ফয়সাল দেবজির “মুসলিম জায়ন”: পাকিস্তান নামের সেই অদ্ভুত ধাঁধা

ভূমিকা

পাকিস্তান নামের দেশটা বড়ই অদ্ভুত। মানচিত্রের দিকে তাকালে মনে হয়, কেউ যেন এক কাপ ঘন দুধ-চায়ের মধ্যে এক ফোঁটা কালি ফেলে দিয়েছে, আর সেই কালি এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে গিয়ে একটা দেশের জন্ম হয়েছে। যার এক টুকরো পূর্বে, আরেক টুকরো পশ্চিমে। মাঝখানে হাজার মাইলের বেশি ব্যবধান, এবং সেই ব্যবধান জুড়ে এমন এক দেশ, যাকে ঠিক বন্ধু বলা চলে না। এমন অদ্ভুত গড়নের রাষ্ট্র পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই রাষ্ট্রের জন্মটাও কম অদ্ভুতুড়ে নয়। বলা হয়, ধর্মের ভিত্তিতে এই দেশের জন্ম। হিন্দুরা এক জাতি, মুসলমানরা আরেক জাতি। এই হলো দ্বিজাতি তত্ত্ব (Two-Nation Theory)। আর এই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই নাকি পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম।

গল্পটা শুনতে খুব সোজা-সাপ্টা লাগে, তাই না? ছোটবেলায় স্কুলের সমাজবিজ্ঞান বইয়ে আমরা ঠিক এমনটাই পড়েছি। শিক্ষকেরা ক্লাসে এসে ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে দুটো বৃত্ত আঁকতেন। এক বৃত্তে লিখতেন ‘হিন্দু’, অন্য বৃত্তে ‘মুসলমান’। তারপর বলতেন, এই দুটি বৃত্ত কখনো মিলতে পারে না, তাই এদের জন্য আলাদা দুটো দেশের দরকার হলো। ব্যস, হয়ে গেল ভারত আর পাকিস্তান। কী সহজ ব্যাখ্যা!

কিন্তু পৃথিবীটা তো আর স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডের মতো সহজ নয়। ইতিহাসের গল্পগুলোও সরলরেখায় চলে না। একটু গভীরে গেলেই দেখা যায়, এই সহজ গল্পের ভেতরে অসংখ্য কাঁটা লুকিয়ে আছে। আচ্ছা, একটা ব্যাপার কি কখনো ভেবে দেখেছেন? যে মুসলমানরা অখণ্ড ভারতে সংখ্যালঘু (minority) হিসেবে ছিলেন, যেমন ধরুন যুক্তপ্রদেশ (United Provinces), বিহার বা মধ্যপ্রদেশের মুসলমানরা, তারাই পাকিস্তান চেয়েছিলেন সবচেয়ে বেশি। তাদের কণ্ঠই ছিল সবচেয়ে সোচ্চার। অথচ ১৯৪৭ সালে যখন দেশটা তৈরি হলো, তারা কিন্তু পাকিস্তানে পড়েননি, ভারতেই রয়ে গেলেন। অন্যদিকে, যে অঞ্চলের মুসলমানরা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ (majority) ছিলেন, যেমন বাংলা বা পাঞ্জাব, সেখানে পাকিস্তান আন্দোলন প্রথমদিকে ততটা জোরদার ছিল না। সেখানকার বড় বড় নেতারা হয় এই ধারণার বিরোধী ছিলেন, নয়তো নিমরাজি ছিলেন।

কেমন যেন একটা ধাঁধার মতো, তাই না? যারা ঘর চাইলেন, তারা ঘর পেলেন না। আর যাদের ঘরে থাকার কথা, তারা যেন নিমরাজি হয়েই একটা নতুন দেশের নাগরিক হয়ে গেলেন। এই ধাঁধার কোনো কিনারা করা যায়?

এইসব জটিল, ধোঁয়াশাচ্ছন্ন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমাদের চোখে এক নতুন চশমা লাগাতে হয়। সেই চশমার নাম ফয়সাল দেবজি (Faisal Devji)। তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ এবং চিন্তাবিদ। ২০১৩ সালে তাঁর একটি বই বের হয়, যা দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস পাঠের জগতে রীতিমতো আলোড়ন ফেলে দেয়। বইটির নাম ‘মুসলিম জায়ন: একটি রাজনৈতিক ধারণা হিসেবে পাকিস্তান’ (Muslim Zion: Pakistan as a Political Idea)। এই বইটি পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির জন্মরহস্য নিয়ে আমাদের এতদিনের জানা গল্পকে একেবারে ওলট-পালট করে দেয়। দেবজি বলেন, পাকিস্তান আসলে ইউরোপীয় মডেলের কোনো জাতি-রাষ্ট্র (nation-state) নয়। এটি কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মানুষের মুক্তির সংগ্রামও নয়। পাকিস্তান ছিল একটি রাজনৈতিক ধারণা (political idea)। একটি ইউটোপিয়ান বা স্বপ্নচারী ধারণা, যা বাস্তবতার চেয়ে কল্পনাতেই বেশি জীবন্ত ছিল। আর এই অদ্ভুত ধারণাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দেবজি একটি আরও অদ্ভুত শব্দবন্ধ ব্যবহার করেন—‘মুসলিম জায়ন’ (Muslim Zion)।

এই ‘জায়ন’ শব্দটা শুনেই অনেকে চমকে উঠতে পারেন। ভ্রু কুঁচকে ভাবতে পারেন, এ আবার কেমন কথা! জায়নবাদ (Zionism) তো ইহুদিদের রাজনৈতিক আন্দোলনের নাম, যার চূড়ান্ত ফসল হলো আজকের ইজরায়েল রাষ্ট্র। মুসলমানদের রাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে তার তুলনা? হ্যাঁ, দেবজি ঠিক এই তুলনাটিই করেছেন। তবে কোনো সরল তুলনা নয়, বরং দুটি আন্দোলনের কাঠামোগত এবং দার্শনিক মিলের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি এক যুগান্তকারী তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর যুক্তিগুলো এতটাই গভীর এবং অপ্রচলিত যে, তা আমাদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে।

চলুন, আজ আমরা এই ধাঁধার জট খোলার এক দীর্ঘ সফরে বের হই। আমরা ফয়সাল দেবজির দেখানো পথে হেঁটে দেখব, পাকিস্তান আসলে কী ছিল—একটি দেশ, একটি জাতি, একটি আদর্শ, নাকি একটি ভঙ্গুর স্বপ্ন?

প্রচলিত ধারণা: দ্বিজাতি তত্ত্বের সহজ পাঠ ও তার সীমাবদ্ধতা

ফয়সাল দেবজির জগতে প্রবেশের আগে, আমাদের সেই পুরনো গল্পটা আর একবার ভালো করে বুঝতে হবে। কারণ নতুনকে বুঝতে হলে পুরনোকে জানাটা জরুরি। পাকিস্তান সৃষ্টির সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাখ্যাটি হলো দ্বিজাতি তত্ত্ব। এই তত্ত্বের মূল প্রবক্তা হিসেবে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং মুসলিম লীগকেই আমরা চিনি। তত্ত্বটি খুব সহজ ভাষায় বলে, ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানরা কেবল একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় নয়, তারা একটি স্বতন্ত্র জাতি। তাদের ধর্ম, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, আইন, নৈতিকতা, জীবনাচরণ—সবকিছুই হিন্দুদের থেকে এতটাই আলাদা যে, এই দুই সম্প্রদায়কে একসঙ্গে একটি রাষ্ট্রে বেঁধে রাখা সম্ভব নয়। যেহেতু তারা আলাদা জাতি, তাই তাদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র বা স্বদেশ (homeland) প্রয়োজন। এই ভাবনা থেকেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবি ওঠে।

এই তত্ত্ব অনুযায়ী, কংগ্রেসের অধীনে একটি অখণ্ড ভারতে মুসলমানরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে হিন্দুদের দ্বারা নিষ্পেষিত হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠের গণতন্ত্রে তাদের স্বকীয়তা হারিয়ে যাবে, তারা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হবে। তাই নিজেদের অস্তিত্ব ও পরিচয় রক্ষার জন্যই একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র অপরিহার্য। এই বয়ানটি শুনতে খুব যৌক্তিক এবং শক্তিশালী মনে হয়। বিশেষ করে যখন ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে হিন্দু ও মুসলিম নেতাদের মধ্যে যে তীব্র অবিশ্বাস ও দ্বন্দ্ব চলছিল, তাতে এই তত্ত্বটি আগুনে ঘি ঢালার কাজ করেছিল (Jalal, 1994)।

কিন্তু এই সহজ-সরল ব্যাখ্যাটির ভেতরে অনেক ফাঁকফোকর আর অমীমাংসিত প্রশ্ন রয়ে গেছে, যা একে প্রায় অকেজো করে দেয়। যেমন:

১. ভূগোল বনাম ধারণা: যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, ভারতের মুসলমানরা একটি একক জাতি, তাহলে সেই জাতির স্বদেশ তো ভারত জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সব মুসলমানকে নিয়েই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা তো হয়নি। কেবল উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্বাঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলো নিয়েই পাকিস্তান গঠিত হয়। ভারতের কোটি কোটি মুসলমান—যারা পাকিস্তান আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি সমর্থন দিয়েছিলেন—তারাই ভারতেই থেকে গেলেন। তাহলে ‘জাতি’ হিসেবে তারা কি খণ্ডিত হয়ে গেল না? একটি জাতি কি এভাবে দুটি ভিন্ন দেশে বিভক্ত হয়ে থাকতে পারে, যাদের একটি আবার অপরটির শত্রু? এই প্রশ্নের কোনো সন্তোষজনক উত্তর দ্বিজাতি তত্ত্ব দিতে পারে না।

২. আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ও তার প্যারাডক্স: ইতিহাসবিদ আয়েশা জালাল তাঁর যুগান্তকারী গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, পাকিস্তান আন্দোলন সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল মুসলিম-সংখ্যালঘু প্রদেশগুলোতে, যেমন যুক্তপ্রদেশ (বর্তমান উত্তরপ্রদেশ), বিহার বা বোম্বেতে (Jalal, 1994)। কারণ সেখানকার শিক্ষিত, অভিজাত মুসলমানরা (আশরাফ শ্রেণি) ভয় পেতেন যে, অখণ্ড ভারতে তারা হিন্দুদের সংখ্যাধিক্যের চাপে তাদের এতদিনের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিপত্তি হারাবেন। অথচ পাঞ্জাব বা বাংলার মতো মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশের প্রভাবশালী নেতারা, যেমন পাঞ্জাবের সিকান্দার হায়াত খান বা বাংলার এ. কে. ফজলুল হক, প্রথমদিকে পাকিস্তান ধারণার ঘোর বিরোধী ছিলেন বা এর বিষয়ে চরম সন্দিহান ছিলেন। ফজলুল হক তো ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে পাকিস্তানের কথা বলেননি, বলেছিলেন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলো নিয়ে একাধিক স্বাধীন ‘রাষ্ট্রসমূহ’ (States) গঠনের কথা। তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? যাদের নিয়ে রাষ্ট্র হওয়ার কথা, তারাই দাবিটি নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত, আর যারা সেই রাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্ত হবেন না, তারাই এর জন্য সবচেয়ে বেশি সোচ্চার। এই বিচিত্র পরিস্থিতি দ্বিজাতি তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না।

৩. ইসলামের ভূমিকা ও তার জটিলতা: পাকিস্তান কি একটি ইসলামিক রাষ্ট্র (Islamic State) হওয়ার জন্য তৈরি হয়েছিল? এই প্রশ্নটি আরও বড় একটি ধাঁধা তৈরি করে। আন্দোলনের নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নিজে ছিলেন পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত একজন সেক্যুলার (secular) আইনজীবী। তাঁর জীবনাচরণে ধর্মীয় গোঁড়ামির লেশমাত্র ছিল না। তাঁর বিখ্যাত ১১ই আগস্ট, ১৯৪৭-এর ভাষণে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছিলেন যে, পাকিস্তানে হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান সবাই সমান নাগরিক অধিকার পাবে এবং রাষ্ট্র নাগরিকদের ধর্মীয় পরিচয়ে কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। এটি ছিল একটি আধুনিক সেক্যুলার রাষ্ট্রের রূপরেখা। অন্যদিকে, ভারতের দেওবন্দের মতো বড় বড় এবং প্রভাবশালী ইসলামি চিন্তাকেন্দ্রগুলো পাকিস্তান ধারণার তীব্র বিরোধিতা করেছিল। তাদের প্রধান নেতা মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী বলেছিলেন, ইসলাম কোনো ভৌগোলিক সীমারেখায় আবদ্ধ হতে পারে না এবং জাতীয়তাবাদ (nationalism) একটি অনৈসলামিক ধারণা। তাহলে দেখা যাচ্ছে, যারা ইসলামি রাষ্ট্রের কথা বলতেন (যেমন জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মওদুদী, যদিও তিনি পরে পাকিস্তানে চলে যান), তারা পাকিস্তান ধারণার বিরোধী ছিলেন, আর যিনি একজন সেক্যুলার নেতা ছিলেন, তিনি ধর্মের নামে রাষ্ট্র তৈরি করলেন। বিষয়টি বড়ই গোলমেলে এবং প্যারাডক্সিকাল।

এই সব অমীমাংসিত প্রশ্ন আমাদের পরিষ্কারভাবে বলে দেয় যে, পাকিস্তান সৃষ্টির গল্পটা মোটেই ততটা সরল নয়, যতটা আমাদের বোঝানো হয়েছে। এখানেই ফয়সাল দেবজির প্রবেশ। তিনি এই সব অসঙ্গতির একটি সুসংহত এবং চমকপ্রদ ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন, যা আমাদের চিন্তার দিগন্তকে প্রসারিত করে।

ফয়সাল দেবজির তত্ত্ব: ‘মুসলিম জায়ন’ হিসেবে পাকিস্তান

ফয়সাল দেবজি তাঁর ‘মুসলিম জায়ন’ তত্ত্বে বলছেন, পাকিস্তান আন্দোলনকে বুঝতে হলে আমাদের জাতি-রাষ্ট্রের গতানুগতিক ইউরোপীয় ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পাকিস্তান কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ড (territory) বা জনগোষ্ঠীর (population) ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়নি। এটি তৈরি হয়েছিল একটি ‘ধারণা’র ওপর ভিত্তি করে। আর সেই ধারণাটি ছিল এক নতুন ধরনের ‘সার্বভৌম মুসলিম’ (Sovereign Muslim) তৈরি করা, যা ছিল খিলাফতের পতনের পর মুসলিম বিশ্বের এক গভীর রাজনৈতিক ও অস্তিত্বের সংকটের উত্তর।

ব্যাপারটা বেশ জটিল। চলুন, কয়েকটি ধাপে ভেঙে ভেঙে বোঝার চেষ্টা করা যাক।

জায়নবাদের সঙ্গে তুলনা কেন?

দেবজি যখন পাকিস্তান আন্দোলনকে ইহুদিদের জায়নবাদী আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করেন, তখন তিনি বলতে চান না যে দুটি আন্দোলন আদর্শগতভাবে বা ঐতিহাসিকভাবে একই রকম। তিনি কোনোভাবেই জিন্নাহকে থিওডোর হার্জেলের (Theodor Herzl) সঙ্গে মেলাচ্ছেন না। বরং তিনি এদের কাঠামোগত মিলের (structural similarity) দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। এই মিলগুলো কী কী?

  • রাজনৈতিক পরিচয় হিসেবে ধর্ম (Religion as Political Identity): জায়নবাদ এবং পাকিস্তান আন্দোলন—দুটিই ধর্মকে একটি আধুনিক রাজনৈতিক পরিচয়ে রূপান্তরিত করেছে। উনিশ শতকের আগে ‘ইহুদি’ ছিল একটি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয়। জায়নবাদীরা এসে বললেন, ইহুদিরা কেবল একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী নয়, তারা একটি জাতি এবং আধুনিক বিশ্বে টিকে থাকতে হলে তাদের একটি নিজস্ব জাতি-রাষ্ট্র প্রয়োজন। একইভাবে, মুসলিম লীগও বলতে শুরু করে যে, ভারতের মুসলমানরা কেবল একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় নয়, তারাও একটি জাতি এবং তাদেরও রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের জন্য একটি রাষ্ট্র প্রয়োজন। দুটি ক্ষেত্রেই ধর্মকে রাজনীতির মাঠে নামানো হয়েছে এক নতুন এবং আধুনিক উপায়ে, যা আগে কখনো ঘটেনি (Devji, 2013)।

  • সংখ্যালঘুর উদ্বেগ ও অস্তিত্বের সংকট (Minority Anxiety and Existential Crisis): জায়নবাদের জন্ম হয়েছিল ইউরোপে ইহুদিদের ওপর চলতে থাকা বহু শতাব্দীর নিপীড়ন এবং তাদের সংখ্যালঘু হিসেবে টিকে থাকার গভীর সংকট থেকে। ইউরোপীয় জাতি-রাষ্ট্রের উত্থানের ফলে তারা সব দেশেই ‘অন্য’ (the other) হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছিল। একইভাবে, পাকিস্তান ধারণার জন্ম হয়েছিল ভারতে মুসলমানদের সংখ্যালঘু হওয়ার ভয় এবং গণতান্ত্রিক ভারতে তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তা থেকে। দুটি আন্দোলনই সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্যের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুর অস্তিত্ব রক্ষার এক মরিয়া প্রচেষ্টা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল।

  • ভবিষ্যৎমুখী ও ইউটোপিয়ান (Forward-looking and Utopian): জায়নবাদ কোনো অতীতমুখী আন্দোলন ছিল না। এর লক্ষ্য ছিল না পুরনো কোনো ইহুদি সাম্রাজ্য ফিরিয়ে আনা। এটি ছিল সম্পূর্ণ ভবিষ্যৎমুখী। এর লক্ষ্য ছিল এক নতুন ধরনের ইহুদি মানুষ তৈরি করা, যারা আর ইউরোপের ‘ঘেটো’তে (ghetto) বাস করবে না, বরং নিজেদের রাষ্ট্রে স্বাধীন ও সার্বভৌম নাগরিক হিসেবে মাথা উঁচু করে বাঁচবে। ফয়সাল দেবজির মতে, পাকিস্তান ধারণাও ঠিক এমনই ভবিষ্যৎমুখী এবং স্বপ্নচারী ছিল। এর লক্ষ্য কোনো অতীতে ফিরে যাওয়া ছিল না, যেমনটা খিলাফত আন্দোলন চেয়েছিল। এর লক্ষ্য ছিল এক নতুন ধরনের ‘আধুনিক’ ও ‘সার্বভৌম’ মুসলিম তৈরি করা, যে ধর্মকে ধারণ করবে কিন্তু আধুনিক বিশ্বের একজন সক্রিয় কর্তা হবে।

  • ভূগোলবিহীন ধারণা (A Homeless Idea): জায়নবাদের একেবারে শুরুতে ইহুদিদের জন্য রাষ্ট্র ঠিক কোথায় হবে, তা নিয়ে তীব্র বিতর্ক ছিল। জায়নবাদের প্রতিষ্ঠাতা থিওডোর হার্জেল নিজে উগান্ডা বা আর্জেন্টিনায় ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবও বিবেচনা করেছিলেন। পরে ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় কারণে প্যালেস্টাইনকে বেছে নেওয়া হয়। অর্থাৎ, ‘রাষ্ট্রের ধারণা’টি আগে এসেছে, ‘ভূগোল’ পরে নির্ধারিত হয়েছে। ফয়সাল দেবজির মতে, পাকিস্তানও ছিল এমনই একটি ‘গৃহহীন’ (homeless) ধারণা। এটি কোনো পবিত্র ভূমির (sacred geography) সঙ্গে যুক্ত ছিল না, যেমনটা ইসলামে মক্কা বা মদিনার গুরুত্ব রয়েছে। পাকিস্তান ছিল একটি বিমূর্ত রাজনৈতিক আশ্রয় (abstract political shelter), যা পরে ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দুটি অঞ্চলকে তার ঠিকানা হিসেবে খুঁজে নেয়। এটি ছিল একটি রাজনৈতিক প্রকল্প, কোনো ভৌগোলিক বাস্তবতা নয় (Devji, 2013)।

এই তুলনার মাধ্যমে দেবজি যা বলতে চান তা হলো, পাকিস্তান আন্দোলনকে কেবল ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ফসল হিসেবে দেখলে মস্ত বড় ভুল হবে। একে বুঝতে হবে একটি বৃহত্তর বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে, যেখানে মুসলিমরা অটোমান খিলাফতের পতনের পর এক গভীর রাজনৈতিক ও আদর্শিক শূন্যতার মধ্যে এক নতুন পরিচয়ের সন্ধানে ছিল।

সংখ্যালঘুর রাজনীতি: পাকিস্তান ধারণার আসল আঁতুড়ঘর

দেবজির তত্ত্বের একটি অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হলো ‘সংখ্যালঘুর রাজনীতি’ (minority politics)। তিনি অত্যন্ত জোরালোভাবে দেখিয়েছেন যে, পাকিস্তান দাবির পেছনে মূল চালিকাশক্তি ছিল ভারতের সেই সব প্রদেশের মুসলমানরা, যেখানে তারা ছিল সংখ্যালঘু। এই বিষয়টিই পাকিস্তান রহস্যের কেন্দ্রবিন্দু।

যুক্তপ্রদেশ (UP), বিহার, বা বোম্বের মতো জায়গায় মুসলমানরা ছিল একটি ঐতিহাসিকভাবে প্রভাবশালী কিন্তু সংখ্যাগতভাবে দুর্বল সংখ্যালঘু গোষ্ঠী। মুঘল আমল থেকে শুরু করে ব্রিটিশ আমলের একটা বড় সময় পর্যন্ত তারাই ছিল শাসক শ্রেণি বা প্রশাসনের অংশ। তারা উর্দু সংস্কৃতির ধারক ও বাহক ছিল। কিন্তু আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হলে তারা বুঝতে পারল যে, ‘এক ব্যক্তি, এক ভোট’ (one man, one vote) নীতিতে সংখ্যার জোরে হিন্দুরা চিরকাল ক্ষমতায় থাকবে। ১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে কংগ্রেসের বিপুল বিজয় এবং সরকার গঠনের পর এই ভয় আরও তীব্র হয়। তথাকথিত ‘কংগ্রেস রাজ’-এর সময় স্কুল-কলেজে ‘বন্দে মাতরম’ গাওয়ার নির্দেশ, হিন্দি ভাষার প্রসারে গুরুত্বারোপ ইত্যাদি ঘটনা সংখ্যালঘু মুসলমানদের মধ্যে এই ধারণাকে বদ্ধমূল করে যে, অখণ্ড ভারতে তাদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিচয় বিলুপ্ত হয়ে যাবে (Robinson, 2007)।

এই গভীর রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতাবোধ (political alienation) থেকে তারা এমন একটি সমাধান খুঁজছিল, যেখানে তাদের পরিচয় ও ক্ষমতা সুরক্ষিত থাকবে। পাকিস্তান তাদের কাছে সেই সমাধানের স্বপ্ন দেখায়। কিন্তু এখানে সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং বিষয়টি হলো, এই সংখ্যালঘু প্রদেশের মুসলমানরা ভালোভাবেই জানতেন যে, পাকিস্তান যদি তৈরিও হয়, তবে তাদের প্রদেশগুলো কোনোদিনও পাকিস্তানে পড়বে না। তাহলে তারা কেন এমন একটি দেশের জন্য এত সোচ্চার ছিলেন, যেখানে তারা নিজেরাই থাকতে পারবেন না?

ফয়সাল দেবজির উত্তরটি এক কথায় অনবদ্য। তিনি বলেন, তারা পাকিস্তানের ‘নাগরিক’ (citizen) হতে চাননি, তারা চেয়েছেন পাকিস্তান ‘ধারণাটি’ (idea) সফল হোক। তাদের কাছে পাকিস্তান ছিল একটি প্রতীকী রাষ্ট্র (symbolic state)। এই রাষ্ট্রটির অস্তিত্বই হবে সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিমদের রাজনৈতিক দর-কষাকষির ক্ষমতা (bargaining power) এবং নিরাপত্তার গ্যারান্টি। পাকিস্তান তৈরি হলে ভারতে থেকে যাওয়া মুসলমানরাও আর কেবল একটি অসহায় সংখ্যালঘু থাকবে না; তাদের পেছনে একটি শক্তিশালী ‘মুসলিম রাষ্ট্র’ থাকবে, যা তাদের পক্ষে কথা বলতে পারবে। এটি তাদের এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক শক্তি জুগিয়েছিল (Devji, 2013)।

সুতরাং, পাকিস্তান আন্দোলন সংখ্যাগরিষ্ঠের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের (right to self-determination) আন্দোলন ছিল না, যেমনটা সাধারণত জাতি-রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে হয়। এটি ছিল সংখ্যালঘুর অস্তিত্বের সংকটের এক অভিনব এবং বিমূর্ত রাজনৈতিক প্রকাশ। তারা নিজেদের জন্য একটি দেশ চায়নি, তারা চেয়েছিল এমন একটি ‘ধারণা’, এমন একটি ‘প্রতীক’, যা তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করবে।

‘সার্বভৌম মুসলিম’: খিলাফতের বিকল্প এক নতুন রাজনৈতিক কল্পনা

ফয়সাল দেবজির তত্ত্বের সবচেয়ে গভীর, দার্শনিক এবং মৌলিক অংশটি হলো ‘সার্বভৌম মুসলিম’ (Sovereign Muslim) এর ধারণা। এটি বুঝতে হলে আমাদের একটু পেছনে ফিরে তাকাতে হবে, বিশ শতকের একেবারে শুরুর দিকে।

১৯২৪ সালে তুরস্কে মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক এক ফরমানের মাধ্যমে বহু শতাব্দীর পুরনো অটোমান খিলাফত (Ottoman Caliphate) বিলুপ্ত করে দেন। এটি ছিল বিশ্বজুড়ে মুসলিমদের জন্য এক বিরাট মনস্তাত্ত্বিক এবং রাজনৈতিক আঘাত। প্রায় তেরোশো বছর ধরে খলিফা ছিলেন মুসলিম উম্মাহর (global Muslim community) রাজনৈতিক ঐক্য এবং সার্বভৌমত্বের প্রতীক, হোক সেই প্রতীক শেষদিকে অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিল। খিলাফতের পতনের পর মুসলিম বিশ্ব এক গভীর পরিচয় সংকটে পড়ে। এখন তাদের রাজনৈতিক অভিভাবক কে? মুসলিম হিসেবে তাদের বিশ্বজনীন পরিচয় কী হবে? এই রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বহীনতার শূন্যস্থান পূরণ করবে কে?

এই শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য নানা রকম চিন্তার উদ্ভব হয়। কেউ প্যান-ইসলামিজমের (Pan-Islamism) কথা বলেন, কেউ আরব জাতীয়তাবাদের পথে হাঁটেন, কেউ বা মিশরের ইখওয়ানুল মুসলিমিনের মতো ইসলামি পুনর্জাগরণের ডাক দেন। দেবজির মতে, পাকিস্তান ছিল এই সংকটেরই একটি অত্যন্ত আধুনিক এবং অভিনব উত্তর। এটি ছিল খিলাফতের একটি আধুনিক বিকল্প, তবে সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে।

খিলাফত ব্যবস্থায় একজন সাধারণ মুসলমান ছিলেন খলিফার ‘প্রজা’ (subject)। তার কোনো ব্যক্তিগত সার্বভৌম ক্ষমতা ছিল না। সার্বভৌমত্ব ছিল খলিফার হাতে। কিন্তু আধুনিক বিশ্বে জাতি-রাষ্ট্রের ধারণা জনপ্রিয় হচ্ছিল, যেখানে রাষ্ট্রের প্রতিটি ‘নাগরিক’ (citizen) নিজেই সার্বভৌম ক্ষমতার অংশীদার বলে বিবেচিত হয়। জিন্নাহ এবং মুসলিম লীগের পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত নেতারা অবচেতনভাবেই এই আধুনিক ধারণাটিকে ইসলামের সঙ্গে যুক্ত করতে চাইলেন।

পাকিস্তান আন্দোলন বলছিল, মুসলমানরা আর কারো প্রজা হয়ে থাকবে না। তারা নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণ করবে। একটি মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রত্যেক মুসলমান, সে যেখানেই থাকুক না কেন, এক অর্থে ‘সার্বভৌম’ হয়ে উঠবে। কারণ তার প্রতিনিধিত্ব করার জন্য একটি রাষ্ট্র থাকবে। এই ‘সার্বভৌম মুসলিম’-এর ধারণাটি ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী এবং আকর্ষণীয়। এটি কোনো মোল্লা-মৌলভির দেওয়া পশ্চাৎপদ ধারণা ছিল না, এটি ছিল পশ্চিমা সাংবিধানিক তত্ত্বে পারদর্শী এক নতুন প্রজন্মের মুসলিম নেতাদের মস্তিষ্কপ্রসূত, যারা ইসলামকে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে চেয়েছিলেন (Metcalf, 2004)।

এই কারণেই দেবজি বলেন, পাকিস্তান আন্দোলন কোনো ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনবাদী (religious revivalist) আন্দোলন ছিল না। এটি ছিল চূড়ান্তভাবে একটি আধুনিক রাজনৈতিক প্রকল্প (modern political project)। এর লক্ষ্য ছিল এমন এক নতুন মুসলিম তৈরি করা, যে একই সঙ্গে ধার্মিক এবং আধুনিক বিশ্বের একজন সার্বভৌম কর্তা। এই বিমূর্ত কিন্তু শক্তিশালী ধারণাটিই ছিল পাকিস্তান নামক ‘মুসলিম জায়ন’-এর আসল ভিত্তি।

জিন্নাহ, গান্ধী এবং নৈতিকতার রাজনীতির দ্বৈরথ

ফয়সাল দেবজি তাঁর বইতে জিন্নাহ এবং গান্ধীর সম্পর্ককেও এক পুরোপুরি নতুন আলোকে বিশ্লেষণ করেছেন, যা প্রচলিত ইতিহাসকে চ্যালেঞ্জ জানায়। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, জিন্নাহ ছিলেন যুক্তিবাদী, আইনসর্বস্ব, পশ্চিমা ধাঁচের একজন সেক্যুলার রাজনীতিবিদ, আর গান্ধী ছিলেন ধর্মপ্রাণ, আধ্যাত্মিক এবং ঐতিহ্যবাহী একজন নেতা। দেবজি এই সরল বিভাজনকে পুরোপুরি নাকচ করে দেন।

তিনি দেখান যে, গান্ধীই প্রথম ভারতীয় রাজনীতিতে ধর্ম ও নৈতিকতাকে প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন। তাঁর ‘রামরাজ্য’, ‘সত্যাগ্রহ’ (সত্যের প্রতি আগ্রহ), ‘অহিংসা’, ‘হরিজন’—এই সবগুলো ধারণার মূলে ছিল হিন্দুধর্মীয় নৈতিকতা এবং দর্শন। গান্ধী যখন রাজনীতিকে এভাবে নৈতিকতার মোড়কে উপস্থাপন করলেন, তখন তিনি ভারতীয় রাজনীতির পুরো খেলার মাঠটিই বদলে দিলেন। তিনি অজান্তেই জিন্নাহর জন্য একটি নতুন পথ খুলে দিলেন।

গোঁড়া সেক্যুলার এবং যুক্তিবাদী জিন্নাহ ধীরে ধীরে বুঝতে পারলেন যে, ব্রিটিশদের সঙ্গে কেবল সাংবিধানিক তর্ক করে বা আইনি যুক্তি দিয়ে এই নতুন রাজনীতিতে টিকে থাকা যাবে না। গান্ধীর নৈতিক রাজনীতির মোকাবেলা করতে হলে একটি পাল্টা নৈতিক রাজনীতির প্রয়োজন। আর সেই নৈতিকতার উৎস হতে পারে ইসলাম। গান্ধী যদি হিন্দুদের আধ্যাত্মিক এবং নৈতিক ঐক্যের কথা বলতে পারেন, তাহলে জিন্নাহ কেন মুসলিমদের নৈতিক ও রাজনৈতিক ঐক্যের কথা বলতে পারবেন না?

এখান থেকেই জিন্নাহর সেই বিখ্যাত রূপান্তর (transformation) শুরু হয়। যিনি একসময় ‘হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের দূত’ (Ambassador of Hindu-Muslim Unity) হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তিনিই হয়ে উঠলেন মুসলিমদের ‘একমাত্র মুখপাত্র’ (The Sole Spokesman)। তিনি আর কেবল মুসলিমদের ‘রাজনৈতিক অধিকার’ বা ‘সংখ্যালঘুর সুরক্ষা’র কথা বলেন না, তিনি বলতে শুরু করেন মুসলিমদের ‘অস্তিত্বের’ কথা, তাদের ‘ঐতিহাসিক ভাগ্যের’ (destiny) কথা, তাদের স্বতন্ত্র সভ্যতার কথা। দেবজির মতে, জিন্নাহ গান্ধীর রাজনীতির ভাষা এবং কৌশল ব্যবহার করেই গান্ধীর বিরুদ্ধে একটি পাল্টা বয়ান তৈরি করেন। তিনি দেখান যে, মুসলমানরা কেবল একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী নয়, তারাও একটি স্বতন্ত্র নৈতিক সম্প্রদায় (moral community), যাদের নিজস্ব রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করার পূর্ণ অধিকার আছে (Devji, 2013)।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, পাকিস্তান দাবিটি তাই কেবল ক্ষমতার ভাগাভাগির দাবি ছিল না। এটি ছিল একটি ‘নৈতিক দাবি’ (ethical claim)। এই দাবিটি ছিল গান্ধীর ‘হিন্দু নৈতিকতা’-ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের বিপরীতে একটি ‘মুসলিম নৈতিকতা’-ভিত্তিক রাজনৈতিক পরিচয়ের ঘোষণা। সুতরাং, পাকিস্তান সৃষ্টির পেছনে গান্ধীর রাজনৈতিক পদ্ধতিরও একটি গভীর এবং পরোক্ষ ভূমিকা ছিল।

সমালোচনা ও বিকল্প ব্যাখ্যা: একটি তত্ত্বের ব্যবচ্ছেদ

ফয়সাল দেবজির ‘মুসলিম জায়ন’ তত্ত্বটি নিঃসন্দেহে অভিনব, প্রভাবশালী এবং চিন্তার খোরাক জোগায়। তবে এটি বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয় এবং অনেক প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ এর শক্ত সমালোচনা করেছেন বা বিকল্প ব্যাখ্যা হাজির করেছেন, যা আমাদের আলোচনাকে আরও সমৃদ্ধ করবে।

১. আয়েশা জালালের ‘দর-কষাকষির গুটি’ তত্ত্ব: পাকিস্তানের ইতিহাস রচনায় আয়েশা জালালের (Ayesha Jalal) বই ‘The Sole Spokesman’ একটি মাইলফলক। তাঁর মতে, জিন্নাহ আসলে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত একটি অখণ্ড ভারতই চেয়েছিলেন। তিনি পাকিস্তান দাবিটিকে একটি ‘দর-কষাকষির গুটি’ (bargaining chip) হিসেবে ব্যবহার করছিলেন। তাঁর আসল লক্ষ্য ছিল অখণ্ড ভারতের মধ্যে একটি শক্তিশালী ফেডারেল কাঠামো তৈরি করা, যেখানে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলোর হাতে প্রায় সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন থাকবে এবং দুর্বল কেন্দ্রে মুসলিমদের জন্য এমন সাংবিধানিক সুরক্ষা (constitutional safeguards) থাকবে, যা তাদের স্বার্থকে সুরক্ষিত করবে। কিন্তু কংগ্রেসের নেতারা, বিশেষ করে নেহেরু এবং প্যাটেল, একটি শক্তিশালী কেন্দ্র করতে চেয়েছিল এবং জিন্নাহর এই দাবি মানতে রাজি ছিলেন না। ব্রিটিশদের পাঠানো ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান (Cabinet Mission Plan, 1946), যা একটি দুর্বল কেন্দ্রসহ ভারতকে ঐক্যবদ্ধ রাখার শেষ চেষ্টা ছিল, তা জিন্নাহ গ্রহণ করলেও কংগ্রেস শেষ পর্যন্ত প্রত্যাখ্যান করে। জালালের মতে, কংগ্রেসের এই অনমনীয় মনোভাব এবং পরিস্থিতি জিন্নাহর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার ফলেই পাকিস্তান সৃষ্টি হয়ে যায়। এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী, পাকিস্তান ছিল একটি রাজনৈতিক দুর্ঘটনা এবং ট্র্যাজেডি, কোনো পরিকল্পিত ইউটোপিয়ান স্বপ্ন বা ‘মুসলিম জায়ন’ নয় (Jalal, 1994)।

২. ভেঙ্কট ধুলিপালার ‘নতুন মদিনা’র স্বপ্ন: প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ ভেঙ্কট ধুলিপালা (Venkat Dhulipala) তাঁর অসাধারণ গবেষণামূলক বই ‘Creating a New Medina’-তে দেবজির তত্ত্বকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছেন। দেবজি যেখানে পাকিস্তান আন্দোলনকে একটি বিমূর্ত, ‘গৃহহীন’ এবং আধুনিকতাবাদী ধারণা হিসেবে দেখছেন, ধুলিপালা সেখানে দেখিয়েছেন যে, অন্ততপক্ষে ভারতের তৃণমূল পর্যায়ে, বিশেষ করে যুক্তপ্রদেশের মুসলিমদের মধ্যে, একটি পরিপূর্ণ ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বাস্তব ও মজবুত স্বপ্ন কাজ করছিল। তিনি শত শত উর্দু প্যামফলেট, সংবাদপত্র এবং নেতাদের বক্তৃতা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, সাধারণ মানুষের কাছে পাকিস্তানকে একটি ‘নতুন মদিনা’ (New Medina) হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছিল। যেমনভাবে নবী মুহাম্মদ মক্কায় নির্যাতিত হয়ে মদিনায় হিজরত করে প্রথম ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তেমনি ভারতের মুসলমানরাও হিন্দুদের অধীনে ‘নির্যাতিত’ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে পাকিস্তানে ‘হিজরত’ করে এক নতুন আদর্শ ইসলামি রাষ্ট্র গড়বে—এই ছিল তাদের স্বপ্ন। এই রাষ্ট্রে শরিয়া আইন চালু হবে এবং এটি বিশ্ব মুসলিমদের জন্য একটি আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করবে। এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী, পাকিস্তান আন্দোলন নিছক একটি বিমূর্ত ধারণা ছিল না, বরং এর একটি সুনির্দিষ্ট ধর্মীয় ও রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল, যা দেবজির ‘সার্বভৌম মুসলিম’-এর সেক্যুলার ও আধুনিকতাবাদী ধারণার চেয়ে অনেক বেশি ইসলামকেন্দ্রিক এবং ঐতিহ্যবাহী ছিল (Dhulipala, 2015)।

৩. বাস্তববাদী ও অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা: অনেক সমালোচকের মতে, দেবজি পাকিস্তান আন্দোলনকে ওভার-ইন্টেলেকচুয়ালাইজ বা অতি-বৌদ্ধিকীকরণ করেছেন। তিনি ‘ধারণা’ বা ‘আদর্শে’র ওপর এত বেশি জোর দিয়েছেন যে, এর পেছনের বাস্তব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণগুলোকে প্রায় উপেক্ষা করেছেন। ব্রিটিশদের বহু পুরনো ‘ভাগ করো ও শাসন করো’ (Divide and Rule) নীতি, মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের নেতাদের মধ্যে তীব্র ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, পাঞ্জাব ও সিন্ধুর মুসলিম ভূস্বামীদের স্বার্থ (যারা একটি হিন্দু-শাসিত ভারতে ভূমি সংস্কারের ভয়ে ভীত ছিলেন), এবং উদীয়মান মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির সরকারি চাকরি ও ব্যবসার সুযোগ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা—এই বিষয়গুলোও পাকিস্তান সৃষ্টিতে বড় ভূমিকা রেখেছিল। এই অর্থনৈতিক ও বস্তুগত কারণগুলোকে ছাড়া কেবল ‘ধারণা’ দিয়ে এত বড় একটি রাজনৈতিক ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয় (Talbot, 2009)।

এই সমালোচনাগুলো থেকে বোঝা যায় যে, পাকিস্তান সৃষ্টির ইতিহাস অত্যন্ত জটিল এবং এর কোনো একমাত্রিক ব্যাখ্যা নেই। দেবজির তত্ত্বটি এই জটিলতার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিককে অসাধারণভাবে আলোকিত করেছে, কিন্তু এটিই একমাত্র বা চূড়ান্ত সত্য নয়। বরং এই সব তত্ত্বকে মিলিয়ে পড়লেই আমরা পাকিস্তান নামক ধাঁধার একটি কাছাকাছি চিত্র পেতে পারি।

‘মুসলিম জায়ন’-এর উত্তরাধিকার: একটি অসমাপ্ত স্বপ্ন না এক দুঃস্বপ্ন?

তাহলে ফয়সাল দেবজির তত্ত্ব আমাদের আজকের দিনে দাঁড়িয়ে কী বার্তা দেয়? পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি তার জন্মের সাত দশকেরও বেশি সময় পর আজও তার পরিচয় সংকট (identity crisis) নিয়ে বেশ বাজেভাবেই স্ট্রাগল করছে। এটি কি একটি সেক্যুলার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবে, যেমনটা জিন্নাহর ১১ই আগস্টের ভাষণে মনে হয়েছিল? নাকি এটি একটি ইসলামিক রাষ্ট্র হবে, যেমনটা এর নামের মধ্যেই নিহিত আছে? এর জাতীয় পরিচয় কি ধর্মীয় (ইসলাম), নাকি জাতিগত (ethnic)? আর যদি জাতিগত হয়, তবে তা কি পাঞ্জাবি, সিন্ধি, বালুচ, না পশতুন? এই প্রশ্নগুলো আজও পাকিস্তানকে তাড়া করে ফেরে।

দেবজির তত্ত্ব অনুযায়ী, এই সংকট পাকিস্তানের জন্মের মধ্যেই নিহিত ছিল। কারণ পাকিস্তান কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ড বা জাতির সুসংহত ইচ্ছার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়নি, এটি তৈরি হয়েছিল একটি বিমূর্ত ‘ধারণা’র ওপর। একটি ইউটোপিয়ান স্বপ্নকে যখন বাস্তবতার কঠিন মাটিতে নামিয়ে আনা হয়, তখন তার সঙ্গে অনেক আপস করতে হয়, এবং প্রায়শই সেই স্বপ্ন ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। ‘সার্বভৌম মুসলিম’-এর যে বিমূর্ত ধারণাটি পাকিস্তান আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল, রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান তা কতটুকু পূরণ করতে পেরেছে?

আজকের পাকিস্তানে দাঁড়িয়ে দেখলে মনে হয়, সেই স্বপ্ন বহু আগেই ভঙ্গ হয়েছে। যে সংখ্যালঘুর নিরাপত্তার কথা বলে পাকিস্তানের জন্ম, সেই পাকিস্তানেই আজ শিয়া, আহমদিয়া, হিন্দু, খ্রিস্টানসহ অন্য ধর্মীয় ও মাজহাবি সংখ্যালঘুরা প্রান্তিক, অধিকারবঞ্চিত এবং প্রায়শই প্রতিহিংসার শিকার। যে ‘সার্বভৌম মুসলিম’ তৈরির কথা ছিল, সে আজ নিজেই চরমপন্থা, দারিদ্র্য, দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার এক দুষ্ট চক্রে আবদ্ধ। আর সবচেয়ে বড় পরিহাস হলো, দ্বিজাতি তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে যে রাষ্ট্র তৈরি হয়েছিল, সেই রাষ্ট্র নিজেই ধর্মের ভিত্তিতে এক থাকতে পারেনি। ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতার কারণে ১৯৭১ সালে তার পূর্বাংশ, অর্থাৎ বাংলাদেশ, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয়ে যায়, যা ‘মুসলিমরা এক জাতি’—এই ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করে।

কিন্তু দেবজি আমাদের আরেকটি কথাও মনে করিয়ে দেন। পাকিস্তান হয়তো একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র (failed state) হওয়ার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে, কিন্তু এটি একটি ‘ব্যর্থ ধারণা’ (failed idea) নয়। ‘মুসলিম জায়ন’-এর ধারণাটি—অর্থাৎ, আধুনিক বিশ্বে মুসলিম পরিচয়ের একটি সার্বভৌম রাজনৈতিক প্রকাশ খোঁজার চেষ্টা—আজও বিশ্বজুড়ে নানা রূপে, নানা আঙ্গিকে বিদ্যমান। কখনো তা ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মধ্যে দেখা যায়, কখনো বা ইউরোপে অভিবাসী মুসলিম তরুণদের নতুন আত্মপরিচয় খোঁজার সংগ্রামের মধ্যে।

পাকিস্তান ছিল সেই অনুসন্ধানের প্রথম এবং সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। সেই পরীক্ষা হয়তো পুরোপুরি সফল হয়নি, কিন্তু এটি বিংশ শতাব্দীর মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক চিন্তার ইতিহাসে একটি সম্পূর্ণ নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল।

শেষ কথা

গল্পের শেষে এসে আমরা আবার সেই পুরনো ধাঁধার সামনে এসে দাঁড়াই। পাকিস্তান আসলে কী? একটি দেশ? একটি আদর্শ? একটি দুর্ঘটনা? নাকি একটি ট্র্যাজেডি?

ফয়সাল দেবজির ‘মুসলিম জায়ন’ আমাদের কোনো সহজ, এক কথায় উত্তর দেয় না। বরং তিনি আমাদের প্রশ্নগুলোকে আরও গভীর, আরও জটিল করে তোলেন। তিনি আমাদের শেখান যে, ইতিহাসকে সাদা-কালোয় দেখলে চলে না। তিনি দেখান যে, পাকিস্তান নিছক ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া একটি ভূখণ্ড নয়। এটি ছিল বিংশ শতাব্দীর মুসলিম বিশ্বের আত্মপরিচয় খোঁজার এক জটিল, ঝুঁকিপূর্ণ এবং স্বপ্নময় প্রয়োগ। এটি ছিল খিলাফতের পতনের পর আধুনিকতার উত্তাল সমুদ্রে ইসলামের জন্য একটি রাজনৈতিক নোঙর ফেলার অভিনব প্রচেষ্টা।

হয়তো পাকিস্তান নামের স্বপ্নটা ছিল একটু বেশি বড়। একটু বেশি বিমূর্ত। বাস্তবতার কঠিন জমিতে সেই স্বপ্নের চারাগাছ হয়তো ঠিকমতো বাড়তে পারেনি। তার ডালে ডালে আজ কাঁটা গজিয়েছে, ফুল ফোটেনি। কিন্তু সেই স্বপ্নের পেছনে যে আকাঙ্ক্ষা, যে উদ্বেগ, যে ভয় আর যে অবিশ্বাস্য কল্পনাশক্তি কাজ করেছিল, তা আজও আমাদের ভাবায়, আমাদের বিস্মিত করে।

পাকিস্তান নামের দেশটা তাই মানচিত্রের একটি এলোমেলো দাগ মাত্র নয়। এটি একটি অসমাপ্ত কবিতা, একটি অমীমাংসিত প্রশ্ন। আর সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলেই ফয়সাল দেবজির ‘মুসলিম জায়ন’ তত্ত্বটি আমাদের হাতে একটি মশাল তুলে দেয়। সে পথে হেঁটে আমরা হয়তো কোনো চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারি না, কিন্তু যাত্রাটা আমাদের চিন্তার জগৎকে চিরদিনের জন্য বদলে দেয়।

তথ্যসূত্র

  • Devji, F. (2013). Muslim Zion: Pakistan as a Political Idea. Harvard University Press.
  • Dhulipala, V. (2015). Creating a New Medina: State Power, Islam, and the Quest for Pakistan in Late Colonial North India. Cambridge University Press.
  • Jalal, A. (1994). The Sole Spokesman: Jinnah, the Muslim League and the Demand for Pakistan. Cambridge University Press.
  • Metcalf, B. D. (2004). Islamic Revival in British India: Deoband, 1860–1900. Oxford University Press.
  • Robinson, F. (2007). Separatism Among Indian Muslims: The Politics of the United Provinces’ Muslims, 1860-1923. Cambridge University Press.
  • Talbot, I. (2009). Pakistan: A New History. C. Hurst & Co. Publishers Ltd.

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.