Table of Contents
ভূমিকা
ভালোবাসা! আহা, কী মধুর শব্দ! এই এক শব্দের চারপাশে ঘুরপাক খায় আমাদের জীবনের কতশত আশা, আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন আর বিভ্রম। কবিগুরু থেকে শুরু করে পাড়ার চায়ের দোকানের উঠতি কবি, সকলেই এই ভালোবাসার মায়াজালে আচ্ছন্ন। সেই যে কবেকার অজানা কোনো এক শুভক্ষণে দুটো মানব-মানবীর হৃদয়ে প্রথম প্রেমের উদয় হয়েছিল, সেই রহস্যের কিনারা আজও কি আমরা করতে পেরেছি? নাকি এই ভালোবাসাও কালের বিবর্তনে, সমাজের চাপে, আর বাজারের কৌশলে তার আদি অকৃত্রিম রূপ হারিয়ে ফেলেছে?
ভাবছেন তো, ভালোবাসা নিয়ে আবার এত কচকচানির কী আছে? এ তো অনুভবের ব্যাপার, হৃদয়ের টান। সেখানে আবার বাজার, পণ্য, ভোগ্য সংস্কৃতি – এসব জটিল শব্দ টেনে আনার মানেটা কী? মানে আছে, মশাই, খুব ভালোভাবেই আছে। আজকের এই ঝা-চকচকে আধুনিক পৃথিবীতে, যেখানে সবকিছুই যেন কেনা যায়, বিক্রি করা যায়, সেখানে আমাদের সবচেয়ে ব্যক্তিগত, সবচেয়ে গোপন অনুভূতিগুলোও যে বাজারের অদৃশ্য হাতের ইশারায় চলছে, সে খবর কি আমরা রাখি?
প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ইভা ইলুজ (Eva Illouz) তাঁর যুগান্তকারী গ্রন্থ ‘কনজিউমিং দ্য রোমান্টিক ইউটোপিয়া: লাভ অ্যান্ড দ্য কালচারাল কন্ট্রাডিকশনস অফ ক্যাপিটালিজম’ (Consuming the Romantic Utopia: Love and the Cultural Contradictions of Capitalism, 1997)-এ ঠিক এই অস্বস্তিকর প্রশ্নগুলোরই মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন আমাদের। তিনি যেন একদল অনুসন্ধানী সাংবাদিকের মতো ভালোবাসার অন্দরমহলে ঢুকে তার নাড়ি-নক্ষত্র বিচার করেছেন। তাঁর বিশ্লেষণে বেরিয়ে এসেছে এক চমকপ্রদ, এবং খানিকটা ভীতিকর, চিত্র। ইলুজ দেখিয়েছেন, আমরা যাকে বিশুদ্ধ প্রেম (pure love) বা হৃদয়ের স্বতঃস্ফূর্ত টান বলে মনে করি, তার অনেকটাই আসলে বাজার (market) এবং ভোগ্য সংস্কৃতি (consumer culture) দ্বারা নির্মিত, নিয়ন্ত্রিত এবং পরিচালিত। ব্যাপারটা হজম করতে একটু কষ্ট হচ্ছে, তাই না? চলুন, ধীরে সুস্থে, একেবারে গোড়া থেকে পুরো বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করা যাক। এই দীর্ঘ আলাপে আমরা ডুব দেব ভালোবাসার ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে, দেখব কীভাবে পুঁজিবাদের সর্বগ্রাসী ক্ষুধা আমাদের প্রেমময় কল্পনাকেও নিজের খাদ্য বানিয়ে ফেলেছে।
এক যে ছিল ভালোবাসা: সেকালের প্রেম, একালের প্রেম
একটু চোখ বন্ধ করে ভাবুন তো, কয়েক দশক আগের মানুষেরা কীভাবে ভালোবাসতেন? তাদের প্রেমকাহিনিগুলো কেমন ছিল? সেখানে হয়তো বিরহের দীর্ঘশ্বাস ছিল, চিঠির পাতায় লুকিয়ে রাখা শুকনো গোলাপ ছিল, লোকচক্ষুর আড়ালে ক্ষণিকের দেখা হওয়া ছিল। কিন্তু আজকের মতো রেস্তোরাঁর ঝলমলে আলোয় ক্যান্ডেল লাইট ডিনার (candlelight dinner), মাল্টিপ্লেক্সে একশো টাকা দামের পপকর্ন খেতে খেতে সিনেমা দেখা, কিংবা জন্মদিনে দামী ব্র্যান্ডের ঘড়ি উপহার দেওয়ার চল কি তখন ছিল? খুব সম্ভবত না।
ঐতিহাসিকভাবে দেখলে, বেশিরভাগ সমাজে বিয়ে ছিল মূলত একটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক চুক্তি (economic and social contract)। দুটো পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন, সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিশ্চিত করা, বংশরক্ষা – এসবই ছিল মুখ্য। ভালোবাসা যদি বা আসত, তা আসত বিয়ের পরে, ধীরে ধীরে, পারস্পরিক নির্ভরতা আর শ্রদ্ধাবোধ থেকে। ব্যক্তির পছন্দ, আবেগের তীব্রতা, বা যাকে আমরা ‘রোমান্টিক লাভ’ বলি, তার গুরুত্ব ছিল খুবই কম। অ্যান্থনি গিডেন্স (Anthony Giddens) তাঁর ‘দ্য ট্রান্সফরমেশন অফ ইনটিমেসি’ (The Transformation of Intimacy, 1992) বইতে দেখিয়েছেন কীভাবে আধুনিকতার আগে সম্পর্কগুলো মূলত প্রথা এবং সামাজিক কর্তব্যের (social duty) উপর নির্ভরশীল ছিল, ব্যক্তিগত আবেগের উপর ততটা নয়। সেখানে ‘সোলমেট’ বা ‘মনের মানুষ’ খুঁজে পাওয়ার রোমান্টিক ধারণা আজকের মতো এত প্রবল ছিল না। এমনও হতে পারে, ‘ভালোবাসা’ নামক অনুভূতিটি তখন অন্য কোনো নামে, অন্য কোনো রূপে বিরাজ করত, যা আজকের সংজ্ঞার সাথে পুরোপুরি মেলে না।
কিন্তু সময় তো আর এক জায়গায় থেমে থাকে না। রেনেসাঁস, জ্ঞানদীপ্তি (Enlightenment), শিল্পবিপ্লব (Industrial Revolution), আর তার হাত ধরে পুঁজিবাদের (capitalism) উত্থান – এই সবকিছু মিলে মানুষের জীবনযাত্রা, চিন্তাভাবনা, এবং সামাজিক কাঠামোকে আমূল বদলে দিল। এই পরিবর্তনের ঝাপটা এসে লাগল আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের উঠোনেও। ধীরে ধীরে ইন্ডিভিজুয়ালিজম বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের ধারণা শক্তিশালী হলো। মানুষ নিজেকে শুধুমাত্র পরিবারের বা গোষ্ঠীর অংশ হিসেবে না দেখে, একজন স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে ভাবতে শুরু করল। আর এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের হাত ধরেই জন্ম নিল ‘রোমান্টিক লাভ’ নামক এক নতুন আদর্শ।
রোমান্টিক ইউটোপিয়ার নির্মাণ: যখন প্রেম হলো জীবনের পরমার্থ
ইভা ইলুজের তত্ত্বের একেবারে কেন্দ্রে রয়েছে এই ‘রোমান্টিক ইউটোপিয়া’ (romantic utopia) বা প্রেমময় কল্পস্বর্গের ধারণা। এই কল্পস্বর্গ আমাদের শেখায় যে, প্রেমই হলো জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া, জীবনের কেন্দ্রবিন্দু। এই প্রেমই পারে আমাদের সব দুঃখ ভুলিয়ে দিতে, জীবনে পূর্ণতা আর সার্থকতা এনে দিতে। এই ইউটোপিয়া অনুযায়ী, পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের জন্যই কোথাও না কোথাও একজন ‘নিখুঁত সঙ্গী’ (perfect partner) বা ‘আত্মার আত্মীয়’ (soulmate) অপেক্ষা করে আছে। আর সেই কাঙ্ক্ষিত সঙ্গীর সাথে প্রেমময়, আবেগঘন সম্পর্ক (passionate relationship) গড়ে তোলার মাধ্যমেই জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জিত হয়। এই প্রেম শুধু ব্যক্তিগত সুখের উৎস নয়, এটি যেন একধরনের মুক্তি (liberation), যা ব্যক্তিকে সমাজের আর দশটা বাঁধাধরা নিয়মকানুন থেকে উত্তরণ ঘটায়।
কবিতা, উপন্যাস, চিত্রকলা, সঙ্গীত – শিল্পের বিভিন্ন মাধ্যম এই রোমান্টিক আদর্শকে সাধারণ মানুষের মনে প্রোথিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। উনিশ শতকের রোমান্টিক সাহিত্যিকরা আবেগের জয়গান গেয়েছেন, প্রেমের জন্য সব ত্যাগ করতে শিখিয়েছেন। ধীরে ধীরে ‘লাভ ম্যারেজ’ (love marriage) বা প্রেমের বিয়ে সামাজিকভাবে আকাঙ্ক্ষিত হয়ে উঠল, অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ (arranged marriage) বা সম্বন্ধ করে বিয়ের ধারণা কিছুটা হলেও পিছিয়ে পড়ল। ভালোবাসা হয়ে উঠল বিয়ের প্রধান এবং অকাট্য শর্ত।
কিন্তু ইলুজ প্রশ্ন তুলেছেন, এই যে রোমান্টিক ইউটোপিয়ার ধারণা, এটা কি সত্যিই মানুষের অন্তর থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জন্ম নিয়েছে? নাকি এর নির্মাণেও রয়েছে বিশেষ কোনো সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট? এখানেই ইলুজ পুঁজিবাদের ভূমিকার কথা বলেন। তিনি দেখান, পুঁজিবাদ একদিকে যেমন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদকে উৎসাহিত করে রোমান্টিক প্রেমের আদর্শকে জনপ্রিয় করে তুলেছে, অন্যদিকে সে এই প্রেমকেই ব্যবহার করেছে নিজের বাণিজ্যিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য। (Illouz, 1997)
পুঁজিবাদের ফাঁদ: রোমান্টিক ইউটোপিয়ার ভোগ্যপণ্যকরণ (Commodification)
পুঁজিবাদের মূল চালিকাশক্তি হলো মুনাফা (profit)। আর মুনাফা আসে পণ্য বিক্রি করে, মানুষকে ভোক্তা (consumer) বানিয়ে। ইলুজ দেখিয়েছেন, পুঁজিবাদ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে আমাদের রোমান্টিক আকাঙ্ক্ষাগুলোকে (romantic desires) ব্যবহার করে নতুন নতুন বাজার তৈরি করেছে। ভালোবাসা, যা একসময় ছিল মূলত অনুভূতির বিষয়, তা ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয়েছে একগুচ্ছ রিচ্যুয়াল (ritual) বা প্রথা, অভিজ্ঞতা (experience) এবং পণ্যের (commodity) সমষ্টিতে।
ব্যাপারটা আরেকটু খোলাসা করা যাক। পুঁজিবাদ যখন বিকশিত হচ্ছিল, তখন মানুষের হাতে অবসর সময় (leisure time) এবং ক্রয়ক্ষমতা (purchasing power) দুটোই কিছুটা বাড়ল (যদিও শ্রেণিভেদে এই বৃদ্ধি ছিল অসম)। এই অবসর সময়কে কীভাবে ‘উপভোগ’ করা যায়, তার জন্য বাজার বিভিন্ন উপায় বাতলে দিতে শুরু করল। আর রোমান্টিক সম্পর্কগুলো হয়ে উঠল এই অবসরকালীন ভোগের (leisure consumption) এক উর্বর ক্ষেত্র।
ইলুজ বলছেন, বাজার এই রোমান্টিক ইউটোপিয়াকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এবং তাকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য ক্রমাগত নতুন নতুন ‘চিত্রনাট্য’ (script) তৈরি করে। এই চিত্রনাট্যে বলা থাকে, কীভাবে ভালোবাসতে হবে, কীভাবে ভালোবাসার প্রকাশ করতে হবে, কোন কোন কাজ করলে সম্পর্ক আরও ‘গভীর’ ও ‘মধুর’ হবে। আর এই চিত্রনাট্যের প্রতিটি ধাপেই জড়িয়ে আছে কোনো না কোনো পণ্য বা সেবা।
-
ভালোবাসার স্থান (Spaces of Love): একটা সময় ছিল যখন প্রেমিকের সাথে দেখা করার জায়গা ছিল নদীর ধার, নিরিবিলি পার্ক, অথবা বাড়ির ছাদ। কিন্তু আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজে ভালোবাসার স্থানগুলোও ক্রমশ বাণিজ্যিক হয়ে উঠেছে। রেস্তোরাঁ, কফি শপ, সিনেমা হল, শপিং মল – এগুলোই এখন যুগলদের পছন্দের জায়গা। এই স্থানগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা হয় যাতে সেখানে মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে অর্থ ব্যয় করতে পারে। এই স্থানগুলোয় কাটানো সময়কে আমরা ‘কোয়ালিটি টাইম’ (quality time) বলে অভিহিত করি, এবং এই ‘কোয়ালিটি’ প্রায়শই নির্ভর করে স্থানটির বাণিজ্যিক চাকচিক্য এবং খরচের উপর।
-
ভালোবাসার কার্যকলাপ (Activities of Love): একসাথে ডিনার করতে যাওয়া, সিনেমা দেখা, কনসার্টে যাওয়া, লং ড্রাইভে যাওয়া – এগুলো এখন রোমান্টিক সম্পর্কের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই প্রতিটি কার্যকলাপের সাথেই জড়িয়ে আছে অর্থব্যয়। বাজার আমাদের শেখায় যে, এই ধরনের ‘অভিজ্ঞতা’ লাভের মাধ্যমেই ভালোবাসা পূর্ণতা পায়।
-
ভালোবাসার প্রতীক (Symbols of Love): ফুল, চকোলেট, পারফিউম, গয়না, দামী পোশাক – এগুলো সবই এখন ভালোবাসার প্রতীকে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে ভ্যালেন্টাইনস ডে, জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকীর মতো দিনগুলোতে এই প্রতীকী উপহারের (symbolic gifts) আদান-প্রদান যেন বাধ্যতামূলক। এই উপহারগুলোর আর্থিক মূল্য (monetary value) অনেক ক্ষেত্রেই ভালোবাসার গভীরতা মাপার একটা মানদণ্ড হয়ে দাঁড়ায়। প্রেমিক বা প্রেমিকা যদি ‘যথাযথ’ মূল্যের বা ব্র্যান্ডের উপহার না দেয়, তাহলে সম্পর্কে সন্দেহের কালো মেঘ জমতে পারে। ইলুজ দেখিয়েছেন, কীভাবে বিজ্ঞাপন জগৎ (advertising world) সুকৌশলে এই বস্তুগুলোকে রোমান্টিক অনুভূতির সাথে জুড়ে দিয়েছে। (Illouz, 1997, Chapter 3: “The Romanticization of Commodities and the Commodification of Romance”).
ইলুজ আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, তা হলো প্রেমের যৌক্তিকীকরণ বা র্যাশনালাইজেশন (rationalization of romance)। শুনতে প্যারাডক্সিকাল মনে হলেও, তিনি দেখান যে আধুনিক প্রেম যদিও আবেগের উপর প্রতিষ্ঠিত বলে দাবি করা হয়, এর মধ্যে একটি শক্তিশালী যৌক্তিক এবং হিসেবি দিকও রয়েছে। সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমরা ‘উপযুক্ততা’ (compatibility), ‘গুণাবলী’ (qualities), এমনকি অর্থনৈতিক সচ্ছলতাও বিচার করি – যা অনেকটাই বাজারের যুক্তির মতো। অনলাইন ডেটিং সাইট এবং অ্যাপগুলো এই যৌক্তিকীকরণকে আরও প্রকট করে তুলেছে, যেখানে সম্ভাব্য সঙ্গীদের প্রোফাইলগুলো পণ্যের ক্যাটালগের মতো ব্রাউজ করা হয়।
ভ্রমণ, ডিনার, গিফট থেকে সোশ্যাল মিডিয়া: ভালোবাসার বাজার-নির্ধারিত মানদণ্ড
চলুন, এবার আরও কিছু সুনির্দিষ্ট উদাহরণের মাধ্যমে দেখি, কীভাবে বাজার আমাদের রোমান্টিক জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করছে।
-
‘পারফেক্ট ডেট’ (The Perfect Date): একটা সফল ‘ডেট’ কেমন হওয়া উচিত? মিডিয়া এবং বিজ্ঞাপন আমাদের শিখিয়েছে যে, এর জন্য প্রয়োজন একটা ভালো রেস্তোরাঁ, পরিপাটি পোশাক, হয়তো বা একটা ছোট্ট কিন্তু রুচিশীল উপহার। রেস্তোরাঁর মেনু, পরিবেশ, বিলের অঙ্ক – সবকিছুই যেন ডেটের সাফল্য বা ব্যর্থতা নির্ধারণ করে। এখানে ব্যক্তিগত আলাপচারিতা বা মানসিক সংযোগের চেয়েও বাহ্যিক আড়ম্বর বেশি গুরুত্ব পেয়ে যায়।
-
রোমান্টিক ভ্রমণ (Romantic Travel): ‘সুইজারল্যান্ডের বরফে ঢাকা পাহাড়ের কোলে হাত ধরে হেঁটে বেড়ানো’, ‘মালদ্বীপের নীল জলে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার’, ‘প্যারিসের আইফেল টাওয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে প্রোপোজ করা’ – এই দৃশ্যগুলো আমাদের চোখে লেগে আছে বিভিন্ন সিনেমা আর বিজ্ঞাপনের দৌলতে। ভ্রমণ সংস্থাগুলো আকর্ষণীয় ‘রোমান্টিক প্যাকেজ’ (romantic packages) তৈরি করে আমাদের এই স্বপ্নগুলো বিক্রি করে। মনে হয়, যেন দূরে কোথাও না গেলে, অনেক টাকা খরচ না করলে ভালোবাসার পূর্ণতা আসেই না। এই অভিজ্ঞতাগুলো একধরনের ‘স্ট্যাটাস সিম্বল’ (status symbol) বা সামাজিক মর্যাদার প্রতীকেও পরিণত হয়েছে।
-
উপহারের মহিমা (The Significance of Gifts): উপহার দেওয়া-নেওয়া ভালোবাসার এক সুন্দর প্রথা। কিন্তু পুঁজিবাদী সংস্কৃতিতে এই প্রথাও তার সরলতা হারিয়েছে। এখন উপহারের ব্র্যান্ড, দাম, এবং তার ‘ইনস্টাগ্রামেবিলিটি’ (Instagrammability) – অর্থাৎ সোশ্যাল মিডিয়ায় কতটা আকর্ষণীয় ছবি দেওয়া যাবে, সেটাও বিবেচ্য বিষয়। হীরের আংটি ছাড়া কি বাগদান সম্পন্ন হয়? জন্মদিনে কি লেটেস্ট মডেলের স্মার্টফোন না দিলে ভালোবাসা কমে যায়? এই প্রশ্নগুলো আমাদের তাড়া করে ফেরে, কারণ বাজার আমাদের মনে এই ধারণাগুলো গেঁথে দিয়েছে।
-
বিশেষ দিবস উদযাপন (Celebrating Special Days): ভ্যালেন্টাইন’স ডে এখন বিশ্বব্যাপী এক বিশাল বাণিজ্যিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। এই একটি দিনকে কেন্দ্র করে ফুল, চকোলেট, কার্ড, গয়না, পোশাক – কত কিছুর রমরমা ব্যবসা! এই দিবসগুলোয় ‘বিশেষ কিছু’ না করলে যেন সঙ্গীর প্রতি অবিচার করা হয়, ভালোবাসা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এই ‘বিশেষ কিছু’ করতে গিয়ে যে মানসিক চাপ এবং অর্থনৈতিক বোঝা তৈরি হয়, সেদিকে আমাদের খেয়াল থাকে না।
-
সৌন্দর্য শিল্প ও প্রেম (The Beauty Industry and Love): আকর্ষণীয় হয়ে ওঠা, কাঙ্ক্ষিত সঙ্গীর মন জয় করা – এই আকাঙ্ক্ষাগুলোকে পুঁজি করে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে সৌন্দর্য শিল্প (beauty industry) এবং ফ্যাশন জগৎ (fashion world)। নিখুঁত ত্বক, মেদহীন শরীর, আধুনিকতম পোশাক – এগুলো যেন ভালোবাসার বাজারে নিজেকে ‘যোগ্য’ প্রমাণ করার অপরিহার্য শর্ত। ইলুজ দেখিয়েছেন, কীভাবে নারীদের উপর এই চাপ বিশেষভাবে বেশি, কারণ ঐতিহ্যগতভাবেই তাদের শারীরিক আকর্ষণকে প্রেমের ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। (Illouz, 1997)
-
সোশ্যাল মিডিয়ার রঙ্গমঞ্চ (The Stage of Social Media): ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের যুগে আমাদের ব্যক্তিগত জীবন, বিশেষ করে প্রেম-ভালোবাসা, অনেকটাই ‘পাবলিক কনজামপশন’ (public consumption) বা সর্বজনীন ভোগের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। যুগলদের ছবি, বেড়াতে যাওয়ার আপডেট, পাওয়া উপহারের ছবি – সবকিছুই যেন অন্যদের দেখানোর জন্য। এখানে একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা চলে – কার সম্পর্ক কতটা ‘পারফেক্ট’, কার সঙ্গী কতটা ‘রোমান্টিক’। এই ‘পারফরম্যান্স’ (performance) অনেক সময়ই আসল অনুভূতির চেয়ে বড় হয়ে ওঠে। এই প্রসঙ্গে আরলি হশচাইল্ডের (Arlie Hochschild) ‘ইমোশনাল লেবার’ বা আবেগজনিত শ্রমের ধারণাটিও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা অনেক সময়ই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য বা সামাজিক প্রত্যাশা পূরণের জন্য নির্দিষ্ট আবেগ ‘প্রদর্শন’ করি, যা হয়তো আমাদের ভেতরের অনুভূতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। (Hochschild, 1983, The Managed Heart)
ভালোবাসার ভাষা ও অনুভূতির বাজারীকরণ
শুধু বাহ্যিক আচার-আচরণ বা পণ্যই নয়, ইলুজ দেখান যে ভালোবাসার ‘অনুভূতি’ (feeling of love) এবং তার প্রকাশের ‘ভাষা’ও (language of love) বাজার দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। সিনেমা, গান, উপন্যাস, টেলিভিশন ধারাবাহিক – এগুলো আমাদের শেখায় যে ভালোবাসা কেমন হওয়া উচিত, ভালোবাসলে কেমন অনুভূতি হয়, কী ধরনের কথা বলতে হয়। একটা ‘স্বপ্নের প্রোপোজাল’ (dream proposal) কেমন হবে, বা ‘আদর্শ রোমান্টিক সঙ্গী’র (ideal romantic partner) বৈশিষ্ট্য কী হবে – তার একটা নির্দিষ্ট ছক মিডিয়া আমাদের মনের মধ্যে তৈরি করে দেয়। এই ছকের সাথে নিজেদের অভিজ্ঞতা না মিললেই আমরা হতাশ হই, মনে করি আমাদের ভালোবাসায় কোনো ঘাটতি আছে।
থেরাপিউটিক সংস্কৃতি (therapeutic culture) এবং সেলফ-হেল্প ইন্ডাস্ট্রিও (self-help industry) এই ক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা পালন করে। সম্পর্ককে কীভাবে ‘উন্নত’ করা যায়, কীভাবে সঙ্গীর সাথে ‘যোগাযোগ’ (communication) বাড়ানো যায়, কীভাবে ‘কনফ্লিক্ট রেজোলিউশন’ (conflict resolution) করা যায় – এই সব বিষয়ে অজস্র বই, ওয়ার্কশপ, এবং অনলাইন কোর্স বাজারে উপলব্ধ। এগুলোর উদ্দেশ্য মহৎ হলেও, অনেক ক্ষেত্রেই এগুলো ভালোবাসাকে একটা ‘প্রজেক্ট’-এ (project) পরিণত করে, যেখানে ক্রমাগত ‘কাজ’ (work) করে যেতে হয়, ‘বিনিয়োগ’ (investment) করতে হয় ভালো ‘ফলাফল’ (outcome) পাওয়ার আশায়। এই ভাষাও কিন্তু বাজারের ভাষা – যেখানে সবকিছুই পরিমাপযোগ্য, উন্নতিযোগ্য, এবং ব্যবস্থাপনার (management) অধীন। ইলুজ তাঁর পরবর্তী কিছু কাজে, যেমন ‘কোল্ড ইনটিমেসিস: দ্য মেকিং অফ ইমোশনাল ক্যাপিটালিজম’ (Cold Intimacies: The Making of Emotional Capitalism, 2007) এবং ‘হোয়াই লাভ হার্টস: এ সোশিওলজিক্যাল এক্সপ্লানেশন’ (Why Love Hurts: A Sociological Explanation, 2012)-এ এই বিষয়গুলো আরও বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন।
তাহলে কি আমাদের ভালোবাসা সবটাই মেকি, সবটাই অভিনয়?
এতক্ষণ ধরে যা আলোচনা হলো, তাতে মনে হতেই পারে যে আমাদের ভালোবাসা, আমাদের আবেগ-অনুভূতি – সবই বুঝি বাজারের হাতের পুতুল, সবটাই মেকি, লোকদেখানো। কিন্তু ইভা ইলুজ এমন চরম সিদ্ধান্তে পৌঁছাননি। তিনি এটা বলতে চাননি যে, আধুনিক প্রেমে কোনো খাঁটি অনুভূতি (genuine feeling) নেই। বরং তিনি দেখাতে চেয়েছেন, আমাদের ভালোবাসার ধরণ (form), তার প্রকাশভঙ্গী (expression), এবং তার চর্চা (practice) বাজার এবং ভোগ্য সংস্কৃতি দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ও নির্মিত (shaped and constructed) হয়।
আমরা যখন কাউকে ভালোবাসি, তখন সেই অনুভূতিটা হয়তো সত্যিই আমাদের অন্তর থেকে আসে। কিন্তু সেই ভালোবাসা কীভাবে প্রকাশ করব, সম্পর্কটাকে কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাব, সঙ্গীর কাছ থেকে কী প্রত্যাশা করব – এই বিষয়গুলো নির্ধারণে বাজারের একটা বড় ভূমিকা থাকে। আমরা অজান্তেই বাজারের তৈরি করা চিত্রনাট্য অনুসরণ করি, কারণ সেটাই আমাদের কাছে ‘স্বাভাবিক’ (normal) এবং ‘আকাঙ্ক্ষিত’ (desirable) বলে মনে হয়।
এই বাজার-চালিত প্রেমের কিছু নেতিবাচক পরিণতির কথাও ইলুজ উল্লেখ করেছেন:
-
বিচ্ছিন্নতা ও কৃত্রিমতা (Alienation and Artificiality): যখন ভালোবাসার প্রকাশভঙ্গীগুলো এতটা পণ্য-নির্ভর হয়ে যায়, তখন অনেক সময়ই আমরা প্রকৃত আবেগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। ভালোবাসার চেয়ে তার ‘প্রদর্শন’ বড় হয়ে ওঠে, যা এক ধরনের কৃত্রিমতা তৈরি করে।
-
চাপ ও উদ্বেগ (Pressure and Anxiety): সঙ্গীকে দামী উপহার দেওয়ার, ‘পারফেক্ট’ ডেটে নিয়ে যাওয়ার, বা সোশ্যাল মিডিয়ায় সুখী যুগলের ছবি পোস্ট করার একটা সামাজিক চাপ তৈরি হয়। এই চাপ অনেককেই অর্থনৈতিক এবং মানসিক উদ্বেগের মধ্যে ফেলে দেয়।
-
অসমতা (Inequality): ভালোবাসার এই ভোগ্য মডেলটি অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল মানুষদের জন্য যতটা সহজলভ্য, নিম্নবিত্ত বা সীমিত আয়ের মানুষের জন্য ততটা নয়। ফলে, ভালোবাসার প্রকাশেও একটা শ্রেণি বিভাজন (class division) তৈরি হতে পারে। যাদের অর্থ কম, তারা কি তাহলে ভালোবাসতে জানে না, বা তাদের ভালোবাসা কি ‘কম দামী’? এই প্রশ্নগুলো খুবই অস্বস্তিকর।
-
সম্পর্কের ভঙ্গুরতা (Fragility of Relationships): জিগমুন্ট বাউমান (Zygmunt Bauman) তাঁর ‘লিকুইড লাভ’ (Liquid Love, 2003) তত্ত্বে দেখিয়েছেন, কীভাবে আধুনিক সমাজে সম্পর্কগুলো ক্রমশ ঠুনকো, অস্থায়ী এবং ‘তরল’ (liquid) হয়ে যাচ্ছে। যখন ভালোবাসা নিজেই একটা ভোগ্যপণ্যের মতো হয়ে যায়, তখন আমরা খুব সহজেই একটা ‘পণ্য’ (সম্পর্ক) থেকে আরেকটা ‘পণ্যে’ (নতুন সম্পর্ক) আকৃষ্ট হতে পারি, ঠিক যেমন আমরা পুরনো মোবাইল ফোন বাতিল করে নতুন মডেল কিনি। এই ‘ব্যবহার করো ও ফেলে দাও’ (use and throw) সংস্কৃতি সম্পর্কের গভীরতা এবং স্থায়িত্বকে নষ্ট করে।
এই বাজারের কবল থেকে মুক্তির পথ কোথায়?
প্রশ্ন হলো, এই সর্বগ্রাসী বাজার এবং ভোগ্য সংস্কৃতির প্রভাব থেকে আমাদের প্রেম-ভালোবাসাকে কি আদৌ বাঁচানো সম্ভব? কাজটা যে খুবই কঠিন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বাজার আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে। কিন্তু হাল ছেড়ে দেওয়াটাও তো কোনো সমাধান নয়। হয়তো পুরোপুরি মুক্তি সম্ভব নয়, কিন্তু সচেতন প্রচেষ্টার মাধ্যমে এর নেতিবাচক প্রভাবগুলো কিছুটা হলেও কমানো যেতে পারে।
-
সমালোচনামূলক সচেতনতা (Critical Awareness): প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো সচেতন হওয়া। আমাদের বুঝতে হবে, কীভাবে বাজার আমাদের চিন্তাভাবনা, আকাঙ্ক্ষা এবং আচরণকে প্রভাবিত করছে। মিডিয়া, বিজ্ঞাপন, এবং সামাজিক প্রথাগুলো আমাদের যা শেখাচ্ছে, সেগুলোকে প্রশ্ন করতে শিখতে হবে। ভালোবাসার প্রকাশ মানেই যে দামী উপহার বা লোকদেখানো আড়ম্বর নয় – এই বোধটা নিজেদের মধ্যে এবং পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে জাগাতে হবে।
-
নিজস্বতার সন্ধান (Search for Authenticity): বাজারের তৈরি করা ছকে নিজেদের না ফেলে, ভালোবাসার নিজস্ব ভাষা (own language of love) এবং নিজস্ব প্রকাশভঙ্গী খুঁজে বের করতে হবে। হয়তো সঙ্গীর জন্য নিজের হাতে তৈরি একটা কার্ড, একসাথে কিছুটা নিরিবিলি সময় কাটানো, মন খুলে কথা বলা, একে অপরের স্বপ্নগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া – এগুলো তথাকথিত ‘দামী’ অভিজ্ঞতার চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান হতে পারে। গ্যারি চ্যাপম্যানের (Gary Chapman) ‘ফাইভ লাভ ল্যাঙ্গুয়েজেস’ (The Five Love Languages) বইটির মূল ভাবনাটিও এখানে প্রাসঙ্গিক – প্রত্যেকে ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে ভালোবাসা অনুভব করে এবং প্রকাশ করে, এবং সেগুলো সবসময় বস্তুগত নাও হতে পারে। (Chapman, 1992)
-
‘উপস্থিতি’ বনাম ‘উপহার’ (Presence vs. Presents): ভালোবাসার সম্পর্কে বস্তুগত উপহারের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো মানসিক উপস্থিতি (emotional presence), সহানুভূতি (empathy), এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ (mutual respect)। এই বিষয়গুলোর উপর জোর দিতে হবে।
-
ভোগসর্বস্বতার ঊর্ধ্বে ওঠা (Rising Above Consumerism): শুধুমাত্র ভালোবাসার ক্ষেত্রেই নয়, জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও ভোগসর্বস্ব মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে। জীবনকে অর্থবহ করে তোলার জন্য যে সবসময় কিছু না কিছু ‘ভোগ’ (consume) করতে হবে, এই ধারণা থেকে মুক্তি প্রয়োজন।
-
ছোট ছোট প্রতিরোধ (Small Acts of Resistance): বাজারের চাপিয়ে দেওয়া দিবস বা প্রথাগুলো অন্ধভাবে অনুসরণ না করে, নিজেদের মতো করে ভালোবাসার মুহূর্ত তৈরি করা যেতে পারে। হয়তো ভ্যালেন্টাইন’স ডে-তে বিশাল আয়োজনের বদলে অন্য কোনো সাধারণ দিনে সঙ্গীকে সারপ্রাইজ দেওয়া, বা কোনো সামাজিক কাজে একসাথে অংশগ্রহণ করা – এগুলোও হতে পারে ভালোবাসার সুন্দর প্রকাশ।
ইভা ইলুজের কাজ আমাদের আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। সেই আয়নায় আমরা দেখতে পাই, আমাদের রোমান্টিক স্বপ্ন আর আকাঙ্ক্ষাগুলোর উপর কীভাবে লেগে আছে বাজারের অদৃশ্য আঙুলের ছাপ। তাঁর বিশ্লেষণ আমাদের চিরাচরিত ভাবনাগুলোকে নাড়া দেয়, আমাদের অস্বস্তিতে ফেলে, কিন্তু একইসাথে আমাদের আরও গভীরভাবে ভালোবাসার স্বরূপ উপলব্ধি করতে সাহায্য করে। তিনি দেখান যে, প্রেম নামক এই অতি ব্যক্তিগত অনুভূতিটিও বৃহত্তর সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক শক্তির (socio-economic and cultural forces) বাইরে নয়।
দিনশেষে, ভালোবাসা হয়তো সত্যিই এক জটিল, বহুমাত্রিক, এবং খানিকটা রহস্যময় অনুভূতি। এই অনুভূতিকে বুঝতে চাওয়া, তাকে বাজারের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে আরও মানবিক, আরও অকৃত্রিম করে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। কারণ, যত যাই হোক, দুটো মানুষের হৃদয়ের অকৃত্রিম টান, পারস্পরিক নির্ভরতা আর ভালোবাসার উষ্ণতাটুকুই হয়তো এই যান্ত্রিক পৃথিবীতে আমাদের বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় প্রেরণা। ভালোবাসার সেই নিজস্ব সুরটি খুঁজে পাওয়াই হোক আমাদের আসল লক্ষ্য, বাজারের তৈরি করা কোলাহলের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া নয়। কী বলেন, পারা যাবে না? চেষ্টা করতে তো দোষ নেই!
তথ্যসূত্র
- Bauman, Z. (2003). Liquid Love: On the Frailty of Human Bonds. Polity Press.
- Chapman, G. D. (1992). The Five Love Languages: How to Express Heartfelt Commitment to Your Mate. Northfield Publishing.
- Giddens, A. (1992). The Transformation of Intimacy: Sexuality, Love and Eroticism in Modern Societies. Polity Press.
- Hochschild, A. R. (1983). The Managed Heart: Commercialization of Human Feeling. University of California Press.
- Illouz, E. (1997). Consuming the Romantic Utopia: Love and the Cultural Contradictions of Capitalism. University of California Press.
- Illouz, E. (2007). Cold Intimacies: The Making of Emotional Capitalism. Polity Press.
- Illouz, E. (2012). Why Love Hurts: A Sociological Explanation. Polity Press.
Leave a Reply