলি এবং কীটসের মতো ছয়জন পুরুষ মহীরুহের যুগ হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু এই চিত্রটি কেবল অসম্পূর্ণই নয়, এটি একটি ঐতিহাসিক অবিচারও বটে। এই সময়ে অনেক প্রতিভাময়ী নারী লেখকও ছিলেন, যাঁরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, যদিও পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সাহিত্যিক অনুশাসন এবং প্রকাশনার সীমাবদ্ধতার কারণে তাঁদের কাজ দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত ও বিস্মৃত ছিল। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে নারীবাদী সাহিত্য সমালোচকরা এই বিস্মৃত অধ্যায়কে নতুন করে উন্মোচন করেছেন, যা আমাদের রোমান্টিক যুগ সম্পর্কে ধারণাকে আরও সমৃদ্ধ ও পরিপূর্ণ করে তুলেছে।

মেরি শেলি (Mary Shelley, 1797-1851): স্রষ্টা, দানব এবং রোমান্টিক ট্র্যাজেডি

মেরি শেলি শুধু পার্সি বিশি শেলির স্ত্রী ছিলেন না, তিনি ছিলেন উনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী নারীবাদী লেখিকা মেরিওলস্টোনক্র্যাফট এবং উগ্রপন্থী দার্শনিক উইলিয়াম গডউইনের কন্যা। এমন এক বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা মেরি মাত্র ১৯ বছর বয়সে রচনা করেন তাঁর যুগান্তকারী উপন্যাস “ফ্রাঙ্কেনস্টাইন; অর, দ্য মডার্ন প্রমিথিউস” (Frankenstein; or, The Modern Prometheus, 1818)। এই উপন্যাসটি লেখার পেছনের গল্পটিও রোমান্টিক কিংবদন্তির অংশ। ১৮১৬ সালে জেনেভা হ্রদের ধারে এক বর্ষার রাতে লর্ড বাইরন, পার্সি শেলি, মেরি এবং বাইরনের চিকিৎসক পোলিডোরি ভৌতিক গল্প বলার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠেন, আর সেখানেই জন্ম নেয় ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের বীজ।

“ফ্রাঙ্কেনস্টাইন” শুধু গথিক সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণই নয়, এটি একটি গভীর রোমান্টিক এবং দার্শনিক রচনা। এর প্রতিটি পাতায় রোমান্টিক যুগের মূল উদ্বেগগুলো প্রতিফলিত হয়েছে:

  • বিজ্ঞানের বিপদ ও স্রষ্টার দায়িত্ব: ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন জ্ঞানদীপ্তি যুগের যুক্তিবাদ এবং বৈজ্ঞানিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতীক। তিনি জীবন সৃষ্টির রহস্য উন্মোচন করতে চান, কিন্তু তাঁর সৃষ্ট দানবকে তিনি পরিত্যাগ করেন। এই উপন্যাসটি আসলে লাগামহীন বৈজ্ঞানিক অহংকারের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী সতর্কবার্তা এবং সৃষ্টির প্রতি স্রষ্টার নৈতিক দায়িত্বের এক গভীর অন্বেষণ।

  • পরিত্যক্ত ‘বাইরনিক হিরো’: ভিক্টরের সৃষ্ট দানব চরিত্রটি আসলে এক পরিত্যক্ত এবং সংবেদনশীল সত্তা। সে জ্ঞান অর্জন করে, প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করে এবং মানুষের ভালোবাসা কাঙাল করে। কিন্তু তার কদর্য চেহারার জন্য সমাজ তাকে প্রত্যাখ্যান করে। এই একাকীত্ব ও যন্ত্রণা তাকে এক হিংস্র দানবে পরিণত করে। সে আসলে এক ট্র্যাজিক ‘বাইরনিক হিরো’—সমাজের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়ে যে একাকীত্ব ও প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে।

  • প্রকৃতি বনাম প্রতিপালন (Nature vs. Nurture): দানবটি কি জন্মগতভাবেই শয়তান ছিল, নাকি সমাজের অবহেলা তাকে শয়তান বানিয়েছে? মেরি শেলি এই বিতর্কটিকে উপন্যাসের কেন্দ্রে রেখেছেন। দানবের নিজের ভাষ্যে আমরা জানতে পারি যে, সে আসলে ছিল এক নিষ্পাপ সত্তা, কিন্তু মানুষের ঘৃণা তাকে দানবে পরিণত করেছে।

  • সাবলাইম প্রকৃতি: উপন্যাসের পটভূমি হিসেবে আল্পস পর্বতমালার বরফাবৃত চূড়া বা উত্তাল সমুদ্রের ব্যবহার প্রকৃতির ‘সাবলাইম’ বা ভয়ংকর সুন্দর রূপকে তুলে ধরে, যা নায়কদের মানসিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি।

“ফ্রাঙ্কেনস্টাইন” ছাড়াও মেরি শেলি আরও অনেক উপন্যাস, ছোটগল্প এবং ভ্রমণকাহিনি লিখেছেন, যার মধ্যে “দ্য লাস্ট ম্যান” (The Last Man) একটি গুরুত্বপূর্ণ সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস। তাঁর কাজ রোমান্টিক যুগের অন্ধকার দিকটি এবং মানব অস্তিত্বের জটিল প্রশ্নগুলোকে সাহসিকতার সাথে অন্বেষণ করেছে।

ডরোথি ওয়ার্ডসওয়ার্থ (Dorothy Wordsworth, 1771-1855): নীরব পর্যবেক্ষক, নিভৃতের শিল্পী

ডরোথি ওয়ার্ডসওয়ার্থ ছিলেন উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের বোন এবং আজীবনের সঙ্গী। তিনি নিজে কবি হিসেবে পরিচিত হতে চাননি এবং তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর কোনো লেখা প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু তাঁর লেখা জার্নাল বা দিনলিপিগুলো, বিশেষ করে “দ্য গ্রাসমেয়ার জার্নাল” (The Grasmere Journal), রোমান্টিক সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। এই জার্নালগুলো আমাদের কেবল লেক ডিস্ট্রিক্টের দৈনন্দিন জীবন বা ওয়ার্ডসওয়ার্থ-কোলরিজ বৃত্তের অন্তরঙ্গ ছবিই দেয় না, বরং প্রকৃতির প্রতি এক ভিন্ন, আরও ব্যক্তিগত ও সূক্ষ্ম দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেয়।

ডরোথির প্রকৃতিকে দেখার দৃষ্টি ছিল অসাধারণ। তিনি খুঁটিনাটি বিষয়গুলোকে গভীর মমতা ও নিবিড় পর্যবেক্ষণের সাথে তুলে ধরতেন। তাঁর জার্নালের অনেক বর্ণনা তাঁর ভাই উইলিয়ামের কবিতায় প্রায় অবিকলভাবে রূপান্তরিত হয়েছে। এর সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণ হলো ড্যাফোডিল ফুল। ডরোথি তাঁর জার্নালে লিখেছেন: “I never saw daffodils so beautiful… they tossed & reeled & danced & seemed as if they verily laughed with the wind that blew upon them.” এই জীবন্ত ও আনন্দময় বর্ণনাটিই পরে উইলিয়ামের বিখ্যাত কবিতা “আই ওয়ান্ডারড লোনলি অ্যাজ আ ক্লাউড”-এ অমরত্ব লাভ করে।

কিন্তু ডরোথিকে কেবল তাঁর ভাইয়ের অনুপ্রেরণা হিসেবে দেখলে ভুল হবে। তাঁর নিজের গদ্যশৈলী ছিল স্বকীয়। যেখানে উইলিয়ামের কবিতায় প্রকৃতি প্রায়শই এক দার্শনিক বা আধ্যাত্মিক উপলব্ধির মাধ্যম, সেখানে ডরোথির লেখায় প্রকৃতি নিজেই এক জীবন্ত সত্তা, যার সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল আরও প্রত্যক্ষ ও অন্তরঙ্গ। তাঁর লেখা প্রমাণ করে যে, রোমান্টিক অনুভূতি প্রকাশের জন্য মহাকাব্যিক কবিতার প্রয়োজন নেই, দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ মুহূর্তগুলোর নিবিড় পর্যবেক্ষণও শিল্প হয়ে উঠতে পারে।

অন্যান্য নারীকণ্ঠ: জনপ্রিয়তার আলো ও বিস্মৃতির আঁধার

  • জোয়ানা বেইলি (Joanna Baillie, 1762-1851): তিনি ছিলেন সেই যুগের অন্যতম জনপ্রিয় ও সম্মানিত নাট্যকার। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ হলো “প্লেজ অন দ্য প্যাশনস” (Plays on the Passions), যেখানে প্রতিটি নাটক একটি নির্দিষ্ট শক্তিশালী আবেগ (যেমন—প্রেম, ঘৃণা, ভয়) কেন্দ্র করে লেখা। আবেগের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের এই প্রচেষ্টা ছিল রোমান্টিক চেতনার সাথে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ। স্যার ওয়াল্টার স্কট এবং লর্ড বাইরনের মতো সাহিত্যিকরাও তাঁর প্রতিভার প্রশংসা করতেন।

  • ফেলিসিয়া হেমানস (Felicia Hemans, 1793-1835): হেমানস ছিলেন তাঁর সময়ের সবচেয়ে বেশি পঠিত কবিদের একজন, বিশেষ করে ইংল্যান্ড ও আমেরিকায়। তাঁর কবিতাগুলো প্রায়শই ঘরোয়া ও নারীকেন্দ্রিক বিষয়বস্তু—যেমন মাতৃত্ব, আত্মত্যাগ, ধর্ম এবং স্বদেশপ্রেম—নিয়ে রচিত। তাঁর “কাসাবিয়াঙ্কা” (Casabianca) (“The boy stood on the burning deck…”) বা “দ্য হোমস অফ ইংল্যান্ড” (The Homes of England)-এর মতো কবিতাগুলো ভিক্টোরিয়ান যুগের স্কুলপাঠ্য ছিল। যদিও তাঁর লেখাকে পরবর্তীকালে অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ ও রক্ষণশীল বলে সমালোচনা করা হয়েছে, তিনি প্রমাণ করেন যে রোমান্টিক আবেগ কেবল বিদ্রোহী পুরুষদের একচেটিয়া ছিল না, তা ঘরোয়া পরিমণ্ডলেও সমানভাবে শক্তিশালী হতে পারে।

  • লেটিশিয়া এলিজাবেথ ল্যান্ডন (Letitia Elizabeth Landon বা L.E.L., 1802-1838): ল্যান্ডন ছিলেন বাইরনের মতোই এক সেলিব্রিটি কবি, যাঁর জীবন ছিল খ্যাতি, বিতর্ক ও ট্র্যাজেডিতে ভরা। তাঁর কবিতায় প্রায়শই প্রেম, মোহভঙ্গ এবং খ্যাতির বিড়ম্বনার মতো বিষয়গুলো উঠে এসেছে, তবে একজন নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে। তিনি দেখিয়েছেন যে, একজন নারীর জন্য খ্যাতি ও প্রকাশ্য জীবন কতটা বিপজ্জনক হতে পারে। তাঁর কাজ রোমান্টিক বিষণ্ণতা এবং নারীত্বের অভিজ্ঞতার এক জটিল মিশ্রণ।

স্কটিশ রোমান্টিসিজম: পাহাড়ের গান ও ইতিহাসের মহাকাব্য

ব্রিটিশ রোমান্টিসিজমের ভেতরেই স্কটল্যান্ডের কবি-সাহিত্যিকরা তাঁদের নিজস্ব এক জোরালো কণ্ঠস্বর তৈরি করেছিলেন। এই স্বাতন্ত্র্যের কারণ ছিল স্কটল্যান্ডের ভিন্ন ইতিহাস, তার অনন্য লোকসংস্কৃতি এবং রুক্ষ-সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ। তাঁদের লেখায় রোমান্টিক যুগের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলোর সাথে মিশে গিয়েছিল তীব্র স্কটিশ জাতীয়তাবাদ এবং অতীতের প্রতি এক গভীর অনুরাগ।

রবার্ট বার্নস (Robert Burns, 1759-1796): জনগণের কবি ও জাতীয় আত্মার কণ্ঠস্বর

স্কটল্যান্ডের জাতীয় কবি রবার্ট বার্নসকে অনেকেই রোমান্টিক যুগের অন্যতম পথিকৃৎ মনে করেন। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই একজন ‘জনগণের কবি’ (people’s poet), কারণ তিনি অভিজাতদের জন্য নয়, সাধারণ মানুষের জন্য লিখতেন। তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান হলো স্কটস উপভাষা (Scots dialect)-কে সাহিত্যের ভাষায় উন্নীত করা, যা ছিল ইংরেজি সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিরোধ।

বার্নসের কবিতার বিষয়বস্তু ছিল তাঁর চারপাশের জীবন—প্রেম, প্রকৃতি, মদ্যপান, সামাজিক ভণ্ডামির বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ এবং স্কটিশ দেশপ্রেম।

  • তাঁর “Auld Lang Syne” গানটি আজ বিশ্বজুড়ে বন্ধুত্ব ও পুরোনো দিনের স্মৃতির প্রতীক।

  • প্রেমের কবিতা হিসেবে “A Red, Red Rose” আজও অতুলনীয়।

  • “Tam o’ Shanter” একটি অসাধারণ আখ্যানকাব্য, যেখানে হাস্যরস, লোকবিশ্বাস আর অতিপ্রাকৃত ঘটনার চমৎকার মিশ্রণ ঘটেছে।

  • “To a Mouse” কবিতায় একটি ইঁদুরের ভাঙা বাসা দেখে কবি মানুষ এবং প্রকৃতির ভঙ্গুর অস্তিত্ব নিয়ে গভীর দার্শনিক ভাবনা প্রকাশ করেন।

  • তাঁর “A Man’s a Man for a’ That” কবিতায় তিনি ফরাসি বিপ্লবের সাম্যের আদর্শকে তুলে ধরে বলেন যে, মানুষের আসল পরিচয় তার সম্পদে বা পদে নয়, তার সততা ও মানবিকতায়।

বার্নসের কবিতায় মাটির কাছাকাছি থাকা মানুষের অকৃত্রিম আবেগ, রসবোধ আর জীবনদর্শনের যে প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে, তা ছিল ওয়ার্ডসওয়ার্থের ‘সাধারণ মানুষের ভাষা’র ধারণার পূর্বসূরি।

স্যার ওয়াল্টার স্কট (Sir Walter Scott, 1771-1832): ইতিহাসের রূপকার ও ঔপন্যাসিক

যদি বার্নস হন স্কটিশ কবিতার প্রাণপুরুষ, তবে স্যার ওয়াল্টার স্কট ছিলেন বিশ্ব সাহিত্যে ঐতিহাসিক উপন্যাস (historical novel) ধারার জনক। রোমান্টিক যুগের অতীতের প্রতি যে তীব্র আকর্ষণ, স্কট তাকেই ভিত্তি করে এক নতুন সাহিত্যিক রূপ দিয়েছেন। তিনি নিছক ঐতিহাসিক তথ্য নয়, বরং ইতিহাসকে একটি জীবন্ত, রোমাঞ্চকর এবং মানবিক কাহিনি হিসেবে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন।

তাঁর “ওয়েভারলি নভেলস” (Waverley Novels), যার মধ্যে রয়েছে “ওয়েভারলি” (Waverley), “রব রয়” (Rob Roy), “দ্য হার্ট অফ মিডলোথিয়ান” (The Heart of Midlothian) এবং “আইভানহো” (Ivanhoe), সমগ্র ইউরোপে আলোড়ন তুলেছিল। এই উপন্যাসগুলোর মাধ্যমে তিনি স্কটল্যান্ডের অশান্ত অতীত, তার কিংবদন্তি, হাইল্যান্ডসের দুর্গম সৌন্দর্য আর সেখানকার মানুষদের বীরত্বগাথাকে জীবন্ত করে তুলেছিলেন। তিনি প্রায়শই এক কাল্পনিক নায়ককে ঐতিহাসিক চরিত্র ও ঘটনার মধ্যে স্থাপন করতেন, যার মাধ্যমে পাঠক ইতিহাসের সংকটময় মুহূর্তগুলোকে ব্যক্তিগতভাবে অনুভব করতে পারত। স্কট এক অর্থে স্কটল্যান্ডের এক রোমান্টিক ভাবমূর্তি তৈরি করেছিলেন, যা আজও সে দেশের পর্যটন ও জাতীয় পরিচয়ের অংশ।

কবিতার পাশাপাশি গদ্যেও রোমান্টিসিজম

রোমান্টিক আন্দোলন শুধু কবিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। আবেগ, কল্পনা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের এই বিপ্লব গদ্য সাহিত্যেও নতুন নতুন ধারার জন্ম দিয়েছিল।

  • গথিক উপন্যাস (Gothic Novel): রহস্য, ভয়, আতঙ্ক এবং অতিপ্রাকৃত ঘটনার প্রতি রোমান্টিক ঝোঁক থেকেই এই ধারার জন্ম। যুক্তির যুগের নিয়ন্ত্রিত পৃথিবীর নিচে যে অন্ধকার, অযৌক্তিক এবং অবদমিত জগৎ রয়েছে, গথিক সাহিত্য সেই জগৎকেই অন্বেষণ করেছে। এর প্রতীকী উপাদানগুলো হলো—ভুতুড়ে দুর্গ, অন্ধকার করিডোর, অত্যাচারী ভিলেন, বিপন্ন নায়িকা এবং ভয়ংকর সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ। মেরি শেলির “ফ্রাঙ্কেনস্টাইন” ছাড়াও এই ধারার গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হলো অ্যান র‍্যাডক্লিফের “দ্য মিস্ট্রিজ অফ উডলফো” (The Mysteries of Udolpho), যেখানে তিনি ‘ব্যাখ্যাকৃত অতিপ্রাকৃত’ (explained supernatural) কৌশল ব্যবহার করেছেন, এবং চার্লস ম্যাটিউরিনের “মেলমথ দ্য ওয়ান্ডারার” (Melmoth the Wanderer), যা মানব আত্মার অন্ধকার দিক নিয়ে এক গভীর অন্বেষণ।

  • প্রবন্ধ সাহিত্য (Essays): রোমান্টিক যুগে প্রবন্ধ আর নিছক নীতিকথামূলক বা তথ্যভিত্তিক লেখা রইল না, তা হয়ে উঠল লেখকের ব্যক্তিগত অনুভূতি, স্মৃতিচারণ এবং আত্ম-আবিষ্কারের মাধ্যম।

    • চার্লস ল্যাম্ব (Charles Lamb) তাঁর “ইলিয়া” ছদ্মনামে লেখা “এসেজ অফ ইলিয়া” (Essays of Elia)-তে স্মৃতিভারাতুর, রসিক এবং মানবিক গদ্যের এক নতুন ধারা তৈরি করেন।

    • উইলিয়াম হ্যাজলিট (William Hazlitt) ছিলেন একজন আবেগময় সমালোচক, যাঁর প্রবন্ধে ব্যক্তিগত মতামত ও রাজনৈতিক আবেগ তীব্রভাবে ফুটে উঠত।

    • টমাস ডি কুইন্সি (Thomas De Quincey) তাঁর “কনফেশন্স অফ অ্যান ইংলিশ ওপিয়াম-ইটার” (Confessions of an English Opium-Eater)-এ মাদকাসক্তির অভিজ্ঞতা এবং স্বপ্নের জগৎকে এক কাব্যিক ও মনস্তাত্ত্বিক গদ্যে তুলে ধরেছেন, যা ছিল রোমান্টিক আত্ম-অন্বেষণের এক চরম উদাহরণ।

  • ঐতিহাসিক উপন্যাস (Historical Novel): স্যার ওয়াল্টার স্কট এই ধারার প্রবর্তক, যিনি দেখিয়েছেন যে উপন্যাস কেবল সমসাময়িক জীবনের দর্পণ নয়, তা অতীতের পুনর্নির্মাণ এবং জাতীয় পরিচয়ের বাহনও হতে পারে।

এইসব বিস্মৃত নারী কণ্ঠ, স্কটল্যান্ডের স্বতন্ত্র সুর এবং গদ্যের নানা রূপকে বিবেচনায় নিলে ব্রিটিশ রোমান্টিসিজম আর কেবল ছয়জন কবির আন্দোলন থাকে না। এটি হয়ে ওঠে এক বহুমাত্রিক, জটিল এবং অনেক বেশি গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক বিপ্লব। এই স্রষ্টাদের সম্মিলিত সাধনাতেই রোমান্টিসিজম কেবল একটি সাহিত্যিক ধারা হিসেবে থেমে থাকেনি, হয়ে উঠেছিল এক জীবনদর্শন—যা আজও আমাদের শেখায় কীভাবে যুক্তির পাশাপাশি হৃদয় দিয়ে জগৎকে অনুভব করতে হয়, কীভাবে প্রকৃতির মধ্যে সান্ত্বনা খুঁজতে হয়, এবং কীভাবে ব্যক্তির স্বাধীনতা ও কল্পনার শক্তিকে উদযাপন করতে হয়।

ব্রিটিশ রোমান্টিসিজমের সমালোচনা ও সীমাবদ্ধতা: আদর্শের অপর পিঠ

ব্রিটিশ রোমান্টিসিজম ছিল এক যুগান্তকারী সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব, যা মানুষের আবেগ, কল্পনা এবং প্রকৃতির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিকে চিরতরে বদলে দিয়েছিল। এটি নিওক্ল্যাসিক্যাল যুগের যুক্তিনিষ্ঠ শৃঙ্খলার বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী বিদ্রোহ ছিল। কিন্তু কোনো মহান আন্দোলনই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। রোমান্টিসিজমের যে উজ্জ্বল আলো আমাদের মুগ্ধ করে, তার পেছনে কিছু অন্ধকার দিক, কিছু সীমাবদ্ধতা এবং কিছু অন্তর্নিহিত স্ববিরোধিতাও ছিল। এই আন্দোলনের প্রকৃত মূল্যায়ন করতে হলে এর শক্তি এবং দুর্বলতা—উভয়কেই নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। আর সেই বিশ্লেষণের পরেই আমরা বুঝতে পারব, কেন প্রায় দুই শতাব্দী পরেও এর উত্তরাধিকার এত জীবন্ত ও প্রাসঙ্গিক।

রোমান্টিক আন্দোলন তার আদর্শের শিখরে দাঁড়িয়ে যে পৃথিবীকে দেখেছিল, তা অনেক সময় ছিল একপেশে এবং বাস্তবতাবিমুখ। এর প্রধান সমালোচনাগুলো নিম্নরূপ:

বাস্তবতা থেকে পলায়ন (Escapism) এবং আদর্শায়িত প্রকৃতি

রোমান্টিকদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো, তাঁরা সমকালীন কঠিন বাস্তবতা থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। শিল্প বিপ্লব ইংল্যান্ডের সমাজকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছিল। শহরগুলোতে দারিদ্র্য, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, অমানবিক শোষণ এবং সামাজিক অস্থিরতা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল। অনেক সমালোচকের মতে, রোমান্টিক কবিরা এই জ্বলন্ত সমস্যাগুলোর সরাসরি মোকাবেলা না করে কল্পনা, প্রকৃতি আর অতীতের এক আদর্শ জগতে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

  • ওয়ার্ডসওয়ার্থের প্রকৃতি: উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ প্রকৃতির এক শান্ত, স্নিগ্ধ এবং আরোগ্যকারী ছবি এঁকেছেন। তাঁর কবিতায় লেক ডিস্ট্রিক্টের মনোরম প্রকৃতি মানুষের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে। কিন্তু সমালোচকরা প্রশ্ন তোলেন, এই প্রকৃতি কি আসল ইংল্যান্ডের প্রতিচ্ছবি? যে সময়ে হাজার হাজার কৃষক জমি হারিয়ে শহরের বস্তিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে, সে সময়ে ওয়ার্ডসওয়ার্থের মেষপালক আর নির্জন উপত্যকার ছবি কি এক ধরনের রোমান্টিক পলায়নবাদ নয়? তাঁর কবিতায় প্রকৃতির কঠোর, রুক্ষ বা উদাসীন রূপটি প্রায়শই অনুপস্থিত।

  • অতীতের প্রতি মোহ: কীটসের মধ্যযুগ বা কোলরিজের অলীক জগৎও এক অর্থে বাস্তবতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা। তাঁরা যখন গ্রিক পুরাণ বা মধ্যযুগীয় কিংবদন্তির জগতে বিচরণ করেন, তখন শিল্প বিপ্লবের চিমনি থেকে ওঠা কালো ধোঁয়ার জগৎটি যেন সাময়িকভাবে বিস্মৃত হয়ে যায়। এই প্রবণতা রোমান্টিক সাহিত্যকে এক অসাধারণ সৌন্দর্য দিলেও, একে সমকালীন সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে কিছুটা দূরে সরিয়ে নিয়েছিল।

আত্মমগ্নতা এবং লাগামহীন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য (Self-indulgence and Unrestrained Individualism)

রোমান্টিসিজম ব্যক্তির আবেগ ও অনুভূতিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছিল। কবির ‘আমি’ বা ‘I’ হয়ে উঠেছিল কবিতার কেন্দ্রবিন্দু। এই আত্মকেন্দ্রিকতা অনেক সময় আত্মমগ্নতা বা আত্ম-করুণার জন্ম দিয়েছে।

  • বাইরনিক হিরো: লর্ড বাইরনের সৃষ্ট ‘বাইরনিক হিরো’ একাকী, বিষণ্ণ এবং সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী। এই চরিত্রটি তরুণদের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা পেলেও, এর মধ্যে এক ধরনের নার্সিসিজম বা আত্মপ্রেমের উপাদানও ছিল। এই নায়ক জগতের সমস্যা সমাধানের চেয়ে নিজের ব্যক্তিগত যন্ত্রণা ও একাকীত্বকে উদযাপন করতেই বেশি ব্যস্ত।

  • ওয়ার্ডসওয়ার্থের আত্মজৈবনিকতা: দ্য প্রিলিউড-এর মতো মহাকাব্য একজন কবির মনের বিকাশ নিয়ে লেখা, যা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু প্রায়শই মনে হয়, কবির নিজের অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা এতটাই প্রাধান্য পাচ্ছে যে বাইরের জগৎটা গৌণ হয়ে যাচ্ছে। এই অতিরিক্ত আত্মমগ্নতার কারণে টি. এস. এলিয়টের মতো আধুনিক কবিরা পরবর্তীকালে রোমান্টিকদের তীব্র সমালোচনা করেছেন এবং এক নৈর্ব্যক্তিক (impersonal) কবিতার তত্ত্ব দিয়েছেন। তাঁদের মতে, রোমান্টিকদের লেখা প্রায়শই ছিল লাগামহীন এবং অসংযত আবেগের প্রকাশ।

বিপ্লবী চেতনার অবক্ষয় ও রক্ষণশীলতায় প্রত্যাবর্তন

প্রথম প্রজন্মের রোমান্টিক কবিদের জীবন এক ট্র্যাজিক স্ববিরোধিতার উদাহরণ। যৌবনে যাঁরা ফরাসি বিপ্লবের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে এক নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাঁরাই জীবনের শেষ দিকে হয়ে উঠেছিলেন ঘোর রক্ষণশীল।

  • ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও কোলরিজ: তরুণ বয়সে ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও কোলরিজ ছিলেন উগ্রপন্থী বা র‍্যাডিকাল। কিন্তু নেপোলিয়নের উত্থান এবং ইংল্যান্ডের সাথে ফ্রান্সের যুদ্ধের পর তাঁরা ক্রমশ জাতীয়তাবাদী ও রক্ষণশীল হয়ে পড়েন। ওয়ার্ডসওয়ার্থ শেষ জীবনে সরকারের কাছ থেকে ‘পোয়েট লরিয়েট’ বা সভাকবির পদ গ্রহণ করেন এবং প্রচলিত চার্চ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সমর্থক হয়ে ওঠেন। কোলরিজও তাঁর শেষ জীবনে ধর্মীয় গোঁড়ামির দিকে ঝুঁকে পড়েন। তাঁদের এই পরিবর্তন দ্বিতীয় প্রজন্মের কবিদের, বিশেষ করে শেলিকে, গভীরভাবে হতাশ করেছিল। শেলি তাঁর সনেট “টু ওয়ার্ডসওয়ার্থ”-এ আক্ষেপ করে লিখেছিলেন যে, যে কবি একসময় মুক্তির গান গাইতেন, তিনি আজ নিজেই নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন। এই আদর্শচ্যুতি রোমান্টিক আন্দোলনের একটি বড় দুর্বলতা হিসেবে বিবেচিত হয়।

সীমাবদ্ধ সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি: কাদের কথা বলেন রোমান্টিকরা

রোমান্টিকরা যদিও ‘সাধারণ মানুষ’-এর কথা বলেছিলেন, কিন্তু তাঁদের এই ‘সাধারণ মানুষ’ কারা, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ আছে।

  • শ্রেণীগত সীমাবদ্ধতা: ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোলরিজ বা বাইরনের মতো কবিরা ছিলেন মধ্যবিত্ত বা অভিজাত শ্রেণীর। তাঁরা যদিও গ্রামীণ জীবনের প্রশংসা করেছেন, কিন্তু একজন ভূমিহীন কৃষক বা কারখানার শ্রমিকের আসল দুর্দশা, তার অর্থনৈতিক শোষণ বা রাজনৈতিক অধিকারহীনতার কথা তাঁদের কবিতায় খুব কমই সরাসরি উঠে এসেছে। তাঁদের দৃষ্টি ছিল মূলত সহানুভূতিশীল, কিন্তু সেই সমস্যাগুলোর গভীরে গিয়ে তার সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা প্রায় ছিলই না। এক্ষেত্রে উইলিয়াম ব্লেইক বা পার্সি শেলি ছিলেন ব্যতিক্রম।

  • নারীর কণ্ঠস্বরের অনুপস্থিতি: রোমান্টিক কবিতা মূলত পুরুষকেন্দ্রিক। নারীরা এখানে হয় প্রকৃতির মতো এক নিষ্ক্রিয় অনুপ্রেরণা (ওয়ার্ডসওয়ার্থের লুসি), অথবা এক রহস্যময়ী, বিপজ্জনক সত্তা (কীটসের লা বেল ডেম), অথবা এক আদর্শ প্রেমিকা। নারীর নিজস্ব চিন্তা, তার সামাজিক অবস্থান বা তার যন্ত্রণা খুব কমই গুরুত্ব পেয়েছে। যদিও মেরি শেলি, ডরোথি ওয়ার্ডসওয়ার্থ বা ফেলিসিয়া হেমানসের মতো লেখিকারা ছিলেন, কিন্তু মূলধারার রোমান্টিক ক্যানন বা সাহিত্য-ঐতিহ্যে তাঁদের স্থান ছিল প্রান্তিক। এই পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি রোমান্টিকদের ‘সার্বজনীন মানবতা’-র দাবিকে অনেকটাই সীমাবদ্ধ করে দেয়।

এই সমালোচনাগুলো সত্ত্বেও, এটা মনে রাখা জরুরি যে রোমান্টিক আন্দোলন তার সময়ের সীমাবদ্ধতা দ্বারা আংশিকভাবে হলেও চালিত ছিল। এর দুর্বলতাগুলোও এর শক্তিরই অন্য পিঠ।

উত্তরাধিকার: যে বিপ্লব কখনও শেষ হয় না

১৮৩০-এর দশকের পর থেকে রোমান্টিক আন্দোলনের প্রাথমিক তেজ ধীরে ধীরে কমে আসতে থাকে। ইংল্যান্ডে ভিক্টোরিয়ান যুগের সূচনা হয়, যা ছিল শিল্পায়ন, সাম্রাজ্যবাদ, বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি এবং সামাজিক নৈতিকতার যুগ। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, ভিক্টোরিয়ান যুগের বাস্তববাদ উপযোগিতাবাদ রোমান্টিসিজমের আবেগপ্রবণ আদর্শকে পুরোপুরিভাবে বাতিল করে দিয়েছে। কিন্তু সত্যিটা হলো, রোমান্টিসিজম কখনও হারিয়ে যায়নি। এটি কেবল রূপ পরিবর্তন করে পরবর্তী যুগগুলোর গভীরে অন্তঃসলিলা নদীর মতো বয়ে চলেছে। এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী এবং বহুমাত্রিক।

ভিক্টোরিয়ান সাহিত্যে অনুরণন: ভিক্টোরিয়ান লেখকরা রোমান্টিকদের সরাসরি উত্তরসূরি। তাঁরা রোমান্টিকদের আবেগ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে গ্রহণ করেছেন, কিন্তু তাকে ভিক্টোরিয়ান যুগের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও নৈতিকতার সাথে সমন্বয় করার চেষ্টা করেছেন।

  • ভিক্টোরিয়ান কবিতা: আলফ্রেড টেনিসন বা রবার্ট ব্রাউনিং-এর কবিতায় রোমান্টিক বিষণ্ণতা, প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা এবং মনস্তাত্ত্বিক গভীরতার ছাপ স্পষ্ট। ব্রাউনিং-এর ‘ড্রামাটিক মনোলগ’ যেন রোমান্টিক আত্মকেন্দ্রিকতারই এক নতুন, নাট্যরূপ।

  • ব্রন্টি বোনেদের উপন্যাস: এমিলি ব্রন্টির “উদারিং হাইটস” (Wuthering Heights)-কে বলা হয় শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক উপন্যাস। এর নায়ক হিথক্লিফ এক নিখুঁত ‘বাইরনিক হিরো’, এবং উপন্যাসের বুনো প্রকৃতি ও লাগামহীন আবেগ খাঁটি রোমান্টিক চেতনার ধারক। শার্লট ব্রন্টির “জেন আয়ার” (Jane Eyre)-এর মধ্যেও আমরা একজন নারীর আত্ম-আবিষ্কারের রোমান্টিক কাহিনি খুঁজে পাই।

আটলান্টিকের ওপারে: আমেরিকান রোমান্টিসিজম: ব্রিটিশ রোমান্টিসিজম সরাসরি আমেরিকান সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছিল। রালফ ওয়াল্ডো এমার্সনহেনরি ডেভিড থোরোর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ট্রান্সেন্ডেন্টালিস্ট (Transcendentalist) আন্দোলন ছিল আমেরিকান রোমান্টিসিজমেরই এক রূপ। তাঁরাও প্রকৃতির মধ্যে ঐশ্বরিক সত্তার সন্ধান করেছেন, ব্যক্তির অন্তর্দৃষ্টি ও স্বনির্ভরতার ওপর জোর দিয়েছেন। থোরোর ওয়াল্ডেন হ্রদের তীরে প্রকৃতির কোলে বসবাসের অভিজ্ঞতা যেন ওয়ার্ডসওয়ার্থের দর্শনেরই এক প্রায়োগিক রূপ।

শিল্প ও সঙ্গীতে প্রভাব: রোমান্টিসিজমের প্রভাব শুধু সাহিত্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। চিত্রশিল্পী জে. এম. ডব্লিউ. টার্নার এবং জন কনস্টেবল-এর ল্যান্ডস্কেপ চিত্রকর্মে আমরা প্রকৃতির রোমান্টিক রূপায়ণ দেখতে পাই। টার্নারের ছবিতে প্রকৃতির ভয়ংকর সুন্দর বা ‘সাবলাইম’ রূপটি ফুটে উঠেছে, আর কনস্টেবলের ছবিতে রয়েছে ওয়ার্ডসওয়ার্থের শান্ত, গ্রামীণ প্রকৃতির প্রতিচ্ছবি। ইউরোপীয় সঙ্গীতে বিথোভেন, শোপ্যাঁ, শ্যুবার্ট-এর মতো সুরকারদের কাজেও রোমান্টিক আবেগের তীব্র প্রকাশ ঘটেছে।

আধুনিক যুগে রোমান্টিক চেতনা: বিংশ এবং একবিংশ শতাব্দীতেও রোমান্টিক চেতনার প্রাসঙ্গিকতা কমেনি।

  • পরিবেশবাদ (Environmentalism): আজকের দিনে পরিবেশ রক্ষার যে আন্দোলন, তার দার্শনিক শিকড় লুকিয়ে আছে রোমান্টিকদের প্রকৃতি-প্রেমের মধ্যে। তাঁরাই প্রথম শিল্পায়নের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রকৃতির পবিত্রতার কথা বলেছিলেন।

  • ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের উদযাপন: আজকের পৃথিবীতে ব্যক্তির আত্ম-আবিষ্কার, নিজের সত্তাকে প্রকাশ করার যে প্রবণতা, তার পেছনেও রোমান্টিকদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের দর্শনের বড় ভূমিকা রয়েছে।

  • জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে প্রভাব: আমরা যখন কোনো সুপারহিরোকে দেখি যে সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে একাকী লড়াই করছে, তখন তার মধ্যে ‘বাইরনিক হিরো’-র ছায়া খুঁজে পাওয়া যায়। যখন কোনো গান শুনে আমাদের চোখে জল আসে, বা কোনো প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে আমরা বাকরুদ্ধ হয়ে যাই, তখন আমরা সেই রোমান্টিক অনুভূতিকেই অভিজ্ঞতা করি, যা শেলি বা কীট্স তাঁদের কবিতায় অমর করে গেছেন।

রোমান্টিসিজম কোনো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আটকে থাকা তত্ত্বকথা নয়, এটি একটি চিরন্তন মানবিক প্রবণতা—যা যুগে যুগে, কালে কালে, নানা রূপে ফিরে ফিরে আসে। এটি হলো সেই অনুভূতি, যা আমাদের যান্ত্রিক জীবনের মধ্যে এক ঝলক তাজা বাতাসের মতো, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—শুধু যুক্তি দিয়ে নয়, হৃদয় দিয়েও পৃথিবীকে ভালোবাসা যায়, অনুভব করা যায়। আর এই হৃদয়ের কথাই যখন বিপ্লব আনে, তখন জন্ম নেয় এমন এক শিল্প ও সাহিত্য, যা কালের সীমানা পেরিয়ে আজও আমাদের অনুপ্রাণিত করে, আলোড়িত করে, এবং সর্বোপরি, মানুষ হিসেবে আমাদের অস্তিত্বের গভীরতম সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায়।

তথ্যসূত্র

  • Abrams, M. H. (1953). The Mirror and the Lamp: Romantic Theory and the Critical Tradition. Oxford University Press.
  • Abrams, M. H. (1971). Natural Supernaturalism: Tradition and Revolution in Romantic Literature. W. W. Norton & Company.
  • Bate, W. J. (1963). John Keats. Harvard University Press.
  • Berlin, I. (1999). The Roots of Romanticism. Princeton University Press.
  • Bloom, H. (1959). Shelley’s Mythmaking. Yale University Press.
  • Botting, F. (1996). Gothic. Routledge.
  • Bowra, C. M. (1961). The Romantic Imagination. Oxford University Press.
  • Butler, M. (1981). Romantics, Rebels and Reactionaries: English Literature and its Background 1760-1830. Oxford University Press.
  • Coleridge, S. T. (1817). Biographia Literaria; or, Biographical Sketches of My Literary Life and Opinions. Rest Fenner.
  • Crawford, R. (2009). The Bard: Robert Burns, a Biography. Princeton University Press.
  • Frye, N. (1947). Fearful Symmetry: A Study of William Blake. Princeton University Press.
  • Hartman, G. H. (1964). Wordsworth’s Poetry, 1787-1814. Yale University Press.
  • Holmes, R. (1974). Shelley: The Pursuit. Weidenfeld & Nicolson.
  • Holmes, R. (1989). Coleridge: Early Visions. Hodder & Stoughton.
  • Lukács, G. (1962). The Historical Novel. Merlin Press.
  • Marchand, L. A. (1957). Byron: A Biography (3 vols.). Alfred A. Knopf.
  • Punter, D. (1996). The Literature of Terror: A History of Gothic Fictions from 1765 to the Present Day. Longman.
  • Thorslev, P. L., Jr. (1962). The Byronic Hero: Types and Prototypes. University of Minnesota Press.
  • Williams, R. (1973). The Country and the City. Chatto & Windus.
  • Wordsworth, W., & Coleridge, S. T. (1798). Lyrical Ballads, with a Few Other Poems. J. & A. Arch.

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.