Table of Contents
ভূমিকা
এক ভদ্রলোকের কথা ভাবুন। সময়টা ঊনবিংশ শতাব্দীর জার্মানি—এক অস্থির সময়, যখন পুরনো বিশ্বাস টলমল করছে আর নতুন যুগ তার আগমনী বার্তা দিচ্ছে। এই সময়ের পটভূমিতে এক ভদ্রলোকের আবির্ভাব। তার একখানা বিশাল গোঁফ আছে, যা দেখে মনে হয় যেন দুটি বিশাল ঈগল পাখি তার ঠোঁটের উপর ডানা মেলে বিশ্রাম নিচ্ছে। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, যেন এক্স-রে মেশিনের মতো আপনার ভেতরটা পর্যন্ত দেখে ফেলছে। তিনি একা একা আল্পস পর্বতমালার চূড়ায় ঘুরে বেড়ান, মাইলের পর মাইল হাঁটেন। মাথায় তার দর্শনের ঝড়, বুকে শারীরিক কষ্টের সমুদ্র। আর হাতে? হাতে তার অদৃশ্য এক হাতুড়ি। যে হাতুড়ি দিয়ে তিনি গত দুই হাজার বছরের পুরোনো সব বিশ্বাস, নৈতিকতা আর সত্যের মর্মর মূর্তিগুলো গুঁড়িয়ে দিতে চান।
ভদ্রলোকের নাম ফ্রিডরিখ ভিলহেলম নিৎশে (Friedrich Wilhelm Nietzsche)।
দর্শনজগতে নিৎশে কোনো শান্ত, সৌম্য ঋষি নন। তিনি এক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের নাম। তার লেখা পড়লে মনে হয়, কেউ যেন আপনার কাঁধ ধরে সজোরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলছে, “ওহে কুম্ভকর্ণ, জাগো! আর কতকাল ঘুমিয়ে থাকবে?” কেউ তাকে ভালোবাসে, কেউ প্রচণ্ড ঘৃণা করে। কিন্তু উপেক্ষা করার সাধ্যি কারো নেই। তার কথাগুলো শল্য চিকিৎসকের ছুরির ফলার মতো, সরাসরি আমাদের আত্মতৃপ্তির আবরণে এসে বিঁধে। তিনি এমন সব প্রশ্ন তুলেছেন, যা আমাদের স্বস্তির ঘুম হারাম করে দেয়। কে আমরা? আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য কী? আমাদের ভালো-মন্দের ধারণাগুলো এলো কোথা থেকে? ঈশ্বর কি সত্যিই আছেন, নাকি তাকে আমরাই বানিয়েছি?
তার জীবনটাও ছিল এক বিয়োগান্তক মহাকাব্যের মতো। খুব অল্প বয়সেই বাবাকে হারান, যিনি ছিলেন একজন প্রোটেস্ট্যান্ট যাজক। বাবার মৃত্যু তার শিশু মনে গভীর দাগ ফেলেছিল। প্রখর মেধাবী নিৎশে মাত্র ২৪ বছর বয়সে সুইজারল্যান্ডের বাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ধ্রুপদী ভাষাতত্ত্বের (Classical Philology) অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন—যা ছিল সে সময়ের একাডেমিক জগতে এক কথায় অবিশ্বাস্য এক ঘটনা। ভাবা যায়, যে বয়সে ছেলেরা সবে পড়াশোনা শেষ করে, সেই বয়সে তিনি অধ্যাপক! তার প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়াই সরাসরি অধ্যাপক পদ গ্রহণের অনুমতি দিয়েছিল।
কিন্তু এই উজ্জ্বল সূচনার পর তার জীবন ছিল নিরন্তর সংগ্রামের। ভাগ্য তার প্রতি সদয় ছিল না। শরীর তার সঙ্গ দেয়নি। প্রচণ্ড মাইগ্রেন, যা তাকে দিনের পর দিন অন্ধকার ঘরে শুয়ে থাকতে বাধ্য করত, প্রায় অন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো চোখের সমস্যা আর পেটের অসহ্য পীড়ায় ভুগে মাত্র দশ বছরের মাথায়, ১৮৭৯ সালে, তিনি অধ্যাপনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। এরপর শুরু হয় তার একাকী ভবঘুরে জীবন। ইতালি, ফ্রান্স আর সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন সরাইখানায় আর ভাড়া করা ঘরে কেটেছে তার দিনগুলো। এই একাকীত্ব, অসুস্থতা আর শারীরিক কষ্টের মধ্যেই জন্ম নিয়েছে তার শ্রেষ্ঠ কাজগুলো—যেন ঝিনুকের বুকের বালুকণা থেকে মুক্তা জন্মানোর মতো। তার দর্শন যেন তার নিজের যন্ত্রণারই এক মহৎ রূপান্তর।
এই একাকী জীবনে তার বুদ্ধিবৃত্তিক সঙ্গীও ছিল কম। তরুণ বয়সে তিনি বিখ্যাত সুরকার রিচার্ড ভাগনারকে (Richard Wagner) গুরু মানতেন, তার সঙ্গীতে তিনি জার্মান সংস্কৃতির এক নতুন ঊষার সম্ভাবনা দেখেছিলেন। কিন্তু পরে ভাগনারের খ্রিস্টীয় ভাবধারা ও ক্রমবর্ধমান ইহুদি-বিদ্বেষ দেখে তিনি মোহমুক্ত হন এবং তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। আরেকবার তার জীবনে ঝড় তুলেছিলেন এক প্রখর বুদ্ধিমতী রুশ তরুণী লু আন্দ্রেয়াস-সালোমে (Lou Andreas-Salomé)। নিৎশে তাকে গভীরভাবে ভালোবেসেছিলেন এবং দুবার বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। কিন্তু সালোমে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এই প্রত্যাখ্যানগুলো তার একাকীত্বকে আরও গভীর করেছিল।
জীবনের শেষ দশটি বছর ছিল সবচেয়ে করুণ। ১৮৮৯ সালের জানুয়ারিতে, ইতালির তুরিন শহরের রাস্তায় তিনি দেখতে পান এক ঘোড়ার গাড়ির চালক তার ঘোড়াটিকে নির্মমভাবে চাবুক মারছে। যে দার্শনিক মানবজাতির দুর্বলতার প্রতি এত কঠোর ছিলেন, তিনিই এক পশুর কষ্টে ভেঙে পড়লেন। নিৎশে দৌড়ে গিয়ে ঘোড়াটির গলা জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এরপরই তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। জীবনের শেষ দশক তিনি সম্পূর্ণ নির্বাক, প্রায় অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় তার মা ও বোনের তত্ত্বাবধানে কাটান। যে মানুষটি তার লেখনী দিয়ে পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন, তিনিই নির্বাক হয়ে গেলেন। কী নিদারুণ পরিহাস!
হিটলার এবং নাৎসিরা তার দর্শনকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে নির্লজ্জভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিল। বিশেষ করে তার বোন এলিসাবেথ ফোর্স্টার-নিৎশে (Elisabeth Förster-Nietzsche), যিনি ছিলেন একজন কট্টর ইহুদি-বিদ্বেষী, তিনি ভাইয়ের মৃত্যুর পর তার অপ্রকাশিত নোটবুকগুলো বিকৃত করে দ্য উইল টু পাওয়ার (The Will to Power) নামে প্রকাশ করেন। এই বিকৃতির কারণেই নিৎশেকে ফ্যাসিবাদ ও আর্যশ্রেষ্ঠত্বের দার্শনিক হিসেবে ভুল বোঝার একটি দীর্ঘস্থায়ী ধারা তৈরি হয়।
কিন্তু নিৎশের দর্শনকে শুধু নাৎসিবাদের নোংরা চশমা দিয়ে দেখলে এর প্রতি ঘোর অবিচার করা হবে। তিনি ছিলেন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, সৃষ্টিশীলতা আর জীবনকে তার সমস্ত কদর্যতা ও সৌন্দর্যসহ শর্তহীনভাবে ভালোবাসার দার্শনিক। তিনি কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রবক্তা ছিলেন না; তিনি ছিলেন আত্মার চিকিৎসক।
চলুন, তার সেই বিখ্যাত হাতুড়ির সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাক। দেখি, তিনি ঠিক কী ভাঙতে চেয়েছিলেন আর নতুন করে কী-ই বা গড়তে চেয়েছিলেন।
হাতুড়ি তৈরির কারিগরেরা: যে জগৎ নিৎশেকে বানিয়েছিল
ধরুন, আপনি একজন ভাস্কর। আপনার হাতে একটি হাতুড়ি আর বাটালি আছে। আপনি পাথর খোদাই করে এক আশ্চর্য মূর্তি গড়তে চান। সবাই আপনার মূর্তির দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হবে, আপনার হাতুড়ির প্রশংসা করবে। কিন্তু খুব কম লোকই জানতে চাইবে, এই হাতুড়িটা আপনি কোথায় পেলেন? এর লোহা কোন খনি থেকে এসেছে? কোন কামার একে আগুনে পুড়িয়ে, পিটিয়ে পিটিয়ে এই রূপ দিয়েছে?
ফ্রিডরিখ নিৎশে ছিলেন দর্শনজগতের সেই ভাস্কর, আর তার হাতে ছিল এক বিধ্বংসী হাতুড়ি। আমরা তার ‘ঈশ্বর মৃত’, ‘উবারমেনশ’ বা ‘ক্ষমতার ইচ্ছা’র মতো মূর্তিগুলো দেখে অবাক হই, তর্ক করি। কিন্তু আমরা প্রায়ই ভুলে যাই, তার এই হাতুড়িটি শূন্য থেকে তৈরি হয়নি। এর পেছনে ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর জার্মানির রাজনৈতিক উত্তাপ, আর তার আগে শত শত বছর ধরে বয়ে আসা দর্শনের স্রোত।
নিৎশে কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপের একাকী ঋষি ছিলেন না। তিনি ছিলেন তার সময়ের সন্তান। তার দর্শনকে বুঝতে হলে আমাদের সেই সময় আর সেই চিন্তার জগতে ডুব দিতে হবে। চলুন, আজ সেই কামারশালায় ঢুঁ মারা যাক, যেখানে নিৎশের সেই বিখ্যাত হাতুড়িটি তৈরি হয়েছিল।
বিসমার্কের জার্মানি ও ‘লোহার যুগ’
নিৎশের জীবনের বেশিরভাগ সময়টা কেটেছে এমন এক জার্মানিতে, যা সবেমাত্র জন্ম নিয়েছে। তার জন্মের আগে ‘জার্মানি’ বলতে কোনো একক রাষ্ট্র ছিল না, ছিল কতগুলো ছোট ছোট রাজ্যের এক দুর্বল জোট। নিৎশে বড় হচ্ছিলেন এই টুকরো টুকরো রাজ্যগুলোর একত্রিত হওয়ার সাক্ষী হয়ে। এই একীকরণের প্রধান কারিগর ছিলেন অটো ফন বিসমার্ক (Otto von Bismarck), ‘লৌহ চ্যান্সেলর’ নামে যিনি পরিচিত। তার নীতি ছিল—বক্তৃতা বা ভোটের মাধ্যমে নয়, বরং ‘লোহা ও রক্তের’ (iron and blood) মাধ্যমে জার্মানিকে এক করতে হবে।
১৮৭১ সালে ফ্রান্সকে পরাজিত করে (ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধ) যখন নতুন জার্মান সাম্রাজ্য বা ‘রাইখ’ (Reich) ঘোষণা করা হলো, তখন সারা জার্মানি জুড়ে এক তীব্র জাতীয়তাবাদী উন্মাদনা। সবাই নতুন রাষ্ট্র, নতুন শক্তি আর নতুন গৌরব নিয়ে মত্ত। কিন্তু তরুণ নিৎশে এই উল্লাসের স্রোতে গা ভাসালেন না। উল্টো, তিনি এক গভীর আশঙ্কার সঙ্গে এই নতুন জার্মানিকে দেখছিলেন।
কেন?
কারণ নিৎশে এই নতুন জার্মান সংস্কৃতিকে মনে করতেন অগভীর, অন্তঃসারশূন্য এবং দাম্ভিক। তার চোখে, এই রাষ্ট্র ছিল শিল্প, সঙ্গীত আর দর্শনের সূক্ষ্মতার বদলে সামরিক শক্তি আর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির এক স্থূল উদযাপন (Safranski, 2002)। তিনি বিদ্রূপ করে একে বলতেন জার্মান সাম্রাজ্য (Reichsdeutsch) সংস্কৃতি। তার মনে হয়েছিল, জার্মানির আসল আত্মা—গ্যেটে, শিলার, বেঠোভেনের সেই গভীর সংস্কৃতি—বিসমার্কের এই নতুন, আগ্রাসী জাতীয়তাবাদের নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে।
তিনি রাষ্ট্রকে (The State) একটি ‘নতুন মূর্তি’ (new idol) হিসেবে দেখেছিলেন। মানুষ যেমন একসময় ঈশ্বরের পূজা করত, এখন তারা রাষ্ট্রের পূজা শুরু করেছে। রাষ্ট্র বলছে, “আমার চেয়ে মহৎ কিছু নেই,” আর মানুষ পালের পশুর মতো সেই রাষ্ট্রের জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত। নিৎশে লিখলেন, “রাষ্ট্র হলো সেই শীতলতম দানব। সে শীতলভাবে মিথ্যা বলে; আর এই মিথ্যা তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে: ‘আমি, রাষ্ট্র, আমিই জনগণ।’” (Nietzsche, Thus Spoke Zarathustra, Part I)।
ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধে তিনি একজন মেডিকেল অর্ডালি হিসেবে কাজ করেছিলেন। খুব কাছ থেকে তিনি যুদ্ধের ভয়াবহতা, সৈন্যদের যন্ত্রণা আর জাতীয়তাবাদের নামে চলা নৃশংসতা দেখেছিলেন। এই অভিজ্ঞতা তার স্বাস্থ্যকে যেমন ভেঙে দিয়েছিল, তেমনি তার মনকেও বিষিয়ে তুলেছিল। তিনি বুঝেছিলেন, এই ‘পালের নীতি’ (herd morality) ব্যক্তিকে মুছে ফেলে এবং মানুষকে নিছকই রাষ্ট্রের যন্ত্রে পরিণত করে। তার দর্শনে ব্যক্তির সার্বভৌমত্ব এবং পালের ঊর্ধ্বে ওঠার যে আহ্বান, তার একটি বড় কারণ ছিল বিসমার্কের এই নতুন জার্মানির প্রতি তার গভীর বিতৃষ্ণা।
দর্শনের দীর্ঘ ছায়া
নিৎশে শুধু তার রাজনৈতিক পারিপার্শ্বিকতা দিয়েই প্রভাবিত হননি, তিনি ছিলেন দর্শনের ইতিহাসের এক অত্যন্ত মনোযোগী ছাত্র। তার হাতুড়িটি সবচেয়ে বেশি আঘাত হেনেছিল সেইসব দার্শনিকদের ওপর, যারা পশ্চিমা চিন্তার ভিত্তি তৈরি করেছিলেন।
সক্রেটিস ও প্লেটো: স্বর্গের লোভ দেখিয়ে পৃথিবীকে অপমান
নিৎশের জন্য পশ্চিমা দর্শনের ‘মূল পাপ’ (original sin) শুরু হয়েছিল সক্রেটিস (Socrates) এবং তার শিষ্য প্লেটোর (Plato) হাত ধরে।
তাদের আগে, প্রাচীন গ্রিসে জীবনকে উদযাপন করা হতো তার সমস্ত সৌন্দর্য ও কদর্যতা নিয়ে। হোমারের মহাকাব্য বা গ্রিক ট্র্যাজেডিতে আপনি দেখবেন, দেবতারাও মানুষের মতোই ঈর্ষা করে, লড়াই করে, ভালোবাসে। সেখানে জীবনের আবেগ, উন্মাদনা (যা নিৎশে বলতেন ডায়োনিসিয়ান [Dionysian]) এবং শৃঙ্খলা ও যুক্তির (যা তিনি বলতেন অ্যাপোলোনিয়ান [Apollonian]) এক অসাধারণ ভারসাম্য ছিল।
কিন্তু সক্রেটিস এসে বললেন, “The unexamined life is not worth living” (অপরীক্ষিত জীবন যাপনের যোগ্য নয়)। তিনি সবকিছুর ওপরে স্থান দিলেন যুক্তিকে (Reason)। প্লেটো এই ধারণাকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেলেন। তিনি বললেন, এই যে জগৎ আমরা দেখছি, এটা আসলে আসল জগৎ নয়। এটা হলো আসল জগতের (World of Forms) একটা ছায়া মাত্র। আসল জগৎ হলো অপরিবর্তনীয়, শাশ্বত এবং নিখুঁত। আমাদের জীবনের লক্ষ্য হলো এই ছায়ার জগৎকে অতিক্রম করে যুক্তির মাধ্যমে সেই আসল জগতের জ্ঞান লাভ করা।
নিৎশের কাছে এটা ছিল এক ভয়াবহ বিপর্যয়। কেন? কারণ এই দর্শন প্রথমবারের মতো এই মাটির পৃথিবীকে, আমাদের এই শরীরকে, আমাদের আবেগ আর অনুভূতিকে ‘মিথ্যা’ ও ‘নিকৃষ্ট’ বলে দাগিয়ে দিল। এটি পরকালের বা এক কাল্পনিক ‘সত্য জগতের’ লোভ দেখিয়ে এই রক্ত-মাংসের জীবনকে অস্বীকার করতে শেখাল। নিৎশে মনে করতেন, খ্রিস্টধর্ম আর কিছুই নয়, “জনগণের জন্য প্লেটোর দর্শন” (Platonism for the people) (Nietzsche, Beyond Good and Evil, Preface)। খ্রিস্টধর্ম প্লেটোর সেই ‘আসল জগৎ’-কে ‘স্বর্গ’ নাম দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। এই জীবনবিরোধী চিন্তার ধারাকেই নিৎশে ভাঙতে চেয়েছিলেন। তার মতে, এই দর্শন থেকেই জন্ম নিয়েছে দুর্বলদের দাস-নীতি (Slave Morality), যা শক্তিশালী ও জীবনবাদী মানুষদের মূল্যবোধকে ‘শয়তানি’ (evil) বলে আখ্যা দিয়েছে।
ইমানুয়েল কান্ট: যুক্তির সোনালি খাঁচা
আলোকায়ন যুগের (Enlightenment) সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক ছিলেন ইমানুয়েল কান্ট (Immanuel Kant)। তিনি পশ্চিমা দর্শনকে এক নতুন পথে চালিত করেছিলেন। কান্ট বললেন, আমরা জগৎকে সরাসরি জানতে পারি না। আমরা জগৎকে জানি আমাদের মনের কিছু নির্দিষ্ট কাঠামোর (Categories of the Mind) মাধ্যমে, যেমন—দেশ (space), কাল (time) এবং কার্যকারণ (causality)। অর্থাৎ, জগৎ নিজে কেমন (thing-in-itself বা noumenon), তা আমরা কখনোই জানতে পারব না; আমরা কেবল আমাদের কাছে জগৎ যেভাবে প্রতিভাত হয় (phenomenon), সেটুকুই জানতে পারি।
একদিক থেকে নিৎশে এই ধারণাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। কারণ কান্টের এই যুক্তি পুরনো ‘পরম সত্য’ বা প্লেটোর ‘আসল জগৎ’-এর দাবিকে নস্যাৎ করে দেয়। যদি আমরা ‘thing-in-itself’ জানতেই না পারি, তাহলে কোনো পরম সত্যের দাবি করাও মূর্খতা।
কিন্তু নিৎশে কান্টের ওপর খাপ্পা ছিলেন অন্য কারণে। কান্ট একদিকে যেমন পুরনো অধিবিদ্যার (metaphysics) দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন, তেমনি অন্যদিকে তিনি ‘ব্যবহারিক যুক্তির’ (practical reason) নামে নৈতিকতা আর ঈশ্বরকে আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলেন। কান্ট বলেছিলেন, যদিও আমরা ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারি না, কিন্তু একটি সার্বজনীন নৈতিক বিধি বা অবশ্যক কর্তব্যবিধি (Categorical Imperative) মেনে চলার জন্য আমাদের ঈশ্বরের অস্তিত্ব ধরে নিতে হবে।
নিৎশের কাছে এটা ছিল এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতারণা। তিনি মনে করতেন, কান্ট একদিকে সাহস করে পুরনো বিশ্বাসকে প্রশ্ন করেছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভয় পেয়ে পেছনের দরজা দিয়ে সেগুলোকে আবার ফিরিয়ে এনেছেন (Kaufmann, 1974)। কান্ট মানুষকে যুক্তির একটি নতুন খাঁচায় বন্দী করেছেন। নিৎশের পার্সপেক্টিভিজম (Perspectivism) বা দৃষ্টিকোণবাদের ধারণাটি কান্টের চিন্তার সরাসরি প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা যেতে পারে। যদি কান্টের কথাই সত্যি হয় যে আমরা কেবল ‘phenomenon’ বা প্রতিভাসকেই জানি, তাহলে তো পরম সত্য বলে কিছু নেই, আছে কেবল বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা জগৎ।
আর্থার শোপেনহাওয়ার: মহান শিক্ষক, আরও বড় শত্রু
নিৎশের জীবনে যদি কোনো দার্শনিকের সবচেয়ে গভীর এবং ব্যক্তিগত প্রভাব থেকে থাকে, তিনি হলেন আর্থার শোপেনহাওয়ার (Arthur Schopenhauer)। তরুণ বয়সে নিৎশে শোপেনহাওয়ারের প্রধান গ্রন্থ The World as Will and Representation পড়ে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি শোপেনহাওয়ারকে তার ‘শিক্ষক’ (educator) বলে মেনে নিয়েছিলেন।
শোপেনহাওয়ার কী বলেছিলেন? তিনি কান্টের দর্শনকে আরও গভীরে নিয়ে গিয়ে বলেন, জগতের মূলে, এই প্রতিভাসের আড়ালে যা আছে, তা হলো এক অন্ধ, অতৃপ্ত, অযৌক্তিক ইচ্ছা—জীবন-ইচ্ছা (Will to Live)। এই ইচ্ছাই মহাবিশ্বের সবকিছুকে চালাচ্ছে। আর যেহেতু এই ইচ্ছা অন্ধ এবং এর কোনো লক্ষ্য নেই, তাই জীবন মানেই হলো নিরন্তর অতৃপ্তি আর কষ্ট। এই দুঃখের সাগর থেকে মুক্তির উপায় কী? শোপেনহাওয়ারের মতে, উপায় হলো এই জীবন-ইচ্ছাকে দমন করা—শিল্পের মাধ্যমে সাময়িকভাবে, অথবা বৈরাগ্য (asceticism) ও করুণার (compassion) মাধ্যমে স্থায়ীভাবে। এক কথায়, জীবনকে অস্বীকার করা।
নিৎশে শোপেনহাওয়ারের এই রোগ নির্ণয়ের সঙ্গে একমত ছিলেন যে, জীবনের মূলে এক অযৌক্তিক ইচ্ছা কাজ করছে। কিন্তু তিনি তার দেওয়া সমাধানকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করলেন। শোপেনহাওয়ারের নৈরাশ্যবাদ (pessimism) নিৎশের জীবনবাদী চেতনার পরিপন্থী ছিল।
এখানেই নিৎশে তার সবচেয়ে যুগান্তকারী চালটি চাললেন। তিনি শোপেনহাওয়ারের ‘জীবন-ইচ্ছা’কে নিলেন, কিন্তু তাকে উল্টে দিলেন। তিনি বললেন, জীবনের মূল চালিকাশক্তি বাঁচার ইচ্ছা নয়, বরং ক্ষমতার ইচ্ছা (Will to Power)। এটি শুধু টিকে থাকার ইচ্ছা নয়, বরং বৃদ্ধি পাওয়ার, বাধা অতিক্রম করার, নিজেকে প্রসারিত করার এবং আরও শক্তিশালী হওয়ার ইচ্ছা।
শোপেনহাওয়ার যেখানে কষ্ট দেখে জীবন থেকে পালাতে বলেছেন, নিৎশে সেখানে কষ্টকে আলিঙ্গন করতে বলেছেন। কারণ কষ্টই আমাদের শক্তিশালী করে তোলে। শোপেনহাওয়ারের দর্শন ছিল জীবনকে ‘না’ বলার দর্শন, এক ক্লান্ত মানুষের দর্শন। আর নিৎশের দর্শন হলো জীবনকে তার সমস্ত ভয়াবহতা ও সৌন্দর্যসহ ‘হ্যাঁ’ বলার দর্শন (Yes-saying philosophy)। শোপেনহাওয়ার ছিলেন সেই গুরু, যাকে অস্বীকার করার মাধ্যমেই নিৎশে দর্শন এর নিজস্ব স্বকীয়তা লাভ করে।
কারিগরের হাতে হাতুড়ি
তাহলে আমরা কী দেখলাম? নিৎশের দর্শন কোনো আকাশ থেকে পড়া দৈববাণী নয়। এটি ছিল তার সময়ের রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত বোঝাপড়া, আর তার পূর্বসূরি দার্শনিকদের সঙ্গে তার এক নিরন্তর বিতর্কের ফসল।
-
বিসমার্কের জাতীয়তাবাদী জার্মানি তাকে দেখিয়েছিল ‘পালের মানসিকতা’ কত ভয়ঙ্কর হতে পারে, আর এর ফলেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন আপসহীন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রবক্তা।
-
প্লেটো আর খ্রিস্টধর্মের ‘পরকালবাদ’ তাকে শিখিয়েছিল কীভাবে দর্শন জীবনবিরোধী হয়ে উঠতে পারে, আর তাই তিনি হয়ে উঠেছিলেন এই মাটির পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রেমিক।
-
কান্টের যুক্তির জগৎ তাকে দেখিয়েছিল পরম সত্যের ধারণা কতটা ঠুনকো, আর তাই তিনি দৃষ্টিকোণবাদের কথা বলেছিলেন।
-
আর শোপেনহাওয়ারের গভীর হতাশাবাদ তাকে ঠেলে দিয়েছিল জীবনের সবচেয়ে শক্তিশালী affirmation বা স্বীকৃতি আবিষ্কার করতে—ক্ষমতার ইচ্ছা এবং আমোর ফাতি (Amor Fati) বা নিয়তির প্রতি ভালোবাসা।
তিনি এই সব উপাদানকে তার নিজের যন্ত্রণার আগুনে গলিয়েছেন, তার প্রতিভার হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়েছেন, আর তৈরি করেছেন এমন এক দর্শন যা আজও আমাদের কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দেয়। তিনি আমাদের কোনো তৈরি করা উত্তর দিয়ে যাননি, বরং প্রশ্ন করার সাহস যুগিয়েছেন।
প্রথম আঘাত: “ঈশ্বর মৃত!” (The Death of God)
নিৎশের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং সম্ভবত সবচেয়ে ভুল বোঝা উক্তিগুলোর একটি হলো “ঈশ্বর মৃত” (Gott ist tot)।
শুনলেই মনে হয়, নিৎশে বুঝি একজন কট্টর নাস্তিক, যিনি ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করছেন। কিংবা তিনি এমন দাবি করছেন যে, ঈশ্বর নামের কেউ একজন ছিলেন, কিন্তু কোনো এক সকালে তিনি মারা গেছেন। ব্যাপারটা আসলে মোটেও তা নয়। নিৎশে এখানে একটি ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক রোগ নির্ণয় করছিলেন।
তার বিখ্যাত বই দ্য গে সায়েন্স (The Gay Science, জার্মান: Die fröhliche Wissenschaft)-এ নিৎশে এক পাগলের গল্প বলেন। পাগলটি ভরদুপুরে একটা লণ্ঠন জ্বালিয়ে বাজারের ভেতর ছোটাছুটি করতে করতে চিৎকার করছে, “আমি ঈশ্বরকে খুঁজছি! আমি ঈশ্বরকে খুঁজছি!” বাজারের লোকজন, যারা নিজেরাও আধুনিক যুক্তিবাদী মানুষ এবং ঈশ্বরের ব্যাপারে উদাসীন, তাকে দেখে হাসাহাসি করতে লাগল। তাদের কাছে ঈশ্বরের ধারণাটিই একটি পুরনো কৌতুক। পাগলটি তখন তাদের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের ঊর্ধ্বে উঠে, তাদের দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল:
“ঈশ্বর কোথায় গেছেন? আমি তোমাদের বলছি। আমরা তাকে হত্যা করেছি—তুমি আর আমি! আমরা সবাই তার হত্যাকারী! … ঈশ্বর মৃত! ঈশ্বর মৃতই থাকবেন! এবং আমরা তাকে হত্যা করেছি। এই হত্যাকারীদের হত্যাকারী আমরা, কী করে নিজেদের সান্ত্বনা দেব? জগতের যা কিছু ছিল পবিত্রতম এবং শক্তিশালী, তা আমাদের ছুরির নিচে রক্তক্ষরণ করে মরেছে: কে এই রক্ত আমাদের গা থেকে মুছিয়ে দেবে? … ঈশ্বরের মৃত্যু এক মহৎ কর্ম, এর চেয়ে মহৎ কর্ম আর কখনো ঘটেনি, এবং আমাদের পরে যারা জন্মাবে, এই কর্মের কারণেই তারা এক উচ্চতর ইতিহাসের অংশ হবে।” (Nietzsche, 1882/2001, section 125)
এখানে নিৎশে যা বোঝাতে চেয়েছেন তা হলো, ইউরোপীয় সভ্যতা আর দর্শনের ভিত্তি ছিল খ্রিস্টীয় ঈশ্বর। শত শত বছর ধরে মানুষের নৈতিকতা, জীবনের উদ্দেশ্য, সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দ—সবকিছু নির্ধারিত হতো ঈশ্বরের ধারণার ওপর ভিত্তি করে। ঈশ্বর ছিলেন সেই মহাজাগতিক ভিত্তি, যা সবকিছুকে ধরে রেখেছিল।
কিন্তু আলোকায়নের (Enlightenment) পর থেকে বিজ্ঞান আর যুক্তির জয়জয়কার শুরু হলো। কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, নিউটন, ডারউইন—তারা দেখালেন যে মহাবিশ্ব কোনো স্বর্গীয় পরিকল্পনা অনুযায়ী চলে না, বরং প্রাকৃতিক নিয়ম দ্বারা পরিচালিত হয়। মহাবিশ্বের কেন্দ্রে পৃথিবী নেই, মানুষও ঈশ্বরের কোনো বিশেষ সৃষ্টি নয়, বরং বিবর্তনের ফসল। মানুষ সবকিছুকে প্রশ্ন করতে শিখল। ধীরে ধীরে, শিক্ষিত ইউরোপীয় সমাজে ঈশ্বরের ধারণাটি তার বিশ্বাসযোগ্যতা ও কার্যকারিতা হারাল।
“ঈশ্বর মৃত”—এই ঘোষণার মাধ্যমে নিৎশে বলছেন না যে ঈশ্বর আক্ষরিক অর্থে মারা গেছেন। তিনি বলছেন, ঈশ্বর নামক যে কেন্দ্রীয় ধারণাটি পশ্চিমা সভ্যতার মূল্যবোধের উৎস হিসেবে কাজ করত, সেটি মরে গেছে। সেই স্তম্ভটি, যার ওপর তাদের পুরো নৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোটি দাঁড়িয়ে ছিল, সেটি ভেঙে পড়েছে। এবং আমরাই, আমাদের যুক্তি-বুদ্ধি-বিজ্ঞান দিয়ে সেই স্তম্ভটি ভেঙে ফেলেছি। আমরাই সেই হত্যাকারী। কিন্তু আমরা অনেকেই এই হত্যার ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে সচেতন নই। বাজারের সেই লোকগুলোর মতো আমরাও হাসাহাসি করছি, বুঝতে পারছি না যে আমরা পায়ের নিচের মাটিটাই সরিয়ে ফেলেছি।
কিন্তু এর ফল কী? এর ফল হলো এক মহাদুর্যোগ, এক গভীর সংকট। ঈশ্বর যদি না থাকেন, তাহলে মহাবিশ্বে কোনো অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য (inherent purpose) নেই। জীবনের কোনো পূর্বনির্ধারিত মানে নেই। ভালো-মন্দের কোনো স্বর্গীয় বা পরম মাপকাঠি নেই। ঈশ্বরের সিংহাসনটি এখন শূন্য। নিৎশে ভয় পাচ্ছিলেন, মানুষ এই শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য নতুন নতুন ‘ঈশ্বর’ বা ‘পরম সত্য’ তৈরি করবে। যেমন—রাষ্ট্র, জাতীয়তাবাদ, সাম্যবাদ, ফ্যাসিবাদ কিংবা এমনকি বিজ্ঞানবাদ (Scientism)—যেখানে বিজ্ঞানকেই সব প্রশ্নের একমাত্র উত্তরদাতা বলে মনে করা হয়। তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন, মানুষ এক ঈশ্বরের বদলে অন্য কোনো মূর্তির পূজা শুরু করবে, যা হয়তো আরও ভয়ঙ্কর হতে পারে। বিংশ শতাব্দীর ইতিহাস যেন তার এই ভবিষ্যদ্বাণীকে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি প্রমাণ করেছে। এই সামগ্রিক সংকটময় অবস্থাকেই নিৎশে বলেছেন নিহিলিজম (Nihilism) বা শূন্যবাদ।
শূন্যতার গান এবং নিহিলিজম (The Song of Emptiness and Nihilism)
ঈশ্বরের মৃত্যু এক বিশাল শূন্যতা তৈরি করে। ভাবুন তো, আপনি এক বিশাল সমুদ্রে নৌকাবিহীন অবস্থায় ভাসছেন, কোনো দিকনির্দেশনা নেই, কোনো গন্তব্য নেই, চারদিকে শুধু অথৈ জল। নিহিলিজম হলো সেই অনুভূতি। এটি হলো এই গভীর উপলব্ধি যে, জীবন অর্থহীন, আমাদের লালন করা মূল্যবোধগুলোর কোনো ভিত্তি নেই এবং কোনো কিছুই আসলে চূড়ান্তভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়।
নিৎশে মনে করতেন, এই নিহিলিজম হলো মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সংকট, এক অন্ধকার ছায়া যা আগামী দুই শতাব্দী ধরে ইউরোপের ওপর নেমে আসবে। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, এই শূন্যতা থেকে জন্ম নেবে ভয়াবহ যুদ্ধ, রাজনৈতিক মতাদর্শের সংঘাত এবং এক ধরনের গভীর আধ্যাত্মিক ক্লান্তি।
তিনি দুই ধরনের নিহিলিজমের কথা বলেছেন:
১. প্যাসিভ নিহিলিজম (Passive Nihilism): এটা হলো ক্লান্ত, হতাশ, দুর্বল মানুষের নিহিলিজম। এরা মনে করে, যেহেতু কোনো কিছুরই কোনো অর্থ নেই, মহৎ কোনো উদ্দেশ্য নেই, তাই চেষ্টা করে আর লাভ কী? চলো, শুধু একটু আরাম-আয়েশ, একটু বিনোদন আর একটু নিরাপত্তাটুকু নিশ্চিত করে জীবনটা কোনোমতে কাটিয়ে দিই। কোনো ঝুঁকি নয়, কোনো মহৎ স্বপ্ন নয়, কোনো কষ্ট স্বীকার নয়। শুধু কোনোমতে টিকে থাকা। এই ধরনের মানুষদের নিৎশে তার শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ দাস স্পোক জারাথুস্ত্রা (Thus Spoke Zarathustra) -তে বলেছেন “শেষ মানব” (The Last Man বা der letzte Mensch)।
এই জরাথুস্ট্র ঐতিহাসিক জরাথুস্ত্র নন, বরং নিৎশের সৃষ্ট এক কাল্পনিক চরিত্র, তার কাল্পনিক নবি। এখানে জরাথুস্ট্র (Zarathustra) পাহাড় থেকে নেমে এসে শহরের মানুষকে যখন মহত্তর জীবনের স্বপ্ন দেখায়, উবারমেনশের কথা বলে, তখন তারা তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। তারা বলে:
“প্রেম কী? সৃষ্টি কী? আকাঙ্ক্ষা কী? তারকা কী? —এই প্রশ্ন করে শেষ মানব এবং বোকার মতো চোখ পিটপিট করে। পৃথিবীটা তখন ছোট হয়ে গেছে, আর তার উপর লাফাচ্ছে শেষ মানব, যে সবকিছুকে ছোট করে ফেলে। তার বংশ মশা-মাছির মতো, কিছুতেই মরে না। … ‘আমরা সুখ আবিষ্কার করেছি’—বলে শেষ মানব এবং চোখ পিটপিট করে।” (Nietzsche, 1883-1885/2006, Zarathustra’s Prologue, 5)
এই শেষ মানব হলো আজকের যুগের সেই মানুষ, যে শুধু নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ, আরাম আর ডিজিটাল বিনোদন নিয়ে ব্যস্ত। সে বড় কোনো স্বপ্ন দেখে না, কোনো আদর্শের জন্য ঝুঁকি নিতে ভয় পায়। সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্মার্টফোনের স্ক্রলে বুঁদ হয়ে থাকে, অন্যের বানানো জীবন দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আর নিজের জীবনের একঘেয়েমিকে ‘শান্তি’ বলে ভুল করে। তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হলো কষ্টকে এড়িয়ে যাওয়া এবং সুখকে সর্বাধিক করা। নিৎশের কাছে এরাই ছিল মানবজাতির চূড়ান্ত অধঃপতন, এক করুণ দৃশ্য।
২. অ্যাকটিভ নিহিলিজম (Active Nihilism): এটা হলো শক্তিশালী, সাহসী মানুষের নিহিলিজম। এরাও বোঝে যে পুরোনো মূল্যবোধগুলো ভিত্তিহীন হয়ে পড়েছে, ঈশ্বর মৃত। কিন্তু তারা হতাশ হয়ে বসে থাকে না। তারা এই শূন্যতাকে একটি সুযোগ হিসেবে দেখে। তারা ভাবে, “বেশ! পুরোনো মন্দির যখন ভেঙেই পড়েছে, তখন এই ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করে ফেলার দায়িত্ব আমাদেরই।” এরা সেই অদৃশ্য হাতুড়ি হাতে তুলে নেয়। পুরোনো, জীর্ণ, জীবনবিরোধী মূল্যবোধগুলোকে সচেতনভাবে ধ্বংস করে নতুন মূল্যবোধ সৃষ্টির জন্য জায়গা তৈরি করে। এটা হলো ধ্বংসের মধ্য দিয়ে সৃষ্টির পথ।
নিৎশের কাছে নিহিলিজম কোনো শেষ কথা নয়, বরং এটি একটি ক্রান্তিকাল, একটি সেতু। এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ কী? কীভাবে এই শূন্যতা পূরণ করা সম্ভব?
এর উত্তর নিৎশে খুঁজেছেন তার সবচেয়ে বিতর্কিত এবং গভীর তত্ত্বগুলোর একটি—“ক্ষমতার ইচ্ছা” (Will to Power)-এর মধ্যে।
জীবনের মূল সুর: ক্ষমতার ইচ্ছা (The Will to Power)
“ক্ষমতার ইচ্ছা” বা জার্মান ভাষায় der Wille zur Macht—নিৎশের দর্শনের আরেকটি কেন্দ্রীয় স্তম্ভ, এবং এটিও প্রায়শই ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। শুনলেই মনে হয়, এটা বুঝি অন্যকে দমন করা, শোষণ করা, বা রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের কথা বলছে। হিটলার এবং নাৎসিরা ঠিক এভাবেই একে ব্যাখ্যা করে তাদের পাশবিক কর্মকাণ্ডকে দার্শনিক ভিত্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছিল।
কিন্তু নিৎশের “ক্ষমতার ইচ্ছা” তার চেয়ে অনেক গভীর, সূক্ষ্ম এবং মহৎ একটি ধারণা। এই ধারণাটি বুঝতে হলে তার পূর্বসূরি আরেক জার্মান দার্শনিক আর্থার শোপেনহাওয়ারের (Arthur Schopenhauer) সঙ্গে তার পার্থক্যটা বোঝা জরুরি। শোপেনহাওয়ার বলেছিলেন, জগতের মূলে আছে এক অন্ধ, অতৃপ্ত ‘বাঁচার ইচ্ছা’ (Will to Live)। এই ইচ্ছা নিরন্তর অতৃপ্তিতে ভোগে, তাই জীবন মানেই দুঃখ। এর থেকে মুক্তির পথ হলো এই ইচ্ছাকে দমন করা, নির্বাণ লাভ করা। তরুণ নিৎশে শোপেনহাওয়ার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন, কিন্তু পরে তিনি এই নৈরাশ্যবাদী দর্শনকে প্রত্যাখ্যান করেন।
তিনি বললেন, জীবনের মূল তাড়না শুধু বেঁচে থাকা নয়, কারণ শুধু বেঁচে থাকাটা একটা দুর্বল লক্ষ্য। জীবনের মূল তাড়না হলো ক্ষমতার ইচ্ছা—নিজের শক্তিকে প্রসারিত করা, বৃদ্ধি পাওয়া, বাধা অতিক্রম করা এবং নিজেকে আরও শক্তিশালী, আরও জটিল, আরও প্রভাবশালী হিসেবে প্রকাশ করা। এটাই হলো ক্ষমতার ইচ্ছা।
বিষয়টাকে এভাবে ভাবা যেতে পারে:
-
একটি ক্ষুদ্র বীজ যখন কঠিন মাটি ফুঁড়ে বিশাল এক বৃক্ষ হয়ে ওঠে, শেকড় দিয়ে মাটিকে আঁকড়ে ধরে আর ডালপালা মেলে আকাশকে ছুঁতে চায়—সেটা তার ক্ষমতার ইচ্ছা।
-
একজন শিল্পী যখন একটি কবিতা লেখেন বা ছবি আঁকেন, তিনি তার ভেতরের বিশৃঙ্খলা (chaos) এবং শক্তিকে একটি সুন্দর রূপে (form) প্রকাশ করেন—সেটাও ক্ষমতার ইচ্ছা।
-
একজন বিজ্ঞানী যখন প্রকৃতির কোনো রহস্য উন্মোচন করেন, তিনি জ্ঞানের মাধ্যমে জগতের ওপর নিজের প্রভাব বিস্তার করেন, জগৎকে নিজের ধারণার আয়ত্তে আনেন—সেটাও ক্ষমতার ইচ্ছা।
-
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, একজন মানুষ যখন নিজের আলস্য, ভয়, দুর্বলতাকে জয় করে, নিজের সীমাবদ্ধতাকে প্রতিনিয়ত ছাড়িয়ে যায়, নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলে—সেটাই ক্ষমতার ইচ্ছার সর্বোচ্চ প্রকাশ। একে নিৎশে বলেছেন আত্ম-অতিক্রম (Self-overcoming)।
সুতরাং, ক্ষমতার ইচ্ছা মানে নিছক অন্যের ওপর প্রভুত্ব নয়, বরং সর্বপ্রথম নিজের ওপর প্রভুত্ব অর্জন করা। এটি জীবনের মূল চালিকাশক্তি, যা সবকিছুকে এগিয়ে নিয়ে যায়। বিখ্যাত নিৎশে-বিশেষজ্ঞ ওয়াল্টার কফমান (Walter Kaufmann) তার ক্লাসিক বইয়ে যেমনটা লিখেছেন, এই ক্ষমতার ইচ্ছা হলো “primarily the will to overcome oneself, a striving for perfection” (Kaufmann, 1974, p. 258)। (“”প্রধানত নিজের সীমাকে অতিক্রম করার ইচ্ছা, পরিপূর্ণতার প্রতি এক প্রবল আকাঙ্ক্ষা।”)
এই ক্ষমতার ইচ্ছাই নিহিলিজমের শূন্যতা পূরণ করতে পারে। কীভাবে? পুরোনো মূল্যবোধ যখন ভেঙে পড়েছে, তখন শক্তিশালী মানুষ আকাশের দিকে তাকিয়ে কোনো ঐশ্বরিক নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করবে না। সে তার নিজের ক্ষমতার ইচ্ছাকে ব্যবহার করে, নিজের জীবনকে ভিত্তি করে, নিজের জন্য নতুন মূল্যবোধ তৈরি করবে। সে হবে একজন মূল্যবোধ-স্রষ্টা (value-creator)। সে আর অন্যের দেওয়া ভালো-মন্দের ছকে জীবন কাটাবে না, বরং এই পৃথিবীতেই, এই জীবনেই নিজের অর্থ নির্মাণ করবে।
কিন্তু আমাদের বর্তমান মূল্যবোধগুলোর সমস্যাটা ঠিক কোথায়? নিৎশে কেন সেগুলোকে এত জীর্ণ এবং জীবনবিরোধী বলে মনে করতেন? এর উত্তর পেতে হলে আমাদের যেতে হবে তার নৈতিকতার প্রত্নতত্ত্ব সন্ধানে, যা তিনি নাম দিয়েছেন “প্রভু-দাস নৈতিকতা” (Master-Slave Morality)।
ভালো-মন্দের ওপারে: প্রভু-দাস নৈতিকতা (Beyond Good and Evil: Master-Slave Morality)
আমরা সাধারণত মনে করি, ‘ভালো’ আর ‘মন্দ’—এই ধারণাগুলো চিরন্তন, সার্বজনীন এবং হয়তো ঈশ্বরপ্রদত্ত। কিন্তু নিৎশে তার বিয়ন্ড গুড অ্যান্ড ইভিল (Beyond Good and Evil) এবং অন দ্য জিনিওলজি অফ মরালিটি (On the Genealogy of Morality) বইতে এক দুঃসাহসিক প্রত্নতাত্ত্বিকের মতো আমাদের নৈতিকতার গভীরে খননকাজ চালান। তার প্রশ্ন ছিল: আমাদের এই ভালো-মন্দের ধারণাগুলো আসলে কোথা থেকে এলো? এসবের উৎস কী?
তিনি ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে দুই ধরনের নৈতিকতার সন্ধান পেয়েছেন:
১. প্রভু-নীতি (Master Morality): প্রাচীন যুগে, যারা শক্তিশালী, অভিজাত, স্বাস্থ্যবান, সম্পদশালী এবং সাহসী ছিল (যেমন—হোমারের মহাকাব্যের গ্রিক বীরেরা বা রোমান অভিজাতরা), তারা নিজেদের মূল্যবোধ নিজেরাই তৈরি করত। তারা চারদিকে তাকিয়ে নিজেদের এবং নিজেদের গুণাবলিকে—যেমন শক্তি, গর্ব, সাহস, আভিজাত্য, সৃষ্টিশীলতা—এগুলোকে ‘ভালো’ (good) বলত। তাদের ‘ভালো’র সংজ্ঞা ছিল আত্ম-অনুমোদন। অন্যদিকে যা কিছু দুর্বল, ভীরু, সাধারণ, নীচ এবং করুণার পাত্র, তাকে তারা বলত ‘খারাপ’ (bad)। এখানে কোনো পাপ-পুণ্যের ধারণা ছিল না। এটা ছিল জীবনকে হ্যাঁ বলার নৈতিকতা, নিজের শ্রেষ্ঠত্বকে উদযাপন করার নৈতিকতা।
২. দাস-নীতি (Slave Morality): অন্যদিকে ছিল সেইসব মানুষ, যারা ছিল দুর্বল, নিপীড়িত, দরিদ্র এবং অসহায়। প্রভুদের সঙ্গে তারা শক্তিতে পেরে উঠত না। কিন্তু তাদের ছিল এক অব্যক্ত ঘৃণা, এক চাপা ক্ষোভ। এই গভীর, বিষাক্ত ঘৃণা আর ক্ষোভ থেকে জন্ম নিল এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক প্রতিশোধ। নিৎশে এই অবস্থাকে বলেছেন রিসেন্টিমেন্ট (Ressentiment)। এটি শুধু সাধারণ রাগ বা ঘৃণা নয়; এটি অক্ষমের সেই বিষাক্ত ক্ষোভ, যা ভেতরে ভেতরে পেকে ওঠে এবং একসময় সৃজনশীল (তবে বিকৃত অর্থে) হয়ে ওঠে। এই রিসেন্টিমেন্ট থেকে তারা এক অবিশ্বাস্য কাণ্ড করল: তারা প্রভুদের মূল্যবোধকে পুরোপুরি উল্টে দিল। এটাকেই নিৎশে বলেন মূল্যবোধের পুনঃমূল্যায়ন (transvaluation of values)।
তারা বলল:
-
ঐ যে প্রভুরা, যারা শক্তিশালী, গর্বিত, নিষ্ঠুর—ওরা আসলে ‘শয়তান’ (evil)। ওদের অহংকার হলো পাপ।
-
আর আমরা, যারা দুর্বল, বিনয়ী, দরিদ্র, সহনশীল, যারা কষ্ট পাচ্ছি—তারাই আসলে ‘ভালো’ (good)। আমাদের বিনয়, দয়া, করুণা—এগুলোই হলো আসল পুণ্য।
অর্থাৎ, প্রভুদের ‘খারাপ’ (bad) হয়ে গেল দাসদের ‘ভালো’ (good), আর প্রভুদের ‘ভালো’ (good) হয়ে গেল দাসদের ‘শয়তান’ (evil)। প্রভুদের নৈতিকতা ছিল হ্যাঁ-বাচক (Yes-saying), যা নিজের ভেতর থেকে উৎসারিত। আর দাসদের নৈতিকতা হলো না-বাচক (No-saying); এটা বাইরের কোনো কিছুর প্রতি—অর্থাৎ প্রভুদের প্রতি—ঘৃণা থেকে জন্ম নিয়েছে।
নিৎশের মতে, ইহুদি এবং পরবর্তীতে খ্রিস্টধর্ম হলো এই দাস-নীতির চূড়ান্ত বিজয়। যিশুর “Blessed are the meek, for they shall inherit the earth” (যারা বিনম্র, তারা ধন্য, কারণ তারাই পৃথিবীর অধিকারী হবে)—এই বাণীকে নিৎশে দাস-নীতির সারসংক্ষেপ বলে মনে করতেন। এই নৈতিকতা দয়া, করুণা, বিনয়, সমবেদনাকে সর্বোচ্চ গুণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।
নিৎশের অভিযোগ হলো, এই নৈতিকতা প্রায় দুই হাজার বছর ধরে পশ্চিমা সভ্যতাকে শাসন করে আসছে এবং এর ফল হয়েছে মারাত্মক। এটি মানুষকে দুর্বল, ভীরু এবং একটি পালের পশুর মতো (herd animal) করে তুলেছে। এটি জীবনকে অস্বীকার করে, কারণ এটি এই মাটির পৃথিবীর জীবনকে মূল্যহীন করে পরকালের অলীক সুখের ওপর গুরুত্ব দেয়। এটি শক্তিশালী, ব্যতিক্রমী এবং সৃষ্টিশীল মানুষকে সন্দেহের চোখে দেখে, কারণ তারা পালের নিয়ম মানে না, তারা ভয়ঙ্কর।
নিৎশে ‘ভালো’ আর ‘শয়তানি’র (good and evil) এই দাস-সৃষ্ট বিভাজনকে অতিক্রম করে আবার ‘ভালো’ আর ‘খারাপ’ (good and bad) এর প্রভু-দাস বিভাজনে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন—তবে কোনো প্রাচীন অভিজাততন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য নয়, বরং এমন এক ভবিষ্যতের জন্য, যেখানে ব্যক্তিমানুষ নিজেই নিজের জীবনের মূল্য নির্ধারণ করবে।
এই প্রেক্ষাপটেই আসে তার সবচেয়ে বিখ্যাত, সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং সবচেয়ে ভুল বোঝা ধারণা: উবারমেনশ (Übermensch)।
সেতুবন্ধন: উবারমেনশ এবং আত্মার তিন রূপান্তর (The Bridge to Übermensch and The Three Metamorphoses)
“ঈশ্বর মৃত”—এই ঘোষণার পর যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, যে নিহিলিজমের সংকট এসেছে, তার উত্তর কী? “শেষ মানব” হয়ে জীবন কাটানো তো কোনো সমাধান হতে পারে না। নিৎশে তার কাল্পনিক নবী জরাথুস্ট্রের মুখ দিয়ে সেই উত্তর দিয়েছেন। উত্তরটি হলো—উবারমেনশ (Übermensch)।
শব্দটির আক্ষরিক অনুবাদ করা কঠিন। ইংরেজিতে একে কখনো বলা হয় ‘Overman’, কখনো ‘Superman’। তবে কমিকসের লাল-নীল পোশাক পরা সুপারম্যানের সঙ্গে এর বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। নাৎসিদের ‘শ্রেষ্ঠ আর্য জাতি’র ধারণার সঙ্গেও এর কোনো সম্পর্ক নেই, যদিও তারা এই শব্দটিকে অপহরণ করে নিজেদের বর্ণবাদী আদর্শের প্রচারণায় ব্যবহার করেছিল।
উবারমেনশ কোনো নির্দিষ্ট জাতি বা গোষ্ঠীর মানুষ নয়। এটি একটি আদর্শ, একটি লক্ষ্য, একটি সম্ভাবনা, যা প্রত্যেক মানুষ নিজের জন্য নির্ধারণ করতে পারে।
তাহলে কে এই উবারমেনশ?
-
উবারমেনশ হলো সেই মানুষ, যে ঈশ্বরের মৃত্যুর পরের শূন্যতাকে ভয় পায় না, বরং তাকে একটি খোলা ময়দান হিসেবে দেখে—যেখানে নতুন কিছু গড়ার স্বাধীনতা আছে।
-
সে প্রচলিত ‘পালের নৈতিকতা’ (herd morality) বা দাস-নীতিকে প্রত্যাখ্যান করে। সে ‘ভালো’ এবং ‘শয়তানি’র আরোপিত বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে নিজের মূল্যবোধ নিজেই সৃষ্টি করে।
-
তার চালিকাশক্তি হলো ক্ষমতার ইচ্ছা (Will to Power)—তবে তা অন্যের ওপর প্রভুত্ব করার জন্য নয়, বরং নিজেকে অতিক্রম করার জন্য (self-overcoming)।
-
সে পরকালে বিশ্বাস করে না। সে এই পৃথিবীকে, এই জীবনকে তার সমস্ত যন্ত্রণা ও সৌন্দর্যসহ ভালোবাসে। জরাথুস্ট্রের ভাষায়, “আমি তোমাদের মিনতি করছি, ভাইয়েরা আমার, পৃথিবীর প্রতি বিশ্বস্ত থেকো… উবারমেনশ হলো পৃথিবীর অর্থ।”
-
সে জীবনের কষ্ট, যন্ত্রণা, সংগ্রামকে ভয় পায় না। বরং সেগুলোকে আলিঙ্গন করে, কারণ সে জানে এগুলোই তাকে আরও শক্তিশালী, আরও গভীর করে তোলে। সে বিপদকে ভালোবাসে।
কিন্তু সাধারণ মানুষ থেকে উবারমেনশ হয়ে ওঠার পথটা কী? জরাথুস্ট্র বইয়ের অন্যতম সুন্দর একটি রূপকের মাধ্যমে নিৎশে এই পথের বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি একে বলেছেন আত্মার তিন রূপান্তর (The Three Metamorphoses of the Spirit)।
১. উট (The Camel): প্রথমে আত্মা হয় উটের মতো। উট হলো ধৈর্যশীল, বিনয়ী এবং ভারবাহী পশু। সে মরুভূমিতে হাঁটু গেড়ে বসে আর বলে, “আমার উপর সবচেয়ে ভারী বোঝাটা চাপিয়ে দাও।” এই বোঝা হলো পুরোনো নৈতিকতা, সামাজিক প্রথা, “তোমার এটা করা উচিত” (Thou Shalt)-এর নির্দেশ। উট কর্তব্যনিষ্ঠ হয়ে এই বোঝাগুলো বহন করে চলে। আজকের দিনে এই উট হলো সেই ছাত্র, যে প্রশ্ন না করে শুধু সিলেবাস মুখস্থ করে; সেই কর্মচারী, যে অপছন্দ সত্ত্বেও বসের সব নির্দেশ মেনে চলে; সেই নাগরিক, যে সমাজের সব নিয়মকে অন্ধভাবে অনুসরণ করে।
২. সিংহ (The Lion): মরুভূমির গভীরে গিয়ে উট সিংহে রূপান্তরিত হয়। সিংহ হলো বিদ্রোহী, স্বাধীন এবং ধ্বংসকারী। সে আর অন্যের দেওয়া বোঝা বহন করতে চায় না। তার সামনে এসে দাঁড়ায় এক বিশাল সোনালি ড্রাগন, যার প্রতিটি আঁশে লেখা আছে “Thou Shalt” (তোমার করা উচিত)। সিংহ সেই ড্রাগনের মুখোমুখি হয়ে গর্জন করে ওঠে, “I Will!” (আমি করব!)। সে পুরোনো মূল্যবোধের ড্রাগনকে হত্যা করে স্বাধীনতা অর্জন করে। সিংহ পুরোনো সব মূর্তি ভেঙে ফেলে, কিন্তু সে নিজে নতুন কোনো মূর্তি গড়তে পারে না। সে শুধু ধ্বংস করতে পারে, মুক্ত করতে পারে। এটি হলো কৈশোরের বিদ্রোহ, যা প্রতিষ্ঠিত সবকিছুকে প্রশ্ন করে।
৩. শিশু (The Child): পুরোনো সব ধ্বংসস্তূপের মধ্যে সিংহ অবশেষে শিশুতে রূপান্তরিত হয়। শিশু হলো পবিত্রতা, বিস্ময় এবং এক নতুন সূচনা। শিশু হলো এক ‘পবিত্র হ্যাঁ’ (a sacred “Yes”)। সে পুরোনো কিছু মনে রাখে না, তার কোনো ক্ষোভ বা রিসেন্টিমেন্ট নেই। সে এক নতুন খেলার চাকা, যা নিজে থেকেই ঘোরে। শিশু হলো নতুন মূল্যবোধের স্রষ্টা। সে খেলাচ্ছলে, আনন্দের সঙ্গে নতুন জগৎ তৈরি করে।
এই শিশুটিই হলো উবারমেনশের প্রতীক। উবারমেনশ হয়ে ওঠা মানে হলো উটের মতো দায়িত্ববোধ, সিংহের মতো বিদ্রোহ এবং সবশেষে শিশুর মতো সৃষ্টিশীল সারল্য অর্জন করা।
নিৎশে জরাথুস্ট্র বইয়ের শুরুতে একটি বিখ্যাত রূপক ব্যবহার করেছেন: “মানুষ হলো পশু এবং উবারমেনশের মাঝখানে বাঁধা একটি দড়ি—একটি অতল গহ্বরের ওপর বাঁধা দড়ি। পার হওয়াটাও বিপজ্জনক, মাঝপথে থাকাও বিপজ্জনক, পেছনে তাকানোও বিপজ্জনক… মানুষের মহত্ত্ব এখানেই যে সে একটি সেতু, কোনো লক্ষ্য নয়।” (Nietzsche, 1883-1885/2006, Zarathustra’s Prologue, 4)
এই উবারমেনশের জন্য নিৎশে চূড়ান্ত একটি পরীক্ষা রেখেছেন। এটি এমন এক পরীক্ষা, যা শুনলেই দুর্বল চিত্তের মানুষ ভয়ে কুঁকড়ে যাবে। সেই পরীক্ষার নাম “অনন্তের ফেরা” (Eternal Recurrence)।
সময়ের চক্র এবং অনন্তের ফেরা (The Wheel of Time and Eternal Recurrence)
এক রাতে, আপনার গভীরতম একাকীত্বের মুহূর্তে, কোনো এক দৈত্য যদি আপনার কাছে এসে ফিসফিস করে বলে:
“এই জীবন, যা তুমি এখন যাপন করছ এবং করেছ, তা তোমাকে আরও একবার এবং অগণিতবার যাপন করতে হবে; এবং এর মধ্যে নতুন কিছুই থাকবে না, বরং প্রতিটি যন্ত্রণা এবং প্রতিটি আনন্দ, প্রতিটি চিন্তা এবং প্রতিটি দীর্ঘশ্বাস… তোমার জীবনে যা কিছু ঘটেছে, ছোট বা বড়, সবকিছু একই ক্রমে, একই অনুক্রমে ফিরে আসবে—এই মাকড়সাটিও, গাছের ফাঁকে এই চাঁদের আলোটিও, এবং এই মুহূর্তটিও, আর আমি নিজেও। অস্তিত্বের অনন্ত বালুঘড়িটি বারবার উল্টে দেওয়া হবে—আর তুমি, ধূলিকণার এক কণা, তার সঙ্গে!” (Nietzsche, 1882/2001, section 341)
—এই কথা শোনার পর আপনার প্রতিক্রিয়া কী হবে?
আপনি কি ভয়ে, হতাশায় মাটিতে লুটিয়ে পড়বেন? ভাববেন, “হে ঈশ্বর, এ কী ভয়াবহ অভিশাপ! এই অর্থহীন, যন্ত্রণাময় জীবনের অনন্ত পুনরাবৃত্তি!”? নাকি আপনি দাঁত কিড়মিড় করে বলবেন, “তুমি এক দেবতা, আর আমি এর চেয়ে ঐশ্বরিক কিছু কখনো শুনিনি!”?
এটাই হলো অনন্তের ফেরা বা এটারনাল রিকারেন্সের-এর চিন্তা-পরীক্ষা (thought experiment)। নিৎশে সম্ভবত এটা বিশ্বাস করতেন না যে এটা আক্ষরিক অর্থে মহাবিশ্বের একটি নিয়ম। বরং তিনি একে একটি মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা হিসেবে ব্যবহার করেছেন। প্রশ্নটি হলো: আপনি কি আপনার জীবনকে এমনভাবে যাপন করতে পারবেন যে, আপনি মন থেকে চাইবেন এর প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি খুঁটিনাটিসহ, অনন্তকাল ধরে ফিরে আসুক?
এই ধারণাটি হলো জীবনকে চূড়ান্তভাবে হ্যাঁ বলার একটি উপায়। এটি আপনাকে প্রতিটি মুহূর্তের গুরুত্ব বুঝিয়ে দেয়। আপনি যদি জানেন যে আপনার প্রতিটি কাজ, প্রতিটি সিদ্ধান্ত অনন্তকাল ধরে পুনরাবৃত্ত হবে, তাহলে কি আপনি আলস্যে সময় নষ্ট করবেন? নাকি প্রতিটি মুহূর্তকে অর্থপূর্ণ করে তোলার চেষ্টা করবেন?
শেষ মানব (The Last Man) এই ধারণা শুনলে আঁতকে উঠবে। কারণ তার জীবনটা একঘেয়ে, অর্থহীন আর ভীরুতায় ভরা। একই জীবনের পুনরাবৃত্তি তার কাছে নরকের মতো মনে হবে।
কিন্তু উবারমেনশ (Übermensch) এই ধারণাকে সানন্দে গ্রহণ করবে। কারণ সে তার জীবনকে এতটাই ভালোবাসা, গৌরব আর সৃষ্টিশীলতা দিয়ে পূর্ণ করবে যে, সে চাইবে এই জীবনই যেন বারবার ফিরে আসে। সে তার জীবনের কোনো অংশকেই বাদ দিতে চাইবে না, কারণ তার ভুলগুলো, তার যন্ত্রণাগুলোও তাকে সে যা, তা হতে সাহায্য করেছে।
এই ধারণার সঙ্গেই জড়িয়ে আছে নিৎশের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা—আমোর ফাতি (Amor Fati) বা “নিয়তির প্রতি ভালোবাসা” (love of fate)। এর মানে হলো, জীবনের ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ, সাফল্য-ব্যর্থতা—যা কিছুই ঘটুক না কেন, তাকে শুধু সহ্য করা নয়, তাকে ভালোবাসা। চাওয়া যে, ঠিক যা ঘটেছে, তা-ই যেন ঘটে, ভিন্ন কিছু নয়। কারণ সবকিছু মিলিয়েই আপনার জীবনটা অনন্য এবং আপনার হয়ে ওঠার পথের অংশ।
যেমনটি নিৎশে তার আত্মজীবনী Ecce Homo-তে লিখেছেন, “My formula for greatness in a human being is amor fati: that one wants nothing to be different, not forward, not backward, not in all eternity. Not merely bear what is necessary… but love it.” (Nietzsche, 1888/2007, “Why I Am So Clever,” 10)।
(“মানুষের মহত্ত্বের জন্য আমার সূত্র হল আমোর ফাতি—নিজ ভাগ্যের প্রেম: এমন এক চাওয়া, যাতে কেউ চায় না কিছু বদলাক—না ভবিষ্যৎ, না অতীত, না চিরন্তন কালের কোনো রেখা। শুধু যা অনিবার্য, তাকে সহ্য করাই নয়… তাকে ভালোবাসাই প্রকৃত শক্তি।”)
শূন্যতার উৎস: ইচ্ছার অতল গহ্বর নাকি ঈশ্বরের শূন্য সিংহাসন?
নিৎশে এবং তার ‘শিক্ষক’ শোপেনহাওয়ার দুজনেই এক গভীর, অন্ধকার সত্যের মুখোমুখি হয়েছিলেন, যার নাম নিহিলিজম বা শূন্যবাদ। দুজনেই বুঝেছিলেন যে, জীবনের পৃষ্ঠতলের নিচে এক অর্থহীনতার অতল গহ্বর লুকিয়ে আছে। কিন্তু সেই গহ্বরের উৎস কী এবং তার সঙ্গে ‘ইচ্ছা’র (Will) সম্পর্কটা ঠিক কেমন—এই প্রশ্নে এসেই গুরু ও শিষ্যের পথ দুই দিকে বেঁকে গেল। তারা দুজনেই শূন্যতার গান গেয়েছিলেন, কিন্তু তাদের সুর এবং লয় ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।
শোপেনহাওয়ারের শূন্যতা: ইচ্ছার অন্তহীন অতৃপ্তি
আর্থার শোপেনহাওয়ারের জন্য, নিহিলিজমের উৎস জগতের বাইরে কোথাও নেই, এটি জগতের মজ্জার মধ্যেই নিহিত। তার মতে, জগতের মূলে কাজ করছে এক অন্ধ, অযৌক্তিক, অতৃপ্ত জীবন-ইচ্ছা (Will to Live)। এই ইচ্ছাই মহাবিশ্বের সবকিছুকে চালাচ্ছে—গ্রহ-নক্ষত্র থেকে শুরু করে ক্ষুদ্রতম অণুজীব পর্যন্ত।
এই জীবন-ইচ্ছা নিজে কোনোদিন তৃপ্ত হয় না। এর স্বভাবই হলো চাওয়া, পাওয়া, এবং পাওয়ার পর আবার নতুন কিছু চাওয়া। এটি একটি অন্তহীন ক্ষুধা। আর আমরা, মানুষ, এই জীবন-ইচ্ছারই সবচেয়ে করুণ প্রকাশ। আমাদের জীবন হলো পেন্ডুলামের মতো—একদিকে অতৃপ্তির কষ্ট, অন্যদিকে পাওয়ার পর একঘেয়েমির যন্ত্রণা। এই অন্তহীন চাওয়ার চক্র থেকে কোনো মুক্তি নেই, তাই জীবন মানেই দুঃখ।
সুতরাং, শোপেনহাওয়ারের জন্য নিহিলিজম বা জীবনের অর্থহীনতা হলো এক অধিবিদ্যক (metaphysical) বাস্তবতা। এটি কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, এটিই জীবনের ডিফল্ট সেটিং। তার শূন্যতাবাদের কারণ হলো সেই জীবন-ইচ্ছা নিজেই, যা আমাদের জীবনের মূলে বসে সবকিছুকে অর্থহীন করে তুলেছে। এর থেকে মুক্তির উপায় কী? ইচ্ছাকে দমন করা, বৈরাগ্য অবলম্বন করা, জীবনকে ‘না’ বলা।
নিৎশের শূন্যতা: ঈশ্বরের মৃত্যুর ঐতিহাসিক সংকট
এবার নিৎশের দিকে তাকানো যাক। নিৎশে তার গুরুর এই রোগ নির্ণয়ের সঙ্গে একমত হলেন না। তিনি বললেন, জীবনের মূলে কোনো অন্তর্নিহিত অর্থহীনতা নেই। জীবন নিজে ভালোও নয়, মন্দও নয়—এটি নিষ্পাপ (innocent)। তাহলে নিহিলিজম এলো কোথা থেকে?
নিৎশের জন্য, নিহিলিজম কোনো অধিবিদ্যক বাস্তবতা নয়, এটি একটি ঐতিহাসিক (historical) এবং সাংস্কৃতিক (cultural) সংকট। এর কারণ “ঈশ্বরের মৃত্যু” (The Death of God)। শত শত বছর ধরে পশ্চিমা সভ্যতা তার জীবনের অর্থ, নৈতিকতা আর মূল্যবোধ খুঁজে পেয়েছিল খ্রিস্টীয় ঈশ্বরের ধারণার মধ্যে। ঈশ্বর ছিলেন সেই মহাজাগতিক ভিত্তি, যা সবকিছুকে ধরে রেখেছিল।
কিন্তু আলোকায়ন, বিজ্ঞান এবং যুক্তির উত্থানের ফলে সেই ভিত্তিটাই ভেঙে পড়েছে। মানুষ নিজেই ঈশ্বরকে ‘হত্যা’ করেছে। এর ফলে এক বিশাল শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এখন জীবনের কোনো অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য নেই, ভালো-মন্দের কোনো পরম মাপকাঠি নেই। এই অবস্থাই হলো নিহিলিজম।
সুতরাং, শোপেনহাওয়ার যেখানে বলছিলেন ‘ইচ্ছা’ই নিহিলিজমের কারণ, নিৎশে সেখানে বলছেন, নিহিলিজমের কারণ হলো এমন একটি বিশ্বদৃষ্টি (worldview) বা মূল্যবোধের ব্যবস্থা (value-system), যা একটি কাল্পনিক পরকালের জন্য এই রক্ত-মাংসের জীবনকে মূল্যহীন করে তুলেছিল, এবং সেই ব্যবস্থাটিই এখন ভেঙে পড়েছে।
ক্ষমতার ইচ্ছা: কারণ নাকি সমাধান?
তাহলে নিৎশের এই ‘ঈশ্বরের মৃত্যু’জনিত নিহিলিজমের সঙ্গে তার ‘ক্ষমতার ইচ্ছা’ (Will to Power)-এর সম্পর্ক কী? এখানেই নিৎশে তার গুরুর থেকে সবচেয়ে বড় এবং চূড়ান্ত বিচ্ছেদটি ঘটান। শোপেনহাওয়ারের কাছে ‘ইচ্ছা’ (Will to Live) ছিল সমস্যার মূল (the cause of the problem)। এটিই নিহিলিজম এবং দুঃখের উৎস। কিন্তু নিৎশের কাছে ‘ইচ্ছা’ (Will to Power) হলো সমস্যার সমাধান (the solution to the problem)। নিৎশে শোপেনহাওয়ারের ‘জীবন-ইচ্ছা’র ধারণাটিকে নিলেন, কিন্তু তাকে সম্পূর্ণ নতুন রূপ দিলেন। তিনি বললেন, জীবনের মূল চালিকাশক্তি শুধু বেঁচে থাকা নয়, বরং শক্তি বৃদ্ধি করা, নিজেকে প্রসারিত করা। এই ‘ক্ষমতার ইচ্ছা’ নিজে নিহিলিজমের কারণ নয়। বরং নিহিলিজমকে অতিক্রম করার একমাত্র উপায়ই হলো এই ক্ষমতার ইচ্ছাকে ব্যবহার করা।
বিষয়টা এভাবে ভাবা যেতে পারে: ধরুন, একটি শক্তিশালী নদী বয়ে চলেছে। শোপেনহাওয়ার বলবেন, “এই নদীর স্রোতই সব ধ্বংসের কারণ। এর গতি থামিয়ে দাও, একটি বাঁধ তৈরি করো, তবেই শান্তি।” নিৎশে বলবেন, “নদীর স্রোত কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা হলো পুরনো, জীর্ণ সেতুটা, যা ভেঙে পড়েছে। এখন এই নদীর শক্তিকেই ব্যবহার করে একটি নতুন, আরও শক্তিশালী টারবাইন বসাও এবং নতুন আলো তৈরি করো।”
এই ‘নতুন আলো’ই হলো নতুন মূল্যবোধ। যখন ঈশ্বরের মৃত্যুর কারণে পুরনো সব মূল্যবোধ ভেঙে পড়েছে, তখন শক্তিশালী মানুষ বা উবারমেনশ হতাশ হয়ে বসে থাকবে না। সে তার নিজের ভেতরের ‘ক্ষমতার ইচ্ছা’কে ব্যবহার করে, এই অর্থহীন পৃথিবীতেই, নিজের জীবনের ওপর ভিত্তি করে নতুন মূল্যবোধ সৃষ্টি করবে। সে শূন্যতাকে ভয় পাবে না, বরং তাকে একটি খোলা ময়দান হিসেবে দেখবে, যেখানে নতুন কিছু গড়ার স্বাধীনতা আছে।
সুতরাং, নিৎশে এখানে শোপেনহাওয়ারের পথ থেকে শুধু ভিন্ন পথে হাঁটছেন না, তিনি তার ঠিক বিপরীত দিকে হাঁটছেন। তিনি ‘ইচ্ছা’কে নিহিলিজমের কারণের তালিকা থেকে পুরোপুরি বাতিল করে দিয়েছেন। তার কাছে নিহিলিজমের কারণ হলো একটি দুর্বল, জীবনবিরোধী মূল্যবোধের পতন। আর সেই শূন্যতা পূরণের একমাত্র উপায় হলো জীবনের মূল চালিকাশক্তি—ক্ষমতার ইচ্ছা—কে আলিঙ্গন করা এবং তার মাধ্যমে নতুন, জীবনবাদী মূল্যবোধ সৃষ্টি করা।
যেমনটি জার্মেন দার্শনিক রুডিগার সাফরানস্কি তার জীবনীতে লিখেছেন, নিৎশে শোপেনহাওয়ারের হতাশাবাদকে একটি রোগের লক্ষণ হিসেবে দেখেছিলেন এবং সেই রোগ নিরাময়ের জন্য তিনি এমন এক দর্শন তৈরি করতে চেয়েছিলেন, যা জীবনকে তার সমস্ত শক্তি ও সম্ভাবনা-সহ স্বীকৃতি দেবে (Safranski, 2002)। এইভাবেই, শিষ্য তার গুরুকে অতিক্রম করে গেলেন, নিহিলিজমের কারণকে তার সমাধানে রূপান্তরিত করে।
নৈতিকতা ও মূল্যবোধ: কান্টের রাজপথ থেকে নিৎশের বিদ্রোহ
বিষয়টা অনেকটা এরকম। ভাবুন, এক মহান স্থপতির কথা, যিনি প্রথম বললেন, “উপাসনালয় বানানোর জন্য আকাশ থেকে কোনো নকশা আসার দরকার নেই। মানুষ নিজেই তার যুক্তির নকশা দিয়ে উপাসনালয় গড়তে পারে।” এই স্থপতির নাম ইমানুয়েল কান্ট। তার আগে নৈতিকতার নকশা আসত হয় ঈশ্বরের কাছ থেকে, নয়তো প্রকৃতির কাছ থেকে। কান্ট এসে এক বৈপ্লবিক কথা বললেন—নৈতিকতার উৎস মানুষের ভেতরে, তার বিশুদ্ধ যুক্তিতে (pure reason)।
এই বিপ্লবের কেন্দ্রে ছিল তার বিখ্যাত ‘ক্যাটাগরিক্যাল ইম্পারেটিভ’ (Categorical Imperative) বা শর্তহীন অনুজ্ঞা। এর তিনটি মূল কথা ছিল:
- ১. এমনভাবে কাজ করো, যেন তোমার কাজের নীতিটি একটি সার্বজনীন আইন (universal law) হয়ে উঠতে পারে।
- ২. মানুষকে (নিজেকে এবং অন্যকে) কখনো নিছক উপায় বা উপকরণ (means) হিসেবে ব্যবহার করো না, তাকে সবসময় উদ্দেশ্য (end) হিসেবে সম্মান করো।
- ৩. এমনভাবে কাজ করো যেন তুমি তোমার নীতির মাধ্যমে একটি সম্ভাব্য উদ্দেশ্যের রাজ্যের (Kingdom of Ends) একজন আইনপ্রণেতা সদস্য।
কিন্তু কান্টের সবচেয়ে বড় অবদান ছিল ‘অটোনমি’ (Autonomy) বা স্বায়ত্তশাসনের ধারণা। তিনি বললেন, একজন নৈতিক মানুষ সে, যে অন্যের দেওয়া আইন বা নিজের প্রবৃত্তির দাস নয়, বরং সে তার নিজের যুক্তির মাধ্যমে নিজেই নিজের জন্য আইন তৈরি করে (gives the law to oneself) এবং তা মেনে চলে। এই প্রথম মানুষ নৈতিকতার জগতে নিছক প্রজা থেকে এক আইন-প্রণেতার আসনে বসল।
এবার মঞ্চে প্রবেশ করলেন ফ্রিডরিখ নিৎশে। তিনি ছিলেন সেই মহান স্থপতির সবচেয়ে প্রখর, কিন্তু সবচেয়ে বিদ্রোহী ছাত্র। তিনি কান্টের এই অটোনমির ধারণাটি দেখলেন এবং মুগ্ধ হলেন। তিনি বুঝলেন, কান্ট মানুষকে ঈশ্বরের দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে এক বিরাট পদক্ষেপ নিয়েছেন। কান্টই প্রথম মানুষকে তার নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সাহস যুগিয়েছেন।
কিন্তু মুগ্ধতার ঘোর কাটতেই নিৎশে প্রশ্ন তুলতে শুরু করলেন। তিনি কান্টের বানানো সেই যুক্তির উপাসনালয়ের নকশার দিকে তাকালেন এবং এর ভেতরের সমস্যাগুলো দেখতে পেলেন। এখানেই কান্টের প্রভাব এবং তার থেকে নিৎশের যাত্রার আসল গল্পটা শুরু হয়।
নিৎশে কান্টের ‘অটোনমি’র ধারণাটি নিলেন, কিন্তু সেটিকে এক আমূল নতুন খাতে বইয়ে দিলেন। তিনি বললেন, “বেশ, আমরা নিজেরাই যদি নিজেদের আইন-প্রণেতা হই, তাহলে প্রশ্ন হলো—কেন আমাদের সবার আইন একই রকম হতে হবে?”
১. সার্বজনীন যুক্তি বনাম ব্যক্তিগত ইচ্ছা (Universal Reason vs. Personal Will): কান্টের আইন-প্রণেতা ছিল এক বিমূর্ত, সার্বজনীন সত্তা। তার আইন আসত বিশুদ্ধ, আবেগবর্জিত যুক্তি থেকে, যা সব মানুষের জন্য সমান। নিৎশের কাছে এই ধারণাটি ছিল প্রাণহীন এবং জীবনবিরোধী। তিনি বললেন, আইন যুক্তির হিমশীতল চূড়া থেকে আসে না, আইন আসে জীবনের উত্তাপ থেকে, আমাদের শরীর থেকে, আমাদের প্রবৃত্তি থেকে, আমাদের ক্ষমতার ইচ্ছা (Will to Power) থেকে। কান্টের নৈতিকতা ছিল সবার জন্য এক মাপের শার্ট বানানোর মতো। নিৎশে বললেন, প্রত্যেক মহান ব্যক্তির জন্য তার নিজস্ব, স্বতন্ত্র মাপের শার্ট দরকার।
২. সার্বজনীন আইন বনাম অনন্য মূল্যবোধ (Universal Law vs. Unique Values): কান্টের ক্যাটাগরিক্যাল ইম্পারেটিভের মূল ভিত্তি ছিল সার্বজনীনতা। একটি কাজ নৈতিক কি না, তা বোঝার উপায় হলো—সবাই যদি এই কাজটি করত, তাহলে জগৎটা কেমন হতো? নিৎশে এই প্রশ্নটিকে উড়িয়ে দিলেন। তার উবারমেনশ (Übermensch) বা মূল্যবোধ-স্রষ্টা (value-creator) কখনোই এই প্রশ্ন করে না। সে প্রশ্ন করে, “এই কাজটি কি আমার জীবনকে স্বীকৃতি দেয়? এটি কি আমাকে আরও শক্তিশালী হতে, নিজেকে অতিক্রম করতে সাহায্য করে?” তার তৈরি করা মূল্যবোধ সার্বজনীন হওয়ার জন্য নয়, বরং তার নিজের অনন্য জীবনকে মহিমান্বিত করার জন্য। যা একজন উবারমেনশের জন্য মহৎ, তা হয়তো সাধারণ মানুষের জন্য ধ্বংসাত্মক হতে পারে। যেমনটি জারথুস্ত্রা বলেন, “My brothers, I consecrate you and I direct you to a new nobility: you shall become creators and cultivators and sowers of the future.” (Nietzsche, Thus Spoke Zarathustra, Part III)। এখানে তিনি কোনো সার্বজনীন আইনের কথা বলছেন না, বলছেন এক নতুন, অভিজাত মূল্যবোধ সৃষ্টির কথা।
৩. কর্তব্য বনাম সৃষ্টি (Duty vs. Creation): কান্টের নৈতিকতার চালিকাশক্তি ছিল কর্তব্য (duty / Pflicht)-এর ধারণা। যুক্তির আইনকে কর্তব্যের খাতিরে মেনে চলার মধ্যেই ছিল নৈতিক মহত্ত্ব। নিৎশের কাছে এই ‘কর্তব্য’ শব্দটিই ছিল দাসত্বের লক্ষণ। এটি ছিল তার আত্মার তিন রূপান্তরের (Three Metamorphoses) প্রথম ধাপ—উট (The Camel)-এর বৈশিষ্ট্য, যে নীরবে “তোমার এটা করা উচিত” (Thou Shalt)-এর বোঝা বহন করে। নিৎশের মূল্যবোধ-স্রষ্টা কর্তব্যের ভারে ন্যুব্জ হয়ে কাজ করে না; সে কাজ করে তার ভেতরের শক্তির প্রাচুর্য থেকে, আনন্দের সঙ্গে, শিশুর মতো খেলাচ্ছলে। তার কাজ কোনো বাধ্যবাধকতা নয়, বরং এক সৃষ্টিশীল প্রকাশ।
সুতরাং, নিৎশে কান্টের কাছ থেকে এই ধারণাটি নিয়েছিলেন যে, মানুষই ভেল্যু বা মূল্যবোধের উৎস। কিন্তু কান্ট যেখানে মানুষকে এক সার্বজনীন, যৌক্তিক আইনসভার সদস্য বানাতে চেয়েছিলেন, নিৎশে সেখানে প্রত্যেক শক্তিশালী ব্যক্তিকে তার নিজস্ব আত্মার একচ্ছত্র স্বৈরশাসক বানাতে চেয়েছেন। কান্ট মানুষকে ঈশ্বরের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে যুক্তির শৃঙ্খলে বাঁধতে চেয়েছিলেন। নিৎশে এসে সেই যুক্তির শৃঙ্খলটিকেও ভেঙে ফেলতে চাইলেন।
ওয়াল্টার কফম্যান যেমনটা বলেছেন, নিৎশে কান্টের এই ধারণার প্রতি ঋণী যে, নৈতিকতা মানুষের সৃষ্টি, কিন্তু তিনি কান্টের এই বিশ্বাসকে প্রত্যাখ্যান করেছেন যে, কোনো একটি মাত্র নৈতিকতাই সব মানুষের জন্য প্রযোজ্য (Kaufmann, 1974)।
শেষ পর্যন্ত, নিৎশে কান্টের দেখানো রাজপথ ধরে কিছুক্ষণ হেঁটেছিলেন, কিন্তু তারপর তিনি সেই মসৃণ পথ ছেড়ে নিজের জন্য এক এবড়োখেবড়ো, বিপজ্জনক কিন্তু জীবন্ত পথ কেটে নিয়েছিলেন পাহাড়ের গা বেয়ে। কান্ট মানুষকে শিখিয়েছিলেন কীভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হয়; নিৎশে এসে শেখালেন কীভাবে সেই পায়ে ভর করে নৃত্য করতে হয়—এমনকি অতল গহ্বরের কিনারায় দাঁড়িয়েও।
দার্শনিকের কলম যখন শিল্পীর তুলি: নিৎশের লেখনী
নিৎশেকে শুধু তার তত্ত্ব দিয়ে বিচার করলে চলবে না। তার লেখার ধরণটিও তার দর্শনেরই একটি অংশ। তিনি শুকনো, অ্যাকাডেমিক ভাষায় দর্শন লেখেননি। তার লেখার ধরণ বৈচিত্র্যময়—কখনো তিনি লিখছেন শাণিত, সংক্ষিপ্ত অ্যাফোরিজম বা সূত্রের আকারে, কখনো রূপক গল্প বা প্যারাবল, আবার কখনো প্রায় কবিতার মতো আবেগময় ভাষায়। দাস স্পোক জারাথুস্ত্রা তো প্রায় একটি মহাকাব্যের মতো।
কেন তিনি এভাবে লিখতেন? কারণ নিৎশে শুধু পাঠকের মস্তিষ্ককে নাড়া দিতে চাননি, তিনি তার আত্মাকেও নাড়া দিতে চেয়েছিলেন। তিনি জানতেন যে, জীবনের গভীরতম সত্যগুলো শুধু যুক্তির মাধ্যমে বোঝা যায় না, সেগুলো অনুভব করতে হয়। তার লেখা আপনাকে আরাম করে বসে জ্ঞানার্জন করতে দেবে না; এটি আপনাকে অস্বস্তিতে ফেলবে, উত্তেজিত করবে, ভাবাবে এবং হয়তো আপনাকে বদলে দেবে। তার দর্শন শুধু পড়ার বিষয় নয়, যাপন করার বিষয়।
শিল্পের দুই মুখ: অ্যাপোলোনিয়ান এবং ডায়োনিসিয়ান (The Two Faces of Art: Apollonian and Dionysian)
উবারমেনশ বা অনন্তের ফেরার মতো ধারণাগুলোতে পৌঁছানোর অনেক আগেই, তার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বই দ্য বার্থ অফ ট্র্যাজেডি (The Birth of Tragedy)-তে নিৎশে শিল্প ও সংস্কৃতির মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি অনুসন্ধান করেছিলেন। এখানে তিনি প্রাচীন গ্রিকদের শিল্পচর্চার গভীরে দুটি বিপরীতমুখী কিন্তু পরিপূরক শক্তির কথা বলেছেন। শক্তি দুটি এসেছে গ্রিক দেবতা অ্যাপোলো (Apollo) এবং ডায়োনিসাস (Dionysus)-এর নাম থেকে।
১. অ্যাপোলোনিয়ান (Apollonian): দেবতা অ্যাপোলো হলেন আলো, শৃঙ্খলা, যুক্তি, স্বপ্ন, পরিমিতি এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রতীক। ভাস্কর্য, স্থাপত্য বা মহাকাব্যের মতো শিল্পকলা, যেখানে রূপ (form), সীমানা এবং শৃঙ্খলা প্রধান, সেগুলো অ্যাপোলোনিয়ান শক্তির প্রকাশ। এটি জীবনের বিশৃঙ্খল, যন্ত্রণাময় এবং ভয়ঙ্কর দিকগুলোকে একটি সুন্দর, যৌক্তিক আবরণের নিচে লুকিয়ে রাখে, যাতে আমরা তা সহ্য করতে পারি। এটা আমাদের স্বপ্ন দেখায়।
২. ডায়োনিসিয়ান (Dionysian): দেবতা ডায়োনিসাস হলেন উন্মত্ততা, আবেগ, বিশৃঙ্খলা, মত্ততা (intoxication) এবং প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়ার প্রতীক। সঙ্গীত, বিশেষ করে সুরনির্ভর উন্মাতাল সঙ্গীত এবং নৃত্য, হলো ডায়োনিসিয়ান শক্তির শ্রেষ্ঠ প্রকাশ। এই অবস্থায় মানুষ তার ব্যক্তিসত্তা (individuality) ভুলে গিয়ে জীবনের আদিম, বুনো এবং যন্ত্রণাময় প্রবাহের সঙ্গে মিশে যায়। সে একই সঙ্গে সৃষ্টি এবং ধ্বংসের ভয়াবহ আনন্দ অনুভব করে। এটা আমাদের মত্ত করে তোলে।
নিৎশের মতে, প্রাচীন গ্রিক ট্র্যাজেডির (যেমন—সফোক্লিস বা ইস্কাইলাসের নাটক) মহত্ত্বের কারণ ছিল এই দুই শক্তির এক অসাধারণ ভারসাম্য। অ্যাপোলোনিয়ান সংলাপ এবং কাহিনীর সুস্পষ্ট কাঠামোর ভেতরে ডায়োনিসিয়ান কোরাসের সঙ্গীত এবং উন্মাদনা জীবনের এক গভীরতর, ভয়ঙ্কর অথচ সুন্দর সত্যকে প্রকাশ করত।
কিন্তু নিৎশের মতে, সক্রেটিস এবং তার শিষ্য প্লেটোর পর থেকে পশ্চিমা দর্শন একপেশে হয়ে গেছে। তারা শুধু যুক্তির (অর্থাৎ, অ্যাপোলোনিয়ান) ওপর জোর দিয়েছে এবং আবেগের (ডায়োনিসিয়ান) দিকটিকে অবদমিত করেছে, তাকে বিপজ্জনক বলে মনে করেছে। এর ফলে সংস্কৃতি তার প্রাণশক্তি হারিয়েছে। নিৎশে মনে করতেন, একটি স্বাস্থ্যকর সংস্কৃতি বা একজন স্বাস্থ্যকর মানুষের জন্য এই দুই শক্তিরই প্রয়োজন। শুধু যুক্তি মানুষকে প্রাণহীন রোবট করে তোলে, আর শুধু আবেগ তাকে বিশৃঙ্খলায় ধ্বংস করে দেয়। সুস্থ জীবন হলো এই দুইয়ের মধ্যে এক গতিশীল নৃত্য।
সত্য বলে কিছু নেই? পার্সপেক্টিভিজম (Is There No Truth? Perspectivism)
নিৎশের আরেকটি বিপ্লবী এবং প্রায়শই ভুল বোঝা ধারণা হলো পার্সপেক্টিভিজম (Perspectivism)। তিনি তার নোটবুকে এমন এক মন্তব্য লিখেছিলেন যা দর্শনের জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করে: “There are no facts, only interpretations” (কোনো বাস্তব ঘটনা নেই, আছে শুধু ব্যাখ্যা) (Nietzsche, 1901/1968, section 481)।
এর মানে কী? এর মানে এই নয় যে, যা খুশি তাই সত্যি, বা পৃথিবীটা চ্যাপ্টা বললেও তা সত্যি হয়ে যাবে। বরং এই ধারণার গভীরে পৌঁছাতে হলে আমাদের আরেকটু পেছনে যেতে হবে। যেতে হবে আলোকায়ন যুগের (Enlightenment) এক মহীরুহের কাছে, যার নাম ইমানুয়েল কান্ট (Immanuel Kant)। কান্ট না থাকলে নিৎশের পার্সপেক্টিভিজম হয়তো জন্মই নিত না।
কান্ট এক যুগান্তকারী কথা বলেছিলেন। তিনি বললেন, জগৎ নিজে ঠিক কেমন (যাকে তিনি বলেছেন নুমেনন (noumenon) বা the thing-in-itself), তা আমরা কখনোই জানতে পারি না। আমরা জগৎকে জানি আমাদের মনের কিছু অন্তর্নির্মিত ছাঁচ বা ফিল্টারের মাধ্যমে। এই ফিল্টারগুলো হলো দেশ (space), কাল (time) এবং কার্যকারণ (causality) এর মতো ধারণা। অর্থাৎ, আমরা সবাই যেন এক বিশেষ ধরনের রঙিন চশমা পরে জগৎকে দেখছি। এই চশমার কারণে আমরা জগৎকে যেভাবে দেখি (যাকে কান্ট বলেছেন ফেনোমেনন (phenomenon) বা the world-as-it-appears), সেটাই আমাদের একমাত্র বাস্তবতা। আসল, চশমাবিহীন জগৎটা কেমন, তা আমাদের জানার বাইরে।
নিৎশে কান্টের এই ধারণার প্রথম অংশটি দারুণ পছন্দ করলেন। কারণ এটি প্লেটোর সময় থেকে চলে আসা ‘পরম সত্যের জগৎ’ বা ‘World of Forms’-এর ধারণাকে এক ঝটকায় বাতিল করে দেয়। কান্ট যেন আমাদের আর পরম সত্যের মধ্যে একটি দেয়াল তুলে দিলেন। নিৎশে এই দেয়াল দেখে খুশি হলেন। তিনি ভাবলেন, “যাক, অবশেষে কেউ তো স্বীকার করল যে আমাদের কোনো ঐশ্বরিক দৃষ্টিকোণ (God’s-eye view) নেই!”
কিন্তু এখানেই নিৎশে তার নিজস্ব পথে যাত্রা শুরু করলেন। কান্টের সঙ্গে তার পার্থক্যটা এখানেই—
কান্ট মনে করতেন, আমাদের সবার মনের চশমাটা একই মডেলের। অর্থাৎ, সব মানুষের মস্তিষ্কের এই ফিল্টারগুলো সার্বজনীন (universal)। তাই আমরা সবাই জগৎকে একইভাবে দেখি এবং এর ওপর ভিত্তি করে বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞান (objective science) গড়ে তোলা সম্ভব।
নিৎশে এসে বললেন, “এক মিনিট দাঁড়ান! চশমা একটাই কেন হবে? চশমা তো অসীম হতে পারে!”
নিৎশের মতে, আমাদের এই চশমা বা দৃষ্টিকোণ শুধু কান্টের বলা কয়েকটি সার্বজনীন ফিল্টার দিয়ে তৈরি নয়। এটি তৈরি হয় আমাদের শরীর, আমাদের ভাষা, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ইতিহাস, আমাদের চাহিদা এবং সর্বোপরি আমাদের ক্ষমতার ইচ্ছা (Will to Power) দ্বারা। জগৎকে আমরা কীভাবে ব্যাখ্যা করব, তা নির্ভর করে আমাদের ভেতরের কোন ড্রাইভ বা তাড়না সেই মুহূর্তে সবচেয়ে শক্তিশালী, তার ওপর।
এবার সেই পুরনো উদাহরণে ফেরা যাক। একটি গাছকে:
-
একজন কাঠুরিয়া দেখেন জ্বালানি হিসেবে, কারণ তার ক্ষমতার ইচ্ছা পরিচালিত হচ্ছে বেঁচে থাকার বা অর্থ উপার্জনের তাড়না দিয়ে।
-
একজন চিত্রকর দেখেন সৌন্দর্য ও মডেল হিসেবে, কারণ তার ক্ষমতার ইচ্ছা পরিচালিত হচ্ছে সৃষ্টিশীলতার তাড়না দিয়ে।
-
একজন উদ্ভিদবিজ্ঞানী দেখেন একটি নির্দিষ্ট প্রজাতি হিসেবে, কারণ তার ক্ষমতার ইচ্ছা পরিচালিত হচ্ছে জ্ঞানার্জন ও শ্রেণিবদ্ধ করার তাড়না দিয়ে।
-
আর একটি ক্লান্ত পাখি দেখে আশ্রয় হিসেবে, কারণ তার ক্ষমতার ইচ্ছা পরিচালিত হচ্ছে নিরাপত্তা ও আত্মরক্ষার তাড়না দিয়ে।
এদের কার দেখাটা ‘পরম সত্য’? নিৎশে বলবেন, কোনো একক ‘পরম সত্য’ নেই, আছে কেবল বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ বা পার্সপেক্টিভ থেকে দেখা সত্য, যার প্রতিটিই কোনো না কোনো জীবনের জন্য কার্যকরী। কান্ট যেখানে একটি সার্বজনীন, যৌক্তিক চশমার কথা বলে থেমে গিয়েছিলেন, নিৎশে সেখানে অসংখ্য ব্যক্তিগত, শারীরবৃত্তীয় এবং ইচ্ছানির্ভর চশমার এক বিশাল বাজার খুলে দিলেন। তিনি কান্টের সেই ‘অজানা জগৎ’ বা নুমেনন-এর ধারণাকেও অপ্রয়োজনীয় বলে বাতিল করে দিলেন। তিনি বললেন, যদি আমরা তা জানতেই না পারি, তবে তা নিয়ে কথা বলার দরকার কী? আছে শুধু এই ব্যাখ্যার জগৎ।
তবে এর মানে এই নয় যে সব দৃষ্টিকোণ সমান। কিছু দৃষ্টিকোণ অন্যগুলোর চেয়ে বেশি শক্তিশালী, বেশি জীবনমুখী এবং বেশি সহায়ক। একজন শক্তিশালী মনের (strong mind) লক্ষণ হলো সে একটি বিষয়কে যত বেশি সম্ভব দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পারে। সে একটি নির্দিষ্ট মতে বা বিশ্বাসে অন্ধভাবে আটকে থাকে না, বরং নমনীয়ভাবে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ গ্রহণ ও বিচার করতে পারে। সে বোঝে যে, ‘সত্য’ কোনো খুঁজে পাওয়ার বিষয় নয়, বরং সৃষ্টি করার বিষয়। অন্যদিকে, একটি দুর্বল মন (weak mind) একটিমাত্র দৃষ্টিকোণকে মরিয়া হয়ে আঁকড়ে ধরে থাকে, কারণ সে অনিশ্চয়তা সহ্য করতে পারে না এবং একটি স্থির, পরম সত্যের আশ্রয়ে নিরাপত্তা খোঁজে।
এইভাবেই নিৎশে কান্টের তোলা দেয়ালটিকে কেবল স্বীকারই করলেন না, বরং সেই দেয়ালের ওপর দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন এক নতুন, আরও বৈপ্লবিক দর্শনের, যা আমাদের পরম সত্যের আরামদায়ক ধারণা থেকে চিরতরে মুক্তি দেয়।
নিৎশের দীর্ঘ ছায়া: যে দার্শনিকেরা তার হাতুড়ি হাতে তুলে নিয়েছিলেন
একটা শান্ত, স্থির দিঘির কথা ভাবুন। টলটলে জল, কোনো ঢেউ নেই। এমন সময় কেউ একজন এসে দিঘির ঠিক মাঝখানে বিরাট এক পাথর ছুড়ে মারল। কী হবে? প্রথমে একটা বড়সড় আলোড়ন, তারপর সেই আলোড়ন থেকে জন্ম নেওয়া ঢেউগুলো ছড়িয়ে পড়তে থাকবে, কিনারায় এসে আছড়ে পড়বে, আবার ফিরে আসবে। দিঘিটা আর আগের মতো শান্ত থাকবে না।
ফ্রিডরিখ নিৎশে ছিলেন দর্শনজগতের সেই পাথর। তার জীবন ছিল একাকী, অস্বীকৃত, প্রায় সকলের চোখের আড়ালে। কিন্তু তার মৃত্যুর পর, তার চিন্তাগুলো সেই পাথরের মতো এক বিশাল আলোড়ন সৃষ্টি করল। সেই ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল বিংশ শতাব্দীর দর্শন, মনোবিজ্ঞান, সাহিত্য আর শিল্পের প্রতিটি কোণায়। যে মানুষটি জীবিত অবস্থায় প্রায় কোনো শিষ্য পাননি, মৃত্যুর পর তিনিই হয়ে উঠলেন প্রজন্মের পর প্রজন্মের চিন্তানায়কদের অদৃশ্য গুরু।
তার দর্শনকে যেমন নির্লজ্জভাবে ব্যবহার করেছে নাৎসিরা, তেমনি তার গভীরে ডুব দিয়ে মণি-মুক্তা খুঁজে এনেছেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কিছু মন। নিৎশে কোনো তৈরি করা ঘরবাড়ি বানিয়ে দিয়ে যাননি; তিনি দিয়ে গেছেন এক বাক্স ডিনামাইট। কে কীভাবে সেই ডিনামাইট ব্যবহার করবে, সেটা তাদের ব্যাপার। কেউ তা দিয়ে নতুন পথের জন্য পাহাড় ফাটিয়েছে, কেউ বা অন্যের ঘরবাড়ি উড়িয়ে দিয়েছে।
চলুন, সেই দীর্ঘ ছায়ার পথ ধরে হাঁটা যাক। দেখি, নিৎশের ছুড়ে দেওয়া পাথরের ঢেউ কাদের কিনারায় এসে আছড়ে পড়েছিল।
প্রথম ঢেউ: অস্তিত্ববাদের উঠানে (The Courtyard of Existentialism)
নিৎশে ঘোষণা করেছিলেন, “ঈশ্বর মৃত!” (God is dead)। এই ঘোষণার মাধ্যমে তিনি শুধু একটি ধর্মীয় বিশ্বাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করেননি, তিনি পশ্চিমা সভ্যতার পায়ের তলার মাটিটাই সরিয়ে দিয়েছিলেন। ঈশ্বর যদি না থাকেন, তাহলে জীবনের কোনো পূর্বনির্ধারিত অর্থ নেই, কোনো মহাজাগতিক নিয়মকানুন নেই, কোনো পরম নৈতিকতা নেই। মানুষ তখন এক অথৈ সাগরে নিক্ষিপ্ত—স্বাধীন, কিন্তু নিঃসঙ্গ।
এই শূন্যতা, এই অর্থহীনতার বোধ থেকেই জন্ম নিয়েছিল বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক আন্দোলনগুলোর একটি—অস্তিত্ববাদ (Existentialism)। নিৎশেকে প্রায়শই অস্তিত্ববাদের ‘ধর্মপিতা’ (Godfather) বলা হয়। কারণ তিনিই প্রথম এই সংকটকে পূর্ণরূপে উপলব্ধি করেছিলেন এবং এর মুখোমুখি হওয়ার সাহস দেখিয়েছিলেন। তার পরে যারা এসেছেন, তারা সবাইকেই এই শূন্যতার সঙ্গে বোঝাপড়া করতে হয়েছে।
-
মার্টিন হাইডেগার (Martin Heidegger): জার্মান এই দার্শনিক নিৎশেকে এতটাই গুরুত্ব দিতেন যে, তিনি তার ওপর একাধিক দীর্ঘ বক্তৃতা এবং বই লিখেছেন। হাইডেগারের কাছে, নিৎশে ছিলেন পশ্চিমা অধিবিদ্যার (Metaphysics) শেষ এবং চূড়ান্ত দার্শনিক। তার মতে, নিৎশের ‘ক্ষমতার ইচ্ছা’ (Will to Power) হলো জগৎকে পুরোপুরি মানুষের নিয়ন্ত্রণে আনার চূড়ান্ত প্রচেষ্টা, যা প্লেটোর সময় থেকে শুরু হয়েছিল। হাইডেগার নিৎশের ‘ঈশ্বর মৃত’ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে তার নিজের দর্শনের মূল প্রশ্নটি তুলেছিলেন: এই ঈশ্বরবিহীন জগতে ‘সত্তা’ (Being) বা অস্তিত্বের অর্থ কী? হাইডেগারের বিখ্যাত ধারণা ডাজাইন (Dasein) বা ‘সেখানে-থাকা-সত্তা’ হলো সেই অস্তিত্ব, যাকে এই অর্থহীন জগতে ছুড়ে ফেলা হয়েছে এবং তাকে নিজের অস্তিত্বের অর্থ নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে। এটা নিৎশের দেখানো পথেরই এক গভীর দার্শনিক অনুসন্ধান।
-
জ্যাঁ-পল সার্ত্রে (Jean-Paul Sartre): ফরাসি অস্তিত্ববাদের সবচেয়ে বড় নাম সার্ত্রে। তার দর্শনের গভীরে কান পাতলে নিৎশের কণ্ঠস্বর শোনা যায়। সার্ত্রের বিখ্যাত উক্তি, “অস্তিত্ব সারধর্মের পূর্বগামী” (Existence precedes essence)—এর মানে হলো, মানুষ কোনো পূর্বনির্ধারিত নকশা বা ‘সারধর্ম’ নিয়ে জন্মায় না। সে প্রথমে এই জগতে আসে, তারপর তার কাজ ও পছন্দের মাধ্যমে সে নিজেকে তৈরি করে। একজন ছুতার যেমন একটি চেয়ার বানানোর আগে তার নকশা (সারধর্ম) মাথায় রাখে, মানুষের ক্ষেত্রে তেমন কোনো নকশা নেই। এই ধারণাটি নিৎশের উবারমেনশ (Übermensch) বা আত্ম-অতিক্রমকারী মানুষের ধারণার প্রতিধ্বনি। উবারমেনশও কোনো তৈরি করা ছাঁচে নিজেকে ফেলে না, সে নিজেই নিজের মূল্যবোধ ও জীবনের অর্থ সৃষ্টি করে। সার্ত্রে যখন বলেন মানুষ “স্বাধীন হতে বাধ্য” (condemned to be free), তখন তিনি সেই নিৎশীয় স্বাধীনতার কথাই বলেন, যা একই সঙ্গে এক বিরাট সম্ভাবনা এবং এক অসহনীয় বোঝা (Sartre, 2007)।
-
আলবেয়ার কামু (Albert Camus): কামু নিজেকে অস্তিত্ববাদী বলতে চাইতেন না, কিন্তু তার দর্শনে নিৎশের প্রভাব সম্ভবত সবচেয়ে স্পষ্ট এবং সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। কামুর দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু হলো ‘অ্যাবসার্ড’ (The Absurd)-এর ধারণা—মানুষের অর্থ খোঁজার আকুতি এবং এই মহাবিশ্বের অর্থহীন নীরবতার মধ্যকার সংঘাত। এই অ্যাবসার্ডের মুখোমুখি হয়ে মানুষ কী করবে? আত্মহত্যা? কাল্পনিক কোনো বিশ্বাসে আশ্রয়? কামু তৃতীয় একটি পথের কথা বললেন—বিদ্রোহ (Rebellion)।
তার বিখ্যাত প্রবন্ধ The Myth of Sisyphus-এ তিনি গ্রিক পুরাণের চরিত্র সিসিফাসের কথা বলেন, যাকে দেবতারা শাস্তি দিয়েছিলেন অনন্তকাল ধরে একটি পাথরকে পাহাড়ের চূড়ায় তোলার জন্য, যা চূড়ায় পৌঁছানোর আগেই আবার গড়িয়ে নিচে পড়ে যায়। এর চেয়ে অর্থহীন কাজ আর কী হতে পারে? কিন্তু কামু বলছেন, “One must imagine Sisyphus happy”। সিসিফাস সুখী, কারণ সে তার নিয়তিকে মেনে নিয়েছে এবং দেবতাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। সে তার পাথরের প্রতি, তার কষ্টের প্রতি ভালোবাসা তৈরি করেছে। এটাই নিৎশের ‘আমোর ফাতি’ (Amor Fati) বা ‘নিয়তির প্রতি ভালোবাসা’র এক কাব্যিক রূপ। সিসিফাস হলো সেই অ্যাবসার্ড হিরো, যে ঈশ্বরবিহীন জগতে নিজের মহিমা নিজেই তৈরি করে। সে-ই নিৎশের উবারমেনশের এক আধুনিক সংস্করণ (Camus, 1991)।
দ্বিতীয় ঢেউ: আত্মার গভীরে (Into the Depths of the Psyche)
নিৎশে কোনো মনোবিজ্ঞানী ছিলেন না, কিন্তু তিনি নিজেকে “প্রথম মনোবিজ্ঞানী” বলে দাবি করতে ভালোবাসতেন। তিনি মানুষের মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা ভণ্ডামি, আত্মপ্রবঞ্চনা, চাপা ক্ষোভ (ressentiment) আর ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষাকে যেভাবে ব্যবচ্ছেদ করেছেন, তা আধুনিক মনোবিজ্ঞানের পথ খুলে দিয়েছিল।
-
সিগমুন্ড ফ্রয়েড (Sigmund Freud): মনোবিশ্লেষণের (Psychoanalysis) জনক ফ্রয়েড এবং নিৎশের সম্পর্কটা বেশ রহস্যময়। ফ্রয়েড দাবি করতেন যে, তিনি ইচ্ছাকৃতভাবেই নিৎশেকে এড়িয়ে চলতেন, পাছে তার নিজের মৌলিক চিন্তা প্রভাবিত হয়ে যায়। কিন্তু দুজনের চিন্তার মধ্যে সাদৃশ্য এত বেশি যে, তা কাকতালীয় হতে পারে না। নিৎশে যেমন বলেছিলেন মানুষ যুক্তির চেয়ে বেশি তাড়না দ্বারা চালিত, ফ্রয়েডও তেমনি মানুষের আচরণের পেছনে অবচেতন মনের (unconscious mind) আদিম তাড়না (drives), বিশেষ করে লিবিডোর (libido) কথা বলেছেন। নিৎশের ‘ক্ষমতার ইচ্ছা’ এবং ফ্রয়েডের তাড়নাগুলো—দুটোই মানুষের সেই অন্ধকার, অযৌক্তিক দিকটাকে সামনে নিয়ে আসে, যা আলোকায়ন যুগ লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিল। নিৎশে যাকে বলতেন ‘আত্ম-অতিক্রম’ (self-overcoming) বা নিজের প্রবৃত্তিকে মহৎ কোনো কাজে লাগানো, ফ্রয়েড তাকেই নাম দিয়েছিলেন ‘সাবলিমিশন’ (sublimation)। ফ্রয়েড হয়তো নিৎশের কাছে তার ঋণ স্বীকার করেননি, কিন্তু ইতিহাস তাদের দুজনকে একই পথের সহযাত্রী হিসেবেই মনে রেখেছে (Yalom, 1992)।
-
কার্ল ইয়ুং (Carl Jung): ফ্রয়েডের শিষ্য এবং পরবর্তীকালে তার সমালোচক কার্ল ইয়ুং নিৎশেকে গভীরভাবে পাঠ করেছিলেন। ইয়ুং-এর বিশ্লেষণী মনোবিজ্ঞান (Analytical Psychology) নিৎশের দ্বারা বহুলাংশে প্রভাবিত। ইয়ুং-এর ‘ইনডিভিডুয়েশন’ (Individuation) বা স্বাতন্ত্র্যলাভের প্রক্রিয়া—যেখানে একজন ব্যক্তি তার ব্যক্তিত্বের সমস্ত দিক, বিশেষ করে তার অন্ধকার দিক বা ‘ছায়া’ (The Shadow)-কে আত্মস্থ করে এক অখণ্ড সত্তায় পরিণত হয়—তা নিৎশের আত্মার তিন রূপান্তরের (Three Metamorphoses) (উট, সিংহ এবং শিশু) এক মনোবৈজ্ঞানিক প্রতিচ্ছবি। উবারমেনশ যেমন সমাজের ‘পালের নীতি’ অতিক্রম করে নিজেকে গড়ে তোলে, তেমনি ইনডিভিডুয়েশনের পথে চলা ব্যক্তিও ‘সম্মিলিত অবচেতন’ (collective unconscious) থেকে নিজেকে পৃথক করে এক স্বতন্ত্র ব্যক্তিতে পরিণত হয়।
-
আলফ্রেড অ্যাডলার (Alfred Adler): ফ্রয়েডের আরেক সহকর্মী অ্যাডলারের দর্শন ছিল আরও সরাসরি নিৎশে-প্রভাবিত। অ্যাডলার মানুষের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে ‘হীনমন্যতার অনুভূতি’ (feeling of inferiority) এবং তা থেকে উত্তরণের জন্য ‘শ্রেষ্ঠত্বের জন্য সংগ্রাম’ (striving for superiority)-এর কথা বলেছিলেন। এটা নিৎশের ‘ক্ষমতার ইচ্ছা’র এক সরলীকৃত, মনস্তাত্ত্বিক সংস্করণ ছাড়া আর কিছুই নয়।
তৃতীয় ঢেউ: সাহিত্যের পাতায় (On the Pages of Literature)
নিৎশে শুধু একজন দার্শনিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ শিল্পী। তার কাব্যিক ভাষা, রূপকের ব্যবহার এবং অ্যাফোরিজম বা সূত্রের আকারে লেখা—এই সবকিছুই ঔপন্যাসিক ও কবিদের গভীরভাবে আকর্ষণ করেছিল। তার ধারণাগুলো ছিল দাহ্য পদার্থের মতো, যা লেখকদের কল্পনায় আগুন ধরিয়ে দিত।
-
টমাস মান (Thomas Mann): জার্মান এই নোবেলজয়ী লেখক নিৎশের চিন্তার সঙ্গে আজীবন এক বোঝাপড়ায় লিপ্ত ছিলেন। তার বিখ্যাত উপন্যাস Death in Venice-এ আমরা দেখি এক প্রৌঢ় লেখক গুস্তাভ ফন আসেনবাখ, যিনি তার সারা জীবন শৃঙ্খলা, পরিমিতি আর যুক্তির (অর্থাৎ, অ্যাপোলোনিয়ান) চর্চা করেছেন, তিনি ভেনিসের বিশৃঙ্খল সৌন্দর্য আর তাদজিও নামের এক কিশোরের সৌন্দর্যের মোহে পড়ে তার সমস্ত সংযম হারিয়ে ফেলেন এবং ধ্বংস হয়ে যান। এটি অ্যাপোলোনিয়ান ও ডায়োনিসিয়ান (Dionysian) শক্তির এক ভয়াবহ সংঘর্ষের কাহিনি। তার আরেকটি বিশাল উপন্যাস, Doctor Faustus, সরাসরি নিৎশের জীবনের ছায়া অবলম্বনে লেখা, যেখানে এক প্রতিভাবান সুরকার শয়তানের কাছে তার আত্মা বিক্রি করে দেয় অসাধারণ সৃষ্টিশীলতার বিনিময়ে।
-
হেরমান হেস (Hermann Hesse): হেসের উপন্যাসের চরিত্ররা প্রায়ই নিৎশীয় দ্বন্দ্বে ভোগে। Steppenwolf উপন্যাসের নায়ক হ্যারি হ্যালার তার ভেতরের দুটো সত্তা নিয়ে বিভক্ত—একটি হলো সভ্য, বুর্জোয়া মানুষ, অন্যটি হলো একাকী, বুনো নেকড়ে। Demian উপন্যাসের বিখ্যাত উক্তি, “পাখিটি ডিম ভেঙে বেরিয়ে আসার জন্য লড়াই করে। ডিমটি হলো জগৎ। যে জন্মাতে চায়, তাকে প্রথমে একটি জগৎ ধ্বংস করতে হবে”—এই কথাটি নিৎশের সেই আহ্বানেরই প্রতিধ্বনি, যা আমাদের পুরনো মূল্যবোধ ভেঙে নতুন জগৎ সৃষ্টি করতে বলে।
-
আঁদ্রে জিদ (André Gide): ফরাসি লেখক আঁদ্রে জিদের উপন্যাস The Immoralist হলো নিৎশের দর্শনকে গল্পে রূপ দেওয়ার এক সরাসরি প্রচেষ্টা। উপন্যাসের নায়ক মিশেল এক কঠিন অসুখ থেকে সেরে ওঠার পর প্রচলিত সমস্ত নৈতিকতা ছুড়ে ফেলে দেয় এবং এক আদিম, ইন্দ্রিয়পরায়ণ জীবন যাপন করার চেষ্টা করে, যা তাকে এবং তার চারপাশের মানুষকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। এটি ‘ভালো-মন্দের ওপারে’ (Beyond Good and Evil) যাওয়ার বিপদের এক শৈল্পিক অনুসন্ধান।
চতুর্থ ঢেউ: উত্তর-আধুনিকতার ঘূর্ণিতে (In the Whirlwind of Postmodernism)
বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে ফরাসি চিন্তাবিদদের হাত ধরে যে উত্তর-আধুনিক (Postmodern) এবং উত্তর-কাঠামোবাদী (Post-structuralist) চিন্তার উদ্ভব হয়, তার প্রধান অনুপ্রেরণা ছিলেন নিৎশে। এই দার্শনিকেরা নিৎশের হাতুড়িটিকে এক নতুন উপায়ে ব্যবহার শুরু করেন।
-
মিশেল ফুকো (Michel Foucault): ফুকো তার জ্ঞান-বিশ্লেষণের পদ্ধতির নামই দিয়েছিলেন ‘জিনিওলজি’ (Genealogy) বা বংশবৃত্তান্ত, যা তিনি সরাসরি নিৎশের বই On the Genealogy of Morality থেকে নিয়েছিলেন। নিৎশে যেমন দেখিয়েছিলেন ‘ভালো’ আর ‘মন্দ’-এর ধারণাগুলো ধ্রুব নয়, বরং ক্ষমতার লড়াই থেকে এদের জন্ম, ফুকোও তেমনি দেখালেন যে, জ্ঞান (knowledge) কখনোই নিরপেক্ষ নয়। জ্ঞান এবং ক্ষমতা (power) সবসময় একসঙ্গে কাজ করে। হাসপাতাল, কারাগার, স্কুল—এই প্রতিষ্ঠানগুলো ‘জ্ঞানের’ মাধ্যমে মানুষের ওপর একধরনের সূক্ষ্ম ক্ষমতা প্রয়োগ করে এবং তাদের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। ফুকোর বিখ্যাত ধারণা Power/Knowledge হলো নিৎশের পার্সপেক্টিভিজম (Perspectivism) এবং ‘ক্ষমতার ইচ্ছা’র এক রাজনৈতিক ও সামাজিক সম্প্রসারণ (Foucault, 1995)।
-
জিল দ্যলুজ (Gilles Deleuze): দ্যলুজের কাছে নিৎশে ছিলেন এক সদর্থক (affirmative) শক্তির দার্শনিক। তিনি নিৎশের ‘ক্ষমতার ইচ্ছা’কে অন্যের ওপর প্রভুত্ব করার ইচ্ছা হিসেবে দেখেননি, দেখেছেন এক অবিরাম সৃষ্টিশীল, জীবনবাদী শক্তি হিসেবে। দ্যলুজ নিৎশের দর্শনের প্রতিক্রিয়াশীল (reactive) শক্তি—যেমন ressentiment বা চাপা ক্ষোভের—তীব্র সমালোচনা করেন এবং সক্রিয় (active) শক্তির জয়গান গান।
-
জাক দেরিদা (Jacques Derrida): দেরিদার বিখ্যাত ‘ডিকনস্ট্রাকশন’ (Deconstruction) বা অবিনির্মাণ পদ্ধতির পেছনেও নিৎশের ছায়া দেখা যায়। ডিকনস্ট্রাকশন হলো কোনো লেখা বা ধারণাকে ভেঙে তার ভেতরের স্ববিরোধিতা ও লুকানো অনুমানগুলোকে প্রকাশ করা। নিৎশে যেমন পশ্চিমা দর্শনের মূর্তিগুলোকে হাতুড়ি দিয়ে ভেঙেছিলেন, দেরিদা তেমনি ভাষার কাঠামোর ভেতরে ঢুকে তাকে ভেঙে দেখিয়েছেন যে, কোনো চূড়ান্ত, স্থির ‘অর্থ’ বলে কিছু নেই।
বিকৃত প্রভাব
প্রাচ্যের জরাথুস্ট্র এবং খুদির উত্থান (Zarathustra in the East and the Rise of Khudi)
নিৎশের ছুড়ে দেওয়া পাথরের ঢেউ যে শুধু ইউরোপের দিঘিতেই আলোড়ন তুলেছিল, তা নয়। সেই ঢেউয়ের জল গড়িয়ে পৌঁছে গিয়েছিল প্রাচ্যেও, বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের চিন্তার জগতে। আর সেখানে যিনি সবচেয়ে বড় জাহাজটি ভাসিয়েছিলেন, তার নাম স্যার মুহাম্মদ ইকবাল, যিনি আল্লামা ইকবাল নামেই বেশি পরিচিত। বিংশ শতাব্দীর এই কবি-দার্শনিক ছিলেন মুসলিম পুনর্জাগরণের অন্যতম প্রধান কণ্ঠস্বর। আর তার দর্শনের যে কেন্দ্রীয় স্তম্ভ—‘খুদি’ (Khudi) বা আত্মসত্তার ধারণা—তার গভীরে কান পাতলে নিৎশের কণ্ঠস্বর বেশ স্পষ্টভাবেই শোনা যায়।
ইকবাল যখন ইউরোপে পড়াশোনা করছিলেন (১৯০৫-১৯০৮), তখন সেখানে নিৎশের দর্শন নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে। ইকবাল জার্মান ভাষা জানতেন এবং নিৎশের লেখাগুলো মূল ভাষাতেই পড়েছিলেন। তিনি নিৎশের দ্বারা এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে, তাকে প্রায়শই ‘প্রাচ্যের নিৎশে’ (Nietzsche of the East) বলে অভিহিত করা হয়। কিন্তু এই প্রভাব কোনো অন্ধ অনুকরণ ছিল না। ইকবাল ছিলেন একজন পাকা জহুরির মতো, যিনি নিৎশের খনি থেকে মূল্যবান পাথর সংগ্রহ করেছেন, কিন্তু সেগুলোকে নিজস্ব দর্শনের আংটিতে, ইসলামী ঐতিহ্যের আবহে নতুন করে বসিয়েছেন।
যেখানে দুই নদী এসে মিশেছে: খুদি এবং উবারমেনশ
ইকবালের খুদি (Khudi) এবং নিৎশের উবারমেনশ (Übermensch) বা ‘ইনসান-ই-কামিল’ (Insan-i-Kamil), যার বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘পূর্ণাঙ্গ মানব’—এই দুটি ধারণার মধ্যে এক আশ্চর্য সাদৃশ্য রয়েছে।
১. আত্মশক্তির জাগরণ: নিৎশের মতো ইকবালও বিশ্বাস করতেন যে, ব্যক্তির সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো তার ভেতরের সুপ্ত সম্ভাবনাকে জাগ্রত করা। তার মতে, মুসলিম উম্মাহর পতনের মূল কারণ হলো তাদের খুদি বা আত্মসত্তার দুর্বলতা। তারা নিজেদের শক্তি ভুলে গিয়ে অনুকরণ, অদৃষ্টবাদ এবং পরনির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ইকবালের বিখ্যাত কবিতা ‘শিকওয়া’ (অভিযোগ) এবং ‘জওয়াব-ই-শিকওয়া’ (অভিযোগের উত্তর)-তে এই আহ্বানেরই প্রতিধ্বনি শোনা যায়। তিনি মানুষকে আহ্বান জানিয়েছেন তাদের ভেতরের শক্তিকে আবিষ্কার করতে এবং নিজেদের ভাগ্য নিজেদেরই গড়তে। এটি নিৎশের ‘শেষ মানব’ (The Last Man)-এর অলস, আরামপ্রিয় জীবনের ঠিক বিপরীত।
২. নিরন্তর সংগ্রাম ও সৃষ্টি: নিৎশের উবারমেনশ যেমন কষ্ট ও সংগ্রামকে ভয় পায় না, বরং তাকে আলিঙ্গন করে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে, ইকবালের ‘মর্দ-এ-মোমিন’ (Mard-e-Momin) বা বিশ্বাসী মানুষও তেমনি। ইকবালের কাছে জীবন কোনো শান্ত, স্থির অবস্থা নয়, বরং এক নিরন্তর সংগ্রাম এবং সৃষ্টির প্রক্রিয়া। তার কবিতায় শাহিন বা ঈগল পাখির যে রূপক বারবার ফিরে আসে, তা এই শক্তিশালী, আত্মনির্ভর, উঁচু আকাঙ্ক্ষারই প্রতীক। শাহিন পাহাড়ের চূড়ায় থাকে, অন্যের শিকার করা খাবার খায় না, সে ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে আনন্দ পায়। এটি নিৎশের সেই একাকী, শক্তিশালী মানুষেরই এক ইসলামী সংস্করণ।
৩. অনুকরণের বিরোধিতা: নিৎশে যেমন ইউরোপীয় সংস্কৃতির ‘পালের নীতি’ (herd morality) এবং অনুকরণবৃত্তির তীব্র সমালোচনা করেছেন, ইকবালও তেমনি পশ্চিমা সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণের বিরুদ্ধে মুসলিম তরুণদের সতর্ক করেছেন। তার মতে, অন্যের সংস্কৃতি ধার করে বড় হওয়া যায় না, বরং নিজের খুদিকে শক্তিশালী করেই কেবল একটি জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে।
যেখানে দুই নদী আলাদা হয়ে গেছে: ঈশ্বর এবং নৈতিকতা
এত সাদৃশ্য সত্ত্বেও ইকবাল এবং নিৎশের পথ একটি মৌলিক জায়গায় এসে পুরোপুরি আলাদা হয়ে গেছে। সেই জায়গাটি হলো—ঈশ্বর।
-
ঈশ্বর মৃত বনাম ঈশ্বর জীবন্ত: নিৎশের দর্শনের সূচনা হয়েছিল “ঈশ্বর মৃত!” (God is dead) এই বিস্ফোরক ঘোষণা দিয়ে। তার উবারমেনশ হলো সেই মানুষ, যে ঈশ্বরের মৃত্যুর পরের শূন্যতায় নিজের মূল্যবোধ নিজেই তৈরি করে। সে কোনো ঐশ্বরিক নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করে না।
অন্যদিকে, ইকবালের দর্শনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন জীবন্ত, সক্রিয় আল্লাহ। তার ‘ইনসান-ই-কামিল’ বা পূর্ণাঙ্গ মানব আল্লাহর সবচেয়ে সেরা সৃষ্টি এবং পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি (খলিফা)। তার খুদির বিকাশ ঘটে আল্লাহর ইচ্ছার সঙ্গে নিজের ইচ্ছাকে মিলিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে, আল্লাহর বিরুদ্ধে গিয়ে নয়। ইকবাল যখন বলেন, “খুদিকো কর বুলন্দ ইতনা কি হর তকদির সে পহলে / খুদা বন্দে সে খুদ পুঁছে—বতা, তেরি রজা কিয়া হ্যায়?” (তোমার খুদিকে এত উঁচু করো যে, প্রতিটি ভাগ্য নির্ধারণের আগে / স্রষ্টা যেন তার সৃষ্টিকে জিজ্ঞেস করেন, বলো, তোমার ইচ্ছাটা কী?), তখন তিনি স্রষ্টাকে অস্বীকার করছেন না, বরং স্রষ্টার সঙ্গে এক সৃষ্টিশীল অংশীদারিত্বের কথা বলছেন (Iqbal, Bal-i-Jibril)।
-
নৈতিকতার উৎস: নিৎশের উবারমেনশ ‘ভালো-মন্দের ওপারে’ (Beyond Good and Evil) চলে যায় এবং নিজের নৈতিকতা নিজেই তৈরি করে। তার নৈতিকতার কোনো ঐশ্বরিক ভিত্তি নেই।
বিপরীতে, ইকবালের পূর্ণাঙ্গ মানবের নৈতিকতার উৎস হলো কুরআন এবং নবী মুহাম্মদ-এর জীবন। তার খুদি লাগামছাড়া নয়, তা শরিয়তের সীমার মধ্যে থেকে বিকশিত হয়। নিৎশে যেখানে খ্রিস্টীয় নৈতিকতাকে দুর্বলদের ‘দাস-নীতি’ বলে ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন, ইকবাল সেখানে ইসলামী নৈতিকতাকে খুদিকে শক্তিশালী করার এবং তাকে সঠিক পথে চালিত করার একটি অপরিহার্য কাঠামো হিসেবে দেখেছেন।
সুতরাং, ইকবাল নিৎশের হাতুড়িটি হাতে নিয়েছিলেন, কিন্তু তা দিয়ে তিনি ঈশ্বর বা ধর্মের মূর্তি ভাঙেননি। বরং তিনি সেই হাতুড়ি ব্যবহার করেছেন মুসলিমদের আত্মতৃপ্তি, অলসতা আর অদৃষ্টবাদের মূর্তি ভাঙার জন্য। তিনি নিৎশের ডিনামাইট ব্যবহার করেছেন, কিন্তু তার লক্ষ্য ছিল মুসলিম উম্মাহর ভেতরের ঘুমন্ত শক্তিকে জাগিয়ে তোলা, ঈশ্বরবিশ্বাসকে ধ্বংস করা নয়।
ঐতিহাসিক এবং ইকবাল-বিশেষজ্ঞ অ্যানমারি শিমেল (Annemarie Schimmel) যেমনটা বলেছেন, ইকবাল নিৎশের প্রতি তার ঋণ স্বীকার করেছেন, কিন্তু তাকে একজন পথপ্রদর্শক হিসেবে নয়, বরং একজন সহযাত্রী হিসেবে দেখেছেন, যিনি পথের একটি নির্দিষ্ট অংশ পর্যন্ত তার সঙ্গে হেঁটেছেন, কিন্তু যার গন্তব্য ছিল ভিন্ন (Schimmel, 1963)। নিৎশে ছিলেন সেই ‘কাফের’ (অবিশ্বাসী), যার চিন্তার গভীরে ইকবাল ঈমানের আলো খুঁজে পেয়েছিলেন।
এইভাবেই নিৎশের দর্শন ইউরোপের সীমানা পেরিয়ে এক সম্পূর্ণ ভিন্ন সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আবহে নতুন করে প্রাণ পেয়েছে, যা তার চিন্তার বৈশ্বিক এবং বহুমাত্রিক প্রভাবের এক অসাধারণ উদাহরণ।
সমালোচনা
নিৎশে ছিলেন তার সময়ের এক প্রথাভাঙা, আপসহীন, বিদ্রোহী কণ্ঠস্বর। তার দর্শন ছিল প্রচলিত মূল্যবোধ ও খ্রিস্টীয় নৈতিকতার প্রতি এক নির্মম সমালোচনা। তার ‘উবারমেনশ’ (Übermensch) বা ‘অতিমানব’ ছিল গতানুগতিক ‘পালের নৈতিকতা’ (herd morality), দুর্বলতা, সমবেদনা এবং গতানুগতিকতা থেকে মুক্ত এক শক্তিশালী, সৃজনশীল, আত্মনির্ভর ও আত্ম-অতিক্রমকারী (self-overcoming) সত্তা (Nietzsche, 1883-1885/1961)। এই অতিমানব ‘ঈশ্বরের মৃত্যু’ (death of God) পরবর্তী শূন্যতার যুগে নিজেই নিজের মূল্যবোধের স্রষ্টা, নিজেই নিজের নিয়তির নিয়ন্তা, পৃথিবীর প্রতি বিশ্বস্ত এক নতুন ধরনের মানুষ। ইকবাল নিৎশের এই ধারণা থেকে গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং এর আদলে তার ‘ইনসান-ই-কামিল’ (Insan-i-Kamil – The Perfect Man) বা ‘মর্দ-ই-মুমিন’ (Mard-e-Momin – The Man of Faith) এর আদর্শ নির্মাণ করেছিলেন। ইকবালের কবিতায় ও দর্শনে এই ‘মর্দ-ই-মুমিন’ এক কেন্দ্রীয় চরিত্র, যিনি আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে পৃথিবীতে ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠা করবেন।
কিন্তু এখানে ইকবাল নিৎশের চিন্তার একটি খণ্ডিত, সুবিধাজনক এবং অনেকাংশে বিকৃত পাঠ গ্রহণ করেছিলেন। নিৎশের অতিমানব ছিল চরমভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক (radically individualistic), সে কোনো ধর্ম বা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি নয়, বরং এক নিঃসঙ্গ, অভিজাত (aristocratic) আত্মার অভিযাত্রী। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, নিৎশের দর্শন ছিল চূড়ান্তভাবে ঈশ্বরবিমুখ (atheistic) বা ঈশ্বরোত্তর (post-theistic)। ‘ঈশ্বরের মৃত্যু’র ঘোষণাই ছিল তার দর্শনের অন্যতম ভিত্তি। অন্যদিকে, ইকবালের ‘মর্দ-ই-মুমিন’ সম্পূর্ণরূপে আল্লাহকেন্দ্রিক, ইসলামের শিক্ষায় পরিপূর্ণ এবং মুসলিম উম্মাহর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। ইকবাল নিৎশের নাস্তিকতাকে সচেতনভাবে পরিহার করেছিলেন, যা তার ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু নিৎশের দর্শনের যে অংশটুকু ‘শক্তি’ (power), ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ (superiority), ‘প্রভুত্ব’ (dominance) এবং দুর্বলকে অতিক্রম করে যাওয়ার কথা বলে, সেটুকু তিনি সযত্নে গ্রহণ করে তার মুসলিম জাতীয়তাবাদী প্রকল্পের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জুড়ে দিয়েছিলেন।
নিৎশের আরেকটি অত্যন্ত বিতর্কিত ও বহুল আলোচিত ধারণা হলো ‘উইল টু পাওয়ার’ (Wille zur Macht) বা ‘ক্ষমতার ইচ্ছা’। নিৎশের কাছে এটি ছিল জীবনের এক মৌলিক, সর্বব্যাপী চালিকাশক্তি, যা সবকিছুকে আরও বিকশিত হতে, আরও শক্তিশালী হতে, নিজেকে অতিক্রম করতে, নিজের পরিধি বিস্তার করতে তাড়িত করে। এটি নিছক রাজনৈতিক ক্ষমতা বা অন্যের ওপর আধিপত্য নয়, বরং এক ধরনের সৃষ্টিশীল, প্রাণবন্ত শক্তি যা নিজেকেই ক্রমাগত অতিক্রম করে চলে। ইকবাল যখন এই ‘ক্ষমতার ইচ্ছা’কে তার ‘খুদি’র দর্শনের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর সম্মিলিত ইচ্ছাশক্তি ও রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষায় রূপান্তরিত করেন, তখন প্রশ্ন জাগে – এই শক্তি কার বিরুদ্ধে প্রযুক্ত হওয়ার কথা? একটি বহু-সাংস্কৃতিক ও বহু-ধর্মীয় সমাজে, যেমন ভারতবর্ষ, যখন একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠী নিজেদের ‘খুদি’কে জাগ্রত করে ‘অতিমানব’ বা ‘মর্দ-ই-মুমিন’ হয়ে ওঠার সাধনা করে এবং ‘ক্ষমতার ইচ্ছা’কে বাস্তবায়িত করতে চায়, তখন তাদের এই আকাঙ্ক্ষা কি অন্য গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই ভীতি, অবিশ্বাস, উদ্বেগ ও প্রতিরোধের জন্ম দেয় না?
নিৎশের দর্শন ছিল মূলত উনিশ শতকের ইউরোপীয় সমাজের অবক্ষয়, নিহিলিজম (nihilism), মূল্যবোধের সংকট এবং ব্যক্তিসত্তার চরম বিকাশের এক গভীর, যন্ত্রণাদগ্ধ আত্ম-সমালোচনা। সেই দর্শনকে যখন একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক পুনরুত্থান, তাদের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার এবং অন্য সম্প্রদায় থেকে নিজেদের পৃথক ও উন্নততর প্রমাণ করার জন্য ব্যবহার করা হয়, তখন তার ফলাফল কেবল বিভেদ, সংঘাত ও আধিপত্যকামিতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য। ইকবালের ‘মর্দ-ই-মুমিন’ যদি হয় আদর্শ মানব, তাহলে যারা এই আদর্শের ছাঁচে পড়েন না, বিশেষত অমুসলিম কিংবা এমনকি ভিন্ন মতাবলম্বী মুসলমান (যেমন, শিয়া, আহমদিয়া বা সুফি ঘরানার মুসলমান), তাদের অবস্থান কোথায়? তারা কি ‘অপূর্ণ’, ‘দুর্বল’ বা ‘নিকৃষ্ট’ মানব হিসেবে পরিগণিত হবেন? এই ধরনের শ্রেষ্ঠত্বের দাবি অনিবার্যভাবে অন্যদের প্রতি অশ্রদ্ধা, অসহিষ্ণুতা এবং এমনকি হিংসার জন্ম দেয়।
ড. খলিফা আব্দুল হাকিম তার ‘ফিকর-ই-ইকবাল’-এ ইকবালের নিৎশেপ্রীতি এবং উভয়ের চিন্তার সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য নিয়ে বিশদ আলোচনা করলেও, নিৎশের চিন্তার এই ধরনের সিলেক্টিভ এবং তার বিপজ্জনক রাজনৈতিক পরিণতির দিকগুলো হয়তো ততটা গুরুত্বের সঙ্গে ও কঠোরভাবে তুলে ধরেননি (Hakim, 1957)। নিৎশের চিন্তার এই খণ্ডিত ও উদ্দেশ্যমূলক ব্যবহার ইকবালের রাজনৈতিক দর্শনকে এক আগ্রাসী, পুরুষতান্ত্রিক (patriarchal) এবং আধিপত্যকামী চরিত্র দান করেছিল, যা একটি বহুত্ববাদী সমাজের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। যে ‘ঈগলের’ মতো উন্নত শির, অপরাজেয় শক্তির কথা ইকবাল বলেন, সেই ঈগল যে অন্য দুর্বল পাখিদের শিকার করে, সেই দিকটা তার দর্শনে প্রায়শই উহ্য থেকে যায়।
হিটলারের প্রিয় দার্শনিক: এক ঐতিহাসিক বিকৃতি ও তার নির্মাণ (Hitler’s Favorite Philosopher: A Historical Distortion and Its Making)
দর্শনের ইতিহাসে এর চেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হয়তো আর দুটি নেই। যে দার্শনিক তার সমগ্র জীবন ধরে জাতীয়তাবাদের তীব্র বিরোধিতা করলেন, জার্মান ‘রাইখ’-এর স্থূল সংস্কৃতিকে ঘৃণা করলেন, আর ইহুদি-বিদ্বেষকে “দুর্বল ও হিংসুটে মনের রোগ” বলে মনে করতেন, সেই দার্শনিকের নামই কিনা জড়িয়ে গেল বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর, বর্ণবাদী ও জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ—নাৎসিবাদের সঙ্গে।
ভাবুন তো, একজন শল্য চিকিৎসকের কথা। তার হাতে থাকা ধারালো ছুরিটি মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য তৈরি। কিন্তু সেই ছুরি যদি কোনো কসাইয়ের হাতে পড়ে, সে তা দিয়ে কী করবে? নিৎশের দর্শনের পরিণতি হয়েছিল ঠিক তেমনই। তার সূক্ষ্ম, জটিল এবং প্রায়শই বিপজ্জনক ধারণাগুলো নাৎসিদের হাতে পড়ে হয়ে উঠেছিল তাদের নৃশংস কর্মকাণ্ডের এক বিকৃত দার্শনিক হাতিয়ার।
এটি ছিল দর্শনের এক কদর্য অপহরণ। আর এই অপহরণের প্রধান কারিগর ছিলেন স্বয়ং নিৎশের বোন—এলিসাবেথ ফোর্স্টার-নিৎশে (Elisabeth Förster-Nietzsche)।
বোনের বিশ্বাসঘাতকতা: যেখান থেকে কলঙ্কের শুরু
নিৎশে যখন ১৮৮৯ সালে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে নির্বাক হয়ে গেলেন, তখন তার অপ্রকাশিত লেখা, নোটবুক আর চিঠিপত্রের বিশাল ভান্ডারের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় তার বোনের হাতে। আর এখানেই ছিল সমস্যার মূল। এলিসাবেথ ছিলেন তার ভাইয়ের সম্পূর্ণ বিপরীত। নিৎশে যেখানে ছিলেন আপসহীন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী, এলিসাবেথ সেখানে ছিলেন একজন কট্টর জার্মান জাতীয়তাবাদী। নিৎশে যেখানে ইহুদি-বিদ্বেষকে ঘৃণা করতেন, এলিসাবেথ সেখানে বার্নহার্ড ফোর্স্টার নামের এক কুখ্যাত ইহুদি-বিদ্বেষীকে বিয়ে করেছিলেন এবং তার সঙ্গে প্যারাগুয়েতে ‘নোভা জার্মানিয়া’ (Nueva Germania) নামে এক ‘বিশুদ্ধ আর্য’ কলোনি স্থাপনের ব্যর্থ চেষ্টাও করেছিলেন।
ভাইয়ের মৃত্যুর পর এলিসাবেথ ‘নিৎশে আর্কাইভ’ (Nietzsche-Archiv) প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজেকে তার ভাইয়ের দর্শনের একমাত্র অভিভাবক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি যা করলেন, তা বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতারণার সামিল। তিনি নিৎশের হাজার হাজার পৃষ্ঠার নোটবুক থেকে সিলেক্টিভলি অংশবিশেষ বেছে নিলেন, নিজের পছন্দমতো সেগুলোকে সাজালেন, এমনকি কিছু জায়গায় শব্দ বা বাক্য বদলে দিয়ে বা যোগ করে সেগুলোকে একটি বই হিসেবে প্রকাশ করলেন। বইটির নাম দিলেন ‘দ্য উইল টু পাওয়ার’ (The Will to Power / Der Wille zur Macht)।
এই বইটিকেই তিনি নিৎশের অসমাপ্ত magnum opus বা শ্রেষ্ঠ কাজ হিসেবে প্রচার করতে লাগলেন। কিন্তু এটি আসলে ছিল এলিসাবেথের নিজের জাতীয়তাবাদী ও ইহুদি-বিদ্বেষী চশমা দিয়ে সম্পাদিত এক বিকৃত কোলাজ। যেমনটা বিখ্যাত নিৎশে-বিশেষজ্ঞ ওয়াল্টার কফম্যান (Walter Kaufmann) দেখিয়েছেন, এই বইটি নিৎশের চিন্তার এক ভয়াবহ বিকৃতি, যা তাকে একজন আগ্রাসী, ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক চিন্তাবিদ হিসেবে উপস্থাপন করে (Kaufmann, 1974)।
নাৎসিদের হাতে নিৎশে: কোন ধারণাগুলো চুরি হলো?
নাৎসিরা দর্শন নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাতো না। তাদের প্রয়োজন ছিল তাদের বর্ণবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী মতাদর্শকে সমর্থন করার জন্য কিছু আকর্ষণীয় শ্লোগান আর দার্শনিক নাম। এলিসাবেথের তৈরি করে দেওয়া নিৎশে ছিলেন তাদের জন্য একেবারে নিখুঁত। তারা নিৎশের কয়েকটি ধারণাকে তাদের প্রয়োজনমতো বাঁকিয়ে নিল:
১. উবারমেনশ (Übermensch) থেকে আর্য শ্রেষ্ঠত্ব (Aryan Supremacy): নিৎশের উবারমেনশ ছিল এক আধ্যাত্মিক লক্ষ্য, যা যেকোনো ব্যক্তি চেষ্টা করলে অর্জন করতে পারে। এটি ছিল নিজেকে, নিজের দুর্বলতাকে অতিক্রম করার (self-overcoming) এক ব্যক্তিগত সাধনা। এর সঙ্গে জাতি বা রক্তের কোনো সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু নাৎসিরা এই ধারণাটিকে চুরি করে একে এক জৈবিক (biological) ও বর্ণবাদী (racial) রূপ দিল। তাদের কাছে উবারমেনশ হলো ‘আর্য জাতি’ (Aryan race), যারা জন্মগতভাবেই অন্য সব জাতির চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং তাদের অধিকার আছে দুর্বল জাতিদের ওপর শাসন করার। নিৎশের ব্যক্তিগত, আত্মিক সংগ্রামকে তারা পরিণত করল এক সম্পূর্ণ জাতির বর্ণবাদী অহংকারে।
২. ক্ষমতার ইচ্ছা (Will to Power) থেকে সামরিক আগ্রাসন (Military Aggression): নিৎশের ‘ক্ষমতার ইচ্ছা’ ছিল এক মহাজাগতিক, মনস্তাত্ত্বিক ধারণা—বেড়ে ওঠার, বাধা জয় করার এক সর্বজনীন তাড়না। এর সর্বোচ্চ প্রকাশ ছিল নিজের ওপর প্রভুত্ব অর্জন। নাৎসিরা একে ব্যাখ্যা করল সবচেয়ে স্থূল অর্থে: রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতা দখলের ইচ্ছা। তাদের কাছে ‘ক্ষমতার ইচ্ছা’ হলো জার্মানির Lebensraum বা ‘বেঁচে থাকার স্থান’ দখলের জন্য অন্য দেশ আক্রমণ করার এবং বিশ্বজুড়ে নিজেদের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করার এক দার্শনিক অনুমতিপত্র।
৩. প্রভু-নীতি (Master Morality) থেকে নিষ্ঠুরতার উদযাপন: নিৎশে প্রাচীন অভিজাতদের ‘প্রভু-নীতি’র কথা বলেছিলেন, যেখানে শক্তি, গর্ব, সাহসকে ‘ভালো’ বলে মনে করা হতো। তিনি খ্রিস্টীয় ‘দাস-নীতি’র সমালোচনা করেছিলেন, কারণ তা দয়া ও করুণার নামে মানুষকে দুর্বল করে ফেলে। নাৎসিরা এই ‘প্রভু-নীতি’র ধারণাটিকে লুফে নিল। তারা তাদের নিষ্ঠুরতা, আগ্রাসন এবং দুর্বলদের প্রতি ঘৃণাকে ‘শক্তিশালী’র লক্ষণ বলে উদযাপন করতে শুরু করল। তারা মনে করত, দয়া বা করুণা দেখানো হলো দুর্বলতা, যা আর্য প্রভুদের সাজে না। তারা নিৎশের সেই সমালোচনাকে ভুলে গেল যে, আধুনিক জার্মানরা কোনোভাবেই সেই প্রাচীন প্রভুদের মতো নয়, বরং তারা নিজেরাই ‘পালের পশু’তে পরিণত হয়েছে।
ঐতিহাসিক পরিহাস: আসল নিৎশে কী ভাবতেন?
সবচেয়ে বড় পরিহাস হলো, নিৎশে নিজে যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে তিনিই হতেন নাৎসিবাদের সবচেয়ে বড় সমালোচক।
-
জাতীয়তাবাদ ও রাষ্ট্র-বিরোধিতা: নিৎশে জার্মান জাতীয়তাবাদকে তীব্রভাবে ঘৃণা করতেন। তিনি বিসমার্কের নতুন ‘রাইখ’কে এক স্থূল ও সংস্কৃতিহীন শক্তি বলে মনে করতেন। তিনি নিজেকে একজন ‘ভালো ইউরোপীয়’ (Good European) বলে পরিচয় দিতে ভালোবাসতেন, কোনো নির্দিষ্ট দেশের নাগরিক হিসেবে নয়। যে দার্শনিক রাষ্ট্রকে ‘শীতলতম দানব’ (the coldest of all cold monsters) বলে আখ্যা দিয়েছেন, তার দর্শনকে একটি সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রশক্তির সমর্থনে ব্যবহার করার চেয়ে বড় বিকৃতি আর কী হতে পারে?
-
ইহুদি-বিদ্বেষের প্রতি ঘৃণা: নিৎশে তার বোন এবং তার স্বামীর ইহুদি-বিদ্বেষকে এতটাই ঘৃণা করতেন যে, তাদের সঙ্গে তিনি সম্পর্ক প্রায় ছিন্ন করে ফেলেছিলেন। তিনি তার লেখায় বারবার ইহুদি-বিদ্বেষীদের “ব্যর্থ ও হিংসুটে” বলে আক্রমণ করেছেন। তিনি ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে ইহুদিদের অবদানকে সম্মান করতেন।
১৯৩০-এর দশকে, এলিসাবেথ ফোর্স্টার-নিৎশে একজন সম্মানিত ব্যক্তিতে পরিণত হন। হিটলার নিজে একাধিকবার ভেইমারে তার প্রতিষ্ঠিত নিৎশে আর্কাইভে গিয়েছেন এবং তার সঙ্গে ছবি তুলেছেন। ১৯৩৪ সালে হিটলারের জন্মদিনে এলিসাবেথ তাকে নিৎশের ব্যবহৃত একটি হাঁটার ছড়ি উপহার দেন। এই ছবিগুলো নাৎসি প্রচারযন্ত্রের জন্য ছিল অমূল্য। তারা বিশ্বকে দেখাতে চেয়েছিল যে, জার্মানির সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক তাদের মতাদর্শকে সমর্থন করেন।
এইভাবে, নিৎশের ভূতকে তারা জোর করে এক নাৎসি ইউনিফর্ম পরিয়ে দিয়েছিল, যে ইউনিফর্মকে তিনি নিজে দেখলেও ঘৃণায় ছুড়ে ফেলে দিতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দীর্ঘদিন পর্যন্ত নিৎশের নাম এই কলঙ্ক থেকে মুক্ত হতে পারেনি। ওয়াল্টার কফম্যানের মতো দার্শনিকদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই ধীরে ধীরে নিৎশের দর্শনের এই বিকৃত পাঠকে চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব হয়েছে এবং আসল নিৎশেকে খুঁজে বের করার পথ সুগম হয়েছে (Safranski, 2002)।
এটি আমাদের শেখায়, দর্শনের ধারণাগুলো কতটা বিপজ্জনক হতে পারে যদি সেগুলোকে তাদের প্রেক্ষিত থেকে ছিঁড়ে নেওয়া হয় এবং কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের সেবায় লাগানো হয়। নিৎশের ছুরি জীবন বাঁচানোর জন্য তৈরি ছিল, কিন্তু ভুল হাতে পড়ে তা অগণিত মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
ভাঙা আয়নায় উবারমেনশের মুখ (The Übermensch in a Broken Mirror)
আজকের দিনের এক অদ্ভুত কামারশালার কথা ভাবুন। এই কামারশালা কোনো বাস্তব জায়গায় নেই, এর ঠিকানা হলো ইন্টারনেটের বিভিন্ন ফোরাম, ইউটিউব চ্যানেল আর সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপে। এখানে হাতুড়ির বদলে চলে কি-বোর্ডের টাইপিং, আর লোহা গলানোর আগুনের বদলে জ্বলে পিক্সেলের আলো। এই ভার্চুয়াল জগৎকে অনেকে বলেন ‘ম্যানোস্ফিয়ার’ (Manosphere)। এখানে সমবেত হয় মূলত তরুণেরা, যারা আধুনিক সমাজে পুরুষ হিসেবে নিজেদের অবস্থান নিয়ে বিভ্রান্ত, হতাশ বা ক্ষুব্ধ।
এই ম্যানোস্ফিয়ারে এক নতুন ধরনের নায়কের কথা শোনা যায়। সে প্রচলিত সামাজিক কাঠামোর বাইরে থাকে। সে ‘আলফা মেল’ (Alpha Male)-এর মতো দলের নেতা হতে চায় না, আবার ‘বিটা মেল’ (Beta Male)-এর মতো অনুসারী হয়েও থাকতে চায় না। সে এক ‘লোন উলফ’ বা একাকী নেকড়ে। সে নিজের নিয়ম নিজে তৈরি করে, সমাজের স্বীকৃতির তোয়াক্কা করে না, নীরবে নিজের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যায়। এই রহস্যময়, আত্মনির্ভর চরিত্রকে তারা এক নতুন নাম দিয়েছে—‘সিগমা মেল’ (Sigma Male)।
আর এই সিগমা মেলের আদর্শিক ভিত্তি খুঁজতে গিয়ে ম্যানোস্ফিয়ারের অনেকেই আবিষ্কার করেছেন এক পুরনো, গোঁফওয়ালা জার্মান দার্শনিককে—ফ্রিডরিখ নিৎশে। তাদের কাছে নিৎশের উবারমেনশ (Übermensch) আর সিগমা মেল যেন একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।
কেন এই সংযোগ?
পৃষ্ঠতল থেকে দেখলে এর কারণ বোঝা কঠিন নয়। নিৎশে কথা বলেছেন ‘পালের নীতি’ (herd morality) বা সমাজের চাপিয়ে দেওয়া ভালো-মন্দের ধারণাকে অতিক্রম করার। সিগমা মেলও সমাজের এই ‘খেলা’ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়। নিৎশে কথা বলেছেন নিজের মূল্যবোধ নিজে তৈরি করার। সিগমা মেলও অন্যের মতামতের ধার ধারে না। নিৎশে দেখিয়েছেন একাকী পথিকের ছবি—জরাথুস্ট্র, যিনি পাহাড়ের নির্জনতায় জ্ঞান অর্জন করেন। সিগমা মেলও সেই একাকীত্বের প্রতিচ্ছবি। নিৎশের ‘ক্ষমতার ইচ্ছা’ (Will to Power)-কে তারা ব্যাখ্যা করে আত্ম-উন্নতি এবং নিজের ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের সাধনা হিসেবে।
ফলে, নিৎশের দর্শন তাদের হাতে এক শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে ওঠে। এটি তাদের প্রচলিত সামাজিক কাঠামোর প্রতি বিদ্রোহকে একধরনের দার্শনিক বৈধতা দেয়। তারা মনে করে, তারা নিৎশের দেখানো পথেই হাঁটছে—দুর্বল, অনুকরণকারী ‘শেষ মানব’ (The Last Man) না হয়ে তারা শক্তিশালী, স্বতন্ত্র উবারমেনশ হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে।
কিন্তু এই আপাত সাদৃশ্যের নিচেই লুকিয়ে আছে এক গভীর এবং করুণ ভুল বোঝাবুঝি। ম্যানোস্ফিয়ারে নিৎশের যে প্রতিচ্ছবি দেখা যায়, তা যেন এক ভাঙা, বিকৃত আয়নায় দেখা মুখ। কারণ তারা নিৎশের দর্শনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং কেন্দ্রীয় একটি বিষয়কে হয় এড়িয়ে যায়, নয়তো পুরোপুরি উল্টোভাবে বোঝে। সেই বিষয়টি হলো—রিসেন্টিমেন্ট (Ressentiment)।
স্মরণ করুন, নিৎশের কাছে রিসেন্টিমেন্ট বা চাপা ক্ষোভ ছিল দাস-নীতির (Slave Morality) উৎস। এটি ছিল দুর্বলদের সেই বিষাক্ত ঘৃণা, যা থেকে তারা শক্তিশালী প্রভুদের মূল্যবোধকে ‘শয়তানি’ (evil) বলে আখ্যা দিয়েছিল। এটি ছিল এক প্রতিক্রিয়াশীল (reactive) শক্তি, যা অন্যের প্রতি ঘৃণা থেকে জন্মায়। নিৎশের সমগ্র দর্শন ছিল এই রিসেন্টিমেন্টকে অতিক্রম করে এক সদর্থক (affirmative), সৃষ্টিশীল জীবনদর্শন খুঁজে পাওয়ার প্রচেষ্টা।
এখন ম্যানোস্ফিয়ারের দিকে তাকান। এর একটি বড় অংশই দাঁড়িয়ে আছে এক ধরনের রিসেন্টিমেন্টের ওপর। এই ক্ষোভ নারীবাদের বিরুদ্ধে, নারীদের বিরুদ্ধে, বা সেই সামাজিক কাঠামোর বিরুদ্ধে, যা তাদের মতে পুরুষদের কোণঠাসা করে দিয়েছে। তাদের দর্শন প্রায়শই কোনো কিছুর ‘বিরুদ্ধে’ সংজ্ঞায়িত হয়। যেমনটি লেখক অ্যাঞ্জেলা নাহল তার Kill All Normies বইয়ে দেখিয়েছেন, এই অনলাইন সাবকালচারগুলো প্রায়শই এক ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী হিসেবে কাজ করে, যারা মূলধারার সংস্কৃতির প্রতি ঘৃণা থেকে শক্তি অর্জন করে (Nagle, 2017)।
এখানেই সেই নিদারুণ পরিহাস। ম্যানোস্ফিয়ারের অনুসারীরা যে দার্শনিককে তাদের গুরু মানে, সেই দার্শনিকের দেওয়া রোগনির্ণয় অনুযায়ী, তারা নিজেরাই সেই রোগে আক্রান্ত, যে রোগকে নিৎশে মানবাত্মার সবচেয়ে বড় ব্যাধি বলে মনে করতেন। তারা দাস-নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য দাস-নীতিরই সবচেয়ে বড় অস্ত্র—রিসেন্টিমেন্ট—ব্যবহার করছে। তারা নিৎশের দেওয়া ওষুধ দিয়ে নিজেদের রোগকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
তাছাড়া, আরও কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে:
১. সৃষ্টি বনাম প্রতিক্রিয়া (Creation vs. Reaction): নিৎশের উবারমেনশ হলো আত্মার তিন রূপান্তরের (Three Metamorphoses) শেষ ধাপ—শিশু (The Child)। শিশু হলো এক নতুন সূচনা, এক পবিত্র ‘হ্যাঁ’। সে খেলাচ্ছলে নতুন মূল্যবোধ তৈরি করে। তার কাজে কোনো ঘৃণা বা ক্ষোভ নেই। অন্যদিকে, সিগমা মেলের ধারণাটি প্রায়শই সিংহ (The Lion) পর্যায়ে আটকে থাকে। সিংহ বিদ্রোহ করে, পুরনো নিয়ম ভাঙে (“I will!”), কিন্তু সে নতুন কিছু সৃষ্টি করতে পারে না। সে আলফা/বিটা কাঠামোর ‘বিরুদ্ধে’ নিজেকে সংজ্ঞায়িত করে, কিন্তু সেই কাঠামোর বাইরে সম্পূর্ণ নতুন কোনো জগৎ সে তৈরি করে না।
২. আমোর ফাতি বনাম ভিক্টিমহুড (Amor Fati vs. Victimhood): নিৎশের সর্বোচ্চ আদর্শ ছিল আমোর ফাতি বা নিয়তির প্রতি ভালোবাসা—জীবনের ভালো-মন্দ সবকিছুকে বিনা অভিযোগে, সানন্দে গ্রহণ করা। এর মূলে আছে এক চরম আত্মকর্তৃত্বের ধারণা। কিন্তু ম্যানোস্ফিয়ারের বয়ানে প্রায়ই এক ধরনের ভিক্টিম বা নিপীড়িতের সুর শোনা যায়—সমাজ বা নারীবাদ তাদের প্রতি অবিচার করেছে, এই অনুভূতি। এই ভিক্টিম মানসিকতা আমোর ফাতির সম্পূর্ণ বিপরীত।
৩. ক্ষমতার ইচ্ছা: আত্ম-অতিক্রম বনাম সামাজিক কৌশল (Will to Power: Self-overcoming vs. Social Tactic): নিৎশের জন্য ‘ক্ষমতার ইচ্ছা’ ছিল নিজেকে, নিজের দুর্বলতাকে, নিজের আলস্যকে প্রতিনিয়ত অতিক্রম করার এক অন্তহীন সাধনা। এটি কোনো সামাজিক কৌশল নয়। কিন্তু ম্যানোস্ফিয়ারে প্রায়ই এই ধারণাগুলোকে নারীকে আকর্ষণ করার বা সামাজিক সিঁড়িতে ওপরে ওঠার এক ধরনের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হয়, এমনকি যদি সেই কৌশলটি হয় ‘খেলা থেকে বেরিয়ে আসা’। এটি নিৎশের মহৎ ধারণাকে এক স্থূল, উদ্দেশ্যমূলক ব্যবহারে নামিয়ে আনে।
সুতরাং, ম্যানোস্ফিয়ার যখন নিৎশের আয়নায় নিজেদের মুখ দেখে, তারা উবারমেনশকে দেখে না। তারা দেখে উবারমেনশের এক ছায়া, এক খণ্ডিত ও বিকৃত রূপ। তারা সেই দার্শনিকের কথাগুলো ধার করে, কিন্তু তার আত্মাটাকে ছুঁতে পারে না। নিৎশে যদি আজ বেঁচে থাকতেন, তিনি হয়তো এই সিগমা মেল ধারণার মধ্যে তার সেই ঘৃণিত ‘দাস-নীতি’রই এক নতুন, আধুনিক এবং ছদ্মবেশী রূপ দেখতে পেতেন।
তারা কি নিৎশের দেখানো পথে সিংহ হয়ে গর্জন করছে, নাকি উটের মতো নতুন এক বোঝা—রিসেন্টিমেন্টের বোঝা—কাঁধে নিয়ে ডিজিটাল মরুভূমিতে ঘুরপাক খাচ্ছে? উত্তরটা সম্ভবত খুব একটা সুখকর নয়।
শেষ কথা: হাতুড়ি দিয়ে কী ভাঙলেন, কী গড়লেন?
তাহলে এই গোঁফওয়ালা, একাকী, অসুস্থ মানুষটি আমাদের কী দিয়ে গেলেন? তার দর্শন কি শুধু ধ্বংস আর শূন্যতার কথাই বলে?
না। তার হাতুড়ি দিয়ে তিনি আমাদের আরামের জগতকে, আমাদের আত্মতৃপ্তির প্রাসাদকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন। তিনি ভেঙেছেন:
-
ঈশ্বরের ধারণার ওপর ভিত্তি করে থাকা পরম নৈতিকতার ঠুনকো মূর্তি।
-
‘পরম সত্য’ সম্পর্কে আমাদের সরল বিশ্বাসকে।
-
দুর্বলের সেই নৈতিকতাকে, যা জীবনকে অস্বীকার করে এবং মানুষকে পালের পশুতে পরিণত করে।
কিন্তু তিনি শুধু ধ্বংসই করেননি। সেই ধ্বংসস্তূপের ওপর তিনি নতুন করে গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। তিনি আমাদের জন্য কোনো তৈরি করা প্রাসাদ রেখে যাননি, কিন্তু একটি নতুন ইমারত গড়ার নকশা আর সরঞ্জাম দিয়ে গেছেন। তিনি আমাদের আহ্বান জানিয়েছেন:
-
নিহিলিজমের শূন্যতাকে ভয় না পেয়ে তাকে জয় করতে, তাকে একটি মুক্ত ময়দান হিসেবে দেখতে।
-
অন্যের দেওয়া আদেশের বোঝা বহন না করে, নিজের জীবনের অর্থ নিজেই তৈরি করতে।
-
নিজের ভেতরের দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতাকে প্রতিনিয়ত জয় করে নিজেকে অতিক্রম করতে, অর্থাৎ উবারমেনশ হয়ে ওঠার দুঃসাহসী পথে চলতে।
-
এবং জীবনের সবটুকু, তার কদর্যতা ও সৌন্দর্য, তার কষ্ট আর আনন্দসহ, ভালোবেসে গ্রহণ করতে (Amor Fati), এতটাই যে আপনি চাইবেন এই জীবনই যেন অনন্তকাল ফিরে আসে।
নিৎশের দর্শন কোনো সহজ উত্তর দেয় না। এটি কোনো নরম বালিশ নয়, বরং পাথরের বিছানা। তিনি আপনাকে স্বস্তি দেবেন না, বরং অস্বস্তিতে ফেলে দেবেন। তিনি আপনাকে পথ দেখিয়ে দেবেন না, বরং আপনার নিজের পায়ে নিজের পথ খুঁজে নিতে বলবেন। তিনি আপনার হাতে কোনো ধর্মগ্রন্থ তুলে দেবেন না, বরং একটি হাতুড়ি তুলে দিয়ে বলবেন, “যাও, নিজের মূর্তি নিজেই গড়ো।”
আজকের এই ভোগবাদী, আরামপ্রিয়, অনুকরণসর্বস্ব পৃথিবীতে, যেখানে সবাই লাইক আর শেয়ারের পেছনে ছোটে, যেখানে সবাই নিরাপদ থাকতে চায়, সেখানে নিৎশে আগের চেয়েও অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। তিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে সেই পুরনো, অস্বস্তিকর প্রশ্নটিই করছেন: তুমি কি পালের ভেড়া হয়ে নিরাপদ, অর্থহীন জীবন কাটাবে, নাকি একাকী সিংহের মতো ঝুঁকি নিয়ে নিজের সাম্রাজ্য গড়বে? তুমি কি “শেষ মানব” হয়ে আরামে চোখ পিটপিট করবে, নাকি উবারমেনশ হওয়ার কষ্টকর কিন্তু মহৎ পথে যাত্রা করবে?
আপনার জীবনের ভার আপনি বইবেন, নাকি তাকে ভালোবেসে তার সঙ্গে নৃত্য করবেন?
উত্তরটা আপনার।
তথ্যসূত্র
- Camus, A. (1991). The myth of Sisyphus and other essays (J. O’Brien, Trans.). Vintage International. (Original work published 1942).
- Foucault, M. (1995). Discipline and punish: The birth of the prison (A. Sheridan, Trans.). Vintage Books. (Original work published 1975).
- Hakim, K. A. (1957). Fikr-i-Iqbal [The Thought of Iqbal]. Bazm-i-Iqbal.
- Iqbal, M. (Bal-i-Jibril). The exact publication date varies, but the work is from the 1930s.
- Kaufmann, W. (1974). Nietzsche: Philosopher, psychologist, antichrist (4th ed.). Princeton University Press.
- Nagle, A. (2017). Kill all normies: Online culture wars from 4chan and Tumblr to Trump and the alt-right. Zero Books.
- Nietzsche, F. (1961). Thus Spoke Zarathustra (R. J. Hollingdale, Trans.). Penguin Books. (Original work published 1883-1885)
- Nietzsche, F. (1968). The will to power (W. Kaufmann & R. J. Hollingdale, Trans.). Vintage Books. (Original work published 1901)
- Nietzsche, F. (1996). On the genealogy of morality (D. Smith, Trans.). Oxford University Press. (Original work published 1887)
- Nietzsche, F. (1997). Untimely Meditations (R. J. Hollingdale, Trans.). Cambridge University Press. (Original work published 1874)
- Nietzsche, F. (2001). The gay science: With a prelude in German rhymes and an appendix of songs (J. Nauckhoff & A. Del Caro, Trans.). Cambridge University Press. (Original work published 1882/1887)
- Nietzsche, F. (2002). Beyond good and evil: Prelude to a philosophy of the future (R.-P. Horstmann & J. Norman, Eds.; J. Norman, Trans.). Cambridge University Press. (Original work published 1886)
- Nietzsche, F. (2005). Thus spoke Zarathustra: A book for everyone and nobody (G. Parkes, Trans.). Oxford University Press. (Original work published 1883-1885)
- Nietzsche, F. (2008). Ecce homo: How to become what you are (D. Large, Trans.). Oxford University Press. (Original work written 1888, published 1908)
- Safranski, R. (2002). Nietzsche: A philosophical biography (S. Frisch, Trans.). W. W. Norton & Company.
- Sartre, J.-P. (2007). Existentialism is a humanism (C. Macomber, Trans.). Yale University Press. (Original work published 1946).
- Schimmel, A. (1963). Gabriel’s wing: A study into the religious ideas of Sir Muhammad Iqbal. E.J. Brill.
- Tanner, M. (2000). Nietzsche: A very short introduction. Oxford University Press.
- Yalom, I. D. (1992). When Nietzsche wept: A novel of obsession. Basic Books.
Leave a Reply