উর্দু সাহিত্য: এক মায়াবী নদীর উপাখ্যান

Table of Contents

ভূমিকা

ভাষা জিনিসটা কী, বলুন তো? আমার কাছে মনে হয়, ভাষা হলো একটা নদী। কখনও পাহাড়ের কোল থেকে ছোট্ট ঝর্ণা হয়ে তার শুরু, তারপর সে নানা বাঁক নেয়, নানা দেশের মাটির গন্ধ গায়ে মাখে। কখনও সে শান্ত, কখনও উত্তাল। কত সভ্যতা, কত মানুষের হাসি-কান্না, কত প্রেম আর কত বিচ্ছেদ বুকে নিয়ে সে বয়ে চলে। উর্দু ভাষাও ঠিক তেমনই এক নদী। এর জন্ম কোনো নির্দিষ্ট উৎস থেকে নয়, বরং বহু সংস্কৃতির স্রোত এক হয়ে তৈরি করেছে এই মায়াবী ধারা। এই নদীর কোনো একক উৎস নেই, যেমন গঙ্গা বা যমুনার আছে। এ যেন বহু ঝর্ণাধারার মিলনে সৃষ্ট এক বিশাল মোহনা, যা নিজেই একসময় নদীতে পরিণত হয়েছে। এর জলে মিশে আছে মধ্য এশিয়ার স্তেপ অঞ্চলের রুক্ষতা, পারস্যের গোলাপ বাগানের সুবাস, আর ভারতবর্ষের মাটির নিজস্ব সোঁদা গন্ধ। এই নদী তার যাত্রাপথে কখনও পারস্যের গজলের আঙ্গিককে আপন করেছে, কখনও বা ভারতীয় দোহা বা গীতের সহজ-সরলতাকে।

এই নদীর গল্পই আজ বলব। উর্দু সাহিত্যের গল্প। যে গল্প শুরু হয়েছিল সৈনিকদের তাঁবুতে, তারপর সে স্থান করে নিল রাজার দরবারে, আশ্রয় পেল সুফির খানকায়, আর সবশেষে সাধারণ মানুষের হৃদয়ে। এই গল্পে যেমন আছে বাদশার ফরমান, তেমনি আছে ফকিরের আর্তি। যেমন আছে প্রেমিকার কানের দুলের বর্ণনা, তেমনি আছে দেশভাগের সময় চলন্ত ট্রেনের আর্তনাদ। এই উপাখ্যানে আমরা দেখব কীভাবে একটি ব্যবহারিক মিশ্র ভাষা ধীরে ধীরে সাহিত্যের মার্জিত রূপ পরিগ্রহ করল, কীভাবে দিল্লির বিষাদ আর লখনউয়ের বিলাসিতা তাকে দুই ভিন্ন পথে চালিত করল, এবং কীভাবে আধুনিকতার ঢেউ এসে তার পুরোনো খাতে নতুন স্রোত বইয়ে দিল। চলুন, সেই নদীর স্রোতে গা ভাসানো যাক, ডুব দেওয়া যাক তার অতল গভীরতায় এবং তার প্রতিটি বাঁকের রহস্য উন্মোচন করা যাক।

শুরুর দিনগুলো: বহু স্রোতের এক মোহনা

গল্পের শুরুটা বেশ অদ্ভুত। সময়টা দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতক। দিল্লির মসনদে তখন তুর্কি সুলতানরা। তারও আগে, দশম-একাদশ শতকে গজনীর সুলতান মাহমুদের সময় থেকেই পাঞ্জাবে ফারসিভাষী তুর্কিদের আগমন শুরু হয়। এরপর ঘুর বংশের হাত ধরে দিল্লিতে তুর্কি শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে মধ্য এশিয়া থেকে এক বিশাল জনস্রোত উত্তর ভারতে প্রবেশ করে। তাঁদের সেনাবাহিনীতে ছিল নানা জাতের, নানা ভাষার সৈনিক—তুর্কি, পারসিক, আরব, আফগান। আর তাদের সঙ্গে কাজ করছে স্থানীয় ভারতীয় সেনারা, যারা কথা বলে শৌরসেনী প্রাকৃত থেকে উদ্ভূত খাড়ি বোলি (Khari Boli), ব্রজভাষা, বা হরিয়ানভির মতো স্থানীয় ভাষায়। এই বিশাল সৈন্য শিবিরে (Lashkar) সবার সঙ্গে সবার যোগাযোগের জন্য একটা মিশ্র ভাষার দরকার পড়ল।

ভাবুন তো একবার, কী বিচিত্র সেই দৃশ্য! একজন তুর্কি সেনাপতি তাঁর হরিয়ানভি সিপাহীকে নির্দেশ দিচ্ছেন, কিন্তু তাঁর ভাষায় মিশে আছে ফারসি আর আরবি শব্দ। সিপাহী তার উত্তর দিচ্ছে নিজের ভাষায়, কিন্তু তাতেও ঢুকে পড়ছে প্রভুর মুখের কিছু শব্দ। এই ভাষাগত দেওয়া-নেওয়ার ভেতর দিয়েই জন্ম নিল এক নতুন ভাষা। ভাষাতাত্ত্বিকভাবে দেখলে, এর ব্যাকরণের কাঠামো, এর ক্রিয়াপদগুলো (যেমন, করা, যাওয়া, আসা) রইল পুরোপুরি ভারতীয় (Indo-Aryan), কিন্তু শব্দভাণ্ডারে ঢুকে পড়ল হাজার হাজার ফারসি (প্রশাসনিক, কাব্যিক ও সাংস্কৃতিক শব্দ), আরবি (ধর্মীয় ও দার্শনিক শব্দ) আর তুর্কি (সৈনিক ও দৈনন্দিন জীবনের শব্দ) শব্দ। সৈনিকদের শিবির বা তুর্কি শব্দ ‘ওর্দু’ (Ordu), যার অর্থ শিবির বা ক্যাম্প, সেখান থেকেই পরবর্তীকালে এই ভাষার নাম হয় ‘জবান-এ-উর্দু’ বা শিবিরের ভাষা। তবে তারও আগে এর এক নাম ছিল ‘লস্করি জবান’ (Lashkari Zaban) বা সৈনিকের ভাষা।

প্রথমদিকে এর কোনো কেতাবি নাম ছিল না। একে ডাকা হতো নানা নামে—‘হিন্দভি’ (Hindavi – অর্থাৎ, হিন্দের বা ভারতের ভাষা), ‘হিন্দি’, ‘দেহলভি’ (দিল্লির ভাষা), ‘গুজরি’ (গুজরাটের ভাষা) এবং পরে ‘রেখতা’ (Rekhta)। ‘রেখতা’ একটি ফারসি শব্দ, যার আক্ষরিক অর্থ ‘মিশ্রিত’ বা ‘ছড়ানো ছিটানো’, যা এই ভাষার মিশ্র প্রকৃতিকেই নির্দেশ করে। ঠিক যেমন বিভিন্ন রঙের সুতো দিয়ে একটি সুন্দর কার্পেট বোনা হয়, তেমনই ফারসি, আরবি ও খাড়ি বোলির শব্দমালা দিয়ে বোনা হয়েছিল এই ভাষা।

এই ভাষার প্রথম সচেতন শিল্পী ছিলেন কবি আমির খসরু (Amir Khusrau)। তাঁকে বলা হয় ‘তুতি-এ-হিন্দ’ (Tota-e-Hind) বা ভারতের তোতাপাখি। খসরু ছিলেন এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি দিল্লির সাতজন সুলতানের (বলবন থেকে গিয়াসউদ্দিন তুঘলক) সভাকবি ছিলেন। তিনি একাধারে সঙ্গীতজ্ঞ, সাধক, ঐতিহাসিক এবং অবশ্যই একজন অসাধারণ কবি। তাঁর পিতা ছিলেন তুর্কি এবং মাতা ভারতীয়, তাই দুই সংস্কৃতিই তাঁর রক্তে মিশে ছিল। তিনি ছিলেন প্রখ্যাত সুফি সাধক হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়ার প্রিয় শিষ্য। এই সুফি পরিমণ্ডল তাঁকে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি আসতে শিখিয়েছিল। তিনি মূলত ফারসি ভাষায় লিখতেন এবং ফারসি কবিতার দিকপাল হিসেবে গণ্য হতেন, কিন্তু তাঁর দোহা, ধাঁধা (পহেলি), আর গানে এই নতুন ‘হিন্দভি’ ভাষার প্রতি তাঁর ভালোবাসা স্পষ্ট। তিনি বুঝেছিলেন, ফারসি যতই দরবারের ভাষা হোক, কিন্তু এই মিশ্র ভাষাই একদিন সাধারণ মানুষের হৃদয়ের ভাষা হয়ে উঠবে। তাঁর একটি বিখ্যাত ধাঁধা দেখুন:

“বিসোঁ কা সর কাট লিয়া,
না মারা, না খুন কিয়া।”
(অর্থ: কুড়ি জনের মাথা কেটে নিলাম, কিন্তু মারিনি বা রক্তও ঝরাইনি।)

উত্তর: নখ কাটা।

এমন সহজ, রসিকতাপূর্ণ ভাষায় তিনি সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। খসরুই প্রথম ফারসি আর হিন্দভি শব্দ মিলিয়ে এক ধরনের মিশ্র কবিতা লেখা শুরু করেন, যা ‘রেখতা’র প্রাথমিক রূপ হিসেবে ধরা হয়। যেমন তাঁর একটি বিখ্যাত পঙক্তি:

“জেহাল-এ-মিসকিন মাকুন তাগাফুল, দুরায়ে নয়না বনায়ে বাতিয়াঁ,
কে তাব-এ-হিজরাঁ না দারাম এ জাঁ, না লেহো কাহে লাগায়ে ছাতিয়াঁ।”

এখানে প্রথম ও তৃতীয় অংশ ফারসি, এবং দ্বিতীয় ও চতুর্থ অংশ ব্রজভাষা। এই মিশ্রণই ছিল উর্দুর ভ্রূণ। তিনি কাওয়ালি সঙ্গীতের জনক, সেতার এবং সম্ভবত তবলাও তাঁরই সৃষ্টি। তিনি যেন এই নতুন নদীর গতিপথটি দেখিয়ে দিয়েছিলেন, যার মধ্যে সুর আর শব্দ মিলেমিশে একাকার।

দাক্ষিণাত্যের উদার আশ্রয়: উর্দু সাহিত্যের প্রথম বিকাশ

মজার ব্যাপার হলো, যে ভাষার জন্ম উত্তর ভারতে, তার সাহিত্যিক চর্চা কিন্তু প্রথমে সেখানে হয়নি। শুরু হয়েছিল অনেক দূরে, দক্ষিণ ভারতে, যা দাক্ষিণাত্য বা ডেকান (Deccan) নামে পরিচিত। এর কারণ ছিল রাজনৈতিক। চতুর্দশ শতকে সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক তাঁর রাজধানী দিল্লি থেকে দাক্ষিণাত্যের দৌলতাবাদে (দেবগিরি) স্থানান্তরের এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নেন। এর ফলে দিল্লির বহু জ্ঞানী-গুণী, সুফি, সাধক আর কবি দিল্লি থেকে দাক্ষিণাত্যে চলে যেতে বাধ্য হন। যদিও রাজধানী পরে দিল্লিতে ফিরিয়ে আনা হয়, কিন্তু অনেকেই সেখানে থেকে যান।

পরবর্তীকালে দাক্ষিণাত্যে বাহমনি সাম্রাজ্য এবং তার পতনের পর গোলকোন্ডার কুতুব শাহি বিজাপুরের আদিল শাহি সুলতানরা ছিলেন শিল্প-সাহিত্যের বড় পৃষ্ঠপোষক। তাঁরা ফারসিকে রাজভাষা হিসেবে রাখলেও, এই নতুন ভাষা (যা তখন ‘দকনি’ (Deccani) নামে পরিচিত) তাকে সাদরে গ্রহণ করলেন। দিল্লির অভিজাত ফারসি পরিমণ্ডলের বাইরে থাকায় দকনি উর্দু ছিল অনেক বেশি মাটির কাছাকাছি। এতে সংস্কৃত ও স্থানীয় দ্রাবিড় ভাষা, যেমন তেলুগু, কন্নড় ও মরাঠির অনেক শব্দও অবলীলায় মিশে গিয়েছিল। এর ফলে দকনি ভাষা এক স্বতন্ত্র চরিত্র লাভ করে।

এই ভাষার প্রথম দিকের লেখকদের মধ্যে ছিলেন সুফি সাধকেরা। যেমন শাহ মীরাজি শামস-উল-উশশাক এবং বুরহানউদ্দিন জানম। তাঁরা তাঁদের অত্যন্ত গভীর ও জটিল সুফি দর্শন সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য এই সহজবোধ্য ভাষাকেই বেছে নিয়েছিলেন। তাঁরা মনে করতেন, মানুষের নিজের ভাষায় কথা না বললে তার হৃদয়ে পৌঁছানো যায় না।

দকনি সাহিত্যের স্বর্ণযুগ আসে গোলকোন্ডার কুতুব শাহি এবং বিজাপুরের আদিল শাহি সুলতানদের সময়ে। বিজাপুরের সুলতান দ্বিতীয় ইব্রাহিম আদিল শাহ (Ibrahim Adil Shah II) নিজেই একজন বড় কবি ও সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। তিনি ‘কিতাব-এ-নওরস’ (Kitab-e-Nauras) নামে একটি সঙ্গীতের বই লেখেন, যা দকনি ভাষায় লেখা। এর শুরুতে তিনি জ্ঞানের দেবী সরস্বতীর বন্দনা করেছেন, যা তখনকার সময়ের সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের এক অসাধারণ উদাহরণ। তিনি নিজেকে ‘জগত গুরু’ বলতেন এবং তাঁর দরবারে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে শিল্পীদের কদর ছিল।

গোলকোন্ডার সুলতান এবং হায়দ্রাবাদ শহরের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ কুলি কুতুব শাহ ছিলেন দকনির সবচেয়ে বড় এবং প্রভাবশালী কবি। তিনিই প্রথম উর্দু কবি যাঁর সম্পূর্ণ দিওয়ান (Diwan) বা কাব্যসংকলন পাওয়া যায়, যা প্রায় পঞ্চাশ হাজার পঙক্তির এক বিশাল সম্ভার। তাঁর কবিতা গতানুগতিক ফারসি ধারার গোলাপ-বুলবুলের সীমাবদ্ধ জগতে আটকে থাকেনি। বরং তাতে পাওয়া যায় ভারতীয় উৎসব (হোলি, দিওয়ালি, বসন্ত), ঋতু, প্রকৃতি, স্থানীয় রীতিনীতি এবং সাধারণ মানুষের জীবনের নিখুঁত ছবি। তিনি তাঁর বারোজন প্রেমিকার প্রত্যেকের জন্য কবিতা লিখেছেন। তাঁর কবিতা পড়লে মনে হয়, তিনি যেন মাটির গন্ধ গায়ে মেখে লিখছেন (Sadiq, 1984)। তাঁর হোলির কবিতাটি দেখুন:

“পিয়া সঙ্গ খেলি হোরী, খুশ হো কর,
মুশক ও অম্বর, আবির ও গুলাল, ছিড়ক কর।”

দকনি যুগে কবিতার পাশাপাশি মসনভি (Masnavi) বা দীর্ঘ কাহিনিকাব্যও খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। মোল্লা ওয়াজহি-র ‘কুতুব মুশতরি’ (Qutb Mushtari) একটি প্রেমকাব্য, যা সুলতান কুলি কুতুব শাহ এবং তাঁর প্রেমিকা মুশতরিকে নিয়ে লেখা। বিজাপুরের কবি নুসরাতির (Nusrati) লেখা ‘গুলশান-এ-ইশক’ (Gulshan-e-Ishq) এবং ‘আলি নামা’ (Ali Nama) বিখ্যাত মসনভি। ওয়াজহির ১৬৩৫ সালে লেখা ‘সব রস’ (Sab Ras) একটি রূপক গদ্য। এতে ‘হুসন’ (সৌন্দর্য) এবং ‘দিল’ (হৃদয়)-এর প্রেমকাহিনির মাধ্যমে সুফিবাদের গভীর দর্শনকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ‘সব রস’-কে উর্দু গদ্যের প্রাচীনতম নিদর্শনগুলোর একটি বলে মনে করা হয়।

এই দকনি ধারা প্রায় তিনশ বছর ধরে চলেছিল। কিন্তু আসল বিপ্লব ঘটালেন একজন ওয়ালি মুহাম্মদ ওয়ালি নামে একজন কবি, যিনি ওয়ালি দকনি (Wali Deccani) নামে পরিচিত। তাঁকে বলা হয় ‘বাবা-এ-রেখতা’ (Baba-e-Rekhta) বা উর্দু কবিতার জনক। অষ্টাদশ শতকের শুরুতে (আনুমানিক ১৭০০ সাল) তিনি যখন তাঁর দকনি কবিতার দিওয়ান নিয়ে দিল্লিতে এলেন, তখন সেখানকার কবিদের মধ্যে এককথায় হুলস্থুল পড়ে গেল। দিল্লির কবিরা তখন ফারসি ভাষায় কবিতা লেখাকেই আভিজাত্যের চূড়ান্ত বলে মনে করতেন। তাঁরা এই ‘রেখতা’-কে কিছুটা অবজ্ঞার চোখে, একটি অপরিশীলিত ভাষা হিসেবে দেখতেন। ওয়ালি দেখালেন যে, এই ভাষাতেও কত উঁচু দরের শায়রী (Shayari) বা কবিতা লেখা সম্ভব। তিনি দকনি ভাষার সারল্যের সঙ্গে ফারসি গজলের গঠন, পরিশীলিত ভাব এবং উপমা-উৎপ্রেক্ষাকে মিলিয়ে এক নতুন শৈলী তৈরি করলেন। তাঁর কবিতার সহজবোধ্যতা, আবেগ আর মিষ্টতা দিল্লির কবিদের মন জয় করে নিল। বলা যায়, ওয়ালির হাত ধরেই উর্দু কবিতার কেন্দ্র দাক্ষিণাত্য থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত হলো (Russell, 1999)। উর্দু নদী যেন তার আপন ঘরে ফিরে এল, নতুন শক্তি ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে।

সোনালি যুগ: দিল্লি ও লখনউ ঘরানা (The Golden Age: The Delhi and Lucknow Schools)

অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দী হলো উর্দু শায়রীর স্বর্ণযুগ। এই সময়ে উর্দু কবিতা দুটি প্রধান ধারায় বা ঘরানায় (School of thought)-এ বিকশিত হয়: দিল্লি ঘরানা এবং লখনউ ঘরানা। এই দুটি ধারা কেবল ভৌগোলিক অর্থে ভিন্ন ছিল না, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, বিষয়বস্তু এবং ভাষার ব্যবহারে ছিল আকাশ-পাতাল পার্থক্য।

দিল্লি ঘরানা (The Delhi School): বিষাদের সৌন্দর্য

ওয়ালির দেখানো পথে হেঁটে দিল্লিতে উর্দু কবিতার এক নতুন দিগন্ত খুলে গেল। কিন্তু এই সময়টা দিল্লির জন্য ছিল এক ঘোর দুর্দিন। মোগল সাম্রাজ্য তখন পতনের মুখেনাদির শাহের নৃশংস আক্রমণ (১৭৩৯), আহমদ শাহ আবদালির বারংবার লুণ্ঠন, মারাঠা আর জাঠদের ক্রমাগত হানা—সব মিলিয়ে মোগল রাজধানী তখন এক ধ্বংসস্তূপ। শহর বিপর্যস্ত, মানুষের জীবনে কোনো নিরাপত্তা নেই। চারদিকে শুধু হাহাকার, রক্তপাত আর ভাঙনের শব্দ। এই বিষণ্ণতাই যেন দিল্লির কবিদের কবিতার মূল সুর হয়ে উঠল। তাঁদের কবিতায় পাওয়া যায় গভীর বেদনা (Gham), বিষাদ, আধ্যাত্মিকতা (Tasawwuf) আর মানব জীবনের দুঃখ-কষ্টের এক দার্শনিক রূপ। তাঁদের কাছে প্রেমও কোনো সুখের অনুভূতি নয়, বরং তা এক অন্তহীন যন্ত্রণা, যা আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে। এই ধারার কবিদের বলা হয় দিল্লি ঘরানা বা Delhi School of Poetry-র কবি। তাঁদের ভাষা ছিল সহজ, আন্তরিক কিন্তু আবেগের গভীরতায় পূর্ণ।

এই স্কুলের চারজন প্রধান স্তম্ভ ছিলেন:

১. মীর তকি মীর (Mir Taqi Mir, ১৭১৩-১৮১০): মীরকে বলা হয় ‘খুদা-এ-সুখন’ (Khuda-e-Sukhan) বা কবিতার ঈশ্বর। তাঁর জীবন ছিল দুঃখ, দারিদ্র্য, মানসিক যন্ত্রণা আর হতাশায় ভরা। শৈশবে পিতৃহীন, যৌবনে প্রেমিকার মৃত্যু, দিল্লির ধ্বংসযজ্ঞ নিজের চোখে দেখা—এই সবকিছু তাঁর মনকে বিষাদে ভরিয়ে দিয়েছিল। সেই ব্যক্তিগত দুঃখই তাঁর কবিতার প্রধান উপজীব্য। কিন্তু মীরের মহত্ত্ব হলো, তিনি তাঁর ব্যক্তিগত দুঃখকে বিশ্বজনীন রূপ দিয়েছেন। তাঁর শের (Sher) বা দ্বিপদীগুলো পড়লে মনে হয়, যেন হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা এক চাপা আর্তনাদ শুনছি। সহজ-সরল ভাষায় এমন তীব্র আবেগ ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতা খুব কম কবিরই থাকে। মীর বলতেন:

“পত্তা পত্তা বুটা বুটা হাল হামারা জানে হ্যায়,
যানে না জানে গুল হি না জানে, বাগ তো সারা জানে হ্যায়।”
(অর্থ: প্রতিটি পাতা, প্রতিটি গাছ আমার অবস্থা জানে, কেবল ফুলই জানে না, কিন্তু সমগ্র বাগান জানে।)

তাঁর আত্মজীবনী ‘জিক্‌র-এ-মীর’ (Zikr-e-Mir) পড়লে তাঁর জীবনের ট্র্যাজেডি সম্পর্কে জানা যায়। তাঁর কবিতায় প্রেম এসেছে দুঃখের অনুষঙ্গ হয়ে। প্রেমের আনন্দ নয়, বরং বিরহ আর না পাওয়ার যন্ত্রণাই তাঁর কবিতার প্রাণ (Matthews & Shackle, 1972)। তাঁর কাছে পৃথিবীটাই এক দুঃখের নগরী।

২. মির্জা আসাদুল্লাহ খান গালিব (Mirza Asadullah Khan Ghalib, ১৭৯৭-১৮৬৯): গালিব এক বিস্ময়। উর্দু কবিতা যদি এক বিশাল প্রাসাদ হয়, তবে গালিব তার সবচেয়ে রহস্যময় আর কারুকার্যময় কক্ষ। তাঁকে বোঝা খুব কঠিন, আবার খুব সহজ। তাঁর শেরগুলোর অনেকগুলো স্তর (Layer) থাকে। প্রথমবার পড়লে এক অর্থ, দ্বিতীয়বার পড়লে আরেক। তাঁর কবিতায় দর্শন (Philosophy) আর বুদ্ধির খেলা (Wit) এমনভাবে মিশে আছে যা আগে কখনও দেখা যায়নি। তিনি নিয়তি, ঈশ্বর, জীবন আর জগৎ নিয়ে এমন সব প্রশ্ন তুলেছেন, যা মানুষকে ভাবায়। তিনি ঈশ্বরের সঙ্গে বন্ধুর মতো ঝগড়া করেন, তর্ক করেন, অভিযোগ করেন। তাঁর মধ্যে একধরনের দার্শনিক সংশয়বাদ কাজ করত।

“হাজারোঁ খওয়াহিশেঁ অ্যায়সি কি হর খওয়াহিশ পে দম নিকলে,
বহুত নিকলে মিরে আরমান, লেকিন ফির ভি কম নিকলে।”
(অর্থ: হাজারো আকাঙ্ক্ষা এমন যে প্রতিটি আকাঙ্ক্ষাই প্রাণঘাতী, আমার অনেক সাধ পূরণ হয়েছে, কিন্তু তা-ও কমই মনে হয়।)

গালিবের জীবনও কেটেছে অর্থকষ্ট আর অপ্রাপ্তিতে। তিনি দিল্লির শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের সভাকবি ও উস্তাদ ছিলেন এবং ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় দিল্লির ধ্বংসযজ্ঞ নিজের চোখে দেখেছিলেন। সেই বেদনাও তাঁর লেখায়, বিশেষ করে তাঁর ফারসি ভাষায় লেখা ডায়েরি ‘দস্তাম্বু’ (Dastambu)-তে ছাপ ফেলেছে। গালিবের গদ্যও ছিল যুগান্তকারী। তাঁর চিঠিগুলো (‘উদ-এ-হিন্দি’ ও ‘উর্দু-এ-মুয়াল্লা’) প্রমাণ করে যে, তিনি কত সহজ আর কথোপকথনের ভঙ্গিতে লিখতে পারতেন, যা ছিল তখনকার অলংকারপূর্ণ গদ্যের থেকে একদম আলাদা (Russell, 1997)।

৩. খাজা মীর দর্দ (Khwaja Mir Dard, ১৭১১-১৭৮৫): দর্দ ছিলেন একজন উচ্চস্তরের সুফি সাধক এবং নকশবন্দি তরিকার পীর। তাঁর কবিতায় তাসাউফ বা সুফিবাদই প্রধান। পৃথিবীর দুঃখ-কষ্ট, প্রেম-ভালোবাসা—সবকিছুকেই তিনি দেখেছেন আধ্যাত্মিকতার চোখে। তাঁর কবিতা পড়লে একধরনের প্রশান্তি আসে। তিনি জগৎকে দেখেছেন মায়া হিসেবে এবং ঈশ্বরের সঙ্গে মিলিত হওয়াকেই জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য বলে মনে করেছেন। তাঁর ভাষা ছিল অত্যন্ত পরিশীলিত, স্নিগ্ধ এবং আবেগের তীব্রতা থাকলেও তা ছিল সংযত।

৪. মুমিন খান মুমিন (Momin Khan Momin, ১৮০০-১৮৫১): মুমিন ছিলেন প্রেমের কবি, কিন্তু তাঁর প্রেম মীরের মতো বিষাদে ভরা নয়। তাঁর কবিতায় আছে একধরনের বুদ্ধিমত্তা আর মনস্তাত্ত্বিক গভীরতা। তিনি তাঁর প্রেমিকার মনস্তত্ত্ব নিয়ে খেলতে ভালোবাসতেন, যাকে বলা হয় ‘মুয়ামেলা বন্দী’ (Mu’amala Bandi)। তাঁর শেরগুলো প্রায়ই ধাঁধার মতো, যার অর্থোদ্ধার করতে পারলে একধরনের আনন্দ পাওয়া যায়। তাঁর একটি বিখ্যাত শের আছে, যা নিয়ে বলা হয়, গালিব এই একটি শেরের বিনিময়ে তাঁর পুরো দিওয়ান দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন:

“তুম মেরে পাস হোতে হো গোয়া,
যব কোঈ দুসরা নহীঁ হোতা।”
(অর্থ: তুমি যেন আমার কাছেই থাকো, যখন অন্য কেউ থাকে না।) এর দুটি অর্থ হতে পারে: এক, যখন আমি একা থাকি, তখন তোমার স্মৃতি আমার সঙ্গে থাকে। দুই, যখন তুমি আর কারও সঙ্গে থাকো না, তখনই আমার কাছে আসো।

দিল্লি ঘরানার আরও উল্লেখ্য কবিদের মধ্যে ছিলেন মির্জা মুহম্মদ রফি ‘সওদা’ (Mirza Muhammad Rafi ‘Sauda’), যিনি কাসিদা (Qasida – প্রশস্তিমূলক কবিতা) এবং হজ্‌ব (Hajv – ব্যঙ্গাত্মক কবিতা)-এর জন্য বিখ্যাত ছিলেন, এবং শেখ মুহম্মদ ইব্রাহিম ‘জওক’ (Sheikh Muhammad Ibrahim ‘Zauq’), যিনি ছিলেন বাহাদুর শাহ জাফরের উস্তাদ এবং গালিবের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী।

লখনউ ঘরানা (The Lucknow School): ঐশ্বর্য ও অলংকারের জগৎ

দিল্লি যখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে, তখন পাশেই অযোধ্যার রাজধানী লখনউ হয়ে উঠেছে শিল্প-সংস্কৃতির নতুন কেন্দ্র। দিল্লির অনেক কবি, শিল্পী ও জ্ঞানীগুণী মানুষ তখন লখনউতে পাড়ি জমান। কিন্তু লখনউয়ের পরিবেশ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। অযোধ্যার নবাবরা ছিলেন বিলাসী এবং শিল্প-সাহিত্যের উদার পৃষ্ঠপোষক। সেখানে ছিল শান্তি, সমৃদ্ধি আর বিলাসিতা। তাই লখনউয়ের কবিতায় দিল্লির বিষাদময়তা বা গভীর দর্শনের বদলে প্রাধান্য পেল বাহ্যিক সৌন্দর্য, ভাষার কারুকাজ (Wordplay) আর অলংকার (Ornamentation)। এই ধারাকে বলা হয় লখনউ ঘরানা বা Lucknow School of Poetry।

লখনউয়ের কবিরা ভাষার শুদ্ধতা (Purity) এবং শৈলী (Style) নিয়ে খুব সচেতন ছিলেন। তাঁরা শব্দ নিয়ে খেলা করতে ভালোবাসতেন, যাকে বলা হয় ‘রিয়ায়ত-এ-লফজি’ (Riayat-e-Lafzi) বা শব্দচাতুর্য। তাঁদের কবিতায় প্রেম, সৌন্দর্য আর বিলাসবহুল জীবনের নিখুঁত বর্ণনা পাওয়া যায়। তাঁরা প্রেমিকার রূপের বর্ণনা দিতে গিয়ে চুল থেকে নখ পর্যন্ত প্রতিটি অঙ্গের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিতেন। তবে অনেক সমালোচক বলেন, এই অতিরিক্ত অলংকারপ্রিয়তার কারণে লখনউয়ের কবিতায় দিল্লির মতো গভীরতা বা আন্তরিকতা নেই। তাতে অনুভূতির চেয়ে কারিগরি বেশি (Sadiq, 1984)।

এই স্কুলের প্রধান কবিদের মধ্যে ছিলেন ইনশা আল্লাহ খান ‘ইনশা’ (Insha Allah Khan ‘Insha’) এবং শেখ ইমাম বখশ ‘নাসিখ’ (Sheikh Imam Bakhsh ‘Nasikh’), যাঁরা ভাষার নিয়মকানুন তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। গোলাম হামদানি ‘মুসহাফি’ (Ghulam Hamdani ‘Mushafi’) এবং হায়দার আলি ‘আতিশ’ (Haider Ali ‘Atish’)-ও এই ধারার গুরুত্বপূর্ণ কবি। আতিশের কবিতায় অবশ্য লখনউয়ের কৃত্রিমতার মধ্যেও একধরনের সরলতা ও আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়া পাওয়া যায়।

তবে লখনউয়ের সবচেয়ে বড় অবদান হলো মর্সিয়া (Marsiya) বা শোককাব্যের বিকাশ। কারবালার প্রান্তরে ইমাম হোসেন এবং তাঁর সঙ্গীদের শহিদ হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে লেখা এই শোককাব্যকে মীর আনিস (Mir Anis) এবং মির্জা দবির (Mirza Dabir) শিল্পের চূড়ান্ত শিখরে নিয়ে যান। শিয়া মতাবলম্বী নবাবদের পৃষ্ঠপোষকতায় মর্সিয়া পাঠের আসর বা ‘মজলিস’ লখনউয়ের সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। আনিস ও দবির মর্সিয়ার মাধ্যমে মহাকাব্যের বিশালতা ফুটিয়ে তুলেছেন, যেখানে যুদ্ধ, বীরত্ব, করুণা এবং বিলাপের অসাধারণ বর্ণনা রয়েছে। তাঁরা মর্সিয়ার একটি নির্দিষ্ট কাঠামো তৈরি করেন, যাতে থাকত ‘চেহরা’ (ভূমিকা), ‘সরাপা’ (নায়কের রূপ বর্ণনা), ‘রুখসত’ (বিদায়), ‘আমদ’ (যুদ্ধক্ষেত্রে আগমন), ‘রজম’ (যুদ্ধ), ‘শাহাদাত’ (আত্মত্যাগ) এবং ‘বাইন’ (বিলাপ)। তাঁদের মর্সিয়াগুলো উর্দু সাহিত্যকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে।

দিল্লি আর লখনউয়ের এই দুটি ধারা উর্দু কবিতার দুটি ভিন্ন কিন্তু শক্তিশালী রূপকে তুলে ধরে। একটি যদি হয় হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা কান্না, অন্যটি তবে কারুকার্যময় ঝাড়বাতির উজ্জ্বল আলো।

গদ্যের নতুন ভোর: ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ও স্যার সৈয়দ 

ঊনবিংশ শতকের আগে পর্যন্ত উর্দু সাহিত্য ছিল মূলত কাব্যনির্ভর। গদ্য যা ছিল, তা হয় দাস্তান (Dastan) বা দীর্ঘ অলৌকিক কাহিনির মতো জটিল ফারসি ধাঁচের, নয়তো ধর্মীয় পুস্তিকায় সীমাবদ্ধ। এই দাস্তানগুলোর ভাষা ছিল অত্যন্ত অলংকারপূর্ণ এবং কৃত্রিম। সাধারণ মানুষের পড়ার মতো সহজ-সরল গদ্য প্রায় ছিলই না। এই ধারার পরিবর্তন এলো ব্রিটিশদের হাত ধরে।

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ (Fort William College)

১৮০০ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর-জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলি কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতে আসা তরুণ ব্রিটিশ অফিসারদের স্থানীয় ভাষা, আইন ও সংস্কৃতি শেখানো, যাতে তারা কার্যকরীভাবে প্রশাসন চালাতে পারে। এই কলেজের হিন্দুস্তানি বিভাগের অধ্যক্ষ জন গিলক্রিস্ট (John Gilchrist) বুঝতে পারলেন যে, কাজ চালানোর জন্য সহজ-সরল উর্দু গদ্যের খুব দরকার। তাঁরই উদ্যোগে মীর আম্মান (Mir Amman) দেহলভির মতো লেখকরা এগিয়ে এলেন। মীর আম্মান ফারসি ‘কিসসা-এ-চাহার দরবেশ’ অবলম্বনে লিখলেন ‘বাগ-ও-বাহার’ (Bagh-o-Bahar)। এই বইটির ভাষা ছিল অসাধারণ! দিল্লির মানুষের মুখের সহজ-সরল, চলিত ভাষায় লেখা এই বই উর্দু গদ্যে এক বিপ্লব নিয়ে এলো। এটি প্রমাণ করল যে, পাণ্ডিত্যপূর্ণ ফারসি শব্দ ব্যবহার না করেও কত সুন্দর, প্রাঞ্জল এবং শক্তিশালী গদ্য লেখা যায় (Siddiqi, 1973)। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশিত হয়, যেমন শের আলি আফসোস-এর ‘বাগ-এ-উর্দু’ এবং হায়দার বখশ হায়দরির ‘আরাইশ-এ-মহফিল’। এই কলেজকে তাই আধুনিক উর্দু গদ্যের আঁতুড়ঘর বলা হয়।

স্যার সৈয়দ আহমদ খান ও আলিগড় আন্দোলন 

উর্দু গদ্যের বিকাশে দ্বিতীয় এবং সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপটি হলো আলিগড় আন্দোলন। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর ভারতীয় মুসলমান সমাজ দিশেহারা হয়ে পড়ে। ব্রিটিশদের রোষানলে পড়ে এবং আধুনিক শিক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তারা নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছিল। এই সময়ে এগিয়ে এলেন স্যার সৈয়দ আহমদ খান (Sir Syed Ahmed Khan)। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান আর ইংরেজি শিক্ষা ছাড়া মুসলমান সমাজের উন্নতি সম্ভব নয়।

তাঁর এই সামাজিক সংস্কারের প্রধান হাতিয়ার ছিল সাহিত্য, বিশেষ করে গদ্য। তিনি ১৮৭০ সালে ‘তহজিব-উল-আখলাক’ (Tahzib-ul-Akhlaq) নামে একটি পত্রিকা বের করেন, যেখানে তিনি ধর্ম, সমাজ, শিক্ষা এবং নৈতিকতা নিয়ে সহজ-সরল এবং যুক্তিনির্ভর (Rational) ভাষায় প্রবন্ধ লিখতেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল একটাই—মানুষের মধ্যে যুক্তিবাদ, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি আর আধুনিক চিন্তার প্রসার ঘটানো। তাই তাঁর গদ্য ছিল অলংকারবর্জিত, সরাসরি, স্পষ্ট এবং উদ্দেশ্যমূলক (Purposeful)। তিনি কবিতাকে অবাস্তব কল্পনার জগৎ বলে মনে করতেন এবং গদ্যকেই সমাজ সংস্কারের প্রধান মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন (Malik, 1980)।

স্যার সৈয়দের প্রভাবে একদল অসাধারণ লেখক তৈরি হন, যাঁরা আলিগড় আন্দোলনের কাণ্ডারী ছিলেন। যেমন:

  • আলতাফ হুসেন হালী (Altaf Hussain Hali): হাল ছিলেন একাধারে কবি, সমালোচক ও জীবনীকার। তিনি স্যার সৈয়দের প্রেরণায় তাঁর বিখ্যাত দীর্ঘ কবিতা ‘মুসাদ্দাস-এ-হালী’ (Musaddas-e-Hali) রচনা করেন, যেখানে তিনি মুসলমানদের অতীত গৌরব আর বর্তমান দুরবস্থার চিত্র তুলে ধরে তাদের জাগরণের ডাক দেন। এটি মুসলিম সমাজে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। তাঁর লেখা ‘মুকাদ্দামা-এ-শের-ও-শায়রি’ (Muqaddama-e-Sher-o-Shayari) আধুনিক উর্দু সমালোচনার ভিত্তি স্থাপন করে। এতে তিনি প্রথম বলেন যে, সাহিত্যের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত সামাজিক কল্যাণ এবং তাকে বাস্তবসম্মত হতে হবে।

  • শিবলি নোমানি (Shibli Nomani): তিনি ছিলেন একজন ইসলামি চিন্তাবিদ ও ঐতিহাসিক। তিনি উর্দুতে ইসলামি ইতিহাস ও মনীষীদের জীবনী (যেমন, ‘আল-ফারুক’, ‘আল-গাজ্জালি’, ‘সিরাত-উন-নবী’) লিখে জ্ঞানচর্চার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। তাঁর গদ্য ছিল পাণ্ডিত্যপূর্ণ কিন্তু প্রাঞ্জল।

  • ডেপুটি নাজির আহমদ (Deputy Nazir Ahmad): তাঁকে উর্দু উপন্যাসের জনক বলা হয়। তিনি মূলত শিক্ষামূলক (Didactic) উপন্যাস লিখতেন, যেমন ‘মিরাত-উল-উরুস’ (Mirat-ul-Uroos – The Bride’s Mirror), যার উদ্দেশ্য ছিল নারীশিক্ষার প্রসার এবং মুসলিম পরিবারের নৈতিক সংস্কার।

  • মুহাম্মদ হুসেন আজাদ (Muhammad Husain Azad): তাঁর লেখা ‘আব-এ-হায়াত’ (Aab-e-Hayat – Water of Life) উর্দু কবিদের জীবনী ও তাঁদের কবিতার এক অনবদ্য, রসালো বর্ণনা। যদিও এতে তথ্যের কিছু ভুল আছে, কিন্তু এর সৃজনশীল ও চিত্রকল্পময় গদ্যশৈলীর জন্য এটি আজও ক্লাসিক হিসেবে সমাদৃত।

এইভাবে, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ আর আলিগড় আন্দোলনের হাত ধরে উর্দু সাহিত্য কবিতার জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে গদ্যের বিশাল প্রান্তরে পা রাখল। উপন্যাস, প্রবন্ধ, জীবনী, সমালোচনা—সবই বিকশিত হতে শুরু করল।

আধুনিক যুগ: নতুন চিন্তা, নতুন দিগন্ত

বিংশ শতাব্দীতে এসে উর্দু সাহিত্য এক নতুন বাঁক নিল। বিশ্বজুড়ে তখন নতুন নতুন চিন্তার ঢেউ—জাতীয়তাবাদ, মার্ক্সবাদ, ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্ব, অস্তিত্ববাদ। ভারতীয় উপমহাদেশে তখন স্বাধীনতার সংগ্রাম তীব্র হচ্ছে। এই সবকিছুরই প্রভাব পড়ল উর্দু সাহিত্যে।

মুহাম্মদ ইকবাল (Muhammad Iqbal): দর্শনের কবি

আধুনিক উর্দু কবিতার কথা উঠলেই যার নাম সবার আগে আসে, তিনি হলেন আল্লামা ইকবাল (Allama Iqbal)। ইকবাল কেবল একজন কবি ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন দার্শনিক। তাঁর কবিতায় গালিবের মতো দার্শনিক গভীরতা আছে, কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্য ভিন্ন। গালিব যেখানে জীবন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং সংশয় প্রকাশ করেছেন, ইকবাল সেখানে জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজেছেন এবং তার উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাঁর দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু হলো ‘খুদি’ (Khudi) বা আত্মশক্তি (Selfhood)। তিনি মনে করতেন, মানুষ তার ভেতরের সুপ্ত আত্মশক্তিকে জাগিয়ে তুলতে পারলেই প্রকৃত স্বাধীনতা, সম্মান ও সৃষ্টিশীলতার শিখরে পৌঁছতে পারে। তাঁর আদর্শ মানুষ হলো ‘শাহিন’ (Shaheen) বা বাজপাখি, যে অন্যের ফেলে দেওয়া শিকার খায় না, পাহাড়ের চূড়ায় বাসা বাঁধে এবং নিজের জগৎ নিজেই তৈরি করে।

“খুদি কো কর বুলন্দ ইতনা কি হর তকদীর সে পহলে,
খুদা বন্দে সে খুদ পুছে, বতা তেরি রজা ক্যা হ্যায়।”

(অর্থ: নিজের আত্মাকে এত উন্নত করো যে, প্রতিটি ভাগ্যলিপি লেখার আগে ঈশ্বর স্বয়ং ভক্তকে জিজ্ঞেস করবেন, “বলো, তোমার ইচ্ছাটা কী?”)

ইকবালের কবিতা উর্দু শায়রী-কে এক নতুন শক্তি ও উদ্দেশ্য দিয়েছে। তিনি গতানুগতিক গজলের পাশাপাশি নজম (Nazm)-কে তাঁর দর্শন প্রচারের প্রধান মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তাঁর লেখা ‘শিকওয়া’ (Shikwa – অভিযোগ) এবং ‘জওয়াব-এ-শিকওয়া’ (Jawab-e-Shikwa – অভিযোগের জবাব) উর্দু সাহিত্যের দুটি মাইলফলক, যেখানে তিনি ঈশ্বরের কাছে মুসলমানদের দুরবস্থার জন্য অভিযোগ করছেন এবং পরে ঈশ্বরের পক্ষ থেকে তার জবাব দিচ্ছেন। তাঁর চিন্তাধারা পাকিস্তানের জন্মকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল, তাই তাঁকে পাকিস্তানের জাতীয় কবি (National Poet) বলা হয় (Schimmel, 1963)।

উপন্যাস ও ছোটগল্পের বিকাশ: প্রেমচাঁদ থেকে মান্টো

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে মুন্সি প্রেমচাঁদ (Munshi Premchand) উর্দু এবং হিন্দি—দুই ভাষাতেই লিখে উপন্যাস ও ছোটগল্পে এক বিপ্লব আনেন। তিনিই প্রথম সাহিত্যকে রোমান্টিক জগৎ বা শুধু উচ্চবিত্তের কাহিনি থেকে বের করে এনে গ্রামের সাধারণ কৃষক, শ্রমিক আর দলিত মানুষের জীবনের সঙ্গে যুক্ত করেন। তাঁর ‘গওদান’ (Godan), ‘ময়দান-এ-অমল’ (কর্মভূমি) এর মতো উপন্যাস এবং ‘কফন’ (Kafan) বা ‘পুস কি রাত’-এর মতো ছোটগল্পগুলো ভারতীয় সমাজ বাস্তবতার এক জীবন্ত দলিল।

প্রগতিশীল লেখক আন্দোলন (Progressive Writers’ Movement):

১৯৩৬ সালে সজ্জাদ জহীরের নেতৃত্বে লক্ষ্ণৌতে শুরু হয় প্রগতিশীল আন্দোলন (Taraqqi Pasand Tehrik)কার্ল মার্ক্সের চিন্তাধারায় প্রভাবিত এই আন্দোলনের লেখকদের মূল উদ্দেশ্য ছিল সাহিত্যের মাধ্যমে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন আনা, সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ ও সামন্ততন্ত্রের বিরোধিতা করা। তাঁরা মনে করতেন, সাহিত্য শুধু বিনোদনের জন্য নয় (‘Art for art’s sake‘), সাহিত্য হলো সামাজিক ন্যায়ের হাতিয়ার (‘Art for life’s sake‘)। তাঁরা তাঁদের গল্প-কবিতায় তুলে আনলেন কৃষক-শ্রমিকের বঞ্চনা, দারিদ্র্য, সাম্প্রদায়িকতা আর সমাজের নানা অসঙ্গতির কথা।

এই আন্দোলনের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রদের মধ্যে ছিলেন:

ফয়েজ আহমদ ফয়েজ (Faiz Ahmed Faiz): ফয়েজ ছিলেন বিপ্লব আর প্রেমের কবি। তিনি উর্দু গজলের কোমল ও রোমান্টিক আঙ্গিকে ভরে দিয়েছেন বিদ্রোহের আগুন। তাঁর কবিতা একই সঙ্গে ব্যক্তিগত প্রেম আর সমষ্টিগত মুক্তির কথা বলে। বারবার কারাবরণ করেছেন, কিন্তু কলম থামাননি। তাঁর কাছে প্রেমিকার গলি আর দেশের বিপন্ন দশা একাকার হয়ে যায়। তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘মুঝসে পহলি সি মহব্বত মেরি মহবুব না মাঙ্গ’ (আমার কাছে আগের মতো ভালোবাসা চেয়ো না প্রিয়তমা) এই আদর্শের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।

“বোল কি লব আজ়াদ হ্যায়ঁ তেরে,
বোল জ়বাঁ অব তক তেরি হ্যায়।”
(অর্থ: কথা বলো, কারণ তোমার ঠোঁট স্বাধীন; কথা বলো, কারণ তোমার জিহ্বা এখনও তোমারই।)

সাদত হাসান মান্টো (Saadat Hasan Manto): উর্দু ছোটগল্পের জগতে মান্টো এক প্রতিষ্ঠান। তিনি সমাজের ভণ্ডামি, যৌন অবদমন আর অন্ধকার দিকগুলোকে কোনো রকম রাখঢাক না করে, ছুরির ফলার মতো তীক্ষ্ণ ভাষায় তুলে ধরেছেন। দেশভাগ (Partition) নিয়ে তাঁর লেখা গল্পগুলো (‘টোবা টেক সিং’, ‘খোল দো’, ‘ঠান্ডা গোশত’) মানব ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ ট্র্যাজেডির এক অসামান্য দলিল। তাঁর বিখ্যাত গল্প ‘টোবা টেক সিং’ (Toba Tek Singh) দেশভাগের নিরর্থকতাকে অমর করে রেখেছে। অশ্লীলতার অভিযোগে তাঁকে বারবার আদালতে যেতে হয়েছে, কিন্তু তিনি সত্য বলা থেকে বিরত হননি। মান্টো বলতেন, “যদি আমার লেখা আপনাদের কাছে অশ্লীল মনে হয়, তবে সমাজটাই অশ্লীল।” (Flemming, 1985)।

ইসমত চুগতাই (Ismat Chughtai): ইসমত ছিলেন এক বিদ্রোহী নারী। তিনি তাঁর লেখার মাধ্যমে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের গোঁড়ামির মূলে আঘাত করেছেন। বিশেষ করে মুসলিম মধ্যবিত্ত পরিবারের নারীদের অবদমিত জীবন, তাদের আকাঙ্ক্ষা আর মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা তিনি সাহসিকতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। তাঁর ‘লিহাফ’ (Lihaaf – The Quilt) গল্পটি প্রকাশের পর সমকামিতার ইঙ্গিতের জন্য তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল এবং তাঁকে আদালতে হাজিরা দিতে হয়েছিল।

এই আন্দোলনের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখক ছিলেন, যেমন—কৃষাণ চন্দর (Krishan Chander), রাজিন্দর সিং বেদি (Rajinder Singh Bedi), আহমদ নাদিম কাসমি (Ahmad Nadeem Qasmi) প্রমুখ। তাঁরা সবাই মিলে উর্দু সাহিত্যকে সাধারণ মানুষের খুব কাছাকাছি নিয়ে এসেছিলেন।

আধুনিকতাবাদ বা জদিদিয়ত (Modernism or Jadidiyat)

পঞ্চাশের দশকের পর প্রগতিশীল আন্দোলনের একপেশে রাজনৈতিক প্রচারণার বিরুদ্ধে একদল নতুন লেখক বিদ্রোহ করেন। তাঁরা মনে করতে শুরু করেন যে, সাহিত্যকে শুধু সামাজিক-রাজনৈতিক স্লোগানের বাহন করে ফেললে তার শৈল্পিক মূল্য কমে যায়। তাঁরা মনোযোগ দিলেন ব্যক্তির ভেতরের জগৎ, তার মনস্তত্ত্ব, বিচ্ছিন্নতাবোধ (Alienation), অস্তিত্বের সংকট (Existential Crisis) এবং চেতনার অন্তঃস্রোত (Stream of Consciousness)-এর দিকে। এই ধারাটি আধুনিকতাবাদ বা জদিদিয়ত (Jadidiyat) নামে পরিচিত।

কবিতায় আধুনিকতা: নুন মিম রাশিদ (N. M. Rashid) এবং মীরাজি (Meeraji) উর্দু কবিতায় মুক্ত ছন্দ (Free Verse) নিয়ে আসেন এবং গজলের চিরাচরিত ফর্ম ভেঙে দেন। তাঁরা ফরাসি প্রতীকীবাদী কবিদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন এবং ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্ব ও প্রতীকের সাহায্যে মানুষের অবচেতন মনের জটিলতার কথা বলেন। তাঁদের কবিতা ছিল দুর্বোধ্য এবং প্রচলিত কাব্যরুচির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

গদ্যে আধুনিকতা: এই ধারার প্রধান লেখকদের মধ্যে ছিলেন—কুররাতুল আইন হায়দার (Qurratulain Hyder) এবং ইন্তিজার হুসেন (Intizar Husain)।

  • কুররাতুল আইন হায়দার: তাঁর মহাকাব্যিক উপন্যাস ‘আগ কা দরিয়া’ (Aag ka Darya – River of Fire) উর্দু সাহিত্যের এক বিস্ময়। এই উপন্যাসে তিনি প্রায় আড়াই হাজার বছরের ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসকে চারটি ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের (গৌতম নীলম্বর, চম্পা, কামাল, সিরিল) দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরেছেন, যারা বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন নামে ফিরে আসে। সময়, ইতিহাস আর মানব অস্তিত্বের সম্পর্ক নিয়ে এমন গভীর কাজ উর্দুতে আর হয়নি। তাঁকে ‘উর্দু সাহিত্যের ভার্জিনিয়া উলফ’ বলা হয়।

  • ইন্তিজার হুসেন: তাঁর লেখায় অতীত, ঐতিহ্য আর পুরাণের (Myth) ঘন ঘন আনাগোনা দেখা যায়। দেশভাগের পর পাকিস্তান চলে গেলেও ফেলে আসা ভারতের জন্য তাঁর মধ্যে একধরনের নস্টালজিয়া বা স্মৃতিবিধুরতা কাজ করত। তিনি প্রায়ই পুরোনো দাস্তান, জাতকের গল্প আর ইসলামি লোককাহিনির আঙ্গিকে আধুনিক মানুষের বিচ্ছিন্নতা, শিকড়হীনতা ও পরিচয় সংকটের গল্প বলেছেন। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘বস্তি’ (Basti) দেশভাগের ট্র্যাজেডিকে এক অনন্য আঙ্গিকে তুলে ধরে।

উত্তর-আধুনিকতাবাদ ও সমসাময়িক ধারা (Post-Modernism and The Contemporary Scene)

আশির দশক থেকে উর্দু সাহিত্যে উত্তর-আধুনিক (Post-Modern) চিন্তার প্রভাব পড়তে শুরু করে। এই ধারার লেখকেরা কোনো একক সত্য বা একক মতাদর্শে (যেমন, মার্ক্সবাদ বা জাতীয়তাবাদ) বিশ্বাস করেন না। তাঁরা ইতিহাসকে নতুন করে দেখেন, বিভিন্ন আঙ্গিক নিয়ে খেলা করেন, প্রতিষ্ঠিত ধারণাগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন এবং লেখকের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করেন।

এই ধারার অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব হলেন শামসুর রহমান ফারুকি (Shamsur Rahman Faruqi)। তিনি একাধারে সমালোচক, তাত্ত্বিক, কবি এবং ঔপন্যাসিক। তাঁর পত্রিকা ‘শবখুন’ (Shabkhoon) আধুনিকতাবাদী ও উত্তর-আধুনিকতাবাদী চিন্তার প্রধান প্ল্যাটফর্ম ছিল। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘কই চাঁদ থে সর-এ-আসমাঁ’ (Kai Chand The Sar-e-Aasman) উনিশ শতকের দিল্লি, সেখানকার কবি ও এক তওয়ায়েফের জীবনকে এক নতুন আঙ্গিকে, ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে তুলে ধরে।

আজকের দিনে উর্দু সাহিত্য ভারত, পাকিস্তান এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা প্রবাসী (Diaspora) লেখকদের হাত ধরে নতুন নতুন পথে বিকশিত হচ্ছে। সামাজিক মাধ্যম, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকাগুলো নতুন লেখকদের জন্য এক নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দিয়েছে। তবে এটাও সত্যি যে, বিশ্বায়নের এই যুগে ইংরেজি ভাষার দাপটে এবং রাজনৈতিক কারণে উর্দু ভাষা তার আগের গৌরব কিছুটা হলেও হারিয়েছে, বিশেষ করে ভারতে। একে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতাও এর স্বাভাবিক বিকাশকে ব্যাহত করেছে।

উর্দু সাহিত্যের বিবিধ ধারা (Various Genres of Urdu Literature)

উর্দু সাহিত্যের বিশালতা বুঝতে হলে এর বিভিন্ন আঙ্গিক বা জঁরা সম্পর্কে একটু ধারণা থাকা ভালো।

  • গজল (Ghazal): এটি উর্দু কবিতার সবচেয়ে জনপ্রিয় আঙ্গিক। এর প্রতিটি শের বা দ্বিপদী স্বয়ংসম্পূর্ণ, কিন্তু সবগুলো শের একই রদিফ (Radif – পুনরাবৃত্ত শব্দ বা শব্দগুচ্ছ) এবং কাফিয়া (Qafiya – অনুপ্রাস) দ্বারা আবদ্ধ থাকে। শেষ শের-এ কবির তখল্লুস বা ছদ্মনাম থাকে, যাকে ‘মক্তা’ বলে।

  • নজম (Nazm): নজম মানে ‘সংগঠিত’ বা ‘মালা গাঁথা’। গজলের মতো এর প্রতিটি শের আলাদা নয়, বরং একটি কেন্দ্রীয় ভাবকে ঘিরে পুরো কবিতাটি গড়ে ওঠে। আধুনিক যুগে নজম খুবই জনপ্রিয় হয়েছে।

  • কাসিদা (Qasida): এটি মূলত কোনো রাজা, পৃষ্ঠপোষক বা কোনো বিষয়ের প্রশংসায় লেখা দীর্ঘ কবিতা। সওদা এই ধারার শ্রেষ্ঠ কবি।

  • মর্সিয়া (Marsiya): কারবালার ঘটনা নিয়ে লেখা শোককাব্য। মীর আনিস ও মির্জা দবির এর শ্রেষ্ঠ রূপকার।

  • মসনভি (Masnavi): দীর্ঘ কাহিনিকাব্য, যার প্রতিটি শের-এর দুটি পঙক্তিই অন্ত্যমিলযুক্ত (rhyming couplets)। মীর হাসান-এর ‘সেহর-উল-বয়ান’ একটি বিখ্যাত মসনভি।

  • দাস্তান (Dastan): দীর্ঘ, জটিল এবং কল্পনাশ্রয়ী গদ্য কাহিনি, যাতে যুদ্ধ, প্রেম, জাদু এবং অলৌকিক ঘটনার ছড়াছড়ি। ‘দাস্তান-এ-আমির হামজা’ এর সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণ।

  • আফসানা (Afsana): আধুনিক ছোটগল্প। প্রেমচাঁদ, মান্টো, ইসমত চুগতাই—এঁরা সবাই আফসানাকে সমৃদ্ধ করেছেন।

  • ইনশাইয়া (Inshaiyya): হালকা মেজাজের রম্যরচনা বা ব্যক্তিগত প্রবন্ধ, যা কোনো নির্দিষ্ট কাঠামো মানে না।

শেষ কথা

তাহলে, এই হলো উর্দু সাহিত্য নামক মায়াবী নদীর সংক্ষিপ্ত উপাখ্যান। যে নদীর জন্ম হয়েছিল সৈনিকদের শিবিরে এক মিশ্র বুলি হিসেবে, যে নদী দাক্ষিণাত্যের মালভূমিতে খুঁজে পেয়েছিল তার প্রথম সাহিত্যিক আশ্রয়। তারপর সে ফিরে এসেছিল দিল্লিতে, যেখানে মীর আর গালিবের হাত ধরে তার জলে মিশেছিল গভীর বিষাদ আর দার্শনিকতা। সেখান থেকে সে বয়ে গেছে লখনউয়ের জমকালো দরবার দিয়ে, যেখানে তার স্রোতে যুক্ত হয়েছিল অলংকারের ঝংকার। আলিগড় আন্দোলনের হাত ধরে এই নদী গদ্যের শক্ত জমিতে নতুন খাত তৈরি করেছে, যা দিয়ে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্রোত বয়ে গেছে। বিংশ শতাব্দীতে এসে এই নদী বুকে ধারণ করেছে ইকবালের আত্মশক্তির ডাক, ফয়েজের বিপ্লব আর মান্টোর দ্রোহ।

আজ এই নদী বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। ভারত, পাকিস্তান ছাড়াও বিশ্বের যেখানেই দক্ষিণ এশীয় মানুষ আছে, সেখানেই এই ভাষার স্রোত বহমান। বলিউড সিনেমার গান থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসব—সবখানেই তার উপস্থিতি।

তবে মাঝে মাঝে মনে হয়, এই নদীর ভবিষ্যৎ কী? বিশ্বায়নের এই যুগে ইংরেজি ভাষার দাপটে উর্দু কি তার জৌলুস হারাচ্ছে? নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কি গালিব বা ফয়েজকে ঠিকমতো চেনে? ভারতে একে ঘিরে যে রাজনৈতিক বিতর্ক, তা কি এর স্বাভাবিক প্রবাহকে রুদ্ধ করে দিচ্ছে?

এইসব প্রশ্ন মনে এলে একটু বিষণ্ণ লাগে। মনে হয়, এত সুন্দর একটা নদী কি ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাবে? কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়, যে ভাষা এত ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে টিকে আছে, এত মানুষের হাসি-কান্না, প্রেম আর বিদ্রোহকে ধারণ করেছে, সে এত সহজে হারিয়ে যাবে না। হয়তো সে নতুন কোনো বাঁক নেবে, নতুন কোনো রূপে আমাদের সামনে আসবে। কারণ ভাষা তো নদীর মতোই। সে নিজের পথ ঠিকই খুঁজে নেয়। আমাদের কাজ হলো শুধু সেই স্রোতের পাশে বসে তার সৌন্দর্য উপভোগ করা আর তার গল্প শোনা। সেই গল্প এখনও ফুরিয়ে যায়নি। এই নদীর স্রোত এখনও বহমান এবং নতুন গল্প বলার জন্য সে চিরপ্রস্তুত।

তথ্যসূত্র

  • Flemming, L. A. (1985). Another Lonely Voice: The Life and Works of Saadat Hasan Manto. Vanguard Books.
  • Malik, H. (1980). Sir Sayyid Ahmad Khan and Muslim Modernization in India and Pakistan. Columbia University Press.
  • Matthews, D. J., & Shackle, C. (1972). An Anthology of Classical Urdu Love Lyrics. Oxford University Press.
  • Pritchett, F. W. (1994). Nets of Awareness: Urdu Poetry and Its Critics. University of California Press.
  • Russell, R. (1997). The Pursuit of Urdu Literature: A Select History. Zed Books.
  • Russell, R. (1999). The Famous Ghalib: The Sound of My Moving Pen. Oxford University Press.
  • Sadiq, M. (1984). A History of Urdu Literature (2nd ed.). Oxford University Press.
  • Schimmel, A. (1963). Gabriel’s Wing: A Study into the Religious Ideas of Sir Muhammad Iqbal. E.J. Brill.
  • Schimmel, A. (1975). Classical Urdu Literature from the Beginning to Iqbal. Otto Harrassowitz Verlag.
  • Siddiqi, A. (1973). Gilchrist and the ‘Language of Hindoostan’. Rachna Prakashan.
  • Zaheer, S. S. (1947). The Progress of a Genius: A Glimpse into the Life and Works of Ismat Chughtai. (Translated from Urdu). Asia Publishing House.
  • Faruqi, S. R. (2001). Early Urdu Literary Culture and History. Oxford University Press.
  • Hyder, Q. (1999). River of Fire (Aag ka Darya, translated by the author). New Directions.

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.