Table of Contents
পাল সাম্রাজ্য (৭৫০-১১৬১ খ্রি.)
রাজবৃত্তান্ত
খ্রিস্টীয় ৮ম শতকের মধ্যভাগে বাংলায় পাল রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হয়। চারশো বছরেরও অধিককাল পালগণ রাজপদে অভিষিক্ত ছিলেন। পাল রাজত্বকাল বাংলার ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়রূপে চিহ্নিত। শুধু রাজনৈতিক সাফল্যের কারণে নয়, সাহিত্য, ধর্ম ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকরূপেও পালরাজগণ ভারতবর্ষের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
বংশপরিচয়
পাল রাজাদের বংশপরিচয় সম্পর্কে আমাদের ধারণা আজও অস্পষ্ট। অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা গ্রন্থের হরিভদ্র-কৃত টীকায় ধর্মপাল নামে জনৈক রাজাকে ‘রাজভটাদিবংশপতিত’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, দীনেশচন্দ্র সরকার এবং আরও অনেকে এই ধৰ্ম পালকে পালরাজ ধর্মপালরূপে শনাক্ত করেছেন। শাস্ত্রী মহাশয় ‘রাজভট’ পদটিকে রাজ সেনাপতি অর্থে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি মনে করেন, ধর্মপাল এক রাজসেনাধ্যক্ষের বংশে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। দীনেশচন্দ্র সরকার ‘রাজভট’ পদটিকে ব্যক্তিবিশেষের নাম অর্থে গ্রহণ করেছেন। তাঁর অভিমত, ধর্মপাল রাজভট প্রভৃতি খ্যাতনামা ব্যক্তিদের বংশে জন্মেছিলেন। কিন্তু এই রাজভট কে সে সম্পর্কে অধ্যাপক সরকার সুনিশ্চিত নন। রাজরাজ বা রাজরাজভট নামে পূর্ব বাংলার খড়্গবংশীয় এক যুবরাজের কথা জানা যায়। অনেকেই মনে করেন, হরিভদ্র-বর্ণিত রাজভট আর এই খড়্গ রাজকুমার এক ও অভিন্ন ব্যক্তি ছিলেন। সেক্ষেত্রে পাল রাজারা পূর্ববঙ্গীয় খড়্গরাজপরিবারভুক্ত ছিলেন, এই ধারণা আপাতগ্রাহ্য বলে স্বীকার করতে হয়। কিন্তু এরূপ সিদ্ধান্তের সত্যতা সম্পর্কে সংশয় থেকেই যায়।
- প্রথমত, খড়্গবংশীয় রাজারা সকলেই খড় গযুক্ত নাম গ্রহণ করেছেন। পাল রাজারা খড়্গবংশোদ্ভব হলে তাঁদের নামকরণে একই রীতি অনুসৃত হত।
- দ্বিতীয়ত, রাজভট পদের অর্থ নিয়ে মতভেদের অবকাশ আছে।
- তৃতীয়ত, হরিভদ্র যে ধর্মপালের কথা বলেছেন তিনি যে পাল সম্রাট ধর্মপালই সে কথা দৃঢ়তার সঙ্গে বলা যায় না।
- চতুর্থত, পতিত শব্দ সাধারণত জাতিচ্যুত, নিচ, অধম, এই অর্থে ব্যবহৃত হয় ; উদ্ভূত, জাত, এই অর্থে নয়।
অমাত্য বৈদ্যদেবের কমৌলি তাম্রশাসনে পালদের সূর্যবংশীয় অর্থাৎ ক্ষত্রিয় বলা হয়েছে। সন্ধ্যাকর নন্দী তাঁর রামচরিত কাব্যে রামপালকে ক্ষত্রিয় বলে বর্ণনা করেছেন। আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে পালদের কায়স্থ পরিচয় দেওয়া হয়েছে। আবার মঞ্জুশ্রীমূলকল্পে পাল রাজাদের দাসজীবী বা শূদ্র বলা হয়েছে। লক্ষ করবার বিষয়, বৈদ্যদেব ও সন্ধ্যাকর নন্দী উভয়েই পাল রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তাঁরা দু’জনেই পালদের ক্ষত্রিয় বলে অভিহিত করেছেন। এ থেকে মনে হয়, পাল রাজারা নিজেদের ক্ষত্রিয়রূপে গণ্য করতেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতার রাজভট পদটিকে রাজসেনাপতি অর্থে গ্রহণ করা যায়। গোপালের পূর্বপুরুষেরা যুদ্ধোপজীবী ছিলেন এই ধারণাই যেন সঠিক বলে মনে হয়।
সন্ধ্যাকর নন্দী রামপালকে ক্ষত্রিয়রূপে চিহ্নিত করেছেন ঠিকই কিন্তু তিনিই আবার ধর্ম পালকে ‘সমুদ্রকুলপ্রদীপ’রূপে বর্ণনা করেছেন। পাল রাজাদের সঙ্গে সমুদ্রকুলের সম্পর্ক শুধু রামচরিতেই উল্লিখিত হয়নি ঘনরামের ধর্মমঙ্গল কাব্যেও তার সমর্থন আছে। এই কাব্যে বলা হয়েছে, রানি বল্লভদেবী কোনও পুত্র সন্তানের জন্ম না দেওয়ায় ধর্মপাল তাঁকে নির্বাসনে পাঠান। বনবাসকালে সমুদ্রের ঔরসে রানির গর্ভে এক পুত্রসন্তান জন্মে। তারনাথও পাল রাজাদের সম্পর্কে এরূপ এক কাহিনির অবতারণা করেছেন। তিনি বলেন, গোপালের মৃত্যুর পর তাঁর যে পুত্র রাজপদ লাভ করেন তিনি গোপালের ছোট রানির গর্ভে সমুদ্রের ঔরসে জন্মগ্রহণ করেন। সন্দেহ নেই, তারনাথ বা ঘনরামের কাহিনি কল্পনার রঙে রাঙানো। কিন্তু পালরা যে একদিন সমুদ্রসংলগ্ন অঞ্চলে রাজত্ব করতেন তাই হয়তো এসব কাহিনিতে আভাসিত হয়েছে।
পালরা যে উত্তর বঙ্গের অধিবাসী ছিলেন তা প্রায় নিশ্চিত। রামচরিতে বরেন্দ্র বা উত্তর বাংলাকে পাল রাজাদের ‘জনকভূ’ বা পিতৃভূমি বলা হয়েছে। পুণ্ড্রবর্ধনের নিকটবর্তী উত্তর বাংলার কোনও এক স্থানে যে গোপালের জন্ম হয়েছিল তা তারনাথও স্বীকার করেছেন। পালরা উত্তর বঙ্গের লোক হলেও তাঁরা প্রথমে এ অঞ্চলেই রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছেন এমন বোধ হয় না। তাঁদের আদি রাজ্যটি সম্ভবত পূর্ব বাংলার বাখরগঞ্জ অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। এ অঞ্চল প্রাচীন বঙ্গাল জনপদের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
গোপাল ও তাঁর বংশধরগণ সকলেই ‘পাল’ নামান্ত গ্রহণ করেছিলেন। এজন্যই এই বংশের ‘পাল’ নামকরণ। গুপ্ত রাজাদের ক্ষেত্রেও ঠিক একই জিনিস ঘটেছে। তাঁরা সকলেই ‘গুপ্ত’ নামান্ত ধারণ করেছিলেন। সে কারণে তাঁদের বংশের নাম ‘গুপ্ত’ হয়েছে। গোপালের মহিষী দেদ্দদেবী সম্ভবত সমতটের ভদ্র রাজবংশের কন্যা ছিলেন। খালিমপুর তাম্রশাসনে মহিষী দেদ্দদেবীকে ‘ভদ্রাত্মজা’ বলা হয়েছে। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ‘ভদ্রাত্মজা’ বলতে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির কন্যা বুঝেছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, খালিমপুর লেখে দেদ্দদেবীকে শিব, কুবের, ইন্দ্র, বিষ্ণু প্রভৃতি দেবতাদের পত্নীদের সমতুল্যরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে গোপালের মহিষীকে নিছক ভদ্রলোকের কন্যা বলা সংগত বোধ হয় না।
প্রাক্-পাল পর্বে বাংলা
প্রাক্-পাল পর্বে বাংলার রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এক অরাজক অবস্থা বিরাজমান ছিল। এ অঞ্চলে কোনও শক্তিশালী রাজ্য ছিল না, এখানে সেখানে ছোট ছোট রাজ্য গড়ে উঠেছিল। ঐক্যবদ্ধ না থাকায় একের পর এক বৈপ্রান্তিক অভিযানের ঢেউ এ অঞ্চলে আছড়ে পড়ে। সারা অঞ্চল জুড়ে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, মাৎস্যন্যায়ের উদ্ভব হয়। বাহুবল রাজদণ্ডের স্থান গ্রহণ করে।
খ্রিস্টীয় ৮ম শতকের প্রথম পর্বে পরবর্তী গুপ্তবংশীয় রাজা দ্বিতীয় জীবিতগুপ্ত উত্তর বিহারে রাজত্ব করতেন। বৈদ্যনাথ মন্দির অভিলেখে তাঁর প্রপিতামহ আদিত্যসেন চতুঃসমুদ্রান্ত রাজ্যের অধীশ্বররূপে বর্ণিত হয়েছেন। তাঁর পিতামহ দেবগুপ্ত এক চালুক্য অভিলেখে ‘সকলোত্তরাপথ নাথ’রূপে বন্দিত হয়েছেন। এসব কারণে কেউ কেউ অভিমত ব্যক্ত করেছেন, পশ্চিম ও পূর্ব বংলার কিয়দংশ পরবর্তী গুপ্ত রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু এই অভিমতের সমর্থনে এখনও কোনও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
কবি বাক্পতিরাজ প্রাকৃত ভাষায় ‘গৌড়বহো’ নামে একখানি কাব্য রচনা করেন। এই কাব্যে খ্রিস্টীয় ৮ম শতকের প্রথম পর্বে বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। এই কাব্যের নায়ক কান্যকুব্জরাজ যশোবর্মা। তিনি দিগ্বিজয়ে বহির্গত হয়ে গৌড়রাজকে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করেন। গৌড়রাজকে ‘গৌড়বহো’ কাব্যে মগধনাথও বলা হয়েছে। এ থেকে মনে হয়, মগধ বা দক্ষিণ বিহার সে সময় গৌড় রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। যশোবর্মা যে গৌড়রাজকে পরাজিত ও নিহত করেন তাঁর সঠিক পরিচয় জানা যায় না। পণ্ডিতেরা যশোবর্মার গৌড়বিজয় ৭২৫ এবং ৭৩৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে ধার্য করেছেন।
‘গৌড়বহো’ কাব্যে বলা হয়েছে, গৌড় জয়ের পর যশোবর্মা বঙ্গ অভিমুখে অগ্রসর হন এবং তথাকার রাজাকে পদানত করেন। কিন্তু কে এই বঙ্গপতি তা নিশ্চিতরূপে জানা যায় না। তবে ‘গৌড়বহো’ কাব্যের বর্ণনা থেকে দু’টি জিনিস স্পষ্ট হচ্ছে :
- এক. খ্রিস্টীয় ৮ম শতকের প্রথম ভাগে বাংলায় অন্তত দু’টি স্বাধীন রাজ্য বর্তমান ছিল। এদের একটি গৌড়, অন্যটি বঙ্গ। গৌড়রাজ্য গড়ে উঠেছিল উত্তর ও পশ্চিম বাংলায়। মগধ এই রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বঙ্গরাজ্যের অভ্যুদয় ঘটেছিল পূর্ব বাংলায়।
- দুই. এই দু’টি রাজ্য কিছুদিনের জন্য কান্যকুব্জরাজ যশোবর্মার অধিকারভুক্ত হয়। কিন্তু গৌড়-বঙ্গে যশোবর্মার এই সাফল্য খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। বাংলা থেকে তাঁর প্রত্যাবর্তনের অব্যবহিত পর অথবা কাশ্মীররাজ ললিতাদিত্য মুক্তাপীড়ের হাতে তাঁর পরাভবের ফলে এ অঞ্চলে আবার স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়। ললিতাদিত্য যে গৌড়রাজের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করেন তিনি যশোবর্মা বা তাঁর কোনও উত্তরাধিকারী নন, তিনি ছিলেন অন্য কোনও রাজা। (তিনি সম্ভবত পূর্বতন গৌড়রাজের আত্মীয় ছিলেন।)
কান্যকুব্জরাজ যশোবর্মাকে পরাজিত করে ললিতাদিত্য মুক্তাপীড় আরও পূর্বদিকে অগ্রসর হন এবং গৌড় অধিকার করেন। রাজতরঙ্গিণীতে বলা হয়েছে, সামরিক অভিযানকালে ললিতাদিত্য পূর্বদিকে প্রাচ্য সমুদ্র অর্থাৎ বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত অগ্রসর হন। তবে রাজতরঙ্গিণীর এই বর্ণনা অতিশয়োক্তি হতে পারে। সেক্ষেত্রে ললিতাদিত্য গৌড় অধিকার করেছিলেন, এ কথা জোরের সঙ্গে বলা যাবে না। ললিতাদিত্য হয়তো গৌড় আক্রমণ করেননি কিন্তু গৌড় কাশ্মীররাজের বশ্যতা স্বীকার করেছিল, এ কথা ভাবার যথেষ্ট কারণ আছে।
- প্রথমত, কল্হণ বলেছেন, গৌড়মণ্ডল থেকে একদল রণহস্তী ললিতাদিত্যের সাহায্যার্থে কাশ্মীরে প্রেরিত হয়েছিল। গৌড়রাজ ললিতাদিত্যের অনুগত না হলে এমনটি ঘটত না।
- দ্বিতীয়ত, কল্হণ আরও বলছেন, ললিতাদিত্য একবার গৌড়রাজকে কাশ্মীরে আসার আমন্ত্রণ জানান। নিজের জীবন বিপন্ন হতে পারে এই ভেবে গৌড়রাজ দ্বিধাগ্রস্ত হন। তখন ললিতাদিত্য দেবতা পরিহাসকেশবের নামে শপথ করেন, গৌড়রাজের কোনও ক্ষতি হবে না। নিজের নিরাপত্তা সম্পর্কে আশ্বস্ত হয়ে গৌড়েশ্বর কাশ্মীরে যান কিন্তু সেখানে ললিতাদিত্যের চক্রান্তে প্রাণ হারান। এই সংবাদ গৌড়ে পৌঁছলে গৌড়নৃপতির একদল বিশ্বস্ত অনুচর পরিহাসকেশবের মূর্তি চূর্ণ করার সংকল্প নিয়ে কাশ্মীরে উপস্থিত হন। সেখানে তাঁরা ভুলক্রমে রামস্বামীর মূর্তি চূর্ণ করেন। ইতিমধ্যে ললিতাদিত্যের সেনারা এসে গৌড়বীরদের ঘিরে ফেলেন। কিন্তু গৌড়রা প্রাণভয়ে পলায়ন করলেন না, তাঁরা যুদ্ধরত অবস্থায় বীরের মতো মৃত্যু বরণ করেন। এই ঘটনার চারশো বছর পর রাজতরঙ্গিণী রচনা প্রসঙ্গে কল্হণ বলেন, ‘গৌড়বীরেরা যা করেছেন তা বিধাতারও অসাধ্য। রামস্বামীর মন্দির আজও শূন্য পড়ে আছে। গৌড়বীরদের যশগানে আজও সারা বিশ্ব মুখরিত।’ জীবনহানির আশঙ্কা সত্ত্বেও অনন্যোপায় হয়ে গৌড়নৃপতির কাশ্মীরে গমনের মতো ঘটনায় ললিতাদিত্যের প্রতি তাঁর আনুগত্যই প্রকাশ পেয়েছে। অর্থাৎ গৌড় ললিতাদিত্যের অধীনস্থ ছিল।
ললিতাদিত্যের পৌত্র জয়াপীড় সম্পর্কে এক কাহিনির অবতারণা করেছেন কল্হণ। পিতামহের অনুকরণে জয়াপীড় দিগ্বিজয়ে বের হন। তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর শ্যালক জজ্জ কাশ্মীরের সিংহাসন অধিকার করেন। সেনারাও তাঁকে পরিত্যাগ করে চলে যান। একাকী ঘুরতে ঘুরতে জয়াপীড় শেষে উত্তর বাংলার পুণ্ড্রবর্ধন নগরে এক বারাঙ্গনার গৃহে আশ্রয় নেন। তখন পুণ্ড্রবর্ধনের শাসক ছিলেন জয়ন্ত। জয়ন্তের কন্যা কল্যাণদেবীর সঙ্গে জয়াপীড়ের প্রণয় জন্মে। জয়াপীড় কল্যাণদেবীকে বিবাহ করেন। পঞ্চগৌড়ের রাজাদের পরাজিত করে তিনি তাঁর শ্বশুর জয়ন্তকে সার্বভৌম সম্রাটরূপে প্রতিষ্ঠিত করেন। কল্হণের জয়াপীড় সম্পর্কিত কাহিনি হয়তো অনৈতিহাসিক কিন্তু বাংলার রাজনৈতিক অনৈক্যের যে ছবি এখানে চিত্রায়িত হয়েছে তাকে অসত্য বলে অগ্রাহ্য করা যায় না।
নেপালের লিচ্ছবিরাজ দ্বিতীয় জয়দেবের কাঠমাণ্ডু অভিলেখে ভগদত্ত বংশীয় রাজা হর্ষ বর্মাকে গৌড়, ওড্র, কলিঙ্গ এবং কোসলের অধিপতিরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। হর্ষবর্মা খ্রিস্টীয় ৮ম শতকের প্রথম ভাগে অসমে রাজত্ব করতেন। কাঠমাণ্ডু অভিলেখের সাক্ষ্য ইঙ্গিত করছে, হর্ষবর্মা গৌড় অধিকার করেছিলেন। কিন্তু এ সাক্ষ্য কতদূর বস্তুনিষ্ঠ বলা কঠিন। অন্তত অন্য কোনও সূত্রে এর সমর্থন নেই। দীনেশচন্দ্র সরকার মনে করেন, অসম নৃপতি সম্ভবত কান্যকুজরাজ যশোবর্মাকে গৌড় অভিযানে সাহায্য করেছিলেন।
খ্রিস্টীয় ৮ম শতকের প্রথমভাগে বাংলায় আর একটি বৈপ্রান্তিক অভিযান পরিচালিত হয়েছিল। শৈল নরপতি দ্বিতীয় জয়বর্ধনের রাঘোলী তাম্রশাসনে এই সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে। এই লেখে বলা হয়েছে জয়বর্ধনের প্রপিতামহের এক ভাই পৌণ্ড্ররাজকে পরাজিত করে তাঁর রাজ্য অধিগ্রহণ করেন। উত্তর বাংলার প্রাচীন নাম পৌণ্ড্র। শৈল রাজকুমার সম্ভবত গৌড় অভিযানে যশোবর্মার সহযাত্রী হয়েছিলেন। তবে উত্তর বাংলায় শৈল অভিযান এক স্বতন্ত্র ঘটনারূপেও চিহ্নিত হতে পারে।
দেখা যাচ্ছে, খ্রিস্টীয় ৮ম শতকের প্রথমার্ধে একটির পর একটি বৈপ্রান্তিক অভিযানের ঢেউ বাংলার বুকে আছড়ে পড়ছিল। স্থানীয় রাজারা ছিলেন দুর্বল ও অক্ষম। এই বৈপ্রান্তিক আক্রমণ প্রতিরোধ করার শক্তি তাঁদের ছিল না। রাজশক্তি দুর্বল হলে রাজ্যময় নৈরাজ্যের সূত্রপাত হয়। বাংলার ক্ষেত্রে তার অন্যথা হয়নি। গোপালের পুত্র ধর্মপালের খালিমপুর তাম্রশাসনে বাংলার এই অরাজক অবস্থাকে মাৎস্যন্যায় আখ্যা দেওয়া হয়েছে। মৎস্যদের নীতি বা যুক্তি এই অর্থে মাৎস্যন্যায়। মৎস্যরাজ্যে বৃহৎ মৎস্যদেরই প্রাধান্য, তারা অতি সহজে ছোট ছোট মৎস্যগুলিকে গ্রাস করে। তেমনি রাজশক্তি দুর্বল হয়ে পড়লে রাজ্যে বাহুবলেরই প্রাধান্য দেখা দেয়। বলবান দুর্বল ব্যক্তিদের পীড়ন করেন। রাজ্যময় চলে পাশব শক্তির উন্মত্ততা। বাংলায় ঠিক এই অবস্থাই দেখা দেয়।
তারনাথের বৃত্তান্তেও বাংলার এই নৈরাজ্য প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর বিবরণ থেকে জানা যায়, চন্দ্রবংশীয় রাজা ললিতচন্দ্রের মৃত্যুর পর ভঙ্গল, ওডিবিস বা ওড়িশা ইত্যাদি প্রাচ্য জনপদগুলিতে কোনও রাজার কর্তৃত্ব ছিল না; ক্ষত্রিয়, অভিজাত ব্যক্তি, ব্রাহ্মণ ও বণিক সকলেই স্ব স্ব গৃহে রাজা। আজ একজন রাজা হচ্ছেন, রাজকর্তৃত্ব দাবি করছেন, কাল তাঁর ছিন্ন মস্তক ধুলায় লুণ্ঠিত হচ্ছে। গোপালের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে বাংলায় এই নৈরাজ্যের অবসান ঘটল।
গোপাল (৭৫০-৭৪ খ্রি.)
গোপাল পাল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর পিতামহ দয়িতবিষ্ণু বা পিতা বপ্যট রাজা ছিলেন না। দয়িতবিষ্ণু ছিলেন সর্বশাস্ত্রবিশারদ এক বিদগ্ধ ব্যক্তি। বপ্যট ছিলেন একজন যুদ্ধোপজীবী। সাধারণ এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করে ভাগ্য ও পুরুষকারের সহায়তায় গোপাল ভারতের পূর্ব প্রান্তে যে রাজ্য স্থাপন করেন তা অচিরে তাঁর পুত্র-পৌত্রদের পরাক্রমে ভারতের এক বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তিরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। গোপালের সিংহাসন লাভ প্রসঙ্গে ধর্মপালের খালিমপুর তাম্রশাসনে বলা হয়েছে : মাৎস্যন্যায়মপোহিতুং প্রকৃতিভিলক্ষ্ম্যাঃ করং গ্রাহিতঃ ॥ শ্রীগোপাল ইতি ক্ষিতীশশিরসাং চূড়ামণিস্তৎসুতঃ।
এখানে বলা হচ্ছে, প্রকৃতিপুঞ্জ মাৎস্যন্যায় দুর করার উদ্দেশ্যে নরপালকুলচূড়ামণি গোপালকে রাজলক্ষ্মীর কর গ্রহণ করিয়েছিলেন। কর গ্রহণ করানোর অর্থ বিবাহ দেওয়া। কোনও ব্যক্তির সঙ্গে রাজলক্ষ্মীর বিবাহ দেওয়ার অর্থ তাঁকে রাজসিংহাসনে বসানো। খালিমপুর লেখের বক্তব্য, প্রকৃতিপুঞ্জ গোপালকে রাজপদে নির্বাচন করেছিলেন। এই ‘প্রকৃতিগণ’ কারা এবং কীভাবে তাঁরা গোপালকে রাজা নির্বাচন করেছিলেন তা অনুমানের বিষয়। প্রকৃতির অর্থ প্রজা। তাই অনেকের অনুমান, জনগণের রায়ে গোপাল বাংলার রাজপদ লাভ করেন। ‘মুখ্য নৃপতিবর্গ” এই অর্থে প্রকৃতি শব্দের ব্যাখ্যা করেছেন রমেশচন্দ্র মজুমদার। তাঁর মতে প্রধান প্রধান রাজারাই উদ্যোগী হয়ে গোপালকে বাংলার সিংহাসনে বসান। দীনেশচন্দ্র সরকার প্রকৃতিগণকে বঙ্গাল বা বাখরগঞ্জ অঞ্চলের নেতৃবৃন্দ বলে মনে করেন। তাঁরা মিলিত হয়ে গোপালকে সেখানকার রাজা নির্বাচিত করেছিলেন, এই তাঁর ধারণা।
তারনাথের বৃত্তান্তের উপর নির্ভর করেই শেষোক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। তারনাথ বলেন, বহু বছর ভঙ্গল অঞ্চলে কোনও রাজা ছিলেন না। এতে প্রজাদের দুর্দশা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। শেষে অঞ্চলের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা মিলিত হয়ে রাজ্যের সুশাসনের জন্য এক ব্যক্তিকে রাজপদে মনোনীত করেন। কিন্তু সে রাতে এক নাগী পূর্বতন রাজার এক পত্নীর রূপ ধরে সেই নির্বাচিত রাজাকে হত্যা করেন। পরদিন থেকে প্রতি সকালে একজন রাজা নির্বাচিত হতেন আর রাতে নাগীর হাতে তিনি নিহত হতেন। এভাবে কয়েক বছর অতিবাহিত হয়। ইতিমধ্যে পুণ্ড্র বর্ধন নগরের উপকণ্ঠে জনৈকা ক্ষত্রিয় রমণীর গর্ভে বৃক্ষদেবতার ঔরসে এক বীরের জন্ম হয়। তিনি ছিলেন দেবী চুন্দার ভক্ত। চুন্দা তাঁকে স্বপ্নে আদেশ করেন, ভক্তটি আর্য খসর্পণের বিহারে গিয়ে রাজ্য প্রার্থনা করুন। এ কাজ সম্পন্ন হলে ভক্তের উপর পুনরাদেশ হল, তিনি যেন অভীষ্ট সিদ্ধির উদ্দেশ্যে পূর্বদিক অভিমুখে যাত্রা করেন। পূর্বদিকে চলতে চলতে ভক্তটি ভঙ্গলে এসে উপস্থিত হন। সেখানে এসে তিনি দেখেন, এক যুবক রাজা নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু রাত্রেই তিনি মারা যাবেন এই আশঙ্কায় তাঁর পরিবার-পরিজনেরা মুহ্যমান হয়ে পড়েছেন। দেবী চুন্দার ভক্তটি বিপদগ্রস্ত সেই পরিবারটির পাশে এসে দাঁড়ালেন। তিনি নিজেকে রাজা নির্বাচিত করালেন এবং রাত্রিকালে দেবীর দেওয়া কাঠের গদার আঘাতে সেই নাগীকে হত্যা করেন। এই কৃতিত্বের জন্য তাঁকেই পর পর সাতদিন রাজপদে মনোনীত করা হয়। দেখা গেল, কোনও নাগী তাঁর ক্ষতি করতে পারছে না। তখন তাঁকে স্থায়িভাবে রাজা নির্বাচন করা হল। তাঁর নতুন নামকরণ হল গোপাল। খালিমপুর লেখে গোপালের রাজপদে মনোনয়নের যে উল্লেখ আছে তারনাথ তা সমর্থন করছেন। তারনাথের কাহিনিতে আর একটি জিনিস স্পষ্ট। গোপালকে সারা বাংলার রাজারূপে নির্বাচিত করা হয়নি, তাঁকে বসানো হয়েছিল ভঙ্গল বা বঙ্গালের সিংহাসনে। তবে গোপালের এই রাজপদে নির্বাচনের কথাটি সত্য নাও হতে পারে। তিনি বাহুবলে ভঙ্গলের রাজপদ অধিকার করেছিলেন, এটিই হয়তো ছিল বাস্তব ঘটনা। গোপালের সিংহাসনে আরোহণের তারিখ আনুমানিক ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ।
ভঙ্গল বা বঙ্গালে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার পর গোপাল বাংলার এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করেন। তাঁর পৌত্র দেবপালের মুঙ্গের তাম্রশাসনে তাঁকে আসমুদ্র-পৃথিবী বিজেতা বলা হয়েছে। তিব্বতি কিংবদন্তী বলছে, তিনি নালন্দায় একটি বৌদ্ধবিহার নির্মাণ করেন। তারনাথও গোপালের মগধে রাজ্য বিস্তারের উল্লেখ করেছেন। কেউ কেউ মনে করেন, কামরূপ বা অসমের কামরূপ-বরপেটা অঞ্চলও তাঁর অধিকারভুক্ত ছিল। বাংলার এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল অবশ্যই তাঁর রাজ্যভুক্ত ছিল। কিন্তু দক্ষিণ বিহার ও কামরূপে তাঁর সাফল্য সম্পর্কে সুনিশ্চিত হওয়া কঠিন। পাল লেখমালায় গোপালের মগধ বা কামরূপ বিজয় সম্পর্কে কোনও সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে গোপাল যে পাল রাজ্যের বুনিয়াদ নির্মাণ করেছিলেন তা অস্বীকার করা যায় না। ধর্মপাল ও দেবপালের মতো তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরিরা পরবর্তিকালে এই বুনিয়াদের উপর সুবিশাল ইমারত গড়ে তোলেন।
গোপাল ঠিক কতদিন রাজত্ব করেন সে সম্পর্কে প্রাচীন গ্রন্থাদিতে পরস্পর বিরোধী তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। তারনাথের সাক্ষ্য অনুসারে তিনি ৪৫ বছর রাজত্ব করেন। আর্য-মঞ্জুশ্রী মূলকল্পে বলা হয়েছে, তাঁর রাজত্বকাল ২৭ বছর স্থায়ী হয়েছিল। এখানে দু’টি জিনিস মনে রাখতে হবে। এক, তিনি যখন সিংহাসনে আরোহণ করেন তখন তিনি সম্ভবত পরিণত বয়স্কই ছিলেন। দুই, তাঁর পুত্র ও পৌত্র দীর্ঘকাল রাজত্ব করেছিলেন। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গোপালের রাজত্বকাল ৭৫০-৭৪ খ্রিস্টাব্দে ধার্য করা যায়।
ধর্মপাল (আ. ৭৭৪-৮০৬ খ্রিস্টাব্দ)
গোপালের মৃত্যুর পর তাঁর সুযোগ্য পুত্র ধর্মপাল রাজপদে অধিষ্ঠিত হন। পালবংশের এক শ্রেষ্ঠ রাজা এই ধর্মপাল। পালরাজ্যের অভ্যুত্থানের ইতিহাসে তিনি এক স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। পিতৃসিংহাসনে আরোহণ করে তিনি প্রথমে বাংলা ও বিহারে নিজের কর্তৃত্ব সুদৃঢ় করেন। এ কাজ সম্পন্ন করে তিনি পশ্চিম দিকে রাজ্য বিস্তারে উদ্যোগী হন। এইসূত্রে তিনি পশ্চিম ভারতের গুর্জর-প্রতীহার ও দক্ষিণ ভারতের রাষ্ট্রকূট রাজগণের সঙ্গে ত্রিপাক্ষিক সংগ্রামে লিপ্ত হন। (পাল, গুর্জর-প্রতীহার ও রাষ্ট্রকূটদের সংঘর্ষ সাধারণত ত্রিপাক্ষিক বা ত্রিশক্তির সংঘর্ষরূপে আখ্যাত। কিন্তু বিনয়চন্দ্র সেন ও দীনেশচন্দ্র সরকার এই সংঘর্ষকে চতুঃশক্তির সংগ্রাম বলে অভিহিত করেছেন। তাঁদের অভিমত, এই সংগ্রাম মূলত পাল, গুর্জর-প্রতীহার, রাষ্ট্রকূট ও আয়ুধ, এই চার শক্তির সংগ্রাম। এ কথা সত্য, এই সংঘর্ষে পঞ্চাল রাজ্যের অধিপতি আয়ুধ বংশীয় রাজারাও জড়িত ছিলেন। কিন্তু এই যুদ্ধে তাঁরা এক স্বতন্ত্র পক্ষের ভূমিকায় অবতীর্ণ হননি, তাঁরা ছিলেন পাল বা গুর্জর-প্রতীহারদের বশীভূত মিত্র। পরের আশ্রিত বলে আয়ুধরাজ চক্রায়ুধকে তো প্রথম ভোজের গ্বালিয়র প্রশস্তিতে তাচ্ছিল্য করা হয়েছে। চক্রায়ুধ গ্বালিয়র প্রশস্তিতে ‘পরাশ্রয়-কৃত-স্ফুট-নীচ-ভাব’ বলে পরিচিত হয়েছেন। চক্রায়ুধ পরের অর্থাৎ ধর্মপালের আশ্রিত, তাই তাঁর তুচ্ছতা পরিস্ফুট। সে কারণে এই সংঘর্ষকে ত্রিশক্তির যুদ্ধ বলাই উচিত।) ধর্মপাল এবং তাঁর সমকালীন প্রতীহাররাজ বৎসরাজের লক্ষ্য ছিল গাঙ্গেয় ভূভাগে নিজ নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা । খাদ্যোৎপাদন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও রাজনৈতিক গুরুত্বের কারণে এই অঞ্চল সর্বদাই বৈপ্রান্তিক রাজগণকে প্রলুব্ধ করেছে। বহিরাক্রমণ প্রতিহত করার মতো কোনও রাজা সে সময় এই অঞ্চলে আবির্ভূত হননি। স্বাভাবিক কারণেই ধর্মপাল ও বৎসরাজ এই অঞ্চলের প্রতি আকৃষ্ট হলেন। এর পর যে ঘটনাপ্রবাহ বয়ে গেল তার পারম্পর্য ও গতিপ্রকৃতি এখনও অনেকটাই অনিশ্চয়তার আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে।
পশ্চিম দিকে বিজয়াভিযানে অগ্রসর হয়ে ধর্মপাল কান্যকুব্জের আয়ুধবংশীয় নৃপতি ইন্দ্ররাজ বা ইন্দ্রায়ুধকে পরাজিত করেন। এর ফলে কান্যকুব্জে পাল অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ধর্মপালেরই এক উত্তরসূরি নারায়ণপালের ভাগলপুর তাম্রশাসনে এই ঘটনা বর্ণিত হয়েছে : “জিত্বেন্দ্ররাজপ্রভৃতীনরাতীন্ উপার্জিতা যেন মহোদয়শ্রীঃ। দত্তা পুনঃ সা বলিনার্থয়িত্রে চক্রায়ুধায় নতিবামনায় ৷৷” ভাগলপুর তাম্রশাসনে বলা হচ্ছে, ইন্দ্ররাজ প্রমুখ শত্রুরাজাদের পরাজিত করে ধর্মপাল মহোদয় বা কান্যকুব্জের রাজলক্ষ্মী লাভ করেন কিন্তু বলিরাজ যেমন বামনরূপী বিষ্ণুকে বিপুলা শ্রী দান করেছিলেন ধর্মপালও তেমনি প্রণতিপরায়ণ চক্রায়ুধকে কান্যকুজের রাজলক্ষ্মী অর্পণ করেন। বোঝা যায়, ইন্দ্ররাজের হাত থেকে কান্যকুব্জ অধিকার করেও ধর্মপাল তা নিজের হাতে রাখলেন না। আয়ুধ রাজপরিবারেরই তাঁর এক অনুগত সদস্য চক্ৰায়ুধকে তিনি কান্যকুব্জের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেন। কান্যকুব্জে চক্রায়ুধ তথা ধর্মপালের এই প্রতিষ্ঠা প্রতীহারনৃপতি বৎসরাজ সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করলেন না। তিনি কান্যকুব্জ আক্রমণ করে চক্রায়ুধকে বিতাড়িত করেন এবং কান্যকুজেরই পূর্বতন নরপতি ইন্দ্ররাজকে সিংহাসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। ইন্দ্ররাজের অনুকূলে কান্যকুব্জের সিংহাসন পুনরুদ্ধার করেছেন বলে ৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ এক প্রস্তরলেখে বৎসরাজ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করে গেছেন।
মনে হয়, বৎসরাজের কান্যকুব্জ আক্রমণকালে ধর্মপাল সসৈন্যে ঘটনাস্থলেই উপস্থিত ছিলেন। সেক্ষেত্রে বলা যায়, শুধু চক্রায়ুধকেই নয়, চক্রায়ুধের সঙ্গে ধর্মপালকেও পরাজিত করে বৎসরাজ ইন্দ্ররাজের অনুকূলে কান্যকুব্জ অধিকার করেন। এ ক্ষেত্রে আর একটি সম্ভাবনার কথাও মনে হয়। যাঁকে কান্যকুব্জের সিংহাসনে বসিয়েছেন সেই চক্রায়ুধকে বৎসরাজ আক্রমণ করলে ধর্মপাল সৈন্যবাহিনী-সহ কান্যকুব্জ অভিমুখে অগ্রসর হন এবং গঙ্গা-যমুনা দোয়াবে এসে উপনীত হন। ততদিনে চক্রায়ুধ কান্যকুব্জ থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। গঙ্গা-যমুনা দোয়াবে পাল ও প্রতীহার বাহিনী পরস্পরের সম্মুখীন হয়। এ যুদ্ধে ধর্মপাল বৎসরাজের হস্তে পরাজয় বরণ করেন।
ধর্মপাল যে বৎসরাজের হস্তে পরাজিত হন সে সম্পর্কে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। এ কথা সত্য, বৎসরাজের নিজস্ব লেখে বা প্রতীহার লেখমালায় এ মর্মে কোনও দাবি উত্থাপিত হয়নি। কিন্তু রাষ্ট্রকূটরাজ তৃতীয় গোবিন্দের রাধনপুর তাম্রশাসনে বলা হয়েছে, বৎস রাজ গৌড়েশ্বরকে পরাজিত করে গৌড়ের দু’টি ধবল রাজচ্ছত্র (গৌড়ীয়ং শরদিন্দুপাদধবলং চ্ছত্রদ্বয়ম্) অধিগ্রহণ করেছিলেন। এই গৌড়েশ্বর স্বয়ং ধর্মপাল। ধর্মপালের বিরুদ্ধে বৎসরাজের বিজয়লাভের ঘটনা তৃতীয় গোবিন্দের রাজত্বকালে উৎকীর্ণ ওয়ানি তাম্রশাসনের সাক্ষ্যেও সমর্থিত হচ্ছে। এই লেখ থেকে জানা যায়, বৎসরাজ গৌড়ের রাজলক্ষ্মী (হেলাস্বীকৃত-গৌড়রাজ্যকমলাম্) আত্মসাৎ করেন।
অনেকে বলেন, ধর্মপালের সঙ্গে বৎসরাজের যুদ্ধ হয়েছিল বাংলারই কোনও এক স্থানে, গঙ্গা যমুনা দোয়াবে নয়। তাঁদের অভিমত, চক্রায়ুধকে কান্যকুব্জে পরাভূত করে বৎসরাজ বিহারের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে একেবারে বাংলার অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন এবং সেখানেই পালরাজকে পরাজিত করেন। তাঁর অনুগত মিত্র চক্রায়ুধের কান্যকুব্জে পরাজয় সত্ত্বেও ধর্মপাল নিশ্চুপ হয়ে বাংলায় অবস্থান করেন আর তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী বৎসরাজ বিনা বাধায় মগধের ভিতর দিয়ে অগ্রসর হয়ে সরাসরি বাংলায় এসে উপস্থিত হবেন, এরূপ ভাবনা কষ্টকল্পিত বৈকি। পাল-প্রতীহার যুদ্ধের ঘটনাস্থল গঙ্গা-যমুনা দোয়াব। রাষ্ট্রকূট লেখমালার ইঙ্গিত সেদিকেই।
বৎসরাজের নিকট পরাজয় ধর্মপালের রাজনৈতিক জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটাতে পারত। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটল না। দক্ষিণ ভারতের পরাক্রান্ত রাষ্ট্রকুটরাজ ধ্রুব অসামান্য তৎপরতায় প্রতীহার রাজ্য আক্রমণ করেন এবং বৎসরাজকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। অনন্যোপায় বৎসরাজ জোধপুর অঞ্চলে পলায়ন করে আত্মরক্ষা করেন। এ সময় ধর্মপাল সসৈন্যে গঙ্গা-যমুনা দোয়াবে অবস্থান করছিলেন। এখানে ধ্রুবের সঙ্গে তাঁর সংঘর্ষ হয়। প্রথম অমোঘবর্ষের সঞ্জান তাম্রশাসন থেকে জানা যায়, ধ্রুব এ যুদ্ধে জয়লাভ করেন (গঙ্গা-যমুনয়োমধ্যে রাজ্ঞো গৌড়স্য নশ্যতঃ)। ধর্মপাল পরাজিত হলেন সত্য কিন্তু ধ্রুবের উত্তর ভারত অভিযান তাঁর পক্ষে আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিল। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী বৎসরাজ তখন হীনবল। রাজস্থানের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে তিনি আবদ্ধ। তাঁর কাছ থেকে কোনও বিপদের আশঙ্কা ছিল না। আর ধ্রুবেরও উত্তর ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপনের কোনও পরিকল্পনা ছিল না। প্রধানত বাণিজ্যিক বা সম্পদ আহরণের স্বার্থেই তাঁর এই উত্তর ভারত অভিযান। তাঁর উত্তর ভারতে অবস্থানকালে রাষ্ট্রকূট রাজ্যে গোলযোগ দেখা দেয়। রাজপুত্রদের মধ্যেও বিরোধ দেখা দেয়। ধ্রুব অনতিবিলম্বে স্বরাজ্যে প্রত্যাবর্তন করেন। ধর্মপালের নিকট উত্তর ভারতে প্রভুত্ব বিস্তারের এই এক সুবর্ণ সুযোগ। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী বৎসরাজ হতমান ও দুর্বল। তাঁকে প্রতিরোধ করার মতো কোনও রাজা তখন উত্তর ভারতে ছিলেন না।
এ পর্বে ধর্মপালের সাফল্য অভূতপূর্ব। তিনি পুনরায় কান্যকুব্জ অধিকার করেন। সেখানকার শাসনভার তিনি স্বহস্তে গ্রহণ করলেন না, অনুগত মিত্র চক্রায়ুধকে কান্যকুব্জের রাজপদে অভিষিক্ত করেন। চক্রায়ুধের রাজ্যাভিষেক প্রসঙ্গে খালিমপুর তাম্রশাসনে বলা হয়েছে : “ভোজৈমৎস্যৈঃ সমদ্রৈঃ কুরুযদু্যুবনাবন্তিগন্ধারকীরে— ভূঁপৈর্ব্যালোলমৌলিপ্রণতিপরিণতৈঃ সাধু সংগীর্যমাণঃ। হৃষ্যৎ পঞ্চালবৃদ্ধোদ্ধৃতকনকময়স্বাভিষেকোদকুম্ভো দত্তঃ শ্রীকান্যকুব্জস্সললিতচলিতভ্ৰুলতালক্ষ্ম যেন ॥” খালিমপুর লেখের এই শ্লোকে ধর্মপালের সভাপতিত্বে কান্যকুব্জ শহরে অনুষ্ঠিত চক্রায়ুধের রাজ্যাভিষেক বর্ণিত হয়েছে। পঞ্চাল রাজ্যের বৃদ্ধজনেরা আনন্দিতচিত্তে চক্রায়ুধের অভিষেকের জন্য জলপূর্ণ স্বর্ণকলসি উত্তোলন করেন ; ভোজ, মৎস্য, মদ্র, কুরু, যদু, যবন, অবন্তি, গন্ধার এবং কীর রাজ্যের প্রণতিপরায়ণ রাজন্যবৃন্দ সাধু, সাধু ধ্বনিতে অভিষেক অনুষ্ঠান অনুমোদন করেন। এবং ধর্মপাল ভ্রূভঙ্গি দ্বারা চক্রায়ুধকে কান্যকুব্জ দান করেন।
সন্দেহ নেই, কান্যকুব্জ শহরে সমবেত বেশির ভাগ নৃপতিই এ পর্বে ধর্মপালের হস্তে পরাজিত হয়েছিলেন। কয়েকজন হয়তো স্বেচ্ছায় পাল সম্রাটের নিকট আত্মসমর্পণ করেছিলেন। অর্থাৎ বৎসরাজের অসহায়তা এবং রাষ্ট্রকূটরাজ ধ্রুবের স্বরাজ্যে প্রত্যাবর্তনের সুযোগে রাজ্যজয়ে বহির্গত হয়ে ধর্মপাল কান্যকুব্জসহ বহু অঞ্চল জয় করেন। ভোজ, মৎস্য ইত্যাদি রাজ্যগুলির ভৌগোলিক অবস্থান জানলে ধর্মপালের দিগ্বিজয়ের চিত্রটি সুস্পষ্ট হবে।
- ভোজরাজ্য বেরারে অবস্থিত ছিল।
- মৎস্যের অবস্থান ছিল রাজস্থানের আলোয়ার-জয়পুর-ভরতপুর অঞ্চলে।
- শিয়ালকোট ও সন্নিহিত অঞ্চল নিয়ে মদ্র রাজ্যটি গঠিত ছিল। কুরুরাজ দিল্লি-মেরঠ অঞ্চলে রাজত্ব করতেন।
- যদু রাজ্যের সঠিক অবস্থান অজ্ঞাত। বিভিন্ন পণ্ডিত গুজরাত, পাঞ্জাব ও উত্তরপ্রদেশে এই রাজ্যটির অবস্থান নির্দেশ করেছেন।
- সিন্ধু অববাহিকা বা উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের কোনও মুসলমান রাজ্য সম্ভবত যবন নামে উল্লিখিত হয়েছে।
- অবন্তির অর্থ পশ্চিম-মালব।
- পেশোয়ার-রাওয়ালপিণ্ডির প্রাচীন নাম গন্ধার।
- কীর রাজ্য হিমাচলপ্রদেশের কাংড়া অঞ্চলে অবস্থিত ছিল।
বোঝা যায়, উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, পূর্ব রাজস্থান, মালব ও বেরারসহ এক বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে ধর্মপালের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ধর্মপালের সুদূরপ্রসারী সামরিক অভিযানের কথা দেবপালের মুঙ্গের তাম্রশাসনেও বর্ণিত হয়েছে। দিগ্বিজয় উপলক্ষে পালরাজের অনুচরেরা কেদার, গঙ্গাসমেতাম্বুধি, গোকর্ণ প্রমুখ তীর্থ ক্ষেত্রে ধর্মকর্মের অনুষ্ঠান করেন, এমন দাবি সেখানে উত্থাপিত হয়েছে। অতি প্রসিদ্ধ তীর্থক্ষেত্র কেদার। কেদারের অবস্থান উত্তরাঞ্চলের গাড়োয়ালে। বাগমতী নদীর তীরবর্তী গোকর্ণ নেপালে অবস্থিত। গঙ্গাসমেতাম্বুধি বা গঙ্গাসাগর গঙ্গা ও বঙ্গোপসাগরের সঙ্গমে অবস্থিত। নেপালে গঙ্গা সমেতাম্বুধি অবস্থিত, এ অভিমতও ব্যক্ত হয়েছে।
দীনেশচন্দ্র সরকার দেবপালের তাম্রশাসনে ধর্মপালের দিগ্বিজয় সম্পর্কিত বর্ণনাকে অনৈতিহাসিক, বাচনিক আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু ভুললে চলবে না, ধর্মপালের রাজ্যজয়ের বর্ণনায় মুঙ্গের ও খালিমপুর লেখে প্রায় একই সুর ধ্বনিত হয়েছে। খালিমপুর লেখে কেদার বা গোকর্ণের উল্লেখ নেই ঠিকই কিন্তু গন্ধার ও কীরের মতো দূরবর্তী রাজ্যগুলিতে ধর্মপালের প্রভাবের কথা বলা হয়েছে। তাই মুঙ্গের লেখের বর্ণনাকে সম্পূর্ণ কাল্পনিক বলে অগ্রাহ্য করা উচিত হবে না। কিন্তু তার অর্থ এই নয়, দক্ষিণ-পূর্বে গঙ্গাসাগর থেকে উত্তর-পশ্চিমে কেদার-গন্ধার পর্যন্ত সমগ্র ভূখণ্ড ধর্মপালের প্রত্যক্ষ শাসনাধীন ছিল। বাংলা-বিহারে নিঃসন্দেহে তাঁর প্রত্যক্ষ শাসন বলবৎ ছিল। কান্যকুব্জসহ গঙ্গা-যমুনা দোয়াব চক্রায়ুধের রাজ্যভুক্ত ছিল। তিনি সর্ব অর্থেই ধর্ম পালের অনুগত ছিলেন। ভোজ, মৎস্য প্রভৃতি অঞ্চলের রাজারা নীতিগতভাবে তাঁর বশীভূত হলেও কার্যত স্বাধীনই ছিলেন। উত্তর ভারতের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ধর্মপাল যে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন তা কবি সোড্ঢলের উদয়সুন্দরীকথা নামে একটি চম্পৃকাব্যে পরোক্ষভাবে সমর্থিত হয়েছে। এই কাব্যে ধর্মপালকে ‘উত্তরাপথস্বামী’ রূপে উপস্থাপিত করা হয়েছে। উত্তরাপথের অর্থ উত্তর ভারত। উত্তর ভারতের রাজনীতিতে ধর্মপালের স্মরণীয় কৃতিত্বের পরিপ্রেক্ষিতে এ সময় ‘পঞ্চগৌড়’ বা বৃহত্তর গৌড়ের ধারণার উন্মেষ ঘটে। সারস্বত (পূর্ব পাঞ্জাব), কান্যকুব্জ, গৌড়, মিথিলা (উত্তর বিহার) এবং উৎকল (উত্তর ওড়িশা) এই পাঁচটি অঞ্চল নিয়ে পঞ্চগৌড়।
শীঘ্রই ধর্মপালের ভাগ্যাকাশে দুর্যোগের কালো মেঘ পুঞ্জীভূত হতে থাকে। বৎসরাজের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দ্বিতীয় নাগভট প্রতীহার সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁর নেতৃত্বে প্রতীহার শক্তির পুনরভ্যুত্থান ঘটে। ইতিমধ্যে রাষ্ট্রকূট সিংহাসনে ধ্রুবের পুত্র তৃতীয় গোবিন্দ অধিষ্ঠিত হয়েছেন। দ্বিতীয় নাগভটের শক্তি খর্ব করার উদ্দেশ্যে তৃতীয় গোবিন্দ ৮ম শতকের একেবারে অন্তিম লগ্নে প্রতীহার রাজ্য আক্রমণ করেন। দ্বিতীয় নাগভট পরাজিত হন। বিজয়ী রাষ্ট্রকূট সেনা বিনা বাধায় গঙ্গা-যমুনা বিধৌত অঞ্চলে এসে উপস্থিত হন। এ অঞ্চল ধর্মপালের আশ্রিত চক্রায়ুধের অধিকারভুক্ত। কিন্তু ধর্মপাল বা চক্রায়ুধ কোনও প্রতিরোধ রচনা করলেন না, তাঁরা বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করেন। তৃতীয় গোবিন্দের নিজের নেসারিকা তাম্রশাসনে অবশ্য বিনা যুদ্ধে ধর্ম পালের আত্মসমর্পণের কথা নেই, আছে তৃতীয় গোবিন্দের বঙ্গালনৃপতি ধর্মের ভগবতী তারার প্রতিকৃতি অলংকৃত ধ্বজের আত্মসাতের কথা। কিন্তু সঞ্জান তাম্রশাসনে স্পষ্টই বলা হয়েছে, ধর্মপাল এবং চক্রায়ুধ স্বেচ্ছায় রাষ্ট্রকূটরাজের বশ্যতা স্বীকার করেন (স্বয়মেবোপনতৌ চ যস্য মহতস্তৌ ধর্মচক্ৰায়ুধৌ)।
তৃতীয় গোবিন্দের নিকট ধর্মপালের বিনা যুদ্ধে বশ্যতা স্বীকারের পিছনে অবশ্যই কোনও বড় কারণ ছিল। রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন, দ্বিতীয় নাগভটের শক্তিবৃদ্ধিতে শঙ্কিত হয়ে ধর্মপাল সম্ভবত তৃতীয় গোবিন্দকে উত্তর ভারত অভিযানে প্ররোচিত করেন। এ মত নিতান্তই অনুমান নির্ভর। ধর্মপালের উপর নির্ভর করতেন বলে চক্রায়ুধকে প্রতীহার লেখে ভর্ৎসনা করা হয়েছে। ধর্মপালের প্রতি প্রতীহার রাজারা কিন্তু শ্রদ্ধাশীল। পরনির্ভরশীল হলে ধর্মপাল সম্পর্কে তাঁদের তাচ্ছিল্যই প্রকাশ পেত। আসলে ধর্মপাল বুঝতে পেরেছিলেন, রাজ্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য নিয়ে তৃতীয় গোবিন্দ উত্তর ভারত অভিযানে বের হননি, পিতার মতো তিনি শীঘ্রই স্বরাজ্যে প্রত্যাবর্তন করবেন। অযথা লোকক্ষয় এবং নিজ শক্তির অপচয় এড়াতেই ধর্মপালের এই কৌশল গত আত্মসমর্পণ। অচিরে তৃতীয় গোবিন্দ দক্ষিণ ভারতে ফিরে যান। কিছুটা হতমান হলেও ধর্মপালের রাজনৈতিক আধিপত্য অটুট থাকে।
এরপর ধর্মপাল এক গুরুতর বিপদের সম্মুখীন হন। তিব্বতের রাজা মু-তিগ-চান-পো (খ্রিস্টাব্দ ৮০৪-১৫) পালরাজ্য আক্রমণ করেন। (মুতিগ চান পো ৮০৪-১৫ খ্রিস্টাব্দে রাজত্ব করেন, রমেশচন্দ্র মজুমদার (History of Ancient Bengal (Calcutta, 1971), পৃষ্ঠা ১১৮) এই অভিমত পোষণ করেন। কিন্তু তিনি অন্যত্র (The Age of Imperial Kananj (Bombay, 1964), পৃষ্ঠা ৪৪৬) এই তিব্বতি রাজার রাজত্বকাল ৭৯৮-৮০৪ খ্রিস্টাব্দে ধার্য করেছেন। শেষোক্ত মত সর্বপ্রথম ব্যক্ত হয় The Age of Imperial Kanauj গ্রন্থখানির ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত প্রথম সংস্করণে। এর দেড় দশককাল পর অর্থাৎ ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে তিনি নতুন করে মু তিগ চান পোর রাজত্বকাল নির্ধারণ করেন। সঙ্গত কারণে এই অভিমতই বেশি গুরুত্ব পাবে। তিব্বততত্ত্ববিদ সুনীতি কুমার পাঠকের (তিব্বত (কলকাতা, ১৯৬০), পরিশিষ্ট ৩) মতে মু তিগ চান পো ৭৮০-৯৭ খ্রিস্টাব্দে রাজত্ব করেন।) লাডাকের ইতিবৃত্ত থেকে জানা যায়, ভারতের দু’জন রাজা তাঁর পদানত ছিলেন। এদের একজন ধর্মপালং, অন্যজন দ্ৰহু পুন। (লাডাকের ইতিবৃত্তে উল্লিখিত ভারতীয় রাজার প্রকৃত নামটি হল ধর্ম-পল। ধর্ম-পল আর ধর্মপাল নিঃসন্দেহে একই ব্যক্তি।) এই দু’জন ভারতীয় রাজা তিব্বতি রাজদরবারে নিয়মিতভাবে ধনরত্নাদি উপঢৌকন পাঠাতেন। ধর্মপাল তিব্বতি রাজার বশীভূত ছিলেন বলে লাডাকের ইতিবৃত্তে যা বলা হয়েছে তার মধ্যে নিঃসন্দেহে অত্যুক্তি আছে। তবে পালরাজের রাজত্বের শেষের দিকে মু-তিগ-চান-পো বঙ্গ-মগধ আক্রমণ করেছিলেন, এরূপ ভাবনা অযৌক্তিক নয়। অনুমান করা যায়, ধর্মপাল সর্বশক্তি দিয়ে এ আক্রমণ প্রতিহত করেন। কিন্তু এ কাজে যে অর্থব্যয় ও লোকক্ষয় হয় তার পরিণাম ধর্মপালের পক্ষে শুভ হয়নি।
ধর্মপালের বিপদের পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করলেন দ্বিতীয় নাগভট। তিনি ধর্মপালের আশ্রিত চক্রায়ুধকে পরাজিত করে কান্যকুব্জ অধিকার করেন। পরাভূত চক্রায়ুধ পালরাজের শরণাপন্ন হন। অতঃপর প্রতীহার নৃপতি সসৈন্যে পূর্বদিকে অগ্রসর হন। এবার তাঁর লক্ষ্য ধর্মপাল। পাল রাজের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে বহু আঞ্চলিক রাজা দ্বিতীয় নাগভটের পক্ষে যোগদান করেন। এ প্রসঙ্গে যোধপুরের কক্ক, উত্তর গুজরাতের বাহুকধবল ও জয়পুরের শঙ্করগণের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
জোধপুর লেখের সাক্ষ্যে প্রকাশ, বিহারের মুঙ্গেরে পাল ও প্রতীহার নৃপতিদ্বয় পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। প্রশ্ন উঠতে পারে, দ্বিতীয় নাগভট ধর্মপালের রাজ্যের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন অথচ পালরাজ কোনও প্রতিরোধ রচনা না করে নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলেন। সম্ভবত তিব্বতি আক্রমণ ধর্মপালকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে ; তাঁর পক্ষে দ্বিতীয় নাগভটকে প্রতিহত করা আর সম্ভব ছিল না। এ প্রশ্নের আর একটি উত্তরও সম্ভব। পালরাজ তাঁর রাজ্যের পশ্চিম সীমান্তে প্রতীহার বাহিনীর বিরুদ্ধে অবরোধ রচনা করেন কিন্তু বিশেষ সফল না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত মুঙ্গেরে চূড়ান্ত সংঘর্ষের জন্য প্রস্তুত হন। মুঙ্গেরের যুদ্ধে ধর্মপাল শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। কান্যকুব্জ তো পূর্বেই পালদের প্রভাবমুক্ত হয়েছে। এবার সমগ্র বিহার বা বিহারের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলও প্রতীহারদের অধিকারে চলে যায়।
রমেশচন্দ্র মজুমদার ধর্মপালের এই ভাগ্যবিপর্যয়কে তৃতীয় গোবিন্দের উত্তর ভারত অভিযানের পূর্ববর্তী ঘটনা বলে মনে করেন। তাঁর অভিমত, দ্বিতীয় নাগভটের হাতে পরাজিত হয়েও ধর্মপাল রাষ্ট্রকূট অভিযানের ফলে বিপদমুক্ত হন এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সগৌরবে রাজত্ব করেন। কিন্তু এ মত অভ্রান্ত মনে হয় না। তৃতীয় গোবিন্দের নেসারিকা তাম্রশাসন থেকে জানা যায়, তাঁর উত্তর ভারত অভিযান ৮০৫ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তিকালে যে দ্বিতীয় নাগভটের শক্তিবৃদ্ধি হয় এবং তিনি ধর্মপালকে পরাজিত করেন তার প্রমাণ রাষ্ট্রকূট কর্কের বড়োদরা তাম্রশাসন। (রাষ্ট্রকূট কর্কের বড়োদরা অভিলেখে গৌড়-বঙ্গের অধিপতির বিরুদ্ধে জনৈক গুর্জররাজের বিজয় লাভের সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে (গৌড়েন্দ্ৰ-বঙ্গপতি-নির্জয়-দুর্বিদগ্ধ)। পরাজিত গৌড়-বঙ্গাধিপতি অবশ্যই ধর্মপাল। আর এই গুর্জররাজ নিঃসন্দেহে দ্বিতীয় নাগভট।) তৃতীয় গোবিন্দের উত্তর ভারত অভিযান এবং ৮০৬ খ্রিস্টাব্দে দেবপালের পাল সিংহাসনে আরোহণের মধ্যবর্তী কোনও এক সময় ধর্মপালের এই পরাজয় ঘটে। সফলতা দিয়ে যাঁর রাজত্বের শুরু, ব্যর্থতার মধ্যে তাঁর রাজত্বের পরিসমাপ্তি। কিন্তু তাঁরই রাজত্বকালে পাল রাজবংশ এক সর্বভারতীয় রাজশক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল। পাল রাজ বংশের এ অভ্যুত্থান তো ভোলবার নয়। এখানেই ধর্মপালের সাফল্য।
সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও ধর্মপালের অবদান অবিস্মরণীয়। তথাগতের ভক্ত ছিলেন তিনি। প্রখ্যাত বৌদ্ধ আচার্য হরিভদ্র তাঁর অনুগ্রহভাজন ছিলেন। বিহারের কাহলগাঁও-এর নিকট আন্টিচকে গঙ্গাতীরে তিনি বিক্রমশীল বৌদ্ধবিহার নির্মাণ করেন। ১১৪ জন অধ্যাপকের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন বিষয়ের অনুশীলন হত এই বিহারে। বর্তমান বিহারশরীফে অবস্থিত ওদন্তপুরী বিহার ধর্মপালের কীর্তি বলে অনেকেই মনে করেন। তবে এ বিষয়ে কোনও স্পষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় না। গোপাল এবং দেবপালের সপক্ষেও এরূপ দাবি উচ্চারিত হয়েছে। তারনাথ বলেন, দেবপাল সোমপুরী বিহার নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু রাজশাহী জেলার পাহাড়পুরে আবিষ্কৃত কয়েকটি মৃৎ ফলকে ধর্মপালকেই স্থানীয় সোমপুর বিহারের নির্মাতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ধর্মে বৌদ্ধ হলেও ধর্মপাল ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সমাদর করেছেন। গর্গ নামে জনৈক ব্রাহ্মণ তাঁর মন্ত্রী ছিলেন। এতে ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রতি তাঁর উদার মনোভাবই ব্যক্ত হয়েছে। তাঁর রাজত্বকালে বোধগয়ার নিকট এক চতুর্মুখ শিবের মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়, শুভস্থলীতে নগ্ন নারায়ণ বা বিষ্ণুর একটি মন্দিরও নির্মিত হয়।
রাষ্ট্রকূটরাজ পরবলের কন্যা রণ্ণাদেবী ধর্মপালের মহিষী ছিলেন। যুবরাজ ত্রিভুবনপাল ছিলেন ধর্মপালেরই এক পুত্র। খালিমপুর শাসনের দূতক ছিলেন তিনি। সম্ভবত ধর্মপালের জীবদ্দশায় তাঁর মৃত্যু হয়। আবার এমনও হতে পারে, দেবপাল তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ত্রিভুবনপালকে উৎখাত করে পিতৃসিংহাসন অধিকার করেন। আনুমানিক ৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে ধর্মপাল সিংহাসনে আরোহণ করেন। ৮০৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর রাজত্বের অবসান হয়।
দেবপাল (আ. ৮০৬-৪৫ খ্রিস্টাব্দ)
পাল সাম্রাজ্যের এক দুর্যোগময় মুহূর্তে দেবপাল পিতৃসিংহাসনে আরোহণ করেন। (খালিমপুর তাম্রশাসনে ত্রিভুবনপাল নামে ধর্মপালের এক পুত্রের কথা আছে। লেখে তিনি যুবরাজ-রূপে আখ্যাত হয়েছেন। তিনিই ছিলেন ধর্মপালের জ্যেষ্ঠ পুত্র। কিন্তু পিতার মৃত্যুর পর দেবপালই রাজপদ লাভ করেন, ত্রিভুবনপাল নন। এর দু’টি ব্যাখ্যা সম্ভব। এক, ত্রিভুবনপাল পিতার জীবদ্দশায় লোকান্তরিত হন। দুই, দেবপাল জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে বিতাড়িত করে সিংহাসন অধিকার করেন। অনেকেই মনে করেন, সোড্ঢলের উদয়সুন্দরীকথায় পালরাজ যুবরাজ, অভিনন্দের রামচরিত কাব্যের যুবরাজ হারবর্ষ এবং খালিমপুর লেখের ত্রিভুবনপাল এক ও অভিন্ন ব্যক্তি ছিলেন। এ মত সঠিক হলে স্বীকার করতে হয়, ত্রিভুবনপাল ধর্মপালের মৃত্যুর পর অল্প কিছুদিনের জন্য রাজপদ অলংকৃত করেছিলেন।) উচ্চাভিলাষের সঙ্গে রণনৈপুণ্যের সংযোগে তাঁর চরিত্র সমুজ্জ্বল। তাঁর রাজত্বকাল পাল ইতিহাসের এক গৌরবময় অধ্যায়।
দেবপালের তৃতীয় ও নবম রাজ্যবর্ষে উৎকীর্ণ দু’টি মূর্তিলেখ বিহারের যথাক্রমে নালন্দা ও কুরকীহারে পাওয়া গেছে। তাঁর ২৫শ রাজ্যবর্ষে উৎকীর্ণ একখানি মূর্তিলেখ পাটনা জেলার হিলসা গ্রামে আবিষ্কৃত হয়েছে। অনুমান করা যায়, আনুমানিক ৮০৬ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণের পর দেবপাল ধীরে ধীরে প্রতীহার কবল থেকে বিহার পুনরুদ্ধার করেন। তখনও কিন্তু দ্বিতীয় নাগভটই প্রতীহার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। পরবর্তী প্রতীহার নৃপতি রামভদ্রের দুর্বলতার সুযোগে দেবপাল পশ্চিম দিকে পালরাজ্যের আরও বিস্তার ঘটান। তাঁর পুত্র প্রথম শূরপালের একখানি লেখ থেকে মনে হয়, বারাণসী দেবপালের অধিকারভুক্ত ছিল। প্রতীহার প্রথম ভোজের বরা লেখ ইঙ্গিত করছে, পালরাজ প্রতীহার রাজ্যভুক্ত বান্দা অঞ্চলেও তাঁর প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।
তাঁর ২৫শ রাজ্যবর্ষের অব্যবহিত পরই দেবপালকে এক কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হতে হয়। ততদিনে রামভদ্রের দুর্বল রাজত্বের অবসান হয়েছে। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন তাঁরই পুত্র প্রথম ভোজ। পরাক্রান্ত এই প্রতীহার রাজা ৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে বা তার কিছুকাল পূর্বে সিংহাসনে আরোহণ করেই দেবপালের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে অবতীর্ণ হন। প্রতীহাররাজের গ্বালিয়র প্রশস্তিতে এই সংঘর্ষের উল্লেখ আছে। এই প্রশস্তিতে বলা হয়েছে, ভোজ ধর্ম বা ধর্মপালের পুত্রের রাজলক্ষ্মী আত্মসাৎ করেছিলেন। দেবপালের বিরুদ্ধে প্রথম ভোজের এই বিজয়লাভের দাবি কয়েকটি সূত্রে সমর্থিত হচ্ছে। কলচুরি নৃপতি সোঢ়দেবের কহলা লেখে দাবি করা হয়েছে, গুণাত্তোধিদেব গৌড়রাজের সৌভাগ্যশ্রী হরণ করেছিলেন এবং প্রতিদানস্বরূপ ভোজের কাছ থেকে জায়গির লাভ করেছিলেন। উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর অঞ্চলে এই জায়গির অবস্থিত ছিল। তাছাড়া বালাদিত্যের চাটসু অভিলেখে হর্ষরাজ ও তাঁর পুত্র গুহিলরাজের গৌড়-বঙ্গ বিজয়ের বর্ণনা আছে। মনে হয়, দেবপালের বিরুদ্ধে অভিযানে প্রথম ভোজ গুণাম্ভোধিদেব ও হর্ষরাজের সহায়তা লাভ করেছিলেন। প্রথম ভোজের হাতে পরাজয়ের ফলে পূর্ব উত্তরপ্রদেশ ও বিহার দেবপালের হস্তচ্যুত হয়। প্রথম ভোজের হস্তে পরাভবের গ্লানি দেবপালকে বেশি দিন বহন করতে হয়নি। অচিরে তিনি শক্তি সঞ্চয় করে প্রতীহাররাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এবার ভাগ্যলক্ষ্মী তাঁর প্রতি প্রসন্ন হলেন।
পাল নৃপতি নারায়ণপালের মন্ত্রী ভট্ট গুরবমিশ্রের বাদাল স্তম্ভলেখে বলা হয়েছে, মন্ত্রী কেদার মিশ্রের সাহায্যপুষ্ট হয়ে দেবপাল গুর্জররাজের দর্প খর্ব করেন : ‘খবীকৃত-দ্রবিড়-গুর্জরনাথ-দর্পম্’। যে গুর্জরনাথের বিরুদ্ধে দেবপালের এই বিজয়লাভ, তিনি নিঃসন্দেহে প্রথম ভোজ। গুর্জরদের বিরুদ্ধে দেবপালের বিজয়লাভের দাবিতে কোনও অতিশয়োক্তি আছে বলে মনে হয় না। দেবপালের ৩৩শ রাজ্যবর্ষে উৎকীর্ণ একখানি তাম্রশাসন বিহারের মুঙ্গেরে আবিষ্কৃত হয়েছে। তাম্রশাসনখানি মুদ্গগিরি জয়স্কন্ধাবার থেকে প্রদত্ত হয়েছিল। লেখটিতে যে গ্রামদানের কথা বলা হয়েছে তা লক্ষ্মীসরাইর নিকটস্থ বালগুদর অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। দেবপালের ৩৫শ বা ৩৯শ রাজ্যবর্ষে উৎকীর্ণ একটি লেখ নালন্দায় পাওয়া গেছে। এই লেখে যে পাঁচটি গ্রামদানের উল্লেখ আছে তার মধ্যে চারটি রাজগৃহ-বিষয়ে এবং একটি গয়া-বিষয়ে অবস্থিত ছিল। মুঙ্গের ও নালন্দা লেখ দু’টি প্রমাণ করছে, দেবপাল তাঁর ৩৩শ রাজ্যবর্ষে বা তার অব্যবহিত পূর্বে বিহার পুনরুদ্ধার করেন। এই বিহার ছিল প্রথম ভোজের অধিকারভুক্ত। তাঁকে পরাজিত করে দেবপাল বিহার পুনরধিকার করেন। শুধু বিহারই অধিকৃত হল না, পালরাজ্য পশ্চিমে সম্ভবত বারাণসী পর্যন্ত প্রসারিত হল।
মুঙ্গের তাম্রশাসন থেকে অনুমিত হয়, তাঁর ৩৩শ রাজ্যবর্ষে বা তার অব্যবহিত পূর্বে দেবপাল প্রথম ভোজকে পরাজিত করেন। তখন দেবপালের রাজত্বের অন্তিম পর্ব। প্রথম ভোজের বিরুদ্ধে দেবপাল যে তাঁর রাজত্বের একেবারে শেষ পর্যায়ে সাফল্য লাভ করেন, বাদাল স্তম্ভলেখের সাক্ষ্যে তার সমর্থন মেলে। যে কেদারমিশ্রের সহায়তায় পালনৃপতি ভোজকে পরাভূত করেন সেই কেদারমিশ্র ছিলেন দর্ভপাণির পৌত্র। দর্ভপাণিও দেবপালের অধীনে মন্ত্রীর কার্যভার গ্রহণ করেছিলেন। যে ঘটনার জন্য দর্ভপাণির পৌত্রকে কৃতিত্ব দেওয়া হয়েছে সেই ঘটনাটি নিঃসন্দেহে দেবপালের রাজত্বের শেষের দিকেই ঘটেছিল।
পাল লেখমালায় যে দেবপালের বর্ণনা আছে তিনি নিছক বাংলা, বিহার ও পূর্ব উত্তর প্রদেশের নরপতি নন, তিনি সারা ভারতবর্ষের অপ্রতিদ্বন্দ্বী সম্রাট। মুঙ্গের তাম্রশাসনে বলা হয়েছে, উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে সেতুবন্ধ-রামেশ্বর এবং পূর্বে পূর্ব সমুদ্র অর্থাৎ বঙ্গোপসাগর থেকে পশ্চিমে পশ্চিম সমুদ্র বা আরব সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে দেবপালের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত ছিল। (আগঙ্গাগম-মহিতাৎ-সপত্নশূন্যাম্/ আসেতোঃ প্রথিত-দশাস্য-কেতুকীর্ডেরুবীম্।/ আবরুণনিকেতনাচ্চ সিন্ধোর – / আলক্ষ্মীকুল-ভবনাচ্চ যো বুভোজ ॥) মুঙ্গের শাসনে দাবি উত্থাপিত হয়েছে, দিগ্বিজয়ে বহির্গত হয়ে দেব পালের অশ্বারোহী বাহিনী সুদূর কম্বোজে গিয়ে উপস্থিত হয়। কিন্তু বাদাল প্রশস্তিতে দেবপালের রাজ্যের যে সীমানা বর্ণিত হয়েছে, তা তুলনায় আয়তনে ক্ষুদ্র ; এ রাজ্যের উত্তর সীমানায় হিমালয় পর্বতমালা, দক্ষিণে বিন্ধ্য পর্বতশ্রেণি, পূর্ব ও পশ্চিমে পূর্ব সমুদ্র এবং পশ্চিম সমুদ্র। (আরেবাজনকাৎ-মতঙ্গজমদস্তিভ্য-চ্ছিলাসংহতে : আগৌরীপিতুরীশ্বরেন্দু-কিরণৈঃ পুষ্যৎ সিতিন্নো গিরেঃ। মার্তণ্ড-অস্তম-য়োদয়াদ-রুণজলাৎ আবারিরাশিদ্বয়াৎ নীত্যা যস্য ভুবং চকার করদাং শ্রীদেবপালো নৃপঃ ।।) এই লেখে দাবি করা হয়েছে, দেবপাল উৎকল ও হূণদের পরাজিত করেন (উৎকীলিতোৎকলকুলং হৃতত্বণগর্বম্) এবং দ্রবিড় ও গুর্জর (খবীকৃত-দ্রবিড়-গুর্জরনাথ-দর্পম্) রাজার দর্প চূর্ণ করেন। ভাগলপুর শাসনে বলা হয়েছে, তাঁর খুল্লতাতপুত্র ও সেনাপতি জয়পালের ভয়ে উৎকলরাজ পলায়ন করেন, আর কামরূপেশ্বর বশ্যতা স্বীকার করেন।
লেখমালায় দেবপালের দিগ্বিজয় বর্ণনার সত্যতা সম্পর্কে ঐতিহাসিকেরা ভিন্ন মত প্রকাশ করেন। রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন, দেবপাল পাকিস্তান-আফগানিস্তানে অবস্থিত কম্বোজ জয় করেন, পাঞ্জাব বা হিমালয়ের পাদদেশের হূণদের পরাজিত করেন এবং সমকালীন পাণ্ড্যরাজ শ্রীমার শ্রীবল্লভকে (আ. ৮১৫-৬২ খ্রিস্টাব্দ) রামেশ্বরের সন্নিকটে বিপর্যস্ত করেন। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় দ্রবিড়নাথ বলতে রাষ্ট্রকূট নৃপতি প্রথম অমোঘবর্ষ (আ. ৮১৪-৮৮০ খ্রিস্টাব্দ) বুঝেছেন। রাষ্ট্রকূটেরা কিন্তু কর্ণাট, দ্রবিড় নন। তাঁরা কন্নড় ভাষাভাষী।
দেবপালের দিগ্বিজয়ের এসব বর্ণনায় অতিশয়োক্তি বিস্তর। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজগণের পরিচয়ও সুস্পষ্ট নয়। তবে দেবপাল যে কম্বোজদের পরাজিত করেন তাঁরা সম্ভবত উত্তর বাংলার কোনও তিব্বতি উপজাতি। পাঞ্জাবের হুণেরা গুর্জর প্রতীহারদের সঙ্গে মিলিত হয়ে পালরাজ্য আক্রমণ করে থাকতে পারেন। সামরিক অভিযানকালে দেবপাল রামেশ্বর পর্যন্ত অগ্রসর হলে সাময়িক কালের জন্য অন্তত ভারতের সমগ্র পূর্ব উপকূল তাঁর পদানত থাকত। কিন্তু এ অঞ্চল যে কখনও দেবপালের অধীন ছিল তার কোনও প্রমাণ নেই। দেবপাল হয়তো অসম এবং ওড়িশা আক্রমণ করেছিলেন। এ সময় অসমে রাজত্ব করতেন প্রালম্ভ বা তাঁর পুত্র হর্জর। ওড়িশা ছিল ভৌম করদের অধীন। এঁরা যে দেবপালের বশীভূত ছিলেন তার কোনও প্রমাণ নেই।
লাডাকের ইতিবৃত্ত বলছে, তিব্বতের রাজা রল-প-চান (আ.৮১৭-৩৬ খ্রিস্টাব্দ) গঙ্গাসাগর পর্যন্ত ভারতীয় ভূখণ্ড জয় করেছিলেন। এই তিব্বতি রাজা দেবপালের সমকালবর্তী ছিলেন। এ কাহিনি কতদূর সত্য বলা কঠিন। লক্ষ করবার বিষয়, প্রথম শূরপালের তাম্রশাসনে দেব পালকে নেপাল বিজেতারূপে বর্ণনা করা হয়েছে। নেপাল তখন তিব্বতের অধীনস্থ। উভয় পক্ষের পরস্পর বিরোধী দাবি থেকে মনে হয়, পালরাজ্য ও তিব্বতের সীমান্ত ঘিরে দুই রাজার মধ্যে সংঘাত বেধেছিল। এর বেশি কিছু বলা হয়তো ঠিক হবে না।
নালন্দা তাম্রশাসনে দেবপালের রাজত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা লিপিবদ্ধ আছে। এই ঘটনা দেবপালের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শৈলেন্দ্রবংশীয় রাজগণের মৈত্রী সম্পর্কিত। শৈলেন্দ্ররাজ বালপুত্রদেব বৌদ্ধধর্মের অনুরাগী ছিলেন। তিনি নালন্দায় একটি বিহার নির্মাণকল্পে দেবপালের দরবারে দূত প্রেরণ করেন। পালনৃপতির অনুমোদনে নালন্দায় একটি বৌদ্ধবিহার নির্মিত হয়। প্রতিষ্ঠানটির দৈনন্দিন ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য দেবপাল পাঁচটি গ্রাম দান করেন। অবশ্য গ্রাম পঞ্চকের মূল্য বাবদ শৈলেন্দ্ররাজকে পাল রাজকোষে উপযুক্ত পরিমাণ অর্থ প্রদান করতে হয়েছিল। এই অর্থ না দিলে পুণ্যের সবটাই দেবপালের ভাগে চলে যেত। তখনকার দিনের লোকদের বিশ্বাস ছিল, দাতা স্বাধিকারভুক্ত জমি দান করলে দানজনিত পুণ্যের পঞ্চষষ্ঠাংশের অধিকারী হন। সে যা হোক, দেবপালের রাজত্বকালে ভারতবর্ষ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে মৈত্রীর সেতুবন্ধ রচিত হয়।
বুদ্ধদেবের ভক্ত ছিলেন দেবপাল। নালন্দা মহাবিহারেরও তিনি ছিলেন পৃষ্ঠপোষক। তাঁরই আগ্রহে নগরহারের (জেলালাবাদ) বিদগ্ধ ব্রাহ্মণ বীরদেব নালন্দা মহাবিহারের অধ্যক্ষ পদে বৃত হন। তারনাথ বলেন, দেবপাল বরেন্দ্রে সোমপুরী বিহার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে প্রমাণিত, সোমপুর বা সোমপুরী বিহারের নির্মাতা ধর্মপাল, দেবপাল নন। রাজশাহী জেলার পাহাড়পুরে এই বৌদ্ধবিহার অবস্থিত ছিল।
আনুমানিক ৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে দেবপাল লোকান্তরিত হন। পাল রাজবংশের তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ নরপতি। প্রতীহার শক্তির আঘাতে তাঁর পিতার রাজ্য ভেঙে পড়েছিল। প্রতীহারদের প্রত্যাঘাত হেনে তিনি বিহার ও উত্তরপ্রদেশের পূর্বাঞ্চল পুনরুদ্ধার করেন। পালশক্তি নতুন প্রাণ পেল। আবিন্ধ্যহিমাচলের রাজচক্রবর্তী তিনি ছিলেন না। তবু তাঁর খ্যাতি ভারতের সীমানা পেরিয়ে সুদূর দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল।
মহেন্দ্রপাল থেকে দ্বিতীয় গোপাল (আ. ৮৪৫-৭৭ খ্রিস্টাব্দ)
মহেন্দ্রপাল (আ. ৮৪৫-৬০ খ্রিস্টাব্দ) : দেবপালের পর তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র, মহিষী মাহটার গর্ভজাত সন্তান মহেন্দ্রপাল (আ. ৮৪৫-৬০ খ্রিস্টাব্দ) পাল সিংহাসনে আরোহণ করেন। (বহু দিন পূর্বেই বাংলা ও বিহারে মহেন্দ্রপালের আটখানি লেখ আবিষ্কৃত হয়েছে। তখন তাঁকে প্রতীহার বংশীয় মহেন্দ্রপাল বলে শনাক্ত করা হত। কিন্তু জগজ্জীবনপুর তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হওয়ায় তাঁর প্রকৃত পরিচয় উদ্ঘাটিত হয়েছে। তিনি এক পালবংশীয় নরপতি, দেবপাল তাঁর পিতা, রানি মাহটা তাঁর মাতা।) উত্তর বাংলা ও বিহারের বিভিন্ন স্থানে তাঁর অভিলেখ আবিষ্কৃত হয়েছে। অনুমান করা যায়, পৈতৃক রাজ্যের অখণ্ডতা রক্ষায় তিনি সম্পূর্ণ সফল হয়েছিলেন। মোটামুটি পঞ্চদশ বৎসরকাল রাজত্ব করার পর সম্ভবত নিঃসন্তান অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।
প্রথম শূরপাল (আ. ৮৬০-৭২ খ্রিস্টাব্দ) : মহেন্দ্রপালের মৃত্যুর পর তাঁর কনিষ্ঠ সহোদর প্রথম শূরপাল (আ. ৮৬০-৭২ খ্রিস্টাব্দ) রাজপদ লাভ করেন। বিহারের পাটনা, মুঙ্গের ও নালন্দা এবং উত্তরপ্রদেশের মির্জাপুর ও বারাণসী জেলায় তাঁর লেখ পাওয়া গেছে। পৈতৃক রাজ্যের অখণ্ডতা রক্ষায় তাঁর সাফল্য প্রশংসনীয়। তিনি দ্বাদশ বৎসর রাজত্ব করেন।
দ্বিতীয় গোপাল (আ. ৮৭২-৭৭ খ্রিস্টাব্দ) : পূর্বে অনুমিত হত, প্রথম শূরপাল অপুত্রক অবস্থায় লোকান্তরিত হলে অথবা তাঁকে কিংবা তাঁর কোনও এক পুত্রকে পদচ্যুত করে দেবপালের খুল্লতাত বাকপালের পৌত্র প্রথম বিগ্রহপাল পাল সিংহাসন অধিকার করেন। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে প্রথম শূরপালের পুত্র গোপালের তিন তিনখানি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হওয়ায় এ ধারণার অবসান ঘটেছে। প্রমাণিত হয়েছে, প্রথম শূরপালের পরলোকগমনের পর তাঁর পুত্র এবং মহিষী মাণিক্যদেবীর গর্ভজাত সন্তান দ্বিতীয় গোপাল পিতৃসিংহাসনে আরোহণ করেন। দ্বিতীয় গোপালের যে তিনখানি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হয়েছে, তাদের একখানি পাওয়া গেছে বাংলাদেশের বগুড়া জেলার মহীপুর গ্রামে, বাকি দু’খানির প্রাপ্তিস্থল এখনও আমাদের অপরিজ্ঞাত। প্রথম শাসন খানির সম্প্রদানকাল গোপালের তৃতীয় রাজ্যবর্ষ, শেষোক্ত দু’খানি তাঁর রাজত্বের চতুর্থ বৎসরে প্রদত্ত হয়।
মনে রাখতে হবে, প্রথম শূরপালের পুত্র গোপালের নাম ভট্ট গুরবমিশ্রের বাদাল শিলাস্তম্ভ লেখে উল্লিখিত থাকা সত্ত্বেও বহুদিন পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট শ্লোকটির প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি করা যায়নি। বাদাল প্রশক্তির পঞ্চদশ শ্লোকে শূরপালের নামোল্লেখ আছে (শ্রীশুরপালো নৃপঃ)। এই লেখের সপ্তদশ শ্লোকে মন্ত্রী গুরবমিশ্রকে ‘গোপাল-প্রিয়কারক’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। গো শব্দের অর্থ পৃথিবী ; পৃথিবীকে পালন করেন যিনি তিনি গোপাল। অর্থাৎ গোপাল পদের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ রাজা, পৃথিবীপাল বা ভূপতি। বিদ্বজ্জনেরা মন্ত্রী গুরবমিশ্রকে পৃথিবীপাল অর্থাৎ রাজার (শূরপাল কিংবা নারায়ণপাল) প্রিয়কারক বা প্রিয়রঞ্জন বলে ব্যাখ্যা করতেন। কিন্তু শূরপাল-পুত্র গোপালের তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হওয়ায় এখন মনে হচ্ছে, ‘গোপাল-প্রিয়কারক’ পদটিকে রাজা গোপালের প্রিয়কারক এই অর্থে গ্রহণ করতে হবে। (অধ্যাপক সুরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য (Journal of Ancient Indian History, Vol. XXXIV (2007-8). পৃষ্ঠা ৭৩-৮২) সর্বপ্রথম ‘গোপাল-প্রিয়কারক’ পদের এরূপ ব্যাখ্যার প্রতি পণ্ডিত-সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।)
প্রশ্ন হচ্ছে, দ্বিতীয় গোপাল কতদিন রাজত্ব করেন। তাঁর রাজত্বকাল যে অন্তত চার বৎসর স্থায়ী হয়, তাম্রশাসনত্রয়ের সাক্ষ্যে তা প্রমাণিত হয়। এই প্রসঙ্গে গোপালের নামাঙ্কিত দু’খানি প্রাচীন পাণ্ডুলিপি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। পাণ্ডুলিপি দু’টির একটি অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতার একটি পাণ্ডুলেখ যা বিক্রমশীলদের বিহারে গোপালের পঞ্চদশ রাজ্যবর্ষে অনুলিখিত; অন্যটি মৈত্রেয়-ব্যাকরণের একটি পাণ্ডুলিপি। পাণ্ডুলিপি দু’টির কোনওটিতেই রাজার পিতৃপরিচয় বর্ণিত হয়নি। অথচ পালবংশে গোপাল নামে চারজন রাজা বর্তমান ছিলেন। অষ্টসাহস্রিকা-প্রজ্ঞাপারমিতার পাণ্ডুলিপি চিত্ৰশোভিত। চিত্রগুলি ১০ম শতকেরও পরবর্তী। এই যুক্তিতে বলা যায়, প্রজ্ঞাপারমিতার পাণ্ডুলিপির গোপাল দ্বিতীয় বা তৃতীয় গোপাল নন, তিনি খ্রিস্টীয় ১২শ শতকীয় চতুর্থ গোপাল। মৈত্রেয়-ব্যাকরণের পুঁথিখানির অনুলিখনের তারিখ সম্পর্কে বিদ্বজ্জনেরা বিভিন্ন অভিমত ব্যক্ত করেছেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকর ও রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এই তারিখটিকে যথাক্রমে ৫৭, ১১ এবং ১৭ রাজ্যবর্ষরূপে পাঠ করেছেন। দশকের ঘরের সংখ্যাটি যে ১ তা সুনিশ্চিত। এককের ঘরের সংখ্যাটি একটু অস্পষ্ট হলেও দীনেশচন্দ্র সরকার ভাণ্ডারকরের পাঠকেই সঠিক বলে গ্রহণ করেছেন। অনুমিত হয়, মৈত্রেয় ব্যাকরণ পুঁথির পাণ্ডুলপিতে উল্লিখিত গোপাল অন্যূন একাদশ বৎসর রাজত্ব করেন। পুঁথির অক্ষর-বিন্যাসের প্রেক্ষিতে এই গোপালকে দ্বিতীয় বা তৃতীয় গোপালরূপে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু এখানে নিম্নোক্ত দু’টি বিষয় প্রণিধানযোগ্য :
- প্রথমত, দ্বিতীয় গোপাল যে অন্তত চার বৎসরকাল রাজত্ব করেন তা প্রমাণিত। তাঁর রাজত্বের এই চার বৎসরের মধ্যে অন্যূন তিনখানি তাম্রশাসন উৎকীর্ণ হয়েছে। তাঁর রাজত্বকাল আরও সম্প্রসারিত হলে তিনি অবশ্যই আরও কয়েকখানি তাম্রশাসন উৎকীর্ণ করতেন। পক্ষান্তরে তৃতীয় গোপালের যে একখানি মাত্র তাম্রশাসনের সন্ধান পাওয়া গেছে সেই জাজিলপাড়া তাম্রশাসন তাঁর রাজত্বের ষষ্ঠ বর্ষে প্রদত্ত হয়।
- দ্বিতীয়ত, দ্বিতীয় গোপালের তুলনায় তৃতীয় গোপালের রাজত্বকাল ঘটনাবহুল। এসব কারণে মৈত্রেয়-ব্যাকরণের পাণ্ডুলিপিতে উল্লিখিত গোপালকে তৃতীয় গোপালরূপে শনাক্ত করাই সমীচীন মনে হয়। অনুমিত হয়, মহীপুর তাম্রশাসন সম্প্রদানের অনতিকাল পরই দ্বিতীয় গোপালের রাজত্বের অবসান ঘটে।
প্রথম বিগ্রহপাল থেকে দ্বিতীয় বিগ্রহপাল (আ. ৮৭২-৯৭৭ খ্রিস্টাব্দ)
প্রথম বিগ্রহপাল (আ. ৮৭২-৭৩ খ্রিস্টাব্দ) : পাল বংশের পরবর্তী রাজা প্রথম বিগ্রহপাল। তিনি ছিলেন দেবপালের খুল্লতাতপুত্র জয়পালের সন্তান। অপুত্রক অবস্থায় দ্বিতীয় গোপালের মৃত্যু হলে তিনি বিনা বাধায় সিংহাসনে আরোহণ করেন। আবার এমন ভাবনাও সম্ভব, দ্বিতীয় গোপাল বা তাঁর পুত্রকে পদচ্যুত করে বিগ্রহপাল রাজপদ লাভ করেন। অল্প কয়েকদিন রাজত্ব করার পর তিনি তাঁর পুত্র, কলচুরি রাজকন্যা লজ্জার গর্ভজাত সন্তান নারায়ণপালের অনুকূলে সিংহাসন পরিত্যাগ করেন। তাঁর রাজত্বকালীন কোনও অভিলেখ আজও আবিষ্কৃত হয়নি। (পূর্বে প্রথম শূরপাল ও পালরাজ প্রথম বিগ্রহপালকে অভিন্ন মনে করা হত। কিন্তু লখনউ সংগ্রহালয় লেখ আবিষ্কারের পর জানা গেল শূরপাল দেবপাল ও মাহটার পুত্র আর বিগ্রহপাল ছিলেন দেবপালের খুল্লতাত পুত্র জয়পালের সন্তান।)
নারায়ণপাল (আ. ৮৭৩-৯২৭ খ্রিস্টাব্দ) : নারায়ণপাল ছিলেন দুর্বল প্রকৃতির রাজা। রাজ্যের অখণ্ডতা রক্ষায় যে সাহস ও পরাক্রমের প্রয়োজন তা তাঁর ছিল না। ফলে এ সময় একের পর এক বিপর্যয়ের ঢেউ পালরাজ্যের বুকে আছড়ে পড়তে থাকে। নারায়ণপালের ভাগলপুর তাম্রশাসন ১৭ রাজ্যবর্ষে মুগগিরি জয়স্কন্ধাবার থেকে প্রদত্ত হয়েছিল। বোঝা যায়, তিনি বিহারে তাঁর কর্তৃত্ব অক্ষুণ্ণ রাখেন। কিন্তু উত্তর বাংলা পালদের হস্তচ্যুত হয়। কম্বোজ নায়ক কুঞ্জরঘটাবর্ষ সেখানে এক স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। গৌড়পতি বলে তিনি নিজেকে ঘোষণা করেন। পূর্ব বাংলা থেকেও নারায়ণপাল বিতাড়িত হন। ত্রৈলোক্যচন্দ্ৰ সেখানে স্বাধীন চন্দ্ররাজ্য গঠন করেন। নারায়ণপালের দুর্গতি এখানেই শেষ হল না। রাষ্ট্রকূট অধিপতি দ্বিতীয় কৃষ্ণ (আ. ৮৮০ ৯১৫ খ্রিস্টাব্দ) পালরাজ্য আক্রমণ করেন। রাষ্ট্রকূটলেখে দাবি করা হয়েছে দ্বিতীয় কৃষ্ণ গৌড়দের বিনয় শিখিয়েছিলেন; অঙ্গ, কলিঙ্গ, বঙ্গ ও মগধ পদানত করেছিলেন। এই দাবি তো নারায়ণপালের বিরুদ্ধে বিজয়লাভের দাবি। কৃষ্ণা জেলার বেলনাণ্ডুর শাসক প্রথম মল্লও বঙ্গ, মগধ ও গৌড়দের বিরুদ্ধে জয়লাভের দাবি করেছেন। প্রথম মল্ল দ্বিতীয় কৃষ্ণের অনুগত ছিলেন এবং গৌড়বঙ্গ অভিযানে রাষ্ট্রকূট রাজাকে সাহায্য করেন। তবে রাষ্ট্রকূট অভিযানের ফল নারায়ণ পালের পক্ষে মারাত্মক হয়ে দেখা দেয়নি। তিনি কৃষ্ণের পৌত্রী ভাগ্যদেবীকে পুত্রবধূরূপে বরণ করে রাষ্ট্রকূটদের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করেন। পালরাজ্যের আয়তন সংকুচিত হতে হতে বিহারের মধ্যেই তা আবদ্ধ হয়ে পড়ে। (নারায়ণপাল রাষ্ট্রকূটরাজ দ্বিতীয় কৃষ্ণের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন, এ মত অনেকেই স্বীকার করেন না। তাঁরা মনে করেন নারায়ণপালের পুত্রবধূ ভাগ্যলক্ষ্মী দ্বিতীয় কৃষ্ণের পুত্র জগত্তুঙ্গের কন্যা নন, তিনি আঞ্চলিক রাষ্ট্রকূট শাসক তুঙ্গের কন্যা।)
রাজ্যপাল (আ. ৯২৭-৫৯ খ্রিস্টাব্দ) : পালশক্তির অবক্ষয় অনেকখানি রোধ করেন নারায়ণপালের পুত্র রাজ্যপাল। তাঁর রাজত্বকালে উৎকীর্ণ ভাতুড়িয়া প্রশস্তিতে দাবি করা হয়েছে, তিনি ম্লেচ্ছ, অঙ্গ, কলিঙ্গ, বঙ্গ, ওড্র, পাণ্ড্য, কর্ণাট, লাট, সুহ্ম, গুর্জর, ক্রীত ও চিনদের পরাজিত করেছিলেন। এই দাবির মধ্যে অত্যুক্তি আছে সন্দেহ নেই কিন্তু রাজ্যপাল যে কীর্তিমান রাজা ছিলেন তা অস্বীকার করা যায় না। উত্তর বাংলায় তিনি পুনরায় পাল অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। ভাতুড়িয়া লেখটি উত্তর বাংলার রাজশাহী জেলায় আবিষ্কৃত হয়েছে। রাজ্যপালেরই পদস্থ রাজপুরুষ যশোদাস এই লেখখানি উৎকীর্ণ করেন। দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার চন্দ্ররাজ্যের একাংশ তিনি জয় করেন। এ সময় কম্বোজেরা মেদিনীপুর-বালেশ্বর অঞ্চলে শক্তিশালী হয়ে উঠছিলেন। তাঁরাও রাজ্যপালের আনুগত্য স্বীকার করেন। সমকালীন কম্বোজ নৃপতি পাল রাজপরিবারের প্রতি আনুগত্যের নিদর্শনস্বরূপ তাঁর পাল প্রভু ও প্রভুপত্নীর নামানুসারে নিজের ও নিজ পত্নীর নামকরণ করেন। দক্ষিণ বিহারের নালন্দা ও কুরকীহারে রাজ্যপালের লেখ আবিষ্কৃত হয়েছে; পূর্ব বিহারের মুঙ্গেরে তাঁর এক শিলালেখের সন্ধান পাওয়া গেছে। পূর্ব ও দক্ষিণ বিহার যে তাঁর রাজ্যভুক্ত ছিল তা প্রমাণিত।
মধ্যপ্রদেশের চন্দেল্লরাজ যশোবর্মা ও কামরূপের পালবংশীয় রত্নপাল পালরাজ্য আক্রমণ করেছিলেন। (দীনেশচন্দ্র সরকার মনে করেন, কামরূপরাজ রত্নপাল এবং পালরাজ রাজ্যপাল সমকালীন ছিলেন (পাল-সেন যুগের বংশানুচরিত, কলকাতা, ২০০৯, পৃষ্ঠা ৭৩)। কিন্তু প্রতাপচন্দ্র চৌধুরী (The History অফ Civilisation of The People of Assam To The Twelfth Century A. D. (Gauhati, 1966), পৃষ্ঠা ৪৮৬) রত্নপালের রাজত্বকাল আ. ১০১০-৪০ খ্রিস্টাব্দে ধার্য করেছেন।) কিন্তু রাজ্যপালের রাজনৈতিক জীবনের উপর এসব সামরিক অভিযানের বিশেষ কোনও প্রভাব পড়েনি। পাল বংশের এক শ্রেষ্ঠ রাজা রাজ্যপাল। বাংলা-বিহারের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তিনি পাল অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। পতনোন্মুখ পালরাজ্য নতুন জীবন পেল।
রমেশচন্দ্র মজুমদার রাজ্যপালের এক অন্য চিত্র এঁকেছেন। তাঁর বর্ণিত রাজ্যপাল দুর্বল ও অক্ষম; চন্দেল্লরাজ যশোবর্মার হাতে তিনি শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিলেন; কম্বোজগণ কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে তিনি পশ্চিম ও উত্তর বাংলার আধিপত্য বিসর্জন দেন। রমেশচন্দ্র মজুমদারের এ অভিমত সম্ভবত যথার্থ নয়। যশোবর্মা গৌড় বিজয়ের দাবি করেছেন সত্য কিন্তু সে দাবির সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ আছে। মনে রাখতে হবে, বাংলা-বিহারে যশোবর্মার কোনও লেখ আজও পাওয়া যায়নি। চন্দেল্লরাজ বাংলা বা বিহারের কিয়দংশ পদানত করেছিলেন, এ কথা এখনও বলার সময় আসেনি। দ্বিতীয়ত, রাজ্যপালের সময় উত্তর বাংলা কম্বোজদের অধিকারভুক্ত ছিল না, রাজ্যপালের শাসনই সেখানে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। ভাতুড়িয়া লেখে যে রাজ্য পালের উল্লেখ আছে তিনি পাল বংশীয় রাজ্যপাল। কম্বোজ রাজ্যপাল মেদিনীপুর বালেশ্বর অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। ভাতুড়িয়া লেখের রাজ্যপাল আর ইরদা লেখের রাজ্যপাল (তিনি কম্বোজবংশীয়) দুই স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব।
তৃতীয় গোপাল (আ. ৯৫৯-৭৬ খ্রিস্টাব্দ) : রাজ্যপালের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র তৃতীয় গোপাল রাজা হন। তাঁর প্রথম রাজ্যবর্ষে উৎকীর্ণ একটি মূর্তিলেখ বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার মনধুক গ্রামে আবিষ্কৃত হয়েছে। দীনেশচন্দ্র সরকার অভিমত প্রকাশ করেছেন, গোপাল চন্দ্ররাজ শ্রীচন্দ্রের হাত থেকে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার কিয়দংশ অধিকার করেন। কিন্তু এ কৃতিত্ব সম্ভবত তাঁর পিতা রাজ্যপালের, তাঁর পুত্র গোপালের নয়। চন্দ্রনৃপতি শ্রীচন্দ্র শেষ পর্যন্ত তৃতীয় গোপালকে পরাজিত করেন। দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় পাল শাসনের অবসান ঘটল। কিন্তু উত্তর বাংলা এবং দক্ষিণ ও পূর্ব বিহারে পাল কর্তৃত্ব অক্ষুণ্ণ ছিল। এসব অঞ্চলে তৃতীয় গোপালের রাজ্যবর্ষে উৎকীর্ণ লেখের সন্ধান পাওয়া গেছে।
দ্বিতীয় বিগ্রহপাল (আ. ৯৭৬-৭৭ খ্রিস্টাব্দ) : পাল বংশের পরবর্তী রাজা দ্বিতীয় বিগ্রহপাল। তৃতীয় গোপালের পুত্র তিনি। তিনি সম্ভবত চন্দ্রবংশীয় রাজা কল্যাণচন্দ্রের নিকট পরাজিত হন। তাঁর কর্তৃত্ব উত্তর বাংলা এবং পূর্ব ও দক্ষিণ বিহারে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। তাঁর সময়ের কোনও অভিলেখ বা পাণ্ডুলিপি আবিষ্কৃত হয়নি।
প্রথম মহীপাল (আ.৯৭৭-১০২৭ খ্রিস্টাব্দ)
দ্বিতীয় বিগ্রহপালের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র প্রথম মহীপাল পাল সিংহাসনে আরোহণ করেন। বিচক্ষণ ও পরাক্রমশালী এই রাজার রাজত্বকাল পাল ইতিহাসে পুনরভ্যুত্থানের যুগরূপে চিহ্নিত। তাঁর তৃতীয় ও চতুর্থ রাজ্যবর্ষে উৎকীর্ণ দু’খানি মূর্তিলেখ যথাক্রমে কুমিল্লা জেলার বাঘাউড়া ও নারায়ণপুরে পাওয়া গেছে। স্বভাবতই মনে হয়, সিংহাসনে আরোহণের অব্যবহিত পরই তিনি চন্দ্রদের কবল থেকে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার কিয়দংশ পুনরধিকার করেন। বাকি অংশে অবশ্য চন্দ্র রাজারাই রাজত্ব করেন। দীনেশচন্দ্র সরকার অভিমত প্রকাশ করেছেন, সমকালীন চন্দ্রনৃপতি লড়হচন্দ্র প্রথম মহীপালের অনুগত ছিলেন। অধ্যাপক সরকার লড়হচন্দ্রের জীবনের একটি ঘটনার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। চন্দ্ররাজ একবার তীর্থভ্রমণ উপলক্ষে বারাণসী ও ইলাহবাদ পরিদর্শন করেন। এজন্য লড়হচন্দ্রকে মহীপালের রাজ্যের ভিতর দিয়ে অগ্রসর হতে হয়েছিল। তিনি মহীপালের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করেছিলেন বলেই তাঁর পক্ষে এই তীর্থযাত্রা সম্ভবপর হয়। কিন্তু এই ঘটনাটির অন্য ব্যাখ্যাও আছে। এমনও হতে পারে, মহীপাল ও লড়হ চন্দ্রের সময় দুই রাজবংশের পুরুষানুক্রমিক শত্রুতার অবসান হয় ;বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের সুবাদেই চন্দ্ররাজ পালরাজ্যের ভিতর দিয়ে বারাণসী ও ইলাহবাদ অভিমুখে যাত্রা করেছিলেন।
উত্তর বাংলা পূর্ব থেকেই পালরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। মহীপাল সে অধিকার আরও সুদৃঢ় করেন। এ অঞ্চলে তাঁর রাজত্বের দু’খানি তাম্রশাসনের সন্ধান পাওয়া গেছে। এদের একটি তাঁর পঞ্চম রাজ্যবর্ষে উৎকীর্ণ বেলোয়া তাম্রশাসন, অন্যটি নবম রাজ্যবর্ষের বাণগড় তাম্রশাসন। বেলোয়ার অবস্থান বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলায়, বাণগড়ের পশ্চিম দিনাজপুর জেলায়। বেলোয়া তাম্রশাসনে যে জমিদানের উল্লেখ আছে তা পঞ্চনগরী বিষয়ে অবস্থিত ছিল। পঞ্চ নগরীর অবস্থান বগুড়া জেলায়। বাণগড় লেখে কোটিবর্ষ বিষয়ে ভূমিদানের কথা বলা হয়েছে। কোটিবর্ষ বিষয় দিনাজপুর জেলায় অবস্থিত। মহীপালের রাজত্বকালে উত্তর বাংলা যে পাল রাজ্যভুক্ত ছিল, এ দু’খানি অভিলেখের সাক্ষ্যে তা সুস্পষ্ট। দিনাজপুরের মহীপাল দিঘি এবং বগুড়া ও দিনাজপুর অঞ্চলের মহীপুর ও মহীসন্তোষ গ্রাম দু’খানি আজও উত্তর বাংলায় মহী পালের স্মৃতি বহন করছে। সন্দেহ নেই, মহীপাল উত্তর বাংলায় পাল আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন, মহীপালের রাজ্য লাভের পূর্বেই পালগণ উত্তর বাংলা থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন কিন্তু তিনি তাঁর রাজত্বের প্রারম্ভেই উত্তর বাংলা পুনরুদ্ধার করেন। এটা প্রকৃত সত্য নয়। মহীপালের প্রপিতামহ রাজ্যপালের সময় থেকেই উত্তর বাংলা পাল রাজাদের অধিকারভুক্ত ছিল।
দারভাঙ্গা অঞ্চলে মহীপালের সপ্তম রাজ্যবর্ষে অনুলিখিত অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতার একখানি পাণ্ডুলিপির সন্ধান পাওয়া গছে। এ থেকে সিদ্ধান্ত করা যায় উত্তর বিহার তাঁর রাজ্যভুক্ত ছিল। কিন্তু রাজ্যপাল, দ্বিতীয় গোপাল ও দ্বিতীয় বিগ্রহপালের মতো তাঁর পূর্বসূরিদের কোনও লেখ এখানে পাওয়া যায়নি। সেক্ষেত্রে মহীপাল বাহুবলে উত্তর বিহার জয় করেছিলেন, না উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেছিলেন, তা নির্ণয় করা কঠিন। কিন্তু শীঘ্রই উত্তর বিহার তাঁর হস্তচ্যুত হয়। ১০১৯ খ্রিস্টাব্দে কলচুরিরাজ গাঙ্গেয়দেবের রাজত্বকালে তীরভুক্তি বা উত্তর বিহারে রামায়ণের একখানি পুঁথি অনুলিখিত হয়। কলচুরিদের অভিলেখে বলা হয়েছে, গাঙ্গেয়দেব অঙ্গ রাজ্যের নরপতিকে পরাজিত করেন। এই অঙ্গরাজ নিঃসন্দেহে প্রথম মহীপাল। রামায়ণের পাণ্ডুলিপি এবং কলচুরি লেখমালার সাক্ষ্য থেকে প্রতীয়মান হয়, গাঙ্গেয়দেব ১০১৯ খ্রিস্টাব্দের কিছু পূর্বে প্রথম মহীপালকে উত্তর বিহার থেকে বিতাড়িত করেন।
গাঙ্গেয়দেবের এই সাফল্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। মহীপালের ৪৮তম রাজ্যবর্ষে প্রতিষ্ঠিত দু’টি বিগ্রহ মুজফফরপুর জেলার গ্রামে আবিষ্কৃত হয়েছে। বোঝা যায়, কিছুকালের মধ্যেই কলচুরিরাজকে পরাজিত করে মহীপাল উত্তর বিহার পুনরধিকার করেন। ১০২৬ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ মহীপালের একখানি লেখ বারাণসীর কাছে সারনাথে পাওয়া গেছে। লেখটিতে বলা হয়েছে, মহীপালের দুই ভাই স্থিরপাল ও বসন্তপাল বারাণসীতে মন্দিরাদি নির্মাণ করেছিলেন। বারাণসী শত্রুকবলিত হলে সেখানে পাল রাজকুমারদের এ কাজ করা সম্ভব হত না। ফলে অনেকেই অনুমান করেছেন, মহীপালের রাজ্য পশ্চিমে বারাণসী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আরব লেখক বৈহাকির বর্ণনা থেকে জানা যায়, ১০৩৪ খ্রিস্টাব্দে বারাণসী গাঙ্গেয়দেবের অধীনস্থ ছিল। গাঙ্গেয়দেব মহীপালকে পরাজিত করে, না তাঁর মৃত্যুর পর বারাণসী অধিকার করেন, তা সঠিক বলা যায় না।
কিন্তু মহীপাল যে ১০২৫ খ্রিস্টাব্দের সামান্য কিছুকাল পূর্বে চোলরাজ রাজেন্দ্রচোলের সেনাপতি শিবনাথের হাতে পরাজিত হয়েছিলেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। চোলরাজের তিরুমালৈ অভিলেখ বলছে, বাংলায় অভিযানে এসে শিবনাথ কয়েকজন স্থানীয় রাজাকে পরাজিত করেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন দণ্ডভুক্তির ধর্মপাল, দক্ষিণ রাঢ়ের রণশূর, বঙ্গালের গোবিন্দ চন্দ্র এবং উত্তর রাঢ়ের মহীপাল। শেষোক্ত ব্যক্তি অবশ্যই পালরাজ প্রথম মহীপাল। বাংলায় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে এ অভিযান পরিচালিত হয়নি। তাই বাংলার রাজনীতিতে এর কোনও প্রভাব পড়েনি।
রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিমত, মহীপাল চোল সেনাদের পরাজিত করেছিলেন। ক্ষেমীশ্বরের চণ্ডকৌশিক নাটকে মহীপাল নামে জনৈক রাজার উল্লেখ আছে। বলা হয়েছে, এই মহীপাল চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের এবং কর্ণাটরা নন্দদের অবতারস্বরূপ ছিলেন। অর্থাৎ, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য যেমন নন্দদের ধ্বংস করেছিলেন, মহীপালও তেমনি কর্ণাটকুল নিধন করেন। ক্ষেমীশ্বরের এ কাহিনির মধ্যে রাখালদাস তাঁর অভিমতের সমর্থন খুঁজেছেন। কিন্তু এ মহীপাল প্রতীহার বংশীয় প্রথম মহীপাল, পালরাজ প্রথম মহীপাল নন। আর কর্ণাট বলতে চোলদের বোঝাচ্ছে না, বোঝাচ্ছে রাষ্ট্রকূটদের।
মহীপাল ধর্মে বৌদ্ধ ছিলেন। সারনাথ, বারাণসী, নালন্দা, বোধগয়া প্রভৃতি স্থানে তাঁর নির্দেশে বহু বৌদ্ধবিহার নির্মিত হয়, অনেক পুরোনো বিহারের সংস্কার হয়। কিন্তু ধর্মীয় সংকীর্ণতার মলিন বন্ধনে তিনি কখনও নিজেকে ধরা দেননি। শৈবধর্মের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম অনুরাগ ছিল। ইন্দ্রশিব ছিলেন তখনকার দিনের এক প্রখ্যাত শৈবাচার্য। তাঁর সম্মানে মহীপাল এক বিশাল মঠ নির্মাণ করেন। সে সময়কার আর এক বিশিষ্ট শৈবাচার্য বামরাশি। তাঁর অনুকূলে মহীপাল ঈশানবিগ্রহ, বিচিত্রঘণ্টা এবং আরও অনেক কিছু স্থাপন করেন। বলাবাহুল্য, পরধর্ম সহিষ্ণুতা মহীপালকে বিপুল জনপ্রিয়তা দান করে।
অসম্ভব জনপ্রিয় ছিলেন এই পালনৃপতি। দিঘি খনন, নগর প্রতিষ্ঠার মতো বহু জনহিতকর কাজের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। বাংলার গ্রামগঞ্জের মানুষ ধর্মপাল, দেবপালের নাম ভুলে গেছেন কিন্তু তাঁদের কণ্ঠে আজও মহীপালের গীত ধ্বনিত হয়। লোকস্মৃতিতে মহীপাল আজও অম্লান।
১০২৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মহীপালের মৃত্যু হয়। পালরাজ্যকে অবলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে রাজ্যপাল যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, মহীপাল তাকে পূর্ণতা দান করেন। সমগ্র বাংলা তিনি জয় করতে পারেননি, কিন্তু বিহার এবং পূর্ব উত্তরপ্রদেশ তাঁর অধীন ছিল। এ সময় সারা উত্তর ও পশ্চিম ভারত জুড়ে চলছিল গজনির সুলতান মামুদের বিজয়োল্লাস। ভারতীয় রাজন্যবর্গ হতোদ্যম ও বিপর্যস্ত। সমকালীন রাজনৈতিক অস্থিরতার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেছিলেন প্রথম মহীপাল।
নয়পাল থেকে দ্বিতীয় মহিপাল (আ. ১০২৭-১০৭১ খ্রিস্টাব্দ)
নয়পাল (আ. ১০২৭-৪৩ খ্রিস্টাব্দ) : মহীপালের মৃত্যুতে তাঁর পুত্র নয়পাল পৈতৃক সিংহাসনে আরোহণ করেন। বারাণসী পালদের হস্তচ্যুত হয়। সেখানে কলচুরিরাজ গাঙ্গেয়দেবের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। অবশ্য এ ঘটনা প্রথম মহীপালের রাজত্বের শেষের দিকেও ঘটতে পারে। পালদের বিরুদ্ধে গাঙ্গেয়দেবের সামরিক সাফল্য তাঁর পুত্র কর্ণকে পালরাজ্য আক্রমণে উদ্বুদ্ধ করে। সিংহাসনে আরোহণ করেই তিনি (আ. ১০৪১-৭১ খ্রিস্টাব্দ) মগধ আক্রমণ করেন। নয়পাল তাঁকে প্রতিহত করেন। বৌদ্ধ আচার্য অতিশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের মধ্যস্থতায় উভয় পক্ষে সন্ধি স্থাপিত হয়। ১০৪০ খ্রিস্টাব্দে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান তিব্বত গমন করেন। কর্ণের মগধ আক্রমণ ও পরিশেষে নয়পালের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের তিব্বতযাত্রার পূর্ববর্তী ঘটনা।
কর্ণের একখানি শিলালেখ বীরভূম জেলার পাইকোড় গ্রামে আবিষ্কৃত হয়েছে। কলচুরিরাজ যে বীরভূমে প্রবেশ করেছিলেন তা স্পষ্ট। কিন্তু তিনি খুব একটা সফলকাম হননি। এর প্রমাণ শান্তিনিকেতনের নিকট সিয়ানের শিলালেখ। এখানে নয়পাল বা তাঁর পুত্র তৃতীয় বিগ্রহ পালের হাতে কর্ণের পরাজয়ের কথা বলা হয়েছে। রামচরিতের টীকা থেকে জানা যায়, তৃতীয় বিগ্রহপাল ডাহল নৃপতি কর্ণকে পরাভূত করেন। কর্ণের মগধ আক্রমণ, বীরভূমে অনুপ্রবেশ এবং তৃতীয় বিগ্রহপালের নিকট পরাজয় বরণ সবই সম্ভবত নয়পালের বিরুদ্ধে কর্ণের একই সামরিক অভিযানের বিভিন্ন পর্যায়। সেক্ষেত্রে ভাবতে হবে, তৃতীয় বিগ্রহপাল নয়পালের সেনাপতিরূপে কর্ণকে পরাজিত করেন। আবার এমনও সম্ভব, তৃতীয় বিগ্রহপালের রাজত্বকালে কলচুরিরাজ আর একবার পালরাজ্য আক্রমণ করেন এবং পশ্চিম বাংলার অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি পরাজিত হন এবং বিগ্রহপালের সঙ্গে নিজ কন্যা যৌবনশ্রীর বিবাহ দেন। বৈরিতা যা ছিল তা অন্তর্হিত হল, প্রীতির বন্ধনে বাঁধা পড়ল বিবদমান দুই রাজ পরিবার।
কখনও কখনও বলা হয়, নয়পালের রাজত্বকালে বাংলা-বিহারে কয়েকটি রাজনৈতিক শক্তির অভ্যুত্থান হয়। পরিতোষের পুত্র-পৌত্ররা মগধে, সেনরা পশ্চিম বাংলায়, বর্মারা পূর্ব বাংলায় এবং স্থানীয় একটি পরিবার ত্রিপুরায় স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। পাল রাজ্যের আয়তন হ্রাস পেয়ে শেষে বিহারের এক সংকীর্ণ অঞ্চলে আবদ্ধ হয়। এ ধারণা যথার্থ নয়। উত্তর ও দক্ষিণ বিহারে নয়পালের লেখ আবিষ্কৃত হয়েছে। এ দু’টি অঞ্চল অবশ্যই নয়পালের রাজ্যভুক্ত ছিল। পশ্চিম বাংলার কিয়দংশও তাঁর শাসনাধীন ছিল। এর প্রমাণ সিয়ান অভিলেখ। বাণগড় শিলালেখে উত্তর বাংলায় পাল কর্তৃত্বের স্বীকৃতি আছে।
তৃতীয় বিগ্রহপাল (আ. ১০৪৩-৭০ খ্রিস্টাব্দ) : নয়পালের মৃত্যুর পর তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন তাঁর পুত্র তৃতীয় বিগ্রহপাল। কর্ণাটকের চালুক্য যুবরাজ ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্য এ সময় পালরাজ্য আক্রমণ করেন। রাজকোষের উপর হয়তো চাপ পড়েছিল কিন্তু রাজ্যের রাজনীতিতে এর কোনও প্রভাব পড়েনি। উত্তর ও পশ্চিম বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পাল প্রভুত্ব অক্ষুণ্ণ থাকে। পূর্ব বাংলায় চন্দ্ৰ রাজারা দীর্ঘদিন ধরে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করছিলেন। তাঁদের বিতাড়িত করে বর্মারা সে অঞ্চলের শাসন-ক্ষমতা অধিগ্রহণ করেন। উত্তর ও দক্ষিণ বিহার পালদের অধীনেই থাকল। কুরকীহার, গয়া, বিহারশরীফ, বনগাঁও, নৌলাগড় প্রভৃতি উত্তর ও দক্ষিণ বিহারের বিভিন্ন স্থানে তাঁর রাজ্যবর্ষে উৎকীর্ণ কয়েকখানি মূর্তিলেখ ও তাম্রশাসন পাওয়া গেছে।
দ্বিতীয় মহীপাল (আ. ১০৭০-৭১ খ্রিস্টাব্দ) : দ্বিতীয় মহীপালের সিংহাসনে আরোহণের সঙ্গে সঙ্গে পালরাজ্যে দুর্যোগ ঘনিয়ে আসে। মহীপাল তৃতীয় বিগ্রহপালের জ্যেষ্ঠ পুত্র। তাঁর আরও দুই ভাই ছিলেন। তাঁরা শূরপাল এবং রামপাল। ভায়ে ভায়ে বিরোধ ছিল। সিংহাসনে বসেই মহীপাল ভাইদের কারারুদ্ধ করেন। সন্দিগ্ধচিত্ততা তো ছিলই। তার উপর মহীপালের চরিত্রে দূরদর্শিতা বা রণনৈপুণ্যেরও একান্ত অভাব ছিল। ফলে রাজ্যের সামন্তরা বিদ্রোহ করলেন। সন্ধ্যাকর নন্দী এ বিদ্রোহকে ‘অনন্তসামন্তচক্র’ আখ্যা দিয়েছেন। দিব্য বা দিব্বোক নামে কৈবর্ত জাতীয় জনৈক পদস্থ রাজপুরুষও বিদ্রোহী হলেন। দিব্য বিদ্রোহী সামন্তদের পক্ষে যোগ দিয়ে ছিলেন, না স্বতন্ত্রভাবে বিদ্রোহী হন, তা জানা যায় না। ‘অনন্তসামন্তচক্র’ বা দিব্যের বিদ্রোহ দমনের ক্ষমতা দ্বিতীয় মহীপালের ছিল না। যুদ্ধে, সম্ভবত দিব্যের হাতে, তিনি নিহত হন। পালদের জীবনে এর আগেও অনেক বিপদ এসেছে, কিন্তু এ বিপর্যয়ের যেন তুলনা নেই। উত্তর বাংলা দিব্য তথা কৈবর্তদের অধিকারে চলে গেল। বিহার ও পশ্চিম বাংলার নানা স্থানে সামন্ত রাজারা কার্যত স্বাধীন হয়ে বসলেন।
দ্বিতীয় শূরপাল, কৈবর্ত বিদ্রোহ, কৈবর্ত শাসন ও রামপাল (আ. ১০৭১-১১২৬ খ্রিস্টাব্দ)
দ্বিতীয় শূরপাল (আ. ১০৭১-৭২ খ্রিস্টাব্দ) : এ ঘোর বিপদের দিনে রাজা হলেন দ্বিতীয় শূরপাল। অল্পদিন মাত্র তিনি রাজত্ব করেন। তারপর তাঁরই ছোট ভাই রামপাল (আ. ১০৭২ খ্রিস্টাব্দ)। রামপালের সিংহাসনে আরোহণের পর দুর্যোগের কালো মেঘ কেটে যায়। পাল ইতিহাসে এক নতুন পর্ব শুরু হয়।
কৈবর্ত বিদ্রোহ ও কৈবর্ত শাসন : পালরাজ দ্বিতীয় মহীপালের বিরুদ্ধে কৈবর্ত জাতিভুক্ত দিব্যের (দিব্বোক, দিবোক) বিদ্রোহ প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে কৈবর্ত বিদ্রোহ নামে অভিহিত। এই বিদ্রোহের কারণ ও প্রকৃতি সম্পর্কে ঐতিহাসিক মহলে মতদ্বৈধ আছে।
অনেকেই এই বিদ্রোহকে দ্বিতীয় মহীপালের উৎপীড়নমূলক নীতির বিরুদ্ধে কৈবর্ত জাতির স্বতঃস্ফূর্ত সশস্ত্র অভ্যুত্থান বলে বর্ণনা করেছেন। তাঁদের অভিমত, দ্বিতীয় মহীপালের দমন মূলক ক্রিয়াকলাপে নির্যাতিত ও অতিষ্ঠ কৈবর্তগণ দিব্যের নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং পালরাজকে পরাজিত ও নিহত করে বরেন্দ্রী তথা উত্তর বাংলায় কৈবর্ত রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, যদুনাথ সরকার, রমাপ্রসাদ চন্দ, উপেন্দ্রনাথ ঘোষাল প্রমুখ ঐতিহাসিকেরা এরূপ অভিমতই পোষণ করেন। কৈবর্তদের এক শ্রেণি কৃষিজীবী। তাই এই বিদ্রোহ কখনও কখনও কৃষক বিদ্রোহ নামেও আখ্যাত হয়েছে। এই অভিমতের সমর্থনে যে কোনও যুক্তি নেই, তা নয়। রামচরিত কাব্যে দিব্যকে ‘উপধিব্রতী’ বলা হয়েছে। রামচরিতের টীকায় দিব্যকে ‘ছদ্মনিব্রতী’ রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। যিনি মুখোশের আড়ালে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করেন তিনিই ‘উপধিব্রতী’ বা অর্থাৎ, নিপীড়িত কৈবর্তদের নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে দিব্য আসলে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করেছেন। কৈবর্ত অভ্যুত্থানের একটা ইঙ্গিত এখানে যেন পাওয়া যাচ্ছে।
রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন, দ্বিতীয় মহীপালের বিরুদ্ধে দিব্যের বিদ্রোহ কৈবর্ত জাতির বিদ্রোহ নয় ; ব্যক্তিস্বার্থ সিদ্ধির জন্য পালরাজ্যের পদস্থ রাজপুরুষ দিব্য বিদ্রোহী হয়েছিলেন। দ্বিতীয় মহীপাল তখন ঘোর সংকটে। ভায়েরা তাঁর বিরুদ্ধে ;সামন্তরাও তাঁর বিপক্ষে। এই সুযোগে দিব্য বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। তাঁর লক্ষ্য উত্তর বাংলায় এক স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা। লক্ষ করবার বিষয়, সন্ধ্যাকর নন্দী দিব্যের বিদ্রোহকে কৈবর্ত বিদ্রোহ আখ্যা দেননি, বরেন্দ্রীতে কৈবর্ত রাজ্য প্রতিষ্ঠার কথাও বলেননি। যে রাজ্যটি জন্ম নিল সেটি দিব্যের রাজ্য, কৈবর্তদের নয়। এ কারণে দিব্যের বিদ্রোহকে কৈবর্ত বিদ্রোহ আখ্যা দেওয়া সমীচীন নয়।
দ্বিতীয় মহীপালের রাজত্বকালে তো সামন্তরাও বিদ্রোহী হয়েছিলেন। দিব্য কী সামস্তদের সঙ্গে যোগদান করেছিলেন, না সামন্তদের নিকট যখন মহীপাল পর্যুদস্ত হচ্ছিলেন তখন দিবা পালনৃপতির অসহায়তার সুযোগে তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন, এ প্রশ্নের সদুত্তর দেওয়ার সময় এখনও আসেনি। তবে দিব্যেরই হাতে যে দ্বিতীয় মহীপাল নিহত হন, তা নিশ্চিত। মহীপালের বিরুদ্ধে জয়লাভের ফলে উত্তর বাংলায় এক স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন দিব্য।
বরেন্দ্রীর রাজপদ গ্রহণের পর দিব্য পূর্ব বাংলার বর্মা বংশীয় রাজা জাতবর্মার (আ. ১০৫৫-৭৩ খ্রিস্টাব্দ) সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। পৌত্র ভোজবর্মার (আ. ১১৩৭-৪৫ খ্রিস্টাব্দ) বেলাব তাম্র শাসনে দাবি করা হয়েছে, জাতবর্মা দিব্যকে পরাজিত করেছিলেন (নিন্দন্ দিব্যভুজশ্রিয়ম)। দিব্যের বিরুদ্ধে জাতবর্মার বিজয়লাভের দাবি অতিরঞ্জিত বলে মনে হয়। বর্মা রাজাদের সঙ্গে সংঘর্ষে দিব্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন, এরূপ ভাবার কোনও কারণ নেই। দিব্যের রাজত্ব সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে এই বংশের তিনজন রাজা বরেন্দ্রীতে পর পর রাজত্ব করেছেন। রামপাল রাজা হয়ে দিব্যের রাজত্বকালে বরেন্দ্রী পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হন কিন্তু সফলকাম হতে পারেননি। বরং দিব্যই একাধিকবার পালরাজ্য আক্রমণ করেছিলেন। এসব ঘটনা প্রমাণ করে, দিব্য একজন দক্ষ প্রশাসক ছিলেন। তিনি বরেন্দ্রীতে নিজ কর্তৃত্ব সুদৃঢ়রূপে করেন। দিব্যের পর তাঁর অনুজ রুদোেক বরেন্দ্রীর সিংহাসনে বসেন। রুদোকের মৃত্যুর পর তাঁর সুযোগ্য পুত্র ভীম রাজা হন। ভীমের পরাক্রম ও সুশাসনের প্রশংসা করেছেন সন্ধ্যাকর নন্দী। ভীম যখন বরেন্দ্রীতে নিজের অধিকার সুদৃঢ় করছিলেন, তখন গঙ্গার অপর তীরে পালরাজ্যে রাম পালের নেতৃত্বে বরেন্দ্রী পুনরুদ্ধারের প্রস্তুতি চলছিল। শেষে রামপালের নিকটই ভীম পরাজিত ও নিহত হন, তাঁর রাজ্য পালরাজ্যের অঙ্গীভূত হয়। তিনজন কৈবর্ত রাজা সর্বসমেত ২৫-৩০ বৎসর রাজত্ব করেন।
রামপাল (আ. ১০৭২-১১২৬ খ্রিস্টাব্দ) : ভ্রাতা দ্বিতীয় শূরপালের অকাল মৃত্যুর পর তাঁর অনুজ রামপাল আনুমানিক ১০৭২ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন। পালরাজ্য তখন পতনোন্মুখ। রামপালও অনভিজ্ঞ, সবে যৌবনের প্রারম্ভে। কিন্তু তিনি অসামান্য দক্ষতা ও সাহসিকতার সঙ্গে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হন এবং বিচক্ষণ কাণ্ডারীর মতো নিমজ্জমান পালরাজ্যতরণীটিকে রক্ষা করেন। পালরাজ্যে আবার সুদিনের আবির্ভাব ঘটল। সংগত কারণেই পালবংশের এক শ্রেষ্ঠ রাজারূপে রামপাল (আ. ১০৭২-১১২৬ খ্রিস্টাব্দ) স্মরণীয় হয়ে আছেন।
বিহারের এক বৃহদংশ যে প্রথম থেকেই রামপালের রাজ্যভুক্ত ছিল তা কিন্তু প্রমাণিত। রামপালের তৃতীয় রাজ্যবর্ষে উৎকীর্ণ একটি মূর্তিলেখ পাটনা জেলার তেত্রাবন গ্রামে পাওয়া গেছে। তাছাড়া পাটনা জেলার চণ্ডীমাউ, মুঙ্গের জেলার উরেন, আরমা ও সংসারপোখরী এবং নালন্দা প্রভৃতি বিহারের বিভিন্ন স্থানে তাঁর রাজত্বকালীন মূর্তিলেখ ও পাণ্ডুলিপি আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয়, বিহারের এক সুবিস্তীর্ণ অঞ্চল রামপালের অধিকার ভুক্ত ছিল। পরবর্তিকালে বরেন্দ্রাধিপতি ভীমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রামপালকে যেসব সামন্ত সাহায্য করেছিলেন তাঁদের কয়েকজনের প্রশাসনিক এলাকা বিহারে অবস্থিত ছিল। এঁরা হলেন তৈলকম্পরাজ রুদ্রশিখর, পীঠির অধিপতি ভীমযশা এবং কুজবটীর রাজা শূরপাল। তাছাড়া তাঁর মাতুল মথন বা মহণ অঙ্গ বা পূর্ব বিহারে রাজত্ব করতেন। এসব আঞ্চলিক প্রশাসকেরা নামে মাত্র রামপালের অনুগত ছিলেন কিন্তু কার্যত স্ব স্ব অঞ্চলে স্বাধীনভাবেই শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। অর্থাৎ বিহারের একাংশে পাল কর্তৃত্ব শিথিল ছিল।
রামপালের প্রধান লক্ষ্য ছিল বরেন্দ্রী তথা উত্তর বাংলা পুনরুদ্ধার। কাজটি সহজ ছিল না। রাজত্বের প্রথম দিকে তিনি দু’একবার বরেন্দ্রী আক্রমণ করেন কিন্তু সফলকাম হননি। তিনি বুঝতে পারলেন, নিজের শক্তিতে বরেন্দ্রী উদ্ধার করা যাবে না, অন্যের সহযোগিতা চাই। প্রভাবশালী আত্মীয়স্বজন ও শক্তিশালী সামন্তবর্গের নিকট তিনি সাহায্য প্রার্থনা করেন। অনেকেই তাঁর সাহায্যার্থে এগিয়ে এলেন। নিজের শক্তিবৃদ্ধি ও আত্মীয়-সামন্তদের সমর্থন লাভের জন্য রাম পালকে তাঁর রাজত্বের প্রথম দু’দশকেরও বেশি সময় অতিবাহিত করতে হয়। ভীমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাঁরা রামপালকে সাহায্য করেন তাঁরা হলেন :
- ১। রাষ্ট্রকূটবংশীয় মাতুল অঙ্গপতি মথন বা মহণ। তিনি তাঁর দুই পুত্র মহামাগুলিক কারদেব ও সুবর্ণদেব এবং ভ্রাতুষ্পুত্র মহাপ্রতীহার শিবরাজসহ ভাগিনেয় রামপালের পক্ষে যোগদান করেন।
- ২। পীঠীপতি ভীমযশা। রামচরিতে তাঁকে কান্যকুব্জরাজ বিজেতা ও মগধেশ্বর বলে বর্ণনা করা হয়েছে। পীঠী সম্ভবত বিহারের বোধগয়া অঞ্চলে অবস্থিত ছিল।
- ৩। কোটাটবীর রাজা বীরগুণ। কখনও বাঁকুড়া জেলার কোটেশ্বরে কখনওবা বর্ধমান জেলার আউসগ্রামের নিকটবর্তী ভল্কিকোট গ্রামে কোটাটবীর অবস্থান নির্দেশ করা হয়।
- ৪। দণ্ডভুক্তির অধিপতি জয়সিংহ। দণ্ডভুক্তির অবস্থান মেদিনীপুর জেলায়।
- ৫। দেবগ্রাম বা দেবগ্রামের নিকটবর্তী বালবলভীর রাজা বিক্রমরাজ। বর্ধমান জেলার দেবগ্রামই সম্ভবত রামচরিতের দেবগ্রাম। অনেকে বলেন, বালবলভী এক নদীর নাম, কোনও স্থানের নাম নয়।
- ৬। অপরমন্দারপতি লক্ষ্মীশুর। সন্ধ্যাকর নন্দী তাঁকে সমস্ত-আটবিক-সামন্ত-চক্র-চূড়ামণিরূপে বর্ণনা করেছেন। তাঁর রাজ্য ছিল বর্তমান হুগলি জেলার গড়-মন্দারণ অঞ্চলে। নলিনীনাথ দাশগুপ্ত অপরমন্দারের অবস্থান বিহারের দেওঘর-বৈদ্যনাথ অঞ্চলে নির্দেশ করেছেন। ৭। কুজবটীর রাজা শূরপাল। স্থানটি সাঁওতাল পরগনার নয়াদুমকার ২২.৫৩০ কি.মি. উত্তরে।
- ৮। তৈলকম্পরাজ রুদ্রশিখর। স্থানটি ধানবাদ-পুরুলিয়া অঞ্চলের তেলকুপী।
- ৯। উচ্ছালরাজ ভাস্কর বা ময়গলসিংহ। উচ্ছাল বর্ধমান ও হুগলি জেলার সীমান্তবর্তী উচলন গ্রাম। উচলন এবং পার্শ্ববর্তী ময়িগাম থেকে পালযুগের প্রত্নসামগ্রী আবিষ্কৃত হয়েছে।
- ১০। ঢেক্করীরাজ প্রতাপসিংহ। ঢেক্করী সম্ভবত বর্ধমান জেলার কাটোয়ার নিকটবর্তী ঢেকুরী। বর্ধমান জেলায় আউসগ্রামের নিকট ঢেকরগড় নামে একটি গ্রাম আছে। এই গ্রামটি প্রাচীন ঢেক্করী হতে পারে। ঢেকরগড়ের নিকটস্থ একটি গ্রাম প্রতাপপুর। হয়তো প্রতাপসিংহের নামানুসারে স্থানটির এরূপ নামকরণ হয়েছে।
- ১১। কয়ঙ্গল-মণ্ডলের অধিপতি নরসিংহার্জুন। কয়ঙ্গলের শুদ্ধরূপ কজঙ্গল। স্থানটি রাজ মহলের দক্ষিণে অবস্থিত কাকজোল।
- ১২। সংকটগ্রামের রাজা চণ্ডার্জুন। স্থানটি সম্ভবত বর্ধমান জেলার শক্তিগড়ের নিকটবর্তী।
- ১৩। নিদ্রাবলীর রাজা বিজয়রাজ। তাঁকে অনেকে সেননৃপতি বিজয়সেনরূপে শনাক্ত করেছেন।
- ১৪। কৌশাম্বীনাথ দ্বোরপবর্ধন। স্থানটি সম্ভবত রাজশাহী বা বগুড়া জেলায় অবস্থিত। পঞ্চানন মণ্ডলের মতে স্থানটি বর্ধমান জেলার কালনা মহকুমায় অবস্থিত কুসুমগ্রাম।
- ১৫। পদুবন্ধা-মণ্ডলের রাজা সোম। কেউ পাবনায়, কেউ দিনাজপুরে, আবার কেউবা হুগলি জেলায় পদুবন্বার অবস্থান নির্দেশ করেছেন।
রামপাল যখন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন তখন ভীম নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকেননি। সম্ভাব্য পাল আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য তিনি সব রকম ব্যবস্থাই গ্রহণ করেন। দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার বর্মা রাজা হরিবর্মাকে বন্ধু করে তিনি নিজের শক্তি বৃদ্ধি করেন। কিন্তু ভাগ্যদেবী তাঁর প্রতিকূল। তাঁর সব উদ্যম ব্যর্থ হয়।
রামচরিতে দেখা যায়, রামপালের রাষ্ট্রকূট সেনাপতি শিবরাজ প্রথমে গঙ্গা পার হয়ে সসৈন্যে বরেন্দ্রীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। ভীমের সীমান্ত রক্ষিবাহিনী পরাজিত হয়। রামপালও অনতিবিলম্বে বাকি সেনাদলের সঙ্গে গঙ্গা পার হয়ে নদীর উত্তর তীরে ভীমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। হস্তিপৃষ্ঠে যুদ্ধরত ভীম বন্দি হলেন। রাজা বন্দি হয়েছেন জেনে ভীমের সৈন্যরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করতে থাকেন। ভীমের মিত্র হরি বা হরিবর্মা প্রবল প্রতিরোধ রচনা করেন কিন্তু রামপাল কৌশলে তাঁকে স্বপক্ষে নিয়ে আসেন। হরিবর্মাকে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার রাজপদে পুনর্নিয়োগের প্রলোভন দেখানো হয় এবং তিনি যুদ্ধ থেকে নিরস্ত হন। এর ফলে ভীমের সেনারা সহজেই পরাজয় বরণ করেন। বরেন্দ্রীতে পাল আধিপত্য স্থাপিত হল।
পরাজিত ও বন্দি ভীমের প্রতি রামপাল নির্দয় আচরণ করেন। ভীমকে বধ্যভূমিতে আনা হয়। তাঁর চোখের সামনে তাঁর সকল প্রিয়জনদের একে একে হত্যা করা হয়। শেষে নিরস্ত্র ভীমের উপর চতুর্দিক হতে মুহুর্মুহুঃ তির নিক্ষিপ্ত হতে থাকে। এভাবেই বরেন্দ্রীরাজ ভূতলে লুণ্ঠিত হন ও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বলতে দ্বিধা নেই, প্রতিদ্বন্দ্বী রাজন্যবর্গের প্রতি হিন্দু রাজারাও কম নৃশংসতার পরিচয় দেননি। বিজয়ী পালনৃপতি গঙ্গা ও করতোয়া নদীর সঙ্গমের নিকট অবস্থিত রামাবতী নগরীতে তাঁর নতুন রাজধানী স্থাপন করেন।
রামপাল বরেন্দ্রী পুনরুদ্ধার করলেন কিন্তু এর জন্য তাঁকে অনেক মূল্য দিতে হয়। বিদ্রোহীদের পরাজিত করতে তাঁর রাজত্বের প্রথম দু’দশকেরও বেশি সময় অতিবাহিত হয়। এতে তাঁর উদ্যম ও শক্তি অনেকটাই ব্যাহত হয়। যে সামন্তরাজদের সাহায্যে তিনি ভীমকে পরাজিত করেছেন, তাঁদের যে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছিলেন তা মনে হয় না। বরঞ্চ তাঁদের উপর বেশি নির্ভর করতে গিয়ে তিনি পরোক্ষভাবে তাঁদের উচ্চাভিলাষ ও আত্মবোধ জাগ্রত করেন। তাই বাকি জীবনে রামপাল পালরাজ্যের বিস্তারকল্পে খুব যে বেশি কিছু করতে পেরেছিলেন, এমনটি মনে হয় না। পূর্ব বা পশ্চিম বাংলায় তাঁর বিশেষ কোনও কর্তৃত্ব ছিল না। অবশ্য আয়ুর্বেদীয় গ্রন্থ শব্দপ্রদীপ এর রচয়িতা সুরেশ্বর বা সুরপাল রামপালকে বঙ্গেশ্বর বলেছেন। আবার রামচরিতে উল্লিখিত আছে, রামপালের সেনাদল গঙ্গার দক্ষিণ কূল থেকে উত্তর কূলে অবতরণ করেছিলেন। এ থেকে অনেকে অনুমান করেছেন, পূর্ববাহিনী গঙ্গার দক্ষিণে এবং দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় রামপালের অধিকার প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু বঙ্গ থেকেই যে রামপাল গঙ্গা অতিক্রম করে উত্তর বাংলায় পৌঁছেছিলেন, এমন নাও হতে পারে। বিহার থেকেও বাংলার পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে গঙ্গা অতিক্রম করা সম্ভব। তাছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা তো বর্মাবংশীয় হরিবর্মার অধিকারভুক্ত ছিল। মোট কথা, পূর্ব বা দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় রামপালের কর্তৃত্বের সপক্ষে এখনও কোনও সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি। পশ্চিম বাংলায় রামপালের কোনও লেখ আবিষ্কৃত হয়নি। এ সময় বিজয়সেন ধীরে ধীরে এ অঞ্চলে তাঁর ক্ষমতা বৃদ্ধি করছিলেন। কিন্তু পালরাজ বিজয়সেনের অগ্রগতির পথ অবরুদ্ধ করতে পারেননি। তেমনি উত্তর বিহারে আর একটি কর্ণাট পরিবারের অভ্যুত্থানও তিনি প্রতিরোধ করতে পারেননি। গাহড়বালরাজ গোবিন্দচন্দ্র ১১২৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বিহারের পাটনা অঞ্চল অধিকার করেন। এ অঞ্চল একদা রামপালের রাজ্যভুক্ত ছিল। কলিঙ্গের গঙ্গরাজ অনন্তবর্মা চোড়গঙ্গ (১০৭৮-১১৪৭ খ্রিস্টাব্দ) ভাগীরথী পর্যন্ত দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল অধিকার করলেন। রামপাল এখানেও ব্যর্থ। ‘কলিঙ্গত্তুষ্মরণি’ নামে এক তামিল কাব্যে প্রথম কুলোত্তুঙ্গ চোলের বঙ্গ, মগধ প্রভৃতি রাজ্য জয়ের কথা বলা হয়েছে। চোলরাজ হয়তো রামপালের রাজ্য আক্রমণ করেননি কিন্তু এ বিষয়ে কোনও সুনিশ্চিত প্রমাণ নেই। তবে পূর্বদিকে রামপাল কিছু সাফল্য অর্জন করেন। রামচরিতে আছে, সেনাপতি তিগ্যদেব কামরূপ অধিকার করেন। ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় পাল প্রভুত্বের বিস্তার নিঃসন্দেহে রামপালের রাজত্বের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় রামপাল রাজপদে আসীন ছিলেন। রামচরিত-রচয়িতা জানাচ্ছেন, মাতুল মহণের মৃত্যুতে শোকাভিভূত হয়ে রামপাল গঙ্গা নদীতে আত্মবিসর্জন দেন। সন্ধ্যাকর বর্ণিত রামপালের আত্মহনন কাহিনির সত্যতায় অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছেন। বিনয়চন্দ্ৰ সেন অভিমত প্রকাশ করেছেন, বিজয়সেনের হাতেই রামপালের জীবনাবসান ঘটে এবং এ ঘটনা চাপা দিতেই সন্ধ্যাকর রামপালের আত্মহত্যামূলক কাল্পনিক কাহিনির অবতারণা করেছেন। এ অভিমত উড়িয়ে দেওয়ার নয়। প্রদীপ নিবে যাওয়ার পূর্বক্ষণে শেষবারের মতো একবার প্রজ্বলিত হয়। রামপালের রাজত্বকালে ক্ষীয়মাণ পাল রাজশক্তির চকিত উজ্জীবন নির্বাণোন্মুখ প্রদীপের সেই অস্তিম বিচ্ছুরণ।
কুমারপাল থেকে পালপাল (আ. ১১২৬-১২০০ খ্রিস্টাব্দ), সেনদের বঙ্গবিজয় ও পালদের পতন
কুমারপাল (আ. ১১২৬-২৮ খ্রিস্টাব্দ) : রামপালের মৃত্যুতে তাঁর পুত্র কুমারপাল সিংহাসনে আরোহণ করেন। কামরূপের শাসনকর্তা তিমৃগ্যদেব বিদ্রোহী হলে সচিব বৈদ্যদেব শক্ত হাতে বিদ্রোহ দমন করেন এবং তথাকার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। বৈদ্যদেবের কমৌলি তাম্রশাসন থেকে জানা যায়, তিনি দক্ষিণ বাংলায় নৌযুদ্ধে শত্রুসৈন্যদের পরাজিত করেন। এই শত্রুরা কারা ছিলেন তা জানা যায় না।
চতুর্থ গোপাল (আ. ১১২৮-৪৩ খ্রিস্টাব্দ) : পরবর্তী রাজা কুমারপালের পুত্র চতুর্থ গোপাল। এ সময় অসমে প্রদেশপাল বৈদ্যদেব স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বিহারে গাহড়বাল অধিকার আরও বিস্তার লাভ করে। প্রায় পনেরো বছর রাজত্ব করার পর তাঁর মৃত্যু হলে রামপালের কনিষ্ঠ পুত্র মদনপাল সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন।
মদনপাল (আ. ১১৪৩-৬১ খ্রিস্টাব্দ) : মদনপালের তৃতীয় রাজ্যবর্ষে উৎকীর্ণ একখানি মুর্তিলেখ নালন্দা জেলার বিহারশরীফে আবিষ্কৃত হয়েছে। বোঝা যায়, তাঁর রাজত্বের তৃতীয় বৎসরের মধ্যেই তিনি গাহড়বালরাজ গোবিন্দচন্দ্রকে বিতাড়িত করে দক্ষিণ বিহার পুনরুদ্ধার করেন। শুধু দক্ষিণ বিহারে নয়, মুঙ্গের অঞ্চলেও তাঁর কর্তৃত্ব অটুট ছিল। এ অঞ্চলের আরমা, জয়নগর, বালণ্ডদর ও নোণগড়ে তাঁর রাজত্বকালীন লেখ পাওয়া গেছে। দিনাজপুর জেলার মনহলি গ্রামে মদনপালের অষ্টম রাজ্যবর্ষের একখানি তাম্রশাসন পাওয়া গেছে। এই লেখে কোটিবর্ষ-বিষয়ে ভূমিদানের উল্লেখ আছে। তাঁর রাজত্বের অষ্টম বৎসর পর্যন্ত মদনপাল যে উত্তর বঙ্গের কিয়দংশে পাল প্রভুত্ব অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন তা নিশ্চিত। কিন্তু সেনবংশীয় বিজয়সেন অনতিবিলম্বে মদনপালকে পরাজিত করে উত্তর বাংলার বৃহদংশ অধিকার করেন। পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায়ও সেন আধিপত্য বিস্তার লাভ করে। উত্তর বঙ্গের পশ্চিমাঞ্চল এবং নালন্দা-গয়া-মুঙ্গের অঞ্চলে মদনপালের কর্তৃত্ব সীমাবদ্ধ থাকে। সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন মদনপাল। প্রখ্যাত কাব্যকার সন্ধ্যাকর নন্দী তাঁর সভাকবি ছিলেন। তাঁর অগ্রমহিষী চিত্রমতিকা। বটেশ্বরস্বামী নামে জনৈক সামবেদী ব্রাহ্মণ এই ধৰ্মশীলা রমণীকে মহাভারত শোনাতেন। বৌদ্ধ মদনপাল ব্রাহ্মণ্যধর্মাবলম্বী বটেশ্বরস্বামীকে ভূমিদানে পুরস্কৃত করেন। তাঁরই রাজ্যের পদস্থ রাজপুরুষ সান্ধিবিগ্রহিক ভীমদের বারাণসীতে শিবমন্দির নির্মাণ করেন।
গোবিন্দপাল (আ. ১১৬১-৬৫ খ্রিস্টাব্দ) : পালবংশের পরবর্তী রাজা গোবিন্দপাল। পূর্ববর্তী রাজা মদনপালের সঙ্গে তাঁর কী সম্পর্ক ছিল তা জানা যায় না। গঙ্গা-মুঙ্গের অঞ্চলে তাঁর রাজ্যবর্ষে উৎকীর্ণ লেখ বা অনুলিখিত পাণ্ডুলিপি আবিষ্কৃত হয়েছে। সম্ভবত গয়া তাঁর হস্তচ্যুত হয়; সেখানে গাহড়বালরাজ বিনয়চন্দ্রের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
পলপাল (আ. ১১৬৫-১২০০ খ্রিস্টাব্দ) : পালবংশের শেষ রাজা পলপাল। তাঁর পঞ্চত্রিংশৎ রাজ্যবর্ষে উৎকীর্ণ একখানি মূর্তিলেখ মুঙ্গের জেলার জয়নগরে আবিষ্কৃত হয়েছে। তিনি গৌড়েশ্বর অভিধায় ভূষিত ছিলেন কিন্তু উত্তরবঙ্গে তাঁর কোনও কর্তৃত্ব ছিল না। সেখানে সেন রাজগণের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। সেননৃপতি বল্লালসেনের নবম রাজ্যবর্ষে বা আনুমানিক ১১৬৭ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ একখানি তাম্রশাসন ভাগলপুরের নিকট সনোখার গ্রামে পাওয়া গেছে। পলপাল হয়তো বল্লালসেনের বশীভূত মিত্র ছিলেন। এমনও হতে পারে, গাহড়বাল এবং সেন রাজগণের পারস্পরিক বিরোধের সুযোগে তিনি মুঙ্গের অঞ্চলে স্বাধীনভাবেই রাজত্ব করেন। তখন সারা উত্তর ভারত জুড়ে তুর্কি বিজয়াভিযানের প্লাবন বইছিল। ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে মোহাম্মদ ঘোরি গাহড়বাল নৃপতি জয়চ্চন্দ্রকে পরাজিত করে উত্তরপ্রদেশ ও বিহারের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তুর্কি অধিকার প্রসারিত করেন। ১২০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তুর্কি সেনানী ইখতিয়ারউদ্দীন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজী পলপালকে উৎখাত করেন। জরাজীর্ণ পালরাজ্যের শেষ স্তম্ভটিও ধসে পড়ল।
উপসংহার : চারশো বছরেরও অধিককাল পাল রাজারা রাজত্ব করে গেছেন। একটি রাজপরিবারের এত দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা ভারতের ইতিহাসে অবশ্যই এক বিরল ঘটনা। তবে পাল রাজবংশের এই সুদীর্ঘ যাত্রাপথের সিংহভাগই ছিল বিপদসংকুল, পদে পদে ছিল পরাভব, অখ্যাতি এবং অবরোহণের গ্লানি। বাংলা ও বিহার জুড়ে অখণ্ড এক রাজ্যস্থাপনে যে উদ্যম, রণনৈপূণ্য ও দক্ষতার প্রয়োজন তা ধর্মপাল, দেবপাল ও প্রথম মহীপাল বাদে অন্য কোনও পাল রাজার ছিল না। বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথা চাড়া দিচ্ছে, যত্র-তত্র নতুন রাজ্য গড়ে উঠছে, ভিন রাজ্যের রাজারা এসে পরাক্রম প্রকাশ করছেন, এসব যেন পাল যুগের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ব্যতিক্রম অবশ্যই ছিল। কিন্তু সে যেন মেঘলা আকাশে ক্ষণিকের বিদ্যুৎ ঝলক। তাই ৭৫০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যে সাড়ে চারশো বছর পাল শাসনপর্বরূপে চিহ্নিত, সে সময় বাংলা ও বিহারের বিভিন্ন অঞ্চলে আরও অনেক রাজ্য গড়ে উঠেছিল। এদের মধ্যে চন্দ্র, বর্মা, কম্বোজ ও সেন রাজ্যের কথা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
পালরাজ্যের রাজধানী
পালরাজ্যের রাজধানীর অবস্থান সম্পর্কে আমাদের ধারণা খুব একটা স্পষ্ট নয়। রামচরিতকার বলছেন, বরেন্দ্রী পুনরুদ্ধার করে রামপাল বরেন্দ্রীর রামাবতীতে রাজধানী স্থাপন করেন। এই রামাবতী ছিল মদনপালেরও রাজধানী। এই শহর হতেই পালরাজ মনহলি শাসন প্রদান করেন। কিন্তু রামপালের আদি রাজধানী কোথায় ছিল? ধর্মপাল, দেবপালদের মতো রামপালের পূর্বসূরিদের রাজধানীই বা কোথায় অবস্থিত ছিল? দুর্ভাগ্যের বিষয়, এসব প্রশ্নের কোনও সঠিক উত্তর নেই। সমকালীন লেখমালা ও প্রাচীন সাহিত্য এ সম্পর্কে আশ্চর্যরকমের উদাসীন। অনেকে বলবেন, পাললেখে উল্লিখিত জয়স্কন্ধাবারসমূহই পালরাজ্যের সাময়িক রাজ ধানী ছিল। লেখে বর্ণিত জয়স্কন্ধাবারগুলির মধ্যে রয়েছে পাটলিপুত্র, কপিলাবাসক, মুদ্গগিরি, বট পর্বতিকা, সাহসগণ্ড, বিলাসপুর, কাঞ্চনপুর এবং রামাবতীর মতো নগরী। উপরোক্ত স্থানগুলিকে রাজধানীরূপে চিহ্নিত করলে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হয়, পালরাজেরা ঘন ঘন রাজধানী পরিবর্তন করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে এ ধারণাও স্পষ্ট হয়, ধর্মপাল এবং প্রথম মহীপালের মতো নরপতিরা একাধিকবার তাঁদের রাজধানী স্থানান্তরিত করেছেন। (ধর্মপালের খালিমপুর ও নালন্দা তাম্রশাসন যথাক্রমে পাটলিপুত্র ও কপিলাবাসক হতে প্রদত্ত হয়। প্রথম মহীপালের বেলোয়া ও বাণগড় শাসন যথাক্রমে সাহসগণ্ড ও বিলাসপুর হতে সম্প্রদত্ত হয়।)
কিন্তু এরূপ সিদ্ধান্ত সমীচীন বোধ হয় না। রাজধানী-পরিবর্তন এক অতি জটিল প্রক্রিয়া। রাজধানীতে শুধু রাজার অবস্থানই প্রয়োজনীয় নয়, মন্ত্রিমণ্ডলী, আমলাবর্গ এবং সৈন্যবাহিনীর উপস্থিতিও একান্ত আবশ্যক। সুতরাং রাজধানী পরিবর্তনের সঙ্গে রাজ্যের বহুসংখ্যক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির স্থানান্তরকরণের প্রশ্নটি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এ কাজ কেবল সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুলই নয়, এ ধরনের অভিযানে সরকারি ও বেসরকারি ব্যক্তিদের দুর্দশা ও হয়রানির অবধি থাকে না। প্রাচীন ভারতে রাজধানী স্থানান্তর করণের যে নিদর্শন নেই, তা নয় কিন্তু এরূপ ঘটনা সচরাচর ঘটত না। মগধের রাজধানী রাজগৃহ হতে পাটলিপুত্রে স্থানান্তরিত হয়েছে, হর্ষবর্ধন থানেশ্বর হতে কান্যকুজে রাজধানী স্থানান্তর করেন, দ্বিতীয় নাগভট কান্যকুব্জ শহরে নতুন রাজধানী স্থাপন করেন। কিন্তু রাজধানীর এই স্থানান্তরকরণ হত কালেভদ্রে, বিশেষ পরিস্থিতিতে। কিন্তু ঘন ঘন রাজধানী পরিবর্তনের নজির প্রাচীন ভারতে নেই। যুদ্ধ-বিগ্রহ, তীর্থদর্শন প্রভৃতি কারণে রাজাদের প্রায়শই নানা স্থানে যেতে হত, তখন তাঁদের নিরাপত্তার প্রতিও যথোচিত দৃষ্টি দেওয়া হত। কিন্তু তাঁদের সাময়িক নিবাস স্থলকে রাতারাতি রাজধানীতে উন্নীত করা সম্ভব ছিল না। সে কারণে পাল লেখমালায় উল্লিখিত জয়স্কন্ধাবারসমূহকে পালরাজ্যের রাজধানীরূপে চিহ্নিত করা যায় না। অর্থাৎ, ধর্মপাল, দেব পালদের মতো আদি পর্বীয় পাল রাজগণের রাজধানীর অবস্থান কোথায় ছিল, প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে সে প্রশ্নের এখনও সদুত্তর পাওয়া যাচ্ছে না।
পাল রাজাদের বংশ-তালিকা ও কালানুক্রম
পালপর্বের রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের ধ্যান-ধারণা মূলত রমেশচন্দ্র মজুমদার, বিনয়চন্দ্র সেন ও দীনেশচন্দ্র সরকারের মূল্যবান গবেষণার উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে এই তিন মহারথীকে কাজ করতে হয়েছে। রমেশচন্দ্র ও বিনয়চন্দ্র যখন প্রাপ্ত অভিজ্ঞানের ভিত্তিতে পালরাজদের বংশ তালিকা প্রস্তুত করেন তখন লখনউ যাদুঘরে সংরক্ষিত, প্রথম শুরপালের তৃতীয় রাজ্যবর্ষে উৎকীর্ণ তাম্রশাসনখানি অনাবিষ্কৃত ছিল। ফলে তাঁদের কৃত পাল বংশপঞ্জিতে প্রথম শূরপালের স্থান স্বভাবতই যথাযথরূপে নির্দিষ্ট হতে পারেনি। দীনেশচন্দ্রের সময় সংশ্লিষ্ট তাম্রশাসনটি আবিষ্কৃত হওয়ায় প্রথম শূরপাল পাল বংশ-তালিকায় সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হন। কিন্তু দীনেশ চন্দ্রের জীবিতকালে মহেন্দ্রপালের জগজ্জীবনপুর তাম্রশাসন এবং দ্বিতীয় গোপালের তিনখানি তাম্রশাসনের কথা বিদ্বৎসমাজে অপরিজ্ঞাত ছিল। ফলে পাল রাজাদের যে বংশ-তালিকা দীনেশ চন্দ্র সংকলন করেছেন, তারও সংশোধন প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। প্রকৃতপক্ষে কয়েকখানি নতুন অভিলেখ আবিষ্কৃত হওয়ায় পাল নরপতিদের রাজত্বের পারম্পর্য ও কালানুক্রম নতুন করে নির্ধারণ করতে হয়েছে। এ কাজ করতে হয়েছে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সবদিক বিবেচনা করে, বিশেষত কতিপয় পাল, প্রতীহার এবং রাষ্ট্রকূট রাজাদের সুপরীক্ষিত ও সুপ্রমাণিত সমকালীনত্বের প্রেক্ষাপটে।
প্রশাসনিক ব্যবস্থা
রাজতন্ত্র : রাষ্ট্র ছিল রাজতান্ত্রিক। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ প্রশাসক রাজা। গালভরা অভিধায় তিনি ভূষিত। তিনি পরমেশ্বর, পরমভট্টারক এবং মহারাজাধিরাজ। তিনি ঈশ্বরত্বের দাবিদার। প্রজাসাধারণ যাতে তাঁর বশীভূত থাকেন সেই উদ্দেশ্যেই রাজার এই দেবত্বের দাবি।
রাজশক্তির দুর্বলতা : নীতিগতভাবে প্রবল প্রতাপান্বিত হলেও কার্যক্ষেত্রে রাজা সীমিত ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। রাজার উপর মন্ত্রীর একটা প্রভাব ছিল। প্রাদেশিক শাসককুলের উপর তাঁর বিশেষ কোনও নিয়ন্ত্রণ ছিল না। প্রশাসনের উঁচু পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে উত্তরাধিকার নীতি অনুসৃত হত। অর্থাৎ কোনও পদস্থ পদাধিকারীর মৃত্যু হলে সাধারণত তাঁর পুত্রই স্থলাভিষিক্ত হতেন। এই ব্যবস্থায় রাজার ক্ষমতা সংকুচিত হয়, রাজ্যে পরিবারতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়। তাছাড়া পালরাজ্যে আর এক প্রভাবশালী গোষ্ঠী ছিলেন। লেখমালায় এঁদের রাজন, রাজন্যক, রাজনক, রাণক, সামন্ত ও মহাসামন্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। রামচরিতে তাঁদের ‘অনন্ত সামন্তচক্র’ বলা হয়েছে। রামপাল এঁদেরই সাহায্যে কৈবর্ত্যরাজ ভীমকে পরাজিত করেছিলেন। নীতিগতভাবে রাজার অধীনস্থ হলেও স্ব স্ব অঞ্চলে তাঁরা কার্যত স্বাধীন ছিলেন। রাজশক্তি যতই দুর্বল হয়েছে তাঁদের ক্ষমতা ততই বৃদ্ধি পেয়েছে। অথবা, তাঁদের ক্ষমতাবৃদ্ধিতে রাজশক্তি দুর্বল হয়েছে।
মন্ত্রী : প্রশাসনে যাঁরা রাজাকে সাহায্য করতেন তাঁদের শীর্ষদেশে ছিলেন মন্ত্রী। গর্গ ছিলেন ধর্মপালের মন্ত্রী। গর্গের পুত্র দর্ভপাণি, পৌত্র সোমেশ্বর এবং প্রপৌত্র কেদারমিশ্র দেবপালের অধীনে মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেছিলেন। কেদারমিশ্রের পুত্র গুরবমিশ্র নারায়ণপালের মন্ত্রী ছিলেন। পাল আমলের মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদাসম্পন্ন ছিলেন। রাজা দুর্বল হলে মন্ত্রীর যথেচ্ছাচার ও ক্ষমতা বৃদ্ধি পেত। নারায়ণপালের মন্ত্রী গুরবমিশ্র গর্বভরে বলেছিলেন, দেবপালের মতো রাজা পরামর্শ গ্রহণের জন্য তাঁর প্রপিতামহ দর্ভপাণির গৃহদ্বারের বাইরে প্রতীক্ষারত থাকতেন। দর্ভপাণির ক্ষমতা সম্পর্কে হয়তো অতিশয়োক্তি করা হয়েছে কিন্তু নারায়ণপালের রাজত্বকালে মন্ত্রী গুরবমিশ্র যে অসীম ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন বাদাল প্রশস্তি তার অকাট্য প্রমাণ।
কেন্দ্রীয় পদস্থ রাজপুরুষবৃন্দ : মন্ত্রী ছাড়া কেন্দ্রের অন্যান্য পদস্থ রাজপুরুষগণের মধ্যে নিম্নোক্ত পদাধিকারীরাও ছিলেন :
- সচিব : তিনি কখনও মন্ত্রীর সমতুল্য, কখনওবা পদস্থ রাজপুরুষ। রাজামাত্য : সাধারণ অর্থে অমাত্য পদস্থ রাজপুরুষ। রাজার একান্ত অমাত্য, এই অর্থে রাজামাত্য।
- দূত : বার্তাবহ। কখনও কখনও মন্ত্রী বা সান্ধিবিগ্রহিকও দূত নিযুক্ত হতেন। দূত স্থায়ী পদ নাও হতে পারে। দূতপ্রৈষণিক : দূত প্রেরণ করেন যিনি তিনিই দূতপ্রৈষণিক। আবার বিশেষ উদ্দেশ্যে দৌত্যে পাঠানো হয়েছে এমন পদস্থ রাজপুরুষও দূতপ্ৰৈষণিক।
- দূতক : ভূমিদান উপলক্ষে তিনি রাজার দূতরূপে কাজ করেন।
- মহাদণ্ডনায়ক : তিনি প্রধান ধর্মাধ্যক্ষ, বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ পদাধিকারী। মহাদণ্ডনায়ক সমর বিভাগের বা পুলিশ বিভাগের সর্বাধ্যক্ষ, এমন অভিমতও ব্যক্ত হয়েছে। দণ্ড শব্দের একাধিক অর্থ থাকায় এই বিপত্তি।
- মহাক্ষপটলিক : আয়-ব্যয় হিসাব বিভাগের অধ্যক্ষ। সরকারি দলিল-দস্তাবেজেরও ভার প্রাপ্ত রাজপুরুষ তিনি।
- মহাকুমারামাত্য : তিনি সম্ভবত বিষয়পতি বা কুমারামাত্যদের সর্বাধ্যক্ষ।
- মহাপ্রতীহার : রাজপ্রাসাদের রক্ষণাবেক্ষক অথবা রাজ্যের সীমান্তরক্ষক ঊর্ধ্বতন রাজপুরুষ।
- সান্ধিবিগ্রহিক : যুদ্ধ ও সন্ধি-শান্তি সম্পর্কিত বিষয়ের ভারপ্রাপ্ত রাজপুরুষ। মহাসান্ধিবিগ্রহিক : যুদ্ধ ও সন্ধি-শান্তির ভারপ্রাপ্ত মুখ্য আধিকারিক।
- মহাসেনাপতি : যুদ্ধ-বিগ্রহাদি সম্পর্কিত উচ্চতম রাজপুরুষ। নৌকা বা নাবাধ্যক্ষ : রাজকীয় নৌবাহিনীর অধ্যক্ষ। মহাসামন্তাধিপতি : সামন্তবর্গের ভারপ্রাপ্ত পদস্থ রাজপুরুষ।
- বলাধ্যক্ষ : রাজকীয় পদাতিক সৈন্যবাহিনীর অধ্যক্ষ।
- মহাসর্বাধিকৃত : তিনি কী কাজ করতেন এবং কোন্ বিভাগের অধ্যক্ষ ছিলেন, বলা কঠিন। সর্বাধিকারী পদবি এই রাজপদের স্মৃতি বহন করছে।
- মহাদৌঃসাধসাধনিক ও মহাকার্তাকৃতিক : এঁদের দায়দায়িত্ব সম্পর্কে সঠিক কিছু জানা যায় না।
প্রাদেশিক প্রশাসন : প্রশাসনের সুবিধার জন্য পালরাজ্য কয়েকটি ভুক্তি বা প্রদেশে বিভক্ত ছিল। পাল লেখমালায় বাংলার পুণ্ড্রবর্ধন, বর্ধমান ও দণ্ড, বিহারের তীর ও শ্রীনগর এবং অসমের প্রাগ্জ্যোতিষ এই ছয়টি ভুক্তির উল্লেখ আছে। ভুক্তির শাসনকর্তারা সাধারণত উপরিক নামে পরিচিত ছিলেন তবে কখনও কখনও তিগ্যদেব বা বৈদ্যদেবের মতো কোনও সেনাপতি বা সচিবও ভুক্তির শাসক নিযুক্ত হতেন।
জেলা-প্রশাসন : এক একটি ভুক্তি আবার কয়েকটি করে বিষয় অথবা মণ্ডলে বিভক্ত হত। ভুক্তির নিম্নতর বিভাগ মণ্ডল না বিষয় সে সম্পর্কে পাল লেখমালার সাক্ষ্য পরস্পর বিরোধী। খালিমপুর লেখের মহন্তাপ্রকাশ-বিষয় ব্যাঘ্রতটী-মণ্ডলভুক্ত আবার মদনপালের মনহলি লেখে হলাবর্ত-মণ্ডল কোটিবর্ষ-বিষয়ের অন্তর্গত। দেখা যাচ্ছে, ভুক্তির নিম্নতর বিভাগ কোথাও মণ্ডল, কোথাও বিষয়। বিষয়ের শাসনকর্তার উপাধি বিষয়পতি। মণ্ডলের শাসক মাণ্ডলিক, কখনওবা মণ্ডলাধিপতি। মণ্ডলাধিপতি মণ্ডলের অধিপতি। মাগুলিকের তুলনায় তাঁর ক্ষমতা ও মর্যাদা বেশিই ছিল। মণ্ডলে তিনি স্বাধীনভাবেই প্রশাসনিক কার্য সম্পাদন করতেন। রাজার প্রত্যক্ষ শাসন সেখানে বলবৎ ছিল না। নালন্দা লেখে বলবর্মা নামে ব্যাঘ্রতটীমণ্ডলের এরূপ এক প্রতাপশালী মণ্ডলাধিপতির উল্লেখ আছে। লেখে তিনি দেবপালের দক্ষিণ হস্তরূপে বর্ণিত হয়েছেন। বিষয়ের শাসন-কার্য কীভাবে পরিচালিত হত, সে সম্পর্কে খালিমপুর লেখে কিছু তথ্য আছে। এই লেখে জ্যেষ্ঠ-কায়স্থ, মহামহত্তর, মহত্তর এবং দাশগ্রামিক—এঁদের ‘বিষয়-ব্যবহারী বলা হয়েছে। অনুমান হয়, এঁরা সকলেই বিষয়ের শাসনকার্যের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। জ্যেষ্ঠ-কায়স্থ সম্ভবত বিষয়াধিকরণের মুখ্য করণিক। তিনি বিষয়পতির কর্মসচিবও হতে পারেন। মহত্তর বলতে স্থানীয় সম্ভ্রান্ত, বিত্তবান ভূম্যধিকারী বোঝায়। মহত্তরদের উচ্চতর শ্রেণিভুক্ত যিনি তিনি মহামহত্তর। আবার মহত্তরদের মধ্যে যিনি শ্রেষ্ঠ তিনিও মহামহত্তর। দশটি গ্রামের প্রশাসক দাশগ্রামিক। প্রশ্ন হচ্ছে বিষয়-ব্যবহারীদের সংখ্যা নিয়ে। জ্যেষ্ঠ-কায়স্থ অবশ্য একজনই ছিলেন। মহা মহত্তরও সংখ্যায় একজন হতে পারেন। কিন্তু মহত্তর ও দাশগ্রামিকেরা তো বহুসংখ্যক ছিলেন। এঁদের কতজন বিষয়াধিকরণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন? কীভাবেই বা তাঁরা মনোনীত বা নিযুক্ত হতেন? এসব প্রশ্নের উত্তর নেই। বিষয়-প্রশাসনের সঙ্গে মহামহত্তর ও মহত্তরদের যোগ প্রমাণ করছে, জেলার প্রশাসনিক কাজে জনসাধারণেরও একটা ভূমিকা ছিল।
বীথী : বাংলার কোনও পাল লেখে বীথী বিভাগের উল্লেখ নেই কিন্তু বিহারে প্রাপ্ত কয়েকটি লেখে উল্লেখ আছে। কিন্তু কম্বোজ-বর্মা সেন লেখমালায় বীথীর কথা আছে। মনে হয়, পাল রাজ্যেও বীথী বিভাগ বর্তমান ছিল। কিন্তু বীথীর শাসনকর্তার পদবি ইত্যাদি কিছু জানা যায় না।
দশগ্রাম : লেখে দাশগ্রামিক নামে এক শ্রেণির রাজপুরুষের কথা বলা হয়েছে। এই রাজপুরুষের উল্লেখ থেকে মনে হয়, এক একটি বিষয় দশ দশটি গ্রামের কয়েকটি উপবিভাগে বিভক্ত ছিল। দাশগ্রামিক ছিলেন এক একটি উপবিভাগের ভারপ্রাপ্ত রাজপুরুষ।
গ্রাম : দশগ্রামের নিম্নতর বিভাগ গ্রাম। গ্রামের ভারপ্রাপ্ত রাজপুরুষ গ্রামপতি।
পাটক : রাজ্যের নিম্নতম বিভাগ পাটক। আধখানা গ্রাম, এই অর্থে পাটক। এ ব্যাখ্যা অভিধান প্রণেতা হেমচন্দ্রের। পাটক থেকেই সম্ভবত পাড়া কথাটি এসেছে।
স্ফীত আমলাতন্ত্র : এতক্ষণ পাল রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে সংযুক্ত কয়েক শ্রেণির রাজপুরুষের কথা আলোচিত হল। লেখমালায় আরও বহু রাজপুরুষের উল্লেখ আছে। লেখমালায় উল্লিখিত এই সব রাজপুরুষদের মধ্যে আছেন : চৌরোদ্ধরণিক, দণ্ডপাশিক, দণ্ডশক্তি, দাণ্ডিক, দাশাপরাধিক, গমাগমিক, গৌল্মিক, খণ্ডরক্ষ, খোল, কোট্টপাল, ক্ষেত্রপ, প্রমাতা, প্রান্তপাল, শরভঙ্গ, শৌল্কিক, সৌনিক, ষষ্ঠাধিকৃত, তদায়ুক্তক, তরপতি, তরিক, বিনিযুক্তক এবং আরও অনেকে। মনে রাখতে হবে, পালরাজ্য সেরূপ সুবিস্তৃত ছিল না অথচ রাষ্ট্রযন্ত্র বিশাল আকার ধারণ করেছিল। রাজস্বের সিংহভাগ এই স্ফীত আমলাতন্ত্রের অনুকূলে নিঃশেষিত হত। এ অবস্থায় রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়।
সমাজ জীবন
সমকালীন লেখমালা, চর্যাপদ এবং রামচরিত প্রমুখ গ্রন্থাদিতে পালযুগের সমাজ জীবনের কিছু ছবি ধরা পড়েছে।
চতুর্বর্ণ : সমাজের একটি অংশ বর্ণ কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত ছিল। অর্থাৎ জনসমষ্টির একাংশ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চারবর্ণে বিভক্ত ছিল। বিভিন্ন বর্ণের একটি বর্ণনা দেয়া যাক –
- ব্রাহ্মণ : ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠত্ব সর্বত্র স্বীকৃত। তাঁরা বেদজ্ঞ, শাস্ত্রবিদ, নীতিবান, সুবক্তা, অধ্যয়ন-অধ্যাপনারত, নির্লোভ ও তেজস্বী। তাঁরা তীর্থভ্রমণ করেন, হোম-যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন, ব্রত পালন করেন ও দানাদি কার্যে অংশগ্রহণ করেন। লেখমালায় ব্রাহ্মণদের সম্পর্কে এ ধরনের কথা বলা হয়েছে ঠিকই কিন্তু ব্রাহ্মণদের সকলেই যে আদর্শবান এবং সদাচারী ছিলেন, তা অবশ্যই নয়। লেখমালায় যে সকল ব্রাহ্মণদের কথা বলা হয়েছে তাঁরা ছিলেন পণ্ডিতশ্রেষ্ঠ, আদর্শবান। বলতে দ্বিধা নেই, সমাজে এ ধরনের ব্রাহ্মণ সংখ্যায় অল্পই ছিলেন। এ যুগে ব্রাহ্মণদের অনুকূলে ভূমিদানের অজস্র নজির আছে। সমকালীন শিলালেখ ও তাম্রশাসনগুলি তো সবই ভূমিদান সম্পর্কিত। সর্বত্রই দানের গ্রহীতা ব্রাহ্মণ। পাল রাজারাও ব্রাহ্মণদের অনুকূলে জমি দান করেছেন। পরমসৌগত প্রথম মহীপাল জনৈক ভট্ট ব্রাহ্মণকে ভূসম্পদ দান করেছিলেন। তৃতীয় বিগ্রহপালও এক ব্রাহ্মণকে জমি প্রদান করেন। ‘হরিচরিত’ গ্রন্থের লেখক চতুর্ভুজ বলেন, তাঁর পূর্বপুরুষদের ধর্মপাল বরেন্দ্রভূমির করঞ্জগ্রাম দান করেছিলেন। এই ধর্মপাল সম্ভবত পালনৃপতি ধর্মপাল। ভূমিদানের পিছনে সাধারণত দু’টি উদ্দেশ্য কাজ করত। এক, পুণ্য অর্জন। দুই, ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও শিক্ষার প্রসার। তখনকার দিনে পণ্ডিত-ব্রাহ্মণদের গৃহ শিক্ষায়তন রূপে গড়ে উঠত। উত্তরপ্রদেশের শ্রাবস্তী, মুক্তাবস্তু, তর্কারি, কোলাঞ্চ প্রভৃতি নামকরা গ্রাম থেকে বহু ব্রাহ্মণ পরিবার এ সময় বাংলা ও বিহারে এসে বসতি স্থাপন করেন। স্থানীয় ব্রাহ্মণদের তুলনায় নবাগত পশ্চিমী ব্রাহ্মণদের সামাজিক মর্যাদা বেশিই ছিল। যজন এবং অধ্যাপনা ছিল সাধারণত ব্রাহ্মণদের উপজীবিকা। কখনওবা তিনি রাজার মন্ত্রী বা পদস্থ রাজপুরুষ। দর্ভপাণি, কেদারমিশ্র, ভট্টগুরব মিশ্ররা পুরুষানুক্রমে মন্ত্রীর কাজ করেছেন। ব্রাহ্মণ করণিকের বৃত্তি গ্রহণ করেছেন, সমকালীন বা প্রায় সমকালীন লেখে এরূপ তথ্যও আছে।
- ক্ষত্রিয় : ব্রাহ্মণদের তুলনায় ক্ষত্রিয়দের উল্লেখ কম। তবে এঁদের যথেষ্ট সামাজিক প্রতিপত্তি ছিল। তা না হলে সন্ধ্যাকর নন্দীর কণ্ঠে রামপালের ত্রিয়ত্বের দাবি উচ্চারিত হত না। চর্যাপদ এবং লেখমালায় মেদ, অন্ধ্র, চণ্ডাল, ডোম, শবর এবং কাপালি প্রভৃতি বিভিন্ন গোষ্ঠী বা জাতির উল্লেখ আছে। এঁরা সকলেই অন্ত্যজ পর্যায়ের। এঁদেরই সমগোত্রীয় বাগদি ও আগুরি। অবশ্য পরে শেষোক্ত জাতি দু’টি যথাক্রমে উগ্র ও ব্যাগ্র ক্ষত্রিয় বলে পরিচিতি লাভ করে।
- অম্বষ্ঠ-বৈদ্য : অম্বষ্ঠ জাতির লোকেরা এ সময় দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু ও কেরল থেকে বাংলা-বিহারে এসে বসতি স্থাপন করেন। চিকিৎসা ছিল তাঁদের অন্যতম উপজীবিকা। বাংলা বিহারে আসার পর তাঁদের সঙ্গে নানা সম্প্রদায়ের স্থানীয় চিকিৎসক পরিবারগুলির সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ফলে ভিষক্ বৃত্তিকে কেন্দ্র করে একটি জাতির উদ্ভব হয়। এই জাতি বৈদ্য বা অন্বষ্ঠ-বৈদ্য। সমাজের চোখে শূদ্র বলে তাঁদের পরিচিতি হয়। বৈদ্যদের বৈশ্যত্ব দাবি ও গুপ্ত নামান্ত গ্রহণ অষ্টাদশ শতকের ঘটনা। তখন থেকে বৈদ্যদের অনেকে উপবীতও ধারণ করতে থাকেন। বৈদ্য কথার অর্থ বেদজ্ঞ। এই বেদজ্ঞ আয়ুর্বেদজ্ঞ।
- করণ-কায়স্থ : বৃত্তিকেন্দ্রিক শূদ্র পদবাচ্য আর একটি জাতি করণ বা কায়স্থ। জাতিরূপে করণ কায়স্থদের আবির্ভাব পালপর্বের সমাজ-জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। প্রথম দিকে, হয়তোবা গুপ্তপর্বে, করণ ও কায়স্থ বলতে লেখকবৃত্তিধারী দু’শ্রেণির ব্যক্তি বোঝাত। (করণ কথার মূল অর্থ, খোদাই যন্ত্র। এই অর্থে ‘করণি’ কথাটি আজও ব্যবহৃত হয়।) তাঁদের মধ্যে একটা পার্থক্য ছিল কিন্তু তা স্পষ্ট নয়। হতে পারে, খোদাই করে লিখতেন যাঁরা, তাঁরাই ছিলেন করণ। পরবর্তিকালে কায়স্থ ও করণ সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়। তখন লেখক বৃত্তিধারী ব্যক্তি মাত্রেই কায়স্থ বা করণ। পালপর্বে করণ ও কায়স্থ নিছক লেখকবৃত্তিধারী ব্যক্তি নন, তাঁরা এক অভিন্ন জাতিতে পরিণত হয়েছেন ; লেখকের বৃত্তিতেও তাঁরা আর আবদ্ধ থাকেননি। রামচরিতের কবি সন্ধ্যাকর নন্দীর পিতা ছিলেন ‘করণানামগ্রণী’ অর্থাৎ করণকুলের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। পালরাজ্যের তিনি ছিলেন সান্ধি বিগ্রহিক। শব্দপ্রদীপের লেখক ‘করণান্বয়’ অর্থাৎ করণবংশজাত বলে আত্মপরিচয় দিয়েছেন। তাঁর পিতা ও পিতামহ যথাক্রমে পালরাজ রামপাল ও বঙ্গালনৃপতি গোবিন্দচন্দ্রের রাজচিকিৎসক ছিলেন। ন্যায়কন্দলী গ্রন্থের লেখক শ্রীধরের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন পাণ্ডুদাস। পাণ্ডুদাসকে কায়স্থ কুলতিলক বলা হয়েছে।
- কৈবর্ত : এ যুগের সাহিত্যে কৈবর্ত জাতির উল্লেখ আছে। শাস্ত্রে এঁদের নিষাদ পিতা ও আয়োগব মাতার সংকর বলা হয়েছে। ১২শ শতকের বাঙালি স্মৃতিকার ভবদেব ভট্ট কৈবর্তদের অন্ত্যজ আখ্যা ; তাঁরা রজক, চর্মকার, নট, বরুড়, মেদ ও ভিল্লদের সমগোত্রীয়। তাঁদের উপ জীবিকা ধীবরবৃত্তি ও নৌকার মাঝিগিরি। পালপর্বের শেষের দিকে কৃষিকার্যও কৈবর্তদের একটি প্রধান উপজীবিকা হয়ে দাঁড়ায় এবং মাহিষ্য বলে তাঁরা পরিচিতি লাভ করেন।
- ডোম-শবর : অন্ত্যজ পর্যায়ভুক্ত ডোমদের বাস ছিল গ্রাম বা শহরের বাইরে, কুঁড়ে ঘরে। তাঁদের উপজীবিকা হস্তশিল্প। কেউ কেউ নৃত্য-গীতে সুপটু ছিলেন। এঁদের যৌনাদর্শ ও অভ্যাস শিথিল ছিল। শবরেরা বাস করতেন পাহাড়ে, জঙ্গলে, তাঁদের পরিধেয় ছিল ময়ূরের পালক, কণ্ঠে গুঞ্জা বিচির মালা, কর্ণে কুণ্ডল।
রাষ্ট্র ও বর্ণ-ব্যবস্থা : ধর্মে বৌদ্ধ হয়েও পাল রাজারা বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার সমর্থক ছিলেন। মুঙ্গের লেখে ধর্মপাল সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনি বিচলিত বর্ণসমূহকে স্ব স্ব স্থানে প্রতিস্থাপিত করেছিলেন। তৃতীয় বিগ্রহপাল আমগাছি লেখে চাতুবর্ণ-সমাশ্রয় অর্থাৎ চতুর্বর্ণের আশ্রয়স্থল রূপে বর্ণিত হয়েছেন। ব্রাহ্মণাদি বর্ণগুলিকে সুবিন্যস্ত করার জন্য পাল রাজারা যে উদ্যম গ্রহণ করেছিলেন তা নিছক ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের সন্তোষ বিধানের জন্য নয়, এর মূল উদ্দেশ্য ছিল সমাজ-জীবনে শৃঙ্খলা ও নীতিবোধের বাতাবরণ প্রতিষ্ঠা করা।
বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ : কিন্তু বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সুর ধ্বনিত হয়েছে শাক্ত সাধকদের কণ্ঠে। পুরুষ ও নারী ছাড়া মানুষের আর কোনও শ্রেণি-বিভাগ নেই, এই ভাবনায় তাঁরা উদ্বুদ্ধ ছিলেন। বৌদ্ধ সাধু-সন্তরাও কখনও বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা অন্তরের সঙ্গে গ্রহণ করেননি। কিন্তু উপাসক ও গৃহী বৌদ্ধরা বর্ণাশ্রমের গুরুত্ব অস্বীকার করেননি।
আদিবাসী : পালরাজ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে আদিবাসীরা বাস করতেন। তাঁদের বৃহদংশ বর্ণাশ্রমের বহির্ভূত ছিলেন। কিন্তু ক্রমশই বর্ণাশ্রমের পরিধি প্রসারিত হচ্ছিল। আদিবাসীরা বর্ণাশ্রমের ক্রম বর্ধমান সীমার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছিলেন।
বিবাহ : সবর্ণ বিবাহই ছিল সমাজের সাধারণ রীতি। অসবর্ণ বিবাহ একেবারে অপ্রচলিত ছিল না। চর্যাপদে অসবর্ণ বিবাহের উল্লেখ আছে। বিবাহের সময় বরপক্ষকে যৌতুক দেওয়া হত। একটি মাত্র স্ত্রী-গ্রহণই ছিল সাধারণ নিয়ম। অভিজাত পরিবারে বহু বিবাহের প্রচলন ছিল। সপত্নী বিদ্বেষ অজ্ঞাত ছিল না। দেবপালের মুঙ্গের লেখে এবং প্রথম মহীপালের বাণগড় লেখে সপত্নী বিদ্বেষের ইঙ্গিত আছে।
নারী : অভিজাত পরিবারের মেয়েদের মধ্যে লেখাপড়ার প্রচলন ছিল বলে মনে হয়। পবনদূত কাব্যে নারীদের প্রেমপত্র রচনার ইঙ্গিত আছে। তাঁরা নৃত্য, গীতসহ নানা কলাবিদ্যায় নিপুণ ছিলেন। চর্যাগীতিতে ডোম রমণীদের নৃত্য-গীতে নৈপুণ্যের উল্লেখ আছে। তাঁরা বীণা সহযোগে গ্রাম-গ্রামান্তরে গান গেয়ে বেড়াতেন। কখনও কখনও পত্নী স্বামীর চিতায় সহমরণে যেতেন। বৈধব্য জীবন নারী জীবনের চরম অভিশাপ ছিল। স্বামীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর আমোদপ্রমোদ, সাজসজ্জা, সুখসম্ভোগ সব ঘুচে যেত। বিবাহাদি শুভ অনুষ্ঠানে তাঁর উপস্থিতি অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল।
বিনোদন : মাঝে মাঝে নাচ-গানের আসর বসত। নাচ ও গানের তালে তালে যন্ত্রসংগীতও পরিবেশিত হত। রামচরিত, লেখমালা ও চর্যাগীতিতে এর উল্লেখ আছে। রাজতরঙ্গিণী কাব্যে পুণ্ড্রবর্ধনের কার্তিকেয় মন্দিরে নিয়মিত নৃত্যগীত অনুষ্ঠানের সংবাদ আছে। পাহাড়পুর ও ময়না মতীর পোড়ামাটির ফলকে এবং অসংখ্য ধাতব ও প্রস্তর মূর্তিতে নানা ভঙ্গিতে নৃত্যপর পুরুষ ও রমণীর প্রতিকৃতি উৎকীর্ণ আছে। বিভিন্ন মৃন্ময় ও প্রস্তর ফলকে কাঁসর, করতাল, ঢাক, বীণা, বাঁশি, মৃদঙ্গ ইত্যাদি নানা প্রকার বাদ্যযন্ত্রের ছবি অঙ্কিত আছে। লাউ-এর খোলা এবং বাঁশের কঞ্চির সাহায্যে বীণা জাতীয় এক প্রকার বাদ্যযন্ত্র তৈরি করা হত। তখনকার দিনে পাশা ও দাবা খেলা জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। জুয়াখেলারও প্রচলন ছিল। অভিজাত পরিবারে পুরুষদের প্রধান বিহার ছিল শিকার বা মৃগয়া। জলক্রীড়া ও বাগান পরিচর্যার মধ্য দিয়েও অবসর সময় যাপিত হত।
শিক্ষা : সমকালীন লেখমালা ও সাহিত্য থেকে জানা যায়, পালপর্বে বাংলা-বিহারে বেদ, বেদান্ত মীমাংসা, নীতি, ব্যাকরণ, জ্যোতিষ, স্মৃতি, তর্ক, আগম, পুরাণ, কাব্য ইত্যাদি বিবিধ বিদ্যার চর্চা হত। এসব বিদ্যার চর্চা শুধু ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ও বিদ্বজ্জন সমাজেই আবদ্ধ ছিল না, পদস্থ রাজ পুরুষেরাও এসব শাস্ত্রের অনুশীলন করতেন। চিকিৎসাশাস্ত্রেরও চর্চা হত। ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রাদির শিক্ষাদানকার্য সম্পন্ন হত ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের নিজেদের গৃহে কিংবা বড় বড় মঠে। বৌদ্ধ বিহারগুলিতে বৌদ্ধশাস্ত্রের চর্চা হত। নালন্দা, ওদন্তপুরী, সোমপুরী, জগদ্দল, কনকস্তূপ ও বিক্রম শীলের মতো বিহার বা মহাবিহারগুলি বৌদ্ধশিক্ষার প্রসিদ্ধ কেন্দ্র ছিল। এক আচার্যই যে সর্বশাস্ত্র বিশারদ হতেন, এমন নয়। বিদ্যার্থীরা এক বা একাধিক শাস্ত্র একজনের নিকট শিক্ষা সমাপ্ত করে অন্য শাস্ত্র পাঠের জন্য বা একই বিষয়ে আরও গভীর জ্ঞান লাভের জন্য অন্য বিশেষজ্ঞ-আচার্যের দ্বারস্থ হতেন। প্রয়োজনে বিদ্যার্থীরা দূরবর্তী অঞ্চলেও গমন করতেন। কাশ্মীরের কবি ক্ষেমেন্দ্রের দশোপদেশ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ১০ম-১১শ শতকে বহু গৌড়ীয় বিদ্যার্থী তর্ক, মীমাংসা ও পাতঞ্জল-ভাষ্যে বুৎপত্তি লাভের জন্য কাশ্মীরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতেন। বাংলা ও বিহার থেকে বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ আচার্যরা আমন্ত্রিত হয়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্যাদান ও ধর্মপ্রচার করতেন। এরূপে আমন্ত্রিত হয়েই সুবিখ্যাত বৌদ্ধাচার্য দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান তিব্বতে গমন করেন এবং সুদীর্ঘ তেরো বৎসরকাল সেখানে অবস্থান করে বৌদ্ধধর্ম ও বৌদ্ধশাস্ত্র প্রচার করেন। ভারত ও তিব্বতের মধ্যে সাংস্কৃতিক মিলনসেতু রচনা করে গেছেন এই বাঙালি বৌদ্ধাচার্য। অধ্যয়ন অধ্যাপনা যাঁরা করতেন তাঁরা রাজা-মহারাজ ও সম্পন্ন ব্যক্তিদের নিকট থেকে অর্থ ও ভূসম্পদ লাভ করতেন। লেখমালায় এ মর্মে সুপ্রচুর সাক্ষ্য আছে। কবি ক্ষেমেন্দ্র বাঙালি বিদ্যার্থীদের বিকৃত সংস্কৃত উচ্চারণ এবং উগ্র ও কৃপণ স্বভাবের নিন্দা করেছেন।
অর্থনৈতিক জীবন
কৃষি : কৃষি ছিল আয়ের মূল উৎস। যেমনি রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে, তেমনি জনজীবনে। ধানই ছিল প্রধান কৃষিজ ফসল। উত্তর বাংলায় ভালো জাতের এবং নানা ধরনের ধান-চাষের উল্লেখ আছে রামচরিতে। খরা, অতিবৃষ্টি এবং বন্যার ফলে চাষের ক্ষতি হত। চাষীকে ক্ষেত্রকর, কর্ষক এবং কৃষক বলা হয়েছে সমকালীন লেখমালায়। চাষের অন্যান্য ফলনের মধ্যে ছিল ইক্ষু, সর্ষপ, আম, কাঠাল, মহুয়া, সুপারি, পান ও নারকেল। ধর্মপালের খালিমপুর লেখে খেজুরের উল্লেখ আছে। পাহাড়পুরের পোড়ামাটির ফলকে ও প্রস্তর ভাস্কর্যে কদলী বৃক্ষ ও ফলের চিত্র অঙ্কিত আছে। রাজশেখর তাঁর কাব্যমীমাংসা গ্রন্থে পূর্বদেশের ষোলোটি জনপদের উল্লেখ করেছেন। এদের কয়েকটি বাংলা-বিহারে অবস্থিত ছিল। জনপদগুলি হল অঙ্গ, বঙ্গ, মগধ, মুদ্গর (মুগগিরি বা মুঙ্গের), বিদেহ, পুণ্ড্র, তাম্রলিপ্তক, সুহ্ম ও ব্রহ্মোত্তর। পূর্ব দেশীয় জনপদগুলিতে উৎপন্ন লবলী, গ্রন্থিলণক, অগুরু, দ্রাক্ষা ও কস্তুরিকার উল্লেখ করেছেন রাজশেখর। দ্রব্যগুলি সুগন্ধি ও আয়ুর্বেদীয় উপকরণ। তখনকার দিনের কৃষি সম্পর্কিত মূল্যবান তথ্য পরিবেশন করেছেন রামচরিতকার সন্ধ্যাকর নন্দী। তিনি বরেন্দ্রী অঞ্চলের লবলী, গুবাক, লকুচ, শ্রীফল, নারকেল এবং খাদ্যোপযোগী কন্দ মূলের উল্লেখ করেছেন, সেখানকার উৎকৃষ্ট বাঁশবাগান ও আখের ক্ষেতেরও বর্ণনা করেছেন। উত্তর বাংলায় উৎকৃষ্ট শ্রেণির এলাচ চাষের কথাও তিনি বলেছেন। এসব তথ্যে নিঃসন্দেহে পালরাজ্যে কৃষির প্রাচুর্য ও বৈচিত্র্য আভাসিত হয়।
ভূমি-রাজস্ব : উৎপন্ন শস্যের এক-ষষ্ঠ ভাগ রাষ্ট্রের প্রাপ্য ছিল। উৎপন্ন শস্যে রাষ্ট্র বা রাজার এই প্রাপ্যাংশ ‘ভাগ’ নামে পরিচিত। খালিমপুর লেখে ‘ভাগ’কে ‘ক্ষেত্রকর’ বলা হয়েছে। ওই একই লেখে ‘ষষ্ঠাধিকৃত’ নামে এক শ্রেণির রাজপুরুষের উল্লেখ আছে। রাজপ্রাপ্য শস্যের এক ষষ্ঠ ভাগ সংগ্রহের দায়িত্বে ছিলেন তাঁরা। কখনও কখনও উৎপাদিত শস্যে রাজার ভাগের পরিমাণ বৃদ্ধি পেত। এই বৃদ্ধি নির্ভর করত রাজার মর্জির উপর বা রাজ্যের পরিস্থিতির উপর। খালিমপুর লেখে পিণ্ডক করের উল্লেখ আছে। এই পিণ্ডক এবং অর্থশাস্ত্রের ‘পিওকর’ সম্ভবত একই বস্তু। টীকাকার ভট্টস্বামী বলেন, সমগ্র গ্রামের উপর যে কর চাপানো হত, তাই পিণ্ডকর। ‘ভোগ’ও এক ধরনের রাজস্ব ছিল। ফল, ফুল, কাঠ, বাঁশ ইত্যাদি যেসব দ্রব্য মাঝে মাঝে রাজা বা রাষ্ট্রকে দেওয়া হত, তারই নাম ভোগ। অর্থাৎ উল্লিখিত দ্রব্যাদি থেকে একটা নিয়মিত আয়ের অংশ রাজার ভোগ্য ছিল। দশ প্রকার অপরাধের জন্যও প্রজা সাধারণকে জরিমানা দিতে হত। এটাও এক প্রকারের রাজস্ব, তবে ভূমিরাজস্ব নয়।
সেচ-ব্যবস্থা : বাংলা ও বিহার নদীমাতৃক অঞ্চল। কিন্তু শুধু নদনদীর জলের উপর নির্ভর করে চাষ-আবাদের কাজ সুসম্পন্ন করা যায় না। ক্ষেতের জমিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ জল সরবরাহের জন্য কৃত্রিম জলসেচের প্রয়োজন হয়। খরার দিনে কৃত্রিম জলসেচের উপযোগিতা আরও গভীরভাবে অনুভূত হয়। কৃষির ফলন বৃদ্ধিকল্পে পাল রাজারা জলসেচের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। বাণগড় লেখে রাজ্যপালের বড় বড় দীর্ঘিকা খননের উল্লেখ আছে। প্রথম মহীপালও বহু দিঘি খনন রামচরিত কাব্যে রামপালের বিশাল বিশাল পুষ্করিণী খননের কথা আছে। এ ধরনের বিশালকায় হ্রদোপম পুষ্করিণীর জল চাষ-আবাদের কাজেই ব্যবহৃত হত। আর এ জাতীয় পুকুর যে সহায়তায় খনিত হত তার প্রমাণ লেখ, কাব্য ও লোকস্মৃতিতে বিধৃত। পাল আমলের লেখসমূহে খাড়িকা, খাল ইত্যাদির উল্লেখ সুপ্রচুর। সন্দেহ নেই, এদের সিংহভাগই সেচের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র কর্তৃক খনিত হয়েছিল।
জমির মালিকানা : জমির মালিক রাজা, না জমিতে জনগণের ব্যক্তিগত মালিকানা সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল, এ বিষয়টি নিয়ে ঐতিহাসিকেরা এখনও তর্ক করেন। পাল লেখমালায় প্রায়ই দেখা যায়, রাজা তাঁর কোনও মনোনীত ব্যক্তিকে জন-অধ্যুষিত গ্রাম দান করছেন। কিন্তু এ দান সাধারণ জমিদান নয়, এ দান জমির উপর রাজার কর আদায়ের স্বত্ব ছাড়। যে কর গ্রামস্থ জমির মালিকরা এতদিন রাজাকে দিতেন, এখন জমি দানের ফলে সে করের ভোগী হলেন নতুন গ্রহীতা। কাজেই গ্রাম দান করছেন, এ যুক্তিতে রাজার জমির মালিকানা প্রমাণিত হয় না। উৎপাদিত ফসলের উপর রাজার রাজস্ব আদায়ের যে অধিকার তা প্রজাদের জমি ভোগের খাজনা নয়, তা আসলে রাজার প্রজাপালনের পারিশ্রমিক। গ্রামস্থ বাস্তু এবং ক্ষেত্রভূমি গ্রামবাসিগণের ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ছিল বলে মনে হয়। গোচারণ ভূমি, বনাঞ্চল ও জলাভূমি সম্ভবত রাজকীয় সম্পত্তি ছিল।
অগ্রহার-ব্যবস্থা : পাল রাজাদের আমলে বাংলা ও বিহারের নানা স্থানে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং বিদ্বান ও পূজারী ব্রাহ্মণদের অনুকূলে জমি ও গ্রাম অগ্রহাররূপে দান করা হত। অগ্রহার প্রতিষ্ঠার পিছনে ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা, শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রসার এবং পুণ্যার্জন (মাতাপিত্রোঃ আত্মনশ্চ পুণ্যযশোঽভিবৃদ্ধয়ে) (তৃতীয় বিগ্রহপালের বেলোয়া তাম্রশাসন (Epigraphia Indica, Vol. XXIX, পৃষ্ঠা ৯-১৩)) – মুখ্যত এই তিনটি উদ্দেশ্য কাজ করত। এ সময় সাধারণত দান করা হত আবাদি ও বসতি অঞ্চল, বনভূমি বা অনাবাদি জমি নয়। ফলে কৃষির বিস্তারের প্রশ্নটি এখানে বড় হয়ে উঠছে না। অগ্রহার-ভোক্তাদের মধ্যে যেমন বৌদ্ধ আচার্যেরা ছিলেন তেমনি ছিলেন স্থানীয় ও বহিরাগত বিদগ্ধ ব্রাহ্মণেরা।
ধর্মপালের নালন্দা তাম্রশাসনে আর্য-তারা ভট্টারিকা দেবী মন্দিরের পূজারীর অনুকূলে গয়া বিষয়ের উত্তর রামগ্রাম নামে একটি নিষ্কর গ্রামদানের কথা আছে। খালিমপুর তাম্রশাসন থেকে জানা যায়, ধর্মপাল মহাসামন্তাধিপতি নারায়ণবর্মার অনুরোধে শুভস্থলীর নন্ন (নন্দ) নারায়ণ মন্দিরের অনুকূলে চারটি গ্রাম দান করেন। লেখে বলা না হলেও বোঝা যায়, উল্লিখিত চারটি রায়তি গ্রামকে অগ্রহারে পরিণত করতে নারায়ণশর্মাকে রাজকোষে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা দিতে হয়। এর ফলে ভূমিদানজনিত পুণ্যের এক-ষষ্ঠাংশ রাজার এবং বাকি পঞ্চ-ষষ্ঠাংশ দাতার প্রাপ্য হত। উত্তরবঙ্গে অবস্থিত এই মন্দিরে কর্মরত ব্রাহ্মণ পুরোহিতেরা পশ্চিম ভারতের লাট অঞ্চল হতে এসেছিলেন। চতুর্ভুজ-কর্তৃক ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দে রচিত হরিচরিত-কাব্যে রাজা ধর্ম পালের উল্লেখ আছে। এই ধর্মপাল এবং পাল নৃপতি ধর্মকাল এক ও অভিন্ন ব্যক্তি ছিলেন। কাব্যে বলা হয়েছে, ধর্মপাল চতুর্ভুজের এক ঊর্ধ্বতন পুরুষ সুবর্ণরেখকে বরেন্দ্রীর অন্তর্ভুক্ত করঞ্জ গ্রাম দান করেন। সুবর্ণরেখ বেদ, স্মৃতি ও পুরাণাদি শাস্ত্রে পারঙ্গম ছিলেন। দেবপালের নালন্দা তাম্র শাসনে যবদ্বীপের অধিপতি বালপুত্রদেবের অনুরোধে পালরাজের নালন্দায় নবনির্মিত এক বৌদ্ধ বিহারের অনুকূলে পাঁচটি নিষ্কর গ্রামদানের উল্লেখ আছে। অনুমিত হয়, পালরাজ পাঁচটি নিষ্কর গ্রামের বিনিময়ে বালপুত্রদেবের নিকট হতে উপযুক্ত পরিমাণ অর্থ গ্রহণ করেন। আশা ব্যক্ত হয়েছে, ওই পাঁচটি গ্রাম হতে সংগৃহীত রাজস্বে বিহারের রক্ষণাবেক্ষণ ও যাবতীয় ব্যয়ভার নির্বাহিত হবে। মুঙ্গের তাম্রশাসনে বর্ণিত আছে, দেবপাল পদ-বাক্য-প্রমাণ—বিশেষজ্ঞ ভট্ট প্রবর বীহেকরাতমিশ্রকে শ্রীনগরভুক্তির অন্তর্ভুক্ত মেষিকাগ্রাম নিষ্কর সম্পত্তিরূপে স্থায়িভাবে দান করেন। প্রথম শূরপালের তৃতীয় রাজ্যবর্ষে সম্প্রদত্ত এবং বর্তমানে লখনউ যাদুঘরে সংরক্ষিত তাম্রশাসনে বলা হয়েছে, পাল নৃপতি তাঁর শিবভক্তা জননী মাহটার অনুরোধে বারাণসীর মাহটেশ্বর শিবমন্দিরের অনুকূলে চারটি গ্রাম দান করেন। লেখে বলা হয়েছে, অঙ্গারগর্তিকা ও বাসন্তিকা গ্রামদু’টি দিয়ে দেবতার পূজা-অর্চনা ও মন্দিরের সংস্কারাদি (নবকর্ম) কার্য সাধিত হবে, আর কুলপুত্র এবং নবল্লিকা গ্রামদু’টির আয় হতে ওই মন্দিরের ভারপ্রাপ্ত পাশুপত আচার্যদের ভরণপোষণ সম্পন্ন হবে।
ভাগলপুর তাম্রশাসনে বলা হয়েছে, পরমসৌগত নারায়ণপাল উত্তর বিহারের কলসপোত গ্রামে এক সহস্ৰায়তন (সহস্ৰস্তম্ভবিশিষ্ট) শিবমন্দির নির্মাণ করে মন্দিরের অনুকূলে মুকুতিকা নামে একটি গ্রাম দান করেন। লেখে আরও বলা হয়েছে, ওই গ্রামের রাজস্ব দিয়ে পূজা, বলি, চরু, সত্রাদি অনুষ্ঠিত হবে, মন্দিরের সংস্কারকার্য সাধিত হবে এবং সংশ্লিষ্ট মন্দিরে পূজাদি কার্যে নিযুক্ত পাশুপত আচার্যদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা হবে। তৃতীয় গোপালের জাজিলপাড়া তাম্রশাসনে সামবেদী ব্রাহ্মণ শ্রীধরশর্মার অনুকূলে দু’টি গ্রামদানের উল্লেখ আছে। গ্রাম দু’টি হল কান্ঠগৃহ এবং মহারাজপল্লিকা। এই দু’টি গ্রাম আনন্দপুর অগ্রহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। অগ্রহার কথা থেকে অনুমিত হয়, পূর্বে আনন্দপুর নিষ্কর গ্রামরূপে দান করা হয়। পরে কোনও কারণে ওই দান প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। আবার এমনও হতে পারে, ওই গ্রামের অগ্রহারিক বা অগ্রহারিকদের নিকট হতে অগ্রহারের কিয়দংশ ক্রয় করে নতুন করে নিষ্কর দানের ব্যবস্থা হয়। গ্রহীতা পরিবারের আদিবাস ছিল উত্তরপ্রদেশের মুক্তাবস্তু গ্রামে। বাণগড় তাম্রশাসন থেকে জানা যায়, প্রথম মহী পাল কৃষ্ণাদিত্যশর্মা নামে জনৈক যজুর্বেদী ব্রাহ্মণকে কুরটপল্লিকা গ্রামের একাংশ স্থায়িভাবে দান করেন। গ্রহীতার পিতামহ ঋষিবেশশর্মার আদিনিবাস ছিল উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর জেলার হস্তিপদ গ্রামে। কৃষ্ণাদিত্যশর্মা মীমাংসা, ব্যাকরণ ও তর্কবিদ্যায় সুপণ্ডিত ছিলেন। তৃতীয় বিগ্রহ পালের আমগাছি তাম্রশাসনে সামবেদী ব্রাহ্মণ খোদুলদেবশর্মার অনুকূলে কোটিবর্ষবিষয়ের একটি গ্রামের ৬ কুল্য ২ দ্রোণ ৩ কাকিনী এবং ২ উন্মান পরিমাণ জমিদানের কথা বলা হয়েছে। খোদুলদেবশর্মার পিতামহ ক্রোড়ঞ্চ হতে উত্তরবঙ্গে আগমন করেন। অনেকের মতে ক্রোড়ঞ্চ প্রাচীন শ্রাবস্তী। কুল্য (কুল্যবাপ), দ্রোণ, কাকিনী এবং উন্মান (উদান, উদমান) জমির বিভিন্ন পরিমাপ। পরিমাপগুলির পারস্পরিক সম্বন্ধ নিম্নরূপ :
- ৪৫ উদমান = ১ আঢ়বাপ
- ৪ আঢ়বাপ = ১ দ্রোণ
- ৮ দ্রোণ = ১ কুল্য বা কুল্যবাপ
যে জমিতে ১ আঢ়ক বা ২৬৪ মুষ্টি পরিমাণ বীজ বপন করা যায়, সেই পরিমাণ জমিই ১ আঢ়বাপ। কাকিনী বলতে কি পরিমাণ জমি বোঝায় তা বলা দুষ্কর। মনিয়ের-উইলিয়ামস-এর মতে ১ কিউবিট বা ১ হস্ত পরিমাণ জমি ১ কাকিনীর সমতুল্য। তবে এ অভিমতের সত্যতা সংশয়ের ঊর্ধ্বে নয়। মনহলি তাম্রশাসনে বলা হয়েছে, পালরাজ মদনপাল বটেশ্বরস্বামী নামে জনৈক সামবেদী বিদ্বান ব্রাহ্মণকে কোটিবর্ষ বিষয়ের হলাবর্ত-মণ্ডলে কিছু জমি দান করেন। এই ব্রাহ্মণ পট্টমহিষী চিত্রমতিকাকে মহাভারত পড়ে শোনাতেন। উপরের বর্ণনা হতে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হচ্ছে :
- প্রথমত, এক একজন অগ্রহারিকের অনুকূলে সাধারণত পুরো একটি বা একাধিক গ্রাম দান করা হত। কোনও অগ্রহারিকের অনুকূলে গ্রামের খণ্ডিতাংশ দান করা হয়েছে, এমন ঘটনা ঘটত কালেভদ্রে।
- দ্বিতীয়ত, যে ভূসম্পদ দান করা হত তা দান করা হত সাধারণত চিরকালীন ভিত্তিতে। তৃতীয় গোপালের জাজিলপাড়া লেখে দেখা যায়, ব্রাহ্মণ শ্রীধরশর্মাকে একটি পুরোনো অগ্রহারের অংশবিশেষ দান করা হয়। এক্ষেত্রে দু’টি সম্ভাবনার কথা মনে হয়। এক, পূর্বতন দান পরবর্তিকালে প্রত্যাহৃত হয়। দুই, পূর্বতন অগ্রহারিকের নিকট হতে কিয়দংশ ক্রয় করে তা নতুন গ্রহীতার অনুকূলে পুনর্দানের ব্যবস্থা হয়। সুতরাং স্থায়িভাবে দান করা হচ্ছে, এরূপ বলা হলেও কখনও কখনও এই নিয়মের অন্যথাও ঘটত।
- তৃতীয়ত, দান গ্রহীতাদের মধ্যে স্থানীয় ও বহিরাগত, উভয় শ্রেণিরই বিদ্বান ব্রাহ্মণেরা ছিলেন। পাল লেখমালায় লাট এবং উত্তরপ্রদেশের মুক্তাবস্তু, ক্রোড়ঞ্চ এবং স্থস্তিপদ হতে আগত অগ্রহারভোগী ব্রাহ্মণদের উল্লেখ আছে।
- চতুর্থত, একই সঙ্গে বহু ব্রাহ্মণ একই বা পৃথক গ্রামের ভোগাধিকার লাভ করছেন, পাল লেখে এ ধরনের ঘটনার উল্লেখ নেই। গ্রামের উপর দানগ্রহীতাদের কী ধরনের অধিকার ছিল সমকালীন লেখমালায় তার উল্লেখ আছে। অধিকারগুলি ছিল নিম্নরূপ :
- ১. স্বসীমা-তৃণযূতি-গোচর-পর্যন্ত : গ্রামসীমান্তে অবস্থিত তৃণ ও গোচারণভূমি পর্যন্ত। অর্থাৎ এই নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে গ্রহীতার অধিকার বর্তমান থাকবে। ‘‘যূতি’ কথাটি’র অর্থ স্পষ্ট নয়। সংরক্ষিত তৃণভূমি, এই অর্থে তৃণযূতি হতে পারে। লেখে গোযূতি পদেরও ব্যবহার আছে। বোঝা যায়, বেষ্টনী অর্থেও ‘যূতি’ শব্দের প্রয়োগ আছে।
- ২. সতল : দীনেশচন্দ্র সরকার তল কথাটিকে ভূপৃষ্ঠ অর্থে গ্রহণ করেছেন। (Indian Epigraphical Glossary (Delhi, 1966), পৃষ্ঠা 808।) কিন্তু আন্তর দেশ বা ভূগর্ভ বলতেও তল কথাটি ব্যবহৃত হয়। পাল লেখে তল কথাটি সম্ভবত এই অর্থেই প্রযুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ এখানে ভূগর্ভস্থ খনিজ ও অন্যান্য সম্পদের উপর গ্রহীতার অধিকারের কথাই বলা হয়েছে। সতল কথাটিকে সেক্ষেত্রে অপরাপর লেখে উল্লিখিত স-নিধি-নিক্ষেপ বা স-নিধি-উপনিধি কথারই সমার্থকরূপে গ্রহণ করতে হবে।
- ৩. স-উদ্দেশ : জমির উপরের অংশ। শুধু জমির তলদেশ নয়, জমির তল ও উপর, উভয় অংশের উপরই গ্রহীতার অধিকার বর্তাত।
- ৪. স-উপরিকর (সপরিকর) : অন্যের জমিতে কাজ করেন এমন চাষিদের দেয় রাজস্বই উপরিকর। আবার অনেকের মতে কৃষকদের উপর মাঝে মাঝে ধার্য বাড়তি রাজস্বই উপরিকর। দানগ্রহীতার এ ধরনের রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা ছিল।
- ৫. স-আম্র-মধুক : গ্রামের আম ও মহুয়া গাছের উপর গ্রহীতার অধিকার ছিল। অনুমিত হয়, এ অধিকার ছিল আংশিক।
- ৬. স-জল-স্থল : এ অধিকার জলাভূমি ও স্থলভূমির উপর অধিকার।
- ৭. স-গর্ত-ঊষর : গ্রামের খাদ ও অনুর্বর বা নোনা জমির উপর গ্রহীতার অধিকার ছিল।
- ৮. স-দশ-উপচার (স-দশ-অপরাধ, স-দশ-অপচার) : নির্দিষ্ট দশটি অপরাধে দোষী ব্যক্তিদের দণ্ডদান এবং তাদের নিকট হতে জরিমানা আদায়ের অধিকার। বৌদ্ধদের মতে অপরাধগুলি হল নরহত্যা, চুরি, ব্যভিচার, মিথ্যা কথা বলা, মিথ্যা অপবাদ রটনা, অসম্মান করা, বাজে বকা, ঘৃণা, লোভ এবং শাস্ত্রের অপব্যাখ্যা করা। ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রানুসারে অপরাধগুলি হল চুরি, নারীহত্যা, ব্যভিচার, অশালীনতা, আদেশ অমান্য করা, অসবর্ণ বিবাহ, গর্ভে অবৈধ সন্তান ধারণ, অশ্লীলতা, আঘাত করা ও ভ্রূণ-হত্যা।
- ৯. স-চৌরোদ্ধরণ : চোরের নিকট হতে অপহৃত দ্রব্য উদ্ধার বা চোরকে দণ্ডদানের অধিকার। ১০. পরিহৃত-সর্বপীড়া : সর্বপ্রকার বাধা-বিপত্তি হতে মুক্তি।
- ১১. আ-চাট-ভট-প্রবেশ : পাইক-পিয়াদা প্রভৃতিদের অগ্রহার গ্রামে প্রবেশ নিষিদ্ধকরণ। এর ফলে এঁদের হাতে অগ্রহারিককে উৎপীড়িত হতে হত না।
- ১২. আ-কিঞ্চিৎ-প্রগ্রাহ্য : রাজপুরুষেরা পরিদর্শনে বের হলে গ্রামবাসীরা তাঁদের বিশেষ কর ও উপঢৌকন প্রদান করতেন। অগ্রহারিককে এই দায়িত্ব হতে অব্যাহতি দেওয়া হত।
- ১৩. সমস্ত-ভাগ-ভোগ-কর-হিরণ্যাদি-প্রত্যায়-সমেত : প্রত্যায় শব্দের অর্থ আয়, রাজস্ব। পুরো কথাটির অর্থ সকল প্রকার ভাগ, ভোগ, কর, হিরণ্যাদি রাজস্বভোগের অধিকার।
- ১৪. ভূমিচ্ছিদ্র-ন্যায় : কৃষির অযোগ্য জমি, এই অর্থে ভূমিচ্ছিদ্র। অকর্ষিত জমি যিনি প্রথম কর্ষণ করেন প্রাচীন রীতি অনুসারে তিনি সেই জমির স্বত্ব লাভ করেন। বস্তুত গ্রহীতার অধিকার প্রসঙ্গে ভূমিচ্ছিদ্র-ন্যায় কথাটির উল্লেখে প্রদত্ত গ্রামের উপর গ্রহীতার চিরকালীন ভোগস্বত্বই প্রমাণিত হচ্ছে। (ক্ষেত্রস্বামীদের বাস আছে এমন অগ্রহার গ্রাম সম্পর্কে ভোগস্বত্ব কথাটি প্রযোজ্য কিন্তু ক্ষেত্রস্বামী বিহীন গ্রামের ক্ষেত্রে গ্রহীতার অনুকূলে ভূমিস্বত্ব বা মালিকানা কথাটি প্রযুক্ত হবে।)
- ১৫. আ-চন্দ্র-অর্ক-ক্ষিতি-সমকালম্ : গ্রাম বা জমির উপর গ্রহীতার ভোগস্বত্ব হবে চিরস্থায়ী। যতদিন চন্দ্র, সূর্য এবং পৃথিবী বর্তমান থাকবে ততদিন গ্রহীতার ভোগাধিকার অক্ষুণ্ণ থাকবে।
শিল্প :
- বস্ত্রশিল্প ছিল সে যুগের এক প্রধান শিল্প। বাংলার বস্ত্রশিল্পের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন আরব পর্যটক সুলেমান (৮৫১ খ্রিস্টাব্দ), আল মাসুদি (৯১৫ খ্রিস্টাব্দ), ইবন খুরদাদ্ধ (৯১২ খ্রিস্টাব্দ), আল ইদ্রিসি (১১৬২ খ্রিস্টাব্দ) প্রভৃতি সমকালীন বিদেশি ব্যক্তিবর্গ। বাংলায় এমন এক ধরনের কাপড় তৈরি হত যার পুরোটা একটি আংটির ভিতর দিয়ে অনায়াসে গলিয়ে দেওয়া যেত।
- লৌহশিল্পও উন্নত ছিল। লোহা দিয়ে গৃহস্থালির জিনিসপত্র, কৃষির যন্ত্রপাতি ও যুদ্ধের অস্ত্র শস্ত্র তৈরি হত। আরব লেখকরা পালরাজ্যে তৈরি তরোয়ালের প্রশংসা করেছেন। ভোজের যুক্তিকল্পতরুতে মগধ ও অঙ্গের উৎকৃষ্ট তরোয়ালের উল্লেখ আছে।
- তাম্ৰশাসনগুলি সেযুগে তামার ব্যাপক প্রচলনের স্বাক্ষর বহন করছে।
- ব্রোঞ্জ ব্যবহারে অগ্রগতির স্বাক্ষর বহন করছে সে পর্বের ধাতব মূর্তিগুলি।
- বাঁশ, বেত ও কাঠের কাজে বহু লোকের জীবিকা নির্বাহ হত।
- বৈদ্যদেবের কমৌলি লেখে কুম্ভকারের কথা বলা হয়েছে। থালা, বাটি, জলপাত্র, রন্ধনপাত্র, দোয়াত, প্রদীপ ইত্যাদি পোড়ামাটির নানা জিনিস পাহাড়পুর, রামপাল, ময়নামতী প্রভৃতিস্থানে আবিষ্কৃত হয়েছে। মহাস্থান, সাভার ইত্যাদি স্থানে অসংখ্য পোড়ামাটির ফলকের সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব নিদর্শন বিস্তৃত মৃৎশিল্পের পরিচয় বহন করছে।
- পাল লেখমালায় ‘নৌবাট’, ‘নৌবিতান’ প্রভৃতি শব্দের উল্লেখ আছে। বৈদ্যদেবের কমৌলি লেখে নৌযুদ্ধের বর্ণনাও আছে। জলপথে যাতায়াত, পণ্যাদির জলপথে পরিবহন ও সামরিক গুরুত্বের কারণে নৌযানের এক বিরাট চাহিদা ছিল। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নৌশিল্পের এক বড় রকমের ভূমিকা ছিল।
- লবণও অন্যতম বাণিজ্যিক সম্ভার ছিল। লেখ মালায় ভূমিদানের সময় বার বার ‘সলবণ’ কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে। বোঝা যায়, লবণের ব্যবসা খুবই লাভজনক ছিল।
বাণিজ্য-পথ :
- বৈদেশিক পর্যটকদের বৃত্তান্ত, লেখমালার সাক্ষ্য এবং গ্রন্থাদি থেকে সে যুগের বাণিজ্যিক পথ সম্পর্কে কিছু ধারণা করা যায়। খ্রিস্টীয় ৭ম শতকের প্রথম ভাগে চিনা পরিব্রাজক শুয়েন চাঙ বাংলা-বিহার সীমান্তে অবস্থিত কজঙ্গল থেকে প্রথমে উত্তর বাংলার পুণ্ড্রবর্ধনে আগমন করেন। সেখান থেকে আবার যাত্রা শুরু করে যথাক্রমে কামরূপ, সমতট, তাম্রলিপ্তি ও কর্ণসুবর্ণের (মুর্শিদাবাদ জেলার রাজবাড়িডাঙা) ভিতর দিয়ে অগ্রসর হয়ে শেষে ওড্র রাজ্যে গিয়ে উপস্থিত হন। বলাবাহুল্য, এসব পথ শুয়েন চাঙ আবিষ্কার করেননি। তাঁর বহু পূর্ব থেকে এবং তাঁর পরেও এই পথগুলি ক্রমাগত ব্যবহৃত হচ্ছিল। বর্তমান যুগের বহু রেলপথই সেই প্রাচীন পথগুলির নিশানা ধরেই নির্মিত হয়েছে।
- ৭ম শতকের দ্বিতীয়ার্ধেই চিঙ তাম্রলিপ্তি থেকে বোধগয়া অভিমুখী একটি পথের ইঙ্গিত দিয়েছেন।
- খ্রিস্টীয় ৮ম শতকের দুধপানি শিলা লেখে অযোধ্যা থেকে তাম্রলিপ্তি পর্যন্ত এক সুদীর্ঘ পথের উল্লেখ আছে।
- একটি পথ কান্যকুব্জ থেকে অযোধ্যা, বারাণসী, পাটনা ও মুঙ্গের হয়ে গঙ্গাসাগর অবধি বিস্তৃত ছিল।
- চিনা পরিব্রাজক কিয়া তান (৭৮৫-৮০৫ খ্রিস্টাব্দ) চিনের টঙ্কিন শহর থেকে কামরূপ, কজঙ্গল হয়ে মগধ পর্যন্ত বিস্তৃত এক পথের সন্ধান দিয়েছেন।
- সোমদেবের কথাসরিৎসাগরে পুণ্ড্রবর্ধন থেকে রাজমহল পাহাড় ঘেঁষে পাটলিপুত্র পর্যন্ত বিস্তৃত এক পথের উল্লেখ আছে।
ব্যবসা-বাণিজ্য : পালযুগে ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি হ্রাস পায় বলে অনেক ঐতিহাসিক অভিমত প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলেন, পাল রাজাদের নামাঙ্কিত কোনও স্বর্ণ বা রৌপ্য মুদ্রা এখনও আবিষ্কৃত হয়নি ; অতি যৎসামান্যই ব্যবসা-বাণিজ্য চলত, আর তা পরিচালনা করতেন আরব বণিক সম্প্রদায়। কিন্তু এ কথা ভুললে চলবে না, পাল ও সমকালীন লেখমালায় শৌল্কিক (শুল্ক বিভাগের কর্মচারী), তরপতি (খেয়াঘাট পরিদর্শক), তরিক (খেয়াকর সংগ্রহকারী), হট্টপতি (হাট পরিচালক) প্রভৃতি শুল্ক বিভাগের বিভিন্ন রাজপুরুষেরা বার বার উল্লিখিত হয়েছেন। এ সময় ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন এসে বাংলায় ও বিহারে বসতি স্থাপন করেছিলেন। রাজ্যে নতুন নতুন শহর গড়ে উঠছিল। ব্যয় বহুল বিহার ও হর্মাদির নির্মাণ চলছিল। এসব কিন্তু বাণিজ্যিক সমৃদ্ধিরই পরিচয় দেয়। পাল পর্বের এই বাণিজ্যিক সমৃদ্ধি আভাসিত হয়েছে রাম চরিত ও সদুক্তিকর্ণামৃতের বৈভবময় নগরজীবনের চিত্রায়ণে, লেখাবলির ঐশ্বর্যময় যাগযজ্ঞ ও পূজানুষ্ঠানের সাক্ষ্যে, মণিমুক্তাখচিত বৈচিত্র্যময় সোনারূপার অলংকারের কাব্যিক বর্ণনায় এবং এ যুগের অসংখ্য ধাতবমূর্তির নয়নমুগ্ধকর অঙ্গসজ্জায়।
মুদ্রা ও কড়ি : এ কথা সত্য, পাল রাজারা কোনও মুদ্রা উৎকীর্ণ করেননি। (কুমিল্লা জেলার ময়নামতীতে উৎখননের ফলে হালকা ওজনের প্রচুর সংখ্যক রৌপ্যমুদ্রার সন্ধান পাওয়া গেছে। এই মুদ্রাগুলির কোনও কোনওটিতে ‘হরিকেল’ এবং কয়েকটিতে ‘পট্টিকের’ বা ‘পটিকের্য’ স্থাননাম’ লিখিত আছে। মুদ্রাগুলি কুমিল্লা অঞ্চলের স্থানীয় রাজারা উৎকীর্ণ করেছিলেন, পাল রাজারা নন।) তার অর্থ এই নয়, পালরাজ্যে মুদ্রার প্রচলন ছিল না। সে সময় জিনিসপত্রের লেনদেনের কাজে পুরাতন আমলের মুদ্রা ব্যবহৃত হত। তাছাড়া ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে সমকালীন প্রচারিত মুদ্রাও এ অঞ্চলের বাজারে প্রচলিত ছিল। পাল লেখমালা এরূপ তথ্যই পরিবেশন করছে। পাল লেখাবলিতে রূপক, দ্রম্ম, পুরাণ, ধরণ, কার্যাপণ প্রভৃতি মুদ্রানাম উল্লিখিত আছে। এগুলি বিভিন্ন শ্রেণির রৌপ্যমুদ্রা। (দীনেশচন্দ্র সরকার মনে করেন, ২০ রতি ওজনের একই শ্রেণির রৌপ্যমুদ্রা বিভিন্ন নামে পাল লেখে উল্লিখিত হয়েছে।) পালরাজ্যে মুদ্রার প্রচলন থাকলেও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কড়ির বহুল ব্যবহার ছিল। জিনিসপত্রের ক্রয়-বিক্রয়ে হিসাবের মান ছিল কপর্দক-পুরাণ। তাম্রশাসনে কপর্দক-পুরাণের উল্লেখ সুপ্রচুর। কপর্দক কথার অর্থ কড়ি। কপর্দক-পুরাণের অর্থ ১ পুরাণ রৌপ্যমুদ্রা পরিমাণ কড়ি। প্রশ্ন হচ্ছে, কটি কড়িতে ১ পুরাণ? এখানে দু’টি উত্তর সম্ভব। গণিতসার অনুসারে, ৮০টি কড়িতে ১ পুরাণ। কিন্তু অন্য মতে, ১২৮০টি কড়ি ১ পুরাণ মুদ্রার সমতুল্য এবং ২০,৪৮০টি কড়ি ১ সুবর্ণ মুদ্রার সমমূল্য। এই কড়ি বাংলা-বিহারে পাওয়া যেত না, আমদানি হত সুদূর মালদ্বীপ থেকে। উত্তরকালীন চৈনিক সূত্রে প্রকাশ, বাংলা-বিহারে কড়ি সংগৃহীত হত মালদ্বীপ থেকে আর তার পরিবর্তে এ অঞ্চল থেকে মালদ্বীপে চাল রপ্তানি হত। পালরাজ্যে কড়ির সুপ্রচলন বহির্বাণিজ্যের সপক্ষে সাক্ষ্য দেয়।
বহির্বাণিজ্য :
- দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে পালরাজ্যের বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত ছিল। দেবপালের নালন্দা লেখে যবদ্বীপ, সুমাত্রা ও মালয়েশিয়ার শৈলেন্দ্রবংশীয় নৃপতি বালপুত্রদেবের এক প্রতিনিধি দলের নালন্দায় উপস্থিতির স্পষ্ট উল্লেখ আছে। বালপুত্রদেব দেবপালের অনুমোদন ক্রমে নালন্দায় এক বৌদ্ধবিহার নির্মাণ করেন এবং পালরাজ বিহারটির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পাঁচ পাঁচটি গ্রাম দান করেন। পাল ও বহির্ভারতীয় শৈলেন্দ্র রাজ্যটির মধ্যে এই সাংস্কৃতিক যোগাযোগ উভয় অঞ্চলের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক যোগসূত্রের ইঙ্গিত করে।
- তাম্রলিপ্তি বন্দরটি তখনও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েনি। খ্রিস্টীয় ৮ম শতকের দুধপাণি শিলালেখে তিন বণিকের তাম্রলিপ্তি বন্দরে উপস্থিতির উল্লেখ আছে। কথাসরিৎসাগরে বলা হয়েছে, তাম্রলিপ্তি থেকে বাণিজ্যপোত গুলি লঙ্কা, সুবর্ণদ্বীপ, কটাহ প্রভৃতি অঞ্চলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করত। ১২শ শতকের কোষকার হেমেন্দ্রের অভিধানচিন্তামণিতেও এই বন্দরের উল্লেখ আছে। সম্ভবত তাম্রলিপ্তি বন্দর দিয়েই বাণিজ্যিক পণ্যাদি বিদেশে রপ্তানি হত।
- এ সময় চট্টগ্রাম অঞ্চলে একটি নতুন বন্দরের অভ্যুদয় ঘটে। বন্দরটির নাম সমন্দর বা সুদকাওয়ান। কালক্রমে এই নতুন বন্দরটি তাম্রলিপ্তির স্থান অধিকার করে।
- হয়তো অসম, মণিপুর ও উত্তর মায়ানমারের ভিতর দিয়ে স্থলপথেও বাণিজ্য চলত।
ধর্মীয় জীবন
বৌদ্ধধর্ম
পাল রাজারা প্রায় সকলেই বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ছিলেন। তাঁদের সিল মোহরে সাধারণত ধর্মচক্র অঙ্কিত আছে। এই ধর্মচক্র ভগবান বুদ্ধদেবের সারনাথে সর্বপ্রথম ধর্মপ্রচারের প্রতীক। তাঁদের লেখমালার প্রারম্ভিক বন্দনা শ্লোকটিও ভগবান বুদ্ধদেবের উদ্দেশ্যে নিবেদিত। তাঁরা প্রায়ই পরমসৌগত বলে নিজেদের পরিচয় দিয়েছেন। সুগত বা বুদ্ধদেবের পরমভক্ত, এই অর্থে পরমসৌগত। বাংলা ও বিহারের নানা স্থানে নতুন নতুন বিহার নির্মাণ ও পুরোনো বিহারের সংস্কার সাধন করে তাঁরা বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি তাঁদের অকুণ্ঠ অনুরাগ প্রকাশ করে গেছেন। ধর্মপাল ভাগলপুরের নিকট গঙ্গাতীরবর্তী আন্টিচকে বিক্রমশীল বিহার নির্মাণ করেন। রাজশাহী জেলার পাহাড়পুরে সোমপুর বিহারেরও তিনি নির্মাতা। বিহারশরীফের ওদন্তপুরী বিহার নির্মাণও পাল রাজাদের কীর্তি। এই পর্বে ত্রৈকূটক বিহার, দেবীকোট বিহার, পণ্ডিত বিহার, ফুল্লহরি বিহার, জগদ্দল মহাবিহার ইত্যাদি আরও কয়েকটি বিহার নির্মিত হয়। নালন্দার ভুবনবিখ্যাত নালন্দা মহাবিহারের উন্নতিকল্পে তাঁরা সচেষ্ট ছিলেন। তাঁদের বদান্যতায় এখানকার পুরোনো বিহার ও স্তূপগুলির সংস্কার হয়, নতুন নতুন বিহার ও স্তূপ নির্মিত হয়। বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষকরূপে তাঁদের খ্যাতি দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শৈলেন্দ্ররাজ বালপুত্রদেব নালন্দায় একটি বিহার নির্মাণের অনুমতি ও তার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পাঁচটি গ্রাম প্রার্থনা করে দেবপালের নিকট দূত পাঠান। পালরাজ তাঁর অনুরোধ রক্ষা করেন। দূরবর্তী দু’টি সার্বভৌম রাষ্ট্রের মধ্যে মৈত্রীর বন্ধন দৃঢ় করে আন্তর্জাতিক বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে এক মহান আদর্শ স্থাপন করেন দেবপাল।
স্বধর্মে অনুরাগ এক জিনিস আর ধর্মান্ধতা অন্য জিনিস। পাল রাজাদের অনুরাগ ছিল কিন্তু ধর্মবিষয়ক গোঁড়ামি ছিল না। তাই বৌদ্ধ হয়েও অন্য ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁদের উৎসাহ কিছুমাত্র কম ছিল না। বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার প্রতি তাঁরা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। ব্রাহ্মণ্য দেবদেবী এবং ব্রাহ্মণদের ভূমিদানে তাঁরা আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ভগবান নন্ন (নন্দ) নারায়ণ বা বিষ্ণুর উদ্দেশে ধর্মপালের চারটি গ্রামদানের কথা খালিমপুর লেখে বলা হয়েছে। অনুরূপ চারটি গ্রাম দেবতা শিবের উদ্দেশে দান করেন তাঁর পৌত্র প্রথম শূরপাল। প্রথম মহীপাল ধর্মে বৌদ্ধ ছিলেন কিন্তু শৈবধর্মের প্রতিও তাঁর গভীর অনুরাগ ছিল। বারাণসীর কঠোরপন্থী পাশুপত আচার্য বামরাশির ভক্ত ছিলেন তিনি। সে যুগের আর এক প্রখ্যাত শৈবাচার্য ইন্দ্রশিব। এই শৈবাচার্যের অনুকূলে মহীপাল এক সুবিশাল মঠ বা মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। পালদের লেখাবলিতে অনেক ব্রাহ্মণ্য দেবদেবী ও পৌরাণিক কাহিনির বর্ণনা আছে। তুলনায় বৌদ্ধ দেবদেবী ও কাহিনির উল্লেখ অনেক কম। রাজপ্রাসাদে মহাভারত পাঠের ব্যবস্থা ছিল। মদনপালের মহিষী চিত্রমতিকাকে মহা ভারত পাঠ করে শোনাতেন ব্রাহ্মণ বটেশ্বরস্বামী।
কোনও কোনও পাল রাজা তো ব্রাহ্মণ্যধর্মই গ্রহণ করেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন নারায়ণপাল, এবং তাঁর অতিকনিষ্ঠ প্রপৌত্র নয়পাল। এঁরা সকলেই বৌদ্ধধর্ম ত্যাগ করে শৈবধর্ম অবলম্বন করেন। প্রথম মহীপালের পুত্র নয়পাল ছিলেন বাণগড়ের গোলগী বা গোলকী শৈব মঠের দুর্বাসা সম্প্রদায়ের আচার্য সর্বশিবের শিষ্য। (দীনেশচন্দ্র সরকার (শিলালেখ-তাম্রশাসনাদির প্রসঙ্গ (কলকাতা, ২০০৯), পৃষ্ঠা ১০৭-০৮) অভিমত প্রকাশ করেছেন, প্রথম মহীপাল শেষজীবনে বৌদ্ধধর্মে বীতস্পৃহ হয়ে শৈব-শাক্ত ধর্মে অনুরক্ত হন। কিন্তু প্রথম মহীপালের রাজত্বকালের শেষপর্বে উৎকীর্ণ লেখেও তাঁর বৌদ্ধধর্মানুরাগের পরিচয় আছে। অনুমিত হয়, বৌদ্ধ ও শৈবধর্মের প্রতি অনুরাগের দু’টি স্বতন্ত্র ধারা এই পাল রাজার অন্তরে সমান্তরাল ভাবে প্রবহমান ছিল।) রাজমহিষীদের ধর্ম অনেক সময় তাঁদের স্বামীর ধর্ম থেকে পৃথক ছিল। দেবপাল বৌদ্ধ ছিলেন কিন্তু তাঁর মহিষী মাহটা ছিলেন শিবভক্তা।
আসলে পালযুগে ধর্মীয় ক্ষেত্রে সমন্বয়ের সুর বেজে ওঠে। উভয়ের মধ্যে ব্যবধান সংকুচিত হয়ে ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধধর্ম পরস্পরের সন্নিকটবর্তী হয়। ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বীদের মতো বৌদ্ধদের অনেকেই মূর্তিপূজা, মন্ত্রপাঠ, আচার-অনুষ্ঠানে উৎসাহী হন। আবার তন্ত্রের প্রভাবে ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ, উভয়ধর্মে দেহবাদ বা কায়সাধন বা নর-নারী বা পুরুষ-প্রকৃতির অতীন্দ্রিয় মিলন পরম জ্ঞানলাভের প্রকৃষ্ট উপায়রূপে গণ্য হয়। শক্তি বা প্রকৃতির সাধনা উভয় ধর্মেই প্রাধান্য পায়। বিষ্ণুর যেমন লক্ষ্মী এবং শিবের মহামায়া, আদি বুদ্ধ বজ্রসত্ত্বের তেমনি প্রজ্ঞা পারমিতা এবং ধ্যানী বুদ্ধ অমিতাভের মামকা।
প্রাক্ পালপর্বে বাংলা-বিহারে মহাযান বৌদ্ধধর্ম প্রচলিত ছিল। আর তা ছিল একান্তই শূন্যবাদ, বিজ্ঞানবাদ, যোগাচার, মধ্যমিকবাদ প্রভৃতি কূট তত্ত্বজালে আকীর্ণ। কিন্তু পালযুগে এসব তাত্ত্বিক ধ্যান-ধারণা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। তত্ত্বগুলি পুরোপুরি বিদায় নিল না ঠিকই কিন্তু তা স্বল্পসংখ্যক পণ্ডিত-সাধকদের চর্চা ও সাধনার মধ্যেই আবদ্ধ থাকল। পরিবর্তে মহাযান বৌদ্ধধর্মে নতুন ধ্যান কল্পনা গড়ে উঠল। এর কারণও ছিল। মহাযানবাদের পুরোনো পরমার্থিক তত্ত্ব ও সাধনমার্গ সাধারণ লোকদের নিকট দুর্বোধ্য ছিল। স্বাভাবিক কারণে সমাজে এসব তত্ত্ব ও সাধনপন্থার আকর্ষণ উত্তরোত্তর হ্রাস পাচ্ছিল। উপরন্তু বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের এক বিরাট অংশ ছিল আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত। আদিবাসীরা তাঁদের নিজস্ব ধর্মবিশ্বাস, যাদুশক্তি সম্পর্কিত ধ্যান-ধারণা, আচার বিচার নিয়েই বৌদ্ধধর্মে অনুপ্রবিষ্ট হন। তাছাড়া হর্ষোত্তর পর্ব থেকে তিব্বত, নেপাল, ভুটান ইত্যাদি পার্বত্য অঞ্চলগুলির সঙ্গে পূর্ব ভারতের সাংস্কৃতিক সম্পর্ক নিবিড়তর, ঘনিষ্ঠতর হতে থাকে। এসব পার্বত্য অঞ্চলের আদিম সংস্কার ও সংস্কৃতির স্রোত বাংলা-বিহারে প্রবাহিত হতে থাকে। এসব বহুমুখী ও বিচিত্রধর্মী ধর্মবিশ্বাস, ধ্যান-ধারণার সংস্পর্শে আসায় মহাযান বৌদ্ধধর্মে এক বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটে যায়। মহাযানের এই বিরাট রূপান্তর-যজ্ঞে হোতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন তান্ত্রিক ভাবনায় সমৃদ্ধ কতিপয় বৌদ্ধাচার্য এবং যোগসাধনায় সিদ্ধ একদল সিদ্ধাচার্য।
তান্ত্রিক ধ্যান-ধারণায় উদ্বুদ্ধ এই শ্রেণির বৌদ্ধ আচার্যদের মধ্যে চন্দ্ৰগোমী, শান্তিদেব, শান্তিরক্ষিত, মহাজেতারি, কনিষ্ঠ জেতারি এবং দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। (অনেকের মতে শান্তিদেব ও শান্তিরক্ষিত এক ও অভিন্ন ব্যক্তি ছিলেন। আবার শান্তিদেব নামে একাধিক ব্যক্তি ছিলেন, এরূপ মতও আছে। শেষোক্ত মতে, বজ্রযানী শান্তিদেব এবং মহাযানী শান্তিদেব দু’জন স্বতন্ত্র ব্যক্তি।) তিব্বতি পরম্পরায় চন্দ্রগোমীকে বারেন্দ্র ক্ষত্রিয় বলা হয়েছে। শান্তিদেব সম্ভবত জন্মসূত্রে বাঙালি ছিলেন। মহাজেতারির জন্ম বরেন্দ্রে। কনিষ্ঠ জেতারি ও দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানও বাংলায় জন্মগ্রহণ করেন। দীপঙ্কর বিক্রমশীল এবং ওদন্তপুরী বিহারের অধ্যাপক ছিলেন। সমকালীন বৌদ্ধসূত্রে ৮৪ জন সিদ্ধাচার্যের কথা বলা হয়েছে। তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব এবং তাঁদের আবির্ভাবকাল খ্রিস্টীয় ৯ম থেকে ১২শ শতক। সিদ্ধাচার্যদের অনেকে গ্রন্থাদিও রচনা করেছেন। সেসব মূল গ্রন্থ এখন বিলুপ্ত কিন্তু তাদের তিব্বতি সংস্করণ আজও বিদ্যমান। তাঁদের রচিত কিছু দোঁহা ও চর্যাপদও আবিষ্কৃত হয়েছে। সিদ্ধাচার্যদের মধ্যে লুইপাদ, সরহপাদ বা সরহবজ্র, নাড়োপাদ (নারোপাদ), নাগার্জুন, তিল্লোপাদ বা তৈলিকপাদ, শবরপাদ বা শবরীপাদ, অদ্বয়বজ্র, কৃষ্ণ বা কৃষ্ণপাদ বা কাহ্নপা, ভুসুকু ও কুকুরিপাদের নাম বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে।
- অনেকের মতে লুইপাদ এবং নাথ সাধনার প্রবর্তক মৎস্যেন্দ্রনাথ এক ও অভিন্ন ব্যক্তি ছিলেন। মৎস্যেন্দ্রনাথের জন্ম পূর্ব বাংলার চন্দ্রদ্বীপে।
- সরহের বাড়ি ছিল পূর্ব ভারতের রাজ্ঞী শহরে। রত্নপালের সমসাময়িক এই বৌদ্ধাচার্য নালন্দা মহাবিহারের আচার্য পদে বৃত ছিলেন।
- সরহপাদেরই শিষ্য নাগার্জুন।
- সরহের অপর এক শিষ্য শবরীপাদ। তাঁর বাড়ি ছিল পাবর্ত্য বঙ্গালে বা মগধে। পূর্বাশ্রমে তিনি ছিলেন একজন নিষাদ।
- তিল্লোপাদ ছিলেন প্রথম মহীপালের সমকালবর্তী। তাঁর বাড়ি চট্টগ্রামে, জন্ম এক ব্রাহ্মণ বংশে। পণ্ডিত বিহারের আচার্য ছিলেন তিনি।
- নাড়োপাদ ছিলেন নয়পালের সমকালীন। বরেন্দ্রীতে তাঁর জন্ম। তিনি প্রথমে ফুল্লহরি বিহারের ও পরবর্তিকালে বিক্রমশীল বিহারের আচার্য ছিলেন।
এই সব বৌদ্ধাচার্য ও সিদ্ধাচার্যরা সাধনায় চিরাচরিত পূজা-আচারাদি অস্বীকার করে গূঢ়াত্মক মন্ত্র, যন্ত্র, ধারণী, বীজ, মণ্ডল প্রভৃতি ধ্যান-ধারণা প্রবর্তন করেন এবং গুহ্য যোগের মাহাত্ম্য প্রচার করেন। তাঁরা উপলব্ধি করেন, প্রকৃতিস্বরূপা সাধনসঙ্গিনীর সঙ্গে অতীন্দ্রিয় যোগসাধনে পুরুষরূপ সাধক পরমানন্দময় মহাসুখসাগরে অবগাহন করে পরমজ্ঞান লাভে ধন্য হন এবং দেহানুভূতি, সংসারজ্ঞান ও আত্মপরভেদ বিস্মৃত হয়ে সর্বজ্ঞান ও সর্বশক্তির অধিকারী হন। গুহ্য সাধনা প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মহাযানধারা তার পুরোনো খাদ ছেড়ে তিনটি নতুন স্রোতে প্রবাহিত হতে থাকে। স্রোত তিনটি হল বজ্রযান, সহজযান এবং কালচক্র্যান। তিনটি যানেই গূঢ়াত্মক যোগের ভূমিকাই মুখ্য।
- বজ্রযান : বজ্রযানের মূল উদ্দেশ্য বোধিজ্ঞান লাভ। বোধিচিত্ত বজ্রের মতো দৃঢ় ও কঠিন হলে তবেই এই বোধিজ্ঞান জন্মায়। মৈথুনযোগে চিত্তের যে পরমানন্দময় ভাব, তাই এই বোধিচিত্ত। এই বোধিচিত্ত তখনই ক্রিয়াশীল হয়, যখন সাধকের শূন্যতার পরম জ্ঞান জন্মায়, সাধকের উপলব্ধি হয় দুঃখ, কর্ম, কর্মফল, সংসার সবই শূন্যময়। সাধক তখন দেবীস্বরূপিনী নিরাত্মায় বিলীন হন। শূন্যতার পরম জ্ঞানই নিরাত্মা। সাধনসঙ্গিনী নিরাত্মারই প্রতীক। নিরাত্মায় বিলীন অবস্থায় গুরু-প্রদত্ত গুহ্য মন্ত্রের মাহাত্ম্যে জিতেন্দ্রিয় সাধকের ধ্যানদৃষ্টিতে স্ব স্ব মণ্ডলে অধিষ্ঠিত বিভিন্ন দেব দেবীর মূর্তি প্রতিভাত হয়। এই মণ্ডলগুলির একাগ্র ধ্যানে বোধিচিত্ত স্থায়ী ও নিশ্চল হয়ে বজ্রের কাঠিন্য লাভ করে। ক্রমে সাধকের অন্তর্লোক বোধিজ্ঞানের নির্মল আলোকে উদ্ভাসিত হয়। সাধক মহাসুখসাগরে নিমগ্ন হন। বোধিচিত্তের এই বজ্রভাব আশ্রয় করে সাধনার যে পথ, তাই বজ্রযান। বজ্রযানের এই সাধনপদ্ধতি অতি গুহ্য। শাস্ত্রে যে ভাষায় ও শব্দে এই পদ্ধতি ব্যাখ্যাত হয়েছে তাও গূঢ়াত্মক। একমাত্র গুরুই পারেন এই রহস্য উন্মোচন করতে। বজ্রযান সাধনা গুরুমুখী সাধনা।
- সহজযান : বজ্রযানের সূক্ষ্মতর স্তর সহজযান। মন্ত্র-মুদ্রা, পূজা-অনুষ্ঠান, দেবদেবীতে বজ্রযানের সাধন মার্গ আকীর্ণ। কিন্তু সহজযানে দেবদেবীর স্বীকৃতি নেই, স্বীকৃতি নেই মন্ত্র-মুদ্রার, পূজা-অনুষ্ঠানের। এই যানে প্রচারিত হয়েছে দেহবাদ, কায়সাধনের বৈভব। সহজযান মতে, শূন্যতা হল প্রকৃতি, করুণা হল পুরুষ। শূন্যতা ও করুণা অর্থাৎ প্রকৃতি ও পুরুষের মিলনে অর্থাৎ নারী ও নরের মৈথুন অবস্থায় বোধিচিত্তের যে পরমানন্দময় অবস্থার সৃষ্টি হয় তাই মহাসুখ। এই মহাসুখই শাশ্বত সত্য। এই সত্যের উপলব্ধি ঘটলে ইন্দ্রিয়শক্তির বিলোপ ঘটে, সংসার জ্ঞান তিরোহিত হয়, আত্মপরভেদ বিলুপ্ত হয় এবং সংস্কার বিনষ্ট হয়। এটিই সহজ অবস্থা।
- কালচক্রযান : বিবর্তিত মহাযানের তৃতীয় স্রোত কালচক্রযান। কালচক্র অবিরাম বৃত্তাকারে আবর্তিত হচ্ছে। ভূত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সবই এই কালচক্রে বিধৃত। এই কালচক্র সর্বদর্শী, সর্বজ্ঞ। আদি বুদ্ধ ও সকল বুদ্ধের জন্মদাতা এই কালচক্র। কালচক্র প্রজ্ঞার সঙ্গে মিলিত হয়ে এই জন্মদান কার্যটি নিষ্পন্ন করেন। কালচক্রযানীদের উদ্দেশ্য হচ্ছে, কালচক্রের এই বিরামহীন আবর্তনকে নিরস্ত করা। এ কাজটি সাধিত হলে নিজেকে সেই কালপ্রভাবের ঊর্ধ্বে উন্নীত করা যায়। কিন্তু কাল কীরূপে নিশ্চল হবে? কালচক্রযানীরা বলেন, প্রাণক্রিয়াকে নিরুদ্ধ করতে পারলেই কালকে নিরস্ত করা সম্ভব। যোগসাধনার বলে শরীরস্থ নাড়ি, নাড়িকেন্দ্র ও পঞ্চবায়ুকে (প্রাণ, অপান, সমান, উদান ও ব্যান) আয়ত্ত করতে পারলেই প্রাণক্রিয়া নিরুদ্ধ করা যায়। এতে কাল নিরস্ত হয়। কাল নিরস্ত করাই যে যানের লক্ষ্য, অনিবার্যরূপে সে যানে বা সাধনমার্গে মুহূর্ত, তিথি, বার, নক্ষত্র, রাশি, যোগ প্রভৃতির উপর সমধিক গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে। তিব্বতি ঐতিহ্য অনুসারে, কালচক্রযানের উদ্ভব হয়েছে ভারতের বাইরে সম্ভল নামে এক স্থানে।
এ সকল গুহ্য সাধনমার্গ ও সাধনপদ্ধতি সকলের পক্ষেই প্রশস্ত ছিল না। শিষ্যের স্বাভাবিক উপরই তাঁর সাধনপন্থা নির্ভর করত। যে পদ্ধতির মাধ্যমে সাধনপথ নির্ধারিত হত তার নাম কুলনিৰ্ণয় পদ্ধতি। ডোম্বী, নটী, রজকী, চণ্ডালী ও ব্রাহ্মণী, এই পাঁচটি কুল। পাঁচটি কুল প্রজ্ঞার পাঁচটি রূপ। ব্যক্তি বিশেষের দেহে যে স্কন্ধ বা বায়ুর প্রকোপ বেশি তদনুযায়ী তাঁর কুল নির্ণীত হত। সাধন মার্গও সেরূপে নির্দিষ্ট হত। গুরুর নির্দেশনায় এ কাজ সম্পন্ন হত।
বৌদ্ধ দেবদেবী : পালযুগে নির্মিত বেশির ভাগ বৌদ্ধ প্রতিমা বজ্রযানী। তবে এ পর্বের কয়েকটি সাধারণ মহাযানী বুদ্ধমূর্তিরও সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব মূর্তিতে বুদ্ধদেব নানা ভঙ্গিতে রূপায়িত হয়েছেন। তিনি কখনও অভয়, কখনও ব্যাখ্যান, কখনও ভূমিস্পর্শ আবার কখনওবা ধর্মচক্র প্রবর্তন মুদ্রায় উপবিষ্ট। ফরিদপুর জেলার উজানী গ্রামে ১১শ শতকের একটি বুদ্ধপ্রতিমা আবিষ্কৃত হয়েছে ; বুদ্ধদেব ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় উপবিষ্ট, প্রতিমার পাদপীঠ বজ্র ও সপ্তরত্ন উৎকীর্ণ। বুদ্ধপ্রতিমাটিতে বজ্রযানের প্রভাব সুপরিস্ফুট।
এ পর্বের প্রাপ্ত ধ্যানীবুদ্ধমূর্তি সংখ্যায় অল্প। বৈরোচন, অক্ষোভ্য, রত্নসম্ভব, অমিতাভ এবং অমোঘসিদ্ধি, এই পাঁচজন ধ্যানীবুদ্ধ। এক একজন ধ্যানীবুদ্ধের একজন করে বোধিসত্ত্ব ও মানুষী বুদ্ধ। বৈরোচনের বোধিসত্ত্ব সমস্তভদ্র, অক্ষোভ্যের বজ্রপাণি, রত্নসম্ভবের রত্নপাণি, অমিতাভের অবলোকিতেশ্বর এবং অমোঘসিদ্ধির বিশ্বপাণি। বৈরোচনের মানুষী বুদ্ধ ভ্রুকুচন্দ্র, অক্ষোভ্যের কনকমুনি, রত্নসম্ভবের কাশ্যপ, অমিতাভের গৌতম এবং অমোঘসিদ্ধির মৈত্রেয়। বোধিসত্ত্ব অবলোকিতেশ্বর অবলোকিত ও লোকনাথ নামেও পরিচিত। বৌদ্ধ দেবতাদের মধ্যে তাঁর জন প্রিয়তাই সর্বাধিক। বিভিন্ন রূপে তিনি পূজিত হন। তিনি কখনও পদ্মপাণি, কখনও সিংহনাদ, কখনও ষড়ক্ষরী আবার কখনওবা খসর্পণ। দ্বাদশভুজ অবলোকিতেশ্বরের আসন ও স্থানক একাধিক মূর্তি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ ও রাজশাহী সংগ্রহশালায় রক্ষিত আছে। ধ্যানীবুদ্ধ অক্ষোভ্যের অধ্যাত্মপুত্র বোধিসত্ত্ব মঞ্জুশ্রীও জনপ্রিয় ছিলেন। জ্ঞান, বিদ্যা, বুদ্ধি ও প্রতিভার দেবতা মঞ্জুশ্রী। এই দেবতারও বিচিত্র রূপ। তিনি কখনও মঞ্জুবর, কখনও অরূপচন, কখনওবা স্থিরচক্র। মঞ্জুশ্রীমূর্তির প্রধান লক্ষণ হস্তধৃত পুস্তক ও তরবারি। এক গৌণ বৌদ্ধ দেবতা জন্তুল। ব্রাহ্মণ্য কুবেরের বৌদ্ধ প্রতিরূপ তিনি। তিনি ধন ও ঐশ্বর্যের দেবতা। বাংলা-বিহারের বিভিন্ন স্থানে জন্তুলের মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে।
বৌদ্ধ দেবীদের মধ্যে তারা সর্বশ্রেষ্ঠা। বোধিসত্ত্বদের শক্তি এই তারা। তাঁর বিভিন্ন রূপ ও প্রকৃতি। তিনি কখনও বজ্রতারা, কখনও ভূকূটী তারা, কখনওবা মিতাতপত্রা বা মিততারা। পাল পর্বের অন্যান্য দেবীদের মধ্যে মারীচী, পর্ণশবরী, হারিতী ও চুণ্ডাই প্রধান। মারীচী ব্রাহ্মণ্য সূর্যেরই প্রতিরূপ। তিনি সাধারণত ত্রিমুখী, সপ্তশূকরবাহিত এবং রাহু চালিত রথে প্রত্যালীঢ় ভঙ্গিতে দণ্ডায়মানা। মারীচীর অনুচর পর্ণশবরী। তিনিও ত্রিমুখী, ষড়ভুজা, পর্ণাচ্ছাদন পরিহিতা। ধ্যানে তিনি পিশাচীরূপে কল্পিতা। হারিতী ধনৈশ্বর্যের দেবী। জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রীদেবী প্রজ্ঞাপারমিতার কম মূর্তিই বাংলা-বিহারে পাওয়া গেছে। প্রজ্ঞাপারমিতা মূর্তির প্রধান লক্ষণ হস্তধৃত প্রজ্ঞাপারমিতাগ্রন্থ।
জৈনধর্ম : পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান, বাঁকুড়া, বীরভূম ও পুরুলিয়া অঞ্চলে পালপর্বীয় কয়েকটি তীর্থঙ্করমূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। মূর্তিগুলি ব্রোঞ্জ ধাতুতে নির্মিত, কোনও কোনওটি আবার ক্লোরাইট পাথরে তৈরি। ঋষভনাথের কায়োৎসর্গ ভঙ্গিতে দণ্ডায়মান একটি অতি মনোরম মূর্তি আসানসোলের নিকট পাওয়া গেছে। পুরুলিয়া জেলায় ঘভনাথ, পার্শ্বনাথ ও পদ্মপ্রভের কায়োৎ সর্গ ভঙ্গিতে দণ্ডায়মান প্রস্তরমূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। নীহাররঞ্জন রায় বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া জেলার বিভিন্ন স্থানে পালযুগে নির্মিত কয়েকটি ভগ্নপ্রায় জৈনমন্দিরের সন্ধান পেয়েছেন। (বাঙ্গালীর ইতিহাস : আদি পর্ব (কলকাতা, ১৯৯৩), পৃষ্ঠা ৫৬২-৬৩।) প্রাপ্ত নিদর্শনাদির সাক্ষ্যে প্রমাণিত হয়, নবম থেকে ১১শ শতকের মধ্যে বর্ধমান, বাঁকুড়া, বীরভূম ও পুরুলিয়া অঞ্চলে জৈনধর্ম সুপ্রচলিত ছিল।
বৈদিক ধর্ম ও সংস্কার
পালপর্বে বৈদিক ধর্ম ও সংস্কারের যথেষ্ট প্রসার ছিল। এ সময় যেসব ব্রাহ্মণদের অনুকূলে ভূমিদান করা হয় তাঁদের মধ্যে অনেকেই বেদ, বেদাঙ্গ, মীমাংসা ও ব্যাকরণ শাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন, বৈদিক যাগ-যজ্ঞ ও ক্রিয়াকলাপে পারদর্শী ছিলেন। বৈদিক হোম, যাগ যজ্ঞের কথাও অনেক লেখে উল্লিখিত হয়েছে। বাদাল স্তম্ভলেখে মন্ত্রী কেদারমিশ্রের গৃহে অনুষ্ঠিত হোমাগ্নিশিখার বর্ণনা আছে। বৈদ্যদেবের কমৌলি লেখে পণ্ডিতশ্রেষ্ঠ শ্রীধরের কর্ম ও জ্ঞানকাণ্ডে ব্যুৎপত্তির কথা বলা হয়েছে। মহীপালের বাণগড় লেখে যজুর্বেদীয় বাজসনেয়ী সংহিতা, মীমাংসা, ব্যাকরণ ইত্যাদি শাস্ত্রচর্চার উল্লেখ আছে। বেদ, বেদান্ত এবং সামবেদের কৌঠুম শাখার চর্চার উল্লেখ আছে দেবপালের মুঙ্গের, বিগ্রহপালের আমগাছি, মদনপালের মনহলি প্রভৃতি লেখাবলিতে। লেখমালা সাক্ষ্যে স্পষ্ট, এ সময় ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণেরা বাংলা-বিহারে এসে বসবাস করেন। এ অঞ্চলে পূর্ব থেকেই বৈদিক ধর্মের স্রোত প্রবহমান ছিল। এসব আগন্তুক বেদবিদ ব্রাহ্মণদের আনুকূল্যে সেই স্রোত প্রবলতর হয়।
ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রসার : এ কথা ভুললে চলবে না, পালযুগে বৌদ্ধ বা বৈদিক ধর্মের তুলনায় পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রতিষ্ঠা ছিল অনেক বেশি। এ পর্বের লেখমালা পুরাণ, রামায়ণ ও মহা ভারতের কাহিনি, ভাবকল্পনা ও উপমা-অলংকারে সমৃদ্ধ। লেখসমূহে যে ধর্মীয় মূর্ছনা অনুরণিত, তা উৎসারিত হয়েছে পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও সংস্কারের সূত্র থেকে।
বৈষ্ণবধর্ম : ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীদের মধ্যে জনপ্রিয়তায় বিষ্ণু সর্বশীর্ষে। লেখমালায় তিনি কৃষ্ণ, শ্রীপতি, ক্ষমাপতি, জনার্দন, হরি, মুরারি প্রভৃতি বিভিন্ন নামে অভিহিত। তাঁর জীবনের বিভিন্ন কাহিনি লেখে বর্ণিত হয়েছে।
আসন, শয়ান ও স্থানক, এই তিন ভঙ্গির বিষ্ণুমূর্তি বাংলা-বিহারে আবিষ্কৃত হয়েছে। অবশ্য স্থানক মূর্তির সংখ্যাই বেশি। আসন মূর্তি দু’প্রকারের, গরুড়াসীন ও যোগাসীন। স্থানকমূর্তিতে বিষ্ণু সপার্ষদ উপস্থিত। তিনি কেন্দ্রস্থলে দণ্ডায়মান। তাঁর চার হাতে শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্মের সন্নিবেশ। কোনও কোনও মূর্তিতে শঙ্খ, চক্র ও গদা যথাক্রমে শঙ্খপুরুষ, চক্রপুরুষ এবং গদা দেবীতে রূপায়িত। দেবতার দুই পার্শ্বে রয়েছেন তাঁর দুই পত্নী, লক্ষ্মী ও সরস্বতী, কখনওবা দেবী বসুমতী। মূর্তির পাদপীঠে বাহন গরুড় এবং দুই দ্বারী জয় ও বিজয়ের অবস্থান।
ধর্মপালের খালিমপুর লেখে নন্ন-নারায়ণের এক মন্দিরের উল্লেখ আছে। নন্ন-নারায়ণ সম্ভবত নন্দ-নারায়ণের অপভ্রংশ। এ মত গ্রাহ্য হলে বুঝতে হবে, এই মন্দিরে যে দেবতার পূজা হত তিনি নন্দদুলাল, কৃষ্ণরূপী নারায়ণ। নারায়ণপালের রাজত্বকালে দিনাজপুর অঞ্চলে একটি গরুড়স্তম্ভ স্থাপিত হয়। বিষ্ণু মন্দিরের সামনে একটি করে গরুড়স্তম্ভ স্থাপন করা ছিল তখনকার দিনের সাধারণ রীতি। এ পর্বের কয়েকটি স্তম্ভশীর্ষ গরুড়মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। গরুড়ের হাত দু’টি অঞ্জলিবদ্ধ।
স্থানকমুদ্রায় বিষ্ণুর দুই পার্শ্বে লক্ষ্মী ও সরস্বতীর অধিষ্ঠান। বোঝা যায়, বিষ্ণুর সঙ্গে তাঁর দুই পত্নীও পূজিত হতেন। খালিমপুর লেখে একটি কাদম্বরী দেবকুলিকা বা সরস্বতী মন্দিরের উল্লেখ আছে। লেখটি প্রমাণ করছে, সরস্বতী কখনও কখনও স্বতন্ত্র মর্যাদায় পূজিত হতেন। সরস্বতীর কয়েকটি স্বতন্ত্র মূর্তিও পাওয়া গেছে। এগুলি তাঁর স্বতন্ত্র পূজার নিদর্শন। দেবী সাধারণত হংস বাহিনী। একটি মূর্তিতে তাঁর বাহন মেষ। লক্ষ্মীরও স্বাধীন, স্বতন্ত্র মূর্তি বিদ্যমান। ১১শ শতকের একটি চতুর্হস্ত স্থানক লক্ষ্মীমূর্তি রাজশাহী সংগ্রহশালায় রক্ষিত আছে। বাংলা-বিহারের বিভিন্ন স্থানে গজলক্ষ্মীর মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে।
এ পর্বে বিষ্ণুর অবতারমূর্তি সংখ্যায় সুপ্রচুর। বিষ্ণুর দশাবতারের প্রতিকৃতি সম্বলিত প্রস্তর ও ধাতব ফলক নানা স্থানে পাওয়া গেছে। তাছাড়া বিষ্ণুর বরাহ, নরসিংহ, বামন বা ত্রিবিক্রম, মৎস্য, পরশুরাম ও বলরাম অবতার মূর্তিও আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রাপ্ত নিদর্শনের ভিত্তিতে মনে হয়, বিষ্ণুর দশটি অবতারের মধ্যে বরাহ, নরসিংহ ও বামন অবতারই সমধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। রাজশাহী সংগ্রহশালায় বিষ্ণুর এক দশভুজ সমপদস্থানক মূর্তি আছে। দেবতা দশটি হাতে গদা, অঙ্কুশ, খড়্গ, মুগর, শূল, শর, চক্র, খেটক, ধনুক, পাশ, শঙ্খ ইত্যাদি লাঞ্ছন ধারণ করে আছেন। এটি সম্ভবত বিশ্বরূপ-বিষ্ণুমূর্তি।
শৈবধর্ম : বৈষ্ণবধর্মের তুলনায় কম হলেও সমকালীন লেখমালা ও গ্রন্থাদিতে শৈবধর্মের উল্লেখ সুপ্রচুর। বাদাল স্তম্ভলেখে দক্ষযজ্ঞে অপমানিতা সতীর অকালে দেহত্যাগের কাহিনি উল্লিখিত আছে। ধর্মপালের বোধগয়া শিলালেখে বোধগয়ায় তাঁর এক চতুর্মুখ শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। লক্ষণীয়, শিলালেখে বিষ্ণু, সূর্য এবং সম্ভবত শ্রীদেবীর প্রতিকৃতি অঙ্কিত আছে। সন্দেহ নেই, তৎকালীন যুগের ধর্মীয় সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল নিদর্শন এই শিলালেখ। ভাগলপুর তাম্র শাসনে নারায়ণপালের শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা এবং শৈব পাশুপত আচার্যদের অনুকূলে একটি গ্রাম দানের উল্লেখ আছে। রামচরিত কাব্যে রামপালের প্রতিষ্ঠিত শিবের তিনটি মন্দির এবং একাদশ রুদ্র, স্কন্দ ও গণপতির একটি করে মন্দিরের বর্ণনা আছে।
এ পর্বে লিঙ্গরূপী শিবের পূজাই সমধিক প্রচলিত ছিল। লিঙ্গগুলি সাধারণত একমুখলিঙ্গ। রাজশাহী সংগ্রহশালায় পালপর্বের একটি সুন্দর একমুখলিঙ্গ রক্ষিত আছে। চতুর্মুখলিঙ্গও একে বারে বিরল নয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ সংগ্রহশালায় ১০ম-১১শ শতকের ধাতব চতুর্মুখ লিঙ্গটি সমকালীন ভাস্কর্য শিল্পের এক উজ্জ্বল নিদর্শন। লিঙ্গটির চতুর্মুখের একটি মুখ শিবের বিরূপাক্ষ বা অঘোররূপের প্রতিকৃতি।
শিবমূর্তি পূজারও প্রচলন ছিল। শিবের সৌম্য ও উগ্র, উভয় ধরনের মূর্তিই বাংলা-বিহারের নানা স্থানে আবিষ্কৃত হয়েছে। সৌম্যমূর্তির মধ্যে রয়েছে চন্দ্রশেখর, নটরাজ, সদাশিব, উমা মহেশ্বর, অর্ধ-নারীশ্বর এবং বৈবাহিক বা কল্যাণ-সুন্দর মূর্তি। পালপর্বের একটি সদাশিব মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। দেবতা পঞ্চানন, দশভুজ ও বদ্ধপদ্মাসনে উপবিষ্ট। শিবের নটরাজমূর্তি বাংলা বিহারে প্রচুর। কিন্তু পূর্ব ভারতীয় নটরাজ রূপকল্পনা দক্ষিণী রীতির অনুকরণ নয়। পালপর্বের নটরাজ দশ বা দ্বাদশভুজ কিন্তু দক্ষিণ ভারতে তিনি সাধারণত চতুর্হস্ত। দক্ষিণ ভারতীয় নটরাজ শিবের পদতলে যে অপস্থার পুরুষটিকে দেখা যায়, বাংলা-বিহারে তাঁর চিহ্নমাত্র নেই। একটি নটরাজ শিবমূর্তির পাদপীঠে ‘নটেশ্বর’ কথাটি উৎকীর্ণ আছে। শিবের নৃত্যরাজ পরিচয় এতে বিধৃত। পালপর্বে উমা-মহেশ্বরের প্রচুর সংখ্যক যুগলমূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। যুগলমূর্তিতে উমা শিবক্রোড়ে উপবিষ্টা, সুখাসীনা, আলিঙ্গনাবদ্ধা, সুমধুরহাসিনী ও আনন্দময়ী। অর্ধনারীশ্বর মূর্তিতে শিব ও দুর্গা এক অভিন্ন সত্তারূপে কল্পিত। মূর্তির দক্ষিণার্ধ শিব, বামার্ধ উমা। এ ধরনের মূর্তির নিদর্শন কম। শিবের কল্যাণ-সুন্দর যুগল মূর্তিও কয়েকটি পাওয়া গেছে। এসব মূর্তিতে সপ্তপদী গমনের মতো স্থানীয় আচার-পদ্ধতি রূপায়িত হয়েছে।
বাংলা-বিহারে শিবের সাধারণত দু’ধরনের উগ্রমূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে, অঘোরমূর্তি এবং বটুক-ভৈরবমূর্তি। ঢাকা ও রাজশাহী সংগ্রহশালায় দু’টি অঘোরমূর্তি রক্ষিত আছে। দু’টিই সম্ভবত পালপর্বের। শিবের বটুক-ভৈরবরূপী কয়েকটি মূর্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। দেবতার মুখমণ্ডল বিকট হাস্যব্যদিত। তিনি নরমুণ্ডমালা ও নরমুণ্ডসজ্জিত। তাঁর সর্বাঙ্গ নগ্ন। রুদ্র-শিবের এই মূর্তিতে তান্ত্রিক প্রভাব সুপরিস্ফুট। শিবপুত্র গণপতির কয়েকটি স্বতন্ত্র মূর্তিও বাংলা-বিহারে আবিষ্কৃত হয়েছে। দেবতা তাঁর বাহন মূষিকের পৃষ্ঠদেশে নৃত্যরত। তাঁর একটি হাতে একটি ফল। এই ফল সিদ্ধির প্রতীক। সিদ্ধিদাতা রূপেই গণেশের পরিচয়। পালপর্বে কার্তিকেয়পূজা গণেশপূজার মতো জনপ্রিয়তা অর্জন করেনি। উত্তর বাংলায় ময়ূরবাহন, মহারাজলীলায় উপবিষ্ট কার্তিকেয়ের একটি ১২শ শতকীয় সুদৃশ্য মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে।
তখনকার দিনের কয়েকজন গৌড়ীয় শৈবাচার্য সর্বভারতীয় খ্যাতি অর্জন করেন। এঁদেরই একজন পণ্ডিত শিবাচার্য। চোল সম্রাট প্রথম রাজরাজ রাজরাজেশ্বর মন্দির নির্মাণ করে তাঁকে মন্দিরের পুরোহিতপদে নিযুক্ত করেন। রাজরাজের স্পষ্ট নির্দেশ ছিল, রাজরাজেশ্বর মন্দিরে অন্য কেউ নন, শিবাচার্য এবং তাঁর গৌড়ীয় শিষ্যানুশিষ্যরাই পৌরোহিত্য করবেন। সে যুগের আর একজন প্রখ্যাত শৈবাচার্য উমাপতিদেব বা জ্ঞানশিবদেব। রাজরাজেরই এক বংশধর রাজাধিরাজ তাঁর এক লেখে স্বীকার করেছেন, এই দক্ষিণ রাঢ়ীয় শৈবাচার্যের পুণ্যের ফলে তিনি এক সিংহলি অভিযাত্রী সৈন্যদলকে যুদ্ধে পরাজিত করেন। কৃতজ্ঞ চোলনৃপতি শৈবাচার্যকে একখানি গ্রাম দান করেন।
সপ্ত মাতৃকা : পালযুগে নির্মিত বহু মাতৃকামূর্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। ব্রহ্মাণী, মাহেশ্বরী, কৌমারী, ইন্দ্রাণী, বৈষ্ণবী, বারাহী ও চামুণ্ডা বা চামুণ্ডী, এই সাত মাতৃকা। এক এক মাতৃকা এক একটি ব্রাহ্মণ্য দেবতার শক্তিরূপে কল্পিতা। মাতৃকাদের মধ্যে চামুণ্ডার জনপ্রিয়তাই ছিল সর্বাধিক। সিদ্ধযোগেশ্বরী, দত্তরা, রূপবিদ্যা, ক্ষমা, রুদ্রচার্চিকা, রুদ্রচামুণ্ডা, সিদ্ধচামুণ্ডা প্রভৃতি বিভিন্ন রূপে মাতৃকা চামুণ্ডার পূজা হত। রাজশাহী সংগ্রহশালায় দ্বিহস্ত দত্তরার কয়েকটি মূর্তি রক্ষিত আছে। ঢাকা সংগ্রহ শালায় রক্ষিত আছে দ্বাদশভুজা সিদ্ধযোগেশ্বরীর একাধিক মূর্তি। এ পর্বের আবিষ্কৃত অষ্টভুজা বা দশভুজা মহিষমর্দিনী দুর্গামূর্তিও বড় কম নয়।
সূর্য : পালপর্বে সূর্যপূজা যথেষ্ট প্রসার লাভ করেছিল। দিনাজপুর অঞ্চলের বৈরহাট্টা গ্রামে ১১শ-১২শ শতকের একটি আসন সূর্যমূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু আসন সূর্যমূর্তি অতি বিরল। বাংলা বিহারে প্রাপ্ত প্রায় সকল সূর্যমূর্তিতেই দেবতা দণ্ডায়মান। পালপর্বের সূর্যপ্রতিমা বৈদিক-পৌরাণিক ধ্যান-কল্পনায় রূপায়িত, দেবতার পদাবরণেই শুধু পারসিক প্রভাবের প্রতিফলন। সমকালীন এক মূর্তিলেখে সূর্যকে ‘সমস্তরোগানাং হর্তা’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সূর্যের পূজা করলে আরোগ্য লাভ হবে, সূর্যপূজার পিছনে জনমানসে এই ভাবনাই সক্রিয় ছিল।
ভাষা ও সাহিত্য
কাব্য : সংস্কৃত সাহিত্যের বিকাশের ক্ষেত্রে পালযুগের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। পাল রাজাদের আনুকূল্যে কাব্য রচনা করে অনেকেই যশস্বী হন। এঁদেরই একজন ‘রামচরিত কাব্যকার অভিনন্দ। বিক্রমশীলের পুত্র যুবরাজ হারবর্ষের সভাকবি ছিলেন তিনি। ধর্মপালের এক অভিধা বিক্রমশীল। তাই মনে হয়, হারবর্ষ ছিলেন ধর্মপালের পুত্রদ্বয় ত্রিভুবনপাল-দেবপালদের একজন। শতানন্দের পুত্র এই অভিনন্দ সম্ভবত গৌড়ের অধিবাসী ছিলেন। খ্রিস্টীয় ৯ম শতকের আর এক কবি গৌড় অভিনন্দ। সংকলয়িতা শাঙ্গধর তাঁর ‘শাঙ্গধর-পদ্ধতি’ সংকলন গ্রন্থে গৌড় অভিনন্দের দু’টি শ্লোকের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। শাঈধরের সংকলনে অভিনন্দ রচিত আরও দু’টি শ্লোক উদ্ধৃত হয়েছে। শেষোক্ত অভিনন্দের গৌড় অভিধা নেই। গৌড় অভিধাহীন অভিনন্দের ৫টি শ্লোক ‘কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়’ গ্রন্থে, ২২টি শ্লোক ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’ গ্রন্থে, ৬টি শ্লোক কল্হণের ‘শুক্তিমুক্তাবলী’তে এবং ১টি শ্লোক ‘পদ্যাবলী’তে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। গৌড় অভিনন্দ ও অভিধা হীন অভিনন্দ এক ও অভিন্ন ব্যক্তি, না দু’জন স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব, তা সঠিক বলা যায় না। গৌড় অভিনন্দ বাঙালি ছিলেন। তাঁর অভিধাতেই তা প্রমাণিত। অনেকে বলেন, গৌড় অভিনন্দ ‘কাদম্বরীকথাসার’ নামে একখানি কাব্যও রচনা করেন। কিন্তু লক্ষ করবার বিষয়, কাদম্বরী কথাসারের রচয়িতা নিজের নামের পূর্বে কখনও গৌড় অভিধা ব্যবহার করেননি। ফলে সংশয় জেগেছে, গৌড় অভিনন্দ কী কাদম্বরীকথাসারেরও রচয়িতা? বিষয়টি নিঃসন্দেহে বিতর্কিত।
পালযুগে আর একখানি ‘রামচরিত’ কাব্য রচিত হয়েছিল। মদনপালের সভাকবি সন্ধ্যাকর নন্দী ২২০টি আর্যা শ্লোকে এ কাব্য প্রণয়ন করেন। দ্ব্যর্থবোধক এই কাব্যে একদিকে যেমন রামপালের জীবনী বর্ণিত হয়েছে, অপর দিকে তেমনি শ্রীরামচন্দ্রের কাহিনি বিবৃত হয়েছে। সন্ধ্যাকরের পিতা প্রজাপতি নন্দী, পিতামহ পিনাক নন্দী। তাঁর জন্ম হয়েছিল উত্তর বাংলার পুণ্ড্র বর্ধনপুরে। নিজেকে কলিকাল-বাল্মীকি বলে পরিচয় দিয়েছেন তিনি। পাল ইতিহাসের উপাদান রূপে রামচরিত কাব্যখানির অশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু রামচরিত ইতিহাস নয়, ইতিহাস-আশ্রয়ী এক কাব্য।
চিকিৎসাশাস্ত্র : পালযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসাবিজ্ঞানী চক্রপাণি দত্ত। তিনি সম্ভবত পালরাজ নয়পালের সমসাময়িক ছিলেন। তাঁর চিকিৎসাসংগ্রহ’ গ্রন্থে চিকিৎসাশাস্ত্রে পূর্ব ভারতের তৎকালীন অগ্রগতির পরিচয় পাওয়া যায়। এটি তাঁর শ্রেষ্ঠ মৌলিক গ্রন্থ। এই গ্রন্থের ধাতবদ্রব্য প্রকরণে চক্রপাণি যে মৌলিকত্ব প্রদর্শন করেছেন, তা অভিনব। চরক এবং সুশ্রুতের উপর তিনি যথাক্রমে ‘আয়ুর্বেদদীপিকা’ এবং ‘ভানুমতী’ নামে দু’খানি টীকাগ্রন্থ রচনা করেন। ‘আয়ুর্বেদ দীপিকা’ আবার ‘চরকতাৎপর্যদীপিকা’ নামেও পরিচিত। তাঁর লেখা অপর দু’খানি গ্রন্থ হল ‘শব্দচন্দ্রিকা’ এবং ‘দ্রব্যগুণসংগ্রহ’। প্রথমটি ভেষজ গাছগাছড়া এবং আকর দ্রব্যাদির তালিকা। দ্বিতীয়টি পথ্যাদি নিরূপণসংক্রান্ত। চক্রপাণির পিতা নারায়ণ, গুরু নরদত্ত। (চক্রপাণির ভাই ভানুও একজন খ্যাতনামা চিকিৎসক ছিলেন।) ‘শব্দপ্রদীপ’ নামে ভেষজ গাছ-গাছড়ার এক তালিকা গ্রন্থের লেখক সুরেশ্বর বা সুরপাল। তাঁর পিতা ভদ্রেশ্বর রামপালের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন। গাছ-গাছড়ার উপর লেখা ‘বৃক্ষায়ুর্বেদ’ এবং লোহার ভেষজ ব্যবহারের উপর রচিত ‘লোহপদ্ধতি’ বা ‘লোহসর্বস্ব’ নামে সুরেশ্বরের আরও দু’খানি গ্রন্থ আছে। ১২শ শতকের বা তাঁর পূর্ববর্তী আর একজন চিকিৎসাশাস্ত্র প্রণেতা বঙ্গসেন। তাঁর লেখা গ্রন্থ ‘চিকিৎসাসার-সংগ্রহ’। তিনি মূলত সুশ্ৰুতপন্থী কিন্তু ‘রোগবিনিশ্চয়’ গ্রন্থপ্রণেতা মাধবকেও তিনি অনুসরণ করেছেন। খুব সম্ভব রাঢ়ে তাঁর জন্ম।
ধর্মীয় গ্রন্থাবলি : এ পর্বে রচিত ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, দর্শন ও সংস্কার বিষয়ক গ্রন্থাদির সংখ্যা বড় কম নয়। দক্ষিণ রাঢ়ের ভূরিশ্রেষ্ঠিক গ্রামের অধিবাসী শ্রীধরভট্ট খ্রিস্টীয় ১০ম-১১শ শতকের লোক ছিলেন। এই ভূরিশ্রেষ্ঠিক গ্রাম বর্ধমান শহরের নিকটবর্তী ভুরসুট গ্রাম। ‘ন্যায়কন্দলী’ নামে বৈশেষিকসূত্রের উপর তিনি এক বিখ্যাত টীকাগ্রন্থ প্রণয়ন করেন। গ্রন্থখানি বাংলার তুলনায় বিহারেই অধিক সমাদৃত ছিল। এই গ্রন্থের একটি টীকাও বঙ্গে-গৌড়ে রচিত হয়নি। পরবর্তিকালে মৈথিলি পণ্ডিত পদ্মনাভ এই গ্রন্থের একটি মূল্যবান টীকা রচনা করেন। শ্রীধরভট্টের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন জনৈক ‘কায়স্থকুলতিলক’ পাণ্ডুদাস। ‘‘ন্যায়কন্দলী’ ছাড়া তিনি ‘অদ্বয়সিদ্ধি’, ‘তত্ত্বপ্রবোধ’, ‘তত্ত্বসংবাদিনী’ ও ‘সংগ্রহটীকা’ নামে অন্তত আরও চারখানি বেদান্ত ও মীমাংসা বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেন। শেষোক্ত চারখানি গ্রন্থই আজ অবলুপ্ত। শ্রীধরভট্টের সমসাময়িক ছিলেন উদয়ন। তিনি চার চারখানি গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থগুলির নাম ‘লক্ষণাবলী’, ‘কিরণাবলী’, ‘কুসুমাঞ্জলি’ ও ‘আত্মতত্ত্ববিবেক’। প্রশস্তপাদের ‘পদার্থধর্মসংগ্রহ’ নামে বৈশেষিক দর্শনের একটি ভাষা আছে। উদয়নের প্রথম দু’খানি গ্রন্থ প্রশস্তপাদভাষ্যেরই টীকা। ১১শ শতকের একজন ধর্মশাস্ত্রকার জিতেন্দ্রিয়। জীমূতবাহন, রঘুনন্দন ও শূলপাণির মতো বিদ্বজ্জনেরা তাঁর নামোল্লেখ করেছেন। তাঁর রচিত গ্রন্থ হারিয়ে গেছে। প্রায় একই সময় আবির্ভূত হয়েছিলেন ভবদেবভট্ট। তাঁর লেখা গ্রন্থাদির মধ্যে আছে ‘তৌতাতিত-মত-তিলক’, ‘ব্যবহার তিলক’, ‘প্রায়শ্চিত্তপ্রকরণ’ এবং ‘দশকর্মপদ্ধতি’ বা ‘দশকর্মদীপিকা’। প্রথম গ্রন্থখানিতে ব্যাখ্যাত হয়েছে পূর্ব মীমাংসা দর্শন। ব্যবহারতিলকের কোনও পুঁথি আজও পাওয়া যায়নি। তবে রঘুনন্দন, মিত্রমিশ্ররা এই গ্রন্থের নানা মতামত উদ্ধার করেছেন তাঁদের স্মৃতিবিষয়ক রচনায়। প্রায়শ্চিত্তপ্রকরণে ভবদেব প্রায় ষাটজন পূর্বসূরির মতামত বিশ্লেষণ করে ছয় প্রকার অপরাধ ও তার প্রায়শ্চিত্ত বিধির নির্দেশ দিয়েছেন। দশকর্মপদ্ধতি সামবেদীয় দ্বিজবর্ণের সংস্কার বিষয়ক গ্রন্থ। গর্ভাধান হতে আরম্ভ করে ষোলো প্রকার সংস্কারের আলোচনা আছে এ গ্রন্থে। সমসাময়িক কালের এক যুগন্ধর শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত এই ভবদেবভট্ট। অদ্বৈত দর্শন, মীমাংসা, তর্কশাস্ত্র-অর্থশাস্ত্র, আয়ুর্বেদ, গণিত, হোরাশাস্ত্র, ধর্মশাস্ত্র, বৌদ্ধদর্শন ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে অসামান্য ব্যুৎপত্তির অধিকারী ছিলেন তিনি। তিনি অবশ্য পাল রাজপরিবারের আনুকূল্য লাভ করেননি। তিনি ছিলেন বর্মা বংশীয় নরপতি হরিবর্মার মহাসন্ধিবিগ্রহিক। তাঁর পিতা গোবর্ধন, মাতা সাঙ্গোকা। সাবর্ণগোত্রীয় সামবেদী ব্রাহ্মণ ভবদেব ভট্টের জন্ম রাঢ়ের সিদ্ধল গ্রামে।
বৌদ্ধযান অবলম্বনে প্রচুর সংস্কৃত গ্রন্থ পালযুগে রচিত হয়। এই গ্রন্থগুলিকে তন্ত্রগ্রন্থও বলা যেতে পারে। মূল গ্রন্থগুলির বেশির ভাগই বিনষ্ট হয়ে গেছে। তাদের তিব্বতি সংস্করণগুলিই বর্তমানে পাওয়া গেছে। তবে একটা কথা ঠিক। মূল গ্রন্থগুলি সংস্কৃত ভাষায় রচিত হলেও সে ভাষা শুদ্ধ, ব্যাকরণসম্মত, সহজ, প্রাঞ্জল সংস্কৃত ভাষা নয়। সে ভাষায় ব্যাকরণের রীতি-নীতি, ছন্দ-অলংকার ইত্যাদি অস্বীকৃত হয়েছে। গ্রন্থকারদের বক্তব্য ছিল, ভাষা অশুদ্ধ ও অপ্রচলিত হলেও ক্ষতি নেই, ভাষা অর্থবহ হলেই হল। তাই বৌদ্ধযান সম্পর্কিত বিভিন্ন গ্রন্থাদিতে সিদ্ধা চার্যরা যে ভাষা ব্যবহার করেছেন, তা গুহ্য, রহস্যময়। এ ভাষার পোশাকি নাম সন্ধা বা সান্ধ্য ভাষা। গুরু এবং দীক্ষিতেরা নিজেদের মধ্যে এ ভাষায় কথা বলতেন। সাধারণের কাছে এ ভাষা দুর্বোধ্য ও রহস্যময়। যৌন জীবন, যৌন অভিজ্ঞতা ও সমকালীন দৈনন্দিন জীবনযাত্রা থেকে নেওয়া প্রচুর রূপক, অলংকার ও শব্দাবলি এই সব গ্রন্থে নির্দ্বিধায় স্থান পেয়েছে। ফলে আক্ষরিক অর্থ ধরলে এই গ্রন্থগুলিকে অশালীন বলে মনে হবে। কিন্তু আপাতদৃষ্ট অর্থের নেপথ্যে একটি আভিপ্রায়িক ব্যঞ্জনা অবশ্যই ছিল। কেবলমাত্র সাধনমার্গীরাই সে ব্যঞ্জনা উপলব্ধি করতেন।
এই বৌদ্ধ-তান্ত্রিক লেখকদেরই একজন মহাজেতারি। বিক্রমশীল বিহারের অন্যতম আচার্য তিনি। বৌদ্ধ ন্যায় অবলম্বনে লেখা ‘হৈতুতত্ত্বোপদেশ’, ‘ধর্মাধর্মবিনিশ্চয়’ এবং ‘বালাবতারতর্ক’ নামের তিনটি গ্রন্থ সম্ভবত তাঁরই রচনা। তাছাড়া তিনি আরও দু’খানি সূত্রগ্রন্থ রচনা করেছেন। ‘সুগতমতবিভঙ্গকারিকা’ এদেরই একটি। কনিষ্ঠ জেতারি এগারোখানি বজ্রযানী সাধনের রচয়িতা। বৌদ্ধ-তান্ত্রিক লেখকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। অতীশ নামেও তিনি পরিচিত। (অতি + ঈশ, এ অর্থে অতীশ। তিব্বতিতে ঈ-কারের ব্যবহার নেই; সেখানে তিনি অতিশ।) ১৬৮টি গ্রন্থের প্রণেতা তিনি। এর মধ্যে অনেকগুলি ছিল অনুবাদ গ্রন্থ। গ্রন্থগুলির বেশির ভাগই বজ্রযানী সাধন, কয়েকখানি মহাযানী সূত্রগ্রন্থ। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে, ‘শিক্ষাসমুচ্চয়-অভিসময়’, ‘সূত্রার্থসমুচ্চয়োপদেশ’, ‘প্রজ্ঞাপারমিতা-পিণ্ডার্থপ্রদীপ’, ‘সংগ্রহগর্ভ’, ‘মহাযানপথসাধনবর্ণসংগ্রহ’ এবং ‘বোধিমার্গপ্রদীপ’।
বিক্রমশীল বিহারের এক প্রধান স্তম্ভ জ্ঞানশ্রীমিত্র। তিনি দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের সমসাময়িক। বৌদ্ধ ন্যায়ের উপর কার্যকারণভাবসিদ্ধি নামে তিনি একখানি বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেন। বজ্রযান মতবাদের উপর প্রায় বিশখানা গ্রন্থ লিখেছেন অভয়াকরগুপ্ত। এই বৌদ্ধ আচার্য রামপালের সমকালীন ছিলেন। তাঁর রচিত গ্রন্থাবলির মধ্যে রয়েছে ‘বজ্রযানাপত্তি-মঞ্জরী’, ‘যোগাবলী’, ‘মর্মকৌমুদী’ এবং ‘বোধিপদ্ধতি’। ‘হেরূকসাধন’ নামে একখানি গ্রন্থ রচনা করেছেন দিবাকরচন্দ্র। তিনি ছিলেন নয়পালের সমসাময়িক। মগধের বিক্রমপুরী বিহারের অবধূত কুমারচন্দ্র তিনখানি তান্ত্রিক পঞ্জিকা প্রণয়ন করেন। টঙ্কদাস বা ডঙ্গদাস নামে আর এক বৌদ্ধ আচার্য হেবজ্রতন্ত্রের উপর ‘সুবিশদসম্পুট’ নামে একখানি টীকা রচনা করেন।
বৌদ্ধ দোঁহা ও চর্যাপদ : বৌদ্ধ দোঁহা ও চর্যাপদগুলি সম্ভবত পালযুগেই রচিত হয়েছিল। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালে চর্যাপদের পুঁথি আবিষ্কার করেন। পরবর্তিকালে অবশ্য আরও অনেক পুঁথি আবিষ্কৃত হয়। (এ প্রসঙ্গে প্রবোধচন্দ্র বাগচীর নামও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আরও তিনখানা পুঁথির সঙ্গে চর্যাচর্যবিনিশ্চয় নামে একখানি পুঁথি নেপালে আবিষ্কার করেন। এর কিছুদিন পর প্রবোধচন্দ্র বাগচী এই মূল গ্রন্থের তিব্বতি অনুবাদ নেপালেই আবিষ্কার করেন। মূল গ্রন্থে গীতির সংখ্যা ছিল ৪৬টি। কিন্তু অনুবাদে গীতি সংখ্যা ৫১টি। মূল সংখ্যা সম্ভবত ৫১টিই ছিল।) দোঁহা ও চর্যাপদগুলি ৯৫০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রচিত বলে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় অভিমত প্রকাশ করেছেন। মহম্মদ শহীদুল্লা, সুকুমার সেন, সুখময় মুখোপাধ্যায়েরা অবশ্য কিছু কিছু দোঁহা ও পদকে সপ্তম-অষ্টম শতকের রচনা বলে মনে করেন। এই গীতগুলির রচয়িতারা সিদ্ধাচার্য নামে পরিচিত। এঁদের মধ্যে লুইপা, কাহ্নপা, জালন্ধরীপা বা হাড়িপা, শবরীপা, ভুসুকু, তন্ত্রীপাদ প্রমুখরাই সমধিক উল্লেখযোগ্য।
দোঁহা-চর্যা পদাবলিতে যে ভাষা ব্যবহৃত, অনেকের মতে তা আদি বাংলা ভাষা। ফলে পালযুগকে অনেকে বাংলা ভাষার উদ্ভবকাল বলে ধার্য করেন। কিন্তু এ বিষয়ে মতভেদ আছে। অনেকে এই ভাষাকে আদি ওড়িয়া বা আদি অসমিয়া নামকরণের অনুকূলে মত প্রকাশ করেছেন। দোঁহা ও চর্যাপদে ব্যবহৃত ভাষার সঙ্গে পূর্ব ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার শব্দগত, ব্যাকরণগত ও বাক্ভঙ্গিগত সাদৃশ্য হেতু এই বিভিন্ন নামকরণ। আসলে এই গীতিগুলি রচিত হয়েছে শৌরসেনী ও মাগধী অপভ্রংশ থেকে বিবর্তিত এক সাধারণ লৌকিক ভাষায়। এই ভাষা থেকেই ধীরে ধীরে হিন্দি, বাংলা, মৈথিলি, নেপালি, অসমিয়া, ওড়িয়া প্রভৃতি আঞ্চলিক ভাষার সৃষ্টি হয়েছে। গুহ্য অধ্যাত্মসাধনার নিগূঢ়তর তত্ত্ব এই দোঁহা ও পদগুলিতে ধ্বনিত হয়েছে। সাহিত্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এই গীতিগুলি রচিত হয়নি সত্য, কিন্তু এমন কয়েকটি গীতি আছে যা ধ্বনি, ব্যঞ্জনা ও চিত্রগৌরবে মাধুর্যমণ্ডিত, হৃদয়গ্রাহী।
স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলা
চারুশিল্পের ক্ষেত্রে, অর্থাৎ স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলায় পাল যুগের এক বিশেষ অবদান রয়েছে। তবে তুলনায় স্থাপত্য নিষ্প্রভ, ভাস্কর্য ও চিত্রকলা স্বমহিমায় উজ্জ্বল।
লৌকিক স্থাপত্য : পালপর্বের লৌকিক স্থাপত্যের নিদর্শন বিধৃত আছে সমকালীন মৃৎ ও প্রস্তর ফলকে উৎকীর্ণ ছবিতে। ক্ষণস্থায়ী উপাদানে তৈরি হত বলে এ ধরনের বাড়িঘরের অবশেষ বড় একটা চোখে পড়ে না। বাসগৃহ সাধারণত নির্মিত হত খড়, কাঠ ও বাঁশের মতো ভঙ্গুর উপকরণে। আজও বাংলা-বিহার-অসমের গ্রামগঞ্জে বাঁশ বা কাঠের খুঁটির উপর মাটি বা বাঁশের চাচারির দেয়াল-ঘেরা চতুষ্কোণ, ধনুকাকৃতি দোচালা, চারচালা ও আটচালা গৃহ দেখা যায়। সন্দেহ নেই, পালপর্বে লোকদের বসবাসের জন্য এ ধরনের গৃহই নির্মিত হত। দ্বিতল, ত্রিতল গৃহও একই রীতিতে তৈরি হত। উপরের চাল বিন্যস্ত হত ক্রমহ্রাসমান ধনুকাকৃতি রেখায়। ধনী-দরিদ্রের বাসগৃহের নির্মাণশৈলী একই ছিল। পার্থক্য ছিল আয়তনে ও অলংকরণে। কখনও কখনও ইট দিয়েও বাড়িঘর তৈরি করা হত। এ কথা স্বীকার করতে হবে, কী বিত্তবান, কী স্বল্পবিত্ত, ধন সম্পত্তি নির্বিশেষে সর্বসাধারণের ইট বা অন্য কোনও স্থায়ী উপকরণের সাহায্যে বাসগৃহ নির্মাণে এক প্রকার অনীহা ছিল। তাঁদের দৃঢ়মূল ধারণা ছিল, ক্ষণস্থায়ী মানবদেহের আবাসের জন্য চিরস্থায়ী গৃহের কিবা প্রয়োজন। সে প্রয়োজন যদি কারোর থাকে, তা দেবতার। দেবতা অজ, নিত্য, শাশ্বত। স্থায়ী আবাসের প্রয়োজন তো তাঁরই। তাঁদের সাগ্রহ দৃষ্টি প্রসারিত ছিল ধর্মগত স্থাপত্যের দিকে।
স্তূপ : পালপর্বীয় ধর্মগত স্থাপত্যের তিনটি শ্রেণি— স্তূপ, বিহার ও মন্দির। রাজশাহী জেলার পাহাড়পুর, বাঁকুড়া জেলার বহুলাড়া এবং বর্ধমান জেলার পানাগড়ের নিকটবর্তী ভরতপুর গ্রামে ১০ম-১১শ-১২শ শতকের কয়েকটি স্তূপের ভগ্নাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব নিবেদন স্তূপ। ভক্তরা নিবেদনরূপে স্তূপগুলি নির্মাণ করে তাঁদের ভক্তি প্রকাশ করে গেছেন। স্তূপগুলি ক্ষুদ্রাকারের। এই স্তূপগুলির গর্ভ থেকে বৌদ্ধসূত্র উৎকীর্ণ অনেক মৃন্ময় সিলমোহর পাওয়া গেছে। তখনকার দিনের বৌদ্ধরা এই সূত্রগুলিকে ধর্মশরীর মনে করতেন। বুদ্ধের দেহাবশেষের পরিবর্তে স্তূপে এই ধর্মশরীর স্থাপন করা তখন রীতি ছিল। বর্তমানে এসব স্তূপের ভিত ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। ভিতগুলির কোনওটি চতুষ্কোণ, কোনওটিবা গোলাকার। বেশির ভাগ চতুষ্কোণ ভিতের প্রতিটি দিকে, ঠিক মধ্যিখানে, একটি করে চতুষ্কোণ অঙ্গ সংযোজিত হয়েছে। ফলে ভিতটি একটি ক্রুশের আকার ধারণ করেছে। ভিতগুলি প্রায়ই বেশ উঁচু এবং ক্রমহ্রাসমান কয়েকটি স্তরে বিন্যস্ত। ভিতের দেয়ালের গায়ে নানা বুদ্ধমূর্তি। দৃশ্যমান ধ্বংসাবশেষ থেকে স্তূপগুলির আকৃতি-প্রকৃতি বোঝার উপায় নেই। সমসাময়িক পাণ্ডুলিপি-চিত্রে স্তূপের প্রতিকৃতি থেকে মনে হয়, ভিত, বেদি, মেধি, অণ্ড, হর্মিকা ও ছত্রাবলি, এই ছয়টি অঙ্গ নিয়ে এক একটি স্তূপ গঠিত হত। সব সময় যে একটি ভিতের উপর একটি স্তূপই বানানো হত, এমন নয়। কখনও কখনও একই ভিতের উপর সারি সারি স্তূপ তৈরি হত, কখনওবা একই ভিতের উপর বৃহত্তর একটি স্তূপকে ঘিরে এক গুচ্ছ ছোট ছোট স্তূপ চক্রাকারে নির্মিত হত। শিল্পগত মানের দিক থেকে এই স্তূপগুলি খুবই সাদামাটা। তুলনায় মায়ানমারের পাগান শহরের প্রায় সমকালীন স্তূপগুলি কত না সমৃদ্ধ, কত না ঐশ্বর্যময়!
বিহার : পালযুগে অনেক বিহার নির্মিত হয়েছিল। ভাগলপুর জেলার আন্টিচকে গঙ্গাতীরে ধর্মপাল বিক্রমশীল বিহার নির্মাণ করেন। রাজশাহী জেলার পাহাড়পুরের সোমপুর বিহার ধর্মপালের আর এক কীর্তি। এ আমলের আর একটি বিহার বিহারশরীফের ওদন্তপুরী। কিন্তু এ বিহারটির নির্মাতা গোপাল, ধর্মপাল, না দেবপাল, তা নিশ্চিত জানা যায় না। এই বিহারগুলি নিছক ভিক্ষুদের আবাসস্থলই ছিল না, তখনকার দিনে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্র ছিল। সোমপুর বিহার আয়তনে বিশাল ছিল। প্রতিদিকে প্রায় ২৭৪.৩২ মি. এমন একটি বর্গাকার বিশাল স্থান জুড়ে বিহারটি বিস্তৃত ছিল। প্রশস্ত বহিঃপ্রাচীর এবং ঘন সন্নিবিষ্ট স্তম্ভের সারি দেখে মনে হয় বিহারটির একাধিক তল ছিল। বিহারটির মাঝখানে ছিল এক বিশাল প্রাঙ্গণ। প্রাঙ্গণটিকে ঘিরে আর বহিঃপ্রাচীর ঘেঁষে চারদিকে ছিল ঘরের সারি। ঘরগুলির সম্মুখভাগে প্রসারিত লম্বমান এক বারান্দা। এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যাবার জন্য দরজা ছিল। সর্বনিম্ন তলে ১৮০টির বেশি কক্ষ ছিল। কক্ষগুলি এবং প্রাঙ্গণ থেকে জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থা ছিল। সুপ্রশস্ত অঙ্গনের কেন্দ্রস্থলে ছিল এক সুডচ্চ, সুবৃহৎ মন্দির। বিহারটির প্রধান তোরণ ছিল উত্তর দিকে। উত্তর দিকের একেবারে পূর্বতম প্রান্তে ছিল একটি ছোট তোরণ। আবাসিকদের ব্যবহারের জন্য একটি খিড়কি-তোরণও ছিল। সেটি ছিল পূর্বদিকে। এত বিশাল ও সমৃদ্ধ বিহার ভারতবর্ষের এক নালন্দা ছাড়া অন্য কোথাও আবিষ্কৃত হয়নি।
মন্দির স্থাপত্য : পালযুগে নির্মিত মন্দিরসমূহের মধ্যে পাহাড়পুরের বৃহদায়তন ও বহুতল মন্দিরটি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। এই মন্দিরের সিংহভাগ ধর্মপালের রাজত্বকালে নির্মিত হয়েছিল বলে অনুমিত হয়। মন্দিরটি সোমপুর বিহার প্রাঙ্গণে অবস্থিত। উত্তর-দক্ষিণে মন্দিরটি ১০৭.৬ মি. এবং পূর্ব-পশ্চিমে ৯৫.৭৭ মিটার। পোড়ামাটির ইট ও কাদার গাঁথুনিতে তৈরি এই মন্দিরটি চতুর্বিংশতি কোণ। অর্থাৎ মূল চতুষ্কোণের প্রতিটি বাহু সম্মুখদিকে তিনটি স্তর বা পর্যায়ে বিস্তৃত করে এক এক দিকে ছয়টি করে কোণ রচিত হয়েছিল। মন্দিরের প্রতিটি দিকে ছিল একটি করে পূজাস্থান। মন্দিরের কেন্দ্রস্থলে ছিল এক বৃহদায়তন, চতুষ্কোণ স্তম্ভ। স্তম্ভটির শীর্ষদেশ ও মন্দিরের উপরের অংশ ভেঙে পড়ায় নীচের দু’টি তলই অবশিষ্ট আছে। (মূল চতুষ্কোণের প্রতিটি বাহু সামনের দিকে বিস্তৃত করে প্রতি তলে চারটি পূজাস্থান রচিত হয়েছে। একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়, পূজাস্থানের দু’টি ভাগ—প্রান্তভাগ ও সম্মুখভাগ। নীহাররঞ্জন রায় (বাঙ্গালীর ইতিহাস : আদি পর্ব (কলকাতা, ১৯৯৩), পৃষ্ঠা ৬৮২-৮৩) ভাগ দু’টিকে যথাক্রমে গর্ভগৃহ ও মণ্ডপ নামকরণ করেছেন।) কাজেই মন্দিরের শীর্ষটি শিখরাকৃতি না স্তূপাকৃতি ছিল তা নির্ণয়ের কোনও উপায় আজ আর নেই। দৃশ্যমান তল দু’টি ক্রমহ্রাসমান। তল দু’টির প্রতিটিতে রয়েছে প্রদক্ষিণা পথ, প্রাচীর আর এক এক দিকে এক একটি করে পূজাস্থান। দ্বিতীয় তলটিই সর্বপ্রধান। প্রথম তলটির তুলনায় এই তল অধিকতর সমৃদ্ধ। অসংখ্য অলংকৃত পোড়ামাটির ফলকে মন্দিরের বাইরের দেয়াল সজ্জিত। উত্তরদিকে মন্দিরের প্রবেশ-তোরণ। এ মন্দির বৌদ্ধ মন্দির।
পাহাড়পুর মন্দিরের স্থাপত্যরীতি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। কাশীনাথ দীক্ষিত মনে করেন, এই মন্দির নির্মাণে এক স্বতন্ত্র স্থাপত্যশৈলী অনুসৃত হয়েছে। ভারতের অন্য কোথাও পূর্বে বা পরে এই রীতিতে কোনও মন্দির নির্মিত হয়নি। সরসীকুমার সরস্বতী অবশ্য মনে করেন, ভারতীয় বাস্তুবিদ্যায় স্বীকৃত সর্বতোভদ্র রীতিতে পাহাড়পুর মন্দির নির্মিত। সর্বতোভদ্র মন্দির চতুষ্কোণ, চতুঃশাল গৃহ মূলত চতুষ্কোণ হলেও এর প্রতিটি বাহু দু’টি পর্যায়ে বা স্তরে বিস্তৃত করে এক এক দিকে চারটি কোণ রচনা করা হয়। সেই অর্থে এ ধরনের মন্দির ষোড়শকোণ। এই মন্দির চতুঃশাল, অর্থাৎ এর চারদিকে চারটি পূজাস্থান। মন্দিরের চারদিকে চারটি প্রবেশ-তোরণ। শাস্ত্রানুসারে এই ধরনের মন্দির হত পঞ্চতল। উপরের তলগুলি ক্রমহ্রাসমান। প্রতি তলে প্রদক্ষিণা পথ, প্রাচীর এবং চারদিকে একটি করে পূজাস্থান। সমগ্র মন্দিরটি অলংকৃত হত অসংখ্য ক্ষুদ্রাকৃতি শিখর ও চূড়ায়। পাহাড়পুরের সুবিস্তৃত মন্দিরটি সর্বতোভদ্র মন্দিরের এক উজ্জ্বল নিদর্শন। অনুরূপ সর্বতোভদ্র শৈলীর ক্ষুদ্রায়তনের এক মন্দির রংপুর জেলার বিরাটে আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রাচীন কালে মায়ানমার, ইন্দোনেশিয়া এবং কামপুচিয়া প্রভৃতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নানা দেশে এই ধরনের অনেক মন্দির নির্মিত হয়েছিল। পাহাড়পুরের বৃহদায়তন বৌদ্ধ মন্দিরটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এসব মন্দিরের অনুপ্রেরণারূপে কাজ করেছিল।
রেখ বা শিখর রীতিতেও এ যুগে বেশ কয়েকটি মন্দির নির্মিত হয়েছিল। এই ধরনের মন্দিরের গর্ভগৃহের চাল ক্রমহ্রাসমান বক্ররেখায় শিখরাকৃতিতে সোজা উপরের দিকে উঠে গেছে। শিখরের উপরিভাগে আমলক শিলা ও চূড়া। ভুবনেশ্বরের মন্দিরগুলির সঙ্গে এদের যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে। এই মন্দিরগুলির নির্মাণে হয়তো ভুবনেশ্বরের মন্দিরের প্রভাব ছিল। তবে দু’য়ের মধ্যে যে পার্থক্য ছিল না তা নয়। সে সময় ওড়িশায় গর্ভগৃহের সঙ্গে জগমোহন তৈরির রেওয়াজ ছিল। কিন্তু বাংলা ও বিহারে এই রীতি অনুসৃত হয়নি। ভূমি-নকশা ও অলংকরণে বৈচিত্র্য ওড়িশার মন্দিরগুলিকে এক বিশিষ্টতা দান করেছে। কিন্তু বাংলা ও বিহারের মন্দিরগুলির সে বৈশিষ্ট্য নেই। তাছাড়া ওড়িশার মন্দিরগুলির তুলনায় এ অঞ্চলের মন্দিরগুলি আয়তনেও বেশ ক্ষুদ্র। বর্ধমান জেলার বরাকরের চতুর্থ মন্দির, বাঁকুড়া জেলার বহুলাড়ার সিদ্ধেশ্বর মন্দির এবং দেহর গ্রামের সরেশ্বর ও সল্লেশ্বর মন্দির, সুন্দরবনের জটার দেউল, বর্ধমানের গৌরাঙ্গপুর মন্দির এবং পুরুলিয়ার বান্দা গ্রামের প্রস্তর মন্দিরটি এ যুগেরই কীর্তি।
সর্বতোভদ্র ও রেখবর্গীয় ছাড়া নিম্নোক্ত তিন শ্রেণির মন্দিরও এ পর্বে নির্মিত হয়েছিল :
- ১. ভদ্র বা পীড় দেউল : এই রীতিতে গর্ভগৃহের চাল ক্রমহ্রাসমান পিরামিড আকৃতি হয়ে স্তরে স্তরে উপরের দিকে উঠে গেছে। স্তর বা ধাপ সংখ্যায় তিনটি, পাঁচটি অথবা সাতটি। সর্বোচ্চ স্তরের উপরে আমলক শিলা। তার উপর চূড়া।
- ২. সস্তূপ পীড় বা ভদ্র দেউল : এ ধরনের দেউলে সর্বোচ্চ স্তরের উপরে একটি স্তূপ। স্তূপের উপরিভাগে চূড়া। প্রতিটি স্তর বা ধাপের চার কোণে একটি করে ক্ষুদ্রাকৃতি স্তূপ।
- ৩. সশিখর পীড় বা ভদ্র দেউল : এই শ্রেণির দেউলে সর্বোচ্চ স্তরের উপর একটি শিখর। শিখরের উপর আমলক শিলা। তার উপরে চূড়া। বৌদ্ধ মন্দির হলে আমলক শিলা ও চূড়ার মধ্যবর্তী স্থানে অতি ক্ষুদ্রাকৃতি একটি স্তূপ সংযোজিত হত।
ভাস্কর্য : পালপর্বের ভাস্কর্যশিল্পের নিদর্শন সুপ্রচুর। এ যুগের প্রতিমা তৈরি হয়েছে বিভিন্ন উপাদানে। কোনও মূর্তি সূক্ষ্ম বা অপেক্ষাকৃত মোটা দানার কষ্টিপাথরে নির্মিত, কোনও মূর্তি পিতল বা মিশ্রধাতুতে গঠিত, কোনও মূর্তি সোনা বা রূপার মতো মূল্যবান ধাতুতে গড়া, আবার কোনওটিবা দারুমূর্তি। মূর্তিগুলি সাধারণত স্থানক বা দণ্ডায়মান এবং আসন বা উপবিষ্ট ভঙ্গিমায় উপস্থাপিত। স্থানক ভঙ্গির আবার বিভিন্ন রূপ — সমপদস্থান, আভঙ্গ, ত্রিভঙ্গ এবং অতিভঙ্গ। দু’পায়ের উপর সমান ভর দিয়ে দাঁড়ানোর যে ভঙ্গি তা সমপদস্থান। সোজা অথচ ঈষৎ বেঁকে দাঁড়ানোর ভঙ্গি আভঙ্গ। তিনটি খাঁজে বা বাঁকে দাঁড়ানোর ভঙ্গি ত্রিভঙ্গ। দাঁড়ানোর ভঙ্গিমায় তিনের অধিক খাঁজ থাকলে তা অতিভঙ্গ। উপবিষ্ট প্রতিমার কোনওটি পর্যঙ্কাসন, কোনওটি বজ্র পর্যঙ্কাসন, কোনওটি ললিতাসন, আবার কোনওটিবা মহারাজলীলাসন। দু’পা ঝুলিয়ে বসাকে পর্যঙ্কাসন বলে। এক পায়ের উপর আর এক পা আড়াআড়িভাবে রেখে যে উপবেশন তা বজ্র পর্যঙ্কাসন। একটি পা আসনের উপর খাঁড়াভাবে রেখে অন্য পা ঝুলিয়ে বসার নাম ললিতাসন। এ আসন অর্ধ পর্যষ্কাসন নামেও পরিচিত। একটি পা সমতলে, অপর পাটি সোজা রেখে বসা মহারাজলীলাসন।
পালযুগের প্রথম পর্বের অর্থাৎ খ্রিস্টীয় ৮ম শতকের ভাস্কর্যের নিদর্শনাদি মূলত বিধৃত রয়েছে পাহাড়পুর মন্দিরের ভিত্তিগাত্রের কোণের কুলুঙ্গিতে। কষ্টিপাথরে তৈরি এই মূর্তিগুলির মধ্যে অনেকগুলিই কৃষ্ণের বাল্যলীলাবিষয়ক। কখনও কৃষ্ণ গিরিগোবর্ধনধারী, কখনও তিনি নবনীতভোজী, আবার কখনওবা তিনি গোপ ও গোপিনীপরিবৃত। অন্যান্য মূর্তিগুলির মধ্যে রয়েছে অবলোকিতেশ্বর, নৃত্যরত রমণী, দ্বারপাল, মিথুন নরনারী এবং সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিকৃতি। এসব মূর্তিতে শিল্পগত অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে। মূর্তিগুলি অতিরিক্ত গুরুভার। তাদের আকৃতি ও প্রকৃতিতে সৌষ্ঠবের একান্ত অভাব। হাতগুলি কাঠির মতো। সূক্ষ্মরেখায় প্রবাহিত মনোরম ছন্দ এগুলিতে নেই। গুরুভার পোশাকে দেহ ঢাকা পড়ে গেছে। এই মূর্তিগুলি হয়তো ভাস্কর্যশিল্পের উৎকৃষ্ট নিদর্শন নয়। কিন্তু এদের ভিতর দিয়ে শিল্পীর প্রকাশভঙ্গির যে স্বকীয়তা এবং শিল্পশাস্ত্র নয়, চলমান জীবন থেকে শিল্পরস আহরণের যে উদ্যম প্রকাশ পেয়েছে। তা মনকে নাড়া দেয়। যে কৃষ্ণ তাঁরা গড়েছেন তিনি ব্রাহ্মণ্যধর্মের শ্রীকৃষ্ণ নন, তিনি দৈনন্দিন লোকায়ত জীবনের কৃষ্ণ। যে পাত্রপাত্রী মূর্তিতে রূপায়িত, তাঁরা প্রায়শই দেবলোকবাসী নন, সমকালীন সমাজজীবনের প্রতিনিধি। পাহাড়পুর মন্দিরগাত্রে এমন কয়েকটি মূর্তি আছে যাদের সুকুমার দেহভঙ্গি, সূক্ষ্ম পেলব গড়ন এবং নমনীয় ডৌল পূর্বাঞ্চলীয় গুপ্তশিল্পের কথা মনে করিয়ে দেয়। আবার এমন অনেক মূর্তি আছে যেখানে গুপ্ত প্রভাব খুবই ক্ষীণ এবং অবক্ষয়ের চিহ্ন সুস্পষ্ট। ষষ্ঠ এবং সপ্তম শতকে নির্মিত এই মূর্তিগুলি পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে পরবর্তিকালে পাহাড়পুর মন্দির গাত্রে আরোপিত হয়।
৯ম শতকের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে ভাস্কর্যশিল্পে নবজীবনের ঢেউ আসে। এ সময়কার ধাতব ও প্রস্তর মূর্তিগুলির দেহ পেলব, কমনীয় ও ছন্দময়, মুখশ্রী প্রশান্ত এবং দৃষ্টি ভাবালু। গুপ্তকালীন মার্গরীতির পূর্ব ভারতীয় ধারার প্রভাব এখানে সুপরিস্ফুট। বরিশালের লক্ষ্মণকাটির বিষ্ণুমূর্তি, দিনাজপুরের মঙ্গলবাড়ির তারামূর্তি, হুগলি জেলার বারাহীমূর্তি এই সময়কার। ভাস্কর্যের এই নবজীবনের পিছনে শিল্পী ধীমান এবং তাঁর পুত্র বীতপালের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। ধর্মপাল ও দেবপালের সমকালীন বরেন্দ্রীবাসী এই দু’জন শিল্পীর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন তারনাথ। তিনি বলেছেন, ভাস্কর্যশিল্পে ধীমান মধ্যদেশীয় এবং বীতপাল প্রাচ্য শৈলী প্রবর্তন করেন। কিন্তু পাল রাজাদের রাজত্বকালে বিহার এবং বাংলা এক একক সত্তারূপে আত্মপ্রকাশ করে। ফলে বাংলা ও বিহারের শিল্পরীতিতে আঙ্গিক বা গুণগত পার্থক্যের পরিবর্তে এক মৌল ঐক্যের সুর ধ্বনিত হয়। সে কারণে পালশিল্প সম্পর্কে দু’টি পৃথক বিভাগের কথা ভাবা অবান্তর। উভয় অঞ্চলের ভাস্কর্যের মধ্যে যে কোনও পার্থক্য নেই তা কিন্তু নয়। সে পার্থক্য গৌণ। মৌল বৈশিষ্ট্যে দু’টি অঞ্চলের ভাস্কর্য একই সূত্রে গ্রথিত। নীহাররঞ্জন রায় ও সরসীকুমার সরস্বতীর মতো শিল্পরসিকেরা পাল শিল্পকলাকে পূর্ব ভারতীয় বা প্রাচ্যদেশীয় রীতি আখ্যা দিয়েছেন।
৯ম শতকের শিল্পগত গুণাবলি ১০ম শতকের ভাস্কর্যেও অক্ষুণ্ণ ছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল শক্তিগর্ভ স্থূল দেহ নির্মাণের প্রবণতা। গ্রন্থি সংকোচক পেশীর ক্রিয়া এই মূর্তিগুলিতে অধিকতর প্রত্যক্ষ। পৃষ্ঠপট এবং কেন্দ্রস্তম্ভে অলংকরণের প্রবণতাও বেশি। তা সত্ত্বেও মূর্তিগুলির শান্ত ও কমনীয় ভাবের কোনও ব্যাঘাত ঘটেনি। এই লক্ষ মূর্তিগুলির মধ্যে পড়ে বরিশালের লোকেশ্বর শিব, ঢাকার সুখরামপুরের জন্তুল, উত্তর বাংলার মনসা, বগুড়ার সিলিমপুরের বরাহরূপী বিষ্ণু, পাওগাছার ইন্দ্রাণী, ফরিদপুরের উজানীর বুদ্ধ, দিনাজপুরের সুরোহরের ঋষভনাথ, হুগলি জেলার মহিষমর্দিনী এবং মুর্শিদাবাদের নবগ্রামের বিষ্ণু।
১১শ শতকের ভাস্কর্যে দেহরূপের ক্ষীণতার দিকে প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এই মূর্তিগুলির দেহের উপরিভাগের গড়ন মনোরম। মুখমণ্ডল প্রশান্ত। কিন্তু জানুদেশের গড়নে আগেকার কমনীয়তা বা গতিময়তা আর নেই। অলংকরণের প্রবণতাও অনেক বেশি। এই পর্বের মূর্তিগুলির মধ্যে রাজশাহী জেলার জোরার সূর্য, খুলনা জেলার শিববাটির বুদ্ধ, ঢাকার বেতকার বাসুদেব কুমিল্লার বাঘাউড়ার বিষ্ণু, মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘির ঋষিকেশ এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ভাঙড়ের মঞ্জুশ্রীর উল্লেখ করা যায়।
পালযুগের শেষপর্বের মূর্তিগুলিতে অবক্ষয়ের চিহ্ন আরও প্রকট। দেবদেবীর মুখায়বে পূর্বের সে সংবেদনশীলতা আর ছিল না। গতিময়তার কোনও চিহ্নই নেই। পদযুগল স্তম্ভের মতো স্থাণুবৎ। আর আছে অকারণ অলংকরণ বাহুল্য। ঢাকার চণ্ডী, পশ্চিম দিনাজপুরের সদাশিব ও রংপুরের বিষ্ণু এই শ্রেণিভুক্ত।
মৃৎশিল্প : ভাস্কর্যের একটি অঙ্গ মৃৎশিল্প। সে সময়কার অসংখ্য পোড়ামাটির ফলক থেকে তৎকালীন মৃৎশিল্পের অগ্রগতির পরিচয় পাওয়া যায়। এই অঞ্চলে, বিশেষ করে বাংলায় প্রচুর পরিমাণে পাথর না থাকায় বিহার ও মন্দিরের অঙ্গসজ্জার জন্য পোড়ামাটির ফলক ব্যবহার করা হত। একান্তই স্থানীয় শিল্পীদের লোকায়ত শিল্পের এই নিদর্শনগুলির বেশির ভাগই ধ্বংস হয়ে গেছে। তবু যা আছে তাতে জনজীবনের নানা দিক আভাসিত হয়েছে। সমকালীন জীবনের কোনও দিকই এই মৃৎশিল্পীদের দৃষ্টি এড়ায়নি। রামায়ণ, মহাভারত, পঞ্চতন্ত্র ও বৃহৎকথার নানা কাহিনি যেমন এই ফলকগুলিতে উপস্থাপিত হয়েছে, তেমনি রূপায়িত হয়েছে প্রত্যন্ত বাংলা-বিহারের নানা নর-নারীর নানা দেহরূপ, নানা সংস্কার এবং স্বপ্নময় ও বাস্তব প্রাণী জগতের নানা বিচিত্র নিদর্শন। বিভিন্ন ভঙ্গিমায় জননী ও শিশু, শারীরক্রিয়ারত মল্লবীর, যষ্টিধৃত দ্বারপাল, জল আহরণরতা ও জলপাত্রবাহিনী রমণী, নারী-পুরুষ যোদ্ধা, রথারোহী ধনুর্ধর, ভ্রাম্যমান সন্ন্যাসী, হতদরিদ্র ভিক্ষুক, শিকারবাহী ব্যাধ, গীতবাদ্যরত পুরুষ, ধর্মাচরণরত ব্রাহ্মণ, মোরগ-ষাঁড় লড়াই ও নানা কৌতুকময় দৃশ্য, সবই এই ফলকগুলিতে রূপায়িত হয়েছে। বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীদের মূর্তিও আছে তবে সংখ্যায় তারা স্বল্প।
পাল ভাস্কর্যশিল্পে দু’টি বিপরীতমুখী ভাবনার অভিব্যক্তি দেখা যায়। পালযুগের প্রতিমাকলা নিরীক্ষণ করলে বোঝা যায়, এ যুগের শিল্পভাবনায় দু’টি পরস্পর বিরোধী ধারণা কাজ করেছিল। একদিকে শিল্পী যেমন ইহগত, দৈহিক, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কামনা-বাসনার সত্য প্রকাশে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন তেমনি তিনি অন্যদিকে নৈর্ব্যক্তিক, অতীন্দ্রিয় ধ্যান-ধারণার রূপায়ণে সচেষ্ট থেকেছেন। একদিকে তন্ত্রসাধনার দেহবাদ তাঁকে অনুপ্রেরিত করেছে, অপরদিকে আত্মোপলব্ধি তথা অধ্যাত্ম্য বাদের মাহাত্ম্য তাঁকে আন্দোলিত করেছে। এই দুই বিরোধী সংঘাত-আবর্তে পাল শিল্পপ্রবাহ আন্দোলিত।
চিত্রকলা : পালযুগের চিত্ররীতি গড়ে উঠেছিল পুঁথিচিত্র আশ্রয় করে। দেয়ালচিত্র বা ভিত্তিচিত্র হয়তো একেবারে অজ্ঞাত ছিল না। কিন্তু এ সম্পর্কে সঠিক কোনও তথ্য নেই। প্রাক-প্রথম মহীপাল পর্বের কোনও পুঁথি পাওয়া যায় না। ফলে পালযুগের দু’শ বছরের অধিক আদি পর্বের চিত্ররীতির সঙ্গে আমাদের কোনও প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটেনি। তবে এই পর্বের চিত্রকলায় গুপ্ত মার্গরীতির যে ঘনিষ্ঠ প্রভাব ছিল সে সম্পর্কে বোধহয় কোনও সন্দেহ নেই। প্রথম মহীপালদেবের সময় থেকে রামপালের কাল পর্যন্ত পুঁথিচিত্রে সেই মাগরীতির আদর্শ ও মানস পরিস্ফুট। রেখা ও রঙের সুষম ব্যবহার এই চিত্রগুলির বৈশিষ্ট্য। ছেদহীন, সাবলীল, তরঙ্গায়িত রেখার বিন্যাসে দেহের নতোন্নত অংশ যেমন একসূত্রে গ্রথিত হয়েছে, তেমনি পরিস্ফুটিত হয়েছে বর তনু ও তার বর্তুলতা। রঙের স্নিগ্ধ ও সুষম ছায়ে প্রস্ফুটিত হয়েছে শ্যামোজ্জ্বলতার আভাস। সৌষ্ঠব মাধুর্যের চিহ্নমাত্র নেই এমন চিত্র যে এ সময় অঙ্কিত হয়নি, তা নয়। কিন্তু সে ধরনের চিত্র স্বল্প। পালযুগের অন্তিম পর্বের চিত্রগুলিতে পূর্বের সৌকর্য বা মাধুর্য অন্তর্হিত। ভঙ্গশীল, কুটিল রেখা বিন্যাসে আর রঙের সমমাত্রিক ছায়াহীন ব্যবহারে চিত্রগুলি ছন্দবিহীন নকশায় পরিণত হয়েছে। দণ্ডায়মান মূর্তির অর্ধচন্দ্রাকার রূপ, পার্শ্বগত ভঙ্গিতে উদ্গত চোখ, এই পর্বের পাল চিত্রকলার সাধারণ লক্ষণ। এটি অবশ্যই অবক্ষয়ের চিহ্ন।
মন্তব্য : পালযুগের ইতিহাসকে অনেকে বাংলার ইতিহাসের এক অধ্যায়রূপে চিহ্নিত করেছেন। গোপাল সম্ভবত উত্তর বাংলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তবু পাল ইতিহাসকে শুধু বাংলার ইতিহাস বলে দাবি করার পিছনে কোনও সংগত কারণ আছে বলে মনে হয় না। পাল রাজগণের সঙ্গে বিহারের সম্পর্ক কম নিবিড় ছিল না, বরঞ্চ বাংলার তুলনায় এ সম্পর্ক দীর্ঘতর ছিল। বাংলা থেকে যখন তাঁরা নির্বাসিত তখনও বিহারের কিয়দংশে তাঁদের আধিপত্য অটুট ছিল। বস্তুত পাল শাসনকালে বাংলা এবং বিহার স্বতন্ত্র অঞ্চলরূপে নয়, এক একক সত্তারূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল। এর প্রমাণ ছড়িয়ে আছে সে আমলের ভাস্কর্যে, স্থাপত্যে, চিত্রকলায় এবং সাহিত্যে। বাংলা ও বিহারের এই একক সত্তারূপে গড়ে ওঠাই হল পালযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান।
গ্রন্থপঞ্জি
রাজবৃত্ত অংশ
- অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় : গৌড়লেখ *(রাজশাহী, ১৩১৯)। দীনেশচন্দ্র সরকার : পাল ও সেন যুগের বংশানুচরিত (কলকাতা, ২০০৯)।
- নীহাররঞ্জন রায় : বাঙ্গালীর ইতিহাস, আদি পর্ব (কলকাতা, ১৯৯৩)।
- রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় : বাঙ্গালার ইতিহাস: প্রথম খণ্ড (কলকাতা, ১৩২১)।
- Chaudhury, Abdul Momin: Dynastic History Of Bengal (Dacca, 1967).
- Ganguly, D. K.: Ancient India : History And Archaeology. (New Delhi, 1994).
- Majumdar, R. C.: History Of Ancient Bengal (Calcutta, 1974).
- Majumdar, R. C. (Ed.): The History Of Bengal, Vol. I (Dacca, 1943); The Age Of Imperial Kanauj (Bombay, 1964).
- Morrison, B. M.: Political centres and cultural regions in early Bengal (Tuscon, 1970).
- Paul, P. L.: The Early History Of Bengal: From the Earliest Times to the Muslim Conquest (Calcutta, 1939 ).
- Sen, B. C.: Some Historical Aspects Of The Inscriptions Of Bengal: Pre-Mohammedan Period (Calcutta, 1942 ).
- Sircar, D. C. Epigraphic Discoveries In East Pakistan (Calcutta, 1973).
প্রশাসন, সমাজ, অর্থনীতি, ধর্ম, সাহিত্য, স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলা অংশ
- অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় : গৌড়লেখমালা (রাজশাহী, ১৩১৯)।
- দীনেশচন্দ্র সরকার : পাল ও সেন যুগের বংশানুচরিত (কলকাতা, ২০০৯)।
- নলিনীনাথ দাশগুপ্ত : বাঙ্গালার বৌদ্ধধর্ম (কলকাতা, ১৩৫৫)। নীহাররঞ্জন রায় : বাঙ্গালীর ইতিহাস : আদি পর্ব (কলকাতা, ১৯৯৩)। রণবীর চক্রবর্তী : প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসের সন্ধানে (কলকাতা, ১৯৮৬)। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় : বাঙ্গালার ইতিহাস, প্রথম খণ্ড (কলকাতা, ১৩২১)। সরসীকুমার সরস্বতী : পাল যুগের চিত্রকলা (কলকাতা, ১৯৮৫)।
- Dikshit, K. N.: Excavations At Paharpur (Memoirs of the Archaeological Survey of India, No. 55 (Delhi, 1938).
- Gopal, L.: The Economic Life Of Northern India (Varanasi, 1963). Khan, F. A.: Mainamati-A Preliminary Report on the Recent Archaeological Excavations in East Pakistan (Karachi, 1963).
- Majumdar, R. C.: History Of Ancient Bengal (Calcutta, 1974). Majumdar, R. C. (Ed.): The History of Bengal, Vol. I (Dacca, 1943): The Age of
- Imperial Kanauj (Bombay, 1964). Morrison, B. M.: Political Centres and Cultural Regions in Early Bengal (Tuscon, 1970).
- Sen, B. C.: Some Historical Aspects Of The Inscriptions Of Bengal Pre-Moham
- medan Period (Calcutta, 1942). Saraswati, S. K.: Early Sculpture Of Bengal (Calcutta, 1962); A Survey Of Indian Sculpture (Calcutta, 1957).
সেন রাজবংশ (১১৬১-১২৪৫/৬০) ও সমকালীন বাংলা
আদি বাসভূমি ও জাতি-পরিচয়
পাল প্রভুত্বের অবসান ঘটিয়ে যে রাজশক্তি ধীরে ধীরে বাংলার শাসন কর্তৃত্ব অধিকার করে বসে বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসে সেই রাজশক্তি সেন রাজবংশ নামে পরিচিত।
আদি বাসভূমি
এই সেন রাজারা কিন্তু বাঙালি নন, তাঁরা ছিলেন বহিরাগত। সেনরাজ বিজয় সেনের দেওপাড়া শিলালেখে বলা হয়েছে, দাক্ষিণাত্যের চন্দ্রবংশীয় রাজা বীরসেন তাঁর পূর্ব পুরুষ ছিলেন। লক্ষ্মণসেনের মাধাইনগর তাম্রশাসনে সেন বংশের এক আদি নৃপতি সামন্তসেনকে কর্ণাট-ক্ষত্রিয়রূপে আখ্যাত করা হয়েছে। বোঝা যাচ্ছে, সেনরা আসলে দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের অধিবাসী ছিলেন। দেওপাড়া শিলালেখেও সেন রাজগণের সঙ্গে কর্ণাটকের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ইঙ্গিত আছে। এই লেখে বলা হয়েছে, সামন্তসেন কর্ণাট লুণ্ঠনকারীদের যুদ্ধে নিহত করেন এবং তাঁর বিজয়গাথা সেতুবন্ধ রামেশ্বরের নিকটবর্তী অঞ্চলে প্রচার লাভ করে। সেনরা যে কন্নড়ভাষাভাষী কর্ণাটক থেকে বাংলায় এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন, তা সুনিশ্চিত।
ঠিক কখন কর্ণাটবাসী সেনরা বাংলায় বসতি স্থাপন করেন, সে সম্পর্কে সেন লেখমালায় পরস্পর বিরোধী তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। দেওপাড়া লেখ বলছে, বিজয়সেনের পিতামহ সামন্তসেন কর্ণাটে যৌবনের দিনগুলি অতিবাহিত করে শেষ বয়সে গঙ্গাতীরবর্তী এক স্থানে বসবাস করেন। এ থেকে অনুমিত হয়, সামন্তসেনই সম্ভবত প্রথম বাংলার রাঢ় অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। কিন্তু বল্লালসেনের নৈহাটী তাম্রশাসনে ইঙ্গিত আছে, সেনরা সামন্তসেনের বহু পূর্ব থেকেই রাঢ় বাংলায় বসবাস করছিলেন।
বিল্হণের ‘বিক্রমাঙ্কদেবচরিত’ থেকে জানা যায়, কর্ণাটকের চালুক্য সেনাদল প্রথম সোমেশ্বরের রাজত্বকালে বাংলা ও অসম আক্রমণ করে। এ বিজয়াভিযান পরিচালনা করেন যুবরাজ ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্য। তখন পালরাজ তৃতীয় বিগ্রহপালের রাজত্বকাল। সিংহাসনে আরোহণের পরও বিক্রমাদিত্য সম্ভবত পূর্ব ভারত বিজয়ে অগ্রসর হয়েছিলেন। ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের এক অনুগত পদস্থ রাজপুরুষ আচ। তিনি এক লেখে দাবি করেছেন, তিনি অঙ্গ, বঙ্গ, গৌড়, মগধ, কলিঙ্গ এবং নেপালে তাঁর প্রভুর আধিপত্য বিস্তার করেন। ১১২২-২৩ খ্রিস্টাব্দে আচ বিক্রমাদিত্যের অধীনে এক প্রাদেশিক শাসকের পদে নিযুক্ত ছিলেন। মনে হয়, আচের এই সামরিক অভিযান ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের রাজত্বকালেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তখন পাল সিংহাসনে রামপাল অধিষ্ঠিত ছিলেন। বিক্রমাদিত্যের বিজয়ী সেনাদলের সঙ্গে সেনদের বাংলায় আসা কিছুমাত্র বিচিত্র নয়। আবার তারও পূর্বে সেনদের বাংলায় বসতি স্থাপনের সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দেবপালের সময় থেকে রামপালের আমল পর্যন্ত পাল লেখে রাজপুরুষদের তালিকায় ‘গৌড় মালব-খশ-হূণ-কুলিক-কর্ণাট-লাট-চাট-ভাট’দের উল্লেখ পাওয়া যায়। এ থেকে মনে হয়, কর্ণাট অঞ্চলের লোকদের বাংলা ও বিহারে রাজকার্যে নিয়োগের প্রথা দেবপালের সময় থেকে চলে আসছিল। কাজেই ১১শ শতকের পূর্বেই হয়তো কর্ণাটকের সেনরা বাংলায় বসতি স্থাপন করেছিলেন।
জাতি-পরিচয়
মাধাইনগর তাম্রশাসনে সেনদের কর্ণাট-ক্ষত্রিয় বলা হয়েছে। অর্থাৎ সেন রাজারা কর্ণাট অঞ্চলের ক্ষত্রিয় ছিলেন। কিন্তু দেওপাড়া লেখে সেনদের শুধু ক্ষত্রিয় বলা হয়নি, বলা হয়েছে ব্রহ্ম-ক্ষত্রিয়। ব্রহ্ম-ক্ষত্রিয় বা ব্রহ্ম-ক্ষত্রি এক সংকর জাতি। এই জাতির লোকদের ধমনীতে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের রক্ত প্রবহমান। সেনরা সম্ভবত এই সংকর জাতির লোক ছিলেন। সেনদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ব্রহ্ম-ক্ষত্রিয় যৌগিক পদটিকে অনেকে অন্য অর্থে গ্রহণ করেছেন। তাঁদের অভিমত, সেনরা বর্ণে ব্রাহ্মণ ছিলেন কিন্তু পরে রাজবৃত্তি অর্থাৎ ক্ষত্রিয়ত্ব অবলম্বন করে ব্রহ্ম-ক্ষত্রিয় নামে পরিচিত হন। এই ব্যাখ্যার মূলেও যুক্তি আছে। লেখে সামন্তসেনকে ব্রহ্মবাদী রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। বৈদিক যাগ-যজ্ঞের প্রতি সেন রাজগণের অনুরাগের কথাও লেখমালায় সগৌরবে ঘোষিত হয়েছে। সেনরা আদিতে ব্রাহ্মণ ছিলেন, এ অভিমত ভ্রান্ত নাও হতে পারে।
সেন রাজগণ কর্ণাটকের ধারবাড় অঞ্চলের এক জৈন সাধু পরিবারের বংশধর, এই মর্মে এক অভিমত ব্যক্ত হয়েছে। এই জৈন সাধুদের সকলেরই অন্তনাম সেন। সাধুদের পরিচয়ও ‘সেনান্বয়’ বলে। তাঁদের আবির্ভাব কাল আনুমানিক ৮৫০ থেকে ১০৫০ খ্রিস্টাব্দ। এই সাধুদের একজন ছিলেন বীরসেন। আবার সেন রাজপরিবারেরও এক আদি পুরুষ বীরসেন। হতে পারে, দু’টি পরিবার আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ ছিল। সুনির্দিষ্ট তথ্যের অভাবে এ সম্পর্কে কোনও সুনিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব নয়।
রাজবৃত্তান্ত
সামন্তসেন ও হেমন্তসেন
সামন্তসেন : সেনরা যে সময়ই বাংলায় আসুন না কেন, হেমন্তসেনের সময় থেকেই পশ্চিম বাংলায় তাঁদের জয়যাত্রা শুরু হয়। সেন লেখমালায় হেমন্তসেনের পিতা সামন্তসেনের উল্লেখ আছে বটে কিন্তু তাঁকে কখনও রাজা বলে বর্ণনা করা হয়নি। কাজেই সামন্তসেন কোনও রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, এ ধারণা পোষণ করা যায় না। মনে হয় পালরাজ তৃতীয় বিগ্রহপাল বা তাঁর কোনও উত্তরাধিকারী তাঁকে রাঢ়ের এক অঞ্চলের প্রশাসকের পদে নিযুক্ত করেছিলেন। জীবনের অপরাহ্ন বেলায় পুত্র হেমন্তসেনের হাতে নিজ জনপদের প্রশাসনিক দায়িত্ব অর্পণ করে তিনি বানপ্রস্থ গ্রহণ করেন। সামন্তসেনের কোনও লেখের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
হেমন্তসেন : পিতার পদাধিকারী রূপে হেমন্তসেন জীবন আরম্ভ করেছিলেন বলে মনে হয়। পুত্র বিজয়সেনের ব্যারাকপুর তাম্রশাসনে তাঁকে মহারাজাধিরাজ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। পালশক্তির দুর্বলতার সুযোগে তিনি তাঁর অঞ্চলটিকে কার্যত এক স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে গড়ে তোলেন। অর্থাৎ, আইনত পাল রাজাদের অনুগত হলেও তিনি কার্যত স্বাধীনই ছিলেন। পাল রাজশক্তিকে তীব্র আঘাত হানার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। তাঁর রাজ্যটিও বৃহদায়তনের ছিল না। দেওপাড়া লেখে তাঁর এক মহিষীর উল্লেখ আছে। তিনি মহিষী যশোদেবী। হেমন্তসেনের কোনও অভিলেখ আজও আবিষ্কৃত হয়নি।
বিজয়সেন (আ. ১০৯৬-১১৫৯ খ্রিস্টাব্দ)
হেমন্তসেনের মৃত্যুর পর রাজা হলেন তাঁর মহিষী যশোদেবীর গর্ভজাত পুত্র বিজয়সেন। (রমেশচন্দ্র মজুমদারের (History of Ancient Bengal (Calcutta, 1971), পৃষ্ঠা ২২৩) মতে বিজয়সেনের রাজত্বকাল আ. ১০৯৫ হতে ১১৫৮ খ্রিস্টাব্দ।) পাল ও বর্মা রাজাদের হাত থেকে তিনি বাংলার বহু স্থান অধিকার করেন। উত্তর বিহারেও তাঁর অধিকার প্রসার লাভ করে। পূর্ব ভারতের এক বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তিরূপে সেনদের আত্মপ্রকাশ ঘটল। সেন রাজ্যটি যেন সহসা তাঁর শৈশব অতিক্রম করে যৌবনে উপনীত হল।
কিন্তু রামপালের জীবিতকালে বিজয়সেন খুব যে একটা সাফল্য অর্জন করেছিলেন, তা বলা যায় না। রামচরিতে বিজয়রাজ নামে নিদ্রাবলীর জনৈক রাজার কথা আছে। কৈবর্তরাজ ভীমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি রামপালকে সৈন্যবল দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। অনেকে এই বিজয়রাজকে বিজয়সেনের সঙ্গে এক ও অভিন্ন বলে মনে করেন। এ মতের সমর্থনে বিশেষ কোনও প্রমাণ নেই। কিন্তু রামপালের সময় বিজয়সেন যে রাঢ়ের এক অঞ্চলে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করেছিলেন সে সম্পর্কে কোনও সন্দেহ নেই।
সেন অধিকৃত রাঢ়ের সে অঞ্চলটির অবস্থান সঠিক জানা যায় না। ধোয়ীর ‘পবনদূত’ কাব্যে গঙ্গার তীরবর্তী কিন্তু ত্রিবেণীর নিকটবর্তী বিজয়পুরকে লক্ষ্মণসেনের রাজধানী বলা হয়েছে। মনে হয়, বিজয়সেন বিজয়পুর নগরের প্রতিষ্ঠা করেন। সম্ভবত এই বিজয়পুরই ছিল তাঁর রাজধানী। অনেকের মতে প্রাচীন বিজয়পুর বর্তমান নবদ্বীপ। মুসলমান ঐতিহাসিকেরা এই শহরটিকেই নওদীহ্ বা নুদিয়া বলেছেন। কুলপঞ্জি ও প্রাচীন কিংবদন্তিতেও নবদ্বীপ সেন রাজধানীর স্বীকৃতি লাভ করেছে। বীরভূম জেলার রামপুরহাটের নিকটবর্তী পাইকোড় গ্রামে বিজয়সেনের একখানি শিলালেখ আবিষ্কৃত হয়েছে। মনে হয়, প্রথম দিকে বিজয়সেনের রাজ্য নদিয়া থেকে বীরভূম তথা বিহার সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
অপর মন্দার বা হুগলি অঞ্চলের শূর রাজবংশের কন্যা বিলাসদেবীকে বিজয়সেন বিবাহ করেন। শ্বশুরকুলের সহায়তা তাঁর ক্ষমতাবৃদ্ধির এক সম্ভাব্য কারণ হতে পারে। আনন্দভট্টের বল্লালচরিতে বিজয়সেনকে চোড়গঙ্গের সখা (চোড়গঙ্গসখঃ) বলা হয়েছে। তাঁর অভ্যুত্থানের মূলে ওড়িশার গঙ্গবংশীয় নরপতি অনন্তবর্মা চোড়গঙ্গের (আ. ১০৭৮-১১৪৭ খ্রিস্টাব্দ) সক্রিয় সমর্থনও থাকতে পারে। বিজয়সেন যখন রাঢ়ে আধিপত্য স্থাপন করছিলেন তখন উত্তর বিহারে নান্যদেবের নেতৃত্বে একটি নতুন রাজ্য গড়ে উঠছিল। নান্যদেব এবং বিজয়সেন উভয়েরই আদি বাড়ি কর্ণাটকে। এই দুই রাজনৈতিক ভাগ্যান্বেষীর মধ্যে প্রথম দিকে হয়তো প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল এবং তাঁরা সম্ভবত পারস্পরিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতিতে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন।
সভাকবি উমাপতিধর দেওপাড়া প্রশস্তিতে বিজয়সেনের বিজয়কাহিনি বর্ণনা করেছেন। বিজয়সেনের বিজয়াভিযানের উল্লেখ প্রসঙ্গে উমাপতিধর বলছেন, “ত্বং নান্যবীরবর্ধনবিজয়ীতি গিরঃ কবীনাম্/ শ্রুত্বান্যথামননরূঢ়নিগূঢ়রোষঃ।/ গৌড়েন্দ্ৰমদ্রবদপাকৃত কামরূপভূপম্/কলিঙ্গমপি যস্তরসা জিগায় ৷৷” শ্লোকটিতে বলা হচ্ছে, “কবিরা বন্দনা করছিলেন, বিজয়সেন, তুমি নান্য, বীর, বর্ধন প্রভৃতি রাজন্যবর্গকে হতমান করেছ। কিন্তু বিজয়সেন এই বন্দনাগীতির মর্মার্থ বুঝতে পারলেন না। তিনি ভাবলেন, কবিরা তাঁর প্রশংসা করছেন না, অপর একজনের গুণগান করছেন (ত্বং ন, অন্য বীরবিজয়ী)। ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে বিজয়সেন অতঃপর গৌড়, কামরূপ ও কলিঙ্গের নৃপতিগণকে অবলীলাক্রমে পরাজিত করেন।” উমাপতিধরের আর একটি উক্তি এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়, “শূরম্মন্য ইবাসি নান্য কিমিহ স্বং রাঘব শ্লাঘসে স্পর্ধাম্?/বর্ধন মুঞ্চ বীর বিরতো নাদ্যাপি দৰ্পস্তব ৷৷” শ্লোকটির ভাবার্থ, “নান্য, তুমি বৃথাই নিজেকে বীর মনে করছ। রাঘব, তুমি অকারণে আস্ফালন করছ। বর্ধন, তুমি নিরস্ত হও। বীর, তোমার দর্প এখনও চূর্ণ হল না!”
দেওপাড়া অভিলেখের উপরোক্ত শ্লোক দু’টি প্রমাণ করছে, বিজয়সেন নান্য, বীর, রাঘব ও বর্ধন নামে কতিপয় রাজা এবং গৌড়, কামরূপ ও কলিঙ্গের অধিপতিদের পরাজিত করেছিলেন। বিজয়সেনের হাতে যাঁরা পরাজিত হন, তাঁদের মধ্যে নান্য ছিলেন মিথিলার কর্ণটি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। প্রথম জীবনে বিজয়সেন ও নান্য হয়তো পরস্পরের সহযোগী ছিলেন কিন্তু পরে তাঁদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। নান্যের পরাজয়ের ফলে মিথিলা সেন অধিকারভুক্ত হয়। ওড়িশার গঙ্গবংশীয় একজন রাজার নাম রাঘব (আ. ১১৫৬-৭০ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি অনন্তকা চোড়গঙ্গের পুত্র। বিজয়সেন হয়তো তাঁকে পরাজিত করেছিলেন। বিনয়চন্দ্র সেনের মতে, রাঘব রামপালেরই এক নাম। বিজয়সেনের হাতে রামপালের পরাভব ও মৃত্যু ঘটে বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেছেন। এ অভিমত বিবেচনার দাবি রাখে। বর্ধন কৌশাম্বীর দ্বোরপবর্ধন। বীরগুণের মতো তিনিও রামপালকে ভীমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাহায্য করেছিলেন।
গৌড়রাজ অবশ্যই পালনৃপতি মদনপাল। গৌড়ের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নিঃসন্দেহে বিজয় সেনের আধিপত্য স্থাপিত হয়। তাঁর দেওপাড়া অভিলেখখানি তো রাজশাহী জেলায় আবিষ্কৃত হয়েছে। সেখানে প্রদ্যুম্নেশ্বর নামে এক হরিহরমূর্তি প্রতিষ্ঠা তো উত্তর বাংলায় তাঁর আধিপত্য বিস্তারের প্রমাণ। তবু মনে হয়, সমগ্র উত্তর বাংলা তিনি জয় করতে পারেননি। ‘গৌড়েশ্বর’ অভিধাও তিনি গ্রহণ করেননি। উত্তর বাংলার পশ্চিমাঞ্চলে পালরাজ মদনপালের কর্তৃত্ব অক্ষুণ্ণ ছিল। পালরাজ মদনপালের বিরুদ্ধে বিজয়সেনের সংঘর্ষের পরোক্ষ সমর্থন আছে ভাগলপুর জেলার আন্টিচকে প্রাপ্ত খ্রিস্টীয় ১২শ শতকের এক শিলাস্তম্ভ লেখে। এই শিলালেখে সাহুর বা সাহব্বর নামে জনৈক বিদগ্ধ কবির উল্লেখ আছে। তিনি গৌড়রাজের সামন্ত বা সেনাপতিরূপে বঙ্গেশ্বরের নৌবাহিনী ধ্বংস করেছিলেন। এই গৌড়েশ্বর সম্ভবত মদনপাল এবং বঙ্গপতি, বিজয়সেন। এ থেকে মনে হয়, বিজয়সেনের প্রতিকূলতা সত্ত্বেও গৌড়ের কিয়দংশ মদনপালের অধিকারভুক্ত ছিল।
বিজয়সেনের কলিঙ্গ বিজয়ের দাবির সত্যতা নির্ধারণ করা কঠিন। তাঁর পৌত্র লক্ষ্মণসেন পুরীতে জয়স্তম্ভ স্থাপনের দাবি করেছেন। হতে পারে, লক্ষ্মণসেন পিতামহের জীবিতকালে কলিঙ্গে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। আবার কলিঙ্গে লক্ষ্মণসেনের এ সামরিক অভিযান তাঁর নিজের রাজত্বকালীন ঘটনাও হতে পারে। কিন্তু বিজয়সেন কলিঙ্গ অধিকার করেছিলেন এ মত সম্ভবত গ্রহণযোগ্য নয়।
বিজয়সেনের কামরূপরাজকে বিতাড়নের দাবি অযৌক্তিক বলে মনে হয় না। তবে তিনি কামরূপে অভিযান পাঠিয়েছিলেন বা সে অঞ্চল জয় করেছিলেন, এমন বোধ হয় না। কামরূপরাজ সম্ভবত সেন রাজ্য আক্রমণ করেছিলেন আর বিজয়সেন সে আক্রমণ প্রতিহত করেন। সে সময় কামরূপ অঞ্চলে বৈদ্যদেব বা তাঁর এক উত্তরাধিকারী রাজত্ব করতেন।
দেওপাড়া লেখে বিজয়সেনের পশ্চিম দিকে নৌ-অভিযান প্রেরণের উল্লেখ আছে। লেখটিতে বলা হয়েছে, পাশ্চাত্য-চক্র অর্থাৎ পশ্চিমী রাজগণকে পদানত করার উদ্দেশ্যে বিজয়সেনের নৌবহর গঙ্গানদীর প্রবাহ ধরে অগ্রসর হয়েছিল। আশ্চর্যের বিষয়, এই অভিযানের সাফল্য সম্পর্কে লেখে কোনও কথা বলা হয়নি। কোন্ কোন্ রাজাদের বিরুদ্ধে এই অভিযান, সে সম্পর্কেও লেখখানি নীরব। সেনরাজ্যের পশ্চিমে যেসব রাজারা রাজত্ব করতেন তাঁদের মধ্যে মিথিলাপতি নান্যদেব, গাহড়বালরাজ গোবিন্দচন্দ্র এবং পাল নৃপতি মদনপাল সবিশেষ উল্লেখ যোগ্য। বিজয়সেনের লক্ষ্য কি এঁরা সকলেই, না এঁদের এক বা একাধিক জন? এ প্রশ্নের উত্তর নেই। মনে হয়, এই অভিযান খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি। পূর্ব বাংলা বিজয়সেনের রাজ্যভুক্ত ছিল। সম্ভবত বর্মাদের বিতাড়িত করে তিনি এ অঞ্চল অধিকার করেন। তাঁর ব্যারাকপুর তাম্রশাসন ঢাকা জেলার বিক্রমপুর নগর থেকে প্রদত্ত হয়। এই বিক্রমপুরেই তাঁর মহিষী তুলাপুরুষ মহাদান যজ্ঞানুষ্ঠান করেন। এই উপলক্ষে বিলাসদেবী জনৈক ব্রাহ্মণকে খাড়ী-বিষয়ের একখণ্ড জমি প্রদান করেন। খাড়ী-বিষয় দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলায় অবস্থিত ছিল। এ থেকে প্রমাণ হয়, বিজয়সেনের রাজ্য দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। শৈবধর্মের অনুরাগী ছিলেন বিজয়সেন। লেখে তিনি ‘পরমমাহেশ্বর’রূপে আখ্যাত হয়েছেন। মহেশ্বর অর্থাৎ শিবের পরম ভক্ত, এই অর্থে পরমমাহেশ্বর। শৈবধর্মের প্রতি অনুরাগবশে তিনি রাজশাহী শহরের সন্নিকটে দেওপাড়া গ্রামে এক সুবিশাল মন্দির নির্মাণ করেন এবং মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রদ্যুম্নেশ্বর নামে হরিহর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। পদুমসর দিঘির তীরে এই মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে।
শিল্প ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকও ছিলেন তিনি। দেওপাড়া প্রশক্তির রচয়িতা কবি উমাপতিধর তাঁর অনুগ্রহভাজন ছিলেন। প্রখ্যাত শিল্পী শূলপাণি তাঁর প্রসাদধন্য ছিলেন। শূলপাণিকে ‘রাণক’ অভিধায় ভূষিত করা হয়। দেওপাড়া অভিলেখ তাঁরই উৎকীর্ণ করা। লেখে শূলপাণি বরেন্দ্রের শিল্পী গোষ্ঠীর চূড়ামণিরূপে বর্ণিত হয়েছেন। প্রথিতযশা কবি শ্রীহর্ষের ‘বিজয়প্রশস্তি’ এবং ‘গৌড়োবীশকুলপ্রশস্তি’ নামে দু’খানি কাব্য আছে। কাব্য দু’খানি এখনও অনাবিষ্কৃত। অনেকেই বলেন, সেনরাজ বিজয়সেনের কীর্তিকলাপ ও তাঁর বংশের গৌরবকাহিনি অবলম্বনেই কাব্য দু’টি রচিত হয়েছে। শ্রীহর্ষ ছিলেন গাহড়বালরাজ জয়চ্চন্দ্রের সভাকবি। বিজয়প্রশস্তির বিজয় সেনরাজ বিজয়সেন, এ অভিমত সঠিক হলে স্বীকার করতে হয়, বিজয়সেনের বীরত্বকাহিনি কান্যকুব্জ নিবাসী শ্রীহর্ষের মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। কিন্তু এ অভিমত সর্বজনগ্রাহ্য নয়। দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকর মনে করেন, বিজয়প্রশস্তির বিজয় ছিলেন জয়চ্চন্দ্রের পিতা গাহড়বাল নৃপতি বিজয়চন্দ্র। আর ‘গৌড়োবীশকুলপ্রশস্তি’তে বিজয়সেনের বংশগৌরব কীর্তিত হয়েছে কিনা সে সম্পর্কেও সন্দেহ আছে। বিজয়সেনের সময় সেন রাজবংশ গৌড়োবীশকুল নামে পরিচিত থাকার কথা নয়। সেন বংশের লক্ষ্মণসেনই প্রথম গৌড়েশ্বর।
বিজয়সেনের ব্যারাকপুর তাম্রশাসনখানি তাঁর ৬২তম রাজ্যবর্ষে প্রদত্ত হয়। এ থেকে অনুমিত হয়, তিনি অন্যূন ৬২ বৎসর রাজত্ব করেন। বীর্যবান, কীর্তিমান নরপতি এই বিজয়সেন। উত্তরের কিয়দংশ ব্যতীত সমগ্র বাংলা তাঁর পদানত ছিল। উত্তর বিহারেও তাঁর অধিকার বিস্তার লাভ করেছিল। বাংলায় রাজনৈতিক অস্থিরতার অবসান ঘটিয়ে এক শক্তিশালী রাজ্য গঠন করে তিনি তাঁর কৃতিত্বের পরিচয় রেখে গেছেন।
বল্লালসেন (আ. ১১৫৯-৭৯ খ্রিস্টাব্দ)
আনুমানিক ১১৫৯ খ্রিস্টাব্দে বিজয়সেনের মৃত্যু হলে তাঁর শূর বংশীয়া মহিষী বিলাসদেবীর গর্ভজাত সন্তান বল্লালসেন পিতৃসিংহাসনে আরোহণ করেন। ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে আনন্দভট্টের লেখা বল্লালচরিতে বল্লালসেনের রাজনৈতিক জীবনের পরিচয় পাওয়া যায়। কিছু কিংবদন্তি বা কল্পনাশ্রিত কাহিনি এই গ্রন্থে স্থান পেয়েছে ঠিকই কিন্তু বল্লালের রাজনৈতিক জীবনের কিছু সত্য ঘটনাও এই গ্রন্থে পরিবেশিত হয়েছে। বল্লালচরিতে বল্লালসেনকে মগধ ও মিথিলা বিজেতারূপে বর্ণনা করা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, বল্লালসেনের রাজ্য বঙ্গ, বরেন্দ্র, রাঢ়, বাগড়ী এবং মিথিলা, এই পাঁচটি প্রদেশ নিয়ে গঠিত ছিল। অদ্ভুতসাগরে তাঁকে গৌড়রাজের দমনকারী বলা হয়েছে।
এসব বর্ণনার মধ্যে কিছু ঐতিহাসিক সত্য অবশ্যই আছে। বল্লালসেন মিথিলা জয় করেননি। তাঁর পিতা এই অঞ্চল অধিকার করেন। মিথিলা সম্ভবত বল্লালসেনের রাজ্যভুক্ত ছিল। মিথিলায় তখন কর্ণাটবংশীয় রাজারা রাজত্ব করতেন বলে দীনেশচন্দ্র সরকার অভিমত ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু এ অভিমতের যাথার্থ্য সম্পর্কে সংশয় রয়েছে। নান্যদেবের পর মিথিলার পরবর্তী কর্ণাট বংশী রাজা হরসিংহদেব। ভুললে চলবে না, তাঁর রাজত্বকাল খ্রিস্টীয় ১৪শ শতকের প্রথম পর্ব। তাছাড়া, এই মিথিলাতেই একদা লক্ষ্মণসেন সংবৎ বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। ফলে বল্লালসেনের আমলে মিথিলায় সেন আধিপত্য অটুট ছিল, এরূপ ধারণাই যেন সংগত বোধ হচ্ছে। মগধে সেনরাজ্য বিস্তারের সপক্ষে কোনও প্রমাণ নেই। ভাগলপুর জেলার সনোখার গ্রামে তাঁর নবম রাজ্যবর্ষে উৎকীর্ণ এক মূর্তিলেখ আবিষ্কৃত হয়েছে। এই অঞ্চল সে সময় অঙ্গ নামে পরিচিত ছিল। রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন, বল্লালসেন মগধের তদানীন্তন পাল নৃপতি গোবিন্দপালকে সিংহাসনচ্যুত করেন। কিন্তু এ মত প্রমাণসাপেক্ষ। এ কথা ঠিক, গোবিন্দপালোত্তর পর্বে মগধ আর পালরাজ্যভুক্ত ছিল না। কিন্তু মগধে বল্লালের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মগধের কিয়দংশ সম্ভবত গাহড়বালরাজ বিনয়চন্দ্রের কর্তৃত্বাধীন ছিল।
নৈহাটি তাম্রশাসনে বর্ণিত আছে, বল্লালসেন বিক্রমপুর থেকে বর্ধমান-ভুক্তির অন্তর্গত এবং উত্তর রাঢ়া মণ্ডলে অবস্থিত একটি গ্রাম জনৈক ব্রাহ্মণের অনুকূলে প্রদান করেন। এ থেকে বোঝা যায়, পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা তাঁর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বাগড়ী অঞ্চলের সঠিক অবস্থান জানা যায় না। সুন্দরবন, মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, হাওড়া, হুগলি প্রভৃতি অঞ্চলে পণ্ডিতেরা এর অবস্থান নির্দেশ করেছেন। তবে মেদিনীপুর অঞ্চল সম্ভবত বল্লালসেনের রাজ্য ভুক্ত ছিল না। সে অঞ্চল ওড়িশার গঙ্গবংশীয় রাজাদের অধীন ছিল। অদ্ভুতসাগরে গৌড়েশ্বরের বিরুদ্ধে বল্লালসেনের সাফল্যের ইঙ্গিত আছে। পালরাজ গোবিন্দপাল ‘গৌড়েশ্বর’ অভিধা গ্রহণ করেছিলেন। বল্লালসেন হয়তো তাঁর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিলেন। কিন্তু বল্লাল নিজে কখনও ‘গৌড়েশ্বর’ উপাধি ধারণ করেননি। গৌড়েশ্বর গোবিন্দপালের বিরুদ্ধে বল্লালসেন কিছু সাফল্য অর্জন করতে পারেন কিন্তু তিনি উত্তর বাংলায় নিরঙ্কুশ আধিপত্য স্থাপনে ব্যর্থ হন।
প্রায় দু’দশককাল রাজত্ব করার পর বল্লালসেন পরলোকগমন করেন। বল্লাল সম্পর্কে অদ্ভুত সাগরে বলা হয়েছে, পুত্র লক্ষ্মণসেনকে রাজ্যাভিষিক্ত করে সেনরাজ ভার্যাসহ গঙ্গা-যমুনা সঙ্গমে ‘নির্জরপুর’-এ গমন করেন। ‘নির্জরপুর’ স্থান বিশেষের নাম হতে পারে। হয়তো রাজকার্য থেকে অবসর নিয়ে তিনি তাঁর পত্নীর সান্নিধ্যে জীবনের শেষ দিনগুলি ধর্মকর্মের মধ্য দিয়ে নির্জরপুরে অতিবাহিত করেন। কিন্তু ‘নির্জরপুর’ শব্দের এই ব্যাখ্যা সম্পর্কে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। ‘নির্জরপুর’ বলতে দেবস্থান বা স্বর্গও বোঝায়। তাই তাঁদের অভিমত, বল্লালসেন সপত্নীক স্বেচ্ছায় গঙ্গাজলে আত্মবিসর্জন দেন। বিষয়টি নিঃসন্দেহে বিতর্কিত।
সুপণ্ডিত ছিলেন রাজা বল্লালসেন। ‘দানসাগর’ নামে একখানি গ্রন্থ তিনি রচনা করেন। ‘অদ্ভুতসাগর’ গ্রন্থটির রচনার কাজেও তিনি হাত দেন কিন্তু তিনি গ্রন্থখানি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি। তাঁর মৃত্যুর পর পুত্র লক্ষ্মণসেন গ্রন্থখানি সমাপ্ত করেন। চালুক্য রাজকুমারী রামদেবী তাঁর মহিষী ছিলেন।
কুলপঞ্জি গ্রন্থাদিতে বল্লালসেন রাঢ়ীয় ও বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ সমাজে কৌলীন্যপ্রথার প্রবর্তকরূপে বর্ণিত হয়েছেন। দীনেশচন্দ্র সরকার মনে করেন, কৌলীন্যপ্রথা বাংলায় পূর্ব থেকেই প্রচলিত ছিল ; ভ্রমবশত কুলপঞ্জিতে এই প্রচলিত সামাজিক ব্যবস্থা সেনরাজের উপর আরোপিত হয়েছে। তবে আচার, বিনয়, বিদ্যা, প্রতিষ্ঠা, তীর্থদর্শন, নিষ্ঠা, বৃত্তি, তপস্যা ও দান – এই নয়টি গুণের ভিত্তিতে বল্লালসেন কতিপয় ব্যক্তি বা পরিবারকে ‘কুলীন’ মর্যাদায় উন্নীত করেছিলেন, এরূপ সম্ভাবনাও তিনি স্বীকার করেছেন।
কিন্তু কৌলীন্যপ্রথার উদ্ভব ও বিকাশে বল্লালসেনের কোনও ভূমিকা ছিল বলে মনে হয় না। সত্য বলতে কী, এই প্রথার তখন উদ্ভবই হয়নি। পাল-সেন পর্বের কোনও লেখে বা স্মৃতি-ব্যবহার গ্রন্থে এই প্রথা সম্বন্ধে ইঙ্গিতমাত্রও নেই। সমকালীন গ্রন্থাদি ও লেখমালায় বহু প্রসিদ্ধ ও অনামী ব্রাহ্মণের উল্লেখ আছে। এঁদের একজনকেও ‘কুলীন’ বলে পরিচয় দেওয়া হয়নি। বল্লালসেন নিজে গ্রন্থ রচনা করেছেন ; তাঁর পুত্র লক্ষ্মণসেনও গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। বল্লাল ও লক্ষ্মণ কৌলীন্য প্রথার উদ্ভবের সঙ্গে জড়িত থাকলে এসব গ্রন্থাদিতে তার উল্লেখ থাকত। খ্রিস্টীয় ১৬শ শতকে রচিত আনন্দভট্টের বল্লালচরিতও এ সম্পর্কে নীরব।
কখনও কখনও বলা হয়, বল্লালসেন বলালী সন নামে এক সংবৎ প্রচলন করেন। কিন্তু বল্লালসেন কোনও সংবৎ প্রচার করেছেন বলে জানা যায় না। বল্লালচরিতে বল্লালসেন সম্পর্কে কয়েকটি কাহিনি পরিবেশিত হয়েছে। কিন্তু এগুলি নিছকই কিংবদন্তি, অনৈতিহাসিক। এরূপ একটি কিংবদন্তি গড়ে উঠেছে বল্লালসেন ও মহাস্থানের ধর্মগিরি নামে তথাকথিত এক শৈব মহন্তের বিরোধকে কেন্দ্র করে। ধর্মগিরি এক সময় সেন রাজ পুরোহিতকে অপমান করেন। সেনরাজ ধর্মগিরিকে নির্বাসন দণ্ড দিয়ে পাল্টা আঘাত হানেন। অপমানিত ধর্মগিরি ম্লেচ্ছরাজ বায়াদুম্বকে বিক্রমপুর আক্রমণে প্ররোচিত করেন। ম্লেচ্ছপতির বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার সময় বল্লালসেন এক জোড়া পায়রা সঙ্গে নিলেন। মহিষীগণ ও পরিজনদের তিনি বলে গেলেন, যুদ্ধে তাঁর পরাজয় হলে মৃত্যুবরণের পূর্বে তিনি পায়রা দু’টিকে ছেড়ে দেবেন। পাখি দু’টিকে দেখলেই তাঁরা যেন নিজেদের সম্মান বাঁচাতে অগ্নিকুণ্ডে আত্মাহুতি দেন। যুদ্ধে বল্লালসেন শত্রুগণকে সংহার করেন। কিন্তু কোনওক্রমে কপোত দু’টি খাঁচা থেকে বেরিয়ে রাজপ্রাসাদে উড়ে আসে। তাদের দেখে মহিষীগণ ও পরিজনেরা ভাবলেন, রাজার পরাজয় ঘটেছে। আর কালবিলম্ব না করে তাঁরা সকলে অগ্নিতে আত্মাহুতি দিলেন। যুদ্ধ শেষে বল্লাল রাজধানী রামপালে ফিরে এলেন। দেখলেন, সব শেষ। তখন শোকে-দুঃখে তিনিও অগ্নিতে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এ কাহিনি কল্পনাপ্রসূত। বল্লালের সময় ম্লেচ্ছ বা মুসলমান অভিযানের কথা নিছকই এক আষাঢ়ে গল্পের মতো শোনায়।
বল্লালসেন ও সঙ্ককোটবাসী ধনী সুবর্ণ বণিক বল্লভানন্দের বিরোধ আর একটি কিংবদন্তির উপজীব্য বিষয়। উদন্তপুরের রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য বল্লাল বল্লভানন্দের কাছ থেকে এক কোটি নিষ্ক বা স্বর্ণমুদ্রা ধার করেন। কিন্তু তাঁর আরও মুদ্রার প্রয়োজন হওয়ায় তিনি বল্লভানন্দের নিকট অতিরিক্ত দেড় কোটি স্বর্ণমুদ্রা চেয়ে পাঠান। বণিক বললেন, ধার তিনি দেবেন কিন্তু এর বিনিময়ে তাঁকে হরিকেলী প্রদেশের রাজস্বের অধিকার দিতে হবে। এতে বল্লাল ক্রুদ্ধ হন এবং বলপূর্বক বহু বণিকের ধন-সম্পত্তি অধিগ্রহণ করেন। বণিকদের উপর নানা রকম বিধি নিষেধ চাপানো হয়। এরপর রাজবাড়ির এক নিমন্ত্রণে সৎ-শূদ্র ও বণিকদের পঙ্ক্তিভোজনের ব্যবস্থা হলে বণিকেরা ভোজনে অসম্মত হন। এদিকে বল্লভানন্দ পালপক্ষে যোগ দেন। মগধের পালরাজের সঙ্গে তিনি নিজ কন্যার বিবাহও দেন। রাজার ক্রোধানলে ঘৃতাহুতি পড়ল। বল্লাল বণিকদের শূদ্র বলে ঘোষণা করেন। ব্রাহ্মণদের সতর্ক করে দেওয়া হল, তাঁরা যেন কোনও বণিকের বাড়িতে পৌরোহিত্য, শিক্ষাদান ও দানগ্রহণ না করেন। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে তাঁরা সমাজে পতিত হবেন। বণিকেরা চড়াদামে দাস-দাসীদের কিনে নিয়ে রাজ্য জুড়ে ভৃত্য-সংকট সৃষ্টি করলেন। গৃহকর্মের জন্য অন্যান্য সম্প্রদায়ের পক্ষে ভৃত্য-সংগ্ৰহ দুর্ঘট হয়ে উঠল। তখন বল্লাল মালাকার, কৈবর্ত, কুম্ভকার এবং কর্মকারদের সৎ-শূদ্র পর্যায়ে উন্নীত করলেন। রাজা সুবর্ণবণিকদের উপবীত ধারণ নিষিদ্ধ করলেন। বণিকেরা সেনরাজ্য ছেড়ে অন্যান্য রাজ্যে চলে যেতে থাকেন। রাজা দেখলেন, ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের মধ্যে অসদাচরণের প্রবণতা বাড়ছে। তাঁদের প্রতি আদেশ হল, প্রায়শ্চিত্ত করে পরিশুদ্ধ হতে হবে। যেসব ব্রাহ্মণ বাণিজ্যজীবী ছিলেন, তাঁদের ব্রাহ্মণত্ব কেড়ে নেওয়া হল। এটিও এক আষাঢ়ে গল্পের মতই শোনায়।
লক্ষ্মণসেন (আ. ১১৭৯-১২০৬ খ্রিস্টাব্দ)
আনুমানিক ১১৭৯ খ্রিস্টাব্দে প্রায় ৬০ বছর বয়সে লক্ষ্মণসেন পিতৃসিংহাসনে আরোহণ করেন। রণদক্ষতা তাঁর কম ছিল না। কিন্তু উদ্যম, বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার তাঁর একান্তই অভাব ছিল। তাই সগৌরবে যাঁর রাজত্বের সূচনা, ব্যর্থতায় তাঁর রাজত্বাবসান। বীর, পণ্ডিত ও গুণগ্রাহী হয়েও লক্ষ্মণসেন বাংলার ইতিহাসে এক ভাগ্যাহত, পরাজিত নায়ক।
জীবনের প্রথম পর্বে লক্ষ্মণসেনের সাফল্য প্রশংসনীয়। কবি শরণ তাঁর রচনায় জনৈক সেনরাজের গৌড়, কলিঙ্গ, কামরূপ, কাশী এবং মগধ জয়ের কথা বলেছেন। চেদি এবং ম্লেচ্ছ রাজারাও নাকি তাঁর নিকট পরাজিত হয়েছিলেন। উমাপতিধরও এক সেন রাজার প্রাগজ্যোতিষ বা কামরূপ এবং কাশী জয়ের কথা বলেছেন। শরণ বা উমাপতিধর কেউই বিজয়ী সেনরাজের নামোল্লেখ করেননি। কিন্তু তাঁরা উভয়েই লক্ষ্মণসেনের সভাকবি ছিলেন। তাঁদের বর্ণিত সেনরাজ সম্ভবত লক্ষ্মণসেন। লক্ষ্মণসেনের নিজের ভাওয়াল ও মাধাইনগর তাম্রশাসনে তাঁর হাতে কাশী, গৌড়, কামরূপ ও কলিঙ্গ নৃপতিদের পরাজয়ের কথা বলা হয়েছে। তাঁর পুত্র বিশ্বরূপসেনের লেখে দাবি উত্থাপিত হয়েছে, লক্ষ্মণসেন কৃষ্ণ ও বলরামের আবাসস্থল অর্থাৎ পুরী, বারাণসী ও প্রয়াগে বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করেছেন। সমকালীন সরকারি দলিলে তিনি ‘গৌড়েশ্বর’ বলে অভিনন্দিত হয়েছেন। তাঁর পিতা ও পিতামহ ‘গৌড়েশ্বর’ অভিধা ধারণ করেননি।
এসব কৃতিত্বের মধ্যে কিছু কিছু হয়তো তাঁর পিতামহ বিজয়সেনের রাজত্বকালে অর্জিত হয়েছিল কিন্তু সবগুলি নিশ্চয় নয়। তাঁর ‘গৌড়েশ্বর’ অভিধা থেকে মনে হয়, সমগ্র উত্তর বাংলা তাঁর পদানত ছিল। তদানীন্তন পাল নৃপতি পলপালেরও অভিধা ছিল গৌড়েশ্বর। পলপালকে বিতাড়িত করেই লক্ষ্মণসেন গৌড়ে তাঁর একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু মুঙ্গের অঞ্চলে পলপালের কর্তৃত্ব তখনও অক্ষুণ্ণ ছিল। হয়তো তিনি সেনরাজের বশীভূত মিত্র ছিলেন। আবার এমনও হতে পারে, গাহড়বালরাজ জয়চ্চন্দ্র এবং লক্ষ্মণসেনের পারস্পরিক বিরোধের সুযোগে তিনি মুঙ্গেরে স্বাধীনভাবেই রাজত্ব করেন।
মিথিলা পূর্ব থেকেই সেন অধিকারভুক্ত ছিল। মিথিলার সঙ্গে সম্পর্ক তিনি আরও সুদৃঢ় করেন। তাঁর নামে পরিচিত ল বা লক্ষ্মণ সংবৎ এই অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত ছিল। মিথিলায় এই সংবতের দীর্ঘকালীন প্রচলন এতদঞ্চলে সেনপ্রভুত্বের এক পরোক্ষ প্রমাণ। (দীনেশচন্দ্র সরকার মনে করেন, গয়া অঞ্চল থেকে যেসব লোকজন মুসলমান আক্রমণের সময় মিথিলায় আশ্রয় গ্রহণ করেন তাঁরাই সম্ভবত স্থানীয় অঞ্চলে এই অব্দটি প্রচলন করেন; এই অব্দের সঙ্গে মিথিলায় লক্ষ্মণসেনের রাজত্বের কোনও সম্পর্ক নাও থাকতে পারে। উল্লেখ্য, ল বা লক্ষ্মণ সংবৎ লক্ষ্মণসেনের রাজত্বের প্রথম বর্ষ থেকে গণিত হয়নি, গণিত হয়েছে সেন রাজার অজ্ঞাত জন্মবর্ষ থেকে। সাধারণত ১১০৮ বা ১১১৯-২০ খ্রিস্টাব্দে লক্ষ্মণসেনের জন্মবর্ষ ধার্য করা হয়। লক্ষ্মণসেন নিজে কোনও অব্দ প্রচলন করেননি। তা যদি তিনি করতেন, তাঁর লেখে তার উল্লেখ থাকত।)
লক্ষ্মণসেনের কাশীরাজকে পরাজিত করার দাবি কতদূর সত্য, তা নিরূপণ করা কঠিন। কাশী বা তপার্শ্ববর্তী অঞ্চলে লক্ষ্মণসেনের কোনও লেখ আবিষ্কৃত হয়নি। এই অঞ্চল তখন গাহড়বালরাজ জয়চ্চন্দ্রের শাসনাধীন। কিন্তু জয়চ্চন্দ্রের সঙ্গে লক্ষ্মণসেন যে সংঘর্ষে জড়িত হন, তা নিশ্চিত। ১১৮৩ থেকে ১১৯২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে উৎকীর্ণ জয়চ্চন্দ্রের একখানি শিলালেখ বোধ গয়ায় আবিষ্কৃত হয়েছে। লেখটি প্রমাণ করছে, মগধে জয়চ্চন্দ্রের শাসনাধিকার প্রতিষ্ঠিত ছিল। এ অঞ্চলে লক্ষ্মণসেনের অতীত-রাজ্য-সংবৎ প্রচলিত ছিল। অশোকচল্পের বোধগয়া লেখ দুখানিতে তা প্রমাণিত। এই লেখ দু’টি সেনরাজের ৫১ এবং ৭৪ অতীত-রাজ্য-সংবতে উৎকীর্ণ হয়েছিল। (অতীত-রাজ্য-সংবৎ সম্ভবত আনুমানিক ১২০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে গণিত হয়।) অনুমান করা যায়, কিছুদিনের জন্য হলেও মগধে লক্ষ্মণসেনের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত ছিল। লক্ষ্মণ সেনের এ সাফল্য অবশ্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। মগধ পুনরায় গাহড়বালদের অধিকারভুক্ত হয়।
অনিশ্চয়তা রয়েছে চেদি এবং কলিঙ্গরাজের বিরুদ্ধে লক্ষ্মণসেনের সাফল্য সম্পর্কেও। লক্ষ্মণসেনের পক্ষ থেকে যেমন চেদিদের বিরুদ্ধে জয়ের দাবি করা হয়েছে, তেমনি বল্লভরাজ নামে এক পদস্থ চেদি রাজপুরুষ গৌড়রাজের বিরুদ্ধে বিজয় লাভের দাবি করেছেন। এসব দাবির হয়তো কোনও ঐতিহাসিকতা নেই। উভয় পক্ষে আদৌ কোনও সংঘর্ষ হয়েছিল কিনা তাও নিশ্চিতরূপে বলা যায় না। লক্ষ্মণসেনের কলিঙ্গ বিজয় সম্ভবত তাঁর পিতামহের রাজত্বকালের ঘটনা। স্মরণ করা যেতে পারে, বিজয়সেনও কলিঙ্গ বিজয়ের দাবি করেছেন। কলিঙ্গ লক্ষ্মণসেনের রাজ্যভুক্ত বলে রমেশচন্দ্র মজুমদার এবং বিনয়চন্দ্র সেন অভিমত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু ওড়িশায় সেনরাজ্য বিস্তারের কোনও প্রমাণ নেই।
বাংলায় অবশ্য লক্ষ্মণসেনের কর্তৃত্ব অটুট ছিল। চব্বিশ পরগনার গোবিন্দপুর, নদিয়ার আনুলিয়া, দিনাজপুরের তর্পণদিঘি, পাবনার মাধাইনগর, ঢাকার রামপাল ও ভাওয়াল এবং মুর্শিদাবাদের শক্তিপুরে সেন রাজার তাম্রপট্ট আবিষ্কৃত হয়েছে। এই লেখগুলিতে তাঁর বর্ধমান ভুক্তি, পৌণ্ড্রবর্ধনভুক্তি, বরেন্দ্রী, উত্তর রাঢ়া প্রভৃতি অঞ্চলে ভূমিদানের কথা বলা হয়েছে। মেদিনীপুর বাদে বাংলার সর্বত্র লক্ষ্মণসেনের কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল।
তাঁর রাজত্বের শেষের দিকে রাজ্যমধ্যে গোলযোগ দেখা দেয়। ১১৯৬ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মহারাজাধিরাজ ডোম্মনপাল সুন্দরবন অঞ্চলে এক স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। (অনেকের মতে তাঁর প্রকৃত নাম মডোম্মনপাল। লেখে তাঁকে শ্রীমডোম্মনপাল বলা হয়েছে। নামটিকে শ্রীমদ্ ডোম্মনপাল অর্থেই ধরা উচিত। দীনেশচন্দ্র সরকার বলেন, মডোম্মনপাল লক্ষ্মণসেনের অনুগত ছিলেন। এ মত সম্ভবত ঠিক নয়। প্রথমত, ডোম্মনপাল ‘মহারাজাধিরাজ’ অভিধা গ্রহণ করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, যে পূর্ব খাটিকা অঞ্চলে তিনি রাজত্ব করতেন, সেই পূর্ব খাটিকা তিনি অর্জন করেছিলেন (উপার্জিত) বলে লেখে দাবি করা হয়েছে।) মেঘনা নদীর পূর্বে দেব নামে এ সময় একটি স্বাধীন রাজ্য গড়ে ওঠে। দেবরাজারা পূর্বে সেন রাজগণের অধীনস্থ ছিলেন। আরও বড় বিপর্যয় লক্ষ্মণসেনের অপেক্ষায় ছিল। (মিনহাজ তাঁর সমকালীন সেনরাজকে রায় লখমনিয়া বলে উল্লেখ করেছেন। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, বিনয়চন্দ্র সেনদের মতো বিদ্বজ্জনদের মতে এই লখমনিয়া আসলে লাক্ষ্মণেয় অর্থাৎ লক্ষ্মণসেনের পুত্র। তাঁদের ধারণা, বখতিয়ারের নুদিয়া অভিযানের পূর্বে লক্ষ্মণসেন পরলোকগমন করেন। কিন্তু শ্রীধরদাসের সদুক্তিকর্ণামৃতের সংকলনবাচক শ্লোক হতে জানা যায়, ১২২৭ শকাব্দের ১০ ফাল্গুন বা ১২০৬ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসেও এই সেনরাজ জীবিত ছিলেন। এক সময় মনে করা হত, এই রাজনৈতিক ভাগ্যান্বেষীর নাম ইখতিয়ারউদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি। এর অর্থ বখতিয়ার খলজির পুত্র ইখতিয়ারউদ্দিন মোহাম্মদ। এই মতের আদি প্রবক্তা মেজর র্যাভার্টি। র্যাভার্টি সাহেব বলেন, তিনি তবকাৎ-ই-নাসিরীর বারোটি পুঁথির চারটিতে ‘বিন’ কথাটি দেখেছেন। বহু বিদ্বজ্জনই মনে করেন র্যাভার্টি সাহেবের এই দেখার মধ্যে ভুল আছে। অর্থাৎ ‘বিন’ শব্দটি থাকার কথা নয়। তাঁর পরীক্ষিত আটটি পাণ্ডুলিপিতে যে ‘বিন’ কথাটি নেই তাতো র্যাভাটি সাহেব নিজমুখেই স্বীকার করেছেন। তাহলে এই আটটি পাণ্ডুলিপির সাক্ষ্য বাতিল করা যায় কোন যুক্তিতে? সমকালীন তাজ-উল-মাসির গ্রন্থে তাকে সুস্পষ্টভাবে ইখতিয়ারউদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার বলা হয়েছে। অন্যান্য প্রাচীন ইসলামি গ্রন্থে তাঁর নাম বখতিয়াররূপেই নির্দিষ্ট হয়েছে। সুতরাং তাঁর নয়, তাঁর পিতার নাম বখতিয়ার, এ মত বর্তমানে পরিত্যক্ত হয়েছে।) এ বিপর্যয় এল ইখতিয়ারউদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজি নামে এক ও দুর্জয় সাহসী তুর্কি ভাগ্যান্বেষীর কাছ থেকে।
মোহাম্মদ বখতিয়ারের বাংলা অভিযানের বর্ণনা করেছেন মৌলানা মিনহাজউদ্দিন আবু উমার ই উসমান তাঁর ‘তবকাৎ-ই-নাসিরী’ নামের এক ঐতিহাসিক গ্রন্থে। তখনকার দিনের এক খ্যাতনামা ব্যক্তি মিনহাজউদ্দিন। দিল্লির সুলতানদের অধীনে নানা উচ্চপদে তিনি অধিষ্ঠিত ছিলেন। ৬৩৯ হিজরি অব্দে বা ১২৪১ খ্রিস্টাব্দে তিনি দিল্লির প্রধান কাজির পদ অলংকৃত করেন। পরের বছর তিনি স্বেচ্ছায় সরকারি কাজ থেকে অবসর গ্রহণ করে লখনৌতি বা গৌড়ে এসে দু’বছর সেখানে অবস্থান করেন। তখনই তিনি এ ঘটনার তথ্য আহরণ করেন। কিন্তু তাঁর তথ্যের মূল উৎস জনশ্রুতি এবং প্রত্যক্ষদর্শীর বিবৃতি, কোনও সরকারি দলিল-দস্তাবেজ নয়। তাঁর গ্রন্থখানি রচিত হয়েছে ৬৫৮ হিজরি অব্দে বা ১২৬০ খ্রিস্টাব্দে। মিনহাজউদ্দিনের বিবরণী থেকে জানা যায়, অশীতিপর বৃদ্ধ লক্ষ্মণসেন ভারতের রাজ নৈতিক ঘটনা প্রবাহের সেরকম খোঁজ-খবর রাখতেন না। অথচ সে সময় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল অগ্নিগর্ভ। ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে মোহাম্মদ ঘোরি তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে দিল্লি আজমেরের চৌহান-বংশীয় রাজপুতরাজ তৃতীয় পৃথ্বীরাজকে পরাজিত করেন। পরের বছরই কিংবা আরও বছরখানেক পর অর্থাৎ ১১৯৩ বা ১১৯৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি বারাণসী এবং কান্যকুব্জের গাহড়বালনৃপতি জয়চ্চন্দ্রকে চূর্ণ করেন।
এদিকে মোহাম্মদ বখতিয়ার প্রথমে গজনি ও পরে দিল্লিতে প্রত্যাখ্যাত হয়ে শেষে অযোধ্যার প্রশাসক হুসামউদ্দিন আঘল বকের অধীনে কর্ম গ্রহণ করেন এবং নিজস্ব সেনাবাহিনীর সহায়তায় মগধ বা দক্ষিণ বিহারে লুঠতরাজ চালনা করে বিপুল বৈভবের অধিকারী হন। বৈভব বৃদ্ধির সঙ্গে বাড়ে তাঁর ক্ষমতা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা। বিহারশরীফের ওদন্তপুরী বৌদ্ধবিহার তিনি বিধ্বংস করেন। অচিরে সমগ্র বিহার তাঁর করতলগত হয়। এসব খবর যখন লক্ষ্মণসেনের কর্ণগোচর হল তখন বখতিয়ারের বিহার বিজয় সম্পূর্ণ। জ্যোতিষীরা প্রচার করলেন, রাজ্যটি অচিরে তুর্কিদের হাতে চলে যাবে। শাস্ত্রে তুর্কি বিজেতার যে বর্ণনা আছে তার সঙ্গে বখতিয়ারের চেহারার নাকি অদ্ভুত সাদৃশ্য! মন্ত্রী ও পদস্থ রাজপুরুষেরা রাজাকে অন্যত্র চলে যেতে পরামর্শ দিলেন। ব্রাহ্মণ ও ধনাঢ্য বণিকেরা কেউ পূর্ববঙ্গে কেউবা অসম বা ওড়িশায় পালিয়ে গেলেন। কিন্তু লক্ষ্মণসেন তা করলেন না। তিনি নদিয়া বা নবদ্বীপেই অবস্থান করতে থাকেন।
এদিকে বাংলা জয়ের উদ্দেশ্যে সুসজ্জিত সেনাদল-সহ বখতিয়ার বিহার থেকে বহির্গত হলেন। এত দ্রুতগতিতে তিনি অগ্রসর হচ্ছিলেন যে মাত্র অষ্টাদশ অশ্বারোহী সেনা তাঁর সঙ্গে সমতা রক্ষা করতে সমর্থ হন। বাকি সৈন্যরা একটু পিছিয়ে পড়েছিলেন। নদিয়া শহর-দ্বারে পৌঁছে বখতিয়ার ও তাঁর সহগামী অষ্টাদশ সৈনিক কোনও শহরবাসীকে আঘাত না করে ধীরভাবে নগরের ভিতর দিয়ে অগ্রসর হন। শহরবাসীরা ভাবলেন, একদল বিদেশি বণিক বুঝি অশ্ববিক্রয়ের উদ্দেশ্যে শহরে এসেছেন। কিন্তু প্রাসাদদ্বারে পৌঁছে বখতিয়ার নিজ মূর্তি ধারণ করলেন। অসিহস্তে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন প্রাসাদরক্ষীদের ওপর। হঠাৎ এই আক্রমণের জন্য তাঁরা প্রস্তুত ছিলেন না। প্রাসাদের অভ্যন্তরে দারুণ বিশৃঙ্খলা, হৈ হট্টগোল। নগরের কেন্দ্রস্থল হতেও তুমুল আর্তনাদ এবং কোলাহল উত্থিত হল। অর্থাৎ ততক্ষণে তুর্কি বাহিনীর বাকি সৈন্যদলের এক বৃহদংশ নগরের ভিতরে ঢুকে পড়েছে। নগরও সম্ভবত অবরুদ্ধ হয়ে গেছে। তখন দ্বিপ্রহর। সেনরাজ আহারে বসেছিলেন। বিপদ বুঝে তিনি নগ্নপদে প্রাসাদের পিছনের দরজা দিয়ে গঙ্গার তীরে চলে এলেন। সেখান থেকে নৌকা করে ‘সঙ্কনাত্’ অর্থাৎ সমতট এবং বঙ্গ অভিমুখে যাত্রা করেন। নদিয়া এবং তদ্পার্শ্ববর্তী অঞ্চল বখতিয়ার বিনা বাধায় অধিকার করেন।
বখতিয়ারের নুদিয়া বা নদিয়া নবদ্বীপ বিজয়ের যে বর্ণনা মিনহাজউদ্দিন দিয়েছেন সে সম্পর্কে কয়েকটি প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। (নোদীয়হ্, নওদীহ্ নুদীয়হ্ ইত্যাদি বানানও ব্যবহৃত হয়। কোনও কোনও ঐতিহাসিক মনে করেন, মিনহাজ-বর্ণিত নুদিয়া বা নদিয়া রাজশাহী জেলার নওদা গ্রাম, পশ্চিম বাংলার নদিয়া নবদ্বীপ নয়।) বখতিয়ার লক্ষ্মণসেনের রাজ্যের ভিতর দিয়ে অগ্রসর হয়ে তাঁর নিবাসস্থল নদিয়া আক্রমণ ও অধিকার করলেন অথচ লক্ষ্মণসেনের মতো শক্তিশালী রাজা কোনও প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুললেন না, এটা ভাবা যায় না। তেমনি কল্পনা করা যায় না, যখন অনেকেই সম্ভাব্য তুর্কি আক্রমণের ভয়ে নদিয়া ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন, তখন লক্ষ্মণসেন নিশ্চেষ্ট হয়ে সে স্থানে অবস্থান করবেন, আত্মরক্ষা বা রাজ্যরক্ষার কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন না। অবশ্য বখতিয়ারের বিনা বাধায় নদিয়া অধিকারের যে কোনও সদুত্তর নেই, তা নয়। তবে তা একান্তই অনুমাননির্ভর। কারণ, এ বিষয়ে আলোকসম্পাত করতে পারে এমন কোনও বিশ্বাসযোগ্য তথ্য নেই।
বখতিয়ারের হাতে লক্ষ্মণসেনের এই চরম পরিণতির অবশ্য একটি সহজ ব্যাখ্যা আছে। বখতিয়ার যখন সেনরাজকে আক্রমণ করেন তখন সেনরাজ নদিয়ায় অবস্থান করছিলেন। নদিয়ায় লক্ষ্মণসেন এসেছিলেন তীর্থ পরিদর্শনে, পুণ্য অর্জন করতে। নদিয়া রাজ্যের রাজধানী ছিল না। তীর্থে যাচ্ছেন বলে রাজার সঙ্গে ছিলেন সীমিত সংখ্যক দেহরক্ষী। এঁদের পরাজিত করতে বখতিয়ারকে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। মিনহাজউদ্দিন যাকে রাজপ্রাসাদ বলেছেন সেটি আসলে ছিল এক অস্থায়ী রাজশিবির। অর্থাৎ, বখতিয়ার এক দুর্বল মুহূর্তে লক্ষ্মণসেনকে আক্রমণ করেন। এ আক্রমণের জন্য সেনরাজ প্রস্তুত ছিলেন না।
কিন্তু এ ব্যাখ্যার কয়েকটি ত্রুটি আছে। প্রথমত নদিয়া নিছক তীৰ্থস্থানই ছিল না, সেনরাজ্যের এক রাজধানীও ছিল। কুলজি গ্রন্থাদিতে নদিয়াকে সেনরাজ্যের রাজধানী রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। ধোয়ীর পবনদূতে উল্লিখিত সেনরাজধানী বিজয়পুর সম্ভবত এই নদিয়া। দ্বিতীয়ত, মিনহাজের বিবরণী থেকে মনে হয়, বখতিয়ার বিহার জয়ের পরই নদিয়া অভিযানের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। বখতিয়ারের সম্ভাব্য নদিয়া অভিযানের আতঙ্কেই স্থানীয় অধিবাসীদের অনেকে পূর্বাহ্নে শহর ত্যাগ করে অন্যত্র আশ্রয় গ্রহণ করেন। বস্তুত, বখতিয়ারের নদিয়া আক্রমণকালে লক্ষ্মণসেন অপ্রস্তুত ছিলেন, এটা মানা যায় না।
হতে পারে, নদিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা লক্ষ্মণসেন ঠিকই করেছিলেন তবে সে ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ ছিল। আশা করা গিয়েছিল, অভিযানকারীরা বিহার থেকে গঙ্গার তীর ধরে অগ্রসর হবেন। সেই মতো শত্রুর মোকাবিলায় রাজমহলের পাহাড়ি অঞ্চলে সেনসৈন্য সমাবেশ করা হয়েছিল। কিন্তু বখতিয়ার সহজগম্য, বহুল ব্যবহৃত পথটি ছেড়ে ঝাড়খণ্ডের দুর্গম অরণ্যের মধ্য দিয়ে অগম্য পথে নদিয়ার উপকণ্ঠে এসে উপস্থিত হন। প্রতিপক্ষের চাতুর্য লক্ষ্মণসেন ধরতে পারেননি। তাঁর গুপ্তচরেরাও তাঁকে অবহিত করতে পারেননি। ফলে উপযুক্ত প্রতিরোধ গড়া যায়নি।
কিংবা হয়তো সেনরাজ আত্মরক্ষার সব আয়োজনই করেছিলেন কিন্তু মীরজাফরদের চক্রান্তে তাঁর সে আয়োজন ব্যর্থ হয়ে যায়। বখতিয়ারসহ উনিশজন তুর্কি সৈন্য রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করলেন অথচ প্রাসাদরক্ষী ও রাজার দেহরক্ষীরা তাঁদের বাধা দিলেন না, অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করলেন, এ এক রহস্যজনক ব্যাপার। তুর্কি সৈন্য রাজ্যের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ করেছেন, এ সংবাদও রাজা চর মারফৎ জানতে পারলেন না। তুর্কি আক্রমণের প্রাককালে শাস্ত্রের কথা তুলে মন্ত্রীরা রাজাকে নদিয়া ত্যাগের পরামর্শ দিলেন অথচ শাস্ত্রে তুর্কি আক্রমণ বা তুর্কি সেনাপতির আকৃতি সম্পর্কে কোনও কথা নেই। মিনহাজের উক্তি সত্য হলে বুঝতে হবে, শাস্ত্ৰ জাল করা হয়েছিল। চক্রান্তজাল বহুদূর বিস্তীর্ণ না হলে এ ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা সম্ভব হয় না। যেখানে মন্ত্রী এবং পদস্থ রাজপুরুষদের বিশ্বাসঘাতকতা, তাঁদের আনুগত্য শত্রুপক্ষের নিকট বিক্রীত, সেখানে রাজা উপযুক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়বেন কী করে?
মাত্র অষ্টাদশ অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে বখতিয়ার বাংলা জয় করেছিলেন বলে যে জনপ্রবাদ প্রচলিত, তার মূলে কোনও ঐতিহাসিক সত্য নেই। তুর্কি সেনাপতি সমগ্র বাংলা জয় করেননি, নবদ্বীপসহ বাংলার একাংশ অধিকার করেছিলেন মাত্র। দ্বিতীয়ত, বখতিয়ারের অভিযানে মাত্র আঠারো জন সঙ্গী ছিলেন, এ কথাও ঠিক নয়। মিনহাজউদ্দিনও তা বলেননি। উনিশজনের একটি অগ্রগামী দল হয়তো ছিল। কিন্তু মূল বাহিনী সঙ্গেই ছিল, একটু পিছিয়ে পড়েছিল মাত্র। বখতিয়ারের অগ্রগামী সৈন্যদল যখন প্রাসাদ আক্রমণ করেন, মূল বাহিনীর একটি বৃহদংশ ততক্ষণে শহরে পৌঁছে গেছে।
তুর্কি সেনার নদিয়া বিজয়ের তারিখ সম্পর্কে মিনহাজউদ্দিন বিশেষ কিছু বলেননি। ‘সেকশুভোদয়া’ ও তিব্বতি ‘পগ্-সম্-জোন্-জঙ্গ’ গ্রন্থে বলা হয়েছে ঘটনাটি ১১২৪ শকাব্দে বা ১২০২ খ্রিস্টাব্দে ঘটে। কিন্তু বখতিয়ারের নুদিয়া-নদিয়া বিজয়ের তারিখ সম্পর্কে তবকাৎ-ই নাসিরীতে বলা হয়েছে, বখতিয়ার ওদন্তপুরী বিহার ধ্বংস করে বুদাউনে কুতবউদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং বুদাউন হতে ফিরে এসে বিহার বা মগধ বিজয় সম্পূর্ণ করার পরের বছর নুদিয়া আক্রমণ করেন। মিনহাজ বুদাউনে কুতবউদ্দিন ও বখতিয়ারের এই সাক্ষাৎকারের তারিখ সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করেননি কিন্তু কুতবউদ্দিনের সভাসদ হাসান নিজামি এবং পরবর্তী লেখক মোহাম্মদ কাশিম ফিরিস্তা উভয়েই একবাক্যে এই সাক্ষাৎকাল হিজরি ৫৯৯ অব্দে বা ১২০৩ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে ধার্য করেছেন। তখনও বখতিয়ারের বিহার বিজয় সম্পূর্ণ হয়নি। সে কাজ সম্পন্ন হয় তাঁর বুদাউন হতে প্রত্যাবর্তনের পর। ১২০৩ খ্রিস্টাব্দেই যে বখতিয়ার বিহার বিজয় সম্পূর্ণ করেন তা অসংকোচেই বলা যায়। পরবর্তী বৎসরে অর্থাৎ ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার নুদিয়া বা নদিয়া-নবদ্বীপ জয় করেন, এরূপ সিদ্ধান্তই সমীচীন বোধ হয়। নবদ্বীপ থেকে বিতাড়িত হয়ে লক্ষ্মণসেন পূর্ববঙ্গে রাজত্ব করতে থাকেন। উত্তর বাংলা তখনও তাঁর অধীনস্থ। এ অঞ্চলের লক্ষ্মণাবতী বা গৌড় ছিল সেনরাজের এক রাজধানী। লক্ষ্মণসেন উত্তর বাংলা থেকেও বিতাড়িত হলেন। বখতিয়ার লক্ষ্মণাবতী থেকে মোহাম্মদ ঘোরির নামে স্বর্ণমুদ্রা প্রচার করলেন। তাতে গৌড়বিজয়ের তারিখ ধার্য হয়েছে হিজরি ৬০১ অব্দের ১৯ রমজান। অর্থাৎ ১০ মে, ১২০৫ খ্রিস্টাব্দ। নবদ্বীপ ও গৌড়বিজয়ের মধ্যে বছর খানেকের ব্যবধান। গৌড় আক্রমণের পূর্বে মোহাম্মদ বখতিয়ার সম্ভবত আরও প্রস্তুতি গ্রহণের প্রয়োজন অনুভব করেন। সেই প্রস্তুতিকার্য সম্পন্ন হলে তিনি সসৈন্যে গৌড় অভিমুখে অগ্রসর হন।
পূর্ববঙ্গে যে লক্ষ্মণসেন শান্তিপূর্ণভাবে রাজত্ব করেন, তা মনে হয় না। সেখানেও বিপদ দেখা দিল। কুমিল্লা অঞ্চলে হরিকাল লক্ষ্মণসেনের পূর্ববাংলায় আশ্রয় গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তাঁকে বশে আনার ক্ষমতা সেনরাজের ছিল না। ১১৪১ শকাব্দে অর্থাৎ ১২১৯ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ তাঁর ময়নামতী তাম্রশাসন থেকে জানা যায়, হরিকাল অন্তত ১৭ বছর রাজত্ব করেছিলেন। হরিকালের মৃত্যুর পর কুমিল্লা বীরধরদেবের অধীনে চলে যায়। লক্ষ্মণসেন বা তাঁর উত্তরাধিকারীরা কুমিল্লা আর পুনরুদ্ধার করতে পারেননি।
লক্ষ্মণসেনের রাজত্বের কখন অবসান হয় তা জানা যায় না। সদুক্তিকর্ণামৃতের সাক্ষ্য অনুসারে তিনি ১২০৬ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসেও জীবিত ছিলেন। এর অনতিকাল পর তাঁর মৃত্যু হয়। সরকারি লেখমালায় লক্ষ্মণসেন কখনও ‘পরমবৈষ্ণব’, কখনওবা ‘পরমনারসিংহ’ রূপে বর্ণিত হয়েছেন। এ থেকে বোঝা যায়, তিনি বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী ছিলেন। তাঁর অন্তত দু’টি লেখে বল্লালসেনও ‘পরমবৈষ্ণব’রূপে পরিচিত হয়েছেন। বল্লালসেন কিন্তু ধর্মমতে শৈব ছিলেন।
দানবীর ছিলেন রাজা লক্ষ্মণসেন। মৌলানা মিনহাজউদ্দিনের মতো মুসলমান ঐতিহাসিকও তাঁর ঔদার্য ও দানশীলতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। মিনহাজ তাঁকে ‘লক্ষদাতা’ সুলতান কুতব উদ্দিনের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, তিনি কোনও প্রার্থীকে কখনও বিমুখ করতেন না, এক লক্ষ কড়ির কম কাউকে দান করতেন না। বিধর্মী রাজা লক্ষ্মণসেনের গুণকীর্তন করে তাঁর গুণ মুগ্ধ মুসলমান মিনহাজউদ্দিন আল্লাহ্ এর নিকট প্রার্থনা করছেন, তিনি যেন গুণবান সেন রাজার অমুসলমানত্বের অপরাধ মার্জনা করেন। লক্ষ্মণসেনের অসাধারণ দানশীলতার আর একটি প্রমাণ আছে। সেন রাজাদের প্রদত্ত তেরোখানি তাম্রশাসনের মধ্যে আটখানিরই দাতা এই লক্ষ্মণসেন। কিন্তু এখানে একটি কথা বলার আছে। লক্ষ্মণসেন কোনও সাধারণ মানুষ বা ব্যবসায়ী নন; তিনি সেনরাজ্যের সর্বোচ্চ প্রশাসক, রাজ্যের সর্বময় কর্তা। রাজকোশ থেকে তাঁর এই অকাতরে অর্থব্যয় রাজনৈতিক বিচক্ষণতা বা দূরদৃষ্টির পরিচায়ক নয়।
লক্ষ্মণসেনের বিদ্যোৎসাহিতা অবশ্যই প্রশংসনীয়। প্রখ্যাত কাব্যকার জয়দেব তাঁর রাজসভা অলংকৃত করেছিলেন। ধোয়ী, শরণ, উমাপতি এবং গোবর্ধনের মতো সেকালের প্রথিতযশা কবিরা তাঁর অনুগ্রহভাজন ছিলেন। সে যুগের আর এক নামকরা বিদগ্ধ ব্যক্তি হলায়ুধ তাঁর প্রধানমন্ত্রী ও ধর্মাধিকারীর পদে নিযুক্ত ছিলেন। লক্ষ্মণসেন নিজেও একজন সুপণ্ডিত ছিলেন। বল্লালসেন অদ্ভুতসাগর গ্রন্থখানি রচনার কাজ শুরু করেন। লক্ষ্মণসেন তা সম্পূর্ণ করেন। শ্রীধরদাসের সংকলন সদুক্তিকর্ণামৃতে লক্ষ্মণসেনের রচনা করা কয়েকটি শ্লোক উদ্ধৃত হয়েছে। বীর্যবান, বিদগ্ধ, বিদ্যোৎসাহী এবং পরহিতব্রতী লক্ষ্মণসেন বাংলার ইতিহাসে এক ভাগ্য বিড়ম্বিত, পরাজিত নায়ক।
বিশ্বরূপসেন (আ. ১২০৬-২৫ খ্রিস্টাব্দ)
লক্ষ্মণসেনের পরলোক গমনে তাঁর পুত্র বিশ্বরূপসেন সিংহাসনে আরোহণ করেন। ফরিদপুরের মদনপাড়া ও ইদিলপুর এবং ঢাকা জেলার মধ্যপাড়া গ্রাম থেকে এই রাজার তিনখানি তাম্রশাসন পাওয়া গেছে। অর্থাৎ পূর্ব বাংলায় যে তিনি রাজত্ব করতেন তা প্রমাণিত। বিশ্বরূপ গর্গযবন অর্থাৎ মুসলমানদের পরাজিত করার দাবি করেছেন তাঁর লেখে। মুসলমান ঐতিহাসিকদের বিবরণী থেকে জানা যায়, গিয়াসউদ্দিন বলবন (১২১১ ২৬ খ্রিস্টাব্দ), মালিক সৈফউদ্দিন (১২৩০-৩৫ খ্রিস্টাব্দ) এবং ইজউদ্দিন বলবনের (১২৩৫ ৪৪ খ্রিস্টাব্দ) মতো গৌড়ের সুলতানেরা কয়েকবার বঙ্গবিজয়ের চেষ্টা করেছেন। পূর্ব বাংলায় নিজের অধিকার বজায় রাখতে বিশ্বরূপসেনকে সম্ভবত এঁদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হয়েছিল। মুসলমান অভিযাত্রীদের তীব্র প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বিশ্বরূপসেন পূর্ব বাংলায় তাঁর কর্তৃত্ব কায়েম রাখেন। নদ-নদী, খাল-বিল পূর্ণ, নৌকাযানসম্বল পূর্ববঙ্গ জয় করা অশ্বনির্ভর ও জলপথে অনভ্যস্ত মুসলমান অভিযানকারীদের পক্ষে সহজ হয়নি। কিন্তু যা অবশ্যম্ভাবী তাকে হয়তো সাময়িকভাবে প্রতিহত করা যায় কিন্তু চিরতরে নির্মূল করা যায় না। তবে লক্ষ্মণসেনের উত্তরসূরিদের সৌভাগ্য, তাঁদের সে ঘটনার সাক্ষী হতে হয়নি। বিশ্বরূপসেন যে অন্তত ১৪শ বৎসর রাজত্ব করেছিলেন, মদনপাড়া লেখে তা প্রমাণিত।
দীনেশচন্দ্র সরকার বিশ্বরূপসেনের রাজত্বের এক অজানা কাহিনি উদ্ঘাটন করেছেন। সেন রাজার তিনখানি লেখ বিশ্লেষণ করে তিনি সিদ্ধান্ত করেছেন, বিশ্বরূপসেন যখন রাজা, তখন তিনি অসুস্থতা বা অন্য কোনও কারণে রাজ্যশাসনে অক্ষম হয়ে পড়েন; এই সময় তাঁর পুত্র সূর্যসেন প্রায় বছর তিনেকের জন্য রাজপদ গ্রহণ করেন; পরে পিতার অনুকূলে তিনি সিংহাসন পরিত্যাগ করেন। অভিমতটি অভিনব, কিন্তু যুক্তিসিদ্ধ।
পূর্বে মনে করা হত, বিশ্বরূপসেনের মৃত্যুর পর তাঁর অনুজ কেশবসেন রাজপদে অধিষ্ঠিত হন। রমেশচন্দ্র মজুমদার, বিনয়চন্দ্র সেন, নীহাররঞ্জন রায়েরা এই অভিমতই ব্যক্ত করেছেন। তাঁদের ধারণা, ইদিলপুর তাম্রশাসনখানি কেশবসেনের তৃতীয় রাজ্যবর্ষে প্রদত্ত হয়েছিল। দীনেশ চন্দ্র সরকার ইদিলপুর তাম্রশাসন পরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত করেছেন, এ শাসনখানি মূলত বিশ্বরূপ সেনের পুত্র সূর্যসেনের প্রদত্ত। (পাল সেন যুগের বংশানুচরিত (কলকাতা, ২০০৯), পৃষ্ঠা ১৩৪-৩৫।) তিনি মনে করেন, পরবর্তিকালে ‘সূর্য্য’ স্থলে ‘বিশ্বরূপ’ খোদাই করা হয়। দু’টি অক্ষরের পরিসরে চারটি অক্ষর খোদিত হওয়ায় অক্ষরগুলি অস্পষ্ট হয়েছে এবং ভ্রমক্রমে ‘বিশ্বরূপ’-স্থানে ‘কেশব’ নাম পঠিত হয়েছে। ইদিলপুর তাম্রশাসনে ‘বিশ্বরূপ’-স্থানে ‘কেশব’ পাঠের অশুদ্ধতা সম্পর্কে দীনেশচন্দ্র সরকারের অভিমত রমেশচন্দ্র মজুমদার কার্যত স্বীকারই করেছেন। (History of Ancient Bengal (Calcutta, 1971), পৃষ্ঠা ২৫০।) বিশ্বরূপসেনের মৃত্যুর পর তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা কেশবসেন রাজপদ লাভ করেন, এ মত বর্তমানে পরিত্যক্ত হতে চলেছে।
বিশ্বরূপসেনের পর সেনরা কতদিন পূর্ব বাংলায় রাজত্ব করেন, তা নিশ্চিত জানা যায় না। মিনহাজউদ্দিনের সাক্ষ্য থেকে মনে হয়, তাঁরা অন্তত ১২৪৫ বা ১২৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। এ সময় নোয়াখালি-কুমিল্লা-চট্টগ্রাম অঞ্চলে দেব রাজবংশ পরাক্রান্ত হয়ে ওঠে। দেব বংশীয় নৃপতি দামোদরের একখানি তাম্রশাসন ঢাকা জেলার শোভারামপুর গ্রামে পাওয়া গেছে। সেনরাজ্যের কিয়দংশ তিনি স্বীয় অধিকারভুক্ত করেন বলে মনে হয়। তাঁর পুত্র দশরথেরও একখানি লেখের প্রাপ্তিস্থান ঢাকা জেলার আদাবাড়ি। তাঁর শাসনগুলি বিক্রমপুর থেকে প্রদত্ত হয়েছিল। এই বিক্রমপুরই ছিল উত্তরকালীন সেনদের রাজধানী। দশরথের (আ. ১২৫৫-৯০ খ্রিস্টাব্দ) আক্রমণেই সম্ভবত পূর্ব বাংলায় সেনশাসনের অবসান হয়।
পঞ্চরক্ষা পুঁথির একটি পাণ্ডুলিপিতে মধুসেন নামে এক রাজার নাম পাওয়া যায়। পরম সৌগত, মহারাজাধিরাজ এবং গৌড়েশ্বর উপাধিধারী এই রাজা ১২১১ শকাব্দ অর্থাৎ ১২৮৯ খ্রিস্টাব্দে রাজত্ব করছিলেন। প্রখ্যাত সেন রাজবংশের সঙ্গে মধুসেনের সম্পর্ক অপরিজ্ঞাত।
প্রশাসন ব্যবস্থা
রাজতন্ত্রে যা হয়ে থাকে, সেন আমলে রাজাই ছিলেন রাজ্যের সর্বোচ্চ প্রশাসক। প্রশাসনিক যন্ত্র তাঁকে ঘিরেই আবর্তিত হত। নিজেদের পদের আভিজাত্য সম্পর্কে তাঁদের চেতনার মাত্রা বেশ বেশিই ছিল। তাই রাজাদের গালভরা উপাধির প্রতি তীব্র আকর্ষণ। নিজেদের পরমেশ্বর, পরমভট্টারক এবং মহারাজাধিরাজ বলে পরিচয় তো দিতেনই তার ওপর তাঁরা নিজ নিজ অভিধাও ব্যবহার করতেন। বিজয়সেনের অভিধা ‘অরিবৃষভশঙ্কর’, বল্লালসেনের ‘অরিরাজ নিঃশঙ্ক-শঙ্কর’, লক্ষ্মণসেনের ‘অরিরাজ-মদন-শঙ্কর’। বিশ্বরূপসেনের দু’টি অভিধা, ‘অরিরাজ বৃষভাঙ্ক-শঙ্কর’ ও ‘অরিরাজ-অসহ্য শঙ্কর’। নবদ্বীপ ও উত্তর বাংলা হারাবার পরও কিন্তু সেন রাজাদের গালভরা উপাধি গ্রহণে কোনও সঙ্কোচ দেখা যায়নি, বরঞ্চ তাঁদের নতুন খেতাব গ্রহণের প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পায়। ভগ্ন সেনরাজ্যের অধিপতি হয়েও বিশ্বরূপসেন নিজেকে ‘অশ্বপতি গজপতি-নরপতি-রাজত্রয়াধিপতি’রূপে সাড়ম্বরে ঘোষণা করেছেন। বিশ্বরূপসেন যখন রাজা হন তখন সেনরা গৌড় থেকে বিতাড়িত। তবু তাঁর অভিধা ‘গৌড়েশ্বর’। রাজা কল্পলোকবিহারী। বখতিয়ারের নদিয়া ও উত্তর বাংলা বিজয়ের ঐতিহাসিক ইঙ্গিত অনুধাবনে তিনি অপারগ।
প্রশাসনিক কাজে রাজা পদস্থ রাজপুরুষদের সাহায্য গ্রহণ করতেন। বিশ্বরূপসেনের ইদিলপুর লেখে বলা হয়েছে, রাজার পাদপদ্ম শত সচিব দ্বারা লালিত হত (সচিবশতমৌলিলালিতঃ পদাম্বুজঃ)। রাজপরিবারের সদস্যরাও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেন লেখে মহিষীদের উল্লেখ আছে। ভূমিদানক্রিয়া তাঁদের অবহিত করা হত। পালপর্বে অবশ্য এরূপ ঘটনার কথা শোনা যায় না। শাসনকার্যে যুবরাজেরও এক মুখ্য ভূমিকা ছিল। সাধারণত জ্যেষ্ঠ রাজকুমারই যুবরাজ হতেন। যুদ্ধ-বিগ্রহে তাঁকে প্রায়ই অংশগ্রহণ করতে হত। রাজামাত্য বা মন্ত্রী রাজার একজন প্রধান পরামর্শদাতা। পালযুগের কেদারমিশ্র বা দর্ভপাণির মতো প্রভাবশালী কোনও মন্ত্রীর কথা সেন আমলে জানা যায় না। পাল লেখে রাজপুরুষরূপে মহাপুরোহিত বা রাজপুরোহিতের উল্লেখ পাওয়া যায় না কিন্তু সেন আমলে তাঁর রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। ব্রাহ্মণ্যধর্মের পৃষ্ঠপোষক সেন রাজাদের শাসনব্যবস্থায় পুরোহিততন্ত্রের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পাবে, এ তো স্বাভাবিক ঘটনা।
সেন লেখে সান্ধিবিগ্রহিক ও মহাসান্ধিবিগ্রহিক সংজ্ঞক দু’শ্রেণির পদস্থ রাজপুরুষের উল্লেখ আছে। পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বা রাজপুরুষ সান্ধিবিগ্রহিক। তাঁদের শীর্ষস্থানীয় যিনি তিনিই মহাসান্ধিবিগ্রহিক। সেন লেখমালায় মহাসান্ধিবিগ্রহিককে এক বিশেষ ভূমিকায় দেখা যায়। সেখানে রাজার প্রতিনিধিরূপে তিনি ভূমিদান ও বিক্রয় অনুমোদন করছেন। নারায়ণদত্ত নামে জনৈক সান্ধিবিগ্রহিক লক্ষ্মণসেনের আনুলিয়া তাম্রশাসনে দূতরূপে বর্ণিত হয়েছেন। সেন লেখে উল্লিখিত মহামহত্তককে অনেকে প্রধানমন্ত্রী অর্থে গ্রহণ করেছেন। এ বিষয়ে পণ্ডিতমহলে বাগ্বিতণ্ডা রয়েছে।
সেন লেখমালায় বর্ণিত কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য পদস্থ রাজপুরুষগণের মধ্যে মহাধর্মাধ্যক্ষ, মহামুদ্ৰাধিকৃত, মহাসর্বাধিকৃত, মহাক্ষপটলিক, মহাপ্রতীহার এবং অন্তরঙ্গ সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। মহাধর্মাধ্যক্ষ ছিলেন রাজ্যের প্রধান বিচারপতি। অবশ্য তিনি ধর্ম-বিভাগের পরিচালকও হতে পারেন। ছাড়পত্র বা পাসপোর্ট বিভাগের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মহামুদ্রাধিকৃত। মুখ্য সচিব, কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক দফতর বা অধিকরণের তত্ত্বাবধায়ক ইত্যাদি বিভিন্ন অর্থে মহাসর্বাধিকৃত পদটির ব্যাখ্যা করা হয়। সাম্প্রতিককালের সর্বাধিকারী পদবি এই রাজপদের স্মৃতি বহন করছে। মহাক্ষপটলিক সরকারি মহাফেজখানার অধ্যক্ষ। তাঁকে গাণনিক অর্থাৎ আয়-ব্যয় হিসাবের দায়িত্বও পালন করতে হত। মহাপ্রতীহার সম্ভবত প্রাসাদ রক্ষিবাহিনীর অধ্যক্ষ ছিলেন। এমনও হতে পারে, তিনি রাজ্যের সীমান্ত রক্ষার কাজে নিযুক্ত ছিলেন। রাজবৈদ্য বা রাজার একান্ত সচিব, এই অর্থে অন্তরঙ্গ। লেখমালায় রাজপুরুষদের তালিকায় রাজা, রাণক ও রাজন্যের উল্লেখ থেকে মনে হয়, প্রশাসনে তাঁদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। মহারাজাধিরাজের অনুগত এসব শাসনকর্তারা স্ব স্ব অঞ্চলে প্রায় স্বাধীন নরপতির ন্যায় আচরণ করতেন। অর্থাৎ, রাজ্যের সর্বত্র মহারাজাধিরাজের প্রত্যক্ষ শাসন বলবৎ ছিল না ; বহু অঞ্চল কার্যত স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা ভোগ করত।
সেনলেখে সেনাধ্যক্ষদের তালিকাটিও কম দীর্ঘ নয় । মহাসেনাপতি, মহাগণস্থ, মহাব্যূহপতি, মহাপীলুপতি প্রভৃতি সেনানায়কেরা এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত। নৌ ও পদাতিক বাহিনী এবং রথারোহী, অশ্বারোহী ও গজারোহী সেনাদলের ভার বিশেষ বিশেষ রাজপুরুষের উপর ন্যস্ত ছিল। তাঁদের উপরে যাঁর অবস্থান তিনি মহাসেনাপতি। সৈন্যবাহিনী কয়েকটি গণ বা এককে বিভক্ত ছিল। ২৭ জন রথারোহী, ২৭ জন গজারোহী, ৮১ জন অশ্বারোহী ও ১৩৫ জন পদাতিক সৈন্য নিয়ে এক একটি গণ গঠিত হত। সেনাবিভাগে গণ গঠনের ভারপ্রাপ্ত সর্বোচ্চ পদাধিকারী এই মহাগণস্থ। যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যবিন্যাসের তত্ত্বাবধায়কের উপাধি মহাব্যূহপতি। মহাপীলুপতির উপর ছিল হস্তীবাহিনীর পরিচালনভার। নৌবাহিনীর অধিকর্তা নাবাধ্যক্ষ।
পালযুগের মতো সেনপর্বেও আমলাতন্ত্র স্ফীত ও বিপুলাকারে বর্ধিত। পালযুগে যেমন সেন আমলেও তেমনি ভুক্তিই ছিল রাষ্ট্রের বৃহত্তম বিভাগ। অবশ্য এ সময় ভুক্তিগুলির আয়তন বৃদ্ধি পেয়েছিল। প্রথম দিকে পুণ্ড্রবর্ধন ও বর্ধমান নামে দু’টিমাত্র ভুক্তি ছিল। লক্ষ্মণসেনের সময় থেকে বর্ধমানের একটি অংশ নিয়ে কঙ্কগ্রাম নামে একটি নতুন ভুক্তি গঠন করা হয়। ভুক্তির শাসনভার বৃহদুপরিক পদাধিকারীর উপর ন্যস্ত ছিল।
পাল শাসনকালে ভুক্তির নিম্নতর প্রশাসনিক বিভাগ ছিল কোথাও বিষয়, কোথাওবা মণ্ডল। কিন্তু সেনরাষ্ট্রে বিষয় বিভাগ বিশেষ দেখা যায় না। বিজয়সেনের ব্যারাকপুর লেখে পুণ্ড্রবর্ধন ভুক্তির অন্তর্গত খাড়ীবিষয়ের উল্লেখ আছে। এ থেকে অনুমিত হয়, ভুক্তি কখনও কখনও বিষয় নামে কয়েকটি উপবিভাগে বিন্যস্ত হত। লক্ষ্মণসেনের রাজত্বকালে খাড়ী আর বিষয় ছিল না, মণ্ডলে রূপান্তরিত হয়েছিল। এক একটি ভুক্তিকে কয়েকটি বিষয়ে বিভক্ত করার যে প্রবণতা গুপ্তযুগ থেকে লক্ষ করা গিয়েছিল, সেনপর্বে তা প্রায় অন্তর্হিত বলা যায়। বিজয়সেনের নৈহাটি লেখে ভুক্তির নিম্নতর বিভাগ মণ্ডল, মণ্ডলের নিম্নতর উপবিভাগ বীথী। আনুলিয়া লেখে ভুক্তির নিম্নতর বিভাগও মণ্ডল। সুন্দরবন লেখে ভুক্তির নিম্নতর বিভাগ মণ্ডল, মণ্ডলের নিম্নতর উপবিভাগ চতুরক। শক্তিপুর লেখে ভুক্তির নিম্নতর বিভাগ মণ্ডল, মণ্ডলের নিম্নতর উপবিভাগ বীথী। চতুরক সম্ভবত চারটি গ্রামের সমষ্টি। বর্তমানকালের চৌকি বা চক চতুরকের স্মৃতি বহন করছে। চতুরকের নিম্নবর্তী উপবিভাগ গ্রাম। গ্রাম আবার পাটকে বিভক্ত। পাটক এখনকার পাড়া। সেনলেখে আবৃত্তি নামে আর একটি প্রশাসনিক বিভাগের উল্লেখ আছে। বীথী ও আবৃত্তির পারস্পরিক সম্বন্ধ সম্পর্কে কোনও ইঙ্গিত নেই। এসব প্রশাসনিক বিভাগগুলির শাসনকার্য সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানা যায় না। তবে শাসক সম্প্রদায় যে প্রায়ই অত্যাচারী হতেন, প্রজা সাধারণের উপর উৎপীড়ন করতেন, তার ইঙ্গিত যথেষ্ট। সমকালীন ভূমিদান সম্পর্কিত লেখে ‘পরিহৃত-সর্বপীড়া’ কথাটির উল্লেখ আছে। অর্থাৎ, ভূমি যখন দান করা হত, তখন দাতা দানগ্রহীতাকে সর্বপ্রকার পীড়া বা নিপীড়ন হতে মুক্তি দিতেন। ইঙ্গিত স্পষ্ট, সাধারণত সকল প্রজাকেই অল্পবিস্তর পীড়া বা উৎপীড়ন ভোগ করতে হত। চাট, ভাট প্রভৃতিদের উপদ্রব কম ছিল না। পল্লিবাসী গৃহস্থদের যে সময় বিশেষে স্থানীয় রাজপুরুষদের অর্থলিপ্সার শিকার হতে হত, তার ইঙ্গিত আছে সদুক্তিকর্ণামৃতে।
সেন শাসনকালে স্থানীয় জনসাধারণের সঙ্গে রাষ্ট্রের যোগাযোগ অনেকখানি শিথিল হয়ে যায় বলে কেউ কেউ অভিমত প্রকাশ করেছেন। প্রমাণস্বরূপ তাঁরা সেন লেখমালায় গ্রামিক, মহত্তর, কুটুম্ব প্রভৃতির অনুল্লেখের কথা বলেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সেন লেখে গ্রামিকদের কথা বলা না হলেও জনপদ, ক্ষেত্রকর, ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণোত্তর প্রভৃতিদের কথা কিন্তু বলা হয়েছে। সেন আমলে রাষ্ট্রের সঙ্গে গ্রামবাসীদের সংযোগ ছিন্ন হয়েছিল, এরূপ ভাবনা অযৌক্তিক।
সমাজ ব্যবস্থা
পাল রাজাদের মতো সেনরা উদার মতাবলম্বী ছিলেন না। ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি ছিল তাঁদের একনিষ্ঠ অনুরাগ। বল্লালসেন ও লক্ষ্মণসেনের মতো দু’জন সেন রাজা তো নিজেরা স্মৃতিশাস্ত্রই রচনা করেছেন। ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠাকল্পে সেন রাজারা ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। বিভিন্ন বর্ণ ও বিভিন্ন ধর্মাদর্শের সহাবস্থান বা সমন্বয় নয়; এক বর্ণ, এক ধর্ম ও এক সমাজাদর্শের একাধিপত্যই সেন যুগের কামনা ও আদর্শ। সে বর্ণ ব্রাহ্মণবর্ণ, সে ধর্ম ব্রাহ্মণ্যধর্ম এবং সে সমাজাদর্শ পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য সমাজাদর্শ। এ যুগের গ্রন্থাবলি ও লেখমালার সর্বত্র ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণ্যাদর্শের জয়জয়কার। পালযুগে সামাজিক জীবনে যে এক ঐকতানের সুর বেজে উঠেছিল তা সেন আমলে স্বাভাবিক কারণেই স্তব্ধ হয়ে যায়। সমাজ ব্রাহ্মণ্য রক্ষণশীল তার দিকে পিছু হঠতে থাকে। বেদ, পুরাণ ও স্মৃতির অনুশাসনে সমাজ আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে যায়।
স্বাভাবিক কারণেই সমাজে ব্রাহ্মণদের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়। অভিজাত ব্রাহ্মণেরা পূর্বের মতো বিভিন্ন রাজকার্যাদিতে অংশগ্রহণ করতে থাকেন। রাজ্যে যাগযজ্ঞ, পূজাপার্বণের বহুল প্রসারের ফলে সাধারণ ব্রাহ্মণদের জীবিকা নির্বাহের পথ সুগম হয়। ব্রাহ্মণদের অনুকূলে রাজার আনুকূল্যে জমিও প্রদত্ত হয়। কৃষিবৃত্তিতে তাঁদের অধিকার ছিল। কিন্তু চিকিৎসা, জ্যোতির্বিদ্যা ও চিত্রশিল্পের অনুশীলন তাঁদের পক্ষে নিষিদ্ধ ছিল। অধস্তন শূদ্রদের শিক্ষাদান বা তাঁদের গৃহে পূজানুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করাও ব্রাহ্মণদের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ ছিল। পূর্ববর্তী যুগের মতো এ পর্বেও কোলাঞ্চ, শ্রাবস্তী, তর্কারি, মৎস্যাবাস, মুক্তাবস্তু, লাট প্রভৃতি স্থান বা অঞ্চল থেকে বহু ব্রাহ্মণ সপরিবারে বাংলায় এসে বসবাস করেন। এখানে এসে তাঁরা সামাজিক বা বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে পূর্বাগত ও স্থানীয় ব্রাহ্মণদের সঙ্গে একাত্ম হন।
ব্রাহ্মণ সমাজে নানা বিভাগ, উপবিভাগ দেখা দেয়। মূল বাসস্থানের উপর ভিত্তি করে অনেক সময় এই শ্রেণি-বিন্যাস করা হত। এর সূচনা হয়েছিল অনেক পূর্বে। কিন্তু এখন এই রীতি প্রথাবদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়। যে মূল গ্রামে যে ব্রাহ্মণ বসতি স্থাপন করতেন, তিনি সেই মূল গ্রামের নামানুসারে গাঁঞী পরিচয় গ্রহণ করতেন। গাঁঞী শব্দ সংস্কৃত ‘গ্রামী’ হতে নিষ্পন্ন। এর অর্থ গ্রামবাসী বা গ্রামভোক্তা। বন্দ্যঘটী, ঘোষলী, কুশারী, বটব্যাল, আতুর্থী, মৈত্র, ভাদুড়ী, গাঙ্গুলী, সান্যাল, ভট্টশালী প্রভৃতি প্রখ্যাত গাঁঞীর উল্লেখ পরবর্তিকালে রচিত কুলজি গ্রন্থাবলিতে পাওয়া যায়। বন্দ্যঘটীসহ কয়েকটি গাঁঞীর উল্লেখ আছে সেন ও সমসাময়িক লেখমালায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বন্দ্যোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায়, ভট্টাচার্য, মুখোপাধ্যায়, গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ ব্রাহ্মণ পদবি যথাক্রমে বন্দ্য, চট্ট, ভট্ট, মুখটি ও গঙ্গৌলী গ্রামের নাম থেকে এসেছে।
জনপদ অনুসারে বাংলার ব্রাহ্মণদের দু’টি ভাগ – রাঢ়ীয় আর বারেন্দ্র। হলায়ুধ তাঁর ‘ব্রাহ্মণ সর্বস্ব’ গ্রন্থে রাঢ়ীয় ও বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের উল্লেখ করেছেন। তাছাড়া, উৎকল ও পাশ্চাত্য নামে তিনি আরও দু’শ্রেণির ব্রাহ্মণদের কথা বলেছেন। উত্তর ভারত থেকে আগত ব্রাহ্মণেরা পাশ্চাত্য বৈদিক এবং দক্ষিণ ভারত থেকে আগত ব্রাহ্মণেরা দাক্ষিণাত্য বৈদিক নামেও পরিচিত ছিলেন। সারস্বত ব্রাহ্মণদের কথা বল্লালসেনের ‘দানসাগর’ গ্রন্থে বলা হয়েছে। এঁদের আদি নিবাস সরস্বতী নদীর অববাহিকা বা পূর্ব পাঞ্জাব। বৃহদ্ধর্ম-পুরাণে শাকদ্বীপী মগব্রাহ্মণদের কথা আছে। পারস্য থেকে আগত এই ব্রাহ্মণদের সেরকম কোনও সামাজিক প্রতিষ্ঠা ছিল না। বৈদিক ধর্মের প্রতি অবজ্ঞা, জ্যোতিষ ও নক্ষত্রবিদ্যায় আসক্তি ও জ্যোতিষ চর্চার দ্বারা জীবিকা গ্রহণ প্রভৃতি কারণে ব্রাহ্মণসমাজে তাঁরা অনাদৃত ছিলেন।
সেন রাজাদের আমলে বাংলায় কৌলিন্যপ্রথার প্রবর্তন হয় বলে কুলজি গ্রন্থাবলিতে বলা হয়েছে। কুলজির কাহিনি অনুসারে বল্লালসেনের মাতামহ আদিশূর যজ্ঞানুষ্ঠানের জন্য উত্তর প্রদেশের কান্যকুব্জ কিংবা কোলাঞ্চ থেকে ৫ জন বেদবিদ ব্রাহ্মণ বাংলায় এনেছিলেন। (আদিশূরের আমন্ত্রণে যে ৫ জন পাশ্চাত্য ব্রাহ্মণ বাংলায় এসেছিলেন তাঁদের নামের তিনটি স্বতন্ত্র তালিকা পাওয়া যায় কুলজিগ্রন্থে। এক, শাণ্ডিল্যগোত্রীয় ক্ষিতীশ, ভরদ্বাজগোত্রীয় মেধাতিথি, কাশ্যপ গোত্রীয় বীতরাগ, বাৎস্যগোত্রীয় সুধানিধি এবং সাবর্ণগোত্রীয় সৌভরি। দুই, শাণ্ডিল্যগোত্রীয় ভট্টানারায়ণ, কাশ্যপগোত্রীয় শ্রীহর্ষ, বাৎস্যগোত্রীয় ছান্দড়, ভরদ্বাজগোত্রীয় দক্ষ এবং সাবর্ণগোত্রীয় বেদগর্ভ। তিন, শাণ্ডিল্যগোত্রীয় নারায়ণ, বাৎস্যগোত্রীয় ধরাধর, কাশ্যপগোত্রীয় সুষেণ, ভরদ্বাজগোত্রীয় গৌতম এবং সাবর্ণগোত্রীয় পরাশর।) ওই ব্রাহ্মণদের সঙ্গে আসেন তাঁদের পাদুকা ও ছত্রবাহী ৫ জন কায়স্থ ভৃত্য। পরে বল্লালসেন রাজা হয়ে ওই ৫ জন ব্রাহ্মণ ও তাঁদের ৫ জন ভৃত্যের ৪ জনের বংশধরদের আচার, বিনয়, বিদ্যা, প্রতিষ্ঠা, তীর্থদর্শন, নিষ্ঠা, বৃত্তি, তপস্যা এবং দান, এই নটি গুণের ভিত্তিতে কুলীনরূপে গণ্য করেন। আর যেসব ব্রাহ্মণদের ৮টি, ৭টি বা আরও কম গুণ ছিল তাঁরা যথাক্রমে সিদ্ধশ্রোত্রিয়, সাধ্যশ্রোত্রিয় এবং কষ্ট বা কাষ্ঠ শ্রোত্রিয় নামে পরিচিত হলেন। কথিত আছে, রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণদের ৫৬টি গাঁঞীর মধ্যে বল্লালসেন ১৯ জন ব্যক্তিকে কৌলিন্য প্রদান করেন। বারেন্দ্রদের ১০০ গাঁঞীর মধ্যে ৮ জন কুলীনরূপে গণ্য হলেন। বল্লালপুত্র লক্ষ্মণসেন নাকি কুলীনের সংখ্যা বর্ধিত করে ২১ করেন। ১৪ জন গৌণকুলীনও তিনি সৃষ্টি করেন।
কিন্তু বল্লালসেন বাংলায় কৌলিন্যপ্রথা প্রবর্তন করেছিলেন বলে কুলজিগ্রন্থে যে কাহিনির অবতারণা আছে, তার সত্যতা সম্পর্কে ঐতিহাসিকেরা নানা প্রশ্ন তুলেছেন। বল্লাল বা তাঁর উত্তরাধিকারীদের লেখমালায় এই প্রথার অস্তিত্ব সম্বন্ধে কোনও ইঙ্গিত নেই। সমকালীন গ্রন্থাবলি ও লেখমালায় বহু প্রখ্যাত ও সাধারণ ব্রাহ্মণদের উল্লেখ আছে। এঁদের একজনও কুলীনরূপে পরিচিত হননি। বল্লাল স্বয়ং গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর পুত্র লক্ষ্মণসেনও গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। কৌলীন্যপ্রথার উদ্ভব ও বিকাশের ক্ষেত্রে বল্লাল ও লক্ষ্মণসেনের কোনও ভূমিকা থাকলে এসব গ্রন্থাদিতে তাঁর উল্লেখ থাকত। আদিশূর বলে যে কোনও রাজা বাংলায় রাজত্ব করেছিলেন, তারও কোনও প্রমাণ নেই। কোনও কুলজিগ্রন্থই ১৫শ বা ১৬শ শতকের পূর্বে রচিত হয়নি। ফলে সেনযুগের ক্ষেত্রে এসব গ্রন্থের প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন উঠেছে। সম্ভবত সেনপর্বে কৌলীন্যপ্রথার উদ্ভবই হয়নি। দীনেশচন্দ্র সরকার অভিমত প্রকাশ করেছেন, বঙ্গীয় সমাজে কৌলীন্যপ্রথা পূর্ব থেকেই প্রচলিত ছিল কিন্তু তা ভ্রমবশত বল্লালসেনের উপর আরোপিত হয়েছে। এ অভিমতের সমর্থনে প্রমাণ কৈ?
ব্রাহ্মণেতর সম্প্রদায়গুলির মধ্যে ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যরা সংখ্যায় খুবই নগণ্য ছিলেন। ভবদেব ভট্ট, জীমূতবাহন ও অন্যান্য স্মৃতিকারেরা বার বার ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য বর্ণের উল্লেখ করেছেন। ব্রাহ্মণেতর জনসাধারণের প্রায় সকলেই শূদ্র জাতির অন্তর্ভুক্ত। এই সময়কার বা আর একটু পরবর্তী যুগের রচনা বৃহদ্ধর্ম-পুরাণে শূদ্র জাতিদের উত্তম সংকর, মধ্যম সংকর এবং অধম সংকর বা অন্ত্যজ, এই তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করে প্রতিটি উপজাতির স্থান ও বৃত্তি নির্দিষ্ট হয়েছে। উত্তম সংকর পর্যায়ে ২০টি উপজাতি উল্লিখিত হয়েছে। তারা হল : (১) করণ বা লেখক, (২) অম্বষ্ঠ বৈদ্য, (৩) উগ্ৰ বা উগ্র ক্ষত্রিয়, (৪) মাগধ বা বার্তাবহ, (৫) তন্তুবায় বা তাঁতি, (৬) গান্ধিক বা গন্ধবণিক, (৭) নাপিত, (৮) গোপ, (৯) কর্মকার বা কামার, (১০) তৌলিক বা গুবাক ব্যবসায়ী, (১১) কুম্ভকার বা কুমোর, (১২) কাংসকার বা কাঁসারি, (১৩) শঙ্খিক বা শঙ্খকার, (১৪) দাস বা চাষী, (১৫) বারুজীবী বা বারুই, (১৬) মোদক বা ময়রা, (১৭) মালাকার, (১৮) সৃত বা চারণ, (১৯) রাজপুত্র বা রাজপুত এবং (২০) তাম্বুলী বা পান-বিক্রেতা। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে এঁদের প্রায় সকলকে সৎশূদ্র আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এঁদের বাড়িতে ব্রাহ্মণের যাগ-যজ্ঞাদি অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্যে কোনও বাধা ছিল না।
কিন্তু বাধা ছিল মধ্যম সংকর এবং অধম সংকর বা অন্ত্যজদের ক্ষেত্রে। এঁদের গৃহে যাগ যজ্ঞাদি অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করলে ব্রাহ্মণ পতিত হতেন। মধ্যম সংকরদের মধ্যে ছিলেন নিম্নোক্ত ১২টি উপবর্ণ বা উপজাতির লোক : (১) তক্ষণ বা খোদাইকর, (২) রজক বা ধোপা, (৩) স্বর্ণকার বা সোনার অলংকার প্রস্তুতকারক, (৪) সুবর্ণবণিক বা সোনা-ব্যবসায়ী, (৫) আভীর বা গোয়ালা, (৬) তৈলকার বা তেলি, (৭) ধীবর বা মৎস্য ব্যবসায়ী, (৮) শৌক্তিক বা শুঁড়ি, (৯) নট, (১০) শাবাক, (১১) শেখর এবং (১২) জালিক বা জেলে।
অধম সংকর বা অন্ত্যজদের অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। তাঁরা ছিলেন বর্ণাশ্রম বহির্ভূত ও অস্পৃশ্য। এঁদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন : (১) মলেগ্রহী (মাল?), (২) কুড়ব (নৌকার মাঝি ?), (৩) চণ্ডাল, (৪) বরুড় (বাউড়ি), (৫) তক্ষ, (৬) চর্মকার, (৭) ঘণ্টাজীবী, (৮) দোলাবাহী এবং (৯) মল্ল বা মালো। উপরোক্ত ৪১টি উপবর্ণ বা উপজাতি ছাড়া আরও কয়েকটি উপজাতি ছিল। উপজাতিগুলি ম্লেচ্ছ পর্যায়ভুক্ত। এই উপজাতিগুলির মধ্যে রয়েছেন : (১) পুক্কশ, (২) পুলিন্দ, (৩) খস, (৪) থর, (৫) কম্বোজ, (৬) যবন, (৭) সুহ্ম, (৮) শবর এবং আরও অনেকে। এঁরাও বর্ণাশ্রম বহির্ভূত ও অস্পৃশ্য।
সমাজে করণ-কায়স্থদের গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল। পেশা থেকে কী করে একটি জাতির উদ্ভব হয়, করণ কায়স্থরা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। পাল-সেন পর্বে করণ-কায়স্থরা এক ও অভিন্ন জাতি রূপে পরিগণিত হন। পরবর্তিকালে তাঁরা বাংলায় কায়স্থ নামেই সমধিক প্রসিদ্ধি লাভ করেন। কায়স্থদের মধ্যে ঘোষ, বসু, মিত্র এবং গুহদের যে বিশেষ সামাজিক মর্যাদা তার শুরু সম্ভবত সেনোত্তর পর্ব থেকে। চিকিৎসাবৃত্তিধারী অম্বষ্ঠ-বৈদ্যদেরও যথেষ্ট সামাজিক মর্যাদা ছিল। বৈদ্যের অর্থ বেদজ্ঞ। এই বেদজ্ঞ আয়ুর্বেদজ্ঞ। কিন্তু সমাজে এঁরা তো সংখ্যালঘু। সংখ্যাগরিষ্ঠরা তখন বর্ণাশ্রমের বিজয়রথের চাকায় পিষ্ট। মানুষের প্রাণের ঠাকুর পূর্বে এমনি করে কখনও অপমানিত হননি। সামাজিক এই অসাম্যের বিরুদ্ধে, ক্ষীণ হলেও, একটা প্রতিবাদ এ সময় ধ্বনিত হচ্ছিল। প্রতিবাদের পুরোভাগে ছিলেন শাক্ত সাধক আর কৃষ্ণপ্রেমীরা। তাঁদের বক্তব্য ছিল, জাতি নয়, অধ্যাত্মমনস্কতাই মানুষের শ্রেষ্ঠ পরিচয়।
সে সময় নারীজাতির অবস্থাও খুব একটা সন্তোষজনক ছিল না। রজঃস্বলা হবার পূর্বেই তাঁদের বিবাহ হত। ফলে উচ্চশিক্ষার দ্বার তাঁদের নিকট অবরুদ্ধ হয়। একগামিতা সাধারণ রীতি হলেও অনেক পুরুষই বহুপত্নীক ছিলেন। উচ্চকোটি পরিবারে উপপত্নীদের সংখ্যাও বড় কম ছিল না। আইনের চোখে মেয়েদের বিশেষ কোনও অধিকার ছিল না। মৃতস্বামীর সম্পত্তিতে অপুত্রক নারীর বৈধ অধিকারের কথা জীমূতবাহন বলেছেন। তবে স্বামীর সম্পত্তি বিক্রয় বা বন্ধকের কোনও অধিকার তাঁর ছিল না। বৈধব্যজীবন ছিল চরম কৃচ্ছ্বসাধনের। অশুভ মনে করে অনেক আচার-অনুষ্ঠান থেকে তাঁকে দূরে সরিয়ে রাখা হত। নারীর পক্ষে সহমরণই ছিল কাম্য।
বেশিরভাগ লোক গ্রামে বাস করলেও ধনবান ব্যক্তিরা শহরেই অবস্থান করতেন। সেখানে ছিল বিলাস-ব্যসনের প্রচুর উপকরণ। যথেচ্ছাচারের স্রোতে অনেকেই গা ভাসিয়েছিলেন। এ সময়কার অবাধ ও উদ্দাম নাগর জীবনের প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায় ধোয়ীর পবনদূতে আর সমকালীন লেখমালায়। নন্দিনীদের নূপুর নিক্কণে প্রমোদাগারগুলি প্রতি সন্ধ্যায় মুখরিত হত। অস্থাবর সম্পত্তির মতো নারীদের কেনা-বেচা চলত। দেবদাসী প্রথারও ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল এ সময়। দক্ষিণ ভারতীয় সেন রাজাদের হয়তো প্রত্যক্ষ সমর্থন ছিল এর পিছনে। বিজয়সেন ও লক্ষ্মণসেনের সুন্দরী মেয়েদের দেবদাসীরূপে নিয়োগের কথা সাড়ম্বরে বলা হয়েছে দেওপাড়া প্রশস্তি এবং পবনদূতে। সমাজের একদিকে ছিল দারিদ্র্যের ভয়াবহতা, অন্যদিকে ছিল তন্ত্র ও শাক্ত সাধনার সর্বগ্রাসী প্রভাব। এরই ফলশ্রুতি নৈতিক অবক্ষয়।
অর্থনৈতিক জীবন
পাল আমলে যেমন, সেন যুগেও তেমনি জমিই ছিল ধনোৎপাদনের প্রধান উৎস। অনেকেই মনে করেন, এ সময় রাজাই ছিলেন জমির প্রকৃত মালিক, আর রাজস্ব দাতারা শুধু জমির মধ্যস্বত্ব ভোগ করতেন। কিন্তু এ কথা ভুললে চলবে না, রাজস্ব জমির ভাড়া নয়, রাজার প্রজাপালনের পারিশ্রমিক। ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ছিল বাস্তু ও ক্ষেত্রজমি আর পতিত জমি, গোচারণক্ষেত্র ও জলাভূমি ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত।
ধানই ছিল প্রধান কৃষিজাত দ্রব্য। গ্রামের পর গ্রাম জুড়ে ধানের খেতের সুন্দর বর্ণনা আছে এ যুগের আনুলিয়া ও ইদিলপুর লেখে। বর্ষায় ধানে ভরা খেতের সুন্দর বর্ণনা আছে সদুক্তি কর্ণামৃতে। সদুক্তিকর্ণামৃতে হেমন্তে কাটা স্তূপীকৃত শালিধানের কথাও আছে। কিন্তু এই ধান যে একান্তভাবে বারিনির্ভর তারও উল্লেখ আছে আনুলিয়া, তর্পণদিঘি, গোবিন্দপুর ও শক্তিপুর তাম্র শাসনে। এই চারটি তাম্রশাসনে বারিবর্ষণের জন্য অন্তরের আকুতি ধ্বনিত হয়েছে। অনাবৃষ্টির কারণে ধানচাষ যে ব্যাহত হত তারও হয়তো একটি প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত এখানে আভাসিত হয়েছে। সদুক্তিকর্ণামৃতের একাধিক শ্লোকে ইক্ষুর প্রচুর ফলনের কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, আখ মাড়াই কলের অবিরাম শব্দে গ্রাম মুখরিত; নতুন আখের গুড়ের গন্ধে গ্রাম আমোদিত। যবেরও উল্লেখ আছে সদুক্তিকর্ণামৃতে। যবের শিষ নীলপদ্মের মতো স্নিগ্ধশ্যাম (নীলোৎপল স্নিগ্ধ শ্যাম) বলে বর্ণনা করা হয়েছে। কদলীবৃক্ষ বা ফলের বড় একটা উল্লেখ সমকালীন লেখ মালায় পাওয়া যায় না। কিন্তু নানা প্রস্তরভাস্কর্যে ফলসমন্বিত বা ফলবিযুক্ত কদলীবৃক্ষের প্রতিকৃতি অঙ্কিত আছে। বিশ্বরূপসেনের বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ অভিলেখে পান চাষের কথা আছে। লক্ষ্মণসেনের গোবিন্দ-পুর পট্টোলীতে ডালিম্বখেতের উল্লেখ আছে। কার্পাসের উল্লেখ আছে বিজয়সেনের দেওপাড়া প্রশস্তিতে। সদুক্তিকর্ণামৃতে বঙ্গ বারাঙ্গনাদের সূক্ষ্ম বস্ত্র পরিধানের কথা বলা হয়েছে। খ্রিস্টীয় ১৩শ শতকের শেষার্ধে ইতালি থেকে ভারত ভ্রমণে এসেছিলেন মার্কো পোলো। বাংলায় কার্পাস উৎপাদনের প্রাচুর্য ও কার্পাস শিল্পের বাণিজ্যিক গুরুত্ব তিনি অকপটে স্বীকার করে গেছেন। অন্যান্য উৎপন্ন দ্রব্যের মধ্যে ছিল সর্বপ, মহুয়া, আম, কাঁঠাল, গুবাক ও নারকেল। সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলে লবণ পাওয়া যেত। জোয়ারের সময় সমুদ্রের তট দেশের অনেক স্থানই নোনা জলে ডুবে যেত। বড় বড় গর্ত করে সেই জল ধরে রাখা হত। পরে রৌদ্র বা আগুনের তাপে তা শুকিয়ে লবণ তৈরি করা হত।
সমকালীন মূর্তিভাস্কর্যে ও চিত্রে দেবদেবীর অলংকরণ ঐশ্বর্য সে যুগের স্বর্ণ ও রৌপ্য শিল্পের পরিচয় বহন করছে। সোনা, রুপা, মণি, মুক্তা ও বিচিত্র বর্ণোজ্জ্বল প্রস্তরশোভিত নানা অলংকার যে বিত্তশালী সমাজে ব্যবহৃত হত, তা তো সহজেই অনুমেয়। দেওপাড়া, নৈহাটি ও অন্যান্য লেখে দেবদাসী ও রাজপরিবারের রমণী ও পরিচারিকাদের বিবিধ মূল্যবান অলংকার-সজ্জার উল্লেখ আছে ৷ মৌলানা মিনহাজউদ্দিন বলেছেন, লক্ষ্মণসেনের রাজপ্রাসাদে সোনা-রুপার বাসন কোশন ব্যবহৃত হত। লৌহশিল্পের ব্যাপক প্রচলন ছিল। লোহা দিয়ে যেমন দা, কাস্তে, কুড়াল, কোদাল, লাঙল ইত্যাদি কৃষি-যন্ত্রপাতি তৈরি হত, তেমনি তির, বর্শা ও তরোয়ালের মতো যুদ্ধের প্রচুর অস্ত্রশস্ত্রও নির্মিত হত। সমকালীন অসংখ্য ব্রোঞ্জ ও মিশ্রধাতুতে নির্মিত মূর্তিগুলিতে ধাতু শিল্পের পরিচয় বিধৃত আছে। হস্তীদন্তশিল্পেরও প্রচলন ছিল। বিশ্বরূপসেনের ইদিলপুর লেখে হস্তীদন্ত নির্মিত শিবিকার উল্লেখ আছে। তাম্রপট্টের খোদাইকররূপে সমকালীন লেখমালায় সূত্রধরদের উল্লেখ পাওয়া যায়। বর্তমানে সূত্রধর বলতে দারুশিল্পীদের বোঝায়। কিন্তু এ পর্বে স্থপতি, তক্ষণকার, খোদাইকর, দারুশিল্পী সকলেরই সাধারণ পরিচয় সূত্রধর। দেওপাড়া লেখের খোদাইকর শূলপাণি নিজেকে ‘বরেন্দ্রশিল্পিগোষ্ঠী-চূড়ামণি’ বলে আখ্যাত করেছেন। শূলপাণি রাণক অভিধায় ভূষিত ছিলেন। গোষ্ঠীমুখ্য বা নিগমপ্রধান যে সমাজে গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন, তা এতে প্রমাণিত। মৃৎশিল্পীরা সংখ্যায় কম ছিলেন না। পোড়ামাটির থালা, বাটি, হাড়ি, জলপাত্র, দোয়াত, প্রদীপ ইত্যাদি গৃহস্থালির নানা জিনিসপত্রের চাহিদা যথেষ্টই ছিল। ভবদেবভট্ট নানা প্রকার মৎস্যের উল্লেখ করেছেন। শুঁটকি মাছের কথাও তিনি বলেছেন। দান-বিক্রয়ের পট্রোলীগুলিতেও মৎস্যের উল্লেখ আছে। মনে হয় কাঁচা এবং শুঁটকি উভয় মৎস্যেরই যথেষ্ট চাহিদা ছিল। নৌশিল্পেরও একটা বিশেষ স্থান ছিল। দেওপাড়া লেখে ‘নৌবিতান’ শব্দ উল্লিখিত হয়েছে। নদীমাতৃক, খাড়িপ্রধান ও বৃষ্টিবহুল এই বাংলা, বিশেষত পূর্ব বাংলা। এখানকার ভূমিও বহুলাংশে নিম্ন। লোকদের যাতায়াত ও অন্তর্বাণিজ্যের জন্য নৌযানের প্রয়োজন ছিল যথেষ্ট। খাল-নদ-নদীগামী ছোট বড় নৌকা-নির্মাণ সংক্রান্ত একটা সমৃদ্ধ শিল্প সেন-বাংলায় অবশ্যই গড়ে উঠেছিল। সমুদ্রগামী পোতও সম্ভবত নির্মিত হত।
প্রথম পর্বে না হলেও পাল যুগের শেষের দিকে ব্যবসা-বাণিজ্যের যথেষ্ট অবনতি ঘটে। পাল লেখমালায় শৌল্কিক, তরিক প্রভৃতি শুল্কবিভাগের রাজপুরুষদের উল্লেখ আছে। কিন্তু সেন লেখমালায় তাঁদের কোনও উল্লেখ নেই। এ সময় উত্তর ভারতের রাজনৈতিক আকাশে ছিল কালো মেঘের ঘনঘটা। চতুর্দিকে এক অরাজক ও বিশৃঙ্খল অবস্থা। ফলে এই অঞ্চলের সঙ্গে বাংলার বাণিজ্যিক লেনদেনে ভাটা পড়ে। তিব্বতের সঙ্গে বোধহয় কিছুটা ব্যবসা-বাণিজ্য চলছিল। (মৌলানা মিনহাজউদ্দিন উত্তর বাংলার লক্ষ্মণাবতী শহরে তিব্বতি অশ্বের প্রচণ্ড চাহিদার উল্লেখ করেছেন। অশ্বগুলি তিব্বত থেকে কামরূপের পথে লক্ষ্মণাবতীতে আনা হত।)
কিন্তু উত্তর বাংলায় মুসলমান অধিকার প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে সে পথও বন্ধ হয়ে যায়। ভারত মহাসাগরের বাণিজ্যিক কর্তৃত্বও আরব বণিকদের হাতে চলে যায়। ৭ম শতকের মধ্যভাগ থেকেই সামুদ্রিক বাণিজ্যে আরব বণিকদের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। ১২শ-১৩শ শতকে সে প্রভাব চরম পরিণতি লাভ করে। অবশ্য দক্ষিণ ভারত ১৪শ শতক পর্যন্ত সামুদ্রিক বাণিজ্যে নিজ প্রভাব বজায় রেখেছিল। কিন্তু পরে তারও অবসান ঘটে।
সেন রাজাদের নামাঙ্কিত কোনও মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়নি। তাঁরা সম্ভবত কোনও মুদ্রা উৎকীর্ণ করেননি। এ পর্বে জিনিসপত্রের কেনা-বেচা চলত কপর্দক-পুরাণের মাধ্যমে। কিন্তু এই কপর্দক পুরাণ কোনও মুদ্রা নয়, ১ পুরাণ বা রজত মুদ্রার মানের কড়ি। অর্থাৎ কড়ি দিয়েই তখনকার দিনে জিনিসপত্রের ক্রয়-বিক্রয় নির্বাহ হত। শোনা যায়, লক্ষ্মণসেন কোনও প্রার্থীকেই খালি হাতে ফেরাতেন না, কাউকে লক্ষ কড়ির কম দান করতেন না। তখন বেশির ভাগ মুদ্রার কাজ এই কড়ি দিয়েই সম্পন্ন হত।
ধর্মীয় জীবন
সেন রাজত্বকালে বাংলায় ব্রাহ্মণ্যধর্মের অভ্যুত্থান দেখা দেয়। সেন রাজারা সকলেই ছিলেন ব্রাহ্মণ্যধর্মাবলম্বী। এই রাজবংশের আদি পুরুষ সামন্তসেন ছিলেন ব্রহ্মবাদী, ঔপনিষদিক আদর্শে বিশ্বাসী। তিনি গঙ্গাতীরবর্তী এক আশ্রমে জীবনের শেষ দিনগুলি অতিবাহিত করেন। মুনি ঋষি অধ্যুষিত এসব আশ্রমে নিরন্তর বেদপাঠ ও বৈদিক যাগযজ্ঞাদি অনুষ্ঠিত হত। প্রশস্তিকার দাবি করছেন, আশ্রমে মৃগশিশুরা তপোবন-রমণীদের স্তন্যদুগ্ধ পান করত আর শুকপাখিরা অখণ্ড বেদ আবৃত্তি করত। কিন্তু এ আশ্রমের অস্তিত্ব তো রূপকথার রাজ্যে, কবির কল্পলোকে। বিজয়সেন এবং বল্লালসেন ছিলেন পরমমাহেশ্বর বা শৈব। লক্ষ্মণসেন ছিলেন পরমবৈষ্ণব এবং তাঁর পুত্র বিশ্বরূপসেন ধর্মমতে সৌর বা সূর্যোপাসক ছিলেন। বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদের উপর তাঁদের কৃপাবর্ষণ ছিল সুপ্রচুর। শুধু রাজারা নন, রাজপরিবারের অন্যান্য সদস্যরা এবং রাজপুরুষেরাও বিভিন্ন তিথি ও অনুষ্ঠান উপলক্ষে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদের অনুকূলে প্রচুর ভূমি প্রদান করেন। লেখমালার সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, এ পর্বে রাজ্যের সর্বত্র প্রচুর যাগ-যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হত, যজ্ঞাগ্নির ধূম্রজালে আকাশ আচ্ছন্ন হত। হলায়ুধের মতো লক্ষ্মণসেনের এক সদাব্যস্ত ও প্রভাবশালী মন্ত্রীর গৃহে সমিধ, অজিন ও ধূপ চারদিকে ছড়ানো থাকত। হলায়ুধের এই গৃহপরিবেশ, সেন রাজ্যের ধর্মীয় পরিবেশের প্রতীক। সেন পর্বের ধর্মীয় পরিমণ্ডল সুস্পষ্টরূপে শ্রৌত, স্মার্ত ও পৌরাণিক তথা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কৃতির মোড়কে মণ্ডিত।
বৈষ্ণবধর্ম
সেন-বাংলায় বৈষ্ণবধর্মের জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত। সমকালীন লেখাবলিতে কৃষ্ণ-বিষ্ণু বিষয়ক নানা পৌরাণিক কাহিনি উপস্থাপিত হয়েছে। উল্লিখিত হয়েছে কৃষ্ণের জন্ম, যশোদার ঘরে তাঁর বাল্যজীবনযাপন, বীরত্বগাথা, গোপিনীদের সঙ্গে বিহার, বিভিন্ন অবতাররূপে তাঁর আবির্ভাব ইত্যাদি নানা কাহিনি-উপকাহিনি। সেন পর্বের নানা ভঙ্গিমার কয়েকটি বিষ্ণু মূর্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। দিনাজপুর জেলার সুরোহর গ্রামে প্রাপ্ত বিষ্ণুমূর্তিটি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। বিষ্ণু একটি নাগের ফণাছত্রের নীচে দণ্ডায়মান। তাঁর চক্র ও গদা এবং দু’পার্শ্বের চক্র ও শঙ্খপুরুষ নীলকমলের উপর স্থিত। ফণাছত্রের শীর্ষদেশে অমিতাভসদৃশ এক উপবিষ্ট মূর্তি। পাদপীঠে নৃত্যরত এক ষড়ভুজ শিবমূর্তি। ঢাকা জেলার বাস্তা গ্রামে এবং দিনাজপুর জেলার এঞ্চাইল গ্রামে দু’টি লক্ষ্মী-নারায়ণ মূর্তি পাওয়া গেছে। লক্ষ্মী বিষ্ণুর বাম ঊরুর উপর উপবিষ্টা। এই লক্ষ্মী নারায়ণ মূর্তি উমা-মহেশ্বর মূর্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রাক-সেন পর্বে লক্ষ্মী-নারায়ণ মূর্তি বড় একটা দেখা যায় না। লক্ষ্মী-নারায়ণের পূজা দক্ষিণ ভারতেই ব্যাপক প্রসার লাভ করেছিল। সম্ভবত সেন পর্বেই লক্ষ্মী-নারায়ণের রূপ-কল্পনা ও পূজা দক্ষিণ ভারত থেকে বাংলায় প্রবর্তিত হয়। হয়তো সেন রাজাদের কুলদেবতাই ছিলেন এই লক্ষ্মী-নারায়ণ। (বিষয়টি নিঃসন্দেহে বিতর্কিত। বিদ্বজ্জনদের অনেকেরই অভিমত, সেন বংশের পারিবারিক দেবতা সদাশিব।) ধোয়ীর পবনদূতে সে রকম যেন ইঙ্গিত আছে। বগুড়া জেলার দেওড়া গ্রামে গরুড়াসন বিষ্ণুর একটি মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে।
বাসুদেব-কৃষ্ণের জনপ্রিয়তা পালযুগ থেকেই লক্ষ করা গিয়েছিল। সেন আমলে কৃষ্ণের মর্যাদা আরও বৃদ্ধি পায়। কৃষ্ণ মাত্র নন, তিনি স্বয়ং ভগবান। কৃষ্ণস্তু ভগবান্ স্বয়ম্। তিনি জগদীশ ; তিনিই স্বয়ং বিষ্ণু। নীরস তাত্ত্বিক জ্ঞানে তিনি লভ্য নন, নিষ্কলুষ প্রেমের আলিঙ্গনে তিনি ধরা দেন। শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য এবং মধুর যে কোনও ভাবেই তাঁকে ভজনা করা যায় কিন্তু প্রেম না থাকলে ভাব আসে না। আর ভক্তি ছাড়া প্রেম জন্মে না।
কৃষ্ণের জনপ্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গে বিষ্ণুর দশাবতারবাদ সবিশেষ প্রাধান্য লাভ করে। অবতার বাদের কল্পনা অবশ্য বহু দিনের। সেন আমলে এই অবতারবাদ সঞ্জীবনী শক্তি লাভ করে। রাজ্যে বৈদেশিক প্রভুত্বের আশঙ্কাজনিত উদ্বেগ হয়তো অবতারবাদের এই জনপ্রিয়তার একটি মুখ্য কারণ। জয়দেবের গীতগোবিন্দে দশাবতারের বর্ণনা পাওয়া যায়। এঁরা হলেন মীন, কূর্ম, বরাহ, নরহরি, বামন, পরশুরাম, রাম, হলধর, বুদ্ধ এবং কল্কি। হরিবংশে কৃষ্ণকে বিষ্ণুর ৭ম অবতার বলা হয়েছে। সদুক্তিকর্ণামৃতেও কৃষ্ণাবতারের উল্লেখ আছে। সেখানে ষাটটি শ্লোকে কৃষ্ণাবতারের মাহাত্ম্য ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু গীতগোবিন্দে তা নেই। সে কাব্যে কৃষ্ণ এবং বিষ্ণুর অভিন্নতা কীর্তিত হয়েছে। আসলে কৃষ্ণের ঈশ্বরত্ব সম্পর্কে ভারতের পূর্বাঞ্চলে প্রচলিত ধারণাই গীতগোবিন্দে প্রতিফলিত হয়েছে। মধ্যযুগে এবং আধুনিককালে ভারতের প্রায় সর্বত্র যে দশাবতারের ঐতিহ্য সুপ্রতিষ্ঠিত, সেই দশাবতারের প্রথম সমন্বিত ও রীতিবদ্ধ রূপ জয়দেবের গীতগোবিন্দেই পরিবেশিত হয়েছে।
এ পর্বের বিষ্ণুর অবতার মূর্তি বাংলার নানা স্থানে পাওয়া গেছে। অবতারমূর্তিগুলির মধ্যে বরাহ এবং নরসিংহ অবতারমূর্তিই প্রধান। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, লক্ষ্মণসেন লেখে নিজেকে ‘পরমনারসিংহ’ অর্থাৎ নরসিংহের পরম ভক্ত বলে বর্ণনা করেছেন।
বিষ্ণুর রাধা-কৃষ্ণ যুগলরূপে উপাসনাও এ সময় জনপ্রিয় হয়। রাধা পরমা প্রকৃতি, কৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি। রাধা-কৃষ্ণের রূপকল্পনায় সাংখ্যের পুরুষ ও প্রকৃতির প্রতিফলন ঘটেছে। ভাগবত, ব্রহ্ম এবং বিষ্ণু-পুরাণে গোপীদের উল্লেখ আছে কিন্তু রাধার উল্লেখ নেই। রাজা ভোজবর্মার বেলাব লেখে শত গোপিনীর সঙ্গে রাধার বিচিত্র লীলার ইঙ্গিত আছে কিন্তু রাধার উল্লেখ নেই। জয়দেবের গীতগোবিন্দেই সর্বপ্রথম রাধা-কৃষ্ণের ধ্যান কল্পনার সুস্পষ্ট ও সুপ্রচলিত রূপ প্রত্যক্ষী ভূত হয়। হালের গাথাসপ্তশতীর একটি শ্লোকে রাধার কথা আছে কিন্তু শ্লোকটির সময়কাল সে কারণে অনেকে রাধার রূপ কল্পনাকে সেন যুগের অবদান বলে মনে করেন। কিন্তু এ মত অবশ্য অনেকের নিকট অগ্রহণীয় বলে মনে হয়েছে। পাহাড়পুরে প্রাপ্ত ৭ম-৮ম শতকের একটি যুগলমূর্তিকে তাঁরা রাধা-কৃষ্ণের মূর্তি বলে শনাক্ত করেছেন।
শৈবধর্ম
সেন পর্বে শৈবধর্ম বাংলায় সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। দক্ষযজ্ঞ, সতীর দেহত্যাগ, শিব-পার্বতীর বিবাহ, উমা ও সর্বাণীর পাতিব্রত্য, কার্তিকেয়ের শিশুলীলা ইত্যাদি শিব ও তাঁর পরিজন সম্পর্কিত নানা কাহিনি সমকালীন লেখমালায় ইতস্তত ছড়ানো আছে। অর্থাৎ পুরাণ ও মহাকাব্যাদিতে বর্ণিত বিভিন্ন শৈব কাহিনি-উপকাহিনির সঙ্গে তৎকালীন বাঙালি সমাজের ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। এ পর্বের আবিষ্কৃত শিবের বিভিন্ন রূপের মূর্তি সংখ্যায় সুপ্রচুর। শিব সাধারণত লিঙ্গরূপে পূজিত হতেন। এই লিঙ্গ কখনও একমুখ, কখনওবা চতুর্মুখ। শিবের ঈশান, নটরাজ, সদাশিব, উমা-মহেশ্বর, অর্ধনারীশ্বর এবং বৈবাহিক বা কল্যাণসুন্দর মূর্তিও দুষ্প্রাপ্য নয়। শিবের উগ্ররূপের অঘোররুদ্র ও বটুকভৈরব মূর্তিও পাওয়া গেছে। সেন পর্বের শিবমূর্তি প্রসঙ্গে একটি কথা মনে রাখতে হবে। শিবের সদাশিব ও কল্যাণসুন্দর মূর্তিগুলিতে দক্ষিণ ভারতীয় প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছে। শিবের এ দু’টি রূপকল্পনা সম্ভবত দক্ষিণ ভারতের দান। নটরাজ শিবের এক রূপকল্পনাতেও এই দক্ষিণ ভারতীয় প্রভাব লক্ষণীয়। এই রূপ নটরাজের ১২শভুজ রূপ। নটরাজের এক দশভুজ রূপও আছে। এই রূপের প্রচুর মূর্তিও বাংলায় আবিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু এ রূপকল্পনা দক্ষিণ ভারতীয় নয়; এটি মৎস্য পুরাণের ধ্যানকল্পনার অনুসরণ। কিন্তু নটরাজের ১২শভুজ রূপের যেসব মূর্তি বাংলায় আবিষ্কৃত হয়েছে তাদের সঙ্গে শিবের দক্ষিণ ভারতে সুপরিচিত বীণাধর, নটরাজমূর্তিগুলির আত্মীয়তার বন্ধন সুস্পষ্ট। সেন যুগের এই বিশেষ শ্রেণির নটরাজমূর্তি ১২শভুজবিশিষ্ট ; দু’টি হাতে একটি বীণা, দু’টি হাতে একটি নাগফণাছত্র এবং আরও দু’টি হাতে করতাল। এই মূর্তিগুলিতে শিবের নটরাজ পরিচয়ের যথার্থ প্রতিফলন ঘটেছে। আর একটি কথা। এই পর্বের কয়েকটি শিবমূর্তিতে লক্ষণীয়রূপে তন্ত্রের প্রভাব পরি লক্ষিত হয়। এ প্রসঙ্গে উমা-মহেশ্বর ও অর্ধনারীশ্বর মূর্তিগুলি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
হরিহর উপাসনার প্রচলন প্রমাণিত হয় বিজয়সেনের দেওপাড়া প্রশস্তি থেকে। লেখটিতে বিজয়সেনের দেওপাড়া গ্রামে এক বিশাল মন্দিরে প্রদ্যুম্নেশ্বর নামে হরিহর মূর্তি প্রতিষ্ঠার উল্লেখ আছে। সেনরাজ এই হরিহর মন্দিরের অনুকূলে ভূমি দান করেছিলেন। শিব ও বিষ্ণুর অভেদত্বের প্রতিফলন দেখা যায় হরিহরের রূপকল্পনায়।
রামপালে একটি পঞ্চমুখ, দশভুজ গর্জমান সিংহপৃষ্ঠে উপবিষ্ট গণেশের প্রতিমা পাওয়া গেছে। প্রতিমার প্রভাবলীতে ছয়টি ক্ষুদ্রাকার মূর্তি রূপায়িত। এই ছয়টি মূর্তি গাণপত্য সম্প্রদায়ের ছয়টি শাখার প্রতীক। মূর্তিটিতে দক্ষিণ ভারতীয় প্রভাব অনস্বীকার্য। সেন বাংলায় গাণপত্য ধর্মের বিশেষ কোনও প্রভাব ছিল না।
কার্তিকেয়ের স্বতন্ত্র মূর্তি বিরল। এরূপ দুর্লভ একটি কার্তিকেয়মূর্তি উত্তর বাংলায় আবিষ্কৃত হয়েছে। ময়ূরের পৃষ্ঠদেশে মহারাজলীলায় দেবতা উপবিষ্ট। তাঁর দু’পার্শ্বে দুই পত্নী-দেবসেনা ও বল্লী। খ্রিস্টীয় ১২শ শতকীয় এই প্রতিমাটি বর্তমানে কলকাতার ভারতীয় সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত।
শাক্তধর্ম
সেন লেখে শক্তিসাধনার সুস্পষ্ট উল্লেখ না থাকলেও এ সময়কার অসংখ্য দেবীমূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। এই দেবীমূর্তিগুলির মধ্যে সিংহবাহিনী মহিষমর্দিনীই প্রধান। এ পর্বের একটি দশভুজা মহিষমর্দিনী মূর্তি ঢাকা জেলার শাক্তগ্রামে পাওয়া গেছে। মূর্তির পাদপীঠে ‘শ্রী-মাসিক চণ্ডী’ কথাটি উৎকীর্ণ। লক্ষ্মণসেনের তৃতীয় রাজ্যাঙ্কে প্রতিষ্ঠিত একটি দেবীপ্রতিমাকে উৎকীর্ণ লেখে চণ্ডী বলা হয়েছে। দেবী চতুর্ভুজা ও সিংহবাহিনী। দিনাজপুর জেলার পৌরুষ গ্রামে এক নবদুর্গা প্রতিমার সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রতিমার মধ্যস্থলে বৃহদাকৃতি অষ্টাদশভুজা মহিষমর্দিনী উগ্রচণ্ডী। তাঁর চারদিকে আটটি ক্ষুদ্রাকার ষোড়শভুজা অনুরূপ মূর্তি। ক্ষুদ্রাকার দেবীমূর্তিগুলির কোনওটি চণ্ডা, কোনওটি চণ্ডনায়িকা, কোনওটিবা চণ্ডবতী। তবে দিনাজপুরের এই নবদুর্গা প্রতিমাটি পাল যুগেরও হতে পারে। দেবী চামুণ্ডার সেন আমলের বেশ কয়েকটি মূর্তি পাওয়া গেছে। অন্যান্য লাঞ্ছনের সঙ্গে দেবীর হাতে রয়েছে কপাল এবং শব। তন্ত্রের প্রভাব এখানে সহজেই লক্ষণীয়। মনসা ও ষষ্ঠীর মূর্তিও আবিষ্কৃত হয়েছে। এ পর্বে সূর্যোপাসনা প্রসার লাভ করে। সেন বংশীয় রাজা বিশ্বরূপসেন তো স্বয়ং পরমসৌর ছিলেন। কয়েকটি সূর্যমূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। দেবতা উদীচ্যপদাবরণ পরিহিত। সূর্যের রূপ কল্পনায় পারসিক ও ব্রাহ্মণ্য ধ্যান-কল্পনার সমাবেশ ঘটেছে। রাজশাহী জেলার মান্দা গ্রামে একটি ত্রিমুখ, দশভুজ মূর্তি পাওয়া গেছে। দেবতার তিনটি মুখের পাশের দু’টিই উগ্ররূপের। তাঁর দশ হাতের আটটিতে পদ্ম, বিয়ঙ্গ, খট্টাঙ্গ, নীলোৎপল ও ডমরু। এই ধরনের মূর্তি মার্তণ্ড ভৈরব নামে পরিচিত। অর্থাৎ এটি নিছক একটি সূর্যপ্রতিমা নয়, সূর্য ও ভৈরবের এক সমন্বিত, যৌগিক মূর্তি।
বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম
ধর্ম বিষয়ে সেন রাজাদের যে উদ্যোগ, তা কিন্তু শুধু ব্রাহ্মণ্যধর্মকে কেন্দ্র করে। অন্য ধর্মের প্রতি তাঁরা শ্রদ্ধিত ছিলেন বলে মনে হয় না। বল্লালসেন তো তাঁর দানসাগরে সদম্ভে ঘোষণা করেছেন, নাস্তিক অর্থাৎ বৌদ্ধদের পদোচ্ছেদের জন্য তাঁর জন্ম। রাজাদের অনুগ্রহ তো ছিলই না। তার উপর বৌদ্ধধর্ম ক্রমশ গুহ্যসাধনবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ছিল। ফলে জনসাধারণ ধীরে ধীরে এই ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। পূজা, প্রতিমা ও অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মধ্যে ব্যবধানও ক্ষীয়মাণ হতে থাকে। ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীরা বৌদ্ধবিহারে, মন্দিরে বৌদ্ধ দেব দেবীদের সঙ্গে সমাদরে পূজিত হতে থাকেন। বৃহত্তর জনমানসে বৌদ্ধধর্মের আর কোনও পৃথক অস্তিত্ব থাকল না, ব্রাহ্মণ্যধর্মের মহাসমুদ্রে বিলীন এক সত্তারূপে প্রতিভাত হল। এর সঙ্গে যুক্ত হল ব্রাহ্মণ্যধর্মের সাঙ্গীকরণ শক্তি। বুদ্ধদেব বহুদিন পূর্বেই বিষ্ণুর অন্যতম অবতাররূপে ব্রাহ্মণ্যধর্মে স্বীকৃতি লাভ করেন। সমকালীন প্রখ্যাত বৈষ্ণব কবি জয়দেব বিষ্ণুর বুদ্ধাবতারের এক জোরালো প্রবক্তা। বুদ্ধের বেদবিহিত যাগযজ্ঞের বিরোধিতা তাঁর অবিদিত নয়। তবু তিনি দয়ার্দ্রচিত্ত বুদ্ধের জয়ধ্বনি করেছেন, বুদ্ধের উদ্দেশে প্রণতি জ্ঞাপন করেছেন। তিনি বুদ্ধকে কেশবের অবতাররূপে গ্রহণ করে অকপটে বুদ্ধের মাহাত্ম্যই প্রচার করেছেন। (“নিন্দসি যজ্ঞবিধেরহহ শ্রুতিজাতম্।/ সদয়হৃদয়দর্শিত পশুঘাতম্ ৷৷/ কেশব, ধৃতবুদ্ধশরীর, জয় জগদীশ হরে।” – গীতগোবিন্দ, ১.১৩। অর্থাৎ, ‘হে কেশব, হে জগদীশ, হে হরি, তুমি বুদ্ধশরীর ধারণ করে করুণাঘন হৃদয়ে জীবহত্যা দেখে বেদবিহিত যজ্ঞের সতত নিন্দা করেছ, তোমার জয় হোক।’) ব্রাহ্মণ্যধর্মের এই ঔদার্য ও সাঙ্গীকরণ শক্তি বৌদ্ধধর্মের বুকে শক্তিশেলের মতো আঘাত করে। এ যুগে যেসব বৌদ্ধমূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে তা সংখ্যায় স্বল্প। বৌদ্ধবিহারগুলির পাল আমলের সে রমরমা ভাব আর ছিল না। বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের অনেকে তখনও জীবিত। তাঁদের পূর্বের প্রতাপ আর ছিল না।
বাঁকুড়া, বীরভূম এবং উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা থেকে সেন আমলের কয়েকটি জৈন মূর্তি গেছে। মূর্তিগুলির বেশিরভাগই পার্শ্বনাথের। এ থেকে সেন যুগে বাংলায় দিগম্বর সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের কথা জানা যায়।
ভাষা ও সাহিত্য
সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে সেন যুগ এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়রূপে স্বীকৃত। রাজাদের অনেকেই ছিলেন বিদ্বান এবং গুণগ্রাহী। ‘দানসাগর’ এবং ‘অদ্ভুত সাগর’ গ্রন্থ দুখানি বল্লালসেনের রচনা। ১০৮৯ অথবা ১০৯০ শকাব্দে অর্থাৎ ১১৬৭ বা ১১৬৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘অদ্ভুতসাগর’ রচনার কাজে হাত দেন। কিন্তু তিনি গ্রন্থখানি সমাপ্ত করে যেতে পারেননি। তাঁর অনুরোধক্রমে সে কার্য সম্পাদন করেন তাঁর পুত্র লক্ষ্মণসেন। ৭০টি অধ্যায়ে বিভক্ত প্রথম গ্রন্থখানি দান ও সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কিত। দ্বিতীয়খানিতে আলোচিত হয়েছে। অন্তরীক্ষীয়, বায়বীয় এবং ভৌতিক নানা ইঙ্গিত ও লক্ষণ। এছাড়া বল্লালসেন ‘আচারসাগর’, ‘প্রতিষ্ঠাসাগর’ ও ‘ব্রতসাগর’ নামে আরও তিনখানি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। সেসব গ্রন্থ কাল স্রোতে হারিয়ে গেছে।
ব্রাহ্মণ্য সংস্কার ও ক্রিয়াকর্মের উপর এ যুগে আরও কয়েকটি গ্রন্থ রচিত হয়। এরূপ দু’খানি গ্রন্থ ‘হারলতা’ ও ‘পিতৃদয়িত’। লেখক বল্লালসেনের গুরু অনিরুদ্ধ। অশৌচ ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশদ আলোচনামূলক গ্রন্থ ‘হারলতা’। শ্রাদ্ধাদি বিষয়ক বিবিধ ক্রিয়াকর্মের বর্ণনামূলক গ্রন্থ ‘পিতৃদয়িত’। লক্ষ্মণসেনের মন্ত্রী হলায়ুধ লিখলেন ‘ব্রাহ্মণসর্বস্ব’, ‘মীমাংসাসর্বস্ব’, ‘বৈষ্ণবসর্বস্ব ‘শৈবসর্বস্ব’ এবং ‘পণ্ডিতসর্বস্ব’। এর মধ্যে কেবল প্রথম গ্রন্থখানিই এখন পাওয়া যায়, বাকি চারখানি গ্রন্থই বিলুপ্ত। ব্রাহ্মণদের নিত্যকর্ম ও সংস্কারাদি সম্পর্কিত গ্রন্থ ‘ব্রাহ্মণসর্বস্ব’। স্মার্ত জীমূতবাহন সম্ভবত এই সময় আবির্ভূত হন। সম্পত্তির উত্তরাধিকারের উপর তাঁর লেখা ‘দায়ভাগ’ সমকালীন ও পরবর্তী যুগে বাংলায় বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। গ্রন্থকার তাঁর পূর্বগামী শাস্ত্রকারদের মতামত খণ্ডন করে অগাধ পাণ্ডিত্য এবং অকাট্য যুক্তির মাধ্যমে স্বমত প্রতিষ্ঠা করেছেন। ১৬শ শতকের বিখ্যাত বাঙালি নৈয়ায়িক রঘুনন্দন বার বার তাঁর ‘দায়তত্ত্ব’ গ্রন্থে জীমূতবাহনের মতামত প্রামাণিকরূপে গ্রহণ করেছেন। তাঁর লেখা আরও দু’খানি গ্রন্থ ‘ব্যবহারমাতৃকা’ ও ‘কালবিবেক’। বিচারপদ্ধতির আলোচনামূলক গ্রন্থ ‘ব্যবহার-মাতৃকা’। এই গ্রন্থে ব্যবহারের সংজ্ঞা, বিচারকের গুণাগুণ, বিচারালয়, ধর্মাধিকরণ সভ্যদের দায়-দায়িত্ব, আবেদনকারী ও অভিযুক্তের উত্তর-প্রত্যুত্তর, সাক্ষ্য প্রমাণ, বিচারকার্য, বিচারফল ইত্যাদি বিষয় বিশদরূপে আলোচিত হয়েছে। ‘কালবিবেক’ গ্রন্থে ব্রাহ্মণ্যধর্মের নানা শুভ ও পূজানুষ্ঠানের শুভাশুভ কাল, সৌরমাস, চান্দ্রমাস প্রভৃতি বিচার্য বিষয় আলোচিত ও বিশ্লেষিত হয়েছে।
এ পর্বে কাব্য রচনা করে যাঁরা যশস্বী হয়েছেন তাঁদের মধ্যে জয়দেব, ধোয়ী, শরণ, উমাপতিধর এবং গোবর্ধন বা গোবর্ধনাচার্য কয়েকটি স্মরণীয় নাম। তাঁরা সকলে লক্ষ্মণসেনের সভা অলংকৃত করেছিলেন। জয়দেবের জন্ম কেন্দুবিল্ব গ্রামে। অনেকের মতে কেন্দুবিশ্বের অবস্থান বীরভূম জেলার কেন্দুলী গ্রামে, আবার কারও মতে ওড়িশায়। তাঁরই রচনা গীতগোবিন্দ। কবি নিজে তাঁর কাব্যকে ‘মধুর-কোমল-কান্ত-পদাবলী’ আখ্যা দিয়েছেন। আসলে এটি রাধাকৃষ্ণের অপ্রাকৃত প্রেমের এক গীতি-আলেখ্য। ছন্দঝংকারে ও পদলালিত্যে কাব্যখানি সুষমামণ্ডিত কিন্তু কবির আবেগপ্রবণ সম্ভোগ বর্ণনায় কাব্যখানির মাধুর্য ব্যাহত। এ কাব্যে ভাবের ব্যঞ্জনা ও জীবন বোধের গভীরতাও তেমন আভাসিত হয়নি। ধোয়ীর লেখা দূতকাব্য ‘পবনদূত’। কালিদাসের ‘মেঘদূত’ এ কাব্যের প্রেরণা। মলয়পর্বতনিবাসিনী গন্ধর্বকন্যা কুবলয়মতী পবনদূত মারফৎ তাঁর প্রেমাস্পদ লক্ষ্মণসেনের নিকট বার্তা পাঠাচ্ছেন, এই হল কাব্যের বিষয়বস্তু। কাব্যটিতে কল্পনা মাধুর্যের স্পর্শ আছে কিন্তু মৌলিকতা বা ভাব-গভীরতার তেমন পরিচয় নেই।
গোবর্ধনাচার্য হালের ‘গাথাসপ্তশতী’র অনুকরণে ‘আর্যাসপ্তশতী’ রচনা করেন। কিঞ্চিদধিক সাত শত শ্লোকে রচিত কাব্যখানি শৃঙ্গাররসাত্মক। ‘গাথাসপ্তশতী’র সরস, সরল ও সহজ প্রকাশ ভঙ্গি এ কাব্যে ফুটে উঠেনি। শরণ বা উমাপতিধরের কোনও কাব্যগ্রন্থ এখন আর পাওয়া যায় না। সদুক্তিকর্ণামৃতে উমাপতিধরের ৯১টি শ্লোক উদ্ধৃত আছে। দেওপাড়া প্রশস্তি তো উমা পতিধরেরই রচনা। নিজ কবিপ্রতিভার পরিচয় প্রসঙ্গে দেওপাড়া লেখে তিনি মন্তব্য করেছেন, শব্দজ্ঞান ও শব্দার্থবোধ দ্বারা তিনি পরিশুদ্ধবুদ্ধি ছিলেন। মনে হয়, বিজয়সেন থেকে আরম্ভ করে লক্ষ্মণসেন পর্যন্ত তিন পুরুষ ধরে উমাপতিধর সেন রাজসভার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। লক্ষ্মণসেনের নবদ্বীপ ত্যাগ করে পূর্ববঙ্গে আশ্রয়গ্রহণের পরও তিনি জীবিত। দীর্ঘদিন যাঁদের অন্নে তিনি প্রতিপালিত দুর্দিনে তাঁদের ত্যাগ করে লক্ষ্মণসেনের শত্রু বখতিয়ারকেই তিনি শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদনের পাত্র নির্বাচন করেন। তিনি লিখলেন : ‘সাধু ম্লেচ্ছনরেন্দ্র, সাধু ভবতো মাতৈব বীরপ্রসূর্/ নীচেনাপি ভবদ্বিধেন বসুধা সুক্ষত্রিয়া বৰ্ততে।’ অর্থাৎ, ‘ম্লেচ্ছরাজ, সাধু, সাধু। আপনার মাতা বীরপ্রসবিনী। নীচ কুলোদ্ভব হলেও আপনার জন্যই বসুধা এখনও সুক্ষত্রিয়’। উমাপতিধর হয়তো বখতিয়ারের সভায় সভাকবির পদে উন্নীত হয়ে ছিলেন কিন্তু নৈতিকতার কী আদর্শ তিনি স্থাপন করলেন?
শরণের রচিত কোনও কাব্য আবিষ্কৃত হয়নি। তাঁর লেখা ২০টি শ্লোক সদুক্তিকর্ণামৃতে উদ্ধৃত আছে। সমকালীন এসব কবিদের প্রশংসার আড়ালে কার্যত নিন্দাই করেছেন জয়দেব তাঁর গীত গোবিন্দ গীতিকাব্যের মুখবন্ধে : “বাচঃ পল্লবয়ত্যুমাপতিধরঃ সন্দর্ভশুদ্ধিং গিরাং/ জানীতে জয়দেব এর শরণঃ শ্লাঘ্যো দুরূহদ্রুতে।/ শৃঙ্গারোত্তরসৎপ্রমেয়রচনৈরাচার্যগোবর্ধন/ স্পৰ্দ্ধী কোঽপি ন বিশ্ৰুতঃ শ্ৰুতিধরো ধোয়ী কবিক্ষ্মাপতিঃ॥” – গীতগোবিন্দ, ১, ৪। উমাপতিধর বাক্য পল্লবিত করেন। অর্থাৎ তাঁর রচনায় অলংকার আছে, অনুপ্রাস আছে কিন্তু কাব্যগুণ নেই। দুরূহপদের দ্রুত রচনায় শরণ সিদ্ধহস্ত। অর্থাৎ তাঁর কাব্যে প্রসাদাদি গুণ নেই। শৃঙ্গাররসের সৎ এবং পরিমিত রচনায় গোবর্ধনাচার্য অপ্রতিদ্বন্দ্বী। অর্থাৎ আচার্যের দক্ষতা শৃঙ্গার রসাত্মক কাব্য রচনায় গণ্ডীবদ্ধ। কবিরাজ ধোয়ী শ্রুতিধর। অর্থাৎ তাঁর কাব্যে মৌলিকতার অভাব। একমাত্র জয়দেবই শুদ্ধ সন্দর্ভ রচনায় পারদর্শী। আসলে এই স্তুতিশ্লোকে জয়দেব স্বকণ্ঠে নিজের শ্রেষ্ঠত্বই ঘোষণা করছেন।
১১২৭ শকাব্দ বা ১২০৫ খ্রিস্টাব্দে লক্ষ্মণসেনের সভাসদ শ্রীধরদাস ‘সদুক্তিকৰ্ণামৃত’ নামে এক কবিতা-সংকলন সম্পাদন করেন। ৪৮৫ জন কবির ২৩৭০টি কবিতা এই গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে বল্লালসেন এবং লক্ষ্মণসেনের কবিতাও আছে। ‘সুভাষিত-রত্নকোষ’ এ পর্বের আর একখানি কবিতা সংকলন। সম্পাদনা করেছেন বিদ্যাকর। এ যুগের আর একজন কথা শিল্পী শ্রীহর্ষ। তিনি একাধারে দার্শনিক ও কবি। তাঁর লেখা কাব্য ‘নৈষধচরিত’ বা ‘নৈষধীয়’। নল দময়ন্তীর প্রণয় এ কাব্যের প্রতিপাদ্য বিষয়। ছন্দ ও অলংকারের চমৎকারিত্ব সত্ত্বেও অকারণ বর্ণনায় কাব্যটি ভারাক্রান্ত। ভাষা ও ভাবের যে বিশেষ ব্যঞ্জনা কাব্যের প্রাণ, তা এখানে অন্তর্হিত। অনেকেই সেনরাজ বিজয়সেনকে শ্রীহর্ষের পৃষ্ঠপোষক বলে মনে করেন। আবার কারও মতে তিনি গাহড়বালরাজ বিজয়চন্দ্র বা জয়চ্চন্দ্র কিংবা উভয়েরই সভাকবি ছিলেন। তথ্য সে রকম নেই, তবু সন্দেহ নেই এ সময় শৌরসেনী অপভ্রংশ এবং মাগধী অপভ্রংশ থেকে বিবর্তিত এক লৌকিক ভাষায় বেশ কিছু চর্যাপদ ও দোঁহা রচিত হয়। এই শেষোক্ত লৌকিক ভাষাটি থেকেই বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে।
স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলা
স্থাপত্য : ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক সেন রাজাদের আমলে কয়েকটি শিব ও বিষ্ণুমন্দির অবশ্যই নির্মিত হয়েছিল। সেন লেখাবলিতে এরূপ কয়েকটি দেবায়তনের সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে। মন্দিরগুলির বেশিরভাগই ধ্বংস হয়ে গেছে। আর ভগ্নপ্রায় যে কটি মন্দির বাংলায় এখনও বিদ্যমান, তাদের বিশেষ কোনওটিকে সেন রাজাদের কীর্তি বলে সুনিশ্চিতরূপে চিহ্নিত করা যায় না। তবে প্রাক-সেন ও সেনোত্তর পর্বের ব্রাহ্মণ্য মন্দিরগুলির গঠন দেখে অনুমিত হয়, এ সময়ের মন্দিরগুলি রেখশৈলীর অনুকরণে নির্মিত হয়েছিল।
ভাস্কর্য : পাল যুগের তুলনায় সেন পর্বের ভাস্কর্যশিল্প অনেক নিষ্প্রভ। এ সময়ের দেবদেবীর মূর্তির পূর্বের সে ধ্যানমগ্ন, প্রশান্ত মুখশ্রী আর নেই। পরিবর্তে ফুটে উঠেছে কামনা-সম্ভোগের পরিতৃপ্তি। দেহবল্লরীও যেন তার গতিময়তা হারিয়ে ফেলেছে। অলংকরণের অকারণ বাহুল্যে মূর্তির সহজ সৌন্দর্য ব্যাহত গৌণ দেবতাদের ভিড়ে মূলদেবতা যেন আড়ালে ঢাকা পড়ে আছেন। এর ব্যতিক্রম যে নেই, তা নয়। তবে তারা সংখ্যায় স্বল্প। ঢাকার চণ্ডী, রংপুরের বিষ্ণু, ব্যারাকপুরের বজ্রাসন বুদ্ধ, মুর্শিদাবাদের হরি হর-ব্রহ্মা, বর্ধমানের বিষ্ণু লোকেশ্বর, পশ্চিম দিনাজপুরের সদাশিব, মেদিনীপুরের শিব-ঈশান এবং দেওপাড়ার গঙ্গামূর্তি এ পর্বের তক্ষণ-শিল্পের উল্লেখ যোগ্য নিদর্শন।
চিত্রকলা : অনুরূপ অবক্ষয়ের রূপ ধরা পড়ে এ যুগের চিত্রকলায়। সেন পর্বের চিত্রশিল্পের নিদর্শন অতি স্বল্পই আবিষ্কৃত হয়েছে। অবক্ষয়ের লক্ষণ কিন্তু সুস্পষ্ট। রেখা-বিন্যাস হ্রস্ব এবং খণ্ডিত। ফলে দেহের গড়ন আর ভঙ্গি বিশেষভাবে ব্যাহত ও বিচ্ছিন্ন। দেহসীমার বাইরে উদ্গত নেত্র চিত্রের চারুতা ক্ষুণ্ণ করেছে বিশেষভাবে। তাছাড়া, সুষম ছায়াযুক্ত রঙের ব্যঞ্জনা ছবির যে বিশেষ বর্তনা তা এখানে সম্পূর্ণরূপে অন্তর্হিত।
গ্রন্থপঞ্জি
- দীনেশচন্দ্র সরকার : পাল ও সেন যুগের বংশানুচরিত (কলকাতা, ২০০৯)।
- নলিনীনাথ দাশগুপ্ত : বাঙ্গালার বৌদ্ধধর্ম (কলকাতা, ১৩৫৫)।
- নীহাররঞ্জন রায় : বাঙালীর ইতিহাস : আদি পর্ব (কলকাতা, ১৯৯৩)।
- রণবীর চক্রবর্তী : প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসের সন্ধানে (কলকাতা, ১৯৮৬)।
- রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় : বাঙ্গালার ইতিহাস: প্রথম খণ্ড (কলকাতা, ১৩২১)।
- সরসীকুমার সরস্বতী : পাল যুগের চিত্রকলা (কলকাতা, ১৯৮৫)।
- Gopal, L.: The Economic Life Of Northern India (Varanasi, 1963). Majumdar, R. C.: History Of Ancient Bengal (Calcutta, 1974).
- Majumdar, R. C. (Ed.): The History Of Bengal, Vol. I (Dacca, 1943); The Age Of Imperial Kanauj (Bombay, 1964).
- Morrison, B. M.: Political Centres and Cultural Regions in Early Bengal (Tuscon, 1970).
- Sen, B. C. : Some Historical Aspects of The Inscriptions of Bengal : Pre-Mohammedan Period (Calcutta, 1942).
- Saraswati, S. K. Early Sculpture of Bengal (Calcutta, 1962); A Survey of Indian Sculpture (Calcutta, 1957).
Leave a Reply