মন উড়ে যায় কার্নিশে: ADHD-এর সাতকাহন

Table of Contents

ভূমিকা

আচ্ছা, ভাবুন তো, ক্লাসের সেই ছেলেটা, যে কোনো কিছুতেই বেশিক্ষণ মন দিতে পারে না? টিচার যখন অঙ্ক কষতে দেন, তার মন তখন জানালার বাইরের আমগাছটায় বসে থাকা হলদে পাখিটার দিকে ছুটে যায়। কিংবা সেই মেয়েটি, যে সারাক্ষণ ছটফট করে, কথা বলতে শুরু করলে আর থামতে চায় না, প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য অধৈর্য হয়ে হাত তুলতে থাকে? অথবা ধরুন আপনার অফিসের সেই সহকর্মী, যার ডেস্কটা সবসময় অগোছালো, মিটিং-এর সময় বারবার ফোন চেক করে, আর জরুরি কাজগুলো প্রায়ই শেষ মুহূর্তে গিয়ে তাড়াহুড়ো করে সারে?

এসব দৃশ্য আমাদের চারপাশে খুব অচেনা নয়, তাই না? আমরা প্রায়শই এমন মানুষদের “অমনোযোগী”, “চঞ্চল” বা “অগোছালো” বলে দাগিয়ে দিই। কিন্তু পর্দার আড়ালের গল্পটা হয়তো আরও একটু জটিল। এই যে মনোযোগ ধরে রাখতে না পারা, স্থির হয়ে বসতে অসুবিধা, হঠাৎ করে কিছু করে ফেলা বা বলে ফেলার প্রবণতা – এগুলো সবই হতে পারে একটি বিশেষ স্নায়বিক-বিকাশজনিত অবস্থার (Neurodevelopmental disorder) লক্ষণ, যার নাম অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিসঅর্ডার (Attention Deficit Hyperactivity Disorder) বা সংক্ষেপে ADHD।

নামটা শুনে একটু খটমট লাগতে পারে, তাই না? যেন বিশাল কোনো দৈত্যদানবের নাম। কিন্তু আসলে ব্যাপারটা অত ভয়ের কিছু নয়, বরং বোঝার। চলুন, আজ আমরা এই ADHD-নামক ব্যাপারটার অলিগলিতে একটু ঘুরে আসি, সহজ ভাষায়, গল্পের ঢঙে। যেন চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বন্ধুর সাথে আড্ডা হচ্ছে।

ADHD আসলে কী বস্তু?

সহজ করে বললে, ADHD হলো মস্তিষ্কের এক বিশেষ অবস্থা, যা মানুষের মনোযোগ (Attention), অতি-চঞ্চলতা (Hyperactivity) এবং হঠকারিতা (Impulsivity) নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। এটা কোনো মানসিক রোগ (Mental illness) নয়, বরং একটি স্নায়বিক-বিকাশজনিত ভিন্নতা (Neurodevelopmental difference)। এর মানে হলো, ADHD আক্রান্ত ব্যক্তির মস্তিষ্ক অন্যদের চেয়ে একটু ভিন্নভাবে কাজ করে, বিশেষ করে মস্তিষ্কের যে অংশগুলো নির্বাহী কার্যাবলী (Executive functions) নিয়ন্ত্রণ করে, সেখানে। এই নির্বাহী কার্যাবলী কী? এগুলো হলো সেইসব মানসিক দক্ষতা যা আমাদের পরিকল্পনা করতে, সংগঠিত হতে, সময়মতো কাজ শুরু করতে, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে এবং মনোযোগ ধরে রাখতে সাহায্য করে (Barkley, 2015)।

ভাবুন তো, আপনার মাথায় একটা সার্কিট বোর্ড আছে। সবার সার্কিট বোর্ডে তারগুলো যেমনভাবে সাজানো, ADHD যাদের আছে, তাদের সার্কিট বোর্ডের কিছু তার হয়তো একটু অন্যভাবে লাগানো, অথবা কিছু সংযোগে বিদ্যুতের প্রবাহ কমবেশি হয়। ফলাফল? মনোযোগের সুইচটা যখন অন করা দরকার, তখন হয়তো হয় না, আবার যখন স্থির থাকার সুইচটা অন থাকা উচিত, তখন সেটা দপ করে অফ হয়ে যায়।

ADHD-এর প্রকারভেদ: সবার গল্প এক নয়

চিকিৎসাবিজ্ঞানে ADHD-কে মূলত তিনটি প্রধান ধরনে ভাগ করা হয়, যা ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিক্যাল ম্যানুয়াল অফ মেন্টাল ডিসঅর্ডারস, পঞ্চম সংস্করণ (DSM-5) অনুযায়ী নির্ধারিত (American Psychiatric Association, 2013):

  • ১. প্রধানত অমনোযোগী প্রকটন (Predominantly Inattentive Presentation): এদের ক্ষেত্রে মনোযোগ ধরে রাখাটাই মূল চ্যালেঞ্জ। এরা হয়তো ক্লাসে দিবাস্বপ্নে বিভোর থাকে, খুব সহজে অন্যমনস্ক হয়ে যায়, জিনিসপত্র হারিয়ে ফেলে, দৈনন্দিন কাজ ভুলে যায়, আর নির্দেশাবলী অনুসরণ করতে হিমশিম খায়। এরা সাধারণত অন্যদের বিরক্ত করে না, তাই এদের সমস্যাটা অনেক সময় চোখেই পড়ে না, বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে। এদেরকে প্রায়শই “শান্ত” বা “লাজুক” বলে ভুল করা হয়।
  • ২. প্রধানত অতি-চঞ্চল-হঠকারী প্রকটন (Predominantly Hyperactive-Impulsive Presentation): এই ধরনের ব্যক্তিরা সারাক্ষণ ছটফট করে, এক জায়গায় স্থির হয়ে বসতে পারে না, অনবরত কথা বলে, অন্যকে কথার মাঝে থামিয়ে দেয়, আর কোনো কিছু করার আগে তার পরিণতির কথা ভাবে না। ছোটবেলায় এরা হয়তো সারাক্ষণ দৌড়ঝাঁপ করে, গাছে চড়ে, আর বড় হলে এদের অস্থিরতা অন্যভাবে প্রকাশ পায় – যেমন, বারবার পা নাচানো, কলম দিয়ে শব্দ করা, অথবা অধৈর্য হয়ে ওঠা।
  • ৩. সম্মিলিত প্রকটন (Combined Presentation): এই ক্ষেত্রে অমনোযোগিতা এবং অতি-চঞ্চলতা-হঠকারিতা – দুটো ধরনের লক্ষণই যথেষ্ট পরিমাণে উপস্থিত থাকে। ADHD আক্রান্তদের মধ্যে এই ধরনটিই সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।

তবে মনে রাখা দরকার, এই ভাগগুলো খুব কাটখোট্টা নয়। সময়ের সাথে সাথে, বিশেষ করে বয়স বাড়ার সাথে সাথে, লক্ষণের ধরনে পরিবর্তন আসতে পারে। যেমন, শৈশবের অতি-চঞ্চলতা কৈশোরে বা প্রাপ্তবয়সে গিয়ে অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা (Inner restlessness) বা অধৈর্য হিসেবে প্রকাশ পেতে পারে (Faraone et al., 2015)।

কেন হয় এই ADHD? কারণের খোঁজে

একটা সময় ছিল যখন মনে করা হতো, বাবা-মায়ের ঠিকমতো শাসন না করা, বেশি চিনি খাওয়া বা বেশি কার্টুন দেখার কারণে বুঝি বাচ্চাদের ADHD হয়। কিন্তু আধুনিক গবেষণা বলছে, এসব ধারণা একেবারেই ভুল। ADHD-র পেছনে বেশ কিছু জটিল কারণ জড়িত, যার মধ্যে প্রধান কয়েকটি হলো:

  • জিনগত কারণ (Genetics): গবেষণায় দেখা গেছে, ADHD বংশগত হতে পারে। অর্থাৎ, পরিবারে কারও ADHD থাকলে অন্যদেরও এই অবস্থা হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। বিজ্ঞানীরা বেশ কিছু জিন শনাক্ত করেছেন যা ADHD-র ঝুঁকির সাথে সম্পর্কিত, যদিও কোনো একটি একক “ADHD জিন” নেই (Faraone & Mick, 2010)। ব্যাপারটা অনেকটা আমাদের উচ্চতা বা চোখের রঙের মতো, যা আমরা বাবা-মায়ের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাই।

  • মস্তিষ্কের গঠন ও কার্যকারিতা (Brain Structure and Function): ADHD আক্রান্ত ব্যক্তিদের মস্তিষ্কের কিছু নির্দিষ্ট অংশের গঠন এবং কার্যকারিতায় সূক্ষ্ম পার্থক্য দেখা যায়। বিশেষ করে, মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স (Prefrontal cortex) – যা মনোযোগ, পরিকল্পনা এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ – এবং এর সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য সার্কিটগুলোতে পার্থক্য দেখা যায়। এছাড়া, মস্তিষ্কের রাসায়নিক দূত বা নিউরোট্রান্সমিটার (Neurotransmitters) যেমন ডোপামিন (Dopamine) এবং নরএপিনেফ্রিন (Norepinephrine) – এর ভারসাম্যহীনতাও ADHD-র সাথে যুক্ত (Swanson & Volkow, 2009; Castellanos & Tannock, 2002)। এই রাসায়নিকগুলো আমাদের মনোযোগ, প্রেরণা এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

  • পরিবেশগত প্রভাবক (Environmental Factors): কিছু পরিবেশগত কারণও ADHD-র ঝুঁকি বাড়াতে পারে, যদিও এগুলো সরাসরি কারণ নয়। যেমন:

    • গর্ভাবস্থায় মায়ের ধূমপান, মদ্যপান বা মাদক সেবন।

    • কম ওজনে বা সময়ের আগে জন্ম (Premature birth)।

    • শৈশবে মাথায় গুরুতর আঘাত (Traumatic brain injury)।

    • শৈশবে পরিবেশগত বিষাক্ত পদার্থ (যেমন, সীসা) বা কিছু খাদ্যাভ্যাস এবং পুষ্টির ঘাটতির সাথেও ক্ষীণ সম্পর্ক পাওয়া গেছে, তবে এগুলো নিয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন (Nigg, 2013)।

তবে আবারও বলছি, চিনি খাওয়া, ভিডিও গেম খেলা বা খারাপ অভিভাবকত্ব ADHD-র কারণ নয়। এই ধারণাগুলো শুধুই মিথ (Myth) এবং এগুলো আক্রান্ত ব্যক্তি ও তাদের পরিবারকে অকারণে অপরাধবোধে ভোগায়।

লক্ষণের সাতকাহন: কীভাবে চিনবেন?

ADHD-র লক্ষণগুলো সাধারণত শৈশবেই প্রকাশ পেতে শুরু করে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ১২ বছর বয়সের আগে। তবে কখনও কখনও কৈশোরে বা প্রাপ্তবয়সেও প্রথমবার শনাক্ত হতে পারে, বিশেষ করে যদি লক্ষণগুলো শৈশবে ততটা প্রকট না থাকে বা ভুলভাবে অন্যকিছু বলে ধরে নেওয়া হয়। DSM-5 অনুযায়ী, ADHD নির্ণয়ের জন্য কিছু নির্দিষ্ট লক্ষণ অন্তত ছয় মাস ধরে এবং একাধিক পরিবেশে (যেমন, স্কুল এবং বাড়ি) উপস্থিত থাকতে হয় এবং ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনযাত্রা বা পড়াশোনায় উল্লেখযোগ্য সমস্যা তৈরি করতে হয়।

চলুন, প্রধান লক্ষণগুলোকে একটু ভেঙে দেখি:

১. অমনোযোগিতার লক্ষণ (Symptoms of Inattention): (কমপক্ষে ছয়টি লক্ষণ থাকতে হবে শিশুদের জন্য, প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য পাঁচটি)

  • প্রায়শই খুঁটিনাটি বিষয়ে মনোযোগ দিতে পারে না বা স্কুল, কাজ বা অন্যান্য বিষয়ে বোকার মতো ভুল করে (Careless mistakes)।
  • কাজ বা খেলাধুলায় মনোযোগ ধরে রাখতে অসুবিধা হয়। মনে হয় যেন শুনছেই না, যখন সরাসরি কথা বলা হয়।
  • নির্দেশাবলী অনুসরণ করতে সমস্যা হয় এবং স্কুলের কাজ, বাড়ির কাজ বা অফিসের দায়িত্ব শেষ করতে পারে না (যেমন, শুরু করে কিন্তু শেষ করতে পারে না)।
  • কাজ এবং বিভিন্ন বিষয় সংগঠিত করতে সমস্যা হয় (Difficulty organizing tasks and activities)। যেমন, জিনিসপত্র এলোমেলো রাখা, সময়ের সঠিক ব্যবহার করতে না পারা।
  • যেসব কাজে একটানা মানসিক প্রচেষ্টার প্রয়োজন (যেমন, স্কুলের পড়া বা অফিসের রিপোর্ট তৈরি), সেগুলো এড়িয়ে চলে বা অপছন্দ করে।
  • কাজের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র (যেমন, স্কুলের বই, পেন্সিল, চাবি, মানিব্যাগ, মোবাইল) প্রায়শই হারিয়ে ফেলে।
  • খুব সহজেই বাইরের কোনো উদ্দীপনা বা শব্দে মন সরে যায় (Easily distracted by extraneous stimuli)।
  • দৈনন্দিন কাজকর্মে প্রায়শই ভুলোমনা হয় (Forgetful in daily activities)।

ভাবুন তো, ক্লাসের শিক্ষক যখন ব্ল্যাকবোর্ডে পড়াচ্ছেন, অমনোযোগী শিশুটির মন তখন হয়তো উড়ে গেছে মাঠে খেলতে থাকা বন্ধুদের দিকে। হোমওয়ার্কের খাতাটা হয়তো বাড়িতেই ফেলে এসেছে, কিংবা পেন্সিল বক্সটা হারিয়ে ফেলেছে খেলার মাঠে। বড়দের ক্ষেত্রে, মিটিং-এর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো হয়তো শুনতেই পেলেন না, কারণ পাশের জানালার পাখির ডাকে মনোযোগ চলে গিয়েছিল।

২. অতি-চঞ্চলতা ও হঠকারিতার লক্ষণ (Symptoms of Hyperactivity and Impulsivity): (কমপক্ষে ছয়টি লক্ষণ থাকতে হবে শিশুদের জন্য, প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য পাঁচটি)

অতি-চঞ্চলতা (Hyperactivity):

  • প্রায়শই হাত-পা নাড়াচাড়া করে বা চেয়ারে ছটফট করে, মোচড়ামুচড়ি করে।
  • যেসব পরিস্থিতিতে বসে থাকা প্রত্যাশিত (যেমন, ক্লাসরুম বা অফিস), সেসব জায়গায় প্রায়শই আসন ছেড়ে উঠে পড়ে।
  • অতিরিক্ত দৌড়াদৌড়ি করে বা জিনিসপত্রে লাফালাফি করে (শিশুদের ক্ষেত্রে); প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে এটি শারীরিক অস্থিরতার অনুভূতি হিসেবে থাকতে পারে।
  • শান্তভাবে খেলাধুলা বা অবসর কাটাতে অসুবিধা হয়।
  • সবসময় “চলমান” থাকে, যেন “মোটরগাড়ির মতো চলছে” (Often “on the go,” acting as if “driven by a motor”)।
  • প্রায়শই অতিরিক্ত কথা বলে।

হঠকারিতা (Impulsivity):

  • প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই চট করে উত্তর দিয়ে দেয়।
  • অন্যদের জন্য অপেক্ষা করা বা নিজের পালা আসা পর্যন্ত ধৈর্য রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।
  • অন্যের কথায় বা কাজে প্রায়শই বাধা দেয় বা অনধিকার প্রবেশ করে (যেমন, অন্যের কথোপকথন বা খেলায় ঢুকে পড়ে)।
  • এই অতি-চঞ্চল ছেলেমেয়েরা যেন এক মুহূর্ত স্থির থাকতে পারে না। ক্লাসে বসেও পা দোলাচ্ছে, কলম দিয়ে টেবিলে শব্দ করছে। লাইনে দাঁড়াতে বললে অধৈর্য হয়ে উঠছে। আর হঠকারী আচরণের জন্য হঠাৎ করেই এমন কিছু করে বসতে পারে, যার জন্য পরে আফসোস হয়। বড়দের ক্ষেত্রে এই হঠকারিতা প্রকাশ পেতে পারে হঠাৎ চাকরি ছেড়ে দেওয়া, বেপরোয়া গাড়ি চালানো বা অতিরিক্ত কেনাকাটার মাধ্যমে।

বিভিন্ন বয়সে ADHD: রঙ বদলায়, ধরনও

ADHD কেবল ছোটদের ব্যাপার নয়, এটি কৈশোর পেরিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক জীবন পর্যন্তও বিস্তৃত হতে পারে। তবে বয়সের সাথে সাথে এর প্রকাশভঙ্গিতে কিছু পরিবর্তন আসে।

  • শিশুদের ADHD (ADHD in Children): এই বয়সে অতি-চঞ্চলতা এবং হঠকারিতার লক্ষণগুলো বেশি প্রকট থাকে। স্কুলে মনোযোগ দিতে সমস্যা, পড়ালেখায় পিছিয়ে পড়া, বন্ধুদের সাথে মিশতে অসুবিধা, এবং প্রায়শই নিয়ম ভাঙার প্রবণতা দেখা যায়। বাবা-মা এবং শিক্ষকদের জন্য এদের সামলানো বেশ কষ্টকর হয়ে পড়ে। এরা অনেক সময় “দুষ্টু” বা “বেয়াদব” তকমা পেয়ে যায়, যা তাদের আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দেয় (DuPaul & Stoner, 2014)।

  • কিশোর-কিশোরীদের ADHD (ADHD in Adolescents): কৈশোরে এসে শারীরিক অতি-চঞ্চলতা কিছুটা কমতে পারে, কিন্তু ভেতরের অস্থিরতা (Inner restlessness) এবং অমনোযোগিতা থেকেই যায়, এমনকি বাড়তেও পারে। পড়াশোনার চাপ বাড়ে, সামাজিক সম্পর্ক জটিল হয়। এই সময়ে ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা (Risk-taking behaviors) যেমন – বেপরোয়া ড্রাইভিং, মাদক বা অ্যালকোহলের ব্যবহার, এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণে সমস্যা দেখা দিতে পারে। পরীক্ষার ফল খারাপ হওয়া, স্কুল থেকে ঝরে পড়ার ঝুঁকিও থাকে (Barkley et al., 2008)।

  • প্রাপ্তবয়স্কদের ADHD (ADHD in Adults): অনেকের ধারণা, ADHD শুধু ছোটদের হয়, বড় হলে সেরে যায়। এটা পুরোপুরি ঠিক নয়। প্রায় ৬০% শিশুর ADHD প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায়ও থেকে যায় (Faraone et al., 2015)। প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে অতি-চঞ্চলতা কমে গেলেও অমনোযোগিতা, অসংগঠিত ভাব, দীর্ঘসূত্রিতা (Procrastination), আবেগ নিয়ন্ত্রণে অসুবিধা, এবং হঠকারী সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতা থাকতে পারে। এর ফলে কর্মক্ষেত্রে সমস্যা, সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে অসুবিধা, আর্থিক ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা এবং আত্মসম্মানবোধের অভাব দেখা দেয়। অনেকে হয়তো বুঝতেই পারেন না যে তাদের এই সমস্যাগুলোর মূলে ADHD থাকতে পারে, এবং তারা নিজেদের “অকর্মা” বা “ব্যর্থ” বলে ভাবতে শুরু করেন (Kooij et al., 2010; Gentile et al., 2006)।

  • মেয়েদের ADHD (ADHD in Girls and Women): ঐতিহ্যগতভাবে ADHD-কে ছেলেদের সমস্যা হিসেবে দেখা হলেও, মেয়েরাও সমানভাবে আক্রান্ত হতে পারে। তবে মেয়েদের ক্ষেত্রে লক্ষণগুলো প্রায়শই ভিন্নভাবে প্রকাশ পায়। তারা সাধারণত অতি-চঞ্চল না হয়ে বরং অমনোযোগী (Inattentive type) হয় বেশি। তারা ক্লাসে চুপচাপ দিবাস্বপ্ন দেখতে পারে, গুছিয়ে কাজ করতে সমস্যা হতে পারে, এবং আবেগজনিত সমস্যায় (যেমন, উদ্বেগ বা বিষণ্ণতা) বেশি ভুগতে পারে। যেহেতু তারা ছেলেদের মতো ক্লাসে উপদ্রব করে না, তাই তাদের ADHD অনেক সময়ই শনাক্ত হয় না (Quinn, 2008; Hinshaw, 2002)। এর ফলে তারা প্রয়োজনীয় সাহায্য থেকে বঞ্চিত হয় এবং পরবর্তী জীবনে নানা জটিলতার সম্মুখীন হতে পারে।

ADHD-র সাথে দোসর কারা?

ADHD প্রায়শই একা আসে না, তার সাথে আরও কিছু “দোসর” বা সহগামী অবস্থা (Co-occurring conditions) থাকতে দেখা যায়। এই সহগামী অবস্থাগুলো ADHD-র লক্ষণগুলোকে আরও জটিল করে তুলতে পারে এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিশেষ মনোযোগ দাবি করে। কিছু সাধারণ সহগামী অবস্থা হলো:

  • লার্নিং ডিজঅ্যাবিলিটি (Learning Disabilities): যেমন ডিসলেক্সিয়া (Dyslexia) বা ডিসক্যালকুলিয়া (Dyscalculia)। ADHD আক্রান্ত শিশুদের প্রায় ৩০-৫০% এর কোনো না কোনো লার্নিং ডিজঅ্যাবিলিটি থাকতে পারে (DuPaul & Stoner, 2014)।

  • অপজিশনাল ডেফিয়ান্ট ডিসঅর্ডার (Oppositional Defiant Disorder – ODD): এই ক্ষেত্রে শিশুরা প্রায়শই তর্ক করে, নির্দেশ অমান্য করে এবং কর্তৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিদের প্রতি বিরূপ মনোভাব দেখায়।

  • কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডার (Conduct Disorder – CD): এটি আরও গুরুতর আচরণগত সমস্যা, যেখানে নিয়ম ভাঙা, আগ্রাসী আচরণ, অন্যের ক্ষতি করা বা সম্পত্তি নষ্ট করার মতো প্রবণতা দেখা যায়।

  • উদ্বেগজনিত ব্যাধি (Anxiety Disorders): ADHD আক্রান্তদের মধ্যে উদ্বেগ বা অ্যাংজাইটিতে ভোগার প্রবণতা বেশি।

  • বিষণ্ণতা (Depression): ক্রমাগত ব্যর্থতা, সমালোচনা এবং একাকীত্বের অনুভূতি থেকে বিষণ্ণতা তৈরি হতে পারে।

  • টিক ডিসঅর্ডার (Tic Disorders) ও ট্যুরেট সিনড্রোম (Tourette Syndrome): শিশু-কিশোরদের মধ্যে দেখা দেওয়া নিউরোডেভেলপমেন্টাল (স্নায়ুবিক বিকাশসংক্রান্ত) অবস্থাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই দুইটি অবস্থা অনেক সময় ADHD-এর সঙ্গে সহাবস্থান করে, অর্থাৎ একাধিক অবস্থার লক্ষণ একসঙ্গে দেখা যায়। টিক (Tic) হলো আকস্মিক, অপ্রত্যাশিত, পুনরাবৃত্তিমূলক শব্দ (vocal tic) বা অঙ্গ-চলাচল (motor tic)। এগুলো ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঘটে এবং সাময়িকভাবে চেপে রাখা গেলেও পুরোপুরি বন্ধ রাখা যায় না। উদাহরণ: চোখ টেপা, মুখ বেঁকানো, ঘাড় ঝাঁকানো, হাত নাড়ানো, গলার স্বর করা, গুঁতো দেওয়া শব্দ বের করা ইত্যাদি। টিক সাধারণত বয়স ৫–৭ এর মধ্যে শুরু হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হ্রাস পায় বা অদৃশ্য হয়ে যায়। Tourette Syndrome (TS) হলো একটি নির্দিষ্ট ধরনের টিক ডিসঅর্ডার, যার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো একাধিক মোটর টিক, অন্তত একটি ভোকাল টিক। এই লক্ষণগুলো কমপক্ষে এক বছর ধরে উপস্থিত থাকে। লক্ষণ হতে পারে: চোখ বারবার কপকপ করা + খিচিয়ে শব্দ করা, মুখের অঙ্গভঙ্গি + অশালীন শব্দ (কিছু ক্ষেত্রে)

  • স্লিপ ডিসঅর্ডার (Sleep Disorders): ঘুমাতে সমস্যা বা ঘুমের অনিয়ম ADHD আক্রান্তদের মধ্যে বেশ সাধারণ (Cortese et al., 2009)।

  • সাবস্টেন্স ইউজ ডিসঅর্ডার (Substance Use Disorders): বিশেষ করে কৈশোরে বা প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে, ADHD আক্রান্তদের মধ্যে মাদক বা অ্যালকোহলের অপব্যবহারের ঝুঁকি বেড়ে যায়, যদি ADHD-র সঠিক চিকিৎসা না হয় (Wilens et al., 2008)।

এই সহগামী অবস্থাগুলো থাকলে ADHD-র চিকিৎসা আরও চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে, তবে সমন্বিত চিকিৎসার মাধ্যমে এগুলোও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

ভুল ধারণার বেড়াজাল

ADHD নিয়ে সমাজে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে, যা আক্রান্ত ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারকে কষ্ট দেয়। চলুন, কয়েকটি সাধারণ ভুল ধারণা ভেঙে দেওয়া যাক:

  • ভুল ধারণা: ADHD আসলে কোনো রোগই নয়, ওটা বাচ্চার দুষ্টুমি বা আলসেমি।
    সঠিক তথ্য: ADHD একটি স্বীকৃত স্নায়বিক-বিকাশজনিত অবস্থা, যার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি রয়েছে। এটি ইচ্ছাকৃত আচরণ নয় (Barkley, 2015)।

  • ভুল ধারণা: শুধু ওষুধ দিয়েই ADHD সারানো যায়।
    সঠিক তথ্য: ওষুধ ADHD ব্যবস্থাপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হতে পারে, কিন্তু এটিই একমাত্র সমাধান নয়। আচরণগত থেরাপি, জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এবং শিক্ষাগত সহায়তাও সমান গুরুত্বপূর্ণ (Pelham et al., 2016)।

  • ভুল ধারণা: ADHD কেবল ছোটবেলার সমস্যা, বড় হলে ঠিক হয়ে যায়।
    সঠিক তথ্য: অনেক ক্ষেত্রেই ADHD প্রাপ্তবয়স্ক জীবন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। লক্ষণের ধরনে পরিবর্তন আসতে পারে, কিন্তু মূল সমস্যাগুলো থেকে যেতে পারে (Faraone et al., 2015)।

  • ভুল ধারণা: ADHD আক্রান্তরা বুদ্ধিমান নয়।
    সঠিক তথ্য: ADHD-র সাথে বুদ্ধিমত্তার কোনো সম্পর্ক নেই। অনেক ADHD আক্রান্ত ব্যক্তি অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং সৃজনশীল হতে পারেন। তাদের সমস্যা হলো অর্জিত জ্ঞান বা বুদ্ধিকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে না পারা।

  • ভুল ধারণা: বেশি চিনি খেলে বা জাঙ্ক ফুড খেলে ADHD হয়।
    সঠিক তথ্য: গবেষণায় এর কোনো শক্ত প্রমাণ মেলেনি। সুষম খাদ্যাভ্যাস সবার জন্যই জরুরি, কিন্তু চিনি বা জাঙ্ক ফুড ADHD-র মূল কারণ নয় (Nigg, 2013)।

  • ভুল ধারণা: ADHD-র ওষুধগুলো খুব বিপজ্জনক এবং আসক্তি তৈরি করে।
    সঠিক তথ্য: চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে সঠিকভাবে ব্যবহার করলে ADHD-র ওষুধগুলো নিরাপদ এবং কার্যকর। এগুলো আসক্তি তৈরি করে না, বরং সঠিক চিকিৎসা না হলে মাদকাসক্তির ঝুঁকি বাড়ে (Wilens et al., 2008)।

রোগ নির্ণয়ের পথ: কীভাবে বোঝা যায়?

ADHD নির্ণয় কোনো রক্ত পরীক্ষা বা ব্রেইন স্ক্যানের মাধ্যমে এক মুহূর্তে করে ফেলা যায় না। এটি একটি জটিল প্রক্রিয়া, যার জন্য একজন অভিজ্ঞ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ (Psychiatrist), শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ (Child psychiatrist), স্নায়ু বিশেষজ্ঞ (Neurologist) বা মনোবিজ্ঞানী (Psychologist)-এর সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন।

নির্ণয় প্রক্রিয়ায় সাধারণত যা যা অন্তর্ভুক্ত থাকে:

  • বিস্তারিত সাক্ষাৎকার (Detailed Interview): চিকিৎসক শিশু বা প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি এবং তাদের বাবা-মা, শিক্ষক বা সঙ্গীর সাথে কথা বলেন। লক্ষণের ইতিহাস, পারিবারিক ইতিহাস, শারীরিক স্বাস্থ্য এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রার উপর এর প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

  • আচরণগত রেটিং স্কেল (Behavioral Rating Scales): বিভিন্ন মানসম্মত প্রশ্নমালা (যেমন, কানার্স রেটিং স্কেল, ভ্যান্ডারবিল্ট অ্যাসেসমেন্ট স্কেল) ব্যবহার করা হয়, যা বাবা-মা, শিক্ষক এবং ক্ষেত্রবিশেষে ব্যক্তি নিজেও পূরণ করেন। এই স্কেলগুলো ADHD-র লক্ষণগুলোর তীব্রতা এবং ব্যাপকতা পরিমাপ করতে সাহায্য করে।

  • অন্যান্য শারীরিক ও মানসিক অবস্থা বাদ দেওয়া (Ruling out other conditions): এমন অনেক শারীরিক বা মানসিক সমস্যা আছে, যার লক্ষণগুলো ADHD-র মতো হতে পারে (যেমন, থাইরয়েডের সমস্যা, উদ্বেগ, বিষণ্ণতা, বা লার্নিং ডিজঅ্যাবিলিটি)। সঠিক নির্ণয়ের জন্য এগুলোকে আলাদা করা জরুরি।

  • DSM-5 বা ICD-10/11 মানদণ্ড অনুসরণ: চিকিৎসকেরা সাধারণত আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের DSM-5 (Diagnostic and Statistical Manual of Mental Disorders, 5th Edition) বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ICD-10/11 (International Classification of Diseases) এর নির্দেশিকা অনুযায়ী লক্ষণগুলো মিলিয়ে দেখেন (American Psychiatric Association, 2013; World Health Organization, 2019)।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ADHD নির্ণয়ের জন্য লক্ষণগুলো একাধিক পরিবেশে (যেমন, বাড়ি ও স্কুল/কর্মক্ষেত্র) উপস্থিত থাকতে হবে এবং ব্যক্তির সামাজিক, শিক্ষাগত বা পেশাগত জীবনে সুস্পষ্ট সমস্যা তৈরি করতে হবে।

চিকিৎসার সাতসতেরো: আলো ঝলমলে দিনের খোঁজে

ADHD পুরোপুরি “সারিয়ে” তোলার কোনো জাদুকরী উপায় নেই, কারণ এটি কোনো অসুখ নয়, বরং মস্তিষ্কের একটি ভিন্ন গঠন ও কার্যপ্রণালী। তবে সঠিক চিকিৎসা এবং ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এর লক্ষণগুলোকে কার্যকরীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং আক্রান্ত ব্যক্তি একটি সফল ও পরিপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারে। ADHD-র চিকিৎসা সাধারণত একটি বহুস্তরীয় (Multimodal) পদ্ধতি অনুসরণ করে, যেখানে বিভিন্ন ধরনের কৌশল একত্রিত করা হয়।

১. ওষুধপত্র (Medications): ADHD-র চিকিৎসায় ওষুধ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, বিশেষ করে মাঝারি থেকে গুরুতর লক্ষণের ক্ষেত্রে। প্রধানত দুই ধরনের ওষুধ ব্যবহৃত হয়:

  • উদ্দীপক ওষুধ (Stimulant Medications): যেমন মিথাইলফেনিডেট (Methylphenidate – Ritalin, Concerta) এবং অ্যামফিটামিন (Amphetamine – Adderall, Vyvanse)। নামটা “উদ্দীপক” হলেও, এগুলো ADHD আক্রান্তদের মস্তিষ্কের সেই অংশগুলোকে উদ্দীপ্ত করে যা মনোযোগ এবং আচরণ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, ফলে তারা শান্ত হয় এবং মনোযোগ দিতে পারে। এগুলো সাধারণত প্রথম পছন্দের চিকিৎসা এবং প্রায় ৭০-৮0% ক্ষেত্রে কার্যকরী (Swanson & Volkow, 2009)।

  • অ-উদ্দীপক ওষুধ (Non-Stimulant Medications): যেমন অ্যাটমোক্সেটিন (Atomoxetine – Strattera), গুয়ানফাসিন (Guanfacine – Intuniv), এবং ক্লোনিডিন (Clonidine – Kapvay)। যখন উদ্দীপক ওষুধ কাজ করে না, বা তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বেশি হয়, অথবা সহগামী কোনো সমস্যা (যেমন, টিক ডিসঅর্ডার বা উদ্বেগ) থাকে, তখন এগুলো ব্যবহৃত হয়। এদের কার্যকারিতা প্রকাশ পেতে একটু বেশি সময় লাগতে পারে।

ওষুধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু বিষয় মনে রাখা জরুরি:

  • ওষুধ অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ও তত্ত্বাবধানে শুরু এবং সমন্বয় করতে হবে।
  • সঠিক ওষুধ এবং সঠিক মাত্রা খুঁজে পেতে কিছুটা সময় লাগতে পারে, কারণ প্রত্যেকের শরীর ভিন্নভাবে সাড়া দেয়।
  • কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (যেমন, ঘুমের সমস্যা, ক্ষুধামান্দ্য, মাথাব্যথা, পেটে অস্বস্তি) দেখা দিতে পারে, যা সাধারণত সাময়িক এবং মাত্রা সমন্বয়ের মাধ্যমে কমানো যায়। যেকোনো গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলে দ্রুত চিকিৎসককে জানাতে হবে।
  • ওষুধ ADHD “সারিয়ে” তোলে না, বরং লক্ষণ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ওষুধ বন্ধ করলে লক্ষণ আবার ফিরে আসতে পারে।

২. আচরণগত থেরাপি (Behavioral Therapies): ওষুধের পাশাপাশি আচরণগত থেরাপি ADHD ব্যবস্থাপনায় অত্যন্ত কার্যকর, বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে এবং দীর্ঘমেয়াদী সুফলের জন্য।

  • পিতামাতার জন্য প্রশিক্ষণ (Parent Training in Behavior Management): বাবা-মাকে শেখানো হয় কীভাবে সন্তানের আচরণ পরিবর্তন ও নিয়ন্ত্রণের জন্য ইতিবাচক কৌশল (Positive reinforcement), সুস্পষ্ট নিয়মকানুন এবং কার্যকরী পরিণতি (Consequences) ব্যবহার করতে হয়। এটি শিশুদের আত্মনিয়ন্ত্রণ বাড়াতে এবং পারিবারিক শান্তি ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে (Pelham & Fabiano, 2008)।

  • স্কুল-ভিত্তিক হস্তক্ষেপ (School-based Interventions): শিক্ষকদের সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে ক্লাসরুমে শিশুর জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা, যেমন – বসার জায়গা পরিবর্তন, সুস্পষ্ট ও সংক্ষিপ্ত নির্দেশ দেওয়া, কাজের মাঝে বিরতি দেওয়া, এবং ইতিবাচক আচরণের জন্য পুরস্কৃত করা। অনেক সময় শিশুর জন্য একটি ইন্ডিভিজুয়ালাইজড এডুকেশন প্রোগ্রাম (Individualized Education Program – IEP) বা ৫০৪ প্ল্যান (504 Plan) প্রয়োজন হতে পারে।

  • কগনিটিভ বিহেভিওরাল থেরাপি (Cognitive Behavioral Therapy – CBT): এটি বিশেষ করে কিশোর ও প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য উপকারী। CBT-র মাধ্যমে নেতিবাচক চিন্তাভাবনা ও আচরণের ধরণ পরিবর্তন করা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বৃদ্ধি করা, আবেগ নিয়ন্ত্রণ এবং সাংগঠনিক দক্ষতা (Organizational skills) উন্নত করার কৌশল শেখানো হয় (Safren et al., 2005)।

  • সোশ্যাল স্কিলস ট্রেনিং (Social Skills Training): ADHD আক্রান্তদের অনেক সময় সামাজিক সম্পর্ক তৈরি ও বজায় রাখতে অসুবিধা হয়। এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের সামাজিক ইঙ্গিত বোঝা, অন্যের সাথে সঠিকভাবে संवाद স্থাপন করা এবং বন্ধুত্ব তৈরি করার কৌশল শেখানো হয়।

  • এক্সিকিউটিভ ফাংশনিং স্কিলস কোচিং (Executive Functioning Skills Coaching): প্রাপ্তবয়স্ক ও কিশোরদের পরিকল্পনা, সময় ব্যবস্থাপনা, কাজ শুরু করা ও শেষ করা, এবং সংগঠিত থাকার মতো নির্বাহী কার্যাবলী উন্নত করতে সাহায্য করে।

৩. জীবনযাত্রায় পরিবর্তন (Lifestyle Adjustments): কিছু জীবনযাত্রাগত পরিবর্তনও ADHD-র লক্ষণ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হতে পারে:

  • সুষম খাদ্যাভ্যাস (Balanced Diet): প্রক্রিয়াজাত খাবার, অতিরিক্ত চিনি এড়িয়ে পুষ্টিকর ও সুষম খাবার গ্রহণ করা সার্বিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। কিছু গবেষণায় ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের সম্ভাব্য ভূমিকার কথা বলা হয়েছে, তবে এ নিয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন (Bloch & Qawasmi, 2011)।

  • নিয়মিত ব্যায়াম (Regular Exercise): শারীরিক কার্যকলাপ মনোযোগ বাড়াতে, অতি-চঞ্চলতা কমাতে এবং মেজাজ ভালো রাখতে সাহায্য করে। প্রতিদিন অন্তত ৩০-৬০ মিনিট ব্যায়াম করার লক্ষ্য রাখা উচিত (Vysniauske et al., 2020)।

  • পর্যাপ্ত ঘুম (Adequate Sleep): ঘুমের অভাব ADHD-র লক্ষণগুলোকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। একটি নির্দিষ্ট ঘুমের রুটিন তৈরি করা এবং পর্যাপ্ত ঘুমানো (শিশুদের জন্য ৯-১১ ঘণ্টা, কিশোরদের ৮-১০ ঘণ্টা, প্রাপ্তবয়স্কদের ৭-৯ ঘণ্টা) জরুরি।

  • মাইন্ডফুলনেস ও মেডিটেশন (Mindfulness and Meditation): মনকে শান্ত করতে, মনোযোগ বাড়াতে এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণে মাইন্ডফুলনেস বা ধ্যান চর্চা উপকারী হতে পারে (Cairncross & Miller, 2020)।

৪. শিক্ষাগত সহায়তা (Educational Support): স্কুলগামী শিশুদের জন্য শিক্ষাগত সহায়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে থাকতে পারে:

  • আইইপি (IEP – Individualized Education Program): বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের জন্য তৈরি ব্যক্তিগতকৃত শিক্ষ পরিকল্পনা।

  • ৫০৪ প্ল্যান (504 Plan): যে শিশুদের বিশেষ শিক্ষার প্রয়োজন নেই কিন্তু তাদের শেখার ক্ষেত্রে কিছু সুবিধা (Accommodations) দরকার, তাদের জন্য এই প্ল্যান। যেমন, পরীক্ষার জন্য অতিরিক্ত সময়, ক্লাসে পছন্দের জায়গায় বসার সুযোগ, ইত্যাদি।

  • শিক্ষকের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ এবং সহযোগিতা।

ADHD নিয়ে বেঁচে থাকা: চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা

ADHD নিয়ে জীবনযাপন করা নিঃসন্দেহে চ্যালেঞ্জিং। দৈনন্দিন জীবনে মনোযোগ ধরে রাখা, কাজ গুছিয়ে করা, সময়মতো পৌঁছানো, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা – এসব ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত হোঁচট খেতে হতে পারে। এর ফলে পড়াশোনায়, কর্মক্ষেত্রে, ব্যক্তিগত সম্পর্কে নানারকম সমস্যা তৈরি হয়। সমাজের ভুল ধারণা, সমালোচনা এবং কখনো কখনো নিজের প্রতিও হতাশা তৈরি হতে পারে।

কিন্তু মুদ্রার অপর পিঠেও কিছু গল্প আছে। ADHD আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে কিছু অসাধারণ গুণও দেখা যায়:

  • সৃজনশীলতা (Creativity): তাদের মস্তিষ্ক একটু ভিন্নভাবে চিন্তা করে, তাই তারা অনেক সময় গতানুগতিক চিন্তার বাইরে গিয়ে নতুন নতুন আইডিয়া বের করতে পারে (White & Shah, 2011)।

  • শক্তি ও উদ্দীপনা (Energy and Enthusiasm): তাদের মধ্যে অফুরন্ত প্রাণশক্তি থাকতে পারে, যা সঠিক পথে চালিত করতে পারলে অনেক বড় কিছু করা সম্ভব।

  • হাইপারফোকাস (Hyperfocus): যখন তারা কোনো পছন্দের বা আগ্রহের বিষয়ে কাজ করে, তখন তারা অবিশ্বাস্য মনোযোগ এবং একাগ্রতার সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করতে পারে।

  • সহানুভূতি (Empathy): নিজেরা যেহেতু অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যায়, তাই তারা অন্যদের প্রতি অনেক বেশি সহানুভূতিশীল হতে পারে।

  • স্থিতিস্থাপকতা (Resilience): ক্রমাগত প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে টিকে থাকার ফলে তাদের মধ্যে এক ধরনের মানসিক দৃঢ়তা তৈরি হয়।

মাইকেল ফেলপস (সাঁতারু), সিমোন বাইলস (জিমন্যাস্ট), জাস্টিন টিম্বারলেক (সংগীতশিল্পী), উইল স্মিথ (অভিনেতা), রিচার্ড ব্র্যানসন (উদ্যোক্তা) – এমন অনেক বিখ্যাত এবং সফল ব্যক্তি আছেন যারা ADHD নিয়েও নিজ নিজ ক্ষেত্রে শিখরে পৌঁছেছেন। তাদের জীবন থেকে আমরা এই শিক্ষাই পাই যে, ADHD কোনো প্রতিবন্ধকতা নয়, যদি সঠিক সমর্থন, চিকিৎসা এবং নিজের ভেতরের শক্তিকে চিনে নেওয়া যায়।

পরিবার ও সমাজের ভূমিকা: বাড়িয়ে দাও তোমার হাত

ADHD আক্রান্ত ব্যক্তির জীবনে পরিবার এবং সমাজের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের প্রয়োজন সমালোচনা বা তাচ্ছিল্য নয়, বরং বোঝা, সহানুভূতি এবং সমর্থন।

  • পরিবারের জন্য:

    • ADHD সম্পর্কে জানুন। যত বেশি জানবেন, তত ভালোভাবে আপনার প্রিয়জনকে বুঝতে এবং সাহায্য করতে পারবেন।

    • ধৈর্য ধরুন। মনে রাখবেন, তার আচরণ ইচ্ছাকৃত নয়।

    • একটি কাঠামোবদ্ধ এবং রুটিনমাফিক পরিবেশ তৈরি করুন।

    • ছোট ছোট সাফল্যের জন্য প্রশংসা করুন।

    • নিজেদের যত্ন নিন। ADHD আক্রান্ত সন্তানের দেখভাল করা বা সঙ্গীর সাথে থাকা মানসিকভাবে চাপের হতে পারে। প্রয়োজনে নিজের জন্যও সাহায্য নিন।

  • শিক্ষকদের জন্য:

    • ADHD আক্রান্ত শিক্ষার্থীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হন।

    • তাদের জন্য ক্লাসরুমে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করুন।

    • তাদের শক্তি এবং দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী শিক্ষাদানের পদ্ধতি ঠিক করুন।

    • বাবা-মায়ের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন।

  • সমাজের জন্য:

    • ADHD নিয়ে প্রচলিত ভুল ধারণাগুলো দূর করতে সাহায্য করুন।

    • ADHD আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রতি সহনশীল ও সহযোগিতামূলক মনোভাব পোষণ করুন।

    • কর্মক্ষেত্রে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সুবিধা (Accommodations) নিশ্চিত করার চেষ্টা করুন।

শেষের কথা: মন যদি হয় প্রজাপতি

মনটা যদি হয় একটা উড়ন্ত প্রজাপতি, তাকে জোর করে ধরে রাখা কঠিন। সে কখনও ফুলে বসবে, কখনও উড়ে যাবে দূরে। ADHD আক্রান্তদের মনটাও অনেকটা তাই – চঞ্চল, কৌতুহলী, সদা পরিবর্তনশীল। এই মনটাকে শৃঙ্খলিত না করে, বরং তার গতিপথটাকে একটু সুন্দর দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

ADHD কোনো অভিশাপ নয়, এটি একটি ভিন্নতা মাত্র। এই ভিন্নতাকে যদি আমরা সঠিকভাবে বুঝতে পারি, গ্রহণ করতে পারি এবং প্রয়োজনীয় সমর্থন দিতে পারি, তাহলে এই “উড়ন্ত প্রজাপতি” মনগুলোও জীবনে অনেক রঙ ছড়াতে পারে, অনেক সুন্দর বাগান তৈরি করতে পারে। দিনশেষে, প্রতিটি মানুষের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে অপার সম্ভাবনা, প্রয়োজন শুধু সেই সম্ভাবনাকে চিনে নেওয়ার এবং বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার। আর সেই সুযোগ তৈরি করার দায়িত্ব আমাদের সবার।

এই দীর্ঘ আলোচনার পর আশা করি ADHD সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হয়েছে। এটি একটি জটিল বিষয়, এবং প্রতিটি ব্যক্তির অভিজ্ঞতা ভিন্ন। আপনার বা আপনার পরিচিত কারো যদি ADHD-র লক্ষণ থাকে, তবে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়াই শ্রেয়। মনে রাখবেন, সঠিক জ্ঞান এবং সমর্থনই পারে একটি সুস্থ ও সুন্দর জীবনের পথ দেখাতে।

(এই আর্টিকেলটি সামগ্রিকভাবে ADHD নিয়ে। বিশেষভাবে প্রাপ্তবয়স্কদের ADHD সম্পর্কে জানতে এখানে যান – প্রাপ্তবয়স্কদের ADHD: এক বিস্তৃত আলোচনা)

তথ্যসূত্র

  • American Psychiatric Association. (2013). Diagnostic and statistical manual of mental disorders (5th ed.). Arlington, VA: American Psychiatric Publishing.
  • Barkley, R. A. (2015). Attention-deficit hyperactivity disorder: A handbook for diagnosis and treatment (4th ed.). New York, NY: Guilford Press.
  • Barkley, R. A., Murphy, K. R., & Fischer, M. (2008). ADHD in adults: What the science says. New York, NY: Guilford Press.
  • Bloch, M. H., & Qawasmi, A. (2011). Omega-3 fatty acid supplementation for the treatment of children with attention-deficit/hyperactivity disorder symptomatology: Systematic review and meta-analysis. Journal of the American Academy of Child & Adolescent Psychiatry, 50(10), 991-1000.
  • Cairncross, M., & Miller, C. J. (2020). The effectiveness of mindfulness-based therapies for ADHD: A meta-analytic review. Journal of Attention Disorders, 24(5), 627-643.
  • Castellanos, F. X., & Tannock, R. (2002). Neuroscience of attention-deficit/hyperactivity disorder: The search for endophenotypes. Nature Reviews Neuroscience, 3(8), 617-628.
  • Cortese, S., Faraone, S. V., Konofal, E., & Lecendreux, M. (2009). Sleep in children with attention-deficit/hyperactivity disorder: Meta-analysis of subjective and objective studies. Journal of the American Academy of Child & Adolescent Psychiatry, 48(9), 894-908.
  • DuPaul, G. J., & Stoner, G. (2014). ADHD in the schools: Assessment and intervention strategies (3rd ed.). New York, NY: Guilford Press.
  • Faraone, S. V., Asherson, P., Banaschewski, T., Biederman, J., Buitelaar, J. K., Ramos-Quiroga, J. A., … & Franke, B. (2015). Attention-deficit/hyperactivity disorder. Nature Reviews Disease Primers, 1(1), 1-23. Article 15020.
  • Faraone, S. V., & Mick, E. (2010). Molecular genetics of attention deficit hyperactivity disorder. Psychiatric Clinics of North America, 33(1), 159-180.
  • Gentile, J. P., Atiq, R., & Gillig, P. M. (2006). Adult ADHD: Diagnosis, differential diagnosis, and medication management. Psychiatry (Edgmont), 3(8), 25–30.
  • Hinshaw, S. P. (2002). Preadolescent girls with attention-deficit/hyperactivity disorder: I. Background characteristics, comorbidity, cognitive and social functioning, and parenting practices. Journal of Consulting and Clinical Psychology, 70(5), 1086–1098.
  • Kooij, S. J. J., Bejerot, S., Blackwell, A., Caci, H., Casas-Brugué, M., Carpentier, P. J., … & Asherson, P. (2010). European consensus statement on diagnosis and treatment of adult ADHD: The European Network Adult ADHD. BMC Psychiatry, 10(1), 67.
  • Nigg, J. T. (2013). Attention-deficit/hyperactivity disorder and adverse health outcomes. Clinical Psychology Review, 33(2), 215-228.
  • Pelham, W. E., Jr., & Fabiano, G. A. (2008). Evidence-based psychosocial treatments for attention-deficit/hyperactivity disorder. Journal of Clinical Child & Adolescent Psychology, 37(1), 184-214.
  • Pelham, W. E., Jr., Foster, E. M., & Robb, J. A. (2007). The economic impact of attention-deficit/hyperactivity disorder in children and adolescents. Journal of Pediatric Psychology, 32(6), 711-727.
  • Pelham, W. E., Jr., Gnagy, E. M., Sibley, M. H., et al. (2016). A A pragmatic randomized clinical trial of behavioral and pharmacological treatments for attention-deficit/hyperactivity disorder in elementary school. Journal of Abnormal Child Psychology, 44(7), 1303-1318.
  • Quinn, P. O. (2008). Attention-deficit/hyperactivity disorder in women: The screening, diagnosis, and management of ADHD in girls and women. Medscape General Medicine, 10(10), 241.
  • Safren, S. A., Otto, M. W., Sprich, S., Winett, C. L., Wilens, T. E., & Biederman, J. (2005). Cognitive-behavioral therapy for ADHD in medication-treated adults with continued symptoms. Behaviour Research and Therapy, 43(7), 831-842.
  • Swanson, J. M., & Volkow, N. D. (2009). Serum and brain concentrations of methylphenidate: Implications for use and abuse. Neuroscience & Biobehavioral Reviews, 33(5), 735-742.
  • Vysniauske, R., Verburgh, L., Oosterlaan, J., & Molendijk, M. L. (2020). The effects of physical exercise on cognitive performance in children and adolescents with clinical or subclinical ADHD: A systematic review and meta-analysis. Journal of Attention Disorders, 24(13), 1788-1805.
  • White, H. A., & Shah, P. (2011). Creative style and achievement in adults with attention-deficit/hyperactivity disorder. Personality and Individual Differences, 50(5), 673-677.
  • Wilens, T. E., Faraone, S. V., Biederman, J., & Gunawardene, S. (2008). Does stimulant therapy of attention-deficit/hyperactivity disorder beget later substance abuse? A meta-analytic review of the literature. Pediatrics, 111(1), 179-185.
  • World Health Organization. (2019). International statistical classification of diseases and related health problems (11th ed.). Retrieved from https://icd.who.int/ (Note: Depending on when this is read, the ICD-11 will be more widely implemented).

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.