শােপেনহাওয়ার (১৭৮৮-১৮৬০)

জীবন ও কর্ম

দার্শনিক শােপেনহাওয়ারের (Schophenhauer) জীবন ও কর্ম একটু ব্যতিক্রম রকমের। তিনি যে যুগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং যে পরিবারের সন্তান ছিলেন তিনি, সেই যুগ ও পরিবারের অনেক বিরূপ ঘটনা তার জীবনকে যথেষ্ট পরিমাণে দুঃখের প্রলেপ লাগিয়ে দিয়েছিল— যার ফলশ্রুতিতে তিনি পরিণত হন একজন দুঃখবাদী দার্শনিকে। ১৭৮৮ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি তারিখে জার্মানির ডেন্টজিগে (Dantzig) দার্শনিক শােপেনহাওয়ার জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। তাই শােপেনহাওয়ারকেও তিনি একজন ব্যবসায়ী বানাতে চেয়েছিলেন। সাংসারিক জীবনে শােপেনহাওয়ারের পিতার অর্থনৈতিক কোন অভাব যদিও ছিল না, কিন্তু অভাব ছিল সুখের।

তার পিতা-মাতা উভয়েই ড্যানজিগের (Danzig) বিখ্যাত বণিক ছিলেন। এই ড্যানজিগ শহরেই তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন ভলতেয়ারপন্থী, এবং তিনি ইংল্যান্ডকে স্বাধীন ও বুদ্ধিমত্তার দেশ হিসেবে অভিহিত করতেন। ড্যানজিগের গণ্যমান্য নাগরিকদের মতােই তিনি মুক্ত শহরের স্বাধীনতার ওপর প্রাশিয়ার (Prussia) অবৈধ হস্তক্ষেপকে ঘৃণা করতেন। ১৭৯৩ সালে মুক্ত শহর প্রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত হলে তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন, তিনি এমনই ক্রুদ্ধ হন যে, প্রচুর আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করেও তিনি হ্যামবার্গে (Hamburg) চলে যান। ১৭৯৩ সাল থেকে ১৭৯৭ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানে পিতার সঙ্গে বসবাস করেন। এর পরবর্তী দুই বছর তিনি প্যারিসে (Paris) বসবাস করেন, এবং শেষ দিকে তিনি লক্ষ করেন তাঁর পুত্র প্রায় জার্মান ভাষা ভুলেই গেছে। ১৮০৩ সালে তাকে ইংল্যান্ডের একটি বাের্ডিং স্কুলে ভর্তি করা হয়। তিনি এখানকার ভণ্ডাক্তি এবং ভণ্ডামিকে ঘৃণা করেন। পিতাকে সন্তুষ্ট করার জন্য তিনি দুই বছর পর হামবার্গের একটি বাণিজ্যিক কার্যালয়ে কেরানির চাকুরি গ্রহণ করেন। তিনি এখানে ব্যবসায়ী হাওয়ার ইচ্ছা ত্যাগ করেন, এবং সাহিত্যিক ও একাডেমিশিয়ান হিসেবে জীবনযাপনের ইচ্ছাপােষণ করেন। ১৮০৫ সালে তার পিতা সম্ভবত আত্মহত্যা করেন, এবং পিতার মৃত্যুর কারণে তার পক্ষে এরূপ সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়েছিল। তার মার ইচ্ছা ছিল যে, সে ব্যবসা-বাণিজ্য বাদ দিয়ে স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করুক। অবশ্য অনুমান করা যায় যে, অবশেষে তিনি পিতার সিদ্ধান্তের চেয়ে মায়ের সিদ্ধান্তকেই অগ্রাধিকার দেবেন, কিন্তু ঠিক বিপরীত ঘটনাই ঘটেছিল। তিনি তার মাকে অপছন্দ করেন, এবং পিতার স্নেহবিজড়িত স্মৃতি বয়ে বেড়ান।

পিতৃহারা শােপেনহাওয়ার তার মায়ের কাছে বড় হতে থাকেন। শােপেনহাওয়ারের মা সাহিত্য সাধনায় উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। জেনা যুদ্ধ শুরু হওয়ার দুই সপ্তাহ পূর্বে তিনি উইমারে (Weimar) বসবাস শুরু করেন। এখানে তিনি একটি সাহিত্য আড্ডার ব্যবস্থা করেন, বইপত্র লেখেন এবং সংস্কৃতিবান লােকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব উপভােগ করেন। পুত্রের জন্য তার স্নেহমমতা কমই ছিল এবং তার দোষত্রুটি ধরার জন্য তীক্ষ্ণ নজর রাখতেন। তিনি তার ফাঁকা বুলি ও শূন্য করুণ রসের জন্য সাবধান করে দেন। পুরুষদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তােলার কারণে তিনি মায়ের প্রতি বিরক্ত হন। বয়ােপ্রাপ্ত হলে উত্তরাধিকারসূত্রে তিনি মােটামুটি স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করার মতাে সম্পত্তি লাভ করেন; এরপর তিনি এবং তার মা উভয়েই ধীরে ধীরে একে অন্যের প্রতি অসহনীয় হয়ে পড়েন। স্ত্রীলােকদের প্রতি তার হীন মনােভাব পােষণ করার কারণ নিঃসন্দেহে তা আংশিকভাবে হলেও, মায়ের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদের ফল। শোপেনহাওয়ারের মা যেন ছিলেন জ্যান্থিপির আরেক নাম। অত্যন্ত বদমেজাজী, উগ্র স্বাধীনতাপ্রিয় এবং অবাধ প্রেমে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। নিজের বাসভবনে তিনি বিভিন্ন পুরুষের সাথে থাকতেন। তবে এসবের মধ্যে তার একটি মাত্র ভালাে গুণ ছিল তা হলাে তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রতিভাবান একজন লেখিকা। অনেকে বলেন স্ত্রীর এরকম চরিত্রের কারণেই শোপেনহাওয়ারের পিতা হাইনরিখ শোপেনহাওয়ার ১৮০৫ সাল জলে ডুবে আত্মহত্যা করেছিলেন, তবে তার ডিপ্রেশন ও অ্যানজাইটির মতো কিছু মানসিক সমস্যাও ছিল। যাই হােক, শােপেনহাওয়ার তাঁর মায়ের এ সকল কার্যকলাপে অত্যন্ত অখুশি হন এবং মাকে ঘৃণা করা শুরু করেন। মায়ের ওপর ঘৃণার কারণে তিনি সকল নারীকেই সকল ঘৃণা করা শুরু করেন। শােপেনহাওয়ার তার মায়ের সাথে নিতান্তই একজন প্রতিবেশীর মতাে করে একসাথে বসবাস করতেন, ঘৃণা করতেন মায়ের সকল কর্মকেই, আর নিজে মৌলিকভাবে একাকিত্বে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চিন্তারত থাকতেন। তিনি ছিলেন প্রচণ্ড মেধাবী। শোপেনহাওয়ারের নিজের মতে, তিনি তাঁর মায়ের কাছ থেকেই হয়তাে মেধা পেয়েছিলেন, চরিত্র পেয়েছেন পিতার। তবে শােপেনহাওয়ারের মা ছেলের এই প্রতিভা সহ্য করতে পারলেন না। তাই একদা কবি গ্যেটে যখন তাকে তার ছেলের অসাধারণ প্রতিভার কথা স্মরণ করিয়ে দেন এবং ভবিষ্যতে তার থেকেও বড় মনীষী হবার সম্ভাবনার কথা ঘােষণা করেন তখন শােপেনহাওয়ারের মায়ের ঈর্শা চরম পর্যায়ে পৌঁছে। তিনি রাগে ফেটে পড়েন এবং সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে তার নিজের ছেলেকে সিঁড়ির ওপর থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেন। বললেন তার বাড়ি থেকে চলে যেতে। শােপেনহাওয়ার তার মায়ের কাছ থেকে চলে গেলেন। যাবার সময় তার মাকে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলেছিলেন, “মা, তুমি আমাকে চলে যেতে বলে ভালােই করেছে, কেননা , তােমার সাথে থাকা অত্যন্ত দুরূহ। তবে আমি বলে যাচ্ছি, তুমি যত বড় লেখিকাই হও না কেন ভবিষ্যতে সব মানুষ তােমাকে চিনবে শুধুমাত্র এই শােপেনহাওয়ারের মা হিসেবে।” বস্তৃত শােপেনহাওয়ার ছিলেন অত্যন্ত আত্মপ্রত্যয়ী একজন মানুষ। তার অসাধারণ মেধা এবং প্রগাঢ় আত্মঅহমিকা তাকে আরও বেশি দুঃখের মধ্যে নিপতিত করেছিল।

ইতােমধ্যে হামবার্গে তিনি রােমান্টিকদের বিশেষ করে টিয়েক (Tieck), নােভালিস (Novalis), এবং হােফম্যানের (Hoffmann) মতাে রােমান্টিকদের দ্বারা প্রভাবিত হন। তিনি এদের কাছ থেকে গ্রিসের প্রশংসা করতে শেখেন এবং খ্রিস্টধর্মে হিব্রু উপাদান থাকার কারণে খ্রিস্টধর্মের নিন্দা করেন। ফ্রেডরিক ব্লেগেল (Friedrick Schlegel) নামক অন্য একজন রােমান্টিক তার ভারতীয় দর্শনের প্রশংসার বিষয়টি সমর্থন করেন। বয়ােপ্রাপ্ত হওয়ার বছরেই (১৮০৯) তিনি গােটিনজেন (Gottingen) বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। প্রথমে চিকিৎসাবিদ্যার ছাত্র হিসেবে ভর্তি হন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে তিনি দর্শনের প্রতি দুর্বলতার কারণে, বিষয় পরিবর্তন করে দর্শনে ভর্তি হন। বিশিষ্ট কান্ট সমালােচক শোল্‌জ (Schulze) এর প্রভাবে তিনি কান্ট প্লেটোর দর্শনের ওপর যথেষ্ট শিক্ষা লাভ করেন। তিনি কান্টের সমালােচনা করতে শেখেন। দুই বছর পর তিনি বার্লিনে (Berlin) চলে যান এবং প্রধান বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশুনা করেন। সেখানে তিনি ফিখ্‌টেশ্লেয়ারম্যাকার-এর অধীনে দর্শন অধ্যয়ন করেন। তিনি ফিকটের বক্তৃতা শােনেন, কিন্তু এই বক্তৃতা তার মনঃপূত হয় নি, স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন উত্তেজনায় তিনি উদাসীন থাকেন। এই সময় থেকেই থেকে শােপেনহাওয়ার মৌলিকভাবে দার্শনিক চিন্তা শুরু করেন। ১৮১৩ সালে তিনি তাঁর প্রথম গ্রন্থ “On the Fourfold Root of Sufficient Reason” এর লেখা শেষ করেন। ১৮১৪ সালে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটি তিনি জেনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট ডিগ্রীর জন্য থিসিস হিসেবে দাখিল করেন। ১৮১৬ সালে “On Vision and Colour” নামক তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটি মূলত কবি গ্যাটের সাথে তাঁর পত্রালাপের ভিত্তিতে রচিত। এর পরে তিনি লিখলেন তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক গ্রন্থ “The World as Will and Idea”; ১৮১৮ সালে গ্রন্থটি তিনি লিখে শেষ করেন। গ্রন্থটি যখন প্রকাশক প্রকাশ করেন তখন তিনি বেশ সন্দেহ প্রকাশ করেন। কিন্তু শােপেনহাওয়ার নিজে যেভাবে নিজের গ্রন্থের উচ্চকিত প্রশংসা করে চিঠি লেখেন তার কারণে শেষমেষ প্রকাশক তা না প্রকাশ করে পারলেন না। শােপেনহাওয়ার প্রকাশকের কাছে লিখেছিলেন, “এখানে গতানুগতিক চিন্তার চর্চা (rehash) করা হয় নি; বরং এক সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ মৌলিক চিন্তার কাঠামাে তৈরি করা হয়েছে।… ভবিষ্যতে এ গ্রন্থই হবে আরাে শত শত গ্রন্থের উৎস ও অনুপ্রেরণা।” (S. Will Durant, The Story of Philosophy, Washington Square Pfas (U.S.A), 1961, p- 305)। কিন্তু গ্রন্থটি প্রকাশের পরে প্রকাশক বেশ বিপাকেই পড়েন। দীর্ঘ ১৬ বছরেও তার প্রথম সংস্করণ শেষ না হওয়ায় তিনি শেষ পর্যন্ত তা সেরদরে (পুরােনাে কাগজের মতাে করে) বিক্রি করা শুরু করলেন। কিন্তু শােপেনহাওয়ার তাতে মােটেই ঘাবড়ালেন না; বরং দৃঢ় ভাষায় নিজের গ্রন্থের উৎকর্ষতা সম্পর্কে বিবৃতি প্রদান করলেন। তিনি বলতে চাইলেন যে, পাঠকগণ তাঁর গ্রন্থের উৎকর্ষতা বুঝতে পারে নি। এমনকি এব্যাপারে তিনি তার ব্যক্তিগত ক্ষোভও প্রকাশ করতে ছাড়েন নি। ‘Fame’ শিরােনামে লেখা তার এক প্রবন্ধে তিনি তাঁর এ গ্রন্থের পরিণতি সম্পর্কে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে পাঠকদের সম্পর্কে কঠোর ভাষায় বিভিন্ন মন্তব্য করেন। যেমন তিনি লিখেছেন, “Works like this are as a mirror; if an ass looks in, you can not expect an angel to took out.” (Will Durant : The Story of Philosophy, Page- 305)।

যাই হােক শােপেনহাওয়ার তাঁর দার্শনিক অনুসন্ধান কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন, লিখতে থাকলেন উদ্দামের সাথে। কিন্তু তাঁর বড় সাধ দর্শনের শিক্ষক হবার। ১৮২০ সালে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে অবৈতনিক শিক্ষক হিসেবে চাকুরীর অফার দিল। তিনি রাজি হয়ে গেলেন। তিনি ১৮২০ সালে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাইভেটডােজেন্ট (Privatdozent) নিযুক্ত হন। নিতান্ত জেদের জন্য স্বেচ্ছায় তিনি তার ক্লাসের সময় নির্ধারণ করলেন ঠিক হেগেলের প্রিয়ডের সাথে। হেগেল তখন জার্মানিতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তারকারী দার্শনিক। তাই যা হবার তাই হল। শােপেনহাওয়ার তার লেকচার কক্ষে তার বক্তৃতা শােনার লােক পেলেন না। কিন্তু তবুও তিনি ছিলেন হেগেলের সমালােচনায় রত। যাই হােক, ১৮৩১ সালে বার্লিনে মহামারী আকারে কলেরা দেখা দিলে শােপেনহাওয়ার ও হেগেল উভয়ই বার্লিন ত্যাগ করেন। কিন্তু মহামারী শেষ না হতেই হেগেল বার্লিনে ফিরে আসায় তিনিও কলেরায় আক্রান্ত হন এবং মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু শােপেনহাওয়ার মহামারী থাকা অবস্থায় আর বার্লিনে ফেরেন নি, যার কারণে তিনি বেঁচে গেলেন। ১৮৩৬ সালে তিনি “On the Will in Nature” নামে এক বিখ্যাত প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। ইতােমধ্যেই তার প্রথম গ্রন্থ বেশ সমাদৃত হতে শুরু করেছে। এসময়ে নতুন উদ্দামে তিনি লিখে চললেন। ১৮৪১ সালে বের করলেন তাঁর নীতিশাস্ত্র বিষয়ক গ্রন্থ “The Two Ground Problems of Ethics” এবং ১৮৫১ সালে প্রকাশ করেন “Essays” (জার্মান নাম Prrengaet Partapomena)। ১৮৪৪ সালে তাঁর “The World as Will and Idea”-এর দ্বিতীয় সংস্করণ বের হয়। কিন্তু এবারও প্রকাশক তাঁকে কোন অর্থ দিলেন না। অবশ্য শােপেনহাওয়ার অর্থের জন্য লালায়িত ছিলেন না। তিনি তাঁর উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত পৈত্রিক সম্পত্তি দিয়েই বেশ ভালােভাবে চলতে পারতেন।

শেষ জীবনে শোপেনহাওয়ার ফ্রাঙ্কফুর্টে একজন বৃদ্ধ কুমার হিসেবে জীবনযাপন শুরু করেন। তিনি আজীবন অবিবাহিত ছিলেন। বিবাহিত জীবন তিনি পছন্দ করতেন না তা কিন্তু না। বরং একাকীত্বের হাহাকার তাঁর জীবনকে বেশ বিষাদময় করে তুলেছিল। কিন্তু তিনি বিয়ে করতে পারেন নি। কেননা, নারী সম্পর্কে তার ধারণা ছিল অত্যন্ত খারাপ। কোন নারীর সাথে থাকার চেয়ে একা থাকাই তিনি ভালাে মনে করতেন। তিনি জীবনের শেষ ভাগে এসে একটি আবাসিক হােটেলের দুটি রুম ভাড়া করে থাকতেন। খেতেন একটি ইংলিশ হােটেলে। এ সময় তাঁর জীবনের একমাত্র সর্বক্ষণিক সাথী ছিল ‘আত্মা’ বা ‘বিশ্ব-আত্মা’ নামক তাঁর একটি পােষা কুকুর। যুবক শ্রেণী রসিকতা করে তাঁর কুকুরটিকে ‘তরুণ শােপেনহাওয়ার’ বলতাে। এই দুঃখবাদী দার্শনিকের শখ ছিল বাঁশি বাজানাে এবং গান শােনা। রাতে খাওয়ার পরে প্রায়ই তিনি একাকী বসে বাঁশি বাজাতেন। কোথাও সংগীত অনুষ্ঠান হলে সাধ্যমত তিনি সেখানে যােগ দিতেন। প্রতিদিন দুই ঘণ্টা করে ভ্রমণ করতেন, লম্বা পাইপে ধূমপান করতেন ও লন্ডন টাইমস (London Times) পত্রিকা পড়তেন। তিনি তার যশ-খ্যাতি নিয়ে প্রকাশিত সংবাদপত্র খোঁজার জন্য সাংবাদিক নিয়ােগ করেন। তিনি গণতন্ত্রবিরােধী ছিলেন, এবং ১৮৪৮ সালের বিপ্লবকে ঘৃণা করতেন (ফরাসিতে পুনরায় বিপ্লব সংঘটিত হয়, রাজা লুই ফিলিপ ইংল্যান্ডে পালিয়ে প্রাণরক্ষা করেন। রাজ্যে সাধারণতন্ত্র ঘােষিত হয়)। তিনি অধ্যাত্মবাদ এবং জাদুতে বিশ্বাস করতেন। তার অধ্যয়ন কক্ষে কান্টের একটি আবক্ষ মূর্তি এবং বুদ্ধের (Buddha) একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি ছিল। তিনি তার জীবনাচরণে কান্টকে করার চেষ্টা করতেন, শুধু ব্যতিক্রম ছিল ভােরে ঘুম থেকে ওঠা। ১৮৬০ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর এই নিঃসঙ্গ দার্শনিক সকালের নাস্তা খেতে বসেছিলেন, কিন্তু তাঁর আর ওঠা হয়নি, ওভাবেই তিনি নিঃশব্দে চলে গেলেন “পরপারে”।

দার্শনিকদের মধ্যে শােপেনহাওয়ার নানা দিক থেকে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ও স্বতন্ত্র। তিনি নৈরাশ্যবাদী দার্শনিক, অন্যদিকে আর প্রায় সকলে আশাবাদী দার্শনিক। কান্ট এবং হেগেলের মতাে তিনি সম্পূর্ণরূপে একাডেমিক না হলেও আবার একেবারে একাডেমিক ধারার বাইরে নন। তিনি খ্রিস্টধর্মকে অপছন্দ করেন, এবং ভারতবর্ষের হিন্দু ও বৌদ্ধধর্ম উভয়কেই অগ্রাধিকার প্রদান করেন। তিনি একজন বৃহৎ সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের লােক, তিনি যেমন কলাবিদ্যায় অনুরাগী ঠিক তেমনি নীতিবিদ্যায়ও অনুরাগী। তিনি জাতীয়তাবাদ থেকে বিশেষভাবে মুক্ত এবং তিনি যেমন তার স্বদেশী লেখকদের সঙ্গে স্বাচ্ছন্দবােধ করেন, তেমনি ইংরেজ ও ফরাসি লেখকদের সঙ্গেও স্বাচ্ছন্দ্যবােধ করেন। পেশাগত দার্শনিকের কাছে তার দর্শনের আবেদন সুরুচিসম্পন্ন ব্যক্তি এবং সাহিত্যিকদের তুলনায় সব সময় কম। সুরুচিসম্পন্ন ব্যক্তি এবং সাহিত্যিকরা বিশেষ এক ধরনের দর্শনে বিশ্বাস করেন এবং তা অনুসন্ধান করেন। তিনি ইচ্ছার (Will) ওপর গুরুত্ব আরােপ করেন যা ১৯শ এবং ২০শ শতাব্দীর দর্শনের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। কিন্তু তার নিকট ইচ্ছা অধিবিদ্যক দিক থেকে মৌলিক হলেও তার ইচ্ছাকে নৈতিক দিক থেকে অশুভ ভাবার ব্যাপারটা কেবল একজন নৈরাশ্যবাদীর নিকটই সম্ভব। তিনি তার নিজের দর্শনের উৎস হিসেবে কান্ট (Kant), প্লেটো (Plato) এবং উপনিষদের কথা স্বীকার করেন। কিন্তু তিনি প্লেটোর নিকট যতটা নিজেকে ঋণী মনে করেন রাসেলের মত অনেকেই ততটা মনে করেন না। রাসেল বলেন, হেলেনিস্টিক যুগের মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে তার দৃষ্টিভঙ্গির সাদৃশ্য রয়েছে; এই দৃষ্টিভঙ্গি ছিল শ্রান্ত-ক্লান্ত এবং রুগ্ন, বিজয়ের চেয়ে শান্তিকে এবং সংস্কারের প্রচেষ্টার চেয়ে প্রশান্তিকে মূল্যবান মনে করা হতাে। শশাপেনহাওয়ার এগুলােকে অনিবার্য নিষ্ফল প্রয়াস হিসেবে অভিহিত করতেন।

তার প্রধান গ্রন্থ দি ওয়ার্ল্ড অ্যাজ উইল অ্যান্ড আইডিয়া (The World as Will and Idea) ১৮১৪ সালের শেষের দিকে প্রকাশিত হয়। তিনি এই গ্রন্থকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিশ্বাস করেন, এবং এমনকি এ কথাও বলেন যে এই গ্রন্থের কিছু অনুচ্ছেদ পবিত্র আত্মা (Holy Ghost, খ্রিস্টধর্মের ট্রিনিটি বা ত্রিত্বের একটি) দ্বারা নির্দেশিত। কিন্তু গভীর মনস্তাপের বিষয় তার আশা সম্পূর্ণরূপে নিরাশায় পরিণত হয়। তিনি ১৮৪৪ সালে প্রকাশককে গ্রন্থের দ্বিতীয় সস্করণ প্রকাশের জন্য রাজি করান। কয়েক বছর পর তিনি তার দীর্ঘ প্রত্যাশিত স্বীকৃতি পেতে শুরু করেন।

শােপেনহাওয়ারের দার্শনিক পদ্ধতি কান্টের দার্শনিক পদ্ধতিরই অভিযােজিত রূপ। ফিকটে অথবা হেগেল কান্টের ক্রিটিক গ্রন্থের যেসব বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরােপ করেছেন, তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন দিকের ওপর তিনি গুরুত্ব প্রদান করেছেন। তারা স্বগত সত্তার ধারণা থেকে মুক্ত হতে পেরেছিলেন, এবং এভাবে জ্ঞানকে অধিবিদ্যকরূপে মৌলিক করতে পেরেছিলেন। শােপেনহাওয়ার স্বগত সত্তার (Thing-in-itself) ধারণার কথা স্বীকার করলেও একে ইচ্ছার ধারণার সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে করেন। তিনি মনে করেন, প্রত্যক্ষণে আমার শরীর হিসেবে যা প্রতীয়মান হয় তা প্রকৃতপক্ষেই আমার ইচ্ছার প্রকাশ। কান্টের দর্শনের অধিকাংশ অনুরাগী যেটুকু স্বীকার করতে আগ্রহী ছিলেন তার চেয়ে কান্টের দর্শনের বিকাশ হিসেবে এই মতবাদের পক্ষে আরাে বেশি বলা যেতে পারে। কান্ট মনে করতেন যে, নৈতিক আইনের পর্যালােচনা আমাদের অবভাসসমূহ বা অ্যাপিয়ারেন্সের পেছনে বিদ্যমান বিষয়ের কাছে নিয়ে এমন জ্ঞান প্রদান করতে পারে যা ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষণ প্রদান করতে পারে না। তিনি আরাে মনে করতেন যে, নৈতিক আইন অপরিহার্যরূপে ইচ্ছার ধারণার সঙ্গে যুক্ত। কান্টের মতে, একজন ভাল মানুষ এবং একজন মন্দ মানুষের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে অবভাসিক জগতের মধ্যে পার্থক্যের বিষয়, প্রকৃত জগত বা স্বগত সত্তা বা থিং-ইন-ইটসেলফের পার্থক্যের বিষয় নয়। ইচ্ছা বা অভীপ্সা ভাল ও মন্দ মানুষের মধ্যে পার্থক্যের সৃষ্টি করে, তাই ইচ্ছা বা অভীপ্সাও কান্টের মতে প্রকৃত জগৎ নয়, বরং অবভাসের জগতের সাথেই সম্পর্কিত হচ্ছে। শোপেনহাওয়ারের দর্শন কান্টের দর্শনের বিকাশ, শোপেনহাওয়ারের মতে, দেহ হচ্ছে অবভাস এবং এর ইচ্ছা হচ্ছে প্রকৃত সত্তা।

‘ইচ্ছা’ সম্পর্কিত দর্শন

নৈরাশ্যবাদী শােপেনহাওয়ার ইচ্ছাতে যেন দেবত্ব আরােপ করেছেন। তিনি ইচ্ছাকে এমন এক শক্তি হিসেবে তুলে ধরেন যা যুক্তি, বুদ্ধি সবকিছুর উর্ধ্বে। ইচ্ছাই সত্তা, ইচ্ছাই পরমমান, গােটা জগতটার মূলে রয়েছে ইচ্ছাশক্তি। দর্শন আলােচনার জন্য তাই ইচ্ছাশক্তিকে নিয়েই আলােচনা করতে হবে সর্বাগ্রে। শােপেনহাওয়ার বলেন, “I hold this thought that the world is will – to be that which has long been sought for under the name of philosophy and the discovery of which is therefore regarded, by those who are familiar with history, as quite as impossible as the discovery of the philosopher’s stone.” (Schopenheauer. H, The World as will and Idea Vol, i, p-vii)। আমরা এখন তাঁর অনুসরণে তাঁর ইচ্ছাশক্তি সম্পর্কিত মত আলােচনা করবাে। ইচ্ছা বলতে আমরা নিছক একটি মানসিক ক্রিয়াকে বুঝি। শােপেনহাওয়ার এমনটি মনে করেন না। তিনি ইচ্ছাকে এক শাশ্বত সত্তা মনে করেন, যা সকল কিছুর অগ্রগামী। শােপেনহাওয়ারের কাছে ইচ্ছা –

  • ১। ইচ্ছা হল বাস্তব সত্তা। হেগেল যেমন বুদ্ধিকে বাস্তব সত্তা বলে চিহ্নিত করেছিলেন এবং বলেছিলেন, “Whatever is real is rational, whatever is rational is real.” শােপেনহাওয়ার আর একধাপ অগ্রসর হলে বললেন ‘বুদ্ধির অগ্রগামী ইচ্ছাই হল বাস্তব সত্তা।’ 
  • ২. ইচ্ছা হচ্ছে চেতনার অগ্রগামী সত্তা। আগে ইচ্ছা তারপর চেতনা। যে কোন মানসিক ঘটনা ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। 
  • ৩. শুধু মানসিক ঘটনাই নয় জগতের সব কিছুর কারণই হল ইচ্ছা। মানসিক ও শারীরিক সকল পরিবর্তন ইচ্ছাই সংঘটিত করে থাকে। বস্তুর ব্যাপারেও তাই। এভাবে শােপেনহাওয়ার মনে করেন যে, আমরা যদি কারণকে ইচ্ছা রূপে বুঝতে না চাই, তাহলে কারণতত্ত্ব নিতান্তই অর্থহীন এক মিস্টিক যাদুশাস্ত্রে পরিণত হয়। তিনি বিতৃষ্ণা আর আকর্ষণ, সংযােগ আর বিয়ােগ, বিদ্যুৎ চৌম্বকশক্তি, মধ্যাকর্ষণ শক্তি এসব কিছুকেই ইচ্ছাশক্তি বলে বর্ণনা করেন। এ ভাবটাই লক্ষ্য করা যায় মহাকবি গ্যেটের মধ্যে। তিনি তার “Electrine affinity’ তে যেভাবে প্রেমিক-প্রেমিকার আকর্ষণ থেকে শুরু করে সবকিছুকে একই রকমের আকর্ষণ শক্তির অন্তর্গত বলে চিহ্নিত করেছেন শশাপেনহাওয়ারও তেমনটি করে সর্বপ্রকার শক্তিকে ইচ্ছাশক্তি বলে চিহ্নিত করেন।
  • ৪. শারীরিক গঠনও ইচ্ছার দাস। শােপেনহাওয়ারের মতে, ইচ্ছার চাহিদা মােতাবেকই দেহের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নির্ধারিত হয়। তিনি বলেন, “সাধারণভাবে মানবদেহ যেমনটি করে ইচ্ছার সাথে সামঞ্জস্য রেখে চলে, তেমনটি করে ব্যক্তিগত শারীরিক গঠনও তার ব্যক্তিগত পরিবর্তিত ইচ্ছার সাথে সংগতি বিধান করবেই।” (Will Durant : The Story of Philosophy p-314)
  • ৫. ইচ্ছা হল সহজাত প্রবৃত্তির মতাে। শােপেনহাওয়ার ইচ্ছাকে সহজাত প্রবৃত্তির সাথে তুলনা করেছেন। কেননা, সহজাত প্রবৃত্তি যেমন ঐ জাতের সকল কিছুর মধ্যে অনিবার্যভাবে থাকে, তেমনটি ইচ্ছাও সকল কিছুর মধ্যে অনিবার্যভাবে বিদ্যমান।
  • ৬. ইচ্ছা এককভাবে স্থায়ী সত্তা। শােপেনহাওয়ারের মতে ইচ্ছা একবার ব্যক্তিগত আবার তা সার্বিক। এটা তাই দুই প্রকার: বিশেষ ইচ্ছা এবং সার্বিক ইচ্ছা। বিশেষ ইচ্ছা পৃথক পৃথক হলেও তা সার্বিক ইচ্ছার অধীন। সার্বিক ইচ্ছা এক সামগ্রিক ঐক্য। সকল বিশেষ বিশেষ ইচ্ছা এই সার্বিক ইচ্ছার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
  • ৭. বিশেষ ইচ্ছা পরাধীন, কিন্তু সার্বিক ইচ্ছা স্বাধীন। শােপেনহাওয়ারের মতে, সর্বজনীন ইচ্ছাই সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করছে, ব্যক্তি ও বস্তু সবই এই নিয়ন্ত্রণের অধীন। এমনকি একটি প্রস্তর খণ্ডও নিয়ন্ত্রিত হয় সর্বজনীন ইচ্ছা দ্বারা। তাই এটিও এক অর্থে ইচ্ছাকৃত আচরণ করে। আমরা জানি, দার্শনিক স্পিনােজা ছিলেন নিয়ন্ত্ৰণবাদী (determinist)। তিনি একবার বলেছিলেন, “যে পাথর-খণ্ডটিকে বাতাসে ছুড়ে দেয়া হয়েছে তার যদি চেতনা থাকতাে, তাহলে ওটাও হয়তাে ভাবতাে যে, সে তার স্বাধীন ইচ্ছাতেই ঘুরছে।” এ ধরনের ধারণার জবাবে শােপেনহাওয়ার বলেন, “আমি শুধুমাত্র এটা বলতে চাই যে, পাথর-খণ্ডটির এমনটি মনে করা ভুল হতাে না। পাথরটিকে যা গতির সঞ্চার করেছে, আমার ক্ষেত্রে তা হচ্ছে উদ্দেশ্য – পাথরের ক্ষেত্রে যাকে সংহতি বলা হচ্ছে, এ ক্ষেত্রেও তা ঐ একই প্রকৃতির। পাথরের জ্ঞান থাকলে পাথরও ওটাকে ‘ইচ্ছা’ বলেই বুঝতো বা জানাতাে। কিন্তু ইচ্ছা পাথর কিংবা দার্শনিক কারাে বেলায় ‘স্বাধীন’ নয়। সার্বিকভাবে ইচ্ছা স্বাধীন। কেননা, এ ছাড়া একে সীমিত করতে পারে এরকম কোন ইচ্ছাই নেই।” (Will Durant : The Story of Philosophy p-314)।
  • ৮. জগতে ইচ্ছার কোন ঘাটতি নেই। জগতের প্রতিটি অস্তিত্বের মধ্যে আবশ্যিকভাবে ইচ্ছার অবস্থান রয়েছে। শােপেনহাওয়ার দেখান যে, জীবনের যত নিম্ন স্তরে আমরা যাই, ততই দেখি বুদ্ধি বা মননের অনুপস্থিতি। কিন্তু ইচ্ছার ক্ষেত্রে তেমনটি হয় না। সব ক্ষেত্রেই ইচ্ছার উপস্থিতি থাকে।
  • ৯. ইচ্ছা বুদ্ধিরও অগ্রগামী। কেননা ইচ্ছা হল সহজাত বৃত্তি, বুদ্ধি হল ইচ্ছা দ্বারা পরিচালিত এবং সৃষ্ট একটি গুণ মাত্র। বুদ্ধিকে ইচ্ছার গােলামী করতে হয়। শােপেনহাওয়ার বুদ্ধিকে ইচ্ছার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলে অভিহিত করেন। তিনি দেখান যে, আমরা আমাদের যুক্তি-বুদ্ধিকে আমাদের ইচ্ছা অনুযায়ী ব্যবহার করে থাকি। ইচ্ছা যুক্তির ধার ধারে না, কিন্তু ইচ্ছার জন্য আমরা বৈধ, অবৈধ অনেক যুক্তিই প্রদর্শন করে থাকি। শােপেনহাওয়ারের ভাষায়, “We do not want a thing because we have found reasons for it, because we want it; we even elaborate philosophies and theologies to clook our desires.” (Will Durant : The Story of Philosophy p-312) তাঁর মতে, মানুষের ইচ্ছাকে চরিতার্থ করার জন্য মানুষ অনেক নির্বিচারে তত্ত্ব প্রদান করে থাকে। এজন্য শােপেনহাওয়ার মানুষকে ‘তত্ত্বজ্ঞানী জীব’ (Metaphysical animal) বলে কটাক্ষ করেছেন।
  • ১০. শােপেনহাওয়ার ইচ্ছাকে মানুষের কার্য সিদ্ধির হাতিয়ার বলে চিহ্নিত করেন। তার মতে, যুক্তি-বুদ্ধি, আইন দ্বারা নয়, বরং ইচ্ছা দ্বারাই মানুষের মন থেকে শুরু করে সবকিছুই জয় করা যায়। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে ঘােষণা করেন যে, লজিকের সাহায্যে কেউ কোনদিন কারাে মন জয় করতে পারে নি। কারাে মনে বিশ্বাস, ভালবাসা, আস্থা অর্জন করতে হলে ইচ্ছার সাথে সংগতি রেখেই এগুতে হয়। শােপেনহাওয়ার বলেন : “এর থেকে কোন কিছু বেশি বিরক্তির নয়, যখন আমরা লক্ষ্য করি যে, আমরা যতই কাউকে যুক্তির ব্যাখ্যার সাহায্যে কোন কিছু বােঝাতে চাইনা কেন শেষমেশ তা বুঝতে চাইবে না। অতএব তার ইচ্ছার সাথেই আমাদের করতে হবে বােঝাপড়া।” (Will Durant : The Story of Philosophy p-312)
  • ১১. শােপেনহাওয়ার নৈতিকতা ও ধর্মকেও ইচ্ছার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বলে অভিমত প্রকাশ করেন। ‘বুদ্ধি নয় হৃদয়ের আবেগই শ্রেয়’– এই হচ্ছে তার নীতি। মানুষের নৈতিকতা ও ধর্মীয় বিষয়াদি কখনই যুক্তির ধার ধারে না, এগুলাে বিশ্বাস নির্ভর। এমনকি তার যে প্রতিশ্রুতি তাও যুক্তির নিরীখে সম্পাদিত হয় না। শােপেনহাওয়ার বলেন,  “মেধাসম্পন্ন মানসিক গুণাবলী প্রশংসিত হয় বটে, কিন্তু কারাে ভালবাসা কুড়াতে পারে না; সব ধর্মই হৃদয়ের ইচ্ছা বা গুণাবলীর জন্যই পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি জানিয়ে থাকে, কিন্তু কোন ধর্মই মস্তিষ্কের অথবা বােধশক্তির উৎকর্ষতার জন্য কোন ধরনের পুরস্কারের কোন প্রতিশ্রুতি দেয় না।” (Will Durant : The Story of Philosophy p-314)
  • ১২. স্মৃতিও ইচ্ছার অধীন। শশাপেনহাওয়ার বলেন: “হিসেব করতে বসলে দেখা যাবে আমরা প্রায়ই আমাদের সুবিধাজনক ভুলই বেশি করে থাকি।” (Will Durant : The Story of Philosophy p-314) এর দ্বারা তিনি বোঝাতে চান যে, স্মৃতি মূলত ইচ্ছার নিয়ন্ত্রণে। আমরা যেমনটি ইচ্ছা করি স্মৃতিও তেমনটি করে ধারণাকে সংরক্ষিত করে থাকে। এজন্যই আমরা অপ্রয়ােজনীয় বা গুরুত্বহীন বিষয় সহজেই ভুলে যাই। এর মধ্য দিয়ে শোপেনহাওয়ার আমাদের কগনিটিভ বায়াস বা চেতনাগত পক্ষপাতসমূহকে ইচ্ছার আওতায় ফেলেছেন।
  • ১৩. ইচ্ছার কোন ক্লান্তি নেই, ইচ্ছা একেবারেই ক্লান্তিহীন। আমাদের বুদ্ধির ক্লান্তি আসে; বুদ্ধির প্রয়ােজন হয় বিশ্রামের, একনাগারে বুদ্ধি বেশিক্ষণ কাজ করতে পারে না। কিন্তু ইচ্ছার কোন ক্লান্তি আসে না। তার প্রয়ােজন হয় না কোন বিশ্রামের। ইচ্ছা সদা সক্রিয়।
  • ১৪. ইচ্ছা দেশ-কালের উর্ধ্বে। ইহা বস্তু ও ঘটনার জগতও অতিক্রম করে যায়। এমনকি কোন কার্য-কারণের দ্বারাও একে নিয়ন্ত্রণ করা বা এর সম্পর্কে আগাম নিশ্চিত হওয়া যায় না। ইচ্ছা একমাত্র ইচ্ছার জগৎ দ্বারা শাসিত। তাই ইহা প্রাকৃতিক কার্যকারণের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ইচ্ছা একমাত্র সার্বিক ইচ্ছাশক্তি দ্বারাই শাসিত হয়।
  • ১৫. ইচ্ছা আত্মরক্ষামূলক। ইচ্ছা সর্বদা নিজেকে রক্ষা করতে চায়। একটি ইচ্ছা অন্য ইচ্ছার মধ্য দিয়েও বেঁচে থাকতে চায়। শােপেনহাওয়ারের মতে, ইচ্ছা মানেই বেঁচে থাকার ইচ্ছা। সব ইচ্ছার প্রকৃত গতি তাই অস্তিত্ব ও আত্মরক্ষার দিকে। ইচ্ছা চায় চিরজীবী হতে। তিনি এ ক্ষেত্রে প্রজনন ইচ্ছাকে উদাহরণ হিসেবে দেখান। তার মতে, প্রজনন এমন একটি ইচ্ছা যার মধ্যে অনেক ইচ্ছা বংশানুক্রমে বেঁচে থাকে। তিনি দেখান যে, মাকড়শা জানে যে, তার সন্তান তাকে খেয়ে ফেলবে। তবুও জীবনের কোন এক সময়ে সে সন্তান নেয় তার মধ্যে সে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে। মানুষ সন্তানের জন্য এমন কিছু নেই যা না করে। মানুষ এই যে এতবেশি লালায়িত, শােপেনহাওয়ার একে দেখেছেন অমরত্ব লাভের কামনা হিসবে। তার মতে, মানুষের মধ্যে সহজাতভাবেই অমরত্বের ইচ্ছা বিদ্যমান। মানুষের ইচ্ছাশক্তিই এক জীবন থেকে অন্য জীবনে সংক্রমিত হয়ে বেঁচে থাকতে চায় অনন্তকাল ধরে। তাই প্রজনন হল জীবনের এক চরম উদ্দেশ্য, চিরজীবী হবার এক পরম বাসনা। শােপেনহাওয়ার বলেন: “প্রত্যেক জীবেরই পরম লক্ষ্য হচ্ছে প্রজনন। আর এটি হচ্ছে তার একটি প্রবলতর সহজাত বৃত্তি। কেননা এ ইচ্ছাই একমাত্র জয় করতে পারে মৃত্যু। মৃত্যুর পর বিজয়কে এভাবে সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যেই প্রজনন ইচ্ছাকে প্রায় সম্পূর্ণরূপেই জ্ঞান এবং চিন্তা-চেতনার নিয়ন্ত্রণাতীত করা হয়েছে। এমনকি সময় সময় দার্শনিকদেরও সন্তান-সন্ততি হয়ে থাকে।” (Will Durant : The Story of Philosophy p-318)

এভাবে শােপেনহাওয়ার দেখাতে চান যে, প্রত্যেকটি প্রজনন ইচ্ছাই এমন একটি পরম মান যার মাধ্যমে ইচ্ছা অনন্তকাল ধরে বেঁচে থাকতে চায়। পিতা-মাতার ইচ্ছা সন্তানের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হয়। সন্তানের মধ্যেই পিতামাতার ইচ্ছা বেঁচে থাকে। শােপেনহাওয়ার দার্শনিকদের কথা বলেছেন সম্ভবত এ অর্থে যে, দার্শনিকগণ যখন কোন তত্ত্ব প্রদান করেন তখন সেই তত্ত্বের প্রতি দার্শনিকদের থাকে এক পরম মমতা। তিনি চান সে তত্ত্বকে বাঁচিয়ে রাখতে। ঐ তত্ত্বের মাধ্যমে প্রকাশিত তাঁর যে ইচ্ছাশক্তি তিনি তাকে যুগ যুগ ধরে বাঁচিয়ে রাখতে চান। তত্ত্বের মধ্যে তাঁর ইচ্ছাকে এভাবে বাচিয়ে রাখার জন্য উক্ত তত্ত্বের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার চান ঐ দার্শনিক। সে জন্য তিনি তার মতবাদের সমর্থক এবং সহযােগী সৃষ্টি করতে চান – এরাই হচ্ছেন তার সন্তান-সন্ততি; আর এদের দ্বারাই তিনি তাঁর ইচ্ছাকে বাঁচিয়ে রাখেন যুগের পর যুগ। এখান থেকে আমরা দেখতে পারছি তিনি সহজাত প্রবৃত্তি ও প্রবণতাকে ইচ্ছার আওতায় ফেলেছেন।

দুঃখবাদ

শােপেনহাওয়ার তার ইচ্ছা-দর্শনের পরিণতি হিসেবে দুঃখবাদে উপনীত হন। দর্শনের ইতিহাসে তিনি একজন বিখ্যাত দুঃখবাদী দার্শনিক হিসেবে পরিচিত। তার ইচ্ছা সম্পর্কিত দর্শনই তাঁর দুঃখবাদের ভিত্তি। দুঃখবাদ অনুসারে জগৎ দুঃখময়। জীবনে দুঃখের ভাগই বেশি। জীবন দুঃখ, দুর্দশা, হতাশায় পূর্ণ। নিরবচ্ছিন্ন সুখ বা আনন্দ লাভ করা অসম্ভব। মােটকথা জীবন ফুলশয্যা নয় – জীবন মানেই যন্ত্রণা। শােপেনহাওয়ার ইচ্ছাকে সবকিছুর উপরে স্থান দিয়েছেন। ইচ্ছাই জগতের নিয়ন্ত্রণকারী। কিন্তু এই ইচ্ছার এমন কিছু ধর্ম আছে যার কারণে জগৎ দুঃখময় হয়ে ওঠে –

  • ১। ইচ্ছা ও প্রাপ্তির ব্যবধান : শােপেনহাওয়ার দেখান যে, ইচ্ছা অসীম। ইচ্ছার কোন শেষ নেই। মানুষ কখনাে এক জীবনে তার সকল ইচ্ছা পূরণ করতে পারে না। অর্থনীতিতে অভাব যেমন অপরিসীম বলে মনে করা হয়, শােপেনহাওয়ার ইচ্ছাকেও তেমনটি মনে করেছেন। কিন্তু অভাবের চেয়ে এটি আরাে ব্যাপকতর। কেননা, অভাব অপরিসীম হলেও বিশেষ অভাব পূরণীয় এবং তাতে অভাব বেশ কিছুটা প্রশমিত হয়। কিন্তু ইচ্ছা এমন যে বিশেষ ইচ্ছা পূরণীয় হলেও এতে করে ইচ্ছা যেন আরাে বেড়ে যায়। একটা ইচ্ছা পূরণ হলে আরাে অনেক ইচ্ছা এসে ভিড় জমায়। তাই বিশেষ ইচ্ছা পূরণ হলেও কোন রক্ষা নেই। এটা একান্তভাবেই সাময়িক, কিন্তু পরিণতিতে তা আরাে ভয়াবহ। শােপেনহাওয়ার বলেন, “এ যেন ভিক্ষুকের প্রতি ভিক্ষার পয়সা ছুঁড়ে দেওয়া, যা ওকে আজ বাচিয়ে রাখে নিতান্তই তার অভাবটা আগামী দিন পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখার জন্যই…। যতদিন আমাদের চেতনা ইচ্ছার দ্বারা পূর্ণ থাকবে, যতদিন কামনা বাসনার অবিরাম আশা আর ভয়-ভীতির ভিড়ে আমরা আত্মসমর্পণ করবাে এবং যতদিন আমরা ইচ্ছার অধীন হয়ে থাকবাে, ততদিন আমরা কখনই স্থায়ী সুখ বা শান্তি পাবাে না।” (Will Durant : The Story of Philosophy p-323) তাই দুঃখ আমাদের চির সঙ্গী হয়েই থাকে। শােপেনহাওয়ার এখানে দেখাতে চান যে, ইচ্ছাই মূলত দুঃখের কারণ, কেননা ইচ্ছা সর্বদা ইচ্ছা পূরণের দাবি রাখে কিন্তু সেই দাবি সুচারুরূপে পূরণ করা জীবনের পক্ষে অসম্ভব। তাই ইচ্ছা মানেই দুঃখ। কোন কিছু সম্পর্কে ইচ্ছা করা মানেই সেই সংক্রান্ত কিছু দুঃখ টেনে নিয়ে আসা। এ যেন ইংরেজ কবি PB Shalley-র কবিতার সেই সুর – “The desire of the north for the star,/of the night for the morrow,/The devotion to something afar/From the sphere of our sorrow.”
  • ২. স্ব-বিরােধী ইচ্ছা : ব্যক্তি চরিত্রের মধ্যে স্ব-বিরােধী ইচ্ছার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। আমরা এখন একটা চাই, ভিন্ন সময়ে চাই তার বিপরীত কিছু। স্থায়ী কোন ইচ্ছা যেন আমরা ধরে রাখতে পারি না। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ-এর ভাষায় বলতে গেলে – “যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাইনা।”
  • ৩. ইচ্ছার জটিলতম প্রকাশ : অন্যান্য জীব শ্রেণীর তুলনায় চেতনার এক উচ্চতর অবস্থা বিদ্যমান রয়েছে মানুষের মধ্যে। এছাড়া মানুষের মধ্যে এই চেতনার ক্রমিক উন্নতি লক্ষ্য করা যায়। চেতনার উন্নতির সাথে সাথে ইচ্ছা জটিলতর রূপ লাভ করে। ইচ্ছা এমন জটিল পর্যায়ে উপনীত হলে তা পূরণ করা হয়ে পড়ে দুঃসাধ্য। তাই দেখা দেয় দুঃখ মানুষের ক্ষেত্রেই ইচ্ছার এই জটিলতম রূপ পরিগ্রহ করে বিধায় অন্যান্য জীবের তুলনায় মানুষেরই দুঃখ-কষ্ট বেশি। শােপেনহাওয়ার বলেন: “ইচ্ছার প্রকাশ যত বেশি জটিল হতে থাকবে, যন্ত্রণা ভােগও তত বেশি স্পষ্টতর হবে। উদ্ভিদের কোন চেতনা নেই, ফলে তার দুঃখও নেই। মানুষের বেলায় চেতনার চরম প্রকাশ ঘটে, ফলে দুঃখও হয় সীমাহীন।” (Will Durant : The Story of Philosophy p-324)
  • ৪. জ্ঞানের উন্নয়ন : ইচ্ছার জটিল প্রকাশ ঘটে চেতনার উন্নতিতে। আর চেতনার উন্নতি জ্ঞানের উন্নয়ন ঘটায়। তাই জ্ঞানের উন্নয়ন দুঃখের মাত্রা বৃদ্ধি করে। কেননা শােপেনহাওয়ারের মতে, চেতনার উন্নতি জটিল ইচ্ছার সৃষ্টি করে, যার পরিণতি দুঃখ। আর জ্ঞানের উন্নতির ফলে যদি চেতনার উন্নতি ঘটে, তাহলে তার ফলে দুঃখ অবশ্যম্ভাবী। শােপেনহাওয়ার বলেন, “যে লােক যতটা জানে তার বুদ্ধিও সে অনুপাতে বাড়ে, ফলে দুঃখও বেড়ে যায়”। যিনি প্রতিভার অধিকারী তিনিই সবচেয়ে বেশি দুঃখ ভােগ করে থাকেন।”(Will Durant : The Story of Philosophy p-323) তাই শােপেনহাওয়ারের মতে, জ্ঞানী লােকদেরই জীবনে দুঃখের পরিমাণ বেশি।
  • ৫. উচ্চতর জীবন বােধ : মানুষের ইচ্ছা জটিলতর পর্যায়ে উন্নীত হলে তার মধ্যে কাজ করে এক উচ্চতর জীবন বােধ। নিজের বর্তমান অবস্থায় সে কখনই সন্তুষ্ট থাকতে পারে না। সে চায় আরাে উন্নত জীবন, আরাে সমৃদ্ধি। কিন্তু চাইলেই এমন উন্নততর জীবন পাওয়া যায় না, চাইলেই জীবনকে পাল্টে দেওয়া যায় না— ফলে জীবনে নেমে আসে দুঃখ।
  • ৬. ইচ্ছা আত্মরক্ষামূলক : জগতের প্রতিটি মানুষই চায় তার নিজের ব্যক্তিগত ইচ্ছার পূর্ণতা। টিকে থাকতে চায় তার নিজের ইচ্ছাকে নিয়ে। তাই এ পৃথিবীতে দেখা দেয় দ্বন্দ্ব-সংঘাত, হানাহানি, স্বার্থ নিয়ে নির্মম নির্লজ্জ টানাটানি। শশাপেনহাওয়ারের ভাষায়, “মানুষ মানুষের কাছে হয়ে ওঠে নেকড়ের মতাে।” (Will Durant : The Story of Philosophy p-323) স্বার্থের কাছে রক্তের সম্পর্কও হয়ে ওঠে গৌণ। শােপেনহাওয়ার বলেন, “মাতৃজঠোর থেকে যে শিশু হাইড্রা ফুলের কলির মতাে বেরিয়ে আসে এবং পরক্ষণে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে, সেও একত্রে থাকা অবস্থায় শিকার নিয়ে মায়ের সাথে করে কাড়াকাড়ি, কে কার আগে খাবারটা কেড়ে নিয়ে মুখে তুলবে তা নিয়েই চলে লড়াই।” (Will Durant : The Story of Philosophy p-325)
  • ৭. মৃত্যুভয় : শশাপেনহাওয়ার বলেন, “সবকিছুই খানিকটা দেরি করে বটে, তবে মুহূর্তের জন্য কিন্তু মৃত্যু বিলম্বিত হয় না। তাই এই মুত্যুর ভয় মানুষকে সর্বদা বিচলিত করে রাখে। শত প্রাচুর্যের মধ্যেও মানুষ এক মর্মান্তিক ভয়ে থাকে ভীত। শােপেনহাওয়ার তাই বলেন, “এটা বেশ স্পষ্ট যে, আমাদের হাঁটাতাে অন্য কিছুই নয়, বরং পড়ে যাওয়ার হাত থেকে নিয়ত আত্মরক্ষার প্রচেষ্টার নামান্তর। তেমনিভাবে আমাদের জৈব জীবনও একমাত্র মৃত্যুকেই নিয়ত বাধা দেওয়ারই নামান্তর, মৃত্যুকে বিলম্বিত করারই এক চির চেষ্টা। প্রাচ্যের স্বৈরাচারী শাসকদের মূল্যবান অলঙ্কারসমূহ এবং বেশভূষার সাথে অধিক মূল্যের একটা বিশেষ শিশিও থাকে।” (Will Durant : The Story of Philosophy p-328) তাই দেখা যায় এ জগতে যত প্রাচুর্য আর সুখের উপাদানই থাকুক না কেন- মৃত্যু এক সর্বগ্রাসী ড্রাগন। মৃত্যুর নির্মম ছােবল থেকে কেউই রেহাই পায় না। এই সর্বজনীন সত্য-বিশ্বাস মানুষের মধ্যে যেহেতু বিদ্যমান, তাই সবকিছুর মধ্যেও সে এই মৃত্যু চিন্তায় থাকে মগ্ন। সব আনন্দ আর উচ্ছলতার মাঝেও মৃত্যু-চিন্তা হঠাৎ করেই যেন সবকিছুকে শান্ত করে দেয়, মনে হয় সবকিছুই অর্থহীন। তাই এ ধরনের সর্বক্ষণিক ভীতি থাকলে জীবন কখনই দুঃখের না হয়ে পারে না।
  • ৮. মানুষ অপূর্ণ সত্তা : মানুষ হল এক অপূর্ণ সত্তা। কিন্তু তার পরিপূর্ণতার বাসনা রয়েছে। সীমিত ইচ্ছার নিয়ন্ত্রণ আছে মানুষের কাছে। কিন্তু মানুষ চায় পরিপূর্ণ ইচ্ছার জগতের সাথে তার বিশেষ ইচ্ছার মিলন ঘটাতে। কিন্তু তা সে কখনই পারে না। তাই তার দুঃখ লেগে থাকে অবিরাম।
  • ৯. ইচ্ছা জ্ঞানের বশ্যতা স্বীকারে রাজি নয় : শােপেনহাওয়ারের মতে, মানুষের বুদ্ধি দ্বারা ইচ্ছাকে কখনাে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না; বরং বুদ্ধি হচ্ছে ইচ্ছার গােলাম। বুদ্ধিকে সে পররাষ্ট্র মন্ত্রীর মতাে কাজে লাগায় মাত্র। মানুষের বিস্তর ইচ্ছা তাই কখনাে। পরিশীলিত ও পরিমার্জিতভাবে পরিচালিত হতে পারে না। মানুষের সব ইচ্ছা অনিবার্যভাবেই পূরণ হয় না। তাই মানুষ যদি তার বুদ্ধি দিয়ে তার কিছু কিছু অবাঞ্ছিত ইচ্ছাকে দমন করতে পারে, তবে কিছু অবাঞ্ছিত দুঃখ এড়ানাে সম্ভব হতাে। কিন্তু তা যেহেতু সম্ভব নয়, তাই অপ্রতিরােধ্য, অনিয়ন্ত্রিত ইচ্ছার অবিরাম কষাঘাতে মানুষের জীবন হয়ে ওঠে দুঃখময়।
  • ১০. সুখ হচ্ছে নেতিবাচক ও শােপেনহাওয়ার বলেন : “সর্ব প্রকার তৃপ্তি অথবা সাধারণভাবে যাকে সুখ বলা হয়ে থাকে, মূলত তা হচ্ছে নিতান্তই একটি নেতিবাচক বিষয়। দুঃখ নিবারণের পর তা আমাদেরকে কেবল নেতিবাচক তৃপ্তিই দিয়ে থাকে।” (Will Durant : The Story of Philosophy p-323) তাই নির্ভেজাল সুখ বলতে কিছু নেই এ জগতে, দুঃখ থেকে মুক্তিই যেন সুখ। তাই জীবন মানেই দুঃখ থেকে মুক্তি পাবার প্রচেষ্টা। আর এমন জীবন নিঃসন্দেহে দুঃখময়।
  • ১১. আত্মহত্যাও সঠিকভাবে দুঃখকে নিবারণ করতে পারে না : আত্মহত্যার মাধ্যমে ব্যক্তি মানুষ তার জীবনের ইচ্ছাগুলিকে নির্বাপিত করতে পারে। কিন্তু জগতে আত্মহত্যার মাধ্যমে ব্যক্তি মানুষের জীবন থেকে দুঃখ বিদায় নিলেও জগতে অন্যান্য মানুষের ইচ্ছা তখনও সজীব থাকে; সুতরাং তাদের জীবনে দুঃখ আশ্রয় করে থাকে এবং জগৎ থেকে তাই দুঃখ বিদায় হয় না। শােপেনহাওয়ার বলেন, “আত্মহত্যা অর্থাৎ একটি বিশেষ অস্তিত্বের বিনাশ সাধন নিতান্তই একটি অর্থহীন নির্বুদ্ধিতা মাত্র; কেননা জাতি-জীবন তার ইচ্ছা দ্বারা বিন্দুমাত্র প্রভাবিত হয় না। আর এই জাতি-জীবনই হচ্ছে প্রকৃত সারসত্তা। এমনকি যে বারি-বিন্দুর দ্বারা রংধনু গঠিত সে বারি-বিন্দুর দ্রুত পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনার সম্মুখেও সে মুহূর্তে রংধনু দিব্যি টিকে থাকে।” (Will Durant : The Story of Philosophy p-329)

মুক্তির পথ

শশাপেনহাওয়ারের দর্শন জীবনকে ঠেলে দেয় এক নিরবচ্ছিন্ন দুঃখ ও হতাশার কৃষ্ণগহ্বরে। কিন্তু এই ‘black-hole’ এর অশুভ গ্রাস থেকে মুক্তির কোন উপায় আছে কী? শশাপেনহাওয়ারের উত্তর দুই প্রকৃতির – সম্ভাব্য এবং নৈরাশ্যবাদী। অর্থাৎ তিনি কিছু কিছু সম্ভাব্য পন্থার উল্লেখ করেছেন যা থেকে দুঃখ-দুর্দশার কিছুটা লাঘব করা হয়তাে সম্ভব হবে। কিন্তু অন্যদিকে তিনি দুঃখ মুক্তির সম্ভাবনাকে নাকোচ করে দিয়েছেন। যাই হােক, তিনি যে সকল সম্ভাব্য পথের কথা চিন্তা করেছেন তা হল –

  • ১. আত্মসংযম : মানুষের ইচ্ছা অসীম কিন্তু প্রাপ্তি সীমিত। আর ইচ্ছা ও প্রাপ্তির দ্বন্দ্বের ফলে যেহেতু দুঃখের উৎপত্তি হয়, সেহেতু আত্মসংযমের মাধ্যমে যদি আমাদের বিভিন্ন অসাধ্য ইচ্ছাগুলােকে দমন করে রাখা যায়, তাহলে সে সকল ক্ষেত্রে বিশেষ বিশেষ দুঃখ এড়ানাে সম্ভব হতে পারে। তবে এটি একটি সাময়িক মুক্তি এবং কিছু কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে ইহা কার্যকর।
  • ২. নির্বান লাভ : শােপেনহাওয়ার প্রাচ্য দর্শনের প্রতি যথেষ্ট আকৃষ্ট ছিলেন। তিনি প্রাচ্যের বৌদ্ধ-দর্শন অনুসরণে দুঃখ থেকে মুক্তির জন্য নির্বাণ লাভের প্রতি গুরুত্ব আরােপ করেন। নির্বাণ অনুসারে আমাদের কামনা-বাসনা নির্বাপণের মাধ্যমে সব রকম জাগতিক মােহ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারলেই দুঃখ-যন্ত্রণা থেকে চির-মুক্তি লাভ করা সম্ভব।
  • ৩. প্রজনন রােধ : প্রজনন যদি রােধ করা সম্ভব হতাে, তাহলে মানুষ আর যন্ত্রণার জগতে জন্মাতাে না, ফলে মানুষ জগতের এই দুঃখকে আর ভােগ করতাে না। শােপেনহাওয়ারের এই মতের পেছনেও বৌদ্ধ-দর্শনের প্রভাব রয়েছে। বৌদ্ধ-দর্শন অনুসারে জগতে জন্মই দুঃখের প্রধান কারণ। মানুষ বারবার জগতে জন্মায়। একে বৌদ্ধ-দর্শনে ‘ভব-চক্র’ বলা হয়ে থাকে। যদি এই ভব-চক্র রােধ করা যায়, তাহলে এই দুঃখময় জীবনে আর ফিরে আসতে হয় না। দুঃখের দুষ্টচক্রে আর ঘুরতে হয় না। তবে। শােপেনহাওয়ার বুদ্ধের মতাে জন্মান্তরের কথা বলেন নি। বুদ্ধ জন্মান্তর রােধের জন্য নির্বাণ লাভের কথা বলেছিলেন। কিন্তু শােপেনহাওয়ার এখানে শুধু প্রজনন রােধের কথাই বলেছেন। অর্থাৎ তিনি দুঃখের এ জগতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আর আনতে চান না।
  • ৪. ইচ্ছাকে জ্ঞান দ্বারা শাসন করা : শােপেনহাওয়ারের মতে, ইচ্ছা স্বাধীন, এটা কোন কিছুর নিয়ন্ত্রণ মানে না। এমনকি বুদ্ধিকেও ইহা গােলামের মতাে ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু মানুষের বুদ্ধি দ্বারা যদি তার ইচ্ছাগুলােকে নিয়ন্ত্রণ করা যেত তাহলে অনেক দুঃখই এড়ানাে সম্ভব হতাে। কিন্তু শােপেনহাওয়ারের মতে, এ এক দুঃসাধ্য কাজ।
  • ৫. আত্মকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন : মানুষ যদি সব কিছুকে তার আত্মকেন্দ্রিক বিশেষ ইচ্ছা দ্বারা বিবেচনা না করে সামগ্রিক দৃষ্টিতে বিচার করতাে তাহলে জগৎ মূলত শান্তিপূর্ণ হয়ে উঠতাে। শােপেনহাওয়ার তাই বলেন, “জীবনের গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থের দিকগুলির দিকেই যদি গুরুত্ব দেওয়া হয় তাহলে জীবনটাকে মনে হবে একটা ট্রাজিক নাটক, কিন্তু সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে মনে হবে যে এটা একটা কমেডি।” কিন্তু মানব প্রকৃতি বড়ই ভিন্ন রকমের। মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই যেন স্বার্থপর। তাই মানুষ সাধারণত সবকিছুকে আত্মগত ইচ্ছার স্বপক্ষে বিবেচনা করতে চায়।

এসকল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও শােপেনহাওয়ার বলেন যে, এগুলাে কোন কার্যকর ব্যবস্থা বা সমাধান নয়। জীবনের চূড়ান্ত দুঃখ-মুক্তি কখনােই কোন অবস্থাতেই সম্ভব নয়। মূলকথা হল, মানুষ তার বুদ্ধির দ্বারা ইচ্ছাকে দমন করতে অক্ষম। আর সে কারণেই কোন অবস্থাতেই নিরবচ্ছিন্ন সুখ সম্ভব নয়। ব্যক্তি মানুষের অফুরন্ত ইচ্ছার অবিরাম ছােবল আর স্বার্থ নিয়ে মানুষে মানুষে যে দ্বন্দ্ব তা চলবেই। সুতরাং জীবন প্রকৃতপক্ষে যাপনযােগ্য নয়, জগৎ সামগ্রিকভাবে দুঃখময়।

নারী-প্রকৃতি

শােপেনহাওয়ার নারী-প্রকৃতি সম্পর্কে বেশ বিতর্কিত এক মতবাদ প্রদান করেছেন। তাঁর দুঃখবাদী দর্শনের সাথেও এই মতাবাদের যােগসূত্র রয়েছে। শশাপেনহাওয়ার তার ‘Essay on Women’ এবং অন্যান্য কিছু রচনায় নারীপ্রকৃতি সম্পর্কে অনেক বিরূপ মন্তব্য করেছেন। তার ব্যাখ্যায় নারী মানব জাতির জন্য এক হুমকি স্বরূপ হয়ে উঠেছে। নারীদের তিনি অযােগ্য, অক্ষম, নির্বোধ, লােভী, প্রচণ্ড স্বার্থপর এমনকি সৌন্দর্যহীন বলে অভিহিত করেছেন। নারী সম্পর্কে তার মত –

  • ১. শােপেনহাওয়ার সাধারণভাবেই মানব প্রকৃতিকে স্বার্থপর বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এই স্বার্থপরতা নারী জাতির মধ্যে সর্বাধিক বলে শােপেনহাওয়ার মন্তব্য করেছেন। তিনি দেখান যে, নারীরা অত্যন্ত নীচু মানের স্বার্থপরতার পরিচয় দিয়ে থাকে। আত্মস্বার্থের বাইরে তারা কখনােই আসতে পারে না। যে কোন নারীকেই তাদের স্বার্থের অনুকূলে কাজ করলেই ভুলিয়ে ফেলা যায়।
  • ২. নারী-জাতি কখনই প্রকৃত প্রতিভার অধিকারী হতে পারে না। তাদের কিছুটা মেধা থাকতে পারে, কিন্তু সত্যিকার প্রতিভা বলতে যা বােঝায় তার বিকাশ কখনােই এদের মধ্যে দেখা যায় না। তারা যতটা মেধার ব্যবহার করে থাকে তা নিতান্তই তাদের আত্ম-স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যই। এমনকি, তাঁর মতে, প্রতিভা এবং নারী জাতির মধ্যে বিরাজ করে এক চির শত্রুতা। (Schophenhauer, A : The World as Will and Idea, London, 1883, Vol III,P-159)
  • ৩. নারী-প্রকৃতির অন্য একটি খারাপ দিক হলাে এরা চরম অমিতব্যায়ী। দু’একজন ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সকল নারীর মধ্যে এ স্বভাবটি বিদ্যমান রয়েছে। বাজার করা বা কেনাকাটাই হচ্ছে তাদের সর্বশেষ আনন্দের কাজ। আর এজন্য তারা পুরুষদেরকে একটা মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে। শােপেনহাওয়ারের ভাষায়, “নারীদের ধারণা অর্থ উপার্জন করাই হলাে পুরুষদের কাজ, আর তাদের কাজ হচ্ছে ঐ অর্থ খরচ করা।” (Schophenhaur. A: Essay on Woman, P- 75)
  • ৪. নারীর একটি মােহনীয় ক্ষমতা রয়েছে যা প্রকৃতি তাদের মধ্যে দিয়ে দিয়েছে। প্রকৃতি তাদের এমন অঙ্গে সৌন্দর্য দিয়েছে যার দ্বারা তারা সহজেই পুরুষ মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারে, ভোলাতে পারে। বিশেষ করে যুবতী নারীদের এই গুণ থাকে চরম মাত্রায়। (Schophenhaaur. A : Essay on Woman, P-73) আর এতে করে তারা পুরুষের জীবনটাকেই করে ফেলে ওলট-পালট। অধিকাংশ পুরুষই এই মােহে পড়ে তাদের পুরো জীবনটাকেই বিশৃঙ্খল করে ফেলে।
  • ৫. নারীর সৌন্দর্য নিহিত তার যৌবনে। যৌবন ছাড়া নারীর রূপের কোন নজীরই মেলে না। যতদিন নারীর যৌবন আছে, ততদিনই তার রূপের রােশনাই রয়েছে। যৌবনােত্তর নারী বাসি ফুলের মতাে। তাই যুবকদের প্রতি শােপেনহাওয়ার বলেন, “যাকে দেখে আজ তারা গীতি কবিতা আর সনেট লেখার অনুপ্রেরণা পাচ্ছে, সেই যদি আজ থেকে আঠারাে বছর পূর্বে জন্মাতাে, তাহলে তার দিকে কেউই দৃষ্টি ঘুরাতাে না।” (Schopenhaauer. A : The World as Will and Idea, London, 1883, vol. 3 P-339)। এছাড়া সন্তান প্রসবের পরেও নারী সৌন্দর্যহীন হয়ে পড়ে। নারী পিপীলিকা যেমনটি গর্ভধারণের পরে পাখা হারায়, তেমনটি নারীও দু’একটা সন্তান প্রসবের পরে সৌন্দর্যহীন হয়ে পড়ে। কিন্তু পুরুষের সৌন্দর্য স্থায়ী। তাই পুরুষরাই নারীদের থেকে বেশি দৈহিক সৌন্দর্যের অধিকারী।
  • ৬. নারীদের প্রতি আকর্ষণের অন্য আর একটি কারণ হচ্ছে যৌনাবেগ। মূলত যৌন আবেগের জন্যই নারীদের এত সুন্দর মনে হয়। এমনকি অপেক্ষাকৃত কুৎসিত একটি যুবতী মেয়েকেও যৌনাবেগের কারণে সুন্দর মনে হতে পারে। শােপেনহাওয়ারের ভাষায়, “যৌনাবেগে যার বুদ্ধি মেঘাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে সেই এমন “যৌন-সুন্দরী” বেসাইজ (under sized), সংকীর্ণ-স্কন্ধা, প্রশস্ত নিতম্ভ, আর খাটো পায়া জাতিকে সুন্দর বলে অভিহিত করতে পারে…” (Schopenhaauer. A : The World as Will and Idea, London, 1883, vol. 3 P-79)।
  • ৭. শােপেনহাওয়ারের মতে, নারী প্রকৃতপক্ষে সংস্কৃতিবান নয়। সাংস্কৃতিক কোন বােধই তাদের মধ্যে নেই। কাব্য, সাহিত্য, সংগীত বা ললিতকলা সম্পর্কে তাদের কোন প্রকার চেতনাই নেই, এমনকি তারা নিজেরা যে সৌন্দর্যের ধারক বলে দাবি করে থাকে তা সত্ত্বেও তাদের মধ্যে নেই কোন নান্দনিক বােধ (esthetic sense)। শােপেনহাওয়ার তাই বলেন, “মেয়ে মানুষকে সুন্দর বলার চাইতে বলা উচিৎ যে, তাদের কোন সৌন্দর্যবােধই নেই।” (Schopenhaauer. A : The World as Will and Idea, London, 1883, vol. 3 P-79)। তিনি দাবি করেন যে, ললিতকলা ও শিল্পের ক্ষেত্রে বা কোন সৃজনশীল কর্মে এ পর্যন্ত নারীদের কোন উল্লেখযােগ্য ও স্থায়ী অবদান নেই। সংস্কৃতিবান বলে যেটুকু পরিচয় মহিলারা দিতে চায় তা মূলত এক প্রকার কপটতা, স্বার্থসিদ্ধির নিমিত্তে কৃত এক প্রকার ছলনা মাত্র। (Schopenhaauer. A : The World as Will and Idea, London, 1883, vol. 3 P-79)
  • ৮. নারী কখনাে পুরুষের সমকক্ষ হতে পারে না। বুদ্ধি, বিবেচনা, প্রতিভা কর্মদক্ষতা, দৈহিক শক্তি এমনকি সৌন্দর্য ইত্যাদি কোন দিক থেকেই নারী পুরুষের সমকক্ষ হতে পারে না। তাই শােপেনহাওয়ার সম্পত্তি, সম্মান ইত্যাদি কোন ক্ষেত্রেই নারীদেরকে পুরুষের সমান অধিকার দিতে রাজি নন। তিনি বলেন, “আইন যখন নারীদেরকে পুরুষের সমান অধিকার দিয়েছিল তখন উচিত ছিল তাদেরকে পুরুষমননের (masculine intellect) অধিকারী করা।” (Schopenhaauer. A : The World as Will and Idea, London, 1883, vol. 3 P-84)। শশাপেনহাওয়ার নারীদের পুরুষের সমান মর্যাদা দিতে নারাজ। কেননা যাদের সম্মান করার মতাে যথার্থ যােগ্যতা নেই, তাদেরকে সম্মান করা নিতান্তই নির্বুদ্ধিতা। নারীদের অতিমাত্রায় গুরুত্ব দেয়ার জন্য তিনি বিভিন্ন জার্মান মনীষী এবং খ্রিষ্টান ধর্মের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন; এবং তার সাথে সাথে এশিয়ার সমাজ ব্যবস্থায় নারীরা যেমন অবস্থায় রয়েছে সেটার প্রশংসা করেন।
  • ৯. শােপেনহাওয়ারের মতে, নারীদের সর্বদা পুরুষের শাসন তথা পুরুষের তত্ত্বাবধানে রাখা উচিত। কেননা তারা কোন কিছুতেই একাকী নিজেদের যােগ্যতা প্রদর্শনে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের হাতে কোন কিছুর দায়িত্ব ছেড়ে দিলে তা ধ্বংস হতে বাধ্য। এমনকি, তারা নিজেরাও ঠিকমত নিজেদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না। শােপেনহাওয়ার তাই বলেন, “আমার মতে মহিলাদের কখনাে তাদের নিজেদের ব্যাপারও তাদের হাতে ছেড়ে দেওয়া ঠিক নয়; বরং তাদেরকে পুরুষের তত্ত্বাবধানেই রাখা উচিত- সে পুরুষ তার পিতা, স্বামী, পুত্র বা রাষ্ট্র যাই হােক না কেন।” (Wallace : Life of Schopenhauer, London, P-80)।
  • ১০. নারীরা অনাকাঙ্ক্ষিত প্রজনন ক্রিয়া সংগঠনের কারণ। শশাপেনহাওয়ারের মতে, প্রজনন ক্রিয়ার ফলে পৃথিবীতে নতুনের আগমন হয়, নতুন কোন জীবনের আর্বিভাব মানেই আরাে দুঃখের আগমন হওয়া। কিন্তু প্রজননের এই ক্রিয়ায় অনেক সময় পুরুষ বাধ্য হয়। নারীর যুক্তিহীন রূপকলা দ্বারা পুরুষ আকৃষ্ট হয়ে প্রজনন ক্রিয়ায় বাধ্য হয়। এ জন্য শােপেনহাওয়ার নারীদেরকে ‘প্রজনন ও মেধাকে বাসনার অধীন করে বাঁচার হাতিয়ারে পরিণত করার প্রতীক’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

যাই হােক, নারীদের সম্পর্কে এসব উক্তি করার মাধ্যমে শােপেনহাওয়ার দেখাতে চান যে, নারী জাতি জাগতিক দুঃখ-দুর্দশার জন্য অনেকটা দায়ী। নারীরা তাদের স্বভাবসুলভ আচরণের দ্বারা শুধু যে পুরুষের জীবন দুঃখময় করে তােলে তা নয়, বরং তাদের নিজেদের জীবনও অনেক সময় তাদের নিজেদের স্বভাব ও নির্বুদ্ধিতার জন্য দুঃখময় করে তােলে। প্রকারান্তরে গােটা জগতই তাদের দ্বারা দুঃখে আক্রান্ত হয়। শােপেনহাওয়ার তাই নারীদেরকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলার উপদেশ দিয়েছেন।

পর্যালোচনা ও সমালোচনা

শােপেনহাওয়ারের মতবাদসমূহ বেশ আকর্ষণীয়। কিন্তু যৌক্তিক বিচারে এর বেশ কিছু ক্রটি দেখা যায়। শােপেনহাওয়ারের ইচ্ছা-দর্শনের প্রতি লক্ষ্য করলে –

  • ১. আধিবিদ্যক দিক থেকে ইচ্ছা সম্পর্কিত দর্শন এমন এক অদ্ভুত কথা আমাদের সামনে উপস্থাপন করে যা পিথাগােরাসের সংখ্যাতত্ত্বকেও হার মানায়। জগৎ ইচ্ছা দ্বারা গড়া এমন কথা আমাদের সাধারণ জ্ঞানের কাছে অত্যন্ত অদ্ভুত বলেই মনে হয়। ইচ্ছা দ্বারা মানুষের জীবন পরিচালিত বা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে কিন্তু ইচ্ছা দ্বারা জীবন সৃষ্টি হয় – এমন কথা মেনে নেওয়া কষ্টকর।
  • ২. শােপেনহাওয়ারের ইচ্ছাতত্ত্ব মনােবৈজ্ঞানিক দিক থেকে গ্রহণযােগ্য নয়, কেননা মনােবিজ্ঞান অনুসারে ইচ্ছা হচ্ছে একটি মানসিক ক্রিয়া, তবে একমাত্র মানসিক ক্রিয়া নয়। ইচ্ছা-ক্রিয়া চেতনার একটি অংশ মাত্র, কারণ সর্বপ্রকার মানসিক ক্রিয়াই চেতন-ক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু শােপেনহাওয়ার ইচ্ছাকে মানসিক ক্রিয়া বলে গােটা মনকেই ইচ্ছার দ্বারা তৈরি বলে মনে করেছেন, এবং চেতনাকেও ইচ্ছার অগ্রগামী না বলে ইচ্ছাকেই চেতনার অগ্রগামী বলে মনে করেন। তাই দেখা যায়, শশাপেনহাওয়ারের মতবাদ মনােবৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়।
  • . শােপেনহাওয়ার বুদ্ধির অবমূল্যায়ন করেছেন। কেননা তিনি বুদ্ধিকে ইচ্ছার দাস বলেছেন; কিন্তু ইচ্ছাশক্তির সেবক হিসেবেই যদি বুদ্ধির উদ্ভব ঘটে তাহলে বুদ্ধির দ্বারা গঠিত যে তত্ত্ব ও কলা-কৌশল তাকে আমরা কিভাবে মূল্যায়ন করবাে? এমনকি তার নিজের মতবাদকেও তাহলে আমরা যুক্তিহীন এক স্বেচ্ছাচার বলে অভিহিত করা যায়।

শােপেনহাওয়ার যে দুঃখবাদী দর্শন প্রচার করেছেন তাও যৌক্তিক বিচারে যথার্থ বলে মনে হয় না। তাঁর এই দুঃখবাদের বিরুদ্ধে আপত্তিগুলো –

  • . শােপেনহাওয়ার মানব-প্রকৃতির যথার্থ ব্যাখ্যা করেছেন বলে মনে হয় না। তার এই ব্যাখ্যা নিতান্তই একদেশদর্শী। মানব প্রকৃতির কদর্য দিকগুলােই যেন তার বর্ণনায় উঠে এসেছে, কিন্তু ভালাে দিকগুলাে তার বর্ণনায় স্থান পায়নি। তিনি দেখিয়েছেন যে, মানুষ চরমভাবে স্বার্থপর, প্রতিহিংসাপরায়ণ, লােভী। মােটকথা তার ব্যাখ্যায় মানুষ চিত্রিত হয়েছে এক পশু-প্রকৃতির জীব হিসেবে। কিন্তু মানুষ কি শুধুই স্বার্থপর, উদার নয়? মানুষ কি কেবল নিজের জন্যেই ভাবে, অপরের জন্য কি তাকে কিছু করতে দেখা যায় না? মূলত মানব-প্রকৃতির মধ্যে স্বার্থপরতা, হীনমন্যতা, লােভ, প্রতিহিংসা এ সকল কিছুই থাকতে পারে, কিন্তু তার সাথে সাথে মানুষের মধ্যে স্নেহ, প্রেম, ভালবাসা, উদারতা, সহমর্মিতা ইত্যাদি সদগুণগুলােও বিদ্যমান। তাছাড়া মানুষে মানুষে যে প্রতিযােগিতা রয়েছে তাই সভ্যতার বিকাশে ভূমিকা রেখেছে, সেটাই মানব জীবনকে ধীরে ধীরে কষ্টহীন করেছে, সমৃদ্ধি এনেছে। মানুষ যদি সংকীর্ণ স্বার্থের পরিবর্তে পরিমার্জিত, প্রতিযােগিতামূলক স্বার্থযুক্ত কাজে অংশগ্রহণ করে তাহলে তার এই স্বার্থযুক্ত আচরণ দোষের কিছু তাে নয়ই বরং এমনটিই কাম্য হওয়া উচিত। এ প্রসঙ্গে Professor Stace বলেন, “The proper degree of unselfishness in my dealings with you is that degree which will result in both you and I receiving a fair and equitable share of the available satisfaction.” (Prof. Stace: Concept of Morals, PP-171-172)।
  • ২. অনেকে বলেন, শােপেনহাওয়ার জীবনকে যেমনটি করে পুরােপুরি দুঃখময় বলেছেন জীবন তেমনটি পুরােপুরি দুঃখময় নয়। কেননা তাই যদি হতাে তাহলে জাগতিক জীবনের জন্য মানুষের যে প্রগাঢ় মােহ তা থাকতাে না। জীবনে দুঃখ আছে সত্য, কিন্তু সুখও আছে। আর সুখের মােহেই আমরা বেঁচে আছি। দুঃখ জীবনে আসে সত্য কিন্তু তা সাধারণত জীবনের আনন্দকে একেবারে বিলীন করে দিতে পারে না। তাই তাে শত দুঃখের মাঝেও মানুষ বাঁচতে চায়। তাই শােপেনহাওয়ার জগতকে যতটা দুঃখপূর্ণ মনে করেন, জীবনকে যতটা দুঃখে জর্জরিত মনে করেন জগৎ ও জীবনের প্রকৃত চিত্র তা নয়। অনেকে বলেন, জীবনে দুঃখ-দুর্দশা থাকবে, কিন্তু তাই বলে নৈরাশ্যবাদিতা ও দেউলিয়াপনা জীবনের কাম্য হতে পারে না। জীবনকে মানসিক শক্তি, বুদ্ধি ও মনন দ্বারা পরিচালিত করে প্রতিকূল অবস্থাকে অনুকূল করার প্রচেষ্টাই মানব জীবনের প্রকৃত কাজ।

নারী প্রকৃতি সম্পর্কে শােপেনহাওয়ারের যে অভিমত তাও একদেশদর্শী বলে সমালোচিত হয়েছে। প্রকৃতি সম্পর্কে যে আক্রমণাত্মক বিভিন্ন উক্তি করেছেন তা সার্বিকভাবে সকল নারীর ক্ষেত্রে প্রযােজ্য নয়। নারীর মধ্যে সহজাত বিবর্তনগত “ছলনাময়তার” গুণ স্বীকার করলে একইভাবে তার “মমতাময়তার” গুণও স্বীকার করতে হয়, নারীর “স্বার্থপরতার” গুণকে সামনে আনলে “সেবার” গুণও সামনে এসে পড়ে। এছাড়া এমন এমন ক্ষেত্র আছে যেখানে নারী পুরুষের চেয়ে বেশি পরিমাণে কর্মদক্ষতা বা পারদর্শিতা দেখায়। এমনও অনেক কাজ আছে যা একান্তভাবেই নারীর, পুরুষকেই তাদের সাহায্য নিতে হয়।

ত্রুটি থাকলেও বেশ কিছু দিক থেকে তাঁর দর্শন যথেষ্ট গুরুত্বের দাবি রাখে। তিনি শিল্প ও সৌন্দর্য সম্পর্কে যথেষ্ট মূল্যবান অভিমত পােষণ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, জীবনের চরম আনন্দ নিহিত আছে সৃষ্টিতে। তাই শিল্প ও সৌন্দর্য সাধনা জীবনের ক্ষেত্রে চরম শ্রেয়। তিনি দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে, জগতে প্রতিভার গুরুত্ব সর্বাধিক। তাছাড়া হেগেলের মতবাদ দ্বারা তৎকালীন মধ্যবিত্ত বা বুর্জোয়া সমাজ যে আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করতাে, যে সর্বগ্রাসী তত্ত্ব দ্বারা হেগেল আটকে দিয়েছিলেন জার্মান মনন, শােপেনহাওয়ার তাকে অতিক্রম করতে চেয়েছিলেন। তিনি সেই বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে আসতে চেয়েছিলেন। এক অদম্য সাহস নিয়ে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন জগৎ ও জীবনের আসল চেহারা। নিজের জীবন ও সমাজের বাস্তবতা থেকেই গড়ে উঠেছে তার দর্শন। এটা কোন ভাববিলাস ছিল না— এ যেন এক জীবন চিত্র। তৎকালীন জার্মানীসহ গােটা ইউরােপীয় সমাজের বিশৃংখলা, জার্মান রােমান্টিসিজম এবং তাঁর নিজ জীবনের বিরূপ অভিজ্ঞতা থেকেই তৈরি হয়েছে তার নৈরাশ্যবাদী চিন্তাধারা। দ্বন্দ্ব-সংঘাত, যুদ্ধ-বিবাদে ভরা ইউরােপীয় সভ্যতা থেকে তিনি মুক্তির জন্য প্রাচ্যের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। ভারতীয় চিন্তাধারা এবং সমাজব্যবস্থার প্রতি তিনি অনেক ক্ষেত্রেই ছিলেন আস্থাবান। জীবনের দুঃখ, বেদনা থেকে মুক্তি খুঁজেছেন বৌদ্ধ দর্শনের মধ্যে।

শোপেনহাওয়ারের দর্শন সম্পর্কে বার্ট্রান্ড রাসেলের বক্তব্য

অবভাসসমূহের পেছনে বিদ্যমান ইচ্ছা বিভিন্ন ইচ্ছার সংখ্যার দ্বারা গঠিত হতে পারে না। কান্টের মতে, দেশ এবং কাল উভয়ই অবভাসের জগতের অধীন। শশাপেনহাওয়ার তার এই মতের সঙ্গে ঐকমত্য পােষণ করে বলেন স্বগত সত্তা বা থিং-ইন-ইটসেলফ বা নোউমেনন দেশ বা কালে বিদ্যমান নয়। সুতরাং, আমার ইচ্ছা যে অর্থে বাস্তব তার সূচনা নির্ণয় করা যায় না, কিংবা তা ইচ্ছার বিভিন্ন কার্য দ্বারাও গঠিত হতে পারে না। কারণ দেশ এবং কাল হচ্ছে বহুত্বের উৎস – শােপেনহাওয়ার স্কলাস্টিক ভাষা ব্যবহার করে এই নীতির নামকরণ করেছেন ‘বিশেষক নীতি’। সুতরাং আমার ইচ্ছা হচ্ছে এক এবং কালাতীত। শুধু তাই নয়, আমার ইচ্ছাকে সমগ্র জগতের ইচ্ছার সঙ্গে অভিন্ন মনে করতে হবে; আমার পৃথকত্ব একটি অধ্যাস যা দেশ-কালের প্রত্যক্ষণজনিত আমার বিষয়ীগত কার্যের ফল, যা বাস্তব তা হচ্ছে একটি একক সীমাহীন ইচ্ছা যা প্রাণময় বা প্রাণহীন বস্তু নিবিশেষে সমস্ত প্রকৃতির মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়।

উপর্যুক্ত আলােচনা থেকে আমরা আশা করতে পারি যে, শােপেনহাওয়ার তার জাগতিক ইচ্ছাকে ঈশ্বরের সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে করেন, এবং স্পিনােজার মতােই একটি সর্বেশ্বরবাদী ধারণা প্রদান করেন। তার এই সর্বেশ্বরবাদে সদগুণ গঠিত হবে ঈশ্বরের ইচ্ছানুসারে। কিন্তু এই প্রশ্নে তার দুঃখবাদ ভিন্ন দিকে অগ্রসর হয়। জাগতিক ইচ্ছা মন্দ প্রকৃতির; সামগ্রিকভাবে ইচ্ছা মন্দ প্রকৃতির, অথবা যেকোনাে ভাবে আমাদের সীমাহীন দুঃখের উৎস। সব রকম প্রাণীর জন্য দুঃখ অপরিহার্য, এবং জ্ঞান বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দুঃখেরও বৃদ্ধি হয়। ইচ্ছার কোনাে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য না থাকলেও তা অর্জিত হলে তৃপ্তিলাভ হবে। অবশেষে যদিও মৃত্যু জয়ী হবে, তবুও আমরা নিস্ফল উদ্দেশ্য অর্জনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবাে। যেমন আমরা একটি সাবানের বুদবুদকে ফুঁ দিয়ে যতদূর সম্ভব বড় করি, যদিও আমরা নিশ্চিত জানি যে এটা ফেটে যাবে। পৃথিবীতে সুখ বলতে কিছু নেই, কারণ অতৃপ্ত ইচ্ছা বেদনা দেয় এবং অতৃপ্ত ইচ্ছা অর্জিত হলে পূর্ণ পরিতৃপ্তি লাভ হয়। সহজাত প্রবৃত্তি মানুষকে প্রজননের জন্য প্ররােচিত করে, দুঃখকষ্টভােগ এবং মৃত্যুর জন্যই প্রজননের ফলে নতুন সত্তা জন্মলাভ করে। এ কারণে লজ্জা যৌন ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। আত্মহত্যা করা অর্থহীন; আত্মার দেহান্তর প্রাপ্তির তত্ত্বটি যদি আক্ষরিক অর্থে সত্য নাও হয়, তাহলে তা অতিকথার বা পৌরাণিক কথার আকারে সত্য প্রকাশ করে। এগুলাে খুবই দুঃখজনক, তবে এর হাত থেকে মুক্তির পথও রয়েছে। ভারতবর্ষেই সেই মুক্তির পথ আবিষ্কৃত হয়েছিল।

অতিকথা বা পৌরাণিক কথাসমূহের মধ্যে সর্বোত্তম হচ্ছে নির্বাণ (শশাপেনহাওয়ার নির্বাণকে নির্বাপণ বা লােপ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন)। তিনি স্বীকার করেন যে, নির্বাণ খ্রিস্টান মতবাদের বিপরীত। কিন্তু তা সত্ত্বেও মানবজাতির প্রাচীন প্রজ্ঞা গ্যালিলিতে (Galilee) সংঘটিত ঘটনার দ্বারা স্থানচ্যুত হবে না। ইচ্ছার তীব্রতাই দুঃখের কারণ; আমরা যত কম ইচ্ছাপ্রকাশ করবাে, তত দুঃখ কম পাবাে। এখানে জ্ঞান প্রয়ােজনীয় বলে প্রমাণিত হয়, যদি না সেই জ্ঞান কোনাে এক বিশেষ ধরনের জ্ঞান হয়। একজন মানুষের সঙ্গে অন্য একজন মানুষের পার্থক্যের বিষয়টি অবভাসিক জগতের অংশবিশেষ। জগতকে সত্যিকার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখলে এই পার্থক্য দূরীভূত হয়। একজন ভাল মানুষের নিকট মায়ার (Maya) আবরণ সুস্পষ্ট থাকে; তিনি উপলব্ধি করেন যে, সবকিছুই এক, এবং তার নিজের সঙ্গে অন্যের পার্থক্যের বিষয়টি বাহ্যত বা আপাতদৃষ্টিতে প্রতীয়মান বলে মনে হবে। ভাল দ্বারা তিনি এই অন্তর্দৃষ্টি লাভ করেন যা সর্বদা সহানুভূতিমূলক এবং অন্যের দুঃখ লাঘবের জন্য এটি প্রয়ােজন। মায়ার আবরণ উন্মােচিত হলে একজন মানুষ সমস্ত পৃথিবীর দুঃখভার নিজে গ্রহণ করেন। ভাল মানুষের মধ্যে সমগ্রের জ্ঞান সকল অভীপ্সাকে বিলীন করে দেয়; তার ইচ্ছা জীবনের পথ থেকে সরে আসে এবং তার নিজের প্রকৃতিকেই অস্বীকার করে। তার মধ্যে প্রকৃতির বিভীষিকা দেখা দেয় যাতে তার নিজস্ব অবভাসিক অস্তিত্ব একটি অভিব্যক্তি রূপে প্রকাশিত হয়। আর ঐ বিভীষিকাময় প্রকৃতির মূলবস্তু ও আন্তর প্রকৃতিকে সে পরিপূর্ণ দুঃখযাতনা হিসেবে স্বীকার করে নেয়।

এভাবে শােপেনহাওয়ার প্রয়ােগের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে সন্ন্যাসধর্মী মরমিবাদে উপনীত হন। নিউ টেস্টামেন্ট, একহার্ট (Eckhart) এবং এঞ্জেলউস সাইলেসিউস (Angllus Silesius) থেকে অধিকতর ভাল। গোড়া খ্রিস্টধর্মে কিছু ভাল বিষয় রয়েছে, যেমন আদি কালতত্ত্ব। সেন্ট অগাস্টিন এবং লুথার ‘স্থূল পেলাগিয়বাদের’* বিরুদ্ধে এই আদি কালতত্ত্ব প্রচার করেন। (পেলাগিয়াস ছিলেন ওয়েলস দেশের অধিবাসী। তার প্রকৃত নাম মর্গান যার অর্থ ‘সমুদ্রবাসী। তিনি ছিলেন একজন সংস্কৃতিবান ও অমায়িক ব্যক্তি। তিনি ছিলেন কম গোঁড়া, স্বাধীন চিন্তায় বিশ্বাসী, আদিকাল সম্পর্কে সন্দেহ পােষণকারী। তার মতে, মানুষ যখন সৎভাবে কাজ করে তখন সে তার নৈতিক প্রচেষ্টার কারণেই সৎভাবে কাজ করে। মানুষ যদি ন্যায়সঙ্গতভাবে কাজ করে এবং ধর্মবিশ্বাসী হয়, তাহলে মানুষ তার সদগুণের পুরস্কার হিসেবে স্বর্গে যাবে।) গসপেলসমূহে দুঃখজনকভাবে অধিবিদ্যক ধারণা কম রয়েছে। তিনি বলেন, বৌদ্ধধর্ম হচ্ছে সর্বোচ্চ ধর্ম; যেসব অঞ্চলে ‘ইসলামের ঘৃণাৰ্হ তত্ত্ব’ রয়েছে সে অঞ্চলসমূহ ব্যতীত এশিয়ার সর্বত্র বৌদ্ধধর্মের নৈতিক তত্ত্বসমূহ গোঁড়া। ভাল মানুষ পূর্ণ কৌমার্য, স্বেচ্ছা দারিদ্র্য, উপবাস, এবং আত্ম-নিপীড়ন অনুশীলন করবে। সব কিছুতেই তার লক্ষ থাকবে ব্যক্তিগত ইচ্ছা ভেঙ্গে ফেলার। পাশ্চাত্য মরমিবাদীরা যেমন এ কাজটি করে না, সেও তেমনি একাজটি করে না; এরকম সদর্থক শুভ কখনাে কাম্য নয়। যে শুভ আমরা কামনা করি তা সম্পূর্ণরূপে নেতিবাচক। তিনি বলেন, ‘আমরা সেই শূন্যতার অন্ধকার ছায়াকে দূর করবাে যাকে আমরা সকল সদগুণ এবং পবিত্রতার পেছনে বিদ্যমান চূড়ান্ত লক্ষ হিসেবে নির্ধারণ করি, এবং শিশুরা যেমন অন্ধকারকে ভয় পায় আমরাও ঠিক তেমনি সেটাকে ভয় করি। আমরা ভারতীয়দের মতাে অতিকথা এবং অর্থহীন শব্দ, যেমন, ব্রহ্মে লীন হয়ে যাওয়া বা বুদ্ধদের মতাে নির্বাণের ধারণা দ্বারা একে কৌশলে এড়িয়ে যাব না। বরং আমরা মুক্তচিত্তে স্বীকার করবাে যে, ইচ্ছার পূর্ণ বিলােপসাধনের পর যা থাকে তা অন্য সকলের জন্য এক ধরনের পূর্ণ ইচ্ছা হলেও অবশ্যই শূন্যতা। কিন্তু বিপরীতক্রমে যাদের নিকট ইচ্ছার ধারণার পরিবর্তন হয়েছে এবং অস্বীকৃত হয়েছে তাদের কাছে আমাদের এই প্রকৃত পৃথিবী এবং এর গ্রহপুঞ্জ ও ছায়াপথ সকলই নিছক শূন্য।’

এখানে এমন একটি অস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে যে, সাধু-সন্তরা সবসময় সদর্থক কিছু দেখতে পায় যা অন্যেরা দেখতে পায় না, কিন্তু এই সদর্থক বস্তুটি কী তার কোনাে ইঙ্গিত কোথাও দেওয়া হয় নি, এবং আমার মনে হয় এই ইঙ্গিত একান্তই আলঙ্কারিক। শােপেনহাওয়ার বলেন, পৃথিবী এবং এর সকল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যবস্তু ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। ইচ্ছার আত্মসমর্পণের সাথে ‘সব প্রপঞ্চ অপসৃত হয়ে যায়; সব ধরনের সতত স্পৃহা ও প্রয়াস যার অস্তিত্বের কোনাে পর্যায়েই কোনাে শেষ ও বিশ্রাম নেই, যার মধ্যে এবং যার মধ্য দিয়ে জগতের সব কিছু অস্তিত্বশীল হয়, বিভিন্ন ধরনের জিনিস যা পর্যায়ক্রমে অর্থাৎ একটির পর আর একটি আসছে তারা তাদের অস্তিত্ব খুঁজে পায়—এসবই ইচ্ছার প্রকাশস্বরূপ। এবং পরিশেষে, এই ইচ্ছার সর্বজনীন প্রকাশ যা বিধৃত হয়েছে তা আছে দেশ ও কালের আকারে এবং এর সবচেয়ে মৌলিক রূপ যা ধরা পড়েছে ব্যক্তি ও বস্তুরূপে—এ সবই অপসৃত হয়ে যায়। এ পর্যায়ে এসে কোনাে ইচ্ছা, কোনাে ধারণা, কোনাে জগৎ থাকে না,—আমরা এক মহাশূন্যতার সম্মুখীন হই।’ এই বক্তব্যকে আমরা শুধু এই অর্থেই ব্যাখ্যা করতে পারি যে, সাধু-সন্তের উদ্দেশ্য হচ্ছে যতদূর সম্ভব অনস্তিত্বের নিকট পৌঁছানাে। এ বিষয়টিকে তারা কখনাে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে নি এবং আত্মহত্যা ব্যতীত এটি অর্জন করাও সম্ভব নয়। সর্বদা মাতাল অবস্থায় থাকা একজন ব্যক্তির চেয়ে একজন সাধু-সন্তকে কেন অগ্রাধিকার দেওয়া হবে তা বলা সহজ নয়; সম্ভবত শােপেনহাওয়ার মনে করেছিলেন যে, প্রায়শ উন্মত্ততার চেয়ে ধীরশান্ত মুহূর্ত গুলােই শ্রেয়।

শশাপেনহাওয়ারের সমপর্ণের কাহিনীটি খুব সঙ্গতিপূর্ণ এবং আন্তরিক নয়। তিনি যেসব মরমিবাদীর নিকট আবেদন করেছিলেন তারা সকলেই অনুধ্যানে বিশ্বাস করতেন। ঈশ্বর দর্শনের মধ্য দিয়ে সবচেয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করতে হবে, এবং এ ধরনের জ্ঞান সর্বোচ্চ শুভ। পারমেনাইডিসের সময় থেকেই অবভাসিক জগতের প্রতারণামূলক জ্ঞানকে অন্য এক ধরনের জ্ঞানের বিরুদ্ধ জ্ঞান হিসেবে তুলনা করা হতাে। যদিও এই জ্ঞান একেবারে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী ছিল না। খ্রিস্টধর্ম আমাদের শিক্ষা দেয় যে, ঈশ্বরের জ্ঞানের মধ্যে রয়েছে আমাদের অনন্ত ও শাশ্বত জীবন। কিন্তু শােপেনহাওয়ারের ইচ্ছার ধারণায় এ ধরনের কিছু নেই। তিনি মনে করেন যে, জ্ঞান হিসেবে পরিগণিত সব কিছুই মায়ার জগতের অধীন, কিন্তু আমরা যখন মায়ার অবগুণ্ঠন সরিয়ে ফেলি তখন আমরা ঈশ্বরকে নয়, শয়তানকে দেখি। এই শয়তান হচ্ছে দুষ্ট সর্বশক্তিমান ইচ্ছা যে তার নিজস্ব সৃষ্টির দুঃখের জন্য অবিরামভাবে দুঃখের জাল তৈরির কাজে ব্যস্ত। শয়তান দর্শন করে। সাধু-সন্ত চিৎকার করে বলেন, ‘দূর হও, ভাগো!’ এবং অনস্তিত্বে যাবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। এ ধরনের পৌরাণিক কাহিনীতে বিশ্বাস করা তাদের জন্য অপমানকর। পূর্ণ অস্তিত্ব অর্জন ব্যতীত সাধু-সন্ত এমন জীবনযাপন করতে পারেন যার কিছু না কিছু বাস্তব মূল্য আছে। সাধু-সন্তের এরূপ অবস্থা শােপেনহাওয়ারের দুঃখবাদের সঙ্গে সমন্বয় করা সম্ভব নয়। যতদিন পর্যন্ত সাধু-সন্তরা অস্তিত্বশীল থাকে, ইচ্ছা বা কামনা থাকার কারণেই তারা ততদিন অস্তিত্বশীল থাকে। এই কামনা বা ইচ্ছা করাই অশুভ। তিনি কামনা শিথিল করে অশুভের পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারেন, কিন্তু এতে তিনি কখনােই সদর্থক শুভ অর্জন করতে পারবেন না।

আমরা যদি শােপেনহাওয়ারের জীবন বিচার-বিশ্লেষণ বা মূল্যায়ন করি, তাহলেও দেখবাে তার মতবাদ আন্তরিক নয়। তিনি তার নিজস্ব অভ্যাসগতভাবেই ভাল ভাল রেস্তরায় খেয়েছেন; তার অনেক তুচ্ছ প্রেমের সম্পর্ক ছিল যার মধ্যে কোনাে আবেগের ছোঁয়া ছিল না, ছিল ইন্দ্রিয়সুখ; তিনি ছিলেন অতিমাত্রায় ঝগড়াটে এবং অস্বাভাবিকভাবে লােভ-লালসায় পূর্ণ। এখানে একদিনের একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে – একদিন তার এপার্টমেন্টের দরজার বাইরে একজন প্রৌঢ়া দরজি তার বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছিলেন। এতে তিনি বিরক্ত হয়ে তাকে ছুড়ে নিচতলায় ফেলে দেন এবং ফলে সে প্রচণ্ড আঘাত পান। এতে সেই দরজি মামলা করে কোর্ট থেকে এই মর্মে আদেশ লাভ করে যে, যতদিন সে জীবিত থাকবে ততদিন পর্যন্ত পনেরো দিন পর পর তাকে কিছু টাকা (১৫ থালেরস) প্রদান করতে হবে। বিশ বছর পর সেই মহিলা মৃত্যুবরণ করলে তিনি তার হিসাব বইতে লিখেন : ‘Obit anus, obit onus’। (‘বৃদ্ধা স্ত্রীলােকটি মৃত্যুবরণ করেছে, আমি ভারমুক্ত হয়েছি।’) মানবেতর প্রাণীর প্রতি মমতা প্রদর্শন ব্যতীত তার জীবনে অন্যকোনাে সদগুণের পরিচয় পাওয়া কঠিন। প্রাণীর প্রতি এই মমত্ববােধটুকুও ছিল বিজ্ঞানের স্বার্থে জীব-ব্যবচ্ছেদের প্রয়ােজনের জন্য। অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন একান্ত স্বার্থপর। একথা বিশ্বাস করা কঠিন যে, যে ব্যক্তি সন্ন্যাসবাদ এবং আত্মত্যাগের আদর্শে পরিপূর্ণভাবে আস্থাশীল ছিলেন তিনি কখনােই তার এই আদর্শকে বাস্তবে প্রয়ােগের কোনাে প্রচেষ্টাই গ্রহণ করেন নি।

ঐতিহাসিকভাবে দুইটি বিষয় শােপেনহাওয়ার সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ছিল – তার দঃখবাদ এবং ইচ্ছা জ্ঞানের চেয়ে শ্রেষ্ঠ – এই মতবাদ। তার দুঃখবাদী দর্শন মানুষের জন্য এ বিষয়টি সম্ভব করে তােলে যে, দার্শনিকভাবে মন্দ জিনিসকে ব্যাখ্যা করা যায়, এবং এভাবে প্রতিষেধক হিসেবে মন্দ জিনিসও উপকারী হিসেবে কাজ করে। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে আশাবাদ এবং দুঃখবাদ একইভাবে আপত্তিযােগ্য : আশাবাদ অনুমান করে, বা প্রমাণ করতে চেষ্টা করে যে, এই পৃথিবীর অস্তিত্ব আমাদের সুখী করার জন্যই এবং দুঃখবাদ মনে করে পৃথিবীর অস্তিত্বের জন্যই আমাদের দুঃখ। আমাদের সুখ-দুঃখের সঙ্গে পৃথিবীর অস্তিত্বের সম্পর্কের কোনােদিক থেকেই কোনাে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। আশাবাদ বা দুঃখবাদে আমাদের বিশ্বাসের বিষয়টি মানসিকতার সঙ্গে সম্পৃক্ত, বুদ্ধির সঙ্গে নয়। কিন্তু দুঃখবাদী মানসিকতা পাশ্চাত্য দার্শনিকদের মধ্যে সাধারণত বেশি। সুতরাং এ ব্যাপারে বিরােধী প্রতিনিধিত্ব আমাদের জন্য উপকারী হতে পারে। তারা আমাদের জন্য এমন সব বিষয় উপস্থাপন করবে যা না হলে সেগুলাে আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যাবে।

দুঃখবাদের চেয়ে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ইচ্ছার প্রাধান্য বা শ্রেষ্ঠত্বের মতবাদ। এটি সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান যে, ইচ্ছার মতবাদের সঙ্গে দুঃখবাদের কোনাে যৌক্তিক সম্পর্ক নেই, এবং শােপেনহাওয়ারের পরবর্তী যে সব দার্শনিক এই যৌক্তিক সম্পর্ককে স্বীকার করেছেন। তারাই এটিকে দুঃখবাদের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। অনেক আধুনিক দার্শনিক বিশেষ করে নিটশে (Nietzche), বার্গসোঁ (Bergson), জেমস (James), এবং ডিউঈ (Dewey) কোনাে না কোনােভাবে এই মতবাদ স্বীকার করেছেন যে, ইচ্ছাই হচ্ছে সর্বোচ্চ বা শ্রেষ্ঠতর। পেশাগত দার্শনিক বৃত্তের বাইরে এই নীতিটি একটি ফ্যাশন হিসেবে স্বীকৃতিলাভ করেছে, তুলনামূলকভাবে জ্ঞানের তুলনায় ইচ্ছার বিষয়টি স্কেলের উপরে উঠে গেছে, এবং জ্ঞানের বিষয়টি নিচে নেমে গেছে। বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে, আমাদের সময়ে দার্শনিক চর্চার ক্ষেত্রে এ বিষয়টি সবচেয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন। রুশাে এবং কান্ট দর্শনের এই ধারার সূচনা করেন, এবং শশাপেনহাওয়ারই সর্বপ্রথম এর বিশুদ্ধ দিকটি তুলে ধরেন। এ কারণে তার দর্শনে অসঙ্গতি এবং কিছু কিছু সংকীর্ণতা থাকা সত্ত্বেও ঐতিহাসিক বিকাশের স্তর হিসেবে এর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে।

শোপেনহাওয়ারের দর্শন সম্পর্কে নাইজেল ওলবার্টনের বক্তব্য

জীবন যন্ত্রণার এবং না-জন্মানাে সম্ভবত সবচেয়ে ভালাে হতাে, খুব কম মানুষেরই এমন হতাশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি আছে, কিন্তু আর্থার শােপেনহাউয়ার (১৭৮৮-১৮৬০) এর তেমনই ছিল। তাঁর মতে, আমরা সবাই কোনােকিছু পাবার কামনা এবং পাবার পর, আবারাে আরাে বেশিকিছু কামনা করার আশাহীন চক্রে আবদ্ধ হয়ে আছি। আমাদের মৃত্যু অবধি এটি চলমান। যখনই মনে হয় আমরা যা চাই সেটা পাই, আমরা অন্যকিছু পাওয়ার বাসনা অনুভব করতে শুরু করি। আপনি হয়তাে ভাবছেন আপনি সন্তুষ্ট হবেন একজন লক্ষপতি হলে, কিন্তু বেশিদিন আপনার এই সন্তুষ্টি থাকবে না। আপনার যা নেই বা যা পাননি আপনি সেটাই কামনা করতে শুরু করবেন। মানুষ এমনই। আমরা কখনােই সন্তুষ্ট নই, আমাদের যা আছে তার চেয়ে বেশি কামনা করতে আমরা কখনােই থামাতে পারিনা। পুরাে ব্যাপারটাই খুব হতাশাজনক। ১৯শ শতাব্দীর এই জার্মান দার্শনিক, আজ চিন্তার জগতে স্মরণীয় হবার দাবি রাখেন, তার সবচেয়ে সেরা কাজ, The World as Will and Representation-এ অন্তর্ভুক্ত অন্তদৃষ্টিগুলাের জন্য। শুনলে যা মনে হতে পারে শােপেনহাউয়ারের দর্শন কিন্তু এতবেশি হতাশাপূর্ণ নয়। তিনি ভাবতেন আমরা যদি বাস্তবতার সত্যিকারের প্রকৃতিটা শুধুমাত্র শনাক্ত করতে , তাহলে খুব ভিন্নভাবে আচরণ করতাম এবং হয়তাে মানব পরিস্থিতির অনেকৃত বিষণ হতাশাজনক কিছু পরিস্থিতি এড়াতে পারতাম। তাঁর বার্তাগুলাে বুদ্ধের বার্তার বেশ কাছাকাছি। বুদ্ধ শিক্ষা দিয়েছিলেন যে, আমাদের পুরাে জীবনটাই যন্ত্রণার আর আরাে গভীরতর স্তরে এমন কোনকিছু নেই যাকে আমরা বলতে পারি the self; যদি আমরা সেটি শনাক্ত করতে পারি, তাহলে আলােকপ্রাপ্ত হতে পারব। এই সদৃশতা কাকতলীয় নয়, বেশিরভাগ পশ্চিমা দার্শনিকদের ব্যতিক্রম শোপেনহাওয়ার প্রাচ্যের দর্শন নিয়ে প্রচুর লেখাপড়া করেছিলেন। তার ডেস্কের উপর এমনকি একটি বুদ্ধের মূর্তি ছিল, তার আরেক প্রিয় দার্শনিক কান্টের মূর্তির ঠিক পাশে, এবং যিনি তাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। শােপেনহাউয়ারই প্রথম পশ্চিমা দার্শনিক যিনি বুদ্ধের দর্শন নিয়ে সত্যিকারভাবে ভেবেছিলেন। তাঁর চিন্তাকে বুদ্ধের চিন্তায় আলােকপ্রাপ্ত হতাশাবাদের ব্যাখ্যা অথবা প্রতিক্রিয়া হিসাবে পড়া যেতে পারে।

কিন্তু কান্ট বা বুদ্ধের ব্যতিক্রম শােপেনহাউয়ার বেশ খানিকটা বিষন্ন, আত্মাভিমানী এবং বেশ জটিল ছিলেন তার আচরণে। বার্লিনে যখন প্রভাষকের একটি চাকরি পেয়েছিলেন, তিনি তাঁর প্রতিভা নিয়ে এতই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে তিনি দাবি করেছিলেন তাঁর লেকচারগুলাে যেন ঠিক সেই সময়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয় যখন হেগেল-এর লেকচার হয়। অবশ্যই এটা তাঁর সেরা ধারণা ছিল না, কারণ হেগেল খুবই জনপ্রিয় ছিলেন তাঁর ছাত্রদের কাছে। বলতে গেলে কেউই শােপেনহাউয়ারের লেকচারে উপস্থিত হননি। অন্যদিকে হেগেলের ক্লাসরুমে জায়গা দেয়াই ছিল সমস্যা। পরে শােপেনহাউয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যান, এবং উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পদের উপর নির্ভর করেই তিনি তার বাকি জীবন কাটিয়েছিলেন। তার সবচেয়ে সেরা বই The World as Will and Representation প্রকাশিত হয়েছিল ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে, কিন্তু তিনি এই বইটির উপর কাজ করে গেছেন বহুবছর, ১৮৪৪ সালে আরাে বর্ধিত আকারে এটি পুনঃপ্রকাশিত হয়। বইটির কেন্দ্রে মূল ধারণাটি খুব সরল। বাস্তবতার দুটি দিক আছে। এটি will এবং Representation এই দুটি রূপেই বিদ্যমান। উইল হচ্ছে সেই অন্ধ পরিচালক শক্তি যা অবশ্যই পাওয়া যায় সবকিছুর মধ্যে যাদের অস্তিত্ব আছে, এটি হচ্ছে সেই শক্তি যা উদ্ভিদ বা প্রাণীর বৃদ্ধির কারণ, কিন্তু এটি চুম্বককে উত্তরমুখী করার কিংবা রাসায়নিক যৌগে স্ফটিক তৈরি হবারও শক্তি। আরেকটি দিক, পৃথিবী Representation রূপে, এটি সেই পৃথিবী, যেভাবে আমরা এর সম্বন্ধে অভিজ্ঞতালব্ধ হই।

রিপ্রেজেন্টেশনরূপে পৃথিবী আমাদের মনের মধ্যে আমাদেরই নির্মাণ করা বাস্তবতা, কান্ট যাকে বলেছিলেন phenomenal world; আপনার চারপাশে তাকিয়ে দেখুন, কোনাে জানালা দিয়ে হয়তাে আপনি গাছ দেখতে পারছেন, মানুষ অথবা গাড়ি, অথবা আপনার সামনে এই লেখাগুলাে, হয়তাে আপনি পাখির ডাক কিংবা রাস্তায় যানবাহন চলাচলের আওয়াজ শুনতে পারছেন, অথবা অন্য ঘর থেকে ভেসে আসা শব্দ। ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আপনি যে অভিজ্ঞতা লাভ করছেন সেটাই World as Representation (প্রতিনিধি করছে এমন পৃথিবী)। সবকিছু বােঝার জন্য সেটি আপনার উপায়, যার জন্য আপনার সচেতনতা প্রয়ােজন। আপনার মন সেই অভিজ্ঞতাগুলােকে সাজায় তাদের অর্থবহ করে তােলার জন্য এই World as Representation-এ আমাদের বসবাস। কিন্তু কান্টের মতো শােপেনহাউয়ার বিশ্বাস করতেন যে আরাে গভীর একটি বাস্তবতা আছে যার অস্তিত্ব আছে আপনার অভিজ্ঞতার বাইরেও, সবকিছু আপাতদৃষ্টিতে যা দেখায় তার বাইরে, কান্ট যার নাম দিয়েছিলেন noumenal পৃথিবী। এবং তিনি ভাবতেন এর সাথে আমাদের কোনাে সরাসরি যােগাযােগ নেই। কিন্তু শােপেনহাউয়ারের মতে World as Will হচ্ছে খানিকটা কান্টের noumenal জগতের মতাে, যদিও গুরুত্বপূর্ণ কিছু পার্থক্য আছে। কান্ট noumena নিয়ে লিখেছিলেন, যা noumenon এর বহুবচন। তিনি ভেবেছিলেন বাস্তবতার একাধিক অংশ থাকতে পারে। অবশ্য কীভাবে কান্ট সেটি জেনেছিলেন সেটি স্পষ্ট নয়, বিশেষ করে যখন তিনি ঘােষণা করেছিলেন noumena জগৎটি আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। এর ব্যতিক্রম শােপেনহাউয়ার মনে করতেন আমাদের পক্ষে এমন কিছু ধারণা করা সম্ভব না যে noumena-র বাস্তবতা আদৌ বিভাজিত করে কিনা, কারণ এই ধরনের বিজ্ঞানের জন্যে দরকার স্থান ও কাল, বাস্তবতায় এর নিজের অস্তিত্ব থাকার পরিবর্তে কান্ট বিশ্বাস করতেন সেটি প্রদান করে কোনাে একক মন। এর পরিবর্তে শােপেনহাউয়ার World as Will-কে ব্যাখ্যা করেন একক, ঐক্যবদ্ধ, লক্ষ্যহীন শক্তি, যার অস্তিত্ব আছে এমন সবকিছুর পেছনে থাকে। আমরা এই জগৎটাকে দেখতে পারি আমাদের নিজেদের কাজের মাধ্যমে এবং শিল্পকলায়, আমাদের অভিজ্ঞতার মাধ্যমেও। আপাতত এটা পড়া বন্ধ করুন, আপনার মাথায় হাত দিন, কী ঘটল? আপনাকে দেখছে এমন কেউ দেখবে যে আপনার হাত উপরে উঠল, এবং আপনি মাথায় হাত রাখলেন। যদি কোনাে আয়নায় দেখেন আপনিও একই জিনিস দেখবেন। এটাই phenomenal world-এর একটি বিবরণ, World as Representation; যদিও শােপেনহাউয়ারের মতে, আমাদের শরীর নাড়াবার অভিজ্ঞতার একটি অভ্যন্তরীণ দিক আছে, সাধারণভাবে ফেনােমেনাল জগতটাকে আমরা যেভাবে অনুভব করি (ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভূত জগৎটার চেয়ে) তার চেয়ে ভিন্নভাবে অনুভব করতে পারি। আমরা World as Will-এর সরাসরি অভিজ্ঞতা নিতে পারিনা, কিন্তু আমরা সেটার খুব কাছাকাছি আসি যখন আমরা পরিকল্পিতভাবে কোনাে কাজ করি, যখন আমরা শরীরের কোনাে কাজ করার জন্য ইচ্ছা পােষণ করি সেটি ঘটানাের জন্যে। আর সেকারণে তিনি will বা ইচ্ছা শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন বাস্তবতার বিবরণ দিতে, এমনকি যদিও এটি শুধুমাত্র মানবিক পরিস্থিতিতে যখন এই শক্তির কোনাে যােগসূত্রতা থাকে কোনােকিছু ইচ্ছাকৃতভাবে করার সাথে, উদ্ভিদ উদ্দেশ্যপ্রণােদিত হয়ে বাড়ে না, রাসায়নিক ক্রিয়াও উদ্দেশ্যপ্রণােদিত হয়ে ঘটেনা। একারণে অনুধাবন করা গুরুত্বপূর্ণ যে will শব্দটি সাধারণ অর্থে যেভাবে ব্যবহার করা হয় এটি তার থেকে আলাদা।

যখন কেউ কোনােকিছু ইচ্ছা পােষণ করে তাদের মনের ভেতর একটি লক্ষ্য থাকে, তারা কিছু করার চেষ্টা করছে। কিন্তু শােপেনহাউয়ার যখন World as Will শব্দটি ব্যবহার করছেন বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করতে সেটি এর থেকে ভিন্ন। Will (বড় হাতের W সহ) লক্ষ্যহীন, অথবা তিনি যেমনভাবে বলেন ‘অন্ধ’; এটি কোনাে সুনির্দিষ্ট ফলাফল সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে না। এটি শুধুমাত্র সেই শক্তির বিশাল প্রবাহ যা প্রতিটি প্রাকৃতিক ঘটনায় আছে এবং কোনােকিছু ঘটানাের জন্যে আমাদের সচেতন ইচ্ছার মধ্যেও আছে। শােপেনহাউয়ার মনে করতেন কোনাে ঈশ্বর নেই, এটি নির্দেশনা দেবার জন্য এবং Will নিজেও ঈশ্বর নয়। মানবিক পরিস্থিতি হচ্ছে যে আমরা, সব বাস্তবতার মতােই এই অর্থহীন শক্তির অংশ। কিন্তু তারপরও কিছু অভিজ্ঞতা জীবনকে সহনীয় করে তুলতে পারে। এগুলাে মূলত আসে শিল্পকলা থেকে। শিল্পকলা একটি স্থির সেই সময়ের সন্ধান দেয়, এবং কিছুটা সময়ের জন্য আমরা সংগ্রাম আর কামনার নিরন্তর চক্র থেকে পালাতে পারি। তিনি মনে করতেন শিল্পকলার সেরা রূপটি হচ্ছে সংগীত আর সেকারণে সংগীত নিজেই সেই will-এর অনুলিপি। তিনি মনে করতেন, এটাই ব্যাখ্যা করে আমাদের গভীরভাবে নাড়া দেবার জন্য সংগীতের ক্ষমতাটিকে। আপনি যদি বীটহােভেন-এর সিম্ফোনি শােনেন মনের সঠিক ভাবনা নিয়ে, আপনি শুধু আবেগীয়ভাবে উদ্দীপ্ত হবেন না, আপনি বাস্তবতা কী সেটিও সত্যিকারভাবে দেখতে পারবেন। শিল্পকলাকে এতটা গুরুত্ব আর কোনাে দার্শনিক দেননি, সুতরাং বিস্ময়কর নয় কেন সৃজনশীল মানুষদের কাছে তিনি জনপ্রিয়। সংগীতজ্ঞ আর সংগীতশিল্পীরা তাকে ভালােবাসেন, কারণ তিনি সংগীতকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিশ্বাস করতেন। তার আবেদন ছিল ঔপন্যাসিকদের মধ্যে, যেমন টলস্টয়, মার্সেল প্রস্ত, টমাস মান এবং টমাস হার্ডি। ডিলান টমাসের কবিতা The force that through the green fuse drives the flower অনুপ্রেরণা ছিল শশাপেনহাউয়ারের World as Will-এর ব্যাখ্যা।

শােপেনহাউয়ার শুধুমাত্র বাস্তবতাকে এবং এর সাথে আমাদের সম্পর্কটাকেই ব্যাখ্যা করেননি, আমরা কীভাবে বাঁচব সেই বিষয়েও তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। যখন একবার আপনি অনুধাবন করবেন যে আমরা সব একটি শক্তির অংশ এবং প্রতিটি একক মানুষ বাস করে শুধুমাত্র World as Representation স্তরে, এটি আপনার কী করা উচিত সেই বিষয়টিকে প্রভাবিত করতে পারে। শােপেনহাউয়ারের জন্যে, অন্য মানুষকে আঘাত মানে নিজের ক্ষতি। এটাই সব নৈতিকতার ভিত্তি। আমি যদি আপনাকে হত্যা করি, আমি জীবনশক্তির একটি অংশকে ধ্বংস করব যা আমাদের দুজনকে যুক্ত করে। যখন কেউ অন্য একজনকে আঘাত করে, এটি অনেকটা কোনাে সাপের নিজের লেজে কামড় দেবার মতাে, যখন সে-কিনা জানছেই না সে তার বিষদাঁত প্রবেশ করাচ্ছে নিজের মাংসে। সুতরাং শােপেনহাউয়ারের শেখানাে মৌলিক নৈতিকতা হচ্ছে সহমর্মিতা, ভালােভাবে বিষয়টি বুঝলে, অন্য মানুষরা আসলে আমাদের বাইরের অংশ না। আমি অবশ্যই ভাবব আপনার সাথে কী হবে কারণ একটি উপায়ে আপনিও সেই জিনিসটির অংশ, যার অংশ আমরা সবাই: World as Will; এটাই তার আনুষ্ঠানিক নৈতিক অবস্থান। এটি অবশ্যই প্রশ্ন জাগায়, তিনি নিজে কি আদৌ সেই মাত্রায় অন্য কোনাে মানুষের জন্য চিন্তিত হয়েছিলেন। একটি ঘটনা বলছে, একজন বৃদ্ধ মহিলা তার দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল, এবং এটি তাকে এত ক্ষিপ্ত করেছিল যে তিনি তাকে ধাক্কা দিয়ে সিড়ি দিয়ে ফেলে দিয়েছিলেন। মহিলা আহত হয়েছিল এবং আদালত শােপেনহাউয়ারকে নির্দেশ দিয়েছিল আজীবন তাকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে যাবার জন্য। কয়েক বছর পর বৃদ্ধা মারা গেলে তিনি কোনাে সহমর্মিতা দেখাননি, বরং একটি ঠাট্টার ছড়া লিখেছিলেন তাঁর ডেথ সার্টিফিকেটে, obit anus, abit onus, যার অর্থ বৃদ্ধ মহিলা মারা গেলেন, বােঝাও চলে গেল।

আরাে একটি চূড়ান্ত উপায় আছে বাসনার চক্রটির সাথে সমঝােতা করার, এর মধ্যে বন্দি হতে না চাইলে পুরােপুরিভাবে আমাদের পৃথিবী থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে হবে, এবং সন্নাসী হতে হবে, দারিদ্র্যে আর যৌনতা পরিহার করে জীবন কাটাতে হবে। একে তিনি আমাদের অস্তিত্বের সাথে খাপ খাইয়ে নেবার জন্য আদর্শ উপায় মনে করতেন। এই সমাধানও একটি বিকল্প পথ হিসেবে চিহ্নিত করেছে প্রাচ্যের ধর্মগুলাে। তবে তিনি কখনােই সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেননি, যদিও বয়স বাড়ার সাথে সাথে সমাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। জীবনের বেশিরভাগ সময়ই তিনি মানুষের সঙ্গ উপভােগ করেছেন, প্রেম করেছেন, ভালাে খেয়েছেন। তার পাঠকরা তাকে ভণ্ড হিসাবে চিহ্নিত করার জন্য খুবই প্ররােচনা বােধ করতে পারেন। আসলে, হতাশাবাদের মূল সুর যা তার লেখার মধ্যে আমরা দেখি তা এতবেশি তীব্র কোনাে-কোনাে জায়গায়, অনেক পাঠকই ভেবেছেন যদি তিনি সত্যি সৎ হতেন তাহলে আত্মহত্যা করতেন। শােপেনহাউয়ার তার আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন ‘আমার ১৭শ জন্মদিনে তীব্র হতাশা আমাকে আক্রান্ত করেছিল, ঠিক যেমন বুদ্ধকে তার তারুণ্যে আক্রান্ত করেছিল, যখন তিনি অসুখ, বার্ধক্য, দুঃখ আর মৃত্যু দেখেছিলেন প্রথমবারের মতাে। সত্যিটা হচ্ছে এই পৃথিবী কোনােভাবেই সবচেয়ে দয়ালু কোনাে সত্তার কাজ হতে পারেনা, বরং এটি কোনাে শয়তানের সৃষ্টি, যিনি জীব সৃষ্টি করেছেন তাদের যন্ত্রণায় ভুগতে দেখে তৃপ্তি পাবার বাসনায়’। বুদ্ধের মতাে এই দুঃখ আর যন্ত্রণার ব্যবচ্ছেদ করা, এই কষ্ট থেকে মুক্তি পাবার জন্য কোনাে সমাধান খুঁজে বের করাই তার লক্ষ্য ছিল।

বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে শােপেনহাউয়ারকে যেভাবে পড়ানাে উচিত সেভাবে পড়ানাে হয়নি বরং বেশ অ্যাকাডেমিকভাবে তাকে উপস্থাপন করা হয়েছে জটিলতর ব্যাখ্যায়। অনেকেই মনে করেন এটি তার পরিচিতি বেশ সীমিত করেছিল, কিন্তু তিনি আসলে বুদ্ধের মতােই আরাে বেশি অনুসারী পাওয়ার যােগ্যতা রাখেন। খুব সহজভাবে তার দর্শন শুরু হয়েছিল সেই প্রাথমিক বা মৌলিক শক্তিকে নাম দেবার মাধ্যমে, যা আমাদের সবার মধ্যেই আছে, তার মতে যা অন্য যে-কোনােকিছুর চেয়ে সবচেয়ে শক্তিশালী, আমাদের চিন্তা করার ক্ষমতা, যুক্তি, নৈতিকতাবােধ, যাকে তিনি নাম দিয়েছিলেন Will-to-Life, এটি সেই নিরন্তর শক্তি যা আমাদের সামনের দিকে চালিত করে, আমাদের অস্তিত্বে আঁকড়ে থাকে, আমাদের সুবিধাগুলাের দিকে নজর করে। এটি অন্ধ, খুব দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তার মনে এই Will-to-Life আমাদের মনকে যেদিকে বেশি মনােযােগ দিতে বাধ্য করে সেটি হচ্ছে যৌনতা। কৈশাের থেকেই, এই Will আমাদের ভিতরে একটানা তাড়না সৃষ্টি করে, আমাদের ভাবনাকে যৌনতার দিকে পরিচালিত করে, বাধ্য করে আমাদের অদ্ভুত সব কাজ করাতে, শােপেনহাউয়ারের মতে সবচেয়ে অদ্ভুততম কাজটি হচ্ছে প্রেমে পড়া। শােপেনহাউয়ার ভালােবাসাকে বেশ শ্রদ্ধা করতেন, যেমন শ্রদ্ধা আমাদের দেখানাে উচিত ঘূর্ণিঝড় অথবা কোনাে বাঘকে। তিনি খুবই অপছন্দ করতেন বুদ্ধিমান মানুষের জীবনে যখন এই ধরনের প্রেমান্ধতা ব্যাঘাত সৃষ্টি করত। কিন্তু তিনি এগুলােকে দুর্ঘটনা বা আসামঞ্জস্যপূর্ণ কিছু ভাবতে অস্বীকার করেছেন, তার দৃষ্টিতে ভালােবাসা যুক্ত Will-to-Life-এর সাথে, তথা আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ (এবং দুর্বিষহ) মূল প্রকল্পটির সাথে, সন্তানের জন্ম দেয়া।

ভালােবাসা নিয়ে এত হট্টগােল কেন? কেন এত অত্যাবশ্যকীয়তা, শােরগােল, পরিশ্রম আর উদ্বেগ? তিনি জানতে চেয়েছিলেন, কারণ সকল প্রেমের চূড়ান্ত লক্ষ্য আসলে কারাে জীবনের অন্য সব লক্ষ্যের চেয়ে আরাে গুরুত্বপূর্ণ, এবং সেকারণে এটি অনুসরণ করার কাজটি করতে হবে গভীর ভাবনাসহ রােমান্টিকরা জীবনে আধিপত্য বজায় রাখে, কারণ তিনি মনে করেন এর মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্ম কেমন হবে সেটি অন্তত নির্ধারিত হয়, অর্থাৎ অনাগত সময়ের মানবজাতির বিশেষ গঠন আর অস্তিত্ব। অবশ্যই, আমরা ভবিষ্যৎ শিশুদের নিয়ে কদাচিৎ ভাবি, যখন কারাে প্রতি আমরা আকর্ষণ অনুভব করি। কিন্তু শােপেনহাউয়ার ভাবতেন এর কারণ, আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি বিচ্ছিন্ন থাকে এর নিজের Will-এর সত্যিকার প্রতিজ্ঞা আর গােপন সিদ্ধান্তগুলাে থেকে। কিন্তু কেন এই প্রতারণার আদৌ দরকার পড়ে? কারণ, তার মতে, আমরা কখনােই নির্ভরযােগ্যভাবে প্রজনন করি না, যদি-না প্রথমে এবং আসলেই আক্ষরিকভাবে, আমাদের কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলি। এটাই হচ্ছে সেই মানুষটি যিনি কিনা কোনাে ধরনের একঘেয়েমি, আটপৌরতা, খরচ, সন্তান প্রতিপালন করার মতাে তীব্রতম আত্মবিসর্জনের তীব্র বিরােধী ছিলেন। উপরন্তু তিনি বেশিরভাগ সময় যুক্তি দিতেন, যদি আমরা ভালােবাসার পাত্রী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আমাদের বুদ্ধিমত্তাকে ভালােভাবে ব্যবহার করতে পারতাম, তাহলে আমরা সাধারণত যে মানুষগুলােকে বেছে নিই তার চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়তাে কাউকে বেছে নিতাম। কিন্তু পরিশেষে আমরা আমাদের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ মানুষের প্রেমে পড়ি না, বরং সেইসব মানুষেরই প্রেমে পড়ি যাদেরকে Will-to-Life আমাদেরকে আদর্শ সঙ্গী হিসেবে শনাক্ত করে দেয়, আমরা যাদের সাথে ভারসাম্যময় সন্তান উৎপাদন করতে পারব। তার মতে আমরা সবাই কমবেশি একটু ভারসাম্যহীন, আমরা হয় বেশি পুরুষালী অথবা বেশি রমণীয়, বেশি লম্বা অথবা বেশি খাটো, বেশি যুক্তিবাদী, অথবা বেশি আবেগপ্রবণ। যদি এইসব ভারসাম্যহীনতাকে টিকে থাকতে অনুমতি দেয়া হয় বা বাড়িয়ে তােলা হয়, পরের প্রজন্মে, মানবজাতি, খুব দ্রুততম সময়ে অদ্ভুত হয়ে যাবে। Will-to-life-কে অবশ্যই তাই আমাদের সেইসব মানুষের দিকে ঠেলে দেবে, যারা পারে, তাদের ভারসাম্যহীনতা সংশােধন করার কারণে আমাদের নিজেদের ভারসাম্যহীনতাগুলােকে সঠিক করতে। এ বড় নাক, ছােট নাকের সাথে মিলে ত্রুটিহীন একটি নাকের প্রতিশ্রুতি দেয়। তিনি যুক্তি দেন যে ছােট আকারের মানুষগুলাে অনেক সময় লম্বা মানুষের প্রেমে পড়ে, বেশি রমণীয় পুরুষরা আরাে বেশি পুরুষালী রমণীর প্রেমে পড়ে।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার এই আকর্ষণতত্ত্বের পরিণতিতে শােপেনহাউয়ার খুব হতাশাময় একটি উপসংহারে আসেন, যেটি হচ্ছে, কোনাে একটি ব্যক্তি যে-কিনা ভারসাম্যময় সন্তান উৎপাদনে খুবই যােগ্য, সে প্রায় কখনােই (যদিও আমরা সেই সময় বিষয়টি অনুধাবন করিনি কারণ Will-to-life আমাদের অন্ধ করে রাখে) আমাদের জন্য খুব বেশি যােগ্য নয়: ‘আমাদের খুব অবাক হলে চলবে না যে বন্ধু নয় এমন মানুষের মধ্যে বিবাহে’, তার মনে ভালােবাসা সেইসব মানুষদের উপর এর প্রভাব ফেলে, যৌনতা ছাড়া, যারা ঘৃণাপূর্ণ এবং আমরা এমনকি পছন্দও করব না, কিন্তু প্রজাতির Will এতবেশি শক্তিশালী সেই একক ব্যক্তির চেয়ে যে, প্রেমিকযুগল সবকিছুই উপেক্ষা করে, ভুল বিচার করে, দুর্বিষহ একটি বিষয়ের প্রতি চিরকালই তারা অন্ধ হয়ে থাকেন। আমাদের সুখ না, Will-to-life-এর নিজের উদ্দেশ্য সফল করার ক্ষমতা, শােপেনহাউয়ারের তত্ত্ব ইঙ্গিত দেয় আমরা বিশেষ সুস্পষ্টতার সাথে অনুভব করতে পারি অর্গাজম বা চরম সুখের পরবর্তী ভীতিকর আর নির্জন মুহূর্তে, তার ভাষায়, সঙ্গমের ঠিক পরে শয়তানের হাসি শােনা যায়।’

মানবজীবনের নানা দৃশ্য শােপেনহাউয়ারকে ব্যথিত করেছিল। আমরা পশুর মতাে, শুধুমাত্র, আমাদের বৃহত্তর আত্মসচেতনতার কারণে, আরাে বেশি দুঃখী। তিনি বিভিন্ন প্রাণীদের নিয়ে আলােচনা করেছিলেন, বিশেষ করে মােল, মাটির নিচে অন্ধকার সুড়ঙ্গে যাদের বসবাস, যারা কদাচিৎ দিনের আলাে দেখে, যাদের সন্তানরা আঠালাে কেঁচোর মতাে দেখতে। কিন্তু সে তার ক্ষমতায় সবকিছু করে টিকে থাকা ও বংশবৃদ্ধির জন্য। আমরাও তাদের চেয়েও বেশি করুণ, আমরা উন্মত্তের মতাে নিজেদের উন্নতির দিকে নিয়ে যাই, ভালাে বেতনের কাজ খুঁজি, যা সবাইকে বিশেষ করে সঙ্গিনীকে মুগ্ধ করার জন্য, সারাক্ষণই ভাবি, সেই একটি মানুষকে খুঁজতে (কল্পনা করি তারা আমাদের সুখি করবে), এবং অবশেষে একসময় কারাে দ্বারা প্ররােচিত হই যথেষ্ট দীর্ঘ সময় কোনাে সন্তান-উৎপাদন করার জন্য এবং পরবর্তী ৪০ বছর দুর্বিষহ জীবন কাটাই একটা ভুলের মাশুল গুনতে গুনতে। শােপেনহাউয়ার খুব সুন্দরভাবে ও রসিকতার সাথে মানবপ্রকৃতি নিয়ে নেতিবাচক ধারণাগুলাে লিখেছিলেন। যেমন, একটি মাত্র জন্মগত ত্রুটি আছে, সেটি হচ্ছে সেই ধারণা পােষণ করা, আমাদের অস্তিত্ব আছে কারণ আমরা সুখী হব তাই। যতক্ষণ এই জন্মগত ত্রুটি নিয়ে আমরা টিকে থাকব, এই পৃথিবী আমাদের কাছে সবসময়েই স্ববিরােধিতাপূর্ণ মনে হবে। কারণ প্রতিটি পদক্ষেপের জন্যে, ছােট কিংবা বড়, আমরা সেই অভিজ্ঞতায় বন্দি যেখানে এই পৃথিবী ও জীবন অবশ্যই আমাদের সন্তুষ্ট করার জন্য সজ্জিত নয়। সেকারণে আমরা এতবেশি বয়ােজ্যেষ্ঠ মানুষ দেখি যাদের মুখে হতাশার ছাপ সুস্পষ্ট।

শােপেনহাউয়ার দুটি সমাধান প্রস্তাব করেছিলেন অস্তিত্বের এই সমস্যাগুলাের সমাধানে। প্রথমটি বরং সেইসব দুষ্প্রাপ্য মানুষদের জন্য, যাদের তিনি বলছেন sage বা প্রাজ্ঞ। এই প্রজ্ঞাবানরা পারেন, তাদের বীরােচিত প্রচেষ্টায় Will-to-life এর দাবির উপরে উঠতে, তারা সেই প্রাকৃতিক তাড়নাটি তাদের ভেতরে দেখতে পান স্বার্থপরতা, যৌনতা, অহংকারের প্রতি, এবং তারা সেটি অতিক্রম করেন, তারা তাদের কামনাগুলােকে জয় করেন, একা থাকেন (প্রায়শই বড় শহর থেকে দূরে), কখনাে বিয়ে করেন না, তাদের খ্যাতি আর সামাজিক মর্যাদার বাসনাকে তারা দমন করেন। বৌদ্ধ দর্শনে, শােপেনহাউয়ার দেখিয়েছিলেন, এই মানুষটি পরিচিত মঙ্ক বা সাধু হিসাবে, কিন্তু তিনি চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন, আমাদের মধ্যে খুব মানুষই এভাবে জীবন কাটাতে পারে। তবে তার দ্বিতীয় এবং আরাে সহজেই পালনযােগ্য এবং বাস্তবসম্মত বিকল্প হচ্ছে যতটা দীর্ঘতম সময় সম্ভব, শিল্পকলা ও দর্শন নিয়ে কাটানাে, যার কাজ হচ্ছে আমাদের সব উন্মত্ত প্রচেষ্টা আর অসুখী সময় যা আমাদের ভেতর সৃষ্টি করেছে Will-to-Life, তার সামনে আয়না মেলে ধরা। আমরা হয়তাে প্রায়শই তাকে জয় করতে পারব না, কিন্তু সন্ধ্যায় মঞ্চে অথবা কবিতার বই নিয়ে হাঁটতে বের হলে, আমরা দৈনন্দিন জীবন থেকে বের হতে পারি এবং কোনাে বিভ্রম ছাড়াই জীবনের দিকে তাকাতে পারি। যে শিল্পকলা তিনি মনে করতেন ভাবালুতার সবচেয়ে বিপরীত, সেটি হচ্ছে গ্রিক ট্র্যাজেডি, ল্যা রােশফুকোর অ্যাফোরিজম ও হবস আর মাকিয়াভেলির রাজনীতিতত্ত্ব। এই কাজগুলাে আমাদের আত্মম্ভরিতা নিয়ে কষ্ট, স্বার্থপরতা আর বৈবাহিক জীবনের ভীতি নিয়ে সরাসরি কথা বলে, এবং মানবজাতির প্রতি একটি ট্র্যাজিক, সম্মানসূচক, বিষন্ন সমবেদনার হাত সম্প্রসারণ করে। শােপেনহাউয়ারের নিজের কাজগুলােই শিল্পকলা ও দর্শনের কী করা উচিত সেই সংক্রান্ত নিজের বিবরণের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। ভয়ংকর তিক্ত হতাশাবাদে এটি গভীরভাবে আমাদের সান্ত্বনা দেয়। যেমন তিনি বলেন: ‘বিয়ে করা মানে পরস্পরের কাছে ঘৃণ্য হবার জন্য সবকিছু করার প্রচেষ্টা’ বা ‘প্রতিটি জীবনকাহিনি দুঃখের’, ‘জীবনের নিজস্ব কোনাে মূল্য নেই, শুধুমাত্র চাহিদা আর মায়া এটিকে চলমান রাখে।’

বহু সময় চেষ্টা করে কাটানাের পর, তারপরও বিখ্যাত হতে ব্যর্থ হবার পর, এবং চেষ্টা করেও ভালাে সম্পর্ক পেতে ব্যর্থ হবার পর, তার জীবনের শেষে, শােপেনহাউয়ার ধীরে ধীরে পাঠক পেয়েছিলেন যারা তার লেখা ভালােবেসেছিল। ফ্রাঙ্কফুর্টে একটা ছােট অ্যাপার্টমেন্টে ছােট একটা কুকুরকে নিয়ে তার জীবন কেটেছে, যার নাম দিয়েছিলেন আত্মা, বৌদ্ধদর্শনের বিশ্বআত্মা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। কুকুরটিকে তার প্রতিবেশীদের ছেলেমেয়েরা ডাকত মিসেস শােপেনহাউয়ার নামে। ৭২ বছর বয়সে, নীরবে তিনি মারা যান। তিনি আমাদের সময়ের প্রাজ্ঞ ছিলেন, এমন কেউ যার আবক্ষ মূর্তি তার প্রিয় বুদ্ধের মূর্তির মতােই সর্বব্যাপী ও শ্রদ্ধেয় হবার দাবি রাখে।

তথ্যসূত্র

  • সমকালীন পাশ্চাত্য দর্শনের রূপরেখা, মোঃ শওকত হোসেন
  • A Little History of Philosophy by Nigel Warburton
  • A History of Western Philosophy by Bertrand Russell

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.