Table of Contents
ভূমিকা
বাংলাদেশে আস্তে আস্তে অন্তত লিবারালদের মধ্যে সুফিবাদ, বাউল এর মত মরমিবাদী চর্চার এপ্রিসিয়েশন বাড়ছে। কাল শিল্পকলায় গিয়েছিলাম সাধনার নৃত্যনাট্য দিলনাওয়াজ দেখতে। সুফিবাদ-কেন্দ্রিক নৃত্যনাট্য। যাই হোক, যেটা বলছিলাম। অ্যাকাডেমিকালি সুফিবাদ, বাউলের মত ব্যাপারগুলো মিস্টিসিজম বা মরমীবাদী আলোচনায় চর্চিত হয়। আর এখানেই চলে আসে উইলিয়াম জেমসের নাম। মরমীবাদের বাঁধাধরা সংজ্ঞা দেয়া কঠিন। তবে পণ্ডিতগণ সংজ্ঞা দেয়ার চেষ্টা ঠিকই করেন। তাদের সংজ্ঞায়, মরমিবাদ হলো এমন এক আধ্যাত্মিক উপলব্ধি বা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা (spiritual realization or direct experience) যার মাধ্যমে ব্যক্তি অনুভব করেন যে তিনি এক পরম সত্তা (Ultimate Reality), দিব্যসত্তা (Divine) বা চূড়ান্ত সত্যের (Ultimate Truth) সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিলিত হয়েছেন, তার অংশ হয়ে গিয়েছেন, অথবা তার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন। এই অভিজ্ঞতা সাধারণ জ্ঞানবুদ্ধির নাগালের বাইরের জিনিস (transcends ordinary intellect)। এর কোনো ভাষা নেই যা দিয়ে একে পুরোপুরি প্রকাশ করা যায়, আছে কেবল এক তীব্র, গভীর অনুভূতি। এই অনুভূতির কাছে পৃথিবীর সব ঐশ্বর্য, সব ক্ষমতা তুচ্ছ মনে হয়। কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন, আমার মত বস্তুবাদী মানুষের এই সব জিনিস নিয়ে কাজ কী। কথা হলো মরমীবাদ জিনিসটার বস্তুগত ভিত্তি না থাকলে মরমী অভিজ্ঞতার আছে, আর এই মরমী অভিজ্ঞতাটা ঘটে আমাদের মস্তিষ্কেই। মস্তিষ্ক-ভিত্তিক এই মরমী অভিজ্ঞতা লাভের জন্য যুগে যুগে মানুষেরা কত সাধনা করে আসছে, মানুষের ধর্মচিন্তা এর দ্বারা কত প্রভাবিত হচ্ছে। তাই অ্যান্থ্রোপলজি, সাইকোলজি, থিওলজি, এমনকি ফিলোসফির আলোচনাতেও এর গুরুত্ব অনেক। আর বিশেষ করে আমাদের দেশে সুফি, বাউল – দু’রকম মিস্টিক ট্রেডিশনই যখন ভীষণভাবে নিপীড়নের শিকার, তখন তো কেবল এদের চিন্তাধারার আন্ডারস্ট্যান্ডিং-টার জন্যও এসব নিয়ে আলোচনা করতেই হয়।
যাই হোক, ভৌগোলিক সীমা, সাংস্কৃতিক ভিন্নতা এবং ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে মরমীবাদীরা এমন এক অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন, যা সাধারণ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ ও যুক্তিনির্ভর জ্ঞানের পরিধির বাইরে। এই অভিজ্ঞতাই মরমি অভিজ্ঞতা, যা জীবনের গভীরতম রহস্য উন্মোচন করে এবং ব্যক্তির সত্তার আমূল পরিবর্তন ঘটায়। মরমিবাদ কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম বা মতাদর্শের একচেটিয়া সম্পত্তি নয়; এটি এক সর্বজনীন মানবীয় প্রবণতা। পৃথিবীর সকল প্রান্তের সংস্কৃতিতেই এর সন্ধান মেলে – প্রাচ্যের বেদান্ত, বৌদ্ধধর্ম, তাওবাদ, সুফিবাদ থেকে শুরু করে পাশ্চাত্যের খ্রিস্টীয় মরমিবাদ, ইহুদি কাব্বালা, এমনকি আদিবাসী শামানিক ঐতিহ্য পর্যন্ত এর বিস্তৃতি। মরমিবাদ নিয়ে যারা গভীর অনুসন্ধানে ব্রতী হয়েছেন, তাদের মধ্যে আমেরিকান দার্শনিক ও মনোবিজ্ঞানী উইলিয়াম জেমস (William James) এক অবিস্মরণীয় নাম। তার যুগান্তকারী গ্রন্থ “দ্য ভ্যারাইটিজ অফ রিলিজিয়াস এক্সপেরিয়েন্স” (The Varieties of Religious Experience, 1902) মরমি অভিজ্ঞতাকে অ্যাকাডেমিক আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসে। এই গ্রন্থে তিনি মরমি অভিজ্ঞতার চারটি প্রধান বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন: অবর্ণনীয়তা, জ্ঞানমূলক গুণ, ক্ষণস্থায়িত্ব এবং নিষ্ক্রীয়তা। জেমসের এই বিশ্লেষণ পরবর্তীকালের গবেষক, ধর্মতত্ত্ববিদ ও মনোবিজ্ঞানীদের জন্য এক আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করেছে। এই চারটি মূল স্তম্ভের পাশাপাশি আরও কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা প্রায় সকল মরমি ঐতিহ্যেই পরিদৃষ্ট হয়, যেমন – পরমসত্তার সঙ্গে একাত্মতা, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, অভ্যন্তরীণ পথ, প্রেম এবং অদ্বৈতবাদ।
১. অবর্ণনীয়তা (Ineffability): যখন ভাষা নির্বাক হয়
মরমি অভিজ্ঞতার প্রথম এবং সম্ভবত সর্বাধিক স্বীকৃত বৈশিষ্ট্য হলো এর অবর্ণনীয়তা। যিনি এই অলৌকিক অভিজ্ঞতা লাভ করেন, তিনি এক গভীর সংকটের সম্মুখীন হন – কীভাবে এই অনুভূতির গভীরতা, এর মাধুর্য বা এর স্বরূপ অন্যদের কাছে ভাষায় প্রকাশ করবেন? তার শব্দভাণ্ডার, তার ভাষার সকল কারুকার্য সেই অভিজ্ঞতার বিশালত্বের সামনে তুচ্ছ ও অপ্রতুল মনে হয়। মরমিরা প্রায়শই বলেন, সেই অভিজ্ঞতা বাক্যের অতীত (beyond words), মনের অতীত (beyond mind), ধারণার অতীত (beyond concepts)।
ভাষা মূলত আমাদের সাধারণ, দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎকে বর্ণনা করার জন্য তৈরি হয়েছে। আমরা যা দেখি, শুনি, স্পর্শ করি, স্বাদ নিই বা গন্ধ পাই, সেগুলোকে শব্দে বাঁধি। কিন্তু মরমি অভিজ্ঞতা এই পঞ্চেন্দ্রিয়ের জগৎকে অতিক্রম করে যায়। এটি এক অতীন্দ্রিয় (transcendental) অনুভূতি, যা আমাদের পরিচিত বাস্তবতার কাঠামো ভেঙে দেয়। যেমন, একজন জন্মান্ধ ব্যক্তিকে লাল রঙ কেমন, তা বোঝানো যেমন অসম্ভব, ঠিক তেমনি মরমি অভিজ্ঞতা যিনি লাভ করেননি, তাকে এর স্বরূপ বোঝানো প্রায় অসম্ভব। উইলিয়াম জেমস নিজেই বলেছেন, “The subject of it immediately says that it defies expression, that no adequate report of its contents can be given in words.”
এই অবর্ণনীয়তার কারণে মরমিরা প্রায়শই নীরবতা বেছে নেন অথবা তাদের অভিজ্ঞতা প্রকাশের জন্য রূপক, উপমা, প্রতীক, কবিতা বা সঙ্গীতের আশ্রয় নেন। এই শৈল্পিক অভিব্যক্তিগুলো সরাসরি অভিজ্ঞতাকে বর্ণনা করতে না পারলেও, তার দিকে ইঙ্গিত করতে পারে, শ্রোতা বা পাঠকের মনে সেই অভিজ্ঞতার জন্য একটি আকাঙ্ক্ষা বা অনুরণন সৃষ্টি করতে পারে। বৌদ্ধধর্মে ‘শূন্যতা’ বা ‘নির্বাণ’ ধারণাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অসংখ্য রূপক ব্যবহার করা হয়েছে। সুফি কবি জালালউদ্দিন রুমি তার কবিতায় প্রেমের রূপকে সেই পরম অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন, কিন্তু তিনিও স্বীকার করেছেন যে তার কথা সেই অভিজ্ঞতার তুলনায় সামান্যই। লালন সাঁই যখন গান, “সহজ মানুষ ভজে দেখ না রে মন দিব্যজ্ঞানে, পাবি রে অমূল্য নিধি বর্তমানে,” তখন সেই ‘অমূল্য নিধি’ যে কী, তা ভজন না করলে, সেই পথে না চললে সম্পূর্ণ বোঝা অসম্ভব। এই ‘অমূল্য নিধি’র স্বরূপ ভাষার জালে ধরা দেয় না।
পাশ্চাত্যের মরমি সাধক মেইস্টার একহার্ট (Meister Eckhart) ঈশ্বরের প্রকৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে নেতিবাচক ভাষা (via negativa) ব্যবহার করেছেন – ঈশ্বর কী নন, তা বলার চেষ্টা করেছেন, কারণ ঈশ্বর কী হন, তা বলা ভাষার পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি বলতেন, ঈশ্বর কোনো ‘বস্তু’ নন, কোনো ‘ধারণা’ নন, তিনি সকল বর্ণনার অতীত। সেন্ট জন অফ দ্য ক্রস (St. John of the Cross) তার “ডার্ক নাইট অফ দ্য সোল” (Dark Night of the Soul) কবিতায় রূপকের মাধ্যমে আত্মার সেই আরোহণের কথা বলেছেন, যেখানে ভাষা পৌঁছাতে পারে না।
সুতরাং, অবর্ণনীয়তা মরমি অভিজ্ঞতার এক মৌলিক দিক, যা আমাদের ভাষার সীমাবদ্ধতা এবং অভিজ্ঞতার গভীরতার প্রতি নির্দেশ করে। এটি এক ধরনের চ্যালেঞ্জও বটে – কীভাবে এই অমূল্য অভিজ্ঞতাকে, অন্তত তার আভাসটুকু, অন্যদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়, যাতে তারাও সেই পথের পথিক হতে অনুপ্রাণিত হয়।
২. জ্ঞানমূলক গুণ (Noetic Quality): অনুভবের গভীরে প্রজ্ঞার উন্মোচন
মরমি অভিজ্ঞতা নিছক একটি তীব্র আবেগ বা অনুভূতিসর্বস্ব ব্যাপার নয়, যদিও আবেগ এর একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এটি এক বিশেষ ধরনের জ্ঞান বা অন্তর্দৃষ্টি (insight) দান করে। এই জ্ঞান সাধারণ যুক্তিতর্ক, বইপড়া বিদ্যা বা ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। মরমি সাধক এই অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এমন কিছু বিষয় উপলব্ধি করেন, যা তার কাছে অত্যন্ত বাস্তব, প্রত্যক্ষ, নিঃসংশয় এবং গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। এই জ্ঞান তার জীবনদর্শন, জগৎবীক্ষা এবং মূল্যবোধকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে, এমনকি আমূল পরিবর্তনও করতে পারে।
উইলিয়াম জেমস এই বৈশিষ্ট্যটিকে “Noetic Quality” হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ‘নোয়েটিক’ শব্দটি গ্রিক ‘নোউস’ (nous) থেকে এসেছে, যার অর্থ মন বা বুদ্ধির থেকেও গভীর কোনো জ্ঞানীয় ক্ষমতা। মরমি অভিজ্ঞতাজাত এই জ্ঞান কোনো অনুমান বা তাত্ত্বিক ধারণা নয়, বরং এটি প্রত্যক্ষ বোধ বা অপরোক্ষানুভূতি। সাধকের মনে হয় যেন এতদিন ধরে যে মহাসত্যের সন্ধান তিনি করছিলেন, যা ছিল ধোঁয়াশায় ঢাকা, তা অকস্মাৎ তার সামনে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এই জ্ঞান তার কাছে এতটাই শক্তিশালী ও প্রত্যয়জনক যে, অভিজ্ঞতার ঘোর কেটে যাওয়ার পরেও সেই জ্ঞানের সত্যতা নিয়ে তার মনে কোনো সংশয় থাকে না।
এই জ্ঞান জগৎ ও জীবন সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। এটি ব্যক্তিকে ক্ষুদ্র ‘আমি’র গণ্ডি থেকে বের করে এনে এক বৃহত্তর বাস্তবতার সঙ্গে সংযুক্ত করে। এই জ্ঞান অনেকটা বিদ্যুতের ঝলকের মতো হঠাৎ করেই আসতে পারে, কিন্তু তার আলোয় সাধকের বাকি জীবন উদ্ভাসিত হয়ে থাকে। যেমন, বুদ্ধের বোধিলাভ কোনো সাধারণ জ্ঞানার্জন ছিল না; এটি ছিল দুঃখের কারণ এবং দুঃখ নিবারণের পথের এক গভীর, প্রত্যক্ষ ও রূপান্তরকারী উপলব্ধি। রমণ মহর্ষির আত্ম-উপলব্ধিও ছিল এমনই এক নোয়েটিক অভিজ্ঞতা, যা তার জীবনকে সম্পূর্ণ নতুন খাতে প্রবাহিত করেছিল।
এই জ্ঞান অনুভবের গভীরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উন্মোচিত হয়। প্লেটো যেমন গুহার উপমার (Allegory of the Cave) মাধ্যমে দেখিয়েছেন, সাধারণ মানুষ গুহার দেওয়ালে ছায়া দেখে তাকেই বাস্তব মনে করে, কিন্তু যিনি গুহার বাইরে গিয়ে প্রকৃত সূর্যের আলোয় জগৎ দেখেছেন, তার জ্ঞান ছায়া দেখা মানুষদের থেকে গুণগতভাবে ভিন্ন। মরমি অভিজ্ঞতাও অনেকটা সেই গুহার বাইরে যাওয়ার মতো, যা এক নতুন বাস্তবতার দুয়ার খুলে দেয়।
সুফিরা এই জ্ঞানকে ‘মারিফত’ বলেন, যা শরিয়ত (আইন) ও তরিকত (পথ) অতিক্রম করে পাওয়া যায়। বেদান্তে একে ‘ব্রহ্মজ্ঞান’ বা ‘আত্মজ্ঞান’ বলা হয়, যা ‘অবিদ্যা’ বা অজ্ঞানতা দূর করে। এই জ্ঞান লাভের পর সাধকের কাছে জগতের রহস্য উন্মোচিত হয়, জীবন ও মৃত্যুর অর্থ স্পষ্ট হয় এবং তিনি এক গভীর শান্তি ও নির্ভয়তা লাভ করেন। এই জ্ঞানই মরমিকে জীবনের প্রতি এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দান করে, যেখানে ক্ষুদ্রতা ও তুচ্ছতার ঊর্ধ্বে এক মহৎ উদ্দেশ্য ও অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়।
৩. ক্ষণস্থায়িত্ব (Transiency): মুহূর্তের মাঝে অনন্তের আস্বাদন
আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, মরমি অভিজ্ঞতা তার তীব্রতা, গভীরতা এবং জীবন-পরিবর্তনকারী প্রভাব সত্ত্বেও সাধারণত বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। এর ব্যাপ্তিকাল কয়েক সেকেন্ড থেকে শুরু করে কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত হতে পারে, তবে কদাচিৎ এর চেয়ে বেশি দীর্ঘ হয়। উইলিয়াম জেমস একে “Transiency” বা ক্ষণস্থায়িত্ব হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু এই ক্ষণস্থায়ী অভিজ্ঞতার প্রভাব হয় সুদূরপ্রসারী এবং দীর্ঘস্থায়ী।
মরমি অবস্থা যখন আসে, তখন তা প্রবল বন্যার মতো ব্যক্তিকে আপ্লুত করে, কিন্তু সেই বন্যা যেমন একসময় নেমে যায়, তেমনি এই তীব্র অনুভূতিও ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। তবে, জল নেমে যাওয়ার পর যেমন পলিমাটি ভূমির উর্বরতা বাড়িয়ে দেয়, তেমনি এই অভিজ্ঞতাও সাধকের চিত্তভূমিতে স্থায়ী ছাপ রেখে যায়। সেই সামান্য সময়ের স্মৃতি, সেই অনুভূতির রেশ, সেই গভীর উপলব্ধির আলো তার বাকি জীবনকে প্রভাবিত করে, তার চিন্তা-ভাবনা, তার কাজকর্ম, তার জীবনদর্শন – সবকিছুকেই নতুন খাতে বইয়ে দেয়।
এই ক্ষণস্থায়িত্বের কারণ কী, তা নিয়ে নানা মত রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, মানব শরীর ও মন এই ধরনের তীব্র ও উচ্চ মার্গের অভিজ্ঞতা বেশিক্ষণ ধারণ করতে সক্ষম নয়। এটি এতটাই অপ্রাকৃত ও শক্তিশালী যে, সাধারণ চেতনার স্তরে ফিরে আসা অনিবার্য হয়ে পড়ে। আবার অনেকে বলেন, এটি পরম সত্তার এক ঝলক মাত্র, যা সাধককে আরও গভীরতর অনুসন্ধানে প্রথিত করার জন্য যথেষ্ট।
অনেকটা যেন স্বপ্নে দেখা কোনো অপরূপ দেশের দৃশ্য, ঘুম ভাঙার পরেও যার ঘোর কাটতে চায় না, মন সেই সৌন্দর্যের জন্য আকুল হয়ে থাকে। মরমি অভিজ্ঞতার পরেও সাধক সেই পরম অনুভূতির জন্য ব্যাকুল হন, সেই স্তরে পুনরায় আরোহণ করার জন্য সাধনা চালিয়ে যান। এই পুনরাবৃত্ত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে ধীরে ধীরে সেই উচ্চতর চেতনা তার সত্তার সঙ্গে আরও বেশি অঙ্গীভূত হতে থাকে।
খ্রিস্টান মরমি সাধিকা টেরেসা অফ আভিলা (Teresa of Ávila) তার আত্মজীবনীতে বিভিন্ন ধরনের মরমি অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন, যার মধ্যে কিছু ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত, আবার কিছু ছিল দীর্ঘতর। কিন্তু প্রতিটি অভিজ্ঞতাই তার আধ্যাত্মিক জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে এবং ঈশ্বরের প্রতি তার অনুরাগ বৃদ্ধি করেছে। সুফি ঐতিহ্যেও ‘হাল’ (আধ্যাত্মিক অবস্থা) এবং ‘মাকাম’ (আধ্যাত্মিক স্তর) এর ধারণা রয়েছে। ‘হাল’ হলো ক্ষণস্থায়ী আধ্যাত্মিক অনুভূতি, যা আল্লাহর তরফ থেকে আসে, আর ‘মাকাম’ হলো সাধনার মাধ্যমে অর্জিত স্থায়ী আধ্যাত্মিক স্তর।
এই ক্ষণস্থায়িত্ব সত্ত্বেও, মরমি অভিজ্ঞতা নিছক একটি মনোবৈজ্ঞানিক ঘটনা নয়। এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ব্যক্তির আচরণ, নৈতিকতা এবং জীবনবোধে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। সাধক আরও বেশি প্রেমময়, সহনশীল, সমর্পিত এবং জগতের প্রতি দায়বদ্ধ হয়ে ওঠেন। সেই সংক্ষিপ্ত মুহূর্তের আলো তার সমগ্র জীবনকে আলোকিত করে রাখে, তাকে পথ দেখায় এবং জীবনের সকল ঘাত-প্রতিঘাতে অবিচল থাকতে সাহায্য করে।
৪. নিষ্ক্রীয়তা (Passivity): যখন ‘আমি’ বিলীন হয় পরম ইচ্ছার স্রোতে
মরমি অভিজ্ঞতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো নিষ্ক্রিয়তা বা Passivity। অভিজ্ঞতাটি যখন ঘটে, তখন সাধক নিজেকে অনেকক্ষেত্রেই অসহায় বা নিষ্ক্রিয় বোধ করতে পারেন। তার মনে হতে পারে যেন তিনি নিজের ইচ্ছায় এই অবস্থায় উপনীত হননি, বরং অন্য কোনো অসীম, অপ্রতিরোধ্য শক্তি তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে বা তার ওপর ভর করেছে, তাকে যেন এক আনন্দময় স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি যেন এই অভিজ্ঞতার একজন দর্শক বা গ্রাহক, কর্তা নন।
উইলিয়াম জেমস এই প্রসঙ্গে বলেছেন, “Although the oncoming of mystical states may be facilitated by preliminary voluntary operations, as by fixing the attention, or going through certain bodily performances, or in other ways which manuals of mysticism prescribe; yet when the characteristic sort of consciousness once has set in, the mystic feels as if his own will were in abeyance, and indeed sometimes as if he were grasped and held by a superior power.”
এই নিষ্ক্রিয়তার অনুভূতি সাধকের ‘আমি’ বা অহং (ego) বিলুপ্ত বা স্থগিত হওয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত। মরমি অবস্থায় অহংকারের দেওয়াল ভেঙে পড়ে এবং ব্যক্তি নিজেকে এক বৃহত্তর সত্তা বা বৃহত্তর ইচ্ছার কাছে সম্পূর্ণরূপে সঁপে দেন। তার ক্ষুদ্র ‘আমি’-কেন্দ্রিক চেতনা বিলুপ্ত হয়ে এক সর্বব্যাপী চেতনার উন্মেষ ঘটে। তিনি অনুভব করেন যে, তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা নয়, বরং এক মহাজাগতিক বা ঐশ্বরিক ইচ্ছা তার মাধ্যমে ক্রিয়াশীল হচ্ছে।
অনেকটা যেন প্রবল স্রোতে ভাসা তৃণের মতো, যার নিজের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, স্রোতই তাকে চালিত করছে। তবে এই ভেসে যাওয়া ভয়ের নয়, বরং পরম আশ্রয় ও নির্ভয়তার। সাধক যেন এক পরম নিরাপদ ও প্রেমময় শক্তির হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্ত হন। এই অবস্থায় কোনো প্রচেষ্টা বা সংগ্রাম থাকে না, থাকে শুধু আত্মসমর্পণ এবং গ্রহণ করার আনন্দ।
খ্রিস্টীয় মরমিবাদে এই অবস্থাকে ঈশ্বরের কৃপা (Grace) হিসেবে দেখা হয়, যা মানুষের প্রচেষ্টার ফল নয়, বরং ঈশ্বরের দান। ভক্তিমূলক ঐতিহ্যগুলিতে, যেমন ভক্তিবাদ বা সুফিবাদ, ভক্ত ঈশ্বরের ইচ্ছার কাছে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সঁপে দেন। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস প্রায়শই সমাধিস্থ হতেন, এবং সেই সময় তার বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হত, তিনি যেন অন্য কোনো শক্তি দ্বারা চালিত হতেন। তিনি বলতেন, “আমি যন্ত্র, তিনি যন্ত্রী”।
এই নিষ্ক্রিয়তা কিন্তু জীবনের প্রতি উদাসীনতা বা কর্মবিমুখতা নয়। বরং, এই অভিজ্ঞতা লাভ করার পর সাধক নতুন শক্তি ও প্রেরণা নিয়ে জগতের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করেন। তার কর্ম তখন অহংতাড়িত না হয়ে নিঃস্বার্থ ও সেবামূলক হয়ে ওঠে। তিনি অনুভব করেন যে, তিনি নন, বরং সেই পরম শক্তিই তার মাধ্যমে কাজ করছে। এই উপলব্ধি তাকে ফলের আশা থেকে মুক্ত করে, নিষ্কাম কর্মে উদ্বুদ্ধ করে।
এই নিষ্ক্রিয়তার অভিজ্ঞতা মরমিকে শিক্ষা দেয় যে, জীবনের সবকিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা বৃথা। পরম সত্তার কাছে আত্মসমর্পণেই রয়েছে প্রকৃত মুক্তি ও শান্তি। এটি অহংকারের বিনাশ এবং বিনয়ের উন্মেষ ঘটায়, যা আধ্যাত্মিক অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য।
উইলিয়াম জেমসের নির্দেশিত এই চারটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছাড়াও, মরমিবাদের আরও কিছু সাধারণ দিক রয়েছে যা বিভিন্ন পণ্ডিত ও গবেষক চিহ্নিত করেছেন। এই দিকগুলো প্রায় সব মরমি ঐতিহ্যেই কমবেশি দেখা যায় এবং মরমি অভিজ্ঞতার প্রকৃতিকে আরও স্পষ্টভাবে বুঝতে সাহায্য করে।
৫. পরমসত্তার সঙ্গে একাত্মতা (Union with the Absolute): দ্বৈততার অবসান, অদ্বৈতের অনুভব
মরমিবাদের কেন্দ্রীয় আকাঙ্ক্ষা এবং সাধনার মূল লক্ষ্য হলো সেই পরমসত্তার সঙ্গে একাত্মতা বা মিলন। এই পরমসত্তা একেক ঐতিহ্যে একেক নামে পরিচিত – হিন্দুধর্মে তিনি ব্রহ্ম বা পরমাত্মা, ইসলামে আল্লাহ, খ্রিস্টধর্মে গড (God), ইহুদিধর্মে এন সোফ (Ein Sof), তাওবাদে তাও (Tao), বৌদ্ধধর্মে শূন্যতা (Void/Emptiness) বা নির্বাণ, অথবা কোনো কোনো ধারায় নিরাকার পরমচৈতন্য (Formless Absolute Consciousness)। নাম এবং রূপের এই বৈচিত্র্য সত্ত্বেও, মূল ধারণাটি একই – এক চূড়ান্ত, অসীম, শাশ্বত সত্তা, যা এই পরিবর্তনশীল জগতের মূল ভিত্তি এবং সকল অস্তিত্বের উৎস।
মরমি সাধক এই দ্বৈততার জগৎ – আমি-তুমি, স্রষ্টা-সৃষ্টি, জীব-জগৎ, ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ – এই সকল ভেদাভেদ ভুলে সেই পরম সত্তার সঙ্গে একাকার হয়ে যেতে চান, লীন হতে চান, ফানা হয়ে যেতে চান (সুফি পরিভাষায়)। এই মিলনই তাদের কাছে পরম প্রাপ্তি, চরম সত্যের সাক্ষাৎকার এবং অনন্ত শান্তি ও আনন্দের উৎস। এই একাত্মতার অভিজ্ঞতাকে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করা হয়েছে – কখনও তা মহাসমুদ্রে নদীর মিশে যাওয়ার মতো, কখনও অগ্নিকুণ্ডে লৌহখণ্ডের বিলীন হওয়ার মতো, যেখানে লৌহখণ্ড নিজেই অগ্নিময় হয়ে ওঠে।
বেদান্তের ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’ (আমিই ব্রহ্ম) বা ‘তত্ত্বমসি’ (তুমিই সেই) মহাবাক্যগুলো এই একাত্মতার কথাই ঘোষণা করে। সুফি সাধক মনসুর হাল্লাজ ‘আনাল হক’ (আমিই সত্য) ধ্বনি তুলে এই অভিজ্ঞতার চরম প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন, যার জন্য তাকে প্রচলিত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের রোষানলে পড়ে প্রাণ দিতে হয়েছিল। মেইস্টার একহার্ট বলেছেন, “The eye with which I see God is the same eye with which God sees me.” এই উক্তি স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে অভেদাত্মক সম্পর্কের দিকেই ইঙ্গিত করে।
এই একাত্মতার অনুভূতি অহংকারের সম্পূর্ণ বিলোপ সাধন করে। যতক্ষণ ‘আমি’ এবং ‘আমার’ বোধ থাকে, ততক্ষণ এই মিলন সম্ভব নয়। সাধনার মাধ্যমে যখন চিত্ত শুদ্ধ হয় এবং অহং দুর্বল হয়ে পড়ে, তখনই এই পরম মিলনের অভিজ্ঞতা লাভ হয়। এই অবস্থায় ব্যক্তি আর নিজেকে ক্ষুদ্র শরীর-মনের মধ্যে আবদ্ধ মনে করেন না, বরং সমগ্র অস্তিত্বের সঙ্গে একাত্ম বোধ করেন। এই একাত্মতার ফলে তার মধ্যে সর্বজনীন প্রেম ও করুণার উন্মেষ ঘটে।
তবে, এই ‘মিলন’ বা ‘একাত্মতা’র প্রকৃতি নিয়েও বিভিন্ন মরমি ধারায় সূক্ষ্ম পার্থক্য দেখা যায়। কিছু ধারায় (যেমন, অদ্বৈত বেদান্ত) এই মিলনকে সম্পূর্ণ অভেদাত্মক (identity) হিসেবে দেখা হয়, যেখানে জীব ও ব্রহ্মের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। আবার কিছু ধারায় (যেমন, বিশিষ্টাদ্বৈত বা ভক্তিবাদী ধারা) এই মিলনকে প্রেমময় সাহচর্য (communion) বা সান্নিধ্য হিসেবে দেখা হয়, যেখানে ভক্ত ও ভগবানের মধ্যে একটি সম্পর্কের মাধুর্য বজায় থাকে, যদিও উভয়ের মধ্যেকার ব্যবধান ঘুচে যায়। কিন্তু মূল সুর সর্বত্রই এক – দ্বৈততার বিভ্রম থেকে মুক্তি এবং এক পরম সত্তার সঙ্গে গভীর, অন্তরঙ্গ ও অবিচ্ছেদ্য সংযোগ স্থাপন।
৬. প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা (Direct Experience): শাস্ত্রের পরপারে, অনুভবের গভীরে
মরমিবাদের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো প্রত্যক্ষ, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ। মরমিরা শাস্ত্রবাক্য, ধর্মগ্রন্থ, আচার্য বা গুরুর মুখের কথার চেয়ে নিজের উপলব্ধি ও অনুভবের ওপর অনেক বেশি জোর দেন। তাদের কাছে সত্য হলো তাই, যা তিনি নিজে উপলব্ধি করেছেন, অনুভব করেছেন, যার স্বাদ তিনি নিজে গ্রহণ করেছেন। অন্য কারও মুখের কথা বা বইয়ের লেখা তাদের কাছে চূড়ান্ত প্রমাণ নয়, বরং তা পথের নির্দেশিকা মাত্র।
শাস্ত্র বা ধর্মগ্রন্থ হয়তো পথের মানচিত্রের মতো দিশা দিতে পারে, গুরু হয়তো সেই পথে চলার কৌশল শিখিয়ে দিতে পারেন, কিন্তু পথ চলতে হবে নিজেকেই, পথের কষ্ট ও আনন্দ অনুভব করতে হবে নিজেকেই এবং গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে নিজের অভিজ্ঞতার শক্তিতেই। মরমি সাধক অন্যের ধার করা জ্ঞানে সন্তুষ্ট থাকেন না, তিনি চান সত্যকে নিজে পরখ করে দেখতে। যেমন, জলের বর্ণনা শুনে তৃষ্ণা মেটে না, জল পান করেই তৃষ্ণা নিবারণ করতে হয়। তেমনি তাদের মতে, পরম সত্যের বর্ণনা শুনে বা পড়ে আধ্যাত্মিক ক্ষুধা মেটে না, তাকে প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করতে হয়।
এই কারণে অনেক মরমি সাধক প্রচলিত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যার জটিলতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের (institutional religion) বাহ্যিক আড়ম্বরের ঊর্ধ্বে উঠে তাদের নিজস্ব উপলব্ধির কথা বলেছেন। তারা মনে করেন, ধর্ম যদি জীবন্ত অভিজ্ঞতা না হয়, তবে তা নিছকই প্রাণহীন কাঠামোতে পরিণত হয়। বুদ্ধ প্রচলিত বৈদিক আচার-অনুষ্ঠান ও ব্রাহ্মণদের আধিপত্যের পরিবর্তে নিজের বোধিলব্ধ আর্যসত্যের ওপর জোর দিয়েছিলেন। যিশু ফরীসীদের শুষ্ক আইনানুগত্যের চেয়ে হৃদয়ের পবিত্রতা ও ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সুফিরা শরিয়তের আক্ষরিক ব্যাখ্যার চেয়ে মারিফতের (প্রত্যক্ষ জ্ঞান) গভীরতাকে মূল্য দিয়েছেন। বাংলার বাউল ফকিরেরা শাস্ত্রীয় জটিলতা ও জাতিভেদের ঊর্ধ্বে উঠে ‘মনের মানুষে’র সহজ সাধনার কথা বলেছেন।
এই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ওপর জোর দেওয়ার কারণে মরমিরা অনেক সময় প্রচলিত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছেন। তাদের স্বাধীন চিন্তা, অপ্রচলিত আচরণ এবং শাস্ত্রের নতুনতর ব্যাখ্যা অনেক সময় রক্ষণশীলদের কাছে ধর্মদ্রোহিতা বা বিদআত (heresy) বলে মনে হয়েছে। কিন্তু মরমিরা সত্যের প্রতি তাদের নিষ্ঠা থেকে বিচ্যুত হননি, কারণ তাদের কাছে তাদের ব্যক্তিগত উপলব্ধিই ছিল সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
এই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সাধককে এক ধরনের আত্মবিশ্বাস ও নির্ভীকতা দান করে। তিনি জানেন যে তিনি যা বলছেন, তা কোনো শোনা কথা বা পড়া কথা নয়, তা তার নিজের জীবনের গভীরতম সত্য। এই সত্যের আলোকেই তিনি জগৎকে দেখেন এবং জীবনকে পরিচালিত করেন। এই কারণেই মরমিদের বাণী যুগ যুগ ধরে মানুষকে অনুপ্রাণিত করে, কারণ তা প্রাণবন্ত অভিজ্ঞতা থেকে উৎসারিত।
৭. অভ্যন্তরীণ পথ (Inner Path): আত্মানুসন্ধানে পরম সত্যের সন্ধান
মরমিবাদীরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, সেই পরম সত্য, সেই পরমসত্তা বা ঈশ্বর বাইরে কোথাও মন্দিরে, মসজিদে, গির্জায় বা তীর্থস্থানে তালাবন্ধ হয়ে নেই। তা রয়েছে আমাদের ভেতরেই – আমাদের হৃদয়ের গভীরে, আমাদের চেতনার অন্তস্তলে। তাই তারা জাগতিক কোলাহল ও বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠান থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে অন্তর্মুখী সাধনার (inward journey) ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেন। তাদের মতে, আত্মাই পরমাত্মার মন্দির।
এই অভ্যন্তরীণ পথের যাত্রাই হলো মরমি সাধনার মূল ভিত্তি। উপনিষদে বলা হয়েছে, “যিনি আত্মাকে জেনেছেন, তিনি ব্রহ্মকে জেনেছেন।” বাইবেলে যিশু বলেছেন, “স্বর্গরাজ্য তোমাদের মধ্যেই আছে” (The kingdom of God is within you)। সুফি কবি রুমি বলেছেন, “আমি কাবায় গিয়েছিলাম, কিন্তু সেখানে তাকে (ঈশ্বরকে) পাইনি। আমি আমার হৃদয়ের দিকে তাকালাম, সেখানেই তাকে দেখলাম।” লালন সাঁই গেয়েছেন, “আমার ঘরের চাবি পরের হাতে,” – এই ঘর হলো নিজের দেহ, নিজের অন্তর, যেখানে পরম রত্ন লুক্কায়িত আছে, কিন্তু তার চাবি অর্থাৎ জ্ঞান আমরা হারিয়ে ফেলেছি।
এই ভেতরের জগতের দরজা খোলার জন্য বিভিন্ন মরমি ঐতিহ্যে নানা ধরনের পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে। ধ্যান (meditation), গভীর মননশীল প্রার্থনা (contemplative prayer), আত্মানুসন্ধান (self-inquiry), জপ (mantra repetition), জিকির (zikr – আল্লাহর স্মরণ), যোগসাধনা, প্রাণায়াম – এই সবই হলো সেই অন্তরের গভীরে ডুব দেওয়ার বিভিন্ন উপায়। এই পদ্ধতিগুলোর উদ্দেশ্য হলো মনকে শান্ত করা, বিক্ষিপ্ত চিন্তাগুলোকে কেন্দ্রীভূত করা, ইন্দ্রিয়গুলোকে অন্তর্মুখী করা এবং চেতনার গভীরতর স্তরগুলোতে প্রবেশ করা।
এই অন্তর্মুখী যাত্রায় সাধককে নিজের মনের নানা প্রবৃত্তির মুখোমুখি হতে হয় – কামনা, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য। এই ষড়রিপুকে জয় করে, চিত্তকে শুদ্ধ করে তবেই সেই পরম সত্যের আভাস পাওয়া যায়। এই পথ সহজ নয়, এতে ধৈর্য, অধ্যবসায় এবং একাগ্রতা প্রয়োজন। একজন যোগ্য গুরুর নির্দেশিকাও এই পথে অনেক সময় সহায়ক হয়।
মরমিরা মনে করেন, বাইরের জগৎ হলো প্রতিবিম্ব, আর ভেতরের জগৎ হলো মূল বস্তু। আমরা যদি নিজেদের ভেতরকে জানতে পারি, তাহলেই সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের রহস্য আমাদের কাছে উন্মোচিত হবে। “তোমাতে রয়েছে সকল ধর্ম, সকল শাস্ত্রসার, খুঁজে দেখ নিজ অন্তঃপুরে, পাবি আপন ঘর,” – এই সুরই যেন বাজে সকল মরমি সাধকের হৃদয়ে। এই আত্মানুসন্ধানই ব্যক্তিকে অজ্ঞতা থেকে জ্ঞানে, অন্ধকার থেকে আলোতে এবং মৃত্যু থেকে অমরত্বে নিয়ে যায়।
৮. প্রেম (Love): মিলনের রাজপথ
অনেক মরমি ধারায়, বিশেষ করে সুফিবাদ এবং ভক্তিবাদী ঐতিহ্যগুলোতে (Bhakti traditions), প্রেমকে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানোর বা পরম সত্তার সঙ্গে মিলিত হওয়ার শ্রেষ্ঠ, সহজতম এবং মধুরতম পথ হিসেবে দেখা হয়। এই প্রেম সংকীর্ণ অর্থে কেবল নর-নারীর জৈবিক আকর্ষণ বা জাগতিক কোনো বস্তুর প্রতি আসক্তি নয়। এ হলো এক সর্বজনীন, শর্তহীন, সর্বপ্লাবী প্রেম (universal, unconditional, all-encompassing love), যা প্রথমে সেই পরম সত্তা বা ঈশ্বরের প্রতি উৎসারিত হয় এবং তারপর তার সমগ্র সৃষ্টির প্রতি – প্রতিটি জীব, প্রতিটি অণু-পরমাণুর প্রতি – প্রসারিত হয়।
এই প্রেমময় পথে সাধক নিজেকে প্রেমিক বা প্রেমিকা এবং পরম সত্তাকে প্রেমাস্পদ বা প্রেমিকা হিসেবে কল্পনা করেন। এই প্রেমের আকুতি, বিরহের বেদনা এবং মিলনের আনন্দ তাদের ভজন, কীর্তন, কবিতা ও সঙ্গীতের মূল উপজীব্য। এই প্রেম সাধকের হৃদয়কে দ্রবীভূত করে, অহংকারকে চূর্ণ করে এবং তাকে পরম সত্তার সঙ্গে এক গভীর অন্তরঙ্গ সম্পর্কে আবদ্ধ করে।
সুফি মরমি কবি জালালউদ্দিন রুমি প্রেমের জয়গানে মুখর হয়েছেন। তার কাছে প্রেমই হলো সেই শক্তি যা জগৎকে চালিত করে, আত্মাকে ঊর্ধ্বায়িত করে এবং ঈশ্বরকে জানার একমাত্র পথ। তিনি গেয়েছেন, “প্রেমাস্পদের আলোয় যখন আত্মা জ্যোতির্ময় হয়, তখন সে দিগন্ত ছাড়িয়ে যায়, তার আর কোনো ছাদের প্রয়োজন হয় না।” তার মতে, এই প্রেম কোনো যুক্তিতর্কের ধার ধারে না, এটি হৃদয়ের স্বতঃস্ফূর্ত আকুতি।
ভারতের ভক্তিবাদী আন্দোলনেও প্রেমের এই মহিমা কীর্তিত হয়েছে। মীরাবাঈ, চৈতন্য মহাপ্রভু, কবীর, সুরদাস, তুকারাম – এদের ভজনে ভগবানকে প্রিয়তম সখা, স্বামী বা প্রভু রূপে পাওয়ার জন্য ব্যাকুলতা প্রকাশ পেয়েছে। বাংলার বাউল ও বৈষ্ণব পদাবলীতেও রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের রূপকে জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলনের আকুতি অপূর্ব ভাষায় চিত্রিত হয়েছে। লালন সাঁই, হাসন রাজা, রাধারমণ দত্ত – এদের গানেও এই অপার্থিব প্রেমের সুর বারবার ধ্বনিত হয়েছে।
এই দিব্য প্রেম ভেদবুদ্ধির দেওয়াল ভেঙে দেয়। যখন সাধক ঈশ্বরকে ভালোবাসেন, তখন তিনি ঈশ্বরের সকল সৃষ্টিকেও ভালোবাসতে শুরু করেন। তার কাছে তখন হিন্দু-মুসলমান, ব্রাহ্মণ-শূদ্র, ধনী-দরিদ্র কোনো ভেদাভেদ থাকে না। তিনি সকল মানুষের মধ্যে, সকল জীবের মধ্যে সেই একই প্রেমাস্পদের প্রকাশ দেখতে পান। এই প্রেমই তাকে নিঃস্বার্থ সেবা ও পরোপকারে উদ্বুদ্ধ করে।
প্রেমের এই পথ অনেক সময় জ্ঞানের পথের চেয়ে দ্রুততর ও সহজতর বলে বিবেচিত হয়, কারণ এতে শুষ্ক তাত্ত্বিক আলোচনার চেয়ে হৃদয়ের আবেগ ও অনুভূতির প্রাধান্য থাকে। এই প্রেম সাধকের হৃদয়কে কোমল করে, সংবেদনশীল করে এবং তাকে এক গভীর আনন্দের জগতে উত্তীর্ণ করে। এই প্রেমই মরমিবাদের প্রাণশক্তি, যা শুষ্ক তত্ত্বকথার ঊর্ধ্বে উঠে জীবনকে রসময় ও অর্থপূর্ণ করে তোলে।
৯. অদ্বৈতবাদ (Non-duality): বহুত্বের আড়ালে এক অখণ্ড সত্তা
মরমিবাদের একটি গভীর দার্শনিক দিক হলো অদ্বৈতবাদ বা Non-duality-র ধারণা। অনেক প্রভাবশালী মরমি ঐতিহ্যে, যেমন হিন্দুধর্মের অদ্বৈত বেদান্ত, বৌদ্ধধর্মের কিছু ধারা (বিশেষত মহাযান ও বজ্রযান), তাওবাদ এবং কিছু সুফি চিন্তাধারায়, এই ধারণা অত্যন্ত জোরালোভাবে উপস্থিত যে, জগতের আপাত বহুত্ব (apparent multiplicity) এবং বৈচিত্র্যের মূলে রয়েছে এক অখণ্ড, অবিভাজ্য (indivisible), শাশ্বত সত্তা।
আমরা যে নানা রকম ভেদ দেখি – যেমন, আমি-তুমি, জীব-জগৎ, স্রষ্টা-সৃষ্টি, আত্মা-পরমাত্মা, বিষয়-विषयी, সুখ-দুঃখ, ভালো-মন্দ – তা আসলে এক ধরনের মায়া (maya) বা ভ্রম (illusion) অথবা আমাদের অজ্ঞতাপ্রসূত দৃষ্টিবিভ্রম। এই ভেদজ্ঞান আমাদের প্রকৃত স্বরূপকে জানতে বাধা দেয় এবং আমাদের দুঃখ ও বন্ধনের কারণ হয়। প্রকৃত জ্ঞান বা বোধি (enlightenment) লাভ হলে এই ভেদজ্ঞান লুপ্ত হয় এবং সাধক সর্বত্র – নিজের মধ্যে এবং জগতের সকল কিছুতে – সেই এক পরম সত্তারই প্রকাশ দেখতে পান। তখন আর ‘আমার’ বা ‘তোমার’ বলে কিছু থাকে না, থাকে শুধু সেই ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’ (One without a second)।
অদ্বৈত বেদান্তের প্রবক্তা শঙ্করাচার্য এই তত্ত্বকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। তার মতে, ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, জগৎ মিথ্যা (অর্থাৎ পরিবর্তনশীল ও আপেক্ষিক) এবং জীবাত্মা ব্রহ্ম থেকে অভিন্ন। অজ্ঞতার কারণে জীব নিজেকে দেহ-মন-বুদ্ধির সঙ্গে একাত্ম করে ফেলে এবং নিজেকে ক্ষুদ্র ও সীমিত মনে করে। জ্ঞান লাভের পর এই ভ্রম দূর হয় এবং জীব নিজের ব্রহ্মস্বরূপ উপলব্ধি করে।
বৌদ্ধধর্মে শূন্যতার (Shunyata) ধারণাটিও অদ্বৈতবাদের কাছাকাছি। শূন্যতা মানে অভাব বা নাস্তিত্ব নয়, বরং শূন্যতা মানে সকল বস্তুর অন্তর্নিহিত সত্তাহীনতা (emptiness of inherent existence)। কোনো কিছুই স্বাধীনভাবে বা নিজে নিজে অস্তিত্বশীল নয়, সবকিছুই পরস্পর নির্ভরশীল এবং আপেক্ষিক। এই আপেক্ষিকতার ঊর্ধ্বে যে পরম সত্য, তা বর্ণনাতীত, ধারণাতীত – তাই শূন্য। এই শূন্যতার উপলব্ধিই নির্বাণ।
তাওবাদে ‘তাও’ হলো সেই আদি, অরূপ, অব্যক্ত সত্তা, যা থেকে সকল কিছুর উদ্ভব এবং যাতে সকল কিছু লীন হয়। তাও এক এবং অদ্বিতীয়। সুফিবাদের ‘ওয়াহদাতুল উজুদ’ (Wahdat al-Wujud) বা সর্বেশ্বরবাদের ধারণা, যা ইবন আরাবির দর্শনে পাওয়া যায়, তাও এই অদ্বৈত চেতনারই প্রতিফলন। এই মতানুসারে, আল্লাহ বা পরম সত্তাই একমাত্র অস্তিত্ব, আর এই জগৎ তারই প্রকাশ বা প্রতিবিম্ব।
এই অদ্বৈত উপলব্ধির নৈতিক ও ব্যবহারিক তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। যখন সাধক সর্বত্র এক পরম সত্তারই প্রকাশ দেখেন, তখন তার মধ্যে হিংসা, দ্বেষ, ঘৃণা বা স্বার্থপরতার কোনো স্থান থাকে না। তিনি সকল জীবের প্রতি সমদৃষ্টিতে দৃষ্টিপাত করেন, কারণ তিনি জানেন যে অন্যের ক্ষতি করা মানে প্রকারান্তরে নিজেরই ক্ষতি করা। এই উপলব্ধি থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে করুণা, মৈত্রী ও অহিংসার জন্ম হয়। এটিই মরমিবাদের নৈতিকতার ভিত্তি।
মরমিবাদের প্রস্তুতি ও পথ: যদিও মরমি অভিজ্ঞতার একটি বৈশিষ্ট্য নিষ্ক্রিয়তা (Passivity), অর্থাৎ এটি যেন উপর থেকে নেমে আসে, তথাপি প্রায় সকল মরমি ঐতিহ্যেই এই অভিজ্ঞতার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এই প্রস্তুতিতে সাধারণত নৈতিক জীবনযাপন, আত্মশুদ্ধি, মনঃসংযোগের অভ্যাস এবং বিশেষ কিছু আধ্যাত্মিক অনুশীলন অন্তর্ভুক্ত থাকে। নৈতিক আচরণ, যেমন – সত্যবাদিতা, অহিংসা, অস্তেয় (অ-চৌর্য), ব্রহ্মচর্য (সংযম) এবং অপরিগ্রহ (অ-লোভ) – চিত্তকে নির্মল করে এবং উচ্চতর চেতনার জন্য উপযুক্ত আধার তৈরি করে। ধ্যান, প্রার্থনা, জপ, কীর্তন, শাস্ত্রপাঠ, সৎসঙ্গ, নিঃস্বার্থ সেবা – এই সবকিছুর মাধ্যমেই সাধক ধীরে ধীরে তার মনকে অন্তর্মুখী করেন এবং পরম সত্তার সান্নিধ্য লাভের জন্য যোগ্য হয়ে ওঠেন। এই প্রস্তুতিপর্ব অনেকটা জমি চাষ করার মতো; জমি ঠিকমতো তৈরি না হলে যেমন ভালো ফসল আশা করা যায় না, তেমনি চিত্ত শুদ্ধ ও একাগ্র না হলে মরমি অভিজ্ঞতারূপী অমৃত ফল লাভ করা কঠিন।
মরমিবাদ ও আধুনিক বিজ্ঞান: বিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে এবং একবিংশ শতাব্দীতে এসে মরমি অভিজ্ঞতা ও চেতনার বিভিন্ন দিক নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণার আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে। মনোবিজ্ঞান, স্নায়ুবিজ্ঞান (neuroscience) এই বিষয়ে আলোকপাত করেছে। ধ্যান ও অন্যান্য মননশীল অভ্যাসের ফলে মস্তিষ্কের গঠনে ও কার্যকারিতায় কী ধরনের পরিবর্তন আসে, তা নিয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে। ‘নিউরোথিওলজি’ (Neurotheology) নামে একটি নতুন শাখার উদ্ভব হয়েছে, যা ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার স্নায়বিক ভিত্তি অনুসন্ধান করে। যদিও বিজ্ঞান এখনও মরমি অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণ রহস্য উন্মোচন করতে পারেনি, এবং হয়তো পারবেও না, কারণ এই অভিজ্ঞতা অনেকটাই ব্যক্তিনিষ্ঠ, তবুও এই প্রচেষ্টা মরমিবাদকে একটি নিছক কাল্পনিক বা অবাস্তব বিষয় হিসেবে উড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতাকে প্রতিহত করতে সাহায্য করছে।
Leave a Reply