গুপ্ত সাম্রাজ্য

Table of Contents

গুপ্তযুগের রাজনৈতিক ইতিহাস 

ভূমিকা

কুষাণোত্তর যুগে উত্তর ভারতে যে রাজনৈতিক অনৈক্য ও বিচ্ছিন্নতার পর্ব শুরু হয়েছিল এক নতুন রাজবংশের অভ্যুদয়ের ফলে সেই অনৈক্য ও বিচ্ছিন্নতার পরিসমাপ্তি ঘটে। এই বংশের প্রথম পর্বের প্রায় সকল রাজাই যােগ্যতা, দূরদৃষ্টি, পরাক্রম প্রভৃতি গুণের অধিকারী ছিলেন। ফলে তারা সহজেই বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্র রাজ্যগুলোকে আত্মসাৎ করে উত্তর ভারতে বিশাল একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। মৌর্য শাসনের অবসানের বহু দিন পর উত্তর ভারতে আবার এক দীর্ঘস্থায়ী, ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র গড়ে ওঠে। ভারতের ইতিহাসে এই রাজবংশ গুপ্ত রাজবংশ নামে প্রসিদ্ধ। 

প্রাক-গুপ্ত পর্বে মগধ

কুষাণােত্তর পর্বে মগধের রাজনৈতিক ইতিহাস স্পষ্ট নয়। খ্রিস্টীয় ২য় শতকের মাঝামাঝি সময় শকগােষ্ঠীভুক্ত মুরুণ্ড জাতি এই অঞ্চলে রাজত্ব করেন। টলেমির বিবরণে এ তথ্যের উল্লেখ তাছে। টলেমির পরবর্তী বৈদেশিক লেখক ওপ্পিয়েন-এর বিবরণেও মুরুণ্ডরাজ্যের কথা আছে। জৈনগ্ৰন্থ ‘প্রভাবচরিতে’ পাটলিপুত্রের এক মুরুণ্ডনরপতির বর্ণনা আছে যিনি শিরঃপীড়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। পাটলিপুত্রের আর একজন মুরুণ্ড রাজার উল্লেখ আছে অপর একখানি জৈনগ্রন্থ ‘আবশ্যকবৃহদ্ধৃত্তি’-তে। এই মুরুণ্ডরাজ পুরুষপুরের রাজার কাছে দূত পাঠান। পুরাণ থেকে বিশ্বস্ফাণি নামে এক রাজার কথা জানা যায় যিনি প্রাক-গুপ্তপর্বে মগধে রাজত্ব করেন। নাম থেকে মনে হয় বিশ্বস্ফাণি জাতিতে মুরুণ্ড ছিলেন। খ্রিস্টীয় ২য় শতকের শেষপর্বে আর্য বিশাখমিত্র মগধে এক স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। সম্ভবত তারই আক্রমণের ফলে মুরুণ্ড শক্তির পতন হয়। বিশাখমিত্র ও তার বংশধরেরা পাটলিপুত্রে কতদিন রাজত্ব করেন তা বলা কঠিন। খ্রিস্টীয় ৩য় শতকের শেষের দিকে পাটলিপুত্রে সম্ভবত গুপ্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। কোনও কোনও পণ্ডিত মনে করেন গুপ্তদের পূর্বে লিচ্ছবিরা পাটলিপুত্রে রাজত্ব করতেন এবং তাদের কন্যা কুমারদেবীকে বিবাহ করে। যৌতুকস্বরূপ এ অঞ্চল লাভ করেন। তবে কুষাণােত্তর পর্বে লিচ্ছরিরা বাজত্ব করতেন ঠিকই, কিন্তু তা পাটলিপুত্রে নয়, বৈশালী বা উত্তর বিহারে। গুপ্তদের আবির্ভাবের পূর্বে কোতবংশীয় রাজারা পাটলিপুত্রে রাজত্ব করেন বলে কাশীপ্রসাদ জায়সওয়াল বহুদিন পরেই এক অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এই অভিমতের সত্যতা সম্পর্কে যথেষ্ট সংশয় আছে। এলাহাবাদ প্রশস্তিতে এধরনের কোনও মন্তব্য নেই।

গুপ্তদের আদি ইতিহাস ও আদি গুপ্তরাজ্য

গুপ্তদের জাতি ও বর্ণ নিয়ে বিতর্ক : গুপ্ত রাজারা কোন জাতির লোক তা নিশ্চিতরূপে জানা যায় না। গুপ্তদের আদি ইতিহাস সম্পর্কিত বিভিন্ন মত ও দিক –

  • বৈশ্যদের পক্ষে গুপ্তান্তক নাম বিধেয় বলে বিষ্ণুপুরাণে নির্দেশ আছে। ফলে অনেকেরই ধারণা গুপ্ত রাজারা বুঝি বৈশ্য ছিলেন। কিন্তু গুপ্তান্তক নাম হলেই যে বৈশ্য হতে হবে এমন কোনও কথা নেই। প্রখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ব্রহ্মগুপ্ত তাে ব্রাহ্মণ ছিলেন।
  • রানি প্রভাবতীগুপ্তার পুণা ও ঋদ্ধপুর তাম্রশাসন থেকে জানা যায় গুপ্ত রাজারা ধারণ গােত্রের লােক ছিলেন। অগস্ত্য নামে ব্রাহ্মণদের এক শাখা আছে। এই শাখার এক প্রশাখা ধারিণী। সে কারণে গুপ্ত রাজারা ব্রাহ্মণ ছিলেন বলেই মনে হয়।
  • হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী মনে করেন গুপ্ত রাজারা সম্ভবত শুঙ্গরাজ অগ্নিমিত্রের মহিষী ধারিণীর আত্মীয় ছিলেন। এই মতের সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ আছে। তবে গুপ্তরা বৈশ্য ছিলেন এই মতই বর্তমানে প্রাধান্য পাচ্ছে। 
  • সাতবাহন লেখমালায় গুপ্ত নামান্ত তিনজন অমাত্যের উল্লেখ আছে। তারা হলেন পরি বা পুরুগুপ্ত, শিবগুপ্ত ও শিবস্কন্দগুপ্ত। অনেকে শেষের দু’জনকে এক ও অভিন্ন মনে করেন। গুপ্ত রাজাদের সঙ্গে এদের নামের বেশ মিল আছে। তবু তাদের সঙ্গে যে গুপ্ত রাজাদের আত্মীয়তার বন্ধন ছিল তা জোর করে বলা যায় না।
  • উত্তর ভারতের দুই একটি পুরাতন গুপ্তবংশের কথা জানা যায়। সেসব রাজবংশের সঙ্গে যে গুপ্ত রাজাদের কোনও সম্পর্ক ছিল, তারও কোনও প্রমাণ নেই। 

গুপ্ত ও ঘটোৎকচের শাসন : গুপ্ত রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা গুপ্ত (খ্রিস্টীয় ৩য় শতকের শেষের দিক)। তার পুত্র ঘটোৎকচ (খ্রিস্টীয় ৩য় শতকের শেষ দিক থেকে ৩১৯ খ্রি.)। লেখমালায় তাদের মহারাজ আখ্যা দেয়া হয়েছে। কিন্তু এই বংশের তৃতীয় রাজা প্রথম চন্দ্রগুপ্তের উপাধি মহারাজাধিরাজ। অনেকের অভিমত গুপ্ত ও ঘটোৎকচ কোনও এক পরাক্রান্ত রাজবংশের অধীনস্থ ছিলেন কিন্তু প্রথম চন্দ্রগুপ্তের সময় গুপ্তরাজ্য স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু ৩য় শতকের শেষ ও ৪র্থ শতকের প্রথম পর্বে উত্তর ও পূর্ব ভারতে কোনও শক্তিশালী রাজবংশ ছিল বলে মনে হয় না। প্রথম দু’জন গুপ্ত রাজা সম্ভবত স্বাধীন নরপতি ছিলেন। তাদের তুলনায় প্রথম চন্দ্রগুপ্ত অনেক শক্তিশালী ছিলেন। মহারাজের পরিবর্তে তার মহারাজাধিরাজ পরিচয়ের রহস্যটি এখানেই।

আদি গুপ্তরাজ্যের স্থান : গুপ্ত ও ঘটোৎকচ কোন অঞ্চলে রাজত্ব করতেন, তা সঠিক জানা যায় না। সমকালীন লেখে এ সম্পর্কে কোনও তথ্য নেই। পুরাণে ও চিনা পরিব্রাজক ই চিঙের বিবরণে এবিষয়ে কিছু ইঙ্গিত আছে। বায়ু-পুরাণের একটি শ্লোক এই প্রসঙ্গে উল্লেখের দাবি রাখে : “অনু-গঙ্গা-প্ৰয়াগঞ্চ সাকেতং মগধাংস্তথা।/ এতান জনপদান সর্বান্ ভােক্ষ্যন্তে গুপ্তবংশজাঃ।।” শ্লোকটির অর্থ নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক আছে। কোনও কোনও পণ্ডিত মনে করেন গুপ্তরাজ্য বলতে এখানে গঙ্গাতীরবর্তী প্রয়াগ বা এলাহাবাদ, সাকেত বা অযােধ্যা এবং মগধ এই তিনটি অঞ্চল বােঝানাে হয়েছে। আবার অনেকের মতে এখানে অনুগঙ্গা বা গঙ্গা সন্নিহিত ভূভাগ, প্রয়াগ, সাকেত ও মগধ এই চারটি অঞ্চলের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় ব্যাখ্যার বিপক্ষে অনেক কিছু বলার আছে। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে বা লেখমালায় অনুগঙ্গা নামে কোনও স্বতন্ত্র জনপদের উল্লেখ নেই। অনুগঙ্গা পদটি যদি গঙ্গা সন্নিহিত অঞ্চল অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে, তবে একই শ্লোকে প্রয়াগ ও মগধের স্বতন্ত্র উল্লেখ কেন? প্রয়াগ ও মগধ তাে গঙ্গাতীরবর্তী। তাছাড়া অনুগঙ্গা যদি কোনও স্বতন্ত্র জনপদের নাম হত তাহলে পদটিতে দ্বিতীয় বিভক্তি যুক্ত হত যেমনটি হয়েছে প্রয়াগ, সাকেত ও মগধের ক্ষেত্রে। ভূমি বা ওই জাতীয় কোনও শব্দ পরে না বসলে শুধু অনুগঙ্গা গঙ্গাসন্নিহিত অঞ্চল বােঝায় কী করে? এসব যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয় অনুগঙ্গা পদ এখানে প্রয়াগের বিশেষণরূপেই ব্যবহৃত হয়েছে। প্রয়াগ, সাকেত ও মগধ নিয়ে যে গুপ্তরাজ্য তা নিঃসন্দেহে সমুদ্রগুপ্তের রাজ্য থেকে আয়তনে অনেক ক্ষুদ্র ছিল। আয়তনে এই রাজ্যটি প্রথম চন্দ্রগুপ্তের অধিকারভুক্ত রাজ্যের প্রায় অনুরূপ। কিন্তু গুপ্ত ও ঘটোৎকচের রাজ্য আয়তনে আরও ছােটো ছিল। অর্থাৎ অখণ্ড প্রয়াগ সাকেত-মগধ অঞ্চলে নয়, এরই কোনও এক অংশে তারা প্রথমে রাজত্ব করতেন।

ই চিঙ এর বিবরণী : এই প্রসঙ্গে চিনা পরিব্রাজক ই চিঙের বিবরণী বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই বিবরণী আছে তার ৬৯১-৯২ খ্রিস্টাব্দে লেখা ‘কউ-ফা-কউ-স্যাঙ-চুয়েন’ গ্রন্থের কোরিয়াবাসী বৌদ্ধশ্ৰমণ হুই লুন বা প্রজ্ঞাবর্মার ভারত-ভ্রমণ সম্পর্কিত পরিচ্ছেদে। এই গ্রন্থ থেকে জানা যায় গ্রন্থ রচনার প্রায় পাঁচশাে বছর পূর্বে চে-লি-কি-তাে নামে এক রাজা বিদেশি শ্রমণদের জন্য একটি চিন-মন্দির নির্মাণ করেন। নবনির্মিত মন্দিরটি মিলি-কিআ-সি-কিআপাে-নো নামে একটি বিখ্যাত বৌদ্ধ বিহারের নিকট অবস্থিত ছিল। মন্দিরের ব্যয় নির্বাহের জন্য রাজা চেলি-কি-তো ২৪টি গ্রামের রাজস্ব দান করেছিলেন। চে-লি-কি-তাে, এই চিনা নামটির সংস্কৃত প্রতিশব্দ হল শ্রীগুপ্ত। এই নামের সঙ্গে গুপ্তবংশের প্রথম রাজা গুপ্তের নামের অদ্ভুত সাদৃশ্য রয়েছে। সেজন্য অনেকেই ই চিঙ বর্ণিত শ্রীগুপ্ত ও গুপ্তরাজ গুপ্তকে এক ও অভিন্ন মনে করেন। এ মত মানেন না এমন পণ্ডিতও আছেন। তাদের বক্তব্য শ্রীগুপ্তের শাসনকাল খ্রিস্টীয় ২য় শতকের শেষার্ধ, পক্ষান্তরে রাজা গুপ্ত এর প্রায় একশাে বছর পর রাজত্ব করেছিলেন। মনে রাখতে হবে মন্দির নির্মাণের যে তারিখ ই চিঙ নির্দেশ করেছেন তার ভিত্তি কোনও সরকারি দলিল-দস্তাবেজ নয়, নিছক জনশ্রুতি। সেই জন্য মনে হয় শ্রীগুপ্ত সম্পর্কে ই চিঙের দেয়া তারিখটির উপর খুব বেশি গুরুত্ব আরােপ করা ঠিক হবে না। তারিখের উল্লেখে চিনা পরিব্রাজকদের ভ্রান্তির অসংখ্য নজির আছে। তাছাড়া খ্রিস্টীয় ২য় শতকের শেষার্ধে শ্রীগুপ্ত নামে এক রাজা যে রাজত্ব করতেন তারও কোনও স্পষ্ট প্রমাণ নেই। আপাতত শ্রীগুপ্তকে গুপ্ত রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা বলে মেনে নেওয়াই ভালাে।

শ্রীগুপ্তের প্রতিষ্ঠা করা মন্দিরের অবস্থান নিয়ে বিতর্ক ও বরেন্দ্রী : কিন্তু যে চিন-মন্দির শ্রীগুপ্ত বা গুপ্ত প্রতিষ্ঠা করেন সেই মন্দিরের ভৌগােলিক অবস্থান নিয়েও পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক আছে। কোনও কোনও পণ্ডিত উত্তরপ্রদেশে, কেউ কেউ বিহারে, আবার অনেকে উত্তর বাংলায় মন্দিরটির অবস্থান নির্দেশ করেছেন। চিন-মন্দিরের অবস্থান সম্পর্কে দু’টি জিনিস মনে রাখতে হবে – প্রথমত, মি-লি-কিআ-সি-কিআপাে-নাে বৌদ্ধ বিহারটি নালন্দার ৪০ যােজন বা ৩৮৬ কি. মি. পূর্বদিকে অবস্থিত ছিল। তথ্যটি স্বয়ং ই চিঙেরই দেয়া। দ্বিতীয়ত, শ্ৰীগুপ্ত বা গুপ্ত প্রতিষ্ঠিত চিন-মন্দিরটি মিলি-কিআ-সি-কিআ-পে-নো বা মৃগস্থাপনস্তূপের সন্নিকটে অবস্থিত ছিল। এ তথ্যটিরও পরিবেশক ই চিঙ। তথ্য দু’টির পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয় চিন-মন্দির ও মি-লি-কিআ-সি-কিআপাে-নাে বিহারটি উত্তর বা অর্থাৎ প্রাচীন বরেন্দ্রী জনপদে অবস্থিত ছিল। এ প্রসঙ্গে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত এক প্রাচীন পাণ্ডুলিপি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পাণ্ডুলিপিখানি থেকে জানা যায়, মৃগস্থাপন স্তূপটি বরেন্দ্রী জনপদে অবস্থিত ছিল। এখানে স্বভাবতই একটি প্রশ্ন উঠছে : ই চিঙ যদি মি লি-কিআ-সি-কিআ-পাে-নাে’র অবস্থান নালন্দার ৪০ যােজন পূর্বদিকে নির্দেশ করে থাকেন, তাহলে ঐতিহাসিকেরা চিন-মন্দিরের অবস্থিতি উত্তরপ্রদেশ বা বিহারে ধার্য করলেন কেন? এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া কঠিন নয়। উত্তরপ্রদেশ ও বিহারের অনুকূলে যারা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তাদের অনেকে চে-লি-কি-তাে এবং গুপ্ত রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা মহারাজ গুপ্তকে দু’জন স্বতন্ত্র নৃপতিরূপে চিহ্নিত করেছেন; আবার কেউ-বা ই চিঙের গ্রন্থটির স্যামুয়েল বিল কৃত ইংরেজি অনুবাদের উপর নির্ভর করেছেন। এ অনুবাদ ত্রুটিপূর্ণ। স্যামুয়েল বিল পরবর্তিকালে নিজের এই অনুবাদ সংশােধনও করেছেন। অথচ কোনও কোনও ঐতিহাসিক স্যামুয়েল বিলের সেই পুরােনাে, পরিত্যক্ত অনুবাদের উপরই নির্ভর করেছেন। এ কথা সত্য, বায়ু-পুরাণে গুপ্তরাজ্যের বর্ণনায় বরেন্দ্রর উল্লেখ নেই। কিন্তু ই চিঙের সাক্ষ্য থেকে মনে হয়, বরেন্দ্রী মহারাজ গুপ্তের রাজ্যের অংশ ছিল। তবে গুপ্তদের আদি রাজ্য শুধু বরেন্দ্র বা উত্তর বাংলার চার সীমানার মধ্যে আবদ্ধ ছিল না, মগধ জনপদও সম্ভবত এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। মনে হয়, মগধ ও বরেন্দ্রী নিয়েই আদি গুপ্তরাজ্য গঠিত ছিল। গুপ্ত রাজবংশের প্রথম দু’জন রাজা গুপ্ত ও ঘটোৎকচ সম্ভবত এই অঞ্চলেই রাজত্ব করতেন। 

মহারাজাধিরাজ প্রথম চন্দ্রগুপ্ত (৩১৯-৩৩৫/৫০ খ্রি.)

লিচ্ছবিদের সাথে সম্পর্ক : মহারাজ ঘটোৎকচের মৃত্যুর পর তার পুত্র প্রথম চন্দ্রগুপ্ত আনুমানিক ৩২০ খ্রিস্টাব্দে পৈতৃক সিংহাসনে আরােহণ করেন। গুপ্ত রাজবংশের প্রথম মহারাজাধিরাজ তিনিই। বাহুবল ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়ে তিনি ক্ষুদ্র পৈতৃক রাজ্যটির আয়তন অনেকখানি বর্ধিত করেন। তার সময় থেকেই গুপ্তরাজ্যের প্রকৃত অভ্যুত্থান শুরু হয়। লিচ্ছবিকন্যা কুমারদেবীর পাণিগ্রহণ প্রথম চন্দ্রগুপ্তের জীবনের একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা। তিনি এবং তার পুত্র সমুদ্রগুপ্ত উভয়েই লিচ্ছবিদের সঙ্গে আত্মীয়তার উপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরােপ করেছেন। লিচ্ছবিদের সঙ্গে তার বিশেষ সম্পর্কের কথা স্মরণ করে চন্দ্রগুপ্ত এক ধরনের স্বর্ণমুদ্রা প্রচলন করেন। অনেকে মনে করেন সমুদ্রগুপ্ত তার পিতা ও মাতার ঐতিহাসিক বিবাহকে স্মরণ করে এই মুদ্রাগুলো উৎকীর্ণ করেছিলেন। বিদেশি রাজারা স্মারক মুদ্রা প্রচলন করলেও কোনও ভারতীয় রাজা স্মারক মুদ্রা উৎকীর্ণ করেছেন বলে জানা যায় না। সমুদ্র গুপ্ত এই মুদ্রাগুলো উৎকীর্ণ করলে তিনি অবশ্যই তার নাম উল্লেখ করতেন। কিন্তু এই শ্রেণির মুদ্রায় সমুদ্রগুপ্তের নামােল্লেখ নেই। যাই হোক, এই স্বর্ণমুদ্রার একদিকে রয়েছে চন্দ্রগুপ্ত ও কুমারদেবীর দণ্ডায়মান মূর্তি ও নাম, অন্যদিকে রয়েছে লিচ্ছবিদের নাম। সমুদ্রগুপ্ত তাে সদম্ভে নিজেকে লিচ্ছবিদৌহিত্র বলে ঘােষণা করেছেন। আসলে লিচ্ছবিদের কাছে তারা যে ঋণী, তারা সে কথাই নানাভাবে প্রকাশ করেছেন।

লিচ্ছবিদের সাথে সম্পর্কের কারণ : অনেকের ধারণা পূর্বে গুপ্তদের কোনও সামাজিক কৌলীন্য ছিল না কিন্তু লিচ্ছবিদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপন করে তারা আভিজাত্য লাভ করেন। আভিজাত্যে উত্তরণের জন্যই গুপ্তরা লিচ্ছবিদের নিকট ঋণী ছিলেন বলে তারা মনে করেন। সমকালীন যুগে কিন্তু লিচ্ছবিদের সেরকম সামাজিক প্রতিষ্ঠা ছিল না। সমাজপতি মনু লিচ্ছবিদের ব্রাত্যক্ষত্রিয় বলে নিন্দা করেছেন। তাছাড়া গুপ্তদের যে সামাজিক হীনতার অপবাদ দেয়া হয় তা অযৌক্তিক। আসলে লিচ্ছবিদের কাছে গুপ্ত রাজারা অন্যক্ষেত্রে ঋণী ছিলেন। সে ক্ষেত্রটি হল গুপ্তরাজ্যের বিস্তার তথা রাজনীতির ক্ষেত্র। ভিনসেন্ট স্মিথ মনে করেন লিচ্ছবিরা এ সময় পাটলিপুত্রে রাজত্ব করতেন। লিচ্ছবিকন্যা কুমারদেবীকে বিবাহ করে চন্দ্রগুপ্ত পাটলিপুত্র তথা মগধের আধিপত্য লাভ করেন। কিন্তু এ সময় লিচ্ছবিরা যে পাটলিপুত্রে রাজত্ব করতেন তার কোনও প্রমাণ নেই। বরঞ্চ এ কথা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে মহারাজ গুপ্তের আমল হতেই এখানে প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। এ সময় লিচ্ছবিদের দুটি শাখা দু’টি পার্শ্ববর্তী ভূখণ্ডে রাজত্ব করত। ভূখণ্ড দুটি হল উত্তর বিহারের বৈশালী ও নেপাল। নেপালের শাসককুলের প্রতি সমুদ্রগুপ্তের উপেক্ষার মনােভাব এলাহাবাদ প্রশস্তিতে স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তাই মনে হয় চন্দ্রগুপ্তজায়া কুমারদেবী লিচ্ছবিদের বৈশালী শাখার কন্যা ছিলেন। কুমারদেবীকে বিবাহ করে চন্দ্রগুপ্ত সম্ভবত উত্তর বিহার যৌতুকস্বরূপ লাভ করেছিলেন। আবার এরূপও হতে পারে, তার শ্বশুর অপুত্রক অবস্থায় মারা গেলে উত্তর বিহার চন্দ্রগুপ্তের অধিকারভুক্ত হয়। চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে উত্তরপ্রদেশের অযােধ্যা ও এলাহাবাদ অঞ্চলেও প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। যাদের পরাজিত করে তিনি এ দু’টি অঞ্চল অধিকার করেন তাদের নাম জানা যায় না। 

গুপ্তাব্দ : চন্দ্রগুপ্তকে সাধারণত গুপ্তাব্দের প্রতিষ্ঠাতা মনে করা হয়। ৩২০ খ্রিস্টাব্দ থেকে এই অব্দের গণনা। তার রাজত্বকালের কোনও লেখ আজও আবিষ্কৃত হয়নি। ফলে তিনিই গুপ্তাব্দের প্রতিষ্ঠাতা কিনা সে সম্পর্কে সন্দেহ আছে। অনেকের মতে গুপ্তাব্দের প্রতিষ্ঠাতা সমুদ্রগুপ্ত, কারাের মতে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য। 

চন্দ্রগুপ্ত কোন বৈদেশিক শাসককে পরাজিত করেননি : চন্দ্রগুপ্ত সম্পর্কে এমন কিছু কিছু মতবাদ আছে যা এক কথায় ভ্রান্ত। কখনও কখনও বলা হয়ে থাকে, শকদের পরাজিত করে তিনি নাকি মগধে তিন শতক ব্যাপী বৈদেশিক শাসনের অবসান ঘটান। শকদের বিরুদ্ধে চন্দ্রগুপ্তের অস্ত্রধারণের সপক্ষে কোনও প্রমাণ নেই। এমনও বলা হয়ে থাকে, কৌমুদীমহােৎসব নাটকে যে চণ্ডসেনের উল্লেখ আছে সেই চণ্ডসেন আসলে প্রথম চন্দ্রগুপ্ত। কৌমুদীমহােৎসবের চণ্ডসেন একজন খলনায়ক। মহারাজ সুন্দরবৰ্মা চণ্ডসেনকে নিজের পালিতপুত্র বলে গ্রহণ করেন। পরে অকৃতজ্ঞ চণ্ডসেন তার পালকপিতাকে হত্যা করে লিচ্ছবিদের সহায়তায় মগধের সিংহাসন অধিকার করেন। এই লিচ্ছবিদের এক কন্যাকে চণ্ডসেন বিবাহ করেন। কিন্তু এত করেও শেষরক্ষা হল না। অল্পদিনের মধ্যেই যুবরাজ কল্যাণবর্মা মন্ত্রী মন্ত্রগুপ্ত ও সেনাপতি কুঞ্জরকের সাহায্যে অনধিকারী চণ্ডসেনকে মগধ হতে বিতাড়িত করেন। চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকৈশীর পুত্রবধূ বিজয়ভট্টারিকার লেখা ‘কৌমুদীমহােৎসব’ অনেক পরবর্তী যুগের রচনা। এ নাটক আর যাই হােক, ইতিহাস নয়। চণ্ডসেনের রাজ্যপ্রাপ্তি ও রাজ্যচ্যুতির ঘটনার সঙ্গে চন্দ্রগুপ্তের জীবনের কোনও মিল নেই। ভবিষ্যোত্তর-পুরাণে চন্দ্রগুপ্ত সম্পর্কে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। এই গ্রন্থে বলা হয়েছে চন্দ্রগুপ্ত তার পুত্র সমুদ্রগুপ্তের হাতে প্রাণ হারান। ভবিষ্যোত্তর-পুরাণের এসব তথ্যকে পণ্ডিতরা ১৯শ শতকের সংযােজন বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন।

উত্তর বিহার, অযোধ্যা ও এলাহাবাদ অধিকার : প্রথম চন্দ্রগুপ্ত যে একজন যােগ্য রাজা ছিলেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কখনওবা কৌশলে, কখনওবা বাহুবলের আশ্রয়ে, তিনি উত্তর বিহার, অযােধ্যা ও এলাহাবাদ তঞ্চল অধিকার করেন। পরবর্তিকালে সমুদ্রগুপ্তদ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত গুপ্তরাজ্যের পরিধি আরও বর্ধিত করেন। কিন্তু গুপ্তসাম্রাজ্যের বুনিয়াদ প্রথম চন্দ্রগুপ্তই নির্মাণ করেন।

মৃত্যু ও উত্তরাধিকার মনোনয়ন : চন্দ্রগুপ্ত কতদিন রাজত্ব করেছিলেন, তা বলা যায় না। সম্ভবত ৩৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তার রাজত্বের অবসান হয়। মৃত্যুর পূর্বে তিনি পুত্র সমুদ্রগুপ্তকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী রূপে মনােনীত করেন। অনেকে ধারণা করেন, সমুদ্রগুপ্তকে তিনি শুধু উত্তরাধিকারী মনােনীত করেন নি, তার অনুকূলে সিংহাসনও ত্যাগ করেন।

মহারাজাধিরাজ সমুদ্রগুপ্ত (৩৩৫/৫০-৩৭৫ খ্রি.)

সিংহাসনে অধিকার নিয়ে কাচের সাথে দ্বন্দ্ব : চন্দ্রগুপ্ত ও কুমারদেবীর পুত্র সমুদ্রগুপ্ত গুপ্তবংশের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা। গুপ্তরাজ্য বিস্তারের যে উদ্যম চন্দ্রগুপ্ত গ্রহণ করেন তাকে আরও উজ্জীবিত ও অর্থবহ করেন সমুদ্রগুপ্ত। সারাজীবনব্যাপী যে কর্মযজ্ঞের তিনি আয়ােজন করেন তার এক চিত্তাকর্ষক বর্ণনা আছে তারই এক পদস্থ কর্মী হরিষেণের লেখা এলাহাবাদ স্তম্ভলেখে। হরিষেণের সাক্ষ্য থেকে মনে হয় সমুদ্রগুপ্তের মনােনয়ন নিয়ে রাজপরিবারে তীব্র মতানৈক্য দেখা দেয়। সাধারণত পিতার সিংহাসনের উপর জ্যেষ্ঠ পুত্রেরই অধিকার থাকে। কিন্তু সমুদ্রগুপ্ত সম্ভবত তার পিতার জ্যেষ্ঠপুত্র ছিলেন না। তাই সিংহাসনের জন্য পিতা তাকে মনােনীত করলে তার ভাইদের অনেকে ক্রুদ্ধ হন এবং সদলে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করেন। এই বিদ্রোহের যিনি নায়ক তার নাম সম্ভবত কাচ। মনে হয় কাচ প্রথম চন্দ্রগুপ্তের জ্যেষ্ঠপুত্র ছিলেন। এলাহাবাদ স্তম্ভলেখে এই বিদ্রোহের ইঙ্গিত আছে কিন্তু সেখানে কাচের নাম নেই। কিছু স্বর্ণমুদ্রায় কাচের নাম উৎকীর্ণ দেখা যায়। অর্থাৎ এই মুদ্রাগুলো কাচই প্রচলন করেন। মুদ্রাগুলোর বিপরীত পৃষ্ঠে লেখা রয়েছে সর্বরাজোচ্ছেত্তা কথাটি, যা নিঃসন্দেহে কাচের বিশেষণ। তিনি সাধারণ রাজা নন, অশেষ পরাক্রমশালী রাজা, এই কথাটিই তিনি বােঝাতে চেয়েছেন। কাচের মুদ্রার সঙ্গে গুপ্ত রাজাদের মুদ্রার অদ্ভুত সাদৃশ্য রয়েছে। আর তার মুদ্রাগুলোও পাওয়া গেছে গুপ্ত মুদ্রার সঙ্গে। সেকারণে তাকে একজন গুপ্তরাজ বলেই মনে হয়। তিনি সম্ভবত সমুদ্রগুপ্তের জ্যেষ্ঠভ্রাতা ছিলেন। চন্দ্রগুপ্ত তার ন্যায্য দাবি উপেক্ষা করলে তিনি বলপূর্বক পিতৃসিংহাসন অধিকার করেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সমুদ্রগুপ্ত তাকে পরাজিত করে নিজেকে সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। অর্থাৎ পিতার সমর্থন সত্ত্বেও সমুদ্রগুপ্ত সিংহাসনে বসতে পারেননি, কাচ তথা বিদ্রোহী ভাইদের পরাজিত করে তিনি সিংহাসন দখল করেন।

কাচকে নিয়ে পণ্ডিতদের ভিন্ন মত : তবে সমুদ্রগুপ্তের মনােনয়নকে কেন্দ্র করে গুপ্তরাজপরিবারে অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখা দেয়, এ মত সকলে স্বীকার করেন না –

  • রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন কাচ সমুদ্রগুপ্তের ভাই ঠিক, তবে তার প্রতিদ্বন্দ্বী নন। তার মতে প্রথম চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে কুষাণদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কাচ প্রাণ হারান। পরে সিংহাসনে আরােহণ করে সমুদ্রগুপ্ত মূত ভ্রাতার স্মরণে তার নামাঙ্কিত স্বর্ণমুদ্রা উৎকীর্ণ করেন। তিনি আরও মনে করেন কাচ নামাঙ্কিত মুদ্রার বিপরীত পৃষ্ঠে সর্বরাজোচ্ছেত্তার কথা আছে তিনি প্রকৃতপক্ষে সমদ্রগুপ্ত। বিদেশি রাজারা ভারতের মাটিতে রে স্মারক মুদ্রা প্রচলন করতেন তার বেশ কিছু প্রমাণ আছে। কিন্তু কোনও ভারতীয় রাজা স্মারক মুদ্রা চালু করেছেন বলে জানা যায় না।
  • কেউ কেউ মনে করেন কাচ সমুদ্রগুপ্তের ভাই নন, কোনও এক প্রতিদ্বন্দ্বী রাজপরিবারের সদস্য। সমুদ্রগুপ্তের দক্ষিণ ভারত অভিযানের সময় তার অনুপস্থিতির সুযােগ নিয়ে তিনি পাটলিপুত্রের গুপ্তসিংহাসন অধিকার করেন কিন্তু পরে গুপ্তরাজের হাতে পরাজিত হন।
  • আবার অনেকের ধারণা, এই কাচ আর কেউ নন, স্বয়ং সমুদ্রগুপ্ত। তাদের মতে কাচই সমুদ্রগুপ্তের আসল নাম, পরে যখন তিনি আসমুদ্র বিস্তৃত রাজ্যের অধীশ্বর হন তখন সমুদ্রগুপ্ত নাম ধারণ করেন। এসব মতের সমর্থনে যে কোনও নিশ্চিত প্রমাণ নেই, তা বলা বাহুল্য।
  • কাচের পরিচয় সম্পর্কে আরও কয়েকটি অভিমত ব্যক্ত হয়েছে। কাশীপ্রসাদ জায়সওয়াল, দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকর ও অনন্ত সদাশিব অলতেকর মনে করেন, কাচই আসলে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের বড় ভাই রামগুপ্ত। তাদের ধারণা, রামগুপ্তেরই আর এক নাম কাচ। সমুদ্রগুপ্তের জ্যেষ্ঠ পুত্রের আসল নাম ছিল কাচ কিন্তু লিপিকরদের অনবধানতায় তা রামগুপ্ত হয়েছে, এমন সম্ভাবনার কথাও তাদের মনে হয়েছে।
  • অজন্তার সপ্তদশ গুহালেখে কাচ নামে একজন স্থানীয় রাজার নামােল্লেখ আছে। এ কথাও বলা হয়ে থাকে, এই কাচ। গৃহযুদ্ধের সময় সমুদ্রগুপ্তকে প্রভূত সাহায্য করেন আর গুপ্ত সম্রাট কৃতজ্ঞচিত্তে কাচ-এর নামে এই শ্রেণির স্বর্ণমুদ্রা উৎকীর্ণ করেন।
  • আবার সুবর্ণমুদ্রার কাচ আর মহারাজ গুপ্তের পুত্র ঘটোৎকচ একই ব্যক্তি, এমন অভিমতও প্রচলিত আছে। বলা বাহুল্য, মতগুলো যথেষ্টই দুর্বল।

বিদিশা, মথুরা, কান্তিপুরী ও পদ্মাবতীর নাগ রাজারা : সে যাই হােক, সিংহাসনে আরােহণের সঙ্গে সঙ্গে যে সমুদ্রগুপ্ত রাজ্যবিস্তারে মনােনিবেশ করেন তা এক প্রকার নিশ্চিত। কিন্তু তার রাজ্য জয়ের আলোচনার পূর্বে তদকালীন বিদিশা, মথুরা,কান্তিপুরী ও পদ্মাবতীর নাগ রাজাদের সম্পর্কে কিছু কথা বলে নেয়া যাক। পুরাণ থেকে জানা যায়, গুপ্ত রাজারা যখন ভারতের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হন তখন বিদিশা, মথুরা, কান্তিপুরী, পদ্মাবতী প্রভৃতি স্থানে নাগ রাজারা রাজত্ব করতেন।

  • মথুরা : পুরাণে আরও বলা হয়েছে মথুরায় সাতজন এবং পদ্মাবতীতে ন’জন নাগ রাজা রাজত্ব করতেন। মথুরা আগে কুষাণদের দখলে ছিল। ১৭৬ খ্রিস্টাব্দে শেষ কুষাণরাজ প্রথম বাসুদেবের মৃত্যুর পর কুষাণশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। পশ্চিম ও মধ্য ভারতের শক ক্ষত্রপরা প্রথম কণিষ্কের অধীনস্থ ছিলেন কিন্তু ধীরে ধীরে তারা কার্যত স্বাধীন হয়ে বসেন, উত্তরপ্রদেশ ও রাজস্থানের নানা স্থানে যৌধেয়, আর্জুনায়ন প্রভৃতি স্বাধীন গণরাজ্য গড়ে ওঠে, আর মথুরায় নাগশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
  • পদ্মাবতী : পদ্মাবতী আধুনিক পদম পাওয়া গ্রাম। গ্রামটি মধ্যপ্রদেশের শিবপুরী জেলায় অবস্থিত।
  • কান্তিপুরী : বর্তমান কুটোয়াল বা কুটোয়ার গ্রাম প্রাচীন কান্তিপুরী।

বিদিশা, মথুরা, পদম পাওয়া ও কুটোয়ার-সব কটি স্থান থেকেই প্রচুর নাগমুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। মুদ্রায় উল্লিখিত রাজাদের মধ্যে আছেন বৃষভ (বৃষনাগ), ভীমনাগ, স্কন্দনাগ, বৃহস্পতিনাগ, ব্যাঘ্ৰনাগ, দেবনাগ, গণপতিনাগ, বিভুনাগ, বসুনাগ, প্রভাকরনাগ, ভবনাগ ও রবিনাগ। পণ্ডিতেরা মুদ্রাগুলোর গঠন, ধরন, প্রতীক, লেখের ব্যবহার, ওজন ইত্যাদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত করেছেন বিদিশা, মথুরা, কান্তিপুরীর নাগ রাজারা একই বংশােদ্ভব ছিলেন। অর্থাৎ এসব অঞ্চল জুড়ে একটাই রাজ্য ছিল; সে রাজ্যের প্রধান কেন্দ্র ছিল পদ্মাবতী, অন্য দুটি কেন্দ্র ছিল মথুরা ও কান্তিপুরী। বিদিশার কোনও রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল না, ছিল বাণিজ্যিক গুরুত্ব। বাকাটক লেখে যাদের ভারশিব বলা হয়েছে, অনেকের মতে তারা এই নাগরাই। মনে রাখা দরকার, মথুরা, কান্তিপুরী ও পদ্মাবতীর নাগরা একই বংশােদ্ভব হতে পারেন কিন্তু খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতকের একেবারে গােড়ার দিকে উত্তর ভারতে যে একাধিক নাগরাজ্য ছিল, সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ স্তম্ভলেখে তার প্রমাণ আছে। এই লেখে গণপতিনাগ ও নাগসেন নামে আরও দু’জন নাগ রাজার নামােল্লেখ আছে। তাছাড়া উল্লেখ আছে অচ্যুত, নাগদত্ত ও নন্দির মতাে আরও কয়েকটি নাম যাদের প্রায় সকলেই নাগরাজ বলে চিহ্নিত করেছেন। গুপ্তসম্রাট সমুদ্রগুপ্ত অনেক নাগ রাজাদের পরাজিত করেছেন। বিজিত নাগ রাজাদের তালিকায় আছেন গণপতি নাগ, নাগসেন, অচ্যুত ও নন্দি। গণপতিনাগ সম্ভবত পদ্মাবতীর অধীশ্বর ছিলেন, নাগসেন ছিলেন মথুরার রাজা (হর্ষচরিত গ্রন্থে নাগসেনকে পদ্মাবতীর রাজারূপে আখাত করা হয়েছে। অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র সরকার মনে করেন, গণপতিনাগ ও নাগসেন পর পর পদ্মাবতীর সিংহাসনে আরােহণ করেন কিন্তু সমুদ্রগুপ্ত তা উভয়কেই পরাজিত করেন)। অচ্যুত অহিচ্ছত্রে রাজত্ব করতেন। এরা সকলেই রাজ্যচ্যুত হন। কিন্তু সমুদ্রগুপ্ত যে সকল নাগরাজ্য ধ্বংস করেন তা মনে হয় না সমুদ্রগুপ্তের বধূমাতা কুবেরনাগা এক নাগ রাজপরিবারের কন্যা ছিলেন। স্কন্দগুপ্তের আমলে সর্বনাগ নামে এক পদস্থ রাজপুরুষ গঙ্গা-যমুনা দোয়াবের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। সর্বনাগ সম্ভবত এক অনুগত নাগ রাজপরিবারের সদস্য ছিলেন।

সমুদ্রগুপ্তের প্রথম আর্যাবর্ত অভিযান : সমুদ্রগুপ্তের রাজ্যবিস্তারের কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে এলাহাবাদ স্তম্ভলেখে। হরিষেণের বর্ণনায় ঘটনার পারম্পর্য যথাযথ অনুসৃত হয়েছে বলে প্রায় সকল ঐতিহাসিকই মনে করেন। এলাহাবাদ স্তম্ভলেখে প্রথমে আর্যাবর্ত অর্থাৎ উত্তর ভারতের তিনজন রাজার বিরুদ্ধে সমুদ্রগুপ্তের বিজয়ের কথা বলা হয়েছে। তার পরে রয়েছে সমুদ্রগুপ্তের দক্ষিণাপথ জয়ের বর্ণনা। তারও পরে আবার আছে সমুদ্রগুপ্তের আর্যাবর্ত জয়ের বর্ণনা। এর থেকে মনে হয়, প্রথমে আর্যাবর্তের গােটা তিনেক রাজ্য জয় করে সমুদ্রগুপ্ত একেবারে দক্ষিণ ভারতে চলে যান। দক্ষিণ ভারতে তার দীর্ঘদিন উপস্থিতির সুযােগে আর্যাবর্তের অন্যান্য রাজারা অরক্ষিত গুপ্তরাজ্য আক্রমণের উপক্রম করেন। খবর পেয়ে সমুদ্রগুপ্ত আর্যাবর্তে প্রত্যাবর্তন করে শত্রু রাজগণকে চূর্ণ করেন। সমুদ্রগুপ্তের দ্বিতীয় আর্যাবর্ত অভিযানের ফলেই উত্তর ভারতে নিরঙ্কুশ গুপ্ত আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম আর্যাবর্ত অভিযানে সমুদ্রগুপ্ত যাদের পরাজিত করেন তারা হলেন অচ্যুত, নাগসেন এবং কোতবংশীয় জনৈক রাজা।

  • অচ্যুত : অচ্যু নামাঙ্কিত কিছু তামার মুদ্রা উত্তরপ্রদেশের বেরিলী জেলায় আবিষ্কৃত হয়েছে। অচ্যুত এবং অচ্যু সম্ভবত একই ব্যক্তি, নাগসেন সম্ভবত নাগবংশীয় রাজা ছিলেন। মনে হয় তিনি মথুরার রাজা ছিলেন। মথুরায় তার মুদ্রা পাওয়া গেছে। কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন উত্তরে মথুরা থেকে দক্ষিণে বিদিশা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলের তিনি অধিপতি ছিলেন। এ মত সম্ভবত ঠিক নয়। 
  • কোতরাজ : যে কোতরাজকে সমুদ্রগুপ্ত পরাজিত করেছেন এলাহাবাদ স্তম্ভলেখে তার উল্লেখ আছে, কিন্তু নাম দেয়া হয়নি। কোতরাজ সম্ভবত উচ্চ গাঙ্গেয় অববাহিকায় রাজত্ব করতেন।

অনেকের বিশ্বাস, অচ্যুত, নাগসেন এবং কোতরাজ একযােগে সমুদ্র গুপ্তকে আক্রমণ করেন কিন্তু গুপ্তরাজ কৌশাম্বীর যুদ্ধে তাদের পরাজিত করেন। এ মতের সপক্ষে কোনও প্রমাণ নেই। সমুদ্রগুপ্তের প্রথম আর্যাবর্ত অভিযানের ফলে এলাহাবাদের পশ্চিমে গুপ্তাধিপত্য বিস্তার লাভ করে।

সমুদ্রগুপ্তের দক্ষিণ ভারত অভিযান : তারপর সমুদ্রগুপ্ত দক্ষিণ ভারত অভিযানে অগ্রসর হন। দক্ষিণ ভারত তখন অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত। সন্দেহ নেই, সেখানকার রাজনৈতিক অনৈক্য তাকে এ অভিযানে অনুপ্রাণিত করে। তাছাড়া সমুদ্রগুপ্তের দক্ষিণ ভারত অভিযানের অর্থনৈতিক কারণও ছিল। সেসময় ভারতের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এই বাণিজ্যে দক্ষিণ ভারতের বন্দরগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। গুপ্ত রাজ্যের আর্থিক বুনিয়াদ সুদৃঢ় করার স্বার্থে এই বন্দরগুলোর উপর গুপ্তদের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ জরুরি হয়ে দেখা দেয়। এলাহাবাদ স্তম্ভলেখে গুপ্ত রাজার দক্ষিণ ভারত অভিযান প্রসঙ্গে সর্বপ্রথম কোসল অর্থাৎ ছত্তীসগঢ়ের রায়পুর ও বিলাসপুর অঞ্চল এবং ওড়িশার সম্বলপুর অঞ্চলের উল্লেখ আছে। এ থেকে মনে হয়, মেদিনীপুর ও বালেশ্বরের পথে নয়, ছত্তীসগঢ়ের পথে সমুদ্রগুপ্ত দক্ষিণ ভারতে প্রবেশ করেন। দক্ষিণ ভারতের যেসব রাজা সমুদ্রগুপ্তের হাতে পরাজয় বরণ করেন তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লিখিত রাজারা হচ্ছেন –

  • কোসলরাজ মহেন্দ্র : যে কোসলের অধিপতি মহেন্দ্র সেই কোসল নিঃসন্দেহে দক্ষিণ কোসল বা মহাকোসল। ছত্তীসগঢ়ের রায়পুর ও বিলাসপুর এবং ওড়িশার সম্বলপুর জেলা নিয়ে এ রাজ্যটি গঠিত ছিল।
  • মহাকান্তারের অধিপতি ব্যাঘ্ররাজ : অনেকের মতে মহাকান্তার রাজ্যটি বুন্দেলখণ্ডে অবস্থিত ছিল। কিন্তু বিন্ধ্যপর্বতমালার উত্তরে অবস্থিত বুন্দেলখণ্ডকে কোনও মতেই দক্ষিণা রাজ্য বলা যায় না। রাজ্যটি সম্ভবত ওড়িশার। কোরাপুট জেলার জয়পুর বনাঞ্চলে অবস্থিত ছিল।
  • কৌরালের নৃপতি মণ্টরাজ : কৌরাল রাজ্যের অবস্থান সঠিক জানা যায়। কেউ ওড়িশায়, আবার কেউ-বা তামিলনাড়ুতে এই রাজ্যটির অবস্থান নির্দেশ করেছেন।
  • পিষ্টপুরাধীশ মহেন্দ্রগিরি : পিষ্টপুর কোনও রাজ্যের নাম নয়, রাজধানীর নাম। অন্ধ্রপ্রদেশের গােদাবরী জেলার বর্তমান পিঠাপুরমই প্রাচীন পিষ্টপুর।
  • কোটুরের নরপতি স্বামিদত্ত : কোটুরের অবস্থান সম্পর্কে নানা মুনির নানা মত। কেউ কর্ণাটকের বেল্লারি অঞ্চলে, কেউ ওড়িশায়, আবার কেউ-বা অন্ধপ্রদেশে এর অবস্থান নির্দেশ করেছেন।
  • এরপল্লের অধীশ্বর দমন : দমনের এরণ্ডপল্ল রাজ্যটি মহারাষ্ট্রের খান্দেশে অবস্থিত ছিল বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু এ ধারণা যথার্থ নয় বলেই মনে হয়। রাজ্যটি সম্ভবত অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীকাকুলম জেলায় অবস্থিত ছিল।
  • কাঞ্চীরাজ বিষ্ণুগােপ : কাঞ্চীর রাজা বিষ্ণুগােপ একজন পল্লবরাজ ছিলেন। তার রাজধানী কাঞ্চী তামিলনাড়ুর কাঞ্চীপুরম জেলার বর্তমান কাঞ্চীপুরম।
  • অবমুক্তের মহারাজনীলরাজ : নীলরাজের অবমুক্ত রাজ্যটি কোথায় অবস্থিত ছিল তা জানা যায় না। হতে পারে অবমুক্ত পল্লবরাজ্যের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে অবস্থিত ছিল।
  • বেঙ্গীর অধীশ্বর হস্তিবর্মা : হস্তিবর্মা শালংকায়নবংশীয় রাজা ছিলেন। তার রাজধানী বেঙ্গী গােদাবরী জেলার পেডবেগিতে অবস্থিত ছিল।
  • পলক্কনৃপতি উগ্রসেন : অন্ধ্রপ্রদেশের নেল্লোর জেলায় পলক্করাজ্যের অবস্থান ছিল।
  • দেবরাষ্ট্র ভূপতি কুবের : কুবেরের রাজ্য দেবরাষ্ট্র আর আধুনিক যুগের মহারাষ্ট্র এক ও অভিন্ন বলে ভিনসেন্ট স্মিথ অভিমত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এ মত বর্তমানে পরিত্যক্ত হয়েছে। বেশির ভাগ পণ্ডিতই বিশাখাপত্তনম জেলায় দেবরাষ্ট্রের অবস্থিতির সপক্ষে মত ব্যক্ত করেছেন।
  • কুস্থলপুরাধীশ ধনঞ্জয় : ধনঞ্জয়ের কুস্থলপুর সম্ভবত তামিলনাড়ুর উত্তর আকট জেলায় অবস্থিত ছিল। ভিনসেন্ট স্মিথ মনে করেন শহরটির নাম কশস্থলপুর, কুস্থলপুর নয়। কুশস্থলপুর বলতে গুজরাতের দ্বারকা বােঝায়। এলাহাবাদ স্তম্ভলেখে কুস্থলপুর পদের পাঠ সম্পর্কে দ্বিমতের কোনও অবকাশ নেই।

দক্ষিণে অভিযানের সীমাবদ্ধতা : উপরে বর্ণিত রাজ্যগুলোর ভৌগােলিক অবস্থান হতে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়। লক্ষণীয়, সব কটি রাজ্যই দক্ষিণ ভারতের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত। এ কথা ঠিক, কোনও কোনও পণ্ডিত এই রাজ্যগুলোর কয়েকটিকে দক্ষিণ ভারতের পশ্চিম প্রান্তে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু সমুদ্রগুপ্তকে দক্ষিণ ভারতের পশ্চিমপ্রান্তে যেতে হলে বাকাটক রাজ্য অতিক্রম করতে হত। কিন্তু এলাহাবাদ স্তম্ভলেখে বাকাটক রাজাদের সঙ্গে সমুদ্রগুপ্তের সংঘর্ষের কোনও উল্লেখ নেই। তাই মনে হয় দক্ষিণ ভারতের পূর্ব প্রান্তেই সমুদ্রগুপ্ত তার বিজয় অভিযান পরিচালনা করেন, বাকাটক রাজশক্তির সঙ্গে তিনি কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হননি। দ্বিতীয়ত, উপরের রাজ্যগুলোর মধ্যে কুস্থলপুর ও কাঞ্চীই সর্ব দক্ষিণে অবস্থিত। অর্থাৎ দক্ষিণ ভারত অভিযানে সমুদ্রগুপ্ত উত্তর তামিলনাড়ু পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন, কাবেরী নদী অতিক্রম করে আরও দক্ষিণে অগ্রসর হননি। 

পরাজিত করার পরও অনেক অঞ্চল দখল না করার কারণ : দক্ষিণা রাজারা সমুদ্রগুপ্তের হাতে পরাজিত হয়েও শেষ পর্যন্ত কিন্তু রক্ষা পেয়ে যান। এলাহাবাদ স্তম্ভলেখে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে, সমদ্রগুপ্ত দক্ষিণ ভারতীয় রাজাদের পরাজিত ও বন্দি করেন কিন্তু অনুগ্রহবশত তাদের মুক্তি দেন। মনে হয়, বশ্যতাস্বীকারের প্রতিশ্রুতিতে সমুদ্রগুপ্ত পরাজিত রাজাদের স্ব স্ব পদে বহাল রাখেন। অর্থাৎ রাজারা হতমান হলেন কিন্তু সিংহাসনচ্যুত হলেন না। দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্যগুলোকে সমুদ্রগুপ্ত নিজের রাজ্যভুক্ত করলেন না কেন, তার অবশ্যই কারণ আছে। অনেকের ধারণা প্রথম দিকে সফল না হলেও দক্ষিণ ভারতীয় রাজারা শেষ পর্যন্ত সমুদ্রগুপ্তকে পরাজিত করেন। ফলে প্রায় শূন্যহাতে গুপ্ত রাজাকে উত্তর ভারতে প্রত্যাবর্তন করতে হয়। কিন্তু দক্ষিণ ভারতের রাজারা যে সমুদ্রগুপ্তকে পরাভূত করেছিলেন তার সমর্থনে কোনও নির্ভরযােগ্য তথ্য নেই। মনে হয় সমুদ্রগুপ্তের দীর্ঘদিন দক্ষিণ ভারতে উপস্থিতির সুযােগে উত্তর ভারতের রাজারা গুপ্তরাজ্য আক্রমণের উপক্রম করেন। সম্ভবত এই আক্রমণ প্রতিহত করতে দক্ষিণ ভারত বিজয় অসম্পূর্ণ রেখেই সমুদ্রগুপ্তকে উত্তর ভারতে প্রত্যাবর্তন করতে হয়। এছাড়া আর একটি সম্ভাব্য কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে। রাজধানী পাটলিপুত্র থেকে দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্যগুলোর দূরত্ব বড় কম ছিল না। এসব দূরবর্তী অঞ্চল যে বেশিদিন নিজের কর্তৃত্বে রাখা যাবে না দূরদর্শী সমুদ্রগুপ্তের তা না বােঝার নয়। এসব ভেবেই তিনি শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ ভারতীয় রাজাদের স্ব স্ব পদে বহাল রাখেন। এলাহাবাদ স্তম্ভলেখে সমুদ্রগুপ্তের দক্ষিণ ভারত অভিযানের বর্ণনা পড়লে কালিদাসের রঘুবংশে রঘুর দিগ্বিজয়ের কথা স্মরণে আসে। সমুদ্রগুপ্ত যেমন দক্ষিণা রাজাদের পরাজিত করেও তাদের রাজ্য অধিগ্রহণ করেননি তেমনি মহারাজ রঘুও মহেন্দ্র অঞ্চলের অধিপতিকে পদানত করেও তার রাজ্য তাকে প্রত্যর্পণ করেন : গৃহীত-প্রতিমুক্তস্য স ধর্মবিজয়ী নৃপঃ ।/ শিয়ং মহেন্দ্রনাথস্য জহার ন তু মেদিনীম্। বলা বাহুল্য, সমুদ্রগুপ্তের অনুকরণে কালিদাস এখানে রঘুর চরিত্র অঙ্কন করেছেন।

আর্যাবর্তে দ্বিতীয় অভিযান : আর্যাবর্তে দ্বিতীয় অভিযানকালে সমুদ্রগুপ্ত রুদ্রদেব, মতিল, নাগদত্ত, চন্দ্রবর্মা, গণপতিনাগ, নাগসেন, অচ্যুত, নন্দি এবং বলবর্মাকে পরাজিত করেছেন বলে হরিষেণ দাবি করেছেন।

  • নাগসেন ও অচ্যুত : উল্লিখিত রাজগণের মধ্যে নাগসেন এবং অচ্যুতকে সমুদ্রগুপ্ত প্রথম আর্যাবর্ত অভিযানেও পরাজিত করেছিলেন। অনেকের অভিমত, প্রথম আর্যাবর্ত অভিযানে নাগসেন এবং অচ্যুত পরাজিত হয়েছিলেন কিন্তু উচ্ছেদ হননি, সমুদ্রগুপ্ত দ্বিতীয় অভিযানে তাদের ধ্বংস করেন। আবার কোনও কোনও পণ্ডিতের মতে প্রথম অভিযানেই সমুদ্রগুপ্ত এদের উচ্ছেদ করেন এবং এলাহাবাদ স্তম্ভলেখে তাদের দ্বিতীয়বার উল্লেখ পুনরুক্তি মাত্র। প্রথম আর্যাবর্ত অভিযানেই সে নাগসেন এবং অচ্যুত উচ্ছেদ হন, তা এলাহাবাদ স্তম্ভলেখে প্রায় স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত হয়েছে। তাই মনে হয়, আর্যাবর্তে দ্বিতীয় অভিযানকালে সমুদ্রগুপ্ত অচ্যুত ও নাগসেন বাদে অন্যান্য সকলকে পরাজিত করেন।
  • রুদ্রদেব : সমুদ্রগুপ্তের হাতে পরাজিত রুদ্রদেবকে কখনও বাকাটকরাজ রুদ্রসেন এবং কখনওবা পশ্চিমা ক্ষত্রপ দ্বিতীয় রুদ্রদামা বা তার পুত্র তৃতীয় রুদ্রসেন বলে শনাক্ত করা হয়। সেসময় বাকাটক রাজারা আর্যাবর্তে রাজত্ব করতেন না, রাজত্ব করতেন আধুনিক মহারাষ্ট্র অঞ্চলে। সমুদ্রগুপ্ত যে পশ্চিমা ক্ষত্রপরাজ্য জয় করেননি তা সুনিশ্চিত। ফলে রুদ্রদেবকে কোনও বাকাটকরাজ বা পশ্চিমা ক্ষত্রপশাসক বলে ভাবার কোনও যুক্তিসংগত কারণ নেই। বস্তুত রুদ্রদেবের প্রকৃত পরিচয় আজও অজানা রয়ে গেছে।
  • মতিল ও নাগদত্ত : মতিল বা নাগদত্ত সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না।
  • চন্দ্রবর্মা : পশ্চিম বাংলার বাঁকুড়া অঞ্চলের রাজা ছিলেন চন্দ্রবর্মা। শুশুনিয়া পাহাড়ের গায়ে তার একখানি লেখ খােদিত আছে। এলাহাবাদ স্তম্ভলেখের চন্দ্রবর্মা রাজস্থানে রাজত্ব করতেন, এরকম একটি মতও প্রচলিত আছে। কিন্তু এ মত অনেকেই সমর্থন করেন না।
  • গণপতিনাগ : গণপতিনাগ নাগবংশীয় রাজা ছিলেন। মথুরা, বিদিশা প্রভৃতি স্থানে তার মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। অনেকে মনে করেন, সমুদ্রগুপ্তের হাতে নাগসেনের পরাজয়ের পর তিনি মথুরা-বিদিশা অঞ্চলে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। এ মত সম্ভবত ঠিক নয়। খুব সম্ভব গণপতিনাগ পদ্মাবতী অর্থাৎ মধ্যপ্রদেশের শিবপুরী অঞ্চলের অধীশ্বর ছিলেন।
  • নাগসেন : নাগসেন মথুরার রাজা ছিলেন।
  • নন্দি : নন্দি কোন অঞ্চলের রাজা ছিলেন, তা জানা যায় না। তিনি সম্ভবত নাগবংশােদ্ভব ছিলেন।
  • বলবর্মা : আর্যাবর্তের আর এক নৃপতি বলবর্মা সম্পর্কেও কিছু জানা যায় না।

দক্ষিণ ভারতে সমুদ্রগুপ্ত যে নীতি গ্রহণ করেছিলেন আর্যাবর্তের ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম ঘটল। এখানে তিনি শত্রু রাজাদের পরাজিত করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি তাদের সমূলে উচ্ছেদ করেন। ফলে গুপ্তসাম্রাজ্য পূর্বে পশ্চিম বাংলা থেকে পশ্চিমে পাঞ্জাবের পূর্ব সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হল।

আটবিক রাজ্য জয় : আর্যাবর্তের রাজাদের পরাজিত করে সমুদ্রগুপ্ত বিন্ধ্য-অঞ্চলের আটবিক রাজগণের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন। এই অঞ্চলে তিনি প্রভূত সাফল্য অর্জন করেন। এলাহাবাদ স্তম্ভলেখে দাবি করা হয়েছে আটবিক রাজারা গুপ্ত রাজার পরিচারকের বৃত্তি গ্রহণ করেন। (পরিচারকীকৃত-সর্ব-আটবিক-রাজস্য)। এলাহাবাদ স্তম্ভলেখের এই উক্তি থেকে মনে হয় রাজ্যচ্যুত আটবিক রাজারা স্ব স্ব অঞ্চলে গুপ্তসম্রাটের অধীনে প্রশাসকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। আটবিক রাজ্যগুলো অধিকার করার ফলে গুপ্তরাজ্য দক্ষিণে নর্মদা নদী পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। দেখা যাচ্ছে, উত্তর ও পশ্চিম বাংলা, ঝাড়খণ্ড, বিহার, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশের কিয়দংশ নিয়ে গঠিত বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড মহারাজাধিরাজ সমুদ্রগুপ্তের প্রত্যক্ষ শাসনাধীন ছিল।

প্রত্যন্ত ও গণরাজ্য : এছাড়া এলাহাবাদ স্তম্ভলেখে সমুদ্রগুপ্তের অধীনস্থ অনেক করদ রাজ্যের উল্লেখ আছে। করদ রাজ্যগুলোকে হরিষেণ প্রত্যন্তরাজ্য ও গণরাজ্য এই দুটি ভাগে ভাগ করেছেন। প্রত্যন্তরাজ্য পাঁচটি – সমতট, ডবাক, কামরূপ, নেপাল ও কর্তৃপুর –

  • সমতট : প্রত্যন্ত রাজ্য সমতট মােটামুটিভাবে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের বদ্বীপ নিয়ে গঠিত ছিল।
  • ডবাক : কোনও কোনও পণ্ডিত ডবাকের অবস্থান অসমের নওগাঁও জেলায় নির্দেশ করেছেন। আবার কখনও উত্তর বাংলায়, কখনওবা ঢাকায় এই রাজ্যটির অবস্থান নির্দেশ করা হয়।
  • কামরূপ : অসমের বর্তমান কামরূপ – বরপেটা অঞ্চলই প্রাচীন কামরূপ।
  • নেপাল : প্রাচীন নেপালই বর্তমান নেপাল দেশ।
  • কর্তৃপুর : পাঞ্জাবের জলন্ধর অঞ্চলে কর্তৃপুরের অবস্থান ছিল। অনেকে মনে করেন, কুমায়ুন, গাড়ােয়াল ও রােহিলখণ্ড কর্তৃপুরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। 

গণরাজ্য ৯টি – মালব, আর্জুনায়ন, যৌধেয়, মদ্র, আভীর, প্রার্জুন, সনকানীক, কাক ও খরপরিক –

  • মালব : পূর্ব রাজস্থানের মেবার, টংক, কোটা প্রভৃতি স্থানে মালবরা রাজত্ব করতেন।
  • আর্জুনায়ন : আর্জুনায়নরা জয়পুর ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে রাজত্ব করতেন।
  • যৌধেয় : যমুনা ও শতদ্রু নদীর মধ্যবর্তী ভূখণ্ডে যৌধেয়রা রাজত্ব করতেন।
  • মদ্র : চন্দ্রভাগা ও ইরাবতী নদীর মধ্যবর্তী ভূভাগ মদ্রদের শাসনাধীন ছিল। প্রাচীন শাকল বা বর্তমানের শিয়ালকোট ছিল তাদের রাজধানী।
  • আভীর : বিদিশা ও ঝাসির মধ্যবর্তী অঞ্চলে আভীররাজ্য অবস্থিত ছিল।
  • প্রার্জুন : নরসিংগড় ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ছিল প্রার্জুনদের শাসনভুক্ত।
  • সনকানীক : গ্বালিয়র অঞ্চল নিয়ে সনকানীক রাজ্য গঠিত ছিল।
  • কাক : সাঁচী ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ছিল কাকদের অধীন। প্রাচীনকালে সাঁচী শহরটি কাকনাদবােট নামে পরিচিত ছিল।
  • খরপরিক : খরপরিকরা সম্ভবত মধ্য প্রদেশের দামাে অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। 

এই রাজ্যগুলো থেকে সমুদ্রগুপ্ত সব রকমের কর আদায় করতেন আর রাজ্যগুলোর রাজা বা প্রশাসকেরা কখনও কখনও পাটলিপুত্রের রাজদরবারে উপস্থিত হয়ে গুপ্ত রাজার প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করতেন। দেখা যাচ্ছে, সমুদ্রগুপ্তের অধীনস্থ করদরাজ্যগুলো মােটামুটিভাবে হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল, পাঞ্জাব, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা ও অসমে অবস্থিত ছিল। এসব অঞ্চলকে কোনওমতেই সমুদ্রগুপ্তের প্রত্যক্ষ শাসনাধীন বলে চিহ্নিত করা যায় না। রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন, উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে বিন্ধ্য এবং পশ্চিমে লাহাের-কর্ণাল থেকে পূর্বে দক্ষিণ পূর্ব অংশ ছাড়া প্রায় সমগ্র বাংলা পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখণ্ড সমুদ্রগুপ্তের প্রত্যক্ষ শাসনাধীন ছিল। করদ রাজ্যগুলোকে এখানে ভুলক্রমে সমুদ্রগুপ্তের প্রত্যক্ষ শাসনাধীন অঞ্চল বলে গণ্য করা হয়েছে। (রমেশচন্দ্র মজুমদার সম্পাদিত The CIZS.sical Age (Bomaay, 1962), পৃষ্ঠা ৯)।

সমুদ্রগুপ্তের পররাষ্ট্রনীতি : যে সকল বৈদেশিক শক্তির সঙ্গে সমুদ্রগুপ্ত কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন এলাহাবাদ স্তম্ভলেখে তাদের উল্লেখ আছে। এ প্রসঙ্গে সিংহল অর্থাৎ শ্রীলঙ্কা ও অন্যান্য দ্বীপবাসিগণের সঙ্গে দৈবপুত্র-যাহি-শাহানুষাহি-শক-মুরুণ্ডদের কথা বলা হয়েছে।

  • দৈবপুত্র যাহি-শাহানুষাহি : দৈবপুত্র যাহি-শাহানুষাহি বলতে সম্ভবত উত্তর-পশ্চিম ভারতের এক বা একাধিক কুষাণ রাজাদের কথা বলা হয়েছে।
  • শক-মুরুণ্ড : ‘মুরুণ্ড’ পদের অর্থ স্বামী। ‘শক-মুরুণ্ড’-এর অর্থ শকস্বামী বা শকরাজ। সম্ভবত পশ্চিমা ক্ষত্রপদের কথা এখানে বলা হয়েছে। কিন্তু জাতি অর্থেও ‘মুরুণ্ড’ পদটি ব্যবহৃত হতে পারে। আর এ সময় আফগানিস্তানের লঘমন অঞ্চলে যে মুরুণ্ডরা বসবাস করতেন তারও প্রমাণ পাওয়া গেছে। হয়তােবা লঘমনের মুরুণ্ডদের কথাই এলাহাবাদ স্তম্ভলেখে বলা হয়েছে। তাই যদি হয়, তাহলে শক বলতে এখানে পশ্চিমা ক্ষত্রপদের বুঝতে হবে।

এলাহাবাদ স্তম্ভলেখে হরিষেণ সদম্ভে দাবি করেছেন, বৈদেশিক রাজারা সমুদ্রগুপ্তের কাছে আত্মনিবেদন করেছিলেন, তাকে কন্যাদান করেছিলেন এবং তার কাছ হতে রাজ্যপরিচালনার অনুমতিপত্র লাভ করেছিলেন। এক কথায়, বৈদেশিক রাজারা গুপ্ত রাজার সার্বভৌমত্ব বিনম্রচিত্তে স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু হরিষেণের এ দাবি অতিরঞ্জিত বলেই মনে হয় – 

  • কুষাণরাজ গ্রুমবাটেস ও কিদার : সমুদ্রগুপ্তের সমকালীন যে দুজন কুষাণ রাজার নাম জানা যায় তাদের একজন গ্রুমবাটেস, অন্যজন কিদার। তাদের কেউই সমুদ্রগুপ্তের আনুগত্য স্বীকার করেছেন বলে জানা যায় না।
  • সিংহলরাজ মেঘবর্ণ : সমুদ্রগুপ্তের সময় মেঘবর্ণ সিংহল বা শ্রীলঙ্কায় রাজত্ব করতেন। তিনি যে গুপ্ত রাজার অনুগত ছিলেন তারও কোনও প্রমাণ নেই। বরঞ্চ চিনা পরিব্রাজক ওয়াং হিউ এন সে-এর বিবরন উভয় রাজার মধ্যে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্কের উল্লেখ আছে। কথিত আছে, সিংহলরাজ বােধগয়ায় দু’জন শ্ৰমণ পাঠান। কিন্তু সেখানে উপযুক্ত বাসস্থানের অভাবে সিংহলি ভিক্ষুদের অশেষ দুর্দশা ভােগ করতে হয়। স্বদেশি ভিক্ষুদের কষ্ট লাঘবের জন্য মেঘবর্ণ বােধগয়ায় একটি বৌদ্ধবিহার নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এই উদ্দেশ্যে সমুদ্রগুপ্তের অনুমতি চেয়ে তিনি গুপ্তরাজদরবারে উপঢৌকনসহ দূত প্রেরণ করেন। গুপ্তরাজ সানন্দে মেঘবর্ণের প্রস্তাব অনুমােদন করেন। সমুদ্র গুপ্তের দরবারে সিংহলি দৌত্যের প্রশস্তিকার হরিষেণ গুপ্তরাজের প্রতি মেঘবর্ণের আনুগত্যের অভিব্যক্তিরূপে বর্ণনা করেছেন।

বৈদেশিক রাজারা সমুদ্রগুপ্তের সঙ্গে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেন ঠিকই কিন্তু তাদের বন্ধুত্বকে আনুগত্য বলে ব্যাখ্যা করা যায় না।

অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান : দিগ্বিজয়ের শেষে সমুদ্রগুপ্ত একটি অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন। এলাহাবাদ স্তম্ভপ্রশস্তিতে এই যজ্ঞের কোনও উল্লেখ নেই। এটি নিঃসন্দেহে সমুদ্রগুপ্তের রাজত্বের একেবারে শেষের দিকের ঘটনা। বাকাটকরানি প্রভাবতীগুপ্তার পুণা স্তম্ভলেখে সমুদ্রগুপ্তকে ‘অনেক-অশ্বমেধ-যাজী’ বলা হয়েছে। ফলে সমুদ্রগুপ্ত একাধিক অশ্বমেধ যজ্ঞ অনুষ্ঠান করেন বলে কেউ কেউ মত প্রকাশ করেছেন। লক্ষ করবার বিষয়, গুপ্তলেখমালায় এ ধরনের কোনও উক্তি নেই। সমর্থনসূচক তথ্যের অভাবে পুণা স্তম্ভলেখের বক্তব্যের উপর বেশি গুরুত্ব আরােপ করা ঠিক নয়। যে অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান বহুদিন ধরে বন্ধ ছিল সমুদ্রগুপ্ত পুনরায় তার প্রচলন করেন বলে গুপ্তলেখমালায় বার বার দাবি করা হয়েছে। কিন্তু সমুদ্রগুপ্তের পূর্বে অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল মনে করা ভুল। সমুদ্রগুপ্তের সামান্য কিছুকাল পূর্বে বাকাটকরাজ প্রথম প্রবরসেনও সাড়ম্বরে অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছিলেন। ভারশিব রাজারাও যে অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়ােজন করেছিলেন বাকাটকলেখে তার সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে। এসব ঘটনা সম্ভবত গুপ্তদের স্মরণে ছিল। সে যাই হােক, অশ্বমেধ যজ্ঞ উপলক্ষে সমুদ্রগুপ্ত বিশেষ এক ধরনের স্বর্ণমুদ্রা প্রচলন করেন। এসব মুদ্রায় তার নাম নেই কিন্তু অভিধা ‘পরাক্রম’ উৎকীর্ণ আছে।

বহুমুখী প্রতিভা : সমুদ্রগুপ্ত কেবল দূরদর্শী রাজনীতিজ্ঞ বা সমরনিপুণ রাজা নন, তিনি নানা গুণে গুণী এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। তার বহুমুখী প্রতিভার এক চিত্তাকর্ষক বর্ণনা আছে এলাহাবাদ স্তম্ভলেখে। তার কোমল হৃদয়, দীনজনে দয়া, দান-ধ্যান (অনেক-গােশত-সহস্র-প্রদায়ী), বিদগ্ধ মন, গান্ধববিদ্যায় পারদর্শিতা ও কাব্যপ্রতিভার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন হরিযেণ। কবিকুলে তিনি রাজা, কবিরাজ (প্রতিষ্ঠিত-কবিরাজ-শব্দ)। দুঃখের বিষয়, তার লেখা কোনও কাব্যগ্রন্থ আজও আবিষ্কৃত হয়নি। হরিষেণের বক্তব্যে অত্যুক্তি আছে সন্দেহ নেই তবু একে সর্বৈব মিথ্যা বলে অগ্রাহ্য করা যায় না। সমুদ্রগুপ্তের বীণাবাদন মূর্তিসম্বলিত স্বর্ণমুদ্রায় তার শিল্পী মনের পরিচয় সুস্পষ্টরূপে ফুটে উঠেছে। তার বিদ্যোৎসাহিতার পরােক্ষ সমর্থন আছে বৌদ্ধসূত্রে। বৌদ্ধসূত্র থেকে জানা যায় জনৈক গুপ্তরাজ প্রখ্যাত বৌদ্ধ দার্শনিক বসুবন্ধুকে তার মন্ত্রীর পদে নিযুক্ত করেন। বসুবন্ধুর আবির্ভাবকাল সম্পর্কে মতভেদ আছে। আধিকাংশ পণ্ডিতের ধারণা খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতকের মাঝামাঝি সময় তিনি লােকান্তরিত হন। এ মত সত্য হলে স্বীকার করতে হয়, অন্য কোনও গুপ্তরাজ নন, স্বয়ং সমুদ্রগুপ্ত বসুবন্ধুর পৃষ্ঠপােষক ছিলেন।

মৃত্যু : সমুদ্রগুপ্ত মােটামুটি দীর্ঘদিন রাজত্ব করেছেন বলা যায়। ৩৮১ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ মথুরা স্তম্ভলেখ থেকে জানা যায় তার পুত্র দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ৩৭৬ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরােহণ করেন। এরই অব্যবহিত পূর্বে সমুদ্রগুপ্তের দেহান্তর ঘটে।

মূল্যায়ন : সমুদ্রগুপ্ত নিঃসন্দেহে প্রাচীন ভারতের এক উল্লেখযােগ্য নরপতি। বীর্যবত্তার সঙ্গে রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও বিবিধ মানবিক গুণের সমন্বয় ঘটেছিল তার চরিত্রে। তার বহুমুখী গুণাবলির জন্য ভিনসেন্ট স্মিথ তাকে নেপােলিয়ন বােনাপার্টের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কিন্তু সাফল্য যদি কোনও ব্যক্তির বিচারের মাপকাঠি হয়, তাহলে এ তুলনা অর্থহীন হয়ে পড়ে। এক জন সফল ব্যক্তিত্ব; অন্যজন ভাগ্যাহত, পরাজিত নায়ক।

রামগুপ্ত-সমস্যা

সমুদ্রগুপ্তের মৃত্যুর পর কে গুপ্তসিংহাসনে আরােহণ করেন সে সম্পর্কে ঐতিহাসিক মহলে মতদ্বৈধ রয়েছে। অনেকের মতে সমুদ্রগুপ্তের মৃত্যুর অব্যবহিত পর তার পুত্র দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য গুপ্তসিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। আবার কোনও কোনও পণ্ডিতের অভিমত, সমুদ্রগুপ্তের তিরােধানের পর তার জ্যেষ্ঠপুত্র রামগুপ্ত পিতৃসিংহাসন অলংকৃত করেন। দু’টি মতেরই পক্ষে ও বিপক্ষে অনেক কিছু বলার আছে।

রামগুপ্ত নামে সমুদ্রগুপ্তের জ্যেষ্ঠপুত্রের কথা জানা যায় ভােজের লেখা ‘শৃঙ্গারপ্রকাশ’ এবং রামচন্দ্র ও গুণচন্দ্রের লেখা ‘নাট্যদর্পণ’ গ্রন্থ দু’খানি থেকে। গ্রন্থ দু’খানিতে কয়েকটি উদ্ধৃতি ব্যবহৃত হয়েছে। এই উদ্ধৃতিগুলো বিশাখদত্তের ‘দেবী-চন্দ্রগুপ্তম’ নাটক থেকে নেওয়া হয়েছে। নাটকটি বর্তমানে পাওয়া যায় না। উদ্ধৃতিগুলো থেকেই আমরা নাটকটির কথা জানতে পারি, আর জানতে পারি নাট্যকারের নাম। উদ্ধৃতিগুলোকে পর পর সাজালে নাটকটির বিষয়বস্তু সম্পর্কে মােটামুটি একটা ধারণা করা যায়।

রামগুপ্তের বিধবাপত্নী ধ্রুবদেবী বা ধ্রুবস্বামিনীর সঙ্গে তার দেবর দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের বিবাহ এই নাটকের প্রতিপাদ্য বিষয়। সমুদ্রগুপ্তের মৃত্যুতে তার জ্যেষ্ঠপুত্র রামগুপ্ত গুপ্তরাজ্যের অধীশ্বর হন। তার রাজত্বকালে জনৈক শকরাজ গুপ্তরাজ্য আক্রমণ করেন। শত্রুর হাতে রামগুপ্ত শােচনীয়ভাবে পরাজিত হন। রাজ্যরক্ষার অন্য কোনও উপায় না দেখে তিনি আক্রমণকারীর হাতে নিজের পত্নীকে সমর্পণ করতে মনস্থ করেন। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বড় ভাই-এর কাপুরুষােচিত কাজে তীব্র আপত্তি জানান। কিন্তু রামগুপ্ত তার সংকল্পে অটল থাকেন। দাদাকে যখন কিছুতেই নিরস্ত করা গেল না, তখন দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ধ্রুবদেবীর ছদ্মবেশে সদলে শক শিবিরে গমন করেন। তার সঙ্গীরা সকলেই মহিলাদের বেশে তার অনুগমন করেন। সেখানে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত চাতুর্যের সঙ্গে শকরাজকে হত্যা করেন। দলপতি নিহত হওয়ায় শকসৈন্যরা পলায়ন করেন। এভাবে অনিবার্য ধ্বংসের হাত থেকে গুপ্তরাজ্য রক্ষা পেল। এই ঘটনায় সকলে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের প্রশংসা করলেও রামগুপ্ত অনুজের প্রতি ঈর্ষান্বিত হন, প্রাণরক্ষার তাগিদে চন্দ্রগুপ্তকে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়। পরে সৈন্য সংগ্রহ করে তিনি জ্যেষ্ঠভ্রাতার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন। রামগুপ্ত পরাজিত ও নিহত হন। চন্দ্রগুপ্ত সিংহাসন দখল করেন। শুধু তাই নয়, ভ্রাতজায়া ধ্রুবদেবীর তিনি প্রাণিগ্রহণ করেন। ‘দেবী-চন্দ্রগুপ্তম’ নাটকের এই কাহিনীর সত্যতা সম্পর্কে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছে। এই সন্দেহ যে একেবারে অমূলক, তা বলা যায় না –

  • প্রথমত, দেবী-চন্দ্রগুপ্তম’ একটি নাটক, ইতিহাসগ্রন্থ নয়।
  • দ্বিতীয়ত, গুপ্তলেখমালায় যে বংশতালিকা আছে তাতে রামগুপ্তের নয় নেই, উপরন্তু দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তকে সমুদ্রগুপ্তের উত্তরাধিকারী রূপে বর্ণনা করা হয়েছে।
  • তৃতীয়ত দেবর তার বিধবা ভ্রাতৃজায়াকে বিবাহ করবেন, এমন ঘটনা সাধারণদৃষ্টিতে ভারতীয় ঐতিহ্যের পরিপন্থী। তেমনি সমুদ্রগুপ্তের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এক অখ্যাত শক রাজার আক্রমণে শক্তিশালী গুপ্তরাজ্য ভেঙে পড়বে, এমন ঘটনাও প্রায় অবিশ্বাস্য।

এসব কারণে সিলভ্যা লেভি, হেমচন্দ্র, রায়চৌধুরী, দীনেশচন্দ্র সরকার প্রমুখ খ্যাতনামা ঐতিহাসিকেরা ‘দেবীচন্দ্রগুপ্তম’ নাটকের কাহিনীর ঐতিহাসিকতা সম্পর্কে গভীর সংশয় প্রকাশ করেছেন। হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী তাে স্পষ্টই বলেছেন, অশােকাবদান বা মুদ্রারাক্ষস-এর মতাে গ্রন্থের ভিত্তিতে যেমন মৌর্যযুগের ইতিহাস রচনা করা যায় না, তেমনি দেবীচন্দ্রও গুম’ নাটকের সাক্ষ্যের ওপর নির্ভর করে গুপ্তপর্বের চালচিত্র আঁকা অসম্ভব।

‘দেবী-চন্দ্রগুপ্তম’ নাটকের বক্তব্যকে কাল্পনিক বলে অগ্রাহ্য করার যত চেষ্টাই হােক না কেন রামগুপ্তের ঐতিহাসিকতা সম্পর্কে বােধহয় আজ আর কোনও প্রশ্ন করা চলে না। মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশের কয়েকটি স্থানে রামগুপ্ত নামাঙ্কিত বেশ কিছু তামার মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। এই মুদ্রাগুলোর সঙ্গে ও মুদ্রার সাদৃশ্য সহজেই নজরে পড়ে। তাছাড়া মহারাজাধিরাজ রামগুপ্তের নামাঙ্কিত তিনটি জৈল মূর্তিলেখ বিদিশায় আবিষ্কৃত হয়েছে। বাণভট্ট, শংকরার্য ও রাজশেখরের লেখা থেকেও ধ্রুবদেবীর প্রতি জনৈক শক রাজার আকর্ষণ, মহিলার ছদ্মবেশে চন্দ্রগুপ্তের শর্করাজকে হত্যা ও ভ্রাতৃজায়ার সম্মান রক্ষায় তার আন্তরিক প্রচেষ্টার কথা জানা যায়। একজন গুপ্ত রাজার উল্লেখ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রকুটরাজ প্রথম অমােঘবর্ষের সঞ্জান স্তম্ভলেখে বলা হয়েছে তিনি ভাইকে হত্যা করে তার রাজ্য ও পত্নী হরণ করেন। (হত্বা ভ্রাতরমের রাজ্যমহরদ্দেবীং চ দীনস্তথা।/ লক্ষং কোটিমলেখয়ৎ কিল কলৌ দাতা স গুপ্তান্বয়ঃ।। Epigraplia Indica, XVIII, পৃষ্ঠা ২৪৮)। রামগুপ্ত যে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের বড় ভাই ছিলেন এসব তথ্যে তা স্পষ্ট হয়। 

দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত যে তার বিধবা ভ্রাতৃবধূ ধ্রুবদেবীকে বিবাহ করেছিলেন, তাও বােধহয় অস্বীকার করা যায় না। বর্তমানে অনভিপ্রেত বলে বিবেচিত হলেও প্রাচীন ভারতে জ্যেষ্ঠ ভায়ের বিধবা স্ত্রীর সঙ্গে তার দেবর অর্থাৎ স্বামীর অনুজের বিবাহের প্রচলন ছিল। যাজ্ঞবল্ক্য ও নারদের স্মৃতিতে এর প্রমাণ আছে। গ্রন্থ দুটিতে ‘পুনর্ভূঃ’ ও ‘পৌনৰ্ভবঃ পদের উল্লেখ আছে। যে মেয়েদের পাণিগ্রহণ করা হয়েছে কিন্তু কোনও কারণে বিবাহ অনুষ্ঠানটি সম্পূর্ণ হতে পারেনি, যে স্ত্রী কুল ত্যাগ করেছেন কিন্তু পরে স্বামীর গৃহে ফিরে এসেছেন এবং স্বামীর মৃত্যুতে যে মহিলা তার দেবর বা পতির অন্য কোনও নিকট আত্মীয়কে বিবাহ করেছেন, এরূপ তিন ধরনের স্ত্রীলােকদের ‘পুনর্ভূঃ’ বলা হয়। অর্থাৎ জ্যেষ্ঠ ভায়ের বিধবা স্ত্রীর সঙ্গে দেবরের বিবাহ যে এক সময় ভারতে প্রচলিত ছিল তারই সমর্থন মেলে স্মৃতিশাস্ত্রে “পুনর্ভুঃ” কথাটির ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। এদের সন্তানদের সমাজ স্বীকার করে নিয়েছিল। “পৌনৰ্ভবঃ” শব্দের অর্থ পুনর্ভর সন্তান। 

প্রশ্ন জাগে, রামগুপ্ত কি সারা গুপ্তরাজ্যের রাজা ছিলেন, না গুপ্ত-অধিকৃত মধ্যপ্রদেশের প্রলেপাল ছিলেন। রামগুপ্তের কোনও স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া যায়নি, ভবিষ্যতে পাওয়া যাবে, এমন সম্ভাবনাও কম। তার লেখ বা মুদ্রার শতকরা নিরানব্বই ভাগই মধ্যপ্রদেশে পাওয়া গেছে। এর থেকে মনে হয়, সমুদ্রগুপ্তের রাজত্বকালে রামগুপ্ত মধ্যপ্রদেশের প্রদেশপাল ছিলেন কিন্তু পিতার মৃত্যর পর তিনি নিজেকে স্থানীয় অঞ্চলের সার্বভৌম রাজা বলে ঘােষণা করেন। এদিকে সমুদ্রগুপ্তের ইচ্ছানুসারে তার মৃত্যুর পর দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত পাটলিপুত্রের সিংহাসনে আরােহণ করেন। পরে সুযােগ বুঝে তিনি কোনও এক সময় জ্যেষ্ঠভ্রাতাকে পরাজিত ও নিহত করে। মধ্যপ্রদেশে নিজের অধিকার বিস্তার করেন। ভ্রাতৃবধূ ধ্রুবদেবীরও তিনি পাণিগ্রহণ করেন।

দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য (৩৮০-৪১৩/১৫ খ্রি.)

যােগ্য পিতার যােগ্য সন্তান দ্বিতীয় চন্দ্র গুপ্ত বিক্রমাদিত্য। তার রাজত্বকালেই গুপ্তরাজ্যের পরিধি সর্বোচ্চ প্রসার লাভ করে। শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নয়, সাংস্কৃতিক জগতেও তার রাজত্বকালের গুরুত্ব অপরিসীম। গুপ্তযুগের তাে বটেই, প্রাচীন ভারতেরও এক শ্রেষ্ঠ রাজা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য। মথুরায় পাওয়া একখানি স্তম্ভলেখ থেকে তার সিংহাসনে আরােহণের তারিখ জানা যায়। লেখটিতে উৰ্কীর্ণকাল সম্পর্কে দু’টি তারিখ আছে। তারিখ দুটির মধ্যে একটি গুপ্তাব্দে ও অন্যটি দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজ্যবর্ষে দেয়া হয়েছে। প্রথম তারিখটি ৬১ গুপ্তাব্দ অর্থাৎ ৩৮১ খ্রিস্টাব্দ। কিন্তু রাজ্যবর্ষের তারিখটির পাঠ সম্পর্কে পণ্ডিতরা দ্বিধাবিভক্ত। তারিখটি কারাের মতে ‘পঞ্চম’, আবার কারাের মতে ‘প্রথম’। প্রথম মতটিই অধিকতর গ্রহণীয়। অর্থাৎ ৩৮১ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্ব চতুর্থ বছর অতিক্রম করে পঞ্চম বছরে পড়েছিল। এ মত গৃহীত হলে ৩৭৬ খ্রিস্টাব্দ চন্দ্রগুপ্তের সিংহাসন আরােহণকাল বলে ধার্য করা যায়। চন্দ্রগুপ্তের আর একটি নাম দেবগুপ্ত। তাকে কখনও আবার দেবশ্রী ও দেবরাজও বলা হয়েছে। তার অন্তত দু’জন রানি, একজন ধ্রুবদেবী, অন্যজন কুবেরনাগা। দত্তদেবী তার মা।  সিংহাসনে আরােহণ করেই দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত গুপ্ত আধিপত্য বিস্তারে উদ্যোগী হন। বাহুবল তথা সামরিক অভিযান এবং বিভিন্ন রাজপরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন, এই দুটি নীতি অবলম্বন করে তিনি উদ্দেশ্যসিদ্ধির পথে অগ্রসর হন।

বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন :

  • নাগরাজবংশ : নাগরাজবংশের কন্যা কুবেরনাগাকে চন্দ্রগুপ্ত বিবাহ করেন। পুণা স্তম্ভলেখে এ ঘটনার স্পষ্ট উল্লেখ আছে। যে নাগদের সঙ্গে তিনি বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। সেই নাগরা কোন অঞ্চলে রাজত্ব করতেন, তা জানা যায় না। তবে কুষাণপশ্চিমা ক্ষত্রপদের বিরুদ্ধে নিজের শক্তিকে সংহত করার উদ্দেশ্যেই তিনি সম্ভবত নাগদের সঙ্গে মৈত্রীর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেন।
  • বাকাটক রাজপরিবার : ঠিক একই উদ্দেশ্যে তিনি বাকাটক রাজপরিবারের সঙ্গেও পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। কুবেরনাগার গর্ভজাতকন্যা প্রভাবতীগুপ্তার সঙ্গে তিনি বাকাটকরাজ দ্বিতীয় রুদ্রসেনের বিবাহ দেন। দ্বিতীয় রুদ্রসেন যখন মারা যান, তার দুই পুত্র দিবাকরসেন এবং দামােদরসেন তখন নাবালক মাত্র। স্বামীর অকাল মৃত্যুতে রানি প্রভাবতীগুপ্তা প্রথমে জ্যেষ্ঠ ও পরে কনিষ্ঠ পুত্রের অভিভাবিকারূপে দীর্ঘদিন বাকাটকরাজ্যের শাসনকার্য পরিচালনা করেন। দীনেশচন্দ্র সরকার মনে করেন, প্রভাবতীগুপ্তা কারাের প্রতিনিধিত্ব করেননি, তিনি স্বনামেই রাজত্ব করেছেন। তার কন্যার সময় দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত যে বাকাটকরাজ্যে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিলেন তা অনুমান করতে বিলম্ব হয় না। 
  • কদম্ব রাজপরিবার : কর্ণাটকের কদম্ব রাজপরিবারের সঙ্গেও দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত সম্ভবত বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন।
  • কুন্তলরাজের পরিবার : কদম্বলেখ থেকে জানা যায়, কুন্তলের রাজা কাকুৎস্থবর্মা তার কন্যাদের গুপ্ত ও অন্যান্য রাজপরিবারে বিবাহ দিয়েছিলেন। যে গুপ্তরাজ কলরাজকুমারীকে বিবাহ করেন তার নাম জানা যায় না। অনেকের মতে তিনি স্বয়ং দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত। আবার কারাের মতে তিনি প্রথম কুমারগুপ্ত। এভাবে বিভিন্ন রাজপরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত গুরাজবংশের প্রভাব ও মর্যাদা বৃদ্ধি করেন।

গুজরাত অধিকার ও অন্যান্য রাজ্যজয়ের সম্ভাবনা : গুজরাত থেকে পশ্চিমা ক্ষত্ৰপ তথা শক আধিপত্যের উচ্ছেদ নিঃসন্দেহে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালের এক উল্লেখযােগ্য ঘটনা। এসময় গুজরাতের ক্ষত্ৰপ ছিলেন তৃতীয় রুদ্ৰসিংহ। চন্দ্রগুপ্তের বিরুদ্ধে তিনি প্রবল প্রতিরােধ রচনা করেন। ফলে বেশ কয়েক বছর ধরে সংঘর্ষ চলে। এই উপলক্ষে চন্দ্রগুপ্ত দীর্ঘদিন সসৈন্যে মধ্যপ্রদেশে অবস্থান করেন। গুজরাত অভিযানে তাকে যারা সক্রিয়ভাবে সাহায্য করেন তাদের মধ্যে সন্ধিবিগ্ৰহিক বীরসেন শাব ও সেনাপতি আম্রকার্দবের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য। এই অভিযানে চন্দ্রগুপ্ত অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেন। গুজরাতে গুপ্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। বিজিত অঞ্চলের জন্য চন্দ্রগুপ্ত পূর্বতনক্ষত্রপ মুদ্রার অনুকরণে রৌপ্যমুদ্রা প্রবর্তন করেন। ঠিক কখন গুজরাতে গুপ্তাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় তা বলা যায় না। ৩৮৮ এবং ৪১৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী কোনও এক সময় ঘটনাটি ঘটে। দুটি কারণে চন্দ্র গুপ্তের গুজরাত জয় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

  • প্রথমত, চন্দ্রগুপ্তের বিজয়ের ফলে গুজরাতে প্রায় তিন শতক ব্যাপী ক্ষত্রপশাসনের অবসান হয়।
  • দ্বিতীয়ত, গুজরাত অধিকারের সঙ্গে সঙ্গে গুপ্তরাজ্যের পশ্চিম সীমানা আরব সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। ফলে পশ্চিমী জগতের সঙ্গে গুপ্তরাজ্যের জলপথে যােগাযােগ ঘনিষ্ঠতর হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য ও সংস্কৃতি বিনিময়ের ক্ষেত্রে এই যােগাযােগের ফল সুদূরপ্রসারী হয়েছিল। 

গুজরাত ছাড়া দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত অন্য কোনও রাজ্য জয় করেছিলেন কিনা সে সম্পর্কে কোনও স্পষ্ট ধারণা করা যায় না। দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকর মনে করেন দ্বিতীয় চন্দ্র গুপ্তের রাজত্বকালেই মথুরা ও সন্নিহিত অঞ্চল গুপ্তরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু সমুদ্রগুপ্তের শাসনকালেই এসব অঞ্চলে গুপ্তপ্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

রাজা চন্দ্র ও মেহরৌলী লৌহ স্তম্ভলেখ : দিল্লির মেহরৌলীতে এক লৌহস্তম্ভের গায়ে চন্দ্র নামে জনৈক রাজার দিগ্বিজয় বর্ণিত আছে। লেখটি সম্ভবত চন্দ্রের মৃত্যুর পর উৎকীর্ণ হয়েছিল। এই লেখে বলা হয়েছে চন্দ্র বঙ্গ অঞ্চলে সংঘবদ্ধ শত্রু রাজাদের পরাজিত করেন; উপরন্তু সিন্ধু নদ অতিক্রম করে বাহ্লিকগণকে পরাভূত করেন। এলাহাবাদ স্তম্ভলেখের সমতট ও মেহরৌলী লেখের বঙ্গ মােটামুটি একই অঞ্চল, অর্থাৎ গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের বদ্বীপ অঞ্চল। কোনও কোনও পণ্ডিত ভারতের পশ্চিম উপকূলে বঙ্গের অবস্থান নির্দেশ করেছেন। কিন্তু এ মত সম্ভবত ঠিক নয়। বাহ্লিক সম্ভবত আফগানিস্তানের বখ বা প্রাচীন ব্যাকট্রিয়া রাজ্য। অনেকে বাহিক বলতে পঞ্চনদীর দেশ পাঞ্জাবকে নির্দেশ করেন। কিন্তু পাঞ্জাবের প্রাচীন নাম বাহীক, বাহ্লিক নয়। সেসময় বাহ্লিকরাজ্য সম্ভবত কুষাণগণের অধিকারভুক্ত ছিল। মেহরৌলী স্তম্ভলেখের সাক্ষ্য হতে প্রমাণিত হয়, চন্দ্র সামান্য রাজা নন, পূর্বদিকে যেমন তিনি বঙ্গ অঞ্চলে বিজয়-অভিযান পরিচালনা করেন তেমনি উত্তর-পশ্চিমে হিন্দুকুশ পর্বতশ্রেণি অতিক্রম করে সুদূর আফগানিস্তান পর্যন্ত তিনি অগ্রসর হন। মেহরোলী লেখে রাজা চন্দ্রের পিতা বা বংশপরিচয় সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। ফলে তিনি কে, কোন বংশের সন্তান, সে সম্পর্কে পণ্ডিতরা ভিন্ন অভিমত পােষণ করেন। কেউ বলেন তিনি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, কেউ বলেন নাগবংশীয় এক রাজা, কারাের মতে তিনি প্রথম চন্দ্রগুপ্ত, আবার কেউ-বা তাকে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য বলে মনে করেন। লেখটি নিঃসন্দেহে গুপ্তযুগের। এই লেখের চন্দ্র ধর্মে বৈষ্ণব ছিলেন। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত তাে তাই। কিন্তু তার পিতামহের ধর্ম কী ছিল তা জানা যায় না। লেখটির প্রাপ্তিস্থান দিল্লি। দিল্লি দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল কিন্তু প্রথম চন্দ্রগুপ্তের রাজ্যভুক্ত ছিল না। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত চন্দ্র নামে তামার মুদ্রাও উৎকীর্ণ করেছেন। এসব কারণে মেহরোলী লেখের রাজা চন্দ্রকে দ্বিতীয় চন্দ্র গুপ্ত বলেই মনে হয়। প্রশ্ন ওঠে, সমতট বা বঙ্গ তাে সমুদ্রগুপ্তের অধীনস্থ করদরাজ্য ছিল। তাহলে দ্বিতীয় চন্দ্র গুপ্ত রাজ্যটি আবার আক্রমণ করলেন কেন? মনে হয়, সমুদ্রগুপ্তের মৃত্যুর পর বঙ্গে বিদ্রোহ দেখা দেয় কিন্তু দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিদ্রোহ দমন করে রাজ্যটিকে পুনরায় করদরাজ্যে পরিণত না করে নিজের প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে আনেন। উত্তর ও পশ্চিম বাংলা পর্বেই গুপ্তরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায়ও গুপ্ত আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হল।

গিলগিট লেখমালা ও দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত : পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের গিলগিট অঞ্চলে দেবশ্রী চন্দ্র বিক্রমাদিত্যের নামাঙ্কিত কয়েকখানি ভগ্ন ব্রাহ্মীলেখের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই চন্দ্র গুপ্তসম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য, এরূপ এক মত প্রচলিত আছে। সেক্ষেত্রে কাশ্মীরে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের প্রভুত্ব বিস্তার সুনিশ্চিত বােধ হয়। তবে গিলগিট লেখাবলির চন্দ্রের সঙ্গে গুপ্তসম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সনাক্তকরণ অনেকের কাছেই গ্রহণীয় মনে হয়নি। লক্ষণীয়, লেখসমূহে কোনও এক বিশেষ অব্দের ১৪৩তম বছরের উল্লেখ আছে। অর্থাৎ, ওই সময় চন্দ্র গিলগিট অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। তারিখটি যদি গুপ্তাব্দের হয়, তাহলে চন্দ্রের সময় দাড়ায় ৪৬৩ খ্রিস্টাব্দ। সময়টা স্কন্দগুপ্তের রাজত্বকাল। তাই গিলগিটের চন্দ্রকে গুপ্তবাজ দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বলে ভাবা অনুচিত। অনেকে এই তারিখটিকে হর্ষাব্দের ১৪৩তম বছর বলে গণ্য করেন। সেক্ষেত্রে চন্দ্র ৮ম শতকের মধ্যভাগে রাজত্ব করেন, এরূপ অনুমান সংগত বােধ হয়। চন্দ্র সম্ভবত গিলগিটের এক স্থানীয় ষাহি রাজা ছিলেন।

দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ও কিংবদন্তীর বিক্রমাদিত্য : মুদ্রা থেকে জানা যায়, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য উপাধি ধারণ করেছিলেন। অনেকেই মনে করেন কিংবদন্তীর প্রাক-খ্রিস্টীয় উজ্জয়িনীরাজ বিক্রমাদিত্যের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য উপাধি গ্রহণ করেন। কিন্তু প্রাক্-খ্রিস্টীয় যুগে উজ্জয়িনীতে বিক্রমাদিত্য নামে কোনও মহাবলী রাজা ছিলেন কিনা সে সম্পর্কে সন্দেহ আছে। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত যে উজ্জয়িনীর রাজা ছিলেন, তা নিঃসন্দেহ। কিংবদন্তীর বিক্রমাদিত্য শকদের পরাজিত করেছিলেন। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত যে শকদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করেছিলেন, তা নিশ্চিত। কথিত আছে, মহাকবি কালিদাস প্রমুখ নবরত্নরা বিক্রমাদিত্যের সভা অলংকৃত করতেন। কালিদাস গুপ্তযুগেই আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং সম্ভবত দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সভাকবি ছিলেন। এসব কারণেই মনে হয়, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তই প্রকৃত বিক্রমাদিত্য। সাধারণ জনপ্রিয় ও কীর্তিমান এই রাজাকে কেন্দ্র করে পরবর্তিকালে সত্য-মিথ্যা নানা কাহিনী রচিত হয়েছে। 

ফা শিয়েন ও মধ্যদেশ : চিনা পরিব্রাজক ফা শিয়েন দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে (আনুমানিক ৪০০-৪১১ খ্রিস্টাব্দ) ভারত পরিভ্রমণ করেন। তদানীন্তন ভারতের এক চিত্তাকর্ষক বৃত্তান্ত তিনি রেখে গেছেন। দুঃখের বিষয়, তার বৃত্তান্তে রাজনৈতিক ঘটনার বর্ণনা নেই, এমনকি যে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সাম্রাজ্যে তিনি পাঁচ বছরেরও বেশি সময় অতিবাহিত করেছেন, সেই গুপ্ত রাজার নামের উল্লেখ পর্যন্ত নেই তার ভারত-বৃত্তান্তে। তবে সাধারণ মানুষের জীবনধারা সম্পর্কে যে আলােকপাত তিনি করেছেন তা বিশেষ উল্লেখের দানি রাখে। গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত মধ্যদেশ বা উচ্চ গাঙ্গেয় অববাহিকার উল্লেখ প্রসঙ্গে ফা শিয়ে বলেন, ‘এ অঞ্চলে বহু লােকের বাস। লােকেরা সুখী। তাদের সরকারি আপিসে ব্যক্তিগত সম্পত্তি নিবন্ধভুক্ত করতে হয় না, বিচারের জন্য কোনও বিচারকের দ্বারস্থ হতে হয় না বা তার কোনও নির্দেশের অপেক্ষায়ও থাকতে হয় না। যারা রাজকীয় জমি চাষ করেন তারা উৎপন্ন ফসলের একটা নির্দিষ্ট অংশ সরকারকে খাজনা দেন। তারা স্বেচ্ছায় সরকারি জমি ছেড়ে অন্যত্র যেতে পারেন। ইচ্ছে করলেই তারা পূর্বস্থানে থেকে যেতে পারেন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে রাজাকে শিরচ্ছেদ বা অন্য কোনও কঠিন শারীরিক শাস্তির বিধান দিতে হয় না। অপরাধের গুরুত্ব অনুসারে দোষী ব্যক্তিকে গুরু বা লঘু অর্থদণ্ড দিতে হয়। রাজদ্রোহমূলক কোনও দুষ্কার্যে বার বার জড়িত হয়ে পড়লে অপরাধীর ডান হাতখানি কেটে ফেলা হয়। রাজার দেহরক্ষী ও ভৃত্যকুল সকলেই বেতন পান। সারা রাজ্যের কোথাও প্রাণিহত্যা হয় না, কেউ উত্তেজক পানীয় সেবন করেন না। পেঁয়াজ ও রসুনও কেউ ভক্ষণ করেন না। তবে চণ্ডালরা এর ব্যতিক্রম। জিনিসপত্রের বেচাকেনার কাজে লােকেরা কড়ি ব্যবহার করেন।” লক্ষ করবার বিষয়, চিনা শ্ৰমণ মধ্যদেশের সর্বত্র সুশৃঙ্খলাই দেখেছেন, কোথাও কোনও বিশৃঙ্খলা বা দস্যু-তস্করদের উপদ্রব তার নজরে পড়েনি। অথচ গুপ্তযুগে ফৌজদারি আইন ছিল যথেষ্ট উদার ও মানবিক। ফা শিয়েনের প্রায় দু’শাে বছর পর ভারতে এসেছিলেন আর এক চিনা পরিব্রাজক, শুয়েন চাঙ। তখন দেশে দণ্ডবিধি ছিল অনেক কঠোর ও নির্মম। তবু দেশের অবস্থা ছিল রীতিমতাে অরাজক। স্বয়ং শুয়েন চাঙকে একাধিক বার দস্যু-তস্করদের হাতে নিগৃহীত হতে হয়েছে। মধ্যদেশে কড়ির মাধ্যমে জিনিসপত্রের বেচাকেনা চলত, ফা শিয়েনের এ বক্তব্য ঠিক নয়। তখনকার দিনে মুদ্রারও ব্যবহার ছিল। সে যুগের ব্যবহৃত বহু তাম্র, রৌপ্য ও স্বর্ণ মুদ্রা ভারতের বিভিন্ন স্থানে আবিষ্কৃত হয়েছে। তবু ফা শিয়েনের বর্ণনায় গুপ্ত সাম্রাজ্যের যে শান্তি, সমৃদ্ধি ও পরিতৃপ্তির ছবি প্রতিফলিত হয়েছে, তা অস্বীকার করা যায় না। সন্দেহ নেই, গুপ্ত সাম্রাজ্যের এই সুশৃঙ্খল ও শান্তিময় পরিবেশ রক্ষার কাজে রাজশক্তির এক বিরাট ভূমিকা ছিল।

গুপ্ত সাম্রাজ্যের রাজধানী : সাধারণত মনে করা হয়, প্রাচীন পাটলিপুত্র নগরই ছিল গুপ্ত সাম্রাজ্যের রাজধানী। কেউ কেউ অবশ্য প্রয়াগ বা এলাহাবাদে গুপ্ত সাম্রাজ্যের রাজধানীর অবস্থান নির্দেশ করেছেন। (S. R. Goyal: A History Of The Imperial Guptas. (Allahabad, 1967).901 SS-G0: V. K. Thakur, Urbanisation in Ancient India (New Delhi, 1981). পৃ. ৩০৬-০৭)। প্রয়াগের সপক্ষে প্রধানত দু’টি যুক্তি উত্থাপিত হয়েছে : এক. সমুদ্রগুপ্তের সুবিখ্যাত এলাহাবাদ স্তম্ভলেখ প্রয়াগেই উৎকীর্ণ হয়। দুই. খ্রিস্টীয় ৭ম শতকের প্রথমার্ধে চিনা শ্ৰমণ শুয়েন চাঙের পরিদর্শনকালে পাটলিপুত্র ছিল এক পরিত্যক্ত, বিজন স্থান; তখন এর প্রাচীন গৌরবের কিছুই আর অবশিষ্ট ছিল না। খ্রিস্টায় ৪র্থ শতকের প্রারম্ভ থেকেই পাটলিপুত্রের অবক্ষয় শুরু হয়। যুক্তি দু’টি বড়ই দুর্বল। প্রথমত, যে শিলাস্তম্ভে সমুদ্রগুপ্তের লেখের উপস্থাপনা সেটির গাত্রদেশে অশােকের একখানি লেখ খােদিত আছে। কৌশাম্বীর মহামাত্রদের উদ্দেশ্যে অশােক এই লেখ উৎকীর্ণ করেন। স্পষ্ট প্রমাণিত হয়, কৌশাম্বীতে প্রতিষ্ঠিত অশােকের এই শিলাস্তম্ভেই সমুদ্রগুপ্ত তার লেখ উৎকীর্ণ করেন। পরে সম্ভবত দিল্লির সুলতান ফিরােজ শাহ এই শিলাস্তম্ভটিকে এলাহাবাদে স্থানান্তরিত করেন। দ্বিতীয়ত, গুপ্ত আমলে পাটলিপুত্রের ক্রমাবনতির সূচনা হয়, এ যক্তি তথ্যভিত্তিক নয়। চিনা পরিব্রাজক ফা শিয়েন দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে পাটলিপুত্র পরিদর্শন করেন। এই শহরের সমৃদ্ধি ও শহরবাসীদের বিপুল বৈভবের কথা তিনি মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন। কুমরাহার, বুলন্দীবাগ প্রভৃতি স্থানে উৎখননের ফলে প্রাচীন পাটলিপুত্রে গুপ্তপবীয় বিহার, দেবায়তন, তাম্রমুদ্রা, সিলমােহর, পােড়ামাটির মূর্তি ও অন্যান্য প্রত্নাবশেষের সন্ধান পাওয়া গেছে। বন্যা ও অগ্নিকাণ্ডে শহরটি বারবার বিপর্যস্ত হয়েছে তবু প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যে প্রমাণিত হয়েছে, খ্রিস্টীয় ১৭শ শতক পর্যন্ত শহরটি জন-অধ্যুষিত ছিল। (Navin Kumar : Archaeological Excavations In Bihar (Patna, 1999), পৃ. ৫০-৫৩)। প্রয়াগের সপক্ষে কোনও প্রমাণ নেই কিন্তু পাটলিপুত্রের অনুকুলে একাধিক প্রমাণ বিদ্যমান : 

  • ১. এলাহাবাদ স্তম্ভলেখে উল্লেখ আছে, সমুদ্রগুপ্তের বাল্যকাল পুষ্প নামক শহরে অতিবাহিত হয় (পুষ্পাহ্বয়ে ক্রীড়তা)। প্রাচীনকালে পাটলিপুত্র পুষ্পপুর, পুষ্পপুরী ও কুসুমপুর নামেও পরিচিত ছিল। পাটলিপুত্র গুপ্ত সাম্রাজ্যের রাজধানী, এ ধারণাই এ থেকে বদ্ধমূল হয়।
  • ২. উদয়গিরি গুহালেখে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সান্ধিবিগ্রহিক বীরসেন শাবকে পাটলিপুত্র-নিবাসী রূপে (পাটলিপুত্ৰকঃ) বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের বীরসেন শাবের মতাে এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর কর্মস্থল ছিল পাটলিপুত্র। অনুমিত হয়, পাটলিপুত্র গুপ্ত সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। 
  • ৩. কালিদাসের রঘুবংশে (৬, ২৪) পুষ্পপুরকে মগধের রাজধানীরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। 
  • ৪, কর্ণাটকের কতিপয় প্রাচীন লেখে চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যকে পাটলিপুরবরাধীশ্বর এবং উজ্জয়িনী-পুরবরাধীশ্বর বলা হয়েছে। (H. C. Raychaudhuri : Political History Of Ancient India (Calcutta, 1953). পৃ. ৫৫৬)
  • ৫. কথাসরিৎসাগরে (৭, ৪, ৩) বিক্রমাদিত্য অর্থাৎ দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তকে পাটলিপুত্রের অধীশ্বর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাকে উজ্জয়িনীরাজরূপেও বর্ণনা করা হয়েছে। 

উপরােক্ত আলােচনাদির প্রেক্ষিতে স্পষ্ট হয়, প্রয়াগ নয়, পাটলিপুত্রই ছিল গুপ্ত সাম্রাজ্যের রাজধানী। অনুমিত হয়, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের রাজত্বকালে উজ্জয়িনী নগরী গুপ্ত সাম্রাজ্যের বিকল্প রাজধানীর মর্যাদা লাভ করে।

মূল্যায়ন : প্রথম চন্দ্রগুপ্ত ও সমুদ্রগুপ্ত রাজ্যগড়ার কাজ আরম্ভ করেন কিন্তু দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত সেই আরব্ধ কাজকে পূর্ণতা দান করেন। শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নয়, গুপ্তযুগের সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশের ক্ষেত্রেও তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের জন্য দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ভারতের ইতিহাসে এক উজ্জ্বলতম স্থান অধিকার করে আছেন। 

প্রথম কুমারগুপ্ত (৪১৫-৪৫৫ খ্রি.)

৪১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৪১৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী কোনও এক সময় দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের মৃত্যু হলে তার পুত্র প্রথম কুমারগুপ্ত ও পুসিংহাসনে আরােহণ করেন। ৪৫৬ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যু হয়। মহিষী ধ্রুবদেবীর গর্ভজাত দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের এই পুত্র প্রায় ৪০ বছর রাজত্ব করেন।

রাজ্যবিস্তার (?) : প্রথম কুমারগুপ্ত তার সুদীর্ঘ রাজত্বকালে কোনও নতুন রাজ্য জয় করেছিলেন বলে মনে হয় না। নর্মদা নদীর দক্ষিণ দিকে তিনি রাজ্যবিস্তার করেছিলেন বলে কেউ কেউ অভিমত প্রকাশ করেছেন। এদের মূলত দু’টি যুক্তি। এক. একশ্রেণির স্বর্ণমুদ্রায় প্রথম কুমারগুপ্তকে ‘ব্যাঘ্র বল-পরাক্রমঃ’ বলা হয়েছে। এই মুদ্রাগুলোতে নর্মদার দক্ষিণে ব্যাঘ্র-অধ্যুষিত বনাঞ্চলে গুপ্ত রাজার অধিপত্য প্রমাণিত হয়। দ্বিতীয়ত, মহারাষ্ট্রের সাতার ও এলিচপুর অঞ্চলে প্রথম কুমারগুপ্তের বেশ কিছু রৌপ্যমুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। বলা বাহুল্য, দুটি যুক্তিই খুব দুর্বল। সমুদ্রগুপ্তও তাে ‘ব্যাঘ্র-পরাক্রমঃঅভিধা গ্রহণ করেছিলেন। তাহলে তাে বুঝতে হবে, নর্মদার দক্ষিণ দিকে গুপ্তরাজ্য বিস্তারের কৃতিত্ব সমুদ্রগুপ্তের। মহারাষ্ট্রে প্রথম কুমারগুপ্তের যে রৌপ্যমুদ্রা পাওয়া গেছে তার কোনও রাজনৈতিক তাৎপর্য আছে বলে মনে হয় না। বাণিজ্য বা তীর্থযাত্রা উপলক্ষে সম্ভবত এই মুদ্রাগুলো মহারাষ্ট্রে চলে আসে। প্রথম কুমারগুপ্তের আমলের অনেক লেখ আবিষ্কৃত হয়েছে। লেখগুলোতে তার রাজ্যজয়ের কোনও উল্লেখ নেই।

রাজ্যের আয়তন : প্রথম কুমারগুপ্ত হয়তাে কোনও নতুন রাজ্য জয় করেননি কিন্তু গুজরাত থেকে বাংলা পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল পৈতৃক রাজ্যটিকে তিনি যে পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তার সময় চিরাতদত্ত উত্তর বাংলার, ঘটোৎকচগুপ্ত তুমেইন-গ্বালিয়র অঞ্চলের এবং বন্ধুবৰ্মা মন্দসাের-উজ্জয়িনীর শাসনকর্তার পদে নিযুক্ত হন। সমকালীন এক লেখে কুমারগুপ্তকে সমুদ্রমেখলা পৃথিবীর অধিপতিরূপে বন্দনা করা হয়েছে। পিতামহ সমুদ্রগুপ্তের মতাে কুমারগুপ্ত একটি অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন। এই যজ্ঞ উপলক্ষে তিনি বিশেষ এক ধরনের সুবর্ণমুদ্রা প্রবর্তন করেন।

পুষ্যমিত্র বা যুধ্যমিত্রদের অভিযান : প্রথম কুমারগুপ্তের রাজত্বের একেবারে শেষের দিকে এক পরাক্রান্ত শত্রুবাহিনী গুপ্তরাজ্য আক্রমণ করে। তার পুত্র স্কন্দগুপ্তের রাজত্বকালে উৎকীর্ণ ভিতরী স্তম্ভলেখে এই ঘটনার বর্ণনা আছে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, যারা গুপ্তরাজ্য আক্রমণ করেছিলেন তাদের নামের সঠিক পাঠ সম্পর্কে সংশয়ের অবকাশ আছে। ফলে এ বিষয়ে বাগবিতণ্ডার সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই এদের পুষ্যমিত্ররূপে চিহ্নিত করেছেন। আবার অন্যেরা বলেন, ভিতরী অভিলেখে পুষ্যমিত্রদের কথা বলা হয়নি, বলা হয়েছে একদল শত্রুবাহিনীর কথা যাদের যুধ্যমিত্র বলে আখ্যাত করা হয়েছে। যুধি ও অমিত্র-এর সন্ধিতে হয় যুধ্যমিত্র। যুধি অর্থাৎ যুদ্ধে যারা অমিত্র বা শত্রু তারাই যুধ্যমিত্র। গুপ্তরাজ্য আক্রমণকারীদের যদি পুষ্যমিত্ররূপে চিহ্নিত করা যায়, তাহলে তাদের সম্পর্কে কিছু ধারণা করা সম্ভব। এই পুষ্যমিত্ররা সম্ভবত নাগ জাতির এক শাখা ছিলেন এবং বিন্ধ্যাঞ্চলে রাজত্ব করতেন। সে ক্ষেত্রে হয়তাে বলা চলে, শত্রুরা দক্ষিণ দিক থেকে গুপ্তরাজ্য আক্রমণ করেছিলেন। কিন্তু যদি ধরা হয়, ভিতরী অভিলেখে যুধ্যমিত্রদের কথাই বলা হয়েছে তাহলে এই শত্রুদের গতিবিধি বা পরিচয় সম্পর্কে সব কিছুই আমাদের অজানা থেকে যায়। গুপ্ত রাজবংশের প্রতিপক্ষ যারাই হােন না কেন, তারা ছিলেন অমিত শক্তির অধিকারী। যেমন ছিল তাদের সামরিক সামর্থ, তেমনি ছিল অর্থবল। তাদের দুর্বার আক্রমণ গুপ্ত রাজবংশকে ধবংসের মুখে ফেলে দেয়। বিপর্যয় ঠেকাতে স্কন্দগুপ্তকে পাঠানাে হয়। প্রথম দিকে স্কন্দগুপ্ত শত্রুদের বিরুদ্ধে বিশেষ সুবিধা করতে পারেননি। এক সময় তার অবস্থা এমন হল যে তাকে সারা রাত ভূমিশয্যায় কাটাতে হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভাগ্যলক্ষ্মী স্কন্দগুপ্তের প্রতি প্রসন্ন হন। শত্রুগণ সম্পূর্ণরূপে পরাভূত হলেন। আসন্ন বিনাশ থেকে গুপ্তরাজ্য রক্ষা পায়। ভিতরী লেখের কবি বলছেন, স্কন্দগুপ্তের বীরত্বে প্রজারা পুলকিত হলেন; বালক-বৃদ্ধ নির্বিশেষে সকলে দিকে দিকে স্কন্দগুপ্তের জয়ধ্বনি করলেন : চরিতমমলকীর্তণয়িতে যস্য শুভ্রং/ দিশি দিশি পরিতুষ্টরাকুমারং মনুষ্যেঃ।।” রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রথম কুমারগুপ্তের রাজত্বের শেষপর্বের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের এক ভিন্ন ছবি এঁকেছেন। (R. C. Majumdar (Ed), A Comprehensive History Of India, Vol. 111. Part 1 (New Delhi, 1981).) তার অভিমত, প্রথম কুমারগুপ্তের রাজত্বের শেষের দিকে যে শত্রুসৈন্য গুপ্তরাজ্য আক্রমণ করেন, তারা হূণ। তিনি মনে করেন, এই আক্রমণের ফলে গুপ্তসাম্রাজ্যের ভিত দুর্বল হয়ে পড়ে এবং পুষ্যমিত্র বা যুধ্যমিত্র জনগােষ্ঠী ও স্কন্দগুপ্তের জ্ঞাতি-ভাইরা এই সুযােগে তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেন। তার ধারণা, এই হুনরাই জুনাগড় লেখে ম্লেচ্ছ বলে বর্ণিত হয়েছেন। নানা কারণে এই অভিমত সমর্থন করা যায় না। প্রথমত, ভিতরী লেখের চতুর্থ স্তবকে পুষ্যমিত্রদের উল্লেখ আছে কিন্তু হূণদের উল্লেখ আছে এই লেখের অষ্টম স্তবকে। এর থেকে ধারণা জন্মে, পুষ্যমিত্রদের অভিযান হূণ আক্রমণের পূর্ববর্তী ঘটনা। দ্বিতীয়ত, জুনাগড় লেখ থেকে জানা যায়, পিতার মৃত্যুর পরই (পিতরি সুরসখিত্বং প্রাপ্তবতি) স্কন্দগুপ্ত ম্লেচ্ছদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। শ্লেচ্ছ জাতি ও হূণরা অভিন্ন বিবেচিত হলে হুনগণ প্রথম কুমারগুপ্তের রাজত্বকালে গুপ্তরাজ্য আক্রমণ করেছিলেন, এমন ভাবার কোনও সংগত কারণ থাকে না। 

অর্থনৈতিক বিপর্যয় : পুষ্যমিত্রদের আক্রমণের জন্য হােক বা অন্য কোনও কারণে হােক, প্রথম কুমারগুপ্তের রাজত্বের শেষের দিকে গুপ্তরাজ্যে আর্থিক অবনতি দেখা দেয়। তার রাজত্বের অন্তিমপর্বে উৎকীর্ণ রূপার প্রলেপযুক্ত মাদ্রায় এই অবক্ষয়ের ছবি প্রতিফলিত হয়েছে। মুদ্রাগুলো আসলে আমার কিন্তু রূপার প্রলেপ দিয়ে এগুলোকে খাটি রূপার মুদ্রারূপে প্রচলনের চেষ্টা হয়।

স্কন্দগুপ্ত (৪৫৫-৪৬৭ খ্রি.)

রাজপরিবারে অন্তর্দ্বন্দ্ব (?) : কুমারগুপ্তের মৃত্যুর পর তার পুত্র স্কন্দগুপ্ত ৪৫৬ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরােহণ করেন। অনেকের ধারণা, সিংহাসনের উপর তার ন্যায্য দাবি ছিল না, তিনি বলপূর্বক সিংহাসন অধিকার করেন। এই ধারণার পিছনে বেশ কয়েকটি যুক্তি আছে।

  • প্রথমত, উত্তরপর্বের লেখমালায় গুপ্তরাজবংশের তালিকায় স্কন্দগুপ্তের উল্লেখ নেই অথচ সেখানে প্রথম কুমারগুপ্তের উত্তরাধিকারী রূপে তার বৈমাত্রেয় ভাই পুরুগুপ্তের নাম আছে।
  • দ্বিতীয়ত, স্কন্দগুপ্ত তার লেখে নিজের মায়ের নাম উচ্চারণ করেননি অথচ তার পূর্বসূরিদের ক্ষেত্রে তাদের মায়েদের কথা উল্লেখ করেছেন। তার বৈমাত্রেয় ভাই পুরুগুপ্ত কিন্তু মহিষী অনন্তদেবীর পুত্র।
  • তৃতীয়ত, জুনাগড় লেখে স্কন্দগুপ্ত সম্পর্কে স্পষ্ট বলা হয়েছে, অপরাপর রাজকুমারদের দাবি উপেক্ষা করে লক্ষ্মী বা রাজলক্ষ্মী তাকে স্বেচ্ছায় পতিরূপে বরণ করেন (ব্যপেত্য সর্বান মনুজেন্দ্রপুত্রা লক্ষ্মীঃ স্বয়ং যং বরয়াং চকার)। স্কন্দগুপ্তের এক শ্রেণির স্বর্ণমুদ্রার কথাও এই প্রসঙ্গে স্মরণ করা যায়। এই মুদ্রায় তাকে রাজলক্ষ্মীর হাত থেকে অঙ্গরীয় বা মালা গ্রহণ করতে দেখা যায়।

অনেকে এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মনে করেন, প্রথম কুমারগুপ্তের মহিষীর গর্ভে নয়, অন্য কোনও পত্নী বা উপপত্নীর গর্ভে স্কন্দগুপ্তের জন্ম হয়েছিল। ফলে গুপ্তসিংহাসনের উপর তার কোনও ন্যায্য দাবি ছিল না; তিনি পিতার প্রকৃত উত্তরাধিকারী পুরুগুপ্তকে বঞ্চিত করে বলপূর্বক সিংহাসন অধিকার করেন। স্কন্দগুপ্ত বাহুবলের সাহায্যে পৈতৃক সিংহাসন অধিকার করেন, এ মত সকলে স্বীকার করেন না। তারা বলেন, স্কন্দগুপ্ত হয়তাে মহাদেবী অনন্তদেবীর পুত্র নন, কিন্তু তিনি নিঃসন্দেহে তার ভাইদের মধ্যে যােগ্যতম ছিলেন। জ্যেষ্ঠ নয়, শ্রেষ্ঠই সিংহাসনে বসবেন, গুপ্তরাজপরিবারে। প্রথম পর্বে এই রেওয়াজই ছিল। উত্তরপর্বের গুপ্তলেখমালায় স্কন্দগুপ্তের অনুল্লেখ প্রসঙ্গে তারা বলেন, লেখগুলো সবই স্কন্দগুপ্তভ্রাতা পুরুগুপ্তের পুত্র-পৌত্র-প্রপৌত্রদের রাজত্বকালে উৎকীর্ণ। ফলে স্কন্দগুপ্তের উল্লেখ সেখানে অবান্তর। জুনাগড় লেখে যাদের ‘মনুজেন্দ্রপুত্র’ বলা হয়েছে, তারা সকলে গুপ্তরাজপরিবারের সন্তান এ মত তারা স্বীকার করেন না। মনুজেন্দ্রপত্র বলতে তারা সেসব সমকালীন রাজাদের চিহ্নিত করেছেন যারা স্কন্দগুপ্তের বশীভূত ছিলেন। তারা আরও মনে করেন, জুনাগড় লেখে স্কন্দগুপ্তের সার্বভৌমত্বের দাবি আছে কিন্তু কোনও ভ্রাতৃ-কলহের ইঙ্গিত নেই। মুদ্রায় অঙ্কিত স্কন্দগুপ্তের লক্ষ্মীর হাতে অঙ্গুরীয় বা মালাগ্রহণের ছবির উল্লেখ প্রসঙ্গে তারা বলেন, যে রমণীর মূর্তি মুদ্রায় অঙ্কিত তিনি লক্ষ্মী বা রাজলক্ষ্মী নন, তিনি স্কন্দগুপ্তের মহিষী। আসলে স্কন্দগুপ্ত বলপূর্বক, না স্বাধিকারে, পৈতৃক সিংহাসনে বসেন তা এখনও সুনিশ্চিত নয়। তবু মনে হয়, প্রথম কুমারগুপ্তের মৃত্যুর অব্যবহিত পরই তিনি সিংহাসনে আরােহণ করেন। পুরুগুপ্ত হয়তাে তাকে বাধা দিয়েছিলেন কিন্তু স্কন্দগুপ্ত সে প্রতিরােধ অগ্রাহ্য করে নিজের কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করেন।

ম্লেচ্ছদের বিরুদ্ধে জয়লাভ : স্কন্দগুপ্তের সিংহাসনে আরােহণের প্রায় অব্যবহিত পরই এক প্রবল প্রতিপক্ষ গুপ্তরাজ্য আক্রমণ করে। বহিঃশত্রুর আক্রমণে গুপ্তরাজ্যের অবস্থা সঙ্গীন হয়। এই বহিরাক্রমণ প্রসঙ্গে ভিতরী লেখের প্রশস্তিকার বলেন, পিতার মৃত্যুর পর গুপ্তরাজ্যে বিপর্যয় দেখা দেয় কিন্তু স্কন্দগুপ্ত নিজের বাহুবলে শত্রুদের চূর্ণ করে সে বিপর্যয় রােধ করেন। তার মাকে যখন তিনি যুদ্ধজয়ের সংবাদ দেন তখন মায়ের দু’চোখ আনন্দাশ্রুতে ভরে ওঠে। প্রশস্তিকার বলছেন, এ যেন শত্রুদের সংহার করে কৃষ্ণের মা দেবকীর কাছে ফিরে আসা কৃষ্ণকে দেখে উদবিগ্ন দেবকীরও দু’চোখ বেয়ে জলের ধারা নেমেছিল। “পিতরি দিবমপেতে বিপ্লুতাং বংশলক্ষ্মীং/ ভুজবল-বিজিতারিঃ প্রতিষ্ঠাপ্য ভূয়ঃ।/ জিতমিতি পরিতােষান্মাতরং সাস্রনেত্রাং/ হতরিপুরিব কৃষ্ণো দেবকীমভপেতঃ।।” ভিতরী লেখের রচয়িতা এই বহিঃশত্রুদের পরিচয় সম্পর্কে সম্পূর্ণ নীরব থেকে গেছেন। কিন্তু স্কন্দগুপ্তের জুনাগড় লেখে ম্লেচ্ছ বলে যাদের উল্লেখ করা হয়েছে তারাই সম্ভবত এই বহিঃশত্রু। কারা এই ম্লেচ্ছ তা অবশ্য সুনিশ্চিতরূপে জানা যায় না। কালিদাসের রঘুবংশে রাজা রঘুর সঙ্গে যবনদের পারসিকদেশে সংঘর্ষের উল্লেখ আছে। মনে হয়, ম্লেচ্ছ ও যবন পদ দু’টির অর্থ একই। জুনাগড় লেখে যাদের ম্লেচ্ছ বলা হয়েছে তারা কুষাণ বা পারসিক। প্রথম কুমারগুপ্তের মৃত্যুর পর তারা সম্ভবত গুপ্তরাজ্য আক্রমণ করেন কিন্তু স্কন্দগুপ্ত তাদের বিতাড়িত করেন।

হূণগণের বিরুদ্ধে বিজয় : স্কন্দগুপ্তের রাজত্বের শেষপর্বে মধ্য এশিয়া থেকে শ্বেতহূণরা দুর্বার গতিতে ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। তাদের অগ্রগতি রুদ্ধ করা সহজ ব্যাপার ছিল না। শ্বেতহূণরা যেমন সাহসী ছিলেন তেমনি ছিলেন নিষ্ঠুর। তাদের নেতা এটিলা এ সময় ইউরােপে ত্রাসের সঞ্চার করেন। পূর্ব ইউরােপ বিধ্বস্ত করে তিনি সসৈন্যে রােমের উপকণ্ঠে উপনীত হন। রােমক সম্রাট তৃতীয় ভ্যালেনটিয়ান পলায়ন করে আত্মরক্ষা করেন। কিন্তু স্কন্দগুপ্ত অন্য ধাতুতে এড়া ছিলেন। তিনি সর্বশক্তি দিয়ে হূণদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং তাদের শােচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। স্কন্দগুপ্তের হাতে পরাজয়ের পর তারা পারস্য অভিমুখে অগ্রসর হন। পারস্যের রাজা নিহত হন, পারস্য তাদের পদানত হয়। (রমেশচন্দ্র মজুমদার ও দীনেশচন্দ্র সরকার অভিমত প্রকাশ করেছেন, ভিতরী লেখে উল্লিখিত হূণরাই জুনাগড় লেখে ম্লেচ্ছ বলে বর্ণিত হয়েছেন। এ মত গ্রহণ করলে বুঝতে হবে, সিংহাসনে আরােহণের অব্যবহিত পরই স্কন্দগুপ্তকে হূণদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়েছিল। ১৩৮ গুপ্তাব্দে বা ৫৫৮ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ জুনাগড় লেখে ম্লেচ্ছদের উল্লেখ আছে। সুতরাং স্কন্দগুপ্ত ৫৫৮ খ্রিস্টাব্দের পূর্ববর্তী কোনও এক সময় ম্লেচ্ছ তথা হুণদের পরাজিত করেন। কিন্তু জুনাগড় লেখের ম্লেচ্ছরাই যে ভিতরী লেখের হূণ, এ কথা এখনও জোরের সঙ্গে বলা যায় না। একই রাজার দু’টি লেখে একই জনগােষ্ঠী দুটি ভিন্ন নামে অভিহিত হবে, এ এক অস্বাভাবিক ঘটনা।) যে শ্বেতহূণরা পারস্য ও পূর্ব ইউরােপ প্রায় হেলায় জয় করলেন স্কন্দগুপ্তের কাছে তারা শােচনীয়ভাবে পরাজিত হলেন। এই বিপর্যয় তাদের মনে এমন ত্রাসের সঞ্চার করে যে স্কন্দগুপ্তের মৃত্যুর বেশ কিছুকাল পরও তারা ভারত আক্রমণের কথা আর চিন্তা করেননি। সন্দেহ নেই, হূণদের বিরুদ্ধে বিজয়লাভই স্কন্দগুপ্তের শ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব। নিজের এই সাফল্যের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের আনুকরণে বিক্রমাদিত্য উপাধি ধারণ করেন। অনেকে মনে করেন, চন্দ্রগােমীর ব্যাকরণ-গ্রন্থে হূণদের বিরুদ্ধে স্কন্দগুপ্তের বিজয়লাভের উল্লেখ আছে। ঘটমান ক্রিয়ার এক উদাহরণ প্রসঙ্গে গ্রন্থকার বলছেন, “অজয়ৎ গুপ্তা হূণান্‌”। এর অর্থ, গুপ্ত হূণদের জয় করেছে। বলা হয়, এই গুপ্ত স্কন্দগুপ্ত। দুঃখের বিষয়, ‘গুপ্তা’ – এই পাঠ সম্পর্কে সংশয় আছে। কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন, পদটির প্রকৃত পাঠ হবে ‘জতাে’, ‘জপ্তো’ বা ‘জর্তো’, ‘গুপ্তো’ নয়। এরা মনে করেন, জাঠ-এরই এক প্রতিশব্দ ‘জতাে’, ‘জপ্তো’ বা জর্তো। অর্থাৎ জাঠরা হূণদের পরাজিত করেছেন, এ কথাই এখানে বলা হয়েছে। বিষয়টি বিতর্কিত।

স্কন্দগুপ্ত ও পশ্চিম ভারত : অনেকের বিশ্বাস, তার রাজত্বের শেষের দিকে স্কন্দগুপ্ত রাজনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন এবং সাম্রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চল তার হস্তচ্যুত হয়। এই অভি মতের সমর্থনে দুটি যুক্তি উত্থাপিত হয় :

  • এক, স্কন্দগুপ্তের রাজত্বের শেষপর্বের সব কটি লেখ উত্তরপ্রদেশ এবং মধ্যপ্রদেশে পাওয়া গেছে। এই পর্বের কোনও লেখই সাম্রাজ্যের পশ্চিম প্রান্তে আবিষ্কৃত হয়নি।
  • দুই, সাম্রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলের জন্য প্রথম কুমারগুপ্ত বিভিন্ন শ্রেণির রৌপ্যমুদ্রা চালু করেন কিন্তু স্কন্দগুপ্ত তাদের কয়েকটিকে প্রত্যাহার করে নেন। 

যুক্তিগুলোর যাথার্থ্য সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ আছে –

  • প্রথমত, স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, স্কন্দগুপ্তের রাজত্বের শেষপর্বের কোনও লেখ গুজরাতে আবিষ্কৃত হয়নি। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে গুজরাত স্বাধীন হয়।
  • দ্বিতীয়ত, স্কন্দপ্ত প্রথম কুমারগুপ্তের কয়েক শ্রেণির রৌপ্যমুদ্রা প্রত্যাহার করে নেন ঠিকই কিন্তু তিনি নতুন ধরনের কিছু রৌপ্যমুদ্রাও প্রচলন করেন। এই প্রসঙ্গে তার বৃষ ও বেদি শ্রেণির মুদ্রার উল্লেখ করা যায়। মুদ্রাগুলো সম্ভবত কচ্ছ ও কাম্বে উপসাগরীয় অঞ্চলের জন্য উৎকীর্ণ হয়েছিল। গুজরাতে স্কন্দগুপ্তের প্রচুর রৌপ্যমুদ্রা আবিষ্কত হয়েছে। গুজরাতে পাওয়া স্কন্দগুপ্তের সবগুনি মুদ্রাই তার রাজত্বের প্রথম পর্বে উৎকীর্ণ হয়েছিল, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই।

তাহলে সিদ্ধান্ত করা যায়, পশ্চিমে গুজরাত থেকে পুর্বে বাংলা পর্যন্ত যে ভূখণ্ড তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেন, অসংখ্য বাধা-বিপত্তি প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তা তিনি সম্পূর্ণ অক্ষত রেখে যান। সাম্রাজ্যের অখণ্ডতা রক্ষায় তার এই সাফল্যের মধ্য দিয়ে স্কন্দগুপ্তের সমরনৈপুণ্য, রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও সংগঠন-শক্তির পরিচয় প্রতিফলিত হয়েছে।

রাজত্বের শেষপর্বে গুপ্তরাজ্যের আর্থিক অবস্থা : স্কন্দগুপ্তের রাজত্বের শেষপর্বে গুপ্তরাজ্যের আর্থিক অবস্থা ভেঙে পড়েছিল বলে অনেকে বলে থাকেন। তারা মনে করেন, সমকালীন স্বর্ণমুদ্রায় গুপ্তরাজ্যের অর্থনৈতিক দুর্গতি প্রতিফলিত হয়েছে। অস্বীকার করা যায় না, স্কন্দগুপ্ত যে স্বর্ণমুদ্রা প্রচলন করেন তা পূর্ববর্তী রাজাদের তুলনায় সংখ্যায় অল্প। এ কথাও সত্য যে তার স্বর্ণমুদ্রায় খাদের পরিমাণ বেশি। এ প্রসঙ্গে দু’টি কথা বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার –

  • প্রথমত, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বা কুমারগুপ্তের তুলনায় স্কন্দগুপ্ত অতি অল্পদিনই রাজত্ব করেছেন। সেকারণে তার স্বর্ণমুদ্রার স্বল্পতা স্বাভাবিক ঘটনা বলেই মনে হয়।
  • দ্বিতীয়ত, স্কন্দগুপ্তের মুদ্রায় খাদের পরিমাণ বেশি হলেও মুদ্রাগুলো কিন্তু ওজনে ভারী। ফলে তার মুদ্রা পূর্ববর্তী গুপ্ত রাজাদের মুদ্রার মতাে খাটি না হলেও তাতে সােনার পরিমাণ একটুকুও কমেনি। চন্দ্রগুপ্ত বা প্রথম কুমারগুপ্তের কিছু কিছু স্বর্ণমুদ্রার ওজন ১২১ গ্রেন। এই মুদ্রায় শতকরা দশভাগ খাদ। তাহলে সােনার পরিমাণ দাঁড়ায় ১০৯ গ্রেন। স্কন্দগুপ্তের বেশ কিছু মুদ্রা ১৪৪ গ্রেনের। এই মুদ্রায় খাদের পরিমাণ পঁচিশ শতাংশ। সােনার পরিমাণ দাঁড়ায় ১০৮ গ্রেন। 

স্কন্দগুপ্তের রৌপ্যমুদ্রা থেকে জানা যায় তিনি অন্ততপক্ষে ১৪৮ গুপ্তাব্দ বা ৪৬৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। 

স্কন্দগুপ্ত-পরবর্তী গুপ্তরাজগণ ও সাম্রাজ্যের অবক্ষয়

পুরুগুপ্ত (৪৬৭-৪৭৩ খ্রি.) : স্কন্দগুপ্তের পর রাজা হন তার ভাই পুরুগুপ্ত। সম্ভবত স্কন্দগুপ্তের কোনও পুত্রসন্তান ছিল না। পুরুগুপ্ত অপুত্রক স্কন্দগুপ্তের মৃত্যুর পর বিনা বাধায় সিংহাসনে আরােহণ করেন, এমন সম্ভাবনা অমূলক নয়। আবার ভাইকে বা ভ্রাতুস্পুত্রকে বিতাড়িত করে পুরুগুপ্ত পৈতৃক সিংহাসন অধিকার করেন, এমন সম্ভাবনাও একেবারে অগ্রাহ্য করা যায় না। পুরুগুপ্ত খুব বেশিদিন রাজত্ব করেছেন বলে মনে হয় না। তার কোনও অভিলেখ বা মুদ্রার কথাও জানা যায় না। প্রকাশাদিত্যের নামাঙ্কিত কিছু স্বর্ণমুদ্রার সন্ধান পাওয়া গেছে। অনেকে মনে করেন, পুরুগুপ্তই এই মুদ্রাগুলো উৎকীর্ণ করেছেন। কিন্তু পুরুগুপ্ত যে প্রকাশাদিত্য নাম বা অভিধা ধারণ করেছিলেন তা আজও প্রমাণিত হয়নি। 

দ্বিতীয় কুমারগুপ্ত (৪৭৩-৪৭৬ খ্রি.) : ৪৭৪ খ্রিস্টাব্দে বা তার কিছু পূর্বে দ্বিতীয় কুমারগুপ্ত সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। সারনাথে তার একখানি লেখ আবিষ্কৃত হয়েছে। নালন্দা ও উত্তরপ্রদেশের ভিতরী গ্রামে কুমারগুপ্তের নামাঙ্কিত লেখ পাওয়া গেছে। কিন্তু সারনাথের কুমারগুপ্ত আর নালন্দা ও ভিতরী লেখের কুমারগুপ্ত এক ব্যক্তি নন। দ্বিতীয়জন নরসিংহগুপ্ত বালাদিত্যের পুত্র। হূণরাজ মিহিরকুলের সমসাময়িক নরসিংহগুপ্ত খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকে রাজত্ব করেন। নরসিংহগুপ্ত বালাদিত্য সারনাথের কুমারগুপ্তের পিতা নন। সম্ভবত পুরুগুপ্ত সারনাথের কুমারগুপ্তের পিতা। এই কুমারগুপ্ত দ্বিতীয় কুমারগুপ্ত। নালন্দা ও ভিতরী অভিলেখে যার উল্লেখ আছে তিনি তৃতীয় কুমারগুপ্ত। রাজ্য-পরিচালনায় যে যােগ্যতা প্রয়ােজন, তা পুরুগুপ্তের বা দ্বিতীয় কুমারগুপ্তের ছিল না। রাজতন্ত্রে রাজাই প্রাণপুরুষ। রাজা দুর্বল বা শক্ত হলে বিচ্ছিন্নতাবাদ আত্মপ্রকাশ করে, রাজ্য ভেঙে পড়ে। পুরুগুপ্তের এবং দ্বিতীয় কুমারগুপ্তের রাজত্বে তাই ঘটল। প্রথম আঘাত এল গুজরাত থেকে। প্রাদেশিক শাসকদের উচ্চাভিলাষ গুপ্তসাম্রাজ্যের বিকাশের পথ রােধ করে। সেনাপতি ভটার্ককে সম্ভবত স্কন্দগুপ্ত গুজরাতের প্রদেশপালের পদে নিয়ােগ করেন। ভটার্ক গুপ্তদের প্রতি অনুগত থাকলেও তার পুত্র ও পৌত্ররা কেন্দ্রীয় শক্তির দুর্বলতার পূর্ণ সুযােগ গ্রহণ করে গুজরাতে কার্যত স্বাধীন মৈত্রক রাজ্য স্থাপন করেন। গুপ্তরাজ্য ভাঙার আন্দোলনের সেই শুরু। মধ্যপ্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলে বন্ধুবৰ্মাও স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। অথচ ভটার্ক এবং বন্ধুবৰ্মা উভয়েই অনুগত গুপ্তরাজকর্মচারী রূপে তাদের কর্মজীবন আরম্ভ করেছিলেন।

বুধগুপ্ত (৪৭৬-৪৯৫ খ্রি.) : ৪৭৭ খ্রিস্টাব্দে পুরু গুপ্তের আর এক পুত্র বুধগুপ্ত রাজা হন। দ্বিতীয় কুমারগুপ্ত অপুত্রক তাবস্থায় মারা যান, না তাকে পদচ্যুত করে বুধগুপ্ত রাজপদ লাভ করেন, তা অজ্ঞাত। স্কন্দগুপ্তের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যভাঙার যে খেলা শুরু হয়েছিল তাকে শক্তহাতে প্রতিহত করার শক্তি তার ছিল না। পশ্চিমা জগতের সঙ্গে ভারতের বহির্বাণিজ্যের অবনতি ঘটায় রাজ্যে অর্থনৈতিক সংকট ঘনীভূত হয়। অবস্থা সামাল দেয়ার ক্ষমতা তার ছিল না। গুজরাত ও পশ্চিম মধ্যপ্রদেশ পুনরুদ্ধার তাে হলই না, উপরন্তু আরও কয়েকটি অঞ্চল তার হাতছাড়া হয় –

  • বুন্দেলখণ্ডে ও বাঘেলখণ্ডে মহারাজ হস্তীর নেতৃত্বে স্বাধীন পরিব্রাজক রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়।
  • পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে জয়নাথ উচ্ছকল্পরাজ্যের পত্তন করেন।
  • পাণ্ডুবংশী উদয়ন উত্তরপ্রদেশের বান্দায় নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।
  • মধ্যপ্রদেশের রেওয়া অঞ্চলে নাগবল ও তার পুত্র ভরতবল আর একটি পাণ্ডুবংশী রাজ্য স্থাপন করেন। এই পাণ্ডুবংশী রাজ্যের উত্তর সীমান্তে মহারাজ লক্ষণের নেতৃত্বে আর একটি নতুন রাজ্য গড়ে ওঠে।
  • এমনকি মধ্যপ্রদেশের এরাণ অঞ্চলেও তার কর্তৃত্ব শিথিল হয়। সেই অঞ্চলের প্রশাসক ছিলেন সুরশ্মিচন্দ্র। সমকালীন এক অভিলেখে তাকে মহারাজ আখ্যা দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেখানে বুধগুপ্তের পরিচয় ‘ভূপতি’ মাত্র।

গাঙ্গেয় ভূভাগ তখনও বুধগুপ্তের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। উত্তরপ্রদেশের সারনাথে ও বারাণসীতে, বিহারের বিহার গ্রামে ও নালন্দায় এবং উত্তর বাংলার দামােদরপুরে বুধগুপ্তের অভিলেখ ও সিলমােহর পাওয়া গেছে। পুণ্ড্রবর্ধন-ভুক্তি তথা উত্তর বাংলার প্রশাসক ছিলেন ব্রহ্মদত্ত। তিনি নিজেকে মহারাজাধিরাজের ‘পাদ-পরিগৃহীত’ বলে বর্ণনা করেছেন। পশ্চিম ও মধ্য ভারতে গুপ্তদের রাজনৈতিক বিপর্যয় গাঙ্গেয় ভূভাগে কোনও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারেনি।

বৈন্যগুপ্ত (আনু. ৫০৭ খ্রি.) : আনুমানিক ৫০০ খ্রিস্টাব্দে বুধণ্ডপ্তের মৃত্যু হলে সম্ভবত বৈন্যগুপ্ত গুপ্তসিংহাসনে আরােহণ করেন। তার রাজত্বকালে ৫০৮ খ্রিস্টাব্দে গুণাইঘর স্তম্ভলেখ উৎকীর্ণ হয়। বুধগুপ্তের পরবর্তী কিন্তু বৈন্যগুপ্তের পূর্ববর্তী কোনও গুপ্ত রাজার নাম জানা যায় না। নালন্দা সিলমােহরে অস্পষ্ট অনরে তার পিতার নাম উল্লিখিত আছে। আনেকে মনে করেন তার পিতা পুরুগুপ্ত। বিষয়টি নিয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে। বৈন্যগুপ্ত ‘দ্বাদশাদিত্য’ অভিধা গ্রহণ করে সুবর্ণমুদ্রাও উৎকীর্ণ করেছেন। তিনি কতদিন রাজত্ব করেন তা জানা যায় না। ৫১১ খ্রিস্টাব্দের এরাণ অভিলেখে ভানুগুপ্তের উল্লেখ আছে। বৈন্যগুপ্তের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক ছিল তা আজও অজ্ঞত। অনেকের ধারণা, তিনি বৈন্যগুপ্তের পিতা ছিলেন। আবার কেউ কেউ তাকে বৈন্যগুপ্তের পুত্র বলেও চিহ্নিত করেছেন। এসব মতবাদের কোনও সদৃঢ় ভিত্তি নেই। ভানুগুপ্ত আদৌ গুপ্তসিংহাসনে আরােহণ করেছিলেন কিনা সে সম্পর্কে সংশয় আছে। যে এরাণ অভিলেখে তার উল্লেখ আছে সেখানে তাকে “বীর”, “পার্থের মত সাহসী” ইত্যাদি আখ্যা দেয়া হয়েছে কিন্তু মহারাজ বা মহারাজাধিরাজ বলা হয়নি। কোনও কোন ঐতিহাসিক তাকে এরাণের গুপ্তপ্রশাসক বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু বুধগুপ্তের রাজত্বের একেবারে শেষের দিকে হূণ নৃপতি তােরমাণ এরাণ অধিকার করেন। যে এরাণে গুপ্তাধিপত্যের অবলুপ্তি ঘটেছে সেখানে ভানুগুপ্তের গুপ্তপ্রশাসকের পদে অবস্থানের প্রশ্ন অর্থহীন।

ভারতে দ্বিতীয় হূণ অভিযান : খ্রিস্টীয় ৫ম শতকের প্রারম্ভে তােরমাণের নেতৃত্বে ভারতে নতুন করে হূণ উপদ্রব শুরু হয়। এসময় ভারতের স্বার্থে একজন শক্তিমান স্কন্দগুপ্তের প্রয়ােজন ছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে বৈন্যগুপ্ত ও ভানুগুপ্তের মতাে শাসকরা ছিলেন দেশের কর্ণধার। ফলে তােরমাণ দুর্বার গতিতে অঞ্চলের পর অঞ্চল অধিকার করেন। তার রাজত্বের প্রথম বছরে উৎকীর্ণ একখানি লেখ এরাণে আবিষ্কৃত হয়েছে। লেখটি অবশ্য তার নয়, এরাণ বা প্রাচীন ঐরিকিণ অঞ্চলের তারই অধীনস্থ স্থানীয় প্রশাসক ধন্যবিষ্ণুর। ধন্যবিষ্ণু মহারাজাধিরাজ তােরমাণের রাজত্বের প্রথম বর্ষে লেখটি উৎকীর্ণ করেন। এরাণ লেখে গুপ্তাব্দ বা শকাব্দের উল্লেখ না থাকায় তােরমাণের রাজপদ গ্রহণের তারিখ অনিশ্চিতই রয়ে গেছে। তবে তারিখটি বুধগুপ্তের রাজত্বকালীন এরাণ প্রস্তরস্তম্ভ লেখের বেশি দূরবর্তী নয়। এরাণ প্রস্তরস্তম্ভ লেখ উৎকীর্ণ হয়েছে ১৬৫ গুপ্তাব্দ বা ৪৮৫ খ্রিস্টাব্দে। সে সময় ধন্যবিষ্ণুর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা মাতৃবিষ্ণু বুধগুপ্তের অধীনে থেকে এরাণের প্রশাসনিক কার্য পরিচালনা করেছেন। এর অনতিকাল পর তােরমাণ এরাণ থেকে গুপ্তদের উচ্ছেদ করেন, মাতৃবিষ্ণুর অনুজ ধন্যবিষ্ণু স্থানীয় প্রশাসক নিযুক্ত হন। গুজরাতে পাওয়া সঞ্জেলি তাম্রশাসন থেকে জানা যায়, তােরমাণ অন্তত ১৯ বছর রাজত্ব করেন। ৫১৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মিহিরকুল যে তার পিতা তােরমাণের স্থলাভিষিক্ত হন তা প্রায় সুনিশ্চিত। অনুমিত হয়, ৪৯৫ খ্রিস্টাব্দে তােরমাণের রাজত্ব শুরু হয় তখন বুধগুপ্তের রাজত্বের অন্তিম পর্ব। পশ্চিম পাঞ্জাবের কুরা গ্রামে তােরমাণের নিজের একখানি অভিলেখের সন্ধান পাওয়া গেছে। শতদ্র ও যমুনার মধ্যবর্তী ভূখণ্ডে তার তামার মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। তােরমাণের চিত্রকূট অভিযানের ইঙ্গিত করেছেন সােমদেব সূরি। এই চিত্রকুট রাজস্থানের চিতােড় বা মন্দাকিনী নদীর তীরবর্তী মধ্যপ্রদেশের চিত্রকুট। ভারতের রাজনৈতিক অনৈক্য ও সামরিক দুর্বলতার সুযােগে তােরমাণ বিশালায়তন এক রাজ্য গড়ে তােলেন। কাশ্মীর, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশের কিয়দংশ জুড়ে এই রাজ্য গঠিত হয়। অনেকের ধারণা, তােরমাণের যা কিছু সাফল্য সবই তার রাজত্বের প্রথম পর্বে অর্জিত, শেষ জীবনে বিপর্যস্ত হয়ে তিনি সিন্ধু নদের পশ্চিমে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তারা মনে করেন, চিনা বিবরণ এবং ৫১১ খ্রিস্টাব্দের এরাণ অভিলেখে তােরমানের ভাগ্যবিপর্যয়ের ইঙ্গিত আছে। প্রাসঙ্গিক চিনা বিবরণ কিন্তু খুব একটা স্পষ্ট নয়। এরাণ অভিলেখে তােরমাণের পরাজয়ের উল্লেখ আছে, এ ধারণাও যুক্তিযুক্ত নয়। এরাণ প্রস্তর স্তম্ভলেখে ভানুগুপ্ত ও রাজা গােপরাজের সঙ্গে এক প্রবল প্রতিপক্ষের তীব্র সংঘর্যের উল্লেখ আছে। এই সংঘর্ষে গােপরাজ নিহত হন, তার পত্নী স্বামীর জুলন্ত চিতায় আত্মাহুতি দেন। তােরমাণের রাজত্বের প্রথম বছরে উৎকীর্ণ একখানি লেখ এই স্থানেই আবিষ্কৃত হয়েছে। ভানুগুপ্ত ও গােপরাজের প্রতিপক্ষ যে হূণরাজ তােরমাণ তা নিঃসংশয়ে বলা যায়। যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে লেখটিতে একটি কথাও উচ্চারিত হয়নি। ফলাফল ভানুগুপ্ত ও গােপরাজের অনুকূল হলে এই লেখে তার সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকত। প্রশ্ন ওঠে, এরাণের মতাে এক হূণ-অধিকৃত অঞ্চলে ভানুগুপ্ত সসৈন্যে উপস্থিত হন কী করে? এর একটি সন্তোষজনক ব্যাখ্যা অবশ্যই আছে। এরাণসহ মধ্যপ্রদেশের অন্যান্য অঞ্চল পূর্বে গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। হূণদের আক্রমণে কয়েকটি অঞ্চল থেকেও প্রশাসনের অবসান ঘটল, বাকি অঞ্চলসমূহে রাজনৈতিক অস্থিরতা ঘনীভূত হল। এরকম সংকটময় পরিস্থিতিতে গােপরাজ প্রমুখ কতিপয় আঞ্চলিক প্রশাসক গুপ্তসম্রাট বৈন্যগুপ্তের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন। বৈন্যগুপ্ত দেখলেন, উপদ্রুত মধ্যপ্রদেশে গুপ্তশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার উপযুক্ত সময় এসেছে। আক্রান্ত প্রশাসকদের সামরিক সাহায্য পাঠালে তারা প্রতিদানে গুপ্তদের অনাগত থাকবেন, মধ্যপ্রদেশে হূণ আধিপত্যের অবসান হবে। এই উদ্দেশ্যে ভাণুগুপ্তকে সসৈন্যে এরাণে পাঠানাে হয় কিন্তু তিনি যুদ্ধে তােরমাণ তথা হূণদের হাতে পরাজিত হন। এরাণ তথা মালবে গুপ্তাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা অন্তর্হিত হয়।

নরসিংহগুপ্ত (৪৯৫ খ্রি. – ?) : বৈন্যগুপ্তের পর সিংহাসনে আরােহণ করেন তার ভাই নরসিংহগুপ্ত বালাদিত্য। দেখা যাচ্ছে, পুরুগুপ্তের পর যে চারজন রাজা গুপ্তরাজ্যে ক্রমান্বয়ে রাজত্ব করেন তারা সম্ভবত চার ভাই ছিলেন। ইতিহাসে এরূপ ঘটনা বিরল কিন্তু এর কারণ দুর্বোধ্য নয়। গুপ্তরাজপরিবার তখন অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত। আইনের অনুশাসনে নয়, কূটবুদ্ধি ও বাহুবলেই তখন উত্তরাধিকার সম্পর্কিত প্রশ্নের মীমাংসা হত। তাই নরসিংহগুপ্ত বৈন্যগুপ্তের পর রাজপদ লাভ করেন – শুধু এ কারণে তাকে বৈন্যগুপ্তের অনুজ বলে চিহ্নিত করা সংগত নাও হতে পারে। তিনি বৈন্যগুপ্তের অগ্রজও হতে পারেন। তেমনি নরসিংহও কখন সিংহাসনে আরােহণ করেন তাও অনিশ্চিত। তবে তিনি যে হূণপতি মিহিরকুলের সমসাময়িক ছিলেন চিনা পরিব্রাজক শুয়েন চাঙের বিবরণে তা স্পষ্ট। তােরমাণের পুত্র মিহিরকুল অন্তত ১৫ বছর রাজত্ব করেন। সম্ভবত ৫১৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি সিংহাসনে আরােহণ করেন এবং ৫৩০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৫৩৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী কোনও এক সময় তার রাজত্ব সমাপ্ত হয়। মনে হয়, মিহিরকুলের রাজত্বের অবসানের পর আরও দু’এক বছর নরসিংহগুপ্ত ক্ষমতাসীন ছিলেন। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল তখন হূণদের কবলে। আনুমানিক ৫১৫ খ্রিস্টাব্দে তােরমাণ লােকান্তরিত হলে পুত্র মিহিরকুল তার স্থলাভিষিক্ত হন। মিহিরকুলের রাজত্বের ১৫শ বছরে গ্বালিয়রে উৎকীর্ণ একখানি লেখ আবিষ্কৃত হয়েছে। সমকালীন গ্রিকলেখক কসমস ইণ্ডিকো প্লেউসটিস বলেন সারা ভারত মিহিরকুলের বশ্যতা স্বীকার করেছিল। একই কথা শুয়েন চাঙও বলেছেন। মিহিরকুলের দক্ষিণ ভারত ও শ্রীলঙ্কা বিজয়ের উল্লেখ করেছেন ১২শ শতকের কাশ্মীরি ঐতিহাসিক কল্‌হণ। সারা ভারত মিহিরকুল অবশ্যই জয় করেননি। তবে পৈতৃক রাজ্যটি তিনি যে অন্তত ৫৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তার পূর্ণ কর্তৃত্বে রেখেছিলেন তা কসমস ইণ্ডিকো প্লেউসটিস-এর বর্ণনায় প্রমাণিত হয়। শুয়েন চাঙের বিবরণে উল্লেখ আছে, বালাদিত্য মিহিরকুলকে পরাজিত করেন। এই বালাদিত্য নরসিংহগুপ্ত বালাদিত্য, ভানুগুপ্ত নন। ঔলিকররাজ যশােধর্মা মিহিরকুলের বিরুদ্ধে জয়লাভের দাবি করেছেন তার মন্দসােরে পাওয়া এক অভিলেখে। মৌখরিনৃপতি ঈশানবর্মার হাতে হূণরা পরাজিত হয়েছিলেন তারও প্রমাণ আছে। ভারতীয় রাজারা একযােগে, না পৃথকভাবে, মিহিরকুল তথা তৃণদের পরাজিত করেন তা অনুমানের বিষয়। তবে প্রথম বিকল্পটির সম্ভাবনাই উজ্জ্বলতর বােধ হয়। মিহিরকুলের রাজত্ব কখন শেষ হয় তাও বিতর্কিত বিষয়। তবে ৫৩২ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ মন্দসের প্রশস্তিতে যশােধর্মার রাজ্যজয়ের বর্ণনা থেকে মনে হয় প্রশস্তিটি উৎকীর্ণ হওয়ার পূর্বেই মিহিরকুলের রাজত্বের অবসান হয়। 

ঔলিকর, মৌখরি ইত্যাদি নতুন শক্তির অভ্যুদয় ও তার প্রতিক্রিয়া : হূণসমস্যার সমাধান হল কিন্তু নতুন এক বিপদ এসে দেখা দিল। দশপুর বা মধ্যপ্রদেশের মন্দসােরের রাজা যশােধর্মা ভারতীয় রাজনীতির আকাশে ধূমকেতুর মতাে আবির্ভূত হলেন। মাত্র বছর দশেক অর্থাৎ আনুমানিক ৫৩০ হতে ৫৪০ খ্রিস্টাব্দকাল তিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন কিন্তু এই অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি সারা ভারতে তীব্র আলােড়ন সৃষ্টি করেন। মন্দসাের লেখে তিনি দাবি করেছেন অপরাজেয় মিহিরকুল তার চরণ বন্দনা করতেন (মিহিরকুলনৃপেণ-অর্চিতং পাদযুগ্মম)। ওই লেখে তিনি আরও ঘােষণা করেছেন, হূণ এবং গুপ্ত রাজারা যেসব অঞ্চল জয় করতে পারেননি সেসব অঞ্চল তার পদানত। ওই একই লেখে তিনি বলেছেন, উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে মহেন্দ্র পর্বত এবং পশ্চিমে সমুদ্র অর্থাৎ আরব সাগর থেকে পূর্বে লৌহিত্য বা ব্রহ্মপুত্র নদ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড তার করায়ত্ত। স্বকৃতিত্ব সম্পর্কে যশােধর্মা যে দাবি করেছেন তা সত্য হলে স্বীকার করতে হবে, তার আক্রমণে গুপ্তরাজ্য ধসে পড়েছিল। প্রকৃত ঘটনা কিন্তু তা নয়। প্রমাণ আছে ৫৪৪ খ্রিস্টাব্দেও উত্তর বাংলা গুপ্ত রাজ্যের অধীন ছিল। এমনকী ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে যে গুপ্তরা ওড়িশায় রাজত্ব করতেন তারও অকাট্য প্রমাণ আছে। গুপ্তরাজ্যের কিয়দংশ যশােধর্মা অধিকার করেছিলেন। ঠিকই কিন্তু সমগ্র রাজ্যটি গ্রাস করেছিলেন বলে মনে হয় না। যশােধর্মার অভ্যুত্থানে গুপ্তশক্তি যে আঘাত পেল নরসিংহগুপ্ত বা তার উত্তরাধিকারীদের পক্ষে তার প্রতিবিধান অসম্ভব হয়ে দেখা দিল। এ সময় উত্তরপ্রদেশে ও বিহারে কয়েকটি নতুন রাজনৈতিক শক্তির অভ্যুদয় ঘটল –

  • বিহারের গয়া অঞ্চলে অনন্তবর্মা এক কার্যত স্বাধীন মৌখরিরাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তার রাজত্বকালের অন্তত তিনখানি অভিলেখ আবিষ্কৃত হয়েছে কিন্তু তাদের কোনওটিতেই গুপ্ত রাজার উল্লেখ নেই।
  • প্রথমে মধ্যপ্রদেশের বাঘেলখণ্ড অঞ্চলে এবং পরবর্তিকালে উত্তরপ্রদেশে আর একটি মৌখরিরাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়। গীতবর্মা, বিজয়বর্মা, হরিবর্মা, আদিত্যবর্মা ও ঈশ্বরবর্মা – এই বংশের প্রথম পাঁচজন রাজা। তাদের সকলের অভিধা মহারাজ। গুপ্তদের প্রতি তারা অনুগতই ছিলেন। ঈশ্বরবর্মার পুত্র ঈশানবর্মা প্রথম দিকে পিতা-পিতামহদের মতাে গুপ্তদের আনুগত্য স্বীকার করলেও পরে স্বাধীনতা ঘােষণা করে মহারাজাধিরাজ পদবি ধারণ করেন।
  • মগধ অঞ্চলও মৌখরিদের অধিকারভুক্ত হয়। পূর্ব মালবে পরবর্তী গুপ্তরাও এক রাজ্য স্থাপন করেন। প্রথম প্রথম তারা গুপ্তদের অধীনতাই স্বীকার করেছেন কিন্তু গুপ্তশক্তির দুর্বলতার সুযােগে তারা ক্রমশ নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করেন।

ইতিমধ্যে নরসিংহগুপ্তের পুত্র তৃতীয় কুমারগুপ্ত সিংহাসনে আরােহণ করেন। নালন্দায় তার সিলমােহর পাওয়া গেছে। তার উৎকীর্ণ স্বর্ণমুদ্রার সাক্ষ্য হতে মনে হয় তিনি সুদীর্ঘকাল রাজত্ব করেন। ৫৪৪ খ্রিস্টাব্দের কিছু পূর্বে তার রাজত্বের অবসান হলে পুত্র বিষ্ণুগুপ্ত রাজপদ লাভ করেন। রাজ্যের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যে সাহসিকতা, দূরদর্শিতার প্রয়ােজন, তা তৃতীয় কুমারগুপ্তের বা বিষ্ণুগুপ্তের ছিল না। তাদের দুর্বলতার ফলে মৌখরি ও পরবর্তী গুপ্ত রাজাদের রাজনৈতিক প্রভাব উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পায়। মৌখরিরাজ ঈশানবর্মা ৫৫৪ খ্রিস্টাব্দের পূর্বেই উত্তরপ্রদেশ থেকে গুপ্ত আধিপত্য উচ্ছেদ করেন। ওই বছরে উৎকীর্ণ তার হরাহা লেখে তিনি অন্ধ্র বা বিষুকুণ্ডী, শুল্কি বা ওড়িশার শুদ্ধি এবং গৌড় বা বাংলার আঞ্চলিক রাজাদের বিরুদ্ধে জয়লাভের দাবি করেছেন। (হরাহা লেখে উল্লিখিত শুলিকদের পরিচয় সম্পর্কে বিদ্বজ্জনেরা আরও কয়েকটি অভিমত ব্যক্ত করেছেন।) পূর্ব-পুরুষদের মহারাজ পদবির পরিবর্তে তিনি আড়ম্বরপূর্ণ মহারাজাধিরাজ উপাধি ধারণ করেন। নিজের নামে মুদ্রাও তিনি উৎকীর্ণ করেন। প্রায় একই সময় বিহারেও গুপ্তপ্রভুত্বের অবসান হয়। বিহার থেকে মৌখরিরাজ ঈশানবর্মা গুপ্তদের উচ্ছেদে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন। আনুমানিক ৫৫২ খ্রিস্টাব্দে মহারাজ নন্দন গয়া অঞ্চলে এক নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ বাংলাও স্বাধীন হল। গােপচন্দ্র, ধর্মাদিত্য ও সমাচারদেব সেখানে ৫২৫ থেকে ৫৮০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পর পর রাজত্ব করেন। ফরিদপুর, বর্ধমান ও বালেশ্বর জেলায় এই রাজাদের অভিলেখ আবিষ্কৃত হয়েছে। মহারাজাধিরাজ উপাধিধারী সমাচারদেবের সুবর্ণমুদ্রাও পাওয়া গেছে। আয়তনে সংকুচিত হয়ে গুপ্তরাজ্য শেষ পর্যন্ত উত্তর বাংলা ও দক্ষিণ ওড়িশায় সীমাবদ্ধ হয়। ৫৪৪ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ মহারাজাধিরাজ বিষ্ণুগুপ্তের আমলের একখানি তাম্ৰলেখ উত্তর বাংলার দামােদরপুর গ্রামে আবিষ্কৃত হয়েছে। ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে অথচ গুপ্তরাজত্বকালে উৎকীর্ণ আর একখানি তাম্রলেখ গঞ্জাম জেলার সুমণ্ডল গ্রামে পাওয়া গেছে। মহারাজাধিরাজ গােপচন্দ্র সম্ভবত গুপ্ত সম্রাট বিষ্ণুগুপ্ত বা তার উত্তরাধিকারীকে পরাজিত করে উত্তর বাংলা অধিকার করেন। ৫৮০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বেই শম্ভুযশ দক্ষিণ ওড়িশায় গুপ্তরাজ্যের ধ্বংসস্তুপের উপর এক স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ভারতের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চ হতে গুপ্তরাজবংশের চিরপ্রস্থান ঘটল। সংক্ষেপে বলা যায়, গুপ্ত রাজত্বের অবক্ষয়-প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় ছিল। পশ্চিম ও মধ্য ভারতে যখন গুপ্ত শাসন অতীত কাহিনীতে পর্যবসিত, তখনও গাঙ্গেয় ভূখণ্ডে ও ওড়িশায় গুপ্ত গৌরবসূর্য দীপ্যমান। গাঙ্গেয় ভূখণ্ডে প্রথমে উত্তরপ্রদেশ ও পরে বিহার হতে গুপ্ত প্রভুত্ব অবলুপ্ত হয়। ৫৫৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই এ দু’টি অঞ্চলে মৌখরি আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। ২২৪ ও গুপ্তাব্দ বা ৫৪৪ খ্রিস্টাব্দেও উত্তর বাংলা গুপ্ত রাজাদের পদানত ছিল। তবে এ অঞ্চলে কখন গুপ্ত রাজত্বের অবসান ঘটল তা সুনিশ্চিত নয়। ৫৭০ খ্রিস্টাব্দেও গুপ্ত সম্রাটেরা ওড়িশায় রাজত্ব করতেন। বালেশ্বর জেলার সােরাে গ্রামে পাওয়া একখানি তাম্রশাসন প্রমাণ করছে, ৫৮০ খ্রিস্টাব্দের কিছুকাল পূর্বে শম্ভুযশা সেখানে এক স্বাধীন মান রাজ্য স্থাপন করেছেন। অর্থাৎ ততদিনে গুপ্ত রাজ্যের শেষ অঙ্গটিও খসে পড়েছে। ওড়িশায় গুপ্ত আধিপত্যের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক আকাশ হতে গুপ্ত রাজশক্তি চিরতরে অন্তর্হিত হল।

গুপ্ত রাজত্বের স্থায়িত্বকাল : গুপ্ত রাজত্বের স্থায়িত্বকাল সম্পর্কে দু’খানি প্রাচীন জৈনগ্রন্থে কিছু মূল্যবান তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। গ্রন্থ দু’টির একটি হরিবংশপুরাণ, অন্যটি তিলােয়পত্তি বা ত্রিলােকপ্রজ্ঞপ্তি। প্রথম গ্রন্থখানি জিনসেন রচিত, রচনাকাল ৭০৫ শকাব্দ বা ৭৮৩ খ্রিস্টাব্দ। দ্বিতীয়খানির রচয়িতা যতি কৃষভ যিনি সম্ভবত গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের অব্যবহিত পরই আবির্ভূত হন। হরিবংশপুরাণে বলা হয়েছে : “গুপ্তানাঞ্চ শতদ্বয়মেকত্রিংশচ্চ বর্ষাণি।/ কালবিদ্ভিরুদাহৃতম…।।” হরিবংশপুরাণের এই শ্লোকটি হতে জানা যায়, গুপ্ত রাজারা ২৩১ বছর রাজত্ব করেন। ৩২০ খ্রিস্টাব্দে (মতান্তরে ৩১৯ খ্রিস্টব্দ) গুপ্ত রাজত্ব শুরু হলে তার ২৩১ বছর পর অর্থাৎ ৫৫১ খ্রিস্টাব্দে গুপ্ত রাজত্বের অবসান হয়, এরূপ সিদ্ধান্তই সঙ্গত বােধ হয়। গুপ্ত সাম্রাজ্যের অবসানের এ তারিখটি উত্তরপ্রদেশ, বিহার এবং সম্ভবত উত্তর বাংলার ক্ষেত্রে প্রযােজ্য। তখনও ওড়িশায় গুপ্ত প্রভুত্ব অক্ষুন্ন। ত্রিলােকপ্রজ্ঞপ্তি গ্রন্থে গুপ্ত বংশের রাজত্বকাল সম্পর্কে দুটি মতের উল্লেখ আছে। একটি মতে গুপ্ত রাজগণ ২৩১ বছরকাল রাজত্ব করেন (ততাে গুত্তা তাণং রজে দোনি সয়াণি ইগিতীসা)। জিনসেনের হরিবংশ পুরাণেও একই তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। ত্রিলােকপ্রজ্ঞপ্তি গ্রন্থে উল্লিখিত অন্য একটি উক্তিতে গুপ্ত রাজারা ২৫৫ বছর রাজত্ব করেন, (দোণি সদা পণবণ্ণা গুত্তানং) এই তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। এই তথ্য অনুসারে গুপ্ত সম্রাটেরা ২৫৫ গুপ্তাব্দ বা ৫৭৫ খ্রিস্টাব্দ (মতান্তরে ৫৭৪ খ্রিস্টাব্দ) পর্যন্ত রাজপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। অনুমিত হয়, ৫৭৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ওড়িশা হতে গুপ্তাধিপত্য বিলুপ্ত হয়। ত্রিলােকপ্রজ্ঞতির দু’টি তথ্যেই গাঙ্গেয় ভূখণ্ড ও ওড়িশায় গুপ্ত শাসনের অবসানের দুটি পর্যায়ের উপর আলােকপাত করা হয়েছে।

সাম্রাজ্যের পতনের কারণ

বস্তুত, একটি বা দুটি নয়, গুপ্তরাজ্যের পতনের জন্য বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করা যায়।

বহিঃশত্রুর আক্রমণ : বহিঃশত্রুর আক্রমণ নিঃসন্দেহে গুপ্তরাজ্যের পতনের এক প্রধান কারণ। প্রথম কুমারগুপ্তের রাজত্বের শেষপর্ব থেকেই গুপ্তরাজ্যে বহিঃশত্রুর আনাগােনা শুরু হয়। পরাক্রান্ত পূষ্যমিত্র বা যুধ্যমিত্রদের আক্রমণে গুপ্তরাজ্যের পতন আসন্ন হয়ে ওঠে। রাজপুত্র স্কন্দ গুপ্ত শেষ পর্যন্ত শত্রুদের বিতাড়িত করে ধ্বংসের হাত থেকে গুপ্তরাজ্যকে রক্ষা করেন। স্কন্দগুপ্তের রাজত্বকালে হূণরা গুপ্তরাজ্য আক্রমণ করলেও তাদের ব্যর্থতা বৈ সাফল্য আসেনি। কিন্তু ৬ষ্ঠ শতকের প্রারম্ভে নতুন উদ্যমে তারা পুনরায় ভারত আক্রমণ করেন এবং বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। শেষ পর্যন্ত নরসিংহগুপ্ত বালাদিত্য হূণদের পরাজিত করেন সত্য কিন্তু হূণদের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষে অপূরণীয় শক্তি ও অর্থের অপচয় হয়। গুপ্তরাজ্য তাে দুর্বলই ছিল, তার উপর যখন যশােধর্মা তীব্র আঘাত হানলেন, সে আঘাত তাকে শক্তিশেলের মতাে বিদ্ধ করল।

দুর্বল নেতৃত্ব : দুর্বল নেতৃত্ব গুপ্তরাজ্যের পতনের আর একটি কারণ। রাজাই রাজ্যের প্রাণ। রাজা শক্তিমান ও বিচক্ষণ হলে যেমন রাজ্যের শান্তি ও সমৃদ্ধি, রাজা দুর্বল হলে রাজ্যের জরা ও লয়। স্কন্দগুপ্তের পর যারা গুপ্তসিংহাসনে আরােহণ করেন, তারা প্রায় সকলেই দুর্বল ও অপরিণামদর্শী ছিলেন। শক্ত হাতে রাজ্যের হাল ধরার ক্ষমতা তাদের ছিল না। ফলে এদের রাজত্বে গুপ্তরাজ্যের অবনতিই ত্বরান্বিত হয়েছে। 

প্রাদেশিক শাসকদের উচ্চাভিলাষ : প্রাদেশিক শাসকদের উচ্চাভিলাষ গুপ্তসাম্রাজ্যের বিকাশের পথ রােধ করে। সেনাপতি ভটার্ককে সম্ভবত স্কন্দগুপ্ত গুজরাতের প্রদেশপালের পদে নিয়ােগ করেন। ভটার্ক গুপ্তদের প্রতি অনুগত থাকলেও তার পুত্র ও পৌত্ররা কেন্দ্রীয় শক্তির দুর্বলতার পূর্ণ সুযােগ গ্রহণ করে গুজরাতে কার্যত স্বাধীন মৈত্রক রাজ্য স্থাপন করেন। গুপ্তরাজ্য ভাঙার আন্দোলনের সেই শুরু। ৬ষ্ঠ শতকের মধ্যভাগে নন্দন নামে আরেক প্রশাসক কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। তিনি ছিলেন একজন কুমারামাত্য কিন্তু সুযোগ বুঝে ৫৫২ খ্রিস্টাব্দের কিছু পূর্বে তিনি গয়া অঞ্চলে স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। মনে রাখা দরকার, গুপ্তরাজ্যে আমলা বিদ্রোহ দু’এক বারই ঘটেছে, ফলে রাজ্যের পতনের ক্ষেত্রে এর কোনও বড় ভূমিকা ছিল বলে মনে হয় না।

মৌখরি, পরবর্তী গুপ্ত, মান ও বাংলার আঞ্চলিক রাজাদের অভ্যুত্থান : মৌখরি, পরবর্তী গুপ্ত, মান ও বাংলার আঞ্চলিক রাজাদের অভ্যুত্থান গুপ্তরাজ্যের পতনের আর একটি প্রধান কারণ। ঈশানবর্মা বিহার ও উত্তরপ্রদেশে, কুমারগুপ্ত পূর্ব মালবে, শম্ভুযশ দক্ষিণ ওড়িশায় এবং গােপচন্দ্রর পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ বাংলায় স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করেন। উত্তর বাংলা থেকেও গােপচন্দ্ররা গুপ্তদের বিতাড়িত করেন। অথচ মূল গুপ্তরাজ্য বলতে একদিন এই সব অঞ্চলই বােঝাত।

গুপ্তরাজপরিবারে অন্তর্দ্বন্দ্ব : গুপ্তরাজপরিবারে অন্তর্দ্বন্দ্ব ছিল। সমুদ্রগুপ্তের সিংহাসনে আরােহণ উপলক্ষে এর শুরু হয়। এবং প্রথম কুমারগুপ্তের মৃত্যুর পর থেকে এর ব্যাপকতা বৃদ্ধি পায়। পুরুগুপ্তের পর তার চার পুত্র পর পর রাজত্ব করেন। অন্তর্দ্বন্দ্ব ছাড়া এই অস্বাভাবিক ঘটনার অন্য কোনও যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা নেই। পারিবারিক কলহে গুপ্তরাজ্যের সংহতি মাঝে মাঝে বিপন্ন হয়েছে, কিন্তু কখনও বিনষ্ট হয়নি। কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী রাজকুমার মূল রাজ্য থেকে বেরিয়ে নতুন রাজ্য গঠন করেছেন, এরকম ঘটনা গুপ্ত ইতিহাসে ঘটেনি। মনে হয়, পারিবারিক অন্তর্দ্বন্দ্ব গুপ্তরাজ্যের পতনের কোনও বড় কারণ নয়।

গুপ্ত রাজাদের বৌদ্ধধর্মে দীক্ষান্তর : শেষের দিকের গুপ্ত রাজাদের বৌদ্ধধর্মে দীক্ষান্তরের ঘটনাকে কেউ কেউ গুপ্তরাজ্যের পতনের এক গুরুত্বপূর্ণ কারণরূপে চিহ্নিত করেছেন। তাদের যুক্তি, বৌদ্ধধর্মের অহিংসা-নীতি রাজাদের নিষ্ক্রিয় করে, ফলে সামরিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তারা ব্যর্থতার পরিচয় দেন। এ মত সমর্থন করা যায় না।

  • প্রথমত, শেষপর্বের সকল গুপ্ত রাজাই বৌদ্ধ ছিলেন, এ ধারণা ঠিক নয়। তথাগতগুপ্ত, বালাদিত্যরা বৌদ্ধ ছিলেন কিন্তু বৈন্যগুপ্ত, তৃতীয় কুমারগুপ্ত এবং বিষ্ণুগুপ্তের মতাে রাজারা সম্ভবত বৈষব ছিলেন।
  • দ্বিতীয়ত, বৌদ্ধধর্ম রাজাকে দুর্বল করে, এ ধারণা কাল্পনিক। গুপ্তযুগের পূর্বে ও পরে ভারতে অনেক পরাক্রান্ত রাজা জন্মগ্রহণ করেছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই বৌদ্ধ ছিলেন। 

সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্রের আদর্শে গুপ্তরাজ্যের গঠন : রামশরণ শর্মা মনে করেন, সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্রের আদর্শে গুপ্তরাজ্য গড়ে ওঠায় রাজশক্তি সেখানে প্রথম থেকেই দুর্বল ছিল। এই প্রসঙ্গে তিনি কয়েকটি সমকালীন লেখের কথা বলেছেন। যেখানে ভূস্বামী বা রাজকর্মচারীর ভূমিদানের বর্ণনা আছে, কিন্তু রাজাজ্ঞার কোনও উল্লেখ নেই। তিনি আরও বলেন, ভূমিদানের সময় রাজা গ্রহীতার স্বার্থে তার যাবতীয় অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক অধিকার প্রত্যাহার করতেন। তার অভিমত, প্রজারা সরাসরি রাজকোষে খাজনা জমা দিতেন না, মধ্যবর্তীদের উপর সরকারি খাজনা আদায়ের ভার ছিল। এই মতের বিপক্ষে অনেক কিছুই বলার আছে।

  • প্রথমত, যে লেখগুলোর উপর নির্ভর করে অধ্যাপক শর্মা তার অভিমত ব্যক্ত করেছেন, একটি বাদে সেগুলোর সবই মধ্যপ্রদেশের। তখন মধ্যপ্রদেশে গুপ্তরাজত্বের অবসান ঘটেছে, তার বদলে নতুন নতুন স্বাধীন রাজ্য গড়ে উঠেছে। ওই সকল লেখে গুপ্ত রাজাদের উল্লেখ না থাকাই স্বাভাবিক। আর যেটিও-বা গাঙ্গেয় ভূভাগের, সেটি উৎকীর্ণ করেছেন নন্দন নামে জনৈক ব্যক্তি। তিনি তখন আর গুপ্তদের অধীনস্থ কোনও কর্মচারী নন, এক স্বাধীন রাজা।
  • দ্বিতীয়ত, গুপ্তলেখে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত আছে, গুপ্তরাজ্যে সরকারি অনুমােদন ছাড়া জমির হস্তান্তর হত না।
  • তৃতীয়ত, রাজা ভূমিদান করতেন এবং গ্রহীতার অনুকূলে কিছু কিছু অর্থনৈতিক অধিকার ছাড় দিতেন কিন্তু সারা রাজ্যের তুলনায় প্রদত্ত ভূমির পরিমাণ এতই ক্ষুদ্র যে তার বাৎসরিক আয়ের উপর এই ছাড়ের প্রভাব তুচ্ছাতিতচ্ছ ছিল।
  • চতুর্থত, মধ্যবর্তীদের মাধ্যমে সরকার খাজনা আদায় করতেন, এ মত সমর্থনযােগ্য নয়। তখনকার দিনে পুস্তপাল, চাট, ভট প্রভৃতি শ্রেণির কর্মচারীদের উপর সাধারণত খাজনা আদায়ের দায়িত্ব ছিল। 

অর্থনৈতিক কারণ : গুপ্তরাজ্যের পতনে অর্থনৈতিক কারণের বেশ বড় ভূমিকা আছে। স্কন্দগুপ্তের মৃত্যুর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মালবে গুপ্ত আধিপত্যে অবসান হয়। মালব যেন দক্ষিণ ভারত থেকে উত্তরে আসার প্রবেশদ্বার। দক্ষিণ ভারতের বন্দর ও বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলো এই মালবের পথেই উত্তর ভারতের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোর সঙ্গে যুক্ত ছিল। মালব গুপ্তদের হাতছাড়া হওয়ায় দক্ষিণের সঙ্গে উত্তরের ব্যবসা-বাণিজ্যে ও গুপ্তরাজ্যের প্রাধান্য ক্ষুন্ন হয়। তাছাড়া ৫ম শতকের শেষের দিকে এবং পরবর্তী শতকের প্রারম্ভে ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে গুপ্তরাজ্যের বাণিজ্যিক সম্পর্কের অবনতি ঘটে। বস্তুত, একদিকে দক্ষিণা রাজ্যগুলো। এবং অপরদিকে মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক অবনতির ফলে গুপ্তরাজ্যে গুরুতর অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। গুপ্তযুগের শেষ পর্যায়ের স্বর্ণমুদ্রায় এই অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সুস্পষ্ট আভাস আছে। সমুদ্রগুপ্তদ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের মতাে আদিপর্বের রাজারা যে স্বর্ণমুদ্রা উৎকীর্ণ করেছেন, তাতে খাদের পরিমাণ দশ শতাংশ। পক্ষান্তরে, শেষ পর্বের রাজাদের মুদ্রায় খাদের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে ৫৭ শতাংশে দাঁড়ায়। ঘাের অর্থনৈতিক সংকটের এ এক বাস্তব চিত্র। 

সমস্যা যেখানে সমাধানের পথ খুঁজে না পায়, সংকট সেখানে জগদ্দল পাথরের মতাে চেপে বসে। ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের জীবনে এরূপ অবস্থার উদ্ভব হলে ধ্বংস অনিবার্য হয়ে দেখা দেয়। গুপ্ত রাজ্যের ক্ষেত্রে ঠিক তাই ঘটেছিল। 

গ্রন্থপঞ্জি

  • Allan, J.: Catalogue of the Coins of the Gupta Dynasties and of Sasanka, King of 
  • Gauda in the British Museum (London, 1914).
  • Altekar, A. S. : Coinage Of The Gupta Empire (Varanasi, 1957).
  • Banerji, R. D.: The Age Of The Imperial Guptas (Banaras, 1933).
  • Basak, R. G. : The History Of North-Eastern India (Calcutta, 1967).
  • Chattopadhyaya, S. : Early History Of North India (Calcutta, 1968).
  • Ganguly, D. K.: The Imperial Guptas And Their Times (New Delhi, 1987).
  • Goyal, S. R. : A History Of The Imperial Guptas (Allahabad, 1967).
  • Gupta, P. L. : The Imperial Guptas, I (Varanasi, 1974).
  • Majumdar, R. C. (Ed.): The Vakataka-Gupta Age (Lahore, 1946): The Classical Age (Bombay, 1962); A Comprehensive History Of India, III. Part 1 (New Delhi, 1981).
  • Raychaudhuri, H. C. : Political History Of Ancient India (Calcutta, 1953).
  • Williams, J. G. : The Art Of Gupta India : Empire and Province (New Delhi, 1983)

গুপ্তরাজ্যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা

রাজা ও তার ক্ষমতা

দেবত্ব আরোপ : গুপ্ত সাম্রাজ্যে প্রশাসনের শীর্ষে ছিলেন রাজা। তিনি নিছক রাজা উপাধিতে তুষ্ট নন, আড়ম্বরপূর্ণ অভিধার প্রতি তাঁর আকর্ষণ। তাই তাঁর উপাধি মহারাজাধিরাজ, পরমদৈবত ও পরমভট্টারক। পরমদৈবত পদের অর্থ শ্রেষ্ঠ বা প্রধান দেবতা। পরমভট্টারক পদের অর্থও তাই। এ দু’টি অভিধা গ্রহণের মধ্য দিয়ে রাজার দেবত্বের দাবি উচ্চারিত হয়েছে। রাজা সাধারণ মানুষ নন, তিনি দেবতা, মহান দেবতা। এই প্রসঙ্গে এলাহাবাদ স্তম্ভলেখের সাক্ষ্য অনুধাবনযোগ্য। লেখটিতে সমুদ্রগুপ্তকে অচিন্ত্যপুরুষ, লোকধামদেব এবং ধনদ (কুবের), ইন্দ্র, বরুণ ও অন্তকের (যম) সমান বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সমুদ্রগুপ্ত মুদ্রায় নিজেকে কৃতান্ত অর্থাৎ যমের পরশু বা কুঠাররূপে পরিচয় দিয়েছেন। রাজার দেবত্বের দাবি কোনও এক আকস্মিক ঘটনা নয়, এর পিছনে বিশেষ এক উদ্দেশ্য কাজ করছিল। প্রজাবর্গের আনুগত্য ছাড়া রাজা রাজ্য চালাতে পারেন না। সম্ভ্রমবোধ থেকেই আনুগত্য জন্মায়। রাজা দেবতা এই বোধ জাগলেই রাজার প্রতি প্রজাদের সম্ভ্রমবোধ জন্মাবে, প্রজারা রাজার প্রতি অনুগত থাকবেন, রাজপদ নিষ্কণ্টক হবে। নিজেকে সুকৌশলে দেবতার আসনে বসিয়ে রাজা প্রজাদের উপর আপন কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন।

উত্তরাধিকার : রাজার মৃত্যু হলে সাধারণত তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রই রাজপদ লাভ করতেন। তবে এই নিয়মের ব্যতিক্রমও দেখা যেত। সমুদ্রগুপ্ত, দ্বিতীয় চন্দ্ৰগুপ্ত, কেউই পিতার জ্যেষ্ঠ পুত্র নন তবু তাঁরা সকলেই সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। এই রাজপদ তাঁরা স্বাধিকারে অর্জন করেননি, পেয়েছিলেন বাহুবলে বা পিতার অনুগ্রহে। কখনও কখনও রাজা তাঁর জীবিতকালে উত্তরাধিকারী মনোনয়ন করতেন। প্রথম চন্দ্রগুপ্ত সমুদ্রগুপ্তকে রাজপদের জন্য মনোনীত করেছিলেন। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত জ্যেষ্ঠত্বের দাবি উপেক্ষিত হয়, যোগ্যতার প্রশ্নই প্রাধান্য পায়।

প্রদেশপাল নিয়োগ : বিবিধ ক্ষমতার অধিকারী রাজা। তিনি প্রদেশপালদের নিযুক্ত করেন। প্রথম কুমারগুপ্ত চিরাতদত্তকে পুণ্ড্রবর্ধন বা উত্তর বাংলার প্রদেশপালের পদে নিয়োগ করেন। পরবর্তিকালে সম্রাট বুধগুপ্ত ব্রহ্মদত্ত নামে আর এক ব্যক্তিকে উত্তর বাংলার প্রদেশপাল নিযুক্ত করেন। কখনও কখনও রাজা জেলাশাসক নিয়োগের দায়িত্বও গ্রহণ করতেন। এমনটি ঘটেছিল পঞ্চনগরী জেলার অধিকর্তা কুলবৃদ্ধির নিয়োগের ক্ষেত্রে। উত্তর বাংলার তৎকালীন প্রদেশপাল নন, স্বয়ং গুপ্তসম্রাট তাঁকে স্বপদে নিযুক্ত করেন। (৪৪৯ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ বৈগ্রাম তাম্রশাসনে পঞ্চনগরী বিষয়ের কুমারামাত্য কুলবুদ্ধিকে ভট্টারকের পাদানুষ্যাতরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। এই ভট্টারক অবশ্যই গুপ্তসম্রাট প্রথম কুমারগুপ্ত। রামশরণ শর্মা Aspects of Political Ideas and Institutions in Ancient India Banaras. (1959), পৃ ২০৯-১০-তে অভিমত প্রকাশ করেছেন, বৈগ্লাম তাম্রশাসনে উল্লিখিত ভট্টারক ছিলেন পুণ্ড্রবর্ধন-ভুক্তির প্রদেশপাল। কোনও প্রাদেশিক শাসনকর্তাকে গুপ্ত লেখে কখনও ভট্টারক অভিধায় আখ্যাত করা হয়নি।) তাছাড়া মহাদগুনায়ক, মহাবলাধিকৃত, সান্ধিবিগ্রহিক, মহাপ্রতিহার প্রভৃতি পদস্থ কেন্দ্রীয় রাজপুরুষদের রাজাই স্বপদে নিযুক্ত করতেন, তাঁদের পদের স্থায়িত্বও একান্তভাবে রাজার মর্জির উপরই নির্ভর করত।

স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, সামরিক ও বিচার সংক্রান্ত বিষয় : শুধু স্বরাষ্ট্র নয়, পররাষ্ট্র, সামরিক ও বিচার সংক্রান্ত বিষয়েও রাজার সর্বময় কর্তৃত্ব। তিনি পররাষ্ট্রনীতির রূপকার, সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ও রাজ্যের প্রধান বিচারপতি। এসব কাজে রাজা পদস্থ রাজপুরুষের সাহায্য গ্রহণ করতেন ঠিকই কিন্তু সর্ব বিষয়ে তাঁর মতামতই চূড়ান্ত ছিল।

রাজার সীমাবদ্ধতা

ব্যক্তিত্ব ও কর্মদক্ষতার উপর প্রকৃত ক্ষমতার নির্ভরশীলতা : নীতিগতভাবে রাজা সর্বশক্তিমান হতে পারেন কিন্তু ব্যক্তিত্ব ও কর্মদক্ষতার উপরই তাঁর প্রকৃত ক্ষমতা নির্ভর করে। সমুদ্রগুপ্ত বা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত যে ব্যক্তিত্ব ও দূরদর্শিতার অধিকারী ছিলেন তা নিশ্চয় নরসিংহগুপ্ত বা বিষ্ণুগুপ্তের মতো তাঁদের দুর্বল উত্তরসূরিদের ছিল না।

প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় এককেন্দ্রিকতার সাফল্যের উপর সরকারের প্রকৃত কর্তৃত্বের নির্ভরশীলতা : তাছাড়া গুপ্তরাজতন্ত্রের ভিত বরাবরই দুর্বল ছিল। প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় এককেন্দ্রিকতার সাফল্যের উপর রাজশক্তি তথা সরকারের প্রকৃত কর্তৃত্ব নির্ভর করে। অথচ কারণ যাই হোক না কেন, গুপ্ত রাজারা এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেননি। সমুদ্র গুপ্তের মতো পরাক্রমশালী রাজা রাজ্যের বিরাট একটি অংশের শাসনভার কার্যত স্বাধীন প্রশাসকদের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। এসব প্রশাসক নামমাত্র আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি ও নির্ধারিত কর দানের বিনিময়ে কার্যত স্বাধীন নরপতির ন্যায় শাসন কার্য পরিচালনা করতেন। এ সব অঞ্চলে কেন্দ্রীয় শাসন জোরদার হলে রাজশক্তিই সুদৃঢ় হত, সুসংহত হত। পরবর্তি কালে গুপ্ত প্রশাসন ব্যবস্থায় বিকেন্দ্রীকরণের প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পায়, রাজশক্তি দুর্বল ও শিথিল হয়ে পড়ে।

কেন্দ্রের কঠোর নিয়ন্ত্রণের অভাব : রাজ্যের যেসব অঞ্চল রাজার প্রত্যক্ষ শাসনাধীন ছিল অন্তত সেসব স্থানে যে রাজার কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল, তা বোধহয় বলা যায় না। অশোকের আমলে মৌর্যসম্রাট তথ্য কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সঙ্গে আঞ্চলিক প্রশাসকদের নিবিড়, ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল। আঞ্চলিক প্রশাসকদের কার্য কলাপের প্রতি সম্রাটের সজাগ ও সতর্ক দৃষ্টি ছিল। আঞ্চলিক প্রশাসকেরা যাতে স্বেচ্ছাচারী না হন, রাজ্যের সর্বত্র যাতে একই নিয়ম বা বিধান প্রচলিত থাকে, সেদিকে কেন্দ্রীয় সরকারের সতর্ক দৃষ্টি ছিল। প্রদেশপালদের উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ হতে প্রায়ই নির্দেশ জারি হত। কেন্দ্রীয় সরকারই জেলা প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত রাজপুরুষদের নিয়োগ করতেন। প্রজাদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য সম্রাট নিয়মিত রাজ্য পরিক্রমায় বের হতেন। কিন্তু গুপ্তপর্বে প্রদেশের উপর কেন্দ্রের সে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আর ছিল না। রাজা প্রদেশ পাল নিয়োগ করতেন ঠিকই কিন্তু তাঁর কাজকর্মে হস্তক্ষেপ করতেন বলে মনে হয় না। রাজা কোনও প্রদেশপালকে প্রশাসনিক নির্দেশ দিচ্ছেন বা রাজপুরুষদের কার্যকলাপ ও জনসাধারণের অবস্থা অবগতির জন্য প্রদেশ পরিক্রমায় বের হচ্ছেন, এধরনের তথ্য সমকালীন লেখমালা বা সাহিত্যে নেই। মৌর্যযুগে জেলাস্তরের রাজপুরুষরাও সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক নিযুক্ত হতেন কিন্তু এই পর্বে প্রদেশ পালরাই সাধারণত সে অধিকার ভোগ করতেন। পঞ্চনগরী বিষয়ের অধিকর্তা কুলবুদ্ধি কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক নিযুক্ত হয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু এই পর্বে এ ধরনের ঘটনার বেশি নজির নেই।

স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে জন প্রতিনিধিদের সংযোগের ফলে রাজশক্তির ক্ষতি : গুপ্ত প্রশাসনে, বিশেষ করে গ্রাম ও জেলার স্তরে, জনপ্রতিনিধিত্বের বড় রকমের ভূমিকা ছিল। জেলার অধিষ্ঠানাধিকরণের অন্তত চারটি আসন জনপ্রতিনিধিদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। এঁদের মধ্যে তিনজনই ব্যবসায়িক ও কারিগরি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত, চতুর্থজন লিপিকর গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। শুধু জেলার স্তরে নয়, নগর ও গ্রামের স্তরেও উপদেষ্টা পরিষদ বা কার্যকরী সমিতি ছিল যা মূলত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত ছিল। এই পরিষদের অনুমোদন ছাড়া ভূমির ক্রয়, বিক্রয় ও দানের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন হত না। স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে জন প্রতিনিধিদের সংযোগ রাজশক্তিকে ক্ষুণ্ণ করেছিল, সন্দেহ নেই।

ভূ-দান প্রথার মধ্যে রাজশক্তির অবক্ষয়ের বীজ : অধ্যাপক রামশরণ শর্মা গুপ্ত সম্রাটদের ভূ-দান প্রথার মধ্যে রাজশক্তির অবক্ষয়ের বীজ লক্ষ করেছেন। লেখমালার সাক্ষ্য হতে জানা যায় গুপ্ত রাজারা প্রায়ই ব্রাহ্মণ ও বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ভূ-সম্পদ দান করতেন। অধ্যাপক শৰ্মা মনে করেন, অগ্রহার ব্যবস্থায় গ্রহীতা যে কেবল ভূমি হতে সংগৃহীত রাজস্ব ভোগ করতেন তা নয়, ভূখণ্ডের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা ও প্রশাসনের যাবতীয় দায়িত্বও গ্রহণ করতেন। অধ্যাপক শর্মা মনে করেন, এর ফলে রাজা তথা রাষ্ট্রের সার্বভৌম অধিকার বিনষ্ট হয় ও ভূস্বামীদের আর্থ-প্রশাসনিক ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। অগ্রহার ব্যবস্থার ফলে রাজার অধিকার সংকুচিত হয়েছিল, এ মত অনেকেই সমর্থন করেন না। তাঁরা মনে করেন প্রদত্ত জমির বেশির ভাগই ছিল অনাবাদি। তাছাড়া সারা রাজ্যের তুলনায় প্রদত্ত ভূমির পরিমাণ এতই নগণ্য ছিল যে রাজার প্রাপ ভূমি-রাজস্বের উপর অগ্রহার ব্যবস্থার প্রভাব তুচ্ছাতিতুচ্ছ ছিল বললেই চলে। ভূমি-সম্পদ দানের সঙ্গে রাজার প্রশাসনিক ক্ষমতার হস্তান্তর হত এই বক্তব্যের সঙ্গেও তাঁরা একমত নন।

কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্র

সুদক্ষ রাজপুরুষদের সাহায্য ছাড়া রাজা একা যাবতীয় প্রশাসনিক কাজ কর্ম নিষ্পন্ন করতে পারেন না। গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর পর্বের লেখমালায় সান্ধিবিগ্রহিক, মহাদণ্ডনায়ক, মহাপীলুপতি, মহাবলাধিকৃত, অক্ষপটলাধিকৃত, কুমারামাত্য প্রভৃতি অনেক পদস্থ রাজপুরুষের উল্লেখ আছে যাঁরা কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন –

  • সান্ধিবিগ্রহিক : এলাহাবাদ প্রশস্তির লেখক হরিষেণ সমুদ্রগুপ্তের সান্ধিবিগ্রহিক ছিলেন। বীরসেন শাব ছিলেন দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের সান্ধিবিগ্রহিক। সন্ধি বলতে এক ধরনের চুক্তি বোঝায় যার ফলে বিবদমান দুই বা ততোধিক গোষ্ঠীর মধ্যে শান্তি স্থাপিত হয়। বিগ্রহের অর্থ যুদ্ধ। অর্থাৎ যে মন্ত্রী যুদ্ধ ও শান্তি স্থাপনের কাজে নিযুক্ত, তিনিই সান্ধিবিগ্রহিক। পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা বিভাগের তিনি ভারপ্রাপ্ত। রাজনীতি ও সমরবিদ্যায় তিনি নিপুণ ছিলেন। কখনও কখনও তাঁকে রাজার সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে হত। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত যখন পশ্চিমা ক্ষত্রপদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন তখন বীরসেন শাব তাঁর অনুগমন করেন। হরিষেণও যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন।
  • মহাদণ্ডনায়ক : মহাদণ্ডনায়কের ঠিক কী কাজ ছিল, সে সম্পর্কে কোনও সুনিশ্চিত ধারণা করা সম্ভব নয়। আসলে দণ্ড পদটি একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হয় বলেই এই বিপত্তি। এক অর্থে দণ্ড জরিমানা বোঝায়। এই অর্থে জরিমানা যিনি ধার্য করেন তিনিই দণ্ডনায়ক অর্থাৎ বিচারপতি। প্রধান বিচারপতি যিনি তিনি মহাদগুনায়ক। দণ্ড বলতে শাস্তিদগুও বোঝায়। যিনি শাস্তিদন্ত ধারণ করেন সেই পদস্থ পুলিশ কর্মচারীও দণ্ডনায়ক। পুলিশ বিভাগের প্রধান যিনি তিনি মহাদগুনায়ক। আবার দণ্ডের অর্থ সেনাবাহিনী। সেক্ষেত্রে সেনাপতি এই অর্থে দণ্ডনায়ক। মুখ্য সেনাপতি যিনি তিনিই মহাদণ্ডনায়ক। বেশির ভাগ পণ্ডিত মনে করেন, গুপ্তযুগে মহাদওনায়ক সামরিক বিভাগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এলাহাবাদ প্রশক্তির লেখক হরিষেণ ও তাঁর পিতা ধ্রুবভূতি উভয়েই মহাদণ্ডনায়ক ছিলেন।
  • মহাবলাধিকৃত : সামরিক বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আর এক পদস্থ রাজপুরুষ হলেন মহাবলাধিকৃত। প্রধান সেনাপতির অনুপস্থিতিতে তিনি সম্ভবত যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যপরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করতেন।
  • মহাপীলুপতি : হস্তিবাহিনীর পরিচালনভার ছিল মহাপীলুপতির উপর।
  • কুমারামাত্য : কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত আর এক শ্রেণির পদস্থ কর্মচারী হলেন কুমারামাত্য। হরিষেণ সমুদ্রগুপ্তের কুমারামাত্য ছিলেন, শিখরস্বামী ছিলেন দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের এবং পৃথিবীষেণ প্রথম কুমারগুপ্তের। অনেকে কুমারামাত্যকে রাজার একাত্তসচিব, আবার কেউ বা তাঁকে রাজস্ব বিভাগের অধ্যক্ষরূপে চিহ্নিত করেছেন।

পুরুষানুক্রমে মন্ত্রিত্ব : এসব রাজপুরুষরা রাজানুগ্রহেই স্বপদে বহাল হতেন। একই পরিবারের লোক পুরুষানুক্রমে মন্ত্রিত্বের পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন, এরকম ঘটনা প্রায়ই ঘটত। হরিষেণের মতো তাঁর পিতাও একজন মহাদগুনায়ক ছিলেন। শিখরস্বামী ও তাঁর পুত্র পৃথিবীষেণ যথাক্রমে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তপ্রথম কুমারগুপ্তের মন্ত্রি-কুমারামাত্য ছিলেন। বীরসেন শাব ছিলেন দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের অধীনস্থ একজন পদস্থ রাজপুরুষ। উত্তরাধিকারসূত্রে এ পদ লাভ করেছেন বলে (অন্বয়-প্রাপ্ত-সাচিব)) তিনি উদয়গিরি গুহালেখে সদত্তে ঘোষণা করেছেন। জন্ম পদ নিয়োগের মাপকাঠি হলে যোগ্যের অনাদর নয়, প্রশাসনে জড়তা ও শৈথিল্য দেখা দেয়। গুপ্ত আমলে কেন্দ্রীয় সরকারের বেশির ভাগ পদ বংশানুক্রমিক হওয়ায় প্রশাসনে নিঃসন্দেহে দক্ষতার ঘাটতি দেখা দিয়েছিল।

একই পদে একাধিক ব্যক্তি ও এক ব্যক্তির একাধিক পদ : সে সময় কখনও কখনও একই পদে একাধিক ব্যক্তি নিযুক্ত হতেন। এলাহাবাদ স্তম্ভলেখ যখন উৎকীর্ণ হয় তখন প্রশস্তিকার হরিষেণ এবং লেখটির যিনি তত্ত্বাবধান করেছেন সেই তিলভট্টক উভয়েই মহাদগুনায়কের পদে আসীন ছিলেন। আবার অনেক সময় একই ব্যক্তিকে একাধিক পদের দায়িত্ব দেওয়া হত। হরিষেণ শুধু প্রতিরক্ষা ও বিদেশ দপ্তরেরই ভারপ্রাপ্ত ছিলেন না, তিনি সেনাবাহিনীরও অধ্যক্ষ ছিলেন। কখনও কখনও মন্ত্রীদের এক ফতর থেকে দফতরে করা হত। এমনটি ঘটেছিল মন্ত্রী পৃথিবীষেণের ক্ষেত্রে। তিনি প্রথমে মহারাজাধিরাজ প্রথম কুমার গুপ্তের কুমারামাতা ছিলেন কিন্তু পরে মহাবলাধিকৃতের পদ অলংকৃত করেন।

মন্ত্রিপরিষৎ নিয়ে প্রশ্ন : মৌর্যযুগে যেমন মন্ত্রীরা ছিলেন, তেমনি মন্ত্রিপরিষৎ নামে এক প্রশাসনিক সংস্থাও ছিল। গুপ্তযুগে কেন্দ্রে এধরনের কোনও পরিষৎ ছিল কিনা বলা কঠিন। বিলসড় শিলা স্তম্ভলেখে ‘পর্ষদ’-এর উল্লেখ আছে। কিন্তু সেটি যে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিপরিষৎ ছিল তার কোনও সুনিশ্চিত প্রমাণ নেই। এলাহাবাদ স্তম্ভলেখে সভ্যগণের উল্লেখ আছে। তাঁরা কী কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্য ছিলেন? এখানেও সংশয় আছে।

যুবরাজ : কেন্দ্রীয় প্রশাসনে যুবরাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। রাজার অনুপস্থিতিতে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যপরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করতেন। প্রথম কুমারগুপ্তের রাজত্বের শেষপর্বে রাজকুমার স্কন্দগুপ্তকে সম্ভবত এ দায়িত্ব পালন করতে হয়। কখনও কখনও প্রদেশের শাসনভার যুবরাজের স্তক্ষে ন্যস্ত হত। বৈশালীতে পাওয়া একটি সিলমোহর হতে এ তথ্য জানা যায়। প্রশাসনিক কাজে কুমারামাত্য নামে এক পদস্থ রাজপুরুষ যুবরাজকে সাহায্য করতেন। কুমারা মাত্যের অধীনে একটি দফতর বা অধিষ্ঠান ছিল।

রানি : প্রশাসনে রানির বিশেষ কোনও ভূমিকা ছিল বলে মনে হয় না। কুমারদেবী তাঁর স্বামী প্রথম চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে একযোগে রাজ্যের সনকার্য পরিচালনা করতেন বলে কেউ কেউ অভিমত প্রকাশ করলেও বেশির ভাগ পণ্ডিতই এ মতের যাথার্থ্য সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেছেন। কখনও কখনও রানিদের মূর্তি সরকারি মুদ্রায় খোদিত হয়েছে বটে কিন্তু তাতে তাঁদের প্রশাসনিক কর্তৃত্ব আভাসিত হয় না।

প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা

প্রশাসনের সুবিধার জন্য গুপ্ত সাম্রাজ্যকে কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত করা হয়। সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলের প্রদেশগুলিকে সাধারণত ভুক্তি এবং অন্যত্র প্রদেশগুলিকে দেশ বলা হত। গুপ্ত লেখমালায় সুকুলি ও সুরাষ্ট্র নামে দু’টি দেশের উল্লেখ আছে। এসময় সম্ভবত ডাভাল ও কালিন্দী-নর্মদা দোয়াব নামে আরও দু’টি দেশ ছিল। সুকুলিদেশের সঠিক অবস্থান জানা যায় না কিন্তু সুরাষ্ট্র এবং ডাভাল বলতে যে গুজরাত ও জব্বলপুর অঞ্চল বোঝাত তা নিশ্চিত। গুপ্ত ও উত্তর পর্বের লেখমালায় পুণ্ড্রবর্ধন (উত্তরবঙ্গ), বর্ধমান (পশ্চিমবঙ্গ), তীর (উত্তর বিহার), নগর (দক্ষিণ বিহার), শ্রাবস্তী (অযোধ্যা-ফৈজাবাদ) ও অহিচ্ছত্র (রোহিলখণ্ড) ভুক্তির উল্লেখ আছে। জুনাগড় শিলালেখ হতে জানা যায়, স্কন্দগুপ্ত বিভিন্ন দেশগুলিতে গোপ্তাদের নিয়োগ করেছিলেন। (সর্বেষু দেশেষ বিধায় গোপ্তৃন্‌)। এর থেকে অনুমান করা যায় দেশের শাসনকর্তাদের গোপ্তা বলা হত। ভুক্তির শাসকের পদবি ছিল উপরিক। পরের দিকে ভুক্তির শাসকরা উপরিক পদবিতে সন্তুষ্ট না থেকে উপরিক মহারাজ অভিধা ধারণ করেন। কখনও কখনও দেশ বা ভুক্তির শাসনকর্তার পদে রাজপুত্রদের নিয়োগ করা হত। পঞ্চম দামোদরপুর লেখে পুণ্ড্রবর্ধনভুক্তির শাসকরূপে রাজপুত্র দেবভট্টারকের উল্লেখ আছে। তিনি সম্ভবত একজন গুপ্তরাজকুমার ছিলেন। তীরভূক্তির উপরিক গোবিন্দগুপ্তও গুপ্তরাজবংশের সন্তান ছিলেন। এযুগের আর এক প্রদেশপাল ঘটোৎকচগুপ্তও সম্ভবত রাজপরিবারের সদস্য ছিলেন। রাজপুত্র নন, এমন ব্যক্তিও কখনও কখনও প্রদেশপালের কর্মভার গ্রহণ করেছিলেন। সুরাষ্ট্রদেশের প্রশাসক পর্ণদত্ত বা পুণ্ড্রবর্ধনভুক্তির শাসনকর্তা চিরাতদত্ত, কেউই গুপ্ত রাজ পরিবারের সদস্য ছিলেন না।

বৈশালীতে পাওয়া সিলমোহরগুলিতে সেযুগের প্রাদেশিক শাসন-ব্যবস্থা সম্পর্কিত অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। এই সিলমোহরগুলি হতে জানা যায়, রাজপুত্র গোবিন্দগুপ্ত উত্তর বিহারের তীরভুক্তির শাসনকর্তা ছিলেন। কুমারামাত্য মহাপ্রতিহার, তলবর, মহাদণ্ডনায়ক, বিনয়স্থিতিস্থাপক, ভটাশ্বপতি প্রভৃতি শ্রেণির সামরিক ও বেসামরিক রাজপুরুষরা তাঁকে প্রশাসনিক ও সামরিক কাজকর্মে সাহায্য করতেন। কুমারামাত্যকে তো যুবরাজপাদীয় বলে বর্ণনা করা হয়েছে। কুমারামাত্যের পরিচালনাধীন একটি দফতর ছিল যাকে অধিকরণ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। মহাপ্রতিহার সম্ভবত প্রাসাদ-রক্ষিবাহিনীর অধ্যক্ষ ছিলেন। তলবর বলতে সম্ভবত কোনও সেনাধ্যক্ষ বা অঞ্চল প্রধানকে বোঝাত। বিনয়স্থিতিস্থাপক হয়তো ধর্ম ও নীতি বিভাগের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন। মন্দির ও বিহারাদির তত্ত্বাবধান এবং জনসাধারণের মধ্যে নৈতিকতা ও শিক্ষার সম্প্রচারের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। কেউ কেউ বিনয় ও স্থিতি বলতে আইন ও শৃঙ্খলা বোঝেন। তাঁরা মনে করেন, বিনয়স্থিতিস্থাপক পুলিশ বিভাগের একজন পদস্থ কর্মচারী ছিলেন। ভটাশ্বপতি সম্ভবত পদাতিক ও অশ্বারোহী বাহিনীর অধ্যক্ষ ছিলেন। বৈশালীতে প্রাপ্ত সিলমোহরে রণভাণ্ডাগারাধিকরণ, বলাধিকরণ, দণ্ডপাশাধিকরণ প্রভৃতি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাদেশিক দফতরের উল্লেখ আছে। এর থেকে অনুমান করা যায়, রণভাণ্ডাগারিক, বলাধিকৃত ও দণ্ডপাশিক নামের তিনজন পদস্থ রাজপুরুষও প্রাদেশিক প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। রণভাণ্ডাগারিক ছিলেন সামরিক সরঞ্জাম ও রসদের দায়িত্বে। বলাধিকৃত ছিলেন পদাতিক বাহিনীর প্রধান। দণ্ডপাশিক সম্ভবত পুলিশ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন।

জেলা, মণ্ডল ও বীথি-প্রশাসন

ভুক্তি বা দেশের কয়েকটি বিষয়ে বিভক্তি ও বিষয়ের মুখ্য প্রশাসক : এক একটি ভুক্তি বা দেশ কয়েকটি বিষয়ে বিভক্ত ছিল। গুপ্ত আমলের বিষয় আধুনিককালের প্রশাসনিক বিভাগ জেলার মতো। গুপ্তলেখমালায় লাট, ত্রিপুরী, ঐরিকিণ, অন্তর্বেদি, গয়া, কোটিবর্ষ, খাদাটাপার প্রভৃতি বিষয়ের উল্লেখ আছে। গুপ্তশাসনের প্রথম দিকে বিষয়ের মুখ্য প্রশাসককে সাধারণত কুমারামাত্য বা আয়ুক্তক বলা হত। কিন্তু পরের দিকে এ দু’টি পদবির বিশেষ প্রচলন দেখা যায় না। তার পরিবর্তে বিষয়পতি পদবিই জনপ্রিয় হয়। কুমারামাত্য বা বিষয়পতিকে সাধারণত প্রাদেশিক শাসনকর্তাই নিযুক্ত করতেন। উত্তর বাংলার কোটিবর্ষ বিষয়ের প্রশাসক বেত্রবর্মার নিয়োগের ক্ষেত্রে এই রীতি অনুসৃত হয়েছিল। কখনও কখনও স্বয়ং সম্রাট সরাসরি বিষয়পতিকে নিয়োগ করতেন। সম্রাট স্কন্দগুপ্ত সর্বনাগকে গঙ্গা ও যমুনার মধ্যবর্তী অন্তবেদির প্রশাসকের পদে নিযুক্ত করেছিলেন। যে জেলাশাসককে প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিযুক্ত করতেন তিনি নিঃসন্দেহে প্রাদেশিক শাসনকর্তারই অধীনে কাজ করতেন। যাঁকে সম্রাট সরাসরি নিয়োগ করতেন তিনি সম্ভবত সম্রাট তথা কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ ছিলেন।

বিষয়পতির কাজকর্ম : বিষয়পতির কাজকর্ম সম্পর্কে বিশেষ তথ্য পাওয়া যায় না। যাও-বা পাওয়া যায়, তা সবই জমির ক্রয়, বিক্রয় ও দানে তাঁর ভূমিকাসম্পর্কিত। অনুমান করা যায়, তাঁরই নির্দেশে বিষয়ের সাধারণ প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থা পরিচালিত হত। তাঁকে সম্ভবত কোনও সামরিক দায়িত্ব বহন করতে হত না। বিষয়পতিকে কাজে সাহায্য করার জন্য যেমন পুস্তপাল প্রভৃতি অনেক সরকারি কর্মচারী ছিলেন, তেমনি তাঁকে পরামর্শ বা সাহায্য দানের জন্য একটি উপদেষ্টা পরিষৎ বা কার্যকরী সমিতিও ছিল। সমকালীন লেখমালায় এই পরিষদকে অধিকরণ বা অধিষ্ঠানাধিকরণ বলা হয়েছে। নগরশ্রেষ্ঠী, সার্থবাহ, প্রথম কুলিক ও প্রথম কায়স্থ এই পরিষদের মুখ্য সদস্য ছিলেন। তাছাড়া বিষয়-মহত্তর নামে পরিচিত বিষয়ের কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তিও সম্ভবত এই পরিষদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। নগরশ্রেষ্ঠী ছিলেন সম্ভবত জেলা শহরের মুখ্য ব্যবসায়ী। শকটে পণ্যসম্ভার সাজিয়ে দেশ-দেশান্তরে ঘুরে ঘুরে যাঁরা ব্যবসা করতেন তাঁদের সার্থ বলা হত। তাঁদের যিনি প্রধান তিনি সার্থবাহ। জেলার কারিগর-শিল্পীদের যিনি অগ্রগণ্য তিনিই প্রথম কুলিক। লিপিকরদের মধ্যে যিনি শ্রেষ্ঠ তিনিই প্রথম কায়স্থ।

প্রথম কায়স্থ : প্রথম কায়স্থ সরকারি কর্মচারী না বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধি তা এক বিতর্কিত বিষয়। লিখন যাঁর বৃত্তি তিনি কায়স্থ বা লেখক। কায়স্থগোষ্ঠীর যিনি প্রধান তিনি প্রথম কায়স্থ, জ্যেষ্ঠকায়স্থ। তিনি যে রাজপুরুষ ছিলেন তা সুনিচিত নয়। সার্থবাহ, কুলিকদের মতো কায়স্থদেরও গোষ্ঠী ছিল এবং গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরূপে প্রথমকায়স্থ বিষয়াধিকরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, এরূপ সিদ্ধান্তই স্বাভাবিক। বিনয়চন্দ্র সেন ও নীহাররঞ্জন রায় অবশ্য প্রথমকায়স্থকে যথাক্রমে বিষয়পত্তির মুখ্যসচিব ও কর্মসচিব রূপে অভিহিত করেছেন। অর্থাৎ তাঁরা প্রথম কায়স্থকে রাজপুরুষরূপেই চিহ্নিত করেছেন যদিও নিজেদের অভিমত সম্পর্কে তাঁরা তাঁদের সংশয় গোপন রাখেননি। প্রথমকায়স্থ করণিকদের প্রতিনিধি ছিলেন এবং সরকারি কর্মী রূপে দলিল-দস্তাবেজ লেখা ও তার রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিযুক্ত ছিলেন, এরূপ এক মতও আছে। কোনও ব্যক্তিকে একাধারে কোনও গোষ্ঠীর প্রতিনিধি এবং সরকারি কর্মী রূপে চিহ্নিত করলে বক্তব্যে অসঙ্গতি দেখা দেয়। দ্বিতীয়ত, পরবর্তিকালে করণ ও কায়স্থ এক ও অভিন্ন গোষ্ঠী বলে বিবেচিত হলেও গুপ্তপর্বে তারা সম্ভবত দু’টি স্বতন্ত্র সম্প্রদায় ছিলেন। তখন লেখকবৃত্তিধারী ব্যক্তিরা কায়স্থ এবং খোদাই করে লিখতেন যাঁরা তাঁরা করণ বা করণিক নামে পরিচিত ছিলেন। তৃতীয়ত, সমকালীন পর্বে দলিল-দস্তাবেজ সংরক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন পুস্তপাল, প্রথম কায়স্থ নন। দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকর প্রথম কায়স্থকে জেলার মুখ্য রাজস্ব আধিকারিক-রূপে শনাক্ত করেছেন। এ মতও সম্ভবত ঠিক নয়।

বিভিন্ন পেশার গিল্ড : বিভিন্ন পেশার এই সব শ্রেষ্ঠী, সার্থবাহ, কুলিক ও কায়স্থদের নিজস্ব সংগঠন বা গিল্ড ছিল। হয়তো তাঁরা নিজ নিজ সংগঠন থেকে নির্বাচিত হয়ে জেলা পরিষদের সদস্যপদ লাভ করতেন। নির্বাচিত হয়ে নয়, বিষয়পতি কর্তৃক মনোনীত হয়ে তাঁরা জেলা-অধিকরণে যোগদান করতেন এমন সম্ভাবনাও বাতিল করা যায় না। সরকারি নথি-পত্র-দস্তাবেজের যিনি সংরক্ষক তিনি পুস্তপাল। উত্তর বাংলার দামোদরপুর গ্রামে পাওয়া তাম্রশাসনগুলি থেকে জানা যায় প্রতিটি জেলায় একাধিক পুস্তপাল ছিলেন। বিষয়পতি, পুক্তপাল প্রভৃতি জেলাস্তরের বিভিন্ন রাজপুরুষরা কী বেতন পেতেন এবং সে বেতন তাঁদের নগদে, না নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের ভূমিরাজস্ব প্রদানের মাধ্যমে দেওয়া হত সে সম্পর্কে কোনও সুনিশ্চিত তথ্য নেই।

প্রশাসনে জনপ্রতিনিধিদের সক্রিয় ভূমিকা ও জেলাপ্রশাসনের উপর নিয়ন্ত্রণের অভাব : গুপ্তযুগের জেলাস্তরের শাসন-ব্যবস্থার কয়েকটি প্রশাসনিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ করবার মতো। প্রশাসনে জনপ্রতিনিধিদের সক্রিয় ভূমিকা এই পর্বের শাসন-ব্যবস্থার এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। জেলা পরিষদের নগরশ্রেষ্ঠী প্রভৃতি সদস্যদের কেউই সরকারি কর্মচারী ছিলেন না, তাঁরা বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিস্থানীয় ছিলেন। জেলা প্রশাসনে জনপ্রতিনিধিত্বের গুরুত্ব এর আগে তেমন অনুভূত হয়নি। দ্বিতীয়ত, মৌর্য আমলে কেন্দ্রীয় সরকারের জেলাপ্রশাসনের উপর যে প্রত্যক্ষ, কঠোর নিয়ন্ত্রণ ছিল, তা এই পর্বে দেখা যায় না। গুপ্তসম্রাটেরা কখনও কখনও জেলা প্রশাসকদের সরাসরি নিযুক্ত করতেন ঠিকই কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রাদেশিক শাসনকর্তারাই এই দায়িত্ব বহন করতেন। ফলে বিষয়পতিদের সিংহভাগই প্রদেশপালদের নির্দেশেই তাঁদের কাজকর্ম পরিচালনা করতেন, কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে তাঁদের কোনও যোগ ছিল না। যেসব অঞ্চলে কেন্দ্রীয় সরকার বিষয়পতিদের সরাসরি নিয়োগ করতেন সেসব অঞ্চলেও কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কতখানি সক্রিয় ছিল বলা শক্ত। মৌর্য আমলে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক পাঠানোর যে বিধি ছিল বা স্বয়ং সাম্রাজ্য পরিক্রমার যে নীতি মহামতি অশোক প্রবর্তন করেছিলেন গুপ্তযুগে তার কোনও নিদর্শন নেই।

মণ্ডল ও বীথি-প্রশাসন : খ্রিস্টীয় ৫ম শতকের পাহাড়পুর তাম্রশাসনে নাগিরট্টমণ্ডল নামে এক মণ্ডলের উল্লেখ আছে। গুপ্তরাজ্যে মণ্ডল বিষয়ের সমার্থক না বিষয়ের নিম্নতর এক প্রশাসনিক বিভাগ, তা স্পষ্ট নয়। মণ্ডলের মুখ্য আধিকারিক মাণ্ডলিক। বিষয়ের এক নিম্নতর বিভাগ বীথী বা বীথি। গুপ্ত ও সমকালীন লেখে নন্দবীথী, দক্ষিণাংশবীথী, সুবর্ণবীথী, শৃঙ্গবেরবীথী ইতাদি কয়েকটি বীথীর উল্লেখ আছে বীথীর প্রশাসকের পদবী বা তাঁর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। বীথীর শাসনকার্য পরিচালনার জন্য এক প্রশাসনিক সংস্থার অস্তিত্ব লেখের সাক্ষ্যে সুপ্রমাণিত। ৪৮৯ খ্রিস্টাব্দের নন্দপুর তাম্রশাসনে বীথীর প্রশাসনিক সংস্থাকে অধিকরণ বলা হয়েছে, বীথী-অধিকরণ বলা হয়নি। নন্দপুর তাম্রশাসনে বীথীর অধিকরণের সদস্য বা অধিকরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে দুজন রাজপুরুষের সুনিশ্চিত উল্লেখ আছে তাঁরা পুস্তপাল। অনুমিত হয়, বীথির আধিকারিক ছাড়া সম্ভবত নির্দিষ্টসংখ্যক মহত্তর ও কুটুম্বীরাও এ অধিকরণের সদস্য ছিলেন।

গ্রাম্য প্রশাসন 

বীথীর নিম্নতর প্রশাসনিক বিভাগ গ্রাম। এ গ্রাম যে কোনও গ্রাম নয়, বিশাল ও বর্ধিষ্ণু এ গ্রাম। এরূপ এক একটি গ্রামই এক একটি স্বতন্ত্র প্রশাসনিক ভূখণ্ড। এ গ্রামের শাসনভার মূলত যার উপর ন্যস্ত তিনি গ্রামিক। গুপ্ত লেখমালায় গ্রামিকের সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে। এই গ্রামিক গ্রামের প্রতিনিধিস্বরূপ ছিলেন, না সরকারি কর্মচারী রূপে তাঁর কাজকর্ম পরিচালনা করতেন, তা স্পষ্ট নয়। স্মৃতিকার মনু গ্রামিককে রাজপুরুষরূপেই চিহ্নিত করেছেন।

এরূপ বিশাল ও বর্ধিষ্ণু গ্রামে এক একটি করে গ্রামসভা বা সংস্থা ছিল। সমকালীন লেখে এই গ্রামসংস্থাকে গ্রাম-অষ্টকুলাধিকরণ বা অষ্টকুলাধিকরণরূপে আখ্যাত করা হয়েছে। ৪৩৩ খ্রিস্টাব্দের ধনাইদহ তাম্রশাসনে গ্রাম-অষ্টকুলাধিকরণের সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে। এ উল্লেখে গ্রামে, বিশেষত বৃহৎ ও সমৃদ্ধ গ্রামে অষ্টকুলাধিকরণের অবস্থিতি নিঃসংশয়ে প্রমাণিত হচ্ছে। এর তাৎপর্য, গ্রামিক নিজের খেয়াল-খুশিমতো গ্রামের শাসনকার্য পরিচালনা করতেন না, গ্রাম-অষ্টকুলাধিকরণের পরামর্শক্রমেই তিনি দায়িত্ব পালন করতেন। গ্রামে শান্তি-শৃঙ্খলার ব্যবস্থাপনা, বাদ-বিসংবাদের নিষ্পত্তি, জনহিতকর কাজকর্মের অনুষ্ঠান, রাজস্বসংগ্রহ, জমির সীমা নির্ধারণ ইত্যাদি বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপ গ্রামিক ও গ্রাম-অষ্টকুলাধিকরণের মিলিত প্রচেষ্টায় নিষ্পন্ন হত।

গুপ্তযুগে এমন অনেক গ্রাম ছিল যা ছিল আয়তনে ক্ষুদ্র ও স্বল্পলোক-অধ্যুষিত। সে সব গ্রামের স্বতন্ত্র প্রশাসনিক ভূখণ্ডের মর্যাদা ছিল না। এরূপ কয়েকটি ছোটো গ্রাম নিয়ে গঠিত হত এক একটি স্বতন্ত্র গ্রামীণ প্রশাসনিক অঞ্চল। এ ধরনের প্রশাসনিক অঞ্চলের জন্য একটি করে প্রশাসনিক সংস্থা বা অষ্টকুলাধিকরণের সংস্থান ছিল। সব গ্রামেই যে গ্রাম-অষ্টকুলাধিকরণ স্থাপিত ছিল না লেখমালার সাক্ষ্যে তা সুপ্রমাণিত। অষ্টকুলাধিকরণের মতো কোনও গ্রামসভার অস্তিত্ব ছিল না এমন বহু গ্রামের উল্লেখ আছে সমকালীন লেখে। ৪৮৩ খ্রিস্টাব্দের সম্রাট বুধগুপ্তের রাজত্বকালীন দামোদরপুর তাম্রশাসনে একটি অষ্টকুলাধিকরণের উল্লেখ আছে, একাধিক গ্রামের উপর যার প্রশাসনিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিল। ওই দামোদরপুর লেখে দেখা যায়, একটি অষ্টকুলাধিকরণ পলাশবৃন্দক গ্রাম হতে চণ্ডগ্রামের কুটুম্বীদের জানাচ্ছে, নাভক নামে জনৈক গ্রামিকের আবেদনে এবং পুস্তপাল পত্রদাসের অনুমোদনে ২ দিনার মুদ্রার বিনিময়ে বায়িগ্রামের উত্তরদিগস্থ ১ কুল্যবাপ পরিমাণ জমি বিক্রয় করা হচ্ছে, ক্রীত জমি নাভক কতিপয় ব্রাহ্মণকে দান করেন। প্রতিভাত হচ্ছে, অন্তত দু’টি গ্রাম দামোদরপুর তাম্রশাসনে উল্লিখিত অষ্টকুলাধিকরণের প্রশাসনিক এলাকার অন্তর্ভুক্ত ছিল। হয়তো আরও কয়েকটি ক্ষুদ্র গ্রাম এ এলাকার অন্তর্গত ছিল। অর্থাৎ গুপ্তপূর্বে একদিকে যেমন এক একটি বিশাল ও বর্ধিষ্ণু গ্রাম নিয়ে এক একটি স্বতন্ত্র প্রশাসনিক ভূখণ্ড গড়ে উঠেছিল তেমনি একাধিক ছোটো গ্রাম নিয়ে এক একটি গ্রামীণ প্রশাসনিক অঞ্চল গঠনের প্রক্রিয়াও সমান্তরাল ধারায় বহমান ছিল।

গ্রাম-অষ্টকুলাধিকরণ বা অষ্টকুলাধিকরণের প্রকৃতি ও গঠন সম্পর্কে বিদ্বদ্-সমাজে বিতর্ক রয়েছে। প্রায়ই বলা হয়, বিহারে যা গ্রামজনপদ, মধ্যভারতে যা পঞ্চমণ্ডলী, উত্তর বাংলায় তাই অষ্টকুলাধিকরণ। কিন্তু এ বর্ণনায় অষ্টকুলাধিকরণের প্রকৃত রহস্য উন্মোচিত হয় না। সংস্থাটি যে আট সদস্যের সে বিষয়ে কোনও দ্বিমত নেই কিন্তু মতদ্বৈধ রয়েছে কুলের প্রকৃত অর্থ ও তাৎপর্য নিয়ে। ব্যক্তি, পরিবার, গোষ্ঠী, জাতি, মুখ্য বা প্রধান, শ্রেণি, নিগম বা সংঘ ইত্যাদি বিভিন্ন অর্থে কুল শব্দের প্রয়োগ আছে। সেক্ষেত্রে অষ্টাধিকরণের সদস্যরা হয়তো আটটি প্রধান পরিবার, গোষ্ঠী, জাতি বা বণিক-শিল্পী-সংঘের প্রতিনিধি ছিলেন কিংবা গ্রাম বা গ্রামীণ অঞ্চলের আটজন মাননীয় ব্যক্তি ছিলেন। তাঁরা সরকারি কর্মচারী নন, গ্রাম বা অঞ্চলবাসী কিংবা স্ব স্ব গোষ্ঠী কর্তৃক মনোনীত হতেন।

সাধারণ মন্তব্য

দেখা যাচ্ছে, গুপ্তসম্রাটেরা প্রজাদের মনে সম্ভ্রম উদ্রেকের জন্য গালভরা উপাধি ধারণ করেছেন, নিজেদের উপর দেবত্ব আরোপ করেছেন, তবু প্রশাসনের সর্বস্তরে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার দিকে তেমন দৃষ্টি দেননি। ফলে মৌর্য আমলে প্রশাসন-ব্যবস্থায় যে এককেন্দ্রিকতার প্রবণতা লক্ষ করা গিয়েছিল, গুপ্তপর্বে তা দেখা যায়নি। কাগজে-কলমে রাজা সর্বশক্তিমান হলেও কার্যক্ষেত্রে তিনি নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হতে পারেননি। সেক্ষেত্রে মৌর্য রাজাদের তুলনায় গুপ্ত রাজারা নিষ্প্রভই ছিলেন বলা যায়। কিন্তু ভারতবর্ষের প্রশাসনিক ইতিহাসের ক্ষেত্রে গুপ্তযুগ এক বিশেষ তাৎপর্য বহন করছে। এসময় জেলা ও গ্রামস্তরের প্রশাসনে জনপ্রতিনিধিদের অংশগ্রহণের ফলে শাসন-পরিচালনায় যে গণতান্ত্রিক বাতাবরণ সৃষ্টি হল তেমনটি পূর্বে আর কখনও হয়নি। রাজা-শাসিত রাষ্ট্রে জনপ্রতিনিধি তথ্য জনগণের হাতে ক্ষমতার হস্তান্তর আকস্মিকতার সঙ্গে ঘটে না, দীর্ঘ সংগ্রামের পর, অনেক মূল্যের বিনিময়েই জনগণের এ অধিকার আয়ত্ত হয়। দুঃখের বিষয়, প্রাচীন ভারতের প্রশাসনিক ইতিহাসের এই গৌরবোজ্জ্বল দিকটি আজও অনালোকিতই থেকে গেছে।

গ্রন্থপঞ্জি

  • ভাস্কর চট্টোপাধ্যায় ভারতের আর্থ-সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা (কলকাতা, ১৯৯৪)।
  • Agarwal, Ashvini Rise And Fall of The Imperial Guptas (Delhi. 1989)
  • Altekar. A S State And Government In Ancient India (Banaras, 1955).
  • Ganguly, DK Aspects Of Ancient Indian Administration (New Delhi, 1979).
  • Ghosal, U. N. A History Of Indian Political Ideas (Bombay, 1959).
  • Majumdar, R C The Classical Age (Bombay. 1962) The Vakataka Gupta Age (Lahore, 1946) A Comprehensive History of India. III, Part 1 (New Delhi, 1981),
  • Raychaudhuri H C Political History of Ancient India (Calcutta, 1953)
  • Saletore, B A Ancient Indian Political Thought And Institutions (Calcutta, 1963)
  • Sharma, R. S Aspects Of Political Ideas And Institutions In Ancient India (Banaras. (1959) Indian Feudalism (Delhi, 1980).

গুপ্তযুগের সমাজ-জীবন ও অর্থনীতি

সমাজ-জীবন

চতুর্বর্ণ : গুপ্তযুগের লেখমালা ও সংস্কৃত সাহিত্যে বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের উল্লেখ কম, ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণ্যধর্মের উল্লেখ সুপ্রচুর। সন্দেহ নেই, এই পর্বে বৌদ্ধ এবং জৈনদের প্রতিবাদী আন্দোলন স্তিমিত হয়ে আসে, ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও সংস্কৃতির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ফলে স্বাভাবিক কারণে চতুর্বর্ণ ব্যবস্থা সুদৃঢ় হয়, যাগ-যজ্ঞের ভূমিকা প্রাধান্য লাভ করে ও ব্রাহ্মণদের প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়। যাজ্ঞবল্ক্য বেদপাঠ, যজন ও দান উচ্চতর তিন বর্ণের আবশ্যিক কর্তব্য বলে নির্দেশ দিয়েছেন। ব্রাহ্মণের বৃত্তি সম্পর্কে তিনি বলেন, ব্রাহ্মণ প্রধানত অধ্যাপনা, যাজন ও প্রতিগ্রহের দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করবেন। দুর্দিনে ব্রাহ্মণ নিম্নবর্ণের বৃত্তি গ্রহণ করতে পারেন। কিন্তু অবস্থার উন্নতি হলে তিনি প্রায়শ্চিত্ত করবেন এবং নিম্নবৃত্তির দ্বারা অর্জিত ধন-সম্পদ ত্যাগ করবেন। ব্রাহ্মণ বর্ণশ্রেষ্ঠ কিন্তু বেদপাঠ না করলে তিনি পতিত হবেন। যাজ্ঞবল্ক্যের মতে শাসন ও যুদ্ধ হল ক্ষত্রিয়ের বৃত্তি কিন্তু অবস্থা বিশেষে ক্ষত্রিয় বৈশ্যের বৃত্তি গ্রহণ করতে পারবেন। কৃষি, পশুপালন, সুদের কারবার এবং ব্যবসা, বৈশ্যের এই চারটি বৃত্তির কথা বলেছেন যাজ্ঞবল্ক্য। মহাভারতের শান্তিপর্বে কৃষি, পশুপালন ও বাণিজ্য বৈশ্যের পক্ষে প্রশস্ত বলা হলেও সেখানে পশুপালনের উপরই বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। উচ্চতর তিন বর্ণ, বিশেষত ব্রাহ্মণের সেবা করে শূদ্র জীবিকা নির্বাহ করবেন, এই যাজ্ঞবল্ক্য-স্মৃতির বিধান। শূদ্রের প্রয়োজনবোধে ব্যবসা ও কারিগরি শিল্প করার অধিকারও সেখানে স্বীকৃত হয়েছে। শান্তিপর্বে শূদ্রের জীবিকারূপে পশুপালনেরও উল্লেখ আছে। বরাহমিহিরের বৃহৎসংহিতায় বেদের বিভাগ অনুসারে ব্রাহ্মণদের ঋগবেদী, সামবেদী, আথবর্ণ ইত্যাদি কয়েকটি শাখায় বিভক্ত করা হয়েছে। অনেক ব্রাহ্মণ ছিলেন যাঁরা চার বেদে পারদর্শী ছিলেন। তাঁদের চাতুর্বিদ্য বলা হত। এক বেদে দক্ষ ব্রাহ্মণকে শ্রোত্রিয় বলা হত। ঠিক সময় উপনয়ন না হলে ব্রাহ্মণ ব্রাত্য বনে যেতেন।

ব্রাহ্মণের বিশেষ অধিকার : ধর্মশাস্ত্রে ব্রাহ্মণের কয়েকটি বিশেষ অধিকারের কথা বলা হয়েছে –

  • যাজ্ঞবল্ক্য-স্মৃতিতে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণকে রাজস্বদান থেকে অব্যহতি দেওয়া হয়েছে।
  • যাজ্ঞবল্ক্য ও কাত্যায়ন বলেছেন, ব্রাহ্মণ গুরুতর অপরাধ করলেও তাঁর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা বা তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া চলবে না, তাঁকে জরিমানা বা বড়জোর নির্বাসন-দণ্ড দেওয়া যেতে পারে।
  • সমকালীন নাটক মৃচ্ছকটিকেও অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত হয়েছে। সেখানে দেখা যায়, বিচারক হত্যার অপরাধে চারুদত্তকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন কিন্তু ব্রাহ্মণত্বের জন্য তাঁকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করেননি।
  • এ সময় বেদজ্ঞ ও ধর্মপ্রাণ ব্রাহ্মণদের অনুকূলে নিষ্কর জমি বা গ্রামদানের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। ব্রাহ্মণরা যাতে তাঁদের ধর্মীয় ও শিক্ষামূলক কার্যকলাপ নিষ্পন্ন করতে পারেন তার জন্যই এই দান। অনাবাদি অথচ চাষযোগ্য, এমন জমিই সাধারণত দান করা হত। ব্রাহ্মণরা সাধারণত নিজের হাতে চাষ করতেন না, ভাগচাষি বা শ্রমিকদের দিয়ে সে কাজ করাতেন। উদার হস্তে ব্রাহ্মণদের উদ্দেশ্যে ভূমিদানের ফলে তাঁদের কেবল আর্থিক সংগতিই বৃদ্ধি পেল না, স্থানীয় অঞ্চলে তাঁদের সামাজিক মর্যাদা বাড়ল। সংগতিসম্পন্ন ও প্রভাবশালী এক ব্রাহ্মণ ভূস্বামী গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটল।

শূদ্রদের অবস্থার উন্নতি : শূদ্রদের অবস্থার উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটল এ পর্বে –

  • এই সময় হতে শূদ্ররা ব্যাপকভাবে কারিগরি শিল্পে অংশগ্রহণ করতে থাকেন। কামন্দকীয় নীতিসার, মার্কণ্ডেয় পুরাণ ও বিষ্ণু-পুরাণে শিল্পকর্ম শূদ্রদের স্বাভাবিক জীবিকারূপে স্বীকৃতি পেয়েছে। বৃহস্পতি ধাতু, দারু, বস্ত্র, প্রস্তর ও চর্ম শিল্পে শূদ্রদের অংশগ্রহণের কথা উল্লেখ করেছেন।
  • অমরকোষে শূদ্রবর্ণের বীণাবাদক, বাঁশিবাদক, বাজনাদার, নট ও নৃত্যশিল্পীর পরোক্ষ উল্লেখ আছে।
  • যেসব শূদ্র কারিগরি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাঁরা নিজস্ব ‘শ্রেণী বা পেশাদারি সংগঠন গঠন করে নিজেদের সুসংহত ও সংঘবদ্ধ করেন। এসব সংগঠনের নিজস্ব আইন কানুন ছিল এবং তা রাষ্ট্রের অনুমোদন লাভ করেছিল। লোকেরা অনেক সময় এ ধরনের শ্রেণীতে সুদের বিনিময়ে তাঁদের টাকা আমানত রাখতেন। শ্রেণী সেই টাকা তার ব্যবসায়ে খাটাত বা চড়া সুদে অন্য প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে ধার দিত। বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজে শ্রেণী অংশগ্রহণ করত। শ্রেণী গড়ে ওঠার ফলে শূদ্র কারিগরদের সামাজিক প্রতিপত্তি ও আর্থিক সংগতি, দুই-ই বৃদ্ধি পেয়েছিল।
  • বৃহস্পতি ও যাজ্ঞবল্ক্য শূদ্রের ব্যবসা-বাণিজ্যে অধিকার অনুমোদন করেছেন। পণ্যাদির কেনাবেচা করে শূদ্র জীবিকা অর্জন করবেন, এ কথা মার্কণ্ডেয় পুরাণেও বলা হয়েছে। তবে উচ্চতর বর্ণের তুলনায় শূদ্রের উপর করের বোঝা বেশিই ছিল। বৃহস্পতি বলেন, শূদ্র তাঁর লাভের এক-ষষ্ঠাংশ রাজাকে দেবেন, বৈশ্য দেবেন এক নবমাংশ, ক্ষত্রিয় এক-দশমাংশ, এবং ব্রাহ্মণ এক-বিংশতি অংশ।
  • শূদ্রদের অনেকেই সেনাবাহিনী, খেত-খামার, গোশালা, মালবহন, জিনিসপত্রের ফেরি করা ও আরও নানা কাজে নিযুক্ত ছিলেন। এসব কাজে বেতন ছিল। বেতন পূর্বেও ছিল কিন্তু এ সময় সম্ভবত তার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। যেখানে মনুর বিধানে গরুর দুধের মাত্র এক-দশমাংশ গোপালকের প্রাপ্য, সেখানে শান্তিপর্বে গোপালকের পাওনা এক-ষষ্ঠাংশে ধার্য হয়েছে। শান্তিপর্বে আরও বলা হয়েছে, ভৃত্য একশোটি গরু তত্ত্বাবধান করলে দু’টি গরু তাঁর প্রাপ্য হবে। নারদ বলেছেন, দু’শোটি গরুর দায়িত্ব নিলে ভৃত্যের ফি-বছর একটি করে দুগ্ধবতী গরু পাওনা হবে। তা ছাড়া প্রতি অষ্টম দিনে সকল গরুর দুধ তাঁর প্রাপ্য হবে। যেসব শূদ্র খেত-খামারে ভাগচাষির কাজ করতেন তাঁদেরও পারিশ্রমিক বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই নতুন ব্যবস্থাপনার সুযোগ গ্রহণ করে বহু শূদ্র আর্থিক ক্ষেত্রে স্বচ্ছল হয়ে উঠেছিলেন।
  • ধর্মীয় ক্ষেত্রেও শূদ্রের অধিকার প্রসারিত হয়।
    • শান্তিপর্বে বলা হয়েছে, শূদ্র যজ্ঞের অনুষ্ঠান করতে পারেন তবে সে যজ্ঞে বৈদিক মন্ত্র উচ্চারিত হবে না।
    • মার্কণ্ডেয় পুরাণের বক্তব্যও অনুরূপ।
    • যাজ্ঞবল্ক্য বিধান দিয়েছেন, শূদ্র শ্রাদ্ধানুষ্ঠান, ব্রত এবং নমঃ মন্ত্রের দ্বারা প্রতিদিন পঞ্চমহাযজ্ঞ সম্পাদন করতে পারবেন। (পঞ্চমহাযজ্ঞ বলতে অধ্যয়ন-অধ্যাপনা, পিতৃলোকের তর্পণ, হোম, পশু-পাখিকে অন্নাদি দান ও অতিথিসেবা বোঝায়।)
    • শান্তিপর্বে শূদ্রের বেদ শ্রবণের অধিকার স্বীকৃতি পেয়েছে।
    • কিন্তু ভাগবত-পুরাণে বলা হয়েছে, বেদ নয়, মহাভারতই শূদ্র ও নারীদের পক্ষে প্রশস্ত। তবে এক্ষেত্রে অধ্যয়ন না শ্রবণের কথা বলা হয়েছে তা স্পষ্ট নয়।
    • ভবিষ্য-পুরাণে আছে, শূদ্র পুরাণ পাঠ করতে পারবেন না, কিন্তু পুরাণ শুনতে পারবেন।
    • পঞ্চম বেদ যাকে বলে সেই নাট্যশাস্ত্রের উপর সকল বর্ণের অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। নাট্যশাস্ত্রকার স্বয়ং এই অভিমত ব্যক্ত করে গেছেন।
    • সাংখ্য ও যোগ, দর্শনের এ দু’টি শাখাও শূদ্ররা অনুশীলন করতে পারতেন।
    • কর্ণবেধন ও চূড়াকরণ, এ দু’টি সংস্কার পালনের অধিকারও শূদ্রদের দেওয়া হয়েছে।
    • গুপ্তপর্বে বৈষ্ণবধর্ম ও তন্ত্রসাধনা বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। এ দু’টি ধর্মীয় আন্দোলনে শূদ্র বর্ণ সম্পর্কে উদার মনোভাব ব্যক্ত হয়েছে। বৈষ্ণব গ্রন্থাদিতে জোর দিয়ে বলা হয়েছে, কৃষ্ণ-নারায়ণ-বাসুদেবের প্রতি অচলা ভক্তি থাকলে শূদ্র ও নারীরাও মোক্ষ লাভ করতে পারেন। তন্ত্রে তো বর্ণভেদই অস্বীকৃত হয়েছে। খ্রিস্টীয় ৫ম শতকে লেখা তন্ত্রের বই জয়াখ্যসংহিতায় বলা হয়েছে, বর্ণনির্বিশেষে যে কোনও ব্যক্তি তন্ত্রসাধনায় দীক্ষা নিতে পারেন। বর্ণ সম্পর্কে বৈষ্ণবধর্ম ও তন্ত্রসাধনার উদার দৃষ্টিভঙ্গি গুপ্তযুগে শূদ্রের ধর্মীয় অধিকার লাভের পথ প্রশস্ত করেছিল।
  • এতদিন শাস্ত্রীয় বিধানে শূদ্রের দান ব্রাহ্মণাদি জাতির কাছে অগ্রহণীয় বলে বিবেচিত হত। কিন্তু শূদ্রের আর্থিক সংগতি ও ধর্মীয় অধিকার বিস্তৃতির সঙ্গে অবস্থার পরিবর্তন ঘটল। শূদ্রের দান করার অধিকার শাস্ত্রের স্বীকৃতি পেল।
    • মৎস্য-পুরাণে বলা হয়েছে, দানের মাধ্যমেই শূদ্রের সর্ব কামনা সিদ্ধ হতে পারে।
    • অনুশাসনপর্বে উল্লেখ আছে, দানের অনুশীলনের দ্বারাই শূদ্রের স্বর্গলাভ বা পরজন্মে ব্রাহ্মণত্ব অর্জন সম্ভব।
    • শূদ্রের গৃহে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব্রাহ্মণ পুরোহিতের প্রয়োজন হত। পুরোহিতেরা শূদ্রের নিকট থেকে দান গ্রহণ করতেন।

বর্ণব্যবস্থার কঠোরতা হ্রাস : একই বংশে পুরুষ পরম্পরায় একই বৃত্তির অনুসরণ ও সম্পূর্ণ বিবাহ বর্ণব্যবস্থার দু’টি মূল স্তম্ভ। কিন্তু পৈতৃক বৃত্তি ত্যাগ ও নতুন বৃত্তি গ্রহণের বহু নিদর্শন এই পর্বে পাওয়া যাবে –

  • গুপ্তরাজেরা সম্ভবত বর্ণে বৈশ্য ছিলেন অথচ তাঁরা রাজপদ অর্থাৎ ক্ষত্রিয়বৃত্তি অবলম্বন করেছিলেন। অনুমান করা যায়, তাঁদের সৈন্যবাহিনীর অনেকেই বৈশ্য ছিলেন।
  • ময়ূর শর্মা বর্ণে ব্রাহ্মণ ছিলেন। কিন্তু তিনি পৈতৃক বৃত্তি ছেড়ে ক্ষত্রিয়ের বৃত্তি গ্রহণ করেছিলেন এবং কর্ণাটকে কদম্ব রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন।
  • মহারাজ মাতৃবিষ্ণু ছিলেন ব্রাহ্মণ সাধু ইন্দ্রবিষ্ণুর প্রপৌত্র। তিনি গুপ্ত রাজাদের অধীনে প্রাদেশিক শাসনকর্তার পদ গ্রহণ করেছিলেন।
  • খ্রিস্টীয় ৫ম শতকের একখানি লেখে দু’জন ক্ষত্রিয়ের উল্লেখ আছে। তাঁরা উচ্চ গাঙ্গেয় অববাহিকায় কোনও এক শহরে ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন।
  • এই পর্বে উৎকীর্ণ মন্দসোর লেখে উল্লেখ আছে, গুজরাতের লাট অঞ্চলের একদল রেশমশিল্পী মালবে এসে কালক্রমে সৈন্য, তিরন্দাজ, চারণকবি, জাদুকর ও জ্যোতিষীর জীবিকা অবলম্বন করেছিলেন। অর্থাৎ শাস্ত্রীয় অনুশাসন যাই হোক না কেন, গুপ্তযুগে এক জাতির লোকদের অন্য জাতির বৃত্তি গ্রহণে সে রকম কোনও বাধা ছিল না।

তেমনি বিবাহাদিতেও অনেক সময় শাস্ত্রীয় নির্দেশ মানা হত না –

  • বৈশ্য নৃপতি দ্বিতীয় চন্দ্ৰ গুপ্তের কন্যা প্রভাবতী গুপ্তার সঙ্গে বাকাটকরাজ দ্বিতীয় রুদ্রসেনের বিবাহ হয়েছিল। রুদ্রসেন ব্রাহ্মণ ছিলেন।
  • মালবিকাগ্নিমিত্রে ব্রাহ্মণ অগ্নিমিত্রের সঙ্গে ক্ষত্রিয় রাজকন্যা মালবিকার বিবাহের উল্লেখ আছে।
  • গুপ্তবংশের রাজকুমারদের সঙ্গে কদম্ববংশের ব্রাহ্মণরাজ কাকুৎহবর্মার কন্যাদের বিবাহ হয়েছিল।
  • সমকালীন নাটক মৃচ্ছকটিকে দেখা যায়, ব্রাহ্মণ চারুদত্ত গণিকা বসন্তসেনাকে বিবাহ করেছিলেন এবং ব্রাহ্মণ শর্বলিক গণিকার সহচরী মদনিকার সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন।
  • যাজ্ঞবল্ক্য শূদ্র পত্নীর পুত্রের ব্রাহ্মণ পিতার সম্পত্তিতে অধিকার অনুমোদন করেছেন। ব্রাহ্মণ সন্তান যে কখনও কখনও শূদ্র কন্যার পাণিগ্রহণ করতেন, তা যাজ্ঞবল্ক্যের বিধানে স্পষ্ট।

শাস্ত্রকারেরা অবশ্য বিভিন্ন বর্ণের লোকদের গ্রাম বা শহরে একত্রে বসবাস অনুমোদন করেননি, এক এক বর্ণের জন্য এক একটি অঞ্চল নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। বরাহমিহির বলেন, ব্রাহ্মণ বাস করবেন শহর বা গ্রামের উত্তরাঞ্চলে, ক্ষত্রিয় পূর্বাঞ্চলে, বৈশ্য দক্ষিণাংশে এবং শূদ্র পশ্চিম প্রান্তে। কোন বর্ণের লোকদের কখানি করে ঘর থাকবে, বৃহৎসংহিতায় তারও নির্দেশ আছে। তবে সাধারণত গৃহস্বামীর আর্থিক সংগতির উপর বাড়ির ঘরের সংখ্যা নির্ভর করে। সে ক্ষেত্রে বৃহৎসংহিতার বিধান কতদূর বাস্তবানুগ ছিল তা অনুমানের বিষয়।

সংকর জাতি

সমকালীন ধর্মশাস্ত্র ও বৃহৎসংহিতায় এমন অনেক জাতির উল্লেখ আছে যাদের সংকর জাতি আখ্যা দেওয়া হয়েছে। বৃহৎসংহিতায় ডোম্ব, নিষাদ, পারাশব, শ্বপচ এবং উরু নামে এরূপ পাঁচটি সংকর জাতির কথা বলা হয়েছে। যাজ্ঞবল্ক্য-স্মৃতির সংকর জাতির তালিকাটি দীর্ঘতর। এই তালিকায় চণ্ডাল, শ্বপদ, ক্ষত্রি, সুত, বৈদেহিক, মাগধ, আয়োগব, অম্বষ্ঠ, নিষাদ, মাহিয্যক, বেণ, শৌস্তিক, রথকার, মূর্ধাভিষিক্ত প্রভৃতি জাতি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। জাতিগুলির উৎপত্তি ও বৃত্তি সম্পর্কে ধর্মশাস্ত্রগ্রন্থাদিতে বিশদ আলোচনা আছে –

  • ডোম্বরা বর্তমানে ডোম নামে পরিচিত। শ্মশান-ঘাটের তদারকি, গান-বাজনা, ঝুড়ি ও অনুরূপ জিনিসপত্র বিক্রি তাঁদের পেশা ছিল। তাঁরা যমের পূজা করতেন।
  • নিষাদরা ব্রাহ্মণ পুরুষ ও শূদ্র নারীর সন্তান। তাঁরা কখনও ভিলদের, কখনওবা পারাশবদের সমগোত্রীয় বলে বর্ণিত হয়েছেন। শিকার ও লুণ্ঠন ছিল তাঁদের বৃত্তি। তাঁদের গায়ের রঙ কালো, আকৃতি খর্ব, নাক বোঁচা, চোয়াল কঠিন ও চুল তামাটে।
  • শূদ্র স্বামী ও ব্রাহ্মণ কন্যার সন্তান পারাশব। উগ্র পিতা ও ক্ষত্রি মাতা বা ক্ষত্রি পিতা ও উগ্র মাতা বা চণ্ডাল পিতা ও ব্রাহ্মণ মাতার বংশজ শ্বপচ। তাঁরা শৃপক নামেও পরিচিত। তাঁরা অন্ত্যজ, চণ্ডালদের সমগোত্রীয়। গ্রাম বা শহরের বাইরেই তাদের বাস। আবর্জনা পরিষ্কার করা তাঁদের পেশা।
  • ক্ষত্রিয় পিতা ও শূদ্র মাতা হতে উগ্র জাতির উৎপত্তি। কৃষি, পশুপালন ও শিকার তাদের জীবিকা।
  • সংকর জাতির সর্বনিম্ন স্তরে চণ্ডালদের অবস্থান। শূদ্র পিতা ও ব্রাহ্মণ মাতার সংকর তাঁরা। তাঁরা অস্পৃশ্য। তাঁদের স্পর্শ লাগলে ব্রাহ্মণকে স্নান করে পবিত্র হতে হবে, যাজ্ঞবল্ক্যের এই বিধান। তাঁদের বাস গ্রাম বা শহরের বাইরে। শ্মশানঘাটের কাজ, বেওয়ারিশ মৃতদেহ বহন ও দাহ, ঘাতকবৃত্তি, রাতের বেলা চোরধরা ইত্যাদি তাঁদের পেশা। রাতে তাঁদের গ্রাম বা শহরে ঢোকা নিষিদ্ধ ছিল। দিনের বেলা গ্রাম বা শহরে প্রবেশের সময় তাঁদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যমূলক চিহ্ন দেহে ধারণ করতে হত। ফা শিয়েন বলেছেন, শহরে বা হাটে প্রবেশের সময় চণ্ডালরা লাঠি ঠুকে শব্দ করে অন্যদের তাদের আগমন-বার্তা জানিয়ে দিতেন যাতে পথচারীরা তাঁদের স্পর্শ এড়িয়ে চলেন। তিনি মাছ-ধরা, শিকার ও মাংস-বিক্রি চণ্ডালদের বৃত্তি বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি আরও বলেছেন, ভারতীয় জাতিদের মধ্যে শুধু চণ্ডালরাই সুরা পান করেন ও পেঁয়াজ-রসুন খান। ভাগবত-পুরাণে বলা হয়েছে, বদমেজাজী চণ্ডালরা মেয়ে অপহরণ করেন।
  • ক্ষত্রিদের পিতা শূদ্র, মা ক্ষত্রিয়। তাঁরা শিকারজীবী।
  • সূতরা ক্ষত্রি পুরুষ ও ব্রাহ্মণ নারীর মিলন জাত। রথচালনা তাঁদের মুখ্য পেশা। রাজাদের গুণকীর্তি আবৃত্তি করা, রথ, হাতি ও ঘোড়ার রক্ষণাবেক্ষণ ও চিকিৎসা তাঁদের জীবিকা বলে বায়ু-পুরাণে বর্ণনা করা হয়েছে।
  • বৈশ্য পুরুষ ও ব্রাহ্মণ নারীর সংকর বৈদেহিক। অন্দরমহলে পাহারার কাজ, পশুপালন ও চর্মসামগ্রী বিক্রি তাঁদের পেশা।
  • বৈশ্যের ঔরসে ক্ষত্রিয় রমণীর গর্ভে মাগধদের জন্ম। অনেকের মতে তাঁদের পিতা শূদ্র, মা বৈশ্য। স্থলবাণিজ্য এবং চাটুকারিতা তাঁদের জীবিকা ছিল।
  • শূদ্র পুরুষ ও বৈশ্য নারীর সন্তান আয়োগব। কাঠকাটা, তাঁত বোনা ও ধাতুর পাত্র তৈরি করা তাঁদের পেশা।
  • ব্রাহ্মণ পিতা ও বৈশা মা হতে অম্বষ্ঠদের উৎপত্তি হয়েছে। তাঁদের প্রধান বৃত্তি চিকিৎসা ও কৃষি।
  • মাহিষ্য বা মহিষকরা ক্ষত্রিয় পুরুষ ও বৈশ্য নারীর সংকর। কৃষি, চিকিৎসা, জ্যোতিষ ইত্যাদি নানা বৃত্তি তাঁদের উপজীবিকা।
  • বৈশ্য ও শূদ্র বা মাহিষ্য ও করণের সংকর রথকার। রথ নির্মাণ তাঁদের পেশা।
  • বেণ বা বৈণরা বৈদেহিক ও অম্বষ্ঠ বা শূদ্র ও ক্ষত্রিয় নর-নারীর সংকর।
  • শৌণ্ডিকরা ছিলেন মদ ব্যবসায়ী।
  • সুবর্ণকারেরা সোনার গহনা তৈরি করতেন।
  • যাজ্ঞবল্ক্য-স্মৃতি ও গুপ্তযুগের লেখমালায় কায়স্থদের উল্লেখ আছে। যাজ্ঞবল্ক্য তাঁদের উৎপীড়ক রাজপুরুষ বলে বর্ণনা করেছেন। লেখমালায় লেখক হিসাবে তাঁদের পরিচিতি। বিজ্ঞানেশ্বর তাঁর মিতাক্ষরা ভাষ্যে কায়স্থদের লেখক এবং গণকরূপে বর্ণনা করেছেন। গুপ্তযুগেই সম্ভবত এক বৃত্তিজীবী গোষ্ঠী রূপে (জাতি রূপে নয়) কায়স্থদের উদ্ভব হয়েছিল।
  • এই পর্বে মূর্ধাভিষিক্ত নামে আর একটি নতুন জাতির উৎপত্তি হয়। তাঁরা ছিলেন ব্রাহ্মণ পুরুষ ও ক্ষত্রিয় নারীর মিলনজাত সন্তান। জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিষ-চর্চা তাঁদের পেশা ছিল।

সংকর জাতিগুলির তালিকার দিকে দৃষ্টি দিলে বোঝা যাবে, বৈদেহিক, মাগধ প্রভৃতি ভারতের কয়েকটি আদি আঞ্চলিক উপজাতি এই তালিকায় স্থান পেয়েছে। কিরাত, চণ্ডাল, শ্বপচ, আরোগব, ডোম্ব, উগ্র এবং স্বর্ণকারদের মতো বৃত্তিধারী জনগোষ্ঠীও এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এসব জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগই তথাকথিত ‘দাস’ বা ‘দস্যু বর্ণের আদি উপজাতি। মনু ও যাজ্ঞবল্ক্য সংকর তত্ত্ব উদ্ভাবন করে এসব আদি উপজাতিদের ভারতীয় জনসমাজের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। বেশির ভাগ সংকর জাতি শূদ্রবর্ণে স্থান পেয়েছে। চণ্ডাল, মৃতপ, সূত্রধর, রজক, কর্মকার, তন্তুবায় প্রভৃতি কয়েকটি সংকর জাতি যে শূদ্রবর্ণের অন্তর্ভুক্ত তা মহাভাষ্যকার পতঞ্জলি বহু পূর্বেই উল্লেখ করে গেছেন। তেমনি করণ, অম্বষ্ঠ, উদ্গ্র (সম্ভবত উগ্ন), মাগধ, মাহিষ্য, ক্ষত্রি, সূত, বৈদেহক, রথকার এবং চণ্ডাল জাতি অমরকোষের শূদ্রবর্গে স্থান পেয়েছে।

বিদেশিদের ভারতীয়করণ

বিদেশিদের ভারতীয়করণ প্রক্রিয়া এই পর্বেও যথেষ্ট সক্রিয় ছিল। গুপ্তযুগের পূর্বেই শক, যবন, পহ্লব, কুষাণ, আভীর প্রভৃতি বিদেশি জাতির লোকেরা ভারতে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন। তাঁরা এ দেশের আচার-ব্যবহার, রীতি-নীতি, ধর্ম-সংস্কৃতি, ভাষা-লিপি গ্রহণ করে ভারতীয় সমাজের অন্তর্ভুক্ত হন। তাছাড়া তাঁরা রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন বলে শাস্ত্রকারেরা তাঁদের উপেক্ষা করতে পারেননি। ব্রাত্য ক্ষত্রিয় আখ্যা দিয়ে, কখনওবা শূদ্র পরিচয় দিয়ে তাঁরা বিদেশিদের বর্ণকাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করেন। এ সময় হূণ নামে এক বিদেশি জাতি ভারতে প্রবেশ করে এক শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করে। মহাভারতের সভাপর্ব, মৎস্য-পুরাণ ও রঘুবংশে হুণদের উল্লেখ আছে। অন্যান্য বিদেশিদের মতো হুণরাও ভারতীয় ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতি গ্রহণ করেন। জৈনগ্রন্থ কুবলয়মালায় বলা হয়েছে, হূণরাজ তোরমাণ শেষজীবনে জৈনধর্ম গ্রহণ করে পাঞ্জাবের চন্দ্রভাগা নদীর তীরে পব্বৈয়া গ্রামে বাস করতেন। রাজা যশোধর্মার মন্দসোর অভিলেখে বলা হয়েছে, হূণনায়ক মিহিরকুল শিবের ভক্ত ছিলেন। তাঁর মুদ্রায় বৃষের প্রতিকৃতি উৎকীর্ণ আছে। বৃষ শিবের প্রতীক। মুদ্রায় বৃষের প্রতিকৃতি উৎকীর্ণ করে মিহিরকুল শিবের প্রতি তাঁর অনুরাগ প্রকাশ করেছেন। তাছাড়া তাঁর মুদ্রায় সংস্কৃত ভাষা ও ব্রাহ্মী লিপির ব্যবহার দেখা যায়। সন্দেহ নেই, রাজা-রাজড়াদের আদর্শ অনুসরণ করে হুণ গোষ্ঠীর অন্যান্য সদস্যরাও ভারতীয় ধর্ম এবং সংস্কৃতি গ্রহণ করেছিলেন। হুণরা পরবর্তী যুগে রাজপুতদের ছত্রিশটি বিশুদ্ধ শাখার একটি রূপে স্বীকৃতি লাভ করেন।

নারী-সমাজ

  • শিক্ষা ও নারী : জন্মলগ্ন থেকেই মেয়েদের অধিকারহীনতার লাঞ্ছনা ভোগ করতে হত –
    • তাঁদের জাতকরণ, নামকরণ এবং চূড়াকরণ অনুষ্ঠানে বেদমন্ত্র উচ্চারিত হত না। অথচ পুত্রদের ক্ষেত্রে বেদমন্ত্র আবশ্যিক ছিল।
    • যাজ্ঞবল্ক্য মেয়েদের উপনয়ন নিষিদ্ধ করেছেন। শিক্ষার্থীর জ্ঞানরাজ্যে প্রবেশের ছাড়পত্র ছিল এই উপনয়ন। মনু ও যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন, মেয়েদের বিবাহই হল উপনয়ন, পতিগৃহে বাসই গুরু সান্নিধ্য।
    • সংস্কৃত নাটকে দেখা যায়, নায়ক সংস্কৃতে কথা বলছেন কিন্তু নায়িকা প্রাকৃত ভাষায় তার প্রত্যুত্তর দিচ্ছেন। এতে নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণই প্রতিফলিত হয়েছে।
    • মহাভারত নারীদের পক্ষে প্রশস্ত বলে ভাগবত-পুরাণে অভিমত ব্যক্ত হয়েছে। কিন্তু এখানে মহাভারতের পাঠ না শ্রবণের কথা বলা হয়েছে তার কোনও স্পষ্ট ইঙ্গিত নেই।

তবে বৃহৎসংহিতায় সর্ববিদ্যাপারদর্শিনী এক ব্রহ্মবাদিনী নারীর উল্লেখ আছে। ব্রহ্মবাদিনী মহিলারা আজীবন কুমারী থেকে অধ্যয়ন অধ্যাপনায় জীবন অতিবাহিত করতেন। অমরকোষে আচার্যা ও উপাধ্যায়ার উল্লেখ আছে। সমগ্র বেদ যিনি অধ্যয়ন করান, তিনিই আচার্য বা আচার্যা। বেদের একাংশ যিনি অধ্যাপনা করেন তিনিই উপাধ্যায় বা উপাধ্যায়া। সমকালীন সাহিত্যিক সূত্র থেকে জানা যায়, তখনকার দিনের মেয়েরা প্রাচীন ইতিহাস ও কাব্য পড়তেন, কবিতাও রচনা করতেন। পুরুষশাসিত সমাজের কঠোর বিধি-নিষেধ সত্ত্বেও কিছু লড়াকু মহিলা পরিশ্রম, নিষ্ঠা এবং মেধার জোরে জ্ঞানের চূড়ায় আরোহণ করেছিলেন, বৃহৎসংহিতা ও অমর কোষের সাক্ষ্য অন্তত তাই প্রমাণ করে। (অধ্যাপিকা সুকুমারী ভট্টাচার্য (প্রাটীন ভারত: সমাজ ও সাহিত্য, কলকাতা, ১৪০১, পৃষ্ঠা ১২২) মনে করেন, প্রাচীন ভারতে নারীকে অসহায়, পরমুখাপেক্ষী করার উদ্দেশ্যেই তাঁকে ‘অশিক্ষিত’ করে রাখা হত। এ মন্তব্য সঠিক নয়। প্রথমত, প্রাচীন ভারতীয় নারী সমাজকে ‘অশিক্ষিত’ বলা চলে না। দ্বিতীয়ত, পিতার উপরই সাধারণত তাঁর সন্তানদের শিক্ষার দায়িত্ব থাকে। কোনও পিতাই চান না তাঁর কন্যা চিরকাল অসহায় থাকুক, পরমুখাপেক্ষী হোক। সে সময় শিক্ষার্থীকে গুরুগৃহে থেকে লেখাপড়া শিখতে হত। কন্যা বছরের পর বছর গুরুগৃহে একাকী অবস্থান করুক, কোনও পিতারই তা কাম্য ছিল না।) সমকালীন কতিপয় লড়াকু মহিলার বিদ্যাবত্তার সপ্রশংস উল্লেখ আছে বাৎস্যায়নের কামসূত্রে। (সন্ত্যপি খলু শাস্ত্রপ্রহতবুদ্ধয়ো গণিকা রাজপুত্রো মহামাত্রদুহিতরশ্চ। কামসূত্র ১, ৩, ১২।) এই গ্রন্থে বলা হয়েছে, গণিকা, রাজকন্যা ও মন্ত্রিতনয়ারা শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছেন।

  • বিবাহের বয়স : মেয়েদের বিবাহের বয়স প্রসঙ্গে বিষ্ণু-পুরাণে বলা হয়েছে, পাত্রের বয়স হবে পাত্রীর বয়সের তিনগুণ। এ থেকে মনে হয়, ঋতুমতী হওয়ার পূর্বেই মেয়েদের বিবাহ হত। যাজ্ঞবল্ক্যও বাল্যবিবাহের সপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। সুশ্রুত বলেছেন, যেসব মায়েদের বয়স ষোলো বছরের বেশি, তাঁদের সন্তানরাই স্বাস্থ্যবান হয়। এই উক্তি থেকে মনে হয়, সমাজে বাল্যবিবাহের প্রচলন থাকলেও তিনি তা সমর্থন করেননি। যুবতী না হলে মেয়েদের বিবাহ দেওয়া অনুচিত বলে নারদ ও বরাহমিহির অভিমত ব্যক্ত করেছেন। বাৎস্যায়ন মেয়েদের বাল্য বিবাহের পক্ষে। কিন্তু তিনি প্রাক্-বিবাহিত পর্বে পাত্র-পাত্রীর প্রণয় স্থাপনের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তাতে মনে হয়, যৌবন বা কৈশোর কোনও পর্যায়কেই তিনি বিবাহের পক্ষে অনুপযুক্ত মনে করেননি। স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বয়সের ব্যবধান সম্পর্কে তাঁর অভিমত, পাত্র পাত্রীর তুলনায় বয়সে তিন থেকে সাত বছরের বড় হবেন। অনুমান করা চলে, সমাজে বাল্যবিবাহের পাশাপাশি বয়স্থা কন্যাদের বিবাহেরও প্রচলন ছিল। যেসব মেয়েদের অল্প বয়সে বিবাহ হত লেখাপড়ার সুযোগ তাঁদের বড় একটা ছিল না।
  • বিবাহ ও তার প্রকারভেদ : সবর্ণ বিবাহই ছিল সাধারণ রীতি। তবে পাত্র-পাত্রীর পিতার দিক থেকে ঊর্ধ্বতন সাত পুরুষ ও মায়ের দিক থেকে ঊর্ধ্বতন পাঁচ পুরুষের মধ্যে সপিণ্ড সম্পর্ক থাকলে বিবাহ হতে পারত না। দক্ষিণ ভারতে মামাতো-পিসতুতো ভাই-বোনদের মধ্যে বিবাহের প্রচলন ছিল। বৃহস্পতি এই বিবাহ অনুমোদন করেছেন। কাম্য না হলেও অসবর্ণ বিবাহও হত। ধর্মশাস্ত্রে অসবর্ণ বিবাহের প্রচুর উল্লেখ আছে। ব্রাহ্ম, আর্য, প্রাজাপত্য, দৈব, গান্ধর্ব, আঙ্গুর, রাক্ষস ও পৈশাচ –এই আট প্রকার বিবাহের উল্লেখ করেছেন যাজ্ঞবল্ক্য। এদের মধ্যে প্রথম চার প্রকার বিবাহ তিনি অনুমোদন করেছেন কিন্তু পরবর্তী বিবাহগুলিকে তিনি নিন্দনীয় বলেছেন। আসলে ব্রাহ্মাদি বিবাহে অভিভাবকের সম্মতিতে যজ্ঞানুষ্ঠানের মাধ্যমে মনোনীত পাত্রে কন্যাদান হয় বলে এই বিবাহ শাস্ত্রের অনুমোদন পেয়েছে। অনুমোদিত না হলেও অন্য বিবাহগুলিও সমাজে প্রচলিত ছিল। অভিজ্ঞানশকুন্তলমে গান্ধর্ব বিবাহ প্রশংসিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, রাজর্ষি কন্যারা অনেক সময় গান্ধর্বমতে বিবাহ করতেন, আর সে বিবাহে পিতাদের সানন্দ সমর্থন থাকত। বাৎস্যায়ন বিবাহের ক্ষেত্রে অভিভাবকের মতের চেয়ে পাত্র-পাত্রীর নিজস্ব অভিমতের উপরই বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছেন কিন্তু পাত্র-পাত্রীদের নিজেদের বর্ণের মধ্যেই নির্বাচন সীমিত রাখতে হবে, এমন শর্তও তিনি আরোপ করেছেন।
  • পুরুষ-সমাজে বহুগামিতা : এক স্বামী, এক স্ত্রী, এই ছিল সাধারণ নিয়ম। ধনী পরিবারের পুরুষরা এক স্ত্রী বর্তমান থাকলেও পুনরায় বিবাহ করতেন। বরাহমিহির ও কালিদাস সপত্নীর উল্লেখ করেছেন। দু’টি স্ত্রী (দ্বিভার্যা) ও বহু পত্নীর (ভূরিভার্যা) উল্লেখও করেছেন বরাহমিহির।
  • স্ত্রীর কর্তৃত্ব : স্বামীর গৃহে স্ত্রীই ছিলেন কর্ত্রী। ভৃত্যদের পরিচালনা করা, গুরুজনদের সেবা করা, ঘর-দোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, বাগানে ফুল-ফলাদি ফলানো, সুতা কাটা, কাপড় বোনা, কৃষির তত্ত্বাবধান করা, গবাদি পশুর দেখাশোনা করা, পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যয় করা, দৈনন্দিন খরচপত্রের হিসাব রাখা, স্বামীর অনুপস্থিতিতে তাঁর কাজকর্ম সচল রাখা, সপত্নীদের সঙ্গে সদয় ব্যবহার করা আদর্শ গৃহিণীর বৈশিষ্ট্য বলে বাৎস্যায়ন মন্তব্য করেছেন। অভিজ্ঞানশকুন্তলমে শকুন্তলার প্রতি মহর্ষি কগের উপদেশ এই প্রসঙ্গে স্মর্তব্য। শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রার সময় মহর্ষি তাঁকে উপদেশ দিয়েছিলেন, গুরুজনদের সেবা করবে, সপত্নীদের সঙ্গে সখীসুলভ আচরণ করবে, স্বামী অহেতুক মেজাজ হারালেও তাঁর বাধ্য থাকবে, দাস-দাসীদের প্রতি সদয় ব্যবহার করবে, আচরণে নম্র হবে। সে সময় বিবাহিত নারীদের পিতৃগৃহে প্রত্যাবর্তন সমাজে নিন্দনীয় ছিল। তাছাড়া, মেয়েরা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্বাবলম্বী ছিলেন না। তাই অনেক সময় স্ত্রীকে পতিগৃহের প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলতে হত। তবে শূদ্র রমণীদের অবস্থা তুলনায় অনেক ভালো ছিল। যাজ্ঞবল্ক্য ও কাত্যায়ন বলেছেন, কোনও গোপালক, তৈলিক বা মদ্যব্যবসায়ী মৃত্যুকালে দেনা রেখে গেলে তা তাঁর স্ত্রী পরিশোধ করবেন। এ থেকে বোঝা যায়, শূদ্র মেয়েরা স্বামীর সঙ্গে একযোগে বা স্বতন্ত্রভাবে অর্থোপার্জন করতেন। মেয়েদের পাতিব্রত্যের উপর শাস্ত্রকারেরা বার বার জোর দিয়েছেন। ধর্মশাস্ত্র ও কাব্যনাটকাদির সাক্ষ্য থেকে নিঃসন্দেহে বলা যায়, সে যুগে পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের চারিত্রিক মান অনেক উন্নত ছিল। বরাহমিহির বিধান দিয়েছেন, বিনা দোষে স্ত্রীকে ত্যাগ করলে স্বামীকে দীর্ঘ ছয়টি মাস ধরে গাধার চর্ম পরতে হবে এবং ভিক্ষার দ্বারা ক্ষুধার নিবৃত্তি করতে হবে। কিন্তু এই বিধান বাস্তবে কতটা রূপায়িত হত, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে।
  • পর্দাপ্রথা : অভিজাত পরিবারের মেয়েরা সম্ভবত বাইরে বের হওয়ার সময় পর্দা ব্যবহার করতেন। অভিজ্ঞানশকুন্তলমে দেখা যায়, শকুন্তলা অবগুণ্ঠিতা হয়েই রাজা দুষ্মন্তের দরবারে প্রবেশ করেছিলেন কিন্তু রাজা তাঁকে প্রত্যাখ্যান করায় আত্মপরিচয় দিতে গিয়ে তিনি অবগুণ্ঠন সরিয়ে ফেলেন। মেয়েদের পর্দাব্যবহার সম্পর্কে ফা শিয়েন নীরব। এ যুগের ভাস্কর্যে মহিলাদের পর্দা ব্যবহারের নিদর্শন অতি বিরল। মনে হয়, সমাজে পর্দাপ্রথার ব্যাপক প্রচলন ছিল না। (সুকুমারী ভট্টাচার্য (তদেব, পৃষ্ঠা ১২২-২৩) অভিমত প্রকাশ করেছেন, পিতার সম্পত্তিতে তাঁর ঔরসজাত পুত্রের অধিকার কায়েমের স্বার্থে অবরোধ তথ্য পর্দাপ্রথার প্রচলন হয়েছিল। এ অভিমত বিতর্কিত। এখনকার আত্মসর্বস্ব ছোট ছোট পরিবারের তুলনায় তখনকার দিনের খুড়তুতো-জেঠতুতো ভাই-বোনদের নিয়ে গড়ে ওঠা একান্নবর্তী পরিবার তুলনায় অনেক উদার, সহনশীল ও সহমর্মী ছিল।)
  • স্ত্রীধন : পরিমাণ যাই হোক না কেন, বিবাহিত নারীর বিশেষ সম্পত্তি ‘স্ত্রীধন’ ছিল। এই ‘স্ত্রীধন’ তাঁরা পেতেন পিতা বা অভিভাবকের কাছ থেকে বিবাহকালে ও পতিগৃহে যাত্রার সময় এবং বিবাহোত্তর জীবন স্বামী, পিতৃকুল ও ভর্তুকুল থেকে স্নেহ ও প্রীতির নিদর্শনরূপে। এই ‘স্ত্রীধন’ ভোগ এবং উত্তরাধিকারসূত্রে হস্তান্তর করার সম্পূর্ণ অধিকার তাঁদের ছিল। যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন, স্বামী অপুত্রক অবস্থায় মারা গেলে তাঁর সম্পত্তি স্ত্রীরই প্রাপ্য।
  • সতীপ্রথা : বৃহৎসংহিতা, কামসূত্র ও কালিদাসের কাব্যে মৃত স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর সহমরণের উল্লেখ আছে। বৃহস্পতি বলেছেন, স্বামী মারা গেলে স্ত্রী হয় কঠোর বৈধব্য বিধি পালন করবেন নতুবা মৃত স্বামীর সঙ্গে সহমরণ বরণ করবেন। এরাণ প্রস্তর স্তম্ভলেখ থেকে জানা যায়, গোপরাজ নামে জনৈক সেনানী যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণত্যাগ করলে তাঁর স্ত্রী স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। চিনা পরিব্রাজক ফা শিয়েন অবশ্য সতীপ্রথার উল্লেখ করেননি। তাছাড়া স্মৃতিশাস্ত্র ও সংস্কৃত সাহিত্যে কঠোরতা ও সংযমের সঙ্গে বৈধব্যজীবনযাপনের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। মৃচ্ছকটিকে সতীপ্রথা নিন্দিত হয়েছে। এ থেকে মনে হয়, এই প্রথা সমাজে প্রচলিত ছিল ঠিকই কিন্তু জনপ্রিয়তা অর্জন করেনি।
  • বিধবা-বিবাহ : বৃহৎসংহিতায় বিধবাদের পুনর্বিবাহ ও তাঁদের সন্তানসন্ততিদের উল্লেখ আছে। অমরকোষে পুনর্ভূদের উল্লেখ আছে। প্রথমে বিধবা ছিলেন কিন্তু পরে আবার বিবাহ করেছেন এমন মহিলাদেরই পুনর্ভূ বলা হত। যাজ্ঞবল্ক্য ও বাৎস্যায়ন সমাজে বিধবা-বিবাহের প্রচলনের উল্লেখ করেছেন কিন্তু এ বিবাহ তাঁরা অনুমোদন করেননি। যাজ্ঞবল্ক্য স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন, কুমারী কন্যার একবারই মাত্র বিবাহ হয়। বাৎস্যায়ন পুনর্ভূদের সম্পর্কে বলেছেন, তাঁরা না সহধর্মিণী, না গণিকা। বিধবা-বিবাহ সম্পর্কে যাজ্ঞবল্ক্য বা বাৎস্যায়নের মত যাই হোক না কেন, সমাজে বিধবা-বিবাহের প্রচলন ছিল। হয়তো এই প্রথা বহুল প্রচলিত ছিল না। নিঃসন্তান বিধবাদেরই শুধু পুনর্বিবাহ হত, এমন নয়। কাত্যায়ন-স্মৃতিতে এমন বিধবাদের উল্লেখ আছে যাঁরা স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তান থাকা সত্ত্বেও দ্বিতীয়বার বিবাহ করেছেন।
  • দেবদাসী : পূজা-অর্চনার কাজ ও নৃত্য-গীত পরিবেশনের জন্য কখনও কখনও কুমারী মেয়েদের স্থায়িভাবে মন্দিরে রাখা হত। এসব মেয়েদের দেবদাসী বলা হত। মেঘদূত থেকে জানা যায়, কালিদাসের সময় উজ্জয়িনীর বিখ্যাত মহাকাল মন্দিরে অনেক দেবদাসী নিযুক্ত ছিলেন।
  • গণিকা : বরাহমিহির বলেছেন, ঘরে সাধ্বী স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও অনেক পুরুষ গণিকার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেন। সমকালীন সাহিত্যে গণিকাদের বিস্তর উল্লেখ থেকে মনে হয়, সে কালের শহরগুলিতে গণিকাদের সংখ্যা নেহাত কম ছিল না। সাহিত্যে তাঁদের সুন্দরী, গুণবতী ও ধনী বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বাৎস্যায়ন তাঁদের বাল্যকাল থেকেই নাচ, গান, অভিনয়, চিত্রাঙ্কন, সুগন্ধি তৈল, লেখাপড়া, বাক্‌চাতুর্য, ব্যাকরণ, তর্কশাস্ত্র, জ্যোতিষ, কামশাস্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষাগ্রহণের উপর জোর দিয়েছেন। মৃচ্ছকটিকের বসন্তসেনা একজন উচ্চশ্রেণির গণিকা। তিনি অভিনয়ে নিপুণা ছিলেন। নাচ, গান ও চিত্রাঙ্কনেও তিনি পারদর্শিনী ছিলেন। তিনি মাঝে মধ্যে তাঁর প্রেমিকের বাড়িতেও যেতেন কিন্তু কখনও অন্দরমহলে প্রবেশ করতেন না। কখনও কখনও গণিকারা তাঁদের বৃত্তি ছেড়ে মনোমতো এক পাত্রকে বিবাহ করে সংসারধর্মে ফিরে আসতেন। বসন্তসেনার জীবনে এমনটিই ঘটেছিল। কিন্তু বেশির ভাগ গণিকাই ছিলেন লোভী ও ধূর্ত। গণিকাদের সম্পর্কে যাজ্ঞবদ্ধ কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। গণিকার স্পর্শকরা খাদ্য গ্রহণের অনুপযুক্ত বলে তিনি বিধান দিয়েছেন।

দাসপ্রথা : যাজ্ঞবল্ক্য ও নারদ সাত শ্রেণির দাসদের কথা বলেছেন। দাসদের মধ্যে কেউ ছিলেন যুদ্ধবন্দি, কেউ দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত অপরাধী, কেউ আত্মবিক্রীত, কেউ প্রতিগ্ৰহলব্ধ, আবার কেউবা জন্ম, কর্ম বা ঋণসূত্রে দাস। যাজ্ঞবন্ধ্যস্মৃতিতে বলা হয়েছে, ব্রাহ্মণের চেয়ে ক্ষত্রিয়, ক্ষত্রিয়ের চেয়ে বৈশ্য এবং বৈশ্যের চেয়ে শূদ্র দাস হিসাবে উৎকৃষ্ট। দাসদের অনেকেরই স্বাধীন জীবনে ফিরে আসার সুযোগ ছিল। যাজ্ঞবস্থ্য বলেছেন, যিনি স্বয়ং আত্মবিক্রয় করেছেন বা যে তাপস পথ ভ্রষ্ট হয়েছেন তাঁকে আজীবন দাসত্বের ভার বহন করতে হবে। অন্যান্য দাসদের শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দেওয়া হত। বিপন্ন প্রভুর জীবন রক্ষা করলে দাসের তাৎক্ষণিক মুক্তির নির্দেশ দিয়েছেন যাজ্ঞবন্ধ্য। মনিব আপন খুশিতে বা নগদ অর্থের বিনিময়ে দাসদের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেবেন, এমন বিধানও যাজ্ঞবন্ধ্য দিয়েছেন। কাত্যায়ন বলেছেন, ব্রাহ্মণকে কখনওই দাস করা চলবে না, কোনও ব্রাহ্মাণীও ক্রয়-বিক্রয়ের যোগ্য নন। কাত্যায়ন বিধান দিয়েছেন, কোনও দাসী প্রভুর সন্তান গর্ভে ধারণ করলে তাঁকে অবিলম্বে দাসত্ব বন্ধন থেকে মুক্তি দিতে হবে। বলতে দ্বিধা নেই, মনুর তুলনায় যাজ্ঞবল্ক্য ও কাত্যায়ন দাসদের প্রতি অনেক উদার ও সহানুভূতিশীল। দাসদের প্রতি সব সময় সদয় ব্যবহার করা হত না। মৃচ্ছকটিকে দেখা যায়, দাসী মদনিকা তাঁর উদারচেতা কর্ত্রীর কাছে সখীর মতো ছিলেন, অপর দিকে দাস স্থাবরককে তাঁর প্রভুর হাতে অশেষ নির্যাতন ভোগ করতে হত। নির্দয়ভাবে প্রহার, শৃঙ্খলবন্ধন কোনও কিছুই বাদ যেত না। মদনিকা যাতে তাঁর প্রণয়ীকে বিবাহ করতে পারেন সেজন্য তাঁর কর্ত্রী তাঁকে মুক্তি দিয়েছিলেন। কিন্তু স্থাবরকের ভাগ্যে বহুদিন নির্যাতন জুটেছিল, অবশেষে রাজার আদেশে তিনি মুক্তিলাভ করেন। ভারতে দাস বলে কোনও জাতি গড়ে ওঠেনি। বিভিন্ন বর্ণের ও জাতির মানুষ দুরবস্থায় পড়ে দাসত্ব বরণ করতেন। প্রাচীন গ্রিস ও রোমে দাসদের উপর নির্ভর করে উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। ভারতের ক্ষেত্রে তেমনটি হয়নি। দাসেরা সাধারণত গৃহকর্মে নিযুক্ত হতেন। উৎপাদন ব্যবস্থা যাঁদের উপর প্রধানত নির্ভর করত, তাঁরা ছিলেন বৈশ্য ও শূদ্র।

নাগরক সম্প্রদায় : তখনকার দিনের ধনী ও শৌখিন লোকেরা শহরে বাস করাই বেশি পছন্দ করতেন। বিলাসসামগ্রীর প্রাচুর্য, অবসর বিনোদনের অঢেল সুযোগ, অর্থোপার্জনের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা, মনোমতো বন্ধু-বান্ধবদের সান্নিধ্য ইত্যাদি কারণে লোকেরা স্বভাবতই শহরের আকর্ষণ অনুভব করতেন। এ যুগের মতো সে যুগেও অনেকেই গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসতেন। শহরের সেই অভিজাত ও শৌখিন নাগরকদের জীবন-যাপনের এক মনোজ্ঞ বর্ণনা দিয়েছেন বাৎস্যায়ন তাঁর কামসূত্র গ্রন্থে।

যে বাড়িতে নাগরক বাস করতেন সে বাড়িটি সুন্দর করে তৈরি হত। বাড়ির সর্বত্র থাকত রুচির ছাপ। বাড়িটির দু’টি অংশ–বহির্বাটি বা প্রমোদভবন ও অন্দর মহল। অন্দর মহলে মহিলারা থাকতেন। বাইরের লোকদের সেখানে প্রবেশাধিকার ছিল না। বাড়ির সামনের দিকে একটা সুন্দর বাগান থাকত, বাগানে নানা শাকসবজি ফলানো হত, ওযধি ও নানা রকম গাছের প্রাচুর্য ছিল সেখানে। সুগন্ধ ও বর্ণোজ্জ্বল ফুলের সমারোহ বাগানটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলত। নাগরক ও তাঁর বন্ধু-বান্ধবদের উপভোগের জন্য বাগানে একটি দোলনা ঝোলানো থাকত। বাগানে বসার ব্যবস্থাও ছিল। বসার জায়গা ফুল দিয়ে সাজানো হত। বহির্বাটির প্রশস্ত হলঘরটিতে দু’টি আরাম কেদারা থাকত। কেদারায় থাকত কয়েকটি নরম বালিশ। সাদা চাদরে কেদারা দু’টি ঢাকা থাকত। কেদারার পিছনে রাখা হত এক দেবমূর্তি, আর মলম, ফুলের মালা, মধুর বাটি ইত্যাদি কয়েকটি অতি প্রয়োজনীয় জিনিস। মেঝেতে একটি গালিচা পাতা হত। গালিচার উপর বালিশ এবং দাবা ও পাশা খেলার সরঞ্জাম রাখা হত। ঘরের বাইরে ঝোলানো খাঁচায় পাখি রাখা হত। একটু দূরে নিরিবিলি স্থানে রাখা থাকত একটা চাক, বাটালি এবং আরও কিছু সরঞ্জাম যা দিয়ে নাগরক খুশিমতো বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি করতেন।

সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নাগরক কীভাবে তাঁর সময় অতিবাহিত করেন তার বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন বাৎস্যায়ন। নাগরক সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে প্রাতঃকৃত্যাদি সম্পন্ন করে প্রসাধন করতেন। তিনি শরীর মালিশ করতেন, জামা-কাপড়ে সুগন্ধ ছড়িয়ে দিতেন। চোখে কাজল দিয়ে ও ঠোট দু’টি রাঙিয়ে তিনি আয়নার সামনে এসে দাঁড়াতেন। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে তিনি হাষ্টচিত্তে পান খেতেন। এরপর তিনি বৈষয়িক কাজকর্মে মন দিতেন। বৈষয়িক কাজকর্ম সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর স্নানের সময় হত। তিনি প্রতিদিনই স্নান করতেন। দু’দিন অন্তর গায়ে সাবান মাথা, তিন দিন অন্তর দাড়ি কামানো, চার বা নয় দিন অন্তর চুলছাঁটা তাঁর বাঁধা রুটিন ছিল। তিনি দু’বার আহার করতেন – একবার মধ্যাহ্নে, আর এক বার সায়াহ্নে। মধ্যাহ্ন ভোজনের পর তিনি কিছুক্ষণ বিশ্রাম করতেন। এ সময় তিনি পোষা পাখিদের সঙ্গে কথা বলতেন, কখনওবা তিতির, মোরগ ও মেষের লড়াই উপভোগ করতেন। অনেক সময় তিনি ছবি এঁকে বা বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে গল্পগুজব করে সময় কাটিয়ে দিতেন। বিকালে সুসজ্জিত হয়ে লোক জনদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ বা কোনও অনুষ্ঠানে যোগদানের উদ্দেশ্যে তিনি বেরিয়ে পড়তেন। সন্ধ্যায় তিনি বাড়িতে গান-বাজনার আসর বসাতেন। তারপর কিছুক্ষণ বান্ধবীদের সান্নিধ্য উপভোগ করতেন। মাঝে মধ্যে নাগরকেরা আনন্দানুষ্ঠানে যোগ দিতেন –

  • এ ধরনেরই এক অনুষ্ঠান ‘সমাজ’। মাসে একবার বা দু’বার বিদ্যাদেবী সরস্বতীর মন্দির প্রাঙ্গণে সমাজ অনুষ্ঠিত হত। এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে গায়ক-গায়িকা, নর্তক-নর্তকী, অভিনেতা-অভিনেত্রীরা নাচ, গান ও অভিনয় প্রদর্শন করতেন। প্রশংসিত শিল্পীদের পুরষ্কৃত করা হত। নাগরকেরাই সমাজের আয়োজন করতেন এবং শিল্পীদের সম্বর্ধনা ও অতিথি-অভ্যাগতদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতেন।
  • সমাজের মতো আর একটি আনন্দঘন অনুষ্ঠান ‘গোষ্ঠী’। গোষ্ঠী আসলে নাগরকদের মিলনোৎসব। প্রায় প্রতিদিন বিকালে কোনও গণিকার বাড়িতে, কোনও নাগরকের গৃহে বা কোনও সভাগৃহে নাগরকেরা সমবেত হতেন। সেখানে তাঁরা কবিতা রচনা, আবৃত্তি, পাঠ, কাব্যব্যাখ্যা, চিত্রাঙ্কন, কণ্ঠ ও যন্ত্র সংগীতে অংশগ্রহণ করতেন। সংস্কৃত ও প্রাকৃত, দু’টি ভাষাতেই আলাপ-আলোচনা চলত। বাৎস্যায়ন বলেছেন, জ্ঞানী ব্যক্তিরা এ ধরনের মজলিশ এড়িয়ে চলতেন।
  • নাগরকদের বাড়িতে অনেক সময় মদ্যপানের আসর বসত। এ আসরে নানা স্বাদ ও গন্ধের মদ পরিবেশিত হত। সুন্দরী গণিকারা সেখানে মদ পরিবেশন করতেন। গণিকারাও মদ খেতেন। এ আসরের নাম ‘আপণক’।
  • আর একটি আনন্দানুষ্ঠান ‘উদ্যানযাত্রা’। নগরের বাইরে কোনও উদ্যানে এই অনুষ্ঠান হত। ভোরবেলায় নাগরকেরা সুসজ্জিত হয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে গণিকা ও দাসদাসীদের সঙ্গে নিয়ে উদ্যান অভিমুখে যাত্রা করতেন। সেখানে উত্তম ভোজের ব্যবস্থা থাকত, নানা মজার খেলা হত, মোরগ ও ভেড়ার লড়াই-এর প্রদর্শনী হত। নাগরকেরা সারা সকাল ও দুপুর আনন্দে কাটিয়ে বিকালে বাড়ি ফিরতেন, বাড়ি ফেরার সময় তাঁরা প্রত্যেকে এক একগুচ্ছ ফুল বা উদ্যান বৃক্ষের এক একটি কচি শাখা স্মৃতিরূপে সঙ্গে নিয়ে আসতেন। কুমারী মেয়েরাও নিজেদের মধ্যে কখনও কখনও উদ্যানযাত্রার আয়োজন করতেন। বিবাহিত রমণীরা সাধারণত এ ধরনের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন না।

প্রমোদ-অনুষ্ঠান : এছাড়া আরও কয়েকটি প্রমোদ-অনুষ্ঠান ছিল যেখানে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সমাজের সকলেই যোগদান করতেন।

  • এরূপ এক অনুষ্ঠান ‘কৌমুদী-জাগর’। অনুষ্ঠানটি হত আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা রাতে। না ঘুমিয়ে নাগরকেরা পাশা খেলে বা অন্য কোনও আমোদ প্রমোদে সারা রাত কাটিয়ে দিতেন।
  • আর একটি অনুষ্ঠান হোলাকা বা হোলি উৎসব। এটি হত ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে।
  • ‘সুবসন্তক’ নামে অপর একটি বসন্তোৎসবেরও আয়োজন হত। অনুষ্ঠানটি হত বসন্তের পূর্ণিমা রাতে। এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে ঝুলন, নৃত্য, গীত ইত্যাদির আয়োজন হত।

চতুরাশ্রম : কালিদাসের কাব্যে ও বরাহমিহিরের বৃহৎসংহিতায় ব্রহ্মচর্য ও গার্হস্থ্যের উল্লেখ তো আছেই, দ্বিজের জীবনের শেষ দু’টি পর্যায় বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস আশ্রমের কথাও বলা হয়েছে। বার্ধক্যে পৌঁছে মহারাজ রঘু তাঁর পুত্র অজকে সিংহাসনে অভিষিক্ত করে সংসার ত্যাগ করে ছিলেন। এ বর্ণনা আছে রঘুবংশে। বানপ্রস্থী ও সন্ন্যাসীরা যে পরিধানরূপে গাছের বন্ধল ব্যবহার করতেন তারও উল্লেখ করেছেন কালিদাস। বানপ্রস্থী ও সন্ন্যাসীদের অনেকে যে মস্তক মুক্ত করতেন এবং কাযায় বস্ত্র পরিধান করতেন, বৃহৎসংহিতা থেকে তা জানা যায়। বরাহমিহির ভিক্ষুণী বা ব্রজিতাদেরও উল্লেখ করেছেন। এ থেকে মনে হয়, মহিলারাও কখনও কখনও সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণ করতেন। তবে নিঃসংশয়ে বলা যায়, সে যুগে বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস আশ্রমের প্রতি লোকদের আকর্ষণ হ্রাস পেয়েছিল।

প্রসাধন, খাদ্য ও পানীয় : বৃহৎসংহিতায় দণ্ডশলাকার উল্লেখ আছে। দণ্ডশলাকা দিয়ে দাঁত মাজা হত। শৌখিন ব্যক্তিরা চুলে কলপ লাগাতেন, সুগন্ধ তেল ও সুগন্ধি মলম ব্যবহার করতেন, গায়ে লেপন করতেন চন্দনের মলম। পান খাওয়া হত কর্পূর দিয়ে। সুগন্ধ মিশিয়ে জল পান করা হত। মাছ ও মাংসের ব্যাপক ব্যবহার ছিল। শুধু পাঁঠা, ভেড়া ও হরিণের মাংসই নয়, হাতি, মোষ, শূকর ও গরুর মাংসও ভক্ষ্য ছিল। মদের প্রতি আসক্তি ছিল যথেষ্ট। মহিলারাও সুরার ভক্ত ছিলেন। ফা শিয়েন অবশ্য মধ্যদেশে মদ-মাংস, পেয়াজ-রসুনের প্রচলন অস্বীকার করেছেন। সাধারণত আখ ও আঙুর থেকে মদ তৈরি হত। অন্যান্য ফল-ফলাদির মধ্যে আমলকি, বেল, আম, কলা, ডালিম, খেজুর, তেঁতুল ও জামের উল্লেখ আছে সমকালীন সাহিত্যে। দুগ্ধ, ঘি, ঘোল, মাখন, মধু, গুড়, চিনি, মোদক, পায়েস ও রাবড়ির উল্লেখ করেছেন বরাহমিহির।

রোগ ও তার প্রতিকার : তখনকার দিনে নানা ধরনের অসুখ-বিসুখ দেখা দিত। সাহিত্যে এসব অসুখ-বিসুখের উল্লেখ আছে। এ প্রসঙ্গে উন্মাদ, মন্দাগ্নি, রক্তস্রাব, উদরপীড়া, হৃদরোগ, চক্ষুপীড়া, শিরঃপীড়া, গুপ্তব্যাধি, গলগ্রহ, প্ৰদেহ, বমন, কাশি, শ্বাস, শোষ, রক্তাল্পতা, কামলা, কুষ্ঠ, শ্বেতি, মুগি, কলেরা, আমাশা, জ্বর ইত্যাদি রোগের উল্লেখ করা যায়। রোগ যেমন ছিল তেমনি তার প্রতিকারের জন্য চিকিৎসকেরাও ছিলেন। চিকিৎসকদের বিভিন্ন শ্রেণি। এঁদের মধ্যে কেউ বৈদ্য, কেউ শল্যচিকিৎসক, কেউবা বিষ-বিশেষজ্ঞ। ঘোড়ার ডাক্তারও ছিলেন। বৃহৎসংহিতায় তাঁকে তুরগ-ভিষজ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। সে সময় চিকিৎসকদের খুব একটা শ্রদ্ধার চোখে দেখা হত না।

শিক্ষা : বরাহমিহির বিদ্যার চারটি চিরাচরিত শাখার উল্লেখ করেছেন বার্তা (অর্থনীতি), ত্রয়ী (বেদ), দণ্ডনীতি (রাজনীতি) এবং অন্বীক্ষী (দর্শন)। ব্যাকরণ, কবিতা ও কাব্য অধ্যয়নেরও ব্যবস্থা ছিল। কাব্যরসিক (কাব্যজ্ঞ গোষ্ঠী) ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের (বিদুষাং সমবায়) নিজস্ব গোষ্ঠী ছিল। ঘন ঘন অধ্যাপক পরিবর্তন নিন্দনীয় ছিল। দারিদ্র অধ্যয়নের প্রতিকূল, এই অভিমত বরাহমিহিরের। গাছের বাকল, তালপাতা, কাপড়, পদ্মপাতা, চামড়া ও পটের উপর লেখা হত। নলখাগড়া দিয়ে কলম তৈরি হত। চক বা চকজাতীয় জিনিসও লেখনীরূপে ব্যবহার করা হত। ছাত্ররা গুরুগৃহে শিক্ষালাভ করতেন। গুপ্তযুগের মধ্যভাগ নাগাদ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে। (শুয়েন চাঙ বলেছেন, শক্রাদিত্য নালন্দা মহাবিহার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ইন্দ্রের এক নাম শক্র। গুপ্তসম্রাট প্রথম কুমারগুপ্ত মহেন্দ্র অভিধা ধারণ করেছিলেন। এ থেকে মনে হয়, শক্রাদিত্য ও প্রথম কুমারগুপ্ত অভিন্ন ব্যক্তি ছিলেন।) এখানে শুধু বৌদ্ধশাস্ত্রই পড়ানো হত না। ব্রাহ্মণ্যশাস্ত্র, আয়ুর্বেদ এবং বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগেও শিক্ষাদান করা হত। শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগই ছিলেন আবাসিক। অনাবাসিক ছাত্ররাও এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষালাভ করতেন। কারিগরি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলি কারিগরি শিক্ষার কেন্দ্র ছিল।

প্রগতিশীল সমাজ-জীবন : গুপ্তযুগের সমাজ-জীবনে বিপরীতমুখী প্রবণতার সহাবস্থান বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়। এ সময় একদিকে যেমন বর্ণ-ব্যবস্থার গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছিল, অপর দিকে তেমনি বিবাহ, বৃত্তি ও জীবন ধারণের ক্ষেত্রে বর্ণাশ্রমধর্মের কঠোরতা হ্রাস পেয়েছিল। এ পর্বে ব্রাহ্মণদের প্রভাব যেমন বেড়েছিল, তেমনি শূদ্রদের অবস্থার সার্বিক উন্নয়নও ঘটেছিল। নারীসমাজে বাল্য বিবাহের প্রচলন থাকলেও পরিণত বয়সেও মেয়েদের বিবাহ অনুষ্ঠিত হত। পর্দাপ্রথা বর্তমান ছিল ঠিকই কিন্তু তা কখনও সর্বজনীন রূপ লাভ করেনি। সতীপ্রথার অস্তিত্ব ছিল কিন্তু বৈধব্য জীবনযাপনের নিদর্শনও সে যুগে বিরল ছিল না। বিধবাদের পুনর্বিবাহেরও সুযোগ ছিল। এ যুগে প্রতিষ্ঠিত নালন্দা মহাবিহারে যে পাঠক্রমের ব্যবস্থা ছিল তাতে শুধু বৌদ্ধশাস্ত্রই অন্তর্ভুক্ত হয়নি, ব্রাহ্মণ্যধর্ম, শরীরবিদ্যা ও আয়ুর্বেদসহ বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখাও তার অঙ্গীভূত ছিল। সমাজে সহনশীলতা, উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও যুক্তিবাদের প্রসার ঘটলেই এ ধরনের বিপরীতধর্মী প্রবণতার সহাবস্থান দেখা যায়। অসংকোচে বলা যায়, এক প্রগতিশীল সমাজজীবনের অভিব্যক্তি ঘটেছিল গুপ্তযুগে।

অর্থনীতি

কৃষি-অর্থনীতি

কৃষিজ ফলন পূর্ববর্তী যুগের মতো এ যুগেও কৃষি লোকদের মুখ্য উপজীবিকা ছিল। কৃষিজ ফলনের মধ্যে ধান ছিল প্রধান। গাঙ্গেয় বদ্বীপে যে নানা ধরনের ধানের চাষ হত কালিদাস তার উল্লেখ করেছেন। এ অঞ্চলের শালি ধানের সপ্রশংস উল্লেখ আছে তাঁর কাব্যে। বরাহমিহিরও শালি ধানের কথা বলেছেন। তাছাড়া কলমশালি, যবক, সূকরক, ষষ্টিক ইত্যাদি আরও আট প্রকার ধানের উল্লেখ আছে তাঁর বৃহৎসংহিতা গ্রন্থে। ষাট দিনে পাকত বলে এক শ্রেণির ধানের নাম যষ্টিক। সুশ্রুত ও চরক বিভিন্ন প্রকার যষ্টিক ধানের বর্ণনা করেছেন। বৃহৎসংহিতায় যব ও গমের উল্লেখ আছে। পুণ্ড্র বা উত্তর বাংলা আখের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। আখ গাছের ছায়ায় বসে কৃষকরমণীদের ধান গাছের শোভা দেখার সুন্দর বর্ণনা আছে কালিদাসের রঘুবংশে। বৃহৎসংহিতায় কালো (সর্ষপ) ও সাদা (সিতসর্ষপ) দু’ধরনের সরষের উল্লেখ আছে। অমরকোষে তুলা, তিল, সরষে ও নীলের কথা আছে। তুলা এবং নীল বস্ত্রশিল্পের পক্ষে বিশেষ উপযোগী ছিল। তিল ও সরষে থেকে তেল উৎপন্ন হত। অমরকোযে গোলমরিচ, এলাচ এবং সুপারির উল্লেখ আছে তবে এসব পণ্যশসা সাধারণত দক্ষিণ ভারতে উৎপন্ন হত। বরাহমিহির তাঁর বৃহৎসংহিতায় জাফরান এবং মুগ, মাষ, মসুর, কলায় প্রভৃতি ডালের উল্লেখ করেছেন। জাফরান কাশ্মীরে পাওয়া যেত।

নীল উপাদান : ৫৯২ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ বিষ্ণুষেণের একখানি তাম্রশাসনে গুজরাত অঞ্চলে নীল চাষের প্রমাণ আছে। (Epigraphica Indica, Vol. XXX, পৃষ্ঠা ১৬৩-৮১।) লেখে নীলকুটী ও নীলডুফ্ফকের সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে। নীলকুটী বলতে নীলের খামার বোঝায়। নীলডুমফক কথাটিকে কখনও কখনও নীলের গামলা অর্থে ব্যাখ্যা করা হয়। পক্ষান্তরে নীলডুমফক নীলকুটীর কর্তাব্যক্তি হতে পারেন আবার নীলগাছের পাতা, শাখা, প্রশাখা নিঙড়ে যিনি রং প্রস্তুত করেন তিনিও হতে পারেন। মোটকথা, নীলডুম্‌ফক কথাটির প্রকৃত অর্থ যাই হোক না কেন, খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের শেষের দিকে গুজরাত অঞ্চলে যে নীলের চাষ হত তার প্রমাণ নিহিত আছে বিষ্ণুষেণের এ তাম্রশাসনে।

দুর্ভিক্ষ : শস্য উৎপন্ন হত ঠিকই কিন্তু পশু-পাখি, পোকা-মাকড়, কীট-পতঙ্গাদির উপদ্রবে প্রচুর শস্য নষ্ট হত। যেসব জমি একান্তরূপে বৃষ্টির উপর নির্ভরশীল ছিল অনাবৃষ্টি বা খরা দেখা দিলে সেখানে চাষ-আবাদ হত না। অতিবৃষ্টির ফলেও ফসলের ক্ষতি হত। ফলে মাঝে মাঝে দুর্ভিক্ষের প্রাদুর্ভাব ঘটত। স্কন্দগুপ্তের জুনাগড় শিলালেখ ও বৃহৎসংহিতায় দুর্ভিক্ষের উল্লেখ আছে। বৃহৎ সংহিতায় দুর্ভিক্ষের কারণও বর্ণনা করা হয়েছে।

সেচ-প্রকল্প : খেতে জলের জন্য শুধু বৃষ্টির উপর নির্ভর করলে চলে না। বৃষ্টি নিয়মিত না হতে পারে, খরা দেখা দিতে পারে। কৃত্রিম জলাশয় নির্মাণ করে জলের অভাব যতটা সম্ভব পূরণ করতে হত। সমকালীন লেখমালায় বাপী, তড়াগ ও দির্ঘিকার উল্লেখ আছে। বাপী বলতে ছোট পুষ্করিণী বোঝায়। বড় পুষ্করিণী তড়াগ। আয়তাকারের সুদীর্ঘ পুষ্করিণী দির্ঘিকা। কূপও খনন করা হত। জুনাগড় লেখে সুদর্শন নামে এক বৃহদায়তন হ্রদের উল্লেখ আছে। গিরনার পাহাড়ের পাদ দেশে অবস্থিত এই হ্রদটি অতিবৃষ্টির ফলে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তার বাঁধ ভেঙে পড়ে। এর ফলে বিস্তীর্ণ এলাকা জলমগ্ন হয় এবং শস্যের বিপুল ক্ষতি হয়। দুই মাস ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে প্রভূত অর্থব্যয়ে নগরপ্রশাসক চক্রপালিত (ধনস্য কৃত্বা ব্যয়ম্ অপ্রমেয়স্) হ্রদটির সংস্কার করেন। হ্রদটির চারপাশ জুড়ে ১০০ হাত দীর্ঘ, ৬৮ হাত প্রশস্ত এবং সাতমানুষ সমান উঁচু এক বিশাল বাঁধ নির্মিত হয়। এত বড় সেচপ্রকল্প বেসরকারি উদ্যোগে সম্পন্ন হতে পারত না, তাই সরকারকেই এ কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়।

জমির শ্রেণি-বিভাগ : সমকালীন সূত্রে জমির প্রকারভেদের উল্লেখ আছে কিন্তু কি প্রকার জমিতে কোন ধরনের ফসল ফলত তার কোনও সুস্পষ্ট নির্দেশ নেই। অমরকোষে অন্তত বারো রকমের জমির উল্লেখ আছে উর্বরা (যে জমির ফলনক্ষমতা বেশি), ঊষর (অনুর্বর, ক্ষার বা নোনা জমি), মরু, অগ্রহত (যে জমিতে লাঙল চালানো হয়নি), শাদল (ঘেসো জমি), পঞ্চিল (কর্দমাক্ত জমি), ‘জল প্রায়মনুপম্’ (জল কাছে আছে এমন জমি), কচ্ছ (জলা জমি), শর্করা (কাঁকুরে জমি), শক্রাবতী (বালু জমি), নদীমাতৃক (নদীতীরবর্তী জমি) ও দেবমাতৃক (বৃষ্টির ফলে যে জমিতে প্রচুর শস্য উৎপন্ন হয়)। এই পর্বের লেখমালায় বিভিন্ন ধরনের জমির যে নাম পাওয়া যায় তা কিন্তু অন্যরূপ। সেখানে বাস্তু, ক্ষেত্র, অগ্রহত, খিল, অপ্রদ, অপ্রতিকর, চারণভূমি ও অরণ্য এই আট প্রকার জমির উল্লেখ আছে।

  • যে জমিতে ঘর বাড়ি তৈরি করে বসবাস করা হয় তাই বাস্তুভূমি। বাস্তুভূমিকে কখনও কখনও স্থলবাস্তভূমিও বলা হয়েছে।
  • ক্ষেত্র বলতে সাধারণত যে কোনও কৃষিজমি বোঝায়। গুপ্তলেখে নেই কিন্তু গুপ্তোত্তর লেখে বাপক্ষেত্র নামে এক প্রকার জমির উল্লেখ আছে। অনেকের মতে ক্ষেত্র এবং বাপক্ষেত্র সমার্থক। আবার অনেকে শব্দ দু’টির মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করেছেন। তাঁদের অভিমত, যে জমিতে চাষ-আবাদের জন্য বেশি জলের প্রয়োজন সে জমি ক্ষেত্র আর জল কম লাগে এমন সিক্ত কৃষিজমিই বাপক্ষেত্র।
  • যে জমিতে চাষ হয় না, যা একেবারে অনুর্বর, তা অগ্রহত। কোনও জমিতে বছরের পর বছর ধরে চাষ করলে তার উর্বরতা হ্রাস পায়। তাই মাঝে মাঝে চাষ না করে জমিকে ফেলে রাখতে হয়।
  • আবাদি জমি অথচ চাষ না করে ফেলে রাখা হয়েছে, পরে চাষ করা হবে, এমন জমিকে খিল বলে। স্মৃতিকার নারদ বলেন, যে জমিতে এক বছর চাষ হয়নি তা অর্ধখিল, যে জমিতে পর পর তিন বছর লাঙল চালানো হয়নি, তা খিল।
  • অপ্রদ বা অপ্রদা কথাটির নানা অর্থ হতে পারে। যে জমি পূর্বে কখনও প্রদত্ত হয়নি তা অপ্রদা। যে জমি হস্তান্তরযোগ্য নয় তাও অপ্রদা। আবার যে জমি বন্ধ্যা, যেখানে কোনও ফসল হয় না, সে জমিও অপ্রদা। গুপ্ত লেখমালায় নীবীধর্ম ও অপ্রদাধর্ম একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এর অর্থ, গ্রহীতা যে জমি দানস্বরূপ পেলেন, তা তিনি অপর কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে কখনও বিক্রি করতে পারবেন না। হস্তান্তরযোগ্য নয় এই অর্থেই সম্ভবত গুপ্তযুগে অপ্রদ বা অপ্রদা পদের ব্যবহার ছিল।
  • যে জমি থেকে কোনও কর বা রাজস্ব আদায় হয় না তা অপ্রতিকর। এ ক্ষেত্রে জমি যে অনুর্বর হবে তার কোনও অর্থ নেই। শস্যশ্যামলা জমিও অনেক সময় নিষ্কর থাকে।
  • চারণভূমি হল সেই জমি যেখানে গরু, মোষ ইত্যাদি পশু বিচরণ করে। সাধারণত চারণভূমির অবস্থান ছিল গ্রামের সীমানার বাইরে।
  • বৈগ্রাম লেখে তল ও বাটকের উল্লেখ আছে। তল বলতে সম্ভবত গ্রামের নিম্ন জলাভূমি বোঝায়। নীহাররঞ্জন রায় নালা অর্থে তল শব্দের ব্যাখ্যা করেছেন।
  • পায়ে চলার পথ অর্থে বাট বা বাটক।

জমির পরিমাপ : গুপ্তরাজ্যে, বিশেষত উত্তর বাংলায়, জমির সর্বনিম্ন একক ছিল ‘আঢ়বাপ’। তার উপরের একক ‘দ্রোণবাপ’, দ্রোণবাপের উচ্চতর একক ‘কুল্যবাপ’। আঢ়, দ্রোণ ও কুলা সবই শস্যমান। ৪ পুষ্কল বা ২৫৬ মুষ্টিতে ১ আঢ়, ৪ আঢ়ে ১ দ্রোণ, ৮ দ্রোণে ১ কুল্য। শব্দকল্পদ্রুমের তথ্য অনুসারে ১ আঢ় ১৬-১৮ সের, ১ দ্রোণ ৬৪-৮০ সের এবং ১ কুল্য ৫১২-৬৪০ সের বা ১২ মন ৩২ সের ধান বোঝায়। তবে গুপ্ত আমলে শস্যমানগুলির পরিমাণ এরূপ ছিল কিনা সন্দেহ আছে। ‘বাপ’ কথাটি ‘বপন’ থেকে এসেছে। এই বপন বীজবপন। অনেকে মনে করেন যে পরিমাণ জমিতে এক আঢ় পরিমাণ বীজ বপন করা যায় সেই পরিমাণ জমি এক আঢ়বাপ। দ্রোণ-বাপ ও কুল্যবাপ ভূমিমানের ক্ষেত্রেও এরূপ ব্যাখ্যা করা হয়। কেউ কেউ বিষয়টিকে অন্য ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এঁদের মতে এক আচ পরিমাণ বীজ থেকে যে চারাগাছ নির্গত হয় তা রোপণ করতে যে পরিমাণ জমি প্রয়োজন হয় সেই পরিমাণ জমিই এক আঢ়বাপ। এঁরা এ ভাবেই দ্রোণবাপ ও কুল্যবাপ ভূমিমান দু’টির ব্যাখ্যা দিয়েছেন। মনে রাখতে হবে এক আঢ় পরিমাণ বীজ বপন করতে যে জমি প্রয়োজন, এক আঢ বীজের চারাগাছ রোপণের জন্য তার তিন গুণেরও বেশি জমি দরকার। গুপ্তপর্বে কুল্য হতেও পাটক নামে জমির এক উচ্চতর একক ছিল। বৈন্যগুপ্তের গুণাইঘর লেখে (কুমিল্লা জেলা, বাংলাদেশ) এর উল্লেখ আছে। পাঁচ কুল্যবাপ পরিমাণ জমি এক পাটকের সমতুল্য ছিল। আঢবাপ, দ্রোণবাপ ইত্যাদি জমির এককগুলির আয়তন কী ছিল সে সম্পর্কে পণ্ডিত মহলে যথেষ্ট বাগ্-বিতণ্ডার সৃষ্টি হয়েছে। দীনেশচন্দ্র সরকার মনে করেন ১ আঢ়বাপ=৪-৫ বিঘা, ১ দ্রোণবাপ = ১৬-২০ বিঘা, ১ কুল্যবাপ= ১২৮-১৬০ বিঘা এবং ১ পাটক=৬৪০-৮০০ বিঘা জমি। কিন্তু এই পরিমাণ অতিরঞ্জিত মনে করার কারণ আছে। গুণাইঘর তাম্রলেখে বলা হয়েছে, মহারাজ রুদ্রদত্ত নামে একজন পদস্থ রাজপুরুষ কুমিল্লা অঞ্চলের এক গ্রামে বৌদ্ধ শ্রমণদের উদ্দেশ্যে ১১ পাটক জমি দান করেছিলেন। অধ্যাপক সরকারের অভিমত গ্রহণ করলে ১১ পাটক জমির আয়তন দাঁড়াবে ৭০৪০-৮৮০০ বিঘার মতো। ওই গ্রামে তো আরও জমি ছিল। তাহলে গ্রামটি আয়তনে অতি বিশাল ছিল বলতে হবে। পূর্ব বা পশ্চিম বাংলায় এত বড় গ্রাম সচরাচর দেখা যায় না। শচীন্দ্রকুমার মাইতি জমির এককগুলির যে পরিমাণ নির্দেশ করেছেন তা বাস্তবানুগ। তাঁর মতে ১ আঢ়বাপ = ১২-১৫ বিঘা, ১ দ্রোণবাপ = ৪৮-৬ বিঘা, ১ কুল্যবাপ = ৩৮-৪-৪৮ বিঘা এবং ১ পাটক=১৯২-২৪০ বিঘা। সমকালীন মৈত্রক লেখে পাদাবর্ত নামে জমি পরিমাপের এক এককের উল্লেখ আছে। ১ পাদাবর্ত বলতে সম্ভবত ০ ৩০৪৮০ মিটার পরিমাণ জমি বোঝাত। দু’টি নলের সাহায্যে জমি পরিমাপ করা হত। এই নল দু’টিকে কখনও ৮, ৯ (অষ্টক নবক-নলাভ্যাম), কখনও ৯, ৯ (নবক-নবক-নলাভ্যাম্), আবার কখনওবা ৯ (ষড়ক-নবক নলাভ্যাম) বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ৮ বা ৯ বলতে সম্ভবত ৮ হাত বা ৯ হাত বোঝাত। অর্থাৎ মানুষের হাতের মাপের উপর নলগুলির দৈর্ঘ্য নির্ভর করত। নল দু’টি দিয়ে সম্ভবত ক্ষেত্রের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ মাপা হত। অর্থাৎ জমির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ মাপার জন্য দু’টি ভিন্ন নল ছিল। প্রশ্ন হতে পারে, কার হাত স্বীকৃত পরিমাপরূপে গণ্য হত? ফরিদপুর তাম্রশাসনাবলির ‘ধর্মশীল-শিবচন্দ্র-হস্ত’, ‘শিবচন্দ্র-হস্তেন’ এবং মল্লসারুল লেখের ‘দর্শীকর্ম-হস্তেন’ প্রভৃতি বর্ণনার প্রেক্ষিতে মনে হয় যে কোনও ব্যক্তির হাত নয়, কোনও এক মাননীয় ব্যক্তির হাতকেই পরিমাপের সাধারণ মানরূপে গ্রহণ করা হত। প্রমাণ আছে, রাজার হাতও কখনও কখনও পরি মাপের মানরূপে স্বীকৃতি পেত। পরবর্তিকালীন এক লেখে সমতটীয় নলের উল্লেখ আছে। অনুমিত হয়, বিশেষ অঞ্চলে বিশেষ ধরনের নল ব্যবহৃত হত। কখনও কখনও জমি পরিমাপে একটি নলই ব্যবহার করা হত। একটি ফরিদপুর তাম্রশাসনের ‘শিবচন্দ্র-হস্ত-অষ্টক-নবক নলেন’ বর্ণনাই তার প্রমাণ। তবে যে নল দৈর্ঘ্যে ৯ হাত ও প্রস্থে ৮ হাত তাকে নল না বলে ফলক বা পাটা বলাই সঙ্গত।

জমির মূল্য : তখনকার দিনে জমির দর কীরূপ ছিল সে সম্পর্কে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারে। প্রথম দামোদরপুর লেখ থেকে জানা যায় উত্তর বাংলায় জমির দর ছিল কুল্যবাপ প্রতি ৩ স্বর্ণ দীনার। পঞ্চম দামোদরপুর লেখেও উত্তর বাংলায় ১ কুল্যবাপ জমির দাম ৩ স্বর্ণ দীনার বলে উল্লিখিত হয়েছে। লক্ষ করবার বিষয়, লেখ দু’টির মধ্যে একশো বছরের ব্যবধান। দেখা যাচ্ছে, সুদীর্ঘ একশো বছরেও জমির দাম কিছুই বৃদ্ধি পায়নি। এ সময় উত্তর বাংলার কোনও কোনও অঞ্চলে জমির দাম ছিল কুল্যবাপ প্রতি ২ স্বর্ণ দীনার। উত্তর বাংলার অন্তত চারখানি লেখে এ তথ্য পাওয়া যায়। এই লেখগুলির মধ্যে অন্তত চার দশকের ব্যবধান রয়েছে। অর্থাৎ চল্লিশ বছর ধরে উত্তর বাংলার কয়েকটি স্থানে জমির দাম একই রয়ে যায়, দামের কোনও হেরফের ঘটেনি। কিন্তু উত্তর বাংলায় জমির দামের মধ্যে যে পার্থক্য দেখা যায় তার কারণ নির্ণয় করা কঠিন। উর্বরতার তারতম্যের প্রশ্ন এখানে অবান্তর কারণ জমিগুলি সবই অনাবাদী, পতিত জমি। তবে চাহিদা একটি কারণ হতে পারে। আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সংগতির প্রশ্নটিও উড়িয়ে দেওয়ার নয়। প্রসঙ্গত বলা যায়, গুপ্তযুগের ঠিক অব্যবহিত পরই পূর্ব বাংলায় ১ কুল্যবাপ জমির দাম ছিল ৪ দীনার। অনুমান করা যায়, উত্তর বাংলার জমির দামের তুলনায় পূর্ব বাংলায় জমির দাম সম্ভবত একটু বেশিই ছিল। পূর্ব বাংলার জমি উর্বর, উৎপাদনশক্তিসম্পন্ন। অনাবাদি জমির তুলনায় সে জমির দাম বেশি হওয়ারই কথা।

অগ্রহার-ব্যবস্থা : অগ্রহার ব্যবস্থার ব্যাপক প্রসার এই পর্বের অর্থনৈতিক জীবনকে বিশেষ তাৎপর্যমণ্ডিত করেছে। (নিষ্কর জমি দান, এই অর্থে অগ্রহার। সাধারণত ব্রাহ্মণ-সম্প্রদায় এ ধরনের জমি পান। ব্রাহ্মণ বা ব্রাহ্মণদের অনুকূলে প্রদত্ত অগ্রহার ব্রহ্মদেয়ের সমার্থক। কিন্তু অগ্রহার ও ব্রহ্মদেয় সমার্থক নয়। কোনও অব্রাহ্মণ ব্রহ্মদেয় ভূমির স্বত্বাধিকারী হন না কিন্তু বৈশ্য (বৈশ্য-অগ্রহার) এবং দেবতাদের অনুকূলেও (দেব-অগ্রহার) অগ্রহার জমি দানের নজির আছে। কখনও কখনও জমির সঙ্গে অন্য সামগ্রীও প্রদান করা হত। দ্বিতীয় দামোদরপুর তাম্রশাসনে যে জমি দানের কথা বলা হয়েছে সে জমিতে অরঘট্ট ও পানীয় জলের সংস্থান ছিল (অরঘট-পানকৈশ্চ-সহিত)। রাধাগোবিন্দ বসাক ‘অরঘট’-স্থলে হট পাঠ নির্দেশ করেছেন। এর অর্থ প্রদত্ত জমিতে হাট বসত।) অগ্রহার ব্যবস্থা বলতে পুরোহিত সম্প্রদায়, দেবস্থান এবং বৌদ্ধ ও জৈন সংঘের অনুকূলে নিষ্কর ভূ-সম্পদ দান বোঝায়। জমি দানের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল গ্রহীতার ধর্মাচরণ ও জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদের সংস্থান সুনিশ্চিত করা। জমির আয় হতেই অগ্নিহোত্র, পঞ্চমহাযজ্ঞাদি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নির্বাহিত হত, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সংস্কার এবং দেবায়তনে বলি, চরু, সত্ৰ, গব্য, ধূপ, প্রদীপ, ফুল, মধুপর্ক ইত্যাদি উপচারের নিয়মিত জোগানের ব্যবস্থা হত (অরণ্যে ভগবতঃ শ্বেতবরাহস্বামিনো দেবকুলে খণ্ড-স্ফুট-প্রতিসংস্কার করণায় বলি-চরু-সত্র প্রবর্তন-গব্য-ধূপ-পুষ্প-প্রাপণ-মধুপর্ক-দীপ-আদি-উপযোগায় চ)। (পঞ্চম দামোদরপুর তাম্রশাসন)। যাঁরা জমি দান করতেন তাঁদের মধ্যে যেমন বণিক ও কারিগরদের মতো সাধারণ ব্যক্তিরা ছিলেন তেমনি রাজা ও পদস্থ রাজপুরুষরাও ছিলেন। পূর্ববর্তী যুগেও ধর্মীয় উদ্দ্যেশ্যে ভূ-সম্পদ দান করা হত কিন্তু এ সময় থেকে তা ব্যাপক আকার নেয়। দানকার্যে প্রশাসকগোষ্ঠীর ভূমিকাও এখন থেকে প্রাধান্য পেতে থাকে।

ভূমিদান ও ভূমিক্রয় : গুপ্তপর্বের বেশির ভাগ লেখই প্রকৃতপক্ষে ভূমিদানের পট্ট বা দলিল। ভূমিদান এক জটিল প্রক্রিয়া, এর সঙ্গে জমির ক্রয়-বিক্রয় তথা হস্তান্তরের প্রশ্নটি অঙ্গাঙ্গিরূপে জড়িত। যিনি জমি দান করছেন তিনি তা সাধারণত নগদ মূল্যে অপর কোনও ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের কাছ থেকে কিনতেন। সমকালীন লেখমালা থেকে জমির ক্রয়, বিক্রয় এবং দানের একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতির পরিচয় পাওয়া যায়। ভূমিক্রয়েচ্ছু ব্যক্তি সাধারণত জেলাপ্রশাসনের নিকট তাঁর আবেদন পেশ করতেন। আবেদনের সময় আবেদনকারীকে বলতে হত তিনি কী ধরনের জমি কিনতে চান, সে জমির দাম কত এবং তাঁর জমিক্রয়ের উদ্দেশ্যই বা কী। জেলাপ্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ ভূমিক্রয়েচ্ছু ব্যক্তির আবেদন পেলে তা পরীক্ষার জন্য জেলার প্রশাসনিক দলিল-দস্তাবেজের ভারপ্রাপ্ত রাজপুরুষ পুস্তপালের দপ্তরে পাঠিয়ে দিতেন। প্রতিটি জেলায় এক বা একাধিক পুস্তপাল ছিলেন। প্রস্তাবিত জমিতে অন্য কারোর অধিকার আছে কি নেই, অপর কোনও ব্যক্তি সেই জমি কিনতে আগ্রহী কিনা, জমির জন্য যে দর ধার্য হয়েছে তা যথাযথ কিনা, জমি বিক্রি হলে রাষ্ট্রের লাভ হবে না। ক্ষতি হবে, এসব জ্ঞাতব্য তথ্য পুস্তপাল বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখতেন। এর পর অন্য কোনও বাধা না থাকলে পুস্তপাল ভূমিবিক্রয়ে সম্মতি জানাতেন। বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার দামোদরপুর গ্রামের পঞ্চম তাম্রপট্রোলীর বর্ণনা (বিষয়পতিনা কশ্চিদ্ বিরোধঃ) থেকে মনে হয়, বিষয়পতি পুক্তপালের কোনও সিদ্ধান্তের প্রতিকূলে অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন কিন্তু উভয়ের মধ্যে কী বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দেয় তা লেখে স্পষ্ট করে বলা হয়নি। অনুমান করা যায়, বিষয়পতি পুস্তপালের কোনও সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপত্তি তুলেছিলেন কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সে আপত্তি নাকচ করে দেন।

জমির সীমা নির্দেশ : জেলাপ্রশাসনের অনুমোদন পেলেই প্রস্তাবিত জমি কেনার ক্ষেত্রে আর কোনও প্রতিবন্ধকতা থাকত না। এর পর নির্দিষ্ট দাম দিয়ে ক্রেতা জমি কিনতেন। উত্তর বাংলার লেখমালায় এই পর্বের যে কয়েকটি জমি ক্রয়-বিক্রয়ের ঘটনা লিপিবদ্ধ আছে তার প্রতিটি ক্ষেত্রেই ক্রেতাকে রাষ্ট্রের কাছ থেকে জমি কিনতে হয়েছে। কারণ, জমিগুলি সবই অনাবাদি, পতিত জমি, এ জমি রাষ্ট্রের সম্পত্তি। যে জমি কেনা হল সেই জমিকে দু’টি নলের সাহায্যে অন্যান্য জমি থেকে বিচ্ছিন্ন করে (অষ্টক নবকনলাভ্যাম্ অপবিস্থা) তার চারপাশের সীমানা চিহ্নিত করা হত। স্থানীয় গ্রামবাসী বা তাঁদের প্রতিনিধিদের সামনে জমির পৃথকরণ ও সীমানা চিহ্নিতকরণের কাজ সম্পন্ন হত। অনেক সময় তুষের ছাই দিয়ে জমির সীমানা চিহ্নিত করা হত। লেখমালায় এই দাগকে চিরস্থায়ী বলে বর্ণনা করা হয়েছে (চিরকালস্থায়িতুষাঙ্গারাদিচিহ্নেচতুর্দিশো নিয়ম্য)। সম্ভবত জমির চার সীমানা বরাবর মাটি খুঁড়ে তুষের ছাই দিয়ে মাটি ভরাট করা হত। ফলে এই সীমারেখার উপর ঘাস, গুল্মাদি জন্মাত না। একটু পরবর্তিকালের লেখে জমির চারপাশে পাকা খুঁটি বসানোর উল্লেখ আছে, জমির চারপাশে বেড়া লাগাবার কথাও আছে। কখনও কখনও গাছ, খাল, নালা, জোলা, নদী, পুষ্করিণী, মন্দির ইত্যাদির অবস্থানের দ্বারাও জমির সীমানা নির্দিষ্ট হত। ক্রীত জমি কোনও ব্রাহ্মণকে তাঁর পূজা-অর্চনা, যাগ-যজ্ঞের ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য বা কোনও মন্দির বা বৌদ্ধ বিহারকে তার ব্যয় সংস্থানের জন্য দান করা হত। অর্থাৎ একই জমি দু’বার হস্তান্তরিত হত ; প্রথমে ক্রেতার সপক্ষে, পরে গ্রহীতার অনুকূলে। ভূমিদানের সমস্ত খুঁটিনাটি তথ্য তাম্রপটে লিপিবদ্ধ করা হত। জেলাপ্রশাসনের সিলমোহর দিয়ে এ ধরনের তাম্রপট্ট নিবন্ধভুক্ত বা রেজেস্ট্রি করা হত। এদিক থেকে বিচার করলে ভূমিদান-সম্পর্কিত লেখগুলিকে ব্রহ্মদেয় বা দেবোত্তর ভূমিদানের সরকারি দলিল বলা চলে।

গ্রামপ্রধানদের ভূমিকা : গুপ্ত আমলে উত্তর বাংলায় জমির ক্রয়, বিক্রয় ও দানের যে পদ্ধতির কথা বলা হল তা যে সব সময় অনুপুঙ্খরূপে অনুসৃত হত এমন নয়। ভূমিক্রয়েচ্ছু ব্যক্তি সরকারি জেলাপ্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ না করে গ্রামকর্তৃপক্ষের দ্বারস্থ হয়েছেন এরূপ ঘটনার কথাও জানা যায়। জমির মাপজোখ ও সীমানানির্দেশের কাজ গ্রামপ্রধানদের নির্দেশনায় সম্পন্ন হয়েছে এমন ঘটনার নজিরও আছে। এরূপ অল্পবিস্তর ব্যতিক্রম সত্ত্বেও উত্তর বাংলায় জমিদান পদ্ধতির রূপটি মোটা মুটি একই ছিল।

নীবীধর্মে ব্রাহ্মণ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্যে ভূমিদান : ব্রাহ্মণ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে জমি দান করা হত বিশেষ এক শর্তে। সমকালীন লেখমালায় এই শর্তকে কখনও নীবীধর্মের শর্ত, কখনও অক্ষয়নীবীধর্মের শর্ত, কখনও অপ্রদা ধর্মের শর্ত, আবার কখনওবা অপ্রদা-অক্ষয়নীবীধর্মের শর্ত বলা হয়েছে। নীবী কথার অর্থ মূলধন বা মূলদ্রব্য। কোনও জমি যখন নীবীধর্ম অনুসারে দান বা বিক্রি করা হয় তখন জমিই হয় মূলধন বা মূলদ্রব্য। সেই জমির আয় বা উৎপন্ন ফসল ভোগ করা চলবে কিন্তু মূলধনটি অর্থাৎ জমিটি কোনওক্রমেই দান বা বিক্রি করা চলবে না। জমিটি অক্ষত রাখতে হবে। নীবীধর্ম ও অক্ষর নীবীধর্মের অর্থ ও তাৎপর্য একই। এ ক্ষেত্রে গ্রহীতা জমি ভোগ করতে পারেন কিন্তু তিনি সে জমি দান বা বিক্রি করতে পারেন না। অপ্রদাধর্ম বলতে সম্ভবত একই শর্ত বোঝায়। কিন্তু ক্রেতা যখন দানের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রের কাছ থেকে জমি কেনেন তখন তার অন্য শর্ত। বাংলাদেশের রাজশাহী জেলায় আবিষ্কৃত ধনাইদহ লেখে এই শর্তকে ‘নীবীধর্মক্ষয়’ বলা হয়েছে। এর তাৎপর্য, ক্রেতা খরিদ করা জমি দান বা হস্তান্তর করতে পারবেন। ক্রেতার হাতে এই অধিকার না থাকলে তাঁর জমি কেনার তাৎপর্য ব্যাহত হত।

অগ্রহার ব্যবস্থায় ভূমিহীন কৃষক শ্রেণীর উদ্ভব : অগ্রহার ব্যবস্থার ফলে যাঁরা জমির মালিক হলেন তাঁরা ছিলেন ব্রাহ্মণ এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক সদস্য। তাঁরা নিজের হাতে জমি চাষ করতেন না, চাষ-আবাদের কাজে পেশাদারী কৃষক নিয়োগ করতেন। এ কৃষকেরা জমি চাষ করতেন, পারিশ্রমিক স্বরূপ উৎপন্ন ফসলের এক নির্দিষ্ট ভাগ গ্রহণ করতেন। কর্ষিত জমিতে তাঁদের কোনও স্বত্ব ছিল না। বলা বাহুল্য, অগ্রহার ব্যবস্থায় এক শ্রেণির ভূমিহীন কৃষকের উদ্ভব ঘটল।

জমির মালিকানা : জমির মালিকানা এই পর্বে জমির মালিকানা কার ছিল সে সম্পর্কে পণ্ডিতমহলে বিতর্কের অন্ত নেই। কেউ বলেন, জমির মালিকানা ছিল রাজা তথা রাষ্ট্রের, কারোর মতে তা ব্যক্তি বিশেষের, আবার কেউবা সে অধিকার গ্রামসভার উপর আরোপ করেছেন। প্রতিটি অভিমতের সমর্থনে কয়েকটি করে যুক্তির অবতারণা করা হয়েছে –

  • রাষ্ট্রীয় মালিকানা : রাজা জমির মালিক এই অভিমতের সপক্ষে টীকাকার বিজ্ঞানেশ্বরের একটি মন্তব্যকে উপস্থাপন করা হয়। সমকালীন গ্রন্থ যাজ্ঞবল্ক্য-স্মৃতির এক শ্লোকের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বিজ্ঞানেশ্বর মন্তব্য করেছেন, ভূমিদানের অধিকার কেবল রাজার, অন্য কারোর সে অধিকার নেই। সে যুগের কয়েকখানি লেখেও প্রায় অনুরূপ তথ্যের উল্লেখ আছে। লেখে দেখা যায়, রাজা স্বয়ং গ্রাম বা ভূখণ্ড দান করছেন। লেখ থেকে আরও জানা যায়, জমির ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে রাজার বা রাষ্ট্রের অনুমোদন আবশ্যিক ছিল। লেখে ও সাহিত্যে জমিতে উৎপন্ন ফসলের এক-ষষ্ঠাংশ রাজার প্রাপ্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে। জমির উপর রাজমালিকানা তত্ত্বের প্রবক্তারা এই রাজস্বকে প্রজার জমি ভোগদখলের খাজনারূপে ব্যাখ্যা করেছেন। জমির উপর রাজমালিকানার সপক্ষে যেসব যুক্তি-তর্ক দেখানো হয় তাদের যৌক্তিকতা সম্পর্কে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
    • তাঁরা বলেন, বিজ্ঞানেশ্বর রাজার জমিদানের যে অধিকারের উল্লেখ করেছেন তা নিছক সরকারি অনুমোদনমাত্র। তাঁরা মনে করেন, সরকারের অনুমতি ছাড়া জমির কেনা-বেচার কাজ নিষ্পন্ন হতে পারে না, এ কথাই বিজ্ঞানেশ্বরের বক্তব্যের তাৎপর্য।
    • দ্বিতীয়ত, লেখমালায় রাজার গ্রামদানের কথা আছে বটে কিন্তু সে দান গ্রাম থেকে গ্রহীতাকে রাজস্ব আদায়ের অধিকার দান। গ্রাম থেকে এতদিন যে রাজস্ব রাজার প্রাপ্য ছিল দানের ফলে সে রাজস্বের উপর গ্রহীতার ভোগাধিকার প্রতিষ্ঠিত হল। এ দান প্রকৃত অর্থে গ্রামদান নয়।
    • তৃতীয়ত, জমির ক্রয়-বিক্রয়ে অনুমতি প্রদান এবং জমির স্বত্বাধিকার দু’টি স্বতন্ত্র বিষয়। রাজ্যময় সরকারের যে প্রশাসনিক কর্তৃত্ব ছিল তারই সুবাদে সরকার জমির কেনা-বেচার কাজে অনুমোদন বা অসম্মতি জানাত। রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলার স্বার্থে সরকার এই অধিকার ভোগ করত, প্রদত্ত জমিতে তার স্বত্বাধিকার ছিল না।
    • চতুর্থত, রাজাকে ভূমিরাজস্ব দেওয়া হত রাজা জমির মালিক বলে নয়, রাজা প্রজাদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা করতেন বলে। জমিতে উৎপন্ন ফসলের এক ষষ্ঠাংশের উপর রাজার অধিকারের সঙ্গে তাঁর প্রজাপ্রতিপালনের অঙ্গাঙ্গিক সম্পর্কের কথা প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে বার বার স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করা হয়েছে।
    • পঞ্চমত, সাঁচী প্রস্তর লেখে আম্রকার্দবের ঈশ্বরবাসক নামে একটি গ্রাম কেনার ঘটনার উল্লেখ আছে। গ্রামটি কেনা হয়েছিল দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের একটি ভগ্নপ্রায় প্রাসাদ বিক্রি করে। এ থেকে অনুমান করা চলে, আম্রকার্দব দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের তরফে গ্রামটি কিনেছিলেন। অর্থাৎ রাজাকে কোনও জমি কিনতে হলে জমির প্রকৃত মালিককে তার মূল্য দিতে হত। এসব যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে রাজাকে রাজ্যের সমগ্র ভুখণ্ডের স্বত্বাধিকারী বলে মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
  • ব্যক্তিগত মালিকানা : জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানার সপক্ষেও বেশ কিছু যুক্তি-তর্কের অবতারণা করা হয়েছে। অর্থশাস্ত্রের দ্বিতীয় অধিকরণে স্পষ্ট বলা হয়েছে, জমি তাঁর যিনি রাজাকে নিয়মিতভাবে রাজস্ব জোগান। মনুসংহিতার অষ্টম অধ্যায়ে জমিবন্ধকের ইঙ্গিত আছে, ব্যক্তিগত মালিকানাধীন খেত-খামারেরও উল্লেখ আছে। মীমাংসাসূত্রের ভাষ্যকার শবরস্বামী সম্ভবত গুপ্তযুগে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তিনি বলেন, জমির উপর রাজার যতখানি অধিকার, প্রজাদের অধিকারও ঠিক ততখানি। রাজা প্রজাদের প্রতিপালন করেন বলে জমিতে উৎপন্ন ফসলের একাংশ ভোগ করেন। কিন্তু যে প্রজা জমিতে ফসল ফলান এবং কৃষির দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করেন, জমির উপর তাঁর ন্যায়সংগত অধিকার আছে। ব্যবহারময়ূখে উল্লেখ আছে, রাজা তাঁর রাজ্যের সমগ্র ভূখণ্ড দান করতে পারেন না, তিনি যখন ভূমিদান করেন, তখন তিনি প্রকৃতপক্ষে তাঁর প্রাপ্য ভূমিরাজস্ব দান করেন। প্রয়োজন হলে রাজা মূল্যের বিনিময়ে প্রজাদের কাছ থেকে জমি কিনবেন, এরূপ ইঙ্গিতও আছে ব্যবহারময়ূখে। জমির উপর ব্যক্তিগত মালিকানার সপক্ষে যেসব যুক্তি দেওয়া হয় তা প্রধানত মীমাংসাসূত্র ও ধর্মশাস্ত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত। কখনও কখনও বলা হয়ে থাকে, মীমাংসাসূত্র ও ধর্মশাস্ত্রের বিধান মূলত তাত্ত্বিক, সমকালীন অর্থনৈতিক জীবনের প্রতিচ্ছবি এতে বড় একটা নেই।
  • এজমালি সম্পত্তি : জমির মালিক রাজা নন, স্বতন্ত্রভাবে গ্রামবাসীরাও নন, জমি গ্রামসভা বা গ্রামবাসীদের এজমালি সম্পত্তি, এমন অভিমতও প্রচারিত হয়েছে। এ মতের সমর্থনে কয়েকটি যুক্তিও দেওয়া হয়েছে। সমকালীন লেখমালায় দেখা যায়, যখন কোনও জমি ক্রয়, বিক্রয় বা দান করা হত, তখন শুধু রাজপুরুষরাই উপস্থিত থাকতেন না, সেই গ্রামের মহত্তর, অষ্টকুলাধিকরণের সদস্যবৃন্দ, গ্রামণী, ব্রাহ্মণ ও কুটুম্বীরাও উপস্থিত থাকতেন। প্রদত্ত জমির পরিমাপ ও সীমানা নির্ধারণের সময়ও গ্রামের প্রতিনিধিদের উপস্থিতি অত্যন্ত জরুরি ছিল। স্থানীয় প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ এবং ঊর্ধ্বতন রাজপুরুষরা জমিহস্তান্তরের কাজ একা করতেন না, গ্রামের স্থানীয় ব্যক্তিদের সাহায্যে তাঁরা সে কাজ সম্পাদন করতেন। অনেকের মতে জমি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে গ্রামবাসীদের এই ভূমিকা গ্রামের উপর তাঁদের যৌথ মালিকানাই প্রমাণ করে। জমির উপর গ্রামবাসীদের যৌথ মালিকানার সমর্থনে সমকালীন দু’টি লেখের উল্লেখ করা হয়। লেখ দু’খানি হল মহারাজাধিরাজ ধর্মাদিত্যের ফরিদপুর তাম্রশাসন এবং গুপ্তরাজ দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের অধীনস্থ পদস্থ রাজপুরুষ আম্রকাদবের সাঁচী প্রস্তর লেখ। এরূপ যুক্তি দেখানো হয় যে ফরিদপুর লেখে বলা হয়েছে, জমির বিক্রয়লব্ধ অর্থের এক-ষষ্ঠাংশ রাজকোষে জমা পড়বে। এ থেকে অনুমান করা হয়েছে, বিক্রয়লব্ধ অর্থের অবশিষ্টাংশ গ্রামসভার ভাণ্ডারে জমা পড়ত। সাঁচী লেখের উল্লেখ প্রসঙ্গে বলা হয় যে সেখানে পঞ্চমণ্ডলী বা গ্রামসভার উল্লেখ আছে এবং এই গ্রামসভার অনুমোদন ক্রমেই আম্রকার্দব জমিদান করেছিলেন। ফরিদপুর এবং সাঁচী লেখের যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয় তা কিন্তু সংশয়ের ঊর্ধ্বে নয়। ফরিদপুর লেখে বিক্রয়লব্ধ অর্থের কথা বলা হয়েছে না উৎপন্ন ফসলের কথা বলা হয়েছে সে সম্পর্কে বিতর্ক আছে। আর সাঁচী লেখে গ্রামসভা বা পঞ্চায়েতের উল্লেখ সম্পর্কে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। জমির ক্রয়, বিক্রয়, দান ও সীমানা নির্ধারণের সময় গ্রামের কর্তাব্যক্তিদের উপস্থিতির অন্য ব্যাখ্যাও হতে পারে। জমি হস্তান্তরের কাজটি রাজ পুরুষদের নির্দেশনায় এবং তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হত; গ্রামবাসীরা নিছক ঘটনার সাক্ষী হিসাবে উপস্থিত থাকতেন।
  • ব্যক্তিমালিকানা সুপ্রতিষ্ঠিতি ছিল : তাহলে জমি কার? রাজাকে নৃপতি বলে। রাজা নৃপতি বা নরপতি বলে প্রজাদের জীবনের উপর তাঁর স্বত্ব জন্মায় না, প্রজারা তাঁর সম্পত্তি বনে যান না। তিনি প্রজাদের পালন করেন, রক্ষা করেন, তাই তিনি নৃপতি, নরপতি। তেমনি রাজা ভূপতি, ক্ষিতিপতি হলেও রাজ্যের সমগ্র ভূখণ্ডের একচ্ছত্র মালিকানার অধিকারী তিনি নন। সুনির্দিষ্টরূপে জমির খাজনা বোঝায়, এরূপ কোনও শব্দ সমকালীন লেখমালা বা সংস্কৃত সাহিত্যে দুর্লভ। নিয়মিত রাজস্ব দেন এমন কোনও ক্ষেত্রস্বামী বা কৃষককে বিতাড়িত করে তাঁর জমি রাজা আপন খেয়ালমতো অন্য কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে দান করছেন এরূপ ঘটনার কথা জানা যায় না। বরঞ্চ সাধারণ ব্যক্তির জমি বিক্রির মতো ঘটনার উল্লেখ সে যুগের লেখমালায় পাওয়া যাবে। উত্তরাধিকারীদের মধ্যে পরলোকগত পিতার স্থাবর সম্পত্তির বণ্টন বা পরিবারের লোকদের পুরুষানুক্রমে স্থাবর সম্পত্তি ভোগের অজস্র নিদর্শন সংস্কৃত সাহিত্যে ছড়ানো আছে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয় গুপ্তযুগে ব্যক্তিগত মালিকানা সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। অনুমান করা যায়, সঙ্গতিসম্পন্ন গ্রামবাসীরা বাস্তুভূমি ও কৃষিক্ষেত্রের মালিকানা ভোগ করতেন এবং জমিতে উৎপন্ন ফসলের নির্দিষ্ট অংশ তাঁরা রাজা তথা রাষ্ট্রকে রাজস্ব হিসাবে প্রদান করতেন।
  • রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কর্তৃত্ব ছিল : তবে জমিতে প্রজাদের ব্যক্তিগত মালিকানা সুপ্রতিষ্ঠিত থাকলেও রাজা তথা রাষ্ট্রের জমির উপর প্রশাসনিক কর্তৃত্ব ছিল। প্রজারা যাতে জমিসংক্রান্ত আইন-কানুন মেনে চলেন, জমি নিয়ে কোনও বাদ-বিসংবাদ দেখা দিলে তার সমাধান, জমির সুরক্ষা ও সুব্যবহার এসব বিষয় দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল রাজার তথা রাষ্ট্রের। জমির ক্রয়, বিক্রয় ও দানের ক্ষেত্রেও সরকারের অনুমোদন আবশ্যিক ছিল। তাছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত জমিও ছিল। অভিজ্ঞানশকুন্তলম্-এ বলা হয়েছে, কোনও ব্যক্তি উত্তরাধিকারী না রেখে মারা গেলে রাজা তাঁর সম্পত্তির অধিকারী হবেন। স্মৃতিকার বৃহস্পতি এবং নারদও একই বিধান দিয়েছেন। মাটির নীচে কোনও নিধি বা খনি পাওয়া গেলে রাজা তাঁর অংশ পাবেন, স্মৃতিকারেরা প্রায় সকলেই এ ধরনের নির্দেশ দিয়েছেন। লেখমালা থেকে জানা যায়, ক্রয়েচ্ছু ব্যক্তি অনাবাদি জমি রাজা বা রাষ্ট্রের কাছ থেকেই ক্রয় করেন। এ থেকে সিদ্ধান্ত করা যায় অনাবাদি জমি রাষ্ট্রের অধিকারভুক্ত ছিল। সর্বসাধারণের চলাচলের পথ-ঘাট এবং গ্রাম সীমান্তে অবস্থিত গোচারণভূমি ও বনাঞ্চল ছিল রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি। রাজার ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমিও ছিল।

ভূমিরাজস্ব : জমি থেকে রাজা নানা ধরনের রাজস্ব সংগ্রহ করতেন –

  • ভাগ : প্রধান ভূমিরাজস্ব ছিল ‘ভাগ’। কালিদাসের কাব্যে রাজাকে ‘যড়ভাগী’ বলা হয়েছে। প্রজার জমিতে উৎপন্ন ফসলের এক ষষ্ঠাংশ গ্রহণ করেন বলে রাজা ‘যড়ভাগী’। কখনও কখনও উৎপন্ন শস্যের এক-তৃতীয়াংশ বা এক-চতুর্থাংশ ভাগরূপে রাজভাণ্ডারে জমা পড়ত। সম্ভবত জমির উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন ব্যয়ের তারতম্যের জন্য ভাগের পরিমাণের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটত। জরুরি অবস্থা দেখা দিলেও ভাগের পরিমাণ বৃদ্ধি পেত। গুপ্তলেখমালায় কখনও কখনও ভাগ অর্থে ‘বলি’ ও ‘মেয়’ পদের ব্যবহার দেখা যায়।
  • ভোগ : ‘ভাগ’ ছাড়া প্রজাদের ‘ভোগ’, ‘কর’, ‘উপরিকর’, ‘উদ্ভঙ্গ’, ‘হিরণ্য’, ‘হলিরাকর’, ‘সেনা ভক্ত’ ইত্যাদি আরও নানা প্রকার রাজস্ব দিতে হত। গ্রামবাসীরা কখনও কখনও রাজাকে যে ফল, ফুল, জ্বালানি কাঠ ইত্যাদি সামগ্রী উপহার দেন তাই ভোগ।
  • কর : ‘কর’ বলতে ঠিক কি ধরনের রাজস্ব বোঝাত তা স্পষ্ট নয়। মেধাতিথি বলেন, প্রজারা রাজাকে যে দ্রব্যাদি দান করেন তাই কর। কুল্লুকের মতে মাসে মাসে, বিশেষত ভাদ্র ও পৌষ মাসে, গ্রাম ও শহরবাসীরা রাজাকে নিয়মিত যে রাজস্ব দেন তাই কর। টীকাকার রামচন্দ্র মনে করেন, রাজার সামরিক শিবিরে প্রজাদের দেয় রাজস্বই কর। ভট্টস্বামী বলেছেন, ভাদ্র-বসন্তে প্রজারা যে বাৎসরিক রাজস্ব দেন তাই কর। ক্ষীরস্বামীর মতে প্রজাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির উপর ধার্য রাজস্বই কর। হরিভদ্রসূরি মনে করেন, প্রজারা রাজাকে যে দ্রব্যাদি উপহার দেন তাই কর। লক্ষ করবার বিষয়, ওগুলেখমালায় কখনও কখনও ‘ভাগ’ ও ‘কর’ একই সঙ্গে উল্লিখিত হয়েছে। এ থেকে স্পষ্ট প্রমাণ হয়, ‘ভাগ’ ও ‘কর’ দু’টি স্বতন্ত্র রাজস্ব ছিল। অনুমান করা যায়, উৎপন্ন ফসলে রাজার নির্দিষ্ট ‘ভাগ’ ছাড়া প্রজাদের স্থাবর-অস্থাবর সামগ্রিক সম্পত্তির উপর এক বিশেষ রাজস্ব ধার্য হত। ‘কর’ বলতে সম্ভবত এই রাজস্বই বোঝানো হয়েছে।
  • উপরিকর : ‘উপরিকর’-এর প্রকৃত অর্থ নিয়েও বিতর্ক আছে। ফ্লিট সাহেবের মতে অন্যের জমিতে কাজ করেন এমন চাষিদের দেয় রাজস্বই ‘উপরিকর’। আবার অনেকে মনে করেন, কৃষকদের উপর মাঝে মাঝে বাড়তি রাজস্ব চাপানো হত। এই বাড়তি রাজস্বই ‘উপরিকর’।
  • উদ্ভঙ্গ : গ্রাম বা শহরে মোতায়েন রক্ষিবাহিনীর ভরণ-পোষণের জন্য যে কর তাই ‘উদ্ভঙ্গ’, এ মত কেউ কেউ ব্যক্ত করেছেন। আবার অনেকের মতে, এটি একটি জলকর; কৃষকরা সরকারি জলসেচের সুযোগ নিলে তাদের এই কর দিতে হত।
  • হিরণ্য : অনেকে সোনা অর্থে ‘হিরণ্য’ শব্দের ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু গুপ্তলেখে ‘হিরণ্য’ সোনার প্রতিশব্দরূপে ব্যবহৃত হয়নি। কয়েকটি বিশেষ পণ্যের উৎপাদনের জন্য কৃষকদের নগদে রাজস্ব দিতে হত। নগদে প্রদত্ত রাজস্বই ‘হিরণ্য’।
  • হলিরাকর : লাঙলের উপর কর ধার্য হত। এই কর হলিরাকর।
  • সেনাভক্ত : রাজা বা সেনাপতি যখন সসৈন্যে গ্রামের মধ্য দিয়ে গমন করতেন তখন গ্রামবাসীদের এক ধরনের কর দিতে হত। এই করকে ‘সেনাভক্ত’ বলা হয়।
  • উপায়নিক : উৎসব-অনুষ্ঠানাদিতে প্রজারা রাজাকে যে উপঢৌকন দিতেন তা ‘উপায়নিক’।
  • বিষ্টি : রাজা বা রাষ্ট্রের নির্দেশে প্রজাদের অনেক সময় বিনা পারিশ্রমিকে শ্রমের জোগান দিতে হত। এর নাম ‘বিষ্টি’।

সন্দেহ নেই, প্রজাদের উপর রাজস্বের বোঝা বেশ ভারীই ছিল। সেনাবাহিনীর পিছনেই রাজস্বের বেশির ভাগ ব্যয় হত। রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলার রক্ষণাবেক্ষণ, বহিরাক্রমণ প্রতিরোধ, রাজ্যজয় ইত্যাদি নানা কারণে স্থায়ী সেনাবাহিনীর প্রয়োজন হত। সেচ প্রকল্প, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে আর্থিক অনুদান ইত্যাদি জনকল্যাণমূলক কাজেও রাজস্বের একাংশ খরচ করা হত।

কারিগরি শিল্প

ধাতু-শিল্প : এই পর্বে ধাতুশিল্পে অগ্রগতির লক্ষণ সুস্পষ্ট। অমরকোষে সোনা, রূপা, তামা, লোহা, পিতল, সিসা ও টিনের উল্লেখ আছে। বৃহৎসংহিতায় সোনা, রূপা, তামা, লোহা, কৃষ্ণায়স্, কৃষ্ণলোহ, সিসা ও কাঁসার উল্লেখ আছে –

  • লোহা : কৃষ্ণায়স্ ও কৃষ্ণলোহ লোহার প্রতিশব্দ। কিন্তু লোহ বলতে শুধু লোহা বোঝায় না, তামা ও কাঁসার মতো সস্তা ধাতুও বোঝায়। কামসূত্রে ধাতুশিল্প বা ধাতুবাদ চৌষট্টি কলার অন্যতম বলে বর্ণিত হয়েছে। এতে সমকালীন যুগে ধাতুশিল্পের গুরুত্বই প্রতিফলিত হয়েছে। মানুষের জীবনে লোহা ছিল নিত্য ব্যবহার্য বস্তু। কৃষি, গাছকাটা, জঙ্গল পরিষ্কার, দারু-শিল্প, প্রস্তর-শিল্প, গৃহস্থালি ও যুদ্ধের কাজে লোহার যন্ত্রপাতি ও হাতিয়ারের প্রয়োজন হত। কালিদাস কর্মকারদের উল্লেখ করেছেন। তাঁদের ব্যবহার করা লোহার হাতুড়ির (অয়োঘন) কথাও বলেছেন। অমরকোযে লোহার কোদাল, কাস্তে, লাঙলের ফলক, শিকল, সাধারণ ফলক, পাত্র ও তরবারি এবং গাছ, বাঁশ ও চামড়া কাটার লোহার যন্ত্রপাতির উল্লেখ আছে। উত্তর ভারতের বিভিন্ন স্থানে উৎখননের ফলে লোহার হাতুড়ি, বাটালি, কুঠার, কাটারি, চামচ ও পাত্র পাওয়া গেছে। ভারতবর্ষ গ্রীষ্মপ্রধান দেশ হওয়ায় এখানকার জলবায়ুতে লোহার দ্রুত ক্ষয় হয়। ফলে এ দেশে লোহার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আশানুরূপ হতে পারেনি। কিন্তু এই পর্বে লৌহশিল্পে যে অগ্রগতি ঘটেছিল তা বিস্ময়কর। এই প্রসঙ্গে দিল্লির নিকটবর্তী মেহরৌলী লৌহস্তম্ভ বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। একটি মাত্র লৌহখণ্ডে তৈরি এই বিশাল স্তম্ভটির উচ্চতা ৭ মিটার, ব্যাস ৫ মিটার এবং ওজন ৬ টনেরও বেশি। রাজা চন্দ্রের আমলে এই লৌহস্তম্ভ নির্মিত হয়েছিল। এই চন্দ্র যে গুপ্তসম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত তা প্রায় সকলেই স্বীকার করেছেন। প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে স্তম্ভটির উপর রোদ-ঝড়-জলের কত দাপট বয়ে গেছে তবু এর মসৃণতা আজও অমলিন। এ ধরনের এক অখণ্ড লৌহস্তম্ভ যে-সে কারখানায় তৈরি হত না, তৈরি হত একদল সুদক্ষ কারিগরের সমবেত প্রচেষ্টায় বৃহদায়তনের কোনও কারখানায়।
  • সোনা : লোহার তুলনায় সোনার চাহিদা কম ছিল। সোনা দিয়ে সাধারণত অলংকার ও মুদ্রা তৈরি হত। চিনা পরিব্রাজক ওয়েন চাঙ এ দেশে সোনার প্রাচুর্যের কথা বললেও এই ধাতু সম্ভবত বিদেশ থেকে আমদানি করা হত। বাণিজ্য উপলক্ষে সংগৃহীত বাইজানটাইন স্বর্ণমুদ্রা সে অভাব অনেকটা পূরণ করত। ধনী পরিবারগুলির সঙ্গে কাজকারবার হত বলে স্বর্ণকাররা প্রধানত শহরে বাস করতেন।
  • রূপা : সোনার মতো এ পর্বে রূপা দিয়েও মুদ্রা এবং নানা ধরন ও প্রকারের অজস্র অলংকার তৈরি হত। রূপা বিদেশ থেকে আমদানি হত।
  • অন্যান্য : আমদানিকৃত ধাতুর মধ্যে তামা, টিন ও সিসাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। অমরকোষে ম্লেচ্ছদেশের তামার উল্লেখ আছে। এ যুগের দু’ মিটারেরও বেশি দীর্ঘ এক তামার বুদ্ধমূর্তি বিহারের ভাগলপুর জেলার সুলতানগঞ্জে আবিষ্কৃত হয়েছে। ধাতু গলানো, ধাতুর ব্যবহার ও শুদ্ধাশুদ্ধি সম্পর্কে ধাতুশিল্পীদের বিশেষ জ্ঞান ছিল। অজন্তার চিত্রাবলিতে ধাতব দর্পণের ব্যবহার সে যুগের ধাতুশিল্পীদের অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দেয়।

মণি-রত্ন শিল্প : মণি-রত্নাদির কাজে ব্যাপক তৎপরতা দেখা দেয়। সোনা-রূপার অলংকার, সিলমোহর, পোষাক-পরিচ্ছদ, আসন, আয়না, প্রদীপ এবং বাড়ির দরজা ও মেঝেকে মণি-রত্নখচিত করে আরও আকর্ষণীয় করা হত। সুস্বাস্থ্যের কারণে এবং মনস্কামনা সিদ্ধির জন্যও মণি-রত্ন ধারণ করা হত। বৃহৎসংহিতায় পদ্মরাগ, পান্না, ইন্দ্রনীল, মরকত, রুধিরাখ্য, শশিকান্ত, মহানীল, বিমলক, রাজমণি, স্ফটিক, শুক্তি, শঙ্খ, বৈদূর্য, হরিতমণি, গোমেদ, প্রবাল, পুষ্পরাগ ইত্যাদি মণি-রত্নের উল্লেখ আছে। নাগপুরের নিকটবর্তী বেণগঙ্গা নদীর তীর, দক্ষিণ কোসল, সুরাষ্ট্র, হিমালয় অঞ্চল ও উত্তর বাংলায় বজ্র বা হিরা পাওয়া যেত। শ্রীলঙ্কা ও তামিলনাড়ুর তাম্রপর্ণী নদীতে মুক্তা পাওয়া যেত। সমকালীন সাহিত্যে এক তারের মুক্তাহারের (একাবলি) যেমন উল্লেখ আছে, তেমনি সাতাশ তারের (নক্ষত্রমালা) মুক্তাহারেরও বর্ণনা আছে। কামসূত্রে ‘রূপ-রত্ন-পরীক্ষা’ বা মণি-রত্নাদির শুদ্ধাশুদ্ধি নির্ণয় এবং ‘মণিরাগ কর-জ্ঞান’ বা মণিকারবৃত্তিকে চৌষট্টি কলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মৃচ্ছকটিক নাটকে রত্নকার-মণিকারদের কাজকর্মের বিশদ বিবরণ আছে।

গজদন্ত শিল্প : অনেক কারিগর গজদন্তশিল্পে নিযুক্ত ছিলেন। গজদন্ত দিয়ে সিলমোহর, সিংহাসন, পালঙ্কের দণ্ড, অঙ্গুরীয়, বাক্স ইত্যাদি তৈরি হত। এলাহাবাদের নিকট ভিটায় গুপ্তযুগের হাতির দাঁতের সিলমোহর আবিষ্কৃত হয়েছে। সেকালে হাতির দাঁতের চাহিদার তুলনায় দেশজ কাঁচামালের জোগান অপ্রতুল ছিল। কসমস ইন্ডিকোপ্লিউসটেস খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি নাগাদ ভারত পরিভ্রমণ করেছিলেন। তাঁর বর্ণনা থেকে জানা যায়, আফ্রিকার ইথিওপিয়া থেকে ভারতে গজদন্ত আমদানি করা হত।

মৃৎশিল্প : মানুষের দৈনন্দিন জীবনে মৃৎশিল্পের উপযোগিতা প্রশ্নাতীত। সমকালীন সাহিত্যে মৃৎশিল্পী বা কুম্ভকারের অজস্র উল্লেখ আছে। কলস, কুম্ভ, ঘট, কমণ্ডলু, দন্দ্বী প্রভৃতি বিভিন্ন প্রকার মৃৎশিল্পের উল্লেখও বিস্তর। উৎখননের ফলে অহিচ্ছত্র, হস্তিনাপুর, ভিটা, বৈশালী, রাজঘাট ও কৌশাম্বীতে প্রচুর পরিমাণে বাটি, গামলা, নানা আকারের বয়ম, প্রদীপ, কলম, ঢাকনা, কমণ্ডলু, বোতল, কুমোরের ছাঁচ ইত্যাদি মাটির তৈরি বিভিন্ন জিনিসের সন্ধান পাওয়া গেছে। গঠনে ও রঙের ব্যবহারে সমুজ্জ্বল এই পাত্রগুলির কোনও কোনওটি চাকে তৈরি, কোনও কোনওটিবা ছাঁচে তৈরি। পাত্রগুলির ঔজ্জ্বল্য বাড়াবার জন্য কখনও কখনও মাটির সঙ্গে অভ্রের মেশাল থাকত। কখনও কখনও পাত্রকে সুদৃশ্য করার জন্য তার গায়ে জ্যামিতিক নকশা কাটা হত বা বিভিন্ন ফুল, ফল ও জীবজন্তুর প্রতিকৃতি আঁকা হত। কোনও কোনও পাত্রের গায়ে হাতল থাকত।

চর্মশিল্প : বৃহৎসংহিতায় চর্মকার বা চর্মশিল্পীর উল্লেখ আছে। অমরকোষে চামড়ার পাদুকা (উপান), বোতল ও পাখার উল্লেখ আছে। চামড়া দিয়ে কখনও কখনও বস্ত্র তৈরি হত। চিত্রকলা ও ভাস্কর্যে চর্মপাদুকা ব্যবহারের স্বাক্ষর বিধৃত আছে। গরু, সিংহ, ব্যাঘ্র ও বন্য বিড়ালের চামড়াই সাধারণত ব্যবহার করা হত।

বস্ত্রশিল্প : অমরকোষ, বৃহৎসংহিতা, ফা শিয়েন-এর ভারতবৃত্তান্ত ও সমকালীন কাব্যসাহিত্যে বস্ত্রশিল্পের সুপ্রচুর উল্লেখ আছে। ফৌম, পশম, কার্পাস, রেশম, পশুর চামড়া ও গাছের বাকল দিয়ে বিভিন্ন ধরন ও আকারের বস্ত্র তৈরি হত। কাশ্মীরবাসীদের পশমবস্ত্র ব্যবহারের উল্লেখ করেছেন ফা শিয়েন। রঘুবংশে এমন এক ধরনের মিহি বস্ত্রের উল্লেখ আছে যা ফুৎকারে উড়ে যেত। মোটা ও মিহি দু’ধরনের বস্ত্রই তৈরি হত। বারাণসী, মথুরা ও উত্তর বাংলা সম্ভবত বস্ত্রশিল্পের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। সূচিশিল্পেও উন্নতি দেখা দেয়। অমরকোষ ও বৃহৎসংহিতায় সূচিক-এর উল্লেখ আছে। সূচিক শরীরের মাপ অনুযায়ী নানা রঙ ও ধরনের কারুকার্যখচিত পোশাক-পরিচ্ছদ তৈরি করতেন। সেযুগের চিত্রকলা, ভাস্কর্য ও মুদ্রায় দেব-দেবী, রাজা-রানি ও সাধারণ নর-নারীদের আটোসাটো পোশাক ও অন্তর্বাস ব্যবহারের অকাট্য নিদর্শন আছে।

দারুশিল্প : দারুশিল্প (তক্ষণম্) কামসূত্রে চৌষটি কলার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। দারুশিল্পী বৃহৎ সংহিতায় তক্ষণ, বর্ধকী, সূত্রধর ইত্যাদি নামে অভিহিত হয়েছেন। সুতার সাহায্যে কাঠের মাপজোখ করতেন বলে তিনি সূত্রধর। মাল ও আরোহী বহনের জন্য শকট, শিবিকা ইত্যাদি যান বাহন, রথ, বাড়ি-ঘর প্রভৃতির নির্মাণকাজে দারুশিল্পীদের ডাক পড়ত। বৃহৎসংহিতায় চক্র, অর, নেমি, অক্ষ, অণি, যুগ ইত্যাদি শকটের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের উল্লেখ আছে। কালিদাস বেতের তৈরি আসনের (বেত্রাসন) উল্লেখ করেছেন। বেত ও বাঁশ দিয়ে ঝুড়ি তৈরি হত।

তেল উৎপাদন : বৃহৎসংহিতা ও স্কন্দগুপ্তের রাজত্বকালে উৎকীর্ণ ইনদউর লেখে তৈলিকদের উল্লেখ আছে। চাকার সাহায্যে তৈলবীজ পিষ্ট করতেন বলে তাঁদের বৃহৎসংহিতায় চাক্রিক, চক্রচর বলা হয়েছে। তেল উৎপন্ন হত সরষে, তিল, তিসি ও ইক্ষুদির বীজ থেকে। প্রদীপ জ্বালানো, ক্ষতের উপশম এবং কেশচর্চায় ইক্ষুদি তেলের প্রয়োজনীয়তার উল্লেখ করেছেন কালিদাস।

অঙ্গরাগ শিল্প : কালিদাসের কাব্যে অঙ্গরাগ শিল্পের উল্লেখ আছে। ধনী পরিবারের লোকেরা দেহের কান্তি বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন অঙ্গরাগ ব্যবহার করতেন। সমকালীন সাহিত্যে কালেরর কালো অগুরু, শ্বেত অগুরু, হরিচন্দন, মনঃশিলা, হরিতাল, লোম্রচূর্ণ, কুমকুম, গোরোচনা, অলঙ্কর ইত্যাদি অঙ্গরাগের উল্লেখ আছে। চন্দনকাঠ থেকে সুগন্ধ মলম ও তেল তৈরি হত। কাবেরী এবং তাম্রপণী নদী দু’টির অববাহিকায় প্রচুর চন্দন গাছ জন্মে বলে কালিদাস উল্লেখ করেছেন।

মদ : মদের ব্যবসা এ সময় ফুলে-ফেঁপে ওঠে। সুরাপান, সুরাবিক্রি ও সুরার দোকানের অজস্র উল্লেখ আছে সমকালীন সাহিত্যে। রঘুবংশে নারকেল থেকে প্রস্তুত এক প্রকার মদের উল্লেখ আছে।

লবণ : দৈনন্দিন জীবনে এক অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্য লবণ। অমরকোষে দু’ধরনের লবণের উল্লেখ আছে – সামুদ্রিক লবণ এবং খনিজ লবণ। শেষোক্ত শ্রেণির লবণকে বৃহৎসংহিতায় ‘সৈন্ধব’ বলা হয়েছে। হিমাচলপ্রদেশের মাণ্ডি পাহাড়ে ও পাকিস্তানের সল্ট রেনজ অঞ্চলে এখনও লবণ পাওয়া যায়। পার্শ্ববর্তী বাকাটক রাজ্যে লবণ উৎপাদনের উপর সরকারের একচেটিয়া কর্তৃত্ব ছিল। গুপ্তরাজ্যেও লবণ উৎপাদনের উপর সরকারি কর্তৃত্ব বজায় ছিল কিনা বলা কঠিন। অন্তত সে রকম কোনও তথ্য নেই।

শিল্পে রাষ্ট্রের ভূমিকা : সন্দেহ নেই গুপ্তযুগে বিভিন্ন কারিগরি শিল্পে বিপুল কর্মচাঞ্চলা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে রাজ্যের শিল্পকর্মে রাষ্ট্রের কী ভূমিকা ছিল? মৌর্যযুগে অনেক শিল্পই ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত। আর যেসব শিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত ছিল না, সেখানে রাষ্ট্রের কঠোর নিয়ন্ত্রণ ছিল। গুপ্তপর্বেও যে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পসংস্থা ছিল না তা নয়, তবে সেখানে প্রধানত সমরোপকরণ ও মুদ্রা নির্মিত হত। মেহরৌলীর মতো বৃহদায়তন লৌহস্তম্ভ ও সুলতানগঞ্জের বুদ্ধমূর্তির ন্যায় ভাস্কর্য নির্মাণের জন্যও হয়তো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ছিল। খনির উপর রাষ্ট্রের পরিপূর্ণ কর্তৃত্ব ছিল। লবণ উৎপাদনেও হয়তো রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ছিল। ঔর্ণস্থানিক নামে যে রাজকর্মচারীর উল্লেখ পাওয়া যায় তিনি সম্ভবত উর্ণস্থান বা পশম উৎপাদন কেন্দ্রের কর্ণধার ছিলেন। এ ব্যাখ্যা সঠিক হলে বস্তু তথা কারিগরি শিল্পে রাষ্ট্রের বিশেষ ভূমিকার কথা অস্বীকার করা যায় না। যাজ্ঞবল্ক্য ও কাত্যায়ন বিধান দিয়েছেন, রাষ্ট্র ভোগ্যপণ্যের মূল্য নির্ধারণ করবে। বিশুদ্ধতার প্রমাণস্বরূপ বাটখারায় সরকারি ছাপ থাকবে এবং সরকার নিয়মিতভাবে বাটখারা পরীক্ষা করবে। যাজ্ঞবল্ক্য এবং কাত্যায়নের বিধানেও কারিগরি শিল্পে সরকারি নিয়ন্ত্রণের আভাস আছে। তবে মৌর্যপর্বে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ যতখানি ব্যাপক ও কঠোর ছিল এই পর্বে তেমনটি ছিল বলে মনে হয় না।

বাণিজ্য

হাট, বাজার ও বাণিজ্যকেন্দ্র : অমরকোষে হাটের প্রতিশব্দ আছে। অনুমান করা যায়, সপ্তাহের বিশেষ বিশেষ দিনে কয়েকটি গ্রামের মধ্যে একটি করে হাট বসত। এসব হাটে গ্রামে উৎপন্ন কৃষি ও শিল্পসামগ্রীর কেনা-বেচা ও বিনিময় চলত, স্থানীয় চাহিদা মিটত। যা উবৃত্ত থাকত তা ব্যবসায়ীরা সংগ্রহ করে শহরে চালান দিতেন। কালিদাসের কাব্য-নাটকে শহরের কর্মচঞ্চল বাজারের (বিপণি) উল্লেখ আছে। বিপণির মাঝখান দিয়ে রাস্তা (আপনমার্গ) চলে গেছে, রাস্তার দু’ধারে বড় বড় দোকানের সারি, মদের দোকানে ক্রেতারা ভিড় জমাচ্ছেন, এ বর্ণনা আছে কালিদাসের কাব্যে। (দোকান ও বাজার উভয় অর্থেই বিপণি শব্দের প্রয়োগ আছে। কিন্তু কালিদাস রঘুবংশে বাজার অর্থেই বিপণি শব্দ ব্যবহার করেছেন।) ভিটার গুপ্তসংস্তরে বড় রাস্তার দু’ধারে সারি সারি দোকান আবিষ্কৃত হয়েছে। সেযুগে বড় ব্যবসায়ীদের সংখ্যা কম ছিল না। কালিদাস তাঁদের ‘প্রধান ব্যবসায়ী’ বলেছেন। বোঝা যায়, বিশাল এলাকা জুড়ে তাঁদের কর্মকাণ্ড বিস্তৃত ছিল। উজ্জয়িনী, প্রতিষ্ঠান, বিদিশা, প্রয়াগ, কৌশাম্বী, বারাণসী, অহিচ্ছত্র, মথুরা, বৈশালী, গয়া, পাটলিপুত্র প্রভৃতি শহরগুলি এই পর্বে বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। স্থল ও জলপথে বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে শহরগুলির যোগ ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্যে বৈশ্যদেরই ছিল মুখ্য ভূমিকা। কিন্তু অন্য বর্ণের লোকেরাও যে কখনও কখনও বাণিজ্য বৃত্তি গ্রহণ করতেন, তারও প্রমাণ আছে। ৪৬৬ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ স্কন্দগুপ্তের ইনদউর তাম্রশাসনে দু’জন ক্ষত্রিয় বণিকের কথা বলা হয়েছে। বণিকদ্বয় উত্তরপ্রদেশের বুলন্দসর অঞ্চলে অবস্থিত ইন্দ্রপুর গ্রামে একটি সূর্য মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। দেববিষ্ণু নামে জনৈক চতুর্বেদী ব্রাহ্মণ এ মন্দিরে প্রদীপাদির সংস্থানের জন্য নগদ অর্থ প্রদান করেন। মৃচ্ছকটিকের নায়ক চারুদত্ত বর্ণে ব্রাহ্মণ কিন্তু বৃত্তিতে সার্থবাহ। তাঁর পিতৃ-পিতামহরাও সার্থবাহ ছিলেন। অর্থাৎ, একটি ব্রাহ্মণ পরিবার পুরুষানুক্রমে বাণিজ্যোপঞ্জীবী ছিল। বস্তুত, সম্পদের প্রলোভনই পরিবারটিকে বণিকের “বৃত্তি গ্রহণে অনুপ্রাণিত করেছে।

বাণিজ্যিক পথ : স্থল ও জল উভয় পথেই বণিকরা পণ্যসম্ভার নিয়ে যাতায়াত করতেন। নদী পথে বাণিজ্যপোতের যাতায়াতের বর্ণনা আছে রঘুবংশে। অভিজ্ঞানশকুত্তলমে বাণিজ্যসত্তার সহ জলযানের নিমগ্ন হওয়া এবং বণিকের সলিল সমাধির উল্লেখ আছে। মালবিকাগ্নিমিত্রে বলা হয়েছে, একবার বণিকদের একটি দল শকটে পণ্যসত্তার সাজিয়ে বিদিশা থেকে বিদর্ভের দিকে যাচ্ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে রক্ষিবাহিনীও ছিল। কিন্তু পথে একদল ডাকাত তাঁদের সব সম্পত্তি অপহরণ করে। মালবহনের কাজে সাধারণত শকট বা গরুর গাড়ি ব্যবহার করা হত। কখনও কখনও শ্রমিকদেরও এ কাজে লাগানো হত। পথঘাটে অনেক বিপদের সম্ভাবনা সত্ত্বেও বণিকরা অধিক লাভের আশায় দূর অঞ্চলে বাণিজ্য করতে যেতেন।

শ্রেষ্ঠী ও সার্থবাহ : সমকালীন লেখে শ্রেষ্ঠী ও সার্থবাহরা ‘ধারবার উল্লিখিত হয়েছেন। সাধারণত ধনী এবং প্রভাবশালী বণিককে শ্রেষ্ঠী বলা হত। কখনও কখনও অর্থ ও ক্ষমতার জোরে তিনি শহরের বণিকগোষ্ঠীর প্রধানরূপে গণ্য হতেন। সুদের কারবারেও তিনি অর্থোপার্জন করতেন। বণিকরা অনেক সময় সদলে শকটে পণ্যসামগ্রী বোঝাই করে দেশ-দেশান্তরে ব্যবসা করতে যেতেন। এক একটি ভ্রাম্যমান বণিকগোষ্ঠীর এক একজন দলপতি ছিলেন। এরূপ দলপতিকে সার্থবাহ বলা হত। উত্তর বাংলার কয়েকখানি সমকালীন লেখে জেলাস্তরের এক সমিতির উল্লেখ আছে। সমিতির সদস্যরা বিষয়পতি বা জেলার অধিকর্তাকে তাঁর কাজকর্মে সাহায্য করতেন। নগরশ্রেষ্ঠী, সার্থবাহ প্রভৃতি কয়েকজন সদস্যকে নিয়ে এই সমিতি গঠিত ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্যের গুরুত্ব সম্পর্কে রাষ্ট্র সচেতন ছিল বলেই জেলাসমিতির দু’টি আসন ব্যবসায়ীদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। রাজা বণিকদের পৃষ্ঠপোষকতা করবেন এই মর্মে কামন্দকের এক বিধান এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যায়।

আন্তর বাণিজ্য : বেশ কিছু জিনিস ছিল যা নির্দিষ্ট কয়েকটি অঞ্চলে জন্মাত অথচ সারা ভারতে তাদের বিপুল চাহিদা ছিল। আন্তর বাণিজ্যের মাধ্যমে সেসব জিনিস ভারতের সর্বত্র চালান যেত। মালাবার উপকূলে মরিচ জন্মাত। সে মরিচ সারা ভারতের চাহিদা মেটাত। দক্ষিণ ভারতে উৎপন্ন চন্দনকাঠ ও প্রবাল ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে রপ্তানি হত। সমুদ্র উপকূল, পাঞ্জাব ও হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চল থেকে সারা ভারতে লবণ চালান যেত। তখনকার দিনে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে কড়ির ব্যাপক ব্যবহার ছিল। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল সম্ভবত মালাবার উপকূল বা মালদ্বীপ থেকে এই কড়ি আমদানি করত। এই পরিস্থিতিতে গুপ্তযুগে আন্তর বাণিজ্যের বিকাশের পথ প্রশস্ত হয়েছিল। মৃচ্ছকটিকে বলা হয়েছে, বণিকমাত্রেই প্রতারক, স্বর্ণকারমাত্রেই অসাধু, রুপোপজীবী মাত্রেই অর্থগৃধু। এ থেকে বোঝা যায় তখনকার সমাজে বণিকদের ভাবমূর্তি তেমন উজ্জ্বল ছিল না।

বহির্বাণিজ্য :

  • পারস্য ও পূর্ব ইউরোপ : এ সময় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। রোমক সাম্রাজ্যের তখন পতনোন্মুখ অবস্থা। একের পর এক বর্বর জাতির আক্রমণের ঢেউ রোমক সাম্রাজ্যের উপর আছড়ে পড়তে থাকে। রোমের এই রাজ নৈতিক অস্থিরতা ভারত-রোম বাণিজ্যের পক্ষে শুভ হয়নি। তবু রোমের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সূত্র একেবারে ছিন্ন হয়নি। ৪০৮ খ্রিস্টাব্দে গথ দলপতি এলারিক সসৈন্যে রোমের উপকণ্ঠে উপস্থিত হন কিন্তু ৩০০০ পাউণ্ড মরিচ এবং ৪০০০ রেশম বস্ত্রের বিনিময়ে অভিযান প্রত্যাহার করেন। এই মরিচ ও রেশমবস্ত্রের বিরাট একটি অংশ সম্ভবত ভারত থেকে রপ্তানি হয়েছিল। দেখা যাচ্ছে রোমের সেই দুর্যোগের দিনেও সেখানকার বাজারে ভারতীয় পণ্যসামগ্রীর অভাব ছিল না। কনস্টানটিনোপলে (আধুনিক ইস্তানবুল) বাইজানটাইন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর থেকে পূর্ব ইউরোপের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়। ভারত-রোম বাণিজ্যে লোহিত সাগরের যে ভুমিকা ছিল ভারত-বাইজানটাইন বাণিজ্যে পারস্য ও ওমান উপসাগর সে স্থান গ্রহণ করে। অবশ্য পারস্যের ভিতর দিয়ে স্থলপথেও এ বাণিজ্য চলত। পারস্যের তদানীন্তন সাসানীয় রাজারা এই বাণিজ্যে যথেষ্ট আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। ভারত থেকে বাইজানটাইন সাম্রাজ্যে পশম, লোহা, সুগন্ধি, হিরা, মুক্তা, স্ফটিক, মণি, রত্ন, রেশম, রেশমবস্ত্র, কচ্ছপের খোল (?), খোজা, হস্তিদন্ত, দারুচিনি, মরিচ, কস্তুরী, আদা, এলাচ, পান, চিতাবাঘ ইত্যাদি রপ্তানি হত। বাইজানটাইনে তুলাও রপ্তানি হত বলে অনেকে অভিমত প্রকাশ করেছেন। তবে এ সম্পর্কে সন্দেহ আছে। খ্রিস্টীয় ৪র্থ, ৫ম ও ৬ষ্ঠ শতকের বাইজানটাইন মুদ্রা দক্ষিণ, পশ্চিম ও পূর্ব ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া গেছে। বাণিজ্য উপলক্ষেই এই মুদ্রাগুলি ভারতে এসেছিল। পশ্চিম উপকূলীয় বন্দরসমূহ পূর্ব ইউরোপ ও পারস্যের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়ায় ভারতের পশ্চিম উপকূলের বন্দরগুলি পুনরায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। ভারতীয় বন্দরগুলির পুনরভ্যুত্থানের ইতিহাস বিধৃত আছে কসমস ইন্ডিকোগ্লিউসটেস-এর ৫৩৫-৪৭ খ্রিস্টাব্দে লেখা ‘খ্রিশ্চিয়ান টপোগ্রাফি’ গ্রন্থে। লেখক পেশায় বণিক ছিলেন, বাণিজ্যোপলক্ষে তিনি ভারতে এসেছিলেন। সে কারণে তাঁর বৃত্তান্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি তাঁর বৃত্তান্তে সিন্ধু (সিন্ধু নদের মোহনায় অবস্থিত), ওরহথ (গুজরাত), ক্যালিয়েনা (কল্যাণ), সিবোর (চাউল), মালে (মালাবার) ইত্যাদি বেশ কয়েকটি বন্দরের উল্লেখ করেছেন। বন্দরগুলি ভারতের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত ছিল। খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের দ্বিতীয় পাদে সব কটি বন্দর কর্মচঞ্চল ছিল।
  • শ্রীলঙ্কা : বাণিজ্য চলত শ্রীলঙ্কার সঙ্গেও। শ্রীলঙ্কা থেকে রূপা এবং উৎকৃষ্ট শ্রেণির মুক্তা ও বস্ত্র আনা হত। সমুদ্রগুপ্তের দরবারে শ্রীলঙ্কাধীশ মেঘবর্ণ একবার দূত পাঠিয়েছিলেন। ঘটনাটির হয়তো বাণিজ্যিক ব্যঞ্জনা ছিল।
  • চিন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া : চিন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশগুলির সঙ্গেও ভারতের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। চিনের সঙ্গে স্থল ও জল উভয়পথেই বাণিজ্য চলত। অধ্যাপক প্রবোধচন্দ্র বাগচী দেখিয়েছেন, খ্রিস্টীয় ৫ম-৬ষ্ঠ শতকে ভারত থেকে বহু বৌদ্ধ শ্রমণ চিনদেশে গিয়েছিলেন। তেমনি চিন থেকেও অনেক বৌদ্ধ ভিক্ষু ভারত পরিভ্রমণে এসেছিলেন। শ্রমণেরা সাধারণ বাণিজ্যপথ ধরেই চলাচল করতেন। যা শিয়েন চিনে ফেরার সময় তাম্রলিপ্তি থেকে একটি বাণিজ্যপোতে চড়ে প্রথমে শ্রীলঙ্কার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন। পরে সেখান থেকে আর একটি বাণিজ্যযানে চেপে যাত্রার ৯০ দিন পর যবদ্বীপে পৌঁছান। যবদ্বীপ থেকে আর একখানি বাণিজ্য জাহাজের সাহায্যে ৭০ দিন পর তিনি চিনে গিয়ে উপনীত হন। সে সময় ভারত, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও চিন দেশের মধ্যে যে নিরন্তর ব্যবসা-বাণিজ্য চলত, ফা শিয়েনের বিবরণে তার সুস্পষ্ট প্রমাণ আছে। কালিদাস ‘চীনাংশুক’ বা চিনা বস্ত্রের উল্লেখ করেছেন। চিন থেকে রেশমবস্ত্র আমদানি করা হত। চিনে রপ্তানি করা হত জাফরান, সূক্ষ্ম বস্ত্র ও মণি-রত্ন। ৫১৯ খ্রিস্টাব্দে কাম্পুচিয়ার রাজা জয়বর্মা চিনসম্রাটের নিকট উপঢৌকনস্বরূপ কিছু জাফরান পাঠান। জাফরান প্রধানত কাশ্মীরে উৎপন্ন হত। অনুমান করা চলে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারত থেকে জাফরান রপ্তানি করা হত। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহে যে ভারতের বস্ত্র ও চন্দন কাঠের ব্যাপক চাহিদা ছিল তা চিনা সূত্র থেকেও জানা যায়।

পূর্ব উপকূলের গুরুত্ব : পূর্ব উপকূলে এক অতি বিখ্যাত বন্দর ছিল তাম্রলিপ্তি। এই তাম্রলিপ্তি সম্ভবত মেদিনীপুর জেলার বর্তমান তমলুক। ওড়িশা উপকূলের চে-লি-ত-লো (পুরী?) ও কোঙ্গোদ এবং অন্ধ্রপ্রদেশের দন্তপুরও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে দূরপাল্লার বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। বাণিজ্যপথগুলিতে পদে পদে ছিল বিপদের হাতছানি। দস্যু-তস্করের উপদ্রব তো ছিলই। দস্যুর হাতে পড়ে বণিক সর্বস্বান্ত হয়েছেন, সাহিত্যে এরূপ অজস্র ঘটনার উল্লেখ আছে। তাছাড়া সমুদ্রপথে যাতায়াতের উপযুক্ত জলযানের অভাব ছিল। সমুদ্রের মধ্যে ডুবো পাহাড়ের আঘাতে বা ঝড়-ঝঞ্ঝায় বাণিজ্যপোেত জলমগ্ন হত, দিক-নির্ণয়ও কঠিন ছিল। কিন্তু সামুদ্রিক বাণিজ্যে লাভের অঙ্ক অনেক বেশি থাকায় বণিকরা সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার ঝুঁকি নিতেন।

শুল্ক : শিল্প-বাণিজ্যের সমৃদ্ধি রাজকোষে অর্থাগমের পথ প্রশস্ত করে। পণ্যসামগ্রীর উপর যে শুল্ক ধার্য হয় তা থেকে রাজকোষে অর্থ জমা পড়ে। কোষকার অমর শুল্কের কথা বলেছেন। স্কন্দগুপ্তের বিহার প্রস্তরলেখে ‘শৌক্ষিক’ নামে শুল্কসংগ্রহকারী এক রাজপুরুষের উল্লেখ আছে। সম্ভবত প্রতি শহর ও বন্দরে শুল্ক বিভাগের শাখা ছিল। শুল্কের হার কী ছিল তা জানা যায় না।

পেশাদারি সংগঠন : গুপ্তযুগের কারিগরি শিল্প ও বাণিজ্যের আলোচনা প্রসঙ্গে শিল্পী ও বণিকদের পেশাদারি সংগঠনগুলি সম্পর্কে দু’চারটি কথা বলার প্রয়োজন আছে।

  • নাম : সমকালীন সূত্রে এই সংগঠনগুলিকে কখনও ‘শ্রেণী’, কখনও ‘নিগম’, আবার কখনওবা ‘সংঘ’ বলা হয়েছে। প্রথম কুমার গুপ্ত ও বন্ধুবর্মার মন্দসোর লেখে এক পট্টবায়শ্রেণী বা রেশমশিল্পী সংঘের উল্লেখ আছে। স্কন্দ গুপ্তের ইন্দোর তাম্রশাসনে ইন্দ্রপুর বা ইনদউরের এক তৈলিক শ্রেণীর কথা আছে। বৈশালীতে “শ্ৰেষ্ঠী-সার্থবাহ-কুলিক-নিগম’, ‘শ্রেষ্ঠী-কুলিক-নিগম’, ‘শ্রেষ্ঠী-নিগম’ ও ‘কুলিক-নিগম’ নামাঙ্কিত প্রচুর সিলমোহর আবিষ্কৃত হয়েছে। রঘুবংশে স্থপতি-সংঘের উল্লেখ আছে। বিশাখদত্তের মুদ্রারাক্ষসে মণিকার-সংঘের বর্ণনা আছে।
  • যাদের সংগঠন : লক্ষ করবার বিষয়, বৈশালীর সিলমোহরে যেমন কুলিক অর্থাৎ কারিগর এবং শ্রেষ্ঠী অথা মুখ্য বণিকদের স্বতন্ত্র সংগঠনের উল্লেখ আছে তেমনি শ্রেষ্ঠী ও কুলিকদের এবং শ্রেষ্ঠী, সার্থবা ও কুলিকদের সম্মিলিত, বৃহত্তর সংগঠনেরও খবর আছে। সাধারণত এক একটি পেশাকে কেন করে এক একটি সংগঠন গড়ে উঠত। কিন্তু বৈশালীর মতো বহুবৃত্তিক বৃহত্তর সংগঠনের পরিকল্পনা রাজ্যের অন্যান্য শহরে কতদূর কার্যকরী ছিল বলা শক্ত। দেখা যাচ্ছে, এ যুগের শিল্প ও বাণিজ্যিক সংগঠনগুলি তাদের নিজস্ব সিলমোহর ব্যবহার করত। পূর্ববর্তী যুগে এ ধরনের সিলমোহর বড় একটা পাওয়া যায় না। বৈশালীতে এ জাতীয় সিলমোহর বা সিলমোহরের ছাঁচ প্রচুর পরিমাণে পাওয়া গেছে। নিজেদের স্বতন্ত্র সিলমোহর ব্যবহারের মধ্য দিয়ে সংগঠনগুলির ক্রমবর্ধমান গুরুত্বই প্রকাশিত হয়েছে। মন্দসোর লেখে বর্ণিত দশপুরের রেশমশিল্পী সংগঠনের কথা বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে এই শিল্পীরা পূর্বে লাট অর্থাৎ দক্ষিণ গুজরাতে বাস করতেন কিন্তু পরে তাঁরা মালবের দশপুরে এসে বসবাস করেন। এখানে এসে শিল্পীদের কেউ কেউ তাঁদের পুরোনো বৃত্তিতে থেকে গেলেও অন্যান্যরা তিরন্দাজি, জ্যোতিষ, কথকতা ইত্যাদি নতুন বৃত্তি গ্রহণ করেন। সংগঠনটির অনেক সদস্যের বৃত্তির পরিবর্তন ঘটলেও প্রতিষ্ঠানটির পুরোনো পরিচয়ই অপরিবর্তিত থেকে যায়। সদস্যদের পেশার পরিবর্তন সংগঠনের পক্ষে শুভ সংকেত নয়। পেশাগত ঐক্য হল সংগঠনের মূল স্তম্ভ। তবে দশপুরের রেশম-শিল্পীদের তাঁদের আদি কর্মক্ষেত্র লাট অঞ্চল থেকে চলে আসা এবং দশপুরে এসেও তাঁদের পেশার পরিবর্তন খ্রিস্টীয় ৫ম শতকের মধ্যভাগ নাগাদ পশ্চিম ভারতের রেশমশিল্পে এক গুরুতর সংকটের ইঙ্গিত বহন করছে।
  • আধুনিক ব্যাংকের ভূমিকা : সমকালীন লেখমালা থেকে পেশাদারি সংগঠনগুলির কর্মধারা সম্পর্কে কিছু ধারণা করা যায়। সংগঠনগুলি অনেক ক্ষেত্রে পূর্বের মতোই আধুনিক ব্যাংকের ভূমিকা পালন করত। ৪৬৫ খ্রিস্টাব্দের একটি লেখ থেকে জানা যায়, দেববিষ্ণু নামে এক ব্রাহ্মণ ইনদউরের এক তৈলিক সংগঠনের নিকট কিছু অর্থ স্থায়িভাবে গচ্ছিত রেখেছিলেন। শর্ত ছিল, ওই আমানত করা অর্থের সুদ দিয়ে স্থানীয় সূর্যমন্দিরে প্রতিদিন দীপ জ্বালাবার জন্য দুই পলা করে তেল জোগান দিতে হবে। গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ যাতে হ্রাস না পায় সেদিকে সংগঠনের দৃষ্টি ছিল। অনুমান করা যায়, সদাশয় ব্যক্তিরা যে অর্থ সংগঠনে লগ্নি করতেন, সংগঠন তা নিজের ব্যবসায়ে খাটাত, হয়তোবা ক্ষেত্রবিশেষে কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে চড়া সুদে ধারও দিত। (কেবল যে শিল্পী বা বণিকসংগঠনে অর্থ লগ্নি করা হত তা নয়, অনেক সময় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেও চির কালীন ভিত্তিতে অর্থ গচ্ছিত রাখা হত। ৪১৩ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ও তাঁর পদস্থ রাজপুরুষ আম্রকার্দব সাঁচীর এক বৌদ্ধসংস্থায় ২৫ দীনার (স্বর্ণমুদ্রা) গচ্ছিত রেখেছিলেন। মহারাজাধিরাজ প্রথম কুমারগুপ্ত একইভাবে এলাহাবাদ অঞ্চলের এক ব্রাহ্মণ্য প্রতিষ্ঠানে ১২ দীনার লগ্নি করেছিলেন।)
  • জনহিতকর কাজকর্মে সক্রিয় অংশগ্রহণ : কখনও কখনও সংগঠনগুলি জনহিতকর কাজকর্মে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করত। উদাহরণ স্বরূপ এখানে দশপুরের পট্টবায় সংঘের উল্লেখ করা যায়। সংঘ স্থানীয় এলাকায় একটি সূর্যমন্দির নির্মাণ করে এবং পরে মন্দিরটি জীর্ণ হয়ে পড়লে তার সংস্কার সাধন করে।
  • সভাপতি : সংঘে একজন করে সভাপতি ছিলেন। তাঁকে ‘প্রমুখ’ বা ‘সংঘমুখ্য’ বলা হত। ইন্দ্রপুরের তৈলিক সংঘের অধ্যক্ষ ছিলেন জীবন্ত। কারিগর-সংঘের সভাপতিকে সম্ভবত প্রথম কুলিক বলা হত। উত্তর বাংলায় কোটিবর্ষ জেলার প্রশাসনকার্যে কয়েকজন বেসরকারি ব্যক্তি জেলাশাসককে সাহায্য করতেন। এঁদেরই একজন ছিলেন প্রথম কুলিক। বাণিজ্যিক ক্রিয়াকলাপ থেকেই সংগঠনের বেশি আয় হত। তাছাড়া সদস্যদের বিনিয়োগ করা মূলধন, চুক্তিভঙ্গকারী সদস্যদের দেয় জরিমানা এবং মহাজনি কারবার থেকেও সংঘের আয় হত। ক্ষেত্রবিশেষে হয়তো সরকারি সাহায্যও পাওয়া যেত।
  • সংঘের সদস্যপদ : ধর্মশাস্ত্র, বিশেষ করে নারদ ও বৃহস্পতির দু’খানি স্মৃতিগ্রন্থ পেশাদারি সংঘের গঠন, নিয়মাবলি, অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে প্রভৃত আলোকপাত করে। বৃহস্পতি বলেছেন, কোনও ব্যক্তিকে সংঘের সদস্যপদ পেতে হলে তাঁকে কয়েকটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হত।
    • প্রথমে তাঁকে চারিত্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হত।
    • দ্বিতীয়ত, সংঘের অনুশাসন তিনি মেনে চলবেন, এই মর্মে তাকে একটি অঙ্গীকারপত্র পেশ করতে হত।
    • তৃতীয়ত, সংঘের এক পুরোনো সদস্যকে নবাগতের জামিন হয়ে থাকতে হত। সংঘের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস থাকা যে একান্ত আবশ্যক সে বিষয়ে নারদ ও বৃহস্পতি একমত।
  • চুক্তিপত্র ও সংঘের নিয়মাবলি পালন : প্রতিটি সংঘে সংগঠনের নিয়মাবলি এবং সদস্যদের কর্তব্যকর্ম সম্পর্কে এক স্থিতিপত্র (স্থিতিপাত্র) বা চুক্তিপত্র ছিল। চুক্তিপত্রে বিধিবদ্ধ নিয়মাবলির আইনগত মর্যাদা ধর্মশাস্ত্রে স্বীকৃত হয়েছে। রাষ্ট্র সংঘের নিয়মকানুন মেনে চলবে এ বিষয়ে সকল ধর্মশাস্ত্রকারেরা সহমত। সকল সদস্যকেই সংঘের নিয়মাবলি মেনে চলতে হত। কোনও সদস্য বিধি-নিয়ম লঙ্ঘন করলে তাঁকে শাস্তি পেতে হত। ক্ষেত্রবিশেষে অপরাধীর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হত ও তাঁকে নির্বাসনদণ্ড দেওয়া হত। তবে কোনও সদস্য অবিচারের শিকার হলে তিনি সুবিচারের আশায় রাষ্ট্রের দ্বারস্থ হতেন। সংঘমুখ্যকে সাহায্য করার জন্য দুই, তিন বা পাঁচজন বিশেষ সদস্যকে নিয়ে একটি কার্যকরী সমিতি গঠন করা হত। কার্যকরী সমিতির সদস্যদের কার্য-চিন্তক বলা হত। সদস্যদের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে সংঘমুখ্য স্বয়ং বা কার্য-চিন্তকদের সহযোগিতায় সে বিরোধের নিষ্পত্তি করতেন। কখনও কখনও সংঘমুখ্যের সঙ্গে কার্য-চিন্তকদের বিরোধ বাধত, কখনওবা কার্য চিন্তকদের মধ্যে ঐকমত্যের অভাবে সংঘে অচলাবস্থা দেখা দিত। সংঘমুখ্যও হয়তো সংঘের স্বার্থবিরোধী কোনও কাজে জড়িত হয়ে পড়তেন। সেসব ক্ষেত্রে রাজা সংঘের কাজে হস্তক্ষেপ করতেন। সংঘ রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত হলে, সংঘ তার ক্ষমতার অপব্যবহার করলে বা একাধিক সংঘের মধ্যে বাদ-বিসংবাদ দেখা দিলে রাজা হস্তক্ষেপ করবেন, নারদ ও বৃহস্পতি এ বিধান দিয়েছেন।
  • সমবায় প্রথা : সংঘ কোনও কার্যভার গ্রহণ করলে তা যেন সমবায় প্রথায় সম্পন্ন হয় সে বিষয়ে নারদ এবং বৃহস্পতি স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন। বৃহস্পতি স্পষ্ট বলেছেন যদি কোনও সদস্য সংঘের বিনা অনুমোদনে কোনও কাজে প্রবৃত্ত হন এবং সেই কাজে যদি সংঘের এজমালি সম্পত্তির ক্ষতি হয় তাহলে বিপথগামী সদস্য ক্ষতিপূরণের যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। বৃহস্পতির এই বিধানে সংঘের সামূহিক চরিত্র প্রকাশ পেয়েছে।
  • সদস্যদের সমপরিমাণ মূলধন বিনিয়োগ : সদস্যরা সমপরিমাণ মূলধন বিনিয়োগ করবেন এই ছিল সাধারণ রীতি। কিন্তু সকলের সংগতি সমান না হওয়ায় বাস্তবক্ষেত্রে প্রায়শই এর ব্যতিক্রম ঘটত। প্রায়ই দেখা যেত কোনও সদস্য বেশি বা কম মূলধন গচ্ছিত রাখছেন। সেক্ষেত্রে নারদ ও বৃহস্পতি নির্দেশ দিয়েছেন, সংঘের লাভ বা ক্ষতির ক্ষেত্রে সদস্যের লভ্যাংশ বা দায় তাঁর মূলধনের আনুপাতিক হারে ধার্য হবে। একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে, বেশির ভাগ শাস্ত্রীয় বিধানের পিছনে যুক্তি আছে, সমদর্শিতা ও সূক্ষ্ম বাস্তববোধের পরিচয় আছে।

বণিকগ্রাম : সমকালীন দু’টি লেখে বণিক্‌গ্রাম (বণিকগ্‌গ্রাম) নামে বণিকদের এক বৃহৎ সংগঠনের উল্লেখ আছে। আক্ষরিক অর্থে বণিকগ্রাম বলতে বণিকদের গ্রামীণ বসতি বোঝায় কিন্তু লেখ দু’টিতে বণিকদের সুবৃহৎ সংগঠন অর্থেই বণিকগ্রাম কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে। লেখ দু’টির একটি তোরমাণের রাজত্বকালীন। অন্যটি গুজরাতের আঞ্চলিক প্রশাসক বিষ্ণুষেণ কর্তৃক ৫৯২ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ। প্রথম লেখে যে বণিকগ্রামের কথা বলা হয়েছে সে সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন স্থানীয় এবং কান্যকুব্জ, উজ্জয়িনী প্রভৃতি নানা স্থানের বণিকেরা। দ্বিতীয় লেখে উল্লিখিত বণিকৃথামও বণিকদের এক সম্মিলিত সংগঠন ছিল। (Epigraphia Indica, Vol XXX, পৃষ্ঠা ১৬৩-৮১। লেখটিতে স্থিতিপাত্রের সমার্থকরূপে স্থিতি ব্যবস্থা ও স্থিতিপাত্র ব্যবস্থা কথা দু’টিও ব্যবহৃত হয়েছে।) তন্তুবায়, পদকার, ছিম্পক (কাপড় রং করার শিল্পী), নীলডুক, লোহকার, বথকার, নাপিত, কুম্ভকার, সুরা-ধান্য-ইক্ষু আদার ব্যবসায়ী প্রভৃতি বিভিন্ন কারুশিল্পী ও ব্যবসায়ীরা এ সংস্থার সদস্য ছিলেন। বেশ কয়েকটি শ্রেণীও এ সংস্থার অন্তর্ভুক্ত ছিল। বিষ্ণুষেণের তাম্রশাসন হতে জানা যায়, কয়েকটি নির্দিষ্ট অধিকারের দাবি নিয়ে বণিকগ্রাম তাঁর শরণাপন্ন হয়। বিষ্ণুষেণ এক আদেশনামা জারি করে সে দাবি মঞ্জুর করেন। এ আদেশ নামাকে স্থিতিপাত্র, আচারস্থিতিপাত্র বা অনুগ্রহস্থিতিপাত্র বলা হয়। বণিক্‌গ্রামের অনুকূলে প্রদত্ত ৭২ দফা অধিকারের মধ্যে রয়েছে কোনও বণিকের অপুত্রক অবস্থায় মৃত্যু হলে উপযুক্ত উত্তরাধিকারীর তাঁর সম্পত্তিতে অধিকারের স্বীকৃতি, সরকারের ভিত্তিহীন অভিযোগ থেকে বিরত থাকা, স্বামীর দোষে স্ত্রীকে দণ্ডদানের রীতি পরিহার করা, বাদ-বিসংবাদের নিষ্পত্তি বাদী ও প্রতিবাদীর উপস্থিতিতে কার্যকর করা, রাজপুরুষদের অঞ্চল পরিক্রমাকালে তাঁদের ব্যবহারের জন্য শয্যা, আসন, সিদ্ধঅন্ন ইত্যাদির সরবরাহ হতে বিরত থাকা, বিভিন্ন সংগঠনের বণিকেরা যাতে একই বিক্রয়কেন্দ্রে ভিড় না করেন তা সুনিশ্চিত করা, বিবাহে শুল্ক ধার্য না করার নীতি গ্রহণ, রাজস্ব (রাজ-অর্ঘিকা) জমা দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কেন্দ্রের ব্যবস্থা, লোহকার, রথকার, নাপিত প্রভৃতিদের বেগার শ্রমের (বিষ্টি) আওতায় আনা কিন্তু নীলডুকদের বেগার শ্রম হতে অব্যাহতি দানের ব্যবস্থা ইত্যাদি আরও কয়েকটি সুবিধাজনক শর্ত।

মুদ্রাব্যবস্থা

ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে মুদ্রাব্যবস্থার ঘনিষ্ঠ সংযোগ রয়েছে। সাধারণত মুদ্রার বিনিময়ে জিনিসপত্রের কেনা-বেচা চলে।

  • স্বর্ণমুদ্রা : গুপ্তরাজেরা নানা প্রকার ও ধরনের প্রচুর স্বর্ণমুদ্রা উৎকীর্ণ করেছিলেন। সমুদ্রগুপ্তের আমলে ছয় প্রকার স্বর্ণমুদ্রা চালু হয়। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে এই সংখ্যা বেড়ে আটে দাঁড়ায়। প্রথম কুমারগুপ্তের সময় সর্বসমেত চোদ্দো প্রকার স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন হয়। প্রথম দিকে এই মুদ্রাগুলি কুষাণ মুদ্রার অনুকরণে কমবেশি ১২১ গ্রেন ওজনে নির্মিত হলেও স্কন্দগুপ্তের শাসনপর্ব থেকে দেশীয় রীতি অনুসারে মুদ্রাগুলির ওজন ৮০ রতি বা ১৪৪ গ্রেনে বাড়ানো হয়। কিন্তু উত্তরপর্বের মুদ্রাগুলিতে আর পূর্বের মতো ধাতব বিশুদ্ধতা বজায় থাকে না, খাদের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে শেষের দিকে সোনার পরিমাণকেও ছাপিয়ে যায়। শিল্পোৎকর্যে গুপ্তপর্বের স্বর্ণমুদ্রাগুলি সত্যই অভিনব, এরূপ নয়নাভিরাম স্বর্ণমুদ্রা প্রাচীন ভারতে সম্ভবত আর কখনও নির্মিত হয়নি।
  • রৌপ্যমুদ্রা : স্বর্ণমুদ্রার তুলনায় গুপ্তদের রৌপ্যমুদ্রার সংখ্যা কম। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত প্রথম রৌপ্যমুদ্রা প্রচলন করেন। প্রকৃতপক্ষে এই মুদ্রাগুলি পশ্চিম ভারতের শক-ক্ষত্রপ শাসকদের রৌপ্যমুদ্রার আদলে তৈরি হয়। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত মূলত গুজরাত অঞ্চলের জন্য এই মুদ্রাগুলি চালু করলেও তাঁর পুত্র প্রথম কুমারগুপ্ত গাঙ্গেয় ভূখণ্ডে এক নতুন ধরনের রৌপ্যমুদ্রা প্রবর্তন করেন। স্কন্দগুপ্ত ও বুধগুপ্তের সময়েও রৌপ্যমুদ্রার প্রচলন ছিল।
  • তাম্রমুদ্রা : গুপ্তরা তাম্রমুদ্রাও প্রচলন করেছিলেন কিন্তু তা সংখ্যায় অতি সীমিত। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত, রামগুপ্ত ও প্রথম কুমারগুপ্ত – শুধু এই তিন রাজার নামাঙ্কিত তাম্রমুদ্রার সন্ধান পাওয়া গেছে। সাধারণত, স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রার ব্যবহার হয় দূর পাল্লার বাণিজ্যে বা মূল্যবান দ্রব্যের বিনিময়ের ক্ষেত্রে। তাম্রমুদ্রার প্রয়োজন হয় নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র কেনা-বেচার কাজে। গুপ্তপর্বে তাম্র মুদ্রার সংখ্যাল্পতা নজর এড়ায় না। তবে কি বুঝতে হবে, সেযুগে দৈনন্দিন জীবনে মুদ্রার ব্যবহার হ্রাস পেয়েছিল? অনেকেই এরূপ সম্ভাবনার কথা বলেছেন। তবে এ সময় কড়ির যে ব্যাপক ব্যবহার ছিল ফা শিয়েনের বিবরণে তা স্পষ্ট। তাছাড়া প্রাচীন ভারতে সমকালীন মুদ্রার সঙ্গে পূর্ববর্তী যুগের মুদ্রার যুগপৎ প্রচলনের রেওয়াজ ছিল। বর্ধমানের নিকট মঙ্গলকোটের গুপ্তসংস্তরে বহুসংখ্যক কুষাণ তাম্রমুদ্রার উপস্থিতি অন্তত তাই প্রমাণ করে। এ যুগে রুপা ও তামার ছাপমারা মুদ্রার প্রচলন অব্যাহত ছিল। বুদ্ধঘোষ এরূপ সাক্ষ্যই দিয়েছেন।

নগরায়ণ

রামশরণ শর্মা মনে করেন, খ্রিস্টীয় ৪র্থ-৫ম শতক থেকে উত্তর ভারতে কারিগরি শিল্প ও বাণিজ্যে অবনতি দেখা দেয়ায় নগরগুলি দ্রুত অবক্ষয়ের পথে এগিয়ে চলে। খ্রিস্টীয় প্রথম তিন শতকে নগরায়ণে যে সমৃদ্ধি দেখা দিয়েছিল এই পর্বে তা ক্রমশ লুপ্ত হতে থাকে। শুয়েন চাঙের বিবরণী উদ্ধৃত করে তিনি দেখাবার চেষ্টা করেছেন, একদা যেসব নগর কর্মচঞ্চল ছিল তা এ সময় পরিত্যক্ত বিজনপুরী বা গ্রামে পরিণত হয়েছিল। নগরায়ণের এই অবক্ষয়ের তিনি সন্ধান পেয়েছেন হস্তিনাপুর, মথুরা, কৌশাম্বী, রাজগির, শ্রাবস্তী, কপিলবস্তু, রামগ্রাম, কুশীনগর, বৈশালী এবং একদা বিখ্যাত আরও কয়েকটি শহরের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে। অধ্যাপক শৰ্মা মনে করেন, এ সময় নগরে পুরোনো ইটই বেশি ব্যবহৃত হত, আর নগর পরিকল্পনায় না ছিল শ্রী, না ছিল ছন্দ। অধ্যাপক শর্মা এই পর্বে নগরের অস্তিত্ব একেবারে অস্বীকার করেননি, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সামরিক ও ধর্মীয় কেন্দ্ররূপে কয়েকটি শহরের অস্তিত্ব তিনি অবশ্যই স্বীকার করেন কিন্তু তাঁর বিশ্বাস, শিল্প ও বাণিজ্যের কেন্দ্ররূপে এই শহরগুলির বিশেষ কোনও ভূমিকা ছিল না। শিল্প-বাণিজ্য হল শহরের জীবনীশক্তির উৎস। সেই উৎস শুকিয়ে যাওয়ায় নগরগুলি রক্তশূন্যতায় আক্রান্ত হয়–অধ্যাপক শর্মা এরূপ অভিমত প্রকাশ করেছেন।

গুপ্তপর্বে অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের যে ছবি অধ্যাপক শৰ্মা এঁকেছেন, অনেকের কাছেই তা গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়নি। আবার এই পর্বে যে কয়েকটি শহর হতদরিদ্র হয়ে পড়েছিল তাও অস্বীকার করা কঠিন। তবে এই পর্বে কয়েকটি পুরোনো শহরের পাশাপাশি যে অনেকগুলি নতুন শহর গড়ে উঠেছিল, সমকালীন সূত্রে তা প্রমাণিত। নতুন গড়ে ওঠা শহরগুলির মধ্যে রয়েছে থানেশ্বর, কনৌজ, নালন্দা, বিক্রমশীল, চিরান্দ, বলিরাজগড় (মধুবনি), বাণগড় (দিনাজপুর), রাজবাড়িডাঙা (মুর্শিদাবাদ) এবং ওড়িশা উপকূলের চরিত্র বন্দর। যেসব পুরোনো শহরের খ্যাতি গুপ্তপর্বেও অম্লান ছিল, তাদের মধ্যে পুরাণকিলা, অহিচ্ছত্র, অত্ৰঞ্জিখেড়া, উজ্জয়িনী, বারাণসী, পাটলিপুত্র, বৈশালী, বিদিশা এবং তাম্রলিপ্তি বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। (শুয়েন চাঙ বৈশালীকে পরিত্যক্ত অবস্থায় দেখেছিলেন। কিন্তু গুপ্তপর্বে এই শহরটি সমৃদ্ধ ছিল। তখন বৈশালী অধিষ্ঠানের মর্যাদালাভ করেছিল। গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর পর্বে অধিষ্ঠান বলতে শহর বোঝাত। বেশ কয়েকটি বণিকসংগঠনের কর্মক্ষেত্র ছিল এই বৈশালী।) কসমস পশ্চিম ভারতীয় উপকূলে গুজরাত নামে যে বন্দরটির কথা বলেছেন সেটি প্রাচীন ভৃগুকচ্ছ হওয়া বিচিত্র নয়। প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননে উত্তর ও পূর্ব ভারতের নানা স্থান থেকে প্রাক্‌ খ্রিস্টীয় যুগ থেকে। খ্রিস্টীয় ১০ম-১১শ শতক পর্যন্ত একটানা বসতির চিহ্ন আবিষ্কৃত হয়েছে। শুয়েন চাঙ মগধের অনেক উপনগরে ঘনবসতি লক্ষ করেছেন। আর একটি কথা। শহরে, তা সে শহর তীর্থস্থান হোক বা প্রশাসনিক সামরিক কেন্দ্র হোক, খাদ্যশস্যের জোগান এবং ভোগ্যপণ্য ও বিলাসসামগ্রীর সরবরাহ ও বণ্টন নিয়মিত ও পর্যাপ্ত হওয়া প্রয়োজন। সে কারণে শহরে শিল্প বাণিজ্যের এক বড় ভূমিকা থাকবেই। শিল্প-বাণিজ্যের এই ভূমিকা না থাকলে শহর বাঁচবে না।

সামন্ততন্ত্র

এতক্ষণে গুপ্তরাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া গেল। এবার একটি বিতর্কিত বিষয়ের অবতারণা করা যেতে পারে। বিতর্কটি গুপ্তযুগে সামন্ত ব্যবস্থার অস্তিত্ব সম্পর্কে। কিন্তু এই বিতর্কে অংশগ্রহণ করতে হলে সামন্ততন্ত্র সম্পর্কে কিছু ধারণা থাকা আবশ্যক। সামন্ততন্ত্র বলতে এমন এক ব্যবস্থা বোঝায় যার শুধু আর্থ-সামাজিক গুরুত্ব নয়, রাজনৈতিক প্রশাসনিক তাৎপর্যও অনেক। তাই সামন্ত-ব্যবস্থা এক আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-প্রশাসনিক ব্যবস্থারই নামান্তর। বিষয়টির একটু ব্যাখ্যা প্রয়োজন। এই ব্যবস্থায় রাজা তত্ত্বগতভাবে রাজ্যের অধীশ্বর হলেও কার্যক্ষেত্রে তিনি সীমিত ক্ষমতার অধিকারী। তিনি নিজের জন্য সামান্য অংশ রেখে রাজ্যের বাকি অংশ মুখ্য সামন্তদের মধ্যে বণ্টন করে দেন। মুখ্য সামন্তরা স্ব স্ব এলাকায় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা ভোগ করেন। রাজস্ব আদায়েও তাদের ক্ষমতা অপ্রতিহত। তাঁরা এই ক্ষমতা ভোগ করেন কয়েকটি শর্তে। এক শর্তে তাঁরা রাজাকে যুদ্ধের সময় সৈন্য ও রসদ দিয়ে সাহায্য করেন। আর এক শর্তে তাঁরা প্রতি বছর রাজাকে নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব দেন। তাছাড়া প্রয়োজনে তাঁরা রাজাকে মন্ত্রণা ও পরামর্শ দিয়েও সাহায্য করেন। মুখ্য সামন্ত তাঁর শর্ত পালন করলে রাজা তাঁর কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। এই একই শর্তে মুখ্য সামন্ত আবার তাঁর এলাকা অধস্তন সামণ্ডদের মধ্যে বিতরণ করেন। অধস্তন সামন্তরা মুখ্য সামস্তের অনুগত থাকেন, রাজার প্রতি তাদের আনুগত্য নেই। অধস্তন সামস্ত অনুরূপভাবে তাঁর জমি আরও ক্ষুদ্র সামন্তদের মধ্যে বিলি-ব্যবস্থা করেন। ক্ষুদ্র সামন্ত অধস্তন সামস্তের অনুগত হন, রাজা বা মুখ্য সামন্তের সঙ্গে তাঁর সংযোগ থাকে না। এভাবে একই শর্তে বিভিন্ন স্তরের ভূস্বামীদের মধ্যে রাজ্যের জমি বণ্টিত হয়। এক একজন ভূস্বামীর আনুগত্য থাকে ঠিক তাঁর উপরের স্তরের ভূস্বামীর প্রতি, আরও বড় যে ভূস্বামী তাঁর প্রতি নয়। ভূস্বামীদের সর্বনিম্ন স্তরের নিচে ভূমিদাস বা ‘সার্ফ’দের অবস্থান। ভূমিদাসরা ভূস্বামীদের জমিতে আবদ্ধ থাকেন, তাঁরা জমির মালিক নন। জমির মালিকানা বদল হলে জমির সঙ্গে তাঁরাও হস্তান্তরিত হন। এই ব্যবস্থায় ভূস্বামীদের মধ্যে পীড়নমূলক কর চাপানোর প্রবণতা বাড়ে। পণ্যসামগ্রী প্রধানত তাৎক্ষণিক ভোগের উদ্দেশ্যেই উৎপন্ন হতে থাকে, যে অতিরিক্ত উৎপাদন বা উদ্বৃত্ত বাণিজ্যের পথ সুগম করে তা ব্যাহত হয়। এর ফলে ব্যবসা বাণিজ্যের সংকোচন হয়। এক একটি অঞ্চল স্বনির্ভর হয়। অঞ্চলে অঞ্চলে পণ্য বিনিময়ের সুযোগ হ্রাস পাওয়ায় এক আবদ্ধ অর্থনীতি আত্মপ্রকাশ করে। মুদ্রার ব্যবহার কমে আসে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনে আঞ্চলিকতা তথা বিকেন্দ্রীকরণ কায়েম হয়। সমাজ-জীবনে স্থাণুত্বের লক্ষণ প্রকাশ পায়, পরিবর্তন বা অভিনবত্বের পথ রুদ্ধ হয়। আঞ্চলিকতার প্রবণতা, ভূমিব্যবস্থায় অন্তর্বর্তীর উদ্ভব, স্বনির্ভর অর্থনীতির প্রতিষ্ঠা, মুদ্রার অত্যল্প ব্যবহার, বাণিজ্যিক অবনতি, নগরের অবক্ষয়, রাজনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যগুলিকে সামন্ত ব্যবস্থার সুস্পষ্ট লক্ষণরূপে চিহ্নিত করা যায়।

সামন্ত-ব্যবস্থার বেশ কয়েকটি লক্ষণ গুপ্তপর্বে দেখা দিয়েছিল বলে অধ্যাপক শৰ্মা অভিমত প্রকাশ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি এবং তাঁর অনুগামীরা নিম্নরূপ কয়েকটি লক্ষণ শনাক্ত করেছেন –

  • প্রথমত, এ সময় থেকে ব্রাহ্মণ এবং ব্রাহ্মণ্য, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্যে ব্যাপক ভাবে জমি দান করা হতে থাকে। প্রদত্ত ভূখণ্ড বা গ্রামের উপর দানগ্রহীতাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তাঁরা কার্যত ভূস্বামীতে পরিণত হন। গ্রাম থেকে তাঁরা শুধু রাজস্বই আদায় করতেন না, প্রশাসনিক এবং বিচার-সংক্রান্ত কাজকর্মও পরিচালনা করতেন। এর ফলে রাজার ক্ষমতা সংকুচিত হয় এবং এক ক্ষমতাশালী বিত্তবান ভূস্বামী সম্প্রদায়ের অভ্যুদয় হয়।
  • দ্বিতীয়ত, ভূস্বামীরা জমিতে নিজের হাতে চাষ-আবাদ করতেন না, তাঁরা এ কাজে শ্রমিক চাষিদের নিয়োগ করতেন। জমির উপর এই চাষিদের কোনও মালিকানা ছিল না, ভূস্বামীরা তাঁদের কাছ থেকে বিষ্টি ও নানা রকম পীড়নমূলক কর আদায় করতেন। যেসব চাষিদের জমিতে ভোগাধিকার ছিল তাঁদেরও ভূস্বামীরা খেয়ালখুশি মতো উৎখাত করে অন্য চাষিদের নিয়োগ করতেন। কৃষকদের সঙ্গে রাজা তথা রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিন্ন হয়। ভূস্বামীরা মধ্যস্বত্ব ভোগীর ভূমিকায় দেখা দেন। কৃষকদের অবস্থা হল ভূমিদাসদের মতো।
  • তৃতীয়ত, প্রদত্ত গ্রামে বা ভূখণ্ডে যে উৎপাদন হত তা ভূস্বামী বা গ্রামবাসীদের তাৎক্ষণিক প্রয়োজনই মেটাত। কারিগর-শিল্পীরাও গ্রামের চাহিদাই পূরণ করতেন। এই চাহিদা পূরণ করে অন্য গ্রাম বা অঞ্চলের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য চালাবার মতো উদ্বৃত্ত কিছু জমত না। অর্থনীতির ক্ষেত্রে এক একটি গ্রাম স্বনির্ভর হয়ে ওঠে।
  • চতুর্থত, লেনদেন করার মতো কৃষিজ ও শিল্পোৎপাদন না হওয়ায় বাণিজ্যে সংকোচন দেখা দেয়। পূর্ববর্তী যুগে ভারতবর্ষের সঙ্গে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের যে ব্যবসা-বাণিজ্য চলত এ পর্বে তাতে ছেদ ঘটে।
  • পঞ্চমত, শিল্প-বাণিজ্য হল নগরের প্রাণ। প্রধানত শিল্প-বাণিজ্যের কেন্দ্ররূপেই নগরের প্রতিষ্ঠা। কিন্তু এ পর্বে শিল্পবাণিজ্যে সংকোচন হওয়ায় নগর তার জীবনীশক্তি হারিয়ে ফেলে। রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সামরিক বা ধর্মীয় গুরুত্বের কারণে কিছু শহর তখনও ছিল কিন্তু পণ্যসামগ্রীর লেনদেনের কেন্দ্ররূপে নগরের আর সে ভূমিকা ছিল না। নগরায়ণে অবক্ষয় নেমে আসে।
  • ষষ্ঠত, ব্যবসা-বাণিজ্যের অবনতির সঙ্গে সঙ্গে মুদ্রার ব্যবহার হ্রাস পায়। খ্রিস্টীয় প্রথম তিন শতকে মুদ্রা ব্যবহারের যে ব্যাপকতা ছিল এই পর্বে তা আর দেখা যায় না।

গুপ্তযুগে সামন্ত-ব্যবস্থার সপক্ষে যেসব যুক্তিতর্কের অবতারণা করা হয়েছে তাদের যুক্তি গ্রাহ্যতা সম্পর্কে নানা প্রশ্ন উঠেছে। গুপ্তপর্বে সামন্ত-ব্যবস্থার পত্তন হয়েছিল এ মত অনেকেই স্বীকার করেন না। তাঁদের বক্তব্য নিম্নরূপ :

  • ইউরোপে রাজা যেসব শর্তে সামন্তদের মধ্যে জমি বিলিব্যবস্থা করতেন গুপ্ত বা গুপ্তোত্তর ভারতে দানগ্রহীতাদের উপর সেসব শর্ত আরোপিত হত না। ইউরোপে সামন্ত রাজাকে নিয়মিত উপঢৌকন, রাজস্ব ও সামরিক সাহায্য প্রদান করতেন। কিন্তু দানগ্রহীতাদের এ ধরনের শর্ত-পালনের কোনও উল্লেখ গুপ্তলেখমালায় নেই। দানগ্রহীতাদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণদের পক্ষে রাজাকে যুদ্ধের সময় সৈন্য দিয়ে সাহায্য করা সম্ভব ছিল না। তাছাড়া ইউরোপীয় সামন্তদের তুলনায় ব্রাহ্মণ ভূস্বামীদের জমিজমা নিতান্তই নগণ্য ছিল। সামন্ত-ব্যবস্থার এক অত্যাবশ্যক উপাদান হল চুক্তি। রাজা ও মুখ্য সামন্ত, মুখ্য সামন্ত ও অধস্তন সামস্ত এবং ক্ষুদ্র সামন্ত ও কৃষকদের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে এই চুক্তি সম্পাদিত হত। প্রভুত্ব-আনুগত্যমূলক এই চুক্তির ফলেই জমির উপর ভূস্বামীর প্রবল কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হত এবং কৃষক উৎপীড়নের শিকার হয়ে শেষ পর্যন্ত দাসত্ব বরণ করতেন। কিন্তু সমকালীন লেখমালায় দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে এ ধরনের চুক্তি সম্পাদনের কোনও উল্লেখ নেই।
  • ইউরোপে রাজা সামন্তদের মধ্যে জমি বণ্টন করে দিতেন কিন্তু অগ্রহার ব্যবস্থায় গ্রামদান বলতে গ্রামের রাজস্বভোগের অধিকার বোঝাত। গ্রাম থেকে যে রাজস্ব এতদিন রাজার প্রাপ্য ছিল গ্রামদানের ফলে সে রাজস্বে দানগ্রহীতার ভোগাধিকার প্রতিষ্ঠিত হত। গ্রামবাসীর ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমির উপর তাঁর স্বত্ব জন্মাত না। গ্রহীতা কেবল গ্রামবাসীদের রাজাকে দেয় রাজস্ব ভোগ করতেন। আর গ্রহীতা রাজস্বভোগের অধিকারী হলেও তিনি গ্রামবাসীদের কাছ থেকে সরাসরি রাজস্ব আদায় করতেন, না সরকারের মাধ্যমে রাজস্ব সংগ্রহ করতেন, তা নিয়ে সংশয় আছে। গ্রামের রাজস্ব গ্রহীতা ভোগ করলেও তা আদায়ের ভার ছিল সরকারের উপর, বহু দিন আগেই দীনেশচন্দ্র সরকার এ অভিমত প্রকাশ করে গেছেন।
  • সামন্ত-ব্যবস্থায় সামন্তরা রাজার কাছ থেকে যে জমি অধিগ্রহণ করেন তা তাঁরা অধস্তন সামন্তদের মধ্যে বণ্টন করে দেন। স্বেচ্ছায় ও স্বাধিকারেই তাঁরা এ কাজ করেন। অধস্তন সামন্তরা আবার নিম্নতর সামন্তদের মধ্যে তাদের জমি বিলিব্যবস্থা করেন। অর্থাৎ, সামন্ত-ব্যবস্থায় সামন্তরা যে জমি লাভ করেন সে জমি তাঁরা আপন ইচ্ছামতো যে কোনও ব্যক্তির অনুকূলে বণ্টন বা হস্তান্তর করতে পারেন। এ কাজে তাঁদের রাজা বা ঊর্ধ্বতন সামন্তদের মতামতের উপর নির্ভর করতে হয় না। কিন্তু গুপ্তযুগে প্রদত্ত জমির উপর গ্রহীতার এত অবাধ অধিকার ছিল না। গ্রহীতা নীবীধর্মের শর্তে জমি ভোগ করতেন। তাঁর জমির উপর ভোগাধিকার ছিল কিন্তু সে জমি দান, বিক্রয় বা হস্তান্তরের অধিকার তাঁর ছিল না। ইউরোপীয় সামন্তদের তুলনায় গুপ্তভারতে গ্রহীতাদের অধিকার যে অনেকখানি সংকুচিত ছিল তা অস্বীকার করা যায় না।
  • সামন্ত-ব্যবস্থায় জমিবণ্টনের ফলে রাজার অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক অধিকার সংকুচিত হয়, সার্বভৌমত্ব খণ্ডিত হয়। কিন্তু অগ্রহার ব্যবস্থায় তেমনটি হওয়ার সম্ভাবনা কম। ভূমিদানের ফলে রাজার প্রাপ্য রাজস্ব রহিত হত, এ কথা ঠিক কিন্তু মনে রাখতে হবে যে জমি সাধারণত দান করা হত তা ছিল অনাবাদি, পতিত জমি। সে জমি থেকে কোনও রাজস্ব পাওয়া যেত না। তাছাড়া যে জমি দান করা হত সে জমির মূল্যবাবদ রাজকোষে থোক টাকা জমা পড়ত। এতে রাজাই লাভবান হতেন। আরও একটি জিনিস মনে রাখা দরকার। যে জমি দান করা হত তা রাজ্যের বিশালত্বের তুলনায় পরিমাণে অনেক কম ছিল। গুপ্ত রাজারা তাঁদের সমগ্র রাজ্যটি কয়েকটি অগ্রহারে বিভক্ত করেছিলেন, এমন ধারণা করার কোনও কারণ নেই। গ্রহীতা রাজস্ব ভোগের অধিকারী ছিলেন কিন্তু এই রাজস্ব আদায়ের প্রশাসনিক কর্তৃত্বও তাঁর হাতে ছিল এমন মনে করারও কোনও যুক্তিসংগত কারণ নেই। প্রদত্ত ভূখণ্ডে গ্রহীতা শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণ করতেন, রাজার শাসন সেখানে কায়েম ছিল না, এ ধারণারও কোনও ভিত্তি নেই।
  • ইউরোপীয় সামন্ত-ব্যবস্থার সর্বনিম্ন স্তরে ছিল ভূমিদাসদের অবস্থান। ভূমিদাসরা তাঁদের জমিতে আবদ্ধ ছিলেন। জমির উপর তাঁদের কোনও স্বত্ব ছিল না। জমির মালিকানার পরিবর্তন ঘটলে জমির সঙ্গে তারাও হস্তান্তরিত হতেন। ভারতবর্ষে কিন্তু এমনটি ঘটেনি। এ দেশের গ্রামে যেসব পেশাদার পুরোহিত, ক্ষৌরকার, সূত্রধর ও রজকদের বাস ছিল তাঁরা সকলেই ভূসম্পদ লাভ করতেন এবং প্রতিদানে বিনা পারিশ্রমিকে গ্রামবাসীদের সেবা করতেন। তাঁরা স্বেচ্ছায় যে কোনও সময় গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে পারতেন। তাঁরা ভূমিদাস ছিলেন না। যেসব কৃষক সরকারি জমিতে কাজ করতেন তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো অবস্থার বিপাকে ভূমিদাসে পরিণত হতেন, কিন্তু সংখ্যায় তাঁরা নগণ্য ছিলেন। বেশির ভাগ কৃষকই কিছু জমি ও উৎপন্ন ফসলের একাংশের বিনিময়ে সরকারি জমিতে চাষ আবাদের কাজ করতেন। সরকারি সুযোগ সুবিধা প্রত্যাখ্যান করে তাঁরা যে কোনও সময় অন্য স্থানে নতুন কর্মভার গ্রহণ করতে পারতেন। ইউরোপের ভূমিদাস আজীবন ভূমিদাসই ছিলেন কিন্তু ভারতবর্ষে যে সামান্যসংখ্যক দাস ছিলেন তাঁদের মুক্তির পথ সব সময়ই উন্মুক্ত ছিল।

গুপ্তপর্বে অর্থনৈতিক অবক্ষয় হয়নি, পতনের কারণও অবক্ষয় নয়

গুপ্তপর্বে যে অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের কথা বলা হয় সমকালীন সূত্রে তার সমর্থন পাওয়া যায় না। অর্থনীতির দু’টি প্রধান ক্ষেত্র – একটি কৃষির ক্ষেত্র, অন্যটি শিল্প ও বাণিজ্যের ক্ষেত্র। এ পর্বে কৃষির যে বিকাশ ঘটেছিল তা স্বীকার না করে উপায় নেই। অগ্রহার ব্যবস্থার মাধ্যমে যে জমি দান করা হত তার বেশির ভাগই ছিল অনাবাদি ও অরণ্যসংকুল। সেসব অঞ্চলে না ছিল জনবসতি, না ছিল কৃষিকার্য। সে জমি দান করার ফলে শুধু দানগ্রহীতাই সেখানে বসতি স্থাপন করলেন না, চাষ-আবাদ ও অন্যান্য কাজের জন্য কৃষক ও বিভিন্ন বৃত্তির লোকদেরও সেখানে বসতি গড়ে ওঠে। এর ফলে কেবল জনবসতিরই প্রসার ঘটল না, অনাবাদি জঙ্গুলে জমিতে শস্যাদি উৎপন্ন হতে থাকল। এতে স্বাভাবিকভাবে ফসলের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। কৃষির মতো শিল্পেও এই পর্বে বৈচিত্র্য দেখা দেয়। এই বৈচিত্র্য বেশি করে চোখে পড়ে ধাতব শিল্পে। লোহা ও তামার জিনিস পত্র এ সময় বেশি পরিমাণে নির্মিত হতে থাকে। প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বের তৈরি দিল্লির মেহরৌলী লৌহস্তও তখনকার দিনের ধাতুশিল্পের উৎকর্যের স্বাক্ষর বহন করছে। কুম্ভকার, সূত্রধর, রথকার, কাংসকার, রেশমশিল্পী, তন্তুবায়, অস্ত্রনির্মাতা, চর্মকার, কর্মকার, শুঁড়ি ইত্যাদি শিল্পী-কারিগর ও তাঁদের শ্রেণী বা পেশাদারি সংগঠনের উল্লেখ সেকালের সাহিত্য ও লেখমালায় বিস্তর পাওয়া যাবে।

আন্তর ও বহির্বাণিজ্যে এ সময় মন্দা দেখা দিয়েছিল, এমন ভাবারও কোনও কারণ নেই। কালিদাসের কাব্যে ও অমরকোষে ব্যবসা-বাণিজ্যের কথা আছে। লেখমালায় সার্থবাহ, শ্রেষ্ঠী ও বণিক সম্প্রদায়ের উল্লেখ আছে। শক মুদ্রার এক ভাণ্ডার অন্ধ্রপ্রদেশে আবিষ্কৃত হয়েছে। মহারাষ্ট্রের সাতারায় গুপ্তমুদ্রার এক ভাণ্ডারের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই মুদ্রাগুলি অন্ধ্রপ্রদেশে বা মহারাষ্ট্রে উৎকীর্ণ হয়নি, উৎকীর্ণ হয়েছিল গুজরাত এবং গাঙ্গেয় ভূভাগে। বাণিজ্য উপলক্ষেই মুদ্রাগুলির স্থানান্তর ঘটেছিল। রোমের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যের গতি এ সময় স্তিমিত হলেও বাইজানটাইন সাম্রাজ্য তথা পূর্ব ইউরোপের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক ক্রিয়াকলাপ বৃদ্ধি পায়। চিনের সঙ্গে ভারতের স্থল ও জল উভয় পথেই ব্যবসা-বাণিজ্য চলত। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশগুলির সঙ্গেও ভারতের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। চিন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্কের ফলে পূর্ব উপকূলের বন্দরগুলির গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। বাংলার তাম্রলিপ্তি, ওড়িশা উপকূলের চে-লি-ত-লো (পুরী?) এবং অন্ধ্রপ্রদেশের দন্তপুর আন্তর্জাতিক বন্দররূপে খ্যাতিলাভ করে।

গুপ্তযুগে মুদ্রার ব্যবহার হ্রাস পেয়েছিল বলে যে মন্তব্য করা হয় তা সমর্থনযোগ্য নয়। গুপ্তরাজেরা প্রচুর পরিমাণে সুবর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা উৎকীর্ণ করেছেন। ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে সেসব মুদ্রার নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। সাহিত্য ও লেখমালায় দীনার, পুরাণ, রূপক, নিষ্ক, সুবর্ণ ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকার মুদ্রার উল্লেখ আছে। গুপ্তযুগে সোনা ও রুপার মুদ্রার সংখ্যাই বেশি। দূরপাল্লার বাণিজ্যে বা মূল্যবান জিনিসপত্রের কেনাবেচার ক্ষেত্রে সোনা ও রুপার মুদ্রার প্রয়োজন হয় কিন্তু গ্রামগঞ্জের হাটে-বাজারে দৈনন্দিন কেনাবেচায় তামার মুদ্রাই ব্যবহার হয়। গুপ্ত আমলেও তামার মুদ্রা উৎকীর্ণ হয়েছিল তবে তা পরিমাণে অল্প ছিল। তার অর্থ এই নয় যে তখন দৈনন্দিন ক্রয়-বিক্রয়ের কাজ হ্রাস পেয়েছিল। এসব কাজে তখন কড়ি ব্যবহার হত। অন্তত চিনা পরিব্রাজক ফা শিয়েনের সাক্ষ্য থেকে তাই মনে হয়। অর্থাৎ তাম্রমুদ্রার ঘাটতি কড়ি দিয়ে পূরণ করা হত। তাছাড়া খ্রিস্টীয় ৫ম শতকে কার্ষাপণ নামে এক শ্রেণির তাম্র ও রৌপ্য মুদ্রা প্রচলনের উল্লেখ করেছেন খ্যাতনামা বৌদ্ধ দার্শনিক বুদ্ধঘোষ। প্রাচীন ভারতীয় মুদ্রাব্যবস্থার এক বৈশিষ্ট্য এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যায়। রাজনৈতিক পালাবদল সত্ত্বেও প্রাচীন ভারতে পুরোনো মুদ্রার প্রচলন অব্যাহত থাকত। অর্থাৎ গুপ্তপর্বে শুধু গুপ্তরাজগণের মুদ্রাই প্রচলিত ছিল না, পূর্ববর্তী মুদ্রারও প্রচলন ছিল। বর্ধমানের নিকট মঙ্গলকোটে উৎখননের ফলে গুপ্তসংস্তর থেকে কুষাণযুগের প্রচুর তাজমুদ্রা পাওয়া গেছে। গুপ্তযুগে কুষাণমুদ্রার অব্যাহত প্রচলনের সপক্ষে এটি একটি সুনিশ্চিত প্রমাণ।

দেখা যাচ্ছে, গুপ্তযুগে সামন্ত-ব্যবস্থার সপক্ষে যেসব যুক্তি-তর্ক দেওয়া হয় তা যথেষ্ট দুর্বল। অগ্রহার ব্যবস্থা গুপ্তভারতে সামন্ততন্ত্রের বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠা করেছিল, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। সামগ্রিকভাবে গুপ্তপর্বে অর্থনৈতিক অবক্ষয় দেখা দিয়েছিল, এমন ধারণারও কোনও যুক্তি নেই। আন্তর ও বহির্বাণিজ্যে এ সময় সন্তোষজনক অগ্রগতি ঘটেছিল। দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিস পত্রের কেনা-বেচার কাজে তামার মুদ্রা, কড়ি ও পুরোনো কার্ষাপণ মুদ্রার প্রচলন ছিল। কয়েকটি পুরোনো শহরের পতন আসন্ন হয়েছিল ঠিকই কিন্তু বেশ কিছু নতুন শহরও গড়ে উঠেছিল। গুপ্তযুগের অস্তিমপর্বে যে অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের চিহ্ন ফুটে উঠেছিল তার মূলে ছিল প্রশাসনিক দুর্বলতা, ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের অবনয়ন। সামন্ত-ব্যবস্থা বা অনুরূপ কোনও পরিস্থিতির সঙ্গে এই আর্থিক অবনতির কোনও যোগসূত্র ছিল না।

গ্রন্থপঞ্জি

  • নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য : ভারতীয় জাতি-বর্ণ প্রথা (কলকাতা, ১৯৮৭)।
  • ভাস্কর চট্টোপাধ্যায় : ভারতের আর্থ-সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা (কলকাতা, ১৯৯৪)।
  • রণবীর চক্রবর্তী : প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসের সন্ধানে (কলকাতা, ১৩৯৮)।
  • Altekar, AS The Coinage Of The Gupta Empire (Varanasi, 1957); The Vikataka Gupta Age (Lahore, 1946).
  • Bhandarkar, DR Corpus Inscriptionum Indicarum, Vol. III (New Delhi, 1981).
  • Ghosal, U. N. The Agrarian System In Ancient India (Calcutta, 1973).
  • Jha. D N. Revenue System In the Post Maurya And Gupta Times (Calcutta, 1967).
  • Maity. SK Economic Life In Northern India In The Gupta Period (Delhi, 1970).
  • Majumdar, R C (Ed.). The Classical Age (Bombay, 1962) Saletore, R. N. Life In The Gupta Age (Bombay, 1943 ).
  • Sharma, R. S. Sudras In Ancient India (Delhi, 1958), Indian Feudalism (Delhi, 1980).
  • Thapar, Romila Ancient Indian Social History (Delhi, 1978)
  • Upadhyaya, B Gupta samrajya kā itihasa I-II (Allahabad, 1939).

গুপ্তযুগে ধর্ম ও সাহিত্য

গুপ্তযুগে ধর্ম

ধর্মীয় জীবনের সাধারণ বৈশিষ্ট্য : ভারতীয় ধর্মের ইতিহাসে গুপ্তযুগ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এ সময় বৈষ্ণব ও শৈবধর্মের প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়, বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের গুরুত্ব হ্রাস পায়। যে বিষ্ণু ও শিব যথাক্রমে বৈষ্ণব ও শৈবধর্মের প্রাণপুরুষ, এ পর্বে তাঁদের বৈদিক ভাবমূর্তির অপসারণ ঘটে। পৌরাণিক ও লৌকিক ধ্যান-ধারণায় সমৃদ্ধ হয়ে তাঁরা দুই প্রবল, প্রতাপান্বিত দেবতারূপে আত্মপ্রকাশ করেন। ঈশ্বর সম্পর্কিত বিমূর্ত ধারণা লোকদের তেমন আকর্ষণ করে না, মন্দির স্থাপন, দেবতার বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা ও পূজা-অর্চনা লোকদের আকৃষ্ট করে। বৈষ্ণর ও শৈবধর্মে তন্ত্রের প্রভাব এসে পড়ে। মহাযান বৌদ্ধধর্মের রূপান্তর ঘটে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে। সহনশীলতা এ পর্বের ধর্মীয় জীবনকে বিশিষ্টতা দান করেছে। সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ হয়তো কিছুটা ছিল কিন্তু তা কখনই প্রশ্রয় পায়নি। দেবতারা অভিন্ন, বিভিন্ন দেবতা এক পরম দেবতার ভিন্ন ভিন্ন রূপ, এরূপ একটি ধারণাও এ সময় মূর্ত হয়ে ওঠে। দেবতাদের অভেদত্বের ধারণা বিভিন্ন মতের ও পথের যাত্রীদের পরস্পরের প্রতি সহনশীল হতে অনুপ্রেরণা জোগায়।

বৈষ্ণবধর্ম

বাসুদেব ও বিষ্ণুর অভেদত্ব : গুপ্তযুগ থেকেই ভাগবতধর্ম বৈষ্ণবধর্ম নামেই বেশি পরিচিতি লাভ করে। বাসুদেব ও বিষ্ণুর অভেদত্বের সর্বজনীন স্বীকৃতি এর মুখ্য কারণ। বাসুদেব ও বিষ্ণু এক ও অভিন্ন দেবতা, এ ধারণার উন্মেষ উত্তর-শুঙ্গপর্বে ঘটেছিল ঠিকই কিন্তু তা তখনও আপামর জনসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি। গুপ্তযুগে বাসুদেব ও বিষ্ণুর সমীকরণ সর্বজনীন স্বীকৃতি লাভ করল। যে মন্ত্রে এতদিন শুধু বাসুদেবেরই পূজা হত সেই ‘ওঁং নমো ভগবতে বাসুদেবায় মন্ত্র এখন থেকে ভগবান বিষ্ণুর উপরও আরোপিত হতে থাকে।

বৈষ্ণবধর্মের অগ্রগতির কারণ : বাসুদেব ও বিষ্ণুর সমীকরণ সর্বজনীন স্বীকৃতি লাভ করায় এই পর্বে বৈষ্ণবধর্মের অগ্রগতি ত্বরান্বিত হয়েছিল। রাজন্যবর্গের পৃষ্ঠপোষকতা গুপ্তযুগে বৈষ্ণব ধর্মের প্রসারের আর একটি প্রধান কারণ। গুপ্তরাজগণের অনেকেই বৈষ্ণবধর্মাবলম্বী ছিলেন। দ্বিতীয় চন্দ্ৰগুপ্ত, প্রথম কুমারগুপ্ত প্রভৃতি গুপ্তরাজেরা পরমভাগবত অভিধা ধারণ করেছিলেন। তাঁদের মুদ্রায় গরুড়ধ্বজের ছবি অঙ্কিত আছে। তাঁরা যে বৈষ্ণবধর্মের অনুরাগী ছিলেন তা এতে প্রমাণিত। সমুদ্রগুপ্ত পরমভাগবত উপাধি গ্রহণ করেননি কিন্তু তাঁর মুদ্রায় গরুড়ধ্বজের ছবি অঙ্কিত আছে। তাঁকে এলাহাবাদ স্তম্ভলেখে অচিন্ত্যপুরুষ বলে আখ্যাত করা হয়েছে। অচিন্ত্য পুরুষ বলতে সাধারণত বিষ্ণুকেই বোঝায়। এলাহাবাদ স্তম্ভলেখে সমুদ্রগুপ্তকে সম্ভবত বিষ্ণুর অবতাররূপে উপস্থাপিত করা হয়েছে। গুজরাতের মৈত্রক রাজারাও বৈষ্ণবধর্মাবলম্বী ছিলেন। বাঁকুড়া অঞ্চলের রাজা চন্দ্রবর্মাও বিষ্ণুভক্ত ছিলেন।

বৈষ্ণবধর্মের বিস্তার : গুপ্তযুগে বৈষ্ণবধর্ম আঞ্চলিকতার গণ্ডি অতিক্রম করে এক অখিল ভারতীয় ধর্মরূপে আত্মপ্রকাশ করে।

  • মধ্যপ্রদেশে বৈষ্ণবধর্মের ব্যাপক প্রসার হয়। ৪০৪ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ নরবর্মার মন্দসোর লেখে বিষ্ণুর উল্লেখ আছে।
  • মন্দসোরে প্রথম কুমারগুপ্ত ও বন্ধুবর্মার যে একটি যৌথ লেখ আবিষ্কৃত হয়েছে তাতেও বিষ্ণুর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়েছে।
  • মধ্য প্রদেশের বুন্দেলখণ্ড-বাঘেলখণ্ড অঞ্চলে পাওয়া পরিব্রাজক মহারাজ সংখোব-এর একটি তাম্র শাসনে বাসুদেবের উল্লেখ আছে।
  • এলাহাবাদের নিকটবর্তী ভিটায় বাসুদেবের মন্ত্র-সম্বলিত এক পোড়ামাটির সিলমোহরের সাক্ষ্য থেকে অনুমিত হয়, এখানে বাসুদেব-বিষ্ণুর এক মন্দির নির্মিত হয়েছিল।
  • মেহরৌলী লেখে উল্লেখ আছে, রাজা চন্দ্র বিষ্ণুপদগিরিতে এক ধ্বজ নির্মাণ করে বিষ্ণুর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন। এই লেখে দিল্লি অঞ্চলে বৈষ্ণবধর্মের প্রসারের ইঙ্গিত আছে।
  • খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতকে অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টুরে নারায়ণের একটি মন্দির নির্মিত হয়েছিল।
  • গুপ্ত রাজগণের আগ্রহে মহারাষ্ট্রে বৈষ্ণবধর্ম বিস্তার লাভ করে। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কন্যা প্রভাবতী গুপ্তার সঙ্গে মহারাষ্ট্রের বাকাটকরাজ রুদ্রসেনের বিবাহ হয়েছিল। পুণে ও ঋদ্ধপুর থেকে পাওয়া দু’টি তাম্রশাসনে প্রভাবতীগুপ্তাকে ‘ভগবদ্-পাদানুধ্যাতা’ ও ‘অত্যন্ত ভগবদ্-ভক্তা’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
  • প্রভাবতীগুপ্তার স্বামী রুদ্রসেনও বিষ্ণুর ভক্ত ছিলেন। বাকাটকরাজ দ্বিতীয় প্রবরসেনের চম্মক অভিলেখে বলা হয়েছে, রুদ্রসেন ভগবান চক্রপাণির অনুগ্রহে সমৃদ্ধি লাভ করেছিলেন।
  • কুষাণ আমলেই উত্তর বাংলায় ভাগবতধর্ম বিস্তার লাভ করেছিল। এ সময় বাঁকুড়া অঞ্চলেও তার প্রসার ঘটে। এ পর্বে বৈষ্ণবধর্মের যে প্রসার ঘটল তা এক কথায় অভূতপূর্ব।

বিষ্ণু-কাহিনির জনপ্রিয়তা : তখনকার সমাজে বিষ্ণু সম্পর্কে যে নানা কাহিনি সুপ্রচলিত ছিল, সমকালীন লেখমালায় ও ভাস্কর্যে তার সাক্ষ্য বিধৃত। লেখের নিদর্শনগুলোর মধ্যে আছে –

  • খ্রিস্টীয় ৫ম শতকের প্রারম্ভে উৎকীর্ণ এক মন্দসোর লেখে বিষ্ণুর শত্রু উৎসব ও সমুদ্রজলে তাঁর নিদ্রা যাপনের বর্ণনা আছে। ওই লেখে আরও বলা হয়েছে, বাসুদেব শরণ্য, অপ্রমেয় ও অজ, তিনি এক মহীরুহ, দেবতারা তার ফল, অপ্সরারা তার শিকড়, স্বর্গীয় প্রাসাদাবলি তার শাখা-প্রশাখা ও বৃষ্টিধারা তার মধুপ্রবাহ। বিষ্ণুর বিশ্বরূপতত্ত্ব যেন এখানে আভাসিত।
  • ৪২৩ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ আর একখানি মন্দসোর লেখে বিষ্ণুকে মধুসূদন এবং চক্র ও গদাধররূপে বর্ণনা করা হয়েছে।
  • প্রথম কুমারগুপ্ত ও বন্ধুবর্মার মন্দসোর লেখে কৌস্তভ রত্ন ও প্রস্ফুটিত পদ্মের মালা বিষ্ণুর ভূষণরূপে বর্ণিত হয়েছে।
  • ৪৮৫ খ্রিস্টাব্দের এরাণ লেখে বিষ্ণুকে জনার্দন বলা হয়েছে, তিনি চতুর্ভুজ, চার সমুদ্র তাঁর পর্যন্ত, বিশ্বের স্থিতি, সৃষ্টি ও লয়ের তিনি কর্তা, গরুড় তাঁর বাহন।
  • স্কন্দগুপ্তের ভিতরী প্রস্তর স্তম্ভলেখে কৃষ্ণের কংসবধের প্রচ্ছন্ন উল্লেখ আছে। কৃষ্ণের জননী দেবকীও এই লেখে উল্লেখিত।

লেখমালায় যেমন, তেমনি সমকালীন ভাস্কর্যেও কৃষ্ণ-বিষ্ণুর অনেক কাহিনি পরিবেশিত হয়েছে।

  • দেওগড়ের দশাবতার মন্দিরগাত্রে অনন্তশায়ী বিষ্ণুমূর্তি উৎকীর্ণ আছে।
  • মধ্যপ্রদেশের পঠারিতে পাওয়া এক ভাস্কর্যে কৃষ্ণকে এক নিদ্রামগ্ন, সদ্যোজাত শিশুরূপে অঙ্কিত করা হয়েছে।
  • কৃষ্ণ দু’হাত দিয়ে গোবর্ধন পাহাড় তুলছেন বা দু’টি অর্জুন গাছ উৎপাটন করছেন, দেবকী সদ্যোজাত কৃষ্ণকে বসুদেবের হাতে অর্পণ করছেন, বসুদের শিশু কৃষ্ণকে কোলে নিয়ে আছেন, কৃষ্ণ অসুর কেশীকে বধ করছেন, কৃষ্ণ ও বলরাম একযোগে চানূর এবং মুষ্টিকের সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করছেন, কৃষ্ণ ও বলরাম কংসকে টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছেন, কৃষ্ণ নবনীত চুরি করছেন বা তিনি কালীয়নাগকে দমন করছেন, এমন অনেক দৃশ্য সমকালীন ভাস্কর্যে ধরা পড়েছে।

বিষ্ণুর অবতারবাদ :

    • অবতাদের উল্লেখ : বিষ্ণুর অবতারবাদের বহুল প্রচার এই পর্বের বৈষ্ণবধর্মের এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। পুরাণাদি গ্রন্থে বিষ্ণুর অবতার সম্পর্কে নানা কাহিনি পরিবেশিত হয়েছে। ভগবান বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন রূপে অবতীর্ণ হয়ে পৃথিবীকে রক্ষা করেছেন এবং ভবিষ্যতে কলিযুগের শেষে ব্রাহ্মণ বিষ্ণু্যশের ঘরে কল্কিরূপে জন্মগ্রহণ করে পুনরায় পৃথিবীকে রক্ষা করবেন, এই হল অবতার কাহিনিগুলির মর্মকথা। অবতারদের সংখ্যা নিয়ে তখনও জনমানসে সংশয় ছিল। সংশয় ছিল অবতারদের রূপ ও প্রকৃতি সম্পর্কেও –
      • মহাভারতের শান্তিপর্ব, মৎস্য ও বায়ু-পুরাণ এবং হরিবংশে বিষ্ণুর দশ অবতারের কথা বলা হয়েছে। শান্তিপর্বে যে দশ অবতারের উল্লেখ আছে তাঁরা হলেন কূর্ম, হংস, মৎস্য, বরাহ, বামন, নরসিংহ, বাসুদেব কৃষ্ণ, ভার্গব রাম, দাশরথি রাম ও কল্কি।
      • মৎস্য পুরাণের দশ অবতারের তালিকায় নারায়ণ, নরসিংহ, বামন, দত্তাত্রেয়, মান্ধাতা, জামদগ্ন্য রাম, দাশরথি রাম, বেদব্যাস, বুদ্ধ এবং কল্কি অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।
      • বায়ু-পুরাণের দশ অবতারের তালিকাটি মৎস্য পুরাণেরই অনুরূপ। তবে সেখানে বুদ্ধের নাম নেই, কৃষ্ণের নাম আছে।
      • হরিবংশের তালিকায় মৎস্য, কুর্ম, জামদগ্ন্য রাম ও বুদ্ধের পরিবর্তে পদ্ম, দত্তাত্রেয়, কেশব এবং ব্যাসের উল্লেখ আছে।
      • কিন্তু ভাগবত ও বরাহ-পুরাণে অসংখ্য অবতারের উল্লেখ আছে। অবতারাঃ হি অসংখ্যেয়াঃ, উক্তিটি ভাগবত-পুরাণের।
    • বরাহ অবতার : গুপ্তযুগের ভাস্কর্যে ও লেখমালায় অনেক অবতারই রূপায়িত বা উল্লেখিত হয়েছেন। প্রাপ্ত নিদর্শনের ভিত্তিতে অনুমান করা যায়, এ সময় বরাহরূপী বিষ্ণুপূজা যথেষ্ট সমাদর লাভ করেছিল। রাজা তোরমাণের আমলের এরাণ লেখখানি একটি প্রস্তর নির্মিত বরাহমূর্তির উপরই উৎকীর্ণ। লেখটিতে বরাহরূপী নারায়ণের মন্দির নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। বুধগুপ্তের সময়কার দামোদরপুর লেখে বরাহরূপী বিষ্ণুকে শ্বেতবরাহস্বামী ও কোকামুখস্বামী নামে অভিহিত করা হয়েছে। দেবতার উদ্দেশ্যে দু’টি মন্দির নির্মাণের কথাও আছে লেখটিতে। তাছাড়া মধ্যপ্রদেশের উদয়গিরি ও কানপুরের নিকটবর্তী ভীতরগাঁওতে বরাহরূপী বিষ্ণুমূর্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। বিষ্ণুর বরাহমূর্তির উপস্থাপনায় ভাস্কর দু’টি পদ্ধতির আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। দেবতা কখনও কখনও পূর্ণ বরাহরূপে উপস্থাপিত হয়েছেন কখনওবা বরাহমুখী ও মনুষ্যদেহধারী দেবতারূপে তিনি প্রতিভাত।
    • নৃসিংহ অবতার : বরাহ অবতারের মতো অতটা না হলেও নরসিংহ অবতারও লোকসমাজে জনপ্রিয় ছিল। বিহারের বৈশালীতে পোড়ামাটির তৈরি গুপ্তযুগের নরসিংহ মূর্তির এক সিলমোহর আবিষ্কৃত হয়েছে। বেলেপাথরে তৈরি খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের এক নরসিংহ মূর্তি গ্বায়ালিয়র সংগ্রহ শালায় সংরক্ষিত আছে। বিষ্ণুর নরসিংহ মূর্তির আর এক নিদর্শন আছে দেওগড় দশাবতার মন্দিরে। দেবতাটি চতুর্ভুজ, তাঁর হাতে চক্র, গদা ও শঙ্খ; তিনি শান্ত, সমাহিতভাবে পদ্মের উপর সুখাসনে উপবিষ্ট। এ ধরনের মূর্তির মুখটি সিংহের, দেহটি মানুষের।
    • রাম অবতার : এই পর্বে দাশরথি রামও বিষ্ণুর অবতাররূপে স্বীকৃতি পান। কালিদাসের রঘুবংশে রামচন্দ্র বিষ্ণুর অবতাররূপে বর্ণিত হয়েছেন। বাকাটক রানি প্রভাবতীগুপ্তা রামগিরিস্বামীর ভক্ত ছিলেন। এই রাম দাশরথি রাম। বরাহমিহির রামচন্দ্রের মূর্তি নির্মাণের কলাকৌশল বর্ণনা করেছেন।
    • অন্যান্য অবতার : ভরতপুর অঞ্চলে মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নরসিংহ ও বামনাবতারের প্রতিকৃতি সম্বলিত গুপ্তপর্বীয় এক ভাস্কর্য ফলকের সন্ধান পাওয়া গেছে। পরশুরাম ও বামনাবতারের একটি করে মূর্তি পঠারি মন্দিরে উৎকীর্ণ আছে। বামন এখানে দ্বিভুজ, ছত্র ও দণ্ডধারী এক সুকুমার ব্রাহ্মণরূপে কল্পিত। বামন চতুর্ভুজ বা অষ্টভুজ, তাঁর এক পা ভূমিতে স্থাপিত, অন্য পা উত্তোলিত, এরূপ বিরাটরূপী ত্রিবিক্রম মূর্তি এ যুগে সম্ভবত নির্মিত হত না। স্কন্দগুপ্তের জুনাগড় লেখে বিষ্ণুর বামনাবতারের প্রচ্ছন্ন উল্লেখ আছে। বিষ্ণুর অবতার হিসাবে পরশুরাম তেমন জনপ্রিয়তা অর্জন করেননি।

ব্যূহপূজা : গুপ্তপর্বে ব্যূহপূজার কোনও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নেই। অবতারবাদের প্রবল দীপ্তিচ্ছটায় ব্যূহপূজা ম্লান হয়ে পড়েছিল ঠিকই কিন্তু একেবারে লুপ্ত হয়নি। সমকালীন পাঞ্চরাত্র শাস্ত্রে ব্যূহপূজার দ্ব্যর্থহীন উল্লেখ আছে।

বিষ্ণুমূর্তি : এই পর্বে স্থানক (দাঁড়ানো), আসন (উপবিষ্ট) ও শয়ন এই তিন শ্রেণির বিষ্ণুমূর্তিই আবিষ্কৃত হয়েছে। তবে অন্যান্য শ্রেণির তুলনায় আসন মূর্তির সংখ্যা কম। বিষ্ণু কখনও কখনও তাঁর দুই স্ত্রী, স্ত্রী ও পুষ্টির সঙ্গেও উপস্থাপিত হয়েছেন। শয়ন মূর্তিতে বিষ্ণুকে আদিশেষের কুণ্ডলীকৃত দেহের উপর অর্ধশায়িত ভঙ্গিতে দেখা যায়।

লক্ষ্মী বা শ্ৰী : লক্ষ্মী বা শ্রীকে বিষ্ণুর পত্নীরূপে রূপকল্পনা গুপ্তযুগের বৈষ্ণবধর্মের এক উল্লেখ যোগ্য বৈশিষ্ট্য। এক সময় লক্ষ্মী আদিত্যের পত্নীরূপে গণ্য হতেন। গুপ্তপর্বে এ ধারণার পরিবর্তন ঘটল। স্কন্দগুপ্তের জুনাগড় লেখে লক্ষ্মী বিষ্ণুর পত্নীরূপে পরিচিতা হয়েছেন। প্রকটাদিত্যের সারনাথ লেখে লক্ষ্মীকে বাসুদেবের পত্নী বলা হয়েছে। পূর্বে লক্ষ্মী ও শ্রীকে দু’টি পৃথক দেবী রূপে কল্পনা করা হত। তাঁরা ছিলেন আদিত্যের দুই সপত্নী। কিন্তু এখন থেকে তাঁরা এক ও অভিন্ন দেবীরূপে পূজিত হন। লক্ষ্মী কখনও কখনও গজলক্ষ্মীরূপেও রূপায়িত হয়েছেন। সেক্ষেত্রে দু’টি হাতি জলসেচনের দ্বারা তাঁকে অভিষিক্ত করছে।

বলদেব, কৃষ্ণ ও সুভদ্রার সম্মিলিত পূজা : গুপ্তপর্বে বলদেব, কৃষ্ণ ও সুভদ্রার সম্মিলিত পূজারও প্রচলন ছিল। বৃহৎসংহিতায় এ ধরনের পূজার উল্লেখ আছে।

শৈবধর্ম

শৈবধর্মের জনপ্রিয়তা : গুপ্ত রাজারা প্রধানত বৈষ্ণবধর্মাবলম্বী হলেও তাদের আমলে শৈব ধর্মেরও যথেষ্ট প্রসার ঘটেছিল। ব্যক্তিগতভাবে গুপ্ত রাজারা যে ধর্মমতই পোষণ করুন না কেন, অন্য ধর্মের প্রতি তাঁরা কখনই অনুদার মনোভাব প্রদর্শন করেননি।

  • দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সান্ধিবিগ্রহিক বীরসেন শাব মধ্যপ্রদেশের উদয়গিরিতে শিবপূজার জন্য এক গুহামন্দির নির্মাণ করেছিলেন।
  • দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের পুত্র প্রথম কুমারগুপ্ত বিষ্ণুভক্ত হয়েও স্কন্দের অনুরাগী ছিলেন। স্কন্দের বাহন ময়ূরের প্রতিকৃতি-সহ তিনি মুদ্রা উৎকীর্ণ করেছেন। নিজের এক পুত্রের নামকরণও করেছেন স্কন্দ বলে।
  • তাঁর মন্ত্রী পৃথ্বীযেণ উত্তরপ্রদেশের করমডাণ্ডা গ্রামে এক শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করে ছিলেন।
  • গুপ্তরাজবংশের সন্তান বৈন্যগুপ্ত তাঁর শুনাইঘর লেখে নিজেকে ভগবান মহাদেবের পাদানুধ্যাত বলে পরিচয় দিয়েছেন।
  • দশপুরের অধিপতি জনেন্দ্র যশোধর্মা, হুণরাজ মিহিরকুলগুজরাতের মৈত্রক রাজারা সকলেই শিবভক্ত ছিলেন।
  • এ যুগের শ্রেষ্ঠ কবি কালিদাস ধর্মে শৈব ছিলেন। স্কন্দের জন্ম বর্ণনা করে কুমারসম্ভব নামে তিনি একখানি অমর কাব্য রচনা করেন।
  • এ যুগেরই আর এক কবি ভারবি পাণ্ডববীর অর্জুনের সঙ্গে কিরাতরূপী শিবের যুদ্ধ বর্ণনা করে ‘কিরাতার্জুনীয়ম্’ নামে এক মহাকাব্য রচনা করেন।
  • বায়ু ও মৎস্য পুরাণে শিবের প্রশক্তি আছে। পুরাণ দু’খানি সম্ভবত গুপ্তযুগেই রচিত হয়েছিল।

পাশুপত সম্প্রদায় : শৈবদের এক শাখা পাশুপত সম্প্রদায় নামে পরিচিত ছিল। এই সম্প্রদায়ের একখানি প্রামাণ্য গ্রন্থ পাশুপতসূত্র। প্রাক্-গুপ্তযুগে রচিত এই গ্রন্থখানির রচয়িতা কে তা জানা যায় না। তবে রাশীকর কৌণ্ডিন্য নামে এক পাশুপতাচার্য গুপ্তযুগে এর একখানি ভাষ্য রচনা করেন। (অনেকে গ্রন্থখানিকে আরও পূর্ববর্তী বলে মনে করেন। রাশীকর এবং কৌণ্ডিন্য একই ব্যক্তি কিনা সে সম্পর্কেও সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে (Surendranath Dasgupta, A History of Indian Philosophy, Vol. V. Delhi, 1988, পৃষ্ঠা ১৪৫))। পাশুপত সম্প্রদায়ের ধর্মবিশ্বাসের বিশদ বিবরণ আছে এ ভাষ্যে। পাশুপত তত্ত্বের মূল কথা হল, পশু বা জীবের দুঃখান্ত, অর্থাৎ নিবৃত্তি। জন্মগ্রহণের পূর্ব থেকেই জীবকে নানা দুঃখ ভোগ করতে হয়। দুঃখ মূলত তিন প্রকার, আধিভৌতিক, আধিদৈবিক ও আধ্যাত্মিক। আধিভৌতিক দুঃখ পাঁচ প্রকার, গর্ভবাস, জন্মগ্রহণ, অজ্ঞান, জরা এবং মরণ। আধিদৈবিক দুঃখও পাঁচ প্রকার, ইহলোকভয়, পরলোকভয়, অহিত-সংপ্রয়োগ, হিত-বিপ্রয়োগ ও ইচ্ছাব্যাখ্যাত। আধ্যাত্মিক দুঃখ তিন প্রকার, মানসজাত প্রবৃত্তিজাত ও দেহজাত। জীবের দুঃখ নিবৃত্তির দু’টি পথ। একটি যোগ, অন্যটি বিধি। যোগ দুই প্রকার, সকর্মক যোগ ও অকর্মক যোগ। সকর্মক যোগ বলতে বোঝায় ওঁং মন্ত্র ও সাংকেতিক সূত্রের বিড়বিড়ানি, ধ্যান ইত্যাদি প্রক্রিয়া। সম্বিদ বা অনুভূতি হল অকর্মক যোগ। বিধি বলতে আচার-অনুষ্ঠান বোঝায়। প্রধান বিধিগুলির নাম চর্যা। চর্যার দু’টি ভাগ, ব্রত ও দ্বার। দিনে তিন বার করে দেহে ছাই মাখা, ছাই-এর গাদায় শোয়া, ‘হা’, ‘হা’, ‘হা’ করে আকণ্ঠবিস্তৃত হাসি, মহেশ্বরের প্রশস্তিসূচক গান, অঙ্গভঙ্গি-সহ নাচ, বিড়বিড় করে মন্ত্রোচ্চারণ, পথ-পরিক্রমা, উপুড় হয়ে শোয়া, আচার অনুষ্ঠানাদি ব্রতের অঙ্গ। দ্বার ছয় প্রকার, ক্রাথন (জেগে থেকে ঘুমানোর ভান করা), স্পন্দন (অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কম্পন ঘটানো), মণ্ডন (অস্বাভাবিকভাবে হাটাচলা করা), শৃঙ্গারণ (যুবতী মেয়েদের প্রতি অশ্লীল অঙ্গভঙ্গির প্রকাশ), অবিতকরণ (অসামাজিক, উন্মত্ত আচরণ) ও অবিতদ্ ভাষণ (অর্থহীন প্রলাপ বকা)। পূজা-অর্চনার পর দেহে ছাই মাথা, অন্যের এঁটো খাওয়া ইত্যাদি আচরণ গৌণ বিধিগুলির অন্তর্ভুক্ত। যোগ বা বিধির অভ্যাসের ফলে জীবের জ্ঞানশক্তি ও ক্রিয়াশক্তি অর্জিত হয়। জ্ঞান পাঁচ প্রকার, দর্শন, শ্রবণ, মনন, বিজ্ঞান ও সর্বজ্ঞত্ব। ক্রিয়াশক্তি তিন প্রকার মনোজবিত্ব (যে কোনও কাজ করার ক্ষমতা), কামরূপিত্ব (যে কোনও আকার ও রূপ ধারণের ক্ষমতা) ও বিক্রমণধর্মিত্ব (মহাশক্তি অর্জন)। পাশুপত শাস্ত্রে বার বার বলা হয়েছে, শুধু যোগাভ্যাস ও আচার-অনুষ্ঠানের দ্বারা জ্ঞানশক্তি ও ক্রিয়াশক্তি অর্জন করা যায় না, এর জন্য প্রয়োজন মহেশ্বরের করুণা। যোগ বা বিধির অনুষ্ঠানে মহেশ্বরের করুণালাভ সহজ হয়। জ্ঞানশক্তি ও ক্রিয়াশক্তির অধিকারী হলে জীবের দুঃখের নিবৃত্তি হয়, জীব মহেশ্বরের সাযুজ্য লাভ করে। জীবের পশুত্বে ফিরে আসার আর কোনও সম্ভাবনা থাকে না, তাঁর পুনরায় জন্মগ্রহণের সম্ভাবনাও রহিত হয়।

শৈব কেন্দ্র : মথুরা ছিল এ যুগের পাশুপত সম্প্রদায়ের এক প্রধান কেন্দ্র। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের আমলে উদিত নামে এখানে এক পাশুপত আচার্য বাস করতেন। তিনি তাঁর গুরু উপমিত এবং গুরুর গুরু কপিলের প্রতিকৃতি সম্বলিত দু’টি লিঙ্গ সংস্থার গুর্বায়তনে প্রতিষ্ঠা করেন। স্থাপিত লিঙ্গ দু’টি উপমিতেশ্বর ও কপিলেশ্বর নামে আখ্যাত হলেও এগুলি আসলে শিবলিঙ্গ। পূর্বতন আচার্যরা মৃত্যুর পর শিব-মহেশ্বরে লীন হয়েছেন, এই ব্যঞ্জনা প্রকাশের জন্যই লিঙ্গ দু’টির গায়ে আচার্যদের প্রতিকৃতি উৎকীর্ণ করা হয়েছিল। শৈবধর্মের অন্যান্য কেন্দ্রগুলির মধ্যে ভূমরা, শঙ্করগড়, করম ডাঙা, খোহ প্রভৃতি স্থানের নাম বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। বায়ু-পুরাণে হিমগিরি, গঙ্গাদ্বার, হৈমক অরণ্য, গন্ধমাদন গিরি, গৌতমারণ্য, গোকর্ণ, দেবদারু অরণ্য, বারাণসী, কালগুর, নৈমিষ, কোটিবর্ষ, রুদ্রবট, কায়ারোহণ ইত্যাদি আরও কয়েকটি শৈব কেন্দ্রের উল্লেখ আছে।

শিবমূর্তি ও শিবলিঙ্গ : গুপ্তযুগে যেমন শিবমূর্তির, তেমনি শিবলিঙ্গের নিদর্শন পাওয়া গেছে। তবে শিবলিঙ্গের নিদর্শন সংখ্যায় অনেক বেশি। এ থেকে মনে হয়, মানবরূপে শিবের পূজার প্রচলন থাকলেও শিবের প্রতীকপূজাই বেশি সমাদর লাভ করেছিল। কখনও কখনও লিঙ্গের রুদ্র বা পূজা ভাগে শিবের এক বা একাধিক প্রতিকৃতি উৎকীর্ণ থাকত। এ ধরনের শিবলিঙ্গকে মুখলিঙ্গ বলে। মুখলিঙ্গে তিন, শিবের মানবরূপ ও প্রতীকরূপের সমন্বয় ঘটানো হয়েছে। যুগের একটি আজমের সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে। লিঙ্গটির চার শিব, বিষ্ণু, ব্রহ্মা প্রতিকৃতি উৎকীর্ণ। সেযুগে সমন্বয় বিধানের যে এক প্রচেষ্টা চলছিল তারই অভিব্যক্তি ঘটেছে আজমেরের চতুর্মুখ লিঙ্গে।

অর্ধ নারীশ্বরমূর্তি : ভিটায় পাওয়া গুপ্তযুগের এক সিলমোহরে অর্ধ-নারীশ্বরমূর্তির উপ এই শিবপত্নী অভিন্ন দেবতার দক্ষিণার্ধ শিব, বামার্ধ উমা। গুপ্তযুগ থেকেই সম্ভবত শিব উমার যৌগিক মূর্তিপূজার সূত্রপাত হয়।

শিবের অবতারত্ব : শিবের অবতারত্ব প্রচারের উদ্যোগ যুগেই প্রথম দেখা সম্ভবত সংকলন বায়ু-পুরাণে হয়েছে, পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছেন। সর্বশেষ অবতারে শিব নকুলি লকুলি নামে এক যোগী রূপে কায়ারোহণে আবির্ভূত হন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর চার অনুচর, কুশিক, সন্নিকটে কায়ারোহণের অবস্থান ছিল অনুমিত হয়। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, শিবের অবতারবাদ কল্পনায় বৈষ্ণবধর্মের অনুপ্রেরণা ছিল।

গণেশ : গুপ্তযুগে শুধু গণেশপূজার প্রচলনই ছিল গণেশকে কেন্দ্র করে সম্ভবত এক স্বতন্ত্র। তাঁর গণেশের বন্দনা করেছেন। এতে সিদ্ধিদাতার রূপটি পেয়েছে। কিন্তু অমরকোষে গণেশের নামের যে দীর্ঘ তালিকা পাওয়া যায়, তাতে বিঘ্নরাজ নামটিরও উল্লেখ আছে। গণেশ বিঘ্ন অমঙ্গলের এমন একটা ব্যঞ্জনা বিঘ্নরাজ নামের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে। সম্ভবত তখনও গণেশের সিদ্ধিদাতার রূপটি সর্বজনীন স্বীকৃতি লাভ করেনি। গুপ্তযুগে নির্মিত, বেলেপাথরে তৈরি গজমুখ এই দেবতার এক মথুরায় পাওয়া গেছে। ভীতরগাঁও মন্দিরের এক পোড়ামাটির ফলকে গণেশের মূর্তি অঙ্কিত আছে। আকাশপথে চলছেন। তাঁর এক হাতে মোদকপাত্র শুণ্ডের সাহায্যে তিনি মোদক আস্বাদন করছেন। ভূমরা শিবমন্দিরের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে দু’টি গণেশমূর্তি পাওয়া গেছে। মূর্তি একটি দ্বিভুজ, অন্যটি চতুর্ভুজ। এই আর একটি গণেশমূর্তি উত্তর বাংলার পাহাড়পুরে আবিষ্কৃত হয়েছে। দেবতা, চতুর্ভুজ, মূষিকরাহন, ত্রিনয়ন সর্পোপবীতধারী।

স্কন্দ : এই পর্বে স্কন্দপূজারও প্রসার ঘটেছিল। গুপ্তরাজগণের মধ্যে অন্তত একজন স্কন্দের অনুরাগী ছিলেন স্বন্দের নামে তিনি তাঁর পুত্রের নামকরণও দেবতা ও বাহন ময়ূরের প্রতিকৃতি সম্বলিত এক শ্রেণির স্বর্ণমুদ্রা উৎকীর্ণ করে তিনি প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। শিব ও পার্বতীর পুত্ররূপে স্কন্দের জন্মগ্রহণের এক বর্ণনা আছে এ যুগেরই অনুপম কাব্য কুমারসম্ভবে। প্রথম কুমারগুপ্তের রাজত্বকালে উৎকীর্ণ বিলসড় অভিলেখে স্কন্দ মহাসেনের এক মন্দিরের উল্লেখ আছে। গুপ্তপর্বে স্কন্দের বেশি পাওয়া যায়নি। যেকয়টি বা পাওয়া গেছে তাতে দেবতা দ্বিভুজ ময়ূরবাহন, হাতে মাতুলুঙ্গ শক্তি। ভূমরা শিবমন্দিরের চৈত্য গবাক্ষে এ ধরনের এক স্কন্দমূর্তি উৎকীর্ণ আছে। কুষাণযুগে স্কন্দ, কুমার, মহাসেন বিশাখ চার স্বতন্ত্র দেবতারূপে পরিচিত ছিলেন কিন্তু গুপ্তপর্বে স্কন্দ, কুমার ও মহাসেন এক ও অভিন্ন দেবতারূপে গণ্য হলেন। বিশাখ স্বতন্ত্র দেবতারূপেই অবস্থান করেন। বরাহমিহির স্কন্দ এবং বিশাখকে দু’টি পৃথক দেবতারূপে বর্ণনা করেছেন। এই দু’টি দেবতার সমীকরণ ঘটতে আরও কিছু সময় লেগেছিল।

ব্রহ্মা : এই পর্বে ব্রহ্মার আর পূর্বের মতো গুরুত্ব ছিল না। বৃহৎসংহিতায় তাঁর মূর্তি নির্মাণের বর্ণনা আছে। এই পর্বে তাঁর কিছু মূর্তিরও সন্ধান পাওয়া গেছে। এ থেকে মনে হয়, ব্রহ্মার পূজা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। দেবতা চতুর্মুখ, চতুর্ভুজ ও স্ফীতোদর। তিনি কখনও দণ্ডায়মান কখনওবা হাঁসের পিঠে উপবিষ্ট।

সৌর ধর্ম

ইরানীয় প্রভাব : অতি প্রাচীন কাল থেকেই ভারতে সূর্যোপাসনার প্রচলন ছিল। পরবর্তী কালে ইরানদেশীয় মগ-ব্রাহ্মণ বা শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণ নামে এক পুরোহিত সম্প্রদায় এ দেশে এসে ইরানীয় ধারায় সূর্যোপাসনা প্রচলন করেন। কুষাণমুদ্রায় যে সূর্য অঙ্কিত হয়েছেন তিনি কুষাণ রাজাদের মতো উদীচ্য বেশে সজ্জিত। তিনি ভারতীয় সূর্য নন, ইরানীয় সৌর দেবতা মিহির। প্রথম দিকে সূর্যো পাসনার এই দেশি ও বিদেশি ধারা দু’টি সমান্তরাল পথে প্রবাহিত হয়। সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে ধারা দু’টি এক সমন্বিত রূপ লাভ করে। প্রাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণাদির ভিত্তিতে মনে হয়, গুপ্ত যুগেই এই সমন্বয়ের কাজ শুরু হয়েছিল। এ যুগের প্রথম পর্বে উত্তর ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে যেসব সূর্যমূর্তি পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যায়, দেবতার গায়ে কুষাণ রাজাদের মতো উদীচ্য পোশাক, পায়ে পাদুকা ও মোজা জাতীয় জিনিস, ঝোলানো হাতে আস্কন্ধ প্রসারিত পদ্মের মৃণাল। সূর্যমূর্তির কুষাণ পোশাকে এবং পাদুকা ও মোজার ব্যবহারে ইরানীয় প্রভাবের প্রতিফলন ঘটেছে। অথচ এই পর্বেই দক্ষিণ ভারতে সম্পূর্ণ দেশীয় রীতিতে সূর্যমূর্তি নির্মিত হচ্ছিল। সেসব মূর্তিতে দণ্ডায়মান দেবতার দেহাবরণ বলতে শুধু উদরবন্ধ, পা দু’খানি নগ্ন, হাত দু’টি উপরের দিকে আস্কন্ধ প্রসারিত, হাতে অর্ধ প্রস্ফুটিত পদ্ম। এই পর্বে দেবতার দণ্ডায়মান মূর্তি ছাড়া উপবিষ্ট মূর্তিও দক্ষিণ ভারতে নির্মিত হচ্ছিল। সেক্ষেত্রে দেবতা সাত ঘোড়ায় টানা রথে উপবিষ্ট, তাঁর দু’পাশে তাঁর দুই স্ত্রী, ঊষা ও প্রত্যুষা। অর্থাৎ ইরানীয় সূর্যোপাসনা উত্তর ভারতেই প্রভাব ফেলেছিল, দক্ষিণ ভারতে তা বিশেষ রেখাপাত করতে পরেনি। ইরানীয় সূর্যোপাসনার এই প্রাধান্য উত্তর ভারতে বেশি দিন চলল না। গুপ্ত যুগের শেষের দিকে উত্তর ভারতে যেসব সূর্যমূর্তি নির্মিত হয়েছিল তাতে ভারতীয় রীতির ভূমিকাই প্রধান হয়ে দেখা দেয়। ইরানীয় উপকরণ যে একেবারে লুপ্ত হল তা নয় তবে তা ছিল অতি ক্ষীণ। বাংলাদেশের বগুড়া জেলার দেওরা গ্রামে এ ধরনের এক সূর্যমূর্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। মূর্তিটিতে সূর্যদেব সাত ঘোড়ায় টানা রথে উপবিষ্টরূপে উপস্থাপিত। দেবতার সঙ্গে আছেন তাঁর দুই অনুচর দণ্ডী ও পিঙ্গল, সারথি অরুণ এবং তাঁর দুই স্ত্রী ঊষা ও প্রত্যুষা। দেবতার পরনে ধুতি, কটিদেশে তরবারি। দেবতার পায়ে বুটজুতা আছে বটে তবে তা অংশত দৃশ্যমান। লক্ষ করবার বিষয়, এ ধরনের সূর্যমূর্তিতে দেবতা বা তাঁর অনুচরদের গায়ে উদীচ্য বেশ নেই। বৈদেশিক উপকরণ বলতে আছে শুধু পাদুকা।

সূর্যমূর্তি ও সূর্যোপাসনা : সমকালীন জ্যোতির্বিজ্ঞানী বরাহমিহির সূর্যমূর্তি ও সূর্যোপাসনা সম্পর্কে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, দেবতা উদীচ্য বেশে সজ্জিত হবেন, তাঁর হাত দু’টিতে থাকবে পদ্মের মৃণাল, কটিদেশে বিয়স, গলায় দীর্ঘ হার, মাথায় কিরীট। বিয়ঙ্গ এক ধরনের মেখলা। বরাহমিহির সূর্যোপাসনায় মগব্রাহ্মণদের পুরোহিতরূপে নিয়োগের কথাও বলেছেন। বলতে দ্বিধা নেই, কুষাণ ও আদি গুপ্তপূর্বের উত্তর ভারতীয় সূর্যমূর্তির সঙ্গে বরাহমিহিরের বর্ণনার অনেক মিল আছে কিন্তু গুপ্তপর্বের শেষের দিকের সূর্যমূর্তির সঙ্গে এর বিশেষ কোনও মিল নেই। মগ বা শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণরাই কেবল সূর্যপুজায় পৌরোহিত্যের অধিকারী, বরাহমিহিরের এ বিধান তখনকার দিনে কতখানি প্রযোজ্য ছিল, তা অনুধাবনের বিষয়। স্মরণ রাখতে হবে, বরাহমিহির নিজেও একজন শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণ ছিলেন।

সূর্যমন্দির : লেখমালায় সেযুগের কয়েকটি সূর্যমন্দিরের উল্লেখ আছে।

  • মন্দসোর লেখ থেকে জানা যায়, প্রথম কুমারগুপ্তের রাজত্বকালে স্থানীয় রেশমশিল্পীদের সমবেত প্রচেষ্টায় ৪৩৬ খ্রিস্টাব্দে দশপুরে একটি সূর্যমন্দির নির্মিত হয়েছিল। মন্দিরটি এত বিশাল ও উঁচু ছিল যে দূর থেকে এটিকে পাহাড় বলে মনে হত। পরে মন্দিরটি জীর্ণ হয়ে পড়লে রেশমশিল্পীরা ৪৭৩ খ্রিস্টাব্দে এটির সংস্কার করেন।
  • স্কন্দগুপ্তের সময়কার এক লেখে আর একটি সূর্যমন্দিরের উল্লেখ আছে। উত্তরপ্রদেশের বুলন্দসর জেলার ইনদউর গ্রামে মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল। গ্রামটির প্রাচীন নাম ইন্দ্রপুর।
  • হূণরাজ মিহিরকুলের সময় মাতৃচেত নামে জনৈক ব্যক্তি গ্বালিয়রের পর্বতশিখরে একটি সূর্যমন্দির নির্মাণ করেছিলেন।

এ পর্বে সৌর উপাসনা জনসমাজে যে যথেষ্ট সমাদর লাভ করেছিল তাতে কোনও সংশয় নেই।

শাক্তধর্ম

মূল বৈশিষ্ট্য : শাক্তধর্মমতে শিবের পত্নী হলেন সর্ব শক্তির আধার। তিনি দেবী, দুর্গা, চণ্ডী, কালী, চামুণ্ডা ইত্যাদি নানা নামে ও রূপে কল্পিত। শিবের স্ত্রীরূপে তাঁর পরিচয় হলেও শিব তাঁরই অনুগত, আজ্ঞাবহ। তিনিই আদ্যাশক্তি, শিব জড়বৎ। এই আদ্যাশক্তির ইচ্ছায় ও সক্রিয়তায় জগৎ ও জীবনের সৃষ্টি। শৈবধর্মেও শিবানীর এক বিশেষ ভূমিকা আছে। কিন্তু সেখানে শিবই মুখ্য। তিনি স্বামীর ছায়ামাত্র। শাক্তধর্মে দেবী সর্বশক্তিস্বরূপিণী। মার্কণ্ডেয় পুরাণের দেবীমাহাত্ম্য অধ্যায়ে দেবীর উদ্ভব সম্পর্কে এক কাহিনির বর্ণনা আছে। সেখানে বলা হয়েছে, মহিষাসুরের অত্যাচারে নিপীড়িত দেবতারা বিষ্ণু ও মহাদেবের শরণাপন্ন হলে বিষ্ণু, মহাদেব, ব্রহ্মা এবং অন্যান্য দেবতাদের ক্রোধসঞ্জাত তেজরাশি থেকে অসুরহত্তা মহা দেবীর আবির্ভাব হয়। অনেকে বলে থাকেন, দেবীমাহাত্ম্য অধ্যায়টি গুপ্তপর্বেই রচিত হয়েছিল। সে কারণে সমকালীন যুগের পরিপ্রেক্ষিতে কাহিনিটির এক বিশেষ ব্যঞ্জনা আছে। দেবী প্রধানত দু’টি রূপে পূজিত হন। একটি রূপ উগ্র, অন্য রূপটি সৌম্য। চামুণ্ডা, দুর্গা, কালী, রাত্রী, চণ্ডা, কাত্যায়নী, ভৈরবী ইত্যাদি রূপে দেবীর উগ্র প্রকৃতি প্রকাশ পেয়েছে। উমা, গৌরী, পার্বতী, ভবানী, অন্নপূর্ণা, ললিতা ইত্যাদি রূপে দেবীর সৌম্য ভার অভিব্যক্ত হয়েছে।

  • মধ্যপ্রদেশের ভিটা ও উদয়গিরিতে এ পর্বের দেবীপূজার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। ভিটার কয়েকখানি প্রস্তর ফলকে দ্বিভুজা দেবীর মূর্তি উৎকীর্ণ, দেবী মহিষরূপী অসুরের সঙ্গে যুদ্ধরত।
  • উদয়গিরির চন্দ্রগুপ্ত গুহায় দ্বাদশভুজা দেবীমূর্তি অঙ্কিত আছে। দেবীর হাতে নানা প্রহরণ। এক হাতের ত্রিশূল দিয়ে তিনি মহিষের কাঁধ বিদ্ধ করছেন, তাঁর এক পা মহিষের দেহের উপর স্থাপিত।

লক্ষ করবার বিষয়, গুপ্তযুগে দেবীমূর্তির পরিবেশনায় না আছে সিংহের উপ স্থাপনা, না আছে দেবীর অনুচরদের উপস্থিতি।

মাতৃকা-পূজা : এ যুগে মাতৃকা-পূজার উল্লেখ পাওয়া যাবে কালিদাসের কাব্যে, বরাহমিহিরের বৃহৎসংহিতায়, স্কন্দগুপ্তের বিহার ও বিশ্বকর্মার গাঙ্গধার শিলালেখে। মাতৃকাদের সংখ্যা ও নাম সম্পর্কে এসব সূত্রে কোনও তথ্য নেই। অমরকোষে সাত জন মাতৃকার কথা বলা হয়েছে, তাঁদের নামও উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁরা হলেন ব্রাহ্মী, মাহেশ্বরী, কৌমারী, বৈষ্ণবী, বারাহী, ইন্দ্রাণি ও চামুণ্ডা। মার্কণ্ডেয় পুরাণের দেবীমাহাত্ম্যে মাতৃকাদের সংখ্যা সাত থেকে বেড়ে ন’য়ে দাঁড়িয়েছে। নতুন দু’জন হলেন শিবদূতী ও নারসিংহী। মাতৃকারা বিভিন্ন দেবতার শক্তিরূপে কল্পিত হয়েছেন।

  • বিহার প্রস্তরলেখে মাতৃকাদের সঙ্গে স্কন্দের উল্লেখ করা হয়েছে। মনে হয়, মাতৃকাদের স্কন্দকে লালনপালনের পৌরাণিক কাহিনি তখন জনসমাজে সুপরিচিত ছিল।
  • গাঙ্গধার লেখে সেকালের একটি মাতৃকা মন্দিরের বর্ণনা আছে। লেখে বলা হয়েছে, সেই মন্দিরে ডাকিনীরা বাস করত। তারা আনন্দে উচ্চ কণ্ঠে ভীতিপ্রদ কলরব করত। তাদের তান্ত্রিক আচারাদি থেকে যে প্রবল বায়ু উত্থিত হত, তা সমুদ্রকে আলোড়িত করত।

স্পষ্ট বোঝা যায়, মাতৃকাপূজায় তান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপ অনুষ্ঠিত হত। প্রবোধচন্দ্র বাগচী অভিমত ব্যক্ত করেছেন, ডাকিনী সংক্রান্ত ধ্যান-ধারণা মধ্য এশিয়া থেকে ভারতে এসেছিল।

তন্ত্রসাধনা : গুপ্তযুগের সাহিত্যে ও লেখমালায় তন্ত্রসাধনার আভাস আছে। এ যুগেরই গাঙ্গধার শিলালেখে স্থানীয় একটি মাতৃকামন্দিরে ডাকিনীদের তান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপের স্পষ্ট উল্লেখ আছে। তন্ত্রসাধনার লক্ষ্য ব্রহ্মোপলব্ধি বা আত্মজ্ঞানলাভ। এরই নাম মোক্ষ বা মুক্তি। দেহস্থিত সুপ্ত শক্তিকে পূর্ণ বিকশিত করলে এই মুক্তি আসে। এই সাধনার তিনটি পর্যায়। পর্যায়গুলি হল পশ্বাচার, বীরাচার ও দিব্যাচার।

  • সাধনার প্রথম স্তর পশ্বাচার। পশু বলতে জীবকে বোঝায়। ঘৃণা, লজ্জা, ভয়, শঙ্কা, জুগুগ্ধা, কুল, শীল ও জাতি এই আটটি পাশের দ্বারা সে বদ্ধ। এই পাশের বাঁধন থৈকে জীবকে বেরিয়ে আসতে হবে। এর জন্য চরিত্র ও সদগুণের অনুশীলন প্রয়োজন।
  • এই অনুশীলনে সফলতা এলে জীব পশু থেকে বীরে পরিণত হবেন। বীরের পর্যায়ে উন্নীত হলে সাধক পঞ্চতত্ত্বের অনুশীলন করবেন। পঞ্চতত্ত্ব বলতে অনেকে মদ, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা এবং মৈথুন বোবোন। আবার অনেকে একে শিবশক্তি সামরস্য, শুদ্ধ চৈতন্য, সংযম, আত্মোন্নয়ন এবং পরমাত্মায় জীবাত্মার নিঃশেষে নিলয় অর্থে গ্রহণ করেন। কিন্তু এই পর্বে সাধকের অবিদ্যা পুরোপুরি দূর হয় না, তাঁর মধ্যে দ্বৈতভাব থেকেই যায়।
  • বীরাচারের পরবর্তী স্তর দিব্যাচার। এই পর্বে সাধককে দু’টি আচার অনুশীলন করতে হয়। এদের একটি সিদ্ধান্তাচার, অন্যটি কৌলাচার। সিদ্ধান্তাচারে সাধকের মনে ত্যাগের বাসনা জন্মায়, কৌলাচারে মোক্ষের দ্বার উন্মুক্ত হয়। এই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করলে কর্দমে ও চন্দনে, পুত্রে ও শত্রুতে, কাঞ্চনে ও তৃণে সাধকের আর কোনও ভেদজ্ঞান থাকে না। তিনি অদ্বৈত জ্ঞানের অধিকারী হন। উপাস্য দেবতার সত্তায় নিজের সত্তা ডুবিয়ে তিনি নির্মল আনন্দ উপভোগ করেন।

তন্ত্র কোনও ধর্ম নয়, এক সাধনমার্গ। শাক্তধর্মে যেমন, তেমনি বৈষ্ণব, বৌদ্ধ ও জৈনধর্মেও এই সাধনমার্গ সমাদরে গৃহীত হয়েছে। অন্তত দু’টি কারণে তন্ত্রসাধনার অশেষ তাৎপর্য রয়েছে।

  • প্রথমত, তন্ত্র জাতিভেদ মানে না। তন্ত্রসাধনায় হাড়ি, ডোম বা চণ্ডালও গুরুর পদ লাভ করতে পারেন।
  • দ্বিতীয়ত, তন্ত্রে নারীজাতির প্রতি সশ্রদ্ধ মনোভাব ব্যক্ত হয়েছে। তাঁদের গুরু এবং দীক্ষাদাত্রী হওয়ার অধিকার দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যায়, এক তান্ত্রিক ভৈরবী রামকৃষ্ণকে দীক্ষা দিয়েছিলেন, তাঁকে পরমহংস বলে ঘোষণা করেছিলেন।

বৌদ্ধধর্ম

ব্রাহ্মণ্যধর্মের ব্যাপক প্রসারের ফলে বৌদ্ধধর্ম এ পর্বে কিছুটা নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছিল। তবে সমকালীন রাজাদের অনেকেই বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। নরসিংহগুপ্ত বালাদিত্যের মতো গুপ্ত রাজারা বৌদ্ধধর্মে দীক্ষাও গ্রহণ করেছিলেন। বৌদ্ধধর্মকে আরও জনমুখী করার এক প্রচেষ্টাও এ পর্বে দেখা যায়।

বৌদ্ধ কেন্দ্র : ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে হীনযানী ও মহাযানী বৌদ্ধদের উপস্থিতির উল্লেখ করেছেন চিনা ভিক্ষু ফা শিয়েন। লোবনোর, দরদ, উদ্যান, গন্ধার, বন্নু, কনৌজ ও কৌশাম্বীতে হীনযান বৌদ্ধধর্মের জনপ্রিয়তা তিনি লক্ষ করেছেন। আফগানিস্তান, পাঞ্জাব, মথুরা এবং পাটলিপুত্রে বৌদ্ধধর্মের উভয় সম্প্রদায়ের লোক বসবাস করতেন বলে তিনি মন্তব্য করেছেন। তাঁর মতে খোটানের বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের সকলেই মহাযানপন্থী ছিলেন।

বৈভাষিক ও সৌত্রান্তিক : গুপ্তযুগে হীনযানীদের মধ্যে সর্বাক্তিবাদীরাই প্রধান্য লাভ করেছিলেন। সর্বাস্তিবাদীদের দু’টি শাখা ছিল, বৈভাষিক ও সৌত্রান্তিক। বিভাষা থেকে বৈভাষিক। বিভাষার অর্থ টীকা। এই টীকা সাতটি অভিধর্ম গ্রন্থের টীকা। বৈভাষিকরা সাতটি অভিধর্ম গ্রন্থ ও তাদের টীকাকে প্রামাণ্য বলে স্বীকার করেন। সূত্র বা সূত্রান্ত থেকে সৌত্রান্তিক। সৌত্রান্তিকরা মনে করেন, বুদ্ধ নিজে কোনও অভিধর্ম গ্রন্থ রচনা করেননি। সে কারণে এগুলি অপ্রামাণ্য। বুদ্ধের দর্শন কয়েকটি সূত্র বা সূত্রান্তের মধ্যে রয়েছে। এগুলিই প্রামাণ্য। বৈভাষিক ও সৌত্রাস্তিকদের মধ্যে আর একটি বিষয়েও মতপার্থক্য ছিল। বৈভাষিকদের মতে, বাহ্য বস্তুসমূহের যে শুধু অস্তিত্বই আছে, তা নয়; তারা প্রত্যক্ষগম্যও। কিন্তু সৌত্রান্তিকরা বিশ্বাস করতেন, বাহ্যবস্তুসমূহের অস্তিত্ব আছে ঠিকই, কিন্তু তা প্রত্যক্ষগম্য নয়। অনুমানের দ্বারাই তার স্বরূপ জানতে হয়। বৈভাষিক দর্শনের ব্যাখ্যাতা বসুবন্ধু খ্রিস্টীয় ৫ম শতকে আবির্ভূত হয়েছিলেন। আভিধর্মকোষের রচয়িতা হিসাবে তিনি প্রসিদ্ধি অর্জন করেছেন।

যোগাচারী বা বিজ্ঞানবাদী : বৈভাষিক ও সৌত্রাস্তিকরা যেমন হীনযান গোষ্ঠীর দু’টি প্রধান সম্প্রদায়, যোগাচারী বা বিজ্ঞানবাদীরা তেমনি মহাযানীদের এক প্রধান সম্প্রদায়। বোধি লাভের জন্য যোগ ও আচারের উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করায় এ সম্প্রদায়ের নাম যোগাচারী। অপ্রাপ্ত ও অজ্ঞাত বিষয়কে জানার জন্য যে অনুসন্ধান তাই যোগ। আর গুরুর উপদিষ্ট তত্ত্বকে বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে গ্রহণ করার প্রক্রিয়া আচার। যোগাচারীরা বাহ্য বস্তু বা জগতের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না কিন্তু তাঁরা মন, চেতনা বা বিজ্ঞানের সত্তায় বিশ্বাসী। তাঁদের মতে জ্ঞান অর্থাৎ বিজ্ঞান স্বয়ংবেদ্য ও স্বপ্রকাশ। জ্ঞানের অস্তিত্ব অস্বীকার করলে কোনও কিছুরই জ্ঞান সম্ভব হয় না, যুক্তি-তর্ক বা বিচারের সত্যতা অপ্রমাণিত রয়ে যায়। তাই বিজ্ঞান বা চেতনার সত্যতা স্বীকার করতেই হয়। বিজ্ঞান এবং একমাত্র বিজ্ঞানের অস্তিত্বে বিশ্বাসী বলে তাঁরা বিজ্ঞানবাদী বা বিজ্ঞপ্তি মাত্রতাবাদী। লঙ্কাবতারসূত্র (লেখকের নাম অপরিজ্ঞাত), শান্তরক্ষিতের ‘তত্ত্বসংগ্রহ ও বসুবন্ধুর ‘বিজ্ঞপ্তিমাত্রতাসিদ্ধি’ এ সম্প্রদায়ের তিনখানি প্রামাণ্য গ্রন্থ।

মহাযান বৌদ্ধধর্মের রূপান্তর : এ পর্বে মহাযান বৌদ্ধধর্মে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে যায় –

  • প্রথম পরিবর্তন এল বোধিসত্ত্ব সংক্রান্ত ধারণায়। এতদিন ধারণা ছিল প্রতিটি মহাযানীই বোধিসত্ত্বত্ব অর্জন করতে পারেন। কিন্তু এ পর্বে বোধিসত্ত্ব নামে এমন এক ধরনের দেবতা কল্পিত হলেন যাঁরা ইচ্ছা করলেই বুদ্ধ হতে পারেন কিন্তু মানুষের কল্যাণের জন্য তাঁরা বোধিসত্ত্বই থেকে যান। তাঁরা অলৌকিক শক্তির অধিকারী, তাঁরা ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন। ফলে এ পর্ব থেকে আরাধ্য দেবতারূপে বোধিসত্ত্বদের পূজা শুরু হয়। এরূপ এক আরাধ্য বোধিসত্ত্ব হলেন অবলোকিতেশ্বর। তিনি করুণার প্রতিমূর্তি। এ যুগের রচনা কারওব্যূহে তাঁর সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে। এ পর্বে তৈরি তাঁর অনেক মূর্তিও আবিষ্কৃত হয়েছে। কখনও কখনও অবলোকিতেশ্বরের সঙ্গিনী রূপে দেবী তারার মূর্তিও উৎকীর্ণ হয়েছে। তারা প্রজ্ঞার দেবীরূপে উপাসিত হন। এ পর্বের আর এক জনপ্রিয় বোধিসত্ত্ব হলেন মঞ্জুশ্রী। চির নবীন এই বোধিসত্ত্ব জ্ঞানের দেবতারূপে উপাসিত হন। আর এক বোধিসত্ত্ব মৈত্রেয়। মৈত্রেয়ের গুপ্তযুগে নির্মিত কিছু মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে।
  • দ্বিতীয় পরিবর্তন এল বুদ্ধত্বের সংজ্ঞায় ও উপাসনা-পদ্ধতিতে। মন্ত্র, মুদ্রা (ভঙ্গি), মণ্ডল (জ্যামিতিক নকশা), ক্রিয়া (আচার-অনুষ্ঠান) ও চর্যার মতো তান্ত্রিক সাধন পদ্ধতি মহাযান বৌদ্ধ ধর্মে অনুপ্রবেশ করে। এটা ঘটল গুপ্তযুগের শেষের দিকে। এর ফলে সত্যোপলব্ধির স্বরূপ ও পন্থা সম্পর্কে মহাযানীদের এক নতুন ধারণা জন্মাল। প্রতীতি হল, নিজের জীবনে প্রজ্ঞা ও উপায়ের মিলন ঘটালেই প্রকৃত বুদ্ধত্ব অর্জন করা যায়, জন্মমৃত্যুর শৃঙ্খল থেকে নিজেকে মুক্ত করা যায়। এই পরম সুখ বা পরম জ্ঞান পেতে হলে পুরুষ ও নারীকে প্রথমে উপলব্ধি করতে হবে, তাঁরা যথাক্রমে উপায় ও প্রজ্ঞার প্রতীক এবং উভয়ের শারীরিক, মানসিক এবং আত্মিক মিলনেই পরম জ্ঞানের উপলব্ধি হয়। খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতকে রচিত বৌদ্ধ গ্রন্থ কারওব্যুহে ‘ওঁং মণিপদ্মে হুম্’ মন্ত্রটির উল্লেখ পাওয়া যায়। মণিপদ্ম বলতে লিঙ্গ-যোনি বোঝায়। এ যুগে রচিত বৌদ্ধধর্মের ধারিণীসমূহে মন্ত্র, মুদ্রা, মণ্ডল, ক্রিয়া ও চর্যার উল্লেখ আছে। সাধন পদ্ধতিতে মন্ত্র, মুদ্ৰাদি অনু প্রবিষ্ট হওয়ায় মহাযান বৌদ্ধধর্ম ক্রমশ তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের রূপ ধারণ করে।

ফা শিয়েনের বর্ণনা : গুপ্তযুগের বৌদ্ধ শ্রমণদের সম্পর্কে ফা শিয়েন অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিবেশন করেছেন। তিনি বলেছেন, মতের যথেষ্ট অমিল থাকা সত্ত্বেও হীনযানী ও মহাযানী শ্রমণেরা সাধারণত একই বিহারে বসবাস করতেন। শারিপুত্র, মৌদগল্যায়ন, আনন্দ, রাহুল ও অন্যান্য প্রখ্যাত বৌদ্ধ আচার্যদের পবিত্র স্মৃতির উদ্দেশ্যে এ পর্বে যে স্তূপ নির্মিত হত, সে তথ্যও তিনি পরিবেশন করেছেন। গুপ্তযুগের ভিক্ষুণীরা আনন্দকে যে বিশেষ শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন, তারও উল্লেখ করেছেন যা শিয়েন। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা মাঝে মাঝে বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বদের মূর্তিসহ শহর পরিক্রমায় বের হতেন। ফা শিয়েন পাটলিপুত্রে এ ধরনের শোভাযাত্রা প্রত্যক্ষ করেছেন। মধ্য এশিয়ার খোটানেও এ ধরনের অনুষ্ঠান হত। ফা শিয়েন বলেছেন, খোটানের অনুষ্ঠানে মহাযানী ভিক্ষুদের সঙ্গে সে দেশের রাজা, রানি ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও অংশগ্রহণ করতেন। এ সময় চিন, কোরিয়া প্রভৃতি দেশ থেকে অনেক বৌদ্ধ ভিক্ষু ভারতে এসেছিলেন। বৌদ্ধ শাস্ত্র অধ্যয়ন ও বৌদ্ধ তীর্থস্থানসমূহ পরিদর্শন তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল। চিনা পরিব্রাজক ফা শিয়েন ছিলেন এঁদেরই একজন। বিদেশি শ্রমণদের বসবাসের জন্য পূর্ব ভারতে একটি বিহার নির্মিত হয়েছিল। বিহারের ব্যয় নির্বাহের জন্য গুপ্তরাজ শ্রীগুপ্ত ২৪টি গ্রামের রাজস্ব দান করেছিলেন। বিহারটি সম্ভবত উত্তর বাংলায় অবস্থিত ছিল।

বিদেশে বৌদ্ধধর্মের প্রসার : গুপ্তযুগে বহির্বিশ্বে, বিশেষ করে চিনদেশে, বৌদ্ধধর্ম ব্যাপক প্রসার লাভ করে। যে সকল ভারতীয় শ্রমণ বিদেশে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেন তাঁদের মধ্যে গুণভদ্র ও পরমার্থের নাম বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। চিনা ভাষা ও সংস্কৃতে সুপণ্ডিত এই দু’জন ভারতীয় ভ্রমণ দীর্ঘ দিন চিনে বসবাস করেন, অনেক সংস্কৃত গ্রন্থ তাঁরা চিনা ভাষায় অনুবাদ করেন। চিনে মহাযান বৌদ্ধধর্মের প্রচারে তাঁরা অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন। এ সময় মধ্য এশিয়ার খোটানে যে মহাযান বৌদ্ধধর্ম সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল, ফা শিয়েনের সাক্ষ্যে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

জৈনধর্ম

এ সময় জৈনধর্ম তেমন জনপ্রিয় ছিল না। কোনও গুপ্তরাজ জৈনধর্ম গ্রহণ করেছেন বা তার পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন বলে জানা যায় না। (বিদিশার রাজা রামগুপ্ত জৈনধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। কিন্তু তিনি গুপ্ত রাজবংশের সন্তান, না স্থানীয় এক রাজা, সে সম্পর্কে পণ্ডিতেরা সহমত নন।) জৈনধর্মের উল্লেখ আছে এমন লেখমালার সংখ্যা এ পর্বে বড় কম। ফা শিয়েনও জৈনধর্মের কোনও উল্লেখ করেননি। কালিদাসের কাব্যে নির্বাণের উল্লেখ আছে, বৌদ্ধ সন্ন্যাসিনীদের কথাও বলা হয়েছে, কিন্তু জৈনদের কোনও উল্লেখ নেই। সম্ভবত সমাজের মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যেই এই ধর্মের আকর্ষণ সীমাবদ্ধ ছিল।

জৈন কেন্দ্ৰসমূহ :

  • প্রথম কুমারগুপ্তের রাজত্বকালীন মথুরা লেখে জনৈক মহিলার জৈন মূর্তি দানের উল্লেখ আছে।
  • প্রথম কুমারগুপ্তের রাজত্বকালীন উদয়গিরি লেখে তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথের একটি মূর্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে।
  • খ্রিস্টীয় ৫ম শতকের মধ্যভাগে উৎকীর্ণ কহৌম লেখে পাঁচজন তীর্থঙ্করের মূর্তি প্রতিষ্ঠার উল্লেখ আছে।
  • তীর্থঙ্করেরা হলেন আদিনাথ, শান্তিনাথ, নেমিনাথ, পার্শ্বনাথ ও মহাবীর। গুপ্ত আমলে তৈরি তিনটি তীর্থঙ্কর মূর্তি বিদিশায় আবিষ্কৃত হয়েছে।

(অনেকে মনে করেন রঘুবংশের ‘প্রায়োপবেশ’ কথাটির মধ্যে জৈনদের অনশনে স্বেচ্ছামৃত্যু বরণের প্রচ্ছন্ন উল্লেখ আছে। প্রায়োপবেশের অর্থ আহার ত্যাগ করে মৃত্যুর প্রতীক্ষায় উপবেশন। এ প্রথা কেবল জৈন সম্প্রদায়ের মধ্যেই প্রচলিত ছিল, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই।) এসব তথ্য থেকে অনুমান করা যায়, মথুরা, উদয়গিরি, বিদিশা, কহৌম প্রভৃতি স্থান জৈনধর্মের কেন্দ্র ছিল।

উত্তর ও পূর্ব বাংলায় জৈনধর্ম : বিহারে জৈনধর্মের তেমন প্রভাব ছিল না। খ্রিস্টীয় ৫ম শতকের শেষার্ধের এক পাহাড়পুর লেখে বট গোহালী নামে স্থানীয় অঞ্চলে একটি জৈন বিহারের কথা বলা হয়েছে। বিহারটির প্রতিষ্ঠাতা গুহনন্দি বারাণসীর অধিবাসী ছিলেন। স্থানীয় এক ব্যক্তি সস্ত্রীক বিহারটির অনুকূলে কিছু জমি দান করেছিলেন। লেখটি উত্তর বাংলার পাহাড়পুর অঞ্চলে জৈনধর্মের প্রসারের ইঙ্গিত বহন করছে। ৭ম শতকের প্রথমার্ধে পুণ্ড্রবর্ধন ও সমতট পরিভ্রমণে এসে চিনা পরিব্রাজক শুয়েন চাঙ সেখানে প্রচুর দিগম্বর সাধু দর্শন করেছিলেন। গুপ্তপর্বে সম্ভবত উত্তর বাংলা ছাড়া সমতট অঞ্চলেও জৈনধর্ম প্রসার লাভ করেছিল।

বলভী সম্মেলন : এ সময় গুজরাতের বলভী নগরে শ্বেতাম্বর জৈন সাধুদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। গুপ্ত রাজারা এই সম্মেলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। এমনকি, যে মৈত্রক রাজগণের রাজ্যে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেই মৈত্রক রাজারাও এ সম্মেলনের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বলে জানা যায় না। সম্মেলনটি খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের প্রথম পাদে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দেবর্ধিগণি সম্মেলনে পৌরোহিত্য করেন। সম্মেলনে অর্ধ মাগধী প্রাকৃতে জৈন শাস্ত্র সংকলিত হয়। তবে দিগম্বর জৈনরা সম্মেলনে সংকলিত শ্বেতাম্বর শাস্ত্রাদির প্রামাণ্য স্বীকার করেন না। তাঁরা মনে করেন, আদি জৈন শাস্ত্র সবই অবলুপ্ত হয়েছে, সেগুলির পুনরুদ্ধার আর সম্ভব নয়।

গুপ্তযুগে সাহিত্য

সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাসে গুপ্তযুগের গুরুত্ব : সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাসে গুপ্তপর এক স্মরণীয় অধ্যায়রূপে চিহ্নিত হয়ে আছে। কালিদাস প্রমুখ কয়েকজন অসাধারণ প্রতিভাবান কথাশিল্পী এ যুগে আবির্ভূত হয়েছিলেন। সংস্কৃত সাহিত্যের অগ্রগতির মূলে তাঁদের অবদান অবিস্মরণীয়। তাছাড়া গুপ্ত রাজারাও সংস্কৃত সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন। লেখ ও মুদ্রায় সংস্কৃত ভাষা ব্যবহার করে সংস্কৃতকে তাঁরা রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দান করেন। অনেকে মনে করেন গুপ্তযুগে সংস্কৃত সাহিত্য নবজন্ম লাভ করেছিল। কিন্তু এ ধারণা সম্ভবত ঠিক নয়। প্রাক্-গুপ্ত পর্বে সংস্কৃত ভাষার যথেষ্ট চর্চা হত, আর সে ভাষা বেশ উন্নতই ছিল। তবে এ পর্বে সংস্কৃত ভাষার আরও উন্নতি ঘটল, সংস্কৃত তার ফুল্ল, কুসুমিত রূপটি নিয়ে দেখা দিল। কাব্য, মহাকাব্য, নাটক, পুরাণ, ধর্মশাস্ত্র, অর্থশাস্ত্র, ব্যাকরণ, অভিধান, দর্শন, গণিত, চিকিৎসাশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা ইত্যাদি সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্র এ সময় সৃষ্টিধর্মী ও কালজয়ী রচনা সম্ভারে সমৃদ্ধ হয়ে উঠল।

মহাকাব্য : এ যুগের লেখমালায় লক্ষ শ্লোকাত্মক মহাভারতের উল্লেখ আছে। অর্থাৎ, মহা ভারতের শ্লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে এ সময় এক লক্ষে দাঁড়ায়। এ থেকে মনে হয়, মহাভারতের সংযোজন ও বিয়োজনের যে প্রক্রিয়াটি দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় ছিল তা এ পর্বে পূর্ণতা লাভ করে এবং মহাকাব্যখানি এ যুগেই তার পরিণত রূপে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু অন্য মহাকাব্যটির ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য নয়। অধ্যাপক উইন্টারনিৎস নানা যুক্তি-তর্ক দিয়ে দেখিয়েছেন, রামায়ণের পরিবর্ধন-পরিবর্জনের কাজটি খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় বা ৩য় শতক নাগাদ সম্পন্ন হয়েছিল।

পুরাণ :

  • পুরাণ সংকলন : পুরাণগুলির সংকলনের কাজেও এ সময় অগ্রগতি দেখা যায়।
    • মার্কণ্ডেয় পুরাণের কয়েকটি অধ্যায়, বিশেষত দেবীমাহাত্ম্য বা চণ্ডী অংশটি এ যুগেই সম্ভবত রচিত হয়েছিল। তবে পুরাণটির এক বিস্তৃত অংশ নিঃসন্দেহে পরবর্তী কালের রচনা।
    • এ সময় বায়ু, ব্রহ্মাণ্ড ও বিষ্ণু-পুরাণের সংকলন কাজ শেষ হয়।
    • ভাগবত, মৎস্য ও কূর্ম-পুরাণের সংকলনের অনেকটা কাজও এ যুগে সম্পন্ন হয়।
    • অন্য পুরাণগুলি গুপ্তোত্তর পর্বের রচনা। এরূপ একটি পুরাণ অগ্নি-পুরাণ। পুরাণখানির রচনাকাল খ্রিস্টীয় ৯ম শতক।
    • পদ্ম-পুরাণ খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ হতে ১৪শ শতকের মধ্যবর্তী সময় রচিত হয়েছিল বলে মনে হয়।
    • ব্রহ্ম-পুরাণে পুরীর জগন্নাথ মন্দির ও কোণার্কের সূর্য মন্দিরের উল্লেখ আছে। সূর্য মন্দিরটি ১২৪১ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়েছিল। এ থেকে বোঝা যায়, ১৩শ শতকেরও পরের রচনা এই ব্রহ্ম-পুরাণ।
    • স্কন্দ-পুরাণে আছে ভুবনেশ্বরের লিঙ্গরাজ মন্দির ও পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের কথা। এ পুরাণটিও প্রায় একই সময় রচিত হয়েছিল বলে মনে হয়।
  • দেবতার প্রাধান্য অনুসারে তিন ভাগ : দেবতার প্রাধান্য অনুসারে পুরাণগুলিকে রাজস, সাত্ত্বিক ও তামস – এই তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়।
    • রাজস শ্রেণির পুরাণগুলিতে ব্রহ্মার প্রাধান্য স্বীকৃত হয়েছে। ব্রহ্ম, ব্রহ্মাণ্ড, ব্রহ্মবৈবর্ত, মার্কণ্ডেয়, ভবিষ্য ও বামন রাজসজাতীয় পুরাণ।
    • সাত্ত্বিক বা বৈষ্ণব পুরাণসমূহে বিষ্ণুর মাহাত্ম্য কীর্তন করা হয়েছে। ভাগবত, নারদীয়, গরুড়, পদ্ম, বরাহ ও বিষ্ণু এই শ্রেণির পুরাণের অন্তর্ভুক্ত।
    • শিব, লিঙ্গ, স্কন্দ, অগ্নি, মৎস্য ও কূর্ম তামসশ্রেণির পুরাণ। এদের শৈব পুরাণও বলে। শিবের মাহাত্ম্য প্রচারই এদের মুখ্য উদ্দেশ্য।
  • পুরাণের আদি আকার : বর্তমানে আমরা পুরাণগুলিকে যে রূপে, যে আকারে পাই, আদিতে পুরাণগুলির সে রূপ, সে আকার ছিল না। একটু ভেবে দেখলেই বিষয়টি বোঝা যাবে।
    • বিষ্ণু, বায়ু, মৎস্য ইত্যাদি কয়েকটি পুরাণে পুরাণ সাহিত্যের পাঁচটি বিশেষ লক্ষণের কথা বলা হয়েছে। সর্গ (সৃষ্টি), প্রতিসর্গ (প্রলয়ের পর নতুন সৃষ্টি), বংশ (দেবতা ও ঋষিদের বংশাবলি), মন্বন্তর (মনুদের রাজত্বকাল) এবং বংশানু-চরিত (রাজবংশাবলি) – এই হল সেই পাঁচটি বিশেষ লক্ষণ। বর্তমানে আমরা যে পুরাণগুলি পাই, তাতে কিন্তু এই পাঁচ লক্ষণের যথাযথ অনুসরণ দেখা যায় না। পুরাণগুলিতে যেসব বিষয় আলোচিত হয়েছে সেগুলি যেমন ব্যাপক, তেমনি বৈচিত্র্যপূর্ণ। ভূগোল, জ্যোতিষ, শারীরবিদ্যা, ব্যাকরণ, দর্শন, অলংকার, ছন্দ, বাস্তুবিদ্যা, সংগীত, চিকিৎসাশাস্ত্র, অস্ত্রবিদ্যা, শ্রাঙ্ককল্প, দানধর্মবিধি, বর্ণাশ্রমব্যবস্থা, দেবতাপ্রতিষ্ঠা, জাতকর্ম, কিনা পুরাণগুলিতে আলোচিত হয়নি।
    • দ্বিতীয়ত, এক একটি পুরাণে এক এক দেবতাবাদ প্রচারিত হয়েছে। অথচ পুরাণ সাহিত্যের যে পাঁচটি লক্ষণের কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে এই গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য অনুচ্চারিত থেকে গেছে।
    • তৃতীয়ত, প্রচলিত পুরাণসমূহের সিংহভাগ জুড়ে রয়েছে দেবমন্দির, নদ নদী, তীর্থস্থান, দান ও অতিথিসেবার বর্ণনা। অথচ এসব বৈশিষ্ট্য পুরাণ সাহিত্যের মৌল লক্ষণের মধ্যে অনুক্ত থেকে গেছে।
  • পুরাণের আদি রূপ : দেখা যাচ্ছে, প্রচলিত পুরাণসমূহে মৌল বিষয়গুলি ছাড়া আরও অনেক জিনিসের আলোচনা আছে। বিষয়বস্তুতে প্রচলিত পুরাণগুলি অনেক ব্যাপক, অনেক বৈচিত্র্যপূর্ণ। স্পষ্ট বোঝা যায়, এক একটি পুরাণের এক একটি আদি বা মূল রূপ ছিল। একদা প্রচলিত সেই আদি বা মূল পুরাণগুলি যুগধর্ম অনুসারে সংযোজিত ও বিয়োজিত হতে হতে প্রচলিত পুরাণসমূহের রূপ লাভ করেছে। আবার এমনও হতে পারে, মূল পুরাণগুলি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে, প্রচলিত পুরাণসমূহ নতুন করে সংকলিত হয়েছে। মূল পুরাণগুলি রচিত হয়েছিল গুপ্তযুগের অনেক পূর্বে, সেই সুদূর প্রাক্-খ্রিস্টীয় পর্বে। আপস্তম্ব ও গৌতম তাঁদের ধর্মসূত্র গ্রন্থে পুরাণের উল্লেখ করেছেন। এঁদের আবির্ভাবকাল খ্রিস্টপূর্ব ৫ম-৪র্থ শতক। সম্ভবত এর কিছুকাল পূর্বে মূল পুরাণগুলি রচিত হয়েছিল। কেউ কেউ মনে করেন, প্রথমদিকে একটিমাত্র মূল পুরাণ ছিল আর সেই মূল পুরাণটি থেকেই বিভিন্ন পুরাণের উদ্ভব হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ পণ্ডিত এ মত স্বীকার করেন না। পার্জিটার সাহেব মনে করেন, আদি পুরাণগুলি সংস্কৃতে নয়, মাগধী প্রাকৃতে রচিত হয়েছিল। এ সিদ্ধান্ত নিছকই কাল্পনিক।
  • রচয়িতা বা কথক : বেশির ভাগ পুরাণে মৃত লোমহর্ষণ বা তাঁর পুত্র উগ্রশ্রবাকে পুরাণকাহিনির কথক বা প্রবক্তা রূপে দেখানো হয়েছে। এ থেকে মনে হয়, প্রথম দিকে সূত বা চারণ কবিরা পুরাণ রচনা ও প্রচারের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। দেবতা, ঋষি, রাজা ও লোকোত্তর পুরুষদের বংশাবলি ও কীর্তিকলাপ অবলম্বন করে গাথা রচনা করে তাঁরা জনসমাজে তা প্রচার করতেন। প্রচারের সময় তাঁরা শ্রোতাদের রুচির দিকে লক্ষ রাখতেন এবং প্রয়োজন মতো পুরোনো কাহিনিটিকে কল্পনার রঙে রাঙিয়ে নতুন রূপে পরিবেশন করতেন। ধীরে ধীরে সূত বা চারণকবিদের কর্তৃত্ব থেকে পুরাণের রচনা ও প্রচারের ভার চলে যায় দেবমন্দিরের ব্রাহ্মণ পুরোহিত সম্প্রদায়ের হাতে। নিজেদের সামাজিক প্রতিষ্ঠা বৃদ্ধি ও জীবিকা নির্বাহের পথ সুগম করার উদ্দেশ্যে তাঁরা পুরাণে ধর্মীয় উপাদান সন্নিবেশ করেন। ফলে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, যাগ-যজ্ঞ, শ্রাদ্ধকর, বর্ণাশ্রম ধর্ম, দেবদেবীর মাহাত্ম্য বর্ণনা ইত্যাদি বিষয় সহজেই পৌরাণিক বিষয়সূচির অন্তর্ভুক্ত হয়। এই পুরোহিত সম্প্রদায় উচ্চশিক্ষিত ছিলেন না। তাঁদের হাতে পড়ে পুরাণের ভাষা দুর্বল হয়েছে, ছন্দ ব্যাহত হয়েছে, ব্যাকরণগত অশুদ্ধি দেখা দিয়েছে এবং বর্ণনায় অতিশয়োক্তি দৃষ্টিকটুভাবে প্রকাশ পেয়েছে। দেবমন্দিরের পুরোহিত সম্প্রদায় পুরাণ রচনার সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ায় বিশেষ বিশেষ পুরাণে বিশেষ বিশেষ স্থান বা বিশেষ বিশেষ দেবদেবীর গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে। ব্রহ্ম-পুরাণে ওড়িশার, পদ্ম-পুরাণে পুষ্করের, অগ্নি-পুরাণে গয়ার, বরাহ-পুরাণে মথুরার, বামনে থানেশ্বরের, কুর্মে বারাণসীর ও মৎস্যে নর্মদা অববাহিকার মাহাত্ম্য প্রচারিত হয়েছে। বৈদিক পরম্পরা ও যুগধর্মের মধ্যে সমন্বয় প্রয়াস পুরাণ সাহিত্যকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে। এখানে বৈদিক যাগ-যজ্ঞ ও বর্ণাশ্রমধর্মের গুরুত্ব যেমন উচ্চারিত হয়েছে তেমনি নদ-নদী, মন্দির, তীর্থস্থান, দানধর্ম অতিথিসেবার মাহাত্ম্যও কীর্তিত ব্যয়বহুল বলে বৈদিক যাগ-যজ্ঞকে যেমন বাতিল হয়নি তেমনি বৈদিক পন্থাকেই ধর্মাচরণের একমাত্র সোপান বলে স্বীকার হয়নি। নদীতে প্রক্রিয়াও সমান ফলপ্রসূ।
  • মহাপুরাণের সংখ্যা : সংখ্যায় বা মহাপুরাণ আঠারোখানি। ব্রহ্মা, পদ্ম, বিষ্ণু, বায়ু (মতান্তরে শিব), ভাগবত, নারদ, মার্কণ্ডেয়, ভবিষ্য বা ভবিষ্যৎ, অগ্নি, ব্রহ্মবৈবর্ত, ব্রহ্মাণ্ড, নিয়ে অষ্টাদশ পুরাণ মহাপুরাণ।

উপপুরাণ : মূল পুরাণগুলির পাশাপাশি আর ধরনের গ্রন্থ রচিত হয়েছিল যাদের উপপুরাণ বা গৌণ পুরাণ লৌকিক দেবদেবী ও ধর্মসম্প্রদায়গুলিকে উপপুরাণগুলি রচিত হয়েছিল। মূল পুরাণগুলির মতো উপপুরাণগুলিও সংখ্যায় আঠারোখানি। বিষ্ণুধর্মোত্তর এরূপ একটি উপপুরাণ। এই উপপুরাণটি কাশ্মীরে রচিত হয়েছিল। দেবদেবী ছাড়া নৃত্য, গীত, চিত্রকলা, ভাস্কর্য ইত্যাদি বিষয় গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। বেরুনি এই থেকে প্রচুর উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন। বৃহদ্ধর্ম-পুরাণ নরসিংহ গ্রন্থ এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। লোকশিক্ষার মাধ্যমরূপে পুরাণ বা উপপুরাণের অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে। বেদের পঠন পাঠন কখনই সমাজের সর্বস্তরে প্রসার লাভ করেনি। শূদ্র ও স্ত্রীলোকদের বেদপাঠে না। ধর্মচর্যায়ও সকলের প্রবেশাধিকার না। পুরাণশ্রবণে ও ধর্মানুষ্ঠানে সকলের সমান অধিকার ব্রাহ্মণ ভেদে অধিকারের তারতম্য ছিল না। পুরাণের ভাষা সহজ গভীর তত্ত্ব হয়েছে করে, আখ্যান-উপাখ্যানের সমাজে জনপ্রিয়তা অর্জন

ধর্মশাস্ত্র : গুপ্তপর্বে কয়েকখানি ধর্মশাস্ত্র রচনার কাজে হাত দেওয়া হয়।

  • এ প্রসঙ্গে কাত্যায়ন ধর্মশাস্ত্র-এর উল্লেখ যায়। গ্রন্থখানি ৪০০ খ্রিস্টাব্দ সময় হয়েছিল।
  • প্রায় একই সময়ের রচনা দেবল-ধর্মশাস্ত্র।
  • ব্যাস-ধর্মশাস্ত্র-এর রচনাপর্ব খ্রিস্টাব্দ থেকে ৫০০ খ্রিস্টাব্দ।
  • পরাশর-স্মৃতি গ্রন্থখানি সম্ভবত ৫০০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে প্রণীত হয়েছিল।
  • পুলস্ত্য, হারীত ও পিতামহের নামে প্রচলিত ধর্মশাস্ত্রগুলি ৪০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৭০০ সংকলিত হয়েছিল।

ধর্মশাস্ত্রের উপর ভাষ্যরচনার প্রয়াস গুপ্তযুগে বড় একটা দেখা যায় না। গুপ্তোত্তর পর্বের একেবারে গোড়ার দিকে এর সূচনা লক্ষ করা যায়। ভাষ্যরচনার এক পথিকৃৎ অসহায়। তিনি গৌতম, মনু ও নারদ-স্মৃতির টীকা রচনা করেছেন। তিনি সম্ভবত খ্রিস্টীয় ৭ম শতকে হয়েছিলেন।

কামসূত্র : বাৎস্যায়নের কামসূত্র গুপ্তপর্বে না পূর্ববর্তী কোনও এক সময় রচিত হয়েছিল সে পণ্ডিত মহলে বাগ্-বিতণ্ডার অন্ত নেই। ধনী ও সম্প্রদায়ের ভোগৈশ্বর্যময় জীবনের ছবি আঁকা হয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, লেখক এ গ্রন্থে অবাধ কামের কথা বলেননি, তিনি মানুষের জীবনে সংযম ও শৃঙ্খলার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি বলেছেন, ধর্ম, অর্থ ও কাম, এই তিন প্রবৃত্তির মধ্যে ধর্ম উত্তম, অর্থ মধ্যম ও কাম অধম। তাঁর গ্রন্থ লোককে জিতেন্দ্রিয় হতে প্রেরণা জোগাবে, এই আশা ব্যক্ত করেছেন বাৎস্যায়ন। অস্য শাস্ত্রসা তত্ত্বজ্ঞো ভবত্যেব জিতেন্দ্রিয়ঃ, এ উক্তি বাৎস্যায়নের। যশোধর ১৩শ শতকে কামসূত্রের উপর একখানি সুন্দর টীকাগ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থখানির নাম জয়মঙ্গলা।

কামন্দকীয় নীতিসার : কামন্দকের কাল সম্পর্কে পণ্ডিতরা সহমত নন। মহাভারতের শান্তি পর্বে কামন্দকের উল্লেখ আছে। এ থেকে মনে হয়, মহাভারতের সংকলন-কাজ শেষ হওয়ার পূর্বে কামন্দক আবির্ভূত হয়েছিলেন। ফলে গুপ্তযুগের প্রথম পর্বে তিনি জন্মেছিলেন, এমন অভিমতই সংগত বোধ হয়। কাশীপ্রসাদ জায়সওয়াল এ মত সমর্থন করেন। কামন্দক ৭ম-৮ম শতকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, এমন অভিমতও ব্যক্ত হয়েছে। তাঁর লেখা গ্রন্থখানি কামন্দকীয় নীতিসার নামে খ্যাত। গ্রন্থখানি কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রের অনুকরণে রচিত। রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থা এই গ্রন্থের বিষয়বস্তু। গ্রন্থটির ২০টি সর্গ। সাধারণত এক একটি সর্গ আবার কয়েকটি প্রকরণে বিভক্ত। কখনওবা এক একটি সর্গ নিয়ে এক একটি প্রকরণ। ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপে গ্রন্থখানি এক সময় বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।

কালিদাস : নিজের সম্পর্কে কবিশ্রেষ্ঠ কালিদাস আশ্চর্যরকম উদাসীন ছিলেন। কোনও কাব্যে বা নাটকে নিজের পিতৃপরিচয়, জন্মস্থান বা কাল সম্পর্কে কোনও ইঙ্গিত তিনি রেখে যাননি। ফলে তাঁকে কেন্দ্র করে সত্যমিথ্যা নানা কাহিনি সৃষ্টি হয়েছে।

  • কালিদাসের সময়কাল : তাঁর কাল সম্পর্কেও পণ্ডিত মহলে নানা বিতর্ক দেখা দিয়েছে। কালিদাস খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকে শুঙ্গ রাজাদের রাজত্বকালে আবির্ভূত হয়েছিলেন, মহা কবির কাল সম্পর্কে এরূপ এক অভিমত আছে। এ মতের সপক্ষে কয়েকটি যুক্তি আছে –
    • প্রথমত, শুঙ্গরাজ অগ্নিমিত্র কালিদাসের মালবিকাগ্নিমিত্রম্ নাটকের নায়ক। এ নাটকে শুঙ্গযুগের সমাজ জীবন ও শুঙ্গ রাজ-অন্তঃপুরের কাহিনি প্রতিফলিত হয়েছে।
    • দ্বিতীয়ত, এলাহাবাদের নিকটবর্তী ভিটায় শুঙ্গযুগের এক বৃত্তাকার ফলক আবিষ্কৃত হয়েছে। ফলকটিতে রাজা দুষ্মন্তের কণ্বের আশ্রমে প্রবেশ, ঋষিকন্যাদের আলবালে জলসেচন ইত্যাদি অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ নাটকের প্রথম অঙ্কের কয়েকটি দৃশ্য চিত্রায়িত হয়েছে।
    • তৃতীয়ত, মালবিকাগ্নিমিত্রম্ নাটকের শেষে ভরতবাক্যে (প্রধান অভিনেতার মুখে নাটকের সমাপ্তিসূচক ঘোষণা) কবি ‘অগ্নিমিত্রে’ এই ভাবে সপ্তমী পদ প্রয়োগ করেছেন। এ থেকে মনে হয়, নাটকটি রচনাকালে অগ্নিমিত্র জীবিত ছিলেন।

স্বীকার করতে হবে, যুক্তিগুলির কোনওটিই অকাট্য নয়। কালিদাস অগ্নিমিত্রের উপর নাটক লিখেছেন ঠিকই, কিন্তু তাতে প্রমাণিত হয় না যে তিনি অগ্নিমিত্রের সমকালীন ছিলেন। অতীত দিনের কাহিনি নিয়ে বহু কবি ও নাট্যকারই কাব্য ও নাটক রচনা করেছেন। ভিটার ফলকে উৎকীর্ণ নারীপুরুষেরা অভিজ্ঞানশকুন্তলম্-এর পাত্র-পাত্রী, এ কথা অনেকেই স্বীকার করেন না। আর অগ্নিমিত্রে কথাটি নাট্যকার নিজের মুখে বসাননি, বসিয়েছেন তাঁর নাটকের প্রধান অভিনেতার মুখে। অভিনেতা যখন অতীত দিনের কোনও ঘটনা মঞ্চস্থ করেন, তখন সে ঘটনা যেন তখনই ঘটছে, এমন এক অনুভূতি তিনি সঞ্চার করেন। দর্শকদের কাছে নাটকের বিষয়বস্তুকে সময়োপযোগী করে পরিবেশন করতে গিয়ে অভিনেতা অগ্নিমিত্র কথাটিকে ভাবে সপ্তমীরূপে ব্যবহার করেছেন। স্বয়ং রাজার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তিনি আশা প্রকাশ করছেন, যতদিন অগ্নিমিত্র রাজত্ব করবেন (গোপ্তরি অগ্নিমিত্রে) ততদিন প্রজাদের চিন্তা নেই। ফলে ‘অগ্নিমিত্রে’ কথাটিকে কালিদাস ও অগ্নিমিত্রের সমকালীনত্ব অর্থে ব্যাখ্যা করা যায় না। কালিদাস খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকে আবির্ভূত হয়েছিলেন, উইলিয়াম জোনস, রায়বাহাদুর সি. ভি. বৈদ্য ও ক্ষেত্রেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ পণ্ডিতেরা এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এ অভিমতের মূলে রয়েছে বহুল প্রচলিত এক জনশ্রুতি। জনশ্রুতি বলছে, কালিদাস উজ্জয়িনীর বিখ্যাত রাজা শকারি বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভার এক রত্ন ছিলেন। (নবরত্ন সভার প্রাচীনতম উল্লেখ পাওয়া যায় খ্রিস্টীয় ১৬শ শতকে রচিত ‘জ্যোতির্বিদ্যাভরণ’ গ্রন্থে। নবরত্নরা হলেন ধাশুরি, রূপণক, অমরসিংহ, শম্ভু, বেতালভট, ঘটকর্নর, কালিদাস, বরাহমিহির ও বররুচি। জ্যোতির্বিদ্যাভরণের শ্লোকটি নিম্নরূপ : “ধন্বন্তরি-ক্ষপণক-অমরসিংহ-শঙ্কু-বেতালভট্ট- ঘটকর্পর-কালিদাসাঃ। / খ্যাতো বরাহমিহিরো নৃপতেঃ সভায়াং রত্নানি বৈ বররুচিনব বিক্রমস্য।।”) জনশ্রুতি আরও বলছে, রাজা বিক্রমাদিত্য শকদের পরাজিত করে ৫৭-৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বিক্রম সংবৎ প্রতিষ্ঠা করেন। বহুল প্রচলিত হলে কি হবে, জনশ্রুতিটির ভিত্তি বড়ই দুর্বল –

    • প্রথমত, বিক্রমাদিত্য কোনও রাজার নাম নয়, অভিধামাত্র। প্রাচীন ভারতের বহু রাজা এই অভিধা গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের কেউই খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকে উজ্জয়িনীতে রাজত্ব করেননি।
    • দ্বিতীয়ত, খ্রিস্টপূর্ব ৫৭-৮ অব্দ থেকে প্রচলিত সংবৎ আদিতে ‘কৃত’ নামে পরিচিত ছিল, ‘বিক্রম’ নামে পরিচিত ছিল না। পরবর্তী কালে জনৈক বিক্রমাদিত্যের সঙ্গে জড়িত হয়ে এ সংবৎ বিক্রম সংবৎ নামে পরিচিত হয়।
    • তৃতীয়ত, যে নবরত্নদের কথা বলা হয় তাঁদের একজনও খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকের লোক নন। তাঁরা সকলে সমকালীনও ছিলেন না। বরাহমিহির খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকে আবির্ভূত হয়েছিলেন। আর এক রত্ন অমরসিংহ সম্ভবত গুপ্তযুগে জন্মেছিলেন।

ল্যাসেন, উইলফোর্ড, জেমস প্রিনসেপ, ম্যাকডোনেল, কীথ, ভিনসেন্ট স্মিথ, ভগবৎশরণ উপাধ্যায় প্রমুখ প্রখ্যাত ভারততত্ত্ববিদরা মনে করেন কালিদাস গুপ্তযুগে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁদের অভিমত, মহাকবি গুপ্তসম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত (খ্রিস্টাব্দ ৩৭৬-৪১৫) ও তাঁর পুত্র প্রথম কুমারগুপ্তের (খ্রিস্টাব্দ ৪১৫-৫৬) সমকালীন ছিলেন। এ মতের সমর্থনে যুক্তিগুলি নিম্নরূপ –

    • এক. কলিদাসের কাব্যে ও নাটকে যে অপার শাস্তি ও আনন্দধারা প্রবাহিত তা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ও প্রথম কুমারগুপ্তের রাজত্বের ঐশ্বর্যমণ্ডিত দিনগুলির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।
    • দুই. ৪৭৩ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ, কবি বৎসভট্টির লেখা মন্দসোর লেখের কয়েকটি শ্লোকে কালিদাসের মেঘদূত ও ঋতুসংহার কাব্যের ছায়া পড়েছে। অর্থাৎ লেখটি রচনাকালে বৎসভট্টি কালিদাসকে অনুকরণ করেছেন। তাহলে কালিদাস বৎসভট্টির পূর্ববর্তী, এ ধারণাই যুক্তিযুক্ত বোধ হয়।
    • তিন. জনশ্রুতি অনুসারে কালিদাস রাজা বিক্রমাদিত্যের সভার নবরত্নের এক রত্ন ছিলেন। রাজা বিক্রমাদিত্য শকদের পরাজিত করেছিলেন। উজ্জয়িনী ছিল তাঁর রাজধানী। গুপ্তরাজ দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য উপাধি ধারণ করেছিলেন। পশ্চিম ভারতের শক রাজাদের তিনি পরাজিত করেছিলেন। উজ্জয়িনীতে তিনি দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। জনশ্রুতি-বিশ্রুত কালিদাসের পৃষ্ঠপোষক উজ্জয়িনীরাজ শকারি বিক্রমাদিত্য এবং গুপ্তসম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য এক ও অভিন্ন ব্যক্তি ছিলেন এমন ধারণাই এ ক্ষেত্রে যুক্তিগ্রাহ্য মনে হয়।
    • চার. কালিদাসের কাব্যে ও নাটকে গুপ্ত রাজাদের প্রচ্ছন্ন উল্লেখ আছে। ‘আসমুদ্রক্ষিতীশানাং’ বর্ণনায় সমুদ্রগুপ্তের সসাগরা রাজ্যের প্রতি ইঙ্গিত আছে। রঘুবংশে রঘুর দিগ্বিজয়ে এবং মাল বিকাগ্নিমিত্রম্ নাটকে পুষ্যমিত্রের অশ্বমেধ যজ্ঞে সমুদ্রগুপ্তের কীর্তিকলাপের প্রতিচ্ছায়া আছে। কুমারসম্ভব নামকরণের মধ্যে প্রথম কুমারগুপ্তের জন্মের প্রচ্ছন্ন উল্লেখ আছে। বিক্রমোরশী নাটকের নামটির সঙ্গে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের নামের অবিচ্ছেদ্য যোগ রয়েছে। রঘুবংশে ‘কুমারকল্পং সুষুবে কুমারং’ বর্ণনায় প্রথম কুমারগুপ্তের জন্মের ইঙ্গিত আছে।
    • পাঁচ. রঘুবংশের চতুর্থ সর্গে রঘুর দিগ্বিজয় প্রসঙ্গে কালিদাস তৃণদের উল্লেখ করেছেন। হুণরা তখন বঙ্কু বা অকসাস নদীর তীরে অবস্থান করছিলেন। ঘটনাকাল সম্ভবত চন্দ্রগুপ্ত-কুমার গুপ্তের রাজত্বকাল।

কার্ন, ম্যাকসম্যুলার, ভাওদাজি, মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রামকৃষ্ণ গোবিন্দ ভাণ্ডারকর প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ববিদরাও কালিদাসকে গুপ্তযুগে ধার্য করেছেন কিন্তু তাঁরা মনে করেন, কালিদাস দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত-কুমারগুপ্তের সময় নয়, খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁরা বলেন, কালিদাস ও বরাহমিহির সমকালীন ছিলেন। ৫০৯ শকাব্দে বা ৫৮৭ খ্রিস্টাব্দে বরাহমিহির লোকান্তরিত হন। সুতরাং কালিদাসও খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকে আবির্ভূত হয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, মেঘদূতের পূর্বমেঘে দিনাগ ও নিচুল নামে কালিদাসের দু’জন সমকালীন সাহিত্যিকের প্রচ্ছন্ন উল্লেখ আছে। এঁরা খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকে জন্মেছিলেন। কিন্তু খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকে উত্তর ভারতের রাজনৈতিক ও আর্থিক অবস্থা খুব একটা সন্তোষ জনক ছিল না। সারা অঞ্চল জুড়ে তখন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অস্থিরতা চলছিল, শিল্পে ও বাণিজ্যে মন্দা দেখা দিয়েছিল। সমৃদ্ধি ও শান্তির বাতাবরণ তখন অদৃশ্যপ্রায়। কালিদাসের কাব্যে ও নাটকে যে সমৃদ্ধি ও আনন্দের সুর ধ্বনিত হয়েছে, খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের বাস্তব চিত্রের সঙ্গে তার সংগতি নেই। তাছাড়া রঘুবংশ থেকে জানা যায়, হূণরা তখনও ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেননি। কিন্তু ৬ষ্ঠ শতকে হুণরা ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছেন, রাজ্যও স্থাপন করেছেন। ফলে গুপ্তযুগের শেষের দিকে নয়, খ্রিস্টীয় ৪র্থ-৫ম শতকেই কালিদাস আবির্ভূত হয়েছিলেন, এরূপ ধারণা বর্তমানে যুক্তিগ্রাহ্য মনে হচ্ছে।

  • কালীদাসের রচনাসমগ্র : 
    • ঋতুসংহার : কবির প্রথম জীবনের রচনা ঋতুসংহার। ছয় সর্গের এ কাব্যের বিষয় ঋতুচক্র। কিন্তু ষড়ঋতুর নিছক বর্ণনাই কবির মূল লক্ষ্য নয়। এক একটি ঋতুর আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতিলোকে ও মানুষের মনোরাজ্যে যে ভাববৈচিত্র্য সৃষ্টি হয়, তার বর্ণনাই এ কাব্যে প্রাধান্য পেয়েছে। এখানেই ঋতুসংহার কাব্যের সৌন্দর্য। বিষয় বর্ণনায় কবির মুনশিয়ানা পরিস্ফুট। অযথা বাগ্‌বিস্তার নেই, স্বল্পভাষী কবির বর্ণনা চিত্রকল্প, হৃদয়স্পর্শী। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের নিবিড় সম্পর্ক প্রতিফলিত হয়েছে কালিদাসের এ কাব্যে। তবে ঋতুসংহারে কবির কাব্যপ্রতিভার পূর্ণ বিকাশ দেখা যায় না। ছন্দদোষ ও যতিপতন কাব্যের সুষমা অনেকখানি ব্যাহত করেছে। মল্লিনাথ কালিদাসের অন্য কাব্যের টীকা রচনা করলেও ঋতুসংহারের উপর কোনও ভাষ্য লেখেননি। ফলে অনেকেরই মনে সংশয় জেগেছে কালিদাসই কি ঋতুসংহার রচনা করেছেন না অন্য কোনও কবি এ কাব্যের রচয়িতা? কিন্তু ঋতুসংহারকে কালিদাসের রচনাবলি থেকে বাদ দিলে মহাকবির যশ অনেকখানি ম্লান হয়ে পড়ে।
    • মেঘদূতম্ : কালিদাসের আর এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টি ‘মেঘদূতম্’। গীতি কবিতা ও মহাকাব্যের অপূর্ব। সংমিশ্রণ ঘটেছে এ কাব্যে। ১১৮টি শ্লোকের এ কাব্যটি আগাগোড়া মন্দাক্রান্তা ছন্দে রচিত। এক যক্ষের বিরহ-বেদনা ও মিলন-কামনাই এ কাব্যের বিষয়। কর্তব্যে শৈথিল্য প্রকাশ করায় যক্ষ তার প্রভু কুবেরের আদেশে এক বছরের জন্য অলকাপুরী থেকে রামগিরি পাহাড়ে নির্বাসিত হয়। যক্ষপ্রিয়া অলকাপুরীতেই থেকে যায়। আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে’ আকাশে মেঘ দেখা দিলে যক্ষের মন অলকাবাসী প্রিয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। চেতন-অচেতন বিস্তৃত হয়ে যক্ষ মেঘকেই দূত নির্বাচন করে অলকাপুরীতে প্রিয়তমার কাছে বার্তা পাঠাতে চায়। মেঘদূতের দু’টি পর্ব, পূর্বমেঘ ও উত্তরমেঘ। রামগিরি থেকে অলকাপুরী পর্যন্ত সুদীর্ঘ পথের বর্ণনার মধ্য দিয়ে পূর্বমেঘের পরিসমাপ্তি। অলকাপুরী ও ‘তন্বী, শ্যামা, শিখরদশনা’ যক্ষপ্রিয়ার বর্ণনা দিয়ে উত্তরমেঘ শেষ হয়েছে। হয়তো সীতার বিরহে শ্রীরামচন্দ্রের দুঃখানুভূতির প্রতিচ্ছায়া এ কাব্যে প্রতিবিম্বিত হয়েছে। সংক্ষিপ্ত অথচ মনোগ্রাহী প্রকাশভঙ্গি, হৃদয়ঢালা ভাবাবেগ ও কল্পনাশক্তির প্রাচুর্য কাব্যটিকে শ্রীমণ্ডিত করেছে।
    • মালবিকাগ্নিমিত্রম্ : মালবিকার সঙ্গে রাজা অগ্নিমিত্রের প্রণয় কাহিনি নিয়েই কালিদাসের পাঁচ অঙ্কের নাটক ‘মালবিকাগ্নিমিত্রম্’। মালবিকা অগ্নিমিত্রের অন্তঃপুরের পরিচারিকা। অসামান্য রূপবতী এই পরি চারিকাকে রানি সব সময় রাজার চোখের আড়ালে রাখেন। কিন্তু মালবিকা রাজার নজরে পড়ে গেলেন এবং তাঁরা দু’জনে পরস্পরের প্রতি আসক্ত হলেন। কিন্তু একজন সামান্য পরিচারিকার সঙ্গে রাজার বিয়ে হয় কী করে? শেষে জানা গেল, মালবিকা বিদর্ভরাজ মাধবসেনের বোন। ভাগ্যের পরিহাসে দস্যুদের হাতে পড়ে তিনি পরিচারিকা হয়েছেন। ফলে উভয়ের মিলনের যে বাধা ছিল তা দূর হল। মালবিকা অগ্নিমিত্রের রানি হলেন। এই নাটকের প্রস্তাবনায় কালিদাস বলেছেন, ভাস, সৌমিল্ল এবং কবিপুত্রের মতো নাট্যকার থাকতে তাঁর নাটক রচনার চেষ্টা ধৃষ্টতা মাত্র। কালিদাসের এ বিনয় আমাদের অভিভূত করে।
    • বিক্রমোবশী : কালিদাসের আর একখানি পঞ্চাঙ্ক নাটক বিক্রমোবশী। রাজা পুরুরবার সঙ্গে স্বর্গের অপ্সরা উর্বশীর প্রণয় এ নাটকের বিষয়বস্তু।
    • অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ : ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম্’ নিঃসন্দেহে কালিদাসের সর্বশ্রেষ্ঠ নাটক। রাজা দুষ্মন্ত ও ঋষিকন্যা শকুন্তলার পরিণয় এ নাটকের উপজীব্য বিষয়। রাজা দুষ্মন্ত মৃগয়া উপলক্ষে মহর্ষি কণ্ঠের আশ্রমে প্রবেশ করেন। সেখানে মহর্ষির পালিতাকন্যা শকুন্তলাকে দেখে রাজা মুগ্ধ হন। কণ্ঠ তখন আশ্রমে অনুপস্থিত ছিলেন। রাজা শকুন্তলাকে গান্ধর্ব রীতিতে বিবাহ করে অভিজ্ঞানস্বরূপ তাঁকে একটি আংটি উপহার দিয়ে রাজধানীতে ফিরে আসেন। পরে কগ আশ্রমে ফিরে এলে শকুন্তলা পতিগৃহ অভিমুখে যাত্রা করেন। পথে শকুন্তলা আংটিটি হারিয়ে ফেলেন। রাজদরবারে পৌঁছে তিনি রাজাকে কোনও প্রমাণ দিতে পারলেন না। রাজা শকুন্তলাকে চিনতে না পেরে প্রত্যাখ্যান করলেন। এদিকে আংটিটিকে এক মৎস্য উদরস্থ করে এবং পরে সেটি বহুলোকের হাত ঘুরে শেষপর্যন্ত রাজার কাছে পৌঁছয়। রাজার তৎক্ষণাৎ শকুন্তলার কথা মনে পড়ে যায়। তিনি মর্মাহত হলেন। শেষে হেমকূটে কশ্যপ মুনির আশ্রমে শকুন্তলা ও পুত্র ভরতের সঙ্গে দুষ্মন্তের মিলন হল। নাটকের চতুর্থ অঙ্কে কালিদাস শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রার ছবি এঁকেছেন। শকুন্তলা তাঁর প্রিয়জন ও চিরপরিচিত আশ্রম ছেড়ে পতিগৃহের উদ্দেশ্যে যাত্রা করছেন। তাঁর মন স্বভাবতই বেদনাহত। বেদনাহত তাঁর প্রিয়জনেরাও। আশ্রমের জীবজন্তু ও তরুলতাও যেন দুঃখমণ। শকুন্তলার আসন্ন বিচ্ছেদের আশঙ্কায় তাঁরাও উদ্‌বেলিত, শোকসন্তপ্ত। কন্যার পতিগৃহে যাত্রার সময় পিতৃগৃহে যে করুণ দৃশ্যের অবতারণা হয় তাকে কেন্দ্র করে মানুষ ও প্রকৃতির অন্তরঙ্গতার যে ছবি কালিদাস নাটকের চতুর্থ অঙ্কে এঁকেছেন, তা অনবদ্য। বলা হয় : “কাব্যেষু নাটকং রম্যং তত্র রম্যা শকুন্তলা।/তত্ৰাপি চ চতুর্থোহঙ্ক: যত্ৰ যাতি শকুন্তলা॥” এ কাব্যে কালিদাস দেখিয়েছেন, সংযম, সততা ও নিষ্ঠা না থাকলে প্রেম সার্থক হয় না।
    • কুমারসম্ভবম্ : কালিদাসের আর একখানি কাব্য ‘কুমারসম্ভবম্’। হর-পার্বতীর মিলন এবং তাঁদের সন্তানরূপে দেবসেনাপতি কার্তিকেয় বা কুমারের জন্মগ্রহণ, এই হল এ কাব্যের আখ্যান। কাব্যটিতে সর্বসমেত ১৭টি সর্গ আছে। নবম থেকে সপ্তদশ সর্গে বহুবার যতিপতন ঘটেছে, অর্থহীন অব্যয়ের ব্যবহার হয়েছে, সর্গগুলির কাব্যিক সৌন্দর্য ব্যাহত হয়েছে। ফলে এ সর্গগুলি কালিদাসেরই রচনা কিনা, সে সম্পর্কে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছেন। গুপ্তরাজ প্রথম কুমারগুপ্তের জন্মোপলক্ষে কাব্যখানি রচিত হয়েছিল, এরূপ এক অভিমতও ব্যক্ত হয়েছে।
    • রঘুবংশম্ : নাটকগুলির মধ্যে যেমন অভিজ্ঞানশকুন্তলম্, কাব্যসমূহের মধ্যে তেমনি ‘রঘুবংশম্’। বলতে দ্বিধা নেই, উনিশটি সর্গের রঘুবংশম্ই কালিদাসের সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্য। দিলীপ থেকে আরম্ভ করে অগ্নিবর্ণ পর্যন্ত সূর্যবংশীয় রাজাদের বর্ণনা আছে এ কাব্যে। ষষ্ঠ সর্গে ইন্দুমতীর স্বয়ম্বরের বর্ণনায়, অষ্টম সর্গে ইন্দুমতীর মৃত্যুতে অজের বিলাপের ব্যাখ্যানে বা চতুর্দশ সর্গে সীতার দুঃখের চিত্র অঙ্কনে কবি অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। রামচন্দ্র সীতাকে নির্বাসনে পাঠিয়েছেন। সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে তপশ্চর্যা করে সীতা জীবন শেষ করবেন। তবুও তপশ্চর্যার এই ফলই কামনা করবেন, আবার যখনই তাঁকে জন্ম নিতে হবে, প্রতিবার রামই হবেন তাঁর স্বামী, রাম থেকে তাঁর কখনও বিচ্ছেদ ঘটবে না। (ভূয়ো যথা মে জননাত্তরেঽপি, ত্বমেব ভর্তা, ন চ বিপ্রয়োগঃ। রঘুবংশম, ১৪।) সীতার দুঃখে বৃক্ষ, লতা, ময়ূর, হরিণী সকলেই শোকমগ্ন। কালিদাসের কাছে সমস্ত প্রকৃতিই চৈতন্যময়, অনুভূতিশীল ও সমদুঃখস্বভাব। বর্ণনীয় বিষয়কে সম্প্রসারিত ও সংহত করার দ্বৈধী শক্তির দ্বৈতলীলা কালিদাসের কাব্যে প্রকাশ পেয়েছে। তাছাড়া কালিদাসের কাব্যের ধ্বনি বড়ই গভীর। প্রকাশ্যে যা বলা হয়েছে, আভাসিত হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি।
    • সম্ভাব্য অন্যান্য গ্রন্থ : কখনও কখনও মনে করা হয়, কালিদাস ‘নলোদয়’, ‘শৃঙ্গার তিলক’ ও ‘শৃঙ্গাররসাষ্টক’ নামে কয়েকটি কাব্য এবং ‘শ্রুতবোধ’ নামে একখানি ছন্দশাস্ত্র রচনা করেন। তবে অনেকেই এ গ্রন্থগুলিকে কালিদাসের রচনা বলে স্বীকার করেন না।
  • লেখা থেকে ব্যক্তিজীবন : কালিদাসের লেখা থেকে তাঁর ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে কয়েকটি কথা জানা যায়। রঘুবংশম্-এর প্রারম্ভে তিনি পার্বতী ও পরমেশ্বরকে বন্দনা করেছেন। এ থেকে বোঝা যায়, তিনি শৈব ছিলেন। তিনি সম্ভবত ব্রাহ্মণ ছিলেন। তাঁর কাব্যে, বিশেষ করে মেঘদূতে উজ্জয়িনীর প্রতি আকর্ষণ ফুটে উঠেছে। অনুমান করা যায়, তিনি দীর্ঘদিন উজ্জয়িনীতে বাস করেছেন। ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান তিনি পরিভ্রমণ করেছেন। জনশ্রুতি বলছে, কালিদাস প্রথম জীবনে অতি মূর্খ ছিলেন কিন্তু পরে বাগ্‌দেবী বা কালীর আরাধনা করে অসামান্য কাব্য প্রতিভার অধিকারী হন। শ্রীলঙ্কার রাজা কুমারদাস কালিদাসের বন্ধু ছিলেন এবং সেখানে এক বারবণিতার গৃহে কালিদাস নিহত হন, এরূপ জনশ্রুতিও আছে। এসব জনশ্রুতির বিশেষ কোনও মূল্য নেই।

ভট্টি : এ যুগের একজন শ্রেষ্ঠ কবি ভট্টি। ভট্টিকাব্য বা রাবণবধ কাব্যের রচয়িতারূপে তিনি প্রসিদ্ধি অর্জন করেছেন। ২২টি সর্গের এ কাব্যে দশরথ ও রামচন্দ্রের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। লঙ্কা থেকে সীতাকে উদ্ধার করে রামচন্দ্রের অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন ও তাঁর রাজ্যাভিষেকের মধ্য দিয়ে এ কাব্যের সমাপ্তি ঘটেছে। এই কাব্য রচনার পিছনে একটি সুন্দর কাহিনি আছে। একদিন ভট্টি ছাত্রদের ব্যাকরণ পড়াচ্ছিলেন। এমন সময় সেখান দিয়ে একটি হাতি চলে যায়। ফলে পুরো একটি বছর ব্যাকরণের পঠন-পাঠন বন্ধ থাকে। কিন্তু কাব্য পাঠের উপর সে রকম কোনও নিষেধাজ্ঞা ছিল না। তাই ভট্টি কাব্যের ছলে ছাত্রদের ব্যাকরণ শেখাতে চাইলেন। এই উদ্দেশ্যেই তিনি ভট্টিকাব্য রচনা করেন। কাহিনিটি কতদূর সত্য বলা কঠিন। তবে ভট্টিকাব্য যে মুখ্যত ব্যাকরণ শোখানোর উদ্দেশ্যেই রচিত হয়েছিল তা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই। আর সে কারণেই এ কাব্যের স্থানে স্থানে ভাষা হয়েছে কৃত্রিম, আড়ষ্ট, কখনওবা দুর্বোধ্য। তথাপি ভট্টিকাব্যে এমন অনেক শ্লোক আছে যা কাব্যসৌন্দর্যে সমুজ্জ্বল। শরৎ ঋতুর বর্ণনায় বা ধূর্ত, ব্রাহ্মণবেশী রাবণের চরিত্র অঙ্কনে কবি যে নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন তা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। কবি নিজেই বলেছেন, তিনি রাজা শ্রীধরসেনের বদান্যতায় বলভী নগরে এ কাব্য রচনা করেন। ‘কাব্যমিদং বিহিতং ময়া বলভ্যাং শ্রীধরসেননরেন্দ্র পালিতায়াম্’। কিন্তু শ্রীধরসেন নামে বলভীতে অন্তত চারজন রাজা ছিলেন। তাঁরা ৪৯৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬৪১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। অনুমান করা যায়, ৬ষ্ঠ শতকের প্রারম্ভ থেকে ৭ম শতকের মধ্যভাগ, এরই মধ্যবর্তী সময় ভট্টি আবির্ভূত হয়েছিলেন। কখনও কখনও বলা হয়, ভট্টিকাব্যের ভট্টি, বাক্যপদীয় ও প্রকীর্ণক গ্রন্থ দু’টির লেখক ভর্তৃহরি এবং মন্দসোর লেখের রচয়িতা বৎসভট্টি এক ও অভিন্ন ব্যক্তি। টীকাকার ভরতমল্লিক ভটি ও ভর্তৃহরিকে অভিন্ন ব্যক্তি বলে মনে করেন। যাঁরা ভাট্টি ও ভর্তৃহরিকে একই ব্যক্তি বলে মনে করেন। তাঁদের ধারণা সংস্কৃত ভর্তুশব্দ প্রাকৃত ভাষায় ভটি পদে পরিণত হয়েছে। ভর্তু ভটি হতে পারে কিন্তু ভর্তৃহরি ভট্টি হয় কী করে? বাক্যপদীয় গ্রন্থের রচয়িতা শুধু ভর্তু নন, তিনি ভর্তৃহরি। বিখ্যাত বৈয়াকরণ ভট্টোজি দীক্ষিত তাঁর মনোরমা টীকাগ্রন্থে ভর্তৃহরি ও ভট্টিকে পৃথক লেখকরূপে চিহ্নিত করেছেন। তেমনি ভট্টি ও বৎসভট্টি নাম দু’টিও এক নয়। এঁরা দু’জন স্বতন্ত্র ব্যক্তি ছিলেন।

বিষ্ণুশর্মা : পঞ্চতন্ত্রের লেখক বিষ্ণুশর্মা গুপ্তযুগে আবির্ভূত হয়েছিলেন, অধ্যাপক কীথ এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। প্রমাণ আছে, ৬ষ্ঠ শতকের মধ্যভাগে গ্রন্থখানি পহলবি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। এ থেকে অনুমান করা যায়, গ্রন্থখানি খ্রিস্টীয় ৫ম শতকে রচিত হয়েছিল। কথিত আছে, বিষ্ণুশর্মা দক্ষিণ ভারতের রাজা অমরশক্তির সভাসদ ছিলেন। আরও বলা হয়, অমরশক্তির পুত্রদের সংস্কৃত ভাষা এবং নীতিশিক্ষার উদ্দেশ্যে বিষ্ণুশর্মা এই গ্রন্থটি রচনা করেছেন। কিন্তু অমরশক্তি নামে দক্ষিণ ভারতে তখন আদৌ কোনও রাজা ছিলেন কিনা সে সম্পর্কে কোনও প্রমাণ নেই। বিষ্ণুশর্মা কোনও গুপ্ত রাজার পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন বলেও জানা যায় না।

শূদ্রক : নর্মদা অববাহিকার অস্মক জনপদের অধিবাসী, জাতিতে ব্রাহ্মণ এই নাট্যকারের আবির্ভাব কাল সম্পর্কে এখনও অনিশ্চয়তা রয়েছে। স্টেন কোনো মনে করেন, শূদ্রক খ্রিস্টীয় ৩য় শতকে আবির্ভূত হয়েছিলেন। সাতবাহন বংশের প্রতিষ্ঠাতা সিমুকই শূদ্রক, এ অভিমতও ব্যক্ত হয়েছে। এ অভিমত অনুসারে শূদ্রক খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকের শেষার্ধে আবির্ভূত হয়েছিলেন। শূদ্রক গুপ্তযুগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, এমন মতও প্রচলিত আছে। মৃচ্ছকটিকের চতুর্থ অঙ্কে জ্যোতিষ সম্পর্কিত যেসব তথ্য পরিবেশিত হয়েছে বা নবম অঙ্কে তৎকালীন বিচার ব্যবস্থার যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তা খ্রিস্টীয় ৪র্থ-৫ম শতকে প্রচলিত বিধি-ব্যবস্থার সঙ্গে সুসমঞ্জস।

  • শূদ্রকের লেখা নাটক ‘মৃচ্ছকটিকম্’। মৃৎ ও শকটিকা এই দু’টি শব্দ নিয়ে মৃচ্ছকটিকম্। মৃৎ এর অর্থ মৃত্তিকা, শকটিকার অর্থ ক্ষুদ্র শকট বা ছোট গাড়ি। মাটির তৈরি ছোট গাড়ি বা খেলনা এই অর্থে মৃচ্ছকটিকম্। নাটকখানির দশটি অঙ্ক। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে পালককে পরাজিত করে আর্যক উজ্জয়িনী অধিকার করেছিলেন। এই রাজনৈতিক ঘটনার প্রেক্ষাপটে নাটকখানি রচিত। বণিক চারুদত্ত ও গণিকা বসন্তসেনার প্রণয় নিয়ে নাটকটির মূল ঘটনাস্রোত আবর্তিত হয়েছে। বসন্ত সেনার সহচরী মদনিকা ও শর্বিলক নামে এক ব্রাহ্মণ তস্করের ভালোবাসাকে উপলক্ষ করে ও একটি গৌণ কাহিনি পল্লবিত হয়েছে। শূদ্রকের মৃচ্ছকটিকম্ নাটকে গতানুগতিকতার অনুসরণ নেই, আছে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গির অভিনবত্ব। এ নাটকে রাজ-রাজড়া বা সমাজের বিত্তশালী লোকদের কথা যেমন আছে তেমনি সমাজের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত সম্প্রদায়ের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও ভালোবাসার কথাও বলিষ্ঠতার সঙ্গে উচ্চারিত হয়েছে। পালক, আর্যক বা শকার নন, চারুদত্ত, বসন্তসেনা, মদনিকা ও শর্বিলকই এ নাটকের মূল আকর্ষণ। তৎকালীন সমাজব্যবস্থার তমসাচ্ছন্ন দিকগুলি নাট্যকার সুনিপুণভাবে এ নাটকে তুলে ধরেছেন।
  • শূদ্রক পদ্মপ্রাভূতক নামে একখানি ভাণ বা একাঙ্ক নাটিকাও রচনা করেন। শহরের সর্বস্তরের মানুষকে এ নাটিকায় উপস্থাপনা করে নাট্যকার এক ব্যাপক সমাজচিত্র অঙ্কন করেছেন। হাস্যরস ও বাঙ্গরসের প্রাচুর্যে নাটিকাটি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।

ভারবি : চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর আইহোল লেখে কালিদাসের সঙ্গে ভারবিকেও যশস্বী কবিরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। লেখটি ৬৩৪-৩৫ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ। এ সময় ভারবি কালিদাসের সঙ্গে উল্লিখিত হওয়ার মতো প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছিলেন। সুতরাং আরও কিছুকাল পূর্বে তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন। মোটামুটিভাবে খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ ভারবির আবির্ভাবকাল বলে ধার্য করা যায়। ভারবি কিছুকাল কাঞ্চীর পল্লবরাজ মহেন্দ্রবিক্রমের সভাসদ ছিলেন। ভারবির সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্য ‘কিরাতার্জুনীয়ম্’। দুর্যোধনের কাছে পাশা খেলায় পরাজিত হয়ে পাণ্ডবদের বনবাসে যাত্রা, দ্বৈত ও কাম্যক বনে তাঁদের অবস্থান এবং অবশেষে কিরাতরূপী মহাদেবের কাছ থেকে অর্জুনের পাশুপত অস্ত্রলাভ এ কাব্যের বর্ণনীয় বিষয়। উপমা ব্যবহারে কালিদাস যেমন সিদ্ধহস্ত, সংক্ষিপ্ত অথচ গভীর অর্থবহ পদ রচনায় ভারবি তেমনি নিপুণ। ‘উপমা কালিদাসস্য, ভারবেরর্থগৌরবম্’। কিন্তু পৌরাণিক ও অলৌকিক উপাদানের প্রাচুর্য ভারবির কাব্যের বাস্তবতাকে বহুলাংশে ক্ষুণ্ণ করেছে। শব্দ নিয়ে খেলা করার এক অস্বাভাবিক প্রবৃত্তি তাঁর কাব্যে কৃত্রিম শব্দসজ্জার সৃষ্টি করেছে। ফলে ভাষার স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হয়েছে, ভাষার কৃত্রিমতা অনেক ক্ষেত্রেই পাঠকের কাছে বিরক্তিকর, ক্লান্তিকর বলে মনে হয়। টীকাকার মল্লিনাথ ভারবির কাব্যকে নারকেল ফলের সঙ্গে তুলনা করেছেন। নারিকেলফলসম্মিতং বচো ভারবেঃ’। নারকেল ফল সুমিষ্ট কিন্তু উপরের কঠিন আস্তরণ ভেদ করলে তবেই এই সুমিষ্ট ফলের স্বাদ পাওয়া যায়। তেমনি ভাষার বাহ্য রুক্ষতা অতিক্রম করলেই ভারবির কাব্যের মাধুর্য উপভোগ করা যায়।

দিঙনাগ : তিনি একাধারে কবি ও দার্শনিক। তাঁর জন্ম দক্ষিণ ভারতে, কাঞ্চীর নিকটবর্তী সিংহবক্র গ্রামে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে। ছয় অঙ্কের কুন্দমালা নাটকের তিনিই রচয়িতা। সীতার বনবাস এ নাটকের প্রতিপাদ্য বিষয়। নির্বাসিতা সীতা বাল্মীকির আশ্রমে যাওয়ার সময় ভাগীরথীর নিকট প্রার্থনা করেন, নির্বিঘ্নে পুত্র প্রসব হলে তিনি প্রতিদিন কুন্দফুলের মালা দিয়ে তাঁর পূজা করবেন। নাটকের নাম তাই কুন্দমালা। যে কুশলতার সঙ্গে দিনাগ সীতার চরিত্র অঙ্কন করেছেন তাতে তাঁকে একজন উচ্চশ্রেণির নাট্যকার বলেই মনে হয়। শুধু নাট্যকাররূপে নয়, বৌদ্ধ দার্শনিকরূপেও দিনাগের খ্যাতি ছিল। তিনি প্রথম জীবনে হীনযান মতাবলম্বী ছিলেন। পরবর্তী কালে আচার্য বসুবন্ধুর অনুপ্রেরণায় তিনি মহাযান মত গ্রহণ করেন। বৌদ্ধশাস্ত্রের উপর লেখা তাঁর দু’খানি বিখ্যাত গ্রন্থ প্রমাণসমুচ্চয় ও ন্যায়প্রবেশ। টীকাকার মল্লিনাথ বলেন, মেঘদূতের চতুর্দশ শ্লোকে কালিদাস দিনাগের প্রতি বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করেছেন। মল্লিনাথের এই ব্যাখ্যা সঠিক নাও হতে পারে।

অসঙ্গ : মহাযান বৌদ্ধধর্মের যোগাচার-বিজ্ঞানবাদ প্রশাখার প্রবক্তা অসঙ্গ খ্রিস্টীয় ৫ম শতকে গন্ধারের পুরুষপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তিব্বতি সূত্রে প্রকাশ, তিনি ‘যোগাচার-ভূমিশাস্ত্র’ গ্রন্থখানি রচনা করেন। অনেকে অবশ্য গ্রন্থখানিকে অসঙ্গের গুরু মৈত্রেয়নাথের রচনা বলে মনে করেন। তাঁর লেখা একখানি গ্রন্থ ‘মহাযান-সম্পরিগ্রহ-শাস্ত্র’। গ্রন্থখানি ৬ষ্ঠ শতকে চিনা ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। যোগ অভ্যাসের দ্বারা বোধি লাভ করা যায়, যোগাচার বিজ্ঞানবাদের এই মূল কথা। শোনা যায়, তিনি কিছুদিন নালন্দা মহাবিহারে অধ্যাপনা করেছিলেন।

বসুবন্ধু : আচার্য অসঙ্গের কনিষ্ঠ ভ্রাতা বসুবন্ধু। প্রথম জীবনে তিনি বৈভাষিক মতাবলম্বী ছিলেন কিন্তু শেষজীবনে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার অণুপ্রেরণায় তিনি যোগাচার-বিজ্ঞানবাদে দীক্ষিত হন। তাঁর লেখা গ্রন্থগুলির মধ্যে আছে অভিধর্মকোষ, পরমার্থসপ্ততি, বিংশতিকা, ত্রিংশতিকা, পঞ্চস্কন্ধ-প্রকরণ, ব্যাখ্যাযুক্তি, কর্মসিদ্ধিপ্রকরণ প্রভৃতি গ্রন্থ। তাছাড়া তিনি সদ্ধর্মপুণ্ডরীক, মহাপরিনির্বাণসূত্র, বজ্র ছেদিকা প্রভৃতি মহাযান গ্রন্থগুলির উপর ভাষ্য রচনা করেন।

বুদ্ধঘোষ : এ পর্বের একজন প্রখ্যাত বৌদ্ধ লেখক বুদ্ধঘোষ। তিনি সম্ভবত বোধগয়ার নিকটবর্তী এক গ্রামে কোনও এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। (ধর্মানন্দ কোশাস্ত্রী মনে করেন, দক্ষিণ ভারতের তেলুগু অঞ্চলে বুদ্ধঘোষের জন্ম।) ভিক্ষু রেবত তাঁকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা দেন। আচার্যের নির্দেশে বুদ্ধঘোষ দুষ্প্রাপ্য বৌদ্ধ পুঁথি অধ্যয়নের জন্য শ্রীলঙ্কায় গমন করেন। সে দেশের সুবিখ্যাত মহাবিহারে দীর্ঘকাল অবস্থানের পর তিনি অবশেষে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। বহু পালি গ্রন্থের প্রণেতা তিনি। তাঁর রচিত একখানি গ্রন্থ বিসুদ্ধিমণ (বিশুদ্ধিমার্গ)। তিনটি অধ্যায়ে বিভক্ত এ গ্রন্থে সমগ্র ত্রিপিটক শাস্ত্র বিশ্লেষিত হয়েছে। বক্তব্যের সারল্যে ও স্পষ্টতায় এবং বহু আকর্ষণীয় কাহিনির উপস্থাপনায় গ্রন্থখানি সহজবোধ্য ও সুখপাঠ্য হয়েছে। এ গ্রন্থ বুদ্ধঘোষকে অমরত্ব দান করেছে। তাঁর রচিত আর একখানি টীকাগ্রন্থ সমস্তপাসাদিকা। মূলত বিনয়পিটকের উপর রচিত হলেও এ গ্রন্থে বৌদ্ধধর্মের ইতিবৃত্তও বর্ণিত হয়েছে, মৌর্য নৃপতি অশোকের প্রসঙ্গও উত্থাপিত হয়েছে। তাঁর রচিত অপর তিনখানি গ্রন্থ সুমঙ্গলবিলাসিনী, পপঞ্চসূদনী ও অর্থসালিনী। শেষোক্ত গ্রন্থটি অভিধর্মের ধর্ম্মসংগণির উপর এক ভাষ্যবিশেষ। শ্রীলঙ্কীয় অট্ঠকথার এক মাগধী সংস্করণও তিনি প্রণয়ন করেন। তাঁর লেখায় প্রগাঢ় বৈদগ্ধের পরিচয় আছে কিন্তু অভিনবত্বের তেমন প্রকাশ নেই।

আর্যভট : ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে এই জ্যোতির্বিজ্ঞানী পাটলিপুত্র শহরে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি আর্যভটীয় নামে জ্যোতির্বিদ্যাবিষয়ক একখানি বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেন। ১২১টি শ্লোকে রচিত এই গ্রন্থের চারটি ভাগ – গীতিকাপাদ, গণিতপাদ, কালক্রিয়াপাদ ও গোলপাদ। শেষ তিনটি ভাগকে একসঙ্গে কখনও কখনও আর্যষ্টিশত নামে উল্লেখ করা হয়। এই গ্রন্থে জ্যোতির্বিদ্যা ছাড়া আরও নানা বিষয় আলোচিত হয়েছে। আলোচ্য বিষয়সূচিতে রয়েছে ত্রৈরাশিক পদ্ধতি, ভগ্নাংশ, বর্গমূল, মনমূল, দ্বিঘাত সমীকরণ এবং অনুবৃত্ত ও উৎকেন্দ্রিক বৃত্ত। পৃথিবী স্থির নয়, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে আর একই সঙ্গে আপন কক্ষের উপর আবর্তিত হচ্ছে, এ সত্য কোপারনিকাসের জন্মের প্রায় হাজার বছর পূর্বে তিনি প্রথম এ গ্রন্থে ব্যক্ত করেন। সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের প্রকৃত কারণও তিনি আবিষ্কার করেন। সংখ্যা হিসেবে শূন্যের ব্যবহারের তিনিই পথিকৃৎ। আর্যভটের উদ্ভাবিত শূন্যতত্ত্ব প্রথমে আরব দুনিয়া ও পরবর্তিকালে ইউরোপে প্রচারিত হয়। পৃথিবী চ্যাপ্টা নয়, আয়তাকারও নয়, পৃথিবী গোলাকার, এ তত্ত্বেরও তিনি উদ্ভাবক। আর্যভট তাঁর লেখায় যে অব্দ ব্যবহার করেছেন তা কলি-অব্দ, শকাব্দ নয়। ৩১০২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ হতে কলি যুগের সূচনা হয়েছে, এ অভিমতও তাঁর। আল বেরুনি তাঁর ভারতবৃত্তান্তে বারবার কুসুমপুরের আর্যভটের উল্লেখ করেন। আর্যভটের নামে আর্যসিদ্ধান্ত বলে একখানি গ্রন্থ আছে। কিন্তু এঁরা এক ব্যক্তি নন, দুই স্বতন্ত্র ব্যক্তি। আর্যসিদ্ধান্ত গ্রন্থখানি ৮৭৫ শকাব্দ বা ৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে রচিত হয়। আর্যসিদ্ধান্তের প্রণেতা যিনি তিনি নিঃসন্দেহে দ্বিতীয় আর্যভট।

বরাহমিহির : খ্যাতনামা এই জ্যোতির্বিজ্ঞানী ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবের কাম্পিল্য শহরে এক শাকদ্বীপী মগব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। জীবনের বেশির ভাগ সময় তিনি উজ্জয়িনীতে অতিবাহিত করেন। তাঁর লেখা গ্রন্থগুলির মধ্যে আছে পঞ্চসিদ্ধান্তিকা, বৃহৎসংহিতা, বৃহস্নাতক ও লঘুজাতক। বৃহৎসংহিতা গ্রন্থখানি বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। মানুষের জীবনে গ্রহ নক্ষত্রাদির প্রভাব, ভূগোল, স্থাপত্য, মূর্তিবিদ্যা ও তৎকালীন সমাজ জীবনের নানা দিক এই গ্রন্থে আলোচিত হয়েছে। সম্ভবত ৫৮৭ খ্রিস্টাব্দে বরাহমিহিরের মৃত্যু হয়। বরাহমিহিরের পুত্র পৃথযশও একজন বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ছিলেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর লেখা তাঁর গ্রন্থখানির নাম ষট্‌পঞ্চাশিকা।

অমরসিংহ : বিখ্যাত কোষকার অমরসিংহ সম্ভবত গুপ্তযুগেই আবির্ভূত হয়েছিলেন। কিংবদন্তি মতে, তিনি বিক্রমাদিত্য সভার এক রত্ন ছিলেন। তাঁর লেখা অভিধান-গ্রন্থের নাম নামলিঙ্গানু শাসনম্। গ্রন্থখানি অমরকোষ নামেই সমধিক প্রসিদ্ধ। গ্রন্থের প্রারম্ভে তিনি বুদ্ধদেবের উদ্দেশ্যে প্রণতি জ্ঞাপন করেছেন। তিনি যে ধর্মমতে বৌদ্ধ ছিলেন এতে তা প্রমাণিত হয়। ১২শ শতকে পুরুষোত্তমদেব অমরকোষের একখানি পরিশিষ্ট রচনা করেন। পরিশিষ্টখানি ত্রিকাগুশেষ নামে পরিচিত।

চন্দ্ৰগোমিন : এই বিখ্যাত বৈয়াকরণ সম্ভবত গুপ্তযুগের শেষপর্বে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ভর্তৃহরি তাঁর বাক্যপদীয় গ্রন্থে এবং মল্লিনাথ কালিদাসের মেঘদূতের ২৫তম স্তবকের উপর টিপ্পনী প্রসঙ্গে চন্দ্ৰগোমিনের উল্লেখ করেছেন। খ্রিস্টীয় ৭ম শতকে রচিত কাশিকাবৃত্তিতেও চন্দ্রগোমিনের অনেক সূত্রের উদ্ধৃতি আছে। ৩১০০টি সূত্রে গ্রথিত তাঁর লেখা ব্যাকরণ-গ্রন্থ ছয়টি অধ্যায়ে বিভক্ত। এই ব্যাকরণ-গ্রন্থখানি এক সময় তিব্বত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।

আর্যাশূর : তিনি সংস্কৃত গদ্যে ও পদ্যে জাতকমালা নামে এক বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেন। জাতক ও চর্যাপিটক থেকে ৩৪টি কাহিনি নিয়ে এ গ্রন্থখানি রচিত হয়েছে। গ্রন্থখানি ৪৩৪ খ্রিস্টাব্দে চিনা ভাষায় অনূদিত হয়। আর্যশূর সম্ভবত খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতকে আবির্ভূত হয়েছিলেন।

আরও কয়েকজন সাহিত্যসেবী : এ যুগে আরও কয়েকজন সাহিত্যসেবী জন্মেছিলেন যাঁদের রচনা সম্ভারে সংস্কৃত সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে। এঁদেরই একজন ধীরনাগ। করুণ রসের কবি তিনি। রামায়ণের উত্তরকাণ্ডের ঘটনাবলি অবলম্বন করে ছয় অঙ্কের এক নাটক তিনি রচনা করেন। ঈশ্বরকৃষ্ণসাংখ্যকারিকা নামে সাংখ্য দর্শনের উপর একখানি গ্রন্থ রচনা করেন। ৬ষ্ঠ শতকের মধ্যভাগে তাঁর গ্রন্থখানি চিনা ভাষায় অনূদিত হয়। তিনি খ্রিস্টীয় ৪র্থ-৫ম শতাব্দীতে বর্তমান ছিলেন। এ যুগের একজন বৌদ্ধ গ্রন্থকার আর্যদেব। তাঁর লেখা গ্রন্থখানির নাম চতুঃশতকম্। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরূপ সমালোচনা আছে এ গ্রন্থে। খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের এক সাহিত্যকার দেবার্ধিগণি। বলভীতে বসে তিনি জৈনধর্মের মূল সূত্রগুলি সংকলন করেন। দেবার্ধিগণিরই সমকালীন ছিলেন সিদ্ধসেনগণি। তাঁর লেখা গ্রন্থ তত্ত্বার্থটীকা।

লেখমালা : গুপ্তযুগে সংস্কৃত সাহিত্যের অগ্রগতির স্বাক্ষর বিধৃত আছে সে যুগের লেখমালায়।

  • হরিষেণ রচিত সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ স্তম্ভলেখ : এ প্রসঙ্গে সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ স্তম্ভলেখ সপ্রশংস উল্লেখের দাবি রাখে। এই প্রশক্তি যিনি রচনা করেছেন সেই হরিষেণ ছিলেন সমুদ্রগুপ্তের অধীনস্থ এক পদস্থ রাজপুরুষ। অনেকে বলে থাকেন, হরিষেণ সমুদ্রগুপ্তের সভাকবি ছিলেন। এ ধারণা ঠিক নয়। এলাহাবাদ প্রশস্তিতে এ ধরনের কোনও মন্তব্য নেই। সেখানে সান্ধিবিগ্রহিক, কুমারামাত্য, মহাদণ্ডনায়ক ও খাদাটপাকিক বলে তাঁর পরিচয় দেওয়া হয়েছে। চম্পু কাব্যের আদর্শে এলাহাবাদ প্রশস্তি রচিত। চম্পু কাব্যে গদ্য ও পদ্যের সংমিশ্রণ আছে। এলাহাবাদ প্রশস্তিতেও এই রীতি অনুসৃত হয়েছে। সমুদ্রগুপ্তের দিগ্বিজয় ও গুণ-গরিমা বর্ণনাই এ প্রশস্তির বিষয়বস্তু। কিন্তু রচয়িতার শব্দচয়নে, বাগ্‌বিন্যাসে, বিচিত্র ছন্দের ব্যবহারে ও কল্পনামাধুর্যে নাতিদীর্ঘ এই লেখটি রসোত্তীর্ণ সাহিত্যে উন্নীত হয়েছে। শ্লোক রচনায় হরিষেণ স্রন্ধরা, শার্দূলবিক্রীড়িত, মন্দাক্রান্তা এবং পৃথ্বী ছন্দ ব্যবহার করেছেন। শ্লোকের ভাষা সরল ও সুমিষ্ট। সমুদ্রগুপ্তের রাজপদে মনোনয়নমূলক শ্লোকটি অতি চমৎকার। তুলনায় গদ্যাংশ নিষ্প্রভ।
  • বৎসভট্টির মন্দসোর প্রশস্তি : সাহিত্যিক উৎকর্ষে কবি বৎসভট্টির লেখা মন্দসোর প্রশস্তি আরও আকর্ষণীয়। দশপুর নগরের একটি পুরোনো সূর্যমন্দিরের সংস্কার উপলক্ষে বৎসভট্টি ৪৭৩ খ্রিস্টাব্দে লেখটি রচনা করেন। আর্যা, মালিনী, অনুষ্টুপ, ইন্দ্ৰবজ্রা, উপেন্দ্রবজ্রা, উপজাতি, দ্রুতবিলম্বিত ইত্যাদি বিবিধ ছন্দে স্তবকগুলি রচিত হয়েছে। অনুপ্রাস, উপমা, রূপক ও অলংকারের প্রয়োগে শ্লোকগুলি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। এই লেখের স্থানে স্থানে কালিদাসের ঋতুসংহার ও মেঘদূত কাব্যের প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছে।
  • জুনাগড় শিলালেখ : ৪৫৬ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ জুনাগড় শিলালেখ এই পর্বের লেখসাহিত্যের আর একটি উজ্জ্বল নিদর্শন। স্কন্দগুপ্ত কর্তৃক সুরাষ্ট্রের প্রশাসকের পদে পর্ণদত্তের নিয়োগ এবং পর্ণদত্তের পুত্র চক্র পালিতের তত্ত্বাবধানে সুদর্শন হ্রদের ভগ্ন বাঁধ সংস্কার ও বিষ্ণুমন্দির নির্মাণ এই লেখের উপজীব্য বিষয়। মালিনী, আর্যা, উপজাতি, ইন্দ্ৰবজ্রা, বংশতিলকা প্রভৃতি বিবিধ ছন্দে লেখটি রচিত হয়েছে। ভাব ও শব্দের বিন্যাসে, গুণ ও অলংকারের সমাবেশে কোনও কোনও স্তবক মনোগ্রাহী হয়ে উঠেছে।
  • যশোধর্মার মন্দসোর প্রশস্তি : যশোধর্মার মন্দসোর প্রশস্তি এ পর্বের আর একটি উল্লেখযোগ্য লেখ। সাহিত্য-সৌকর্যে লেখটি বৎসভট্টির রচনার সঙ্গে তুলনীয়। যশোধর্মার রাজ্যবিস্তার সম্পর্কিত স্তবকটি এক কথায় অনবদ্য।

গ্রন্থপঞ্জি

  • জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় পঞ্চোপাসনা (কলকাতা, ১৯৯৪)।
  • নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। ধর্ম ও সংস্কৃতি প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট (কলকাতা, ১৯৯৬); ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস (কলকাতা, ১৯৭৭)।
  • ভাস্কর চট্টোপাধ্যায় ভারতের সংস্কৃতি (কলকাতা, ১৯৯৫)।
  • Banerjea, J N. The Development of Hindu Iconography (New Delhi, 1985).
  • Bhandarkar, DR. Corpus Inscriptionum Indicarum, Vol. III (New Delhi, 1981).
  • Chattopadhyaya, S. The Evolution of The Theistic Sects In Ancient India (Calcutta, 1962).
  • Jash, P. History of Saivism (Calcutta, 1974) History And Evolution of Vaishnavism In Eastern India (Calcutta, 1984).
  • Majumdar, R. C (Ed): The Classical Age (Bombay, 1962), The Vakataka-Gupta Age (Lahore, 1946).

গুপ্তযুগে স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলা

স্থাপত্যশিল্পের ইতিহাসে গুপ্তযুগের গুরুত্ব : স্থাপত্যশিল্পের ইতিহাসে গুপ্তযুগ এক স্মরণীয় অধ্যায়রূপে চিহ্নিত। ভারতীয় স্থাপত্যের দু’টি ভাগ – প্রস্তরখোদিত স্থাপত্য ও সৌধস্থাপত্য। প্রস্তরখোদিত স্থাপত্যের মধ্যে পড়ে গুহা-চৈত্য, বিহার বা সংঘারাম এবং গুহা-মন্দির। মন্দির, স্তূপ এবং বিহার বা সংঘারাম সৌধস্থাপত্যের অন্তর্ভুক্ত। একটি জিনিস সহজবোধ্য। তখনকার দিনে যেমন পাহাড় কেটে চৈত্য, স্তূপ, বিহার ও মন্দির নির্মাণ করা হত, তেমনি ইট বা পাথরের মতো স্থায়ী উপকরণ দিয়ে চৈত্য, মন্দির প্রভৃতি সৌধও নির্মিত হত। প্রস্তরখোদিত স্থাপত্যের ক্ষেত্রে গুপ্তযুগ সুবর্ণযুগ। পূর্ববর্তী পর্বের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ধ্যান-ধারণা এ সময় সুসংহত, পরিণত রূপ লাভ করে। এরই অভিব্যক্তি ঘটেছে অজন্তা, এলোরা ও বাঘ গুহার স্থাপত্য শিল্পে। ভারতীয় সৌধস্থাপত্যের ইতিহাসে এ পর্বের ছবিটা কিন্তু অন্যরকম। পর্ব ভারতীয় সৌধস্থাপত্যের বুনিয়াদ নির্মাণের পর্ব। পরবর্তী কালে সারা ভারত জুড়ে যেসব সুদৃশ্য, সুরম্য মন্দির, হর্মাদি তৈরি হয়েছিল তার আদি রূপরেখা গুপ্তপর্বেই রচিত হয়। মন্দির নির্মাণে এতদিন বাঁশ ও কাঠের মতো ভঙ্গুর উপকরণই বেশি ব্যবহৃত হত। কিন্তু এ সময় থেকেই পাথর ও ইটের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। এসব কারণে ভারতীয় সৌধস্থাপত্যের ইতিহাসে গুপ্তযুগের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

সৌধস্থাপত্য

সৌধস্থাপত্য : ভিতরের দিকে একটি গর্ভগৃহ, আর সামনে মণ্ডপ, মোটামুটি এই ছিল গুপ্তযুগের মন্দিরগুলির গড়ন। এ পর্বের প্রথম দিকে যেসব মন্দির তৈরি হত, তার গর্ভগৃহ ছিল বর্গক্ষেত্রাকার, সামনের মণ্ডপ থাকত স্তম্ভশোভিত। সমতল ছিল গর্ভগৃহ ও মণ্ডপের ছাদ। কখনও কখনও আয়ত ক্ষেত্রাকার গর্ভগৃহও তৈরি হত। দেখলেই বোঝা যায়, গুহামন্দিরের অনুকরণে এ ধরনের মন্দির নির্মিত হয়েছিল। সাঁচীর সপ্তদশ মন্দিরটি এই শ্রেণিভুক্ত। খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতকে তৈরি এই মন্দিরটি দেহগঠনে সুসমঞ্জস, পরিচ্ছন্ন ও পরিমিত অলংকরণসজ্জিত। মণ্ডপের সামনের দিকে রয়েছে চারটি স্তম্ভ। তারা ছাদের ভার বহন করছে। প্রতিটি স্তম্ভশীর্ষে সিংহমূর্তি উৎকীর্ণ। মণ্ডপের তিন দিক ঘিরে রয়েছে দু’ধাপের সিঁড়ি। এই মন্দিরটিকে কলা-রসিকেরা প্রাচীন গ্রিসের শ্রেষ্ঠ মন্দিরগুলির সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুর জেলার তিগাওয়ার বিষ্ণু মন্দির এবং এরাণের মহাবরাহ ও বিষ্ণুমন্দিরও এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। ভিনসেন্ট স্মিথ মনে করেন, তিগাওয়ার বিষ্ণুমন্দির সমুদ্রগুপ্তের রাজত্বকালে নির্মিত হয়েছিল। এ অভিমত সম্ভবত ঠিক। তিগাওয়ার মন্দিরের তুলনায় এরাণের মন্দির দু’টির স্তম্ভের কারুকার্য অনেক বেশি। এ থেকে বোঝা যায়, এ মন্দির দু’টি পরবর্তী কালের। তবে মন্দির দু’টির গর্ভগৃহ বর্গক্ষেত্রাকার নয়, আয়তাকার।

প্রদক্ষিণা পথ-যুক্ত মন্দির : গুপ্তযুগে আর এক ধরনের মন্দির তৈরি করা হত যাদের গঠন অনেকটাই পূর্বোক্ত শ্রেণির মন্দিরগুলির মতো। এসব মন্দিরের গর্ভগৃহ বর্গ বা আয়তক্ষেত্রাকার, সম্মুখস্থ মণ্ডপ স্তম্ভশোভিত এবং ছাদ সমতল। পূর্বোক্ত শ্রেণির মন্দিরগুলিরও এসব বৈশিষ্ট্য আছে। কিন্তু এদের এমন একটি উপাদান আছে যা প্রথম শ্রেণির মন্দিরগুলির নেই। সেটি হল গর্ভগৃহের চারদিক ঘিরে এক প্রদক্ষিণা পথ। প্রদক্ষিণা পথটি কখনও প্রাচীর দিয়ে ঘেরা থাকত, আবার কখনওবা উন্মুক্ত থাকত। কখনও কখনও গর্ভগৃহের উপর আর একটি তল নির্মাণ করা হত। মধ্যপ্রদেশের নাচনা কুঠারার পার্বতীমন্দির এবং ভূমরার শিব-মন্দির এই শ্রেণির।

  • নাচনা কুঠারার পার্বতী-মন্দিরের গর্ভগৃহটি দ্বিতল। প্রদক্ষিণা পথে সূর্যালোকের প্রবেশের জন্য বাইরের দেয়ালগুলিতে গবাক্ষ বা বাতায়নের সংস্থান রাখা হত।
  • ভূমরার শিব-মন্দিরের প্রবেশপথের দু’ধারে দু’টি ছোট মন্দির আছে। ভারতে পরবর্তী কালে অধিকসংখ্যায় পঞ্চায়তন মন্দির নির্মিত হয়েছিল। চার কোণায় চারটি ছোট মন্দির আর মধ্যিখানে মূল মন্দির, এই নিয়ে পঞ্চায়তন মন্দির। ভূমরার শিবমন্দিরে এই পঞ্চায়তন মন্দিরের পূর্বাভাস দেখা যায়।

গুপ্তযুগের এই মন্দিরগুলি খ্রিস্টীয় ৫ম-৬ষ্ঠ শতকে নির্মিত হয়েছিল বলে অনুমিত হয়।

শিখর-মন্দির : এ যুগে আরও এক ধরনের মন্দির নির্মিত হয়। এ ধরনের মন্দিরগুলিকে শিখর-মন্দির আখ্যা দেওয়া যায়। বর্গক্ষেত্র বা আয়তাকৃতি গর্ভগৃহের উপর নিচু শিখরের সংস্থাপনা – এই শ্রেণির মন্দিরের বৈশিষ্ট্য। মন্দিরকে উঁচু, আরও উঁচু করে গড়ে তোলার এক বিশেষ প্রবণতা দেখা যায় ভারতীয় ধর্মীয় স্থাপত্যে। শিখর স্থাপনার মধ্য দিয়ে সেই প্রবণতার উন্মেষ ও বিকাশ দেখা গেল। পূর্ববর্তী শ্রেণির মতো এই ধরনের মন্দিরগুলিতেও আছে গর্ভগৃহকে ঘিরে এক প্রদক্ষিণা পথ, আর আছে গর্ভগৃহের সামনে স্তম্ভশোভিত একটি মণ্ডপ। উত্তরপ্রদেশের ঝাঁসি জেলার দেওগড়ের দশাবতার মন্দির, নাচনা কুঠারার মহাদেব মন্দির, কানপুরের নিকটবর্তী ভীতরগাঁও-এর ইষ্টক নির্মিত মন্দির এবং চিনা পরিব্রাজক শুয়েন চাঙ বর্ণিত বোধগয়ার মহাবোধি মন্দির এই পর্যায়ভুক্ত।

  • দশাবতার মন্দির প্রস্তরনির্মিত। এক প্রশস্ত ও উঁচু বেদির উপর মন্দিরটি দাঁড়িয়ে আছে। বেদির চারদিক ঘিরে রয়েছে সোপান। রামায়ণ ও মহাভারতের বিভিন্ন দৃশ্যের উপস্থাপনা রয়েছে বেদির বহিরঙ্গে। দৃশ্যগুলির মধ্যে আছে রামচন্দ্রের পাদস্পর্শে পাষাণী অহল্যার শাপমোচন, লক্ষ্মণ কর্তৃক শূর্পনখার নাসিকাছেদন, হনুমানের গন্ধমাদন পর্বত বহন, নন্দ ও যশোদার শিশু কৃষ্ণ ও বলরামকে সোহাগ প্রদর্শন ইত্যাদি। গর্ভগৃহের উপরে শিখরের এক এক দিকে তিনটি করে তল অর্থাৎ প্রতিটি দিক ত্রিতল ক্ষেত্র। সে কারণে মন্দিরটি ত্রিরথ। দুঃখের বিষয়, মন্দির-শিখরের সিংহভাগই ভেঙে পড়েছে। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, একদা এই শিখর ১৫.২৪ মি. উঁচু ছিল। মন্দিরটি পঞ্চায়তন শ্রেণির। মূল মন্দিরের প্রতি কোণে একটি করে ছোট মন্দির। মন্দিরটি সম্ভবত খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছিল।
  • ভীতরগাঁও-এর মন্দিরটিও এই সময়কার। উঁচু বেদির উপর প্রতিষ্ঠিত এ মন্দিরটিও ত্রিরথ। কিন্তু এর গর্ভগৃহের ছাদ গম্বুজাকৃতি। মন্দিরের বহিরঙ্গ ভাস্কর্যে অলংকৃত। এর মধ্যে পোড়ামাটির ভাস্কর্যও আছে। মন্দিরটির তোরণদ্বারের খিলান লক্ষ করবার মতো। এটি গোল। (প্রাচীন ভারতে গোল খিলানের চলন ছিল। কেউ কেউ বলেন, গোল খিলানের নকশা মোগল যুগে পারস্য থেকে ভারতবর্ষে আমদানি করা হয়।)
  • বোধগয়ার মহাবোধি মন্দির ভীতরগাঁও-এর মন্দিরটির সমকালবর্তী। তবে এই মন্দিরের সংস্কারের কাজ এতবার হয়েছে যে, এর আদিরূপ কী ছিল তা বলা সম্ভব নয়। শুয়েন চাঙ একে মহাবোধি বিহার বলে বর্ণনা করেছেন। মন্দিরটির গর্ভগৃহ বর্গক্ষেত্রাকার। এর উপর পঞ্চরথ শিখর। শিখরটি সপ্ততল। ভূমি-আমলক এক তলকে অপর তল থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। গর্ভগৃহের অভ্যন্তরে বুদ্ধদেবের ভূমিস্পর্শমুদ্রার এক প্রতিকৃতি।

বর্তুলাকার মন্দির : এ পর্বে বর্তুলাকার মন্দিরও নির্মিত হয়েছিল তবে তা বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেনি। রাজগিরের মনিয়ার মঠ বা মণিনাগের মন্দির এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। পূর্বকার ভগ্ন এক সৌধের বৃত্তাকার এক ভিতের উপর মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে। গোলাকার এই মন্দিরের চতুষ্পার্শ্বে কিছুটা করে অংশ বাইরের দিকে প্রসারিত। মন্দিরের বহিরঙ্গে অনেক কুলুঙ্গি। আস্তরে তৈরি গণেশ, বিষ্ণু, নাগ ইত্যাদি বিভিন্ন মূর্তি দিয়ে এসব কুলুঙ্গি সজ্জিত ছিল। স্তূপস্থাপত্যের অনুকরণে নির্মিত এ মন্দিরটি গুপ্তযুগে তৈরি হয়েছিল।

ধনুকাকৃতি ছাদের মন্দির : গুপ্তযুগে আর এক ধরনের মন্দিরের সন্ধান পাওয়া গেছে। এদের সম্মুখভাগ আয়তাকার বা বর্গক্ষেত্রাকার, পিছনের দিক অর্ধবৃত্তাকার। মন্দিরের ছাদ ধনুকাকৃতি। শোলাপুরের নিকটবর্তী ত্রিবিক্রম-মন্দির এবং গুন্টুর অঞ্চলের কপোতেশ্বর মন্দির এ শ্রেণির দু’টি বিখ্যাত মন্দির। খ্রিস্টীয় ৪র্থ-৫ম শতকে তৈরি হলেও এ মন্দির দু’টির কোনওটিই গুপ্তরাজ্যে অবস্থিত ছিল না। তক্ষশিলা ও সাঁচীতেও এ ধরনের মন্দিরের নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। মন্দিরগুলির নির্মাণ শৈলীতে গৃহাচৈত্যের ছায়া পড়েছে।

সংঘারাম বা বিহার : সৌধস্থাপত্যের একটি ভাগ সংঘারাম বা বিহার। এ সময় বিভিন্ন বৌদ্ধকেন্দ্রে বহু সংঘারাম বা বিহার স্থাপিত হয়। বিহারগুলি সাধারণত ইঁট দিয়ে তৈরি হত। মাঝখানে অঙ্গন, আর তার চারদিকে চার সারি কক্ষ, মোটামুটি এই হচ্ছে এক একটি বিহারের চিত্র। উপাসনাগৃহের অবস্থান ছিল পিছনের সারিতে। বর্তমানে এসব বিহারের ভিত ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। গুপ্তসম্রাট প্রথম কুমারগুপ্তের রাজত্বকালে নালন্দায় একটি বৃহদায়তন বৌদ্ধবিহার নির্মিত হয়। কালক্রমে এই বিহার বিদ্যাচর্চার এক আন্তর্জাতিক কেন্দ্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে। শুয়েন চাঙ বলেছেন, এই বিহারটি ৯১.৪৪ মি. উঁচু ছিল। তিনি আরও বলেছেন, এই বিহারটি দেখলে বোধগয়ার বিরাটকায় মহাবোধি বিহারের কথা মনে পড়ে। বর্তমানে এই বিহারটির শুধু ভিতই পড়ে আছে।

ইটের তৈরি স্তূপ : এ পর্বে ইটের তৈরি অনেক স্তূপও নির্মিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সারনাথের ধামেখ স্তূপ এবং সিন্ধু অববাহিকার মীরপুর খাস-এর বিখ্যাত স্তূপটির কথা বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয়। ধামেখ স্তূপটি পূর্বে ৪৫.৪২ মি. উঁচু ছিল। এর পরিধি ৩১ মিটারের কিছু কম। স্তূপটির তিনটি স্তর – বেদিকা, মেধি ও অশু। বেদিকা পাথর দিয়ে তৈরি কিন্তু মেধি ও অশু ইট-নির্মিত। লতা-পাতার কেয়ারি ও জ্যামিতিক নকশায় বেদিকা অলংকৃত। এর আট কোনায় আটটি কুলুঙ্গি। একদিন এ কুলুঙ্গিগুলি দেবমূর্তিশোভিত ছিল। ধামেখস্তূপের অণ্ড অর্ধগোলাকার নয়, চোঙাকৃতি। এ স্তূপটি সম্ভবত খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকে নির্মিত হয়। মীরপুর খাস-এর স্তূপটির বেদিকা বর্গক্ষেত্রাকার, এর অণ্ড অর্ধগোলাকার। স্তূপটির পশ্চিমদিকে মাঝ বরাবর একটি প্রবেশদ্বার সমেত তিনটি কক্ষের সংস্থান আছে। সেদিক থেকে বিচার করলে বলা যায়, মীরপুর খাস-এর স্তূপটির মধ্যে স্তূপ ও মন্দিরের সমন্বয় ঘটেছে। স্তূপটি আনুমানিক খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতকে নির্মিত হয়েছিল। রাজগিরের দু’টি পুরোনো স্তূপের একটি এ সময় নির্মিত হয়।

প্রস্তরখোদিত স্থাপত্য

গুপ্তযুগে পাহাড় কেটে প্রচুর চৈত্যগৃহ এবং সংঘারাম বা বিহার নির্মিত হয়। এগুলি প্রধানত নির্মিত হয় মধ্যপ্রদেশের বাঘ-এ, আর মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদ জেলার অজন্তা ও এলোরা নামে দু’টি স্থানে। গঠন ও ব্যবহারিক উপযোগিতার পরিপ্রেক্ষিতে চৈত্যগৃহ ও বিহারের মধ্যে পার্থক্য আছে। চৈত্যগৃহ বলতে উপাসনালয় বা মন্দির বোঝায়। বিহার বা সংঘারাম বলতে বোঝায় শ্রমণ শ্রমণাদের আবাসস্থল। চৈত্যগৃহ দেখতে প্রলম্বিত আয়তক্ষেত্রের মতো। এর পিছনের দিকটি হত অর্ধবৃত্তাকার। অর্ধবৃত্তাকার স্থানে উপাসনার বস্তু হিসাবে স্তূপ থাকত। আয়তক্ষেত্রাকার হলঘরের দু’টি অংশ – মূল হলঘর ও দেয়াল বরাবর পার্শ্বপথ। এক সারি স্তম্ভ মূল হলঘরকে পার্শ্বপথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। স্তূপ পরিক্রমার জন্য পার্শ্বপথ প্রদক্ষিণা পথরূপে ব্যবহৃত হত। চৈত্যগৃহের ছাদ হত ধনুকাকৃতি। স্তূপের ঠিক সামনের দিকে প্রবেশপথ। প্রবেশপথের ঠিক উপরে ঘোড়ার ক্ষুরের নালের মতো দেখতে এক প্রকাণ্ড চৈত্য গবাক্ষ। প্রাঙ্গণের চার দিকে সারি সারি কুঠরি তুলে সংঘারাম বা বিহার তৈরি করা হত। কিন্তু পাহাড় কেটে যখন সংঘারাম তৈরি করা হত, তখন চারদিকে আর কুঠরির সংস্থান থাকত না। তখন সামনের দিক থাকত উন্মুক্ত আর দু’পাশে এবং পিছনের দিকে শ্রমণদের বসবাসের জন্য ছোট ছোট প্রকোষ্ঠ তৈরি করা হত।

অজন্তা : এ সময় অজন্তায় ইন্ধ্যাদ্রি নামে একটি অর্ধচন্দ্রাকৃতি পাহাড়ের গা কেটে কুড়িটির মতো সংঘারাম ও চারটি চৈত্যগৃহ নির্মাণ করা হয়। অজন্তায় অবশ্য গুহা নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল অনেক আগে, খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতাব্দীতে। ৭ম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত অজন্তায় গুহা নির্মাণ পর্ব চলে। অজন্তায় সর্বসমেত ২৯টি গুহা আছে। এদের কয়েকটি অর্ধসমাপ্ত। অজন্তার চৈত্যগৃহগুলির মধ্যে ঊনবিংশ গুহার চৈত্যকক্ষটি অতি মনোরম। এটি ছোট আকারের এর আয়তাকার মণ্ডপ, যার পিছনটা অর্ধগোলাকার। ৩.৩ মিটার উঁচু ১৫টি স্তম্ভের উপস্থাপনায় গুহাটি তিনটি অংশে বিভক্ত – দেয়াল থেকে স্তম্ভ পর্যন্ত প্রসারিত দু’টি পার্শ্বপথ এবং মধ্যবর্তী প্রশস্ত মূল অংশ। স্তম্ভ কারুকার্যখচিত। এর গায়ে লতা, পাতা, ঘট, প্রস্ফুটিত পদ্ম, বুদ্ধ, আকাশপথযাত্রী গন্ধর্ব, সিদ্ধযোগী ও পশুমূর্তি উৎকীর্ণ। পাহাড় খুঁড়ে মণ্ডপের ছাদের তলদেশকে কড়াই-এর অন্তর্ভাগের আকার দেওয়া হয়েছে। চৈত্যকক্ষ বা মণ্ডপের শেষ প্রান্তে রয়েছে একটি স্তূপ। স্তূপটির সর্ব নিম্নে এক বর্গক্ষেত্রাকার মঞ্চ বা বেদিকা। এরপর ক্রমান্বয়ে মেধি, অণ্ড, হর্মিকা, ছত্রাবলি ও কলস। স্তূপের সামনের দিকে সুগভীর খিলানযুক্ত কুলুঙ্গির মধ্যে এক দণ্ডায়মান, মনোরম বুদ্ধমূর্তি উৎকীর্ণ করা হয়েছে। চৈত্যগৃহের একটি মাত্র প্রবেশপথ। প্রবেশপথের সামনে একটি মুখমণ্ডপ। মুখমণ্ডপের সামনে এক সারির চারটি অলংকৃত স্তম্ভ। মুখমণ্ডপের সম্মুখভাগে বেশ খানিকটা উপরে অর্থাৎ গুহামন্দিরের বহির্ভাগের ঠিক মধ্যিখানে পদ্মের পাপড়ির মতো আকৃতিবিশিষ্ট নয়নাভিরাম এক চৈত্যগবাক্ষ। গুহার সমগ্র স্থাপত্য পরিকল্পনাকে এক কেন্দ্রানুগ ভারসাম্য দান করেছে এই চৈত্যগবাক্ষটি। এই গবাক্ষের উপরে, নিচে ও দু’পাশে আছে অপূর্ব সুন্দর ভাস্কর্য। গবাক্ষের দু’পাশে দাঁড়ানো যক্ষমূর্তি তাদের বীরত্বব্যঞ্জক ভঙ্গি এবং দৃঢ় পেশীযুক্ত গুরুভার দেহকাণ্ডের জন্য সহজেই দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অজন্তার ষোড়শ গুহাটি ভারতীয় প্রস্তরখোদিত স্থাপত্যের এক শ্রেষ্ঠতম দৃষ্টান্ত। বাকাটক নৃপতি হরিষেণের রাজত্বকালে আনুমানিক ৪৭৫-৫০০ খ্রিস্টাব্দে এই গুহাবিহার খনন করা হয়। ১৯৮১ বর্গমিটারের এক প্রশস্ত মণ্ডপ এই গুহার মূল আকর্ষণ। মণ্ডপের অভ্যন্তরে সমান ব্যবধানে চারদিক জুড়ে এক সারির ২০টি অলংকৃত ও নিরলংকার স্তম্ভ। মণ্ডপের পিছন দিকে চৈত্যগৃহ বা মন্দির। সেখানে প্রলম্বপাদ আসনে উপবিষ্ট বুদ্ধমূর্তি। অজন্তার গুহাগুলিতে স্তম্ভের এক বিশেষ ভূমিকা আছে। এরা নিছক গুহার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করছে না, ছাদেরও ভার বহন করছে। মণ্ডপের ভিতরে ও বাইরে সর্বসমেত ১৬টি কক্ষ। অজন্তার কয়েকটি গুহার সম্ভাব্য তারিখ –

  • নবম ও দশম গুহা সাধারণত মনে করা হয় খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতক থেকে খ্রিস্টীয় ১ম শতাব্দীর মধ্যে অজন্তার নবম ও দশম গুহা দু’টি খোদিত হয়। গুহা দু’টি আনুমানিক ১০০ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়েছিল, এ মতও প্রচলিত আছে। দশম গুহার ভিতরকার স্তম্ভগুলি খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতকের শেষের দিকে তৈরি হয়েছিল।
  • ষষ্ঠ, সপ্তম ও একাদশ গুহা আনুমানিক ৪৫০ খ্রিস্টাব্দ।
  • পঞ্চদশ-বিংশ ও ষডুবিংশ গুহা আনুমানিক ৪৫০-৫৫০ খ্রিস্টাব্দ।
  • প্রথম, দ্বিতীয় ও ঊনত্রিংশ গুহা – এই গুহা কটি ৬ষ্ঠ শতাব্দীর শেষের দিকে ও ৭ম শতাব্দীর গোড়ার দিকে খনন করা হয়েছিল। পার্সি ব্রাউন মনে করেন, প্রথম ও দ্বিতীয় গুহা দু’টি আনুমানিক ৬২৬-২৮ খ্রিস্টাব্দে খোদিত হয়েছিল।

এলোরা : অণ্টার মতো এলোরাও ভারতীয় প্রস্তরখোদিত স্থাপত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। এখানে কেবল চৈত্যগৃহ ও বৌদ্ধবিহারই নির্মিত হয়নি, ব্রাহ্মণ্য ও জৈন মন্দিরও তৈরি হয়েছে। অজন্তার পরিমণ্ডল বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতির সুবাস-মুখরিত, অন্য কোনও ধর্ম বা সংস্কৃতির সৌরভ সেখানে পৌঁছায়নি। এলোরার বাতাসে সমন্বয়ের সুর। বৌদ্ধ, জৈন এবং ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কৃতির সহাবস্থান ঘটেছে এখানে। অজন্তার তুলনায় এলোরার গুহাগুলি আয়তনে বৃহৎ ও উঁচু। এখানকার বেশ কয়েকটি গুহা ত্রিতল। দ্বিতল গুহা অজন্তায়ও আছে, কিন্তু সেখানে কোনও ত্রিতল গুহা নেই। এলোরার দশম গুহা একটি চৈত্যগৃহ। আয়তনে বিশাল এই চৈত্যগৃহের ভাস্কর্যের স্বল্পতা লক্ষণীয়। চৈত্যগৃহের পিছন দিকে একটি স্তূপ। স্তূপের সম্মুখভাগে প্রলম্বপাদ আসনে উপবিষ্ট এক বিশালকায় বুদ্ধমূর্তি উৎকীর্ণ। বুদ্ধমূর্তির দু’পাশে দণ্ডায়মান দুই অনুচর। মূর্তির তুলনায় স্তূপটিকে নিষ্প্রভ বলে মনে হয়। চৈত্যগৃহটি বিশ্বকর্মা গুহা নামে পরিচিত। বৌদ্ধগুহার ব্রাহ্মণ্য নামকরণের মধ্য দিয়েও এলোরার ধর্মীয় সমন্বয়ের চিত্রটি ফুটে উঠেছে।

বাঘ : গুপ্তকালীন গুহাস্থাপত্যের আর এক উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র বাঘ। অজন্তার প্রায় ২৪১.৩৫০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত এই স্থানটি মধ্যপ্রদেশের গ্বালিয়রের নিকট অবস্থিত। এখানে পাহাড় কেটে সর্বসমেত ৯টি গুহাবিহার নির্মিত হয়। গুহাবিহারগুলি ৫০০-৬০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে উৎকীর্ণ হয়েছে। এখানকার পাথর নরম হওয়ায় বেশির ভাগ গুহাবিহারই বিনষ্ট হয়ে গেছে। বাঘের গুহাবিহারগুলির মধ্যে চতুর্থ গুহাবিহারটি সমধিক প্রসিদ্ধ। এই গুহাবিহারটি ‘রঙমহল’ নামে পরিচিত। বিহারটির কেন্দ্রীয় কক্ষের আয়তন ২৯ ২৬ বর্গমিটার। কক্ষমধ্যে আছে ৩২টি স্তম্ভ। সামনের দিক ছাড়া কক্ষের বাকি তিনদিকে শ্রমণদের বসবাসের জন্য আছে ছোট ছোট প্রকোষ্ঠ। কক্ষের সামনে কারুকার্যখচিত একটি সুদৃশ্য মণ্ডপ। বিহারটির পাশেই রয়েছে বৃহদায়তন এক কক্ষ। এর দৈর্ঘ্য ২৯.২৬ মি., প্রস্থ ১৩.৪১ মি.। ৬৭.০৫ মি. দীর্ঘ এক অলিন্দ এই বৃহদায়তন কক্ষটিকে বিহারটির সঙ্গে সংযুক্ত করে রেখেছে। কক্ষটিকে ‘শালা’ বলে। এটি কি পাঠকক্ষ? হতেও পারে।

নতুন কোন স্থানে চৈত্যগৃহ তৈরি না হবার কারণ : অজন্তা ও এলোরায় পাহাড়ের গায়ে বেশ কয়েকটি চৈত্যগৃহ খোদিত হলেও পরবর্তী কালে ভারতের কোনও স্থানে নতুন করে আর চৈত্যগৃহ নির্মিত হয়নি। এর পিছনে কারণ আছে। প্রথম দিকে বৌদ্ধদের মধ্যে স্তূপপূজার প্রচলন ছিল। যতদিন স্তূপপূজা জনপ্রিয় ছিল ততদিন চৈত্যগৃহ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে বৌদ্ধদের মধ্যে মূর্তিপূজার প্রচলন হয় এবং তা উত্তরোত্তর ব্যাপক ও সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠে। স্তূপপূজার জনপ্রিয়তা হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে চৈত্যগৃহ নির্মাণের প্রয়োজনও ফুরিয়ে যায়।

পূর্ববর্তী যুগের তুলনায় এ পর্বের গুহা-চৈত্যগুলির কয়েকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে।

  • প্রথমত, এ সময়কার গুহা-চৈত্যগুলি মূর্তি-ভাস্কর্যে সমৃদ্ধ। কী বহিরঙ্গে, কী অন্তরঙ্গে, গুহা-চৈত্যের সর্বত্রই রয়েছে মূর্তি-ভাস্কর্যের উপস্থাপনা।
  • দ্বিতীয়ত, পূর্বে চৈতাগৃহের প্রবেশমুখে বেষ্টনী পরিবেষ্টিত বোধিবৃক্ষের ছবি উৎকীর্ণ হত। এখন সেখানে দেখা যাচ্ছে, উপরে অশ্বখুরাকৃতি এক প্রকাণ্ড চৈতাগবাক্ষ আর নিচে কয়েকটি ছোট ছোট চৈত্যগবাক্ষ।
  • তৃতীয়ত, চৈত্যগৃহের অভ্যন্তরস্থ স্তূপের গঠনেও পরিবর্তনের ঢেউ লেগেছে। পূর্বে স্তূপ ছিল নিরাভরণ কিন্তু অজষ্টায় বা এলোরায় স্তূপের সম্মুখভাগে বুদ্ধদেবের উপবিষ্ট বা দণ্ডায়মান মূর্তি উৎকীর্ণ আছে। স্তম্ভশীর্ষেও দেখা যায় বৃদ্ধ মূর্তির অলংকরণ। এক কথায়, দু’টি ভিন্নযুগের ধর্মীয় পরিমণ্ডল বিভিন্ন হওয়ায় দু’যুগের গুহা চৈত্যগুলিতে রূপবৈচিত্র্য দেখা দিয়েছে।

মিশ্র স্থাপত্য-শৈলী : অজন্তায় যে পাহাড় কেটে গোটা মন্দির তৈরি হয়েছে, তা আমরা জানি। কিন্তু গুপ্তযুগে এমন মন্দিরও নির্মিত হয়েছে, যার খানিকটা হয়েছে পাহাড় কেটে, বাকিটা হয়েছে ইট বা পাথর গেঁথে। মধ্যপ্রদেশের উদয়গিরি ও ভিলসায় এ ধরনের মন্দির দেখা যায়। এসব মন্দিরের গর্ভগৃহ তৈরি হয়েছে পাহাড় কেটে কিন্তু মণ্ডপ ও তার স্তম্ভ নির্মিত হয়েছে পাথর বা ইট গেঁথে। এই শ্রেণির মন্দিরের গর্ভগৃহ বেশ বড় কিন্তু মণ্ডপ তুলনায় অপ্রশস্ত।

ভাস্কর্য-শিল্প

ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের সীমানা ছাড়িয়ে অতীন্দ্ৰীয় লোকের দিকে যাত্রা : ভারতীয় ভাস্কর্য-শিল্পের ইতিহাসে গুপ্তযুগ সুবর্ণযুগ বলে পরিচিত। এ পর্বে ভারতীয় ভাস্কর খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর শিল্পসাধনার সঠিক নিশানা। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন তাঁর শিল্পী জীবনের সার্থকতা। তিনি সিদ্ধিলাভ করেছিলেন তাঁর সৃষ্টির বহিরঙ্গে অন্তর্লোকের বিমূর্ত ভাবনার প্রতিফলন ঘটাতে। সমকালীন ভাস্কর্যশিল্পে তাই অনিবার্যভাবে ফুটে উঠেছে ভারতশিল্পের ‘ফুল্ল কুসুমিত’, মহিমময় রূপ। বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে ভাস্কর্যশিল্পে যেসব ধ্যান-ধারণা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা সক্রিয় ছিল, এ সময় তা সুসংহত, পরিশীলিত ও পরিপুষ্ট রূপ লাভ করে। গুপ্তভাস্কর্যের অত্যাশ্চর্য স্বচ্ছতা এসেছে মথুরার ভাস্কর্য থেকে, গুপ্তভাস্কর্যের কোমলতা, পেলবতা এসেছে অমরাবতীর শিল্পকর্ম থেকে। মথুরা বা অমরাবতীতে যা ছিল অর্ধস্ফুট, তাই পল্লবিত, বিকশিত রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে গুপ্তযুগের শিল্পকর্মে। পূর্ববর্তী যুগের তুলনায় এ পর্বের ভাস্কর্য অনেক পরিণত, পরিশীলিত, পরিচ্ছন্ন, সূক্ষ্ম, ছন্দায়িত, বাঙ্ময় ও দৃষ্টিনন্দন। পূর্বে বস্তুর বহিরঙ্গের দিকেই শিল্পীর দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল। বস্তুর মনোজগতের প্রতি তিনি উদাসীন ছিলেন। কিন্তু এ পর্বে শিল্পীর দৃষ্টি ধাবিত হল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের সীমানা ছাড়িয়ে অতীন্দ্ৰীয় লোকের দিকে। মানবমনের ভিতরে যে বিমূর্ত ভাবনা বা অধ্যাত্ম-চেতনা তাকে শিল্পকার্যে প্রতিফলনের এক তীব্র বাসনা তাঁকে অনুপ্রাণিত করল। মানুষের বহিরঙ্গে অন্তর্লোকের অভিব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। বস্তুর বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গের মধ্যে সমন্বয় সাধন শিল্পীর অভীপ্সিত লক্ষ্য বলে নির্দিষ্ট হল। পূর্বে যেসব মানব প্রতিকৃতি নির্মিত হত, তাতে মানবমনের অন্তর্মুখী চেতনার কোনও ব্যঞ্জনা ছিল না। ফলে সেসব শিল্পকীর্তি অনেকাংশেই স্থূল হয়েছে, পার্থিবতায় মলিন হয়েছে। কিন্তু এ সময় মানবমনের অন্তর্নিহিত ভাবনাকে বেশি প্রাধান্য দেওয়ায় দেহাবয়ব আর নিষ্প্রাণ, নির্জীব রইল না। সে হয়ে উঠল সতেজ, সজীব ও বাঙময়। আধ্যাত্মিক চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে সে হয়ে উঠল শাস্ত, সমাহিত ও উজ্জীবিত। এ ভাব অভিব্যক্ত হয়েছে প্রতিকৃতির সুঠাম দেহগঠনে, মুখের বৈশিষ্ট্যব্যঞ্জক ভঙ্গিমায়, আর আনত নয়নপল্লবে। মানব-অবয়বের মধ্যে শিল্পী খুঁজে পেলেন তাঁর কল্পলোকের ঈশ্বরকে। ফলে মানবদেহের আদলেই দেব-দেবীর মূর্তি নির্মিত হতে থাকে। যৌবন জীবনীশক্তির প্রতীক। জীবনের পর্যায়রূপে শিল্পী যৌবনকে বেছে নিয়েছেন। দেব-দেবীর মূর্তি নির্মাণেও যৌবনের আদর্শই জয়যুক্ত হল। দেব-দেবী চিরযৌবনসম্পন্ন, এই আদর্শই প্রচারিত হল। শিল্পীর হাতে গড়া ঈশ্বর হলেন চিরযৌবনের দূত, তিনি অধ্যাত্মচেতনায় সমৃদ্ধ, শান্ত, সুন্দর, করুণাঘন ও সমাহিত।

যথাযথ নয় বরং সর্বাঙ্গসুন্দর উপস্থাপনা : মানবদেহের গঠন সম্পর্কে এ যুগের শিল্পী এক অভিনব ধারণায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন। মানব দেহের যথাযথ রূপায়ণ নয়, তার সর্বাঙ্গসুন্দর উপস্থাপনাই ছিল তাঁর কাম্য। মূর্তি, তা সে পাথুরে হোক বা ধাতব হোক, হবে যৌবনোচিত সুঠাম, নমনীয়, প্রশান্ত, স্বচ্ছ ও দৃষ্টিনন্দন। মূর্তি তো অড়, নিশ্চল, কিন্তু তাকে এমনভাবে গড়তে হবে যেন দেখে মনে হয়, ভিতর থেকে উৎসারিত শক্তি ও প্রজ্ঞায় সে দ্যুতিময়, সে সজীব, সে প্রাণবন্ত। দেহের পেলবতা, সজীবতা যাতে ক্ষুণ্ন না হয় সেজন্য পোশাক ও অলংকারের ব্যবহার হয়েছে সীমিত। যখনই পোশাকের ব্যবহার হয়েছে তখনই তাকে সিক্ত বা স্বচ্ছরূপে দেখানো হয়েছে। দেহের কোমলতা, পেলবতা এবং ছন্দায়িত গড়ন যাতে ব্যাহত না হয় সেজন্যই এ ব্যবস্থা। মানবদেহের সর্বাঙ্গসুন্দর রূপায়ণের ক্ষেত্রে এ যুগের ভাস্কর প্রকৃতি-জগৎ থেকে উপকরণ সংগ্রহ করেছেন। প্রকৃতি থেকে তিল তিল করে সৌন্দর্য আহরণ করে তিনি আদর্শ মানবের রূপ কল্পনা করেছেন। শিল্পীর কল্পনায় আদর্শ মানুষের মুখ হবে ডিমের মতো মসৃণ ও আকারবিশিষ্ট। কপাল হবে ধনুকের মতো বাঁকা। ভূ হবে নিম পাতার শিরা বা ধনুকের মতো বঙ্কিম। চঞ্চলা রমণীর চোখ হবে খঞ্জনা পাখির চোখ বা শফরী মাছের মতো। স্নিগ্ধ ও শান্ত রমণীর চোখ হবে হরিণের চোখের মতো কিংবা পদ্মের কুড়ি বা পাপড়ির মতো। দেবী বা রমণীদের নাক হবে তিল ফুলের মতো কিন্তু দেবতা ও পুরুষের নাক শুকপাখির নাকের মতো তীক্ষ্ণ হবে। নরম ও আর্দ্র ঠোঁট হবে রক্তিম বিশ্বফলের মতো। কম্বু বা শাঁখের মতো হবে গ্রীবা। দেবতা ও মানুষের কোমর হবে সিংহের কটিদেশের মতো কিন্তু দেবী ও রমণীদের কটিদেশ হবে ডমরুমধ্য। হাতির মাথার মতো হবে কাঁধ। কলাগাছের কাণ্ডের মতো হবে হাত। কলাগাছের কাণ্ড বা হাতির শুঁড়ের মতো হবে। ঊরু। হাত ও পায়ের রূপ-কল্পনায় শিল্পীর চোখে ভেসে উঠেছে পদ্মফুল ও কিশলয়ের ছবি। বোঝা যায়, নিজের চোখে দেখা কোনও মানবদেহ নয়, কল্পনার তুলিতে আঁকা মানবদেহের যথার্থ রূপায়ণের স্থির লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন গুপ্তশিল্পী।

আসন ও মুদ্রার ব্যবহারে সতর্কতা ও দক্ষতা : মূর্তির বিভিন্ন ভাব-ভঙ্গি ও ক্রিয়াকলাপের সুষ্ঠু প্রকাশের জন্য শিল্পী সতর্কতা ও দক্ষতার সঙ্গে আসন ও মুদ্রা ব্যবহার করেছেন। আসন ও মুদ্রার প্রয়োগ-নৈপুণ্যে গুপ্ত ভাস্কর্য আরও সংবেদনশীল, নয়নাভিরাম ও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।

  • আসন : আসন তিন প্রকার – দণ্ডায়মান, উপবিষ্ট ও শয়ন। দণ্ডায়মান অর্থাৎ দাঁড়ানোর ভঙ্গি আবার বিবিধ। সোজা ও ঋজুভাবে দাঁড়ানোর নাম সমভঙ্গ। এ আসনের উদ্দেশ্য দেবতাকে প্রশান্ত ও অচঞ্চলভাবে উপস্থাপিত করা। একটু সামান্য বেঁকে দাঁড়ানোর ভঙ্গি আভঙ্গ। মাথা, কোমর ও পা হেলিয়ে দাঁড়ানোর নাম ত্রিভঙ্গ। ত্রিভঙ্গেরই উগ্ররূপ অতিভঙ্গ। বসার ভঙ্গিরও প্রকারভেদ আছে। কোনও ভঙ্গি বজ্রপর্যঙ্ক। বোধগয়ায় গৌতম বুদ্ধের বোধি জ্ঞান লাভের দৃশ্যের উপস্থাপনায় এ আসন ব্যবহৃত হয়। বজ্রদৃঢ় সংকল্পের প্রতীক এ আসন। এ আসন পদ্মাসন কিন্তু পদতল হবে ঊর্ধ্বমুখী, দেহের উপরার্ধ হবে ঋজু ও স্থির, চোখের দৃষ্টি হবে আনত। বজ্রপর্যন্ত আসনেরই শিথিলরূপ পদ্মাসন বা পদ্ম-পর্যন্ত আসন। এর থেকে আরও শিথিল আসন অর্ধ-পর্যঙ্ক বা ললিতামন। এ আসনে এক পা ঝুলে থাকে। মহারাজলীলা আসনে এক পা থাকে আসনের উপর। শেষোক্ত আসন দু’টিকে সুখাসনও বলে। শয়ন আসন বড় একটা দেখা যায় না। বুদ্ধদেবের মহাপরিনির্বাণ দৃশ্যে এ আসনের ব্যবহার দেখা যায়। অনওশায়ী বিষ্ণুর রূপকল্পনায়ও এই আসন।
  • মুদ্রা : মনের অন্তর্নিহিত ভাবের সুষ্ঠু বহিঃপ্রকাশের জন্য শিল্পী মুদ্রা অর্থাৎ হাত ও আঙুলের বিন্যাসের উপরও যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
    • এরূপ এক মুদ্রা অভয়মুদ্রা। দণ্ডায়মান ও উপবিষ্ট, উভয় আসনেই এই মুদ্রা আরোপিত হয়। এই মুদ্রায় দক্ষিণ করতল ডান কাঁধ বরাবর সামনের দিকে ঝুঁকে থাকে।
    • যোগাসীন, ধ্যানমগ্ন ভাব প্রকাশের জন্য ধ্যানমুদ্রা। বজ্রপর্যঙ্ক আসনে বসে ঊর্ধ্বমুখী পদতলের উপর উপরের দিকে মুখ করে হাতের চেটো রেখে ও আঙুলগুলি টান টান করে মেলে ধরে আনত দৃষ্টিতে অবস্থানই ধ্যানমুদ্রা। প্রাক্-গুপ্তপর্বেও এ দু’টি মুদ্রার প্রচলন ছিল কিন্তু এ পর্বে তাদের উপস্থাপনা নতুন মাত্রা পেল।
    • ভূমিস্পর্শ মুদ্রা ও ধর্মচক্রপ্রবর্তন মুদ্রা এ পর্বের দু’টি অভিনব মুদ্রা। মুদ্রা দু’টি বুদ্ধমূর্তির সঙ্গে সম্পর্কিত। ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় প্রকটিত হয়েছে বুদ্ধদেবের বুদ্ধত্ব লাভের ব্যঞ্জনা।
    • সারনাথে বুদ্ধদেবের প্রথম ধর্মপ্রচারের প্রতীক হল ধর্মচক্রপ্রবর্তন মুদ্রা। এই মূর্তির পাদপীঠে একটি চক্র এবং চক্রের দু’পাশে দু’টি হরিণ উৎকীর্ণ থাকে।
    • এ পর্বের বহুল প্রচলিত এক মুদ্রা বরদ মুদ্রা। উপবিষ্ট ও দণ্ডায়মান, উভয় ভঙ্গিতেই এই মুদ্রা ব্যবহৃত হয়। এ মুদ্রায় ডান হাত নীচের দিকে প্রসারিত থাকে। করতল থাকে ঊর্ধ্বমুখী কিন্তু ভূমির সঙ্গে সমান্তরাল।

মথুরা : ভাস্কর্যশিল্পের কেন্দ্ররূপে এ পর্বে কয়েকটি স্থান বা অঞ্চল বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে। মথুরা নিঃসন্দেহে এ পর্বের একটি শ্রেষ্ঠ শিল্পকেন্দ্র। এখানকার মূর্তিগুলি প্রধানত স্থানীয় লাল পাথর দিয়ে তৈরি হত। মূর্তিগুলি আকারে একটু বড়, গুরুভার, কাঠিন্যযুক্ত তবে কুষাণযুগের স্থূলতা, বিশালতা ও গাম্ভীর্য গুপ্তপর্বে অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। এ পর্বের মথুরার মূর্তিগুলিতে আধ্যাত্মিকতার স্পর্শ আছে ঠিকই তবু মূর্তিগুলিকে কেমন যেন নিষ্প্রাণ মনে হয়। যে মূর্তিগুলির ভঙ্গি দাঁড়ানো, সেগুলিও কেমন যেন স্তম্ভের মতো, গতিহীন। মূর্তির অঙ্গে পোশাকের ব্যবহার বেশি। বাঁ কাঁধ ও বাহুর উপর পোশাকের ভাঁজের রেখা স্পষ্ট। কুষাণপর্বের তুলনায় এ পর্বে ভাস্কর্য শিল্পে যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটেছে তবু সারনাথের তুলনায় মথুরার শিল্পমান নিম্নই থেকে গেছে।

  • মহারাজ ত্রিকমলের সময়কালীন বোধগয়ার বোধিসত্ত্ব মূর্তি এ পর্বের মথুরা ভাস্কর্যের এক উজ্জ্বল নিদর্শন। মূর্তিটি বোধগয়ায় পাওয়া গেছে ঠিকই কিন্তু যে পাথরে এই মূর্তিটি নির্মিত, সেই পাথরের গঠন ও প্রকৃতি এবং শিল্পরীতি প্রমাণ করে, মূর্তিটি মথুরায় তৈরি হয়েছিল। সময়ের নিরিখে এটিকে খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতকে ধার্য করা যায়। আয়তনে বড় ও গুরুভার এই বোধিসত্ত্বের মুখমণ্ডলে আধ্যাত্মিকতার ব্যঞ্জনা ফুটে উঠেছে। কয়েকটি রেখার সাহায্যে ভাস্কর অতি নিপুণ ভাবে বোধিসত্ত্বের দেহের উপর পোশাকের আভাস দিয়েছেন। এর ফলে বোধিসত্ত্বের দেহ সৌন্দর্য বস্ত্রের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়নি বরং দেহের সৌন্দর্য ও সুষমা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
  • বুদ্ধদেবের সমপদস্থানক মূর্তি মথুরার আর একটি শ্রেষ্ঠ ভাস্কর্যকীর্তি। শাক্যসিংহ এখানে সমানভাবে দু’পায়ের উপর ভর রেখে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর মুখখানিতে অপূর্ব দেবভাব ফুটে উঠেছে। ভ্রুযুগল ধনুকের মতো বাঁকানো। অর্ধনিমীলিত চোখ দু’টিতে করুণাধারা ঝরে পড়ছে। মাথার চুলগুলি ছোট ছোট শামুকের মতো। কান দু’টি প্রায় কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে। তাঁর ভারী দেহ বস্ত্রখণ্ডে আবৃত। ডান কাঁধ থেকে আরম্ভ করে ছোট থেকে বড় টানে রেখার সারি দিয়ে। বস্ত্রখানি রচিত হয়েছে। রেখার বিন্যাস এমন নিপুণতার সঙ্গে করা হয়েছে যাতে বুদ্ধদেবের দেহসৌন্দর্য ঢাকা পড়ে না যায়। বুদ্ধমূর্তির পিছনে রয়েছে প্রভা বা জ্যোতিমণ্ডল। প্রভামণ্ডলের সংযোজনায় দেবমূর্তির শোভা শতগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।
  • মথুরায় শুধু বুদ্ধ বা বোধিসত্ত্বমূর্তি নির্মিত হয়নি, শিব, বিষ্ণু এবং জৈন তীর্ঘঘরদেরও মূর্তি তৈরি হয়েছে। তবে সব মূর্তিই সমান মানের হতে পারেনি। খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতকে মথুরায় তৈরি এক প্রশান্তচিত্ত ও আত্মনিমগ্নভাবের শিবমূর্তি লন্ডন শহরের এক সংগ্রহশালায় রক্ষিত আছে। মথুরার এক বিষ্ণুমূর্তির কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। মূর্তিখানি নানা আভরণে সজ্জিত ও মুকুট পরিহিত। পৌরুষের সঙ্গে সৌন্দর্যের মিলন ঘটিয়েছেন শিল্পী এ মূর্তিটিতে।

সারনাথ : ভাস্কর্যশিল্পের কেন্দ্র হিসাবে উত্তরপ্রদেশের সারনাথের স্থান মথুরারও উপরে। গঙ্গার তীরবর্তী চুনারের বেলে পাথরে তৈরি সারনাথের বুদ্ধ-বোধিসত্ত্ব মূর্তিগুলি তাদের পেলব, কমনীয়, সুঠাম দেহ-গঠন, অত্যাশ্চর্য গতিময়তা ও আধ্যাত্মিক ব্যঞ্জনার গুণে ভারতশিল্পের অনুপম নিদর্শনরূপে স্বীকৃতি পেয়েছে। মূর্তিগুলির সুন্দর, ছন্দায়িত দেহগঠন, মসৃণ ও উজ্জ্বল অবয়ব, লঘুভার এবং প্রশান্ত ও আত্মনিমগ্ন ভাব সারনাথের ভাস্করদের অসামান্য শিল্পপ্রতিভার স্বাক্ষর বহন করে। শিল্পীদের কাজ এত সূক্ষ্ম ও সুচারু যে বুদ্ধ-বোধিসত্ত্ব মূর্তিগুলিকে দেখলে মনে হয় তারা পরম আনন্দে নিমগ্ন। মথুরার তুলনায় সারনাথের মূর্তির শরীরে পোশাকের ব্যবহার কম। দেহের গায়ে দু’একটি রেখার সাহায্যে পোশাকের প্রান্ত বোঝানো হয়েছে। সারনাথের ভাস্কর যে বুদ্ধ-বোধিসত্ত্বের মূর্তি উৎকীর্ণ করেছেন, তিনি পার্থিব জগতের কোলাহল, প্রলোভন থেকে মুক্ত, প্রজ্ঞার আলোকে উদ্ভাসিত, শান্ত, সমাহিত এক জ্যোতির্ময় পুরুষ।

  • সারনাথের শিল্পকর্মের মধ্যে বুদ্ধদেবের মহিমান্বিত ধর্মচক্রপ্রবর্তন মূর্তি জগৎ বিখ্যাত। এখানে বুদ্ধদেব বজ্রপর্যঙ্ক আসনে উপবিষ্ট। তাঁর হাত দু’টি বুকের কাছাকাছি। উজ্জ্বল, মসৃণ, নমনীয়, ছন্দায়িত তাঁর দেহগঠন। স্তিমিত তাঁর চোখ। স্বর্গীয় আনন্দধারায় তাঁর মুখমণ্ডল উদ্ভাসিত। মাথার চারদিকে প্রভামণ্ডলী। প্রভামণ্ডলী মথুরার মূর্তিতেও উৎকীর্ণ হয়েছে। মূর্তির পাদপীঠে একটি চক্র। তার দু’পাশে সাতজন লোক উপাসনারত। এঁদের পাঁচজন তাঁর প্রথম পাঁচ শিষ্য, যাঁরা সর্ব প্রথম বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। অন্য দু’জন সম্ভবত সেই দম্পতি যাঁদের বদান্যতায় মূর্তিখানি তৈরি হয়েছে। সারনাথের এই মূর্তিতে বুদ্ধদেবের যে ধ্যানমগ্ন, করুণাঘন, স্বর্গীয় আনন্দধারায় আবিষ্ট দিব্যরূপ ফুটে উঠেছে, তার কোনও তুলনা নেই। তথাগতের এই অনিন্দ্যসুন্দর মূর্তিখানির সামনে দাঁড়ালে বিশ্বকবির কথাই মনে পড়ে : “বসেছেন পদ্মাসনে প্রসন্ন প্রশান্ত মনে/ নিরঙ্কুশ আনন্দমুরতি।/ দৃষ্টিতে শান্তি ঝরে স্ফুরিছে অধর ‘পরে/ করুণার সুধা হাস্যজ্যোতি।”
  • সারনাথের বেশির ভাগ মূর্তিই উৎকৃষ্ট ভাস্কর্যশিল্পের নিদর্শন। কিন্তু বুদ্ধদেবের ধর্মচক্রপ্রবর্তন মূর্তি অতুলনীয়। তবে একটা কথা বোধহয় স্পষ্ট করে বলা যায়। বুদ্ধ-বোধিসত্ত্বের মূর্তিগঠনে যে শিল্পসৌকর্য ফুটে উঠেছে, ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীদের মূর্তিতে তেমনটি দেখা যায় না। এ প্রসঙ্গে ভারত কলাভবনে রক্ষিত কার্তিকেয়ের মূর্তি এবং সারনাথ সংগ্রহশালার লোকেশ্বর শিবের মূর্তির উল্লেখ করা যায়। মূর্তি দু’টির গঠন ভঙ্গিমায় গুরুভার রয়েছে। আধ্যাত্মিক ভাবেরও অভাব ঘটেছে।

মনকুওয়ার ও দেওগড় : মথুরা ও সারনাথ ছাড়া উত্তরপ্রদেশের আরও কয়েকটি স্থানে এ যুগের ভাস্কর্যের নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মনকুওয়ার ও দেওগড়ের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। প্রথমোক্ত স্থান থেকে বিরাট এক বুদ্ধমূর্তি পাওয়া গেছে। মূর্তির পাদপীঠে উৎকীর্ণ একটি লেখ থেকে জানা যায়, এটি ১২৯ গুপ্তাব্দ বা ৪৪৯ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ভারী ও রুক্ষএই মূর্তিটিতে বুদ্ধদেব মুণ্ডিতমস্তকরূপে প্রদর্শিত হয়েছেন। মূর্তির গড়নে মথুরা শিল্পরীতির প্রভাব পড়েছে কিন্তু বস্ত্রের বিন্যাসে আছে সারনাথ শৈলীর ছাপ। দেওগড়ের দশাবতার মন্দির গুপ্তভাস্কর্যের এক রত্ন-খনি। মন্দিরের পাদদেশে রামায়ণ ও মহাভারতের বিভিন্ন কাহিনি উৎকীর্ণ হয়েছে। মূর্তিগুলির দেহের গড়ন বলিষ্ঠ ও রুক্ষ কিন্তু মুখমণ্ডলে প্রশান্তি ও নির্লিপ্ততার আভাস আছে। তুলনায় মন্দির দেয়ালের কুলুঙ্গির মুর্তিগুলি অনেক পরিশীলিত, অনেক দৃষ্টিনন্দন। এই মন্দিরের নর ও নারায়ণের প্রতিকৃতি তাদের ছন্দায়িত দেহগঠন ও আত্মনিমগ্ন ভঙ্গির গুণে গুপ্তশিল্পের এক উৎকৃষ্ট নিদর্শনরূপে গণ্য হতে পেরেছে। কিন্তু এ মন্দিরের অনন্তশায়ী বিষ্ণুর মূর্তিতে সে ব্যঞ্জনা প্রতিফলিত হয়নি। মূর্তির দেহগঠনে কমনীয়তা, ছন্দ বা গতিময়তা নেই, আছে কাঠিন্য, রুক্ষতা ও জড়তা। অতি সাধারণ মানের শিল্পকর্ম এটি। বিষ্ণু এখানে নিঃসঙ্গ নন। বিষ্ণুর পদসেবারত লক্ষ্মী, মাথার উপরে প্রস্ফুটিত পদ্মে চতুর্মুখ ব্রহ্মা, বৃষপৃষ্ঠে উমা-মহেশ্বর, ঐরাবতে দেবরাজ ইন্দ্র ও ময়ূরবাহন দেবসেনাপতি কার্তিকেয়, সকলেই এ ভাস্কর্যফলকে রূপায়িত হয়েছেন। মূর্তির নিম্নদেশে দেবসেনা ও কতিপয় নারীমূর্তি খোদিত রয়েছে। কিন্তু এত আয়োজন সত্ত্বেও মূর্তিগুলিকে কেমন যেন গতিহীন, প্রাণহীন বলে মনে হয়।

মধ্যপ্রদেশ : মধ্যপ্রদেশের গালিয়র, বিদিশা, উদয়গিরি প্রভৃতি স্থানে গুপ্তযুগের অনেক ভাস্কর্য আবিষ্কৃত হয়েছে।

  • গ্বালিয়রে পাওয়া গেছে এক গন্ধর্ব দম্পতির মূর্তি। মূর্তিটি বর্তমানে স্থানীয় সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে। শিল্পী যেভাবে ছেনি এবং বাটালির সাহায্যে পাথরে বাঁধাহীন আকাশবিহারের ভাব মূর্ত করে তুলেছেন, তা বিস্ময়কর।
  • গন্ধর্ব দম্পতির মূর্তি এমন সুন্দরভাবে উৎকীর্ণ হয়েছে যে মনে হচ্ছে তারা দু’জনে সহজ ও স্বচ্ছন্দ গতিতে আকাশপথে উড়ে চলেছে, আর গন্ধর্ববধূর বস্ত্রখানি বাতাসে আন্দোলিত হচ্ছে।
  • বিদিশার মকরবাহিনী গঙ্গাদেবীর মূর্তিখানিও অতি মনোরম। মকরের পিঠে গঙ্গাদেবী রমণীয় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন। এ স্থানে গুপ্তযুগের একখানি নরসিংহ মূর্তিও পাওয়া গেছে।
  • উদয়গিরি গুহায় উৎকীর্ণ বরাহরূপী বিষ্ণুর মূর্তিও সে যুগের ভাস্কর্যশিল্পের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনেই মূর্তিটি উৎকীর্ণ হয়েছে। বরাহ অবতার ধারণ করে বিষ্ণু সদ্য তাঁর ডান দিকের প্রলম্বিত দাঁতের সাহায্যে মা ধরিত্রীকে অনন্ত জলধি থেকে উদ্ধার করেছেন। তাঁর ডান পাখানি একটু উঁচুতে আছে আর বাঁ পাখানি রাখা হয়েছে সামান্য নিচে, কুণ্ডলীকৃত আদিশেষের দেহের উপর। তাঁর ডান হাত কোমরে, বাঁ হাত হাটুর উপর। এক দম্পতি করজোড়ে তাঁর বন্দনা করছেন। (এই দম্পতির পরিচয় সম্পর্কে পণ্ডিতমহলে বিতর্ক আছে। আলেকজান্ডার কানিংহাম ও জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ( J. N. Banerjea, The Development of Hindu Iconography New Delhi, 1985, পৃষ্ঠা ৪১৪) মনে করেন, এঁরা সমুদ্রের রাজা ও রানি। কেউ কেউ এঁদের নাগ দম্পতি বলে শনাক্ত করেছেন।) ভাস্কর্যফলকের উপরার্ধে শ্রেণিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন দেবতা ও ঋষিগণ। বন্দনারত দম্পতি, দেবতা এবং ঋষিদের সকলকে ক্ষুদ্রাকারে উৎকীর্ণ করা হয়েছে। এতে বিষ্ণুর বিরাটত্বই প্রকাশ পেয়েছে। বিষ্ণুর ভঙ্গি বীরত্ব ব্যঞ্জক ও দৃপ্ত। বিষ্ণুর বাঁ দিকে মকরবাহিনী গঙ্গা ও কূর্মবাহিনী যমুনার মূর্তি উৎকীর্ণ রয়েছে।

পূর্ব ভারত : পূর্ব ভারতের নানা স্থানে গুপ্তযুগের ভাস্কর্য আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব স্থানগুলির মধ্যে আছে বিহারের চণ্ডীমৌ, সুলতানগঞ্জ ও রাজগির, পশ্চিমবঙ্গের কাশীপুর ও তমলুক, বাংলা দেশের দেওড়া, বিহারেইল ও মহাস্থান এবং অসমের দহ পর্বতিয়া। যে আধ্যাত্মিক চেতনা সারনাথ ভাস্কর্যের প্রাণ, পূর্ব ভারতীয় মুর্তিশিল্পে তার বড় একটা প্রকাশ দেখা যায় না। মথুরার শিল্পের বলিষ্ঠতাও এখানকার ভাস্কর্যে মূর্ত হয়ে ওঠেনি। পূর্ব ভারতের ভাস্কর তাঁর শিল্পকর্মে মানবিক ভাবের প্রতিই বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ফলে তাঁর হাতে গড়া মূর্তিগুলি হয়ে উঠেছে আবেগপ্রবণ, প্রাণবন্ত, ঘরোয়া ও পার্থিব।

  • সুলতানগঞ্জের তামার বিরাট বুদ্ধমূর্তির কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। মূর্তিটি বর্তমানে ইংল্যান্ডের বার্মিংহাম শহরের চারুকলা কেন্দ্রে সংরক্ষিত আছে। এতে দেখা যাচ্ছে, বুদ্ধদেব আভঙ্গ ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছেন। বস্ত্র দিয়ে আবৃত তাঁর দেহ। কিন্তু বস্ত্রখানি এত সূক্ষ্ম ও মসৃণ যে এতে তাঁর সুন্দর দেহাবয়ব ঢাকা পড়েনি। মূর্তিটির ঔজ্জ্বল্য ও আত্মনিমগ্ন ভাব লক্ষণীয়। বস্ত্র-বিন্যাসের দিক থেকে মথুরা, কিন্তু গড়ন ও ভাবের প্রেক্ষিতে এ মূর্তির সঙ্গে সারনাথ শিল্পের ঘনিষ্ঠ যোগ রয়েছে। কিন্তু যে পার্থিবতা বা আবেগপ্রবণতা পূর্ব ভারতীয় শিল্পের বৈশিষ্ট্য তারও ব্যঞ্জনা এই মূর্তিতে সুনিশ্চিতভাবে ফুটে উঠেছে।
  • রাজগিরে মনিয়ার মঠের প্রাচীর গাত্রে কয়েকজন নারীর আস্তর-নির্মিত প্রতিকৃতি আছে। বর্তমানে প্রতিকৃতিগুলির ভগ্নাংশমাত্র অবশিষ্ট আছে। তবু যেটুকু আছে, তাতে মূর্তিগুলির সুডৌল গড়ন ও ইন্দ্রিয় সচেতনার আভাস সুস্পষ্ট।
  • রাজশাহী জেলার বিহারেইলের দণ্ডায়মান বুদ্ধমূর্তিতে আবেগপ্রবণতা কম, আত্মনিমগ্ন ভাবই বেশি।
  • এর ঠিক বিপরীত চিত্র প্রকাশ পেয়েছে বগুড়া জেলার দেওড়া ও চব্বিশ পরগনার কাশীপুর গ্রামের দু’টি সূর্যমূর্তিতে। মূর্তি দু’টি গতিময় ও বলিষ্ঠ কিন্তু আবেগপ্রবণ।
  • বগুড়া জেলার মহাস্থানের মঞ্জুশ্রীর ব্রোঞ্জ নির্মিত মূর্তির দেহগড়ন মসৃণ, দাঁড়ানোর ভঙ্গি মনোমুগ্ধকর, মুখ ও হাতের গড়ন চমৎকার। মূর্তিটিতে আত্মনিমগ্নতার ছাপ আছে কিন্তু আবেগপ্রবণতা ততটা প্রখর নয়।
  • অসমের দরং জেলার দহ পর্বতিয়ায় পাওয়া দেবী গঙ্গা ও যমুনার মূর্তি-ফলক দু’টিও কম আকর্ষণীয় নয়। মকরবাহিনী গঙ্গা ও কূর্মবাহিনী যমুনার মাথার চারদিকে প্রভাবলী আছে ঠিকই তবু মূর্তি দু’টিতে আধ্যাত্মিক ব্যঞ্জনা ফুটে ওঠেনি।

অজন্তা ও বাঘ : অজন্তা ও বাঘের গুহাগুলির ভিতরে, কখনওবা দেয়ালে, আবার কখনও কখনও স্তদ্ভদেশে বুদ্ধদেবের দাঁড়ানো বা উপবিষ্ট ভঙ্গির প্রচুর মূর্তি খোদিত হয়েছে। অজন্তার পাথর শক্ত হওয়ায় মূর্তিগুলি মোটামুটি অক্ষতই রয়ে গেছে। তুলনায় বাঘের পাথর অনেক নমনীয়। ফলে বাঘগুহার সিংহভাগ মূর্তি বিনষ্ট হয়ে গেছে। অজন্তা ও বাঘের মূর্তিগুলির দেহ গঠন সুষম ও বলিষ্ঠ কিন্তু তাদের মধ্যে সারনাথের সে ঔজ্জ্বল্য বা আত্মনিমগ্ন ভাব নেই। মূর্তিগুলির মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে এক নিদ্রাতুর, ভাবলেশহীন অভিব্যক্তি। শিল্পসৌন্দর্যে অজন্তা ও বাঘের ভাস্কর্যসত্তার সারনাথের সমগোত্রীয় নয়।

পোড়ামাটির ভাস্কর্য : রাজস্থানের বিকানীর ও হনুমানগড়, উত্তরপ্রদেশের কোসম, রাজঘাট ও অহিচ্ছত্র, বিহারের চিরান্দ, পশ্চিমবঙ্গের বাণগড় ও পান্না এবং বাংলাদেশের মহাস্থানগড় প্রভৃতি স্থানে গুপ্তযুগের পোড়ামাটির ফলকের প্রচুর নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। গৃহসজ্জার উপকরণ ও খেলনা হিসাবে যেমন এগুলি ব্যবহার করা হত, তেমনি মন্দিরের অঙ্গসজ্জার কাজেও এদের ব্যবহার ছিল।

  • কানপুরের নিকটবর্তী ভীতরগাঁও-এর ইষ্টক নির্মিত মন্দিরে পোড়ামাটির ফলকের বহুল ব্যবহার দেখা যায়। পৌরাণিক কাহিনি, দেব-দেবীর মূর্তি এবং সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনকাহিনি, এসব পোড়ামাটির ফলকগুলিতে রূপায়িত হয়েছে।
  • তমলুকের নিকট পান্না গ্রামে পাওয়া হাস্যময়ী অপ্সরা মূর্তিটি আবেগ ও মাধুর্যে মণ্ডিত।
  • মহাস্থানগড়ে আবিষ্কৃত দম্পতি মূর্তিটিও কম আকর্ষণীয় নয়।

গুপ্তযুগের বেশির ভাগ পোড়ামাটির ফলকে গেরিমাটি, হলুদ ও লাল রঙের প্রলেপ লাগানো হত। এতে ফলকটি আরও মসৃণ ও আকর্ষণীয় হয়ে উঠত।

মুদ্রা

গুপ্তপর্বের স্বর্ণমুদ্রার উভয়পৃষ্ঠে রাজা, রানি ও তাঁদের উপাসিত দেব-দেবীর প্রতিকৃতি উৎকীর্ণ হয়েছে। এসব প্রতিকৃতি অতি পরিচ্ছন্ন ও মনোরম। রাজারা কখনও রাজদণ্ডধারী, কখনও শিকাররত, কখনও শস্ত্রধারী, কখনওবা বীণাবাদনরত ইত্যাদি নানা বিচিত্র ভঙ্গিতে মুদ্রায় রূপায়িত হয়েছেন। মুদ্রার গড়ন, অক্ষরের বিন্যাস ও প্রতিকৃতির অসাধারণ উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে সে যুগের শিল্পীদের রসবোধ ও সৌন্দর্যচেতনা অতি সুন্দরভাবে প্রকাশ পেয়েছে। গুপ্তযুগের স্বর্ণ মুদ্রাগুলি সত্যিই অসাধারণ। প্রাচীন ভারতে এ ধরনের অপূর্ব সুন্দর স্বর্ণমুদ্রা আর কোনও দেশীয় রাজার আমলে উৎকীর্ণ হয়নি।

চিত্রকলা

অজন্তা :

  • আবিষ্কার ও স্থান : অজন্তার গুহাগুলি এ যুগের চিত্রশিল্পের অমূল্য ভাণ্ডার। অজন্তায় সর্বসমেত ২৯টি গুহার মধ্যে ১৬টি গুহায় কমবেশি ছবি ছিল। কিন্তু বর্তমানে ১, ২, ৯, ১০, ১৬, ১৭ এবং ১৯ সংখ্যক গুহাতেই ছবি আছে, বাকি সব বিনষ্ট হয়েছে। বহুদিন পর্যন্ত অজন্তার গুহাগুলি বন-জঙ্গলে ঢাকা পড়েছিল। জনসমাজের কাছে অজন্তা ছিল সম্পূর্ণ অপরিচিত, অপরিজ্ঞাত। ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে তদানীন্তন মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির সামরিক বিভাগের একদল কর্মচারী এখানে শিকার করতে এসে জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেলেন। জন্তু-জানোয়ারের ভয়ে রাত্রিতে তাঁরা এই গুহাগুলির একটিতে আশ্রয় নেন। পরদিন ভোর হলে গুহাগুলি দেখে তাঁরা বিস্মিত, হতচকিত হন এবং বিষয়টি মাদ্রাজ সরকারের গোচরে আনেন। ধীরে ধীরে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে অজন্তা সম্পর্কে বিপুল আগ্রহের সঞ্চার হয়। এ স্থান তখন হায়দ্রাবাদের নিজাম বাহাদুরের অধিকারভুক্ত ছিল। বর্তমানে অজন্তা মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদ জেলার অন্তর্ভুক্ত।
  • ছবি আঁকার উপকরণ : অজন্তায় জলরঙে আঁকা ছবিগুলি দেখা যাবে গুহার দেয়ালে ও ছাদের তলদেশে। কিন্তু দেয়ালই হোক বা ছাদের তলদেশই হোক, তা ছিল অসমান। অসমান এ জমিকে আস্তর লাগিয়ে সমান করা হত। শিরিষের আঠা, মাটি, গোবর, আর মিহি করে গুঁড়ো করা পাথরের বালি একসঙ্গে মিশিয়ে পুরু করে একটি আস্তর দেওয়া হত। কখনও কখনও এই প্রলেপের সঙ্গে সরু করে কাটা খড়কুচি বা ধানের তুষ অথবা পশুর লোমের মিশাল থাকত। অনেক সময় পুরু এই আস্তরের উপর খুব সরু আর একটি সাদা প্রলেপ লাগানো হত। শেষে এ রকম জমির উপরই ছবি আঁকা হত।
  • ছবি আঁকার পদ্ধতি : অজান্টার শিল্পী কী পদ্ধতিতে ছবি আঁকতেন, সে সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ মহলে বিতর্ক আছে –
    • অনেকের মতে অজন্তায় চিত্রাঙ্কনে ফ্রেসকো রীতি অনুসরণ করা হয়েছে। এই পদ্ধতিতে আস্তর ভিজে থাকতে থাকতে রেখাচিত্র এঁকে দরাজভাবে রঙ দিতে হয়। আস্তর শুকোবার আগেই ছবি সম্পূর্ণ হওয়া চাই। এই পদ্ধতিতে একবারে বেশি জমিতে কাজ করা সম্ভব নয়। ফলে কোনও বড় ছবি আঁকতে হলে সেটিকে ভাগে ভাগে শেষ করতে হয়। এর ফলে ছবিতে এক ধরনের জোড় দেখা যায়। অজন্তার ছবিতে সে ধরনের জোড় নেই। তাছাড়া, ভিজে জমিতে ছবি আঁকতে হলে উপরের প্রলেপটি অন্তত সিকি ইঞ্চি পুরু হওয়া দরকার। কিন্তু অজন্তার উপরের আস্তরটি ডিমের খোলার মতো পাতলা।
    • অজন্তায় ‘টেম্পেরা’ রীতি অনুসারে ছবি আঁকা হয়েছিল, এ মত অনেকের কাছেই যুক্তিগ্রাহা বলে মনে হয়েছে। এই রীতি অনুসারে প্রথমে আস্তরটিকে বেশ ভালো করে শুকিয়ে নিতে হয়। তারপর চুনগোলা জলে জমিটিকে ভালো করে ভিজিয়ে নিয়ে ছবি আঁকার কাজ শুরু করতে হয়।
  • সময়ের বিচারে শ্রেণীভেদ : সময়ের বিচারে অজন্তার গুহাচিত্রগুলিকে তিনটি বিভিন্ন পর্যায়ে বিভক্ত করা যায় – আদি পর্ব, বাকাটক-গুপ্ত পর্ব ও উত্তর পর্ব। খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় ৩য় শতক পর্যন্ত সময় আদি পর্ব। এ সময় নবম ও দশম গুহার ছবিগুলি আঁকা হয়। দশম গুহার কয়েকটি ছবি খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতাব্দীর শেষের দিকে অঙ্কিত হয়েছিল, এরূপ মতও আছে। পঞ্চদশ-বিংশ ও ষড়বিংশ গুহার ছবিগুলি বাকাটক-গুপ্ত যুগে অঙ্কিত হয়েছিল। প্রথম, দ্বিতীয় ও ঊনত্রিংশ গুহার ছবিগুলি খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের শেষের দিকে ও ৭ম শতকের প্রথমার্ধে চিত্রায়িত হয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতক থেকে ৭ম শতাব্দীর প্রথম ভাগ – এই সুদীর্ঘ প্রায় আট শতক ধরে অজন্তার গুহাগুলিতে ছবি আঁকার পর্ব চলছিল। গুহাগুলি প্রায়ান্ধকার। বাইরের ধাতব আয়না থেকে আলো প্রতিফলিত হত। সেই প্রতিফলিত আলোতেই ছবি আঁকা হত।
    • প্রথম পর্ব : বুদ্ধদেবের জন্ম-জন্মান্তরের কাহিনি অবলম্বন করেই অজন্তার প্রথম পর্বের ছবিগুলি রচিত হয়েছে। ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ থেকেও অজন্তার শিল্পী জীবনের রূপ, রস ও গন্ধের প্রতি অপরিসীম আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। প্রকৃতির বৈভব, বৈচিত্র্য ও প্রাণস্পন্দন তাঁর অন্তরে দোলা দিয়েছে। তাই ধর্ম বিষয়ক ছবি আঁকতে গিয়েও তিনি যেখানে সুযোগ পেয়েছেন সেখানেই ফুল, লতা-পাতা, জীব-জন্তু, পশু-পাখি, গন্ধর্ব-কিন্নর, মানুষ, সামাজিক আচার-বিচার তাঁর তুলিতে মনোরম ছন্দে জীবন্ত, প্রাণবন্তরূপে ফুটিয়ে তুলেছেন। অথচ সব কিছুর মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে শিল্পীর পরিমিতি বোধ, ভারসাম্য বজায় রাখার তাঁর সযত্ন প্রয়াস, তাঁর পরিশীলিত, সংযত চিত্ত বৃত্তি। তিনি ছবি এঁকেছেন দেয়ালে, দুই সমান্তরাল সরল রেখার বন্ধনীর ভিতরে। খুব যে বেশি রঙ তিনি ব্যবহার করেছেন তা নয়। লাল, ফিকা সবুজ, গেরিমাটি, সাদা ও কালো রঙ দিয়েই তিনি তাঁর ছবি আঁকার কাজ সম্পন্ন করেছেন। ফিকা সবুজ দিয়ে তিনি এঁকেছেন মানুষের গায়ের রঙ। ত্রিভুজ ও চতুষ্কোণ এঁকে তিনি পাহাড়ের ব্যঞ্জনা ফুটিয়েছেন। ঘূর্ণিরেখার সমাবেশ ঘটিয়ে তিনি মেঘ দেখিয়েছেন। নবম গুহার একদল হাতির বনে বিচরণের ছবি এবং দশম গুহার ষড়দন্ত জাতকের কাহিনিমূলক চিত্রটি সে যুগের শিল্পীদের কাজের দু’টি উৎকৃষ্ট নিদর্শন।
    • বাকাটক-গুপ্ত পর্ব : আদি পর্বের মতো বাকাটক-গুপ্ত পর্বের ছবিগুলিও মুখ্যত জাতকে বর্ণিত গৌতম বুদ্ধের জন্ম জন্মান্তরের কাহিনিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। এ পর্বের শিল্পী সৃষ্টির উন্মাদনায় মাতোয়ারা। শিল্পসাধনায় তিনি সিদ্ধকাম। ফলে এ যুগে শুধু ছবির সংখ্যাই বৃদ্ধি পেল না, সুনিপুণ হাতের তুলির টানে ছবি হয়ে উঠল আরও বাঙ্ময়, আরও প্রাণবন্ত, আরও আকর্ষণীয়। পূর্ববর্তী যুগে শুধু গুহার দেয়ালের কয়েকটি স্থানেই ছবি আঁকা হয়েছিল। কিন্তু এ পর্বে আর সে বাধা থাকল না। দেয়ালের সর্বাঙ্গ, ছাদ ও স্তম্ভ সর্বত্রই রঙ ও রেখায় ভরে উঠল। রঙের বৈচিত্র্যও গেল বেড়ে। অন্যান্য রঙ তো ছিলই। শুরু হল হরিতাল এবং ফিকা ও গাঢ় নীল রঙের ব্যবহার। ফিকা নীল রঙ তৈরি হত নীল গাছ থেকে, গাঢ় নীল রঙ প্রস্তুত হত আমদানি করা ল্যাপিজ লাজুলি পাথর থেকে। আদি যুগের শিল্পী ফিকা সবুজ দিয়ে মানুষের গায়ের রঙ এঁকেছেন। কিন্তু এ পর্বে দেখা গেল, সামাজিক মর্যাদার তারতম্য অনুসারে ছবিতে মানুষের গায়ের রঙের পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে। রাজা ও রানির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে হালকা বেগনি, হালকা হলদে এবং হালকা লাল রঙ। দাস-দাসী বা অতি সাধারণ লোকদের গায়ের রঙ আঁকা হয়েছে ইন্ডিয়ান রেড দিয়ে। এই পর্বের ছবিতে মানুষের শরীরকে কত না ভাবে ও ভঙ্গিতে উপস্থাপিত করা হয়েছে। ভগবান বুদ্ধ মানবদেহ ধারণ করেছিলেন। তাই শিল্পীর কাছে মানবদেহ নতুন ব্যঞ্জনা পেল। নানা রকম করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মানুষের শরীর আঁকাতেই শিল্পী পেলেন তাঁর পরম তৃপ্তি ও চরম চরিতার্থতা। অজন্তায় গুহার দেয়ালে, ছাদের তলদেশে, সর্বত্র মানবজন্মের জয়গান ঘোষিত হয়েছে। একই সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে রূপ, রস ও গন্ধে ভরা পৃথিবীকে, সুনিপুণভাবে, প্রাণবন্ত করে। অজন্তা চিত্রের এক বৈশিষ্ট্য হল তার বিশাল ব্যাপ্তি। সন্দেহ নেই, জন্ম-জন্মান্তরের বুদ্ধদেব অজন্তা চিত্রশালার প্রাণপুরুষ। তবু শিল্পীর তুলিতে ফুটে উঠেছে কত না চরিত্র, কত না চিত্র! দেব-দেবী, রাজা-রানি, গন্ধর্ব-অপ্সরা, দাস-দাসী, সৈন্য-সামন্ত, মন্ত্রী-সভাসদ, সাধু-সন্ন্যাসী, কুলনারী, হলকর্ষণরত কৃষক, লোভী, ভিখারি, ধীবর, সাপুড়ে, গোয়ালা, চোর-ডাকাত, পশু-পাখি, গাছ-পালা, লতা-পাতা, ফুল-ফল, গহনাপত্র, প্রাসাদ-কুটির, কাপড়-চোপড়, প্রসাধনসামগ্রী, অস্ত্রশস্ত্র, দোকানপাট, যানবাহন, সমুদ্রযাত্রা, কল্পলোকের জীবজন্তু যা কিছু শিল্পী চোখ মেলে দেখেছেন বা তাঁর কল্পনায় এসেছে, তাই তাঁর তুলির টানে মূর্ত হয়ে উঠেছে। রঙের ঔজ্জ্বল্যে ও বৈচিত্র্যে, রেখার সাবলীলতায় ও ছন্দায়িত রূপে এবং আলোছায়ার সুষম সম্পাতে এ পর্বের ছবিগুলি উদ্ভাসিত, প্রাণবন্ত ও গতিময়। ষোড়শ ও সপ্তদশ গুহা বাকাটক-গুপ্ত পর্বের চিত্রশিল্পের এক স্বর্ণভাণ্ডার। এই গুহা দু’টিতে অঙ্কিত আছে কৃষ্ণা অপ্সরা ও মরণাহতা জনপদকল্যাণীর অবিস্মরণীয় দু’টি ছবি। সপ্তদশ গুহার বুদ্ধদেব, যশোধরা এবং রাহুলের ছবিটি অতি মর্মস্পর্শী। কপিলবস্তুতে এসে ভিক্ষুর বেশে বুদ্ধদেব স্ত্রী যশোধরা ও পুত্র রাহুলের কাছ থেকে ভিক্ষা গ্রহণ করছেন। বুদ্ধের প্রশান্ত, সমাহিত রূপ সারনাথ বুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দেয়। রাহুলের মুখের সরলতা ও যশোধরার মুখে আত্ম নিবেদনের ভাবটি সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। কেউ কেউ ছবিটির অন্য ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। তাঁদের মতে এ খণ্ডচিত্রে যশোধরা বা রাহুলের প্রতিকৃতি নেই, প্রতিকৃতি আছে বুদ্ধদেবের কৃপাপ্রার্থী এক বালক ও তার মায়ের। এ পর্বে কয়েকটি কৌতুক চিত্রও আঁকা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে সপ্তদশ গুহার লোভী ব্রাহ্মণের ছবিটির কথা বলা যায়। এই লোভী ব্রাহ্মণের সামনের পাটির দাঁত কটি নেই। তার মুখে ছাগলের মতো দাড়ি। কখনও মাথাটি বড় করে, কখনও বেঁটে মানুষের বিরাট ভুঁড়ি এঁকে, আবার কখনওবা হাত-পা সরু বা মোটা করে কৌতুক চিত্র আঁকা হয়েছে।
    • বাকাটক-গুপ্তোত্তর পর্ব : অজন্তার শেষ পর্যায়ের অর্থাৎ বাকাটক-গুপ্তোত্তর পর্বের ছবিগুলিতে অবক্ষয়ের লক্ষণ সুস্পষ্ট। প্রথম ও দ্বিতীয় গুহার ছবিগুলি এ পর্বেই আঁকা হয়েছিল। এ পর্বের মানুষের ছবিগুলিতে পারি মিতির অভাব লক্ষ করা যায়। কখনও কখনও মানুষের মাথাকে অস্বাভাবিক বড় করে দেখানো হয়েছে, নিম্নাঙ্গকে সরু ও দুর্বল করে আঁকা হয়েছে, দেহকে অযথা মেদবহুল করা হয়েছে। রঙের সে বৈচিত্র্য ও ঔজ্জ্বল্যও আর নেই। স্ত্রী-পুরুষ ভেদে মুখের বিভিন্নতাও নেই। কী স্ত্রী, কী পুরুষ, সকলের মুখই একই ধরনের। সেজন্য এ পর্বের বেশির ভাগ ছবি বৈচিত্র্যহীন, প্রাণহীন। তবে কিছু ব্যতিক্রমও আছে। প্রথম গুহার পদ্মপাণি বোধিসত্ত্বের চিত্রখানি অজন্তার শ্রেষ্ঠ চিত্রের একটি। ছবিখানিতে বোধিসত্ত্ব ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিতে এক দিব্যকান্তি তরুণরূপে উপস্থাপিত। তাঁর মাথায় মণিমুক্তাখচিত মুকুট, ডান হাতে একটি পদ্মফুল। তাঁর দৃষ্টি অর্ধনিমীলিত। শান্ত, কিন্তু বেদনার করুণ রসে সিক্ত তাঁর মুখশ্রী। রঙ ও তুলির টানে শিল্পী কত সুন্দরভাবে বোধিসত্ত্বের মুকুটের ঔজ্জ্বল্য এবং অবয়বের পেলবতা ও স্বর্গীয় সুষমা প্রকাশ করেছেন। প্রথম গুহার মহাজনক জাতকের চিত্র কাহিনিটিও অপূর্ব। প্রথম গুহার একটি ছবিতে আছে, চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশী (৬১১-৬৪২ খ্রিস্টাব্দ) ইরানের রাজা দ্বিতীয় পরভেজ খুসরুর পাঠানো দূতকে অভিবাদন জানাচ্ছেন। উৎকৃষ্ট চিত্রকলার হয়তো এটি কোনও নিদর্শন নয় কিন্তু সমকালীন ভারতের এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিলরূপে এই ছবিখানির বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। এ কথা নিঃসংশয়ে বলা চলে, কয়েক শতাব্দী ধরে ভারতীয় ভাস্কর্য ও চিত্রশিল্পের এক প্রধান কেন্দ্র ছিল এই অজন্তা। প্রাচীন যুগের সেসব নামহীন, পরিচয়হীন শিল্পীরা তাঁদের অতুলনীয় দক্ষতা ও অত্যাশ্চর্য সৃজন প্রতিভাবলে যেসব মূর্তি গড়েছেন বা চিত্র এঁকেছেন, তা ভাস্কর্যশিল্প ও চিত্রকলার উৎকৃষ্ট নিদর্শনরূপে আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে। শিল্প যখন সমকালের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বজনীন ও চিরন্তন আবেদনে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে তখনই হয় তার চরম সার্থকতা। এই সার্থক ও শাশ্বত শিল্পই রচিত হয়েছে অজন্তার নির্জন গিরিকন্দরে শিল্পীদের কয়েক শতাব্দীর নিরলস প্রচেষ্টায়। অজন্তার ভাস্কর্য মূলত ধর্মমূলক। কিন্তু এখানকার চিত্রাবলিতে একাধারে প্রকাশ পেয়েছে ত্যাগ ও সন্ন্যাসের মাহাত্ম্য, অন্যদিকে ঘোষিত হয়েছে রূপ, রস ও গন্ধে ভরা দৃশ্যমান জগতের মহিমা। ঐশী জগৎ ও মাটির পৃথিবী, তথা স্বর্গ এবং মর্ত্যের মিলনের লক্ষ্যেই কি শিল্পীদের এ উদ্যম? হয়তোবা তাই।

বাঘ : বাঘে গুহার সংখ্যা নয়। তাদের মধ্যে হাতিখানা ও রঙমহল গুহা দু’টির দেয়ালে ও ছাদের তলদেশে কয়েকখানি ছবি এখনও দেখা যায়। এখানে যেমন বুদ্ধদেব ও বোধিসত্ত্বদের ছবি আছে তেমনি আছে রাজা-রানি, নর্তক-নর্তকী, হাতি-ঘোড়া, নাচ-গান ও বিলাস-বৈভবের ছবি। অর্থাৎ ত্যাগ-তিতীক্ষা ও ভোগ-ঐশ্বর্য, উভয় জগৎই বাঘ গুহার চিত্রাবলিতে প্রতিফলিত হয়েছে। হাতির ছবিগুলি অসাধারণ। তাদের গতিময় ও প্রাণবন্ত রূপ ছবিতে অনবদ্যরূপে ফুটে উঠেছে। হাতিখানা গুহার চামরব্যঞ্জনরত মহিলার ছবি বা রঙমহল গুহার শোকার্ত রাজকন্যার চিত্রখানি সপ্রশংস উল্লেখের দাবি রাখে।

অজন্তা-এলোরা ও গুপ্ত রাজকুল : গুপ্তযুগের স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলা সম্পর্কিত আলোচনায় অজন্তা ও এলোরার প্রসঙ্গ বারবার উঠেছে। সব বিশেষজ্ঞরাই তাই করেছেন। কিন্তু গুপ্তরাজ্য তথা গুপ্তযুগের আলোচনায় অজন্তা বা এলোরার প্রসঙ্গ টেনে আনা হয়তো অনুচিত। মনে রাখতে হবে, এ স্থান দু’টি গুপ্তরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল না, বাকাটক রাজাদের কর্তৃত্বাধীন ছিল। রাজারা অনেক সময় পররাজ্যেও জনহিতকর বা ধর্মীয় কার্যাদিতে অংশগ্রহণ করে থাকেন। গুপ্ত সম্রাটরা অজন্তা বা এলোরায় এ ধরনের কাজে লিপ্ত ছিলেন বলে জানা যায় না। খ্রিস্টীয় ৪র্থ, ৫ম ও ৬ষ্ঠ শতকে বাকাটক শাসনাধীন মহারাষ্ট্র তাঞ্চলের শৈল্পিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে গুপ্ত রাজগণের যোগসূত্র আজও প্রমাণিত হয়নি।

গ্রন্থপঞ্জি

  • অশোক মিত্র : ভারতের চিত্রকলা। প্রথম খণ্ড (কলকাতা, ১৯৯৫)।
  • নারায়ণ সান্যাল অপরূপা অজন্তা (কলকাতা)।
  • Agrawala, P. K. Gupta Temple Architecture (Varanasi, 1981).
  • Agrawala, V. S. Gupta An (Lucknow, 1947). Brown Percy Indian Architecture, Buddhist and Hindu (Bombay. 1949)
  • Dey, M. C My Pilgrimage to Ajanta and Bagh (London, 1925)
  • Goyal. S. R. and Goyal, Shankar (Ed.) Indian Art Of The Gupta Age Form Pre-Classical Roots To The Emergence of Medieval Trends (Jodhpur 2000).
  • Harle, J. C Gupta Sculpture (Oxford, 1974)
  • Majumdar, RC (Ed) The Classical Age (Bombay, 1962),
  • Saraswati, SK A Survey Of Indian Sculpture (Calcutta, 1957):
  • Sivaramamurti, C. Indian Paintings.
  • Yazdanı, G Ajanta, Text and Plates, Parts I-IV (London, 1930-55)

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.