Table of Contents
ভূমিকা
বিষয়টা শুরু করা যাক খুব সাধারণ একটা দৃশ্য দিয়ে। ধরুন, ঢাকার কোনো এক রাস্তায় প্রচণ্ড গরমে এক নারী মাথায় ইটের বোঝা নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। পরনে মলিন শাড়ি। এই দৃশ্য দেখে আপনার মনে কী প্রতিক্রিয়া হবে? হয়তো কষ্ট হবে, মায়া লাগবে। আপনি ভাবতে পারেন, এই নারীর মুক্তি দরকার। তার এই কষ্টকর জীবন থেকে বের হয়ে আসা উচিত। এই ভাবনার মধ্যে কোনো ভুল নেই। এটি অত্যন্ত মানবিক একটি অনুভূতি।
এবার আরেকটা দৃশ্য ভাবুন। নিউইয়র্কের কোনো এক কর্পোরেট অফিসের ঝা-চকচকে কেবিনে এক নারী বসে আছেন। নামী ব্র্যান্ডের পোশাক, চোখেমুখে আত্মবিশ্বাসের ছাপ। কিন্তু তিনি হয়তো তার পুরুষ সহকর্মীর চেয়ে কম বেতন পাচ্ছেন। অথবা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং-এ তার মতামতকে পাত্তা দেওয়া হচ্ছে না। কাঁঁচের দেওয়ালের আড়ালে যে অদৃশ্য বৈষম্যের দেয়াল, যাকে বলে ‘গ্লাস সিলিং’ (Glass Ceiling), সেটা ভাঙতে গিয়ে তিনি ক্লান্ত। এই নারীরও মুক্তি দরকার। তিনিও একধরনের শোষণের শিকার।
এখন প্রশ্ন হলো, এই দুই নারীর মুক্তির পথ কি একই? তাদের লড়াইয়ের ধরণ কি এক? ঢাকার ইটভাটার নারী শ্রমিকের জন্য যে নারীবাদ (Feminism) দরকার, নিউইয়র্কের কর্পোরেট কর্মকর্তার জন্যও কি ঠিক একই নারীবাদ কাজ করবে? তাদের দুজনের ‘মুক্তি’ শব্দটির অর্থ কি এক?
সাধারণ জ্ঞানে মনে হতে পারে, নারী তো নারীই। পৃথিবীর সব নারীর সমস্যা মোটামুটি একই— পিতৃতন্ত্রের (Patriarchy) শোষণ। কাজেই তাদের মুক্তির পথও এক হবে। এই ভাবনা থেকেই পশ্চিমা বিশ্বে নারীবাদী আন্দোলনের মূল স্রোতটি (Mainstream Feminism) তৈরি হয়েছিল। তারা ভেবেছিল, তাদের দেখানো পথেই পৃথিবীর সব নারীর মুক্তি আসবে। তারা এক ‘বৈশ্বিক ভগিনীত্ব’ (Global Sisterhood) গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিল। কী সুন্দর একটি ধারণা! পৃথিবীর সব নারী একে অপরের বোন, হাতে হাত রেখে এগিয়ে যাবে সমতার দিকে।
কিন্তু সমস্যাটা হলো অন্য জায়গায়। স্বপ্নটি সুন্দর হলেও বাস্তব ছিল কঠিন। পশ্চিমা নারীবাদীরা যখন তাদের নিজেদের অভিজ্ঞতার চশমা দিয়ে বাকি পৃথিবীকে দেখতে শুরু করল, তখন তারা অনেক কিছু দেখতে পেল না। তাদের চশমার কাঁচটা ছিল মূলত সাদা, মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত, খ্রিস্টীয় বা ধর্মনিরপেক্ষ পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা মানুষদের অভিজ্ঞতা দিয়ে তৈরি। তারা তৃতীয় বিশ্বের (Third World) নারীদের দেখল অসহায়, অশিক্ষিত, শোষিত এক জনগোষ্ঠী হিসেবে, যাদের উদ্ধার করা দরকার। এই উদ্ধারকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো তারাই—উন্নত বিশ্বের সাদা নারীরা। তাদের চোখে তৃতীয় বিশ্বের নারীরা ছিল ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা জীবন্ত ছবি, যাদের আধুনিকতার আলোয় আলোকিত করতে হবে।
এই সরলীকরণ, এই ‘আমরা বনাম ওরা’র বিভাজনের বিরুদ্ধেই জন্ম নিল এক নতুন স্বর, এক নতুন তত্ত্ব। যার নাম পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজম (Postcolonial Feminism)। এই তত্ত্বটি কোনো হৈ-হট্টগোল করে আসেনি। এটি এসেছে গভীর আত্মজিজ্ঞাসা আর ঐতিহাসিক পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে। এই তত্ত্বটি বললো, থামুন! সব নারীর গল্প এক নয়। উপনিবেশবাদের (Colonialism) ইতিহাস, গায়ের রং, শ্রেণি, ধর্ম, জাতি, ভূগোল—এই সবকিছু নারীর অভিজ্ঞতাকে ভিন্ন ভিন্ন রূপ দেয়। ঢাকার ওই নারী শ্রমিকের লড়াই শুধু পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে নয়, তার লড়াই শ্রেণি বৈষম্যের বিরুদ্ধে, তার লড়াই ঔপনিবেশিক মানসিকতার রেখে যাওয়া শোষণমূলক অর্থনৈতিক কাঠামোর বিরুদ্ধে। তার লড়াইটা অনেক বেশি জটিল, অনেক বেশি স্তরবিশিষ্ট। পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজম আমাদের সেই জটিল গল্পটাই শোনাতে চায়।
চলুন, এই জটিল কিন্তু জরুরি তত্ত্বের অলিগলিতে একটু ধৈর্য ধরে ঘুরে আসা যাক। কারণ এই তত্ত্ব আমাদের কেবল নারীবাদ নয়, বরং গোটা পৃথিবীকেই নতুন করে দেখতে শেখায়।
পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজম: যে মাটি ও মনন থেকে জন্মাল এক নতুন দর্শন
কোনো গাছ কি শূন্যে জন্মায়? জন্মায় না। তার জন্য মাটি লাগে, জল লাগে, আলো-বাতাসের নির্দিষ্ট রসায়ন লাগে। ঠিক তেমনি, কোনো দর্শন বা তত্ত্বও আকাশ থেকে পড়ে না। তারও একটি মাটি থাকে—একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক পরিস্থিতি, একটি সামাজিক আলোড়ন। আর তার জন্য জল আর আলোর মতো প্রয়োজন হয় পূর্ববর্তী কিছু চিন্তার, কিছু দর্শনের, যা তাকে বেড়ে ওঠার রসদ জোগায়।
পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজম (Postcolonial Feminism) নামক যে শক্তিশালী তত্ত্বটির কথা আমরা বলি, সেটিও একদিনে তৈরি হয়নি। এর শেকড় ছড়িয়ে আছে বিংশ শতাব্দীর উত্তাল রাজনৈতিক ইতিহাস এবং তারও আগে থেকে বয়ে চলা বিভিন্ন দার্শনিক স্রোতের মধ্যে। এই তত্ত্বটিকে ভালোভাবে বুঝতে হলে আমাদের একটু গোয়েন্দার মতো পেছনে ফিরে তাকাতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে সেই রাজনৈতিক মাটি আর সেই বুদ্ধিবৃত্তিক বীজ, যা থেকে এই চিন্তার চারাগাছটি একদিন মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল।
চলুন, সেই শেকড়ের সন্ধানে এক দীর্ঘ যাত্রা শুরু করা যাক।
রাজনৈতিক জমিনটা কেমন ছিল?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। পৃথিবীর মানচিত্র দ্রুত বদলে যাচ্ছে। কয়েক শতাব্দী ধরে যে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো এশিয়া, আফ্রিকা আর লাতিন আমেরিকাকে শাসন-শোষণ করে আসছিল, তাদের সূর্য অস্তাচলে। একের পর এক দেশ স্বাধীন হচ্ছে। বাতাসে মুক্তির ঘ্রাণ। কিন্তু এই মুক্তির আনন্দটা যতটা সহজ শোনায়, বাস্তবতা ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি জটিল। এই জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিই পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজমের প্রথম আঁতুড়ঘর।
বিউপনিবেশায়নের ঢেউ এবং ‘তৃতীয় বিশ্বের’ জন্ম (The Wave of Decolonization and the Birth of the ‘Third World’)
১৯৪০ থেকে ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত সময়কালকে বলা হয় বিউপনিবেশায়নের (Decolonization) স্বর্ণযুগ। ভারত, পাকিস্তান, ঘানা, নাইজেরিয়া, ভিয়েতনাম, আলজেরিয়া—অগণিত দেশ রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করে। কিন্তু পতাকা বদল হলেই কি সব বদলে যায়? যায়নি। নতুন স্বাধীন দেশগুলো দেখল, রাজনৈতিক স্বাধীনতা এলেও অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি অনেক দূরের পথ। তাদের অর্থনীতি তখনও পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল, তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা তখনও ঔপনিবেশিক প্রভুদের তৈরি করা, আর তাদের শিক্ষিত অভিজাতদের মনোজগতে তখনও রয়ে গেছে প্রভুদের সংস্কৃতির প্রতি একধরনের মোহ। এই অবস্থাকেই বলা হয় নয়া-উপনিবেশবাদ (Neo-colonialism)।
ঠিক এই সময়েই, ১৯৫৫ সালে ইন্দোনেশিয়ার বান্দুং শহরে একটি ঐতিহাসিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যা বান্দুং সম্মেলন (Bandung Conference) নামে পরিচিত। সেখানে এশিয়া ও আফ্রিকার ২৯টি সদ্য স্বাধীন দেশ একত্রিত হয়। তারা ঘোষণা করে, তারা আমেরিকার নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা ব্লক বা সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক ব্লক—কোনো দিকেই যাবে না। তারা নিজেদের একটি আলাদা জগৎ তৈরি করবে, যার নাম ‘তৃতীয় বিশ্ব’ (Third World)। এই ‘তৃতীয় বিশ্ব’ ধারণাটি কেবল একটি ভৌগোলিক বা অর্থনৈতিক পরিচয় ছিল না, এটি ছিল একটি রাজনৈতিক সংহতির ডাক। এই সম্মিলিত কণ্ঠস্বরই প্রথম বিশ্বব্যাপী ঔপনিবেশিকতার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করে। পোস্টকলোনিয়াল চিন্তার রাজনৈতিক ভিত্তি এখানেই স্থাপিত হয়েছিল।
জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এবং নারীর দ্বৈত সংগ্রাম (Nationalist Movements and Women’s Dual Struggle)
স্বাধীনতার লড়াইয়ে নারীরা কি বসে ছিল? মোটেই না। উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামে নারীরা পুরুষদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছে। তারা মিছিলে হেঁটেছে, অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে, কারাগারে গেছে। জাতীয়তাবাদী নেতারা নারীদের অংশগ্রহণের জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। তারা নারীকে ‘জাতির জননী’, ‘দেশের মা’ বা ‘ঐতিহ্যের ধারক’ হিসেবে তুলে ধরেছিলেন।
কিন্তু স্বাধীনতা আসার পর দেখা গেল এক অন্য ছবি। যে নারীরা দেশের জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করল, নতুন স্বাধীন হওয়া রাষ্ট্রের কাঠামোতে তাদের জায়গা হলো সেই পুরোনো রান্নাঘরেই। জাতীয়তাবাদী পুরুষ নেতারা তখন বলতে শুরু করলেন, ‘এখন দেশ গড়ার সময়, নারীর অধিকারের মতো ছোটখাটো বিষয় নিয়ে পরে ভাবা যাবে।’ নারীর মুক্তিকে জাতীয় মুক্তির অধীনস্থ করে ফেলা হলো। এই অভিজ্ঞতা নারীদের এক কঠিন সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করাল। তারা বুঝল, তাদের লড়াইটা দ্বৈত। একদিকে লড়াই উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে, আরেকদিকে লড়াই নিজেদের সমাজের পিতৃতন্ত্রের (Patriarchy) বিরুদ্ধে। এই দ্বৈত সংগ্রামের উপলব্ধিই পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজমের অন্যতম চালিকাশক্তি।
পশ্চিমা নারীবাদী আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা
একই সময়ে পশ্চিমে নারীবাদী আন্দোলনের দ্বিতীয় তরঙ্গ (Second Wave Feminism) বেশ শক্তিশালী। তারা কর্মক্ষেত্রে সমানাধিকার, যৌন মুক্তি, প্রজনন অধিকার নিয়ে সোচ্চার। তাদের এই আন্দোলন নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের নারীরা দেখল, এই আন্দোলনের সাথে তাদের জীবনের বাস্তবতার মিল খুব কম। যখন একজন আমেরিকান নারী তার ‘নামহীন সমস্যা’ (The Problem that has no name) নিয়ে চিন্তিত, তখন একজন ভিয়েতনামী নারী হয়তো আমেরিকান বোমার হাত থেকে তার সন্তানকে বাঁচানোর জন্য লড়ছেন (Spivak, 1988)।
পশ্চিমা নারীবাদীরা যখন ‘বৈশ্বিক ভগিনীত্বে’র (Global Sisterhood) ডাক দিল, তখন তৃতীয় বিশ্বের নারীবাদীরা প্রশ্ন তুলল—এই ভগিনীত্বে ক্ষমতার সম্পর্কটা কেমন হবে? বড় বোন কি ছোট বোনকে শেখাবে কীভাবে চলতে হবে? এই অস্বস্তি, এই দূরত্ব থেকেই একটি স্বতন্ত্র নারীবাদী চিন্তার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়, যা কেবল লিঙ্গ নয়, বরং বর্ণ, শ্রেণি এবং উপনিবেশের ইতিহাসকেও বিবেচনায় আনবে।
কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদ এবং ইন্টারসেকশনসমূহের আবিষ্কার (Black Feminism and the Discovery of Intersections)
পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজমের ভাবনার সবচেয়ে কাছের আত্মীয় হলো আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদ (Black Feminism)। ষাট ও সত্তরের দশকে আমেরিকার সিভিল রাইটস মুভমেন্ট এবং নারীবাদী আন্দোলন—দুটোই চলছিল। কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গ নারীরা দেখল, সিভিল রাইটস মুভমেন্ট মূলত পুরুষদের কথা বলছে আর নারীবাদী আন্দোলন মূলত সাদা নারীদের কথা বলছে। তাদের জায়গা কোথাও হচ্ছিল না।
এই পরিস্থিতি থেকেই ১৯৭৭ সালে কম্বাহি রিভার কালেকটিভ (The Combahee River Collective) নামে একদল কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদী তাদের বিখ্যাত ঘোষণাপত্রটি প্রকাশ করে। তারা ঘোষণা করে, তাদের সংগ্রামকে আলাদা আলাদা বাক্সে ভাগ করা সম্ভব নয়। তারা একই সাথে বর্ণবাদ (Racism), লৈঙ্গিক বৈষম্য (Sexism) এবং শ্রেণি শোষণের (Class Oppression) শিকার। এই শোষণ ব্যবস্থাগুলো একে অপরের সাথে জড়িত এবং একটিকে ছেড়ে অন্যটির বিরুদ্ধে লড়াই করা অসম্ভব। তারা যাকে বলেছিল ‘ইন্টারলকিং ব্যবস্থা’ (Interlocking Systems), সেই ধারণাটিই পরে কিম্বার্লি ক্রেনশ’র হাতে ‘ইন্টারসেকশনালিটি’ (Intersectionality) নামে পরিচিতি পায়। এই উপলব্ধি—যে শোষণ একরৈখিক নয়, বরং বহুমাত্রিক এবং ইন্টারসেকশনাল—পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজমের একেবারে কেন্দ্রীয় একটি ধারণা।
এই উত্তাল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটিই ছিল সেই উর্বর মাটি, যেখানে পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজমের বীজ অঙ্কুরিত হওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল।
দ্বিতীয় ভাবনার বীজগুলো এলো কোথা থেকে?
কেবল রাজনৈতিক পরিস্থিতিই যথেষ্ট নয়। একটি তত্ত্বের জন্য প্রয়োজন হয় কিছু দার্শনিক হাতিয়ারের, যা দিয়ে সেই পরিস্থিতিকে বিশ্লেষণ করা যায়। পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজম তার বুদ্ধিবৃত্তিক রসদ সংগ্রহ করেছিল কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন দার্শনিক ধারা থেকে।
ফরাসি পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজম: ক্ষমতার নতুন পাঠ (French Post-structuralism: A New Reading of Power)
ষাটের দশকে ফ্রান্সে একদল দার্শনিক প্রচলিত চিন্তার কাঠামোকে ভীষণভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাদের বলা হয় পোস্ট-স্ট্রাকচারালিস্ট (Post-structuralist)। তাদের দুজনের কাজ পোস্টকলোনিয়াল চিন্তাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে।
-
মিশেল ফুকো (Michel Foucault): ফুকো আমাদের ক্ষমতা (Power) সম্পর্কে ভাবনার ছকটাই বদলে দিলেন। তিনি বললেন, ক্ষমতা কেবল রাজা বা রাষ্ট্রের হাতে থাকে না। ক্ষমতা সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। এটি কাজ করে জ্ঞান (Knowledge), ভাষা এবং ‘ডিসকোর্স’ (Discourse) বা বয়ানের মাধ্যমে। ডিসকোর্স হলো কোনো একটি বিষয় নিয়ে কথা বলার নির্দিষ্ট ধরণ, যা সমাজে সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। যেমন, চিকিৎসা শাস্ত্রের ডিসকোর্স নির্ধারণ করে দেয় কে সুস্থ আর কে অসুস্থ। আইনশাস্ত্রের ডিসকোর্স নির্ধারণ করে দেয় কে অপরাধী আর কে নিরপরাধ। ফুকো দেখালেন, জ্ঞান কখনোই নিরপেক্ষ নয়; জ্ঞান নিজেই ক্ষমতার একটি রূপ (Foucault, 1980)।
পোস্টকলোনিয়াল তাত্ত্বিকরা ফুকোর এই ধারণাটি ব্যবহার করে দেখালেন, কীভাবে উপনিবেশবাদ একটি ‘ডিসকোর্স’ হিসেবে কাজ করেছিল। ঔপনিবেশিক শাসকরা প্রাচ্য সম্পর্কে, আফ্রিকা সম্পর্কে এমন এক জ্ঞানকাণ্ড তৈরি করেছিল, যা তাদের ‘অসভ্য’, ‘অযৌক্তিক’ ও ‘শিশুসুলভ’ হিসেবে চিত্রিত করে। এই ‘জ্ঞান’ই তাদের ওপর শাসন করার নৈতিক ভিত্তি তৈরি করেছিল।
-
জ্যাক দেরিদা (Jacques Derrida): দেরিদা দেখালেন, সমগ্র পশ্চিমা দর্শন দাঁড়িয়ে আছে এক ধরনের বাইনারি অপোজিশন বা দ্বি-বিভাজনের ওপর। যেমন: পুরুষ/নারী, সাদা/কালো, যুক্তি/আবেগ, পশ্চিম/প্রাচ্য, সংস্কৃতি/প্রকৃতি। এই বিভাজনে প্রথম শব্দটি সব সময় দ্বিতীয়টির চেয়ে শ্রেষ্ঠ বা গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। দেরিদা এই কাঠামোকে ভেঙে ফেলার কথা বললেন, যার নাম তিনি দিলেন ‘ডিকনস্ট্রাকশন’ (Deconstruction) বা বিনির্মাণ (Derrida, 1976)।
পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিস্টরা দেরিদার এই টুলটি ব্যবহার করে দেখালেন, কীভাবে ‘পুরুষ/নারী’ এবং ‘পশ্চিম/প্রাচ্য’—এই দুটি বাইনারি একে অপরের ওপর ভর করে টিকে থাকে। পশ্চিম নিজেকে ‘পুরুষালি’, ‘যৌক্তিক’ ও ‘শক্তিশালী’ হিসেবে নির্মাণ করে প্রাচ্যকে ‘নারীসুলভ’, ‘আবেগপ্রবণ’ ও ‘দুর্বল’ হিসেবে দেখানোর মাধ্যমে। এই কাঠামোকে ভেঙে দিতে পারলেই ঔপনিবেশিক এবং পুরুষতান্ত্রিক—উভয় শোষণ থেকেই মুক্তির পথ পাওয়া সম্ভব।
উপনিবেশ-বিরোধী প্রথম স্বরগুলো (The Early Anti-Colonial Voices)
পোস্ট-স্ট্রাকচারালিস্টদের আগেই উপনিবেশের মনস্তাত্ত্বিক ক্ষত নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছিলেন কয়েকজন বিপ্লবী চিন্তক।
-
ফ্রানৎস ফানোঁ (Frantz Fanon): ফানোঁ ছিলেন ফরাসি উপনিবেশ মার্টিনিকের একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং বিপ্লবী। তার দুটি বই—”Black Skin, White Masks” (১৯৫২) এবং “The Wretched of the Earth” (১৯৬১)—উপনিবেশবাদের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব নিয়ে লেখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর অন্যতম। ফানোঁ দেখালেন, উপনিবেশবাদ কেবল ভূমি দখল করে না, এটি উপনিবেশিত মানুষের আত্মাকে দখল করে। উপনিবেশিত মানুষ তার নিজের সংস্কৃতিকে ঘৃণা করতে শুরু করে এবং ঔপনিবেশিক প্রভুর মতো হওয়ার চেষ্টা করে। সে ‘সাদা মুখোশ’ পরে নিজের কালো চামড়াকে ঢাকতে চায়। এই গভীর মনস্তাত্ত্বিক হীনম্মন্যতাই উপনিবেশবাদের সবচেয়ে বড় জয়। ফানোঁর এই বিশ্লেষণ পোস্টকলোনিয়াল তাত্ত্বিকদের বুঝতে সাহায্য করেছিল যে, মুক্তি কেবল রাজনৈতিক নয়, এটি একটি গভীর মনস্তাত্ত্বিক এবং সাংস্কৃতিক লড়াই।
-
এডওয়ার্ড সাঈদ (Edward Said): ফিলিস্তিনি-আমেরিকান সাহিত্য তাত্ত্বিক এডওয়ার্ড সাঈদ তার যুগান্তকারী বই “Orientalism” (১৯৭৮)-এ ফুকোর তত্ত্বকে ব্যবহার করে দেখালেন, কীভাবে পশ্চিমা জগত শত শত বছর ধরে ‘প্রাচ্য’ (The Orient) সম্পর্কে একটি কল্পিত, অপরিবর্তনীয় এবং নিকৃষ্ট ধারণা তৈরি করেছে। এই প্রাচ্যতত্ত্ব বা ওরিয়েন্টালিজম কোনো বাস্তব প্রাচ্য নয়, বরং এটি পশ্চিমাদের নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য তৈরি করা একটি ডিসকোর্স। এই ডিসকোর্সে প্রাচ্য হলো রহস্যময়, অলস, স্বৈরাচারী এবং নারীসুলভ। আর এর বিপরীতে পশ্চিম হলো যৌক্তিক, কর্মঠ, গণতান্ত্রিক এবং পুরুষালি। সাঈদের কাজ সরাসরি দেখিয়ে দিল, কীভাবে জ্ঞান উৎপাদনের মাধ্যমে শাসন করা যায়। পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিস্টরা সাঈদের এই কাঠামোকে ব্যবহার করে দেখালেন, এই ‘নারীসুলভ’ প্রাচ্যের কেন্দ্রে রয়েছে প্রাচ্যের নারী—যিনি একই সাথে মোহনীয়, রহস্যময় এবং অবদমিত, যাকে পশ্চিমা পুরুষের উদ্ধার করা প্রয়োজন।
সব স্রোত এসে যেখানে মিশল
তাহলে গল্পটা কী দাঁড়াল? একদিকে ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থা, নতুন স্বাধীন দেশগুলোর আশা ও হতাশা, জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের মধ্যে নারীর দ্বৈত অবস্থান এবং পশ্চিমা নারীবাদের সাথে তৃতীয় বিশ্বের নারীদের দূরত্বের উপলব্ধি। এটি ছিল মাটি।
অন্যদিকে ছিল ফুকো-দেরিদার মতো দার্শনিকদের তৈরি করা নতুন হাতিয়ার, যা দিয়ে ক্ষমতার অদৃশ্য কাঠামোকে কাটাছেঁড়া করা যায়। ছিল ফানোঁ-সাঈদের মতো চিন্তকদের দেখানো পথ, যা উপনিবেশবাদের গভীর ক্ষতকে উন্মোচিত করে। আর ছিল কম্বাহি রিভার কালেকটিভের মতো সংগ্রামী নারীদের ঘোষণা, যা দেখিয়ে দেয় যে শোষণকে আলাদা করে দেখার কোনো উপায় নেই। এগুলো ছিল বীজ।
এই রাজনৈতিক মাটি আর বুদ্ধিবৃত্তিক বীজের সংমিশ্রণেই জন্ম নিল পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজম। এটি কোনো একক ব্যক্তির সৃষ্টি নয়। এটি একটি সম্মিলিত প্রয়াস, একটি ঐতিহাসিক প্রয়োজনে জন্ম নেওয়া দর্শন। এটি একই সাথে পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজমের কাছে ঋণী তার বিশ্লেষণাত্মক পদ্ধতির জন্য, আবার একই সাথে তার ইউরোপ-কেন্দ্রিকতার সমালোচক। এটি ফেমিনিজমের কাছে ঋণী তার পিতৃতন্ত্র-বিরোধী লড়াইয়ের জন্য, আবার একই সাথে তার পশ্চিমা-কেন্দ্রিকতার সমালোচক।
এই জটিল বোঝাপড়াটিই পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজমকে এত গুরুত্বপূর্ণ এবং আজকের দিনেও এত প্রাসঙ্গিক করে রেখেছে। এটি আমাদের শেখায়, কোনো তত্ত্বকে তার ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে বোঝা যায় না, ঠিক যেমন কোনো গাছকে তার মাটি থেকে আলাদা করে ভাবা যায় না।
নারীবাদ কেন ‘এক’ নয়? পশ্চিমা নারীবাদীর চশমায় সমস্যা
নারীবাদ মূলত একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলন, যার মূল লক্ষ্য হলো লৈঙ্গিক সমতা (Gender Equality) প্রতিষ্ঠা করা। এর ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। প্রথম তরঙ্গের নারীবাদীরা (First Wave Feminism), যেমন মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট বা সাফারগেটরা (suffragette), মূলত আইনের চোখে সমানাধিকার এবং ভোটাধিকারের জন্য লড়েছিলেন। এরপর এলো দ্বিতীয় তরঙ্গ (Second Wave Feminism)। সিমোন দ্য বোভোয়া (Simone de Beauvoir), বেটি ফ্রিডান (Betty Friedan)-এর মতো তাত্ত্বিকদের হাত ধরে এই তরঙ্গ বলল, আইনি সাম্যই যথেষ্ট নয়। আসল সমস্যা লুকিয়ে আছে সমাজে, সংস্কৃতিতে, পরিবারে। ‘ব্যক্তিগতই রাজনৈতিক’ (The Personal is Political)—এই ছিল তাদের মূলমন্ত্র। তারা কর্মক্ষেত্রে সমান বেতন, প্রজনন অধিকার, যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে সোচ্চার হলো।
এগুলো নিঃসন্দেহে জরুরি দাবি। কিন্তু এই দাবিগুলো কি বাংলাদেশের একজন গার্মেন্টকর্মী অথবা কেনিয়ার একজন আদিবাসী নারীর জীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যা? সম্ভবত নয়। তাদের কাছে হয়তো বিশুদ্ধ পানি পাওয়া বা সন্তানের মুখে দুবেলা খাবার তুলে দেওয়াটা ছিল আরও বড় লড়াই।
সমস্যাটা হলো, দ্বিতীয় তরঙ্গের নারীবাদীরা তাদের অভিজ্ঞতাকে ‘সার্বজনীন নারী অভিজ্ঞতা’ (Universal Female Experience) বলে ধরে নিয়েছিল। বেটি ফ্রিডান তার বিখ্যাত বই “The Feminine Mystique” (১৯৬৩)-এ আমেরিকার শহরতলির গৃহিণীদের ‘নামহীন সমস্যা’র কথা বলেছিলেন, যারা শিক্ষিত হয়েও ঘরের কাজে নিজেদের সত্তা হারিয়ে ফেলছিলেন। এই সমস্যাটি বাস্তব ছিল, কিন্তু এটি ছিল মূলত সাদা, মধ্যবিত্ত নারীদের সমস্যা। একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারী, যিনি হয়তো ওই সাদা নারীর বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করতেন, তার কাছে এই ‘নামহীন সমস্যা’ ছিল এক ধরনের বিলাসিতা। তার লড়াইটা ছিল বর্ণবাদ এবং অর্থনৈতিক শোষণ—এই দুই ফ্রন্টে।
পশ্চিমা নারীবাদীরা প্রায়শই তৃতীয় বিশ্বের নারীদের এক সমসত্ত্ব (Homogeneous) দল হিসেবে দেখত। তাদের গবেষণায়, লেখায়, বক্তৃতায় ফুটে উঠত একধরনের সরল এবং করুণ ছবি: ‘তৃতীয় বিশ্বের নারীরা পর্দাপ্রথার শিকার, বাল্যবিবাহের শিকার, যৌতুকের শিকার, তাদের খৎনা করা হয়, তারা অশিক্ষিত এবং তাদের কোনো স্বাধীনতা নেই।’ এই বর্ণনায় সত্যের অংশ থাকলেও তা ছিল খণ্ডিত এবং একপেশে। এই খণ্ডিত চিত্রায়নের মাধ্যমে তারা নিজেদের ‘আধুনিক’, ‘শিক্ষিত’ ও ‘স্বাধীন’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করত এবং তৃতীয় বিশ্বের নারীদের ‘অপর’ (Other) বানিয়ে ফেলত। এই ‘অপর’ নারীরা ছিল তাদের গবেষণার বস্তু, তাদের দয়ার পাত্র, কিন্তু তাদের সমান সহযোদ্ধা নয়।
এই জায়গাতেই সবচেয়ে জোরালো আপত্তি জানালেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান তাত্ত্বিক চন্দ্রা তালপাড়ে মোহান্তি (Chandra Talpade Mohanty)। তার যুগান্তকারী প্রবন্ধ “Under Western Eyes: Feminist Scholarship and Colonial Discourses” (১৯৮৪)-এ তিনি তীব্রভাবে এই পশ্চিমা নারীবাদী ধারার সমালোচনা করেন। মোহান্তি দেখান, কীভাবে পশ্চিমা নারীবাদীরা তাদের নিজেদের জীবনের মানদণ্ডে (যেমন—ধর্মনিরপেক্ষতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, যৌন মুক্তি) তৃতীয় বিশ্বের নারীদের বিচার করে। তারা ধরে নেয়, পশ্চিমা নারীর জীবনই হলো আদর্শ, এবং বাকিদের সেই আদর্শে পৌঁছাতে হবে।
মোহান্তির ভাষায়, এই দৃষ্টিভঙ্গি একধরনের ‘জ্ঞানতাত্ত্বিক উপনিবেশবাদ’ (Epistemic Colonization) তৈরি করে। অর্থাৎ, জ্ঞানের জগতেও উপনিবেশবাদ কায়েম হয়, যেখানে পশ্চিমা জ্ঞান, পশ্চিমা তত্ত্ব, পশ্চিমা সমাধানই একমাত্র সঠিক বলে বিবেচিত হয়। এর ফলে তৃতীয় বিশ্বের নারীদের নিজস্ব লড়াই, তাদের প্রতিরোধের নিজস্ব ধরণ, এবং তাদের নিজেদের মতো করে ভালো থাকার চেষ্টাগুলো অদৃশ্য হয়ে যায়। তাদের দেখা হয় কেবলই ‘ভুক্তভোগী’ (Victim) হিসেবে, নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের ক্ষমতাহীন (Agency-less) একজন হিসেবে।
এই দৃষ্টিভঙ্গির একটি বিখ্যাত উদাহরণ হলো ‘সাদা পুরুষদের কালো/বাদামি পুরুষদের হাত থেকে কালো/বাদামি নারীদের রক্ষা করা’—এই ধারণাটি। ঔপনিবেশিক সময়ে সাদা শাসকেরা প্রায়ই বলত, তারা এই দেশ শাসন করছে এখানকার ‘বর্বর’ পুরুষদের হাত থেকে অসহায় নারীদের রক্ষা করার জন্য। যেমন, ব্রিটিশরা ভারতে সতীদাহ প্রথা বন্ধ করার আইন করেছিল। কাজটি মহৎ ছিল, কিন্তু এর পেছনের যুক্তিটি ছিল ঔপনিবেশিক। তারা নিজেদের ‘সভ্য’ এবং ভারতীয় পুরুষদের ‘বর্বর’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। আশ্চর্যের বিষয় হলো, অনেক পশ্চিমা নারীবাদীও প্রায় একই সুরে কথা বলতে শুরু করেন। তারা এমন একটি ছবি আঁকেন যেখানে তৃতীয় বিশ্বের পুরুষরা হলো চরম শোষক আর নারীরা হলো অসহায় শিকার। এই ছবি আঁকতে গিয়ে তারা ভুলে যান যে, ঔপনিবেশিকতার ইতিহাসে ওই পুরুষরাও কিন্তু সাদা চামড়ার শাসকদের হাতে শোষিত, অপমানিত এবং পুরুষত্বহীন (emasculated) হয়েছে। ফলে সমস্যাটা শুধু লিঙ্গের নয়, বরং বর্ণ, শ্রেণি এবং ঔপনিবেশিক ক্ষমতার জটিল সম্পর্কের সঙ্গে জড়িত।
এই জটিল সমীকরণটিই পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজমের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। এটি বলে, নারীবাদকে একরৈখিক হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে এবং ইতিহাসের ক্ষতগুলোকে স্বীকার করতে শিখতে হবে।
পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজম আসলে কী?
নামটা শুনেই বোঝা যাচ্ছে, পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজম দুটি শক্তিশালী তত্ত্বের সংযোগে তৈরি। একটি হলো পোস্টকলোনিয়ালিজম বা উত্তর-ঔপনিবেশিকতাবাদ (Postcolonialism) এবং অন্যটি ফেমিনিজম বা নারীবাদ (Feminism)। বিষয়টাকে পরিষ্কার করতে হলে এই দুটিকে আলাদাভাবে একটু বোঝা দরকার।
পোস্টকলোনিয়ালিজম (Postcolonialism): এই তত্ত্বটি বলে যে, উপনিবেশবাদ কেবল রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক শোষণেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি ছিল এক গভীর সাংস্কৃতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক প্রকল্প। উপনিবেশবাদ শেষ হয়ে দেশ স্বাধীন হলেও এর প্রভাব থেকে যায়। শাসকের ভাষা, সংস্কৃতি, শিক্ষা ব্যবস্থা, আইন, জ্ঞানচর্চার পদ্ধতি—এই সবকিছু শাসিতের মনে গভীর ছাপ ফেলে যায়। ফ্রানৎস ফানোঁ (Frantz Fanon) তার “Black Skin, White Masks” বইতে দেখিয়েছেন, কীভাবে উপনিবেশিত মানুষ তার নিজের সংস্কৃতিকে ঘৃণা করতে শুরু করে এবং শাসকের মতো হওয়ার চেষ্টা করে এক ধরনের মানসিক দ্বন্দ্বে ভোগে। এডওয়ার্ড সাঈদ (Edward Said) তার “Orientalism”-এ দেখিয়েছেন, কীভাবে পশ্চিমারা প্রাচ্য সম্পর্কে একধরনের কল্পিত, অপরিবর্তনীয় এবং নিকৃষ্ট ধারণা তৈরি করে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। হোমি কে. ভাবা (Homi K. Bhabha) এবং গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক (Gayatri Chakravorty Spivak)-এর মতো তাত্ত্বিকরা এই ধারার প্রধান প্রবক্তা। পোস্টকলোনিয়ালিজমের মূল লক্ষ্য হলো এই মানসিক ও সাংস্কৃতিক দাসত্ব থেকে মুক্তি, যাকে বলা হয় ডিকলোনাইজেশন (Decolonization) বা বিউপনিবেশায়ন।
ফেমিনিজম (Feminism): আগেই বলা হয়েছে, এই তত্ত্ব পিতৃতন্ত্রের অধীনে নারীর শোষণ ও তার অবসানের পথ নিয়ে আলোচনা করে। তবে ফেমিনিজমেরও অনেক ধারা আছে। লিবারেল ফেমিনিজম (Liberal Feminism) চায় ব্যবস্থার মধ্যে থেকেই সংস্কার। র্যাডিকাল ফেমিনিজম (Radical Feminism) মনে করে, গোটা পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থাটাকেই উপড়ে ফেলতে হবে। মার্ক্সিস্ট ফেমিনিজম (Marxist Feminism) নারীর শোষণের মূল কারণ হিসেবে পুঁজিবাদের শ্রেণি-শোষণকে দেখে।
পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজম এই সবগুলো তত্ত্বের সাথে একটি বিতর্কে জড়ায়। এটি মার্ক্সিস্ট ফেমিনিজমের শ্রেণি বিশ্লেষণকে গ্রহণ করে, কিন্তু প্রশ্ন করে—এই শ্রেণি কি কেবল অর্থনৈতিক? ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপটে বর্ণ (Race) কি শ্রেণির চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ? এটি র্যাডিকাল ফেমিনিজমের পিতৃতন্ত্রের ধারণাটিকে মানে, কিন্তু বলে—সব পিতৃতন্ত্র কি এক? একজন আমেরিকান সিইও-র পিতৃতন্ত্র আর কেনিয়ার মাসাই আদিবাসী গোষ্ঠীর পিতৃতন্ত্র কি একইভাবে কাজ করে?
পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজম এই দুটি তত্ত্বকে একবিন্দুতে নিয়ে এসে কয়েকটি মূল সিদ্ধান্তে পৌঁছায়:
১. উপনিবেশের অভিজ্ঞতা নারীর জীবনকে ভিন্নভাবে গঠন করে: একজন ভারতীয় নারী বা একজন নাইজেরীয় নারীর অভিজ্ঞতা একজন ব্রিটিশ বা ফরাসি নারীর চেয়ে ভিন্ন হবেই, কারণ তাদের ইতিহাস ভিন্ন। উপনিবেশের শাসকেরা শুধু দেশ শাসন করেনি, তারা স্থানীয় সংস্কৃতি, প্রথা এবং লিঙ্গীয় সম্পর্ককেও নিজেদের মতো করে বদলে দেওয়ার চেষ্টা করেছে বা ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছে। যেমন, আফ্রিকার অনেক সমাজে নারীদের জমিতে অধিকার ছিল বা তারা বাজারে ব্যবসা করত। ঔপনিবেশিক শাসকেরা এসে তাদের ভিক্টোরিয়ান ধ্যানধারণা অনুযায়ী জমির মালিকানা কেবল পুরুষদের হাতে তুলে দেয়, ফলে নারীরা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই আজকের দিনে ওই সব সমাজে নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করতে গেলে এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটি জানা জরুরি।
২. পশ্চিমা নারীবাদ সর্বজনীন নয়: পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজম ‘বৈশ্বিক ভগিনীত্বে’র সুন্দর ধারণাটিকে কঠোরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এটি বলে, সাদা নারীদের অভিজ্ঞতাকে সব নারীর অভিজ্ঞতা বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে না। কারণ বর্ণ (Race), জাতি (Ethnicity) এবং শ্রেণি (Class) লৈঙ্গিক পরিচয়ের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারীর সংগ্রাম শুধু পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে নয়, বর্ণবাদের (Racism) বিরুদ্ধেও। একজন দলিত নারীর সংগ্রাম পিতৃতন্ত্র এবং বর্ণবাদের পাশাপাশি বর্ণপ্রথার (Casteism) বিরুদ্ধেও। এই বিভিন্ন ধরনের শোষণ একে অপরের উপর কাজ করে, যা নারীকে আরও প্রান্তিক করে তোলে।
৩. তৃতীয় বিশ্বের নারীরা অসহায় শিকার নয়, তারা সক্রিয় কর্তা: পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদানগুলোর একটি হলো তৃতীয় বিশ্বের নারীদের ‘এজেন্সি’ (Agency) বা সক্রিয় কর্তাসত্তার ওপর জোর দেওয়া। পশ্চিমা বয়ানে তারা কেবলই শোষণের শিকার। কিন্তু পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিস্টরা বলেন, নারীরা কখনোই কেবল নিষ্ক্রিয় ভুক্তভোগী ছিল না। তারা সব সময়ই প্রতিরোধ করেছে, দর কষাকষি করেছে, নিজেদের জন্য পরিসর তৈরি করেছে। তাদের প্রতিরোধের ভাষা হয়তো পশ্চিমা নারীবাদীদের কাছে পরিচিত নয়। তারা হয়তো রাস্তায় নেমে মিছিল করেনি, কিন্তু পারিবারিক পরিসরে ছোট ছোট সিদ্ধান্তের মাধ্যমে, অথবা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে (যেমন—গান, গল্প, ব্রত) আঁকড়ে ধরে রাখার মাধ্যমে তারা নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ও সত্তা বজায় রেখেছে। এই ছোট ছোট প্রতিরোধকে স্বীকৃতি দেওয়া জরুরি।
সহজ ভাষায় বললে, পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজম হলো সেই নারীবাদ যা উপনিবেশের ক্ষত বয়ে বেড়ানো দেশগুলোর নারীদের গল্প তাদের নিজেদের ভাষায় শুনতে চায়, সাদা প্রভুদের শেখানো ভাষায় নয়। এটি একটি ঐক্যবদ্ধ, সমসত্ত্ব ‘নারী’ ধারণাকে ভেঙে দিয়ে অগণিত নারীর অগণিত বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা বলে।
তত্ত্বের টুলবক্স: কিছু জরুরি পরিভাষা
যেকোনো তত্ত্ব বুঝতে গেলে তার কিছু নিজস্ব শব্দ বা পরিভাষা থাকে। এগুলো অনেকটা যন্ত্রপাতির মতো, যা দিয়ে এই জটিল বিষয়গুলোকে কাটাছেঁড়া করা যায়। পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজমের টুলবক্সেও এমন কিছু জরুরি যন্ত্রপাতি আছে।
সাবঅল্টার্ন (The Subaltern)
এই শব্দটি ইতালীয় মার্ক্সিস্ট তাত্ত্বিক আন্তোনিও গ্রামশি (Antonio Gramsci) প্রথম ব্যবহার করেছিলেন। গ্রামশির তত্ত্বে, সমাজে একটি শাসক শ্রেণি থাকে যারা কেবল শক্তি দিয়ে নয়, বরং আদর্শ ও সংস্কৃতি দিয়েও শাসন করে, যাকে তিনি বলেছেন ‘হেজিমনি’ (Hegemony)। এই হেজিমনিক কাঠামোর বাইরে যারা থাকে, যারা এতটাই প্রান্তিক যে তাদের কণ্ঠস্বর ক্ষমতার কেন্দ্রে পৌঁছায় না, তারাই হলো সাবঅল্টার্ন।
পোস্টকলোনিয়াল আলোচনায় এই শব্দটিকে জনপ্রিয় করেছেন গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক। তার বিখ্যাত এবং অত্যন্ত জটিল প্রবন্ধ “Can the Subaltern Speak?” (১৯৮৮)-এ তিনি এই প্রশ্নটি তুলেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, ঔপনিবেশিক এবং পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোয় সবচেয়ে নিচে যে নারী অবস্থান করে—যেমন একজন দলিত, আদিবাসী বা প্রান্তিক কৃষক নারী—তার কথা কি আদৌ আমাদের কানে পৌঁছায়?
স্পিভাকের উত্তর ছিল, না, সে পারে না। এর কারণ দুটি। প্রথমত, শোষণের কাঠামোটিই এমন যে তার কথা বলার কোনো পরিসর বা ভাষা নেই। দ্বিতীয়ত, যখন কোনো শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত গবেষক বা নারীবাদী তার হয়ে কথা বলতে যান (to represent her), তখন আসলে তিনি ওই নারীর কণ্ঠকে প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে নিজের ভাষায়, নিজের তত্ত্বের কাঠামোয়, নিজের স্বার্থে তাকে উপস্থাপন (to re-present) করেন। ফলে সাবঅল্টার্নের আসল কণ্ঠস্বর হারিয়ে যায়।
স্পিভাক ভুবনেশ্বরী ভাদুড়ী নামে এক বাঙালি নারীর আত্মহত্যার একটি ঐতিহাসিক ঘটনাকে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করেন। ব্রিটিশ ভারতে ভুবনেশ্বরী নামে এক তরুণী স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি রাজনৈতিক গুপ্তহত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল। ধরা পড়ার আগে বা সহযোদ্ধাদের নাম প্রকাশ করতে বাধ্য হওয়ার আগে তিনি আত্মহত্যা করেন। কিন্তু তিনি এমন সময়ে আত্মহত্যা করেন যখন তার ঋতুস্রাব চলছিল, যাতে কেউ বলতে না পারে যে তিনি অবৈধ গর্ভধারণের লজ্জায় আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু তার পরিবার ও সমাজ তার এই রাজনৈতিক বার্তাকে বুঝতে ব্যর্থ হয়। তারা এটিকে একটি পারিবারিক কলঙ্কের ঘটনা হিসেবেই দেখে। স্পিভাকের মতে, ভুবনেশ্বরী তার দেহ দিয়ে একটি বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সেই বার্তা পড়ার মতো কেউ ছিল না। সাবঅল্টার্ন কথা বলার চেষ্টা করলেও, শোনার মতো কান প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে নেই।
সাবঅল্টার্নের ধারণাটি আমাদের শেখায়, প্রান্তিক নারীর হয়ে কথা বলার আগে শতবার ভাবতে হবে। আমরা কি সত্যিই তাদের কথা বলছি, নাকি তাদের ওপর নিজেদের কথা চাপিয়ে দিয়ে তাদের আরও নীরব করে দিচ্ছি?
গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক এর “Can the Subaltern Speak?” (১৯৮৮) সম্পর্কে জানতে যান এখানে – গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের “ক্যান দ্য সাবঅল্টার্ন স্পিক?”: এক সাড়াজাগানো সাবঅল্টার্ন বাস্তবতার পাঠ
ইন্টারসেকশনালিটি (Intersectionality)
এই শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদী আইন বিশেষজ্ঞ কিম্বার্লি ক্রেনশ (Kimberlé Crenshaw) ১৯৮৯ সালে। যদিও তিনি সরাসরি পোস্টকলোনিয়াল তাত্ত্বিক নন, তার এই ধারণাটি পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজমের একেবারে হৃদয়ে অবস্থিত।
ইন্টারসেকশনালিটি বলে, একজন মানুষের পরিচয়ের বিভিন্ন দিক—যেমন লিঙ্গ, বর্ণ, শ্রেণি, ধর্ম, যৌনতা, শারীরিক সক্ষমতা—আলাদা আলাদা বাক্স নয়। এগুলো একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং একসাথে কাজ করে, অনেকটা রাস্তার মোড়ের মতো (Intersection)। একটি গাড়ি যেমন একাধিক রাস্তার সংযোগস্থলে দুর্ঘটনার শিকার হতে পারে, তেমনি একজন মানুষ একাধিক ধরনের বৈষম্যের শিকার হতে পারে।
ক্রেনশ একটি আইনি মামলার উদাহরণ দেন। একটি গাড়ি নির্মাতা কোম্পানিতে কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষেরা কাজ পেত এবং শ্বেতাঙ্গ নারীরাও কাজ পেত। কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের চাকরি দেওয়া হতো না। তারা যখন মামলা করল, আদালত তা খারিজ করে দিল। কারণ কোম্পানির যুক্তি ছিল, তারা তো কৃষ্ণাঙ্গদের চাকরি দেয় (পুরুষদের) এবং নারীদেরও চাকরি দেয় (শ্বেতাঙ্গদের), তাই তাদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদ বা লিঙ্গবৈষম্যের অভিযোগ আনা যায় না। আদালত বুঝতে পারল না যে, এই নারীরা কেবল ‘কৃষ্ণাঙ্গ’ বা কেবল ‘নারী’ হিসেবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছিল না; তারা ‘কৃষ্ণাঙ্গ নারী’ হিসেবে এক স্বতন্ত্র এবং ছেদিত বা ইন্টারসেকশনাল বৈষম্যের শিকার হচ্ছিল।
পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজম এই ধারণাটিকে ব্যবহার করে দেখায়, তৃতীয় বিশ্বের নারীদের শোষণকে শুধু ‘নারী’ হিসেবে দেখলে চলবে না। তাদের শোষণকে বুঝতে হলে তার ঔপনিবেশিক অতীত, তার ধর্মীয় পরিচয়, তার জাতিগত পরিচয়, তার শ্রেণি—সবকিছুকে একসাথে বিবেচনায় আনতে হবে। একজন বাংলাদেশি মুসলিম নারী, একজন ভারতীয় দলিত নারী এবং একজন আদিবাসী নারীর অভিজ্ঞতা এক হবে না, কারণ তাদের পরিচয়ের ছেদবিন্দুগুলো ভিন্ন।
অপরীকরণ (Othering)
এই ধারণাটি আমরা আগেই এডওয়ার্ড সাঈদের সূত্রে পেয়েছি। তার বিখ্যাত বই “Orientalism” (১৯৭৮)-এ সাঈদ দেখিয়েছেন, পশ্চিমা জগত (The Occident) নিজেদের পরিচয় তৈরি করেছে প্রাচ্যকে (The Orient) ‘অপর’ হিসেবে নির্মাণ করে। প্রাচ্যকে দেখানো হয়েছে রহস্যময়, অযৌক্তিক, স্বৈরাচারী, অলস এবং নারীসুলভ হিসেবে। আর এর বিপরীতে পশ্চিম নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে যৌক্তিক, আধুনিক, গণতান্ত্রিক এবং পুরুষালি হিসেবে।
পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিস্টরা দেখান, এই ‘অপরীকরণে’র প্রক্রিয়ায় তৃতীয় বিশ্বের নারীদের দ্বিগুণভাবে অপর বানানো হয়। প্রথমত, তারা প্রাচ্যের অংশ হিসেবে ‘অপর’। দ্বিতীয়ত, তারা নারী হিসেবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ‘অপর’। এই দ্বৈত শোষণের ফলে তারা হয়ে ওঠে সবচেয়ে প্রান্তিক। পশ্চিমা নারীবাদীরাও অনেক সময় এই ফাঁদে পা দেন এবং তৃতীয় বিশ্বের নারীদের ‘অপর’ হিসেবে দেখেন, যাদের উদ্ধার করা প্রয়োজন, যারা নিজেরা চিন্তা করতে বা সিদ্ধান্ত নিতে অক্ষম। এই দৃষ্টিভঙ্গি আসলে ঔপনিবেশিক মানসিকতারই একটি নারীবাদী সংস্করণ।
সঙ্করতা এবং অনুকরণ (Hybridity and Mimicry)
এই দুটি ধারণা হোমি কে. ভাবা’র (Homi K. Bhabha) তাত্ত্বিক কাজের অংশ, যা পোস্টকলোনিয়াল সংস্কৃতিকে বোঝার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
-
সঙ্করতা (Hybridity): ভাবা বলেন, উপনিবেশের সংস্কৃতি এবং উপনিবেশিতের সংস্কৃতি কখনো সম্পূর্ণ আলাদা থাকে না। শাসক ও শাসিতের মধ্যেকার সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানে এক নতুন, সঙ্কর বা মিশ্র সংস্কৃতির জন্ম হয়। এই সঙ্করতা উপনিবেশিতের জন্য প্রতিরোধের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে। যেমন, ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনা করা। ভাষাটা শাসকের, কিন্তু গল্পটা, অনুভূতিটা, দর্শনটা শাসিতের। সালমান রুশদি, অরুন্ধতী রায় বা অমিতাভ ঘোষের সাহিত্য এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। একইভাবে, পোস্টকলোনিয়াল নারীবাদীরা দেখান, তৃতীয় বিশ্বের নারীরাও পশ্চিমা ধারণা (যেমন নারীবাদ) এবং দেশীয় সংস্কৃতিকে মিলিয়ে নিজেদের মতো করে প্রতিরোধের পথ তৈরি করে। তারা হয়তো নারীবাদের পশ্চিমা পোশাকটা নেয়, কিন্তু তার ভেতরে নিজেদের সংস্কৃতি ও অভিজ্ঞতার সুতো দিয়ে নতুন নকশা বোনে।
-
অনুকরণ (Mimicry): উপনিবেশিত মানুষ যখন শাসককে অনুকরণ করে—তার পোশাক, তার ভাষা, তার চালচলন—তখন তা কেবলই অন্ধ অনুকরণ থাকে না। ভাবার মতে, এই অনুকরণ প্রায় এক, কিন্তু পুরোপুরি এক নয় (“almost the same, but not quite”)। এই সামান্য পার্থক্যের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে ব্যঙ্গ এবং বিদ্রূপ, যা শাসকের কর্তৃত্বকে ভেতর থেকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। যেমন, একজন ভারতীয় যখন ব্রিটিশদের মতো স্যুট-বুট পরে নিখুঁত অক্সফোর্ড উচ্চারণে ইংরেজি বলেন, তখন তা শাসকের চোখে একই সাথে স্বস্তিদায়ক (কারণ সে সভ্য হচ্ছে) এবং অস্বস্তিদায়ক (কারণ সে প্রায় আমাদের মতোই হয়ে যাচ্ছে, আমাদের অনন্যতা আর থাকছে না)। এই অনুকরণ শাসকের ক্ষমতাকে একধরনের প্যারোডিতে পরিণত করে। পোস্টকলোনিয়াল নারীরাও পুরুষতান্ত্রিক বা ঔপনিবেশিক আচরণকে অনুকরণ করে তাকে ভেতর থেকে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারেন।
এই পরিভাষাগুলো আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে, পোস্টকলোনিয়াল নারীর জগৎটি সাদা-কালো নয়, বরং অনেক বেশি ধূসর, জটিল এবং কৌশলপূর্ণ।
তাত্ত্বিকদের উঠান: কয়েকজন পথিকৃৎ এবং তাদের ভাবনা
তত্ত্বের কথা যখন হয়, তখন তা প্রায়শই খুব দূরের, বায়বীয় কিছু বলে মনে হয়। যেন কতগুলো কঠিন কঠিন শব্দ আর জটিল বাক্য ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু প্রতিটি তত্ত্বের পেছনে থাকেন একজন বা একাধিক মানুষ—যিনি তার নিজের জীবন, নিজের সময় আর চারপাশের পৃথিবীকে দেখে কিছু প্রশ্ন তুলেছেন। সেই প্রশ্নগুলো থেকেই জন্ম নিয়েছে ভাবনা, আর সেই ভাবনাগুলোই ধীরে ধীরে তত্ত্বের রূপ নিয়েছে। পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজমও এর ব্যতিক্রম নয়। চলুন, এই তত্ত্বের কয়েকজন প্রধান স্থপতির উঠানে একটু উঁকি দিয়ে আসা যাক। দেখা যাক, কোন যন্ত্রণা, কোন জিজ্ঞাসা থেকে তাদের ভাবনারা ডানা মেলেছিল।
চন্দ্রা তালপাড়ে মোহান্তি: ‘বৈশ্বিক ভগিনীত্বে’র সরল ছবির সমালোচক
ভাবুন তো, আপনাকে কেউ একটিমাত্র বিশেষণে চেনার চেষ্টা করছে। যেমন, আপনি ‘এশীয়’। এই একটি শব্দ দিয়ে কি আপনার সবটা বোঝানো সম্ভব? আপনার ভাষা, ধর্ম, শ্রেণি, আপনার হাসি-কান্না, স্বপ্ন-সংগ্রাম—সবকিছু কি এই একটি শব্দের বাক্সে আঁটবে? আঁটবে না। ঠিক এই অস্বস্তিটাই চন্দ্রা তালপাড়ে মোহান্তিকে (Chandra Talpade Mohanty) তাড়িয়ে বেড়িয়েছিল। তিনি যখন পশ্চিমা নারীবাদী লেখালেখি পড়ছিলেন, তখন দেখলেন, সেখানে ‘তৃতীয় বিশ্বের নারী’ (The Third World Woman) বলে একটি চরিত্র তৈরি করা হয়েছে। এই নারী যেন একটিই মানুষ—সে পর্দায় ঢাকা, অশিক্ষিত, প্রজননের চাপে পিষ্ট এবং পিতৃতন্ত্রের অসহায় শিকার।
মোহান্তি তার সেই বিখ্যাত প্রবন্ধ “Under Western Eyes: Feminist Scholarship and Colonial Discourses” (১৯৮৪)-এ এই সরলীকরণের বিরুদ্ধেই তার কলমকে শানিত করলেন। তিনি বললেন, এই যে ‘তৃতীয় বিশ্বের নারী’ বলে একটি সমসত্ত্ব (Homogeneous) চরিত্র বানানো হচ্ছে, এটা কেবল ভুল নয়, এটা একধরনের জ্ঞানতাত্ত্বিক সহিংসতা (Epistemic Violence)। এই নির্মাণের মাধ্যমে পশ্চিমা নারীবাদীরা আসলে নিজেদেরকেই প্রতিষ্ঠা করছে। কীভাবে?
তারা একটি সরল সমীকরণ তৈরি করে:
-
পশ্চিমা নারী: শিক্ষিত, আধুনিক, যৌনতায় স্বাধীন, নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নেয়।
-
তৃতীয় বিশ্বের নারী: অশিক্ষিত, ঐতিহ্যবাহী, যৌনগতভাবে অবদমিত, পরিবারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল।
এই দ্বি-বিভাজনের (Binary Opposition) মাধ্যমে, তৃতীয় বিশ্বের নারীকে ‘অপর’ (Other) বানিয়ে তার বিপরীতে পশ্চিমা নারী নিজের ‘আধুনিক’ ও ‘মুক্ত’ পরিচয়টি খুঁজে পায়। মোহান্তি দেখালেন, এই কাজটি করতে গিয়ে পশ্চিমা নারীবাদীরা তৃতীয় বিশ্বের নারীদের ইতিহাস, সংস্কৃতি, শ্রেণি এবং জাতিগত ভিন্নতাকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলে। একজন ইরানি মধ্যবিত্ত নারী, যিনি বিপ্লবের পক্ষে লড়ছেন, আর একজন বলিভিয়ার আদিবাসী নারী, যিনি বহুজাতিক কোম্পানির বিরুদ্ধে নিজের জমির জন্য লড়ছেন—তাদের অভিজ্ঞতা কি এক? পশ্চিমা নারীবাদী বয়ান তাদের দুজনকেই ‘নির্যাতিত তৃতীয় বিশ্বের নারী’র একটিমাত্র ছাঁচে ফেলে দেয়।
মোহান্তির সবচেয়ে বড় অবদান হলো, তিনি দেখিয়েছেন যে নারীবাদী গবেষণাও কীভাবে ঔপনিবেশিক হতে পারে। তিনি যাকে বলেছেন ‘জ্ঞানতাত্ত্বিক উপনিবেশবাদ’ (Epistemic Colonization), তার মানে হলো—জ্ঞানের জগতে উপনিবেশ স্থাপন করা। যেখানে পশ্চিমা তত্ত্ব, পশ্চিমা পদ্ধতি, পশ্চিমা মানদণ্ডই একমাত্র সত্য বলে বিবেচিত হয় এবং বাকি সব জ্ঞানকে ‘স্থানীয়’ বা ‘অগুরুত্বপূর্ণ’ বলে বাতিল করে দেওয়া হয়।
তাহলে কি কোনো ‘বৈশ্বিক ভগিনীত্ব’ সম্ভব নয়? মোহান্তি বলছেন, সম্ভব, কিন্তু সেটা আগে থেকে ধরে নেওয়া কোনো পরিচয়ের ওপর ভিত্তি করে নয়। নারীরা বোন, কারণ তারা সবাই নারী—এই ভাবনাটা রোমান্টিক, কিন্তু বাস্তব নয়। প্রকৃত ভগিনীত্ব বা সংহতি (Solidarity) গড়ে উঠবে রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। বর্ণবাদ-বিরোধী, পুঁজিবাদ-বিরোধী, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী লড়াইগুলোতে যখন নারীরা একসাথে কাজ করবে, তখনই তাদের মধ্যে একটি রাজনৈতিক ঐক্য তৈরি হবে। এই ঐক্য হবে সংগ্রামের ঐক্য, আগে থেকে চাপিয়ে দেওয়া পরিচয়ের ঐক্য নয়। মোহান্তির কাজ পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজমকে একটি দৃঢ় তাত্ত্বিক ভিত্তি দিয়েছে এবং পশ্চিমা নারীবাদকে আত্মসমালোচনার আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক: সেই কণ্ঠস্বর, যা শোনা যায় না
যদি মোহান্তি প্রশ্ন তোলেন পশ্চিমা নারীবাদীর চশমা নিয়ে, তবে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক (Gayatri Chakravorty Spivak) প্রশ্ন তোলেন আরও মৌলিক একটি বিষয় নিয়ে। তার সেই পৃথিবী কাঁপানো প্রশ্নটি হলো, ‘সাবল্টার্ন কি কথা বলতে পারে?’ (Can the Subaltern Speak?, 1988)।
স্পিভাকের আলোচনা অত্যন্ত জটিল, দর্শন ও সাহিত্যতত্ত্বের নানা শাখায় তার অবাধ যাতায়াত। কিন্তু তার মূল কথাটি বোঝার চেষ্টা করা যাক। তিনি ‘সাবঅল্টার্ন’ (Subaltern) বা প্রান্তিক বলতে সেই মানুষগুলোকে বুঝিয়েছেন, যারা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক কাঠামোর এতটাই নিচে অবস্থান করে যে, তাদের কণ্ঠস্বর ক্ষমতার কেন্দ্রে পৌঁছানোর কোনো উপায়ই নেই। তারা কথা বললেও, সেই কথা শোনার মতো কান বা বোঝার মতো ভাষা শাসকগোষ্ঠীর নেই।
স্পিভাক বলেন, সমস্যাটা দ্বিমুখী। প্রথমত, সাবঅল্টার্ন নারী (যেমন—একজন ভূমিহীন, দলিত, আদিবাসী নারী) প্রাতিষ্ঠানিক শোষণের কারণে কথা বলার পরিসরই পায় না। দ্বিতীয়ত, যখন কোনো সহানুভূতিশীল বুদ্ধিজীবী, গবেষক বা নারীবাদী তার হয়ে কথা বলতে যান, তখন একটি বড় বিপদ ঘটে। ওই বুদ্ধিজীবী আসলে সাবঅল্টার্নের কণ্ঠকে ‘প্রতিনিধিত্ব’ (Represent) করতে গিয়ে নিজের ভাষায়, নিজের তত্ত্বের কাঠামোয়, নিজের রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা অনুযায়ী তাকে নতুন করে ‘উপস্থাপন’ (Re-present) করেন। ফলে সাবঅল্টার্নের আসল স্বরটি হারিয়ে যায়। সে তখন বুদ্ধিজীবীর গবেষণার ‘ডেটা’ বা ‘কেস স্টাডি’তে পরিণত হয়, কিন্তু তার নিজস্ব সত্তা (Subjectivity) হারিয়ে ফেলে।
এই বিষয়টি বোঝানোর জন্য তিনি ব্রিটিশ ভারতে সতীদাহ প্রথা বিলোপের উদাহরণ দেন। ব্রিটিশরা যখন সতীদাহ বন্ধ করে, তখন তাদের বয়ান ছিল—‘শ্বেতাঙ্গ পুরুষেরা বাদামী পুরুষদের হাত থেকে বাদামী নারীদের রক্ষা করছে’ (“white men are saving brown women from brown men”)। এখানে নারীর কোনো কণ্ঠ নেই। সে হয় তার স্বামীর চিতায় পুড়ে মরা এক নিষ্ক্রিয় বস্তু, অথবা ব্রিটিশদের উদ্ধার করা এক অসহায় শিকার। অন্যদিকে, ভারতীয় জাতীয়তাবাদীরা যখন সতীদাহের পক্ষে কথা বলেছে, তখন তারা বলেছে, এটা আমাদের ঐতিহ্য, নারীরা স্বেচ্ছায় এই পথ বেছে নেয়। এখানেও নারীর কোনো নিজস্ব কণ্ঠস্বর নেই, সে ঐতিহ্যের এক মূর্ত প্রতীক মাত্র। দুই পক্ষের পুরুষতান্ত্রিক বিতর্কে, যে নারীটি পুড়ছে, তার নিজের কথা কী ছিল, তা চিরতরে হারিয়ে গেল।
তাহলে কি বুদ্ধিজীবীর কোনো করণীয় নেই? স্পিভাক কোনো সহজ সমাধান দেন না। তিনি বলেন, বুদ্ধিজীবীকে প্রথমে নিজের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। তাকে বুঝতে হবে যে, সে নিজেও ক্ষমতার কাঠামোর অংশ। সে সাবঅল্টার্নের হয়ে কথা বলতে পারে না, তার কণ্ঠকে ফিরিয়ে দিতে পারে না। সে যা করতে পারে, তা হলো ক্ষমতার কাঠামোটিকে এমনভাবে বিশ্লেষণ করা, যাতে সাবঅল্টার্নের কথা বলার মতো পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পথ সুগম হয়।
তবে স্পিভাক ‘স্ট্র্যাটেজিক এসেনশিয়ালিজম’ (Strategic Essentialism) বা ‘কৌশলগত সারবস্তুবাদ’ নামে একটি ধারণাও দিয়েছেন। তিনি জানেন যে ‘নারী’ বা ‘দলিত’—এই ধরনের কোনো সমসত্ত্ব পরিচয় বাস্তবে নেই। কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য, সাময়িকভাবে এই পরিচয়গুলোকে ভিত্তি করে ঐক্যবদ্ধ হওয়া যেতে পারে। যেমন, একটি নির্দিষ্ট আইন পরিবর্তনের জন্য নারীরা ‘নারী’ হিসেবে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে, যদিও আমরা জানি সব নারী এক নয়। এটি একটি কৌশল, কোনো চিরস্থায়ী সত্য নয়।
স্পিভাকের কাজ হতাশাবাদী মনে হতে পারে, কিন্তু এটি আসলে আমাদের দায়িত্ব সম্পর্কে অনেক বেশি সৎ এবং সচেতন করে তোলে। তিনি আমাদের শেখান, প্রান্তিকের কথা শোনার আগে নিজেদের কানকে প্রস্তুত করতে হয় এবং আমাদের নিজেদের ক্ষমতার অবস্থান নিয়ে অবিরামভাবে প্রশ্ন করতে হয়।
লীলা আবু-লুঘোদ: ‘উদ্ধারকর্তা’র রাজনীতি এবং সংস্কৃতির সীমানা
২০০১ সালে আফগানিস্তানে আমেরিকান হামলার পর তৎকালীন ফার্স্ট লেডি লরা বুশ রেডিওতে ভাষণ দিয়ে বলেন, এই যুদ্ধ আফগান নারীদের ‘স্বাধীনতা’ দেবে, তাদের বোরকার কারাগার থেকে ‘মুক্তি’ দেবে। এই বয়ান পশ্চিমা বিশ্বে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। যেন আফগান নারীদের উদ্ধার করা আমেরিকার এক পবিত্র দায়িত্ব।
ঠিক এই সময়েই নৃতাত্ত্বিক লীলা আবু-লুঘোদ (Lila Abu-Lughod) তার শক্তিশালী প্রবন্ধটি লেখেন—”Do Muslim Women Really Need Saving?” (২০০২)। তার প্রশ্নটি ছিল সহজ কিন্তু গভীর। তিনি জিজ্ঞাসা করেন, এই যে মুসলিম নারীদের ‘উদ্ধার’ করার কথা বলা হচ্ছে, এই উদ্ধারকর্তার ভূমিকায় কারা অবতীর্ণ হচ্ছে এবং কেন?
আবু-লুঘোদের মূল যুক্তিগুলো হলো:
-
সাংস্কৃতিক প্রতীক হিসেবে বোরকা: তিনি দেখান, বোরকা বা হিজাবকে পশ্চিমা মিডিয়া যেভাবে নারী নিপীড়নের একমাত্র প্রতীক হিসেবে তুলে ধরে, তা অত্যন্ত সরলীকরণ। তিনি তার নিজের গবেষণার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, অনেক আফগান নারীর কাছে বোরকা ছিল শালীনতা, সম্মান এবং বাড়ির বাইরের জগতে বিচরণের একটি মাধ্যম। তালেবানরা এটিকে বাধ্যতামূলক করার আগে এটি ছিল একটি স্থানীয় পোশাক, যার বিভিন্ন অর্থ ছিল। এটিকে কেবল ‘কারাগার’ হিসেবে দেখাটা হলো বিষয়টিকে এর সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা।
-
‘উদ্ধার’ করার ঔপনিবেশিক ইতিহাস: আবু-লুঘোদ মনে করিয়ে দেন, এই ‘উদ্ধার’ করার বয়ানের একটি দীর্ঘ ঔপনিবেশিক ইতিহাস আছে। ব্রিটিশরা ভারতে সতীদাহ বন্ধ করার যুক্তি দেখিয়েছিল, ফরাসিরা আলজেরিয়ায় নারীদের হিজাব খোলার কথা বলে তাদের সভ্য করার দাবি করেছিল। এই ‘উদ্ধার’ করার রাজনীতির মাধ্যমে আসলে পশ্চিমা শক্তিগুলো তাদের সামরিক ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপকে একটি নৈতিক ন্যায্যতা (Moral Justification) দেয়। নারীদের মুক্তি তখন হয়ে ওঠে সাম্রাজ্যবাদী প্রকল্পের একটি অজুহাত।
-
সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতাবাদ নয়: আবু-লুঘোদ সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতাবাদের (Cultural Relativism) পক্ষে কথা বলছেন না, অর্থাৎ ‘ওদের সংস্কৃতি ওদের কাছে, আমাদের নাক গলানোর দরকার নেই’—এমনটা তিনি বলছেন না। তিনি বলছেন, আমাদের অন্যের সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলার আগে নিজের অবস্থান নিয়ে ভাবতে হবে। আফগান নারীদের জীবনের সমস্যাগুলো (যেমন—দারিদ্র্য, অপুষ্টি, যুদ্ধ) কি কেবল বোরকার জন্য? নাকি এর পেছনে আছে কয়েক দশকের যুদ্ধ, সোভিয়েত আগ্রাসন এবং আমেরিকান মদদপুষ্ট মুজাহিদীনদের উত্থানের মতো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ? পশ্চিমা জগৎ কি এই কারণগুলোর জন্য দায়ী নয়? কেবল বোরকার ওপর সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে এই জটিল ইতিহাসকে আড়াল করা হয়।
-
সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লেখা (Writing Against Culture): আবু-লুঘোদ নৃতাত্ত্বিকদের জন্য একটি নতুন পথের কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘সংস্কৃতি’কে একটি স্থির, সীমানাযুক্ত বাক্স হিসেবে দেখা বন্ধ করতে হবে। সংস্কৃতি কোনো জেলখানা নয়, মানুষ এর মধ্যে বাস করে, একে নিয়ে দর কষাকষি করে, একে পরিবর্তন করে। তাই আমাদের কাজ হলো সংস্কৃতির সরলীকরণের বিরুদ্ধে লেখা, মানুষের দৈনন্দিন জীবনের জটিলতা, বৈপরীত্য এবং পছন্দের জায়গাগুলোকে তুলে ধরা।
আবু-লুঘোদের কাজ পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজমকে অ্যাকাডেমিক আলোচনার জগৎ থেকে বের করে এনে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ময়দানে দাঁড় করিয়ে দেয়। তিনি দেখান, নারীবাদ কীভাবে ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহৃত হতে পারে এবং প্রকৃত সংহতির জন্য প্রয়োজন ইতিহাস ও ক্ষমতার সম্পর্ক নিয়ে একটি সৎ বোঝাপড়া।
উমা নারায়ণ: ‘সংস্কৃতির ফাঁদ’ এবং দেশীয় নারীবাদ
ধরুন, ভারতে একজন নারীকে তার স্বামী যৌতুকের জন্য পুড়িয়ে মারল। পশ্চিমা সংবাদপত্রে খবরটা ছাপা হলো—‘ভারতীয় সংস্কৃতিতে নারীর করুণ পরিণতি’। এবার ভাবুন, আমেরিকায় একজন পুরুষ তার স্ত্রীকে গুলি করে মারল। খবরটা ছাপা হলো—‘এক মানসিক বিকারগ্রস্তের হাতে নারীর মৃত্যু’ বা ‘গার্হস্থ্য হিংসার মর্মান্তিক ঘটনা’।
লক্ষ্য করুন, দুটিই নারীর প্রতি সহিংসতা, কিন্তু ব্যাখ্যা দুই রকম। ভারতের ঘটনাটিকে ব্যাখ্যা করা হলো ‘সংস্কৃতি’ দিয়ে, আর আমেরিকার ঘটনাটিকে ব্যাখ্যা করা হলো ব্যক্তিগত বা সামাজিক সমস্যা হিসেবে। ভারতীয়-আমেরিকান তাত্ত্বিক উমা নারায়ণ (Uma Narayan) তার বই “Dislocating Cultures” (১৯৯৭)-এ এই দ্বিচারিতার দিকেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি একে বলছেন ‘সংস্কৃতির ফাঁদ’ বা ‘Death by Culture’। যখন তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশে নারীর ওপর সহিংসতা হয়, তখন সেটিকে ঢালাওভাবে ওই দেশের ‘পশ্চাৎপদ সংস্কৃতি’র ফল বলে দেগে দেওয়া হয়। এর ফলে সমস্যাটির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বা আইনি দিকগুলো আড়ালে চলে যায়।
নারায়ণ দেখান, পশ্চিমা নারীবাদীরা প্রায়ই তৃতীয় বিশ্বের নারীদের সমস্যাগুলোকে (যেমন—যৌতুক, সতীদাহ, FGM) ‘সাংস্কৃতিক সমস্যা’ হিসেবে চিহ্নিত করে, আর নিজেদের সমস্যাগুলোকে (যেমন—খাওয়ার সমস্যা বা Anorexia, কসমেটিক সার্জারি) ‘সামাজিক সমস্যা’ হিসেবে দেখে। এই বিভাজন একধরনের সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্ব তৈরি করে।
নারায়ণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো, তিনি ‘দেশীয় নারীবাদ’ (Indigenous Feminism) বা তৃতীয় বিশ্বের নিজস্ব নারীবাদী সংগ্রামের ইতিহাসকে তুলে ধরেছেন। পশ্চিমা বয়ানে মনে হয়, নারীবাদ একটি পশ্চিমা আমদানি, যা তৃতীয় বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। নারায়ণ দেখান, এটা একেবারেই ভুল ধারণা। ভারতে রামাবাই, রোকেয়া বা সাবিত্রীবাই ফুলে-র মতো নারীরা পশ্চিমা নারীবাদীদের সমসাময়িক সময়ে বা তারও আগে থেকেই নারীর অধিকার নিয়ে লড়ছিলেন। তাদের লড়াইয়ের ভাষা, ধরণ হয়তো ভিন্ন ছিল, কিন্তু লক্ষ্য ছিল একই—পুরুষতান্ত্রিক শোষণের অবসান।
তিনি ঔপনিবেশিকতার একটি জটিল প্রভাবের কথা বলেন। উপনিবেশবাদ একদিকে যেমন কিছু ক্ষতিকর প্রথাকে (যেমন—সতীদাহ) নির্মূল করতে সাহায্য করেছে, তেমনি অন্যদিকে অনেক ক্ষেত্রে পিতৃতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করেছে। ব্রিটিশ আইন ও প্রশাসন স্থানীয় পুরুষদের হাতে নতুন ক্ষমতা তুলে দিয়েছিল এবং নারীর ঐতিহ্যগত অনেক অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। তাই ঔপনিবেশিকতাকে কেবল ‘ভালো’ বা ‘খারাপ’ হিসেবে না দেখে, এর দ্বৈত ও পরস্পরবিরোধী প্রভাবকে বুঝতে হবে।
উমা নারায়ণের লেখা অনেক বেশি স্পষ্ট এবং উদাহরণভিত্তিক, যা পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজমের জটিল তত্ত্বগুলোকে বাস্তব জীবনের সাথে যুক্ত করতে সাহায্য করে। তিনি আমাদের শেখান, কীভাবে সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে আসল সমস্যাকে আড়াল করা হয় এবং কীভাবে নিজেদের ইতিহাস থেকেই আমরা প্রতিরোধের শক্তি খুঁজে পেতে পারি।
অন্যান্য তাত্ত্বিকগণ
এই তাত্ত্বিকরা ছাড়াও আরও অনেকেই পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজমের আকাশকে সমৃদ্ধ করেছেন। ভিয়েতনামী বংশোদ্ভূত চলচ্চিত্র নির্মাতা ও তাত্ত্বিক ত্রিন টি. মিন-হা (Trinh T. Minh-ha) প্রশ্ন তুলেছেন ‘প্রামাণ্য’ বা ‘Authentic’ পরিচয়ের ধারণা নিয়ে। তিনি বলেছেন, কোনো ‘খাঁটি’ তৃতীয় বিশ্বের নারী বলে কিছু নেই। তিনি ‘speaking nearby’ বা ‘কাছাকাছি থেকে কথা বলা’র এক ধারণা দিয়েছেন—অর্থাৎ, অন্যের হয়ে কথা না বলে বা তাকে বস্তু না বানিয়ে, তার পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলা। পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত সারা সুলেরি (Sara Suleri) তার আত্মজৈবনিক লেখায় দেখিয়েছেন, কীভাবে ব্যক্তিগত স্মৃতি ও জাতীয় ইতিহাস একাকার হয়ে যায় এবং পোস্টকলোনিয়াল নারীর অভিজ্ঞতা কতটা খণ্ডিত ও যন্ত্রণাময় হতে পারে।
এই তাত্ত্বিকদের কাজ আমাদের এটাই মনে করিয়ে দেয় যে, পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজম কোনো একক, স্থির তত্ত্ব নয়। এটি একটি চলমান সংলাপ, একটি নিরন্তর আত্মসমালোচনা। এটি একটি লড়াই—কেবল পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে নয়, বরং সেইসব জ্ঞানতাত্ত্বিক কাঠামোর বিরুদ্ধেও, যা পৃথিবীর অর্ধেক মানুষের গল্পকে একটিমাত্র ফ্রেমে বেঁধে ফেলতে চায়।
পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজমের কয়েকটি জ্বলন্ত উদাহরণ
তত্ত্বের কথা অনেক হলো। এবার বাস্তব জগতে এর প্রয়োগ দেখা যাক। কয়েকটি বিতর্কিত বিষয়কে পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজমের চশমা দিয়ে দেখলে কেমন দেখায়? এই চশমা আমাদের প্রচলিত ধারণাকে নাড়িয়ে দিতে পারে।
হিজাব বা পর্দার রাজনীতি
পশ্চিমা মূলধারার নারীবাদ প্রায়শই হিজাব, নিকাব বা বোরকাকে নারী নিপীড়নের চূড়ান্ত প্রতীক হিসেবে দেখে। তাদের কাছে এটি পিতৃতন্ত্রের চাপিয়ে দেওয়া একটি প্রথা, যা নারীর স্বাধীনতাকে খর্ব করে, তার ব্যক্তিসত্তাকে ঢেকে দেয়। ফ্রান্সের মতো দেশে প্রকাশ্য স্থানে হিজাব নিষিদ্ধ করার পেছনেও এই যুক্তি কাজ করেছে, যা তাদের ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা ‘লাইসিতে’ (laïcité)-র সঙ্গে জড়িত। তাদের মতে, হিজাব পরা নারী মানেই সে নির্যাতিত, তার কোনো এজেন্সি বা পছন্দ নেই।
কিন্তু পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিস্টরা বলবেন, দাঁড়ান, এত সহজভাবে সিদ্ধান্তে আসবেন না। ফিলিস্তিনি-আমেরিকান নৃতাত্ত্বিক লীলা আবু-লুঘোদ (Lila Abu-Lughod) তার বিখ্যাত প্রবন্ধ “Do Muslim Women Really Need Saving?” (২০০২)-এ এই প্রশ্নটিই তুলেছেন। আফগানিস্তানে আমেরিকান আগ্রাসনের পর যখন ফার্স্ট লেডি লরা বুশ বলেছিলেন যে, আফগান নারীদের বোরকার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য এই যুদ্ধ, তখন আবু-লুঘোদ এর তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি দেখান, অনেক মুসলিম নারীর কাছে হিজাব কেবল নিপীড়নের প্রতীক নয়, এর বহুবিধ অর্থ থাকতে পারে।
-
পরিচয়ের প্রতীক: পশ্চিমা বিশ্বে বা ইসলামোফোবিয়ার (Islamophobia) আবহে অনেক তরুণী মুসলিম নারীর কাছে হিজাব তার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয়কে গর্বের সাথে তুলে ধরার একটি মাধ্যম। এটি তাদের আত্মপরিচয়ের একটি অংশ, যা তারা স্বেচ্ছায় বেছে নেয়।
-
প্রতিরোধের হাতিয়ার: অনেক সময় এটি পশ্চিমা ভোগবাদী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে একটি নীরব প্রতিরোধ। যে সংস্কৃতি নারীকে যৌন পণ্যে (sexual object) পরিণত করে, তার বিরুদ্ধে হিজাব হতে পারে শালীনতা এবং আত্মমর্যাদার প্রতীক।
-
স্বাধীনতার পরিসর: অনেক রক্ষণশীল পরিবার বা সমাজে, হিজাব পরেই মেয়েরা ঘরের বাইরে কাজ করতে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়ার অনুমতি পায়, যা হয়তো হিজাব ছাড়া সম্ভব হতো না। এক্ষেত্রে হিজাব তার জন্য নিপীড়নের বদলে একধরনের স্বাধীনতার দরজা খুলে দিচ্ছে।
-
আধ্যাত্মিকতার প্রকাশ: অনেক নারীর কাছে এটি ঈশ্বরের প্রতি তার ব্যক্তিগত আনুগত্য ও আধ্যাত্মিকতার প্রকাশ, যার সাথে পিতৃতন্ত্রের কোনো সম্পর্ক নেই।
এর মানে এই নয় যে, হিজাব কখনো জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয় না। ইরান বা তালেবান শাসিত আফগানিস্তানের মতো জায়গায় এটি রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের হাতিয়ার। পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজমের শিক্ষা হলো, একটি বিষয়কে ঢালাওভাবে ‘ভালো’ বা ‘খারাপ’ বলে দাগিয়ে না দিয়ে এর পেছনের জটিল সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত কারণগুলো বোঝা। নারীর পছন্দ (Choice) এবং তার প্রেক্ষাপটকে (Context) সম্মান করা। একজন নারীকে হিজাব পরতে বাধ্য করা যেমন নিপীড়ন, তেমনি তাকে হিজাব খুলতে বাধ্য করাও আরেক ধরনের নিপীড়ন।
ফিমেল জেনিটাল মিউটিলেশন (Female Genital Mutilation – FGM)
আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের কিছু সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত মেয়েদের খৎনা বা FGM নিঃসন্দেহে একটি ভয়ঙ্কর, বেদনাদায়ক এবং স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর চর্চা। পশ্চিমা নারীবাদী এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো এটিকে ‘বর্বর’ এবং ‘অমানবিক’ বলে তীব্রভাবে এর বিরোধিতা করে।
পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিস্টরাও এই প্রথার ভয়াবহতা এবং ক্ষতিকারক দিকটা স্বীকার করেন। কিন্তু তারা এর বিরোধিতার পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ভারতীয়-আমেরিকান তাত্ত্বিক উমা নারায়ণ (Uma Narayan) তার বই “Dislocating Cultures” (১৯৯৭)-এ দেখিয়েছেন, পশ্চিমা মিডিয়া যখন FGM নিয়ে কথা বলে, তখন তারা প্রায়ই পুরো একটি সংস্কৃতিকে ‘বর্বর’ বলে চিহ্নিত করে। তারা এমনভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করে যেন ওই সব দেশের সব মানুষই এই প্রথার সমর্থক এবং সেখানকার নারীরা কেবলই অসহায় শিকার, যারা মুক্তির জন্য সাদা উদ্ধারকর্তার দিকে তাকিয়ে আছে। এই ধরনের বয়ান একধরনের ‘সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ’ (Cultural Imperialism) তৈরি করে।
পোস্টকলোনিয়াল নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বলবে:
-
এই প্রথার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় এবং কার্যকর লড়াইটা করছেন ওই সব সম্প্রদায়ের স্থানীয় নারীরাই। তাদের সেই লড়াইকে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে, তাদের নেতা হিসেবে মেনে নিতে হবে।
-
বাইরে থেকে গিয়ে ‘উদ্ধারকর্তা’ সেজে সমাধান চাপিয়ে দিলে হিতে বিপরীত হতে পারে। এতে স্থানীয় প্রতিরোধ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বিষয়টি ‘পশ্চিমা হস্তক্ষেপ’ হিসেবে চিহ্নিত হয়, ফলে মানুষ আরও রক্ষণশীল হয়ে ওঠে।
-
এই প্রথার পেছনের জটিল সামাজিক কারণগুলো বুঝতে হবে। অনেক সমাজে এটি নারীর ‘পবিত্রতা’, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা এবং ‘বিয়ের যোগ্যতা’র সাথে জড়িত। তাই কেবল আইন করে এটি বন্ধ করা কঠিন। এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী শিক্ষা, স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, যা ভেতর থেকে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনবে।
অর্থাৎ, সমস্যাকে স্বীকার করেও তার সমাধানের পথটি হতে হবে সাংস্কৃতিক সংবেদনশীল (Culturally Sensitive) এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর নেতৃত্বে।
উন্নয়নের নামে উপনিবেশ?
আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা (NGOs) এবং উন্নয়ন প্রকল্পগুলো প্রায়শই তৃতীয় বিশ্বের নারীদের উন্নয়নের জন্য কাজ করে। ক্ষুদ্রঋণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের অবদান অনস্বীকার্য।
কিন্তু পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিস্টরা এর একটি অন্য পিঠও দেখতে পান। অনেক সময় এই উন্নয়ন প্রকল্পগুলো পশ্চিমা মডেলের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। তারা ধরে নেয়, পশ্চিমা নারীর জীবনযাপনই হলো ‘উন্নত’ জীবন। ফলে তারা স্থানীয় নারীদের শেখাতে আসে কীভাবে ‘সঠিক’ উপায়ে জীবনযাপন করতে হবে, কীভাবে ব্যবসা করতে হবে, কীভাবে পরিবার পরিকল্পনা করতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় ‘উন্নয়ন’ একধরনের নতুন ঔপনিবেশিক প্রকল্পে পরিণত হয়, যেখানে ভালো জীবনের একটিমাত্র সংজ্ঞা চাপিয়ে দেওয়া হয়।
এই প্রক্রিয়ায় স্থানীয় জ্ঞান (Indigenous Knowledge) এবং নারীর নিজস্ব প্রতিরোধ ও টিকে থাকার কৌশলগুলো অবহেলিত হয়। নারীর ক্ষমতায়ন (Empowerment) তখন হয়ে দাঁড়ায় পশ্চিমা মানদণ্ডে তাকে মানিয়ে নেয়া। নারীর এজেন্সি বা কর্তাসত্তাকে গুরুত্ব না দিয়ে তাকে কেবলই উন্নয়নের ‘গ্রহীতা’ (Recipient) বানানো হয়। যেমন, ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পগুলো প্রায়ই নারীদের ঋণ দেয়, কারণ তারা বেশি নির্ভরযোগ্য। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ঋণের টাকাটা পরিবারের পুরুষ সদস্যরাই ব্যবহার করে, অথচ ঋণ পরিশোধের দায় থেকে যায় নারীর ওপর। ফলে নারী উন্নয়নের নামে নতুন এক শোষণের চক্রে প্রবেশ করে। পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজম এই ‘উন্নয়ন’ বয়ান বা ডিসকোর্সের ক্ষমতা সম্পর্ককে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
আমাদের উঠানে পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজম
এতক্ষণ তো বিদেশের কথা হলো। আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশে, বিশেষ করে বাংলাদেশে পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজমের প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু? উত্তর হলো—অনেক বেশি। কারণ আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি এবং নারীর জীবন ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত এবং খচিত।
বেগম রোকেয়া: একজন অগ্রগামী পোস্টকলোনিয়াল নারীবাদী?
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন যখন লিখেছিলেন, তখন পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজম বলে কোনো তত্ত্ব ছিল না। কিন্তু তার কাজে এর অনেক উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়, যা তাকে তার সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে রেখেছিল। তিনি একদিকে যেমন অবরোধ প্রথা, বাল্যবিবাহ এবং পিতৃতন্ত্রের কঠোর সমালোচনা করেছেন (“অবরোধবাসিনী”-তে), তেমনি অন্যদিকে পশ্চিমা সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণকেও তিনি ভালো চোখে দেখেননি।
তার কালজয়ী রচনা “সুলতানার স্বপ্ন” (Sultana’s Dream)-এ তিনি যে নারীস্থানের (Ladyland) ছবি এঁকেছেন, তা কোনো পশ্চিমা মডেলের অনুকরণ নয়। সেই নারীস্থান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নত, কিন্তু সেখানকার নারীরা তাদের নিজস্ব পোশাকে, নিজস্ব সংস্কৃতিতে স্বচ্ছন্দ। সেখানে পুরুষরা ‘মর্দানা’য় (পুরুষদের জন্য নির্দিষ্ট স্থান, অবরোধের একটি বিপরীত রূপ) আবদ্ধ, কারণ তারা যুদ্ধ ও সহিংসতা ছাড়া কিছু বোঝে না। রোকেয়া এখানে কেবল পিতৃতন্ত্রকে উল্টে দেননি, বরং তিনি ঔপনিবেশিকতার একটি প্রধান যুক্তি—পুরুষালি শক্তি ও সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব—তাকে ব্যঙ্গ করেছেন। তিনি নারীশিক্ষার কথা বলেছেন, কিন্তু সেই শিক্ষা নারীদের শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে—এমনটা তিনি চাননি। তার ভাবনার মধ্যে দেশীয় প্রেক্ষাপট এবং নারীর নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি একধরনের সম্মান ছিল, যা তাকে একজন দূরদর্শী তাত্ত্বিকের মর্যাদা দেয়।
‘ভদ্রমহিলা’র নির্মাণ
ঔপনিবেশিক কালে বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজে এক নতুন নারী-আদর্শ তৈরি হয়, যা ‘ভদ্রমহিলা’ নামে পরিচিত। এই ভদ্রমহিলা হবেন শিক্ষিত, রুচিশীল, কিন্তু মূলত গৃহকেন্দ্রিক। তিনি একদিকে যেমন সনাতনী গ্রাম্য নারী থেকে আলাদা, তেমনি অন্যদিকে পশ্চিমা ‘মেমসাহেব’ থেকেও আলাদা। তিনি হবেন জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। এই ‘ভদ্রমহিলা’র আদর্শ নির্মাণ ছিল ঔপনিবেশিক আধুনিকতার সঙ্গে জাতীয়তাবাদের এক জটিল দর কষাকষি। এটিও পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজমের আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কারণ এটি দেখায় কীভাবে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলোও প্রায়শই নারীর জন্য একটি নির্দিষ্ট ছাঁচ তৈরি করে দেয়।
বর্তমান প্রেক্ষাপট
আজকের বাংলাদেশে পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজম আমাদের অনেক জ্বলন্ত প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সাহায্য করতে পারে:
-
গার্মেন্টস শ্রমিকের লড়াই: একজন নারী গার্মেন্টস শ্রমিকের লড়াই কি কেবল কম মজুরি আর লম্বা কর্মঘণ্টার বিরুদ্ধে? নাকি এর সাথে জড়িয়ে আছে বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন (Global Supply Chain), যেখানে সস্তা শ্রমের জন্য H&M, Zara, Walmart-এর মতো পশ্চিমা ব্র্যান্ডগুলো আমাদের মতো দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল? এই অর্থনৈতিক কাঠামোটিও তো ঔপনিবেশিকতারই একটি নতুন রূপ—নয়া-উপনিবেশবাদ (Neo-colonialism)। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি কেবল একটি দুর্ঘটনা ছিল না, এটি ছিল এই বৈশ্বিক শোষণ ব্যবস্থার একটি নির্মম পরিণতি। তাই এই শ্রমিকের মুক্তি কেবল দেশের ভেতরের পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়ে আসবে না, এর জন্য এই আন্তর্জাতিক ক্ষমতা কাঠামোকেও প্রশ্ন করতে হবে।
-
আইন ও ধর্ম: আমাদের দেশের পারিবারিক আইনগুলো (Family Laws) অনেকাংশেই ধর্মভিত্তিক। একজন মুসলিম নারী, হিন্দু নারী বা খ্রিস্টান নারীর উত্তরাধিকার, বিবাহবিচ্ছেদ বা সন্তানের অভিভাবকত্বের অধিকার ভিন্ন ভিন্ন। পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজম আমাদের দেখায়, কীভাবে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা তাদের ‘ভাগ করো ও শাসন করো’ (Divide and Rule) নীতির অংশ হিসেবে এবং শাসনকার্যের সুবিধার জন্য বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর জন্য আলাদা আলাদা আইন তৈরি করেছিল। তারা প্রায়শই প্রাচীন ধর্মগ্রন্থের রক্ষণশীল ব্যাখ্যাকে আইনে পরিণত করেছিল, যা আজও আমাদের সমাজে নারীর প্রতি বৈষম্য টিকিয়ে রেখেছে। তাই একটি অভিন্ন পারিবারিক আইনের (Uniform Family Code) জন্য লড়াই কেবল একটি নারীবাদী দাবি নয়, এটি একটি বিউপনিবেশায়নের (Decolonization) প্রকল্পও বটে।
-
আধুনিকতা বনাম ঐতিহ্য: ‘আধুনিক’ হওয়া মানেই কি পশ্চিমা পোশাক পরা, পশ্চিমা ভাষায় কথা বলা? নাকি নিজের ঐতিহ্যকে ধারণ করেও আধুনিক হওয়া যায়? শাড়ি পরা একজন নারী কি জিন্স পরা নারীর চেয়ে কম ‘আধুনিক’ বা কম ‘স্বাধীন’? পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজম এই বাইনারি বা দ্বি-বিভাজনকে ভেঙে দেয়। এটি বলে, নারীর স্বাধীনতা তার পোশাকে নয়, তার পছন্দে এবং কর্তৃত্বে নিহিত। এটি আমাদের শেখায়, কীভাবে নিজস্ব সংস্কৃতিকে সম্মান জানিয়েও ক্ষতিকর প্রথাগুলোকে বর্জন করা যায় এবং বাইরের পৃথিবীর ভালো দিকগুলোকে গ্রহণ করা যায়।
উত্তরাধিকার ও আগামী দিনের পথ: পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজম আজ কোথায় দাঁড়িয়ে?
কোনো তত্ত্বের সার্থকতা কেবল তার নিজের কাঠামো বা যুক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। তার আসল পরীক্ষা হয় সময়ের কষ্টিপাথরে। তত্ত্বটি কি কেবল কিছু বইয়ের পাতায় আর সেমিনার কক্ষের বিতর্কে সীমাবদ্ধ রইল, নাকি তা অন্য চিন্তার জগৎকে নাড়া দিতে পারল? অ্যাকাডেমির দেয়াল পেরিয়ে কি তা আন্দোলনকারীর হাতে নতুন হাতিয়ার তুলে দিতে পারল? পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজম তার জন্মের পর প্রায় চার দশক পার করে ফেলেছে। আজ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, এর প্রভাব ও উত্তরাধিকার কী? এটি কীভাবে অন্যান্য তত্ত্বকে প্রভাবিত করেছে এবং আগামী দিনের জন্য এর প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু?
এই তত্ত্বের প্রভাবকে আমরা কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে দেখতে পারি।
নারীবাদী চিন্তার ভূগোলে ভূমিকম্প
পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজমের সবচেয়ে বড় এবং প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে খোদ নারীবাদী চিন্তার জগতেই। এটি পশ্চিমা মূলধারার নারীবাদকে (Mainstream Western Feminism) এমন এক আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, যা থেকে মুখ ফেরানো আর সম্ভব হয়নি।
-
‘বৈশ্বিক ভগিনীত্বে’র ধারণার রূপান্তর: চন্দ্রা মোহান্তির (Chandra Mohanty) মতো তাত্ত্বিকদের সমালোচনার পর ‘বৈশ্বিক ভগিনীত্ব’ (Global Sisterhood) ধারণাটি তার আগের সরল, রোমান্টিক রূপটি হারিয়ে ফেলে। নারীবাদীরা বুঝতে শুরু করেন যে, সংহতি (Solidarity) কোনো আগে থেকে ধরে নেওয়া বিষয় নয়, এটি অর্জন করতে হয়। এই সংহতি গড়ে ওঠে ক্ষমতার সম্পর্ক নিয়ে সচেতন থেকে, একে অপরের পার্থক্যকে সম্মান জানিয়ে এবং সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের মতো বৃহত্তর শোষণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একসাথে লড়াই করার মাধ্যমে। আজকের নারীবাদী আন্দোলনে ইন্টারসেকশনালিটি (Intersectionality) যে একটি কেন্দ্রীয় ধারণা হয়ে উঠেছে, তার পেছনে পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজমের চাপ একটি বড় কারণ।
-
তৃতীয় তরঙ্গের নারীবাদকে প্রভাবিত করা (Influencing Third-wave Feminism): নব্বইয়ের দশকে যে তৃতীয় তরঙ্গের নারীবাদ (Third-wave Feminism) আসে, তার অন্যতম বৈশিষ্ট্যই ছিল বহুস্বরকে স্বীকৃতি দেওয়া। এই তরঙ্গের নারীবাদীরা দ্বিতীয় তরঙ্গের নারীবাদকে সমালোচনা করে বলেন যে, তারা মূলত সাদা, মধ্যবিত্ত নারীদের কথা বলেছে। তৃতীয় তরঙ্গ বর্ণ, শ্রেণি, যৌনতা (Sexuality) এবং জাতিগত পরিচয়ের ভিন্নতাকে উদযাপন করার কথা বলে। এই বহুস্বরের ধারণাটি অনেকাংশেই পোস্টকলোনিয়াল এবং কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদীদের সমালোচনার ফসল।
-
ট্রান্সন্যাশনাল ফেমিনিজম বা আন্তর্জাতিকতাবাদী নারীবাদের জন্ম (Birth of Transnational Feminism): পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজমের ভাবনাকে আরও এগিয়ে নিয়ে গেছে ট্রান্সন্যাশনাল ফেমিনিজম। এই ধারাটি কেবল ‘পশ্চিম’ আর ‘প্রাচ্যে’র বাইনারিতে আটকে না থেকে, বিশ্বায়নের (Globalization) যুগে পুঁজি, শ্রম এবং সংস্কৃতির আন্তর্জাতিক প্রবাহ কীভাবে নারীর জীবনকে প্রভাবিত করছে, তা বিশ্লেষণ করে। যেমন, একজন বাংলাদেশি গার্মেন্টস কর্মী যে পোশাক তৈরি করছেন, তা কিনছেন একজন আমেরিকান নারী। এই দুজন নারীর জীবন অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা। ট্রান্সন্যাশনাল ফেমিনিজম এই সংযোগগুলোকেই তুলে ধরে এবং স্থানীয় ও বৈশ্বিক (Local and Global) লড়াইকে একসাথে যুক্ত করার কথা বলে (Grewal & Kaplan, 1994)। এই চিন্তার বিকাশে পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজমের গ্রাউন্ডওয়ার্ক ছিল অপরিহার্য।
অন্যান্য জ্ঞানকাণ্ডে ঢেউ তোলা
পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজমের প্রভাব কেবল নারীবাদের গণ্ডিতে আটকে থাকেনি। এর ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে সমাজবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, ইতিহাস এবং সাহিত্য সমালোচনার মতো বিভিন্ন জ্ঞানকাণ্ডে।
-
নৃতত্ত্বে আত্মসমালোচনা (Self-critique in Anthropology): লীলা আবু-লুঘোদের (Lila Abu-Lughod) মতো তাত্ত্বিকদের কাজ নৃতত্ত্বকে (Anthropology) গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। নৃতত্ত্বের জন্মই হয়েছিল ঔপনিবেশিক প্রকল্পের অংশ হিসেবে—‘অপর’ সংস্কৃতিকে বোঝা এবং শাসন করার হাতিয়ার হিসেবে। পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজম নৃতাত্ত্বিকদের শিখিয়েছে, কীভাবে গবেষক হিসেবে নিজের ক্ষমতার অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হতে হয় এবং কীভাবে সংস্কৃতির সরলীকরণের বিরুদ্ধে গিয়ে মানুষের জীবনের জটিলতাকে তুলে ধরতে হয়।
-
উন্নয়ন অধ্যয়নকে (Development Studies) প্রশ্নবিদ্ধ করা: আগে উন্নয়নকে দেখা হতো একটি নিরপেক্ষ, প্রযুক্তিগত বিষয় হিসেবে। পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিস্টরা দেখিয়েছেন, ‘উন্নয়ন’ ধারণাটি নিজেই একটি পশ্চিমা ডিসকোর্স, যা প্রায়শই স্থানীয় জ্ঞানকে অগ্রাহ্য করে এবং নতুন ধরনের শোষণ তৈরি করে। আজকের উন্নয়ন অধ্যয়নে ‘অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন’ (Participatory Development) বা ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ (Women’s Empowerment)-এর মতো ধারণাগুলো যে এত গুরুত্ব পায়, তার পেছনে এই সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির বড় ভূমিকা আছে।
-
কুইয়ার তত্ত্বের সাথে সংলাপ (Dialogue with Queer Theory): কুইয়ার তত্ত্ব (Queer Theory) লিঙ্গ এবং যৌনতার স্বাভাবিকতার (Normativity) ধারণাকে প্রশ্ন করে। পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজমের সাথে এর একটি স্বাভাবিক মিত্রতা রয়েছে। উভয় তত্ত্বই পরিচয়ের স্থির, বাইনারি ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে। অনেক তাত্ত্বিক এই দুই ধারাকে একসাথে এনে কাজ করেছেন। তারা দেখিয়েছেন, কীভাবে ঔপনিবেশিক শাসকেরা তাদের নিজেদের যৌন নৈতিকতা (যেমন—বিষমকামিতার আদর্শ) উপনিবেশিত সমাজে চাপিয়ে দিয়েছিল এবং স্থানীয় যৌনতার বিভিন্ন রূপকে ‘অস্বাভাবিক’ বা ‘অপরাধ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল (Puar, 2007)। যেমন, ব্রিটিশরা ভারতে সমকামিতার বিরুদ্ধে আইন (ধারা ৩৭৭) তৈরি করেছিল, যা সম্প্রতি বাতিল হয়েছে। এই আলোচনাগুলো আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে, লিঙ্গ, যৌনতা, বর্ণ এবং উপনিবেশের ইতিহাস কতটা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিজম ও সামাজিক আন্দোলনে প্রভাব
তত্ত্ব যদি কেবল অ্যাকাডেমিতেই থেকে যায়, তবে তার প্রাণ শুকিয়ে যায়। পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজমের ধারণাগুলো বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনেও শক্তি জুগিয়েছে।
-
স্থানীয় নারীবাদী আন্দোলনের ভাষা: তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে অনেক নারীবাদী সংগঠন তাদের নিজেদের লড়াইকে সংজ্ঞায়িত করার জন্য পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজমের ভাষা ও ধারণা ব্যবহার করে। তারা এখন পশ্চিমা মডেলের অন্ধ অনুকরণ না করে, নিজেদের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করার কৌশল তৈরি করে। তারা ‘উন্নয়ন’, ‘মানবাধিকার’ বা ‘নারীবাদ’—এই ধারণাগুলোকে গ্রহণ করার আগে প্রশ্ন করে, এটি কার উন্নয়ন? কার মানবাধিকার? কার নারীবাদ?
-
পরিবেশবাদী নারীবাদের (Ecofeminism) সাথে সংযোগ: অনেক পোস্টকলোনিয়াল নারীবাদী, যেমন—বন্দনা শিবা (Vandana Shiva), দেখিয়েছেন যে প্রকৃতির ওপর শোষণ এবং নারীর ওপর শোষণ—এই দুয়ের মধ্যে গভীর যোগসূত্র রয়েছে। পশ্চিমা উন্নয়ন মডেল যেভাবে প্রকৃতিকে ধ্বংস করে, তাক প্রায়শই আদিবাসী ও গ্রামীণ নারীদের জীবন-জীবিকাকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে, কারণ তারাই প্রকৃতি ও সম্পদের সবচেয়ে কাছের রক্ষক। এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবেশবাদী আন্দোলনকে একটি নারীবাদী এবং উপনিবেশ-বিরোধী মাত্রা দিয়েছে।
-
আন্তর্জাতিক সংহতি নির্মাণ: বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আন্দোলন—যেমন, ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রাম বা আমেরিকার ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলন—এদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করার জন্য পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজমের ইন্টারসেকশনাল দৃষ্টিভঙ্গি একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। এটি আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে, বিভিন্ন ধরনের শোষণ একই বৈশ্বিক ক্ষমতা কাঠামো থেকে উৎসারিত হয় এবং এদের বিরুদ্ধে লড়াইটাও হতে হবে সম্মিলিত।
উত্তরাধিকার এবং আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ
পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজম নিঃসন্দেহে একটি সফল এবং প্রভাবশালী তত্ত্ব। এর প্রধান উত্তরাধিকার হলো, এটি নারীবাদী চিন্তাকে একরৈখিক এবং ইউরোপ-কেন্দ্রিক হওয়া থেকে বাঁচিয়েছে। এটি ‘ভিন্নতা’কে (Difference) একটি সমস্যা হিসেবে না দেখে, একটি শক্তি হিসেবে দেখতে শিখিয়েছে। এটি আমাদের একটি নতুন বিশ্লেষণাত্মক টুলবক্স দিয়েছে, যা দিয়ে আমরা ক্ষমতা, সংস্কৃতি এবং পরিচয়ের জটিল সম্পর্ককে বুঝতে পারি।
তবে এর সামনে চ্যালেঞ্জও কম নয়।
-
একাডেমিক ভাষার প্রাচীর ভাঙা: এর একটি বড় সমালোচনা হলো এর দুর্বোধ্যতা। আগামী দিনের তাত্ত্বিকদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে, এই তত্ত্বের গভীর অন্তর্দৃষ্টিগুলোকে সাধারণ মানুষের কাছে, অ্যাক্টিভিস্টদের কাছে আরও সহজ ও বোধগম্য ভাষায় পৌঁছে দেওয়া।
-
নয়া-উপনিবেশবাদ এবং ডিজিটাল যুগের সাথে বোঝাপড়া: বিশ্বায়ন, ডিজিটাল টেকনোলজি এবং সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে ক্ষমতার কাঠামো আরও জটিল হয়েছে। ফেসবুক বা গুগলের মতো বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলো কীভাবে নতুন ধরনের সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক উপনিবেশ তৈরি করছে, তা বিশ্লেষণ করা পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজমের জন্য একটি নতুন ক্ষেত্র।
-
পরিচয়ের রাজনীতির ফাঁদ এড়ানো: পরিচয়ের ওপর জোর দিতে গিয়ে তত্ত্বটি যেন বিভেদের রাজনীতিতে আটকে না যায়, সেই সতর্কতা সবসময়ই জরুরি। ভিন্নতাকে স্বীকার করেও কীভাবে বৃহত্তর ঐক্য ও সংহতি নির্মাণ করা যায়, সেই পথ খুঁজে বের করাই হবে আগামী দিনের সবচেয়ে বড় সৃজনশীল চ্যালেঞ্জ।
শেষ কথা হলো, পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজম কোনো সমাপ্ত অধ্যায় নয়। এটি একটি জীবন্ত, চলমান প্রকল্প। যতদিন পৃথিবীতে বর্ণ, শ্রেণি, লিঙ্গ এবং ঔপনিবেশিকতার ক্ষতচিহ্নগুলো টিকে থাকবে, ততদিন এই তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতাও থাকবে। এটি আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেবে, মুক্তির কোনো একটিমাত্র রাজপথ নেই। মুক্তির পথ হাজারো, এবং সেই পথগুলো খুঁজে বের করতে হবে তাদেরই, যারা সেই পথে হাঁটবে। সাদা চামড়ার চশমা খুলে পৃথিবীকে দেখার যে শিক্ষা পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজম আমাদের দিয়েছে, সেই শিক্ষা আজও সমানভাবে জরুরি।
সমালোচনা ও শেষ কথা
সব তত্ত্বেরই সমালোচনা থাকে। পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজমও তার ঊর্ধ্বে নয়। এর বিরুদ্ধে কিছু শক্তিশালী সমালোচনাও রয়েছে, যা আমাদের জানা দরকার।
-
অতিরিক্ত অ্যাকাডেমিক এবং দুর্বোধ্যতা: একটি বড় সমালোচনা হলো, এই তত্ত্বটি বড্ড বেশি অ্যাকাডেমিক এবং তাত্ত্বিক পরিভাষায় ভারাক্রান্ত। গায়ত্রী স্পিভাক বা হোমি ভাবার লেখা সাধারণ পাঠকের জন্য বোঝা প্রায় অসম্ভব। তাদের ভাষা অত্যন্ত জটিল এবং দর্শন-মনস্তত্ত্বের নানা শাখা থেকে নেওয়া। ফলে যাদের নিয়ে এই তত্ত্ব—অর্থাৎ প্রান্তিক নারীরা—তাদের কাছে এটি পৌঁছাতে পারে না। এটি মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনার কক্ষে বা অ্যাকাডেমিক জার্নালেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়।
-
পরিচয়ের রাজনীতিতে আটকে পড়া: অনেক সমালোচক মনে করেন, পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজম পরিচয়ের রাজনীতিতে (Identity Politics) বেশি জোর দিতে গিয়ে বৃহত্তর লড়াইয়ের কথা ভুলে যায়। কেবল বর্ণ, শ্রেণি, ধর্মের ভিন্নতা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে নারীদের মধ্যে বিভেদ আরও বাড়ে এবং পিতৃতন্ত্রের মতো সার্বজনীন শোষণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। ‘বৈশ্বিক ভগিনীত্ব’ ধারণাটি ত্রুটিপূর্ণ হলেও এর মধ্যে যে ঐক্যের ডাক ছিল, পরিচয়ের রাজনীতি কি সেই ঐক্যকে অসম্ভব করে তোলে?
-
তৃতীয় বিশ্বকে নতুন করে নির্মাণ: এই তত্ত্ব পশ্চিমা নারীবাদকে সমালোচনা করতে গিয়ে অনেক সময় নিজেই ‘তৃতীয় বিশ্বের নারী’ বা ‘পোস্টকলোনিয়াল নারী’ বলে একটি সমসত্ত্ব ক্যাটাগরি তৈরি করে ফেলে, যা তারাও ভাঙতে চেয়েছিল। ভারত, নাইজেরিয়া আর বলিভিয়ার নারীর অভিজ্ঞতা কি এক? এই তত্ত্ব অনেক সময় জাতীয়তাবাদকে বেশি গুরুত্ব দেয়, অথচ অনেক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনও নারীর জন্য নিপীড়নমূলক হতে পারে।
এই সমালোচনাগুলো সত্ত্বেও পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজমের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি কোনো নিখুঁত তত্ত্ব নয়, কিন্তু এটি একটি অত্যন্ত জরুরি সংশোধন। এটি নারীবাদী আন্দোলনকে আরও সংবেদনশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং আত্মসমালোচনামূলক হতে শিখিয়েছে। এটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, গায়ের রং, ভূগোল আর ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করে কোনো মানবিক মুক্তির গল্প লেখা যায় না।
শেষ করার আগে আবার সেই প্রথম দৃশ্যে ফিরে যাই। ঢাকার সেই নারী শ্রমিক। পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজম আমাদের বলে না যে, তার কষ্টকে অস্বীকার করতে হবে বা একে রোমান্টিসাইজ করতে হবে। বরং এটি আমাদের বলে, তার কষ্টকে বুঝতে হলে কেবল তার লিঙ্গ পরিচয় দেখলে চলবে না। দেখতে হবে তার শ্রেণি, তার গ্রাম থেকে শহরে আসার ইতিহাস, তার ধর্মের অবস্থান, তার শিক্ষার অভাব এবং সর্বোপরি, যে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা তাকে এই অবস্থানে ঠেলে দিয়েছে, সেই ব্যবস্থার দিকেও তাকাতে হবে।
তার মুক্তির পথ নিউইয়র্কের ওই নারীর মুক্তির পথ থেকে ভিন্ন হবে। হয়তো তার মুক্তি আসবে ন্যায্য মজুরিতে, হয়তো সন্তানের জন্য ভালো শিক্ষায়, হয়তো সামাজিক নিরাপত্তায়, হয়তো ইউনিয়ন করার অধিকারে, অথবা হয়তো এই সবকিছুর সমন্বয়ে। তার মুক্তির ভাষা হয়তো আমাদের পরিচিত নারীবাদী স্লোগানের মতো হবে না। তার প্রতিরোধ হয়তো হবে নীরব, দৈনন্দিন জীবনের ছোট ছোট সংগ্রামের মাধ্যমে।
পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজম আসলে কোনো তৈরি করা সমাধান বা রেসিপি বুক দেয় না। এটি আমাদের একটি নতুন চশমা দেয়। যে চশমা দিয়ে আমরা পৃথিবীর নানা রঙের, নানা কণ্ঠের নারীদের গল্পগুলো তাদের নিজেদের মতো করে দেখতে ও শুনতে শিখি। সাদা চামড়ার সেই আরামদায়ক, সরল চশমাটা খুলে রেখে পৃথিবীর জটিল, অমসৃণ বাস্তবতা দেখার এই আহ্বান—এটাই সম্ভবত পোস্টকলোনিয়াল ফেমিনিজমের সবচেয়ে বড় শক্তি। আর এই দেখাটা শুরু হলেই হয়তো প্রকৃত অর্থেই একটি বৈষম্যহীন পৃথিবীর দিকে আমাদের সম্মিলিত যাত্রা শুরু হবে।
তথ্যসূত্র
- Abu-Lughod, L. (2002). Do Muslim women really need saving? Anthropological reflections on cultural relativism and its others. American Anthropologist, 104(3), 783–790. https://doi.org/10.1525/aa.2002.104.3.783
- Bhabha, H. K. (1994). The location of culture. Routledge.
- Combahee River Collective. (1977). A Black feminist statement. Retrieved from http://circuitous.org/scraps/combahee.html
- Crenshaw, K. (1989). Demarginalizing the intersection of race and sex: A black feminist critique of antidiscrimination doctrine, feminist theory and antiracist politics. University of Chicago Legal Forum, 1989(1), Article 8.
- Derrida, J. (1976). Of grammatology (G. C. Spivak, Trans.). Johns Hopkins University Press. (Original work published 1967).
- Fanon, F. (1963). The wretched of the earth (C. Farrington, Trans.). Grove Press. (Original work published 1961).
- Fanon, F. (1967). Black skin, white masks (C. L. Markmann, Trans.). Grove Press. (Original work published 1952).
- Freidan, B. (1963). The feminine mystique. W. W. Norton & Company.
- Foucault, M. (1980). Power/knowledge: Selected interviews and other writings, 1972-1977 (C. Gordon, Ed.). Pantheon Books.
- Grewal, I., & Kaplan, C. (Eds.). (1994). Scattered hegemonies: Postmodernity and transnational feminist practices. University of Minnesota Press.
- Hooks, b. (1981). Ain’t I a woman: Black women and feminism. South End Press.
- Minh-ha, T. T. (1989). Woman, native, other: Writing postcoloniality and feminism. Indiana University Press.
- Mohanty, C. T. (1984). Under western eyes: Feminist scholarship and colonial discourses. Boundary 2, 12(3), 333–358.
- Mohanty, C. T. (2003). Feminism without borders: Decolonizing theory, practicing solidarity. Duke University Press.
- Narayan, U. (1997). Dislocating cultures: Identities, traditions, and third world feminism. Routledge.
- Puar, J. K. (2007). Terrorist assemblages: Homonationalism in queer times. Duke University Press.
- Said, E. W. (1978). Orientalism. Pantheon Books.
- Shiva, V. (1989). Staying alive: Women, ecology and development. Zed Books.
- Spivak, G. C. (1988). Can the subaltern speak? In C. Nelson & L. Grossberg (Eds.), Marxism and the interpretation of culture (pp. 271–313). University of Illinois Press.
- Suleri, S. (1989). Meatless days. University of Chicago Press.
Leave a Reply