স্ট্রাকচারালিজম (Structuralism): সম্পর্কের সুতায় বোনা জগৎ

Table of Contents

ভূমিকা

আচ্ছা, কখনো কি এমন হয়েছে, খুব চেনা কোনো সুর, বহুবার শোনা, হঠাৎ একদিন তার ভেতরের অচেনা কোনো মূর্ছনা আপনাকে চমকে দিল? কিংবা ধরুন, রোজকার দেখা একটা সাধারণ দৃশ্য, যেমন বাজারের কোলাহল বা নদীর ধারে কাশফুলের দোলা, হঠাৎ একদিন তার মধ্যে এমন এক ছন্দ খুঁজে পেলেন, যা আগে কখনো খেয়াল করেননি? মনে হলো, আরে! এই সাধারণ ব্যাপারগুলোর মধ্যেও তো একটা অদ্ভুত সুশৃঙ্খল বিন্যাস লুকিয়ে আছে! এই যে একটা সাধারণের ভেতরে অসাধারণের খোঁজ, একটা পরিচিত কাঠামোর আড়ালে লুকিয়ে থাকা মূল সুরটা ধরতে পারার আনন্দ, এটাই যেন স্ট্রাকচারালিজম বা কাঠামোবাদের গোড়ার কথা। যেন কোনো এক জাদুকর আমাদের চোখের ওপর থেকে একটা হালকা পর্দা সরিয়ে দিলেন, আর আমরা দেখতে পেলাম—বাহ, সবকিছুই তো একটা অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা!

কাঠামোবাদীরা ঠিক এই কাজটাই করতে চেয়েছিলেন। তাঁরা বলতে চাইলেন, আমরা পৃথিবীতে যা কিছু দেখি, যা কিছু অনুভব করি, যা কিছু সৃষ্টি করি—সেটা হোক মহাকাব্য, গ্রামের মেঠো গান, রান্নার রেসিপি, বিশাল অট্টালিকা, জটিল সামাজিক প্রথা, এমনকি আমাদের মনের গহিনের স্বপ্নগুলো—সবকিছুর পেছনেই একটা না একটা নকশা বা কাঠামো (structure) কাজ করছে। এই কাঠামোটা হলো কিছু অলিখিত নিয়মকানুন, কিছু মৌলিক উপাদানের পারস্পরিক সম্পর্কের জাল, যা আপাতদৃষ্টিতে বিচ্ছিন্ন আর এলোমেলো জিনিসগুলোকে একটা অর্থপূর্ণ ঐকতানে বেঁধে ফেলে। অনেকটা যেন একটা অর্কেস্ট্রা। সেখানে নানা রকম বাদ্যযন্ত্র—বাঁশি, বেহালা, ড্রামস, পিয়ানো—প্রত্যেকে নিজের সুরে বাজছে, কিন্তু একজন কন্ডাক্টর (conductor) বা পরিচালক সবাইকে একটা মূল সুরের সঙ্গে এমনভাবে মিলিয়ে দেন যে, একটা অপূর্ব সঙ্গীত তৈরি হয়। কাঠামোবাদীরা সেই কন্ডাক্টরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চাইলেন, কিংবা বলা ভালো, সেই কন্ডাক্টরের হাতে থাকা স্বরলিপিটা (musical score) উদ্ধার করতে চাইলেন।

তাহলে, এই যে আমরা এতক্ষণ ধরে ‘কাঠামো’ ‘কাঠামো’ করছি, এই জিনিসটা আসলে কী? খুব সহজ করে বললে, এটা হলো একটা চশমা। যে চশমাটা চোখে লাগালে আমরা কোনো জিনিসকে আর আলাদা আলাদা অংশ হিসেবে দেখি না, বরং দেখি অংশগুলোর মধ্যে কী সম্পর্ক, কীভাবে তারা মিলেমিশে একটা গোটা জিনিস তৈরি করছে। এখানে দুটো শব্দ খুব জরুরি: একটা হলো ‘উপাদান’ (element), আরেকটা হলো ‘সম্পর্ক’ (relation)। উপাদানগুলো হয়তো সাধারণ, কিন্তু তাদের ভেতরের সম্পর্কটাই আসল জাদু। ভাবুন তো, সামান্য কার্বন, হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন—এই উপাদানগুলোই নানা অনুপাতে আর বিন্যাসে জুড়ে গিয়ে কখনো চিনি, কখনো অ্যালকোহল, কখনো বা প্রাণধারণের জন্য জরুরি ফ্যাট তৈরি করে ফেলছে! কাঠামোবাদীরা বলেন, এই বিন্যাস বা সম্পর্কটাই আসল, উপাদানগুলো গৌণ।

বিশ শতকের শুরুর দিকে, যখন পৃথিবী জুড়ে নানা রকম পরিবর্তন আর ভাঙা-গড়ার খেলা চলছিল, তখন একদল চিন্তাশীল মানুষ এই কাঠামোবাদের ধারণা নিয়ে এগিয়ে এলেন। তাঁরা চাইলেন, জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায়—যেমন ভাষা, সাহিত্য, নৃবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান—একটা নতুন আলো ফেলতে। তাঁরা ভাবলেন, যদি আমরা এই মূল কাঠামোটা ধরতে পারি, তাহলে হয়তো পৃথিবীর অনেক জটিল রহস্যের সমাধান করা যাবে। এর আগে জ্ঞানচর্চার জগতে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, লেখকের ব্যক্তিগত জীবন, বা কোনো ঘটনার কার্যকারণ অনুসন্ধানের ওপর বেশি জোর দেওয়া হতো। কিন্তু কাঠামোবাদীরা বললেন, ওসব তো বাইরের জিনিস। আসল ব্যাপার লুকিয়ে আছে সিস্টেমের (system) ভেতরে, তার অলঙ্ঘনীয় নিয়মের মধ্যে। তাঁরা চাইলেন একটা আরও ‘বৈজ্ঞানিক’ (scientific) পদ্ধতি, যা দিয়ে মানব সংস্কৃতির বিচিত্র প্রকাশগুলোকে একটা সাধারণ সূত্রের মধ্যে বাঁধা যায়।

এই কাঠামোর সন্ধানীরা যেন একদল গোয়েন্দা। তাঁরা ক্লু (clue) খোঁজেন ভাষার প্রতিটি শব্দে, গল্পের প্রতিটি ঘটনায়, সমাজের প্রতিটি প্রথায়। তাঁদের লক্ষ্য একটাই—সেই অদৃশ্য কারিগরকে খুঁজে বের করা, যিনি পর্দার আড়ালে বসে এই বিশাল জগৎটাকে একটা নির্দিষ্ট ছকে সাজিয়ে চলেছেন। চলুন, আমরাও সেই গোয়েন্দাদের সঙ্গে এই রহস্যময় কাঠামোর জগতে একটু উঁকি দিয়ে আসি। কে জানে, হয়তো আমাদের পরিচিত জগতের দিকে তাকানোর নতুন একটা চোখ খুলে গেলেও যেতে পারে!

উৎস সন্ধানে: ফের্দিনঁ দ্য সস্যুর (Ferdinand de Saussure)

কাঠামোবাদের আঁতুড়ঘর খুঁজতে হলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে গত শতাব্দীর একেবারে গোড়ার দিকে, সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে। সেখানে এক অধ্যাপক ছিলেন, নাম ফের্দিনঁ দ্য সস্যুর (Ferdinand de Saussure)। তিনি ছিলেন ভাষাবিজ্ঞানী। মজার ব্যাপার হলো, ভদ্রলোক নিজে কিন্তু খুব বেশি কিছু লিখে যাননি। তাঁর আসল কাজ ছিল ক্লাসরুমে, ছাত্রদের পড়ানোর মধ্যে। ১৯০৭ থেকে ১৯১১ সালের মধ্যে তিনি জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ভাষাতত্ত্বের ওপর যে লেকচারগুলো দিয়েছিলেন, সেগুলোই তাঁর দুই ছাত্র শার্ল বালি (Charles Bally) আর আলবেয়ার সেশেহে (Albert Sechehaye) অনেক যত্ন করে নোট করে রাখেন। সস্যুরের মৃত্যুর পর, ১৯১৬ সালে, সেই নোটগুলোই বই আকারে প্রকাশিত হয়—‘কোর্স ইন জেনারেল লিঙ্গুইস্টিকস’ (Course in General Linguistics)। আর এই একটি বই যেন হয়ে উঠল পরবর্তীকালের গোটা কাঠামোবাদী আন্দোলনের পথপ্রদর্শক, এক ধরনের আদি ধর্মগ্রন্থ।

সস্যুর এমন কিছু মৌলিক কথা বলেছিলেন, যা তখনকার দিনে ভাষা নিয়ে আমাদের ভাবনাচিন্তাকে একেবারে নাড়িয়ে দিয়েছিল। তাঁর আগে ভাষাবিজ্ঞান মূলত ভাষার ঐতিহাসিক পরিবর্তন, শব্দের ব্যুৎপত্তি (etymology) এসব নিয়েই বেশি মাথা ঘামাত। সস্যুর বললেন, ওভাবে শুধু ভাষার অতীত নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না, ভাষার বর্তমান ব্যবস্থাটাকে (system) বুঝতে হবে। আসুন, তাঁর কিছু বিপ্লবী ভাবনাকে আরেকটু তলিয়ে দেখি, গল্পের মতো করে।

লাং (Langue) ও পারোল (Parole): ভাষার দুই পিঠ

সস্যুর আমাদের বোঝালেন, ভাষা জিনিসটা আসলে এক নয়, দুই। এর একটা দিক হলো ‘লাং’ (Langue), আরেকটা হলো ‘পারোল’ (Parole)।

‘লাং’ হলো ভাষার সেই অদৃশ্য, কিন্তু সবার জন্য অভিন্ন (common) ব্যবস্থাটা। এটা অনেকটা একটা দেশের সংবিধানের মতো, যা সবাই মেনে চলে, কিন্তু চোখে দেখা যায় না। ‘লাং’ হলো একটা ভাষাগোষ্ঠীর সব মানুষের মনের মধ্যে থাকা ভাষার অলিখিত নিয়মকানুন, শব্দভাণ্ডার, আর ব্যাকরণের সমষ্টি। যেমন, বাংলা ভাষায় আমরা কর্তা-কর্ম-ক্রিয়া (Subject-Object-Verb) এই ক্রমে বাক্য সাজাই (‘আমি ভাত খাই’), আবার ইংরেজিতে কর্তা-ক্রিয়া-কর্ম (Subject-Verb-Object) এই ক্রমে (‘I eat rice’)। এই যে একটা নিয়ম, যা আমরা না ভেবেই মেনে চলি, এটাই ‘লাং’-এর অংশ। এটা সামাজিক (social), ব্যক্তিগত নয়। ‘লাং’ একটা যৌথ আমানতের মতো, যা আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পাই এবং ব্যবহার করি। কেউ একা ইচ্ছে করলেই ‘লাং’কে বদলে ফেলতে পারে না। এটা অনেকটা একটা বিশাল লাইব্রেরির মতো, যেখানে অসংখ্য বই (শব্দ, নিয়ম) সাজানো আছে, যা থেকে আমরা প্রয়োজন অনুযায়ী বেছে নিই।

অন্যদিকে, ‘পারোল’ হলো সেই ‘লাং’-এর নিয়ম মেনে আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত কথাবার্তা, লেখালেখি। এটা হলো ভাষার বাস্তব প্রয়োগ (actual utterance)। আমি এখন যে বাক্যগুলো ব্যবহার করে এই লেখাটা তৈরি করছি, সেটা ‘পারোল’-এর উদাহরণ। আপনি যখন বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দেন, বা দোকানে গিয়ে কিছু কেনেন, তখন যে কথাগুলো বলেন, সেগুলোও ‘পারোল’। ‘পারোল’ হলো সৃজনশীল, পরিবর্তনশীল, এবং একান্তই ব্যক্তিগত। কিন্তু এই ব্যক্তিগত প্রকাশও ‘লাং’-এর চৌহদ্দির মধ্যেই থাকতে হয়, নইলে তা অর্থহীন হয়ে পড়ে। যদি কেউ ‘লাং’-এর নিয়ম ভেঙে অদ্ভুত শব্দ বা বাক্য তৈরি করে, আমরা তাকে ‘পাগলের প্রলাপ’ বলতে পারি।

কাঠামোবাদীরা, বিশেষ করে সস্যুর, এই ‘লাং’-এর প্রতিই বেশি মনোযোগ দিয়েছিলেন। কারণ, তাঁদের মতে, এই অদৃশ্য সিস্টেমটাই ভাষার আসল রহস্য ধারণ করে। যেমন, দাবা খেলার নিয়মকানুনগুলো হলো ‘লাং’, আর দুজন খেলোয়াড়ের মধ্যে নির্দিষ্ট একটা ম্যাচ হলো ‘পারোল’। নিয়ম না জানলে যেমন খেলা বোঝা যায় না, তেমনি ‘লাং’-এর গঠন না বুঝলে ভাষার গভীরের কার্যকারণ অধরা থেকে যায়। সস্যুর বললেন, ভাষাবিজ্ঞানের আসল কাজ হলো এই ‘লাং’-কে বিশ্লেষণ করা, তার ভেতরের নিয়মগুলোকে আবিষ্কার করা। (Saussure, 1916/1959, pp. 9-15)

সংকেত (Sign), সংকেতক (Signifier) ও সংকেতিত (Signified): অর্থের রহস্য

সস্যুর ভাষাকে দেখলেন কতগুলো সংকেত বা চিহ্নের (sign) সমষ্টি হিসেবে। আর প্রতিটি সংকেত, তাঁর মতে, দুটো অবিচ্ছেদ্য অংশ নিয়ে গঠিত: একটা হলো ‘সংকেতক’ (signifier), আরেকটা হলো ‘সংকেতিত’ (signified)।

‘সংকেতক’ হলো সংকেতের বাস্তব বা বস্তুগত রূপটা—অর্থাৎ, যে ধ্বনিটা আমরা কানে শুনি বা যে শব্দটা আমরা চোখে দেখি বা লিখি। যেমন, ‘গ-আ-ছ’—এই তিনটি ধ্বনির সমন্বয়ে তৈরি হওয়া শব্দটা, অথবা কাগজে লেখা ‘গাছ’ অক্ষরগুলো হলো সংকেতক। এটা একটা শব্দ-প্রতিমা (sound-image or word-image)।

আর ‘সংকেতিত’ হলো ওই ধ্বনি বা শব্দটা শোনার বা দেখার পর আমাদের মনের ভেতরে যে ধারণা (concept) বা মানসিক চিত্র (mental image) তৈরি হয়। ‘গাছ’ শব্দটা শুনলেই আমাদের মনে একটা কাণ্ড, ডালপালা, পাতাওয়ালা বস্তুর ধারণা জন্মায়—সেটাই হলো সংকেতিত।

এই সংকেতক আর সংকেতিত—এরা যেন একটা কাগজের দুই পিঠের মতো। একটাকে ছাড়া অন্যটা কল্পনা করা যায় না। তারা অবিচ্ছেদ্যভাবে জুড়ে থেকেই একটা পূর্ণাঙ্গ ‘সংকেত’ তৈরি করে। যেমন, ‘জল’ (সংকেতক) শুনলেই আমাদের মনে তরল, স্বচ্ছ, তৃষ্ণা মেটায় এমন একটা বস্তুর ধারণা (সংকেতিত) তৈরি হয়। এই দুটো মিলেই হলো ‘জল’ নামক ভাষাগত সংকেত।

সংকেতের ঐচ্ছিকতা (Arbitrariness of the Sign): নামকরণের স্বাধীনতা

এখানেই সস্যুর তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং বৈপ্লবিক কথাটি বললেন। তিনি জানালেন, সংকেতক (শব্দ) আর সংকেতিত (ধারণা)-র মধ্যে যে সম্পর্ক, সেটা সম্পূর্ণ ঐচ্ছিক (arbitrary) বা যুক্তিহীন। অর্থাৎ, ‘বিড়াল’ নামক প্রাণীটির সঙ্গে ‘ব-ই-ড়-আ-ল’ এই ধ্বনিসমষ্টির কোনো অন্তর্নিহিত, প্রাকৃতিক বা অবশ্যম্ভাবী সম্পর্ক নেই। আমরা বাঙালিরা ওই চারপেয়ে, নরমসরম, ‘মিঁয়াও’ করা প্রাণীটাকে ‘বিড়াল’ বলি, কিন্তু ইংরেজরা বলে ‘ক্যাট’ (cat), ফরাসিরা বলে ‘শা’ (chat), জার্মানরা বলে ‘কাৎসে’ (Katze)। বস্তু বা ধারণা কিন্তু একই (বিড়ালের ধারণা), কিন্তু বিভিন্ন ভাষায় তার জন্য ব্যবহৃত শব্দ বা সংকেতকগুলো সম্পূর্ণ আলাদা। যদি এমন হতো যে, বিড়ালের ডাকের সঙ্গে মিলিয়ে তার নাম রাখা হয়েছে (onomatopoeia), তাহলেও একটা যুক্তির আভাস পাওয়া যেত। কিন্তু বেশিরভাগ শব্দের ক্ষেত্রেই এমন কোনো যুক্তি নেই।

এই ঐচ্ছিকতার মানে হলো, কোনো বিশেষ শব্দকে কোনো বিশেষ ধারণার জন্য বেছে নেওয়ার পেছনে কোনো অকাট্য প্রাকৃতিক কারণ নেই। এটা সম্পূর্ণই একটা সামাজিক চুক্তি বা কনভেনশনের (convention) ব্যাপার। একটা ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ দীর্ঘদিন ধরে একটা নির্দিষ্ট শব্দকে একটা নির্দিষ্ট ধারণার জন্য ব্যবহার করতে করতে সেটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। যদি আদিকাল থেকে আমরা সবাই মিলে ঠিক করতাম যে, ‘গরু’ বলতে আমরা ‘টেবিল’ বুঝব আর ‘টেবিল’ বলতে ‘গরু’ বুঝব, তাহলে সেটাই হতো নিয়ম। এই ঐচ্ছিকতার ধারণাটা প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটা প্রমাণ করে যে ভাষার অর্থ কোনো শব্দের ভেতরের কোনো জাদু বা গুণ থেকে আসে না, বরং আসে ভাষার সামগ্রিক ব্যবস্থার (system) ভেতরে অন্য শব্দগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্কের ভিত্তিতে। এই ঐচ্ছিকতার কারণেই ভাষা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হতে পারে, নতুন শব্দ তৈরি হতে পারে, পুরোনো শব্দ হারিয়ে যেতে পারে বা অর্থ বদলে ফেলতে পারে। (Saussure, 1916/1959, pp. 67-70)

সিনক্রনিক (Synchronic) বনাম ডায়াক্রনিক (Diachronic) বিশ্লেষণ: বর্তমান না অতীত?

সস্যুর ভাষার গবেষণার জন্য দুটো ভিন্ন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির কথা বললেন। একটা হলো ‘সিনক্রনিক’ (synchronic) বা এককালিক বিশ্লেষণ। এটা হলো, একটা নির্দিষ্ট সময়ে কোনো ভাষার যে বর্তমান অবস্থা, তার গঠনতন্ত্র, তার শব্দভাণ্ডার, তার নিয়মকানুন—এসবের স্টাডি। অনেকটা একটা ক্যামেরায় তোলা ছবির (snapshot) মতো, যা একটা মুহূর্তকে ধরে রাখে। যেমন, আজকের দিনের প্রমিত বাংলা ভাষার বাক্য গঠন পদ্ধতি, সন্ধি-সমাসের নিয়ম, বা বহুল প্রচলিত শব্দের অর্থ নিয়ে যখন আমরা গবেষণা করি, তখন সেটা হয় সিনক্রনিক বিশ্লেষণ। এই বিশ্লেষণে ভাষার অতীত বা ভবিষ্যৎ নিয়ে মাথা ঘামানো হয় না, শুধু বর্তমান সিস্টেমটাই বিবেচ্য।

আরেকটা হলো ‘ডায়াক্রনিক’ (diachronic) বা কালানুক্রমিক বিশ্লেষণ। এটা হলো, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভাষার যে বিবর্তন বা পরিবর্তন ঘটে, তার স্টাডি। যেমন, প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা থেকে কীভাবে পালি, প্রাকৃত, অপভ্রংশের স্তর পেরিয়ে আজকের বাংলা ভাষার জন্ম হলো, বা কীভাবে একটা নির্দিষ্ট শব্দের অর্থ শত শত বছর ধরে বদলে গেছে—এসবের আলোচনা হলো ডায়াক্রনিক বিশ্লেষণ। এটা ভাষার ঐতিহাসিক যাত্রাপথের ওপর আলোকপাত করে।

সস্যুরের আগে ভাষাবিজ্ঞান মূলত ডায়াক্রনিক বা ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের দিকেই বেশি ঝুঁকে ছিল। কিন্তু সস্যুর বললেন, ভাষার আসল প্রকৃতি বুঝতে হলে সিনক্রনিক বিশ্লেষণ অনেক বেশি জরুরি। কারণ, ভাষা ব্যবহারকারীরা ভাষার অতীত ইতিহাস জেনে ভাষা ব্যবহার করে না; তারা বর্তমান সিস্টেমটাকেই ব্যবহার করে। একটা দাবা খেলার সময় খেলোয়াড়েরা যদি শুধু দাবার ছক আর ঘুঁটিগুলোর বর্তমান অবস্থান দেখেই খেলে, তাদের যদি খেলার নিয়মের ইতিহাস (যেমন, একসময় মন্ত্রী কেবল এক ঘর করে চলতে পারত) নিয়ে ভাবতে না হয়, তাহলে ভাষার ক্ষেত্রেও তাই। ভাষার ‘লাং’ বা সিস্টেমটাকে বুঝতে হলে তার বর্তমান কার্যকরী রূপটাকেই খুঁটিয়ে দেখা দরকার। (Saussure, 1916/1959, pp. 79-81)

পার্থক্য থেকে মূল্য (Value from Difference): আমি আছি তাই তুমি আছ

সস্যুরের আরেকটি যুগান্তকারী ধারণা হলো, ভাষায় কোনো শব্দের এককভাবে, বিচ্ছিন্নভাবে কোনো নির্দিষ্ট অর্থ বা মূল্য (value) থাকে না। একটি শব্দের অর্থ বা মূল্য তৈরি হয় ভাষার সামগ্রিক কাঠামোর মধ্যে অন্য শব্দগুলোর সঙ্গে তার পার্থক্যের (difference) নিরিখে। ব্যাপারটা একটু গোলমেলে লাগতে পারে। উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হবে।

যেমন, ‘লাল’ শব্দটার অর্থ আমরা ঠিকভাবে বুঝতে পারি, কারণ আমাদের ভাষায় ‘নীল’, ‘সবুজ’, ‘হলুদ’, ‘কালো’, ‘সাদা’ ইত্যাদি আরও অনেক রঙের নাম আছে। যদি পৃথিবীতে একটাই রঙ থাকত, ধরুন সবকিছুই লাল, তাহলে ‘লাল’ শব্দটার আলাদা করে কোনো তাৎপর্য থাকত না, কারণ অন্য কোনো রঙের সঙ্গে তার তুলনা করার বা পার্থক্য করার সুযোগই থাকত না। ‘লাল’ মূল্যবান কারণ সে ‘নীল’ নয়, ‘সবুজ’ নয়।

একইভাবে, ‘দিন’ শব্দটার অর্থ আমরা বুঝি কারণ ‘রাত’ আছে। ‘ভালো’র অর্থ স্পষ্ট হয় ‘মন্দ’র উপস্থিতিতে। সস্যুর বললেন, “ভাষায় কেবল পার্থক্যই থাকে… ইতিবাচক কোনো পদ (positive terms) ছাড়াই।” (Saussure, 1916/1959, p. 120) অর্থাৎ, প্রতিটি ভাষাগত সংকেত তার পরিচয় পায় অন্য সংকেতগুলো থেকে নিজেকে পৃথক করার মাধ্যমে। অনেকটা একটা পরিবারের সদস্যদের মতো। ‘বাবা’র পরিচয় নির্ভর করে ‘মা’, ‘ছেলে’, ‘মেয়ে’ ইত্যাদি সম্পর্কের ওপর। এই সম্পর্কগুলোর জালেই তাঁর ‘বাবা’ পরিচয়টা অর্থবহ হয়ে ওঠে।

এই ধারণাটা কাঠামোবাদের একেবারে কেন্দ্রে অবস্থান করে। সবকিছুই আপেক্ষিক (relative), সবকিছুই সম্পর্কনির্ভর। কোনো কিছুই শূন্যে দাঁড়িয়ে নিজের অর্থ নিজে তৈরি করতে পারে না।

সস্যুরের এই মৌলিক ভাবনাগুলো, যা তিনি মূলত ভাষার ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করেছিলেন, পরবর্তীকালে যেন একটা বীজমন্ত্রের মতো ছড়িয়ে পড়ল জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখাতেও। নৃবিজ্ঞানীরা পুরাণের কাহিনিতে, সাহিত্য সমালোচকেরা উপন্যাসের ঘটনায়, মনোবিজ্ঞানীরা মনের গহনে, সমাজবিজ্ঞানীরা সামাজিক প্রথায়—সবখানেই এই অদৃশ্য কাঠামো আর সম্পর্কের জাল খোঁজার চেষ্টা শুরু করলেন। সস্যুর যেন একটা নতুন আতসকাচ ধরিয়ে দিয়েছিলেন, যার নিচে জগতের পরিচিত জিনিসগুলোও নতুন রূপে, নতুন অর্থে ধরা দিতে শুরু করল।

বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্ট্রাকচারালিজম: যখন কাঠামো কথা বলে

সস্যুরের দেখানো পথে আলো হাতে নিয়ে অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি নিজ নিজ গবেষণার ক্ষেত্রে কাঠামোবাদী চিন্তার মশাল জ্বালালেন। তাঁরা চাইলেন নিজ নিজ বিষয়ের গভীরে লুকিয়ে থাকা সেই ‘লাং’-কে খুঁজে বের করতে, সেই অদৃশ্য ব্যাকরণকে আবিষ্কার করতে, যা সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করছে। আসুন, তাঁদের কয়েকজনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবং তাঁদের দেখানো নতুন পথগুলো সম্পর্কে একটু বিস্তারিত জেনে নিই।

নৃবিজ্ঞানে ক্লদ লেভি-স্ট্রাউস (Claude Lévi-Strauss): পুরাণের জট ছাড়িয়ে

যদি সস্যুরকে কাঠামোবাদের জনক বলা হয়, তাহলে ফরাসি নৃবিজ্ঞানী ক্লদ লেভি-স্ট্রাউসকে (Claude Lévi-Strauss) বলা যায় এই তত্ত্বের প্রধান রূপকারদের একজন, যিনি একে ভাষার গণ্ডি পেরিয়ে সংস্কৃতির বিস্তৃত অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি যখন সস্যুরের কাজ পড়লেন, তখন যেন বিদ্যুচ্চমকের মতো তাঁর মনে হলো, আরে! ভাষার এই নিয়মগুলো তো মানব সংস্কৃতির অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা যেতে পারে! বিশেষ করে পুরাণ (myth) এবং জ্ঞাতি সম্পর্ক (kinship system) বিশ্লেষণে তিনি এই পদ্ধতি ব্যবহার করে সাড়া ফেলে দিলেন।

লেভি-স্ট্রাউস পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীর পুরাণের কাহিনি সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করলেন। শুনতে হয়তো সেই গল্পগুলো একেক রকম—কোথাও সৃষ্টিতত্ত্বের গল্প, কোথাও বা কোনো নায়ক বা দেবতার বীরত্বের কাহিনি। কিন্তু লেভি-স্ট্রাউস দেখালেন, এই আপাত ভিন্নতার আড়ালে কিছু মৌলিক কাঠামো বা ‘মাইথিম’ (mytheme) লুকিয়ে আছে। ‘মাইথিম’ হলো পুরাণের ক্ষুদ্রতম অর্থপূর্ণ একক, অনেকটা ভাষার ‘ফোনিম’ (phoneme) বা ধ্বনিমূলের মতো, যা নিজে অর্থহীন হলেও অর্থের পার্থক্য তৈরি করতে পারে। এই মাইথিমগুলো জোড়ায় জোড়ায়, সাধারণত বাইনারি অপোজিশন (binary opposition) বা দ্বিমেরু বৈপরীত্যের আকারে থাকে। যেমন—কাঁচা বনাম রান্না করা (raw vs. cooked), প্রকৃতি বনাম সংস্কৃতি (nature vs. culture), জীবন বনাম মৃত্যু (life vs. death), স্বর্গ বনাম মর্ত্য (heaven vs. earth), পুরুষ বনাম নারী (male vs. female) ইত্যাদি। তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দ্য স্ট্রাকচারাল অ্যানালাইসিস অফ মিথ’ (The Structural Analysis of Myth, 1955)-এ দেখালেন, কীভাবে বিভিন্ন সংস্কৃতির পুরাণে এই বাইনারি অপোজিশনগুলো নানা সমীকরণে ফিরে ফিরে আসে। তাঁর মতে, এই বৈপরীত্যগুলোর মাধ্যমে মানুষ তার জগতের মৌলিক দ্বন্দ্ব এবং সমস্যাগুলোকে (যেমন, জীবন ও মৃত্যুর রহস্য, প্রকৃতি ও সংস্কৃতির সংঘাত) বোঝার ও সমাধান করার চেষ্টা করে। পুরাণগুলো হলো সেইসব দ্বন্দ্ব নিরসনের প্রতীকী প্রচেষ্টা। (Lévi-Strauss, 1963)

উদাহরণস্বরূপ, তাঁর ‘দ্য কাঁচা অ্যান্ড দ্য কুকড’ (The Raw and the Cooked, প্রথম খণ্ড ‘মিথোলজিক্স’ সিরিজের, ১৯৬৪) বইতে তিনি দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসীদের অসংখ্য পুরাণ বিশ্লেষণ করে দেখান, কীভাবে ‘কাঁচা’ (প্রকৃতির প্রতীক) থেকে ‘রান্না করা’ (সংস্কৃতির প্রতীক) খাদ্যের উত্তরণ মানব সভ্যতার একটা গুরুত্বপূর্ণ ধাপকে সূচিত করে এবং এই ধারণাটি তাদের বিশ্ববীক্ষার কেন্দ্রে অবস্থান করে। তিনি আরও দেখান যে, বিভিন্ন পুরাণের চরিত্র বা ঘটনা আলাদা হলেও, তাদের মধ্যেকার সম্পর্কের বিন্যাস (pattern of relations) একই রকম থাকতে পারে। অনেকটা গণিতের সমীকরণের মতো, যেখানে সংখ্যাগুলো বদলালেও সমীকরণের কাঠামোটা একই থাকে।

জ্ঞাতি সম্পর্ক (kinship systems) বিশ্লেষণেও লেভি-স্ট্রাউস একই ধরনের কাঠামোবাদী পদ্ধতি প্রয়োগ করেন। তিনি বিভিন্ন সমাজে প্রচলিত আপাতদৃষ্টিতে জটিল ও ভিন্ন ভিন্ন জ্ঞাতি সম্পর্ক এবং বিবাহরীতি পর্যবেক্ষণ করে দেখান যে, সেগুলোর গভীরে কিছু সার্বজনীন নিয়ম কাজ করে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো অজাচার ট্যাবু (incest taboo) বা নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে যৌনসম্পর্ক ও বিবাহ নিষিদ্ধকরণ, যা প্রায় সব মানব সমাজেই কমবেশি দেখা যায়। লেভি-স্ট্রাউসের মতে, এই ট্যাবু নেতিবাচক মনে হলেও এর একটা ইতিবাচক দিক আছে: এটা মানুষকে নিজের গোষ্ঠীর বাইরে অন্য গোষ্ঠীর সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে বাধ্য করে। এর ফলে বিভিন্ন পরিবারের মধ্যে আদান-প্রদান (exchange of women) এবং সামাজিক ঐক্য (social solidarity) তৈরি হয়। তিনি এই আদান-প্রদানকে ভাষার মতোই একটা যোগাযোগের ব্যবস্থা হিসেবে দেখেছিলেন। জ্ঞাতি সম্পর্কগুলোও যেন একটা ভাষার মতো, যার নিজস্ব শব্দ (জ্ঞাতিবাচক শব্দ যেমন—বাবা, কাকা, মামা) এবং নিজস্ব ব্যাকরণ (বিবাহের নিয়মকানুন) রয়েছে। (Lévi-Strauss, 1969, The Elementary Structures of Kinship, প্রথম প্রকাশ ১৯৪৯)। তাঁর মতে, মানব মনের একটা অন্তর্নিহিত প্রবণতাই হলো জগৎকে শ্রেণিবদ্ধ করা, সম্পর্ক তৈরি করা এবং বৈপরীত্যের মাধ্যমে বোঝা। এই প্রবণতাই সংস্কৃতির বিভিন্ন রূপে প্রকাশিত হয়।

সাহিত্য সমালোচনায় স্ট্রাকচারালিজম: লেখকের মৃত্যু, টেক্সটের জীবন

সাহিত্য সমালোচনার জগতে কাঠামোবাদীরা যেন একটা বিপ্লব নিয়ে এলেন। তাঁরা বললেন, এতদিন ধরে আমরা সাহিত্য বোঝার জন্য ভুল জায়গায় আলো ফেলেছি। আমরা হয় লেখকের জীবনী ঘেঁটে তাঁর মন বোঝার চেষ্টা করেছি (biographical criticism), নয়তো ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট দিয়ে সাহিত্যকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছি (historical criticism), অথবা সাহিত্যের নৈতিক-দার্শনিক দিক নিয়েই বেশি মেতেছি। কাঠামোবাদীরা বললেন, এসব তো সাহিত্যের বাইরের ব্যাপার। সাহিত্যের আসল রহস্য লুকিয়ে আছে সাহিত্যের নিজস্ব কাঠামোর ভেতরে, তার ভাষার বুননে, তার কাহিনির বিন্যাসে। সাহিত্য হলো ভাষারই একটা বিশেষ ধরনের ব্যবহার, তাই সস্যুরের ভাষাতাত্ত্বিক মডেল এখানেও সমানভাবে প্রযোজ্য। সাহিত্যকর্মকে একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ (self-contained) ব্যবস্থা হিসেবে দেখতে হবে, যার অর্থ তার ভেতরের উপাদানগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক থেকেই তৈরি হয়।

এই ধারার তাত্ত্বিকদের মধ্যে রোলাঁ বার্থ (Roland Barthes), এ. জে. গ্রেমাস (A.J. Greimas), জেফ্রা জিনেট (Gérard Genette), তিৎসভান তোদোরভ (Tzvetan Todorov) এবং ভ্লাদিমির প্রপ (Vladimir Propp, রুশ রূপকথা গবেষক, যাঁর কাজ পরবর্তীকালে কাঠামোবাদীদের প্রভাবিত করে) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

ভ্লাদিমির প্রপ (Vladimir Propp): রূপকথার রহস্যভেদ

যদিও প্রপ সরাসরি কাঠামোবাদী আন্দোলনের অংশ ছিলেন না, তাঁর ১৯২৮ সালে প্রকাশিত (অনেক পরে ইংরেজিতে অনূদিত) ‘মরফোলজি অফ দ্য ফোকটেল’ (Morphology of the Folktale) বইটি কাঠামোবাদী সাহিত্যতত্ত্বের বিকাশে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। প্রপ একশরও বেশি রুশ রূপকথা বিশ্লেষণ করে দেখান যে, গল্পগুলোর চরিত্র, ঘটনা বা পরিবেশ ভিন্ন হলেও তাদের গভীরে একটা সাধারণ কাহিনি-কাঠামো (narrative structure) রয়েছে। তিনি ৩১টি ‘ফাংশন’ (function) বা কার্য শনাক্ত করেন, যা রূপকথার কাহিনিতে একটা নির্দিষ্ট ক্রমে ঘটতে দেখা যায় (যদিও সব গল্পে সব ফাংশন থাকে না)। যেমন: নায়কের কোনো কিছুর অভাব বা ক্ষতি (lack), নায়কের যাত্রা (departure), কোনো সাহায্যকারী চরিত্র থেকে জাদুকরী সাহায্য লাভ (receipt of a magical agent), খলনায়কের সঙ্গে যুদ্ধ (struggle), জয়লাভ (victory), প্রত্যাবর্তন (return), এবং পুরস্কার বা বিবাহ (reward/marriage)। প্রপ দেখালেন, এই ফাংশনগুলোই হলো রূপকথার মূল গাঠনিক উপাদান, চরিত্রগুলো এই ফাংশনগুলো সম্পন্ন করার উপলক্ষ মাত্র। (Propp, 1968)

রোলাঁ বার্থ (Roland Barthes): চিহ্নের কারবারি

বার্থের প্রথম দিকের কাজগুলো ছিল পুরোদস্তুর কাঠামোবাদী। তাঁর ‘মিথোলজিস’ (Mythologies, 1957) বইতে তিনি দেখালেন, কীভাবে দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন বস্তু, ঘটনা বা ধারণা—যেমন পেশাদার কুস্তি, নতুন মডেলের গাড়ি, বিজ্ঞাপনের ছবি, এমনকি মদের বোতল—সমাজে মিথ বা পুরাণের মতো অর্থ তৈরি করে। তিনি এগুলোকে বুর্জোয়া সংস্কৃতির তৈরি করা ‘দ্বিতীয় স্তরের সংকেত ব্যবস্থা’ (second-order semiological system) বা ‘কনোটেশন’ (connotation) হিসেবে চিহ্নিত করেন। অর্থাৎ, একটা সাধারণ বস্তু (যেমন, ওয়াইন) তার প্রথম স্তরের অর্থ (অ্যালকোহলযুক্ত পানীয়) ছাড়িয়ে দ্বিতীয় স্তরে গিয়ে ফরাসি জাতীয়তাবাদ, আভিজাত্য বা সংস্কৃতির প্রতীক হয়ে ওঠে। বার্থ এই মিথগুলোকে বিশ্লেষণ করে তাদের ভেতরের ভাবাদর্শগত (ideological) তাৎপর্য উন্মোচন করতে চেয়েছিলেন। (Barthes, 1972)

তাঁর বিখ্যাত বই ‘এস/জেড’ (S/Z, 1970)-এ তিনি অনোরে দ্য বালজাকের (Honoré de Balzac) একটি ছোটগল্প ‘সারাসিন’ (Sarrasine)-কে একেবারে লাইন ধরে ধরে, টুকরো টুকরো করে (lexias) বিশ্লেষণ করেন। তিনি দেখান, কীভাবে পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন ‘কোড’ (code) বা সংকেত ব্যবস্থা একটি টেক্সটের আপাত সরল কাহিনির ভেতরে অর্থের বহুস্তরীয় জাল তৈরি করে। এই কোডগুলো হলো: হারমেনিউটিক কোড (hermeneutic code – রহস্য তৈরি ও সমাধানের সংকেত), প্রোএরেটিক কোড (proairetic code – ঘটনার ক্রম বা অ্যাকশনের সংকেত), সেমিক কোড (semic code – চরিত্রের বৈশিষ্ট্য বা বস্তুর গুণাবলি সূচক সংকেত, যা কনোটেশন তৈরি করে), সিম্বলিক কোড (symbolic code – দ্বিমেরু বৈপরীত্য বা থিম্যাটিক অর্থের সংকেত), এবং কালচারাল কোড (cultural code – সামাজিক জ্ঞান বা প্রথার সংকেত)। এই বিশ্লেষণের মাধ্যমে বার্থ দেখান যে, একটি টেক্সট আসলে বহুস্বরিক (polyphonic), বিভিন্ন কোডের পারস্পরিক ক্রিয়ায় তার অর্থ নির্মিত হয়। (Barthes, 1974)

তবে, বার্থের সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী প্রবন্ধ সম্ভবত ‘লেখকের মৃত্যু’ (The Death of the Author, 1967)। এখানে তিনি ঘোষণা করেন যে, একটি টেক্সটের অর্থ বোঝার জন্য লেখকের জীবন বা তাঁর অভিপ্রায় (intention) খোঁজা অর্থহীন। লেখক যখন লেখাটা শেষ করেন, তখন তাঁর ভূমিকাও শেষ। টেক্সট তখন একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাষাগত কাঠামোতে পরিণত হয়, যার অর্থ পাঠকই তার পঠন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে নির্মাণ করে। প্রতিটি পাঠক তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা, জ্ঞান এবং কোড ব্যবহার করে টেক্সটকে নতুন নতুন অর্থে জীবন্ত করে তোলে। “লেখকের মৃত্যুর বিনিময়েই পাঠকের জন্ম হয়।” এই ভাবনাটা কাঠামোবাদের সীমানা পেরিয়ে উত্তর-কাঠামোবাদের দিকে একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল। (Barthes, 1977)

এ. জে. গ্রেমাস (A.J. Greimas): কাহিনির গভীর ব্যাকরণ

লিথুয়ানিয়ান-ফরাসি তাত্ত্বিক আলগির্দাস জুলিয়েন গ্রেমাস (A.J. Greimas) কাহিনির গভীর কাঠামোর (deep structure) প্রতি আগ্রহী ছিলেন। তিনি প্রপের কাজকে আরও বিমূর্ত (abstract) স্তরে নিয়ে যান এবং একটি ‘অ্যাকট্যানশিয়াল মডেল’ (actantial model) তৈরি করেন। এই মডেলে তিনি কাহিনির চরিত্রগুলোকে তাদের গতানুগতিক ভূমিকার (যেমন, নায়ক, খলনায়ক) পরিবর্তে ছয়টি বিমূর্ত ‘অ্যাকট্যান্ট’ (actant) বা কার্যকরী ভূমিকায় ভাগ করেন। এই ছয়টি অ্যাকট্যান্ট হলো:

  • ১. সাবজেক্ট (Subject): যে কোনো লক্ষ্য অর্জন করতে চায় (যেমন, নায়ক)।
  • ২. অবজেক্ট (Object): সাবজেক্ট যা লাভ করতে চায় (যেমন, রাজকন্যা, কোনো গুপ্তধন, বা কোনো আদর্শ)।
  • ৩. সেন্ডার (Sender): যে সাবজেক্টকে অবজেক্টের সন্ধানে পাঠায় বা অনুপ্রাণিত করে (যেমন, রাজা, কোনো দৈববাণী)।
  • ৪. রিসিভার (Receiver): যে বা যারা অবজেক্ট লাভের ফলে উপকৃত হয় (অনেক সময় সাবজেক্ট নিজেই রিসিভার হতে পারে, অথবা কোনো জনগোষ্ঠী)।
  • ৫. হেল্পার (Helper): যে সাবজেক্টকে তার লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করে (যেমন, জাদুকর, কোনো বন্ধু)।
  • ৬. অপোনেন্ট (Opponent): যে সাবজেক্টের পথে বাধা সৃষ্টি করে (যেমন, খলনায়ক, কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ)।

গ্রেমাস দেখান যে, পৃথিবীর অসংখ্য গল্পে (সেটা পুরাণ হোক, রূপকথা হোক, বা আধুনিক উপন্যাস) চরিত্র এবং ঘটনা ভিন্ন হলেও, এই ছয়টি অ্যাকট্যান্টের পারস্পরিক সম্পর্কের কাঠামোটি প্রায়শই একই রকম থাকে। একটি চরিত্র একাধিক অ্যাকট্যান্টের ভূমিকাও পালন করতে পারে, অথবা একটি অ্যাকট্যান্টের ভূমিকা একাধিক চরিত্র মিলে পালন করতে পারে। এই মডেলের মাধ্যমে গ্রেমাস কাহিনির একেবারে মৌলিক অর্থ উৎপাদনকারী কাঠামোটি ধরতে চেয়েছিলেন। (Greimas, 1983) তিনি আরও একটি জটিল বিশ্লেষণাত্মক টুল, ‘সেমিওটিক স্কোয়ার’ (semiotic square) বা চিহ্নতাত্ত্বিক চতুষ্কোণ তৈরি করেন, যা কোনো ধারণার বিভিন্ন লজিক্যাল সম্পর্ক (যেমন, বৈপরীত্য, অনুপূরকতা) ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করে।

তিৎসভান তোদোরভ (Tzvetan Todorov): কথাসাহিত্যের কথকতা

বুলগেরিয়ান-ফরাসি তাত্ত্বিক তিৎসভান তোদোরভ ‘ন্যারেটোলজি’ (narratology) বা কথনতত্ত্বের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তিনি বোক্কাচ্চিওর (Boccaccio) ‘ডেকামেরন’ (Decameron) বিশ্লেষণ করে দেখান যে, প্রতিটি আখ্যান বা কাহিনির একটি সাধারণ ব্যাকরণ (grammar) থাকে। তিনি মনে করেন, একটি আদর্শ কাহিনি সাধারণত তিনটি দশার মধ্যে দিয়ে যায়:

  • ১. স্থিতিশীল অবস্থা (Equilibrium): গল্পের শুরুতে একটা স্বাভাবিক বা শান্ত অবস্থা থাকে।
  • ২. বিশৃঙ্খলা বা ভারসাম্যহীনতা (Disruption/Disequilibrium): কোনো ঘটনা বা শক্তির প্রভাবে সেই স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়, একটা সমস্যা বা সংকট তৈরি হয়।
  • ৩. নতুন স্থিতিশীল অবস্থা (New Equilibrium): গল্পের শেষে সেই সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে বা নতুন কোনো পরিস্থিতিতে পৌঁছে একটি নতুন (তবে আগের চেয়ে ভিন্ন) স্থিতিশীল অবস্থা অর্জিত হয়।

তোদোরভের মতে, এই সরল কাঠামোটি (স্থিতিশীলতা ১ → ভারসাম্যহীনতা → স্থিতিশীলতা ২) প্রায় সব ধরনের গল্পেই, এমনকি খুব জটিল গল্পেও, খুঁজে পাওয়া যায়। (Todorov, 1977) তিনি সাহিত্যের বিভিন্ন ‘জঁর’ (genre) বা প্রকরণ (যেমন, ফ্যান্টাসি, গোয়েন্দা কাহিনি) নিয়েও আলোচনা করেন এবং দেখান যে, প্রতিটি জঁর-এর নিজস্ব কিছু নিয়মকানুন বা কনভেনশন থাকে, যা পাঠককে সেই জঁর-এর লেখা বুঝতে সাহায্য করে।

কাঠামোবাদী সাহিত্য সমালোচকেরা মূলত টেক্সটকেই তাঁদের গবেষণার কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেছিলেন। তাঁদের লক্ষ্য ছিল, সাহিত্যের সেই ‘ভাষা’ বা ‘লাং’-কে আবিষ্কার করা, যার মাধ্যমে সাহিত্যকর্ম অর্থবহ হয়ে ওঠে। তাঁরা লেখকের মনস্তত্ত্ব, জীবনী বা সামাজিক ইতিহাসের চেয়ে টেক্সটের ভেতরের সংকেত, চিহ্ন, প্রতীক, আখ্যানের গঠন, চরিত্রের পারস্পরিক সম্পর্ক, ভাষাগত বৈশিষ্ট্য ইত্যাদির ওপর অনেক বেশি জোর দিয়েছিলেন।

মনোসমীক্ষণে জ্যাক লাকাঁ (Jacques Lacan): অবচেতনের ভাষা

ফরাসি মনোসমীক্ষক জ্যাক লাকাঁ (Jacques Lacan) ছিলেন বিশ শতকের অন্যতম প্রভাবশালী এবং বিতর্কিত চিন্তাবিদ। তিনি সিগমুন্ড ফ্রয়েডের (Sigmund Freud) মনোসমীক্ষণ তত্ত্বকে নতুন করে ব্যাখ্যা করেন সস্যুরের ভাষাতত্ত্ব এবং লেভি-স্ট্রাউসের নৃবিজ্ঞানের আলোকে। লাকাঁর বিখ্যাত এবং প্রায়শই উদ্ধৃত উক্তি হলো, “অবচেতন (unconscious) একটি ভাষার মতো কাঠামোবদ্ধ” (“The unconscious is structured like a language”)। (Lacan, 1977, p. 147)

এর মানে কী? লাকাঁ বললেন, ফ্রয়েড যাকে অবচেতন বলেছেন, সেটা আসলে কোনো আদিম, প্রাক-ভাষাগত (pre-linguistic) বিশৃঙ্খল জগৎ নয়। বরং, আমাদের অবচেতন মন ভাষার নিয়মেই গঠিত এবং পরিচালিত হয়। আমাদের স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা, ভয়, মানসিক কষ্টের লক্ষণ (symptoms)—এগুলো সবই যেন এক ধরনের প্রতীকী ভাষা, যার নিজস্ব ব্যাকরণ আছে। যেমন, ভাষার সংকেতক (signifier) আর সংকেতিত (signified)-এর মধ্যে যেমন একটা ফাঁক বা গ্যাপ থাকে, তেমনি মানুষের আকাঙ্ক্ষার ক্ষেত্রেও তার লক্ষ্যবস্তু (object of desire) সবসময় অধরা থেকে যায়, এক সংকেতক থেকে আরেক সংকেতকের দিকে ছুটে চলে।

লাকাঁ মানব শিশুর বিকাশের ক্ষেত্রে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্তরের (orders) কথা বলেন: কাল্পনিক বা ইমাজিনারি (Imaginary), প্রতীকী বা সিম্বলিক (Symbolic), এবং বাস্তব বা রিয়েল (Real)। ‘সিম্বলিক অর্ডার’ হলো ভাষা, সামাজিক নিয়মকানুন, পিতৃতান্ত্রিক কর্তৃত্বের জগৎ। শিশু যখন ভাষার জগতে প্রবেশ করে, তখন সে এই সিম্বলিক অর্ডারের অধীন হয় এবং তার আত্মপরিচয় (subjectivity) গঠিত হয়। লাকাঁর মতে, এই ভাষাগত কাঠামোই আমাদের মানবসত্তা নির্মাণ করে। ফ্রয়েডের ইডিপাস কমপ্লেক্সকে (Oedipus complex) তিনি এই সিম্বলিক অর্ডারে প্রবেশের একটা গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় হিসেবে ব্যাখ্যা করেন, যেখানে শিশু ‘পিতার নাম’ (Name-of-the-Father) বা সামাজিক আইনের মুখোমুখি হয়। লাকাঁর কাজ অত্যন্ত জটিল এবং দুর্বোধ্য বলে পরিচিত, কিন্তু তিনি মনোসমীক্ষণ, দর্শন এবং সাহিত্যতত্ত্বের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছেন।

মার্কসবাদে লুই আলথুসার (Louis Althusser): ভাবাদর্শের কাঠামো

ফরাসি মার্কসবাদী দার্শনিক লুই আলথুসার (Louis Althusser) কার্ল মার্কসের (Karl Marx) তত্ত্বকে কাঠামোবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে নতুনভাবে পাঠ করার চেষ্টা করেন। তিনি চিরাচরিত মার্কসবাদী ব্যাখ্যা, যেখানে সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তিকেই (economic base) মূল নির্ধারক এবং বাকি সবকিছুকে (যেমন, রাষ্ট্র, আইন, সংস্কৃতি) তার উপরিকাঠামো (superstructure) হিসেবে দেখা হতো, তার থেকে কিছুটা ভিন্ন পথে হাঁটেন। আলথুসার বলেন, সমাজ একটি জটিল কাঠামো, যেখানে অর্থনীতি, রাজনীতি এবং ভাবাদর্শ (ideology) – এই তিনটি স্তর একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং প্রত্যেকেরই আপেক্ষিক স্বতন্ত্রতা (relative autonomy) রয়েছে।

আলথুসারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো ‘ভাবাদর্শ’ (ideology) এবং ‘ভাবাদর্শগত রাষ্ট্রযন্ত্র’ (Ideological State Apparatuses বা ISA) সম্পর্কিত তাঁর ধারণা। তিনি বলেন, শাসকশ্রেণী শুধু দমনমূলক রাষ্ট্রযন্ত্র (Repressive State Apparatuses বা RSA) যেমন—পুলিশ, সেনাবাহিনী, আদালত—এসবের মাধ্যমে শাসন করে না, বরং আরও সূক্ষ্মভাবে ভাবাদর্শগত রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমেও তাদের আধিপত্য বজায় রাখে। এই ISA-গুলো হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (স্কুল, কলেজ), ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান (মসজিদ, মন্দির, গির্জা), পরিবার, গণমাধ্যম (রেডিও, টিভি, সংবাদপত্র), সংস্কৃতি (সাহিত্য, শিল্পকলা) ইত্যাদি। এই প্রতিষ্ঠানগুলো আপাতদৃষ্টিতে নিরপেক্ষ মনে হলেও, তারা আসলে বিদ্যমান সামাজিক সম্পর্ক এবং শাসকশ্রেণীর ভাবাদর্শকে জনগণের মধ্যে স্বাভাবিক ও গ্রহণযোগ্য করে তোলে, তাদের পুনরুৎপাদন (reproduce) করে। (Althusser, 1971)

আলথুসার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দেন, যার নাম ‘ইন্টারপিলেশন’ (interpellation) বা ‘আহ্বান’। তিনি বলেন, ভাবাদর্শ ব্যক্তিদেরকে ‘সাবজেক্ট’ (subject) বা কর্তা হিসেবে গঠন করে। অনেকটা রাস্তায় পুলিশ যখন কাউকে “এই যে, আপনি!” (“Hey, you there!”) বলে ডাকে, তখন সেই ব্যক্তি যেমন সাড়া দেয় এবং নিজেকে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের ‘বিষয়’ বা সাবজেক্ট হিসেবে স্বীকার করে নেয়, তেমনি ভাবাদর্শও আমাদের অলক্ষ্যে ডেকে আমাদের নির্দিষ্ট সামাজিক ভূমিকা ও পরিচয়ে আবদ্ধ করে। আমরা মনে করি আমরা স্বাধীন কর্তা, কিন্তু আসলে আমরা ভাবাদর্শের দ্বারা নির্মিত। আলথুসারের এই কাঠামোবাদী মার্কসবাদ পরবর্তীকালে সংস্কৃতি অধ্যয়ন (cultural studies) এবং উত্তর-মার্কসবাদী চিন্তাভাবনার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল।

স্ট্রাকচারালিজমের মূলনীতি: এক নজরে কয়েকটি চাবিকাঠি

এতক্ষণ ধরে আমরা কাঠামোবাদের বিস্তীর্ণ উঠোনে ঘুরে বেড়ালাম, বিভিন্ন মনীষীর অন্দরমহলে উঁকি দিলাম। এবার যদি এক ঝুড়িতে এই তত্ত্বের মূল ফলগুলোকে সাজাতে চাই, তাহলে কেমন দেখাবে? আসুন, কাঠামোবাদের প্রধান কয়েকটি সূত্র বা মূলনীতিকে আরেকবার গুছিয়ে নিই:

১. কাঠামোর প্রাধান্য (Primacy of the Structure): এটাই হলো কাঠামোবাদের হৃদপিণ্ড। এর মূল কথা হলো, যেকোনো ব্যবস্থার (সেটা ভাষা, সাহিত্য, সমাজ, পুরাণ, বা মানুষের মন যাই হোক না কেন) অর্থ বা তাৎপর্য তার উপাদানগুলোর নিজস্ব গুণের ওপর ততটা নির্ভর করে না, যতটা করে সেই উপাদানগুলোকে ধারণ করে থাকা সামগ্রিক কাঠামোর ওপর। এই কাঠামোই উপাদানগুলোর ভূমিকা, সম্পর্ক এবং মূল্য নির্ধারণ করে। উপাদানগুলো হলো নাটকের অভিনেতা, আর কাঠামো হলো নাটকের কাহিনি ও মঞ্চসজ্জা।

২. উপাদানের আপেক্ষিকতা ও সম্পর্কনির্ভরতা (Relativity and Relationality of Elements): কোনো উপাদানেরই একক, বিচ্ছিন্ন বা অন্তর্নিহিত (inherent) কোনো অর্থ নেই। তার অর্থ বা মূল্য তৈরি হয় ওই কাঠামোর মধ্যে অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে তার সম্পর্কের (বিশেষ করে পার্থক্যের) ভিত্তিতে। সস্যুরের সেই বিখ্যাত উক্তি মনে আছে তো? “ভাষায় কেবল পার্থক্যই থাকে… ইতিবাচক কোনো পদ ছাড়াই।” একটা শব্দ ‘কালো’ কারণ তা ‘সাদা’ নয়, একটা চরিত্র ‘নায়ক’ কারণ সে ‘খলনায়ক’ নয়।

৩. সিনক্রনিক বিশ্লেষণের ওপর জোর (Emphasis on Synchronic Analysis): কাঠামোবাদীরা সাধারণত কোনো ব্যবস্থার একটা নির্দিষ্ট মুহূর্তের (synchronic) গঠনতন্ত্র বা সিস্টেমকে বিশ্লেষণ করার ওপর বেশি গুরুত্ব দেন। সেই সিস্টেমটা কীভাবে কাজ করে, তার ভেতরের নিয়মগুলো কী—এটাই তাঁদের মূল আগ্রহের বিষয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই সিস্টেমের যে ঐতিহাসিক পরিবর্তন (diachronic), সেটা তাঁদের কাছে তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা বর্তমানের স্থিরচিত্রটাকেই খুঁটিয়ে দেখতে চান।

৪. দ্বিমেরু বৈপরীত্যের (Binary Oppositions) ভূমিকা: অনেক কাঠামোবাদী, বিশেষ করে লেভি-স্ট্রাউস এবং তাঁর অনুসারীরা, মনে করেন যে মানব মন জগৎকে বোঝার এবং সুশৃঙ্খল করার জন্য প্রায়শই দ্বিমেরু বৈপরীত্যের (binary oppositions) আশ্রয় নেয়। যেমন—আলো/অন্ধকার, ভালো/মন্দ, পুরুষ/নারী, প্রকৃতি/সংস্কৃতি, কাঁচা/রান্না করা ইত্যাদি। এই বাইনারি অপোজিশনগুলো সংস্কৃতির বিভিন্ন প্রকাশে (যেমন—পুরাণ, সাহিত্য, সামাজিক প্রথা) প্রতিফলিত হয় এবং অর্থের কাঠামো নির্মাণে সাহায্য করে। তবে, এই বৈপরীত্যগুলো সবসময় সমান ক্ষমতাসম্পন্ন হয় না; প্রায়শই একটি পদ অন্যটির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে (যা পরবর্তীকালে উত্তর-কাঠামোবাদীরা বিশেষভাবে তুলে ধরবেন)।

৫. সার্বজনীনতার সন্ধান (Search for Universals): অনেক কাঠামোবাদী বিশ্বাস করেন যে, বিভিন্ন সংস্কৃতি বা টেক্সটের উপরিভাগের বৈচিত্র্য এবং ভিন্নতা সত্ত্বেও, তাদের গভীরে কিছু সার্বজনীন (universal) বা সাধারণ কাঠামো বা নিয়ম খুঁজে পাওয়া সম্ভব। এই কাঠামো গুলো নাকি মানব মনের মৌলিক গঠনকেই (fundamental structures of the human mind) নির্দেশ করে। লেভি-স্ট্রাউসের পুরাণের বিশ্লেষণ বা প্রপের রূপকথার ফাংশন—এগুলো এই সার্বজনীনতার অনুসন্ধানেরই উদাহরণ।

৬. ‘মানবকেন্দ্রিকতা’র বিরোধিতা ও ব্যক্তির অবমূল্যায়ন (Anti-Humanism and De-centering of the Subject): চিরাচরিত মানবতাবাদী (humanist) দর্শন যেখানে ব্যক্তি মানুষের স্বাধীনতা, সৃজনশীলতা, চেতনা এবং একক ভূমিকাকে (agency) সবকিছুর কেন্দ্রে রাখে, সেখানে কাঠামোবাদীরা কাঠামোর ভূমিকাকেই বড় করে দেখেন। তাঁদের মতে, ব্যক্তি আসলে ভাষার কাঠামো, সামাজিক কাঠামো বা ভাবাদর্শগত কাঠামোরই সৃষ্টি বা ফল (product)। মানুষ যা ভাবে, যা বলে, যা করে, তা অনেকাংশেই এই অদৃশ্য কাঠামো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। রোলাঁ বার্থের ‘লেখকের মৃত্যু’র ঘোষণা এই ‘মানবকেন্দ্রিকতা’র বিরোধিতারই একটি জোরালো প্রকাশ, যেখানে লেখকের একক কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে টেক্সটের ভাষাগত কাঠামো এবং পাঠকের ভূমিকাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, মানুষ ইতিহাস সৃষ্টি করে না, বরং কাঠামোই মানুষের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করে।

এই মূলনীতিগুলো মাথায় রাখলে কাঠামোবাদের জটিল জগৎটাকে বুঝতে কিছুটা সুবিধা হয়। মনে হয় যেন একটা মানচিত্র হাতে পাওয়া গেল, যা দিয়ে এই অচেনা ভূখণ্ডের পথঘাট চেনা যায়।

স্ট্রাকচারালিজমের শক্তি ও সম্ভাবনা: নতুন এক দেখার চোখ

বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে কাঠামোবাদ জ্ঞানচর্চার জগতে একটা নতুন তরঙ্গ সৃষ্টি করেছিল, যার ঢেউ লেগেছিল প্রায় সবখানে। এর কিছু অন্তর্নিহিত শক্তি ও সম্ভাবনা ছিল, যা সমসাময়িক পণ্ডিত ও গবেষকদের গভীরভাবে আকৃষ্ট করেছিল।

  • বৈজ্ঞানিক শৃঙ্খলা ও পদ্ধতির আকাঙ্ক্ষা পূরণ: মানবিক বিদ্যা (humanities) এবং সমাজবিজ্ঞানের (social sciences) অনেক শাখায় দীর্ঘদিন ধরেই একটা ‘বৈজ্ঞানিক কঠোরতা’ (scientific rigor) এবং বস্তুনিষ্ঠতার (objectivity) অভাব অনুভূত হচ্ছিল। কাঠামোবাদ সেই অভাব পূরণের একটা প্রতিশ্রুতি নিয়ে এসেছিল। সস্যুরের ভাষাবিজ্ঞান বা লেভি-স্ট্রাউসের নৃবিজ্ঞান যেভাবে বিষয়বস্তুকে সুশৃঙ্খলভাবে বিশ্লেষণ করে তার অন্তর্নিহিত নিয়মাবলি আবিষ্কারের চেষ্টা করেছিল, তা অনেককে গণিত বা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের পদ্ধতির কথা মনে করিয়ে দেয়। এই ‘বিজ্ঞানমনস্কতা’ই ছিল কাঠামোবাদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ।

  • গভীর সত্যের উন্মোচন ও জটিলতার নিরসন: কাঠামোবাদ দাবি করেছিল যে, এটি কোনো বিষয়ের উপরিভাগের চাকচিক্য, আপাত বিশৃঙ্খলা বা বিভ্রান্তিকর ভিন্নতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা গভীরতর সত্য বা মূল কাঠামোকে উন্মোচন করতে সক্ষম। যেমন, লেভি-স্ট্রাউস দেখালেন যে, পৃথিবীর শত শত ভিন্ন ভিন্ন পুরাণের গল্পের নিচে আসলে মানব মনের কিছু মৌলিক দ্বন্দ্ব ও তার সমাধানের চেষ্টা লুকিয়ে আছে। এই ক্ষমতা অনেক জটিল সাংস্কৃতিক বা সামাজিক প্রপঞ্চকে (phenomena) সরল ও বোধগম্য করে তোলার সম্ভাবনা জাগিয়েছিল।

  • বিভিন্ন শাস্ত্রের মধ্যে সেতুবন্ধন ও আন্তঃশাস্ত্রীয়তার (Interdisciplinarity) প্রসার: সস্যুরের ভাষাতাত্ত্বিক মডেলকে যখন সাহিত্য, নৃবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, মার্কসবাদ, এমনকি স্থাপত্য বা চলচ্চিত্র বিশ্লেষণেও প্রয়োগ করা শুরু হলো, তখন জ্ঞানচর্চার বিভিন্ন শাখার মধ্যে একটা অভূতপূর্ব যোগসূত্র ও সংলাপের পরিবেশ তৈরি হলো। মনে হচ্ছিল, সবাই যেন একটা অভিন্ন পরিভাষা ও পদ্ধতি খুঁজে পেয়েছে, যা দিয়ে নিজ নিজ ক্ষেত্রের সমস্যাগুলোকে নতুনভাবে বিচার করা যায়। প্যারিসে ১৯৬০-এর দশকে যে ‘কাঠামোবাদী বিপ্লব’ ঘটেছিল, তা ছিল এই আন্তঃশাস্ত্রীয়তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

  • নতুন দৃষ্টিকোণ ও প্রচলিত ধারণার পুনর্বিবেচনা: কাঠামোবাদ জগৎকে দেখার একটা সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিকোণ তৈরি করেছিল। ব্যক্তি বা বিচ্ছিন্ন ঘটনার চেয়ে সিস্টেম বা কাঠামোর ওপর জোর দেওয়ায় অনেক সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা মনস্তাত্ত্বিক প্রপঞ্চকে নতুনভাবে বোঝার ও ব্যাখ্যা করার সুযোগ তৈরি হলো। যেমন, সাহিত্য বিশ্লেষণে লেখকের জীবন বা ইতিহাসের চেয়ে টেক্সটের নিজস্ব গঠনতন্ত্রকে গুরুত্ব দেওয়ায় নতুন ধরনের পাঠ ও উপলব্ধির দরজা খুলে গিয়েছিল।

  • পদ্ধতিগত স্বচ্ছতা ও প্রয়োগযোগ্যতা: কাঠামোবাদীরা তাঁদের বিশ্লেষণ পদ্ধতিকে স্পষ্ট এবং অনুসরণযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। প্রপের ফাংশন, গ্রেমাসের অ্যাকট্যান্ট মডেল বা লেভি-স্ট্রাউসের বাইনারি অপোজিশনের ধারণাগুলো গবেষকদের হাতে যেন কিছু টুলকিট (toolkit) তুলে দিয়েছিল, যা দিয়ে তাঁরা বিভিন্ন ধরনের ‘টেক্সট’ (সাহিত্য, পুরাণ, সংস্কৃতি) বিশ্লেষণ করতে পারতেন।

এইসব কারণে কাঠামোবাদ একটা শক্তিশালী বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন হিসেবে পরিচিতি লাভ করে এবং বহু গবেষককে অনুপ্রাণিত করে। মনে হচ্ছিল, যেন মানব জ্ঞানভাণ্ডারের অনেক অজানা রহস্যের চাবিকাঠি হাতে এসে গেছে।

সমালোচনা ও সীমাবদ্ধতা: কাঠামোর কারাগারে?

তবে, কোনো তত্ত্বই চিরস্থায়ী নয়, কোনো পদ্ধতিই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। কাঠামোবাদের আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা এবং প্রভাব সত্ত্বেও, কিছুদিনের মধ্যেই এর নানা সীমাবদ্ধতা এবং দুর্বলতা সমালোচকদের চোখে পড়তে শুরু করে। যে কাঠামোকে একসময় মুক্তির পথ বলে মনে হয়েছিল, সেটাই অনেকের কাছে ‘কাঠামোর কারাগার’ (prison-house of structure) বলে প্রতিভাত হতে লাগল। আসুন, সেইসব প্রধান সমালোচনাগুলো একটু খতিয়ে দেখি:

  • ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও পরিবর্তনের উপেক্ষা (Ahistoricism and Neglect of Change): কাঠামোবাদীরা সিনক্রনিক বা এককালিক বিশ্লেষণের ওপর এত বেশি জোর দিয়েছিলেন যে, তাঁরা প্রায়শই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট (historical context) এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঘটা সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তনকে (diachronic change) উপেক্ষা করেছেন। তাঁদের বিশ্লেষণ অনেক ক্ষেত্রে স্থবির (static), গতিহীন এবং অসম্পূর্ণ মনে হয়েছে। সমাজ বা সংস্কৃতি তো আর স্থির কোনো বস্তু নয়, তা প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে। এই পরিবর্তনকে ধারণ করতে না পারায় কাঠামোবাদী ব্যাখ্যা অনেক সময় যান্ত্রিক ও সরলীকৃত হয়ে পড়েছে।
  • ব্যক্তি মানুষের সৃজনশীলতা, স্বাধীনতা ও সক্রিয় ভূমিকার (Agency) অবমূল্যায়ন: কাঠামোকে সর্বেসর্বা এবং ব্যক্তিকে কাঠামোর সৃষ্টি বা পুতুল (puppet) হিসেবে দেখতে গিয়ে কাঠামোবাদীরা মানুষের সৃজনশীলতা, ইচ্ছাশক্তি, স্বাধীনতা এবং সমাজে পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে তার সক্রিয় ভূমিকাকে (agency) প্রায় অস্বীকার করেছেন। যদি সবকিছুই অদৃশ্য কাঠামো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তাহলে মানুষের আর করার কী থাকে? এই অতি-নির্ধারণবাদী (over-deterministic) দৃষ্টিভঙ্গি অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি।
  • অতিসরলীকরণ (Oversimplification) ও সার্বজনীনতার দাবির সমস্যা: জটিল এবং বহুস্তরীয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতা বা মানব মনের বিচিত্র প্রকাশকে অনেক সময় বাইনারি অপোজিশন বা সরল কাঠামোর ছাঁচে ফেলতে গিয়ে অতিসরলীকরণের বিপদ দেখা দিয়েছে। সবকিছুর মধ্যেই কি এমন নিখুঁত, সুশৃঙ্খল, সার্বজনীন কাঠামো খুঁজে পাওয়া সত্যিই সম্ভব? নাকি গবেষক তাঁর নিজের পছন্দ অনুযায়ী একটা কাঠামো ‘আবিষ্কার’ না করে ‘আরোপ’ (impose) করছেন? এই সার্বজনীনতার দাবি অনেক সময় পশ্চিমা সংস্কৃতির মডেলকে অ-পশ্চিমা সংস্কৃতির ওপর চাপিয়ে দেওয়ার ঝুঁকিও তৈরি করেছে।
  • বস্তুনিষ্ঠতার (Objectivity) দাবি নিয়ে প্রশ্ন: কাঠামোবাদীরা তাঁদের বিশ্লেষণকে বিজ্ঞানসম্মত এবং বস্তুনিষ্ঠ বলে দাবি করলেও, সমালোচকরা প্রশ্ন তুলেছেন যে, কোন কাঠামোটিকে ‘আসল’ বা ‘গুরুত্বপূর্ণ’ বলে চিহ্নিত করা হবে, কোন উপাদানগুলোকে বিশ্লেষণের জন্য বেছে নেওয়া হবে, এবং কীভাবে তাদের ব্যাখ্যা করা হবে—এইসব ক্ষেত্রে গবেষকের ব্যক্তিগত পছন্দ, মূল্যবোধ বা পক্ষপাত (bias) কাজ করতে পারে। ফলে, তাঁদের ‘বৈজ্ঞানিক’ দাবি পুরোপুরি অটুট থাকেনি।
  • অর্থের স্থিরতা ও টেক্সটের বহু অর্থের সম্ভাবনার অভাব: কাঠামোবাদীরা সাধারণত ধরে নিয়েছেন যে, একটি টেক্সট বা সংস্কৃতির অর্থ তার কাঠামোর মধ্যেই স্থির, নির্দিষ্ট এবং আবিষ্কারযোগ্য। কিন্তু অর্থ কি সত্যিই এত বাঁধা? পাঠক বা দর্শকের ভূমিকা, তাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবস্থান, বা তাদের পঠন প্রক্রিয়ার ভিন্নতা কি অর্থের ওপর কোনো প্রভাব ফেলে না? কাঠামোবাদ এই দিকগুলোকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়নি, যা পরবর্তীকালে উত্তর-কাঠামোবাদীরা বিশেষভাবে তুলে ধরেন।
  • অভিজাততন্ত্র (Elitism) ও দুর্বোধ্যতা: কাঠামোবাদী বিশ্লেষণ অনেক সময়ই অত্যন্ত পরিভাষাগত (technical), জটিল এবং অ্যাকাডেমিক মারপ্যাঁচে ভরা ছিল। ফলে, সাধারণ পাঠক বা সমাজের বৃহত্তর অংশের কাছে তা দুর্বোধ্য এবং অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে। জ্ঞানচর্চা যদি শুধু মুষ্টিমেয় বিশেষজ্ঞের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে তার সামাজিক উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।

এইসব দুর্বলতা এবং সমালোচনার কারণেই ধীরে ধীরে কাঠামোবাদের সূর্য অস্তাচলের দিকে ঝুঁকতে শুরু করে। তবে, তার আলো একেবারে নিভে যায়নি। বরং, সেই আলোর উত্তাপেই জন্ম নিয়েছিল নতুন এক চিন্তার জগৎ।

স্ট্রাকচারালিজমের উত্তরাধিকার: উত্তর-কাঠামোবাদ ও তারপর

ষাটের দশকের শেষ দিক থেকে এবং সত্তরের দশক জুড়ে কাঠামোবাদের প্রভাব কিছুটা স্তিমিত হতে শুরু করে এবং তার গর্ভ থেকেই জন্ম নেয় একগুচ্ছ নতুন চিন্তাভাবনা, যা সম্মিলিতভাবে উত্তর-কাঠামোবাদ (Post-structuralism) নামে পরিচিতি লাভ করে। ব্যাপারটা অনেকটা বসন্তের শেষে গ্রীষ্মের আগমনের মতো—এক ঋতু বিদায় নেয়, কিন্তু তার রেখে যাওয়া রসদেই নতুন ঋতুর আগমন ঘটে। মজার ব্যাপার হলো, অনেক চিন্তাবিদ যাঁরা একসময় কাঠামোবাদী শিবিরের অগ্রণী সৈনিক ছিলেন (যেমন—রোলাঁ বার্থ, মিশেল ফুকো), তাঁরাই পরবর্তীকালে উত্তর-কাঠামোবাদী চিন্তার অন্যতম প্রধান প্রবক্তা হয়ে ওঠেন। তাঁরা যেন নিজেদের তৈরি করা দুর্গের দেওয়াল নিজেরাই ভাঙতে শুরু করলেন!

উত্তর-কাঠামোবাদীরা কাঠামোবাদের অনেক মৌলিক ধারণাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেন, চ্যালেঞ্জ জানান, এমনকি বাতিলও করে দেন। তবে, তাঁরা কাঠামোবাদের সবকিছুকে ফেলে দেননি, বরং তার কিছু গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্দৃষ্টিকে নতুনভাবে কাজে লাগিয়েছেন। আসুন, উত্তর-কাঠামোবাদের কিছু মূল প্রবণতা সংক্ষেপে দেখে নিই:

  • কাঠামোর অস্থিতিশীলতা ও অর্থের পিছলে যাওয়া: কাঠামোবাদীরা যেখানে স্থিতিশীল, সার্বজনীন কাঠামো এবং নির্দিষ্ট অর্থের সন্ধান করেছিলেন, সেখানে উত্তর-কাঠামোবাদীরা বললেন, কোনো কিছুরই একটিমাত্র স্থির বা সার্বজনীন কাঠামো থাকতে পারে না। কাঠামো নিজেই ঐতিহাসিক ও পরিস্থিতি সাপেক্ষে পরিবর্তনশীল। আর অর্থ? সে তো আরও অধরা, আরও পিচ্ছিল। ভাষার সংকেতক (signifier) আর সংকেতিত (signified)-এর মধ্যে যে সম্পর্ক, তা কখনোই পুরোপুরি স্থির বা নিশ্চিত নয়। সংকেতিত নিজেই আরেক সংকেতকের দিকে ইঙ্গিত করে, ফলে অর্থ ক্রমাগত স্থগিত (deferred) হতে থাকে। জাক দেরিদা (Jacques Derrida) এই ধারণাকে ‘ডিফারঁস’ (Différance) নামে অভিহিত করেছেন—যা একই সঙ্গে ‘পার্থক্য করা’ (to differ) এবং ‘স্থগিত রাখা’ (to defer) দুটো অর্থই বহন করে।

  • বিনির্মাণ (Deconstruction) ও বাইনারি অপোজিশনের ভাঙন: জাক দেরিদা, উত্তর-কাঠামোবাদের অন্যতম প্রধান পুরোহিত, ‘বিনির্মাণ’ বা ‘ডিকনস্ট্রাকশন’ নামক এক বিশ্লেষণ পদ্ধতির প্রবর্তন করেন। তিনি দেখান যে, পশ্চিমা দর্শনের মূল ভিত্তি হলো ‘উপস্থিতির অধিবিদ্যা’ (metaphysics of presence) এবং ‘লোগোসেন্ট্রিজম’ (logocentrism) – অর্থাৎ, সত্য, অর্থ, বা উৎসকে একটা স্থির ও উপস্থিত সত্তা হিসেবে দেখার প্রবণতা। দেরিদা আরও দেখান, কাঠামোবাদীরা যে বাইনারি অপোজিশনগুলোকে (যেমন—পুরুষ/নারী, সাদা/কালো, বাক্য/লেখনী, প্রকৃতি/সংস্কৃতি) এত গুরুত্ব দিয়েছিলেন, সেগুলোর মধ্যে প্রায়শই একটি পদ অন্যটির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, স্বাভাবিক বা সুবিধাজনক (privileged) অবস্থানে থাকে, আর অন্যটি থাকে প্রান্তিক বা অবদমিত (marginalized/suppressed) অবস্থানে। বিনির্মাণের কাজ হলো এই শ্রেণিবিন্যাস (hierarchy) বা আধিপত্যের সম্পর্ককে উন্মোচন করা, প্রশ্নবিদ্ধ করা এবং উল্টে দেওয়া—তবে নতুন কোনো স্থির আধিপত্য তৈরি না করে, বরং অর্থের বহুত্ব (plurality) ও অনির্দিষ্টতাকে (indeterminacy) স্বীকৃতি দেওয়া। (Derrida, 1976, Of Grammatology)

  • ক্ষমতা, জ্ঞান ও বয়ান (Power, Knowledge, and Discourse) – মিশেল ফুকোর ভাবনা: মিশেল ফুকো (Michel Foucault), আরেকজন দিকপাল উত্তর-কাঠামোবাদী চিন্তাবিদ, দেখালেন যে জ্ঞান কখনোই নিরপেক্ষ বা নির্মোহ নয়। জ্ঞান এবং ক্ষমতা (power) অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সমাজে যা ‘সত্য’ বা ‘স্বাভাবিক’ বলে পরিচিত, তা আসলে নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ক্ষমতার দ্বারা নির্মিত ও সমর্থিত ‘বয়ান’ (discourse) বা ডিসকোর্সের ফল। ডিসকোর্স হলো ভাষা, প্রথা, এবং প্রতিষ্ঠানের এমন এক ব্যবস্থা, যা আমাদের চিন্তাভাবনা, কথাবার্তা, এবং কাজকর্মকে নিয়ন্ত্রণ করে, যা কিছু বলা বা চিন্তা করা ‘সম্ভব’ তার সীমা নির্ধারণ করে দেয়। ফুকো তাঁর বিভিন্ন গবেষণায় (যেমন—পাগলামি, চিকিৎসাবিদ্যা, কারাগার, যৌনতা) দেখিয়েছেন, কীভাবে বিভিন্ন ঐতিহাসিক যুগে বিভিন্ন ডিসকোর্স এবং ক্ষমতার সম্পর্ক মানুষকে নির্দিষ্ট পরিচয়ে ও শৃঙ্খলায় আবদ্ধ করেছে। (Foucault, 1972, The Archaeology of Knowledge; Foucault, 1977, Discipline and Punish)

  • ‘মানবকেন্দ্রিকতা’র পূর্ণ প্রত্যাখ্যান ও ‘সাবজেক্ট’-এর মৃত্যু: কাঠামোবাদীরা যেখানে ‘লেখকের মৃত্যু’ ঘোষণা করেছিলেন, উত্তর-কাঠামোবাদীরা সেখানে ‘মানুষ’ (Man) বা সেই স্বয়ংসম্পূর্ণ, চেতনাসম্পন্ন, যুক্তিবাদী ‘সাবজেক্ট’-এর ধারণাকেই বাতিল করে দেন। তাঁদের মতে, এই ‘সাবজেক্ট’ কোনো পূর্বনির্ধারিত সত্তা নয়, বরং ভাষা, ডিসকোর্স এবং ক্ষমতার সম্পর্কের দ্বারা নির্মিত ও বিনির্মিত একটি অবস্থান মাত্র।

তবে, এটা মনে রাখা দরকার যে, উত্তর-কাঠামোবাদ কোনো সুসংহত একক তত্ত্ব বা আন্দোলন নয়। এটি বিভিন্ন চিন্তাবিদের ভিন্ন ভিন্ন ভাবনা ও পদ্ধতির একটি সমন্বয়, যার মূল সুর হলো সন্দেহ, প্রশ্ন এবং প্রচলিত ধারণার প্রতি অনাস্থা। তাঁরা কাঠামোবাদের মতো নতুন কোনো সার্বজনীন ব্যবস্থা তৈরি করতে চাননি, বরং সব ধরনের ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত ফাঁকফোকর, অসংগতি এবং ক্ষমতার খেলাকে উন্মোচন করতে চেয়েছেন।

আজকের দিনে ‘বিশুদ্ধ’ কাঠামোবাদী বা ‘বিশুদ্ধ’ উত্তর-কাঠামোবাদী হয়তো খুব বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু এই দুটি প্রধান চিন্তাধারার রেখে যাওয়া প্রভাব আমাদের সমসাময়িক জ্ঞানচর্চা, সাহিত্য সমালোচনা, সংস্কৃতি অধ্যয়ন, সমাজবিজ্ঞান, এবং দর্শনের ওপর অত্যন্ত গভীর ও সুদূরপ্রসারী। কাঠামোবাদ আমাদের শিখিয়েছিল সিস্টেম বা কাঠামোর গুরুত্ব অনুধাবন করতে, আর উত্তর-কাঠামোবাদ আমাদের শিখিয়েছে সেই সিস্টেমকে প্রশ্ন করতে, তার সীমাবদ্ধতা ও ক্ষমতার দিকগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে। দুটোই যেন একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।

শেষের কথা: কাঠামোর খেলায় এখনও মাতি

তাহলে, এই যে এতক্ষণ ধরে আমরা কাঠামোবাদের অলিগলিতে ঘুরপাক খেলাম, তার মোদ্দা কথাটা কী দাঁড়াল? ব্যাপারটা অনেকটা সেই ছোটবেলার লুকোচুরি খেলার মতো। কাঠামোবাদীরা যেন ‘টুকি’ দিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন, এই বিশাল জগৎসংসারের আড়ালে কে বা কী লুকিয়ে আছে, কোন সে কারিগর এত নিখুঁতভাবে সবকিছু সাজিয়ে রেখেছে। তাঁরা ভেবেছিলেন, একবার যদি সেই কারিগরের হাতের নকশাটা (blueprint) পড়ে ফেলা যায়, তাহলেই কেল্লাফতে! জগতের সব রহস্য জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে।

তাঁদের সেই অভিযান পুরোপুরি সফল হয়েছিল কি না, সেই তর্ক চলতেই পারে, চলবেও। অনেকে বলবেন, তাঁরা বড্ড বেশি সরলীকরণ করে ফেলেছিলেন, অনেক কিছু তাঁদের নজর এড়িয়ে গিয়েছিল। আবার অনেকে বলবেন, তাঁরা যে একটা নতুন দিশা দেখিয়েছিলেন, সেটাই বা কম কীসের! তাঁরাই তো প্রথম আমাদের চোখ খুলে দিয়ে বলেছিলেন, “ওহে, শুধু ওপর-ওপর দেখলেই হবে না, ভেতরের কলকব্জাগুলোও একটু নেড়েচেড়ে দেখো! দেখবে, কত মজার জিনিস লুকিয়ে আছে।”

সত্যি বলতে, কাঠামোবাদীরা আমাদের দৃষ্টিকে বস্তুর চকমকে উপরিভাগ থেকে সরিয়ে তার গহিনের দিকে, তার গঠনের দিকে নিয়ে যাওয়ার একটা গুরুত্বপূর্ণ পথ দেখিয়েছিলেন। তাঁরা আমাদের শিখিয়েছিলেন, পৃথিবীর আপাত বিশৃঙ্খল, এলোমেলো, হাজারো জিনিসের মধ্যেও একটা গোপন ছন্দ, একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। শিখিয়েছিলেন, বিচ্ছিন্ন অংশ নয়, অংশগুলোর পারস্পরিক সম্পর্কটাই আসল।

আজও যখন আমরা কোনো জটিল সমস্যার মুখোমুখি হই, তখন নিজের অজান্তেই হয়তো তার ভেতরের ‘কাঠামো’টা বোঝার চেষ্টা করি। ভাবি, কোন কোন ফ্যাক্টর এখানে কাজ করছে, তাদের মধ্যে সম্পর্কটা কী? যখন কোনো ভালো সিনেমা দেখি বা উপন্যাস পড়ি, তখন তার কাহিনির বুনন, চরিত্রের বিকাশ, ঘটনার পরম্পরা আমাদের মুগ্ধ করে—এগুলোও তো এক ধরনের কাঠামোরই কারসাজি। যখন কোনো বিজ্ঞানীর আবিস্কারের কথা শুনি, যিনি প্রকৃতির কোনো জটিল রহস্যের পেছনের সরল নিয়মটা খুঁজে বের করেছেন, তখন কি কাঠামোবাদীদের সেই অনুসন্ধিৎসু মনেরই প্রতিধ্বনি শুনতে পাই না?

হয়তো কাঠামোবাদীরা সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি। হয়তো তাঁদের দেখানো পথটাই একমাত্র বা নির্ভুল পথ নয়। কিন্তু তাঁরা যে সাহসী প্রশ্নগুলো তুলেছিলেন, জগৎকে দেখার আর বোঝার যে নতুন একটা চশমা তাঁরা আমাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, তার জন্য তাঁদের কাছে আমরা চিরঋণী থাকব। তাঁদের কাজ অনেকটা সেই পুরনো দিনের মানচিত্রের মতো, যা হয়তো সব খুঁটিনাটি দেখাতে পারে না, কিন্তু নতুন ভূখণ্ড আবিষ্কারের একটা আবছা আন্দাজ তো দেয়!

কাঠামোবাদের চরিত্ররাও যেন আমাদের খুব চেনা, আবার অচেনাও। তাঁরা কঠিন কঠিন কথা বলেন, কিন্তু তার ভেতরে কোথায় যেন একটা সহজ সত্যের ইশারা থাকে। কাঠামোবাদ আমাদের সেই ইশারাটাকেই ধরতে শেখায়। শেখায়, এই যে এত শব্দ, এত রং, এত ঘটনা—এদের সবার পেছনেই একটা ঐকতান আছে। শুধু একটু মন দিয়ে শুনতে হবে, একটু ধৈর্য ধরে খুঁজতে হবে। তাহলেই হয়তো দেখা যাবে, নেপথ্যের সেই কারিগরেরা খুব দূরে নয়, আমাদের ভাবনার চৌহদ্দির মধ্যেই তাঁরা নিত্যনতুন নকশা বুনে চলেছেন। আর আমরাও, জেনে বা না জেনে, সেই নকশারই অংশ হয়ে বেঁচে আছি। এই তো খেলা!

তথ্যসূত্র

  • Althusser, L. (1971). Lenin and Philosophy and Other Essays (B. Brewster, Trans.). Monthly Review Press.
  • Barthes, R. (1972). Mythologies (A. Lavers, Trans.). Hill and Wang. (Original work published 1957)
  • Barthes, R. (1974). S/Z (R. Miller, Trans.). Hill and Wang. (Original work published 1970)
  • Barthes, R. (1977). The Death of the Author. In Image–Music–Text (S. Heath, Trans., pp. 142-148). Hill and Wang. (Original work published 1967)
  • Derrida, J. (1976). Of Grammatology (G. C. Spivak, Trans.). Johns Hopkins University Press. (Original work published 1967)
  • Foucault, M. (1972). The Archaeology of Knowledge and The Discourse on Language (A. M. Sheridan Smith, Trans.). Pantheon Books. (Original work published 1969)
  • Foucault, M. (1977). Discipline and Punish: The Birth of the Prison (A. Sheridan, Trans.). Pantheon Books. (Original work published 1975)
  • Greimas, A. J. (1983). Structural Semantics: An Attempt at a Method (D. McDowell, R. Schleifer, & A. Velie, Trans.). University of Nebraska Press. (Original work published 1966)
  • Lacan, J. (1977). Écrits: A Selection (A. Sheridan, Trans.). W. W. Norton & Company. (Original work published 1966)
  • Lévi-Strauss, C. (1963). Structural Anthropology (C. Jacobson & B. G. Schoepf, Trans.). Basic Books. (Original work published 1958, contains “The Structural Study of Myth,” 1955)
  • Lévi-Strauss, C. (1966). The Savage Mind (G. Weidenfeld & Nicolson Ltd, Trans.). University of Chicago Press. (Original work published 1962)
  • Lévi-Strauss, C. (1969). The Elementary Structures of Kinship (J. H. Bell, J. R. von Sturmer, & R. Needham, Trans., Revised ed.). Beacon Press. (Original work published 1949)
  • Propp, V. (1968). Morphology of the Folktale (L. Scott, Trans., 2nd ed.). University of Texas Press. (Original work published 1928)
  • Saussure, F. de. (1959). Course in General Linguistics (W. Baskin, Trans.). Philosophical Library. (Original work published 1916)
  • Todorov, T. (1977). The Poetics of Prose (R. Howard, Trans.). Cornell University Press. (Original work published 1971)

আরও কিছু সাধারণ সহায়ক গ্রন্থ:

  • Culler, J. D. (2002). Structuralist Poetics: Structuralism, Linguistics and the Study of Literature (25th Anniversary ed.). Routledge. (Original work published 1975)
  • Hawkes, T. (2003). Structuralism and Semiotics (2nd ed.). Routledge.
  • Kurzweil, E. (1980). The Age of Structuralism: Lévi-Strauss to Foucault. Columbia University Press.
  • Lane, M. (Ed.). (1970). Structuralism: A Reader. Jonathan Cape.
  • Scholes, R. (1974). Structuralism in Literature: An Introduction. Yale University Press.
  • Selden, R., Widdowson, P., & Brooker, P. (2005). A Reader’s Guide to Contemporary Literary Theory (5th ed.). Pearson Longman. (Chapters on structuralism and post-structuralism are particularly relevant).

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.