Table of Contents
ভূমিকা
আচ্ছা, ভাবুন তো, আপনার পরিচিত কেউ – ধরা যাক তার নাম প্রমিথিউস। ছোটবেলা থেকেই প্রমিথিউস একটু অন্যরকম। ক্লাসে মন বসতো না, সারাক্ষণ ছটফট করতো, প্রায়শই জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকত কিংবা সহপাঠীদের সাথে খুনসুটিতে মেতে উঠত। শিক্ষকেরা প্রায়ই বলতেন, “মনোযোগ দাও, প্রমিথিউস, মনোযোগ দাও!” কিন্তু মনোযোগ জিনিসটা যেন এক অধরা, পলাতক প্রজাপতি, প্রমিথিউসের হাতের মুঠোয় আসতেই চাইতো না। তার খাতা থাকত অগোছালো, হোমওয়ার্ক অর্ধেক করা, নয়তো স্কুলেই ফেলে আসা। বড় হয়েও প্রমিথিউসের জীবনে সেই ছটফটানি, সেই মনোযোগের অভাব এক অদৃশ্য সঙ্গী হয়ে রয়ে গেছে। অফিসে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং-এ বসেও তার মন কখন যে জানালার বাইরের নীল আকাশে উড়ে বেড়ানো পাখিটার দিকে চলে যায়, সে টেরই পায় না। কিংবা হয়তো টেবিলে রাখা কলমটা দিয়ে সে আপনমনে ছবি আঁকতে শুরু করে, গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো তার কান এড়িয়ে যায়। প্রায়শই গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ভুলে যায় – গাড়ির চাবি কোথায় রেখেছে, মানিব্যাগটা পড়ার টেবিলে না অফিসের ডেস্কে, জরুরি বিলটা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ কবে ছিল – এসব নিয়ে তার নিত্যদিনের যুদ্ধ। ঘরের জিনিসপত্র থাকে এলোমেলো, গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র খুঁজে পাওয়াটা যেন খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজা। মাঝে মাঝে হুটহাট রেগে যায়, সামান্য কথায় অধৈর্য হয়ে ওঠে, আবার পরক্ষণেই হয়তো নিজেই বুঝতে পারে না কেন এমন করলো, অনুশোচনায় ভোগে। তার অনেক পরিকল্পনা থাকে, কিন্তু শুরুটা করেও শেষ পর্যন্ত চালিয়ে নিয়ে যাওয়াটা কঠিন হয়ে পড়ে।
প্রমিথিউসের মতো এমন অনেকেই আছেন আমাদের চারপাশে, হয়তো আপনার খুব কাছের কেউ, অথবা আপনি নিজেই। আমরা হয়তো তাদের ‘অমনোযোগী’, ‘অলস’, ‘খামখেয়ালি’, ‘অগোছালো’, ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ বা ‘অপরিণত’ বলে দেগে দিই। কিন্তু এর আড়ালে যে এক জটিল স্নায়বিক-উন্নয়নমূলক অবস্থা (Neurodevelopmental Condition) লুকিয়ে থাকতে পারে, তা আমরা ক’জনই বা জানি বা বোঝার চেষ্টা করি? এই অবস্থার নামই হলো অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিসঅর্ডার (Attention Deficit Hyperactivity Disorder), সংক্ষেপে এডিএইচডি (ADHD)।
সাধারণত এডিএইচডি বলতে আমরা শিশুদের সমস্যা বলেই ধরে নিই। মিডিয়া বা সাধারণ আলোচনায় শিশুদের চঞ্চলতা বা অমনোযোগ নিয়েই বেশি কথা হয়। কিন্তু সত্যিটা হলো, শৈশবে শুরু হওয়া এই সমস্যা প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে (Faraone et al., 2015) প্রাপ্তবয়স্ক জীবন পর্যন্ত গড়ায়, আর জীবনের নানা ক্ষেত্রে ফেলে তার দীর্ঘ ও গভীর ছায়া। প্রাপ্তবয়স্কদের এডিএইচডি (ADHD in Adults) নিয়ে আমাদের সমাজে সচেতনতা এখনও বেশ কম, ক্ষেত্রবিশেষে প্রায় নেই বললেই চলে। এর অন্যতম কারণ হলো, প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে এর লক্ষণগুলো শিশুদের মতো অতটা স্পষ্ট বা চেনা ছকের নাও হতে পারে। অথচ এই সমস্যাটি কারো জীবনকে রীতিমতো এলোমেলো করে দিতে পারে, যদি না সময়মতো একে চিনে নিয়ে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া, সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া, কর্মজীবনে ব্যর্থতা, আর্থিক সংকট, এমনকি মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি – এ সবই হতে পারে প্রাপ্তবয়স্ক এডিএইচডি-র নীরব পরিণতি।
আসুন, আজ আমরা এই প্রাপ্তবয়স্কদের এডিএইচডি নিয়ে একটু বিস্তারিত জানার চেষ্টা করি। চেষ্টা করবো বিষয়টিকে সহজভাবে, গল্পের আবহে, কিন্তু তথ্যের গভীরতা বজায় রেখে তুলে ধরতে, যেন ব্যাপারটা বুঝতে সুবিধা হয় এবং এই বিষয়ে সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কিছুটা হলেও সাহায্য করে।
এডিএইচডি আসলে কী?
প্রথমেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা বলি, এডিএইচডি কোনো ‘রোগ’ বা ‘পাগলামি’ নয়, এটি ইচ্ছাকৃত আচরণ বা চারিত্রিক দুর্বলতাও নয়। এটি মস্তিষ্কের গঠন ও কার্যপ্রণালীর এক ধরনের ভিন্নতা, যা মূলত মনোযোগ (Attention), অতিচঞ্চলতা (Hyperactivity) এবং আবেগপ্রবণতা বা হঠকারিতা (Impulsivity) নিয়ন্ত্রণকারী মস্তিষ্কের অংশগুলোকে এবং তাদের মধ্যকার যোগাযোগ ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে। (American Psychiatric Association, 2013)। এটি একটি স্নায়বিক-উন্নয়নমূলক ব্যাধি, যার মানে হলো এটি মস্তিষ্কের বিকাশকালীন সময়ে শুরু হয় এবং এর প্রভাব ব্যক্তির জীবনভর থাকতে পারে।
বিষয়টা আরেকটু খোলাসা করা যাক। আমাদের মস্তিষ্কের সামনের অংশে, কপাল ঘেঁষে যে জায়গাটা, তাকে বলে ফ্রন্টাল লোব (Frontal Lobe), বিশেষ করে এর একটি অংশ প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স (Prefrontal Cortex)। এই প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স আমাদের ‘মস্তিষ্কের পরিচালক’ বা ‘নির্বাহী কেন্দ্র’ (Executive Control Center) হিসেবে কাজ করে। এর অধীনে থাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু ‘নির্বাহী কার্যাবলী’ (Executive Functions)। এই নির্বাহী কার্যাবলী অনেকটা অফিসের বড় বসের মতো – পরিকল্পনা করা (Planning), কাজ শুরু করা (Initiation), কাজ গুছিয়ে করা (Organization), সিদ্ধান্ত নেওয়া (Decision making), মনোযোগ ধরে রাখা (Sustained attention), কাজের প্রায়োরিটি নির্ধারণ করা (Prioritization), আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা (Emotional regulation), সময়ের সঠিক ব্যবহার করা (Time management), একাধিক কাজের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা (Working memory and task switching), এবং নিজের আচরণ পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করা (Self-monitoring)। এডিএইচডি আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এই প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স এবং এর সাথে যুক্ত অন্যান্য মস্তিষ্কের অঞ্চলের (যেমন বেসাল গ্যাংলিয়া, সেরিবেলাম) কার্যকারিতায় এবং কিছু বিশেষ রাসায়নিক বার্তাবাহক বা নিউরোট্রান্সমিটার (Neurotransmitter) যেমন ডোপামিন (Dopamine) ও নরএপিনেফ্রিন (Norepinephrine) এর উৎপাদন, পরিবহন ও গ্রহণের ভারসাম্যে তারতম্য দেখা যায়। (Wilens & Spencer, 2010; Arnsten, 2009)। এই নিউরোট্রান্সমিটারগুলো মস্তিষ্কের কোষগুলোর মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এদের ভারসাম্যহীনতার কারণে মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট সার্কিটগুলো ঠিকমতো কাজ করতে পারে না, যার ফলে নির্বাহী কার্যকারিতাগুলো বাধাগ্রস্ত হয়।
ফলে, তারা সাধারণ মানুষের মতো সহজে মনোযোগ দিতে পারে না, নিজেদের আবেগ বা আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে সমস্যায় ভোগে, এবং অনেক সময় অতিমাত্রায় চঞ্চলতা বা মানসিক অস্থিরতা প্রদর্শন করে। তবে মনে রাখতে হবে, এডিএইচডি মানেই কিন্তু বুদ্ধি বা মেধার অভাব নয়। অনেক প্রতিভাবান, সৃজনশীল এবং বুদ্ধিমান ব্যক্তিও এডিএইচডি-তে আক্রান্ত হতে পারেন। তাদের সমস্যাটা বুদ্ধিমত্তার নয়, বরং তাদের মস্তিষ্কের “সিস্টেম অ্যাডমিনিস্ট্রেটর” ঠিকমতো কাজ না করায় নিজেদের ক্ষমতাকে সঠিকভাবে, সময়মতো ও ধারাবাহিকভাবে কাজে লাগানোর পথে মনোযোগ, আবেগ ও আচরণের বাধাগুলো পেরিয়ে আসাটা তাদের জন্য অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে।
ছোটবেলার ছটফটানি কি বড় বেলায়ও থাকে?
এডিএইচডি-র লক্ষণগুলো সাধারণত শৈশবেই (DSM-5 অনুযায়ী, ১২ বছর বয়সের আগে একাধিক লক্ষণ উপস্থিত থাকতে হয় এবং সেগুলো জীবনের একাধিক ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করতে হয়) প্রকাশ পেতে শুরু করে। তবে বড় হওয়ার সাথে সাথে এই লক্ষণগুলোর ধরনে এবং তীব্রতায় কিছুটা পরিবর্তন আসে। শৈশবের যে উদ্দাম শারীরিক ছটফটানি, সেটা হয়তো প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় কিছুটা কমে আসে বা অন্য রূপে প্রকাশ পায়।
শিশুদের ক্ষেত্রে যেমন অতিচঞ্চলতা (Hyperactivity) খুব স্পষ্টভাবে দেখা যায় – যেমন এক জায়গায় স্থির হয়ে বসতে না পারা, ক্লাসরুমে নিজের সিট ছেড়ে উঠে ঘোরাঘুরি করা, সারাক্ষণ দৌড়ঝাঁপ করা, অতিরিক্ত কথা বলা, খেলার সময়ও শান্ত থাকতে না পারা – প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে এই শারীরিক চঞ্চলতা কমে আসতে পারে, তবে পুরোপুরি মিলিয়ে যায় না। তার বদলে এক ধরনের তীব্র মানসিক অস্থিরতা (Inner Restlessness) বা ছটফটানি দেখা দেয়। তারা হয়তো শারীরিকভাবে একটি মিটিং-এ স্থির হয়ে বসে আছেন, কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা অসহ্য অস্থিরতা কাজ করে, ঘন ঘন পা নাচাচ্ছেন, আঙুল মটকাচ্ছেন, কলম দিয়ে টেবিলে শব্দ করছেন, অথবা মনে মনে হাজারটা চিন্তা করছেন, যার ফলে বর্তমান আলোচনা থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তাদের জন্য দীর্ঘক্ষণ একঘেয়ে কাজ করা বা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করা খুব কঠিন হতে পারে।
মনোযোগের সমস্যা (Inattention) অবশ্য শৈশব থেকে প্রাপ্তবয়স্ক জীবন পর্যন্ত প্রায় একই রকম থাকতে পারে, তবে তার প্রকাশের ভঙ্গি ও ক্ষেত্র পাল্টায়। ছোটবেলায় হয়তো স্কুলের পড়ায় মন বসতো না, সাধারণ নির্দেশ শুনতে বা মনে রাখতে অসুবিধা হতো, খেলার সময়ও মনোযোগ ধরে রাখতে পারত না। বড় বেলায় অফিসের গুরুত্বপূর্ণ কাজে মনোযোগ দিতে অসুবিধা হয়, সামান্য শব্দ বা ঘটনায় সহজেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়া, দীর্ঘ বক্তৃতা বা মিটিং-এ মনোযোগ হারিয়ে ফেলা, সাধারণ দৈনন্দিন কাজ (যেমন – ঘরের কাজ, বিল দেওয়া) গুছিয়ে করতে না পারা, জিনিসপত্র (চাবি, মোবাইল, ওয়ালেট, জরুরি কাগজ) প্রায়শই হারিয়ে ফেলা বা ভুল জায়গায় রাখা, গুরুত্বপূর্ণ অ্যাপয়েন্টমেন্ট বা তারিখ (বন্ধুর জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী) ভুলে যাওয়া – এগুলোই হয়ে ওঠে নিত্যদিনের চিত্র। কাজ শুরু করতে দীর্ঘসূত্রিতা (Procrastination) এবং শুরু করা কাজ শেষ করতে না পারাটাও খুব সাধারণ সমস্যা।
আবেগপ্রবণতা বা হঠকারিতা (Impulsivity) প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে নানাভাবে প্রকাশ পেতে পারে। যেমন, কোনো কিছু গভীর ভাবে না ভেবে হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা (যেমন – হঠাৎ চাকরি ছেড়ে দেওয়া, বেশি ঝুঁকি নিয়ে টাকা বিনিয়োগ করা, অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনে ফেলা), অধৈর্য হয়ে ওঠা, অন্যের কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে নিজের কথা বলা, দ্রুত রেগে যাওয়া বা মেজাজ হারিয়ে ফেলা, কিংবা কোনো কিছুর প্রতি অতিরিক্ত আসক্ত হয়ে পড়া (যেমন – কেনাকাটা, খাওয়া, ইন্টারনেট, গেমিং বা অন্য কোনো অভ্যাস)। এই হঠকারিতা তাদের সামাজিক সম্পর্ক এবং আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
আসুন, প্রাপ্তবয়স্কদের এডিএইচডি-র প্রধান লক্ষণগুলোকে আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের DSM-5 এর নির্দেশিকা অনুসারে আরেকটু বিশদভাবে দেখি। মূলত তিন ধরনের প্রধান লক্ষণের ওপর ভিত্তি করে এডিএইচডি-কে চিহ্নিত করা হয়:
১. মনোযোগহীনতা প্রধান প্রকাশ (Predominantly Inattentive Presentation): এই ধরনের ক্ষেত্রে মনোযোগ সংক্রান্ত সমস্যাগুলোই মুখ্য থাকে। বিগত ৬ মাস ধরে নিচের লক্ষণগুলোর মধ্যে অন্তত ৫টি (শিশুদের ক্ষেত্রে ৬টি) লক্ষণ যদি এমন মাত্রায় উপস্থিত থাকে যা ব্যক্তির সামাজিক, শিক্ষাগত বা কর্মজীবনের স্বাভাবিক কার্যকারিতাকে ব্যাহত করে, তবে এই ধরনটি বিবেচিত হতে পারে:
- প্রায়শই খুঁটিনাটি বিষয়ে মনোযোগ দিতে ব্যর্থ হওয়া বা কাজ, পড়াশোনা বা অন্যান্য ক্ষেত্রে অসাবধানতাবশত ভুল করা (Careless mistakes)।
- কাজ বা খেলার সময় বেশিক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখতে অসুবিধা হওয়া।
- সরাসরি কথা বলার সময়ও মনে হয় যেন শুনছে না বা মন অন্য কোথাও (Seems like mind is elsewhere)।
- নির্দেশনা অনুসরণ করতে সমস্যা হওয়া এবং স্কুলের কাজ, ঘরের কাজ বা অফিসের দায়িত্ব শেষ করতে না পারা (কোনো বিরুদ্ধাচরণ বা বুঝতে না পারার কারণে নয়)।
- কাজ ও বিভিন্ন বিষয় সংগঠিত করতে অসুবিধা হওয়া (যেমন – জিনিসপত্র অগোছালো রাখা, সময় ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা, ডেডলাইন মিস করা)।
- একটানা মানসিক পরিশ্রমের কাজ (যেমন – রিপোর্ট লেখা, দীর্ঘ ফর্ম পূরণ করা, পড়াশোনা) এড়িয়ে যাওয়া, অপছন্দ করা বা করতে অনীহা প্রকাশ করা।
- প্রায়শই দরকারি জিনিস (যেমন – চাবি, মোবাইল, ওয়ালেট, কাগজপত্র, চশমা) হারিয়ে ফেলা।
- সহজেই অন্য কিছু দ্বারা মনোযোগ বিঘ্নিত হওয়া (Easily distracted by extraneous stimuli)।
- দৈনন্দিন কাজকর্ম ভুলে যাওয়া (যেমন – বিল পরিশোধ করা, ফোন কল ব্যাক করা, অ্যাপয়েন্টমেন্ট রাখা)।
- কাজ শুরু করতে ব্যাপক গড়িমসি করা (Procrastination), শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ফেলে রাখা।
২. অতিচঞ্চলতা-আবেগপ্রবণতা প্রধান প্রকাশ (Predominantly Hyperactive-Impulsive Presentation): এই ক্ষেত্রে অতিচঞ্চলতা এবং আবেগপ্রবণ আচরণগুলো প্রধান থাকে। বিগত ৬ মাস ধরে নিচের লক্ষণগুলোর মধ্যে অন্তত ৫টি (শিশুদের ক্ষেত্রে ৬টি) লক্ষণ যদি এমন মাত্রায় উপস্থিত থাকে যা ব্যক্তির স্বাভাবিক কার্যকারিতাকে ব্যাহত করে, তবে এই ধরনটি বিবেচিত হতে পারে:
- প্রায়শই হাত বা পা দিয়ে ছটফট করা বা চেয়ারে নড়াচড়া করা।
- এমন পরিস্থিতিতে যেখানে বসে থাকা প্রত্যাশিত (যেমন – মিটিং, ক্লাসরুম, ধর্মীয় স্থান) সেখানে নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে পড়া।
- শারীরিকভাবে অস্থির বোধ করা (প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে এটি দৌড়াদৌড়ি না হয়ে বরং তীব্র মানসিক অস্থিরতা হিসেবে প্রকাশ পেতে পারে)।
- শান্তভাবে কোনো অবসর বা বিনোদনমূলক কাজ করতে অসুবিধা হওয়া।
- প্রায়শই এমনভাবে আচরণ করা যেন “একটি ইঞ্জিন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে” (Often “on the go” acting as if “driven by a motor”)।
- অতিরিক্ত কথা বলা।
- প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই হুট করে উত্তর দিয়ে ফেলা।
- অন্যের জন্য অপেক্ষা করতে বা নিজের পালা আসতে ধৈর্য ধরতে অসুবিধা হওয়া।
- অন্যের কাজে বা কথায় প্রায়শই বাধা দেওয়া বা হস্তক্ষেপ করা (যেমন – অন্যের আলাপে বা খেলায় ঢুকে পড়া)।
- হুট করে সিদ্ধান্ত নেওয়া বা কাজ করে ফেলা, যার পরিণতি ভালো নাও হতে পারে (যেমন – হঠাৎ চাকরি ছেড়ে দেওয়া, বেশি ঝুঁকি নিয়ে টাকা বিনিয়োগ করা, বেপরোয়া গাড়ি চালানো)।
- খুব দ্রুত মেজাজ পরিবর্তন হওয়া, সহজেই রেগে যাওয়া বা অধৈর্য হয়ে পড়া।
৩. মিশ্র প্রকাশ (Combined Presentation): এক্ষেত্রে মনোযোগহীনতা এবং অতিচঞ্চলতা-আবেগপ্রবণতা – উভয় ধরনের লক্ষণই গত ৬ মাস ধরে যথেষ্ট পরিমাণে (প্রত্যেক বিভাগ থেকে অন্তত ৫টি করে লক্ষণ) উপস্থিত থাকে এবং তা ব্যক্তির জীবনে উল্লেখযোগ্য সমস্যা তৈরি করে। এটিই এডিএইচডি-র সবচেয়ে সাধারণ রূপ যা প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে দেখা যায়। (American Psychiatric Association, 2013)
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই লক্ষণগুলো যদি মাঝে মাঝে বা নির্দিষ্ট কোনো পরিস্থিতিতে দেখা যায়, তাহলেই যে কারো এডিএইচডি আছে, তা কিন্তু নয়। এডিএইচডি নির্ণয়ের জন্য এই লক্ষণগুলো দীর্ঘ সময় ধরে (কমপক্ষে ৬ মাস) একাধিক পরিবেশে (যেমন – কাজ ও বাড়ি, বা স্কুল ও বাড়ি) ধারাবাহিকভাবে উপস্থিত থাকতে হবে এবং ব্যক্তির জীবনের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে (যেমন – কাজ, পড়াশোনা, সামাজিক সম্পর্ক, পারিবারিক জীবন) সুস্পষ্ট নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে হবে। এছাড়াও, এই লক্ষণগুলো শৈশবে (১২ বছর বয়সের আগে) শুরু হওয়ার প্রমাণ থাকতে হবে। (Kessler et al., 2006)
কেন হয় এই এডিএইচডি?
এডিএইচডি কেন হয়, এই প্রশ্নের একটিমাত্র সহজ উত্তর নেই। বিজ্ঞানীরা এখনও এর সুনির্দিষ্ট কারণগুলো নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে এখনও পর্যন্ত যা জানা গেছে, তাতে মনে হয় এটি মূলত জিনগত এবং স্নায়ুজীববিজ্ঞানীয় (Neurobiological) কারণগুলির একটি জটিল সমন্বয়ের ফল, যেখানে পরিবেশগত কিছু কারণও অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে।
-
বংশগতি (Genetics): গবেষণায় দেখা গেছে, এডিএইচডি অনেকাংশেই বংশগত। অর্থাৎ, পরিবারে বাবা-মা, ভাই-বোন বা অন্য কোনো নিকটাত্মীয়ের এডিএইচডি থাকলে অন্যদেরও এডিএইচডি হওয়ার সম্ভাবনা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। (Faraone & Mick, 2010)। এটি একক কোনো জিনের কারণে হয় না, বরং একাধিক জিন (Polygenic) এবং তাদের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া এর জন্য দায়ী হতে পারে। বিষয়টা অনেকটা আমাদের উচ্চতা বা গায়ের রঙের মতো, যা আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পাই। এটি কোনো দোষের ব্যাপার নয়, বরং জিনের এক ধরনের ভিন্নতা যা মস্তিষ্কের বিকাশ এবং কার্যপ্রণালীকে প্রভাবিত করে। যমজদের (Twin studies) ওপর করা গবেষণায় এর বংশগতির শক্তিশালী প্রমাণ পাওয়া গেছে।
-
মস্তিষ্কের গঠন ও কার্যপ্রণালী (Brain Structure and Function): আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, এডিএইচডি আক্রান্ত ব্যক্তিদের মস্তিষ্কের কিছু নির্দিষ্ট অংশের গঠন, আকার এবং কার্যপ্রণালীতে সূক্ষ্ম ভিন্নতা দেখা যায়। ইমেজিং স্টাডি (যেমন – এমআরআই, এফএমআরআই) থেকে দেখা গেছে যে, মনোযোগ, পরিকল্পনা, আবেগ নিয়ন্ত্রণ এবং আচরণের সাথে জড়িত থাকা মস্তিষ্কের প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স, বেসাল গ্যাংলিয়া, সেরিবেলাম এবং কর্পাস ক্যালোসামের মতো অংশগুলির আয়তন তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম হতে পারে বা এদের মধ্যে সংযোগকারী স্নায়ুপথগুলো (Neural pathways) ঠিকমতো বিকশিত নাও হতে পারে। (Shaw et al., 2007)। এছাড়া, মস্তিষ্কের রাসায়নিক বার্তাবাহক বা নিউরোট্রান্সমিটার, বিশেষ করে ডোপামিন ও নরএপিনেফ্রিন, এদের পরিমাণে বা কার্যকারিতায় ভারসাম্যহীনতা এডিএইচডি-র একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে মনে করা হয়। (Arnsten, 2009)। এই রাসায়নিকগুলোই আমাদের মনোযোগ, মেজাজ, পুরস্কার অনুভূতি (Reward sensation) ও আচরণের সুইচ অন-অফ করার মতো কাজ করে। এদের ঘাটতি বা অকার্যকারিতা নির্বাহী ফাংশনগুলোকে বাধাগ্রস্ত করে।
-
পরিবেশগত প্রভাব (Environmental Factors): কিছু পরিবেশগত বিষয়ও এডিএইচডি-র ঝুঁকি বাড়াতে পারে, যদিও এগুলো সরাসরি কারণ হিসেবে এককভাবে প্রমাণিত নয় এবং জিনগত প্রবণতার সাথে এদের মিথস্ক্রিয়া থাকতে পারে। যেমন:
-
- গর্ভাবস্থায় মায়ের ধূমপান, মদ্যপান বা মাদক সেবন।
- গর্ভাবস্থায় মায়ের অতিরিক্ত মানসিক চাপ বা অপুষ্টি।
- কম ওজনে বা অপরিণত অবস্থায় শিশুর জন্ম (Premature birth or low birth weight)।
- শৈশবে মস্তিষ্কে গুরুতর আঘাত (Traumatic brain injury)।
- শৈশবে পরিবেশগত বিষাক্ত পদার্থের (যেমন – সিসা বা লেড) সংস্পর্শে আসা। (Thapar et al., 2013)
- খুব অল্প বয়সে প্রতিকূল বা অবহেলামূলক পরিবেশে বেড়ে ওঠা।
- তবে একটা কথা অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে মনে রাখা দরকার, এডিএইচডি কখনোই দুর্বল প্যারেন্টিং (Poor parenting), অতিরিক্ত টিভি দেখা, ভিডিও গেম খেলা বা বেশি চিনি খাওয়ার কারণে হয় না। এগুলো হয়তো বিদ্যমান এডিএইচডি-র লক্ষণগুলোকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাময়িকভাবে বাড়িয়ে তুলতে পারে বা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করতে পারে, কিন্তু এডিএইচডি-র মূল কারণ এগুলো নয়। এ ধরনের ভ্রান্ত ধারণা সমাজে অপরাধবোধ তৈরি করে এবং সঠিক চিকিৎসা থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখে।
প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে এডিএইচডি-র প্রভাব
প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে এডিএইচডি নানাভাবে সমস্যা তৈরি করতে পারে, যা কেবল ব্যক্তির নিজের জীবনকেই নয়, তার চারপাশের মানুষদের জীবনকেও প্রভাবিত করে। এই প্রভাবগুলো বিস্তৃত ও বহুমাত্রিক হতে পারে।
-
কর্মজীবন (Career and Work):
-
- কাজে মনোযোগ ধরে রাখতে না পারার কারণে প্রায়শই ছোটখাটো বা বড় ধরনের ভুল হওয়া।
- সময়মতো কাজ শেষ করতে না পারা, ডেডলাইন ক্রমাগত মিস করা।
- অগোছালো কর্মপদ্ধতি, পরিকল্পনা ও অগ্রাধিকার নির্ধারণে দুর্বলতার কারণে সহকর্মীদের সাথে সমস্যা বা কর্মক্ষেত্রে অদক্ষ হিসেবে বিবেচিত হওয়া।
- বিরক্তি বা একঘেয়েমির কারণে ঘন ঘন চাকরি পরিবর্তন বা চাকরি হারানোর ঝুঁকি।
- যোগ্যতা ও বুদ্ধিমত্তা থাকা সত্ত্বেও কর্মজীবনে প্রত্যাশিত সাফল্য না পাওয়া, আন্ডারএমপ্লয়মেন্ট (যোগ্যতার চেয়ে নিচু পদে কাজ করা)।
- মিটিং বা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় মনোযোগ হারিয়ে ফেলা, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ভুলে যাওয়া।
- প্রজেক্ট শুরু করলেও শেষ করতে না পারা বা দীর্ঘসূত্রিতা।
- সহকর্মী বা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আবেগপ্রবণ আচরণের কারণে সম্পর্ক নষ্ট হওয়া। (Barkley, 2015)
-
পড়াশোনা (Education):
-
- উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে মনোযোগ ধরে রাখতে, লেকচার অনুসরণ করতে ও পড়াশোনা গুছিয়ে করতে তীব্র অসুবিধা।
- দীর্ঘ সময় ধরে পড়াশোনা বা পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে সমস্যা।
- অ্যাসাইনমেন্ট বা থিসিস সময়মতো জমা দিতে না পারা, বা শুরু করেও শেষ করতে না পারা।
- সহজেই অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়ার কারণে ক্লাসে পিছিয়ে পড়া।
- পরীক্ষার সময় জানা উত্তরও ঠিকমতো গুছিয়ে লিখতে না পারা বা সময়ের অভাবে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারা।
-
সম্পর্ক (Relationships):
-
- মনোযোগ দিয়ে অন্যের কথা না শোনার (বা শুনতে না পারার) কারণে সঙ্গীর সাথে ভুল বোঝাবুঝি, সঙ্গী মনে করতে পারেন তাকে অবহেলা করা হচ্ছে।
- গুরুত্বপূর্ণ তারিখ বা ঘটনা (যেমন – জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী, পারিবারিক অনুষ্ঠান) ভুলে যাওয়া।
- হুট করে রেগে যাওয়া, অধৈর্য হওয়া বা আবেগপ্রবণ আচরণ করার ফলে পরিবার, বন্ধু বা জীবনসঙ্গীর সাথে সম্পর্কে টানাপোড়েন ও ঘন ঘন ঝগড়া।
- প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে না পারা বা দেওয়া কথা ভুলে যাওয়া।
- দৈনন্দিন পারিবারিক দায়িত্ব পালনে (যেমন – ঘরের কাজ, সন্তানের যত্ন) অবহেলা বা অসামঞ্জস্যতা।
- আর্থিক বিষয়ে আবেগপ্রবণ সিদ্ধান্ত বা দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের কারণে সঙ্গীর সাথে মতবিরোধ। (Robin & Payson, 2002)
-
দৈনন্দিন জীবন (Daily Life):
-
- অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সমস্যা, যেমন – বিল দিতে ভুলে যাওয়া, আবেগপ্রবণ কেনাকাটা করে অতিরিক্ত খরচ করা, বাজেট মেনে চলতে না পারা, ঋণগ্রস্ত হওয়া।
- ঘরবাড়ি, ব্যক্তিগত জিনিসপত্র এবং কাজের জায়গা অগোছালো রাখা।
- নিয়মিত ব্যায়াম বা স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা (যেমন – পরিমিত আহার, সময়ে ওষুধ খাওয়া) বজায় রাখতে অসুবিধা।
- সময়মতো ঘুমাতে না যাওয়া বা ঘুম থেকে উঠতে না পারা, ফলে সারাদিন ক্লান্তি বোধ করা।
- নিয়মকানুন বা রুটিন অনুসরণ করতে সমস্যা।
- বেপরোয়া গাড়ি চালানো বা অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ আচরণে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা।
-
মানসিক স্বাস্থ্য (Mental Health): এডিএইচডি আক্রান্ত প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে উদ্বেগ (Anxiety Disorders), বিষণ্ণতা (Depressive Disorders), বাইপোলার ডিসঅর্ডার (Bipolar Disorder), অবসেসিভ-কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার (OCD) এবং মাদকাসক্তির (Substance Use Disorders) মতো অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেওয়ার ঝুঁকি সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক বেশি থাকে। (Kessler et al., 2006)। প্রায়শই এডিএইচডি-র কারণে সৃষ্ট ক্রমাগত ব্যর্থতা, সমালোচনা, নিজের সাথে নিজের লড়াই এবং প্রত্যাশা পূরণে অক্ষমতা তাদের আত্মবিশ্বাস মারাত্মকভাবে কমিয়ে দেয় এবং অসহায়ত্বের অনুভূতি তৈরি করে, যা এই ধরনের সমস্যাগুলোকে আরও বাড়িয়ে তোলে বা নতুন সমস্যার জন্ম দেয়।
-
আবেগ নিয়ন্ত্রণ (Emotional Regulation): প্রাপ্তবয়স্ক এডিএইচডি-র একটি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু অনেক সময় কম আলোচিত দিক হলো আবেগ নিয়ন্ত্রণে অসুবিধা (Emotional Dysregulation)। তারা খুব সহজেই হতাশ, অধৈর্য, বিরক্ত বা উত্তেজিত হয়ে পড়তে পারে। তাদের আবেগের বহিঃপ্রকাশও অনেক সময় পরিস্থিতির তুলনায় অনেক তীব্র হতে পারে (Emotional hyperreactivity)। এই হঠাৎ আবেগের বিস্ফোরণ বা মেজাজের আকস্মিক পরিবর্তন তাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও কর্মজীবনের সম্পর্কগুলোতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তারা অনেক সময় নিজেদের আবেগ বুঝতে এবং তা সঠিকভাবে প্রকাশ করতে সমস্যায় ভোগেন। (Shaw et al., 2014)। এর সাথে সম্পর্কিত একটি ধারণা হলো “রিজেকশন সেনসিটিভ ডিসফোরিয়া” (Rejection Sensitive Dysphoria – RSD), যেখানে প্রত্যাখ্যাত হওয়া বা সমালোচিত হওয়ার ভয়ে বা অভিজ্ঞতায় তীব্র মানসিক কষ্ট অনুভূত হয়। যদিও এটি DSM-এ আনুষ্ঠানিক ডায়াগনোসিস নয়, অনেক এডিএইচডি বিশেষজ্ঞ এর গুরুত্ব স্বীকার করেন।
ভাবছেন, এতসব সমস্যা নিয়ে একজন মানুষ কীভাবে স্বাভাবিক, সফল ও সুখী জীবনযাপন করবে? এখানেই আসে সময়োচিত ও সঠিক রোগ নির্ণয় এবং কার্যকরী ব্যবস্থাপনার অপরিহার্য গুরুত্ব।
রোগ নির্ণয়: নিজেকে চেনার প্রথম ধাপ
প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে এডিএইচডি নির্ণয় করাটা শিশুদের চেয়ে বেশ কিছুটা জটিল ও সময়সাপেক্ষ। এর একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, বড় হতে হতে অনেকেই তাদের লক্ষণগুলোকে ঢাকার জন্য বা সেগুলোর সাথে মানিয়ে চলার জন্য নিজস্ব কিছু কৌশল (Coping mechanisms) তৈরি করে ফেলে, যা অনেক সময় রোগনির্ণয়কে কঠিন করে তোলে। দ্বিতীয়ত, প্রাপ্তবয়স্কদের জীবনের দায়িত্ব ও জটিলতা অনেক বেশি হওয়ায় এডিএইচডি-র লক্ষণগুলো অন্য অনেক মানসিক চাপ বা জীবনযাত্রার সমস্যার সাথে গুলিয়ে যেতে পারে। তৃতীয়ত, অনেক সময় এডিএইচডি-র লক্ষণগুলো অন্য মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার (যেমন – অ্যাংজাইটি, ডিপ্রেশন, বাইপোলার ডিসঅর্ডার) লক্ষণের সাথে মিলে যেতে পারে বা এগুলোর দ্বারা ঢাকা পড়ে যেতে পারে।
প্রাপ্তবয়স্কদের এডিএইচডি নির্ণয়ের জন্য কোনো নির্দিষ্ট রক্ত পরীক্ষা বা ব্রেন স্ক্যান (যেমন সিটি স্ক্যান বা এমআরআই) নেই যা এককভাবে রোগনির্ণয় করতে পারে। যদিও গবেষণায় মস্তিষ্কের গঠন ও কার্যকারিতায় কিছু পার্থক্য দেখা গেছে, এগুলো এখনও ক্লিনিক্যাল ডায়াগনোসিসের জন্য ব্যবহৃত হয় না। রোগ নির্ণয় মূলত একজন অভিজ্ঞ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ (Psychiatrist), মনোবিজ্ঞানী (Psychologist) বা স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ (Neurologist) বিস্তারিত ক্লিনিক্যাল সাক্ষাৎকার (Clinical interview), লক্ষণ পর্যবেক্ষণ এবং নির্দিষ্ট মানদণ্ডভিত্তিক মূল্যায়নের মাধ্যমে করে থাকেন।
নির্ণয় প্রক্রিয়ায় সাধারণত যা যা করা হয়:
-
বিস্তারিত সাক্ষাৎকার ও ইতিহাস সংগ্রহ: চিকিৎসক আপনার বর্তমান লক্ষণগুলো (ধরণ, তীব্রতা, স্থায়িত্ব, প্রভাব), সেগুলো কবে থেকে শুরু হয়েছে, আপনার শৈশবের ইতিহাস (স্কুলজীবনের অভিজ্ঞতা, আচরণ, পড়াশোনার ফলাফল, শিক্ষকদের মন্তব্য), কৈশোরের অভিজ্ঞতা, পারিবারিক ইতিহাস (পরিবারে আর কারো এডিএইচডি বা সমতুল্য সমস্যা আছে কিনা), চিকিৎসা সংক্রান্ত ইতিহাস, সামাজিক ও কর্মজীবনের ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত ও গভীরভাবে জানতে চাইবেন।
-
মানদণ্ডভিত্তিক মূল্যায়ন: আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের (American Psychiatric Association) তৈরি করা ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিক্যাল ম্যানুয়াল অফ মেন্টাল ডিসঅর্ডারস, পঞ্চম সংস্করণ (Diagnostic and Statistical Manual of Mental Disorders, 5th Edition, সংক্ষেপে DSM-5) বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (World Health Organization) ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অফ ডিজিজেস, একাদশ সংস্করণ (International Classification of Diseases, 11th Revision, সংক্ষেপে ICD-11) এর সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড অনুযায়ী লক্ষণগুলো মিলিয়ে দেখা হয়। (American Psychiatric Association, 2013)।
-
স্ট্যান্ডার্ডাইজড রেটিং স্কেল (Standardized Rating Scales): আপনাকে এবং ক্ষেত্রবিশেষে আপনার পরিবারের সদস্য (যেমন – সঙ্গী, বাবা-মা) বা ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে কিছু প্রমাণসিদ্ধ প্রশ্নমালা (Questionnaire) বা রেটিং স্কেল পূরণ করতে দেওয়া হতে পারে। এগুলো এডিএইচডি-র লক্ষণগুলোর উপস্থিতি, তীব্রতা এবং দৈনন্দিন জীবনে এর প্রভাব পরিমাপ করতে সাহায্য করে। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য প্রচলিত কিছু স্কেলের মধ্যে রয়েছে Adult ADHD Self-Report Scale (ASRS), Conners’ Adult ADHD Rating Scales (CAARS), Brown Attention-Deficit Disorder Symptom Assessment Scale (BADDS) for Adults ইত্যাদি।
-
শৈশবের তথ্য যাচাই: যেহেতু এডিএইচডি একটি স্নায়বিক-উন্নয়নমূলক ব্যাধি যা শৈশবেই শুরু হয়, তাই রোগ নির্ণয়ের জন্য শৈশবে এর লক্ষণ উপস্থিত থাকার প্রমাণ থাকা জরুরি। সম্ভব হলে, শৈশবের রিপোর্ট কার্ড, বাবা-মা, পুরনো শিক্ষক বা শৈশবের কোনো অভিভাবকের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য (Collateral information) রোগ নির্ণয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
-
অন্যান্য সম্ভাব্য কারণ বাতিল করা (Differential Diagnosis): চিকিৎসক আপনার লক্ষণগুলো অন্য কোনো শারীরিক অসুস্থতা (যেমন – থাইরয়েডের সমস্যা, স্লিপ অ্যাপনিয়া), মানসিক অসুস্থতা (যেমন – উদ্বেগ, বিষণ্ণতা, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, ব্যক্তিত্বের সমস্যা), ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা জীবনযাত্রার কোনো বিশেষ পরিস্থিতির (যেমন – অতিরিক্ত কাজের চাপ, সম্পর্কের সমস্যা) কারণে হচ্ছে কিনা, তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখবেন। সঠিক রোগ নির্ণয়ের জন্য এই ধাপটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
-
সহগামী অসুস্থতার (Comorbidities) মূল্যায়ন: এডিএইচডি-র সাথে প্রায়শই অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা সহাবস্থান করে। তাই রোগ নির্ণয়ের সময় এ ধরনের কোনো সহগামী অসুস্থতা আছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখা হয়।
যদি আপনার মনে হয় আপনি বা আপনার পরিচিত কেউ প্রাপ্তবয়স্ক এডিএইচডি-তে ভুগছেন, তাহলে সংকোচ বা দ্বিধা না করে একজন অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞের (মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট) পরামর্শ নেওয়া উচিত। সঠিক রোগ নির্ণয়ই হলো সমস্যা থেকে উত্তরণের প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এটা অনেকটা অন্ধকারে পথ চেনার জন্য আলো জ্বালানোর মতো; একবার আলো জ্বলে উঠলে পথটা অনেক সহজ হয়ে যায়। স্ব-চিকিৎসা বা অপরিচিত ও অপ্রশিক্ষিত কারো পরামর্শ এ ক্ষেত্রে মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে।
সহগামী অসুস্থতা বা কমরবিডিটি
প্রাপ্তবয়স্ক এডিএইচডি আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায়শই এক বা একাধিক অন্যান্য মানসিক বা আচরণগত সমস্যা সহাবস্থান করতে দেখা যায়। এই অবস্থাকে চিকিৎসা পরিভাষায় কমরবিডিটি (Comorbidity) বা সহগামী অসুস্থতা বলা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৭০-৮০% প্রাপ্তবয়স্ক এডিএইচডি আক্রান্ত ব্যক্তির অন্তত একটি এবং প্রায় ৫০% এর একাধিক সহগামী মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা থাকে। (Katzman et al., 2017)। এই সহগামী সমস্যাগুলো এডিএইচডি-র উপসর্গগুলোকে আরও জটিল ও তীব্র করে তুলতে পারে, রোগ নির্ণয় প্রক্রিয়াকে কঠিন করতে পারে এবং চিকিৎসা পরিকল্পনা ও তার ফলাফলকেও প্রভাবিত করে।
কিছু সাধারণ কমরবিড অবস্থা হলো:
-
উদ্বেগজনিত ব্যাধি (Anxiety Disorders): এটি প্রাপ্তবয়স্ক এডিএইচডি-র সাথে সবচেয়ে বেশি দেখা যাওয়া সহগামী সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রায় ৫০% প্রাপ্তবয়স্ক এডিএইচডি আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে কোনো না কোনো ধরনের উদ্বেগজনিত সমস্যা, যেমন – জেনারালাইজড অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার (Generalized Anxiety Disorder – GAD), সোশ্যাল অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার (Social Anxiety Disorder), প্যানিক ডিসঅর্ডার (Panic Disorder) বা অবসেসিভ-কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার (OCD) দেখা যায়। (Katzman et al., 2017)। এডিএইচডি-র কারণে সৃষ্ট দৈনন্দিন জীবনের চ্যালেঞ্জ, যেমন – কাজ শেষ করতে না পারার ভয়, সামাজিক পরিস্থিতিতে অস্বস্তি, ভবিষ্যৎ নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা ইত্যাদি উদ্বেগের জন্ম দিতে পারে, আবার উদ্বেগের কারণে মনোযোগের সমস্যাও বাড়তে পারে।
-
মেজাজজনিত ব্যাধি (Mood Disorders): বিষণ্ণতা (Major Depressive Disorder) প্রাপ্তবয়স্ক এডিএইচডি-র একটি খুবই সাধারণ সহগামী সমস্যা। বারবার ব্যর্থতা, নিজের প্রতি হতাশা, কর্মজীবনে ও ব্যক্তিগত সম্পর্কে সমস্যা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং এডিএইচডি-র কারণে ক্রমাগত মানসিক চাপ বিষণ্ণতার ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দেয়। এছাড়াও বাইপোলার ডিসঅর্ডারও (Bipolar Disorder) এডিএইচডি-র সাথে থাকতে পারে, যা নির্ণয় করা অনেক সময় চ্যালেঞ্জিং হয় কারণ বাইপোলারের ম্যানিক বা হাইপোম্যানিক পর্বের কিছু লক্ষণ (যেমন – অতি চঞ্চলতা, দ্রুত কথা বলা, আবেগপ্রবণতা) এডিএইচডি-র লক্ষণের সাথে মিলে যেতে পারে। (Skirrow et al., 2009)
-
নেশাজাতীয় দ্রব্যের অপব্যবহার (Substance Use Disorders – SUDs): আবেগপ্রবণতা, আত্মনিয়ন্ত্রণের সমস্যা, অস্থিরতা এবং অনেক সময় সহগামী উদ্বেগ বা বিষণ্ণতা থেকে মুক্তি পাওয়ার একটি ভুল প্রচেষ্টা হিসেবে এডিএইচডি আক্রান্ত প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সিগারেট, অ্যালকোহল বা অন্যান্য মাদকের প্রতি আসক্তির ঝুঁকি সাধারণ জনসংখ্যার তুলনায় ২ থেকে ৩ গুণ বেশি থাকে। (Wilens et al., 2008)। তারা অনেক সময় মানসিক চাপ, অস্থিরতা বা এডিএইচডি-র অন্যান্য কষ্টকর লক্ষণ কমানোর জন্য এসব দ্রব্যের আশ্রয় নেয় (Self-medication hypothesis), যা পরবর্তীকালে মারাত্মক আসক্তিতে রূপ নেয়।
-
ঘুমের সমস্যা (Sleep Disorders): অনিদ্রা (Insomnia), বিলম্বিত ঘুম চক্র (Delayed Sleep Phase Syndrome), রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম (Restless Leg Syndrome) বা ঘুমের অন্যান্য সমস্যা এডিএইচডি আক্রান্ত প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে খুবই সাধারণ। মস্তিষ্কের অতিসক্রিয়তা, মানসিক অস্থিরতা বা উদ্বেগপূর্ণ চিন্তার কারণে তাদের ঘুমাতে যেতে, ঘুমিয়ে থাকতে বা সকালে সময়মতো ঘুম থেকে উঠতে অসুবিধা হয়। (Wajszilber et al., 2018)। অপর্যাপ্ত ঘুম এডিএইচডি-র লক্ষণগুলোকে (বিশেষ করে মনোযোগহীনতা, খিটখিটে মেজাজ) আরও বাড়িয়ে তোলে, যা একটি দুষ্টচক্র তৈরি করে।
-
লার্নিং ডিসএবিলিটি (Learning Disabilities): ডিসলেক্সিয়া (Dyslexia – পঠন অক্ষমতা), ডিসগ্রাফিয়া (Dysgraphia – লিখন অক্ষমতা) বা ডিসক্যালকুলিয়া (Dyscalculia – গাণিতিক অক্ষমতা) এর মতো নির্দিষ্ট শিখন অক্ষমতাও প্রায় ২৫-৪০% ক্ষেত্রে এডিএইচডি-র সাথে থাকতে পারে। এটি পড়াশোনা বা তথ্য প্রক্রিয়াকরণে অতিরিক্ত অসুবিধা তৈরি করে এবং শিক্ষাগত ও কর্মজীবনের সাফল্যকে আরও বাধাগ্রস্ত করে।
-
ব্যক্তিত্বের সমস্যা (Personality Disorders): কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষ করে যদি এডিএইচডি শৈশব থেকে সঠিকভাবে ম্যানেজ করা না হয়, তাহলে বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার বা অ্যান্টিসোশ্যাল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের মতো ব্যক্তিত্বের সমস্যাও দেখা যেতে পারে।
এই সহগামী সমস্যাগুলোর সঠিক নির্ণয় এবং সমন্বিত চিকিৎসা অত্যন্ত জরুরি। কেবল এডিএইচডি-র চিকিৎসা করালে যদি সহগামী সমস্যাগুলো উপেক্ষিত হয়, তাহলে পূর্ণ সুফল পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে, এমনকি এডিএইচডি-র চিকিৎসাও অকার্যকর হতে পারে। তাই একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের মাধ্যমে একটি সামগ্রিক মূল্যায়ন এবং সমন্বিত চিকিৎসা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা অপরিহার্য।
চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা: নতুন পথে যাত্রা
সুসংবাদ হলো, প্রাপ্তবয়স্ক এডিএইচডি একটি অত্যন্ত নিরাময়যোগ্য কন্ডিশন। যদিও একে সম্পূর্ণ “নিরাময়” করা যায় না (কারণ এটি মস্তিষ্কের একটি গঠনগত ভিন্নতা), সঠিক চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এর লক্ষণগুলোকে কার্যকরীভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, দৈনন্দিন জীবনের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করা সহজ হয় এবং জীবনের মান উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করা যায়। সাধারণত একটি সমন্বিত বা বহুমাত্রিক চিকিৎসা পরিকল্পনা (Multimodal treatment plan) সবচেয়ে কার্যকর বলে বিবেচিত হয়, যেখানে ঔষধ, মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা (সাইকোথেরাপি), জীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং প্রায়োগিক কৌশল – এই সবকিছুর সমন্বয় ঘটানো হয়।
১. ঔষধ (Medication): এডিএইচডি-র চিকিৎসায় ঔষধ একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রায়শই প্রথম সারির হস্তক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই ঔষধগুলো মস্তিষ্কের রাসায়নিক বার্তাবাহক বা নিউরোট্রান্সমিটারের (বিশেষত ডোপামিন ও নরএপিনেফ্রিন) ভারসাম্যহীনতা সংশোধন করতে সাহায্য করে, যার ফলে মনোযোগ বৃদ্ধি পায়, আবেগপ্রবণতা ও অতিচঞ্চলতা কমে এবং সামগ্রিক নির্বাহী কার্যকারিতা উন্নত হয়।
-
স্টিমুল্যান্ট ঔষধ (Stimulant Medications): এগুলো এডিএইচডি-র চিকিৎসায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত এবং সাধারণত সবচেয়ে কার্যকর ঔষধ হিসেবে পরিচিত। এই শ্রেণীর ঔষধের মধ্যে রয়েছে মিথাইলফেনিডেট (Methylphenidate) এবং অ্যামফিটামিন (Amphetamine) জাতীয় ঔষধ। নাম ‘স্টিমুল্যান্ট’ বা উত্তেজক হলেও, এগুলো এডিএইচডি আক্রান্ত ব্যক্তিদের মস্তিষ্কের সেই অংশগুলোকে উদ্দীপ্ত করে যা মনোযোগ ও আচরণ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, ফলে তারা শান্ত হয় ও মনোযোগ বাড়াতে পারে। (Faraone & Glatt, 2010)। স্টিমুল্যান্ট ঔষধগুলো দ্রুত কাজ শুরু করে এবং বিভিন্ন মেয়াদে (স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী, দীর্ঘমেয়াদী) পাওয়া যায়।
-
নন-স্টিমুল্যান্ট ঔষধ (Non-Stimulant Medications): যদি স্টিমুল্যান্ট ঔষধ কাজ না করে, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে ব্যবহার করা না যায়, রোগীর অন্য কোনো শারীরিক সমস্যা থাকে (যেমন – হৃদরোগ) বা আসক্তির ঝুঁকি থাকে, তাহলে নন-স্টিমুল্যান্ট ঔষধ ব্যবহার করা যেতে পারে। এই শ্রেণীর প্রধান ঔষধ হলো অ্যাটমোক্সেটিন (Atomoxetine – যেমন স্ট্র্যাটেরা)। এটি একটি সিলেক্টিভ নরএপিনেফ্রিন রিআপটেক ইনহিবিটর (SNRI) এবং এর কার্যকারিতা শুরু হতে কয়েক সপ্তাহ সময় লাগতে পারে। এছাড়া অন্যান্য নন-স্টিমুল্যান্ট যেমন – গুয়ানফেসিন (Guanfacine) বা ক্লোনিডিন (Clonidine) যা মূলত আলফা-২ অ্যাড্রেনার্জিক অ্যাগোনিস্ট, সেগুলোও ব্যবহৃত হতে পারে, বিশেষত যদি আবেগপ্রবণতা, অতিচঞ্চলতা বা ঘুমের সমস্যা বেশি থাকে। (Sanford & Scott, 2016)
-
অন্যান্য ঔষধ: কিছু ক্ষেত্রে, বিষণ্ণতারোধী ঔষধ (Antidepressants) যেমন বুপ্রোপিওন (Bupropion) এডিএইচডি-র চিকিৎসায় (বিশেষত যদি সহগামী বিষণ্ণতা থাকে) অফ-লেবেল ব্যবহৃত হতে পারে।
যেকোনো ঔষধই চিকিৎসকের (সাধারণত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ) নিবিড় পরামর্শ অনুযায়ী এবং তার কঠোর তত্ত্বাবধানে গ্রহণ করা উচিত। চিকিৎসক রোগীর সার্বিক অবস্থা, বয়স, ওজন, লক্ষণগুলোর ধরণ ও তীব্রতা, সহগামী অসুস্থতা এবং ঔষধের সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (যেমন – ঘুমের সমস্যা, ক্ষুধামান্দ্য, মাথাব্যথা, হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি ইত্যাদি) বিবেচনা করে সঠিক ঔষধ ও তার মাত্রা নির্ধারণ করবেন। ঔষধের কার্যকারিতা ও সহনশীলতা পর্যবেক্ষণের জন্য নিয়মিত ফলো-আপ জরুরি। নিজে নিজে ঔষধ শুরু করা, বন্ধ করা বা ডোজ পরিবর্তন করা অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে।
২. মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা (Psychotherapy/Psychological Treatments): ঔষধ যেমন মস্তিষ্কের রসায়নে কাজ করে মনোযোগ ও আচরণগত প্রাথমিক লক্ষণগুলো কমাতে সাহায্য করে, তেমনি মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা বা সাইকোথেরাপি আচরণ, চিন্তার ধরণ এবং কোপিং বা এঁটে করার কৌশল (Coping skills) পরিবর্তনে সাহায্য করে। এটি এডিএইচডি-র সাথে সম্পর্কিত মানসিক, আবেগিক ও ব্যবহারিক সমস্যাগুলো মোকাবেলা করতে এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে অত্যন্ত কার্যকর।
- কগনিটিভ বিহেভিওরাল থেরাপি (Cognitive Behavioral Therapy – CBT): সিবিটি এডিএইচডি আক্রান্ত প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য খুবই কার্যকর এবং গবেষণালব্ধ একটি থেরাপি। এটি তাদের অকার্যকর চিন্তাভাবনা (যেমন – “আমি কিছুই ঠিকমতো করতে পারি না”), আবেগ এবং আচরণকে শনাক্ত করতে এবং সেগুলোকে আরও বাস্তবসম্মত, ইতিবাচক ও গঠনমূলক চিন্তা, আবেগ ও আচরণে পরিবর্তন করতে সাহায্য করে। এছাড়া, সিবিটি প্রায়োগিক দক্ষতা যেমন – সময় ব্যবস্থাপনা (Time management), পরিকল্পনা (Planning), কাজ শুরু করা (Task initiation), সাংগঠনিক দক্ষতা (Organizational skills), সমস্যা সমাধান (Problem-solving) এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণ (Emotional regulation) উন্নত করতে নির্দিষ্ট কৌশল ও অনুশীলন শেখায়। (Safren et al., 2005)
- এডিএইচডি কোচিং (ADHD Coaching): এডিএইচডি কোচ একজন প্রশিক্ষিত পেশাদার, যিনি থেরাপিস্ট নন, তবে এডিএইচডি আক্রান্ত ব্যক্তিকে তার দৈনন্দিন জীবনের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে, ব্যক্তিগত ও পেশাগত লক্ষ্য নির্ধারণ করতে এবং সেই লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করেন। কোচ ব্যক্তিকে তার শক্তি ও দুর্বলতা চিনতে, বাস্তবসম্মত লক্ষ্য নির্ধারণ করতে, কার্যকর কৌশল (Strategies) ও রুটিন তৈরি করতে এবং সেগুলো বাস্তবায়নে নিয়মিত সহায়তা ও উৎসাহ জোগান। (Ratey et al., 2007)। এটি মূলত প্রায়োগিক সমস্যা সমাধানের ওপর জোর দেয়।
- মাইন্ডফুলনেস ও মেডিটেশন (Mindfulness and Meditation): মননশীলতা বা মাইন্ডফুলনেস অনুশীলন মনোযোগ বাড়াতে, মানসিক চাপ কমাতে, আবেগ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে এবং বর্তমান মুহূর্তে মনোনিবেশ করার ক্ষমতা বাড়াতে পারে। নিয়মিত মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন, শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম এবং শরীরের প্রতি সচেতনতা মস্তিষ্কের অস্থিরতা কমাতে এবং আবেগপ্রবণ প্রতিক্রিয়াশীলতা হ্রাস করতে সাহায্য করতে পারে। (Zylowska et al., 2008)
- ডায়ালেকটিক্যাল বিহেভিওর থেরাপি (Dialectical Behavior Therapy – DBT) ভিত্তিক দক্ষতা: বিশেষত যাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণে তীব্র অসুবিধা (Emotional Dysregulation) রয়েছে, তাদের জন্য ডিবিটি-র কিছু দক্ষতা (Skills) যেমন – মানসিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতা বৃদ্ধি (Distress tolerance), আবেগ শনাক্তকরণ ও নিয়ন্ত্রণ (Emotion regulation), এবং আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক উন্নয়ন (Interpersonal effectiveness) অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে।
- পারিবারিক বা দাম্পত্য থেরাপি (Family/Marital Therapy): এডিএইচডি যেহেতু সম্পর্কের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে, তাই পারিবারিক বা দাম্পত্য থেরাপিও অনেক ক্ষেত্রে উপকারী হতে পারে। এটি পরিবারের সদস্যদের এডিএইচডি সম্পর্কে বুঝতে, কার্যকর যোগাযোগের পদ্ধতি শিখতে এবং পারস্পরিক সমর্থন বাড়াতে সাহায্য করে।
৩. জীবনযাত্রার পরিবর্তন ও প্রায়োগিক কৌশল (Lifestyle Adjustments and Practical Strategies): ঔষধ ও থেরাপির পাশাপাশি কিছু জীবনযাত্রাগত পরিবর্তন এবং দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারিক কৌশল অবলম্বন করা এডিএইচডি ব্যবস্থাপনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এগুলো এডিএইচডি-র লক্ষণগুলোকে কমাতে এবং সামগ্রিক সুস্থতা বাড়াতে সাহায্য করে।
- নিয়মিত ব্যায়াম (Regular Exercise): শারীরিক ব্যায়াম, বিশেষত অ্যারোবিক এক্সারসাইজ (যেমন – দ্রুত হাঁটা, দৌড়ানো, সাঁতার, সাইকেল চালানো) মস্তিষ্কে ডোপামিন, নরএপিনেফ্রিন ও সেরোটোনিনের (Serotonin) মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে, যা মনোযোগ, মেজাজ এবং নির্বাহী কার্যকারিতা উন্নত করে। প্রতিদিন অন্তত ৩০-৬০ মিনিটের মাঝারি থেকে তীব্র মাত্রার ব্যায়াম এডিএইচডি-র লক্ষণ কমাতে সহায়ক। (Verburgh et al., 2014)
- স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস (Healthy Diet): সুষম ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া সার্বিক শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য জরুরি। যদিও কোনো নির্দিষ্ট “এডিএইচডি ডায়েট” নেই, কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড (Omega-3 fatty acids) সমৃদ্ধ খাবার (যেমন – সামুদ্রিক মাছ, ফ্ল্যাক্সসিড, আখরোট), পর্যাপ্ত প্রোটিন, জটিল শর্করা (Complex carbohydrates) এবং কম প্রক্রিয়াজাত খাবার, কৃত্রিম রং ও সংরক্ষণকারী পদার্থ যুক্ত খাবার গ্রহণ করা এডিএইচডি-র কিছু লক্ষণ নিয়ন্ত্রণে কিছুটা সাহায্য করতে পারে। রক্তে শর্করার মাত্রা স্থিতিশীল রাখা মনোযোগের জন্য উপকারী। (Bloch & Qawasmi, 2011)। তবে যেকোনো খাদ্যতালিকাগত পরিবর্তনের আগে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
- পর্যাপ্ত ও মানসম্পন্ন ঘুম (Sufficient and Quality Sleep): ঘুমের অভাব এডিএইচডি-র লক্ষণগুলোকে (বিশেষ করে মনোযোগহীনতা, স্মৃতিভ্রংশ, খিটখিটে মেজাজ, আবেগপ্রবণতা) আরও মারাত্মকভাবে বাড়িয়ে তোলে। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য প্রতিদিন রাতে ৭-৯ ঘণ্টা নিয়মিত ও গভীর ঘুম নিশ্চিত করা জরুরি। একটি নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যাওয়া ও ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস তৈরি করা (Sleep hygiene), শোবার ঘর শান্ত, অন্ধকার ও আরামদায়ক রাখা, এবং শোবার আগে উত্তেজক পানীয় (চা, কফি) ও স্ক্রিন টাইম (মোবাইল, ল্যাপটপ) পরিহার করা ঘুমের মান উন্নত করতে সাহায্য করে।
- সাংগঠনিক কৌশল ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনা (Organizational Strategies and Environmental Management): দৈনন্দিন কাজগুলো গুছিয়ে করার জন্য এবং মনোযোগ বিঘ্নকারী উপাদান কমানোর জন্য কিছু কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে। যেমন:
- তালিকা তৈরি ও প্ল্যানার ব্যবহার: প্রতিদিনের কাজের তালিকা (To-do list) তৈরি করা এবং একটি ডায়েরি, প্ল্যানার বা ডিজিটাল ক্যালেন্ডার ব্যবহার করে কাজ ও অ্যাপয়েন্টমেন্টগুলো লিখে রাখা।
- রিমাইন্ডার ও অ্যালার্ম: মোবাইলে বা স্মার্টওয়াচে গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য রিমাইন্ডার ও অ্যালার্ম সেট করা।
- বড় কাজকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করা: বড় বা জটিল কাজকে কয়েকটি ছোট, সহজ ও পরিচালনাযোগ্য অংশে ভাগ করে নেওয়া (Task breakdown), এতে কাজ শুরু করতে সুবিধা হয় এবং সম্পন্ন করার অনুভূতি পাওয়া যায়।
- পোমোডোরো টেকনিক: একটি নির্দিষ্ট সময় (যেমন ২৫ মিনিট) একটানা কাজ করে অল্প বিরতি (৫ মিনিট) নেওয়া, যা মনোযোগ ধরে রাখতে সাহায্য করে।
- কর্মপরিবেশ গোছানো: কাজের জন্য একটি নির্দিষ্ট শান্ত, পরিচ্ছন্ন ও অগোছালোমুক্ত (Clutter-free) জায়গা বেছে নেওয়া। অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলা যাতে মনোযোগ নষ্ট না হয়।
- একবারে একটি কাজ: মাল্টিটাস্কিং এড়িয়ে একবারে একটি কাজে মনোযোগ দেওয়া।
- গুরুত্বপূর্ণ জিনিস নির্দিষ্ট স্থানে রাখা: চাবি, মোবাইল, ওয়ালেট, চশমা ইত্যাদি রাখার জন্য নির্দিষ্ট জায়গা (যেমন – একটি ট্রে বা বক্স) নির্ধারণ করা এবং ব্যবহারের পর সেখানেই ফিরিয়ে রাখার অভ্যাস করা।
- ভিজ্যুয়াল ক্লু ব্যবহার: গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বা অনুস্মারক স্টিকি নোট বা হোয়াইট বোর্ডে লিখে দৃষ্টিগোচর স্থানে রাখা।
সমন্বিত চিকিৎসা পদ্ধতিতে এই সবকিছুর সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে একজন প্রাপ্তবয়স্ক এডিএইচডি আক্রান্ত ব্যক্তি তার জীবনের নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই নিজের হাতে নিতে পারেন।
এডিএইচডি-র ইতিবাচক দিক: ভিন্নতার শক্তি
এতক্ষণ আমরা এডিএইচডি-র সমস্যাগুলো এবং তা থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলাম। কিন্তু মুদ্রার ওপিঠও তো আছে, তাই না? এডিএইচডি মানেই কেবল সমস্যা, দুর্বলতা আর ঘাটতি নয়। এই স্নায়বিক ভিন্নতার কিছু অসাধারণ ইতিবাচক দিকও থাকতে পারে, যদি সেগুলোকে সঠিকভাবে চিনে, লালন করে এবং সঠিক পরিবেশে কাজে লাগানো যায়। এডিএইচডি আক্রান্ত অনেক ব্যক্তিই তাদের এই “ভিন্নভাবে তারযুক্ত” (Differently wired) মস্তিষ্ককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে জীবনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছেন।
অনেক এডিএইচডি আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে নিম্নলিখিত গুণাবলী বা প্রবণতা দেখা যায়:
- অসাধারণ সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা (Exceptional Creativity and Innovative Thinking): তাদের মস্তিষ্ক প্রায়শই গতানুগতিক চিন্তার গণ্ডি পেরিয়ে, বিভিন্ন ধারণার মধ্যে অপ্রত্যাশিত সংযোগ স্থাপন করে নতুন নতুন আইডিয়া বা সমাধান তৈরি করতে পারে। তারা অনেক সময় খুবই সৃজনশীল, শৈল্পিক এবং “আউট-অফ-দ্য-বক্স” চিন্তাবিদ হন। (Healey & Rucklidge, 2006)
- প্রচুর শক্তি, উদ্যম ও আবেগ (High Energy, Enthusiasm, and Passion): যখন তারা কোনো বিষয়ে ভেতর থেকে আগ্রহী হন বা কোনো কাজকে অর্থপূর্ণ মনে করেন, তখন তারা প্রচণ্ড শক্তি, উদ্যম এবং আবেগের সাথে সেই কাজটি করতে পারেন, যা অন্যদের অনুপ্রাণিত করতে পারে।
- হাইপারফোকাস (Hyperfocus): যদিও মনোযোগ ধরে রাখা এডিএইচডি-র একটি প্রধান সমস্যা, কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, যখন তারা কোনো পছন্দের, আগ্রহের বা চ্যালেঞ্জিং বিষয়ে কাজ করেন, তখন তারা এতটাই গভীরভাবে এবং একনিষ্ঠভাবে মনোযোগ দিতে পারেন যে চারপাশের আর কোনো কিছু (এমনকি ক্ষুধা বা ক্লান্তিও) তাদের খেয়ালে থাকে না। এই অবস্থাকে বলে হাইপারফোকাস। এই ক্ষমতা সঠিক দিকে পরিচালিত হলে অসাধারণ ফলাফল বয়ে আনতে পারে। (Hallowell & Ratey, 2005)
- স্থিতিস্থাপকতা ও প্রতিকূলতা মোকাবেলার ক্ষমতা (Resilience and Ability to Cope with Adversity): জীবনের নানা প্রতিকূলতা, চ্যালেঞ্জ এবং ব্যর্থতা মোকাবেলা করতে করতে তারা অনেক সময় মানসিকভাবে বেশ শক্তিশালী, সহনশীল ও স্থিতিস্থাপক (Resilient) হয়ে ওঠেন। তারা সহজে হাল ছাড়েন না।
- স্বতঃস্ফূর্ততা ও নমনীয়তা (Spontaneity and Flexibility): তাদের মধ্যে এক ধরনের স্বতঃস্ফূর্ততা ও নমনীয়তা দেখা যায়, যা অনেক সময় নতুন সম্ভাবনা বা মজার অভিজ্ঞতা নিয়ে আসে। তারা পরিবর্তনের সাথে দ্রুত মানিয়ে নিতে পারে।
- সহমর্মিতা ও সংবেদনশীলতা (Empathy and Sensitivity): নিজেরা যেহেতু অনেক সংগ্রাম, ভুল বোঝাবুঝি ও কষ্টের মধ্যে দিয়ে যান, তাই অনেক এডিএইচডি আক্রান্ত ব্যক্তি অন্যের দুঃখ-কষ্ট, আবেগ ও অনুভূতি সহজে বুঝতে পারেন এবং তাদের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ও সংবেদনশীল হন।
- সমস্যা সমাধানের ভিন্নধর্মী প্রয়াস (Unique Problem-Solving Skills): জটিল পরিস্থিতিতে তারা অনেক সময় গতানুগতিক সমাধানের বাইরে গিয়ে নতুন ও কার্যকর পথ খুঁজে বের করতে পারেন।
- সাহসিকতা ও ঝুঁকি গ্রহণের প্রবণতা (Courage and Risk-Taking): নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে এই গুণটি নতুন উদ্যোগ নেওয়া বা উদ্ভাবনী কাজে লাগতে পারে।
এই শক্তিগুলোকে চিনতে পারা, সেগুলোকে গ্রহণ করা এবং সেগুলোকে কাজে লাগানোর জন্য উপযুক্ত পরিবেশ ও সুযোগ তৈরি করা গেলে এডিএইচডি আক্রান্ত ব্যক্তিরাও জীবনে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করতে পারেন। অনেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী, শিল্পী, লেখক, উদ্যোক্তা, উদ্ভাবক এবং ক্রীড়াবিদ এডিএইচডি-তে আক্রান্ত ছিলেন বা আছেন (যেমন – আলবার্ট আইনস্টাইন, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, রিচার্ড ব্র্যানসন, মাইকেল ফেলপস প্রমুখ, যদিও ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের ক্ষেত্রে এটি মূলত অনুমানভিত্তিক), যারা তাদের এই ভিন্নতাকেই শক্তিতে রূপান্তরিত করে বিশ্বকে সমৃদ্ধ করেছেন।
সামাজিক ভ্রান্ত ধারণা, কলঙ্ক এবং সচেতনতার গুরুত্ব
প্রাপ্তবয়স্ক এডিএইচডি নিয়ে আমাদের সমাজে, এমনকি অনেক স্বাস্থ্যকর্মীর মধ্যেও, অনেক ভুল ধারণা (Misconceptions) এবং এর সাথে সম্পর্কিত সামাজিক কলঙ্ক (Stigma) গভীরভাবে প্রচলিত আছে। এই ভ্রান্ত ধারণা ও কলঙ্ক এডিএইচডি আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য পরিস্থিতি আরও অনেক বেশি কঠিন এবং বেদনাদায়ক করে তোলে।
কিছু সাধারণ ভুল ধারণা হলো:
-
“এডিএইচডি শুধুমাত্র শিশুদের একটি রোগ, বড়দের হয় না বা বড় হলে সেরে যায়।” (সম্পূর্ণ ভুল। প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে এটি প্রাপ্তবয়স্ক জীবন পর্যন্ত বিস্তৃত হয়)।
-
“ওরা আসলে অলস, দায়িত্বজ্ঞানহীন, বা যথেষ্ট চেষ্টা করছে না। চেষ্টা করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।” (ভুল। এটি ইচ্ছাকৃত আচরণ নয়, বরং একটি স্নায়বিক অবস্থা যা ইচ্ছাশক্তি দিয়ে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না)।
-
“এডিএইচডি একটা অজুহাত মাত্র, কাজের ফাঁকি দেওয়ার বা দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বানানো।” (ভুল। এটি একটি স্বীকৃত চিকিৎসা অবস্থা যার সুনির্দিষ্ট স্নায়বিক ভিত্তি রয়েছে)।
-
“এডিএইচডি-র ওষুধগুলো হলো নেশার দ্রব্য এবং এগুলো শিশুদের বা প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ক্ষতিকর।” (ভুল। চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে সঠিক মাত্রায় ব্যবহৃত হলে স্টিমুল্যান্ট ঔষধগুলো নিরাপদ ও কার্যকর। এগুলো মস্তিষ্কের কার্যকারিতা স্বাভাবিক করতে সাহায্য করে, নেশা তৈরি করে না)।
-
“সবাই তো মাঝে মাঝে অমনোযোগী হয় বা জিনিস ভুলে যায়, তার মানে কি সবার এডিএইচডি আছে?” (ভুল। এডিএইচডি-র লক্ষণগুলো সাধারণ অমনোযোগিতার চেয়ে অনেক বেশি তীব্র, দীর্ঘস্থায়ী এবং জীবনের একাধিক ক্ষেত্রে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে)।
এই ধরনের ভুল ধারণা এবং এর ফলে সৃষ্ট সামাজিক কলঙ্ক এডিএইচডি আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে লজ্জা, অপরাধবোধ, একাকিত্ব এবং আত্মবিশ্বাসের অভাব তৈরি করে। তারা নিজেদের সমস্যা নিয়ে কথা বলতে ভয় পায়, সাহায্য চাইতে সংকোচ বোধ করে, এবং অনেক সময় নিজেদেরকেই দোষারোপ করতে থাকে। এর ফলে সঠিক রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা পেতে দেরি হয়, যা তাদের জীবনকে আরও জটিল করে তোলে।
তাই, প্রাপ্তবয়স্ক এডিএইচডি সম্পর্কে সমাজে ব্যাপক সচেতনতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি। পরিবার, বন্ধু, সহকর্মী, শিক্ষক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের এই অবস্থা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। সহানুভূতি, ধৈর্য, সমর্থন এবং সঠিক তথ্যের প্রসারই পারে এই নীরব সংকট মোকাবেলায় সাহায্য করতে।
শেষ কথা: আশার আলো ও এগিয়ে চলার পথ
প্রাপ্তবয়স্ক এডিএইচডি নিঃসন্দেহে একটি চ্যালেঞ্জিং অবস্থা। এর কারণে জীবনের নানা ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, যা হতাশাব্যঞ্জক হতে পারে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, এখানেই সব শেষ, বা এডিএইচডি আক্রান্ত ব্যক্তিরা একটি পরিপূর্ণ ও সফল জীবনযাপন করতে পারবেন না। সঠিক ও সময়োচিত রোগ নির্ণয়, কার্যকর ও সমন্বিত চিকিৎসা (যার মধ্যে ঔষধ, থেরাপি, কোচিং এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তন অন্তর্ভুক্ত), নিজের প্রতি সহানুভূতি ও সহমর্মিতা, নিজের শক্তিগুলোকে চিনে সেগুলোকে কাজে লাগানো এবং পরিবার ও সমাজের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সমর্থন ও বোঝাপড়া পেলে এডিএইচডি আক্রান্ত ব্যক্তিরাও একটি সুস্থ, সুন্দর, অর্থবহ ও সফল জীবনযাপন করতে পারেন।
যদি আপনার মনে হয় প্রমিথিউসের মতো লক্ষণগুলো আপনার বা আপনার প্রিয়জনের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে বিদ্যমান এবং তা জীবনের গুণগত মানকে ব্যাহত করছে, তাহলে দ্বিধা বা সংকোচ না করে একজন অভিজ্ঞ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের সাহায্য নিন। মনে রাখবেন, নিজেকে চেনা, নিজের সীমাবদ্ধতা ও শক্তি সম্পর্কে অবগত হওয়া এবং সাহায্য গ্রহণ করতে পারাটাই পরিবর্তনের দিকে প্রথম এবং সবচেয়ে সাহসী পদক্ষেপ।
এডিএইচডি একটি দীর্ঘ যাত্রার মতো, যেখানে উত্থান-পতন থাকবে, ভালো দিন আসবে, আবার খারাপ দিনও আসতে পারে। কিন্তু সঠিক পথনির্দেশনা, উপযুক্ত কৌশল, আত্মবিশ্বাস এবং মানুষের সমর্থন থাকলে এই যাত্রাও আনন্দময় এবং ফলপ্রসূ হয়ে উঠতে পারে। আমাদের চারপাশের মানুষগুলোর প্রতি একটু বেশি সংবেদনশীল হওয়া, তাদের না জেনেই বিচার না করা, এবং তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া – এটাই মানবিকতা এবং একটি সুস্থ সমাজের প্রতিফলন। এডিএইচডি কোনো অভিশাপ বা ব্যক্তিগত ব্যর্থতা নয়, বরং এটি মস্তিষ্কের এক ধরনের ভিন্নতা যা অনন্য সম্ভাবনাও ধারণ করে। এই ভিন্নতাকে গ্রহণ করে, তার সাথে মানিয়ে চলার কৌশল শিখে নিলেই জীবনের অনেক জটিলতা সহজ হয়ে আসে এবং লুকানো শক্তিগুলো বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়। আর কে না জানে, পৃথিবীর অনেক সুন্দর, সৃজনশীল এবং যুগান্তকারী জিনিসই তো একটু “অন্যরকম” বা “ভিন্ন” চিন্তার ফসল!
(এই আর্টিকেলটা শুধু প্রাপ্তবয়স্কদের ADHD নিয়ে। সামগ্রিকভাবে ADHD সম্পর্কে জানতে এখানে যান – মন উড়ে যায় কার্নিশে: ADHD-এর সাতকাহন)
তথ্যসূত্র
- American Psychiatric Association. (2013). Diagnostic and statistical manual of mental disorders (5th ed.). Arlington, VA: American Psychiatric Publishing.
- Arnsten, A. F. T. (2009). The Emerging Neurobiology of Attention Deficit Hyperactivity Disorder: The Key Role of the Prefrontal Association Cortex. Journal of Pediatrics, 154(5), I–S43.
- Barkley, R. A. (2015). Attention-deficit hyperactivity disorder: A handbook for diagnosis and treatment (4th ed.). New York, NY: Guilford Press.
- Bloch, M. H., & Qawasmi, A. (2011). Omega-3 Fatty Acid Supplementation for the Treatment of Children With Attention-Deficit/Hyperactivity Disorder Symptomatology: Systematic Review and Meta-Analysis. Journal of the American Academy of Child & Adolescent Psychiatry, 50(10), 991–1000.
- Faraone, S. V., Asherson, P., Banaschewski, T., Biederman, J., Buitelaar, J. K., Ramos-Quiroga, J. A., … & Franke, B. (2015). Attention-deficit/hyperactivity disorder. Nature reviews Disease primers, 1(1), 1-23.
- Faraone, S. V., & Glatt, S. J. (2010). A comparison of the efficacy of stimulants for adult ADHD using meta-analysis of experimental data. Journal of Clinical Psychiatry, 71(6), 754-763.
- Faraone, S. V., & Mick, E. (2010). Molecular genetics of attention deficit hyperactivity disorder. Psychiatric Clinics of North America, 33(1), 159–180.
- Hallowell, E. M., & Ratey, J. J. (2005). Delivered from distraction: Getting the most out of life with attention deficit disorder. Ballantine Books.
- Healey, D., & Rucklidge, J. J. (2006). An investigation into the relationship among ADHD, creativity, and neuropsychological functioning in children. Child Neuropsychology, 12(6), 421-438.
- Katzman, M. A., Bilkey, T. S., Chokka, P. R., Fallu, A., & Klassen, L. J. (2017). Adult ADHD and comorbid disorders: clinical implications of a dimensional approach. BMC psychiatry, 17(1), 1-15.
- Kessler, R. C., Adler, L., Barkley, R., Biederman, J., Conners, C. K., Demler, O., … & Zaslavsky, A. M. (2006). The prevalence and correlates of adult ADHD in the United States: results from the National Comorbidity Survey Replication. American Journal of Psychiatry, 163(4), 716-723.
- Ratey, N. A., Hallowell, E. M., & Miller, M. L. (2007). The Disorganized Mind: Coaching Your ADHD Brain to Take Control of Your Time, Tasks, and Talents. St. Martin’s Griffin.
- Robin, A. L., & Payson, E. (2002). The impact of ADHD on marriage. The ADHD Report, 10(3), 9-11, 14.
- Safren, S. A., Otto, M. W., Sprich, S., Winett, C. L., Wilens, T. E., & Biederman, J. (2005). Cognitive-behavioral therapy for ADHD in medication-treated adults with continued symptoms. Behaviour research and therapy, 43(7), 831-842.
- Sanford, M., & Scott, L. J. (2016). Atomoxetine: a review in attention-deficit hyperactivity disorder in adults. CNS drugs, 30(12), 1207-1219.
- Shaw, P., Eckstrand, K., Sharp, W., Blumenthal, J., Lerch, J. P., Greenstein, D., … & Rapoport, J. L. (2007). Attention-deficit/hyperactivity disorder is characterized by a delay in cortical maturation. Proceedings of the National Academy of Sciences, 104(49), 19649-19654.
- Shaw, P., Stringaris, A., Nigg, J., & Leibenluft, E. (2014). Emotion dysregulation in attention deficit hyperactivity disorder. American Journal of Psychiatry, 171(3), 276-293.
- Skirrow, C., Hosang, G. M., Farmer, A. E., & Asherson, P. (2009). An update on the comorbidity of ADHD and bipolar disorder: a focus on bipolar disorder in adults and children. Journal of affective disorders, 119(1-3), 1-13.
- Thapar, A., Cooper, M., Eyre, O., & Langley, K. (2013). What have we learnt about the causes of ADHD?. Journal of Child Psychology and Psychiatry, 54(1), 3-16.
- Verburgh, L., Königs, M., Scherder, E. J., & Oosterlaan, J. (2014). Physical exercise and executive functions in preadolescent children, adolescents and young adults: a meta-analysis. British journal of sports medicine, 48(12), 973-979.
- Wajszilber, D., Santiseban, J. A., & Gruber, R. (2018). Sleep disorders in patients with ADHD: a review of the literature. Journal of the Canadian Academy of Child and Adolescent Psychiatry, 27(3), 186.
- Wilens, T. E., Adler, L. A., Adams, J., Sferi, S., Gatz, G., & Monuteaux, M. C. (2008). Misuse and diversion of stimulants prescribed for ADHD: a systematic review of the literature. Journal of the American Academy of Child & Adolescent Psychiatry, 47(1), 21-31.
- Wilens, T. E., & Spencer, T. J. (2010). Understanding attention-deficit/hyperactivity disorder from childhood to adulthood. Postgraduate medicine, 122(5), 97-109.
- Zylowska, L., Ackerman, D. L., Yang, M. H., Futrell, J. L., Horton, N. L., Hale, T. S., … & Smalley, S. L. (2008). Mindfulness meditation training in adults and adolescents with ADHD: a feasibility study. Journal of attention disorders, 11(6), 737-746.
Leave a Reply