- ভূমিকা
ধরা যাক, আপনার বাসার দেয়ালে একটি পুরনো, দামী ঘড়ি ঝুলছে। পেন্ডুলামওয়ালা একটি গ্র্যান্ডফাদার ক্লক। টিক্ টিক্ করে গম্ভীর শব্দে সময় দিয়ে যাচ্ছে। আপনি হয়তো ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে শুধু সময় দেখেন, কিন্তু কখনো কি ভেবেছেন এর কাঁচের আবরণের ভেতরে ঠিক কী এক মহাযজ্ঞ ঘটে চলেছে? অসংখ্য ছোট-বড় দাঁতওয়ালা চাকা, প্যাঁচানো স্প্রিং, সূক্ষ্ম লিভার, ওজনদার পাথর—সবাই একটা নির্দিষ্ট ছন্দে, এক অমোঘ নিয়মে কাজ করে চলেছে। কোনো একটা চাকা যদি সামান্য বিগড়ে যায়, কিংবা একটা স্প্রিং যদি ছিঁড়ে যায়, তবে শুধু সেই অংশটিই নয়, বরং পুরো ঘড়িটাই অচল হয়ে পড়বে। একটি কাঁটা আরেকটা কাঁটাকে ছাড়া চলতে পারে না, একটি চাকা আরেকটা চাকাকে ছাড়া ঘুরতে পারে না। এদের সবার মধ্যে এক অদ্ভুত বোঝাপড়া, এক অলিখিত চুক্তি আছে। এরা প্রত্যেকেই পুরো ঘড়িটাকে সচল রাখার জন্য, অর্থাৎ ‘সঠিক সময় দেওয়া’ নামক চূড়ান্ত লক্ষ্যটি অর্জনের জন্য নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। এদের সম্মিলিত ও সমন্বিত প্রচেষ্টার ফলেই একটি অর্থবহ ফলাফল—সময়—তৈরি হচ্ছে।
সমাজবিজ্ঞানীরা যখন সমাজের দিকে তাকান, তখন তাদের কেউ কেউ সমাজকে ঠিক এই জটিল ও সুন্দর ঘড়িটার মতোই ভাবেন। তাদের মতে, সমাজ হলো এমন এক বিশাল ব্যবস্থা (System), যার ভেতরে রয়েছে পরিবার, রাষ্ট্র, অর্থনীতি, ধর্ম, শিক্ষা, আইন ব্যবস্থার মতো অসংখ্য ছোট-বড় অংশ বা কাঠামো (Structure)। এই প্রতিটি কাঠামোরই নির্দিষ্ট কিছু কাজ বা ক্রিয়া (Function) রয়েছে, যা পুরো সমাজব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য অপরিহার্য। আর এই সবগুলো অংশ যখন ঠিকঠাকভাবে নিজ নিজ কাজ করে যায়, তখনই সমাজ স্থিতিশীল (Stable) থাকে, সংহতিপূর্ণ (Cohesive) থাকে এবং টিকে থাকে। এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতা আর সমন্বয়ের এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা আমাদের এই সমাজ জীবন।
সমাজকে দেখার এই বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি বা তত্ত্বের নামই হলো কাঠামোগত ক্রিয়াবাদ (Structural Functionalism)। এই তত্ত্বটি একটু পুরনো ধাঁচের, অনেকটা গ্র্যান্ডমা-গ্র্যান্ডপার আমলের গল্পের মতো, যেখানে সবকিছুই কোনো না কোনো কারণে ঘটে, সবকিছুরই একটা উদ্দেশ্য থাকে। কিন্তু পুরনো বলে এর গুরুত্ব এতটুকুও কমেনি। সমাজকে সামগ্রিকভাবে বুঝতে হলে এই শক্তিশালী চশমাটা চোখে লাগিয়ে একবার দেখতেই হয়। এটি আমাদের সমাজের বড় চিত্রটা (Macro-level perspective) দেখতে সাহায্য করে; ব্যক্তি বা ছোট ছোট গোষ্ঠীর প্রতিদিনকার আলাপচারিতার বদলে পুরো সমাজের কলকব্জাগুলো কীভাবে কাজ করে, তা দেখায়। এটি একটি ‘টপ-ডাউন’ তত্ত্ব, যা দেখায় কীভাবে সামাজিক কাঠামো ব্যক্তির আচরণকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করে। চলুন, আজ এই পুরনো কিন্তু কাজের চশমাটা পরেই আমরা সমাজের ভেতরের সেই জটিল অথচ সুন্দর যন্ত্রটাকে দেখার এবং বোঝার চেষ্টা করি।
Table of Contents
এই ভাবনার শেকড় কোথায়? এক দীর্ঘ যাত্রার গল্প
কোনো কিছুই তো আকাশ থেকে পড়ে না। এই কাঠামোগত ক্রিয়াবাদের ধারণাটিও একদিনে তৈরি হয়নি। এর জন্ম হয়েছিল এক বিশেষ ঐতিহাসিক মুহূর্তে—ইউরোপের জ্ঞানদীপ্তি (Enlightenment) পরবর্তীকালে এবং ফরাসি বিপ্লব ও শিল্প বিপ্লবের চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে। পুরনো সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছিল, ধর্ম ও রাজতন্ত্রের প্রতি মানুষের আস্থা টলে গিয়েছিল, আর গ্রাম ছেড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ শহরের কারখানায় ভিড় জমাচ্ছিল। এই ভাঙাগড়ার যুগেই সমাজবিজ্ঞানীরা প্রশ্ন করতে শুরু করেন: এই চরম পরিবর্তনের মাঝেও সমাজ কীভাবে টিকে থাকে? কী সেই আঠা যা সমাজকে একসাথে ধরে রাখে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতেই কাঠামোগত ক্রিয়াবাদের বীজ রোপিত হয়েছিল। কয়েকজন বিখ্যাত চিন্তাবিদের হাত ধরে এই ভাবনার বীজ ধীরে ধীরে এক বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়েছে। এই যাত্রার প্রতিটি ধাপ তত্ত্বটিকে নতুন মাত্রা দিয়েছে।
অগাস্ট কোঁত (Auguste Comte): দূর থেকে দেখা প্রথম পথিক
ফরাসি এই ভদ্রলোককে সমাজবিজ্ঞানের জনক (Father of Sociology) বলা হয়। তিনি এমন এক সময়ে জন্মেছিলেন যখন ফরাসি বিপ্লবের (১৭৮৯-১৭৯৯) তোলপাড় এবং পরবর্তী নেপোলিয়নীয় যুদ্ধের কারণে পুরো ইউরোপের সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়েছিল। বিপ্লব সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার কথা বললেও বাস্তবে নিয়ে এসেছিল চরম অরাজকতা ও সন্ত্রাস। এই চরম বিশৃঙ্খলার মাঝে দাঁড়িয়ে কোঁত চাইলেন সমাজের একটি বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রাকৃতিক জগৎকে যেমন পদার্থবিজ্ঞান বা জীববিজ্ঞান দিয়ে বোঝা যায়, তেমনি সামাজিক জগৎকেও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে বোঝা সম্ভব। এই নতুন বিজ্ঞানের নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘সমাজবিজ্ঞান’ (Sociology), যাকে তিনি প্রথমে ‘সামাজিক পদার্থবিজ্ঞান’ (Social Physics) বলতে চেয়েছিলেন। তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল দুটি: সমাজের স্থিতিশীলতার সূত্র (laws of order) এবং অগ্রগতির সূত্র (laws of progress) খুঁজে বের করা। এই স্থিতিশীলতা ও গতিশীলতার দ্বৈত ধারণাই পরবর্তীকালে ক্রিয়াবাদের কাঠামো (structure) ও ক্রিয়া (function) ধারণার পূর্বসূরি।
কোঁত দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণার কথা বলেন, যা ক্রিয়াবাদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে:
১. সামাজিক স্থিতিশীলতা (Social Statics): এটি সমাজের কাঠামোগত দিকটি নিয়ে আলোচনা করে। অর্থাৎ, সমাজের বিভিন্ন অংশ (যেমন পরিবার, রাষ্ট্র, ধর্ম, অর্থনীতি) কীভাবে একে অপরের সাথে সম্পর্কিত এবং কীভাবে তারা একসাথে মিলে সমাজকে একটি সংহতিপূর্ণ সমগ্র হিসেবে স্থিতিশীল রাখে। ঠিক যেমন জীববিজ্ঞানের অ্যানাটমি বা শারীরস্থানে আমরা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের গঠন ও তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে পড়ি। কোঁতের মতে, সমাজের মূল ভিত্তি হলো একটি সাধারণ নৈতিক ঐক্য বা ‘কনসেনসাস’ (Consensus), যা ছাড়া কোনো সমাজই টিকে থাকতে পারে না। এই ঐক্যই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে একসাথে কাজ করতে চালিত করে। যেমন—পরিবার যদি শিশুকে নৈতিকতা শেখায়, রাষ্ট্র যদি সেই নৈতিকতার ভিত্তিতে আইন তৈরি করে এবং ধর্ম যদি তাকে পারলৌকিক সমর্থন দেয়, তবেই সমাজ স্থিতিশীল থাকে।
২. সামাজিক গতিশীলতা (Social Dynamics): এটি সমাজের পরিবর্তন ও অগ্রগতির দিকটি নিয়ে আলোচনা করে। কোঁতের মতে, মানব জ্ঞান এবং সমাজ তিনটি স্তরের মধ্যে দিয়ে বিকশিত হয়—ধর্মতাত্ত্বিক (Theological) স্তর, যেখানে মানুষ সবকিছুকে ঈশ্বরের বা অলৌকিক শক্তির কাজ বলে ব্যাখ্যা করে; অধিবিদ্যাগত (Metaphysical) স্তর, যেখানে মানুষ বিমূর্ত দার্শনিক ধারণা দিয়ে জগৎকে ব্যাখ্যা করে; এবং সবশেষে দৃষ্টবাদী বা বৈজ্ঞানিক (Positivistic) স্তর, যেখানে মানুষ পর্যবেক্ষণ ও যুক্তির মাধ্যমে জগৎকে ব্যাখ্যা করতে শেখে। এই দৃষ্টবাদই (Positivism) ছিল কোঁতের কাছে সমাজবিজ্ঞানের মূল ভিত্তি, যা সামাজিক ঘটনাকে বৈজ্ঞানিক কঠোরতার সাথে অধ্যয়নের কথা বলে।
কোঁতই প্রথম সমাজকে জীবদেহের (Organism) সাথে তুলনা করার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, যদিও তিনি বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি গভীরে যাননি। তাঁর এই ভাবনাগুলোই পরবর্তী চিন্তাবিদদের জন্য দরজা খুলে দিয়েছিল। তিনিই প্রথম শিখিয়েছেন কীভাবে সমাজের অংশগুলোকে একটি সামগ্রিক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে দেখতে হয় এবং সমাজের স্থিতিশীলতার জন্য তাদের ভূমিকার গুরুত্ব অনুধাবন করতে হয়।
হার্বার্ট স্পেন্সার (Herbert Spencer): জীবদেহের সাথে সমাজের বিয়ে
ব্রিটিশ দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানী হার্বার্ট স্পেন্সার ছিলেন কোঁতের ভাবনার যোগ্য উত্তরসূরি। তিনিই প্রথম সমাজ এবং জীবদেহের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট, বিস্তারিত এবং পদ্ধতিগত তুলনা হাজির করেন, যা জৈব সাদৃশ্য (Organic Analogy) নামে পরিচিত। স্পেন্সারের এই তুলনাটি কাঠামোগত ক্রিয়াবাদের মূল ভিত্তি স্থাপন করেছিল। তিনি বললেন, একটি প্রাণীর যেমন বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ (যেমন—হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, মস্তিষ্ক) থাকে এবং তারা একে অপরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পুরো দেহকে বাঁচিয়ে রাখে, সমাজেরও তেমনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা কাঠামো (যেমন—সরকার, অর্থনীতি, পরিবার, যোগাযোগ ব্যবস্থা) রয়েছে।
স্পেন্সার দেখালেন, জীবদেহ ও সমাজের মধ্যে বেশ কিছু গভীর মিল রয়েছে:
-
বৃদ্ধি (Growth): একটি শিশুদেহ যেমন কোষ বিভাজনের মাধ্যমে সময়ের সাথে সাথে বড় হয়, সমাজও তেমনি জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং ভৌগোলিক এলাকা বিস্তারের মাধ্যমে আকারে বৃদ্ধি পায়। একটি ছোট গ্রাম বড় শহরে পরিণত হয়।
-
জটিলতা বৃদ্ধি (Increasing Complexity): দেহ যেমন একটি সরল কোষ থেকে বিকশিত হয়ে জটিল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে বিভক্ত হয়, সমাজও তেমনি আদিম সরল অবস্থা থেকে আধুনিক জটিল অবস্থায় রূপান্তরিত হয়। আদিম সমাজে শ্রম বিভাজন (Division of Labor) অনেক কম ছিল। কিন্তু আধুনিক সমাজে প্রত্যেকে বিশেষায়িত কাজ করে।
-
অঙ্গগুলোর পৃথকীকরণ ও বিশেষায়ন (Differentiation and Specialization): জীবদেহে যেমন ফুসফুস শুধু শ্বাসপ্রশ্বাসের কাজ করে আর হৃৎপিণ্ড রক্ত সঞ্চালনের, তেমনি আধুনিক সমাজেও সরকার শাসনের কাজ করে, অর্থনীতি উৎপাদনের কাজ করে এবং শিক্ষা ব্যবস্থা জ্ঞান বিতরণের কাজ করে। প্রতিটি অঙ্গ বিশেষায়িত হয়ে ওঠে।
-
অঙ্গগুলোর পারস্পরিক নির্ভরশীলতা (Interdependence of Parts): হৃৎপিণ্ড ছাড়া যেমন মস্তিষ্ক অচল, তেমনি অর্থনীতি ছাড়া রাষ্ট্র চলতে পারে না। সমাজের একটি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে (যেমন অর্থনৈতিক মন্দা), অন্য অংশগুলোও (যেমন পরিবার, রাজনীতি) মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়।
-
সামগ্রিক অস্তিত্ব (Survival of the Whole): প্রতিটি অঙ্গ একা একা টিকে থাকতে পারে না; তারা পুরো জীবদেহকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কাজ করে। তেমনি, প্রতিটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান বিচ্ছিন্নভাবে অর্থহীন; তারা পুরো সমাজকে টিকিয়ে রাখার জন্য কাজ করে।
তবে স্পেন্সার একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যের কথাও বলেছিলেন। জীবদেহে চেতনা কেবল একটি অংশে (মস্তিষ্কে) কেন্দ্রীভূত থাকে, কিন্তু সমাজে চেতনা প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে ছড়িয়ে থাকে। সমাজের কোনো কেন্দ্রীয় মস্তিষ্ক নেই, বরং প্রতিটি সদস্যই সচেতন সত্তা।
স্পেন্সার আরও একটি ধারণার জন্য পরিচিত, যা হলো “সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট” (Survival of the Fittest) বা যোগ্যতমের টিকে থাকা। তিনি ডারউইনের বিবর্তনবাদকে সমাজে প্রয়োগ করে বলেন যে, সমাজেও একটি প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়া চলে। যে সমাজ বা গোষ্ঠী পরিবেশের সাথে ভালোভাবে খাপ খাওয়াতে পারে, সে-ই টিকে থাকে। এই ধারণাটি পরে ‘সামাজিক ডারউইনবাদ’ (Social Darwinism) নামে সমালোচিত হয়েছিল, কারণ এটি সামাজিক বৈষম্য, সাম্রাজ্যবাদ এবং ধনীদের প্রতি রাষ্ট্রের উদাসীনতাকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল। কিন্তু তাঁর মূল জৈব সাদৃশ্যের ধারণাটি ক্রিয়াবাদের বিকাশে একটি অপরিহার্য ধাপ ছিল।
এমিল ডুর্খাইম (Émile Durkheim): তত্ত্বের আসল স্থপতি
যদি স্পেন্সার এই তত্ত্বের ভিত্তি স্থাপন করে থাকেন, তবে ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খাইম এর উপর একটি মজবুত ও বৈজ্ঞানিক ইমারত গড়ে তুলেছেন। তাঁকে এই তত্ত্বের প্রধান এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রবক্তাদের একজন বলা হয়। তিনি স্পেন্সারের জীবদেহের ধারণাকে আরও শক্তিশালী ও গবেষণালব্ধ রূপ দেন। ডুর্খাইম বললেন, সমাজ কেবল ব্যক্তির সমষ্টি নয়, বরং এর ঊর্ধ্বে একটি স্বতন্ত্র সত্তা (sui generis reality), যার নিজস্ব নিয়ম ও বাস্তবতা আছে। তাঁর কয়েকটি যুগান্তকারী ধারণা ছাড়া ক্রিয়াবাদকে বোঝাই যাবে না।
১. সামাজিক ঘটনা (Social Fact): এটি ডুর্খাইমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। তাঁর মতে, সমাজে এমন কিছু নিয়মকানুন, বিশ্বাস, নৈতিকতা এবং আচরণবিধি রয়েছে যা ব্যক্তির বাইরে থেকেও ব্যক্তির ওপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করে এবং তাকে নির্দিষ্ট পথে চলতে বাধ্য করে। যেমন—আইন, ভাষা, ধর্মীয় বিশ্বাস, ফ্যাশন, মুদ্রা ব্যবস্থা, এমনকি ট্রাফিক সিগন্যাল মেনে চলার নিয়ম। আপনি চাইলেই হুট করে নতুন কোনো ভাষা বানিয়ে সবার উপর চাপিয়ে দিতে পারবেন না, কিংবা দোকানে গিয়ে নিজের বানানো টাকা দিয়ে জিনিস কিনতে পারবেন না। এই সামাজিক ঘটনাগুলো আমাদের জন্মের আগে থেকেই সমাজে উপস্থিত থাকে এবং আমাদের আচরণের সীমানা নির্ধারণ করে দেয়। এগুলো বস্তুনিষ্ঠ এবং পর্যবেক্ষণযোগ্য, তাই এগুলোই হলো সমাজবিজ্ঞানের গবেষণার মূল বিষয় (Durkheim, 1895)।
২. সামাজিক সংহতি (Social Solidarity): সমাজ কীভাবে বিশৃঙ্খল না হয়ে একসাথে টিকে থাকে? এই মৌলিক প্রশ্নের উত্তরে ডুর্খাইম বলেন, সংহতির কারণে। তাঁর বিখ্যাত বই The Division of Labor in Society-তে তিনি দুই ধরনের সংহতির কথা বলেছেন:
-
যান্ত্রিক সংহতি (Mechanical Solidarity): এটি আদিম বা সরল সমাজে দেখা যায়, যেখানে মানুষের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য থাকে না। সবার বিশ্বাস, কাজ ও জীবনযাত্রা প্রায় একই রকম। এই গভীর মিলের কারণেই তারা একত্রিত থাকে, অনেকটা একটি যন্ত্রের বিভিন্ন অভিন্ন পার্টসের মতো। এখানে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য প্রায় নেই বললেই চলে এবং নৈতিকতা ও বিশ্বাসগুলো এতটাই শক্তিশালী যে একে সম্মিলিত চেতনা (Collective Conscience) বলা হয়। এই সম্মিলিত চেতনা হলো একটি সমাজের গড় সদস্যদের সাধারণ বিশ্বাস ও অনুভূতির সমষ্টি। এখানে আইন হয় দমনমূলক (Repressive Law), কারণ যে কোনো বিচ্যুতি পুরো গোষ্ঠীর সম্মিলিত চেতনাকে আঘাত করে এবং কঠোর শাস্তির মাধ্যমে তা দমন করা হয়।
-
জৈব সংহতি (Organic Solidarity): এটি আধুনিক, শিল্পোন্নত ও জটিল সমাজে দেখা যায়, যেখানে শ্রম বিভাজন অনেক বেশি। এখানে মানুষ ভিন্ন ভিন্ন কাজ করে এবং ভিন্ন ভিন্ন জীবনযাপন করে। এই ভিন্নতার কারণেই তারা একে অপরের ওপর গভীরভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কৃষককে যেমন তাঁতির ওপর নির্ভর করতে হয়, তেমনি ডাক্তারকে ইঞ্জিনিয়ারের ওপর। এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতাই তাদের মধ্যে এক ধরনের জৈব সংহতি তৈরি করে, ঠিক যেমন জীবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। এখানে সম্মিলিত চেতনা দুর্বল হয়ে আসে, কিন্তু পারস্পরিক প্রয়োজনীয়তা তাদের বেঁধে রাখে। এখানে আইন হয় সংস্কারমূলক (Restitutive Law), যার মূল উদ্দেশ্য ক্ষতিপূরণ করে সামাজিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা (Durkheim, 1893)।
৩. অ্যানোমি বা আদর্শহীনতা (Anomie): ডুর্খাইম তাঁর বিখ্যাত গবেষণা Suicide-এ দেখিয়েছেন যে, দ্রুত সামাজিক পরিবর্তনের সময়ে (যেমন—অর্থনৈতিক মন্দা বা হঠাৎ সমৃদ্ধি) সমাজের পুরনো নিয়মকানুন ও মূল্যবোধগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে, কিন্তু নতুন নিয়মকানুন সেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় না। এই আদর্শহীন বা নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থাকেই তিনি বলেছেন অ্যানোমি। এই অবস্থায় মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ে, তাদের আকাঙ্ক্ষার কোনো সীমা থাকে না এবং তাদের মধ্যে হতাশা ও বিচ্ছিন্নতাবোধ বাড়ে। এর ফলে সমাজে আত্মহত্যা (বিশেষত অ্যানোমিক আত্মহত্যা) ও অপরাধের মতো বিচ্যুত আচরণের (Deviant Behavior) হার বেড়ে যায়। এটি দেখায় যে, সমাজের স্থিতিশীলতার জন্য একটি সুস্পষ্ট নৈতিক কাঠামো কতটা জরুরি।
৪. ধর্ম ও অপরাধের ক্রিয়া (The Function of Religion and Crime): ডুর্খাইম আরও কিছু চমকপ্রদ কথা বলেছিলেন। তিনি মনে করতেন, সমাজে অপরাধের মতো একটি নেতিবাচক বিষয়েরও ইতিবাচক ক্রিয়া বা ফাংশন রয়েছে। যখন কোনো অপরাধ ঘটে এবং অপরাধীকে সমাজের সামনে শাস্তি দেওয়া হয়, তখন সমাজের বাকি সদস্যদের মধ্যে নৈতিকতার সীমানা কোনটি, তা আরও স্পষ্ট হয়। এটি মানুষের মধ্যেকার সম্মিলিত চেতনাকে জাগ্রত করে এবং তাদের মধ্যে সংহতি বৃদ্ধি পায়। একইভাবে, তাঁর বই The Elementary Forms of the Religious Life-এ তিনি দেখান যে, ধর্মের মূল কাজ হলো সামাজিক সংহতি তৈরি করা। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের মাধ্যমে মানুষ একটি গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে নিজেদের অনুভব করে এবং সামাজিক মূল্যবোধগুলো পুনরুজ্জীবিত হয়। ঈশ্বর বা টোটেমকে পূজা করার মাধ্যমে সমাজ আসলে নিজেকেই পূজা করে।
তত্ত্বের মহারাজা: ট্যালকট পার্সনস (Talcott Parsons) ও ব্যবস্থার সূক্ষ্মতা
বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এসে আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী ট্যালকট পার্সনস এই তত্ত্বকে এর শিখরে পৌঁছে দেন। তাঁকে কাঠামোগত ক্রিয়াবাদের সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে সুসংগঠিত এবং সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রবক্তা বলা হয়। তাঁর কাজ অত্যন্ত তাত্ত্বিক, বিমূর্ত এবং জটিল; অনেকে রসিকতা করে বলেন, পার্সনসের লেখা বুঝতে হলে আলাদা অভিধান লাগে। কিন্তু তাঁর মূল ভাবনাগুলো বুঝতে পারলে সমাজের এক বিশাল এবং পূর্ণাঙ্গ চিত্র চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
পার্সনস সমাজকে একটি সামাজিক ব্যবস্থা (Social System) হিসেবে দেখেছেন, যা টিকে থাকার জন্য কিছু মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে হয়। তাঁর মতে, যেকোনো সামাজিক ব্যবস্থা, তা সে একটি ছোট পরিবার হোক বা একটি গোটা রাষ্ট্র, টিকে থাকার জন্য চারটি মৌলিক ক্রিয়া (Functional Imperatives) সম্পন্ন করতে হয়। এই চারটি কাজকে তিনি সংক্ষেপে AGIL মডেল নামে পরিচিত করেছেন। চলুন, এই কঠিন দেখতে মডেলটিকে একটি আধুনিক রাষ্ট্রের উদাহরণ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি।
১. অভিযোজন (Adaptation – A): প্রথমত এবং সর্বাগ্রে, যেকোনো ব্যবস্থাকে তার বাহ্যিক পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হবে এবং পরিবেশ থেকে প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণ করতে হবে। একটি রাষ্ট্রের জন্য এর মানে হলো প্রাকৃতিক সম্পদ (খনিজ, ভূমি, জল) ব্যবহার করা, খাদ্য উৎপাদন করা এবং পণ্য ও সেবা তৈরি করে তা জনগণের মধ্যে বণ্টন করা। আধুনিক সমাজে এই অপরিহার্য কাজটি করে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা (Economic System)। আমাদের অর্থনীতিই প্রকৃতি থেকে সম্পদ নিয়ে আসে, কারখানায় তা রূপান্তর করে এবং বাজারের মাধ্যমে মানুষের ব্যবহারের উপযোগী করে তোলে। ব্যাংক, শিল্প এবং কৃষি এই উপ-ব্যবস্থার অংশ।
২. লক্ষ্য অর্জন (Goal Attainment – G): দ্বিতীয়ত, ব্যবস্থাকে কিছু সম্মিলিত লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে এবং তা অর্জনের জন্য সম্পদ ও জনগণকে সংগঠিত করতে হবে। একটি রাষ্ট্রের লক্ষ্য হতে পারে জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, দারিদ্র্য দূর করা, শিক্ষার হার শতভাগে উন্নীত করা, বা মহাকাশে রকেট পাঠানো। এর জন্য দরকার নেতৃত্ব, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং ক্ষমতার প্রয়োগ। সমাজে এই কাজটি করে রাজনৈতিক ব্যবস্থা (Political System) বা সরকার। সরকারই দেশের জন্য সমষ্টিগত লক্ষ্য ঠিক করে এবং সেই অনুযায়ী নীতি নির্ধারণ ও সম্পদ বণ্টন করে। আইন প্রণয়ন এবং তা কার্যকর করা এই ব্যবস্থার মূল কাজ।
৩. সংহতি (Integration – I): তৃতীয়ত, ব্যবস্থার বিভিন্ন অংশের মধ্যে সমন্বয়, নিয়ন্ত্রণ ও সংহতি বজায় রাখতে হবে। সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, গোষ্ঠী ও ব্যক্তির মধ্যে যেন সংঘাত না বাধে এবং তারা যেন একে অপরের সাথে সহযোগিতামূলকভাবে কাজ করে, তা নিশ্চিত করতে হয়। সমাজে এই কাজটি করে আইন ও বিচার ব্যবস্থা (Legal System), পুলিশ, এবং বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান। এরাই সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে, সংঘাত কমায় এবং সামাজিক নিয়মকানুন প্রয়োগ করে সংহতি বজায় রাখে। গণমাধ্যম এবং বিভিন্ন নাগরিক সংগঠনও এই সংহতির কাজ করে।
৪. সুপ্ততা বা প্যাটার্ন রক্ষণাবেক্ষণ (Latency / Pattern Maintenance – L): চতুর্থত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ব্যবস্থাকে তার সদস্যদের মধ্যে সমাজের মৌলিক সংস্কৃতি, বিশ্বাস ও মূল্যবোধ (Values) সঞ্চারিত ও পুনরুজ্জীবিত করতে হবে, যাতে তারা ব্যবস্থার প্রতি অনুগত থাকে এবং সেই অনুযায়ী চালিত হয়। এই প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় প্যাটার্ন রক্ষণাবেক্ষণ (Pattern Maintenance)। এছাড়া, মানুষের মধ্যে দৈনন্দিন জীবনে যে হতাশা, চাপ বা মানসিক দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তা নিরসনেরও একটি ব্যবস্থা থাকতে হবে, যাকে বলে উত্তেজনা প্রশমন (Tension Management)। সমাজে এই দ্বৈত কাজটি করে পরিবার (Family), শিক্ষা ব্যবস্থা (Education System) এবং ধর্ম (Religion)। পরিবার ও স্কুলই আমাদের সমাজের রীতিনীতি ও মূল্যবোধ শেখায় (সামাজিকীকরণ), যা আমাদের সমাজের সদস্য হিসেবে আচরণ করতে সাহায্য করে (Parsons, 1951)। ধর্ম, বিনোদন ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো মানসিক চাপ কমাতে ও জীবনের অর্থ খুঁজে পেতে সাহায্য করে।
পার্সনসের এই AGIL মডেলটি হলো সমাজের একটি পূর্ণাঙ্গ এক্স-রে রিপোর্টের মতো। তিনি দেখাতে চেয়েছেন, সমাজের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই কোনো না কোনো অপরিহার্য কাজ করছে, যার ওপর পুরো সমাজের অস্তিত্ব নির্ভর করে। তাঁর মতে, সমাজ সবসময় একটি ভারসাম্যের (Equilibrium) দিকে ধাবিত হয়। কোনো কারণে এই ভারসাম্যে বিচ্যুতি ঘটলে, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কাজ বাড়িয়ে দিয়ে সেই ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে, ঠিক যেমন আমাদের শরীর অসুস্থ হলে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে ওঠে।
উদাহরণস্বরূপ, একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে যদি আমরা একটি ব্যবস্থা হিসেবে দেখি, তবে এটিও AGIL মডেল অনুযায়ী কাজ করে:
-
A (Adaptation): বিশ্ববিদ্যালয় সরকার ও ছাত্রদের থেকে অনুদান ও টিউশন ফি সংগ্রহ করে, যা তার আর্থিক ভিত্তি।
-
G (Goal Attainment): এর লক্ষ্য হলো গবেষণা ও শিক্ষাদানের মাধ্যমে জ্ঞান সৃষ্টি ও বিতরণ করা।
-
I (Integration): বিশ্ববিদ্যালয় তার বিভিন্ন বিভাগ, শিক্ষক, ছাত্র ও কর্মচারীদের মধ্যে নিয়মকানুন ও কমিটির মাধ্যমে সমন্বয় সাধন করে।
-
L (Latency): এটি ছাত্রদের মধ্যে একাডেমিক সততা ও বুদ্ধিবৃত্তিক কৌতূহলের মতো মূল্যবোধ তৈরি করে এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মানসিক চাপ কমায়।
পার্সনসের ভাবনার পরিমার্জন: রবার্ট কে. মার্টন (Robert K. Merton) ও বাস্তবতার ছোঁয়া
পার্সনসের ছাত্র রবার্ট মার্টন ছিলেন একজন বাস্তববাদী ও সমালোচনামূলক চিন্তাবিদ। তিনি গুরুর মতো এত বড় এবং সার্বজনীন তত্ত্ব (Grand Theory) তৈরিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি মধ্যম-পরিসরের তত্ত্ব (Middle-range Theory) তৈরির উপর জোর দেন, যা নির্দিষ্ট সামাজিক ঘটনাকে ব্যাখ্যা করার জন্য যথেষ্ট বিমূর্ত, কিন্তু গবেষণার মাধ্যমে পরীক্ষা করার মতো যথেষ্ট সুনির্দিষ্ট। তিনি মনে করতেন, সমাজ সবসময় এতো নিখুঁতভাবে একটি যন্ত্রের মতো কাজ করে না এবং সবকিছুরই ইতিবাচক ফাংশন থাকে না। তাই তিনি পার্সনসের তত্ত্বের কিছু সীমাবদ্ধতা দূর করে একে আরও বাস্তবসম্মত, নমনীয় ও ব্যবহারিক করে তোলেন। মার্টন কয়েকটি অসাধারণ ধারণা যোগ করেন, যা ক্রিয়াবাদকে আরও সমৃদ্ধ এবং প্রায়োগিক করেছে।
১. প্রকাশ্য ও সুপ্ত ক্রিয়া (Manifest and Latent Functions): মার্টন বলেন, সামাজিক কোনো প্রথা বা প্রতিষ্ঠানের কাজগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়।
-
প্রকাশ্য ক্রিয়া (Manifest Function): এটি হলো সেই কাজ বা ফলাফল যা অংশগ্রহণকারীরা জানে, স্বীকার করে এবং ইচ্ছা করেই করে। এটি হলো ঘোষিত ও স্বীকৃত উদ্দেশ্য। যেমন—একটি হাসপাতালের প্রকাশ্য ক্রিয়া হলো রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া ও সুস্থ করে তোলা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশ্য ক্রিয়া হলো উচ্চশিক্ষা ও ডিগ্রি প্রদান করা।
-
সুপ্ত ক্রিয়া (Latent Function): এটি হলো সেই কাজ বা ফলাফল যা অংশগ্রহণকারীরা জানে না বা ইচ্ছা করে করে না, কিন্তু তা ঘটে যায়। এটি হলো অনাকাঙ্ক্ষিত বা অস্বীকৃত ফলাফল। যেমন—হাসপাতালের একটি সুপ্ত ক্রিয়া হতে পারে সমাজে ডাক্তার ও নার্সদের মতো পেশার উচ্চ সামাজিক মর্যাদা তৈরি করা এবং বজায় রাখা। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সুপ্ত ক্রিয়া হতে পারে তরুণদের শ্রমবাজার থেকে কয়েক বছরের জন্য দূরে রাখা, যা বেকারত্বের হার কম দেখাতে সাহায্য করে। এটি একটি ভালো ‘বিয়ের বাজার’ (marriage market) হিসেবেও কাজ করতে পারে!
মার্টন একটি চমৎকার উদাহরণ দিয়েছিলেন হোপি (Hopi) আদিবাসীদের বৃষ্টির নাচ (Rain Dance) দিয়ে। এই নাচের প্রকাশ্য ক্রিয়া হলো বৃষ্টি নামানো, কারণ তারা বিশ্বাস করে নাচলেই দেবতা সন্তুষ্ট হয়ে বৃষ্টি দেবেন। কিন্তু সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সুপ্ত ক্রিয়াও আছে। যখন খরা বা বিপদের সময়ে পুরো গোষ্ঠীর মানুষ একসাথে এই আবেগঘন নাচে অংশ নেয়, তখন তাদের মধ্যেকার সামাজিক বন্ধন ও সংহতি আরও দৃঢ় হয়, যা গোষ্ঠীটিকে মানসিক শক্তি জোগায় এবং টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে (Merton, 1968)। বৃষ্টি নামুক বা না নামুক, এই সুপ্ত ক্রিয়াটি ঠিকই সম্পন্ন হয়।
২. অক্রিয়া (Dysfunction): পার্সনস যেখানে সমাজের প্রতিটি অংশের ইতিবাচক কাজের ওপর জোর দিয়েছিলেন, মার্টন সেখানে বলেন যে কিছু কিছু কাঠামোর এমন ফলাফলও থাকতে পারে যা সমাজের স্থিতিশীলতা বা সংহতির জন্য ক্ষতিকর। একে তিনি বলেছেন অক্রিয়া (Dysfunction)। যেমন—আমলাতন্ত্র (Bureaucracy) একদিকে যেমন কাজকে সুশৃঙ্খল ও দক্ষ করে (ফাংশন), অন্যদিকে তার ‘লাল ফিতার দৌরাত্ম্য’ (Red Tape) এবং অনমনীয় নিয়মকানুন অনেক সময় জরুরি কাজকে বাধাগ্রস্ত করে এবং মানুষের মধ্যে হতাশা তৈরি করে, যা একটি অক্রিয়া। একইভাবে, অর্থনীতিতে শ্রম বিভাজনের একটি ক্রিয়া হলো উৎপাদন বৃদ্ধি করা, কিন্তু এর একটি অক্রিয়াও থাকতে পারে। অতিরিক্ত বিশেষায়িত ও পুনরাবৃত্তিমূলক কাজ করতে করতে শ্রমিকদের মধ্যে একঘেয়েমি ও বিচ্ছিন্নতাবোধ (Alienation) তৈরি হতে পারে, যা সামাজিক অস্থিরতা ও ধর্মঘটের কারণ হতে পারে।
৩. বিচ্যুতির তত্ত্ব (Strain Theory of Deviance): মার্টন ক্রিয়াবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে অপরাধ বা বিচ্যুত আচরণের এক অসাধারণ ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, সমাজ তার সদস্যদের জন্য কিছু নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক লক্ষ্য (Cultural Goals) নির্ধারণ করে দেয় (যেমন: আমেরিকান সমাজে আর্থিক সাফল্য বা ‘আমেরিকান ড্রিম’)। একই সাথে সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য কিছু প্রাতিষ্ঠানিক উপায় (Institutionalized Means) বা বৈধ পথও বাতলে দেয় (যেমন: কঠোর পরিশ্রম, শিক্ষা, সততা)। কিন্তু সমস্যা হলো, সমাজ সবার জন্য এই বৈধ উপায়গুলো সমানভাবে উন্মুক্ত রাখে না। ফলে লক্ষ্য ও উপায়ের মধ্যে একটি টানাপোড়েন বা বিকৃতি (Strain) তৈরি হয়। এই টানাপোড়েনের সাথে মানুষ পাঁচভাবে খাপ খাইয়ে নেয়:
-
কনফর্মিটি (Conformity): সমাজের লক্ষ্য ও উপায় দুটোই মেনে চলা (বেশিরভাগ মানুষ)। যেমন—একজন ব্যক্তি যিনি ভালো পড়াশোনা করে ভালো চাকরি পেয়ে ধনী হতে চান।
-
ইনোভেশন (Innovation): লক্ষ্য মানে, কিন্তু তা অর্জনের জন্য অবৈধ উপায় অবলম্বন করে (যেমন: চোর, দুর্নীতিবাজ, শেয়ার কেলেঙ্কারির হোতা)। তারা সফল হতে চায়, কিন্তু বৈধ পথে নয়।
-
রিচুয়ালিজম (Ritualism): লক্ষ্যের আশা (যেমন: ধনী হওয়া) ছেড়ে দিয়েছে, কিন্তু নিয়মকানুন অন্ধভাবে মেনে চলে (যেমন: একজন হতাশ কেরানি যিনি পদোন্নতির আশা করেন না কিন্তু প্রতিদিন নিয়ম করে অফিসে আসেন ও যান)।
-
রিট্রিটিজম (Retreatism): লক্ষ্য ও উপায় দুটোই বর্জন করে সমাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয় (যেমন: মাদকাসক্ত, ভবঘুরে)।
-
রেবেলিয়ন (Rebellion): পুরনো লক্ষ্য ও উপায় দুটোই বর্জন করে তার জায়গায় নতুন লক্ষ্য ও উপায় প্রতিষ্ঠা করতে চায় (যেমন: বিপ্লবী, সন্ত্রাসী বা চরমপন্থী গোষ্ঠী)।
মার্টনের এই ধারণাগুলো কাঠামোগত ক্রিয়াবাদকে অনেক বেশি বাস্তবসম্মত এবং সমালোচনামূলক করে তুলেছে। তিনি দেখিয়েছেন যে, সমাজ একটি নিখুঁত যন্ত্র নয়। এর কিছু অংশ হয়তো ঠিকমতো কাজ করে, কিছু অংশ হয়তো অপ্রত্যাশিত ভালো কাজ করে, আবার কিছু অংশ হয়তো সমাজের জন্য ক্ষতির কারণও হয়ে দাঁড়ায়।
ক্রিয়াবাদের চশমায় কিছু সামাজিক প্রতিষ্ঠান: একটি ব্যবচ্ছেদ
এই তত্ত্বের মূল কথাগুলো তো জানা গেল। এখন সমাজবিজ্ঞানের সেই শক্তিশালী চশমাটি চোখে লাগানোর পালা। চলুন, এই চশমা চোখে দিয়ে আমাদের চারপাশের কিছু পরিচিত ও অপরিহার্য প্রতিষ্ঠানকে ব্যবচ্ছেদ করে দেখি—তারা আসলে সমাজের জন্য কী কী গুরুত্বপূর্ণ কাজ নীরবে-নিভৃতে করে চলেছে। ক্রিয়াবাদীদের মতে, এই প্রতিষ্ঠানগুলো বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ নয়, বরং একটি সামগ্রিক ব্যবস্থার একেকটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, যারা পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে পুরো সমাজদেহকে সচল ও সুস্থ রাখে।
পরিবার (The Family): সমাজের মূল ভিত্তিপ্রস্তর
ক্রিয়াবাদীদের মতে, পরিবার হলো সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং মৌলিক আণুবীক্ষণিক একক (microscopic unit)। এটি সেই প্রাথমিক ইট, যা দিয়ে পুরো সমাজ-কাঠামো নির্মিত হয়। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে পরিবারের রূপ ভিন্ন হলেও এর কিছু সার্বজনীন কাজ রয়েছে, যা সমাজকে টিকিয়ে রাখার জন্য অপরিহার্য।
প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী জর্জ মারডক (George Murdock) ২৫০টি ভিন্ন ভিন্ন সমাজ বিশ্লেষণ করে দেখান যে, পরিবার বিশ্বব্যাপী চারটি অপরিহার্য কাজ (functions) সম্পাদন করে:
-
প্রজনন (Reproductive Function): সমাজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রথম শর্ত হলো নতুন সদস্য তৈরি করা। পরিবারই প্রজননের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের জন্ম দেয়, যা ছাড়া সমাজ বিলুপ্ত হয়ে যেত। এটি সমাজের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে।
-
যৌন সম্পর্কের নিয়ন্ত্রণ (Sexual Regulation): পরিবার তার প্রাপ্তবয়স্ক সদস্যদের মধ্যে একটি সামাজিকভাবে স্বীকৃত যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে। এর ফলে যৌন বিশৃঙ্খলা, ঈর্ষা এবং সংঘাত কমে আসে, যা সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য জরুরি।
-
অর্থনৈতিক সহযোগিতা (Economic Cooperation): পরিবার তার সদস্যদের জন্য একটি অর্থনৈতিক একক হিসেবে কাজ করে। ঐতিহ্যবাহী সমাজে পরিবারের সদস্যরা একসাথে খাদ্য উৎপাদন ও সংগ্রহ করত। আধুনিক সমাজেও পরিবার তার সদস্যদের ভরণপোষণ, আশ্রয় এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তা প্রদান করে।
-
সামাজিকীকরণ (Socialization): এটি পরিবারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর একটি। পরিবারই শিশুর প্রথম পাঠশালা, যেখানে সে সমাজের ভাষা, বিশ্বাস, মূল্যবোধ এবং আচরণবিধি শেখে।
ট্যালকট পার্সনস (Talcott Parsons) এই ধারণাগুলোকে আরও পরিমার্জিত করে বলেন যে, আধুনিক শিল্প সমাজে পরিবারের দুটি প্রধান এবং অপরিহার্য কাজ রয়েছে:
-
প্রাথমিক সামাজিকীকরণ (Primary Socialization): পরিবারই শিশুদের সমাজের আদবকায়দা, ভাষা, নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও বিশ্বাস শেখায়। শিশুরা অনুকরণ এবং নির্দেশের মাধ্যমে তাদের সংস্কৃতির মৌলিক উপাদানগুলো আত্মস্থ করে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই একটি জৈবিক শিশু সামাজিক মানুষে পরিণত হয় এবং সমাজের যোগ্য সদস্য হিসেবে গড়ে ওঠার প্রাথমিক পাঠ গ্রহণ করে।
-
ব্যক্তিত্বের স্থিতিশীলতা (Stabilization of Adult Personalities): আধুনিক শিল্প সমাজ অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক, যান্ত্রিক এবং চাপপূর্ণ। কর্মক্ষেত্রে মানুষকে কঠোর নিয়মকানুন ও চাপের মধ্যে কাজ করতে হয়। পরিবার এখানে একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে। এটি প্রাপ্তবয়স্ক সদস্যদের মানসিক শান্তি, ভালোবাসা, আবেগীয় সমর্থন ও নিরাপত্তা দেয়, যা তাদের আধুনিক জীবনের চাপ ও হতাশা মোকাবেলা করতে সাহায্য করে। পার্সনস এই বিষয়টিকে তার বিখ্যাত ‘উষ্ণ স্নান তত্ত্ব’ (Warm Bath Theory) দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন। তার মতে, পরিবার হলো একটি উষ্ণ জলের স্নানের মতো, যেখানে কর্মক্ষেত্রের সমস্ত ক্লান্তি ও চাপ থেকে ফিরে এসে একজন মানুষ মানসিক শান্তি ও সতেজতা লাভ করে। এই মানসিক পুনরুজ্জীবনের ফলেই কর্মীরা পরের দিন আবার সমাজের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অবদান রাখার জন্য প্রস্তুত হতে পারে।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে, পরিবার শুধু ব্যক্তির জন্য নয়, বরং পুরো সমাজের স্থিতিশীলতার জন্যই এক অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান।
শিক্ষা (Education): সমাজের ক্ষুদ্র সংস্করণ
স্কুল-কলেজের কাজ কী? শুধু বই পড়ানো আর সার্টিফিকেট দেওয়া? ক্রিয়াবাদীরা বলবেন, এর প্রকাশ্য কাজের আড়ালে লুকিয়ে আছে আরও অনেক গভীর এবং গুরুত্বপূর্ণ সুপ্ত কাজ। শিক্ষা ব্যবস্থা সমাজের জন্য একটি অপরিহার্য উপ-ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে, যা পরিবার থেকে শুরু হওয়া সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যায় এবং সমাজকে দক্ষ মানবসম্পদ সরবরাহ করে।
-
জ্ঞান ও দক্ষতার সঞ্চালন (Transmitting Knowledge and Skills): প্রতিটি সমাজের টিকে থাকার জন্য তার জ্ঞান, সংস্কৃতি ও কারিগরি দক্ষতা নতুন প্রজন্মের কাছে হস্তান্তর করা প্রয়োজন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এই কাজটিই করে। এটি একদিকে যেমন সাধারণ জ্ঞান (যেমন: ভাষা, গণিত, ইতিহাস) প্রদান করে, তেমনি আধুনিক জটিল সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় বিশেষায়িত দক্ষতা (যেমন: চিকিৎসা, প্রকৌশল, আইন) তৈরি করে। এটি সমাজের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্য একটি দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরি করে।
-
মাধ্যমিক সামাজিকীকরণ (Secondary Socialization): স্কুল হলো ‘সমাজ জীবনের এক ক্ষুদ্র সংস্করণ’ (Society in Miniature)। পরিবারে শিশুরা বিশেষায়িত নিয়ম (Particularistic Standards) দ্বারা পরিচালিত হয়, যেখানে তারা বাবা-মায়ের বিশেষ স্নেহ ও মনোযোগ পায়। কিন্তু স্কুলে এসে তারা প্রথমবারের মতো বৃহত্তর সমাজের সার্বজনীন নিয়মের (Universalistic Standards) মুখোমুখি হয়। এখানে মেধা বা লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল ছাত্রছাত্রীকে একই নিয়ম মেনে চলতে হয়, একই পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়। এর মাধ্যমে শিশুরা ব্যক্তিগত সম্পর্কের ঊর্ধ্বে উঠে নৈর্ব্যক্তিক নিয়মকানুন মানতে শেখে, যা তাদের প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে কর্মক্ষেত্র ও সমাজে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করে।
-
ভূমিকা বণ্টন (Role Allocation): শিক্ষা ব্যবস্থা একটি ‘বাছাই ও ছাঁটাই’ (Sifting and Sorting) করার যন্ত্র হিসেবে কাজ করে। বিভিন্ন পরীক্ষা ও মূল্যায়নের মাধ্যমে এই ব্যবস্থা ছাত্রছাত্রীদের মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী তাদের আলাদা করে এবং বিভিন্ন পেশার জন্য তৈরি করে। ক্রিয়াবাদীদের মতে, এটি একটি মেধাতান্ত্রিক (Meritocratic) প্রক্রিয়া। অর্থাৎ, এখানে যোগ্যতম ব্যক্তিরাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাগুলো পাওয়ার সুযোগ পায়, যা সমাজের কার্যকারিতা ও দক্ষতার জন্য অত্যন্ত জরুরি। ডেভিস ও ম্যুরের তত্ত্ব অনুযায়ী, শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে যে সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো সবচেয়ে প্রতিভাবান ব্যক্তিরা পূরণ করবে।
-
সামাজিক সংহতি বৃদ্ধি (Promoting Social Cohesion): স্কুল শিশুদের মধ্যে একটি দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং জাতীয়তাবাদের মতো অভিন্ন মূল্যবোধ সঞ্চারিত করে। একসাথে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া, জাতীয় দিবস পালন করা এবং দেশের ইতিহাস পাঠ করার মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একটি সম্মিলিত পরিচয় বা ‘আমরা’ বোধ তৈরি হয়, যা সামাজিক সংহতিকে শক্তিশালী করে।
ধর্ম (Religion): সামাজিক আঠা এবং পবিত্র আচ্ছাদন
ডুর্খাইমের পথ ধরে ক্রিয়াবাদীরা মনে করেন, ধর্মের মূল কাজ জাগতিক বা পারলৌকিক নয়, বরং সামাজিক। ধর্ম হলো এক শক্তিশালী সামাজিক আঠা, যা সমাজকে একত্রে বেঁধে রাখে।
-
সামাজিক সংহতি (Social Cohesion): ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, উৎসব (যেমন: ঈদ, পূজা, বড়দিন) এবং সাপ্তাহিক প্রার্থনা (যেমন: জুমার নামাজ, রবিবারের চার্চ সার্ভিস) মানুষকে শারীরিকভাবে একত্রিত করে। এই সম্মিলিত অংশগ্রহণের সময় মানুষের মধ্যে এক ধরনের আবেগঘন ঐক্য বা ‘সম্মিলিত উচ্ছ্বাস’ (Collective Effervescence) তৈরি হয়। এই অভিজ্ঞতা তাদের মধ্যে গোষ্ঠীবদ্ধতার অনুভূতি জাগিয়ে তোলে এবং সামাজিক বন্ধনকে আরও দৃঢ় করে।
-
মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ (Reinforcing Norms and Social Control): ধর্ম সমাজে ভালো-মন্দের একটি সুস্পষ্ট নৈতিক কাঠামো তৈরি করে দেয় (যেমন: ইসলামের হালাল-হারাম, খ্রিস্টধর্মের দশ আজ্ঞা বা Ten Commandments)। এই নিয়মগুলো মেনে চললে পুরস্কার (স্বর্গ) এবং না মানলে তিরস্কারের (নরক) ধারণা দিয়ে মানুষকে সামাজিক নিয়মকানুন মেনে চলতে উৎসাহিত করে। অনেক ক্ষেত্রেই দেশের আইনকানুন এই ধর্মীয় নৈতিকতার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। ফলে ধর্ম একটি শক্তিশালী অনানুষ্ঠানিক সামাজিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।
-
জীবনের অর্থ প্রদান ও মানসিক স্বস্তি (Providing Meaning and Emotional Support): মানুষের জীবনে এমন অনেক প্রশ্ন ও সংকট আসে, যার কোনো বৈজ্ঞানিক বা যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা পাওয়া কঠিন। যেমন—জীবনের উদ্দেশ্য কী? মৃত্যুর পর কী হবে? কেন ভালো মানুষের জীবনেও এত কষ্ট আসে? ধর্ম এই ‘চরম প্রশ্নগুলোর’ (Ultimate Questions) উত্তর দিয়ে মানুষের জীবনকে একটি অর্থপূর্ণ রূপ দেয়। এটি মানুষকে জীবনের কষ্ট, যন্ত্রণা এবং মৃত্যুর মতো চরম বাস্তবতার মুখে একটি ‘পবিত্র আচ্ছাদন’ (Sacred Canopy) প্রদান করে, যা তাকে সান্ত্বনা ও মানসিক শক্তি জোগায়। বিভিন্ন ধর্মীয় আচার (যেমন: জন্ম, বিবাহ, মৃত্যু) জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণগুলোকে সহজভাবে পার হতে সাহায্য করে।
রাষ্ট্র ও আইন ব্যবস্থা (The State and Legal System): শৃঙ্খলা ও দিকনির্দেশনা
সমাজব্যবস্থা টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন একটি কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ, যা নিয়মকানুন প্রয়োগ করবে, লক্ষ্য নির্ধারণ করবে এবং বিভিন্ন অংশের মধ্যে সমন্বয় সাধন করবে। রাষ্ট্র এবং তার আইন ব্যবস্থা এই কাজটিই করে।
-
সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষা (Maintaining Social Order): রাষ্ট্রের প্রাথমিক কাজ হলো আইন প্রণয়ন এবং তা প্রয়োগের মাধ্যমে সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা। পুলিশ, আদালত এবং কারাগারের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো আইন অমান্যকারীদের শাস্তি দিয়ে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে এবং নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। এটি পার্সনসের ‘সংহতি’ (Integration) ফাংশনের সাথে সম্পর্কিত।
-
সমষ্টিগত লক্ষ্য নির্ধারণ (Goal Attainment): রাষ্ট্রই সমগ্র সমাজের জন্য দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য নির্ধারণ করে (যেমন: অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, নিরক্ষরতা দূরীকরণ) এবং সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সম্পদ ও জনগণকে সংগঠিত করে। পরিকল্পনা প্রণয়ন, কর আরোপ এবং বাজেট বণ্টনের মাধ্যমে রাষ্ট্র এই কাজটি করে, যা পার্সনসের ‘লক্ষ্য অর্জন’ (Goal Attainment) ফাংশনের সাথে মিলে যায়।
-
অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় সাধন (Coordinating other Institutions): রাষ্ট্র অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা ব্যবস্থা এবং পরিবারের মতো অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করে। যেমন—অর্থনীতির প্রয়োজনে শিক্ষা নীতি পরিবর্তন করা বা পরিবারের সুরক্ষার জন্য আইন তৈরি করা।
সামাজিক স্তরবিন্যাস (Social Stratification): প্রয়োজনীয় অসমতা?
সমাজে ধনী-গরিব বা উঁচু-নিচু ভেদাভেদ কেন থাকে? এই প্রশ্নটি সমাজবিজ্ঞানের অন্যতম কেন্দ্রীয় প্রশ্ন। যেখানে দ্বন্দ্বমূলক তত্ত্ব একে শোষণ ও অবিচারের ফল হিসেবে দেখে, সেখানে ক্রিয়াবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে কিংসলে ডেভিস ও উইলবার্ট ম্যুর (Davis and Moore, 1945) এর এক বিতর্কিত কিন্তু প্রভাবশালী ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাদের মতে, সামাজিক অসমতা বা স্তরবিন্যাস শুধুমাত্র অনিবার্যই নয়, বরং এটি সমাজের টিকে থাকার জন্য কার্যকরীভাবে প্রয়োজনীয় (Functionally Necessary)। তাদের যুক্তিটি নিম্নরূপ:
-
সমাজে কিছু পদ বা পেশা অন্যগুলোর চেয়ে সমাজের টিকে থাকার জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ (Functionally more important)। যেমন: একজন ডাক্তার বা সামরিক জেনারেলের ভূমিকা একজন সাধারণ শ্রমিকের চেয়ে সমাজের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
-
এই গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো পূরণের জন্য বিশেষ প্রতিভা, দক্ষতা এবং দীর্ঘ ও কঠোর প্রশিক্ষণের প্রয়োজন।
-
সমাজে প্রতিভাবান মানুষের সংখ্যা সীমিত। সবাই এই কঠিন প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় মেধা, অধ্যবসায় বা ত্যাগ স্বীকার করার মানসিকতা রাখে না।
-
তাই, সমাজের স্বার্থেই সবচেয়ে যোগ্য ও প্রতিভাবান ব্যক্তিদের এই কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো পূরণে উৎসাহিত করতে হবে। এই উৎসাহ সৃষ্টির জন্য সমাজ একটি পুরস্কার ব্যবস্থা তৈরি করে। যে পদ যত বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং যার জন্য যত বেশি দক্ষতার প্রয়োজন, তার পুরস্কারও (যেমন: উচ্চ বেতন, সামাজিক সম্মান, ক্ষমতা) তত বেশি।
-
সুতরাং, এই পুরস্কারের অসম বণ্টন বা সামাজিক স্তরবিন্যাস হলো একটি ‘অবচেতনভাবে বিকশিত কৌশল’ (unconsciously evolved device), যা নিশ্চিত করে যে সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সবচেয়ে যোগ্য লোকেরাই করবে। এটি পুরো সমাজের জন্যই কল্যাণকর।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে, বৈষম্য সমাজের কোনো রোগ নয়, বরং এটি একটি সুস্থ সমাজেরই লক্ষণ, যা তার সদস্যদের নিজ নিজ যোগ্যতা অনুযায়ী বিভিন্ন ভূমিকা পালনে চালিত করছে।
সময়ের স্রোতে প্রাসঙ্গিকতা হারানো: কাঠামোগত ক্রিয়াবাদের কঠোর সমালোচনা
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এই তত্ত্বটি সমাজবিজ্ঞানে একচেটিয়া রাজত্ব করলেও সত্তরের দশক থেকে এর জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করে। বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী এর কঠোর সমালোচনা শুরু করেন। অনেকটা পুরনো ঘড়ির মতো, যার টিক্ টিক্ শব্দ একসময় শ্রুতিমধুর লাগলেও পরে একঘেয়ে এবং বিরক্তিকর লাগতে শুরু করে।
এর প্রধান সমালোচনাগুলো হলো:
১. স্থিতাবস্থার পক্ষে সাফাই (Justification of the Status Quo): এই তত্ত্বটি সবসময় সমাজের স্থিতিশীলতা, ভারসাম্য ও সংহতির কথা বলে। এর মানে হলো, সমাজে যা কিছু যেভাবে আছে, সেটাই ঠিক আছে, কারণ তার নিশ্চয়ই কোনো না কোনো ইতিবাচক কাজ আছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি সমাজে বিদ্যমান গভীর বৈষম্য (Inequality), শোষণ (Exploitation) এবং অবিচারকে বৈধতা দেয়। যেমন—ডেভিস ও ম্যুরের তত্ত্বটি দারিদ্র্য ও অসমতাকে স্বাভাবিক এবং প্রয়োজনীয় বলে উপস্থাপন করে, যা আসলে বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামো এবং ধনীদের স্বার্থ রক্ষা করার একটি কৌশল। নারীবাদীরা সমালোচনা করে বলেন, পার্সনসের তত্ত্ব ঐতিহ্যবাহী লিঙ্গীয় ভূমিকা (পুরুষের ‘Instrumental’ ও নারীর ‘Expressive’ ভূমিকা) কে স্বাভাবিক ও কার্যকরী বলে দেখিয়ে পিতৃতন্ত্রকে ন্যায্যতা দেয়।
২. সংঘাত ও ক্ষমতার অনুপস্থিতি (Ignoring Conflict and Power): এই তত্ত্ব সমাজকে একটি সম্প্রীতিপূর্ণ ব্যবস্থা হিসেবে দেখে, যেখানে সবাই মিলেমিশে সাধারণ লক্ষ্যের জন্য কাজ করছে। কিন্তু বাস্তবতা কি তাই? দ্বন্দ্বমূলক তত্ত্বের (Conflict Theory) প্রবক্তারা, যেমন কার্ল মার্কস (Karl Marx) বা রালফ ডারেনডর্ফ (Ralf Dahrendorf), বলেন যে সমাজ সম্প্রীতি দিয়ে নয়, বরং সংঘাত ও ক্ষমতার লড়াই দিয়েই চালিত হয়। মার্কস দেখান যে, পুঁজিবাদী সমাজে মালিক (বুর্জোয়া) ও শ্রমিক (প্রোলেতারিয়েত) শ্রেণির স্বার্থ সম্পূর্ণ বিপরীত এবং তাদের মধ্যকার সংঘাতই সমাজকে চালিত করে। ক্রিয়াবাদ এই সংঘাতের দিকটিকে প্রায় পুরোপুরি উপেক্ষা করে যায়। এটি ধরে নেয় যে সমাজের সকলের স্বার্থ অভিন্ন, যা একটি ভ্রান্ত ধারণা।
৩. অতি-সামাজিক মানুষ (Over-socialized Conception of Man): ক্রিয়াবাদ মনে করে, মানুষ হলো সমাজের হাতের পুতুল। সমাজ তার মূল্যবোধ ও নিয়মকানুন দিয়ে মানুষকে এমনভাবে তৈরি করে যে সে কেবল ব্যবস্থার চাহিদা অনুযায়ীই আচরণ করে। এখানে ব্যক্তির নিজস্ব ইচ্ছা, সৃজনশীলতা, স্বার্থ বা বিদ্রোহ করার ক্ষমতার (Agency) কোনো জায়গা নেই। সমালোচকরা বলেন, মানুষ সবসময় সমাজের নিয়ম মেনে চলে না। তারা নিয়ম ভাঙে, নিয়ম নিয়ে দর কষাকষি করে, নতুন নিয়ম তৈরি করে এবং সমাজকে পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে। প্রতীকী মিথস্ক্রিয়াবাদ (Symbolic Interactionism)-এর মতো তত্ত্বগুলো দেখায় যে, মানুষ নিষ্ক্রিয় প্রাণী নয়, বরং সক্রিয় কর্তা যারা প্রতিনিয়ত তাদের সামাজিক জগৎকে নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ করছে।
৪. কার্যকারণগত সমস্যা বা উদ্দেশ্যবাদ (Teleology and Tautology): এই তত্ত্ব অনেক সময় একটি ঘটনার কারণকে তার ফলাফল দিয়ে ব্যাখ্যা করে, যা একটি যৌক্তিক ভুল। যেমন—‘পরিবার টিকে আছে কারণ এর কাজ হলো সামাজিকীকরণ করা’। সমালোচকরা বলেন, এটি একটি উদ্দেশ্যবাদী বা টেলিওলজিক্যাল (Teleological) ব্যাখ্যা। একটি জিনিসের ফলাফল তার অস্তিত্বের কারণ হতে পারে না। বৃষ্টি নামানোর জন্য নাচ হয়, কিন্তু নাচের কারণে পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটি তৈরি হয়নি। আবার অনেক সময় এর যুক্তিগুলো চক্রাকার বা টটোলজিক্যাল (Tautological) হয়ে যায়। যেমন: একটি প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি টিকে আছে, আর এটি টিকে আছে কারণ এটি গুরুত্বপূর্ণ। এই ধরনের ব্যাখ্যা বৈজ্ঞানিকভাবে দুর্বল।
৫. পরিবর্তনের ব্যাখ্যা দিতে অক্ষমতা (Inability to Explain Social Change): যেহেতু এই তত্ত্বটি ভারসাম্য ও স্থিতিশীলতার ওপর চরমভাবে জোর দেয়, তাই এটি সামাজিক পরিবর্তন (Social Change) কেন এবং কীভাবে ঘটে, তার কোনো ভালো ব্যাখ্যা দিতে পারে না। এটি ধীর, ক্রমবিবর্তনমূলক পরিবর্তনের কথা বললেও, দ্রুত, আমূল ও বৈপ্লবিক পরিবর্তন (Revolutionary Change) কেন ঘটে (যেমন: ফরাসি বিপ্লব, নারী অধিকার আন্দোলন), তা ব্যাখ্যা করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। এর মডেলে পরিবর্তনের কোনো অন্তর্নিহিত উৎস নেই; পরিবর্তন যেন সবসময় বাইরের কোনো ধাক্কার ফলেই আসে।
তত্ত্বের উত্তরাধিকার: একটি পতনের প্রতিধ্বনি ও নতুন পথের সূচনা
কোনো প্রভাবশালী তাত্ত্বিক কাঠামোই নীরবে বিলীন হয়ে যায় না। কাঠামোগত ক্রিয়াবাদ সমাজবিজ্ঞানের সিংহাসন থেকে বিদায় নিলেও, তার প্রেতাত্মা আজও তত্ত্বের করিডোরে ঘুরে বেড়ায়। এর পতনটি ছিল একটি বিস্ফোরণের মতো, যা থেকে ছিটকে বের হওয়া টুকরোগুলো নতুন নতুন তাত্ত্বিক নক্ষত্রপুঞ্জের জন্ম দিয়েছে। সত্তরের দশক থেকে ক্রিয়াবাদের কঠোর সমালোচনা শুরু হলেও, এর প্রভাবকে দুইভাবে বিচার করা যায়: প্রথমত, এটি একটি ‘প্রতিপক্ষ’ হিসেবে কাজ করেছে, যার বিরোধিতার মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন ও বিপরীতধর্মী তত্ত্বের জন্ম হয়েছে। দ্বিতীয়ত, এর মূল কিছু ধারণাকে পরিমার্জন ও সংশোধনের মাধ্যমে নতুন ধারার (যেমন: নব্য-ক্রিয়াবাদ) উদ্ভব ঘটেছে। সুতরাং, ক্রিয়াবাদের উত্তরাধিকার কেবল তার সীমাবদ্ধতার মধ্যেই নয়, বরং সমাজবিজ্ঞানকে নতুন পথে চালিত করার অনুঘটক হিসেবেও এর গুরুত্ব অপরিসীম।
১. প্রত্যক্ষ বিরোধিতা থেকে জন্ম: দ্বন্দ্বমূলক ও মিথস্ক্রিয়াবাদী তত্ত্বের উত্থান
ক্রিয়াবাদের প্রধান উত্তরাধিকার হলো এটি তার সবচেয়ে শক্তিশালী সমালোচকদের জন্ম দিয়েছে। এর স্থিতিশীলতা ও ঐক্যের ধারণার প্রতিক্রিয়া হিসেবেই সংঘাত, ক্ষমতা এবং ব্যক্তির কর্তাসত্তার মতো বিষয়গুলো সমাজতাত্ত্বিক আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে।
-
দ্বন্দ্বমূলক তত্ত্ব (Conflict Theory): ক্রিয়াবাদ যেখানে সমাজকে একটি সংহতিপূর্ণ ব্যবস্থা হিসেবে দেখে, দ্বন্দ্বমূলক তত্ত্ব সেখানে সমাজকে দেখে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতা, সম্পদ ও মর্যাদার জন্য চলমান এক লড়াইয়ের ক্ষেত্র হিসেবে। সি. রাইট মিলস (C. Wright Mills) ছিলেন পার্সনসের ‘গ্র্যান্ড থিওরি’র একজন কঠোর সমালোচক। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ The Sociological Imagination-এ তিনি পার্সনসের বিমূর্ত তত্ত্বকে বাস্তব সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন বলে আখ্যা দেন। মিলসের ‘পাওয়ার এলিট’ বা ‘ক্ষমতার ক্রীড়নক’ ধারণাটি সরাসরি ক্রিয়াবাদের মূল্যবোধের ঐক্যের ধারণাকে আঘাত করে। তিনি দেখান যে, সমাজ সাধারণ মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত হয় না, বরং সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রের একটি ক্ষুদ্র প্রভাবশালী গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে (Mills, 1959)।
একইভাবে, জার্মান সমাজবিজ্ঞানী রালফ ডারেনডর্ফ (Ralf Dahrendorf) ক্রিয়াবাদের ঐক্যের মডেলকে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি মার্কসের শ্রেণি-সংঘাতের ধারণাকে আরও বিস্তৃত করে বলেন যে, সংঘাত শুধু অর্থনৈতিক শ্রেণি থেকেই নয়, বরং সমাজের যেকোনো ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের সম্পর্ক (authority relations) থেকেই উদ্ভূত হয়। তাঁর মতে, প্রতিটি সমাজেই শাসক ও শাসিতের মধ্যে একটি অন্তর্নিহিত সংঘাত বিদ্যমান। এই সংঘাত সমাজের জন্য ‘অক্রিয়’ (dysfunctional) নয়, বরং এটিই সামাজিক পরিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি (Dahrendorf, 1959)। এভাবেই, ক্রিয়াবাদের স্থিতিশীলতার ধারণার শূন্যস্থান পূরণ করতে গিয়ে দ্বন্দ্বমূলক তত্ত্ব সমাজবিজ্ঞানে নিজের জন্য একটি শক্তিশালী জায়গা করে নেয়।
-
প্রতীকী মিথস্ক্রিয়াবাদ ও এথনোমেথডোলজি (Symbolic Interactionism and Ethnomethodology): ক্রিয়াবাদের ‘অতি-সামাজিক মানুষ’ (over-socialized conception of man) ধারণার প্রতিক্রিয়ায় এই ক্ষুদ্র-স্তরের (micro-level) তত্ত্বগুলোর বিকাশ ঘটে। ক্রিয়াবাদ যেখানে দেখায় কীভাবে সামাজিক কাঠামো ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেখানে প্রতীকী মিথস্ক্রিয়াবাদীরা দেখান কীভাবে ব্যক্তিরা মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের নিজস্ব সামাজিক জগৎ নির্মাণ করে।
এই ধারার সবচেয়ে আকর্ষণীয় উদাহরণ হলেন হ্যারল্ড গারফিঙ্কেল (Harold Garfinkel), যিনি ছিলেন ট্যালকট পার্সনসেরই ছাত্র। তিনি গুরুর বিমূর্ত ‘সামাজিক শৃঙ্খলা’র ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেন। গারফিঙ্কেলের প্রশ্ন ছিল: আমরা কীভাবে দৈনন্দিন জীবনে এই শৃঙ্খলার অনুভূতি তৈরি করি এবং টিকিয়ে রাখি? তাঁর প্রতিষ্ঠিত এথনোমেথডোলজি (Ethnomethodology) দেখায় যে, সামাজিক শৃঙ্খলা কোনো পূর্ব-প্রতিষ্ঠিত কাঠামো নয়, বরং এটি মানুষের দৈনন্দিন আলাপচারিতা ও সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের মাধ্যমে প্রতি মুহূর্তে নির্মিত ও পুনর্নির্মিত একটি ভঙ্গুর অর্জন। তাঁর বিখ্যাত ‘ব্রীচিং এক্সপেরিমেন্টস’ (Breaching Experiments)-এর মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন যে, আমরা যখন দৈনন্দিন জীবনের অলিখিত নিয়মগুলো লঙ্ঘন করি, তখনই বুঝতে পারি আমাদের সামাজিক বাস্তবতা কতটা নাজুক এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার উপর নির্ভরশীল (Garfinkel, 1967)। এটি ছিল পার্সনসের ‘টপ-ডাউন’ কাঠামোগত ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী ‘বটম-আপ’ বা নিম্ন থেকে ঊর্ধ্বমুখী চ্যালেঞ্জ।
২. সংশ্লেষণ ও পুনর্গঠন: নব্য-ক্রিয়াবাদের জন্ম
ক্রিয়াবাদের উত্তরাধিকার কেবল তার বিরোধিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর পতনের পর কিছু সমাজবিজ্ঞানী তত্ত্বটির সম্পূর্ণ বর্জনের পরিবর্তে এর দুর্বলতাগুলো সংশোধন করে একটি নতুন ও আরও শক্তিশালী সংস্করণ তৈরির চেষ্টা করেন। এই প্রচেষ্টা থেকেই নব্য-ক্রিয়াবাদ (Neofunctionalism)-এর জন্ম হয়, যার প্রধান প্রবক্তা হলেন জেফরি সি. আলেকজান্ডার (Jeffrey C. Alexander)।
নব্য-ক্রিয়াবাদীরা পার্সনসের মূল কাঠামোর কিছু দিক বজায় রাখলেও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনেন। আলেকজান্ডারের মতে, নব্য-ক্রিয়াবাদ হলো একটি “আত্ম-সমালোচনামূলক তাত্ত্বিক ধারা,” যা পুরনো ক্রিয়াবাদের সীমাবদ্ধতাগুলো কাটিয়ে উঠতে চায় (Alexander, 1985)। এর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:
-
ভারসাম্য মডেলের বর্জন: এটি সমাজকে একটি স্থিতিশীল ও ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা হিসেবে দেখার অনমনীয় ধারণা থেকে সরে আসে। এর পরিবর্তে, সমাজকে একটি উন্মুক্ত, গতিশীল এবং সম্ভাব্য ভারসাম্যহীন ব্যবস্থা হিসেবে দেখা হয়।
-
দ্বন্দ্ব ও ক্ষমতার অন্তর্ভুক্তি: নব্য-ক্রিয়াবাদীরা স্বীকার করেন যে সমাজে ঐক্য ও সংহতির পাশাপাশি সংঘাত ও জবরদস্তিও বিদ্যমান। তারা সমাজকে কেবল সংহতিপূর্ণ না ভেবে, একই সাথে সংহত ও সংঘাতপূর্ণ একটি জটিল ব্যবস্থা হিসেবে দেখেন।
-
ব্যক্তি ও সংস্কৃতির উপর গুরুত্বারোপ: পুরনো ক্রিয়াবাদের যান্ত্রিক নির্ধারণবাদ থেকে বেরিয়ে এসে এটি ব্যক্তির সক্রিয় ভূমিকা বা কর্তাসত্তা (agency) এবং সংস্কৃতির আপেক্ষিক স্বায়ত্তশাসনের ওপর জোর দেয়। সংস্কৃতিকে এখানে কেবল সামাজিক ব্যবস্থার প্রতিফলন হিসেবে না দেখে, একটি স্বাধীন শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয় যা সমাজকে প্রভাবিত করতে পারে।
-
পরিবর্তনের উপর জোর: নব্য-ক্রিয়াবাদ সামাজিক পরিবর্তনের একটি উন্নততর ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করে এবং দেখায় যে পরিবর্তন কেবল বাহ্যিক ঘাত-প্রতিঘাত থেকেই আসে না, বরং সমাজের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও উত্তেজনা থেকেও আসতে পারে।
সংক্ষেপে, নব্য-ক্রিয়াবাদ হলো ক্রিয়াবাদের সেই আধুনিক সংস্করণ, যা তার সমালোচকদের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেকে আরও নমনীয়, বহুমাত্রিক এবং সমালোচনামূলক করে তুলেছে।
এক অপরিহার্য তাত্ত্বিক ভিত্তি
কাঠামোগত ক্রিয়াবাদ আজ হয়তো তার পুরনো জনপ্রিয়তা হারিয়েছে, কিন্তু সমাজবিজ্ঞানের ইতিহাসে তার প্রভাব অনস্বীকার্য। এটি ছিল বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগের সেই প্রভাবশালী প্রতিপক্ষ, যাকে কেন্দ্র করে বা যার প্রতিক্রিয়া হিসেবে পরবর্তী প্রায় সকল তাত্ত্বিক ধারার বিকাশ ঘটেছে। এটি সেইসব মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল—সমাজ কীভাবে টিকে থাকে? বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাজ কী? —যে প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা আজও সমাজবিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় কাজ।
ক্রিয়াবাদ সেই তাত্ত্বিক ভিত্তি বা স্প্রিংবোর্ড তৈরি করে দিয়েছিল, যার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বা যার উপর ভর করে পরবর্তী তত্ত্বগুলো বিকশিত হয়েছে। দ্বন্দ্বমূলক তত্ত্ব এর ঐক্যের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছে, মিথস্ক্রিয়াবাদ এর কাঠামোগত নির্ধারণবাদকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, আর নব্য-ক্রিয়াবাদ এর সীমাবদ্ধতাগুলোকে সংশোধনের চেষ্টা করেছে। তাই কাঠামোগত ক্রিয়াবাদকে না বুঝে আধুনিক সমাজতাত্ত্বিক তত্ত্বের মানচিত্র বোঝা প্রায় অসম্ভব। এটি একটি পুরনো চশমা হতে পারে, কিন্তু সেই চশমাটি পরেই আমরা নতুন এবং আরও উন্নত চশমা তৈরির অনুপ্রেরণা পেয়েছি।
নব্য-ক্রিয়াবাদ (Neofunctionalism): ধ্বংসস্তূপ থেকে নতুন নির্মাণ
ষাটের ও সত্তরের দশকে কাঠামোগত ক্রিয়াবাদ যখন তীব্র সমালোচনার মুখে প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, তখন সমাজবিজ্ঞানের জগতে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপিত হয়: এই তত্ত্বের কি কিছুই রক্ষা করার মতো নেই? এর সকল ধারণাই কি বাতিলযোগ্য? এই ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকেই একদল সমাজবিজ্ঞানী একটি সাহসী পুনর্গঠনের কাজে হাত দেন। তাদের লক্ষ্য ছিল ক্রিয়াবাদের মূল অন্তর্দৃষ্টিগুলো—যেমন সমাজের অংশগুলোর পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, সংস্কৃতির গুরুত্ব এবং সামগ্রিক ব্যবস্থার ধারণা—রক্ষা করা, কিন্তু এর সমালোচিত দিকগুলো—যেমন স্থিতাবস্থার প্রতি পক্ষপাত, সংঘাতের উপেক্ষা এবং যান্ত্রিক নির্ধারণবাদ—বর্জন করা। এই বুদ্ধিবৃত্তিক পুনর্গঠন প্রকল্পের নামই হলো নব্য-ক্রিয়াবাদ (Neofunctionalism)।
এই ধারার প্রধান কান্ডারি হলেন আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী জেফরি সি. আলেকজান্ডার (Jeffrey C. Alexander) এবং তাঁর সহযোগী পল কলোমি (Paul Colomy)। তাঁরা ক্রিয়াবাদকে একটি মৃত তত্ত্ব হিসেবে না দেখে, একটি ‘সমস্যাগ্রস্ত কিন্তু সম্ভাবনাময়’ গবেষণা ধারা হিসেবে বিবেচনা করেন। আলেকজান্ডারের মতে, নব্য-ক্রিয়াবাদ কোনো নতুন তত্ত্ব নয়, বরং এটি একটি ‘আত্ম-সমালোচনামূলক তাত্ত্বিক ধারা’ (self-critical strand of theory), যা পুরনো ক্রিয়াবাদের সীমাবদ্ধতাগুলো চিহ্নিত করে এবং সেগুলোকে অতিক্রম করার চেষ্টা করে। এটি ক্রিয়াবাদের মূল কাঠামো ঠিক রেখে তার মধ্যে নতুন এবং আরও নমনীয় উপাদান যোগ করার একটি প্রচেষ্টা। চলুন, এই পুনর্গঠনের মূল ভিত্তিগুলো গভীরভাবে পর্যালোচনা করা যাক।
কীভাবে নব্য-ক্রিয়াবাদ পুরনো তত্ত্বকে সংশোধন করে?
নব্য-ক্রিয়াবাদীরা পার্সনসীয় ক্রিয়াবাদের প্রধান সমালোচনাগুলোকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেন এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই একটি সংশোধিত বা বিকল্প পথের প্রস্তাব দেন।
১. ভারসাম্য ও স্থিতিশীলতার ধারণার সংশোধন: পুরনো ক্রিয়াবাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিল সমাজের স্থিতিশীলতা ও ভারসাম্যের (Equilibrium) উপর অতিরিক্ত জোর দেওয়া। পার্সনসের মডেল অনুযায়ী, সমাজ সর্বদা একটি স্থির অবস্থার দিকে ধাবিত হয়। নব্য-ক্রিয়াবাদীরা এই অনমনীয় ধারণাটি বর্জন করেন। তাঁরা সমাজকে একটি উন্মুক্ত, গতিশীল এবং সম্ভাব্য ভারসাম্যহীন ব্যবস্থা হিসেবে দেখেন। তাঁদের মতে, সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে নিখুঁত সংহতির পরিবর্তে প্রায়শই উত্তেজনা, সংঘাত এবং অসামঞ্জস্য বিরাজ করে। সমাজ স্থিতিশীলতার দিকে ধাবিত হতে পারে, কিন্তু এটি কোনো অনিবার্য বা স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া নয়। এর ফলে, সামাজিক পরিবর্তনকে আর একটি ব্যতিক্রমী বা ‘অক্রিয়’ (dysfunctional) ঘটনা হিসেবে দেখার প্রয়োজন পড়ে না; বরং পরিবর্তনই সমাজের একটি স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে।
২. ব্যক্তি ও কাঠামোর সমন্বয় (Micro-Macro Linkage): ক্রিয়াবাদের বিরুদ্ধে অন্যতম প্রধান অভিযোগ ছিল এর ‘অতি-সামাজিক মানুষ’ (over-socialized man) ধারণা, যেখানে ব্যক্তিকে কাঠামোর হাতের পুতুল হিসেবে দেখা হয়। নব্য-ক্রিয়াবাদ এই যান্ত্রিক নির্ধারণবাদকে প্রত্যাখ্যান করে। আলেকজান্ডার যুক্তি দেন যে, সমাজকে বুঝতে হলে কাঠামো (macro) এবং ব্যক্তির সক্রিয় ভূমিকা বা কর্তাসত্তা (micro-agency)—উভয়কেই সমান গুরুত্ব দিতে হবে। ব্যক্তিরা কেবল সামাজিক নিয়মের নিষ্ক্রিয় গ্রাহক নয়; তারা সক্রিয় কর্তা, যারা সামাজিক নিয়মকে ব্যাখ্যা করে, পরিবর্তন করে এবং কখনও কখনও প্রতিরোধও করে। সুতরাং, সামাজিক শৃঙ্খলা কেবল উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয় না, বরং এটি ব্যক্তির দৈনন্দিন মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে ক্রমাগত তৈরি হয়। এটি ক্রিয়াবাদকে প্রতীকী মিথস্ক্রিয়াবাদের মতো ক্ষুদ্র-স্তরের তত্ত্বের সাথে আলোচনার একটি সুযোগ করে দেয়।
৩. সংঘাত ও ক্ষমতার স্বীকৃতি: ক্রিয়াবাদ সমাজকে একটি ঐকমত্য-ভিত্তিক ব্যবস্থা হিসেবে দেখে সংঘাতকে প্রায় পুরোপুরি উপেক্ষা করেছিল। নব্য-ক্রিয়াবাদ এই মারাত্মক ভুলটি সংশোধন করে। তারা স্বীকার করে যে, সমাজে মূল্যবোধের ঐক্যের পাশাপাশি ক্ষমতা, জবরদস্তি এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর স্বার্থের সংঘাতও বিদ্যমান। তবে দ্বন্দ্বমূলক তাত্ত্বিকদের মতো তারা সমাজকে কেবল সংঘাতের ক্ষেত্র হিসেবে দেখেন না। বরং, তারা দেখান যে একটি সুস্থ সমাজে সংহতি ও সংঘাত উভয়ই সহাবস্থান করে এবং এই দুইয়ের মধ্যকার টানাপোড়েনই সমাজকে গতিশীল রাখে। সংঘাতকে এখানে কেবল ধ্বংসাত্মক শক্তি হিসেবে না দেখে, সামাজিক উদ্ভাবন ও ইতিবাচক পরিবর্তনের একটি উৎস হিসেবেও বিবেচনা করা হয়।
৪. সংস্কৃতির আপেক্ষিক স্বায়ত্তশাসন (Relative Autonomy of Culture): পার্সনসের তত্ত্বে সংস্কৃতিকে প্রায়শই সামাজিক ব্যবস্থার চাহিদা পূরণের একটি অধীনস্থ উপাদান হিসেবে দেখা হতো। অর্থাৎ, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রয়োজনেই সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। নব্য-ক্রিয়াবাদীরা এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেন। আলেকজান্ডারের মতে, সংস্কৃতি একটি স্বাধীন এবং শক্তিশালী চলক (independent variable), যার নিজস্ব যুক্তি ও গতিপথ রয়েছে। সংস্কৃতি কেবল সামাজিক কাঠামোর প্রতিফলন নয়, বরং এটি নিজেই সামাজিক কাঠামোকে প্রভাবিত ও পরিবর্তন করতে পারে। সমাজের মূল্যবোধ, বিশ্বাস এবং প্রতীকগুলো এমন এক শক্তি, যা অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সামাজিক পরিবর্তনের অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে।
নব্য-ক্রিয়াবাদের প্রয়োগ: একটি উদাহরণ
এই তাত্ত্বিক পরিবর্তনগুলো কীভাবে কাজ করে তা বোঝার জন্য আমেরিকার নাগরিক অধিকার আন্দোলন (Civil Rights Movement)-এর উদাহরণটি অত্যন্ত সহায়ক।
-
পুরনো ক্রিয়াবাদী ব্যাখ্যা: পুরনো ক্রিয়াবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে, এই আন্দোলনটিকে সামাজিক ভারসাম্যের জন্য একটি হুমকি বা ‘অক্রিয়া’ (dysfunction) হিসেবে দেখা যেত। কারণ এটি বিদ্যমান সামাজিক শৃঙ্খলা, বিশেষ করে বর্ণবাদী কাঠামোকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছিল। এই তত্ত্বের পক্ষে ব্যাখ্যা করা কঠিন ছিল যে, কেন একটি স্থিতিশীল ব্যবস্থা হঠাৎ করে এমন একটি সংঘাতপূর্ণ পরিবর্তনের দিকে গেল।
-
নব্য-ক্রিয়াবাদী ব্যাখ্যা: নব্য-ক্রিয়াবাদ এই আন্দোলনকে অনেক সমৃদ্ধ এবং সূক্ষ্মভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে:
-
ব্যক্তির কর্তাসত্তা (Agency): এটি মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের মতো ক্যারিশম্যাটিক নেতা এবং অগণিত সাধারণ মানুষের সক্রিয় ভূমিকাকে স্বীকৃতি দেয়, যারা নিষ্ক্রিয়ভাবে বর্ণবৈষম্য মেনে না নিয়ে সচেতনভাবে তা পরিবর্তনের জন্য সংগঠিত হয়েছিলেন।
-
সাংস্কৃতিক স্বায়ত্তশাসন: আন্দোলনটি আমেরিকার মূল সাংস্কৃতিক কোড বা মূল্যবোধ—যেমন ‘স্বাধীনতা’, ‘সাম্য’ এবং ‘সকল মানুষ সমান’—ব্যবহার করেছিল। এই মূল্যবোধগুলো এতদিন শ্বেতাঙ্গদের জন্য সীমাবদ্ধ থাকলেও, আন্দোলনকারীরা এই সার্বজনীন মূল্যবোধগুলোকে বিদ্যমান বর্ণবাদী কাঠামোর বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী নৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। এখানে সংস্কৃতি ব্যবস্থার অধীনস্থ না থেকে, নিজেই পরিবর্তনের একটি চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে। আলেকজান্ডার একে ‘সিভিল স্ফিয়ার’ (Civil Sphere)-এর শক্তি হিসেবে বর্ণনা করেন, যেখানে সার্বজনীন মূল্যবোধের ভিত্তিতে সামাজিক অবিচারের সমালোচনা করা সম্ভব হয় (Alexander, 2006)।
-
সংঘাতের ইতিবাচক ভূমিকা: বর্ণবাদী কাঠামোর সাথে আন্দোলনকারীদের সংঘাতকে এখানে ধ্বংসাত্মক হিসেবে না দেখে, একটি প্রয়োজনীয় ও সৃজনশীল প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা হয়। এই সংঘাতের মাধ্যমেই পুরনো বৈষম্যমূলক সংহতি ভেঙে একটি নতুন ও আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক সামাজিক সংহতির জন্ম হয়।
-
পৃথকীকরণ (Differentiation): আন্দোলনের চূড়ান্ত ফল ছিল সামাজিক পৃথকীকরণ। অর্থাৎ, নাগরিক অধিকার এবং রাজনৈতিক সুযোগ-সুবিধাগুলোকে বর্ণ বা জাতি থেকে আইনগতভাবে আলাদা করা হয়। এটি সমাজের একটি ইতিবাচক কাঠামোগত পরিবর্তন, যা পার্সনসের পৃথকীকরণের ধারণার একটি গতিশীল প্রয়োগ।
-
সমালোচনা ও উপসংহার
নব্য-ক্রিয়াবাদ নিঃসন্দেহে কাঠামোগত ক্রিয়াবাদকে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক অচলাবস্থা থেকে উদ্ধার করেছে এবং একে সমসাময়িক বিতর্কের জন্য আরও প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। এটি পুরনো তত্ত্বের কঠোরতা ও রক্ষণশীলতা দূর করে একে অনেক বেশি নমনীয়, বহুমাত্রিক ও সমালোচনামূলক রূপ দিয়েছে।
তবে নব্য-ক্রিয়াবাদও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। কিছু সমালোচক মনে করেন, এটি এখনও তার পূর্বসূরির অনেক বোঝা বহন করে। তারা যুক্তি দেন যে, ‘ক্রিয়াবাদ’ শব্দটি ধরে রাখার কারণেই এটি এখনও স্থিতিশীলতা ও সংহতির দিকেই বেশি ঝুঁকে থাকে এবং ক্ষমতা ও শোষণের মতো বিষয়গুলোকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয় না। জেফরি আলেকজান্ডারের লেখা অত্যন্ত বিমূর্ত ও তাত্ত্বিক হওয়ায় এর প্রায়োগিক উপযোগিতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়।
এতদসত্ত্বেও, নব্য-ক্রিয়াবাদের অবদান অনস্বীকার্য। এটি প্রমাণ করেছে যে একটি তাত্ত্বিক ধারাকে পুরোপুরি বর্জন না করেও তার দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। এটি ক্রিয়াবাদের গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্দৃষ্টিগুলোকে রক্ষা করে একে দ্বন্দ্বমূলক তত্ত্ব, মিথস্ক্রিয়াবাদ এবং সাংস্কৃতিক সমাজবিজ্ঞানের সাথে একটি ফলপ্রসূ সংলাপে যুক্ত করেছে। শেষ পর্যন্ত, নব্য-ক্রিয়াবাদ হলো ধ্রুপদী সমাজতাত্ত্বিক চিন্তার সাথে আধুনিক পৃথিবীর জটিল বাস্তবতার সেতুবন্ধন রচনার একটি সফল প্রচেষ্টা।
শেষ কথা: পুরনো চশমা, নতুন দৃষ্টি
এতসব ধারালো সমালোচনার পরেও কি কাঠামোগত ক্রিয়াবাদের কোনো মূল্য আছে? উত্তরটা হলো—হ্যাঁ, অবশ্যই আছে। এবং এর মূল্য অনেক গভীর।
ধরা যাক, আপনি একজন ডাক্তার। আপনি যদি শুধু শরীরের রোগ-জীবাণু বা আঘাত নিয়েই ভাবেন, কিন্তু হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, কিডনি—এই অঙ্গগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় কীভাবে একে অপরের সাথে মিলে একটি সুস্থ শরীরকে টিকিয়ে রাখে তা না জানেন, তাহলে আপনি কখনোই ভালো ডাক্তার হতে পারবেন না। রোগের চিকিৎসা করার আগে সুস্থতা কী, তা জানতে হয়। তেমনি, সমাজবিজ্ঞানীকে সমাজের সংঘাত, বৈষম্য ও পরিবর্তন বোঝার আগে জানতে হয়, স্বাভাবিক অবস্থায় সমাজ কীভাবে টিকে থাকে, এর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে একে অপরের সাথে যুক্ত হয়ে একটি জটিল অথচ কার্যকর ব্যবস্থা তৈরি করে।
কাঠামোগত ক্রিয়াবাদ আমাদের সমাজের সেই মৌলিক কাঠামো ও তার কাজগুলো চেনায়। এটি আমাদের সমাজের একটি বড় বা সামগ্রিক চিত্র (Macro-level perspective) দেখতে সাহায্য করে। যদিও এটি সমাজের সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না, বিশেষ করে ক্ষমতা, সংঘাত ও ব্যক্তির কর্তাসত্তার মতো বিষয়গুলো এর দৃষ্টি এড়িয়ে যায়, তবুও সমাজকে একটি সামগ্রিক ব্যবস্থা হিসেবে বোঝার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই।
আধুনিক সমাজবিজ্ঞানে এই তত্ত্বের দুর্বলতাগুলো কাটানোর জন্য নব্য-ক্রিয়াবাদ (Neofunctionalism)-এর মতো নতুন কিছু তত্ত্ব এসেছে। জেফরি আলেকজান্ডার (Jeffrey Alexander) এর মতো সমাজবিজ্ঞানীরা ক্রিয়াবাদকে একটি একরৈখিক ও যান্ত্রিক তত্ত্ব থেকে মুক্ত করে একটি বহুমাত্রিক তত্ত্বে পরিণত করার চেষ্টা করেছেন। তারা মনে করেন, সমাজকে একটি ভারসাম্যের মডেল হিসেবে না দেখে, একটি উন্মুক্ত ও কম নির্ধারিত ব্যবস্থা হিসেবে দেখা উচিত। নব্য-ক্রিয়াবাদীরা দ্বন্দ্ব, সংস্কৃতি ও ব্যক্তির ভূমিকাকে আরও বেশি গুরুত্ব দেন এবং ক্রিয়াবাদকে অন্যান্য তত্ত্বের সাথে সমন্বয়ের চেষ্টা করেন। তারা দেখান যে, সমাজ একই সাথে সংহত এবং সংঘাতপূর্ণ হতে পারে, এবং সংস্কৃতি শুধুমাত্র ব্যবস্থার প্রতিফলন নয়, বরং এটি একটি স্বাধীন শক্তি যা সমাজকে প্রভাবিত করে।
শেষ পর্যন্ত, কাঠামোগত ক্রিয়াবাদ হলো সমাজের দিকে তাকানোর অনেকগুলো চশমার মধ্যে একটি। হয়তো সবচেয়ে আধুনিক বা নিখুঁত চশমা এটি নয়, এবং এই চশমা দিয়ে সবকিছু পরিষ্কার দেখাও যায় না। কিন্তু এই চশমাটা ছাড়া আমাদের দৃষ্টি চিরকাল অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। সমাজটা হয়তো সত্যিই একটা জটিল যন্ত্র, নয়তো এক বিশাল জীবদেহ। আর আমরা সবাই তার অতি ক্ষুদ্র কিন্তু অপরিহার্য এক একটি অংশ। এই বিরাট ব্যবস্থার মাঝে নিজের অবস্থানটা খুঁজে পাওয়ার জন্যও বোধহয় এই তত্ত্বটা একটু-আধটু জানা দরকার। কারণ একটি ব্যবস্থার সমালোচনা করার আগে, ব্যবস্থাটি কীভাবে কাজ করে তা জানা অপরিহার্য। এটি আমাদের সেই ভিত্তি প্রদান করে যার উপর দাঁড়িয়ে আমরা আরও উন্নত এবং ন্যায়সঙ্গত সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখতে পারি।
তথ্যসূত্র
- Alexander, J. C. (Ed.). (1985). Neofunctionalism. Sage Publications.
- Alexander, J. C. (2006). The Civil Sphere. Oxford University Press.
- Alexander, J. C., & Colomy, P. (Eds.). (1990). Differentiation Theory and Social Change: Comparative and Historical Perspectives. Columbia University Press.
- Dahrendorf, R. (1959). Class and Class Conflict in Industrial Society. Stanford University Press.
- Davis, K., & Moore, W. E. (1945). Some Principles of Stratification. American Sociological Review, 10(2), 242–249.
- Durkheim, É. (1984). The Division of Labor in Society. (W. D. Halls, Trans.). The Free Press. (Original work published 1893).
- Durkheim, É. (1982). The Rules of Sociological Method. (W. D. Halls, Trans.). The Free Press. (Original work published 1895).
- Durkheim, É. (1995). The Elementary Forms of the Religious Life. (K. E. Fields, Trans.). The Free Press. (Original work published 1912).
- Garfinkel, H. (1967). Studies in Ethnomethodology. Prentice-Hall.
- Merton, R. K. (1968). Social Theory and Social Structure (Enlarged ed.). The Free Press.
- Mills, C. W. (1959). The Sociological Imagination. Oxford University Press.
- Parsons, T. (1951). The Social System. The Free Press.
- Parsons, T., & Bales, R. F. (1955). Family, Socialization and Interaction Process. The Free Press.
- Spencer, H. (1896). Principles of Sociology (Vol. 1). D. Appleton and Company. (Original work published 1876).
Leave a Reply