Table of Contents
ভূমিকা
পশুদের মনস্তত্ত্ব (Animal psychopathology) – এই খটমটে কথাটা শুনলেই কেমন যেন মনে হয়, তাই না? এর মানে হলো, মানুষ ছাড়া অন্য যেসব প্রাণী আছে, তাদের মনের আর আচরণের মধ্যে যদি কোনো গোলমাল দেখা দেয়, সেটা নিয়েই পাঠ।
আগেকার দিনে, মানে ঐতিহাসিকভাবে, পশুদের এই মানসিক সমস্যাগুলো নিয়ে গবেষণার পেছনে একটা অন্যরকম উদ্দেশ্য ছিল। গবেষকরা ভাবতেন, পশুদের ব্যবহার করে হয়তো মানুষের মানসিক রোগগুলো আরও ভালোভাবে বোঝা যাবে (Owen, Treasure & Collier, 2001)। মানে, একটা মানুষকেন্দ্রিক (anthropocentric) ব্যাপার আরকি। কিন্তু এখনকার দিনে, বিবর্তনের চশমা দিয়ে দেখলে, পশুদের এই মানসিক সমস্যাগুলোকে অন্যভাবেও দেখা যায়। হতে পারে, তাদের জানার ক্ষমতায় কোনো ঘাটতি আছে, অথবা তাদের আবেগ-অনুভূতিতে কোনো দুর্বলতা দেখা দিয়েছে, কিংবা তারা কোনো কষ্টের মধ্যে আছে – আর এসবের কারণেই তারা এমন কিছু আচরণ করছে যা পরিবেশের সাথে ঠিক খাপ খাচ্ছে না। এই লেখায় আমরা পশুদের মনস্তত্ত্বের কয়েকটা উদাহরণ নিয়ে কথা বলব। তবে, বলে রাখা ভালো, এই তালিকাটা কিন্তু সম্পূর্ণ নয়। আরও অনেক কিছুই হয়তো বলার বাকি থেকে যাবে।
খাওয়ার গোলমাল (Eating disorders)
বনের পশুদের মধ্যে কিন্তু খাওয়া-দাওয়া নিয়ে তেমন একটা গোলমাল দেখা যায় না বললেই চলে। হ্যাঁ, ঋতু বদলের সাথে বা ছানাপোনা হওয়ার সময় তাদের শরীরের গড়ন কিছুটা এদিক-ওদিক হয় বটে, কিন্তু খাওয়ার ব্যাপারে তারা বেশ স্বাভাবিক। গোলমালটা বাধে খামারের পশু, গবেষণাগারের প্রাণী, আর আমাদের পোষা প্রাণীদের নিয়ে। তাদের মধ্যে এই ধরনের সমস্যা বেশ দেখা যায়। বনের পশুরা যেভাবে খাবার খায়, সেটা মূলত তাদের টিকে থাকার কৌশলের (evolutionary fitness) ওপর নির্ভর করে। খামারের পশুদের ক্ষেত্রেও আমরা এমনটাই আশা করি। কিন্তু গবেষণাগারের প্রাণী আর পোষা জানোয়ারদের বেলায়ও কি একই নিয়ম খাটবে? – এই প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই যায়।
অ্যাকটিভিটি অ্যানোরেক্সিয়া (Activity anorexia)
অ্যাকটিভিটি অ্যানোরেক্সিয়া (AA) – নামটা শুনলেই কেমন যেন একটা অসুস্থতার গন্ধ পাওয়া যায়, তাই না? এটা এমন একটা রোগ, যেখানে ইঁদুরগুলো হঠাৎ করেই খুব বেশি ব্যায়াম করতে শুরু করে, আর সেই সাথে খাবার খাওয়াও কমিয়ে দেয়। এটা অনেকটা মানুষের অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা (anorexia nervosa) বা হাইপারজিমন্যাসিয়া (hypergymnasia) নামের অসুখগুলোর মতো।
যখন ইঁদুরদের ইচ্ছেমতো খাবার আর ব্যায়াম করার জন্য একটা চাকা দেওয়া হয়, তখন তারা সাধারণত ব্যায়াম আর খাবারের মধ্যে একটা বেশ সুন্দর ভারসাম্য তৈরি করে দিব্যি ফিটফাট হয়ে ওঠে। কিন্তু গোলমালটা বাধে তখনই, যখন তাদের খাবার কমিয়ে দেওয়া হয়, অথচ চাকা ব্যবহারের সুযোগটা আগের মতোই অবাধ থাকে। তখন ইঁদুরগুলো খাওয়া কমিয়ে দেয় ঠিকই, কিন্তু ব্যায়াম বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে! ফলাফল? যা হওয়ার তাই হয়। হু হু করে তাদের ওজন কমতে থাকে, আর শেষমেশ বেচারারা মারাই যায়। এই যে দৌড়ানোর নেশা, এটা এমনভাবে তাদের পেয়ে বসে যে, বেশিরভাগ দৌড়াদৌড়িই তারা করে খাবার দেওয়ার নির্ধারিত সময়ের ঠিক আগে আগে।
তবে, সব পরিস্থিতিতেই যে অ্যাকটিভিটি অ্যানোরেক্সিয়া দেখা দেয়, তা কিন্তু নয়। যেমন ধরুন, যদি খাবার ইচ্ছেমতো দেওয়া হয়, কিন্তু চাকা ব্যবহারের সুযোগটা সীমিত করে দেওয়া হয়, তাহলে তাদের খাবার বা ব্যায়ামের অভ্যাসে তেমন কোনো পরিবর্তন আসে না। আবার, যদি খাবার আর চাকা দুটোই সীমিত করে দেওয়া হয়, তাহলেও ইঁদুরগুলো সেটার সাথে ঠিকঠাক মানিয়ে নেয়। আরও মজার ব্যাপার হলো, যদি ইঁদুরদের প্রথমে খাবারের একটা নির্দিষ্ট সময়সূচিতে অভ্যস্ত করানো হয়, আর তারপর ব্যায়ামের চাকা ইচ্ছেমতো ব্যবহার করতে দেওয়া হয়, তাহলেও তারা অ্যাকটিভিটি অ্যানোরেক্সিয়ার মতো আচরণ করে না।
এই গবেষণার ফলাফল থেকে এটাই বোঝা যায় যে, এই যে খামোখা দৌড়ানো, এটা আসলে নতুন খাবারের সময়সূচির সাথে মানিয়ে নিতে বাধা দেয়। আর এই ব্যাপারটা মস্তিষ্কের পুরস্কার ব্যবস্থার (reward system) সাথেও জড়িত (Hampstead, LaBounty & Hurd, 2003)। একটা তত্ত্ব আছে, যেটা বলে যে, এই দৌড়ানোটা আসলে বুনো ইঁদুরের খাবার খোঁজার (foraging) যে স্বাভাবিক আচরণ, সেটারই একটা পরিবর্তিত রূপ। তাই যখন খাবারের অভাব দেখা দেয়, তখন গবেষণাগারের ইঁদুরগুলো আরও বেশি করে দৌড়ায় (অর্থাৎ, খাবার খোঁজে)।
আধা-পেটা থাকার (semi-starvation) প্রভাব প্রাইমেটদের, মানে বানর গোত্রের প্রাণীদের মধ্যেও দেখা গেছে। দীর্ঘ সময় ধরে খাবার কম পেলে রেসাস ম্যাকাক (Rhesus macaque) পুরুষ বানরগুলোও কিন্তু অতিমাত্রায় ছটফটে আর সক্রিয় হয়ে ওঠে (Hebebrand et al., 2003)।
শুকরী অপচয়জনিত সিনড্রোম (Thin sow syndrome)
শুকরী অপচয়জনিত সিনড্রোম (TSS) – এই নামটাও কেমন যেন মন খারাপ করা, তাই না? এটা হলো আবদ্ধ পরিবেশে থাকা শুকরীদের মধ্যে দেখা যাওয়া এক ধরনের আচরণ, যা অনেকটা ওই অ্যাকটিভিটি অ্যানোরেক্সিয়ার মতোই। কিছু শুকরী আছে, যারা গর্ভধারণের প্রথম দিকে হঠাৎ করেই অসম্ভব রকম চঞ্চল হয়ে ওঠে। খাওয়া-দাওয়া প্রায় ছেড়েই দেয়, আর দেখতে দেখতে শুকিয়ে একেবারে কাঠি হয়ে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর পরিণতি হয় মৃত্যু। তারা শীর্ণতা (emaciation), শরীরের তাপমাত্রা কমে যাওয়া বা হাইপোথার্মিয়া (hypothermia), যা তা খাওয়ার বদভ্যাস বা অস্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাস (depraved appetite), অস্থিরতা (restlessness) আর অতিসক্রিয়তায় (hyperactivity) ভুগতে থাকে (Hebebrand et al., 2003)।
এই সিনড্রোমের মূল কারণ হতে পারে সামাজিক আর পরিবেশগত চাপ। আবদ্ধ পরিবেশে থাকা শুকরীদের মধ্যে এই চাপটা বেশি দেখা যায়, বিশেষ করে যখন তাদের বিশাল বিশাল উৎপাদন ইউনিটগুলোতে (intensive production units) আটকে রাখা হয়।
যেসব শুকরী সবচেয়ে বেশি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে থাকে – যেমন, দুধ খাওয়ানোর সময় বা গর্ভবতী অবস্থায় – তাদের নড়াচড়ার সুযোগ খুবই কম থাকে। কারণ, তাদের পুরো ষোলো সপ্তাহের গর্ভাবস্থায় হয় গর্ভধারণের খাঁচায় (barred gestation crates) আটকে রাখা হয়, অথবা দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। এর ফলে তাদের স্বাভাবিক সামাজিক আচরণগুলো বাধা পায় (Radostits, 2000)। তবে, বাচ্চা হওয়ার পর যখন তাদের ছেড়ে দেওয়া হয় আর একসাথে রাখা হয়, তখন নড়াচড়া আর স্বাধীনতার সুযোগ বাড়লেও, সেটা তাদের জন্য বেশ চাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তখন তারা একে অপরের সাথে প্রচণ্ড মারামারি শুরু করে দেয়। যেখানে একটা প্রভাবশালী শুকরী বাকিদের হটিয়ে দিয়ে পেট পুরে খায়। এমনও হতে পারে যে, দলের দুটো দুর্বল শুকরী এই খাবারের লড়াই থেকে নিজেদের বাঁচানোর জন্য এড়িয়ে চলে, আর প্রভাবশালী শুকরীর দ্বারা নিগৃহীত হয়। যে শুকরীরা এই সমস্যায় ভোগে, তাদের খাওয়ার রুচি কমে যায়। কিন্তু প্রায়শই তাদের মধ্যে পিকা (pica) বা যা তা খাওয়ার প্রবণতা, অতিরিক্ত জল পান (polydipsia) আর রক্তাল্পতা (anemic) দেখা যায় (Owen, Treasure & Collier, 2001)।
উনিশশো চল্লিশের দশকে অতিরিক্ত ভিড়ের (overcrowding) প্রভাব নিয়ে কিছু গবেষণা করা হয়েছিল। গর্ভবতী নরওয়ে ইঁদুরদের (Norway rats) একটা ঘরে প্রচুর খাবার আর জল দিয়ে রেখে তাদের বংশবৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল। দেখা গেল, শূকর জনসংখ্যা একটা নির্দিষ্ট সংখ্যায় পৌঁছানোর পর আর বাড়ল না। অতিরিক্ত ভিড় তাদের মধ্যে মানসিক চাপ আর নানারকম মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা তৈরি করেছিল। যদিও সেখানে খাবার আর জলের কোনো অভাব ছিল না, ইঁদুরগুলো খাওয়া আর বংশবৃদ্ধি দুটোই বন্ধ করে দিয়েছিল (Siegel, Hinson & Krank, 1978)।
গুবরে পোকাদের (beetles) ঘনবসতিপূর্ণ পরিবেশেও একই রকম প্রভাব দেখা গেছে। যখন খুব বেশি ভিড় হয়ে যায়, তখন মেয়ে গুবরে পোকারা তাদের ডিম নষ্ট করে ফেলে আর স্বজাতিভুক (cannibalistic) হয়ে একে অপরকে খেতে শুরু করে। পুরুষ গুবরে পোকারা মেয়েদের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, আর প্রচুর খাবার ও জল থাকা সত্ত্বেও জনসংখ্যা আর বাড়ে না। একই ধরনের ঘটনা জ্যাক র্যাবিট (jack rabbits) আর হরিণদের (deer) মধ্যেও দেখা গেছে, যখন তারা অতিরিক্ত ভিড়ের মধ্যে পড়ে (“Sociology: A Self-Corrective for The Population Explosion?”, 1964)।
পিকা (Pica)
পিকা (Pica) – এই শব্দটার মানে হলো, এমন সব জিনিস খাওয়া যেগুলোর কোনো পুষ্টিগুণ নেই। আর এই বিষয়টা নিয়ে এখনও খুব বেশি কিছু জানা যায়নি। গবেষণাগারে, মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীদের মধ্যে এটা পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে ইঁদুরকে কেওলিন (kaolin) (এক ধরনের কাদামাটি) খাইয়ে। কপার সালফেট, অ্যাপোমর্ফিন, সিসপ্ল্যাটিন আর গতির মতো বিভিন্ন বমি হওয়ার স্টিমুলাই বা উত্তেজক দিয়ে ইঁদুরকে কেওলিন খেতে বাধ্য করা হয়েছিল। ইঁদুর যখন কোনো ক্ষতিকর জিনিস খেয়ে ফেলে, তখন তারা কিন্তু বমি করতে পারে না। তাই, ইঁদুরের এই পিকা আচরণটা অন্য প্রাণীদের বমি করার মতোই একটা ব্যাপার; এটা আসলে ইঁদুরের পেটের অস্বস্তি দূর করার একটা উপায় (Saeki et al., 2001)।
কিছু কিছু প্রাণীর মধ্যে পিকা একটা অভিযোজিত বৈশিষ্ট্য (adaptive trait) বলে মনে হয়, মানে এটা তাদের টিকে থাকতে সাহায্য করে। কিন্তু অন্য প্রাণীদের ক্ষেত্রে, যেমন কিছু মুরগির বেলায়, এটা একটা সত্যিকারের মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা। মুরগিরা যখন খাবার কম পায় (ডিম পাড়ার শিল্পে ডিম পাড়ানোকে প্রভাবিত করার জন্য খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া হয়), তখন তারা পিকা দেখাতে পারে। তারা তখন তাদের চারপাশের পুষ্টিহীন জিনিসপত্রে ঠোকরানো বাড়িয়ে দেয় – যেমন, তাদের ঘরের কাঠের কাঠামো, বা বেড়ার তার, বা অন্য পাখির পালক। খাবার কম পেলে বা একেবারেই না পেলে এটা একটা স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। কিছু কিছু ক্ষেত্রে, এই পুষ্টিহীন জিনিসপত্রে ঠোকরানোটা হয়তো শিকার ধরার আচরণেরই একটা অন্যরকম প্রকাশ (Webster, 2003)।
গরু হলো আরেকটা প্রাণী, যাদের মধ্যে পিকার আরও জটিল উদাহরণ দেখা গেছে। যখন গরুর শরীরে ফসফরাসের অভাব হয়, তখন তারা হাড় খায়। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে, তাদের শরীরে ফসফরাসের মাত্রা ঠিক হয়ে যাওয়ার পরও, আর তারা যখন তাদের খাবারে যথেষ্ট পরিমাণে ফসফরাস পায়, তখনও তারা হাড় খাওয়া চালিয়ে যায়। এক্ষেত্রে, প্রমাণ থেকে বোঝা যায় যে, এর পেছনে শারীরিক আর মনস্তাত্ত্বিক দুটো কারণই থাকতে পারে। যে গরুগুলো শরীরে পর্যাপ্ত ফসফরাস থাকার পরও হাড় খাওয়া চালিয়ে যায়, তারা আসলে একটা মনস্তাত্ত্বিক পুরস্কারের (psychological reinforcer) জন্য এটা করে। “শারীরিক কারণের আপাত অনুপস্থিতিতেও যে পিকা চলতে থাকে, তার কারণ হতে পারে শারীরিক অসুস্থতার সময় কোনো শর্তাধীন অসুস্থতার আকস্মিক অর্জন” (Mitchell, Winter & Morisaki, 1977)।
বিড়ালদের ক্ষেত্রেও তাদের স্বাভাবিক পরিবেশে পিকা আচরণ দেখা যায়, আর এর পেছনে যে মনস্তাত্ত্বিক কারণ আছে, তারও প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিছু বিশেষ জাতের বিড়াল (যেমন, সায়ামিজ বিড়াল) অন্য জাতের চেয়ে এই ধরনের আচরণ বেশি দেখায়, তবে বিভিন্ন জাতের বিড়ালকেই পিকা দেখাতে দেখা গেছে। বিড়ালদের প্রথমে উল, তুলা, রাবার, প্লাস্টিক, এমনকি কার্ডবোর্ডের মতো অপুষ্টিকর জিনিস চিবানো আর চোষা শুরু করতে দেখা গেছে, আর তারপর তারা এই জিনিসগুলো গিলে ফেলতে শুরু করে। এই ধরনের আচরণ একটা বিড়ালের জীবনের প্রথম চার বছরের মধ্যে দেখা যায়, তবে এটা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় জীবনের প্রথম দুই মাসে, যখন বিড়ালছানাদের নতুন বাড়িতে আনা হয় (Bradshaw, Neville & Sawyer, 1997)।
কেন এই সময়টাতে এই আচরণটা সক্রিয় হয়ে ওঠে, তা ব্যাখ্যা করার জন্য কিছু তত্ত্ব আছে। যেমন, মায়ের কাছ থেকে আর ভাইবোনদের কাছ থেকে তাড়াতাড়ি দুধ ছাড়ানো এবং একা হয়ে যাওয়ার ফলে যে চাপ তৈরি হয়, আর একটা নতুন পরিবেশে যাওয়ার ফলে যে অস্বস্তি হয় – সেগুলোই হয়তো এর কারণ। উল বা অন্য কোনো জিনিস খাওয়া হয়তো একটা নিজেকে শান্ত করার কৌশল, যা বিড়ালটা পারিপার্শ্বিক পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নেওয়ার জন্য তৈরি করে। যখন বিড়ালের মধ্যে এলাকা দখলের আর যৌন আচরণগুলো প্রকাশ পেতে শুরু করে, অর্থাৎ জীবনের ছয় থেকে আট মাসের মধ্যে, তখন পিকা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এই সামাজিক চাপগুলোও পিকা উস্কে দিতে পারে (Bradshaw, Neville & Sawyer, 1997)।
অন্যান্য চিন্তাভাবনার মধ্যে রয়েছে, চুরির ঝুঁকির কারণে – বিশেষ করে প্রাচ্যদেশীয় জাতের বিড়ালদের মধ্যে – ঘরের ভেতরে আটকে থাকার ফলে শিকার ধরা বা খাওয়ার আচরণেরই একটা অন্যরকম প্রকাশ হিসেবে পিকা দেখা দেওয়া (Bradshaw, Neville & Sawyer, 1997)। প্রাকৃতিক পরিবেশে টিয়াপাখি (যেমন, ম্যাকাও) আর অন্যান্য পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যেও পিকা দেখা গেছে। চার্লস মান (Charles Munn) আমাজন অঞ্চলের ম্যাকাওদের নিয়ে গবেষণা করছেন। এই ম্যাকাওরা তাদের খাওয়া বীজের বিষাক্ততা দূর করার জন্য আমাজনের নদীতীরের কাদামাটি চাটে। আমাজন ম্যাকাওরা দিনে দুই থেকে তিন ঘণ্টা ধরে এই কাদামাটি চাটতে ব্যয় করে (Alcock, 2005)। মান দেখেছেন যে, এই কাদামাটি ম্যাকাওদের খাওয়া বীজের মধ্যে থাকা ট্যানিন আর অ্যালকালয়েড নামের ক্ষতিকর পদার্থগুলো প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। আর মজার ব্যাপার হলো, পেরুর আন্দিজ পর্বতমালার স্থানীয় সংস্কৃতিতেও কিন্তু এই একই কৌশল ব্যবহার করা হয়।
পিকা পোষা প্রাণীদেরও প্রভাবিত করে। যদিও প্রোজ্যাক (Prozac) নামের ওষুধের মতো কিছু ওষুধ পোষা কুকুরের ঝামেলাপূর্ণ আচরণ কমাতে প্রায়শই সাহায্য করে, তবে এই খাওয়ার গোলমালের ক্ষেত্রে সেগুলো খুব একটা কাজে আসে বলে মনে হয় না। বাম্বলি (Bumbley) নামের একটা ওয়ার ফক্স টেরিয়ার (wire fox terrier) কুকুরের গল্প আছে, যে তার এই খাওয়ার গোলমালের জন্য ‘টোয়েন্টি/টোয়েন্টি’ (20/20) নামের একটা টিভি শো-তে এসেছিল। এই গল্পটা ডক্টর নিকোলাস ডডম্যানের (Dr. Nicholas Dodman) একটা বই থেকে নেওয়া হয়েছে (Dodman, 1999, pp. 54-55):
এই কুকুরটার প্রধান সমস্যা ছিল আলো তাড়া করা (যেটাকে ছায়া তাড়াও বলা হয়)। এটা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে ছায়া তাড়া করত, এমনকি প্লাস্টারবোর্ডের দেয়াল খুঁড়েও তার সেই অধরা ভ্রম বা মায়ার পেছনে ছুটত… শো-তে যেটা পরিষ্কারভাবে দেখানো হয়নি, সেটা হলো বাম্বলি যা পেত, তাই গিলে ফেলত। আর তার মালিকদের বাড়িটাকে “বাম্বলি-প্রুফ” করে রাখতে হতো, যাতে তাদের ফেলে যাওয়া কোনো জিনিস সে তার ওই অবিরাম খাওয়ার নেশায় গিলে না ফেলে… তার এই অভ্যাসের ফলে পেটের নাড়িভুঁড়ির জট ছাড়ানোর জন্য তার একবার অপারেশনও হয়েছিল। আর প্রতিদিন, তার মালিকরা কাজ থেকে ফিরে ভয়ে ভয়ে বাড়িতে ঢুকত, এই আশঙ্কায় যে বাম্বলি হয়তো আরও কিছু গিলে ফেলেছে।
ডডম্যান সাহেব বুলিমিয়া (bulimia) আর বাধ্যতামূলক অতিরিক্ত খাওয়ার সাথে মানুষের মৃগীরোগীদের (epileptic patients) খিঁচুনি আচরণের (seizural behavior) সম্পর্ক নিয়ে নতুন কিছু গবেষণার কথা বলেছেন। তিনি মনে করেন, অ্যান্টি-এপিলেপটিক বা মৃগীরোধী ওষুধ পশুদের পিকার কিছু ক্ষেত্রে একটা সম্ভাব্য চিকিৎসা হতে পারে।
আচরণগত ব্যাধি (Behavioral disorders)
প্রাণীদের আচরণগত সমস্যা নিয়ে গবেষণা করাটা, বুঝলেন কিনা, বেশ কঠিন একটা কাজ। কারণ, আমরা তো আর তাদের মনের খবর জানতে পারি না। আর এই যে মনস্তত্ত্বের সমস্যাগুলো বোঝার জন্য আমরা বিভিন্ন প্রাণী মডেল ব্যবহার করি, সেগুলো আসলে কোনো একটা বিশেষ অবস্থা নিয়ে গবেষণা করার জন্য তৈরি করা পরীক্ষামূলক পদ্ধতি। ধরুন, বিষণ্ণতা বা মানসিক চাপের মতো আচরণগত সমস্যা নিয়ে যখন গবেষণা করা হয়, তখন তো আর প্রাণীদের সাথে কথা বলে তাদের মনের অবস্থা জানা যায় না। ভাষার ব্যবহার করতে না পারার কারণে এই ধরনের গবেষণার বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। আর মানুষের সমস্যাগুলোকে সরাসরি মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়াটাও কিন্তু বেশ কঠিন একটা ব্যাপার (Healy, 1987)।
অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার (OCD) (Obsessive compulsive disorder)
প্রাণীদের মধ্যে এই যে অবসেসিভ-কম্পালসিভ আচরণ দেখা যায়, যেটাকে প্রায়শই “স্টিরিওটাইপি” (stereotypy) বা “স্টিরিওটাইপিক্যাল আচরণ” (stereotypical behavior) বলা হয়, সেটাকে বুঝতে হলে এমন একটা নির্দিষ্ট, খামোখা কাজ (বা একটার পর একটা কাজ) হিসেবে ধরতে হবে, যা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশিবার করা হয়। প্রাণীরা কি মানুষের মতো একইভাবে কোনো কিছু নিয়ে ‘অবসেসড’ (obsess) হতে পারে? – এই প্রশ্নের উত্তরটা কিন্তু আমাদের জানা নেই। আর যেহেতু মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীদের এই বাধ্যতামূলক কাজগুলোর পেছনের আসল কারণটাও অজানা, তাই “অস্বাভাবিক পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ” (abnormal repetitive behavior) – এই কথাটা বলাই বোধহয় কম গোলমেলে।
অনেক ধরনের প্রাণীই আছে, যারা এমন সব হাবভাব দেখায়, যেগুলোকে অস্বাভাবিক রকম বারবার করা হচ্ছে বলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক।
নির্দিষ্ট ছকে বাঁধা ও পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ (Ritualized and stereotyped behaviors)
যদিও এই অবসেসিভ-কম্পালসিভ কাণ্ডকারখানাগুলোকে বেশিরভাগ সময়ই একটা রোগ হিসেবে বা পরিবেশের সাথে বেমানান বলে মনে করা হয়, কিছু কিছু নির্দিষ্ট ছকে বাঁধা, বারবার করা আচরণ কিন্তু বেশ কাজেরও হতে পারে। এগুলোকে সাধারণত বলা হয় “নির্দিষ্ট কার্যকরী বিন্যাস” (fixed action patterns)। এই আচরণগুলোর সাথে কিন্তু অবসেসিভ-কম্পালসিভ আচরণের মাঝে মধ্যে বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন – বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে একই রকম গড়ন আর ব্যবহার, আর সেই সাথে বারবার করার একটা প্রবণতা।
অনেক পশুপাখির চালচলনেই এমন কিছু ব্যাপার-স্যাপার দেখা যায়, যা যুগের পর যুগ ধরে প্রায় একই রকম রয়ে গেছে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক – ইঁদুরের গা পরিষ্কার করার (grooming) ভঙ্গিটা। এই কাজটা ওরা কয়েকটা নির্দিষ্ট ধাপে করে, যা সাধারণত এক ইঁদুর থেকে অন্য ইঁদুরে খুব একটা পাল্টায় না। ইঁদুরটা প্রথমে তার গোঁফে থাবা বোলায়, তারপর চোখের চারপাশে, কানের কাছে, আর সবশেষে পুরো শরীর চেটে সাফ করে (Kalueff et al., 2007)। এটার শেষে আরও কিছু হাবভাব যোগ হতে পারে, কিন্তু এই চারটে কাজ একেবারে বাঁধা। এটা যে কত ব্যাপক আর কী পরিমাণ পুনরাবৃত্তিমূলক, তা দেখলেই বোঝা যায় যে, এটা একটা দরকারি আচরণরীতি যা বিবর্তনের স্রোতে টিকে গেছে।
যদিও মানুষ আর পশু, উভয়ের মধ্যেই রোগ হিসেবে এই বারবার করা আচরণগুলো দেখা যায়, সেগুলো কিন্তু সবসময় ওসিডি-র (OCD) একেবারে ঠিকঠাক মডেল হিসেবে কাজ করে না (Lutz, 2014)। যেমন ধরুন, কমলা-ডানাযুক্ত আমাজন টিয়াপাখির (orange-winged amazon parrots) পালক তোলার (feather picking) যে বদভ্যাস, তার পেছনে যেমন জিনের একটা ভূমিকা আছে (মানে, এক ভাইবোনের মধ্যে এই স্বভাব থাকলে অন্যজনের মধ্যেও সেটা দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি), তেমনি দলের মধ্যে যারা খাঁচার দরজার আশেপাশে থাকে, তাদের মধ্যেও এই ব্যাপারটা বেশি দেখা যায় (Garner et al., 2006)। একই গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে, মেয়ে টিয়াদের মধ্যে পালক তোলার বাতিকটা বেশি ছিল, আর এই আচরণের কোনো সামাজিক ছোঁয়াচে ব্যাপার (social transmission) ছিল না; মানে, পালক ছেঁড়া পাখির আশেপাশে থাকা অন্য পাখিরা কেবল তখনই এই আচরণ বেশি দেখাত, যদি তাদের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক থাকত।
একটি বিবর্তনীয় ভিত্তি (An evolutionary basis)
কিছু গবেষক আবার মনে করেন, এই যে ক্ষতিকর অবসেসিভ কম্পালসিভ আচরণগুলো, এগুলো আসলে একটা স্বাভাবিক উপকারী প্রক্রিয়ারই একটু বাড়াবাড়ি রূপ। ব্রুন (Brüne, 2006) যেমনটা বলেছেন, আমাদের মস্তিষ্কের স্ট্রাইটাল (striatal) আর ফ্রন্টাল (frontal) সার্কিটে যদি কোনো গড়বড় হয় – যে সার্কিটগুলো ভবিষ্যতের সম্ভাব্য চাহিদা আর বিপদ-আপদ আন্দাজ করতে সাহায্য করে – তাহলে এমন হতে পারে যে, আমাদের জ্ঞানীয় ক্ষতি পরিহার ব্যবস্থাটা (cognitive harm avoidance system) বড্ড বেশি সজাগ হয়ে উঠবে। তখন মানুষ একটা এমন কোনো অসম্ভাব্য বা অসম্ভব ঘটনা নিয়ে খামোখাই ভয়ে কুঁকড়ে থাকবে (Brüne, 2006; Healy, 1987)। এমনটা অন্য প্রাণীদের বেলাতেও সত্যি হতে পারে বৈকি।
জিনগত কারণ (Genetic factors)
কুকুরদের মধ্যে এই যে বাতিকগ্রস্ততা বা কম্পালশন, এটা কিছু বিশেষ জাতের (breeds) মধ্যে বেশি দেখা যায়। আবার একই মায়ের পেটের (litter) কুকুরছানাদের মধ্যেও একই ধরনের আচরণগত প্রবণতা প্রায় সবার মধ্যেই দেখা যায়। এতে বোঝা যায়, এই গোলমালের পেছনে জিনের একটা হাত আছে। কুকুর মালিকদের জিজ্ঞাসাবাদ করে আর চারটে প্রজাতির (যেমন, মিনিয়েচার আর স্ট্যান্ডার্ড বুল টেরিয়ার, জার্মান শেফার্ড, আর স্টাফোর্ডশায়ার বুল টেরিয়ার) ১৮১টা কুকুরের রক্তের নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, এই জাতগুলো বাধ্যতামূলক আর পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণের দিকে বেশি ঝুঁকে থাকে (Nuwer, 2012)। ক্যানাইন কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার (canine compulsive disorder) বা কুকুরদের এই বাতিকগ্রস্ততার কারণ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে হয়তো মানুষের অবসেসিভ ডিসঅর্ডার (human obsessive disorders) তৈরিতে জিনের আর বংশগতির ভূমিকা বোঝার ক্ষেত্রেও অনেকটা এগিয়ে যাওয়া যাবে (Miller, 1992)।
কুকুরদের শরীরে এমন একটা ক্রোমোজোমও খুঁজে পাওয়া গেছে, যেটা ওসিডি-র (OCD) প্রতি তাদের সংবেদনশীল হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় (“Canine compulsive disorder gene identified in dogs”, 2010)। দেখা গেছে, ক্যানাইন ক্রোমোজোম ৭ (Canine chromosome 7) কুকুরদের অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার, বা আরও নির্দিষ্ট করে বললে, ক্যানাইন কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার (CCD)-এর সাথে সবচেয়ে বেশি জড়িত। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারটা মানুষের ওসিডি-কে কুকুরদের সিসিডি-র সাথে আরও ভালোভাবে মেলাতে সাহায্য করেছে। মজার ব্যাপার হলো, এই ক্যানাইন ক্রোমোজোম ৭ মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যাম্পাস (hippocampus) নামক অংশে কাজ করে, আর মানুষের ওসিডি রোগীদের ক্ষেত্রেও কিন্তু মস্তিষ্কের এই একই জায়গাতেই গোলমালটা দেখা যায়। শুধু তাই নয়, মানুষ আর কুকুর, দুজনের ক্ষেত্রেই ওষুধের চিকিৎসায় একই ধরনের পথ ধরে সাড়া পাওয়া যায়। এসব থেকে মনে হয়, এই দুটো প্রাণীর উপসর্গের মধ্যে মিল আছে এবং চিকিৎসাতেও তারা একইভাবে সাড়া দেয়। এই তথ্যগুলো বিজ্ঞানীদের সিসিডি (CCD) নিয়ে গবেষণা করে মানুষের ওসিডি (OCD) চিকিৎসার আরও কার্যকর আর সহজ উপায় খুঁজে বের করতে সাহায্য করতে পারে।
প্রাণী মডেল (Animal models)
মানুষের ওসিডি-র (OCD) মতো ঘ্যানঘ্যানে আর বারবার করা আচরণ দেখানো পশুদের এই রোগের সম্ভাব্য জিনগত দিক, চিকিৎসার পথ, আর সাধারণভাবে এই আচরণের ভেতরের গোলমালটা বোঝার জন্য একটা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। যদিও এই ধরনের মডেলগুলো কাজের, তবে তাদেরও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে; যেমন, পশুদের মধ্যে এই আচরণটা কি তাদের নিজেদের কাছেও অস্বস্তিকর (ego dystonic) লাগে? সেটা পরিষ্কার নয়। মানে, একটা পশু কি বুঝতে পারে যে তার আচরণটা বাড়াবাড়ি রকমের আর অযৌক্তিক, আর এই ভাবনাটা কি তাকে উদ্বেগে ফেলে? – এসব বিচার করা বেশ কঠিন।
সাইমন ভারমিয়ার (Simon Vermeier) একটা গবেষণায় নিউরোইমেজিং (neuroimaging) বলে একটা কৌশল ব্যবহার করেছিলেন। তিনি ক্যানাইন কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার (CCD) আছে এমন ৯টা কুকুরের মস্তিষ্কে সেরোটোনিন ২এ (serotonin 2A) রিসেপ্টরের যোগান কেমন, সেটা মেপে দেখতে চেয়েছিলেন। এর মাধ্যমে তিনি সেরোটোনার্জিক (serotonergic) আর ডোপামিনার্জিক (dopaminergic) নিউরোট্রান্সমিশন (neurotransmission) নিয়ে তদন্ত করছিলেন। কন্ট্রোল গ্রুপ হিসেবে নেওয়া ১৫টা সুস্থ (অ-বাধ্যতামূলক) কুকুরের সাথে তুলনা করে দেখা গেল, সিসিডি (CCD) থাকা কুকুরগুলোর মস্তিষ্কে এই রিসেপ্টরের যোগান কম, আর সেই সাথে সাবকর্টিক্যাল পারফিউশন (subcortical perfusion) আর হাইপোথ্যালামিক (hypothalamic) যোগানও কম। এই গবেষণার ফলাফল থেকে প্রমাণ মেলে যে, কুকুরদের সেরোটোনার্জিক আর ডোপামিনার্জিক পথগুলোতে একটা ভারসাম্যহীনতা আছে। মানুষের ওসিডি (OCD) নিয়ে করা অন্যান্য গবেষণার সাথে এই গবেষণার ফলাফলের মিল দেখে, এই গবেষণার গঠনগত বৈধতা (construct validity) পাওয়া যায়। আর তা থেকে বোঝা যায়, অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডারে মস্তিষ্কের কার্যকলাপ আর ওষুধের চিকিৎসা নিয়ে আরও গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার জন্য এই কাজটা বেশ নির্ভরযোগ্য আর কাজের হবে (Vermeire et al., 2012)।
সিসিডি (CCD) থাকা কুকুরদের কিছু চিকিৎসা দিয়ে দেখা হয়েছে, তারা কেমন সাড়া দেয়, আর মানুষের বেলায় একই ওষুধ বা আচরণগত চিকিৎসায় তারা কতটা একই রকম বা ভিন্নভাবে সাড়া দিত। দেখা গেছে, দুটো পদ্ধতি মিলিয়ে চিকিৎসা করলে কুকুর আর মানুষ, উভয়ের ক্ষেত্রেই ওসিডি-র (OCD) তীব্রতা আর ঘনঘন হওয়ার প্রবণতা কমাতে সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যায় (Overall & Dunham, 2002)। ওষুধের দিক থেকে দেখলে, কুকুরদের চিকিৎসার জন্য ক্লোমিপ্রামিন (clomipramine) নামের ওষুধটা অ্যামিট্রিপ্টিলিন (amitriptyline) নামের অন্য একটা রাসায়নিকের চেয়ে বেশি কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। ক্যারেন ওভারঅলের (Karen Overall) একটা গবেষণায় দেখা গেছে, আচরণগত থেরাপির সাথে যখন আরও কার্যকর ক্লোমিপ্রামিন ওষুধটা জুড়ে দেওয়া হয়েছে, তখন গবেষণায় অংশ নেওয়া সব কুকুরের মধ্যেই ক্যানাইন কম্পালসিভ ডিসঅর্ডারের লক্ষণগুলো পঞ্চাশ শতাংশেরও বেশি কমে গেছে (Overall & Dunham, 2002)। এই চিকিৎসার ফলাফল কিন্তু মানুষের বাধ্যতামূলক ব্যাধিগুলোর পূর্বাভাসের সাথে বেশ মেলে – যেখানে অনেকটা উন্নতি হয় ঠিকই, কিন্তু অল্প কিছু উপসর্গ থেকেই যায় (Eddy et al., 2004)।
অ্যালিসিয়া গ্রেফের (Alicia Graef) একটা লেখায় (Graef, 2013) বেশ জোর দিয়ে কিছু কথা বলা হয়েছে। তার মতে, মানুষের অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার কীভাবে আরও ভালোভাবে চেনা, বোঝা আর সারিয়ে তোলা যায়, সেই পথ দেখানোর জন্য কুকুরই হলো আমাদের ভবিষ্যৎ। তার কথার পেছনে যুক্তি আছে বটে, কিন্তু সিসিডি (CCD) আর ওসিডি-র (OCD) মধ্যেকার আসল যোগসূত্রটা এখনও পুরোপুরি পরিষ্কার নয়। এখন পর্যন্ত গবেষণায় এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, কুকুরদের জন্য যে চিকিৎসাগুলো কার্যকর, সেগুলো মানুষের জন্যও একইভাবে কাজ করে। কিন্তু তারপরও, এখনও কত কিছুই যে অজানা! অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার একটা অন্যরকম মানসিক রোগ, যা পুরোপুরি সারিয়ে তোলা যায় না। তবে এটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, আর বোঝা যায়। আর সেটা আরও ভালোভাবে করার একটা রাস্তা হতে পারে কুকুরদের সিসিডি (CCD) নিয়ে গবেষণা করা। যে কুকুরগুলো এই ধরনের বাধ্যতামূলক আচরণ দেখায়, তাদের নিয়ে গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা জীববিজ্ঞান আর জিনতত্ত্ব কীভাবে অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডারে ভূমিকা রাখে, সে বিষয়ে অনেক নতুন কিছু জানতে পেরেছেন। রোগ ধরা পড়া কুকুরদের মস্তিষ্কের কার্যকলাপ, হাবভাব আর জিনের মধ্যে সিসিডি (CCD) কীভাবে প্রকাশ পায়, সেটা খুঁটিয়ে দেখে আর গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা তাদের এই নতুন পাওয়া তথ্য কাজে লাগিয়ে আরও ভালো রোগনির্ণয় পদ্ধতি তৈরি করতে পেরেছেন। আর সেই সাথে, কাদের এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি বা কাদের উপসর্গ দেখা দিচ্ছে, সেটাও আরও সহজে চিনে ফেলতে পারছেন। সিসিডি (CCD) থাকা কুকুর আর ওসিডি (OCD) থাকা মানুষের মস্তিষ্কের কাজ আর আচরণের মধ্যে যে মিল, সেটা থেকে বোঝা যায় তাদের মধ্যে একটা যোগসূত্র আছে – শুধু আচরণ আর উপসর্গের ক্ষেত্রেই নয়, চিকিৎসার প্রতি সাড়াদানের ব্যাপারেও। কুকুরদের ক্যানাইন কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার নিয়ে গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা মানুষের অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডারের চিকিৎসার নতুন আর আরও ভালো উপায় বের করার জন্য তাদের শেখা জ্ঞান আরও ভালোভাবে বুঝতে আর কাজে লাগাতে পারছেন।
মানুষের ওসিডি (OCD) ব্যাপারটা বোঝানোর জন্য সবচেয়ে বেশি যে দুটো প্রাণী মডেল ব্যবহার করা হয় – অর্থাৎ ইঁদুর আর নেংটি ইঁদুর (mice) – তাদের কীভাবে কাজে লাগানো হয়েছে, তার কিছু উদাহরণ নিচে দেওয়া হলো।
ইঁদুরের লিভার চাপানো (Lever pressing in rats)
গবেষণাগারে কিছু বিশেষ জাতের ইঁদুর আছে, বুঝলেন? যাদের কিনা বংশের পর বংশ ধরে এমনভাবে বড় করা হয়েছে যে, তারা অন্য জাতের ইঁদুরদের চেয়ে খামোখা কাজ করার (compulsive behaviors) দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ে। যেমন ধরুন, লুইস ইঁদুর (Lewis rats) বলে এক জাত আছে, তারা স্প্র্যাগ ডাউলি (Sprague Dawley) বা উইস্টার (Wistar rats) জাতের ইঁদুরদের চেয়ে অনেক বেশি করে লিভার চাপানোর মতো বাতিকগ্রস্ত আচরণ দেখায়। আবার, প্যারোক্সেটিন (paroxetine) নামের একটা ওষুধ আছে, যেটা এই বাতিক কমানোর জন্য দেওয়া হয়, সেটার প্রতিও তারা কম সাড়া দেয় (Brimberg et al., 2007)।
একটা পরীক্ষায়, এই ইঁদুরগুলোকে অপারেন্ট কন্ডিশনিং (operant conditioning) বলে একটা কৌশলের মাধ্যমে খাবার পাওয়ার জন্য লিভার চাপাতে শেখানো হয়েছিল। মানে, লিভার চাপলেই খাবার পাবে। কিন্তু পরে যখন লিভার চাপানোর পরও খাবার দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হলো, তখন আশা করা হয়েছিল যে ইঁদুরগুলো বুঝি লিভার চাপানো থামিয়ে দেবে। কিন্তু কী আশ্চর্য, লুইস ইঁদুরগুলো অন্য দুই জাতের চেয়ে বেশিবার লিভার চাপতেই থাকল! যদিও তারা সম্ভবত বুঝে গিয়েছিল যে এখন আর খাবার পাওয়া যাবে না। এমনকি ওষুধের চিকিৎসা চলার পরও তারা এই খামোখা লিভার চাপানোটা চালিয়ে গিয়েছিল। এই তিন জাতের ইঁদুরের জিনের মধ্যে কী তফাৎ আছে, সেটা বিশ্লেষণ করলে হয়তো এই বাতিকগ্রস্ত আচরণের জন্য দায়ী জিনগুলোকে খুঁজে বের করা যেতে পারে।
ইঁদুরদের মস্তিষ্কে ডোপামিন (dopamine) বলে একটা রাসায়নিকের মাত্রায় কোনো গড়বড় আছে কিনা, সেই সন্দেহটাও পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। কুইনপাইরোল (quinpirole) নামের একটা রাসায়নিক আছে, যেটা বিশেষভাবে মস্তিষ্কের ডোপামিন ডি২/ডি৩ রিসেপ্টরগুলোকে (dopamine D2/D3 receptors) আটকে দেয়। এই রাসায়নিকটা ইঁদুরদের দেওয়ার পর দেখা গেল, একটা খোলা মাঠের নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় তারা আগের চেয়ে অনেক বেশি করে, একরকম বাতিকগ্রস্তের মতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে (Dvorkin, Perreault & Szechtman, 2006)।
এই পরীক্ষা করার ধরনের কিছু কিছু দিক, যেমন – প্রাণীরা যে পথে জায়গাগুলো পরীক্ষা করত, সেটার পুনরাবৃত্তির মাত্রা, কতবার পরীক্ষা করত, আর কতক্ষণ ধরে করত – এগুলো কুইনপাইরোলের ডোজ বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে লাগল। অর্থাৎ, বাতিকগ্রস্ততাও বেড়ে গেল। তবে, অন্য কিছু দিক – যেমন, পরীক্ষিত জায়গা থেকে আগের জায়গায় ফিরে আসতে কত সময় লাগত, বা সেই যাওয়া-আসা করতে কত সময় নিত – সেগুলো কিন্তু প্রথম ইনজেকশনের পর থেকে পুরো পরীক্ষা জুড়েই একই রকম ছিল। এর মানে হলো, ওসিডি-র (OCD) ডোপামিন ঘাটতির যে মডেল, তার জীববিজ্ঞানে একটা ‘হয় সব নয়তো কিছু নয়’ (all-or-none) ব্যাপারও থাকতে পারে, আবার একটা সংবেদনশীলতাও (sensitization) থাকতে পারে। কে জানে, হয়তো কুইনপাইরোল ওষুধটা ইঁদুরদের কোনো জায়গা পরীক্ষা করার পর যে একটা তৃপ্তির অনুভূতি হয়, সেটা কমিয়ে দেয়। আর তাই তারা বারবার সেই একই জায়গায় ফিরে আসে।
পুরুষ ইঁদুরের ইস্ট্রোজেন স্বল্পতা (Estrogen deficiency in male mice)
মেয়েদের যেমন মাসিক বা ঋতুস্রাবের সময় ওসিডি-র (OCD) উপসর্গের কিছু রদবদল হয়, আর পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে এই রোগটা যেভাবে দেখা দেয়, তার মধ্যেও কিছু তফাৎ আছে – এই সব দেখে হিল আর তার সহকর্মীরা ভাবলেন, ইস্ট্রোজেন (estrogen) নামের হরমোনটার অভাব হলে ইঁদুরদের মধ্যে এই বাতিকগ্রস্ত আচরণ তৈরি হয় কিনা, সেটা একটু খতিয়ে দেখা যাক (Hill et al., 2007)। তারা এমন কিছু পুরুষ ইঁদুর নিলেন যাদের শরীরে অ্যারোমাটেজ জিনটা (aromatase gene knockout) অকেজো করে দেওয়া হয়েছিল, যাতে তারা ইস্ট্রোজেন তৈরি করতে না পারে। দেখা গেল, এই ইঁদুরগুলো খুব বেশি করে গা পরিষ্কার (grooming) করছে আর চাকার ওপর দৌড়াদৌড়ি (wheel running) করছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, মেয়ে ইঁদুরদের মধ্যে এমন কিছুই দেখা গেল না।
এরপর যখন এই পুরুষ ইঁদুরগুলোকে ১৭β-এস্ট্রাডিওল (17β-estradiol) নামের একটা জিনিস দিয়ে চিকিৎসা করা হলো – যেটা তাদের শরীরে ইস্ট্রোজেনের অভাব পূরণ করে দিল – তখন ওই বাতিকগ্রস্ত আচরণগুলোও উধাও হয়ে গেল! এই গবেষণায় আরও দেখা গেল, যে ইঁদুরগুলো ইস্ট্রোজেন তৈরি করতে পারছিল না, তাদের শরীরে সিওএমটি (COMT) নামের একটা প্রোটিনের মাত্রা কমে গিয়েছিল। আর ইস্ট্রোজেন দিয়ে চিকিৎসা করার পর মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস (hypothalamus) অংশে এই প্রোটিনের মাত্রা আবার বেড়ে গিয়েছিল। সহজ করে বললে, এই সিওএমটি (COMT) প্রোটিনটা ডোপামিন, নরএপিনেফ্রিন (norepinephrine) আর এপিনেফ্রিন (epinephrine) সহ আরও কিছু নিউরোট্রান্সমিটারকে ভেঙে ফেলতে সাহায্য করে। এই সব তথ্য থেকে মনে হয়, এই বাতিকগ্রস্ত আচরণের পেছনে হরমোনের একটা ভূমিকা থাকতে পারে, আর সেই সাথে হরমোন আর জিনের মধ্যে একটা বোঝাপড়ারও ব্যাপার থাকতে পারে।
পোষা প্রাণী (Pets)
ডক্টর নিকোলাস ডডম্যান (Dr. Nicholas Dodman) তার ‘ডগস বিহেভিং ব্যাডলি’ (Dogs Behaving Badly) নামের বইটাতে কুকুরদের নানারকম ওসিডি-র (OCD) মতো হাবভাবের কথা লিখেছেন (Dodman, 1999)। এই ধরনের আচরণ সাধারণত তখনই বেশি দেখা যায়, যখন কুকুরটাকে কোনো চাপের মুখে ফেলা হয়। যেমন ধরুন, এমন কোনো পরিবেশে রাখা হলো যেখানে তার মন ভালো থাকার মতো কিছুই নেই, অথবা এমন কোনো কুকুরের ক্ষেত্রে যাদের ওপর আগে অত্যাচার করা হয়েছে।
কুকুরদের বিভিন্ন জাতের মধ্যে আবার বিভিন্ন ধরনের বাতিক দেখা যায়। যেমন, লিক গ্রানুলোমা (Lick granuloma) – অর্থাৎ, চামড়ায় ঘা না হওয়া পর্যন্ত একনাগাড়ে চেটে যাওয়া – এই সমস্যাটা ল্যাব্রাডর, গোল্ডেন রিট্রিভার, গ্রেট ডেন আর ডোবারম্যানের মতো বড় জাতের কুকুরদের বেশি হয়। অন্যদিকে, বুল টেরিয়ার, জার্মান শেফার্ড, ওল্ড ইংলিশ শিপডগ, রটওয়েলার, আর ওয়্যার-হেয়ার্ড ফক্স টেরিয়ার বা স্প্রিঙার স্প্যানিয়েলরা আবার কাল্পনিক মাছি ধরা অথবা আলো আর ছায়া তাড়া করার মতো অদ্ভুত কাজ বেশি করে। এই সব হাবভাবের পেছনে হয়তো বিবর্তনের একটা পুরনো গল্প লুকিয়ে আছে, যদিও ডডম্যান সাহেব সেই ব্যাপারটা খুব খোলাসা করে বলেননি।
লুইস শুস্টার (Louis Shuster) আর নিকোলাস ডডম্যান (Nicholas Dodman) লক্ষ্য করেছেন যে, কুকুরগুলো প্রায়শই মানুষের মতোই অবসেসিভ আর কম্পালসিভ আচরণ দেখায় (Holden & Travis, 2010)। ক্যানাইন কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার (CCD) যে শুধু বিশেষ কোনো জাতের কুকুরের মধ্যেই দেখা যায় তা নয়, তবে কুকুরের জাতের ওপর নির্ভর করে বাতিকের ধরনটা পাল্টাতে পারে। যেমন, বুল টেরিয়াররা প্রায়শই শিকার ধরার বা মারামারি করার মতো একটা বাতিকগ্রস্ত আচরণ দেখায় (“Anxiety and compulsive disorders in dogs”, 2013)। জাতের কারণে হয়তো বাতিকের ধরনে পার্থক্য হয়, কিন্তু কিছু কিছু আচরণ আবার সব জাতের কুকুরের মধ্যেই কমবেশি দেখা যায়।
সবচেয়ে সাধারণভাবে, সিসিডি (CCD) কুকুরদের মধ্যে তখনই দেখা যায় যখন তারা তাদের লেজ তাড়া করা, কোনো জিনিস নিয়ে খামোখা চিবানো, বা তাদের থাবা বারবার চাটার মতো কাজগুলো পুনরাবৃত্তি করে। এটা অনেকটা সেই অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডারে ভোগা অনেক মানুষের বারবার হাত ধোয়ার বাতিকের মতো (Miller, 1992)। আবার কিছু কুকুরের মধ্যে এমনও দেখা গেছে যে, তারা তাদের মাথার চারপাশের বাতাসে যেন কোনো পোকা দেখতে পাচ্ছে এমন ভান করে আর সেটাকে আক্রমণ করার চেষ্টা করে। এছাড়া, গোল হয়ে ঘোরা, নিজের চুল কামড়ানো, একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা, এমনকি খামোখা ঘেউ ঘেউ করা – এই সব আচরণও যদি খুব বেশি বাড়াবাড়ি রকমের আর পুনরাবৃত্তিমূলক হয়ে ওঠে, তাহলে সেগুলোকে কুকুরদের বাতিকগ্রস্ততা হিসেবেই ধরা হয় (“Anxiety and compulsive disorders in dogs”, 2013)।
চিকিৎসা (ফার্মাসিউটিক্যাল) (Treatment (pharmaceutical))
ডডম্যান সাহেব কুকুরদের এই বাতিক কমানোর জন্য কয়েকটা জিনিসের ওপর জোর দেন – ব্যায়াম করানো, তাদের চারপাশের পরিবেশটাকে একটু আনন্দদায়ক করে তোলা (যেমন, মালিক যখন কাজে যায়, তখন কুকুরটার শোনার জন্য কোনো শব্দ বা গান চালিয়ে রাখা), আর প্রায়শই প্রোজ্যাক (Prozac) নামের একটা ওষুধ দেওয়া (এটা একটা এসএসআরআই (SSRI) যা মানুষের ওসিডি (OCD) সারাতেও ব্যবহার করা হয়)।
শুস্টার আর ডডম্যান সাহেব সিসিডি (CCD) থাকা কুকুরদের ওপর ওষুধের চিকিৎসা পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছিলেন, এটা মানুষের মতো তাদের ক্ষেত্রেও ততটাই কার্যকর হয় কিনা। তারা বাতিকগ্রস্ত আচরণ দেখানো ১১টা কুকুরের ওপর গ্লুটামেট রিসেপ্টর ব্লকার (glutamate receptor blockers) (যেমন, মেমান্টিন (memantine)) আর ফ্লুওক্সেটিন (fluoxetine) (যেটা প্রোজ্যাক (Prozac) নামে বেশি পরিচিত আর একটা অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট) ব্যবহার করে তাদের প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। দেখা গেল, ওষুধ পাওয়ার পর ১১টা কুকুরের মধ্যে সাতটারই বাতিকগ্রস্ত আচরণের তীব্রতা আর ঘনঘন হওয়ার প্রবণতা অনেকটাই কমে গেছে (Holden & Travis, 2010)।
ডডম্যান সাহেব হোগান (Hogan) নামের একটা বধির পুরুষ ডালমেশিয়ান (Dalmatian) কুকুরের গল্প বলেছেন, যার এই বাতিকগ্রস্ত আচরণের সমস্যা ছিল। কনি (Connie) আর জিম (Jim) নামের দুজন তাকে দত্তক নেওয়ার আগে হোগানের ওপর অনেক অবহেলা আর অত্যাচার করা হয়েছিল। তারা আমেরিকান সাংকেতিক ভাষা (American Sign Language) শিখিয়ে তার আচরণ ভালো করার চেষ্টা করেছিলেন। হোগানের ফাইল থেকে কিছু কথা নিচে তুলে দেওয়া হলো (Dodman, 1999, pp. 33-36):
দেড়টা বছর সব ভালোই কাটছিল, হঠাৎ একদিন মার্চ মাসের সকালে সে ঘুম থেকে উঠে যা কিছু হাতের কাছে পেল, থাবা মারতে শুরু করল, আর থামতেই চাইছিল না। সে কার্পেট, কম্বল, কাঠের মেঝে, লিনোলিয়াম, ঘাস, মাটির ওপর সমানে থাবা মারছিল… সে যা করছিল, সেটার সাথে শিকার খোঁজার ভঙ্গির একটা অদ্ভুত মিল ছিল, যা দেখে অবাক না হয়ে পারা যায় না।
আমার কিন্তু মনে হয়… হোগান সেই সময় কোনো একটা মানসিক চাপের মধ্যে ছিল, যখন তার এই খামোখা থাবা মারার বাতিকটা তৈরি হয়েছিল। কনি আর জিমকে তো দিনের প্রায় আট ঘণ্টা তাকে একা ফেলে কাজে যেতে হতো। … অর্থাৎ, দোলনাটা যেন তৈরিই ছিল, শুধু একটু ধাক্কা লাগার অপেক্ষা।
এইরকম পরিস্থিতিতে যে ঠিক কোন ধরনের বাতিক তৈরি হয়, সেটা ততটা জরুরি নয়; আসল কথা হলো, একটা বাতিক যে “তৈরি হয়” – সেটাই বড় ব্যাপার।
পুনর্বাসনের “তিন ‘আর’ (R)” হলো ব্যায়াম, পুষ্টি, আর যোগাযোগ। প্রথমত, আমি কনিকে পরামর্শ দিলাম হোগানের ব্যায়ামের পরিমাণ বাড়িয়ে দিনে অন্তত আধ ঘণ্টার অ্যারোবিক কসরত করাতে। সেই সাথে, আমি বললাম হোগানকে যেন কম প্রোটিন আর প্রিজারভেটিভ ছাড়া খাবার দেওয়া হয়। পুনর্বাসনের চেকলিস্টটা পূরণ করার পর, আমি কনিকে সাংকেতিক ভাষার ব্যাপারে আরও মনযোগী হতে বললাম, আর হোগান যখনই মাটি আঁচড়ানো শুরু করত, তখন দেখানোর জন্য একটা নতুন সঙ্কেত শিখিয়ে দিলাম। সঙ্কেতটা ছিল একটা কার্ডের টুকরো, যার ওপর মোটা কালো কালিতে বড় করে “H” লেখা। কনিকে বলা হলো, হোগান যেই মুহূর্তে এই অবাঞ্ছিত থাবা মারার কাজটা শুরু করবে, সাথে সাথেই যেন তাকে এই সঙ্কেতটা দেখানো হয়, আর তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া হয়। উদ্দেশ্য ছিল, তাকে বুঝিয়ে দেওয়া যে এই আচরণটা ঠিক নয়, আর কনি যে ঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছে, সেই সঙ্কেত দেওয়া। আমাকে কাপুরুষ বলতে পারেন, কিন্তু ক্যানাইন কম্পালসিভ ডিসঅর্ডারের আগের অভিজ্ঞতা থেকে আমার মনে হয়নি যে শুধু এটাতেই কাজ হবে। তাই, একটা ‘বেল্ট-আর-সাসপেন্ডার’ নীতি নিয়ে, আমি হোগানকে এলাভিল (Elavil) নামের একটা ট্রাইসাইক্লিক অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট খাওয়ানোরও পরামর্শ দিলাম। তত্ত্ব অনুযায়ী, এলাভিল হয়তো অবসেসিভ-কম্পালসিভ আচরণের ক্ষেত্রে ততটা ভালো কাজ করবে না, কিন্তু খরচের সীমাবদ্ধতা আর এই যে সে একা থাকতে ভয় পায়, সেটার সম্ভাব্য প্রভাব মাথায় রেখে, এলাভিলই আমার কাছে সেরা উপায় বলে মনে হয়েছিল।
চিকিৎসার সুফল পেতে পেতে হোগানের প্রায় ছ’মাস লেগে গেল। … এই সময়টায় হোগান কেবল মাঝে মাঝে, আর সেটাও খুব কম তীব্রতার সাথে থাবা মারত, আর এই থাবা মারাটা ঘটত কেবল চাপের মুহূর্তগুলোতে। কনি জানিয়েছিল, বিশেষ করে যখন সে কনিকে খুঁজে পেত না, অথবা যখন তার মনে হতো যে তাকে বুঝি একা ফেলে যাওয়া হবে, তখনই তার থাবা মারার প্রবণতা বেড়ে যেত। হোগান ধীরে ধীরে উন্নতি করতে লাগল, আর এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছাল যেখানে সে প্রায় থাবা মারা ছেড়েই দিয়েছিল – কিন্তু পুরোপুরি নয়। মানুষ আর পশু, উভয়ের ক্ষেত্রেই এই বাধ্যতামূলক ব্যাধিগুলোর ব্যাপারে এমনই হয় বলে মনে হয়। এগুলোকে এমন একটা পর্যায়ে নামিয়ে আনা যায়, যাতে আক্রান্তরা মোটামুটি স্বাভাবিক জীবন কাটাতে পারে, কিন্তু মাঝে মাঝে রোগটা আবার ফিরে আসে।
স্টিরিওটাইপি (Stereotypies)
স্টিরিওটাইপি (Stereotypies) হলো বারবার করা কিছু আচরণ, যা কখনো কখনো অস্বাভাবিকও হতে পারে। যেমন, পাখিদের খাঁচার ডালে পায়চারি করা। বিড়ালদের গা চাটা বা পাখিদের পালক পরিষ্কার করার মতো কিছু অভিযোজিত স্টিরিওটাইপিক আচরণও আছে। খাঁচায় থাকা টিয়াপাখিরা সাধারণত বিভিন্ন ধরনের স্টিরিওটাইপি দেখায়। এই আচরণগুলো একই রকমভাবে বারবার করা হয়, আর এগুলোর কোনো নির্দিষ্ট কাজ বা উদ্দেশ্য থাকে না। খাঁচার টিয়াপাখিরা মুখের সাহায্যে বা শরীরের নড়াচড়ার মাধ্যমে কিছু আকর্ষণীয় স্টিরিওটাইপি দেখায়, যেমন খাঁচার ডালে পায়চারি করা বা একটা নির্দিষ্ট খেলনা নিয়ে বারবার খেলা করা।
পালক ছেঁড়া বা খুব জোরে চিৎকার করাও স্টিরিওটাইপি হতে পারে, তবে এগুলো ততটা ধরাবাঁধা নিয়মে হয় না। এগুলো হয়তো বন্দিদশা, স্ট্রেস, একঘেয়েমি বা একাকীত্বের প্রতিক্রিয়া হতে পারে। কারণ গবেষণায় দেখা গেছে, যে টিয়াপাখিরা খাঁচার দরজার সবচেয়ে কাছে থাকে, তাদের মধ্যেই পালক ছেঁড়া বা চিৎকার করার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। পালক ছেঁড়াটা ঠিক সত্যিকারের স্টিরিওটাইপি নয়, এটা অনেকটা মানুষের চুল টানার মতো। খুব জোরে চিৎকার করা বা চেঁচানো একটা স্টিরিওটাইপি হতে পারে, তবে কণ্ঠস্বর ব্যবহার করাটা টিয়াপাখির স্বাভাবিক আচরণেরই একটা অংশ। খাঁচায় থাকা টিয়াপাখিদের যথেষ্ট উদ্দীপনার অভাব হয়। সম্ভবত তারা বন্ধুত্বের অভাব আর খাবার খোঁজার সুযোগের অভাব থেকেও কষ্ট পায় (Garner et al., 2006)।
স্টিরিওটাইপিগুলো সামাজিক পরিবেশ থেকেও তৈরি হতে পারে। যেমন, কিছু বিশেষ সামাজিক উদ্দীপনার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি, একা থাকা, খাবারের জায়গা কম থাকা, বা খুব বেশি প্রাণী একসাথে থাকা (বিশেষ করে শূকরদের লেজ কামড়ানোর ক্ষেত্রে)। এই আচরণগুলো আবার সামাজিক শিক্ষার মাধ্যমেও ছড়াতে পারে। ব্যাংক ভোল (Bank voles), পায়রা আর শূকরদের যখন স্টিরিওটাইপি দেখানো অন্য প্রাণীদের পাশে রাখা হয়, তখন তারাও সেগুলো শিখে নেয়। এছাড়া, উদ্দীপনা বেড়ে গেলেও এমনটা হতে পারে, যেমনটা শূকরদের লেজ কামড়ানো আর মুরগিদের পালক ঠোকরানোর ক্ষেত্রে ঘটে (Vieuille-Thomas, Le Pape & Signoret, 1995)।
স্টিরিওটাইপিগুলো হয়তো কোনো সমস্যা মোকাবিলার কৌশলও হতে পারে। যেমনটা দড়িতে বাঁধা আর আবদ্ধ শুকরীদের ওপর করা গবেষণা থেকে বোঝা যায়। যে শুকরীরা দড়িতে বাঁধা বা আবদ্ধ ছিল, তারা বাইরে দলে থাকা শুকরীদের চেয়ে বেশি করে চাটা বা গা ঘষার মতো স্টিরিওটাইপি দেখাত। এই অস্বাভাবিক আচরণটা অপিওয়েড (opioid) (পুরস্কার ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত) রিসেপ্টরের ঘনত্বের সাথে সম্পর্কিত বলে মনে হয় (Zanella et al., 1996)। শুকরীদের ক্ষেত্রে, দীর্ঘ সময় ধরে বন্দি থাকা, দড়িতে বাঁধা থাকা বা গর্ভধারণের খাঁচায় থাকা অস্বাভাবিক আচরণ আর স্টিরিওটাইপির কারণ হতে পারে। মু (Mu) আর কাপা (kappa) নামের রিসেপ্টরগুলো বিরূপ আচরণের সাথে যুক্ত, আর মু রিসেপ্টরের ঘনত্ব বাইরে দলে থাকা শুকরীদের চেয়ে দড়িতে বাঁধা শুকরীদের মধ্যে বেশি থাকে। তবে, যে শুকরীদের মধ্যে স্টিরিওটাইপি আচরণ দেখা যায়, তাদের মস্তিষ্কে মু আর কাপা দুটো রিসেপ্টরের ঘনত্বই কমে যায়। এটা থেকে বোঝা যায়, নিষ্ক্রিয়তা মু রিসেপ্টরের ঘনত্ব বাড়িয়ে দেয়, আর স্টিরিওটাইপি তৈরি হলে কাপা আর মু দুটো রিসেপ্টরের ঘনত্বই কমে যায়। এমনটা প্রস্তাব করা হয় যে, খাঁচার পরিবেশের নকশা এমনভাবে করা উচিত যাতে স্টিরিওটাইপির অস্তিত্ব রোধ করা যায়। প্রাণীর স্বাভাবিক পরিবেশের যতটা সম্ভব কাছাকাছি একটা ঘের তৈরি করা, আর তাদের স্বাভাবিক আচরণকে উৎসাহিত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের উদ্দীপনার ব্যবস্থা করা দরকার (Maulana, Gawi & Utomo, 2020)।
আসক্তি (Addiction)
চিনির প্রতি যে একটা টান, যেটাকে বলে চিনির নেশা (Sugar addiction), সেটা গবেষণাগারের ইঁদুরদের মধ্যে পরীক্ষা করে দেখা গেছে। আর মজার ব্যাপার হলো, এই নেশাটা কিন্তু মাদকাসক্তির মতোই দানা বাঁধে। যখন মিষ্টি কোনো খাবার খাওয়া হয়, তখন মস্তিষ্কের লিম্বিক সিস্টেমে (limbic system) অপিওয়েড (opioids) আর ডোপামিন (dopamine) নামের কিছু প্রাকৃতিক রাসায়নিক বেরিয়ে আসে। সুস্বাদু খাবারগুলো মস্তিষ্কের ভেন্ট্রাল টেগমেন্টাল এরিয়া (ventral tegmental area) বলে একটা জায়গায় থাকা অপিওয়েড রিসেপ্টরগুলোকে জাগিয়ে তুলতে পারে। এর ফলে নিউক্লিয়াস অ্যাকাম্বেন্স (nucleus accumbens) (NAc) নামের অংশে থাকা ডোপামিন তৈরির কোষগুলোও চাঙ্গা হয়ে ওঠে।
এই যে ডোপামিন আর অপিওয়েড বেরিয়ে আসার ফলে একটা তীব্র আনন্দের অনুভূতি হয়, মস্তিষ্ক সেটা চিনে রাখে আর আরও বেশি করে চিনি খাওয়ার জন্য মনটা ছটফট করতে থাকে। এই যে স্বাভাবিক পুরস্কার – মানে মিষ্টি খাবার – আর মস্তিষ্কের মেসোলিম্বিক সিস্টেমের (mesolimbic system) সিনাপ্সগুলোতে (synapses) বেরিয়ে আসা অপিওয়েড আর ডোপামিন, এগুলোর মাধ্যমেই কিন্তু একটা নির্ভরতা তৈরি হয়। যখন ইঁদুরগুলো চিনির জন্য আকুল হয়ে ওঠে, তখন তাদের মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যাম্পাস, ইনসুলা (insula) আর কডেট (caudate) নামের অংশগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে – ঠিক যেমনটা মাদকাসক্তদের ক্ষেত্রে হয় যখন তারা মাদকের জন্য ছটফট করে।
চিনি তো শরীরের জন্য ভালো, কারণ এটা শক্তি জোগায়। কিন্তু যদি স্নায়ুতন্ত্রের মধ্যে কোনো রদবদল ঘটে যায় আর শরীরটা চিনি খাওয়ার ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তখন চিনি না পেলেই কিন্তু বিপদ! দাঁতে কাঁপুনি, সামনের পায়ে কাঁপুনি, আর মাথা ঝাঁকানোর মতো কিছু শারীরিক লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে, যেগুলোকে বলে উইথড্রয়াল সিম্পটম (withdrawal symptoms) (Colantuoni et al., 2002)।
মরফিনের (Morphine) প্রতি সহনশীলতা, যেটা কিনা আসক্তির একটা মাপকাঠি, সেটাও ইঁদুরদের মধ্যে দেখা গেছে। মরফিনের প্রতি তাদের এই সহনশীলতার কারণ হিসেবে পরিবেশের কিছু ইঙ্গিত আর ওষুধের শারীরিক প্রভাবকে দায়ী করা হয়েছে। মরফিনের প্রতি সহনশীলতা যে শুধু কত ঘনঘন ওষুধ দেওয়া হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করে, তা কিন্তু নয়। বরং, ওষুধের শারীরিক প্রভাবের সাথে কোনো একটা ওষুধ-পূর্বাভাসী ইঙ্গিতের (drug-predictive cue) কতবার জুটি বাঁধছে, সেটার ওপরেও নির্ভর করে (Siegel, Hinson & Krank, 1978)। যে ইঁদুরগুলোকে মরফিনের সাথে একটা ওষুধ-পূর্বাভাসী ইঙ্গিত জুড়ে দেওয়া হয়েছিল, তারা যে ইঁদুরগুলোকে মরফিনের সাথে ওইরকম কোনো ইঙ্গিত দেওয়া হয়নি সেই ইঁদুরগুলোর চেয়ে মরফিনের প্রতি অনেক বেশি সহনশীল হয়ে উঠেছিল।
বিষণ্ণতা (Depression)
কুকুরদের ওপর গবেষণা করে মার্টিন সেলিগম্যান (Martin Seligman) আর তার সহকর্মীরা পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্জিত অসহায়ত্ব (learned helplessness) বলে একটা ব্যাপার আবিষ্কার করেছিলেন, যেটা কিনা বিষণ্ণতা বোঝার জন্য প্রাণীদের ওপর করা গবেষণার একটা মডেল হিসেবে কাজ করে। তারা কুকুরগুলোকে তিনটে দলে ভাগ করেছিলেন। একটা ছিল কন্ট্রোল গ্রুপ। দল ‘এ’-র (group A) কুকুরগুলো কখন তাদের বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হবে, সেটার ওপর তাদের কিছুটা নিয়ন্ত্রণ ছিল। আর দল ‘বি’-র (group B) কুকুরগুলোর কখন তাদের শক দেওয়া হবে, সেটার ওপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণই ছিল না।
শক দেওয়ার পর্বটা শেষ হওয়ার পর, কুকুরগুলোকে একটা শাটল বাক্সে (shuttle box) পরীক্ষা করা হলো। সেখানে তারা একটা দেয়াল টপকে শক থেকে পালাতে পারত। যাতে কোনো ভুল না হয় – অর্থাৎ, যে কুকুরগুলো শক পাওয়ার সময় এমন কোনো হাবভাব শেখেনি যা তাদের স্বাভাবিক পালানোর আচরণে বাধা দেবে – সেইজন্য কুকুরগুলোকে কিউরারে (curare) নামের একটা অবশকারী ওষুধ দিয়ে শক দেওয়ার সময় অচল করে রাখা হয়েছিল। দেখা গেল, কন্ট্রোল গ্রুপের আর ‘এ’ গ্রুপের কুকুরগুলো দেয়াল টপকে শক থেকে পালানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু ‘বি’ গ্রুপের কুকুরগুলো লাফ দিল না, চুপচাপ শক হজম করল। ‘বি’ গ্রুপের কুকুরগুলো বুঝে গিয়েছিল যে, তাদের চেষ্টার সাথে ফলাফলের কোনো সম্পর্ক নেই (Hahner, n.d., “Learned Helplessness: A Critique of Research and Theory”)।
এর ফলে একটা তত্ত্ব উঠে এলো। বলা হলো, এই যে প্রাণীদের হাবভাব, এর কারণ হলো শকটা এত বেশি চাপের ছিল যে, তাদের চলাফেরার জন্য যে নিউরোকেমিক্যালটা (neurochemical) দরকার, সেটাই কমে গিয়েছিল (Hahner, n.d.)। কুকুরদের ওপর এই গবেষণার পর মাছ থেকে শুরু করে বিড়াল পর্যন্ত বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে এই অর্জিত অসহায়ত্বের (learned helplessness) প্রভাব পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে (Hahner, n.d.)। খুব সম্প্রতি, রেসাস ম্যাকাক (rhesus macaques) নামের এক ধরনের বানরের ওপর এই অর্জিত অসহায়ত্ব নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে। তাদের ওপর এমন সব চাপপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে – যেমন, এড়ানো যাবে না এমন বৈদ্যুতিক শক, জোর করে সাঁতার কাটানো, হতাশাজনক কাজ করানো, লেজ ধরে ঝুলিয়ে রাখা, বা চিমটি কেটে ক্যাটালেপসি (catalepsy) বা শরীর শক্ত হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা তৈরি করা – যেগুলোতে বানরটা পরিবেশের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে (Kalueff & Tuohimaa, 2004)।
বিষণ্ণতা আর মন খারাপ ভাবকে যোগাযোগের একটা মাধ্যম হিসেবেও দেখা গেছে। এগুলো দিয়ে তারা হয়তো কোনো উঁচু পদের প্রাণীর কাছে হার মানার বা সাহায্যের জন্য আকুতি জানানোর ইঙ্গিত দেয় (Nesse, 2000)। মন খারাপ বা খুব বেশি মন খারাপ (যেটাকে বিষণ্ণতাও বলা হয়) কোনো একটা কাজে লেগে থাকার ধরনটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, আর না পাওয়ার মতো লক্ষ্য থেকে সরে আসতেও উৎসাহিত করতে পারে। “মন খারাপ একটা জীবের সেইসব প্রতিকূল পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়, যেখানে কোনো একটা বড় লক্ষ্য পূরণের চেষ্টা করতে গেলে বিপদ, ক্ষতি, শারীরিক আঘাত বা খামোখা শক্তি নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে” (Nesse, 2000)। কখনো কখনো উদাসীন (apathetic) হয়ে যাওয়াটাও জীবের টিকে থাকার জন্য সুবিধাজনক হতে পারে। পরজীবী আর রোগজীবাণুর বিপদ থেকে বাঁচতে মেরুদণ্ডী প্রাণীরা তাদের নিজেদের বা নিজেদের দলের অন্যদের টিকে থাকার সম্ভাবনা (inclusive fitness) বাড়ানোর জন্য যে আচরণগত কৌশল ব্যবহার করে, সেগুলোর মধ্যে বিষণ্ণতাকেও একটা বলে মনে করা হয় (Hart, 1990)।
নিউরোজেনেসিসের (neurogenesis) অভাব, অর্থাৎ মস্তিষ্কে নতুন কোষ তৈরি না হওয়াকে বিষণ্ণতার সাথে যুক্ত করা হয়েছে। যে প্রাণীরা মানসিক চাপের মধ্যে থাকে (যেমন, একা থাকা, বা শরীরে কর্টিসলের মাত্রা বেশি থাকা), তাদের মধ্যে নিউরোজেনেসিস কমে যায়। আর অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টগুলো নিউরোজেনেসিস বাড়াতে সাহায্য করে বলে জানা গেছে। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রেনে হেন (Rene Hen) আর তার সহকর্মীরা ইঁদুরদের ওপর একটা গবেষণা করেছিলেন। তারা অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টের কার্যকারিতা পরীক্ষা করার জন্য মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যাম্পাল অংশে রেডিয়েশন দিয়ে নিউরোজেনেসিস বন্ধ করে দিয়েছিলেন। গবেষণার ফলাফল থেকে বোঝা যায়, নিউরোজেনেসিস যদি বাধা পায়, তাহলে অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টগুলো ঠিকমতো কাজ করতে পারে না।
স্ট্রেস (Stress)
রবার্ট স্যাপোলস্কি (Robert Sapolsky) আফ্রিকার সেরেঙ্গেটি (Serengeti) অঞ্চলে বেবুনদের (baboons) তাদের স্বাভাবিক পরিবেশে অনেকদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি দেখেছেন, বেবুনদের সমাজে মানুষের মতোই বেশ একই রকম উঁচু-নিচু ভেদাভেদ (hierarchies) আছে। তারা খাবার খোঁজা আর নিজেদের প্রাথমিক চাহিদাগুলো মেটানোর জন্য খুব কম সময়ই খরচ করে। ফলে, তাদের হাতে সামাজিক সম্পর্কগুলো গড়ে তোলার জন্য অনেকটা সময় থাকে। প্রাইমেটদের ক্ষেত্রে, মানসিক চাপটা শরীরেও প্রভাব ফেলে। প্রাইমেটরা এমন ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ অনুভব করে, যা থেকে এমন শারীরিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে, যা সময়ের সাথে সাথে তাদের অসুস্থ করে তুলতে পারে।
স্যাপোলস্কি বেবুনদের পদমর্যাদা, তাদের ব্যক্তিত্ব আর সামাজিক সম্পর্কগুলো খুঁটিয়ে দেখেছেন। তারপর তিনি তাদের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে কর্টিসলের (cortisol) (যেটা স্ট্রেস হরমোন নামে পরিচিত) মাত্রা মেপেছেন, আর সেই মাত্রার সাথে তাদের সামাজিক অবস্থান মিলিয়ে দেখেছেন। বেশিরভাগ তথ্যই পুরুষ বেবুনদের থেকে পাওয়া গেছে, কারণ যেকোনো নির্দিষ্ট সময়ে প্রায় আশি শতাংশ মেয়ে বেবুনই গর্ভবতী থাকত (Levy, 2001)। তিনটে জিনিস একটা বেবুনের কর্টিসলের মাত্রাকে প্রভাবিত করত: বন্ধুত্ব, পরিস্থিতি বোঝার ক্ষমতা, আর পদমর্যাদা। বেবুনদের কর্টিসলের মাত্রা কম থাকত যদি তারা: ১. ছোটদের সাথে খেলত আর বন্ধুত্ব করত, ২. কোনো পরিস্থিতি সত্যিই বিপদজনক কিনা, আর তারা জিতবে না হারবে, সেটা বুঝতে পারত, আর ৩. দলের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু পদে থাকত।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে কর্টিসলের মাত্রা বাড়তে থাকে, আর মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যাম্পাল কোষগুলো অতিরিক্ত কর্টিসল থেকে নিজেদের বাঁচানোর জন্য তাদের বাইরের স্তরে কম হরমোন রিসেপ্টর তৈরি করে। ফলে, স্ট্রেসের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা আরও কঠিন হয়ে পড়ে (Levy, 2001)। যাদের মারাত্মক বিষণ্ণতা আছে, তাদের প্রায় অর্ধেক লোকের মধ্যেই কর্টিসলের মাত্রা বেশি দেখা যায়। আর এই হিপ্পোক্যাম্পাল অঞ্চলটাই কিন্তু দুটো ক্ষেত্রেই প্রভাবিত হয়। স্ট্রেস হজম প্রক্রিয়ার ওপর খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে, যার ফলে আলসার হতে পারে। এটা যৌন ইচ্ছাও কমিয়ে দিতে পারে, ঘুমের ধরনে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে, আর রক্তচাপ বাড়িয়ে দিতে পারে। তবে, স্ট্রেস কিন্তু আবার উদ্দীপনা আর উৎসাহও জোগাতে পারে। যখন প্রাণীরা স্ট্রেসের মধ্যে থাকে, তখন তারা সাধারণত অন্য সময়ের চেয়ে বেশি সতর্ক থাকে। এটা তাদের অচেনা পরিবেশ আর সেই পরিবেশে তাদের জীবনের জন্য সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে আরও ভালোভাবে সচেতন হতে সাহায্য করতে পারে (Maestripieri, 2005)।
ইয়েরকিস (Yerkes) আর ডডসন (Dodson) একটা নিয়ম তৈরি করেছেন, যেটা একটা উল্টানো ‘ইউ’ (U-shape) আকৃতির গ্রাফের মাধ্যমে উত্তেজনা আর কর্মক্ষমতার মধ্যেকার সম্পর্কটা ব্যাখ্যা করে (Ripped Enterprises website, n.d., http://cbass.com/Breakout.htm)। ইয়েরকিস-ডডসন আইন (Yerkes-Dodson Law) অনুযায়ী, জ্ঞানীয় উত্তেজনার সাথে সাথে কর্মক্ষমতাও বাড়ে, তবে একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত। ‘ইউ’ আকৃতির গ্রাফের নিচের দিকে নেমে যাওয়া অংশটা স্ট্রেসের কারণে ঘটে। স্ট্রেস বাড়ার সাথে সাথে দক্ষতা আর কর্মক্ষমতাও বাড়ে, তবে সেটাও একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত (Ripped Enterprises website, n.d.)। যখন স্ট্রেস খুব বেশি হয়ে যায়, তখন কর্মক্ষমতা আর দক্ষতা দুটোই কমে যায়।
স্যাপোলস্কি ইঁদুরদের মধ্যেও স্ট্রেস নিয়ে গবেষণা করেছেন। তার গবেষণার ফলাফল থেকে বোঝা যায়, অল্প বয়সে ইঁদুরদের যে অভিজ্ঞতাগুলো হয়, সেগুলোর একটা শক্তিশালী আর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব থাকে। যে ইঁদুরগুলোকে মানুষের হাতে ধরা হয়েছিল (যেটা একটা চাপপূর্ণ পরিস্থিতি), তাদের স্ট্রেসের প্রতি প্রতিক্রিয়াগুলো খুব সূক্ষ্মভাবে তৈরি হয়েছিল। এর ফলে, তাদের সারা জীবনে যে পরিমাণ স্ট্রেস হরমোনের সংস্পর্শে আসার কথা, সেটা হয়তো সেই ইঁদুরগুলোর চেয়ে কম ছিল, যাদের ধরা হয়নি। সহজ কথায়: স্ট্রেস কিন্তু মানিয়ে নিতেও সাহায্য করতে পারে। চাপপূর্ণ পরিস্থিতির সাথে যত বেশি পরিচয় হবে, ইঁদুর তত ভালোভাবে সেই পরিস্থিতি সামলাতে পারবে (Levy, 2001)।
আত্ম-আগ্রাসন (Self-aggression)
রেসাস ম্যাকাকদের (Rhesus macaques) নিজেদের ওপর আগ্রাসন (SA) দেখাতে দেখা গেছে। যেমন, নিজেদের কামড়ানো, আঁচড়ানো, চাপড়ানো, ঘষা, বা শরীরের বিভিন্ন অংশকে হুমকি দেওয়া। যে রেসাস ম্যাকাকগুলোকে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল, তাদের প্রত্যেককে আলাদা আলাদা খাঁচায় রাখা হয়েছিল এবং তারা রোগমুক্ত ছিল। যখন তাদের এক খাঁচা থেকে অন্য খাঁচায় নিয়ে যাওয়া হতো – অর্থাৎ, চাপপূর্ণ আর উদ্দীপক পরিস্থিতিতে – তখন তাদের আত্ম-আগ্রাসনের মাত্রা বেড়ে যেত (Pond & Rush, 1983)।
স্টাম্প-টেইলড ম্যাকাকদের (Stump-tailed macaques) ওপর গবেষণা করে তাদের এই আত্ম-আগ্রাসনের কারণ খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে। দেখা গেছে, যখন পরিবেশটা খুব একটা আকর্ষণীয় বা উদ্দীপক থাকত না, তখন আত্ম-আগ্রাসন বেড়ে যেত। এই ফলাফল থেকে মনে হয়, আত্ম-আগ্রাসন হয়তো অনুত্তেজক পরিবেশে সংবেদনশীল ইনপুট বাড়ানোর একটা উপায়। খাঁচায় থাকা ম্যাকাকরা বন্য ম্যাকাকদের মতো সামাজিক মেলামেশা করে না, আর সেটাও হয়তো আত্ম-আগ্রাসনকে প্রভাবিত করতে পারে। যখন তাদের সামাজিক মেলামেশার সুযোগ দেওয়া হয় – যেমন, খাঁচায় অন্য একটা ম্যাকাক রেখে বা তাদের খাঁচায় না রেখে – তখন ম্যাকাকদের মধ্যে আত্ম-আগ্রাসনের মাত্রা কমে যায়। এই ফলাফল থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, আত্ম-আগ্রাসন আসলে অন্য দিকে চালিত হওয়া সামাজিক আগ্রাসনেরই একটা রূপ (Chamove, Anderson & Nash, 1984)। আত্ম-আগ্রাসন হতাশা আর সামাজিক মর্যাদার সাথে সম্পর্কিত, বিশেষ করে সেইসব ম্যাকাকদের মধ্যে যাদের আধিপত্যের ক্রমে মাঝামাঝি অবস্থান থাকে (De Monte, Anderson & Charbonnier, 1992)।
তথ্যসূত্র
- Alcock, J. (2005). Animal Behavior: An Evolutionary Approach (8th ed.). Sinaur Associates, Inc.
- Anxiety and compulsive disorders in dogs. (2013). PetMD. Retrieved from http://www.petmd.com/dog/conditions/behavioral.
- Bradshaw, J. W. S., Neville, P. F., & Sawyer, D. (1997). Factors affecting pica in the domestic cat. Applied Animal Behaviour Science, 52(3–4), 373–379. doi:10.1016/s0168-1591(96)01136-7
- Brimberg, L., Flaisher-Grinberg, S., Schilman, E. A., & Joel, D. (2007). Strain differences in ‘compulsive’ lever-pressing. Behavioural Brain Research, 179(1), 141–51. doi:10.1016/j.bbr.2007.01.014
- Brüne, M. (2006). The evolutionary psychology of obsessive-compulsive disorder: the role of cognitive metarepresentation. Perspectives in Biology and Medicine, 49(3), 317–29. doi:10.1353/pbm.2006.0037
- Canine compulsive disorder gene identified in dogs. (2010, January). Pharma Business Week, p. 118.
- Chamove, A. S., Anderson, J. R., & Nash, V. J. (1984). Social and environmental influences on self-aggression in monkeys. Primates, 25(3), 319–325. doi:10.1007/bf02382270
- Colantuoni, C., Rada, P., McCarthy, J., Patten, C., Avena, N. M., Chadeayne, A., & Hoebel, B. G. (2002). Evidence that intermittent, excessive sugar intake causes endogenous opioid dependence. Obesity Research, 10(6), 478–88. doi:10.1038/oby.2002.66
- De Monte, M., Anderson, J. R., & Charbonnier, H. (1992). Self-aggression in stumptail macaques: Effects of frustration and social partners. Primates, 33(1), 115–120. doi:10.1007/bf02382767
- Dodman, N. (1999). Dogs Behaving Badly: An A-to-Z Guide to Understanding & Curing Behavioral Problems in Dogs. Bantam Books.
- Dvorkin, A., Perreault, M. L., & Szechtman, H. (2006). Development and temporal organization of compulsive checking induced by repeated injections of the dopamine agonist quinpirole in an animal model of obsessive-compulsive disorder. Behavioural Brain Research, 169(2), 303–11. doi:10.1016/j.bbr.2006.01.024
- Eddy, K. T., Dutra, L., Bradley, R., & Westen, D. (2004). A multidimensional meta-analysis of psychotherapy and pharmacotherapy for obsessive-compulsive disorder. Clinical Psychology Review, 24(8), 1011–1030. doi:10.1016/j.cpr.2004.08.004
- Garner, J. P., Meehan, C. L., Famula, T. R., & Mench, J. A. (2006). Genetic, environmental and neighbor effects on severity of stereotypies and feather picking in Orange-winged Amazon parrots (Amazona amazonica): An epidemiological study. Applied Animal Behaviour Science, 96(1–2), 153–168. doi:10.1016/j.applanim.2005.09.009
- Graef, A. (2013, October). Can dogs lead us to a cure for obsessive-compulsive disorder? Care 2 Make a Difference. Retrieved from http://www.care2.com/causes/can-dogs-lead-us-to-a-cure-for-obsessive-compulsive-disorder.html
- Hahner, K. (n.d.). Learned Helplessness: A Critique of Research and Theory. On the Americans Europeans Japanese for Medical Advancement Website. Retrieved November 5, 2007, from http://www.curedisease.com/Perspectives/vol_1_1989/Learned%20Helplessness.html (Archived from the original)
- Hampstead, B. M., LaBounty, L. P., & Hurd, C. (2003). Multiple exposure to activity anorexia in rats: effects on eating, weight loss, and wheel running. Behavioural Processes, 61(3), 159–166. doi:10.1016/s0376-6357(02)00188-2
- Hart, B. L. (1990). Behavioral adaptations to pathogens and parasites: five strategies. Neuroscience & Biobehavioral Reviews, 14(3), 273–94. doi:10.1016/s0149-7634(05)80038-7
- Healy, D. (1987). The comparative psychopathology of affective disorders in animals and humans. Journal of Psychopharmacology, 1(3), 193–210. doi:10.1177/026988118700100306
- Hebebrand, J., Exner, C., Hebebrand, K., Holtkamp, C., Casper, R. C., Remschmidt, H., Herpertz-Dahlmann, B., & Klingenspor, M. (2003). Hyperactivity in patients with anorexia nervosa and in semistarved rats: evidence for a pivotal role of hypoleptinemia. Physiology & Behavior, 79(1), 25–37. doi:10.1016/s0031-9384(03)00102-1
- Hill, R. A., McInnes, K. J., Gong, E. C., Jones, M. E., Simpson, E. R., & Boon, W. C. (2007). Estrogen deficient male mice develop compulsive behavior. Biological Psychiatry, 61(3), 359–66. doi:10.1016/j.biopsych.2006.01.012
- Holden, C., & Travis, J. (2010). Profile: Nicholas Dodman. Can dogs behaving badly suggest a new way to treat OCD? Science, 329(5990), 386–7. doi:10.1126/science.329.5990.386
- Kalueff, A. V., & Tuohimaa, P. (2004). Experimental modeling of anxiety and depression. Acta Neurobiologiae Experimentalis, 64(4), 439–48.
- Kalueff, A. V., et al. (2007). Analyzing grooming microstructure in neurobehavioral experiments. Nature Protocols, 2(10), 2538–2544. doi:10.1038/nprot.2007.367
- Levy, D. (2001). “We can all relate to stressed-out baboons”. Stanford Report.
- Lutz, C. K. (2014). Stereotypic Behavior in Nonhuman Primates as a Model for the Human Condition. ILAR Journal, 55(2), 284–296. doi:10.1093/ilar/ilu016
- Maestripieri, D. (2005). Book Reviews: Primate Psychology. Animal Behaviour, 69, 245–248. doi:10.1016/j.anbehav.2004.08.001
- Maulana, R., Gawi, J. M., & Utomo, S. W. (2020). Architectural design assessment of Javan leopard rehabilitation facility regarding the occurrence of stereotypical pacing. IOP Conference Series: Earth and Environmental Science, 426(1), 012075. doi:10.1088/1755-1315/426/1/012075
- Miller, J. A. (1992). Look who’s clucking! Bioscience, 42(4), 257-259. JSTOR 1311673
- Mitchell, D., Winter, W., & Morisaki, C. M. (1977). Conditioned taste aversions accompanied by geophagia: evidence for the occurrence of “psychological” factors in the etiology of pica. Psychosomatic Medicine, 39(6), 401–12. doi:10.1097/00006842-197711000-00004
- Nesse, R. M. (2000). Is depression an adaptation? Archives of General Psychiatry, 57(1), 14–20. doi:10.1001/archpsyc.57.1.14
- Nuwer, R. (2012). From tail chasing to hand washing. Scientific American, 307(5), 25. doi:10.1038/scientificamerican1112-25
- Overall, K. L., & Dunham, A. E. (2002). Clinical features and outcome in dogs and cats with obsessive-compulsive disorder: 126 cases (1989-2000). Journal of the American Veterinary Medical Association, 221(10), 1445–52. doi:10.2460/javma.2002.221.1445
- Owen, J. B., Treasure, J. L., & Collier, D. A. (2001). Animal Models- Disorders of Eating Behaviour and Body Composition. Kluwer Academic Publishers.
- Pond, C. L., & Rush, H. G. (1983). Self-aggression in macaques: Five case studies. Primates, 24(1), 127-134.
- Radostits, O. M. (2000). Veterinary Medicine: A Textbook of the Diseases of Cattle, Sheep, Pigs, Goats and Horses (9th ed.). Saunders Ltd.
- Ripped Enterprises website. (n.d.). Retrieved from http://cbass.com/Breakout.htm
- Saeki, M., Sakai, M., Saito, R., Kubota, H., Ariumi, H., Takano, Y., Yamatodani, A., & Kamiya, H. (2001). Effects of HSP-117, a novel tachykinin NK1-receptor antagonist, on cisplatin-induced pica as a new evaluation of delayed emesis in rats. Japanese Journal of Pharmacology, 86(3), 359–62. doi:10.1254/jjp.86.359
- Siegel, S., Hinson, R. E., & Krank, M. D. (1978). The role of predrug signals in morphine analgesic tolerance: support for a Pavlovian conditioning model of tolerance. Journal of Experimental Psychology: Animal Behavior Processes, 4(2), 188–196. doi:10.1037/0097-7403.4.2.188
- Sociology: A Self-Corrective for The Population Explosion? (1964, February 28). Time. Retrieved from https://web.archive.org/web/20121021081123/http://www.time.com/time/magazine/article/0,9171,873834-1,00.html
- Vermeire, S., Audenaert, K., De Meester, R., Vandermeulen, E., Waelbers, T., De Spiegeleer, B., Eersels, J., Dobbeleir, A., & Peremans, K. (2012). Serotonin 2A receptor, serotonin transporter and dopamine transporter alterations in dogs with compulsive behaviour as a promising model for human obsessive-compulsive disorder. Psychiatry Research, 201(1), 78–87. doi:10.1016/j.pscychresns.2011.06.006
- Vieuille-Thomas, C., Le Pape, G., & Signoret, J. P. (1995). Stereotypies in pregnant sows: indications of influence of the housing system on the patterns expressed by the animals. Applied Animal Behaviour Science, 44(1), 19–27. doi:10.1016/0168-1591(95)00574-c
- Webster, A. B. (2003). Physiology and behavior of the hen during induced molt. Poultry Science, 82(6), 992–1002. doi:10.1093/ps/82.6.992
- Zanella, A. J., Broom, D. M., Hunter, J. C., & Mendl, M. T. (1996). Brain opioid receptors in relation to stereotypies, inactivity, and housing in sows. Physiology & Behavior, 59(4–5), 769–75. doi:10.1016/0031-9384(95)02118-3
Leave a Reply