Table of Contents
ভূমিকা
ধরুন, আমরা প্রায় আড়াই হাজার বছর পিছিয়ে গিয়েছি। সময়টা খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী। স্থান—গ্রীসের এথেন্স নগরী। চারদিকে কেবল পরিবর্তনের হাওয়া নয়, একধরনের অস্থিরতা আর সম্ভাবনার অদ্ভুত মিশেল। একদিকে পারস্যের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে, যা এথেন্সকে দিয়েছে এক নতুন আত্মবিশ্বাস। অন্যদিকে, স্পার্টার সঙ্গে পেলোপোনেশীয় যুদ্ধের (Peloponnesian War) কালো মেঘ ঘনিয়ে আসছে। বহুদিনের পুরনো বিশ্বাস, বংশমর্যাদা আর অ্যারিস্টোক্র্যাটিক (Aristocratic) বা অভিজাততন্ত্রের দেয়ালে ফাটল ধরেছে। ঠিক এই সময়েই গণতন্ত্র (Democracy) নামের এক নতুন শাসনব্যবব্যবস্থা সবে ডানা মেলতে শুরু করেছে। আগে যেখানে গুটিকয়েক অভিজাত বংশের লোকেরাই সব সিদ্ধান্ত নিত, এখন সেখানে সাধারণ নাগরিকদেরও (অন্তত পুরুষ নাগরিকদের) কথা বলার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
এই নতুন পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে বা সফল হতে হলে পেশিশক্তির চেয়ে মস্তিষ্কের শক্তি বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে। অ্যাসেম্বলি বা গণপরিষদে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিয়ে নিজের নীতিকে প্রতিষ্ঠা করতে হয়। আদালতে (Court) নিজের পক্ষে বা প্রতিপক্ষের বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরতে হয়। যার কথার জোর যত বেশি, যার যুক্তি যত ধারালো, তার সফল হওয়ার সম্ভাবনাও তত। সোজা কথায়, বাগ্মিতা বা কথা বলার শিল্প (Art of Speaking) হয়ে উঠেছে ক্ষমতার অন্যতম চাবিকাঠি।
ঠিক এমন এক সময়ে এথেন্সের রাস্তায়, বাজারের প্রাণকেন্দ্র আগোরায় (Agora), বা অভিজাতদের বাড়ির উঠোনে কিছু জ্ঞানী লোকের আনাগোনা শুরু হলো। তাঁরা দূর-দূরান্ত থেকে এসেছেন—সিসিলি, থ্রেস, অ্যাবডেরা থেকে। দেখতে সুদর্শন, কথা বলেন গুছিয়ে, আর তাঁদের যুক্তির সামনে দাঁড়ানো বড়ই কঠিন। তাঁরা পয়সার বিনিময়ে তরুণদের শেখাচ্ছেন কীভাবে কথা বলতে হয়, কীভাবে বিতর্ক জিততে হয়, আর কীভাবে সমাজে প্রভাবশালী হওয়া যায়। এই জ্ঞানপিপাসু, ভ্রাম্যমাণ শিক্ষকদেরই বলা হতো সফিস্ট (Sophist)।
কিন্তু এই সফিস্টরা কারা ছিলেন? তাঁরা কি শুধুই বাক্যবাগীশ, টাকার বিনিময়ে জ্ঞান ফেরি করা চালাক লোক? আধুনিক কনসালট্যান্ট বা পাবলিক স্পিকিং কোচের প্রাচীন সংস্করণ? নাকি তাঁরা ছিলেন তাঁদের সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা বিপ্লবী চিন্তাবিদ, যারা সমাজের প্রতিষ্ঠিত সব ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছিলেন? প্লেটো (Plato) বা তাঁর শিষ্য অ্যারিস্টটলের (Aristotle) মতো দার্শনিকরা সফিস্টদের দু’চোখে দেখতে পারতেন না। তাঁদের চোখে সফিস্টরা ছিলেন সত্যের শত্রু, যারা কেবল জয়ের জন্য যুক্তি তৈরি করে, সত্যের জন্য নয়। তাঁদের দর্শন যেন এক চোরাবালি, যেখানে সত্য, ন্যায়, নৈতিকতা—সবকিছুই আপেক্ষিকতার অতল গহ্বরে হারিয়ে যায়।
কিন্তু আসলেই কি তাই? ইতিহাস সব সময় বিজয়ীর হাতে লেখা হয়। আর দর্শনের ইতিহাসে বিজয়ী ছিলেন প্লেটো। তাই সফিস্টদের আমরা বহু শতাব্দী ধরে প্লেটোর চোখ দিয়েই দেখে এসেছি। চলুন, আজ সেই চশমাটা একটু খুলে রেখে, এই রহস্যময় সফিস্টদের জগতে সরাসরি প্রবেশ করি। তাদের দর্শনটা ঠিক কী ছিল, তা গভীরে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করা যাক। বিষয়গুলো একটু জটিল, কিন্তু আমরা ধীরে ধীরে এগোব। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে গল্পটা শুনতে পারেন, কারণ এটা কেবল দর্শনের নীরস আলোচনা নয়, বরং মানুষের চিন্তার ইতিহাসের এক রোমাঞ্চকর অধ্যায়ের গল্প।
কারা ছিলেন এই সফিস্ট? একদল পেশাদার বুদ্ধিজীবী
সফিস্ট শব্দটা এসেছে গ্রিক শব্দ ‘সফোস’ (Sophos) থেকে, যার মানে হলো ‘জ্ঞানী’ বা ‘বিশেষজ্ঞ’। শুরুর দিকে হোমার বা হেসিয়ডের মতো কবিদের, কিংবা গ্রীসের সাত জ্ঞানী ব্যক্তিকে (Seven Sages of Greece) ‘সফিস্ট’ বলা হতো, যা ছিল একটি সম্মানজনক উপাধি। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে এই শব্দটি একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর ভ্রাম্যমাণ শিক্ষকদের বোঝাতে ব্যবহৃত হতে শুরু করে, যারা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে জ্ঞান বিতরণ করতেন।
তাঁরা ছিলেন এক অর্থে প্রাচীন গ্রীসের প্রথম পেশাদার বুদ্ধিজীবী। তাঁরা জ্ঞানের বিনিময়ে ফি (Fee) নিতেন, যা তৎকালীন অনেক অভিজাত গ্রীকের কাছে ছিল এক নতুন এবং কিছুটা আপত্তিকর ধারণা। অভিজাতদের কাছে জ্ঞানচর্চা ছিল অবসরের (Leisure বা গ্রিক ভাষায় Schole, যেখান থেকে ‘School’ শব্দটি এসেছে) কাজ, যা অর্থ উপার্জনের জন্য নয়। প্লেটোর মতো দার্শনিকদের মতে, জ্ঞান হলো পবিত্র, তা বিক্রি করার জিনিস নয়। বন্ধুত্ব যেমন টাকায় কেনা যায় না, জ্ঞানও তেমন। কিন্তু সফিস্টরা মনে করতেন, তাঁরা যে মূল্যবান দক্ষতা (Arete বা Excellence) দিচ্ছেন, তার জন্য পারিশ্রমিক নেওয়াই যুক্তিযুক্ত। এই বিতর্কটা আজও কিন্তু রয়ে গেছে, তাই না? শিক্ষা কি সেবা, নাকি পণ্য? ভালো শিক্ষক কি তাঁর জ্ঞানের জন্য পারিশ্রমিক দাবি করতে পারেন না?
সফিস্টদের প্রথম প্রজন্মকে বলা হয় ‘Older Sophists’। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত কয়েকজন হলেন:
-
প্রোটাগোরাস (Protagoras) (আনু. ৪৯০-৪২০ খ্রিস্টপূর্ব): অ্যাবডেরা থেকে আগত এই চিন্তাবিদকে প্রায়শই প্রথম এবং সর্বশ্রেষ্ঠ সফিস্ট বলা হয়। তিনি ছিলেন অসামান্য প্রতিভার অধিকারী এবং তাঁর খ্যাতি এতটাই ছড়িয়ে পড়েছিল যে পেরিক্লিসের মতো রাষ্ট্রনায়কও তাঁর পরামর্শ নিতেন।
-
গোর্গিয়াস (Gorgias) (আনু. ৪৮৫-৩৮০ খ্রিস্টপূর্ব): সিসিলির লিওনটিনি থেকে আসা এক রহস্যময় যুক্তিবাদী। তিনি ছিলেন একজন অতুলনীয় অলঙ্কারবিদ (Orator)। তাঁর কথা শুনলে মনে হতো বাস্তবতাই বুঝি একটা ভ্রম। তিনি প্রায় একশ বছর বেঁচেছিলেন এবং তাঁর দীর্ঘ জীবনে প্রচুর সম্পদ ও সম্মান অর্জন করেছিলেন।
-
হিপ্পিয়াস (Hippias) (আনু. ৪৫৫ খ্রিস্টপূর্বের পর): এলিস শহরের এই সফিস্ট ছিলেন একজন সত্যিকারের বহুশাস্ত্রজ্ঞ বা পলিম্যাথ (Polymath)। বলা হয়, এমন কোনো বিষয় ছিল না যা নিয়ে তিনি কথা বলতে পারতেন না—গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, সঙ্গীত, কবিতা, ইতিহাস, ভাস্কর্য—সবকিছুতেই তাঁর জ্ঞান ছিল। প্লেটো তাঁকে কিছুটা ব্যঙ্গ করে অহংকারী হিসেবে চিত্রিত করলেও, তাঁর জ্ঞানের পরিধি ছিল বিশাল। কথিত আছে, তিনি একবার অলিম্পিকে এমন পোশাকে হাজির হয়েছিলেন যার সবকিছু—পোশাক, জুতো, আংটি—তিনি নিজের হাতে তৈরি করেছিলেন। এর মাধ্যমে তিনি হয়তো ‘আত্মনির্ভরশীলতা’র (Self-sufficiency বা Autarkeia) এক বার্তা দিতে চেয়েছিলেন।
-
প্রোডিকাস (Prodicus) (আনু. ৪৬৫-৩৯৫ খ্রিস্টপূর্ব): সিওস দ্বীপের এই সফিস্ট ছিলেন শব্দের অর্থের প্রতি বিশেষভাবে মনোযোগী। তাঁর বিশেষত্ব ছিল orthoepeia বা শব্দের সঠিক ব্যবহার। তিনি সমার্থক মনে হওয়া শব্দগুলোর মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য নিরূপণ করতেন, অনেকটা আজকের শব্দার্থতত্ত্ববিদের (Semanticist) মতো। যেমন, তিনি ‘আনন্দ’ (Enjoyment) এবং ‘সুখ’ (Pleasure)-এর মধ্যে পার্থক্য করতেন। তাঁর মতে, আনন্দ আসে সৎ কাজ থেকে এবং তা আত্মার জন্য উপকারী, অন্যদিকে সুখ আসে শারীরিক ভোগ থেকে এবং তা ক্ষণস্থায়ী। তাঁর বিখ্যাত রূপক কাহিনী ‘হেরাকলসের পছন্দ’ (The Choice of Heracles)-এ তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে তরুণ হেরাকলসকে ‘গুণ’ (Virtue) এবং ‘পাপ’ (Vice) নামক দুই নারীর মধ্যে যেকোনো একটি পথ বেছে নিতে হয়েছিল। এই কাহিনীটি নৈতিক শিক্ষার এক ক্লাসিক উদাহরণ হয়ে ওঠে।
তাঁদের মূল বিচরণক্ষেত্র ছিল এথেন্স, কারণ সেখানকার গণতান্ত্রিক পরিবেশ এবং নতুন ধনী বণিক শ্রেণির উত্থান তাঁদের পেশার জন্য ছিল উর্বর জমির মতো। তরুণ অভিজাতরা সমাজে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের জন্য উন্মুখ ছিল, আর সফিস্টরা তাঁদের সেই সাফল্যের চাবিকাঠি সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
যে মাটিতে জন্ম নিলো সফিস্টদের দর্শন
যেকোনো নতুন চিন্তার জন্ম শূন্য থেকে হয় না। একটি বীজ থেকে চারা গজানোর জন্য যেমন উর্বর মাটি, আলো, বাতাস আর জলের প্রয়োজন হয়, ঠিক তেমনি একটি নতুন দর্শনের জন্ম হতেও লাগে একটি বিশেষ সময়, একটি বিশেষ সমাজ আর পূর্ববর্তী চিন্তার এক মজবুত ভিত্তি। সফিস্টদের দর্শন—সেই যে সত্যকে আপেক্ষিক বলা, আইনকে মানুষের তৈরি প্রথা বলা, আর যুক্তির মারপ্যাঁচে সবকিছুকে প্রশ্নের মুখে ফেলা—তা হঠাৎ করে আকাশ থেকে পড়েনি। এর পেছনে ছিল প্রাচীন এথেন্সের উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতি আর তার আগের দার্শনিকদের রেখে যাওয়া কিছু অমীমাংসিত প্রশ্ন।
চলুন, সেই সময়ের গ্রীসে আরেকবার ডুব দেওয়া যাক। এবার আমরা সফিস্টদের দিকে সরাসরি না তাকিয়ে, তাঁদের চারপাশের পৃথিবীর দিকে তাকাবো। দেখব, কোন রাজনৈতিক ঝড় তাঁদের চিন্তাকে উসকে দিয়েছিল আর কোন দার্শনিক উত্তরাধিকার তাঁদের হাতে এসে পড়েছিল। এই গল্পটা বুঝতে পারলে, সফিস্টরা কেন এমন অদ্ভুত আর বিপ্লবী কথা বলতে শুরু করলেন, তা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে।
রাজনৈতিক মাটি—গণতন্ত্র, যুদ্ধ এবং সাম্রাজ্য
খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর এথেন্স ছিল এক কথায় এক পরীক্ষাগার। সেখানে এমন কিছু ঘটছিল যা পৃথিবীর ইতিহাসে আগে কেউ দেখেনি। এই রাজনৈতিক পরীক্ষাই ছিল সফিস্টদের বেড়ে ওঠার প্রধান নার্সারি।
গণতন্ত্রের জয়গান এবং বাগ্মিতার উত্থান
ভাবুন তো একবার, আপনার শহরের সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে এক বিশাল গণপরিষদে, যার নাম ‘একেক্লেসিয়া’ (Ekklesia) বা অ্যাসেম্বলি। সেখানে হাজার হাজার সাধারণ নাগরিক উপস্থিত। যেকোনো আইন পাশ করতে হলে বা যুদ্ধের ঘোষণা দিতে হলে, সেখানে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন আদায় করতে হয়। আবার ধরুন, আপনার প্রতিবেশীর সঙ্গে জমি নিয়ে বিরোধ বেধেছে। আপনাকে যেতে হবে আদালতে বা ‘ডিকাস্টেরিয়া’তে (Dikasteria), যেখানে শত শত জুরি (Juror) আপনার কথা শুনবে। সেখানে কোনো পেশাদার আইনজীবী নেই, নিজের মামলা নিজেকেই লড়তে হবে।
এটাই ছিল এথেন্সের র্যাডিক্যাল গণতন্ত্রের (Radical Democracy) বাস্তবতা। ক্ষমতা আর অভিজাত বংশের হাতে সীমাবদ্ধ নেই, ক্ষমতা এখন ছড়িয়ে পড়েছে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে। কিন্তু এই ক্ষমতা প্রয়োগের হাতিয়ার কী? টাকা? বংশমর্যাদা? না। প্রধান হাতিয়ার হলো ‘লোগোস’ (Logos) বা কথা—যুক্তি দিয়ে, আবেগ দিয়ে মানুষকে বোঝানোর ক্ষমতা। যার কথা যত সুন্দর, যত গোছানো, যত প্রভাবশালী, তারই জয়। একজন সাধারণ কিন্তু বাগ্মী লোক একজন ধনী কিন্তু তোতলা অভিজাতকে হারিয়ে দিতে পারত (Hansen, 1999)।
এই পরিস্থিতিতে কীসের চাহিদা তৈরি হবে? অবশ্যই কথা বলার প্রশিক্ষকের! সফিস্টরা ঠিক এই চাহিদাটাই পূরণ করতে এসেছিলেন। তাঁরা ছিলেন সেই সময়ের পাবলিক স্পিকিং কোচ, রাজনৈতিক পরামর্শদাতা এবং আইনজীবী। তাঁরা তরুণদের শেখাতেন কীভাবে অলঙ্কারশাস্ত্র (Rhetoric) ব্যবহার করে গণপরিষদে নিজের পক্ষে জনমত তৈরি করতে হয়, কীভাবে আদালতে জুরিদের মন গলিয়ে মামলা জিততে হয়। তাঁদের শিক্ষা ছিল পুরোপুরি ব্যাবহার বা প্রয়োগমুখী। তাই তাঁদের দর্শনে মহাবিশ্বের মূল উপাদানের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল—কোন যুক্তিতে কাজ হবে? কোন কথায় মানুষ প্রভাবিত হবে? সত্য কী, তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল—কোনটাকে ‘সত্য’ বলে প্রতিষ্ঠা করা যাবে? গণতন্ত্রের এই ব্যবহারিক দিকটাই সফিস্টদের আপেক্ষিকতাবাদের দিকে ঠেলে দিয়েছিল।
পারস্য যুদ্ধ এবং সাম্রাজ্যের অভিজ্ঞতা
খ্রিস্টপূর্ব ৪৯০ থেকে ৪৭৯ সাল পর্যন্ত গ্রীস এক ভয়াবহ অগ্নিপরীক্ষার মধ্যে দিয়ে গিয়েছিল—পারস্য সাম্রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধ। ম্যারাথন, থার্মোপাইলি, সালামিসের মতো যুদ্ধগুলোতে বিশাল পারস্য বাহিনীকে হারিয়ে দেওয়ার পর এথেন্সের আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে ওঠে। তারা নিজেদের সংস্কৃতি, নিজেদের শাসনব্যবস্থাকে শ্রেষ্ঠ ভাবতে শুরু করে।
এই যুদ্ধের পর এথেন্স ডেলিয়ান লীগ (Delian League) নামে একটি সামরিক জোট গঠন করে, যা ধীরে ধীরে এথেনীয় সাম্রাজ্যে (Athenian Empire) পরিণত হয়। এথেন্স হয়ে ওঠে গ্রিক বিশ্বের বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। দূর-দূরান্ত থেকে বণিক, নাবিক, শিল্পী, আর সফিস্টদের মতো চিন্তাবিদরা এথেন্সে আসতে শুরু করেন।
এই সাম্রাজ্য আর বহু সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসাটা সফিস্টদের চিন্তায় এক বিরাট প্রভাব ফেলেছিল। এথেন্সের একজন নাগরিক দেখত যে, তাদের সমাজে যা নৈতিক বলে মানা হয় (যেমন: গণতন্ত্র), স্পার্টায় হয়তো ঠিক তার উল্টোটা (অভিজাততন্ত্র) মানা হয়। আবার পারস্য বা মিশরের রীতিনীতি তো আরও ভিন্ন। হেরোডোটাসের (Herodotus) মতো ঐতিহাসিকরা তখন বিভিন্ন জাতির অদ্ভুত সব প্রথার কথা লিখছিলেন—কোথাও মৃতদেহকে পোড়ানো হয়, কোথাও কবর দেওয়া হয়, আবার কোথাও খেয়ে ফেলা হয়!
এই অভিজ্ঞতা থেকে একটা প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে: তাহলে আসল ‘সঠিক’ প্রথা কোনটি? আমাদের আইন ও নৈতিকতা (যাকে গ্রিকরা বলত ‘নোমোস’ বা Nomos) কি প্রকৃতির মতো সার্বজনীন (Physis)? নাকি এটা শুধুই অভ্যাস বা স্থানীয় চুক্তি বা সামাজিক রীতি? সফিস্টরা এই প্রশ্নটিই লুফে নিয়েছিলেন। তাঁরা সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, আইন বা নৈতিকতার কোনো পরম ভিত্তি নেই, এগুলো সবই মানুষের তৈরি প্রথা। এই ‘ফিসিস বনাম নোমোস’ (Physis vs. Nomos) বিতর্কটি ছিল সরাসরি তৎকালীন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতার ফসল (Guthrie, 1971)।
দার্শনিক উত্তরাধিকার—যুক্তি যখন পথ হারায়
সফিস্টরা যখন এলেন, তার আগে প্রায় দেড়শ বছর ধরে গ্রিক দার্শনিকরা জগৎ আর জীবনের কিছু মৌলিক প্রশ্ন নিয়ে তোলপাড় করে ফেলেছেন। এই পূর্ববর্তী দার্শনিকদের বলা হয় প্রাক-সক্রেটীয় (Pre-Socratic) চিন্তাবিদ। তাঁদের রেখে যাওয়া কিছু অমীমাংসিত প্রশ্ন আর বিতর্কই সফিস্টদের জন্য নতুন পথ খুলে দিয়েছিল।
মহাবিশ্বের রহস্যভেদ করতে গিয়ে বিভেদ
প্রথম দিকের দার্শনিকরা, যেমন থেলিস (Thales), অ্যানাক্সিম্যান্ডার (Anaximander) বা অ্যানাক্সিমিনিস (Anaximenes), মূলত কসমোলজিস্ট (Cosmologist) ছিলেন। তাঁরা জানতে চেয়েছিলেন, এই বিশাল জগতের মূল উপাদান বা ‘আর্কি’ (Arche) কী? থেলিস বললেন, সবকিছু জল দিয়ে তৈরি। অ্যানাক্সিমিনিস বললেন, বাতাস। হেরাক্লিটাস (Heraclitus) বললেন, আগুন।
হেরাক্লিটাসের দর্শন ছিল বিশেষভাবে প্রভাবশালী। তিনি বলেছিলেন, “সবকিছুই প্রবহমান” (Panta rhei)। জগতে স্থায়ী বলে কিছু নেই, সবকিছুই অনবরত বদলাচ্ছে। “একই নদীতে দুবার পা রাখা যায় না,” কারণ দ্বিতীয়বার নামার আগেই নদী এবং আপনি দুজনেই বদলে গেছেন। এই যে চিরন্তন পরিবর্তনের ধারণা, এটা সফিস্টদের আপেক্ষিকতাবাদের সঙ্গে খুব ভালোভাবে খাপ খেয়ে যায়। যদি সবকিছুই বদলায়, তাহলে কোনো চিরস্থায়ী বা পরম সত্য (Absolute Truth) থাকবে কীভাবে? প্রোটাগোরাসের দর্শনে আমরা হেরাক্লিটাসের এই চিন্তারই এক মানবকেন্দ্রিক রূপ দেখতে পাই (Kirk, Raven, & Schofield, 1983)।
পারমেনাইডিসের ভয়ংকর যুক্তি: যা আছে, তা আছেই
হেরাক্লিটাসের ঠিক উল্টো দিকে দাঁড়িয়েছিলেন আরেক প্রভাবশালী দার্শনিক, পারমেনাইডিস (Parmenides)। তিনি ছিলেন এলিয়া (Elea) নামক শহরের লোক, তাই তাঁর দর্শনকে বলা হয় এলিয়াটিক দর্শন (Eleatic School)। তিনি যুক্তির ওপর ভিত্তি করে এক ভয়ংকর সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন। তিনি বলেছিলেন:
“যা আছে (What is), তা আছে। যা নেই (What is not), তা নেই।”
কথাটা শুনতে খুব সহজ মনে হলেও এর ভেতর থেকে তিনি দেখালেন যে, ‘যা আছে’ বা ‘সত্তা’ (Being) তা অখণ্ড, চিরন্তন, অপরিবর্তনীয় এবং গতিহীন। কারণ, যদি কোনো পরিবর্তন বা গতি থাকত, তাহলে বস্তুকে এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় যেতে হতো, অর্থাৎ ‘যা নেই’ সেই অবস্থায় যেতে হতো, যা অসম্ভব। আর আমাদের ইন্দ্রিয় (Senses) যে আমাদের চারদিকে নানা বস্তু আর পরিবর্তন দেখায়, তা আসলে একটা ভ্রম বা মায়া। একমাত্র বিশুদ্ধ যুক্তিই (Pure Reason) সত্যকে জানতে পারে।
পারমেনাইডিসের এই দর্শন গ্রিক চিন্তাজগতে এক বিরাট সংকট তৈরি করল। একদিকে আমাদের সাধারণ অভিজ্ঞতা বলছে জগৎ পরিবর্তনশীল ও বহুমাত্রিক। অন্যদিকে পারমেনাইডিসের অকাট্য যুক্তি বলছে জগৎ এক ও অপরিবর্তনীয়। তাহলে কোনটা ঠিক? (Barnes, 1982)।
তাঁর শিষ্য জেনো (Zeno of Elea) কিছু বিখ্যাত কূটাভাস বা প্যারাডক্স (Paradox) তৈরি করে দেখালেন যে, গতি বা বহুত্বকে যৌক্তিকভাবে প্রমাণ করা যায় না। তাঁর বিখ্যাত ‘অ্যাকিলিস ও কচ্ছপ’ প্যারাডক্সে তিনি দেখান যে, দৌড়ে দ্রুতগামী অ্যাকিলিস কখনোই কচ্ছপকে ধরতে পারবে না, কারণ তাকে সবসময় কচ্ছপের ছেড়ে যাওয়া অসীম সংখ্যক বিন্দু পার হতে হবে।
এই এলিয়াটিক চ্যালেঞ্জের পর দার্শনিকদের সামনে দুটি পথ খোলা ছিল: হয় পারমেনাইডিসকে ভুল প্রমাণ করা, অথবা তাঁর সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়ে নতুন কোনো ব্যাখ্যা খোঁজা।
সংকটের প্রতিক্রিয়া এবং সফিস্টদের উত্থান
পারমেনাইডিসের যুক্তির পর গ্রিক দর্শন একরকম পথ হারিয়ে ফেলেছিল। এই সংকট থেকে তিনটি প্রধান ধারার জন্ম হয়:
-
বহুত্ববাদী (pluralists): এম্পেডোক্লিস (Empedocles) এবং অ্যানাক্সাগোরাস (Anaxagoras) এর মতো দার্শনিকরা পারমেনাইডিসের যুক্তির কিছু অংশ মেনে নিলেন। তাঁরা বললেন, হ্যাঁ, শূন্য থেকে কিছু সৃষ্টি বা ধ্বংস হয় না। কিন্তু জগৎ এক নয়, বহু উপাদান (যেমন: মাটি, জল, আগুন, বাতাস) দিয়ে তৈরি, যেগুলো ভালোবাসা (Love) আর ঘৃণা (Strife) নামক শক্তির মাধ্যমে মেশে আর আলাদা হয়। এইভাবেই পরিবর্তন ঘটে।
-
পরমাণুবাদী (Atomists): লিউসিপ্পাস (Leucippus) এবং ডেমোক্রিটাস (Democritus) আরও এক ধাপ এগিয়ে বললেন, জগৎ অসংখ্য অবিভাজ্য কণা বা ‘পরমাণু’ (Atom) এবং শূন্যস্থান (Void) দিয়ে গঠিত। এই পরমাণুরা শূন্যস্থানে ঘুরতে ঘুরতে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে জগতের সব বস্তু তৈরি করে।
-
সফিস্ট (Sophists): সফিস্টরা এই সব বিতর্ক দেখে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি পথ বেছে নিলেন। তাঁরা ভাবলেন, জগতের মূল উপাদান কী—তা নিয়ে দেড়শ বছর ধরে দার্শনিকরা ঝগড়া করে কোনো সমাধানে আসতে পারেননি। কেউ বলছেন জগৎ এক, কেউ বলছেন বহু। কেউ বলছেন সব জল, কেউ বলছেন আগুন। কেউ বলছেন ইন্দ্রিয়ই সব, কেউ বলছেন ইন্দ্রিয় একটা ভ্রম।
এই অবস্থায় গোর্গিয়াসের (Gorgias) মতো সফিস্টরা বললেন, এই পুরো অনুসন্ধানটাই আসলে অর্থহীন। আমরা হয়তো কখনোই জগতের আসল রূপ জানতে পারব না। পারমেনাইডিসের যুক্তি যদি ঠিক হয়, তাহলে আমাদের ইন্দ্রিয় ভুল। আর যদি ইন্দ্রিয় ঠিক হয়, তাহলে পারমেনাইডিসের যুক্তি ভুল। এই দার্শনিক বিতর্কের কোনো সমাধান নেই। তাই, বাইরের জগৎ নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে, চলো ভেতরের জগৎ, অর্থাৎ মানুষকে নিয়ে ভাবা যাক (Kerferd, 1981)।
এইভাবেই সফিস্টরা মহাবিশ্বের আলোচনা (Cosmology) থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে এলেন মানবকেন্দ্রিক আলোচনায়। প্রোটাগোরাস বললেন, যেহেতু পরম সত্যকে জানা সম্ভব নয়, তাহলে “মানুষই সবকিছুর মাপকাঠি”। আমার কাছে যা সত্য মনে হচ্ছে, সেটাই আমার জন্য সত্য। আপনার কাছে যা সত্য, সেটাই আপনার জন্য। এই আপেক্ষিকতাবাদ ছিল পূর্ববর্তী দার্শনিকদের অমীমাংসিত বিতর্কের একটি যৌক্তিক পরিণতি।
নিখুঁত ঝড়ের ফসল
তাহলে দেখা যাচ্ছে, সফিস্টরা ছিলেন এক ‘নিখুঁত ঝড়ের’ (Perfect Storm) ফসল। একদিকে এথেন্সের গণতন্ত্র তৈরি করেছিল বাগ্মিতা আর ব্যবহারিক জ্ঞানের এক বিশাল চাহিদা। অন্যদিকে, পারস্য যুদ্ধ ও সাম্রাজ্যবাদ জন্ম দিয়েছিল বহুত্ববাদী চেতনার এবং আইন ও নৈতিকতা নিয়ে গভীর প্রশ্নের। এই উর্বর রাজনৈতিক মাটিতে, পূর্ববর্তী দার্শনিকদের রেখে যাওয়া অমীমাংসিত বিতর্কের বীজগুলো এক নতুন রূপে অঙ্কুরিত হলো।
হেরাক্লিটাসের ‘সবকিছু পরিবর্তনশীল’ তত্ত্ব, পারমেনাইডিসের যুক্তির তৈরি করা সংকট, আর বিভিন্ন দার্শনিকের মধ্যে মতের অমিল—এই সবকিছু মিলিয়ে সফিস্টদের এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সাহায্য করেছিল যে, পরম সত্যের সন্ধান একটি নিষ্ফল প্রচেষ্টা। তার চেয়ে বরং মানুষের জগৎ, তার আইন, তার ভাষা আর তার সাফল্য নিয়েই ভাবা ভালো।
তাঁরা হয়তো অনেক প্রশ্নের চূড়ান্ত উত্তর দেননি, কিন্তু তাঁরা সঠিক প্রশ্নগুলো করতে পেরেছিলেন। আর সেই প্রশ্নগুলো এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, তার জবাব দিতে গিয়েই সক্রেটিস, প্লেটো আর অ্যারিস্টটলের মতো মহীরুহদের জন্ম হয়েছিল। সফিস্টরা না এলে হয়তো পশ্চিমা দর্শনের ইতিহাস সম্পূর্ণ অন্য খাতে বইত। তাঁরা ছিলেন সেই ঝাঁকুনি, যা ঘুমন্ত গ্রিক চিন্তাজগৎকে জাগিয়ে তুলেছিল এক নতুন ও আরও গভীর আত্মানুসন্ধানের পথে।
দর্শনের মোড় ঘোরানো: জগৎ থেকে মানুষের দিকে
সফিস্টদের আসার আগে গ্রিক দার্শনিকদের মূল আগ্রহের বিষয় ছিল মহাবিশ্ব। থেলিস, অ্যানাক্সিম্যান্ডার বা হেরাক্লিটাসের মতো প্রাক-সক্রেটীয় (Pre-Socratic) দার্শনিকরা ভাবতেন—এই জগৎ কী দিয়ে তৈরি? এর মূল উপাদান বা আর্কি (Arche) কী? সবকিছু কি জল থেকে এসেছে, নাকি আগুন থেকে, নাকি বায়ু থেকে? জগতের পরিবর্তন কীভাবে হয়? এই প্রশ্নগুলোকে বলা হয় বিশ্বতত্ত্ব বা কসমোলজি (Cosmology)।
সফিস্টরা এসে এই পুরো খেলার মোড় ঘুরিয়ে দিলেন। তাঁরা বললেন, “আকাশের তাঁরা বা জগতের মূল উপাদান নিয়ে ভেবে কী হবে, যদি আমরা নিজেদেরই না জানি? আগে মানুষকে নিয়ে ভাবা যাক।” তাঁদের দর্শনের কেন্দ্রে ছিল মানুষ এবং তার সমাজ। মানুষের জ্ঞান, তার ভাষা, তার আইন, তার নৈতিকতা—এগুলোই ছিল তাঁদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। এই যে জগৎ থেকে মানুষের দিকে দর্শনের ফোকাস ঘোরানো, একেই বলা হয় মানবকেন্দ্রিক বাঁক বা Anthropocentric Turn। আর এই বাঁকের পথিকৃৎ ছিলেন সফিস্টরা (Guthrie, 1971)। তাঁরাই প্রথম রাষ্ট্রবিজ্ঞান (Political Science), নীতিশাস্ত্র (Ethics) এবং ভাষাতত্ত্বের (Linguistics) মতো মানববিদ্যাগুলোর ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।
প্রোটাগোরাসের সেই বিখ্যাত উক্তি: “মানুষই সবকিছুর মাপকাঠি”
যদি সফিস্টদের দর্শনকে একটা বাক্যে প্রকাশ করতে বলা হয়, তবে সেটি হবে প্রোটাগোরাসের সেই অমর উক্তি—
“Man is the measure of all things, of the things that are, that they are, and of the things that are not, that they are not.”
(মানুষই সকল বস্তুর পরিমাপক; যা আছে, তা যে আছে তার, এবং যা নেই, তা যে নেই তার।)
কথাটা শুনতে সহজ মনে হলেও এর ভেতর লুকিয়ে আছে এক গভীর এবং বিপ্লবী দর্শন। এই দর্শনকে বলা হয় আপেক্ষিকতাবাদ (Relativism)। চলুন, একটু ভেঙে বোঝা যাক।
ধরুন, বাইরে বাতাস বইছে। আমার গায়ে বাতাস লেগে ঠান্ডা লাগছে। আমি বললাম, “বাতাসটা ঠান্ডা।” আপনার হয়তো গরম লাগছে, তাই আপনি বললেন, “বাতাসটা তো বেশ আরামদায়ক, মোটেই ঠান্ডা নয়।”
এখন প্রশ্ন হলো, বাতাসটা আসলে কী? ঠান্ডা, নাকি আরামদায়ক? প্রোটাগোরাস বলবেন, দুজনের কথাই ঠিক। আমার কাছে যেহেতু ঠান্ডা লাগছে, তাই আমার জন্য ‘সত্য’ হলো বাতাসটি ঠান্ডা। আপনার কাছে যেহেতু আরামদায়ক লাগছে, তাই আপনার জন্য ‘সত্য’ হলো বাতাসটি আরামদায়ক। কোনো পরম বা চূড়ান্ত সত্য (Absolute Truth) বলে কিছু নেই যা আমাদের ব্যক্তিগত উপলব্ধি থেকে স্বাধীন। সত্য সবসময়ই ব্যক্তি-সাপেক্ষ (Subjective)।
এই ‘মানুষ’ শব্দটি দিয়ে প্রোটাগোরাস কি একজন ব্যক্তি-মানুষকে বুঝিয়েছেন, নাকি সমগ্র মানবজাতিকে? এ নিয়ে বিতর্ক আছে। যদি তিনি ব্যক্তি-মানুষকে বুঝিয়ে থাকেন, তবে এটি চরম ব্যক্তি-আপেক্ষিকতাবাদ (Individual Relativism)। আর যদি তিনি মানবজাতিকে বুঝিয়ে থাকেন, তবে এটি প্রজাতি-আপেক্ষিকতাবাদ (Species Relativism), অর্থাৎ, আমরা জগৎকে মানুষের চোখ দিয়েই দেখি, অন্য কোনো প্রাণীর মতো করে নয়। তবে বেশিরভাগ ব্যাখ্যাকার মনে করেন, প্রোটাগোরাস ব্যক্তি-আপেক্ষিকতাবাদের কথাই বলছিলেন (Plato, Theaetetus, 152a)।
এই ধারণাটা সে সময়ের জন্য ছিল অভাবনীয়। কারণ তৎকালীন গ্রিক সমাজে—বিশেষ করে প্লেটোর দর্শনে—বলা হতো যে, সত্য এক এবং অপরিবর্তনীয়। ন্যায়, সৌন্দর্য বা ভালোর (Goodness) একটি চিরন্তন রূপ বা আকার (Form) আছে, যা ব্যক্তি বা সমাজের ঊর্ধ্বে। প্রোটাগোরাস সেই ধারণার গোড়ায় কুঠার মেরে বসলেন। তিনি বললেন, কোনো কিছুই নিজে থেকে ভালো বা মন্দ, ন্যায় বা অন্যায় নয়। যা আমার কাছে ভালো মনে হয়, সেটাই আমার জন্য ভালো। যা একটি সমাজের কাছে ন্যায় বলে গৃহীত, সেটাই সেই সমাজের জন্য ন্যায়।
এর মানে দাঁড়ায়, এক সমাজে যা নৈতিক, অন্য সমাজে তা অনৈতিক হতে পারে। যেমন, কোনো সমাজে হয়তো বহুবিবাহ নৈতিক, আবার কোনো সমাজে তা গুরুতর অপরাধ। প্রোটাগোরাসের মতে, কোনো সমাজই অন্যের ওপর নিজের নৈতিকতার মাপকাঠি চাপিয়ে দিতে পারে না, কারণ কোনো পরম মাপকাঠিই নেই।
প্লেটো এই ধারণার ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি মনে করতেন, এমনটা হলে তো জ্ঞান এবং নৈতিকতার কোনো ভিত্তিই থাকে না। যে যা খুশি তাই ভাবতে পারে এবং সেটাই তার জন্য ‘সত্য’ হয়ে যাবে। একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আর একজন সাধারণ মানুষের মতামতের মধ্যে তো কোনো পার্থক্যই থাকবে না! এটা তো এক ধরনের জ্ঞানভিত্তিক নৈরাজ্য (Epistemological Anarchy)!
কিন্তু প্রোটাগোরাস হয়তো এতটা চরমপন্থী ছিলেন না। তিনি বলতেন না যে সব মতামতই সমানভাবে ‘ভালো’। তিনি বলতেন, যদিও কোনো মতামতই ‘মিথ্যা’ নয়, তবে কিছু মতামত অন্যগুলোর চেয়ে ‘উত্তম’ (better) বা ‘বেশি উপকারী’ (more useful) হতে পারে। যেমন, অসুস্থ ব্যক্তির কাছে খাবার তেতো লাগে, আর সুস্থ ব্যক্তির কাছে সুস্বাদু। দুজনের উপলব্ধিই তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে ‘সত্য’। কিন্তু সুস্থ ব্যক্তির অবস্থাটা অসুস্থ ব্যক্তির অবস্থার চেয়ে উত্তম। তাই চিকিৎসকের কাজ হলো রোগীর অবস্থাকে পরিবর্তন করে দেওয়া, যাতে তার কাছেও খাবার সুস্বাদু মনে হয়। একইভাবে, সফিস্টের কাজ হলো একজন ব্যক্তির বা একটি রাষ্ট্রের ‘খারাপ’ অবস্থাকে (যেখানে তাদের কাছে ক্ষতিকর জিনিস ভালো মনে হচ্ছে) যুক্তির মাধ্যমে পরিবর্তন করে ‘ভালো’ অবস্থায় (যেখানে তাদের কাছে উপকারী জিনিস ভালো মনে হবে) নিয়ে আসা (Plato, Theaetetus, 166d-167b)।
এই ধারণাটি কিন্তু আধুনিক প্র্যাগম্যাটিজম বা প্রয়োগবাদের খুব কাছাকাছি, যেখানে একটি ধারণার সত্যতা তার কার্যকারিতা দিয়ে বিচার করা হয়।
প্রোটাগোরাসের যুক্তির প্যাঁচ নিয়ে একটি কিংবদন্তী প্রচলিত আছে। তিনি নাকি ইউয়াথলাস (Euathlus) নামের এক তরুণকে এই শর্তে আইন শেখাতে রাজি হয়েছিলেন যে, ইউয়াথলাস তার প্রথম মামলায় জিতলে তবেই ফি পরিশোধ করবে। পড়ালেখা শেষে ইউয়াথলাস কোনো মামলা লড়ছিলেন না, ফলে ফি-ও দিচ্ছিলেন না। তখন প্রোটাগোরাস তার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিলেন। আদালতে তিনি যুক্তি দিলেন, “যদি আমি এই মামলায় জিতি, তাহলে আদালতের রায় অনুযায়ী আমি আমার টাকা পাব। আর যদি ইউয়াথলাস জেতে, তাহলে আমাদের চুক্তি অনুযায়ী সে তার প্রথম মামলায় জিতেছে, সুতরাং তখনও সে আমাকে টাকা দিতে বাধ্য। অতএব, যাই ঘটুক, টাকা আমি পাবই।” অন্যদিকে ইউয়াথলাস, তার গুরুর শেখানো বিদ্যা প্রয়োগ করে পাল্টা যুক্তি দিল, “যদি আমি জিতি, তাহলে আদালতের রায় অনুযায়ী আমাকে টাকা দিতে হবে না। আর যদি প্রোটাগোরাস জেতেন, তাহলে চুক্তি অনুযায়ী আমি আমার প্রথম মামলায় হেরে গেছি, সুতরাং আমাকে টাকা দিতে হবে না। অতএব, যাই ঘটুক, আমাকে টাকা দিতে হবে না।” এই বিখ্যাত প্যারাডক্সটি (Paradox of the Court) দেখিয়ে দেয়, সফিস্টরা কীভাবে যুক্তিকে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে যেকোনো পক্ষে ব্যবহার করতে পারতেন।
গোর্গিয়াসের চরম শূন্যবাদ: “কিছুই নেই”
প্রোটাগোরাস যদি আপেক্ষিকতাবাদের দরজা খুলে দেন, তবে গোর্গিয়াস সেই দরজা দিয়ে ঢুকে সবকিছুকে শূন্যে মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। গোর্গিয়াস ছিলেন এক জাদুকরী বক্তা, যাঁর দর্শন ছিল প্রোটাগোরাসের চেয়েও অনেক বেশি র্যাডিক্যাল। তাঁর দর্শনকে বলা হয় শূন্যবাদ (Nihilism) বা চরম সংশয়বাদ (Radical Skepticism)।
তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “অন নেচার, অর অন হোয়াট-ইজ-নট” (On Nature, or On What-Is-Not) -এ তিনি তিনটি ধাপে তাঁর যুক্তি সাজিয়েছিলেন। বইটি এখন আর পাওয়া যায় না, তবে অন্য লেখকদের সূত্রে আমরা তাঁর মূল বক্তব্য জানতে পারি (Sextus Empiricus, Against the Mathematicians, VII. 65-87)।
গোর্গিয়াসের তিনটি প্রতিজ্ঞা ছিল এককথায় বিধ্বংসী:
১. কিছুই অস্তিত্বশীল নয় (Nothing exists): প্রথম ধাপেই তিনি বললেন, এই যে আমরা জগৎ, বস্তু, যা কিছু দেখছি, তার কোনো কিছুরই আসল অস্তিত্ব নেই। তাঁর এই যুক্তি ছিল মূলত পারমেনাইডিস (Parmenides) এবং জেনোর (Zeno) মতো দার্শনিকদের বিরুদ্ধে, যারা মনে করতেন ‘সত্তা’ (Being) হলো এক, চিরন্তন ও অপরিবর্তনীয়। গোর্গিয়াস যুক্তি দেন, যদি কিছুর অস্তিত্ব থাকতেই হয়, তবে তা হয় চিরন্তন অথবা সৃষ্ট। যদি চিরন্তন হয়, তবে তার কোনো শুরু নেই, যা অযৌক্তিক কারণ তাহলে তা অসীম এবং কোথাও অবস্থিত নয়। আবার যদি সৃষ্ট হয়, তবে তা হয় সত্তা থেকে অথবা অসত্তা (Not-Being) থেকে সৃষ্টি হতে হবে। সত্তা থেকে সত্তা সৃষ্টি হতে পারে না কারণ তাহলে তা আগে থেকেই ছিল। আর অসত্তা বা শূন্য থেকে কিছু সৃষ্টি হওয়া অসম্ভব। সুতরাং, কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই। যুক্তিগুলো বেশ জটিল ও প্যাঁচানো, কিন্তু তার মূল উদ্দেশ্য ছিল ‘অস্তিত্ব’ ধারণাটিকেই ভেঙে দেওয়া।
২. যদি কিছুর অস্তিত্ব থাকেও, তাকে জানা সম্ভব নয় (If anything exists, it cannot be known): দ্বিতীয় ধাপে তিনি আরও এক ধাপ এগিয়ে বললেন, আচ্ছা, তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই যে কিছুর অস্তিত্ব আছে, তাহলেও আমরা তাকে জানতে পারব না। কারণ, আমাদের জ্ঞান আসে আমাদের চিন্তা থেকে। কিন্তু আমাদের চিন্তা আর বাইরের বস্তুর মধ্যে কোনো আবশ্যিক সংযোগ নেই। আমি আমার মনে একটি উড়ন্ত ঘোড়া বা স্কাইলা (Scylla) নামের পৌরাণিক দানবের কথা ভাবতে পারি, তার মানে এই নয় যে বাস্তবে তাদের অস্তিত্ব আছে। ঠিক তেমনি, বাইরের কোনো বস্তুর অস্তিত্ব থাকলেও, আমাদের মন যে তাকে সঠিকভাবে জানতে পারবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমাদের জ্ঞান আমাদের মনের ভেতরেই সীমাবদ্ধ, বাস্তবতার সাথে তার কোনো মিল না-ও থাকতে পারে।
৩. যদি তাকে জানাও যায়, তবে তা অন্যকে জানানো সম্ভব নয় (If it can be known, it cannot be communicated): শেষ ধাপে তিনি চূড়ান্ত আঘাত হানলেন। তিনি বললেন, আচ্ছা, ধরলাম কোনো কিছুর অস্তিত্ব আছে এবং কোনোভাবে আমি তা জানতেও পারলাম। কিন্তু সেই জ্ঞান আমি কখনোই আরেকজনকে সঠিকভাবে জানাতে পারব না। কারণ, আমরা যোগাযোগের জন্য কী ব্যবহার করি? শব্দ বা ভাষা (Language)। কিন্তু শব্দ তো আর আসল বস্তু নয়। আমি যখন ‘আপেল’ শব্দটি উচ্চারণ করি, তখন আপনার মনে একটি ধারণা তৈরি হয়। কিন্তু সেই ধারণাটি কি আমার মনের ধারণার সাথে হুবহু এক? আর এই শব্দ বা ধারণাটি কি আসল, রক্ত-মাংসের আপেলটার সমান? কখনোই না। ভাষা বাস্তবতাকে প্রকাশ করতে অক্ষম। এটি একটি চিহ্ন মাত্র, আসল বস্তু নয়। এটা অনেকটা আঙুল দিয়ে চাঁদ দেখানোর মতো; আঙুলটা তো আর চাঁদ নয়। তাই আমাদের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান একান্তই ব্যক্তিগত, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
গোর্গিয়াসের এই তিনটি ধাপ আসলে জ্ঞান, অস্তিত্ব এবং যোগাযোগের সম্ভাবনাকেই পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়। যদি কিছুই না থাকে, বা থাকলেও জানা না যায়, বা গেলেও জানানো না যায়, তাহলে সত্যের সন্ধান করা তো একটা অর্থহীন প্রচেষ্টা। প্লেটোর জন্য এটা ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। কারণ প্লেটোর পুরো দর্শনই দাঁড়িয়ে আছে এই বিশ্বাসের ওপর যে, একটি পরম সত্য জগৎ (World of Forms) আছে, এবং দর্শন বা জ্ঞানের মাধ্যমে সেই জগৎকে জানা সম্ভব। গোর্গিয়াস সেই সম্ভাবনাকেই গোড়া থেকে কেটে দিচ্ছেন (Kerferd, 1981)। তবে গোর্গিয়াস কি সত্যিই একজন শূন্যবাদী ছিলেন? নাকি তিনি কেবল অলঙ্কারশাস্ত্রের শক্তি দেখানোর জন্য এই চরম যুক্তিগুলো তৈরি করেছিলেন, এটা প্রমাণ করার জন্য যে কথার মাধ্যমে যেকোনো কিছুকেই প্রমাণ বা অপ্রমাণ করা যায়? এই রহস্য আজও অমীমাংসিত।
প্রকৃতি বনাম প্রথা (Physis vs. Nomos): আইনের ভিত্তি কী?
সফিস্টদের আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী আলোচনার বিষয় ছিল ‘ফিসিস’ (Physis) এবং ‘নোমোস’ (Nomos) এর মধ্যকার দ্বন্দ্ব। এই দুটি ধারণা বোঝা সফিস্টদের দর্শন বোঝার জন্য অপরিহার্য।
-
ফিসিস (Physis): এর অর্থ হলো প্রকৃতি (Nature)। অর্থাৎ, যা স্বাভাবিক, চিরন্তন এবং মানুষের তৈরি নয়। যেমন, মাধ্যাকর্ষণ একটি প্রাকৃতিক নিয়ম। আগুন সব জায়গাতেই পোড়ায়—এটা ফিসিস। মানুষের ক্ষুধার্ত হওয়া বা মৃত্যু বরণ করাও ফিসিস।
-
নোমোস (Nomos): এর অর্থ হলো প্রথা, আইন বা সামাজিক রীতিনীতি (Convention/Law)। অর্থাৎ, যা মানুষ তার সুবিধার জন্য তৈরি করেছে এবং যা বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন রকম হতে পারে। যেমন, ট্রাফিক আইন, বিয়ের নিয়মকানুন, বা কর দেওয়ার বিধান—এগুলো নোমোস।
সফিস্টরা প্রশ্ন তুলেছিলেন: আমাদের সমাজের আইনকানুন ও নৈতিকতার ভিত্তি কী? এগুলো কি প্রকৃতির মতো অমোঘ এবং সার্বজনীন (Physis)? নাকি এগুলো নিছকই মানুষের তৈরি প্রথা (Nomos), যা দেশ-কাল-পাত্রে বদলে যায়?
বেশিরভাগ সফিস্টই মনে করতেন, আইন ও নৈতিকতা হলো নোমোস, অর্থাৎ মানুষের তৈরি চুক্তি বা কনভেনশন। সফিস্ট অ্যান্টিফোন (Antiphon) এই বিষয়ে খুব পরিষ্কারভাবে লিখেছেন। তাঁর মতে, প্রকৃতির নিয়ম (Physis) ভাঙলে শাস্তি অনিবার্য, কেউ দেখুক বা না দেখুক। আপনি যদি উঁচু জায়গা থেকে লাফ দেন, তাহলে মাধ্যাকর্ষণের নিয়মে আপনি ব্যথা পাবেনই। কিন্তু মানুষের তৈরি আইন (Nomos) ভাঙলে শাস্তি তখনই হবে, যদি কেউ আপনাকে ধরে ফেলে। আপনি যদি গোপনে কোনো অন্যায় করেন এবং কোনো সাক্ষী না থাকে, তাহলে আপনার কোনো শাস্তি হবে না। এর মানে হলো, মানুষের আইন ততটা শক্তিশালী বা সার্বজনীন নয়। অ্যান্টিফোন আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেন যে, অনেক সময় নোমোস বা আইন মেনে চলা প্রকৃতির বিরুদ্ধে যায় এবং তা ব্যক্তির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তিনি এমনকি গ্রিক ও অ-গ্রিক (Barbarian) বিভাজনেরও বিরোধিতা করে বলেন যে, প্রকৃতিগতভাবে সব মানুষ সমান, কারণ আমরা সবাই একই বাতাস থেকে নিঃশ্বাস নিই (Untersteiner, 1954)। এটি ছিল তৎকালীন গ্রিক সমাজের জন্য এক বিপ্লবী ধারণা।
এই ফিসিস-নোমোস বিতর্কের দুটি প্রধান ধারা তৈরি হয়েছিল:
১. রক্ষণশীল ধারা: প্রোটাগোরাসের মতো সফিস্টরা মনে করতেন, যদিও আইনগুলো নোমোস বা মানুষের তৈরি, তবুও সমাজের স্থিতিশীলতার জন্য সেগুলো মেনে চলা উচিত। কারণ এগুলো ছাড়া সমাজে বিশৃঙ্খলা বা মাৎস্যন্যায় দেখা দেবে। আইন হয়তো পরম সত্য নয়, কিন্তু তা সমাজের জন্য উপকারী। এটি একটি সামাজিক চুক্তি (Social Contract) যা সবাইকে মেনে চলতে হবে।
২. বিপ্লবী বা র্যাডিক্যাল ধারা: অন্যদিকে প্লেটোর ডায়ালগে আমরা কিছু সফিস্টকে পাই যারা আরও চরমপন্থী মতামত পোষণ করতেন। প্লেটোর রিপাবলিক গ্রন্থের প্রথম দিকে আমরা থ্রাসিমেকাস (Thrasymachus) নামের এক সফিস্টকে পাই, যিনি রাগত স্বরে ঘোষণা করেন:
“Justice is nothing other than the advantage of the stronger.”
(ন্যায়বিচার আর কিছুই নয়, কেবল শক্তিশালী শাসকের স্বার্থ।)
তাঁর মতে, শাসকরা নিজেদের সুবিধার জন্য আইন তৈরি করে এবং সেটাকেই ‘ন্যায়’ বলে দুর্বলদের ওপর চাপিয়ে দেয়। গণতন্ত্রে সাধারণ মানুষ, অভিজাততন্ত্রে অভিজাতরা, আর স্বৈরতন্ত্রে স্বৈরশাসক—সবাই নিজের স্বার্থে আইন বানায়।
প্লেটোর গোর্গিয়াস ডায়ালগে ক্যালিক্লিস (Callicles) নামের চরিত্রটি (যিনি হয়তো কাল্পনিক, কিন্তু র্যাডিক্যাল সফিস্টদের প্রতিনিধি) আরও ভয়ঙ্কর কথা বলেন। তিনি বলেন, প্রচলিত নৈতিকতা (নোমোস) হলো দুর্বল এবং সংখ্যাগরিষ্ঠদের ষড়যন্ত্র। তারা শক্তিশালী ও প্রতিভাবানদের ভয় পায়, তাই তারা ‘সমতা’ বা ‘ন্যায়বিচার’-এর মতো ধারণা তৈরি করে সবলদেরকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখতে চায়। কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম (ফিসিস) হলো ভিন্ন। প্রকৃতিতে আমরা কী দেখি? সবল প্রাণী দুর্বল প্রাণীকে শাসন করে, খেয়ে ফেলে। এটাই প্রাকৃতিক ন্যায়। তাই মানব সমাজেও সবল, বুদ্ধিমান ও সাহসী ব্যক্তির অধিকার আছে দুর্বলদের শাসন করার এবং নিজের ইচ্ছামতো সবকিছু ভোগ করার। ‘জোর যার মুল্লুক তার’ (Might is Right)—এটাই হলো প্রকৃতির আসল আইন।
আরেকজন সফিস্ট, ক্রিটিয়াস (Critias) (যিনি ছিলেন প্লেটোর আপন চাচা এবং এথেন্সের কুখ্যাত ‘ত্রিশ স্বৈরশাসকের’ একজন), ধর্মের উৎপত্তি নিয়ে এক ভয়ানক তত্ত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর একটি নাটকের খণ্ডাংশ থেকে জানা যায়, তিনি মনে করতেন, একসময় কোনো আইন ছিল না, তখন মানুষ গোপনে অপরাধ করত। পরে মানুষ আইন (নোমোস) তৈরি করল, কিন্তু তাতেও গোপন অপরাধ বন্ধ হলো না। তখন এক চতুর শাসক মানুষকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ঈশ্বর বা দেবতাদের ধারণা তৈরি করল। সে প্রচার করল যে, এমন এক সত্তা আছেন যিনি সবকিছু দেখেন, এমনকি মানুষের গোপন চিন্তাও পড়তে পারেন, এবং তিনি পাপীকে শাস্তি দেন। এই ভয়ে মানুষ আর গোপনেও অপরাধ করতে সাহস পায় না। সুতরাং, ধর্ম হলো শক্তিশালী শাসকের একটি চতুর রাজনৈতিক কৌশল।
এই ফিসিস-নোমোস বিতর্কটি আসলে রাজনৈতিক দর্শনের একেবারে গোড়ার কথা। আজও আমরা এই প্রশ্ন নিয়ে ভাবি—আইন কি সার্বজনীন নৈতিকতার ওপর ভিত্তি করে হওয়া উচিত, নাকি তা কেবলই সামাজিক চুক্তি? মানবাধিকার কি প্রাকৃতিক (Physis), নাকি এটিও মানুষের তৈরি একটি ধারণা (Nomos)?
অলঙ্কারশাস্ত্র (Rhetoric): দুর্বল যুক্তিকে সবল করার শিল্প?
সফিস্টদের রুটি-রুজির মূল উৎস ছিল অলঙ্কারশাস্ত্র বা রেটোরিক শেখানো। গণতন্ত্রের এথেন্সে বাগ্মিতা ছিল সাফল্যের চাবিকাঠি। একজন নাগরিককে গণপরিষদে দাঁড়িয়ে নিজের প্রস্তাবের পক্ষে বলতে হতো, আদালতে নিজের কেস লড়তে হতো। যার যুক্তি যত ধারালো, যার উপস্থাপনা যত আকর্ষণীয়, তার জেতার সম্ভাবনা তত বেশি। সফিস্টরা ঠিক এই জিনিসটিই শেখাতেন।
তাঁরা কেবল সুন্দর করে কথা বলাই শেখাতেন না, এটি ছিল একটি পূর্ণাঙ্গ কলা। তাঁরা শেখাতেন কীভাবে একটি বক্তব্যকে কাঠামোবদ্ধ করতে হয় (Structure), কীভাবে যুক্তি বিন্যাস করতে হয় (Argumentation), কীভাবে সঠিক মুহূর্তে সঠিক কথা বলতে হয় (Kairos), কীভাবে মানুষের আবেগ বা ইমোশনকে (Pathos) প্রভাবিত করতে হয়, এবং কীভাবে প্রতিপক্ষের যুক্তিকে খণ্ডন করতে হয়। এই দক্ষতাগুলো নিঃসন্দেহে যেকোনো আধুনিক আইনজীবী, রাজনীতিবিদ বা বিপণন বিশেষজ্ঞের জন্য অতি প্রয়োজনীয়।
কিন্তু এইখানেই সফিস্টদের নিয়ে সবচেয়ে বড় অভিযোগটি উঠে আসে। প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের মতে, সফিস্টরা কেবল জেতার জন্য শেখাতেন, সত্য অনুসন্ধানের জন্য নয়। তাঁদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল, তাঁরা “দুর্বল যুক্তিকে সবল এবং সবল যুক্তিকে দুর্বল করে দেখাতে পারতেন” (to make the weaker argument appear the stronger)। এই কৌশলকে বলা হতো dissoi logoi বা দ্বিবিধ যুক্তি, অর্থাৎ যেকোনো বিষয়ের পক্ষে এবং বিপক্ষে সমানভাবে যুক্তি দেওয়ার ক্ষমতা।
ব্যাপারটা কেমন? ধরুন, এক লোক অন্যায়ভাবে আরেকজনের টাকা আত্মসাৎ করেছে। তার পক্ষে কোনো শক্তিশালী যুক্তি নেই। একজন সফিস্ট তাকে শেখাতে পারেন কীভাবে নানা কথার মারপ্যাঁচে, আবেগি আবেদন দিয়ে, প্রতিপক্ষের চরিত্রের দিকে আঙুল তুলে এবং তার যুক্তির ছোটখাটো ভুল ধরে বিষয়টিকে এমনভাবে উপস্থাপন করা যায়, যাতে মনে হয় সে-ই নির্দোষ। এখানে সত্যটা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো মামলায় জেতা।
প্লেটোর কাছে এটা ছিল এক ভয়ানক ব্যাপার। তাঁর মতে, দর্শনের কাজ হলো দ্বান্দ্বিকতা (Dialectic) বা যুক্তিমূলক কথোপকথনের মাধ্যমে ধাপে ধাপে সত্যে পৌঁছানো। আর সফিস্টদের রেটোরিক হলো সত্যকে আড়াল করার একটি চাটুকারিতা (flattery) বা প্রসাধনী শিল্পের মতো, যা অসুন্দরকে সুন্দর দেখায় কিন্তু তার ভেতরের অসুন্দরকে বদলাতে পারে না (Plato, Gorgias, 465a-c)।
সফিস্ট গোর্গিয়াস তাঁর এক বিখ্যাত বক্তৃতায়, ‘হেলেনের প্রশস্তি’ (Encomium of Helen)-এ, ট্রোজান যুদ্ধের জন্য কুখ্যাত হেলেনের পক্ষ নিয়ে যুক্তি দিয়েছিলেন। তিনি দেখান যে, হেলেন আসলে নির্দোষ ছিলেন। কারণ, তিনি চারটি শক্তির একটির দ্বারা চালিত হয়েছিলেন: (১) দেবতাদের ইচ্ছা, (২) শারীরিক জোর, (৩) কথার শক্তি (Logos), অথবা (৪) প্রেমের শক্তি (Eros)। এই চারটি শক্তির কোনোটিই মানুষের পক্ষে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। তাই হেলেন যা করেছেন, তার জন্য তিনি দায়ী নন। যুক্তিগুলো অকাট্য না হলেও, তাঁর উপস্থাপনার গুণে তা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছিল। এটাই ছিল সফিস্টদের রেটোরিকের শক্তি—ভাষার জাদুতে শ্রোতাকে সম্মোহিত করে ফেলা। গোর্গিয়াস নিজেই বলতেন, ভাষা হলো এক শক্তিশালী প্রভু (logos dynastes megas estin), যা আত্মাকে প্রভাবিত করতে পারে অনেকটা ড্রাগ বা মাদকের মতো।
তবে সফিস্টদের পক্ষ থেকেও বলার কথা আছে। ‘দুর্বল যুক্তিকে সবল করা’ মানে সবসময় প্রতারণা নাও হতে পারে। এর একটা ইতিবাচক ব্যাখ্যাও সম্ভব। হতে পারে, এর দ্বারা বোঝানো হয়েছে একটি অপ্রচলিত, অজনপ্রিয় বা সামাজিকভাবে গৃহীত নয় এমন যুক্তির পক্ষে কথা বলা। যেমন, সক্রেটিসের বিরুদ্ধেই এই একই অভিযোগ আনা হয়েছিল। তিনি প্রচলিত দেবতাদের নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, যা তৎকালীন সমাজের চোখে ছিল একটি ‘দুর্বল’ অবস্থান। সুতরাং, সফিস্টদের এই দক্ষতাটিকে নতুন বা বিপ্লবী ধারণার পক্ষে দাঁড়ানোর একটি উপায় হিসেবেও দেখা যেতে পারে (Guthrie, 1971)।
ধর্ম নিয়ে সংশয়: অজ্ঞেয়বাদ (Agnosticism) থেকে নাস্তিক্য
সফিস্টরা কেবল আইন বা নৈতিকতা নিয়েই প্রশ্ন তোলেননি, তাঁরা দেবতাদের অস্তিত্ব নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন, যা ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। প্রোটাগোরাস এই বিষয়ে যা বলেছিলেন, তা আধুনিক অজ্ঞেয়বাদের (Agnosticism) এক দারুণ উদাহরণ। তিনি তাঁর ‘অন দ্য গডস’ (On the Gods) বইয়ের শুরুতে লিখেছিলেন:
“Concerning the gods, I have no means of knowing either that they exist or that they do not exist, nor what sort of form they may have. There are many things that prevent knowledge: the obscurity of the subject, and the brevity of human life.”
(দেবতাদের সম্পর্কে আমি জানি না তাঁরা আছেন কি নেই, বা তাঁদের রূপই বা কেমন। জানার পথে অনেক বাধা: বিষয়টির অন্তর্নিহিত অস্পষ্টতা এবং মানবজীবনের স্বল্পতা।)
এই উক্তির জন্য প্রোটাগোরাসকে এথেন্স থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল এবং তাঁর বই পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল বলে শোনা যায়। খেয়াল করুন, তিনি কিন্তু বলেননি যে দেবতারা নেই (Atheism)। তিনি বলছেন, আমাদের জানার কোনো উপায় নেই। বিষয়টি এতই জটিল ও অস্পষ্ট, আর আমাদের জীবন এতই ছোট যে এই প্রশ্নের মীমাংসা করা সম্ভব নয়। এটা ছিল তৎকালীন ধর্মবিশ্বাসের ওপর এক বিরাট আঘাত।
অন্যান্য সফিস্টরা আরও এগিয়ে গিয়েছিলেন। আমরা আগেই ক্রিটিয়াসের কথা জেনেছি, যিনি মনে করতেন দেবতারা হলেন শাসকের চতুর আবিষ্কার। আর প্রোডিকাস মনে করতেন, মানুষ প্রথমে তাদের জন্য উপকারী প্রাকৃতিক বস্তু বা শক্তিকে (যেমন: সূর্য, চাঁদ, নদী, রুটি, মদ) পূজা করতে শুরু করে এবং পরে এগুলোকেই দেবতা হিসেবে কল্পনা করে। এটি ধর্মের উৎপত্তির একটি নৃতাত্ত্বিক বা বস্তুবাদী ব্যাখ্যা।
সক্রেটিস বনাম সফিস্ট: মিল ও অমিলের দ্বন্দ্ব
সাধারণ এথেন্সবাসীর চোখে সক্রেটিস (Socrates) এবং সফিস্টদের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য ছিল না। অ্যারিস্টোফেনিসের (Aristophanes) বিখ্যাত কমেডি নাটক ‘দ্য ক্লাউডস’ (The Clouds)-এ সক্রেটিসকে একজন আদর্শ সফিস্ট হিসেবেই ব্যঙ্গ করা হয়েছে, যিনি তরুণদের মাথা খাচ্ছেন এবং দুর্বল যুক্তিকে সবল করতে শেখাচ্ছেন।
কিছু মিল তো ছিলই। দু পক্ষই:
- প্রচলিত বিশ্বাস ও কর্তৃপক্ষকে প্রশ্ন করতেন।
- যুক্তির ওপর জোর দিতেন।
- তরুণদের সঙ্গে সময় কাটাতে ও তাদের শেখাতে পছন্দ করতেন।
- মানবকেন্দ্রিক বিষয়, বিশেষ করে নৈতিকতা নিয়ে আগ্রহী ছিলেন।
কিন্তু তাঁদের মধ্যে অমিল ছিল আকাশ-পাতাল। প্লেটোর মতে, মূল পার্থক্যগুলো হলো:
- অর্থ: সফিস্টরা মোটা অঙ্কের পারিশ্রমিক নিতেন। সক্রেটিস কখনোই কোনো টাকা নিতেন না। তিনি বলতেন, তাঁর শেখানোর মতো কিছুই নেই।
- উদ্দেশ্য: সফিস্টদের উদ্দেশ্য ছিল বিতর্ক জেতা ও সাফল্য অর্জন। সক্রেটিসের উদ্দেশ্য ছিল ডায়ালেক্টিকের মাধ্যমে সত্য (Truth) এবং জ্ঞানের (Knowledge) সন্ধান করা।
- জ্ঞানের দাবি: সফিস্টরা নিজেদের জ্ঞানী বলে দাবি করতেন। সক্রেটিসের বিখ্যাত উক্তি ছিল, “আমি কেবল একটি জিনিসই জানি, আর তা হলো আমি কিছুই জানি না।” তাঁর জ্ঞান ছিল তাঁর অজ্ঞতা সম্পর্কে জ্ঞান।
- সত্যের ধারণা: সফিস্টরা বিশ্বাস করতেন সত্য আপেক্ষিক (Relativism)। সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন ন্যায়, ভালো, সাহসের মতো ধারণাগুলোর একটি সার্বজনীন ও অপরিবর্তনীয় সংজ্ঞা (Universal Definition) আছে, যা খুঁজে বের করাই দর্শনের কাজ।
সক্রেটিসের বিচার ও মৃত্যুদণ্ডের পেছনে তাঁর সঙ্গে সফিস্টদের এই মিল ও অমিলের বিষয়টিও হয়তো কাজ করেছিল। রক্ষণশীল এথেন্সবাসী তাঁকে একজন বিপজ্জনক সফিস্ট হিসেবেই দেখেছিল, যিনি যুবসমাজকে বিপথে চালিত করছেন।
আধুনিক চোখে সফিস্টদের পুনর্মূল্যায়ন
বহু শতাব্দী ধরে সফিস্টদের প্লেটোর চোখে দেখা হয়েছে—একদল প্রতারক, যারা অর্থের জন্য সত্যকে বিকিয়ে দিত। কিন্তু ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে এসে দার্শনিকরা সফিস্টদের নতুন করে মূল্যায়ন করতে শুরু করেছেন। এখন আর তাঁদের কেবল প্লেটোর খলনায়ক হিসেবে দেখা হয় না।
জার্মান দার্শনিক হেগেল (Hegel) প্রথম সফিস্টদের গুরুত্বকে স্বীকার করেন। তিনি মনে করতেন, সফিস্টরা গ্রিক দর্শনের বিকাশে এক অপরিহার্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁরাই প্রথম ‘আত্মচেতনা’ (Subjectivity) বা ব্যক্তির দৃষ্টিকোণের ওপর জোর দিয়েছিলেন, যা দর্শনের অগ্রগতির জন্য জরুরি ছিল।
ফ্রিডরিখ নিৎশে (Nietzsche) তো আরও এক ধাপ এগিয়ে সফিস্টদের প্লেটোর চেয়ে অনেক বেশি সৎ ও জীবনবাদী মনে করতেন। তাঁর মতে, সফিস্টরা জীবনকে তার সমস্ত জটিলতা, নিষ্ঠুরতা ও আপেক্ষিকতা সহ গ্রহণ করেছিলেন। অন্যদিকে প্লেটো এই বাস্তব জগৎকে অস্বীকার করে ‘সত্যিকারের জগৎ’ (True World) নামে এক কাল্পনিক জগতের আশ্রয় নিয়েছিলেন, যা ছিল দুর্বলতা ও জীবনবিমুখতার লক্ষণ।
আধুনিক চিন্তাবিদরা মনে করেন, সফিস্টরা ছিলেন তাঁদের সময়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রগতিশীল চিন্তাবিদ। তাঁদের অবদানগুলো হলো:
-
শিক্ষার গণতন্ত্রীকরণ: সফিস্টরাই প্রথম ব্যক্তি যারা শিক্ষাকে অভিজাতদের গণ্ডি থেকে বের করে সাধারণ মানুষের (যাদের সামর্থ্য ছিল) কাছে নিয়ে এসেছিলেন। তাঁরাই প্রথম আনুষ্ঠানিক পাঠ্যক্রমের (Curriculum) ধারণা দেন।
-
মানবতাবাদী দর্শনের জন্ম: তাঁরাই দর্শনকে মহাবিশ্ব থেকে নামিয়ে এনে মানুষের দোরগোড়ায় হাজির করেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ভাষাতত্ত্বের মতো বিষয়গুলোর ভ্রূণ তাঁদের চিন্তার মধ্যেই নিহিত ছিল।
-
আপেক্ষিকতাবাদ ও বহুত্ববাদের পথিকৃৎ: তাঁরাই প্রথম দেখান যে, সত্য বা নৈতিকতা একরৈখিক নয়। ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি ও ব্যক্তির নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থাকতে পারে। এই ধারণা আজকের বহুসাংস্কৃতিক (Multicultural) ও বহুত্ববাদী (Pluralistic) সমাজের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তাঁদের দর্শন আমাদের শেখায় অন্যের দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্মান করতে।
-
যুক্তিবাদী ও সমালোচনামূলক চিন্তার প্রসার: তাঁরা মানুষকে অন্ধ বিশ্বাস বা প্রচলিত প্রথাকে প্রশ্ন করতে শিখিয়েছিলেন। আইন, ধর্ম, নৈতিকতা—সবকিছুকেই তাঁরা যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করতে চেয়েছেন। এই সমালোচনামূলক মনোভাবই (Critical Thinking) দর্শনের প্রাণ।
-
ভাষার গুরুত্ব অনুধাবন: তাঁরাই প্রথম দার্শনিক যাঁরা ভাষার শক্তি এবং সীমাবদ্ধতা নিয়ে গভীরভাবে ভেবেছিলেন। গোর্গিয়াসের দর্শন আমাদের দেখায় যে, ভাষা ও বাস্তবতার মধ্যে একটা বিরাট ফারাক রয়েছে। এই চিন্তা আধুনিক ভাষাদর্শন (Philosophy of Language) এবং উত্তর-আধুনিকতাবাদের (Postmodernism) অন্যতম ভিত্তি। ফুকো (Foucault) বা দেরিদার (Derrida) মতো দার্শনিকদের চিন্তায় সফিস্টদের দর্শনের গভীর ছায়া দেখতে পাওয়া যায়।
শেষ কথা
তাহলে সফিস্টদের আমরা কী বলব? তাঁরা কি জ্ঞানী, নাকি প্রতারক? বিপ্লবী, নাকি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী?
গল্পের শেষে এসে মনে হয়, তাঁরা ছিলেন এর সবগুলোই, আবার কোনোটিই নন। তাঁরা ছিলেন জটিল, বহুমাত্রিক একদল চিন্তাবিদ, যাদের এক কথায় সংজ্ঞায়িত করা প্রায় অসম্ভব। তাঁদের দর্শন ছিল অনেকটা আয়নার মতো, যা তৎকালীন এথেন্সের সামাজিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অস্থিরতাকে প্রতিফলিত করেছিল। গণতন্ত্রের উত্থান, বিভিন্ন সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসা, এবং পুরনো বিশ্বাসগুলোর ভাঙন—এই সবকিছুই তাঁদের চিন্তায় ধরা দিয়েছিল।
তাঁদের আপেক্ষিকতাবাদ হয়তো আমাদের অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। কারণ আমরা সবাই চাই একটা স্থির, ধ্রুব সত্যকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে। একটা মজবুত নৈতিক ভিত্তি চাই। কিন্তু সফিস্টরা আমাদের সেই আরামের জায়গা থেকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেন। তাঁরা আমাদের বাধ্য করেন ভাবতে—আমি যা বিশ্বাস করি, তা কি আসলেই ধ্রুব সত্য? নাকি এটাও আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি বা সামাজিকভাবে তৈরি করা এক ‘নোমোস’? আমার ‘ন্যায়’ কি অন্যের কাছেও ‘ন্যায়’?
প্লেটো চেয়েছিলেন এক চিরন্তন, অপরিবর্তনীয় সত্যের জগৎ, যেখানে সবকিছু নিখুঁতভাবে সাজানো। সফিস্টরা দেখিয়েছিলেন, মানুষের পৃথিবীটা অতটা সরল নয়। এখানে সত্য আপেক্ষিক, নৈতিকতা পরিবর্তনশীল, আর ভাষা এক পিচ্ছিল ও শক্তিশালী মাধ্যম যা দিয়ে বাস্তবতা তৈরিও করা যায়, আবার ধ্বংসও করা যায়। আড়াই হাজার বছর পরেও তাঁদের তোলা প্রশ্নগুলো আমাদের তাড়া করে ফেরে। হয়তো এখানেই তাঁদের আসল সাফল্য। তাঁরা কোনো চূড়ান্ত উত্তর দিয়ে যাননি, কিন্তু এমন কিছু প্রশ্ন রেখে গেছেন, যা মানবজাতিকে অনন্তকাল ধরে ভাবাবে, অস্বস্তিতে ফেলবে এবং চিন্তা করতে বাধ্য করবে।
রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে আমরা হয়তো ভাবি, মহাবিশ্বের রহস্য কী? সফিস্টরা মুচকি হেসে বলতেন, “তার আগে বলুন, আপনি কে? আপনার জানার মাপকাঠিটি কী?”
এই প্রশ্নটিই হয়তো সবথেকে বড় দর্শন।
তথ্যসূত্র
- Barnes, J. (1982). The Presocratic Philosophers. Routledge.
- Guthrie, W. K. C. (1971). The Sophists. Cambridge University Press.
- Hansen, M. H. (1999). The Athenian Democracy in the Age of Demosthenes: Structure, Principles, and Ideology. University of Oklahoma Press.
- Kerferd, G. B. (1981). The Sophistic Movement. Cambridge University Press.
- Kirk, G. S., Raven, J. E., & Schofield, M. (1983). The Presocratic Philosophers: A Critical History with a Selection of Texts (2nd ed.). Cambridge University Press.
- Plato. (1997). Complete Works (J. M. Cooper, Ed.). Hackett Publishing Company. (This single volume contains translations of all dialogues mentioned, including Protagoras, Gorgias, Theaetetus, Republic, and Sophist).
- Sextus Empiricus. (2000). Against the Logicians (R. Bett, Trans.). Cambridge University Press. (This is a modern translation of the work often cited as Against the Mathematicians VII-VIII, where Gorgias’s arguments are preserved).
- Untersteiner, M. (1954). The Sophists (K. Freeman, Trans.). Basil Blackwell. (A comprehensive work that includes fragments from Sophists like Antiphon).
Leave a Reply