চীনের ধনী হওয়ার স্বপ্ন: এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা?

ভূমিকা

২০২১ সালের এক সকাল। চীনের কুনমিং শহরে গোটা বারো সুউচ্চ দালান চোখের পলকে ধুলোয় মিশে গেল। প্রায় ১৫০ মিলিয়ন ডলারের সম্পত্তি! ভাবছেন, নিশ্চয়ই দালানগুলো নড়বড়ে ছিল, কিংবা অন্য কোনো গাঠনিক সমস্যা? নাহ্, তেমন কিছুই না। গুজব শোনা যায়, দেশের জিডিপি (GDP) বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৫%-এ পৌঁছানোর পথে নাকি এই বিল্ডিংগুলো একটা ‘ছোট্ট’ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই একটা ঘটনাই চীনের কয়েক দশক ধরে প্রবৃদ্ধির পেছনে ছোটার গল্পটা অনেকখানি বলে দেয়। দ্রুত বানাও, বড় করে বানাও, উদ্দেশ্য নিয়ে পরে ভাবা যাবে। কিন্তু এই মডেলটা এখন আর আগের মতো কাজ করছে না, তার দম ফুরিয়ে আসছে। বেইজিং এখন অন্য পথে হাঁটতে চায়।

বদলে যাওয়া অর্থনীতির চালচিত্র

চীন এখন বিনিয়োগ করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), রোবটবিজ্ঞান (robotics), আর স্মার্ট ডিভাইস (smart devices) এর মতো শিল্পে। উদ্দেশ্য? দেশের মানুষের জীবনযাত্রা আর কাজের পদ্ধতির উন্নয়ন। ২০২৫ থেকে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত, দেশটি বার্ষিক ৫% হারে প্রবৃদ্ধির আশা করছে। যদি এই ধারা বজায় থাকে, তাহলে ২০২০ সালের তুলনায় তাদের মাথাপিছু জিডিপি (GDP per capita) দ্বিগুণ হয়ে যাবে। সোজা কথায়, ২০৩৫ সালের মধ্যে বেইজিং ধনী দেশগুলোর ক্লাবে যোগ দেবে। এই স্বপ্ন চীন দেখছে এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে।

কিন্তু একটা ছোট্ট কিন্তু আছে। জিডিপি বৃদ্ধি মানেই সবসময় সত্যিকারের উৎপাদনশীল বৃদ্ধি (productive growth) নয়। ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলি। ধরুন, আপনি একটা হাইওয়ে বানালেন, তারপর সেটা ভেঙে ফেললেন, আবার ঠিক আগের মতোই বানালেন, আবার ভাঙলেন – এই ভাঙা-গড়ার খেলা চলতেই থাকল। জানেন কি, এই সব কিছুই জিডিপির খাতায় ‘অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি’ হিসেবে জমা হবে? নির্মাণ হোক বা ধ্বংস, জিডিপির তাতে কিছু যায় আসে না; সে শুধু টাকার অঙ্ক চেনে। এই ফাঁকফোকরটা শুধু চীনের জন্য নয়, সব দেশের অর্থনীতিতেই আছে। তবে চীনের স্থানীয় কর্মকর্তারা জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছেন বেশ। আর তাইতো মাঝে মাঝে দেখবেন, দিব্যি ভালো, শক্তপোক্ত দালান চোখের সামনে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। দিনের শেষে, এসবের কিছুই কিন্তু উৎপাদনশীল বৃদ্ধি নয়। এটা বাস্তব নয়। দীর্ঘমেয়াদে এতে জনগণের কোনো উপকার হয় না।

তাই এখন, চীনের অর্থনীতি যখন পরিপক্কতার দিকে এগোচ্ছে, তখন সময় এসেছে সিঁড়ির উপরের ধাপে ওঠার। এখন নির্ভর করতে হবে চীনের সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ওপর, অর্থাৎ চীনা ভোক্তার (Chinese consumer) ওপর। আগামী দশকে বেইজিং তার অর্থনীতির ইঞ্জিনটাকেই নতুন করে সাজাতে চাইছে। রাষ্ট্রচালিত বিনিয়োগ (state-driven investment) নয়, বরং পারিবারিক ভোগ (household consumption) হবে প্রবৃদ্ধির প্রধান চালিকাশক্তি। তবে, উৎপাদন-ভিত্তিক মডেল থেকে ভোগ-ভিত্তিক মডেলে উত্তরণ সম্ভবত একটি উচ্চ-আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার সবচেয়ে জটিল পর্যায়। একটা যন্ত্র তৈরি করা যত সহজ, মানুষকে সেটা ব্যবহার করতে রাজি করানো তার চেয়ে অনেক কঠিন।

লক্ষ্য যখন ধনী দেশের তালিকা

ফিরে আসি চীনের কথায়। ২০২৩ সালে চীনের মাথাপিছু জিডিপি ছিল ১২,৬০০ ডলার, যা বিশ্বব্যাংকের (World Bank) উচ্চ-আয়ের দেশের তালিকার প্রবেশদ্বার ১৩,৮০০ ডলারের চেয়ে সামান্য কম। তবে, এই প্রবেশমূল্যও কিন্তু স্থির থাকছে না। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৮ সাল নাগাদ এটা বেড়ে ১৫,৭০০ ডলার এবং ২০৩৫ সালের মধ্যে ১৮,২০০ ডলারে পৌঁছাবে। চীন যদি তার ৫% প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা থেকে পিছিয়ে পড়ে, তবে সে শুধু ধনী ক্লাবে ঢুকতেই ব্যর্থ হবে না, বরং মধ্যম আয়ের ফাঁদে (middle-income trap) আটকে পড়ার ঝুঁকিতে পড়বে, যেখান থেকে বেরিয়ে আসার সহজ কোনো পথ নেই।

তাছাড়া, শুধু জিডিপি দিয়ে সত্যিকারের সম্পদের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক উপেক্ষা করা হয় – সেটা হলো ভোগবাদ (consumerism)। একটা অর্থনীতির উন্নতি করতে হলে তাকে উৎপাদন করতে হবে, বিক্রি করতে হবে, নির্মাণ করতে হবে। টাকা বাজারে ঘুরতে হবে। চীনা কর্মকর্তারা অনেকদিন ধরেই অর্থনীতিকে বিনিয়োগ আর রপ্তানি (exports) থেকে সরিয়ে এনে জনগণের ব্যয়ের (consumer spending) দিকে চালিত করার কথা ভাবছেন। চীন তো আর ছোটখাটো বাজার নয়। এর জনসংখ্যা উত্তর আমেরিকা আর ইউরোপীয় ইউনিয়নকে মেলালেও তার চেয়ে বেশি। কিন্তু এখন মার্কিন শুল্কের (US tariffs) কারণে অভ্যন্তরীণ ভোগ বাড়ানোর তাগিদটা আরও বেড়েছে।

দেখুন, এতদিন পর্যন্ত চীন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য রপ্তানি আর নির্মাণের ওপর নির্ভর করে এসেছে। কিন্তু আপনি কতই বা বানাবেন আর কতই বা বিক্রি করবেন? জার্মানি, ভারত, জাপান এবং আরও অনেক দেশও তো জিনিসপত্র তৈরি করে বিক্রি করতে চায়। আর ভূ-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বাড়ার সাথে সাথে অনেক উন্নত অর্থনীতিই তাদের নিজ নিজ শিল্পকে রক্ষা করার জন্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে, একই সাথে চীন থেকে তাদের সরবরাহ শৃঙ্খলকে (supply chains) সরিয়ে এনে বৈচিত্র্য আনছে। সোজা কথায়, বিশ্বায়ন (globalization) যেন কিছুটা পিছিয়ে পড়ছে, আর এর সবটাই বেইজিংয়ের জন্য ক্ষতির কারণ হচ্ছে। এই প্রবণতা ৫% জিডিপির লক্ষ্য অর্জনকে আরও কঠিন করে তুলছে, আর এর দায় পড়ছে চীনা ভোক্তার কাঁধে।

চীনের ভোক্তার মনস্তত্ত্ব

কিন্তু সমস্যা হলো, বর্তমানে চীনের জিডিপির মাত্র ৩৯% আসে পারিবারিক ভোগ থেকে। এটা বেশ কম। সত্যি বলতে, যেকোনো বড় অর্থনীতির মধ্যে এটাই সর্বনিম্ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভোগ জিডিপির ৬৮% জুড়ে আছে। ব্রিটেনে ৬২%, ব্রাজিলে ৬৩%, দক্ষিণ আফ্রিকায় ৬৭% আর জাপানে ৫৩%। প্রসঙ্গত, পারিবারিক ভোগ নির্দেশ করে যে অর্থনীতির কতটা অংশ ভোক্তার ব্যয়ের দ্বারা চালিত হয়। বিশ্বব্যাপী গড় সাধারণত ৬০ থেকে ৭০ শতাংশের মধ্যে থাকে। চীন, সেখানে, বিশ্বব্যাপী নীচের ১৫টি দেশের মধ্যে রয়েছে। এর কারণ হলো, গড় চীনা পরিবার তাদের আয়ের ৩০% এরও বেশি সঞ্চয় করে, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই হার প্রায় ৯%।

চীনের এই উচ্চ সঞ্চয়ের হার তার সংস্কৃতি আর ইতিহাসের গভীরে প্রোথিত। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কষ্ট সহ্য করার ফলে, জাতীয় মানসিকতায় এক গভীর সতর্কতার বোধ মিশে গেছে। তাই সঞ্চয় শুধু একটা অভ্যাস নয়, এটা প্রায় সহজাত। আর হ্যাঁ, অতিরিক্ত ব্যয় (যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দেখা যায়) যেমন সমস্যা তৈরি করতে পারে, তেমনি খুব কম ব্যয়ও কিন্তু প্রকৃত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

ভয়াবহ কোভিড-১৯ লকডাউনের পর চীনে ভোগবাদ একেবারে মুখ থুবড়ে পড়েছিল। পরিবারগুলো সেই ধাক্কা পুরোপুরি সামলে উঠতে পারেনি, বরং আরও মিতব্যয়ী হয়ে উঠেছে। এমনকি ২০২২ সালের শেষের দিকে লকডাউনের বিধিনিষেধ পুরোপুরি তুলে নেওয়ার পরেও, ভোক্তার আস্থা (consumer confidence) তলানিতে ঠেকে এবং মানুষ মহামারীর আগের চেয়েও বেশি হারে সঞ্চয় করতে শুরু করে। আরও যা দুশ্চিন্তার, চীনের রিয়েল এস্টেট খাতের অস্থিরতার কারণে, এই সঞ্চয়ের বেশিরভাগটাই নতুন বাড়ি না কিনে বরং ব্যাংকের আমানত এবং অন্যান্য আর্থিক সম্পদে (financial assets) জমা হয়েছে এবং হচ্ছে। সুতরাং, সারমর্ম হলো, চীনা পরিবারগুলোর সঞ্চয় আছে, ভালো চাকরিও আছে, কিন্তু লকডাউনের পর তারা খরচ করা বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ তারা পারে না তা নয়, বরং তারা ভয় পাচ্ছে সামনে কী আছে তা ভেবে।

এর ফলে, চীন পশ্চিমা দেশগুলোর চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক আর্থিক সংকটের (financial crisis) সম্মুখীন হচ্ছে। যখন আমেরিকা কোভিড-পরবর্তী মুদ্রাস্ফীতি (inflation) নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে, তখন চীন ভুগছে মুদ্রা সংকোচন বা ডিফ্লেশনে (deflation)। এর মানে হলো, মুদ্রাস্ফীতির হার শূন্যের নিচে নেমে যায় এবং জিনিসপত্রের দাম কমতে থাকে। গত দুই বছরে, টানা ১৮ মাস ধরে দাম কমেছে। প্রথম দৃষ্টিতে এটা ভালো মনে হলেও, দীর্ঘস্থায়ী ডিফ্লেশন মুদ্রাস্ফীতির চেয়েও বেশি ক্ষতিকর হতে পারে। যখন মানুষ আশা করে যে দাম আরও কমবে, তখন তারা প্রায়শই কেনাকাটা পিছিয়ে দেয়, পরে আরও ভালো দামে পাওয়ার আশায়। ব্যবসায়ীরা তখন ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে দাম কমায়। কিন্তু যত বেশি এটা ঘটে, তাদের লাভ তত কমতে থাকে। অবশেষে, অর্থনৈতিক গতি থেমে যায়, যা কর্মী ছাঁটাই বা ব্যবসা বন্ধের দিকে নিয়ে যেতে পারে। একই সময়ে, ঋণ পরিশোধ করা আরও কঠিন হয়ে পড়ে কারণ টাকার মূল্য বাড়ে, কিন্তু ঋণের পরিমাণ একই থাকে। খরচ কমার সাথে সাথে ব্যবসা সংকটে পড়ে, মানুষ চাকরি হারায়, এবং অর্থনীতি সংকুচিত হয়, যা এক দুষ্টচক্র তৈরি করে। এই চক্র থেকে বের হওয়া মাঝারি মুদ্রাস্ফীতি সামলানোর চেয়ে অনেক বেশি কঠিন। চীন মরিয়া হয়ে এই পরিস্থিতি এড়াতে চাইছে।

সরকারি পদক্ষেপ ও একটি জনসংখ্যাতাত্ত্বিক চ্যালেঞ্জ

চীনের বিশাল ভোক্তা ব্যয়ের সম্ভাবনাকে উন্মোচন করতে, বেইজিং একটি কার্যকরী পরিকল্পনা (action plan) তৈরি করেছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী তার বার্ষিক সংসদীয় ভাষণে মানুষকে বেশি খরচ করাতে তিনটি উপায়ের কথা উল্লেখ করেছেন: তাদের হাতে আরও বেশি টাকা দেওয়া, তাদের কম সঞ্চয় করতে উৎসাহিত করা, এবং যারা সঞ্চয় করে তাদের থেকে টাকা সরিয়ে যারা খরচ করে তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। এই তিনটি নীতির সাথে সঙ্গতি রেখে, একই পরিকল্পনায় স্থানীয় ন্যূনতম মজুরি (minimum wages) বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসেবা ভর্তুকি (healthcare subsidies) ও পেনশন (pensions) বৃদ্ধি, সবেতন ছুটি (paid leave) উন্নত করা, শিশু যত্ন সুবিধা (child care relief) সম্প্রসারণ, সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন (housing affordability) উন্নয়ন, এবং কর্মীদের কেনাকাটা ও টাকা খরচ করার জন্য আরও বেশি ছুটি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে, এই অতিরিক্ত আর্থিক প্রণোদনা (fiscal stimuli) জিডিপির ২% এর সমতুল্য। চীন যে পারিবারিক ব্যয়কে একটি উচ্চ-আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার চাবিকাঠি হিসেবে দেখছে, তা স্পষ্ট।

কিন্তু একটা বড় সমস্যা আছে। ধনী হওয়ার জন্য চীন হয়তো বড্ড বেশি বুড়ো হয়ে গেছে। দেশটির জনসংখ্যা কমছে, জন্মহার (birth rates) টানা তিন বছর ধরে পড়ছে। যদি জন্মহার ১.০-এ স্থির থাকে, তাহলে ২১০০ সালের মধ্যে চীনের জনসংখ্যা কমে প্রায় ৭৬০ মিলিয়নে দাঁড়াতে পারে। জাতিসংঘের মতে, সর্বোচ্চ অনুমান ১.১ বিলিয়ন। সর্বনিম্ন ৪৮০ মিলিয়ন, তবে ৭৬০ মিলিয়নই সবচেয়ে সম্ভাবনাময়। যেটাই হোক না কেন, এই জনসংখ্যাতাত্ত্বিক রূপান্তর (demographic transformation) আগামী বছরগুলোতে চীনের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে। এটা আমরা যে চীনকে চিনি, তাকে আমূল পরিবর্তন করে দেবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (World Health Organization) মতে, কোনো দেশের জনসংখ্যার ৭% এর বেশি মানুষের বয়স ৬৫ বছর বা তার বেশি হলে সেই জনসংখ্যাকে বার্ধক্যপীড়িত (aging) বলে ধরা হয়। চীন ১৯৯৮ সালেই এই মাইলফলক ছুঁয়েছিল, আর এখন তার প্রবীণ অংশ জনসংখ্যার অন্তত ১৪%। আগামী বছরগুলোতে, চীনের প্রবীণদের অংশ অপ্রতিরোধ্যভাবে বাড়তে থাকবে, যা উৎপাদন, ভোগ, উদ্যোক্তা এবং উদ্ভাবন – সবকিছুর ওপর প্রভাব ফেলবে। আর এসবই চীনের অর্থনৈতিক গতি এবং চালিকাশক্তিকে একটু একটু করে ক্ষয় করে দেবে।

তরুণ জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশগুলো, যেমন ১৯৫০-এর দশকে জাপান এবং ১৯৬০-এর দশকে দক্ষিণ কোরিয়া, তাদের বিশাল কর্মক্ষম জনসংখ্যার (working age populations) কল্যাণে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল। কিন্তু যখন তাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধ হতে শুরু করে এবং শ্রমশক্তি (labor pool) হ্রাস পায়, তখন প্রবৃদ্ধির গতি তীব্রভাবে কমে যায়। উভয় অর্থনীতিতেই, তাদের তরুণ জনসংখ্যার কারণে মাথাপিছু জিডিপি শীর্ষে পৌঁছেছিল। আর এই একই জনসংখ্যাতাত্ত্বিক নীতি সব উন্নত অর্থনীতির ক্ষেত্রেই সত্য। চীন বিশ্বের কারখানায় (world’s factory) পরিণত হয়েছিল ঠিক এই কারণেই যে, ১৯৬২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সেখানে বছরে গড়ে ২৩.৪ মিলিয়ন শিশুর জন্ম হতো। ২০২০ সালে সেই জন্মের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১১.৮ মিলিয়নে, আর আজ সম্ভবত আরও কম।

চীনের জনসংখ্যাতাত্ত্বিক সংকট (demographic crisis) অন্যান্য বার্ধক্যপীড়িত সমাজে যা ঘটেছিল, তারই প্রতিধ্বনি। ২০২৩ সালে, চীনের মধ্যক বয়স (median age) ছিল ১৯৯৫ সালের জাপানের এবং ২০০০ সালের জার্মানির সমান, যখন তার প্রবীণ জনসংখ্যা ১৯৯৬ সালের জাপান এবং ১৯৯৫ সালের জার্মানির সাথে মিলে যায়। এর পরের দশকগুলোতে যা ঘটেছিল তা হলো, জাপানের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছিল, আর জার্মানির অর্থনীতি অভিবাসীদের (immigrants) আগমনের কল্যাণে সামান্য বৃদ্ধি পেয়েছিল। মূল কথা হলো, কর্মশক্তি যত কম এবং প্রবীণ জনসংখ্যা যত বেশি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করা তত কঠিন হয়ে পড়ে। বস্তুত, ১৫% প্রবীণ জনসংখ্যার মাইলফলক পার হওয়ার পর, প্রধান অর্থনীতিগুলো এক দশকের বেশি সময় ধরে ৪% এর বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে ধারাবাহিকভাবে হিমশিম খেয়েছে। তাই সামনে চীনের জন্য একটা বড় রকমের চ্যালেঞ্জ দেখা যাচ্ছে।

উদ্ভাবনের বাজি ও শেষ কথা

বার্ধক্যপীড়িত জনসংখ্যার সমস্যার সমাধানে বেইজিংয়ের বাজি হলো উদ্ভাবন (innovation)। তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং রোবটবিজ্ঞানে প্রচুর বিনিয়োগ করছে তাদের প্রবীণ জনসংখ্যার অর্থনৈতিক চাপকে কিছুটা হলেও প্রশমিত করার জন্য। তবে, এটা একটা অজানা ময়দান। এমনটা আগে কখনো করা হয়নি। হ্যাঁ, উদ্ভাবন হয়তো কিছুটা সময় পাইয়ে দেবে, কিন্তু এটা চাহিদার (demand) জায়গা পূরণ যে করতে পারবেই তা বলা যায়না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর রোবট তো মানুষের মতো ভোগ করে না। তারা বিদ্যুৎ খরচ করে, কিন্তু সেটা অর্থনীতিতে মানুষের ব্যয়ের মতো চাহিদা তৈরি করে না।

সবকিছু বিবেচনা করে, চীন এখন এক ক্রসরোডে (crossroads) দাঁড়িয়ে। কয়েক দশক ধরে সে বিশ্বের জন্য নির্মাণ করে বড় হয়েছে। এখন তাকে শুধু দেশের বাইরের লোকেদের জন্যই নয়, নিজেদের লোকেদের জন্যেও নির্মাণ করতে শিখতে হবে। উৎপাদক থেকে ভোক্তায় এই রূপান্তর, পরিমাণ থেকে গুণে উত্তরণ – এর জন্য শুধু অর্থনৈতিক নীতিই যথেষ্ট নয়। এর জন্য প্রয়োজন চীনের মানুষ কীভাবে কাজ করে, খরচ করে এবং জীবনযাপন করে, তার সম্পূর্ণ নতুন এক চিন্তাভাবনা। এটা এমন এক পরিবর্তন যা রাতারাতি ঘটবে না। কিন্তু বেইজিং যদি পরিবারগুলোর ওপর থেকে বোঝা কমাতে পারে এবং তার বার্ধক্যপীড়িত সমাজের সাথে মানিয়ে নিতে পারে, তাহলে ধীর, স্থির এবং ভোক্তা-চালিত প্রবৃদ্ধি হয়তো অতীতের সেই রমরমা বছরগুলোর চেয়েও বেশি শক্তিশালী প্রমাণিত হবে।

চীন যদি এই কঠিন কাজটি করে দেখাতে পারে, তবে সে শুধু ধনী দেশগুলোর সারিতেই যোগ দেবে না, বরং কীভাবে সেখানে পৌঁছাতে হয়, সেই নিয়মকানুনই নতুন করে লিখবে।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.