
(সাহিত্যের অর্থ অনুসন্ধানে আমরা সচরাচর রচয়িতার জীবন ও অভিপ্রায়কেই মূল চাবিকাঠি মনে করি। কিন্তু প্রখ্যাত ফরাসি চিন্তাবিদ রোলাঁ বার্ত তাঁর যুগান্তকারী “রচয়িতার মৃত্যু” (The Death of the Author) প্রবন্ধে এই চিরাচরিত ধারণাকেই চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে রচনার জন্মলগ্নে রচয়িতার চিরাচরিত কর্তৃত্বের অবসান ঘটে এবং পাঠ বা পাঠকই সেখানে মুখ্য হয়ে ওঠেন, উন্মোচন করেন অর্থের বহুমাত্রিক দিগন্ত। এই প্রবন্ধে বার্ত সেই বিপ্লবী ভাবনারই বিশদ আলোচনা করেছেন।)
বিখ্যাত ফরাসি ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার বালজাক (Honoré de Balzac) তার ‘সাঁরাসিন’ (Sarrasine) গল্পে এক অদ্ভুত চরিত্রের কথা বলেছিলেন। চরিত্রটা খোজা হওয়া এক পুরুষ গায়কের (castrato), যে কিনা নারীর ছদ্মবেশে থাকে। তার বর্ণনা দিতে গিয়ে বালজাক লিখলেন, “আহা, নারীমন! হুট করে ভয় পায়, আবার খামখেয়ালীপনাও কম নয়। সহজাত কিছু ভীতি যেমন আছে, তেমনি অকারণে বীর বনে যায়। কখনো দুঃসাহসী অভিযানে নামে, তো পরক্ষণেই তার অনুভূতি রেশমের মতো কোমল।” কিন্তু এই কথাটা কার? গল্পের সেই নায়কের, যে মেয়েটার আড়ালে থাকা পুরুষটাকে পাত্তাই দিতে চায় না? নাকি স্বয়ং বালজাকের, যিনি নারীদের নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে একটা দর্শন দাঁড় করিয়েছেন? অথবা এমনও হতে পারে, রচয়িতা বালজাকের সাহিত্যিক কিছু ভাবনাচিন্তা এর মাঝে কাজ করছে। এই যে কথাগুলো, এগুলো কি জীবনের কোনো গভীর সত্য? নাকি শুধুই কোনো রোমান্টিক মনস্তত্ত্বের কথা?
সত্যি বলতে কী, এর উত্তর আমাদের জানা নেই। কোনোদিন হয়তো জানাও যাবে না। কারণটা খুব সোজা। প্রতিটা লেখাই তো আসলে অনেকগুলো অস্পষ্ট স্বরের একটা মিশেল, সব সেখানে মিলেমিশে একাকার। সাহিত্য তো সেই সুর খুঁজে বের করার চেষ্টা, যার উৎসটা ঠিক কোথায়, আমরা ধরতে পারি না। সাহিত্য বড় অদ্ভুত জিনিস – কখনো নিরপেক্ষ, কখনো বহু উপাদানে মিশ্রিত, কখনো বা সাপের মতো আঁকাবাঁকা তার চলন। এখানে এসে সব পরিচয় (subject) কেমন যেন হারিয়ে যায়। এ এমনই এক মায়াজাল, যেখানে সব পরিচয় গুলিয়ে যায়। এমনকি যে হাতটা কলম ধরে লেখে, তার নিজের পরিচয়টাও ধীরে ধীরে মুছে যেতে থাকে। হয়তো চিরকাল এরকমই ছিল ব্যাপারটা। যখন কোনো গল্প বলা হয় শুধু বলার আনন্দের জন্য, বাস্তবের ওপর তার কোনো আঁচড় ফেলার উদ্দেশ্য থাকে না, অর্থাৎ যখন তা প্রতীকের ইশারা ছাড়া আর কিছুই নয়, ঠিক তখনই এই ছাড়াছাড়িটা ঘটে। গলার স্বর তখন তার মালিককে ভুলে যায়, রচয়িতা যেন নিজের মৃত্যুর দরজায় কড়া নাড়েন। আর, ঠিক সেই মুহূর্তেই লেখাটা যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে।
তবে হ্যাঁ, এই ব্যাপারটা নিয়ে মানুষের ভাবনা কিন্তু সবসময় একরকম ছিল না। সেই পুরনো দিনের আদিম সমাজে গল্প বলাটা কখনোই একজনের ব্যাপার ছিল না। গল্প বলতেন একজন মাধ্যম, কখনো শাম্যান, কখনোবা কথক। তার সেই পরিবেশনা হয়তো বাহবা পেত, মানে, গল্প বলার কৌশলে তার মুনশিয়ানা সবাই মেনে নিত, কিন্তু তার ভেতরের ‘জিনিয়াস’ বা অসামান্য প্রতিভার কথা কেউ ভাবত না। আসলে, এই যে ‘রচয়িতা’ ব্যাপারটা, তা আধুনিক কালেরই আবিষ্কার। আমাদের এই সমাজই তাকে বানিয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। সেই মধ্যযুগের শেষ দিকে, যখন ইংরেজি অভিজ্ঞতাবাদ (English empiricism), ফরাসি যুক্তিবাদ (French rationalism) এবং রিফর্মেশনের (Reformation) ব্যক্তিগত বিশ্বাসের হাওয়া বইতে শুরু করল, মানুষ তখন নিজের মর্যাদাকে, আরও খোলাসা করে বললে ‘মানুষ’ নামক ব্যক্তিটার গুরুত্বকে নতুন করে চিনতে শিখল। ঠিক তখন থেকেই এই রচয়িতার আবির্ভাব।
সাহিত্যের উঠানে তাই দৃষ্টবাদের (positivism) এত দাপট দেখলে অবাক হওয়ার কিছু থাকে না। এই দৃষ্টবাদ জিনিসটা তো আসলে পুঁজিবাদী মতাদর্শের একেবারে গোড়ার কথা, তারই অবশ্যম্ভাবী ফল। তাই দেখবেন, এই মতবাদই সবসময় রচয়িতার ‘ব্যক্তি’ সত্তাটার ওপরেই বেশি করে আলো ফেলেছে। যদি সাহিত্যের ইতিহাসের পাতা ওল্টান, কিংবা ধরুন রচয়িতাদের জীবনের নানান গল্প পড়ছেন, অথবা পত্রিকার কোনো সাক্ষাৎকারে চোখ বোলাচ্ছেন – দেখবেন, সবখানেই রচয়িতার সেই পুরনো, চেনা আধিপত্য। অবাক করা ব্যাপার হলো, সাহিত্যিকদের নিজেদের মনের গভীরেও কিন্তু সেই রচয়িতার দাপট আজও একটুও কমেনি, আগের মতোই রয়ে গেছে। তারা তাদের ব্যক্তিগত ডায়েরি, তাদের দিনযাপনের গল্প এবং তাদের লেখালেখির মধ্যে একটা গভীর যোগসূত্র খুঁজে বের করতে সারাক্ষণ ব্যস্ত। আজকের দিনে সংস্কৃতির দিকে তাকালে সাহিত্যের যে ছবিটা আমাদের চোখে ভাসে, মনে হয় যেন এক স্বৈরাচারী রচয়িতাই তার সব কলকাঠি নাড়ছে। সবকিছুতেই যেন তার ব্যক্তিজীবন, তার ইতিহাস, তার ভালো লাগা মন্দ লাগা, তার যত আবেগ – এসবেরই জয়জয়কার। সাহিত্য সমালোচনাও তো বেশিরভাগ সময়ে এই একই পথে হাঁটে। তারা বলে বেড়ায়, বোদলেয়ারের লেখালেখি আসলে মানুষ বোদলেয়ারের জীবনের ব্যর্থতারই প্রতিচ্ছবি, ভ্যান গগের আঁকা ছবি তার মাথার পাগলামির প্রকাশ, আর চাইকোভস্কির সুর যেন তার ব্যক্তিগত বদভ্যাসেরই (vice) সুরলিপি। মানে, কোনো একটা সৃষ্টির ব্যাখ্যা খুঁজতে গিয়ে আমরা সবসময় সেই মানুষটার দিকেই আঙুল তুলি, যিনি ওটা তৈরি করেছেন। যেন, এই যে কল্পকাহিনী, তার কমবেশি স্বচ্ছ রূপকের (allegory) ভেতর দিয়ে শেষমেশ সেই একই মানুষ, অর্থাৎ রচয়িতা, তিনিই তার মনের গোপন কথাগুলো আমাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন।
রচয়িতার দাপট তো এখনও বেশ শক্তিশালী। তার উপর, সমালোচনার জগতে কিছু লোকজন সেই দাপট আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন বলা যায়। কিন্তু একটা ব্যাপার পরিষ্কার, অনেক দিন ধরেই কিছু রচয়িতা এই পুরনো খোলসটা ভাঙার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ফ্রান্সের কথাই ধরা যাক। সেখানে স্তেফান মালার্মে (Stéphane Mallarmé) নামে একজন ছিলেন। তিনিই বোধহয় প্রথম এই ব্যাপারটা পুরোপুরি ধরেছিলেন, এর জল যে কতদূর গড়াবে, সেটাও বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি বুঝলেন, এতদিন তো মানুষ ভাষার কর্তা সেজে বসেছিল, এবার স্বয়ং ভাষাকেই সেই সিংহাসনে বসাতে হবে। মালার্মের মতে, আমাদেরও তো সে কথাই মনে হয়, আসলে ভাষাই কথা বলে, রচয়িতা বেচারা তো নিমিত্ত মাত্র। লেখার আসল মানেটাই হলো, আগে থেকে থাকা এক ধরনের নৈর্ব্যক্তিকতার (preexisting impersonality) ভেতর দিয়ে এমন এক জায়গায় পৌঁছানো, যেখানে শুধু ভাষাই কাজ করে চলে, ‘পরিবেশন করে’, কোনো আলাদা ‘ব্যক্তিমানুষ’ নয়। তবে হ্যাঁ, এই নৈর্ব্যক্তিকতাকে আবার বাস্তববাদী উপন্যাস রচয়িতাদের সেই নিজেকে আড়াল করার নৈর্ব্যক্তিকতার (castrating objectivity) সাথে গুলিয়ে ফেললে কিন্তু চলবে না। মালার্মের পুরো কাব্যভাবনাটাই দাঁড়িয়ে আছে লেখার ভালোর জন্য রচয়িতাকে একটু চেপে রাখার ওপর। এর ফলে যা হয় – পাঠকের গুরুত্বটা আবার ফিরে আসে। সে কথা আমরা পরে দেখব।
এরপর এলেন পল ভালেরি (Paul Valéry)। তিনি আবার ‘আত্ম’ (Self) বিষয়ক মনস্তত্ত্বের প্যাঁচে পড়ে মালার্মের তত্ত্বটাকে একটু হালকা করে ফেলেছিলেন। কিন্তু তার আবার ধ্রুপদী সাহিত্যের দিকে খুব ঝোঁক ছিল। সেখান থেকে অলংকারশাস্ত্রের পাঠ নিতে গিয়ে তিনি রচয়িতাকে নিয়ে কেবলই প্রশ্ন তুলেছেন, ঠাট্টা করেছেন। সেই সাথে, রচয়িতার কাজকর্মের যে একটা ভাষাগত, অনেক সময়ই ‘আকস্মিক’ দিক আছে, সেটার ওপর জোর দিয়েছেন। তার সব গদ্যে তিনি একটা কথাই বলেছেন, সাহিত্যের আসল ব্যাপারটা হলো তার মুখের ভাষা। এর সামনে রচয়িতার ছোট হয়ে থাকাকে প্রশ্রয় দেওয়াটা তার কাছে একটা কুসংস্কারের বেশি কিছু মনে হয়নি। আর মার্সেল প্রুস্ত (Proust)-এর ক্ষেত্রে, বাইরে থেকে তার বিশ্লেষণ দেখলে মনে হবে যেন কতই না মনস্তত্ত্বের মারপ্যাঁচ। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তিনি রচয়িতা ও তার নিজের গড়া চরিত্রের সম্পর্কটাকে এমন এক চরম পরিশীলনের (extreme subtilization) জালে ফেলতেন, যে সবকিছু কেমন ধোঁয়াটে হয়ে যেত। এই যে ইচ্ছে করে সব একটু গুলিয়ে দেওয়া, একটা রহস্যের ধোঁয়াশা তৈরি করা, এই কাজটাই তিনি যেন একটা দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছিলেন। তিনি গল্পের কথককে এমনভাবে তৈরি করেননি যে সে কিছু দেখেছে বা অনুভব করেছে, এমনকি এমনও নয় যে সে লিখছে। বরং সে এমন একজন যে লিখবে। যেমন ধরুন, উপন্যাসের সেই ছেলেটা, যার বয়স বা পরিচয় আমরা ঠিক জানি না, সে লিখতে চায় কিন্তু পারে না। উপন্যাসটা শেষ হয় ঠিক তখনই, যখন তার পক্ষে লেখাটা সম্ভব হয়ে ওঠে। বলা যায়, প্রুস্ত আধুনিক লেখায় তুলে ধরেছেন এর নিজেরই মহাকাব্যিকতাকে। চালিত করেছেন একটা অপ্রত্যাশিত মোড়ের (radical reversal) দিকে। লোকে যেমন বলে, নিজের জীবনকে উপন্যাসে ঢেলে দেওয়া, তিনি তা না করে, নিজের জীবনটাকেই এমন একটা শিল্প বানিয়ে ফেলেছেন, যার নকশাটা ছিল তার নিজেরই লেখা বই। এতে করে, শার্লুস (Charlus) যে মঁতেস্কিউকে (Montesquiou) নকল করেনি, তা বুঝতে আমাদের মোটেও অসুবিধা হয় না। বরং ভেতরের সত্যিটা হলো, এই যে মঁতেস্কিউ, আমরা যাকে এত বড় ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব ভাবি, যার কাজকর্ম প্রায় কিংবদন্তির পর্যায়ে চলে গেছে, তিনি আসলে শার্লুসের কাছ থেকে তুলে আনা এক অতি সাধারণ, গুরুত্বহীন চরিত্র ছাড়া আর কিছুই নন।
এবারে সুররিয়ালিজমের কথায় আসি। আধুনিকতার সেই আদিকালের দিকে যদি তাকাই, তাহলে বলতেই হবে, ওরা কিন্তু ভাষাকে তার রাজার আসনটা পুরোপুরি ফিরিয়ে দিতে পারেনি। পারেনি, কারণ ভাষা তো একটা নিয়মকানুনের ব্যাপার। ওই আন্দোলন চেয়েছিল খুব রোমান্টিক কায়দায় সব ধরনের নিয়মকানুন ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে। কিন্তু সেটা ছিল একটা আকাশকুসুম ভাবনা, এক ধরনের অলীক বিধ্বংসী চেষ্টা। আসলে কোনো নিয়মকেই তো ধ্বংস করা যায় না, বড়জোর তা নিয়ে একটু ‘খেলা’ করা যেতে পারে। তবে হ্যাঁ, ওরা একটা কাজ করেছিল। অর্থের যে একটা গতে বাঁধা মানে এতদিন ধরে চলে আসছিল, সেই চিরাচরিত বাঁধনটাকে ওরা এক ঝটকায় দিয়েছিল ছিঁড়ে (এটাই ছিল ওদের সেই বিখ্যাত সুররিয়ালিস্ট ‘ঝাঁকুনি’ বা ‘jolt’)। আবার, মনের গহিনে যে সব ভাবনাচিন্তা লুকিয়ে থাকতো, অবহেলায় পড়ে থাকতো, সেগুলোকে খুব দ্রুত, কোনো রকম বাছবিচার না করে কাগজের বুকে ফুটিয়ে তোলার একটা নতুন ধারাও তৈরি করেছিল (একে বলে স্বতঃস্ফূর্ত লিখন বা automatic writing)। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সম্মিলিত লিখনের (Collective Writing) সেই রীতি, আর তার সূত্রে পাওয়া কত যে বিচিত্র অভিজ্ঞতা। এসব করে সুররিয়ালিজম রচয়িতার সেই দেবতাতুল্য ভাবমূর্তিটাকে বেশ খানিকটা মাটির কাছাকাছি (secularize) নামিয়ে আনতে সাহায্য করেছিল। সবশেষে, সাহিত্যের ওই চেনা গণ্ডিটার বাইরে (যদিও আজকাল আর কেই বা ওসব ভাগাভাগি নিয়ে মাথা ঘামায়!), ভাষাবিজ্ঞানও এসে যেন এইমাত্র, রচয়িতার এই ভেঙে পড়ার খেলায়, একটা দামি বিশ্লেষণের হাতিয়ার হাতে তুলে দিল। ভাষাবিজ্ঞান আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে একটা ব্যাপার কিন্তু খুব পরিষ্কার করে দেখিয়েছে। এই যে আমরা কথা বলি, এই যে আমাদের বাচনভঙ্গি, সেটা আসলে একটা শূন্য কলসির মতো। বক্তারা এসে সেই কলসি ভরার ঢের আগেই, কলসিটা কিন্তু দিব্যি নিজের মতো করে কাজ চালিয়ে যেতে পারে। ভাষার দিক থেকে দেখলে, রচয়িতা হলেন গিয়ে সেই লোকটা যিনি লেখেন, ঠিক যেমন ‘আমি’ হলাম সেই লোকটা যে ‘আমি’ বলে। ভাষা চেনে একটা ‘কর্তা’ (subject), কোনো ‘ব্যক্তিমানুষকে’ (person) নয়। এই কর্তা, যাকে সংজ্ঞায়িত করা হয় কথার মধ্যে, কথার বাইরে সে শূন্য। এইটুকুই যথেষ্ট ভাষাকে দিয়ে ‘কাজ’ করিয়ে নেওয়ার জন্য, অর্থাৎ, তাকে পুরোপুরি ব্যবহার করে ফেলার জন্য।
রচয়িতার এই যে চলে যাওয়া, (ব্রেশট (Brecht) একে বলতেন এক সত্যিকারের “বিচ্ছিন্নতা” (alienation); মানে, সাহিত্য নামের বিশাল মঞ্চের এক কোণে রচয়িতা যেন ছোট্ট একটা মূর্তির মতো একটু একটু করে মিলিয়ে যাচ্ছেন), এটা কিন্তু শুধু ইতিহাসের কোনো ঘটনা নয়, কিংবা লেখার কোনো মামুলি কৌশলও নয়। এর ফলে আধুনিক লেখাটা (modern text) একেবারে আগাগোড়া বদলে যায়। অন্যভাবে যদি বলি, ব্যাপারটা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, লেখা তৈরি হওয়ার এবং পড়ার ভঙ্গিটাই কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গেছে। এই নতুন রীতিতে রচয়িতা যেন লেখার প্রতিটা স্তরে, প্রতিটা বাঁকে, সবার চোখের সামনে থেকেও নিজেকে আড়াল করে রাখেন। প্রথমেই বলি, সময়ের যে হিসাবটা, সেটা তখন আর আগের মতো থাকে না। যখন আমরা কোনো রচয়িতার ওপর এক ধরনের বিশ্বাস রাখি, তখন তাকে আমরা সবসময় তার বইয়ের অতীত (past) বলেই ধরে নিই। বই আর রচয়িতা, দুটো যেন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা ছায়া, একটা আরেকটার আগে বা পরে। আমাদের মনের ভেতর এই ভাবনাটা কাজ করে যে, রচয়িতাই তো বইটাকে জন্ম দেন। তার মানে, তিনি বইয়েরও আগে ছিলেন, কত ভেবেছেন, কত কষ্ট করেছেন, হয়তো বইটার জন্যই জীবনটা কাটিয়েছেন। তার সঙ্গে তার কাজের সম্পর্কটা অনেকটা বাবা আর ছেলের মতো। বাবা যেমন ছেলের পৃথিবীতে আসার আগে থেকেই থাকেন।
কিন্তু আধুনিক রচয়িতার (scriptor) বেলায় ঘটনাটা ঘটে ঠিক উল্টো। তিনি তো জন্মই নেন তার লেখার সঙ্গে সঙ্গে। লেখার আগে অথবা তারও ঊর্ধ্বে তার নিজের কোনো আলাদা অস্তিত্ব থাকে না। তিনি কোনোভাবেই সেই কর্তা নন, যার সৃষ্টি হলো তার বই। কথা বলার, অর্থাৎ লেখার মুহূর্তটা ছাড়া এখানে অন্য কোনো সময় নেই। প্রতিটা লেখা যেন অনন্তকাল ধরে এখানেই, এই বর্তমানে, এই মুহূর্তেই নতুন করে জন্ম নিচ্ছে, একদম আমাদের চোখের সামনে। এর কারণটাই বলুন, অথবা ফলটাই ধরুন, লেখা তখন আর আগের দিনের মতো কোনো কিছুর ছবি তোলা (recording) থাকল না। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা (observing) কিংবা চোখের সামনে সবটা তুলে ধরাও (representing) নয়। সেকালের রচয়িতারা যেমনটা মনের আনন্দে বলতেন, রং তুলিতে ‘আঁকা’ (painting) – লেখা আর সেসবের মধ্যে আটকে রইল না। বরং ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়াল একেবারেই অন্যরকম। ভাষাবিদরা অক্সফোর্ডের পণ্ডিতদের কাছ থেকে একটা নতুন শব্দ ধার করে এনেছেন। তারা একে বলেন পারফরমেটিভ (performative) কাজ। মানেটা হলো, এমন এক আশ্চর্য ধরনের কথা, যা শুধু ‘আমি’ বললে আর বর্তমান কালেই খাটে, আর যেখানে বলার সঙ্গে সঙ্গেই কাজটা যেন জাদুর মতো হয়ে যায়। অনেকটা সেকালের রাজাদের ‘আমি আদেশ করছি’ (I Command) বা চারণকবিদের ‘আমি গাই’ (I Sing) বলার মতো ব্যাপার আরকি।
এই যে আধুনিক কালের রচয়িতা, তিনি তো পুরনো দিনের রচয়িতাকে একরকম কবরেই পাঠিয়ে দিয়েছেন। তাই আগের দিনের রচয়িতাদের মতো তার আর সেই বুক চাপড়ানো হা হুতাশ নেই। সেই যে একটা চাপা ‘দুঃখবিলাস’ (pathos) ছিল, যে মনের কথা বা ভেতরের তোলপাড় প্রকাশের জন্য তার হাত বড্ড আস্তে চলে, ওসব ভাবনাচিন্তায় তিনি আর বিশ্বাসই করেন না। এর ফলে, এই যে একটা দূরত্ব, একটা ফাঁক তৈরি হয়েছে রচয়িতার সঙ্গে লেখার, সেটাকেই তিনি যেন আরও বাড়িয়ে চলেন, এই প্রয়োজনটাই যেন তার কাছে নতুন নিয়ম। ক্রমাগত তিনি তার লেখার ভঙ্গিটাকে আরও নিখুঁত, আরও ‘সাজিয়েগুছিয়ে’ তোলেন। তার কাছে ব্যাপারটা এখন ঠিক উল্টো। তার হাত, কোনো বিশেষ কণ্ঠস্বর বা মনের গভীর কোনো ভাবনা থেকে একেবারেই আলগা হয়ে গিয়ে, কেবলই এক বিশুদ্ধ ‘লিখে যাওয়া’র জন্ম দেয়। সেই লেখায় আগে থেকে কোনো অনুভূতি জমা থাকে না, যা কিনা বাইরে আসার জন্য কেবলই ছটফট করে। এই লেখা যেন একটা বিশেষ ভঙ্গি বা ইশারায় আপন মনে চলে; তৈরি করে এমন এক জগৎ, যার কোনো বাবা মা নেই, কেউ নেই। অথবা বলতে পারেন, এ এমন এক আশ্চর্য জগৎ, যার জন্ম কেবল ভাষার নিজের খেয়াল থেকে। আর এই ভাষাই তো এমন এক অদ্ভুত জিনিস, যে কিনা সব রকমের উৎস, সব রকমের শিকড়কে নিয়ে কেবলই প্রশ্ন তুলে যায়, তাদের অস্তিত্বকেই নাড়িয়ে দেয়।
এবারে আমরা বুঝতে পারছি, একটা লেখা মানে শুধু পাশাপাশি সাজানো কিছু শব্দ নয়। রচয়িতার মতো কোনো সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কাছ থেকে আসা একটামাত্র স্বর্গীয় (theological) অর্থ বা বার্তা সে বয়ে বেড়ায় না। আসলে লেখা তো একটা বহুমাত্রিক জগৎ, যেখানে কত না লেখার ধারা এসে মেশে, নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়ায়। মজার ব্যাপার হলো, এর কোনোটাই কিন্তু একেবারে খাঁটি, মৌলিক নয়। লেখা আসলে অজস্র উদ্ধৃতির এক সুন্দর বুনন, সংস্কৃতির হাজারো ঝরনাধারা থেকে যার জন্ম। আচ্ছা, বুভার এবং পেকুশে (Bouvard and Pecuchet), সেই যে দুজন, তাদের কথাই একটু ভাবা যাক। তারা আগাগোড়াই ছিলেন, যাকে বলে পাকা নকলবাজ। তাদের মধ্যে একদিকে যেমন ছিল মহৎ একটা ব্যাপার, অন্যদিকে তারা ছিলেন আর দশজনের হাসির পাত্র। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপারটা হলো, তাদের এই যে সব অদ্ভুত, অর্থহীন কাজকর্ম (absurdity), এই খামখেয়ালিপনাই যেন লেখার একেবারে ভেতরের কথাটা, তার আসল চেহারাটা আমাদের চোখের সামনে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট করে দেয়। রচয়িতা আসলে কী করেন? তিনি তো যুগ যুগ ধরে চলে আসা একটা পুরনো ভঙ্গিকেই নকল করে যান মাত্র। সেখানে তার নিজের মৌলিক সৃষ্টি বলে তেমন কিছু থাকে না। তার ক্ষমতা বলতে এটুকুই যে, তিনি নানান ধরনের লেখাকে এক সুতোয় গাঁথতে পারেন। কয়েকটার সঙ্গে কয়েকটার মিলমিশ ঘটান, আবার কখনো তাদের মধ্যে বিরোধও বাধিয়ে দেন। উদ্দেশ্য হলো, কোনো একটা বিশেষ লেখার ওপর যেন পুরোপুরি নির্ভর করে বসে থাকতে না হয়। তিনি যদি কখনো নিজেকে প্রকাশ করার খুব ইচ্ছেও করেন, তার অন্তত এইটুকু জানা উচিত, ভেতরের যে ‘অনুভূতিটা’ (thing) তিনি ‘অনুবাদ’ (‘translate’) করতে চাইছেন বলে ভাবছেন, সেটাও আসলে আগে থেকে তৈরি করা একটা অভিধানের (readymade dictionary) মতো। কেবল অন্য শব্দের সাহায্যেই সেই অভিধানের শব্দগুলোকে ব্যাখ্যা করা যায়, সেগুলোর মানে বের করা যায়। এই খেলা চলতেই থাকে, অনন্তকাল।
বোদলেয়ার (Baudelaire) আমাদের একটা আশ্চর্য খবর দিয়েছেন। এই যে ডি কুইন্সি (Thomas De Quincy) নামের ভদ্রলোক, তিনি এক অদ্ভুত খেয়ালে মেতেছিলেন। গ্রিক ভাষা, যা কিনা বলতে গেলে মৃতপ্রায়, তার ভেতরে তিনি ফুটিয়ে তুলতে চাইলেন নতুন যুগের চিন্তা, নতুন যুগের যত ছবি। আর এই অসাধ্য সাধনের জন্য তিনি যে কাণ্ডটা করলেন, সেটা শুনলে অবাক না হয়ে উপায় থাকে না! বোদলেয়ারের নিজের মুখেই শুনুন, ডি কুইন্সি নাকি “এমন এক স্থায়ী অভিধান তৈরি করে ফেলেছিলেন, যা কিনা প্রচলিত সাহিত্য ঘেঁটে অনেক যত্ন আর অনেক পরিশ্রম করে যেসকল অভিধান তৈরি করা হয়, তাদের চেয়েও ছিল ঢের বেশি প্যাঁচালো, অনেক বেশি ছড়ানো।” (বোদলেয়ার এই কথাটা লিখেছেন তার ‘প্যারাডিস আর্টিফিসিয়েলস/Paradis Artificiels’ বইতে)। মানে, পুরনো দিনের সাহিত্যকে তন্নতন্ন করে খুঁজে, অনেক ধৈর্য ধরে, অনেক পরিশ্রম করে যে ধরনের অভিধান সাধারণত তৈরি করা হয়, কুইন্সিরটা ছিল তার চেয়েও অনেক বেশি জটিল, অনেক বেশি বিশাল। রচয়িতা যখন বিদায় নেন, তখন তার নিজের ভেতরে আবেগ বলুন, রস বলুন, অনুভূতি বা কোনো ধারণার ছিটেফোঁটাও আর অবশিষ্ট থাকে না। তিনি তখন হয়ে ওঠেন যেন এক বিশাল অভিধান, যেখান থেকে তিনি তুলে আনেন এমন এক লেখা, যার কোনো শেষ নেই, কোনো থামাথামি নেই। জীবনও তখন পারে কেবল বইকেই নকল করতে। আর বই? সে তো নিজেই এক চিহ্নের জাল, বহু দূরের এক হারিয়ে যাওয়া অনুকরণ ছাড়া আর কিছুই নয়। রচয়িতা একবার পর্দার আড়ালে চলে গেলে, কোনো লেখার ভেতর থেকে গুপ্তধন ‘উদ্ধার’ (‘decipher’) করার যে কথাটা, সেটা কিন্তু একেবারেই ভিত্তিহীন হয়ে পড়ে। কোনো একটা লেখার ঘাড়ে জোর করে একজন রচয়িতাকে চাপিয়ে দেওয়ার মানে হলো, সেই লেখার পায়ে একটা বেড়ি পরিয়ে দেওয়া, তাকে একটা শেষ কথা বা চূড়ান্ত তাৎপর্যে (final signification) বেঁধে ফেলা। সোজা কথায়, লেখাটার মুখ বন্ধ করে দেওয়া আরকি।
এই ভাবনাটা আবার সমালোচকদের বেশ পছন্দ। তাদের প্রধান কাজ তখন হয়ে দাঁড়ায় রচয়িতাকে খুঁজে বের করা, অথবা তার হয়ে যারা কথা বলে, যেমন সমাজ, ইতিহাস, মনস্তত্ত্ব বা ব্যক্তি স্বাধীনতা, তাদের খুঁজে পাওয়া। রচয়িতাকে একবার ধরতে পারলেই যেন লেখার সব রহস্য “ব্যাখ্যা” করা হয়ে গেল, আর সমালোচক তখন বিজয়ীর হাসি হাসেন। তাই এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, ইতিহাসে যখন রচয়িতার একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল, সেই যুগটা আসলে সমালোচকেরও যুগ ছিল। এমনকি, যে সমালোচনাকে আমরা “নব্য সমালোচনা” (new criticism) বলি, সেটারও বোধহয় রচয়িতার সাথেই বিদায় নেওয়া উচিত। একটা বহুমাত্রিক লেখায় অনেক কিছুই আলাদা করে চেনা যায় বটে, কিন্তু কোনো কিছুই একেবারে পাকাপাকিভাবে উদ্ধার করা যায় না। তার ভেতরের নকশাটা অনুসরণ করা যেতে পারে, তার সব পুনরাবৃত্তি আর বাঁকগুলোতে সুতো মেলানো যায়, ঠিক যেন একটা ছেঁড়া মোজার সুতো ধরে এগোনো। কিন্তু টানতে টানতে শেষে গিয়ে দেখবেন, তার গভীরে কোনো শক্তপোক্ত ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। লেখার এই জগৎটাকে কেবল পার হয়ে যাওয়া যায়, একে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেখা যায় না। লেখা অবিরামভাবে অর্থ তৈরি করতে থাকে, কিন্তু সবসময়ই যেন সেই অর্থটাকে মিলিয়ে দেওয়ার জন্য। এ যেন এক পরিকল্পিতভাবে অর্থকে মুক্তি দেওয়া (systematic exemption), যা নিয়ে লেখা আপন মনে এগিয়ে চলে। এভাবেই দেখুন না, সাহিত্য – যাকে এখন থেকে ‘লেখা’ বলাই ভালো – সে কিন্তু কোনো লেখাকে (আর এই বিশ্বটাকেও যদি একটা লেখা হিসেবে ভাবি) কোনো ‘গুপ্ত রহস্যের’ জালে আটকাতে চায় না। কোনো বাঁধা অর্থ দিয়ে তাকে শেষ করে দিতে চায় না। যখন এমনটা হয়, তখন এক অদ্ভুত কাজ করার স্বাধীনতা মেলে, যাকে আমরা বলতে পারি ঈশ্বরতত্ত্ববিরোধী (counter-theological)। একইসাথে সেটা সত্যিকারের বিপ্লবী (revolutionary) ব্যাপারও বটে। কারণটা কী জানেন? অর্থকে যখন এক জায়গায় থামিয়ে দিতে চাওয়া হয় না, তখন আপনি আসলে শেষমেশ খোদ ঈশ্বর আর তার সব প্রতিনিধি – যেমন ধরুন যুক্তি (reason), বিজ্ঞান (science), বা আইন (law) – এদের সকলকেই যেন একরকম চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন, অস্বীকার করছেন।
চলুন, আবার বালজাকের সেই বাক্যটার কাছে ফিরে যাই। কেউই, মানে কোনো নির্দিষ্ট “ব্যক্তি” ওটা বলেনি। ওর উৎস কোথায়, ওর গলার স্বর কার, তা খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবুও, বাক্যটা কিন্তু আমরা দিব্যি পড়তে পারছি। কারণ, লেখার আসল আস্তানা হলো পাঠকের মন, অর্থাৎ পড়া (reading) ব্যাপারটা। আরেকটা খুব সহজ উদাহরণ দিলে বিষয়টা আরও পরিষ্কার হবে। সম্প্রতি কিছু গবেষণা হয়েছে, যেমন জে. পি. ভেরন্যাঁ (J. P. Vernant) নামে একজন দেখিয়েছেন, গ্রিক ট্র্যাজেডির গঠনটা এমন যে তার মধ্যে একটা দ্ব্যর্থকতা লুকিয়ে থাকে। এই ট্র্যাজেডির কথাগুলো এমনভাবে সাজানো, যেখানে দুটো করে অর্থ থাকে। কিন্তু নাটকের চরিত্রগুলো তার একটা মানেই বোঝে। দেখুন, এই যে যুগ যুগ ধরে চলে আসা একটা ভুল বোঝাবুঝি, সেটাই কিন্তু “ট্র্যাজিক” অনুভূতির একেবারে খাঁটি জায়গা। তবে হ্যাঁ, একজন কিন্তু ঠিকই থাকেন, যিনি ওই কথার দুটো মানেই ধরতে পারেন। শুধু তাই না, তার সামনে যে চরিত্রগুলো কথা বলছে, তারা যে অন্য মানেটা কানেই তুলছে না, সেই যে তাদের বধিরতা, সেটাও তিনি ঠিকই বুঝতে পারেন। সেই বিশেষ মানুষটা কে, জানেন? তিনি হলেন পাঠক। আর নাটক যদি হয়, তাহলে বলতে পারি দর্শক।
এইভাবেই একটা লেখার পুরো সত্তা আমাদের সামনে খুলে যায়। একটা লেখা আসলে অনেক ধরনের লেখার একটা সমষ্টি, যা নানান সংস্কৃতি থেকে উঠে আসে। এই লেখাগুলো পরস্পরের সঙ্গে কথা বলে, কখনো ব্যঙ্গ করে (parody), কখনোবা জুড়ে দেয় তর্ক। কিন্তু একটা জায়গা আছে, যেখানে এই সব বৈচিত্র্য এসে জমা হয়, এক হয়ে যায়। সেই জায়গাটা কিন্তু রচয়িতা নন, যেমনটা আমরা এতদিন ধরে জেনে এসেছি। সেই জায়গাটা হলেন পাঠক। পাঠকই সেই পাথর, যেখানে একটা লেখার সব উদ্ধৃতি কোনো কিছু না হারিয়েই যেন খোদাই হয়ে যায়। একটা লেখার আসল বাঁধনটা তার উৎপত্তিস্থলে নয়, বরং তার গন্তব্যে লুকিয়ে থাকে। কিন্তু এই যে গন্তব্য, সে তো আর কোনো একজনের নিজস্ব ব্যাপার নয়। পাঠক তো এক আশ্চর্য মানুষ। তার কোনো অতীত নেই, কোনো জীবনকাহিনি নেই, তার মনের ভেতরটাও কোনো বাঁধাধরা ছকে ফেলা যায় না। তিনি কেবলই সেই ‘একজন’, যিনি লেখাটার সব আঁকিবুঁকি, সব না বলা কথা নিজের ভেতর চুপচাপ পুষে রাখেন। এইজন্যই তো, নতুন কালের লেখাকে যখন কেউ এক ধরনের মানবতাবাদের (humanism) দোহাই পেড়ে খারাপ বলতে যায়, তখন ব্যাপারটা বড্ড বেখাপ্পা শোনায়। অথচ দেখুন, সেই মানবতাবাদই আবার কেমন ভান করে, যেন সে-ই পাঠকের সব অধিকারের সবচেয়ে বড় পাহারাদার। অথচ ধ্রুপদী ধারার সমালোচনা (classical criticism) কোনোদিন পাঠককে পাত্তাই দেয়নি। তাদের চোখে, সাহিত্যের ওই বিশাল উঠানে রচয়িতা ছাড়া আর কোনো মানুষই যেন ছিল না।
এইসব কথার মারপ্যাঁচ, এসবে এখন আমরা আর তেমন একটা ভুল করি না। আসলে এই চাতুরীর আড়ালেই কিন্তু আমাদের সমাজ বুক ফুলিয়ে সেইসব জিনিসকেই সমর্থন জানায়, যেগুলোকে সে নিজেই বাতিল করে দিয়েছে, কোনো দামই দেয় না, গলা টিপে প্রায় দমবন্ধ করে দিয়েছে, কিংবা আপনি বলতেই পারেন, একরকম নিশ্চিহ্নই করে ফেলেছে। আমরা এখন একটা কথা বেশ বুঝতে পারছি। লেখার ভবিষ্যৎকে যদি সত্যিই বাঁচাতে হয়, তবে আমাদের মগজে গেঁথে থাকা একটা বহু পুরনো ধারণাকে একেবারে ওলটপালট করে ফেলতে হবে। কারণ, পাঠকের জন্মের মূল্য রচয়িতার মৃত্যু দিয়েই শোধ করতে হয়।
Leave a Reply