Table of Contents
ভূমিকা
আচ্ছা, আপনারা কি কখনো ভেবে দেখেছেন, একজন মানুষ ঠিক কতটা লিখতে পারে? ধরুন, দিনে দশ ঘণ্টা, বারো ঘণ্টা, কিংবা ধরুন সতেরো-আঠারো ঘণ্টা! তাও আবার একদিন-দু’দিন নয়, বছরের পর বছর। কফি নামক কালো তরলের সাগরে সাঁতার কেটে, বাস্তবতার রুক্ষ জমিনে দাঁড়িয়ে কল্পনার তুলিতে যিনি এঁকে গেছেন উনিশ শতকের গোটা ফরাসি সমাজকে, তিনিই অনোরে দ্য বালজ্যাক (Honoré de Balzac)। নামটা শুনলেই যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিশাল ভুঁড়ি, একমাথা ঝাঁকড়া চুল, আর অসম্ভব প্রতিভাদীপ্ত দুটো চোখ। ভদ্রলোক কেবল লেখক ছিলেন না, ছিলেন এক মহাকাব্যিক জীবনের নায়ক, যিনি কাগজের ওপর কালির আঁচড়ে তৈরি করেছিলেন এক সমান্তরাল জগৎ – ‘লা কমেডি উমেন’ (La Comédie humaine) বা ‘মানব নাট্যশালা’। এ এক এলাহি কারবার, যেন গোটা একটা শতাব্দীর মানুষের হাসি-কান্না, উত্থান-পতন, প্রেম-প্রতারণা সব ধরে রেখেছেন কালির আঁচড়ে।
আসুন, আজ আমরা সেই জগৎটাতেই একটু ভালো করে ঢুঁ মারি। তবে সাবধান, এ জগৎ বড় বিচিত্র, বড় জটিল, বড় নেশা ধরানো। এখানে ভালো আছে, মন্দ আছে, প্রেম আছে, প্রতারণা আছে, উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে, আর আছে টাকার খেলা – সে এক ভয়াবহ খেলা! বালজ্যাকের চরিত্ররা যেন আমাদেরই চেনা-জানা মানুষ, শুধু তাদের পরনে উনিশ শতকের পোশাক। তাদের লোভ, তাদের আকাঙ্ক্ষা, তাদের হৃদয়ের আর্তি – সবই যেন চিরকালীন।
যেভাবে শুরু
১৭৯৯ সালের ২০শে মে, ফরাসি বিপ্লবোত্তর এক অস্থির সময়ে, ফ্রান্সের তুর (Tours) শহরে বালজ্যাকের জন্ম। বাবা, বার্নার্ড-ফ্রাঁসোয়া বালসা (পরে ‘দ্য বালজ্যাক’ এই অভিজাত-ধাচের সংযোজনটি তিনি নিজেই করেছিলেন), ছিলেন কিছুটা সুবিধাবাদী মানুষ। নেপোলিয়নের সৈন্যদলের রসদ সরবরাহকারী হিসেবে কাজ করেছেন, পরে সরকারি দপ্তরেও চাকরি করেছেন। মা, অ্যান-শার্লত-লর সালমবিয়ে, ছিলেন প্যারিসের এক মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে, স্বামীর চেয়ে বয়সে প্রায় বত্রিশ বছরের ছোট। এই অসম বয়সী দাম্পত্য আর মায়ের শীতল ব্যবহার বালজ্যাকের শৈশবে এক গভীর শূন্যতা তৈরি করেছিল। অনেকেই বলেন, এই মাতৃস্নেহবঞ্চনাই তাঁকে পরবর্তী জীবনে বয়সে বড় নারীদের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল এবং তাঁর চরিত্রে একধরনের নিরাপত্তাহীনতাও তৈরি করেছিল (Robb, 1994)। বোর্ডিং স্কুলের নিঃসঙ্গ দিনগুলোতে বই-ই হয়ে উঠেছিল তাঁর একমাত্র বন্ধু। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইব্রেরিতে কাটিয়ে দিতেন, গিলতেন যা পেতেন হাতের কাছে। এখানেই হয়তো তাঁর ভবিষ্যতের ‘লা কমেডি উমেন’-এর বীজ বোনা হয়েছিল, কে জানে!
পড়াশোনা শেষে পরিবারের চাপে প্যারিসে এসে আইন নিয়ে কিছুদিন নাড়াচাড়া করলেন, কেরানির কাজও করলেন কিছুদিন। কিন্তু মন তাঁর পড়ে রইল সাহিত্যের মায়াবী জগতে। বাবা সাফ জানিয়ে দিলেন, সাহিত্য করে পেট চলবে না বাপু! এ তো আমাদের চিরচেনা মধ্যবিত্ত মানসিকতা, তাই না? কিন্তু বালজ্যাক ছিলেন হাড়হাভাতে গোঁয়ার। বাবার সাথে চুক্তি হলো, দু’বছর সময় দেওয়া হবে, এর মধ্যে যদি সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা না পান, তবে আবার আইনের শুকনো খাতাপত্রে মুখ গুঁজে থাকতে হবে। এই সময়টাতেই তিনি বেনামে একগাদা সস্তা প্রেমের উপন্যাস, গথিক নভেল (Gothic Novel), ঐতিহাসিক রোমাঞ্চকাহিনি লিখে হাত পাকালেন। এগুলোকে ঠিক উঁচু দরের সাহিত্য বলা চলে না, অনেকটা আজকালকার বাজারের চলতি রহস্য-রোমাঞ্চ সিরিজের মতো। কিন্তু এই লেখার মাধ্যমেই তিনি শিখেছিলেন কাহিনি ফাঁদতে, চরিত্র তৈরি করতে আর সবচেয়ে বড় কথা, দ্রুত লিখতে (Pritchett, 2002)। এ যেন তলোয়ার চালানোর আগে লাঠি ঘুরিয়ে হাত তৈরি করা। এই সময় তিনি প্রকাশনা ব্যবসায়ও নামলেন, কিন্তু সেখানেও বিরাট অঙ্কের লোকসান। ঋণের বোঝা তখন থেকেই তাঁর কাঁধে চেপে বসেছিল, যা তাঁকে আমৃত্যু তাড়া করে ফিরেছে।
‘লা কমেডি উমেন’: এক বিস্ময়কর নির্মাণ
আসল বালজ্যাককে আমরা চিনতে শুরু করি ১৮২৯ সালের পর থেকে, বিশেষ করে ‘লে শুয়াঁ’ (Les Chouans) বা ‘দ্য শুয়াঁ’ উপন্যাসের সাফল্যের পর। এই সময় থেকেই তিনি তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় প্রকল্প, ‘লা কমেডি উমেন’ (La Comédie humaine) রচনার পরিকল্পনা করেন। কী ছিল এই পরিকল্পনা? এর ব্যাপ্তি শুনলে মাথা ঘুরে যেতে পারে! তিনি চেয়েছিলেন দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি’র (Divine Comedy) আদলে উনিশ শতকের ফরাসি সমাজের একটি সামগ্রিক চিত্র এঁকে ফেলতে। তবে দান্তে যেখানে পরলোকের কথা বলেছেন, বালজ্যাক সেখানে ইহলোকের, আরও নির্দিষ্ট করে বললে তাঁর সমসাময়িক ফরাসি সমাজের প্রতিটি স্তর, প্রতিটি পেশা, প্রতিটি প্রবৃত্তির ব্যবচ্ছেদ করতে চেয়েছেন।
‘লা কমেডি উমেন’-এর বিশাল ক্যানভাসে রয়েছে প্রায় ৯১টি সমাপ্ত ও ৪৮টি অসমাপ্ত উপন্যাস, গল্প ও প্রবন্ধ। বালজ্যাক এটিকে তিনটি প্রধান স্তরে ভাগ করেছিলেন, যেন এক বিশাল অট্টালিকার বিভিন্ন তলা:
১. এত্যুদ দ্য ম্যর (Études de mœurs) বা রীতিনীতির পর্যবেক্ষণ (Studies of Manners): এটিই ছিল তাঁর প্রকল্পের হৃদপিণ্ড। এখানে তিনি ফরাসি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের জীবনযাত্রা, তাদের নৈতিকতা, অবক্ষয়, আশা-আকাঙ্ক্ষা, সবকিছুকে তুলে ধরেছেন। এর আবার ছয়টি উপবিভাগ ছিল, যেন সমাজের বিভিন্ন ঘরের ছবি:
- ব্যক্তিগত জীবনের দৃশ্য (Scènes de la vie privée): যেমন ‘পের গোরিও’ (Père Goriot)।
- প্রাদেশিক জীবনের দৃশ্য (Scènes de la vie de province): যেমন ‘ইউজেনি গ্রাঁদে’ (Eugénie Grandet), ‘হারানো স্বপ্ন’ (Illusions perdues)।
- প্যারিসের জীবনের দৃশ্য (Scènes de la vie parisienne): যেমন ‘লা কুজিন বেত’ (La Cousine Bette), ‘নুসিঙ্গেন হাউসের উত্থান’ (La Maison Nucingen)।
- রাজনৈতিক জীবনের দৃশ্য (Scènes de la vie politique): যেমন ‘উন তেনেব্রুজ আফেয়ার’ (Une ténébreuse affaire) বা ‘এক অন্ধকারময় কাহিনী’।
- সামরিক জীবনের দৃশ্য (Scènes de la vie militaire): যেমন ‘লে শুয়াঁ’ (Les Chouans)।
- গ্রামীণ জীবনের দৃশ্য (Scènes de la vie de campagne): যেমন ‘গ্রাম্য ডাক্তার’ (Le Médecin de campagne)। ভাবুন একবার, কী অসীম পরিধি!
২. এত্যুদ ফিলোসফিক (Études philosophiques) বা দার্শনিক পর্যবেক্ষণ (Philosophical Studies): এই অংশে তিনি জীবনের আরও গভীর, বিমূর্ত প্রশ্নগুলো নিয়ে কাজ করেছেন। মানুষের ইচ্ছাশক্তি, নিয়তি, আধ্যাত্মিকতা, সৃজনীশক্তির রহস্য – এসব ছিল তাঁর আগ্রহের বিষয়। ‘লা পো দ্য শ্যাগ্রাঁ’ (La Peau de chagrin) বা ‘দ্য ম্যাজিক স্কিন’, ‘ল্যুই লাঁবের’ (Louis Lambert), ‘সেরাফিতা’ (Séraphîta) এই ধারার বিখ্যাত কাজ। এখানে যেন তিনি সমাজের চামড়া ছাড়িয়ে আত্মার ভেতরে উঁকি মারতে চেয়েছেন।
৩. এত্যুদ আনালিতিক (Études analytiques) বা বিশ্লেষণাত্মক পর্যবেক্ষণ (Analytical Studies): এই অংশে তিনি সমাজ ও মানুষের আচরণের পেছনের মূলনীতিগুলো আরও তাত্ত্বিকভাবে বিশ্লেষণ করতে চেয়েছিলেন। এটি ছিল তাঁর প্রকল্পের সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী এবং সম্ভবত সবচেয়ে কম সম্পন্ন হওয়া অংশ। ‘ফিজিওলজি দু মারিয়াজ’ (Physiologie du mariage) বা ‘বিবাহের শারীরতত্ত্ব’ (The Physiology of Marriage) এর একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ।
বালজ্যাকের সবচেয়ে অসাধারণ কৌশল ছিল তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে পুনরাবৃত্ত (recurring characters) করানো। প্রায় দু’হাজারের বেশি চরিত্র তিনি তৈরি করেছিলেন, যাদের অনেকেই এক উপন্যাস থেকে অন্য উপন্যাসে অনায়াসে যাতায়াত করত। ইউজিন দ্য রাস্তিনঞাক (Eugène de Rastignac), ডাক্তার বিয়াঁশো (Horace Bianchon), ধুরন্ধর ভোত্রাঁ (Vautrin), ব্যাংকার নুসিঙ্গেন (Baron de Nucingen), কৃপণ গোবসেল (Gobseck) – এরা যেন ‘লা কমেডি উমেন’-এর বিশাল মঞ্চের মঞ্চের অভিনেতা-অভিনেত্রী। এই পদ্ধতির ফলে তাঁর সৃষ্ট জগৎটা একটা আশ্চর্যজনক বাস্তব সংহতি (coherence) লাভ করে। এক উপন্যাসের প্রধান চরিত্র অন্য উপন্যাসে হয়তো নিতান্তই পার্শ্বচরিত্র, আবার কোথাও বা তার নামটুকু শুধু উল্লেখ করা হয়েছে। এতে মনে হয়, আরে, এই লোকগুলো তো সত্যিই বেঁচে আছে, প্যারিসের অলিতে-গলিতে এদের সাথেই তো দেখা হয়ে যায়! (Lukács, 1964)। এ যেন এক সুবিশাল মানব চিড়িয়াখানা, যেখানে প্রতিটি প্রাণীই তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে জীবন্ত।
বালজ্যাকের মনোজগতে পূর্বসূরিদের ছায়া
কোনো বড় মাপের স্রষ্টাই শূন্য থেকে আসেন না। বালজ্যাকের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। তাঁর চিন্তাভাবনা ও শিল্পকর্মের ওপর বেশ কয়েকজন পূর্বসূরি ও সমসাময়িক চিন্তাবিদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
-
প্রকৃতিবিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের প্রভাব: বালজ্যাক নিজেকে কেবল ঔপন্যাসিক ভাবতেন না, ভাবতেন ‘সমাজের ঐতিহাসিক’ (historian of society) বা আরও বড় করে বললে, ‘সমাজের ডাক্তার’ (doctor of society)। তিনি সমসাময়িক প্রকৃতিবিজ্ঞানী জর্জেস ক্যুভিয়ে (Georges Cuvier) এবং এতিয়েন জফ্রোয়া সেঁত-হিলের (Étienne Geoffroy Saint-Hilaire) দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন। ক্যুভিয়ে প্রাণিজগৎকে বিভিন্ন প্রজাতিতে ভাগ করেছিলেন, আর সেঁত-হিলের ‘ঐক্য তত্ত্ব’ (theory of unity of composition) অনুযায়ী সকল প্রাণীর গঠনে একটি মৌলিক নকশা কাজ করে। বালজ্যাক এই ধারণা মানব সমাজেও প্রয়োগ করতে চাইলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, পরিবেশ (milieu) এবং সামাজিক চাপের ফলে মানুষও বিভিন্ন ‘সামাজিক প্রজাতি’তে (social species) বিভক্ত হয়ে যায় – সৈনিক, ব্যাংকার, শিল্পী, পুরোহিত, পতিতা, কৃপণ – প্রত্যেকেই যেন এক একটি স্বতন্ত্র প্রজাতি, যাদের আচার-আচরণ, চিন্তাভাবনা তাদের সামাজিক অবস্থান ও পেশা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত (Balzac, Avant-propos to La Comédie humaine, 1842)। এ যেন লিনিয়াসের প্রাণীজগতের শ্রেণিবিন্যাসের এক সামাজিক সংস্করণ!
-
মরমীবাদী চিন্তাধারা: বালজ্যাকের যুক্তিবাদী মনের আড়ালে একটি মরমীবাদী (mystical) প্রবণতাও ছিল। তিনি সুইডিশ মিস্টিক ইমানুয়েল সুইডেনবর্গ (Emanuel Swedenborg) এবং জার্মান চিকিৎসক ফ্রানৎস অ্যান্টন মেসমের (Franz Anton Mesmer)-এর ‘প্রাণী চুম্বকত্ব’ (animal magnetism) তত্ত্ব দ্বারা আকৃষ্ট হয়েছিলেন। সুইডেনবর্গের আধ্যাত্মিক জগৎ, স্বর্গ-মর্ত্যের যোগাযোগ, বিশেষ করে তাঁর ‘করেসপন্ডেন্স’ (correspondences) বা সাদৃশ্য তত্ত্ব, যেখানে জাগতিক বস্তুর সাথে আধ্যাত্মিক সত্যের মিল খোঁজা হয়, তা বালজ্যাকের ‘ল্যুই লাঁবের’ এবং ‘সেরাফিতা’র মতো উপন্যাসে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত। মেসমেরের ধারণা ছিল, মহাবিশ্বে এক অদৃশ্য তরল শক্তি (fluid) বা চুম্বকীয় শক্তি প্রবাহিত হচ্ছে যা মানুষের শরীর ও মনকে প্রভাবিত করতে পারে। বালজ্যাকের ‘ইচ্ছাশক্তি’ (willpower) এবং ‘প্রাণশক্তি’ (vital energy) সংক্রান্ত ধারণাগুলোর পেছনে এই চিন্তার ছায়া দেখা যায়। তিনি মনে করতেন, মানুষের চিন্তা ও আবেগ এক ধরনের তরল পদার্থের মতো, যা অন্যের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
-
সাহিত্যিক পূর্বসূরি: অবশ্যই, বালজ্যাক পূর্ববর্তী সাহিত্যিকদের দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছিলেন। জাঁ-জাক রুশো (Jean-Jacques Rousseau)-র প্রকৃতিবাদ ও আবেগপ্রবণতা, ভলতেয়ার (Voltaire)-এর সমাজ সচেতনতা ও শ্লেষ, এমনকি গ্যেটে (Goethe)-র মতো মহীরুহদের কাজও তিনি পাঠ করেছিলেন। তবে তাঁর উপন্যাসের গঠন ও সমাজের সমগ্র চিত্র আঁকার প্রচেষ্টায় ওয়াল্টার স্কট (Walter Scott)-এর ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলোর প্রভাব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। স্কট যেমন স্কটল্যান্ডের অতীতকে উপন্যাসের মাধ্যমে জীবন্ত করেছিলেন, বালজ্যাকও তেমনি সমসাময়িক ফ্রান্সকে জীবন্ত করতে চেয়েছিলেন (Bellos, 1987)।
এইসব বিভিন্নমুখী প্রভাব আত্মস্থ করে বালজ্যাক নিজস্ব এক স্বতন্ত্র পথে হেঁটেছিলেন। তিনি অন্যের থেকে উপাদান নিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু সেগুলোকে নিজের প্রতিভার উত্তাপে গলিয়ে নতুন এক শিল্পরূপ দিয়েছেন।
টাকা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর সমাজের চালচিত্র
বালজ্যাকের সাহিত্য পড়লে একটা জিনিস খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে – তাঁর সময়ে ফরাসি সমাজে টাকার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। ফরাসি বিপ্লব পুরনো অভিজাততন্ত্রের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু নেপোলিয়নের পতন এবং পরবর্তী বুরবোঁ পুনঃপ্রতিষ্ঠা (Bourbon Restoration) ও জুলাই রাজতন্ত্রের (July Monarchy) যুগে এক নতুন শক্তি প্রবল হয়ে উঠেছিল – তা হলো অর্থ। বুর্জোয়া (bourgeoisie) বা বিত্তশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণি তখন সমাজের নিয়ন্তা। বালজ্যাক তাঁর লেখায় এই টাকার খেলাটা খুব নির্মমভাবে দেখিয়েছেন। তাঁর চরিত্ররা টাকার জন্য সবকিছু করতে পারে – ভালোবাসা বিক্রি করতে, আত্মসম্মান বিসর্জন দিতে, বন্ধুকে ঠকাতে, এমনকি অপরাধ করতেও দ্বিধা করে না।
‘পের গোরিও’ (Père Goriot) উপন্যাসের কথাই ধরুন। বৃদ্ধ গোরিও তাঁর দুই মেয়ের বিলাসবহুল জীবন নিশ্চিত করতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যান। মেয়েরা সমাজের উঁচু মহলে বিয়ে করে নিজেদের আভিজাত্য বজায় রাখে, কিন্তু বাবাকে দেখে না। গোরিও যখন মৃত্যুপথযাত্রী, তখনও তাঁর মেয়েরা আসে না – কারণ? কারণ, বাবার আর দেওয়ার মতো টাকা ছিল না। এই উপন্যাসে রাস্তিনঞাক যখন দেখে যে সমাজের উঁচু মহলে উঠতে গেলে নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিতে হয়, তখন সে প্যারিসের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, “এবার আমাদের দুজনের লড়াই!” (Balzac, Père Goriot)। এই একটি বাক্যেই যেন উনিশ শতকের প্যারিসের তরুণদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর নৈতিক সংকটের ছবিটা ফুটে ওঠে।
‘ইউজেনি গ্রাঁদে’ (Eugénie Grandet) উপন্যাসে আমরা দেখি কৃপণ বৃদ্ধ গ্রাঁদের অর্থলালসার শিকার হয় তাঁর একমাত্র কন্যা ইউজেনি। সোনার মোহরের ঝনঝনানিই যেন গ্রাঁদের জীবনের একমাত্র সঙ্গীত। ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা – এই মানবিক অনুভূতিগুলো সেখানে তুচ্ছ। আবার ‘লা কুজিন বেত’ (La Cousine Bette) বা ‘হারানো স্বপ্ন’ (Illusions perdues) এর মতো উপন্যাসগুলোতে মানুষের ভেতরের ঈর্ষা, লোভ, প্রতিশোধস্পৃহা আর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব অত্যন্ত দক্ষতার সাথে চিত্রিত হয়েছে। লুসিয়েন দ্য রুবামপ্রে নামক তরুণ কবির উত্থান-পতনের কাহিনি ‘হারানো স্বপ্ন’কে করে তুলেছে উচ্চাকাঙ্ক্ষার বিষাদগাথা (tragedy of ambition)-এর এক অসাধারণ দলিল। বালজ্যাক দেখিয়েছেন, প্যারিস শহরটা যেন এক মায়াবী রাক্ষসী, যে তরুণদের স্বপ্ন দেখায়, খ্যাতির শীর্ষে তোলার লোভ দেখায়, আবার সেই স্বপ্নকে নির্মমভাবে পিষে মারতেও দ্বিধা করে না। তাঁর চোখে, টাকা কেবল বিনিময়ের মাধ্যম ছিল না, টাকা ছিল ক্ষমতার প্রতীক, সামাজিক মর্যাদার মাপকাঠি, এবং প্রায়শই নৈতিক অবক্ষয়ের মূল কারণ।
উনিশ শতকের ফ্রান্স: রাজনীতির উত্তাল তরঙ্গ ও বালজ্যাক
বালজ্যাকের জীবন ও সাহিত্য উনিশ শতকের ফ্রান্সের রাজনৈতিক পটভূমি থেকে অবিচ্ছেদ্য। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব, নেপোলিয়নের উত্থান ও পতন (১৮১৫), বুরবোঁ রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা (১৮১৫-১৮৩০), ১৮৩০ সালের জুলাই বিপ্লব এবং তার ফলস্বরূপ লুই-ফিলিপের ‘বুর্জোয়া রাজতন্ত্র’ (July Monarchy, ১৮৩০-১৮৪৮) – এই উত্তাল সময়প্রবাহের মধ্য দিয়েই বালজ্যাক তাঁর ‘লা কমেডি উমেন’ রচনা করেছিলেন।
ব্যক্তিগতভাবে বালজ্যাক নিজেকে রাজতন্ত্রী (legitimist) এবং ক্যাথলিক (Catholic) বলে দাবি করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র এবং ধর্মের অনুশাসনই সমাজের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পারে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, তাঁর লেখায় এই ঘোষিত রাজনৈতিক অবস্থানের প্রতিফলন খুব একটা দেখা যায় না। বরং, তিনি একজন নির্মোহ পর্যবেক্ষকের মতো বুর্জোয়া শ্রেণির অপ্রতিরোধ্য উত্থান, অভিজাত শ্রেণির ক্ষয়িষ্ণুতা এবং সর্বোপরি অর্থের ক্রমবর্ধমান শক্তিকে তুলে ধরেছেন। কার্ল মার্কসের বন্ধু ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস (Friedrich Engels) একবার লিখেছিলেন যে, বালজ্যাকের লেখা থেকে তিনি ফরাসি সমাজ সম্পর্কে যা শিখেছেন, তা তৎকালীন সকল অর্থনীতিবিদ, ইতিহাসবিদ ও পরিসংখ্যানবিদের সম্মিলিত জ্ঞান থেকেও বেশি, যদিও বালজ্যাক নিজে ছিলেন একজন কট্টর রাজতন্ত্রী (Engels, Letter to Margaret Harkness, April 1888, cited in Prawer, 1976)। এ থেকেই বোঝা যায়, শিল্পী বালজ্যাক তাঁর রাজনৈতিক বালজ্যাকের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ও সৎ ছিলেন।
তাঁর উপন্যাসগুলোতে রাজনৈতিক ঘটনাবলির প্রত্যক্ষ উল্লেখ হয়তো খুব বেশি নেই, কিন্তু সেই সময়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনগুলো তাঁর চরিত্রদের জীবন, তাদের আকাঙ্ক্ষা, তাদের নৈতিকতাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। যেমন, ‘লে শুয়াঁ’ উপন্যাসে ফরাসি বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে রাজতন্ত্রী বিদ্রোহীদের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। ‘উন তেনেব্রুজ আফেয়ার’-এ নেপোলিয়নীয় আমলের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের ছবি ফুটে উঠেছে। আবার, জুলাই রাজতন্ত্রের অধীনে বুর্জোয়াদের প্রাধান্য বিস্তারের ফলে যে সামাজিক গতিশীলতা (social mobility) এবং একই সাথে নৈতিক শিথিলতা দেখা দিয়েছিল, তার নিখুঁত চিত্র আমরা পাই ‘পের গোরিও’ বা ‘হারানো স্বপ্ন’-এর মতো উপন্যাসগুলোতে। রাস্তিনঞাকের মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষী তরুণেরা বুঝতে পারে যে পুরনো অভিজাত বংশমর্যাদার চেয়ে নতুন অর্জিত অর্থ ও প্রতিপত্তিই এখন সমাজে এগিয়ে যাওয়ার চাবিকাঠি। বালজ্যাক দেখিয়েছেন, এই পরিবর্তনের যুগে কীভাবে পুরনো মূল্যবোধগুলো ভেঙে পড়ছে আর নতুন, অর্থকেন্দ্রিক এক ব্যবস্থা তার জায়গা নিচ্ছে। তাঁর লেখায় আমরা পাই সেসময়ের রাজনৈতিক বিতর্ক, শ্রেণি-সংঘাত এবং ক্ষমতার পালাবদলের এক বিশ্বস্ত প্রতিচ্ছবি।
বাস্তবতাবাদ ও বালজ্যাকের দর্শন
বালজ্যাককে সাহিত্যের বাস্তবতাবাদ (Realism) নামক ধারাটির অন্যতম প্রধান স্থপতি হিসেবে গণ্য করা হয়। এই বাস্তবতাবাদের মানে কী? এর মানে হলো, সাহিত্য হবে জীবনের দর্পণ। লেখক সেখানে কোনো রঙ চড়াবেন না, কোনো আদর্শের চশমা দিয়ে জগৎকে দেখবেন না। তিনি যা দেখবেন, যা অনুভব করবেন, তাই তুলে ধরবেন – তার ভালো-মন্দ, সুন্দর-কুৎসিত সবটা নিয়েই। অনেকটা চিত্রশিল্পীর বদলে একজন ফটোগ্রাফারের মতো। বালজ্যাক ঠিক এই কাজটিই করেছিলেন। তাঁর চরিত্ররা রক্তমাংসের মানুষ, তাদের দোষ আছে, গুণ আছে, তারা ভুল করে, তারা ভালোবাসে, তারা ঘৃণা করে। তারা কেউ দেবদূত নয়, আবার কেউ নিছক শয়তানও নয়।
তবে বালজ্যাক নিছক একজন ফটোগ্রাফার ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন ‘সমাজ বিজ্ঞানীও’ (social scientist)। তিনি বিশ্বাস করতেন, পরিবেশ (milieu) এবং সামাজিক পরিস্থিতি মানুষের চরিত্র ও ভাগ্যকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। এইজন্যই তিনি তাঁর উপন্যাসে এত খুঁটিনাটি বর্ণনা দিতেন – ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র, পোশাক-পরিচ্ছদ, রাস্তাঘাট – সবকিছু। এই বর্ণনাগুলো শুধু দৃশ্যমান জগৎ তৈরি করত না, বরং চরিত্রগুলোর মনস্তত্ত্ব, তাদের সামাজিক অবস্থান এবং তাদের সম্ভাব্য নিয়তি সম্পর্কেও ইঙ্গিত দিত। এই পদ্ধতিকে অনেকে ‘পরিবেশগত নিয়তিবাদ’ (environmental determinism) বলে থাকেন (Auerbach, 1953)। তাঁর বিখ্যাত উক্তি, “Tell me what you possess, and I will tell you what you think” (আমাকে বলো তোমার কী আছে, আর আমি বলে দেব তুমি কী ভাবো), এই দর্শনেরই প্রতিধ্বনি।
তাঁর দর্শনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ‘ইচ্ছাশক্তি’ (willpower) এবং ‘প্রাণশক্তি’ (vital energy)-র ধারণা। তিনি মনে করতেন, প্রতিটি মানুষের মধ্যে এক সীমিত পরিমাণ প্রাণশক্তি বা ইচ্ছাশক্তি রয়েছে। এই শক্তি যখন কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে প্রবলভাবে চালিত হয়, তখন তা অসাধারণ কাজ করতে পারে, কিন্তু একই সাথে তা দ্রুত নিঃশেষিতও হয়ে যায়। ‘লা পো দ্য শ্যাগ্রাঁ’ (The Magic Skin) বা ‘দুঃখের চামড়া’ উপন্যাসে এই ধারণাটি রূপক আকারে এসেছে। উপন্যাসের নায়ক রাফায়েল একটি জাদুর চামড়া পায়, যা তার সব ইচ্ছা পূরণ করে, কিন্তু প্রতিটি ইচ্ছাপূরণের সাথে সাথে চামড়াটি সঙ্কুচিত হতে থাকে এবং সেই সাথে রাফায়েলের আয়ুও কমতে থাকে। চামড়াটি এখানে মানুষের প্রাণশক্তির প্রতীক। বালজ্যাক যেন বলতে চেয়েছেন, জীবনের প্রতিটি আনন্দ, প্রতিটি উচ্চাকাঙ্ক্ষা, প্রতিটি তীব্র আবেগ আমাদের প্রাণশক্তি ক্ষয় করে। তাই, সংযম এবং পরিমিতিবোধই দীর্ঘ ও সুস্থ জীবনের চাবিকাঠি। যদিও বালজ্যাক নিজে এই দর্শন কতটা মানতেন, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে!
‘সারাসিন’: শিল্পের ধাঁধা ও নিষিদ্ধ কামনার প্রতিধ্বনি
বালজ্যাকের বিশাল সাহিত্যসম্ভারের মধ্যে ‘সারাসিন’ (Sarrasine) নামক নভেলা বা ছোট উপন্যাসটি একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে, বিশেষ করে আধুনিক সাহিত্য সমালোচনায়, এবং তার অন্যতম কারণ ফরাসি দার্শনিক ও সমালোচক রোলঁ বার্থ (Roland Barthes)-এর বিখ্যাত বিশ্লেষণধর্মী গ্রন্থ ‘এস/জেড’ (S/Z) (Barthes, 1974)। গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৩০ সালে। আপাতদৃষ্টিতে এটি এক শিল্পীর ট্র্যাজিক প্রেমের কাহিনি মনে হলেও, এর পরতে পরতে লুকিয়ে আছে শিল্প, বাস্তবতা, ভ্রম (illusion), লিঙ্গ পরিচয় (gender identity) এবং তৎকালীন সমাজের যৌনতা বিষয়ক ভীতি ও ভণ্ডামির জটিল প্রশ্ন।
গল্পের কথক এক পার্টিতে রহস্যময়ী মাদাম দ্য রোশফিদকে একটি অদ্ভুত ভাস্কর্যের পেছনের কাহিনি শোনাচ্ছেন। ভাস্কর্যটি অ্যাদোনিসের (Adonis), কিন্তু তার মডেলে ছিল এক বৃদ্ধ, যার নামও সারাসিন। এই বৃদ্ধ লোকটি আসলে কে, সেই রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে কথক আমাদের নিয়ে যান অষ্টাদশ শতকের রোমে। তরুণ ফরাসি ভাস্কর আর্নেস্ট-জিন সারাসিন (Ernest-Jean Sarrasine) ছিলেন একরোখা, আবেগপ্রবণ এবং প্রতিভাবান। সে রোমে গিয়ে অপেরা গায়িকা লা জাম্বিনেল্লা (La Zambinella)-র গান শুনে ও রূপ দেখে তার প্রেমে উন্মত্ত হয়ে যায়। জাম্বিনেল্লাকে সে নারীত্বের নিখুঁত প্রতিমূর্তি হিসেবে কল্পনা করে এবং তার একটি মূর্তি তৈরি করতে শুরু করে। সারাসিন বিশ্বাস করতেন, জাম্বিনেল্লাই তার জীবনের পরম কাঙ্ক্ষিত নারী।
কিন্তু কাহিনির মোড় ঘুরে যায় যখন সারাসিন ভয়ঙ্কর সত্যটি জানতে পারে। জাম্বিনেল্লা আসলে কোনো নারী নয়, সে একজন কাস্ত্রাতো (castrato) – অর্থাৎ, শৈশবে তাকে নপুংসক করা হয়েছিল যাতে তার কণ্ঠস্বর নারীর মতো মিষ্টি ও সুরেলা থাকে। তৎকালীন ইউরোপে, বিশেষ করে ইতালিতে, অপেরার জন্য কাস্ত্রাতো গায়কদের বেশ কদর ছিল। এই সত্য জানার পর সারাসিনের জগৎ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। তার ভালোবাসা ঘৃণায় পরিণত হয়, তার শিল্পকর্ম তার কাছে অর্থহীন মনে হয়। সে জাম্বিনেল্লাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়, কিন্তু তার আগেই কার্ডিনালের অনুচরদের হাতে সে নিহত হয়। আর সেই বৃদ্ধ, পার্টিতে উপস্থিত জাম্বিনেল্লা, এই ঘটনার বহু বছর পরের স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে।
‘সারাসিন’ কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
১. শিল্প ও বাস্তবতা (Art and Reality): বালজ্যাক এখানে শিল্পের প্রকৃতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সারাসিন জাম্বিনেল্লার বাহ্যিক রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে আদর্শায়িত (idealize) করেছিল। তার শিল্প ছিল সেই আদর্শ রূপেরই প্রতিফলন। কিন্তু যখন সে বাস্তবতার মুখোমুখি হলো, তখন তার শিল্প আর আদর্শ দুটোই ভেঙে পড়ল। শিল্প কি বাস্তবতার হুবহু অনুকরণ, নাকি শিল্পীর কল্পনার সৃষ্টি? বালজ্যাক যেন বলতে চান, শিল্পের মূলে আছে এক ধরনের ভ্রম বা মায়া।
২. লিঙ্গ ও যৌনতার জটিলতা (Complexity of Gender and Sexuality): জাম্বিনেল্লার চরিত্রটি তৎকালীন সমাজের লিঙ্গ বিষয়ক ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে। সে দেখতে নারীর মতো, তার কণ্ঠস্বর নারীর মতো, কিন্তু শারীরিকভাবে সে পুরুষও নয়, নারীও নয়। সারাসিনের কাছে এটা ছিল এক ভয়ঙ্কর প্রতারণা। বালজ্যাক এখানে দেখিয়েছেন, কীভাবে সমাজের তৈরি করা লিঙ্গীয় বাইনারি (gender binary) ভেঙে গেলে তা মানুষের মনে আতঙ্ক ও বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে। কাস্ত্রাতো প্রথাটিই ছিল এক নির্মম বাস্তবতা, যেখানে শিল্পের নামে পুরুষের শরীরকে বিকৃত করা হতো।
৩. অর্থ ও শোষণ (Money and Exploitation): জাম্বিনেল্লার সম্পদ ও সামাজিক প্রতিষ্ঠা এসেছিল তার এই বিকৃত শরীর ও শৈল্পিক প্রতিভার বিনিময়ে। তার সৌন্দর্য ও কণ্ঠস্বর ছিল বিক্রয়যোগ্য পণ্য। এখানেও বালজ্যাক টাকার সর্বগ্রাসী ক্ষমতার দিকটি তুলে ধরেছেন।
৪. রোলঁ বার্থ-এর বিশ্লেষণ: বার্থ তাঁর ‘এস/জেড’ গ্রন্থে ‘সারাসিন’কে ব্যবচ্ছেদ করে দেখিয়েছেন কীভাবে এই ছোট গল্পটি অর্থের বহুস্তরীয় জাল (polysemy) তৈরি করে। তিনি পাঁচটি কোড (code) – হারমেনিউটিক (hermeneutic; রহস্য বা প্রশ্ন উত্থাপন ও সমাধানের কোড), প্রোএরেটিক (proairetic; ঘটনা বা অ্যাকশনের কোড), সেমিক (semic; চরিত্রের বৈশিষ্ট্যসূচক কোড), সিম্বলিক (symbolic; প্রতীকী অর্থের কোড, যেমন এখানে কাস্ট্রেশন বা লিঙ্গহীনতা) এবং কালচারাল (cultural; সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জ্ঞানের কোড) – ব্যবহার করে দেখিয়েছেন যে, এই আপাত সরল গল্পটি আসলে অত্যন্ত জটিল এবং এর কোনো একক, নির্দিষ্ট অর্থ নেই। বার্থ-এর মতে, ‘কাস্ট্রেশন’ বা লিঙ্গকর্তন এই গল্পের কেন্দ্রীয় রূপক, যা কেবল শারীরিক নয়, বরং প্রতীকী অর্থেও গুরুত্বপূর্ণ – যেমন, অর্থের অভাব, সৃজনশীলতার সংকট, পরিচয়ের অনিশ্চয়তা ইত্যাদি।
‘সারাসিন’ বালজ্যাকের অন্যান্য অনেক কাজের তুলনায় ভিন্নধর্মী, কিন্তু এটি তাঁর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা এবং মানব মনস্তত্ত্বের গভীর উপলব্ধির এক উজ্জ্বল নিদর্শন। এই গল্প আমাদের ভাবতে বাধ্য করে শিল্প, সমাজ এবং আমাদের নিজেদের সম্পর্কে।
বালজ্যাকের লিখনশৈলী
বালজ্যাকের লেখার ধরনটিও ছিল তাঁর মতোই বিশাল ও বর্ণাঢ্য। আগেই বলেছি, তিনি খুঁটিনাটি বর্ণনার (detailed description) ওপর খুব জোর দিতেন। তাঁর উপন্যাসের শুরুতেই প্রায়শই দেখা যায় দীর্ঘ, পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা – কোনো শহরের রাস্তাঘাট, কোনো বাড়ির অন্দরমহল, আসবাবপত্রের নকশা, জানালার পর্দার রঙ, এমনকি বাতাসে ভেসে আসা গন্ধ পর্যন্ত। অনেকের কাছে এটা প্রথমদিকে একটু একঘেয়ে বা ক্লান্তিকর লাগতে পারে, যেন মূল কাহিনি শুরু হতে বড্ড দেরি হচ্ছে। কিন্তু এই বর্ণনাগুলো মোটেই অপ্রয়োজনীয় নয়। এগুলো চরিত্র ও ঘটনার প্রেক্ষাপট (context) তৈরিতে অসাধারণ ভূমিকা রাখে। এই পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা পাঠকদের যেন সেই সময়ের সেই পরিবেশে হাত ধরে নিয়ে যায়, চরিত্রগুলোকে তাদের সঠিক সামাজিক অবস্থানে স্থাপন করে। তাঁর এই কৌশলকে ভিস্যুয়াল রিয়ালিজম (visual realism) বলা যেতে পারে।
তাঁর চরিত্র চিত্রণও ছিল অনবদ্য। তিনি কেবল বাহ্যিক বর্ণনা দিয়েই ক্ষান্ত হতেন না, চরিত্রের মনের গভীরে ডুব দিয়ে তার চিন্তা-ভাবনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভয়-ভীতি, গোপন বাসনা – সবকিছু তুলে ধরতেন। তাঁর চরিত্রগুলো প্রায়শই কোনো না কোনো তীব্র আবেগ বা নেশা (obsession) দ্বারা চালিত হয় – যেমন, গোরিওর অন্ধ কন্যাস্নেহ, গ্রাঁদের রোগগ্রস্ত (pathological) কৃপণতা, রাস্তিনঞাকের আকাশছোঁয়া উচ্চাকাঙ্ক্ষা, বা ব্যারন হুলো’র (Baron Hulot in La Cousine Bette) দুর্দমনীয় কামাসক্তি। এই এককেন্দ্রিকতা (monomania) চরিত্রগুলোকে একদিকে যেমন জীবন্ত ও স্মরণীয় করে তোলে, অন্যদিকে তাদের পতনেরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ যেন গ্রিক ট্র্যাজেডির নায়কদের মতো, যাদের কোনো একটি চারিত্রিক ত্রুটিই (hamartia) তাদের ধ্বংস ডেকে আনে।
বালজ্যাকের গদ্য অনেক সময় দীর্ঘ ও জটিল বাক্যবিন্যাসে ভরা, কিন্তু একই সাথে তা শক্তিশালী, প্রাণবন্ত ও ব্যঞ্জনাময়। তিনি প্রায়শই সর্বজ্ঞ বর্ণনাকারী (omniscient narrator) হিসেবে আবির্ভূত হন, যিনি কেবল গল্পের ঘটনাপ্রবাহই নিয়ন্ত্রণ করেন না, বরং চরিত্রদের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করেন, তাদের কাজের পেছনে থাকা সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণগুলো ব্যাখ্যা করেন, এবং সমাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে নিজস্ব মন্তব্যও জুড়ে দেন। তাঁর রচনায় নাটকীয়তা (dramatic tension), রহস্য (suspense) এবং আকস্মিক মোড় (sudden twists) পাঠকদের আগ্রহ ধরে রাখে। তিনি জানতেন কীভাবে গল্প বলতে হয়, কীভাবে পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে হয়।
কর্মবীর বালজ্যাক: এক অবিশ্বাস্য জীবন
বালজ্যাকের ব্যক্তিগত জীবনটাও ছিল তাঁর উপন্যাসের মতোই নাটকীয়, বিশৃঙ্খল এবং ঘটনায় ভরা। তিনি ছিলেন এক অবিশ্বাস্য কর্মবীর। ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে, প্রকাশকদের তাগাদায়, তিনি দিনের পর দিন, রাতের পর রাত জেগে লিখতেন। কথিত আছে, তিনি মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠতেন, সাদা ডমিনিকান সন্ন্যাসীর মতো একটি আলখাল্লা পরতেন এবং ভোরের আলো ফোটা পর্যন্ত একটানা লিখে যেতেন। আর এই লেখার জ্বালানি হিসেবে চলত কফি, কড়া কালো কফি – দিনে পঞ্চাশ কাপেরও বেশি! (Maurois, 1965)। ভাবা যায়, কী অমানুষিক পরিশ্রম! এই জীবনযাত্রার ফলস্বরূপ তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছিল, কিন্তু লেখার নেশা তাঁকে ছাড়েনি।
এত লেখার পেছনে একটা বড় কারণ ছিল তাঁর পাহাড়প্রমাণ ঋণ। তিনি বারবার বিভিন্ন ব্যবসায় হাত দিয়ে (যেমন, ছাপাখানা, রূপার খনি) হাত দিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন, বিলাসবহুল জীবনযাপনের চেষ্টা করেছেন, দুষ্প্রাপ্য শিল্পকর্ম সংগ্রহ করেছেন – ফলে ঋণের বোঝা তাঁর কাঁধে চেপে বসেছিল জগদ্দল পাথরের মতো। এই ঋণ শোধ করার জন্যই তাঁকে এত বেশি লিখতে হয়েছে। অনেকটা যেন নিজের তৈরি করা ফাঁদেই তিনি আটকে পড়েছিলেন।
কিন্তু কেবল টাকার জন্য লিখেছেন বললে তাঁর সৃজনীশক্তির প্রতি অবিচার করা হবে। তাঁর ভেতরে ছিল এক দুর্দমনীয় সৃজনী তাড়না (creative urge) আর খ্যাতি ও অমরত্বের এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা। তিনি নেপোলিয়নের সাথে নিজেকে তুলনা করতেন; নেপোলিয়ন তরবারি দিয়ে যা জয় করেছিলেন, বালজ্যাক তা কলম দিয়ে জয় করতে চেয়েছিলেন। এবং বলা বাহুল্য, সাহিত্যজগতে তিনি এক বিশাল সাম্রাজ্যই প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।
তাঁর জীবনে প্রেমেরও অভাব ছিল না, যদিও সেই প্রেমগুলো প্রায়শই ছিল জটিল ও ঝঞ্ঝাময়। বিভিন্ন নারীর সাথে তাঁর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, যাদের মধ্যে মাদাম দ্য বের্নি (Madame de Berny) এবং কাউন্টেস ইভলিনা হানস্কা (Countess Ewelina Hańska) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মাদাম দ্য বের্নি ছিলেন তাঁর চেয়ে বাইশ বছরের বড়, অনেকটা মায়ের মতো স্নেহশীলা, আবার একই সাথে প্রেমিকা ও সাহিত্যিক পরামর্শদাত্রী। তিনি বালজ্যাকের সাহিত্যিক প্রতিভাকে শুরুতেই চিনতে পেরেছিলেন এবং তাঁকে নানাভাবে উৎসাহিত করেছিলেন। আর পোলিশ কাউন্টেস ইভলিনা হানস্কার সাথে তাঁর দীর্ঘ আঠারো বছরের পত্রালাপ এবং অধীর প্রতীক্ষার পর মিলন ছিল কিংবদন্তিতুল্য। হানস্কা ছিলেন বিবাহিতা, এবং তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পরই কেবল বালজ্যাকের সাথে তাঁর মিলনের পথ প্রশস্ত হয়। জীবনের একেবারে শেষদিকে, মৃত্যুর মাত্র পাঁচ মাস আগে, ১৮৫০ সালের মার্চ মাসে, বালজ্যাক অবশেষে ইভলিনা হানস্কাকে বিয়ে করেন। কিন্তু সেই বহুকাঙ্ক্ষিত সুখ তাঁর বেশিদিন সইল না। ১৮৫০ সালের ১৮ই আগস্ট, মাত্র ৫১ বছর বয়সে, প্যারিসে এই মহান সাহিত্যিক মৃত্যুবরণ করেন। অতিরিক্ত পরিশ্রম, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, কফির নেশা আর ঋণের দুঃসহ চাপ হয়তো তাঁর অকালমৃত্যুর জন্য বহুলাংশে দায়ী ছিল। তাঁর শেষকৃত্যে ভিক্টর হুগো (Victor Hugo) যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তা আজও ফরাসি সাহিত্যের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে।
উত্তরাধিকার ও প্রভাব
বালজ্যাক মারা গেছেন দেড় শতাব্দীরও বেশি আগে, কিন্তু ফরাসি তথা বিশ্বসাহিত্যে তাঁর আসন আজও অটল। তিনি কেবল উনিশ শতকের ফরাসি সমাজের এক নিখুঁত দর্পণ ছিলেন না, তিনি ছিলেন মানব প্রকৃতির এক নিপুণ রূপকার, যাঁর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। তাঁর সৃষ্ট চরিত্র আর সামাজিক বিশ্লেষণ আজও আমাদের সমাজ ও নিজেদের বুঝতে সাহায্য করে।
পরবর্তী প্রজন্মের বহু লেখক বালজ্যাকের দ্বারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। গুস্তাভ ফ্লবেয়ার (Gustave Flaubert) তাঁর বাস্তবতাবাদকে আরও পরিশীলিত ও নৈর্ব্যক্তিক (impersonal) রূপ দিয়েছিলেন। এমিল জোলা (Émile Zola) তাঁর ‘লে রুগোঁ-মাকার’ (Les Rougon-Macquart) নামক উপন্যাস সিরিজটি বালজ্যাকের ‘লা কমেডি উমেন’-এর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই রচনা করেছিলেন, যেখানে তিনি বংশগতি (heredity) ও পরিবেশের প্রভাবকে আরও প্রকটভাবে দেখিয়েছেন। এমনকি ফিওদর দস্তয়েভস্কি (Fyodor Dostoevsky)-র মতো রুশ সাহিত্যিকও বালজ্যাকের গুণমুগ্ধ ছিলেন; তিনি ‘ইউজেনি গ্রাঁদে’ রুশ ভাষায় অনুবাদও করেছিলেন। ইংল্যান্ডে চার্লস ডিকেন্স (Charles Dickens) এবং জর্জ এলিয়ট (George Eliot)-এর মতো লেখকদের সমাজ-সচেতন উপন্যাসেও বালজ্যাকীয় বাস্তবতাবাদের ছায়া খুঁজে পাওয়া যায়। হেনরি জেমস (Henry James) তাঁকে ‘The father of us all’ বলে অভিহিত করেছেন (James, The Future of the Novel, 1899)।
তাঁর প্রভাব কেবল সাহিত্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। সমাজতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক, এমনকি দার্শনিকরাও তাঁর কাজ থেকে প্রেরণা পেয়েছেন। আগেই যেমন উল্লেখ করা হয়েছে, কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস তাঁর লেখায় বুর্জোয়া সমাজের বিকাশের এক জীবন্ত চিত্র খুঁজে পেয়েছিলেন। বালজ্যাকের ‘লা কমেডি উমেন’ যেন এক অফুরন্ত খনি, যেখান থেকে আজও নতুন নতুন অর্থ ও তাৎপর্য আহরণ করা সম্ভব।
আজকের দিনে যখন আমরা ভোগবাদ (consumerism), সামাজিক অসমতা (social inequality), লাগামহীন উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর পুঁজির সর্বগ্রাসী ক্ষমতা নিয়ে কথা বলি, তখন বালজ্যাকের কথা মনে না করে উপায় থাকে না। তাঁর সৃষ্ট জগৎ, তাঁর চরিত্ররা, তাদের সংকট – সবকিছুই যেন আশ্চর্যরকমভাবে সমকালীন। এইখানেই বালজ্যাকের চিরস্থায়ী আবেদন।
শেষের কথা
তাহলে, বালজ্যাককে পড়া কি খুব কঠিন? হ্যাঁ, তাঁর লেখার বিশাল ব্যপ্তি, তাঁর খুঁটিনাটি বর্ণনা, তাঁর জটিল বাক্যবিন্যাস – এসব অনেক সময় সাধারণ পাঠকের ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিতে পারে। অনেকটা যেন এক বিশাল জাদুঘরে ঢোকার মতো, যেখানে অসংখ্য দ্রষ্টব্য জিনিস, প্রতিটিই তার নিজস্ব গল্প নিয়ে দাঁড়িয়ে। কিন্তু একবার যদি সেই জাদুঘরের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করা যায়, একবার যদি তাঁর সৃষ্ট চরিত্রদের সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে, তাহলে এক নতুন, বিস্ময়কর জগৎ উন্মোচিত হয়। আপনি যদি মানুষকে ভালোবাসেন, সমাজকে বুঝতে চান, আর জীবনের জটিল সমীকরণগুলো নিয়ে ভাবতে পছন্দ করেন, তাহলে বালজ্যাক আপনার জন্য এক অবশ্যপাঠ্য লেখক।
ভদ্রলোক হয়তো ব্যক্তিগত জীবনে অনেক ভুল করেছেন, ঋণের দায়ে জর্জরিত ছিলেন, খানিকটা আত্মম্ভরীও ছিলেন হয়তো। কিন্তু সাহিত্যের প্রতি তাঁর সততা, তাঁর নিষ্ঠা আর তাঁর অসীম সৃজনীশক্তি ছিল প্রশ্নাতীত। তিনি যা দেখেছেন, যা অনুভব করেছেন, তাই লিখেছেন – নির্ভীকভাবে, আপোষহীনভাবে, কল্পনার রঙে বাস্তবকে রাঙিয়ে। এই কারণেই অনোরে দ্য বালজ্যাক কেবল একজন ঔপন্যাসিক নন, তিনি একজন দ্রষ্টা, একজন সমাজ সংস্কারক (যদিও তিনি নিজে তা দাবি করেননি), এবং সর্বোপরি, মানবাত্মার এক মহান কারিগর। তাঁর তৈরি করা ‘মানব নাট্যশালা’ আজও আমাদের হাসায়, কাঁদায়, বিস্মিত করে আর সবচেয়ে বড় কথা, ভাবতে শেখায়। আর এখানেই তো একজন লেখকের পরম সার্থকতা, তাই না? বালজ্যাকের কফির কাপে চুমুক দেওয়ার মতো করে তাঁর উপন্যাসগুলোয় একবার ডুব দিয়েই দেখুন না, নেশা ধরে যেতে বাধ্য!
তথ্যসূত্র
- Auerbach, E. (1953). Mimesis: The Representation of Reality in Western Literature. Princeton University Press.
- Balzac, H. de. (1842). Avant-propos to La Comédie humaine. (Various editions and translations exist).
- Balzac, H. de. (Père Goriot). (Various editions and translations exist, original publication 1835).
- Barthes, R. (1974). S/Z: An Essay (R. Miller, Trans.). Hill and Wang. (Original work published 1970).
- Bellos, D. (1987). Balzac Criticism in France, 1850-1900: The Making of a Reputation. Clarendon Press.
- James, H. (1899). The Future of the Novel. In The House of Fiction: Essays on the Novel (L. Edel, Ed., 1957). Rupert Hart-Davis.
- Lukács, G. (1964). Studies in European Realism. Grosset & Dunlap. (Original work published earlier in other languages).
- Maurois, A. (1965). Prometheus: The Life of Balzac. Harper & Row.
- Prawer, S. S. (1976). Karl Marx and World Literature. Oxford University Press.
- Pritchett, V. S. (2002). Balzac: A Biography. New York Review Books. (Originally published 1973).
- Robb, G. (1994). Balzac: A Life. W. W. Norton & Company.
Leave a Reply