Table of Contents
ভূমিকা
রাজনীতি! নামটা শুনলেই কেমন যেন ভুরু কুঁচকে যায়, তাই না? কেউ হয়তো দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবেন, ‘এর চেয়ে দাঁতের ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্টও ভালো ছিল!’ চায়ের কাপের তুফান থেকে শুরু করে টিভির পর্দায় কথার মারপ্যাঁচ – এই রাজনীতি যেন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এক নাছোড়বান্দা সঙ্গী। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই যে এত সংকট, এত সমস্যা, তার জন্য কি শুধুই ওই ‘রাজনীতি’ নামক ভিলেনটাই দায়ী? নাকি এর ভেতরে আরও জটিল, আরও গভীর কোনো রহস্য খেলা করছে?
এই লেখায় আমরা ঠিক সেই গোয়েন্দাগিরিটাই করতে বসেছি। বিভিন্ন বাস্তবতাকে সাক্ষী রেখে আমরা বোঝার চেষ্টা করব, কেন এই আপাত কদর্য বিষয়টি আসলে আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর সেই বোঝার চাবিকাঠি হিসেবে আমরা হাতে তুলে নেব তিনটি বিশেষ চশমা: কখনো দেখব বস্তুগত স্বার্থের নির্জলা লড়াই, কখনো পরখ করব প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মের জটিল জাল, আবার কখনো ডুব দেব ভাবাদর্শ আর বিশ্বাসের অতল গভীরে।
রাজনীতির মঞ্চে নিত্যনতুন নাটক, যেখানে চরিত্ররা কখনও হাসে, কখনও কাঁদে, কখনও বা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। কিন্তু এই আপাত বিশৃঙ্খল অভিনয়ের পেছনের সূত্রগুলো কী? কেন একই পরিস্থিতিতে বিভিন্ন মানুষ বা গোষ্ঠী ভিন্ন আচরণ করে? রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ক্রেইগ পারসন্স যেন আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন তিনটি জাদুকরী চশমা, যার ভেতর দিয়ে তাকালে রাজনীতির এই জটিল খেলার নাড়িনক্ষত্র অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
প্রথম চশমাটি হলো স্বার্থ বা যৌক্তিক-বস্তুনিষ্ঠতার (Rational-Material)। এটি আমাদের বলে, মানুষ তার বস্তুগত লাভ-ক্ষতির হিসাব কষেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়; যেখানে তার রুটি-রুজি, সম্পদ আর ক্ষমতার প্রশ্ন জড়িত। দ্বিতীয় চশমা, প্রাতিষ্ঠানিকতার (Institutional), আমাদের দেখায় কীভাবে সংবিধান, আইন আর বিভিন্ন সংগঠনের নিয়মকানুনগুলো রাজনৈতিক খেলোয়াড়দের আচরণের পথ তৈরি করে দেয়; যেন অদৃশ্য কিছু দেয়াল তাদের একদিকে ঠেলে দেয়, অন্যদিকে বাধা দেয়। আর তৃতীয়, অথচ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চশমাটি হলো ভাবাদর্শের (Ideational)। এটি উন্মোচন করে কীভাবে মানুষের বিশ্বাস, সংস্কৃতি আর দুনিয়াকে দেখার ভঙ্গি তাদের রাজনৈতিক পছন্দ-অপছন্দ, এমনকি আত্মত্যাগ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করে। এই তিনটি ভিন্ন কিন্তু পরিপূরক দৃষ্টিভঙ্গিই আমাদের আজকের আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু, যা দিয়ে আমরা বোঝার চেষ্টা করব, রাজনীতির ভেতরের আসল খেলাটা আসলে কীসের!
দোষটা কি রাজনীতির?
আমেরিকার দিকে যদি তাকাই, এক অদ্ভুত সুন্দর ছবি চোখে পড়ে। ২০০৯ সাল। বারাক ওবামা নামের এক তরুণ নেতা প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিচ্ছেন। তার চোখেমুখে স্বপ্ন, গলায় দৃঢ় প্রত্যয়। তিনি খুব আশা নিয়ে বলেছিলেন সহযোগিতার কথা, বলেছিলেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার কথা। তার উদ্বোধনী ভাষণের একটা কথা ছিল এরকম: “আমি আমার রিপাবলিকান সহকর্মীদের কাছ থেকে সব বিষয়ে একশ ভাগ সহমত আশা করি না, তবে আমি আশা করি আমরা সবাই মিলে রাজনীতিকে একপাশে সরিয়ে রেখে আমেরিকান জনগণের জন্য সঠিক কাজটি করতে পারব।” (ওবামা, ২০০৯, উদ্বোধনী ভাষণ)। কী চমৎকার কথা, তাই না? মনে হয়, এই তো, এবার বুঝি সব ঠিক হয়ে যাবে। বিভেদের দেয়াল ভেঙে যাবে, দেশ এগিয়ে যাবে সবার হাত ধরে।
কিন্তু হায়! স্বপ্ন আর বাস্তবতার পথ সবসময় এক হয় না। ইতিহাসের পাতা উল্টালে আমরা এক অন্য ছবি দেখি। দেখি, সেই আশা এক বুকভরা দীর্ঘশ্বাস হয়েই রয়ে গেছে। ওবামার পুরো শাসনকাল জুড়েই ডেমোক্র্যাট আর রিপাবলিকানরা যেন সাপে-নেউলে সম্পর্ক নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। কেউ কাউকে এক ইঞ্চিও ছাড় দিতে রাজি নন।
তবে একটা বিষয়ে কিন্তু তাদের মধ্যে ভারি মিল! সেটা হলো, আমেরিকার যত সমস্যা, যত সংকট, তার সবকিছুর মূলে নাকি এই রাজনীতিই! বিষয়টা বেশ মজার। ২০১২ সালের নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মিট রমনি, হাউসের স্পিকার জন বোয়েনার, কিংবা সিনেটের প্রভাবশালী নেতা মিচ ম্যাককনেল – সবাই যেন এক সুরে গান গাইতে শুরু করলেন। তাদের অভিযোগের তীর ওবামার দিকে। কেন? কারণ তিনি নাকি অর্থনীতি, আফগানিস্তানের যুদ্ধ আর অন্যান্য জরুরি বিষয়ে “রাজনীতি করছেন”! ২০১০ সালের এক গ্রীষ্মের দুপুরে ওয়াশিংটনের লিঙ্কন মেমোরিয়ালে এক র্যালিতে কট্টরপন্থী মিডিয়া ব্যক্তিত্ব গ্লেন বেক, যিনি ওবামার কড়া সমালোচক হিসেবে পরিচিত, তিনি তো আরও এক কাঠি সরেস। তিনি রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে বসলেন, নাগরিক অধিকারের মতো পবিত্র বিষয়গুলোকে “রাজনীতির নোংরা খপ্পর থেকে” মুক্ত করতে হবে। তবেই আমেরিকা আবার সঠিক পথে ফিরবে।
সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হলো, ওবামাও কিন্তু প্রায় একই সুরে কথা বলেছেন। ২০১৩ সালের অক্টোবর মাসের কথা। বাজেট নিয়ে দুই দলের ঝগড়ার কারণে আমেরিকার ফেডারেল সরকার প্রায় দুই সপ্তাহের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। এক অচলাবস্থা। সেই সময় ওবামা মিসৌরির এক জনসভায় গিয়ে রিপাবলিকানদের একহাত নিয়ে বললেন, “ওরা আপনাদের কথা ভাবছে না। ওরা তো কেবল রাজনীতি নিয়েই ব্যস্ত।”
সাধারণ মানুষ, অর্থাৎ আপনার-আমার মতো আমজনতা, তারাও কিন্তু এই অচলাবস্থাকে ঠিক সেভাবেই দেখেছিল। নেভাডার রেনো শহরের এক বাসিন্দা সেখানকার স্থানীয় পত্রিকাকে দুঃখ করে বলেছিলেন, “সবই তো রাজনীতি, বুঝলেন? আর এটা দেখতে আমার যে কী পরিমাণ হতাশা লাগে!” আরেকজন যোগ করলেন, “ভবিষ্যতে নিজেদের আখের গোছানোর জন্য রাজনীতিবিদরা কেবল ক্ষমতার লড়াই করছেন। এর বেশি কিছু না।” ঠিক যেমন ভার্জিনিয়ার সেই তরুণ কংগ্রেসের সামনে একটা প্ল্যাকার্ড হাতে একাকী দাঁড়িয়েছিল, যেখানে লেখা ছিল, “বখে যাওয়া ছেলেমেয়ের মতো আচরণ বন্ধ করুন,” তেমনি কোটি কোটি আমেরিকান হতাশ হয়েছিলেন তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের এমন শিশুসুলভ অসহযোগিতামূলক আচরণে।
তাহলে কি আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাব যে, সমাজের যত নষ্টের গোড়া, যত দুর্ভোগের কারণ, এই একটাই শব্দ – “রাজনীতি”? নেতা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত, সবাই যেন “রাজনীতি” শব্দটা শুনলেই একটা নোংরা ক্ষমতার লড়াই, কাদা ছোড়াছুড়ি, কামড়াকামড়ি আর অর্থহীন বাগবিতণ্ডার ছবি দেখতে পায়। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে ব্যাপারটা দাঁড়ায় এইরকম: নাগরিকদের ন্যায্য অধিকার আর সমস্যাগুলো যখনই “রাজনীতিবিদদের” হাতে পড়ে, তখনই “রাজনীতি” তার সবচেয়ে কদর্য রূপটা ধারণ করে। এই রাজনৈতিক জীবেরা নাকি কেবল ক্ষমতা, পদের আরাম আর মিডিয়ার আলোর ঝলকানি ছাড়া আর কিছুই বোঝেন না। তারা অহেতুক ঝগড়া বাধিয়ে আসল সমস্যার বাস্তবসম্মত সমাধান থেকে আমাদের যোজন যোজন দূরে সরিয়ে দেয়। আর যারা একটা সুস্থ, স্বাভাবিক, উৎপাদনশীল জীবন চায়, তারা এই নোংরা রাজনৈতিক জগৎ থেকে শত হাত দূরে থাকতেই ভালোবাসে। একটা ভালো সমাজে, একটা সুন্দর জীবনে রাজনীতির কোনো লেশমাত্র থাকা উচিত নয় – ব্যাপারটা কি আসলেই তাই?
একদম ভুল! পুরোপুরি ভুল। ক্ষমতার লোভ, দলাদলি, মিডিয়ার ঝলকানি – এগুলো রাজনৈতিক অঙ্গনের অংশ হতে পারে, কিন্তু এগুলোই রাজনীতির সবটুকু নয়, এর সারকথাও নয়। সত্যি বলতে কি, আপনি মানুন বা না মানুন, রাজনীতি আপনার আমার দৈনন্দিন জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটাকে আপনার ব্যক্তিগত বিষয়ে একটা অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখার বদলে, বরং ভাবুন এটা মানব অস্তিত্বের অন্যসব মৌলিক ও অপরিহার্য দিকের মতোই, যেমন ধরুন স্বাস্থ্য বা পারস্পরিক সম্পর্ক। আপনার স্বাস্থ্য ভালোও থাকতে পারে, আবার খারাপও হতে পারে; আপনার সম্পর্কগুলো মধুরও হতে পারে, আবার তিক্ততায় ভরে যেতে পারে। দুটোই কখনও নিখুঁত হয় না, আবার দুটোই আংশিকভাবে আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কিন্তু দুটোই আপনার জীবনের মৌলিক অংশ, এগুলো ছাড়া আপনার অস্তিত্ব অকল্পনীয়। রাজনীতির ক্ষেত্রেও ঠিক একই কথা প্রযোজ্য। একে বর্জন করা, যেমনটা ওই রাজনীতি-বিরোধী কথাবার্তায় ইঙ্গিত করা হয়, তার মানে হলো আপনি কী বিশ্বাস করেন, আপনার সামনে কী কী সমস্যা এবং কীভাবে তার সমাধান হতে পারে – সে বিষয়ে সচেতনভাবে চিন্তাভাবনা করার প্রক্রিয়া থেকেই মুখ ফিরিয়ে নেওয়া। (Heywood, 2019)
এই রাজনীতি-বিমুখতা আপনাকে আপনার চারপাশের রাজনৈতিক জগৎটাকে বোঝার চেষ্টা করা থেকেও বিরত রাখে। অথচ এই জগৎটা একটা জটিল প্রেক্ষাপট; সবসময় হয়তো সুন্দর নয়, কিন্তু এটা আপনার জীবনের প্রায় প্রতিটি দিককে প্রতিনিয়ত প্রভাবিত করে চলেছে, আপনি তা স্বীকার করুন বা না করুন। নিজের জীবনে, নিজের সমাজে ভালো কিছু করতে হলে, রাজনীতিকে ভয় পেয়ে বা ঘৃণা করে দূরে ঠেলে দিলে চলবে না। একে জীবনের এক অপরিহার্য অংশ হিসেবে পুনরায় গ্রহণ করতে হবে, একে বুঝতে হবে। এই আলোচনা সেই কঠিন কিন্তু জরুরি কাজেই আপনাকে সাহায্য করবে।
“রাজনীতি” (Politics) কে নতুন করে চেনা: কেন এটি আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ
রাজনীতিকে যদি আমাদের জীবনে পুনরায় জায়গা করে দিতে হয়, তাহলে সবার আগে জানা দরকার, এই জিনিসটা আসলে কী। খুব সহজ কথায় বলতে গেলে, রাজনীতি হলো সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া (Politics is the making of collective decisions)। (Lasswell, 1936; Easton, 1953)। খুব সহজ শোনাল, তাই না? কিন্তু এই সহজ কথাটার মধ্যেই লুকিয়ে আছে বিশাল এক জগৎ। যখনই মানুষ একে অপরের সঙ্গে মিলে তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক বা কার্যাবলি পরিচালনার জন্য কোনো না কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা করে, তখনই সেখানে রাজনীতির জন্ম হয়।
যদি না আপনি কোনো নির্জন দ্বীপে একা একা বসবাস করেন, তবে আপনি আপনার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে বহু রাজনৈতিক অঙ্গনের অংশ। একটু তলিয়ে ভাবুন। আপনার পরিবারের কথাই ধরুন। পরিবারের সদস্যরা একে অপরের জীবনকে সুন্দর করার জন্য, টিকিয়ে রাখার জন্য প্রতিনিয়ত সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নেন। যেমন ধরুন, সন্তানের কলেজের শিক্ষার জন্য কে কতটুকু অর্থ প্রদান করবে এবং তার বিনিময়ে তার কাছ থেকে কী ধরনের দায়িত্ববোধ বা ফলাফল প্রত্যাশা করা হয় – এই আলোচনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণও কিন্তু এক ধরনের পারিবারিক রাজনীতি। এবার আরেকটু বড় পরিসরে ভাবুন। একটা ক্রীড়া দল, একটা ক্লাব, একটা ধর্মীয় সংগঠন বা এমনকি আপনার বন্ধুদের একটা অনানুষ্ঠানিক আড্ডার বৃত্তেও, দলটি একসাথে কী করবে, কোথায় যাবে, কী খাবে – এই চলমান আলোচনার অংশ হিসেবে আপনিও কিন্তু রাজনীতিই করছেন। যেকোনো চাকরিতে, আপনি একটি প্রতিষ্ঠানের বা নেটওয়ার্কের অংশ যেখানে ভালো ফলাফল অর্জনের জন্য সবাইকে নিজেদের মধ্যে সমন্বয় ও বোঝাপড়া করে চলতে হয়। এটাও প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতি।
আর তারপরে অবশ্যই রাজনীতির সেই স্তরটি আসে, যা “রাজনীতি” শব্দটি আমাদের সবচেয়ে বেশি করে মনে করিয়ে দেয় – সেটা হলো সরকার (Government)। সরকারের ভেতরে এবং তার আশেপাশে, মানুষ হাজারো বিষয়ে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নিতে প্রতিনিয়ত মিথস্ক্রিয়া করে। যেমন – দেশের অবকাঠামো (রাস্তাঘাট, বিমানবন্দর, সেচ ব্যবস্থা), সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য আইন-আদালত ও পুলিশ ব্যবস্থা, সবার জন্য শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও কূটনীতির মাধ্যমে বৈদেশিক সম্পর্ক স্থাপন, এমনকি আপনার আমার নিত্য ব্যবহার্য খাদ্য, গাড়ি বা শিশুদের খেলনার নিরাপত্তা বিধিমালা প্রণয়ন, একটি আধুনিক অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্য ব্যাংকিং বা বীমার মতো প্রতিষ্ঠানের নিয়মকানুন তৈরি করা – এমন আরও অসংখ্য বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এই বৃহত্তর রাজনীতিরই অংশ। এমনকি জাতীয় সরকারের গণ্ডি পেরিয়েও, আপনার জীবন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিভিন্ন দেশের মধ্যে সহযোগিতা এবং সংঘাতের বৈশ্বিক রাজনীতি দ্বারাও প্রতিনিয়ত প্রভাবিত হচ্ছে। (Keohane & Nye, 1977)
আপনি হয়তো এখনই মুখ বাঁকিয়ে আপত্তি জানিয়ে বলবেন: “বেশ! মানলাম আমি এই সমস্ত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার জালে আটকা পড়ে আছি, কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে আমার এই জাল থেকে পালানোর চেষ্টা করা উচিত নয়!” আপনার হয়তো মনে হতে পারে যে, বেশিরভাগ সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্তরে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশাল দেশের সরকার বা বৃহত্তর বিশ্বের বড় বড় রাজনীতির খেলায় আপনার তেমন কোনো ভূমিকাই নেই। আপনি অসহায় দর্শক মাত্র। কিন্তু আসুন, একটু তলিয়ে ভাবি, এই “রাজনীতি থেকে পালানো” বলতে আসলে আমরা কী বোঝাচ্ছি? এটা কি আদৌ সম্ভব?
কেন রাজনীতি থেকে পালানো একটি মৃত গলি (Why Escaping Politics Is a Dead End)
এটা ঠিক যে, আপনার জীবনের বেশিরভাগ সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া, যেখানে আপনি আমি জড়িয়ে আছি, সেগুলো সবসময় পুরোপুরি খোলাখুলি, সবার জন্য সমান সুযোগের আর অংশগ্রহণমূলক হয় না। প্রেক্ষাপটটা আপনার পরিবারই হোক, আপনার বিশ্ববিদ্যালয়, আপনার ছোট্ট শহর, কিংবা ধরা যাক সেই ওয়াশিংটন ডিসি-র ক্ষমতার অলিন্দ – সবখানেই দেখা যায়, কিছু লোক সাধারণত অন্যদের চেয়ে এই সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের খেলায় বড়সড় ভূমিকা পালন করে। আর এর ফলে, অনেক মানুষ, আপনার আমার মতোই সাধারণ মানুষ, মনে করে যে তাদের ভূমিকাটা একেবারেই নগণ্য, না থাকার মতোই। আর ঠিক এই কারণেই তারা “রাজনীতিবিহীন” একটা সুন্দর, ঝঞ্ঝাটহীন পৃথিবীর জন্য মনে মনে আকুল আকাঙ্ক্ষা করে। তারা দিবাস্বপ্ন দেখে, যদি এমন হতো যে তারা তাদের জীবনের সমস্ত সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে পারত, তাহলে বুঝি অন্যদের দ্বারা এতটা কোণঠাসা বা নিয়ন্ত্রিত বোধ করত না। এই ধরনের এক মুক্ত, স্বাধীন জীবনের ছবিই এঁকেছিলেন রাজনৈতিক দার্শনিক জ্যাঁ-জ্যাক রুশো (Jean-Jacques Rousseau, ১৭১২-১৭৭৮) তার “প্রকৃতির রাজ্য” (State of Nature) ধারণার মধ্যে। অর্থাৎ, আজকের এই জটিল, দমনমূলক সামাজিক সংগঠন আর সরকারের যাঁতাকল তৈরি হওয়ার আগে, এক কাল্পনিক সময়ে মানুষ কেমন ছিল – সেই ভাবনা। (Rousseau, 1762)
খুব কম আমেরিকানই হয়তো এই ব্যাপারটা খেয়াল করে, কিন্তু রাজনীতিবিহীন এক প্রকৃতির রাজ্যের জন্য এই যে আকুতি, এই যে আকাঙ্ক্ষা, এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী। এই দেশটা তো এমন কিছু মানুষের হাতে গড়া, যারা রাজা-রানীর শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে ইউরোপ ছেড়েছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল অনেক, স্বপ্ন ছিল নানা রঙের: কেউ চেয়েছিল ধর্মীয় স্বাধীনতা, কেউ রাজনৈতিক মুক্তি, আবার অনেকের উদ্দেশ্য ছিল নতুন জমি আর ব্যক্তিগত সুযোগের সন্ধান। এই দেশের প্রতিষ্ঠাতাদের বেশিরভাগই মনে করতেন, অতিরিক্ত শক্তিশালী সরকারই হলো রাজনীতির সবচেয়ে বড় সমস্যা। তাই তারা এমন একটা পথ খুঁজছিলেন যাতে একটা নতুন মার্কিন সংবিধান তৈরি করে ব্যক্তিগত অধিকারকে আরও মজবুত করা যায়, কেন্দ্রীভূত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কমানো যায়, আর যেটুকু সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণকে তারা একেবারে অপরিহার্য বলে মনে করতেন, তার মধ্যে একটা “নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের” (Check and Balance) ব্যবস্থা রাখা যায়। ঔপনিবেশিকরা যখন এই নতুন মহাদেশে এসে বিশাল বিশাল এলাকা দখল করল, যা ছিল প্রায় জনমানবহীন কিন্তু সম্পদে ভরপুর, তখন তাদের মধ্যে এই বিশ্বাস আরও গেড়ে বসল যে, একজন কঠোর পরিশ্রমী ব্যক্তি বা পরিবার এই নতুন ভূখণ্ডের সীমান্তে মূলত নিজেদের চেষ্টাতেই উন্নতি করতে পারবে, কারও সাহায্যের দরকার হবে না। এই ধারণাগুলো থেকেই এমন এক ধরনের রাজনৈতিক কথাবার্তা বা ডিসকোর্স তৈরি হলো, যা আমাদের ব্যক্তিগত সুখের অনুসন্ধানে সরকার ও রাজনীতিকে কেবল বাধা আর হস্তক্ষেপ হিসেবেই দেখতে শেখাল। আর সরকারি বিধিনিষেধ ছাড়াই প্রকৃতির রাজ্যের সেই কাল্পনিক অস্তিত্বকে একটা আদর্শ হিসেবে আমাদের সামনে তুলে ধরল। (Hartz, 1955)
কিন্তু এই “প্রকৃতির রাজ্যে” পালানোর ধারণাটা বেশিরভাগ মানুষের কাছেই আর ততটা আকর্ষণীয় মনে হবে না, যদি তারা এর বাস্তব পরিস্থিতিটা নিয়ে একটুখানিও ভাবে। আমেরিকান উপনিবেশগুলোতে মানুষের গড় আয়ু ছিল ত্রিশ বছরেরও কম, আর উনিশ শতকের সেই দুর্গম সীমান্তের বসতি স্থাপনকারীদের জন্যেও তা চল্লিশ বছরের বেশি কিছুতেই হয়নি। আজকের এই আধুনিক যুগেও, খুব বেশি মানুষ যে স্পষ্ট কারণেই নিজেদেরকে কোনো নির্জন দ্বীপে বা আলাস্কার বরফঢাকা প্রান্তরে পাঠিয়ে দেয় না, তার কারণটা তো জলের মতোই পরিষ্কার: বিশুদ্ধ জল জোগাড় করা, খাবারের জন্য ফসল ফলানো, মাথার ওপর একটা শক্তপোক্ত আশ্রয় তৈরি করা, লজ্জা নিবারণের জন্য পোশাক তৈরি করা, কিংবা অসুস্থ হলে সেবাযত্ন পাওয়ার মতো জরুরি কাজগুলো করার জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক অন্য মানুষ ছাড়া একার জীবনটা মোটেই সহজ নয়, বরং দুঃসহ। আর বেশিরভাগ মানুষই একটা বৃহত্তর সমাজের অংশ হিসেবে থাকার যে হাজারো সুবিধা, সেগুলোও নিশ্চয়ই এক কথায় ত্যাগ করতে চাইবে না। যেমন ধরুন: আইন-শৃঙ্খলার নিরাপত্তা, ছেলেমেয়ের জন্য ভালো স্কুল-কলেজ, যোগাযোগের জন্য রাস্তাঘাট আর অন্যান্য অবকাঠামো, আর আরও কত কী! আইফোন, মাউন্টেন বাইক, নতুন সিনেমা, বাথরুমের অতিরিক্ত নরম টয়লেট পেপার, চুল কাটার সেলুন – এসব তো অতি তুচ্ছ উদাহরণ। এর বাইরেও যে লক্ষ লক্ষ পণ্য আর পরিষেবা আমরা প্রতিদিন ভোগ করছি, সেগুলোর কথা না হয় বাদই দিলাম।
এই আধুনিক জীবনের সব সুবিধা আর আরাম-আয়েশ বজায় রাখতে হলে সমাজকে একটা নির্দিষ্ট নিয়মে সাজাতে হয়, তাকে পরিচালনা করতে হয়। আর এই পরিচালনার জন্যই দরকার সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ, অর্থাৎ রাজনীতি। একবার আপনি যখন একটা সামাজিক প্রেক্ষাপটে এসে পড়েছেন, তখন আপনার যদি এমনও মনে হয় যে, আপনাকে যেন অন্যদের লেখা নাটকের একটা খুব ছোট, গুরুত্বহীন চরিত্রে অভিনয় করতে বাধ্য করা হচ্ছে, তাহলেও এই “সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ” প্রক্রিয়া থেকে “পালানোর” চেষ্টা করলে দুটো খারাপ ফলাফল ছাড়া আর কিছুই জুটবে না। একটা হলো, আপনি যখন আপনার জায়গাটা খালি করে দেবেন, তখন অন্য লোকেরা সেই শূন্যস্থান পূরণ করে আরও বেশি প্রভাবশালী হয়ে উঠবে। অন্যটা হলো, ধীরে ধীরে সবকিছু ভেঙে পড়তে শুরু করবে, পারস্পরিক যোগাযোগের সুবিধাগুলো, যা সমাজবদ্ধ জীবনের মূল আকর্ষণ, সেগুলো একে একে অদৃশ্য হয়ে যাবে। এই ব্যাপারটা আপনার পরিবার থেকে শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার এবং তারও বাইরের যেকোনো স্তরের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেই ঘটতে পারে। ধরুন, আপনি যদি আপনার পরিবারে নিজেকে খুব ক্ষমতাহীন মনে করেন এবং সেই পরিবারের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন, তাহলে হয় সেই পরিবারটা ভেঙে যাবে, অথবা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের দ্বারা আরও বেশি করে নিয়ন্ত্রিত হবে। আপনার প্রিয় ক্লাব বা ধর্মীয় সংগঠনের পরিচালনার ব্যাপারে উদাসীন হয়ে আপনি একই রকম তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হবেন। সরকারের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রেও ঠিক একই কথা খাটে: রাজনীতিবিহীন একটা সুন্দর, শান্তিময় পৃথিবীর কল্পনাকে যদি আপনি অনুসরণ করতে যান, তাহলে আপনি রাজনীতি আর সরকার থেকে “মুক্তি” পাবেন না; বরং আপনি আরও খারাপ, আরও জঘন্য রাজনীতি আর সরকারের খপ্পরে পড়বেন। একটা পুরোনো প্রবাদ আছে না, “আপনি রাজনীতিতে আগ্রহ না দেখালেও, রাজনীতি কিন্তু আপনার প্রতি আগ্রহ দেখাতে একটুও ভুলবে না।” (এই উক্তিটি প্রায়শই প্রাচীন গ্রিক রাষ্ট্রনায়ক পেরিক্লিস বা লেখক জর্জ অরওয়েলকে ভুলভাবে উদ্ধৃত করা হয়, তবে এর আসল উৎসটা বেশ অস্পষ্ট, সম্ভবত এটি একটি লোকমুখে প্রচলিত প্রবাদ)।
মার্কিন ইতিহাসের সেই রাজনীতি-বিরোধী, প্রকৃতির রাজ্যের গুণগান গাওয়া কথাবার্তাগুলোও একইভাবে আমাদের বিভ্রান্ত করে। অনেক দিক থেকেই দেখলে মনে হবে, ওরা যেন গল্পটা উল্টো করে বলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা পিতারা (Founding Fathers) কিন্তু রাজনীতি থেকে পালানোর চেষ্টা করেননি। তাঁরা ছিলেন একেকজন গভীর রাজনৈতিক চিন্তাবিদ, যারা খুব উচ্চস্বরে এবং পরিষ্কারভাবে ঘোষণা করেছিলেন যে, তাঁরা সচেতনভাবেই সম্পূর্ণ নতুন উপায়ে রাজনীতির সঙ্গে নিজেদের জড়াতে চান। তাঁরা অত্যন্ত ইচ্ছাকৃতভাবে এবং অনেক বিচার-বিবেচনা করে এক ভিন্ন ধরনের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া – অর্থাৎ, এক ভিন্ন ধরনের রাজনীতি – তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন, যেখানে ব্যক্তিমানুষ আরও বেশি স্বাধীনতা আর সমতা নিয়ে বাঁচতে পারবে। তাঁরা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, রাজনীতি আর সরকারকে যদি পুরোপুরি সরিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে যা অবশিষ্ট থাকে, তা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা নয়; বরং উল্টোটা। ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে টিকিয়ে রাখার জন্যই তাদের এমন এক ধরনের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ব্যবস্থা বা রাজনীতি তৈরি করতে হয়েছিল, যা সেই স্বাধীনতাকে সমর্থন জোগাবে, তাকে রক্ষা করবে। (Madison, Hamilton, & Jay, 1788, The Federalist Papers)
এই মৌলিক বিষয়টা আরও পরিষ্কারভাবে বোঝার জন্য, এক মুহূর্তের জন্য ভাবুন তো, কেন আমেরিকার অ্যারিজোনা রাজ্যের জীবনযাত্রা আফগানিস্তানের জীবনযাত্রা থেকে এত আলাদা? আফগানিস্তান হলো এই মুহূর্তে পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্রতম, সবচেয়ে নিরাপত্তাহীন একটা দেশ। যদিও দেশটির মাটির নিচে প্রচুর সম্ভাবনাময় প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে, তার সরকার সবেমাত্র একটা নির্বাচন ঠিকমতো পরিচালনা করতে বা দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলে মৌলিক নাগরিক পরিষেবাগুলো সরবরাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে। অন্যদিকে, অ্যারিজোনার ভৌগোলিক অবস্থা কিন্তু মধ্য এশিয়ার চেয়ে খুব একটা বেশি অতিথিপরায়ণ নয়। আফগানিস্তানের সবচেয়ে অনুর্বর, শুষ্ক অংশগুলোর মতোই, অ্যারিজোনার বেশিরভাগটাই মরুভূমি, যেখানে জলের অভাব প্রকট এবং কোনো সমুদ্র উপকূলও নেই। কিন্তু এই দুটি জায়গার জীবনযাত্রায় আকাশ-পাতাল তফাৎ: অ্যারিজোনার মানুষ আফগানদের চেয়ে গড়ে প্রায় ১০০ গুণ বেশি ধনী। বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা, যেমন হেরিটেজ ফাউন্ডেশন বা ফ্রিডম হাউস, যারা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার পরিমাপ করে, তাদের তালিকা অনুযায়ী অ্যারিজোনা, এবং বৃহত্তর অর্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তালিকার প্রায় শীর্ষের দিকে অবস্থান করে, যেখানে আফগানিস্তান রয়েছে একেবারে নীচের দিকে। যেখানে আফগানিস্তান থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ শরণার্থী হয়ে অন্য দেশে পালিয়ে যাচ্ছে, সেখানে মানুষ আক্ষরিক অর্থেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মেক্সিকান সীমান্ত পেরিয়ে অ্যারিজোনায় প্রবেশ করতে গিয়ে মারাও যাচ্ছে। এটা বেশ স্পষ্ট যে, এই দুই অঞ্চলের মধ্যে মূল পার্থক্যটা এই নয় যে, অ্যারিজোনা বুঝি “কম” রাজনীতি ও সরকার সহ প্রকৃতির রাজ্যের একটা প্রতিচ্ছবি। বরং, আমরা পরিমাপ করতে পারি এমন বেশিরভাগ দিক থেকেই দেখলে, অ্যারিজোনা আফগানিস্তানের চেয়ে একটি অনেক বেশি সুসংহত এবং কার্যকরী রাজনীতি ও সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তবে এখানে “কম” বা “বেশি” শব্দগুলো হয়তো ঠিক উপযুক্ত নয়, কারণ আফগানিস্তানে যে অত্যন্ত জটিল এবং অনেক ক্ষেত্রেই সহিংস রাজনীতি বিদ্যমান, তা তো আর কেউ অস্বীকার করবে না। এই দুটি স্থলবেষ্টিত অঞ্চলের ভাগ্যকে তুলে ধরার একটা ভালো উপায় হলো এটা বলা যে, তাদের সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া তাদের নাগরিকদের জীবনে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা এনে দিয়েছে। ভালো আর মন্দের পার্থক্যটা আসলে রাজনীতির ধরণের মধ্যে নিহিত, রাজনীতি আছে কি নেই, তার মধ্যে নয়।
রাজনীতিকে যদি আমরা আমাদের জীবনে সঠিকভাবে পুনরুদ্ধার করতে চাই, তার গুরুত্ব যদি নতুন করে উপলব্ধি করতে চাই, তাহলে প্রথম ধাপ হলো এটা পরিষ্কারভাবে দেখা এবং স্বীকার করে নেওয়া যে, যেখানেই মানুষের মধ্যে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া রয়েছে, সেখানেই সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের এক অনিবার্য প্রক্রিয়াও থাকবে। এই প্রক্রিয়াটাই হলো রাজনীতি। রাজনীতি সেই নিরাপদ, আরামদায়ক এবং সম্ভাবনাময় জীবন তৈরি করার জন্য অপরিহার্য, যা বেশিরভাগ মানুষই চায় – আমরা প্রকৃতির রাজ্যে এক দুঃসাহসিক, স্বশাসিত, বন্ধনহীন অস্তিত্বের যতই রঙিন দিবাস্বপ্ন দেখি না কেন। একবার আপনি যখন আপনার চারপাশের বিশ্বে রাজনীতির এই সর্বব্যাপী উপস্থিতি এবং তার গভীর প্রভাব স্বীকার করে নেবেন, তখন আপনি ধীরে ধীরে এটিকে সংগঠিত করতে, এর বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করতে এবং এটি আপনার জন্য ব্যক্তিগতভাবে ও সামষ্টিকভাবে কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ, তা বুঝতে শুরু করতে পারবেন। আর আপনার চারপাশের এই রাজনীতিকে দেখতে ও বুঝতে হলে, আপনাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং রাজনৈতিক দর্শনের মৌলিক ধারণাগুলোর সঙ্গে পরিচিত হতে হবে, সেগুলোকে উপলব্ধি করতে হবে।
রাজনীতির পথ ও পদ্ধতির সুলুকসন্ধান: বর্ণনা, দর্শন আর বিজ্ঞান
স্বাস্থ্য, সম্পর্ক আর জীবনের অন্যান্য জরুরি দিকগুলোর মতোই, রাজনীতিও প্রায়শই বেশ অগোছালো আর জটিল একটা ব্যাপার। আমরা যতই বলি না কেন যে, ওই রাজনীতি-বিরোধী কথাবার্তাগুলো আসলে রাজনীতিকে শুধু “ঝগড়ার জন্য ঝগড়া” হিসেবে দেখিয়ে ভুল করে, এটা তো সত্যি যে রাজনীতিতে মানুষ তর্ক করে, ঝগড়া করে, আর একজনের সঙ্গে আরেকজনের মতের অমিল লেগেই থাকে। এই যে মতবিরোধগুলো, তা আপনার পরিবারেই হোক, খবরের কাগজের গরম গরম আলোচনাতেই হোক, দেশের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর বা জাতিসংঘের বিশাল সভাকক্ষেই হোক – সবখানেই দেখা যায়, মানুষ প্রায়শই তাদের নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মেলানোর জন্য ঘটনাকে একটু এদিক-ওদিক করে, যাকে কেতাবি ভাষায় বলে “বিকৃত” (spin) করা। কখনও তারা জেনেশুনে, আবার কখনও বা নিজেদের অজান্তেই, তাদের নিজেদের পক্ষ সমর্থন করার জন্য বেছে বেছে কিছু তথ্য ব্যবহার করে, আর বাকিগুলো বেমালুম চেপে যায়। সব মিলিয়ে দেখলে, আপনার মনে হতেই পারে, রাজনীতিতে বুঝি আদৌ কোনো সত্য বা ধ্রুব কিছু খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। আপনি হয়তো অবাক হয়ে ভাবতেও পারেন, এই ধরনের লাগাতার মতবিরোধ আর তথ্য বিকৃতির একটা জগাখিচুড়ি স্তূপকে কীভাবে ঠান্ডা মাথায় অধ্যয়ন করা বা বোঝা সম্ভব?
এমনও মনে হতে পারে যে, এই জটিল প্রশ্নের উত্তর দিতে বোধহয় কেউই আপনাকে সাহায্য করতে পারবে না, কারণ যারা রাজনীতির পন্ডিত বা বিশেষজ্ঞ, তারা নিজেরাই তো এই বিষয়ে একমত হতে পারেন না! যদিও রাজনীতি স্বাস্থ্যের মতোই একটা অপরিহার্য ক্ষেত্র, আপনি কিন্তু আপনার ডাক্তারের ওপর নির্দিষ্ট চিকিৎসার জন্য অনেক বেশি ভরসা করতে পারেন। কারণ, ডাক্তারদের মধ্যে একটা ইনফেকশন কীভাবে সারাতে হবে, একটা ভাঙা হাড় কীভাবে জোড়া লাগাতে হবে, বা হাঁপানির মতো রোগের সঙ্গে কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে – এসব বিষয়ে মোটামুটি একটা শক্তিশালী ঐকমত্য বা মতৈক্য রয়েছে। কিন্তু এর বিপরীতে, রাজনীতির পন্ডিতদের মধ্যে কোনো বিষয়েই তেমন শক্তিশালী বা সুনির্দিষ্ট ঐকমত্য খুঁজে পাওয়া ভার। এই রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা রাজনৈতিক বিশ্বকে বোঝার জন্য একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রায়শই উত্তপ্ত বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন।
তবে, এই যে তীব্রভাবে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, এর মধ্যেই কিন্তু রাজনীতির অধ্যয়নের আসল পথটা লুকিয়ে আছে। রাজনীতিকে যদি আপনার জীবনে সঠিকভাবে পুনরুদ্ধার করতে হয়, এর গুরুত্ব যদি নতুন করে উপলব্ধি করতে হয়, তাহলে আপনাকে একজন সমালোচনামূলক চিন্তাবিদ (Critical thinker) হতে হবে। সমালোচনামূলক চিন্তাবিদ মানে এমন একজন ব্যক্তি, যে রাজনৈতিক বিশ্ব সম্পর্কে বিভিন্ন নির্দিষ্ট মতামত বুঝতে পারে, সেগুলোকে নিরপেক্ষভাবে সমালোচনা করতে পারে, এবং অন্যদের সামনে নিজের মতামতকে যুক্তিসহকারে তুলে ধরতে ও রক্ষা করতে পারে। আর সব ধরনের স্বাধীন, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার মূল ভিত্তিটাই হলো বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি কল্পনা করার ক্ষমতা। একবার আপনি যখন কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি বা সম্ভাবনার কথা কল্পনা করতে পারবেন, তখন আপনি তাদের মধ্যে থেকে এক বা একাধিক দৃষ্টিভঙ্গি বেছে নিতে পারবেন এবং বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে আপনার সেই পছন্দগুলোকে রক্ষা করতে পারবেন। রাজনীতির এই প্রধান দৃষ্টিভঙ্গিগুলো অধ্যয়ন করা আপনাকে রাজনীতিকে পুনরুদ্ধার করার জন্য কিছু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার যুগিয়ে দেবে। এটা আপনাকে রাজনীতি সম্পর্কে ঠিক কী ভাবতে হবে, তা হয়তো সরাসরি বলে দেবে না – আপনাকে এখনও আপনার নিজের পছন্দগুলো নিজেকেই করতে হবে – কিন্তু এটা আপনাকে একটা দরকারী, কার্যকর এবং সমালোচনামূলক উপায়ে রাজনীতি সম্পর্কে কীভাবে ভাবতে এবং কথা বলতে হয়, তা শিখিয়ে দেবে।
রাজনীতির অধ্যয়ন আপনাকে তিনটি ভিন্ন দিক থেকে রাজনৈতিক বিকল্পগুলো কল্পনা করে একজন সমালোচনামূলক চিন্তাবিদ হয়ে উঠতে সাহায্য করে:
প্রথমত, এটি আপনাকে রাজনীতিতে মানুষ কীভাবে সংগঠিত হয় এবং কীভাবে কাজ করে, তার বিভিন্ন উপায় দেখতে ও বুঝতে সাহায্য করতে পারে। এটাকে বলা যেতে পারে রাজনৈতিক বর্ণনার (Political description) চ্যালেঞ্জ। অর্থাৎ, এই প্রশ্ন তোলা যে: স্থানীয়ভাবে, জাতীয়ভাবে, কিংবা বিশ্বব্যাপী মানুষ তাদের রাজনৈতিক জীবনকে কীভাবে সাজিয়েছে, কীভাবে তারা একে বুঝতে চেয়েছে, তার কিছু উপায় কী কী? আপনার নিজের রাজনৈতিক পছন্দগুলোর জন্য কী কী বিকল্প রাস্তা খোলা আছে, তা কল্পনা করতে সক্ষম হওয়ার জন্য আপনাকে বিভিন্ন ধরনের সরকার, সংবিধান, রাজনৈতিক বিশ্বাস, রাজনৈতিক দল, জননীতি ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে হবে, সেগুলোকে বর্ণনা করতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে রাজনৈতিক অনুশীলনগুলো কেমন, সেগুলো আপনার নিজের দেশের বা নিজের অভিজ্ঞতার সাথে তুলনা করার জন্য আপনার সামনে সম্ভাবনার একটা বিশাল তালিকা খুলে ধরে। (Almond, Powell, Strøm, & Dalton, 2004)
দ্বিতীয়ত, রাজনীতির অধ্যয়ন আপনাকে আপনার চারপাশের রাজনীতির ভালো-মন্দ দিকগুলোর সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত হতে এবং আপনার নিজের রাজনৈতিক মূল্যবোধ ও লক্ষ্য সম্পর্কে নতুন করে চিন্তা করতে সাহায্য করতে পারে। এটাকে বলা হয় রাজনৈতিক দর্শনের (Political philosophy) চ্যালেঞ্জ। অর্থাৎ, রাজনৈতিক জীবনের কোনটা ভালো বা কোনটা খারাপ, তা মূল্যায়ন করার একটা সচেতন প্রচেষ্টা। এই দর্শন মূলত রাজনৈতিক বিশ্বটা কেমন হওয়া উচিত, সেই আদর্শগত (Normative) ধারণার ওপর বেশি জোর দেয়, যদিও এটা রাজনৈতিক ব্যবস্থা কীভাবে কাজ করে, সে সম্পর্কে বিশ্লেষণাত্মক (Analytic) বা ব্যাখ্যামূলক ধারণাও তৈরি করে থাকে। আমাদের দৈনন্দিন রাজনীতিতে, রাজনৈতিক দর্শনের এই বিভিন্ন বিকল্প ভাবনাগুলোই একেকটা রাজনৈতিক মতাদর্শ (Political ideologies) হিসেবে আমাদের সামনে আসে, যা আমাদের বিতর্কগুলোকে একটা নির্দিষ্ট কাঠামো দেয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং তাদের পেছনের দার্শনিক ধারণাগুলো সম্পর্কে জানার মাধ্যমে, আপনি আপনার নিজের পছন্দগুলোকে আরও সমৃদ্ধ করার জন্য বিকল্প ভাবনার একটা ঝুলি হাতে পান। (Rawls, 1971; Nozick, 1974)
তৃতীয়ত, রাজনীতির অধ্যয়ন আপনাকে এটা ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করতে পারে যে, কেন আপনি এবং আপনার চারপাশের মানুষজন রাজনৈতিক সম্ভাবনার বিশাল মেনু থেকে নির্দিষ্ট কিছু বিকল্পের সঙ্গেই শেষ পর্যন্ত আটকে যান বা সেগুলোকেই বেছে নেন। এটা হলো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের (Political science) মূল চ্যালেঞ্জ – রাজনীতি কেন এমন অদ্ভুত বা নির্দিষ্টভাবে কাজ করে, তার একটা পদ্ধতিগত, বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করা। এই ব্যাখ্যা দেওয়ার কাজটাই হলো বেশিরভাগ রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর প্রধান কাজ। আর তাদের এই ব্যাখ্যাগুলো আপনাকে রাজনীতি সম্পর্কে “কেন” এই মৌলিক প্রশ্নটার কিছু সম্ভাব্য উত্তর খুব দ্রুত এবং মোটামুটিভাবে কল্পনা করার জন্য কিছু দরকারী রাস্তা বাতলে দিতে পারে। যখন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা যেকোনো রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখেন (সেটা আপনার পরিবারেই হোক, আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে, আপনার শহরে, আপনার রাজ্যে, গোটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, কিংবা বিশ্বব্যাপী কোনো ঘটনা হোক), তখন তারা কমবেশি একই ধরনের মৌলিক প্রশ্নগুলো উত্থাপন করেন যে, কেন মানুষগুলো এমনভাবে আচরণ করছে বা কথা বলছে। এই প্রশ্নগুলো আসলে রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের মূল কারণ সম্পর্কে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে গভীরভাবে প্রোথিত। অর্থাৎ, আমরা এই পৃথিবীতে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে নির্দিষ্ট ধরণগুলো দেখতে পাই, সেগুলো কেন এমন, সে সম্পর্কে আমরা যে বিভিন্ন মৌলিক গল্প বা ব্যাখ্যা কল্পনা করতে পারি, সেগুলোই এই প্রশ্নগুলোর উৎস। যদিও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা কোনো একটা পরিস্থিতি সম্পর্কে কোন গল্পটা বা ব্যাখ্যাটা সবচেয়ে সঠিক, সে বিষয়ে খুব কম সময়ই পুরোপুরি একমত হতে পারেন, তবুও রাজনৈতিক পদক্ষেপের পেছনে কী কী কারণ থাকতে পারে, সে সম্পর্কে চিন্তাভাবনার জন্য তারা এই মৌলিক বিকল্প ব্যাখ্যার সেটটা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেন। আপনিও এই সরঞ্জামগুলো ব্যবহার করতে শিখতে পারেন রাজনীতির এই অগোছালো, জটিল জগতটাকে “কেন” এই প্রশ্নের কিছু সম্ভাব্য, গোছানো উত্তরের একটা ছোট, সংগঠিত সেটে অনুবাদ করার জন্য। (King, Keohane, & Verba, 1994)
এই তিন ধরনের বিকল্প ভাবনার সঙ্গে নিজেকে পরিচিত করাটা আপনাকে গভীরভাবে ক্ষমতায়িত করতে পারে। রাজনৈতিক বর্ণনা সম্পর্কে জানার মাধ্যমে, আপনি আপনার নিজের জীবনযাত্রা অন্যান্য দেশের বা সমাজের সম্ভাবনার সঙ্গে তুলনা করার সঙ্গে সঙ্গে আপনার বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আরও একটা বাস্তবসম্মত ধারণা পান। বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ সম্পর্কে শেখার মাধ্যমে, আপনি আপনার সামনে যখন কেউ কোনো একটা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মত বা রায় চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে, তখন খুব দ্রুত তার বিকল্পগুলো নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করার বা মস্তিষ্কে ঝড় তোলার ক্ষমতা অর্জন করেন। যদি কেউ আপনাকে একটা নির্দিষ্ট মতাদর্শগত পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে কোনো একটা দৃষ্টিভঙ্গিতে প্ররোচিত করার চেষ্টা করে, তাহলে অন্যান্য বিকল্পগুলোর কথা একটু ভাবলেই আপনি বুঝতে পারবেন যে, তারা যে যুক্তিটা দিচ্ছে, তার মধ্যে কী ভুল আছে বা কী অসম্পূর্ণতা রয়ে গেছে। আর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভিন্ন ব্যাখ্যা সম্পর্কে জানার মাধ্যমে, আপনি দেখতে পান যে, একই ধরনের মৌলিক বিশ্লেষণ পদ্ধতি যেকোনো রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, আপনার পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে আপনার দৈনন্দিন মিথস্ক্রিয়া থেকে শুরু করে বিশ্ব রাজনীতির জটিল সমস্যা পর্যন্ত, সবকিছুতেই প্রযোজ্য হতে পারে। আপনি একটা খবরের কাগজ (বা ওয়েবসাইট, বা ব্লগ, বা আপনি যেভাবেই আজকাল তথ্য পান না কেন) দেখতে এবং মোটামুটিভাবে, খুব দ্রুত একটা খবরের বা ঘটনার পেছনে কী ঘটছে, তার একটা ধারণা তৈরি করতে সক্ষম হন। আপনি যেখানেই কোনো সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন – হোক সেটা আপনার বিশ্ববিদ্যালয় বা অফিসের কোনো নীতি নির্ধারণ, একটা স্কুল বোর্ডের মিটিং, আপনি যখন সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়া বা কোনো দাতব্য প্রতিষ্ঠানে অনুদান দেওয়ার কথা ভাবছেন, এবং অবশ্যই যখন আপনি নির্বাচনে কাকে ভোট দেবেন বা সরকারের সঙ্গে অন্য কোনোভাবে যুক্ত হবেন কিনা তা বিবেচনা করছেন – আপনি আপনার চারপাশের লোকদের দিকে তাকিয়ে তাদের রাজনৈতিক পছন্দগুলোকে কী কী বিষয় অনুপ্রাণিত করছে, তার একটা অনুমান করতে সক্ষম হন।
এইভাবে, রাজনীতির অধ্যয়ন আপনাকে সেই সংকীর্ণ, একপেশে, দূরবর্তী পথের বাইরে নিয়ে যেতে পারে, যে পথে হেঁটে মানুষ প্রায়শই তাদের রাজনৈতিক পরিবেশের সঙ্গে দায়সারাভাবে সম্পর্কিত হয়। এই তাত্ত্বিক সরঞ্জামগুলো ছাড়া, মানুষ প্রায়শই তাদের নিজেদের তৈরি করা একটা নির্বাচনী, অর্ধ-সচেতন দৃষ্টিভঙ্গির ছোট জানালা দিয়েই বিশাল রাজনৈতিক অঙ্গনের দিকে উঁকি মারে। রাজনৈতিক বিকল্পগুলোর সঙ্গে একটা বৃহত্তর, আরও সমালোচনামূলক সম্পৃক্ততা আপনার আজকের যেকোনো দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতেও পারে, আবার নাও করতে পারে – সম্ভবত এটা আপনাকে কেবল আপনার প্রাথমিক চিন্তা বা প্রবণতাগুলোকে আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করতে এবং সেগুলোকে আরও জোরালোভাবে রক্ষা করতে সহায়তা করবে – কিন্তু এটা নিশ্চিতভাবেই আপনার এবং রাজনীতির মধ্যেকার সেই সংকীর্ণ, আবছা জানালাটি সরিয়ে দেবে। এটি আপনাকে রাজনীতিকে আপনার বিশ্বের একটি বোধগম্য, বিশ্লেষণযোগ্য অংশ হিসাবে পুনরুদ্ধার করতে এবং আপনি যে পছন্দগুলো করছেন বা করবেন, সেগুলোর পেছনের কারণ সম্পর্কে আরও ভালো বোঝার সাথে নিজেকে আরও শক্তিশালী করার অনুমতি দেবে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে তিনটি ব্যাখ্যামূলক পদ্ধতি (Three Explanatory Approaches in Political Science)
রাজনীতির নাড়িনক্ষত্র বোঝার তিন তরিকা: কার ইশারায় চলে এই খেলা?
দেখুন, আমাদের প্রত্যেকেরই কিন্তু চারপাশের রাজনীতিটাকে একটু-আধটু দেখা আর তার সম্পর্কে দু-চার কথা বলার অভিজ্ঞতা আছে। আপনি নিশ্চয়ই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কে, কোন দল ক্ষমতায়, বা অন্যান্য দেশের হালচাল সম্পর্কে কিছু না কিছু বর্ণনামূলক তথ্য নিজের ঝুলিতে জমিয়েছেন। আর বিভিন্ন জায়গা সম্পর্কেও হয়তো কিছু খবর রাখেন। রাজনৈতিক দুনিয়াটা আসলে কেমন, আর সেখানে কী কী বিকল্প রাস্তা খোলা আছে, সে সম্পর্কে আরও অনেক কিছু শেখার বাকি থাকলেও, এই যে দেখা আর বর্ণনা করার ব্যাপারটা, এটা আমাদের কাছে খুব একটা অপরিচিত নয়।
একইভাবে, আমাদের প্রত্যেকেরই কিন্তু রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গেও একটু-আধটু বোঝাপড়া হয়েছে। আপনি নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন যে, কিছু রাজনৈতিক ধারণা আপনার কানে বেশ ভালো শোনায়, মন ছুঁয়ে যায় (যেমন ধরুন, গণতন্ত্র? মানবাধিকার? স্বাধীনতা? সমতা?)। আবার কিছু ধারণা শুনলেই কেমন যেন গা শিরশির করে ওঠে, খারাপ লাগে (যেমন ধরুন, একনায়কতন্ত্র? শোষণ? নিপীড়ন? যুদ্ধ?)। আপনি হয়তো “রিপাবলিকান” বা “ডেমোক্র্যাট” বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের নামের সঙ্গেও ভালো বা খারাপ লাগার একটা অনুভূতি জুড়ে দিয়েছেন। একটা পরিপূর্ণ, সুবিবেচনাপ্রসূত রাজনৈতিক অবস্থানে পৌঁছানোর জন্য আপনার হয়তো বিভিন্ন বিকল্প মতাদর্শ সম্পর্কে আরও গভীর এবং বিস্তৃত ধারণা অর্জনের প্রয়োজন হবে, কিন্তু এই যে কোনো কিছুকে ভালো বা খারাপ বলে বিচার করা, এটাও কিন্তু আমাদের সবার কাছেই মোটামুটি স্বাভাবিক একটা ব্যাপার।
তবে, রাজনীতি কেন এমনভাবে ঘটছে, তার একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর অভিজ্ঞতা আপনার হয়তো তেমন একটা নেই। বেশিরভাগ মানুষের জন্যই, রাজনৈতিক ঘটনাগুলোর একটা বর্ণনামূলক খতিয়ান রাখা আর সেই ঘটনাগুলো তাদের নিজেদের মতাদর্শগত দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে কীভাবে খাপ খাচ্ছে, সেদিকে একটা সজাগ দৃষ্টি রাখাই যথেষ্ট কঠিন একটা কাজ বলে মনে হয়; সেখানে আবার জিনিসগুলো কেন ঘটছে, তার একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানো তো রীতিমতো দুঃসাধ্য ব্যাপার বলে কল্পনা করাও কঠিন। আর যেহেতু এই ব্যাখ্যা দেওয়ার কাজটাই রাজনীতির অধ্যয়নের সবচেয়ে কম পরিচিত অংশ, এবং এটাই আবার রাষ্ট্রবিজ্ঞান নামক ডিসিপ্লিনের একেবারে মূল কেন্দ্রবিন্দু, তাই এই পরিচিতিমূলক অধ্যায়টিতে আমরা এর প্রতি একটু বিশেষ মনোযোগ দেব।
এই ব্যাখ্যার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়ার কারণ হলো, প্রথম দর্শনে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে কীভাবে ব্যাখ্যামূলক বিকল্পের একটা ছোট, সহজবোধ্য আর দরকারী সেটে সাজানো যায়, তা বোঝা মোটেই সহজ কাজ নয়। আপনি যদি রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা কী লেখেন, তার একটা নির্বাচিত অংশও পড়েন, তাহলে পদ্ধতির কোনো সহজ, সরল সেট আপনার চোখে পড়বে না। বরং, আপনি একাডেমিক পরিভাষা আর কেতাবি বুলির একটা দীর্ঘ, মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া তালিকা দেখতে পাবেন, যা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা তাদের বলা গল্পগুলোকে বা ব্যাখ্যাগুলোকে চিহ্নিত করতে ব্যবহার করেন: যেমন – “কাঠামোগত (structural),” “প্রাতিষ্ঠানশনগত (institutional),” “যুক্তিবাদী (rationalist),” “গঠনবাদী (constructivist),” “বাস্তববাদী (realist),” “উদারপন্থী (liberal),” “মার্কসবাদী (Marxist),” “কার্যবাদী (functionalist),” এবং আরও কত কী! তবে, সৌভাগ্যের বিষয় হলো, এই সমস্ত ভারী ভারী লেবেলের নিচে আসলে মাত্র কয়েকটি প্রধান ব্যাখ্যামূলক ঐতিহ্য বা চিন্তার ধারা লুকিয়ে আছে। (Hall & Taylor, 1996)
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা তাদের যুক্তি যাই বলুন না কেন, তাদের দৃষ্টিভঙ্গিগুলোকে মূলত রাজনীতি ব্যাখ্যা করতে ব্যবহৃত তিনটি প্রধান ধরণের গল্পে বা তত্ত্বে ভাগ করা যায়। একবার আপনি যখন রাজনীতি কীভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে এই তিনটি মৌলিক চিন্তাভাবনার কিছুটা ধারণা পেয়ে যাবেন – অর্থাৎ, তিনটি মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি যা আপনাকে যেকোনো রাজনৈতিক ঘটনা দেখলে প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করবে, “আরে, এখানে কি এটাই ঘটছে?” – তখন আপনার হাতে সেই প্রধান সরঞ্জামগুলো চলে আসবে যা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা যেকোনো রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে প্রয়োগ করেন। যখন আপনি এই সরঞ্জামগুলোর সঙ্গে একটু স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন, তখন আপনি চাইলে আরও কিছুটা পরিশীলিত বা জটিল স্তরে যেতে পারবেন: কারণ প্রতিটি ধরণের গল্পেরই আবার বিভিন্ন রকমফের রয়েছে, এবং এই তিনটি প্রধান গল্পকে অনেক আকর্ষণীয় উপায়ে একে অপরের সঙ্গে মেশানো বা একত্রিত করাও যেতে পারে। কিন্তু এমনকি যদি আপনি এই প্রধান বিকল্পগুলোর সহজতম সংস্করণগুলোর চেয়ে বেশি কিছু নাও করেন, তাহলেও আপনি রাজনীতি বুঝতে এবং এটি সম্পর্কে সমালোচনামূলকভাবে চিন্তা করতে আগের চেয়ে অনেক ভালোভাবে সজ্জিত হবেন।
এই তিনটি ব্যাখ্যামূলক বিকল্প খুব সহজ কিছু চিন্তার চারপাশে তৈরি হয়েছে (নিচের ছবিটি দেখুন, চিত্র ১-১)। যখন আমরা দেখি কেউ কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক পছন্দ করছে বা কোনো বিশেষ রাজনৈতিক আচরণ করছে, তখন একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হতে পারে যে, সে বা তিনি সেই বস্তুগত বা বাস্তব পরিস্থিতিতে এমনটাই করছে যা অন্য যে কেউ একই পরিস্থিতিতে পড়লে করত। বাম দিকের ছবিটার কথা ভাবুন: একদিকে যদি অভেদ্য জঙ্গল থাকে, অন্যদিকে হিংস্র শিকারী প্রাণী ওঁত পেতে থাকে, আর সামনে পাহাড়ের একটা গিরিপথ দিয়ে সোনা পাওয়ার গুজব শোনা যায়, তাহলে যেকোনো যুক্তিসঙ্গত মানুষ কি আর সাতপাঁচ না ভেবে পাহাড়ের দিকেই ছুটবে না? অন্যদিকে, এমনও হতে পারে যে, তার বা তার পছন্দগুলো আসলে মাঝখানের ছবিটার মতো, যেখানে সে মানুষের তৈরি কিছু নিয়মকানুন আর সংগঠনের দ্বারা একটা নির্দিষ্ট পথে পরিচালিত হচ্ছে। মানুষের তৈরি এই নিয়মকানুন আর কাঠামো, যেগুলোকে প্রায়শই “প্রতিষ্ঠান (institutions)” নামে ডাকা হয়, সেগুলো আমাদের সামনে এমন একটা প্রণোদনার (incentives) বাধা কোর্স তৈরি করে যা আমাদের কোনো কাজের জন্য পুরস্কৃত করে, আবার কোনো কাজের জন্য শাস্তি দেয়। আর তৃতীয় প্রধান সম্ভাবনাটা হলো, তার বা তার রাজনৈতিক পছন্দগুলো আসলে তার নিজের সংস্কৃতি, বিশ্বাস আর ধ্যানধারণা দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং সেভাবেই তৈরি হয়েছে, যেমনটা আমরা ডানদিকের ছবিটাতে দেখতে পাচ্ছি। এই শেষ ধরণের ব্যাখ্যাটা আমাদের বলে যে, একজন ব্যক্তি তার বস্তুগত বা প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশে থেকেও অনেক ভিন্ন ভিন্ন কাজ করতে পারত, এবং যা আসলে একজন ব্যক্তির পছন্দকে চূড়ান্তভাবে আকার দেয়, তা হলো সে কীভাবে ব্যাখ্যা করে যে সে কী চায় এবং কীভাবে সেই কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা সে পেতে পারে।

-
বাম প্যানেল: (পাহাড়, জঙ্গল, ভাল্লুক, সোনার খনির ছবি) মানুষ বস্তুগত ভূখণ্ড বিবেচনা করে সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত পথ গ্রহণ করে। যৌক্তিক-বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যা (Rational-Material Explanation)
-
মধ্য প্যানেল: (শহর, ব্যক্তিগত সম্পত্তি, ঘাসে না হাঁটার চিহ্ন) মানুষ প্রাতিষ্ঠানিক ভূখণ্ড বিবেচনা করে সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত পথ গ্রহণ করে। প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাখ্যা (Institutional Explanation)
-
ডান প্যানেল: (চার্চ, রিসাইকেল বিন, বিভিন্ন সামাজিক বার্তা) মানুষ তাদের সংস্কৃতি এবং বিশ্বাস দ্বারা সংজ্ঞায়িত লক্ষ্য এবং কৌশল অনুসরণ করে। ভাবাদর্শগত ব্যাখ্যা (Ideational Explanation)
এই তিনটি ব্যাখ্যামূলক পদ্ধতিকে আরও স্পষ্টভাবে পরিচিত করার জন্য, আসুন আমরা এই অধ্যায়ের শুরুতে যে একটা বাস্তব-পৃথিবীর উদাহরণ দিয়েছিলাম, সেখানে ফিরে যাই। ১ অক্টোবর থেকে ১৬ অক্টোবর, ২০১৩ পর্যন্ত, প্রায় দুই সপ্তাহের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকার পুরোপুরি বন্ধ ছিল। এই চরম অচলাবস্থাটা তৈরি হয়েছিল কংগ্রেসের রিপাবলিকান সদস্যদের মধ্যে একটা তুমুল লড়াইয়ের পর, যারা সরকারি ব্যয় কমাতে এবং কিছু সরকারি কর্মসূচি পুরোপুরি বাতিল করতে চেয়েছিল, এবং অন্যদিকে ছিলেন প্রেসিডেন্ট ওবামা ও তার ডেমোক্র্যাটিক দলের মিত্ররা, যারা মূলত সরকারের সেইসব বিদ্যমান কার্যক্রম রক্ষা করতে চেয়েছিল। যখন সরকারি ব্যয়ের জন্য আগের চুক্তিগুলোর মেয়াদ ১ অক্টোবর তারিখে শেষ হয়ে গেল, এবং উভয় পক্ষ একটা নতুন চুক্তিতে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলো, তখন সরকারকে একপ্রকার বাধ্য হয়েই তার দরজা বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। এর ফলে, প্রায় ৮ লক্ষ সরকারি কর্মীকে কাজে না আসতে বলা হয়েছিল। লক্ষ লক্ষ বেসরকারি খাতের ঠিকাদার, যাদের কাজ সরকারি অর্থায়নের ওপর নির্ভরশীল ছিল, তারাও তাদের প্রকল্পগুলোতে কাজ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছিল। অনেক ছোট-বড় ব্যবসাও দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, কারণ তারা সরকারি বিভিন্ন পরিষেবার ওপর নির্ভরশীল ছিল: যেমন, ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নতুন বিমানের নিরাপত্তা সনদ দিতে না পারায় এয়ারলাইনসগুলো নতুন বিমান পরিষেবাতে আনতে পারেনি। কাঁকড়া জেলেরা বিশাল লোকসানের মুখে পড়েছিল কারণ কেউ তাদের মৌসুম শুরু করার জন্য প্রয়োজনীয় পারমিট জারি করতে পারেনি। এমনকি ক্যান্সারে আক্রান্ত শিশুদের জন্য পরীক্ষামূলক চিকিৎসাও স্থগিত করা হয়েছিল। কিছু হিসেব অনুসারে, এই অচলাবস্থার কারণে মার্কিন অর্থনীতি থেকে রাতারাতি প্রায় ৩.১ বিলিয়ন ডলার উবে গিয়েছিল, এবং এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবগুলো ছিল আরও অনেক বেশি ব্যয়বহুল এবং সুদূরপ্রসারী। কিন্তু কেন? আমেরিকান নেতারা কেন মার্কিন সরকারকে এভাবে বন্ধ করে দিয়েছিলেন?
অবশ্যই! আপনার অনুরোধ অনুযায়ী, “যৌক্তিক-বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যা” (Rational-Material Explanation) অংশটিকে ৬০০০ শব্দের কাছাকাছি বিস্তারিতভাবে, বিভিন্ন তত্ত্ব ও উদাহরণসহ, বিশেষ করে বাংলাদেশ ও ভারতের রাজনীতিকে অন্তর্ভুক্ত করে, হুমায়ুন আহমেদের লেখার ধরণ অনুসরণ করে নিচে লেখা হলো।
বিকল্প ১—যৌক্তিক-বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যা (Rational-Material Explanation): আসলে লড়াইটা স্বার্থের, দুনিয়াটা মেটারিয়াল বা বস্তুর
২০১৩ সালের সেই মার্কিন মুলুকের সরকারি অচলাবস্থার গল্পটা তো আমরা একটু আগেই শুনলাম। যখন বলি, এর পেছনের সবচেয়ে সহজবোধ্য, বা অনেকের মতে, সবচেয়ে মৌলিক ব্যাখ্যাটা কী, তখন একটা ছবি আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ছবিটা হলো, আমেরিকান সমাজের দুটো প্রধান গোষ্ঠী, একদল যারা অগাধ সম্পদের মালিক, আরেক দল যারা দিন আনে দিন খায় বা টেনেটুনে সংসার চালায় – এই দুই দলের মধ্যে নিজেদের বস্তুগত সুযোগ-সুবিধা আদায় আর রক্ষার একটা নির্জলা, কাঁচা লড়াই। এই যে দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে রাজনীতির সব মারপ্যাঁচ, সব ভালো-মন্দ, সব উত্থান-পতনকে মূলত মানুষের পেটের দায়ে, বেঁচে থাকার তাগিদে, আর আরও একটু ভালো থাকার আদিম আকাঙ্ক্ষার নিরিখে দেখা হয়, সেটাকেই আমরা কেতাবি ভাষায় বলছি যৌক্তিক-বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যা (Rational-Material Explanation)।
একটু ভেঙে বলি। “বস্তুনিষ্ঠ” (Material) শব্দটা এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ। এর মানে হলো, যা কিছু আমরা ধরতে পারি, ছুঁতে পারি, পরিমাপ করতে পারি – যেমন টাকা-পয়সা, জমিজমা, কলকারখানা, খনিজ সম্পদ, এমনকি সামরিক শক্তি বা প্রযুক্তিগত সক্ষমতা। আর “যৌক্তিক” (Rational) মানে হলো, মানুষ সাধারণত বোকার মতো আচরণ করে না। সে তার চারপাশের এই বস্তুগত পরিস্থিতি বিচার-বিশ্লেষণ করে, লাভ-ক্ষতির একটা ঠান্ডা হিসাব কষে, তারপর এমন একটা পথ বেছে নেয়, যাতে তার নিজের বা তার গোষ্ঠীর বস্তুগত স্বার্থ সবচেয়ে ভালোভাবে রক্ষা পায়। সে চায় তার সম্পদ বাড়ুক, তার নিরাপত্তা নিশ্চিত হোক, তার প্রভাব বাড়ুক। অনেকটা দাবা খেলার মতো, যেখানে প্রত্যেক খেলোয়াড় নিজের ঘুঁটি বাঁচিয়ে প্রতিপক্ষের রাজাকে কাবু করার জন্য সবচেয়ে সেরা চালটা দেওয়ার চেষ্টা করে।
তো, মার্কিন অচলাবস্থার ক্ষেত্রে এই ব্যাখ্যাটা কীভাবে কাজ করছে? ধনীরা, যারা সমাজের উঁচু তলার বাসিন্দা, তারা সাধারণত চায় সরকারি খরচ কমুক। কেন? কারণ, সরকারের আয়ের প্রধান উৎস তো তাদের দেওয়া কর। আর সরকারি সুযোগ-সুবিধা, যেমন – সাধারণ হাসপাতাল বা গণপরিবহন, সেগুলো তাদের খুব একটা দরকারও হয় না। তাদের পয়সা আছে, তারা নিজেদের জন্য সেরাটাই কিনে নিতে পারে। অন্যদিকে, যারা গরিব বা মধ্যবিত্ত, তারা চায় সরকারি খরচ বাড়ুক। কারণ, সরকারের দেওয়া স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বা সামাজিক নিরাপত্তার সুবিধাগুলো তাদের জীবনকে অনেকটাই সহজ করে দেয়। আর এই খরচের বেশিরভাগটা যদি ধনীদের কাছ থেকে আদায় করা যায়, তাহলে তো সোনায় সোহাগা!
এই যে দুটো ভিন্নমুখী স্বার্থ, এটাকে রাজনৈতিক মঞ্চে তুলে ধরার জন্যই জন্ম নেয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আর গোষ্ঠী। আমেরিকায় যেমন রিপাবলিকান পার্টিকে প্রায়শই ধনীদের বা বড় বড় কর্পোরেশনের মুখপাত্র হিসেবে দেখা হয়, আর ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে দেখা হয় সাধারণ মানুষ, শ্রমিক বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসেবে। কিন্তু এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী, আসল সংঘাতটা কিন্তু এই রাজনীতিবিদ বা দলগুলোর মধ্যে নয়। আসল লড়াইটা হলো অর্থনীতির এই বিশাল খেলার মাঠে বিভিন্ন অবস্থানে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর মধ্যে। ২০১২ সালের নির্বাচনের ফলাফলটাও কিন্তু এই দিকেই ইঙ্গিত করে। যাদের বার্ষিক আয় ছিল কম, তাদের বেশিরভাগই ভোট দিয়েছিল ডেমোক্র্যাট প্রার্থী বারাক ওবামাকে। আর যাদের আয় ছিল অনেক বেশি, তাদের একটা বড় অংশ সমর্থন করেছিল রিপাবলিকান প্রার্থী মিট রমনিকে। এখানে প্রত্যেকেই যেন তাদের অর্থনৈতিক অবস্থান থেকে নিজেদের জন্য সবচেয়ে লাভজনক কৌশলটাই বেছে নিচ্ছে। ধনী আর দরিদ্রের মধ্যে এই যে সম্পদের ভাগাভাগি নিয়ে নিরন্তর প্রতিযোগিতা, এটা আমেরিকার রাজনীতিকে যুগ যুগ ধরে প্রভাবিত করে আসছে। তবে, ইদানীং এই বিভাজনটা আরও ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। কারণ, সবচেয়ে ধনী ১% বা ১০% মানুষ দেশের সিংহভাগ সম্পদ নিজেদের হাতে কুক্ষিগত করে ফেলেছে, আর বাকিদের অবস্থা তথৈবচ। তাই, ২০১৩ সালের সেই বাজেট নিয়ে যখন দর কষাকষি শুরু হলো, তখন কোনো পক্ষই এক চুলও ছাড় দিতে রাজি ছিল না। প্রত্যেকেই চেয়েছিল, ভবিষ্যতের সরকারি খরচের বোঝাটা যেন অন্য পক্ষের ঘাড়ে বেশি করে চাপে।
তাত্ত্বিক শিকড়: মার্ক্স থেকে মর্গেনথাউ, ওয়াল্টজ থেকে ওয়ালারস্টিন
এই যে যৌক্তিক-বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গি, এটা কিন্তু আজকের বা গতকালের কোনো নতুন ভাবনা নয়। এর শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। চলুন, কয়েকজন দিকপাল তাত্ত্বিকের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাক, যাদের চিন্তা এই দৃষ্টিভঙ্গিকে পুষ্ট করেছে।
১. কার্ল মার্ক্স ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস (Karl Marx & Friedrich Engels): ইতিহাসের চাবিকাঠি অর্থনীতির হাতে: উনিশ শতকের এই দুই জার্মান দার্শনিক বন্ধু মিলে এমন এক তত্ত্ব দিলেন, যা গোটা দুনিয়াকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। তাদের মূল কথাটা ছিল খুব সহজ কিন্তু মারাত্মক: মানব ইতিহাসের মূল চালিকাশক্তি হলো অর্থনীতি, আরও নির্দিষ্টভাবে বললে, উৎপাদনের উপকরণ (means of production) – যেমন জমি, কলকারখানা, যন্ত্রপাতি – কার দখলে আছে, তার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা শ্রেণি-সংগ্রাম (class struggle)। মার্ক্স ও এঙ্গেলসের মতে, প্রতিটি সমাজেই দুটো প্রধান শ্রেণি থাকে: একটা শোষক শ্রেণি, যারা উৎপাদনের উপকরণের মালিক; আর একটা শোষিত শ্রেণি, যারা কেবল তাদের শ্রম বিক্রি করে বেঁচে থাকে। পুঁজিবাদী সমাজে এই দুই শ্রেণি হলো বুর্জোয়া (পুঁজিপতি) আর প্রলেতারিয়েত (শ্রমিক)। এই দুই শ্রেণির স্বার্থ সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী, আর তাদের মধ্যেকার সংঘাতই সমাজ পরিবর্তনের মূল কারণ। রাষ্ট্র, আইন, সংস্কৃতি, ধর্ম – এগুলো সবই হলো উপরিকাঠামো (superstructure), যা আসলে অর্থনৈতিক ভিত্তির (economic base) ওপর দাঁড়িয়ে থাকে এবং শোষক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করে। (Marx & Engels, 1848, The Communist Manifesto)। এই মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের শেখায়, যেকোনো রাজনৈতিক ঘটনাকে বুঝতে হলে তার অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট, শ্রেণি-সম্পর্ক এবং সম্পদের বণ্টনের দিকে তাকাতে হবে। কে লাভবান হচ্ছে, আর কে বঞ্চিত হচ্ছে – এই প্রশ্নটা করলেই অনেক জট খুলে যায়। যেমন, কোনো একটা আইন কেন পাস হলো, বা কোনো একটা নীতি কেন নেওয়া হলো, তার পেছনে প্রায়শই কোনো না কোনো প্রভাবশালী অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর চাপ বা স্বার্থ লুকিয়ে থাকে।
২. হ্যান্স মর্গেনথাউ ও ধ্রুপদী বাস্তববাদ (Hans Morgenthau & Classical Realism): ক্ষমতার জন্য অনন্ত ক্ষুধা: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ধ্রুপদী বাস্তববাদ (Classical Realism) বা ক্লাসিক্যাল রিয়ালিজম হলো এক প্রভাবশালী তত্ত্ব। এর অন্যতম প্রধান প্রবক্তা হ্যান্স মর্গেনথাউ। তিনি মনে করতেন, রাষ্ট্রগুলো আসলে মানুষের মতোই। মানুষের যেমন ক্ষমতা দখলের একটা সহজাত প্রবৃত্তি বা “অ্যানিমাস ডমিনান্ডি” (animus dominandi) আছে, তেমনি রাষ্ট্রগুলোও সবসময় নিজেদের ক্ষমতা (power) বাড়ানোর জন্য সচেষ্ট থাকে। এই ক্ষমতা মূলত বস্তুগত – যেমন সামরিক শক্তি, অর্থনৈতিক সামর্থ্য, ভৌগোলিক অবস্থান, প্রাকৃতিক সম্পদ। আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাটা হলো একটা নৈরাজ্যিক (anarchic) ক্ষেত্র, যেখানে কোনো কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ নেই। তাই প্রত্যেক রাষ্ট্রকেই নিজের নিরাপত্তার জন্য নিজের ওপর নির্ভর করতে হয় (self-help)। আর এই নিরাপত্তাহীনতার কারণেই রাষ্ট্রগুলো আরও বেশি ক্ষমতা অর্জনের প্রতিযোগিতায় নামে। (Morgenthau, 1948, Politics Among Nations) মর্গেনথাউয়ের এই ভাবনা আমাদের বলে, রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বন্ধুত্ব বা শত্রুতা, সহযোগিতা বা সংঘাত – এগুলোর মূলে রয়েছে ক্ষমতার হিসাব-নিকাশ। কোনো রাষ্ট্র যখন অন্য কোনো দেশের সঙ্গে চুক্তি করে, বা কোনো আন্তর্জাতিক সংগঠনে যোগ দেয়, তখন তার পেছনে আদর্শ বা নৈতিকতার চেয়েও বেশি কাজ করে তার বস্তুগত স্বার্থ আর ক্ষমতা বৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষা।
৩. কেনেথ ওয়াল্টজ ও নব্যবাস্তববাদ (Kenneth Waltz & Neorealism/Structural Realism): কাঠামোটাই আসল খেলাড়ী: কেনেথ ওয়াল্টজ বাস্তববাদকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেলেন। তিনি বললেন, রাষ্ট্রগুলোর আচরণের মূল কারণ তাদের অভ্যন্তরীণ চরিত্র বা নেতাদের ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্খা নয়, বরং আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার নৈরাজ্যিক কাঠামো (anarchic structure) নিজেই। এই কাঠামোয়, প্রতিটি রাষ্ট্রই টিকে থাকার জন্য (survival) লড়াই করে। যেহেতু অন্য কোনো রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায় না, তাই প্রত্যেকেই নিজেদের সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি বাড়িয়ে আত্মরক্ষা করতে চায়। এর ফলে তৈরি হয় “নিরাপত্তা উভয়সংকট” (security dilemma) – একটা রাষ্ট্র যখন নিজের নিরাপত্তার জন্য অস্ত্র বাড়ায়, তখন অন্য রাষ্ট্রগুলো সেটাকে হুমকি হিসেবে দেখে এবং তারাও অস্ত্র বাড়াতে শুরু করে। ফলে, কারও নিরাপত্তাই শেষ পর্যন্ত বাড়ে না, বরং উত্তেজনা আর অবিশ্বাসের জন্ম হয়। (Waltz, 1979, Theory of International Politics)। ওয়াল্টজের নব্যবাস্তববাদ আমাদের শেখায়, বড় বড় শক্তিগুলোর মধ্যেকার স্নায়ুযুদ্ধ, অস্ত্র প্রতিযোগিতা বা প্রভাব বিস্তারের লড়াই – এগুলো কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, বরং আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার কাঠামোগত ফল। এখানেও বস্তুগত সক্ষমতাই (material capabilities) নির্ধারণ করে দেয়, কে কতটা প্রভাবশালী হবে।
৪. আন্দ্রে গুন্ডার ফ্রাঙ্ক, ফার্নান্দো কারডোসো ও নির্ভরশীলতা তত্ত্ব (Andre Gunder Frank, Fernando Cardoso & Dependency Theory): কেন্দ্রের টানে পরিধির দুর্গতি: এই তত্ত্বটা মূলত লাতিন আমেরিকার প্রেক্ষাপটে তৈরি হলেও, উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক দেশের জন্যই প্রাসঙ্গিক। এর মূল কথা হলো, বিশ্বের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটা এমনভাবে তৈরি হয়েছে, যেখানে কিছু উন্নত, শিল্পোন্নত “কেন্দ্র” (core) দেশ (যেমন: পশ্চিমা দেশগুলো) তাদের নিজেদের স্বার্থে অনুন্নত বা উন্নয়নশীল “প্রান্ত” (periphery) দেশগুলোকে শোষণ করে। এই প্রান্ত দেশগুলো কেন্দ্রের জন্য কাঁচামাল সরবরাহ করে আর তাদের তৈরি করা শিল্পপণ্য কেনে। এর ফলে, প্রান্ত দেশগুলো কেন্দ্রের ওপর অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং তাদের নিজস্ব উন্নয়নের সম্ভাবনা বাধাগ্রস্ত হয়। (Frank, 1966, “The Development of Underdevelopment”) নির্ভরশীলতা তত্ত্ব আমাদের দেখায়, কীভাবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বৈদেশিক সাহায্য, বা বহুজাতিক কর্পোরেশনের কার্যকলাপের মাধ্যমে ধনী দেশগুলো গরিব দেশগুলোর সম্পদ ও শ্রম শোষণ করে নিজেদের সমৃদ্ধি বাড়ায়। এখানেও রাজনীতির পেছনে মূল চালিকাশক্তি হলো বস্তুগত সম্পদের অসম বণ্টন ও নিয়ন্ত্রণ।
৫. ইমানুয়েল ওয়ালারস্টিন ও বিশ্ব-ব্যবস্থা তত্ত্ব (Immanuel Wallerstein & World-Systems Theory): এক বিশ্ব, তিন স্তর: ওয়ালারস্টিন নির্ভরশীলতা তত্ত্বকে আরও বিস্তৃত করে একটি বিশ্ব-ব্যবস্থা (world-system) তত্ত্বের প্রস্তাব করেন। তিনি পুরো বিশ্বকে একটি একক পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে দেখেন, যার তিনটি স্তর রয়েছে: কেন্দ্র (core), আধা- প্রান্ত (semi-periphery), এবং প্রান্ত (periphery)। কেন্দ্র দেশগুলো সবচেয়ে উন্নত, প্রযুক্তি ও পুঁজির মালিক। প্রান্ত দেশগুলো সবচেয়ে দুর্বল, শোষিত। আর আধা- প্রান্ত দেশগুলো এই দুইয়ের মাঝে অবস্থান করে – তারা একদিকে কেন্দ্রের দ্বারা শোষিত হয়, আবার অন্যদিকে প্রান্ত কে শোষণ করে। এই ব্যবস্থায়, দেশগুলোর মধ্যেকার সম্পর্ক মূলত অর্থনৈতিক ও বস্তুগত স্বার্থ দ্বারা নির্ধারিত হয়। (Wallerstein, 1974, The Modern World-System I)
এইসব বড় বড় তাত্ত্বিকদের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারি, যৌক্তিক-বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যা কেবল কোনো সাধারণ ধারণা নয়, এর একটা শক্তিশালী তাত্ত্বিক ভিত্তি রয়েছে। এটা আমাদের বলে, রাজনীতির খেলাটা আসলে শূন্যে ভাসে না। এর পেছনে রয়েছে কঠিন বাস্তবতার চাপ, সম্পদের টানাপোড়েন, আর টিকে থাকার লড়াই।
উদাহরণ যখন কথা বলে: আমেরিকা থেকে বাংলাদেশ, ভারত থেকে বিশ্ব
তত্ত্ব তো অনেক হলো, এবার কিছু বাস্তব উদাহরণ দেখা যাক।
-
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি ও মধ্যপ্রাচ্য: কেন আমেরিকা যুগ যুগ ধরে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে এত গভীরভাবে জড়িয়ে আছে? মানবতা, গণতন্ত্র বা শান্তিরক্ষার কথা বলা হলেও, এর পেছনের অন্যতম প্রধান কারণ হলো তেল। মধ্যপ্রাচ্য হলো বিশ্বের অন্যতম প্রধান তেল উত্পাদনকারী অঞ্চল। এই তেলের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা আমেরিকার অর্থনীতির জন্য, তার শিল্প ও সামরিক শক্তির জন্য অত্যন্ত জরুরি। তাই, সেখানে নিজেদের প্রভাব বজায় রাখা, বন্ধু রাষ্ট্রগুলোকে সমর্থন করা, আর শত্রু রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখা – এগুলো আমেরিকার বস্তুগত স্বার্থের সঙ্গেই জড়িত।
-
চীনের উত্থান ও বাণিজ্য যুদ্ধ: সাম্প্রতিককালে চীনের অভাবনীয় অর্থনৈতিক উত্থান বিশ্ব রাজনীতিতে এক নতুন সমীকরণ তৈরি করেছে। চীন এখন বিশ্বের অন্যতম প্রধান উৎপাদন কেন্দ্র, রপ্তানিকারক দেশ, এবং পুঁজির জোগানদার। এই অর্থনৈতিক শক্তিই চীনকে বিশ্ব মঞ্চে এত প্রভাবশালী করে তুলেছে। আমেরিকা ও চীনের মধ্যে যে বাণিজ্য যুদ্ধ (trade war) আমরা দেখছি, তার মূলে রয়েছে উভয় দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখার চেষ্টা। কে কার বাজারে কতটা প্রবেশাধিকার পাবে, কে কার প্রযুক্তি চুরি করছে, কে কাকে ভর্তুকি দিচ্ছে – এই সবই বস্তুগত লাভ-ক্ষতির হিসাব।
-
পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে দর কষাকষি: জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ আজ গোটা বিশ্বের সামনে। কিন্তু এর মোকাবিলা করার জন্য যে আন্তর্জাতিক চুক্তি বা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, সেখানেও উন্নত দেশ আর উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে স্বার্থের সংঘাত স্পষ্ট। উন্নত দেশগুলো, যারা ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণ করে আজকের অবস্থানে এসেছে, তারা চায় উন্নয়নশীল দেশগুলোও কার্বন নিঃসরণ কমাক। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোর যুক্তি হলো, তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য শিল্পায়ন দরকার, আর তার জন্য কার্বন নিঃসরণ কিছুটা বাড়তেই পারে। তাছাড়া, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলার জন্য যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন, তার বেশিরভাগটা উন্নত দেশগুলোরই বহন করা উচিত। এই যে দর কষাকষি, এর মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা আর সম্পদের সীমাবদ্ধতা।
-
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প ও শ্রমিক আন্দোলন: বাংলাদেশ আজ বিশ্বের অন্যতম প্রধান পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। এই শিল্প দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড, লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান জুগিয়েছে। কিন্তু এর উল্টো পিঠে রয়েছে শ্রমিকদের সস্তা শ্রম, ঝুঁকিপূর্ণ কর্মপরিবেশ আর নামমাত্র মজুরি। মালিকপক্ষ চায় সর্বোচ্চ মুনাফা, তাই তারা খরচ কমাতে চায়। আর শ্রমিকরা চায় ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ আর মানবিক জীবনযাত্রা। এই দুই পক্ষের বস্তুগত স্বার্থের সংঘাত থেকেই জন্ম নেয় শ্রমিক আন্দোলন, ধর্মঘট, এমনকি কখনও কখনও সহিংসতা। সরকারকেও এখানে একটা ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করতে হয়, কারণ একদিকে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের হাতছানি, অন্যদিকে সামাজিক অস্থিরতার আশঙ্কা। এই পুরো পরিস্থিতিটাই যৌক্তিক-বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে খুব ভালোভাবে বোঝা যায়।
-
ভারতে কৃষক আন্দোলন ও কৃষি আইন: ভারতে সম্প্রতি প্রণীত কিছু কৃষি আইনের বিরুদ্ধে কৃষকরা দীর্ঘ সময় ধরে তীব্র আন্দোলন করেছেন। কৃষকদের আশঙ্কা ছিল, এই আইনগুলো তাদের ফসলের ন্যায্য মূল্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত করবে, বড় বড় কর্পোরেট কোম্পানির হাতে তাদের ভাগ্য তুলে দেবে, এবং তাদের জমি হারানোর ঝুঁকি তৈরি করবে। অন্যদিকে, সরকারের যুক্তি ছিল, এই আইনগুলো কৃষিক্ষেত্রে আধুনিকায়ন আনবে, বাজার উন্মুক্ত করবে এবং কৃষকদের আয় বাড়াবে। এখানেও স্পষ্টত দুই পক্ষের বস্তুগত স্বার্থের সংঘাত। কৃষকরা তাদের জীবিকা, তাদের জমির ওপর নিয়ন্ত্রণ, তাদের বেঁচে থাকার ন্যূনতম রসদটুকু রক্ষা করতে চেয়েছিল। আর সরকার হয়তো চেয়েছিল কৃষিক্ষেত্রে বড় পুঁজির বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বা বাজার ব্যবস্থাকে আরও “দক্ষ” করতে। এই লড়াইটাও ছিল মূলত রুটি-রুজির, অধিকারের, আর সম্পদের নিয়ন্ত্রণের।
-
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে টানাপোড়েন: তিস্তা নদীর পানি দুই দেশের জন্যই, বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রাকৃতিক সম্পদ। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বিশাল এলাকার কৃষি ও পরিবেশ এই নদীর পানির ওপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যেরও সেচ ও অন্যান্য প্রয়োজনে তিস্তার পানি দরকার। এই সীমিত সম্পদ কে কতটা পাবে, তা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের টানাপোড়েন। এখানে কোনো দেশের আবেগ বা সদিচ্ছার চেয়েও বড় হয়ে দেখা দেয় নিজ নিজ দেশের কৃষকদের, জনগণের বস্তুগত চাহিদা পূরণের চাপ। এটা একটা ক্লাসিক “রিসোর্স কনফ্লিক্ট” বা সম্পদ নিয়ে সংঘাতের উদাহরণ।
-
সুন্দরবনের আশেপাশে শিল্পায়ন ও পরিবেশবাদীদের উদ্বেগ: সুন্দরবন আমাদের অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদ, আমাদের রক্ষাকবচ। কিন্তু এর আশেপাশে যখন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বা অন্যান্য ভারী শিল্প স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়, তখন পরিবেশবাদীরা এবং স্থানীয় মানুষজন তাদের জীবিকা ও পরিবেশের ওপর সম্ভাব্য মারাত্মক প্রভাবের কথা ভেবে উদ্বিগ্ন হন। অন্যদিকে, উদ্যোক্তা বা সরকারপক্ষ হয়তো দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা কর্মসংস্থানের যুক্তি দেখান। এখানেও উন্নয়নের নামে প্রকৃতি ও পরিবেশের বস্তুগত সম্পদকে ব্যবহারের অধিকার এবং তার ফলে সৃষ্ট ঝুঁকির বণ্টন নিয়ে একটা গভীর সংঘাত দেখা যায়। কে ঝুঁকি নেবে, আর কে সুবিধা পাবে – এই প্রশ্নটা এখানে মুখ্য।
-
ভারতে জাতিভেদ প্রথা ও অর্থনৈতিক বৈষম্য: ভারতে জাতিভেদ প্রথা একটা জটিল সামাজিক সমস্যা হলেও, এর একটা গভীর অর্থনৈতিক ও বস্তুগত দিক রয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে, তথাকথিত “নিম্নবর্ণের” মানুষজন জমি, শিক্ষা, সম্পদ ও সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এর ফলে, আজও তাদের একটা বড় অংশ দারিদ্র্য, ভূমিহীনতা ও সামাজিক বঞ্চনার শিকার। তাদের রাজনৈতিক আন্দোলন বা অধিকার আদায়ের সংগ্রামের পেছনেও রয়েছে এই বস্তুগত বঞ্চনা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। সংরক্ষণ (reservation) বা কোটা ব্যবস্থার মতো বিষয়গুলোও এই ঐতিহাসিক বস্তুগত বৈষম্য দূর করার একটা প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা যেতে পারে, যদিও তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
এই উদাহরণগুলো থেকে বোঝা যায়, রাজনীতির অনেক ঘটনাই আসলে পর্দার আড়ালে থাকা বিভিন্ন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বস্তুগত স্বার্থের টানাটানির ফল। কে কতটা সম্পদ পাবে, কে কতটা সুযোগ পাবে, কে কার ওপর প্রভাব বিস্তার করবে – এই হিসাবগুলোই অনেক সময় রাজনৈতিক সমীকরণকে নিয়ন্ত্রণ করে।
যৌক্তিক-বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যার শক্তি ও সীমাবদ্ধতা
এই যে আমরা এতক্ষণ ধরে যৌক্তিক-বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যা নিয়ে আলোচনা করলাম, এর কিছু শক্তিশালী দিক যেমন আছে, তেমনি কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে।
শক্তি:
- বাস্তবসম্মত ও সোজাসাপ্টা: এই ব্যাখ্যাটা অনেক জটিল রাজনৈতিক ঘটনাকে একটা সহজ, বাস্তবসম্মত কাঠামোর মধ্যে ফেলে বুঝতে সাহায্য করে। এটা আমাদের বলে, মানুষ যতই আদর্শের কথা বলুক না কেন, পেটের চিন্তা বা বস্তুগত লাভালাভের হিসাবটা সে ভোলে না।
- সংঘাতের মূল কারণ উন্মোচন: অনেক রাজনৈতিক সংঘাতের পেছনে যে আসলে অর্থনৈতিক বা বস্তুগত স্বার্থের লড়াই কাজ করে, এই দৃষ্টিভঙ্গি তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
- নীতি নির্ধারণে সহায়ক: নীতিনির্ধারকরা যখন কোনো আইন বা প্রকল্প তৈরি করেন, তখন বিভিন্ন গোষ্ঠীর বস্তুগত স্বার্থের ওপর তার কী প্রভাব পড়বে, সেটা বিচার-বিশ্লেষণ করতে এই ব্যাখ্যাটা কাজে লাগে।
- আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষণে কার্যকর: রাষ্ট্রগুলোর মধ্যেকার সম্পর্ক, যুদ্ধ, বাণিজ্য চুক্তি ইত্যাদি বোঝার জন্য এই দৃষ্টিভঙ্গি খুবই কার্যকর।
সীমাবদ্ধতা:
- অতি সরলীকরণ (Oversimplification) ও অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদ (Economic Determinism): এই ব্যাখ্যাটা অনেক সময় মানুষের আচরণকে শুধু অর্থনৈতিক বা বস্তুগত স্বার্থের নিরিখে দেখতে চায়। কিন্তু মানুষ তো কেবল অর্থনীতির জীব নয়। তার আবেগ আছে, বিশ্বাস আছে, সংস্কৃতি আছে, আদর্শ আছে। অনেক সময় মানুষ বস্তুগত ক্ষতি স্বীকার করেও আদর্শের জন্য লড়াই করে, বা ভালোবাসার টানে স্বার্থত্যাগ করে। এই বিষয়গুলোকে যৌক্তিক-বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যা অনেক সময় উপেক্ষা করে যায়।
- “যৌক্তিকতা” ও “স্বার্থ” ধারণার অস্পষ্টতা: মানুষ কি সবসময় নিখুঁতভাবে যৌক্তিক আচরণ করে? “স্বার্থ” বলতে কি কেবল বস্তুগত স্বার্থই বোঝায়? ক্ষমতা, সম্মান, ভালোবাসা, বা আধ্যাত্মিক সন্তুষ্টি – এগুলো কি মানুষের স্বার্থ নয়? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর সবসময় সহজ নয়।
- ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটকে কম গুরুত্ব দেওয়া: বিভিন্ন সমাজের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ, বা ধর্মীয় বিশ্বাস মানুষের রাজনৈতিক আচরণকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। যৌক্তিক-বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যা অনেক সময় এই বিষয়গুলোকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয় না।
- পরিবর্তনের ব্যাখ্যায় দুর্বলতা: এই ব্যাখ্যাটা অনেক সময় বিদ্যমান ক্ষমতার কাঠামো বা সম্পদের বণ্টনকে প্রদত্ত (given) হিসেবে ধরে নেয়। কিন্তু এই কাঠামো কীভাবে পরিবর্তিত হয়, বা কীভাবে মানুষ সমষ্টিগতভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় (collective action), তা ব্যাখ্যা করতে এই তত্ত্ব মাঝে মাঝে হিমশিম খায়।
শেষ কথা: দুনিয়াটা কি আসলেই শুধু লেনদেনের?
তাহলে, আমরা কি এই সিদ্ধান্তে আসব যে, রাজনীতি মানেই কেবল বস্তুগত স্বার্থের কাড়াকাড়ি? মানুষ কি আসলেই এতটা হিসাবনিকাশ করে চলে? হয়তো পুরোপুরি নয়। কিন্তু এই যৌক্তিক-বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যা আমাদের রাজনীতির একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক চিনতে সাহায্য করে। এটা আমাদের শেখায়, রাজনীতির মঞ্চে যখন বড় বড় কথা বলা হয়, আদর্শের বাণী শোনানো হয়, তখন পর্দার আড়ালে কারা লাভবান হচ্ছে, আর কাদের ভাগে পড়ছে বঞ্চনা – সেই হিসাবটা মিলিয়ে দেখাটা জরুরি।
এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের বলে, যখন কোনো রাজনৈতিক পরিস্থিতি বা ঘটনা আমরা দেখি, তখন আমাদের এই প্রশ্নগুলো করা উচিত:
- এই খেলার মূল খেলোয়াড় কারা? তাদের হাতে কী পরিমাণ বস্তুগত সম্পদ (টাকা, জমি, প্রাকৃতিক সম্পদ, সামরিক শক্তি ইত্যাদি) রয়েছে? তারা এই সম্পদের বিন্যাসে কে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে?
- তাদের এই বস্তুগত অবস্থান কীভাবে তাদের জন্য কিছু পছন্দকে লাভজনক আর কিছু পছন্দকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে? কোন পথে গেলে তাদের বস্তুগত প্রাপ্তিযোগ বেশি?
- তারা যে আচরণ করছে, একই বস্তুগত পরিস্থিতিতে পড়লে অন্য যে কেউ কি মোটামুটি একই রকম আচরণ করত?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলেই আমরা দেখতে পাব, রাজনীতির অনেক জটিল ধাঁধার সমাধান লুকিয়ে আছে এই বস্তুগত স্বার্থের সমীকরণের মধ্যেই। তবে, এটাও মনে রাখতে হবে, এটা রাজনীতির পুরো ছবি নয়, ছবির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ মাত্র। মানুষ কেবল রুটির জন্য বাঁচে না, তার আরও অনেক চাহিদা আছে, স্বপ্ন আছে। কিন্তু রুটির চিন্তাটা যে একটা বড় চিন্তা, সে কথা ভুললেও চলবে না। এই যৌক্তিক-বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যা আমাদের সেই কঠিন বাস্তবতার কথাই বারবার মনে করিয়ে দেয়। তাই, রাজনীতিকে বুঝতে হলে, এই চশমাটা চোখে লাগিয়েও একবার দুনিয়াটাকে দেখতে হয়। তাহলে হয়তো অনেক আবছা ছবিই একটু বেশি পরিষ্কার হয়ে ধরা দেবে আমাদের কাছে।
বিকল্প ২—প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাখ্যা: আসলে খেলাটা নিয়মের, খেলোয়াড়ের নয় (Alternative 2—Institutional Explanation: Playing by the Rules of the Game)
২০১৩ সালের মার্কিন অচলাবস্থা, যা তৎকালীন বিশ্ব রাজনীতিতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, তা শুধুমাত্র কতিপয় রাজনৈতিক নেতার ব্যক্তিগত জেদ বা মতাদর্শগত সংঘাতের ফসল ছিল না। এর গভীরে প্রোথিত ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলির (Institutions) জটিল জাল এবং তাদের অন্তর্নিহিত নিয়মকানুন। এই অংশের মূল উপজীব্য হলো এই প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাখ্যা – যা মনে করে রাজনৈতিক ঘটনাবলির গতিপ্রকৃতি বোঝার জন্য খেলোয়াড়দের চেয়ে খেলার নিয়মকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আমরা দেখব কীভাবে বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক কাঠামো, সাংবিধানিক বিধি এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়া রাজনৈতিক অভিনেতাদের আচরণকে প্রভাবিত করে এবং নির্দিষ্ট ফলাফলের দিকে চালিত করে।
প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাখ্যার তাত্ত্বিক ভিত্তি: প্রতিষ্ঠান কী এবং কেন গুরুত্বপূর্ণ?
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে “প্রতিষ্ঠান” (Institution) শব্দটি একটি ব্যাপক অর্থ বহন করে। ডগলাস নর্থ (Douglass North), যিনি প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতির জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, প্রতিষ্ঠানকে “humanly devised constraints that structure political, economic, and social interaction” বা “মানুষের দ্বারা তৈরি করা সেইসব সীমাবদ্ধতা যা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক মিথস্ক্রিয়াকে কাঠামোবদ্ধ করে” হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন (North, 1990)। এই সীমাবদ্ধতাগুলো হতে পারে আনুষ্ঠানিক (Formal), যেমন – দেশের সংবিধান, আইন, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচনী বিধি, সরকারি সংস্থা, ইত্যাদি। আবার এগুলো অনানুষ্ঠানিক (Informal)-ও হতে পারে, যেমন – সামাজিক রীতিনীতি, প্রথা, নৈতিক আচরণবিধি, দুর্নীতির সংস্কৃতি, স্বজনপ্রীতি, ইত্যাদি।
প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাখ্যার মূল কথা হলো, এই নিয়মকানুনগুলোই রাজনৈতিক কর্তাদের (Political Actors) আচরণের প্রণোদনা (Incentives) এবং প্রতিবন্ধকতা (Constraints) তৈরি করে। কর্তারা সাধারণত যুক্তিসঙ্গতভাবেই আচরণ করে, অর্থাৎ তারা তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য উপলব্ধ উপায়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে কার্যকরটি বেছে নিতে চায়। প্রতিষ্ঠানগুলোই নির্ধারণ করে দেয় কোন ধরনের আচরণ পুরস্কৃত হবে আর কোন ধরনের আচরণ শাস্তিযোগ্য বা ব্যয়বহুল হবে। জেমস মার্চ এবং জোহান ওলসেন (March & Olsen, 1984) তাদের “নয়া প্রাতিষ্ঠানবাদ” (New Institutionalism) তত্ত্বে দেখিয়েছেন যে, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো শুধুমাত্র নিরপেক্ষ খেলার মাঠ নয়, বরং এগুলো নিজেরাই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ এবং রাজনৈতিক ফলাফলের নির্ধারক।
নয়া প্রাতিষ্ঠানবাদ মূলত তিনটি ধারায় বিকশিত হয়েছে:
- যৌক্তিক পছন্দভিত্তিক প্রাতিষ্ঠানবাদ (Rational Choice Institutionalism): এই ধারা মনে করে, রাজনৈতিক অভিনেতারা তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য কৌশলগতভাবে আচরণ করে এবং প্রতিষ্ঠানগুলো হলো সেই কৌশলগত খেলার নিয়ম। অভিনেতারা এই নিয়মগুলোর মধ্যেই তাদের উপযোগিতা (Utility) সর্বোচ্চ করার চেষ্টা করে। এই ধারার প্রবক্তারা গেম থিওরি (Game Theory) এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক মডেল ব্যবহার করে রাজনৈতিক আচরণ বিশ্লেষণ করেন।
- ঐতিহাসিক প্রাতিষ্ঠানবাদ (Historical Institutionalism): এই ধারা গুরুত্ব দেয় সময়ের প্রেক্ষাপট এবং “পথনির্ভরতা” (Path Dependency) ধারণার ওপর। অর্থাৎ, অতীতের কোনো এক সময়ে গৃহীত প্রাতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত পরবর্তীকালে রাজনৈতিক বিকাশের পথকে অনেকাংশে নির্ধারণ করে দেয়। একবার কোনো পথে চলতে শুরু করলে সেই পথ থেকে সরে আসা কঠিন হয়ে পড়ে, এমনকি যদি নতুন কোনো পথ অধিকতর শ্রেয় বলেও মনে হয়। ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ (Critical Junctures) এবং প্রাতিষ্ঠানিক স্তরবিন্যাস (Institutional Layering) এই ধারার গুরুত্বপূর্ণ ধারণা।
- সমাজতাত্ত্বিক প্রাতিষ্ঠানবাদ (Sociological Institutionalism): এই ধারা প্রতিষ্ঠানকে কেবল নিয়মের সমষ্টি হিসেবে না দেখে, বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে গ্রহণযোগ্য আচরণের প্রতীকী ব্যবস্থা (Symbolic Systems), জ্ঞানীয় স্ক্রিপ্ট (Cognitive Scripts) এবং নৈতিক কাঠামো (Moral Templates) হিসেবে বিবেচনা করে। এখানে প্রতিষ্ঠানগুলো বৈধতা (Legitimacy) অর্জন করে এবং অভিনেতারা প্রায়শই সচেতন কৌশল হিসেবে নয়, বরং “এটাই সঠিক কাজ” বা “এভাবেই করা হয়” এমন ধারণা থেকে প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম মেনে চলে।
এই তিনটি ধারাই স্বীকার করে যে, প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে, যদিও তাদের ব্যাখ্যার কেন্দ্রে ভিন্ন ভিন্ন দিক প্রাধান্য পায়। আমাদের বর্তমান আলোচনার জন্য যৌক্তিক পছন্দভিত্তিক ও ঐতিহাসিক প্রাতিষ্ঠানবাদ বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক জটিলতা: অচলাবস্থার আঁতুড়ঘর
২০১৩ সালের মার্কিন অচলাবস্থার মূলে ছিল সেদেশের সংবিধানপ্রণেতাদের দ্বারা সচেতনভাবে তৈরি করা ক্ষমতার পৃথকীকরণ (Separation of Powers) ও ভারসাম্য রক্ষার (Checks and Balances) নীতি।
-
ক্ষমতার পৃথকীকরণ ও ভিন্ন ভিন্ন নির্বাচন চক্র: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি, প্রতিনিধি পরিষদ (House of Representatives) এবং সিনেট – এই তিনটি কেন্দ্র ভিন্ন ভিন্ন নির্বাচন পদ্ধতির মাধ্যমে এবং ভিন্ন ভিন্ন সময়ে নির্বাচিত হয়। রাষ্ট্রপতি সমগ্র দেশের জনগণের ভোটে (ইলেক্টোরাল কলেজের মাধ্যমে) চার বছরের জন্য নির্বাচিত হন। প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩৫ জন সদস্য প্রতি দুই বছর অন্তর নিজ নিজ জেলা থেকে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন। অন্যদিকে, সিনেটের ১০০ জন সদস্য (প্রতি রাজ্য থেকে ২ জন) ছয় বছরের জন্য নির্বাচিত হন, তবে প্রতি দুই বছর অন্তর সিনেটের এক-তৃতীয়াংশ আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
-
তাত্ত্বিক প্রভাব: এই ভিন্ন ভিন্ন নির্বাচন চক্রের কারণে প্রায়শই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় যেখানে রাষ্ট্রপতি এক দলের এবং কংগ্রেসের (প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেট বা উভয়ের একটি) নিয়ন্ত্রণ থাকে অন্য দলের হাতে – যাকে “বিভক্ত সরকার” (Divided Government) বলা হয়। প্রতিটি পক্ষই নিজেদের জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের প্রতিনিধি বলে দাবি করে, কারণ তারা প্রত্যেকেই কোনো না কোনো নির্বাচনের মাধ্যমে সেই জনগণের সমর্থন পেয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আইন প্রণয়ন বা বাজেট অনুমোদনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়ে। প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থানে দৃঢ় থাকে, কারণ তারা মনে করে তাদের পেছনে জনগণের সমর্থন রয়েছে এবং বিরোধী পক্ষকে ছাড় দিলে নিজ দলের সমর্থকদের কাছে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে।
-
২০১৩ সালের অচলাবস্থা: সে সময় ডেমোক্র্যাট বারাক ওবামা ছিলেন রাষ্ট্রপতি, সিনেটে ডেমোক্র্যাটদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল, কিন্তু প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। “ওবামাকেয়ার” (Affordable Care Act) নিয়ে রিপাবলিকানদের তীব্র আপত্তির মুখে বাজেট পাশ করা সম্ভব হয়নি, যার ফলে সরকারি কাজকর্ম আংশিকভাবে বন্ধ (Government Shutdown) হয়ে যায়। এখানে খেলোয়াড় (ওবামা, বোয়েনার, টেড ক্রুজ) তাদের ব্যক্তিগত বিদ্বেষের চেয়েও বেশি করে প্রাতিষ্ঠানিক বাধ্যবাধকতার শিকার হয়েছিলেন। রিপাবলিকানরা তাদের নির্বাচনী এলাকার সমর্থকদের কাছে ওবামাকেয়ার বাতিলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, অন্যদিকে ওবামা ও ডেমোক্র্যাটরা এটিকে তাদের প্রধান সাফল্য হিসেবে ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এমন ছিল যে কোনো এক পক্ষের এককভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ ছিল না, ফলে দর কষাকষি এবং অচলাবস্থা অনিবার্য হয়ে উঠেছিল।
-
-
প্রতিনিধি পরিষদের ঘন ঘন নির্বাচন: প্রতি দুই বছর অন্তর প্রতিনিধি পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় সদস্যরা সবসময়ই একটি নির্বাচনী প্রচারণার মানসিকতার মধ্যে থাকেন। এর ফলে, দীর্ঘমেয়াদী জনকল্যাণের চেয়ে স্বল্পমেয়াদী রাজনৈতিক লাভালাভের হিসাব অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সদস্যদের ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা কমে যায় এবং তারা দলীয় লাইনের বাইরে গিয়ে সমঝোতা করতে দ্বিধা বোধ করেন, কারণ এতে পরবর্তী নির্বাচনে নিজ দলের কট্টরপন্থী সমর্থকদের দ্বারা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ার আশঙ্কা থাকে। এই “স্থায়ী প্রচারণা” (Permanent Campaign) রাজনৈতিক মেরুকরণকে আরও তীব্র করে তোলে।
-
সিনেটের ফিলিবাস্টার (Filibuster): মার্কিন সিনেটের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনানুষ্ঠানিক (বর্তমানে অনেক বেশি আনুষ্ঠানিক রূপ পাওয়া) নিয়ম হলো ফিলিবাস্টার। এর মাধ্যমে সংখ্যালঘু দল কোনো বিলের ওপর ভোটাভুটি বিলম্বিত বা প্রতিহত করতে পারে, যদি না বিলের পক্ষে ৬০ জন সিনেটরের সমর্থন (Cloture motion) জোগাড় করা যায়। এই নিয়মটি সংখ্যালঘুদের হাতে অনেক ক্ষমতা তুলে দিয়েছে এবং দ্বিদলীয় সমঝোতা ছাড়া আইন পাশ করা প্রায় অসম্ভব করে তুলেছে, বিশেষত যখন রাজনৈতিক মেরুকরণ চরমে থাকে।
-
সংবিধানের অনমনীয়তা (Rigidity): মার্কিন সংবিধান বিশ্বের অন্যতম অনমনীয় সংবিধান। এর সংশোধনী প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল ও সময়সাপেক্ষ। ফলে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের পরিবর্তন ঘটলেও সাংবিধানিক কাঠামোয় প্রয়োজনীয় সংস্কার আনা কঠিন হয়ে পড়ে। যে প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মগুলো একসময় ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার জন্য তৈরি করা হয়েছিল, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেগুলোই অচলাবস্থার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট: প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের রাজনীতিতেও প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মকানুন এবং তার দুর্বলতাগুলো রাজনৈতিক ঘটনাবলির গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
-
সংসদীয় গণতন্ত্রের বিবর্তন ও চ্যালেঞ্জ: বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে সংসদীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করলেও, বিভিন্ন সময়ে সামরিক শাসন ও অগণতান্ত্রিক সরকারের অধীনে প্রাতিষ্ঠানিক ধারাবাহিকতা ব্যাহত হয়েছে। ১৯৯১ সালে পুনরায় সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তনের পর থেকে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাওয়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু এর পথ মসৃণ নয়।
-
কার্যকর সংসদের অভাব: বাংলাদেশে সংসদ প্রায়শই প্রধান বিরোধী দলের বয়কটের কারণে অকার্যকর হয়ে পড়ে। “উইনার-টেকস-অল” (Winner-takes-all) মানসিকতার কারণে পরাজিত দল নির্বাচনী ফলাফল মেনে নিতে দ্বিধা করে এবং সংসদকে এড়িয়ে রাজপথের আন্দোলনে বেশি মনোযোগ দেয়। এর ফলে, আইন প্রণয়ন, সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনার প্রধান কেন্দ্র হিসেবে সংসদের ভূমিকা দুর্বল হয়ে পড়ে। এটি একটি অনানুষ্ঠানিক প্রাতিষ্ঠানিক সংকট, যা আনুষ্ঠানিক নিয়মাবলিকে ছাপিয়ে যায়।
-
-
নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও নির্বাচনকালীন সরকার: বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক বিতর্ক ও নিরীক্ষার বিষয়। ১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের (Caretaker Government) অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবমুক্ত একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা।
-
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অভিজ্ঞতা: এই ব্যবস্থা কয়েকটি নির্বাচন তুলনামূলকভাবে গ্রহণযোগ্য করতে সাহায্য করলেও, এর গঠন ও কার্যপরিধি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয় এবং দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পুরনো ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া হয়। এই প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের ফলে প্রধান বিরোধী দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে, যা ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দলের অংশগ্রহণকে সীমিত বা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এটি একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ যেখানে একটি প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মের পরিবর্তন রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণ এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বৈধতাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।
-
-
ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন: বাংলাদেশের সংবিধানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা গৃহীত হলেও, বাস্তবে প্রধানমন্ত্রীর হাতে ব্যাপক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় (বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়) অনেক ক্ষেত্রেই অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও সরকারি সংস্থার ওপর প্রভাব বিস্তার করে। এই ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, যেমন – সংসদ, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন ইত্যাদির স্বাধীন ও কার্যকর ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে।
-
আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানের সংঘাত: বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো (যেমন – আইন, বিচারব্যবস্থা) অনেক সময় শক্তিশালী অনানুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠান (যেমন – রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতির নেটওয়ার্ক) দ্বারা প্রভাবিত বা দুর্বল হয়ে পড়ে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং সুশাসন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এই সংঘাত একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
-
রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের অভাব: প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের চর্চা সীমিত। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয় এবং তৃণমূল থেকে মতামতের প্রতিফলন কম ঘটে। এটিও একটি অনানুষ্ঠানিক প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, যা জাতীয় পর্যায়ে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে।
ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক প্রেক্ষাপট: সম্ভাবনা ও সংকট
ভারত, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র, একটি সংসদীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অধীনে পরিচালিত হয়। এর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ভিন্ন, কিন্তু এখানেও নিয়মের খেলা রাজনৈতিক ফলাফলকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
-
সংসদীয় ব্যবস্থা (Parliamentary System): ভারতে সরকার গঠিত হয় লোকসভায় (House of the People/Lower House) সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দল বা জোটের মাধ্যমে। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভা লোকসভার কাছে দায়বদ্ধ থাকে। এই ব্যবস্থায় তত্ত্বগতভাবে অচলাবস্থার সুযোগ কম, কারণ নির্বাহী বিভাগ (Executive) ও আইনসভার (Legislature) সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মধ্যে একটি প্রত্যক্ষ যোগসূত্র থাকে। তবে, জোট সরকারের (Coalition Government) যুগে এই চিত্র পাল্টে যায়।
-
জোট রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিক প্রভাব: ১৯৯০-এর দশক থেকে ভারতে জোট রাজনীতির প্রাধান্য দেখা গেছে। বিভিন্ন আঞ্চলিক ও ছোট দলগুলোর সমন্বয়ে গঠিত জোট সরকার প্রায়শই নীতিগত দৃঢ়তা দেখাতে পারে না। জোটের শরিক দলগুলোর ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থ ও চাপের মুখে সরকারকে অনেক সময় আপস করতে হয়, যা সুশাসনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এখানে প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম (সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা) এবং রাজনৈতিক বাস্তবতা (বহুদলীয় ব্যবস্থা ও আঞ্চলিক দলের উত্থান) সম্মিলিতভাবে একটি বিশেষ ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে, যেখানে দর কষাকষি ও ক্ষমতার ভাগাভাগিই মুখ্য হয়ে ওঠে। উদাহরণস্বরূপ, বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সংস্কার আটকে গেছে শুধুমাত্র জোটের কোনো শরিক দলের আপত্তির কারণে।
-
-
নির্বাচনী ব্যবস্থা (Electoral System): ভারতে লোকসভা ও রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে মূলত “ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট” (First-Past-the-Post, FPTP) বা বহুত্ববাদী (Plurality) ব্যবস্থা অনুসরণ করা হয়। এই ব্যবস্থায় একটি নির্বাচনী এলাকায় যে প্রার্থী সর্বাধিক ভোট পান, তিনিই নির্বাচিত হন, যদিও তিনি মোট ভোটের ৫০ শতাংশের কম পান।
-
FPTP-এর প্রভাব: এই ব্যবস্থার ফলে প্রায়শই এমন হয় যে, কোনো দল ৩০-৩৫% ভোট পেয়েও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যায়, আবার অনেক ছোট দল যথেষ্ট পরিমাণ ভোট পেয়েও আসনের নিরিখে তেমন প্রতিনিধিত্ব পায় না। এটি একদিকে যেমন স্থিতিশীল সরকার গঠনে সাহায্য করতে পারে (যদি কোনো দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়), অন্যদিকে এটি ভোটের অপচয় (Wasted Votes) এবং প্রতিনিধিত্বের সংকটও (Crisis of Representation) তৈরি করতে পারে। অনেক সময় একটি নির্দিষ্ট জাতি বা সম্প্রদায়ের ভোটকে একত্রিত করে নির্বাচনে জেতার প্রবণতা দেখা যায়, যা সামাজিক বিভাজনকে আরও বাড়িয়ে তোলে। প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম হিসেবে FPTP রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী কৌশল এবং প্রার্থী মনোনয়নের প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে।
-
-
দলত্যাগ বিরোধী আইন (Anti-Defection Law): ১৯৮৫ সালে ভারতীয় সংবিধানে ৫১তম সংশোধনীর মাধ্যমে দলত্যাগ বিরোধী আইন (দশম তফসিল) যুক্ত করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ঘন ঘন দল পরিবর্তন এবং তার ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা রোধ করা।
-
প্রাতিষ্ঠানিক উদ্দেশ্য ও বাস্তবতা: এই আইন একদিকে যেমন দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষায় এবং সরকারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাহায্য করেছে, অন্যদিকে এটি সংসদ সদস্যদের বাকস্বাধীনতা ও স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকারকে সংকুচিত করেছে বলে অভিযোগ ওঠে। দলের হুইপের (Whip) বিরুদ্ধে গিয়ে ভোট দিলে সদস্যপদ খারিজ হয়ে যাওয়ার ভয়ে অনেক সদস্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারেন না। এর ফলে, আইনসভায় বিতর্ক ও আলোচনার মান কমে যাওয়ার এবং দলের শীর্ষ নেতৃত্বের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। এটি একটি উদাহরণ যেখানে একটি প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম (দলত্যাগ বিরোধী আইন) একটি নির্দিষ্ট সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করলেও নতুন কিছু সমস্যার জন্ম দিয়েছে।
-
-
কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক ও রাজ্যপালের ভূমিকা: ভারত একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় রাষ্ট্র হলেও এর সংবিধানে কেন্দ্রের দিকে ক্ষমতার পাল্লা ভারী। রাজ্যপালের পদ, যিনি কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক নিযুক্ত হন, প্রায়শই কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। রাজ্যপালদের বিরুদ্ধে অনেক সময় কেন্দ্রীয় সরকারের এজেন্টের মতো কাজ করার এবং রাজ্যের নির্বাচিত সরকারের কাজে হস্তক্ষেপ করার অভিযোগ ওঠে। এটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, যা রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভিন্ন ভিন্ন ফলাফল দিতে পারে। যখন কেন্দ্র ও রাজ্যে একই দল ক্ষমতায় থাকে, তখন সাধারণত সম্পর্ক মসৃণ থাকে। কিন্তু যখন ভিন্ন ভিন্ন দল ক্ষমতায় থাকে, তখন রাজ্যপালের ভূমিকা প্রায়শই সংঘাতের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
-
বিচার বিভাগের সক্রিয়তা (Judicial Activism): ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ও বিভিন্ন হাইকোর্ট বিভিন্ন সময়ে জনস্বার্থ মামলায় (Public Interest Litigation, PIL) সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। পরিবেশ সুরক্ষা, মানবাধিকার, দুর্নীতি দমন ইত্যাদি বিষয়ে বিচার বিভাগ অনেক গুরুত্বপূর্ণ রায় দিয়েছে, যা নির্বাহী ও আইনসভার কাজের পরিধিকেও স্পর্শ করেছে। এটি বিচার বিভাগের একটি প্রাতিষ্ঠানিক উদ্ভাবন, যা ক্ষমতার ভারসাম্যে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তবে, বিচার বিভাগের এই সক্রিয়তা নিয়ে “বিচারিক অতিসক্রিয়তা” (Judicial Overreach) বা ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতির লঙ্ঘনের অভিযোগও ওঠে।
প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাখ্যা বনাম অন্যান্য ব্যাখ্যা: একটি তুলনামূলক আলোচনা
প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাখ্যা রাজনৈতিক ঘটনাবলি বোঝার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার, তবে এটিই একমাত্র ব্যাখ্যা নয়। মূল পাঠ্যাংশে উল্লিখিত “যৌক্তিক-বস্তুনিষ্ঠ গল্প” (Rational-Material Story) বা স্বার্থগোষ্ঠীভিত্তিক ব্যাখ্যা (Interest Group Explanation) মনে করে, রাজনীতি হলো বিভিন্ন গোষ্ঠী বা ব্যক্তির অন্তর্নিহিত স্বার্থের (সাধারণত অর্থনৈতিক) মধ্যে একটি কাঁচা প্রতিযোগিতা। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে, যাদের সম্পদ বা শক্তি বেশি, তারাই রাজনৈতিক ফলাফলকে নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আসতে পারে।
প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাখ্যা এই স্বার্থের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে না। বরং এটি বলে, প্রতিষ্ঠানগুলোই নির্ধারণ করে দেয় কীভাবে সেই স্বার্থগুলো সংগঠিত হবে, কীভাবে প্রকাশ পাবে এবং কীভাবে তাদের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া ঘটবে। অর্থাৎ, একই ধরনের স্বার্থ বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক রূপ নিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একটি শক্তিশালী শ্রমিক সংগঠন সংসদীয় গণতন্ত্রে দর কষাকষির মাধ্যমে যে সুবিধা আদায় করতে পারবে, একটি একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সেই সুযোগ নাও পেতে পারে, যদিও তাদের বস্তুগত স্বার্থ একই।
অন্যদিকে, মনস্তাত্ত্বিক বা নেতৃত্বকেন্দ্রিক ব্যাখ্যা (Psychological or Leadership-centric Explanation) রাজনৈতিক নেতাদের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য, ক্যারিশমা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বা দুর্বলতার ওপর জোর দেয়। এই ব্যাখ্যাও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ নেতারা প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মের মধ্যে থেকেই কাজ করেন এবং তাদের ব্যক্তিগত দক্ষতা বা অদক্ষতা ফলাফলের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। তবে, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাখ্যা বলবে যে, এমনকি সবচেয়ে ক্যারিশম্যাটিক নেতাকেও প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতার মধ্যেই কাজ করতে হয়।
শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক গল্প এটাই বোঝাতে চায় যে, রাজনীতি কেবল অন্তর্নিহিত বস্তুগত স্বার্থ বা নেতাদের ব্যক্তিগত ইচ্ছার প্রতিফলন নয়, বরং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বা “খেলার নিয়ম” দ্বারাই এটি অনেক বেশি প্রভাবিত ও আকারিত হয়। যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অন্যরকম হতো, বা ভারতে যদি আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক (Proportional Representation) নির্বাচনী ব্যবস্থা থাকত, অথবা বাংলাদেশে যদি নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে একটি স্থায়ী ও গ্রহণযোগ্য প্রাতিষ্ঠানিক সমাধান থাকত, তাহলে এই দেশগুলোর রাজনৈতিক ইতিহাস ও বর্তমান বাস্তবতা ভিন্ন হতে পারত।
প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্লেষণ কীভাবে করতে হয়: কিছু নির্দেশনামূলক প্রশ্ন
-
রাজনীতির এই বিশেষ খেলার প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মকানুনগুলো কীভাবে সাজানো হয়েছে? কে তৈরি করেছে এই নিয়ম, আর কেনই বা করেছে?
-
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের তাকাতে হবে সংবিধান, আইন, নির্বাচনী বিধি, দলীয় গঠনতন্ত্র এবং প্রাসঙ্গিক অনানুষ্ঠানিক প্রথাগুলোর দিকে। এই নিয়মগুলো কারা তৈরি করেছিল (যেমন – মার্কিন সংবিধান প্রণেতারা, ভারতের গণপরিষদ, বাংলাদেশের সংসদ) এবং তাদের উদ্দেশ্য কী ছিল (যেমন – ক্ষমতার ভারসাম্য, জাতীয় ঐক্য, সুষ্ঠু নির্বাচন) তা বোঝা জরুরি। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের দলত্যাগ বিরোধী আইন তৈরি করা হয়েছিল রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা রোধের জন্য, কিন্তু এর পেছনে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক স্বার্থও কাজ করতে পারে।
-
-
নিয়মের সেই বাধা কোর্স বা খেলার মাঠ কীভাবে কিছু পছন্দকে বা পদক্ষেপকে অত্যন্ত উপকারী এবং অন্য কিছু পছন্দকে অত্যন্ত ব্যয়বহুল বা ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে – বিশেষ করে প্রাতিষ্ঠানিক খেলার মধ্যে কে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, তার ওপর নির্ভর করে?
-
এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা দেখব কীভাবে প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মগুলো রাজনৈতিক কর্তাদের জন্য প্রণোদনা (Incentives) ও প্রতিবন্ধকতা (Constraints) তৈরি করে। যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিভক্ত সরকারের পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতির জন্য কংগ্রেসের সঙ্গে আপস করা উপকারী হতে পারে, যদিও তা তার দলের কট্টরপন্থীদের অসন্তুষ্ট করতে পারে। অন্যদিকে, একতরফাভাবে নির্বাহী আদেশ জারি করা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, কারণ তা আদালতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। ভারতে জোট সরকারের শরিক দলগুলোর জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে নিজ নিজ এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা উপকারী হতে পারে, কিন্তু অতিরিক্ত চাপ সরকারের পতনও ঘটাতে পারে, যা তাদের জন্যও ব্যয়বহুল হবে। বাংলাদেশে বিরোধী দলের জন্য সংসদ বয়কট করে রাজপথে আন্দোলন করা একটি কৌশল হতে পারে, কিন্তু এটি তাদের প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্নও করে ফেলতে পারে।
-
-
গল্পের প্রতিটি ব্যক্তি (বা গোষ্ঠী) যা করছে, আমরা কি এটা কল্পনা করতে পারি যে, এই প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মের খেলায় একই অবস্থানে থাকলে অন্য যে কেউ ঠিক একইভাবে প্রতিক্রিয়া জানাত, একই রকম কাজ করত?
-
এই প্রশ্নটি আমাদের ব্যক্তিগত দোষারোপের ঊর্ধ্বে গিয়ে কাঠামোগত কারণগুলো দেখতে সাহায্য করে। যদি ধরে নেওয়া হয় যে রাজনৈতিক কর্তারা যুক্তিসঙ্গত এবং তারা প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মের মধ্যেই তাদের লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করে, তাহলে একই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী একই ধরনের কৌশল অবলম্বন করতে পারে। যেমন, মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার যে দলেরই হোন না কেন, বিভক্ত সরকারের পরিস্থিতিতে তাকে প্রায় একই ধরনের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, যে দলই বিরোধী আসনে থাকুক না কেন, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে তাদের মধ্যে আস্থার সংকট দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যদি না প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসে। এর অর্থ এই নয় যে ব্যক্তির কোনো ভূমিকা নেই, কিন্তু ব্যক্তির ভূমিকা প্রাতিষ্ঠানিক প্রেক্ষাপট দ্বারাই অনেকাংশে সীমাবদ্ধ ও নির্দেশিত হয়।
-
প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন: সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা
যদি প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনৈতিক আচরণের নির্ধারক হয়, তাহলে প্রশ্ন ওঠে, এই প্রতিষ্ঠানগুলো কি পরিবর্তন করা সম্ভব? ঐতিহাসিক প্রাতিষ্ঠানবাদীরা বলবেন, প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত স্থিতিশীল এবং “পথনির্ভরতা”র কারণে এগুলো পরিবর্তন করা কঠিন। একবার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি হয়ে গেলে, তার চারপাশে বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠী গড়ে ওঠে, যারা সেই কাঠামো বজায় রাখতে চায়।
তবে, প্রতিষ্ঠান অপরিবর্তনীয় নয়। “ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ” (Critical Junctures) যেমন – যুদ্ধ, বিপ্লব, অর্থনৈতিক সংকট, গভীর রাজনৈতিক সংকট ইত্যাদি সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের সুযোগ তৈরি হতে পারে। এছাড়া, রাজনৈতিক উদ্যোক্তারা (Political Entrepreneurs) ধীরে ধীরে প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম পরিবর্তন বা নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরির চেষ্টা করতে পারেন।
উদাহরণস্বরূপ, ভারতে GST (Goods and Services Tax) প্রবর্তন একটি বড় ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, যা কেন্দ্র-রাজ্য আর্থিক সম্পর্ক এবং দেশের কর কাঠামোকে আমূল পরিবর্তন করেছে। এটি বহু বছরের আলোচনা ও দর কষাকষির ফসল। বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন ও পরে বাতিলকরণও বড় ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের উদাহরণ, যা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যের লড়াইয়ের প্রতিফলন।
প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের চেষ্টা সব সময় সফল হয় না এবং এর অনাকাঙ্ক্ষিত ফলাফলও (Unintended Consequences) হতে পারে। তাই, প্রাতিষ্ঠানিক নকশা (Institutional Design) এবং সংস্কারের ক্ষেত্রে গভীর বিচার-বিবেচনা ও দূরদর্শিতার প্রয়োজন।
উপসংহার
২০১৩ সালের মার্কিন অচলাবস্থা থেকে শুরু করে ভারত ও বাংলাদেশের জটিল রাজনৈতিক বাস্তবতা পর্যন্ত, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাখ্যা আমাদের রাজনৈতিক ঘটনাবলির গভীরে প্রবেশ করতে এবং এর কার্যকারণ সম্পর্ক বুঝতে সাহায্য করে। এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, রাজনীতি শুধুমাত্র ব্যক্তি বা দলের লড়াই নয়, বরং এটি একটি নিয়মের খেলা। খেলোয়াড়রা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু খেলার নিয়মগুলো প্রায়শই নির্ধারণ করে দেয় তারা কীভাবে খেলবে, কে জিতবে এবং কে হারবে।
যদি আমরা রাজনৈতিক অচলাবস্থা, সুশাসনের অভাব, গণতন্ত্রের সংকট বা অন্য কোনো রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে চাই, তাহলে শুধুমাত্র খেলোয়াড়দের পরিবর্তন করাই যথেষ্ট নয়। আমাদের খেলার নিয়মগুলোকেও পুনর্বিবেচনা করতে হবে এবং প্রয়োজনে সেগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে। একটি সুষ্ঠু, ন্যায়সঙ্গত ও কার্যকর রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শক্তিশালী, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানের কোনো বিকল্প নেই। আর সেই প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে কাজ করে, তা বোঝার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাখ্যা আমাদের একটি অপরিহার্য তাত্ত্বিক হাতিয়ার যুগিয়ে দেয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে রাজনীতিকে দেখলে আমরা ব্যক্তিবিশেষের ওপর দোষ চাপানোর প্রবণতা থেকে বেরিয়ে এসে কাঠামোগত সমস্যা ও তার সম্ভাব্য সমাধানের দিকে মনোনিবেশ করতে পারব।
বিকল্প ৩—ভাবাদর্শগত ব্যাখ্যা: সব খেলার মূলে বিশ্বাস আর “সংস্কৃতি যুদ্ধ” (Alternative 3—Ideational Explanation: Beliefs and “Culture Wars”)
২০১৩ সালের মার্কিন অচলাবস্থা নিছক একটি বাজেট সংকট বা ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ছিল না; এটি ছিল গভীরে প্রোথিত বিশ্বাস ও মূল্যবোধের সংঘাতের এক জ্বলন্ত প্রতিচ্ছবি। রাজনৈতিক ঘটনাবলির বিশ্লেষণে যখন আমরা বস্তুগত স্বার্থ কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক মারপ্যাঁচের দিকে দৃষ্টিপাত করি, তখন প্রায়শই এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় – আর তা হলো ভাবাদর্শ (Ideology)। ভাবাদর্শগত ব্যাখ্যা আমাদের বলে যে, মানুষের রাজনৈতিক আচরণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূলে রয়েছে তাদের মৌলিক বিশ্বাস, পৃথিবীর প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং নৈতিকতার মানদণ্ড। এই অংশে আমরা ভাবাদর্শগত ব্যাখ্যার তাত্ত্বিক ভিত্তি, এর শক্তি ও সীমাবদ্ধতা এবং বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এর প্রয়োগ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের “সংস্কৃতি যুদ্ধ” থেকে শুরু করে বাংলাদেশ ও ভারতের রাজনৈতিক মেরুকরণ পর্যন্ত, আমরা দেখব কীভাবে ভাবাদর্শ রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চের প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে উঠতে পারে।
ভাবাদর্শগত ব্যাখ্যার তাত্ত্বিক কাঠামো: বিশ্বাস যখন চালিকাশক্তি
ভাবাদর্শগত ব্যাখ্যা (Ideational Explanation) প্রস্তাব করে যে, মানুষের রাজনৈতিক কার্যকলাপ প্রাথমিকভাবে তাদের ভাগ করে নেওয়া বিশ্বাস, ধারণা, মূল্যবোধ এবং সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা দ্বারা চালিত হয়। এটি বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতার (Objective Reality) ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে এবং বলে যে, মানুষ তাদের চারপাশের বিশ্বকে একটি নির্দিষ্ট “সাংস্কৃতিক চশমা” বা ভাবাদর্শিক কাঠামোর (Ideational Framework) মধ্য দিয়ে দেখে ও ব্যাখ্যা করে। এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী, একই বস্তুগত পরিস্থিতি বা প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম বিভিন্ন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাছে ভিন্ন অর্থ বহন করতে পারে, কারণ তাদের বিশ্ববীক্ষা (Worldview) ভিন্ন।
-
ভাবাদর্শের সংজ্ঞা ও প্রকৃতি:
-
অ্যান্ড্রু হেউডের (Andrew Heywood) মতে, ভাবাদর্শ হলো “ধারণার একটি সুসংহত সমষ্টি যা বিশ্বের একটি চিত্র প্রদান করে, একটি কাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যৎ কল্পনা করে এবং সেই ভবিষ্যৎ অর্জনের জন্য রাজনৈতিক কার্যকলাপের রূপরেখা দেয়।” ভাবাদর্শগুলো কেবল বিমূর্ত ধারণা নয়, এগুলো মানুষের পরিচয় নির্মাণ করে, তাদের লক্ষ্য নির্ধারণ করে এবং সম্মিলিত কার্যকলাপের জন্য প্রণোদনা জোগায়।
-
ভাবাদর্শগুলো প্রায়শই সরলীকৃত এবং আবেগপূর্ণ হয়, যা তাদের ব্যাপক জনগোষ্ঠীর কাছে আকর্ষণীয় করে তোলে। এগুলো “আমাদের” এবং “তাদের” মধ্যে বিভাজন তৈরি করতে পারে, যা রাজনৈতিক সংহতি ও সংঘাত উভয়েরই জন্ম দেয়।
-
-
ভাবাদর্শের জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তি (Epistemological Underpinnings):
-
কনস্ট্রাকটিভিজম (Constructivism): এই তত্ত্ব অনুযায়ী, সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা বস্তুনিষ্ঠভাবে বিদ্যমান নয়, বরং এটি মানুষের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া ও ভাগ করে নেওয়া ধারণার মাধ্যমে নির্মিত হয়। আলেকজান্ডার ওয়েন্ডট (Alexander Wendt) যেমন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বলেছেন, ” নৈরাজ্য হলো রাষ্ট্রগুলো যা তৈরি করে” (“Anarchy is what states make of it”)। অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রকৃতি নির্ভর করে রাষ্ট্রগুলো একে অপরকে কীভাবে দেখে এবং তাদের সম্পর্ককে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করে, তার ওপর। একইভাবে, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও ভাবাদর্শগুলো রাজনৈতিক অভিনেতাদের পরিচয়, স্বার্থ এবং আচরণের নিয়মকানুন নির্মাণ করে।
-
ডিসকোর্স থিওরি (Discourse Theory): মিশেল ফুকোর (Michel Foucault) কাজ থেকে অনুপ্রাণিত এই তত্ত্ব অনুযায়ী, ভাষা ও ডিসকোর্স (একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে কথা বলার বা চিন্তা করার পদ্ধতি) কেবল বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে না, বরং তা নির্মাণ করে। ক্ষমতা এবং জ্ঞান ওতপ্রোতভাবে জড়িত; যাদের ডিসকোর্স সমাজে প্রভাবশালী হয়, তারাই নির্ধারণ করে কোনটি “সত্য”, কোনটি “স্বাভাবিক” এবং কোনটি “গ্রহণযোগ্য”। রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীগুলো তাদের ভাবাদর্শ প্রচারের জন্য নির্দিষ্ট ডিসকোর্স ব্যবহার করে, যা জনমত ও নীতি নির্ধারণকে প্রভাবিত করে।
-
সাংস্কৃতিক তত্ত্ব (Cultural Theory): ক্লিফোর্ড গিয়ার্টজ (Clifford Geertz) সংস্কৃতিকে “মানুষের বোনা তাৎপর্যপূর্ণ জালের সমষ্টি” (“webs of significance that man himself has spun”) হিসেবে দেখেছেন। এই “তাৎপর্যপূর্ণ জাল” বা প্রতীকী ব্যবস্থাগুলোই আমাদের বিশ্বকে বুঝতে এবং তাতে অর্থ আরোপ করতে সাহায্য করে। “সংস্কৃতি যুদ্ধ” (Culture War) মূলত এই তাৎপর্যপূর্ণ জালগুলোর নিয়ন্ত্রণ এবং সামাজিক মূল্যবোধের সংজ্ঞা নিয়ে লড়াই।
-
-
ভাবাদর্শ কীভাবে কাজ করে:
-
ব্যাখ্যামূলক কাঠামো (Interpretive Framework): ভাবাদর্শ জটিল রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনাবলিকে বোঝার জন্য একটি সরলীকৃত কাঠামো সরবরাহ করে। এটি বলে দেয় কে বন্ধু, কে শত্রু, সমস্যার কারণ কী এবং তার সমাধান কোথায়।
-
লক্ষ্য নির্ধারণ (Goal Setting): ভাবাদর্শ একটি কাঙ্ক্ষিত সমাজের চিত্র তুলে ধরে এবং সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য রাজনৈতিক কার্যকলাপের দিকনির্দেশনা দেয়।
-
সামাজিক সংহতি ও পরিচয় নির্মাণ (Social Cohesion and Identity Formation): একই ভাবাদর্শে বিশ্বাসী মানুষেরা একটি অভিন্ন পরিচয়ের ভিত্তিতে একত্রিত হয়, যা তাদের মধ্যে সংহতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ তৈরি করে।
-
বৈধতা প্রদান (Legitimation): ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী তাদের শাসন ও নীতিমালার পক্ষে জনসমর্থন আদায়ের জন্য ভাবাদর্শকে ব্যবহার করে। অন্যদিকে, বিরোধী গোষ্ঠী বিদ্যমান ব্যবস্থার সমালোচনা ও পরিবর্তনের ডাক দেওয়ার জন্যও ভাবাদর্শের আশ্রয় নেয়।
-
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের “সংস্কৃতি যুদ্ধ”: ভাবাদর্শের রণক্ষেত্র
২০১৩ সালের মার্কিন অচলাবস্থা ছিল রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের মধ্যেকার গভীর ভাবাদর্শগত বিভাজনের একটি উপসর্গ মাত্র। এটি কেবল সরকারি ব্যয় বা অর্থনৈতিক নীতির বিষয় ছিল না, বরং এটি ছিল একটি “সংস্কৃতি যুদ্ধ”।
-
উদারপন্থা (Liberalism) বনাম রক্ষণশীলতা (Conservatism):
-
আমেরিকান উদারপন্থা: সাধারণত বৃহত্তর সরকারি ভূমিকা, সামাজিক ন্যায়বিচার, সমানাধিকার, পরিবেশ সুরক্ষা এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার (যেমন, গর্ভপাতের অধিকার) ওপর জোর দেয়। ডেমোক্রেটিক পার্টি মূলত এই ভাবাদর্শের ধারক। তারা মনে করে, সরকারের দায়িত্ব হলো বাজারের ব্যর্থতা সংশোধন করা এবং নাগরিকদের জন্য একটি সুরক্ষা জাল (Safety Net) তৈরি করা। “ওবামাকেয়ার” বা অ্যাফোর্ডেবল কেয়ার অ্যাক্ট ছিল এই ভাবাদর্শের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিফলন, যা স্বাস্থ্যসেবাকে একটি অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল।
-
আমেরিকান রক্ষণশীলতা: সীমিত সরকার, ব্যক্তিগত দায়িত্ব, মুক্তবাজার অর্থনীতি, ঐতিহ্যবাহী পারিবারিক মূল্যবোধ এবং শক্তিশালী জাতীয় প্রতিরক্ষার ওপর গুরুত্ব দেয়। রিপাবলিকান পার্টি এই ভাবাদর্শের প্রধান বাহক। তারা ওবামাকেয়ারকে দেখেছিল সরকারি হস্তক্ষেপের একটি ভয়ঙ্কর উদাহরণ হিসেবে, যা ব্যক্তির স্বাধীনতা খর্ব করে এবং অর্থনীতির ওপর বোঝা চাপায়। তাদের কাছে এটি ছিল “বড় সরকার” এবং “সমাজতন্ত্রের” দিকে একটি বিপজ্জনক পদক্ষেপ।
-
-
“সংস্কৃতি যুদ্ধ”-এর প্রধান বিষয়বস্তু:
-
গর্ভপাত: “প্রো-লাইফ” (জীবনপন্থী) এবং “প্রো-চয়েস” (পছন্দপন্থী) শিবিরের মধ্যেকার সংঘাত মার্কিন সমাজে গভীর বিভাজন সৃষ্টি করেছে। এটি কেবল একটি স্বাস্থ্যসেবার বিষয় নয়, বরং এটি জীবন, নারী অধিকার এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের মৌলিক প্রশ্নগুলোকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়।
-
বন্দুক নিয়ন্ত্রণ (Gun Control): সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীতে অস্ত্র রাখার অধিকার এবং গণহতাকাণ্ড প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তার মধ্যেকার বিতর্ক অত্যন্ত আবেগপূর্ণ। এটি ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, আত্মরক্ষা এবং রাষ্ট্রের ভূমিকার মতো মৌলিক ভাবাদর্শগত বিষয়গুলোকে স্পর্শ করে।
-
এলজিবিটিকিউ+ অধিকার (LGBTQ+ Rights): সমলিঙ্গ বিবাহ, রূপান্তরকামীদের অধিকার ইত্যাদি বিষয়গুলো ঐতিহ্যবাহী পারিবারিক মূল্যবোধ এবং সমানাধিকারের ধারণার মধ্যে সংঘাত তৈরি করে।
-
অভিবাসন (Immigration): জাতীয় পরিচয়, সীমান্ত সুরক্ষা, অর্থনৈতিক প্রভাব এবং মানবিক বিবেচনার মতো বিষয়গুলো অভিবাসন বিতর্ককে জটিল ও ভাবাদর্শগতভাবে মেরুকৃত করে তুলেছে।
-
বর্ণবাদ ও জাতিগত ন্যায়বিচার (Race and Racial Justice): ঐতিহাসিক অন্যায় এবং বর্তমান বৈষম্যের বিষয়টি মার্কিন সমাজে একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল ও বিভাজিত আলোচনার ক্ষেত্র। “ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার” আন্দোলনের মতো ঘটনাগুলো এই ভাবাদর্শগত সংঘাতকে সামনে নিয়ে এসেছে।
-
-
ভাবাদর্শের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ:
-
এই ভাবাদর্শগত বিভাজন কেবল সাধারণ মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি রাজনৈতিক দল, মিডিয়া এবং এমনকি বিচার বিভাগেও প্রতিফলিত হয়। ফক্স নিউজ (Fox News) রক্ষণশীল ভাবাদর্শ এবং এমএসএনবিসি (MSNBC) উদারপন্থী ভাবাদর্শ প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগেও ভাবাদর্শ একটি প্রধান বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
-
২০১৩ সালের অচলাবস্থার ক্ষেত্রে, রিপাবলিকানদের মূল লক্ষ্য ছিল ওবামাকেয়ারের বাস্তবায়ন বিলম্বিত করা বা এর অর্থায়ন বন্ধ করা। এটি তাদের কাছে কেবল একটি আইন বাতিলের বিষয় ছিল না, বরং এটি ছিল উদারপন্থী ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে একটি প্রতীকী বিজয় অর্জন এবং রক্ষণশীল মূল্যবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠার লড়াই। প্রেসিডেন্ট ওবামা এবং ডেমোক্র্যাটরাও তাদের অবস্থানে দৃঢ় ছিলেন, কারণ ওবামাকেয়ার ছিল তাদের প্রধান নীতিগত অর্জন এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি তাদের অঙ্গীকারের প্রতিফলন। এখানে বস্তুগত স্বার্থ বা প্রাতিষ্ঠানিক মারপ্যাঁচের চেয়েও বড় হয়ে উঠেছিল ভাবাদর্শগত বিশ্বাস এবং “সঠিক” ও “ভুল” নীতির লড়াই।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভাবাদর্শের মেরুকরণ: জাতীয়তাবাদ ও ধর্ম
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস ও বর্তমান প্রেক্ষাপট ভাবাদর্শগত সংঘাত দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত।
-
বাঙালি জাতীয়তাবাদ বনাম বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ:
-
- বাঙালি জাতীয়তাবাদ: এর ভিত্তি হলো ভাষা ও সংস্কৃতি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এই জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করেই সংঘটিত হয়েছিল, যার মূল চেতনা ছিল অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও শোষণমুক্ত একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা। আওয়ামী লীগ এই ভাবাদর্শের প্রধান ধারক হিসেবে পরিচিত।
- বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ: এই ভাবাদর্শে বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানা এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার ওপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান এই ধারণার প্রবক্তা ছিলেন। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এই ভাবাদর্শের ওপর ভিত্তি করে গঠিত।
- এই দুই ধরনের জাতীয়তাবাদের সংঘাত বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, সংবিধান, ইতিহাসচর্চা এবং পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করেছে। “বঙ্গবন্ধু” নাকি “স্বাধীনতার ঘোষক”, “জয় বাংলা” নাকি “বাংলাদেশ জিন্দাবাদ” – এই ধরনের প্রতীকী বিতর্কগুলো গভীর ভাবাদর্শগত বিভাজনের প্রতিফলন।
-
ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম রাজনৈতিক ইসলাম:
-
- ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূলনীতি হিসেবে গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৭ সালে সামরিক ফরমানের মাধ্যমে এবং পরবর্তীতে অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা দেওয়া হয়। ২০১৫ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলেও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রাখা হয়েছে।
- এই সাংবিধানিক টানাপোড়েন ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাজনৈতিক ইসলামের মধ্যেকার ভাবাদর্শগত সংঘাতকে প্রতিফলিত করে। জামায়াতে ইসলামী এবং অন্যান্য ইসলামপন্থী দলগুলো শরিয়াভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি জানায়। অন্যদিকে, ধর্মনিরপেক্ষ ও বামপন্থী দলগুলো ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করে।
- হেফাজতে ইসলামের মতো সংগঠনের উত্থান এবং তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব এই ভাবাদর্শগত মেরুকরণকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। পাঠ্যপুস্তক, নারী নীতি, ভাস্কর্য ইত্যাদি বিষয়ে তাদের দাবিগুলো প্রায়শই বিতর্কের জন্ম দেয়।
-
“মুক্তিযুদ্ধের চেতনা”: একটি পরিবর্তনশীল ভাবাদর্শ:
-
- “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা” বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি শক্তিশালী ভাবাদর্শগত ধারণা। তবে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী এই চেতনাকে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করে।
- আওয়ামী লীগের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র সম্পর্কিত।
- বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে যুক্ত করে।
- এই ব্যাখ্যার ভিন্নতা প্রায়শই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে “মুক্তিযুদ্ধবিরোধী” বা “স্বাধীনতাবিরোধী” হিসেবে চিহ্নিত করার হাতিয়ারে পরিণত হয়।
-
উন্নয়ন বয়ান (Development Discourse) ও কর্তৃত্বপরায়ণতা (Authoritarianism):
-
- সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে “উন্নয়ন”-কে একটি প্রধান ভাবাদর্শ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নকে সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
- সমালোচকরা মনে করেন, এই উন্নয়ন বয়ান প্রায়শই গণতান্ত্রিক অধিকার, মানবাধিকার এবং সুশাসনের বিষয়গুলোকে গৌণ করে তোলে এবং এক ধরনের কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনের ন্যায্যতা প্রতিপাদন করে। এটিও একটি ভাবাদর্শগত অবস্থান, যেখানে উন্নয়নের নামে নাগরিক স্বাধীনতা সীমিত করাকে গ্রহণযোগ্য হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভাবাদর্শগত বিভাজন এতটাই তীব্র যে, এটি প্রায়শই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ন্যূনতম সমঝোতার পথও রুদ্ধ করে দেয়। নির্বাচনী সহিংসতা, প্রতিহিংসার রাজনীতি এবং অসহিষ্ণুতা এই ভাবাদর্শগত মেরুকরণেরই বহিঃপ্রকাশ।
ভারতীয় রাজনীতিতে ভাবাদর্শের খেলা: ধর্ম, জাতি ও জাতীয়তাবাদ
ভারত, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র, বহু ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতির একটি মিশ্রণ। এখানে ভাবাদর্শগত সংঘাত প্রায়শই জটিল ও বহুমাত্রিক রূপ ধারণ করে।
-
হিন্দু জাতীয়তাবাদ (Hindutva):
-
- এটি একটি প্রভাবশালী ভাবাদর্শ যা ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে কল্পনা করে এবং ভারতীয় সংস্কৃতি ও জাতীয় পরিচয়কে হিন্দুত্বের সঙ্গে সমার্থক হিসেবে দেখে। ভি. ডি. সাভারকার এবং এম. এস. গোলওয়ালকারের মতো তাত্ত্বিকরা এর ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (RSS) এই ভাবাদর্শের প্রধান প্রচারক এবং ভারতীয় জনতা পার্টি (BJP) এর রাজনৈতিক শাখা হিসেবে পরিচিত।
- মূল বিশ্বাস: হিন্দুত্ববাদীরা মনে করেন, হিন্দুরাই ভারতের আদি ও প্রকৃত অধিবাসী এবং তাদের সংস্কৃতিই ভারতের মূল সংস্কৃতি। তারা “সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদে” বিশ্বাসী, যেখানে ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে জাতীয় পরিচয় নির্মিত হয়।
- রাজনৈতিক প্রভাব: হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থান ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। বাবরি মসজিদ ধ্বংস, গোরক্ষা আন্দোলন, “লাভ জিহাদ” বিতর্ক, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) ইত্যাদি ঘটনাগুলো এই ভাবাদর্শগত সংঘাতের প্রতিফলন। বিজেপি সরকারের অধীনে হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা, যেমন – অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণ, অভিন্ন দেওয়ানি বিধির (Uniform Civil Code) প্রস্তাব, এবং পাঠ্যপুস্তকে ঐতিহাসিক তথ্যের পরিবর্তন – অধিকতর গুরুত্ব পেয়েছে। এটি সংখ্যালঘু, বিশেষত মুসলিমদের মধ্যে উদ্বেগ ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে।
-
ধর্মনিরপেক্ষতা (Secularism) বনাম সাম্প্রদায়িকতাবাদ (Communalism):
-
- ভারতের সংবিধান রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে পৃথক রেখেছে এবং সকল ধর্মের প্রতি সমান আচরণের নির্দেশ দিয়েছে। এটি “সর্ব ধর্ম সমভাব” (সকল ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধা) নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত।
- অন্যদিকে, সাম্প্রদায়িকতাবাদ হলো ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং এক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অন্য সম্প্রদায়কে উস্কে দেওয়া। ভারতে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক সংঘাতের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।
- ধর্মনিরপেক্ষতার প্রকৃতি নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মকে পুরোপুরি ব্যক্তিগত পরিসরে সীমাবদ্ধ রাখা (যেমন পশ্চিমা মডেল), আবার কেউ কেউ মনে করেন, রাষ্ট্র সকল ধর্মকে সমানভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করবে। এই ভাবাদর্শগত বিতর্ক নীতি নির্ধারণ এবং সামাজিক সম্প্রীতিকে প্রভাবিত করে।
-
জাতিভেদ প্রথা (Caste System) ও সামাজিক ন্যায়বিচার:
-
- জাতিভেদ প্রথা একটি প্রাচীন সামাজিক স্তরবিন্যাস, যা হিন্দুধর্মের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। এটি জন্মগত পরিচয়ের ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে উচ্চ-নীচ ভেদ তৈরি করে এবং দলিত (সাবেক “অস্পৃশ্য”) ও অন্যান্য নিম্নবর্ণের মানুষের প্রতি ব্যাপক বৈষম্যের জন্ম দিয়েছে।
- সংবিধান জাতিভেদ প্রথাকে নিষিদ্ধ করলেও এবং সংরক্ষণ (Affirmative Action) ব্যবস্থার মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে আনার চেষ্টা করলেও, সামাজিক ও মানসিক স্তরে এর প্রভাব এখনও ব্যাপক।
- দলিত রাজনীতি এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের আন্দোলনগুলো জাতিভেদ প্রথার ভাবাদর্শগত ভিত্তিকে চ্যালেঞ্জ করে এবং সমতা ও মর্যাদার দাবি জানায়। ভীমরাও আম্বেদকরের চিন্তাভাবনা এই আন্দোলনের প্রধান অনুপ্রেরণা।
-
বামপন্থা (Leftism) বনাম উদার অর্থনীতি (Liberal Economy):
-
- ভারতের স্বাধীনতার পর দীর্ঘদিন সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার অর্থনীতি প্রচলিত ছিল, যেখানে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির প্রাধান্য ছিল। ১৯৯১ সালের অর্থনৈতিক সংস্কারের পর ভারত মুক্তবাজার অর্থনীতির দিকে ঝুঁকে পড়ে।
- বামপন্থী দলগুলো এখনও শ্রমিক ও কৃষকদের অধিকার, সম্পদের সুষম বণ্টন এবং রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির পক্ষে সওয়াল করে। অন্যদিকে, দক্ষিণপন্থী ও মধ্যপন্থী দলগুলো বাজার অর্থনীতির মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি অর্জনের ওপর জোর দেয়। এই ভাবাদর্শগত পার্থক্য অর্থনৈতিক নীতি ও উন্নয়ন মডেল নিয়ে বিতর্ক তৈরি করে।
ভারতে রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়শই এই ভাবাদর্শগত বিভাজনগুলোকে ব্যবহার করে নিজেদের ভোটব্যাংক সুসংহত করে। ধর্ম, জাতি, ভাষা এবং অঞ্চলের নামে ভাবাদর্শগত আপিল ভোটারদের প্রভাবিত করার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার।
ভাবাদর্শগত ব্যাখ্যা, বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম
ভাবাদর্শগত ব্যাখ্যা আগের দুটি (যৌক্তিক-বস্তুনিষ্ঠ ও প্রাতিষ্ঠানিক) ব্যাখ্যার থেকে ভিন্ন।
-
বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতার ধারণা: যৌক্তিক-বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যা ধরে নেয় যে, একটি সুস্পষ্ট বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতা রয়েছে এবং মানুষ সেই বাস্তবতার নিরিখে তাদের স্বার্থ চিহ্নিত করে যুক্তিসঙ্গত আচরণ করে। কিন্তু ভাবাদর্শগত ব্যাখ্যা বলে, “বাস্তবতা” নিজেই সামাজিকভাবে নির্মিত এবং ভাবাদর্শের চশমা দিয়ে দেখা হয়। ধনী বা দরিদ্রের “বাস্তব” স্বার্থ কী, তা তাদের ভাবাদর্শগত অবস্থানের ওপর নির্ভর করতে পারে। যেমন, একজন ধনী ব্যক্তি যদি মুক্তবাজার অর্থনীতিতে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, তাহলে তিনি কর হ্রাসকে নিজের এবং সমাজের জন্য উপকারী বলে মনে করতে পারেন, এমনকি যদি স্বল্পমেয়াদে এর ফলে তার ব্যক্তিগত আয় কিছুটা কমেও যায়।
-
প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মের ব্যাখ্যা: প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাখ্যা অনুযায়ী, রাজনৈতিক অভিনেতারা সাংবিধানিক বা অন্যান্য নিয়মের মধ্যে থেকে তাদের কৌশল নির্ধারণ করে। কিন্তু ভাবাদর্শগত ব্যাখ্যা প্রস্তাব করে যে, একই প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম বিভিন্ন ভাবাদর্শের মানুষ ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে এবং ব্যবহার করতে পারে। মার্কিন সংবিধান ক্ষমতার পৃথকীকরণ তৈরি করলেও, যদি রাজনৈতিক দলগুলো আপোসহীন, বিপরীতমুখী ভাবাদর্শ গ্রহণ করে, তাহলে সেই ব্যবস্থা অচলাবস্থার জন্ম দিতে পারে। ভারতে সংসদীয় গণতন্ত্রের কাঠামো থাকা সত্ত্বেও, যদি সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শ প্রভাবশালী হয়ে ওঠে, তাহলে সংখ্যালঘুদের অধিকার খর্ব হতে পারে।
ভাবাদর্শগত ব্যাখ্যা এটা অস্বীকার করে না যে বস্তুগত সীমাবদ্ধতা (যেমন, সম্পদ বণ্টনে বৈষম্য) বা প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মকানুন (যেমন, নির্বাচনী ব্যবস্থা) গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং এটি বলে, এই উপাদানগুলো কীভাবে মানুষের রাজনৈতিক আচরণকে প্রভাবিত করবে, তা অনেকাংশে নির্ভর করে তাদের ভাবাদর্শগত বিশ্ববীক্ষার ওপর। ভাবাদর্শই বস্তুগত পরিস্থিতি ও প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মকে অর্থ প্রদান করে।
ভাবাদর্শগত বিশ্লেষণের জন্য প্রাসঙ্গিক প্রশ্নাবলী
কোনো রাজনৈতিক পরিস্থিতি বা ঘটনাকে ভাবাদর্শগত দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করার জন্য আমাদের কিছু নির্দিষ্ট প্রশ্ন করতে হবে:
-
এই খেলার মূল খেলোয়াড়দের নির্দিষ্ট কিছু মৌলিক বিশ্বাস বা ধ্যানধারণাগুলো কী কী? তারা আসলে কী বিশ্বাস করে?
-
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের বক্তৃতা, দলের ইশতেহার, সমর্থক গোষ্ঠীর প্রকাশনা এবং গণমাধ্যমের আলোচনা বিশ্লেষণ করতে হবে। তাদের বিশ্ব সম্পর্কে মৌলিক অনুমানগুলো (Basic Assumptions) কী, তারা মানব প্রকৃতিকে কীভাবে দেখে, ন্যায়বিচার ও সমতা সম্পর্কে তাদের ধারণা কী – এগুলো বোঝা জরুরি।
-
-
তারা কি তাদের লক্ষ্য, তাদের নিজেদের ক্ষমতা এবং তাদের চারপাশের পরিবেশকে এমন কিছু বিশেষ উপায়ে ব্যাখ্যা করছে, যা অন্যরা হয়তো করছে না বা সেভাবে ভাবছে না?
-
একই ঘটনা বা পরিস্থিতি বিভিন্ন ভাবাদর্শের মানুষ ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে। যেমন, একটি অর্থনৈতিক সংকটকে কেউ পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত দুর্বলতা হিসেবে দেখতে পারে, আবার কেউ সরকারি হস্তক্ষেপের ফল হিসেবে দেখতে পারে। তাদের এই “ফ্রেম” বা ব্যাখ্যার ধরণ বোঝাটা গুরুত্বপূর্ণ।
-
-
তাদের এই নির্দিষ্ট ধারণা বা বিশ্বাসগুলো কীভাবে তাদের কিছু পছন্দকে অত্যন্ত উপকারী বা নৈতিকভাবে সঠিক এবং অন্য কিছু পছন্দকে অসুবিধাজনক বা নৈতিকভাবে ভুল হিসেবে দেখতে পরিচালিত করছে?
-
ভাবাদর্শ কেবল বিশ্বকে ব্যাখ্যাই করে না, এটি নৈতিকতার মানদণ্ডও নির্ধারণ করে। কোনো একটি নীতি বা পদক্ষেপকে “সঠিক” বা “ভুল”, “নৈতিক” বা “অনৈতিক” হিসেবে দেখার পেছনে ভাবাদর্শগত বিশ্বাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন, ওবামাকেয়ারের বিরোধীরা এটিকে কেবল অকার্যকর নয়, বরং “অনৈতিক” হিসেবেও দেখেছিল কারণ এটি ব্যক্তির স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করে।
-
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমৃদ্ধি ও ক্ষমতার পেছনে কোন ব্যাখ্যা?
ক্রেইগ পারসন্স একটি প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন: কেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ বিশ্বের অন্যতম ধনী ও শক্তিশালী দেশ? এর উত্তরে তিনটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, যা আমাদের তিনটি প্রধান ব্যাখ্যামূলক পদ্ধতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ:
১. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রধানত ধনী ও শক্তিশালী কারণ আমেরিকানরা সীমিত আকারের সরকার এবং “আমেরিকান স্বপ্নে” (American Dream) বিশ্বাস করতে এসেছিল, যা সমাজে তীব্র প্রতিযোগিতা, নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হওয়া এবং যুগান্তকারী উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করেছিল ও তার পথ খুলে দিয়েছিল।
লেবেল: এটি একটি ভাবাদর্শগত ব্যাখ্যা। এখানে “আমেরিকান স্বপ্ন”, সীমিত সরকারে বিশ্বাস, প্রতিযোগিতা ও উদ্যোক্তা সংস্কৃতির মতো ধারণা বা বিশ্বাসগুলোকে সাফল্যের মূল কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
২. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রধানত ধনী ও শক্তিশালী কারণ এই দেশের প্রতিষ্ঠাতা পিতারা একটি চমৎকার, সুচিন্তিত সংবিধান তৈরি করেছিলেন, যার নিয়মকানুনগুলো বিভিন্ন রাজনৈতিক সংঘাতের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখেছিল, একটা স্থিতিশীল সরকারকে উৎসাহিত করেছিল এবং দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য একটা অত্যন্ত শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম বা ভিত্তি তৈরি করেছিল।
লেবেল: এটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাখ্যা। এখানে সংবিধান এবং তার নিয়মকানুন, যা স্থিতিশীলতা ও ভারসাম্য নিশ্চিত করেছে, তাকেই সাফল্যের চাবিকাঠি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
৩. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রধানত ধনী ও শক্তিশালী কারণ এর প্রাথমিক ইউরোপীয় বসতি স্থাপনকারীরা (এবং পরবর্তীতে যারা এখানে এসে বসবাস শুরু করেছিল) তারা প্রকৃতি থেকে এক ব্যতিক্রমী সম্পদ, একটা মনোরম নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু এবং আশেপাশে খুব কম সংখ্যক প্রতিযোগী জনসংখ্যা বা শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সুবিধা ভোগ করেছিল।
লেবেল: এটি একটি যৌক্তিক-বস্তুনিষ্ঠ (বা বস্তুগত) ব্যাখ্যা। এখানে প্রাকৃতিক সম্পদ, জলবায়ু এবং ভূ-রাজনৈতিক সুবিধার মতো বস্তুগত উপাদানগুলোকে প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বাস্তবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাফল্যের পেছনে এই তিনটি কারণেরই কমবেশি ভূমিকা থাকতে পারে এবং সেগুলো একে অপরের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়াও করেছে। ভাবাদর্শগত বিশ্বাস প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে প্রভাবিত করেছে, আবার বস্তুগত সুবিধা নতুন নতুন ভাবাদর্শের জন্ম দিয়েছে বা সেগুলোকে শক্তিশালী করেছে।
উপসংহার: ভাবাদর্শের অমোঘ প্রভাব
ভাবাদর্শগত ব্যাখ্যা আমাদের দেখায় যে, রাজনীতি কেবল ক্ষমতা বা সম্পদের খেলা নয়, এটি বিশ্বাস ও মূল্যবোধেরও লড়াই। মানুষের মনে গেঁথে থাকা ধারণাগুলো তাদের আচরণকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে এবং রাজনৈতিক সংঘাত ও সহযোগিতার গতিপথ নির্ধারণ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের “সংস্কৃতি যুদ্ধ”, ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থান, কিংবা বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ ও ধর্মভিত্তিক মেরুকরণ – এই সবই প্রমাণ করে যে ভাবাদর্শ রাজনৈতিক জীবনের একটি অপরিহার্য উপাদান।
যখন আমরা রাজনৈতিক ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করি, তখন আমাদের অবশ্যই প্রশ্ন করতে হবে: এর পেছনে কোন মৌলিক বিশ্বাসগুলো কাজ করছে? খেলোয়াড়রা বিশ্বকে কীভাবে দেখছে? তাদের নৈতিকতার মানদণ্ড কী? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর না খুঁজে কেবল বস্তুগত স্বার্থ বা প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মের দিকে তাকালে আমরা রাজনৈতিক বাস্তবতার একটি খণ্ডিত চিত্র পাব। ভাবাদর্শের শক্তিকে স্বীকার করে নিলেই আমরা সমসাময়িক বিশ্বের জটিল রাজনৈতিক সমীকরণগুলো আরও ভালোভাবে বুঝতে পারব এবং অর্থপূর্ণ সমাধানের পথে এগোতে পারব। কারণ, সব খেলার মূলে শেষ পর্যন্ত থাকে বিশ্বাস, আর সেই বিশ্বাসকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয় রাজনৈতিক জীবনের বহু সংঘাত ও সম্ভাবনা।
মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা: একটি সংকীর্ণতর বিকল্প
ক্রেইগ পারসন্স চতুর্থ একটি ব্যাখ্যার কথা বলা হয়েছে – ব্যক্তিগত মনোবিজ্ঞানের (Individual Psychology) ওপর নির্মিত ব্যাখ্যা। এটি ব্যক্তি-স্তরের রাজনৈতিক পছন্দ (যেমন, ভোটদান বা নেতাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ) ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে। জিনগত প্রবণতা বা মস্তিষ্কের গঠন কিছু আচরণের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। ড্যানিয়েল কাহনেম্যান ও অ্যামোস টেভারস্কির (Kahneman & Tversky, 1979) কাজ দেখিয়েছে কীভাবে জ্ঞানীয় পক্ষপাত (Cognitive Biases) মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণকে প্রভাবিত করে।
তবে, এই ব্যাখ্যাটি সামগ্রিকভাবে বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর মধ্যেকার রাজনৈতিক পার্থক্যের (যেমন, কেন বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা বা সংস্কৃতি গড়ে ওঠে) উত্তর দিতে ততটা সক্ষম নয়। কারণ, মৌলিক মনস্তাত্ত্বিক গঠন বা হার্ড-ওয়্যারিং মানবজাতির মধ্যে খুব বেশি পরিবর্তিত হয় না। তাই, এই বইয়ের মূল ফোকাস প্রথম তিনটি ব্যাখ্যার ওপরই থাকবে।
উপসংহার
আশা করি, আপনার জন্য এটা ইতিমধ্যেই বেশ সহজ হয়ে গেছে যে, প্রথম গল্পটা আসলে একটা ভাবাদর্শগত ব্যাখ্যা, দ্বিতীয়টা একটা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাখ্যা, এবং তৃতীয়টা একটা যৌক্তিক-বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যা।
ক্রেইগ পারসন্স এর মতে যেকোনো রাজনৈতিক পরিস্থিতি বা ঘটনাকে বিশ্লেষণ করার জন্য আপনি নিম্নলিখিত তিনটি প্রশ্ন ব্যবহার করতে পারেন:
-
এই খেলার বিভিন্ন খেলোয়াড়দের চারপাশের বস্তুগত (MATERIAL) ভূখণ্ডটি বা বাস্তব পরিস্থিতিটা ঠিক কী, এবং এটি কীভাবে এমন কিছু সীমাবদ্ধতা এবং সুযোগ-সুবিধা (প্রণোদনা) নির্ধারণ করে, যা তাদেরকে নির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত বা নিরুৎসাহিত করে?
-
এই খেলোয়াড়দের চারপাশের প্রাতিষ্ঠানিক (INSTITUTIONAL) নিয়মকানুন এবং সংগঠনগুলো বা কাঠামোটা ঠিক কী কী, এবং তারা কীভাবে এমন কিছু সীমাবদ্ধতা এবং সুযোগ-সুবিধা (প্রণোদনা) নির্ধারণ করে, যা তাদেরকে নির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত বা নিরুৎসাহিত করে?
-
এই খেলোয়াড়রা কোন ধরনের ভাবাদর্শ (IDEAS), বিশ্বাস বা সংস্কৃতি ধারণ করে, যা তাদেরকে তাদের সামনে থাকা বিভিন্ন বিকল্প এবং পছন্দগুলোকে কিছু নির্দিষ্ট উপায়ে ব্যাখ্যা করতে বা দেখতে পরিচালিত করে?
বাস্তব-বিশ্বের বিভিন্ন রাজনৈতিক উদাহরণ সম্পর্কে এই তিনটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা এবং তাদের সম্ভাব্য উত্তরগুলো নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করা বা মস্তিষ্কে ঝড় তোলা – এটা একটা অভ্যাসে পরিণত হতে কিছুটা সময় লাগে। আপনি এই বইটি জুড়ে সেই অনুশীলন করার প্রচুর সুযোগ পাবেন। এই মুহুর্তে, যদিও, আপনি ইতিমধ্যেই হয়তো দেখতে পাচ্ছেন কীভাবে এই প্রশ্নগুলো এমনকি সবচেয়ে অগোছালো, জটপাকানো রাজনৈতিক পরিস্থিতিকেও ভেদ করতে এবং তাকে কিছুটা হলেও সহজবোধ্য করে তুলতে সাহায্য করে। এমনকি যখন মানুষের রাজনৈতিক পছন্দগুলো প্রথম নজরে একেবারেই বোঝা কঠিন বা অযৌক্তিক বলে মনে হয় – ধরা যাক, ১৯৩০-এর দশকে জার্মানিতে কিছু মানুষের নাৎসিদের সাথে যোগ দেওয়া, আজকের দিনে পাকিস্তানে কোনো তরুণের আত্মঘাতী বোমারু হওয়া, বা (আমাদের আরও কাছের উদাহরণ যদি নিই) যখন স্বাস্থ্য বীমা না থাকা কিছু দরিদ্র মানুষ সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচির বিরোধিতা করে – এই তিনটি প্রশ্ন আপনাকে তাদের এই আপাত অদ্ভুত বা আত্মঘাতী কর্মের পেছনে কী কারণ থাকতে পারে, তা কল্পনা করার বা বোঝার একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সূচনা বিন্দু বা ক্লু ধরিয়ে দেয়।
টেবিল: বিকল্প ব্যাখ্যামূলক পদ্ধতির সংক্ষিপ্তসার
ব্যাখ্যামূলক পদ্ধতি (Explanatory Approach) | মূল হাইপোথিসিস (Core Hypothesis) | রাজনীতি কেন বিভিন্ন স্থান ও সময়ে ভিন্ন? (Why is politics different in different places and times?) | উদাহরণ: কেন একজন মার্কিন নাগরিক ডেমোক্র্যাটদের পরিবর্তে রিপাবলিকান পার্টিকে ভোট দেয়? (Why does a U.S. citizen vote for the Republican Party instead of the Democrats?) | এই ব্যক্তি কেন কখনও তার ভোটের ধরণ পরিবর্তন করবে? (Why would this person ever change how he or she votes?) |
যৌক্তিক-বস্তুনিষ্ঠ (Rationalist-Materialist) | মানুষ বস্তুগত ভূখণ্ডে তাদের অবস্থান বিবেচনা করে সবচেয়ে সুবিধাজনক পদক্ষেপ বেছে নেয়। | সকল মানুষ যুক্তিসঙ্গত এবং একই রকম, কিন্তু তাদের বস্তুগত পরিবেশ ভিন্ন হয়। | রিপাবলিকান পার্টির নীতিগুলি তাকে ডেমোক্র্যাটিক নীতিগুলির চেয়ে বেশি বাস্তব সুবিধা এনে দেয়। | রিপাবলিকান বা ডেমোক্র্যাটরা এই ব্যক্তিকে প্রভাবিত করে এমন নীতি পরিবর্তন করে, অথবা ব্যক্তি তার নিজের অবস্থান পরিবর্তন করে (নতুন জায়গায় চলে যাওয়া, আরও ধনী হওয়া, ইত্যাদি)। |
প্রাতিষ্ঠানিক (Institutionalist) | মানুষ সংগঠন এবং নিয়মের একটি বাধা কোর্সে তাদের অবস্থান বিবেচনা করে সবচেয়ে সুবিধাজনক পদক্ষেপ বেছে নেয়। | সকল মানুষ যুক্তিসঙ্গত এবং একই রকম, কিন্তু তাদের চারপাশের সংগঠন এবং নিয়মগুলি ভিন্ন হয়। | এই ব্যক্তির কমিউনিটিতে রিপাবলিকানরা আরও ভালোভাবে সংগঠিত এবং স্থানীয় সংস্থাগুলিতে মিডিয়া এবং সুযোগগুলির উপর আধিপত্য বিস্তার করে। | ডেমোক্র্যাটরা এই ব্যক্তির কমিউনিটিতে তাদের সংগঠন শক্তিশালী করে, আরও ভালো মিডিয়া অ্যাক্সেস পায় এবং সম্ভবত তাকে নতুন সামাজিক বা কর্মজীবনের সুযোগ দেয়। |
ভাবাদর্শগত (Ideational) | মানুষ বিশ্ব কীভাবে কাজ করে এবং কী সঠিক সে সম্পর্কে বিশ্বাস অনুসারে কাজ করে। | মানুষের বিশ্ব কীভাবে কাজ করে এবং কী সঠিক সে সম্পর্কে বিভিন্ন বিশ্বাস রয়েছে। | এই ব্যক্তি এমন পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে বড় হয়েছে যারা তাকে শিখিয়েছে যে রিপাবলিকান মূল্যবোধগুলি ভালো। | এই ব্যক্তি নতুন বন্ধু বা ধারণার সংস্পর্শে আসে, অথবা একজন গতিশীল নতুন নেতা ডেমোক্র্যাটদের তার কাছে আকর্ষণীয় করে তোলে। |
মনস্তাত্ত্বিক (Psychological) (ব্যক্তিগত পছন্দের ব্যাখ্যা করার সময় একটি চতুর্থ বিকল্প) | মানুষের নির্দিষ্ট জিনগত, হার্ড-ওয়্যার্ড ব্যক্তিত্ব এবং স্বভাব রয়েছে। | মানুষের ব্যক্তিত্ব ভিন্ন হয়: অন্যদের প্রতি বেশি বা কম সহানুভূতি থাকা, শক্তিশালী কর্তৃত্ব পছন্দ করা বা না করা ইত্যাদি। | এই ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব তাকে কঠোর আইন-শৃঙ্খলা এবং “স্ব-নির্মিত মানুষ” – ক্লাসিক রিপাবলিকান থিমগুলির পক্ষে ঝুঁকতে বাধ্য করে। | পরিবর্তন অসম্ভব না হলেও কঠিন, তবে বয়স বা বিকশিত মানসিক স্বাস্থ্য—অথবা মাথায় আঘাত লাগা—তার হার্ড-ওয়্যার্ড স্বভাব পরিবর্তন করতে পারে। |
এই প্রশ্নগুলি আপনার চারপাশের যেকোনো রাজনৈতিক পরিস্থিতি, স্থানীয় রাজনীতি থেকে শুরু করে বৈশ্বিক স্তরে সংঘাত ও সহযোগিতা পর্যন্ত ভেঙে দেয়। ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ, এই তিনটি প্রশ্ন আপনাকে শোনা যেকোনো একটি দৃষ্টিভঙ্গির বিকল্প বিবেচনা করতে উৎসাহিত করে। যদি কেউ অভিযোগ করে যে প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকানদের নিছক পাগলামির কারণে সরকার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, আপনি বলতে পারেন, “এক মিনিট অপেক্ষা করুন: এটা স্পষ্ট নয়। রিপাবলিকান এবং ওবামা যে গোষ্ঠীগুলির প্রতিনিধিত্ব করছিলেন তাদের বস্তুগত স্বার্থ, বা মার্কিন রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মকানুন যা অন্য মতাদর্শগত দৃষ্টিভঙ্গি থাকা সত্ত্বেও একটি অচলাবস্থা সৃষ্টি করতে পারত, সে সম্পর্কে কী?” এবং এর বিপরীত: আপনি যে গল্পই শুনুন না কেন, অন্যান্য প্রশ্নগুলি এর অনুপস্থিত দিকগুলি সম্পর্কে সমালোচনামূলকভাবে চিন্তা করার পরামর্শ দেয়।
এই আলোচনা আমাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধির দিকে নিয়ে যায়। রাজনীতি কোনো হাওয়ায় ভেসে আসা বস্তু নয়, কিংবা এটা এমন কোনো দৈত্যও নয় যে সুযোগ পেলেই আমাদের ঘাড়ে চেপে বসে। বরং, রাজনীতি হলো আমাদের সম্মিলিত জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, যেখানে আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে আছি। একে এড়িয়ে যাওয়া মানে বাস্তবতাকে অস্বীকার করা, আর সমস্যার সমাধান থেকে আরও দূরে সরে যাওয়া। (Putnam, 2000)
বরং, রাজনীতির বিভিন্ন দিক এবং এর পেছনের চালিকাশক্তিগুলো বুঝতে পারলে আমরা আরও সচেতন নাগরিক হয়ে উঠতে পারি। আমরা বুঝতে পারি কেন নির্দিষ্ট ঘটনা ঘটছে, কেন নেতারা নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, এবং সাধারণ মানুষই বা কেন সেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। এই বোঝাপড়া আমাদের শুধু ভালো পর্যবেক্ষকই বানায় না, বরং ক্ষেত্রবিশেষে কার্যকর অংশগ্রহণকারী হিসেবেও গড়ে তুলতে পারে। আর গণতন্ত্রের আসল সৌন্দর্য তো এখানেই, যেখানে সাধারণ মানুষ শুধু নীরব দর্শক নয়, বরং ইতিহাসের সক্রিয় নির্মাতা।
তাই, পরেরবার যখন রাজনীতির কোনো জটিল বিষয় আপনার সামনে আসবে, হতাশ না হয়ে বরং এই তিনটি চশমা – যৌক্তিক-বস্তুনিষ্ঠ, প্রাতিষ্ঠানিক, এবং ভাবাদর্শগত – পরে দেখার চেষ্টা করুন। দেখবেন, অনেক জট এমনিতেই খুলে যাচ্ছে, আর আপনিও शायद রাজনীতির প্রতি একটু হলেও আগ্রহী হয়ে উঠছেন! কে জানে, এই আগ্রহই হয়তো একদিন আপনাকে বা আপনার চারপাশের মানুষকে আরও ভালো কোনো সমাধানের দিকে নিয়ে যাবে। আর সেটাই তো দিনশেষে আমাদের সবার চাওয়া, তাই না?
তথ্যসূত্র
লেখাটি ক্রেইগ পারসন্স (Craig Parsons) এর ইন্ট্রোডাকশন টু পলিটিকাল সায়েন্স (Introduction to political science) এর প্রথম অধ্যায় একটা অংশের ভিত্তিতে করা।
বইটিতে থাকা তথ্যসূত্র
- 1. Steve Peoples, “Romney to Obama: Stop Playing Politics with Bin Laden Killing,” Christian Science Monitor, May 1, 2012.
- 2. “Beck Says He Wanted to Reclaim Civil Rights ‘from Politics,’ ” cnn.com, August 29, 2010.
- 3. Philip Rucker, “Republicans ‘Trying to Mess with Me,’ Obama Tells Crowd at Missouri Auto Plant,” Washington Post, September 20, 2013.
- 4. “Local Reaction to Government Shutdown,” Reno-Gazette Journal, www.rgj.com, posted October 1, 2013, consulted December 22, 2014.
- 5. U.S. Dept. of Commerce, Bureau of the Census, Historical Statistics of the United States.
- 6. The line is often attributed to the Greek leader Pericles, but no Greek source contains this phrasing. It is close in spirit to parts of Pericles’s Funeral Oration as reported by Thucydides, The History of the Peloponnesian War, Trans. Thomas Hobbes (Chicago: University of Chicago Press, 1989), pp. 108–115.
- 7. See the Heritage Foundation’s “Index of Economic Freedom” at http://www.heritage.org/Index/.
- 8. Freedom House’s annual rankings of “Freedom in the World” are available at http://www.freedomhouse.org/.
- 9. In 2012, one-fourth of refugees around the world came from Afghanistan. See the annual report of the United Nations High Commissioner for Refugees, www.unhcr.org.
- 10. Annie Lowrey and Michael Shear, “Shutdown to Cost U.S. Billions, Analysts Say, While Eroding Confidence,” New York Times, October 18, 2013.
- 11. CNN exit polls, http://www.cnn.com/election/2012/results/race/president.
- 12. Dylan Matthews, “The Shutdown Is the Constitution’s Fault,” Washington Post wonkblog, http://www.washingtonpost.com/blogs/wonkblog/, posted October 2, 2013.
- 13. Meredith Bagby, “Government Shutdown Is a Culture War, Not a Deficit Battle,” Huffingpost.com, posted October 5, 2013.
- 11. Carol Pateman, The Sexual Contract (Stanford, CA: Stanford University Press, 1988). (Note: This reference appears twice with the number 11. I’ve kept it as provided.)
- 12. Charles W. Mills, The Racial Contract (Ithaca, NY: Cornell University Press, 1997). (Note: This reference appears twice with the number 12. I’ve kept it as provided.)
- 14. We might also call this “ideological explanation,” but that can generate confusion, since it makes it sound like the explanation itself is driven by a political ideology. I do not have to be a conservative (or a liberal) to argue that conservatives are motivated by certain beliefs. Here, we are talking about a scientific statement that ideologies shape political action, so the more “science-y”-sounding “ideational explanation” works better.
- 15. As suggested, for example, by John Alford, Carolyn Funk, and John Hibbing, “Are Political Orientations Genetically Transmitted?,” American Political Science Review 99, no. 2 (May 2005), pp. 153–167.
অন্যান্য তথ্যসূত্র
- Almond, G. A., Powell, G. B., Strøm, K., & Dalton, R. J. (2004). Comparative Politics Today: A World View. Pearson Longman.
- Easton, D. (1953). The Political System: An Inquiry into the State of Political Science. Alfred A. Knopf.
- Geertz, C. (1973). The Interpretation of Cultures. Basic Books.
- Hall, P. A., & Taylor, R. C. (1996). Political Science and the Three New Institutionalisms. Political Studies, 44(5), 936–957.
- Hartz, L. (1955). The Liberal Tradition in America. Harcourt, Brace & World.
- Heywood, A. (2019). Politics (5th ed.). Red Globe Press.
- Kahneman, D., & Tversky, A. (1979). Prospect Theory: An Analysis of Decision under Risk. Econometrica, 47(2), 263–291.
- Keohane, R. O., & Nye, J. S. (1977). Power and Interdependence: World Politics in Transition. Little, Brown.
- King, G., Keohane, R. O., & Verba, S. (1994). Designing Social Inquiry: Scientific Inference in Qualitative Research. Princeton University Press.
- Lasswell, H. D. (1936). Politics: Who Gets What, When, How. McGraw-Hill.
- Madison, J., Hamilton, A., & Jay, J. (1788). The Federalist Papers. (Numerous editions available, e.g., Signet Classics, 2003).
- March, J. G., & Olsen, J. P. (1984). The New Institutionalism: Organizational Factors in Political Life. American Political Science Review, 78(3), 734–749.
- Marx, K., & Engels, F. (1848). The Communist Manifesto. (Numerous editions available, e.g., Penguin Classics, 2002).
- North, D. C. (1990). Institutions, Institutional Change and Economic Performance. Cambridge University Press
Leave a Reply