আইডিওলজি বা ভাবাদর্শের চশমা: যে কাঁচের ভেতর দিয়ে আমরা জগৎ দেখি

Table of Contents

ভূমিকা

বৃষ্টির দিন। বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছি। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ অপূর্ব এক সঙ্গীত তৈরি করেছে। এই শব্দের সাথে আমার শৈশবের স্মৃতি, ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ আর টিনের চালের নিচে বসে গরম খিচুড়ি খাওয়ার এক নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে। আমার কাছে এই ঝমঝম শব্দ মানেই একরাশ মুগ্ধতা, একরাশ নস্টালজিয়া। এই শব্দ আমাকে আমার শিকড়ের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যায়, এক সরল ও নিরাপদ অতীতে ডুব দিতে সাহায্য করে।

পাশের ফ্ল্যাটের ভদ্রলোক বিরক্ত মুখে এসে দাঁড়ালেন। কপাল কুঁচকে বললেন, “কী যে এক উৎপাত শুরু হলো! এই ঝুম বৃষ্টিতে বাইরেও যাওয়া যাবে না, আবার টিনের চালে এই বিকট শব্দে মাথা ধরে যাচ্ছে। অসহ্য! আধুনিক বিল্ডিংয়ে এই একটাই সমস্যা, শান্তির উপায় নেই।”

আমি অবাক হলাম না। শুধু একটু হাসলাম। একই বৃষ্টি, একই শব্দ, একই বাস্তবতা। অথচ আমাদের দুজনের অনুভূতি সম্পূর্ণ বিপরীত। আমার কাছে যা স্বর্গীয় সঙ্গীত, তাঁর কাছে তা অসহ্য কোলাহল। কেন?

ব্যাপারটা খুব সহজ, আবার একই সাথে অতলস্পর্শী জটিল। আমি আর তিনি একই পৃথিবী দেখছি না। আমরা দুজনেই একজোড়া অদৃশ্য চশমা পরে আছি। এই চশমাগুলো আমরা কোনো দোকান থেকে কিনিনি; সমাজ, পরিবার, শিক্ষা, সংস্কৃতি আর আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা মিলেমিশে আমাদের চোখের ওপর এই চশমা পরিয়ে দিয়েছে। সেই চশমার কাঁচ আমাদের বাস্তবতাকে ভিন্ন ভিন্ন রঙে রাঙিয়ে দিচ্ছে। আমার চশমার কাঁচ হয়তো স্মৃতিকাতরতার নীল, যা অতীতকে সুন্দর করে দেখে। আর তাঁর চশমার কাঁচ হয়তো আধুনিকতার ধূসর, যা উপযোগিতা আর শান্তিকেন্দ্রিক। এই চশমা শুধু আমাদের দেখার রঙকেই বদলে দেয় না, এর লেন্সের পাওয়ার বা ফোকাসও ভিন্ন। কোনো চশমা কাছের জিনিস ভালো দেখায়, কোনোটা দূরের। কোনোটা পৃথিবীকে বড় করে দেখায়, কোনোটা ছোট। এই অদৃশ্য চশমাটির একটি গালভরা নাম আছে—ভাবাদর্শ বা আইডিওলজি (Ideology)

আমরা প্রত্যেকেই এই চশমা পরে থাকি। নিজের অজান্তেই। এই চশমা আমাদের বলে দেয় কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ; কোনটা সুন্দর, কোনটা অসুন্দর; কোনটা ন্যায়, কোনটা অন্যায়। এই চশমা ছাড়া আমরা জগৎকে দেখতে পাই না, বুঝতেও পারি না, কারণ জগৎ তখন হয়ে ওঠে অর্থহীন, বিশৃঙ্খল তথ্যের সমষ্টি। চলুন, আজ এই রহস্যময় চশমাটির নাড়ি-নক্ষত্র নিয়ে একটি দীর্ঘ ও গভীর আলাপে বসা যাক।

ভাবাদর্শ আসলে কী?

ভাবাদর্শ শব্দটা শুনলেই আমাদের মাথায় রাজনীতি, মিছিল, স্লোগান, দলীয় পতাকা আর বিপ্লবী তত্ত্বের কথা আসে। ব্যাপারটা ঠিক, কিন্তু এটি ভাবাদর্শের বিশাল রাজ্যের একটি ছোট অংশ মাত্র। ভাবাদর্শ আসলে এর চেয়েও অনেক বড়, সূক্ষ্ম এবং গভীর একটি ধারণা।

সবচেয়ে সহজ ভাষায় বললে, ভাবাদর্শ হলো বিশ্বাস, ধারণা, মূল্যবোধ আর লক্ষ্যের একটি সুসংহত কাঠামো (a coherent system of beliefs, ideas, values, and goals)। এটি একটি মানসিক মানচিত্রের (mental map) মতো, যা আমাদের চারপাশের অসীম ও জটিল পৃথিবীকে বুঝতে, ব্যাখ্যা করতে এবং একটি অর্থপূর্ণ রূপ দিতে সাহায্য করে। এই মানচিত্র আমাদের কয়েকটি মৌলিক প্রশ্নের উত্তর দেয়, যা প্রতিটি সমাজ ও ব্যক্তিকে মোকাবেলা করতে হয়:

১. পৃথিবীটা এখন কেমন আছে? (The Descriptive Question): এই প্রশ্নটির উত্তর ভাবাদর্শের সূচনা করে। এটি বর্তমানের একটি চিত্র বা ডায়াগনোসিস।

  • একজন উদারনীতিবাদীর চোখে, পৃথিবীটা হয়তো অসম্পূর্ণ কিন্তু ব্যক্তি-স্বাধীনতার বিকাশের মাধ্যমে ক্রমশ উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এখানে বাজার অর্থনীতির মাধ্যমে সম্পদ তৈরি হচ্ছে, যদিও কিছু বৈষম্য রয়ে গেছে।

  • একজন মার্ক্সবাদীর চোখে, এটি শ্রেণি-শোষণে জর্জরিত এক অন্যায্য ব্যবস্থা, যেখানে বুর্জোয়া শ্রেণি প্রলেতারিয়েতের শ্রম শোষণ করে মুনাফা লুটছে।

  • একজন কট্টর পরিবেশবাদীর চোখে, পৃথিবী লাগামহীন ভোগবাদের কারণে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা এক মুমূর্ষু গ্রহ, যার বাস্তুতন্ত্র ভেঙে পড়ছে।

  • একজন নারীবাদীর চোখে, এটি একটি পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো যেখানে নারীর কণ্ঠ, শ্রম ও অধিকার পদ্ধতিগতভাবে দমন করা হয়।

  • একজন ধর্মীয় মৌলবাদীর চোখে, পৃথিবীটা নৈতিক অবক্ষয়, বস্তুবাদ আর অধার্মিকতায় ডুবে গেছে, যা ঈশ্বরের নির্দেশিত পথ থেকে বিচ্যুত।

এই ‘বর্তমান চিত্র’ হলো প্রতিটি ভাবাদর্শের ভিত্তিপ্রস্তর।

২. পৃথিবীটা কেন এমন হলো? (The Explanatory Question): বর্তমান চিত্রটি আঁকার পর ভাবাদর্শ এর পেছনের কারণ ব্যাখ্যা করে। পৃথিবী যদি অন্যায্য হয়, তবে তার কারণ কী?

  • উদারনীতিবাদীরা হয়তো বলবেন, কিছু ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ বা সুযোগের অভাবই বৈষম্যের কারণ।

  • মার্ক্সবাদীরা বলবেন, ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণাই সকল শোষণ ও শ্রেণিদ্বন্দ্বের মূল। পুঁজিবাদের ঐতিহাসিক বিকাশই এর জন্য দায়ী।

  • পরিবেশবাদীরা বলবেন, শিল্পবিপ্লব পরবর্তী মানবকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি (Anthropocentrism) এবং সীমাহীন প্রবৃদ্ধির লোভই এই পরিবেশগত সংকটের কারণ।

  • রক্ষণশীলরা হয়তো বলবেন, ঐতিহ্য, ধর্ম ও নৈতিকতার অবক্ষয়ের কারণে সমাজের এই অবস্থা। পরিবারের কাঠামো ভেঙে যাওয়াই এর মূল কারণ।

  • নারীবাদীরা বলবেন, হাজার হাজার বছরের পুরুষতান্ত্রিক ইতিহাস, যেখানে ক্ষমতা, জ্ঞান ও সম্পদ পুরুষের হাতে কেন্দ্রীভূত ছিল, সেটাই আজকের লিঙ্গীয় বৈষম্যের কারণ।
    এই ব্যাখ্যা ভাবাদর্শকে একটি তাত্ত্বিক ভিত্তি বা কার্যকারণ সম্পর্ক (causal logic) দেয়।

৩. ভবিষ্যতে পৃথিবীটা কেমন হওয়া উচিত? (The Normative/Prescriptive Question): বর্তমানের রোগনির্ণয় এবং কারণ ব্যাখ্যার পর ভাবাদর্শ একটি আদর্শ সমাজের রূপরেখা বা ইউটোপিয়া (Utopia) তৈরি করে। এটি একটি স্বপ্নের জগৎ, যেখানে বর্তমানের সকল সমস্যা দূর হয়ে গেছে।

  • মার্ক্সবাদীদের কাছে সেই স্বপ্ন হলো শ্রেণিহীন, শোষণহীন সাম্যবাদী সমাজ।

  • উদারনীতিবাদীদের কাছে সেটি এমন এক জগৎ যেখানে প্রতিটি ব্যক্তির স্বাধীনতা ও অধিকার সর্বোচ্চ সুরক্ষিত।

  • জাতীয়তাবাদীদের কাছে সেটি এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে তাদের জাতির গৌরব ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত।

  • পরিবেশবাদীদের কাছে সেটি একটি টেকসই সমাজ, যেখানে মানুষ প্রকৃতির সাথে ভারসাম্য বজায় রেখে বসবাস করবে।
    এই ‘আদর্শ চিত্র’ মানুষকে অনুপ্রাণিত করে এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করে।

৪. সেই আদর্শ সমাজে পৌঁছানোর পথ কী? (The Practical/Strategic Question): সবশেষে, ভাবাদর্শ বর্তমান অবস্থা থেকে সেই আদর্শ অবস্থায় পৌঁছানোর জন্য একটি নির্দিষ্ট পথ বা কর্মপন্থা বাতলে দেয়।

  • সেই পথ কি হবে বিপ্লবী? অর্থাৎ, বর্তমান কাঠামোকে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে উপড়ে ফেলে নতুন সমাজ গড়া (যেমনটা মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদীরা বিশ্বাস করেন)?

  • নাকি সংস্কারপন্থী? অর্থাৎ, বিদ্যমান ব্যবস্থার মধ্যেই ধীরে ধীরে আইনি ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা (যেমনটা সামাজিক গণতন্ত্রী বা সোশ্যাল ডেমোক্র‍্যাটরা চান)?

  • পথটি কি অহিংস অসহযোগ (গান্ধীবাদ), নাকি সশস্ত্র প্রতিরোধ?

  • এজেন্ট অফ চেঞ্জ বা পরিবর্তনের কাণ্ডারী কারা হবে? শ্রমিক শ্রেণি, বুদ্ধিজীবী, অভিজাত শ্রেণি, নাকি সাধারণ নাগরিক?
    এই কর্মপন্থাই ভাবাদর্শকে একটি বিমূর্ত দর্শন থেকে একটি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে রূপান্তরিত করে।

এই চারটি প্রশ্নের উত্তর যে কাঠামো দেয়, সেটাই হলো ভাবাদর্শ। এটি শুধু রাজনৈতিক দলের ইশতেহার নয়; এটি আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাপনের অংশ। আপনি কোন পোশাক পরবেন (ঐতিহ্যবাহী না পাশ্চাত্য?), কোন ভাষায় কথা বলবেন (মাতৃভাষা না ইংরেজি?), কাকে বিয়ে করবেন (প্রেম করে না পারিবারিকভাবে?), সন্তানের নাম কী রাখবেন (ধর্মীয়, আধুনিক না ঐতিহ্যবাহী?)—এর সবকিছুর পেছনেই কোনো না কোনো ভাবাদর্শগত ছায়া কাজ করে (Eagleton, 1991)।

ভাবাদর্শের জন্ম কিন্তু খুব বেশিদিন আগে নয়। ফরাসি বিপ্লবের (French Revolution) সময়কার বুদ্ধিবৃত্তিক আলোড়নের মধ্যে আঁতোয়ান দেস্ত্যু দ্য ত্রাসি (Antoine Destutt de Tracy) নামের একজন ফরাসি দার্শনিক প্রথম ‘idéologie’ শব্দটি ব্যবহার করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল অত্যন্ত মহৎ এবং জ্ঞানদীপ্তি (Enlightenment) দ্বারা অনুপ্রাণিত। তিনি ‘আইডিয়ার বিজ্ঞান’ বা ‘Science of Ideas’ তৈরি করতে চেয়েছিলেন, যা দিয়ে মানুষের মন থেকে সব ধরনের কুসংস্কার, অযৌক্তিক বিশ্বাস এবং ধর্মীয় গোঁড়ামি দূর করে একটি যুক্তিনির্ভর সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যাবে। কিন্তু ক্ষমতার রঙ্গমঞ্চে এই নিরীহ দর্শন বেশিদিন টিকতে পারল না। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, যিনি ছিলেন একজন চরম বাস্তববাদী ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক শাসক, এই ধারণাটিকে একদমই পছন্দ করলেন না। তিনি ত্রাসি ও তাঁর অনুসারীদের ‘ভাববাদী’ (ideologues) বলে ব্যঙ্গ করতে শুরু করেন। নেপোলিয়নের চোখে তারা ছিল বাস্তব পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন, অলীক স্বপ্ন দেখা একদল বুদ্ধিজীবী, যারা রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ (Kennedy, 1978)। তখন থেকেই ভাবাদর্শ শব্দটি একটি নেতিবাচক অর্থ বহন করতে শুরু করে—বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন, অবাস্তব তত্ত্ব বা আরও খারাপ অর্থে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হেয় করার একটি গালি।

মার্ক্সীয় দৃষ্টিকোণ: শাসকের অদৃশ্য চশমা

ভাবাদর্শের আলোচনায় যাঁর কথা না বললেই নয়, তিনি হলেন কার্ল মার্ক্স (Karl Marx)। মার্ক্স এবং তাঁর আজীবনের বন্ধু ও সহযোদ্ধা ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস (Friedrich Engels) ভাবাদর্শকে সম্পূর্ণ নতুন এবং বিপ্লবী একটি চোখে দেখেছিলেন। তাঁদের কাছে ভাবাদর্শ কোনো নিরপেক্ষ ‘আইডিয়ার বিজ্ঞান’ নয়, এটি একটি শক্তিশালী ও অদৃশ্য অস্ত্র। কার অস্ত্র? শাসকশ্রেণীর অস্ত্র।

মার্ক্সীয় তত্ত্বে সমাজকে একটি দ্বিতল বাড়ির সাথে তুলনা করা হয়:

  • ভিত্তি (Base/Basis): সমাজের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, অর্থাৎ উৎপাদন ব্যবস্থা (mode of production)। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হলো উৎপাদনের উপকরণ (means of production) যেমন—জমি, কলকারখানা, যন্ত্রপাতি এবং উৎপাদন সম্পর্ক (relations of production), অর্থাৎ এই উপকরণগুলোর মালিক কারা (বুর্জোয়া/পুঁজিপতি) এবং কারা কেবল শ্রম বিক্রি করে বেঁচে থাকে (প্রলেতারিয়েত/শ্রমিক)। মার্ক্সের মতে, এই অর্থনৈতিক ভিত্তিই হলো সমাজের মূল চালিকাশক্তি।

  • উপরিকাঠামো (Superstructure): এই অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে সমাজের বাকি সবকিছু—রাষ্ট্র, আইন, রাজনীতি, বিচারব্যবস্থা, সংস্কৃতি, ধর্ম, নৈতিকতা, শিল্পকলা এবং অবশ্যই ভাবাদর্শ।

মার্ক্সের যুগান্তকারী তত্ত্ব টি ছিল, অর্থনৈতিক ভিত্তিই উপরিকাঠামোকে নির্ধারণ করে (The base determines the superstructure)। অর্থাৎ, যে শ্রেণীর হাতে সমাজের অর্থনৈতিক ক্ষমতা থাকে (মালিক শ্রেণী), তারাই সমাজের চিন্তা-ভাবনা, বিশ্বাস ও মূল্যবোধকে নিয়ন্ত্রণ করে। শাসকশ্রেণী তাদের নিজেদের শ্রেণীস্বার্থ রক্ষা করার জন্য এমন সব ধারণা, বিশ্বাস ও নৈতিকতার জন্ম দেয় এবং সেগুলোকে সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়, যা তাদের শাসন ও শোষণকে কেবল বৈধতাই দেয় না, বরং সেটিকে একটি স্বাভাবিক, চিরন্তন এবং অনিবার্য ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে (Marx & Engels, 1846/1976)।

একেই মার্ক্সবাদীরা বলেন মিথ্যা চেতনা (False Consciousness)

একটি ক্লাসিক উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। একটি পুঁজিবাদী সমাজে মালিক পক্ষ শ্রমিকদের যথাসম্ভব কম মজুরি দিয়ে তাদের শ্রম থেকে অর্জিত উদ্বৃত্ত মূল্য (surplus value) আত্মসাৎ করে মুনাফা লাভ করে। মার্ক্সের মতে, এটি একটি নির্লজ্জ শোষণ। এখন শ্রমিকরা যদি এই শোষণটি বুঝতে পেরে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিদ্রোহ করে, তাহলে তো মালিক শ্রেণীর সর্বনাশ! তাই শাসক শ্রেণী সমাজে একটি শক্তিশালী ভাবাদর্শ ছড়িয়ে দেয়: “পরিশ্রমই সৌভাগ্যের প্রসূতি। যে কেউ কঠোর পরিশ্রম ও মেধা দিয়ে ধনী হতে পারে। যারা গরিব, তারা আসলে অলস, অযোগ্য বা যথেষ্ট বুদ্ধিমান নয়।”

এই ধারণাটি একটি অত্যন্ত কার্যকর ভাবাদর্শ। যখন একজন শ্রমিক এই কথাটিকে ধ্রুব সত্য বলে বিশ্বাস করে এবং নিজের দারিদ্র্যের জন্য নিজেকে বা নিজের ভাগ্যকে দায়ী করে, সিস্টেম বা মালিক শ্রেণীকে নয়, তখন সে আসলে ‘মিথ্যা চেতনা’র শিকার। সে শাসকের তৈরি করা অদৃশ্য চশমা দিয়েই জগৎ দেখছে এবং নিজের শোষণকে একটি স্বাভাবিক বাস্তবতা হিসেবে মেনে নিচ্ছে। ‘আমেরিকান ড্রিম’ এই ভাবাদর্শের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

মার্ক্সীয় তত্ত্বে, পুঁজিবাদী ভাবাদর্শ আরও দুটি শক্তিশালী ধারণার জন্ম দেয়:

  • বিচ্ছিন্নতাবোধ (Alienation): শ্রমিক তার নিজের শ্রমের ফল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সে যে পণ্য তৈরি করে, তার ওপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। সে তার সৃজনশীলতা হারিয়ে কেবল যন্ত্রের একটি অংশে পরিণত হয় এবং সহকর্মী ও নিজের মানবসত্তা থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

  • পণ্য-ফেটিশিজম বা বস্তুভক্তিবাদ (Commodity Fetishism): পুঁজিবাদী সমাজে পণ্যের একটি জাদুকরী বা অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা তৈরি হয়। আমরা পণ্যের পেছনের মানবিক শ্রম ও শোষণকে ভুলে গিয়ে কেবল পণ্যের ব্র্যান্ড, মূল্য এবং আকর্ষণকেই দেখি। মানুষের মধ্যকার সামাজিক সম্পর্কগুলো তখন পণ্যের মধ্যকার সম্পর্কে রূপান্তরিত হয়। যেমন, আইফোন থাকা বা না থাকা দিয়ে সামাজিক মর্যাদা নির্ধারিত হয়।

ধর্মকেও মার্ক্সবাদীরা একই কাতারে ফেলেন। মার্ক্সের সেই বিখ্যাত উক্তি—“ধর্ম হলো জনগণের আফিম” (Religion is the opium of the people)—এই ধারণারই প্রকাশ। তাঁদের মতে, ধর্ম শোষিত ও নিপীড়িত মানুষকে এই ইহলৌকিক জীবনের দুঃখ-কষ্ট, বঞ্চনা ভুলিয়ে রাখার জন্য একটি পারলৌকিক সুখের (স্বর্গ) স্বপ্ন দেখায়। এই আফিমের ঘোরে আচ্ছন্ন মানুষ ভাবে, এই জীবনে কষ্ট করলে পরকালে সুখ পাওয়া যাবে। ফলে, তারা আর বিদ্যমান শোষণমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার কথা ভাবে না (Marx, 1844/1975)।

মার্ক্সীয় দৃষ্টিতে ভাবাদর্শ তাই একটি নেতিবাচক, প্রতারণামূলক জিনিস—এটি বাস্তবতাকে আড়াল করে (camera obscura-র মতো উল্টো প্রতিবিম্ব তৈরি করে), শোষণকে টিকিয়ে রাখে এবং বিপ্লবী চেতনাকে ভোঁতা করে দেয়।

মার্ক্সবাদের পর: নতুন ভাবনা ও জটিল তত্ত্ব

মার্ক্সের ধারণাটি ছিল যুগান্তকারী, কিন্তু পরবর্তীকালের চিন্তাবিদরা ভাবলেন, ব্যাপারটা এতটা একরৈখিক নয়। ভাবাদর্শ কি কেবলই শাসকের চাপিয়ে দেওয়া ‘মিথ্যা চেতনা’? আমরা কি এতটাই নিষ্ক্রিয় ও বোকা? সংস্কৃতি, ভাষা বা মনস্তত্ত্বের কি কোনো ভূমিকা নেই? এই প্রশ্নগুলো থেকেই ভাবাদর্শের আলোচনা আরও জটিল, সূক্ষ্ম ও মজার দিকে মোড় নেয়।

আন্তোনিও গ্রামশি ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য (Antonio Gramsci and Hegemony)

ইতালির মার্ক্সবাদী চিন্তাবিদ ও বিপ্লবী আন্তোনিও গ্রামশি (Antonio Gramsci) মুসোলিনির কারাগারে বসে তাঁর বিখ্যাত Prison Notebooks-এ এক অসাধারণ তত্ত্ব দাঁড় করালেন। তিনি প্রশ্ন করলেন, মার্ক্সের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোতে কেন শ্রমিক বিপ্লব হলো না? তাঁর উত্তর ছিল, শাসকশ্রেণী কেবল জোরজবরদস্তি দিয়ে শাসন করে না।

গ্রামশি রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে দুটি ভাগে ভাগ করলেন:

  • দমন (Domination/Coercion): এটি হলো রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ, বলপ্রয়োগকারী ক্ষমতা, যা পুলিশ, মিলিটারি, আইন-আদালত ও কারাগারের মাধ্যমে প্রয়োগ করা হয়। একে তিনি বলেছেন ‘রাজনৈতিক সমাজ’ (Political Society)

  • সম্মতি (Consent/Hegemony): এটি হলো রাষ্ট্রের পরোক্ষ, কিন্তু আরও অনেক বেশি শক্তিশালী ক্ষমতা। শাসকশ্রেণী তাদের ভাবাদর্শকে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে—শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, গণমাধ্যম—এমনভাবে ছড়িয়ে দেয় যে শোষিত শ্রেণী বা সাধারণ মানুষ সেটাকে নিজেদেরই ‘স্বাভাবিক’, ‘প্রাকৃতিক’ বা ‘সাধারণ জ্ঞান’ (common sense) বলে মনে করতে শুরু করে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষের ‘সম্মতি’ আদায় করে শাসন করার নামই হলো সাংস্কৃতিক আধিপত্য বা হেজিমনি (Cultural Hegemony)। এটি কার্যকর হয় ‘নাগরিক সমাজ’ (Civil Society)-এর মাধ্যমে।

এই আধিপত্য কীভাবে তৈরি হয়?

  • স্কুলের পাঠ্যবইয়ে আমরা দেশের গৌরবময় ইতিহাস পড়ি, কিন্তু প্রায়শই সেই ইতিহাসের অন্ধকার দিকগুলো, যেমন—শ্রেণী সংগ্রাম, জাতিগত নিপীড়ন বা কৃষকদের বিদ্রোহের কথা সুকৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়।

  • সিনেমায় আমরা দেখি, একজন সৎ, পরিশ্রমী ও একক নায়ক শেষ পর্যন্ত সব বাধা পেরিয়ে সফল হয়। এটি আমাদের এই বিশ্বাস শেখায় যে, ব্যক্তিগত প্রচেষ্টাই সাফল্যের একমাত্র চাবিকাঠি, ব্যবস্থার কোনো দোষ নেই।

  • বিজ্ঞাপন আমাদের শেখায়, নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের পণ্য ব্যবহার করলেই আমরা সুখী, আধুনিক ও আকর্ষণীয় হতে পারব, যা আসলে ভোগবাদী সংস্কৃতিরই প্রচার।

এই সবকিছুই হেজিমনির অংশ। আমরা নিজের অজান্তেই শাসকের মূল্যবোধকে গ্রহণ করি এবং তাদের শাসনকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করি। গ্রামশির তত্ত্ব আমাদের দেখায়, ভাবাদর্শ কেবল ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয় না, এটি একটি চলমান সংগ্রাম ক্ষেত্র (a site of struggle)। আমরা নিজেরাই এর নির্মাণ ও পুনরুৎপাদনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিই (Gramsci, 1971)। তবে গ্রামশি আশার কথাও শুনিয়েছেন। তিনি বলেছেন, শাসক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীদের (Traditional Intellectuals) বিপরীতে শোষিত শ্রেণীও তাদের নিজস্ব ‘জৈব বুদ্ধিজীবী’ (Organic Intellectuals) তৈরি করতে পারে, যারা একটি বিকল্প ভাবাদর্শ বা ‘কাউন্টার-হেজিমনি’ (Counter-Hegemony) তৈরি করে সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করবে।

লুই আলথুসার ও ভাবাদর্শগত যন্ত্র (Louis Althusser and Ideological Apparatuses)

ফরাসি দার্শনিক লুই আলথুসার (Louis Althusser) ভাবাদর্শের আলোচনাকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেলেন। তিনি গ্রামশির ধারণাকে ভিত্তি করে বললেন, রাষ্ট্র দু ধরনের যন্ত্রের মাধ্যমে তার ক্ষমতা ও উৎপাদন সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখে:

  • রাষ্ট্রীয় দমনমূলক যন্ত্র (Repressive State Apparatus – RSA): এর মধ্যে পড়ে সরকার, প্রশাসন, পুলিশ, সেনাবাহিনী, আদালত, কারাগার ইত্যাদি। এরা মূলত বলপ্রয়োগের মাধ্যমে শাসন টিকিয়ে রাখে।

  • রাষ্ট্রীয় ভাবাদর্শগত যন্ত্র (Ideological State Apparatus – ISA): এর মধ্যে পড়ে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান (চার্চ, মন্দির, মসজিদ), শিক্ষা ব্যবস্থা, পরিবার, আইন, রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম, এবং শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি। এরা বলপ্রয়োগ করে না, বরং ভাবাদর্শ প্রচারের মাধ্যমে মানুষের ‘সম্মতি’ আদায় করে।

আলথুসারের মতে, দীর্ঘমেয়াদে ISA দমনমূলক যন্ত্রের (RSA) চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর ও লাভজনক। কারণ পুলিশ দিয়ে মানুষকে জোর করে দাবিয়ে রাখা যায়, কিন্তু তাদের চিন্তা-ভাবনা ও মননকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে আর জোর করার প্রয়োজনই হয় না (Althusser, 1971/2001)।

আলথুসার আরও একটি যুগান্তকারী ধারণা দেন, যার নাম ইন্টারপেলেশন বা আহ্বান (Interpellation)। তাঁর মতে, “ভাবাদর্শ ব্যক্তিকে ‘সাবজেক্ট’ (Subject) বা কর্তা হিসেবে আহ্বান করে।”

ব্যাপারটা একটু জটিল শোনালেও খুবই সহজ। ধরুন, আপনি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। পেছন থেকে একজন পুলিশ চিৎকার করে বলল, “এই যে আপনি, দাঁড়ান!” আপনি প্রায় সাথে সাথেই ঘুরে দাঁড়াবেন। কেন? কারণ আপনি নিজেকে ওই ‘আপনি’ হিসেবে চিনে নিয়েছেন। আপনি বুঝে গেছেন, পুলিশ আপনাকে একজন নাগরিক (বা সন্দেহভাজন) হিসেবে ‘আহ্বান’ করছে এবং আপনি সেই আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন। এই আহ্বানের মধ্য দিয়ে আপনি রাষ্ট্রের আইন মান্যকারী একজন ‘সাবজেক্ট’-এ পরিণত হলেন।

আলথুসার বলছেন, ভাবাদর্শ ঠিক এভাবেই কাজ করে। এটি আমাদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ক্রমাগত বিভিন্ন পরিচয়ে (যেমন: ভালো ছাত্র, দায়িত্বশীল নাগরিক, দেশপ্রেমিক, ধার্মিক ব্যক্তি, ভালো সন্তান, নির্দিষ্ট লিঙ্গের সদস্য) ‘আহ্বান’ করে। আর আমরা সেই পরিচয়গুলোকে নিজের বলে মেনে নিয়ে সে অনুযায়ী আচরণ করতে শুরু করি। আমরা যখন বলি “আমি একজন বাঙালি” বা “আমি একজন মুসলমান” বা “আমি একজন উদারপন্থী”—তখন আমরা আসলে ভাবাদর্শের আহ্বানে সাড়া দিচ্ছি। এভাবেই আমরা ভাবাদর্শের কাঠামোর মধ্যে ‘সাবজেক্ট’ বা কর্তা হয়ে উঠি, এবং আমাদের মনে হয় এই পরিচয়গুলো সম্পূর্ণ আমাদের নিজস্ব এবং স্বাধীন। আলথুসার বলেন, এই প্রক্রিয়া এতটাই সর্বব্যাপী যে আমাদের মনে হয় “It is obvious!” বা “এটা তো খুবই স্বাভাবিক!”। তাঁর ভাষায়, “Ideology represents the imaginary relationship of individuals to their real conditions of existence.”

স্লাভয় জিজেক ও সিনিক্যাল ভাবাদর্শ (Slavoj Žižek and Cynical Ideology)

আধুনিককালের অন্যতম প্রভাবশালী, বিতর্কিত ও ব্যতিক্রমী চিন্তাবিদ স্লাভয় জিজেক (Slavoj Žižek) ভাবাদর্শ নিয়ে আরও মজার এবং উত্তরাধুনিক কথা বলেছেন। মার্ক্সবাদীরা বলতেন, মানুষ ‘মিথ্যা চেতনা’র কারণে ভাবাদর্শের ফাঁদে পা দেয়—তারা জানে না যে তারা শোষিত হচ্ছে। জিজেক বলছেন, আজকের দিনে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ উল্টো।

জিজেকের বিখ্যাত উক্তি হলো: “They know very well what they are doing, but still, they are doing it.” (তারা খুব ভালো করেই জানে তারা কী করছে, কিন্তু তারপরেও তারা সেটা করে যাচ্ছে)।

এর মানে কী? আজকের যুগের মানুষ অনেক বেশি সচেতন ও তথ্য-সমৃদ্ধ। আমরা জানি, বিজ্ঞাপনে দেখানো পণ্য আমাদের সুখী করবে না। আমরা জানি, রাজনৈতিক নেতারা প্রায়ই মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেন। আমরা জানি, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা পরিবেশের কী ভয়ানক ক্ষতি করছে। অর্থাৎ, আমাদের মধ্যে ‘মিথ্যা চেতনা’ নেই। আমরা ‘সিনিক’ (cynic) হয়ে গেছি। আমরা ব্যবস্থার ত্রুটিগুলো জানি, এর সমালোচনা করি, একে নিয়ে মজা করি, কিন্তু তারপরেও আমরা সেই ব্যবস্থার অংশ হয়েই থাকি।

কেন? জিজেকের মতে, ভাবাদর্শ এখন আর আমাদের ‘বিশ্বাস’-এ কাজ করে না, কাজ করে আমাদের ‘আচরণ’ ও উপভোগে (Enjoyment/Jouissance)। যেমন, আপনি হয়তো জানেন কোকা-কোলা খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয় এবং এটি একটি বহুজাতিক কোম্পানির শোষণের প্রতীক। কিন্তু তারপরেও আপনি ঠান্ডা এক বোতল কোক কিনে খান, কারণ এর সাথে ‘আসল জিনিসের অনুভূতি’ (the real thing) বা এক ধরনের ফ্যান্টাসি জড়িত।

জিজেকের একটি চমৎকার উদাহরণ হলো ‘চ্যারিটি ভোগবাদ’। ধরুন, একটি কফি শপ বিজ্ঞাপনে বলছে, তাদের প্রতি কাপ কফি কিনলে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আফ্রিকার ক্ষুধার্ত শিশুদের জন্য দান করা হবে। আমরা জানি যে এক কাপ কফির টাকায় পৃথিবীর ক্ষুধা দূর হবে না। এটা একটা লোকদেখানো ব্যাপার। কিন্তু আমরা কফিটা কিনি। কেন? কারণ এটি আমাদের দুটি জিনিস একসাথে দেয়: কফি পানের ভোগবাদী আনন্দ এবং একজন নৈতিক ব্যক্তি হিসেবে ভালো কাজ করার আত্মতৃপ্তি। আমরা আমাদের ‘সিনিক্যাল’ দূরত্ব বজায় রেখেই ভাবাদর্শগত আচরণগুলো করে যাই। জিজেকের মতে, এটাই আজকের যুগের ভাবাদর্শের সবচেয়ে শক্তিশালী ও অধরা রূপ, কারণ একে সরাসরি আক্রমণ করা যায় না। এটি আমাদের সচেতনতাকেই নিজের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে (Žižek, 1989)।

ভাবাদর্শের চিড়িয়াখানা: কয়েকটি প্রধান ভাবাদর্শের পরিচয়

ভাবাদর্শ কেবল একটি বিমূর্ত তত্ত্ব নয়, এর বাস্তব প্রয়োগ আমরা বিশ্বজুড়ে দেখতে পাই। পৃথিবীর ইতিহাসকে বদলে দেওয়া কয়েকটি প্রধান ভাবাদর্শের সাথে সংক্ষেপে পরিচিত হওয়া যাক।

উদারনীতিবাদ (Liberalism): ব্যক্তি-স্বাধীনতা (individual liberty), যুক্তি (reason), সহনশীলতা (tolerance), এবং সম্মতিভিত্তিক সরকার (government by consent) হলো এর মূল ভিত্তি। উদারনীতিবাদীরা মনে করেন, প্রত্যেক মানুষের কিছু অপরিহার্য বা প্রাকৃতিক অধিকার আছে। এর দুটি প্রধান ধারা রয়েছে:

  • ক্লাসিক্যাল লিবারেলিজম: জন লক, অ্যাডাম স্মিথ প্রমুখের হাত ধরে এর বিকাশ। এরা ‘ন্যূনতম রাষ্ট্র’ (minimal state) বা ‘নৈশপ্রহরী রাষ্ট্র’ (night-watchman state)-এ বিশ্বাসী। এরা মুক্তবাজার অর্থনীতিতে (free-market economy) রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের ঘোর বিরোধী। এরা মূলত নেতিবাচক স্বাধীনতা (Negative Liberty), অর্থাৎ ব্যক্তির কাজে কোনো ধরনের বাহ্যিক বাধা না থাকাকেই প্রকৃত স্বাধীনতা মনে করে।

  • আধুনিক বা সামাজিক লিবারেলিজম: টি. এইচ. গ্রিন, জন স্টুয়ার্ট মিল, জন রলস প্রমুখ এর প্রবক্তা। তারা মনে করেন, প্রকৃত স্বাধীনতার জন্য কিছু সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ প্রয়োজন। তাই রাষ্ট্রকে ইতিবাচক ভূমিকা নিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষার মতো বিষয়গুলোতে হস্তক্ষেপ করতে হবে। এরা ইতিবাচক স্বাধীনতা (Positive Liberty), অর্থাৎ ব্যক্তির সম্ভাবনা বিকাশের ক্ষমতা অর্জনের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। আজকের কল্যাণমূলক রাষ্ট্র (welfare state) এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।

রক্ষণশীলতাবাদ (Conservatism): এই ভাবাদর্শের মূল কথা হলো ঐতিহ্য (tradition), মানবীয় অসম্পূর্ণতা (human imperfection), শৃঙ্খলা (order), এবং স্থাপিত প্রতিষ্ঠানগুলোর (established institutions) প্রতি শ্রদ্ধা। রক্ষণশীলতাবাদীরা দ্রুত ও বৈপ্লবিক পরিবর্তনকে সন্দেহের চোখে দেখেন। তারা মনে করেন, দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত প্রথা ও প্রতিষ্ঠান (যেমন: পরিবার, ধর্ম, রাষ্ট্র) সমাজের স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য। এডমান্ড বার্ক (Edmund Burke)-কে আধুনিক রক্ষণশীলতাবাদের জনক বলা হয়।

সমাজতন্ত্র (Socialism): উদারনীতিবাদের ব্যক্তি-কেন্দ্রিকতার বিপরীতে সমাজতন্ত্রের কেন্দ্রে রয়েছে সমাজ বা গোষ্ঠী (community)। সমাজতন্ত্রীরা পুঁজিবাদের তীব্র সমালোচক। তারা মনে করেন, ব্যক্তিগত মালিকানা (private ownership) সমাজে অন্যায্য বৈষম্য, শোষণ ও বিচ্ছিন্নতার জন্ম দেয়। তাই তারা উৎপাদনের উপকরণগুলোর সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় মালিকানার (social/state ownership) কথা বলেন। তাদের মূল লক্ষ্য হলো সাম্য (equality), সহযোগিতা (cooperation) এবং সামাজিক ন্যায়বিচার (social justice) প্রতিষ্ঠা করা।

জাতীয়তাবাদ (Nationalism): এটি এমন এক ভাবাদর্শ যা ‘জাতি’কে (nation) মানুষের পরিচয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন করে। জাতীয়তাবাদীরা মনে করেন, প্রতিটি জাতির একটি নিজস্ব স্বাধীন রাষ্ট্র (nation-state) থাকার অধিকার আছে এবং ব্যক্তির প্রথম ও প্রধান আনুগত্য থাকবে জাতির প্রতি। এর দুটি রূপ দেখা যায়:

  • নাগরিক জাতীয়তাবাদ (Civic Nationalism): এটি একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাসকারী সমস্ত নাগরিকের জন্য প্রযোজ্য, যারা একই আইন, মূল্যবোধ এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে বিশ্বাসী, তাদের জাতিগত পরিচয় নির্বিশেষে।

  • জাতিগত জাতীয়তাবাদ (Ethnic Nationalism): এটি রক্ত, বংশ, সংস্কৃতি ও ভাষার ঐক্যের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে, যা প্রায়শই বহিরাগতদের প্রতি অসহিষ্ণু এবং আগ্রাসী হতে পারে।

নারীবাদ (Feminism): নারীবাদ হলো এমন একটি ভাবাদর্শ ও আন্দোলন যা সমাজে নারী-পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য, বিশেষ করে পুরুষতান্ত্রিক (patriarchal) শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলে।

  • প্রথম তরঙ্গ: মূলত ভোটাধিকার ও আইনি সমতার দাবিতে সীমাবদ্ধ ছিল।

  • দ্বিতীয় তরঙ্গ: “The personal is political” স্লোগানকে কেন্দ্র করে পরিবার, যৌনতা, প্রজনন অধিকারের মতো ব্যক্তিগত বিষয়গুলোকে রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসে।

  • তৃতীয় ও চতুর্থ তরঙ্গ: ‘নারী’র একক সংজ্ঞাকে চ্যালেঞ্জ করে বর্ণ, শ্রেণি, জাতি ও যৌন পরিচয়ের ভিন্নতাকে গুরুত্ব দেয়। ছেদনশীলতা বা ইন্টারসেকশনালিটি (Intersectionality) ধারণাটি এখানে গুরুত্বপূর্ণ, যা দেখায় যে একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারী কেবল নারী হিসেবে নয়, তার বর্ণ ও লিঙ্গ উভয়ের কারণে দ্বিগুণ বৈষম্যের শিকার হতে পারে।

ফ্যাসিবাদ (Fascism): এটি একটি চরম কর্তৃত্ববাদী, উগ্র জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শ। এর মূল বৈশিষ্ট্য হলো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের সম্পূর্ণ বিলোপ, রাষ্ট্রের কাছে ব্যক্তির নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ, একজন ক্যারিস্মেটিক বা সম্মোহনী ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতার প্রতি অন্ধ আনুগত্য (cult of personality), সামরিক শক্তি প্রদর্শন, এবং গণতন্ত্র, উদারনীতিবাদ ও সমাজতন্ত্রের প্রতি তীব্র ঘৃণা। এটি অতীতকে একটি পৌরাণিক গৌরবময় যুগ হিসেবে উপস্থাপন করে এবং সেই হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার ডাক দেয়।

পরিবেশবাদ (Environmentalism/Ecologism): এটি অপেক্ষাকৃত নতুন কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ভাবাদর্শ। পরিবেশবাদীরা মনে করেন, মানুষ প্রকৃতির অংশ, তার প্রভু নয়। এর দুটি ধারা রয়েছে:

  • অগভীর পরিবেশবাদ (Shallow Ecology): এরা মানবকেন্দ্রিক। পরিবেশ রক্ষা করা প্রয়োজন কারণ এটি মানুষের বেঁচে থাকার জন্য জরুরি।

  • গভীর পরিবেশবাদ (Deep Ecology): এরা জীবকেন্দ্রিক। এরা মনে করে, প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানেরই নিজস্ব মূল্য রয়েছে, মানুষের জন্য তার উপযোগিতা নির্বিশেষে।

এইগুলো ছাড়াও পৃথিবীতে আরও অসংখ্য ভাবাদর্শ ক্রিয়াশীল আছে, যেমন—নৈরাজ্যবাদ (Anarchism), ধর্মীয় মৌলবাদ (Religious Fundamentalism), উত্তরাধুনিকতাবাদ (Postmodernism) ইত্যাদি। প্রতিটি ভাবাদর্শই জগৎকে দেখার জন্য আমাদের হাতে একটি বিশেষ ধরনের চশমা তুলে দেয়।

দৈনন্দিন জীবনে ভাবাদর্শের লুকোচুরি

বড় বড় তত্ত্বের কথা তো অনেক হলো। এবার একটু দেখি, আমাদের সাধারণ আটপৌরে জীবনে ভাবাদর্শ কীভাবে সুতোর মতো জড়িয়ে থাকে, যা আমরা প্রায়শই খেয়াল করি না।

  • ভাষা ও শব্দচয়ন: আমরা যে শব্দ ব্যবহার করি, তার পেছনেও ভাবাদর্শ কাজ করে। কেউ যখন বলে ‘শহীদ’, তখন তার সাথে যে আবেগ ও সম্মান জড়িত, ‘নিহত’ বললে তা থাকে না। ফিলিস্তিনের সশস্ত্র যোদ্ধাকে কেউ বলে ‘জঙ্গিবাদী’ (terrorist), আবার কেউ বলে ‘স্বাধীনতা সংগ্রামী’ (freedom fighter)। গর্ভপাতকে কেউ বলে ‘নারীর প্রজনন অধিকার’, আবার কেউ বলে ‘ভ্রূণহত্যা’। শব্দের এই নির্বাচন আমাদের ভাবাদর্শগত অবস্থানকে নগ্ন করে দেয়।

  • বিজ্ঞাপন ও ভোগবাদ: পেপসির বিজ্ঞাপন আমাদের শুধু একটি পানীয়র কথাই বলে না, তারুণ্য, উৎসব আর বিদ্রোহের এক গল্প শোনায়। ফেয়ারনেস ক্রিমের বিজ্ঞাপন আমাদের অবচেতনে শেখায়, ফর্সা হওয়াই সুন্দর ও সফল হওয়ার চাবিকাঠি। এই বার্তাগুলো ভোগবাদী ও প্রায়শই বর্ণবাদী বা লিঙ্গবাদী (sexist) ভাবাদর্শ প্রচার করে।

  • খেলাধুলা: ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ কেবলই একটি খেলা থাকে না, হয়ে ওঠে জাতীয়তাবাদের যুদ্ধক্ষেত্র। খেলার জয়-পরাজয় তখন জাতির জয়-পরাজয় বলে মনে হয়। খেলোয়াড়দের জার্সি, জাতীয় সঙ্গীত, পতাকা ওড়ানো—এই সবই জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শকে উসকে দেয়।

  • পরিবার ও লিঙ্গীয় ভূমিকা: পরিবারে আমরা প্রথম শিখি কোনটা ‘মেয়ের কাজ’ (রান্না, ঘর গোছানো) আর কোনটা ‘ছেলের কাজ’ (বাইরের কাজ, আয় করা)। “ছেলেরা কাঁদে না” বা “মেয়েরা জোরে কথা বলবে না”—এই ধরনের লিঙ্গীয় ভূমিকা (gender roles) আমরা পরিবার থেকেই শিখি, যা আসলে পুরুষতান্ত্রিক ভাবাদর্শের সূক্ষ্ম প্রয়োগ।

  • খবর ও গণমাধ্যম: কোন খবরটি পত্রিকার প্রথম পাতায় আট কলাম জুড়ে ছাপা হবে, আর কোনটি ভেতরের পাতায় ছোট করে ছাপা হবে, তা সম্পাদকের বা মালিকপক্ষের ভাবাদর্শগত অবস্থানের ওপর নির্ভর করে। একটি শ্রমিক আন্দোলনকে কোনো পত্রিকা ‘ন্যায্য দাবি আদায়ের সংগ্রাম’ বলতে পারে, আবার অন্য কোনো পত্রিকা ‘শিল্পখাতে নৈরাজ্য সৃষ্টির পাঁয়তারা’ বলে আখ্যা দিতে পারে। গণমাধ্যম বাস্তবতা তৈরি করে না, বাস্তবতার একটি ভাবাদর্শগত সংস্করণ আমাদের সামনে তুলে ধরে।

  • স্থাপত্য ও নগর পরিকল্পনা: শহরের ধনী এবং গরিব এলাকাগুলো কেন আলাদা থাকে? কেন সরকারি অফিস বা বাণিজ্যিক এলাকাগুলো একটি নির্দিষ্ট ধাঁচে তৈরি হয়? ফুটপাতে বা পার্কের বেঞ্চে লোহার হাতল দিয়ে রাখা হয় কেন, যাতে গৃহহীন মানুষ সেখানে শুতে না পারে (hostile architecture)? এই সবই নগর পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে শ্রেণি ও ক্ষমতার ভাবাদর্শকে প্রকাশ করে।

  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি: আমরা প্রায়ই বিজ্ঞানকে একটি নিরপেক্ষ, বস্তুনিষ্ঠ এবং মূল্যবোধহীন ক্ষেত্র হিসেবে দেখি। কিন্তু এটিও ভাবাদর্শের প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। কোন গবেষণা অর্থায়ন পাবে (ক্যান্সারের ওষুধ না বিরল রোগের?), প্রযুক্তির বিকাশ কোন দিকে চালিত হবে (সামরিক ড্রোন না সস্তা জলের ফিল্টার?), এমনকি বৈজ্ঞানিক সত্যকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা হবে—এর সবকিছুতেই ভাবাদর্শের ছায়া পড়তে পারে। ‘প্রযুক্তিগত সমাধানবাদ’ (Technological Solutionism), অর্থাৎ এই বিশ্বাস যে সমস্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান প্রযুক্তি দিয়ে করা সম্ভব, এটি নিজেই একটি শক্তিশালী ভাবাদর্শ।

  • খাদ্যাভ্যাস: আমরা কী খাই, কীভাবে খাই, তার পেছনেও ভাবাদর্শ কাজ করে। নিরামিষভোজন কেবল একটি খাদ্যাভ্যাস নয়, এটি অহিংসা এবং পরিবেশবাদী ভাবাদর্শের প্রকাশ হতে পারে। অন্যদিকে, ফাস্ট ফুডের সংস্কৃতি গতি, উপযোগিতা আর বিশ্বায়নের ভাবাদর্শকে তুলে ধরে। কোনো নির্দিষ্ট খাবারকে ‘জাতীয় খাবার’ হিসেবে প্রচার করা জাতীয়তাবাদের অংশ।

অর্থাৎ, ভাবাদর্শ বায়ুর মতো। আমরা একে দেখতে পাই না, কিন্তু এর মধ্যেই আমরা শ্বাস নিই, বেড়ে উঠি এবং জগৎকে অর্থপূর্ণ করে তুলি।

ভাবাদর্শ থেকে মুক্তির উপায় আছে কি?

এত আলোচনার পর মনে হতেই পারে, ভাবাদর্শ যদি এতই সর্বব্যাপী, সূক্ষ্ম এবং শক্তিশালী হয়, তাহলে কি এর থেকে আমাদের কোনো মুক্তি নেই? আমরা কি সবাই অদৃশ্য সুতোর টানে নাচতে থাকা অসহায় পুতুল?

এই প্রশ্নের উত্তর সরলরৈখিক ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’-তে দেওয়া কঠিন।

লুই আলথুসারের মতো চিন্তাবিদরা বলবেন, ভাবাদর্শ থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি সম্ভব নয়। কারণ ভাবাদর্শের বাইরে কোনো অর্থপূর্ণ জগৎ নেই। মানুষ হিসেবে আমরা অর্থসন্ধানী প্রাণী; আমরা বিশৃঙ্খল তথ্যের মধ্যে শৃঙ্খলা ও প্যাটার্ন খুঁজি। ভাবাদর্শই সেই কাঠামো সরবরাহ করে। একটি ভাবাদর্শকে ত্যাগ করার অর্থ হলো প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আরেকটি ভাবাদর্শকে গ্রহণ করা। একজন ধার্মিক ব্যক্তি ধর্ম ত্যাগ করে হয়তো মানবতাবাদী বা মার্ক্সবাদী হবেন, কিন্তু তিনি ভাবাদর্শহীন হতে পারবেন না। কারণ আলথুসারের মতে, আমরা সবসময়ই কোনো না কোনো ভাবাদর্শের মধ্যে ‘সাবজেক্ট’ হিসেবে বিদ্যমান।

কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমরা অসহায় বা আমাদের কোনো স্বাধীনতা নেই। মুক্তির পথটি হলো সচেতনতা (awareness) এবং সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি (critical perspective)। নিজের চশমাটাকে চিনে ফেলা। একে বলা হয় ভাবাদর্শের সমালোচনা (Ideology Critique)

এই সমালোচনার কয়েকটি ধাপ থাকতে পারে:

  • ১. আত্ম-জিজ্ঞাসা: যখন আপনি একটি খবর পড়ছেন, তখন নিজেকে প্রশ্ন করুন: “খবরটি কে তৈরি করেছে? তার উদ্দেশ্য কী হতে পারে? কোন তথ্যগুলো দেওয়া হয়েছে এবং কোনগুলো দেওয়া হয়নি? কোন শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে?”
  • ২. দূরত্ব তৈরি (Defamiliarization): যা কিছুকে ‘স্বাভাবিক’ বা ‘প্রাকৃতিক’ বলে মনে হয়, সেগুলোকে অপরিচিত বা অদ্ভুত হিসেবে দেখার চেষ্টা করা। যেমন, কেন মেয়েরা নির্দিষ্ট পোশাক পরবে আর ছেলেরা অন্যরকম? এই ‘স্বাভাবিক’ নিয়মের পেছনের ইতিহাস ও ক্ষমতা সম্পর্ককে খুঁজে বের করা। শিল্প-সাহিত্য ও চলচ্চিত্র এই দূরত্ব তৈরিতে সাহায্য করে।
  • ৩. বহুমাত্রিক পাঠ: একই ঘটনাকে বিভিন্ন ভাবাদর্শের দৃষ্টিকোণ থেকে পাঠ করার চেষ্টা করা। একটি অর্থনৈতিক সংকটকে উদারনৈতিক, মার্ক্সবাদী এবং পরিবেশবাদী—তিনটি ভিন্ন চশমা দিয়ে দেখলে ঘটনার একটি বহুমাত্রিক ও জটিল চিত্র পাওয়া যায়।
  • ৪. ভাষাকে ব্যবচ্ছেদ: যখন কোনো রাজনৈতিক নেতার ভাষণ শুনছেন, তখন বিশ্লেষণ করুন: “তিনি কোন শব্দগুলো ব্যবহার করছেন? তিনি কাদের ‘আমরা’ এবং কাদের ‘ওরা’ বলছেন? এই বিভাজনের মাধ্যমে তিনি কোন উদ্দেশ্য সাধন করতে চাইছেন?”

মুক্তি মানে ভাবাদর্শহীন হওয়া নয়; মুক্তি মানে কোনো একটি নির্দিষ্ট ভাবাদর্শের অন্ধ দাসে পরিণত না হওয়া। মুক্তি মানে হলো নিজের চিন্তার ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। ভাবাদর্শ আমাদের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, কিন্তু মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো তার চিন্তার ক্ষমতা (reason) এবং আত্ম-সচেতনতা (self-awareness)। ভাবাদর্শ আমাদের একটি নির্দিষ্ট ছাঁচে ঢালতে চায়, কিন্তু আমরা সেই ছাঁচকে প্রশ্ন করতে পারি, ভাঙতে পারি, এমনকি নতুন ছাঁচও তৈরি করতে পারি। গ্রামশির ভাষায়, একটি প্রতি-আধিপত্য (Counter-Hegemony) গড়ে তোলার সংগ্রামে লিপ্ত হওয়া।

ভাবাদর্শের আশপাশে: জ্ঞান, মতামত ও সংস্কৃতির গোলকধাঁধা

আমরা ভাবাদর্শের (Ideology) চশমা নিয়ে অনেক কথা বললাম। এই চশমা যে আমাদের জগৎ দেখার ভঙ্গিটাই পাল্টে দেয়, সেটাও বুঝলাম। কিন্তু একটা জরুরি প্রশ্ন থেকে যায়। আমরা রাজনীতি নিয়ে যা কিছু ভাবি বা বলি, তার পুরোটাই কি ভাবাদর্শ?

ব্যাপারটা ঠিক তেমন নয়। ভাবাদর্শ হলো একটি সচেতন, গোছানো বিশ্বাসের কাঠামো। অনেকটা পাকা দালানের মতো, যার প্রতিটি ইট জেনে-বুঝে, মেপে-জোকি গাঁথা হয়েছে। কিন্তু এই পাকা দালানের আশেপাশে আরও অনেক কিছু থাকে—কিছু কাঁচা ইট, পুরনো দেয়ালের ধ্বংসাবশেষ, কিছু এলোমেলো ধারণা, আবার কিছু এমন জিনিস যা আমরা নিজের অজান্তেই বিশ্বাস করি। ভাবাদর্শকে ভালোভাবে বুঝতে হলে, এই আশপাশের জিনিসগুলোকেও চেনা দরকার। চলুন, আজ সেই গোলকধাঁধায় একটু ঢুঁ মারা যাক।

অনেকে ‘আইডিওলজিক্যাল’ বা ‘ভাবাদর্শিক’ শব্দটাকে একটা গালি হিসেবে ব্যবহার করেন। যেমন, “ওদের সাথে কাজ করা যাবে না, ওরা বড্ড বেশি আইডিওলজিক্যাল।” কথাটা শুনলে মনে হয়, ভাবাদর্শ বুঝি খুব খারাপ একটা জিনিস। কিন্তু সত্যি বলতে, ভাবাদর্শ ছাড়া রাজনীতি নিয়ে গোছানো চিন্তা করা প্রায় অসম্ভব। এটা অনেকটা ভাষা শেখার মতো। ভাষা না জানলে যেমন মনের ভাব প্রকাশ করা যায় না, তেমনি কোনো ভাবাদর্শের কাঠামো ছাড়া রাজনীতির জটিল জগৎটাকে বোঝা বা সেখানে নিজের অবস্থান তৈরি করা যায় না।

সমস্যা হলো, বেশিরভাগ মানুষের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা আসলে পুরোপুরি সচেতন বা গোছানো নয়। সেগুলো হলো কিছু টুকরো টুকরো তথ্য, ভাঙা ভাঙা চিন্তা, লোকমুখে শোনা কথা আর কিছু চলতি হাওয়ার মিশ্রণ। এই সবকিছু মিলিয়ে হয়তো একটা অবস্থান তৈরি হয়, কিন্তু তাকে ঠিক সচেতন ভাবাদর্শ বলা চলে না। এই আধা-সচেতন জগৎটাকে বুঝতে পারলে, ভাবাদর্শের আসল গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

আপনি কী জানেন? রাজনৈতিক জ্ঞানের ফ্যাক্টরি

রাজনীতির অনেক বিষয় নিয়েই তর্ক করা যায়, ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায়। কিন্তু কিছু জিনিস আছে, যা তর্ক বা ব্যাখ্যার ঊর্ধ্বে। সেগুলো হলো নিরেট তথ্য বা ফ্যাক্ট (Fact)। যেমন, আপনার রাজ্যে গাঁজা খাওয়া বৈধ কি না, আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি কত, অথবা আপনার দেশের রাষ্ট্রপতির নাম কী—এগুলো হলো রাজনৈতিক জ্ঞান (Political Knowledge)। এই তথ্যগুলো আপনার ভাবাদর্শ যা-ই হোক না কেন, বদলাবে না।

এই জ্ঞানটুকু থাকাটা খুব জরুরি। সাধারণ কিছু তথ্য না জানলে আমাদের সিদ্ধান্তগুলো অদ্ভুত হতে পারে এবং খুব সহজেই অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, বেশিরভাগ মানুষই এই জ্ঞানের ক্ষেত্রে বেশ পিছিয়ে। আমেরিকায় ১৯৪০ সাল থেকে যত জরিপ (Polling) হয়েছে, তার ফলাফল প্রায় একই রকম ছবি দেখায়। খুব ছোট্ট একটা অংশ, যাদেরকে বলা হয় রাজনৈতিক অভিজাত (Political Elite), তাদের জ্ঞানের ভান্ডার বেশ সমৃদ্ধ। জনসংখ্যার প্রায় পঞ্চাশ থেকে ষাট শতাংশ মানুষ কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে বা সম্প্রতি খুব আলোচিত ঘটনাগুলো সম্পর্কে খোঁজ রাখে। আর বাকিদের জ্ঞান বর্তমান প্রেসিডেন্টের নাম জানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।

এই মাঝের বড় দলটিই সবচেয়ে মজার। তারা সেই তথ্যগুলোই জানে, যেগুলো খবরের কাগজে বা টেলিভিশনে বারবার দেখানো হয়। যেমন, ২০১০ সালের এক জরিপে বেশিরভাগ আমেরিকান বলতে পেরেছিল যে, আমেরিকার সবচেয়ে বেশি সরকারি ঋণ কোন দেশের কাছে (প্রায় ৫৯ শতাংশ জানতো দেশটি হলো চীন)। কিন্তু এর বাইরে গেলেই অবস্থা সঙ্গীন।

ব্যাপারটা কৌতুকের মতো শোনালেও সত্যি। অর্ধেকের বেশি আমেরিকান টেলিভিশনের জনপ্রিয় কার্টুন চরিত্র ‘সিম্পসন’ পরিবারের পাঁচজন সদস্যের নাম বলতে পারে, কিন্তু মাত্র ২৫ শতাংশ আমেরিকান তাদের সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর (First Amendment) পাঁচটি অধিকারের মধ্যে দুটি অধিকারের নাম বলতে পারে (Converse, 1964)। ভাবুন একবার! ২০০০ সালের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময়ও প্রায় অর্ধেক ভোটার বলতে পারেনি যে, রিপাবলিকান প্রার্থী জর্জ ডব্লিউ বুশের অন্যতম প্রধান প্রতিশ্রুতি ছিল আয়কর কমানো। মানুষ মনে রাখে খুব তুচ্ছ জিনিস। যেমন, তার বাবা জর্জ এইচ. ডব্লিউ. বুশ যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন তার সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি মানুষ যে তথ্যটি জানতো, তা হলো—তিনি ব্রকলি খেতে অপছন্দ করতেন!

আরেকটি জরিপের কথা বলি। ২০১০ সালে পিউ রিসার্চ সেন্টার (Pew Research Center) একটি রাজনৈতিক কুইজ করেছিল। সেখানে ৮৫ শতাংশ মানুষ টুইটারকে (Twitter) একটি তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যম হিসেবে শনাক্ত করতে পেরেছিল। কিন্তু মাত্র ২৮ শতাংশ মানুষ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নাম একাধিক বিকল্পের মধ্য থেকে বেছে নিতে পেরেছিল।

এর মানে কী দাঁড়ায়? এর মানে হলো, রাজনৈতিক তথ্য বা জ্ঞান হলো ভাবাদর্শ তৈরির কাঁচামাল। এটা ছাড়া ভাবাদর্শের দালান গড়া সম্ভব নয়। কিন্তু শুধু কাঁচামাল থাকাই যথেষ্ট নয়; সেগুলো দিয়ে সচেতনভাবে একটি কাঠামো তৈরি করতে হয়। কাঁচা ইট আর সিমেন্ট পড়ে থাকলেই তাকে বাড়ি বলা যায় না।

আপনার কী ভাবা উচিত? জনমত ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির মায়াজাল

মানুষ রাজনৈতিক তথ্য জানুক বা না জানুক, তাদের মতামত (Public Opinion) ঠিকই থাকে। আমরা ভাবতে পারি, যেকোনো মতামত দেওয়ার জন্য তো একটি ভাবাদর্শগত ভিত্তি লাগেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা তেমন নয়। আমাদের অনেক রাজনৈতিক মতামতের উৎস আরও অগোছালো এবং অচেতন।

আমেরিকার জনমত নিয়ে প্রভাবশালী একটি গবেষণায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফিলিপ কনভার্স (Philip Converse) দেখিয়েছিলেন যে, বেশিরভাগ নাগরিকের রাজনৈতিক ধারণাগুলো এতটাই খাপছাড়া যে, সেগুলোকে কোনো অর্থপূর্ণ ভাবাদর্শের অংশ বলাই মুশকিল (Converse, 1964)। এর একটি চমৎকার প্রমাণ পাওয়া যায় জরিপের প্রশ্ন বদলালে। যেমন, আমেরিকানদের যদি জিজ্ঞেস করা হয়, “আপনি কি গরিবদের জন্য সহায়তা (assistance for the poor) সমর্থন করেন?”, তাহলে যতজন ‘হ্যাঁ’ বলেন, তার চেয়ে অনেক কম মানুষ ‘হ্যাঁ’ বলেন যখন প্রশ্নটা সামান্য বদলে জিজ্ঞেস করা হয়, “আপনি কি ওয়েলফেয়ার প্রোগ্রাম (welfare programs) সমর্থন করেন?”। দুটো প্রশ্নের অর্থ কিন্তু একই! ওয়েলফেয়ার প্রোগ্রাম মানেই তো গরিবদের জন্য সহায়তা।

একইভাবে, ২০১০ সালের এক গ্যালাপ জরিপে (Gallup poll) দেখা যায়, যতজন আমেরিকান ‘ওয়াল স্ট্রিট ব্যাংকগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা’ সমর্থন করে, তার চেয়ে অনেক কম মানুষ ‘বড় ব্যাংকগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা’ সমর্থন করে। অথচ ওয়াল স্ট্রিট তো বড় ব্যাংকগুলোরই প্রতীক। শব্দের কী অদ্ভুত জাদু, তাই না? এই উদাহরণগুলো থেকে বোঝা যায়, বহু মানুষ প্রশ্নের সারবস্তু নিয়ে সচেতনভাবে চিন্তা করে না। তাদের প্রতিক্রিয়াটি আসে কিছু নির্দিষ্ট শব্দ শুনে, একেবারে ভেতর থেকে, যাকে বলে ‘গাট রিঅ্যাকশন’ (gut reaction)। ‘ওয়েলফেয়ার’ বা ‘ওয়াল স্ট্রিট’-এর মতো শব্দগুলো তাদের মনে এক ধরনের স্বয়ংক্রিয় প্রতিক্রিয়া তৈরি করে।

কিন্তু এই স্বয়ংক্রিয় প্রতিক্রিয়াগুলোও একেবারে এলোমেলো নয়। এর পেছনে কাজ করে আরও গভীর এবং সূক্ষ্ম একটি জিনিস, যার নাম রাজনৈতিক সংস্কৃতি (Political Culture)

রাজনৈতিক সংস্কৃতি হলো রাজনীতি নিয়ে কথা বলার, কাজ করার এবং চিন্তা করার সেই ধরনগুলো, যা মানুষ তার নিজের মতো মানুষদের জন্য ‘স্বাভাবিক’ বলে ধরে নিতে শেখে। এটি সচেতন ভাবাদর্শের মতো নয়। বরং এটি হলো পটভূমিতে বাজতে থাকা সঙ্গীতের মতো—কিছু অলিখিত নিয়ম, কিছু পূর্বধারণা, কিছু গল্প যা আমরা অবচেতনভাবে গ্রহণ করি। আমরা হয়তো ব্যাখ্যা করতে পারব না কেন এমনটা ভাবি, কিন্তু আমরা শিখে ফেলি যে এভাবেই ভাবতে হয়, এভাবেই কথা বলতে হয়।

রাজনৈতিক সংস্কৃতির পার্থক্যটা সবচেয়ে ভালোভাবে বোঝা যায় যখন আমরা বিভিন্ন দেশের তুলনা করি। যেমন, আমেরিকানরা অন্য অনেক দেশের মানুষের চেয়ে বেশি বিশ্বাস করে যে, বাজার ব্যবস্থা (Market System) কঠোর পরিশ্রমকে পুরস্কৃত করে। তাই ধনীরা তাদের সম্পদের যোগ্য দাবিদার এবং গরিবরা তাদের দারিদ্র্যের জন্য নিজেরাই দায়ী। ১৯৮৩ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত করা বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, গড়ে ৬০ শতাংশ ইউরোপীয় মনে করে যে, গরিবরা দারিদ্র্যের ফাঁদে আটকা পড়ে আছে। কিন্তু মাত্র ২৯ শতাংশ আমেরিকান এই কথায় সহমত পোষণ করে। অন্যদিকে, ৬০ শতাংশ আমেরিকান মনে করে গরিবরা অলস, যেখানে মাত্র ২৬ শতাংশ ইউরোপীয় এমনটা ভাবে (Alesina & Glaeser, 2004)।

এই ভিন্ন ভিন্ন উত্তরের পেছনে কোনো গভীর ভাবাদর্শগত যুক্তি হয়তো অনেকেরই নেই। প্রশ্নটা একটু ঘুরিয়ে করলে হয়তো তারা উত্তরও বদলে ফেলবে! কিন্তু তারা বড় হওয়ার সময় এমন এক সাংস্কৃতিক আবহে বড় হয়েছে, যেখানে বাজার ব্যবস্থাকে আমেরিকার পরিচয়ের একটি মৌলিক অংশ হিসেবে প্রশংসা করা হয়। তারা সেই শেখানো ভাষাতেই কথা বলে, হয়তো খুব বেশি না ভেবেই।

এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে বাহিত হয় সামাজিকীকরণের (socialization) মাধ্যমে। পরিবার, বন্ধুবান্ধব, এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও এই সংস্কৃতি তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখে। যেমন, আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলি (University of California, Berkeley)-তে এক ধরনের প্রতিবাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতির ঐতিহ্য আছে। সেখানে একজন নতুন ছাত্র যে ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের জন্য এক ধরনের সামাজিক চাপ অনুভব করে, সেই একই ছাত্র ইউনিভার্সিটি অফ ওকলাহোমা (University of Oklahoma)-তে গেলে হয়তো তা কখনোই অনুভব করত না।

হার্ভার্ডের অধ্যাপক স্যামুয়েল হান্টিংটন (Samuel Huntington) আরও বড় পরিসরে এই সাংস্কৃতিক পার্থক্যের কথা বলেছেন। তিনি এক বিতর্কিত তত্ত্বে দাবি করেন যে, একবিংশ শতাব্দীতে সংঘাতের মূল কারণ হবে বিভিন্ন সভ্যতার মধ্যকার সংঘর্ষ (clash of civilizations)—যেমন, পশ্চিমা সভ্যতা, ইসলামী সভ্যতা, চৈনিক সভ্যতা ইত্যাদি (Huntington, 1996)। তাঁর তত্ত্ব নিয়ে অনেক সমালোচনা থাকলেও, এটা অস্বীকার করা কঠিন যে এই সভ্যতাগুলোর মধ্যে রাজনীতি নিয়ে চিন্তা ও আচরণের কিছু মৌলিক সাংস্কৃতিক পার্থক্য বিদ্যমান।

তাহলে দাঁড়ালোটা কী?

তাহলে আমরা রাজনীতি নিয়ে যা কিছু শুনি বা ভাবি, তার অনেকটাই ঠিক ‘ভাবাদর্শ’ নয়।

  • প্রথমত, আছে রাজনৈতিক জ্ঞান—কিছু নিরেট তথ্য, যা ভাবাদর্শের দালান তৈরির ইট-পাথর।

  • দ্বিতীয়ত, আছে জনমত—যা প্রায়শই খণ্ডিত, তাৎক্ষণিক এবং শব্দের মারপ্যাঁচে প্রভাবিত হয়।

  • এবং তৃতীয়ত, আছে রাজনৈতিক সংস্কৃতি—আমাদের অবচেতন মনের সফটওয়্যার, যা আমাদের শেখায় কোনটা ‘স্বাভাবিক’ এবং কোনটা ‘অস্বাভাবিক’। এটা আমাদের মধ্যে এক ধরনের রাজনৈতিক রিফ্লেক্স তৈরি করে দেয়।

এই সবকিছু পার হয়েই আমরা ভাবাদর্শের জগতে প্রবেশ করি। যখন আমরা সচেতনভাবে রাজনৈতিক কোনো বিষয়কে বিশ্লেষণ করি, কোনো ব্যবস্থার সমালোচনা করি, কোনো আদর্শকে রক্ষা করার জন্য যুক্তি সাজাই, অথবা একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা তৈরি করি—তখনই আমরা ভাবাদর্শের চশমাটা চোখে পরি। তখন আমরা শুধু এলোমেলো ইটের স্তূপ নিয়ে বসে থাকি না, সেই ইট দিয়ে সচেতনভাবে একটি বাড়ির নকশা তৈরি করি। আর সেই নকশাটাই হলো ভাবাদর্শ।

শেষ কথা

রাতের আকাশ। হাজার হাজার তারা। প্রাচীনকালে মানুষ এই তারাগুলোকে মিলিয়ে মিলিয়ে বিভিন্ন আকৃতি কল্পনা করত—কালপুরুষ, সপ্তর্ষিমণ্ডল, ক্যাসিওপিয়া। তারাগুলো কিন্তু একই আছে, বদলায়নি। বদলেছে শুধু মানুষের দেখার ভঙ্গি, তার কল্পনা, তার গল্প তৈরির ক্ষমতা।

ভাবাদর্শও অনেকটা সেরকম। বাস্তবতার অগণিত, বিশৃঙ্খল ঘটনাপ্রবাহকে আমরা একটি নির্দিষ্ট কাঠামোতে সাজিয়ে অর্থপূর্ণ করে তুলি। সেই কাঠামোই আমাদের ভাবাদর্শ। কেউ সমাজতন্ত্রের কাঠামোতে জগৎকে সাজায়, কেউ উদারনীতিবাদের, কেউ বা ধর্মের।

কোনো একক ভাবাদর্শই হয়তো বাস্তবতার সম্পূর্ণ, নিরপেক্ষ বা বস্তুনিষ্ঠ চিত্র দিতে পারে না। প্রতিটি চশমারই নিজস্ব রঙ, ফোকাস এবং সীমাবদ্ধতা আছে। হয়তো পরম সত্য (absolute truth) বলে কিছুই নেই, আছে কেবল ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা খণ্ডিত সত্য।

তাহলে উপায়? উপায় হলো একজন বৌদ্ধিক পর্যটক হওয়া। খোলা মন নিয়ে জগৎকে দেখা। নিজের চশমাটাকে মাঝে মাঝে খুলে রেখে অন্যের চশমা দিয়ে জগৎকে দেখার চেষ্টা করা। নিজের বিশ্বাসের প্রতি সৎ থাকা, কিন্তু অন্যের বিশ্বাসকে সম্মান করা এবং তা বোঝার চেষ্টা করা। আর সবচেয়ে বড় কথা, প্রশ্ন করতে শেখা। নিরন্তর প্রশ্ন করা—নিজেকে, সমাজকে, ক্ষমতাকে, পৃথিবীকে। সক্রেটিসের সেই বিখ্যাত উক্তির মতো, “The unexamined life is not worth living” (অপরীক্ষিত জীবন যাপনের যোগ্য নয়)। একটি অপরীক্ষিত ভাবাদর্শও একইভাবে আমাদের চিন্তার জগৎকে সংকীর্ণ করে ফেলে।

কারণ প্রশ্ন করার মধ্যেই লুকিয়ে আছে চিন্তার স্বাধীনতা। আর সেই স্বাধীনতাই হয়তো ভাবাদর্শের অদৃশ্য কারাগার থেকে আমাদের মুক্তির একমাত্র চাবিকাঠি।

তথ্যসূত্র

  • Alesina, A., & Glaeser, E. L. (2004). Fighting poverty in the US and Europe: A world of difference. Oxford University Press.
  • Althusser, L. (2001). Lenin and philosophy and other essays (B. Brewster, Trans.). Monthly Review Press. (Original work published 1971)
  • Converse, P. E. (1964). The nature of belief systems in mass publics. In D. E. Apter (Ed.), Ideology and discontent (pp. 206–261). Free Press of Glencoe.
  • Eagleton, T. (1991). Ideology: An introduction. Verso.
  • Gramsci, A. (1971). Selections from the prison notebooks (Q. Hoare & G. N. Smith, Eds. & Trans.). Lawrence and Wishart.
  • Huntington, S. P. (1996). The clash of civilizations and the remaking of world order. Simon & Schuster.
  • Kennedy, E. (1978). A philosophe in the age of revolution: Destutt de Tracy and the origins of “ideology”. The American Philosophical Society.
  • Marx, K. (1975). Contribution to the critique of Hegel’s philosophy of right: Introduction. In Marx, Engels: Collected works (Vol. 3, pp. 175-187). International Publishers. (Original work published 1844)
  • Marx, K., & Engels, F. (1976). The German ideology. In Marx, Engels: Collected works (Vol. 5, pp. 19-539). International Publishers. (Original work written 1846)
  • Žižek, S. (1989). The sublime object of ideology. Verso.

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.