সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ (Sociological Perspective): চেনা পৃথিবীর অচেনা আয়নায়

Table of Contents

ভূমিকা

মধ্যদুপুর গড়িয়ে বিকেল নামছে। ধরুন, আপনি জানালার পাশে বসে আছেন। আপনার সামনে চায়ের কাপ, তাতে আলতো ধোঁয়া উড়ছে, বৃষ্টির পর ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ ভেসে আসছে। বাইরে তাকিয়ে দেখছেন, স্কুলফেরত একদল শিশু কাঁদা-জল মাড়িয়ে চেঁচামেচি করতে করতে ছুটে যাচ্ছে। তাদের পিঠে ভারী স্কুলব্যাগ, পায়ে ধুলোমাখা জুতো। একটু দূরে একজন ফেরিওয়ালা প্রায়-ছিঁড়ে-যাওয়া প্লাস্টিকের ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে উদাস সুরে ডেকে চলেছেন। রাস্তার মোড়ে ট্রাফিক জ্যামে আটকে থাকা গাড়িগুলো অধৈর্য হর্নের ঐকতান বাজাচ্ছে, যার সাথে মিশে যাচ্ছে কোনো অ্যাম্বুলেন্সের তীব্র সাইরেন।

খুব সাধারণ, আটপৌরে একটি দৃশ্য। তাই না? প্রতিদিন এমন শত শত দৃশ্য আমাদের চোখের সামনে দিয়ে ভেসে যায়। আমরা দেখি, কিন্তু খেয়াল করি না। কারণ, মস্তিষ্ক এই পরিচিত তথ্যগুলোকে দ্রুত প্রসেস করে আমাদের মনোযোগ বাঁচায়। কিন্তু যদি বলি, এই সাধারণ দৃশ্যের প্রতিটি উপাদানের পেছনে লুকিয়ে আছে এক-একটি মহাকাব্য? যদি বলি, ওই শিশুদের স্কুলব্যাগের ওজন শুধু বইয়ের নয়, বরং এক তীব্র প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষাব্যবস্থা, মধ্যবিত্তের সামাজিক সচলতার (Social Mobility) আকাঙ্ক্ষা আর ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার সম্মিলিত ভার? ফেরিওয়ালার ওই উদাস সুরের সাথে জড়িয়ে আছে গ্রামীণ অর্থনীতি ভেঙে পড়া, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষির সংকট এবং শহরে অভিবাসনের দীর্ঘশ্বাস? আর ওই ট্রাফিক জ্যাম কেবল গাড়ির জটলা নয়, বরং অপরিকল্পিত নগরায়ন, শ্রেণি-বৈষম্য (একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত SUV এবং একটি গাদাগাদি করা পাবলিক বাসের সহাবস্থান) আর রাষ্ট্রীয় নীতির এক জটিল জ্যামিতি?

এই যে চেনা দৃশ্যকে নতুন করে দেখা, সাধারণের গভীরে লুকিয়ে থাকা অসাধারণকে খুঁজে বের করা, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সাথে বৃহত্তর সমাজকে জুড়ে দেওয়া—এটাই হলো সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ (The Sociological Perspective)। এটি কোনো জাদুমন্ত্র নয়, আবার রকেট সায়েন্সও নয়। এটি হলো আমাদের পৃথিবীকে দেখার একটি বিশেষ চশমা। এই চশমা চোখে দিলে আমাদের চিরচেনা পৃথিবীটাই হঠাৎ করে অদ্ভুত, রহস্যময় আর নতুন মনে হতে শুরু করে। মনে হয়, এতদিন যা কিছু করেছি বা ভেবেছি, তার কতটুকুই বা আমার নিজের ছিল? আমাদের সিদ্ধান্ত, আমাদের ভালোবাসা, আমাদের দুঃখ, এমনকি আমাদের স্বপ্নগুলোও কি অলক্ষ্যে কোনো সামাজিক সুতোয় বাঁধা?

এই দীর্ঘ লেখায় আমরা সেই বিশেষ চশমাটা পরে আমাদের সমাজকে তন্নতন্ন করে দেখার চেষ্টা করব। আমরা দেখব এই দৃষ্টিকোণ কীভাবে কাজ করে, কেনই বা এর জন্ম হলো, এবং কোন কোন মূল তত্ত্বের মাধ্যমে সমাজবিজ্ঞানীরা এই জটিল, গোলমেলে অথচ সুন্দর পৃথিবীকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। শুধু তাই নয়, আমরা দেখব সমাজবিজ্ঞানীরা কীভাবে মাঠ পর্যায়ে কাজ করে এই তত্ত্বগুলোকে বাস্তবে রূপ দেন। এটি একটি দীর্ঘ যাত্রা হতে চলেছে। চায়ের কাপটি আরেকবার ভরে নিন। চলুন, ডুব দেওয়া যাক সমাজবিজ্ঞানের রহস্যময় আর বিস্ময়কর জগতে।

সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ: পৃথিবীকে পাঠ করার তিনটি সূত্র

সমাজবিজ্ঞানী পিটার বার্জার (Peter Berger) তাঁর বিখ্যাত বই “ইনভিটেশন টু সোসিওলজি”-তে এক চমৎকার কথা বলেছেন। তাঁর মতে, সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণের প্রথম পাঠ হলো “seeing the general in the particular” অর্থাৎ বিশেষের মধ্যে সাধারণকে খুঁজে পাওয়ার ক্ষমতা (Berger, 1963)। এর সাথে আরও দুটো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত: “seeing the strange in the familiar” বা পরিচিতের মধ্যে অপরিচিতকে আবিষ্কার করা এবং আমাদের প্রতিটি নিঃশ্বাসে সমাজের অদৃশ্য কিন্তু শক্তিশালী প্রভাবকে উপলব্ধি করা। এই তিনটি সূত্রকে বোঝা মানে সমাজবিজ্ঞানের সদর দরজায় পা রাখা।

১. বিশেষের মধ্যে সাধারণকে খুঁজে পাওয়া (Seeing the General in the Particular)

ধরুন, আপনার বন্ধু সজীব সিদ্ধান্ত নিল সে বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়বে। এটি তার একটি ‘বিশেষ’ (particular) বা ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। সে হয়তো বলবে, “আমার ছোটবেলা থেকেই কম্পিউটারের প্রতি ঝোঁক ছিল” অথবা “এই লাইনে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল”। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানী এর মধ্যে একটি ‘সাধারণ’ (general) সামাজিক প্যাটার্ন খুঁজে বের করবেন। তিনি দেখবেন, এই সময়ে কেন হাজার হাজার তরুণ-তরুণী সজীবের মতো কম্পিউটার সায়েন্স বা এই জাতীয় প্রযুক্তি-নির্ভর বিষয় পড়তে চাইছে?

  • অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট: বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে প্রযুক্তি শিল্পের রমরমা অবস্থা। এখানে ভালো বেতনের চাকরি, বিদেশে যাওয়ার সুযোগ আর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি আছে। এই অর্থনৈতিক বাস্তবতা সজীবের ‘ব্যক্তিগত’ সিদ্ধান্তকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে। তার পছন্দটি একটি বৃহত্তর অর্থনৈতিক কাঠামোর প্রতিচ্ছবি।

  • সামাজিক মর্যাদা (Social Status): আমাদের সমাজে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার যে ঐতিহ্যবাহী মর্যাদা ছিল, তার পাশাপাশি এখন আইটি প্রফেশনাল, সফটওয়্যার ডেভেলপার—এই পেশাগুলোরও একটি নতুন সামাজিক মর্যাদা তৈরি হয়েছে। ‘সফল’ হওয়ার সামাজিক সংজ্ঞার সাথে এই পেশাগুলো এখন সমার্থক। সজীবের সিদ্ধান্তটি শুধু আর্থিক নয়, সামাজিক মর্যাদা অর্জনের আকাঙ্ক্ষারও প্রতিফলন।

  • সাংস্কৃতিক পুঁজি (Cultural Capital): ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী পিয়ের বোর্দিও (Pierre Bourdieu) বলতেন, শুধু অর্থনৈতিক পুঁজিই নয়, মানুষের সাংস্কৃতিক পুঁজি—যেমন শিক্ষা, রুচি, কথা বলার ধরণ—তার জীবনকে প্রভাবিত করে। সজীবের পরিবার হয়তো তাকে এমনভাবে বড় করেছে যেখানে প্রযুক্তিগত জ্ঞানকে উৎসাহিত করা হয়, যা তার এই বিষয় পছন্দের পেছনে একটি বড় ভূমিকা রেখেছে।

  • লিঙ্গীয় ভূমিকা (Gender Roles): একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, কম্পিউটার সায়েন্সের ক্লাসে ছেলেদের সংখ্যা মেয়েদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি। কেন? এর পেছনে কি ‘টেকনোলজি ছেলেদের বিষয়’—এই জাতীয় কোনো অলিখিত সামাজিক ধারণা কাজ করছে? যদিও এই ধারণা বদলাচ্ছে, তবুও এর ঐতিহাসিক প্রভাব এখনও বিদ্যমান।

  • শ্রেণিগত অবস্থান (Class Position): ভালো মানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়ার খরচ নেহায়েত কম নয়। সজীবের পারিবারিক শ্রেণিগত অবস্থানই তাকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ এবং সাহস জুগিয়েছে। বস্তিতে থাকা কোনো কিশোরের পক্ষে এমন স্বপ্ন দেখাও হয়তো কঠিন।

এভাবে সজীবের একটি আপাত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তকে বিশ্লেষণ করলেই আমরা দেখতে পাই, এর পেছনে কীভাবে কাজ করছে অর্থনীতি, বিশ্বায়ন, সামাজিক মর্যাদা, লিঙ্গ এবং শ্রেণির মতো বড় বড় সামাজিক শক্তি। আমাদের জীবনের প্রতিটি ‘বিশেষ’ পছন্দের পেছনেই লুকিয়ে আছে এমন অজস্র ‘সাধারণ’ সামাজিক প্যাটার্ন। আপনি কোন ব্র্যান্ডের শ্যাম্পু ব্যবহার করেন, ছুটির দিনে সিনেমা দেখতে যান নাকি গ্রামের বাড়ি যান, প্রেম করে বিয়ে করবেন নাকি পরিবারের পছন্দে—এই সবকিছুর মধ্যেই সমাজ তার অদৃশ্য ছাপ রেখে যায়।

২. পরিচিতের মধ্যে অপরিচিতকে দেখা (Seeing the Strange in the Familiar)

এই দৃষ্টিকোণ আমাদের সবচেয়ে স্বাভাবিক এবং অভ্যস্ত বিষয়গুলোকেও প্রশ্নের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে শেখায়। এটা অনেকটা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রথমবার দেখার মতো; নিজের চেহারাটাকেই অদ্ভুত লাগতে শুরু করে।

ধরুন, আপনি লাইনে দাঁড়িয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন। কী এমন ব্যাপার! এ তো রোজকার ঘটনা। কিন্তু সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত। কেন সম্পূর্ণ অপরিচিত একদল মানুষ কোনোপ্রকার ঝগড়াঝাঁটি ছাড়াই একটি অদৃশ্য সরলরেখা তৈরি করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে? কে এই নিয়ম বানিয়েছে? কেন কেউ লাইন ভেঙে আগে যেতে চাইলে বাকিরা সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ করে?

এই প্রশ্নগুলো করতে শুরু করলেই আমাদের ‘পরিচিত’ লাইনে দাঁড়ানোর ঘটনাটি ‘অপরিচিত’ বা ‘অদ্ভুত’ লাগতে শুরু করে। আমরা বুঝতে পারি, এটি কেবল অপেক্ষার একটি প্রক্রিয়া নয়। এটি হলো সামাজিক শৃঙ্খলা (Social Order), পারস্পরিক বোঝাপড়া (Mutual Understanding) এবং অলিখিত নিয়ম (Unwritten Rules) পালনের এক অসাধারণ উদাহরণ। এই লাইনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে নাগরিকতার বোধ, সামাজিক নিয়ন্ত্রণ (Social Control) এবং সভ্যতার এক ক্ষুদ্র সংস্করণ। এখানে কোনো পুলিশ নেই, আইন নেই, তবু নিয়ম মানা হচ্ছে। এই অদৃশ্য শক্তিটাই সমাজবিজ্ঞানীর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।

একইভাবে ভাবুন বিয়ে নামক প্রথাটির কথা। দুটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ একসাথে জীবনযাপন করতে চায়—ব্যাপারটা তো খুবই সরল। কিন্তু এর জন্য পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র মিলে যে বিশাল যজ্ঞের আয়োজন করে, তা কি অদ্ভুত নয়? কেন হাজার বছরের পুরনো ধর্মীয় মন্ত্র পাঠ করতে হয়, সরকারি দপ্তরে গিয়ে কাগজে সই করতে হয়, শত শত মানুষকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতে হয়? কেবল ভালোবাসার জন্য এত আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজন কী?

সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ বলবে, বিয়ে কেবল দুটি মানুষের আবেগকেন্দ্রিক মিলন নয়। এটি আসলে সম্পত্তি (Property) ও উত্তরাধিকারের প্রশ্ন, বংশরক্ষা (Lineage) ও সামাজিক পরিচয়ের ধারাবাহিকতা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এবং সমাজে লিঙ্গীয় ভূমিকা (Gender Roles) নির্ধারণের একটি অত্যন্ত শক্তিশালী সামাজিক প্রতিষ্ঠান (Social Institution)। বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানটি নিশ্চিত করে যে জন্ম নেওয়া শিশুর একটি সামাজিক পরিচয় থাকবে এবং তার ভরণপোষণের দায়িত্ব নির্দিষ্ট হবে। যখন আমরা এই চোখে দেখতে শিখি, তখন আমাদের কাছে খুব ‘স্বাভাবিক’ মনে হওয়া বিয়েটাও তার সমস্ত জটিলতা আর ঐতিহাসিক ভার নিয়ে এক ‘অদ্ভুত’ প্রথা হিসেবে হাজির হয়।

৩. আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সমাজের ভূমিকা এবং সমাজতাত্ত্বিক কল্পনা

আমরা সবাই ভাবতে ভালোবাসি যে আমরা আমাদের জীবনের চালক। আমাদের সাফল্য আমাদের চেষ্টার ফল, আমাদের ব্যর্থতা আমাদের ভুলের মাসুল। আমাদের পছন্দ-অপছন্দ, আমাদের পথচলা—সবকিছুই আমাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে। সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ এই আরামদায়ক ব্যক্তি-স্বাধীনতার (Individualism) ধারণাটিকে একটি বড় ঝাঁকুনি দেয়। এটি দেখায়, আমাদের জীবনতরীর গতিপথ বহুলাংশে নির্ধারিত হয় আমরা কোন সামাজিক সমুদ্রে, কোন আবহাওয়ায় এবং কোন ধরনের নৌকায় জন্মেছি তার দ্বারা।

ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খাইম (Émile Durkheim) তাঁর যুগান্তকারী গবেষণা “সুইসাইড”-এ দেখিয়েছেন যে আত্মহত্যা—যা কিনা সবচেয়ে ব্যক্তিগত, মনস্তাত্ত্বিক এবং চরম একটি কাজ বলে মনে করা হয়—তারও রয়েছে শক্তিশালী সামাজিক কারণ (Durkheim, 1897/1951)। তিনি উনিশ শতকের ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলের আত্মহত্যার হার বিশ্লেষণ করে দেখান যে, আত্মহত্যার হারের সাথে ব্যক্তির সামাজিক একাত্মতার (Social Integration) এবং সামাজিক নিয়ন্ত্রণের (Social Regulation) গভীর সম্পর্ক রয়েছে। যেমন:

  • বিবাহিতদের চেয়ে অবিবাহিতদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি (কম সামাজিক একাত্মতা)।

  • ক্যাথলিকদের চেয়ে প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি (প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মে ব্যক্তির উপর গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ কম, যা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে বেশি গুরুত্ব দেয়)।

  • শান্তির সময়ের চেয়ে যুদ্ধ বা সামাজিক বিপ্লবের সময় আত্মহত্যার হার কমে যায় (মানুষ তখন বৃহত্তর গোষ্ঠীর সাথে বেশি একাত্ম বোধ করে)।

ডুর্খাইম প্রমাণ করেন যে, সমাজ যখন তার সদস্যদের যথেষ্ট পরিমাণে একাত্ম করতে বা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়, তখন এক ধরনের লক্ষ্যহীনতা বা বিশৃঙ্খলা (Anomie) তৈরি হয়, যা আত্মহত্যার মতো চরম পদক্ষেপের দিকে মানুষকে ঠেলে দিতে পারে।

এই দৃষ্টিকোণটিকেই আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী সি. রাইট মিলস (C. Wright Mills) নাম দিয়েছেন “সমাজতাত্ত্বিক কল্পনা” (The Sociological Imagination)। মিলসের মতে, এটি হলো ব্যক্তিগত সমস্যাকে (Personal Troubles) বৃহত্তর সামাজিক ইস্যুর (Public Issues) সাথে যুক্ত করে দেখার ক্ষমতা (Mills, 1959)। যেমন:

  • ব্যক্তিগত সমস্যা: একজন তরুণী, রিমি, চাকরি পাচ্ছে না। সে হয়তো ভাবছে তার যোগ্যতার অভাব, বা ইন্টারভিউ ভালো হয়নি। এটি তার ব্যক্তিগত ব্যর্থতার অনুভূতি।

  • সামাজিক ইস্যু: যখন একটি সমাজে রিমির মতো লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত তরুণ-তরুণী বেকার, তখন এটি আর রিমির ব্যক্তিগত সমস্যা থাকে না। এটি হয়ে যায় একটি সামাজিক ইস্যু। এর কারণ তখন খুঁজতে হবে সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো, শিক্ষাব্যবস্থার গলদ (যা হয়তো বাস্তব কর্মসংস্থানের জন্য দক্ষ কর্মী তৈরি করতে পারছে না), সরকারের কর্মসংস্থান নীতি এবং বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার মধ্যে।

সমাজতাত্ত্বিক কল্পনা আমাদের শেখায় যে, আমাদের ব্যক্তিগত জীবন একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। এটি বৃহত্তর ইতিহাস এবং সামাজিক কাঠামোর বিশাল ক্যানভাসে আঁকা একটি ছবি। এই দৃষ্টিকোণ একদিকে যেমন আমাদের ব্যক্তিগত অহংকার কমায়, তেমনই অন্যদিকে আমাদের সহানুভূতি বাড়ায়। আমরা বুঝতে পারি, দারিদ্র্য, অপরাধ বা বেকারত্বের জন্য কেবল ব্যক্তি নিজে দায়ী নয়, এর পেছনে অদৃশ্য কিন্তু প্রচণ্ড শক্তিশালী সামাজিক শক্তিও কাজ করে। এটি আমাদের অন্যের পরিস্থিতি বিচার করার আগে একটু থামতে শেখায়।

সমাজবিজ্ঞানের জন্ম: এক রক্তাক্ত ও উত্তাল সময়ের ফসল

সমাজবিজ্ঞান নামক এই নতুন ধরনের জ্ঞানকাণ্ডটি কোনো শান্ত, নিরিবিলি লাইব্রেরিতে বসে থাকা দার্শনিকের মস্তিষ্ক থেকে জন্মায়নি। এর জন্মের পেছনে আছে এক রক্তরঞ্জিত, উত্তাল এবং বৈপ্লবিক সময়ের ইতিহাস। অষ্টাদশ এবং ঊনবিংশ শতকে ইউরোপে পরপর তিনটি বিশাল ঝড় বয়ে গিয়েছিল, যা হাজার বছরের পুরনো সামন্ততান্ত্রিক পৃথিবীকে ভেঙে চুরমার করে এক নতুন, অচেনা এবং জটিল পৃথিবীর জন্ম দেয়। এই নতুন পৃথিবীর সংকট, সম্ভাবনা আর অফুরন্ত প্রশ্নগুলোকে বুঝতেই জন্ম হয়েছিল সমাজবিজ্ঞানের।

১. শিল্প বিপ্লব (The Industrial Revolution): ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে শুরু হওয়া এই বিপ্লব ছিল মানব ইতিহাসের এক বিরাট উল্লম্ফন। বাষ্পীয় ইঞ্জিন, নতুন নতুন যন্ত্রপাতি আর কারখানার আবিষ্কার মানুষের জীবনযাত্রাকে আমূল বদলে দেয়। হাজার হাজার বছর ধরে যে গ্রামভিত্তিক, কৃষিনির্ভর সমাজ টিকে ছিল, তা দ্রুত ভেঙে পড়তে শুরু করে। লাখ লাখ মানুষ রুটি-রুজির সন্ধানে গ্রাম ছেড়ে শহরের কারখানায় কাজ করতে আসে। জন্ম নেয় বিশাল, ঘিঞ্জি, নাম-পরিচয়হীন নগর সমাজ। এর সাথে সাথে জন্ম নেয় সম্পূর্ণ নতুন ধরনের সামাজিক সমস্যা—অস্বাস্থ্যকর বস্তি, ভয়াবহ দূষণ, লাগামহীন অপরাধ, নারী ও শিশুশ্রমসহ ভয়াবহ শ্রমিক শোষণ, এবং এক ধরনের বিচ্ছিন্নতাবোধ (Alienation)। পুরনো ধর্ম বা সামন্ততান্ত্রিক দর্শন দিয়ে এই নতুন নগরকেন্দ্রিক সমস্যাগুলোকে আর ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল না। প্রয়োজন ছিল নতুন এক বিজ্ঞানের।

২. ফরাসি বিপ্লব (The French Revolution): যদি শিল্প বিপ্লব হয় অর্থনৈতিক পরিবর্তন, তবে ফরাসি বিপ্লব ছিল রাজনৈতিক ও ভাবাদর্শগত এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। ১৭৮৯ সালের এই বিপ্লব কেবল ফ্রান্সের অত্যাচারী রাজতন্ত্রকেই বাস্তিলের সাথে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়নি, এটি ‘রাজার ঐশ্বরিক অধিকার’ (Divine Right of Kings) বা ‘ঈশ্বর প্রদত্ত সমাজ ব্যবস্থা’—এই জাতীয় হাজার বছরের পুরনো বিশ্বাসগুলোকেও ভেঙে চুরমার করে দেয়। সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার (Liberty, Equality, Fraternity) মতো নতুন ধারণাগুলো সামনে আসে। মানুষ প্রথমবারের মতো ভাবতে শুরু করে, সমাজ কোনো ঈশ্বর বা প্রকৃতি প্রদত্ত অপরিবর্তনীয় ব্যবস্থা নয়, বরং মানুষই এর নির্মাতা। আর যা মানুষ তৈরি করতে পারে, তা মানুষ আরও ভালোভাবে বিশ্লেষণ, সমালোচনা এবং পরিবর্তনও করতে পারে। এই ধারণাটিই সমাজকে বৈজ্ঞানিকভাবে অধ্যয়ন করার দরজা হাট করে খুলে দেয়।

৩. বৈজ্ঞানিক বিপ্লব (The Scientific Revolution): এর আগেই কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, নিউটনের হাত ধরে প্রাকৃতিক বিশ্বকে পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ এবং বিশ্লেষণের যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির (Scientific Method) জন্ম হয়েছিল, তা মানুষের চিন্তার জগতে এক বিপ্লব এনেছিল। জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, রসায়নের সাফল্য দেখে তৎকালীন চিন্তাবিদদের মনে এই বিশ্বাস দৃঢ় হয় যে, মানব সমাজকেও একইভাবে বৈজ্ঞানিকভাবে বোঝা সম্ভব। তাঁরা ভাবতে শুরু করেন, সমাজেরও হয়তো নিজস্ব কিছু নিয়ম বা সূত্র (Social Laws) আছে, যা আবিষ্কার করা গেলে সামাজিক সমস্যাগুলোর সমাধান করা সম্ভব।

এই তিন বিপ্লবের ফলে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা, নতুন আশা এবং অজস্র নতুন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই এগিয়ে আসেন একদল চিন্তাবিদ। ফরাসি দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানী অগুস্ত কোঁত (Auguste Comte) এই নতুন জ্ঞানকাণ্ডের প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে স্পষ্টভাবে অনুভব করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, সমাজের বিশৃঙ্খলা দূর করে প্রগতি আনতে হলে একটি নতুন বিজ্ঞানের প্রয়োজন, যার নাম তিনি দেন “Social Physics” বা সামাজিক পদার্থবিদ্যা, এবং পরবর্তীতে ১৮৩৮ সালে এর নাম পরিবর্তন করে রাখেন “Sociology” (সমাজবিজ্ঞান)। তাঁর স্বপ্ন ছিল, প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মতোই কঠোর নিয়মকানুন ও পর্যবেক্ষণ দিয়ে সমাজকে বিশ্লেষণ করে একটি উন্নত মানব সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, যাকে তিনি বলতেন পজিটিভিজম (Positivism) (Comte, 1830-42/1975)। কোঁতকে তাই সমাজবিজ্ঞানের আনুষ্ঠানিক জনক হিসেবে অভিহিত করা হয়।

কোঁতের দেখানো পথে হেঁটে পরবর্তীতে কার্ল মার্ক্স (Karl Marx), এমিল ডুর্খাইম (Émile Durkheim) এবং ম্যাক্স ওয়েবার (Max Weber)-এর মতো দিকপাল তাত্ত্বিকরা সমাজবিজ্ঞানকে একটি পরিপূর্ণ ও শক্তিশালী জ্ঞানকাণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁদের কাজই আজকের সমাজবিজ্ঞানের মূল ভিত্তি।

সমাজতাত্ত্বিক তত্ত্ব: পৃথিবীকে দেখার তিনটি প্রধান লেন্স

সমাজবিজ্ঞানীরা এই জটিল সমাজকে কীভাবে ব্যাখ্যা করেন? তাদের কি কোনো গোপন সূত্র আছে? ঠিক সূত্র না থাকলেও, তাদের কিছু তাত্ত্বিক কাঠামো বা দৃষ্টিকোণ (Theoretical Approach/Paradigm) আছে, যা সমাজকে বিভিন্ন দিক থেকে বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করে। এগুলোকে অনেকটা ভিন্ন ভিন্ন পাওয়ারের চশমার সাথে তুলনা করা যায়। একই দৃশ্যকে এই তিনটি চশমা দিয়ে দেখলে তিন রকম মনে হবে। কোনো একটি চশমা ‘সঠিক’ আর অন্যটি ‘ভুল’—ব্যাপারটা মোটেও তেমন নয়। বরং তিনটি চশমাই আমাদের সমাজ নামক জটিল ছবির ভিন্ন ভিন্ন দিক উন্মোচন করে একটি পূর্ণাঙ্গ ধারণা পেতে সাহায্য করে।

এই তিনটি প্রধান তাত্ত্বিক কাঠামো হলো:

  • ১. কাঠামোগত-ক্রিয়াবাদী দৃষ্টিকোণ (The Structural-Functional Approach)
  • ২. সামাজিক-দ্বন্দ্বমূলক দৃষ্টিকোণ (The Social-Conflict Approach)
  • ৩. প্রতীকী-মিথস্ক্রিয়াবাদী দৃষ্টিকোণ (The Symbolic-Interaction Approach)

চলুন, এবার এই তিনটি শক্তিশালী লেন্স চোখে লাগিয়ে আমাদের সমাজকে ব্যবচ্ছেদ করা যাক।

১. কাঠামোগত-ক্রিয়াবাদী দৃষ্টিকোণ (The Structural-Functional Approach)

এই দৃষ্টিকোণ সমাজকে একটি জীবন্ত দেহের (Living Organism) সাথে তুলনা করে। আমাদের দেহে যেমন হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, মস্তিষ্ক, কিডনি—এরকম বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আছে এবং প্রতিটি অঙ্গ নির্দিষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে পুরো শরীরটাকে সুস্থ ও সচল রাখে, ঠিক তেমনই সমাজে বিভিন্ন কাঠামো বা প্রতিষ্ঠান (Structure/Institution) আছে। যেমন: পরিবার, শিক্ষাব্যবস্থা, অর্থনীতি, রাষ্ট্র, ধর্ম ইত্যাদি। এই প্রতিটি কাঠামোর নির্দিষ্ট কিছু কাজ বা ক্রিয়া (Function) আছে, যা গোটা সমাজকে স্থিতিশীল (Stable), সুসংহত (Integrated) এবং ভারসাম্যপূর্ণ (Equilibrium) রাখতে সাহায্য করে।

এই মতবাদের মূল প্রবক্তাদের মধ্যে রয়েছেন অগুস্ত কোঁত, হার্বার্ট স্পেন্সার (Herbert Spencer) এবং এমিল ডুর্খাইম। স্পেন্সার, যিনি ডারউইনের বিবর্তনবাদ দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন, সমাজকেও টিকে থাকার জন্য সংগ্রামরত একটি জীবন্ত সত্তা হিসেবে দেখেছেন, যা সরল থেকে জটিলের দিকে বিবর্তিত হয়। ডুর্খাইমের কাছে সমাজের মূল প্রশ্ন ছিল সামাজিক সংহতি (Social Solidarity)—কী সেই আঠা যা সমাজকে একসাথে বেঁধে রাখে? তিনি দুই ধরনের সংহতির কথা বলেছেন: যান্ত্রিক সংহতি (Mechanical Solidarity), যা সাদৃশ্যের উপর ভিত্তি করে সরল, ঐতিহ্যবাহী সমাজে দেখা যায়, এবং জৈবিক সংহতি (Organic Solidarity), যা আধুনিক জটিল সমাজে শ্রম বিভাজনের (Division of Labor) মাধ্যমে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা থেকে তৈরি হয়।

আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী ট্যালকট পার্সনস (Talcott Parsons) এই তত্ত্বের একজন প্রধান প্রবক্তা ছিলেন, যিনি সমাজকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যবস্থা (System) হিসেবে দেখেছেন। তবে আরেকজন আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী রবার্ট কে. মার্টন (Robert K. Merton) এই তত্ত্বকে আরও বাস্তবসম্মত এবং সূক্ষ্মভাবে বিকশিত করেন। তিনি দেখান যে, যেকোনো সামাজিক কাঠামোর ফলাফল বা পরিণতি সবসময় কাঙ্ক্ষিত বা স্পষ্ট হয় না। তিনি তিন ধরনের ক্রিয়ার কথা বলেন (Merton, 1968):

  • প্রকাশ্য ক্রিয়া (Manifest Functions): কোনো কাঠামোর সেইসব কাজ যা স্বীকৃত, উদ্দেশ্যমূলক এবং সুস্পষ্ট। যেমন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশ্য কাজ হলো শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা প্রদান করা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করা এবং তাদের উন্নত চাকরির জন্য প্রস্তুত করা।

  • সুপ্ত ক্রিয়া (Latent Functions): কোনো কাঠামোর সেইসব কাজ যা অস্বীকৃত, উদ্দেশ্যমূলক নয় এবং প্রায়শই অলক্ষ্যে থেকে যায়, কিন্তু বাস্তবে ঘটে। যেমন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপ্ত কাজ হলো তরুণ-তরুণীদের একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত শ্রমবাজারের প্রতিযোগিতা থেকে দূরে রাখা, তাদের জন্য একটি সামাজিক নেটওয়ার্ক বা বন্ধুত্বের বলয় তৈরি করা, এবং অনেকের জন্য ভাবী জীবনসঙ্গী খুঁজে পাওয়ার একটি উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করা।

  • অ-ক্রিয়া বা দুষ্ক্রিয়া (Dysfunctions): সামাজিক কাঠামোর সেইসব পরিণতি যা সমাজের স্থিতিশীলতা ও সংহতির জন্য ক্ষতিকর। যেমন, বিশ্ববিদ্যালয়ের দুষ্ক্রিয়ার একটি উদাহরণ হতে পারে, এটি এমন একটি আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা তৈরি করে যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা, মানসিক চাপ এবং হতাশার জন্ম দেয়।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, সমাজে যা কিছুই টিকে আছে, তার নিশ্চয়ই কোনো না কোনো ইতিবাচক কাজ আছে, নইলে তা হারিয়ে যেত। এমনকি অপরাধের মতো নেতিবাচক বিষয়েরও নাকি কাজ আছে! ডুর্খাইম মনে করতেন, অপরাধ সমাজের নৈতিক সীমানা (Moral Boundaries) নির্ধারণ করতে সাহায্য করে। যখন কোনো অপরাধী সমাজের চোখে শাস্তি পায়, তখন সমাজের বাকি সদস্যরা বুঝতে পারে কোনটি ঠিক এবং কোনটি ভুল। এই প্রক্রিয়া সমাজের সদস্যদের মধ্যে এক ধরনের নৈতিক ঐক্য তৈরি করে এবং সামাজিক সংহতিকে শক্তিশালী করে।

সমালোচনা: এই তত্ত্বের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো, এটি স্থিতিশীলতা, সংহতি এবং ভারসাম্যের উপর এত বেশি জোর দেয় যে সমাজে বিদ্যমান গভীর অসাম্য (Inequality), সংঘাত (Conflict) এবং অবিরাম পরিবর্তনকে (Change) প্রায় উপেক্ষা করে। এই তত্ত্ব পড়লে মনে হয় যেন সমাজ একটি নিখুঁত যন্ত্র, যার সব অংশই সুন্দরভাবে কাজ করে চলেছে। কিন্তু আসলেই কি তাই? ধনী-গরিবের আকাশ-পাতাল বৈষম্য, জাতিগত বিদ্বেষ, নারী-পুরুষের অসাম্য—এগুলো কি সমাজের ‘ভালোর’ জন্য টিকে আছে? এই তত্ত্ব এসব অস্বস্তিকর প্রশ্নকে এড়িয়ে যায় এবং অনেক সময় রক্ষণশীল বা স্থিতাবস্থার সমর্থক হিসেবে সমালোচিত হয়। এই তত্ত্বের সীমাবদ্ধতার উত্তর খুঁজতেই জন্ম হয়েছে পরের তত্ত্বটির।

২. সামাজিক-দ্বন্দ্বমূলক দৃষ্টিকোণ (The Social-Conflict Approach)

ক্রিয়াবাদী তত্ত্ব যদি সমাজকে দেখে একটি শান্ত, সুসংহত দেহ হিসেবে, তাহলে দ্বন্দ্বমূলক তত্ত্ব সমাজকে দেখে একটি উত্তপ্ত যুদ্ধক্ষেত্র বা কুস্তির আখড়া (Arena) হিসেবে। এই দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী, সমাজ কোনো সম্প্রীতি বা সহযোগিতার জায়গা নয়, বরং এটি ক্ষমতা, সম্পদ, সুযোগ এবং মর্যাদার মতো সীমিত ও মূল্যবান রিসোর্সের জন্য বিভিন্ন প্রভাবশালী ও সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠীর মধ্যে চলমান সংগ্রাম ও সংঘাতের ক্ষেত্র। সম্প্রীতি বা স্থিতিশীলতা যদি কোথাও দেখা যায়, তবে তা আসলে এক পক্ষের উপর অন্য পক্ষের আধিপত্যের ফল, সত্যিকারের ঐক্য নয়।

এই তত্ত্বের অবিসংবাদিত মূল পুরোধা হলেন জার্মান দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী কার্ল মার্ক্স (Karl Marx)। মার্ক্স মানব ইতিহাসকে দেখেছেন শ্রেণি সংগ্রামের (Class Struggle) ইতিহাস হিসেবে। তিনি আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজকে দুটি প্রধান পরস্পরবিরোধী শ্রেণিতে (Class) বিভক্ত হিসেবে দেখেছেন: বুর্জোয়া (Bourgeoisie) বা পুঁজিপতি শ্রেণি, যারা উৎপাদনের উপকরণের (যেমন—কারখানা, জমি, পুঁজি, প্রযুক্তি) মালিক, এবং প্রলেতারিয়েত (Proletariat) বা শ্রমিক শ্রেণি, যাদের বেঁচে থাকার জন্য নিজেদের শ্রম শক্তি বিক্রি করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই (Marx & Engels, 1848/2004)।

মার্ক্সের মতে, এই দুটি শ্রেণির স্বার্থ সম্পূর্ণ বিপরীত। পুঁজিপতি শ্রেণি চায় সর্বোচ্চ মুনাফা, আর তা সম্ভব হয় শ্রমিককে তার শ্রমের ন্যায্য মূল্যের চেয়ে কম মজুরি দিয়ে। এই শোষণই হলো পুঁজিবাদী সমাজের মূল ভিত্তি এবং মূল দ্বন্দ্ব। মার্ক্স আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দেন:

  • বিচ্ছিন্নতাবোধ (Alienation): পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমিক তার নিজের শ্রমের ফল থেকে, উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে, সহকর্মী থেকে এবং এমনকি নিজের মনুষ্যত্ব থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সে একটি যন্ত্রের যন্ত্রাংশে পরিণত হয়।

  • মিথ্যা চেতনা (False Consciousness): শাসক শ্রেণি তাদের মতাদর্শ (ধর্ম, জাতীয়তাবাদ, গণমাধ্যম) ব্যবহার করে শ্রমিক শ্রেণিকে এমনভাবে ব্রেনওয়াশ করে যে, তারা তাদের নিজেদের শোষণের বাস্তবতাকে বুঝতে পারে না এবং এই ব্যবস্থাকেই স্বাভাবিক ও ন্যায্য বলে মেনে নেয়।

  • শ্রেণি চেতনা (Class Consciousness): মার্ক্স বিশ্বাস করতেন, এই শোষণের এক পর্যায়ে শ্রমিক শ্রেণি তাদের মিথ্যা চেতনা থেকে বেরিয়ে আসবে। তারা নিজেদেরকে একটি শোষিত শ্রেণি হিসেবে ঐক্যবদ্ধভাবে চিনতে পারবে এবং বিপ্লবের মাধ্যমে এই শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে একটি শ্রেণিহীন, সাম্যবাদী (Communist) সমাজ প্রতিষ্ঠা করবে।

মার্ক্সের অর্থনৈতিক শ্রেণিকেন্দ্রিক কাজকে ভিত্তি করে পরবর্তীতে আরও অনেক ধরনের দ্বন্দ্বমূলক তত্ত্ব গড়ে উঠেছে, যা সমাজের অন্যান্য বিভাজন রেখাগুলোকে সামনে নিয়ে এসেছে। এর মধ্যে দুটি প্রধান ধারা হলো:

ক) নারীবাদ এবং লিঙ্গ-দ্বন্দ্ব তত্ত্ব (Feminism and Gender-Conflict Theory)

এই তত্ত্বটি সামাজিক-দ্বন্দ্বের ধারণাকে শ্রেণি থেকে সরিয়ে লিঙ্গের (Gender) ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে। নারীবাদী তাত্ত্বিকরা বলেন, সমাজ কেবল শ্রেণি দ্বারাই বিভক্ত নয়, এটি লিঙ্গ দ্বারাও গভীরভাবে বিভক্ত। প্রায় সকল জ্ঞাত সমাজেই একটি পিতৃতান্ত্রিক (Patriarchal) ব্যবস্থা চালু আছে, যেখানে পুরুষরা কাঠামোগতভাবে নারীদের উপর আধিপত্য বিস্তার করে এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত জীবনে বেশি ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে।

লিঙ্গ-দ্বন্দ্ব তত্ত্ববিদরা যেসব বিষয় নিয়ে গবেষণা ও আন্দোলন করেন তার মধ্যে রয়েছে:

  • কর্মক্ষেত্রে একই কাজের জন্য নারী-পুরুষের বেতন বৈষম্য (Gender Pay Gap)।

  • নারীর উপর পারিবারিক ও সামাজিক সহিংসতা (Domestic and Social Violence)।

  • রাজনীতি, কর্পোরেট জগৎ এবং ক্ষমতার কেন্দ্রে নারীর নগণ্য উপস্থিতি।

  • বিজ্ঞাপন ও গণমাধ্যমে নারীকে যৌনবস্তু (Sexual Object) বা পণ্য হিসেবে উপস্থাপন।

  • ‘দ্বিতীয় শিফট’ (Second Shift) ধারণা, যেখানে কর্মজীবী নারীদের অফিসের কাজের পর ঘরে ফিরে আবার অবৈতনিক সাংসারিক ও পরিচর্যার কাজ করতে হয়, যা তাদের উপর এক অসহনীয় দ্বিগুণ বোঝা চাপিয়ে দেয় (Hochschild & Machung, 2012)।

ছেদবিন্দু তত্ত্ব বা ইন্টারসেকশনালিটি (Intersectionality): আধুনিক নারীবাদী তাত্ত্বিকরা, বিশেষ করে কিম্বার্লি ক্রেনশ (Kimberlé Crenshaw) দেখিয়েছেন যে, লিঙ্গীয় শোষণ বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এটি শ্রেণি, জাতি, ধর্ম, যৌন অভিরুচি ইত্যাদি অন্যান্য পরিচয়ের সাথে মিলেমিশে এক জটিল ধরনের বৈষম্য তৈরি করে। একজন দরিদ্র, কৃষ্ণাঙ্গ, সমকামী নারীর অভিজ্ঞতা একজন উচ্চবিত্ত, শ্বেতাঙ্গ, বিষমকামী নারীর অভিজ্ঞতা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

খ) জাতি-দ্বন্দ্ব তত্ত্ব (Race-Conflict Theory)

এই তত্ত্বটি জাতি (Race) এবং বর্ণকে (Ethnicity) কেন্দ্র করে সমাজে বিদ্যমান অসাম্য, শোষণ ও সংঘাতকে বিশ্লেষণ করে। এই তত্ত্বের মূল কথা হলো, শ্বেতাঙ্গ বা সামাজিকভাবে প্রভাবশালী জাতিগোষ্ঠী ঐতিহাসিকভাবে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী, বিশেষ করে অশ্বেতাঙ্গ বা সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর উপর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে আধিপত্য বজায় রেখেছে এবং তাদের শোষণ ও প্রান্তিকীকরণের মাধ্যমে নিজেরা সুবিধাভোগী হয়েছে।

আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী ডব্লিউ. ই. বি. ডু বোইস (W. E. B. Du Bois) এই ধারার একজন পথিকৃৎ। তিনি “দ্বৈত চেতনা” (Double Consciousness) নামক একটি অসাধারণ ধারণা দেন। তিনি বলেন, আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গদের সব সময় নিজেদেরকে দুটি চোখে দেখতে হয়: একটি নিজের চোখে, অন্যটি আধিপত্যকারী শ্বেতাঙ্গ সমাজের চোখে, যে সমাজ তাদের অবজ্ঞা, ভয় আর করুণার চোখে দেখে (Du Bois, 1903/1994)। এই দ্বৈত সত্তার যন্ত্রণা তাদের আত্মপরিচয়কে এক চিরস্থায়ী সংকটের মধ্যে রাখে।

জাতি-দ্বন্দ্ব তত্ত্ব প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদ (Institutional Racism) বা সিস্টেমিক বর্ণবাদ (Systemic Racism)-এর মতো বিষয়গুলোকেও সামনে নিয়ে আসে। এটি দেখায় যে, বর্ণবাদ কেবল কতিপয় ব্যক্তির ব্যক্তিগত কুসংস্কার বা বিদ্বেষ নয়, বরং এটি সমাজের আইন, বিচারব্যবব্যবস্থা, পুলিশিং, আবাসন নীতি, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষাব্যবস্থার গভীরে এমনভাবে প্রোথিত, যা পদ্ধতিগতভাবে একটি জাতিগোষ্ঠীকে অন্যটির উপর প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সুবিধা দেয়।

সমালোচনা: দ্বন্দ্বমূলক তত্ত্ব সমাজে বিদ্যমান অসাম্য, অবিচার এবং বিভাজনকে উন্মোচন করতে অত্যন্ত শক্তিশালী একটি হাতিয়ার। কিন্তু এর সমালোচনা হিসেবে অনেকেই বলেন, এটি সংঘাত ও শোষণের উপর এত বেশি জোর দেয় যে সমাজের স্থিতিশীলতা, সংহতি এবং মানুষের পারস্পরিক সহযোগিতার দিকগুলোকে প্রায়ই উপেক্ষা করে, যেখানে মানুষ কেবল লড়াই করে না, ভালোবাসে, বন্ধুত্ব করে, একে অপরকে সাহায্যও করে। তাদের মতে, মার্ক্সীয় তত্ত্ব অর্থনৈতিক শ্রেণির উপর এত বেশি জোর দেয় যে লিঙ্গ, জাতি, ধর্মের মতো পরিচয়ের নিজস্ব গুরুত্বকে অনেক সময় খাটো করে দেখে।

৩. প্রতীকী-মিথস্ক্রিয়াবাদী দৃষ্টিকোণ (The Symbolic-Interaction Approach)

এতক্ষণ আমরা যে দুটি তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করলাম, সেই দুটিই ছিল ‘ম্যাক্রো-লেভেল’ (Macro-level) বা বৃহৎ পরিসরের তত্ত্ব। তারা সমাজের বড় বড় কাঠামো—যেমন শ্রেণি, রাষ্ট্র, পরিবার—এগুলো নিয়ে কাজ করে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটা হেলিকপ্টার থেকে পুরো শহরটাকে দেখার মতো, যেখানে বড় বড় রাস্তা আর বিল্ডিং দেখা যায়, কিন্তু মানুষের মুখ দেখা যায় না।

এবার চলুন, হেলিকপ্টার থেকে মাটিতে নেমে আসা যাক। প্রতীকী-মিথস্ক্রিয়াবাদী দৃষ্টিকোণ হলো একটি ‘মাইক্রো-লেভেল’ (Micro-level) বা ক্ষুদ্র পরিসরের তত্ত্ব। এর ফোকাস সমাজের বড় কাঠামোর উপর নয়, বরং দৈনন্দিন জীবনে মানুষে-মানুষে যে মুখোমুখি মিথস্ক্রিয়া (Face-to-face Interaction) বা ভাবের আদান-প্রদান হয়, তার উপর। এই তত্ত্ব বলে, সমাজ কোনো উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া বিশাল আকৃতির বস্তু নয়, বরং অগণিত মানুষ তাদের প্রতিদিনের ছোট ছোট মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমেই সমাজকে প্রতিনিয়ত তৈরি করছে, পরিবর্তন করছে এবং নতুন করে অর্থ প্রদান করছে। সমাজ হলো একটি চলমান প্রক্রিয়া, কোনো স্থির বস্তু নয়।

এই তত্ত্বের মূল দার্শনিক ভিত্তি স্থাপন করেছেন জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার (Max Weber)। ওয়েবার মার্ক্স ও ডুর্খাইমের মতো বৃহৎ কাঠামোর বিপরীতে গিয়ে বলেছেন, সমাজকে বুঝতে হলে মানুষের কাজকর্মের পেছনের ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য বা অর্থকে (Subjective Meaning) বুঝতে হবে। তিনি এই পদ্ধতিকে বলেছেন Verstehen (উচ্চারণ: ফেয়ার-শ্টে-হেন), যা একটি জার্মান শব্দ, যার অর্থ ‘গভীরভাবে বোঝা’ বা ‘সহানুভূতিশীল উপলব্ধি’ (Weber, 1922/1978)।

পরবর্তীতে আমেরিকান দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানী জর্জ হার্বার্ট মিড (George Herbert Mead) এই তত্ত্বের মূল ভিত্তি স্থাপন করেন। মিড দেখিয়েছেন, মানুষ হিসেবে আমাদের অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো আমরা প্রতীকের (Symbol) মাধ্যমে চিন্তা করি এবং একে অপরের সাথে যোগাযোগ করি। ভাষা, অঙ্গভঙ্গি, চিহ্ন, পোশাক, পতাকা—এগুলো সবই প্রতীক। এই প্রতীকগুলোর কোনো সহজাত অর্থ নেই; আমরা সামাজিকভাবেই এগুলোর অর্থ আরোপ করি। এই সম্মিলিতভাবে আরোপ করা অর্থের উপর ভিত্তি করেই আমাদের বাস্তবতা (Reality) তৈরি হয়।

সমাজবিজ্ঞানী আরভিং গফম্যান (Erving Goffman) এই তত্ত্বকে এক অবিশ্বাস্য নতুন মাত্রা দেন তাঁর “নাট্যতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ” (Dramaturgical Analysis) দিয়ে। গফম্যানের মতে, আমাদের সামাজিক জীবনটা হলো একটি বিশাল নাটকের মঞ্চ (Stage) আর আমরা সবাই অভিনেতা-অভিনেত্রী (Goffman, 1959)। আমরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ভূমিকায় (Role) অভিনয় করে চলেছি—কখনো ছাত্র, কখনো সন্তান, কখনো বন্ধু, কখনো ক্রেতা। প্রতিটি পরিস্থিতিতে আমরা আমাদের ‘পারফরম্যান্স’ বা অভিনয় এমনভাবে সাজাই যাতে অন্যের কাছে আমাদের সম্পর্কে একটি কাঙ্ক্ষিত ধারণা বা ছাপ (Impression) তৈরি হয়। একে তিনি বলেছেন “সত্তার উপস্থাপন” (Presentation of Self)

গফম্যানের মতে, আমাদের একটা ‘ফ্রন্ট স্টেজ’ (Front Stage) আছে, যেখানে আমরা দর্শকের (অর্থাৎ অন্য মানুষের) সামনে সচেতনভাবে অভিনয় করি। আমাদের পোশাক-আশাক, কথা বলার ভঙ্গি, আচার-আচরণ—এগুলো সবই আমাদের চরিত্রের ‘প্রপস’ আর ‘স্ক্রিপ্ট’। আবার আমাদের একটা ‘ব্যাক স্টেজ’ (Back Stage) আছে, যেখানে আমরা দর্শকহীন অবস্থায় প্রস্তুতি নিই, মহড়া দিই এবং নির্ভার হয়ে আমাদের আসল সত্তায় ফিরে আসতে পারি (যেমন—বন্ধুদের সাথে আড্ডা বা নিজের শোবার ঘর)।

একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। একজন তরুণ চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছে। সে ফরমাল পোশাক পরছে (কস্টিউম), তার সার্টিফিকেট ফাইল গোছাচ্ছে (প্রপস), এবং সম্ভাব্য প্রশ্নের উত্তরগুলো মনে মনে মহড়া দিচ্ছে (স্ক্রিপ্ট)। ইন্টারভিউ বোর্ডে সে অত্যন্ত বিনয়ী, আত্মবিশ্বাসী এবং যোগ্য একজন প্রার্থী হিসেবে অভিনয় করবে (ফ্রন্ট স্টেজ পারফরম্যান্স)। ইন্টারভিউ শেষে বন্ধুদের সাথে দেখা করে সে হয়তো বলবে, “ধুর, কী সব প্রশ্ন করল, কিছুই পারলাম না!”—এটি তার ব্যাক স্টেজ।

এই তত্ত্বের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হলো থমাস থিওরেম (Thomas Theorem), যা ডব্লিউ. আই. থমাস এবং ডরোথি এস. থমাস দিয়েছেন: “If men define situations as real, they are real in their consequences.” অর্থাৎ, “মানুষ যদি কোনো পরিস্থিতিকে বাস্তব বলে সংজ্ঞায়িত করে, তবে তার পরিণতিও বাস্তব হয়ে ওঠে” (Thomas & Thomas, 1928)। এর মানে হলো, কোনো একটি বিষয় বস্তুগতভাবে সত্য কি না, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো মানুষ সেটিকে কীভাবে দেখছে বা বিশ্বাস করছে। যেমন, কোনো একটি ব্যাংক সম্পর্কে যদি গুজব ছড়ায় যে সেটি দেউলিয়া হয়ে যাবে (যদিও গুজবটি মিথ্যা), এবং মানুষ সেই গুজব বিশ্বাস করে ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে শুরু করে, তাহলে সত্যিই ব্যাংকটি দেউলিয়া হয়ে যাবে। এখানে মিথ্যা গুজবটিই একটি কঠিন বাস্তবতা তৈরি করল।

সমালোচনা: এই তত্ত্বটি দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি, মানুষের সৃজনশীলতা এবং মানুষ কীভাবে নিজেদের সামাজিক বাস্তবতা তৈরি করে, তা বুঝতে অসাধারণভাবে সাহায্য করে। কিন্তু এর প্রধান দুর্বলতা হলো, এর ক্ষুদ্র দৃষ্টিকোণ অনেক সময় বড় বড় সামাজিক কাঠামো—যেমন শ্রেণি, বর্ণবৈষম্য বা পিতৃতন্ত্রের প্রভাবকে উপেক্ষা করে। একজন বস্তিবাসী আর একজন কোটিপতির ‘সত্তার উপস্থাপন’ বা অভিনয়ের সুযোগ, স্বাধীনতা ও উপকরণ কি সমান? অবশ্যই না। প্রতীকী-মিথস্ক্রিয়াবাদ অনেক সময় এই বৃহত্তর ক্ষমতার প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় আনতে ব্যর্থ হয়, যা তার সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা।

সমাজতত্ত্ব শুধু তত্ত্ব নয়: মাঠের গবেষণা এবং পদ্ধতি

এতক্ষণ আমরা সমাজকে বোঝার জন্য বিভিন্ন তাত্ত্বিক লেন্স নিয়ে আলোচনা করলাম। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সমাজবিজ্ঞানীরা এই তত্ত্বগুলো কীভাবে তৈরি করেন? তারা কি শুধুই লাইব্রেরিতে বসে বড় বড় বই পড়েন আর চিন্তা করেন? উত্তর হলো, না। তত্ত্ব যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই গুরুত্বপূর্ণ হলো মাঠ পর্যায় থেকে তথ্য সংগ্রহ করে সেই তত্ত্বকে পরীক্ষা করা, সংশোধন করা বা নতুন তত্ত্ব তৈরি করা। সমাজবিজ্ঞান একটি অভিজ্ঞতামূলক (Empirical) বিজ্ঞান। এখানে তথ্য-প্রমাণ ছাড়া কোনো কথাই গ্রহণযোগ্য নয়।

সমাজবিজ্ঞানীরা মূলত দুই ধরনের গবেষণা পদ্ধতি ব্যবহার করেন:

১. পরিমাণগত গবেষণা (Quantitative Research): এই পদ্ধতিতে সংখ্যা বা পরিসংখ্যানের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হয়। এর মূল লক্ষ্য হলো বিভিন্ন সামাজিক ঘটনার মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক (Cause-and-effect relationship) খুঁজে বের করা এবং সেগুলোকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে সাধারণীকরণ (Generalize) করা। এর প্রধান হাতিয়ার হলো:

  • জরিপ (Survey): একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে অনেক মানুষের মতামত, বিশ্বাস বা আচরণ জানার জন্য প্রশ্নমালা ব্যবহার করা হয়। যেমন, বেকারত্বের হার বা নির্বাচনে কোন দল জিততে পারে, তা জানার জন্য জরিপ চালানো হয়।

২. গুণগত গবেষণা (Qualitative Research): এই পদ্ধতির লক্ষ্য সংখ্যা নয়, বরং গভীরতা। এটি মানুষের অভিজ্ঞতা, অনুভূতি এবং সামাজিক প্রক্রিয়ার ভেতরের অর্থ বোঝার চেষ্টা করে। এখানে তথ্য সংখ্যায় প্রকাশ না করে বর্ণনামূলকভাবে উপস্থাপন করা হয়। এর প্রধান হাতিয়ারগুলো হলো:

  • অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণ (Participant Observation): গবেষক নিজে কোনো একটি গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের সাথে মিশে গিয়ে তাদের জীবনযাত্রা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন এবং তথ্য সংগ্রহ করেন। যেমন, একজন সমাজবিজ্ঞানী বস্তিবাসীদের জীবন বুঝতে কয়েক মাস তাদের সাথে বস্তিতেই বসবাস করতে পারেন।

  • গভীর সাক্ষাৎকার (In-depth Interview): গবেষক অল্প কিছু মানুষের সাথে খোলামেলা এবং দীর্ঘ আলাপচারিতার মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে তাদের গভীর অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গি জানার চেষ্টা করেন।

  • ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশন (FGD): একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে আলোচনার জন্য ৮-১০ জনের একটি ছোট দলকে একত্রিত করা হয় এবং তাদের পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

এই পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করে সমাজবিজ্ঞানীরা আমাদের সামনে সমাজের এমন সব ছবি তুলে ধরেন, যা খালি চোখে দেখা সম্ভব নয়। এই গবেষণাগুলোই নীতি নির্ধারকদের সামাজিক সমস্যা সমাধানে এবং সাধারণ মানুষকে নিজেদের সমাজকে আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করে।

উপসংহার: চশমা যখন অনেক, পৃথিবী তখন বহুমাত্রিক

আমরা সমাজকে দেখার জন্য তিনটি ভিন্ন ভিন্ন লেন্স বা চশমার কথা জানলাম।

  • কাঠামোগত-ক্রিয়াবাদ নামক চশমাটি আমাদের দেখায় সমাজের স্থিতিশীলতার দিক, বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কাজ এবং কীভাবে সবকিছু মিলে একটি বিশাল ব্যবস্থা কোনোমতে টিকে থাকে। এটি অনেকটা শহরের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া ড্রোন ক্যামেরার মতো, যা পুরো শহরের কাঠামোটা দেখায়।

  • সামাজিক-দ্বন্দ্ব তত্ত্বের চশমাটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সমাজে লুকিয়ে থাকা গভীর ফাটল, অসাম্য, শোষণ আর ক্ষমতার নির্লজ্জ লড়াইকে। এটি সেই ড্রোন ক্যামেরা, যা শহরের সুন্দর পার্কের পাশে লুকিয়ে থাকা নোংরা বস্তিটাকেও ফোকাস করে।

  • আর প্রতীকী-মিথস্ক্রিয়াবাদের চশমাটি হলো একটি হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরা, যা আমাদের নিয়ে যায় মানুষের মুখের খুব কাছে, দেখায় কীভাবে প্রতিদিনের ছোট ছোট কথোপকথন, হাসি-কান্না, অভিনয় আর প্রতীকের আদান-প্রদানের মাধ্যমে আমরা আমাদের সামাজিক জগৎ তৈরি করি এবং ভেঙে ফেলি।

তাহলে প্রশ্ন হলো, কোনটি সেরা? কোনটি সত্য?

উত্তর হলো, কোনোটিই এককভাবে সেরা বা সম্পূর্ণ সত্য নয়। সমাজ এত জটিল এবং বহুমাত্রিক একটি ব্যাপার যে, তাকে কোনো একটি মাত্র চশমা দিয়ে পুরোপুরি দেখা অসম্ভব। একজন দক্ষ সমাজবিজ্ঞানী একজন দক্ষ ক্যামেরাম্যানের মতো। তিনি পরিস্থিতি অনুযায়ী লেন্স পরিবর্তন করতে জানেন। একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেতে হলে আমাদের যেমন ম্যাক্রো (বৃহৎ) ও মাইক্রো (ক্ষুদ্র) উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখতে হবে, তেমনই সমাজের সম্প্রীতি ও সংঘাত—উভয়কেই স্বীকার করতে হবে।

সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ আমাদের কোনো সহজ-সরল, রেডিমেড উত্তর দেয় না। বরং এটি আমাদের আরও ভালো, আরও গভীর এবং আরও অস্বস্তিকর প্রশ্ন করতে শেখায়। এটি আমাদের শেখায়, যা কিছু ‘স্বাভাবিক’ বলে মনে হয়, তাকে প্রশ্ন করতে। যা কিছু ‘ব্যক্তিগত’ বলে মনে হয়, তার পেছনে লুকিয়ে থাকা সামাজিক শক্তিকে খুঁজতে। এটি আমাদের শেখায়, পরম সত্য বলে কিছু নেই, আছে কেবল ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা খণ্ডিত সত্য।

এই দৃষ্টিকোণ অর্জন করা এক ধরনের মুক্তি, যদিও তা কিছুটা যন্ত্রণাদায়ক। এটি আমাদের নিজেদের জীবন এবং আমাদের চারপাশের পৃথিবীকে আরও স্বচ্ছভাবে, আরও গভীরভাবে বুঝতে সাহায্য করে। যখন আমরা বুঝতে পারি যে আমাদের পছন্দ বা ভাগ্য কেবল আমাদের একার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়, তখন আমরা অন্যের প্রতি আরও বেশি সহনশীল ও সহানুভূতিশীল হতে শিখি। আমরা যখন দেখি, জানালার ওপাশের ফেরিওয়ালা বা ট্রাফিক জ্যামে আটকে থাকা মানুষগুলো বিচ্ছিন্ন কোনো ব্যক্তি নয়, বরং তারা এক বৃহত্তর সামাজিক নাটকের চরিত্র, তখন আমাদের একাকিত্ব কমে আসে। আমরা বুঝতে পারি, সমাজকে আরও একটু সুন্দর, আরও একটু ন্যায্য করার জন্য আমাদের সবারই কিছু না কিছু করার আছে, কারণ আমরা প্রত্যেকেই এই বিশাল নাটকের এক একজন অভিনেতা, দর্শক এবং নাট্যকারও বটে।

চেনা পৃথিবীর ভেতরে লুকিয়ে থাকা এই অচেনা, জটিল ও বিস্ময়কর জগৎকে আবিষ্কারের যাত্রাই হলো সমাজবিজ্ঞান। এই যাত্রা কিছুটা গোলমেলে, কিছুটা হতাশাজনক, কিন্তু নিঃসন্দেহে মানবজীবনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর বুদ্ধিবৃত্তিক অভিযানগুলোর একটি।

তথ্যসূত্র

  • Berger, P. L. (1963). Invitation to sociology: A humanistic perspective. Anchor Books.
  • Comte, A. (1975). Auguste Comte and positivism: The essential writings (G. Lenzer, Ed.). Harper & Row. (Original work published 1830-1842).
  • Du Bois, W. E. B. (1994). The souls of black folk. Dover Publications. (Original work published 1903).
  • Durkheim, É. (1951). Suicide: A study in sociology (J. A. Spaulding & G. Simpson, Trans.). The Free Press. (Original work published 1897).
  • Goffman, E. (1959). The presentation of self in everyday life. Anchor Books.
  • Hochschild, A. R., & Machung, A. (2012). The second shift: Working families and the revolution at home (Rev. ed.). Penguin Books.
  • Marx, K., & Engels, F. (2004). The communist manifesto. Penguin Books. (Original work published 1848).
  • Merton, R. K. (1968). Social theory and social structure. The Free Press.
  • Mills, C. W. (1959). The sociological imagination. Oxford University Press.
  • Thomas, W. I., & Thomas, D. S. (1928). The child in America: Behavior problems and programs. Alfred A. Knopf.
  • Weber, M. (1978). Economy and society: An outline of interpretive sociology (G. Roth & C. Wittich, Eds.). University of California Press. (Original work published 1922).

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.