সােফিস্ট দার্শনিকগণ

প্রাক-সোফিস্ট যুগ ও সোফিস্ট যুগের পার্থক্য

প্রাক-সক্রেটিস যুগের বিস্তৃতি : গ্রীক দর্শনে যাকে প্রাকসক্রেটিস যুগ (Pre Socratic Period) নামে অভিহিত করা হয় তার বিস্তৃতি গ্রীক দার্শনিক থেলিস থেকে সােফিস্টদের দার্শনিক চিন্তাধারা পর্যন্তঅনেকেই মনে করেন অ্যানাক্সাগােরাসের দর্শনের সঙ্গে সঙ্গেই গ্রীক দর্শনের প্রথম যুগের সমাপ্তি ঘটলদার্শনিক চিন্তার ক্ষেত্রে তার অবদান হল এক নতুন নীতির উদ্ভাবনসেই নীতি হল জগৎ সংগঠনকারী এক বুদ্ধির নীতি, যাকে তিনি নাউস (Nous) নামে অভিহিত করেছেনএই নীতির কথা বলে তিনি ভৌতিক জড় এবং ভৌতিক মন বা বুদ্ধি, অর্থাৎ, প্রকৃতি মানুষের মধ্যে যে বিরােধ বা বৈপরীত্য তার নির্দেশ করলেন। 

প্রাক-সােফিস্ট যুগের দর্শনের স্বরূপ : প্রাকসক্রেটিস যুগকে প্রাকসােফিস্ট যুগ এবং সােফিস্ট যুগএই দুই ভাগে ভাগ করা হয়প্রাকসােফিস্ট যুগের দার্শনিকবৃন্দের কাছে বাহ্য প্রকৃতিই ছিল দর্শনের প্রধান আলােচনার বিষয়বস্তুবস্তুজগতের মূলতত্ত্বের স্বরূপ কী এই প্রশ্নের আলােচনাই ছিল তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলােচনাঅর্থাৎ,বস্তু (Object), আর বস্তুকে যে প্রত্যক্ষ করে সেই মন (Subject)এই দুইএর মধ্যে প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকদের আগ্রহ ছিল বস্তুর স্বরপ নিরূপণের দিকেকিন্তু কপলস্টোন যে কথা বলেছেন তা স্মরণে রাখা দরকারতিনি বলেন যে, প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকদের মধ্যে আন্তরিকতার অভাব ছিল না কিন্তু তবু তারা সাফল্য লাভ করতে পারেননি। 

বহুত্বের মূলে ঐক্য : থেলিস, অ্যানাক্সিমিনিস, হেরাক্লিটাস প্রমুখ প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকবৃন্দ জগতের যাবতীয় বস্তুর আদি কারণ নিরূপণ করতে গিয়ে যথাক্রমে জল, বায়ু এবং অগ্নিকে সেই আদি কারণ বা জগতের মূল উপাদানরূপে নির্দেশ করেছিলেন বহুত্বের মূলে এক ঐক্যের কথা তারা চিন্তা করেছিলেনসব কিছুই এক এই ঐক্যের কথা ঘােষণা করতে গিয়ে তারা কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ উপস্থাপিত করতে পারেননি। অভিজ্ঞতালব্ধ উপাত্তকে অতিক্রম করে যেন এক প্রত্যক্ষ অনুভূতি বা স্বজ্ঞার (Intuition) মাধ্যমে তারা তাদের সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন। কপলস্টোন তাদের এই ক্ষমতাকে অধিবিদ্যাগত প্রত্যক্ষ অনুভূতির ক্ষমতা (Power of Metaphysical Intuition) বলে অভিহিত করেছেন। এটা ভাবলে ভুল হবে যে, তাদের সিদ্ধান্ত ছিল নিছক কল্পনার ব্যাপার; যা তারা ব্যক্ত করেছিলেন গভীর মনন ও বিচার বুদ্ধির সাহায্যেই করেছিলেন।

প্রাক-সক্রেটিস যুগের দার্শনিকবৃন্দের আন্তরিকতা ও ব্যর্থতা : প্রাক-সক্রেটিস যুগের দার্শনিকবৃন্দের মধ্যে আন্তরিকতার অভাব ছিল না। তাদের ধারণা ছিল এই জগৎ নিয়মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এক সমগ্র (Whole), এক সংহতি (System)। এই সব দার্শনিকবৃন্দ জাগতিক ঐক্যের কথা চিন্তা করলেও জগতের অসীম বৈচিত্র্য, নিয়ত পরিবর্তন ও জগতের বহুতু তাদের দৃষ্টি এড়ায়নি। একের সঙ্গে বহুর, ঐক্যের সঙ্গে বিভেদের, সমন্বয় সাধনের প্রশ্নও দেখা দিল। প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকদের মধ্যে যেমন অ্যানাক্সিমিনিস ঘনীভবন এবং তনুভবন প্রক্রিয়ার সাহায্যে এবং এম্পিডক্লিস রাগ এবং দ্বেষ, এই দুই শক্তির সাহায্যে এই সমাধানে সচেষ্ট হলেন। পারমিনাইডিস বহুত্বকে ইন্দ্রিয়জাত ভ্ৰম-প্রত্যক্ষ বলে আখ্যাত করে তাকে পরিহার করে ঐক্যকে স্বীকার করলেন। কিন্তু এই সব প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক এক এবং বহুর সমন্বয় সাধনের সমস্যা নিয়ে আলােচনা করলেও তার কোন যুক্তিযুক্ত সমাধান দিতে পারেননি। প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকবৃন্দ আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলােচনা করেছিলেন সেটি হল, ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা এবং বিচার বুদ্ধির মধ্যে সম্পর্ক, কিন্তু এই সমস্যারও কোন সন্তোষজনক সমাধান তারা করতে পারেননি। তাহলে তাদের কৃতিত্ব কোথায়? সেটি হল পরবর্তীকালের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক সমস্যার বীজ তাদের আলােচনার মধ্যে নিহিত ছিল , যেমন – পারমিনাইডিসের মতবাদের মধ্যে পরবর্তীকালের ভাববাদের বীজ, লিউসিপ্পাস এবং ডেমােক্রিটাসের মতবাদের মধ্যে যান্ত্রিকতাবাদ এবং জড়বাদের পূর্বাভাস নিহিত ছিল। কিন্তু সমস্যার যুক্তিযুক্ত সন্তোষজনক সমাধান তারা করতে পারেননি। অথচ এদের ব্যর্থতা সত্ত্বেও এদের দার্শনিক চিন্তা উপেক্ষার বিষয় নয়। তাদের দার্শনিক চিন্তা কোন কল্পনাপ্রসূত পৌরাণিক বিশৃঙ্খল চিন্তার সমষ্টি নয়, বিশ্বজগতের মূল কারণকে জানার, তার স্বরূপ নির্ধারণের আন্তরিক প্রচেষ্টা, যে প্রচেষ্টার পেছনে ছিল বিচারবুদ্ধি ও মননের সাহায্যে সত্য আবিষ্কারের আকাঙ্ক্ষা। তাই ব্যর্থতা সত্ত্বেও তারা ইউরােপের প্রথম দার্শনিক। কপলস্টোন বলেন যে, “প্ৰাক-সক্রেটিস দর্শন কোন প্রাক দর্শনের স্তর নয়, এটি গ্রীক দর্শনের প্রথম স্তর।” যাকে বিশুদ্ধ বা প্রকৃত দর্শন বলে অভিহিত করা যেতে পারে, এটা তা নয়, তবু এটা দর্শন পদবাচ্য। প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের দর্শনে দার্শনিক চিন্তার চরম উৎকর্ষ পরিলক্ষিত হলেও, উভয় দার্শনিকই প্রাক-সক্রেটিস দর্শনের প্রভাবের কথা অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করেছেন। প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকবৃন্দের অনেক দার্শনিক সমস্যা এরা আলােচনা করেছেন। অবশ্য এ ব্যাপারে তারা মৌলিক সমাধান দিতে সমর্থ হয়েছিলেন। অতীতকে উপেক্ষা করার কথা এরা কখনও চিন্তা করেননি। প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকদের মধ্যে জগতের উৎপত্তির এবং জগতের ঘটনাবলীর ব্যাখ্যা দেবারই প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। সকলেই মনে করতেন তাদের প্রচারিত মতবাদ নির্ভুল। কিন্তু যারা এরূপ মনে করতেন তাদের প্রচারিত মতবাদের সঙ্গে বিরােধী মতবাদের সমন্বয় সাধনে সচেষ্ট হননি।

সােফিস্টদের মানুষের আলােচনায় আগ্রহ : বিশ্বজগতের উৎপত্তি তার স্বরূপ সম্পর্কে তাদের প্রচারিত মতবাদের মধ্যে বিরােধ দেখা দিলমানুষের পক্ষে বিশ্বের স্বরূপ সম্পর্কে আদৌ কোন জ্ঞান লাভ করা সম্ভব কিনা, মানুষের মনে এমন সংশয়ের সৃষ্টি হলউদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, হেরাক্লিটাস এবং পারমিনাইডিস প্রচারিত মতবাদ ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষের যথার্থ সম্পর্কে সংশয়বাদী দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করলহেরাক্লিটাসের মতে, পরিবর্তনই মূলতত্ত্ব; কোন স্থির, অপরিবর্তনীয় সত্তার অস্তিত্ব নেইঅপরপক্ষে, পারমিনাইডিসের মতে, শুদ্ধ সত্তা হল মূলতত্ত্ব; যা অপরিণামী; গতির প্রত্যক্ষ নিছক ভ্রান্তিতাহলে দেখা যায় যে, ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ সুনিশ্চিত জ্ঞান দিতে পারে এই সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া যায় নাযেহেতু পরস্পর বিরােধী মতবাদগুলোকে কোন ব্যাপকতর মতবাদে সমন্বিত করার প্রচেষ্টা লক্ষ করা গেল না, সেহেতু বিভিন্ন দার্শনিকদের প্রচারিত সটি সম্পর্কীয় মতবাদগুলো সম্পর্কে মানুষের আলােচনায় অগ্রসর হওয়ার প্রয়ােজন দেখা দিলেও, প্রাচীন দার্শনিকদের মধ্যে সেই প্রচেষ্টা লক্ষ করা গেল না। এই প্রচেষ্টা সর্বপ্রথম লক্ষ করা গেল গ্রীসের কূটতার্কিক পণ্ডিত, যারা সােফিস্ট নামে পরিচিত তাদের মধ্যেসুতরাং দর্শনের প্রথম যুগে, সৃষ্টিতত্ত্ব দার্শনিক আলােচনার কেন্দ্রীয় বিষয় হলেও, সােফিস্টদের কাছে আলােচনার বিষয়বস্তু ছিল বিশ্বজগতের মানুষের স্থানগ্রীক দর্শনের দ্বিতীয় যুগে প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলে দর্শনে প্রকৃতি মন সম্পর্কীয় সমস্যার আলােচনা একই সঙ্গে লক্ষ করা যায়। বিশ্বজগতের আলােচনা থেকে মনের আলােচনার দিকে অগ্রগতির কারণ হিসেবে ইতােপূর্বে সংশয়বাদের কথা উল্লেখ করা হলেও, কোন কোন লেখক যেমন জেলার, কপলস্টোন অপর একটি কারণের কথা উল্লেখ করেছেনএই কারণটি হল, গ্রীকরা অন্যান্য বিদেশী উন্নত জাতি যেমন, পারস্য, ব্যাবিলন এবং মিশরের সংস্কৃতি সভ্যতার পরিচয় লাভ করে এবং অপেক্ষাকৃত কম উন্নত যেমন লিবিয়া, সিদিয়া, থ্রাসিয়া প্রভৃতি দেশের লােকদের জীবনধারণ, তাদের সভ্যতা সংস্কৃতির সঙ্গেও পরিচিত হয়উভয়ের তুলনা তাদের মনে এই প্রশ্ন জাগিয়ে তােলে যে মানুষের রীতি নীতি, জীবনধারণ, ধর্মীয় এবং নৈতিক নিয়মাবলী কি প্রচলিত রীতি মাত্র, না তার আধক কিছু? সভ্যতা কি দেবতাদের সৃষ্টি, তা কি অপরিবর্তনীয়? সর্বকালে কি তার একই রূপ, না তার পরিবর্তন বিকাশ সাধন সম্ভব? এই ভাবেই সােফিস্ট চিন্তাধারার শুরু চিন্তার ক্ষেত্রে নি:সন্দেহে এক অভিনবত্বের সূচনা

গ্রীক দর্শনের সঙ্গে সােফিস্টবাদের পার্থক্য : বিষয়বস্তু, পদ্ধতি এবং লক্ষ, নানা বিষয়ে প্রাচীন গ্রীক দর্শনের সঙ্গে সােফিস্টবাদের পার্থক্য নির্দেশ করা যে পারেসেগুলো হল –  

  • প্রথমত, সােফিস্টদের আলােচনার বিষয়বস্তুর সঙ্গে প্রাচীন গ্রীক দর্শনের আলােচনার বিষয়বস্তুর পার্থক্য রয়েছেপ্রাচীন গ্রীক দার্শনিকবৃন্দের কাছে বাহ্য প্রকৃতিই ছিল দর্শনের প্রধান আলােচনার বিষয়বস্তুসেই কারণে প্রাচীনতম গ্রীক দর্শন ছিল নি:স্বৰ্গবাদী বা প্রকৃতিবাদী (Naturalist)গ্রীসের কুটতার্কিক পণ্ডিত যারা সােফিস্ট নামে পরিচিত, বাহ্য জগতের উৎপত্তি স্বরূপের আলােচনা তত্ত্ববিদ্যা সম্পর্কীয় সমস্যার আলােচনা বর্জন করে বিশেষভাবে মানুষের সমস্যার, মানুষের জ্ঞান এবং আচরণের সমস্যার প্রতি মনােযােগী হলেনসােফিস্টদের দর্শন হল মানুষের সভ্যতার ও আচরণের দর্শনজেলার বলেন, এর বিষয়বস্তু হল মানুষ, যে হল ব্যক্তি এবং এক সামাজিক সত্তা, তাছাড়া ভাষা, ধর্ম, কলা, কাব্য, নীতিবিদ্যা এবং রাষ্ট্রনীতির মাধ্যমে তার দ্বারা সৃষ্ট হয়েছে যে সংস্কৃতি” (Zeller: Outlines of the History of Greek Philosophy: Page 76.)
  • দ্বিতীয়ত, প্রাচীন গ্রীক দর্শন সােফিস্ট মতবাদের মধ্যে পদ্ধতির ব্যাপারেও পার্থক্য লক্ষ করা যায়প্রাচীন গ্রীক দর্শন প্রকৃতি, সৌরজগৎ, প্রাণী, উদ্ভিদ এবং ধাতু সম্পর্কে অভিজ্ঞতামূলক পর্যবেক্ষণকে বর্জন না করলেও, মনন (Spaculation) ছাড়া অন্য কোন পদ্ধতির আশ্রয় গ্রহণ করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না যেহেতু তার চরম লক্ষ্য ছিল জগতের ব্যাখ্যার জন্য এক অপরিবর্তনীয় নীতির রূপায়ণতার পদ্ধতি ছিল অবরােহমূলক (Deductive), কেননা গ্রীক দার্শনিক বিশেষ ঘটনাকে সার্বিক নীতি থেকে নি:সৃত করতসােফিস্ট দার্শনিকরা বস্তুর পরিণতি কারণ বা প্রথম কারণ (First Cause) নির্ধারণের কোন চেষ্টা করত নাসােফিস্টরা অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে জীবনের সমস্ত বিভাগ থেকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ জ্ঞান অর্জন করত এবং তারপর তার থেকে কতকগুলো সিদ্ধান্ত টানত যেগুলো অংশত তাত্ত্বিক, অংশত ব্যবহারিক। প্রথমটির উদাহরণ দিতে গিয়ে বলা যেতে পারে যে, তারা সিদ্ধান্ত করত যে, মানুষের পক্ষে সুনিশ্চিত জ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয়আর ব্যবহারিক সিদ্ধান্তের উদাহরণ দিতে গিয়ে বলা যেতে পারে যে, তারা সিদ্ধান্ত করত, সমাজ ব্যক্তির মধ্যে যথাযথ অভিযােজনের ফলেই সমাজের প্রগতি ত্বরান্বিত হয়কাজেই এদের পদ্ধতি ছিল অভিজ্ঞতামূলকঅবরােহমূলকপদ্ধতি। 
  • তৃতীয়ত, প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকদের সঙ্গে সােফিস্টদের লক্ষ্যের পার্থক্যও অনুধাবন করার বিষয়প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকরা ছিলেন সত্যসন্ধানীজ্ঞান এবং সত্যের অনুসন্ধানই ছিল তাদের লক্ষতারা জগৎ সম্পর্কে বস্তুগত সত্য আবিষ্কারে আগ্রহী ছিলেনতারা ছিলেন সত্যের একনিষ্ঠ অনুসন্ধানীঅপরপক্ষে, সােফিস্টরা বস্তুগত সত্য প্রতিষ্ঠায় তেমন আগ্রহী ছিল না, তাদের লক্ষ ছিল বিশুদ্ধ তাত্ত্বিক আলােচনা। সােফিস্টদের কাছে জ্ঞানের মুল্য এই কারণেই যে জ্ঞান জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করতে সাহায্য করত। প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকদের যে শিষ্যের বা অনুরাগীর একান্ত প্রয়ােজন ছিল, তা নয়। যদি থাকত তবে তাদেরকেও তারা দার্শনিকে পরিণত করত। কিন্তু সােফিস্টদের ‘ছাত্র’ বা শিষ্য ছাড়া চলতই না। তাদের লক্ষ ছিল সাধারণ লােকদের এমন শিক্ষা দেয়া যা তারা জীবনে প্রয়ােগ করতে পারে।

সোফিস্টগণের পরিচয়

সামাজিক রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা : সােফিস্টরা কিভাবে তাদের লক্ষ সিদ্ধ করত, তা ভাল করে বুঝতে হলে সেই সময়কার সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় অবস্থা ভাল করে বুঝে নেওয়া দরকার। গ্রীস দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও ঠিক আজকার দিনে গণতন্ত্র বলতে যে জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে সরকার গঠনের কথা আমরা বুঝে থাকি, তা তখন ছিল না। প্রাচীন গ্রীসের প্রতিটি নগরই ছিল একটা স্বাধীন রাষ্ট্র, যা তার নিজের প্রণীত আইনের দ্বারা শাসিত হত। এই সব রাষ্ট্রের মধ্যে কোন কোন রাষ্ট্র এত ছােট ছিল যে তার নাগরিকের সংখ্যা ছিল খুবই অল্প। এত অল্প যে সকলে এক জায়গায় সমবেত হয়ে আইন প্রণয়ন ও সরকারের কাজে অংশগ্রহণ করতে পারত। এর ফলে গ্রীস দেশে প্রতিটি নাগরিক হয়ে উঠল একজন রাষ্ট্রনীতিবিদ এবং আইন প্রণেতা। ফলে ব্যক্তির কাছে নিজের দলের স্বার্থ রাষ্ট্রের স্বার্থের তুলনায় বড় হয়ে দেখা দিল। কাজেই সেই সময়কার রাজনীতিতে দলীয় স্বার্থ, লােভ, অহংবৃত্তিবই প্রকাশ ঘটল। এছাড়া বিজ্ঞান ও দর্শনের প্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ধর্মেরও বিলুপ্তি ঘনিয়ে এল। শিক্ষিত ব্যক্তি ঘটনাকে প্রাকৃতিক কারণের সাহায্যে ব্যাখ্যার জন্য প্রয়াসী হল, ঐশ্বরিক শক্তির সাহায্যে নয়। ঐশ্বরিক ঘটনা, অলৌকিক ঘটনা এবং দৈবজ্ঞদের ভবিষ্যৎবাণীতে শিক্ষিত ব্যক্তিরা আর আস্থা জ্ঞাপনে ইচ্ছুক হলেন না। এর ফলে গ্রীস দেশের লােকেরা হয়ে উঠল সংশয়বাদী এবং সমস্যার বিচারসম্মত সমাধানে আস্থাশীল। সমালোচনামূলক এবং ধ্বংসমূলক চিন্তনের দিকেই যেন এই যুগের লােকদের ঝোঁক। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে যেমন অভিজাততন্ত্রী রাষ্ট্রের আদর্শ ভেঙ্গে পড়ল, তেমনি বিজ্ঞানের প্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় গোঁড়ামি লােপ পেতে লাগল। প্রচলিত নৈতিক আদর্শ, আচার-ব্যবহার, রীতি-নীতি, ঐতিহ্যকে তীব্র সমালােচনার সম্মুখীন হতে হল এবং অনেক কিছুকেই বর্জন করা হল। পূর্বপুরুষদের অনেক ঐতিহ্যই হয়ে উঠল উপহাসের বিষয়। মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তির প্রকাশ-পথে আচার-ব্যবহার, আইন ও নৈতিকতার নিয়ন্ত্রণকে এক বিরাট বাঁধা বলে গণ্য করা হতে লাগল। কাজেই ব্যক্তির নিজস্ব ইচ্ছা ও চাহিদাই প্রাধান্য লাভ করল। সােফিস্টদের শিক্ষাদানের মধ্য দিয়ে সেই যুগের উপরিউক্ত প্রবণতার প্রকাশ ঘটেছে।

পরিচয় : সােফিস্টরা ছিল কুটতার্কিক পণ্ডিতের দলএরা হল একদল পেশাধারী শিক্ষক যারা স্থান থেকে স্থানান্তরে ভ্রমণ করত এবং এরা গ্রীক দর্শনের বিরুদ্ধে এক অভিনব এবং গুরুত্বপূর্ণ ধরনের বিদ্রোহ ঘােষণা করতযেঅর্থে পিথাগােরীয় দার্শনিক সম্প্রদায় এবং এলিয়ার দার্শনিক সম্প্রদায়ের কথা বলা হয়, সে-অর্থে সােফিস্টদের কোন দার্শনিক সম্প্রদায় বলে অভিহিত করা যেতে পারে না। এই সােফিস্ট সম্প্রদায় কোন সুসংহত দার্শনিক চিন্তার অধিকারী ছিল না। তারা ছিল কিছু এলােমেলাে, অবিন্যস্ত চিন্তার অধিকারী, সেই চিন্তাগুলোকে সুসংহত, সুবিন্যস্ত ঐক্যবদ্ধ করে তারা কোন চিন্তার সংহতি গড়ে তুলতে পারেনি। তারা কোন দার্শনিক সম্প্রদায়ের সভ্য ছিল না। তারা ছিল এক শ্রেণীর পেশাধারী শিক্ষক। সােফিস্ট শ্রেণী গড়ে ওঠার মূলে ছিল জনগণের মধ্যে শিক্ষা অর্জন করার আকাঙ্ক্ষা। তবে এখানে শিক্ষা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা বলতে প্রকৃত জ্ঞানার্জনের দ্বারা মনকে উন্নত করার কথা বুঝলে চলবে না। রাজনৈতিক এবং জাগতিক সাফল্য এনে দিতে পারে এমন কৃত্রিম শিক্ষার জন্যই তখন বহু লােক শিক্ষার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেছিল এবং এদের চাহিদা মেটাবার জন্যই সােফিস্ট সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটেছিল। গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা এবং জয়যাত্রা গ্রীসদেশে সাধারণ লােককেও রাজনৈতিক দিক থেকে প্রতিষ্ঠা লাভের সুযােগ এনে দিয়েছিলযেকোন মানুষ উপযুক্ত শিক্ষা লাভ করলে এবং চালাকচতুর হলে, সাধারণের মনােভাব বুঝে নিয়ে তাদের চালিত করতে পারলেই রাষ্ট্রের সবচেয়ে উঁচু পদটিতেও আরােহণ করতে পারতকাজেই যে শিক্ষা মানুষকে রাজনৈতিক উচ্চ পদে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে সেই শিক্ষার গ্রীসে খুব চাহিদা দেখা দিলসােফিস্টরা চাইল এই সুযােগের সদ্ব্যবহার করতেতাই তারা এই চাহিদা মেটাতে প্রয়াসী হলতাছাড়া নাগরিকরা লক্ষ করল যে রাজনৈতিক সফলতা লাভের পক্ষে পুরাতন শিক্ষা খুব কার্যকর নয়; আরও অধিক কিছু শিক্ষা করার প্রয়ােজনসেই শিক্ষাদান কার্যে ব্রতী হল সােফিস্টরাসােফিস্টরা প্রাচীন ব্যবহারিক শিক্ষা (Practical Training)পরিবর্তে তাত্ত্বিক শিক্ষা (Theoritical Training) বা সাধারণ শিক্ষা দান করার সঙ্কল্প করল ব্যবহারিক শিক্ষা বলতে বােঝায় রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে, খ্যাতনামা রাষ্ট্রনীতিবিদদের সংস্পর্শে এসে রাজনীতি শিক্ষা করাতাত্ত্বিক শিক্ষা দান অর্থে বােঝায় বিশেষ বিশেষ বিষয়ে একটিমাত্র বক্তৃতাদান বা ধারাবাহিকভাবে একাধিক বক্তৃতাদানযাবৎ যুবকেরা যে শিক্ষা লাভ করেছে তা হল সাধারণ পড়া, লেখা, অঙ্ক করা এবং সঙ্গিতে কিছু পাঠ গ্রহণ করাকিন্তু রাষ্ট্রনৈতিক জীবনে অংশ গ্রহণের জন্য প্রয়ােজনে ইতােপূর্বে যা শিক্ষা করা হয়েছে তাকে আরও ব্যাপকভাবে শিক্ষা করাতাছাড়া কিভাবে চিন্তা করতে হয়, কথা বলতে হয় এবং ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতির উপযােগী আচরণ শিক্ষা করতে হয়, তাই শিক্ষা দেওয়া হল সােফিস্টদের কাজআসলে সােফিস্টদের এই শিক্ষাদান হল মানুষকে বেঁচে থাকার জন্য ব্যবহারিক দক্ষতা অর্জন করতে শেখানসােফিস্টরা দেখাতে চাইল যে ভাল আচরণ এবং যথাযথ বাচনভঙ্গি মানুষকে শেখানাে যেতে পারেগ্রীস দেশের অভিজাত বংশীয় ব্যক্তিরা বা অভিজাতবর্গ ইতােপূর্বে মনে করতেন যে ভদ্রজনােচিত ব্যবহার শিক্ষা করা যায় না; এটা হল বংশগত ব্যাপার। 

ভ্রাম্যমান শিক্ষা ও পারিশ্রমিক গ্রহণ : সােফিস্টরা ছিল পরিব্রাজনশীল শিক্ষক, যারা স্থান থেকে স্থানান্তরে গিয়ে শিক্ষা দান করত এবং শিক্ষকতার কাজের জন্য উঁচু হারে পারিশ্রমিক গ্রহণ করতজ্ঞান দান করতে গিয়ে পারিশ্রমিক নেওয়া এই ব্যাপারে গ্রীসদেশে তারাই সর্বপ্রথম একটা নতুন রীতির প্রবর্তন করলজ্ঞান দানের জন্য অর্থ গ্রহণ করার রীতি খারাপ না হলেও, সােফিস্টদের পূর্বে এই রীতির প্রচলন ছিল নাবরং এমন কথা বলা যেতে পারে যে, প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকদের অনুসৃত নীতির ছিল সমপূর্ণ বিরুদ্ধ রীতিপ্রখ্যাত গ্রীক দার্শনিক প্লেটো (Plato) এই জাতীয় রীতিকে ঘৃণার চক্ষে দেখতেন এবং জেনােফোন (Xenophon)-ও সােফিস্টদের এই রীতির নিন্দা করতে দ্বিধা করেননিসােফিস্টদের একটা লক্ষ ছিল যুবকদের শিক্ষাকে নিয়ন্ত্রিত করাকাজেই তারা যুবকদের নিজ মতবাদে দীক্ষিত করার জন্য, যুবকদের নিজ পরিবারের পরিচিত পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজেদের পরিবেশে নিয়ে যেত, এমন একটা কথা বেশ প্রচার হয়ে পড়েছিলএও প্রচার হয়েছিল যে, যুবকদের তাদের পরিচিত পরিবেশ থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে তাদেরই সামনে প্রচলিত নৈতিক আদর্শ এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের মর্যাদা নষ্ট হয় এমন শিক্ষা দেওয়া হততার ফলে প্রচলিত নৈতিক আদর্শে ধর্মীয় বিশ্বাসে যারা আস্থাশীল তারা সােফিস্টদের শিক্ষাকে সংশয়ের দৃষ্টিতে দেখতেনকিন্তু যুবক সম্প্রদায়, যারা নতুনকে বরণ করে নিতে উৎসুক, উৎসাহভরে সােফিস্টদের কাজকে সমর্থন করতঅনেকের মতে সােফিস্টরা যে যুবকদের সুসংহতিপূর্ণ শিক্ষার প্রবর্তক সেই বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। সােফিস্টরা বিশেষ করে গণিতশাস্ত্র , জোতির্বিজ্ঞান এবং ব্যাকরণ শিক্ষা দিতশেষােক্ত বিষয়টি শিক্ষা দেওয়ার রেওয়াজ তারা প্রবর্তন করেছিলসােফিস্টদের কাছে সত্যতা নির্ধারণের ব্যাপারটা বড় ছিল নাযে বিষয়ের উপর তারা গুরুত্ব দিত সেটা হল বিরােধী পক্ষের যুক্তিকে খণ্ডন করাবিরােধী পক্ষের যুক্তিকে খণ্ডন করা যতই কষ্টসাধ্য মনে হত, বক্তা তার বক্তৃতাদক্ষতার ততই কৃতিত্ব দেখিয়ে সফলতা লাভের জন্য সচেষ্ট হতএই বিতর্ক দুটি রূপ গ্রহণ করতহয় সুদীর্ঘ বক্তৃতা এবং তার পাল্টা, সংক্ষেপে যার মধ্য দিয়ে বিষয়টির বিশদ আলােচনা হত বা কথােপকথন যার মাধ্যমে সংক্ষেপে কোন বক্তব্য উপস্থাপিত হত এবং তার সমালােচনা করা হত। 

সােফিস্টরা সদাচার শিক্ষা দিত : বলা হয় যে, সােফিস্টরা সততা বা সদাচার (Virtue) সম্পর্কেই শিক্ষা দিতসােফিস্টদের সম্পর্কে এই জাতীয় উক্তিকে মিথ্যা বলা চলে না, যদি সততা বলতে গ্রীকরা যে অর্থে শব্দটিকে গ্রহণ করেছিলেন সেই অর্থে তাকে গ্রহণ করা হয়গ্রীকরা সততা শব্দটিকে তার নৈতিক অর্থের মধ্যেই সীমিত রাখেনিগ্রীকদের কাছে সততা শব্দের অর্থ হল কোন ব্যক্তির রাষ্ট্র সম্পর্কীয় কার্য সফলতার সঙ্গে সম্পাদন করা, যেমন একজন চিকিৎসক তার কার্য দক্ষতার সঙ্গে সম্পাদন করেসােফিস্টরা এই অর্থেই জনসাধারণকে সততা সম্পর্কে শিক্ষা দান করততাদের লক্ষ ছিল রাষ্ট্রের নাগরিককে রাষ্ট্রের কৃতি এবং সভ্য নাগরিক করে তােলাতখনকার দিনে কোন গ্রীক নাগরিকের পক্ষে রাষ্ট্রের উচ্চ পদ লাভ করার বিশেষভাবে প্রয়ােজন ছিল বাগ্মিতার অধিকারী হওয়া। কারও পক্ষে বাগ্মিতার অধিক হওয়া সম্ভব না হলেও অন্ততপক্ষে তাৎক্ষণিক বক্তৃতা করার, তর্ক করার এবং প্রতি বিতর্কমূলক বিষয় সম্পর্কে উপযুক্ত যুক্তি উপস্থাপিত করতে না পারলেও , খুব চটপট উত্তর দেবার প্রয়ােজন অবশ্যই ছিল। সেই কারণে সােফিস্টরা অলঙ্কারশাস্ত্র (Rhetoric) শিক্ষা দেবার ব্যাপারে খুবই যত্ন নিত।

অলঙ্কারশাত্রের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি : বস্তুঅলঙ্কারশাত্রের প্রতি জনসাধারণের আগ্রহ সৃষ্টি করেছিল সােফিস্টরাইএক হিসেবে এই শাস্ত্র শিক্ষা দেবার ব্যাপারে তারাই ছিল অগ্রণীকিন্তু এর কুফলের দিকটাকে অগ্রাহ্য করা যায় নাবলা বাহুল্য, সুফলের তুলনায় এর কুফলের দিকটাই বড় হয়ে দেখা দিলযেসব তরুণকে সােফিস্টরা শিক্ষা দিত তাদের উদ্দেশ্য কি ছিল? তাদের উদ্দেশ্য সত্য নির্ধারণ ছিল নাতাদের উদ্দেশ্য ছিল বহুসংখ্যক ব্যক্তিকে, যা তারা বিশ্বাস করাতে চায়, তাই বিশ্বাস করানকাজেই সােফিস্টরাও, মামলায় উকীলের মত, সত্যতা নির্ধারণের চেষ্টা করে, কিভাবে কতকগুলো যুক্তির সাহায্যে একটা বচনকে প্রমাণ করা যায় সেদিকেই তাদের সমস্ত উৎসাহ প্রচেষ্টাকে নিয়ােগ করতযুক্তির সাহায্যে কালােকে সাদা, বা ভালকে মন্দ প্রমাণ করা যেতে পারে বলে তারা অহঙ্কার করতসােফিস্টরা কোন একটি যুক্তিকে, যতদূর পর্যন্ত চালিয়ে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে, চালিয়ে নিয়ে যেতে প্রস্তুত থাকতঅধিকাংশক্ষেত্রেই এই যুক্তি তাদের সংশয়বাদের (Scepticism) দিকে চালিত করতজর্জিয়াস নামে জনৈক সােফিস্ট মনে করতেন, কোন কিছুরই অস্তিত্ব নেই, যদি কোন কিছুর অস্তিত্ব থাকে তাকে জানা যায় না, এটি অজ্ঞাত, এবং যদি মনে করাও যায় যে এটি অস্তিত্বশীল এবং কোন ব্যক্তি তাকে জানতে পারে, সে তার সেই জ্ঞান অন্য কোন ব্যক্তিকে জানাতে পারে নাতারা বড়াই করে বলত যে, যে কোন বিষয় সম্পর্কেই যুক্তি খাড়া করা যায়; বিষয়বস্তু সম্পর্কে গভীর কোন জ্ঞানের প্রয়ােজন হয় নাসে কারণে জর্জিয়াস (Gorgias) প্রমুখ খ্যাতনামা সােফিস্ট, যে কোন সময়ে যেকোন বিষয় সম্পর্কেই প্রশ্নের উত্তর সঙ্গে সঙ্গে দেবার জন্য উদ্যত হতেন, কোন কিছু চিন্তা করার প্রয়ােজন আছে বলে মনে করতেন নাকাজেই সােফিস্টদের কাছে জয়ের লক্ষ্যটাই ছিল বড় এবং এই উদ্দেশ্যে বাকচাতুরি বা কুটতর্ক ছিল তাদের প্রধান অত্রতর্ক, তা কুটতর্কই হােক না কেন, জয়ের জন্য তাকে প্রয়ােগ করতে সােফিস্টরা দ্বিধা করত নাসােফিস্টরা বিরােধী পক্ষকে তর্কের জালে জড়িয়ে নাস্তানাবুদ করতে ইতস্তত করত নাপ্রয়ােজন হলে হৈচৈ করে, গােলমাল করে, হিংসার আশ্রয় নিয়ে তারা কার্যসিদ্ধি করত সােফিস্টদের যুক্তি তর্ক শিক্ষা দেওয়ার ব্যাপার নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বাট্রান্ড রাসেল বলেন, যা তারা শিক্ষা দিত, তার সঙ্গে তাদের মনে ধর্ম বা সততার কোন সম্পর্ক ছিল নাতারা তর্ক করতে এবং এই কলা বা বিদ্যার জন্য যতখানি জ্ঞান সহায়ক হতে পারে তাই শিক্ষা দিতব্যাপকভাবে বলতে গেলে বলতে হয় যে আধুনিক উকীলদের মত তারা দেখাতে প্রস্তুত ছিল, কিভাবে কোন অভিমতের পক্ষে বা বিপক্ষে কি উপস্থাপিত করতে হয়, নিজেদের কোন সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠায় তারা আগ্রহী ছিল না। যাদের কাছে দর্শন ছিল একটা জীবন ধারা (a way of life), যে জীবন ধর্মের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত, স্বাভাবিকভাবেই তারা এতে আঘাত পেতেন। তাদের দৃষ্টিতে সােফিস্টরা ছিল লঘুচেতা বা চপল এবং নীতিহীন।” (B. Russell : History of Western Philosophy: Page 98)। কথার ফুলঝুরি দিয়ে শ্রোতার মনে চমৎকারিত্বের ভাব সৃষ্টি করা, রূপক অলঙ্কার, অস্বাভাবিক আলঙ্কারিক ভাষা, শ্লেষ, বাক্‌ছল, আপাত:দৃষ্টিতে আত্মবিরােধী অথচ সত্য, এমন কথা প্রয়ােগ করে কার্য উদ্ধার করার দিকেই ছিল তাদের দৃষ্টি। আন্তরিক বা সত্যবাদী হওয়ার তুলনায় চাতুর্যের আশ্রয় গ্রহণই ছিল তাদের কাছে শ্রেয় পন্থা। 

বক্তৃতার ব্যবস্থা : বয়স্কদের জন্য সােফিস্টরা জনসাধারণের উপযােগী বক্তৃতার ব্যবস্থা করতএইসব বক্তৃতা হত সােফিস্টদের কোন পরিচিত বন্ধুর গৃহে বা কোন সাধারণ স্থানেসাধারণ স্থানে অনুষ্ঠিত হলে প্রবেশের জন্য কিছু পারিশ্রমিক নেওয়া হতএই সব অনুষ্ঠানে যে সব বক্তৃতা দেওয়া হত সেগুলোর অলঙ্কারবহুল ভাষা ছিল লক্ষণীয়কি বিষয় সম্পর্কে বক্তৃতা দিতে হবে সােফিস্টরা উপস্থিত জনসাধারণকেই সেই সম্পর্কে বলার জন্য অনুরােধ করত এবং কোনরকম পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই তারা সেই সম্পর্কে বক্তৃতা দিতখুবই স্বাভাবিক যে এইসব বক্তৃতায় বৈজ্ঞানিক বিষয়বস্তুর প্রাচুর্যের তুলনায় অলঙ্কারবহুল ভাষা ব্যবহারের দক্ষতাই প্রাধান্য লাভ করততাদের বক্তব্য বিষয়ের মধ্যে কতখানি সারবস্তু আছে সেই সম্পর্কে কোন রকম সন্দেহের অবকাশ থাকত না এমন জাতীয় কথা বলা চলে নাতবে ধর্মীয়, বৈজ্ঞানিক, রাজনৈতিক এবং নৈতিক বিষয় সম্পর্কে এই জাতীয় সাধারণ আলােচনার কোন মূল্য ছিল না এমন কথাও বলা চলে নাকারণ এই জাতীয় আলােচনার জন্য যে তারা উচ্চ প্রশংসা লাভ করত, ইতিহাসের পাতা থেকেই তা সুস্পষ্টভাবে জানা যায়তাছাড়া প্রতিটি গ্রীক জাতির প্রতিনিধির কাছে, জনসমষ্টির কাছে, তারা বক্তৃতা করার সুযােগ গ্রহণ করত এবং যেহেতু তারা ছিল দেশদেশান্তর পরিব্রাজক শিক্ষক সেহেতু, জাতীয় ঐক্য প্রচার করতে গিয়ে গ্রীক নগররাষ্ট্রের সীমা অতিক্রমে দ্বিধা করত না। 

প্রােটেগােরাস (Protagoras, ৪৮০-৪১০ খ্রি.পূ.)

জীবনচিত্র : সবচেয়ে প্রাচীন সােফিস্ট হিসেবে যার নাম জানা যায় তিনি হলেন প্রােটেগােরাসখ্রি.পূ.৪৮০ অব্দে এবডেরায় তিনি জন্মগ্রহণ করেনতিনি গ্রীসের বহু স্থান পরিভ্রমণ করেন এবং শতাব্দীর মাঝামাঝি প্রথমে এথেন্সে আসেনএথেন্সে তিনি পেরিক্লিসের (Pericles) অনুগ্রহ লাভ করেছিলেন, যিনি তাকে থুরি নামে একটি কলােনীর শশবধান প্রণয়ন করার দায়িত্ব অর্পণ করে তাকে সম্মানিত করেছিলেনএথেন্সে বসবাস করার সময় তার বিরুদ্ধে ঈশ্বরনিন্দার ও নাস্তিকতার অভিযােগ আনয়ন করা হয়। কারণ তিনি ঈশ্বর প্রসঙ্গে (On the Gods) একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, যে গ্রন্থের নাম ছিল, “দেবতারা আছেন কি নেই, আমি বলতে অক্ষম”। এ গ্রন্থে তিনি বলেন যে দেবতাদের অনেক বিষয় আছে যা সুনিশ্চিত জ্ঞানের পথে বাধা সৃষ্টি করে, যেমন বিষয়ের দুর্বোধ্যতা এবং মানুষের জীবনের সংক্ষিপ্ততা। তার গ্রন্থটি উন্মুক্ত হাটে পুড়িয়ে ফেলা হয়। তার বিচার হবার পূর্বেই তিনি এথেন্স পরিত্যাগ করে সিসিলি অভিমুখে পলায়ন করেন এবং পথে জলে ডুবে মারা যান। খ্রি.পূ.৪১০ অব্দে তার মৃত্যু হয় বলে। কথিত আছে প্লেটো তার ডায়লগে প্রােটেগােরাস নামক এক বয়স্ক ব্যক্তির চিত্র অঙ্কিত করেছেনবার্নেট, জেলার প্রমুখ লেখকবৃন্দ তার কথা মনে করে প্রােটেগােরাস সম্পর্কীয় উপরিউক্ত কাহিনী বিশ্বাস করেন। 

সবকিছুর পরিমাপ মানুষ নিজে : সব কিছুর পরিমাপ মানুষ নিজেঅর্থাৎ, মানুষই যাবতীয় বিষয়ের বিচারের মানদণ্ড (Man is the measure of all things)প্রােটেগােরাসের এই সুবিখ্যাত উক্তির মধ্যেই, অনেকের মতে, সােফিস্টদের চিন্তার মূল সূত্র পাওয়া যায়স্টেইসের মতে, উপরিউক্ত উক্তির মধ্যে প্রােটেগােরাসের সমস্ত শিক্ষা ছাড়াও, সােফিস্টদের সমগ্র চিন্তাধারার বীজ নিহিত রয়েছে। প্রােটেগােরাসের এই উক্তির যথার্থ তাৎপর্য সম্পর্কে মতভেদ লক্ষ করা যায়কারও কারও মতে মানুষবলতে প্রােটেগােরাস ব্যক্তিমানুষ (Individual Man)কে না বুঝে সমগ্র মনুষ্য জাতিকে বুঝেছেনযদি প্রােটেগােরাস মানুষবলতে ব্যক্তিমানুষকে বােঝেন তাহলে উপরিউক্ত উক্তির অর্থ হবে, যা তােমার কাছে সত্য মনে হচ্ছে, তা তােমার কাছে সত্য, যা আমার কাছে সত্য মনে হচ্ছে, তা আমার কাছে সত্যকিন্তু মানুষশব্দটিকে শেষােক্ত অর্থে গ্রহণ করলে তার অর্থ হবে, যাকে সমগ্রমনুষ্য জাতি সত্য বলে গ্রহণ করে তাই সত্যআবার বিষয়(Things) বলতে অনেকে যেমন জেলার (Zeller) মনে করেন যে, শুধুমাত্র ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য মূর্ত বস্তু এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য গুণকে বােঝায় তা নয় , ভালমন্দ, সুন্দর, কুৎসিৎ, উচিত, অনুচিতকেও বােঝায়অর্থাৎ, বিষয় বলতে মূল্যকেও বুঝে নিতে হবেকিন্তু আলােচ্য বিষয়টি বিতর্কমূলক বলে অনেকে মনে করেন। অনেকের মতে, প্রােটেগােরাস মানুষশব্দটিকে ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে ব্যক্তি মানুষ অর্থে গ্রহণ করেছেনএই মতের সমর্থনে তারা প্লেটোর Theaetetus’ গ্রন্থে তিনি সম্পর্কে যে আলােচনা করেছেন তার উল্লেখ করেনআবার প্লেটোর Protagorasমানুষ শব্দটিকে নৈতিক মূল্যের ক্ষেত্রে ব্যক্তি মানুষ অর্থে গ্রহণ করা হয়নি বলে তারা বলেনকেউ কেউ হয়ত এমন কথা বলতে পারেন যে, প্রােটেগােরাস ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষ এবং নৈতিক মূল্যের ক্ষেত্রে ‘মানুষ’ শব্দটিকে দুটি ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করেছেন, তাহলে এমন সিদ্ধান্ত করা অসঙ্গত হবে না যে, তার চিন্তার মধ্যে সংগতির অভাব ঘটেছে। কিন্তু মানুষ’ শব্দটির প্রয়ােগ নিয়ে কোন চিন্তার অসংগতি প্রােটেগােরাসের ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে কপলস্টোন মনে করেন না। কেননা, কপলস্টোন মনে করেন যে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর প্রকৃতি এমন হতে পারে যে, তারা সত্য। এবং সার্বিক জ্ঞানের বিষয়বস্তু হতে পারে না। কিন্তু নৈতিক মূল্যের প্রকৃতি যেহেতু ভিন্ন তারা সত্য এবং সার্বিক বিষয়বস্তু হতে পারে।

নৈতিক অবধারণ ও মূল্য সম্পর্কে প্রােটেগােরাসের অভিমত : নৈতিক অবধারণ এবং মূল্য সম্পর্কে প্রােটেগােরাসের যথার্থ অভিমত কি, এ সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করা হলে অনেকে প্লেটোর ‘Theaetetus’ অনুসরণ করে বলতে চান যে, নৈতিক অবধারণ হল আপেক্ষিক কেননা নৈতিক অভিমতের ক্ষেত্রে সত্য বা মিথ্যা হবার প্রশ্ন দেখা না দিলেও, কোন অভিমত অন্য অভিমতের তুলনায় বেশি উপযােগী হতে পারে। কাজেই কেউ ভ্রান্তভাবে চিন্তা করে না, এ কথা যেমন সত্য, আবার তেমনি কোন কোন ব্যক্তি অপর ব্যক্তির তুলনায় অধিকতর জ্ঞানী, এ কথাও সত্য। বিভিন্ন রাষ্ট্রে যে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে সেগুলো আপেক্ষিক, কেননা কোন আইন আবার অপর আইনের তুলনায় বেশি উপযােগী হতে পারে। রাষ্ট্র বা নগর সম্প্রদায় (City Community)-ই কোন আইন প্রণয়ন করবে, তা নির্ধারণ করবে। কিন্তু বাতব নৈতিক অবধারণগুলো প্রকৃতির দিক থেকে আপেক্ষিক বলেই গণ্য হবে।

প্রােটেগােরাস শিক্ষার গুরত্বকে অস্বীকার করেননি। শিক্ষার দ্বারা আত্মার অবস্থার উন্নতি সাধন করা যেতে পারে। মন্দ অনুভূতি, মিথ্যা অনুভূতির বদলে সুস্থ এবং সত্য অনুভূতিকে আত্মায় উপস্থাপিত করা যেতে পারে। প্রােটেগােরাস একথাও মনে করেন যে, নৈতিকতা এবং ন্যায়পরায়ণতার কথা চিন্তা না করে কোন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। তবে সব নৈতিকতা, নিয়ম তুলনামূলকভাবে যথার্থ, কেননা যে সমাজ সেগুলো প্রণয়ন করেছে কেবলমাত্র সেই সমাজের দৃষ্টিতেই সেগুলো যথার্থ বলে গণ্য করা হবে। পরম ধর্ম, নৈতিকতা, এবং ন্যায়পরায়ণতা বলে কিছুই নেই। বিভিন্ন জনসাধারণের প্রণীত সংবিধান, আইন, তাদের ভাষ্য এবং ধর্মীয় ধারণার মতই আপেক্ষিক। ব্যক্তি-নাগরিকদের উচিত হবে সম্প্রদায় প্রণীত নিয়মকানুন মেনে চলা, ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরা, কেননা কোন নিয়মই অপরটির চেয়ে বেশি সত্য নয়। কাজেই আপাতদৃষ্টিতে প্রােটেগােরাসের আপেক্ষিক মতবাদ বৈপ্লবিক প্রতিপন্ন হলেও তিনি কিন্তু কর্তৃপক্ষ ও ঐতিহ্যের সমর্থনেই তার মতবাদকে প্রযুক্ত করেছেন। যেহেতু কোন নিয়ম, কোন আইনই অন্য নিয়ম বা আইনের তুলনায় সত্য নয়, কাজেই কোন ব্যক্তিরই উচিত হবে না রাষ্ট্র প্রণীত আইনের বিরােধীতা করে নিজের ব্যক্তিগত অভিমতকে তার ঊর্ধে তুলে ধরা।

প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকরা, যেমন-এলিয়ার দার্শনিকবৃন্দ, মনে করতেন যে, সত্য ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, বিচারবুদ্ধিগ্রাহ্য। এলিয়ার দার্শনিক পারমিনাইডিসের মতে, কেবলমাত্র সত্তার (Being) যথার্থ অস্তিত্ব আছে এবং সত্তা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, বুদ্ধিগ্রাহ্য। সত্তার অস্তিত্ব নেই, ইন্দ্রিয়ের জন্যই অ-সত্তার অস্তিত্ব আছে মনে করে তা প্রতারিত হই। হেরাক্লিটাসের মতে, ভবনই (Becoming) সত্য, বুদ্ধির দ্বারাই এই নীতি বােধগম্য হয়। হেরাক্লিটাস স্পষ্টই বলেছেন ইন্দ্রিয়ের উপর নির্ভর করে সত্য জানা যায় না-কেবলমাত্র বিচার-বুদ্ধির সাহায্যেই তাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়। কাজেই সত্য বিচার-বুদ্ধিগ্রাহ্য, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়। বিচার-বুদ্ধি মানুষের মধ্যে সার্বিক উপাদান, সংবেদন মানুষের মধ্যে ব্যক্তিগত উপাদান। কিন্তু প্রােটেগােরাস এই বিষয়টিই স্বীকার করে নিতে পারেননি। প্রতিটি মানুষ নিজের কাছে যাকে সত্য বলে মনে করে, তাই সত্য।

মানুষ যা নিজের কাছে সত্য বলে মনে করে তাই সত্য? প্রােটেগােরাসের মতে, মানুষ সব কিছুর মাপকাঠি বা মানদণ্ড। মানুষ বলতে তিনি সমগ্র মনুষ্যজাতিকে না বুঝে, ব্যক্তি মানুষকে বুঝেছেন। সব কিছুর মাপকাঠি (Measure) বলতে তিনি বুঝেছেন সব কিছুর সত্যতা নিরূপণের মানদণ্ড। কোন ব্যক্তি মানুষের কাছে যা সত্য বলে মনে হয়, তাই সত্যতার মাপকাঠি। যা আমার কাছে সত্য বলে মনে হচ্ছে তা আমার কাছে সত্য, যা তােমার কাছে সত্য বলে মনে হচ্ছে তা তােমার কাছে সত্য। যখন মানুষের মধ্যে মতবিভেদ দেখা দেয়, তখন কোন বস্তুগত সত্যের সন্ধান পাওয়া যায় না যার প্রেক্ষিতে বলা যেতে পারে একজন ঠিক বলেছে, অন্যজন ভুল বলেছে। এর অর্থ দাঁড়ায় যে, বতুগত সত্যতা বলে কিছু নেই, ব্যক্তি মন-নিরপেক্ষ কোন সত্যতার অস্তিত্ব নেই। এই বস্তুগত সত্যতা বলতে কি বুঝি? ব্যক্তিগত চিন্তা, ভাবনা, ধ্যান-ধারণা এবং বস্তুগত সত্যতা-এই দুই-র মধ্যে আমরা পার্থক্য করি। কোন ব্যক্তি মনে করতে পারে পৃথিবী সমতল, এটা তার মনােগত ধারণা। কিন্তু বস্তুগত সত্য হল পৃথিবী গােলাকার। বস্তুগত সত্যতা বলতে আমরা মনে করি যে, সত্যতার ব্যক্তি-চিন্তা নিরপেক্ষ অস্তিত্ব আছে। ব্যক্তি বিশেষের নিজ নিজ ভাবনা চিন্তার উপর এই সত্যতা নির্ভর করে না। সত্য যা তাই। ব্যক্তিকেই সত্যতার সঙ্গে সংগতি সাধন করতে হবে। সত্যতা কোন বিশেষ ব্যক্তির ইচ্ছা, ভাবনা, ইন্দ্রিয়জ (Impressions) এর সঙ্গে সংগতি সাধন করে চলবে না। প্রােটেগােরাস এই বিষয়টিই অস্বীকার করতে চাইলেন। প্রােটেগােরাস কোন বস্তুগত সত্যতার অস্তিত্ব স্বীকার করতে চাইলেন না। ব্যক্তি-জ্ঞাতা নিরপেক্ষ কোন বস্তুগত সত্যতার অস্তিত্ব নেই। ব্যক্তির সংবেদন বা ব্যক্তির মনে যা কিছু ছাপ রেখে যায়, সেগুলোই তার কাছে সত্য। এর অনিবার্য ফল হল, যে যা বলেছে তাই তার কাছে সত্য, তার ফলে দুই পরস্পরবিরােধী বচনও সত্য বলে গণ্য হবে। কিন্তু তা কখনও হতে পারে না। কিন্তু প্রােটেগােরাস বলেছিলেন যে, সব অভিমতই সত্য; ভ্রান্তি সম্ভব নয়। যে বচনকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠা করা হয়, উপযুক্ত যুক্তি সহকারে তার বিরােধী বচনকেও সত্য বলে উপস্থাপিত করা যায়। প্রােটেগােরাস-এর এই জাতীয় সিদ্ধান্তের অর্থ দাঁড়ায়, সত্য-মিথ্যা বলে কিছু নেই। যা আমি সত্য বলে অনুভব করি তাই যদি সত্য হয়, সত্যতা আমার অনুভূতির ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। বস্তুগত সত্য বলে আর কিছু থাকে না। প্রােটেগােরাস এই জাতীয় সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন কেন? –

  • প্রথমত, তিনি দেখলেন যে, কোন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু সম্পর্কে বিভিন্ন ব্যক্তির প্রদত্ত বিবরণ বা একই ব্যক্তির বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত বিবরণ ভিন্ন হয়; এই জাতীয় বিবরণের ভিত্তিতে সত্য নিরূপণ করা যায় না। 
  • দ্বিতীয়ত, সব কিছুই পরিবর্তনশীল , স্থায়ী কোন কিছু নেইভবন (Becoming)সত্য, স্থায়ীত্ব অলীক বা মিথ্যা, হেরাক্লিটাসেএই মতবাদ প্রােটেগােরাসকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিলহেরাক্লিটাসএর অভিমতানুসারে, যা এই মুহূর্তে আছে, তা পরমুহূর্তে নেই, কোন কিছু আছে, এও যেমন সত্য, নেই, তাও তেমন সত্য। 

ঈশ্বরতত্ত্ব : প্রােটেগােরাসের মতবাদের অনিবার্য পরিণতি হল জ্ঞান অসম্ভববস্তুগত সত্যতার যদি কোন অস্তিত্ব না থাকে তবে তার জ্ঞান সম্ভবপর হবে কিভাবে? ঈশ্বর প্রসঙ্গে (On the Gods) নামক যে গ্রন্থ তিনি রচনা করেছেন, তাতে তার অজ্ঞেয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশিত হয়েছেকেননা তিনি স্পষ্টই বলেছেন যে, দেবতারা আছে কি নেই, আমি সুনিশ্চিতভাবে বলতে পারছি নাকিন্তু কপলস্টোন বলেন যে, প্রােটেগােরাসের এই ধরনের অজ্ঞেয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, প্লেটোর ডায়লগে যে প্রােটেগােরাসের পরিচয় পাওয়া যায়, তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়হয়ত প্রােটেগােরাস এর আসল বক্তব্য হল যে, প্রচলিত ধর্মকে মেনে নেওয়া যুক্তিযুক্ত। 

প্রােডিকাস (আনু. ৪৬৫-৩৯৫ খ্রি.পূ.)

প্রােডিকাস (Prodicus) হলেন অপর একজন খ্যাতনামা সােফিস্টতিনি ছিলেন প্রােটেগােরাসের থেকে বয়সে তরুণএগিনের সিওস দ্বীপ থেকে তিনি এসেছিলেনএই দ্বীপের অধিবাসীদের জীবনের প্রতি ছিল নৈরাশ্যবাদী বা দু:খবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকথিত আছেযে, প্রােডিকাসেরও তার দেশবাসীদের মত দু:খবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ছিলপ্লেটোর Axiochusনামক ডায়লগ থেকে তার এই দু:খবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কথা জানা যায়, যেখানে তিনি বলেছেন যে, জীবনের অকল্যাণকে এড়াবার জন্য মৃত্যু কাম্যমৃত্যুভীতি যুক্তিসঙ্গত নয় কেননা যে ব্যক্তি জীবিত তার সঙ্গে মৃত্যুর সম্পর্ক কোথায়? সে তো জীবিত, মৃত্যুকে তার ভয় করার কি আছে? আর যে মৃত তার মৃত্যুকে ভয় করার কোন প্রশ্নই ওঠে নাতথাকথিত সুখের জীবন সম্পর্কে তিনি যুবকদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন; তিনি যুবকদের জীবনের বাধাবিপত্তি সাহসের সঙ্গে অতিক্রম করতে উপদেশ দিতেনরিপুর দাসত্ব স্বীকার করার যে বিপদ তার উপর তিনি গুরুত্ব আরােপ করতেন এবং ধন ঐশ্বর্যের ব্যবহার মানুষের পক্ষে সময় সময় কতখানি অকল্যাণ হয়ে উঠতে পারে, সেই সম্পর্কেও তিনি সাবধানবাণী উচ্চারণ করতেন। হয়ত এই কারণেই তিনি দারিদ্রের আর্শীবাদ (The Praises of Poverty) নামে একটি রচনা প্রকাশ করেছিলেন।

তার ‘প্রকৃতি প্রসঙ্গে(On Nature) রচনার বিষয়বস্তু কি, সঠিকভাবে জানা যায়নিতবে গ্রন্থে ধর্মের উৎপত্তি সম্পর্কে তিনি এক চমৎকার মতবাদ উপস্থাপিত করেছেনতার মতে, ধর্মের শুরুতে মানুষ সূর্য, চন্দ্র, নদী, হ্রদ, ফল প্রভৃতিকে অর্থাৎ, সেই সব বস্তুকে যাদের সে উপকারী মনে করত, তাদের দেবতারূপে উপাসনা বা পুজা করত এবং তাদের উদ্দেশ্যে খাদ্য উৎসর্গ করত। তিনি উদাহরণ হিসেবে মিশর দেশের নীল নদীকে কেন্দ্র করে ধর্মবিশ্বাসের কথা উল্লেখ করেনতিনি ধর্মের এই আদিম স্তরের পরবর্তী এক দ্বিতীয় স্তরের কথা উল্লেখ করেছেন যখন কৃষি, ধাতুর কাজ, আঙুরের চাষ ইত্যাদির আবিষ্কার কর্তাদের ডিমিটার (Demeter), ডায়ােনিসাস (Dionysus), হেফেস্টাস (Hephaestus) প্রভৃতিকে দেবতারূপে পূজা করা হতধর্ম সম্পর্কে এই জাতীয় অভিমতের একটা বৈশিষ্ট্য হল, ধর্মের উৎপত্তি সম্পর্কে এই জাতীয় মতবাদ ধর্মোপসনাকে প্রয়ােজনহীন গণ্য করে। এর ফলে প্রােডিকাসের সঙ্গে এথেন্সের কর্তৃপক্ষের সংঘাত অনিবার্য হয়ে দেখা দিল এবং যুবকদের সঙ্গে এই জাতীয় ধর্মালােচনা করার জন্য তাকে লিমিয়াস এর দার্শনিক সম্প্রদায় থেকে বহিষ্কৃত করা হল। 

প্রােটেগােরাসের মত প্রােডিকাসও ভাষাগত আলােচনায় নিজেকে নিযুক্ত করেছিলেনতিনি সমার্থক শব্দের বিজ্ঞানের একজন প্রতিষ্ঠাতা ছিলেনসুস্পষ্ট যৌক্তিক ধারণা গঠনে এই জাতীয় বিজ্ঞান সহায়কতবে প্লেটো প্রােডিকাস সম্পর্কে শ্লেষাত্মক উক্তি করেছেন। 

হিপ্পিয়াস (খ্রি.পূ. ৫ম শতকের শেষের দিক)

এলিসের হিপিয়াস (Hippias) ছিলেন প্রােটেগােরাসের সমসাময়িক কিন্তু তার থেকে বয়সে তরুণসরকারি রাষ্ট্রদূতরূপে তিনি এথেন্সের তুলনায় স্পার্টায় বেশি আসতেনতবে গ্রীসের অবশিষ্ট স্থানগুলোতেও তিনি ব্যাপকভাবে ভ্রমণ করতেনপাণ্ডিত্যের জন্য তার খ্যাতি ছিল এবং গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ব্যাকরণ, অলঙ্কারশাস্ত্র, সাহিত্য, ইতিহাসে তার অগাধ ব্যুৎপত্তি ছিল। তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের সােফিস্ট, কারণ তিনি তার জ্ঞান অপরকে দান করার জন্য বিশেষ আগ্রহী ছিলেনসক্রেটিসের মত তিনিও হাটতলায় মানুষের সঙ্গে কথােপকথনে নিযুক্ত হতেন এবং বিজ্ঞান, দর্শন গণিতের ইতিহাস নিয়ে আলােচনা করতেনউচ্চতর জ্যামিতিক ক্ষেত্র সম্পর্কে তার নিজস্ব কিছু মৌলিক অবদান আছে বলে জানা যায়। নৈতিকতার ক্ষেত্রে আত্মপরিতৃপ্তিকে নৈতিক আদর্শরূপে তিনি নির্দেশ করেছিলেন। অবশ্য আত্মপরিতৃপ্তি অর্থে তিনি মনে করতেন নিজের জন্য যা প্রয়ােজন তা সংগ্রহ করে পর-নির্ভরতা থেকে নিজেকে মুক্ত করা। হিপ্পিয়াস প্রােটেগােরাসকে অনুসরণ করে দেশের প্রচলিত আইনকে প্রাকৃতিক নিয়মের বিরােধী বলে বর্ণনা করেন। তার মতে, প্রচলিত আইন প্রাকৃতিক নিয়মের দ্বারা সংশােধিত হয়। তিনি গ্রীক নগর রাষ্ট্রের সংকীর্ণ সীমা উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চ আকাঙক্ষা ও প্রত্যাশা সমন্বিত এক স্বাধীন মানব-সমাজের কথা চিন্তা করেন। জেলার বলেন যে, নাগরিকত্বের ধারণার শুরু তখন থেকেই।

জর্জিয়াস (৪৮৩ – ৩৭৫ খ্রি.পূ.) 

সিসিলিতে অবস্থিত নিওনটিনির জর্জিয়াস (Gorgias) খ্রি: পূ: ৪৮৩ থেকে ৩৭৫ অব্দ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন৪২৭ খ্রিস্টাব্দে সাইরাকুজের বিরুদ্ধে সাহায্য প্রার্থনা করার জন্য তার স্বদেশীয় নগরের রাষ্ট্রদূত রূপে এথেন্সে এসেছিলেনপ্রথমে তিনি ছিলেন এম্পিডক্লিসের ছাত্র এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন প্রশ্নের আলােচনা নিয়ে তিনি ব্যস্ত থাকতেনকথিত আছে তিনি চক্ষু বা দৃষ্টি সংক্রান্ত একটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেছিলেন জেনাের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি তাকে সংশয়বাদের দিকে চালিত করেছিল এবং তার সেই চিন্তাধারাকেই তিনি সত্তা বা প্রকৃতি(On Notbeing or Nature) নামক গ্রন্থে রূপদান করেনকপলস্টোন বলেন যে, তার মূল চিন্তাধারা Sextus Empiricus, এবং অ্যারিস্টটলের ছদ্মনামে প্রচারিত রচনা On MelissusXenophonesএই সব রচনার বিষয়বস্তু থেকে জানা যায় যে, এলিয়ার দার্শনিকের দ্বান্দ্বিক মতবাদের বিপক্ষে প্রােটেগােরাসের তুলনায় তিনি ভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া করেছিলেন, কারণ প্রােটেগােরাসের মতে, সব কিছুই সত্য, কিন্তু জর্জিয়াস এর বিপরীত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন। 

জর্জিয়াস তিনটি বচন প্রতিষ্ঠার জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেনএই তিনটি বচন হল

  • (১) কোন কিছুরই অস্তিত্ব নেই : এটি  প্রমাণ করতে গিয়ে তিনি জেনাের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির প্রয়ােগ করেছিলেন। জেনাে দেখিয়েছিলেন যে, যা কিছু অস্তিত্বশীল তাই আত্ম-বিরােধীতা দোষে দুষ্ট। তার থেকে জর্জিয়াস সিদ্ধান্ত করলেন যে, কোন কিছুই অস্তিত্বশীল নয়। তবে এক্ষেত্রে একথা স্মরণে রাখা দরকার যে, জেনাে পারমিনাইডিস-এর সত্তার-ই একমাত্র অস্তিত্ব আছে, একথা প্রমাণ করার জন্যই সব অস্তিত্বশীল বস্তু, আত্ম-বিরােধীতা দোষে দুষ্ট বলে আখ্যাত করেছেন। কাজেই জেনাের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ভাবাত্মক বা সদর্থক, নঞর্থক বা অভাবাত্মক নয়। ‘কোন কিছু অস্তিত্বশীল নয়’ – এই বচনটি প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি পারমিনাইডিসের সত্তার উৎপত্তি সম্পর্কীয় যুক্তিটি ব্যবহার করতেন। তিনি বলতেন, কোন কিছুকে অস্তিত্বশীল হতে হলে তার একটা উৎপত্তি থাকবে, তার একটা শুরু থাকবে। হয় সেটি সত্তা থেকে কিংবা অ-সত্তা থেকে উৎপন্ন হয়েছে। কিন্তু সত্তা থেকে উৎপন্ন হলে, এর শুরু আছে বলা যেতে পারে না। আর যদি অ-সত্তা থেকে উৎপন্ন হয়েছে বলা হয় তাহলে তা হবে অর্থহীন। কেননা, নিছক শূন্যতা থেকে কোন কিছু উৎপন্ন হতে পারেনা। আর যদি একথা বলা হয় যে, যা আছে তা অনাদিকাল থেকে রয়েছে তাহলে তাকে অসীম হতে হবে। কিন্তু যা অসীম তা অন্য কিছুতে অস্তিত্বশীল হতে পারে না, বা নিজেতেই অস্তিত্বশীল হতে পারে না। কাজেই তা কোথাও অস্তিত্বশীল নয়। তার মানেই তা অস্তিত্বশীল নয়, বা তা সম্ভব নয়। কাজেই কোন কিছুরই অস্তিত্ব নেই।
  • (২) যদি কোন কিছুর অস্তিত্ব থাকে, তাকে জানা যায় না : দ্বিতীয় বচন হল, “যদি কোন কিছু অস্তিত্বশীল হয় তাকে জানা যায় না। বস্তুত জর্জিয়াস-এর এই বক্তব্য সােফিস্টদের সমগ্র চিন্তাধারারই প্রকাশক; কেননা সােফিস্টদের মতে, জ্ঞান হল ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষণ নির্ভর এবং ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষণ যেহেতু ব্যক্তিভেদে পৃথক, এমনকি একই ব্যক্তির ক্ষেত্রে পৃথক বস্তু সেহেতু তাকে জানা যায় না।
  • (৩) যদি কোন কিছু অস্তিত্বশীল হয়, তাকে অপরের কাছে প্রকাশ করা যায় না : এর কারণ হলো, বস্তুর সংবেদন ব্যক্তিভেদে পৃথকতাছাড়া সংবেদন ব্যক্তিগত ব্যাপারতাকে অপরের কাছে কিভাবে ব্যক্ত করা যাবে? শব্দের সাহায্যে অপরকে বর্ণের জ্ঞান কিভাবে দেওয়া যাবে? কেননা কর্ণ ধ্বনি শােনে, বর্ণ শোনে নাসত্তার একই ছাপ, দুই ব্যক্তির ক্ষেত্রে একই সময়ে কি করে বিদ্যমানথাকতে পারে, যেহেতু তারা পরস্পর পৃথক

জর্জিয়াসএর উদ্দেশ্যের প্রকৃতি সম্পর্কে মতবিভেদ প্রশ্ন হল, জর্জিয়াস কি সত্যই প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে, কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই? সম্পর্কে মতবিভেদ আছেকারও কারও মতে জর্জিয়াসএর উপরিউক্ত চিন্তাধারা দার্শনিক শূন্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চায়আবার অনেকে মনে করেন, যেমন জেলার বলেছেন যে, জর্জিয়াস তার নিজের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির প্রয়ােগ করে এলিয়ার দার্শনিক চিন্তাধারাকে অসঙ্গতিপূর্ণ প্রমাণ করতে চেয়েছিলেনতিনি দেখাতে চেয়েছিলেন যে, অলঙ্কার শাত্রের বা শব্দের সুকৌশল প্রয়ােগের মাধ্যমে একেবারে অসঙ্গতিপূর্ণ সিদ্ধান্তও সম্ভব এমন বিষয় প্রমাণ করা যেতে পারেকিন্তু এই অভিমতকে অনেকে গ্রহণ করেননিতাদের বক্তব্য হল জর্জিয়াসএর চিন্তাধারার দার্শনিক সমালােচনা হিসেবে যথেষ্ট মূল্য রয়েছেকিন্তু যে কথা আগে বলা হয়েছে যে জেলার, কপলস্টোন প্রমুখ লেখকবৃন্দ মনে করেন যে, এলিয়ার দার্শনিক চিন্তাধারাকে অসঙ্গতিপূর্ণ প্রমাণ করার জন্য তিনি এলিয়ার দার্শনিকদের যুক্তিগুলোকেই কৌশলতার সঙ্গে প্রয়ােগ করেছিলেনউপরিউক্ত গ্রন্থটি রচনা করার পর জর্জিয়াস দর্শন পরিত্যাগ করে অলঙ্কারশাস্ত্রের আলােচনায় নিজেকে নিযুক্ত করলেনকিন্তু নিজের মধ্যে দার্শনিক সত্তাকে তিনি সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করতে পারলেন না। সত্যতার জ্ঞান অর্জন থেকে বিরত হয়ে তা সম্ভাব্য তার জ্ঞান অর্জনে তিনি নিজেকে নিযুক্ত করলেন।

বাগ্মিতার কলাকৌশলকে জর্জিয়াস বিশ্বাস বা প্রত্যয় উৎপাদন বা নির্দিষ্ট কোন মতে কারও সমর্থন লাভের ব্যাপারে শ্রেষ্ঠ কলাবিদ্যা বলে গণ্য করতেনএই কারণে তিনি ব্যবহারিক মনােবিদ্যার আলােচনা শুরু করলেন, দর্শনের যে শাখাটি তখনও পর্যন্ত আবিস্কৃত হয়নি। তিনি সৌন্দর্য বিদ্যার এবং কাব্যসমালোচনাবিদ্যার প্রতিষ্ঠা করেছিলেনজর্জিয়াস ছিলেন অভিভাবন (Suggestion)এর আবিষ্কার কর্তা এবং সচেতনভাবে এই বিদ্যার অনুশীলন করতেনমানুষের মনকে প্রভাবিত করার ব্যাপারে তিনি একে একটি শক্তিশালী হাতিয়াররূপে গণ্য করতেনতিনি মনে করতেন যে, একে ভাল বা মন্দ উদ্দেশ্যে প্রয়ােগ করা যেতে পারে, আবার শিল্পজনােচিত উদ্দেশ্যেও এর দ্বারা সিদ্ধ হতে পারেজর্জিয়াস সমর্থনযােগ্য প্রতারণার (Justifiable Deception) উদ্ভাবন করেছিলেন নীতিগত অর্থে নয়, সৌন্দর্যবিদ্যাগত অর্থে বিয়ােগান্তক নাটককে তিনি প্রতারণা বলে অভিহিত করেন। জর্জিয়াস এবং তার সম্প্রদায়, অন্যান্য সােফিস্টদের মত মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে আগ্রহী ছিলেনতার মতে, বুদ্ধিবৃত্তিসম্পৰ্কীয় ক্রিয়ার ভাল নৈতিক ফল আছে (has good moral effect)সকল রকম পরিকল্পনা বা আবিষ্কারের ফলেই সভ্যতার প্রগতি ঘটে। সত্যতা এবং নৈতিকতার প্রশ্নে জর্জিয়াস কোন উত্তর দিতে অস্বীকার করতেনএই কারণে প্রাকৃতিক নিয়ম সম্পর্কে তার সম্প্রদায়ের মধ্যে দুই বিরােধী মতবাদের সাক্ষাৎ মেলে –

  • জোর যার মুল্লুক তার : একটি মতবাদ হল, জোর যার মুল্লুক তার (might is right); এই মতানুসারে নৈতিক নিয়ম এবং আইন হল দুর্বল ব্যক্তিদের সৃষ্টি, যারা শক্তিশালী ব্যক্তিদের এর দ্বারা বশীভূত রাখেনকিন্তু ইতিহাস এবং বাস্তব একে সত্য বলে প্রমাণ করে নাকেননা শক্তিমান দূর্বলের প্রতারণার ব্যাপারটি বুঝতে পারলেই এই সব নিয়মকে দূরে ছুড়ে ফেলে দেবেউপরিউক্ত কথা বলেছেন জর্জিয়াসের ছাত্র মেনাে (Meno)জর্জিয়াসের অপর ছাত্র প্রক্সিনাস (Proxenus)এর মতে, প্রকৃতির নিয়ম হল যারা দূর্বল তারা শক্তিমানের দ্বারা শাসিত হবে
  • সব মানুষই সমান : দ্বিতীয় মতবাদটি হল, অভিজাত সম্প্রদায় হল মিথ্যা বা নকলবস্তু এবং সব মানুষই সমান এবং আইন হল একটা চুক্তি যার দ্বারা পারস্পরিক অধিকার স্বীকার করে নেওয়া হয়কিন্তু এই আইন নাগরিকনীতিবােধসম্পন্ন এবং ন্যায়পরায়ণ হতে শিক্ষা দেয় নাআবার এলিয়ার এলসিডামাস (Alcidamas) প্রাকৃতিক নিয়মের নামে ক্রীতদাসের মুক্তির কথা ঘােষণা করেছেনঈশ্বর সকলকেই স্বাধীন করে সৃষ্টি করেছেন। প্রকৃতি কাউকেই ক্রীতদাস করেনিএমন কথা বলা অসমীচীন হবে না যে, প্রাকৃতিক নিয়ম সম্পর্কীয় এই জাতীয় মতবাদের সঙ্গে নারীজাতির মুক্তির সমস্যা সম্পর্কীয় আন্দোলনের সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে। 

অন্যান্য সােফিস্টগণ 

অবশিষ্ট সােফিস্টদের মধ্যে উল্লেখ্য চেলসিডনের থেসিমেকাসের কথাপ্লেটোর ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে তাকে শক্তিমানদের অধিকার রক্ষার ব্যাপারে একজন একনিষ্ঠ সমর্থক হিসাবে দেখানাে হয়েছেতিনি ন্যায়পরায়ণতার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন যে, হল যারা শ্রেষ্ঠ তাদের সুবিধার ব্যাপারএরপর উল্লেখ করা যেতে পারে এথেন্সএর এন্টিফোন (Antiphon)-এর কথা, যদিও প্লেটো তার নাম উল্লেখযােগ্য বলে মনে করেননিএন্টিফোনের প্রাপ্ত রচনা থেকে বােঝা যায় যে, তিনি তার চিন্তাধারার জন্য প্রােটেগােরাস এবং পারমিনাইডিসের কাছে ঋণীতার মতানুসারে রাষ্ট্র একটা সামাজিক চুক্তির ফলতিনি নৈতিক নিয়ম এবং প্রচলিত রীতিনীতির মধ্যে প্রকৃতির বন্ধনকে দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি এই অভিমত প্রকাশ করেন যে, সব লােকই সমান এবং অভিজাত সম্প্রদায়সাধারণ মানুষের মধ্যে এবং গ্রীক বর্বরদের মধ্যে যে পার্থক্য তাকে তিনি বর্বরােচিত বলে ঘােষণা করেনমানবজীবন সম্পর্কে তিনি এক নৈরাশ্যবাদী ধারণা প্রকাশ করেনতিনি ঘােষণা করেন যে, জীবনে শিক্ষাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং অরাজকতা সবচেয়ে অকল্যাণকর বিষয়নৈতিক দিক থেকে সুখবাদ এবং সামাজিক নীতির সংযােগের কথা তিনি ব্যক্ত করেন। 

প্রােটেগােরাস এবং জর্জিয়াস প্রমুখ সােফিস্টদের পরে যেসব সােফিস্টদের আবির্ভাব ঘটেছিল তাদের কাজ ছিল প্রােটেগােরাসএর প্রচারিত নীতিকে রাষ্ট্রনীতি নৈতিকতার ক্ষেত্রে প্রয়ােগ করাএর ফল হল এই যে, বস্তুগত সত্যতা বলে যদি কিছু না থাকে এবং ব্যক্তি নিজেই যদি হয় সত্যতার মানদণ্ড , তাহলে নৈতিকতাও হয়ে পড়ে ব্যক্তিগত ব্যাপারপ্রতিটি ব্যক্তি যাকে উচিত মনে করে, তাই তার কাছে উচিতকাজেই সর্বজনস্বীকৃত কোন নৈতিক নিয়মের অস্তিত্ব নেই, নৈতিকতা হয়ে পড়ে ব্যক্তির নিজস্ব অনুভূতির ব্যাপারবস্তুত:পক্ষে পােলাস, প্রেসিমেকাস এবং ক্রিটিয়াস এই সিদ্ধান্তেই উপনীতি হয়েছিলেনআবার কোন বস্তুগত নৈতিক নিয়ম যেমন নেই, তেমনি রাষ্ট্রের আইনের ভিত্তিও হল ক্ষমতা, আচারব্যবহার, প্রচলিত রীতিনীতিকোন আইনই ভাল বা ন্যায্য নয়। কেননা ভালত্ব বা ন্যায্যতার কোন যথার্থ মানদণ্ডই নেইসেকারণেই অনেকে, যেমন পােলাস বা প্রেসিমেকাস, মনে করতেন যে রাষ্ট্রের আইন দূর্বলদের সৃষ্টি যারা এই আইনের সাহায্যে শক্তিমানদের নিয়ন্ত্রিত করত, এবং শক্তিমানদের, তাদের স্বাভাবিকক্ষমতা প্রয়ােগের সুযােগ থেকে বঞ্চিত করতসত্যতা নৈতিকতা নির্ধারিত হয় মানুষের বিচারবুদ্ধির দ্বারা, অনুভূতি সংবেদনের দ্বারা নয়। 

সোফিস্টদের গুরুত্ব 

অভিমত প্রকাশের অধিকার : প্রত্যেকেরই নিজ অভিমত প্রকাশের অধিকার আছেপ্রােটেগােরাস যখন বলেন যে কোন বিশেষ অর্থে সব অভিমতই সত্য, এবং জর্জিয়াস যখন বলেন যে, কোন এক বিশেষ অর্থে সব অভিমত মিথ্যা, তখন তার মধ্যেও যথেষ্ট সত্যতা আছে। তবে সােফিস্টদের এই সব উক্তির মধ্যে সত্যতার সর্বনিরপেক্ষতা ও বস্তুগত হবার বৈশিষ্ট্যকে অস্বীকার করার প্রবণতা দেখা দেয় । সত্যতার প্রতিষ্ঠা শুধু কথার জাল বিস্তার করে নিজ অভিমতকে চাপিয়ে দেওয়া নয়। সেই কারণেই সােফিস্টবাদ বলতে কূটতর্ক বুঝিয়ে থাকে। সােফিস্টরা অলঙ্কার শাস্ত্রের আলােচনার প্রবর্তন করেছিলেন। কিন্তু এর বিপদের দিকটা অগ্রাহ্য করা উচিত নয়। কেননা বাগ্নিতা বা বাকচতুরতাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে ব্যক্তি বিষয়বস্তুর গুরুত্বকে অগ্রাহ্য করতে পারে। ঐতিহ্যগত প্রতিষ্ঠান, বিশ্বাস এবং জীবন ধারার ভিত্তি সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করে সােফিস্টরা একটা আপেক্ষিক দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করেছিলেন। তারা অনেক সমস্যা উত্থাপন করেছিলেন, যদিও সমস্যার সমাধান করতে পারেননি। এই আপেক্ষিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধেই প্রতিক্রিয়া করেছিলেন সক্রেটিস এবং প্লেটো তাদের লক্ষ ছিল সত্য জ্ঞান এবং নৈতিক অবধারণের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করা। সােফিস্টরা সব কিছু ধ্বংস করতে চেয়েছিল, কথা অনেকেই স্বীকার করেন নাতারা বলেন যে, প্রােটেগােরাস এবং জর্জিয়াসএর জাতীয় কোন উদ্দেশ্য ছিল না, যদিও তারা খ্যাতনামা সােফিস্ট ছিলেনবস্তুত খ্যাতনামা সােফিস্টবৃন্দ প্রাকৃতিক নিয়মের কথা বলে সাধারণ গ্রীক নাগরিকের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রসারিত করতে চেয়েছিলেনশিক্ষার প্রসারের ক্ষেত্রে সােফিস্টদের যথেষ্ট অবদান আছে। শব্দ, বাক্য, রচনাশৈলী, ছন্দপ্রকরণ সম্পর্কে আলােচনার ক্ষেত্রে তাদের অবদান সকলের মনােযােগ আকর্ষণ করেছিলতারা ছিল অলঙ্কারশাত্রের প্রবর্তকতারা শিক্ষা সংস্কৃতিকে গ্রীসের চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেননৈতিক ধারণা সম্পর্কীয় আলােচনায় তারা উৎসাহ যুগিয়েছিল, যা সক্রেটিসের শিক্ষাকে সম্ভব করে তুলেছিলতারা এমন সব ধারণার আলােচনার প্রবর্তন করেছিল সেগুলো ছাড়া প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল-এর যুগ অতখানি প্রসিদ্ধি লাভ করতে পারত নাসােফিস্টশব্দটি উচ্চারণ করলেই যে তাদের প্রতি একটা নিন্দার ভাব জেগে ওঠেতার কারণ নিরূপণ করতে গিয়ে জনৈক খ্যাতনামা আধুনিক দার্শনিক বলেন যে, সক্রেটিস এবং প্লেটোর বিরােধীতা করার জন্যই সােফিস্টদের অতখানি দুর্নাম হয়েছিল যার জন্য শব্দটি বর্তমানে যে বিষয়টি সূচিত করে তা হল এই যে, হয় কোন সত্যকে মিথ্যা যুক্তির সাহায্যে খণ্ডন করা যায় এবং তাকে সংশয়পূর্ণ করে তােলা যায় বা কোন মিথ্যাকে প্রমাণ করা যায় এবং আপাতদৃষ্টিতে ন্যায়সঙ্গত করে তােলা যায়| সােফিস্ট মতবাদ সম্পর্কে কপলস্টোন তার অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন যে, এই মতবাদ সাধারণভাবে নিন্দার যােগ্য এমন নয়যে মানুষ চিন্তা করে এবং ইচ্ছা করে সেই মানুষের প্রতি চিন্তাশীল ব্যক্তিদের মনােযােগ ধাবিত করে, প্লেটো অ্যারিস্টটলের কৃতিত্বপূর্ণ যুগে উত্তীর্ণ হবার পথে এটি একটি স্তরস্বরূপ। 

দর্শনে সােফিস্টদের অবদান : দর্শনের দিক থেকে সােফিস্টদের বড় অবদান হল মানুষের স্বাধীনভাবে চিন্তা করার অধিকার স্বীকার করে নেওয়াসােফিস্টরা যে কর্তৃপক্ষের, প্রচলিত রীতিনীতির, নির্বিচারে গৃহীত বচনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করেছিলেন তার পেছনে যথেষ্ট যুক্তি আছে। মানুষ বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন জীব, তার ইচ্ছা স্বাধীনতা আছে। কাজেই কেউ যদি তার চিন্তার স্বাধীনতাকে খর্ব করতে চায় তা কোন মতেই মেনে নেওয়া যায় না। কোন বিশ্বাস বলপূর্বক মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। কোন অভিমত গ্রহণ করার পূর্বে, তাকে যাচাই করে দেখার অধিকার সকলের রয়েছে। কিন্তু সােফিস্টদের চিন্তার ত্রুটি হল এই যে, তারা মানুষের চিন্তার স্বাধীনতা স্বীকার করতে গিয়ে সত্যতার বস্তুগত বৈশিষ্ট্য অস্বীকার করে তাকে সম্পূর্ণভাবে মনােগত মনে করেছেন। তারা ব্যক্তির আবেগ, অনুভূতি, সংবেদন ইত্যাদি আপতিক (Accidental) বৈশিষ্ট্যগুলোকেই সত্যতা এবং নৈতিকতার উৎস বলে গণ্য করেছিলেন। সত্যতা ও নৈতিকতার যথার্থ উৎস বা প্রতিষ্ঠাভূমি যে মানুষের বিচারবুদ্ধি-এই সত্য তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিল। খ্যাতনামা সােফিস্ট প্রােটেগােরাসের উক্তি – ‘মানুষই যাবতীয় বিষয়ের বিচারের মানদণ্ড’, এই উক্তি একেবারে অগ্রাহ্য করার মত বিষয় নয়, যদি মানুষের যথার্থ পরিচয় অনুধাবন করতে পারা যায়। যে মানুষের কথা বলা হচ্ছে, মনে রাখতে হবে যে, সেই মানুষ বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ, শুধুমাত্র সংবেদন, আবেগ, খামখেয়ালিপনা, স্ব-ইচ্ছা, অযৌক্তিক সংস্কার, নানা ধরনের দূর্বলতা, দোষত্রুটির সমষ্টিমাত্র নয়। ব্যক্তির নিজস্ব অনুভূতি ও সংবেদনই যদি সত্যতার মানদণ্ড হয় তাহলে সর্বজনস্বীকৃত সত্যতা বলে কিছু থাকে না। ক্ষমতার আইনএকমাত্র আইন যা প্রকৃতি স্বীকার করে নেয়কাজেই সােফিস্টরা হলেন প্রথম যারা জোর যার মুলুক তার এই নীতি প্রচার করেছেনএই সূত্র ধরে ক্রিটিয়াস প্রচার করেন যে সাধারণ লােকের দেবদেবীতে বিশ্বাস হল কোন ধূর্ত রাজনীতিবিদের জনসাধারণকে ভীতির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য জাতীয় বিশ্বাসের আবিষ্কার। 

সােফিস্টদের প্রভাব : অনেকেই মনে করেন যে, সােফিস্টদের প্রচারিত নীতির প্রভাব প্রশংসনীয় নয়, কেননা তার মধ্যে একটা ধ্বংসমূলক এবং সমাজ বিরােধী প্রবণতা বর্তমানবস্তুত তাদের প্রচারিত নীতি, ধর্ম, নৈতিকতা, রাষ্ট্রের এবং প্রচলিত প্রতিষ্ঠানের ভিত্তিকে ধ্বংস করে দিতে চায়বস্তুত সােফিস্টরা ব্যক্তির ইচ্ছা অস্মিতাকেই প্রাধান্য দিয়েছেনসােফিস্টদের প্রচারিত মতবাদের অভিনবত্বকে অস্বীকার করা যায় না; তাদের প্রচারিত ধারণা জনসাধারণের প্রাচীন কুসংস্কার, বদ্ধমূল ধারণার মূলে আঘাত করেছেকাজেই প্রথমে গঠনমূলক হলেও তার পরিণতি হয় ধ্বংসমূলকএর ফলে অস্বীকৃতি, সংশয়বাদ এবং অবিশ্বাসদেখা দেয়এর ফলাফল বা পরিণতি হল নঞর্থক বা অভাবাত্মকযে আচারব্যবহার, রীতিনীতি ঐতিহ্যের উপর সমাজের ভিত্তি, সেগুলো অংশত ধ্বংস হয়ে যায়তার ফলে সমাজের ঐক্যও ব্যাহত হয়ব্যক্তিই প্রাধান্য লাভ করেব্যক্তিকে কেন্দ্র করেই চিন্তার বিস্তৃতি ঘটেব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের প্রাধান্য বা জয়জয়কার ঘােষিত হয়। তার ফলে সভ্যতা, ভালত্ব, সবই হয়ে পড়ে মনােগত এবং ব্যক্তি যাকে সত্য বা ভাল বলে গণ্য করে তাই হয়ে ওঠে ভাল বা সত্য। কিন্তু এই অবস্থাকে স্বীকার করে নেওয়া যেতে পারে নাসত্যতা নৈতিকতার ভিত্তি মানুষের বিচারবুদ্ধির উপরই প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিততাই জ্ঞানের সম্ভাবনাকে স্বীকার করে নেওয়ার এবং জ্ঞানের বিষয়বস্তু যে সুনির্দিষ্ট, অনির্দিষ্ট নয়, মানুষের অনিশ্চিত মতামতের উপর তা নির্ভর করে , এই বিষয়টিকেও মেনে নেবার প্রয়ােজনীয়তা দেখা দিল। মানুষের ব্যবহারিক জীবনকে পরিচালিত করার জন্য যে আদর্শের প্রয়ােজন, সেই আদর্শ যে মানুষের প্রকৃতির মধ্যেই নিহিত আছে, তার অনুসন্ধানের প্রয়ােজনও দেখা দিলএই কাজেই আত্মনিয়ােগ করলেন সক্রেটিস এবং তার অনুরাগীবৃন্দ

আধুনিক যুগে সােফিস্টদের ভাল ও মন্দ নীতির উদাহরণ : সােফিস্টদের ভাল মন্দ নীতির উদাহরণ আধুনিক প্রটেসট্যান্টদের মতবাদ বা আচরণে এবং আধুনিক গণতন্ত্রেও দেখা যায়প্রটেসট্যান্টরা ব্যক্তির নিজের বিচারবুদ্ধিকে প্রকাশ করার স্বাধীনতাকে স্বীকার করে নিয়েছেন আর গণতন্ত্রের নীতিই হল ব্যক্তির বিচারবুদ্ধি যে আইনের প্রতি স্বীকৃতি জানাতে পারছে না, তাকে মেনে না নেওয়াঅবশ্য মানুষের বিচারবুদ্ধির উপরই আইনের প্রতিষ্ঠা। 

আধুনিক যুগের চিন্তা ধারার উপর সােফিস্টদের প্রভাব : আধুনিক যুগে মানুষের চিন্তাধারার মধ্যেও সােফিস্টদের ধারণা এবং চিন্তার প্রবণতা লক্ষ করা যায়অনেকেই বলে থাকেন যে, মানুষ যে অভিমতই পােষণ করুক না কেন তা দৃঢ়ভাবে পােষণ করা উচিতআবার একথাও অনেকে বলেছেন যে, প্রত্যেকেরই নিজ মত প্রকাশের অধিকার আছেনৈতিকতার কোন সুনির্দিষ্ট বস্তুগত আদর্শ নেই, দেশভেদে এবং কালভেদে তা পৃথক, এমন কথা বিতর্কমূলক হলেও আজকের দিনে অনেকের মুখ থেকেই শােনা যায়ব্যক্তির নিজের ব্যক্তিত্বকে বিকশিত করার প্রয়ােজন আছে, আধুনিক যুগে অনেকেই এই কথা বলেছেন। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের পথে কোন বাধা আরােপ করা উচিত নয়এও অনেকের অভিমতকাজেই দেখা যাচ্ছে যে, আধুনিক যুগের মানুষের চিন্তাধারার উপর সােফিস্ট চিন্তাধারার প্রভাব লক্ষ করা যায় তবে সেই প্রভাব শুভ কি অশুভ সেই আলােচনার স্থান এটি নয়

তথ্যনির্দেশ 

  1. Zeller : Outlines of the History of Greek Philosophy; Page 76.
  2. B. Russel : History of Western Philosophy; Page 98.
  3. Hegel : History of Philosophy; Page 354.
  4. F. Copleston : A History of Philosophy; Vol. 1. Part I; Page 105.

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.