মার্ক্সবাদ সম্পর্কে জানতে যান এখানে – কার্ল মার্ক্স ও তার মার্ক্সবাদ: যা পৃথিবীকে ঝাঁকিয়ে দিয়েছে
Table of Contents
ভূমিকা
চায়ের কাপে কখনো ঝড় উঠতে দেখেছেন?
হয়তো দেখেননি। কিন্তু ‘চায়ের কাপে ঝড়’ কথাটা আমরা প্রায়ই বলি। ছোটখাটো কোনো ঘটনা যখন বড় আকার ধারণ করে, তখন এই বাক্যটি ব্যবহৃত হয়। আচ্ছা, ভাবুন তো, আসলেই কি চায়ের কাপে ঝড় ওঠে? ওঠে তো বটেই। হয়তো খালি চোখে দেখা যায় না। গরম চা ধীরে ধীরে ঠান্ডা হচ্ছে। বাষ্প উড়ে যাচ্ছে। চিনির কণাগুলো গলে গিয়ে চায়ের সাথে মিশে যাচ্ছে। প্রতিটি মুহূর্তে চায়ের কাপের ভেতরে চলছে এক বিশাল পরিবর্তন। এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় রূপান্তর। প্রতিটি কণার মধ্যে চলছে এক নীরব, কিন্তু তীব্র সংঘাত।
আমাদের চারপাশের জগৎটাও ঠিক এই চায়ের কাপের মতো। সবকিছু বদলে যাচ্ছে। আপনি, আমি, আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র, গাছপালা, নদী-নালা, মহাকাশের গ্রহ-নক্ষত্র—কোনো কিছুই স্থির নয়। সবকিছুই এক নিরন্তর পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে চলেছে। এই যে আপনি লেখাটি পড়ছেন, এই মুহূর্তেও আপনার শরীরের কোটি কোটি কোষ মরে যাচ্ছে, আবার নতুন কোষ জন্ম নিচ্ছে। হিমালয় পর্বতমালা, যা আমাদের কাছে স্থিরতার প্রতীক, প্রতি বছর কয়েক মিলিমিটার করে উঁচু হচ্ছে। পরিবর্তনই এই মহাবিশ্বের একমাত্র ধ্রুবক।
কিন্তু এই পরিবর্তনটা হয় কীভাবে? এর পেছনের মূল সূত্রটা কী? কোনো নিয়ম কি আছে, নাকি সবকিছু খামখেয়ালিভাবে, কোনো এক অদৃশ্য জাদুকরের ইশারায় ঘটে? জগৎ কি এক বিশৃঙ্খল প্রহেলিকা, নাকি এর গতির পেছনে কোনো যুক্তিপূর্ণ নিয়ম কাজ করছে?
উনিশ শতকের জার্মানির দুই বন্ধু, কার্ল মার্ক্স (Karl Marx) আর ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস (Friedrich Engels), এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গিয়ে এক অদ্ভুত চশমা আবিষ্কার করলেন। সেই চশমার নাম ‘দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ’ (Dialectical Materialism)। এই চশমা চোখে লাগালে পৃথিবীকে আর আগের মতো মনে হয় না। সবকিছুকে কেমন যেন অন্যরকম লাগে। মনে হয়, জগতের সব রহস্যের চাবিকাঠি বুঝি হাতে এসে গেছে। যা কিছুকে এতদিন বিচ্ছিন্ন, আকস্মিক বা দৈব মনে হতো, তার পেছনেও এক গভীর কার্যকারণ সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়। এটি শুধু একটি দর্শন নয়, এটি জগৎকে দেখার একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, একটি বিশ্ববীক্ষা (Worldview)।
আজ আমরা সেই জাদুকরী চশমাটা পরেই পৃথিবীটাকে দেখার চেষ্টা করব। ভয় পাবেন না, খুব কঠিন কিছু নয়। চায়ের কাপের উদাহরণটা মাথায় রাখলেই চলবে। আমরা ধীরে ধীরে, ধাপে ধাপে এই দর্শনের গভীরে প্রবেশ করব। চলুন, এক দীর্ঘ কিন্তু আগ্রহোদ্দীপক ভ্রমণে বেরিয়ে পড়া যাক।
নামেই পরিচয়: চলুন ব্যবচ্ছেদ করি
‘দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ’—নামটা শুনেই কেমন দাঁতভাঙা মনে হচ্ছে, তাই না? মনে হচ্ছে, খুব জটিল আর কাঠখোট্টা কোনো বিষয়। দর্শনের বইগুলো খুললেই এমন সব শব্দ পাওয়া যায়, যা পড়লে মাথা ঘুরে যায়। কিন্তু আসলে ব্যাপারটা অত জটিল নয়। আমরা যদি নামটাকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলি, তাহলে এর ভেতরের মূল আত্মাটাকে ধরতে পারব।
ভাগ দুটি হলো:
- ১. বস্তুবাদ (Materialism)
- ২. দ্বন্দ্বমূলক পদ্ধতি (The Dialectical Method)
এই দুটিকে একসাথে মিশিয়েই তৈরি হয়েছে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ। এটি যেন একটি গাড়ির মতো। ‘বস্তুবাদ’ হলো গাড়ির কাঠামো আর চাকা, যা মাটির উপর দাঁড়িয়ে আছে। আর ‘দ্বন্দ্বমূলক পদ্ধতি’ হলো সেই গাড়ির ইঞ্জিন, যা তাকে স্থির থাকতে দেয় না, অনবরত সামনের দিকে ঠেলে নিয়ে যায়। চলুন, প্রথমে গাড়ির কাঠামো, অর্থাৎ ‘বস্তুবাদ’ অংশটা নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করা যাক।
বস্তুবাদ (Materialism): জগৎটা আসলে কী দিয়ে তৈরি?
জগৎটা কী দিয়ে তৈরি—এই প্রশ্নটা মানব ইতিহাসের সম্ভবত সবচেয়ে পুরোনো প্রশ্নগুলোর একটি। প্রাচীন গ্রিস থেকে প্রাচীন ভারত, সব জায়গার চিন্তাশীল মানুষেরা এই প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন। এই প্রশ্নের উত্তরের উপর ভিত্তি করে দার্শনিকেরা মোটা দাগে দুই ভাগে বিভক্ত।
ভাববাদ (Idealism): একদল বলেন, জগৎটা মূলত ‘ভাব’ (Idea), ‘চেতনা’ (Consciousness) বা ‘আত্মা’ (Spirit) দিয়ে তৈরি। আসল জিনিসটা হলো চিন্তা বা ভাবনা। বস্তু বা পদার্থ যা আমরা দেখি, তা সেই ভাবনারই একটি প্রকাশ মাত্র, একটি ছায়ামূর্তি। এদেরকে বলা হয় ভাববাদী (Idealist)। যেমন ধরুন, গ্রিক দার্শনিক প্লেটো (Plato) মনে করতেন, আমাদের এই জগতের প্রতিটি জিনিসের (যেমন: চেয়ার, টেবিল, বিড়াল) একটি নিখুঁত ‘আদর্শ রূপ’ বা ‘ভাব’ (Form) অন্য কোনো এক ভাবনার জগতে (World of Forms) রয়েছে। আমরা আমাদের এই বস্তু জগতে যা দেখি, তা সেই আসল রূপের একটি অসম্পূর্ণ নকল মাত্র। অর্থাৎ, চেয়ারের ‘ভাবনা’ আগে, সত্যিকারের চেয়ার পরে। আইরিশ দার্শনিক বিশপ বার্কলি (George Berkeley) তো আরও এক ধাপ এগিয়ে বললেন, “To be is to be perceived” অর্থাৎ কোনো কিছুর অস্তিত্ব নির্ভর করে তাকে উপলব্ধি করার ওপর। যদি কোনো মন তাকে উপলব্ধি না করে, তবে তার অস্তিত্বই নেই। ভারতীয় দর্শনেও অদ্বৈত বেদান্তের মতো ভাববাদী ধারা রয়েছে, যেখানে ‘ব্রহ্ম’ বা পরম চৈতন্যকেই একমাত্র সত্য বলে মনে করা হয় এবং এই জগৎকে ‘মায়া’ বা ভ্রম বলে বর্ণনা করা হয়।
বস্তুবাদ (Materialism): আরেক দল ঠিক এর উল্টো কথা বলেন। তারা বলেন, না, আসল জিনিসটা হলো ‘বস্তু’ (Matter) বা ‘পদার্থ’। আমাদের চারপাশের এই জগৎ, গাছপালা, মাটি, জল, বাতাস—সবই বস্তু। আর আমাদের ‘ভাবনা’ বা ‘চেতনা’ এই বস্তুরই একটি উন্নত এবং জটিল রূপ। অর্থাৎ, বস্তু আগে, চেতনা পরে। এদেরকেই বলা হয় বস্তুবাদী (Materialist)। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক ডেমোক্রিটাস (Democritus) মনে করতেন, সবকিছুই অবিভাজ্য ‘পরমাণু’ (Atom) দিয়ে তৈরি। ভারতের চার্বাক বা লোকায়ত দর্শনও ছিল ঘোর বস্তুবাদী। তাদের মতে, দেহ ছাড়া আত্মার কোনো অস্তিত্ব নেই, এবং প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাই জ্ঞানের একমাত্র উৎস।
মার্ক্স ও এঙ্গেলস ছিলেন কট্টর বস্তুবাদী, অর্থাৎ দ্বিতীয় দলের লোক। তাদের মতে, ভাব বা চেতনা আকাশ থেকে পড়ে না। এটি কোনো অতিপ্রাকৃত বিষয় নয়। মানুষের মস্তিষ্ক, যা কিনা একটি বস্তুগত অঙ্গ, তার জটিল স্নায়বিক ক্রিয়ার ফলেই চেতনার জন্ম হয়। মস্তিষ্ক ছাড়া যেমন ভাবনা সম্ভব নয়, তেমনি বস্তু ছাড়া এই জগৎও সম্ভব নয়। বস্তু হলো প্রাথমিক (primary), আর চেতনা হলো তার থেকে উদ্ভূত বা গৌণ (secondary)।
বিষয়টাকে আরেকটু সহজ করা যাক। ধরুন, আপনি একটি সুস্বাদু আম খাচ্ছেন। ভাববাদীরা হয়তো বলবেন, ‘আমের স্বাদ’ নামক যে ‘ভাবনা’ বা ‘অনুভূতি’, সেটাই আসল। আমটা সেই ভাবনার একটি বস্তুগত প্রকাশ। অন্যদিকে, বস্তুবাদীরা বলবেন, ‘আরে না! আগে আম নামক বস্তুটি আছে। সেই বস্তুটি আপনার জিহ্বার স্নায়ুতে রাসায়নিক বিক্রিয়া করছে, সেই সংকেত আপনার মস্তিষ্কে যাচ্ছে এবং তার ফলেই ‘মিষ্টি স্বাদ’ নামক চেতনার জন্ম হচ্ছে। আম না থাকলে আমের স্বাদ আসত কোথা থেকে?’ (Engels, 1886)।
তবে মার্ক্স ও এঙ্গেলসের বস্তুবাদ আগের বস্তুবাদীদের থেকে ভিন্ন ছিল। আঠারো শতকের ফরাসি জ্ঞানদীপ্তি যুগের বস্তুবাদীরা (যেমন: দিদেরো, হলবাক) জগৎকে একটি বিশাল ঘড়ির মতো ভাবতেন, যা কিছু নির্দিষ্ট, অপরিবর্তনীয় নিয়ম মেনে চলে। একে বলা হয় যান্ত্রিক বস্তুবাদ (Mechanical Materialism)। সেখানে পরিবর্তনের কোনো অভ্যন্তরীণ উৎস ছিল না, ছিল শুধু বাইরের ধাক্কা। মার্ক্সের গুরুস্থানীয় জার্মান দার্শনিক লুডভিগ ফয়েরবাখও (Ludwig Feuerbach) বস্তুবাদী ছিলেন, কিন্তু তার বস্তুবাদ ছিল মূলত নিষ্ক্রিয় ও ধ্যানমূলক (contemplative)। মার্ক্স ফয়েরবাখের সমালোচনা করে তার বিখ্যাত Theses on Feuerbach-এ লেখেন, “দার্শনিকেরা এতদিন কেবল জগৎকে নানাভাবে ব্যাখ্যাই করেছেন; কিন্তু আসল কাজ হলো জগৎকে পরিবর্তন করা।” মার্ক্স ও এঙ্গেলস এই যান্ত্রিক ও নিষ্ক্রিয় বস্তুবাদকে প্রত্যাখ্যান করে বললেন, বস্তু নিছকই এক জড়পিণ্ড নয়। বস্তুর ভেতরেই পরিবর্তনের শক্তি লুকিয়ে আছে। আর এইখানেই তারা হেগেলের কাছ থেকে ধার করা ‘দ্বন্দ্বমূলক পদ্ধতি’কে বস্তুবাদের সাথে জুড়ে দিয়ে এক নতুন, বৈপ্লবিক বস্তুবাদ তৈরি করলেন।
দ্বন্দ্বমূলক পদ্ধতি (The Dialectical Method): পরিবর্তনের ইঞ্জিন
‘বস্তুবাদ’ যদি হয় গাড়ির কাঠামো, যা তাকে মাটিতে দাঁড় করিয়ে রাখে, তবে ‘দ্বন্দ্বমূলক পদ্ধতি’ হলো সেই গাড়ির ইঞ্জিন। তবে এ সাধারণ কোনো ইঞ্জিন নয়, যা কেবল বাইরের শক্তি দিয়ে চলে। এ এমন এক ইঞ্জিন, যার ভেতরেই রয়েছে বিস্ফোরণ, সংঘাত এবং রূপান্তরের এক অন্তহীন প্রক্রিয়া। এই ইঞ্জিনই জগৎকে স্থির থাকতে দেয় না, অনবরত সামনের দিকে ঠেলে নিয়ে যায়।
পৃথিবীকে দেখার দুটি মৌলিক উপায় আছে। একটি হলো অধিবিদ্যামূলক (Metaphysical) বা যান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে জগৎকে দেখা হয় কতগুলো বিচ্ছিন্ন, স্থির ও অপরিবর্তনীয় জিনিসের সমষ্টি হিসেবে। এটি যেন একটি ছবির অ্যালবামের মতো, যেখানে প্রতিটি ছবি আলাদা এবং স্থির। একটির সাথে আরেকটির সম্পর্ক বাহ্যিক। পরিবর্তন ঘটলে তা বাইরে থেকে কোনো ধাক্কার ফলেই ঘটে।
এর বিপরীতে রয়েছে দ্বন্দ্বমূলক (Dialectical) দৃষ্টিভঙ্গি। এটি জগৎকে একটি ছবির অ্যালবাম হিসেবে দেখে না, দেখে একটি চলমান চলচ্চিত্র হিসেবে। এখানে কোনো কিছুই বিচ্ছিন্ন বা স্থির নয়। সবকিছুই পরস্পরের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত এবং এক নিরন্তর পরিবর্তন ও বিকাশের প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। আর এই পরিবর্তনের উৎস বাইরে নয়, বস্তুর বা ঘটনার ভেতরেই নিহিত। তার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বই তাকে পরিবর্তনের দিকে চালিত করে। দ্বন্দ্বমূলক পদ্ধতি হলো এই পরিবর্তনের অন্তর্নিহিত যুক্তি বা লজিককে বোঝার চাবিকাঠি।
প্রাচীন গ্রিসের পদধ্বনি: হেরাক্লিটাস থেকে সক্রেটিস
‘ডায়ালেক্টিকস’ (Dialectics) বা দ্বন্দ্বতত্ত্বের ধারণাটি বেশ পুরোনো। এর জন্ম প্রাচীন গ্রিসে, প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে। আইওনিয়ান দার্শনিক হেরাক্লিটাস (Heraclitus), যিনি ‘অন্ধকার দার্শনিক’ (The Obscure) নামেও পরিচিত, তিনিই প্রথম এই ধারণার একটি জোরালো রূপ দেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, “Panta rhei” অর্থাৎ “সবকিছুই প্রবহমান।” তার সেই বিখ্যাত উক্তি— “একই নদীতে দুবার পা রাখা যায় না”—এই ধারণারই সারমর্ম। কারণ দ্বিতীয়বার পা রাখতে গেলে নদীর জল বদলে যায়, আপনিও বদলে যান।
হেরাক্লিটাসের মতে, এই অনন্ত পরিবর্তনের কারণ কী? তার মতে, বিপরীতের সংঘাত (conflict of opposites)। তিনি বলতেন, “সংগ্রামই সবকিছুর জনক এবং সবকিছুর রাজা।” (War is the father and king of all)। জগৎ টিকে আছে বিপরীতের টানের ওপর, যেমন একটি ধনুকের টান বা বীণার সুর। তিনি আরও বলেন, “পথ, ওপরের দিকে এবং নীচের দিকে, এক এবং অভিন্ন।” (The way up and the way down are one and the same)। ঠান্ডা থেকে গরম হয়, গরম থেকে ঠান্ডা; ভেজা শুকিয়ে যায়, শুকনো ভিজে যায়। জগৎ হলো এক চিরন্তন আগুন, যা নির্দিষ্ট মাপে জ্বলে ওঠে এবং নির্দিষ্ট মাপে নিভে যায়।
হেরাক্লিটাসের ঠিক বিপরীতে ছিলেন এলিয়াটিক দার্শনিক পারমেনাইডিস (Parmenides)। তিনি যুক্তি দেন যে, পরিবর্তন একটি ভ্রম মাত্র। আসল সত্তা (Being) হলো এক, শাশ্বত এবং অপরিবর্তনীয়। তার শিষ্য জেনো (Zeno) গুরুর এই মতকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিখ্যাত কিছু কূটাভাস বা প্যারাডক্স তৈরি করেন। যেমন, তার ‘তীরের কূটাভাস’ (Arrow Paradox) অনুযায়ী, একটি উড়ন্ত তীর আসলে স্থির। কারণ সময়ের প্রতিটি মুহূর্তে তীরটি একটি নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করে। আর কোনো নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করার অর্থ হলো স্থির থাকা। যেহেতু সময়ের প্রতিটি মুহূর্তে তীরটি স্থির, সুতরাং পুরো যাত্রাপথেই এটি স্থির! এই যুক্তির মাধ্যমে জিনো দেখাতে চেয়েছিলেন যে, আমাদের ইন্দ্রিয়লব্ধ গতির ধারণাটি আসলে যৌক্তিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ।
এই দুই বিপরীত চিন্তার (হেরাক্লিটাসের পরিবর্তনশীল জগৎ বনাম পারমেনাইডিসের স্থির জগৎ) মধ্য দিয়েই পশ্চিমা দর্শন এগিয়েছে। দ্বন্দ্বমূলক পদ্ধতি এই দুই চরম অবস্থানের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন রচনার চেষ্টা করে। এটি স্বীকার করে যে জগতে স্থিতিশীলতা আছে, কিন্তু সেই স্থিতিশীলতা আপেক্ষিক এবং অস্থায়ী। মূল সত্য হলো পরিবর্তন, যা স্থিতিশীলতার খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসে।
‘ডায়ালেক্টিকস’ শব্দটি নিজেও গ্রিক ‘dialegesthai’ থেকে এসেছে, যার অর্থ কথোপকথন বা বিতর্ক করা। সক্রেটিস (Socrates) এই পদ্ধতিকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যান। তিনি কোনো কিছু সরাসরি শেখাতেন না, বরং প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে অন্যের যুক্তির ভেতরের দ্বন্দ্ব বা অসংগতিকে উন্মোচন করতেন। এই পদ্ধতির মাধ্যমে একটি অস্পষ্ট বা ভুল ধারণা থেকে একটি স্পষ্টতর ধারণায় পৌঁছানো যেত। এটিও ছিল এক ধরনের দ্বন্দ্বমূলক প্রক্রিয়া, তবে তা ছিল মূলত জ্ঞানতাত্ত্বিক বা যৌক্তিক।
হেগেলের ভাববাদী ডায়ালেক্টিকস: যখন ভাবনাই ইতিহাস গড়ে
হেরাক্লিটাস বা সক্রেটিসের হাতে যা ছিল ভ্রূণ আকারে, সেই দ্বন্দ্বমূলক পদ্ধতিকে একটি পরিপূর্ণ, সুবিশাল এবং জটিল দার্শনিক পদ্ধতিতে রূপ দেন জার্মান ভাববাদী দার্শনিক গেয়র্গ ভিলহেলম ফ্রিডরিখ হেগেল (Georg Wilhelm Friedrich Hegel)। হেগেলের দর্শনকে বুঝতে হলে তার সময়কার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বোঝা জরুরি। ফরাসি বিপ্লব তখন ইউরোপের পুরোনো সমাজব্যবস্থাকে ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে। ইতিহাস যে স্থির নয়, বরং এক নাটকীয় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে, তা হেগেল নিজের চোখেই দেখছিলেন। তিনি এই ঐতিহাসিক পরিবর্তনের পেছনের মূল সূত্রটি আবিষ্কার করতে চেয়েছিলেন।
হেগেল ছিলেন একজন ভাববাদী (Idealist)। তার কাছে মূল চালিকাশক্তি ছিল ‘ভাব’ বা ‘Idea’, যা তিনি ‘পরম ভাব’ (Absolute Idea) বা ‘বিশ্ব-আত্মা’ (World-Spirit/Geist) নামে অভিহিত করেছেন। তার মতে, জগতের ইতিহাস হলো এই ‘পরম ভাব’-এর আত্ম-বিকাশের ইতিহাস। পরম ভাব প্রথমে নিজের সম্পর্কে অসচেতন থাকে। সে নিজেকে জানার জন্য প্রকৃতি এবং মানব ইতিহাসের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করে এবং অবশেষে দর্শন, শিল্প ও ধর্মের মাধ্যমে নিজের সম্পর্কে পূর্ণ চেতনা লাভ করে। এই পুরো যাত্রাটিই একটি দ্বন্দ্বমূলক প্রক্রিয়ায় ঘটে।
হেগেলের এই জটিল পদ্ধতিকে তার অনুসারীরা পরে একটি সরল ছকে জনপ্রিয় করেন, যা ‘থিসিস-অ্যান্টিথিসিস-সিন্থেসিস’ নামে পরিচিত।
- ১. থিসিস (Thesis): কোনো একটি ধারণা বা অবস্থা। (যেমন: একটি বীজ)
- ২. অ্যান্টিথিসিস (Antithesis): সেই ধারণা বা অবস্থার ভেতরের বা বাইরের বিপরীত শক্তি, যা তাকে নাকচ করে। (যেমন: বীজটি মাটিতে পুঁতে দিলে অঙ্কুরোদগম হয়, যা বীজের অবস্থাকে নাকচ করে দেয়)
- ৩. সিন্থেসিস (Synthesis): এই দুই বিপরীতের সংঘাতের ফলে একটি নতুন ও উন্নত অবস্থার জন্ম, যা পুরোনো দুটি ধাপের ভালো দিকগুলোকে ধারণ করে। (যেমন: বীজ ও অঙ্কুরোদগমের সংঘাতের ফলে একটি পূর্ণাঙ্গ গাছের জন্ম হয়, যা বীজের চেয়ে উন্নত কিন্তু তার মধ্যেই আবার নতুন বীজ ধারণ করে)।
তবে এই সরল ছকটি হেগেলের চিন্তার গভীরতাকে পুরোপুরি ধরতে পারে না। হেগেলের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারণাটি ছিল Aufhebung (সাধারণত ইংরেজিতে Sublation বলা হয়)। এই জার্মান শব্দটির কোনো নিখুঁত ইংরেজি বা বাংলা প্রতিশব্দ নেই। এর মধ্যে তিনটি অর্থ একসঙ্গে লুকিয়ে আছে: (ক) বাতিল করা বা নাকচ করা (to cancel), (খ) সংরক্ষণ করা (to preserve), এবং (গ) উন্নত স্তরে তুলে ধরা (to lift up)।
বীজের উদাহরণটিতে ফিরে যাওয়া যাক। গাছটি যখন জন্মায়, তখন সে বীজকে ‘বাতিল’ করে দেয়, বীজটি আর থাকে না। কিন্তু সে বীজের সম্ভাবনাকে ‘সংরক্ষণ’ করে এবং একটি উন্নত স্তরে, অর্থাৎ গাছে ‘তুলে ধরে’। একইভাবে, গাছ থেকে যখন ফল ও নতুন বীজ হয়, তখন তা গাছকে নাকচ করে, কিন্তু তার সারবস্তুকে একটি উচ্চতর এবং বহুগুণিত রূপে সংরক্ষণ করে। হেগেলের কাছে ইতিহাস এভাবেই এগোয়—পুরোনোকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে নয়, বরং তাকে অতিক্রম করে এবং তার সারবস্তুকে নতুন রূপে ধারণ করে। যেমন, তার মতে, ফরাসি বিপ্লবের ‘সিন্থেসিস’ হলো এমন একটি সাংবিধানিক রাষ্ট্র, যা রাজতন্ত্রের স্থিতিশীলতা (থিসিস) এবং বিপ্লবের চরম স্বাধীনতা (অ্যান্টিথিসিস)—উভয়কেই একটি উচ্চতর ঐক্যে ধারণ করে।
মার্ক্সের বৈপ্লবিক উল্টানো: ডায়ালেক্টিকস যখন পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ায়
তরুণ কার্ল মার্ক্স ছিলেন ‘ইয়ং হেগেলিয়ান’ নামক একটি দার্শনিক গোষ্ঠীর সদস্য, যারা হেগেলের পদ্ধতিকে ধর্মের সমালোচনায় ব্যবহার করতেন। কিন্তু খুব শীঘ্রই মার্ক্স হেগেলের ভাববাদে সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। তার কাছে মনে হলো, হেগেলের দর্শন একটি চমৎকার প্রাসাদের মতো, কিন্তু তা দাঁড়িয়ে আছে বাতাসের উপর। ইতিহাসকে চালনা করছে কোনো রহস্যময় ‘পরম ভাব’—এই ধারণা তার কাছে অযৌক্তিক মনে হলো।
এই সময়েই লুডভিগ ফয়েরবাখের বস্তুবাদী দর্শন তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। ফয়েরবাখ দেখান, ঈশ্বর মানুষকে সৃষ্টি করেনি, বরং মানুষই তার নিজের কল্পনা দিয়ে ঈশ্বরকে সৃষ্টি করেছে। মার্ক্স এই ধারণাটিকে আরও এগিয়ে নিয়ে গেলেন। তিনি বললেন, শুধু ধর্ম নয়, হেগেলের ‘পরম ভাব’ও মানুষেরই সৃষ্টি। হেগেলের দর্শন আসলে বাস্তব জগতেরই একটি উল্টানো প্রতিবিম্ব।
এই উপলব্ধি থেকেই মার্ক্সের সেই বিখ্যাত উক্তিটি আসে: হেগেলের দর্শনে ডায়ালেক্টিকস ‘মাথার ওপর দাঁড়িয়ে’ ছিল। তিনি তাকে ধরে ‘পায়ের ওপর দাঁড় করিয়েছেন’ (Marx, 1873, Afterword to the Second German Edition of Das Kapital)।
এর মানে কী? এর মানে হলো, মার্ক্স হেগেলের পদ্ধতিটির বিপ্লবী সারবস্তু (revolutionary kernel) গ্রহণ করলেন, কিন্তু তার ভাববাদী রহস্যময় খোলসটি (mystical shell) ফেলে দিলেন। তিনি বললেন, দ্বন্দ্ব বা সংঘাত ভাবনার জগতে হয় না, হয় আমাদের চারপাশের এই বস্তুগত জগতে। ইতিহাসকে চালনা করে কোনো বিমূর্ত ‘ভাব’ নয়, বরং মূর্ত, বাস্তব জগতের দ্বন্দ্ব। সমাজের ভেতরে থাকা বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে, উৎপাদন পদ্ধতির ভেতরে থাকা বিভিন্ন শক্তির মধ্যে এই দ্বন্দ্ব চলতে থাকে। আর এই দ্বন্দ্বই হলো প্রকৃতি, সমাজ ও ইতিহাস বদলের মূল চালিকাশক্তি।
হেগেলের কাছে যেখানে ইতিহাসের চালিকাশক্তি ছিল ভাবের বিকাশ, মার্ক্সের কাছে তা হলো বস্তুগত উৎপাদন পদ্ধতির বিকাশ। হেগেলের কাছে দ্বন্দ্ব ছিল যৌক্তিক, মার্ক্সের কাছে দ্বন্দ্ব হলো বাস্তব। যেমন, পুঁজিবাদের প্রধান দ্বন্দ্বটি কোনো বিমূর্ত ধারণা নয়। এটি হলো একটি বাস্তব দ্বন্দ্ব: একদিকে উৎপাদন প্রক্রিয়াটি ক্রমবর্ধমানভাবে সামাজিক (হাজার হাজার শ্রমিক একসাথে একটি কারখানায় কাজ করে), কিন্তু সেই উৎপাদনের ফল এবং উৎপাদনের উপকরণের মালিকানা ব্যক্তিগত (কয়েকজন পুঁজিপতির হাতে)। এই সামাজিক উৎপাদন এবং ব্যক্তিগত মালিকানার মধ্যকার দ্বন্দ্বই পুঁজিবাদের সমস্ত সংকট, যেমন – অর্থনৈতিক মন্দা, বেকারত্ব এবং শ্রেণী সংগ্রামের জন্ম দেয়। মার্ক্সের মতে, এই বাস্তব দ্বন্দ্বের সমাধান কোনো দার্শনিকের মস্তিষ্কে হবে না, হবে বাস্তব শ্রেণী সংগ্রামের মাধ্যমে, বিপ্লবের মাধ্যমে।
একটি জরুরি নোট: নামটি কে দিল?
মজার ব্যাপার হলো, ‘দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ’ (Dialectical Materialism) এই নামটি কার্ল মার্ক্স বা ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস নিজেরা কখনো ব্যবহার করেননি। মার্ক্স তার পদ্ধতিকে বলতেন ‘বস্তুবাদী দ্বন্দ্বমূলক পদ্ধতি’ (the materialist dialectic) বা সহজভাবে ‘আমাদের পদ্ধতি’। এই নামটি প্রথম জনপ্রিয় করেন রাশিয়ান মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক গেওর্গি প্লেখানভ (Georgy Plekhanov), যাকে ‘রাশিয়ান মার্ক্সবাদের জনক’ বলা হয়। তিনিই প্রথম মার্ক্সের দর্শনকে একটি সুসংহত রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন এবং এর দুটি ভাগ করেন: দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ (দর্শন) এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদ (ইতিহাস ও সমাজ)।
পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়নে, বিশেষ করে জোসেফ স্তালিনের সময়, এই নামটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় এবং মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের একটি অনড় তত্ত্বে (dogma) পরিণত হয়। স্তালিনের লেখা Dialectical and Historical Materialism (1938) বইতে এই দর্শনকে কয়েকটি সরল সূত্রে বেঁধে ফেলা হয়। এর ফলে যা ঘটল তা হলো, মার্ক্স-এঙ্গেলসের চিন্তার নমনীয়তা, জটিলতা এবং সমালোচনামূলক চরিত্রটি হারিয়ে গেল। একটি জীবন্ত, সমালোচনামূলক পদ্ধতি থেকে এটি পরিণত হলো এক নিষ্প্রাণ, যান্ত্রিক এবং অপরিবর্তনীয় সূত্রে, যা প্রায়শই রাষ্ট্রীয় নীতির ন্যায্যতা প্রমাণের জন্য ব্যবহৃত হতো। পশ্চিমা মার্ক্সবাদীরা (যেমন: ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল বা গ্রামশি) এই যান্ত্রিক ‘ডায়াম্যাট’ (Diamat)-এর তীব্র সমালোচনা করেছেন এবং মার্ক্সীয় চিন্তার হেগেলীয় ও সমালোচনামূলক শিকড়ে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাই, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদকে বুঝতে হলে এর স্তালিনীয় সরলীকৃত রূপ এবং মার্ক্স-এঙ্গেলসের মূল লেখার মধ্যকার পার্থক্যটি মনে রাখা জরুরি।
দ্বন্দ্বের তিনটি সূত্র: প্রকৃতির গোপন কোড
ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস তার Anti-Dühring এবং অসমাপ্ত গ্রন্থ Dialectics of Nature বইয়ে এই দ্বন্দ্বমূলক পদ্ধতির তিনটি মূল সূত্রের কথা উল্লেখ করেছেন। এই সূত্র তিনটিকে বলা যেতে পারে প্রকৃতির গোপন কোড। এগুলো বুঝতে পারলে জগতের অনেক পরিবর্তনকেই আর বিচ্ছিন্ন বা আকস্মিক মনে হবে না, বরং একটি নিয়মের অধীনে চলমান প্রক্রিয়া বলে মনে হবে।
সূত্র ১: বিপরীতের ঐক্য ও সংগ্রামের নিয়ম (The Law of the Unity and Conflict of Opposites)
এই সূত্রটি হলো দ্বন্দ্বমূলক পদ্ধতির একেবারে হৃৎপিণ্ড। এর মূল কথা হলো, জগতের প্রতিটি বস্তু বা ঘটনার ভেতরেই দুটি বিপরীতধর্মী শক্তি বা প্রবণতা একসঙ্গে কাজ করে। তারা একে অপরের বিরোধী, কিন্তু আবার একে অপরকে ছাড়া তাদের অস্তিত্বও নেই। তারা একটি অবিচ্ছেদ্য ঐক্য (Unity) তৈরি করে, কিন্তু তাদের মধ্যে নিরন্তর সংগ্রামও (Conflict) চলতে থাকে। এই সংগ্রামই পরিবর্তনের মূল কারণ। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বই বিকাশের উৎস, বাইরের কোনো ধাক্কা নয়।
বিষয়টা কেমন? ভাবুন তো:
-
পদার্থবিজ্ঞানে: একটি পরমাণুর কথা। এর ভেতরে আছে পজিটিভ চার্জযুক্ত প্রোটন এবং নেগেটিভ চার্জযুক্ত ইলেকট্রন। দুটো বিপরীত, কিন্তু এদেরকে ছাড়া পরমাণুর অস্তিত্বই নেই। এই বিপরীত শক্তির আকর্ষণ-বিকর্ষণের কারণেই পরমাণু স্থিতিশীল থাকে, আবার এই শক্তির পরিবর্তনের ফলেই রাসায়নিক বিক্রিয়া বা নিউক্লিয়ার ফিশন ঘটে। আধুনিক পদার্থবিদ্যায় আলোর ‘তরঙ্গ-কণা দ্বৈততা’ও (Wave-particle duality) এই দ্বন্দ্বের এক চমৎকার উদাহরণ।
-
জীববিজ্ঞানে: জীবের মধ্যে বংশগতি (Heredity) ও অভিযোজন (Adaptation) নামক দুটি বিপরীত প্রবণতা কাজ করে। বংশগতি চায় পুরোনো বৈশিষ্ট্যকে ধরে রাখতে (ঐক্য), আর পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য অভিযোজন চায় নতুন বৈশিষ্ট্য তৈরি করতে (সংগ্রাম)। এই দুইয়ের দ্বন্দ্বের ফলেই বিবর্তন (Evolution) ঘটে। আবার, জীবদেহের ভেতরেই প্রতিনিয়ত কোষের গঠন (Anabolism) এবং ভাঙন (Catabolism) চলছে।
-
সমাজে: পুঁজিবাদী সমাজে বুর্জোয়া (Bourgeoisie) ও প্রলেতারিয়েত (Proletariat) শ্রেণীর স্বার্থ পুরোপুরি বিপরীত। মালিক চায় যতটা সম্ভব কম মজুরি দিয়ে বেশি মুনাফা করতে, আর শ্রমিক চায় তার শ্রমের ন্যায্য মূল্য। তাদের মধ্যে চলছে এক নিরন্তর সংগ্রাম, যেটাকে বলা হয় ‘শ্রেণী সংগ্রাম’ (Class Struggle)। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এই দুই শ্রেণী একে অপরকে ছাড়া চলতেও পারে না। শ্রমিক ছাড়া মালিকের কারখানা অচল, আবার কারখানা ছাড়া শ্রমিকের কাজ নেই। এই বিপরীতের ঐক্য ও সংগ্রামই পুঁজিবাদী সমাজকে টিকিয়ে রাখে এবং একই সাথে এর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে তীব্র করে তোলে, যা শেষ পর্যন্ত এর ধ্বংসের বীজও বপন করে (Marx & Engels, 1848)। চীনা বিপ্লবী মাও সে তুং (Mao Zedong) তার ‘অন কন্ট্রাডিকশন’ প্রবন্ধে এই ধারণাটিকে আরও এগিয়ে নিয়ে বলেন, যেকোনো জটিল প্রক্রিয়ায় একটি ‘প্রধান দ্বন্দ্ব’ (Principal Contradiction) থাকে যা অন্যগুলোকে প্রভাবিত করে।
সূত্র ২: পরিমাণগত পরিবর্তনের গুণগত পরিবর্তনে রূপান্তরের নিয়ম (The Law of the Transformation of Quantity into Quality)
এই সূত্রটি ব্যাখ্যা করে যে পরিবর্তনগুলো ঠিক কীভাবে ঘটে। পরিবর্তন সবসময় নাটকীয়ভাবে হয় না। অনেক সময় পরিবর্তনগুলো ধীরে ধীরে, অল্প অল্প করে হতে থাকে। এই পর্যায়টিকে বলা হয় পরিমাণগত পরিবর্তন (Quantitative Change)। এই পরিবর্তনগুলো সাধারণত চোখে পড়ে না। কিন্তু এই পরিবর্তন একটি নির্দিষ্ট সীমা বা পর্যায় (Nodal Point or Tipping Point) অতিক্রম করার পর হঠাৎ করে একটি বড়, উল্লম্ফনধর্মী (leap) পরিবর্তন ঘটে। তখন বস্তু বা ঘটনাটির পুরো গুণ বা চরিত্রই বদলে যায়। এই পর্যায়টিকে বলা হয় গুণগত পরিবর্তন (Qualitative Change)।
সবচেয়ে সহজ উদাহরণ হলো জল গরম করা। আপনি যখন একটি পাত্রে জল নিয়ে গরম করতে শুরু করেন, তখন তার তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বাড়ে: ২০°C, ৩০°C, ৫০°C, ৯৯°C। এই পুরো সময়টা জুড়ে জল জলই থাকে, শুধু তার উষ্ণতা বাড়ে। এটা হলো পরিমাণগত পরিবর্তন। কিন্তু তাপমাত্রা যেই ১০০°C-তে (সমুদ্রপৃষ্ঠে) পৌঁছায়, অমনি ঘটে এক নাটকীয় ঘটনা। জল ফুটতে শুরু করে এবং বাষ্পে পরিণত হয়। তরল থেকে গ্যাসীয় অবস্থা—এটা একটা সম্পূর্ণ নতুন গুণ। এই উল্লম্ফনটাই হলো গুণগত পরিবর্তন (Engels, 1883)। একইভাবে, জল ঠান্ডা করতে থাকলে ০°C-তে এসে তা বরফে পরিণত হয়, যা আরেকটি গুণগত পরিবর্তন।
সমাজেও এই নিয়ম কাজ করে। ধরুন, একটি সমাজে দীর্ঘদিন ধরে শোষণ-বঞ্চনা চলছে। মানুষ ছোট ছোট প্রতিবাদ করছে, বিক্ষোভ করছে, আবেদন-নিবেদন করছে, কর্মবিরতি পালন করছে। এগুলো সবই পরিমাণগত পরিবর্তন, যা ব্যবস্থার ভেতরে ক্ষোভের পরিমাণ বাড়াতে থাকে। কিন্তু এই শোষণ আর প্রতিবাদ যখন একটি চরম পর্যায়ে পৌঁছায়, তখন একটি ছোট ঘটনাই (যেমন: তিউনিসিয়ায় মোহামেদ বুয়াজিজির আত্মাহুতি) স্ফুলিঙ্গের মতো কাজ করে এবং পুরো সমাজে বিপ্লব (যেমন: আরব বসন্ত) ঘটে যায়। তখন পুরোনো সমাজব্যবব্যবস্থা ভেঙে একটি নতুন ব্যবস্থার জন্ম হয়। এটিই হলো গুণগত পরিবর্তন। ছোট ছোট সংস্কার একসময় বড় ধরনের বিপ্লবের পথ তৈরি করে।
সূত্র ৩: নেতির নেতিকরণ নিয়ম (The Law of the Negation of the Negation)
নামটা শুনলে মাথা ঘুরে যেতে পারে, কিন্তু ধারণাটা বেশ সহজ এবং সুন্দর। এই সূত্রটি বলে যে, বিকাশ বা উন্নয়ন সরলরৈখিকভাবে (linearly) হয় না, বা একই বৃত্তে ঘুরতেও থাকে না (circular)। বরং এটি একটি সর্পিল (spiral) পথে এগিয়ে চলে। বিকাশের প্রতিটি পর্যায়ে পুরোনো অবস্থাকে নাকচ (negate) করে নতুন অবস্থা তৈরি হয়, এবং পরবর্তী পর্যায়ে সেই নতুন অবস্থাকেও নাকচ করে আরও উন্নত একটি অবস্থার জন্ম হয়, যা দেখতে হয়তো পুরোনো অবস্থার মতো, কিন্তু আসলে তা আরও উচ্চস্তরের।
চলুন আমাদের সেই প্রথম উদাহরণে ফিরে যাই—বীজ।
-
প্রথম অবস্থা (Thesis): একটি গমের দানা।
-
নেতিকরণ (Negation / Antithesis): এই দানাটিকে মাটিতে পুঁতলে এটি অঙ্কুরিত হয়ে একটি গাছে পরিণত হয়। গাছটি গমের দানার অস্তিত্বকে নাকচ (negate) করে দিল। গমের দানাটি আর নেই। এটি হলো প্রথম নেতিকরণ।
-
নেতির নেতিকরণ (Negation of the Negation / Synthesis): এই গাছটি বড় হয়ে আবার অনেকগুলো নতুন গমের দানা জন্ম দেয়। তারপর গাছটি নিজে মরে যায়। এই নতুন দানাগুলো হলো ‘নেতির নেতিকরণ’। এটি গাছটিকে (নেতিকে) নাকচ করল। দেখুন, আমরা আবার সেই গমের দানাতেই ফিরে এলাম, কিন্তু এবার একটি দানার বদলে আমরা পেলাম দশটি বা বিশটি দানা। অর্থাৎ, আমরা শুরুর বিন্দুতে ফিরে এলেও একটি উচ্চতর স্তরে ফিরে এলাম। পথটা বৃত্তাকার না হয়ে সর্পিল হলো (Engels, 1883)।
মার্ক্স ও এঙ্গেলস মানব ইতিহাসের বিকাশেও এই সূত্রটি প্রয়োগ করেছেন। তাদের মতে:
-
আদিম সাম্যবাদী সমাজ (Primitive Communism): ইতিহাসের শুরুতে কোনো ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল না, সবাই মিলে উৎপাদন করত, মিলে ভোগ করত। এটি ছিল এক ধরনের শ্রেণীহীন সমাজ।
-
নেতিকরণ: কৃষির বিকাশের সাথে সাথে উদ্বৃত্ত উৎপাদন শুরু হলো এবং ব্যক্তিগত মালিকানার জন্ম হলো। এর ফলে সমাজ শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে গেল এবং শ্রেণীবিভক্ত সমাজের (যেমন: দাস সমাজ, সামন্ততন্ত্র, পুঁজিবাদ) উদ্ভব ঘটল। এটি আদিম সাম্যবাদকে নাকচ করে দিল।
-
নেতির নেতিকরণ: পুঁজিবাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফলে যখন বিপ্লব হবে, তখন উৎপাদনের উপকরণের ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান ঘটবে এবং এক নতুন সাম্যবাদী (Communist) সমাজের জন্ম হবে। এই সমাজেও কোনো ব্যক্তিগত মালিকানা থাকবে না, ঠিক আদিম সাম্যবাদের মতো। কিন্তু এটি হবে অনেক উন্নত স্তরের। কারণ এটি ঘটবে প্রাচুর্যের মধ্যে, আধুনিক প্রযুক্তির উপর ভিত্তি করে। এটি হবে শ্রেণীবিভক্ত সমাজের নেতিকরণ, যা আদিম সাম্যবাদের বৈশিষ্ট্যকে একটি উচ্চতর স্তরে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে।
এভাবেই দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের তিনটি সূত্র প্রকৃতি, সমাজ ও চিন্তার জগতের সমস্ত পরিবর্তন ও বিকাশকে একটি একক নিয়মের অধীনে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে।
ঐতিহাসিক বস্তুবাদ (Historical Materialism): ইতিহাসের চাকা ঘোরে যেভাবে
দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ যখন মানব ইতিহাসের উপর প্রয়োগ করা হয়, তখন তার একটি বিশেষ নাম হয়—‘ঐতিহাসিক বস্তুবাদ’ (Historical Materialism)। এটি মার্ক্সীয় চিন্তার অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। এটি ইতিহাসের এক বস্তুবাদী ব্যাখ্যা, যা রাজা-বাদশার কাহিনী বা মহান ব্যক্তির ইচ্ছার বদলে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা ও উৎপাদন পদ্ধতিকে ইতিহাসের কেন্দ্রে স্থাপন করে।
মার্ক্সের কথায়, কোনো সমাজের আইন, রাজনীতি, ধর্ম, দর্শন, সংস্কৃতি (এগুলোকে বলা হয় উপরিকাঠামো বা Superstructure) তার অর্থনৈতিক ভিত্তির (Economic Base) উপর নির্ভর করে। অর্থাৎ, মানুষ কীভাবে তাদের জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র উৎপাদন করে, সেই উৎপাদন ব্যবস্থাটাই সমাজের বাকি সবকিছুকে নির্ধারণ করে। মার্ক্সের বিখ্যাত উক্তি হলো, “চেতনা মানুষের অস্তিত্বকে নির্ধারণ করে না, বরং মানুষের সামাজিক অস্তিত্বই তার চেতনাকে নির্ধারণ করে” (Marx, 1859, Preface to A Contribution to the Critique of Political Economy)।
ভিত্তি ও উপরিকাঠামো (Base and Superstructure)
মার্ক্স সমাজকে একটি বাড়ির সাথে তুলনা করেছেন।
-
ভিত্তি (Base): বাড়ির ভিত্তি বা ভিতের মতো। এটি হলো সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো। এই ভিত্তি আবার দুটি জিনিস নিয়ে গঠিত:
-
উৎপাদন শক্তি (Forces of Production): উৎপাদনের জন্য যা যা লাগে। যেমন: শ্রমিকদের দক্ষতা ও জ্ঞান, যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তি, হাতিয়ার, কাঁচামাল।
-
উৎপাদন সম্পর্ক (Relations of Production): উৎপাদনের সময় মানুষে মানুষে যে সম্পর্ক তৈরি হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো উৎপাদনের উপকরণের (জমি, কারখানা, পুঁজি) মালিকানার সম্পর্ক। কে মালিক আর কে শ্রমিক—এই সম্পর্কটাই শ্রেণীবিভাজন তৈরি করে।
-
-
উপরিকাঠামো (Superstructure): বাড়ির দেয়াল, ছাদ, দরজা-জানালার মতো। এটি ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে থাকে এবং ভিত্তিকে রক্ষা করে। এর মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্র, আইন, বিচারব্যবস্থা, পুলিশ, সেনাবাহিনী, রাজনীতি, দর্শন, ধর্ম, নৈতিকতা, শিল্প-সাহিত্য ইত্যাদি। ফরাসি মার্ক্সবাদী লুই আলথুসার (Louis Althusser) এই উপরিকাঠামোকে দুটি ভাগে ভাগ করেছেন: (ক) দমনমূলক রাষ্ট্রযন্ত্র (Repressive State Apparatus – RSA) যা বলপ্রয়োগ করে (পুলিশ, সেনাবাহিনী), এবং (খ) ভাবাদর্শগত রাষ্ট্রযন্ত্র (Ideological State Apparatus – ISA) যা সম্মতি আদায় করে (স্কুল, পরিবার, ধর্ম, গণমাধ্যম)।
ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মতে, উপরিকাঠামো অর্থনৈতিক ভিত্তি দ্বারা নির্ধারিত হয় এবং এর কাজ হলো বিদ্যমান অর্থনৈতিক ভিত্তিকে টিকিয়ে রাখা ও বৈধতা দেওয়া। যেমন, সামন্ততান্ত্রিক সমাজে উৎপাদন সম্পর্ক ছিল ভূমিদাস ও জমিদারের। তাই সেই সমাজের আইন, ধর্ম ও নৈতিকতাও জমিদারের ভূমি মালিকানাকেই সমর্থন করত। পুঁজিবাদী সমাজে আইন ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকে রক্ষা করে, যা বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করে।
তবে এই সম্পর্কটি যান্ত্রিক বা একমুখী নয়। উপরিকাঠামোও ভিত্তিকে প্রভাবিত করতে পারে, যাকে বলা হয় ‘আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্য’ (Relative Autonomy)। এঙ্গেলস তার শেষ জীবনে লেখা এক চিঠিতে এই ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটাতে লেখেন যে, তারা কখনোই বলেননি যে অর্থনীতিই একমাত্র নির্ধারক। রাজনীতি, আইন, দর্শন ইত্যাদিও ইতিহাসের গতিপথকে প্রভাবিত করে, কিন্তু “চূড়ান্ত বিচারে অর্থনৈতিক গতিই নির্ধারক ভূমিকা পালন করে” (Engels to J. Bloch, 1890)।
ইতিহাসের চালিকাশক্তি: দ্বন্দ্ব ও শ্রেণীসংগ্রাম
ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মতে, ইতিহাসের মূল চালিকাশক্তি হলো উৎপাদন শক্তি এবং উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যকার দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বই শ্রেণী সংগ্রামের রূপ নেয়।
-
আদিম সাম্যবাদী সমাজ: শিকার ও সংগ্রহের উপর নির্ভরশীল। কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি বা শ্রেণী নেই।
-
দাস সমাজ: কৃষির আবিষ্কার উৎপাদন শক্তিকে বাড়িয়ে দেয়। উদ্বৃত্ত খাদ্য তৈরি হয়। এর ফলে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব হয় এবং সমাজ দাস ও দাস-মালিকে বিভক্ত হয়। উৎপাদন সম্পর্ক (মালিক-দাস) একসময় উৎপাদন শক্তির (উন্নত কৃষি) বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
-
সামন্তবাদী সমাজ: দাস বিদ্রোহ এবং অন্যান্য কারণে দাস সমাজ ভেঙে পড়ে এবং সামন্ততন্ত্রের জন্ম হয়। এখানে মূল উৎপাদন সম্পর্ক হলো ভূমিদাস (Serf) ও সামন্ত প্রভুর (Lord) মধ্যে। ভূমিদাসরা জমিতে বাঁধা।
-
পুঁজিবাদী সমাজ: সামন্ততন্ত্রের শেষের দিকে ইউরোপে নতুন বাণিজ্য পথ, নতুন বাজার এবং নতুন উৎপাদন কৌশল (যেমন: ম্যানুফ্যাকচারিং) তৈরি হচ্ছিল। এই নতুন উৎপাদন শক্তিগুলোর বিকাশের জন্য প্রয়োজন ছিল স্বাধীন শ্রমিক এবং পুঁজির অবাধ চলাচল। কিন্তু সামন্তবাদী সমাজের উৎপাদন সম্পর্ক—যেখানে ভূমিদাসরা জমিতে বাঁধা ছিল এবং গিল্ড প্রথা উৎপাদনকে নিয়ন্ত্রণ করত—এই বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। এই দ্বন্দ্বের ফলেই বুর্জোয়া বিপ্লব (যেমন: ফরাসি বিপ্লব) ঘটে, যা সামন্ততান্ত্রিক সম্পর্ককে ভেঙে দিয়ে পুঁজিবাদের জন্ম দেয়।
-
সমাজতান্ত্রিক/সাম্যবাদী সমাজ: মার্ক্সের মতে, পুঁজিবাদের ভেতরেও একই ধরনের দ্বন্দ্ব কাজ করছে। একদিকে উৎপাদন ক্রমবর্ধমানভাবে সামাজিক (হাজার হাজার শ্রমিক মিলে একটি কারখানায় উৎপাদন করছে), কিন্তু মালিকানা ব্যক্তিগত। এই দ্বন্দ্ব, এবং এর ফলে সৃষ্ট সংকট ও শ্রেণী সংগ্রাম, পুঁজিবাদের পতন ডেকে আনবে এবং সমাজতন্ত্রের জন্ম দেবে, যেখানে উৎপাদনের উপকরণ থাকবে সামাজিক মালিকানায়।
কিছু জরুরি চাবি-কাঠি
দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ বুঝতে হলে আরও কয়েকটি ধারণা জানা জরুরি। এগুলো যেন এই দর্শনের বিভিন্ন ঘরের চাবি-কাঠি।
-
বিচ্ছিন্নতা (Alienation): মার্ক্স তার প্রথম দিকের লেখায়, বিশেষ করে Economic and Philosophic Manuscripts of 1844-এ এই ধারণাটি ব্যবহার করেন। পুঁজিবাদের অধীনে শ্রমিক তার মানবিক সারসত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। মার্ক্স চার ধরনের বিচ্ছিন্নতার কথা বলেন:
-
শ্রমের পণ্য থেকে বিচ্ছিন্নতা: শ্রমিক যে জিনিসটা তৈরি করছে, সেটার উপর তার কোনো অধিকার বা নিয়ন্ত্রণ নেই। পণ্যটি তার কাছে একটি অচেনা বস্তু, যা বাজারে তার বিরুদ্ধেই শক্তি হিসেবে দাঁড়ায়।
-
শ্রম প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্নতা: শ্রমিকের নিজের শ্রম প্রক্রিয়ার উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সে একঘেয়ে, যান্ত্রিক কাজ করতে বাধ্য হয়। শ্রম তার জন্য সৃজনশীল আনন্দের উৎস না হয়ে, বেঁচে থাকার এক যন্ত্রণাদায়ক উপায় হয়ে ওঠে। আজকের দিনের কল সেন্টারের কর্মী বা অ্যামাজনের ওয়্যারহাউসের কর্মীর কথা ভাবুন।
-
নিজের মনুষ্যত্ব থেকে বিচ্ছিন্নতা: মার্ক্সের মতে, মানুষের ‘প্রজাতি-সত্তা’ (Species-being) হলো সৃজনশীল ও সামাজিক শ্রম। পুঁজিবাদে শ্রমিক এই সৃজনশীলতা হারিয়ে ফেলে, সে একটি যন্ত্রের অংশে পরিণত হয়।
-
অন্য মানুষ থেকে বিচ্ছিন্নতা: পুঁজিবাদী সমাজে মানুষে মানুষে সম্পর্ক হয় প্রতিযোগিতামূলক। শ্রমিকরা একে অপরের প্রতিযোগী, এবং পুঁজিপতি ও শ্রমিকের সম্পর্ক হয় শোষণের। ফলে মানুষ পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
-
-
ভাবাদর্শ (Ideology) ও মিথ্যা চেতনা (False Consciousness): ভাবাদর্শ হলো শাসক শ্রেণীর চিন্তাধারা বা বিচারধারা, যা সমাজে এমনভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয় যেন তা সবার সাধারণ জ্ঞান বা Common Sense বলে মনে হয়। যেমন: ‘গরিবরা গরিব কারণ তারা অলস’, ‘সবারই কঠোর পরিশ্রম করলে ধনী হওয়ার সমান সুযোগ আছে’ (The American Dream), বা ‘রাষ্ট্র সবার ঊর্ধ্বে, নিরপেক্ষ’—এই ধারণাগুলো পুঁজিবাদী ভাবাদর্শের অংশ, যা কাঠামোগত শোষণ ও বৈষম্যকে আড়াল করে। যখন শোষিত শ্রেণী এই ভাবাদর্শকে নিজের বলে গ্রহণ করে এবং নিজের শোষণের আসল কারণ বুঝতে পারে না, তখন তাকে ‘মিথ্যা চেতনা’ বলা হয়। এর বিপরীতে, যখন শ্রমিক শ্রেণী নিজেদের শ্রেণীগত অবস্থান এবং শোষণের বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতন হয়, তখন তাকে ‘শ্রেণী চেতনা’ (Class Consciousness) বলে।
-
শ্রেণী ও শ্রেণী সংগ্রাম (Class and Class Struggle): মার্ক্সের কাছে শ্রেণী কোনো আয় বা মর্যাদার বিষয় নয়, বরং উৎপাদনের উপকরণের সাথে সম্পর্কের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। যার হাতে উৎপাদনের উপকরণ (জমি, কারখানা) আছে সে শোষক শ্রেণী (বুর্জোয়া), আর যার নেই এবং শ্রম বিক্রি করে বাঁচতে হয়, সে শোষিত শ্রেণী (প্রলেতারিয়েত)। কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোর বিখ্যাত প্রথম লাইনটিই হলো: “আজ পর্যন্ত বিদ্যমান সমস্ত সমাজের ইতিহাস হলো শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস” (Marx & Engels, 1848)। এই সংগ্রামই ইতিহাসের মূল ইঞ্জিন।
মার্ক্সের পরের পথ: তত্ত্বের নতুন বাঁক
মার্ক্স ও এঙ্গেলসের মৃত্যুর পর দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ থেমে থাকেনি। এটি একটি জীবন্ত তত্ত্ব হিসেবে নতুন নতুন ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে বিকশিত ও পরিবর্তিত হয়েছে।
-
ভ্লাদিমির লেনিন (Vladimir Lenin): লেনিন মার্ক্সবাদকে রাশিয়ার বিপ্লবের বাস্তবতায় প্রয়োগ করেন। তিনি ‘সাম্রাজ্যবাদ’কে (Imperialism) পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ এবং অন্তিম পর্যায় বলে বিশ্লেষণ করেন (Imperialism, the Highest Stage of Capitalism, 1917)। তিনি দেখান, পুঁজিবাদী দেশগুলো মুনাফার সন্ধানে দুর্বল দেশগুলোকে উপনিবেশ বানিয়ে শোষণ করে। এই অতিরিক্ত মুনাফার একটি অংশ দিয়ে তারা নিজেদের দেশের শ্রমিকদের একাংশকে ‘শ্রমিক অভিজাত’ (labor aristocracy) বানিয়ে শান্ত রাখে, ফলে পশ্চিমে বিপ্লব বিলম্বিত হয়। তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো ‘ভ্যানগার্ড পার্টি’র (Vanguard Party) ধারণা। তিনি মনে করতেন, শ্রমিক শ্রেণী নিজে থেকে বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে পারে না, তাদের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য প্রয়োজন পেশাদার বিপ্লবীদের একটি সুসংগঠিত দল।
-
আন্তোনিও গ্রামশি (Antonio Gramsci): ইতালির এই মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক মুসোলিনির কারাগারে বসে এক নতুন ধারণা দেন, যার নাম ‘সাংস্কৃতিক আধিপত্য’ বা ‘হেজেমনি’ (Hegemony)। তিনি প্রশ্ন তোলেন, পশ্চিমে কেন মার্ক্সের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী বিপ্লব হচ্ছে না? তার উত্তর ছিল, শাসক শ্রেণী শুধু রাষ্ট্রযন্ত্র (RSA) দিয়ে নয়, বরং সমাজের ‘বেসামরিক প্রতিষ্ঠান’ (Civil Society) যেমন—স্কুল, চার্চ, গণমাধ্যম ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের ভাবাদর্শ ছড়িয়ে দিয়ে জনগণের ‘সম্মতি’ (consent) আদায় করে। বিপ্লবের জন্য শুধু ‘ম্যানুভারের যুদ্ধ’ (war of maneuver) বা সরাসরি ক্ষমতা দখলই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী ‘অবস্থানের যুদ্ধ’ (war of position) বা পাল্টা সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা।
-
ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল (The Frankfurt School): থিওডোর অ্যাডর্নো, ম্যাক্স হর্কহাইমার, হার্বার্ট মারক্যুজার মতো চিন্তাবিদরা বিংশ শতাব্দীর উন্নত পুঁজিবাদের নতুন রূপ বিশ্লেষণ করেন। তারা ‘সংস্কৃতি শিল্প’ (Culture Industry) নামক ধারণার মাধ্যমে দেখান, কীভাবে সিনেমা, সঙ্গীত, বিজ্ঞাপনের মতো গণসংস্কৃতি মানুষকে নিষ্ক্রিয় ভোক্তায় পরিণত করে এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে। মারক্যুজার মতে, এই সমাজ ‘এক-মাত্রিক মানুষ’ (One-Dimensional Man) তৈরি করে, যে ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে।
সমালোচনা ও বিতর্ক: চশমাটা কি নিখুঁত?
দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ নিঃসন্দেহে একটি শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী তত্ত্ব। এটি সমাজ, অর্থনীতি ও ইতিহাসকে দেখার জন্য এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে এর কোনো সমালোচনা নেই। এই চশমাটাও পুরোপুরি নিখুঁত নয়।
১. অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদ (Economic Determinism): সবচেয়ে বড় সমালোচনা হলো, মার্ক্সবাদ সবকিছুকেই অর্থনীতির আয়নায় দেখে। এটি সমাজের ভিত্তি (Base) বা অর্থনীতিকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয় এবং উপরিকাঠামো (Superstructure) যেমন—সংস্কৃতি, ধর্ম, রাজনীতি, বা ব্যক্তির ইচ্ছাশক্তিকে প্রায় অগ্রাহ্য করে।
মার্ক্সবাদী প্রত্যুত্তর: মার্ক্সবাদীরা যুক্তি দেন, এটি একটি ভুল পাঠ। এঙ্গেলসের চিঠি এবং গ্রামশির হেজেমনির ধারণা দেখায় যে, উপরিকাঠামো নিষ্ক্রিয় নয়। এটি ভিত্তিকে প্রভাবিত করে। সম্পর্কটি যান্ত্রিক নয়, দ্বন্দ্বমূলক। অর্থনীতি ‘চূড়ান্ত বিচারে’ নির্ধারক, একমাত্র নির্ধারক নয়।
২. ভবিষ্যদ্বাণীর ব্যর্থতা: মার্ক্স ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোতে (যেমন: ব্রিটেন, জার্মানি) প্রলেতারীয় বিপ্লব অনিবার্য। কিন্তু বাস্তবে বিপ্লব ঘটেছে রাশিয়া বা চীনের মতো তুলনামূলকভাবে অনগ্রসর, কৃষিপ্রধান দেশগুলোতে।
মার্ক্সবাদী প্রত্যুত্তর: লেনিনের সাম্রাজ্যবাদ তত্ত্ব এর একটি ব্যাখ্যা দেয়। সাম্রাজ্যবাদী শোষণের মাধ্যমে উন্নত দেশগুলো তাদের শ্রমিকদের শান্ত রাখতে পেরেছে, ফলে দ্বন্দ্বের কেন্দ্র পেরিফেরি বা উপনিবেশগুলোতে সরে গেছে। তাছাড়া, কল্যাণমূলক রাষ্ট্র (Welfare State) বা ট্রেড ইউনিয়নের মতো সংস্কারগুলো পুঁজিবাদের টিকে থাকার অভিযোজন ক্ষমতারই প্রমাণ, যা শ্রেণী সংগ্রামেরই ফল।
৩. বৈজ্ঞানিক মর্যাদার প্রশ্ন: দার্শনিক কার্ল পপারের (Karl Popper) মতো সমালোচকেরা প্রশ্ন তুলেছেন, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ কি আদৌ একটি বিজ্ঞান? বিজ্ঞানের একটি প্রধান শর্ত হলো, যেকোনো তত্ত্বকে ‘মিথ্যা প্রমাণযোগ্য’ (Falsifiable) হতে হবে। পপারের মতে, মার্ক্সবাদীরা যেকোনো ঘটনাকেই তাদের তত্ত্বের ছাঁচে ফেলে ব্যাখ্যা করতে পারে, তাই এটি অবৈজ্ঞানিক।
মার্ক্সবাদী প্রত্যুত্তর: অনেক মার্ক্সবাদী বলেন, মার্ক্সবাদকে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মানদণ্ডে বিচার করা ভুল। এটি একটি সামাজিক বিজ্ঞান বা একটি ‘সমালোচনামূলক তত্ত্ব’ (Critical Theory)। এর লক্ষ্য শুধু জগৎকে ব্যাখ্যা করা নয়, বরং শোষণের বাস্তবতা উন্মোচন করে তাকে পরিবর্তন করা। এর সত্যতা যাচাই হয় তাত্ত্বিক বিতর্কে নয়, বরং সামাজিক পরিবর্তনে এর কার্যকারিতার মাধ্যমে (Praxis)।
৪. রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের হাতিয়ার: বিংশ শতাব্দীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, এবং অন্যান্য দেশে মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদকে রাষ্ট্রীয় ভাবাদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা হয়। সমালোচকরা বলেন, এই তত্ত্বের ‘ঐতিহাসিক অনিবার্যতা’ এবং ‘প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র’ (dictatorship of the proletariat) এর ধারণাগুলো একদলীয় শাসন, ভিন্নমত দমন এবং ব্যাপক রাষ্ট্রীয় নিপীড়নকে ন্যায্যতা দিতে ব্যবহৃত হয়েছে।
মার্ক্সবাদী প্রত্যুত্তর: অনেক মার্ক্সবাদী (যেমন: ট্রটস্কিপন্থী বা বামপন্থী কমিউনিস্টরা) স্তালিনের শাসনকে মার্ক্সবাদের বিকৃতি বলে মনে করেন। তাদের মতে, মার্ক্স ‘প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র’ বলতে সমগ্র শ্রমিক শ্রেণীর শাসন বুঝিয়েছিলেন, একটি পার্টির বা একজন ব্যক্তির একনায়কতন্ত্র নয়। তারা যুক্তি দেন যে, এই দেশগুলোতে সমাজতন্ত্র নয়, বরং ‘রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ’ (State Capitalism) বা ‘বিকৃত শ্রমিক রাষ্ট্র’ (Deformed Workers’ State) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
উপসংহার: চশমাটা কি আজও প্রাসঙ্গিক?
আজকের পৃথিবীতে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্য, যেখানে পৃথিবীর শীর্ষ ১% মানুষের হাতে বাকি ৯৯% মানুষের চেয়ে বেশি সম্পদ; বহুজাতিক কর্পোরেশনের হাতে রাষ্ট্রশক্তির নিয়ন্ত্রণ; জলবায়ু পরিবর্তনে পুঁজিবাদের মুনাফাকেন্দ্রিক ব্যবস্থার ভূমিকা; গিগ ইকোনমিতে (Gig Economy) অ্যাপ-ভিত্তিক কর্মীদের নতুন ধরনের বিচ্ছিন্নতাবোধ; বা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া ভোগবাদী ভাবাদর্শ—এই সবকিছুকে বুঝতে গেলে মার্ক্সের দেওয়া টুলস বা যন্ত্রপাতিগুলো ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক।
দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ আমাদের শেখায় যে, কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়। যা আজ শক্তিশালী, কাল তা দুর্বল হতে পারে। প্রতিটি ব্যবস্থার ভেতরেই তার ধ্বংসের বীজ লুকিয়ে থাকে। পরিবর্তনই জগতের একমাত্র ধ্রুব সত্য। এটি আমাদের প্রশ্ন করতে শেখায়—কেন সমাজটা এমন? এটা কি সব সময়ই এমন ছিল? এর চেয়ে ভালো কোনো ব্যবস্থা কি সম্ভব?
আপনি এই তত্ত্বে বিশ্বাস করুন বা না করুন, একে সমর্থন করুন বা এর ঘোর বিরোধী হন, একটা জিনিস অস্বীকার করার উপায় নেই: কার্ল মার্ক্স ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের এই দর্শন পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে। এটি কোটি কোটি মানুষকে শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অনুপ্রাণিত করেছে, বিপ্লব ঘটিয়েছে, রাষ্ট্র তৈরি করেছে, আবার ভয়াবহ বিতর্কেরও জন্ম দিয়েছে।
শেষ পর্যন্ত, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ একটি চশমার মতো। এই চশমা চোখে দিলে আপনি হয়তো জগতের ভেতরের দ্বন্দ্বগুলো, পরিবর্তনের প্রক্রিয়াগুলো আরও স্পষ্টভাবে দেখতে পাবেন। পৃথিবীটাকে তখন আর স্থির, শান্ত, বা এলোমেলো মনে হবে না। বরং মনে হবে, এর প্রতিটি কণার ভেতরে চলছে এক মহানাটক। এক অন্তহীন ভাঙা-গড়ার খেলা।
এখন চশমাটা আপনি পরবেন কি পরবেন না, সেই সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ আপনার।
তথ্যসূত্র
- Althusser, L. (1971). Lenin and Philosophy and Other Essays. Monthly Review Press.
- Engels, F. (1883). Dialectics of Nature. (Published posthumously in 1925). Progress Publishers.
- Engels, F. (1886). Ludwig Feuerbach and the End of Classical German Philosophy. Progress Publishers.
- Engels, F. (1890). Letter to J. Bloch in Königsberg. Retrieved from Marxists Internet Archive.
- Gramsci, A. (1971). Selections from the Prison Notebooks. (Q. Hoare & G. N. Smith, Eds. & Trans.). Lawrence and Wishart. (Written 1929-1935).
- Hegel, G. W. F. (1807). Phenomenology of Spirit. (A. V. Miller, Trans.). Oxford University Press.
- Lenin, V. I. (1917). Imperialism, the Highest Stage of Capitalism. Penguin Classics.
- Mao, Z. (1937). On Contradiction. Foreign Languages Press.
- Marcuse, H. (1964). One-Dimensional Man: Studies in the Ideology of Advanced Industrial Society. Beacon Press.
- Marx, K. (1844). Economic and Philosophic Manuscripts of 1844. Dover Publications. (Original work published 1932).
- Marx, K. (1845). Theses on Feuerbach. Progress Publishers.
- Marx, K. (1859). A Contribution to the Critique of Political Economy. Progress Publishers.
- Marx, K. (1873). Capital, Volume I: Afterword to the Second German Edition. Penguin Classics.
- Marx, K., & Engels, F. (1848). The Communist Manifesto. Penguin Classics.
- Popper, K. (1945). The Open Society and Its Enemies. Routledge.
- Weber, M. (1930). The Protestant Ethic and the Spirit of Capitalism. (T. Parsons, Trans.). Unwin Hyman. (Original work published 1905).
Leave a Reply