জন স্টুয়ার্ট মিল: আপনার স্বাধীনতা কতটুকু আপনার?

Table of Contents

ভূমিকা

কখনো কি আপনার মনে হয়েছে, চারপাশের সবাই যা বিশ্বাস করে, যা ভাবে, সেটাই কি একমাত্র সত্যি? কিংবা সমাজের অলিখিত নিয়মগুলোর চাপে পড়ে নিজের ভেতরের মানুষটাকে একটু একটু করে বিসর্জন দেওয়াটা কি খুব জরুরি? সুখ জিনিসটা আসলে কী? শুধু পেটপুরে খাওয়া, নিশ্চিন্তে ঘুমানো আর দশজনের চোখে ‘ভালো’ হয়ে থাকাই কি সুখ? নাকি এর চেয়েও গভীর, আরও বড় কোনো আনন্দের অস্তিত্ব আছে, যার জন্য কিছুটা অতৃপ্তি বা কষ্টকেও অনায়াসে মেনে নেওয়া যায়?

এই প্রশ্নগুলো যদি আপনার চিন্তার দরজায় কখনো কড়া নেড়ে থাকে, তবে আপনাকে স্বাগত জন স্টুয়ার্ট মিলের জগতে। মিল ছিলেন উনিশ শতকের একজন ব্রিটিশ দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, সংসদ সদস্য এবং সর্বোপরি এক আশ্চর্য চিন্তাবিদ। তবে এই সাদামাটা পরিচয়ের আড়ালে তিনি ছিলেন একজন মানুষ, যার পুরো জীবনটাই ছিল এক দীর্ঘ, নিঃসঙ্গ পরীক্ষানিরীক্ষা। আর সেই পরীক্ষা থেকে পাওয়া সিদ্ধান্তগুলো তিনি বিলিয়ে দিয়ে গেছেন আমাদের জন্য। তাঁর লেখা পড়লে মনে হয়, কেউ যেন খুব কাছের কোনো বন্ধু হয়ে কানের কাছে এসে নরম গলায় বলছে, “ভয় পেয়ো না। নিজের মতো করে ভাবো। সমাজের তৈরি করা ছাঁচে নিজেকে ঢালতে যেও না। তোমার ভেতরের স্বরকে শোনো। নিজের জীবনটা নিজের মতো করে বাঁচো, নিজের সত্যকে খুঁজে বের করো।”

চলুন, আজ আমরা এই মানুষটিকে একটু কাছ থেকে চেনার চেষ্টা করি। তাঁর চিন্তার গভীর সমুদ্রে একটা লম্বা ডুব দিয়ে দেখি, যদি কিছু অমূল্য মুক্তো খুঁজে পাওয়া যায়।

এক মনের নির্মাণ এবং তার অনিবার্য ভাঙন

এক আশ্চর্য শৈশব: জ্ঞানের পরীক্ষাগার

জন স্টুয়ার্ট মিলের গল্পটা শুরু করতে হয় তাঁর জন্মেরও আগে থেকে। তাঁর বাবা, জেমস মিল, ছিলেন একজন কঠোর পরিশ্রমী এবং আরও কঠোর প্রকৃতির স্কটিশ দার্শনিক, ইতিহাসবিদ এবং অর্থনীতিবিদ। জেমস মিলের জীবনের ব্রত ছিল একটাই—উপযোগবাদ (Utilitarianism)। তাঁর পরম বন্ধু এবং এই মতবাদের জনক ছিলেন আরেক কিংবদন্তী চিন্তাবিদ জেরেমি বেন্থাম (Jeremy Bentham)। তাঁরা দুজন মিলে এক যুগান্তকারী, এবং কিছুটা ভয়ংকর, পরিকল্পনা করলেন। পরিকল্পনাটি ছিল – একটি শিশুকে একেবারে শূন্য থেকে এমনভাবে গড়ে তোলা হবে, যে হবে তাঁদের যুক্তিবাদী আদর্শের নিখুঁত প্রতিচ্ছবি। সে হবে উপযোগবাদের এক জীবন্ত প্রমাণ, এক ভবিষ্যৎ রক্ষাকর্তা। সেই ‘প্রজেক্ট’ বা পরীক্ষামূলক শিশুটিই ছিলেন জন স্টুয়ার্ট মিল, যিনি ১৮০৬ সালের ২০ মে লন্ডনে জন্মেছিলেন।

ভাবুন তো, একটি শিশুর জীবন কেমন হতে পারে, যার কোনো খেলার সাথী নেই, নেই কোনো রূপকথার বই, নেই কোনো শিশুতোষ কবিতা বা গান? যার বাবা স্নেহের চেয়ে শিক্ষাকে বড় মনে করেন? মিলের শৈশব ছিল ঠিক তাই। তাঁর বাবা তাঁকে বানিয়েছিলেন এক জ্ঞান তৈরির যন্ত্র, এক চলমান বিশ্বকোষ। তাঁর শিক্ষার রুটিন শুনলে আজকের দিনের সবচেয়ে কঠোর অভিভাবকও হয়তো আঁতকে উঠবেন:

  • তিন বছর বয়সে: মিলকে প্রাচীন গ্রিক ভাষা শেখানো শুরু হয়। এমন একটি ভাষা, যা শিখতে বড়দেরও হিমশিম খেতে হয়। তাঁর বাবা মনে করতেন, শৈশবের স্মৃতিহীন বছরগুলো নষ্ট করার কোনো মানে হয় না।

  • আট বছর বয়সে: তিনি প্লেটো, হিরোডোটাস, জেনোফোন, ডায়োজিনিস লেরটিয়াসের মতো বিশ্বসেরা গ্রিক দার্শনিক ও ঐতিহাসিকদের লেখা মূল ভাষায় পড়া শেষ করে ফেলেছেন। একই সাথে শুরু হয়েছে ল্যাটিন, জ্যামিতি, বীজগণিত আর ডিফারেনশিয়াল ক্যালকুলাস। ইতিহাস তো ছিলই। শুধু তাই নয়, তাঁকে তাঁর ছোট ভাইবোনদের পড়ানোর দায়িত্বও দেওয়া হয়েছিল। তিনি ছিলেন তাঁর বাবার সহকারী শিক্ষক।

  • বারো বছর বয়সে: তিনি অ্যারিস্টটলের যুক্তিবিদ্যা (Logic) নিয়ে গভীর পড়াশোনা করছেন, যা তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল।

  • চৌদ্দ বছর বয়সে: তিনি ফ্রান্সের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির ওপর বক্তৃতা শুনছেন এবং অ্যাডাম স্মিথ ডেভিড রিকার্ডোর মতো অর্থনীতিবিদদের কাজ প্রায় সম্পূর্ণ আয়ত্ত করে ফেলেছেন।

তাঁর শৈশবে কোনো ছুটি ছিল না, ছিল না কোনো কবিতা, নাটক বা উপন্যাস—কারণ জেমস মিল মনে করতেন, এগুলো নিছকই ভাবালুতা। আবেগ (Emotion) জিনিসটা মানুষের যুক্তিবুদ্ধিকে (Reason) নষ্ট করে দেয়, এটি যুক্তির পরম শত্রু। তাই ছেলেকে তিনি আবেগ থেকে শত হাত দূরে রেখেছিলেন, যেন সে এক বিশুদ্ধ যুক্তিনির্ভর মানুষ হয়ে ওঠে। উদ্দেশ্য ছিল মহৎ—ছেলেকে পৃথিবীর সেরা জ্ঞানী বানানো, উপযোগবাদের এক অজেয় সৈনিক তৈরি করা। কিন্তু এই মহৎ উদ্দেশ্য পূরণ করতে গিয়ে তিনি প্রায় তাঁর ছেলেকে ভেতর থেকে নিঃশেষ করে ফেলেছিলেন। তিনি মিলকে এক অসাধারণ মস্তিষ্ক দিয়েছিলেন, কিন্তু একটি হৃদয় দিতে ভুলে গিয়েছিলেন।

কুড়ি বছরের সেই অন্ধকার: যখন আত্মা শুকিয়ে যায়

বিশ বছর বয়সে, যখন মিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে তাঁর বাবার অধীনেই একজন কেরানি হিসেবে কাজ করছেন এবং তরুণ উপযোগবাদীদের ‘ফিলোসফিক্যাল র‍্যাডিক্যালস’ (Philosophical Radicals) দলের নেতা হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছেন, তখন তাঁর জীবনে নেমে এলো এক ভয়াবহ বিপর্যয়। তিনি নিজেই তাঁর আত্মজীবনীতে (Autobiography, 1873) এই সংকটের নাম দিয়েছেন ‘মানসিক সংকট’ (Mental Crisis)।

হঠাৎ একদিন ১৮২৬ সালের শরৎকালে তাঁর মনে একটি প্রশ্ন উদয় হলো, যে প্রশ্নটি তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়: “ধরো, তোমার জীবনের সমস্ত লক্ষ্য এই মুহূর্তে অর্জিত হলো। পৃথিবীর সব আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, যা তুমি চেয়েছিলে, তা বাস্তবায়িত হলো। মানবজাতি উপযোগবাদী নীতিতে পুরোপুরি সুখী হয়ে গেল। এখন বলো, এই ঘটনা কি তোমার জন্য এক বিরাট আনন্দের কারণ হবে?”

তাঁর ভেতর থেকে এক শীতল, নিরুত্তাপ কণ্ঠস্বর উত্তর দিলো—”না।”

এই একটি ‘না’ তাঁর পায়ের তলার মাটি কেড়ে নিলো। তাঁর জীবনের সব উদ্দেশ্য, সব আদর্শ, যা নিয়ে তিনি বেঁচে ছিলেন, এক মুহূর্তে ধূলিসাৎ হয়ে গেল। তিনি লিখেছেন, “The whole foundation on which my life was constructed fell down.” (Mill, 1873)। পড়াশোনায় মন বসে না, কোনো কিছুতেই আনন্দ নেই। প্রিয় বইগুলো মনে হচ্ছে যেন শুকনো পাতার মতো নীরস। চারদিকে শুধুই এক গভীর বিষণ্ণতা, শূন্যতা আর একঘেয়েমি। তাঁর মনে হলো, তিনি যেন এক অনুভূতিহীন যন্ত্রে পরিণত হয়েছেন। যে বাবা তাঁকে পৃথিবীর সব জ্ঞান দিয়েছিলেন, তিনি তাঁকে অনুভূতি কী জিনিস, তা শেখাননি। তাঁকে বিশ্লেষণ করতে শিখিয়েছেন, কিন্তু অনুভব করতে শেখাননি। এই অবস্থাকে আধুনিক মনোবিজ্ঞানের ভাষায় অ্যানহেডোনিয়া (Anhedonia) বা আনন্দ অনুভব করার অক্ষমতা বলা যেতে পারে।

কয়েক মাস এই ভয়ংকর অবস্থা চলার পর, একদিন তিনি ঘটনাক্রমে ফরাসি লেখক জ্যাঁ-ফ্রাঁসোয়া মার্মন্টেলের স্মৃতিকথা পড়ছিলেন। সেখানে লেখকের বাবার মৃত্যুর একটি বর্ণনা পড়তে পড়তে, যেখানে লেখক তাঁর পরিবারের দায়িত্ব নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করছেন, মিলের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। সেই কান্না ছিল মুক্তির কান্না। সেই প্রথম তিনি বুঝতে পারলেন, তিনি এখনো একজন মানুষ। তাঁর ভেতরে আবেগ বেঁচে আছে। তিনি কাঁদতেও পারেন!

এই ঘটনা মিলের জীবনে এক নতুন দরজা খুলে দিল। তিনি বুঝতে পারলেন, মানুষের জীবনে শুধু যুক্তি আর বিশ্লেষণই সব নয়। মানুষের ভালো থাকার জন্য, সুখী হওয়ার জন্য, প্রয়োজন ‘অনুভূতির চাষ’ (Culture of the feelings)। তিনি কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ (William Wordsworth) এবং স্যামুয়েল টেলর কোলরিজের (Samuel Taylor Coleridge) কবিতা পড়তে শুরু করলেন। প্রকৃতির সৌন্দর্য আর মানুষের সাধারণ সুখ-দুঃখ, আবেগ নিয়ে লেখা সেই কবিতাগুলো তাঁর শুকিয়ে যাওয়া আত্মাকে সজীব করে তুলল।

তিনি বুঝলেন, সুখকে যদি জীবনের একমাত্র প্রত্যক্ষ লক্ষ্য বানানো হয়, তবে সুখ অধরাই থেকে যায়। সুখ হলো প্রজাপতির মতো, ধরতে গেলেই উড়ে যায়। সুখকে পেতে হয় পরোক্ষভাবে, অন্য কোনো লক্ষ্যে মনোনিবেশ করার মাধ্যমে। যেমন, অন্যের মঙ্গলের জন্য কাজ করা বা শিল্প-সাহিত্যের মতো কোনো মহৎ বিষয়কে ভালোবাসা। এই সংকট তাঁকে জেরেমি বেন্থামের যান্ত্রিক উপযোগবাদ থেকে বের করে এনে এক নতুন, আরও মানবিক দর্শনের দিকে নিয়ে যায়।

এক বিপ্লবী প্রেম: হ্যারিয়েট টেইলর মিল

মিলের জীবনে দ্বিতীয় এবং সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল হ্যারিয়েট টেইলরের (Harriet Taylor) সাথে তাঁর পরিচয়। ১৮৩০ সালে, তাঁর মানসিক সংকট থেকে বেরিয়ে আসার কিছুদিন পর, পঁচিশ বছর বয়সী মিলের সাথে পরিচয় হয় হ্যারিয়েটের। হ্যারিয়েট ছিলেন একজন বিবাহিতা নারী এবং দুই সন্তানের জননী। কিন্তু তাঁর অসাধারণ মেধা, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, স্বাধীন চিন্তা এবং প্রচলিত প্রথার প্রতি বিদ্রোহের মনোভাব মিলকে গভীরভাবে আকর্ষণ করে। হ্যারিয়েট ছিলেন সেই নারী, যার মধ্যে মিল তাঁর নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক সমকক্ষ এবং আবেগের আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিলেন।

তাঁদের মধ্যে গড়ে ওঠে এক আশ্চর্য সুন্দর বন্ধুত্ব, যা ছিল মূলত বুদ্ধিবৃত্তিক এবং প্লেটোনিক (Platonic)। দীর্ঘ একুশ বছর তাঁরা বন্ধু হিসেবেই একে অপরের চিন্তার জগৎকে সমৃদ্ধ করেছেন। তৎকালীন ভিক্টোরিয়ান সমাজের কঠোর নৈতিকতার চোখে এই সম্পর্ক ছিল এক বিরাট কেলেঙ্কারি। সমাজের নিন্দা, কৌতুক আর কানাঘুষাকে তাঁরা দুজনই উপেক্ষা করেছেন। এই সম্পর্ক ছিল প্রচলিত প্রথার প্রতি এক সরাসরি চ্যালেঞ্চ। হ্যারিয়েটের স্বামী জন টেইলরের মৃত্যুর দু’বছর পর, ১৮৫১ সালে, তাঁরা বিয়ে করেন।

মিল তাঁর প্রায় সব লেখার কৃতিত্ব হ্যারিয়েটকে দিয়েছেন। তিনি হ্যারিয়েটকে তাঁর ‘জীবনের আলো’ (light of his life) এবং তাঁর লেখার ‘উৎসকেন্দ্র’ (fountain of inspiration) বলে উল্লেখ করেছেন। বিশেষ করে তাঁর বিখ্যাত বই অন লিবার্টি (On Liberty) এবং দ্য সাবজেকশন অফ উইমেন (The Subjection of Women) ছিল তাঁদের দুজনের সম্মিলিত চিন্তার ফসল। মিলের ভাষায়, এই বইগুলো যতটা তাঁর, ততটাই হ্যারিয়েটের।

হ্যারিয়েটই মিলকে শিখিয়েছিলেন, ব্যক্তিগত জীবন আর সামাজিক স্বাধীনতার প্রশ্নগুলো কতটা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তিনিই মিলের উদারনীতিবাদকে (Liberalism) আরও র‍্যাডিক্যাল বা বৈপ্লবিক করে তুলেছিলেন, বিশেষ করে নারী অধিকারের প্রশ্নে। হ্যারিয়েট ছিলেন সেই অগ্নিশিখা, যা মিলের প্রজ্ঞাকে আরও উজ্জ্বল, আরও মানবিক করে তুলেছিল।

চিন্তার শেকড়: যে আলো-হাওয়ায় বেড়ে উঠেছিলেন জন স্টুয়ার্ট মিল

কোনো মানুষই কি শূন্যে ভেসে থাকে? কিংবা কোনো চিন্তা কি আকাশ থেকে হঠাৎ করে টুপ করে পড়ে? পড়ে না। প্রতিটি বড় নদীর যেমন অসংখ্য ছোট ছোট ঝর্ণা আর উপনদী উৎস হিসেবে কাজ করে, তেমনি প্রতিটি বড় চিন্তার পেছনেও থাকে যুগ যুগ ধরে বয়ে চলা অজস্র পুরোনো চিন্তার স্রোত। থাকে সময়ের চাপ, পারিপার্শ্বিকতার ঢেউ। জন স্টুয়ার্ট মিলও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না।

আমরা যখন মিলের স্বাধীনতার জয়গান শুনি, বা তাঁর মানবিক উপযোগবাদের কথা পড়ি, তখন মনে হতে পারে, উনিশ শতকের ইংল্যান্ডে একাকী এক ঋষি যেন নিজের জ্ঞান আর প্রজ্ঞা দিয়ে এই দর্শন গড়ে তুলেছেন। কিন্তু গল্পটা মোটেও তেমন নয়। মিল ছিলেন তাঁর সময়ের এক আশ্চর্য ফসল। তাঁর চিন্তার শেকড় ছড়িয়ে ছিল একদিকে জ্ঞানদীপ্তির (The Enlightenment) যুক্তিবাদী মাটিতে, অন্যদিকে ফরাসি বিপ্লবের উত্তাল হাওয়ায়। তাঁর দর্শনের কারিগর কেবল তিনি একা ছিলেন না; তাঁর পেছনে ছিলেন লক, বেন্থাম, এমনকী তাঁর ঘোর বিরোধী রোমান্টিক কবিরাও।

এক উত্তাল, বদলে যাওয়া পৃথিবী

মিলের চিন্তার জগৎ বুঝতে হলে আমাদের প্রথমে তাঁর সময়টাকে বুঝতে হবে। তিনি জন্মেছিলেন উনিশ শতকের শুরুতে, এমন এক ইংল্যান্ডে যা এক কথায় ছিল এক তোলপাড় করা পরীক্ষাগার।

শিল্প বিপ্লবের দীর্ঘ ছায়া (The Shadow of the Industrial Revolution)

ইংল্যান্ড তখন শিল্প বিপ্লবের কেন্দ্রে। একদিকে বাষ্পীয় ইঞ্জিন, নতুন নতুন কারখানা আর রেললাইন দেশটাকে বদলে দিচ্ছে, তৈরি হচ্ছে বিপুল সম্পদ। ম্যানচেস্টার, লিভারপুলের মতো শহরগুলো ফুলেফেঁপে উঠছে। কিন্তু এই আলোর নিচেই ছিল জমাট বাঁধা অন্ধকার। গ্রামের পর গ্রাম ভেঙে মানুষ ছুটে আসছে শহরের বস্তিতে। অস্বাস্থ্যকর, ঘিঞ্জি পরিবেশে লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের জীবন কাটছে। নারী-পুরুষ, এমনকি কচি কচি শিশুরাও দিনের পনেরো-ষোলো ঘণ্টা কাজ করছে সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। একদিকে যেমন জন্ম নিচ্ছিল এক নব্য ধনী বুর্জোয়া শ্রেণি, অন্যদিকে তৈরি হচ্ছিল এক বিশাল, শোষিত শ্রমিক শ্রেণি বা প্রলেতারিয়েত (Proletariat)

এই ভয়াবহ বৈষম্য, এই সামাজিক যন্ত্রণা তৎকালীন চিন্তাবিদদের মনে গভীর দাগ কেটেছিল। প্রশ্ন উঠছিল—এই কি উন্নতি? এই বিপুল সম্পদের বিনিময়ে কি মানবতাকে বিসর্জন দেওয়া হচ্ছে? এই পরিস্থিতিই মিল এবং তাঁর মতো চিন্তাবিদদের বাধ্য করেছিল এমন এক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা ভাবতে, যা কেবল সম্পদ তৈরি করবে না, বরং সেই সম্পদকে আরও ন্যায্যভাবে বণ্টন করবে এবং মানুষের মর্যাদাকে সম্মান জানাবে (Reeves, 2007)।

ফরাসি বিপ্লবের ভূত (The Ghost of the French Revolution)

যদিও মিলের জন্মের আগেই ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯) শেষ হয়ে গিয়েছিল, তার ঢেউ তখনও ইউরোপের রাজনীতিতে আছড়ে পড়ছিল। “স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রী” (Liberty, Equality, Fraternity)—এই তিনটি শব্দ ছিল তখনকার তরুণদের কাছে মন্ত্রের মতো। বিপ্লব দেখিয়ে দিয়েছিল যে, হাজার বছরের পুরোনো রাজতন্ত্র আর অভিজাততন্ত্রকে ভেঙে ফেলা সম্ভব। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এই বিপ্লবের উদারনৈতিক (Liberal) দিকটি মিলকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।

কিন্তু এর একটি ভয়ংকর দিকও ছিল। বিপ্লবের পর ‘সন্ত্রাসের রাজত্ব’ (Reign of Terror) দেখিয়েছিল, লাগামহীন জনতার শাসন বা গণতন্ত্র কত ভয়ংকর রূপ নিতে পারে। সংখ্যাগুরুদের উন্মত্ততা কীভাবে সংখ্যালঘুদের জীবন কেড়ে নিতে পারে, গিলোটিনের নিচে চাপা দিতে পারে যেকোনো ভিন্নমতকে। এই ভয় মিলের মনে গেঁথে গিয়েছিল। তাই তিনি সারাজীবন ধরে এমন এক গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখেছেন, যেখানে ব্যক্তির স্বাধীনতা সংখ্যাগুরুদের স্বৈরাচারের (Tyranny of the Majority) হাত থেকে সুরক্ষিত থাকবে।

এই রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটেই জন্ম নিয়েছিল মিলের দর্শন। এবার চলুন দেখি, কোন কোন দার্শনিকের কাঁধে ভর দিয়ে তিনি নিজের যাত্রাপথ তৈরি করেছিলেন।

দর্শনের উত্তরাধিকার: যাঁদের কাছে তিনি ঋণী

মিলের চিন্তার জগতে প্রবেশ করলে আমরা দেখতে পাই, তিনি বেশ কয়েকজন পূর্বসূরীর কাছে গভীরভাবে ঋণী। কেউ তাঁকে পথ দেখিয়েছেন, আবার কারও সাথে বিতর্ক করতে করতেই তিনি নিজের পথ খুঁজে পেয়েছেন।

জন লক: উদারনীতিবাদের জনক (John Locke: The Father of Liberalism)

সপ্তদশ শতকের ব্রিটিশ দার্শনিক জন লককে ছাড়া আধুনিক উদারনীতিবাদকে কল্পনা করা যায় না। মিলের দর্শনের অনেক মৌলিক ধারণার বীজ লুকিয়ে আছে লকের চিন্তায়।

  • অভিজ্ঞতাবাদ (Empiricism): লক বলেছিলেন, মানুষ জন্মের সময় এক ‘ট্যাবুলা রাসা’ (Tabula Rasa) বা অলিখিত সাদা পাতা নিয়ে জন্মায়। তার সমস্ত জ্ঞান অর্জিত হয় অভিজ্ঞতা আর পারিপার্শ্বিকতা থেকে। এই ধারণাটি জেমস মিলকে (জনের বাবা) গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। তিনি ভেবেছিলেন, যদি তাই হয়, তবে একজন শিশুকে সঠিক শিক্ষা ও পরিবেশ দিয়ে পৃথিবীর সেরা যুক্তিবাদী মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। জন স্টুয়ার্ট মিল ছিলেন সেই ‘পরীক্ষার’ ফল (Capaldi, 2004)।

  • প্রাকৃতিক অধিকার (Natural Rights): লক যুক্তি দিয়েছিলেন, প্রত্যেক মানুষের কিছু অবিচ্ছেদ্য প্রাকৃতিক অধিকার আছে—জীবন, স্বাধীনতা এবং সম্পত্তির অধিকার। সরকার এই অধিকারগুলো রক্ষা করার জন্যই তৈরি হয়েছে, হরণ করার জন্য নয়। সরকারের ক্ষমতা জনগণের সম্মতির ওপর নির্ভরশীল। এই চিন্তাটিই মিলের অন লিবার্টি বইয়ের মূল ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিল। ব্যক্তির স্বাধীনতার ধারণাটি তিনি লকের কাছ থেকেই উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন।

উপযোগবাদী গুরুরা: বেন্থাম ও জেমস মিল (The Utilitarian Fathers: Bentham and James Mill)

মিলের সবচেয়ে প্রত্যক্ষ এবং শক্তিশালী প্রভাব এসেছিল উপযোগবাদীদের কাছ থেকে, বিশেষ করে জেরেমি বেন্থাম এবং তাঁর নিজের বাবা জেমস মিলের কাছ থেকে।

  • জেরেমি বেন্থাম (Jeremy Bentham): বেন্থাম ছিলেন উপযোগবাদের মূল প্রবক্তা। তাঁর সহজ-সরল নীতি ছিল—যে কাজটি সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি পরিমাণ সুখ (The greatest happiness for the greatest number) তৈরি করবে, সেটিই নৈতিকভাবে সঠিক। তিনি মনে করতেন, সুখকে মাপা যায়। কোন কাজের ফলে কতটুকু আনন্দ বা কষ্ট হচ্ছে, তার একটি গাণিতিক হিসাব বা ‘ফেলিসিফিক ক্যালকুলাস’ (Felicific Calculus) করা সম্ভব। তাঁর কাছে সব সুখের মান ছিল সমান। তিনি বিখ্যাতভাবে বলেছিলেন, “Push-pin is as good as poetry” অর্থাৎ, শিশুদের একটি সাধারণ খেলার আনন্দ আর কবিতা পড়ার আনন্দ গুণগতভাবে এক, যদি তাদের পরিমাণ সমান হয় (Bentham, 1789)। মিল এই দর্শনের আবহে বড় হয়েছিলেন, কিন্তু পরে এর যান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন।

  • জেমস মিল (James Mill): মিলের বাবা ছিলেন বেন্থামের একনিষ্ঠ শিষ্য এবং তাঁর চেয়েও বেশি কট্টর। তিনি তাঁর ছেলের ওপর উপযোগবাদের আদর্শকে আক্ষরিক অর্থেই চাপিয়ে দিয়েছিলেন। জেমস মিলের কঠোর, আবেগহীন এবং বিশুদ্ধ যুক্তিনির্ভর শিক্ষাই ছিল জন স্টুয়ার্ট মিলের শৈশব। এই শিক্ষা একদিকে যেমন মিলকে অসাধারণ পাণ্ডিত্য দিয়েছিল, অন্যদিকে তাঁর মানসিক স্বাস্থ্যের প্রায় সর্বনাশ করে ফেলেছিল। তাই বলা যায়, উপযোগবাদ ছিল মিলের জন্য একাধারে আশীর্বাদ ও অভিশাপ। তিনি এর মূলনীতি গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু এর মানবিকীকরণের প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন তাঁর নিজের জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে।

বিদ্রোহ ও সংশ্লেষণ: নতুন পথের সন্ধান

কোনো বড় চিন্তাবিদই তাঁর পূর্বসূরীদের হুবহু নকল করেন না। মিলও করেননি। তিনি তাঁর উত্তরাধিকারকে গ্রহণ করেছেন, কিন্তু তাকে নিজের মতো করে গড়েপিটে নিয়েছেন। এই রূপান্তরের পেছনেও কিছু প্রভাবক কাজ করেছে।

রোমান্টিক ধারার প্রভাব (The Influence of Romanticism)

উনিশ শতকের শুরুতে শিল্প বিপ্লব এবং জ্ঞানদীপ্তির শীতল যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে এক বড় ধরনের সাংস্কৃতিক বিদ্রোহ দেখা দেয়, যা রোমান্টিসিজম নামে পরিচিত। ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোলরিজ, শেলি, কিটসের মতো কবিরা আবেগের জয়গান গেয়েছিলেন। তাঁরা প্রকৃতির সৌন্দর্য, ব্যক্তির ভেতরের জগৎ, অনুভূতি আর কল্পনার গুরুত্বের কথা বলেছিলেন।

কুড়ি বছর বয়সে মিল যখন ভয়াবহ মানসিক সংকটে ভুগছিলেন, যখন তাঁর মনে হচ্ছিল সব জ্ঞান অর্থহীন, তখন বেন্থামের দর্শন তাঁকে কোনো পথ দেখাতে পারেনি। তাঁকে বাঁচিয়েছিল কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতা (Mill, 1873, Autobiography)। তিনি প্রথমবার বুঝতে পারেন, মানুষের জন্য কেবল যুক্তিই যথেষ্ট নয়; অনুভূতির চাষ (Culture of the feelings) করাও জরুরি। এই উপলব্ধি থেকেই তিনি বেন্থামের উপযোগবাদকে সংশোধন করেন। তিনি বলেন, সব সুখ সমান নয়। কিছু সুখ ‘উচ্চতর’ (Higher Pleasures), যা মানুষের মেধা ও অনুভূতির সাথে জড়িত, আর কিছু সুখ ‘নিম্নতর’ (Lower Pleasures), যা কেবল ইন্দ্রিয়গত। এই বিভাজনটি ছিল রোমান্টিক চিন্তার দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত।

আলেক্সি ডি টকভিল এবং গণতন্ত্রের বিপদ (Alexis de Tocqueville and the Dangers of Democracy)

ফরাসি চিন্তাবিদ আলেক্সি ডি টকভিল ছিলেন মিলের সমসাময়িক। আমেরিকায় ভ্রমণ করে তিনি তাঁর বিখ্যাত বই ডেমোক্রেসি ইন আমেরিকা (Democracy in America) লেখেন। এই বইটি মিলকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। টকভিলই প্রথম গণতন্ত্রের এক নতুন বিপদের কথা স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন, যার নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘সংখ্যাগুরুদের স্বৈরাচার’ (Tyranny of the Majority)। তিনি দেখান, একটি গণতান্ত্রিক সমাজে আইনি বা রাজনৈতিক নিপীড়নের চেয়েও ভয়ংকর হতে পারে সামাজিক চাপ। যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ একই রকম চিন্তা করে, তখন তারা ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর এক অদৃশ্য কিন্তু শক্তিশালী চাপ তৈরি করে, যা ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যকে (Individuality) পিষে ফেলে (Tocqueville, 1835)।

টকভিলের এই বিশ্লেষণ মিলের মনে থাকা ভয়টিকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। তাঁর অন লিবার্টি বইটি ছিল মূলত টকভিলের এই সমস্যার একটি দার্শনিক উত্তর। কীভাবে ব্যক্তিকে সমাজের এই অদৃশ্য কারাগার থেকে রক্ষা করা যায়, সেই প্রশ্নেরই জবাব খুঁজেছিলেন মিল।

হ্যারিয়েট টেইলর মিল: সহযোদ্ধা ও পথপ্রদর্শক (Harriet Taylor Mill: The Collaborator and Guide)

মিলের চিন্তার জগতে হ্যারিয়েট টেইলরের প্রভাবকে খাটো করে দেখার কোনো উপায় নেই। হ্যারিয়েট ছিলেন একজন র‍্যাডিক্যাল চিন্তাবিদ, যিনি নারী অধিকার, সমাজতন্ত্র এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতা নিয়ে মিলের চেয়েও এক ধাপ এগিয়ে ভাবতেন। মিলের নিজের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, হ্যারিয়েট ছিলেন তাঁর চিন্তার সঙ্গী এবং অনেক ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক। বিশেষ করে অন লিবার্টি এবং দ্য সাবজেকশন অফ উইমেন বই দুটিতে হ্যারিয়েটের চিন্তার ছাপ অত্যন্ত স্পষ্ট। হ্যারিয়েটই মিলকে শিখিয়েছিলেন, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা কেবল রাজনৈতিক বিষয় নয়, এটি সামাজিক এবং পারিবারিক জীবনেও সমানভাবে জরুরি। তিনিই মিলের উদারনীতিবাদকে আরও সাহসী এবং বৈপ্লবিক করে তুলেছিলেন (Ryan, 1990)।

যেখানে সব নদী এসে মেশে

তাহলে আমরা কী দেখতে পেলাম? জন স্টুয়ার্ট মিল ছিলেন এক আশ্চর্য সঙ্গমস্থল, যেখানে এসে মিশেছে বিভিন্ন চিন্তার স্রোত। লকের উদারনীতিবাদ তাঁকে দিয়েছিল ব্যক্তির অধিকারের ভিত্তি। বেন্থাম ও জেমস মিল দিয়েছিলেন উপযোগবাদের কাঠামো। রোমান্টিক কবিরা শিখিয়েছিলেন অনুভূতির মূল্য। টকভিল দেখিয়েছিলেন গণতন্ত্রের অন্ধকার দিক। আর হ্যারিয়েট টেইলর দিয়েছিলেন সাহস ও র‍্যাডিক্যাল দৃষ্টি।

মিলের মহত্ত্ব এখানে যে, তিনি এই ভিন্ন ভিন্ন, এমনকি পরস্পরবিরোধী চিন্তাগুলোকে কেবল গ্রহণ করেননি, তিনি সেগুলোকে সংশ্লেষণ করে এক নতুন, আরও মানবিক এবং যুগোপযোগী দর্শন তৈরি করেছেন। তিনি বুঝেছিলেন, মানুষের জন্য কেবল রুটিই যথেষ্ট নয়, গোলাপেরও প্রয়োজন আছে। কেবল সমষ্টির সুখই নয়, ব্যক্তির আত্মার বিকাশও জরুরি। এই বোঝাপড়াটাই তাঁকে তাঁর পূর্বসূরীদের থেকে আলাদা করে তুলেছে এবং আজকের দিনেও প্রাসঙ্গিক রেখেছে।

তিনি ছিলেন সেই কারিগর, যিনি পুরোনো দিনের ইট-পাথর দিয়ে এক নতুন এবং আরও সুন্দর ইমারত গড়ে তুলেছিলেন।

সুখের নতুন সংজ্ঞা—উপযোগবাদের মানবিক রূপ

উপযোগবাদ (Utilitarianism) ছিল মিলের দর্শনের ভিত্তি। কিন্তু তিনি যে উপযোগবাদকে আমাদের সামনে এনেছেন, তা তাঁর বাবা ও বেন্থামের উপযোগবাদ থেকে অনেকটাই ভিন্ন—আরও মানবিক, জটিল এবং উন্নত।

বেন্থামের উপযোগবাদ: সুখ মাপার এক সরল অঙ্ক

প্রথমে জেরেমি বেন্থামের ধারণাটি বোঝা দরকার। তাঁর মতে, প্রকৃতি মানুষকে দুটি সার্বভৌম প্রভুর অধীনে রেখেছে: যন্ত্রণা (Pain) এবং আনন্দ (Pleasure)। আমাদের সব কাজই হয় আনন্দ লাভের জন্য, নয়তো যন্ত্রণা এড়ানোর জন্য। সুতরাং, নৈতিকতার একমাত্র মাপকাঠি হওয়া উচিত উপযোগিতা (Utility), অর্থাৎ কোনো কাজ কতটা আনন্দ উৎপাদন করছে বা যন্ত্রণা হ্রাস করছে।

বেন্থামের মূলমন্ত্র ছিল—”সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি পরিমাণ সুখ” (The greatest happiness for the greatest number)। তাঁর কাছে, সব সুখই সমান। ভালো বই পড়ে যে আনন্দ পাওয়া যায়, আর বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে যে আনন্দ পাওয়া যায়—এই দুই আনন্দের মধ্যে গুণগত (Qualitative) কোনো পার্থক্য নেই, কেবল পরিমাণের (Quantitative) পার্থক্য থাকতে পারে। তিনি একটি ‘সুখের ক্যালকুলাস’ বা ‘ফেলিসিফিক ক্যালকুলাস’ (Felicific Calculus) তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন, যা দিয়ে যেকোনো কাজের ফলে সৃষ্ট সুখ বা দুঃখের পরিমাণ মাপা যাবে। এটাকে বলা হয় পরিমাণগত উপযোগবাদ (Quantitative Utilitarianism)।

উচ্চতর বনাম নিম্নতর সুখ: শূকরের দর্শন নয়

এখানেই মিল বেন্থামের সাথে তাঁর বিখ্যাত ভিন্নমতটি পোষণ করলেন। তাঁর কুড়ি বছর বয়সের মানসিক সংকট তাঁকে শিখিয়েছিল, সব সুখ এক নয়। তিনি বললেন, সুখের কেবল পরিমাণ (Quantity) নেই, এর গুণগত মানও (Quality) আছে।

কিছু সুখ আছে যা মানুষের উন্নত মানসিক বৃত্তির (Higher Faculties) সাথে জড়িত, যেমন—জ্ঞানার্জন, শিল্প-সাহিত্য উপভোগ, সৃজনশীল কাজ, অন্যের উপকার করা, নৈতিক জীবনযাপন, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা। এগুলো হলো ‘উচ্চতর সুখ’ (Higher Pleasures)।

আর কিছু সুখ আছে যা কেবল শারীরিক বা ইন্দ্রিয়গত, যা মানুষ ও পশু উভয়ের মধ্যেই বিদ্যমান। যেমন—খাওয়া, ঘুম, আমোদ-ফুর্তি। এগুলো হলো ‘নিম্নতর সুখ’ (Lower Pleasures)।

মিলের মতে, অল্প পরিমাণ উচ্চতর সুখও অনেক বেশি পরিমাণ নিম্নতর সুখের চেয়ে শ্রেয়। এই প্রসঙ্গে তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তিটি না বললেই নয়, যা তাঁর দর্শনকে এক বাক্যে তুলে ধরে:

“It is better to be a human being dissatisfied than a pig satisfied; better to be Socrates dissatisfied than a fool satisfied. And if the fool, or the pig, are of a different opinion, it is because they only know their own side of the question.”
(একজন অতৃপ্ত মানুষ হওয়াও একজন তৃপ্ত শূকর হওয়ার চেয়ে ভালো; একজন অতৃপ্ত সক্রেটিস হওয়াও একজন তৃপ্ত বোকা হওয়ার চেয়ে ভালো। আর যদি সেই বোকা বা শূকর ভিন্নমত পোষণ করে, তার কারণ হলো তারা কেবল মুদ্রার এক পিঠই দেখেছে।) (Mill, 1863)

এর মানে কী? এর মানে হলো, একজন জ্ঞানী মানুষ (সক্রেটিস) হয়তো পৃথিবীর দুঃখ-কষ্ট, অবিচার আর নিজের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা নিয়ে চিন্তা করে সবসময় কিছুটা অতৃপ্ত থাকেন। কিন্তু তাঁর সেই অতৃপ্তিও একজন নির্বোধ মানুষের পেটপুরে খেয়ে আর দশটা স্থূল আনন্দে পাওয়া তৃপ্তির চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান। কারণ, জ্ঞানী মানুষটি উচ্চতর সুখের স্বাদ পেয়েছেন, যা সেই নির্বোধ পায়নি। যে ব্যক্তি শেক্সপিয়রের সনেট এবং একটি সাধারণ কৌতুক—দুটিরই রস আস্বাদন করতে পারে, সে জানে যে সনেটের আনন্দ অনেক গভীর এবং স্থায়ী।

মিলের এই ধারণা উপযোগবাদকে সমালোচকদের ‘শূকরের দর্শন’ (A doctrine worthy only of swine) নামক অভিযোগ থেকে রক্ষা করে। এটি আর নিছক সুখ পরিমাপের যন্ত্র থাকে না, বরং এক উন্নত, মানবিক ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের দর্শন হয়ে ওঠে, যা মানুষের আত্মবিকাশ বা সমৃদ্ধিকে গুরুত্ব দেয়।

নিয়ম যখন সুখের রক্ষাকবচ: কর্ম বনাম নিয়ম উপযোগবাদ

বেন্থামের তত্ত্বকে অনেক সময় ‘কর্ম উপযোগবাদ’ (Act Utilitarianism) বলা হয়। এর অর্থ হলো, প্রতিটি আলাদা আলাদা কাজের ফলাফল বিচার করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে কাজটি নৈতিকভাবে সঠিক কি না। যেমন, একজন ডাক্তার যদি মনে করেন, একজন সুস্থ মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে পাঁচজন মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচানো যাবে এবং এতে মোট সুখের পরিমাণ বাড়বে (পাঁচজনের জীবন > একজনের জীবন), তবে কর্ম উপযোগবাদ হয়তো বলবে, কাজটি করা যেতে পারে।

কিন্তু মিল এই ধরনের চিন্তার বিপদ বুঝতে পেরেছিলেন। এটি সমাজকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে এবং মানুষের মৌলিক অধিকারকে (Rights) ক্ষুণ্ণ করতে পারে। তাই তিনি পরোক্ষভাবে ‘নিয়ম উপযোগবাদে’র (Rule Utilitarianism) দিকে ঝোঁকেন। এই মতবাদ অনুযায়ী, আমরা প্রতিটি কাজের বিচার আলাদাভাবে করব না। বরং আমরা এমন কিছু সাধারণ নৈতিক নিয়ম (Moral Rules) অনুসরণ করব, যেগুলো সার্বিকভাবে সমাজের জন্য সবচেয়ে বেশি মঙ্গল বা সুখ বয়ে আনে।

যেমন, “নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা উচিত নয়” বা “চুরি করা উচিত নয়”—এগুলো হলো এমন নিয়ম। এই নিয়মগুলো মেনে চললে হয়তো কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে (যেমন ওই সার্জনের ক্ষেত্রে) সর্বাধিক সুখ তৈরি হলো না, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে সমাজে যে আস্থা, নিরাপত্তা ও পারস্পরিক বিশ্বাস তৈরি হবে, তার ফলে মোট সুখের পরিমাণ অনেক বেশি বাড়বে। তাই ডাক্তারের ওই কাজটি করা ভুল হবে, কারণ এটি একটি প্রতিষ্ঠিত এবং সার্বিকভাবে উপকারী সামাজিক নিয়মকে লঙ্ঘন করছে। এই নিয়মগুলো হলো সেই বেড়া, যা আমাদের সাময়িক ভুলের হাত থেকে সমাজকে রক্ষা করে।

উপযোগবাদের ‘প্রমাণ’ এবং নৈতিকতার উৎস

মিলের দর্শনের একটি বিতর্কিত অংশ হলো উপযোগবাদের ‘প্রমাণ’। তিনি যুক্তি দেন, কোনো কিছু যে কাঙ্ক্ষিত (desirable), তার একমাত্র প্রমাণ হলো মানুষ আসলে তা কামনা (desire) করে। যেহেতু প্রত্যেকেই নিজের সুখ কামনা করে, তাই সমষ্টিগতভাবে মানবজাতির সুখই হলো সার্বিকভাবে কাঙ্ক্ষিত বিষয়।

সমালোচকরা বলেন, এটি একটি যৌক্তিক ভুল (Fallacy of composition)। কোনো কিছুকে মানুষ কামনা করে (is desired) মানেই যে তা কাঙ্ক্ষিত বা নৈতিকভাবে চাওয়া উচিত (is desirable), তা না-ও হতে পারে। মানুষ তো অনেক খারাপ জিনিসও কামনা করে। তবে মিলের সমর্থকরা বলেন, তিনি এখানে কোনো গাণিতিক প্রমাণ দিতে চাননি, বরং মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতার দিকে ইঙ্গিত করেছেন।

তিনি আরও প্রশ্ন তোলেন, মানুষ কেন উপযোগবাদী নীতি মেনে চলবে? এর উত্তরে তিনি দুই ধরনের নিয়ন্ত্রণের (Sanctions) কথা বলেন: বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ (External Sanctions), যেমন—সমাজের প্রশংসা বা নিন্দা, আইনের ভয়; এবং অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ (Internal Sanctions), যা হলো আমাদের বিবেক (Conscience) এবং অন্যের প্রতি সহানুভূতি। মিলের মতে, এই অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণই সবচেয়ে শক্তিশালী। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে এই সামাজিক অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে পারলেই উপযোগবাদ একটি শক্তিশালী নৈতিক ভিত্তি পাবে।

স্বাধীনতার ইশতেহার—‘অন লিবার্টি’-র পৃথিবী

যদি মিলের মাত্র একটি বই পড়ার সুযোগ থাকে, তবে সেটি হওয়া উচিত অন লিবার্টি (১৮৫৯)। এই ছোট বইটি আধুনিক গণতন্ত্র, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য (Individuality) ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার ভিত্তি স্থাপন করেছে। পৃথিবীর যেখানেই মানুষ তার অধিকার নিয়ে কথা বলে, সেখানেই মিলের এই বইটির ছায়া খুঁজে পাওয়া যায়।

ক্ষতির নীতি: আমার সীমানা কোথায় শেষ?

এই বইয়ের মূল ধারণাটি কী? মিল বলছেন, একজন ব্যক্তির জীবনে সমাজ বা রাষ্ট্র কখন হস্তক্ষেপ করতে পারে, তার একটিই মাত্র সুস্পষ্ট সীমা আছে। সেটি হলো ‘ক্ষতির নীতি’ (The Harm Principle)।

মিল খুব পরিষ্কার এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন:

“The only purpose for which power can be rightfully exercised over any member of a civilized community, against his will, is to prevent harm to others. His own good, either physical or moral, is not a sufficient warrant.”
(কোনো সভ্য সমাজের সদস্যের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ক্ষমতার সঠিক প্রয়োগ কেবল একটি কারণেই হতে পারে: অন্যের ক্ষতি প্রতিরোধ করা। তার নিজের ভালো, তা শারীরিক বা নৈতিক যাই হোক, হস্তক্ষেপের জন্য যথেষ্ট কারণ নয়।) (Mill, 1859)

এর মানে কী? এর মানে হলো, আমি বা আপনি কী পোশাক পরব, কী খাব, কোন ধর্মে বিশ্বাস করব বা করব না, কী বই পড়ব, প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে কাদের সাথে মিশব—এগুলো একান্তই আমার ব্যক্তিগত বা ‘আত্ম-সম্পর্কিত’ (Self-regarding) বিষয়। আমার এই কাজগুলোর জন্য সমাজ বা রাষ্ট্র আমাকে ততক্ষণ পর্যন্ত বাধা দিতে পারবে না, যতক্ষণ না আমার কোনো কাজ সরাসরি অন্যের ক্ষতি করছে।

এখানে ‘ক্ষতি’ (Harm) বলতে মিল কী বুঝিয়েছেন? এটি একটি জটিল প্রশ্ন। মিল মূলত বুঝিয়েছেন অন্যের স্বার্থ বা অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করা। যেমন, শারীরিক আঘাত করা, সম্পত্তি নষ্ট করা, কাউকে তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করা, অথবা কোনো নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হওয়া (যেমন, একজন সাক্ষীর সাক্ষ্য না দেওয়া)। কিন্তু কেবল অনুভূতিতে আঘাত লাগা (Offense) বা কারও কাজ অপছন্দ হওয়া ‘ক্ষতি’ নয়। আপনি কারও পোশাক বা জীবনযাপন দেখে বিরক্ত হতে পারেন, কিন্তু তা তাকে জোর করে বদলানোর অধিকার আপনাকে দেয় না। এর মাধ্যমে মিল সমাজের ‘নৈতিক পুলিশগিরি’র (Moral Policing) ঘোর বিরোধিতা করেছেন।

চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা: কেন ভুল মতেরও দাম আছে

অন লিবার্টি বইয়ের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং বিখ্যাত অংশ হলো চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা (Freedom of Thought and Expression) নিয়ে মিলের আলোচনা। তিনি মনে করতেন, যেকোনো মত, তা যতটাই অজনপ্রিয়, উদ্ভট, আপত্তিকর বা ভুল মনে হোক না কেন, তাকে প্রকাশ করার সুযোগ দিতে হবে। কোনো মতকে স্তব্ধ করে দেওয়া মানবজাতির জন্য এক বিরাট ক্ষতি। এর পেছনে তিনি তিনটি অকাট্য যুক্তি দিয়েছেন:

১. যে মতটিকে আমরা দমন করছি, সেটি সত্য হতে পারে: ইতিহাস সাক্ষী, এমন অনেক মহান সত্যকে একসময় মিথ্যা, ধর্মদ্রোহিতা বা রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলে দমন করা হয়েছিল। সক্রেটিসকে হেমলক পান করতে হয়েছিল, যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ হতে হয়েছিল, গ্যালিলিওকে গৃহবন্দী থাকতে হয়েছিল। যারা কোনো মতকে দমন করতে চায়, তারা নিজেদেরকে অভ্রান্ত (Infallible) বা ভুলের ঊর্ধ্বে বলে দাবি করে। কিন্তু কোনো মানুষ বা কোনো প্রজন্মই অভ্রান্ত নয়। তাই হতে পারে, যে নতুন বা অজনপ্রিয় মতটি আমরা শুনতে চাইছি না, সেটাই আসলে সত্যি। তাকে দমন করার অর্থ হলো সত্যকে জানার একটি সুযোগ চিরতরে হারিয়ে ফেলা।

২. মতটি যদি ভুলও হয়, সত্যের সাথে তার সংঘাত জরুরি: ধরুন, আমরা একশ ভাগ নিশ্চিত যে আমাদের বিশ্বাসটিই পরম সত্য। মিল বলছেন, সেই সত্যকে যদি আমরা কোনো ভিন্নমতের সাথে বিতর্ক বা সংঘাতের সুযোগ না দিই, তবে সেই সত্য একসময় মৃত মতবাদে (Dead Dogma) পরিণত হবে। মানুষ কারণ না জেনেই তোতাপাখির মতো তা আওড়াবে, কিন্তু এর ভেতরের শক্তি বা অর্থ অনুভব করতে পারবে না। সত্যকে জীবন্ত, প্রাণবন্ত ও অর্থপূর্ণ রাখতে হলে তাকে ক্রমাগত সমালোচনার আগুনে পরীক্ষা দিতে হয়। ভুলের সাথে লড়াই করেই সত্য আরও শক্তিশালী, স্পষ্ট এবং উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

৩. সত্য হয়তো দুই পক্ষের মধ্যেই ভাগাভাগি হয়ে আছে: অনেক সময় এমন হয় যে, প্রচলিত বিশ্বাস এবং বিরোধী মত—দুটোর মধ্যেই আংশিক সত্য লুকিয়ে থাকে। সাধারণত, কোনো জনপ্রিয় মত যেমন পুরোটা সত্য হয় না, তেমনি কোনো অজনপ্রিয় মতও পুরোটা মিথ্যা হয় না। মুক্ত আলোচনার মাধ্যমেই আমরা দুই পক্ষের ভালো দিকগুলো গ্রহণ করে এক পূর্ণাঙ্গ সত্যের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারি। এই সংঘাতমূলক বা দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়াই জ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

মিলের এই যুক্তিগুলো আজকের এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। যখন কোনো মত আমাদের পছন্দ না হলেই আমরা তাকে ‘রিপোর্ট’, ‘ব্লক’ বা ‘ক্যান্সেল’ করে দিতে চাই, তখন মিল আমাদের মনে করিয়ে দেন, এই অসহিষ্ণুতা আদতে সত্যেরই ক্ষতি করে এবং সমাজকে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক অচলায়তনের দিকে ঠেলে দেয়।

ব্যক্তিত্বের জয়গান: জীবনযাপনের পরীক্ষানিরীক্ষা

গণতন্ত্রের একটি বড় বিপদ হলো ‘সংখ্যাগুরুদের স্বৈরাচার’ (Tyranny of the Majority)। মিল ভয় পেতেন, সরকার ছাড়াও সমাজ নিজেই এক বড় স্বৈরশাসক হয়ে উঠতে পারে। যখন সমাজের বেশিরভাগ মানুষ একটি নির্দিষ্ট পন্থায় চিন্তা করে, জীবনযাপন করে, তখন তারা ভিন্নমতাবলম্বী বা সংখ্যালঘুদের ওপর এক ধরনের অদৃশ্য কিন্তু সর্বব্যাপী চাপ সৃষ্টি করে। এই সামাজিক চাপ অনেক সময় আইনের চেয়েও বেশি ভয়ংকর।

মানুষ তখন সমাজের ভয়ে, লোকলজ্জার ভয়ে, নিজের আসল সত্তা, নিজের ‘খামখেয়ালিপনা’ (Eccentricity) প্রকাশ করতে পারে না। সবাই একই রকম পোশাক পরতে চায়, একই রকম কথা বলতে চায়, একই রকম ‘নিরাপদ’ জীবনযাপন করতে চায়। এর ফলে সমাজে নতুন চিন্তা, নতুন উদ্ভাবন এবং ব্যক্তিত্বের (Individuality) বিকাশ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। মিল এই একঘেয়েমি বা সমরূপতার (Conformity) ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি চাইতেন, সমাজে নানা ধরনের মানুষ থাকুক, নানা রকম ‘জীবনযাপনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা’ (Experiments in living) চলুক। যেমন একটি বাগানে নানা রকম ফুল থাকলে তার সৌন্দর্য বাড়ে, তেমনি সমাজেও নানা রকম জীবনযাপন ও চিন্তার মানুষ থাকলে সমাজ সমৃদ্ধ হয়। কারণ এর মাধ্যমেই মানবজাতি নতুন পথ খুঁজে পায় এবং সামনে এগোতে পারে। তাঁর কাছে, একজন উন্নত মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো তার নিজস্ব চরিত্র এবং ব্যক্তিত্ব।

শেকল ভাঙার গান—‘দ্য সাবজেকশন অফ উইমেন’

জন স্টুয়ার্ট মিলকে তাঁর সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকা একজন মানুষ বলার অন্যতম কারণ হলো নারী অধিকার নিয়ে তাঁর সোচ্চার এবং বৈপ্লবিক অবস্থান। তাঁর বই দ্য সাবজেকশন অফ উইমেন (The Subjection of Women, ১৮৬৯) ছিল নারীবাদের ইতিহাসে এক মাইলফলক। মনে রাখতে হবে, এটি এমন এক সময়ে লেখা, যখন ব্রিটেনে নারীদের ভোটাধিকার তো দূরের কথা, সম্পত্তিতেও কোনো আইনি অধিকার ছিল না। বিবাহিত নারীর নিজের উপার্জনের ওপরও তার স্বামীর আইনগত অধিকার ছিল। নারীকে দেখা হতো পুরুষের সম্পত্তি হিসেবে।

এক ভিন্ন ধরনের দাসপ্রথা

মিল খুব সাহসের সাথে বলেন, পরিবারে নারীর অবস্থান অনেকটা দাসের মতো। তবে এই দাসত্ব অন্য সব দাসত্বের চেয়েও গভীর এবং জটিল। কারণ, দাসদের অন্তত বিদ্রোহ করার জন্য একটি গোষ্ঠী থাকে, তারা তাদের প্রভুর থেকে আলাদা থাকে। কিন্তু নারীরা তাদের ‘প্রভু’ অর্থাৎ স্বামীর সাথেই বসবাস করে এবং ভালোবাসা ও আবেগের এক জটিল বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। ফলে তাদের পরাধীনতা আরও সূক্ষ্ম, ব্যক্তিগত এবং মনস্তাত্ত্বিক। তাদের শেখানো হয়, এই পরাধীনতাই তাদের প্রকৃতি এবং ধর্ম।

তিনি একটি শক্তিশালী যুক্তি দেন, যা ‘অজ্ঞতার যুক্তি’ (Argument from Ignorance) নামে পরিচিত। তিনি বলেন, নারীদের যে বলা হয় তারা আবেগপ্রবণ, যুক্তিতে দুর্বল বা পুরুষের চেয়ে কম বুদ্ধিমান—এই ধারণাগুলোর কোনো বৈজ্ঞানিক বা প্রাকৃতিক ভিত্তি নেই। কারণ আমরা আসলে জানিই না নারীর ‘প্রকৃত প্রকৃতি’ কী। যেহেতু ইতিহাসে কখনোই নারীদের স্বাধীনতা দেওয়া হয়নি, তাদের পুরুষের মতোই সমান সুযোগ দেওয়া হয়নি, তাই আমরা কীভাবে বলব যে স্বাধীন অবস্থায় তারা কেমন হবে? একটি পাখিকে খাঁচায় বন্দী রেখে তার উড়তে না পারাকে তার ‘প্রকৃতি’ বলা যায় না। এগুলো সবই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের দাবিয়ে রাখার জন্য তৈরি করা অজুহাত এবং দীর্ঘদিনের অভ্যাসের ফল।

সম-অধিকার এবং মানবজাতির মুক্তি

মিল কেবল তত্ত্ব দিয়েই থেমে থাকেননি। তিনি নারীদের জন্য পূর্ণ আইনি ও সামাজিক সমতা দাবি করেছেন:

  • শিক্ষার অধিকার: ছেলেদের মতো মেয়েদেরও সব ধরনের শিক্ষার সমান সুযোগ দিতে হবে।

  • পেশা গ্রহণের অধিকার: নারীরা তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী যেকোনো পেশা বেছে নিতে পারবে, তা ডাক্তারি হোক বা ওকালতি।

  • সম্পত্তির অধিকার: নারীদের নিজের নামে সম্পত্তি রাখা এবং উপার্জন করার পূর্ণ অধিকার থাকতে হবে।

  • ভোটাধিকার (Suffrage): মিল ছিলেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রথম সদস্যদের একজন, যিনি ১৮৬৭ সালে নারীদের ভোটাধিকারের জন্য একটি বিল উত্থাপন করেছিলেন। বিলটি পরাজিত হলেও তা এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ ছিল।

তিনি উপযোগবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তি দেখান, নারীদের পরাধীন করে রাখা কেবল তাদের জন্যই ক্ষতিকর নয়, এটি পুরো মানবজাতির জন্য এক বিরাট ক্ষতি। কারণ এর ফলে আমরা মানবজাতির অর্ধেক অংশের মেধা, প্রতিভা ও সম্ভাবনাকে সিন্দুকে বন্দী করে রাখছি। একটি সমাজ কীভাবে তার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছাবে, যদি তার অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়? নারীদের মুক্তি তাই কেবল নারীর মুক্তি নয়, এটি সমগ্র মানবজাতির মুক্তি।

দর্শনের অন্যান্য দিগন্ত

মিলের চিন্তার জগৎ ছিল বিশাল। উপযোগবাদ, স্বাধীনতা আর নারী অধিকার ছাড়াও আরও অনেক বিষয়ে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে।

যুক্তিবিদ্যা: অভিজ্ঞতার ওপর দাঁড়ানো জ্ঞান

মিলের দর্শনের ভিত্তিপ্রস্তর ছিল তাঁর অ্যা সিস্টেম অফ লজিক (A System of Logic, 1843) বইটি। তিনি ছিলেন একজন কট্টর অভিজ্ঞতাবাদী (Empiricist)। অর্থাৎ, তিনি মনে করতেন, আমাদের সমস্ত জ্ঞান আসে অভিজ্ঞতা থেকে। কোনো জন্মগত ধারণা (Innate Idea) বা স্বজ্ঞা (Intuition) থেকে নয়। এই বইতে তিনি আরোহ অনুমানের (Inductive Reasoning) কিছু পদ্ধতির কথা বলেন, যা আজও বৈজ্ঞানিক গবেষণার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। আরোহ অনুমান হলো, বিশেষ বিশেষ ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে একটি সাধারণ সিদ্ধান্তে পৌঁছানো। এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য মিল পাঁচটি পদ্ধতির (Mill’s Methods) কথা বলেন, যার মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হলো:

  • অন্বয়ী পদ্ধতি (Method of Agreement): কোনো একটি ঘটনা ঘটার সময় যদি একাধিক ক্ষেত্রের মধ্যে কেবল একটি সাধারণ মিল খুঁজে পাওয়া যায়, তবে সেই মিলটিই ওই ঘটনার কারণ হতে পারে। (যেমন, যে ক’জন মানুষ অসুস্থ হয়েছে, তারা সবাই একটি নির্দিষ্ট রেস্তোরাঁর খাবার খেয়েছে। সুতরাং, ওই খাবারেই সমস্যা থাকতে পারে)।

  • ব্যতিরেকী পদ্ধতি (Method of Difference): একটি ঘটনা ঘটছে এবং ঘটছে না—এই দুই অবস্থার মধ্যে যদি কেবল একটিমাত্র পার্থক্য থাকে, তবে সেই পার্থক্যটিই ঘটনার কারণ। (যেমন, দুটি গাছের মধ্যে একটি বেড়ে উঠছে, অন্যটি নয়। দেখা গেল, দুটিই জল-মাটি পেয়েছে, কিন্তু একটি সূর্যালোক পায়নি। সুতরাং, সূর্যালোকই বেড়ে ওঠার কারণ)।

এই পদ্ধতিগুলো বিজ্ঞানের কার্যকারণ সম্পর্ক (Causality) নির্ণয়ে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছে।

সরকার ব্যবস্থা ও গণতন্ত্রের কাঁটা

মিল গণতন্ত্রের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন, কিন্তু তিনি সাধারণ বা নিরঙ্কুশ গণতন্ত্রের কিছু দুর্বলতা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তিত ছিলেন। তাঁর প্রধান ভয় ছিল, অশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত বিশাল জনগোষ্ঠীর ভোটে এমন সরকার নির্বাচিত হতে পারে, যা দেশের জন্য ক্ষতিকর, অপরিণামদর্শী এবং জনতোষী (Populist) সিদ্ধান্ত নেবে। সেই ‘সংখ্যাগুরুদের স্বৈরাচার’-এর ভয়!

এই সমস্যার সমাধানে তিনি কনসিডারেশনস অন রিপ্রেজেন্টেটিভ গভর্নমেন্ট (Considerations on Representative Government, 1861) বইয়ে কিছু প্রস্তাব দেন, যা আজ বেশ বিতর্কিত। যেমন, তিনি ‘বহু ভোট’ (Plural Voting) পদ্ধতির কথা বলেছিলেন। এর মানে হলো, শিক্ষিত বা জ্ঞানী নাগরিকদের ভোটের ওজন অশিক্ষিতদের ভোটের চেয়ে বেশি হবে। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল মহৎ—সরকারের গুণগত মান নিশ্চিত করা। তবে এই ধারণাটি গণতন্ত্রের মূলনীতি “এক ব্যক্তি, এক ভোট”-এর পরিপন্থী হওয়ায় এটিকে অনেকেই এলিটিস্ট বা অভিজাততান্ত্রিক বলে সমালোচনা করেন।

অর্থনীতির নতুন পথ: পুঁজিবাদের ঊর্ধ্বে

প্রাথমিকভাবে মিল ছিলেন একজন ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদ, যিনি মুক্তবাজার বা লেসে-ফেয়ার (Laissez-faire) নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু জীবনের শেষ দিকে এসে তিনি পুঁজিবাদের কিছু অন্তর্নিহিত সমস্যা, বিশেষ করে চরম বৈষম্য নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। ফলে তিনি ধীরে ধীরে এক ধরনের উদারনৈতিক সমাজতন্ত্রের (Liberal Socialism) দিকে ঝুঁকে পড়েন। তিনি মনে করতেন, উৎপাদনের উপায়গুলো (Means of Production) ব্যক্তিগত মালিকানায় থাকলেও বণ্টনের নিয়মগুলো (Laws of Distribution) সমাজ পরিবর্তন করতে পারে। তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তির ওপর বিপুল কর, শ্রমিকদের সমবায় সমিতি (Worker’s Cooperatives) এবং ভূমি সংস্কারের মতো বৈপ্লবিক প্রস্তাব দেন। মিলের স্বপ্ন ছিল এমন একটি সমাজের, যেখানে পুঁজিবাদের স্বাধীনতা এবং সমাজতন্ত্রের সাম্য—এই দুইয়ের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন রচনা করা সম্ভব।

ঈশ্বর, ধর্ম ও মানবতা

মিল তাঁর জীবদ্দশায় ধর্ম নিয়ে খুব বেশি লেখেননি। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় থ্রি এসেজ অন রিলিজিয়ন (Three Essays on Religion)। এখানে তাঁর চিন্তার এক ভিন্ন দিক উন্মোচিত হয়। তিনি প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম এবং ঈশ্বরের সর্বশক্তিমান ও পরম দয়ালু রূপকে প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর মতে, পৃথিবীতে এত দুঃখ-কষ্টের অস্তিত্ব প্রমাণ করে যে, ঈশ্বর যদি থাকেনও, তিনি সর্বশক্তিমান হতে পারেন না। তবে তিনি এক ধরনের সীমিত ক্ষমতার ঈশ্বরের (Limited God) সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেননি। জীবনের শেষ দিকে তিনি অগ্যুস্ত কঁতের (Auguste Comte) ‘মানবতার ধর্ম’ (Religion of Humanity) দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, যেখানে ঈশ্বরের বদলে মানবজাতির কল্যাণকেই সর্বোচ্চ উপাসনার বস্তু হিসেবে দেখা হয়।

সমালোচনা ও উত্তরাধিকার

জন স্টুয়ার্ট মিল কোনো বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিলেন না। তাঁর দর্শনের অনেক দিকই সমালোচিত হয়েছে।

  • অভিজাততন্ত্রের অভিযোগ: তাঁর ‘বহু ভোট’ পদ্ধতি এবং ‘উচ্চতর’ ও ‘নিম্নতর’ সুখের বিভাজনকে অনেকে অভিজাততান্ত্রিক বলে মনে করেন। কে ঠিক করবে কোনটি উচ্চতর সুখ? শিক্ষিত এলিটরাই কি সবসময় সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়?

  • সাম্রাজ্যবাদ ও স্ববিরোধিতা: মিলের দর্শনের সবচেয়ে সমালোচিত দিকগুলোর একটি হলো উপনিবেশবাদ (Colonialism) নিয়ে তাঁর অবস্থান। যদিও তিনি ব্রিটেনে ব্যক্তি-স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় প্রবক্তা ছিলেন, তিনি মনে করতেন যে, তাঁর স্বাধীনতার নীতিগুলো কেবল ‘সভ্য’ (Civilized) জাতিগুলোর জন্যই প্রযোজ্য। ভারত বা অন্যান্য ‘পশ্চাৎপদ’ (Backward) জাতির জন্য তিনি এক ধরনের ‘কল্যাণকামী স্বৈরতন্ত্র’কে (Benevolent Despotism) সমর্থন করতেন। এই স্ববিরোধিতা মিলের দর্শনে এক বড় দাগ রেখে গেছে।

  • ‘ক্ষতির নীতি’র অস্পষ্টতা: ‘ক্ষতি’ বলতে ঠিক কী বোঝায়, তা নিয়ে বিতর্ক আজও শেষ হয়নি। পরোক্ষ ক্ষতি, মানসিক ক্ষতি বা পরিবেশগত ক্ষতি কি এর অন্তর্ভুক্ত? এই অস্পষ্টতা তাঁর নীতির প্রয়োগকে জটিল করে তোলে।

এত সমালোচনা সত্ত্বেও মিলের উত্তরাধিকার বিশাল। তিনি আধুনিক উদারনীতিবাদের অন্যতম প্রধান স্থপতি। তাঁর চিন্তা নারীবাদী আন্দোলন, বাকস্বাধীনতা আন্দোলন এবং মানবাধিকারের ধারণাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। ডানপন্থী ও বামপন্থী উভয় ধারার চিন্তাবিদরাই তাঁর থেকে প্রেরণা নিয়েছেন।

শেষ কথা: মিলের আয়নায় আমরা

আমরা একুশ শতকে বাস করছি। আমাদের হাতে ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া, তথ্যের অবাধ প্রবাহ। কিন্তু উনিশ শতকের এই চিন্তাবিদ কি এখনো প্রাসঙ্গিক?

এর উত্তর হলো—আগের চেয়েও অনেক বেশি।

  • আজ যখন ফেক নিউজ আর ঘৃণাত্মক বক্তব্যের (Hate Speech) দোহাই দিয়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর খাঁড়া নেমে আসতে চায়, তখন মিল আমাদের মনে করিয়ে দেন, ভুল এবং আপত্তিকর মতামতের সাথে যুক্তির লড়াই করেই সত্যকে টিকিয়ে রাখতে হয়।

  • যখন সামাজিক মাধ্যমে কাউকে তার ব্যক্তিগত জীবনযাপনের জন্য ট্রোল বা সামাজিকভাবে হেনস্থা করা হয়, তখন মিলের ‘ক্ষতির নীতি’ আমাদের শেখায় সহনশীল হতে এবং অন্যের ব্যক্তিগত পরিসরকে সম্মান করতে।

  • যখন কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর চাপে বা সংখ্যাগুরুদের মতের দাপটে শিল্প, সাহিত্য বা সিনেমাকে বয়কট করার হিড়িক ওঠে, তখন মিলের ‘সংখ্যাগুরুদের স্বৈরাচার’-এর বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি আমাদের কানে তীব্রভাবে বাজে।

  • আজও পৃথিবীর বহু জায়গায় নারীরা তাদের পূর্ণ অধিকার ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত। মিলের লেখাগুলো তাদের সমতার লড়াইয়ের পথে এক অনন্ত প্রেরণার উৎস।

  • আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা যখন শিক্ষার্থীদের কেবল পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার যন্ত্রে পরিণত করে, তখন মিলের নিজের জীবন আমাদের শেখায় যে, জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি আবেগ, অনুভূতি ও সৃজনশীলতার বিকাশও সমান জরুরি।

জন স্টুয়ার্ট মিল কোনো দেবতা বা নিখুঁত মানুষ ছিলেন না। তাঁর দর্শন ছিল তাঁর জীবনের মতোই জটিল, সংগ্রামমুখর এবং কখনো কখনো স্ববিরোধী। কিন্তু তিনি আমাদের যা শিখিয়েছেন, তার মূল কথা হলো—নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রশ্ন করা, প্রতিষ্ঠিত সত্যকে সন্দেহ করা, নিজের বিবেক ও যুক্তি দিয়ে পৃথিবীকে বিচার করা এবং নির্ভয়ে নিজের সত্যকে খুঁজে বেড়ানো।

তিনি ছিলেন এক একাকী পথিক, যিনি সমাজের স্রোতের বিরুদ্ধে হেঁটেছিলেন। তাঁর জীবনটা ছিল অতৃপ্ত, কিন্তু সেই অতৃপ্তি ছিল এক তৃপ্ত শূকরের জীবনের চেয়ে হাজার গুণ শ্রেয়। কারণ তিনি মানুষের অফুরন্ত সম্ভাবনাকে বিশ্বাস করতেন। বিশ্বাস করতেন, সঠিক স্বাধীনতা ও সুযোগ পেলে প্রতিটি মানুষই হয়ে উঠতে পারে এক একজন সক্রেটিস—চিন্তাশীল, আত্মমর্যাদা সম্পন্ন এবং অনন্য।

সেই বিশ্বাসটাই তাঁর সবচেয়ে বড় উত্তরাধিকার। চিন্তার জগতে কোনো শেষ স্টেশন নেই, আর জন স্টুয়ার্ট মিল হলেন সেই পথের এক চিরকালীন বাতিঘর।

তথ্যসূত্র

  • Bentham, J. (1789). An Introduction to the Principles of Morals and Legislation. T. Payne and Son.
  • Capaldi, N. (2004). John Stuart Mill: A Biography. Cambridge University Press.
  • Mill, J. S. (1843). A System of Logic, Ratiocinative and Inductive. John W. Parker.
  • Mill, J. S. (1859). On Liberty. John W. Parker and Son.
  • Mill, J. S. (1861). Considerations on Representative Government. Parker, Son, and Bourn.
  • Mill, J. S. (1863). Utilitarianism. Parker, Son, and Bourn.
  • Mill, J. S. (1869). The Subjection of Women. Longmans, Green, Reader, and Dyer.
  • Mill, J. S. (1873). Autobiography. Longmans, Green, Reader, and Dyer.
  • Mill, J. S. (1874). Three Essays on Religion. Henry Holt and Company.
  • Reeves, R. (2007). John Stuart Mill: Victorian Firebrand. Atlantic Books.
  • Ryan, A. (1990). The Philosophy of John Stuart Mill. Prometheus Books.
  • Skorupski, J. (Ed.). (1998). The Cambridge Companion to Mill. Cambridge University Press.
  • Tocqueville, A. de. (1835). Democracy in America. Saunders and Otley.
  • Urbinati, N., & Zakaras, A. (Eds.). (2007). J.S. Mill’s Political Thought: A Bicentennial Reassessment. Cambridge University Press.

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.