মেয়ার্স্কের (Maersk) বিরুদ্ধে গাজায় অস্ত্র পাঠানোর অভিযোগ: যুদ্ধ অর্থনীতি এবং মানবাধিকারের প্রশ্ন

ভূমিকা

একটা খবর বেশ কিছুদিন ধরেই হাওয়ায় ভাসছে, ফিসফিস করে ছড়াচ্ছে এদিক-সেদিক। ডেনমার্কের সেই যে বিশাল জাহাজ কোম্পানি, মেয়ার্স্ক (Maersk), তাদের নামে নাকি এক গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। বলা হচ্ছে, গাজার যুদ্ধে অস্ত্রশস্ত্র আর সামরিক সরঞ্জাম পাঠাবার ব্যাপারে তারা নাকি বেশ ভালোভাবেই জড়িত। অভিযোগকারীরা বলছেন, মেয়ার্স্কের মালবাহী জাহাজে করে মার্কিন মুলুকে তৈরি মারণাস্ত্র আর অন্যান্য সামরিক জিনিসপত্র নাকি সটান চলে গেছে ইসরায়েলে। আর ইসরায়েল সেগুলো ব্যবহার করেছে গাজায় তাদের সামরিক অভিযানে (Lennard, 2024)। ভাবুন একবার, কথাটা যদি সত্যি হয়! তাহলে তো বলতে হবে, কোম্পানিটা সোজাসাপ্টা গাজা যুদ্ধের সেই ভয়ানক “যুদ্ধ অর্থনীতি” (war economy) – মানে, যে অর্থনীতি কেবল যুদ্ধ থেকে মুনাফা লোটে আর যুদ্ধকে আরও উস্কে দেয় – তার সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েছে। আর এর ফলে, মেয়ার্স্ক হয়তো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়েও অভিযুক্ত হতে পারে। এই অবস্থায় কিছু জরুরি প্রশ্ন যেন কিলবিল করে উঠছে মাথার ভেতর, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক আইন আর এই বড় বড় কোম্পানিগুলোর দায়বদ্ধতার দিক থেকে: একটা জলজ্যান্ত যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্র পাঠাতে সাহায্য করলে, কোনো কোম্পানি কি যুদ্ধাপরাধ বা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য দায়ী হতে পারে?

এই লেখায় আমরা মেয়ার্স্কের এই কথিত ভূমিকা নিয়েই একটু কাটাছেঁড়া করব, একটু তলিয়ে দেখব। বিষয়টা খতিয়ে দেখা হবে আন্তর্জাতিক মানবিক আইন (International Humanitarian Law – IHL) এর আয়নায়। মানে, যুদ্ধের সেইসব আইনকানুন, যা সাধারণ মানুষকে বাঁচানোর জন্য, তাদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য তৈরি হয়েছে তার আয়নায়। আরও উঁকি দেব যুদ্ধ অর্থনীতি তত্ত্বের (War Economy theory) জানালায় – যে তত্ত্ব আমাদের বলে, যুদ্ধ নিজেই কেমন করে একটা আস্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করে ফেলে, যা কিছু বিশেষ দলের পকেট ভারী করে। সবশেষে, কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (Corporate Social Responsibility – CSR) আর যাকে বলে জবাবদিহিতা – সেইসব ভারী ভারী কথার মারপ্যাঁচ, যা বড় বড় কোম্পানিগুলোকে মানুষের অধিকার নষ্ট না করার জন্য চাপ দেয় – সেটাও আমরা হিসেবের মধ্যে রাখব। আমাদের লক্ষ্য একটাই: গাজার মতো একটা দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা যুদ্ধক্ষেত্রে, একটা বিশ্বজোড়া নামীদামী কোম্পানির জাহাজ চলাচল কীভাবে তাকে সেই যুদ্ধের অর্থনীতির একটা ঘুঁটি বানিয়ে ফেলতে পারে, কেমন করে তাকে আন্তর্জাতিক আইন ভাঙার দায়ে ফেলতে পারে, এমনকি যুদ্ধাপরাধ বা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে জড়িত থাকার মতো সাংঘাতিক অভিযোগে অভিযুক্ত করতে পারে – সেই জটিল বিষয়টার ওপর একটুখানি আলো ফেলা।

গাজার যুদ্ধ অর্থনীতি: সংঘাত যখন ব্যবসা

গাজার যুদ্ধ, বুঝলেন কিনা, শুধু একটা রাজনৈতিক গোলমাল বা মানবিক বিপর্যয় নয়। এটা আসলে একটা পুরোদস্তুর অর্থনৈতিক কারবারও বটে – যাকে কেতাবি ভাষায় প্রায়শই বলা হয় যুদ্ধ অর্থনীতি (war economy)। এই অর্থনীতিটাই কিন্তু আর্থিকভাবে এই রক্তাক্ত সংঘাতকে সযত্নে লালনপালন করে, তাকে আরও ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তোলে। সহজ বাংলায় বলতে গেলে, যুদ্ধ অর্থনীতি হলো টাকা-পয়সা, সহায়-সম্পদ আর বাণিজ্যিক ধান্দার সেই জটিল জাল, যা একটা জলজ্যান্ত সংঘাতকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে, ডালপালা ছড়ায়। যে কোম্পানিগুলো অস্ত্রশস্ত্র, যুদ্ধের সরঞ্জাম কিংবা ধরুন পরিবহনের মতো লজিস্টিক মালমশলা জোগায়, তারা সবাই এই ব্যবস্থার এক-একটা অংশ হয়ে যায়, যুদ্ধ থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি মুনাফা কামায় (Ackerman, 2024)। সত্যিই, বিশ্লেষকরা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন যে নানান ধরনের কর্পোরেশন – একদম অস্ত্র নির্মাতা থেকে শুরু করে মালপত্র আনা-নেওয়া করা লজিস্টিক সংস্থা পর্যন্ত – সবাই গাজার এই ধ্বংসলীলা থেকে “বেজায় মোটা অঙ্কের মুনাফা” লুটছে। যুদ্ধের যাবতীয় ভয়াবহতাকে তারা এমনভাবে নিজেদের “বোর্ডরুমের বিরাট বিজয়ে” বদলে ফেলেছে, দেখলে অবাক হতে হয় (Ackerman, 2024)। অন্যভাবে যদি বলি, যুদ্ধ হয়তো শুরু হয় রাজনীতির প্যাঁচে, কিন্তু এর ভেতরের ব্যাপারটা আসলে ভয়ানক রকমের অর্থনৈতিক (Taylor & Hammouri, 2024)।

মেয়ার্স্ক, পৃথিবীর অন্যতম নামকরা আর বিশাল জাহাজ ও লজিস্টিক কোম্পানি। অভিযোগ উঠেছে, এই কোম্পানিটিই নাকি ইসরায়েলের যুদ্ধ প্রচেষ্টায় দরকারি সামরিক সরঞ্জাম পরিবহন করে গাজার এই যুদ্ধ অর্থনীতিতে একটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ের ভূমিকা নিয়েছে। প্যালেস্টাইনিয়ান ইয়ুথ মুভমেন্ট আর প্রগ্রেসিভ ইন্টারন্যাশনাল নামের দুটো সংস্থার করা একটা অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অক্টোবর ২০২৩-এ গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে পরের একটা বছর ধরে, মেয়ার্স্ক নাকি প্রায় দু’হাজার বারেরও বেশি “যুদ্ধ উপকরণ” (war materiel) – যেমন ধরুন ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া গাড়ির কলকব্জা, উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ আর অন্যান্য নানাবিধ সামরিক সরঞ্জাম – সোজা ইসরায়েলের ঠিকানায় পাঠিয়েছে (Lennard, 2024)। গবেষকরা জাহাজের মালপত্রের তালিকা, মানে সেই যে বিল অফ লেডিং (bill of lading) থাকে, সেগুলো তন্নতন্ন করে ঘেঁটে এই সব তথ্য বের করেছেন। আর তাতেই মার্কিন মুলুকে তৈরি সামরিক সরঞ্জাম কেমন করে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর হাতে গিয়ে পৌঁছাচ্ছে, সেই সরবরাহ ব্যবস্থার একটা পরিষ্কার ছবি ফুটে উঠেছে (Lennard, 2024)। একটা উদাহরণ দিই, শুনুন। ডিসেম্বর ২০২৩-এর ঘটনা। মেয়ার্স্কের একটা জাহাজ নাকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেশ কিছু ভারী সাঁজোয়া ট্রাক (Oshkosh HEMTT military trucks) নিয়ে সোজা ইসরায়েলের হাইফা বন্দরে নোঙর করে। আর তার ঠিক দিন কয়েকের মধ্যেই, সেই একই যানগুলোকে দেখা যায় গাজা উপত্যকায়! সেখানে ইসরায়েলি বাহিনী যুদ্ধের সময় দিব্যি সেগুলো ব্যবহার করছিল (Kjær, 2025)। গাজা থেকে পাওয়া কিছু ছবিতে তো এমনও দেখা গেছে যে, ইসরায়েলি সৈন্যরা মেয়ার্স্কের জাহাজে করে আসা একটা ওশকোশ ট্যাকটিক্যাল ট্রাক ব্যবহার করে কাতারে কাতারে ফিলিস্তিনি বন্দিকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে। এই দৃশ্যটা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, কেমন করে একটা বাণিজ্যিক পরিবহনের কাজ সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রের ভয়ংকর কার্যকলাপের সাথে জড়িয়ে পড়তে পারে (Kjær, 2025)।

যুদ্ধের এই যে মারণাস্ত্রের জোগান, সেটা বন্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক স্তরে কম চেষ্টা-চরিত্র হয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও, এই ধরনের অস্ত্র পরিবহন কিন্তু দিব্যি চলেছে। এমনকি, মজার ব্যাপার দেখুন, স্পেন সরকার ২০২৪ সালের মে মাসে ঘটা করে ঘোষণা করল যে, গাজা যুদ্ধের জন্য অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যাওয়া কোনো মালবাহী জাহাজকে তারা তাদের দেশের কোনো বন্দরে ভিড়তে দেবে না (Lennard, 2024)। কিন্তু তদন্তকারীরা বলছেন, এই নিয়ম চালু হওয়ার পরেও নাকি মেয়ার্স্কের জাহাজ, যেগুলো ইসরায়েলের জন্য সামরিক সরঞ্জাম বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, সেগুলো দিব্যি নিয়মিতভাবে স্পেনের আলজেসিরাস বন্দরে থেমেছে। মনে হচ্ছে, তারা বেশ কায়দা করেই এই নিষেধাজ্ঞাটা এড়িয়ে গেছে (Lennard, 2024)। কাতালুনিয়ার একটা অ্যাক্টিভিস্ট দল আবার এই নিয়ে রীতিমতো আইনি অভিযোগ ঠুকে দিয়েছে। তার ফলে, বার্সেলোনার একটা আদালত স্পেনের বন্দর ব্যবহার করে মার্কিন অস্ত্র ইসরায়েলে পাঠানোর ব্যাপারে মেয়ার্স্কের ভূমিকা নিয়ে তদন্তও শুরু করে দিয়েছে (The New Arab, 2025)। আদালত তো আবার মেয়ার্স্কের দুটো জাহাজের ক্যাপ্টেন আর কোম্পানির স্প্যানিশ প্রতিনিধিকে ডেকে পাঠিয়ে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য তলবও করেছে। বুঝতেই পারছেন, অভিযোগটা বেশ গুরুতর (The New Arab, 2025)। শুধু স্পেনেই নয়, অন্যান্য দেশের বন্দরেও এই নিয়ে বেশ ভালোই হইচই, বিক্ষোভ হয়েছে। যেমন ধরুন, মরক্কোর ডককর্মীরা একবার মেয়ার্স্কের একটা জাহাজ থেকে মাল নামাতে বেঁকে বসেছিল। কারণ, তাদের সন্দেহ হয়েছিল, ওই জাহাজে করে নাকি ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর জন্য এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানের যন্ত্রাংশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে (Kjær, 2025)। এই সমস্ত ঘটনাই কিন্তু দিনের আলোর মতো স্পষ্ট করে দেয় যে, গাজার এই যুদ্ধের পেছনে বিশ্ব বাণিজ্যের এক বিশাল, জটিল জাল সক্রিয় রয়েছে। আর মেয়ার্স্কের এই যে কথিত সম্পৃক্ততা, সেটা এটাই ইঙ্গিত দেয় যে, কোম্পানিটা এই যুদ্ধ অর্থনীতির একটা অবিচ্ছেদ্য কলকব্জা হয়ে উঠেছে। অস্ত্রের জোগান চালু রেখে সে একদিকে যেমন সংঘাতকে আরও দীর্ঘায়িত করতে সাহায্য করছে, তেমনই অন্যদিকে এই পরিবহনের মাধ্যমে নিজের ব্যবসার অংশ হিসেবে মুনাফাও কামিয়ে নিচ্ছে।

মেয়ার্স্কের অস্ত্র পরিবহনের অভিযোগ ও প্রমাণ

নানান দিক থেকে আসা অনুসন্ধানী রিপোর্ট আর তথ্যপ্রমাণ ঘাঁটলে মেয়ার্স্কের মালপত্র যে গাজার সংঘাতে একটা বেশ উদ্বেগজনক ভূমিকা রাখছে, তার একটা ছবি ক্রমশ পরিষ্কার হয়ে ওঠে। ড্যানওয়াচ (Danwatch) (এটা হলো ডেনমার্কের একটা অনুসন্ধানী গবেষণা সংস্থা) তাদের নভেম্বর ২০২৪ সালের একটা বিশ্লেষণে দেখাচ্ছে যে, যুদ্ধটা শুরু হওয়ার পর থেকে মেয়ার্স্ক নাকি “হাজার হাজার টন অস্ত্রের যন্ত্রাংশ ইসরায়েলে” চালান করেছে। আর খুব সম্ভবত, সেইসব যন্ত্রাংশ শেষমেশ গাজাতেই ব্যবহার করা হয়েছে (Kjær, 2025)। মার্কিন মুলুকের রপ্তানি সংক্রান্ত তথ্য ঘেঁটে ড্যানওয়াচ সেপ্টেম্বর ২০২৩ থেকে সেপ্টেম্বর ২০২৪ – এই এক বছরের মধ্যে মেয়ার্স্কের জাহাজে করে ভারী সামরিক গাড়ির যন্ত্রাংশ (যেমন ধরুন, ওশকোশ ডিফেন্স কোম্পানির ট্রাকের পার্টস) নিয়ে যাওয়ার অন্তত ৪৫৩টা চালান খুঁজে পেয়েছে (Kjær, 2025)। অনেক চালানের বিবরণে আবার তেমন কিছুই লেখা ছিল না, খুব সাদামাটা একটা লেবেল সাঁটা ছিল, কিংবা ধরুন, বিবরণটা একদম ফাঁকা। প্রায় ৩৫% রেকর্ডে তো কোনো বিস্তারিত তথ্য ছাড়াই কেবল দায়সারাভাবে “সামরিক সরঞ্জাম” (military equipment) বলে উল্লেখ করা হয়েছে (Lennard, 2024)। এই সময়টার মধ্যে মেয়ার্স্ক ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর কাছে মোট ষাট লক্ষ পাউন্ডেরও বেশি ওজনের এমন সব মালপত্র পাঠিয়েছে, যার ভেতরের জিনিসপত্র সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি (Lennard, 2024)। যারা এই বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন, সেইসব সমালোচকদের ভয় হচ্ছে, এই যে এত রাখঢাক, এত অস্পষ্ট বিবরণ, এর আড়ালে আসলে আরও অনেক অস্ত্রশস্ত্র বা গোলাবারুদ পরিবহনের ঘটনা লুকিয়ে রাখা হয়েছে।

এইসব তথ্যপ্রমাণ যদি সত্যি হয়, তাহলে মেয়ার্স্ক শুধু যে নৈতিক দিক থেকেই প্রশ্নের মুখে পড়ছে তাই নয়, তারা হয়তো নির্দিষ্ট কিছু নিয়মকানুনও ভেঙেছে। কোম্পানির জাহাজগুলো স্পেনের মাটি ব্যবহার করে অস্ত্র পরিবহন করে সম্ভবত স্পেনের সেই অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞাটা লঙ্ঘন করেছে, যেখানে বলা হয়েছিল ইসরায়েলের জন্য কোনো অস্ত্র তাদের দেশ দিয়ে যেতে পারবে না (Lennard, 2024)। স্পেনের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে তারা নাকি “ব্যাপারটা খতিয়ে দেখছে” এবং অভিযোগ সত্যি প্রমাণিত হলে তারা ঠিকঠাক ব্যবস্থাও নেবে। কারণ, স্পেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নাকি বন্দরগুলোকে পরিষ্কার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধের জন্য পাঠানো কোনো সামরিক চালান তারা যেন কিছুতেই গ্রহণ না করে (Lennard, 2024)। ইউরোপের একটা আদালত যে মেয়ার্স্কের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য বেআইনি অস্ত্র পরিবহনের দায়ে তদন্ত করছে, এই ঘটনাটাই কিন্তু অভিযোগগুলোর সিরিয়াসনেস চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। আর এর ফলে, কোম্পানিটার আইনি প্যাঁচে পড়ার একটা সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে।

এখানে একটা কথা কিন্তু পরিষ্কার করে নেওয়া দরকার। এই যে এত অভিযোগ, এগুলোর মূল লক্ষ্য কিন্তু মেয়ার্স্ককে অস্ত্র বিক্রেতা হিসেবে দেখানো নয়। বরং, তাদের ভূমিকাটা হলো সামরিক সরঞ্জাম বহনকারী বা পরিবহনকারী হিসেবে। মেয়ার্স্ক নিজেরা কোনো অস্ত্র তৈরি করে না; তারা হলো বিশাল বিশাল কন্টেইনার জাহাজ চালায় এমন একটা কোম্পানি। কিন্তু, সেই যে যুদ্ধ অর্থনীতি তত্ত্বের (war economy theory) কথা বললাম, সেই তত্ত্ব অনুযায়ী, একটা সংঘাতপূর্ণ এলাকায় যদি কেউ মালপত্র আনা-নেওয়ার মতো লজিস্টিক পরিষেবাও দেয়, তাহলেও কিন্তু সেই কোম্পানিটা ওই সংঘাতের সরবরাহ ব্যবস্থার সাথে আর তার থেকে হওয়া মুনাফার সাথে জড়িয়ে পড়ে। প্যালেস্টাইনি ইয়ুথ মুভমেন্টের একটি জোরালো প্রচারাভিযান রয়েছে, যার নাম “মাস্ক অফ মেয়ার্স্ক” (Mask Off Maersk)। তাদের বক্তব্য হলো, মেয়ার্স্ক ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর অস্ত্রের জোগান চালু রেখে ফিলিস্তিনিদের ওপর গণহত্যায়ু একরকমের অংশীদার (complicit) হয়ে পড়েছে (Kjær, 2025)। যুদ্ধ অর্থনীতির চশমা দিয়ে দেখলে, মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর আর ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে মেয়ার্স্কের এই যে সামরিক মালপত্র পরিবহনের চুক্তি, এগুলোকে আসলে গাজা যুদ্ধের সেই বৃহত্তর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক খেলারই একটা অংশ হিসেবে দেখা হয়। এই খেলায় বেসরকারি কোম্পানিগুলো যুদ্ধের সরঞ্জাম সরবরাহ করে কাঁচা টাকা কামায় (Taylor & Hammouri, 2024)। খুব সহজ করে বললে, গবেষক আর সমাজকর্মীরা যে সমস্ত তথ্যপ্রমাণ জড়ো করেছেন, সেগুলো মেয়ার্স্ককে এমন একটা কোম্পানি হিসেবে তুলে ধরছে, যা কিনা বেশ সজ্ঞানেই যুদ্ধের এই ব্যবসায় নেমেছে। আর গাজার ওপর সেই ভয়াবহ আক্রমণ সম্ভব করে তোলার জন্য যে অস্ত্রশস্ত্র দরকার, সেগুলো এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পৌঁছে দিতে সাহায্য করছে।

তবে হ্যাঁ, এখানে একটা ছোট্ট ফুটনোট দিয়ে রাখা ভালো। মেয়ার্স্ক কিন্তু সবার সামনে বুক ফুলিয়ে অস্বীকার করেছে যে তারা গাজা সংঘাতের এলাকায় সরাসরি কোনো অস্ত্র বা গোলাবারুদ পাঠিয়েছে। তাদের সাফাই হলো, তারা নাকি সব আইনকানুন মেনেই শুধু “সামরিক-সম্পর্কিত কার্গো” পরিবহন করে (Reuters, 2025)।

আন্তর্জাতিক মানবিক আইন: যুদ্ধাপরাধ এবং সংশ্লিষ্টতা

এই যে আন্তর্জাতিক মানবিক আইন (International Humanitarian Law – IHL) (যাকে আবার অনেক সময় যুদ্ধের আইনও বলা হয়) হলো গিয়ে সশস্ত্র সংঘাতের সময় মারামারি করা দলগুলোর আচার-আচরণ কেমন হবে, তার একটা নিয়মকানুন। এর একেবারে কলিজার মধ্যে রয়েছে সেই বিখ্যাত জেনেভা কনভেনশন। এই IHL কিন্তু সাফ সাফ বলে দেয়, সাধারণ নিরীহ মানুষজনের ওপর ইচ্ছে করে হামলা করা যাবে না। আর যারা যুদ্ধ করছে, তাদেরও খুব ভালো করে চিনে নিতে হবে কোনটা সাধারণ মানুষ আর কোনটা সামরিক লক্ষ্যবস্তু। এই আইনের ব্যত্যয় ঘটলে, যেমন ধরুন, সাধারণ মানুষের এলাকায় বোমা ফেলা হলো, কিংবা বন্দিদের সাথে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করা হলো – এমনটা হলে তখন সেগুলোকে যুদ্ধাপরাধ (war crimes) হিসেবে ধরা হয়। গাজার কথাই ধরুন না! সেখানে এত এত প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, জাতিসংঘের তদন্তকারী দল এই সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছে যে, ইসরায়েলি বাহিনী তাদের অভিযানের সময় যুদ্ধাপরাধ তো করেছেই, সম্ভবত মানবতার বিরুদ্ধেও অপরাধ (মানে, সাধারণ মানুষের ওপর একেবারে পরিকল্পনা করে, দলবদ্ধভাবে আক্রমণ) করেছে (Kjær, 2025)। জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর তো খোলাখুলিই জানিয়েছে যে, ইসরায়েলি বাহিনী বারবার গাজায় সাধারণ মানুষ আর যোদ্ধাদের মধ্যে তফাত করতে পারেনি। আর জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের একটা দল তো এই সামরিক অভিযানকে ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য গণহত্যা বলেও দাগিয়ে দিয়েছে (Tétrault-Farber, 2024)। ভাবুন একবার, ২০২৪ সালের শুরুর দিকে, আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (International Court of Justice) – যেটা কিনা এই দুনিয়ার সবচেয়ে বড় আদালত – একটা জরুরি ফরমান জারি করে ইসরায়েলকে হুকুম দিয়েছিল যে, তারা যেন গাজার রাফাহ এলাকায় তাদের অভিযানটা থামায়। কারণ, সেখানে নাকি গণহত্যার একটা “সম্ভাব্য ঝুঁকি” (plausible risk) তৈরি হয়েছিল (Tétrault-Farber, 2024)। খুব সহজ করে বললে, সারা দুনিয়ার তাবড় তাবড় লোকজন কিন্তু গাজার ওপর এই হামলাটাকে বেজায় বেআইনি আর সাধারণ মানুষের ওপর হওয়া এক ভয়াবহ নৃশংসতা হিসেবেই দেখছে।

এখন প্রশ্ন হলো, এই সবের মধ্যে মেয়ার্স্কের মতো একটা জাহাজ কোম্পানি আবার কেমন করে জড়িয়ে পড়ল? দেখুন, আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আইনের ধারা অনুযায়ী, ব্যক্তিমানুষ (এমনকি কোম্পানির বড় বড় সাহেবরাও এর মধ্যে পড়েন) যদি যুদ্ধাপরাধে সাহায্য বা সহযোগিতা (aiding and abetting) করেন, তাহলে তারাও কিন্তু ফেঁসে যেতে পারেন। এই সাহায্য বা সহযোগিতা মানে হলো, এমন কোনো বাস্তব সাহায্য করা, কাউকে উস্কানি দেওয়া বা ধরুন নৈতিক সমর্থন জোগানো, যা কোনো একটা অপরাধ ঘটাতে বেশ ভালো রকমের প্রভাব ফেলে। এই নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে, যদি কোনো কোম্পানি জেনেশুনে এমন অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহের পথ সহজ করে দেয়—যেগুলো দিয়ে ভয়াবহ নৃশংসতা চালানো হবে, আর সেটার মোটামুটি ধারণাও তাদের থাকে—তাহলে সেই কোম্পানির কর্তাব্যক্তিদের ওই অপরাধের সহযোগী হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। জাতিসংঘের সেই যে স্বাধীন বিশেষজ্ঞদের দল, তারা ২০২৪ সালের জুন মাসে একেবারে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিল যে, অস্ত্র সরবরাহকারী আর এই মালপত্র আনা-নেওয়া করা লজিস্টিক কোম্পানিগুলো যদি গাজা যুদ্ধের সময় ইসরায়েলের কাছে অস্ত্র বা সামরিক সরঞ্জাম পাঠায়, তাহলে তারা “আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও মানবিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘনে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিতে পড়তে পারে” (Tétrault-Farber, 2024)। তারা সমস্ত অস্ত্র নির্মাতা আর ব্যবসায়ীদের কাছে হাতজোড় করে অনুরোধ জানিয়েছিল, এই ধরনের সরবরাহ যেন তারা বন্ধ করে দেয়, “এমনকি যদি সেগুলো আগে থেকে নেওয়া রপ্তানি লাইসেন্সের অধীনেও করা হয়।” আর তারা এটাও জোর দিয়ে বলেছিল যে, যুদ্ধাপরাধের এত এত পরিষ্কার প্রমাণের পরেও যদি কেউ ইসরায়েলকে মালপত্র জুগিয়েই যায়, তাহলে সেটাকে বেআইনি সামরিক অভিযানে “জেনেশুনে সাহায্য করা” (knowingly providing assistance) হিসেবেই দেখা হতে পারে (Tétrault-Farber, 2024)। আরও এক কাঠি সহজ করে যদি বলি: যদি কোম্পানিগুলো একটা চলমান কসাইখানার মধ্যে সমানে ছুরি-চাপাতি পাঠাতেই থাকে, তাহলে তো তারা সেই কসাইগিরিতেই মদত দিচ্ছে! আর এর পরিণতির জন্য তাদেরকেই তো আইনি আর নৈতিকভাবে দায়ী হতে হবে, তাই না?

তবে হ্যাঁ, এখানে একটা কথা কিন্তু বেশ ভালো করে মনে রাখা দরকার। এই যে আন্তর্জাতিক আইন, এটা কিন্তু সাধারণত রাষ্ট্র আর ব্যক্তিমানুষের ওপরই খাটে। কর্পোরেশন নামের সেই যে বিশাল, ধরাছোঁয়ার বাইরের দৈত্য, তার ওপর কিন্তু সরাসরি এর প্রয়োগ নেই। এখন পর্যন্ত এমন কোনো আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত তৈরি হয়নি, যার কিনা কর্পোরেশনের ওপর সরাসরি খবরদারি করার ক্ষমতা আছে। ক্ষমতা যা আছে, তা শুধু ব্যক্তিমানুষের ওপর। কিন্তু, কর্পোরেট সাহেবরা – মানে, যারা বড় বড় সিদ্ধান্তগুলো নেন – তারা যদি যুদ্ধাপরাধে জড়িয়ে পড়েন, তাহলে কিন্তু দেশীয় আইনের আওতায়, কিংবা ধরুন, আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালেও তাদের বিচার হতে পারে। এর ঐতিহাসিক নজিরও কিন্তু কম নেই (যেমন ধরুন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নাৎসিদের যুদ্ধযন্ত্রকে মালমশলা জোগান দেওয়ার জন্য বড় বড় শিল্পপতিদের কেমন বিচার হয়েছিল, মনে আছে তো?)। আর যুদ্ধাপরাধে এই যে কর্পোরেটদের জড়িয়ে পড়া (corporate complicity), এই ধারণাটাও কিন্তু দিনকে দিন বেশ জাঁকিয়ে বসছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো তো খোলাখুলিই বলছে যে, নৃশংসতা চালানোর জন্য যদি কেউ উপকরণ সরবরাহ করে, তাহলে সে তো সেই নৃশংসতারই ভাগীদার হয়ে যায় (Taylor & Hammouri, 2024)। গাজার এই নির্দিষ্ট ঘটনার ক্ষেত্রে, যদি মেয়ার্স্ক জেনেশুনে এমন অস্ত্র পরিবহন করে থাকে—যেগুলো দিয়ে যুদ্ধাপরাধ (যেমন বাছবিচারহীনভাবে বোমা ফেলা কিংবা সাধারণ মানুষকে পাইকারিভাবে শাস্তি দেওয়া) সংঘটিত হয়েছে—এবং তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে কোম্পানিটি সেই অপরাধে ভাগীদার হওয়ার দায় এড়িয়ে যেতে পারবে না। সোজাসুজি ফৌজদারি বিচার হয়তো হলো না, কিন্তু সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধের সাথে নাম জড়িয়ে যাওয়ার অভিযোগটাও তো একটা সাংঘাতিক রকমের সুনাম নষ্টের আর আইনি ঝামেলার ব্যাপার! যেমনটা একজন আন্তর্জাতিক আইনের অধ্যাপক বেশ জোর দিয়েই বলেছেন, কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে এত এত সতর্কবার্তা (যেমন ধরুন, আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের সেই আদেশ, বা জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের বিবৃতি) পাওয়ার পরেও যদি কেউ অস্ত্র সরবরাহ চালিয়েই যায়, তাহলে সেটাকে “আন্তর্জাতিক আইন ভেঙে করা অভিযানে সাহায্য করা” এবং এমনকি সেই সাহায্য থেকে মুনাফা লোটা হিসেবেও দেখা যেতে পারে (Tétrault-Farber, 2024)। এই কথাটা কিন্তু দিনের আলোর মতো পরিষ্কার করে দেয় যে, মেয়ার্স্কের বিরুদ্ধে ওঠা এই কর্মকাণ্ডগুলো কেমন করে গাজায় এত এত নৃশংসতা ঘটাতে সাহায্য করেছে, আর তার ফলে আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের মূল ভাবনাটাকেই (যদি সরাসরি আইন নাও হয়) বুড়ো আঙুল দেখিয়েছে।

কর্পোরেট দায়বদ্ধতা এবং জবাবদিহিতা

সরাসরি আইনি প্যাঁচে পড়ার প্রশ্নটা তো আছেই, কিন্তু সেটা ছাড়াও মেয়ার্স্কের এই ঘটনাটা কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (Corporate Social Responsibility – CSR) আর এই যে যুদ্ধ-বিগ্রহের মতো গোলমেলে জায়গায় বড় বড় কোম্পানিগুলোর যাকে বলে কর্পোরেট জবাবদিহিতা (corporate accountability), সেইসব জরুরি বিষয়গুলোকেও যেন একেবারে সামনে টেনে এনেছে। এই যে CSR, এটা আসলে হলো একটা কোম্পানির নিজের গরজে, নৈতিকভাবে ঠিকঠাক কাজ করার আর সমাজের ওপর, মানুষের অধিকারের ওপর তার কাজকর্মের কী প্রভাব পড়ছে, সেটা ভেবে দেখার একটা প্রতিশ্রুতি। মেয়ার্স্ক নিজেই তো ঢাকঢোল পিটিয়ে বলে যে, তারা নাকি ব্যবসা আর মানবাধিকার বিষয়ে জাতিসংঘের যে নির্দেশিকা (United Nations Guiding Principles on Business and Human Rights) আছে (যাকে কিনা ছোট করে UNGPs বলা হয়) সেটা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে। এই আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন কিন্তু পরিষ্কার বলে দেয়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমন কোনো কাজ করা চলবে না, যাতে মানুষের অধিকার নষ্ট হয়, বা সেই নষ্ট হওয়ার পেছনে তাদের কোনো রকম অবদান থাকে। এমনকি যদি সেই অধিকার নষ্ট করার কাজটা অন্য কেউ, যেমন ধরুন কোনো রাষ্ট্রও করে থাকে, তাহলেও কিন্তু এই নিয়ম খাটবে। UNGPs-এর আওতায়, কোম্পানিগুলোর একটা মস্ত বড় দায়িত্ব হলো, মানবাধিকারের ঝুঁকি কতটা, সেটা খতিয়ে দেখা (human rights due diligence)। এর মানে হলো, তাদের কাজকর্মের ফলে মানুষের কী ধরনের ক্ষতি হতে পারে, সেটা আগে থেকে আন্দাজ করা এবং সেই ক্ষতি আটকানোর জন্য যা যা করার দরকার, সেটা করা। আরও সহজ করে বললে, একটা কোম্পানিকে কোনো কিছু করার আগে দশবার ভাবতে হবে: যদি আপনি একটা দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা যুদ্ধক্ষেত্রে মালপত্র পাঠান, তাহলে সবার আগে নিজেকে জিজ্ঞাসা করতে হবে, “এই যে চালানটা পাঠাচ্ছি, এটা কি যুদ্ধাপরাধ বা মানুষের অধিকার ভাঙার কাজে সাহায্য করতে পারে?” যদি উত্তর ‘হ্যাঁ’ হয়, তাহলে “সেটা আটকানোর জন্য আমরা কী করতে পারি?”

যারা এই দায়িত্বশীল ব্যবসায়িক আচার-আচরণ নিয়ে কাজ করেন, সেইসব বিশেষজ্ঞরা কিন্তু জোর গলায় বলছেন যে, মেয়ার্স্কের উচিত ছিল এই সামরিক মালপত্রগুলো ভালো করে যাচাই-বাছাই করা। আর যে চালানগুলো এই ধরনের নৃশংসতায় মদত জোগাতে পারত, সেগুলো হয়তো ফিরিয়ে দেওয়া বা আপাতত বন্ধ রাখা (Kjær, 2025)। এই যে ঝুঁকি খতিয়ে দেখা (due diligence), এটা কিন্তু শুধু একটা কেতাবি বা আমলাতান্ত্রিক শব্দ নয়। এটা আসলে একটা পুরো প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে একটা কোম্পানি নিশ্চিত করে যে, সে জেনে বা না জেনে (কিংবা ধরুন, গাফিলতির কারণে) মানুষ খুন করার বা তাদের ওপর অত্যাচার করার কাজে কোনোভাবেই সাহায্য করছে না। ড্যানিশ ইনস্টিটিউট ফর হিউম্যান রাইটসের একজন পোড়খাওয়া গবেষক যেমনটা বলেছেন, যদিও অস্ত্রের রপ্তানি লাইসেন্স দেয় সরকার বাহাদুর, “মেয়ার্স্ক যা করছে, সেটা হলো – খুব সহজ করে বললে – শুধু সেই মালটা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় বয়ে নিয়ে যাওয়া।” আর তাই, কোম্পানিটা কিন্তু সব নৈতিক দায় সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিজে হাত ধুয়ে ফেলতে পারে না (Kjær, 2025)। উদাহরণ হিসেবে ডেনমার্ক আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথাই ধরুন না। এই দুটো দেশেই অস্ত্র রপ্তানির জন্য বেশ কড়াকড়ি আইনকানুন আছে। কিন্তু সেই আইনগুলো খাটে মূলত অস্ত্র বিক্রি আর রপ্তানির অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে। মেয়ার্স্ক তো হলো গিয়ে একটা পরিবহন সংস্থা। তাই, এই চুক্তিগুলো করার সময় তারা নিজের বিচারবুদ্ধি কতটা কাজে লাগিয়েছে, সেই প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। কর্পোরেট দুনিয়ার নীতি-নৈতিকতা নিয়ে কাজ করা একজন দিকপাল ব্যক্তি, সুনে স্কাদেগার্ড থরসেন (Sune Skadegaard Thorsen) বলেছেন যে, আসল প্রশ্নটা হলো, মেয়ার্স্ক তার এই সামরিক চালানগুলোর জন্য ঠিকঠাকভাবে মানবাধিকারের ঝুঁকি যাচাই করেছিল কিনা (Kjær, 2025)। যদি তারা তাদের পাঠানো মালের শেষমেশ কী ব্যবহার হবে, আর সেই মাল দিয়ে গাজায় যুদ্ধাপরাধ ঘটানো হবে কিনা, সেই ঝুঁকিটা খতিয়ে দেখতে ব্যর্থ হয়, তাহলে বলতে হবে মেয়ার্স্ক সম্ভবত মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার যে দায়িত্ব, সেটা পালনে সোজাসাপ্টা ফেল মেরেছে। থরসেন সাহেব আরও জোর দিয়ে বলেছেন যে, আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন অনুযায়ী, “এটাই হলো মেয়ার্স্ককে জবাবদিহি করানোর একমাত্র রাস্তা।” এর মানে হলো, এই ঝুঁকি খতিয়ে দেখার কাজে যে গাফিলতি হয়েছে, সেটা প্রমাণ করতে পারলেই কোম্পানিটাকে শাস্তি দেওয়া বা তার সংস্কারের দাবি জানানোর একটা শক্ত ভিত্তি তৈরি হবে (Kjær, 2025)।

বাস্তবে, মেয়ার্স্কের মতো একটা বিশাল কর্পোরেশনকে শায়েস্তা করার, মানে জবাবদিহি করানোর কিন্তু বেশ কয়েকটা রাস্তা আছে। আমরা তো ইতিমধ্যেই স্পেনে দেখেছি কেমন করে আইনি পদক্ষেপ (legal action) নেওয়া হয়েছে। সেখানে দেশের ভেতরের আইন কাজে লাগিয়েই সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধে জড়িত থাকার দায়ে তদন্ত চলছে। আবার অন্য জায়গায়, যারা এই সব নিয়ে আন্দোলন করেন, সেই অ্যাক্টিভিস্টরা আর কোম্পানির অংশীদার বা শেয়ারহোল্ডাররা মিলে বেশ ভালোই চাপ সৃষ্টি করেছেন। মেয়ার্স্কের সেই যে ২০২৫ সালের বার্ষিক সাধারণ সভা হলো, সেখানে কিছু সমালোচক শেয়ারহোল্ডার একজোট হয়ে একটা প্রস্তাব এনেছিলেন। তাদের দাবি ছিল, গাজা যুদ্ধের সময় ইসরায়েলে অস্ত্র বহন করা থেকে কোম্পানিটাকে যেন একেবারে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয় (Reuters, 2025)। যদিও সেই প্রস্তাবটা ভোটে জিততে পারেনি, কিন্তু এটা বিষয়টাকে বেশ আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছিল আর বিনিয়োগকারীরা যে চিন্তিত, সেটার একটা স্পষ্ট ইঙ্গিতও দিয়েছিল। শ্রমিক ইউনিয়ন আর সাধারণ মানুষজনও কিন্তু চুপ করে বসে থাকেনি। তারা বিভিন্ন বন্দরে মেয়ার্স্কের জাহাজের সামনে রীতিমতো শারীরিক প্রতিবাদ জানিয়েছে, জাহাজ আটকে দিয়েছে। যেখানে হয়তো আইনের হাত পৌঁছাচ্ছে না, সেখানে তারা এভাবেই নৈতিকতার ঝান্ডা তুলে ধরার চেষ্টা করেছে (Kjær, 2025)। তাছাড়া, ২০২৪ সালে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা যে কড়া ভাষায় সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন, সেটা আসলে বড় বড় কোম্পানিগুলোকে এই বার্তাই দিয়েছিল যে, “ব্যবসা আর মানবাধিকার” (business and human rights) নিয়ে যারা কাজ করে, সেই সমাজ কিন্তু কড়া নজর রাখছে। আর এই ধরনের সন্দেহজনক মালপত্র পাঠানো যদি চলতেই থাকে, তাহলে সেটা যে শুধু জনরোষের কারণ হবে তাই নয়, ভবিষ্যতে হয়তো বড়সড় মামলা-মোকদ্দমারও মুখোমুখি হতে হবে (Taylor & Hammouri, 2024)।

যুদ্ধের এই ভয়ংকর প্রেক্ষাপটে, কর্পোরেট জগতের এই যে জবাবদিহিতা (corporate accountability), এটা আসলে একটা বেশ বিস্তৃত ব্যাপার। এর একদিকে আছে নৈতিক নিয়মকানুন (যেমন ধরুন, CSR-এর প্রতিশ্রুতি আর UNGPs-এর নির্দেশিকা) স্বেচ্ছায় মেনে চলার সদিচ্ছা। আর অন্যদিকে আছে মামলা-মোকদ্দমা, ফৌজদারি তদন্ত বা ধরুন নানারকম নিষেধাজ্ঞার মতো কঠিন সাজার ভয়। মেয়ার্স্কের এই ঘটনাটা যেন ঠিক এই দুয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। কোম্পানিটা মুখে বলছে বটে যে তারা সব আইনকানুন আর মানবাধিকারের নীতি মেনেই কাজ করে। কিন্তু সাংবাদিক আর বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) জোগাড় করা তথ্যপ্রমাণ কিন্তু তাদের এই দাবির সাথে বাস্তবের একটা বেশ বড়সড় ফারাক দেখিয়ে দিচ্ছে। যুদ্ধ অর্থনীতির চশমা দিয়ে দেখলে একটা জিনিস খুব পরিষ্কার হয়ে যায়: মুনাফার লোভ অনেক সময়ই নৈতিক দুশ্চিন্তাকে ছাপিয়ে যেতে পারে। প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত মালপত্র আনা-নেওয়ার চুক্তিগুলো তো বেশ লাভজনক বটেই। আর যুদ্ধ যত বেড়েছে, পেন্টাগন আর ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর সাথে মেয়ার্স্কের ব্যবসাও সম্ভবত ততই ফুলেফেঁপে উঠেছে (Ackerman, 2024; Lennard, 2024)। কিন্তু, সারা দুনিয়ার যে নিয়মকানুন, সেটা কিন্তু সাফ বলে দেয়, “কর্পোরেশনগুলোর কোনো অধিকার নেই আন্তর্জাতিক আইন ভাঙার ঘটনাগুলো (যার মধ্যে যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ আর গণহত্যাও পড়ে) থেকে ফায়দা লোটার বা সেসবে কোনোভাবে মদত জোগানোর” (Taylor & Hammouri, 2024)। গাজায় বোমাবর্ষণ আর দখলদারিত্ব চালানোর জন্য দরকারি মালপত্র সরবরাহ করে মেয়ার্স্ক কিন্তু তর্কসাপেক্ষে সেইসব আইন ভাঙার ঘটনা থেকেই ফায়দা লুটেছে আর সেসবে মদতও জুগিয়েছে। এটা কোম্পানির নিজের দেওয়া CSR প্রতিশ্রুতির একেবারে সোজাসুজি বিরোধী। আর এর ফলে, তাদের বিরুদ্ধে ভণ্ডামি আর অন্যায় কাজের অভিযোগ ওঠাটা খুবই স্বাভাবিক।

উপসংহার

মেয়ার্স্ক গাজা যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্রশস্ত্র আর সামরিক সরঞ্জাম পাঠিয়েছে, এই যে অভিযোগগুলো উঠেছে, সেগুলো কোম্পানিটাকে একটা বেজায় অস্বস্তিকর, কণ্টকাকীর্ণ অবস্থানে ফেলে দিয়েছে। যদি এই অভিযোগগুলো শেষ পর্যন্ত সত্যি বলে প্রমাণিত হয়, তার মানে দাঁড়াবে, মেয়ার্স্ক আসলে গাজার সেই ভয়াল যুদ্ধ অর্থনীতির সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েছে – এমন সব অস্ত্রের স্রোত থেকে মুনাফা কামিয়েছে, যা একটা বিধ্বংসী সংঘাতকে দিনের পর দিন জিইয়ে রেখেছে। কোম্পানির জাহাজগুলো তখন কার্যকরভাবে সেইসব ধমনীর মতো কাজ করেছে, যেগুলো হাজার হাজার সাধারণ মানুষের মৃত্যু আর গাজা উপত্যকার বিশাল অংশ ধ্বংসকারী এক ভয়ংকর যুদ্ধে সমানে সামরিক রসদ জুগিয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের চোখে দেখলে, এই ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের অনেকগুলোই কিন্তু যুদ্ধাপরাধ, এমনকি মানবতার বিরুদ্ধে সম্ভাব্য অপরাধ হিসেবেও গণ্য হতে পারে। এই ধরনের অপকর্মে সহায়তা করাটা যে একটা গুরুতর নৈতিক অপরাধ, আর এর যে সাংঘাতিক আইনি পরিণতি হতে পারে, সেটা বলাই বাহুল্য। খুব কম করে বললেও, মেয়ার্স্কের বিরুদ্ধে ওঠা এই কর্মকাণ্ডগুলো কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা আর জাতিসংঘের নির্দেশিকার সেই মূল মন্ত্র – “কারও ক্ষতি কোরো না” (do no harm) – সেটাকে সোজাসাপ্টা লঙ্ঘন করেছে। তাদের পাঠানো মালপত্র যাতে কোনো নৃশংসতায় মদত না জোগায়, সেটা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়ে কোম্পানিটা সম্ভবত মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার যে গুরুদায়িত্ব, সেটা এড়িয়ে গেছে। আর সবচেয়ে খারাপ যা হতে পারে, তা হলো, মেয়ার্স্ক হয়তো যুদ্ধাপরাধে জড়িত থাকার মতো সাংঘাতিক অভিযোগের মুখোমুখি হতে পারে – এমন এক অভিযোগ, যা শুনলে যেকোনো ব্যবসারই কিন্তু ভয়ে পিলে চমকে ওঠার কথা!

এই ঘটনাটা আসলে একটা আরও বড়, আরও গভীর বাস্তবতাকে আমাদের সামনে তুলে ধরে: আধুনিক যুগের এই যুদ্ধ-বিগ্রহের খেলায়, বেসরকারি খাত (private sector) কিন্তু হিংসাকে আরও বাড়িয়ে তোলার ক্ষেত্রে বা তাকে থামিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে একটা নির্ণায়ক, অর্থাৎ খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। জাহাজ কোম্পানি, বিমান সংস্থা, ব্যাংক, প্রযুক্তি সংস্থা – এরা সবাই হয় যুদ্ধযন্ত্রের একটা অংশ হয়ে উঠতে পারে, অথবা এর বদলে শান্তির পক্ষে, সমাধানের পথে একটা ঘুঁটি হতে পারে। মেয়ার্স্কের এই উদাহরণটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, কর্পোরেশনগুলোর জন্য এটা কতটা জরুরি যে, তারা যেন সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতিতে তাদের মালপত্র পাঠানোর পুরো ব্যবস্থাটা, তাদের চুক্তিগুলো ভালো করে খতিয়ে দেখে। যুদ্ধ অর্থনীতি তত্ত্ব আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয় যে, যুদ্ধ ততদিনই চলতে থাকে, যতদিন লড়াই করার পেছনে কোনো না কোনো অর্থনৈতিক লাভের ব্যাপার থাকে। তাই, টাকা-পয়সা আর মালপত্রের জোগান যদি বন্ধ করে দেওয়া যায়, তাহলে যুদ্ধকে নিয়ন্ত্রণে আনার সেটাই কিন্তু একটা মোক্ষম উপায়। উল্টোদিকে, যে কোম্পানিগুলো আন্তর্জাতিক আইন আর নৈতিকতার নিয়মকানুনকে বুড়ো আঙুল দেখায়, তারা কিন্তু নিপীড়ন আর নৃশংসতার ভাগীদার হয়ে ওঠার একটা মস্ত বড় ঝুঁকিতে পড়ে। গাজার ক্ষেত্রে, মেয়ার্স্কের জাহাজগুলো অভিযোগ অনুযায়ী শুধু যে মালপত্রই বয়ে নিয়ে গেছে তাই নয় – তারা আসলে বয়ে নিয়ে গেছে এক গুরুতর দায়বদ্ধতার বোঝা। আগামী দিনগুলোতে হয়তো কোম্পানির এই ভূমিকা নিয়ে আরও অনেক কাটাছেঁড়া হবে, আরও গভীর তদন্ত হবে, এবং সম্ভবত তাদের জবাবদিহিও করতে হবে। ব্যবসায়িক নীতি-নৈতিকতা আর মানবাধিকারের ওপর যখন সারা দুনিয়ায় এত বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে, তখন গাজা যুদ্ধে মেয়ার্স্কের এই জড়িয়ে পড়াটা বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলোর জন্য একটা বড়সড় সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করতে পারে: মনে রাখবেন, আপনি যখন সংঘাতের বাণিজ্যে গা ভাসাবেন, তখন কিন্তু সেই সংঘাতের অপরাধের দায়ও আপনার ঘাড়ে এসে চাপতে পারে।

তথ্যসূত্র

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.