টেকনো-ফিউডালিজম: ডিজিটাল যুগের নয়া সামন্তবাদ এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভূমিকা

Table of Contents

ভূমিকা

এই যে ধরুন, আপনি চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে দিতে স্মার্টফোন বা ল্যাপটপের পর্দায় কোন লেখা পড়ছেন, কিংবা চলার পথে বাসের জানালার কাচে মাথা ঠেকিয়ে, হেডফোনে গান শুনতে শুনতে স্মার্টফোনে একঝলক চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন – আপনার আঙুলের এক খোঁচায় পৃথিবীর এমাথা-ওমাথার খবর চলে আসছে মুহূর্তের মধ্যে। বন্ধুদের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনর্গল আড্ডা দিচ্ছেন, সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারের কোনো শিল্পীর কনসার্ট লাইভ দেখছেন, রাতের বেলা মন কেমন করলে পুরোনো দিনের সাদাকালো সিনেমা চালিয়ে দিচ্ছেন, কিংবা ঘরে বসেই কিনে ফেলছেন দরকারি-অদরকারি কত শত জিনিস – সবই হচ্ছে এই মায়াবী ডিজিটাল মাধ্যমে। কী দারুণ ব্যাপার, তাই না? মনে হচ্ছে যেন এক জাদুকরি ব্যাপারস্যাপার, আলাদিনের চেরাগ হাতে পেয়েছেন আপনি। এই ডিজিটাল জগতের আপনিই যেন একচ্ছত্র অধিপতি, আপনার ইচ্ছাই সব। এক ক্লিকে দুনিয়া আপনার হাতের মুঠোয়! নিজেকে এই গ্রহের সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষদের একজন মনে হওয়াটা কি খুব অস্বাভাবিক?

কিন্তু আসলেই কি তাই? নাকি এই আপাত স্বাধীনতার ঝলমলে পর্দার আড়ালে লুকিয়ে আছে অন্য কোনো গল্প? এমন এক গল্প, যা শুনলে আপনার কপালের চিন্তার ভাঁজ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে পারে, চায়ের কাপটা হয়তো টেবিলেই রাখা থাকবে, গানটাও আর শোনা হবে না। গল্পটা হলো টেকনো-ফিউডালিজমের (Techno-feudalism)।

নামটা শুনে একটু খটমট লাগছে, তাই না? লাগারই কথা। ফিউডালিজম বা সামন্তবাদ শব্দটা তো আমরা ইতিহাসের পাতায় ধুলোমাখা অক্ষরের ভেতর ফেলে এসেছি। সেই যে মধ্যযুগের রাজা-জমিদার-ভূমিদাস প্রথা, যেখানে গুটিকয়েক মানুষের হাতে ছিল অঢেল ক্ষমতা আর অফুরন্ত সম্পদ, আর বাকি বিশাল জনগোষ্ঠী ছিল তাদের দয়ার পাত্র, তাদের ইশারার পুতুল। আধুনিক যুগে, বিশেষ করে পুঁজিবাদের (Capitalism) জয়জয়কারে, যন্ত্রের ঝনঝনানিতে সেই ব্যবস্থা কবেই না পাততাড়ি গুটিয়েছে! ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে সেই শোষণ আর বৈষম্যের কঙ্কাল। তাহলে আবার এই “টেকনো-ফিউডালিজম” নামক অদ্ভুতদর্শন প্রাণিটা কোত্থেকে উদয় হলো? এ যেন মশা মারতে কামান দাগার মতো ব্যাপার, কিংবা বলা ভালো, মশা নিজেই কামান হয়ে ফিরে এসেছে নতুন রূপে, নতুন অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে। আর এই নয়া সামন্ততন্ত্রের সবচেয়ে বড় সাগরেদ হিসেবে আবির্ভূত হতে চলেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence – AI)।

আসলে হয়েছে কী, পৃথিবীটা বড্ড দ্রুত পাল্টাচ্ছে। এই যে আমরা কথায় কথায় বলি “ডিজিটাল বাংলাদেশ” বা “স্মার্ট অমুক-তমুক”, এর পেছনের প্রযুক্তি (Technology) দুনিয়ায় যে অভাবনীয়, প্রায় অবিশ্বাস্য বিপ্লব ঘটে গেছে গত কয়েক দশকে, তা আমাদের জীবনযাত্রা, অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি – সবকিছুকেই নতুন করে ভাবতে, নতুন করে সাজাতে বাধ্য করছে। অনেকটা ভূমিকম্পের পর যেমন চেনা শহরও অচেনা লাগে, সেরকম আরকি। আর এই নতুন বাস্তবতার প্রেক্ষাপটেই কতিপয় ক্ষুরধার চিন্তাবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ এই টেকনো-ফিউডালিজম তত্ত্বটি আমাদের সামনে এনেছেন। তাদের মতে, আমরা হয়তো না বুঝেই, কিংবা বুঝেও না বোঝার ভান করে, এক নতুন ধরনের সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে ধাবমান। এমন এক ব্যবস্থা, যেখানে মধ্যযুগের জমির বদলে তথ্য বা ডেটা (Data) হয়ে উঠেছে ক্ষমতার মূল উৎস, সম্পদের আধার। আর সেই সময়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপ জমিদারের আসনে জাঁকিয়ে বসেছে একালের গুগল, ফেসবুক, অ্যামাজনের মতো বিশাল বিশাল প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো (Big Tech)। তারা যেন নতুন যুগের ডিজিটাল লর্ড, আর আমরা তাদের বিশাল সাম্রাজ্যের প্রজা, কলের পুতুল।

সামন্তবাদ জিনিসটা আসলে কী ছিল?

টেকনো-ফিউডালিজম বুঝতে হলে, আমাদের স্মৃতির টাইম মেশিনে চড়ে একটুখানি সামন্তবাদের উঠোনে ঢুঁ মেরে আসা দরকার। মধ্যযুগের ইউরোপের কথা ভাবুন। চারদিকে দিগন্তবিস্তৃত মাঠ, সবুজ বনানী, আর তার মাঝে মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা পাথরের দুর্গ। তখন মূল উৎপাদন ব্যবস্থা ছিল কৃষিভিত্তিক। যার যত বেশি একর জমি, তার তত বেশি প্রভাব-প্রতিপত্তি, তত বেশি ক্ষমতা। সমাজের একেবারে মাথায়, পিরামিডের চূড়ায় থাকতেন রাজা বা সম্রাট, ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচিত তিনি। তার নিচে বিভিন্ন স্তরের লর্ড বা সামন্তপ্রভু – ডিউক, কাউন্ট, ব্যারন, কত কী নাম! এই লর্ডরা রাজার কাছ থেকে বিশাল বিশাল জমি পেতেন, যাকে বলা হতো ফিয়েফ (Fief) বা ম্যানর (Manor)। এই জমি ভোগদখলের বিনিময়ে তারা রাজাকে প্রয়োজনে সামরিক সাহায্য (যেমন, নাইট বা সৈন্য সরবরাহ) বা অন্যান্য আনুগত্য (যেমন, রাজসভায় উপস্থিতি, কর প্রদান) দেখাতে বাধ্য থাকতেন। অনেকটা আজকের দিনের ফ্র্যাঞ্চাইজি ব্যবসার মতো, তবে আরও অনেক বেশি জটিল এবং রক্তক্ষয়ী। (Bloch, 1961)

এই লর্ডদের অধীনে, তাদের জমিতে, থাকত অসংখ্য কৃষক বা ভূমিদাস (Serf)। তারা প্রভুর জমিতে হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে ফসল ফলাত, প্রভুর ঘরদোর সামলাত, রাস্তাঘাট বানাত। বিনিময়ে তারা পেত সামান্য বাঁচার রসদ – এক টুকরো রুটি, একটু সবজি, আর হিংস্র শ্বাপদ বা দস্যুদের হাত থেকে বাঁচার জন্য প্রভুর দুর্গের কাছাকাছি থাকার নিরাপত্তা। তাদের কোনো ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ছিল না বললেই চলে; তারা ছিল আক্ষরিক অর্থেই জমির সাথেই বাঁধা, যেন জমির অংশ। জমির মালিকানা বদলালে, যেমন এক লর্ডের মৃত্যুর পর তার ছেলে সেই জমির মালিক হলে, বা যুদ্ধবিগ্রহের ফলে জমি হাতবদল হলে, ভূমিদাসদেরও প্রভু বদলাত। তারা ছিল প্রভুর ব্যক্তিগত সম্পত্তি। এই ব্যবস্থায় ক্ষমতার একটা বিকেন্দ্রীকরণ ছিল বটে, কারণ প্রত্যেক লর্ড তার নিজের এলাকায় প্রায় সর্বেসর্বা ছিলেন, কিন্তু চূড়ান্ত ক্ষমতা এবং সম্পদের সিংহভাগ কুক্ষিগত থাকত সমাজের ওপরের তলার মুষ্টিমেয় অভিজাত শ্রেণির হাতে। সম্পদের প্রবাহ ছিল মূলত একমুখী – ভূমিদাস থেকে লর্ডের দিকে, এবং লর্ড থেকে সুযোগ বুঝে রাজার দিকে। একটা সুস্পষ্ট, অনড় শ্রেণিবিভাজন (Class Hierarchy) ছিল, যেখানে ওপরের তলার মানুষেরা নীচের তলার মানুষদের উদয়াস্ত পরিশ্রমের ওপর নির্ভর করে বিলাসবহুল, আয়েশি জীবন কাটাত। সেই জীবনযাত্রা ছিল সাধারণ মানুষের কল্পনারও অতীত।

তারপর এলো পুঁজিবাদ। শিল্প বিপ্লবের (Industrial Revolution) কালো ধোঁয়া আর কারখানার ভোঁ ভোঁ সাইরেন সামন্তবাদের অচলায়তনে জোর ধাক্কা দিল। কলকারখানা গড়ে উঠল, বাষ্পীয় ইঞ্জিন চলল, শহরগুলো ফুলেফেঁপে উঠল। বাজারের (Market) ধারণা প্রসারিত হলো, মুদ্রা অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হলো। পুঁজি (Capital) বা মূলধন হয়ে উঠল সমাজের প্রধান চালিকাশক্তি, নতুন ক্ষমতার উৎস। যারা এই পুঁজির মালিক, সেই পুঁজিপতি বা বুর্জোয়া শ্রেণি (Bourgeoisie) সমাজের নিয়ন্ত্রক ভূমিকায় চলে এল, সামন্ত প্রভুদের হটিয়ে। কারখানায় কাজ করার জন্য গ্রামের ভূমিহীন কৃষকেরা শহরে এসে ভিড় জমাল, তৈরি হলো শ্রমিক শ্রেণি (Proletariat)। তারা তাদের শ্রমশক্তি বিক্রি করে জীবনধারণ করতে লাগল। এখানেও শোষণ ছিল, অসাম্য ছিল, শ্রমিকের দুর্দশার অন্ত ছিল না। কার্ল মার্কস (Marx, 1867) এই ব্যবস্থার নির্মম সমালোচনা করে দেখিয়েছেন কীভাবে পুঁজিপতি শ্রেণি শ্রমিকের কাছ থেকে উদ্বৃত্ত মূল্য (Surplus Value) আত্মসাৎ করে মুনাফা অর্জন করে। কিন্তু সামন্তবাদের মতো প্রত্যক্ষ দাসত্ব বা ভূমিদাস প্রথা এখানে ছিল না। অন্তত তত্ত্বগতভাবে শ্রমিকের স্বাধীনতা ছিল তার শ্রমশক্তি যেখানে খুশি, যার কাছে খুশি বিক্রি করার। যদিও সেই “স্বাধীনতা” অনেক ক্ষেত্রেই ছিল প্রহসনমাত্র।

তাহলে টেকনো-ফিউডালিজম কেন?

বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে একবিংশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত আমরা যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটাকে চিনতাম লেট ক্যাপিটালিজম (Late Capitalism) বা বিলম্বিত পুঁজিবাদ হিসেবে, সেখানেও বড় বড় বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলোর (Multinational Corporations) দাপট ছিল প্রশ্নাতীত। ওয়াল স্ট্রিট, লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জ – এগুলোই ছিল বিশ্ব অর্থনীতির স্নায়ুকেন্দ্র। কিন্তু ডিজিটাল বিপ্লব, বিশেষ করে ইন্টারনেটের জাদুর কাঠি হাতে পাওয়ার পর এবং পরবর্তীতে স্মার্টফোন ও সোশ্যাল মিডিয়ার (Social Media) মাকড়সার জালের মতো বিশ্বব্যাপী প্রসারের পর দৃশ্যপট অনেকটাই পাল্টে যেতে শুরু করেছে। এই পরিবর্তন এতটাই দ্রুত এবং গভীর যে অনেক সমাজবিজ্ঞানী মনে করছেন, আমরা পুঁজিবাদের একটা নতুন স্তর দেখছি না, বরং পুঁজিবাদ নিজেই একটা গুণগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, অথবা হয়তো তার মৃত্যুঘণ্টা বেজে উঠেছে।

বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ইয়ানিস ভারুফাকিস (Yanis Varoufakis) হচ্ছেন গ্রিসের সাবেক অর্থমন্ত্রী এবং একজন প্রখ্যাত ও স্পষ্টভাষী অর্থনীতিবিদ। তিনি তার সাম্প্রতিক সাড়া জাগানো বই “টেকনো-ফিউডালিজম: হোয়াট কিলড ক্যাপিটালিজম” (Techno-Feudalism: What Killed Capitalism / Technofeudalism: What Killed Capitalism) (Varoufakis, 2023)-এ অত্যন্ত জোরালোভাবে এই তত্ত্ব তুলে ধরেছেন। তার মতে, চিরায়ত পুঁজিবাদের দুটো মূল স্তম্ভ ছিল বাজার (Market) আর মুনাফা (Profit)। কোম্পানিগুলো বাজারে পণ্য বা সেবা বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করত, এবং সেই মুনাফা আবার নতুন বিনিয়োগের মাধ্যমে আরও মুনাফা তৈরির চক্রে প্রবেশ করত। কিন্তু আজকের দিনে গুগল (Google), ফেসবুক (Facebook, বর্তমানে Meta), অ্যামাজন (Amazon), অ্যাপল (Apple), মাইক্রোসফট (Microsoft) – এই ধরনের দানবীয় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো (যাদেরকে একত্রে GAMAM বা Big Tech বলা হয়) এমন এক নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করেছে, যেখানে চিরায়ত প্রতিযোগিতামূলক বাজারের ভূমিকা গৌণ হয়ে পড়েছে, প্রায় বিলুপ্তির পথে। মুনাফার চেয়েও তাদের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এক ধরনের ডিজিটাল খাজনা বা রেন্ট (Rent)। এই টেক জায়ান্টরা আর দশটা সাধারণ কোম্পানির মতো আচরণ করছে না; তারা আচরণ করছে মধ্যযুগীয় জমিদারদের মতো, যারা তাদের প্রজাদের কাছ থেকে বিভিন্ন উপায়ে খাজনা আদায় করত। ভারুফাকিস এদেরকে বলছেন ‘ক্লাউড অ্যালডারমেন’ (Cloud Aldermen) বা ‘ক্লাউড ক্যাপিটালিস্ট’ (Cloud Capitalists)।

কেমন সেই খাজনা? ভারুফাকিস বলছেন, এই খাজনা হলো আমাদের মনোযোগ (Attention), আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য বা ডেটা (Data), এবং তাদের একচ্ছত্র প্ল্যাটফর্ম (Platform) ব্যবহারের সুযোগ বা অ্যাক্সেস (Access)। এই প্ল্যাটফর্মগুলো এখন আর সাধারণ বাজার নয়, যেখানে একাধিক বিক্রেতা ও ক্রেতা দর কষাকষি করে; এগুলো পরিণত হয়েছে এক ধরনের ডিজিটাল ফিয়েফ বা ‘ক্লাউড ফিয়েফ’ (Cloud Fiefs) – অর্থাৎ ভার্চুয়াল জমিদারিতে। অ্যামাজন নিজেই একটা বাজার, কিন্তু সেই বাজারের নিয়মকানুন অ্যামাজনই তৈরি করে। গুগল সার্চের মাধ্যমে আমরা তথ্যের মহাসমুদ্রে সাঁতার কাটি, কিন্তু কোন তথ্য আমাদের চোখের সামনে আসবে, তা গুগলের অদৃশ্য অ্যালগরিদমই ঠিক করে দেয়। ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামে আমরা বন্ধুদের সাথে যুক্ত থাকি, কিন্তু আমাদের নিউজফিড আসলে আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আমরা এই ডিজিটাল জমিদারদের জমিতে (প্ল্যাটফর্মে) বাস করছি, তাদের নিয়ম মেনে চলছি, এবং প্রতিনিয়ত তাদের খাজনা (ডেটা, মনোযোগ) দিয়ে যাচ্ছি, প্রায়শই নিজেদের অজান্তে। এই যে আমরা কথায় কথায় “ফ্রি সার্ভিস”, “ফ্রি অ্যাপ” বলে আহ্লাদে আটখানা হই, এর আড়ালে যে কী বিশাল এক কারবার চলছে, তা কজন খেয়াল করি? আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য, আমাদের গোপন পছন্দ-অপছন্দ, আমাদের গতিবিধি, আমাদের বন্ধু-বান্ধব, আমাদের রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা, এমনকি আমাদের অবচেতন মনের আকাঙ্ক্ষাগুলোও – সবকিছুই এই টেক-জায়ান্টদের কাছে মুনাফা কামানোর কাঁচামাল।

আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাবিদ, যিনি এই ডিজিটাল যুগের সমালোচনামূলক বিশ্লেষণের পথিকৃৎ, তিনি হলেন এভজেনি মোরোজভ (Evgeny Morozov)। তিনি অনেক আগে থেকেই প্রযুক্তির প্রতি আমাদের অন্ধ মোহ এবং তথাকথিত “প্রযুক্তিগত সমাধানবাদ” (Technological Solutionism) – অর্থাৎ সব সমস্যার সমাধান প্রযুক্তির মাধ্যমেই সম্ভব, এই ধারণার বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে আসছেন। মোরোজভ তার বিভিন্ন লেখায় এবং বইয়ে (যেমন, Morozov, 2013) দেখিয়েছেন, কীভাবে বৃহৎ প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবহারকারীদের ওপর এক ধরনের সর্বব্যাপী নজরদারি (Surveillance) চালায় এবং তাদের ডেটা নিষ্কাশন (Data Extraction) করে নিজেদের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যকে আরও শক্তিশালী করে। যদিও মোরোজোভ সরাসরি “টেকনো-ফিউডালিজম” শব্দটি সেভাবে ব্যবহার করেননি, তার বিশ্লেষণ এই তত্ত্বের সপক্ষেই জোরালো যুক্তি হাজির করে। তিনি দেখান যে, এই ডেটা-ভিত্তিক অর্থনীতি কীভাবে ক্ষমতাকে আরও বেশি কেন্দ্রীভূত করছে এবং নাগরিকদের স্বাধীনতাকে খর্ব করছে।

ফরাসি অর্থনীতিবিদ সেড্রিক ডুরান্ড (Cédric Durand) তার “টেকনো-ফিউডালিজম: ডিজিটাল অর্থনীতির সমালোচনা” (Techno-féodalisme: Critique de l’économie numérique) (Durand, 2020) বইতে এই ধারণাকে আরও এগিয়ে নিয়ে গেছেন। ডুরান্ড দেখিয়েছেন, কীভাবে বৃহৎ প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো তাদের প্ল্যাটফর্মের ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে তথাকথিত “ডিজিটাল কমনস” (Digital Commons) – অর্থাৎ যে ডিজিটাল পরিসরগুলো একসময় সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল বা হওয়ার কথা ছিল (যেমন, ইন্টারনেট, তথ্য, জ্ঞান) – সেগুলোকে নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পদে (Private Property) পরিণত করছে। এই প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করার জন্য আমাদের তাদের বেঁধে দেওয়া শর্তাবলি (Terms of Service) মেনে নিতে হয়, যা প্রায়শই একতরফা এবং ব্যবহারকারীর স্বার্থবিরোধী। এই শর্ত মানাটা অনেকটা মধ্যযুগীয় লর্ডের কাছে ভূমিদাসের আনুগত্য প্রদর্শনের সমতুল্য। আপনি যদি তাদের শর্ত না মানেন, তাহলে আপনি তাদের ডিজিটাল জমিদারি থেকে বিতাড়িত (De-platformed) হতে পারেন, আপনার ডিজিটাল অস্তিত্ব মুছে যেতে পারে। ডুরান্ড আরও দেখিয়েছেন, (যেমন তার “ফিকটিশাস ক্যাপিটাল” গ্রন্থে এবং পরবর্তীকালে “টেকনো-ফিউডালিজম” বিষয়ক রচনায়) কীভাবে এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো এক ধরনের ‘ডিজিটাল খাজনা’ (Digital Rent) আদায় করছে (Durand, 2017; Durand, 2020)। এই খাজনাটা পুঁজিবাদের চিরায়ত মুনাফার (Profit) ধারণার চেয়ে অনেক বেশি সামন্তবাদী খাজনার (Feudal Rent) সঙ্গেই তুলনীয়।

এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, তাহলে প্রথাগত পুঁজিপতিরা (Capitalists), যারা কলকারখানা বা ব্যবসা-বাণিজ্যের মালিক, তারা কোথায় গেল? ভারুফাকিসের মতে, তারা এখন এই টেকনো-ফিউডাল প্রভুদের করুণার পাত্র, তাদের প্রজা বা ‘ভ্যাসাল’ (Vassals) হয়ে উঠেছে।

এইসব চিন্তাবিদের মূল কথা হলো, আজকের অর্থনীতিতে ক্ষমতার ভরকেন্দ্র সরে গেছে। আগে ক্ষমতা ছিল তাদের হাতে, যাদের কলকারখানা ছিল, পুঁজি ছিল। এখন ক্ষমতা তাদের হাতে, যাদের ডেটা আছে, প্ল্যাটফর্ম আছে, অ্যালগরিদম আছে। এই নতুন ক্ষমতার মালিকেরাই আজকের দিনের টেকনো-ফিউডাল লর্ড।

টেকনো-ফিউডালিজমের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো কী কী?

আসুন, একটু ধৈর্য ধরে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি এই নয়া সামন্তবাদের চেহারাটা ঠিক কেমন, এর প্রধান লক্ষণগুলো কী কী।

১. ডেটা হলো নতুন জমি (Data as the New Land)

মধ্যযুগের সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেমন জমি ছিল উৎপাদন, ক্ষমতা ও সামাজিক মর্যাদার মূল ভিত্তি, আজকের ডিজিটাল যুগে সেই স্থান প্রায় পুরোপুরি দখল করে নিয়েছে ডেটা বা তথ্য। আমরা যখন ইন্টারনেট ব্রাউজ করি, গুগলে কিছু খুঁজি, ফেসবুকে কোনো পোস্টে লাইক দিই বা স্ট্যাটাস আপডেট করি, ইউটিউবে মজার ভিডিও দেখি, ইনস্টাগ্রামে বেড়াতে যাওয়ার ছবি আপলোড করি, অনলাইনে খাবার অর্ডার করি বা পছন্দের পোশাকটা কিনি – প্রতি মুহূর্তে, প্রতি ক্লিকে, প্রতি স্ক্রোলে আমরা অজস্র ডিজিটাল পদচিহ্ন (Digital Footprint) বা ডেটা তৈরি করছি। আমাদের পছন্দ-অপছন্দ, ভালো লাগা-মন্দ লাগা, অভ্যাস-অনভ্যাস, রাজনৈতিক মতামত, ধর্মীয় বিশ্বাস, ভৌগোলিক অবস্থান, শারীরিক অসুস্থতা, মানসিক অবস্থা, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, কেনাকাটার তালিকা, ভ্রমণ পরিকল্পনা – সবকিছুই ডেটা আকারে জমা হচ্ছে এই টেক জায়ান্টদের সুবিশাল, দুর্ভেদ্য সার্ভারগুলোতে, যা ছড়িয়ে আছে সারা পৃথিবী জুড়ে।

এই ডেটাই তাদের কাছে সোনার খনি, আলাদিনের চেরাগ। এই ডেটা বিশ্লেষণ (Data Analytics) করে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (Artificial Intelligence – AI) সাহায্যে তারা আমাদের আচরণ সম্পর্কে প্রায় নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে। তারা জানতে পারে আমরা কখন কী কিনতে চাইব, কোন রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করব, কোন খবরে বিশ্বাস করব, এমনকি আমরা কখন অসুস্থ হতে পারি বা মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে পারি। এই জ্ঞান ব্যবহার করে তারা আমাদের অত্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে টার্গেট করে বিজ্ঞাপন দেখাতে পারে (Targeted Advertising), আমাদের পছন্দকে প্রভাবিত করতে পারে, এমনকি আমাদের সিদ্ধান্তকেও নিপুণ কৌশলে বদলে দিতে পারে। অনেকটা মধ্যযুগের জমির মতো, যার যত বেশি ডেটার ওপর নিয়ন্ত্রণ, ডিজিটাল দুনিয়ায় তার তত বেশি ক্ষমতা, তত বেশি প্রভাব।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শোশানা জুবফ (Shoshana Zuboff) তার বিখ্যাত এবং প্রভাবশালী বই “দ্য এজ অফ সারভেইল্যান্স ক্যাপিটালিজম: দ্য ফাইট ফর এ হিউম্যান ফিউচার অ্যাট দ্য নিউ ফ্রন্টিয়ার অফ পাওয়ার” (The Age of Surveillance Capitalism: The Fight for a Human Future at the New Frontier of Power) (Zuboff, 2019)-এ এই ডেটা আহরণ ও ব্যবহারের ভয়ংকর চিত্র বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে টেক কোম্পানিগুলো আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে বিনামূল্যে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে, তা থেকে “আচরণগত উদ্বৃত্ত” (Behavioral Surplus) আহরণ করে, এবং সেই উদ্বৃত্তকে পণ্যে পরিণত করে “আচরণগত ভবিষ্যৎ বাজার” (Behavioral Futures Markets)-এ বিক্রি করে। এটা এক নতুন ধরনের পুঁজিবাদ, যার মূল ভিত্তিই হলো নজরদারি এবং ডেটা শোষণ। জুবফের মতে, এটা শুধু আমাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তাকেই (Privacy) আক্রমণ করছে না, এটা আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ (Autonomy), আমাদের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি (Free Will) এবং পরিণামে গণতন্ত্রকেই (Democracy) হুমকির মুখে ফেলছে। এই ডেটা নিষ্কাশন প্রক্রিয়া এতটাই সর্বব্যাপী ও সূক্ষ্ম যে আমরা অনেক সময়ই তা টেরই পাই না। আমরা যেন কাচের ঘরে বাস করছি, যেখানে আমাদের প্রতিটি নড়াচড়া অদৃশ্য চোখে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।

২. প্ল্যাটফর্ম হলো নতুন ফিয়েফ বা জমিদারি (Platforms as the New Fiefdoms)

ফেসবুক, গুগল, অ্যামাজন, ইউটিউব, এক্স (সাবেক টুইটার), ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, উবার, এয়ারবিএনবি – এগুলো এখন আর শুধু নিরীহ ওয়েবসাইট বা মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন নয়। এগুলো একেকটা বিশাল, বিস্তৃত, স্বয়ংসম্পূর্ণ ডিজিটাল সাম্রাজ্য বা আধুনিক ফিয়েফ, যাকে ভারুফাকিস বলেছেন ‘ক্লাউড ফিয়েফ’। এই প্ল্যাটফর্মগুলোর মালিকেরাই একচ্ছত্রভাবে ঠিক করে দেন সেখানে কী করা যাবে, কী করা যাবে না, কোন ধরনের কনটেন্ট (Content) আপলোড করা যাবে, কোন ভাষায় কথা বলা যাবে, কে কার সাথে যোগাযোগ করতে পারবে। তাদের তৈরি করা “টার্মস অফ সার্ভিস” (Terms of Service) বা ব্যবহারের শর্তাবলি, যা আমরা সাধারণত না পড়েই “I Agree” বাটনে ক্লিক করে দিই, সেগুলো অনেকটা যেন মধ্যযুগীয় লর্ডের জারি করা ফরমান বা আইন। সেইসব শর্ত প্রায়শই এতটাই দীর্ঘ, জটিল এবং আইনজ্ঞদের ভাষায় লেখা থাকে যে সাধারণ ব্যবহারকারীর পক্ষে তা বোঝা দুঃসাধ্য।

আমরা সেই শর্ত না মেনে এই প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করতে পারি না। যদি আমরা তাদের কোনো নিয়ম ভঙ্গ করি (বা তাদের অ্যালগরিদম যদি মনে করে যে আমরা নিয়ম ভঙ্গ করেছি), তাহলে তারা কোনো প্রকার কৈফিয়ত ছাড়াই আমাদের অ্যাকাউন্ট সাসপেন্ড (Suspend) বা ব্যান (Ban) করে দিতে পারে, আমাদের ডিজিটাল কণ্ঠরোধ করতে পারে। এই প্ল্যাটফর্মগুলোর রয়েছে অত্যন্ত শক্তিশালী “নেটওয়ার্ক এফেক্ট” (Network Effect) – অর্থাৎ, যত বেশি মানুষ এগুলো ব্যবহার করে, এগুলো অন্যদের জন্যও তত বেশি আকর্ষণীয় ও অপরিহার্য হয়ে ওঠে। আমার সব বন্ধুরা যদি ফেসবুকে থাকে, তাহলে আমার পক্ষে ফেসবুক ছাড়া থাকা কঠিন। বেশিরভাগ বিক্রেতা যদি অ্যামাজনে পণ্য বিক্রি করে, তাহলে ক্রেতা হিসেবে আমার অ্যামাজনে না গিয়ে উপায় থাকে না। এই নেটওয়ার্ক এফেক্টের কারণে এই প্ল্যাটফর্মগুলো প্রায় অপ্রতিরোধ্য মনোপলি (Monopoly) বা অলিগোপলি (Oligopoly) তৈরি করতে পেরেছে। ফলে এদের থেকে বেরিয়ে আসা বা এদের বিকল্প খুঁজে পাওয়াও অত্যন্ত কঠিন, প্রায় অসম্ভব। আমরা যেন স্বেচ্ছায়, কিংবা পরিস্থিতির চাপে, এই ডিজিটাল জমিদারদের অনুগত প্রজা হয়েছি, তাদের ডিজিটাল ফিয়েফে বসবাস করছি। এই ফিয়েফের বাইরে আমাদের অনেকেরই যেন কোনো সামাজিক বা অর্থনৈতিক অস্তিত্ব নেই।

৩. টেক লর্ড বা প্রযুক্তি অধিপতি (Tech Lords)

এই ডিজিটাল ফিয়েফগুলোর মালিক, অর্থাৎ গুগল (ল্যারি পেজ, সের্গেই ব্রিন, সুন্দর পিচাই), মেটা (মার্ক জাকারবার্গ), অ্যামাজন (জেফ বেজোস), অ্যাপল (টিম কুক, এবং অবশ্যই স্টিভ জবসের উত্তরাধিকার), মাইক্রোসফট (বিল গেটস, সত্য নাদেলা)-এর মতো কোম্পানি এবং তাদের কর্ণধারেরা হলেন আজকের যুগের নতুন সামন্তপ্রভু বা টেক লর্ড। তাদের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে বিপুল, প্রায় অকল্পনীয় অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা। তারা শুধু বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে না, তারা তথ্যের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছে, সংস্কৃতির গতিপথ নির্ধারণ করছে, জনমত গঠন করছে, এমনকি বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাব ফেলছে।

তাদের ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ অনেক ছোট বা মাঝারি দেশের মোট জাতীয় আয়ের (GDP) চেয়েও বেশি। বিল গেটস বা জেফ বেজোসের মতো ব্যক্তিরা তাদের ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে মানবকল্যাণে প্রচুর অর্থ দান করেন বটে, কিন্তু সেই দান বা ফিলানথ্রোপি অনেক ক্ষেত্রেই তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ এবং ভাবমূর্তি রক্ষার কৌশলের অংশ হিসেবেও সমালোচিত হয়। এই মুষ্টিমেয় কিছু কোম্পানি এবং ব্যক্তির হাতে এত বিপুল ক্ষমতা জমা হওয়াটা যেকোনো গণতান্ত্রিক সমাজের জন্যই এক বিরাট অশনিসংকেত। তারা যেন আধুনিক যুগের সম্রাট, যাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই, যাদের ক্ষমতার কোনো দৃশ্যমান সীমা-পরিসীমা নেই। তাদের জীবনযাত্রা, তাদের চিন্তাভাবনা, তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা – সবকিছুই সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। তারা যেন অলিম্পাস পাহাড়ের দেবতাদের মতো, মর্ত্যের সাধারণ মানুষদের নিয়ে ইচ্ছেমতো খেলা করছেন।

৪. ডিজিটাল ভূমিদাস বা প্রিক্যারিয়েট (Digital Serfs / Precariat)

আমরা যারা সাধারণ ব্যবহারকারী (User), ফেসবুক-গুগল-ইউটিউবের “ফ্রি” সেবার ভোক্তা, তারা অনেকটা এই নতুন যুগের ডিজিটাল ভূমিদাসের মতো। আমরা এই প্ল্যাটফর্মগুলোতে আমাদের মূল্যবান সময়, আমাদের দুর্লভ মনোযোগ (Attention Economy) এবং আমাদের অতি ব্যক্তিগত তথ্য (Personal Data) উদার হস্তে বিলিয়ে দিয়ে তাদের আরও সম্পদশালী, আরও ক্ষমতাধর করে তুলছি। বিনিময়ে আমরা পাচ্ছি “ফ্রি” (Free) সার্ভিস, যেমন সামাজিক যোগাযোগের সুযোগ, তথ্য খোঁজার সুবিধা, বিনোদনের উপকরণ। কিন্তু এই “ফ্রি” সার্ভিস আসলে মোটেও ফ্রি নয়। এর আসল দাম আমরা চুকাচ্ছি আমাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, আমাদের তথ্যের গোপনীয়তা, আমাদের মানসিক শান্তি এবং আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দিয়ে। আমরা যখন ফেসবুকে কোনো পোস্টে লাইক দিচ্ছি, বা ইউটিউবে কোনো ভিডিও দেখছি, তখন আমরা আসলে অদৃশ্য শ্রমে (Invisible Labor) বা ‘ডিজিটাল শ্রমে’ (Digital Labour) নিয়োজিত হচ্ছি – আমরা ডেটা তৈরি করছি, যা এই প্ল্যাটফর্মগুলোর অ্যালগরিদমকে আরও নিখুঁত ও কার্যকরী করে তুলছে, তাদের বিজ্ঞাপন ব্যবসাকে আরও লাভজনক করছে।

শুধু সাধারণ ব্যবহারকারী নয়, আজকের “গিগ ইকোনমি” (Gig Economy)-র অংশ হিসেবে যারা কাজ করেন – যেমন উবার বা পাঠাওয়ের রাইডশেয়ারিং ড্রাইভার, ফুডপ্যান্ডা বা সহজ ফুডের ফুড ডেলিভারি কর্মী, ফ্রিল্যান্সিং প্ল্যাটফর্মে কাজ করা কন্টেন্ট রাইটার বা গ্রাফিক ডিজাইনার – তাদের অবস্থাও তথৈবচ। তারা কোনো নির্দিষ্ট কোম্পানির স্থায়ী কর্মী নন, তারা কাজ করেন প্ল্যাটফর্মের বেঁধে দেওয়া শর্ত অনুযায়ী, অনেকটা দিনমজুরের মতো। তাদের কাজের কোনো নিরাপত্তা (Job Security) নেই, নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা নেই, অসুস্থতাজনিত ছুটি নেই, স্বাস্থ্যবিমা বা ভবিষ্যৎ তহবিলের (Provident Fund) মতো সামাজিক সুরক্ষাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। তাদের আয় নির্ভর করে প্ল্যাটফর্মের নির্ধারিত রেট এবং অ্যালগরিদমের খামখেয়ালিপনার ওপর। তারা যেন আধুনিক যুগের শ্রমিক, যারা কোনো কারখানার মালিকের অধীনে নয়, বরং এক অদৃশ্য, সর্বব্যাপী প্ল্যাটফর্মের দয়ায় বেঁচে থাকে। ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ গাই স্ট্যান্ডিং (Guy Standing) তার বিখ্যাত বই “দ্য প্রিক্যারিয়েট: দ্য নিউ ডেঞ্জারাস ক্লাস” (The Precariat: The New Dangerous Class) (Standing, 2011)-এ এই অস্থিতিশীল, অনিশ্চিত, অধিকারহীন কর্মজীবী শ্রেণিকে “প্রিক্যারিয়েট” (Precariat) বা অস্থিতিশীল শ্রমিক শ্রেণি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই প্রিক্যারিয়েট শ্রেণিই যেন টেকনো-ফিউডালিজমের নতুন ভূমিদাস বাহিনী, যারা ডিজিটাল লর্ডদের মুনাফার চাকা সচল রাখতে নিজেদের ঘাম-শ্রম বিলিয়ে দিচ্ছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে কন্টেন্ট মডারেটরদের (Content Moderators) মতো একদল অদৃশ্য কর্মী, যারা প্রতিদিন হাজার হাজার বীভৎস, হিংসাত্মক, পর্নোগ্রাফিক কন্টেন্ট দেখে প্ল্যাটফর্মগুলোকে “পরিষ্কার” রাখার মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু মানসিকভাবে পীড়াদায়ক কাজ করেন, খুবই সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে এবং প্রায়শই চরম গোপনীয়তার মধ্যে। মেরি এল. গ্রে (Mary L. Gray) ও সিদ্ধার্থ সুরি (Siddharth Suri) তাদের “ঘোস্ট ওয়ার্ক” (Ghost Work: How to Stop Silicon Valley from Building a New Global Underclass) বইতে এই ‘অদৃশ্য’ শ্রমিকদের মানবেতর জীবনের করুণ চিত্র তুলে ধরেছেন (Gray & Suri, 2019)। এদেরকে বলা যেতে পারে আধুনিক যুগের ‘ডিজিটাল কুলি’ বা ‘অ্যালগরিদমের দাস’।

৫. খাজনাভিত্তিক অর্থনীতি (Rent-based Economy)

যেমনটি আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ইয়ানিস ভারুফাকিস এবং সেড্রিক ডুরান্ডের মতে, টেকনো-ফিউডালিজমে চিরায়ত মুনাফার (Profit derived from production and sale) চেয়ে খাজনা বা রেন্টের (Rent extracted from control over assets), বিশেষত ‘ডিজিটাল খাজনা’র গুরুত্ব অনেক বেশি। অ্যামাজন তার প্ল্যাটফর্মে অন্য বিক্রেতাদের (Third-party sellers) জিনিস বিক্রি করতে দেওয়ার বিনিময়ে একটা নির্দিষ্ট হারে কমিশন বা খাজনা আদায় করে। গুগল বা ফেসবুক বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছ থেকে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করানোর জন্য, অর্থাৎ তাদের প্ল্যাটফর্মে বিজ্ঞাপন দেখানোর সুযোগ দেওয়ার জন্য, বিপুল পরিমাণ অর্থ খাজনা হিসেবে নেয়। অ্যাপল তার অ্যাপ স্টোরে (App Store) ডেভেলপারদের তৈরি অ্যাপ বিক্রির ওপর একটা মোটা অঙ্কের (সাধারণত ৩০%) কমিশন কেটে রাখে, যা এক ধরনের ডিজিটাল টোল বা খাজনা।

আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো ক্লাউড কম্পিউটিং (Cloud Computing) সেবা, যেমন অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিসেস (AWS), মাইক্রোসফট অ্যাজুর (Azure), বা গুগল ক্লাউড প্ল্যাটফর্ম (GCP)। আজকের দিনের প্রায় সমস্ত ডিজিটাল ব্যবসা, স্টার্টআপ থেকে শুরু করে বড় বড় কর্পোরেশন, এমনকি সরকারি সংস্থাও, তাদের ডেটা স্টোরেজ, কম্পিউটিং পাওয়ার এবং অন্যান্য ডিজিটাল পরিকাঠামোর জন্য এই ক্লাউড সেবাগুলোর ওপর নির্ভরশীল। এই সেবা ব্যবহারের জন্য তাদের নিয়মিতভাবে মোটা অঙ্কের ভাড়া বা খাজনা দিতে হয় এই টেক জায়ান্টদের। এই ক্লাউড প্ল্যাটফর্মগুলো এখনকার ডিজিটাল অর্থনীতির মেরুদণ্ড, অনেকটা বিদ্যুৎ বা পানির মতো অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা (Utility)। আর এই পরিষেবার মালিকানা এবং নিয়ন্ত্রণ রয়েছে মুষ্টিমেয় কয়েকটি কোম্পানির হাতে। এই খাজনাগুলো অনেকটা মধ্যযুগের লর্ডদের বিভিন্ন উপায়ে (যেমন, বাজারের টোল, নদীর খেয়া পারাপারের মাসুল, ফসল বা শ্রমের একাংশ) আদায় করা কর বা টোলের মতো, যা সরাসরি উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত না থেকেও সম্পদ আহরণের এক অপ্রতিরোধ্য পথ তৈরি করে। এই টেক লর্ডরা নিজেরা সরাসরি পণ্য উৎপাদন না করেও, অন্যদের তাদের “জমিতে” (প্ল্যাটফর্মে) ব্যবসা করতে বা পরিষেবা ব্যবহার করতে দেওয়ার বিনিময়ে খাজনা আদায় করে ফুলেফেঁপে উঠছে। ভারুফাকিস এই প্রক্রিয়াকে পুঁজিবাদের মৃত্যু এবং এক নতুন, আরও শোষণমূলক ব্যবস্থার উত্থান হিসেবে দেখছেন।

৬. অ্যালগরিদমের শাসন (Algorithmic Governance)

আমাদের ডিজিটাল জীবনযাত্রা, আমাদের অনলাইন অভিজ্ঞতা, এমনকি আমাদের অফলাইন সিদ্ধান্তগুলোও এখন ক্রমশ নিয়ন্ত্রণ করছে অদৃশ্য, জটিল, এবং প্রায়শই দুর্বোধ্য সব অ্যালগরিদম (Algorithm)। আমরা ফেসবুকে কোন বন্ধুর পোস্ট আগে দেখব, ইউটিউবে কোন ভিডিও আমাদের সামনে সুপারিশ হিসেবে আসবে, গুগল সার্চে কোন ওয়েবসাইট বা তথ্য তালিকার প্রথমে দেখাবে, নেটফ্লিক্সে কোন সিনেমা বা সিরিজ আমাদের জন্য “সাজেস্ট” করা হবে, অ্যামাজনে কোন পণ্য আমাদের “পছন্দ” হতে পারে বলে দেখানো হবে – সবকিছুই নির্ধারিত হয় এই স্বয়ংক্রিয় সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী অ্যালগরিদমের মাধ্যমে।

এই অ্যালগরিদমগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যাতে আমরা প্ল্যাটফর্মে আরও বেশি সময় কাটাই, আরও বেশি ক্লিক করি, আরও বেশি কনটেন্ট শেয়ার করি, এবং ফলস্বরূপ আরও বেশি ডেটা তৈরি করি, যা তাদের ব্যবসায়িক মডেলের মূল চালিকাশক্তি। এর ফলে আমরা অনেক সময়ই “ফিল্টার বাবল” (Filter Bubble) বা “ইকো চেম্বার” (Echo Chamber)-এর শিকার হই। অর্থাৎ, অ্যালগরিদম আমাদের এমন তথ্য ও মতামতই বেশি করে দেখাতে থাকে, যা আমাদের পূর্ববর্তী পছন্দের সাথে বা বিদ্যমান বিশ্বাসের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। এর ফলে আমরা ভিন্নমত বা বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গির সংস্পর্শ থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাই, আমাদের জানার পরিধি সংকীর্ণ হয়ে আসে, এবং সমাজে মেরুকরণ (Polarization) ও অসহিষ্ণুতা বাড়ে। (Pariser, 2011)

শুধু তাই নয়, এই অ্যালগরিদমগুলো প্রায়শই “ব্ল্যাক বক্স” (Black Box) হিসেবে কাজ করে – অর্থাৎ, কীভাবে তারা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, কোন কোন ফ্যাক্টরকে তারা গুরুত্ব দিচ্ছে, তা আমাদের কাছে, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে তাদের নির্মাতাদের কাছেও পুরোপুরি স্বচ্ছ নয়। এর ফলে অ্যালগরিদমিক বায়াস (Algorithmic Bias) বা পক্ষপাতদুষ্টতার ঝুঁকি তৈরি হয়। যদি অ্যালগরিদম তৈরির ডেটাসেটে বা তার ডিজাইনারদের মধ্যে কোনো সামাজিক পূর্বসংস্কার (Prejudice) বা বৈষম্যমূলক চিন্তাভাবনা থেকে থাকে, তাহলে সেই অ্যালগরিদমও সেই বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে – যেমন, চাকরির আবেদনে, ঋণের আবেদনে, বা এমনকি অপরাধী শনাক্তকরণের ক্ষেত্রেও বর্ণ, লিঙ্গ, বা শ্রেণির ভিত্তিতে পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এই অ্যালগরিদমিক নিয়ন্ত্রণ আমাদের স্বাধীন চিন্তা ও বিচারবুদ্ধি প্রয়োগের ক্ষমতাকে খর্ব করে, আমাদেরকে ক্রমশ অ্যালগরিদমের দাসে পরিণত করে। আমরা যেন এক অদৃশ্য প্রভুর ইশারায় চালিত হচ্ছি, যার কোনো চেহারা নেই, কোনো জবাবদিহিতা নেই।

৭. সার্বভৌমত্বের অবক্ষয় (Erosion of Sovereignty)

এই টেক জায়ান্টগুলো এতটাই বিশাল, সম্পদশালী এবং বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত হয়ে উঠেছে যে তারা অনেক ক্ষেত্রে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রকেও (Nation-State) তোয়াক্কা করছে না বা করতে চাইছে না। বিভিন্ন দেশে কর ফাঁকি দেওয়া বা অত্যন্ত কম হারে কর দেওয়ার জন্য জটিল আইনি ও আর্থিক কাঠামো ব্যবহার করা (Tax Avoidance), ডেটা প্রাইভেসি সংক্রান্ত স্থানীয় আইন লঙ্ঘন করা, বা নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থে বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ নীতিকে প্রভাবিত করার জন্য লবিং (Lobbying) করা – এই ধরনের অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে প্রায়শই ওঠে। তাদের কার্যক্রম কোনো একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানায় আবদ্ধ নয়, তারা আক্ষরিক অর্থেই বিশ্বজুড়ে তাদের ডিজিটাল সাম্রাজ্য পরিচালনা করছে। তাদের কাছে জাতীয় সীমান্ত অনেক সময়ই একটা অপ্রয়োজনীয় বাধা মাত্র।

এর ফলে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব (Sovereignty) এবং নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার উভয়ই মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়ছে। রাষ্ট্র যখন এই দৈত্যাকার কর্পোরেশনগুলোর ওপর যথাযথ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়, তখন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। টেকনো-ফিউডাল প্রভুরা যেন এক ধরনের অরাষ্ট্রীয় (Non-state) বা আধা-রাষ্ট্রীয় (Quasi-state) সত্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে, যারা নিজেদের নিয়মকানুন নিজেরাই তৈরি করে এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রচলিত রাষ্ট্রীয় আইনের ঊর্ধ্বে নিজেদের স্থান করে নিতে চায়। তারা তাদের প্ল্যাটফর্মকে এক ধরনের “সাইবার-লিবার্টারিয়ান” (Cyber-libertarian) স্বর্গরাজ্য হিসেবে কল্পনা করে, যেখানে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ অবাঞ্ছিত। এই পরিস্থিতি রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে যেমন খর্ব করে, তেমনি নাগরিকদের সুরক্ষার দায়িত্বও রাষ্ট্রের হাত থেকে ফসকে যেতে পারে।

৮. বাজারের মৃত্যু এবং পুঁজিবাদের রূপান্তর (Death of Markets and Transformation of Capitalism)

ইয়ানিস ভারুফাকিসের একটি কেন্দ্রীয় এবং সবচেয়ে বিতর্কিত যুক্তি হলো, টেকনো-ফিউডালিজম চিরায়ত পুঁজিবাদী বাজার ব্যবস্থাকে প্রায় ধ্বংস করে দিচ্ছে বা করে ফেলেছে। চিরায়ত পুঁজিবাদে বাজার ছিল অসংখ্য ক্রেতা ও বিক্রেতার প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র। কিন্তু আজকের ডিজিটাল অর্থনীতিতে, যেখানে অ্যামাজন, গুগল, ফেসবুকের মতো কয়েকটি প্ল্যাটফর্মই পুরো বাজার বা বাজারের একটি বড় অংশ দখল করে নিয়েছে, সেখানে আর তেমন কোনো প্রতিযোগিতা নেই। অ্যামাজনের কথাই ধরুন, এটি শুধু একটি অনলাইন দোকান নয়, এটি নিজেই একটি সুবিশাল বাজারস্থান (Marketplace) যেখানে লক্ষ লক্ষ ছোট-বড় বিক্রেতা তাদের পণ্য বিক্রি করে। কিন্তু এই বাজারস্থানের সমস্ত নিয়মকানুন, বিক্রেতাদের কাছ থেকে আদায় করা কমিশন বা ফি, তাদের পণ্যের ডিসপ্লে বা র‍্যাংকিং, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, ক্রেতাদের সমস্ত ডেটার মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ – সবকিছুই একচ্ছত্রভাবে অ্যামাজনের হাতে। এখানে চিরায়ত অর্থে কোনো মুক্তবাজার (Free Market) বা অবাধ প্রতিযোগিতা নেই। বিক্রেতারা অ্যামাজনের দয়ার ওপর নির্ভরশীল।

ভারুফাকিস আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেন যে, শুধু বাজারই নয়, খোদ পুঁজিই (Capital) তার চরিত্র হারিয়েছে। আগেকার দিনে পুঁজিপতিরা তাদের পুঁজি বিনিয়োগ করে কারখানা বানাত, শ্রমিক নিয়োগ করত, পণ্য উৎপাদন করত এবং বাজারে বিক্রি করে মুনাফা করত। কিন্তু এখন, এমনকি বড় বড় পুঁজিপতি বা বিনিয়োগকারী সংস্থাকেও এই টেক-লর্ডদের প্ল্যাটফর্মে প্রবেশাধিকার পাওয়ার জন্য, তাদের ক্লাউড সার্ভিস ব্যবহার করার জন্য, বা তাদের প্ল্যাটফর্মে বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য নিয়মিতভাবে খাজনা বা ভাড়া গুনতে হচ্ছে। পুঁজি নিজেই যেন এক ধরনের ভ্যাসাল (Vassal) বা অনুগত প্রজার স্তরে নেমে এসেছে, যে তার লর্ডকে (টেক জায়ান্টকে) খাজনা দিতে বাধ্য। এই পরিস্থিতিতে, মুনাফা অর্জনের চিরায়ত পুঁজিবাদী প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং তার জায়গা নিচ্ছে খাজনা আদায়ের ফিউডাল বা সামন্ততান্ত্রিক প্রক্রিয়া। (Varoufakis, 2023) এই রূপান্তর এতটাই মৌলিক যে একে আর নিছক “পুঁজিবাদের নতুন রূপ” বলা চলে না, বরং একে পুঁজিবাদের গুণগত পরিবর্তন বা এমনকি মৃত্যু হিসেবেও দেখা যেতে পারে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI): টেকনো-ফিউডালিজমের আলাদিনের চেরাগ

এতক্ষণ তো আমরা টেকনো-ফিউডালিজমের কাঠামোটা বোঝার চেষ্টা করলাম। এবার আসা যাক সেই আলাদিনের চেরাগের কথায়, যা এই নয়া সামন্ত প্রভুদের হাতে তুলে দিয়েছে প্রায় অসীম ক্ষমতা। সেই চেরাগটাই হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা AI। AI যেন এই ব্যবস্থার শিরা-উপশিরায় রক্ত সঞ্চালন করছে, একে আরও শক্তিশালী, আরও অপ্রতিরোধ্য, আরও সর্বগ্রাসী করে তুলছে। চ্যাটজিপিটি (ChatGPT)-র মতো জেনারেটিভ এআই (Generative AI) মডেলগুলোর সাম্প্রতিক উত্থান টেকনো-ফিউডালিজমের আলোচনাকে আরও উস্কে দিয়েছে। এই শক্তিশালী এআই মডেলগুলো তৈরি এবং প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ ডেটা এবং বিশাল কম্পিউটিং ক্ষমতা, যা মূলত হাতে গোনা কয়েকটি টেক জায়ান্টের (যেমন, মাইক্রোসফট-সমর্থিত ওপেনএআই, গুগল, মেটা) হাতেই রয়েছে। চলুন, একটু বিস্তারিতভাবে দেখি, কীভাবে AI এই ভয়ঙ্কর খেলাটায় মূল খেলোয়াড়ের ভূমিকা নিচ্ছে:

ক. ডেটা শোষণের অকল্পনীয় ক্ষমতা

আগেই বলেছি, টেকনো-ফিউডালিজমের প্রাণভোমরা হলো ডেটা। যত বেশি ডেটা, তত বেশি ক্ষমতা। একটা সময় ছিল যখন মানুষ হাতে-কলমে তথ্য সংগ্রহ করত, বিশ্লেষণ করত। কিন্তু এখন যে বিপুল পরিমাণ ডেটা প্রতি মুহূর্তে তৈরি হচ্ছে – যাকে বলা হয় বিগ ডেটা (Big Data) – তা মানুষের পক্ষে প্রক্রিয়াকরণ করা একেবারেই অসম্ভব। এখানেই AI তার আসল জাদুটা দেখাচ্ছে। মেশিন লার্নিং (Machine Learning), ডিপ লার্নিং (Deep Learning), ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং (Natural Language Processing) – এই সব জটিল নামের AI প্রযুক্তি ব্যবহার করে টেক-জায়ান্টগুলো প্রতি সেকেন্ডে কোটি কোটি মানুষের অনলাইন কার্যকলাপ, তাদের কথোপকথন, তাদের ছবি, তাদের ভিডিও, তাদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য, তাদের আর্থিক লেনদেন – সবকিছু বিশ্লেষণ করতে পারছে। তারা আমাদের অনলাইন আচরণের এমন সব সূক্ষ্ম প্যাটার্ন (Pattern) খুঁজে বের করছে, যা থেকে আমাদের সম্পর্কে এমন সব ভবিষ্যদ্বাণী (Prediction) করতে পারছে, যা হয়তো আমরা নিজেরাও কল্পনা করতে পারি না। আমরা এরপর কী কিনব, কোন রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করব, আমাদের মানসিক অবস্থা এখন কেমন, আমরা কোন রোগে আক্রান্ত হতে পারি – এই সব কিছুই তাদের নখদর্পণে চলে আসছে। শোশানা জুবফ (Shoshana Zuboff) তার “দ্য এজ অফ সার্ভেইল্যান্স ক্যাপিটালিজম” (The Age of Surveillance Capitalism)-এ এই প্রক্রিয়াকে বলেছেন ‘আচরণগত উদ্বৃত্ত’ (Behavioural Surplus) আহরণ। তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাগুলোকে নিংড়ে মুনাফা তৈরির কাঁচামালে পরিণত করা হচ্ছে, আর এই পুরো প্রক্রিয়াটার ইঞ্জিন হিসেবে কাজ করছে AI (Zuboff, 2019)। এই জ্ঞানই তাদের হাতে তুলে দিচ্ছে আমাদের পছন্দকে প্রভাবিত করার, আমাদের সিদ্ধান্তকে নিয়ন্ত্রণ করার এবং শেষ পর্যন্ত আমাদের স্বাধীনতাকে খর্ব করার এক বিশাল ক্ষমতা। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারির কথা মনে আছে? কীভাবে লক্ষ লক্ষ ফেসবুক ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং ব্রেক্সিট গণভোটকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হয়েছিল, তা এই AI চালিত ডেটা বিশ্লেষণের একটা ভয়ঙ্কর উদাহরণ।

খ. অ্যালগরিদমিক কারাগার ও অদৃশ্য শাসন

এই বৈশিষ্ট্যটি এই লেখার “অ্যালগরিদমের শাসন” অংশে ইতিমধ্যেই বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে। AI এই অ্যালগরিদমিক ফিল্টারগুলোকে (Algorithmic Filters) আরও শক্তিশালী করে আমাদের অজান্তেই আমাদের চারপাশে এক অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করে, যাকে ইলাই প্যারিসার (Eli Pariser) বলেছেন ‘ফিল্টার বাবল’ (Filter Bubble)। এর ফলে আমরা শুধু সেইসব তথ্য, মতামত বা দৃষ্টিভঙ্গিই বেশি করে দেখতে পাই, যা আমাদের পূর্ববর্তী আচরণের সাথে মিলে যায় বা যা অ্যালগরিদম মনে করে আমরা দেখতে চাইব। ভিন্নমত, নতুন চিন্তা বা অপ্রত্যাশিত তথ্যের সাথে আমাদের পরিচয় হওয়ার সুযোগ ক্রমশ কমে আসছে। এর পরিণতি কী হচ্ছে? সমাজে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে, মানুষ নিজের মতের বাইরের সবকিছুকেই ভুল বা ষড়যন্ত্র বলে ধরে নিচ্ছে, ফলে মেরুকরণ (Polarization) তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। গণতান্ত্রিক আলাপ-আলোচনার সুস্থ পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে, কারণ মানুষ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার বা শোনার ধৈর্য হারিয়ে ফেলছে। AI চালিত এই অ্যালগরিদমগুলোই যেন হয়ে উঠছে একালের অদৃশ্য কারারক্ষী, যারা আমাদের চিন্তার জগৎকে এক নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আটকে রাখছে।

গ. শ্রমিকের বিদায় ঘণ্টা ও ডিজিটাল দাসত্বের নতুন শেকল

AI-এর কল্যাণে অটোমেশন (Automation) বা স্বয়ংক্রিয়তা বাড়ছে ঝড়ের গতিতে। কলকারখানার রোবট থেকে শুরু করে সেলফ-ড্রাইভিং কার, কাস্টমার সার্ভিসের চ্যাটবট, এমনকি সংবাদ লেখা বা ছবি আঁকার মতো সৃজনশীল কাজেও AI মানুষের জায়গা নিতে শুরু করেছে। এর একটা ভালো দিক অবশ্যই আছে – উৎপাদনশীলতা বাড়ছে, অনেক ঝুঁকিপূর্ণ বা একঘেয়ে কাজ থেকে মানুষ মুক্তি পাচ্ছে। কিন্তু মুদ্রার অপর পিঠে রয়েছে এক ভয়াবহ চিত্র। কোটি কোটি মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। যাদের কাজ থাকবে, তাদেরও কাজের ধরণ এবং শর্ত আমূল পাল্টে যাবে। অনেকেই হয়তো তথাকথিত ‘গিগ ইকোনমি’র (Gig Economy) অংশ হয়ে পড়বেন, যা এই লেখার “ডিজিটাল ভূমিদাস বা প্রিক্যারিয়েট” অংশে আলোচিত হয়েছে। AI এই ‘প্রিক্যারিয়েট’ শ্রেণির সংখ্যা আরও বাড়াবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অন্যদিকে, AI সিস্টেম প্রশিক্ষণের জন্য ‘ডিজিটাল কুলি’ বা ‘অ্যালগরিদমের দাস’ তৈরি হচ্ছে, যাদের কথাও এই লেখায় আগেই বলা হয়েছে (Gray & Suri, 2019)।

ঘ. সর্বব্যাপী নজরদারি ও অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ

জর্জ অরওয়েলের “নাইন্টিন এইটি-ফোর” উপন্যাসের ‘বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং ইউ’ কথাটা এখন আর শুধু কল্পনা নয়, বরং আমাদের দৈনন্দিন বাস্তবতার অংশ হয়ে উঠেছে। AI চালিত ফেসিয়াল রিকগনিশন (Facial Recognition) প্রযুক্তি এখন রাস্তাঘাটে, শপিং মলে, এয়ারপোর্টে আমাদের চিনে ফেলতে পারে। ভয়েস রিকগনিশন (Voice Recognition) আমাদের কথা শুনে আমাদের নির্দেশ পালন করতে পারে, আবার আমাদের কথোপকথন রেকর্ডও করতে পারে। স্মার্ট স্পিকার, স্মার্ট টিভি, এমনকি আমাদের হাতের স্মার্টফোনটিও সারাক্ষণ আমাদের ওপর নজর রাখছে। চীনের সোশ্যাল ক্রেডিট সিস্টেম (Social Credit System) তো এই নজরদারির এক চরম উদাহরণ। কিন্তু শুধু রাষ্ট্র নয়, টেক-জায়ান্টরাও তাদের প্ল্যাটফর্ম এবং ডিভাইস ব্যবহার করে আমাদের ওপর সার্বক্ষণিক নজরদারি চালাচ্ছে। এই সংগৃহীত ডেটা শুধু আমাদের কাছে বিজ্ঞাপন দেখানোর জন্যই ব্যবহৃত হচ্ছে না, বরং আমাদের আচরণকে আরও সূক্ষ্মভাবে, আরও কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যও কাজে লাগানো হচ্ছে। জুবফ এই প্রক্রিয়াকে বলেছেন ‘ইনস্ট্রুমেন্টারিয়ান পাওয়ার’ (Instrumentarian Power) – যা অনেকটা পুতুলনাচের মতো, যেখানে সুতোর টানে পুতুল নাচে, কিন্তু পুতুল জানে না কে তাকে নাচাচ্ছে। আমরাও সেই পুতুলের মতোই এই অদৃশ্য শক্তির ইশারায় চালিত হচ্ছি, অথচ ভাবছি আমরা স্বাধীন (Zuboff, 2019)। এই নজরদারি কেবল আমাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তাই কেড়ে নিচ্ছে না, বরং ভিন্নমত পোষণ বা প্রতিবাদের সাহসও কমিয়ে দিচ্ছে।

ঙ. ক্ষমতার অভূতপূর্ব ও বিপজ্জনক কেন্দ্রীভবন

উন্নত AI প্রযুক্তি তৈরি এবং তা পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজন তিনটি প্রধান উপাদান: (ক) বিপুল পরিমাণ ডেটা, (খ) অত্যাধুনিক এবং ব্যয়বহুল কম্পিউটিং পরিকাঠামো (Computing Infrastructure), বিশেষ করে শক্তিশালী জিপিইউ (GPU), এবং (গ) উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন গবেষক ও প্রকৌশলী। দুর্ভাগ্যবশত, এই তিনটি উপাদানই এখন মূলত হাতে গোনা কয়েকটি বহুজাতিক টেক-জায়ান্টের কুক্ষিগত। ছোটখাটো কোম্পানি, স্টার্টআপ, বা ব্যক্তিবিশেষের পক্ষে এদের সাথে পাল্লা দেওয়া প্রায় অসম্ভব। এর ফলে যা ঘটছে, তা হলো AI-এর গবেষণা, উন্নয়ন এবং প্রয়োগের ক্ষমতা ক্রমশ এই গুটিকয়েক সংস্থার হাতেই কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। এর পরিণতি অত্যন্ত বিপজ্জনক। কারণ, যাদের হাতে AI-এর নিয়ন্ত্রণ, প্রকারান্তরে তাদের হাতেই ভবিষ্যতের অর্থনীতির, সমাজের, এমনকি রাজনীতির নিয়ন্ত্রণও চলে যাচ্ছে। ড্যারন অ্যাসেমোগলু (Daron Acemoglu) এবং সাইমন জনসন (Simon Johnson) তাদের সাম্প্রতিক আলোড়ন সৃষ্টিকারী বই “পাওয়ার অ্যান্ড প্রগ্রেস: আওয়ার থাউজ্যান্ড-ইয়ার স্ট্রাগল ওভার টেকনোলজি অ্যান্ড প্রসপারিটি” (Power and Progress: Our Thousand-Year Struggle Over Technology and Prosperity)-তে অত্যন্ত জোরালোভাবে দেখিয়েছেন যে, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি নিজে থেকেই সমাজের সকলের জন্য মঙ্গল বয়ে আনে না। বরং, ইতিহাস সাক্ষী, প্রায়শই প্রযুক্তি ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস ঘটায় এবং গুটিকয়েকের হাতে আরও বেশি সম্পদ ও প্রভাব জমা করে, যদি না সচেতন নাগরিক সমাজ এবং শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় নীতি এই ক্ষমতাকে লাগাম পরানোর জন্য সক্রিয় হয় (Acemoglu & Johnson, 2023)। AI-এর ক্ষেত্রে এই কেন্দ্রীভবন টেকনো-ফিউডাল কাঠামোকে আরও পোক্ত করবে।

চ. নেটওয়ার্কের জাল আর একচেটিয়া রাজত্ব

ফেসবুক, গুগল, হোয়াটসঅ্যাপ বা আমাজনের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো ‘নেটওয়ার্ক প্রভাব’ (Network Effect) নামক এক আশ্চর্য ঘটনা থেকে ব্যাপকভাবে লাভবান হয়। এর মানে হলো, যত বেশি মানুষ একটি প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে, সেই প্ল্যাটফর্মটি অন্যদের জন্য তত বেশি আকর্ষণীয় ও অপরিহার্য হয়ে ওঠে। এই নেটওয়ার্ক প্রভাবের কারণেই এই প্ল্যাটফর্মগুলো খুব সহজেই বিশাল বাজার দখল করে ফেলে এবং একচেটিয়া (Monopoly) বা স্বল্পবিক্রেতার বাজার (Oligopoly) তৈরি করতে পারে। AI এই নেটওয়ার্ক প্রভাবকে আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। কারণ, যত বেশি ব্যবহারকারীর ডেটা একটি AI সিস্টেম পায়, সেটি তত বেশি বুদ্ধিমান, নিখুঁত ও কার্যকর হয়ে ওঠে। আর একটি AI সিস্টেম যত ভালো পারফর্ম করে, তত বেশি ব্যবহারকারী সেটির দিকে আকৃষ্ট হয়। এটি একটি চক্রের মতো, যা ভেদ করে নতুন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীর পক্ষে বাজারে প্রবেশ করা বা টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই দুষ্টচক্র (Vicious Cycle) টেকনো-ফিউডাল প্রভুদের সিংহাসনকে আরও মজবুত ও প্রশ্নাতীত করে তোলে।

ছ. ভূ-রাজনৈতিক দাবাখেলা ও ডিজিটাল উপনিবেশবাদ

AI-এর আধিপত্য নিয়ে বিশ্বজুড়ে এক নতুন ঠান্ডা লড়াই শুরু হয়েছে, যার প্রধান খেলোয়াড় হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। ইউরোপীয় ইউনিয়নও নিজেদের মতো করে এই খেলায় টিকে থাকার চেষ্টা করছে। চীন যেখানে রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে AI-এর উন্নয়ন ঘটাচ্ছে এবং নজরদারি প্রযুক্তিতে বিশ্বে এক নম্বর হওয়ার পথে, সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রাইভেট কোম্পানিগুলোই এই অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি। এই প্রতিযোগিতার ফলে AI প্রযুক্তি আরও দ্রুত উন্নত হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এর ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব সুদূরপ্রসারী। উন্নত দেশগুলো তাদের AI প্রযুক্তি ও প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর এক নতুন ধরনের ‘ডিজিটাল উপনিবেশবাদ’ (Digital Colonialism) কায়েম করতে পারে। এই দেশগুলো উন্নত বিশ্বের টেক-জায়ান্টদের ডেটার কাঁচামাল সরবরাহকারী এবং তাদের তৈরি AI পণ্যের বাজারে পরিণত হতে পারে, যার ফলে তাদের নিজস্ব প্রযুক্তিগত সক্ষমতা তৈরি হওয়ার সুযোগ কমে যাবে। এই গ্লোবাল সাউথের (Global South) দেশগুলো টেকনো-ফিউডাল ব্যবস্থার সবচেয়ে নিচের স্তরে, অনেকটা সেই পুরনো উপনিবেশগুলোর মতোই, শোষিত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে।

যদি এই প্রবণতা চলতে থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে এই এআই প্ল্যাটফর্মগুলোই হয়ে উঠতে পারে নতুন ধরনের ডিজিটাল ফিয়েফ, যেখানে বাকি বিশ্ব তাদের তৈরি করা এআই টুলস এবং অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহারের জন্য খাজনা দিতে বাধ্য থাকবে। এর ফলে জ্ঞান সৃষ্টি, উদ্ভাবন এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতার আরও বেশি কেন্দ্রীভবন ঘটতে পারে। আমরা হয়তো এমন এক ভবিষ্যতের দিকে যাচ্ছি যেখানে কিছু “এআই লর্ড” থাকবে, আর বাকিরা হবে তাদের “এআই সার্ফ”।

এই উদাহরণগুলো হিমশৈলের চূড়ামাত্র। আমাদের ডিজিটাল জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এই নয়া সামন্তবাদের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে, যদি আমরা কান পেতে শুনি।

পুঁজিবাদ নাকি সামন্তবাদ – বিতর্ক কোথায়?

টেকনো-ফিউডালিজম তত্ত্বটি নিঃসন্দেহে উস্কানিমূলক এবং আলোড়ন সৃষ্টিকারী। তবে এটি নিয়ে অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী এবং প্রযুক্তি বিশ্লেষকদের মধ্যে কিন্তু বিতর্কও কম নেই। অনেকেই মনে করেন, আমরা যা প্রত্যক্ষ করছি তা আসলে সামন্তবাদের আক্ষরিক পুনরাবৃত্তি নয়, বরং এটি পুঁজিবাদেরই একটি নতুন, আরও আগ্রাসী, আরও কেন্দ্রীভূত এবং আরও নজরদারিমূলক রূপ।

তাদের মতে, ডেটা এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো হলো নতুন ধরনের পুঁজি (Digital Capital), এবং টেক জায়ান্টরা হলো নতুন যুগের অত্যন্ত সফল এবং ক্ষমতাধর পুঁজিপতি। তারা বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করছে, উদ্ভাবনী কৌশলে একচেটিয়া (Monopoly) বা স্বল্পবিক্রেতার বাজার (Oligopoly) আধিপত্য কায়েম করছে, এবং শ্রমিকদের (বিশেষ করে গিগ কর্মী এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর সস্তা ডেটা লেবেলারদের) আরও সূক্ষ্মভাবে এবং কার্যকরভাবে শোষণ করছে। এই ধারাকে শোশানা জুবফ (2019) “নজরদারি পুঁজিবাদ” (Surveillance Capitalism) হিসেবে নামকরণ করেছেন, যেখানে মানুষের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে মুনাফা তৈরি করা হয়। আবার, নিক সর্নিসেক (Nick Srnicek, 2017) তার “প্ল্যাটফর্ম ক্যাপিটালিজম” (Platform Capitalism) বইতে দেখিয়েছেন কীভাবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো ডেটা নিষ্কাশন, নেটওয়ার্ক এফেক্ট এবং ক্লাউড কম্পিউটিং-এর ওপর ভিত্তি করে নতুন ধরনের ব্যবসায়িক মডেল তৈরি করেছে, যা চিরায়ত শিল্প পুঁজিবাদের থেকে আলাদা, কিন্তু তবুও পুঁজিবাদেরই অন্তর্গত। এই সমালোচকদের মতে, “টেকনো-ফিউডালিজম” শব্দটি কিছুটা অতিসরলীকরণ এবং ঐতিহাসিক সামন্তবাদের সাথে এর মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। যেমন, সামন্তবাদে ভূমিদাসরা আইনত জমির সাথে বাঁধা থাকত, কিন্তু আজকের ডিজিটাল ব্যবহারকারীরা তত্ত্বগতভাবে যে কোনো প্ল্যাটফর্ম ত্যাগ করতে পারে (যদিও নেটওয়ার্ক এফেক্ট এবং ডেটা লক-ইনের কারণে তা কঠিন)।

অন্যদিকে, যারা টেকনো-ফিউডালিজম তত্ত্বের পক্ষে, যেমন ভারুফাকিস বা ডুরান্ড, তারা জোরালোভাবে বলেন যে বর্তমান ব্যবস্থায় চিরায়ত বাজারের ভূমিকা যেভাবে निর্ণায়কভাবে কমে আসছে এবং খাজনাভিত্তিক আয়ের পরিমাণ যেভাবে রকেট গতিতে বাড়ছে, তা আর যাই হোক, চিরায়ত পুঁজিবাদের সংজ্ঞার সাথে কিছুতেই মেলে না। সামন্তযুগে যেমন লর্ডরা সরাসরি উৎপাদনের (চাষাবাদ) সাথে নিজেরা জড়িত না থেকেও ভূমিদাসদের উৎপাদিত ফসলের একটা বড় অংশ বা তাদের শ্রম খাজনা হিসেবে আদায় করতেন, তেমনি আজকের টেক লর্ডরাও তাদের প্ল্যাটফর্মের ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ খাটিয়ে অন্যদের (ব্যবহারকারী, বিক্রেতা, ডেভেলপার, এমনকি অন্যান্য পুঁজিবাদী সংস্থাকেও) কাছ থেকে বিভিন্ন রূপে খাজনা আদায় করছেন। তাদের মতে, মুনাফা অর্জনের চিরায়ত পুঁজিবাদী প্রক্রিয়ার (অর্থাৎ, বিনিয়োগ -> উৎপাদন -> বিক্রি -> মুনাফা) চেয়ে এই খাজনা আদায় প্রক্রিয়া এখন অর্থনীতির অনেক বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে এবং বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। (Varoufakis, 2023; Durand, 2020) পুঁজি নিজেই এখন এই টেক-লর্ডদের কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে, যা পুঁজিবাদের মৌলিক ধারণার পরিপন্থী।

আসলে সত্যিটা হয়তো এই দুই চরম ব্যাখ্যার মাঝখানে কোথাও একটা ধূসর অঞ্চলে লুকিয়ে আছে। হতে পারে, আমরা এমন এক জটিল, মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, যেখানে পুঁজিবাদের কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য (যেমন, ব্যক্তিগত মালিকানা, মুনাফার আকাঙ্ক্ষা) যেমন এখনও বজায় থাকছে, তেমনি সামন্তবাদের কিছু গা ছমছমে ছায়াও নতুন রূপে, নতুন পোশাকে ফিরে আসছে। পৃথিবীটা তো আর সাদা-কালো নয়, এখানে ভালো-মন্দ, সাদা-কালোর বাইরেও অনেক সূক্ষ্ম রঙের খেলা চলে। তবে নামের বিতর্ক যা-ই হোক না কেন, একটা বিষয় স্পষ্ট: ডিজিটাল প্রযুক্তি আমাদের অর্থনীতি ও সমাজে ক্ষমতার ভারসাম্যে এক বিশাল ওলটপালট ঘটিয়েছে, এবং এই পরিবর্তনের সুফল মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে, যা গভীর উদ্বেগের কারণ।

এর পরিণতি কী হতে পারে?

যদি টেকনো-ফিউডালিজমের এই ধারা অব্যাহত থাকে এবং এটি সত্যিই আমাদের সমাজের প্রধান সাংগঠনিক নীতি হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে তার সুদূরপ্রসারী এবং সম্ভবত বিধ্বংসী পরিণতি সম্পর্কে আমাদের এখনই সচেতন হওয়া দরকার।

১. ক্রমবর্ধমান অসাম্য (Growing Inequality): ক্ষমতা ও সম্পদ গুটিকয়েক টেক লর্ড এবং তাদের কোম্পানির হাতে আরও বেশি করে জমা হতে থাকবে, আর সাধারণ মানুষ, ছোট ব্যবসায়ী, এবং এমনকি চিরায়ত শিল্পপতিরাও আরও প্রান্তিক এবং ক্ষমতাহীন হয়ে পড়বে। আর্থিক অসাম্যের পাশাপাশি জ্ঞান, তথ্য এবং সুযোগের অসাম্যও (Digital Divide) আরও প্রকট হবে। একটি ক্ষুদ্র অংশ “ডিজিটাল এলিট” (Digital Elite) হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে, আর বাকি বিশাল জনগোষ্ঠী তাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে।

২. গণতন্ত্রের ক্ষয় (Erosion of Democracy): টেক জায়ান্টদের হাতে যদি নীতি নির্ধারণী ক্ষমতা চলে যায় (যা ইতিমধ্যেই বিভিন্ন দেশে লবিং এবং রাজনৈতিক চাঁদা দেওয়ার মাধ্যমে ঘটছে) এবং তথ্যের প্রবাহ যদি সম্পূর্ণরূপে তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় (যেমনটি AI-চালিত ফিল্টার বাবল ও ইকো চেম্বারের ক্ষেত্রে দেখা যায়), তাহলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। নাগরিকদের স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করার, সংগঠিত হওয়ার এবং নিজেদের প্রতিনিধিদের নির্বাচন করার ক্ষমতা কমে যাবে। ভুয়া খবর (Fake News), বিদ্বেষপূর্ণ প্রচারণা (Hate Speech) এবং সুপরিকল্পিত ডিসইনফরমেশন ক্যাম্পেইন (Disinformation Campaigns) জনমতকে বিষাক্ত করে তুলবে, সামাজিক বিভাজন বাড়াবে এবং নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ করবে। রাষ্ট্র নিজেই এই টেক লর্ডদের হাতের পুতুলে পরিণত হতে পারে।

৩. উদ্ভাবনের পথে বাধা (Stifling Innovation): যদিও টেক জায়ান্টরা নিজেদেরকে উদ্ভাবনের অগ্রদূত হিসেবে জাহির করে, বাস্তবতা হলো, কয়েকটি বড় কোম্পানি যখন পুরো বাজার বা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি (যেমন AI) নিজেদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়, তখন নতুন এবং ছোট উদ্যোগপতিদের (Entrepreneurs) পক্ষে সেই বাজারে প্রবেশ করা বা টিকে থাকা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। এই টেক জায়ান্টরা প্রায়শই সম্ভাবনাময় ছোট প্রতিদ্বন্দ্বীদের হয় কিনে নেয় (Acquisition) অথবা তাদের আইডিয়া নকল করে বা তাদের বাজারে প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করে তাদের ধ্বংস করে দেয় (যাকে “কিল জোন” – Kill Zone – বলা হয়)। এর ফলে সত্যিকারের যুগান্তকারী উদ্ভাবনের (Disruptive Innovation) বদলে অনুকরণ (Imitation) এবং ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের (Incremental Improvement) প্রবণতা বাড়ে, যা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির গতিশীলতাকে হ্রাস করে।

৪. ব্যক্তিগত স্বাধীনতার চরম সংকোচন (Drastic Loss of Personal Freedom): সার্বক্ষণিক ডিজিটাল নজরদারি এবং ব্যক্তিগত ডেটা সংগ্রহের ফলে, বিশেষত AI-এর ক্রমবর্ধমান ক্ষমতার কারণে, আমাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা (Privacy) বলে আর কিছু থাকবে না। আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি পছন্দ, প্রতিটি চিন্তাভাবনা (যা আমরা অনলাইনে প্রকাশ করি) রেকর্ড করা হবে, বিশ্লেষণ করা হবে এবং আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হতে পারে। শুধু তাই নয়, এই ডেটা ব্যবহার করে আমাদের আচরণকে সূক্ষ্মভাবে প্রভাবিত করার (Nudging) বা নিয়ন্ত্রণ করার (Manipulation) চেষ্টা করা হবে। আমাদের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা (Autonomy) কমে যাবে, আমরা ক্রমশ অ্যালগরিদমের দাসে পরিণত হব। এই পরিস্থিতি জর্জ অরওয়েলের (George Orwell) “নাইন্টিন এইটি-ফোর” (Nineteen Eighty-Four) উপন্যাসের “বিগ ব্রাদার” (Big Brother)-এর দুঃস্বপ্নকেও হার মানাতে পারে।

৫. সামাজিক অস্থিরতা ও মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি (Social Unrest and Deterioration of Mental Health): AI ও অটোমেশনের ফলে ব্যাপক হারে কর্মচ্যুতি (Job Displacement), অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ক্রমবর্ধমান সামাজিক অসাম্য এবং ব্যক্তিগত হতাশা সমাজে ব্যাপক অসন্তোষ, ক্ষোভ ও অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়ার অতি ব্যবহার, সাইবারবুলিং (Cyberbullying), অনলাইন আসক্তি (Online Addiction) এবং তথ্যের অতিবোঝাই (Information Overload) মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বিষণ্ণতা (Depression), উদ্বেগ (Anxiety) এবং একাকিত্ব (Loneliness) বাড়ছে। এই সামাজিক ও মানসিক সংকটগুলো একসময় বড় ধরনের সামাজিক বিস্ফোরণের জন্ম দিতে পারে।

৬. পরিবেশগত সংকট বৃদ্ধি (Aggravation of Environmental Crisis): টেক জায়ান্টদের ডেটা সেন্টারগুলো পরিচালনা করতে এবং তাদের ডিভাইসগুলো তৈরি করতে প্রচুর পরিমাণে বিদ্যুৎ ও প্রাকৃতিক সম্পদ প্রয়োজন হয়। AI সিস্টেমগুলো, বিশেষ করে বৃহৎ ভাষার মডেল (Large Language Models – LLMs) চালাতে যে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ শক্তির প্রয়োজন হয়, তা প্রায়শই জীবাশ্ম জ্বালানি (Fossil fuels) থেকে আসে। এর ফলে কার্বন নিঃসরণ বাড়ছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সংকটকে আরও তীব্র করে তুলছে। এছাড়া, পুরনো ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলো থেকে তৈরি হওয়া ই-বর্জ্য (E-waste) এবং ইলেকট্রনিক গ্যাজেট ও চিপ তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় খনিজ (যেমন লিথিয়াম, কোবাল্ট) আহরণ পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। টেকনো-ফিউডালিজমের মুনাফাকেন্দ্রিক মডেল পরিবেশগত স্থায়িত্বের (Environmental Sustainability) বিষয়টিকে প্রায়শই উপেক্ষা করে।

এই পরিণতিগুলো কোনো কল্পবিজ্ঞান কাহিনী নয়, বরং বর্তমান প্রবণতাগুলোর যুক্তিসঙ্গত বিশ্লেষণ। এখনই ব্যবস্থা না নিলে এই অন্ধকার ভবিষ্যৎ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

তাহলে উপায় কী? আমরা কি অসহায়? এই আঁধার রাতে আমরা কী করতে পারি?

এতসব ভীতিকর কথা শুনে হতাশ হওয়া স্বাভাবিক। মনে হতে পারে, এই অতিকায়, সর্বশক্তিমান টেক দৈত্যদের সামনে আমরা নিতান্তই ক্ষুদ্র, অসহায় বামন। তাদের ক্ষমতার জাল এতটাই বিস্তৃত ও শক্তিশালী যে তা থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব। কিন্তু মশাই, অত সহজে হাল ছাড়লে তো চলবে না। মানুষের ইতিহাস আমাদের বারবার শিখিয়েছে, মানুষ কখনোই পুরোপুরি অসহায় থাকে না, যদি সে সচেতন হয় এবং রুখে দাঁড়ায়। পরিবর্তন সব সময়ই সম্ভব, যদি আমরা সম্মিলিতভাবে সেই পরিবর্তনের জন্য কাজ করি। কোনো সমস্যা যত বড়ই হোক না কেন, তার সমাধানের পথও কোথাও না কোথাও থাকে। এই জটিল জাল থেকে বেরিয়ে আসার পথটা হয়তো গোলাপ বিছানো নয়, বরং কাঁটায় ভরা। তবে চেষ্টা করতে তো দোষ নেই। সম্মিলিতভাবে কিছু পদক্ষেপ নিলে হয়তো এই টেকনো-ফিউডাল ঢেউয়ের ধাক্কা কিছুটা হলেও সামলানো যাবে। চলুন, তেমন কিছু সম্ভাব্য পথের কথা ভাবা যাক:

১. সজাগ প্রহরী: জ্ঞান ও সচেতনতা বৃদ্ধি: প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো এই নতুন ডিজিটাল বাস্তবতা, টেকনো-ফিউডালিজম বা নজরদারি পুঁজিবাদের বিপদগুলো এবং এর পেছনে AI-এর ভূমিকা সম্পর্কে নিজেদের জানা এবং অন্যদের, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে জানানো। এই প্ল্যাটফর্মগুলো কীভাবে কাজ করে, কীভাবে আমাদের ডেটা ব্যবহৃত হয়, অ্যালগরিদম যে কীভাবে আমাদের চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করছে, এবং এর সুদূরপ্রসারী সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব কী – এই বিষয়গুলো নিয়ে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, গণমাধ্যম, সামাজিক সংগঠন, চায়ের দোকান থেকে শুরু করে খাবার টেবিল পর্যন্ত – সর্বত্র খোলামেলা ও বিস্তারিত আলোচনা হওয়া দরকার। স্কুল-কলেজের পাঠ্যসূচিতে ক্রিটিক্যাল ডিজিটাল লিটারেসি (Critical Digital Literacy) অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা শুধু প্রযুক্তি ব্যবহার করতে না শেখে, বরং এর পেছনের জটিল বিষয়গুলো বুঝতে এবং প্রশ্ন করতে শেখে। শিল্প, সাহিত্য, নাটক, সিনেমার মাধ্যমেও এই সচেতনতা তৈরির কাজ করা যেতে পারে। মানুষ যদি বুঝতেই না পারে যে সে শোষিত হচ্ছে, তাহলে সে প্রতিরোধের কথা ভাববে কী করে?

২. আমার ডেটা, আমার অধিকার: ডেটা মালিকানা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন: ব্যক্তিগত ডেটার আসল মালিক কে? ব্যক্তি নিজে, নাকি যে কর্পোরেশন সেই ডেটা সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াকরণ করছে? এই মৌলিক প্রশ্নটির একটি সুস্পষ্ট এবং ন্যায়সঙ্গত মীমাংসা হওয়া অত্যন্ত জরুরি। আমাদের ব্যক্তিগত তথ্যকে ‘ব্যক্তিগত সম্পত্তি’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি তুলতে হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের জেনারেল ডেটা প্রোটেকশন রেগুলেশন (GDPR) এই দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা ব্যবহারকারীদের তাদের ডেটার ওপর আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ দিয়েছে (European Parliament and Council, 2016)। কিন্তু এটা যথেষ্ট কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। নাগরিকদের ডেটা প্রাইভেসি এবং ডেটা মালিকানার (Data Ownership) অধিকার সুরক্ষিত করার জন্য বিশ্বব্যাপী শক্তিশালী ও কার্যকর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করতে হবে। ‘ডেটা ডিভিডেন্ড’ (Data Dividend) বা ডেটা থেকে কর্পোরেশনগুলো যে বিপুল মুনাফা করছে, তার একটা অংশ ডেটার প্রকৃত মালিক, অর্থাৎ সাধারণ মানুষকে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব নিয়েও চিন্তাভাবনা চলছে। এছাড়াও, ‘ডেটা ট্রাস্ট’ (Data Trust) বা ‘ডেটা সমবায়’ (Data Cooperatives) এর মতো মডেল নিয়েও কাজ হচ্ছে, যেখানে একটি অছি পরিষদ বা সমবায় ব্যবহারকারীদের পক্ষ থেকে তাদের ডেটা পরিচালনা করবে এবং তাদের স্বার্থ রক্ষা করবে। পাশাপাশি, প্রতিটি দেশকেও তাদের নাগরিকদের ডেটার সার্বভৌমত্ব (Data Sovereignty) রক্ষার জন্য নিজস্ব নীতি ও পরিকাঠামো (যেমন, স্থানীয় ডেটা সেন্টার) গড়ে তোলার ওপর জোর দিতে হবে, যাতে বিদেশী কোম্পানির ওপর অতি নির্ভরশীলতা কমানো যায়।

৩. দৈত্যদের লাগাম টানা: শক্তিশালী অ্যান্টি-ট্রাস্ট আইন ও তার প্রয়োগ: সরকার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে এই বিষয়ে জরুরিভাবে হস্তক্ষেপ করতে হবে। গুটিকয়েক টেক-জায়ান্টের হাতে যে বিপুল পরিমাণ ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছে, তা ভেঙে দেওয়ার জন্য শক্তিশালী এবং যুগোপযোগী অ্যান্টি-ট্রাস্ট (বা মনোপলি বিরোধী) আইন প্রণয়ন ও তার কঠোর প্রয়োগ অপরিহার্য। প্রয়োজনে বড় কোম্পানিগুলোকে ভেঙে ছোট করার (Break-up) মতো সাহসী পদক্ষেপও নিতে হতে পারে। ঐতিহাসিক উদাহরণ রয়েছে, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্ট্যান্ডার্ড অয়েল বা এটিঅ্যান্ডটি-কে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল তাদের একচেটিয়া বাজার ভাঙার জন্য। বর্তমান টেক-জায়ান্টদের ক্ষেত্রেও একই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবা যেতে পারে – যেমন, তাদের বিভিন্ন ব্যবসাকে আলাদা করে দেওয়া, অথবা তাদের প্ল্যাটফর্মগুলোকে ‘পাবলিক ইউটিলিটি’ (Public Utility) বা জনসেবামূলক অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা (যেমন বিদ্যুৎ বা জল সরবরাহ) হিসেবে ঘোষণা করে সেগুলোকে কঠোর সরকারি নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনা। টেক জায়ান্টদের কর ফাঁকি বন্ধ করার জন্য একটি সমন্বিত আন্তর্জাতিক কর ব্যবস্থা (Global Tax Regime) গড়ে তুলতে হবে। তবে এই দৈত্যদের রাজনৈতিক প্রভাব এবং লবিং ক্ষমতাও প্রচণ্ড, তাই এই লড়াইটা খুব সহজ হবে না।

৪. AI হোক মানুষের বন্ধু: নৈতিক ও গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা: AI-এর উন্নয়ন ও প্রয়োগ যাতে স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক, পক্ষপাতহীন এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। অ্যালগরিদমিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যে ধরনের জাতিগত, লিঙ্গভিত্তিক বা অন্য কোনো প্রকার পক্ষপাত (Bias) ঢুকে পড়তে পারে, তা দূর করার জন্য সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে হবে। AI সিস্টেমগুলো কীভাবে কাজ করছে, তা বোঝার জন্য ‘ব্যাখ্যাযোগ্য AI’ (Explainable AI – XAI) এর ওপর জোর দিতে হবে। প্রতিটি AI সিস্টেমের কার্যকারিতা নিরপেক্ষভাবে নিরীক্ষা (Audit) করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। অ্যালগরিদমের স্বচ্ছতা (Algorithmic Transparency) ও জবাবদিহিতা (Accountability) নিশ্চিত করার জন্য আইনগত কাঠামো তৈরি করতে হবে। AI-এর নৈতিক নীতিমালা প্রণয়ন এবং তা প্রয়োগের জন্য স্বাধীন ও শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক সংস্থা (Regulatory Body) গঠন করা প্রয়োজন, যেখানে সরকার, প্রযুক্তিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, নীতিবিদ এবং সাধারণ নাগরিকদের প্রতিনিধিরা থাকবেন। AI যেন শুধু কর্পোরেট মুনাফা বা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার না হয়ে ওঠে, বরং তা যেন বৃহত্তর মানবকল্যাণে ব্যবহৃত হয়, সেই লক্ষ্যেই কাজ করতে হবে।

৫. বিকল্পের সন্ধানে: বিকেন্দ্রীভূত ও সমবায়ভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম: বর্তমানে বেশিরভাগ জনপ্রিয় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মই কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত (Centralized)। এর বিকল্প হিসেবে ব্লকচেইন (Blockchain) প্রযুক্তি, ক্রিপ্টোকারেন্সি (Cryptocurrency), ফেডারেটেড সোশ্যাল নেটওয়ার্ক (Federated Social Networks, যেমন Mastodon), পিয়ার-টু-পিয়ার (Peer-to-Peer – P2P) নেটওয়ার্ক, এবং সমবায়ভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম (Platform Cooperativism) – যেখানে ব্যবহারকারী ও কর্মীরাই প্ল্যাটফর্মের মালিক ও পরিচালক – এই ধরনের বিকেন্দ্রীভূত (Decentralized) এবং ব্যবহারকারী-কেন্দ্রিক (User-centric) প্রযুক্তি ও মডেলগুলোকে উৎসাহিত করা ও সমর্থন করা দরকার। এই প্রযুক্তিগুলো কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে ডেটার মালিকানা ব্যবহারকারীর হাতে ফিরিয়ে দিতে এবং আরও গণতান্ত্রিক ও ন্যায্য ডিজিটাল পরিসর তৈরি করতে সাহায্য করতে পারে। ব্যবহারকারী-মালিকানাধীন (User-owned) সমবায় বা অলাভজনক (Non-profit) ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে, যেখানে মুনাফাই শেষ কথা নয়, বরং ব্যবহারকারীদের স্বার্থ ও সামাজিক কল্যাণই হবে মূল লক্ষ্য। যদিও এই প্রযুক্তিগুলোরও নিজস্ব সীমাবদ্ধতা এবং চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবুও বিকল্প পথের সন্ধান চালিয়ে যেতে হবে।

৬. পেটের চিন্তা আগে: সর্বজনীন মৌলিক আয় ও সামাজিক নিরাপত্তা: AI চালিত অটোমেশনের ফলে যদি সত্যিই লক্ষ লক্ষ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে, তাহলে সমাজে ব্যাপক অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য ‘সর্বজনীন মৌলিক আয়’ (Universal Basic Income – UBI) এর মতো যুগান্তকারী সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির কথা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। UBI মানে হলো, রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিককে কোনো শর্ত ছাড়াই একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নিয়মিতভাবে প্রদান করা, যাতে তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো (খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান) পূরণ হয়। এর পাশাপাশি, গিগ কর্মীদের জন্য ন্যায্য মজুরি, কাজের শর্ত এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নতুন শ্রম আইন তৈরি করতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ সকলের জন্য সহজলভ্য করতে হবে, যাতে মানুষ পরিবর্তিত শ্রমবাজারের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে।

৭. নাগরিক প্রতিরোধ ও বিকল্প নির্মাণ: সাধারণ ব্যবহারকারী হিসেবে আমরাও আমাদের দৈনন্দিন আচরণের মাধ্যমে এই একাধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারি। কোন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করব, কোন শর্তে করব, সেই বিষয়ে আরও সচেতন ও জিজ্ঞাসু সিদ্ধান্ত নিতে পারি। ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষায় আরও যত্নবান হতে পারি (যেমন, প্রাইভেসি সেটিংস ঠিক রাখা, অপ্রয়োজনীয় অ্যাপ ডিলিট করা, ভিপিএন ব্যবহার করা)। প্রয়োজনে বিশেষ কোনো শোষণমূলক প্ল্যাটফর্ম বয়কট করা বা তার বিকল্প প্ল্যাটফর্ম (যেমন, সিগনালের মতো এনক্রিপ্টেড মেসেজিং অ্যাপ, ডাকডাকগো-এর মতো প্রাইভেসি-ফোকাসড সার্চ ইঞ্জিন) ব্যবহারের মতো সম্মিলিত পদক্ষেপও নেওয়া যেতে পারে। ডেটা ইউনিয়ন (Data Union) গঠনের মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা তাদের ডেটার ওপর সম্মিলিত দর কষাকষির ক্ষমতা অর্জন করতে পারে।

৮. নৈতিক প্রযুক্তির (Ethical Tech) বিকাশ ও সমর্থন:
প্রযুক্তিবিদ, ডিজাইনার এবং বিনিয়োগকারীদের এমন প্রযুক্তি ও ব্যবসায়িক মডেল তৈরি করতে উৎসাহিত করতে হবে যা মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং সামাজিক ন্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। মুনাফার পাশাপাশি মানুষের কল্যাণ এবং পরিবেশের সুরক্ষার বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। “টেক ফর গুড” (Tech for Good) আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।

৯. রাষ্ট্রের সক্রিয় ভূমিকা: রাষ্ট্রের শুধুমাত্র নিয়ন্ত্রকের (Regulator) ভূমিকায় থাকলেই চলবে না, তাকে অনেক ক্ষেত্রে ডিজিটাল পাবলিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার (Digital Public Infrastructure) বা জনগণের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ডিজিটাল পরিষেবা (যেমন, নিরাপদ ক্লাউড স্টোরেজ, উন্মুক্ত ডেটা প্ল্যাটফর্ম, ডিজিটাল আইডেন্টিটি সিস্টেম) তৈরি ও প্রদানে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে, যাতে নাগরিকরা বেসরকারি টেক জায়ান্টদের ওপর এককভাবে নির্ভরশীল না হয়ে পড়ে।

১০. পরিবেশ বাঁচাও, AI বাঁচাও: AI-এর পরিবেশগত প্রভাব (Environmental Impact) কমিয়ে আনার জন্য ‘গ্রিন AI’ (Green AI) বা পরিবেশবান্ধব AI প্রযুক্তির গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে হবে এবং টেক কোম্পানিগুলোকে তাদের কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমানোর জন্য চাপ সৃষ্টি করতে হবে। টেকনো-ফিউডালিজমের এই দিকটি প্রায়শই আলোচনার বাইরে থেকে যায়, কিন্তু এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এই পথগুলো সহজ নয়, এবং রাতারাতি কোনো পরিবর্তন আসবে না। এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী প্রচেষ্টা, সাহস এবং সম্মিলিত সদিচ্ছা।

শেষের আগে কিছু কথা

টেকনো-ফিউডালিজম, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, নজরদারি, নিয়ন্ত্রণ – এই সব ভাবতে বসলে মনটা কেমন যেন পাথরচাপা হয়ে যায়। মনে হয়, আমরা এক গোলকধাঁধায় আটকে পড়া অসহায় ইঁদুরের মতো, বেরোবার পথ খুঁজে পাচ্ছি না।

টেকনো-ফিউডালিজম কোনো নিশ্চিত ভবিষ্যদ্বাণী বা নিয়তির লিখন নয়, বরং এটি একটি গুরুতর ও সম্ভাব্য ঝুঁকির দিকে আমাদের সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে, একটি সতর্কবার্তা শোনায়। প্রযুক্তি নিজে ভালোও না, মন্দও না; অনেকটা ধারালো ছুরির মতো। এই ছুরি দিয়ে যেমন রোগীর জীবন বাঁচানো যায়, তেমনি কারও প্রাণ নেওয়াও যায়। এর ব্যবহারই ঠিক করে দেয় এটি আমাদের জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনবে নাকি অভিশাপ। ইন্টারনেট এবং ডিজিটাল প্রযুক্তি নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য অগণিত সুযোগ তৈরি করেছে, জ্ঞান ও যোগাযোগের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে, আমাদের জীবনকে অনেক দিক থেকে সহজ ও সমৃদ্ধ করেছে। কিন্তু এই অপার সম্ভাবনার পাশাপাশি যে গভীর এবং জটিল বিপদগুলো ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে, সেগুলোর ব্যাপারে যদি আমরা এখনই সতর্ক না হই, তাহলে আমরা হয়তো নিজেদের অজান্তেই এক নতুন ধরনের, আরও সূক্ষ্ম ও সর্বব্যাপী পরাধীনতার অদৃশ্য শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়ব।

এতক্ষণ ধরে এতসব আলোচনার পর এখন নিশ্চয়ই আপনাকে বেশ ভাবনায় ফেলে দিয়েছে, চিন্তায় চিড় ধরিয়েছে, পায়ের তলার মাটিটা একটু কেঁপে উঠেছে। তবে ঘাবড়ানোর কিছু নেই, প্রিয় পাঠক। চিড় ধরা মানেই সবকিছু ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া নয়। চিড় ধরা মানে হলো, এবার ভালো করে পর্যবেক্ষণ করার, বিশ্লেষণ করার এবং মেরামতের সময় এসেছে। সময় এসেছে গভীরভাবে ভাবার, কঠিন প্রশ্ন করার, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, সঠিক ও সাহসী পদক্ষেপ নেওয়ার।

তবে, মানুষের ভেতরের সেই অদম্য সৃষ্টিশীলতা আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আদিম প্রবৃত্তিটার ওপর বিশ্বাস হারালে চলবে না। আমরাও হয়তো অনেক ভুল করি, অনেক দুর্বলতার শিকার হই, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো না কোনোভাবে একটা আলোর রেখা খুঁজে বের করার চেষ্টা তো করতেই পারি। এই নয়া সামন্ততন্ত্রের ডিজিটাল জমিদারেরা যতই শক্তিশালী হোক না কেন, ইতিহাসের শিক্ষা হলো, কোনো স্বৈরাচারী ক্ষমতাই চিরস্থায়ী নয়। সম্মিলিত মানবিক প্রচেষ্টা, দূরদর্শিতা আর নৈতিক সাহসের কাছে তাদেরও হয়তো একদিন মাথা নোয়াতে হবে।

আমাদের শুধু চোখ-কান খোলা রাখতে হবে, চারপাশের পরিবর্তনগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে, প্রশ্ন করতে শিখতে হবে – কেন এমন হচ্ছে, কার স্বার্থে হচ্ছে? আর সবচেয়ে বড় কথা, ভাবতে হবে। কারণ, ভাবনা থেকেই জন্ম নেয় নতুন চিন্তা, আর নতুন চিন্তা থেকেই আসে পরিবর্তন। সেই পরিবর্তনের স্বপ্নটা যদি আমরা সবাই মিলে দেখতে শুরু করি, তাহলে হয়তো এই বিষণ্ণ জলছবিতেও একটু একটু করে উজ্জ্বল রঙ লাগতে শুরু করবে। কে জানে, হয়তো আমাদের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর আর অবিরাম প্রচেষ্টাই একদিন এই টেকনো-ফিউডাল কারাগারের অদৃশ্য দেওয়ালগুলো ভেঙে ফেলতে পারবে। হয়তো পারবে। হয়তো পারবে না। কিন্তু চেষ্টা না করে হাল ছেড়ে দেওয়াটা তো কাপুরুষতা, তাই না?

যেমন ধরুন, আপনি এতক্ষণ ধরে এই কাটখোট্টা লেখাটা ধৈর্য ধরে পড়লেন। এটাও তো এক ধরনের প্রতিরোধ, এক ধরনের সচেতন হওয়ার চেষ্টা। হয়তো আমার এই সামান্য কথাগুলো আপনার চিন্তার জগতে একফোঁটা শিশিরবিন্দুর মতো হলেও নাড়া দেবে। আর সেটাই বা কম কীসে? একটা দুটো স্ফুলিঙ্গ থেকেই তো দাবানলের সৃষ্টি হয়।

তথ্যসূত্র

  • Acemoglu, D., & Johnson, S. (2023). Power and Progress: Our Thousand-Year Struggle Over Technology and Prosperity. PublicAffairs.
  • Bloch, M. (1961). Feudal Society (Vol. 1 & 2, L. A. Manyon, Trans.). University of Chicago Press.
  • Durand, C. (2017). Fictitious Capital: How Finance is Appropriating Our Future. Verso Books.
  • Durand, C. (2020). Techno-féodalisme: Critique de l’économie numérique. La Découverte. (English translation: Techno-Feudalism: Critique of the Digital Economy. Verso Books, 2023).
  • European Parliament and Council. (2016). Regulation (EU) 2016/679 of the European Parliament and of the Council of 27 April 2016 on the protection of natural persons with regard to the processing of personal data and on the free movement of such data, and repealing Directive 95/46/EC (General Data Protection Regulation). Official Journal of the European Union, L 119/1.
  • Gray, M. L., & Suri, S. (2019). Ghost Work: How to Stop Silicon Valley from Building a New Global Underclass. Houghton Mifflin Harcourt.
  • Marx, K. (1867). Das Kapital, Kritik der politischen Ökonomie (Band 1). Verlag von Otto Meissner. (English translation: Capital: A Critique of Political Economy, Vol. 1. Penguin Classics, 1990).
  • Morozov, E. (2013). To Save Everything, Click Here: The Folly of Technological Solutionism. Allen Lane.
  • Orwell, G. (1949). Nineteen Eighty-Four. Secker & Warburg.
  • Pariser, E. (2011). The Filter Bubble: What the Internet Is Hiding from You. Penguin Press.
  • Srnicek, N. (2017). Platform Capitalism. Polity Press.
  • Standing, G. (2011). The Precariat: The New Dangerous Class. Bloomsbury Academic.
  • Tarnoff, B. (2022). Internet for the People: The Fight for Our Digital Future. Verso Books.
  • Varoufakis, Y. (2023). Technofeudalism: What Killed Capitalism. Melville House.
  • Zuboff, S. (2019). The Age of Surveillance Capitalism: The Fight for a Human Future at the New Frontier of Power. PublicAffairs.

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.