চন্দ্রা তালপাড়ে মোহান্তীর “আন্ডার ওয়েস্টার্ন আইজ”: পশ্চিমা চোখে নারী যখন শুধুই এক ছাঁচের পুতুল

Table of Contents

ভূমিকা

ধরুন, দুটো ছবি। আমরা অনেক সময় জীবনকে ছবির ফ্রেমে বাঁধানো মুহূর্ত দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি। চলুন, আজকেও তাই করি। এই দুটো ছবি কোনো ফটোগ্রাফার তোলেননি, বরং আমাদের মনোজগতে পশ্চিমা জ্ঞানচর্চা এদেরকে এঁকে দিয়েছে।

প্রথম ছবিটি নিউইয়র্কের কোনো ঝলমলে ম্যানহাটন ক্যাফেতে বসা একজন নারীর। তার পরনে দামী, স্টাইলিশ বিজনেস স্যুট, টেবিলের ওপর চকচকে ম্যাকবুক এয়ার খোলা, হাতে স্টারবাকসের ভেন্টি কাপ, যার ওপর তার নাম ভুল বানানে লেখা। তার চোখেমুখে আত্মবিশ্বাসের ঝিলিক, হয়তো এইমাত্র কোনো বড় কর্পোরেট ডিল ফাইনাল করে এসেছেন বা একটি সফল বইয়ের চুক্তি সই করেছেন। তার নারীবাদী চেতনা হয়তো সিমোন দ্য বোভোয়ার (Simone de Beauvoir) এর ‘The Second Sex’ বা বেটি ফ্রিডানের (Betty Friedan) ‘The Feminine Mystique’ পড়ে শাণিত হয়েছে। তিনি নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলতে শিখেছেন, ‘The Personal is Political’ স্লোগানটি তার মননে গেঁথে গেছে। তার লড়াইটা হয়তো কাঁচের দেয়াল (Glass Ceiling) ভাঙার, পুরুষের সমান পারিশ্রমিক (Equal Pay for Equal Work) আদায়ের, কিংবা নিজের শরীর ও যৌনতার (Body and Sexuality) ওপর নিরঙ্কুশ অধিকার প্রতিষ্ঠার। তিনি হয়তো ভাবছেন, নারীমুক্তি মানেই এই ব্যক্তিগত ও পেশাগত স্বাধীনতার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছানো। আর পৃথিবীর সব নারীর লড়াই তো শেষ পর্যন্ত এমনই হওয়া উচিত। তিনি হলেন ‘আধুনিক নারী’, ‘মুক্ত নারী’।

এবার দ্বিতীয় ছবিটার কথা ভাবুন। ঠিক একই মুহূর্তে, হাজার হাজার মাইল দূরে, ভারতের কালাহান্ডি বা বাংলাদেশের কোনো প্রত্যন্ত গ্রামের একজন নারী। উঠোনে ভেজা ধান শুকাতে দিচ্ছেন, পরনে তার আটপৌরে শাড়ি, রোদে পোড়া মুখে কপালে চিন্তার গভীর ভাঁজ। তার চিন্তা শুধু ছেলেমেয়ের পড়ালেখার খরচ নিয়ে নয়, বরং দূষিত জলের কারণে হওয়া অসুখ নিয়ে, বহুজাতিক কোম্পানির দখলে চলে যাওয়া জমির ভবিষ্যৎ নিয়ে, স্বামীর দীর্ঘ অসুখ নিয়ে, মহাজনের ঋণের বোঝা নিয়ে, কিংবা যৌতুকের জন্য শ্বশুরবাড়ি থেকে আসা নিরন্তর মানসিক ও শারীরিক চাপ নিয়ে। তার কাছে স্বাধীনতা মানে হয়তো দুটো পয়সা জমিয়ে একটা সেলাই মেশিন কেনা, মেয়ের বাল্যবিবাহ রুখে দেওয়া, গ্রামের সালিশে দাঁড়িয়ে নিজের পক্ষে দুটো কথা বলার সাহস অর্জন করা, অথবা স্রেফ একবেলা পেট ভরে খেতে পাওয়া। তার নারীবাদী চেতনা কোনো বই পড়ে আসেনি, এসেছে জীবন থেকে, তার প্রতিদিনকার সম্মিলিত সংগ্রাম থেকে। তার কাছে সিমোন দ্য বোভোয়ার একটি অচেনা নাম, কিন্তু তিনি হয়তো চিপকো আন্দোলনের গৌরা দেবীর নাম শুনেছেন, যিনি গাছ জড়িয়ে ধরে বন বাঁচিয়েছিলেন।

এখন প্রশ্ন হলো, এই দুজন নারীর জীবন, সংগ্রাম আর মুক্তির আকাঙ্ক্ষা কি এক? পশ্চিমা নারীবাদ (Western Feminism) অনেকদিন পর্যন্ত এই প্রশ্নের উত্তরে প্রায়শই বলেছে—হ্যাঁ, তারা এক। কারণ তারা দুজনেই ‘নারী’। আর নারী মানেই পিতৃতন্ত্রের (Patriarchy) শিকার। তাই তাদের মুক্তির পথও এক—আমাদের দেখানো পথ। এই যে এক সরল, সর্বজনীন ভগ্নীত্বের (Universal Sisterhood) ধারণা, এই যে পৃথিবীর সব নারীকে এক কাতারে ফেলে দেখার প্রবণতা, এই আপাত নিরীহ চেহারার আড়ালে যে এক গভীর ঔপনিবেশিক মানসিকতা, ক্ষমতার দম্ভ আর জ্ঞানতাত্ত্বিক অহংকার লুকিয়ে আছে, সেই দেয়ালে প্রথম এবং সবচেয়ে জোরালো আঘাতটি যিনি হেনেছিলেন, তিনি হলেন ভারতীয়-আমেরিকান নারীবাদী তাত্ত্বিক চন্দ্রা তালপাড়ে মোহান্তী (Chandra Talpade Mohanty)

১৯৮৪ সালে তার লেখা “Under Western Eyes: Feminist Scholarship and Colonial Discourses” প্রবন্ধটি যখন অ্যাকাডেমিক জার্নাল ‘বাউন্ডারি ২’-তে প্রকাশিত হলো, তখন নারীবাদী চিন্তা ও তত্ত্বে রীতিমতো এক ভূমিকম্প ঘটে গেল। এটি শুধু একটি প্রবন্ধ ছিল না; ছিল একটি আয়না, যা পশ্চিমা নারীবাদকে তার নিজের চেহারা দেখতে বাধ্য করেছিল। সেই চেহারায় উপনিবেশবাদের (Colonialism) ভূত লেগে ছিল, জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের (Ethnocentrism) ছাপ ছিল আর ছিল এক ধরনের অজ্ঞানতাপ্রসূত করুণা। মোহান্তী আমাদের দেখালেন, কীভাবে ভালো উদ্দেশ্য থাকা সত্ত্বেও, পশ্চিমা নারীবাদীরা প্রায়ই তৃতীয় বিশ্বের নারীদের নিয়ে এমন এক বয়ান বা ডিসকোর্স তৈরি করেন যা তাদের মুক্তি দেওয়ার বদলে নতুন এক জ্ঞানতাত্ত্বিক কারাগারে (Epistemic Prison) বন্দী করে ফেলে।

আজ আমরা সেই আয়নার সামনে দাঁড়াব। খুব ধীরে, যত্ন করে বোঝার চেষ্টা করব, মোহান্তী ঠিক কী বলতে চেয়েছিলেন? কেন তার এই লেখাটি প্রকাশের প্রায় চার দশক পরেও এতটা প্রাসঙ্গিক? চলুন, একটু সহজ করে, গল্পের মতো করে পুরো ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করি। এটি কোনো অ্যাকাডেমিক কচকচানি নয়, বরং আমাদের নিজেদের ভাবনার জগৎকে নাড়া দেওয়ার একটি প্রচেষ্টা।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: যে জমিতে মোহান্তীর চিন্তার জন্ম

কোনো বড় চিন্তাই শূন্য থেকে জন্মায় না। তার জন্য একটি উর্বর জমি লাগে, একটি উত্তাল প্রেক্ষাপট লাগে। মোহান্তীর প্রবন্ধটিকে বুঝতে হলে আমাদের একটু পিছিয়ে যেতে হবে সত্তরের ও আশির দশকের সেই বুদ্ধিবৃত্তিক আলোড়নের সময়ে। তখন পৃথিবীতে একই সাথে কয়েকটি বড় বুদ্ধিবৃত্তিক ঝড় চলছিল।

ঝড় এক: দ্বিতীয় ঢেউয়ের নারীবাদ ও তার শ্বেতাঙ্গ কেন্দ্রিকতা

ষাটের দশকের শেষভাগ থেকে পশ্চিমে নারীবাদী আন্দোলনের দ্বিতীয় ঢেউ (Second-Wave Feminism) আছড়ে পড়েছিল। নারীরা দলে দলে রাস্তায় নামছেন, নিজেদের অধিকারের কথা বলছেন, প্রচলিত সমাজব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। “The Personal is Political” (ব্যক্তিগত যা, তা-ই রাজনৈতিক)—এই স্লোগান অ্যাকাডেমিক জগৎ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের রান্নাঘর পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। বেটি ফ্রিডান তার বইতে শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত আমেরিকান নারীদের জীবনের সেই ‘নামহীন সমস্যা’র (The Problem That Has No Name) কথা বলছিলেন, যা তাদের সুন্দর শহরতলির বাড়ির ভেতরে থেকেও এক ধরনের শূন্যতায় ভোগাতো। নারীরা বুঝতে পারছিলেন যে তাদের ব্যক্তিগত হতাশাগুলো আসলে একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক কাঠামোরই ফল। এই ঢেউ গর্ভপাতের অধিকার, সমানাধিকার, কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে সামনে নিয়ে আসে।

কিন্তু এই আন্দোলনের একটি বড় এবং প্রায়শই অনুচ্চারিত সীমাবদ্ধতা ছিল। এর নেতৃত্ব এবং তাত্ত্বিক ভিত্তি ছিল মূলত শ্বেতাঙ্গ, মধ্যবিত্ত, বিষমকামী (Heterosexual) পশ্চিমা নারীদের হাতে। তাদের অভিজ্ঞতাকেই ‘নারীর অভিজ্ঞতা’র সার্বজনীন রূপ হিসেবে দেখা হচ্ছিল। তাদের লড়াইয়ের বিষয়গুলো—যেমন কর্মক্ষেত্রে সমান সুযোগ, গর্ভপাতের অধিকার, ব্যক্তিগত মুক্তি—এগুলোকেই নারীমুক্তির একমাত্র এজেন্ডা হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছিল। এই আন্দোলনে কৃষ্ণাঙ্গ, লাতিনা বা এশীয় বংশোদ্ভূত নারীদের অভিজ্ঞতা প্রায়শই ব্রাত্য থেকে যেত। তাদের বর্ণবাদ (Racism) এবং শ্রেণী শোষণের (Class Exploitation) সংগ্রামকে নারীবাদের মূলধারায় জায়গা দেওয়া হচ্ছিল না। এই নারীবাদ যেন বলতে চাইছিল, ‘আগে আমরা লিঙ্গবৈষম্য দূর করি, তারপর বর্ণবাদ বা অন্য সমস্যাগুলো দেখা যাবে।’ কিন্তু একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারীর কাছে তো লিঙ্গ আর বর্ণ আলাদা কোনো বিষয় নয়, তার অভিজ্ঞতা তো এই দুয়ের সম্মিলিত ফল। তার পক্ষে বলা সম্ভব নয়, ‘আজ আমি নারী হিসেবে নিপীড়িত, কাল কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে।’ তিনি প্রতি মুহূর্তে একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবেই বেঁচে থাকেন।

ঝড় দুই: উত্তর-ঔপনিবেশিকতাবাদের উত্থান ও সাঈদের ছায়া

একই সময়ে অ্যাকাডেমিক জগতে আরেকটি বড় বিপ্লব চলছিল—উত্তর-ঔপনিবেশিকতাবাদ (Postcolonialism)। সাম্রাজ্যগুলো ভেঙে গেলেও সাবেক উপনিবেশগুলোর ওপর পশ্চিমা দেশগুলোর সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক আধিপত্য শেষ হয়ে যায়নি। এই আধিপত্যকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছিলেন নতুন প্রজন্মের চিন্তাবিদরা। এই ধারার সবচেয়ে প্রভাবশালী কণ্ঠ ছিলেন ফিলিস্তিনি-আমেরিকান বুদ্ধিজীবী এডওয়ার্ড সাঈদ (Edward Said)। তার কালজয়ী বই “ওরিয়েন্টালিজম” (১৯৭৮) পশ্চিমা জ্ঞানচর্চার দম্ভকে একেবারে নাড়িয়ে দিয়েছিল। সাঈদ দেখালেন, পশ্চিমারা কীভাবে শত শত বছর ধরে উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনি, চিত্রকলা ও অ্যাকাডেমিক গবেষণার মাধ্যমে ‘প্রাচ্য’ (The Orient) সম্পর্কে এক ধরনের গৎবাঁধা, নিকৃষ্ট এবং রহস্যময় ধারণা তৈরি করেছে। এই ধারণায় প্রাচ্য হলো স্বৈরাচারী, অলস, অযৌক্তিক, রহস্যময় এবং নারীসুলভ, আর পশ্চিম হলো গণতান্ত্রিক, কর্মঠ, যৌক্তিক এবং পুরুষালি। এই কাল্পনিক বিভাজন (Binary Opposition) পশ্চিমা দেশগুলোকে প্রাচ্যের ওপর শাসন এবং শোষণ চালানোর জন্য একটি নৈতিক বৈধতা দিয়েছিল। এটি ছিল এক ধরনের ক্ষমতার জ্ঞান (Knowledge as Power)। অর্থাৎ, জ্ঞান এখানে নিরপেক্ষ নয়, জ্ঞান নিজেই ক্ষমতার একটি হাতিয়ার। সাঈদ দেখালেন, পশ্চিমারা প্রাচ্যকে ‘জানার’ মাধ্যমে তাকে ‘নিয়ন্ত্রণ’ করেছে।

ঝড় তিন: অ-শ্বেতাঙ্গ নারীবাদীদের সম্মিলিত প্রতিরোধ

এই দুই স্রোতের সংযোগস্থলেই মোহান্তীর জন্ম। তিনি নিজে একজন ভারতীয় নারী, যিনি পড়াশোনা ও কাজের জন্য আমেরিকায় এসেছেন। তিনি একদিকে পশ্চিমা নারীবাদী তত্ত্বের বিপ্লবী সম্ভাবনাকে স্বীকার করেছেন, অন্যদিকে নিজের চোখে দেখেছেন কীভাবে সেই তত্ত্ব তার মতো ‘তৃতীয় বিশ্বের’ নারীদের ভুলভাবে উপস্থাপন করে। তবে তিনি একা ছিলেন না। তার সাথে যোগ দিয়েছিলেন আরও অনেক অ-শ্বেতাঙ্গ নারীবাদী। কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদী তাত্ত্বিক অড্রে লর্ড (Audre Lorde) তার বিখ্যাত উক্তিতে বলেছিলেন, “প্রভুর শেখানো বুলি দিয়ে প্রভুর ঘর ভাঙা যায় না” (“The master’s tools will never dismantle the master’s house”)। তিনি বলছিলেন, শ্বেতাঙ্গ নারীবাদের তৈরি করা কাঠামো দিয়ে বর্ণবাদের সমস্যাকে বোঝা বা সমাধান করা যাবে না। বেল হুকস (bell hooks) পশ্চিমা নারীবাদকে ‘সাম্রাজ্যবাদী শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যকামী পুঁজিবাদী পিতৃতন্ত্র’ (Imperialist White Supremacist Capitalist Patriarchy) এর অংশ হিসেবে সমালোচনা করছিলেন, কারণ তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন এই বিভিন্ন নিপীড়নের ব্যবস্থাগুলো একে অপরের সাথে সংযুক্ত। চিকানা (Chicana) নারীবাদী গ্লোরিয়া আনজালদুয়া (Gloria Anzaldúa) তার ‘Borderlands/La Frontera’ বইতে সীমান্ত অঞ্চলের নারীদের মিশ্র পরিচয় ও অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন, যা কোনো সরল বর্গীকরণের মধ্যে আঁটে না।

এই সময়েই কম্বাহি রিভার কালেকটিভ (Combahee River Collective) এর মতো কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদী সংগঠনগুলো তাদের বিখ্যাত বিবৃতিতে ঘোষণা করছিল যে তাদের লড়াই শুধু লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে নয়, বরং বর্ণবাদ, শ্রেণী শোষণ এবং হোমোফোবিয়ার বিরুদ্ধেও। তারা প্রশ্ন তুলছিল, “সার্বজনীন ভগ্নীত্ব” কি আসলেই সার্বজনীন? নাকি এটি শ্বেতাঙ্গ নারীদের অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে বাকিদের অদৃশ্য করে রাখার একটি কৌশল?

এই উত্তাল বিতর্কের মধ্যেই মোহান্তী তার কলম ধরলেন। তার লক্ষ্য ছিল কোনো ব্যক্তিবিশেষকে আক্রমণ করা নয়, বরং পশ্চিমা নারীবাদী জ্ঞানচর্চার গভীরে থাকা একটি পদ্ধতিগত সমস্যাকে উন্মোচন করা। তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন, এই সমস্যাটি কোনো বিচ্ছিন্ন ভুল নয়, বরং একটি ঔপনিবেশিক জ্ঞানকাণ্ডের ধারাবাহিকতা মাত্র।

মূল সমস্যাটা কোথায়? ‘তৃতীয় বিশ্বের নারী’ নামক এক ছাঁচ

মোহান্তীর মূল আক্রমণের লক্ষ্য ছিল পশ্চিমা নারীবাদী লেখালেখি, গবেষণা এবং অ্যাকাডেমিক জগৎ। তিনি দেখালেন, এই লেখাগুলোর একটি বড় অংশ যখন ‘তৃতীয় বিশ্বের নারী’ (Third World Woman) নিয়ে কথা বলে, তখন তারা আসলে নির্দিষ্ট কোনো দেশের, নির্দিষ্ট কোনো সংস্কৃতির, নির্দিষ্ট কোনো শ্রেণীর নারীকে নিয়ে কথা বলে না। তারা একটি কাল্পনিক, গড়পড়তা (Average), সমসত্ত্ব (Homogeneous) নারী চরিত্র তৈরি করে নেয়। মোহান্তী এই কাল্পনিক চরিত্রটিকে একটি “একক, সমজাতীয় তৃতীয় বিশ্বের নারী” (singular, monolithic Third World Woman) বলে অভিহিত করেছেন।

এই কাল্পনিক ‘তৃতীয় বিশ্বের নারী’ চরিত্রটির কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য আছে, যা পশ্চিমা লেখায় বারবার ফিরে আসে:

  • সে চিরকালীন নিপীড়িত (Oppressed): তার জীবনের একমাত্র পরিচয় হলো সে একজন শিকার (Victim)। তার কোনো আনন্দ, সাফল্য, হাস্যরস বা প্রতিরোধের গল্প নেই। তার জীবন যেন শুধুই দুঃখ, কষ্ট আর অশ্রু দিয়ে গড়া। পশ্চিমা গবেষক তার গ্রামে গিয়ে শুধু তার কান্নার ছবি তোলেন, তার হাসির গল্পটা শোনেন না।

  • সে অশিক্ষিত (Uneducated) এবং পশ্চাৎপদ (Backward): আধুনিকতা ও প্রগতির আলো তার কাছে পৌঁছায়নি। সে কুসংস্কার আর অজ্ঞানতার অন্ধকারে ডুবে আছে। তার নিজস্ব জ্ঞান, লোকজ্ঞান বা হাজার বছরের সঞ্চিত অভিজ্ঞতাকে ‘জ্ঞান’ হিসেবেই স্বীকার করা হয় না।

  • সে ধর্মীয় গোঁড়ামির শিকার (Victim of Religious Fundamentalism): পর্দা, হিজাব বা বোরখা তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং এটিই তার নিপীড়নের একমাত্র ও প্রধান প্রতীক। তার নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাস বা আধ্যাত্মিকতার কোনো জগৎ নেই। হিজাব পরা নারী মানেই তিনি নিপীড়িত, তার নিজের কোনো পছন্দ বা এজেন্সি থাকতে পারে না—এই সরল সমীকরণটিকেই সত্য বলে ধরে নেওয়া হয়।

  • তার নিজের কোনো স্বর বা এজেন্সি (Agency) নেই: অর্থাৎ, নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, ইচ্ছা বা সাহস তার নেই। সে কেবলই পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার এক অসহায় পুতুল, যে নীরবে সবকিছু সহ্য করে যায়। সে যদি পরিবারের জন্য ত্যাগ স্বীকার করে, সেটাকে তার দুর্বলতা হিসেবে দেখা হয়, তার ভালোবাসা বা দায়িত্ববোধ হিসেবে নয়।

  • সে মূলত যৌন নিপীড়নের শিকার: এবং পারিবারিক সহিংসতার (Domestic Violence) এক জীবন্ত প্রতীক। তার শরীর যেন শুধুই পুরুষের ভোগের বস্তু। পশ্চিমা লেখায় ‘অনার কিলিং’, ‘জেনিটাল মিউটিলেশন’ বা ‘বধূ পোড়ানো’র মতো বিষয়গুলোকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যেন এগুলোই তৃতীয় বিশ্বের নারীদের একমাত্র বাস্তবতা, এবং এই বর্বরতাগুলো তাদের সংস্কৃতিরই অংশ।

  • সে ঐতিহ্যের কারাগারে বন্দী (Trapped by Tradition): তার সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকেই তার পিছিয়ে থাকার মূল কারণ হিসেবে দেখানো হয়। পশ্চিমা আধুনিকতাই যেন মুক্তির একমাত্র পথ, আর বাকি সব সংস্কৃতিই পশ্চাৎপদ।

মোহান্তী বললেন, এই যে একটিমাত্র ছাঁচে ফেলে সব নারীকে দেখা—এটাই হলো প্রধান সমস্যা। কেন? কারণ এটি একটি বিপজ্জনক সমজাতীয়করণ (Homogenization)। ইরান, বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া, বলিভিয়া—এই সব দেশের কোটি কোটি নারীর জীবন, সংস্কৃতি, ধর্ম, শ্রেণী, সংগ্রাম—সবকিছুকে মুছে দিয়ে একটিমাত্র পরিচয়ে তাদের বন্দী করা হয়। ঢাকার একজন গার্মেন্টস কর্মী, যিনি ট্রেড ইউনিয়নের নেত্রী; দিল্লির একজন অধ্যাপক, যিনি দলিত নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করেন; তেহরানের একজন শিল্পী, যিনি তার শিল্পের মাধ্যমে প্রতিবাদ করেন; আর আমাজনের জঙ্গলে থাকা একজন আদিবাসী নারী, যিনি তার জমির অধিকারের জন্য লড়াই করছেন—তাদের সবাইকে একই ‘নিপীড়িত নারী’র লেবেল পরিয়ে দেওয়া হয় (Mohanty, 1984)।

এর বিপরীতে পশ্চিমা নারীবাদীরা নিজেদের কীভাবে চিত্রিত করেন? তারা হলেন আধুনিক, শিক্ষিত, মুক্তমনা এবং নিজেদের জীবনের চালক। এভাবেই তৈরি হয় এক ধরনের বিভাজন (Binary Opposition): ‘আমরা’ বনাম ‘ওরা’। ‘আমরা’ (পশ্চিমা নারী) মুক্ত, আর ‘ওরা’ (তৃতীয় বিশ্বের নারী) বন্দী। ‘আমাদের’ কাজ হলো ‘ওদের’ উদ্ধার করা। এই দৃষ্টিভঙ্গি এক ধরনের জ্ঞানতাত্ত্বিক উপনিবেশবাদ (Discursive Colonization) তৈরি করে, যেখানে পশ্চিমা মানদণ্ডকেই সার্বজনীন সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়।

ব্যাপারটা অনেকটা এরকম—একজন ডাক্তার সব রোগীকে না দেখেই, তাদের ভিন্ন ভিন্ন উপসর্গের কথা না শুনেই, একটিমাত্র প্রেসক্রিপশন লিখে দিচ্ছেন। এতে কি রোগ সারবে? নাকি আরও জটিল হবে? মোহান্তীর মতে, পশ্চিমা নারীবাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি কেবল ভুলই নয়, এটি এক ধরনের জ্ঞানতাত্ত্বিক সহিংসতাও (Epistemic Violence) বটে। কারণ এটি তৃতীয় বিশ্বের নারীদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা এবং সংগ্রামকে মুছে দেয় এবং তাদের ওপর পশ্চিমা জ্ঞানকে চাপিয়ে দেয়।

মোহান্তীর বিশ্লেষণ: কীভাবে পশ্চিমা নারীবাদ এই ফাঁদে পা দেয়?

মোহান্তী শুধু অভিযোগ করেই থেমে যাননি। তিনি বেশ কিছু প্রভাবশালী পশ্চিমা নারীবাদী লেখা (যেমন—পার্দিতা হস্টন, বেভারলি লিন্ডসে বা ফ্রাঁসোয়া হোসাইন-এর লেখা) বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, কীভাবে এই ভুলগুলো করা হয়। তিনি মূলত তিনটি পদ্ধতিগত (Methodological) ত্রুটির কথা বলেছেন, যা পশ্চিমা নারীবাদী জ্ঞানচর্চার মূলে প্রোথিত।

১. নারী একটি সমসত্ত্ব বর্গ (Women as a Homogeneous Category)

মোহান্তীর প্রথম এবং প্রধান যুক্তি হলো, পশ্চিমা নারীবাদী তাত্ত্বিকরা প্রায়শই ‘নারী’ (Woman) শব্দটিকে এমনভাবে ব্যবহার করেন, যেন এটি একটি অখণ্ড, একাট্টা এবং আগে থেকেই সংজ্ঞায়িত একটি বর্গ। যেন পৃথিবীর সব নারীর অভিজ্ঞতা, বিশেষ করে নিপীড়নের অভিজ্ঞতা, কাঠামোগতভাবে একই রকম।

মোহান্তী দেখালেন, এই পদ্ধতি দুটি কাজ করে। প্রথমত, এটি ধরে নেয় যে ‘নারী’র একটি সার্বজনীন পরিচয় আছে, যা সংস্কৃতি, শ্রেণী বা ইতিহাসের ঊর্ধ্বে। দ্বিতীয়ত, এই সার্বজনীন পরিচয়ের ভিত্তি হিসেবে ধরা হয় লিঙ্গীয় নিপীড়ন বা পিতৃতান্ত্রিক আধিপত্যকে। এর ফলে, ‘নারী’ সংজ্ঞায়িত হন কেবল তার লিঙ্গের ভিত্তিতে এবং তার শিকার (Victim) হওয়ার স্ট্যাটাসের ভিত্তিতে।

এই ধারণাটি মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ। যেমন, ‘পুরুষের সহিংসতা’ (Male Violence), ‘প্রজনন অধিকার’ (Reproductive Rights) বা ‘পর্দা প্রথা’ (Veiling) নিয়ে আলোচনার সময় প্রায়শই ধরে নেওয়া হয়, সব নারী একইভাবে এর শিকার। কিন্তু একজন শ্বেতাঙ্গ, মধ্যবিত্ত আমেরিকান নারীর পিতৃতন্ত্রের অভিজ্ঞতা আর একজন দলিত, ভূমিহীন ভারতীয় নারীর অভিজ্ঞতা কি এক? আমেরিকার নারী হয়তো কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে লড়ছেন, আর ভারতের দলিত নারী লড়ছেন বর্ণপ্রথা, দারিদ্র্য এবং যৌন সহিংসতা—এই তিনটির সম্মিলিত আক্রমণের বিরুদ্ধে। তাদের লড়াইয়ের প্রেক্ষাপট (Context) সম্পূর্ণ ভিন্ন। একজন ফিলিস্তিনি নারীর কাছে ইসরায়েলি দখলদারিত্বের অধীনে বেঁচে থাকাটাই হয়তো প্রধান সংগ্রাম, যা তার লিঙ্গীয় পরিচয়ের অভিজ্ঞতাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।

পশ্চিমা নারীবাদ যখন ‘নারীর পছন্দ’ (Woman’s Choice) বা গর্ভপাতের অধিকার নিয়ে লড়াই করে, তখন তারা ভুলে যায় যে আমেরিকার ইতিহাসে কৃষ্ণাঙ্গ বা পুয়ের্তো রিকান নারীদের তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নির্বীজকরণ (Forced Sterilization) করা হয়েছে। তাদের লড়াইটা ছিল সন্তান জন্ম দেওয়ার অধিকার রক্ষার, জন্ম না দেওয়ার অধিকারের নয়। এই ভিন্ন ভিন্ন ঐতিহাসিক বাস্তবতাগুলোকে একটিমাত্র ‘নারীর অভিজ্ঞতা’র ছাঁচে ফেলাটা কেবল ভুলই নয়, এটি এক ধরনের জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ববাদেরও (Ethnocentric Universalism) পরিচায়ক।

মোহান্তী জোর দিয়ে বলেন, আমাদের ‘নারী’ (Woman) নামক এই কাল্পনিক একক ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে ‘নানাবিধ নারী’ (women) নিয়ে ভাবতে হবে। তাদের শ্রেণী, বর্ণ, ধর্ম, জাতি, ইতিহাস, যৌন অভিমুখিতা—এই সবকিছুকে বিবেচনায় না আনলে তাদের জীবন ও সংগ্রামকে বোঝা অসম্ভব (Mohanty, 1984)। এই ধারণাটি পরবর্তীতে আইন বিশেষজ্ঞ কিম্বার্লি ক্রেনশ’র (Kimberlé Crenshaw) ‘ইন্টারসেকশনালিটি’ (Intersectionality) তত্ত্বের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। ক্রেনশ আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের আইনি লড়াইয়ের উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন, তারা প্রায়শই বৈষম্যের শিকার হন কারণ আইন তাদের হয় ‘নারী’ (শ্বেতাঙ্গ নারীর মতো) নয়তো ‘কৃষ্ণাঙ্গ’ (কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষের মতো) হিসেবে দেখে, কিন্তু ‘কৃষ্ণাঙ্গ নারী’ হিসেবে তাদের সম্মিলিত ও অনন্য অভিজ্ঞতাকে স্বীকার করে না (Crenshaw, 1989)। মোহান্তীর কাজ এই ইন্টারসেকশনাল বা ইন্টারসেকশনাল বিশ্লেষণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিল, যা দেখায় যে পরিচয়ের বিভিন্ন অক্ষ একে অপরকে ছেদ করে এবং এক জটিল অভিজ্ঞতার জন্ম দেয়।

২. সার্বজনীন পিতৃতন্ত্রের ধারণা (The Idea of Universal Patriarchy)

মোহান্তীর দ্বিতীয় সমালোচনাটি হলো, পশ্চিমা নারীবাদী তত্ত্বে প্রায়শই পিতৃতন্ত্রকে একটি সার্বজনীন (Universal), অপরিবর্তনীয় এবং সবখানে একই চেহারার একটি ব্যবস্থা হিসেবে দেখানো হয়। যেন এর কোনো স্থান-কাল-পাত্র ভেদ নেই। যেন পিতৃতন্ত্র মানেই হলো সব পুরুষ সব নারীর ওপর একইভাবে আধিপত্য কায়েম করে।

মোহান্তী এর তীব্র বিরোধিতা করে বলেন, পিতৃতন্ত্রের চেহারা সব সমাজে এক নয়। এটি স্থানীয় সংস্কৃতি, অর্থনীতি, ধর্ম এবং ইতিহাসের সাথে মিলেমিশে ভিন্ন ভিন্ন ও জটিল রূপ ধারণ করে। সৌদি আরবের রাজতান্ত্রিক ও ধর্মীয় পিতৃতন্ত্র আর সুইডেনের সামাজিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে টিকে থাকা পিতৃতন্ত্র এক জিনিস নয়। আফ্রিকার কোনো মাতৃতান্ত্রিক (Matriarchal) সমাজের লিঙ্গীয় ক্ষমতার রসায়ন আর বাংলাদেশের পিতৃতান্ত্রিক (Patriarchal) সমাজের রসায়ন ভিন্ন। এমনকি একই দেশের শহর ও গ্রামের পিতৃতন্ত্রের মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে। শুধু তাই নয়, ‘তৃতীয় বিশ্বে’র পুরুষরাও একটি সমসত্ত্ব গোষ্ঠী নয়। একজন নিপীড়িত শ্রেণীর পুরুষ এবং একজন শাসক শ্রেণীর পুরুষের ক্ষমতা এক নয়। ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং বর্ণবাদ প্রায়শই অ-শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের ‘পুরুষত্বহীন’ (Emasculated) করেছে, যা তাদের নিজেদের পরিবারের নারীদের ওপর আধিপত্য কায়েমের চেষ্টাকে আরও হিংস্র করে তুলতে পারে। এই জটিলতাগুলোকে না বুঝে, কেবল ‘পিতৃতন্ত্র’ নামক একটি সার্বজনীন দৈত্যের কথা বললে আসল সমস্যাকে আড়াল করা হয়।

যখন পশ্চিমা নারীবাদীরা তাদের নিজেদের সমাজের পিতৃতন্ত্রের মডেলটিকেই পৃথিবীর সবখানে চাপিয়ে দেন, তখন তারা আসলে এক ধরনের জ্ঞানতাত্ত্বিক সাম্রাজ্যবাদ (Epistemological Imperialism) কায়েম করেন। তারা বলতে চান, পিতৃতন্ত্রকে বোঝার জন্য তাদের তৈরি করা চশমাটাই একমাত্র সঠিক চশমা। এর ফলে স্থানীয় নারীদের প্রতিরোধ এবং সংগ্রামের নিজস্ব ধরণগুলো অদৃশ্য হয়ে যায়। যেমন, অনেক সমাজে নারীরা ধর্মের ভেতর থেকেই নিজেদের অধিকারের ভাষা খুঁজে নেন, যা পশ্চিমা সেক্যুলার নারীবাদের চোখে ‘পশ্চাৎপদতা’ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তারা হয়তো কোরআন বা গীতার নতুন ব্যাখ্যা দিয়ে নিজেদের মুক্তি খুঁজছেন, যা পশ্চিমা নারীবাদীর চোখে স্ববিরোধিতা মনে হতে পারে। মোহান্তী আমাদের এই জটিলতাগুলো দেখার জন্য আহ্বান জানান।

৩. ঔপনিবেশিক ডিসকোর্স এবং প্রতিনিধিত্বের সংকট (Colonial Discourse and the Crisis of Representation)

মোহান্তীর যুক্তির সবচেয়ে শক্তিশালী এবং মৌলিক দিকটি হলো, তিনি পশ্চিমা নারীবাদের এই সমস্যাগুলোকে ঔপনিবেশিকতার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে স্থাপন করেছেন। এখানেই তিনি এডওয়ার্ড সাঈদের (Edward Said) ‘ওরিয়েন্টালিজম’ তত্ত্বের সাহায্য নেন।

সাঈদ দেখিয়েছিলেন, পশ্চিমারা কীভাবে ‘প্রাচ্য’ (The Orient) সম্পর্কে এক ধরনের গৎবাঁধা, নিকৃষ্ট এবং রহস্যময় ধারণা তৈরি করেছে, যা তাদের শাসন এবং শোষণকে ন্যায্যতা দিয়েছে। এই ডিসকোর্স বা বয়ান অনুযায়ী, প্রাচ্য হলো পশ্চাৎপদ এবং তার নিজেকে শাসন করার ক্ষমতা নেই, তাই পশ্চিমাদের দায়িত্ব হলো তাকে ‘সভ্য’ করে তোলা।

মোহান্তী বলেন, পশ্চিমা নারীবাদীরাও ঠিক একই কাজ করেছেন, যদিও হয়তো অসচেতনভাবে এবং ভালো উদ্দেশ্য নিয়েই। তারা ‘তৃতীয় বিশ্বের নারী’ সম্পর্কে এমন একটি ডিসকোর্স বা বয়ান (Discourse) তৈরি করেছেন, যা তাকে দুর্বল, অসহায় এবং পরনির্ভরশীল হিসেবে দেখায়। এই বয়ান অনুযায়ী, এই নারীদের মুক্তির জন্য পশ্চিমা জ্ঞান, পশ্চিমা নারীবাদ এবং পশ্চিমা হস্তক্ষেপ অপরিহার্য। এটি একবিংশ শতাব্দীর ‘শ্বেতাঙ্গ মানুষের বোঝা’র (White Man’s Burden) এক নতুন নারীবাদী সংস্করণ, যেখানে ‘শ্বেতাঙ্গ পুরুষে’র জায়গায় এসেছে ‘শ্বেতাঙ্গ নারী’। তারা এখন ‘বাদামী নারীদের’ (Brown Women) ‘বাদামী পুরুষদের’ (Brown Men) হাত থেকে উদ্ধার করতে চায়।

এই “উদ্ধারকর্তা”র মানসিকতার একটি চমৎকার উদাহরণ দিয়েছেন নৃতত্ত্ববিদ লিলা আবু-লুগোদ (Lila Abu-Lughod)। আফগানিস্তানে আমেরিকান আগ্রাসনের প্রেক্ষাপটে তিনি তার বিখ্যাত প্রবন্ধে প্রশ্ন তুলেছিলেন, “মুসলিম নারীদের কি সত্যিই উদ্ধার করা প্রয়োজন?” (Do Muslim Women Really Need Saving?)। তিনি দেখিয়েছেন, বোরকা বা হিজাবকে কেবলই নিপীড়নের প্রতীক হিসেবে দেখাটা কতটা সরলীকরণ। অনেক নারীর কাছে এটি পরিচয়, প্রতিরোধ, ধার্মিকতা বা সামাজিক নিরাপত্তারও প্রতীক হতে পারে। পশ্চিমা উদ্ধারকর্তারা এই জটিলতাগুলো দেখতে চান না, কারণ এতে তাদের ‘উদ্ধারকারী’র মহৎ ভূমিকা প্রশ্নের মুখে পড়ে (Abu-Lughod, 2002)।

এই প্রতিনিধিত্বের সংকটের আরেকটি দিক তুলে ধরেছিলেন গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক (Gayatri Chakravorty Spivak)। তার যুগান্তকারী এবং কিছুটা দুরূহ প্রবন্ধে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, “সাবল্টার্ন কি কথা বলতে পারে?” (Can the Subaltern Speak?)। তার মূল বক্তব্য ছিল, ক্ষমতার কাঠামো এমনভাবে তৈরি যে, সাবল্টার্ন বা প্রান্তিক মানুষের স্বর ক্ষমতাবানদের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না, অথবা পৌঁছালেও তার অর্থ বদলে যায়। যখন পশ্চিমা গবেষক তৃতীয় বিশ্বের নারী সম্পর্কে লেখেন, তখন তিনি আসলে সেই নারীর স্বরকে তুলে ধরছেন না, বরং নিজের মতো করে তাকে নির্মাণ করছেন, তাকে প্রতিনিধিত্ব (Represent) করছেন। এই প্রক্রিয়ায়, আসল নারীটি হারিয়ে যায়, এবং তার জায়গায় পশ্চিমা গবেষকের তৈরি করা একটি প্রতিমূর্তি স্থান পায়। এভাবেই নিম্নবর্গ বা সাবঅল্টার্ন নারীকে নীরব করে রাখা হয় (Spivak, 1988)।

ফলাফল কী দাঁড়ায়? ক্ষমতার এক সূক্ষ্ম খেলা

মোহান্তীর মতে, পশ্চিমা নারীবাদের এই দৃষ্টিভঙ্গির ফলাফল অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং এটি কেবল একটি অ্যাকাডেমিক বিতর্ক নয়, এর বাস্তব রাজনৈতিক পরিণতি রয়েছে।

১. রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়করণ এবং এজেন্সির বিলোপ (Political Depoliticization and Erasure of Agency): যখন তৃতীয় বিশ্বের নারীদের কেবলই ‘শিকার’ (Victim) হিসেবে দেখা হয়, তখন তাদের নিজেদের সংগ্রাম, প্রতিরোধ এবং রাজনৈতিক সচেতনতাকে অস্বীকার করা হয়। ভারতের চিপকো আন্দোলন, যেখানে নারীরা গাছ জড়িয়ে ধরে বন ধ্বংসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, থেকে শুরু করে শাহবাগের গণজাগরণ, ইরানের সাম্প্রতিক হিজাব-বিরোধী আন্দোলন থেকে লাতিন আমেরিকার পরিবেশ আন্দোলন—ইতিহাস সাক্ষী, এই অঞ্চলের নারীরা কখনোই চুপ করে বসে থাকেনি। তারা নিজেদের লড়াই নিজেরাই লড়েছে, নিজেদের মতো করে প্রতিরোধের ভাষা তৈরি করেছে। কিন্তু পশ্চিমা বয়ান তাদের এই এজেন্সি বা কর্তৃত্বকে (Agency) মুছে দেয়। তারা হয়ে ওঠে ইতিহাসের দর্শক, চালক নয়। তাদের দেখানো হয় এমন অসহায় প্রাণী হিসেবে, যারা নিজেরা কিছু করতে পারে না, কেবল বাইরের সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করে থাকে। এটি তাদের রাজনৈতিক শক্তিকে খর্ব করে এবং তাদের সংগ্রামকে গুরুত্বহীন করে তোলে।

২. ভ্রান্ত সংহতি এবং ক্ষমতার সম্পর্ককে আড়াল করা (False Solidarity and Obscuring Power Relations): মোহান্তী ‘সার্বজনীন ভগ্নীত্বে’র (Universal Sisterhood) ধারণাকে তীব্রভাবে আক্রমণ করেন। তিনি বলেন, সব নারী এক—এই আবেগি ধারণার ওপর ভিত্তি করে প্রকৃত রাজনৈতিক সংহতি (Solidarity) গড়ে উঠতে পারে না। কারণ এটি বিভিন্ন নারীর মধ্যেকার ক্ষমতার সম্পর্ককে আড়াল করে। একজন আমেরিকান নারী এবং একজন বাংলাদেশি গার্মেন্টস কর্মী, যিনি হয়তো আমেরিকান কোনো ব্র্যান্ডের জন্য দিনে ১২ ঘণ্টা কাজ করে পোশাক তৈরি করেন, তারা কি সমান? তাদের মধ্যে কি ক্ষমতার কোনো সম্পর্ক নেই? যখন আমেরিকান নারী সস্তায় পোশাকটি কেনেন, তখন তিনি কি পরোক্ষভাবে সেই বৈশ্বিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার (Global Capitalist System) অংশ হয়ে যান না, যা বাংলাদেশি নারীটিকে শোষণ করছে?

প্রকৃত সংহতি গড়ে ওঠে পার্থক্যকে স্বীকার করে নেওয়ার মাধ্যমে। এটি গড়ে ওঠে যখন পশ্চিমা নারীবাদীরা নিজেদের সুবিধাপ্রাপ্ত (Privileged) অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হন এবং বোঝেন যে, বিশ্বজুড়ে নারীদের নিপীড়নের পেছনে শুধু পিতৃতন্ত্রই নয়, বিশ্বায়ন (Globalization), নয়া-উপনিবেশবাদ (Neocolonialism), বহুজাতিক পুঁজি (Multinational Capital) এবং সাম্রাজ্যবাদও (Imperialism) গভীরভাবে দায়ী। এই অভিন্ন শত্রুগুলোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মাধ্যমেই প্রকৃত আন্তর্জাতিক নারীবাদী সংহতি তৈরি হতে পারে (Mohanty, 2003)। এটি দাতব্য বা করুণা নয়, এটি রাজনৈতিক জোট।

৩. জ্ঞানতাত্ত্বিক সহিংসতা ও ‘তৃতীয় বিশ্বের পার্থক্য’র নির্মাণ: মোহান্তীর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, পশ্চিমা নারীবাদী গবেষণায় ‘তৃতীয় বিশ্বের নারী’ প্রায়শই গবেষণার ‘কর্তা’ (Subject of knowledge) না হয়ে ‘বস্তু’ (Object of study) তে পরিণত হন। তাকে বিশ্লেষণ করা হয়, তার সম্পর্কে তত্ত্ব তৈরি করা হয়, কিন্তু তার নিজের জ্ঞান বা বিশ্লেষণকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এটি এক ধরনের জ্ঞানতাত্ত্বিক সহিংসতা, যা তার আত্মপরিচয় এবং আত্মমর্যাদাকে কেড়ে নেয়। আরও ভয়ংকর বিষয় হলো, এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পশ্চিমা নারীবাদ নিজেকে সংজ্ঞায়িত করে। সে ‘তৃতীয় বিশ্বের নারী’র বিপরীতে নিজেকে স্থাপন করে। ‘ওরা’ যদি হয় অশিক্ষিত, ঐতিহ্যবাদী, পরাধীন, তাহলে ‘আমরা’ হলাম শিক্ষিত, আধুনিক, স্বাধীন। অর্থাৎ, তৃতীয় বিশ্বের নারীর এই পশ্চাৎপদ ছবিটি পশ্চিমা নারীর আধুনিক পরিচয় নির্মাণের জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠে। এটিকেই মোহান্তী বলেছেন “The production of the Third World Difference”। এই পার্থক্যটি কোনো বাস্তব সত্য নয়, এটি একটি জ্ঞানতাত্ত্বিক নির্মাণ, যা ক্ষমতার সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখে।

তাহলে উপায় কী? মোহান্তীর প্রস্তাবনা

“Under Western Eyes” শুধু সমস্যা চিহ্নিত করেই থেমে থাকেনি, সমাধানের পথও দেখিয়েছে। মোহান্তীর প্রস্তাবনাগুলো ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট এবং কার্যকর। তিনি পশ্চিমা নারীবাদকে পুরোপুরি বর্জন করতে বলেননি, বরং একে ভেতর থেকে পরিবর্তন করার, একে উপনিবেশমুক্ত (Decolonize) করার কথা বলেছেন।

১. প্রেক্ষাপট ও ইতিহাসের গুরুত্ব (The Importance of Context and History): প্রথম এবং প্রধান কাজ হলো, যেকোনো বিশ্লেষণকে তার নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে স্থাপন করা। ‘ইসলামে নারী’ বা ‘হিন্দু ধর্মে নারী’—এরকম ঢালাও আলোচনা বন্ধ করতে হবে। তার বদলে আলোচনা করতে হবে, নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট দেশে, নির্দিষ্ট শ্রেণীর মুসলিম বা হিন্দু নারীর অবস্থা কেমন। যেমন, ইরানে বিপ্লব-পূর্ববর্তী সময়ে নারীর অবস্থা আর বর্তমান সময়ে তার অবস্থা এক নয়। বাংলাদেশের একজন চাকমা নারীর অভিজ্ঞতা আর একজন বাঙালি মুসলিম নারীর অভিজ্ঞতাও এক নয়। এই নির্দিষ্টতার (Specificity) ওপর জোর দেওয়াই হলো প্রথম পদক্ষেপ। এর জন্য প্রয়োজন গভীর ও শ্রমসাধ্য গবেষণা, শুধুমাত্র মিডিয়ার তৈরি করা ছবির ওপর নির্ভর করা নয়।

২. পার্থক্যের রাজনীতি (The Politics of Difference): নারীদের মধ্যকার পার্থক্যকে সমস্যা হিসেবে না দেখে, শক্তি হিসেবে দেখতে হবে। তাদের ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা, লড়াই এবং জ্ঞানকে সম্মান করতে হবে। নারীবাদী আন্দোলনকে হতে হবে বহু স্বরের এক সম্মিলিত ঐকতান, কোনো একক কণ্ঠের নির্দেশ নয়। এর অর্থ হলো, শ্বেতাঙ্গ নারীবাদীদের শিখতে হবে কখন কথা বলতে হবে, আর কখন চুপ করে থেকে প্রান্তিক নারীদের কথা শুনতে হবে। পার্থক্যকে ভয় না পেয়ে, পার্থক্যের ভিত্তিতেই জোট গড়ার রাজনীতি করতে হবে।

৩. সংহতির নতুন সংজ্ঞা: কৌশলগত জোট (Redefining Solidarity: Strategic Coalitions): মোহান্তী তার পরবর্তী কাজ, বিশেষ করে তার বই “Feminism Without Borders: Decolonizing Theory, Practicing Solidarity” (2003)-এ, সংহতির ধারণাকে আরও বিকশিত করেছেন। তিনি বলেন, সংহতি কোনো আবেগি বা প্রাকৃতিক বিষয় নয় (“কারণ আমরা সবাই নারী”), এটি একটি কঠিন রাজনৈতিক কাজ (Political Work)। এটি গড়ে ওঠে যৌথ রাজনৈতিক লক্ষ্যের ভিত্তিতে, যাকে বলা যেতে পারে কৌশলগত জোট (Strategic Coalition)।

যেমন, বিশ্বজুড়ে নারীরা পরিবেশ রক্ষা, শ্রমিকের অধিকার আদায়, যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন বা বর্ণবাদ-বিরোধী আন্দোলনের জন্য একসাথে কাজ করতে পারে। এই ধরনের সংহতি পরিচয়ের ওপর ভিত্তি করে নয়, বরং রাজনৈতিক অঙ্গীকারের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। এখানে একজন আমেরিকান পরিবেশকর্মী, একজন ভারতীয় কৃষক এবং একজন ব্রাজিলিয়ান আদিবাসী নারী—সবাই মিলে একটি বহুজাতিক কোম্পানির দূষণের বিরুদ্ধে জোট বাঁধতে পারে। তাদের পরিচয় ভিন্ন, তাদের দৈনন্দিন জীবন ভিন্ন, কিন্তু তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য এক। এটাই হলো মোহান্তীর প্রস্তাবিত সংহতি। এই সংহতি করুণা বা দাতব্যের ওপর ভিত্তি করে নয়, বরং পারস্পরিক সম্মান ও সংহতির শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ভিত্তিতে তৈরি হয়।

৪. অবস্থানের রাজনীতি (The Politics of Location): এটি মোহান্তীর একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। এর মানে হলো, প্রত্যেক তাত্ত্বিক বা কর্মীকে নিজের সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। আমি কোথা থেকে কথা বলছি? আমার শ্রেণী, বর্ণ, জাতীয়তা, শিক্ষা—এগুলো আমার দৃষ্টিভঙ্গিকে কীভাবে প্রভাবিত করছে? আমার কথায় কি কোনো ক্ষমতার দম্ভ মিশে আছে? এই স্ব-সমালোচনা (Self-reflexivity) ছাড়া একটি ন্যায়সঙ্গত নারীবাদী রাজনীতি অসম্ভব। একজন পশ্চিমা গবেষককে বুঝতে হবে যে তার পাসপোর্ট, তার শিক্ষা, তার গায়ের রং তাকে এমন কিছু সুবিধা দেয় যা তার গবেষণার বিষয় হওয়া নারীটির নেই। তাকে প্রশ্ন করতে হবে, ‘আমার গবেষণা কার কাজে লাগবে? এই জ্ঞান কি স্থানীয় নারীদের ক্ষমতায়ন করবে, নাকি আমার নিজের অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ারকে এগিয়ে নিয়ে যাবে?’ এই ক্ষমতার পার্থক্যকে স্বীকার করেই তাকে কাজ করতে হবে।

আজকের দিনে “আন্ডার ওয়েস্টার্ন আইজ”-এর প্রাসঙ্গিকতা

১৯৮৪ সালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ কেন ২০২৪ সালেও এত গুরুত্বপূর্ণ? কারণ মোহান্তী যে সমস্যাগুলোর কথা বলেছিলেন, সেগুলো আজও প্রবলভাবে বর্তমান। হয়তো তাদের চেহারা কিছুটা বদলেছে, কিন্তু মূল রোগটি সারেনি।

  • ‘উদ্ধারকারী’র মানসিকতা: আজও আফগানিস্তান, ইরান বা অন্য কোনো মুসলিম দেশের নারীদের নিয়ে কথা উঠলেই পশ্চিমা গণমাধ্যম ও রাজনীতিতে ‘উদ্ধার’ করার ডিসকোর্সটি ফিরে আসে। ইরানের মাহসা আমিনির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে প্রায়শই পশ্চিমা মিডিয়া একটি সরল ‘হিজাব বনাম স্বাধীনতা’র লড়াই হিসেবে চিত্রিত করেছে, যা আন্দোলনের গভীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটকে আড়াল করে দেয়। ইউক্রেনের শ্বেতাঙ্গ নারী শরণার্থীদের প্রতি যে সহানুভূতি দেখানো হয়, সিরিয়া, ফিলিস্তিন বা রোহিংগা বাদামী নারী শরণার্থীদের প্রতি কি একই রকম সহানুভূতি দেখা যায়? এখানেই “Under Western Eyes”-এর বিশ্লেষণ জীবন্ত হয়ে ওঠে।

  • সোশ্যাল মিডিয়া ও সরলীকরণ: সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে যেকোনো জটিল বিষয়কে হ্যাশট্যাগের মাধ্যমে সরলীকরণ করার প্রবণতা বেড়েছে। কোনো একটি দেশের নির্দিষ্ট একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে (যেমন: একটি অনার কিলিং) পুরো দেশের নারীদের সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা তৈরি করে ফেলা হয়, যা মোহান্তীর সমালোচনার মূল বিষয় ছিল। #SaveAfghanWomen বা এই জাতীয় হ্যাশট্যাগগুলো প্রায়শই একটি জটিল রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক পরিস্থিতিকে একটি সরল মানবিক সংকটে পরিণত করে, যা পশ্চিমা হস্তক্ষেপের পথ খুলে দেয় এবং আফগান নারীদের নিজেদের এজেন্সি ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞাকে অস্বীকার করে।

  • এনজিও এবং উন্নয়ন সংস্থা: অনেক আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা এবং এনজিও আজও এমন সব প্রকল্প নিয়ে কাজ করে, যা স্থানীয় বাস্তবতা এবং নারীদের চাহিদা থেকে বিচ্ছিন্ন। তাদের উন্নয়ন মডেলগুলো প্রায়শই পশ্চিমা মানদণ্ড দ্বারা নির্ধারিত হয়, যা স্থানীয় সংস্কৃতির ওপর এক ধরনের আগ্রাসন চালায়। এই ‘এনজিও-করণ’ (NGO-ization) প্রায়শই নারীবাদী আন্দোলনকে র‍্যাডিকাল রাজনৈতিক সংগ্রাম থেকে সরিয়ে এনে প্রকল্প-ভিত্তিক এবং দাতা-নির্ভর কাজে পরিণত করে। এতে প্রান্তিক নারীরা হয়ে ওঠেন ‘প্রকল্পের সুবিধাভোগী’ (beneficiary), রাজনৈতিক কর্তা (political agent) নন।

  • পপ-কালচার ও কর্পোরেট নারীবাদ: আজকের কর্পোরেট বা ‘গার্ল বস’ নারীবাদ (Girlboss Feminism) প্রায়শই মোহান্তীর সমালোচনার আওতায় পড়ে। এই নারীবাদ ব্যক্তিগত সাফল্য এবং ভোগকেই নারীমুক্তি হিসেবে দেখায়, কিন্তু বৈশ্বিক পুঁজিবাদী শোষণ বা সাম্রাজ্যবাদের মতো কাঠামোগত সমস্যাগুলোকে এড়িয়ে যায়। টি-শার্টে ‘ফেমিনিস্ট’ লিখে পরাটা সহজ, কিন্তু যে নারী শ্রমিকটি সেই টি-শার্টটি বানিয়েছে তার অধিকারের জন্য লড়াই করাটা কঠিন। এই ধরনের নারীবাদ প্রথম বিশ্বের সুবিধাপ্রাপ্ত নারীদের জন্য স্বস্তিদায়ক হলেও, বিশ্বের অধিকাংশ নারীর জীবনের বাস্তবতার সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই।

শেষ কথা: নতুন এক চশমা

চন্দ্রা তালপাড়ে মোহান্তীর কাজ কোনো বিভেদের দলিল নয়। এটি পশ্চিমা নারীবাদকে বাতিল করে দেওয়ার জন্যও লেখা হয়নি। বরং এটি ছিল একটি আত্মসমালোচনার জরুরি আহ্বান। একটি আহ্বান ছিল আরও সৎ, আরও ন্যায়সঙ্গত এবং আরও কার্যকর একটি আন্তর্জাতিক নারীবাদী আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য। এটি পশ্চিমা নারীবাদকে তার সীমানা চিনতে এবং সেই সীমানা অতিক্রম করার পথ দেখিয়েছে।

শুরুতে যে দুজন নারীর কথা বলেছিলাম—নিউইয়র্কের সেই নারী আর বাংলাদেশের গ্রামের সেই নারী—তাদের লড়াই হয়তো ভিন্ন। তাদের জগৎ হয়তো আলাদা। কিন্তু তারা কি পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন? মোহান্তী আমাদের শেখান, না, তারা বিচ্ছিন্ন নয়। তাদের মধ্যে অদৃশ্য কিন্তু শক্তিশালী যোগসূত্র রয়েছে। হয়তো নিউইয়র্কের নারী যে কফিটি পান করছেন, সেই কফি এসেছে লাতিন আমেরিকার কোনো নারী শ্রমিকের শোষিত শ্রম থেকে। হয়তো যে বহুজাতিক সংস্থাটি নিউইয়র্কের নারীর কর্মক্ষেত্র, সেই সংস্থাই দূষণ ছড়িয়ে বাংলাদেশের নারীর পরিবেশ নষ্ট করছে। হয়তো যে সস্তা পোশাকটি পশ্চিমা নারীবাদীর শক্তি ও পছন্দের প্রতীক, সেটি তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের সেই নারীর সস্তা শ্রমে, তার চোখের জলে।

মোহান্তী আমাদের এই অদৃশ্য যোগসূত্রগুলোই দেখতে বলেন। তিনি বলেন, শুধু লিঙ্গের ভিত্তিতে নয়, পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ এবং বর্ণবাদের মতো বড় বড় কাঠামোগুলোর বিরুদ্ধে যৌথ সংগ্রামের ভিত্তিতেই গড়ে উঠতে পারে সত্যিকারের সংহতি। সেই সংহতি উপর থেকে নিচে নামে না, পাশাপাশি হেঁটে তৈরি হয়। এটি করুণার সম্পর্ক নয়, কমরেডশিপের সম্পর্ক।

“Under Western Eyes” একটি চশমা। যে চশমা দিয়ে দেখলে আমরা শুধু অন্যদের নয়, নিজেদেরও নতুন করে দেখতে শিখি। এই চশমা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আমাদের নিজেদের অজ্ঞানতা, আমাদের নিজেদের সুবিধাভোগী অবস্থান। এটি আমাদের শেখায় যে, জগৎটা সাদা-কালো নয়। এখানে হাজারো রং, হাজারো স্বর, হাজারো লড়াই। সব স্বরকে শোনার মতো কান এবং সব রংকে দেখার মতো চোখ তৈরি করাই হলো সত্যিকারের নারীবাদী রাজনীতির প্রথম পাঠ। আর সেই পাঠ আজও শেষ হয়নি। মোহান্তীর প্রবন্ধটি সেই অশেষ পাঠের এক অবশ্যম্ভাবী এবং চিরকালীন ভূমিকা। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মুক্তি বাইরে থেকে আসে না, মুক্তি আসে ভেতর থেকে, নিজেদের শর্তে, নিজেদের লড়াইয়ের মাধ্যমে। আর সেই লড়াইয়ে বিশ্বজুড়ে নারীরা একা নন, যদি তারা একে অপরের পার্থক্যকে সম্মান করে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াতে শেখে।

তথ্যসূত্র

  • Abu-Lughod, L. (2002). Do Muslim Women Really Need Saving? Anthropological Reflections on Cultural Relativism and Its Others. American Anthropologist, 104(3), 783–790.
  • Crenshaw, K. (1989). Demarginalizing the Intersection of Race and Sex: A Black Feminist Critique of Antidiscrimination Doctrine, Feminist Theory and Antiracist Politics. University of Chicago Legal Forum, 1989(1), Article 8.
  • Mohanty, C. T. (1984). Under Western Eyes: Feminist Scholarship and Colonial Discourses. Boundary 2, 12/13, 333–358.
  • Mohanty, C. T. (2003). Feminism Without Borders: Decolonizing Theory, Practicing Solidarity. Duke University Press.
  • Said, E. W. (1978). Orientalism. Pantheon Books.
  • Spivak, G. C. (1988). Can the Subaltern Speak? In C. Nelson & L. Grossberg (Eds.), Marxism and the Interpretation of Culture (pp. 271–313). University of Illinois Press.

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.