উর্দু কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজের বিষণ্ণ সুন্দর পৃথিবী

ভূমিকা

পৃথিবীতে কিছু মানুষ আসেন, যাঁদের জন্মই হয় যেন এক গভীর বিষণ্ণতা আর তীব্র ভালোবাসা বুকে নিয়ে। তাঁরা পৃথিবীকে আমাদের মতো করে দেখেন না। তাঁদের চোখে সাধারণ দৃশ্যও অসাধারণ হয়ে ওঠে। যেমন ধরুন, রাতের আকাশ। আপনি বা আমি হয়তো চাঁদ দেখে বলব, ‘বাহ্, কী সুন্দর!’ কিন্তু একজন অন্যরকম মানুষ হয়তো সেই চাঁদের দিকে তাকিয়ে ভাববেন, ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে এটা তো একটা ‘ঝলসানো রুটি’ ছাড়া আর কিছুই নয়।

হ্যাঁ, এমনই একজন মানুষ ছিলেন। নাম তাঁর ফয়েজ আহমদ ফয়েজ (Faiz Ahmad Faiz)।

কবি বললেই আমাদের মনে যে নরম-সরম, উদাস, স্বপ্নালু চেহারার ছবি ভেসে ওঠে, ফয়েজ ঠিক তেমন ছিলেন না। আবার বিপ্লবী বললেই যে আগুনঝরা, একরোখা, আপসহীন মানুষের কথা মনে হয়, ফয়েজ ঠিক তেমনও ছিলেন না। তিনি ছিলেন এই দুইয়ের এক অদ্ভুত, রহস্যময় এবং প্রায় অসম্ভব এক মিশ্রণ। তাঁর একদিকে ছিল প্রেমিকার জন্য লেখা নরম, আর্দ্র পঙক্তি, অন্যদিকে ছিল শোষিতের জন্য দ্রোহের গনগনে আগুন। একদিকে গালিব আর হাফিজের গজলের মায়া, অন্যদিকে কার্ল মার্কসের সমাজ বদলের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ (Dialectical Materialism)। এই দুই বিপরীত স্রোতকে যিনি এক জীবনে, এক সত্তায়, এক কলমে মিলিয়ে দিতে পারেন, তিনি তো সাধারণ কেউ নন। তিনি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ।

তাঁর জীবনটা যেন একটা জটিল নকশার গালিচা। প্রতিটি সুতোয় জড়িয়ে আছে প্রেম, বিরহ, জেল, নির্বাসন, বিপ্লব আর গভীর মানবতাবাদ। চলুন, এই মানুষটার জগতে খুব সাবধানে, ধীর পায়ে একটু ডুব দেওয়া যাক। তাঁর জগৎটা যেমন বিষণ্ণ, তেমনই সুন্দর। যেমন জটিল, তেমনই সরল।

শিয়ালকোটের সেই বালক: শিকড়ের সন্ধান

সব গল্পেরই একটা শুরু থাকে। ফয়েজের গল্পের শুরুটা হয়েছিল ১৯১১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি, ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাবের শিয়ালকোট জেলার কালা কাদের গ্রামে। জায়গাটার নাম শুনে কিছু মনে পড়ছে? হ্যাঁ, এই শিয়ালকোটেই জন্মেছিলেন আরেক মহাকবি—আল্লামা ইকবাল। একই মাটির দুই সন্তান, কিন্তু দুজনের পথ, দর্শন আর কবিতার ভাষা কী আশ্চর্যরকম ভিন্ন! ইকবাল যেখানে ইসলামিক পুনর্জাগরণের (Islamic Renaissance)পাকিস্তান জাতীয়তাবাদের স্বপ্নদ্রষ্টা, সেখানে ফয়েজ আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্রের (International Socialism) একনিষ্ঠ সাধক।

ফয়েজের বাবা, চৌধুরী সুলতান মোহাম্মদ খান, ছিলেন একজন শিক্ষিত, অভিজাত ও প্রভাবশালী মানুষ। তিনি নিজে কৃষকের সন্তান হয়েও কঠোর পরিশ্রমে ব্যারিস্টার হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার খ্যাতি এমনই ছিল যে, তিনি আফগানিস্তানের তৎকালীন আমির হাবিবুল্লাহ খানের উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছেন। বাড়িতে তাই জ্ঞানচর্চার একটা আবহ ছিল। একদিকে ছিল ফার্সি আর আরবি ভাষার ধ্রুপদী ঐতিহ্য, অন্যদিকে ছিল আধুনিক ইংরেজি শিক্ষার চল। বাবা চাইতেন, ছেলেও তাঁর মতো বড় আইনজীবী হবে, নামকরা মানুষ হবে। কিন্তু ছেলের মন পড়ে থাকত কবিতার দিকে, গল্পের বইয়ের পাতায়। এক সাক্ষাৎকারে ফয়েজ বলেছিলেন, তাঁর বাবা চাইতেন তিনি যেন সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন, কিন্তু তাঁর ঝোঁক ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন দিকে (Hashmi, 2016)।

এই দ্বৈত পরিবেশই ফয়েজের ব্যক্তিত্বের ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল। তিনি একই সঙ্গে প্রাচ্যের ধ্রুপদী সাহিত্য আর পাশ্চাত্যের আধুনিক চিন্তার রস আস্বাদন করে বড় হচ্ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন চুপচাপ, অন্তর্মুখী আর অসম্ভব সংবেদনশীল। লাহোরের গভর্নমেন্ট কলেজ আর পরে ওরিয়েন্টাল কলেজে আরবি ও ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়ার সময় তাঁর প্রতিভার আসল স্ফূরণ ঘটল।

লাহোরের সেই দিনগুলো ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। গভর্নমেন্ট কলেজ তখন ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার এক তীর্থক্ষেত্র। তাঁর শিক্ষকেরা—যেমন তখনকার বিখ্যাত লেখক ও অধ্যাপক পিতরাস বুখারি (Patras Bokhari) এবং বাবা-ই-উর্দু (উর্দু ভাষার জনক) মৌলভি আব্দুল হক—বুঝতে পারছিলেন, এই শান্তশিষ্ট ছেলেটির ভেতরে এক আগ্নেয়গিরি লুকিয়ে আছে। ফয়েজ তখন ইংরেজি সাহিত্যে ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কিটস, শেলির রোমান্টিসিজমের (Romanticism) সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন, আবার একই সাথে উর্দুতে গালিব, মির তকি মির আর ফার্সিতে হাফিজ ও রুমির সুফিবাদী (Sufi) রহস্যময়তার গভীরে ডুব দিচ্ছেন।

এই সময়েই তাঁর মনে দুটি জিনিস গেঁথে যায়, যা তাঁর সারা জীবনের সঙ্গী হয়েছিল।

প্রথমত, ভালোবাসা। এক তীব্র, রোমান্টিক অনুভূতি, যা তাঁর কবিতার মূল সুর বেঁধে দিয়েছিল। কিন্তু এই ভালোবাসা শুধু রক্ত-মাংসের প্রেমিকার জন্য ছিল না, তা ধীরে ধীরে এক বিমূর্ত, মহৎ আদর্শের দিকে ধাবিত হচ্ছিল।

দ্বিতীয়ত, পারিপার্শ্বিক জগতের দুঃখ-দুর্দশা। ব্রিটিশ শাসনে নিষ্পেষিত ভারতবর্ষ, ১৯১৯ সালের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের স্মৃতি, মানুষের হাহাকার, সামাজিক অবিচার—এগুলো তাঁর সংবেদনশীল মনকে প্রতিনিয়ত রক্তাক্ত করছিল। তিনি বুঝতে পারছিলেন, শুধু প্রেমিকার চোখের সৌন্দর্য আর তার চিবুকের তিল নিয়ে কবিতা লিখলে চলবে না। কবিতার আরও বড় কোনো দায়িত্ব আছে। সমাজের প্রতি, মানুষের প্রতি।

এই উপলব্ধিই সাধারণ ফয়েজকে ‘ফয়েজ আহমদ ফয়েজ’ হয়ে ওঠার পথে প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ ছিল।

অ্যালিস: যখন বিপ্লব এলো ভালোবাসার বেশে

ফয়েজের জগৎ বুঝতে হলে তাঁর জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়কে জানতেই হবে। তিনি হলেন অ্যালিস জর্জ (Alys George)। ফয়েজের স্ত্রী। কিন্তু শুধু ‘স্ত্রী’ বললে কিছুই বলা হয় না। অ্যালিস ছিলেন ফয়েজের কমরেড, বন্ধু, সমালোচক এবং তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় আশ্রয়।

১৯৩৭ সাল। ফয়েজ তখন অমৃতসরের এম.এ.ও. কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক। সেখানেই তাঁর আলাপ হয় অ্যালিস জর্জের সাথে। অ্যালিস ছিলেন একজন ব্রিটিশ নারী, তাঁর বড় বোনের সাথে ভারতে বেড়াতে এসেছিলেন। কিন্তু তাঁর পরিচয় আরও গভীর। তিনি ছিলেন ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টির একজন সক্রিয় সদস্য। সমাজতন্ত্রের আদর্শে গভীরভাবে বিশ্বাসী একজন নারী।

তাঁদের প্রথম দেখা, প্রেম এবং বিয়ে—সবটাই ছিল যেন এক সিনেমার গল্প। একজন পাকিস্তানি মুসলিম কবি এবং একজন ব্রিটিশ কমিউনিস্ট নারী, তৎকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপটে তাঁদের সম্পর্ক ছিল রীতিমতো বৈপ্লবিক। অ্যালিসের বড় বোন ক্রিস্টাবেল, যিনি ফয়েজের এক সহকর্মীকে বিয়ে করেছিলেন, এই সম্পর্কের মূল কারিগর ছিলেন। ফয়েজের লাজুক, শান্ত স্বভাব আর অ্যালিসের প্রাণবন্ত, বুদ্ধিবাদী ব্যক্তিত্ব—দুয়ে মিলে এক अद्भुत রসায়ন তৈরি হয়েছিল।

তাঁদের বিয়ে হয়েছিল ১৯৪১ সালে, শ্রীনগরে। সেই বিয়েতে কাজির দায়িত্ব পালন করেছিলেন কাশ্মীরের তৎকালীন নেতা শেখ আবদুল্লাহ। এই বিয়ে শুধু দুটি মানুষের মিলন ছিল না, ছিল দুটি ভিন্ন সংস্কৃতি, দুটি ভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শের মেলবন্ধন। অ্যালিস ফয়েজের জীবনে এসে তাঁর বামপন্থী চিন্তাধারাকে আরও শাণিত ও মজবুত করেছিলেন। ফয়েজ মার্কসবাদ (Marxism) পড়ছিলেন আগে থেকেই, কিন্তু অ্যালিসের সাহচর্যে সেই তত্ত্ব তাঁর কাছে আরও জীবন্ত ও প্রায়োগিক হয়ে ওঠে। অ্যালিস নিজে আজীবন ফয়েজের রাজনৈতিক বিশ্বাসের সঙ্গী ছিলেন, স্বামীর বিপদে-আপদে পাহাড়ের মতো পাশে দাঁড়িয়েছেন। ফয়েজের জেলজীবনের সেই ভয়ংকর দিনগুলোতে অ্যালিস একা হাতে সংসার সামলেছেন, মেয়েদের বড় করেছেন এবং স্বামীর মুক্তির জন্য দেশে-বিদেশে জনমত তৈরি করেছেন (Faiz, A., 1989)।

ফয়েজের অনেক কবিতায় অ্যালিসের ছায়া খুঁজে পাওয়া যায়। তিনি শুধু প্রেমিকা নন, তিনি সহযোদ্ধা। এই ব্যক্তিগত ভালোবাসা আর রাজনৈতিক আদর্শের এমন অপূর্ব সমন্বয় ফয়েজের আগে উর্দু সাহিত্যে কেউ দেখাতে পারেননি।

যখন ভালোবাসা আর বিপ্লব মিলেমিশে একাকার: প্রগতিশীল লেখক সংঘ

ত্রিশের দশক। গোটা পৃথিবীজুড়ে তখন এক অস্থির সময়। ইউরোপে হিটলার-মুসোলিনির ফ্যাসিবাদের (Fascism) উত্থান, স্পেনে গৃহযুদ্ধ, আর ভারতে স্বাধীনতার সংগ্রাম তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। ঠিক এমন এক বিশ্ব পরিস্থিতিতে, ১৯৩৬ সালে, লন্ডনে কয়েকজন ভারতীয় ছাত্র ও লেখক—সাজ্জাদ জহির, মুলক রাজ আনন্দ, জ্যোতির্ময় ঘোষ—মিলে তৈরি করলেন ‘প্রগতিশীল লেখক সংঘ’ (Progressive Writers’ Association – PWA)। তাঁদের মূলমন্ত্র ছিল—সাহিত্য হবে জীবনের জন্য, মানুষের জন্য। সাহিত্য শুধু বিনোদনের বস্তু বা ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রকাশ নয়, এটি সমাজ পরিবর্তনের এক শক্তিশালী হাতিয়ার। ‘Art for life’s sake’, নট ‘art for art’s sake’

ফয়েজ এই আন্দোলনে সানন্দে যোগ দিলেন। এটাই ছিল তাঁর আসল ঠিকানা। এখানেই তিনি তাঁর মনের মতো সঙ্গী খুঁজে পেলেন—কৃষণ চন্দর, ইসমত চুঘতাই, সাদত হাসান মান্টো, কাইফি আজমি, সাহির লুধিয়ানভির মতো সমমনস্ক লেখকদের। তাঁর ভেতরের রোমান্টিক সত্তা আর বিপ্লবী সত্তা—দুটোই এখানে এসে মিলে গেল। তিনি বুঝতে পারলেন, প্রেমিকার প্রতি ভালোবাসা আর দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা—এ দুটো আসলে আলাদা কিছু নয়। বরং একটি আরেকটির পরিপূরক।

তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘মুঝসে পহলি সি মোহাব্বত মেরে মেহবুব না মাঙ’ (Mujhse Pehli Si Mohabbat Mere Mehboob Na Maang) বা ‘আমার কাছে আগের মতো ভালোবাসা চেয়ো না, প্রিয়তমা’—এই দর্শনের শ্রেষ্ঠতম উদাহরণ।

ভাবুন একবার, একজন কবি তাঁর প্রেমিকাকে বলছেন:

“আমার কাছে আগের মতো ভালোবাসা চেয়ো না, প্রিয়তমা,
আমি ভেবেছিলাম তুমি আছো, তাই জীবনটা উজ্জ্বল,
তোমার দুঃখ ছাড়া জগতে আর কোনো দুঃখ নেই,
তোমার সৌন্দর্যেই বসন্তেরা চিরস্থায়ী।
তোমার চোখ ছাড়া আর কী আছে এই পৃথিবীতে?
তুমি যদি আমার হয়ে যাও, নিয়তি আমার হাতের মুঠোয় চলে আসবে।”

এই পর্যন্ত পড়ে মনে হবে, এ তো এক নিখাদ প্রেমের কবিতা। চিরায়ত উর্দু গজলের ধারাতেই লেখা। কিন্তু এরপরই কবি এক ঝটকাতে পাঠককে বাস্তবের রুক্ষ মাটিতে নামিয়ে আনেন।

“…কিন্তু পৃথিবীতে আরও দুঃখ আছে ভালোবাসার দুঃখ ছাড়াও,
আরও অনেক স্বস্তি আছে তোমার মিলনের স্বস্তির চেয়েও।”

তারপর তিনি কীসের কথা বলছেন? তিনি বলছেন সেই সব ভয়ংকর বাস্তবতার কথা, যা এতকাল কবিতার জগতে উপেক্ষিত ছিল—

“রেশম, কিংখাব আর জরি-সুতোর আড়ালে লুকিয়ে থাকা বীভৎসতা,
পথে-ঘাটে বিক্রি হওয়া মনুষ্যত্বের শবদেহ,
পুঁজ আর রক্তে মাখামাখি শরীর,
ক্ষুধার্ত অসুখে ভরা তন্দুর থেকে বেরিয়ে আসা দেহ…
আমার চোখ ওদিকেও ফিরে যায়, আমি কী করব?
তোমার সৌন্দর্য আজও মন টানে, কিন্তু আমি কী করব?
তাই আমার কাছে আগের মতো ভালোবাসা চেয়ো না, প্রিয়তমা।”

(Kiernan, 1971)

কী অবিশ্বাস্য রূপান্তর! উর্দু গজলের হাজার বছরের ইতিহাসে প্রেমিকার কথাই ছিল শেষ কথা। তাঁর দুঃখই ছিল জগতের একমাত্র দুঃখ। ফয়েজ সেই অচলায়তন ভেঙে দিলেন। তিনি বললেন, আমার ভালোবাসা এখন আর কেবল তোমার ব্যক্তিগত চৌহদ্দিতে আটকে নেই। আমার ভালোবাসা ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর সব দুঃখী, নিপীড়িত, ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য। প্রেমিকার ভালোবাসা (Love) আর বিপ্লবের সংগ্রাম (Revolution)—দুটোকে তিনি এক সমান্তরালে নিয়ে এলেন। প্রেমিকার অবয়ব আর বিপ্লবের অবয়ব তাঁর কাছে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল।

তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নকশ-এ-ফরিয়াদি’ (Naqsh-e-Faryadi) বা ‘অভিযোগের প্রতিচ্ছবি’ প্রকাশিত হলো ১৯৪১ সালে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই উর্দু সাহিত্যে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। সবাই বুঝল, এ কোনো সাধারণ কবি নয়। এ এক নতুন কণ্ঠস্বর। যে কণ্ঠস্বর একই সাথে নরম ও কঠিন, রোমান্টিক ও বিপ্লবী।

সেনাবাহিনীর উর্দি ও সম্পাদকের কলম: এক অন্য ফয়েজ

প্রগতিশীল লেখক সংঘের সাথে যুক্ত থাকার পাশাপাশি ফয়েজের জীবনে আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব ছিল, যা প্রায়ই আলোচনায় আসে না। প্রথমটি হলো সেনাবাহিনীতে যোগদান এবং দ্বিতীয়টি সাংবাদিকতা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, ১৯৪২ সালে, ফয়েজ ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ক্যাপ্টেন হিসেবে যোগ দেন। অনেকেই অবাক হয়েছিলেন। একজন বামপন্থী, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী কবি কেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেবেন? এর পেছনে ছিল তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির একটি কৌশলগত সিদ্ধান্তহিটলারের ফ্যাসিবাদকে তখন মানবজাতির প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। তাই সোভিয়েত ইউনিয়নকে সমর্থনের জন্য কমিউনিস্ট পার্টি এই যুদ্ধকে ‘জনযুদ্ধ’ (People’s War) আখ্যা দিয়ে ব্রিটিশদের সহযোগিতা করার সিদ্ধান্ত নেয়। ফয়েজ পার্টির সেই সিদ্ধান্ত মেনেই সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন এবং মূলত জনসংযোগ ও প্রচারের (Public Relations) দায়িত্বে ছিলেন। যুদ্ধের শেষে, ১৯৪৭ সালে, তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল (Lieutenant Colonel) পদে উন্নীত হয়ে সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন।

সেনাবাহিনীর এই অভিজ্ঞতা তাঁকে শৃঙ্খলা এবং সাংগঠনিক কাঠামোর এক ভিন্ন জগৎ দেখিয়েছিল, যা তাঁর পরবর্তী জীবনে কাজে লেগেছিল।

দেশভাগের পর ফয়েজ পাকিস্তানে চলে যান। সেখানে তিনি সাংবাদিকতাকে তাঁর সংগ্রামের নতুন ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেন। তিনি প্রগতিশীল পত্রিকা ‘পাকিস্তান টাইমস’ (The Pakistan Times) এবং উর্দু দৈনিক ‘ইমরোজ’ (Imroze) এর সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। তাঁর সম্পাদনায় এই পত্রিকাগুলো শুধু সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যম ছিল না, হয়ে উঠেছিল গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের পক্ষে এক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। তাঁর ক্ষুরধার ও নির্ভীক সম্পাদকীয়গুলো পাকিস্তানের নবগঠিত রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠী, বিশেষ করে সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের (Bureaucracy) জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তিনি খোলাখুলিভাবে সরকারের কাশ্মীর নীতি, সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি তোষণ এবং আমেরিকার সাথে পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতার সমালোচনা করতেন।

এই আপসহীন সাংবাদিকতাই তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় বিপর্যয় ডেকে এনেছিল।

বন্দীর ডায়েরি: রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলা ও কারাগারের কবিতা

দেশভাগের পর থেকেই পাকিস্তানের রাজনীতিতে অস্থিরতা চলছিল। ১৯৫১ সাল। ফয়েজ তখন ‘পাকিস্তান টাইমস’ এর সম্পাদক। ৯ মার্চ, এক গভীর রাতে, তাঁকে বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হলো। অভিযোগ—তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের সরকারকে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এই মামলাটিই ইতিহাসে ‘রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলা’ (Rawalpindi Conspiracy Case) নামে পরিচিত।

অভিযোগ ছিল, মেজর জেনারেল আকবর খানের নেতৃত্বে কিছু সেনা কর্মকর্তা এবং ফয়েজের মতো কিছু বামপন্থী বুদ্ধিজীবী একটি কমিউনিস্ট অভ্যুত্থানের (Communist Coup) পরিকল্পনা করছিলেন। অভিযোগটি কতটা সত্যি ছিল, তা নিয়ে আজও বিতর্ক আছে। অনেক গবেষকের মতে, এটি ছিল পাকিস্তানের সামরিক-আমলাতান্ত্রিক চক্রের একটি অজুহাত, যার মাধ্যমে তারা দেশের প্রগতিশীল এবং বামপন্থী শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল (Zaheer, 2006)। আসল কারণ ছিল, ফয়েজের জনপ্রিয়তা এবং তাঁর আপসহীন লেখনী শাসকগোষ্ঠীর জন্য অসহনীয় হুমকি হয়ে উঠেছিল।

শুরু হলো ফয়েজের জীবনের এক নতুন, অন্ধকার এবং কঠিন অধ্যায়। প্রায় চার বছর তিনি হায়দ্রাবাদ, সারগোদা এবং মন্টগোমারির বিভিন্ন কারাগারে বন্দী ছিলেন। প্রথমদিকে তাঁকে মাসের পর মাস নির্জন কারাবাসে (Solitary Confinement) রাখা হয়েছিল। এই সময়টা ছিল শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার।

কিন্তু এই বন্দী জীবনই তাঁর ভেতরের কবিকে এক নতুন, অভাবনীয় উচ্চতায় পৌঁছে দিল। জেলখানার ধূসর দেয়াল, লোহার শেকল, তালাবদ্ধ দরজা—এগুলোই হয়ে উঠল তাঁর কবিতার নতুন প্রতীক, নতুন রূপক। কারাগারের নিঃসঙ্গ রাতগুলোয় তিনি লিখলেন তাঁর শ্রেষ্ঠ কিছু কবিতা। এই সময়ে লেখা কাব্যগ্রন্থ দুটি হলো—‘দস্ত-এ-সবা’ (Dast-e-Saba) বা ‘হাতের তালুতে রাখা বাতাস’ এবং ‘জিন্দান-নামা’ (Zindan-Nama) বা ‘কারাগারের কাহিনী’।

জেলখানার জীবন তাঁকে শারীরিকভাবে বন্দী করলেও, তাঁর কল্পনাকে দিয়েছিল অসীম মুক্তি। তিনি কারাগারের ছোট জানালা দিয়ে যে এক টুকরো আকাশ দেখতেন, যে বাতাস অনুভব করতেন, তাই হয়ে উঠত বাইরের মুক্ত পৃথিবী থেকে আসা বার্তা। তাঁর কাছে তখন সকালের স্নিগ্ধ বাতাস (Saba) আর কোনো সাধারণ বাতাস নয়, সেটি যেন বাইরের মুক্ত পৃথিবী থেকে প্রেমিকার পাঠানো চিঠি, বিপ্লবের আসন্ন বার্তা।

‘দস্ত-এ-সবা’-র ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন:

“পাথরের এই দেয়ালের ওপারে, কখনও সকালের বাতাস আসে, কখনও চাঁদের আলো, কখনও বা স্মৃতির সুবাস… এই দেয়াল, এই ছাদ থেকে শুধু দুঃখের প্রতিধ্বনিই আসে না, অন্যের কণ্ঠস্বর, অন্যের ঠোঁটের উষ্ণতাও অনুভব করা যায়।”

তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতায় তিনি লিখছেন:

“নিসার ম্যায় তেরি গলিওঁ কে, অ্যায় ওয়াতন, কে জাঁহা
চলি হ্যায় রসম কে কোয়ি না সর উঠা কে চলে।
জো কোয়ি চাহনে ওয়ালা তওয়াফ কো নিকলে,
নজর চুরা কে চলে, জিসম-ও-জাঁ বচা কে চলে।”

(“আমি তোমার অলিগলির জন্য উৎসর্গীকৃত, হে স্বদেশ, যেখানে
এমন নিয়ম চালু হয়েছে যে কেউ মাথা উঁচু করে চলতে পারে না।
যদি কোনো প্রেমিক প্রদক্ষিণে বের হতে চায়,
তাকে দৃষ্টি লুকিয়ে চলতে হয়, শরীর ও প্রাণ বাঁচিয়ে চলতে হয়।”)

এই কবিতায় তিনি তাঁর দেশকে, তাঁর স্বদেশকে সম্বোধন করছেন প্রেমিকার মতো করে। বলছেন, তোমার জন্য আমি জীবন দিতে প্রস্তুত। কিন্তু সেই দেশে তখন এমন এক স্বৈরাচারী শাসন চলছে, যেখানে মাথা উঁচু করে বাঁচাটাই অপরাধ। ভালোবাসার কথা বলাও অপরাধ। এই লাইনের মধ্যে যে তীব্র হাহাকার আর গভীর ভালোবাসা লুকিয়ে আছে, তা কেবল ফয়েজের পক্ষেই লেখা সম্ভব।

কারাগার ফয়েজের কাছে হয়ে উঠেছিল এক আধ্যাত্মিক যাত্রার (Spiritual Journey) মতো। তিনি গালিবের মতো করেই বলতেন, দুঃখ যখন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন তা নিজেই একধরনের মুক্তির পথ দেখায়। জেলখানার লোহার শিকল তাঁর কাছে পরিণত হলো কলমে, আর দেয়াল হয়ে গেল ক্যানভাস। এই সময়েই তিনি আশা আর নিরাশার দ্বন্দ্বে দুলতে থাকা সেই বিখ্যাত পঙক্তিগুলো লেখেন, যা আজও কোটি মানুষকে শক্তি জোগায়:

“মাতে কি শিকন, দিল কি জলন, তপ্তী হুই রাতেঁ,
সচ কহো তো ইয়ারো, হামে সব কুছ হ্যায় গওঁয়ারা।
এক তর্জ-এ-তগাফুল হ্যায় সো ও উনকো মুবারক,
এক অর্জ-এ-তমন্না হ্যায় সো হাম করতে রহেঙ্গে।”

(কপালের ভাঁজ, হৃদয়ের জ্বালা, তপ্ত দীর্ঘ রাত,
সত্যি বলতে বন্ধু, আমার সবই সহনীয়।
এক ধরনের উপেক্ষা আছে, তা তাদের জন্য মোবারক হোক,
এক ধরনের আকাঙ্ক্ষার নিবেদন আছে, তা আমরা করতেই থাকব।)

এই জেদ, এই অদম্য আশাবাদই ছিল ফয়েজের শক্তি। ১৯৫৫ সালে তিনি মুক্তি পান। কিন্তু ততদিনে পাকিস্তানের রাজনৈতিক দৃশ্যপট অনেকটাই বদলে গেছে।

প্রতীক যখন কথা বলে: ফয়েজের কবিতার মায়াবী জগৎ

ফয়েজের কবিতা বুঝতে হলে তাঁর প্রতীক (Symbols) এবং রূপকের (Metaphors) জগৎকে বোঝা খুব জরুরি। তিনি উর্দু ও ফার্সি কবিতার ক্লাসিক্যাল প্রতীকগুলোকে নিয়েছেন, কিন্তু সেগুলোকে সম্পূর্ণ নতুন, রাজনৈতিক ও আধুনিক অর্থ দিয়েছেন। ব্যাপারটা অনেকটা পুরনো বোতলে নতুন, আরও তীব্র, আরও ঝাঁঝালো মদ ভরার মতো।

চলুন, তাঁর কিছু প্রিয় প্রতীক দেখে নেওয়া যাক, যা তাঁর কবিতার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে:

  • কফস (Qafas) বা খাঁচা: এটি হলো কারাগার, পরাধীনতা, বা যেকোনো ধরনের নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার প্রতীক। ফয়েজ বারবার খাঁচায় বন্দী পাখির কথা বলেছেন, যে আসলে নিজেই, বা তাঁর মতো সমস্ত মুক্তিকামী মানুষ। কিন্তু তাঁর পাখি শুধু কাঁদে না, সে খাঁচার ভেতরে বসেই বসন্তের গান গায়, মুক্তির স্বপ্ন দেখে।

  • জঞ্জির (Zanjeer) বা শেকল: এটি সরাসরি দাসত্ব ও বন্ধনের প্রতীক। তবে ফয়েজের কবিতায় শেকলের শব্দ কখনও কখনও প্রতিবাদের সঙ্গীতে পরিণত হয়। তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘আজ বাজার মে পা-ব-জৌলাঁ চলো’ (আজ শেকল পায়ে বাজারে চলো)-তে তিনি শেকল পরা অবস্থাকেই এক গৌরবময় শোভাযাত্রায় পরিণত করেন।

  • দার (Daar) বা ফাঁসির মঞ্চ: এটি হলো সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের প্রতীক। বিপ্লবীরা হাসিমুখে ফাঁসির মঞ্চে ওঠেন, কারণ তাঁরা জানেন তাঁদের মৃত্যু ব্যর্থ হবে না। ফাঁসির মঞ্চ তাঁর কাছে প্রেমিকার সাথে মিলনের মঞ্চের মতোই পবিত্র।

  • রাকিব (Raqeeb) বা প্রতিদ্বন্দ্বী: ক্লাসিক্যাল উর্দু গজলে ‘রাকিব’ হলো প্রেমিকার ভালোবাসার-এর জন্য কবির প্রতিদ্বন্দ্বী। এটি একটি নেতিবাচক চরিত্র। কিন্তু ফয়েজ এই প্রতীকটিকে অবিশ্বাস্যভাবে বিনির্মাণ (Deconstruction) করেছেন। তাঁর কবিতায় ‘রাকিব’ হয়ে যায় সেই স্বৈরাচারী শাসক বা শোষক শ্রেণি, যে কবির ‘প্রেমিকা’ অর্থাৎ তাঁর দেশ বা জনগণের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে। তিনি ‘রাকিব সে’ (প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতি) নামক কবিতায় শাসককে সম্বোধন করে বলছেন, এসো, আমরাও দেখব আমাদের কার কত সাহস।

  • সাবা (Saba) বা ভোরের বাতাস: এটি হলো আশা, মুক্তি এবং বিপ্লবের বার্তা বহনকারী দূত। কারাগারের ছোট্ট জানালা দিয়ে যখন এক ঝলক বাতাস আসে, কবি তাকেই মুক্তির পূর্বাভাস বলে মনে করেন। এই বাতাস যেন প্রেমিকার পাঠানো গোপন চিঠি।

  • সুবহ্ (Subh) বা ভোর: এটি হলো চূড়ান্ত মুক্তি বা বিপ্লবের প্রতীক। রাত যত গভীরই হোক না কেন, ভোর আসবেই—এই বিশ্বাস ফয়েজের কবিতার মূল ভিত্তি। ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর তিনি লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘সুবহ-এ-আজাদি’ (স্বাধীনতার ভোর), যেখানে তিনি এই স্বাধীনতাকে এক ‘কলঙ্কিত ভোর’ বলছেন: ‘ইয়ে দাগ দাগ উজালা, ইয়ে শব-গজিদা সহর’ (এই কলঙ্কিত আলো, এই রাত্রির দংশনে জর্জরিত ভোর)। কারণ এটা সেই ভোর নয়, যার জন্য তাঁরা অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। তিনি এক সত্যিকার, নিষ্কলুষ ভোরের স্বপ্ন দেখতেন।

  • মেহবুব (Mehboob) বা প্রিয়তমা: ফয়েজের কবিতায় ‘প্রিয়তমা’ কখনও রক্ত-মাংসের নারী, কখনও তাঁর দেশ, কখনও বা বিপ্লবের বিমূর্ত আদর্শ। এই তিন সত্তা এমনভাবে মিলেমিশে গেছে যে তাদের আলাদা করা প্রায় অসম্ভব।

এই প্রতীকগুলো ব্যবহার করে ফয়েজ তাঁর রাজনৈতিক বক্তব্যকে এক শৈল্পিক, কালজয়ী উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, যা সরাসরি স্লোগানের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী এবং স্থায়ী (Russell, 1992)।

“হাম দেখেঙ্গে”: যখন কবিতা হয়ে ওঠে গণবিপ্লবের সঙ্গীত

সময়টা ১৯৭৭ সাল। পাকিস্তানে জেনারেল জিয়া-উল-হক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেছেন। শুরু হয়েছে পাকিস্তানের ইতিহাসের অন্যতম অন্ধকার এক যুগ। কঠোর ইসলামিকীকরণ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর চরম দমন-পীড়ন, নারীদের ওপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ—সব মিলিয়ে এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি।

ঠিক এমনই এক সময়ে, ফয়েজ লিখলেন তাঁর অমর কবিতা—‘হাম দেখেঙ্গে’ (Hum Dekhenge) বা ‘আমরা দেখব’। কবিতাটি তিনি লিখেছিলেন মূলত ইরানের শাহের বিরুদ্ধে আয়াতুল্লাহ খোমেনির বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে, যেখানে ধর্মীয় চিত্রকল্প (Quranic imagery) ব্যবহার করে তিনি আসলে সব ধরনের স্বৈরাচারের অবশ্যম্ভাবী পতনের কথা বলেছেন।

“হাম দেখেঙ্গে,
লাজিম হ্যায় কে হাম ভি দেখেঙ্গে,
ওহ দিন কে জিসকা ওয়াদা হ্যায়,
জো লওহ-এ-আজল মে লিখা হ্যায়…

(আমরা দেখব,
এটাই অবশ্যম্ভাবী যে আমরাও দেখব,
সেই দিনের, যার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে,
যা অনন্তের ফলকে লেখা আছে…)

কবিতাটি যখন এগোতে থাকে, তখন তার প্রতিটি শব্দ যেন এক-একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়ে ওঠে। তিনি বলছেন, একদিন আসবে যখন অত্যাচারীর বিশাল পাহাড় তুলোর মতো উড়ে যাবে, আর শোষিত মানুষের পায়ের নিচে মাটি কাঁপবে।

“জব জুলম-ও-সিতম কে কোহ-এ-গারান,
রুই কি তরহা উড় জায়েঙ্গে…
হাম মহকুমোঁ কে পাওঁ তলে,
ইয়ে ধরতি ধড় ধড় ধড়কেগি,
ঔর আহল-এ-হকম কে সর উপর,
জব বিজলি কড় কড় কড়কেগি…
হাম দেখেঙ্গে।”

(যখন অত্যাচার আর নিপীড়নের বিশাল পাহাড়,
তুলোর মতো উড়ে যাবে…
আমরা, শোষিতদের পায়ের নিচে,
এই পৃথিবীটা থরথর করে কাঁপবে,
আর শাসকদের মাথার ওপর,
যখন বিদ্যুৎ কড়কড় করে চমকাবে…
আমরা দেখব।)

(Ali, A. S., 2009)

এই কবিতাটি কিংবদন্তী হয়ে ওঠে ১৯৮৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি। জিয়া-উল-হকের স্বৈরশাসনের প্রতিবাদে লাহোরের আলহামরা আর্টস কাউন্সিলের অডিটোরিয়ামে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। মঞ্চে উঠলেন কিংবদন্তী শিল্পী ইকবাল বানো। জিয়ার সরকার তখন শাড়ি পরা নিষিদ্ধ করেছিল। ইকবাল বানো সেই নিষেধাজ্ঞাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে একটি কালো শাড়ি পরে মঞ্চে এলেন—কালো শাড়িটি ছিল প্রতিবাদের প্রতীক।

তারপর তিনি গাইতে শুরু করলেন ফয়েজের ‘হাম দেখেঙ্গে’। অডিটোরিয়ামে উপস্থিত হাজার হাজার দর্শক মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলেন। জিয়ার গোয়েন্দারা চারদিকে ঘুরছিল। কিন্তু সেদিন ভয়কে জয় করেছিল ফয়েজের কবিতার শক্তি। ইকবাল বানানোর কণ্ঠ আর ফয়েজের শব্দ মিলেমিশে এক অভূতপূর্ব প্রতিবাদের জন্ম দিয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানের রেকর্ডিং গোপনে ক্যাসেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা পাকিস্তানে। ‘হাম দেখেঙ্গে’ পরিণত হয়েছিল স্বৈরাচার-বিরোধী জাতীয় সঙ্গীতে।

এই কবিতার আবেদন এতটাই সর্বজনীন যে, কয়েক দশক পরেও ২০১৯-২০ সালে ভারতের নাগরিকত্ব আইন (CAA) বিরোধী আন্দোলনে দিল্লির শাহিনবাগ থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের কণ্ঠে এই গানই ছিল প্রধান স্লোগান।

এটাই ফয়েজের জাদু। তাঁর কবিতা কোনো নির্দিষ্ট দেশ বা কালের গণ্ডিতে আটকে থাকে না। যেখানেই অন্যায়, যেখানেই নিপীড়ন, সেখানেই ফয়েজের কবিতা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে, মানুষের মনে প্রতিরোধের আগুন জ্বালিয়ে দেয়।

নির্বাসনের দিনগুলি ও আন্তর্জাতিকতাবাদ

জিয়া-উল-হকের শাসনের সময় পাকিস্তানে থাকা ফয়েজের জন্য আর নিরাপদ ছিল না। তিনি কার্যত এক নির্বাসিত (Exile) জীবন কাটাতে বাধ্য হন। এই সময়ে তিনি বৈরুতে ছিলেন। তখন লেবাননে চলছিল ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ (Civil War)। ফয়েজ নিজের চোখে দেখছিলেন ফিলিস্তিনিদের সংগ্রাম, ইজরায়েলি বোম হামলায় বিধ্বস্ত শহর, রক্তের স্রোত। এই অভিজ্ঞতা তাঁর কবিতায় এক নতুন, আন্তর্জাতিক মাত্রা যোগ করে। তাঁর কবিতার ভূগোল (Geography) তখন আর শুধু ভারত বা পাকিস্তান থাকে না, তা আফ্রিকা, এশিয়া, লাতিন আমেরিকার মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রামের সাথে একাত্ম হয়ে যায়।

তিনি আফ্রো-এশীয় লেখক সঙ্ঘের (Afro-Asian Writers’ Association) পত্রিকা ‘লোটাস’ (Lotus) এর সম্পাদক হিসেবে কাজ করছিলেন। এই সময় তিনি পাবলো নেরুদা, নাজিম হিকমত, ইয়াসির আরাফাতের মতো বিশ্বনেতা ও কবিদের সংস্পর্শে আসেন। তিনি ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগ্রামের (Palestinian Liberation Movement) একজন একনিষ্ঠ সমর্থক হয়ে ওঠেন। বৈরুতের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘সর-এ-ওয়াদি-এ-সিনা’ (Sar-e-Wadi-e-Sina) বা ‘সিনাই উপত্যকার উপরে’।

বৈরুতের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে তিনি লিখছেন:

“ফির আতে হ্যায় গায়েব সে ইয়ে মজমুন খেয়াল মে,
কে দিল বাশার কা হ্যায় মিসর-ও-শাম ও ফিলিস্তিন মে।
জাহা ভি আদা-এ-হক কা মোহসিন কোয়ি মিলে,
উসে সালাম করো।”

(অদৃশ্য থেকে এই ভাবনা আবার মনে আসছে,
যে মানুষের হৃদয় আজ মিশর, সিরিয়া আর ফিলিস্তিনে পড়ে আছে।
যেখানেই সত্যের জন্য কোনো যোদ্ধা পাবে,
তাকে সালাম জানাও।)

এই আন্তর্জাতিকতাবাদ (Internationalism) ফয়েজকে দক্ষিণ এশিয়ার গণ্ডি ছাড়িয়ে এক বিশ্বকবির মর্যাদা দিয়েছিল। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে লেনিন শান্তি পুরস্কার (Lenin Peace Prize) পেয়েছিলেন, যা ছিল নোবেল পুরস্কারের সমাজতান্ত্রিক বিকল্প।

জীবনের শেষ দিকে, জিয়ার শাসনের কঠোরতা কিছুটা শিথিল হলে তিনি দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু ততদিনে তাঁর শরীর ভেঙে পড়েছে। ১৯৮৪ সালের ২০ নভেম্বর, এই চিরকালীন আশাবাদী, প্রেমিক ও বিপ্লবী কবি লাহোরে তাঁর প্রিয় মানুষদের সান্নিধ্যে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কিন্তু তিনি কি সত্যিই চলে গেছেন?

যাওয়ার আগে তিনি যেন বলে গেছেন:

“মত রোকো, ইসি গম কো মেরি নিসবত কা সাহারা কহনে দো,
ম্যায় ভুল গয়া থা রাহ্‌-এ-সফর, ম্যায় ভুল গয়া থা ঘর আপনা।
অব ইয়াদ তুমহারি আয়ি হ্যায়, তো লব পে ফয়েজ ফয়েজ আয়া,
ওয়ারনা তো কব সে নাম-ও-নসব ভি ভুল গয়া থা ম্যায় আপনা।”

(আমাকে আটকাতে এসো না, এই দুঃখকেই আমার পরিচয়ের আশ্রয় হতে দাও,
আমি তো যাত্রার পথ ভুলে গিয়েছিলাম, আমি তো নিজের ঘর ভুলে গিয়েছিলাম।
এখন তোমার স্মৃতি মনে পড়েছে, তাই মুখে ‘ফয়েজ’ ‘ফয়েজ’ নামটা এসেছে,
নাহলে কবেই তো আমি নিজের নাম-পরিচয়ও ভুলে গিয়েছিলাম।)

তাঁর কাছে ‘দুঃখ’ (Gham) ছিল তাঁর আসল পরিচয়। মানুষের দুঃখ, দেশের দুঃখ, পৃথিবীর দুঃখ। সেই দুঃখই তাঁকে কবি বানিয়েছে, বিপ্লবী বানিয়েছে।

কেন আমরা আজও ফয়েজ পড়ব? তাঁর প্রাসঙ্গিকতা

এত বছর পরেও ফয়েজ কেন এত প্রাসঙ্গিক? কেন ঢাকা, দিল্লি, লাহোর, কায়রো—সর্বত্রই সংকটের মুহূর্তে, প্রতিবাদের মিছিলে তাঁর কবিতা আশ্রয় হয়ে ওঠে?

কারণ ফয়েজ আমাদের কয়েকটি জরুরি জিনিস শিখিয়ে গেছেন, যা আজও অমূল্য।

  • প্রথমত, ব্যক্তিগত ও সমষ্টির মেলবন্ধন: তিনি শিখিয়েছেন কীভাবে ব্যক্তিগত অনুভূতিকে সমষ্টির অনুভূতির সাথে মেলানো যায়। ভালোবাসা যে শুধু দুজন মানুষের ব্যক্তিগত আদান-প্রদান নয়, তা যে একটা গোটা দেশের জন্য, গোটা মানবজাতির জন্যও হতে পারে—এই বোধ তিনি আমাদের দিয়েছেন। তাঁর প্রেমিকার চোখ আর বিপ্লবের পতাকা তাঁর কাছে একাকার হয়ে গিয়েছিল।
  • দ্বিতীয়ত, শিল্পীর দায়বদ্ধতা: তিনি শিখিয়েছেন যে শিল্প আর রাজনীতির মধ্যে কোনো দুর্ভেদ্য দেয়াল নেই। সত্যিকারের বড় শিল্পকর্ম সবসময়ই তার সময় ও সমাজকে ধারণ করে। শিল্পীর দায়বদ্ধতা আছে তাঁর সময়ের প্রতি, মানুষের প্রতি। ফয়েজ সেই দায়বদ্ধতা কখনো এড়িয়ে যাননি, বরং সাহসের সাথে কাঁধে তুলে নিয়েছেন। জেল, নির্বাসন—কোনো কিছুই তাঁকে দমাতে পারেনি।
  • তৃতীয়ত, ঐতিহ্যের আধুনিকায়ন: ফয়েজ উর্দু কবিতার হাজার বছরের ঐতিহ্যকে অস্বীকার করেননি। তিনি গালিব, মির, হাফিজের কাছ থেকে গজলের আঙ্গিক, ভাষা আর প্রতীক নিয়েছেন, কিন্তু সেগুলোকে এক নতুন, আধুনিক ও বিপ্লবী বিষয়বস্তু দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরেই আধুনিক হওয়া যায়।
  • চতুর্থত, সঙ্গীতের সাথে অবিচ্ছেদ্য বন্ধন: ফয়েজের কবিতার একটি বড় শক্তি হলো তার অন্তর্নিহিত সঙ্গীতময়তা। তাঁর শব্দচয়ন, ছন্দ এবং চিত্রকল্প এতটাই শক্তিশালী যে তা সুরকার ও শিল্পীদের চুম্বকের মতো আকর্ষণ করেছে। নূর জাহান, মেহদি হাসান, ইকবাল বানো, টিনা সানি, নুসরাত ফতেহ আলি খান—কিংবদন্তী শিল্পীদের কণ্ঠে তাঁর কবিতা গণমানুষের কাছে পৌঁছে গেছে। এই সঙ্গীতায়োজন তাঁর কবিতাকে অভিজাতদের পাঠাগার থেকে সাধারণ মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে দিয়েছে।
  • পঞ্চমত, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ – আশা: তাঁর জীবন কেটেছে নিরন্তর সংগ্রাম, কারাবাস আর নির্বাসনে। তিনি দেখেছেন দেশভাগ, যুদ্ধ, সামরিক স্বৈরশাসন। এত কিছুর পরেও তাঁর কবিতার মূল সুর কিন্তু হতাশার নয়, চূড়ান্ত আশার। তিনি বিশ্বাস করতেন, রাত যত অন্ধকারই হোক, ভোর আসবেই। অত্যাচারী যত শক্তিশালীই হোক, তার পতন অনিবার্য। এই বিশ্বাসটুকু আঁকড়ে ধরেই মানুষ দুঃসময় পার করে।

ফয়েজ আহমদ ফয়েজ শুধু একজন উর্দু কবি নন। তিনি একটি প্রতিষ্ঠান, একটি আন্দোলন, একটি দর্শন। তিনি এমন এক বাতিঘর, যা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে চিরকাল আলো দেখিয়ে যাবে।

যখনই আপনার মনে হবে চারদিকে শুধুই অন্ধকার, যখন রাষ্ট্র আপনার কণ্ঠরোধ করতে চাইবে, যখন মনে হবে সব আশা শেষ, তখন একবার ফয়েজের কবিতা খুলে বসবেন। দেখবেন, কোথাও না কোথাও তিনি আপনার জন্যই, আপনার সময়ের জন্যই লিখে রেখেছেন—

“দিল না-উমিদ তো নহিঁ, নাকাম হি তো হ্যায়,
লম্বি হ্যায় গম কি শাম, মগর শাম হি তো হ্যায়।”

(মন আশাহত নয়, শুধু ব্যর্থই তো হয়েছে,
দুঃখের সন্ধ্যাটা দীর্ঘ, কিন্তু সে তো কেবল একটি সন্ধ্যাই।)

এই একটি সন্ধ্যা কেটে যাবে। নতুন ভোর আসবে। এই ভরসাটুকুই তো ফয়েজ আহমদ ফয়েজ। চাঁদের দিকে তাকিয়ে যিনি ক্ষুধার্তের জন্য ‘ঝলসানো রুটি’ দেখতে পেতেন, তিনিই আবার সেই চাঁদকে ভোরের আলোর দূত হিসেবেও চিনতে পারতেন। এই দ্বৈততা, এই সংবেদনশীলতা আর এই অদম্য আশাবাদই তাঁকে অমর করে রেখেছে।

তথ্যসূত্র

  • Ali, A. S. (2009). The rebel’s silhouette: Selected poems by Faiz Ahmed Faiz. Gibbs Smith.
  • Coppola, C. (1981). Urdu poetry, 1935-1970: The progressive episode. Vanguard Books.
  • Faiz, A. (1989). Over my shoulder. Sang-e-Meel Publications.
  • Faiz, F. A. (2007). Nuskha-ha-ye-wafa (Collected Works). Maktaba-e-Danyal. (Original works collection for thematic analysis).
  • Hashmi, A. M. (2016). Love and revolution: Faiz Ahmed Faiz: The authorized biography. Rupa Publications India.
  • Kiernan, V. G. (Trans.). (1971). Poems by Faiz. George Allen & Unwin.
  • Russell, R. (1992). The pursuit of the Urdu Ghazal. Zed Books. (Provides context for how Faiz transformed the ghazal form).
  • Zaheer, H. (2006). The times and trial of the Rawalpindi Conspiracy 1951: The first coup attempt in Pakistan. Oxford University Press.

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.