সাহিত্য কী? – টেরি ইগলটন

(এই প্রবন্ধটা প্রখ্যাত ব্রিটিশ সাহিত্যতাত্ত্বিক ও সমালোচক টেরি ইগলটনের লেখা। এটা তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “লিটারারি থিওরি: অ্যান ইন্ট্রোডাকশন” (Literary Theory: An Introduction)-এর প্রথম অধ্যায় “হোয়াট ইজ লিটারেচার?”-এর বঙ্গানুবাদ। এই অংশে ইগলটন সাহিত্যের প্রচলিত সংজ্ঞাগুলোকে বিশ্লেষণ ও প্রশ্নবিদ্ধ করে সাহিত্যের স্বরূপ উন্মোচনের চেষ্টা করেছেন।)

সাহিত্যতত্ত্ব (literary theory) বলে যদি কিছু একটা থাকে, তবে সাহিত্য বলেও যে কিছু আছে, তা তো মেনে নিতেই হয়। ওই সাহিত্য বস্তুটার ওপর ভর করেই তো তত্ত্বটা দাঁড়িয়ে, তাই না? কিন্তু গোলমালটা তো এইখানেই। যে সাহিত্য নিয়ে এত কথা, সেই সাহিত্য আদতে কী? সাহিত্য বস্তুটা ঠিক কী, এই প্রশ্ন নিয়ে পণ্ডিতেরা তো কম মাথা ঘামাননি। কতজনে কত কথাই তো বললেন। কেউ হয়তো বলবেন, সাহিত্য মানে হলো ‘কল্পনাপ্রসূত লেখা’ (imaginative writing)। অর্থাৎ, যা সত্যি ঘটেনি, স্রেফ বানিয়ে তোলা গল্প। যাকে আমরা বইয়ের ভাষায় বলি কথাসাহিত্য (fiction)। কিন্তু এই সংজ্ঞার জালে কি সবকিছু ধরা পড়ে? একটু খতিয়ে দেখলেই চোখে পড়বে, মানুষ যেসব লেখাকে সযত্নে সাহিত্যের সেরা আসনে বসায়, সেখানে শুধু ‘কল্পনাপ্রসূত লেখা’র নিরিখে বিচার করলে খুব একটা সুবিধা হয় না।

ধরা যাক সপ্তদশ শতকের ইংরেজি সাহিত্যের কথা। শেক্সপিয়র, জন ওয়েবস্টার, এন্ড্রু মার্ভেল কিংবা জন মিল্টন – এঁদের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। কিন্তু এঁদের সাথে ফ্রান্সিস বেকনের প্রবন্ধ, জন ডানের ধর্মবিষয়ক গুরুগম্ভীর বক্তৃতা (sermons), জন বানিয়ানের আত্মজীবনীমূলক আধ্যাত্মিক উপাখ্যান, এমনকি স্যার টমাস ব্রাউনের যাবতীয় রচনা – সবকিছুকেই মানুষ সাহিত্যের অঙ্গ বলে মেনে নিয়েছে। একটু চেষ্টা করলে টমাস হবসের ‘লেভিয়াথন’ বা ক্ল্যারেনডনের (Clarendon) আর্লের (Earl) ‘হিস্ট্রি অফ দ্য রেবেলিয়ন’-এর মতো বইও দিব্যি ওই তালিকায় ঢুকে যেতে পারে। আবার ওই একই জমানায় ফরাসি সাহিত্যের দিকে যদি তাকানো যায়, সেখানেও ছবিটা একই। পিয়ের কর্নেই (Corneille) আর জঁ রাসিনের (Racine) নাটকের পাশেই দিব্যি জায়গা করে নিয়েছে লা রোশফুকোর (La Rochefoucauld) ক্ষুরধার সব নীতিকথা (maxims)। বোসুয়েটের (Bossuet) অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য লেখা ভাবগম্ভীর ভাষণগুলোও বাদ যায়নি। সাথে বোয়ালোর (Boileau) কাব্যতত্ত্ব, মাদাম দে সেভিনিয়ের (Madame de Sevigne) তাঁর আদরের কন্যার কাছে লেখা চিঠিপত্র, এমনকি দেকার্ত (Descartes) আর প্যাসকেলের (Pascal) গভীর দার্শনিক চিন্তাভাবনাও যেন বেশ জাঁকিয়েই সাহিত্যের আসরে বসে গেছে। এরপর উনিশ শতকের ইংরেজি সাহিত্যের দিকে যদি নজর ফেরাই, সেখানে ল্যাম্বকে (Lamb) আমরা সাহিত্যের লোক বলে গণ্য করি, অথচ বেন্থামকে (Bentham) সেভাবে পাত্তা দিই না। ম্যাকলেকে (Macaulay) সাহিত্যের কাতারে ফেলা হয়, কিন্তু কার্ল মার্কসকে সেখানে দেখা যায় না। জন স্টুয়ার্ট মিলকে কেউ কেউ হয়তো সাহিত্যিক বলবেন, কিন্তু ডারউইন বা হার্বার্ট স্পেন্সারকে নিশ্চয়ই কেউ সাহিত্যিক তকমা দিতে চাইবেন না।

তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়াল? ‘সত্য ঘটনা’ আর ‘কল্পকাহিনি’ – এই দুইয়ের মাঝে ঝকঝকে একটা দাগ টেনে সাহিত্যকে আলাদা করাটা বড়ই দুরূহ কাজ। দুরূহ, কারণ দাগটাই অনেক সময় কেমন যেন ধোঁয়াটে, অস্পষ্ট হয়ে যায়। একটা নজির দেওয়া যাক। আজকাল আমরা কথায় কথায় ‘ঐতিহাসিক সত্য’ (historical truth) আর ‘শৈল্পিক সত্য’ (artistic truth) বলে দুটো ভিন্ন জিনিস বোঝাই। কিন্তু শুনলে তাজ্জব বনে যেতে হয়, প্রাচীন আইসল্যান্ডের বীরগাথায় নাকি এই ভেদরেখা একেবারেই অচল ছিল। কিংবা ধরা যাক ষোড়শ শতকের শেষ দিক বা সপ্তদশ শতকের শুরুর কথা; তখন ইংরেজিতে ‘নভেল’ (novel) শব্দটা কিন্তু সত্যি ঘটনা বা বানানো গল্প, দুটো অর্থেই দিব্যি চালু ছিল। খবরের কাগজের বিবরণকেও যে লোকে তখন পুরোপুরি সত্যি বলে ধরে নিত, তাও নয়। কোনটা আসল, কোনটা কল্পিত, এই ফারাকটা তখন আজকের মতো এত পরিষ্কার ছিল না। সেকালে এমন স্পষ্ট বিভাজন আজকের মতো ছিলই না। গিবন (Gibbon) যখন ইতিহাস লিখছিলেন, তিনি নিশ্চয়ই বিশ্বাস করতেন যা লিখছেন তা অক্ষরে অক্ষরে ‘ঐতিহাসিক সত্য’। যিনি জেনেসিস (Genesis) লিখেছিলেন, তিনিও সম্ভবত একই কথা ভাবতেন। অথচ আজকের দিনে কিছু পাঠকের কাছে এগুলো যেমন ‘সত্য’, অনেকের কাছেই আবার ‘কল্পকাহিনি’। নিউম্যানের (Newman) বিষয়টাও দেখুন। তিনি তো মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন তাঁর ধর্মতত্ত্বের ভাবনাগুলো পরম সত্য। কিন্তু এখনকার বহু পাঠকের কাছে সেগুলো স্রেফ ‘সাহিত্য’।

আরও একটা দিক কিন্তু ভাববার মতো। সাহিত্য যদি বহু ‘বাস্তব’ বা ঘটনাভিত্তিক রচনাকে আপন করে নেয়, তবে এটাও সত্যি যে কিছু কিছু কল্পকাহিনিকে সে আবার বাইরের রাস্তাও দেখিয়ে দেয়। সুপারম্যানের কমিক বই বা মিলস অ্যান্ড বুন (Mills and Boon) সিরিজের প্রেমের উপন্যাসগুলো তো আগাগোড়াই গালগল্প। কিন্তু সেগুলোকে তো কেউ সাহিত্যের উঁচু বেদিতে বসায় না, ধ্রুপদী সাহিত্যের সম্মান তো দেয়ই না। তাহলে, সাহিত্য যদি শুধু ‘সৃজনশীল’ বা ‘কল্পনাপ্রসূত’ লেখাই হবে, তবে ইতিহাস, দর্শন বা প্রকৃতিবিজ্ঞানের মতো বিষয়গুলো কি একদম নীরস? সেগুলোতে সৃজনশীলতা আর কল্পনার লেশমাত্র নেই, এমনটা কি ধরে নিতে হবে? মন কিন্তু এতে সায় দেয় না, তাই না? তাহলে বোধহয় আমাদের একটু অন্য রাস্তায় হেঁটে দেখতে হবে। সাহিত্য মানেই আজগুবি গল্প বা আকাশকুসুম ভাবনা হতে হবে, এমন কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। বরং সাহিত্য লুকিয়ে রয়েছে ভাষাকে একটু অন্যভাবে, খানিকটা অদ্ভুত কায়দায় ব্যবহার করার মধ্যে। এই চিন্তা থেকেই একটা তত্ত্ব উঠে এল। বলা হলো, সাহিত্য হলো সেই প্রকার লেখা, যা রুশ সমালোচক রোমান জ্যাকবসনের (Roman Jakobson) ভাষায়, ‘সাধারণ কথাবার্তার ওপর এক পরিকল্পিত আক্রমণ’ (organized violence committed on ordinary speech)। সাহিত্য আদতে করেটা কী? আমাদের রোজকার আটপৌরে ভাষাকে সে যেন কেমন বদলে দেয়, আরও শাণিত, আরও জোরালো করে তোলে। প্রতিদিনকার সাধারণ আলাপের যে একটা চেনা বৃত্ত, সাহিত্য সেখান থেকে বেশ সযত্নে, নিয়ম মেনেই যেন একটু তফাতে সরে দাঁড়ায়।

একটা ছোট্ট নজির দিই, কেমন? ধরুন, আপনি বাসস্টপে আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ ফিসফিস করে আমার কানে বললেন, ‘Thou still unravished bride of quietness’ (হে নীরবতার অনাঘ্রাত বধূ, এখনও তুমি অপরিণীত)। শুনেই আমার বুকের ভেতরটা কেমন ছ্যাঁৎ করে উঠবে। আমি নিমেষেই ধরে ফেলব, আরে, এ যে সাহিত্য! কেন এমন বুঝব? কারণ আপনার ওই কথা ক’টার যে গড়ন, যে সুর, যে অদ্ভুত ব্যঞ্জনা, সেগুলো তার মামুলি আক্ষরিক অর্থের চেয়ে অনেক বেশি কিছু জানান দিচ্ছে। ভাষাবিদরা হয়তো আরও শক্ত করে বলবেন, এখানে সংকেতিত (signified) আর সংকেতকের (signifier) মধ্যে একটা তফাত তৈরি হয়েছে। আপনার বলা কথাগুলো নিজেই নিজের দিকে আমাদের সমস্ত মনোযোগ আকর্ষণ করছে, নিজের একটা আলাদা পরিচয় ঘোষণা করছে। অথচ যদি কেবল জানতে চাইতেন, ‘আচ্ছা, ড্রাইভাররা কি আজ ধর্মঘট ডেকেছে, কিছু জানেন নাকি?’ শেষের বাক্যটা কিন্তু এমন নজর কাড়ত না। সোজাসাপ্টা তার দরকার মিটিয়েই হাওয়ায় মিলিয়ে যেত।

ভাষার এই যে অন্যরকম ব্যবহারের কথা বলছিলাম, সেটাই ছিল আসলে ফর্মালিস্ট (Formalists) নামে পরিচিত একদল রুশ মনীষীর দেওয়া ‘সাহিত্যিক’ রচনার সংজ্ঞা। এই দলে ছিলেন সে আমলের বিখ্যাত সব পণ্ডিত। যেমন ভিক্টর শক্লোভস্কি (Viktor Shklovsky), রোমান জ্যাকবসন (Roman Jakobson), ওসিপ ব্রিক (Osip Brik), ইউরি তিনিয়ানভ (Yury Tynyanov), বরিস আইখেনবম (Boris Eichenbaum) এবং বরিস তোমাশেভস্কি (Boris Tomashevsky)। এই ফর্মালিস্টরা রাশিয়ায় ১৯১৭ সালের সেই দুনিয়া কাঁপানো বলশেভিক বিপ্লবের (Bolshevik Revolution) ঠিক একটু আগে বেশ দাপটের সঙ্গেই আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯২০-র দশক জুড়ে তাঁদের কাজকর্ম বেশ ফুলেফেঁপেও উঠেছিল। কিন্তু তারপর স্তালিনবাদ (Stalinism) এসে একরকম তাঁদের টুঁটি চেপে ধরে। সমালোচকদের এই দলটা ছিল বেশ ঝাঁঝালো আর যুক্তিনিষ্ঠ। তাঁদের আগে সাহিত্য বিচারে যেসব আধ্যাত্মিক আর রহস্যময় প্রতীকী ধ্যানধারণা জাঁকিয়ে বসেছিল, সেগুলোকে তাঁরা এক ঝটকায় নস্যাৎ করে দিলেন। তার বদলে তাঁরা চাইলেন একেবারে বাস্তবনিষ্ঠ, একটা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে সাহিত্যকর্মের শরীরটাকে দেখতে, তার ভেতরের কলকব্জা বুঝতে। তাঁদের বক্তব্য ছিল, সমালোচনা মানে হলো শিল্পকে যাবতীয় রহস্যের কুয়াশা থেকে মুক্ত করা। সাহিত্যকর্মগুলো আসলে কী করে চলে, তাদের কার্যপদ্ধতি কেমন, সেসব নিয়েই মাথা ঘামানো দরকার। সাহিত্য তো কোনো ধর্ম নয়, মনোবিজ্ঞান বা সমাজতত্ত্বও নয়। তাঁদের মতে, সাহিত্য হলো ভাষার এক বিশেষ কারদানি। এর নিজস্ব কিছু নিয়মকানুন, গড়ন আর কলাকৌশল আছে, যেগুলোকে অন্যকিছুর সঙ্গে গুলিয়ে না ফেলে তাদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য দিয়েই বিচার করতে হবে। সাহিত্যকর্ম কোনো তত্ত্বকথা প্রচারের বাহন নয়, সামাজিক বাস্তবতার একটা নিছক প্রতিচ্ছবিও নয়, কিংবা কোনো গভীর অতীন্দ্রিয় সত্যের দেহ ধারণও নয়। সাহিত্যকে তাঁরা দেখতেন এক বস্তুগত বিষয় হিসেবে, যার কাজকর্ম বিশ্লেষণ করা যায়, ঠিক একটা যন্ত্রের মতো করে। তাঁদের বিচারে, সাহিত্য শব্দ দিয়েই গড়া, কোনো অনুভূতি বা ভাবনা দিয়ে নয়। সাহিত্যকে লেখকের মনোগহনের কথার প্রকাশ হিসেবে দেখাটাও একটা মস্ত ভুল। ওসিপ ব্রিক তো একবার বেশ হালকা চালে একটা সাংঘাতিক কথা বলে ফেলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আলেকজান্ডার পুশকিন (Alexander Pushkin) যদি বেঁচে নাও থাকতেন, তাহলেও নাকি তাঁর বিখ্যাত কাব্য ‘ইউজিন ওয়ানগিন’ (Eugene Onegin) ঠিকই লেখা হয়ে যেত!

ফর্মালিজম ব্যাপারটাই ছিল আদতে সাহিত্যচর্চায় ভাষাবিজ্ঞানের একটা প্রয়োগ। সেই ভাষাবিজ্ঞানটাও ছিল বেশ কাঠামোগত (structural) গোছের। অর্থাৎ, ভাষার শরীর, তার গড়ন বা কাঠামোর ওপরই তাঁদের যাবতীয় নজর। কী বলা হচ্ছে, তার চেয়ে ঢের বেশি জরুরি ছিল কীভাবে বলা হচ্ছে। এই কারণেই ফর্মালিস্টরা সাহিত্যের ‘বিষয়বস্তু’ (content) বা ভেতরের কাহিনি নিয়ে তেমন একটা মাথা ঘামাতেন না। কারণ, ওই বিষয়বস্তু নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গেলেই তো মনোবিজ্ঞান বা সমাজবিজ্ঞানের মতো প্যাঁচালো সব বিষয়ের মধ্যে ঢুকে পড়ার একটা বিরাট ঝুঁকি থেকে যায়। তাই তাঁরা বরং সাহিত্যের ‘রূপ’ (form) বা বাইরের গড়ন নিয়েই বেশি উৎসাহী ছিলেন। রূপকে তাঁরা বিষয়বস্তুর প্রকাশ হিসেবে দেখতেন না, বরং গোটা ব্যাপারটাকে তাঁরা দেখতেন ঠিক উল্টো দিক থেকে। তাঁদের কাছে, বিষয়বস্তু ছিল রূপের একটা ‘প্রেরণা’ মাত্র। অর্থাৎ, একটা বিশেষ ধরনের রূপ বা আঙ্গিক দেখানোর জন্য একটা সুযোগ। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। দন কিহোতে (Don Quixote) নামের যে বিখ্যাত উপন্যাস, সেটা আসলে ওই নামের মানুষটার কাহিনি নয়। তাঁদের মতে, চরিত্রটা আসলে নানা ধরনের গল্প বলার ভঙ্গিমাকে এক সুতোয় গাঁথার একটা কৌশল মাত্র। ফর্মালিস্টদের চোখে জর্জ অরওয়েলের ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ মোটেই স্তালিনবাদের (Stalinism) কো্নো রূপক গল্প হতো না। বরং তাঁরা বলতেন, স্তালিনবাদের মতো একটা বিষয় একটা চমৎকার রূপক গল্প ফাঁদার জন্য বেশ ভালো একটা সুযোগ জুগিয়ে দিয়েছে। এমন কিছুটা বেয়াড়া আর জেদি ধরনের কথাবার্তার জন্যই ফর্মালিস্টরা তাঁদের বিরোধী শিবিরের কাছ থেকে এই বাঁকা নামটা পেয়েছিলেন। যদিও তাঁরা কখনোই অস্বীকার করেননি যে শিল্পের সঙ্গে সমাজ বাস্তবতার একটা যোগসাজশ আছে। সত্যি বলতে কী, তাঁদের কেউ কেউ তো বলশেভিকদের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠভাবেই যুক্ত ছিলেন। কিন্তু তাঁরা বেশ জোরের সঙ্গে, খানিকটা উস্কানিমূলকভাবেই দাবি করতেন, এই সামাজিক সম্পর্ক সাহিত্য সমালোচকের বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত নয়। ফর্মালিস্টরা শুরুর দিকে সাহিত্যকর্মকে দেখতেন কিছু ‘কৌশলের’ (devices) একটা ছড়ানো ছিটানো সমাহার বা জটলা হিসেবে। পরে অবশ্য এই কৌশলগুলোকে তাঁরা আর বিচ্ছিন্নভাবে না দেখে, একটা পূর্ণাঙ্গ পাঠ্য ব্যবস্থার (textual system) মধ্যে একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন উপাদান বা ‘ফাংশন’ হিসেবে গণ্য করতে শুরু করেন। এই যে ‘কৌশল’, এর মধ্যে কী কী পড়ে? আছে শব্দ, চিত্রকল্প (imagery), ছন্দ (rhythm), বাক্যের বাঁধুনি (syntax), মাত্রা (metre), অন্তমিল (rhyme), গল্প বলার নানা ঢং (narrative techniques)। এক কথায়, সাহিত্য নির্মাণের সকল সরঞ্জামই এর আওতায়। এই সব উপাদানের মধ্যে একটা বৈশিষ্ট্য কিন্তু সকলের মধ্যেই হাজির। সেটা হলো, এদের একদিকে যেমন রয়েছে কোনো কিছুকে তার চেনা চেহারা থেকে ভিন্ন করে দেখানোর (estrangement) ক্ষমতা, তেমনি অন্যদিকে আছে সেটাকে একেবারে অচেনা করে তোলার (defamiliarizing) অবাক করা এক জাদু। সাহিত্যিক ভাষার কেরামতিও ঠিক এইখানে। এই কেরামতিই তাকে আর পাঁচটা সাধারণ কথাবার্তা থেকে আলাদা করে তোলে। সাহিত্য করেটা কী? সে সাধারণ ভাষাকে নানাভাবে ‘বিকৃত’ করে, একটু যেন তার ভোল পাল্টে দেয়। সাহিত্যিক কলাকৌশলের চাপে পড়ে আটপৌরে ভাষা তখন আরও জোরালো, আরও জমাট, আরও প্যাঁচালো হয়ে ওঠে। কখনও খুব আঁটোসাঁটো, আবার কখনও বেশ ছড়ানো, কিংবা একেবারে ওলটপালট হয়ে যায়। তখন সেটা হয়ে দাঁড়ায় এক ‘বিস্ময়-জাগানো ভাষা’ (language made strange)। ভাষা যখন এমন অন্যরকম চেহারা নেয়, ঠিক সেই কারণেই আমাদের রোজকার অতি চেনা জগৎটাও আচমকা কেমন অচেনা, একেবারে আনকোরা বলে মনে হয়।

রোজকার গতানুগতিক কথাবার্তার ঘেরাটোপে আমাদের বাস্তবকে অনুভব করার ক্ষমতা, তার প্রতি সাড়া দেওয়ার ইচ্ছেগুলো কেমন যেন ভোঁতা, ম্যাড়মেড়ে হয়ে যায়। ফর্মালিস্টদের ভাষায় যাকে বলে ‘স্বয়ংক্রিয়’ (automatized) হয়ে যাওয়া। সাহিত্য তখন কী করে? ভাষার এই নাটকীয় জাগরণের মধ্যে আমাদের ঠেলে দিয়ে, ওইসব ভোঁতা হয়ে যাওয়া অনুভূতি, অভ্যস্ত প্রতিক্রিয়াগুলোকে ফের সজীব, তরতাজা করে তোলে। চারপাশের জিনিসগুলোকে আরও বেশি করে ‘উপলব্ধিযোগ্য’ (perceptible) করে তোলে। সাধারণের চেয়ে একটু বেশি খেটে, একটু বেশি সজাগ হয়ে যখন আমরা ভাষার সঙ্গে বোঝাপড়া করতে বসি, তখন সেই ভাষার ভেতরের দুনিয়াটা যেন নতুন করে জীবন পায়। জেরার্ড ম্যানলি হপকিন্সের (Gerard Manley Hopkins) কবিতা পড়লে এই ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হয়। সাহিত্যের ভাষা আমাদের রোজকার আটপৌরে কথাবার্তাকে যেন খানিকটা অদ্ভুত ঠেকায় (estranges), কিংবা বলা ভালো, অচেনা করে তোলে (alienates) ঠিকই। কিন্তু মজাটা হলো, এই কাজটা করতে গিয়েই, সে আমাদের অভিজ্ঞতার আরও গভীর, আরও নিবিড় এক উপলব্ধির দুয়ারে পৌঁছে দেয়। বেশিরভাগ সময় আমরা যে শ্বাস নিই, সেই বাতাস যে ফুসফুসে গিয়ে ঢোকে, তা কি আমরা সব সময় টের পাই? পাই না। ভাষাও অনেকটা সে রকম, বাতাসের মতোই আমাদের চারপাশ ঘিরে রয়েছে। কিন্তু ধরুন, বাতাসটা যদি হঠাৎ করে খুব ভারী হয়ে যায়, কিংবা বিদঘুটে রকমের দূষিত হয়ে পড়ে, তখন কী হয়? তখন কিন্তু ঠিকই শ্বাসপ্রশ্বাসের দিকে আমাদের খেয়াল যায়, আর তার ফলে নিজেদের বেঁচে থাকা নিয়েও কেমন যেন একটা অন্যরকম, গভীর অনুভূতি জাগে, তাই না?

বন্ধুর কাছ থেকে পাওয়া একটা কাঁচা হাতের আঁকাবাঁকা চিঠির কথাই ধরুন। আমরা তো তার ভেতরের গল্প বলার ঢং নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাই না। কিন্তু ধরুন, একটা গল্প যদি এমন হয় – চলতে চলতে মাঝপথে আচমকা একটু যেন দাঁড়ি টানল, পরের মুহূর্তেই আবার নতুন উদ্যমে এগিয়ে চলল, পাঠককে সে এক গল্পের গোলকধাঁধা থেকে আরেক মায়াবী পথে ঘুরিয়ে নিয়ে চলল, শেষটায় পৌঁছাতে যেন ইচ্ছে করেই দেরি করে, আমাদের কৌতূহলটাকে একদম দমবন্ধ অবস্থায় দাঁড় করিয়ে দেয় – তখন ঠিকই আমাদের চোখে পড়ে যায়, আরে, গল্পটা তো বেশ পাকা হাতে বোনা! একইসঙ্গে, সেই গল্পের সঙ্গে আমাদের একটা অন্যরকম, গভীর সখ্যও তৈরি হয়ে যায়। ফর্মালিস্টরা যেমনটা বলতেন, গল্প আমাদের মনোযোগ ধরে রাখার জন্য ইচ্ছে করেই যেন একটু পথ আটকে দাঁড়ায় (impeding), গতিটাকে একটু শ্লথ করে দেয় (retarding)। আর এই সব কলাকৌশল, সাহিত্যের ভাষায় নাকি এতটাই প্রকট, যে সেগুলো যেন খালি চোখেই দেখা যায়। এইজন্যই তো, ভিক্টর শক্লোভস্কি (Viktor Shklovsky) লরেন্স স্টার্নের (Laurence Sterne) সেই নামকরা উপন্যাস, ‘ট্রিস্ট্রাম শ্যান্ডি’র (Tristram Shandy) বিষয়ে এক মজাদার কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, উপন্যাসটা নাকি নিজের গল্পকে এমন পদে পদে ভেংচি কেটে থামিয়ে দেয় যে, বেচারা গল্পটা ভালো করে মুখ ফুটে উঠতেই পারে না! তাই, শক্লোভস্কির মতে, ওটাই নাকি ‘বিশ্বসাহিত্যের সবচেয়ে টিপিক্যাল উপন্যাস’।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, ফর্মালিস্টরা সাহিত্যিক ভাষাকে দেখেছিলেন একটা চেনা পরিচিত মানদণ্ড থেকে খানিকটা সরে যাওয়া, অথবা কিছু বিচ্যুতির (deviation) সমষ্টি হিসেবে। তাঁদের চোখে সাহিত্য ছিল ভাষার চলতি রীতির ওপর এক প্রকার পরিকল্পিত আঘাত (linguistic violence)। তাঁরা বলতেন, সাহিত্য হলো এক ‘বিশেষ’ ধরনের ভাষা, যা আমরা সচরাচর যে ‘সাধারণ’ ভাষা ব্যবহার করি, তার থেকে অনেকটাই ভিন্ন। কিন্তু ফ্যাসাদটা হলো অন্য জায়গায়। একটা জিনিস যে পথ থেকে সরে গেছে, বিচ্যুত হয়েছে, সেটা বুঝতে হলে আগে তো সেই আসল রাস্তাটা, সেই মাপকাঠিটা জানা চাই। ‘সাধারণ ভাষা’ কথাটা হয়তো অক্সফোর্ডের কয়েকজন নামজাদা দার্শনিকের খুব প্রিয় একটা ধারণা হতে পারে। তবে গোলমাল হলো, অক্সফোর্ডের সেইসব বিদগ্ধ পণ্ডিতদের মুখের সাধারণ ভাষার সঙ্গে গ্লাসগো শহরের কোনো বন্দর শ্রমিকের মুখের সাধারণ ভাষার মিল খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন, বলতে গেলে প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। আচ্ছা, দুটো ভিন্ন সামাজিক দলের মানুষের কথাই ভাবুন। তারা যখন মনের কথা জানিয়ে ভালোবাসার চিঠি লেখে, তখন যে ভাষা তারা ব্যবহার করে, সেটা নিশ্চয়ই তাদের এলাকার ধর্মযাজকের সঙ্গে কথা বলার ভঙ্গি থেকে অনেকটাই আলাদা হবে। সমাজে সবাই মিলেমিশে একই রকম একটা ‘স্বাভাবিক’ (normal) ভাষা ব্যবহার করে, এমন ধারণাটা আসলে একটা মস্ত বড় ফাঁকি, একটা ভুল বিশ্বাস। যে কোনো জীবন্ত ভাষা তো আসলে নানান ধরনের ভাষারীতি (discourses) বা বলা যায়, বাচনভঙ্গির এক ভীষণ জটিল জালবুনুনি। এই রীতিনীতিগুলো আবার মানুষভেদে কেমন পাল্টে যায় দেখুন – কার শ্রেণি কেমন, সে কোন অঞ্চলের মানুষ, পুরুষ না নারী, সমাজে তার মানসম্মান কতখানি, এমন হাজারো বিষয়ের ওপর নির্ভর করে মুখের ভাষাও তখন অন্যরকম হয়ে যায়। এই সব ভিন্ন ভিন্ন বলার ঢং বা ভাষারীতিকে কোনোভাবেই একটা একক, সবার জন্য সমান এক ভাষাগোষ্ঠীর ছাঁচে ফেলে পরিপাটি করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা যায় না, একেবারেই না। একজনের কাছে যা অতি সাধারণ, অন্যজনের কাছে সেটাই তো কেমন বেখাপ্পা, বেমানান ঠেকতে পারে।

একটা ছোট্ট উদাহরণ দিলেই বিষয়টা আরও খোলাসা হবে। ধরুন, ব্রাইটন শহরে ‘গলি’ (alleyway) বোঝাতে ‘গিনেল’ (ginnel) শব্দটা ব্যবহার করলে আমাদের কানে বেশ কাব্যিক শোনায়, তাই না? কিন্তু বার্নসলি (Barnsley) নামের আরেক শহরে এই ‘গিনেল’ শব্দটা কিন্তু খুবই আটপৌরে, একেবারেই সাদামাটা একটা কথা। এমনও তো হতে পারে, ধরুন, সেই পঞ্চদশ শতকের একটা নিতান্ত সাধারণ, যাকে বলে কিনা আগাগোড়া ‘গদ্যময়’ (prosaic) লেখা, সেটাও হয়তো তার সেই সেকেলে রীতিনীতি আর পুরনো ধাঁচের (archaism) শব্দ বা বাক্যবন্ধের জন্য আজকাল আমাদের কানে কেমন ‘কাব্যিক’ (poetic) শোনায়। ভাবুন তো, আমরা কোনোদিন মাটি খুঁড়ে কোনো হারিয়ে যাওয়া সভ্যতার একটা ছেঁড়াখোড়া লেখার টুকরো খুঁজে পেলাম। আমরা কি কেবল সেটার দিকে তাকিয়েই বলে দিতে পারব যে লেখাটা ‘কবিতা’ ছিল, না অন্য কিছু? পারব না। কারণ, সেই সমাজের মানুষজনের ‘সাধারণ’ কথাবার্তা কেমন ছিল, সে বিষয়ে আমাদের কোনো ধারণাই তো থাকবে না। আর যদি অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, অনেক গবেষণা করে প্রমাণও হয় যে লেখাটা আসলেই তাদের চলতি ভাষা থেকে ‘বিচ্যুত’ ছিল, তাতেও কি প্রমাণ হয় যে ওটা কবিতা ছিল? মোটেই না। কারণ, সব ভাষাগত বিচ্যুতিই তো আর কাব্যিক হয় না, তাই না? স্ল্যাং বা চলতি অপভাষার (slang) কথাই ধরুন। সেটাও তো সাধারণ ভাষা থেকে অনেকটাই সরে আসা। কিন্তু তাই বলে কি সেটা কবিতা? আমরা শুধু লেখাটার দিকে তাকিয়ে বলতে পারব না যে, ওটা ‘বাস্তববাদী’ (realistic) সাহিত্যের কোনো অংশ ছিল না। যদি না আমাদের হাতে ওই বিশেষ সমাজে একটা লেখা হিসেবে জিনিসটা ঠিক কীভাবে কাজ করত, সেই বিষয়ে আরও অনেক তথ্য না থাকে।

তবে হ্যাঁ, রুশ ফর্মালিস্টরা যে এই বিষয়টা একেবারেই বুঝতেন না, তা কিন্তু নয়। তাঁরা ঠিকই জানতেন, সমাজের হাওয়া যখন বদলায়, ইতিহাসের পাতা যখন উল্টে যায়, তখন ওই যে মাপকাঠি আর তা থেকে এদিক-ওদিক সরে যাওয়ার হিসাবনিকাশ, সেগুলোও কিন্তু চুপচাপ বসে থাকে না, দিব্যি বদলে যায়। আসলে, কোনটা কবিতা আর কোনটা নয়, তা অনেকটাই নির্ভর করে আপনি ঠিক কোন সময়ে, কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে কথাটা শুনছেন বা পড়ছেন, তার ওপর। একটা ভাষার কোনো অংশ শুনে আজ যে আপনার মনে হচ্ছে ‘আহা, কী কাব্য!’, কাল হয়তো সেই একই কথা শুনে আর কিছুই মনে হবে না। চারপাশের কথাবার্তার চল যদি পাল্টে যায়, তাহলে আগের দিনের খাস সাহিত্যও কেমন পানসে লাগতে শুরু করতে পারে। ওই যে বলেছিলাম না, ‘হে নীরবতার অনাঘ্রাত বধূ, এখনও তুমি অপরিণীত’ – এই কথাটা যদি পাড়ার পানশালায় সবাই কথায় কথায় বলত, তাহলে কি আর কারও কাছে ওটা শুনে বুকের ভেতরটা ধক করে উঠত? মোটেই না। ফর্মালিস্টরা আসলে বলতে চেয়েছিলেন, ‘সাহিত্যিকতা’ (literariness) জিনিসটা হলো এক ধরনের কথার সঙ্গে আরেক ধরনের কথার একটা তুলনামূলক সম্পর্ক, একটা ফারাক। এটা এমন নয় যে কোনো লেখার গায়ে ‘সাহিত্য’ বলে একটা চিরস্থায়ী ছাপ মারা আছে। তাঁরা কিন্তু ‘সাহিত্য’ বস্তুটাকে সংজ্ঞার জালে আটকাতে চাননি। তাঁরা বরং খুঁজেছিলেন ‘সাহিত্যিকতা’ – ভাষার সেই বিশেষ চাল, যা সাহিত্য বলে পরিচিত লেখার মধ্যে তো বটেই, তার বাইরেও অনেক জায়গায় উঁকিঝুঁকি মারে। এখন, কেউ যদি ভাবেন যে ভাষার এই বিশেষ কারসাজি দিয়েই সাহিত্যকে চেনা যাবে, তাহলে তাদের একটা কঠিন সত্যি মেনে নিতে হবে। ম্যানচেস্টার শহরের রাস্তায়ঘাটে মানুষ যে ভাষায় কথা বলে, সেখানে মার্ভেলের (Marvell) কবিতার চেয়েও অনেক বেশি রূপকের (metaphor) ছড়াছড়ি দেখতে পাওয়া যায়! এমন কোনো সাহিত্যিক কৌশল, সে মেটোনিমি (metonymy) হোক, সিনেকডেকি (synecdoche) হোক, লিটোটেস (litotes) বা কায়াজমাস (chiasmus) যাই হোক না কেন, খুঁজে পাওয়া যাবে না, যা আমরা রোজকার কথাবার্তায় হরহামেশা ব্যবহার করি না।

এতকিছুর পরেও, ওই যে কোনো কিছুকে একটু অন্যরকম করে দেখানোর (making strange) ব্যাপারটা, ফর্মালিস্টরা কিন্তু মনে করতেন ওটাই হলো সাহিত্যের আসল কেরামতি, আসল মজাটা ওখানেই। তাঁরা কেবল ব্যাপারটাকে একটু ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে দেখেছিলেন, বলেছিলেন, এক ধরনের কথার পাশে আরেক ধরনের কথা রাখলেই এই অন্যরকম ভাবটা ফুটে ওঠে। আচ্ছা, একটা কথা বলি। ধরুন, কোনো পানশালায় পাশের টেবিলে বসে কেউ যদি বলে ওঠে, ‘কী বিদঘুটে হাতের লেখা রে বাবা!’ এই কথাটা কি ‘সাহিত্যিক’ (literary) না ‘অসাহিত্যিক’ (non-literary)? সত্যি বলতে কি, কথাটা কিন্তু সাহিত্যিক। কেন বলুন তো? কারণ এটা নুট হামসুনের (Knut Hamsun) সেই বিখ্যাত উপন্যাস ‘হাঙ্গার’ (Hunger) থেকে তুলে আনা। কিন্তু আমি যে জানলাম এটা সাহিত্যিক, সেটা কীভাবে? কথাটার মধ্যে তো আহামরি কোনো ভাষাগত মারপ্যাঁচ নেই যে সে নিজেই নিজের দিকে আমাদের নজর কাড়বে। উত্তরটা হলো, ওটা নুট হামসুনের উপন্যাস ‘হাঙ্গার’ থেকে নেওয়া। মানে, যে লেখাটাকে আমি ‘গল্প’ হিসেবে পড়ছি, যে বইটা নিজেই নিজের গায়ে ‘উপন্যাস’ তকমা সেঁটে দিয়েছে, যেটা হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যের পাঠ্যক্রমেও দিব্যি জায়গা করে নিয়েছে – সেই জন্যেই ওটা সাহিত্যিক। মোটকথা, চারপাশের পরিবেশটাই আমাকে বলে দিচ্ছে যে এটা সাহিত্য। ভাষাটার নিজের কিন্তু এমন কোনো ক্ষমতা নেই, যা তাকে অন্য ধরনের কথাবার্তা থেকে আলাদা করে চিনিয়ে দেবে। সত্যি বলতে কি, পানশালায় দাঁড়িয়েও তো কেউ এমন কথা বলতেই পারে, তার জন্য তো আর লোকে তাকে বাহবা দেবে না। ফর্মালিস্টদের চোখে সাহিত্যকে দেখতে গেলে আসলে সব সাহিত্যকেই একরকম কবিতা বলে ধরে নিতে হয়। মজার ব্যাপার হলো, এই ফর্মালিস্টরা যখন গদ্য নিয়ে আলোচনা করতে বসতেন, তখনও তারা প্রায়শই কবিতার জন্য বরাদ্দ কৌশলগুলোই সেখানে টেনে আনতেন। অথচ, আমরা তো জানি, সাহিত্যের আঙিনাটা কবিতার চেয়েও অনেক বড়। সেখানে বাস্তববাদী (realist) বা প্রকৃতিবাদী (naturalistic) লেখালেখিও আছে, যেখানে ভাষা মোটেই নিজেকে জাহির করে না, বা খুব একটা আত্মসচেতন ভাবও দেখায় না। বরং, অনেক সময় তো মানুষ কোনো লেখাকে ‘দারুণ’ বলে এইজন্যই যে সেটা অহেতুক নিজের দিকে নজর টানে না। তার সহজ সরল ভাব, বা একটা চাঁপা গাম্ভীর্যের জন্যই লোকে তাকে পছন্দ করে। আর ওই যে হাসির সব গল্প, খেলার মাঠের স্লোগান, খবরের কাগজের শিরোনাম, বা বিজ্ঞাপনের চমক লাগানো কথাবার্তা? সেগুলোতেও তো ভাষার কম কারসাজি থাকে না। কিন্তু সেগুলোকে তো আমরা সাধারণত সাহিত্যের খাতায় ফেলি না। তাদের বেলায় কী হবে, বলুন তো?

এই যে কোনো কিছুকে তার চেনা পরিবেশ থেকে আলাদা করে দেখা বা বিস্ময়কর করে তোলার (estrangement) তত্ত্ব, এর ভেতরেও কিন্তু আরেকটা প্যাঁচ লুকিয়ে আছে। ব্যাপারটা হলো, এমন কোনো লেখা খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেটাকে কিনা একটু বুদ্ধি খাটালে অচেনা করে পড়া যায় না। লন্ডনের (London) পাতাল রেলের কথাই ভাবুন না। সেখানে মাঝে মাঝে একটা খুব সাদামাটা, সোজাসাপ্টা বিজ্ঞপ্তি চোখে পড়ে: ‘এসকেলেটরে কুকুর অবশ্যই কোলে নিতে হবে’ (Dogs must be carried on the escalator)। কথাটা শুনতে যতটা সোজাসাপ্টা লাগছে, ততটা কি? এর মানে কি এমন যে, এসকেলেটরে চড়তে গেলেই আপনাকে একটা কুকুর বগলদাবা করতে হবে? রাস্তায় যদি একটা নেড়ি কুত্তাও খুঁজে না পান, তাহলে কি আর এসকেলেটরে চড়া হবে না, সেখান থেকে নামিয়ে দেওয়া হবে? দেখুন দেখি কাণ্ড! এরকম আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ বিজ্ঞপ্তির মধ্যেও কিন্তু এমন সব গোলমেলে অর্থ লুকিয়ে থাকতে পারে। কিংবা ধরুন একটা ঝুড়ির গায়ে লেখা, ‘এই ঝুড়িতে আবর্জনা ফেলা নিষেধ’ (Refuse to be put in this basket)। একটু অন্যভাবে দেখলে, কথাটাকে কি আবর্জনা ফেলার নির্দেশ বলেও ধরে নেওয়া যায় না? অথবা ইংল্যান্ডের রাস্তায় ‘ওয়ে আউট’ (Way Out) লেখা সাইনবোর্ড দেখে ক্যালিফোর্নিয়ার কোনো লোক হয়তো ভাববে, আরে! জীবন নিয়ে কী গভীর একখানা দার্শনিক কথা লেখা! তবে এসব খামোখা কচকচানির কথা বাদ দিলেও, এটা কিন্তু ঠিক যে পাতাল রেলের ওই বিজ্ঞপ্তিটাকেও দিব্যি সাহিত্য হিসেবে পড়া যায়। কেউ হয়তো ওই লেখার প্রথম দিককার ভারী, ছোট ছোট শব্দগুলোর হঠাৎ করে থমকে যাওয়া, খানিকটা হুমকিসূচক ভঙ্গিতে (staccato) মুগ্ধ হয়ে যেতে পারে। ‘বহন করা’ (carried) শব্দটার গভীর অর্থের দিকে মন যাওয়ার আগেই হয়তো জীবনের পথে অসহায় কুকুরদের সাহায্য করার এক বিরাট ভাবনায় ডুবে যেতে পারে। এমনকি এমনও তো হতে পারে, কেউ একজন ‘এসকেলেটর’ (escalator) শব্দটার সুর আর উচ্চারণের ঢঙের মধ্যেই দিব্যি ওই যন্ত্রটার গড়গড়িয়ে ওঠা-নামার একটা ছায়া দেখতে পেলেন। মানছি, এমন খোঁজাখুঁজি হয়তো একটু বাড়াবাড়িই শোনায়। কিন্তু সত্যি বলতে, কোনো যুদ্ধের কবিতায় তলোয়ারের ঠোকাঠুকি বা ঝনঝনানি শোনার চেষ্টার চেয়ে যে এটা আহামরি বেশি বাড়াবাড়ি, তেমনটা কিন্তু বলা যায় না। আবার, এর একটা মস্ত সুবিধা আছে। এই ভাবনাটা আমাদের বলে দেয়, ‘সাহিত্য’ জিনিসটা লেখার নিজের কারসাজির ওপর যতটা না নির্ভর করে, তার চেয়ে বেশি নির্ভর করে মানুষ সেই লেখার সঙ্গে কী আচরণ করছে, তার ওপর।

কিন্তু কেউ যদি ওই বিজ্ঞপ্তিটা ওভাবে পড়তেন, তাহলেও তো সেটাকে কবিতা হিসেবেই ধরে নেওয়া হতো। কবিতা তো সাহিত্যের যে মস্ত বড় দুনিয়া, তার একটা কণা মাত্র। তাহলে আসুন, ওই বিজ্ঞপ্তিটাকে ‘ভুলভাবে পড়ার’ আরেকটা কায়দা দেখা যাক, যা হয়তো আমাদের আরও একটু দিশা দেখাতে পারে। এক গভীর রাতের কথা ভাবুন। সেই রাতে এক মাতাল লোক টলতে টলতে এসকেলেটরের হাতল ধরে ঝুঁকে বিজ্ঞপ্তিটার দিকে কয়েক মিনিট ধরে খুব কষ্ট করে তাকালেন। তারপর আপনমনে বিড়বিড় করে বললেন, ‘কী অভদ্রতা!’ ভুলটা কোথায় হচ্ছে বলুন তো? আসলে হয়েছে কী, ওই মাতাল লোকটা বিজ্ঞপ্তিটাকে আর দশটা সাধারণ লেখার মতো না দেখে, ধরে নিয়েছেন ওটা যেন মস্ত বড় কোনো ব্যাপার, এমনকি হতে পারে জগৎ-সংসার নিয়ে কোনো গভীর তাৎপর্যপূর্ণ বাণী। লেখাটা পড়ার যে কিছু চিরাচরিত নিয়মকানুন আছে, সেগুলো তিনি ওই শব্দগুলোর ওপর এমনভাবে চাপিয়ে দিয়েছেন, যেন ওগুলো তাদের আশপাশের চেনা জগত থেকে আলগা হয়ে গেল, একেবারে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল আর কি। ওই যে বিজ্ঞপ্তিটার একটা সাদামাটা, দরকারি অর্থ ছিল, বেচারা মাতাল সেটা থেকে কথাগুলোকে ছাড়িয়ে নিয়ে এমন এক বিশাল, গূঢ় অর্থের দিকে ঠেলে দিয়েছেন, যা শুনলে অবাক হতে হয়। লোকে যাকে সাহিত্য বলে, তার সঙ্গেও তো এমন একটা ব্যাপারই ঘটে। কবি যখন বলেন তার প্রেমিকা টুকটুকে লাল গোলাপের মতো সুন্দর, আমরা কি তখন খাতা পেন্সিল নিয়ে হিসেব করতে বসি, তার সত্যি সত্যি কোনো প্রেমিকা ছিল কিনা, অথবা সে মেয়েটা আদৌ গোলাপের মতো দেখতে ছিল কিনা! তিনি তো আসলে নারী আর প্রেম নিয়ে সাধারণভাবে একটা কথা বলতে চেয়েছেন, ব্যস। তাহলে কি সাহিত্যকে আমরা এমন বলতে পারি, এটা হলো গিয়ে এক ধরনের ‘অ-দরকারি’ বাচনভঙ্গি (non-pragmatic discourse)? মানে, জীববিজ্ঞানের বই পড়লে যেমন কিছু জানা যায়, কিংবা দুধওয়ালাকে একটা ছোট চিরকুট দিলে যেমন চটজলদি একটা কাজ হয়, সাহিত্যের বেলায় তেমন কোনো তাৎক্ষণিক দরকারি ব্যাপার নেই। বরং, ধরে নেওয়া হয়, সাহিত্য আমাদের চারপাশের সাধারণ হালচাল বা অবস্থা নিয়েই কিছু একটা বলতে চায়। সবসময় না হলেও, মাঝে মাঝে এই ব্যাপারটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার জন্যই যেন সাহিত্য একটু অন্যরকম, খানিকটা অচেনা ভাষাও ব্যবহার করে। যেন সে বলতে চাইছে, শোনো, এখানে কোনো বিশেষ মেয়ের কথা হচ্ছে না, বরং মেয়েদের নিয়ে কথা বলার একটা বিশেষ ভঙ্গি, একটা চাল দেখানো হচ্ছে। এই যে, কী বলা হচ্ছে তার চেয়েও যখন কীভাবে বলা হচ্ছে সেদিকে বেশি নজর চলে যায়, তখন অনেকে সাহিত্যকে বলেন এক ধরনের আত্ম-মগ্ন ভাষা (self-referential language) – এমন এক ভাষা, যে কেবল নিজের কথাই নিজে বলে, নিজের দিকেই তাকিয়ে থাকে।

তবে সাহিত্যকে এভাবে সংজ্ঞার বাঁধনে বাঁধার চেষ্টাতেও কিন্তু কিছু মুশকিল আছে। যেমন ধরুন, জর্জ অরওয়েল যদি কোনোদিন শুনতেন যে, তার লেখা প্রবন্ধগুলো লোকে পড়ছে তার লেখার ভেতরের কথার চেয়ে বলার ভঙ্গিটাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে, তাহলে তিনি বোধহয় বেশ হকচকিয়ে যেতেন! সাহিত্য বলে যে অনেক লেখা আমরা পড়ি, সেগুলোর মধ্যে কী বলা হলো, সেই বক্তব্যের সত্যমূল্য (truth-value) কতখানি, আমাদের আটপৌরে জীবনে তার কতটা দরকার (practical relevance) – এই সবকিছু মিলিয়েই তো লেখাটা আসল দাম, তার কদরটা ঠিক হয়। কিন্তু যদি ধরেও নিই, কোনো বাচনভঙ্গিকে (discourse) ‘অ-দরকারি’ ভাবে দেখাই সাহিত্যের একটা দিক, তাহলেও এই ‘সংজ্ঞা’ থেকে এটাই দাঁড়ায় যে, সাহিত্যকে আসলে কোনো বস্তুনিষ্ঠ (objectively) বাঁধাধরা নিক্তিতে মাপা যায় না। তখন পুরো ব্যাপারটা নির্ভর করে, কে কীভাবে পড়ছে তার ওপর, লেখার নিজের স্বভাব বা ধাঁচের (nature of what is written) ওপর ততটা নয়। কিছু লেখা আছে বটে – যেমন ধরুন কবিতা, নাটক, বা উপন্যাস – যেগুলো দেখলে বেশ স্পষ্টভাবেই বোঝা যায় যে, ওগুলো লেখাই হয়েছে এই অর্থে অনেকটা ‘অ-দরকারি’ হবার জন্য। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সবাই সেগুলো সেভাবেই পড়বে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। এমনও তো হতে পারে, আমি হয়তো গিবনের (Gibbon) লেখা রোমান সাম্রাজ্যের সেই বিশাল কাহিনি পড়ছি। প্রাচীন রোম নিয়ে একেবারে আদ্যোপান্ত বিশ্বাসযোগ্য খবর পাব, এমন বোকার মতো আশা নিয়ে কিন্তু পড়ছি না। আসলে হয়েছে কী, গিবনের লেখার ওই যে ভঙ্গিটা, ওই যে স্টাইল, সেটাই আমার ভারী ভালো লাগে। কিংবা ধরুন, মানুষের ভেতরকার যত নষ্টামি, যত পঙ্কিলতা, তার নানান রকম ছবি দেখে বেশ একটা মজাই পাই – সেইসব ঘটনা ইতিহাসে সত্যি ঘটেছিল কি না, তা নিয়ে অত মাথা ঘামানোর দরকারই বোধ করি না। আবার দেখুন, উল্টোটাও তো হতে পারে। আমি হয়তো রবার্ট বার্নসের (Robert Burns) একটা কবিতা পড়ছি। কেন পড়ছি, জানেন? কারণ, আমি হলাম গিয়ে একজন জাপানি বাগান বিশেষজ্ঞ, ফুল-লতাপাতা নিয়েই আমার কাজ। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে, আঠারো শতকের ব্রিটেনে তখন সত্যি সত্যিই লাল গোলাপ ফুটত কিনা!

তখন কেউ হয়তো বলবেন, ‘এভাবে পড়লে আর সেটাকে ‘সাহিত্য পড়া’ বলা চলে নাকি!’ কিন্তু একটা কথা বলুন তো, অরওয়েলের (Orwell) প্রবন্ধ আমি কি কেবল তখনই সাহিত্য হিসেবে পড়ছি, যখন স্পেনের গৃহযুদ্ধ নিয়ে তার বলা কথাগুলোকে মানবজীবন নিয়ে কোনো বিরাট, মহাজাগতিক বাণী বলে ধরে নেব? এটা ঠিক, স্কুল-কলেজে সাহিত্য বলে যে অনেক লেখা পড়ানো হয়, সেগুলোকে সাহিত্য হিসেবে পড়ানোর জন্যই যেন একরকম ‘তৈরি’ করে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এটাও তো সত্যি, তাদের মধ্যে অনেক লেখাই শুরুতে মোটেই তেমন ছিল না। একটা লেখা হয়তো ইতিহাস বা দর্শন হিসেবে তার জীবন শুরু করল, তারপর একদিন হঠাৎ করে সে সাহিত্য বলে নাম কিনে ফেলল। আবার উল্টোটাও হতে পারে; কোনো লেখা হয়তো সাহিত্য হিসেবেই যাত্রা শুরু করেছিল, কিন্তু পরে তার প্রত্নতাত্ত্বিক (archaeological) গুরুত্বের জন্য কদর বেড়ে গেল। কিছু লেখা আছে, যারা জন্ম থেকেই যেন সাহিত্যিক। কেউ কেউ আবার অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, চেষ্টা করে সেই সাহিত্যিক খেতাব অর্জন করে। আর কিছু লেখার ওপর এই সাহিত্যিকতার তকমাটা একরকম জোর করেই চাপিয়ে দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে, জন্মপরিচয়ের চেয়ে লোকে আপনাকে কীভাবে দেখছে, কীভাবে আপনার কদর করছে, সেটাই বোধহয় বড় কথা। আপনি কোথা থেকে এলেন, সেটা ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। লোকে আপনার সঙ্গে কী রকম ব্যবহার করছে, সেটাই আপনার দাম ঠিক করে দেয়। লোকে যদি একবার মনে করে আপনি সাহিত্য, ব্যস, আপনি তখন সাহিত্যই! আপনি নিজে নিজেকে তখন যা-ই ভাবুন না কেন, তাতে কী আসে যায়! সাহিত্য ব্যাপারটাকে যদি আমরা সেকেলে বেউলফ (Beowulf) থেকে হাল আমলের ভার্জিনিয়া উলফ পর্যন্ত ছড়ানো ছিটানো কিছু বাছাই করা লেখার ভেতরের বাঁধা কিছু গুণ বা বৈশিষ্ট্যের যোগফল হিসেবে না দেখি, তাহলে কেমন হয়? বরং এভাবেও তো ভাবা যায়, মানুষ লেখার সাথে কীভাবে নিজেকে জড়ায়, কেমন করে তার সাথে গড়ে তোলে একটা সম্পর্ক – সেই হাজারো পথের খোঁজ করাই আসল কথা। বিভিন্ন সময়ে মানুষ যাকে ‘সাহিত্য’ বলে সিলমোহর দিয়েছে, তার ভেতর থেকে এমন কিছু চিরকালীন, জন্মগত বৈশিষ্ট্য খুঁজে বের করা রীতিমতো দুঃসাধ্য। সত্যি বলতে কী, কাজটা অনেকটা দুনিয়ার তাবৎ খেলার ভেতর একটামাত্র সাধারণ মিল খুঁজে পাওয়ার মতোই অবাস্তব। সাহিত্যের তেমন কোনো ‘আসল নির্যাস’ (essence) বা সারবস্তু নেই। যেকোনো লেখাকেই তো ‘অ-দরকারি’ ভঙ্গিতে পড়া যেতে পারে, যদি সাহিত্য পাঠের মানে সেটাই দাঁড়ায়। ঠিক যেমন, যেকোনো লেখাকেই কাব্যিক ঢঙে পড়া সম্ভব। ধরুন, আমি একটা ট্রেনের সময়সারণী (train timetable) নিয়ে বসলাম। উদ্দেশ্য কিন্তু ট্রেন ধরা নয়, একেবারেই না। বরং এই যে যান্ত্রিক জীবন, তার উদ্দাম গতি, তার হাজারো প্যাঁচঘোঁচ – এইসব নিয়ে যদি মনের গভীরে কিছু ভাবনার ঢেউ ওঠে, কিছু নতুন চিন্তার ফুল ফোটে, সেই আশায়। তখন তো বলাই যায়, আমি জিনিসটাকে সাহিত্য হিসেবেই পড়ছি, তাই নয় কি?

জন এম. এলিস (John M. Ellis) নামে এক ভদ্রলোক তাঁর এক রচনায় বেশ চমৎকার একটা কথা তুলে ধরেছেন। তিনি বলছেন, ‘সাহিত্য’ শব্দটা নাকি ‘আগাছা’ শব্দটার মতো। আগাছা বলতে তো কোনো বিশেষ প্রজাতির গাছ বোঝায় না। আগাছা হলো সেইসব গাছপালা, যা বাগানের মালিক তার সবজি বা ফুলের কেয়ারিতে দেখতে চান না, কোনো না কোনো কারণে। ‘সাহিত্য’ হয়তো ঠিক এর উল্টো: এমন যেকোনো লেখা, যাকে কোনো না কোনো কারণে কেউ পরম যত্নে আগলে রাখতে চায়, মূল্যবান মনে করে। দার্শনিকরা যেমন বলেন, ‘সাহিত্য’ আর ‘আগাছা’ – এই দুটো শব্দই তাদের কাজ দিয়ে চেনা যায়, তাদের জাত দিয়ে নয়। ওই শব্দগুলো আমাদের জানায়, আমরা বস্তুটা নিয়ে কী করি, কিন্তু জিনিসটার ভেতরের আসল চেহারাটা কেমন, তা নিয়ে বিশেষ কিছুই বলে না। এগুলো আমাদের বুঝিয়ে দেয়, একটা লেখা বা একটা কাঁটাঝোপের সামাজিক দাম কেমন, পারিপার্শ্বিক অন্যসবকিছুর সাথে তার সম্পর্কটাই বা কী, অথবা ফারাকটাই বা কোথায়। জিনিসটা কেমন আচরণ করে, কোন উদ্দেশ্যে তাকে ব্যবহার করা যেতে পারে, আর তাকে ঘিরে মানুষের কেমন সব ধ্যানধারণা, রীতিনীতি গড়ে উঠেছে – এই সবই আমরা জানতে পারি। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, ‘সাহিত্য’ আসলে একটা ফাঁপা, নেহাতই আনুষ্ঠানিক সংজ্ঞা। যদি আমরা বলিও যে সাহিত্য হলো ভাষার এক ধরনের ‘অ-দরকারি’ প্রয়োগ, তাহলেও কিন্তু সাহিত্যের আসল রহস্যের কোনো কিনারা হয় না। কারণ, এই একই কথা তো কৌতুক বা আরও নানা ধরনের বাক্যালাপের ক্ষেত্রেও দিব্যি খাটে। আসলে, ভাষার সঙ্গে আমাদের যে লেনদেন, তার ‘দরকারি’ (practical) আর ‘অ-দরকারি’ (non-practical) দিকগুলোর মধ্যে খুব স্পষ্ট একটা দেয়াল টেনে দেওয়া যায়, ব্যাপারটা তেমন সরল নয়। আনন্দের জন্য একটা উপন্যাস পড়া আর রাস্তার মোড়ে চিহ্ন দেখে দরকারি তথ্য জোগাড় করা – দুটো যে আলাদা জিনিস, তা তো সহজেই বোঝা যায়। কিন্তু ধরুন, নিজের জ্ঞানভাণ্ডার বাড়াতে একটা জীববিজ্ঞানের বই পড়া, সেটাকে কী বলবেন? সেটা কি ভাষার ‘দরকারি’ ব্যবহার, নাকি নয়? অনেক সমাজে তো ‘সাহিত্য’ রীতিমতো দরকারি সব ভূমিকা পালন করেছে, যেমন ধরুন নানান ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান। এই যে ‘দরকারি’ আর ‘অ-দরকারি’র মধ্যে এমন শক্তপোক্ত একটা বিভাজনরেখা টানা, এটা বোধহয় কেবল আমাদের এই আধুনিক সমাজেই সম্ভব, যেখানে সাহিত্য আজকাল তেমন কোনো কাজের কাজ করে না বললেই চলে। এমনও তো হতে পারে, আমরা ‘সাহিত্যিক’ বলে যে একটা সাধারণ অর্থ দাঁড় করাতে চাইছি, সেটা আসলে একটা বিশেষ সময়ের, একটা বিশেষ পরিস্থিতিরই প্রতিফলন মাত্র।

ল্যাম্ব (Lamb), ম্যাকলে (Macaulay) বা মিলকে (Mill) আমরা সাহিত্যের পাতায় জায়গা দিই, অথচ বেন্থাম (Bentham), মার্কস কিংবা ডারউইনকে কেন যেন সেই দলে ফেলতে কুণ্ঠাবোধ করি – এই ধাঁধা তো আজও মেলেনি। একটা সহজ উত্তর অবশ্য চালু আছে। লোকে বলে, ওই প্রথম সারির দিকপালরা নাকি ‘সরেস লেখা’ লিখেছেন, আর পরের জনেরা তেমনটা পারেননি। কিন্তু মুশকিল হলো, এই কথাটা কতটা খাঁটি, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। অন্তত আমি তো মানতে রাজি নই। তবে হ্যাঁ, এই যুক্তির একটা সুবিধাও আছে। এখান থেকে একটা ধারণা করা যায়, মানুষ বোধহয় সেইসব লেখাকেই ‘সাহিত্য’ বলে আপন করে নেয়, যা তাদের মনকে নাড়া দেয়, যা তাদের ভালো লাগে। কিন্তু এখানেও একটা প্যাঁচ আছে। কথাটা যদি অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হতো, তাহলে তো ‘খারাপ সাহিত্য’ (bad literature) বলে কিছুর অস্তিত্বই থাকত না। আমার হয়তো ল্যাম্ব বা ম্যাকলের লেখাকে তেমন আহামরি কিছু মনে হয় না, মনে হতে পারে তাদের নিয়ে একটু বেশিই হইচই করা হচ্ছে। কিন্তু তাই বলে কি আমি তাদের লেখাগুলোকে সাহিত্য বলে মানা বন্ধ করে দেব? তা তো নয়। রেমন্ড চ্যান্ডলারের (Raymond Chandler) গোয়েন্দা কাহিনি হয়তো আপনার কাছে ‘তার ঘরানার উৎকৃষ্ট নমুনা’ মনে হতে পারে, কিন্তু তাঁকে কি সাহিত্যের উঁচু আসনে বসানো যায়? আবার উল্টোটাও ভাবুন। ম্যাকলে যদি সত্যিই যাচ্ছেতাই লিখতেন – মানে ধরুন, ব্যাকরণ নিয়ে কোনো ধারণাই নেই, কেবল সাদা ইঁদুর নিয়ে পাতার পর পাতা ভরাট করছেন – তাহলে কি লোকে তার লেখাকে সাহিত্য বলত? এমনকি খারাপ সাহিত্যও? আমার তো মনে হয় না। সত্যি বলতে, এই যে মূল্য বিচার (value-judgements), সাহিত্য চেনবার ক্ষেত্রে এর একটা বিরাট ভূমিকা আছে। কোনটা সাহিত্য আর কোনটা নয়, সেই সিদ্ধান্তটা এই মূল্যায়নের ওপর অনেকটাই দাঁড়িয়ে থাকে। তার মানে কিন্তু এই নয় যে সাহিত্য হতে হলে লেখাটাকে একেবারে নির্ভেজাল, ‘সোনায় সোহাগা’ হতেই হবে। বরং, লেখাটা এমন এক গোত্রের হওয়া চাই, যাকে লোকে সাধারণত ভালো বলেই জানে। এমনও হতে পারে, লেখাটা হয়তো এমন একটা বর্গের, যাকে লোকে সাধারণত খুব দামি মনে করে, কিন্তু এই নির্দিষ্ট লেখাটা সেই বর্গের একটা বাজে উদাহরণ। একটা বাসের টিকিটকে তো আর কেউ খারাপ সাহিত্যের নজির বলে গাল পাড়বে না। কিন্তু আর্নেস্ট ডাউসনের (Ernest Dowson) কবিতাকে হয়তো কেউ সেই দলে ফেলতে পারেন। এই যে ‘সরেস লেখা’ বা বইয়ের ভাষায় ‘বেল লেত্র’ (belles lettres) কথাটা, এর মধ্যেও কিন্তু একটা মারপ্যাঁচ আছে। এর দ্বারা এমন ধরনের লেখাকে বোঝানো হয়, যাকে লোকে সচরাচর বেশ সমীহের চোখে দেখে। যদিও তার মানে এই নয় যে ওই গোত্রের প্রত্যেকটা লেখাই আপনার ভালো লাগতেই হবে।

এইটুকু যদি আমরা একটু তলিয়ে দেখি, তাহলে ‘সাহিত্য মানেই খুব মূল্যবান লেখা’ – এই ধারণাটা কিন্তু আমাদের অনেক কিছু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। তবে, এর একটা বেশ গুরুতর দিকও আছে। সেটা হলো, আমাদের মন থেকে এই বিশ্বাসটা একেবারে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে হবে যে, ‘সাহিত্য’ বস্তুটা বুঝি একটা অনড়, অপরিবর্তনীয় কিছু, যা অনন্তকাল ধরে একই রকম থাকবে, চুল পরিমাণ নড়চড় হবে না। যদি যেকোনো কিছুই সাহিত্য হয়ে উঠতে পারে, তাহলে এমনও তো হতে পারে, যাকে আমরা আজ প্রায় বিনা প্রশ্নে সাহিত্য বলে মেনে নিচ্ছি – ধরা যাক শেক্সপিয়রের কথাই – তিনিও হয়তো একদিন সাহিত্যের আঙিনা থেকে বিদায় নেবেন, তার আর কোনো কদরই থাকবে না! তখন, সাহিত্য নিয়ে লেখাপড়া মানেই যে একটা স্থির, সুনির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে চর্চা করা – যেমন ধরুন পোকা-মাকড়ের জগৎ নিয়ে মাথা ঘামায় কীটতত্ত্ব – এই বিশ্বাসটা যে আসলে একটা দিবাস্বপ্ন, একটা মরীচিকা ছাড়া আর কিছুই নয়, সেটা বুঝতে আর সময় লাগবে না। কিছু বানানো গল্প সাহিত্য, কিছু আবার নয়। কিছু সাহিত্য আছে যা বানানো গল্প নয়, বরং সত্যি ঘটনা। কিছু সাহিত্য আছে যা নিজের ভাষা নিয়েই খুব মগ্ন, খুব সচেতন। আবার এমন অনেক লেখা আছে যেখানে খুব সাজানো গোছানো, কারুকার্যময় ভাষা (highly-wrought rhetoric) ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু সেগুলো মোটেই সাহিত্য নয়। সাহিত্য বলতে যদি এমন কোনো একগুচ্ছ লেখাকে বোঝায়, যার একটা নিশ্চিত, অপরিবর্তনীয় মূল্য আছে, যার মধ্যে এমন কিছু সহজাত, অন্তর্নিহিত গুণ (inherent properties) আছে যা সব সাহিত্যের মধ্যেই থাকবে – তাহলে বলতে হয়, তেমন সাহিত্যের কোনো অস্তিত্বই নেই। এই বইতে এরপর যখনই আমি ‘সাহিত্যিক’ বা ‘সাহিত্য’ শব্দগুলো ব্যবহার করব, মনে মনে আমি সেগুলোর ওপর একটা অদৃশ্য কালির দাগ টেনে রাখব। বোঝাতে চাইব যে, শব্দগুলো আসলে পুরোপুরি নিখুঁত নয়, মনের সব কথা ঠিকঠাক প্রকাশ করতে পারছে না। কিন্তু কী আর করার, আপাতত এর চেয়ে ভালো কোনো উপায় তো আমাদের হাতে নেই। সাহিত্যকে যদি খুব দামি লেখা বলে ধরে নেওয়া হয়, তাহলেই দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যায় কেন এই জিনিসটা মোটেই স্থির বা অপরিবর্তনীয় নয়। তার কারণ হলো, এই যে মূল্য বিচার, যা দিয়ে আমরা কোনো কিছুকে দামি বলি, সেগুলো তো ভীষণ নড়বড়ে, সময়ে সময়ে অবাক করার মতো পাল্টে যায়। খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনে হয়তো বড় হরফে লেখা থাকে, ‘সময় বদলায়, কিন্তু মূল্যবোধ বদলায় না’। কথাটা শুনলে আজকাল হাসি পায় বৈকি। আমরা কি এখনও সেই সেকেলে ধ্যানধারণা আঁকড়ে ধরে বিশ্বাস করি যে, দুর্বল বা রুগ্ণ শিশুদের মেরে ফেলাই উচিত, কিংবা মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষদের রাস্তায় নামিয়ে তামাশা দেখাটা খুব কাজের কাজ? মোটেই না। ঠিক যেমন, একশো বছর আগে মানুষ যেটাকে খাঁটি দর্শনশাস্ত্র বলে মাথায় তুলে নাচত, পরের একশো বছরে সেটাকেই হয়তো লোকে সাহিত্য বলে গ্রহণ করছে, কদর করছে। কিংবা এমনও হতে পারে, ঠিক এর উল্টো ঘটনাটাই ঘটছে। তেমনি, কোন লেখাটা দামি আর কোনটা নয়, সে ব্যাপারেও তো মানুষের রুচি, তাদের পছন্দ-অপছন্দ সময়ে সময়ে পাল্টাতে বাধ্য। শুধু তাই নয়, কিসের ভিত্তিতে, কোন নিক্তিতে তারা একটা জিনিসকে দামি বা কমদামি বলছে, সেই বিচার করার প্রক্রিয়াগুলোও কিন্তু এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভোল পাল্টায়।

তবে, এর মানে কিন্তু এই নয় (যেমনটা আগেও একবার ইশারা দিয়েছি), যে কোনো একটা লেখাকে তাদের হঠাৎ করে খারাপ লাগতে শুরু করলেই তারা আর সেটাকে সাহিত্য বলে মানবে না। তারা তখনও সেটাকে সাহিত্য বলতে পারে, হয়তো এই ভেবে যে, লেখাটা অন্তত সেই গোত্রের, সেই জাতের, যে ধরনের লেখাকে তারা সাধারণত সমাদর করে থাকে, মূল্য দিয়ে থাকে। কিন্তু এর মানে, এই যে আমরা ‘স্বীকৃত সাহিত্য-সম্ভার’ (literary canon) বা ‘জাতীয় সাহিত্যের’ প্রশ্নাতীত ‘চিরায়ত মহৎ ধারা’ (great tradition) বলে এত গর্বে বুক ফোলাই – এগুলো আসলে নির্দিষ্ট কিছু মানুষেরই গড়া জিনিস। বিশেষ কিছু মানুষ, বিশেষ কিছু সময়ে, বিশেষ কিছু কারণ বা উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এগুলোকে সযত্নে নির্মাণ করেছে। এমন কোনো সাহিত্যকর্ম বা ঐতিহ্য নেই, যা কিনা নিজে নিজেই, আপনাআপনি মূল্যবান, যার কদর অনন্তকাল ধরে বজায় থাকবে। কে কী বলল বা না বলল, তাতে কিছুই যায় আসে না। ‘মূল্য’ (value) শব্দটা কিন্তু বেশ গভীর, বেশ অর্থবহ। এর মানে হলো, বিশেষ কিছু পরিস্থিতিতে, বিশেষ কিছু মাপকাঠির নিরিখে, বিশেষ কিছু উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখে, বিশেষ কিছু লোক একটা জিনিসকে মূল্যবান বলে গণ্য করছে, তাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। কাজেই, এমনটা তো ঘটতেই পারে, আমাদের ইতিহাসের স্রোত যদি সম্পূর্ণ উল্টোমুখে বইতে শুরু করে, তাহলে ভবিষ্যতে এমন একটা সমাজ আসবে, যারা শেক্সপিয়রের লেখার মধ্যে আর কোনো রস খুঁজে পাবে না, কোনো আবেদনই অনুভব করবে না। তার লেখাগুলো তখন হয়তো তাদের কাছে অদ্ভুত রকমের অচেনা ঠেকবে। এমন সব ভাবনা, এমন সব অনুভূতিতে ঠাসা মনে হবে, যা সেই সমাজের মানুষজন হয়তো খুব হালকা বা একেবারেই ফেলনা বলে উড়িয়ে দেবে। সেরকম একটা পরিস্থিতিতে, শেক্সপিয়রের দাম আজকের দিনের রাস্তার মোড়ের দেয়াল-লিখনের চেয়ে বেশি কিছু হবে না। অনেকেই হয়তো তখন হাহুতাশ করে বলবেন, কী দুর্ভাগ্য, সমাজটা কত রিক্ত, কত দেউলিয়া হয়ে গেল! কিন্তু আমার কেন যেন মনে হয়, এমনটা ভাবা একটু বাড়াবাড়ি, খানিকটা একপেশে বিচার। কে বলতে পারে, মানুষের সামগ্রিক চিন্তা-ভাবনার বিকাশের ফলেই হয়তো এমনটা ঘটবে! কার্ল মার্কসও এই ব্যাপারটা নিয়ে বেশ চিন্তিত ছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, প্রাচীন গ্রিক শিল্পকর্মগুলো যে সময়ে তৈরি হয়েছিল, সেই যুগ তো কবেই ইতিহাসের গর্ভে বিলীন, তবু তাদের সেই ‘চিরন্তন আকর্ষণ’ (eternal charm) আজও কীভাবে টিকে আছে? কিন্তু আমরাই বা কী করে বুক ঠুকে বলছি যে এই আকর্ষণ ‘চিরকাল’ থাকবে? ইতিহাস তো আর এক জায়গায় থেমে থাকে না, তার চাকা তো অবিরাম ঘুরেই চলেছে।

ধরুন, অনেক পোড় খাওয়া প্রত্নতাত্ত্বিকের গভীর অনুসন্ধানের ফলে আমরা হঠাৎ করে অনেক কিছু জেনে গেলাম, প্রাচীন গ্রিক ট্র্যাজেডিগুলো তখনকার দর্শকদের কাছে ঠিক কী তাৎপর্য বহন করত, তাদের মনে কী ধরনের অনুভূতি জাগাত। আমরা হয়তো বুঝতে পারলাম, তাদের সেইসব ধ্যানধারণা, তাদের জীবনদর্শন আমাদের থেকে একেবারেই ভিন্ন, আকাশ-পাতাল ফারাক। এই নতুন জ্ঞানের আলোয় আমরা আবার সেই নাটকগুলো পড়তে বসলাম। তখন কী হতে পারে, বলুন তো? এমনও তো হতে পারে যে, নাটকগুলো আর আমাদের মন ছুঁলই না! আমরা হয়তো অবাক হয়ে দেখব, এতদিন যে নাটকগুলো আমাদের এত ভালো লাগত, তার কারণ আমরা নিজেদের অজান্তেই সেগুলোকে আমাদের নিজেদের ভাবনার চশমা দিয়েই দেখছিলাম, নিজেদের মনের রঙেই রাঙিয়ে তুলছিলাম। যখন আর সেটা করা যাবে না, তখন নাটকগুলোও হয়তো আমাদের কাছে আর তেমন কোনো বিশেষ বার্তা বয়ে আনবে না, বোবা হয়ে যাবে। আমরা যখন কোনো পুরোনো দিনের লেখা পড়ি বা তার ভালো-মন্দ বিচার করতে বসি, তখন আমাদের নিজেদের এখনকার ভাবনা-চিন্তা, আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের সুখ-দুঃখ, নানা উদ্বেগ বা আগ্রহের (our own concerns) একটা ছাপ তার ওপর ফেলে দিই। মানে, আমরা সেই পুরোনো লেখাটাকে আমাদের আজকের দিনের চশমা দিয়েই দেখি আর বোঝার চেষ্টা করি। সত্যি বলতে, এটা ছাড়া আর উপায়ই বা কী? আমরা তো আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা, নিজেদের ভাবনাকে পুরোপুরি সরিয়ে রেখে কোনো কিছুকে নিরপেক্ষভাবে দেখতে পারি না। আর ঠিক এই কারণেই হয়তো আমাদের এমনটা মনে হয় যে, কিছু কালজয়ী সাহিত্যকর্ম যুগের পর যুগ ধরেও তাদের গুরুত্ব বা আবেদন হারায়নি, আজও সেগুলো একইভাবে প্রাসঙ্গিক। হ্যাঁ, এমনটা হতেই পারে যে সেইসব লেখার সঙ্গে আমাদের আজকের দিনের অনেক ভাবনার, অনেক উদ্বেগের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু এমনও তো হতে পারে, মানুষ আসলে একই ‘লেখা’কে মোটেই আর আগের মতো করে দাম দিচ্ছে না, যদিও তারা হয়তো ভাবছে যে দিচ্ছে। ‘আজকের দিনের হোমার’ (Homer) তো আর মধ্যযুগের হোমারের মতো নন। কিংবা ‘আমাদের শেক্সপিয়র’ও তো আর তার নিজের জমানার শেক্সপিয়রের মতো নন। আসলে, প্রত্যেকটা যুগ, প্রত্যেকটা কাল তার নিজের মতো করে, নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী এক ‘অন্যরকম হোমার’ বা ‘অন্যরকম শেক্সপিয়র’ গড়ে নিয়েছে। আর সেইসব লেখার মধ্যে নিজেদের পছন্দসই দামি বা কমদামি উপাদান, জরুরি বা অদরকারি বিষয় খুঁজে নিয়েছে – যদিও সেই জিনিসগুলো হয়তো আদতে একই রকম নয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের মানেও পাল্টে গেছে।

অন্যভাবে বলতে গেলে, ব্যাপারটা দাঁড়ায় অনেকটা এইরকম: সব সাহিত্যই আসলে, যে সমাজের মানুষজন সেটা পাঠ করছে, তাদের হাতেই যেন নতুন করে ‘সৃষ্টি’ হয়ে যায়। তা তারা নিজেরা সেটা বুঝুক আর নাই বুঝুক। শুধু তাই নয়, সেই লেখার অর্থটাও তখন নতুন করে জন্ম নেয়। তবে, কোনো সাহিত্য পড়া মানেই তো এক ধরনের ‘নতুন করে সৃষ্টি করা’। একটা লেখা, সাথে তার আজকের দিনের যে কদর, যে দাম – এই দুটো জিনিসই যখন নতুন প্রজন্মের হাতে যায়, নতুন পাঠকদের কাছে পৌঁছে যায়, তখন তারা অমোঘভাবেই বদলে যায়, এমনভাবে বদলে যায় যে প্রায় চেনাই যায় না। ঠিক এই কারণেই, সাহিত্য বলে যা আমরা জানি, যা নিয়ে এত আলোচনা করি, সেটা এমন একটা টলায়মান, অস্থির, পরিবর্তনশীল ব্যাপার। আমি কিন্তু এটা বলছি না যে, মূল্য বিচার (value-judgements) নেহাতই ‘ব্যক্তিবাচক’ (subjective) বা মনগড়া ব্যাপার বলেই সাহিত্যের দুনিয়াটা এত নড়বড়ে, এত টলোমলো। এই ভাবনাটা অনেকটা এরকম: যেন গোটা জগতটা দুটো পরিষ্কার ভাগে বিভক্ত। একদিকে আছে গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল স্টেশনের মতো একেবারে বাস্তব, যা চাইলেই যাচাই করে নেওয়া যায় এমন সব তথ্য, যা ‘বাইরে’ থেকে দেখা যায়, সকলের পক্ষেই দেখা সম্ভব। অন্যদিকে আছে আমাদের ‘ভেতরের’ সব ভালো-লাগা, মন্দ-লাগা, ব্যক্তিগত সব খেয়ালখুশি। যেমন, কলার প্রতি আমার একটা বিশেষ দুর্বলতা থাকতে পারে, অথবা ইয়েটসের (Yeats) কোনো কবিতার ছন্দ শুনে আমার মনে হতে পারে, কবি যেন কখনও গর্জে উঠছেন, আবার কখনও বা কঠিন এক বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে শান্ত ও সমাহিত হয়ে যাচ্ছেন। এই মত অনুসারে, সত্য হলো সকলের জন্য, একেবারে সন্দেহাতীত, প্রশ্নাতীত। কিন্তু মূল্যবোধ হলো একান্তই আপন ব্যাপার, তার কোনো শক্ত ভিত্তি নেই, ওসব নাকি হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়। দেখুন, ‘এই গির্জাটা ১৬১২ সালে তৈরি হয়েছিল’ – এটা একটা সোজাসাপ্টা তথ্য, একটা খাঁটি সত্য। আবার যদি বলি, ‘এই গির্জাটা বারোক আমলের (baroque architecture) একখানা অসাধারণ নিদর্শন’ – তবে সেটা হয়ে দাঁড়ায় একটা মূল্য বিচার, একটা পছন্দের বহিঃপ্রকাশ। দুটোর মধ্যে যে আকাশ-পাতাল তফাত, তা তো আর বুঝিয়ে বলার দরকার নেই।

কিন্তু একটা কথা ভাবুন তো। ধরুন, আমি এক বিদেশি সাহেবকে ইংল্যান্ডের শহর ঘোরাতে নিয়ে গেছি। তাকে বললাম, ‘এই যে গির্জাটা দেখছেন, এটা বানানো হয়েছিল ১৬১২ সালে।’ শুনে সে তো অবাক! হয়তো সে জিজ্ঞেস করল, ‘আশ্চর্য তো! আপনারা কেবল এসব বাড়ির তৈরির সাল-তারিখ নিয়েই পড়ে আছেন দেখছি! কবে কোনটা তৈরি হলো, তা নিয়ে আপনাদের এত মাথাব্যথাই বা কিসের? এই যে সবকিছু খুঁড়ে খুঁড়ে গোড়া বের করার এত শখ, এর কারণটা কী বলুন তো?’ সে আরও বলতে পারত, ‘দেখুন, আমরা যেখান থেকে এসেছি, সেখানে কবে কী তৈরি হলো, এসবের কোনো হিসেব রাখাই হয় না। আমরা বরং বাড়িগুলোকে অন্যভাবে চিনি। যেমন ধরুন, কোনটা উত্তর-পশ্চিম দিকে মুখ করে আছে, আর কোনটা দক্ষিণ-পূর্ব দিকে, সেই হিসেবে।’ ওই কথাগুলো শুনলেই হয়তো আমার নিজের মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা মূল্যবোধের এক অচেতন কাঠামো (unconscious system of value-judgements) বেরিয়ে আসত, যার হদিস হয়তো আমি নিজেও জানতাম না। আমার ওই সাদামাটা, নিরেট তথ্যের আড়ালেই তো সেগুলো ঘাপটি মেরে ছিল, তাই না? এই যে বিশেষ কিছু জিনিসের ওপর জোর দেওয়ার ঝোঁক, এগুলো হয়তো ‘বাহ্, গির্জাটা তো বারোক আমলের একটা চমৎকার নিদর্শন!’ – এমন সরাসরি মূল্য বিচার নয়। তবে এগুলোও তো এক ধরনের দাম দেওয়া, কদর করার ব্যাপার, তাই না? আমি যতই নিরেট বাস্তব, যতই খাঁটি সত্য বলার ভান করি না কেন, এই ধরনের মূল্য চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা থেকে আমার রেহাই নেই।

আমরা যে বুক ফুলিয়ে জাহির করি, ‘এটা একেবারে খাঁটি সত্যি কথা’, সেগুলোও তো আসলে এক ধরনের কথাই, এক ধরনের বয়ান। আর সেইসব বয়ানের পেছনেও কিন্তু হাজারটা সাতপাঁচ ভাবনার, অনেক গুরুত্ব বিচারের একটা লম্বা ফিরিস্তি ঘাপটি মেরে থাকে। যেমন ধরুন: কথাটা কি আদৌ বলার মতো কিছু? নাকি এর চেয়েও জরুরি, আরও কাজের কথা বলার জন্য পড়ে আছে? আমি যে কথাটা বলছি, আমি কি তা বলার মতো কেউ? আমার কি সেই মুরোদ বা যোগ্যতা আছে? কথাটা যে সত্যি, তার প্রমাণ কি আমি হাজির করতে পারব? আর আপনি যে শুনছেন, আপনার কি এই কথা শোনার মতো সময় বা ইচ্ছে আছে, নাকি এটা আপনার কাছে নেহাতই ফালতু প্যাঁচাল? সবশেষে, কথাটা বলে আখেরে ফায়দাটাই বা কী হবে? এমন হাজারটা প্রশ্ন, হাজারটা ভাবনা কিন্তু আমাদের প্রতিটা আপাত নিরীহ তথ্যের আড়ালেও চুপিসারে বসে থাকে। একটা পানশালার আড্ডার কথাই ভাবুন না। সেখানে হয়তো কিছু খবরাখবর, কিছু তথ্য এদিক-ওদিক চালাচালি হয় ঠিকই। তবে সেইসব কথার মধ্যে আসল যে জিনিসটা দাপিয়ে বেড়ায়, সেটা হলো – ভাষাবিদরা যাকে বলেন ‘ফ্যাটিক’ (phatic) বা সামাজিক যোগাযোগের উপাদান। মানে, সেখানে আসল মতলব তথ্য দেওয়া-নেওয়া নয়, বরং শুধু কথা বলার জন্যই কথা বলা। শুধুই একটু যোগাযোগ রাখা, একটা সম্পর্ক তৈরি করা বা টিকিয়ে রাখা, সেটাই হলো গিয়ে আসল ধান্দা। আপনার সঙ্গে যখন আমি ওই যে আবহাওয়া কেমন, এই নিয়ে দুটো কথা পাড়ি, তখন আসলে আমি প্রকারান্তরে এটাও বুঝিয়ে দিচ্ছি যে, আপনার সঙ্গে কথাবার্তা বলাটা আমার কাছে ফেলনা নয়, আমি সেটাকে দাম দিচ্ছি। আপনি কথা বলার মতো একজন মানুষ, আপনার সাথে আলাপ করাটা বেহুদা নয়। আমি অসামাজিক নই, কিংবা ধরুন আপনার হাবভাব বা পোশাক-আশাক নিয়ে কোনো টিপ্পনী কাটার জন্য এখানে আসিনি। নেহাতই মামুলি ভদ্রতা, সামাজিকতা, আর কী!

এই দিক থেকে দেখলে, পুরোপুরি নিরপেক্ষ কথা বলে আসলে কিছুই হয় না, সব কথার পেছনেই কিছু না কিছু কলকাঠি নাড়তে থাকে। হ্যাঁ, আমাদের সমাজে একটা গির্জা কবে তৈরি হয়েছিল, সে কথা বলাটাকে তার স্থাপত্য নিয়ে রায় দেওয়ার চেয়ে বেশি নিরপেক্ষ, বেশি সাদামাটা বলে মনে করা হয় ঠিকই। কিন্তু এমন পরিস্থিতিও তো আসতে পারে, যেখানে ওই প্রথম নিরীহ কথাটা দ্বিতীয়টার চেয়েও বেশি ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ বা ‘মতাদর্শ প্রভাবিত’ হয়ে দাঁড়াবে। হয়তো এমন হলো, ‘বারোক’ আর ‘অসাধারণ’ (magnificent) শব্দ দুটো লোকের মুখে মুখে প্রায় একই মানে বইতে শুরু করেছে, দুটোই বাহবা পাওয়ার যোগ্য বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে, আমাদের মধ্যে কিছু গোঁয়ার, পুরোনো ধ্যানধারণার মানুষ হয়তো তখনও সেই বিশ্বাস আঁকড়ে বসে আছে যে, একটা বাড়ি ঠিক কবে তৈরি হলো, সেই তারিখটাই আসল, সেটাই সবচেয়ে জরুরি। তখন, আমার ওই সাদামাটা, তথ্যভিত্তিক কথাটাই হয়তো ওই বিশেষ ধরনের গোঁয়ার্তুমির একটা গোপন ইশারা বা সংকেত বলে ধরে নেওয়া হবে। আমরা যা কিছুই বলি না কেন, তার সবই আসলে মূল্যবোধের (value-categories) একটা অদৃশ্য জালের ফাঁসে, একটা ছাঁচের ভেতরে ঘুরপাক খেতে থাকে। আর সত্যি বলতে কী, এই মূল্য চাপানোর কায়দাগুলো না থাকলে আমাদের একে অপরের সঙ্গে বলার মতো কোনো কথাই থাকত না, সব কেমন যেন পানসে, অর্থহীন হয়ে যেত। ব্যাপারটা কিন্তু এমন নয় যে, আমাদের মগজে আগে থেকে কিছু খাঁটি, নিরেট জ্ঞান (factual knowledge) জমা হয়ে আছে, যা কিনা পরে বিশেষ কোনো মতলবের টানে বা ব্যক্তিবাচক বিচার-বিবেচনার প্যাঁচে পড়ে বেঁকেচুরে যায়, তার চেহারাটাই পাল্টে যায় – যদিও তেমনটা যে একেবারেই ঘটে না, তা অস্বীকার করছি না। আসল ব্যাপারটা হলো, বিশেষ কোনো আগ্রহ, বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য বা কৌতূহল না থাকলে আমাদের কোনো জ্ঞানই জন্মাত না। কারণ, তখন কিছু জানার জন্য, কোনো কিছু নিয়ে মাথা ঘামানোর জন্য আমরা কোনো গরজই বোধ করতাম না, কোনো মানেই খুঁজে পেতাম না। আগ্রহ বা উদ্দেশ্যই আমাদের জ্ঞানের একটা মূল উপাদান (constitutive), সেটা কেবল একটা কুসংস্কার বা পক্ষপাতিত্ব নয় যা আমাদের জ্ঞানকে নষ্ট করে দেয় বা বরবাদ করে। জ্ঞানকে সব ধরনের ‘মূল্যবোধ থেকে মুক্ত’ (value-free) বা পুরোপুরি ‘নিরপেক্ষ’ হতে হবে – এই যে দাবিটা, এটাও কিন্তু নিজেই একটা মূল্য বিচার, একটা বিশেষ ধরনের মূল্য চাপানো।

কলা ভালো লাগাটা হয়তো আপনার কাছে নেহাতই ব্যক্তিগত, একেবারে আপনার নিজের ব্যাপার বলে মনে হতে পারে, যদিও সত্যি বলতে কী, এ নিয়েও প্রশ্ন তোলার ঢের অবকাশ আছে। আমার খাওয়া-দাওয়ার অভ্যাসগুলো যদি একটু খুঁটিয়ে, ভালো করে পরখ করা যায়, তাহলে হয়তো এমন সব ব্যাপার বেরিয়ে আসবে, যার পেছনে লুকিয়ে আছে ছোটবেলার কিছু না-ভুলতে-পারা স্মৃতি, বাবা-মা-ভাইবোনের সঙ্গে আমার সহজ-সরল বা হয়তো খানিকটা প্যাঁচালো সম্পর্ক, সেই সাথে আরও অনেক সামাজিক রীতিনীতি, আচার-ব্যবহার – যেগুলো মোটেই ব্যক্তিগত বা আপনার একান্ত নিজের ব্যাপার নয়, বরং রেল স্টেশনের মতোই সবার জন্য খোলা, সবার নজরেই পড়ে। এই কথাটা আরও বেশি করে খাটে সেইসব গভীর বিশ্বাস আর স্বার্থের বেলায়, যা নিয়ে আমি একটা বিশেষ সমাজে জন্মেছি এবং বেড়ে উঠেছি। যেমন, আমার নিজের শরীরের যত্ন নেওয়া উচিত, এটা একটা ভালো কাজ; কিংবা নারী-পুরুষের মধ্যে যে ফারাক, সেটা প্রকৃতিরই কেরামতি, এতে মানুষের হাত নেই; অথবা মানুষ নামের জীবটা কুমিরের চেয়ে অনেক বেশি দামি, অনেক বেশি জরুরি – এইসব বিশ্বাস। আমরা হয়তো এটা-ওটা নিয়ে তর্ক জুড়ে দিতে পারি, মতের অমিল হতে পারে। কিন্তু সেটাও আমরা পারি, কারণ আমাদের সবার মধ্যেই কিছু জিনিস দেখার, কিছু জিনিসকে গুরুত্ব দেওয়ার বা কদর করার ব্যাপারে কিছু ‘গভীর’ বোঝাপড়া আছে। এই মিলগুলো আমাদের সামাজিক জীবনের সঙ্গে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে যে, সেই জীবনটাকে একেবারে উল্টে না দিলে এগুলোকেও বদলানো প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।

আমি যদি জন ডানের কোনো একটা বিশেষ কবিতা অপছন্দ করি, তার জন্য কেউ আমাকে শাস্তি দেবে না, জেলে ভরবে না। কিন্তু আমি যদি জোর গলায় বলি, ডানের লেখা মোটেই সাহিত্য নয়, সাহিত্যের কাতারেও পড়ে না, তাহলে বিশেষ কিছু গোলমেলে পরিস্থিতিতে আমার চাকরিটাও কিন্তু যেতে পারে! আমি স্বাধীনভাবে লেবার পার্টিকে ভোট দিই বা কনজারভেটিভ পার্টিকেই সমর্থন করি, তাতে সাধারণত কারও কিছু বলার থাকে না। কিন্তু আমি যদি এই বিশ্বাস মনেপ্রাণে আঁকড়ে ধরে সেই অনুযায়ী কাজ করতে শুরু করি যে, এই যে ভোটের মাধ্যমে পছন্দের দল বেছে নেওয়া, এর আড়ালেই একটা গভীর কুসংস্কার, একটা ভুল ধারণা ঘাপটি মেরে আছে – অর্থাৎ, গণতন্ত্র মানেই যে কেবল কয়েক বছর পর পর ব্যালট পেপারে একটা ক্রস চিহ্ন দেওয়া, আর কিছুই নয়, এই সীমিত ধারণাটা – তাহলে কিন্তু কোনো কোনো বেকায়দা বা আজগুবি পরিস্থিতিতে আমার জেল পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে।

আমরা যে প্রতিদিন নানারকম কথাবার্তা বলি, তার গভীরে কিন্তু মূল্যবোধের একটা কাঠামো, একটা মাপকাঠি ঠিকই কলকাঠি নাড়ে। এই যে একটা প্রায় অদৃশ্য, আস্ত কাঠামো, ওটাই আসলে ‘মতাদর্শ’ (ideology) বলতে যা বোঝায়, তার একটা জরুরি অংশ। ‘মতাদর্শ’ শব্দটাকে যদি খুব সহজ করে, চলতি ভাষায় বুঝতে চাই, তাহলে বিষয়টা দাঁড়ায় অনেকটা এরকম: আমাদের মুখের কথা, আমাদের মনের ভেতরের সব বিশ্বাস, ধ্যানধারণা – এই সবকিছুই কিন্তু আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে বিশেষ এক ক্ষমতার সম্পর্কের (power-relations) সঙ্গে। অর্থাৎ, আমরা যে সমাজে বাস করি, সেখানকার ক্ষমতার নকশাটা কেমন, কে বা কারা ছড়ি ঘোরাচ্ছে, আর কারা সেই ছড়ি ঘোরানো মুখ বুজে মেনে নিচ্ছে – এই সবকিছুর সঙ্গেই। এই যে একটা জটিল বাঁধন, একটা অদৃশ্য সুতোর টান, এটাই হলো গিয়ে মতাদর্শ। এই সহজ সংজ্ঞাটা যদি আমরা মেনে নিই, তাহলে বলতে হয়, আমাদের সব ধরনের বিচার-বুদ্ধি, সব ধরনের শ্রেণিবিন্যাসকেই কিন্তু ঢালাওভাবে, এক কথায় মতাদর্শগত বলে দাগিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। যেমন ধরুন, আমরা সাধারণত নিজেদেরকে এমনভাবে দেখি, যেন আমরা সবসময় সামনের দিকে, ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছি (যদিও এমন সমাজও আছে, যারা মনে করে তারা আসলে পেছনের দিকে, অতীতের দিকে হাঁটছে)। এই যে দেখার ভঙ্গি, এটা আমাদের সমাজের ক্ষমতার কাঠামোর সঙ্গে বেশ জুতসইভাবে জুড়ে থাকতে পারে ঠিকই, কিন্তু সবসময় যে সব জায়গায় এমনটাই ঘটবে, তেমন কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। ‘মতাদর্শ’ বলতে আমি কেবল মানুষের মনের গভীরে গেঁথে থাকা, প্রায়শই অবচেতন বা না-জানা কিছু বিশ্বাসকেই বোঝাচ্ছি না। আমি আরও খোলসা করে সেইসব অনুভূতি, কোনো কিছুকে গুরুত্ব দেওয়ার বা কদর করার যে সব ভঙ্গি, জগতটাকে দেখার নানান রকম চলন বা দৃষ্টিকোণ, সেইসাথে সেইসব বিশ্বাসের কথা বলছি, যেগুলো কোনো না কোনোভাবে সমাজে বিদ্যমান ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা এবং একইসাথে নতুন করে সেই ক্ষমতা কায়েম করার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই ধরনের বিশ্বাসগুলো যে মোটেই ব্যক্তিবাচক খেয়ালখুশির ব্যাপার নয়, নিছক মনের খামখেয়ালিপনা নয়, একটা সাহিত্যের নজির টানলেই ব্যাপারটা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে, কোনো ধোঁয়াশা থাকবে না।

আই. এ. রিচার্ডস (I. A. Richards) ছিলেন ক্যামব্রিজের এক নামকরা সমালোচক। তাঁর বিখ্যাত বই ‘প্র্যাকটিক্যাল ক্রিটিসিজম’ (Practical Criticism) (১৯২৯), সেখানে তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন, সাহিত্যের গুণাগুণ বিচার বা তার কদর বোঝার ব্যাপারগুলো আসলে কতটা খামখেয়ালি আর ব্যক্তিবাচক হতে পারে। এই ব্যাপারটা হাতে-কলমে দেখানোর জন্য তিনি তাঁর কিছু স্নাতক স্তরের ছাত্রছাত্রীর হাতে একগাদা কবিতা ধরিয়ে দিলেন। তবে একটা প্যাঁচ কষলেন – কবিতাগুলোর নাম, এমনকি কবিদের নাম পর্যন্ত, সব গায়েব করে দিলেন। তারপর বললেন, “নাও, এবার দেখি কেমন বিচার করতে পারো তোমরা।” ফল যা বেরোল, তা দেখলে তাজ্জব বনে যেতে হয়। একেকজন দিল একেক রকম রায়। সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, ঝানু কবিরা পেলেন কম নম্বর, আর যত অখ্যাত, অচেনা লেখক, তাদের বেলায় দেখা গেল প্রশংসার বন্যা। আমার কাছে কিন্তু এই পুরো ব্যাপারটার সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক দিকটা হলো, রিচার্ডস নিজেও হয়তো ঠাহর করে উঠতে পারেননি যে, এই আপাতদৃষ্টিতে নানা রকম মতপার্থক্যের গভীরেও মূল্যবোধের (unconscious valuations) ক্ষেত্রে একটা বেশ বড়সড়, প্রায় অলিখিত বোঝাপড়া ছিল। রিচার্ডসের সেই ছাত্রছাত্রীরা সাহিত্য নিয়ে যা যা লিখেছিলেন, সেগুলো পড়লে অবাক হতে হয়। তারা সাহিত্যকে কীভাবে দেখে, একটা কবিতার কাছ থেকে তাদের ঠিক কী পাওনা, কবিতা পড়ে কোন ধরনের আরাম বা আনন্দ তারা পেতে চায় – এইসব ব্যাপারে তাদের মধ্যে ছিল এক অদ্ভুত, প্রায় অবিশ্বাস্য রকমের মিল। অবশ্য, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। পরীক্ষায় যারা বসেছিল, তারা তো সবাই ছিলেন সেই ১৯২০-এর দশকের তরুণ, শ্বেতাঙ্গ, সমাজের উঁচুতলার বা উঁচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়ে, নামকরা সব প্রাইভেট স্কুলে পড়াশোনা করা ইংরেজ। তাঁরা একটা কবিতার প্রতি কীভাবে সাড়া দিয়েছিল, সেটা কিন্তু কেবল ‘সাহিত্যিক’ কারণের ওপর ভর করে ছিল না। তদের সমালোচনার ধরনের সাথে তাদের আরও অনেক গভীর কুসংস্কার, তাদের মনের ভেতরকার পুষে রাখা বিশ্বাসগুলো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল। এটা কিন্তু কোনো দোষের ব্যাপার নয়, এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। এমন কোনো সমালোচনাই নেই, যা এভাবে জড়িয়ে থাকে না। আর সেকারণেই, ‘খাঁটি’ বা ‘বিশুদ্ধ’ সাহিত্যিক সমালোচনা অথবা ব্যাখ্যা বলে আদতে কিছুই হয় না, ওটা একট ধাপ্পাবাজ্জি। দোষ যদি এখানে কারও দিতেই হয়, তবে সেটা আই. এ. রিচার্ডসের নিজের। তিনিও ছিলেন একজন তরুণ, শ্বেতাঙ্গ, উঁচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্যামব্রিজের অধ্যাপক। ফলে, তিনি এমন একটা আগ্রহ এবং মূল্যবোধের জগৎকে (a context of interests) পুরোপুরি নিরপেক্ষভাবে, বাইরে থেকে দেখতে পারেননি, যার অনেকটাই আসলে তিনি নিজেও মনেপ্রাণে মেনে চলতেন। ঠিক একারণেই, মূল্যায়ন বা কোনো কিছুকে কদর করার এই যে ছোটখাটো, আপাতদৃষ্টিতে ‘ব্যক্তিবাচক’ (subjective) ফারাকগুলো, সেগুলো যে আসলে একটা বিশেষ, সামাজিকভাবে গড়ে ওঠা জগৎ দেখার দৃষ্টিভঙ্গির (socially structured way of perceiving the world) ভেতরেই কাজ করে চলেছে, সেই ব্যাপারটা তিনি পুরোপুরি আঁচ করতে পারেননি।

সাহিত্যকে যদি ‘বস্তুনিষ্ঠ’ (objective), একটা ধরাবাঁধা, বর্ণনামূলক ভাগ হিসেবে দেখা না যায়, তাহলে এও কিন্তু বলা যাবে না যে, সাহিত্য কেবল সেটাই, যা মানুষ নিজের খেয়ালখুশি মতো, যখন যা ইচ্ছে হলো সাহিত্য বলে দেগে দেয়। কেন যাবে না? কারণ, এই যে মূল্য বিচার বা কোনো কিছুকে গুরুত্ব দেওয়ার উপলব্ধি, এর মধ্যে খেয়ালখুশির ছিটেফোঁটাও নেই। এদের শেকড় যে কোথায়! হয়তো আমাদের বিশ্বাসের আরও অনেক গভীর সব কাঠামোর মধ্যে, যা কিনা সুউচ্চ এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের মতোই অটল, অনড়, সহজে টলে না এমন বলে মনে হয়। তাহলে এতক্ষণের কচকচানির পর আমরা কী বুঝলাম? শুধু এটুকুই নয় যে, সাহিত্য জিনিসটা পোকা-মাকড়ের মতো কোনো বাস্তব, হাতেনাতে ধরা যায় এমন বস্তু নয়, যার একটা নির্দিষ্ট গড়ন বা চেহারা আছে। সেই সাথে এটাও বুঝলাম, যে মূল্য বিচারের (value-judgements) নিক্তিতে একে মাপা হয়, ভালো বা মন্দ বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়, তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যায়, মোটেই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না। তার চেয়েও বড় কথা, এই যে মূল্য চাপানোর ধারাগুলো বা কোনো কিছুকে কদর করার ভঙ্গি, সেগুলো নিজেরাই আবার সামাজিক মতাদর্শের সঙ্গে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে যে, একটা সময় পর এগুলো আর নিছক ব্যক্তিবাচক রুচি বা পছন্দের ব্যাপার থাকে না। এগুলো তখন হয়ে ওঠে সেইসব গভীর অনুমান বা অলিখিত নিয়মের বিষয়, যার মাধ্যমে সমাজের বিশেষ কিছু গোষ্ঠী অন্যদের ওপর নিজেদের কর্তৃত্ব কায়েম করে এবং সেই কর্তৃত্ব যুগ যুগ ধরে টিকিয়েও রাখে। কথাটা যদি আপনাদের কাছে বাড়াবাড়ি রকমের দাবি, আজগুবি গল্প, অথবা নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত কুসংস্কার বা মনগড়া আষাঢ়ে গল্প বলে মনে হয়, তাহলে আমরা বরং ইংল্যান্ডে ‘সাহিত্য’ নামক এই রহস্যময় বস্তুটা কীভাবে একদিন হঠাৎ করে গজিয়ে উঠল, সেই কাহিনিটা একটু নেড়েচেড়ে দেখতে পারি, কী বলেন?

 

 

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.