রোজা লুক্সেমবার্গ: এক রক্তগোলাপের তাত্ত্বিক সৌরভ – বিস্তারিত বীক্ষণ

ভূমিকা

“কে এই রোজা লুক্সেমবার্গ?” – এই প্রশ্নটা শুনলে এখনো অনেকের কপালে একটা হালকা ভাঁজ পড়তে পারে, যেন বহু পুরনো কোনো অ্যালবামের ধুলোমাখা পাতা থেকে উঠে আসা এক আবছা নাম। স্কুল-কলেজের পাঠ্যবইতে হয়তো তাঁর নাম সেভাবে পাওয়া যায় না, খবরের কাগজের পাতা উল্টালেও দৈনন্দিন রাজনৈতিক কচকচানিতে তিনি প্রায়শই অনুপস্থিত। কিন্তু ইতিহাসের সেইসব বাঁকে, যেখানে চিন্তার স্ফুলিঙ্গ তৈরি করেছে নতুন পথের দিশা, সেখানেই জ্বলজ্বল করে তাঁর নাম। রোজা লুক্সেমবার্গ শুধু পোল্যান্ডে জন্ম নেওয়া এক ইহুদি নারী বা জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির সহ-প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন না; তিনি ছিলেন এমন এক ক্ষুরধার তাত্ত্বিক, যাঁর চিন্তা ও কর্ম প্রায় সোয়াশো বছর পরেও আমাদের চিন্তার জগতে আলোড়ন তোলে, প্রশ্ন জাগায়, আর নতুন করে ভাবতে শেখায়। আসুন, আজ আমরা সেই ‘রেড রোজা’-র তাত্ত্বিক দুনিয়ায় আরেকটু গভীর, আরেকটু বিস্তারিত এক ডুব দেওয়ার চেষ্টা করি। ভয় নেই, এই ডুবসাঁতারে জটিল তত্ত্বের দুর্বোধ্য পাথর এড়িয়ে আমরা খুঁজে নেবো সহজবোধ্য মুক্তোর দানা, যা গল্পের মতো করে সাজানো থাকবে আপনাদের জন্য।

ব্যাপারটা অনেকটা সেই গোয়েন্দা কাহিনীর মতো, যেখানে এক অসামান্য মেধাবী চরিত্র প্রচলিত ধারণার জাল ছিঁড়ে ফেলে, আপাতদৃষ্টিতে সমাধান হয়ে যাওয়া রহস্যের গভীরে লুকিয়ে থাকা নতুন সত্য আবিষ্কার করে। রোজা লুক্সেমবার্গও অনেকটা তাই। মার্কসবাদ নামক বিশাল মহীরুহের ছায়ায় দাঁড়িয়েও তিনি নিজস্ব আলোয় খুঁজে ফিরেছেন এর কিছু অমীমাংসিত প্রশ্ন, কিছু অস্পষ্ট দিক। কখনো তিনি মার্কসের হাত ধরে এগিয়েছেন, কখনো বা তাঁর দেখানো পথের সীমাবদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল গভীর পাণ্ডিত্য, অকাট্য যুক্তি আর জ্বলন্ত সততায় পূর্ণ।

পুঁজির নিরন্তর সঞ্চয়ন ও সাম্রাজ্যবাদের অনিবার্য পদধ্বনি: এক গভীরতর বিশ্লেষণ

রোজা লুক্সেমবার্গের তাত্ত্বিক অবদানের কথা উঠলেই প্রথমেই বলতে হয় তাঁর যুগান্তকারী গ্রন্থ ‘পুঁজির সঞ্চয়ন’ (Die Akkumulation des Kapitals, ১৯১৩)-এর কথা। এই বইটিকে কেন্দ্র করে যে বিতর্ক মার্কসবাদী শিবিরে তৈরি হয়েছিল, তার রেশ আজও মিলিয়ে যায়নি। কিন্তু বিতর্ককে ভয় পেলে তো নতুন চিন্তা জন্মায় না! রোজা সেই ভয়কে জয় করেছিলেন।

কার্ল মার্কস তাঁর মহাকাব্যিক গ্রন্থ ‘পুঁজি’ (Das Kapital)-তে দেখিয়েছিলেন, পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় কীভাবে উদ্বৃত্ত মূল্য (Surplus Value) তৈরি হয়। শ্রমিক তার শ্রমশক্তি বিক্রি করে যে মজুরি (Wage) পায়, সে তার চেয়ে অনেক বেশি মূল্যের পণ্য উৎপাদন করে। এই বাড়তি মূল্যটুকুই হলো উদ্বৃত্ত মূল্য, যা আত্মসাৎ করে পুঁজিপতি শ্রেণি। এই উদ্বৃত্ত মূল্যই আবার নতুন করে বিনিয়োগ (Investment) হয়ে পুঁজির পাহাড় জমাতে থাকে, যাকে মার্কস বলেছেন পুঁজির সঞ্চয়ন (Accumulation of Capital)। মার্কস মূলত এই প্রক্রিয়াকে একটি ‘বদ্ধ ব্যবস্থা’ (Closed System) অর্থাৎ একটি দেশের অভ্যন্তরীণ পুঁজিপতি ও শ্রমিকের সম্পর্কের নিরিখে বিশ্লেষণ করেছিলেন, যেখানে উৎপাদিত সমস্ত পণ্য এই দুই শ্রেণির মধ্যেই ভোগ (Consumption) ও বিনিয়োগের মাধ্যমে বিলি হয়ে যায়। তিনি তাঁর ‘পুঁজি’র দ্বিতীয় খণ্ডে বিস্তারিত ‘পুনরুৎপাদন ছক’ (Reproduction Schema)-এর মাধ্যমে দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন কীভাবে এই অভ্যন্তরীণ বাজারেই পুঁজির বিস্তার ঘটতে পারে।

এইখানেই রোজা লুক্সেমবার্গ এক মৌলিক প্রশ্ন নিয়ে হাজির হলেন। তিনি বললেন, মার্কসের দেখানো ছক অনুযায়ী একটি বিশুদ্ধ পুঁজিবাদী সমাজে (Pure capitalist society), যেখানে কেবল পুঁজিপতি আর শ্রমিকই আছে, সেখানে পুঁজির নিরন্তর সঞ্চয়ন এক পর্যায়ে এসে অসম্ভব হয়ে পড়বে। (Luxemburg, 1913, p. 347) কেন?

ব্যাপারটা একটু তলিয়ে ভাবা যাক। উৎপাদিত পণ্যসম্ভার বাজারে বিক্রি করতে হবে। এই পণ্যের ক্রেতা কারা? শ্রমিক শ্রেণি তাদের সীমিত মজুরি দিয়ে ভোগ্যপণ্য কিনবে। পুঁজিপতি শ্রেণিও তাদের মুনাফার একটা অংশ ভোগ করবে, বাকিটা আবার বিনিয়োগ করবে। কিন্তু সমস্যা হলো, শ্রমিক যা উৎপাদন করে, তার সম্পূর্ণ মূল্য সে মজুরি হিসেবে পায় না। উদ্বৃত্ত মূল্যের একটা বড় অংশ পুঁজিপতির হাতে যায়। পুঁজিপতিরাও যদি তাদের পুরো মুনাফা ভোগ না করে (কারণ তাদের লক্ষ্যই হলো সঞ্চয়ন), তাহলে বাজারে একটা বিরাট অংশের পণ্য অবিক্রিত থেকে যাবে। এই অবিক্রিত পণ্য মানেই হলো উদ্বৃত্ত মূল্যের পূর্ণ রূপান্তর (Realization of surplus value) না হওয়া। আর উদ্বৃত্ত মূল্য যদি মুনাফায় রূপান্তরিত না হয়, তাহলে নতুন বিনিয়োগ আসবে কোথা থেকে? পুঁজির সঞ্চয়ন তো থমকে যাবে! এটা অনেকটা এমন যে, একটা বিশাল পুকুরে মাছ চাষ করা হলো, মাছগুলোও খুব বাড়লো, কিন্তু সেই মাছ কেনার মতো যথেষ্ট খদ্দের পুকুরের মালিকের নিজের পরিবারে বা কর্মচারীদের মধ্যে নেই। তাহলে বাড়তি মাছগুলো পচে যাবে, লাভের গুড় পিঁপড়া খাবে!

রোজা এই জটিল ধাঁধার সমাধান খুঁজতে গিয়ে বললেন, পুঁজিবাদ এই সংকট থেকে মুক্তি পায় তার নিজের গণ্ডির বাইরে, অর্থাৎ অ-পুঁজিবাদী পরিমণ্ডলে (Non-capitalist milieu) বাজার খুঁজে নেওয়ার মাধ্যমে। এই অ-পুঁজিবাদী পরিমণ্ডল মানে হলো সেইসব দেশ বা অঞ্চল, যেখানে তখনও পুঁজিবাদের পূর্ণ বিকাশ ঘটেনি – যেমন এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার উপনিবেশগুলো, বা এমনকি ইউরোপের ভেতরের অনুন্নত কৃষিপ্রধান এলাকাগুলো। পুঁজিবাদী দেশগুলো মরিয়া হয়ে এইসব নতুন বাজারে তাদের উদ্বৃত্ত পণ্য বিক্রি করে এবং সেখান থেকে সস্তায় কাঁচামাল (Raw materials) ও শ্রম শোষণ করে। (Nettl, 1966, Vol. 1, p. 405-410)

এই প্রক্রিয়াতেই রোজা সাম্রাজ্যবাদকে (Imperialism) পুঁজিবাদের বেঁচে থাকার অনিবার্য শর্ত হিসেবে চিহ্নিত করলেন। তাঁর মতে, সাম্রাজ্যবাদ কোনো বিচ্ছিন্ন নীতি বা রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা নয়, বরং এটি পুঁজির সঞ্চয়ন প্রক্রিয়ারই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। পুঁজিবাদকে যদি ক্রমাগত বাড়তে হয়, তাহলে তাকে ক্রমাগত নতুন নতুন অ-পুঁজিবাদী এলাকা গ্রাস করতে হবে, তাদের অর্থনীতির স্বকীয়তা ধ্বংস করে নিজের বাজারে পরিণত করতে হবে। এই গ্রাস করার প্রক্রিয়া সবসময় মসৃণ হয় না। এতে থাকে লুণ্ঠন, থাকে সামরিক আগ্রাসন, থাকে স্থানীয় শিল্প ও সংস্কৃতির বিনাশ। রূপকথার রাক্ষস যেমন তার ক্ষুধা মেটাতে আশপাশের গ্রামগুলো উজাড় করে দেয়, পুঁজিবাদও অনেকটা সেভাবেই অ-পুঁজিবাদী সমাজগুলোকে গিলে ফেলে।

রোজার এই তত্ত্ব লেনিনের সাম্রাজ্যবাদ বিষয়ক তত্ত্ব (Imperialism, the Highest Stage of Capitalism, 1917) থেকে কিছুটা ভিন্ন ছিল। লেনিন সাম্রাজ্যবাদের কারণ হিসেবে পুঁজির কেন্দ্রীভবন (Centralization of Capital), বৃহৎ একচেটিয়া পুঁজির (Monopoly Capital) উদ্ভব এবং পুঁজি রপ্তানির (Export of Capital) ওপর জোর দিয়েছিলেন। অন্যদিকে রোজা জোর দিয়েছিলেন উদ্বৃত্ত মূল্যের রিয়ালাইজেশন (Realization) সংকটের ওপর, যার সমাধানের জন্য পুঁজিবাদকে বাইরের বাজারের দিকে ছুটতে হয়। (Howard, 1971, Introduction) যদিও দুজনেই সাম্রাজ্যবাদকে পুঁজিবাদের সংকট ও পরিণতির সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন, তাঁদের ব্যাখ্যার কেন্দ্রবিন্দুতে সূক্ষ্ম কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য ছিল।

রোজার ‘পুঁজির সঞ্চয়ন’ তত্ত্বটি প্রকাশের পর থেকেই তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। অটো বাউয়ার (Otto Bauer), নিকোলাই বুখারিন (Nikolai Bukharin) সহ অনেক মার্কসবাদী তাত্ত্বিক এর বিরোধিতা করেন। তাঁদের যুক্তি ছিল, মার্কসের পুনরুৎপাদন ছক সঠিকভাবে বুঝতে পারলে দেখা যাবে যে, অভ্যন্তরীণ বাজারেই পুঁজির সঞ্চয়ন সম্ভব এবং রোজার তত্ত্ব মার্কসের মূল কাঠামো থেকে বিচ্যুত। (Kolakowski, 1978, Vol. 2, pp. 76-86) বুখারিন তাঁর ‘Imperialism and the Accumulation of Capital’ (১৯২৪) গ্রন্থে রোজার তত্ত্বকে খণ্ডন করার চেষ্টা করেন। এই বিতর্কগুলো অত্যন্ত জটিল এবং টেকনিকাল, কিন্তু এর মূল কথা হলো, পুঁজিবাদের সম্প্রসারণের চালিকাশক্তি কী এবং তার সীমা কোথায় – এই মৌলিক প্রশ্ন।

বিতর্ক সত্ত্বেও, রোজার বিশ্লেষণ সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের চরিত্র বুঝতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। কেন উন্নত দেশগুলো অনুন্নত দেশগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, কেন তাদের সম্পদ লুণ্ঠিত হয়, কেন তাদের সস্তা শ্রম শোষিত হয় – এই প্রশ্নগুলোর এক শক্তিশালী অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা মেলে রোজার লেখায়। তিনি দেখালেন যে, বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কেবল বিকশিত কেন্দ্র (Developed core) আর অনুন্নত পরিধির (Underdeveloped periphery) মধ্যে এক অসম সম্পর্ক তৈরি করে না, বরং এই অসম সম্পর্কই তার টিকে থাকার জ্বালানি। (Frölich, 1940, pp. 198-208) তাঁর তত্ত্ব আজও প্রাসঙ্গিক, যখন আমরা দেখি নব্য-উপনিবেশবাদ (Neo-colonialism) বা বিশ্বায়নের (Globalization) নামে কীভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্র ও বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলো দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলোর ওপর তাদের প্রভাব বিস্তার করে চলেছে।

সাম্রাজ্যবাদের করাল থাবা ও যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রাম

এতক্ষণ আমরা আলোচনা করলাম, কিভাবে রোজা লুক্সেমবার্গ তাঁর ‘পুঁজির সঞ্চয়ন’ তত্ত্বে দেখিয়েছেন কীভাবে পুঁজিবাদের অভ্যন্তরীণ সংকট তাকে সাম্রাজ্যবাদী বিস্তারের দিকে ঠেলে দেয়। এই তাত্ত্বিক উপলব্ধির ভিত্তিতেই তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) বহু আগে থেকেই যুদ্ধের আসন্ন বিপদ সম্পর্কে মানবজাতিকে সতর্ক করে আসছিলেন। তিনি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন, বিভিন্ন বৃহৎ পুঁজিবাদী শক্তিগুলোর মধ্যে বাজার, কাঁচামাল এবং উপনিবেশ দখলের ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতা পৃথিবীকে এক ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী সংঘাতের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে।

তৎকালীন ইউরোপের, তথা বিশ্বের, সবচেয়ে শক্তিশালী ও সুসংগঠিত সমাজতান্ত্রিক দল ছিল জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (SPD)। রোজা ছিলেন এই পার্টির বামপন্থী অংশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। কিন্তু যুদ্ধের দামামা যখন বেজে উঠল, তখন SPD-র অধিকাংশ নেতাই তাঁদের এতদিনের আন্তর্জাতিকতাবাদী (Internationalist) ও যুদ্ধবিরোধী অবস্থান থেকে সরে দাঁড়ালেন। ‘পিতৃভূমি রক্ষা’র (Defending the fatherland) নামে তাঁরা কাইজারের যুদ্ধবাজ সরকারের পাশে দাঁড়ালেন, যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট (War credits) অনুমোদনে সম্মতি দিলেন। আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতির (International proletarian solidarity) মহান আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে তাঁরা সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের (Nationalism) চোরাবালিতে পা দিলেন। এই ঘটনা ছিল দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের (Second International) জন্য এক চরম বিপর্যয়, এক ঐতিহাসিক বিশ্বাসঘাতকতা।

এই চরম দুর্দিনে রোজা লুক্সেমবার্গ, কার্ল লিবনেখট (Karl Liebknecht), ক্লারা জেটকিন (Clara Zetkin), ফ্রানৎস মেরিং (Franz Mehring) সহ মুষ্টিমেয় কয়েকজন বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী তাঁদের আদর্শে অটল রইলেন। রোজা তাঁর বিখ্যাত ‘জুনিয়াস প্যামফ্লেট’ (The Junius Pamphlet, যা তিনি ১৯১৫ সালে জেলে বসে ‘জুনিয়াস’ ছদ্মনামে লিখেছিলেন)-এ যুদ্ধের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রকে নগ্নভাবে উন্মোচন করেন এবং SPD নেতৃত্বের এই সুবিধাবাদী ও দেউলিয়া নীতির তীব্র, জ্বালাময়ী সমালোচনা করেন। (Luxemburg, 1915) তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করলেন, “এই যুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণির কিছুই পাওয়ার নেই, হারানোর আছে সবকিছু।” তাঁর কাছে, এই যুদ্ধ ছিল বিভিন্ন দেশের পুঁজিপতিদের মধ্যে বিশ্ববাজার ভাগাভাগি করে নেওয়ার লড়াই, যেখানে কামানের খোরাক হচ্ছে লক্ষ লক্ষ সাধারণ শ্রমিক ও কৃষক।

তিনি ডাক দিয়েছিলেন এক বিপ্লবী যুদ্ধবিরোধী নীতির: “প্রলেতারিয়েতের যুদ্ধ নীতি: যুদ্ধকালীন সময়েও শ্রেণি সংগ্রাম!” অর্থাৎ, যুদ্ধ চললেও পুঁজিপতি শ্রেণির বিরুদ্ধে শ্রমিকদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংগ্রাম বন্ধ করা চলবে না। বরং, যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকটকে কাজে লাগিয়ে বিপ্লবের সম্ভাবনাকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। (Howard, 1971, pp. 315-319) তিনি বলতেন, সমাজতন্ত্র অথবা বর্বরতা (Socialism or Barbarism) – এই দুটির মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হবে মানবজাতিকে। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ মানব সভ্যতাকে বর্বরতার দিকেই ঠেলে দিচ্ছিল।

রোজার এই আপসহীন যুদ্ধবিরোধী অবস্থান এবং বিপ্লবী কার্যকলাপের জন্য তাঁকে বারবার কারাবরণ করতে হয়েছে। কিন্তু জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকেও তাঁর কলম থামেনি। তিনি গোপনে পার্টির বামপন্থী অংশের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন, স্পার্টাকাস লীগ (Spartacus League) গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং তাঁর লেখনীর মাধ্যমে যুদ্ধবিরোধী চেতনা ও বিপ্লবী আশাবাদ জাগিয়ে রেখেছিলেন। তাঁর এই অটল আন্তর্জাতিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রাম আজও বিশ্বের শান্তিকামী, প্রগতিশীল ও শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখা মানুষদের কাছে এক অফুরন্ত অনুপ্রেরণার উৎস।

গণ-আন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ত অগ্নিশিখা বনাম বিপ্লবী পার্টির ইস্পাত-কঠিন শৃঙ্খলা

বিপ্লব কীভাবে সংগঠিত হবে? গুটিকয়েক প্রজ্ঞাবান, দূরদর্শী নেতা কি জনগণকে পথের দিশা দেখাবেন, আর জনতা সেই নির্দেশের শৃঙ্খলিত সৈনিকের মতো এগিয়ে যাবে? নাকি জনগণের অন্তরের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ আর আকাঙ্ক্ষা থেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে জ্বলে উঠবে প্রতিবাদের লেলিহান শিখা, যা ভাসিয়ে নিয়ে যাবে পুরোনো সব জঞ্জাল? এই প্রশ্নটি সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে এক দীর্ঘস্থায়ী বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। রোজা লুক্সেমবার্গ ছিলেন এই বিতর্কের এক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর।

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, রাশিয়ায় ভ্লাদিমির লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টি (Bolshevik Party) একটি সুসংগঠিত, কেন্দ্রনির্ভর বিপ্লবী অগ্রগামী পার্টির (Vanguard Party) ধারণার ওপর জোর দিয়েছিল। লেনিনের বিখ্যাত রচনা ‘কী করতে হবে?’ (What Is To Be Done?, ১৯০২)-তে তিনি যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে, শ্রমিক শ্রেণি নিজে থেকে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক চেতনা অর্জন করতে পারে না। তাদের মধ্যে ট্রেড ইউনিয়নবাদী (Trade-unionist) অর্থাৎ অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়া আদায়ের চেতনাই প্রধান থাকে। বিপ্লবী রাজনৈতিক চেতনা তাদের মধ্যে সঞ্চারিত করতে হয় ‘বাইরে থেকে’ (from without), অর্থাৎ মার্কসবাদী বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে গঠিত বিপ্লবী পার্টির মাধ্যমে। এই পার্টি হবে পেশাদার বিপ্লবীদের (Professional revolutionaries) এক সুশৃঙ্খল সংগঠন।

রোজা লুক্সেমবার্গের মতে এটি একটি অতি-কেন্দ্রিক (Ultra-centralist) পার্টি কাঠামো ও এটিতে বিপদও রয়েছে। তিনি জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সৃজনশীলতা (Spontaneous creativity of the masses) এবং তাদের ঐতিহাসিক উদ্যোগের (Historical initiative) ওপর অগাধ আস্থা রাখতেন। তাঁর দুটি বিখ্যাত কাজ – ‘রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রেসির সাংগঠনিক প্রশ্নাবলি’ (Organizational Questions of Russian Social Democracy, ১৯০৪, যা পরে ‘লেনিনবাদ না মার্কসবাদ?’ নামে পরিচিতি পায়) এবং ‘গণধর্মঘট, রাজনৈতিক দল ও ট্রেড ইউনিয়ন’ (The Mass Strike, the Political Party and the Trade Unions, ১৯০৬) – এই বিষয়ে তাঁর চিন্তার গভীরতা ও মৌলিকত্বের পরিচয় বহন করে। (Luxemburg, 1904; Luxemburg, 1906)

রোজা মনে করতেন, বিপ্লবী সংগ্রাম কোনো পরীক্ষাগারে তৈরি ফর্মুলা নয় যে, কিছু নেতা তা প্রয়োগ করলেই সাফল্য আসবে। বরং এটি একটি জীবন্ত, গতিশীল প্রক্রিয়া, যা জনগণের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, তাদের ভুলভ্রান্তি এবং তা থেকে অর্জিত শিক্ষার মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়। তিনি বলতেন, পার্টি বা সংগঠনের কাজ জনগণকে কঠোর শৃঙ্খলার নিগড়ে বেঁধে ফেলা নয়, বরং তাদের স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রামকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করা, তাকে সঠিক পথে চালিত করতে সহায়তা করা এবং তাদের বিক্ষিপ্ত শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করা। পার্টি হবে জনগণের সংগ্রামের অগ্রবর্তী বাহিনী, তাদের শিক্ষক নয়, সহযাত্রী। (Geras, 1976, pp. 108-130) তিনি লেনিনের পার্টির ধারণাকে তুলনা করেছিলেন কারখানার অধ্যক্ষের (Factory overseer) সঙ্গে, যিনি সবকিছুর ওপর কড়া নজর রাখেন। এর বিপরীতে তিনি চেয়েছিলেন এমন এক পার্টি, যা হবে শ্রমিক শ্রেণির নিজস্ব রাজনৈতিক জীবনের প্রকাশ।

রোজা লুক্সেমবার্গ সংগঠন বা পার্টির গুরুত্বকে কখনোই অস্বীকার করেননি। তিনি জানতেন, স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন যদি সঠিক রাজনৈতিক দিশা না পায়, তাহলে তা সহজেই বিভ্রান্ত হতে পারে বা প্রতিবিপ্লবী শক্তির দ্বারা ব্যবহৃত হতে পারে। কিন্তু তিনি যে বিপদটির ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছিলেন, তা হলো পার্টির আমলাতান্ত্রিকতা (Bureaucratization) এবং নেতৃত্বের অন্ধ অনুকরণ। তিনি ভয় পেতেন, পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি যদি শ্রমিক শ্রেণির ওপর নিজস্ব ইচ্ছা চাপিয়ে দেয়, তাহলে তা জনগণের সৃজনশীলতা ও আত্মশক্তিকে খর্ব করবে। বিপ্লবের আত্মা হলো সাধারণ মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ, তাদের সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা। পার্টি যদি এই আত্মাকেই হত্যা করে, তাহলে সেই বিপ্লব আর জনগণের বিপ্লব থাকে না।

১৯০৫ সালের প্রথম রুশ বিপ্লবের অভিজ্ঞতা রোজার এই চিন্তাকে আরও শাণিত করেছিল। তিনি দেখেছিলেন, কীভাবে কোনো কেন্দ্রীয় নির্দেশ ছাড়াই রাশিয়ার লক্ষ লক্ষ শ্রমিক, কৃষক ও সৈনিক স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধর্মঘট, বিক্ষোভ ও বিদ্রোহে ফেটে পড়েছিল, যা জারতন্ত্রের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। এই গণধর্মঘট (Mass Strike) তাঁর কাছে ছিল নিছক কোনো কৌশল নয়, বরং শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী জাগরণের এক জীবন্ত প্রকাশ, এক রাজনৈতিক পাঠশালা। এই গণধর্মঘটের মধ্য দিয়েই শ্রমিকরা তাদের শ্রেণিগত ঐক্য অনুভব করে, নিজেদের শক্তি সম্পর্কে সচেতন হয় এবং রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ওঠে। (Waters, 1970, pp. 43-47)

অবশ্যই, রোজার এই ভাবনাকে অনেকে ভুল বুঝে নৈরাজ্যবাদের (Anarchism) কাছাকাছি বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু রোজা কখনোই লাগামছাড়া, বিশৃঙ্খল স্বতঃস্ফূর্ততার পক্ষে সওয়াল করেননি। তিনি চেয়েছিলেন স্বতঃস্ফূর্ততা ও সংগঠনের মধ্যে একটি দ্বান্দ্বিক সমন্বয় (Dialectical synthesis), যেখানে একটি অপরটিকে পুষ্ট করবে, খর্ব নয়। তাঁর কাছে, পার্টি এবং গণ-আন্দোলন একে অপরের পরিপূরক। গণ-আন্দোলনের উত্তাপ ও শক্তি পার্টিকে সজীব রাখে, আর পার্টির তাত্ত্বিক স্বচ্ছতা ও রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা গণ-আন্দোলনকে লক্ষ্যচ্যুত হওয়া থেকে রক্ষা করে। এই ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্কই ছিল তাঁর বিপ্লবী কৌশলের মূল কথা। (Nettl, 1966, Vol. 1, pp. 280-295)

সংস্কারের চেনা পথে ধীর পায়ে হাঁটা, নাকি বিপ্লবের অগ্নিপরীক্ষায় আমূল পরিবর্তন?

সমাজ কি একটু একটু করে, ছোট ছোট সংস্কারের সিঁড়ি বেয়ে বদলে যাবে? নাকি একটা আমূল ঝাঁকুনি, একটা বিপ্লবী উত্থান ছাড়া মৌলিক পরিবর্তন অসম্ভব? এই প্রশ্নটি সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্মলগ্ন থেকেই তাত্ত্বিক ও কর্মীদের ভাবিয়ে তুলেছে। উনিশ শতকের শেষদিকে এবং বিশ শতকের শুরুতে জার্মান সমাজতন্ত্রী নেতা এডুয়ার্ড বার্নস্টাইন (Eduard Bernstein) এই বিতর্ককে নতুন করে উস্কে দিয়েছিলেন। তিনি মার্কসের বিপ্লবী তত্ত্বকে সেকেলে আখ্যা দিয়ে বললেন, পুঁজিবাদ এখন আর সেই আদিম যুগের মতো সংকটগ্রস্ত ও ভঙ্গুর নয়। বরং এটি বিভিন্ন উপায়ে (যেমন কার্টেল, ক্রেডিট ব্যবস্থা, ট্রেড ইউনিয়নের শক্তি বৃদ্ধি, সংসদীয় গণতন্ত্রের বিস্তার) নিজেকে স্থিতিশীল করে তুলেছে। তাই এখন আর সহিংস বিপ্লবের প্রয়োজন নেই। সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে হেঁটে, আইনি সংস্কারের (Legal reforms) মাধ্যমে ধীরে ধীরে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এই মতবাদ ‘সংশোধনবাদ’ (Revisionism) বা ‘বিবর্তনবাদী সমাজতন্ত্র’ (Evolutionary socialism) নামে পরিচিতি পায়।

রোজা লুক্সেমবার্গ ছিলেন এই সংশোধনবাদের এক আপসহীন, অকুতোভয় সমালোচক। ১৮৯৯ সালে প্রকাশিত তাঁর ক্ষুরধার ও বিশ্লেষণাত্মক পুস্তিকা ‘সামাজিক সংস্কার না বিপ্লব?’ (Sozialreform oder Revolution?)-এ তিনি বার্নস্টাইনের যুক্তির জাল ছিন্নভিন্ন করে দেন। (Luxemburg, 1899) রোজার বক্তব্য ছিল, সংস্কার আর বিপ্লব পরস্পরবিরোধী নয়, বরং একই সংগ্রামের দুটি ভিন্ন দিক। কিন্তু সংস্কার কখনোই বিপ্লবের বিকল্প হতে পারে না।

তিনি বার্নস্টাইনের এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানালেন যে, পুঁজিবাদ তার অভ্যন্তরীণ সংকটগুলো কাটিয়ে উঠেছে। রোজা বললেন, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমিকরা তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য, কাজের পরিবেশ উন্নত করার জন্য, মজুরি বৃদ্ধির জন্য, রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে। এই সংগ্রামের ফলে কিছু আইনকানুন পরিবর্তিত হয়, কিছু সুযোগ-সুবিধা অর্জিত হয়। এগুলোই হলো সংস্কার। রোজা এই সংস্কারের গুরুত্বকে খাটো করে দেখেননি। তিনি মনে করতেন, এই ছোট ছোট লড়াইগুলো শ্রমিকদের সংগঠিত করে, তাদের শ্রেণিচেতনা (Class consciousness) শাণিত করে এবং বৃহত্তর বিপ্লবী সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করে তোলে। এগুলো যেন বিপ্লবের পথে এগিয়ে যাওয়ার একেকটি সোপান।

কিন্তু তাঁর মূল বক্তব্য ছিল, এই সংস্কারগুলো পুঁজিবাদের মৌলিক চরিত্রকে, তার শোষণমূলক ভিত্তিটাকে বদলাতে পারে না। পুঁজিবাদ এমন এক ব্যবস্থা, যার ডিএনএ-তেই রয়েছে শোষণ। ছোটখাটো প্রসাধনী পরিবর্তন করে তার ভেতরের কদর্যতাকে ঢাকা যায় না। সংস্কারের মাধ্যমে হয়তো শোষণের শৃঙ্খলটাকে একটু আলগা করা যায়, কিন্তু তাকে ভেঙে ফেলা যায় না। পুঁজিবাদ অনেকটা হাইড্রার মতো, একটা মাথা কাটলে সেখান থেকে আরও দুটো গজায়। রোজার ভাষায়, সংস্কারের কাজ হলো পুঁজিবাদের কাঠামোর মধ্যে থেকেই কিছু উন্নতি সাধন করা, আর বিপ্লবের কাজ হলো সেই কাঠামোটাকেই ভেঙে নতুন কাঠামো তৈরি করা। (Ettinger, 1976, pp. 65-70)

তিনি বার্নস্টাইনকে অভিযুক্ত করেছিলেন এই বলে যে, তিনি আসলে সমাজতন্ত্রের চূড়ান্ত লক্ষ্যকেই (Ultimate goal) বিসর্জন দিতে চাইছেন, শ্রমিক আন্দোলনকে নিছক মজুরি বৃদ্ধির সংগ্রামে পরিণত করতে চাইছেন। রোজার কাছে, সমাজতন্ত্র কোনো দূর ভবিষ্যতের স্বপ্নবিলাস নয়, বরং এটি ইতিহাসের এক অনিবার্য প্রয়োজন। তিনি সেই বিখ্যাত উক্তিটি করেছিলেন, “যারা বিপ্লবের পরিবর্তে সমাজ সংস্কারের পথকে এই যুক্তিতে বেছে নেয় যে, তা অধিকতর নিশ্চিত ও শান্তিময়, তারা আসলে মুরগি চুরির জন্য কসাইখানার ছুরি ব্যবহার করার মতো অধিকতর শান্তিময় কিন্তু কম নিশ্চিত পথ বেছে নেয় না, বরং তারা পুঁজিবাদের খাঁচা থেকে সংস্কারের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রের দিকে না গিয়ে, পুঁজিবাদের খাঁচাটিকেই সামান্য মেরামত করে আরও টেকসই করতে চায়।” (Luxemburg, 1899, Conclusion) এই বক্তব্যের মধ্যে তাঁর গভীর প্রত্যয় ও সমাজ পরিবর্তনের আমূল আকাঙ্ক্ষা মূর্ত হয়ে ওঠে।

তিনি দেখালেন যে, পুঁজিবাদ নিজেই তার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব (Internal contradictions) এবং সংকটের (Crises) জন্ম দেয়। এই সংকটগুলো যখন ঘনীভূত হয়, তখন সংস্কারের পথগুলোও ক্রমশ রুদ্ধ হয়ে আসে। তখন শ্রমিক শ্রেণির সামনে একটিই পথ খোলা থাকে – বিপ্লব। তাই, সংস্কারের সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি শ্রমিকশ্রেণিকে সর্বদা বিপ্লবী লক্ষ্যের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তাঁর কাছে বিপ্লব কোনো আকাশ থেকে পড়া আকস্মিক ঘটনা নয়, বরং তা হলো শ্রেণি-সংগ্রামের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার এক গুণগত উল্লম্ফন (Qualitative leap)। (Davis, 1973, pp. 120-125) তাঁর এই বিশ্লেষণ আজও প্রাসঙ্গিক, যখন আমরা দেখি কীভাবে রাষ্ট্র ও পুঁজি সংস্কারের দাবিগুলোকে পাশ কাটিয়ে যায় বা সামান্য কিছু সুবিধা দিয়ে বৃহত্তর আন্দোলনকে শান্ত করার চেষ্টা করে।

গণতন্ত্রের পূজারী ও সমাজতন্ত্রের পথিকের চোখে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের রূপরেখা

রোজা লুক্সেমবার্গ ছিলেন গণতন্ত্রের এক একনিষ্ঠ সাধক। তাঁর কাছে সমাজতন্ত্র আর গণতন্ত্র ছিল একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। একটিকে ছাড়া অন্যটি অসম্পূর্ণ, বিকলাঙ্গ। তিনি এমন এক সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখতেন, যা হবে সর্বাধিক গণতন্ত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এইখানেই পরবর্তীকালে বলশেভিক শাসনের কিছু পদক্ষেপের সঙ্গে তাঁর মৌলিক মতপার্থক্য তৈরি হয়েছিল, যা তাঁর রাজনৈতিক চিন্তার এক গুরুত্বপূর্ণ দিক।

১৯১৭ সালে রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লব (Bolshevik Revolution) যখন সফল হলো, রোজা তাকে উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। তিনি একে বিশ্ব শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রামের এক ঐতিহাসিক বিজয় এবং বিশ্ববিপ্লবের এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখেছিলেন। তিনি কার্ল কাউটস্কি (Karl Kautsky) সহ অন্যান্য সমালোচকদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে রুশ বিপ্লবের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু একইসঙ্গে, একজন দূরদর্শী ও স্বাধীনচেতা মার্কসবাদী হিসেবে তিনি বলশেভিকদের গৃহীত কিছু নীতি ও পদক্ষেপের তীক্ষ্ণ কিন্তু গঠনমূলক সমালোচনা করতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি ‘রুশ বিপ্লব’ (The Russian Revolution, ১৯১৮)-এ এই সমালোচনামূলক মূল্যায়ন স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। (Luxemburg, 1918)

রোজা বিশেষভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন গণপরিষদ (Constituent Assembly) ভেঙে দেওয়া, বাকস্বাধীনতা (Freedom of speech), সংবাদপত্রের স্বাধীনতা (Freedom of the press), সমাবেশের স্বাধীনতা (Freedom of assembly) এবং সমিতি গঠনের স্বাধীনতা (Freedom of association) সংকোচনের মতো ঘটনাগুলো নিয়ে। তিনি বলশেভিক নেতাদের সতর্ক করে বলেছিলেন যে, সন্ত্রাস (Terror) কখনোই বিপ্লবকে রক্ষা করতে পারে না, বরং তা বিপ্লবী চেতনাকেই কলুষিত করে। তাঁর সেই অমর উক্তি, “মুক্তি সর্বদাই ভিন্নমতাবলম্বীর মুক্তি” (Freiheit ist immer Freiheit der Andersdenkenden / Freedom is always and exclusively freedom for the one who thinks differently), এই প্রসঙ্গে আজও বিপ্লবীদের পথনির্দেশ করে। (Arendt, 1951, Introduction to Luxemburg’s ‘The Russian Revolution’)

তিনি বিশ্বাস করতেন, সমাজতন্ত্র মানে যদি হয় সাধারণ মানুষের স্বশাসন, তাহলে সেই সমাজে ভিন্নমত প্রকাশের, অবাধ বিতর্কের এবং সমালোচনার অধিকার থাকতেই হবে। যদি একটি পার্টি বা গুটিকয়েক নেতা সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করে, যদি ভিন্নমতকে শত্রুতা হিসেবে দেখা হয় এবং দমন করা হয়, তাহলে সমাজতন্ত্র নিজেই এক নতুন ধরনের স্বৈরতন্ত্রে (Dictatorship) – আমলাতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রে (Bureaucratic dictatorship) – পর্যবসিত হতে পারে। তিনি লেনিন ও ট্রটস্কিকে (Trotsky) উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “আপনারা যে সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়তে চাইছেন, তার জন্য প্রয়োজন জনগণের ব্যাপকতম সক্রিয় অংশগ্রহণ, সীমাহীন গণতন্ত্র ও অবাধ জনমত। সন্ত্রাস মানুষের মনোবল ভেঙ্গে দেয়।”

তাঁর মতে, সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের ভিত্তি হবে শ্রমিকদের স্ব-শাসিত সংস্থা, যেমন শ্রমিক কাউন্সিল বা সোভিয়েত (Soviet)। কিন্তু এই সোভিয়েতগুলোকেও হতে হবে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, যেখানে বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দল ও মতাদর্শের মানুষ স্বাধীনভাবে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারবে এবং নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে। একদলীয় শাসন (One-party rule) এবং ভিন্নমত দমনের পথ দীর্ঘমেয়াদে বিপ্লবের প্রাণশক্তিকেই নিঃশেষ করে দেয়। সমাজতন্ত্র কোনো পূর্বনির্ধারিত ছকে ফেলা জিনিস নয় যে, কয়েকজন নেতা তা উপর থেকে চাপিয়ে দেবেন। এটি গড়ে উঠবে লক্ষ কোটি শ্রমজীবী মানুষের সৃজনশীল অংশগ্রহণ, তাদের উদ্যম এবং তাদের সম্মিলিত প্রজ্ঞার মধ্য দিয়ে। আর এই সৃজনশীল অংশগ্রহণের পূর্বশর্ত হলো একটি প্রাণবন্ত, অবাধ গণতান্ত্রিক পরিবেশ। (Geras, 1976, pp. 163-205)

তবে, বলশেভিকদের এই সমালোচনা সত্ত্বেও রোজা কখনোই রুশ বিপ্লবের প্রতি তাঁর মৌলিক সমর্থন ও সংহতি প্রত্যাহার করেননি। তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, প্রতিবিপ্লবী শক্তি, গৃহযুদ্ধ এবং সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপের মতো চরম প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে বলশেভিকরা অনেক কঠিন ও বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁর সমালোচনা ছিল মূলত বিপ্লবের ভবিষ্যতের কথা ভেবে, বিপ্লবকে সঠিক পথে চালিত করার আন্তরিক আকাঙ্ক্ষা থেকে। তিনি চেয়েছিলেন এমন এক সমাজতন্ত্র, যা হবে শোষণমুক্ত এবং একইসঙ্গে গণতান্ত্রিক ও মানবিক।

জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতা: এক জটিল সম্পর্কের বিশ্লেষণ

রোজা লুক্সেমবার্গের তাত্ত্বিক পরিমণ্ডলে জাতীয় প্রশ্ন (National Question) এবং আন্তর্জাতিকতাবাদের (Internationalism) সম্পর্ক একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। পোল্যান্ডে জন্মগ্রহণকারী এবং পরবর্তীতে জার্মানিতে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় রোজা নিজে পোলিশ জাতীয়তাবাদের তীব্র বিরোধী ছিলেন। তাঁর এই অবস্থান অনেক সময় ভুল বোঝাবুঝির শিকার হয়েছে, কিন্তু এর পেছনে ছিল তাঁর সুগভীর মার্কসবাদী আন্তর্জাতিকতাবাদী প্রত্যয়।

তৎকালীন পোল্যান্ড তিনটি বৃহৎ সাম্রাজ্য – রাশিয়া, জার্মানি ও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি – দ্বারা বিভক্ত ছিল। পোলিশ সোশ্যালিস্ট পার্টি (PPS), যার নেতৃত্বে ছিলেন জোসেফ পিলসুডস্কি (Józef Piłsudski), পোল্যান্ডের জাতীয় স্বাধীনতার (National independence) দাবিকে তাদের কর্মসূচির কেন্দ্রে রেখেছিল। তারা মনে করত, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আগে জাতীয় মুক্তি অর্জন জরুরি। রোজা লুক্সেমবার্গ এবং তাঁর সহযোদ্ধা লিও জোগিখিস (Leo Jogiches) এই লাইনের তীব্র বিরোধিতা করেন। তাঁরা পোল্যান্ড ও লিথুয়ানিয়ার সোশ্যাল ডেমোক্রেসি (SDKPiL) গঠন করেন, যার মূল বক্তব্য ছিল, পোলিশ শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থ রুশ, জার্মান ও অস্ট্রিয়ান শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। বিচ্ছিন্ন জাতীয় স্বাধীনতার সংগ্রাম শ্রমিক শ্রেণিকে আন্তর্জাতিক শ্রেণি সংগ্রাম থেকে বিচ্যুত করবে এবং বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের ফাঁদে ফেলবে। (Nettl, 1966, Vol. 1, pp. 58-85)

রোজা মনে করতেন, পুঁজিবাদের যুগে জাতীয় রাষ্ট্রগুলো (Nation-states) আর প্রগতির বাহন নয়, বরং সেগুলো সাম্রাজ্যবাদী প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও যুদ্ধের উৎস। শ্রমিক শ্রেণির মুক্তি কোনো একটি জাতির ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে আবদ্ধ থাকতে পারে না। তাদের সংগ্রাম হতে হবে আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে এক বিশ্বজনীন সংগ্রাম। তাই তিনি “জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার” (Right of nations to self-determination) – এই স্লোগানটিরও সমালোচক ছিলেন, কারণ তিনি আশঙ্কা করতেন, এই স্লোগান বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদকে শক্তিশালী করতে পারে এবং বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর শ্রমিকদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে পারে। (Davis, 1973, pp. 126-145)

অবশ্য, এর মানে এই নয় যে রোজা জাতিগত নিপীড়ন (National oppression) সমর্থন করতেন। তিনি জাতিগত নিপীড়নের তীব্র বিরোধী ছিলেন, কিন্তু তার সমাধান তিনি বিচ্ছিন্ন জাতীয় রাষ্ট্রে নয়, বরং একটি আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে সকল জাতির শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ মুক্তির মধ্যে দেখেছিলেন। তাঁর কাছে, জাতীয় মুক্তি ও সামাজিক মুক্তি ছিল অবিচ্ছেদ্য। এই প্রশ্নে লেনিনের সঙ্গে তাঁর উল্লেখযোগ্য মতপার্থক্য ছিল। লেনিন জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে (এমনকি বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকারসহ) সমর্থন করতেন, যদিও তিনিও আন্তর্জাতিকতাবাদের ওপর জোর দিতেন। লেনিন মনে করতেন, নিপীড়িত জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে স্বীকৃতি না দিলে বৃহত্তর শ্রমিক ঐক্য গড়ে তোলা কঠিন হবে।

রোজার জাতীয়তাবাদ বিষয়ক চিন্তা নিঃসন্দেহে জটিল এবং বিতর্কিত। কিন্তু এর কেন্দ্রে ছিল তাঁর অটল আন্তর্জাতিকতাবাদী বিশ্বাস এবং শ্রমিক শ্রেণির ঐক্যের প্রতি গভীর দায়বদ্ধতা। তিনি বুঝেছিলেন, জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণ আবেগ কীভাবে শ্রমিক আন্দোলনকে বিভক্ত ও দুর্বল করে দিতে পারে, যা শাসকশ্রেণিরই স্বার্থ রক্ষা করে।

উপসংহারের আলো-আঁধারি

রোজা লুক্সেমবার্গের জীবন ছিল এক উল্কার মতো – ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু তীব্র আলোকময়। মাত্র ৪৮ বছরের জীবনে তিনি যে তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক উত্তরাধিকার রেখে গেছেন, তা আজও আমাদের পথ দেখায়। ১৯১৯ সালের ১৫ই জানুয়ারি, বার্লিনে স্পার্টাসিস্ট বিদ্রোহ (Spartacist Uprising) নির্মমভাবে দমন করার পর, প্রতিক্রিয়াশীল ফ্রি-কর্পস (Freikorps) বাহিনীর ভাড়াটে গুন্ডারা তাঁকে ও কার্ল লিবনেখটকে পাশবিকভাবে হত্যা করে। তাঁর ক্ষতবিক্ষত দেহ নিক্ষেপ করা হয়েছিল লান্ডভের খালের হিমশীতল জলে। ঘাতকেরা ভেবেছিল, রোজাকে হত্যা করলেই তাঁর কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হয়ে যাবে। তারা ভুল ভেবেছিল।

তাঁর তত্ত্বগুলো নিয়ে বিতর্ক হয়েছে, হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। এটাই জীবন্ত চিন্তার লক্ষণ। তাঁর কিছু বিশ্লেষণ হয়তো আজকের পরিবর্তিত বিশ্বে হুবহু প্রয়োগযোগ্য নয়। কিন্তু তিনি যে মৌলিক প্রশ্নগুলো তুলেছিলেন – পুঁজিবাদের চরিত্র ও তার সংকট, সাম্রাজ্যবাদের স্বরূপ, বিপ্লবে গণ-উদ্যোগের ভূমিকা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক, জাতীয়তাবাদ বনাম আন্তর্জাতিকতাবাদ – সেই প্রশ্নগুলো আজও আমাদের তাড়া করে ফেরে।

রোজা লুক্সেমবার্গ আমাদের শিখিয়েছেন প্রচলিত জ্ঞানকে নির্ভয়ে প্রশ্ন করতে, ক্ষমতার দম্ভের সামনে দাঁড়িয়ে সত্য কথা বলতে, আর সাধারণ মানুষের সৃজনশীলতা ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষার ওপর অবিচল আস্থা রাখতে। তিনি শুধু একজন বিপ্লবী নেত্রী বা প্রখর তাত্ত্বিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন মানবতার এক মূর্ত প্রতীক – যাঁর হৃদয়ে ছিল বিশ্বের সকল নিপীড়িত (Oppressed) মানুষের জন্য অফুরন্ত ভালোবাসা আর শোষণমুক্ত, সাম্যবাদী সমাজের এক দুর্নিবার স্বপ্ন। তাঁর চিন্তা ছিল তীক্ষ্ণ ইস্পাতের মতো, আর হৃদয় ছিল রক্তগোলাপের মতো কোমল ও বিদ্রোহী।

তাঁর রেখে যাওয়া কাজগুলো যেন এক জটিল, কিন্তু আকর্ষণীয় মানচিত্র, যা আমাদের বর্তমান পৃথিবীর গোলকধাঁধা থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজতে সাহায্য করে। যারা পুঁজিবাদের নির্মমতাকে অনুধাবন করতে চান, যারা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে চান, যারা সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ও মানবিক সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখেন, তাদের জন্য রোজা লুক্সেমবার্গ এক অবিনশ্বর প্রেরণার বাতিঘর। তাঁর চিন্তার গভীরে ডুব দিলে, তাঁর যুক্তির শাণিত আলোয় আলোকিত হলে, হয়তো আমরাও খুঁজে পাবো একবিংশ শতাব্দীর জটিল থেকে জটিলতর সমস্যাগুলোর সমাধানের কিছু মূল্যবান সূত্র। ব্যাপারটা আবারও ভেবে দেখার মতো, তাই না? তাঁর সেই বিখ্যাত কথা দিয়েই শেষ করি, “সবচেয়ে বিপ্লবী কাজ হলো সবসময় উচ্চস্বরে ঘোষণা করা, যা ঘটছে।” (The most revolutionary thing one can do is always to proclaim loudly what is happening.)

তথ্যসূত্র

  • Arendt, H. (1951). Introduction. In R. Luxemburg, The Russian Revolution and Leninism or Marxism? (pp. 7-29). University of Michigan Press.

  • Bukharin, N. (1972). Imperialism and the Accumulation of Capital (R. Luxemburg, The Accumulation of Capital: An Anti-Critique, & N. Bukharin, Imperialism and the Accumulation of Capital, K.J. Tarbuck, Ed. & Trans.). Monthly Review Press. (Original work published 1924).

  • Davis, H. B. (1973). Nationalism and Socialism: Marxist and Labor Theories of Nationalism to 1917. Monthly Review Press.

  • Ettinger, E. (1976). Rosa Luxemburg: A Life. Beacon Press.

  • Frölich, P. (1972). Rosa Luxemburg: Her Life and Work. (Translated by J. Hoornweg). Monthly Review Press. (Original German edition 1939, first English translation 1940).

  • Geras, N. (1976). The Legacy of Rosa Luxemburg. New Left Books.

  • Howard, D. (Ed.). (1971). Selected Political Writings of Rosa Luxemburg. Monthly Review Press.

  • Kolakowski, L. (1978). Main Currents of Marxism: Its Rise, Growth, and Dissolution (Vol. 2: The Golden Age). (P.S. Falla, Trans.). Clarendon Press.

  • Lenin, V. I. (1902). What Is To Be Done? Burning Questions of Our Movement. (Original Russian publication; numerous English translations exist).

  • Lenin, V. I. (1917). Imperialism, the Highest Stage of Capitalism. (Original Russian publication; numerous English translations exist, e.g., Foreign Languages Press, Peking, 1975).

  • Luxemburg, R. (1899). Sozialreform oder Revolution? (Original German publication). Leipzig: Verlag der Leipziger Buchdruckerei Aktiengesellschaft. (English translation: Social Reform or Revolution?).

  • Luxemburg, R. (1904). Organisationsfragen der russischen Sozialdemokratie. Die Neue Zeit. (English translation: Organizational Questions of Russian Social Democracy, later published as Leninism or Marxism?).

  • Luxemburg, R. (1906). Massenstreik, Partei und Gewerkschaften. (Original German publication). Hamburg: Erdmann Dubber. (English translation: The Mass Strike, the Political Party and the Trade Unions).

  • Luxemburg, R. (1913). Die Akkumulation des Kapitals: Ein Beitrag zur ökonomischen Erklärung des Imperialismus. (Original German publication). Berlin: Buchhandlung Vorwärts Paul Singer. (English translation: The Accumulation of Capital).

  • Luxemburg, R. (1915). Die Krise der Sozialdemokratie (Junius-Broschüre). (Written in prison, published clandestinely). (English translation: The Crisis in German Social Democracy (The Junius Pamphlet)).

  • Luxemburg, R. (1918). Zur russischen Revolution. (Written in 1918, published posthumously in 1922 by Paul Levi). (English translation: The Russian Revolution).

  • Nettl, J. P. (1966). Rosa Luxemburg (2 vols.). Oxford University Press. (Abridged edition published in 1969).

  • Waters, M. A. (Ed.). (1970). Rosa Luxemburg Speaks. Pathfinder Press.

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.