কার্ল মার্ক্স ও তার মার্ক্সবাদ: যা পৃথিবীকে ঝাঁকিয়ে দিয়েছে

Table of Contents

ভূমিকা

চায়ের দোকানের সাদামাটা কাপে ঝড় ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সেমিনার রুমে জ্বালাময়ী বিতর্ক হয়। কারখানার ক্লান্ত শ্রমিকের দীর্ঘশ্বাসে তাঁর নাম ভাসে, আবার কর্পোরেট জগতের উঁচু তলার কর্তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে তাঁরই তত্ত্ব। পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কম চিন্তাবিদ আছেন যাঁকে নিয়ে এমন নিরন্তর তোলপাড় হয়েছে। কেউ তাঁকে দেখেন শোষিত, বঞ্চিত, সর্বহারা মানুষের মুক্তির দিশারী হিসেবে, এক নতুন পৃথিবীর স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে। আবার কেউ তাঁকে দেখেন মানব ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী ও ভয়ঙ্কর একনায়কতন্ত্রের মতাদর্শিক জনক হিসেবে। প্রশংসা বা নিন্দা, ফুল বা কাঁটা—যা-ই জুটুক না কেন, তাঁকে উপেক্ষা করার কোনো উপায় নেই। ভদ্রলোকের নাম কার্ল হাইনরিখ মার্ক্স। ঝাঁকড়া চুল আর ঋষিসুলভ রাশভারী দাড়ির আড়ালে লুকিয়ে থাকা তাঁর তীক্ষ্ণ চোখ দুটো যেন আজও মানব সমাজের গভীরতম অসুখগুলোকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে, তার নাড়ি টিপে রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা করছে।

মার্ক্সকে বোঝাটা একবারে বসেই হজম করে ফেলার মতো কোনো সহজ বিষয় নয়। ব্যাপারটা অনেকটা গভীর সমুদ্রে ডুব দেওয়ার মতো। তাঁর লেখালেখি উনবিংশ শতাব্দীর জার্মান দর্শন, ফরাসি সমাজতন্ত্রের বিপ্লবী চেতনা আর ব্রিটিশ ধ্রুপদী অর্থনীতির এক জটিল, প্রায়শই দুর্বোধ্য ককটেল। কিন্তু ভয় পাওয়ার কিছু নেই। চলুন, আমরা একদম সহজ ভাষায়, গল্পের ছলে, ডুবসাঁতার কেটে এই জটিল মানুষটার চিন্তার জগতে প্রবেশ করি। চেষ্টা করে দেখি, কী এমন কথা তিনি বলেছিলেন যা প্রায় পৌনে দুশো বছর পরেও মানুষকে ভাবায়, উস্কে দেয়, স্বপ্ন দেখায়, এবং ভয়ও দেখায়।

মার্ক্স মানুষটা কে ছিলেন? (The Man Behind the Beard)

যেকোনো দর্শনের গভীরে যাওয়ার আগে তার স্রষ্টা মানুষটাকে একটু চিনে নেওয়া ভালো। কারণ কোনো চিন্তাই শূন্য থেকে জন্মায় না, তার পেছনে থাকে একজন রক্ত-মাংসের মানুষ, তাঁর সময়, তাঁর সংগ্রাম আর তাঁর ব্যক্তিগত যাপন।

কার্ল মার্ক্স জন্মেছিলেন ১৮১৮ সালের ৫ই মে, তৎকালীন প্রুশিয়ার (আজকের জার্মানি) এক শান্ত, প্রাচীন শহর ট্রিয়ারে। তাঁর বাবা, হার্শেল মার্ক্স, ছিলেন একজন সফল এবং উদারপন্থী আইনজীবী। ইহুদি পরিবারে জন্ম হলেও, সেই সময়ে ইহুদিদের প্রতি সামাজিক ও পেশাগত বৈষম্যের কারণে তিনি প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হন এবং নিজের নাম বদলে হাইনরিখ মার্ক্স রাখেন। এই ঘটনাটি ছোট্ট কার্লের মনে হয়তো রাষ্ট্র ও ধর্মের সম্পর্ক নিয়ে প্রথম প্রশ্নবীজ বুনে দিয়েছিল।

মার্ক্স আইন নিয়েই পড়াশোনা শুরু করেছিলেন বন বিশ্ববিদ্যালয়ে, বাবার ইচ্ছায়। কিন্তু আইনশাস্ত্রের শুকনো কচকচানিতে তাঁর মন বসছিল না। তাঁর মন পড়ে ছিল দর্শন আর ইতিহাসের রহস্যময় জগতে। তাই তিনি পাড়ি জমান বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে, যা তখন ছিল দর্শনের মক্কা। এখানেই তিনি জর্জ ভিলহেলম ফ্রিডরিখ হেগেল (Georg Wilhelm Friedrich Hegel) নামের এক অতিকায় জার্মান দার্শনিকের চিন্তার প্রেমে পড়েন। সে এক সাংঘাতিক প্রেম! হেগেলের দর্শন তখন জার্মানির তরুণ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে রীতিমতো ঝড় তুলেছে। মার্ক্স সেই ঝড়ের কেন্দ্রে থাকা ‘তরুণ হেগেলীয়’দের (Young Hegelians) দলে ভিড়ে গেলেন। এঁরা হেগেলের দর্শনকে আরও বিপ্লবী এবং নাস্তিক্যবাদী পথে চালিত করতে চাইতেন।

তবে মার্ক্স শুধু বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে থাকা কেতাবি দার্শনিক ছিলেন না। তাঁর রক্তে ছিল বিদ্রোহ। অল্প সময়ের মধ্যেই সাংবাদিক হিসেবে তাঁর ক্ষুরধার ও সমালোচনামূলক লেখনী প্রুশীয় সরকারের সেন্সরশিপের রোষানলে পড়ে। ফলাফল—‘রাইনিশে সাইটুং’ (Rheinische Zeitung) নামের যে পত্রিকার তিনি সম্পাদক ছিলেন, তা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং মার্ক্স কার্যত রাজনৈতিক শরণার্থী হিসেবে প্যারিসে নির্বাসনে যেতে বাধ্য হন।

প্যারিসেই তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটে। ১৮৪৪ সালে, সেখানেই তাঁর সাথে পরিচয় ও গভীর বন্ধুত্ব হয় ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের (Friedrich Engels) সাথে। এঙ্গেলস ছিলেন ম্যানচেস্টারের এক ধনী শিল্পপতির ছেলে, কিন্তু তাঁর সংবেদনশীল মন কাঁদত পুঁজিবাদের যাঁতাকলে পিষ্ট শ্রমিকদের দুঃখে। মার্ক্সের বিপ্লবী দার্শনিক গভীরতা আর এঙ্গেলসের পুঁজিবাদের ভেতরের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও আর্থিক সহায়তা মিলে এক নতুন শক্তির জন্ম দিল, যা পৃথিবীকে বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখত। এই বন্ধুত্ব ছিল এক অদ্ভূত বুদ্ধিবৃত্তিক ও ব্যক্তিগত মেলবন্ধন, যা টিকে ছিল মার্ক্সের আমৃত্যু।

মার্ক্সের ব্যক্তিগত জীবনও ছিল ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ। তিনি ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন তাঁর ছোটবেলার খেলার সাথী, অভিজাত পরিবারের মেয়ে জেনি ফন ভেস্টফালেনকে (Jenny von Westphalen)। জেনি তাঁর স্বামীর বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের জন্য নিজের আরামের জীবন বিসর্জন দিয়ে আজীবন তাঁর পাশে ছিলেন। এরপর ব্রাসেলস, আবার জার্মানিতে ফেরা এবং ১৮৪৮ সালের ব্যর্থ বিপ্লবের পর শেষ পর্যন্ত লন্ডনে স্থায়ী নির্বাসন।

লন্ডনের জীবন ছিল দুঃসহ দারিদ্র্য, অসুস্থতা আর হতাশায় ভরা। মার্ক্সের বেশ কয়েকটি সন্তান অপুষ্টি ও চিকিৎসার অভাবে শিশুকালেই মারা যায়। অনেক সময় পাওনাদারের ভয়ে বাড়ির বাইরে বেরোতে পারতেন না, ঘরের আসবাবপত্র পর্যন্ত বন্ধক রাখতে হয়েছিল। এই চরম দুর্দশার মধ্যেও একটি কাজ তিনি নিষ্ঠার সাথে করে গেছেন—পড়াশোনা। ব্রিটিশ মিউজিয়ামের সুবিশাল লাইব্রেরিতে বসে তিনি দিনের পর দিন, বছরের পর বছর পড়াশোনা আর লেখালেখি করে কাটিয়েছেন। এই কঠিন জীবনের তপস্যারই ফসল তাঁর শ্রেষ্ঠ কাজগুলো—‘দ্য কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো’ (The Communist Manifesto) (এঙ্গেলসের সাথে যৌথভাবে) এবং তিন খণ্ডের মহাকাব্যিক গ্রন্থ ‘ডাস ক্যাপিটাল’ (Das Kapital) বা ‘পুঁজি’। ১৮৮৩ সালে, লন্ডনের হাইগেট কবরস্থানে এই বর্ণময় ও সংগ্রামী জীবনের অবসান ঘটে। তাঁর সমাধির ওপর লেখা আছে তাঁরই বিখ্যাত উক্তি: “এযাবৎ দার্শনিকেরা কেবল বিশ্বকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যাই করেছেন, কিন্তু আসল প্রশ্ন হলো একে পরিবর্তন করা” (The philosophers have only interpreted the world, in various ways; the point is to change it)।

মার্ক্সের রেসিপি: যে আঁচে তৈরি হয়েছিল এক বিপ্লবী দর্শন

কোনো চিন্তাই আকাশ থেকে টুপ করে পড়ে না। প্রতিটি বড় দর্শনের পেছনে থাকে একটি যুগ, একটি সময়ের উত্তাপ আর কিছু পুরনো চিন্তার স্রোত। ব্যাপারটা অনেকটা জাদুকরের রান্নার মতো। নানা রকম মশলা, নানা উপাদান মিশে গিয়ে এক অদ্ভুতুড়ে কিন্তু শক্তিশালী মিশ্রণ তৈরি হয়। কার্ল মার্ক্সের দর্শনও ঠিক তেমনই এক মিশ্রণ। তাঁর চিন্তার আগুন জ্বলে উঠেছিল উনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপের উত্তাল রাজনৈতিক কড়াইয়ে, আর তাতে রসদ জুগিয়েছিল তিনটি প্রধান ঝরনাধারা: জার্মান দর্শন, ফরাসি সমাজতন্ত্র আর ব্রিটিশ অর্থনীতি

এই তিনটি স্রোত কীভাবে এবং কেন এসে মার্ক্সের চিন্তার মহাসমুদ্রে মিশেছিল, সেই গল্পটা না জানলে মার্ক্সকে পুরোপুরি বোঝা প্রায় অসম্ভব। চলুন, সেই গল্পটাই আজ সহজ করে বলার চেষ্টা করা যাক। দেখাই যাক, কী এমন ঘটেছিল সে যুগে, আর কোন কোন চিন্তাবিদদের কাঁধে ভর করে মার্ক্স তাঁর নিজের মহীরুহ সমান দর্শনকে দাঁড় করিয়েছিলেন।

যে কড়াইয়ে রান্না হয়েছিল—উনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপ

মার্ক্সের চিন্তাকে বুঝতে হলে প্রথমে সেই সময়টার ছবিটা আমাদের চোখের সামনে ভাসাতে হবে। উনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপ ছিল এক বিশাল তোলপাড়ের যুগ। দুটি যুগান্তকারী ঘটনা এর ভিতকে নাড়িয়ে দিয়েছিল।

১. ফরাসি বিপ্লবের ভূত (The Ghost of the French Revolution): ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব শুধু ফ্রান্সের রাজতন্ত্রকেই উৎখাত করেনি, এটি পুরো ইউরোপের বুকে সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার (Liberty, Equality, Fraternity) এক অবিনাশী স্বপ্ন বুনে দিয়েছিল। এই বিপ্লব প্রমাণ করেছিল যে, ঈশ্বরপ্রদত্ত রাজক্ষমতা বা হাজার বছরের পুরনো সমাজব্যবস্থা কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়। জনগণ চাইলে যে কোনো ব্যবস্থাকেই পাল্টে দিতে পারে।

মার্ক্স যখন বড় হচ্ছেন, তখন ফরাসি বিপ্লবের ঢেউ কিছুটা স্তিমিত হলেও তার বিপ্লবী চেতনা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। ‘অধিকার’, ‘নাগরিক’, ‘বিপ্লব’, ‘জাতি’—এই শব্দগুলো তখন ইউরোপের তরুণদের রক্তে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। মার্ক্স এই বিপ্লবী উত্তরাধিকারকেই আত্মস্থ করেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, ইতিহাস স্থির নয়, একে ধাক্কা দিয়ে পরিবর্তন করা সম্ভব। কিন্তু তাঁর প্রশ্ন ছিল, ফরাসি বিপ্লব যে সাম্য আর স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা কি অর্জিত হয়েছে? বুর্জোয়ারা তো ক্ষমতা পেয়েছে, কিন্তু সাধারণ মানুষ, শ্রমিকদের মুক্তি কোথায়? এই অতৃপ্তিই তাঁকে এক নতুন, আরও গভীরতর বিপ্লবের দিকে ঠেলে দিয়েছিল।

২. শিল্প বিপ্লবের ধোঁয়া ও যন্ত্রণা (The Smoke and Pain of the Industrial Revolution): মার্ক্সের চিন্তার সবচেয়ে বড় প্রেক্ষাপট ছিল শিল্প বিপ্লব। বাষ্পীয় ইঞ্জিন, নতুন নতুন যন্ত্রপাতি আর কারখানার বিস্তার ইউরোপের চেহারাটাই পাল্টে দিচ্ছিল। একদিকে উৎপাদন বাড়ছিল হু হু করে, তৈরি হচ্ছিল বিপুল সম্পদ, জন্ম নিচ্ছিল এক নতুন শক্তিশালী শ্রেণী—শিল্পপতি বা বুর্জোয়া (Bourgeoisie)।

কিন্তু মুদ্রার অপর পিঠ ছিল ভয়ংকর। গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হওয়া নিঃস্ব মানুষ কাজের খোঁজে শহরের নোংরা, অস্বাস্থ্যকর বস্তিতে এসে ভিড় করছিল। জন্ম নিচ্ছিল এক নতুন শ্রেণী—কারখানার শ্রমিক বা সর্বহারা (Proletariat)। তাদের জীবন ছিল দুঃসহ। দিনে ১২-১৪ ঘণ্টা অমানবিক পরিশ্রম, সামান্য মজুরি, কোনো নিরাপত্তা বা অধিকারের বালাই নেই। নারী ও শিশুদের শোষণ ছিল আরও মর্মান্তিক। শহরের বাতাস কারখানার কালো ধোঁয়ায় ভারী, আর মানুষের জীবন দারিদ্র্য আর হতাশায় অন্ধকার।

মার্ক্স তাঁর জীবনের একটা বড় অংশ কাটিয়েছেন শিল্প বিপ্লবের কেন্দ্রভূমি লন্ডনে। তিনি নিজের চোখে এই বৈষম্য আর যন্ত্রণা দেখেছেন। ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের লেখা ‘দ্য কন্ডিশন অব দ্য ওয়ার্কিং ক্লাস ইন ইংল্যান্ড’ (The Condition of the Working Class in England) বইটি তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে (Engels, 1845)। এই ভয়ংকর বাস্তবতাই তাঁকে প্রশ্ন করতে বাধ্য করেছিল—এই যে বিপুল সম্পদ তৈরি হচ্ছে, তা যাচ্ছে কোথায়? কেন যারা এই সম্পদ তৈরি করছে, সেই শ্রমিকরাই সবচেয়ে বঞ্চিত? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই তিনি তাঁর দর্শনের কাঠামো তৈরি করেন।

চিন্তার প্রথম স্রোত—জার্মান দর্শন (The German Philosophical Stream)

মার্ক্সের দর্শনের মস্তিষ্ক বা পদ্ধতিটা এসেছিল তাঁর নিজের দেশ জার্মানি থেকেই। দুজন দার্শনিক এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

জর্জ ভিলহেলম ফ্রিডরিখ হেগেল (Georg Wilhelm Friedrich Hegel): যে দৈত্যের কাঁধে চড়েছিলেন মার্ক্স

মার্ক্স যৌবনে ছিলেন হেগেলের একনিষ্ঠ ভক্ত। হেগেল ছিলেন সেই সময়ের জার্মানির সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক। তাঁর কাছ থেকেই মার্ক্স তাঁর দর্শনের মূল হাতিয়ারটি ধার করেছিলেন—দ্বন্দ্ববাদ বা ডায়ালেকটিক্স (Dialectics)

হেগেল শিখিয়েছিলেন, জগৎ স্থির নয়, এটি নিরন্তর পরিবর্তনশীল। আর এই পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটি চলে দ্বন্দ্বের মাধ্যমে। প্রতিটি অবস্থা বা ভাবনা বা থিসিসের (Thesis) অন্তরেই তার একটি বিপরীত অবস্থা বা অ্যান্টিথিসিস (Antithesis) থাকে। এই দুইয়ের সংঘাতের ফলে একটি নতুন, উন্নততর অবস্থা বা সিন্থেসিসের (Synthesis) জন্ম হয়। এই সিন্থেসিস আবার নতুন থিসিসে পরিণত হয় এবং এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকে। ইতিহাস এভাবেই এগিয়ে চলে।

মার্ক্সের কাছে এই ধারণাটি যুগান্তকারী মনে হয়েছিল। তিনি বুঝলেন, পুঁজিবাদও চিরস্থায়ী নয়, এর ভেতরেই এর ধ্বংসের বীজ, অর্থাৎ তার বিপরীত শক্তি (সর্বহারা শ্রেণী) লুকিয়ে আছে। কিন্তু হেগেলের সাথে তাঁর একটা মস্ত বড় বিরোধ ছিল। হেগেল ছিলেন ভাববাদী (Idealist)। তাঁর মতে, এই দ্বন্দ্বের চালিকাশক্তি হলো ‘ভাব’ বা ‘চেতনা’ (Idea/Spirit)। জগৎ হলো ভাবেরই প্রকাশ।

মার্ক্স বললেন, এখানেই হেগেল ভুল করেছেন। তিনি মাথা দিয়ে হাঁটছেন। মার্ক্স হেগেলের এই দ্বন্দ্বমূলক পদ্ধতিকে নিলেন, কিন্তু তাঁর ভাববাদকে ছুড়ে ফেলে দিলেন। তিনি বললেন, চালিকাশক্তি ‘ভাব’ নয়, ‘বস্তু’ (Matter) বা বাস্তব জীবন। মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থাই তার চেতনাকে তৈরি করে, চেতনা অর্থনৈতিক অবস্থাকে নয়। এভাবেই তিনি হেগেলের দ্বন্দ্ববাদকে ‘মাথা থেকে পায়ে’ দাঁড় করালেন এবং তৈরি হলো তাঁর দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ (Dialectical Materialism)। তিনি হেগেলের কাছ থেকে নিলেন ‘কীভাবে পরিবর্তন হয়’ (দ্বন্দ্ব), কিন্তু ‘কী পরিবর্তন হয়’—এর উত্তরে বললেন ‘বস্তুগত জগৎ’।

লুডভিগ ফয়েরবাখ (Ludwig Feuerbach): ভাববাদ থেকে বস্তুবাদে উত্তরণের সেতু

হেগেলের ভাববাদের দুর্ভেদ্য দুর্গ থেকে মার্ক্সকে বস্তুবাদে নামিয়ে আনার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন আরেক জার্মান দার্শনিক লুডভিগ ফয়েরবাখ। ফয়েরবাখ ছিলেন তরুণ হেগেলীয়দের (Young Hegelians) একজন, যিনি হেগেলের ভাববাদের কড়া সমালোচনা করেন।

ফয়েরবাখের সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ ছিল ধর্মের সমালোচনা। তিনি তাঁর ‘দ্য এসেন্স অব ক্রিশ্চিয়ানিটি’ (The Essence of Christianity) বইতে বলেন, ঈশ্বর মানুষকে সৃষ্টি করেননি, বরং মানুষই তার নিজের কল্পনা ও সেরা গুণগুলোকে দিয়ে ঈশ্বরকে সৃষ্টি করেছে (Feuerbach, 1841)। মানুষ তার নিজের শক্তি, ভালোবাসা, জ্ঞানকে নিজের থেকে বিচ্ছিন্ন করে এক কাল্পনিক সত্তা ‘ঈশ্বরে’র ওপর আরোপ করে এবং তারপর সেই কাল্পনিক সত্তার উপাসনা করে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষ নিজের প্রকৃত সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন (alienated) হয়ে পড়ে।

এই ধারণাটি মার্ক্সের ওপর বজ্রপাতের মতো প্রভাব ফেলে। তিনি ফয়েরবাখের কাছ থেকে দুটি জিনিস নিলেন: এক, বস্তুবাদ (Materialism)—অর্থাৎ ভাব নয়, বস্তুই প্রধান। দুই, বিচ্ছিন্নতাবোধ (Alienation)-এর ধারণা। মার্ক্স ভাবলেন, ফয়েরবাখ যা ধর্মের ক্ষেত্রে বলেছেন, তা তো পুঁজিবাদের ক্ষেত্রেও সত্যি! শ্রমিক তার শ্রম দিয়ে পণ্য তৈরি করে, কিন্তু সেই পণ্য তার নিজের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং একসময় সেই পণ্যের বাজারই তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষ ঈশ্বরের বদলে টাকার পূজা শুরু করে।

কিন্তু মার্ক্স ফয়েরবাখের সমালোচনাও করেন। তিনি তাঁর বিখ্যাত ‘থিসিস অন ফয়েরবাখ’ (Theses on Feuerbach)-এ বলেন, ফয়েরবাখের বস্তুবাদ নিষ্ক্রিয় (contemplative)। ফয়েরবাখ জগৎকে শুধু ব্যাখ্যা করেছেন, কিন্তু আসল কাজ তো জগৎকে পরিবর্তন করা (Marx, 1845)। এখানেই মার্ক্স নিছক দার্শনিক থেকে বিপ্লবী হয়ে ওঠেন।

চিন্তার দ্বিতীয় স্রোত—ফরাসি সমাজতন্ত্র (The French Socialist Stream)

মার্ক্সের দর্শনের ‘হৃদয়’ বা তার আবেগ ও লক্ষ্যের অনুপ্রেরণা এসেছিল ফ্রান্স থেকে। ফরাসি বিপ্লব রাজনৈতিক সাম্য আনলেও অর্থনৈতিক অসাম্যকে দূর করতে পারেনি। এই প্রেক্ষাপটে ফ্রান্সে এমন একদল চিন্তাবিদের আবির্ভাব হয়, যাঁরা পুঁজিবাদের তীব্র সমালোচনা করেন এবং এক নতুন, শোষণহীন সমাজের স্বপ্ন দেখেন। এঁদেরকে বলা হয় কল্পলৌকিক বা ইউটোপিয়ান সমাজতন্ত্রী (Utopian Socialists)

এঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন তিনজন:

  • সাঁ-সিমোঁ (Henri de Saint-Simon): তিনি স্বপ্ন দেখতেন এমন এক সমাজের, যেখানে সমাজের নেতৃত্ব দেবে শিল্পপতি ও বিজ্ঞানীরা, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া আলসে অভিজাতরা নয়। তাঁর লক্ষ্য ছিল সমাজের সবচেয়ে দরিদ্র শ্রেণীর উন্নতি।

  • শার্ল ফুরিয়ে (Charles Fourier): তিনি ছিলেন এক অদ্ভুত কল্পনাবিলাসী। তিনি পুঁজিবাদের অমানবিক শ্রমবিভাগ এবং একঘেয়েমির তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি ‘ফ্যালানস্টেরি’ (Phalanstery) নামে ছোট ছোট স্বয়ংসম্পূর্ণ কলোনির স্বপ্ন দেখতেন, যেখানে মানুষ তার পছন্দের কাজ করবে এবং আনন্দের সাথে জীবন কাটাবে।

  • রবার্ট ওয়েন (Robert Owen): ইনি নিজে একজন শিল্পপতি হয়েও শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতিতে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি তাঁর কারখানায় শিশুশ্রম বন্ধ করেন, শ্রমঘণ্টা কমান এবং শ্রমিকদের জন্য স্কুল ও ভালো বাসস্থানের ব্যবস্থা করেন। তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে, মানবিক পরিবেশ দিলেও মুনাফা করা সম্ভব।

মার্ক্স ও এঙ্গেলস এই ইউটোপিয়ানদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছিলেন। তাঁরা পুঁজিবাদের অমানবিকতার তীব্র সমালোচনা, ব্যক্তিগত মালিকানার বিরোধিতা এবং এক শোষণহীন সমবায়ী সমাজের ধারণা এঁদের কাছ থেকেই পেয়েছিলেন (Marx & Engels, 1848)।

কিন্তু মার্ক্স এঁদেরকে ‘ইউটোপিয়ান’ বা ‘কল্পনাবিলাসী’ বলে সমালোচনাও করেছেন। কারণ, এঁদের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিল না। এঁরা মনে করতেন, ধনী ব্যক্তিদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বা ভালো উদাহরণ তৈরি করেই সমাজকে বদলে ফেলা যাবে। তাঁরা ইতিহাসের নিয়ম বা শ্রেণী সংগ্রামের গুরুত্ব বুঝতেন না। মার্ক্স তাঁদের স্বপ্নকে সম্মান করলেও, তাঁদের পথকে অবৈজ্ঞানিক বলে মনে করতেন। তিনি চাইলেন এমন এক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে, যা হবে বৈজ্ঞানিক (Scientific Socialism), যা ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণের ওপর দাঁড়িয়ে থাকবে।

চিন্তার তৃতীয় স্রোত—ব্রিটিশ ধ্রুপদী অর্থনীতি (British Classical Economy)

মার্ক্সের দর্শনের কঙ্কাল বা অর্থনৈতিক কাঠামোর ভিত্তি এসেছিল ব্রিটেন থেকে। শিল্প বিপ্লবের কেন্দ্রভূমি হিসেবে ব্রিটেনেই পুঁজিবাদের নিয়মকানুন নিয়ে প্রথম গভীর বিশ্লেষণ শুরু হয়। এই ধারার দুজন প্রধান অর্থনীতিবিদ হলেন অ্যাডাম স্মিথ (Adam Smith) এবং ডেভিড রিকার্ডো (David Ricardo)

তাঁরা দুজনেই পুঁজিবাদের সমর্থক ছিলেন, কিন্তু তাঁদের বিশ্লেষণ ছিল খুবই গভীর। তাঁদের কাছ থেকেই মার্ক্স তাঁর অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারণাটি গ্রহণ করেন—শ্রম-মূল্য তত্ত্ব (Labour Theory of Value)। স্মিথ ও রিকার্ডো দেখান যে, যেকোনো পণ্যের বিনিময় মূল্য (exchange value) শেষ পর্যন্ত তার মধ্যে থাকা শ্রমের পরিমাণ দ্বারা নির্ধারিত হয় (Ricardo, 1817)।

মার্ক্স এই তত্ত্বটিকে নিলেন এবং তাকে বিপ্লবী উদ্দেশ্যে ব্যবহার করলেন। তিনি প্রশ্ন তুললেন, যদি শ্রমই সমস্ত মূল্য সৃষ্টি করে, তাহলে শ্রমিক কেন তার শ্রমের পূর্ণ মূল্য পায় না? মুনাফা (Profit) জিনিসটা তাহলে আসে কোথা থেকে?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই তিনি তাঁর যুগান্তকারী ‘উদ্বৃত্ত মূল্য’ (Surplus Value)-এর তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। তিনি দেখান যে, পুঁজিপতি শ্রমিককে তার শ্রমের মূল্য দেয় না, দেয় তার শ্রমশক্তির (labour power) মূল্য, যা শ্রমিককে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় খরচের সমান। কিন্তু শ্রমিক তার মজুরির সমান মূল্য তৈরি করার পরেও কাজ করে যায়। এই অতিরিক্ত শ্রমের মাধ্যমে যে উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি হয়, সেটাই পুঁজিপতি আত্মসাৎ করে। এভাবেই স্মিথ ও রিকার্ডোর অর্থনৈতিক তত্ত্বকে ব্যবহার করে মার্ক্স পুঁজিবাদের শোষণের গোপন রহস্যটি উন্মোচন করেন (Marx, 1867)। তিনি পুঁজিবাদের সমর্থকদের তৈরি করা অস্ত্র দিয়েই পুঁজিবাদের হৃৎপিণ্ডে আঘাত হানেন।

যেখানে সব স্রোত এসে মিশে গেল

তাহলে দেখা যাচ্ছে, কার্ল মার্ক্স কোনো শূন্য থেকে গজিয়ে ওঠা চিন্তাবিদ ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ সংশ্লেষক (synthesizer)। তিনি জার্মান দর্শন থেকে নিলেন দ্বন্দ্বমূলক পদ্ধতি, ফরাসি সমাজতন্ত্র থেকে নিলেন শোষণহীন সমাজের স্বপ্ন ও বিপ্লবী আবেগ, আর ব্রিটিশ অর্থনীতি থেকে নিলেন পুঁজিবাদের ব্যবচ্ছেদের বৈজ্ঞানিক হাতিয়ার।

এই তিনটি উপাদানকে তিনি উনবিংশ শতাব্দীর উত্তাল রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার কড়াইয়ে ফেলে নিজের মৌলিক চিন্তার আঁচে এক নতুন ও বিস্ফোরক দর্শন তৈরি করলেন। তিনি হেগেলের মতো শুধু জগৎকে ব্যাখ্যা করতে চাননি, ফয়েরবাখের মতো শুধু সমালোচনাতেও সন্তুষ্ট থাকেননি, বা ইউটোপিয়ানদের মতো শুধু স্বপ্ন দেখেই থেমে যাননি। তিনি চেয়েছেন জগৎকে বৈজ্ঞানিকভাবে বুঝতে এবং সেই বোঝার ওপর ভিত্তি করে তাকে বিপ্লবী পথে পরিবর্তন করতে।

তাঁর এই রেসিপি সফল হয়েছিল কি না, তা নিয়ে বিতর্ক আজও চলছে। কিন্তু এটা অনস্বীকার্য যে, এই তিনটি স্রোতধারার সঙ্গম ছাড়া কার্ল মার্ক্সের দর্শনকে কল্পনাও করা যায় না। এই প্রভাবগুলোই সেই জমি তৈরি করেছিল, যেখানে দাঁড়িয়ে একজন ঝাঁকড়া চুলের মানুষ পৃথিবীকে বদলে দেওয়ার এক ভয়ংকর সুন্দর স্বপ্ন দেখতে পেরেছিলেন।

দর্শনের মূল ভিত্তি – দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ (Dialectical Materialism)

মার্ক্সের সুবিশাল চিন্তার অট্টালিকায় প্রবেশ করতে হলে তার মূল দরজাটা আগে খুঁজে বের করতে হবে। সেই দরজার নাম দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ (Dialectical Materialism)। এই দুটি আপাত কঠিন শব্দকে বুঝতে পারলেই মার্ক্সের বাকি চিন্তা বোঝাটা অনেক সহজ হয়ে যাবে।

দ্বন্দ্ব (Dialectic): পরিবর্তনের নিয়ম

‘দ্বন্দ্ব’ বা ডায়ালেকটিকসের ধারণাটি মার্ক্স ধার করেছিলেন তাঁর গুরু হেগেলের কাছ থেকে। হেগেল বিশ্বাস করতেন, ইতিহাস বা জগতের সমস্ত পরিবর্তন হয় চিন্তার (Idea) বা চেতনার (Consciousness) মাধ্যমে। তাঁর মতে, প্রতিটি চিন্তার (যাকে তিনি বলতেন Thesis) একটি অন্তর্নিহিত বিপরীত চিন্তা (Antithesis) থাকে। এই দুই বিপরীত চিন্তার সংঘাত ও সমন্বয়ের মাধ্যমে একটি নতুন এবং উন্নততর চিন্তার (Synthesis) জন্ম হয়। এই নতুন চিন্তাটি আবার একটি নতুন Thesis-এ পরিণত হয়, তারও একটি Antithesis জন্মায় এবং প্রক্রিয়াটি চলতেই থাকে। এই নিরন্তর দ্বন্দ্বের মাধ্যমেই চিন্তা ও জগৎ বিকশিত হয়। যেমন: ‘স্বৈরতন্ত্র’ (Thesis) তার গর্ভেই তার বিপরীত ধারণা ‘গণতান্ত্রিক বিপ্লব’ (Antithesis) ধারণ করে এবং এই দুইয়ের প্রচণ্ড সংঘাতের ফলে তৈরি হয় একটি ‘সাংবিধানিক রাষ্ট্র’ (Synthesis)। এটা হলো হেগেলের দ্বন্দ্বমূলক ভাববাদ (Dialectical Idealism), কারণ এখানে মূল চালিকাশক্তি হলো ‘ভাব’ বা ‘চিন্তা’।

বস্তুবাদ (Materialism): জগৎ কী দিয়ে তৈরি?

মার্ক্স হেগেলের এই দ্বন্দ্বের ধারণাটাকে গ্রহণ করলেন, কিন্তু একে আক্ষরিক অর্থেই ‘মাথা থেকে পায়ে’ দাঁড় করালেন। তিনি বিখ্যাত উক্তিটি করলেন, হেগেল মাথা নিচে আর পা উপরে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁকে সোজা করে দাঁড় করাতে হবে। মার্ক্স বললেন, ইতিহাসের মূল চালিকাশক্তি কোনো বিমূর্ত ‘চিন্তা’, ‘ভাব’ বা ঈশ্বর-নিরপেক্ষ কোনো ‘পরমাত্মা’ (Absolute Spirit) নয়। মূল চালিকাশক্তি হলো ‘বস্তু’ (Matter) বা আমাদের চারপাশের বাস্তব, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, পারিপার্শ্বিক জগৎ।

এখানে ‘বস্তু’ বলতে শুধু ইট-কাঠ-পাথর বোঝাচ্ছে না। এখানে বস্তু বলতে বোঝানো হচ্ছে মানুষের বেঁচে থাকার বাস্তব শর্তগুলো—তার অর্থনীতি, তার উৎপাদন পদ্ধতি, তার সামাজিক সম্পর্ক। মার্ক্স তাঁর বন্ধু এঙ্গেলসের সাথে লেখা ‘দ্য জার্মান আইডিওলজি’ বইতে পরিষ্কার করে বলেন, “মানুষের চেতনা তার অস্তিত্বকে নির্ধারণ করে না, বরং উল্টো, মানুষের সামাজিক অস্তিত্বই তার চেতনাকে নির্ধারণ করে” (It is not the consciousness of men that determines their being, but, on the contrary, their social being that determines their consciousness) (Marx & Engels, 1846)।

সহজ কথায়, আমরা কী খাব, কী পরব, কীভাবে উৎপাদন করব, কার জন্য উৎপাদন করব—এই বাস্তব, জাগতিক বিষয়গুলোই আমাদের চিন্তা, আমাদের আইন, রাজনীতি, ধর্ম, দর্শন, নৈতিকতা, শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে। আগে পেট, তারপর অন্যকিছু। এটাই হলো বস্তুবাদ (Materialism)।

এই দুইয়ে মিলে তৈরি হলো মার্ক্সের দর্শনের ভিত্তি—দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ (Dialectical Materialism)। অর্থাৎ, বস্তুগত জগতের ভেতরেই দ্বন্দ্ব বা সংঘাত নিহিত থাকে এবং এই দ্বন্দ্বের ফলেই জগৎ ও সমাজ পরিবর্তিত হয়, বিকশিত হয়। এটি কোনো আকাশ থেকে পড়া বিমূর্ত ধারণা নয়, বরং বাস্তব পৃথিবীর পরিবর্তনের বৈজ্ঞানিক নিয়ম। যেমন, জলের পরিমাণগত (quantitative) তাপমাত্রা বাড়তে বাড়তে ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছালে তা এক লাফে গুণগতভাবে (qualitatively) বাষ্পে পরিণত হয়। সমাজের পরিবর্তনও ঠিক এভাবেই ঘটে—ছোট ছোট পরিমাণগত পরিবর্তন জমতে জমতে একসময় একটা গুণগত উল্লম্ফন বা বিপ্লব ঘটায়।

দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে যান এখানে – দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ: যে চশমায় পৃথিবীকে অন্যভাবে দেখা যায়

ইতিহাসের চালিকাশক্তি—ঐতিহাসিক বস্তুবাদ (Historical Materialism)

দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের এই সাধারণ তত্ত্বকে যখন মার্ক্স বিশেষভাবে মানব ইতিহাসের বিশ্লেষণে প্রয়োগ করলেন, তখন তার নাম হলো ঐতিহাসিক বস্তুবাদ (Historical Materialism)। মার্ক্সের মতে, মানব ইতিহাস কোনো রাজা-বাদশার খামখেয়ালিপূর্ণ গল্প, বীরদের বীরত্বগাথা বা বিচ্ছিন্ন ঘটনার বিশৃঙ্খল সমষ্টি নয়। এর একটি নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক প্যাটার্ন আছে, এর একটি অভ্যন্তরীণ যুক্তি আছে। এই ইতিহাসের মূল চালিকাশক্তি হলো উৎপাদন ব্যবস্থা (Mode of Production)

ব্যাপারটা বোঝার জন্য একটা বাড়ির কথা ভাবুন। বাড়ির দুটো অংশ থাকে—ভিত্তি (Base) এবং উপরিকাঠামো (Superstructure)।

১. ভিত্তি (Base): মার্ক্সের মতে, যেকোনো সমাজের ভিত্তি বা বুনিয়াদ হলো তার অর্থনীতি। অর্থাৎ, মানুষ কীভাবে তাদের জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র (খাবার, পোশাক, আশ্রয়) উৎপাদন করে। এই ভিত্তির আবার দুটো প্রধান অংশ আছে:

  • উৎপাদন শক্তি (Forces of Production): উৎপাদনের জন্য যা যা লাগে—যেমন, কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তি, কারখানা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, মানুষের শ্রমশক্তি ও দক্ষতা। পাথরের কুঠার, লাঙল, বাষ্পীয় ইঞ্জিন থেকে শুরু করে আজকের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স—এ সবই উৎপাদন শক্তির অংশ।
  • উৎপাদন সম্পর্ক (Relations of Production): উৎপাদনের এই উপকরণগুলোর মালিকানা কার হাতে থাকবে, এবং এই মালিকানার ভিত্তিতে মানুষে মানুষে যে সম্পর্ক তৈরি হয়, তাই হলো উৎপাদন সম্পর্ক। যেমন: দাস সমাজে উৎপাদন যন্ত্র (ভূমি ও দাস) ছিল দাস-মালিকের, ফলে দাস-মালিক ও দাসের মধ্যে একটি শোষণের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। পুঁজিবাদী সমাজে কারখানার মালিক পুঁজিপতি আর শ্রমিকেরা তাদের শ্রম বিক্রি করে—এখানেও একটি নির্দিষ্ট সম্পর্ক তৈরি হয়। এই উৎপাদন সম্পর্কই সমাজে শ্রেণী (Class) তৈরি করে।

২. উপরিকাঠামো (Superstructure): বাড়ির ভিত্তির ওপর যেমন দেয়াল, জানালা, দরজা, ছাদ ইত্যাদি থাকে, তেমনি সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর গড়ে ওঠে তার আইনি ও রাজনৈতিক উপরিকাঠামো। এর মধ্যে আছে রাষ্ট্র, আইন, বিচার ব্যবস্থা, পুলিশ, সেনাবাহিনী, রাজনীতি, দর্শন, ধর্ম, নৈতিকতা, শিল্প-সাহিত্য, শিক্ষা ব্যবস্থা, পরিবার—অর্থাৎ সমাজের যাবতীয় অ-অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও ধারণা।

মার্ক্সের সবচেয়ে বিপ্লবী এবং বিতর্কিত ধারণাটি হলো—সমাজের ভিত্তিই (Base) তার উপরিকাঠামোকে (Superstructure) নির্ধারণ করে এবং তার চরিত্রকে রূপ দেয় (Marx, 1859)। অর্থাৎ, একটি সমাজের অর্থনীতি যেমন হবে, তার আইন, রাজনীতি, সংস্কৃতিও শেষ পর্যন্ত সেই অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে রক্ষা করার ও বৈধতা দেওয়ার কাজ করবে। সামন্তবাদী অর্থনীতির (Feudalism) আইনকানুন যেমন ভূমিদাসদের শোষণকে টিকিয়ে রাখার জন্য তৈরি হয়েছিল, তেমনি পুঁজিবাদী অর্থনীতির (Capitalism) আইন ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকে সবচেয়ে পবিত্র বলে মনে করে। ধর্মও শোষক শ্রেণীর স্বার্থে ব্যবহৃত হতে পারে, যেমন—‘গরিব হয়ে জন্মানোটা ঈশ্বরের ইচ্ছা’—এই ধারণা শোষিতকে শান্ত রাখতে সাহায্য করে। মার্ক্স তাই ধর্মকে ‘জনগণের আফিম’ (Opium of the people) বলে আখ্যা দিয়েছিলেন।

আর ইতিহাস কীভাবে বদলায়? মার্ক্সের মতে, ইতিহাস বদলায় যখন উৎপাদন শক্তি এবং উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে সংঘাত বা দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। উৎপাদন শক্তি (বিশেষ করে প্রযুক্তি) প্রতিনিয়ত উন্নত হতে থাকে। একসময় এই নতুন ও উন্নত উৎপাদন শক্তি পুরনো উৎপাদন সম্পর্কের (মালিকানা কাঠামো) খোলসের মধ্যে আর আঁটতে পারে না। ধরুন, নতুন এমন সব মেশিন আবিষ্কার হলো যা দিয়ে ব্যাপক হারে উৎপাদন সম্ভব। কিন্তু উৎপাদনের মালিকানা যদি পুরনো সামন্তপ্রভুদের হাতেই থেকে যায়, যারা শুধু নিজেদের ভোগের জন্য উৎপাদন করে, তাহলে সেই নতুন প্রযুক্তির পূর্ণ ব্যবহার সম্ভব নয়। এই নতুন শক্তি (বুর্জোয়া শ্রেণী) তখন পুরনো সম্পর্কের (সামন্ততন্ত্র) বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। এই দ্বন্দ্বের ফলেই একটি সামাজিক বিপ্লব (Social Revolution) ঘটে, পুরনো সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে এবং তার জায়গায় নতুন উৎপাদন সম্পর্কের ভিত্তিতে একটি নতুন সমাজ ব্যবস্থা জন্মায়।

মার্ক্স ও এঙ্গেলসের মতে, ইতিহাস এইভাবেই কয়েকটি নির্দিষ্ট ধাপ বা পর্ব পেরিয়ে এসেছে (Marx & Engels, 1848):

  • আদিম সাম্যবাদী সমাজ (Primitive Communism): ইতিহাসের শুরুতে ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল না। মানুষ ছোট ছোট গোষ্ঠীতে বাস করত, সবাই মিলে শিকার বা ফলমূল সংগ্রহ করত এবং মিলেমিশে ভোগ করত। কোনো উদ্বৃত্ত উৎপাদন ছিল না, তাই কোনো শ্রেণী বা শোষণও ছিল না।

  • দাস সমাজ (Slave Society): কৃষির বিকাশের সাথে সাথে উদ্বৃত্ত উৎপাদন শুরু হয় এবং ব্যক্তিগত মালিকানার জন্ম হয়। একদল মানুষ আরেকদল মানুষকে দাসে পরিণত করে। উৎপাদন যন্ত্রের মালিক ছিল দাস-মালিক, আর দাসেরা ছিল তাদের জীবন্ত সম্পত্তি। গ্রিসরোমের সভ্যতা এই ব্যবস্থার ওপর দাঁড়িয়েছিল।

  • সামন্তবাদী সমাজ (Feudalism): রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের বিকাশ ঘটে। এখানে মূল সম্পদ ছিল জমি। জমির মালিক ছিল সামন্তপ্রভু বা লর্ড, আর ভূমিদাসরা (Serfs) সেই জমিতে কাজ করত এবং ফসলের একটি অংশ প্রভুকে দিতে বাধ্য থাকত। তারা দাসদের মতো পুরোপুরি সম্পত্তি না হলেও কার্যত প্রভুর জমিতে বাঁধা ছিল।

  • পুঁজিবাদী সমাজ (Capitalism): সামন্ততন্ত্রের গর্ভেই বাণিজ্য ও নতুন প্রযুক্তির বিকাশের মাধ্যমে বুর্জোয়া বা পুঁজিপতি শ্রেণীর জন্ম হয়। তারা বিপ্লবের মাধ্যমে সামন্ততন্ত্রকে উচ্ছেদ করে। এই সমাজে কলকারখানা বা পুঁজির (Capital) মালিক হলো বুর্জোয়ারা (Bourgeoisie), আর সহায়-সম্বলহীন সর্বহারা শ্রমিকরা (Proletariat) বেঁচে থাকার জন্য তাদের একমাত্র সম্বল—শ্রমশক্তি (Labour Power)—মজুরির বিনিময়ে বিক্রি করতে বাধ্য হয়।

  • সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ (Socialism and Communism): মার্ক্সের ভবিষ্যদ্বাণী হলো, পুঁজিবাদের ভেতরের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বই তাকে ধ্বংস করবে। শ্রমিক বিপ্লবের মাধ্যমে এর পতন ঘটবে এবং এর পরের ধাপে আসবে সমাজতন্ত্র এবং সবশেষে ইতিহাসের চূড়ান্ত পর্যায়—এক শ্রেণীহীন, শোষণহীন, রাষ্ট্রহীন সাম্যবাদী সমাজ।

এই হলো ইতিহাসের ট্রেন। মার্ক্স শুধু তার চলার পথ এবং পেছনের বৈজ্ঞানিক নিয়মটাকেই আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন।

পুঁজিবাদের ব্যবচ্ছেদ—যেখানে লুকিয়ে আছে আসল রহস্য

মার্ক্স তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশই ব্যয় করেছেন তাঁর সময়কার প্রধান শক্তি—পুঁজিবাদকে বুঝতে। তিনি পুঁজিবাদকে একাধারে ঘৃণা করতেন তার অমানবিক শোষণের জন্য, কিন্তু একই সাথে এর বিপ্লবী শক্তিকে স্বীকারও করতেন। সামন্ততন্ত্রের অচলায়তন ভেঙে দিয়ে উৎপাদন শক্তিকে অভাবনীয় স্তরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তিনি পুঁজিবাদের প্রশংসা করেছেন। তাঁর বিখ্যাত বই ‘পুঁজি’ (Das Kapital) হলো পুঁজিবাদের এক নির্মোহ, বিস্তারিত এবং ক্ষমাহীন ব্যবচ্ছেদ। চলুন, এর কিছু মূল ধারণা দেখে নেওয়া যাক।

১. পণ্যের ফেটিসিজম বা বস্তুভক্তিবাদ (Commodity Fetishism): এটা মার্ক্সের অন্যতম মৌলিক এবং মনস্তাত্ত্বিক একটি ধারণা। বাজারে যখন আমরা একটা ঝকঝকে নতুন মোবাইল ফোন বা একজোড়া ব্র্যান্ডেড স্নিকার্স দেখি, তখন আমরা কী দেখি? আমরা তার চমৎকার ডিজাইন, তার ব্র্যান্ড ভ্যালু, তার প্রযুক্তিগত ক্ষমতা এবং তার দাম দেখি। ফোনটা বা জুতোটা আমাদের কাছে নিছক একটা জড়বস্তু থাকে না, বরং এক ধরনের জাদুকরী, প্রায় অলৌকিক বস্তু মনে হয়, যা আমাদের সামাজিক মর্যাদা (status) বাড়িয়ে দেবে, আমাদের আধুনিক প্রতিপন্ন করবে।

কিন্তু আমরা কী দেখি না? আমরা দেখি না যে এই পণ্যটি বানাতে পৃথিবীর কোনো প্রান্তে একজন শ্রমিক দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা নামমাত্র মজুরিতে হাড়ভাঙা খাটুনি খেটেছে। আমরা দেখি না তার পেছনের সামাজিক সম্পর্ক, তার পেছনের শোষণ। আমরা পণ্যের পেছনের এই মানবিক সম্পর্ককে ভুলে যাই এবং পণ্যকেই এক ধরনের অলৌকিক শক্তি দিয়ে পূজা করতে শুরু করি। এটাই হলো পণ্যের ফেটিসিজম (Commodity Fetishism) (Marx, 1867)। পুঁজিবাদের অধীনে, মানুষের মধ্যকার সামাজিক সম্পর্ক ঢাকা পড়ে যায় এবং তার জায়গায় পণ্যের মধ্যকার সম্পর্কই প্রধান হয়ে ওঠে। আমাদের সম্পর্ক হয় টাকার সাথে, ব্র্যান্ডের সাথে, কিন্তু সেই টাকা বা ব্র্যান্ডের পেছনের মানুষগুলোর সাথে নয়।

২. শ্রম-মূল্য তত্ত্ব (Labor Theory of Value): মার্ক্স এই ধারণাটি অ্যাডাম স্মিথ ও ডেভিড রিকার্ডোর মতো ধ্রুপদী অর্থনীতিবিদদের কাছ থেকে নিয়ে তাকে আরও বিকশিত করেন। তাঁর মতে, যেকোনো পণ্যের মূল্য (Value) নির্ধারিত হয় সেটি তৈরি করতে সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় গড় শ্রম-সময় (Socially Necessary Labor Time) দ্বারা। অর্থাৎ, একটি নির্দিষ্ট সমাজে, নির্দিষ্ট প্রযুক্তিগত অবস্থায়, একটি পণ্য তৈরি করতে গড়ে যে পরিমাণ শ্রম-ঘণ্টা লাগে, তাই তার মূল্য নির্ধারণ করে। একটি চেয়ার বানাতে যদি গড়ে দশ ঘণ্টা লাগে, আর একটি টেবিল বানাতে যদি বিশ ঘণ্টা লাগে, তবে টেবিলের মূল্য চেয়ারের দ্বিগুণ হবে। বাজারে চাহিদা ও যোগানের কারণে দাম (Price) এই মূল্যের থেকে সাময়িকভাবে কমবেশি হতে পারে, কিন্তু পণ্যের আসল অন্তর্নিহিত মূল্য তৈরি হয় মানুষের শ্রমের মাধ্যমে। মেশিন বা কাঁচামাল কোনো নতুন মূল্য তৈরি করে না, তারা কেবল তাদের নিজস্ব মূল্যটুকুই পণ্যে স্থানান্তর করে। নতুন মূল্য সৃষ্টির একমাত্র উৎস হলো জীবন্ত শ্রম।

৩. উদ্বৃত্ত মূল্য (Surplus Value): শোষণের গোপন রহস্য: এটাই মার্ক্সীয় অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড। যদি শ্রম দিয়েই পণ্যের মূল্য তৈরি হয় এবং শ্রমিক যদি তার শ্রমের সমান মজুরি পায়, তাহলে পুঁজিপতিরা লাভ করে কীভাবে? জাদুটা কোথায়? এখানেই মার্ক্স তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারটি করেন।

ধরুন, একজন শ্রমিক একটি কারখানায় দিনে ৮ ঘণ্টা কাজ করে। পুঁজিপতি তাকে ৮ ঘণ্টার মজুরি দেয় না। মার্ক্সের মতে, শ্রমিক যে পণ্যটি তৈরি করে তার মূল্য এবং শ্রমিকের শ্রমশক্তির মূল্য (অর্থাৎ, তাকে ও তার পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদির মূল্য) এক নয়। পুঁজিপতি শ্রমিককে তার শ্রমের জন্য মজুরি দেয় না, দেয় তার শ্রমশক্তি (ability to work) কিনে নেওয়ার জন্য।

ধরা যাক, শ্রমিক প্রথম ৪ ঘণ্টাতেই তার নিজের মজুরির সমান মূল্যের পণ্য তৈরি করে ফেলে। এই সময়টাকে মার্ক্স বলেছেন আবশ্যক শ্রম-সময় (Necessary Labor Time)। এই সময়ে উৎপাদিত মূল্য দিয়ে শ্রমিকের বেতন হয়ে যায়।

কিন্তু পুঁজিপতি তো তাকে দিয়ে বাকি ৪ ঘণ্টাও কাজ করিয়ে নেয়। এই বাকি ৪ ঘণ্টায় শ্রমিক যে অতিরিক্ত মূল্য তৈরি করে, তার জন্য সে কোনো মজুরি পায় না। এই শ্রম হলো উদ্বৃত্ত শ্রম (Surplus Labour) এবং এই সময়ে উৎপাদিত অতিরিক্ত বা উদ্বৃত্ত মূল্যই (Surplus Value) হলো পুঁজিপতির মুনাফা, সুদ এবং খাজনার উৎস। এটাই হলো পুঁজিবাদী শোষণের মূল বৈজ্ঞানিক ভিত্তি (Marx, 1867)। এটা কোনো চুরি বা ডাকাতি নয়, বরং বাজারের স্বাভাবিক নিয়ম মেনেই এই শোষণ সম্পন্ন হয়। শ্রমিক তার নিজের শ্রমের একটি অংশ বিনামূল্যে পুঁজিপতিকে দিয়ে দিতে বাধ্য হয়, কারণ তার বেঁচে থাকার জন্য নিজের শ্রমশক্তি বিক্রি করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। পুঁজিবাদের এই গোপন রহস্যটি উন্মোচন করাকেই মার্ক্স তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা কাজ বলে মনে করতেন।

৪. বিচ্ছিন্নতাবোধ (Alienation): আধুনিক মানুষের অসুখ: পুঁজিবাদ শুধু অর্থনৈতিকভাবে মানুষকে শোষণ করে না, এটা তার আত্মাকেও পঙ্গু করে দেয়, তাকে তার মনুষ্যত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। মার্ক্স তাঁর যৌবনের লেখায় (Economic and Philosophic Manuscripts of 1844) এই অবস্থাকে বলেছেন বিচ্ছিন্নতাবোধ বা Alienation। তাঁর মতে, পুঁজিবাদের অধীনে শ্রমিক চারভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে:

  • নিজের তৈরি পণ্য থেকে বিচ্ছিন্নতা (Alienation from the Product): শ্রমিক যে জিনিসটা নিজের হাতে তৈরি করে, সেটার ওপর তার কোনো অধিকার বা নিয়ন্ত্রণ থাকে না। একজন আইফোন ফ্যাক্টরির কর্মী হয়তো সারাজীবনেও একটি আইফোন কেনার সামর্থ্য রাখে না। পণ্যটি তার কাছে একটি অচেনা, বাহ্যিক এবং এমনকি শত্রুভাবাপন্ন বস্তু হয়ে দাঁড়ায়।

  • উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্নতা (Alienation from the Process of Production): কারখানায় শ্রমিকের কাজ হয়ে যায় একটি বড় উৎপাদন প্রক্রিয়ার ক্ষুদ্র, একঘেয়ে এবং যান্ত্রিক অংশ। সে হয়তো সারাদিন ধরে শুধু একটা স্ক্রু লাগানোর কাজ করে। পুরো জিনিসটা কীভাবে তৈরি হচ্ছে, কেন হচ্ছে, বা এর সামাজিক তাৎপর্য কী, তার কোনো ধারণা তার থাকে না। তার কাজ তার সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটায় না, বরং তার জীবনশক্তিকে কেড়ে নেয়। কাজটি তার জন্য আনন্দের বদলে একঘেয়ে শাস্তিতে পরিণত হয়।

  • নিজের মানব প্রজাতিসত্তা থেকে বিচ্ছিন্নতা (Alienation from Species-Being): মার্ক্সের মতে, মানুষের প্রকৃত স্বভাব বা প্রজাতিসত্তা হলো স্বাধীন ও সৃজনশীল কাজ করা। মানুষ তার সৃজনশীলতা ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে প্রকৃতি ও জগৎকে নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তন করতে চায়, এটাই তাকে অন্য প্রাণী থেকে আলাদা করে। কিন্তু পুঁজিবাদে শ্রমিকের কাজ তার এই সৃজনশীল সত্তার বিকাশের বদলে তাকে নিছক পশুর পর্যায়ে নামিয়ে আনে, যার একমাত্র লক্ষ্য হলো শারীরিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা।

  • অন্য মানুষ থেকে বিচ্ছিন্নতা (Alienation from Other Humans): পুঁজিবাদী সমাজে সবাই একে অপরের প্রতিযোগী। পুঁজিপতিরা একে অপরের সাথে মুনাফার জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা করে। শ্রমিকরাও সীমিত চাকরির জন্য একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করে। ফলে মানুষের মধ্যে সহযোগিতার বদলে তৈরি হয় বিচ্ছিন্নতা, অবিশ্বাস আর শত্রুতার সম্পর্ক। সহকর্মী বন্ধু না হয়ে প্রতিযোগী হয়ে ওঠে।

আজকের দিনে কর্পোরেট জগতে কাজ করা অনেক উচ্চ বেতনভোগী মানুষও কি এই বিচ্ছিন্নতাবোধে ভোগেন না? নিজের কাজের প্রতি ভালোবাসা হারিয়ে ফেলা, কাজকে কেবল মাস শেষে বেতনের উৎস ভাবা, সহকর্মীদের সাথে কেবলই পেশাগত সম্পর্ক রাখা—এই সবই কি মার্ক্সের সেই দেড়শো বছরের পুরনো বিশ্লেষণের সত্যতা নতুন করে প্রমাণ করে না?

অনিবার্য সংঘাত—শ্রেণী সংগ্রাম (Class Struggle)

মার্ক্স ও এঙ্গেলস তাঁদের অমর সৃষ্টি ‘কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো’-র শুরুতেই বজ্রনির্ঘোষে ঘোষণা করেছিলেন, “আজ পর্যন্ত যত সমাজ টিকে আছে, তাদের সকলের ইতিহাসই হলো শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস” (The history of all hitherto existing society is the history of class struggles) (Marx & Engels, 1848)।

তাঁদের মতে, ব্যক্তিগত মালিকানাভিত্তিক সমাজে মানুষ সবসময়ই শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল এবং এই শ্রেণীগুলোর স্বার্থ ছিল পরস্পরবিরোধী। দাস সমাজে দাস ও মালিক, সামন্ত সমাজে ভূমিদাস ও সামন্তপ্রভু, এবং পুঁজিবাদী সমাজে প্রধানত দুটি শ্রেণী রয়েছে যাদের স্বার্থের সংঘাত অনিবার্য:

  • বুর্জোয়া (Bourgeoisie): যারা উৎপাদন ব্যবস্থার (কলকারখানা, জমি, পুঁজি, ব্যাংক) মালিক। তারা সংখ্যালঘু কিন্তু সমাজের শাসক শ্রেণী। তাদের একমাত্র লক্ষ্য হলো সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করা।

  • সর্বহারা (Proletariat): যারা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ কিন্তু তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য নিজেদের শ্রমশক্তি বিক্রি করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তাদের নিজেদের কোনো উৎপাদন ব্যবস্থা নেই। তারা চায় ন্যায্য মজুরি এবং উন্নততর জীবনযাত্রার মান।

এই দুই শ্রেণীর স্বার্থ মৌলিকভাবেই পরস্পরবিরোধী। পুঁজিপতি চায় মজুরি কমিয়ে, কাজের সময় বাড়িয়ে বা প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদন বাড়িয়ে উদ্বৃত্ত মূল্য তথা মুনাফা বাড়াতে। আর শ্রমিক চায় মজুরি বাড়াতে, কাজের সময় কমাতে এবং কাজের পরিবেশ উন্নত করতে। একজনের লাভ মানে অন্যজনের ক্ষতি। এই মৌলিক স্বার্থের সংঘাতই হলো শ্রেণী সংগ্রাম। এই সংগ্রাম কখনও আড়ালে চলে, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের মতো আইনি পথে চলে, আবার কখনও তা প্রকাশ্যে আসে ধর্মঘট, বিক্ষোভ, দাঙ্গা বা চূড়ান্ত পর্যায়ে বিপ্লবের রূপে।

মার্ক্সের মতে, শ্রমিকরা প্রথমে তাদের দুঃখ-দুর্দশার জন্য নিজেদের ভাগ্য বা কোনো নির্দিষ্ট মালিককে দায়ী করে। তারা বিচ্ছিন্ন এবং দুর্বল থাকে। তারা বুঝতে পারে না যে তাদের শোষণের কারণ কোনো একজন ব্যক্তি নয়, বরং গোটা পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা। এটাকে মার্ক্স বলেছেন মিথ্যা চেতনা (False Consciousness)। শাসক শ্রেণীর ভাবাদর্শ (ideology), যা মিডিয়া, শিক্ষা, ধর্মের মাধ্যমে প্রচারিত হয়, এই মিথ্যা চেতনা তৈরিতে সাহায্য করে।

কিন্তু সময়ের সাথে সাথে, কারখানার ভেতরে একই ছাদের নিচে কাজ করতে করতে এবং একই রকম শোষণের শিকার হতে হতে শ্রমিকদের মধ্যে একতা জন্মায়। তারা ধীরে ধীরে বুঝতে পারে যে তাদের সকলের স্বার্থ এক এবং তাদের শত্রুও এক—পুরো পুঁজিবাদী শ্রেণী। এই সঠিক বোঝাপড়াকেই মার্ক্স বলেছেন শ্রেণী চেতনা (Class Consciousness)। যখন সর্বহারা শ্রেণী এই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে একটি সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবে, তখনই পুঁজিবাদকে উচ্ছেদ করার জন্য বিপ্লবের মঞ্চ প্রস্তুত হবে।

ভবিষ্যদ্বাণী—পুঁজিবাদের পতন ও সাম্যবাদের আগমন

মার্ক্স শুধু পুঁজিবাদের নির্মোহ বিশ্লেষকই ছিলেন না, তিনি একজন বিপ্লবীও ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ইতিহাস এক জায়গায় থেমে থাকে না। পুঁজিবাদও চিরস্থায়ী নয়। পুঁজিবাদ তার নিজের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বের কারণেই নিজের কবর নিজেই খুঁড়বে। কয়েকটি কারণে এটা ঘটবে:

  • পুঁজির কেন্দ্রীভবন ও একচেটিয়াকরণ (Concentration and Centralization of Capital): পুঁজিবাদের নিয়মই হলো প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতায় বড় মাছ ছোট মাছকে খেয়ে ফেলে। অর্থাৎ, বড় পুঁজিপতিরা ছোট পুঁজিপতিদের হারিয়ে দিয়ে তাদের ব্যবসাকে গ্রাস করে। ফলে পুঁজি ক্রমশ অল্প কিছু মানুষের বা কর্পোরেশনের হাতে জমা হবে এবং সর্বহারাদের সংখ্যা ও পাল্লা ভারী হতে থাকবে।

  • মুনাফার হার কমে যাওয়ার প্রবণতা (Tendency of the Rate of Profit to Fall): এটি মার্ক্সের অন্যতম জটিল একটি তত্ত্ব। পুঁজিপতিরা মুনাফা বাড়ানোর জন্য শ্রমিকের বদলে বেশি করে মেশিন বা প্রযুক্তি (Constant Capital) ব্যবহার করতে শুরু করে। কিন্তু মার্ক্সের মতে, নতুন মূল্য ও মুনাফা আসে কেবল জীবন্ত শ্রমের শোষণ (Variable Capital) থেকে, মেশিন থেকে নয়। তাই অর্থনীতিতে সামগ্রিকভাবে শ্রমের তুলনায় মেশিনের অনুপাত যত বাড়বে, গড় মুনাফার হার তত কমতে থাকবে। এটি পুঁজিবাদকে দীর্ঘমেয়াদী সংকটের দিকে ঠেলে দেবে।

  • পর্যায়ক্রমিক সংকট (Periodic Crises): পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বারবার সংকট দেখা দেবে। এর মূল কারণ হলো অতিরিক্ত উৎপাদন (Overproduction) এবং স্বল্প ভোগ (Underconsumption)। মুনাফার লোভে পুঁজিপতিরা ব্যাপক হারে পণ্য উৎপাদন করে, কিন্তু শ্রমিকদের মজুরি এতটাই কম থাকে যে তারা সেই উৎপাদিত সমস্ত পণ্য কিনে নিতে পারে না। ফলে পণ্য অবিক্রিত থেকে যায়, গুদাম উপচে পড়ে, কারখানা বন্ধ হয়ে যায়, শ্রমিকরা ব্যাপক হারে বেকার হয় এবং অর্থনীতিতে ভয়াবহ মন্দা দেখা দেয়। মার্ক্সের মতে, এই সংকটগুলো কোনো দুর্ঘটনা নয়, বরং পুঁজিবাদের কাঠামোগত রোগ এবং সময়ের সাথে সাথে তা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।

এই পরিস্থিতিতে, যখন সংকট চরমে পৌঁছবে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ সর্বহারা শ্রেণী আরও বেশি শোষিত ও সংগঠিত হবে, তখন তারা আর তাদের শোষণ মেনে নেবে না। তারা এক চূড়ান্ত বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবে এবং বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধ্বংস করে দেবে।

বিপ্লবের পরের ধাপগুলো কী?

১. সর্বহারার একনায়কত্ব (Dictatorship of the Proletariat): এই শব্দটি শুনলেই আজ অনেকের মনে স্বৈরাচার, গুল্যাগ আর একদলীয় শাসনের ভয়ঙ্কর ছবি ভেসে ওঠে। কিন্তু মার্ক্সের কাছে এর অর্থ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাঁর কাছে এটি কোনো একজন স্বৈরাচারীর শাসন নয়, বরং পুরো শ্রমিক শ্রেণীর গণতান্ত্রিক শাসন। যেমনভাবে পুঁজিবাদী গণতন্ত্রকে তিনি ‘বুর্জোয়াদের একনায়কত্ব’ বলতেন (যেখানে সংখ্যালঘু পুঁজিপতি শ্রেণী সংখ্যাগরিষ্ঠের ওপর শাসন চালায়), তেমনি ‘সর্বহারার একনায়কত্ব’ হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিক শ্রেণীর শাসন, যা সংখ্যালঘু বুর্জোয়াদের প্রতিরোধকে দমন করবে। এটি হবে একটি অন্তর্বর্তীকালীন অবস্থা, যার কাজ হবে উৎপাদনের সমস্ত মাধ্যমকে (কারখানা, জমি, ব্যাংক) ব্যক্তিগত মালিকানা থেকে কেড়ে নিয়ে সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নিয়ে আসা।

২. সমাজতন্ত্র (Socialism): এটি হলো সাম্যবাদের প্রথম বা নিম্ন পর্যায়। এই পর্যায়ে ব্যক্তিগত মালিকানা বিলুপ্ত হবে, উৎপাদনের সবকিছুর মালিক হবে সমাজ বা রাষ্ট্র। রাষ্ট্রই উৎপাদন ও বণ্টনের পরিকল্পনা করবে। এই স্তরে বণ্টন নীতি হবে: “প্রত্যেকে তার সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করবে এবং প্রত্যেকে তার কাজ অনুযায়ী পারিশ্রমিক পাবে” (From each according to his ability, to each according to his work)। অর্থাৎ, যে বেশি কাজ করবে বা যার কাজের গুণমান ভালো, সে বেশি পাবে। তখনও রাষ্ট্র থাকবে, কারণ শ্রেণী পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়নি এবং মানুষের চেতনাও পুরোপুরি বদলায়নি।

৩. সাম্যবাদ (Communism): এটি হলো মানব ইতিহাসের চূড়ান্ত পর্যায়। সমাজতন্ত্রের বিকাশের ফলে উৎপাদন শক্তি এতটাই বেড়ে যাবে যে সমাজে বৈষয়িক প্রাচুর্য তৈরি হবে। তখন আর ‘কে কতটুকু কাজ করল’ তার হিসাব রাখার প্রয়োজন হবে না। মানুষ আর পেটের দায়ে বা বাঁচার জন্য কাজ করবে না, বরং আত্মবিকাশের আনন্দে, সৃজনশীলতার তাগিদে কাজ করবে। মানসিক ও শারীরিক শ্রমের মধ্যে পার্থক্য ঘুচে যাবে। এই প্রাচুর্যের সমাজে বণ্টনের নীতি হবে: “প্রত্যেকে তার সামর্থ্য অনুযায়ী দেবে, প্রত্যেকে তার প্রয়োজন অনুযায়ী পাবে” (From each according to his ability, to each according to his need) (Marx, 1875)। যেহেতু শ্রেণী থাকবে না, শোষণ থাকবে না, তাই শ্রেণী শোষণের যন্ত্র হিসেবে রাষ্ট্রেরও আর কোনো প্রয়োজন থাকবে না। রাষ্ট্র নিজে থেকেই শুকিয়ে যাবে বা বিলুপ্ত হবে (The state withers away)।

এটা ছিল মার্ক্সের স্বপ্ন—এক শ্রেণীহীন, শোষণহীন, বিচ্ছিন্নতামুক্ত, রাষ্ট্রহীন সত্যিকারের মানবিক এক বিশ্ব-সমাজের স্বপ্ন।

তর্কের টেবিল—সমালোচনা ও প্রত্যুত্তর

কোনো বড় দর্শনই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। মার্ক্সবাদ তো নয়ই। কার্ল মার্ক্স কোনো ধর্মগুরু ছিলেন না, আর তাঁর লেখাও কোনো অভ্রান্ত ধর্মগ্রন্থ নয়। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর তত্ত্বকে বিজ্ঞানের পর্যায়ে উন্নীত করতে, আর বিজ্ঞানের প্রথম শর্তই হলো তাকে প্রশ্ন করা যাবে, সমালোচনা করা যাবে, এমনকি ভুল প্রমাণ করার চেষ্টাও করা যাবে। তাঁর মৃত্যুর পর থেকে আজ পর্যন্ত তাঁর তত্ত্বের চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়েছে, এবং বহু শক্তিশালী সমালোচনাও উঠে এসেছে।

কিন্তু এই সমালোচনাগুলোর কি কোনো উত্তর নেই? মার্ক্সবাদীরা কি একেবারেই চুপ করে থেকেছেন? না, একদমই না। চলুন, আমরা তর্কের টেবিলে বসি। একপাশে সমালোচকদের প্রশ্নগুলো রাখি, আর অন্য পাশে মার্ক্সবাদীরা কীভাবে তার জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, সেটাও শুনি। এই বিতর্কটা বুঝতে পারলেই মার্ক্সবাদের শক্তি এবং দুর্বলতা, দুটোই আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদের অভিযোগ

সমালোচনা: এটা মার্ক্সবাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে পুরনো এবং শক্তিশালী অভিযোগ। সমালোচকরা বলেন, মার্ক্স সবকিছুকে অর্থনীতির একমুখী চশমা দিয়ে দেখেছেন। তাঁর ভিত্তি (Base) আর উপরিকাঠামো (Superstructure) মডেলে অর্থনীতিই যেন সবকিছুর নিয়ন্তা। মানুষের চিন্তা, সংস্কৃতি, ধর্ম, জাতীয়তাবাদ, শিল্পকলা—এইসব জটিল বিষয়ের কি নিজস্ব কোনো ভূমিকা নেই? হিটলারের উত্থান কি কেবলই জার্মান পুঁজিবাদের সংকট ছিল, নাকি এর পেছনে জাতীয়তাবাদ ও বর্ণবাদের মতো শক্তিশালী ভাবাদর্শের কোনো ভূমিকা ছিল না? সমালোচকরা বলেন, মার্ক্স উপরিকাঠামোকে বড্ড বেশি নিষ্ক্রিয় এবং অর্থনীতির যান্ত্রিক প্রতিফলন (mechanical reflection) হিসেবে দেখেছেন। এই যান্ত্রিক বস্তুবাদ মানব সমাজের জটিলতাকে ব্যাখ্যা করতে পারে না।

মার্ক্সীয় প্রত্যুত্তর: মার্ক্সবাদীরা এই অভিযোগকে ‘যান্ত্রিক মার্ক্সবাদ’ (Vulgar Marxism) বা সরলীকরণের ফল বলে মনে করেন। তাঁদের জবাবগুলো এরকম:

  • ‘একমাত্র’ নয়, ‘চূড়ান্ত’ নির্ধারক: মার্ক্সের সবচেয়ে কাছের বন্ধু ও সহকর্মী, ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস নিজেই এই ভুল বোঝাবুঝির জবাব দিয়ে গেছেন। জীবনের শেষ দিকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি স্পষ্ট করে বলেন, “মার্ক্স এবং আমি কখনওই দাবি করিনি যে অর্থনৈতিক উপাদানই ইতিহাসের একমাত্র নির্ধারক। আমরা বলেছি, এটি চূড়ান্ত বিচারে (in the last instance) নির্ধারক।” (Engels, 1890)। ব্যাপারটা অনেকটা নদীর মতো। নদীর গতিপথ শেষ পর্যন্ত তার ভূখণ্ড বা নদীর তলদেশ দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে নদীর স্রোত, ঘূর্ণি বা ঢেউয়ের নিজস্ব কোনো ভূমিকা নেই। উপরিকাঠামোর বিষয়গুলো (যেমন আইন, রাজনীতি, ভাবাদর্শ) সেই ঢেউয়ের মতোই, যা অর্থনৈতিক ভিত্তিকে প্রভাবিত করতে পারে, এমনকি কখনও কখনও তার গতিপথও কিছুটা বদলে দিতে পারে।

  • আপেক্ষিক স্বায়ত্তশাসনের ধারণা (Concept of Relative Autonomy): পরবর্তী মার্ক্সবাদীরা, বিশেষ করে লুই আলথুসারের (Louis Althusser) মতো তাত্ত্বিকরা, দেখিয়েছেন যে উপরিকাঠামোর নিজস্ব একটি ‘আপেক্ষিক স্বায়ত্তশাসন’ আছে। অর্থাৎ, আইন, রাষ্ট্র বা ভাবাদর্শ অর্থনীতির দ্বারা প্রভাবিত হলেও তাদের নিজস্ব কার্যকারিতার নিয়ম আছে। তারা অর্থনীতির ওপর উল্টো প্রভাবও ফেলে। যেমন, একটি প্রগতিশীল আইন অর্থনৈতিক পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করতে পারে, আবার একটি প্রতিক্রিয়াশীল আইন তাকে বাধা দিতে পারে।

  • সাংস্কৃতিক আধিপত্য (Cultural Hegemony): ইতালীয় মার্ক্সবাদী আন্তোনিও গ্রামশি (Antonio Gramsci) এই ধারণাটিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান। তিনি বলেন, শাসক শ্রেণী শুধু পুলিশ আর মিলিটারি দিয়ে জোর করে (coercion) শাসন করে না। তারা মূলত শাসন করে সমাজের শিক্ষা, সংস্কৃতি, মিডিয়া এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের নিজেদের দর্শন ও মূল্যবোধকে ‘সাধারণ জ্ঞান’ বা ‘স্বাভাবিক’ (common sense) হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। এই প্রক্রিয়ায় শোষিত শ্রেণী নিজেদের শোষণকেই স্বাভাবিক ও অনিবার্য বলে মেনে নেয়। এটাই হলো সাংস্কৃতিক আধিপত্য বা হেজিমনি। এখানে ভাবাদর্শ বা সংস্কৃতি কোনো নিষ্ক্রিয় প্রতিফলন নয়, বরং শ্রেণী শাসন টিকিয়ে রাখার এক সক্রিয় ও শক্তিশালী হাতিয়ার।

মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিস্তৃতির বাস্তবতা

সমালোচনা: মার্ক্স ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, পুঁজিবাদের বিকাশের সাথে সাথে সমাজ ক্রমশ দুটি প্রধান শিবিরে ভাগ হয়ে যাবে—খুব ধনী মুষ্টিমেয় বুর্জোয়া আর বিপুল সংখ্যার খুব গরিব সর্বহারা। মাঝখানের ছোট দোকানদার, কারিগর বা পেটি বুর্জোয়ারা (Petty Bourgeoisie) প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে সর্বহারা শ্রেণীতে নেমে আসবে। কিন্তু বাস্তবে কী হয়েছে? বিশেষ করে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোতে এর উল্টো চিত্র দেখা গেছে। সেখানে একটি বিশাল, স্থিতিশীল এবং প্রভাবশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর (Middle Class) উদ্ভব হয়েছে—ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ম্যানেজার, শিক্ষক, সরকারি আমলা ইত্যাদি। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণী তো বিপ্লবের বদলে স্থিতাবস্থাই পছন্দ করে। তাহলে মার্ক্সের মেরুকরণের (polarization) তত্ত্বটি কি ভুল ছিল?

মার্ক্সীয় প্রত্যুত্তর:

  • মধ্যবিত্ত কি আসলেই ‘মধ্যবিত্ত’?: মার্ক্সবাদীরা প্রশ্ন তোলেন, আমরা যাদের ‘মধ্যবিত্ত’ বলি, তারা আসলে কোন শ্রেণীতে পড়ে? মার্ক্সের শ্রেণী বিভাজনের মূল ভিত্তি হলো উৎপাদনের উপকরণের মালিকানা। একজন উচ্চ বেতনভোগী সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার বা কর্পোরেট ম্যানেজার হয়তো জীবনযাত্রার মানে অনেক ধনী, কিন্তু তিনি যদি উৎপাদনের উপকরণের (কোম্পানি, প্ল্যাটফর্ম, পুঁজি) মালিক না হন এবং বেঁচে থাকার জন্য নিজের শ্রম (মানসিক বা শারীরিক) বিক্রি করতে বাধ্য হন, তাহলে মার্ক্সীয় সংজ্ঞায় তিনিও একজন সর্বহারা। তিনি ‘নতুন সর্বহারা’ (new proletariat) বা ‘শ্রমিক অভিজাত’ (labour aristocracy) হতে পারেন, কিন্তু বুর্জোয়া নন।

  • অস্থিতিশীল পেটি বুর্জোয়া: মার্ক্স যে পেটি বুর্জোয়াদের কথা বলেছিলেন, তারা আজও আছে। কিন্তু তাদের অবস্থান খুবই অস্থিতিশীল। অর্থনৈতিক সংকটের সময় বড় কর্পোরেশনের ধাক্কায় ছোট ব্যবসাগুলোই সবার আগে বন্ধ হয়ে যায়, এবং তাদের মালিকরা সর্বহারাদের কাতারে নেমে আসতে বাধ্য হয়। আজকের ‘গিগ ইকোনমি’তে (Gig Economy) স্বাধীন কন্ট্রাক্টর বা ফ্রিল্যান্সারদের অবস্থাও প্রায় একই রকম।

  • সাম্রাজ্যবাদের ভূমিকা: লেনিনের (Vladimir Lenin) মতো মার্ক্সবাদীরা দেখিয়েছেন যে, উন্নত দেশগুলোর মধ্যবিত্ত শ্রেণীর স্থিতিশীলতার পেছনে সাম্রাজ্যবাদের (Imperialism) একটি বড় ভূমিকা আছে। পশ্চিমা দেশগুলো উপনিবেশ বা তৃতীয় বিশ্ব থেকে সস্তায় কাঁচামাল ও শ্রম শোষণ করে যে বিপুল পরিমাণ উদ্বৃত্ত মুনাফা (super-profit) অর্জন করে, তার একটি অংশ দিয়ে তারা নিজেদের দেশের শ্রমিক শ্রেণীর একটি অংশকে এবং মধ্যবিত্তকে নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে শান্ত রাখে। ফলে, শ্রেণীসংগ্রামের তীব্রতা নিজ দেশে কমে এলেও তা বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত হয়।

বিপ্লবের ভুল ঠিকানা

সমালোচনা: মার্ক্স মনে করতেন, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটবে সবচেয়ে উন্নত ও শিল্পোন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোতে (যেমন: ব্রিটেন, জার্মানি বা ফ্রান্স), যেখানে শ্রমিক শ্রেণী সবচেয়ে সংগঠিত ও সচেতন। কিন্তু ইতিহাস দেখাল একেবারে উল্টোটা। বিংশ শতাব্দীতে যে ‘মার্ক্সবাদী’ বিপ্লবগুলো হলো, সেগুলো ঘটল রাশিয়া, চীন, ভিয়েতনাম বা কিউবার মতো তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে থাকা, কৃষিপ্রধান ও আধা-সামন্তবাদী দেশগুলোতে। এটা কি মার্ক্সের তত্ত্বের সরাসরি ব্যত্যয় নয়?

মার্ক্সীয় প্রত্যুত্তর: এই আপাত ব্যত্যয়কে ব্যাখ্যা করার জন্য পরবর্তী মার্ক্সবাদীরা নতুন তত্ত্বের অবতারণা করেন।

  • সাম্রাজ্যবাদ ও দুর্বলতম শৃঙ্খল তত্ত্ব (Imperialism and the Weakest Link Theory): লেনিন তাঁর ‘সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়’ (Imperialism, the Highest Stage of Capitalism) বইতে দেখান যে, পুঁজিবাদ বিশ্বব্যাপী একটি শৃঙ্খলে (chain) পরিণত হয়েছে। উন্নত দেশগুলো উপনিবেশ শোষণ করে নিজেদের সংকটকে বাইরে চালান করে দেয়। ফলে, বিপ্লব সেইসব শক্তিশালী কেন্দ্রে না হয়ে, হয় সেই বিশ্ব-শৃঙ্খলের সবচেয়ে দুর্বল অংশে (weakest link)। জারশাসিত রাশিয়া ছিল ঠিক তেমনই একটি দুর্বলতম শৃঙ্খল। সেখানে একদিকে ছিল শিল্প পুঁজিবাদের বিকাশ, অন্যদিকে ছিল সামন্ততন্ত্রের অবশেষ এবং একটি দুর্বল বুর্জোয়া শ্রেণী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের চাপ এই দুর্বলতম অংশটিকেই ভেঙে দেয় এবং বিপ্লবের পরিস্থিতি তৈরি করে।

  • তত্ত্বের অভিযোজন (Adaptation of Theory): মাও সেতুং (Mao Zedong) চীনে মার্ক্সবাদকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যান। তিনি দেখান যে, রাশিয়ার মতো আধা-শিল্পোন্নত দেশের বদলে চীনের মতো প্রায় পুরোপুরি কৃষিভিত্তিক দেশে বিপ্লবের প্রধান শক্তি হবে কৃষক শ্রেণী, সর্বহারা নয়। এটি মার্ক্সের মূল তত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিযোজন। মার্ক্সবাদীরা বলেন, মার্ক্সবাদ কোনো তৈরি পোশাক নয় যে সব গায়ে একভাবে ফিট হবে। এটি একটি বিশ্লেষণ পদ্ধতি, যা প্রতিটি দেশের নির্দিষ্ট বাস্তব পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রয়োগ করতে হয়।

মানব প্রকৃতির প্রশ্ন

সমালোচনা: মার্ক্সের সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্ন কি মানব প্রকৃতির সাথে মেলে? মানুষ কি সত্যিই চূড়ান্তভাবে পরার্থপর হতে পারে? নাকি প্রতিযোগিতা, মালিকানার আকাঙ্ক্ষা, ক্ষমতা ও সম্পদের লোভ এবং স্বার্থপরতা মানুষের সহজাত ও অপরিবর্তনীয় প্রবৃত্তি? সমালোচকরা বলেন, সাম্যবাদের স্বপ্ন মানব প্রকৃতির এই ‘অপ্রিয়’ সত্যকে অস্বীকার করে এবং একটি অবাস্তব ইউটোপিয়া বা কল্পস্বর্গ তৈরি করার চেষ্টা করে, যা বাস্তবে ব্যর্থ হতে বাধ্য।

মার্ক্সীয় প্রত্যুত্তর: এই প্রশ্নের জবাবেই মার্ক্সবাদের সবচেয়ে গভীর দার্শনিক দিকটি লুকিয়ে আছে।

  • মানব প্রকৃতি স্থির নয়: মার্ক্সবাদীদের মূল কথা হলো, ‘মানব প্রকৃতি’ (human nature) বলে কোনো শাশ্বত, চিরস্থায়ী বা অপরিবর্তনীয় বস্তু নেই। মানুষের চেতনা ও স্বভাব তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা, বিশেষ করে তার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দ্বারা গঠিত হয়। সামন্তবাদী সমাজে আনুগত্য ও সম্মানকে ‘স্বাভাবিক’ মনে করা হতো। পুঁজিবাদী সমাজে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও প্রতিযোগিতাকে ‘স্বাভাবিক’ মনে করা হয়। এই ‘স্বভাব’গুলো মানুষের জিন-এর মধ্যে লেখা নেই, এগুলো সামাজিক উৎপাদন।

  • ঐতিহাসিক উদাহরণ: মানব ইতিহাসের বেশিরভাগ সময় জুড়েই (আদিম সাম্যবাদী সমাজে) মানুষ ব্যক্তিগত মালিকানা ছাড়াই সমবায়ভিত্তিক জীবন কাটিয়েছে। ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং তার থেকে উদ্ভূত লোভ ও প্রতিযোগিতা মানব ইতিহাসের খুবই সাম্প্রতিক একটি ঘটনা। যা ঐতিহাসিকভাবে তৈরি হয়েছে, তা ঐতিহাসিকভাবে বদলেও যেতে পারে।

  • পরিস্থিতিই স্বভাব তৈরি করে: মার্ক্সবাদীরা বলেন না যে সাম্যবাদী সমাজে রাতারাতি সব মানুষ ফেরেশতা হয়ে যাবে। তাঁরা বলেন, সাম্যবাদ এমন একটি বস্তুগত পরিস্থিতি তৈরি করবে, যেখানে স্বার্থপর হওয়ার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। যখন সমাজে কোনো অভাব থাকবে না, প্রত্যেকে তার প্রয়োজন অনুযায়ী সবকিছু পাবে, তখন সম্পদ কুক্ষিগত করার বা অন্যকে ঠকানোর কোনো সামাজিক বা অর্থনৈতিক প্রণোদনাই থাকবে না। একটি অরক্ষিত পরিবেশে মানুষ যেমন আত্মরক্ষার জন্য হিংস্র হতে পারে, একটি সুরক্ষিত ও প্রাচুর্যের পরিবেশে সেই একই মানুষ সহযোগিতাপূর্ণ ও পরার্থপর হয়ে উঠতে পারে।

ঐতিহাসিক বাস্তবতা ও সর্বগ্রাসীবাদ: কাঠগড়ায় মার্ক্সবাদ

সমালোচনা: তত্ত্বের পাতায় যা-ই লেখা থাক না কেন, বাস্তব পৃথিবী বড় নির্মম। মার্ক্সবাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে নৈতিক ও আবেগপূর্ণ অভিযোগটি আসে ঠিক এখানেই। সমালোচকরা আঙুল তুলে দেখান বিংশ শতাব্দীর রক্তাক্ত ইতিহাসকে। তাঁরা বলেন, মার্ক্সবাদকে যেখানেই রাষ্ট্রীয় মতাদর্শ হিসেবে প্রয়োগের চেষ্টা হয়েছে—স্তালিনের সোভিয়েত ইউনিয়ন, মাওয়ের চীন, পোল পটের কম্বোডিয়া বা পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে— সেখানেই তা পর্যবসিত হয়েছে একদলীয় স্বৈরতন্ত্র, ভয়াবহ আমলাতান্ত্রিকতা, ব্যক্তিস্বাধীনতার বিলুপ্তি, ভিন্নমত দমনের জন্য কুখ্যাত গুলাগ বা লেবার ক্যাম্প এবং দুর্ভিক্ষ ও রাজনৈতিক শুদ্ধি অভিযানে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর করুণ ইতিহাসে। সাম্যবাদের স্বর্গ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যা তৈরি হয়েছে, তা যেন এক নরক।

এই সমালোচনার সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক রূপ দিয়েছেন কার্ল পপার (Karl Popper)। তাঁর বিখ্যাত বই ‘দ্য ওপেন সোসাইটি অ্যান্ড ইটস এনিমিস’ (The Open Society and Its Enemies)-এ তিনি প্লেটো, হেগেল ও মার্ক্সকে ‘মুক্ত সমাজের শত্রু’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। পপারের মতে, মার্ক্সবাদ একটি ‘ঐতিহাসিকতাবাদী’ (historicist) মতবাদ। অর্থাৎ, এটি বিশ্বাস করে যে ইতিহাসের একটি নির্দিষ্ট, পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্য (সাম্যবাদ) আছে এবং এটি সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে। পপার বলেন, এই বিশ্বাসটি অত্যন্ত বিপজ্জনক। কারণ, যারা নিজেদেরকে ইতিহাসের এই গোপন নিয়ম সম্পর্কে অবগত বলে মনে করে, তারা সেই ‘মহৎ’ লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য যেকোনো ধরনের দমন-পীড়ন, সহিংসতা ও স্বৈরাচারকে ন্যায্যতা দেয়। লক্ষ লক্ষ মানুষের বর্তমানের দুর্দশাকে তারা ভবিষ্যতের স্বর্গের জন্য একটি প্রয়োজনীয় মূল্য বলে মনে করে।

পপার আরও অভিযোগ করেন, মার্ক্সবাদ একটি ‘মিথ্যা প্রমাণ অযোগ্য’ (unfalsifiable) তত্ত্ব। বিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্য হলো, তার তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করার সুযোগ থাকতে হয়। যেমন, ‘সব রাজহাঁস সাদা’—এই তত্ত্বটি একটি কালো রাজহাঁস দেখেই ভুল প্রমাণ করা যায়। কিন্তু মার্ক্সবাদের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। যদি কোনো উন্নত দেশে বিপ্লব না হয়, তবে মার্ক্সবাদীরা বলবেন ‘শ্রমিকদের মিথ্যা চেতনা’র কথা। যদি বিপ্লব পিছিয়ে থাকা দেশে হয়, তবে তাঁরা লেনিনের ‘দুর্বলতম শৃঙ্খল’ তত্ত্ব হাজির করবেন। অর্থাৎ, মার্ক্সবাদ যেকোনো ঘটনার পরেই নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য একটি ব্যাখ্যা তৈরি করে ফেলে। এটি একটি বদ্ধ ধর্মবিশ্বাসের মতো কাজ করে, যা সবকিছুরই ব্যাখ্যা দিতে পারে এবং তাই কোনো কিছুরই আসল ব্যাখ্যা দেয় না (Popper, 1945)।

মার্ক্সীয় প্রত্যুত্তর: এই কঠিন এবং জটিল অভিযোগের জবাবে মার্ক্সবাদীরা কোনো একক সুরে কথা বলেন না। তাঁদের প্রত্যুত্তরগুলো বিভিন্ন শিবিরে বিভক্ত।

ক. তত্ত্ব বনাম প্রয়োগের বিচ্যুতি: ‘ওটা আসল মার্ক্সবাদ ছিল না’ (The “Not Real Marxism” Argument): এই ধারার মার্ক্সবাদীরা (যাদের মধ্যে ট্রটস্কিপন্থী এবং অনেক পশ্চিমা মার্ক্সবাদী পড়েন) বলেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন বা চীনে যা হয়েছিল, তা মার্ক্সের তত্ত্বের প্রকৃত প্রয়োগ নয়, বরং তার এক ভয়ংকর বিকৃতি বা বিচ্যুতি। তাঁদের যুক্তিগুলো হলো:

  • ভুল প্রেক্ষাপট: মার্ক্স সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা বলেছিলেন সবচেয়ে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোতে, যেখানে উৎপাদন শক্তি বিকশিত, শ্রমিক শ্রেণী সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য বিদ্যমান। কিন্তু বাস্তবে বিপ্লব হলো রাশিয়া বা চীনের মতো অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা, বিপুল কৃষক অধ্যুষিত, এবং স্বৈরাচারী শাসনের অধীনে থাকা দেশগুলোতে।

  • প্রতিকূল পরিস্থিতি: বিপ্লবের পরপরই এই দেশগুলোকে ভয়ঙ্কর সব পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়েছে—ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর সামরিক হস্তক্ষেপ ও অর্থনৈতিক অবরোধ, এবং ব্যাপক দুর্ভিক্ষ। এই চরম প্রতিকূল ও যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে, যেখানে বিপ্লবকে টিকিয়ে রাখাই মূল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, সেখানে রাষ্ট্রযন্ত্র শুকিয়ে যাওয়ার (withering away) বদলে আরও বেশি কেন্দ্রীভূত, দমনমূলক ও স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে। রোজা লুক্সেমবার্গের মতো বিপ্লবীও বলশেভিকদের বাড়াবাড়ির সমালোচনা করলেও এই কঠিন বাস্তবতাকে স্বীকার করেছিলেন।

  • স্তালিনের বিকৃতি: অনেক মার্ক্সবাদী লেনিনের সময় এবং স্তালিনের সময়ের মধ্যে একটি গুণগত পার্থক্য টানেন। তাঁরা বলেন, লেনিন পার্টি ও রাষ্ট্রে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর স্তালিন ‘এক দেশে সমাজতন্ত্র’ (Socialism in one country)-এর নামে ট্রটস্কির বিশ্ববিপ্লবের ধারণাকে বাতিল করে দেন এবং এক ভয়ংকর স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি পার্টিকে নিজের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার যন্ত্রে পরিণত করেন এবং ভিন্নমতাবলম্বী লক্ষ লক্ষ বলশেভিককে হত্যা করেন। এটি ছিল মার্ক্সবাদের আন্তর্জাতিকতাবাদী চেতনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা।

খ. রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ: ‘ওটা সমাজতন্ত্রই ছিল না’ (The “Not Even Socialism” Argument): কিছু মার্ক্সবাদী আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেন, সোভিয়েত মডেল শুধু মার্ক্সবাদের বিকৃতি নয়, এটি আসলে সমাজতন্ত্রই ছিল না। এটি ছিল এক নতুন ধরনের শোষণমূলক ব্যবস্থা—রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ (State Capitalism)। এই তত্ত্বের প্রবক্তারা (যেমন, টনি ক্লিফ) বলেন:

  • শোষণের অবসান হয়নি: সমাজতন্ত্রের মূল কথা হলো শোষণ, অর্থাৎ উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাতের অবসান। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নে ব্যক্তিগত পুঁজিপতিদের বদলে রাষ্ট্র বা পার্টি আমলাতন্ত্রই (Bureaucracy) সম্মিলিত পুঁজিপতির ভূমিকা পালন করেছে। তারা শ্রমিকদের শোষণ করে উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ করেছে এবং সেই পুঁজি সামরিক প্রতিযোগিতা ও শিল্পায়নের জন্য পুনঃবিনিয়োগ করেছে।

  • পুঁজি সঞ্চয়ের নিয়ম: সোভিয়েত অর্থনীতি বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বাইরে ছিল না। তাকে পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় নামতে হয়েছিল। এই প্রতিযোগিতা তাকে ক্রমাগত পুঁজি সঞ্চয়ের (capital accumulation) জন্য বাধ্য করেছে, যা পুঁজিবাদী ব্যবস্থারই মূল চালিকাশক্তি। শ্রমিকদের প্রয়োজন বা কল্যাণের বদলে পুঁজি সঞ্চয়ের এই তাগিদই ছিল অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক। যেহেতু শোষণের মূল সম্পর্ক এবং পুঁজি সঞ্চয়ের নিয়ম—দুই-ই বজায় ছিল, তাই এই ব্যবস্থাকে সমাজতান্ত্রিক বলা যায় না।

গ. মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট ও মাওবাদীদের আত্মপক্ষ সমর্থন: ‘বিপ্লব কোনো পার্টি নয়’ (The Revolutionary Defence): বিপরীত দিকে, যারা সোভিয়েত ইউনিয়ন বা চীনকে সমাজতান্ত্রিক বলে মনে করেন (অর্থাৎ, মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট ও মাওবাদীরা), তাঁরা এই সমালোচনাকে বুর্জোয়া অপপ্রচার বলে উড়িয়ে দেন। তাঁদের প্রত্যুত্তর সম্পূর্ণ ভিন্ন:

  • ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা: তাঁরা বলেন, সমালোচকরা যে ‘স্বৈরাচার’ বা ‘দমন-পীড়নে’র কথা বলেন, তা ছিল ঐতিহাসিক বাস্তবতার নিরিখে অনিবার্য এবং প্রয়োজনীয়। একটি পশ্চাৎপদ, সামন্ততান্ত্রিক দেশকে রাতারাতি আধুনিক শিল্পোন্নত সমাজে পরিণত করা এবং গৃহযুদ্ধ ও সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রের মুখে বিপ্লবকে রক্ষা করার জন্য একটি শক্তিশালী, কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র এবং কঠোর শৃঙ্খলার প্রয়োজন ছিল। স্তালিনের শিল্পায়ন ছাড়া সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের নাৎসি বাহিনীকে পরাজিত করতে পারত না। এই অর্জনগুলোকে ছোট করে দেখা উচিত নয়।

  • সর্বহারার একনায়কত্ব বনাম বুর্জোয়া গণতন্ত্র: তাঁরা মার্ক্সের ‘সর্বহারার একনায়কত্ব’ (Dictatorship of the Proletariat)-এর ধারণাকে সাহসের সাথে সমর্থন করেন। তাঁদের মতে, পুঁজিবাদী ‘গণতন্ত্র’ আসলে বুর্জোয়াদের একনায়কত্ব ছাড়া আর কিছুই নয়, যেখানে সংখ্যালঘুদের শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য ভাবাদর্শিক ও দমনমূলক যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। এর বিপরীতে, সর্বহারার একনায়কত্ব হলো সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষের শাসন, যা সংখ্যালঘু শোষক শ্রেণীর প্রতিরোধকে দমন করার জন্য প্রয়োজনীয়। তাই বুর্জোয়া মাপকাঠিতে একে ‘স্বৈরাচার’ বললে ভুল হবে।

  • মাওয়ের সাংস্কৃতিক বিপ্লব: মাও সেতুং এই তত্ত্বকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান। তিনি দেখেন যে, সোভিয়েত ইউনিয়নে বিপ্লবের পরেও পার্টি ও রাষ্ট্রের মধ্যে একটি নতুন আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া শ্রেণী তৈরি হয়েছে। এই ‘পার্টির ভেতরের পুঁজিবাদী পথের পথিক’দের উৎখাত করার জন্যই তিনি ১৯৬৬ সালে মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লব (Great Proletarian Cultural Revolution) শুরু করেন। তাঁর মতে, এটি ছিল সমাজতন্ত্রের অধীনে শ্রেণীসংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার এক নতুন রূপ, যার উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্র ও পার্টির ওপর জনগণের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। যদিও এর ফলে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতা হয়েছিল, মাওবাদীরা একে সমাজতন্ত্রকে রক্ষা করার এক ঐতিহাসিক প্রচেষ্টা হিসেবেই দেখেন।

ঘ. পপারের অভিযোগের জবাব: ‘বিজ্ঞান বনাম ভবিষ্যদ্বাণী’ (The Popperian Challenge Answered): কার্ল পপারের দার্শনিক অভিযোগগুলোর জবাবে মার্ক্সবাদীরা বলেন, পপার মার্ক্সবাদকে ভুলভাবে পাঠ করেছেন।

  • ‘ঐতিহাসিকতাবাদ’ নয়, ‘ঐতিহাসিক বস্তুবাদ’: মার্ক্সবাদ কোনো জ্যোতিষশাস্ত্র নয় যে তা ইতিহাসের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিশ্চিত ভবিষ্যদ্বাণী করবে। এটি ‘ঐতিহাসিকতাবাদ’ (Historicism) নয়, এটি ‘ঐতিহাসিক বস্তুবাদ’ (Historical Materialism)। এটি ইতিহাসের কিছু সাধারণ প্রবণতা বা নিয়মকে (laws of tendency) নির্দেশ করে, কোনো অবশ্যম্ভাবী ভবিষ্যৎকে নয়। যেমন, মার্ক্স বলেছিলেন পুঁজিবাদের সংকট ঘনীভূত হবে এবং শ্রেণীসংগ্রাম তীব্র হবে। এর মানে এই নয় যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব একটি গ্যারান্টিযুক্ত ঘটনা। বিপ্লবের সাফল্য নির্ভর করে বস্তুগত পরিস্থিতির পাশাপাশি শ্রমিক শ্রেণীর সচেতনতা, সংগঠন এবং সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মতো আত্মগত (subjective) উপাদানের ওপর।

  • ‘মিথ্যা প্রমাণ অযোগ্যতা’র অভিযোগ: পপারের এই অভিযোগের জবাবে বলা হয়, তিনি মার্ক্সবাদকে একটি সরল প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মডেল দিয়ে বিচার করতে চেয়েছেন, যা একটি সমাজ বিজ্ঞানকে বোঝার জন্য সঠিক পদ্ধতি নয়। মার্ক্সবাদের ভবিষ্যদ্বাণীগুলো শর্তসাপেক্ষ। যেমন, ‘যদি শ্রমিক শ্রেণী সচেতন ও সংগঠিত হয়, তবে তারা বিপ্লব করতে পারে’। এই ধরনের জটিল সামাজিক তত্ত্বকে একটি কালো রাজহাঁস দেখিয়ে ভুল প্রমাণ করা যায় না। তাছাড়া, মার্ক্সবাদ নিজে একটি নিরন্তর ‘সমালোচনা’ (critique)। মার্ক্স তাঁর ‘পুঁজি’ বইটির উপশিরোনামই দিয়েছিলেন ‘রাজনৈতিক অর্থনীতির একটি সমালোচনা’ (A Critique of Political Economy)। সত্যিকারের মার্ক্সবাদ কোনো বদ্ধ ব্যবস্থা নয়, এটি একটি উন্মুক্ত বিশ্লেষণ পদ্ধতি যা নিজেকেও প্রতিনিয়ত প্রশ্ন করে এবং নতুন বাস্তবতার আলোকে নিজেকে সংশোধন করে। ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল বা গ্রামশির মতো বিভিন্ন ধারার অস্তিত্বই প্রমাণ করে যে এটি কোনো একক ধর্মমত নয়।

এই বিতর্ক আজও শেষ হয়নি। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন মার্ক্সবাদের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছে বলে অনেকে মনে করলেও, একবিংশ শতাব্দীর ক্রমবর্ধমান অসাম্য, অর্থনৈতিক সংকট এবং সামাজিক অস্থিরতা আবার নতুন করে সেই পুরনো প্রশ্নগুলোকে সামনে নিয়ে আসছে। মার্ক্সবাদের ঐতিহাসিক প্রয়োগের ব্যর্থতার দায় তত্ত্বের, নাকি তার প্রয়োগকারীদের, নাকি প্রতিকূল পরিস্থিতির—এই প্রশ্নটি সম্ভবত ইতিহাসের অন্যতম অমীমাংসিত একটি প্রশ্ন হয়েই থাকবে। এই বিতর্কগুলো আজও জীবন্ত এবং সম্ভবত এর কোনো চূড়ান্ত মীমাংসা নেই। কিন্তু এই প্রশ্ন ও উত্তরগুলোর মধ্যেই লুকিয়ে আছে মার্ক্সবাদের প্রাণশক্তি—একটি তত্ত্ব হিসেবে তার নিজেকে বদলে ফেলার, নতুন বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করার এবং দেড়শো বছর পরেও প্রাসঙ্গিক থাকার আশ্চর্য ক্ষমতা।

মার্ক্সের পরের কথা—এক নদীর বহু ধারা

কার্ল মার্ক্স যখন ১৮৮৩ সালে লন্ডনে মারা যান, তখন তাঁর কাজ অনেকটাই অসম্পূর্ণ ছিল। ‘পুঁজি’-র মাত্র প্রথম খণ্ডটি তিনি নিজের জীবনে প্রকাশ করে যেতে পেরেছিলেন। তাঁর সবচেয়ে কাছের বন্ধু ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস তাঁর বাকি পাণ্ডুলিপিগুলো সম্পাদনা করে দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড প্রকাশ করেন। কিন্তু মার্ক্সের চিন্তার ধারা তাঁর বা এঙ্গেলসের মৃত্যুর সাথে সাথেই থেমে যায়নি।

মার্ক্সবাদ কোনো স্থির, বদ্ধ জলাশয় নয়। এটি একটি জীবন্ত, প্রবহমান নদীর মতো। মার্ক্স যে বীজ বুনেছিলেন, তা পরবর্তী এক শতাব্দী ধরে নানা দেশে, নানা বাস্তবতায়, নানা চিন্তাবিদের হাতে অঙ্কুরিত ও বিকশিত হয়েছে। এই নদী কখনও বিপ্লবী রাজনীতির খরস্রোতা পথে বয়েছে, কখনও আবার দর্শন ও সংস্কৃতির গভীর ও শান্ত খাতে প্রবাহিত হয়েছে। লেনিন, ট্রটস্কি, রোজা লুক্সেমবার্গ থেকে শুরু করে আন্তোনিও গ্রামশি, লুকাচ, ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল এবং আলথুসার পর্যন্ত বহু চিন্তাবিদ মার্ক্সবাদকে নতুন নতুন দিকে চালিত করেছেন, তাকে সমৃদ্ধ করেছেন, এবং কখনও কখনও তার মৌলিক ধারণাকেই চ্যালেঞ্জ করেছেন।

এই বিবর্তনকে বোঝাটা খুব জরুরি, কারণ ‘মার্ক্সবাদ’ বললেই আমরা যেন শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নের একরৈখিক ও প্রাতিষ্ঠানিক চেহারাটিই না দেখি। চলুন, এই নদীর কয়েকটি প্রধান ধারার সাথে পরিচিত হওয়া যাক।

ধ্রুপদী মার্ক্সবাদ ও দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের যুগ (Classical Marxism and The Second International)

মার্ক্স ও এঙ্গেলসের মৃত্যুর পর তাঁদের কাজকে সংগঠিত রূপ দেওয়ার এবং শ্রমিক আন্দোলনকে নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব নেয় ‘দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক’ (Second International)। এই সময়ের প্রধান তাত্ত্বিক ছিলেন কার্ল কাউটস্কি (Karl Kautsky) এবং এডুয়ার্ড বার্নস্টাইন (Eduard Bernstein)

  • কার্ল কাউটস্কি (Karl Kautsky): তাঁকে ‘মার্ক্সবাদের পোপ’ বলা হতো। তিনি মার্ক্সের তত্ত্বকে একটি সুসংহত বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থায় পরিণত করার চেষ্টা করেন। তাঁর ব্যাখ্যায় মার্ক্সবাদ হয়ে ওঠে অনেকটা অবশ্যম্ভাবী ও নির্ধারণবাদী (deterministic)। তিনি বিশ্বাস করতেন, পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক নিয়মেই তার পতন ঘটবে এবং সমাজতন্ত্র অনিবার্যভাবে আসবে। এর জন্য খুব বেশি বিপ্লবী সক্রিয়তার প্রয়োজন নেই, বরং সংসদীয় পথে শ্রমিক শ্রেণীর শক্তি বৃদ্ধি করাই মূল কাজ।

  • এডুয়ার্ড বার্নস্টাইন (Eduard Bernstein): তিনি ছিলেন প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ‘সংশোধনবাদী’ (Revisionist)। বার্নস্টাইন মার্ক্সের কিছু ভবিষ্যদ্বাণীকে চ্যালেঞ্জ করেন। তিনি বলেন, পুঁজিবাদের পতন আসন্ন নয়, বরং এটি নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণী বিলুপ্ত না হয়ে বরং বাড়ছে, এবং শ্রমিকদের অবস্থাও ধীরে ধীরে উন্নত হচ্ছে। তাই বিপ্লবের বদলে তাঁর পথ ছিল বিবর্তনবাদ বা সংস্কারবাদ (Evolutionism/Reformism)। তিনি মনে করতেন, ট্রেড ইউনিয়ন এবং সংসদীয় রাজনীতির মাধ্যমে ধীরে ধীরে সমাজতন্ত্র অর্জন করা সম্ভব।

এই বিপ্লব বনাম সংস্কার (Revolution vs. Reform) বিতর্কটি মার্ক্সবাদের ইতিহাসে প্রথম বড় ভাঙন তৈরি করে এবং আজও তা প্রাসঙ্গিক।

রুশ বিপ্লবের মার্ক্সবাদ: লেনিন, ট্রটস্কি ও বলশেভিজম

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে মার্ক্সবাদের ভরকেন্দ্র জার্মানি থেকে রাশিয়ায় সরে আসে। রাশিয়ার পিছিয়ে থাকা, স্বৈরাচারী পরিবেশে মার্ক্সবাদ এক নতুন ও বিস্ফোরক রূপ নেয়।

  • ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন (Vladimir Ilyich Lenin): লেনিন ছিলেন একজন বিপ্লবী তাত্ত্বিক এবং বাস্তববাদী রাজনীতিবিদ। তিনি মার্ক্সবাদকে নিছক একটি বিশ্লেষণ পদ্ধতি থেকে এক কার্যকর বিপ্লবী হাতিয়ারে পরিণত করেন। তাঁর প্রধান অবদানগুলো হলো:

    • বিপ্লবী পার্টি (The Revolutionary Party): লেনিন তাঁর ‘কী করতে হবে?’ (What Is to Be Done?) বইতে বলেন, শ্রমিক শ্রেণী নিজে থেকে বিপ্লবী চেতনায় পৌঁছাতে পারে না, তারা বড়জোর ট্রেড ইউনিয়ন চেতনায় (অর্থাৎ, অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া) সীমাবদ্ধ থাকে। বিপ্লবী চেতনা বাইরে থেকে নিয়ে আসতে হয়। এই কাজটি করবে পেশাদার বিপ্লবীদের একটি সুসংগঠিত, কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত ও ইস্পাতকঠিন পার্টি—ভ্যানগার্ড পার্টি (Vanguard Party)। এই পার্টিই হবে বিপ্লবের চালিকাশক্তি।

    • সাম্রাজ্যবাদ তত্ত্ব (Theory of Imperialism): কেন উন্নত দেশে বিপ্লব হচ্ছে না, এই প্রশ্নের জবাবে লেনিন তাঁর ‘সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়’ (Imperialism, the Highest Stage of Capitalism) বইতে এক যুগান্তকারী তত্ত্ব দেন। তিনি দেখান যে, পুঁজিবাদ তার শেষ পর্যায়ে এসে সাম্রাজ্যবাদে পরিণত হয়েছে। উন্নত দেশগুলো উপনিবেশ শোষণ করে যে বিপুল উদ্বৃত্ত মুনাফা অর্জন করে, তা দিয়ে নিজেদের দেশের শ্রমিক শ্রেণীর একটি অংশকে সুবিধা দিয়ে শান্ত রাখে। ফলে, বিপ্লবের কেন্দ্র উন্নত দেশ থেকে সরে গিয়ে পুঁজিবাদের শৃঙ্খলের সবচেয়ে দুর্বল অংশে (weakest link), অর্থাৎ রাশিয়া বা উপনিবেশগুলোতে স্থানান্তরিত হয়।

    • সর্বহারার একনায়কত্ব (Dictatorship of the Proletariat): লেনিন মার্ক্সের এই ধারণাকে বাস্তবে প্রয়োগ করেন। তাঁর কাছে এর অর্থ ছিল, বিপ্লবের পর বুর্জোয়াদের প্রতিরোধকে চূর্ণ করার জন্য এবং সমাজতন্ত্র নির্মাণের জন্য শ্রমিক শ্রেণীর (পার্টির নেতৃত্বে) একচ্ছত্র রাষ্ট্রক্ষমতা।

  • লিওন ট্রটস্কি (Leon Trotsky): তিনি ছিলেন লেনিনের অন্যতম প্রধান সহযোগী। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত তত্ত্ব হলো ‘নিরন্তর বিপ্লব’ (Permanent Revolution)। ট্রটস্কি বলেন, রাশিয়ার মতো পিছিয়ে থাকা দেশে বিপ্লব শুধু বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক পর্যায়ে (যেমন, ভূমি সংস্কার) থেমে থাকবে না। যেহেতু সেখানকার বুর্জোয়া শ্রেণী দুর্বল ও বিপ্লববিমুখ, তাই শ্রমিক শ্রেণীকেই ক্ষমতা দখল করতে হবে এবং অবিলম্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কাজ শুরু করতে হবে। কিন্তু এই বিপ্লব একটি দেশে সীমাবদ্ধ থাকলে সফল হবে না। একে টিকে থাকার জন্য উন্নত দেশগুলোতেও বিপ্লব ছড়িয়ে দিতে হবে। এই বিশ্ববিপ্লবের ধারণাটি ছিল তাঁর চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু।

পশ্চিমা মার্ক্সবাদ (Western Marxism): বিপ্লবের ব্যর্থতা থেকে দর্শনের গভীরে

রাশিয়ার বাইরে, বিশেষ করে জার্মানিতে বিপ্লব ব্যর্থ হওয়ার পর পশ্চিমা বিশ্বে মার্ক্সবাদের একটি নতুন ধারার জন্ম হয়, যা ‘পশ্চিমা মার্ক্সবাদ’ নামে পরিচিত। এই ধারার চিন্তাবিদরা প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক সংগ্রাম থেকে কিছুটা সরে এসে দর্শন, সংস্কৃতি, মনোবিজ্ঞান এবং সমাজতত্ত্বের গভীরে প্রবেশ করেন। তাঁদের মূল প্রশ্ন ছিল—কেন উন্নত দেশের শ্রমিক শ্রেণী বিপ্লবী হয়ে উঠছে না? কেন তারা পুঁজিবাদের সাথেই নিজেদের মানিয়ে নিচ্ছে?

এই ধারার কয়েকজন প্রধান নক্ষত্র হলেন:

ক. গেয়র্গ লুকাচ (György Lukács): হাঙ্গেরীয় এই চিন্তাবিদকে পশ্চিমা মার্ক্সবাদের জনক বলা হয়। তাঁর বিখ্যাত বই ‘ইতিহাস ও শ্রেণী চেতনা’ (History and Class Consciousness)-এ তিনি দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দেন:

  • বস্তুকরণ (Reification): তিনি মার্ক্সের ‘পণ্যের ফেটিসিজম’ ধারণাটিকে আরও প্রসারিত করেন। তিনি দেখান যে, পুঁজিবাদী সমাজে শুধু পণ্য নয়, মানুষের সম্পর্ক, চিন্তা, এমনকি মানুষের আত্মাও বস্তুতে পরিণত হয়। সবকিছুকে কেনাবেচার নিরিখে মাপা হয়। এই বস্তুকরণ বা Reification সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে এবং মানুষের বিপ্লবী চেতনাকে ভোঁতা করে দেয়।

  • শ্রেণী চেতনা (Class Consciousness): লুকাচ বলেন, শ্রেণী চেতনা কোনো স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাপার নয়। শ্রমিক শ্রেণীকে তার ঐতিহাসিক ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে হয় এবং সামগ্রিকভাবে সমাজকে বোঝার ক্ষমতা অর্জন করতে হয়।

খ. আন্তোনিও গ্রামশি (Antonio Gramsci): মুসোলিনির কারাগারে লেখা অমর তত্ত্ব: ইতালীয় এই চিন্তাবিদ মার্ক্সবাদী তত্ত্বের অন্যতম সেরা মস্তিষ্ক। মুসোলিনির ফ্যাসিবাদী কারাগারে বসে তিনি তাঁর বিখ্যাত ‘প্রিজন নোটবুকস’ (Prison Notebooks) লেখেন। তাঁর মূল প্রশ্ন ছিল, রাশিয়ার মতো সহজে কেন পশ্চিম ইউরোপে বিপ্লব করা যাচ্ছে না? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে তিনি এক অসাধারণ তত্ত্ব দেন—সাংস্কৃতিক আধিপত্য বা হেজিমনি (Cultural Hegemony)। গ্রামশি বলেন, উন্নত পুঁজিবাদী সমাজে শাসক শ্রেণী শুধু রাষ্ট্রযন্ত্রের দমন-পীড়ন (পুলিশ, মিলিটারি) বা ডমিনেশন (Domination)-এর মাধ্যমে শাসন করে না। তাদের শাসনের মূল ভিত্তি হলো সমাজের সুশীল বা নাগরিক সমাজের (Civil Society) ওপর তাদের আধিপত্য বা হেজিমনি। এই নাগরিক সমাজ হলো—স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, চার্চ, মিডিয়া, ট্রেড ইউনিয়ন, বিভিন্ন ক্লাব ইত্যাদি। শাসক শ্রেণী এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে তাদের নিজস্ব দর্শন, মূল্যবোধ ও নৈতিকতাকে সমাজের ‘সাধারণ জ্ঞান’ (common sense) বা ‘স্বাভাবিক’ বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। ফলে, শোষিত শ্রেণী নিজেদের শোষণকেই স্বাভাবিক, যৌক্তিক এবং এমনকি অনিবার্য বলে মেনে নেয়। তারা শাসকের চোখে জগৎকে দেখতে শেখে। এটাই হলো হেজিমনি—জোর করে নয়, সম্মতি (consent) আদায়ের মাধ্যমে শাসন করা। গ্রামশির মতে, বিপ্লব সফল করতে হলে শুধু রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলেই হবে না। তার আগে প্রয়োজন একটি দীর্ঘস্থায়ী ‘অবস্থানের লড়াই’ (War of Position)। এই লড়াইয়ের মাধ্যমে বিপ্লবী শক্তিকে নাগরিক সমাজের ভেতরে প্রবেশ করে পাল্টা হেজিমনি (counter-hegemony) প্রতিষ্ঠা করতে হবে—অর্থাৎ, শ্রমিক শ্রেণীর নিজস্ব দর্শন, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে সমাজের নতুন ‘সাধারণ জ্ঞানে’ পরিণত করতে হবে। এটি মার্ক্সের অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদের একটি শক্তিশালী সমালোচনা ও পরিপূরক।

গ. ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল (The Frankfurt School): সংস্কৃতির সমালোচনা: জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে গড়ে ওঠা এই ঘরানার চিন্তাবিদরা (যেমন, ম্যাক্স হরকহাইমার, থিওডোর অ্যাডর্নো, হার্বার্ট মারক্যুজা) মার্ক্সবাদের সাথে ফ্রয়েডীয় মনোবিশ্লেষণ এবং সমাজতত্ত্বের মিশ্রণ ঘটান। তাঁরা দেখান, আধুনিক পুঁজিবাদ শুধু অর্থনীতি নয়, মানুষের মনস্তত্ত্বকেও নিয়ন্ত্রণ করে। তাঁদের মতে, ‘সংস্কৃতি শিল্প’ (Culture Industry)—যেমন, সিনেমা, পপ সঙ্গীত, টেলিভিশন—মানুষকে নিষ্ক্রিয় ভোগবাদী করে তোলে। এটি মানুষকে কৃত্রিম চাহিদা তৈরি করে দেয় এবং প্রতিবাদের ক্ষমতা কেড়ে নেয়। হার্বার্ট মারক্যুজা তাঁর ‘একমাত্রিক মানুষ’ (One-Dimensional Man) বইতে দেখান, আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজ এতটাই সর্বগ্রাসী যে এখানে কোনো সত্যিকারের বিরোধী চিন্তার অবকাশই নেই। সবকিছুই এই ব্যবস্থার অংশ হয়ে যায়।

ঘ. লুই আলথুসার (Louis Althusser): বিজ্ঞানের চোখে মার্ক্সবাদ: ফরাসি এই দার্শনিক মার্ক্সবাদকে আবার তার ‘বৈজ্ঞানিক’ মর্যাদায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। তিনি মার্ক্সের তরুণ বয়সের মানবতাবাদী লেখা (যেমন, ‘বিচ্ছিন্নতাবোধ’) এবং পরিণত বয়সের বৈজ্ঞানিক কাজ (‘পুঁজি’)-র মধ্যে একটি সুস্পষ্ট ছেদ বা ‘জ্ঞানতাত্ত্বিক বিচ্ছেদ’ (Epistemological Break) টানেন।
আলথুসার বলেন, ভাবাদর্শ (Ideology) কোনো মিথ্যা চেতনা নয়। এটি একটি বাস্তব প্রক্রিয়া, যা মানুষকে সমাজের মধ্যে তার কাল্পনিক সম্পর্ককে যাপন করতে সাহায্য করে। রাষ্ট্র শুধু দমনমূলক যন্ত্র (Repressive State Apparatus – RSA), যেমন পুলিশ বা সেনাবাহিনী, দিয়ে কাজ করে না। এটি মূলত কাজ করে ভাবাদর্শিক রাষ্ট্রযন্ত্র (Ideological State Apparatus – ISA), যেমন—স্কুল, পরিবার, ধর্ম, মিডিয়া ইত্যাদির মাধ্যমে। এই যন্ত্রগুলোই মানুষকে ব্যবস্থার অনুগত নাগরিকে পরিণত করে।

এখান থেকে এটাই পরিষ্কার যে, মার্ক্সবাদ কোনো একক, অখণ্ড মতবাদ নয়। এটি একটি বিচিত্র ও বিতর্কিত চিন্তার ঐতিহ্য। কাউটস্কির অবশ্যম্ভাবী সমাজতন্ত্র থেকে লেনিনের ভ্যানগার্ড পার্টি, গ্রামশির সাংস্কৃতিক লড়াই থেকে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ—প্রতিটি ধারাই মার্ক্সের মূল চিন্তাকে এক নতুন সময়ের, নতুন বাস্তবতার আলোকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে। এই বিভিন্ন ধারা প্রায়শই একে অপরের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছে, একে অপরকে ভুল বলে সমালোচনা করেছে। কিন্তু এই বিতর্ক, এই বৈচিত্র্যই মার্ক্সবাদের প্রাণশক্তি। এটি প্রমাণ করে যে, মার্ক্স কোনো চূড়ান্ত উত্তর দিয়ে যাননি; তিনি দিয়ে গেছেন একগুচ্ছ শক্তিশালী প্রশ্ন আর সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার একটি শক্তিশালী পদ্ধতি। সেই পদ্ধতি ব্যবহার করেই তাঁর উত্তরসূরিরা একবিংশ শতাব্দীর নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ—যেমন, বিশ্বায়ন, পরিবেশ সংকট, ডিজিটাল ক্যাপিটালিজম—বোঝার চেষ্টা করে চলেছেন। মার্ক্স তাই আজও প্রাসঙ্গিক।

একবিংশ শতাব্দীতে মার্ক্সের প্রাসঙ্গিকতা

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯০-এর দশকে ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার মতো তাত্ত্বিকরা ‘ইতিহাসের সমাপ্তি’ (The End of History) ঘোষণা করেছিলেন, যেখানে বলা হয়েছিল পুঁজিবাদী উদারনৈতিক গণতন্ত্রই মানব ইতিহাসের চূড়ান্ত পর্যায়, এর কোনো বিকল্প নেই। মনে হচ্ছিল, মার্ক্স বুঝি ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন।

কিন্তু সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে মার্ক্স আবার ফিরে এসেছেন, নতুন করে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা অনুভূত হচ্ছে। কেন?

  • ক্রমবর্ধমান অসাম্য: ২০০৮ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকট এবং তারপর থেকে বিশ্বজুড়ে সম্পদ ও আয়ের যে বিপুল অসাম্য তৈরি হয়েছে, তা মার্ক্সের পুঁজির কেন্দ্রীভবনের তত্ত্বকেই মনে করিয়ে দেয়। আজ পৃথিবীর মুষ্টিমেয় কিছু বিলিয়নিয়ারের হাতে বিশ্বের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর চেয়ে বেশি সম্পদ কুক্ষিগত। এই বাস্তবতা মার্ক্সীয় বিশ্লেষণের জন্য নতুন রসদ জোগাচ্ছে।

  • বিশ্বায়ন (Globalization): মার্ক্স ও এঙ্গেলস ‘কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো’-তেই পুঁজির বিশ্বজয়ের চরিত্র সম্পর্কে লিখেছিলেন। পুঁজি কীভাবে নিজের প্রয়োজনে সমস্ত ভৌগোলিক সীমানা ভেঙে দিয়ে একটি বিশ্ব-বাজার তৈরি করবে, তার নিখুঁত বর্ণনা তাঁরা দিয়েছিলেন। আজকের বিশ্বায়ন, বহুজাতিক কর্পোরেশন এবং বিশ্বব্যাপী সাপ্লাই চেইন যেন তাঁদের সেই ভবিষ্যদ্বাণীরই প্রতিচ্ছবি।

  • গিগ ইকোনমি ও প্রিক্যারিয়েট: আজকের উবার চালক, ডেলিভারি বয় বা ফ্রিল্যান্সারদের কাজের ধরণ দেখুন। এখানে কোনো নির্দিষ্ট চাকরির নিরাপত্তা নেই, নেই কোনো ইউনিয়ন বা পেনশনের ব্যবস্থা। এই নব্য শ্রমিক শ্রেণী, যাদেরকে ‘প্রিক্যারিয়েট’ (Precariat – Precarious Proletariat) বলা হচ্ছে, তারা মার্ক্সের বর্ণিত বিচ্ছিন্নতাবোধ এবং শোষণের এক নতুন ও নগ্ন রূপের শিকার।

  • পরিবেশ সংকট: মুনাফার জন্য প্রকৃতির ওপর লাগামহীন অত্যাচার এবং তার ফলে সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ বিপর্যয়কেও মার্ক্সীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা যায়। মার্ক্স ‘মেটাবলিক রিফট’ (Metabolic Rift) বা মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যকার বিপাকীয় ভাঙনের কথা বলেছিলেন, যেখানে পুঁজিবাদী কৃষি প্রকৃতির স্বাভাবিক চক্রকে ধ্বংস করে দেয়। আজকের পরিবেশ সংকট সেই বিশ্লেষণেরই এক ভয়ঙ্কর রূপ।

  • ডিজিটাল ক্যাপিটালিজম: গুগল, ফেসবুকের মতো টেক জায়ান্টরা আমাদের ব্যক্তিগত ডেটা বা তথ্যকে পণ্যে পরিণত করে বিপুল মুনাফা অর্জন করছে। এখানে আমরা তাদের পরিষেবা ব্যবহার করার মাধ্যমে এক নতুন ধরনের অলক্ষ্য শ্রম দিচ্ছি। এটিও পুঁজিবাদের শোষণের এক নতুন ক্ষেত্র, যা মার্ক্সীয় তত্ত্ব দিয়ে বোঝা সম্ভব।

শেষ কথা

তাহলে কার্ল মার্ক্সকে আমরা কীভাবে দেখব? তাঁকে কোনো অভ্রান্ত নবী বা রক্তপিপাসু শয়তান হিসেবে দেখার দরকার নেই। এই দ্বিমাত্রিক চিত্রায়ন তাঁর প্রতি সুবিচার করে না। তিনি ছিলেন উনবিংশ শতাব্দীর একজন অসামান্য সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ ও বিপ্লবী দার্শনিক, যিনি তাঁর সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যবস্থা—পুঁজিবাদের চরিত্রকে বোঝার এবং তাকে অতিক্রম করার জন্য তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর বিশ্লেষণ ছিল ক্ষুরধার, তাঁর অন্তর্দৃষ্টি ছিল গভীর এবং তাঁর স্বপ্ন ছিল বিশাল।

তার দেয়া উত্তরগুলো নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকলেও একটা বিষয় সকলেই মেনে নেন, আর তা হচ্ছে কিন্তু সঠিক প্রশ্নগুলো করতে পেরেছিলেন। কেন এই পৃথিবীতে এত সম্পদ থাকা সত্ত্বেও কোটি কোটি মানুষ অনাহারে থাকে? কেন এত প্রযুক্তিগত উন্নতির পরেও মানুষ তার নিজের কাজে আনন্দ পায় না, বিচ্ছিন্ন বোধ করে? কেন আমাদের সমাজ এমনভাবে তৈরি যেখানে একজনের লাভ মানে অন্যজনের ক্ষতি? এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন—এর থেকে ভালো, আরও মানবিক, আরও ন্যায্য একটি সমাজ কি আদৌ সম্ভব?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আজও আমাদের তাড়া করে ফেরে। আর এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার জন্যই কার্ল মার্ক্সকে পড়া, বোঝা ও তাঁর সাথে বিতর্কে জড়ানোটা জরুরি। তাঁর সাথে একমত হওয়া বা না হওয়াটা পরের বিষয়। আসল কথা হলো, তাঁর চিন্তার আয়নায় আমাদের সময় ও সমাজকে যাচাই করে দেখা। কারণ যে ঘুমিয়ে আছে, তাকে জাগানো যায়। কিন্তু যে জেগে জেগে ঘুমায়, তাকে জাগানো খুব কঠিন। কার্ল মার্ক্স আমাদের সেই আরামের ঘুম ভাঙানোর জন্যই আজীবন লিখে গেছেন।

তথ্যসূত্র

  • Engels, F. (1845). The Condition of the Working Class in England. (Published in German). Panther. (English translation edition).
  • Feuerbach, L. (1841). Das Wesen des Christentums (The Essence of Christianity). (M. Evans, Trans.). J. Chapman.
  • Gramsci, A. (1971). Selections from the Prison Notebooks. (Q. Hoare & G. Nowell Smith, Eds. & Trans.). Lawrence & Wishart.
  • Marx, K. (1844). Economic and Philosophic Manuscripts of 1844. (Published posthumously). In Marx-Engels Collected Works, Vol. 3. Lawrence & Wishart.
  • Marx, K. (1845). Theses on Feuerbach. (Published posthumously). In Marx-Engels Collected Works, Vol. 5. Lawrence & Wishart.
  • Marx, K., & Engels, F. (1848). Manifesto of the Communist Party. In Marx-Engels Collected Works, Vol. 6. Lawrence & Wishart.
  • Marx, K. (1859). A Contribution to the Critique of Political Economy. Progress Publishers.
  • Marx, K. (1867). Capital: A Critique of Political Economy, Volume 1. (B. Fowkes, Trans.). Penguin Classics. (Original work published 1867).
  • Marx, K. (1875). Critique of the Gotha Programme. (Published posthumously). In Marx-Engels Selected Works, Vol. 3. Progress Publishers.
  • Marx, K., & Engels, F. (1846). The German Ideology. (Published posthumously). In Marx-Engels Collected Works, Vol. 5. Lawrence & Wishart.
  • Marx, K., & Engels, F. (1848). Manifesto of the Communist Party. In Marx-Engels Collected Works, Vol. 6. Lawrence & Wishart.
  • Popper, K. (1945). The Open Society and Its Enemies, Vol. 2: The High Tide of Prophecy: Hegel, Marx, and the Aftermath. Routledge.
  • Ricardo, D. (1817). On the Principles of Political Economy and Taxation. John Murray.

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.