
(সাহিত্যে ‘ঐতিহ্য’ শব্দটা শুনলেই অনেকে ভাবেন তা বুঝি নতুন সৃষ্টির পথে বাধা বা শুধু পুরোনোকে আঁকড়ে থাকা। কিন্তু প্রখ্যাত কবি ও সমালোচক টি. এস. এলিয়ট তাঁর যুগান্তকারী “ঐতিহ্য এবং ব্যক্তি–প্রতিভা” (Tradition and the Individual Talent) প্রবন্ধে বলেছেন অন্য কথা। তাঁর মতে, ঐতিহ্য উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া বিষয় নয়, বরং কঠোর পরিশ্রমে অর্জিত ‘ঐতিহাসিক বোধের’ ফসল। এই বোধ কবিকে অতীত ও বর্তমানের যুগপৎ ধারায় স্থাপন করে, যেখানে পূর্বসূরিদের সঙ্গে সংযোগ রেখেই তাঁর স্বকীয় প্রতিভার বিকাশ ঘটে, যা পরিণামে এক প্রকার শৈল্পিক নৈর্ব্যক্তিকতার জন্ম দেয়।)
১.
আমরা যখন ইংরেজিতে কিছু একটা লিখতে যাই, ‘ঐতিহ্য’ শব্দটা যে তখন মুখে প্রায় আসেই না, সে কথা না বললেও চলে। তবে হ্যাঁ, পুরোনো কোনো জিনিস যখন আর টেকে না, চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে যায়, তখন বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে ওঠে। ঠিক তখনই আফসোস করতে গিয়ে ঐ শব্দটা আমাদের ঠোঁটে চলে আসে। ‘সেই ঐতিহ্য’ বা ‘একটা ঐতিহ্য’ – এসব আমরা তেমন একটা বলি না। বড়জোর, কারও কবিতার ব্যাপারে বলতে হলে, বিশেষণটা জুড়ে দিয়ে বলি, অমুকের কবিতা বড্ড ‘ঐতিহ্যগত’ (traditional) বা বড় বেশি ‘ঐতিহ্যমাফিক’ (too traditional)। সম্ভবত, কাউকে একটু খাটো করে দেখানোর মতলব না থাকলে শব্দটা তেমন পাত্তা পায় না। কখনো সখনো যদি মুখে আসেও, কেমন যেন একটু প্রশংসার মতো শোনায় ঠিকই, কিন্তু সেই প্রশংসার ভেতরেও একটা কিন্তু কিন্তু ভাব থেকে যায়। মনে হয়, আরে বাহ্, বেশ পুরোনো দিনের একটা চমৎকার জিনিস যত্ন করে আবার তৈরি করা হয়েছে, একটা ‘মনোরম প্রত্নতাত্ত্বিক পুনর্গঠন’ (pleasing archæological reconstruction) গোছের ব্যাপার আরকি! প্রত্নতত্ত্বের মতো এমন একটা আরামদায়ক বিষয় টেনে না আনলে এই শব্দটাকে ইংরেজদের কানে মিষ্টি শোনানো, সে ভারি কঠিন কাজ।
জীবিত বা প্রয়াত লেখকদের যখন আমরা মাপজোখ করতে বসি, তাঁদের মূল্যায়নের সময় এই শব্দটা যে আমাদের লেখালিখিতে বিশেষ পাত্তা পাবে না, তা একরকম ধরেই নেওয়া যায়। প্রত্যেক জাতি বা জনগোষ্ঠীর যেমন নিজস্ব সৃষ্টিশীল মন আছে, তেমনি আছে সমালোচক মনও। কিন্তু নিজেদের সৃষ্টিশীলতার ছোটখাটো ভুলত্রুটি বা সীমাবদ্ধতা নিয়ে তারা যতটা না ভাবে, তার চেয়েও অনেক বেশি উদাসীন থাকে নিজেদের সমালোচনার অভ্যাসের সীমাবদ্ধতা বিষয়ে। ফরাসি ভাষায় প্রকাশিত রাশি রাশি সমালোচনামূলক লেখা থেকে ফরাসিদের সমালোচনার ধরন বা অভ্যাসের খানিকটা আমরা জানি, বা অন্তত জানার ভানটুকু করি। সেসব পড়ে আমরা (এমনই আমাদের বেখেয়ালীপনা) হুট করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাই যে, ফরাসিরা বুঝি আমাদের চেয়ে ‘বেশি সমালোচক’ (more critical) মনের মানুষ। কখনো সখনো এই নিয়ে একটু-আধটু গর্বও যে হয় না, তা নয়; যেন ফরাসিরা বুঝি কম স্বতঃস্ফূর্ত, কম প্রাণবন্ত। হয়তো তারা তাই; কিন্তু আমাদের একটা কথা মাথায় গেঁথে রাখা দরকার, সমালোচনা করাটা শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়ার মতোই একটা অবশ্যম্ভাবী, একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। যখন আমরা কোনো বই পড়ি বা সেটা নিয়ে মনে কোনো ভাবনার উদয় হয়, তখন মনের গহীনে যা কিছু ঘটে চলে, সেগুলোকে গুছিয়ে বলতে পারলে, কিংবা নিজেদের সমালোচনামূলক মানসিকতাকেই একটু নেড়েচেড়ে দেখলে, আমাদের কোনো লোকসান তো হতোই না, বরং লাভই হতো। এই কাটাছেঁড়ার মধ্যে একটা ব্যাপার হয়তো দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে উঠত: যখন আমরা কোনো কবির প্রশংসা করি, তখন তাঁর লেখার সেইসব দিকের ওপরই আলো ফেলি, যেখানে তিনি আর দশজনের মতো নন। তাঁর লেখার এই অংশগুলোতে আমরা যেন কবির একান্ত নিজস্বতা, তাঁর ভেতরের আসল মানুষটাকে খুঁজে ফিরি। তিনি তাঁর আগের কবিদের থেকে, বিশেষ করে তাঁর ঠিক আগের কবিদের থেকে কতটা আলাদা, কতটা স্বতন্ত্র, সেটা খুঁজে পেয়ে আমাদের মন তৃপ্তিতে ভরে যায়। তখন আমরা এমন কিছু একটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করি যাকে আলাদা করে, এককভাবে উপভোগ করা যায়। অথচ এই বদ্ধমূল ধারণা ঝেড়ে ফেলে কোনো কবির কাছে গেলে প্রায়শই দেখতাম, তাঁর সৃষ্টির সেরা অংশ তো বটেই, এমনকি সবচেয়ে স্বতন্ত্র, সবচেয়ে মৌলিক অংশগুলোও আসলে সেইসব জায়গা, যেখানে তাঁর প্রয়াত পূর্বসূরি কবিরা নিজেদের অমরত্বের ছাপ সবচেয়ে স্পষ্টভাবে রেখে গেছেন। আমি কিন্তু এখানে কাঁচা বয়সের আবেগী দিনগুলোর কথা বলছি না, বলছি সেই পরিণত বয়সের কথা, যখন লেখক তাঁর সৃষ্টিতে সম্পূর্ণ নিমগ্ন।
তবে হ্যাঁ, যদি ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার, মানে পরবর্তী প্রজন্মের হাতে সঁপে দেওয়ার, একমাত্র পথ হতো আমাদের ঠিক আগের প্রজন্মের পদাঙ্ক অনুসরণ করা, তাঁদের সাফল্যের প্রতি অন্ধ বা ভীরু আনুগত্য দেখানো, তাহলে ‘ঐতিহ্য’ শব্দটাকেই ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দেওয়া উচিত। আমরা এরকম বহু অগভীর স্রোতকে শুকনো বালির মধ্যে হারিয়ে যেতে দেখেছি, মিলিয়ে যেতে দেখেছি। আর, গতানুগতিকতার চেয়ে নতুনত্ব সব সময়ই তো ভালো। আসলে ঐতিহ্যের অর্থটা কিন্তু এর চেয়েও অনেক গভীর, অনেক বড়সড় একটা ব্যাপার। এটা এমন কোনো জমিদারি নয় যে বাবার কাছ থেকে ছেলে পেয়ে যাবে। আপনি যদি এই জিনিসটা চান, তাহলে কিন্তু খেটেখুটে, রীতিমতো সাধনা করে তবেই মিলবে। এই জন্যে সবার আগে যে জিনিসটা দরকার, সেটাকে আমরা বলি ‘ঐতিহাসিক বোধ’ (historical sense)। পঁচিশ বছর বয়স পার হয়ে যাওয়ার পরেও যদি কোনো কবি টিকে থাকতে চান, অর্থাৎ লেখালেখি চালিয়ে যেতে চান, তাহলে এই বোধটা তাঁর জন্য প্রায় অপরিহার্য। বলতে পারেন, ঠিক শ্বাস নেওয়ার মতোই জরুরি। এই যে ঐতিহাসিক বোধের কথা বলছি, এর মানে কিন্তু শুধু অতীতের পুরোনো হয়ে যাওয়াটা নয়। বরং বর্তমানেও যে অতীত দিব্যি বেঁচেবর্তে আছে, সেই উপলব্ধিটা খুব জরুরি। এই বোধটা থাকলে একজন লেখক কেবল নিজের সময়ের গণ্ডিতে, নিজের প্রজন্মের মধ্যে আটকে থাকেন না। তখন তাঁর মনে হয়, সেই হোমারের আমল থেকে শুরু করে ইউরোপের সব সাহিত্য, এমনকি নিজের দেশের পুরো সাহিত্যের জগৎটা – সব যেন একই সুতোয় বাঁধা, একই সঙ্গে চলছে, একটা যুগপৎ শৃঙ্খলা (simultaneous order) তৈরি করে রেখেছে। এই অদ্ভুত অনুভূতি নিয়েই তাঁকে লিখতে হয়। ঐ যে বললাম ঐতিহাসিক বোধের কথা, সে কিন্তু ভারি অদ্ভুত এক জিনিস। একদিকে সে যেন সময়কে কোনো পাত্তাই দেয় না, তরতর করে এগিয়ে চলে, আবার অন্যদিকে কোনো একটা বিশেষ সময়ের সঙ্গে নিজেকে ঠিকই জড়িয়ে রাখে, তার অংশ হয়ে যায়। এই দুটো ব্যাপারকে একসঙ্গে মিলিয়ে দেখার যে একটা অসাধারণ ক্ষমতা, সেটাই কিন্তু একজন লেখককে আসল অর্থে, একেবারে খাঁটি অর্থে ঐতিহ্যবাহী করে তোলে। এই জিনিসটাই একজন লেখককে সময়ের বিরাট স্রোতের মধ্যে তাঁর নিজের জায়গাটা কোথায়, তাঁর সমসাময়িকতাটা ঠিক কেমন, সেই বিষয়ে সবচেয়ে বেশি সজাগ করে দেয়।
কোনো কবি বলুন বা অন্য যে কোনো শিল্পের স্রষ্টাই হোন, একা একা দাঁড়ালে তাঁর পুরো তাৎপর্য বোঝা যায় না। তাঁর গুরুত্ব, তাঁকে বুঝতে হলে, তাঁর কদর করতে হলে প্রয়াত কবি আর শিল্পীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা খতিয়ে দেখতে হবে। একা একা তাঁর দাম যাচাই করা যাবে না; তুলনা করার জন্য, ফারাকটা স্পষ্ট করার জন্য, তাঁকে অতীতের দিকপালদের কাতারে দাঁড় করাতে হবে। আমি যে কথাটা বললাম, সেটাকে কিন্তু ইতিহাসের শুকনো পাতা ওল্টানোর মতো কোনো নীরস ব্যাপার ভাববেন না। এটা বরং শিল্পের হৃদয়ে ডুব দেওয়ার, তার আসল রূপটা চিনে নেওয়ার, অর্থাৎ যাকে আমরা বইয়ের ভাষায় বলি নান্দনিক (æsthetic) সমালোচনা, তার একেবারে গোড়ার কথা, বলতে পারেন প্রথম ধাপ। শিল্পীকে যে মানিয়ে চলতে হবে, একটা সঙ্গতি রাখতে হবে, এই ব্যাপারটা কিন্তু একতরফা নয়, মোটেই নয়। যখন নতুন একটা শিল্পকর্ম জন্ম নেয়, তখন একইসঙ্গে তার আগের সমস্ত শিল্পকর্মের বেলাতেও কিছু একটা ঘটে যায়। আগে থেকে যে শিল্পকর্মগুলো সযত্নে সাজানো ছিল, সেগুলোর নিজেদের মধ্যে একটা আদর্শ শৃঙ্খলা (ideal order) থাকে। ঐ যে শিল্পকর্মগুলো নিজেদের মধ্যে একটা আদর্শ শৃঙ্খলা নিয়ে সযত্নে সাজানো ছিল, তাদের মধ্যে যখন নতুন (সত্যিকারের নতুন, মৌলিক) একটা কিছু এসে পড়ে, তখন সেই পুরোনো সাজানো ভাবটা, সেই শৃঙ্খলাটা আর আগের মতো থাকে না। খানিকটা হলেও নড়েচড়ে যায়। নতুনটা আসার আগে পর্যন্ত ঐ পুরোনো শৃঙ্খলাটা কিন্তু দিব্যি সম্পূর্ণ ছিল, ছিল নিখুঁত একটা ব্যাপার। কিন্তু যেই না নতুন কিছু একটা এসে হাজির হয়, পুরোনো শৃঙ্খলাটা যদি টিকে থাকতে চায়, তখন পুরো ব্যাপারটাকে, খুব সামান্য হলেও, একটু এদিক ওদিক করে, নতুন করে সাজিয়ে নিতে হয়। আর এর ফলে কী হয়? প্রত্যেকটা শিল্পকর্মের সঙ্গে অন্য সবার যে একটা সম্পর্ক ছিল, তাদের মাপজোখ, তাদের মূল্য, সবকিছুই নতুন করে ঠিকঠাক হয়ে যায়। একটা নতুন বোঝাপড়া, একটা নতুন ভারসাম্য তৈরি হয় তাদের মধ্যে। এই যে নতুন ও পুরোনোর মধ্যে একটা মানিয়ে নেওয়ার ব্যাপার, এইটাই হলো আসল খেলা, আসল মজা।
যে কবি এই শৃঙ্খলার ধারণাটা, তার সাথে ইউরোপের সাহিত্য বা ধরুন ইংরেজি সাহিত্যের যে একটা নিজস্ব গড়ন আছে, সেই ব্যাপারটা ঠিকঠাক মগজে ঢোকাতে পেরেছেন, তাঁর কাছে একটা কথা কিন্তু মোটেই আজগুবি ঠেকবে না। কথাটা হলো, বর্তমান যেমন অতীতের হাতে নিজেকে একটু একটু করে গড়েপিটে নেয়, ঠিক তেমনি অতীতও কিন্তু বর্তমানের ছোঁয়ায় একটু আধটু পাল্টে যায়, নতুন করে সেজে ওঠে। আর যে কবি এই গভীর সত্যিটা একবার মন দিয়ে বুঝতে পারেন, তাঁর মাথায় তখন অনেক বড় বড় ভাবনাচিন্তা ঘোরে, অনেক গুরুদায়িত্বের বোঝাও তিনি নিজের কাঁধে তুলে নেন। বেশ অদ্ভুত এক ব্যাপার হচ্ছে, কবি মানুষটা ঠিকই টের পান, অতীত দিয়েই তাঁর বিচার হবে। অতীতকে পাশ কাটিয়ে যাবার কোনো পথ খোলা নেই। আমি কিন্তু বলছি বিচার, অতীত দ্বারা ব্যবচ্ছেদের মতো কোনো ব্যাপার নয়। কিংবা মরে যাওয়া মানুষগুলোর সমান ভালো, বা তাঁদের চেয়ে খারাপ, অথবা ভালো – এমন বিচারও এটা নয়। মৃত সমালোচকদের তৈরি করা নিয়মকানুন দিয়ে তো বিচার হবেই না, কক্ষনো না। এ হলো এক ধরনের বিচার, এক রকমের তুলনা। দুটো জিনিসকে পাশাপাশি রেখে মাপা হয় আরকি। কেবল মানিয়ে চলার চেষ্টা করলে তো নতুন সৃষ্টিটা আসলে মোটেই টিকতে পারবে না। সেটা নতুনও হবে না, ফলে শিল্পকর্ম হয়ে ওঠাও তার কপালে জুটবে না। নতুন কিছু একটা মানিয়ে নিতে পারছে বলেই যে তার দাম বেড়ে গেল, এমন কথাও আমরা সচরাচর বলি না। তবে এই মানিয়ে নেওয়ার ব্যাপারটাই তার দাম যাচাইয়ের একটা পরীক্ষা বটে। আর সত্যি বলতে কী, এই পরীক্ষাটা বেশ ধীরে সুস্থে, খুব সাবধানে করতে হয়। কারণ এই মানিয়ে নেওয়ার খেলায় আমরা কেউই তো আর একেবারে নিখুঁত বিচারক নই, তাই না? আমরা বড়জোর বলতে পারি: মনে হচ্ছে যেন খাপ খেয়ে যাচ্ছে, আবার হয়তো কিছুটা স্বকীয়তাও (originality) আছে। কিংবা মনে হচ্ছে বেশ স্বকীয়, হয়তো মানিয়েও যাবে। কিন্তু এমন জিনিস খুঁজে পাওয়া মুশকিল যেখানে একটা আছে, অন্যটা নেই।
কবির সঙ্গে অতীতের সম্পর্কটা যদি আরেকটু সহজ করে বোঝাতে চাই, তাহলে বলতে হয়: তিনি অতীতকে একটা আস্ত গোল্লা, একটা যা তা তালগোল পাকানো জিনিস (indiscriminate bolus) হিসেবে হজম করতে পারেন না। আবার কেবল নিজের পছন্দের দু’একজন কবিকে ভালোবেসে তাঁদের ছাঁচে নিজেকে পুরোপুরি ঢেলে সাজাতে পারেন না। কিংবা শুধু একটা বিশেষ পছন্দের যুগকে আঁকড়ে ধরেও নিজেকে গড়ে তুলতে পারেন না। প্রথম পথটা তো একেবারেই অচল। দ্বিতীয়টা হলো যৌবনের একটা জরুরি অভিজ্ঞতা, আর তৃতীয়টা বেশ আনন্দদায়ক এবং খুব দরকারি একটা বাড়তি পাওনা। কবিকে সমাজের বা জীবনের সেই প্রধান ধারা বা প্রবণতাটাকে মনোযোগ দিয়ে শুনতে বা উপলব্ধি করতে হবে, যা সবসময় পরিচিত, বিখ্যাত বা প্রভাবশালী মানুষদের জীবন বা কার্যকলাপের মাধ্যমে প্রকাশিত হয় না। শিল্পের যে আসলে কোনো উন্নতি হয় না, কিন্তু শিল্পের উপাদান যে কখনো একই রকম থাকে না – এই জলের মতো পরিষ্কার সত্যিটা তাঁকে ভালোমতোই বুঝতে হবে। তাঁকে বুঝতে হবে ইউরোপের একটা মন আছে। সেই মনটা, বলতে গেলে, তাঁর নিজের দেশেরও মন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি এও টের পাবেন, এই যে সবার মন, এই মন তাঁর নিজের একার মনের চেয়ে অনেক বেশি দামি। এই মন কিন্তু এক জায়গায় থেমে থাকে না, সে বদলায়। এই বদলানোটা এমন এক এগিয়ে চলা, যা পথের বাঁকে কোনো কিছুই ফেলে যায় না। সে শেক্সপিয়রকে বাতিল করে না, হোমারকে বাতিল করে না, এমনকি ধরুন ম্যাগডালেনিয়ার (Magdalenian) যুগের শিল্পীদের আঁকা সেই গুহাচিত্রগুলোকেও বাতিল করে দেয় না। এই যে এগিয়ে চলা, যাকে কেউ কেউ হয়তো বলবেন আরও নিখুঁত হওয়া, কিংবা আরও জটিল হয়ে ওঠা, এটা কিন্তু শিল্পীর চোখে কোনো উন্নতিটুন্নতি নয়। এমনকি মনোবিজ্ঞানীরাও হয়তো একে উন্নতি বলতে চাইবেন না; অন্তত আমরা যতটা ভাবি, ততটা তো নয়ই। হতে পারে, শেষমেশ পুরো ব্যাপারটা দাঁড়িয়ে আছে অর্থনীতি ও যন্ত্রবিদ্যার (economy and machinery) কারসাজির ওপর। কিন্তু বর্তমান আর অতীতের মধ্যে আসল তফাৎটা হলো, আমাদের এই যে আজকের সচেতন মন, সে অতীতকে এমনভাবে এবং এমন গভীরতায় জানে, খোদ অতীতের পক্ষেও নিজেকে সেভাবে জানা বা বোঝানো সম্ভব ছিল না। কে যেন বলেছিলেন: ‘মৃত লেখকেরা আমাদের থেকে অনেক দূরে, কারণ আমরা তাঁদের চেয়ে অনেক বেশি জানি।’ ঠিক তাইই। তাঁরা তো আসলে সেটাই, যা আমরা জানি।
কবিতার কলাকৌশল (métier of poetry) নিয়ে আমার যে একটা বাঁধাধরা ভাবনাচিন্তা আছে, সে ব্যাপারে প্রায়ই একটা সাধারণ আপত্তি ওঠে। সে ব্যাপারে আমি কিন্তু বেশ সজাগ, আমার কান খাড়া-ই। আপত্তিটা হলো, এই মতবাদ মানতে গেলে নাকি গোঁড়া রকমের পণ্ডিতিপনা (pedantry) দরকার হয়। এ এমন এক দাবি, যা কিনা যেকোনো ধারার শ্রেষ্ঠ কবিদের জীবনীর প্রতি আমাদের আগ্রহের দিকে তাকালেই নস্যাৎ হয়ে যায়। এমন কথাও জোর গলায় বলা হয় যে, বেশি লেখাপড়া করলে নাকি কাব্যিক সংবেদনশীলতা (poetic sensibility) ভোঁতা হয়ে যায়, কিংবা বিগড়ে যায়। তবে আমরা তো এটা মেনেই নিচ্ছি, একজন কবির ঠিক ততটাই জানা উচিত, যতটা তাঁর জরুরি গ্রহণক্ষমতা (necessary receptivity) আর অতি প্রয়োজনীয় আলসেমির (necessary laziness) ওপর চেপে না বসে। তা, সেই জ্ঞান যদি কেউ শুধু পরীক্ষার জন্য, বা ধরুন বৈঠকখানায় একটু ভাব মারার জন্য, কিংবা আরও হাবিজাবি জাহিরি প্রচারের ধান্দায় জমিয়ে রাখে, তাহলে সেটা মোটেই কাজের কথা হয় না। কেউ কেউ আছেন যারা চটজলদি জ্ঞান শুষে নিতে পারেন, আবার যাদের একটু সময় লাগে, তাঁদের রীতিমতো ঘাম ঝরাতে হয়। শেক্সপিয়র প্লুটার্ক ঘেঁটে যতটা জরুরি ইতিহাস জেনেছিলেন, বেশিরভাগ মানুষ আস্ত ব্রিটিশ মিউজিয়াম তোলপাড় করেও ততটা জানতে পারত না। যেটার ওপর জোর দেওয়া দরকার, সেটা হলো, কবিকে অতীত-চেতনা তৈরি করতে হবে, কিংবা জোগাড় করতে হবে। এরপর তাঁর পুরো লেখকজীবনে এই চেতনাকে লালন করে যেতে হবে, বিকশিত করতে হবে। আসলে যা ঘটে, তা হলো – সেই মুহূর্তে তিনি নিজে যা, তার চেয়ে মূল্যবান কোনো কিছুর কাছে ক্রমাগত নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া। একজন শিল্পীর উন্নতি মানেই হলো ক্রমাগত আত্মত্যাগ, ক্রমাগত ব্যক্তিসত্তার বিসর্জন। এই আত্মবিচ্ছিনতা (depersonalization) প্রক্রিয়া, আর ঐতিহ্যের বোধের সঙ্গে এর সম্পর্কটাই বা কী, সেটা এবার বলার পালা। এই আত্মবিচ্ছিনতার পথ ধরেই শিল্প যেন বিজ্ঞানের কাছাকাছি একটা স্তরে পৌঁছে যায়। তাই, একটা ছোট্ট ইঙ্গিতপূর্ণ উপমা হিসেবে, আপনাদের বরং একটা ঘটনার কথা ভাবতে বলি, কেমন? ধরুন, এক টুকরো মিহি প্ল্যাটিনামের তার যদি অক্সিজেন আর সালফার ডাইঅক্সাইড গ্যাসে ভরা একটা পাত্রে ঢোকানো হয়, তাহলে কী ঘটে, বলুন তো?
২.
দেখুন, খাঁটি যে সমালোচনা (honest criticism) কিংবা রসাস্বাদনমূলক পাঠ (sensitive appreciation), সেগুলোর চোখ কিন্তু কবির দিকে থাকে না, থাকে কবিতার দিকে। খবরের কাগজের পাতায় সমালোচকদের নানা রকম গোলমেলে কথাবার্তা, সঙ্গে তার পিছু পিছু সাধারণ মানুষের মুখে মুখে ফেরা ফিসফাস শুনলে আমাদের কানে কেবল অজস্র কবির নামই ভেসে আসে। কিন্তু আমরা যদি সরকারি হিসাবের খাতার (Blue-book) মতো নীরস তথ্য না খুঁজে কবিতা পড়ার আনন্দটুকু পেতে চাই, যদি একটা সত্যিকার কবিতার জন্য মনটা আকুলি বিকুলি করে, তখন তাকে খুঁজে পাওয়া কিন্তু বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। আগের লেখাটায় আমি খানিকটা বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম, একটা কবিতার সঙ্গে অন্যান্য কবিদের লেখা অন্যসব কবিতার সম্পর্কটা কতটা গভীর হতে পারে। সেখানে এও বলেছিলাম, আজ পর্যন্ত যত কবিতা রচিত হয়েছে, সব মিলিয়ে তাদের যেন একটা জীবন্ত, অখণ্ড সত্তা হিসেবে দেখা যায়। কবিতার এই যে নৈর্ব্যক্তিক (Impersonal) ধারণা, তার আরেকটা জরুরি দিক হলো, কবিতার সঙ্গে তার স্রষ্টা অর্থাৎ কবির সম্পর্কটা ঠিক কেমন। এছাড়াও, আমি একটা উপমা দিয়েছিলাম সেখানে, বলেছিলাম একজন পরিণত কবির মন আর একজন অপরিণত কবির মনের মধ্যে পার্থক্যটা ঠিক ‘ব্যক্তিত্বের’ বিচারে হয় না। মানে, পরিণত কবি যে মানুষ হিসেবে খুব বেশি আকর্ষণীয় হবেন, কিংবা তার যে ‘অনেক কিছু বলার’ থাকবে, ব্যাপারটা মোটেও তেমন নয়। বরং তার মনটা যেন আরও নিখুঁত, আরও পরিশীলিত একটা মাধ্যম হয়ে ওঠে, যেখানে বিশেষ বা খুব বিচিত্র ধরনের অনুভূতিরা এসে অনায়াসে নতুন নতুন জোট বাঁধে, নতুন রূপে প্রকাশ পায়।
আমার উপমাটা ছিল অনুঘটক নিয়ে। ধরুন, দুটো গ্যাস, যাদের কথা একটু আগেই বলছিলাম, তাদের যদি প্ল্যাটিনামের এক টুকরো তারের কাছে এনে মেশানো যায়, তাহলে তৈরি হয় সালফিউরাস অ্যাসিড। মজার ব্যাপার হলো, এই প্ল্যাটিনাম না থাকলে কিন্তু কিছুই হয় না, গ্যাসেরা বোকার মতো চেয়ে থাকে। অথচ দেখুন, যে নতুন অ্যাসিডটা তৈরি হলো, তার ভেতরে প্ল্যাটিনামের চিহ্নমাত্র নেই। প্ল্যাটিনাম নিজেও যেন কিছুই জানে না, আগের মতোই নিষ্ক্রিয়, নিরপেক্ষ, একচুলও বদলায়নি। কবির মনটা ঠিক সেই প্ল্যাটিনামের টুকরোর মতোই। এই মনটা হয়তো মানুষ হিসেবে কবির নিজের যে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, তার ওপর কিছুটা বা পুরোপুরি কাজ করে। কিন্তু শিল্পী যত পোক্ত, যত পরিণত হবেন, তার ভেতরের দুঃখ পাওয়া মানুষটা আর যে মনটা সৃষ্টি করে – এই দুটো সত্তা ততই যেন আলাদা হয়ে যাবে। সেইসাথে মনটাও ততটাই নিখুঁতভাবে শিল্পের মূল উপাদান সেই আবেগগুলোকে হজম করবে। এরপর সেগুলোকে সম্পূর্ণ অন্যরকম, নতুন কিছুতে রূপান্তরিত করে ফেলবে। এই যে অভিজ্ঞতা মনের মাঝে জমা হয়, এবং যা সেই আশ্চর্য রূপান্তরের অনুঘটক (transforming catalyst) হিসেবে কাজ করে, তা মূলত দুই ধরনের। একটা হলো আবেগ (emotions), অন্যটা অনুভূতি (feelings)। কোনো শিল্পকর্ম যখন কেউ আস্বাদন করে, তখন তার যে অভিজ্ঞতাটা হয়, সেটা কিন্তু শিল্পের বাইরের দশটা সাধারণ অভিজ্ঞতার চেয়ে একেবারেই আলাদা, অন্য জাতের। এই শৈল্পিক অভিজ্ঞতা কখনো স্রেফ একটা আবেগ দিয়ে তৈরি হতে পারে, আবার কখনো একাধিক আবেগের একটা সুন্দর মিশ্রণও হতে পারে। আবার এমনটাও হতে পারে, লেখকের মনের গভীর থেকে উঠে আসা কিছু বিশেষ শব্দ, কথার টুকরো কিংবা কোনো ছবি – এবং, তাদের আড়ালে লুকিয়ে থাকা রাজ্যের অনুভূতি – সব কখন যে মিলেমিশে এক হয়ে একটা আশ্চর্য সুন্দর সৃষ্টি হয়ে ওঠে, কেউ টেরও পায় না। অনেক সময় দেখা গেছে, বড় মাপের কবিতা কোনো রকম আবেগের সরাসরি ব্যবহার ছাড়াই তৈরি হয়েছে; কেবল অনুভূতি দিয়েই দিব্যি সে অসাধারণ হয়ে উঠেছে।
দান্তের ইনফার্নো-র (Inferno) পনেরো নম্বর সর্গের (Canto XV) কথাই ভাবুন। সেখানে ব্রুনেত্তো লাতিনির (Brunetto Latini) যে বর্ণনা, তা কিন্তু ওই মুহূর্তের ভেতরের একটা তীব্র আবেগকে কেন্দ্র করেই তৈরি। কিন্তু তার যে ফল, সেই শৈল্পিক প্রকাশ, সেটা অন্য যেকোনো শিল্পকর্মের মতোই একক, তবুও বেশ জটিল সব উপাদানের সমন্বয়েই তা গড়ে উঠেছে। একেবারে শেষের যে চারটে লাইন, অর্থাৎ স্তবকটা, সেখানে একটা ছবি ফুটে ওঠে, আর সেই ছবির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে একটা অনুভূতি। এই অনুভূতিটা যেন কোত্থেকে ‘এসেছিল’, আগের ঘটনা থেকে সরাসরি জন্ম নেয়নি। বরং কবির মনের ভেতর সেটা হয়তো আনমনেই ভাসছিল, যতক্ষণ না উপযুক্ত একটা সুযোগ পেয়ে অন্য সবার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। আসলে, কবির মনটা তো এক পুরোনো সিন্দুকের মতোই, যেখানে অসংখ্য অনুভূতি, কথার টুকরো, কত যে ছবি এসে ভিড় করে, তার হিসেব নেই। এই উপাদানগুলো সেখানে নীরবে অপেক্ষা করতে থাকে ভবিষ্যতে একত্রিত হওয়ার জন্য। অবশেষে, এক বিশেষ মুহূর্তে এই সবকিছু মিলেমিশে এক নতুন সৃষ্টিতে পরিণত হয়। আপনি যদি সেরা কবিতার কিছু উল্লেখযোগ্য অংশ (representative passages) পাশাপাশি রেখে তুলনা করেন, তাহলে বুঝবেন সেখানে কত রকমের মিশ্রণ ঘটা সম্ভব। সাথে এও দেখবেন, ‘মহত্ত্ব’ (sublimity)-এর মতো ওইসব আধা-নৈতিক বিচারপদ্ধতি (semi-ethical criterion) কেমন বেমালুম লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। কারণ, আবেগের ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ (greatness) বা তার যে তীব্রতা, অর্থাৎ উপাদানগুলোর ভেতরের যে শক্তি, সেটা আসল ব্যাপার নয়। বরং শৈল্পিক প্রক্রিয়ার যে অসাধারণ তীব্রতা, বলতে গেলে, যে অদ্ভুত চাপের (pressure) মধ্যে এই মিশ্রণটা ঘটে, সেটাই হলো আসল কথা। পাওলো আর ফ্রান্সেসকার (Paolo and Francesca) সেই যে বিখ্যাত গল্পটা, সেখানে একটা বিশেষ আবেগ কাজ করেছে, তা তো আমরা জানিই। কিন্তু আসল মজাটা কোথায় জানেন? কবিতাটা পড়ার পর আমাদের মনে যে তীব্র অনুভূতিটা এসে ঘা মারে, সেটা কিন্তু ওই গল্পের চরিত্রদের কল্পিত দুঃখ-কষ্টের যে ছবিটা আমাদের চোখে ভাসে, তার চেয়ে একেবারেই অন্যরকম, যেন অন্য কোনো পৃথিবীর। আবার ওদিকে দেখুন, ইউলিসিসের সেই যে সমুদ্রযাত্রা, যার কথা বলা আছে ছাব্বিশ নম্বর সর্গে (Canto XXVI), তার চেয়ে পাওলো-ফ্রান্সেসকার এই আবেগ যে অনেক বেশি জোরালো, এমনটাও কিন্তু হলফ করে বলা মুশকিল। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপারটাই বলি এবার। ইউলিসিসের ওই সর্গটাতে কিন্তু আবেগের চিহ্নমাত্র সরাসরি খুঁজে পাওয়া যায় না!
আবেগের এই যে বদলে যাওয়া, এই যে রূপান্তর, এই প্রক্রিয়ার মধ্যে কিন্তু অনেক রকমফের দেখা যায়। ধরুন, আগামেমননের (Agamemnon) হত্যাকাণ্ড কিংবা ওথেলোর (Othello) সেই বুকফাটা যন্ত্রণা থেকে যে শৈল্পিক অনুভূতি জন্মায়, সেটা দান্তের (Dante) লেখা বিভিন্ন দৃশ্যের চেয়ে সত্যিকারের ঘটনার অনেক বেশি কাছাকাছি বলে মনে হতে পারে। আগামেমননের ক্ষেত্রে দেখুন, শৈল্পিক আবেগটা একজন সত্যিকারের দর্শকের মনের যে আলোড়ন, তার কাছাকাছি চলে আসে। আবার ওথেলোর ক্ষেত্রে, সেটা নায়কের নিজের ভেতরের যে কষ্ট, তার কাছাকাছি। কিন্তু শিল্প ও সত্যিকারের ঘটনার মধ্যে তফাৎটা কিন্তু সবসময়ই আকাশ-পাতালের মতো; আগামেমননের হত্যাকাণ্ডের যে শৈল্পিক মিশ্রণ, সেটা সম্ভবত ইউলিসিসের সমুদ্রযাত্রার মিশ্রণের মতোই একই রকম জটিল, একই রকম গভীর একটা ব্যাপার। দেখুন, দুটো ক্ষেত্রেই আসলে বিভিন্ন উপাদানের একটা চমৎকার মিশ্রণ ঘটেছে, তাই না?
একই ব্যাপার ঘটেছে কীটসের সেই বিখ্যাত কবিতাটা, ‘ওড টু এ নাইটিঙ্গেল’ (Ode to a Nightingale)-এর ক্ষেত্রেও। সেখানে এমন অনেক অনুভূতি এসে ভিড় করেছে, যার সঙ্গে আদতে নাইটিঙ্গেল পাখিটার কোনো সরাসরি সম্পর্কই নেই। কিন্তু কী আশ্চর্য দেখুন, ওই নাইটিঙ্গেল পাখিটাই, হয়তো তার নামের মিষ্টি মধুর ধ্বনির কারণে, কিংবা লোকমুখে তার যে এত সুনাম, সেই কারণেই যেন সম্পর্কহীন অনুভূতিগুলোকে এক সুতোয় গেঁথে ফেলেছে। আমি যে ধারণাটার বিরুদ্ধে এতক্ষণ ধরে কথা বলার চেষ্টা করছি, সেটার সঙ্গে সম্ভবত আত্মার অখণ্ড সত্তার (substantial unity of the soul) সেই যে একটা বেশ ভারী অধিবিদ্যামূলক (metaphysical) তত্ত্ব আছে, তার একটা যোগসাজশ রয়েছে। কারণ আমি আসলে বলতে চাইছি, কবির এমন কোনো বাঁধা ধরা ‘ব্যক্তিত্ব’ (personality) নেই যা তাকে প্রকাশ করতে হবে। বরং তার আছে একটা বিশেষ মাধ্যম, একটা আশ্চর্য জাদুর বাক্স। এই মাধ্যমটা শুধুই একটা মাধ্যম, কোনো ব্যক্তিমানুষের ছাপ তাতে সরাসরি পড়ে না। আর সেখানেই কিনা যত ছাপ (impressions), যত অভিজ্ঞতা এসে অদ্ভুত, অপ্রত্যাশিত সব উপায়ে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। অথচ মানুষ হিসেবে কবির কাছে যে ছাপগুলো, যে অভিজ্ঞতাগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলো হয়তো তার কবিতায় কোনো পাত্তাই পেল না। আবার অন্যদিকে, যে বিষয়গুলো তার কবিতায় অসাধারণ হয়ে ফুটে উঠল, সেগুলো হয়তো ব্যক্তিমানুষ হিসেবে তার কাছে, তার নিজস্ব ব্যক্তিত্বের কাছে একেবারেই নগণ্য, খুবই তুচ্ছ একটা ব্যাপার ছিল।
এক জায়গা থেকে কয়েকটা লাইন তুলে আনছি, দেখুন তো। লাইনগুলো এতটাই অচেনা, এই যে এত কথা হলো আমাদের মধ্যে, সেই কথার আলোয় (কিংবা কে জানে, হয়তো তার আবছায়া আঁধারেই) সেগুলোকে নতুন করে মন দিয়ে দেখলে কেমন হয়?
And now methinks I could e’en chide myself
For doating on her beauty, though her death
Shall be revenged after no common action.
Does the silkworm expend her yellow labours
For thee? For thee does she undo herself?
Are lordships sold to maintain ladyships
For the poor benefit of a bewildering minute?
Why does yon fellow falsify highways,
And put his life between the judge’s lips,
To refine such a thing—keeps horse and men
To beat their valours for her?… (Cyril Tourneur, The Revenger’s Tragedy, 1606-7)
(বাংলা কাব্যানুবাদঃ
ধিক মোরে আজ, ভাবি অনুতাপে জ্বলি,
কেন রূপে তার হয়েছিনু আনমনা!
প্রতিশোধ তবু হবে সে মরণক্ষত,
সে নহে সামান্য কোনো সাধারণ ঘটনা।
গুটিপোকা কেন তার হলুদ সুতো বোনে
তোমারই জন্য? তোমারই জন্য কি নিজেকে রিক্ত করে সে?
বিকিয়ে যায় কি মান, জমিদারি যত,
বিস্ময়কর সে পলকের সুখ-আবেশে?
কেন ঐ দস্যু রাজপথ করে লুণ্ঠন,
বিচারকের হাতে সঁপে দেয় নিজ প্রাণ,
শুধু কি সাজাতে ঐ রমণীরতন?
পোষে অশ্ব, সেনা রাখে সে কি তারি তরে,
যাহাতে দেখায় সবে বিক্রম আপন?…)
দেখুন, এই যে অংশটুকু (যদি এর আগে-পরের সবটা মিলিয়ে পড়েন, তাহলে ব্যাপারটা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে), এর ভেতরে কিন্তু ভালো ও মন্দ, এই দুই বিপরীতধর্মী আবেগের একটা আশ্চর্য সুন্দর মেশামিশি আছে। একদিকে যেমন রূপের জন্য তীব্র একটা আকর্ষণ, অন্যদিকে ঠিক ততটাই গভীর টান সেই অসুন্দরের প্রতি, যা কিনা ওই রূপের একেবারে উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে আছে, আবার তাকে খানখান করে ভেঙেও দিচ্ছে। এই যে দুটো উল্টো দিক থেকে আসা আবেগের একটা অদ্ভুত ভারসাম্য, সেটা নাটকের যে বিশেষ মুহূর্তটার কথা এখানে বলা হচ্ছে, তার মধ্যে তো খুঁজে পাওয়া যায়ই। তবে শুধু ওই পরিস্থিতিটুকুই কিন্তু সবটা নয়। এটাকে আপনি বলতে পারেন নাটকের গড়ন থেকে পাওয়া একটা আবেগ (structural emotion)। মানে, যে আবেগটা নাটক নিজেই আমাদের জুগিয়েছে। কিন্তু সব মিলিয়ে যে একটা আশ্চর্য আবহ তৈরি হয়েছে, যাকে আমরা বলি কিনা মূল সুর, সেটা আসলে অন্য অনেক কিছুর জন্য। কিছু আলগা ভাসমান অনুভূতি, যাদের সাথে এই প্রধান আবেগটার একটা গভীর, গোপন যোগসাজশ আছে, যা চট করে বাইরে থেকে দেখে বোঝার জো নেই – সেই সবকিছু কখন যে মিলেমিশে এক হয়ে আমাদের একটা একেবারে নতুন ধরনের শৈল্পিক আবেগ (art emotion) উপহার দিয়ে বসে, আমরা টেরও পাই না।
কবির যে একান্ত ব্যক্তিগত আবেগ, অর্থাৎ, তার নিজের জীবনের কোনো বিশেষ ঘটনা থেকে যে সব অনুভূতি জন্মায়, সেগুলোর জন্য কবি মানুষটাকে যে খুব আহামরি বা মজার কেউ হতে হবে, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই কিন্তু। তার সেই ভেতরের আবেগগুলো হয়তো খুবই সাধারণ, কিংবা কাঁচা, অথবা একদম সাদামাটা গোছের হতে পারে। অথচ দেখুন, তার কবিতার আবেগটা হবে বেশ জটিল একটা ব্যাপার। কিন্তু সেই জটিলতা এমন নয়, যেমনটা আমরা সাধারণত খুব জটিল বা অদ্ভুত আবেগপ্রবণ মানুষদের মধ্যে দেখতে পাই। আসলে, কবিতায় এক ধরনের ভুল প্রবণতা (perversity) হলো নতুন নতুন মানবিক আবেগ খুঁজে ফেরা। এই ভুল জায়গায় নতুন কিছু আবিষ্কার করতে গিয়ে সে প্রায়শই বিকৃতির দেখা পায়। ব্যাপারটা ঠিক এইরকম: অনেক অনেক অভিজ্ঞতা যেন এক বিন্দুতে এসে জমাট বাঁধে, আর তা থেকে জন্ম নেয় সম্পূর্ণ নতুন একটা কিছু। এই যে সব অভিজ্ঞতা, এগুলো এতটাই অন্যরকম যে, প্রতিদিনের খেটে খাওয়া, দশটা-পাঁচটার যাঁতাকলে বাঁধা পড়া ব্যস্ত মানুষের কাছে এগুলোকে হয়তো অভিজ্ঞতাই মনে হবে না। এই যে সবকিছু ঘনীভূত হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটা, এটা কিন্তু এমন নয় যে কেউ ইচ্ছে করলেই বা ভেবেচিন্তে ঘটিয়ে ফেলতে পারে। এই অভিজ্ঞতাগুলোকে ঠিক ‘স্মরণ’ (recollection) করা হয় না। শেষ পর্যন্ত এগুলো এমন একটা মনের অবস্থায় (tranquility) গিয়ে মেশে, যা ‘শান্ত’ শুধু এই অর্থে যে, সেখানে ঘটনার প্রতি একটা নিবিড়, নিষ্ক্রিয় মনোযোগ (passive attention) থাকে। তবে হ্যাঁ, এখানেই কিন্তু সব শেষ নয়। কবিতা লেখার মধ্যে এমন অনেক কিছুই আছে, যা অবশ্যই বেশ সজ্ঞানে, বেশ ভেবেচিন্তেই করতে হয়। আসলে, যারা ততটা ভালো কবি নন, তারা সাধারণত সেখানেই উদাসীন থাকেন যেখানে তাদের সবচেয়ে বেশি সজাগ থাকা দরকার ছিল, আবার ঠিক সেখানেই কিনা সচেতন হয়ে ওঠেন যেখানে তাদের একটু উদাসীন, একটু বেখেয়ালি থাকলেই ভালো হতো। এই দুটো ভুলই শেষমেশ তাকে বড্ড বেশি ‘ব্যক্তিগত’ (personal) করে তোলে। কবিতা তো আসলে আবেগের লাগাম ছেড়ে দেওয়া নয়, বরং আবেগ থেকে পালিয়ে বাঁচা। কবিতা আসলে ব্যক্তিত্বের প্রকাশ নয়, বরং ব্যক্তিত্ব থেকে এক ধরনের মুক্তি। তবে হ্যাঁ, এ কথা বলাই বাহুল্য, যাদের সত্যিকারের ব্যক্তিত্ব আর আবেগ বলে কিছু আছে, কেবল তারাই বোঝে এই সবকিছু থেকে পালিয়ে বাঁচার ইচ্ছেটা আসলে কী, তার মানেটাই বা কতটা গভীর।
৩.
অ্যারিস্টটলের ‘ডি অ্যানিমা’ (De Anima) বইয়ের সেই যে উক্তি, “ὁ δὲ νοῦς ἴσως θειότερόν τι καὶ ἀπαθές ἐστιν”, যার মানে দাঁড়ায় “বুদ্ধি বা মনন সম্ভবত আরও বেশি ঐশ্বরিক, কিছুটা আবেগশূন্য একটা ব্যাপার”, সে কথাই যেন এখানে মনে পড়ছে।
দেখুন, এতসব আলোচনার মূল উদ্দেশ্য কিন্তু অধিবিদ্যা (metaphysics) কিংবা মরমীবাদের (mysticism) গভীর জলের ধারে গিয়েও, ঠিক তার সীমানাতেই থেমে যাওয়া। সেইসাথে নিজেকে সেইসব কাজের কথার (practical conclusions) মধ্যে বেঁধে রাখা, যা হয়তো কবিতার প্রতি যাদের আগ্রহ, যারা কবিতার ভালোমন্দের দায়টুকু নিজেদের কাঁধে তুলে নিতে চান, তাদের কোনো না কোনো উপকারে আসতে পারে। কবির দিক থেকে চোখটা সরিয়ে এনে কবিতার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা – নিঃসন্দেহে এক দারুণ ব্যাপার, এক মহৎ উদ্দেশ্যও বলা চলে। কারণ এমনটা হলেই আসল যে কবিতা, সে ভালো কিংবা মন্দ যাই হোক, সবকিছুরই আরও খাঁটি, আরও ঠিকঠাক মূল্যায়ন সম্ভবপর হয়। অনেকেই আছেন, যারা কবিতার মধ্যে রচয়িতার হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা আবেগের কোনো প্রকাশ দেখলে আহা-উহু করেন, প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন। তার চেয়ে কিছু কম লোক হয়তো রচনাটার কারিগরি দিকটা, তার গঠন, তার শব্দচয়ন – এই সবকিছুর প্রশংসা করতে পারেন। কিন্তু খুব কম লোকেই উপলব্ধি করেন যে, কখন এক সত্যিকার অর্থে গুরুত্বপূর্ণ আবেগের প্রকাশ ঘটছে – এমন এক আবেগ, যার জীবন আসলে কবিতার নিজের ভেতরেই বাসা বেঁধে থাকে, কবির ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের কাহিনীর মধ্যে নয়। শিল্পের আবেগ আসলে নৈর্ব্যক্তিক, একেবারেই আলাদা এক ব্যাপার। কবি সেই নৈর্ব্যক্তিকতায় ততক্ষণ পৌঁছাতে পারবেন না, যতক্ষণ না তিনি যে কাজটা তাকে করতে হবে, তার কাছে নিজেকে পুরোপুরি, নিঃশর্তে সঁপে দিচ্ছেন। কী যে তাকে করতে হবে, সেটাও তিনি সম্ভবত সঙ্গে সঙ্গেই বুঝে উঠতে পারবেন না। এই গভীর সত্য উপলব্ধি করতে হলে তাকে শুধু বর্তমানে বেঁচে থাকলে চলবে না, তাকে একই সঙ্গে বেঁচে থাকতে হবে অতীতের সেই জীবন্ত মুহূর্তেও (present moment of the past)। তাকে সচেতন হতে হবে সেইসব ব্যাপারে যা আসলে মরে যায়নি, বরং যা আজও দিব্যি সতেজ, আজও আমাদের মধ্যে, আমাদের চেতনায় বেঁচে আছে।
Leave a Reply