মধ্য এশিয়া, চিন, তিব্বত ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিস্তার

Table of Contents

মধ্য এশিয়া ও চিনের সম্পর্ক

সম্পর্কের সূত্রপাত ও বৌদ্ধধর্মের বিস্তার

ভূমিকা : প্রাক-খ্রিস্টীয় পর্বে ভারতবর্ষের সঙ্গে একদিকে মধ্য এশিয়া ও চিন এবং অপর দিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশসমূহের সঙ্গে বাণিজ্যিক যােগসূত্র স্থাপিত হয়। পরবর্তিকালে ভারতীয় ধর্ম, সংস্কৃতি ও ভাষার প্রচারের মধ্য দিয়ে এই সংযােগ এক সাংস্কৃতিক সম্পর্কের রূপ পরিগ্রহ করে। মধ্য এশিয়া, চিন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অভিজাত ও রাজপরিবারের অকুণ্ঠ সহযােগিতায় এই সম্পর্ক উত্তরােত্তর গভীরতর, নিবিড়তর হয়।

সম্পর্কের সূত্রপাত : প্রাচীনকালে ভারতীয় সভ্যতা হিমালয় ও হিন্দুকুশ পর্বতমালার উত্তরে অবস্থিত মধ্য এশিয়া, চিন প্রভৃতি বহির্ভারতীয় দেশসমূহে প্রসার লাভ করেছিল। এখন চিন বলতে যে বিস্তৃত ভূখণ্ড বােঝায়, প্রাচীন চিন আয়তনে তেমন বিশাল ছিল না। কাসগড়, হােটান, ইয়ারকন্দ প্রভৃতি স্থান বর্তমানে চিনের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু সে সময় মধ্য এশিয়ার এসব অঞ্চল স্বাধীন ও স্বতন্ত্র রাষ্ট্ররূপে গড়ে উঠেছিল। তখন তিব্বতও ছিল এক স্বতন্ত্র দেশ। মধ্য এশিয়া ও চিনের সঙ্গে ভারতবর্ষের বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কের ইতিহাস অতি প্রাচীন। চিনে প্রচলিত এক কাহিনী থেকে জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকের শেষ পাদ হতেই বেভার থেকে বৌদ্ধ শ্রমণরা নিয়মিতভাবে সে দেশে যাতায়াত শুরু করেন। কিন্তু এ কাহিনীর ঐতিহাসিকতা সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ আছে। আর এক চিনা কাহিনীতে বলা হয়েছে, এক চিনা সেনাপতি ১২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মধ্য এশিয়ায় সামরিক অভিযানের সময় বুদ্ধদেবের একটি স্বর্ণমূর্তি সংগ্রহ করে সেটি নিয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন; চিনারা সেই প্রথম বৌদ্ধধর্মের কথা জানতে পারেন। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকে বৌদ্ধধর্ম চিনে প্রচারিত হয়েছিল এমন ভাবা যুক্তি যুক্ত বােধ হয় না। তখন থেকে, হয়তােবা আরও কিছুকাল পূর্ব হতে, মধ্য এশিয়া ও চিনের সঙ্গে ভারতের যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল সে সম্পর্কে অবশ্য কোনও সন্দেহ নেই। এ প্রসঙ্গে চিনা রাজদূত চ্যাঙ কিয়েন-এর বিবৃতি বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। চ্যাঙ কিয়েন ১২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ব্যাকট্রিয়ার বাজারে চিনের বাঁশ ও বস্ত্র দেখতে পান। ওই দু’টি চিনা সামগ্রী স্থানীয় বাজারে বিক্রি হচ্ছিল। চিনা রাজদূত অনুসন্ধান করে জানলেন, সুন্নান, মায়ানমার, পূর্ব ও উত্তর ভারত এবং আফগানিস্তানের পথ ঘুরে জিনিসগুলো ব্যাকট্রিয়ার বাজারে এসে পৌঁছেছে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে ‘চীনপট্ট’-এর উল্লেখ আছে। প্রাক-খ্রিস্টীয় যুগে ভারতে চিনা বস্ত্রের যে ব্যাপক চাহিদা ছিল তা এই উল্লেখে প্রমাণিত হয়। খ্রিস্টীয় ১ম শতকে রচিত একখানি চিনা ইতিবৃত্ত থেকে জানা যায়, চিনের সঙ্গে দক্ষিণ চিন সাগর ও ভারত মহাসাগর সংলগ্ন বিভিন্ন অঞ্চলের সমুদ্রপথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। চিনের সঙ্গে সামুদ্রিক বাণিজ্যে লিপ্ত একটি অঞ্চলের নাম ছিল হুয়াঙ চে। হুয়াঙ চেকে অনেকে দক্ষিণ ভারতের কাঞ্চী বলে শনাক্ত করেছেন। উল্লিখিত ইতিবৃত্তে আরও বলা হয়েছে, হুয়াঙ চে হতে চিনা সম্রাট উকে প্রচুর উপঢৌকন পাঠানাে হয়। তাছাড়া কর্ণাটকে একটি চিনা মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। মুদ্রাটি সম্ভবত ১৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে উৎকীর্ণ হয়েছিল। এসব তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয়, খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতক বা তার কিছু পূর্বেই ভারত ও মধ্য এশিয়া-চিনের মধ্যে নিয়মিত বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। মধ্য এশিয়া ও চিনের সঙ্গে ভারতবর্ষের এই বাণিজ্যিক সম্পর্ক পরবর্তিকালে সাংস্কৃতিক সম্পর্কে সম্প্রসারিত হয়। বৌদ্ধধর্ম মধ্য এশিয়া ও চিনে অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা অর্জন করে, সংস্কৃত সাহিত্যও বিপুল সমাদর লাভ করে। খ্রিস্টীয় ১ম ও ২য় শতকে মধ্য এশিয়া ও চিনের এক সুবিস্তীর্ণ অঞ্চল কুষাণ সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। ভারতের এক বিশাল ভূখণ্ডও কু্যাণ রাজাদের শাসনাধীন ছিল। স্বাভাবিক কারণেই কুষাণপর্বে ভারতের সঙ্গে মধ্য এশিয়া ও চিনের সম্পর্ক নিবিড় ও ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে।

মধ্য এশিয়া ও চিনে বৌদ্ধধর্মের সুচনাকাল : মধ্য এশিয়া ও চিনে কখন বৌদ্ধধর্মের প্রসার ঘটল তা সঠিক বলা সম্ভব নয়। চিনা সূত্রে বলা হয়েছে, ভারত থেকে একদল বৌদ্ধ শ্ৰমণ ২১৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চিনে গিয়েছিলেন। বৌদ্ধগ্রন্থাদিতে অশােকের পুত্র কুণালের মধ্য এশিয়ার হােটানে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের উল্লেখ আছে। কিন্তু এ ধরনের তথ্য বিশ্বাসযােগ্য নয়। এক প্রাচীন চিনা কাহিনী হতে জানা যায়, ১২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জনৈক চিনা সেনাপতি মধ্য এশিয়া জয় করে সেখান থেকে বুদ্ধদেবের একটি স্বর্ণমূর্তি সংগ্রহ করে চিনে নিয়ে যান। এ কাহিনীর সত্যতা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে। চিনের প্রাচীন ইতিবৃত্তে হানবংশীয় রাজা মিঙ তি সম্পর্কে এক কাহিনীর অবতারণা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সম্রাট মিঙ তি ৬৫ খ্রিস্টাব্দে এক সুবর্ণকান্তি পুরুষকে স্বপ্নে দেখেন। সভাসদরা রাজাকে বলেন, স্বপ্নে যাকে তিনি দেখেছেন তিনি বুদ্ধদেব। এ কথা শুনে হান সম্রাট ভারতে দূত পাঠান। দুতেরা ভারতবর্ষ হতে ধর্মরতু ও কাশ্যপ মাতঙ্গ নামে দু’জন প্রখ্যাত বৌদ্ধাচার্যকে সঙ্গে নিয়ে দেশে ফেরেন। প্রায় সকলেই এই কাহিনীর ঐতিহাসিকতা স্বীকার করেছেন। খ্রিস্টীয় ১ম শতকের মধ্যভাগে বৌদ্ধধর্ম যে চিন দেশে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল, তা এই কাহিনীতে প্রমাণিত হয়। কিন্তু মধ্য এশিয়ায় বৌদ্ধধর্মের প্রসার ঘটেছিল চিনে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের অবশ্যই কিছুকাল পূর্বে, সম্ভবত খ্রিস্টীয় ১ম শতকের প্রারম্ভে বা প্রাক্-খ্রিস্টীয় শতকের একেবারে শেষের দিকে।

স্থল ও জলপথ : ভারত ও চিনের মধ্যে স্থল ও জল উভয় পথেই যাতায়াতের ব্যবস্থা ছিল। আফগানিস্তানের বলখ শহর থেকে চিন দেশে যাওয়ার তিনটি রাজপথ ছিল। অবস্থানগত বৈচিত্রের জন্য রাজপথ তিনটিকে উত্তরাপথ, অন্তর্বর্তী পথ ও দক্ষিণাপথ আখ্যা দেয়া চলে। উত্তরাপথটি তাজিকিস্তান ও কাজাকস্তানের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে সিনকিয়াং ভূখণ্ডের উত্তরাঞ্চল অভিমুখে চলে গিয়েছিল। অন্তর্বর্তী পথটি দিয়ে বলখ থেকে কাসগড় নদীর উচ্চ অববাহিকা অঞ্চলে পৌঁছানাে যেত। দক্ষিণাপথটি বলখ থেকে বেরিয়ে পামির মালভূমি ও ওয়াখান অববাহিকার মধ্য দিয়ে চলে গিয়েছিল কাসগড়, ইয়ারকন্দ ও হােটানের মতাে দূরবর্তী শহর অভিমুখে। তাছাড়া পশ্চিম চিনে যাওয়ার আরও একটি স্থলপথ ছিল। পথটি ছিল হ্রস্ব কিন্তু অতি দুর্গম। এ পথ বলখ ঘুরে মধ্য এশিয়া বা চিনে যাওয়ার পথ নয়, এ পথ গিলগিট থেকে বেরিয়ে যাসিন উপত্যকার ভেতর দিয়ে অগ্রসর হয়ে ওয়াখান অববাহিকায় গিয়ে দক্ষিণাপথটির সঙ্গে মিশেছিল। খ্রিস্টীয় ৫ম শতকে চিনা পরিব্রাজক ফা শিয়েন এই দুর্গম পথ ধরেই ভারতবর্ষে এসেছিলেন। উত্তর-পূর্ব ভারতের ভেতর দিয়ে মায়ানমারের মধ্য দিয়ে একটি সুদীর্ঘ স্থলপথ ভারতকে দক্ষিণ-পূর্ব চিনের সঙ্গে সংযুক্ত করে রেখেছিল। জলপথেও চিন দেশের সঙ্গে ভারতের সংযােগ ছিল। পূর্ব ভারত ও মায়ানমারের উপকূল ধরে বা মাঝ দরিয়া দিয়ে মালক্কা প্রণালী পার হয়ে ইন্দোচিনের উপকূল ধরে জলপথে ভারত থেকে চলে যাওয়া যেত। প্রখ্যাত চিনা শ্ৰমণ ফা শিয়েন পশ্চিমবঙ্গের তাম্রলিপ্তি বন্দর থেকে যাত্রা করে শ্রীলঙ্কা ও যবদ্বীপ হয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন।

ভারতীয় সংস্কৃতির কয়েকটি কেন্দ্র

ভারত-মধ্য এশিয়া বা ভারত-চীন সম্পর্কের উপর আলােকপাত করে এমন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন মধ্য এশিয়া ও চিনের বিভিন্ন স্থানে আবিষ্কৃত হয়েছে –

  • হোটান : হােটানে কয়েকখানি খরােষ্ঠী অভিলেখ ও বেশ কিছু মুদ্রা পাওয়া গেছে। এখানে পাওয়া একখানি লেখে বিজিতসিংহ নামে জনৈক স্থানীয় রাজার কথা বলা হয়েছে। তিনি মহারাজ ও রাজাধিরাজরূপে বর্ণিত হয়েছেন। প্রাচীন হােটানের অনেক রাজারই নামের আদ্যভাগে ‘বিজিত’ কথাটির উল্লেখ আছে। এ ধরনের নাম যারা গ্রহণ করেছেন তাদের বংশকে ‘বিজিত’ বংশ আখ্যা দেয়া হয়। এখানে যেসব প্রাচীন মুদ্রা পাওয়া গেছে তাদের মুখ্য পিঠে উৎকীর্ণ আছে চিনা লেখ। মুদ্রাগুলোর গৌণ পিঠে প্রাকৃত ভাষা ও খরােষ্ঠী বর্ণমালা ব্যবহৃত হয়েছে। এর থেকে বােঝা যায়, হােটানের প্রাচীন রাজাদের অনেকেই ভারতীয় নাম ও অভিধা ধারণ করেছেন; তারা প্রশাসনিক কাজকর্মে প্রাকৃত ভাষা ও খরােষ্ঠী লিপি ব্যবহার করেছেন। লেখ ও মুদ্রাগুলো খ্রিস্টীয় ২য়-৩য় শতকে উৎকীর্ণ হয়েছিল বলে অনুমিত হয়। হোটান শহরের প্রাচীন নাম খােটান। তকলা মাকান মরুভূমির দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে এই মরুদ্যান-শহরটির অবস্থান। হােটান বা খােটান যেমন একটি শহরের নাম তেমনি একটি অঞ্চলেরও নাম। সুবিখ্যাত গােমতী বিহার হােটানেই অবস্থিত ছিল। বৌদ্ধশাস্ত্র চর্চার এক প্রধান কেন্দ্র ছিল এই বিহার। বহু ভারতীয় পণ্ডিত এই বিহারে অধ্যাপনা করতেন। চিনা শ্রমণদের অনেকেই ভারতে না এসে হােটানের গােমতী বিহারেই বৌদ্ধশাস্ত্র অধ্যয়ন করতেন।
  • কুচ : হােটানের মতাে ভারতীয় সংস্কৃতির আর এক প্রধান কেন্দ্র ছিল কুচ। উত্তরাপথের উপর অবস্থিত ছিল এই বৌদ্ধ শহরটি। এই শহর ও নিকটস্থ অঞ্চল থেকে বহু প্রাচীন পুঁথি ও প্রত্নতাত্ত্বিক অভিজ্ঞান আবিষ্কৃত হয়েছে। সুবর্ণপুষ্প, হরিপুষ্প, হরদেব, সুবর্ণদেব প্রভৃতি নামের রাজারা এখানে রাজত্ব করতেন। এরা স্থানীয় অধিবাসী ছিলেন কিন্তু ভারতীয় নাম ধারণ করেছেন। প্রাপ্ত নিদর্শনাদি থেকে জানা যায়, কাতন্ত্র ব্যাকরণ এখানে জনপ্রিয় ছিল কিন্তু পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী তেমন সমাদৃত ছিল না। উদানবর্গ-এর মতাে শাস্ত্রগ্রন্থ, ভারতীয় জ্যোতিষ ও আয়ুর্বেদের চর্চা হত এখানে। সেই প্রাচীনকালে বহু সংস্কৃত গ্রন্থ স্থানীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছিল এই শহরে। মােঙ্গোলিয়া, জাপান প্রভৃতি দেশে বৌদ্ধধর্মের বিস্তারের এক প্রধান কেন্দ্র ছিল এই শহর।
  • মিং ওই : কুচেরই নিকটবর্তী মিং ওই’র এখানে কয়েকখানি ভগ্ন ব্রাহ্মী লেখের সন্ধান পাওয়া গেছে। লেখগুলো সম্ভবত খ্রিস্টীয় ২য় শতকের।
  • কারাশহ্র‌ : কুচ ও মিং ওই’র পার্শ্ববর্তী কারাশহ্র‌ ছিল ভারতীয় সংস্কৃতির আর এক প্রধান কেন্দ্র। প্রাচীনকালে এই স্থান অগ্নিদেশ নামে পরিচিত ছিল। এই শহরে বহু বৌদ্ধবিহারের ভগ্নাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। ইন্দ্রার্জুন, চন্দ্রার্জুন প্রভৃতি নামের রাজারা এখানে রাজত্ব করেছেন। ভারতীয় নাম গ্রহণ করলেও এরা সকলেই স্থানীয় অধিবাসী ছিলেন। 
  • বাজাকলিক : ভারতীয়, বিশেষত বৌদ্ধ, সংস্কৃতির আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল বাজাকলিক। প্রাচীনকালে এই শহরে বহুসংখ্যক বৌদ্ধবিহার নির্মিত হয়েছিল। বিহারগুলোর দেয়ালে চিত্রের সমারােহ। এখানে সাধারণত শ্ৰমণদের চিত্রই আঁকা হত। বাজাকলিকের বেশির ভাগ দেয়ালচিত্র বিনষ্ট হয়ে গেছে। তবু যা এখনও অবশিষ্ট আছে তা থেকে স্পষ্ট, এখানকার দেয়ালে ভারতীয়, চিনা ও তিব্বতি শ্ৰমণদের প্রতিকৃতি আঁকা হত। ভারতীয় শ্রমণদের পরনে হরিদ্রাবণের বস্ত্র, তাদের নাম ব্রাহ্মী বর্ণমালায় লেখা হয়েছে। পক্ষান্তরে চিনা ও তিব্বতি শ্ৰমণদের পরনে বেগনি পােশাক; তাদের নাম লেখা আছে চিনা ও তিব্বতি তাক্ষরে।

দেখা যাচ্ছে, প্রাচীনকালে মধ্য এশিয়া ও চিনের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য বৌদ্ধস্তুপ ও বিহার নির্মিত হয়েছিল। বৌদ্ধধর্ম যে একদিন এ অঞ্চলে সমাদৃত ছিল তা এ ঘটনায় প্রমাণিত হয়। মধ্য এশিয়া ও চিনের এসব স্তূপ, বিহার উত্তর-পশ্চিম ভারতের বৌদ্ধ স্থাপত্যের অনুকরণে নির্মিত হয়েছিল। সন্দেহ নেই, মধ্য এশিয়া ও চিনে শুধু যে বৌদ্ধধর্মই প্রচারিত হয়েছিল তা নয়, বৌদ্ধ স্থাপত্যশৈলীও বিস্তার লাভ করেছিল। 

আবিষ্কৃত পুঁথি ও লেখ

আবিষ্কৃত পুঁথি : এসব দেশে আবিষ্কৃত প্রাচীন ভারতীয় পুঁথির সংখ্যাও বড় কম নয়। সংস্কৃত বা প্রাকৃত ভাষায় রচিত এসব পুঁথি ব্রাহ্মী বা খরােষ্ঠী হরফে লিখিত হয়েছিল। খ্রিস্টীয় ১ম বা ২য় শতকের খরােষ্ঠী বর্ণমালায় লিখিত বৌদ্ধ ‘ধম্মপদ’ গ্রন্থের একখানি পাণ্ডুলিপি খােটানের সন্নিকটবর্তী কোনও এক স্থানে পাওয়া গেছে। মূল ‘ধম্মপদ’ পালি ভাষায় রচিত কিন্তু এই পাণ্ডুলিপিখানির ভাষা প্রাকৃত। সংস্কৃত বৌদ্ধগ্রন্থ ‘উদানবর্গ’-এর পাণ্ডুলিপির বিভিন্ন অংশ মধ্য এশিয়ার তুনহােয়াং প্রভৃতি স্থানে আবিষ্কৃত হয়েছে। তুরফানে তালপাতার এক পুঁথির সন্ধান পাওয়া গেছে। পূর্ণাঙ্গ পুঁথি এটি নয়, অশ্বঘােষের লেখা ‘শারিপুত্র-প্রকরণ’-এর সর্বশেষ অধ্যায়ের পুঁথি এটি। এখানকার লােকেরা শুধু যে মূল ভারতীয় গ্রন্থগুলোই পাঠ করতেন তা নয়, তারা ভারতীয় গ্রন্থগুলোর দেশীয় ভাষায় অনুবাদের কাজেও হাত দিয়েছিলেন। এসব অঞ্চলে শুধু সংস্কৃত বা প্রাকৃত গ্রন্থই পাওয়া যায়নি, বহু ভারতীয় গ্রন্থের চিনা ও তিব্বতি সংস্করণও আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব চিনা ও তিব্বতি সংস্করণের এক বিশেষ তাৎপর্য আছে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, মূল গ্রন্থখানি বিলুপ্ত হয়েছে কিন্তু তার চিনা বা তিব্বতি সংস্করণ বর্তমান আছে। সংস্করণগুলো আবিষ্কৃত না হলে সেসব মূল গ্রন্থগুলোর কথা আমাদের অজানাই থেকে যেত। বর্তমানে চিনা বা তিব্বতি সংস্করণগুলোর সাহায্যে হারিয়ে যাওয়া মূল গ্রন্থগুলোর পুনরুদ্ধারের কাজ চলছে। প্রাপ্ত নিদর্শনাদি থেকে অনুমিত হয়, হীনযানের তুলনায় মহাযান বৌদ্ধধর্ম মধ্য এশিয়া ও চিনে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। তুলনায় ব্রাহ্মণ্যধর্ম এখানে সে রকম প্রতিষ্ঠা পায়নি। এন্দেরে নামক এক স্থানে গণেশের চিত্র পাওয়া গেছে। নিয় নামে আর এক স্থানে কুবের ও ত্রিমুখের মূর্তি সংবলিত সিলমােহর আবিষ্কৃত হয়েছে। 

আবিষ্কৃত লেখ : মধ্য এশিয়া ও চিনের বিভিন্ন স্থানে বহুসংখ্যক প্রাচীন লেখের সন্ধান পাওয়া গেছে। সংস্কৃত বা প্রাকৃত ভাষায় রচিত এসব লেখ ব্রাহ্মী ও খরােষ্ঠী বর্ণমালায় লিখিত। লেখগুলো উৎকীর্ণ হয়েছে কাঠের উপর, চামড়ার উপর, কাগজ বা রেশমি কাপড়ের উপর। মধ্য এশিয়ায় এমন এক রেশমি বস্ত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে যার উপর কম করে আটটি লেখ অঙ্কিত আছে। লেখগুলো বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কিত। কোনও কোনও লেখে আপনজনের সুস্বাস্থ্য কামনা করা হয়েছে, কোনও কোনও লেখে অধস্তন রাজপুরুষদের উদ্দেশ্যে প্রশাসনিক নির্দেশ জারি করা হয়েছে, কখনওবা লেখগুলো ব্যক্তিগত বা সরকারি বার্তা বহন করছে। আইন-আদালত, অস্ত্রশস্ত্র, প্রতিরক্ষা-ব্যবস্থা, সরকারি পদে নিয়ােগ ও উপহার সামগ্রীর মতাে বিষয়ের অবতারণা আছে এসব লেখে। লেখাগুলো সবই যে সংস্কৃত বা প্রাকৃত ভাষায় উৎকীর্ণ তা নয়, বহু লেখ আছে যা স্থানীয় ভাষায় লেখা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, সংস্কৃত বা প্রাকৃত লেখের তাে বটেই, স্থানীয় ভাষায় রচিত বেশ কিছু লেখের বর্ণমালা ব্রাহ্মী বা খরােষ্ঠী। ব্রাহ্মী বা খরােষ্ঠীর মতাে ভারতীয় বর্ণমালা যে প্রাচীনকালে মধ্য এশিয়া ও চিনে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল, সে সম্পর্কে কোনও সংশয় নেই। লেখগুলোতে এমন সব ব্যক্তিগত নামের উল্লেখ আছে যা নিঃসন্দেহে ভারতীয়। ভিম, বঙ্গুসেন, নন্দসেন, যমসেন, শিতক, উপজিব ইত্যাদি ভারতীয় নাম এসব লেখে উল্লিখিত হয়েছে। স্পষ্ট বােঝা যায়, একদিন ছিল যখন মধ্য এশিয়া ও চিনের জনসাধারণ ভারতীয়দের নামে নিজ সন্তানদের নামকরণ করতেন। চর, দূত ইত্যাদি সংজ্ঞক রাজপুরুষদের উল্লেখ আছে এসব লেখে। সন্দেহ নেই, ভারতীয় রাজনীতি ও প্রশাসনিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে এখানকার লােকেরা অবহিত ছিলেন। খ্রিস্টীয় ১ম থেকে ৪র্থ শতকের মধ্যবর্তী সময় লেখগুলো উৎকীর্ণ হয়েছিল বলে মনে করা হয়।

বৌদ্ধধর্ম প্রচারে শ্রমণগণ

মধ্য এশিয়া ও চিনে বৌদ্ধধর্মের প্রচারে ভারতীয় শ্রমণদের ভূমিকা : মধ্য এশিয়া ও চিন দেশে বৌদ্ধধর্মের প্রচার কার্যে কয়েকজন ভারতীয় শ্রমণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে ধর্মরত্ন ও কাশ্যপ মাতঙ্গের নাম সবিশেষ উল্লেখযােগ্য। খ্রিস্টীয় ১ম শতকে হান সম্রাট মিঙ তি’র অনুরােধে তারা চিনে গমন করেন ও সে দেশে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেন। অনেক মূল বৌদ্ধগ্রন্থ তারা চিনা ভাষায় অনুবাদ করেন। সে দেশেই তারা মৃত্যুবরণ করেন। মধ্য এশিয়া ও চিনে বৌদ্ধধর্মের প্রচারকরূপে কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ বুদ্ধযশের নাম স্মরণীয় হয়ে আছে। তিনি মধ্য এশিয়ার বিখ্যাত পণ্ডিত কুমারজীবের সমকালবর্তী ছিলেন। প্রথমে কাসগড়ে ও পরে চিন দেশে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করে তিনি শেষে জন্মভূমি কাশ্মীরে প্রত্যাবর্তন করেন। কাশ্মীরের আর এক বিখ্যাত বৌদ্ধশ্রমণ গুণবর্মা। তিনি ৪৩১ খ্রিস্টাব্দে জলপথে নানকিং শহরে এসে উপস্থিত হন। পরের বছরই তার মৃত্যু হয়। কিন্তু চিন দেশে এই স্বল্পকাল অবস্থানের মধ্যে তিনি অন্তত ১১খানি মূল সংস্কৃত গ্রন্থের চিনা অনুবাদ প্রকাশ করেন। মধ্য এশিয়া ও চিনে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের কাজে আরও বহু ভারতীয় শ্রমণ উল্লেখযােগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। কাশ্মীরের সংঘভূতি (খ্রিস্টাব্দ ৩৮১-৮৪) (এই তারিখ শ্রমণদের চিনে অবস্থানের তারিখ), গৌতম সংঘদেব (খ্রিস্টাব্দ ৩৮৪ ৯৭), পুণ্যত্ৰাত (খ্রিস্টাব্দ ৪০৪), বিমলাক্ষ (খ্রিস্টাব্দ ৪০৬-১৩), বুদ্ধজীব (খ্রিস্টাব্দ ৪২৩), ধর্মমিত্র (খ্রিস্টাব্দ ৪২৪-৪২) ও ধর্মযশ (খ্রিস্টাব্দ ৪০০-২৪), মধ্য ভারতের ধর্মক্ষেম ও গুণভদ্র (খ্রিস্টাব্দ ৪৩৫-৬৮) (প্রায় দু’দশক (খ্রিস্টাব্দ ৪১৪-৩২) তিনি চিনে অবস্থান করেন। অবশেষে তিনি দেশে ফিরে আসার সংকল্প করেন কিন্তু চিনরাজ তার এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে হত্যা করেন), বারাণসীর প্রজ্ঞারুচি (খ্রিস্টাব্দ ৫১৬-৪৩), উজ্জয়িনীর উপশূন্য (খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতক), পূর্ব ভারতের জ্ঞানভদ্র, জিনযশ ও যশােগুপ্ত (খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতক) এবং উত্তর-পশ্চিম ভারতের বুদ্ধভদ্র, বিমােক্ষসেন ও জিনগুপ্তের নাম এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যায়।

  • পরমার্থ : কিন্তু চিনে বৌদ্ধধর্ম প্রসারের কাজে যিনি নিঃসন্দেহে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তার নাম পরমার্থ। তার জন্ম হয়েছিল উজ্জয়িনী শহরে কিন্তু তিনি সম্ভবত পাটলিপুত্র নগরে বাস করতেন। বৌদ্ধশাস্ত্রে তার প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য ছিল। চিনা সম্রাট উ এক প্রতিনিধি দলকে মগধরাজের নিকট পাঠান। তখন গুপ্তরাজ বিষ্ণুগুপ্ত সম্ভবত মগধের সিংহাসনে সমাসীন ছিলেন। চিনা প্রতিনিধি দলটি মগধের রাজাকে চিন দেশে এক বিদগ্ধ শ্রমণকে পাঠাতে অনুরােধ জানায়। শেষ পর্যন্ত পরমার্থকে চিনে পাঠানো হয়। প্রচুর বৌদ্ধগ্রন্থ সঙ্গে নিয়ে পরমার্থ ৫৪৫ খ্রিস্টাব্দে চিনে গিয়ে উপস্থিত হন। চিন দেশে ৫৬৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি দেহরক্ষা করেন। সেখানে অবস্থান কালে তিনি প্রায় ৭০টি বৌদ্ধগ্রহ চিনা ভাষায় অনুবাদ করেন। 
  • ধর্মগুপ্ত, বোধিধর্ম ও বিনীতরুচি : আরও তিনজন ভারতীয় শ্রমণের কথা এখানে উল্লেখের দাবি রাখে। এদের একজন ধর্মগুপ্ত। দ্বিতীয় জন বােধিধর্ম, তৃতীয় ব্যক্তি বিনীতরুচি। ধর্মগুপ্তের বাড়ি দক্ষিণ গুজরাতে, পড়াশােনা কান্যকুব্জের কৌমুদী সংঘারামে। তিনি পরবর্তিকালে চিন দেশকেই নিজের কর্মক্ষেত্ররূপে নির্বাচন করেন। তিনি বহু বৌদ্ধগ্রন্থের চিনা ভাষায় অনুবাদ করেন। বােধিধর্মের জন্ম হয়েছিল কাঞ্চীর পল্লব রাজপরিবারে। ৬ষ্ঠ শতকের দ্বিতীয় পাদে তিনি চিনে গমন করেন। সম্রাট উ তাকে সাদরে গ্রহণ করেন। বিনীতরুচিরও বাড়ি ছিল দক্ষিণ ভারতে, জন্ম এক ব্রাহ্মণ পরিবারে। তিনি ৫৮১ খ্রিস্টাব্দে চিনের রাজধানীতে পৌঁছান। দু’খানি বৌদ্ধগ্রন্থ তিনি চিনা ভাষায় অনুবাদ করেন।

মধ্য এশিয়া ও চিনে বৌদ্ধধর্মের প্রচারে স্থানীয় শ্রমণদের ভূমিকা : দেখা যাচ্ছে, প্রাচীনকালে মধ্য এশিয়া ও চিনের বহু লােক বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। শ্রমণদের জীবন গ্রহণ করেছেন, এমন লােকের সংখ্যা এ অঞ্চলে কম ছিল না। স্বদেশে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের কাজে তারা উল্লেখযােগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন –

  • শে কাও (লােকোত্তম) : শে কাও বা লােকোত্তম ছিলেন এদেরই একজন। জন্মসূত্রে তিনি ছিলেন একজন পহলব রাজকুমার কিন্তু অল্প বয়সেই তিনি বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। বৌদ্ধশাস্ত্রে সুপণ্ডিত এই শ্রমণ চিন দেশের শ্বেঅশ্ব বিহারে বসবাস করতেন। বৌদ্ধধর্মের প্রচার ও বৌদ্ধগ্রন্থের অনুবাদের কাজে তিনি আত্মনিয়ােগ করেছিলেন। তার আবির্ভাবকাল খ্রিস্টীয় ২য় শতকের মধ্যভাগ।
  • সেং হুই (সংঘভদ্র) : সেং হুই বা সংঘভদ্রের জন্ম হয়েছিল সােগডিয়ানার এক বণিক পরিবারে। তার পিতা বাণিজ্যিক সূত্রে দক্ষিণ চিনে স্থায়িভাবে বসবাস করেন। পিতার মৃত্যুর পর সেং হুই বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হন এবং দক্ষিণ চিনে বৌদ্ধধর্মের প্রচারের কাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি নানকিং শহরে ২৪৭ খ্রিস্টাব্দে একটি বৌদ্ধবিহার স্থাপন করেন। তার ঐকান্তিক আগ্রহে দক্ষিণ চিনে আরও কয়েকটি বিহার প্রতিষ্ঠিত হয়। ভগবান বুদ্ধেরও অনেক মূর্তি নির্মিত হয়।
  • ফা হু (ধর্মরক্ষ) : শ্রমণ ফা হু বা ধর্মরক্ষ ইউ চি জাতিভুক্ত ছিলেন। সংস্কৃত ও চিনাসহ ছত্রিশটি ভাষায় তিনি পারদর্শী ছিলেন। খ্রিস্টীয় ৩য় শতকের মাঝামাঝি সময় তিনি চিনের রাজধানীতে স্থায়িভাবে বসবাস শুরু করেন। বৌদ্ধধর্মের প্রচার ও মূল সংস্কৃত গ্রন্থের চিনা ভাষায় অনুবাদের কাজে তিনি জীবনের বাকি কটা দিন অতিবাহিত করেন।
  • কুমারজীব : মধ্য এশিয়ার আর এক বিখ্যাত শ্ৰমণ কুমারজীব। তার পিতা কুমারায়ণ। ছিলেন কুচির রাজার গুরুদেব। তার মাতা জীবা ছিলেন কুচি রাজপরিবারের কন্যা। জীবা সন্ন্যাস গ্রহণ করে ৯ বছরের শিশু কুমারজীবকে সঙ্গে নিয়ে কাশ্মীরে আসেন। সেখানে বৌদ্ধাচার্য বন্ধুদত্তের নিকট শিক্ষা লাভ করে কুমারজীব বৌদ্ধসাহিত্য ও দর্শনে সুপণ্ডিত হন। তারপর মধ্য এশিয়ার নানা স্থান পরিভ্রমণ করে তিনি শেষে কুচিতে এসে বাস করেন। কিন্তু কু সাং-এর শাসক কুচি অধিকার করে কুমারজীবকে বন্দি করে কান সু’তে নিয়ে আসেন। ঘটনাটি ঘটে ৩৮৩ খ্রিস্টাব্দে। কু সাং নৃপতির সাহচর্যে কুমারজীব প্রায় ১৫ বছর কান সু’তে অতিবাহিত করেন। পরে চিনা সম্রাটের অনুরােধে তিনি ৪০১ খ্রিস্টাব্দে চিন দেশের রাজধানীতে গমন করেন। ৪১২ খ্রিস্টাব্দ অবধি তিনি সেখানেই অবস্থান করেন। শতাধিক সংস্কৃত গ্রন্থ তিনি চিনা ভাষায় অনুবাদ করেন। তার আগ্রহে মহাযান ধর্মমত চিনে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। চিনের বহু পণ্ডিত তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। খ্রিস্টীয় ৫ম শতকে চিনে বৌদ্ধধর্মের, বিশেষ করে মহাযান বৌদ্ধধর্মের যে জাগরণ ঘটেছিল তার রূপকার শ্রমণ কুমারজীব।

মধ্য এশীয় ও চিনা শ্ৰমণদের ভারত পরিদর্শন : সেই প্রাচীনকালে মধ্য এশিয়া ও চিন থেকে বহু শ্ৰমণ ভারতে এসেছিলেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ভারতে বসে ভারতীয় পণ্ডিতদের নিকট বৌদ্ধশাস্ত্র অধ্যয়ন করা, শ্ৰমণদের জীবনচর্যা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান আহরণ করা। বৌদ্ধশাস্ত্র ও বুদ্ধের দেহাবশেষ সংগ্রহ করাও তাদের উদ্দেশ্য ছিল। কপিলবস্তু, মৃগদাব, বােধগয়া ইত্যাদি বুদ্ধদেবের স্মৃতিবিজড়িত সব স্থান ভারতীয় উপমহাদেশে অবস্থিত। এসব স্থান পরিদর্শনে পুণ্য লাভ হয়, এ ধারণাও তাদের ছিল।

  • ফা শিয়েন : ভারত ভ্রমণকারী চিনা শ্রমণদের কথা প্রসঙ্গে যার নাম প্রথমেই মনে পড়ে তিনি ফা শিয়েন। চারজন শ্রমণকে সঙ্গে নিয়ে ফা শিয়েন ৩৯৯ খ্রিস্টাব্দে ভারত অভিমুখে যাত্রা করেন। পথে একজনের মৃত্যু হয়। পথের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে বাকি সঙ্গীদের কেউ কেউ দেশে ফিরে যান। অবশেষে কাশ্মীরের ভেতর দিয়ে ফা শিয়েন ভারতে প্রবেশ করেন এবং সারা উত্তর ভারত তিনি পরিভ্রমণ করেন। তিনি পাটলিপুত্র ও তাম্রলিপ্তি শহরে যথাক্রমে তিন ও দুই বছর অবস্থান করেন। ভারতে এসে সংস্কৃত শিখে তিনি বৌদ্ধধর্মের মূল গ্রন্থগুলো অধ্যয়ন করেন। শ্ৰমণদের জীবন-যাপন সম্পর্কিত অনুশাসনাবলি তিনি সযত্নে সংগ্রহ করেন। ভারতে দীর্ঘদিন অবস্থানের পর তিনি তাম্রলিপ্তি হয়ে জলপথে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ৮৮ বছর বয়সে এই জ্ঞানতপস্বী দেহত্যাগ করেন। ফা শিয়েনের একজন সঙ্গী ভারতেই থেকে যান। ভারতীয় শ্রমণদের নিয়মানুবর্তিতা ও অনাড়ম্বর জীবন তাকে মুগ্ধ করে। স্বদেশি শ্ৰমণদের ত্রুটিপূর্ণ জীবনযাত্রা তাকে ব্যথিত করে। জন্ম জন্মান্তরে তিনি যেন ভারতে জন্মগ্রহণ করেন, এই ছিল তার ঐকান্তিক কামনা। 
  • প্যাও উন : প্যাও উন ছিলেন ফা শিয়েনের সমকালবর্তী এক চিনা শ্ৰমণ। এ দেশে এসে তিনি সংস্কৃত শিক্ষা করেন। পরে স্বদেশে ফিরে গিয়ে তিনি বৌদ্ধশাস্ত্রের ভাষান্তরের কাজে আত্মনিয়ােগ করেন। 
  • চে মঙ : চে মঙ-এর নেতৃত্বে পনেরােজন চিনা শ্রমণের একটি দল ৪০৪ খ্রিস্টাব্দে ভারত অভিমুখে যাত্রা করেন। এদের মধ্যে ৯ জন পামির মালভূমি থেকে দেশে ফিরে যান। একজন পথে মারা যান। বাকি ৫ জন শ্রমণ শেষ পর্যন্ত ভারতে এসে উপনীত হন। এখানে এসে তারা বহু গ্রন্থ সংগ্রহ করেন। দেশে ফেরার সময় তিনজন প্রাণত্যাগ করেন। একজন সঙ্গীসহ চে মঙ ৪২৪ খ্রিস্টাব্দে চিনে এসে উপস্থিত হন। 
  • ফা ইয়ােঙ : শ্ৰমণ ফা ইয়ােঙ ৪২০ খ্রিস্টাব্দে ২৫ জন শ্রমণকে সঙ্গে নিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। চিনা শ্ৰমণদের এই দলটি মধ্য এশিয়া হয়ে কাশ্মীরের ভেতর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। সারা উত্তর ভারত পরিদর্শন করে চিনা দলটি সমুদ্রপথে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। 

এছাড়া আরও বহু চিনা শ্ৰমণ ভারত পরিদর্শনে এসেছিলেন। প্রাচীন চিনা ইতিবৃত্তে তাদের নাম আছে কিন্তু বিশদ তথ্য নেই। 

বৌদ্ধধর্মের প্রসারে মধ্য এশীয় ও চিনা রাজা-মহারাজদের ভূমিকা

প্রাচীন মধ্য এশিয়া ও চিনে বৌদ্ধধর্মের বহুল প্রসারের মূলে সেখানকার রাজা-মহারাজদের এক বিরাট ভূমিকা ছিল। তাদের অনেকেই বৌদ্ধধর্মের প্রতি অকৃত্রিম অনুরাগ প্রদর্শন করেছেন, বৌদ্ধ শ্রমণদের পৃষ্ঠ পােষকতা করেছেন, অকাতরে অর্থ ব্যয় করে বিহার-চৈত্য নির্মাণ করেছেন।

  • পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য সিন রাজারা : এ প্রসঙ্গে পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য সিন রাজাদের কথা উল্লেখ করা যায়। পাশ্চাত্য সিন বংশের দু’জন রাজা উ (খ্রিস্টাব্দ ২৬৬-৯০) এবং মিন-এর (খ্রিস্টাব্দ ৩১৩-১৬) সময় চিনের বিভিন্ন স্থানে বহু বৌদ্ধবিহার নির্মিত হয়, নানকিং ও চ্যাংগন শহরে ১৮০টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়, বৌদ্ধ শ্ৰমণদের সংখ্যা ৩,৭০০-তে গিয়ে দাঁড়ায়। প্রাচ্য সিন রাজাদের আমলে (খ্রিস্টাব্দ ৩১৭-৪২০) চারটি বৃহদায়তন বৌদ্ধবিহার নির্মিত হয়েছিল। প্রতিটি বিহারে এক হাজার শ্রমণের বসবাসের ব্যবস্থা ছিল। এ সময় সারা চিনে ১৭,০৬৮টি বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। ২৬৩টি মূল সংস্কৃত গ্রন্থ এ সময় চিনা ভাষায় অনূদিত হয়েছিল।
  • ওয়ে রাজারা : সিন রাজাদের মতাে ওয়ে রাজারাও (খ্রিস্টাব্দ ৩৮৬-৫৫৭) বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপােষকতা করেছেন। এই রাজাদের অনেকেই বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত ছিলেন, শাস্ত্রব্যাখ্যায় পারদর্শী ছিলেন। এই বংশের যিনি প্রথম রাজা ছিলেন তিনি ১৫টি চৈত্য, ২টি বিহার ও বুদ্ধদেবের ১০০০টি স্বর্ণমূর্তি নির্মাণ করেছিলেন। তাছাড়া প্রতিমাসে ধর্ম সম্মেলন আয়ােজন করে তিনি ৩ হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষুকে আপ্যায়ন করতেন। ওয়ে যুগে চিন দেশে ৪৭টি বৌদ্ধবিহার নির্মিত হয়েছিল, অন্তত ৩০ হাজার উপাসনাগৃহ স্থাপিত হয়েছিল। ভিক্ষু-ভিক্ষুণীদের সংখ্যা ২০ লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ওয়ে সম্রাটদের আমলে চিনের তনহােয়াং, য়ুন কাং এবং লােং মেনে পাহাড় কুদে কয়েকটি চৈত্য ও বিহার নির্মিত হয়, নির্মিত হয় ১৮ থেকে ২১ মিটার দীর্ঘ বিশালাকৃতির কয়েকটি দৃষ্টিনন্দন বুদ্ধ প্রতিমা। চৈত্য ও বিহারের দেয়ালে চিত্রিত হয়েছে বহুবিধ বৌদ্ধ উপাখ্যান। এখানকার প্রস্তর খােদিত স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও দেয়ালচিত্রে তাজুন্টা শিল্পকলার প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছে। সমকালীন চিনা শিল্পকলার উৎকর্ষ সাধনে ভারতীয় শিল্পীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন। শাক্যবুদ্ধ, বুদ্ধকীর্তি ও কুমারবােধির মতাে যেসব যশস্বী শিল্পী চিনা চিত্রকলাকে সমৃদ্ধ করেছেন, তারা তো সকলেই জন্মসূত্রে ভারতীয় ছিলেন।
  • উদীচ্য সি রাজবংশ : ওয়ে রাজবংশের অবসানের পর চিন দেশে উদীচ্য সি রাজবংশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় (৫৫০ খ্রিস্টাব্দে প্রাচ্য ওয়ে রাজবংশের উচ্ছেদের পর উদীচ্য সি রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হয়। প্রাচ্য ওয়েদের পতনের ৭ বছর পর তার্থাৎ ৫৫৭ খ্রিস্টাব্দে পাশ্চাত্য ওয়ে রাজবংশ ক্ষমতাচ্যুত হয়)। সি বংশের রাজারাও বৌদ্ধধর্মের অনুরাগী ছিলেন। এদেরই একজন স্বহস্তে ১২ খানি বৌদ্ধগ্রন্থের প্রতিলিপি প্রস্তুত করেন এবং ৩ হাজার শ্রমণের নিয়মিত ভরণ-পােষণের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এই বংশের আর একজন রাজা একটি সােনার চৈত্য নির্মাণ করেন। এই বংশেরই অপর এক নৃপতি বৌদ্ধগ্রন্থাদি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে পাশ্চাত্য দেশে এক প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেন। ২৬০টি গ্রন্থ সংগ্রহ করে যখন প্রতিনিধি দলটি চিনে প্রত্যাবর্তন করে তখন সি রাজবংশের অবলুপ্তি ঘটেছে এবং উদীচ্য চৌ (খ্রিস্টাব্দ ৫৫৭-৮১) বংশের রাজত্ব শুরু হয়েছে।
  • দক্ষিণ চিনের সােঙ, সি, লিয়াঙ ও চেন রাজারা : দক্ষিণ চিনের সােঙ (খ্রিস্টাব্দ ৪২০-৭৯), সি (খ্রিস্টাব্দ ৪৭৯-৫০২), লিয়াঙ (খ্রিস্টাব্দ ৫০২-৫৭) এবং চেন (খ্রিস্টাব্দ ৫৫৭-৮১) রাজারাও বৌদ্ধধর্মের অকৃপণ পৃষ্ঠপােষকতা করেছেন।

স্বীকার করতে হবে, মধ্য এশিয়া ও চিনে বৌদ্ধধর্মের প্রসারে স্থানীয় রাজাদের এক বড় রকমের ভূমিকা ছিল। রাজশক্তির সমর্থন ছিল বলেই বৌদ্ধধর্ম এসব দেশে সহজে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিল। দেখা যাচ্ছে, বৌদ্ধধর্মকে আশ্রয় করে ভারতবর্য, মধ্য এশিয়া ও চিনের মধ্যে এক নিবিড় সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। মধ্য এশিয়া ও চিনে সংস্কৃত ভাষার চর্চা হত, বৌদ্ধশাস্ত্রের অনুশীলন হত। এসব দেশে কত যে বৌদ্ধ বিহার, চৈত্য ও বুদ্ধমূর্তি নির্মিত হয়েছিল তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। সেই সুদূর অতীতে বহু সংস্কৃত গ্রন্থ চিনা ও মধ্য এশীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। এই অনুবাদের কাজে ভারতীয় শ্রমণদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ভারতবর্ষ হতে বহু শ্ৰমণ সে সব দেশে গিয়েছেন, সেখানে বৌদ্ধধর্মের মাহাত্ম প্রচার করেছেন, সেখানকার ভাষা আয়ত্ত করে মূল সংস্কৃত গ্রন্থগুলোকে স্থানীয় ভাষায় অনুবাদও করেছেন। বৌদ্ধশাস্ত্র অধ্যয়ন ও পুঁথি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে মধ্য এশিয়া ও চিন থেকে বহু শ্ৰমণ ভারতে এসেছেন। বেশির ভাগ চিনা শ্রমণ দেশে ফিরে গেছেন। ভারতবর্ষকে ভালােবেসেছেন, আমৃত্যু ভারতবর্ষে অবস্থান করেছেন, এমন চিনা শ্ৰমণও ছিলেন। জন্মে জন্মে ভারতে জন্ম নেবেন, এই আশা ব্যক্ত করে গেছেন চিনা শ্রমণদেরই একজন। সে সময় বিশ্ব-সংস্কৃতির আকাশে ভারত ছিল এক দীপ্তিমান জ্যোতিষ্ক।

তাঙ রাজবংশের সময় ভারত ও চিনের মধ্যে শ্রমণদের যাতায়াত

সম্পর্ক বৃদ্ধি : ৬১৮ খ্রিস্টাব্দে তাঙ রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হলে ভারত-চিন সম্পর্কের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সূচিত হয়। বৌদ্ধধর্মের অনুরাগী তাঙ রাজাদের উৎসাহে দুটি দেশের মধ্যে কেবল সাংস্কৃতিক যােগসূত্ৰই সুদৃঢ় হল না, রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কও নিবিড় হয়। এই রাজাদের অকৃপণ পৃষ্ঠপােষকতায় চিনের নানা স্থানে বৌদ্ধবিহার নির্মিত হয়, বহু বৌদ্ধ সংস্কৃত গ্রন্থ চিনা ভাষায় অনূদিত হয়, বৌদ্ধধর্মের ব্যাপক প্রসার হয়, ভারতীয় ও তাঙ রাজাদের মধ্যে দৌত্য বিনিময় হয় এবং উভয় দেশের মধ্যে, বিশেষত তাঙ যুগের প্রাথমিক পর্বে, বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রাণবন্ত, সঞ্জীবিত রূপ লাভ করে।

চিন থেকে ভারতে ভ্রমণকারী শ্রমণগণ : এ সময় চিনদেশ থেকে বহু শ্ৰমণ ভারত পরিভ্রমণ করেন। বুদ্ধ ও তার শিষ্য প্রশিষ্যদের স্মৃতি বিজড়িত স্থান দর্শন যেমন চিনা শ্রমণদের ভারত পরিদর্শনের এক প্রধান আকর্ষণ ছিল তেমনি তক্ষশিলা ও নালন্দার মতাে আন্তর্জাতিক শিক্ষাকেন্দ্রে বৌদ্ধ সাহিত্য ও দর্শন অধ্যয়ন এবং পাণ্ডুলিপি সংগ্রহও তাদের ভারত দর্শনের উদ্দেশ্য ছিল। শিক্ষার পীঠস্থান নালন্দা মহা বিহার তখন খ্যাতির শিখরে। এই শিক্ষায়তনে শুধু বৌদ্ধ সাহিত্য, ধর্ম ও দর্শনের চর্চাই হত না, ষড়দর্শন, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা এবং চিকিৎসাশাস্ত্রের মতাে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখারও অনুশীলন হত।

  • শুয়েন চাঙ : খ্রিস্টীয় ৭ম শতকে চিন থেকে বহু বৌদ্ধশ্ৰমণ ভারতবর্ষে আগমন করেন। এই শ্রমণদের সর্বশীর্ষে রয়েছেন বিশ্রুতকীর্তি শুয়েন চাঙ। ৬০০ খ্রিস্টাব্দে (মতান্তরে ৬০২) চিনের এক রক্ষণশীল কনফুসীয় পরিবারে তার জন্ম হয় (পাই শােউ ই (Bai Shou yi, Ayn Outline History Of China (Beijing, 1982), পৃষ্ঠা ২১৭) শুয়েন চাঙের জন্ম ৬০২ খ্রিস্টাব্দে ধার্য করেছেন। কিন্তু রমেশচন্দ্র মজুমদারের (The Classical age (Bombay, 1962), পৃষ্ঠা ৬১৮) মতে এই চিনা শ্রমণ ৬০০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।)। অতি অল্প বয়সেই তিনি বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হন এবং মাত্র বিশ বৎসর বয়ঃক্রমে শ্রমণস্তরে উন্নীত হন। মূল বৌদ্ধগ্রন্থের চিনা সংস্করণে তৃপ্ত না হয়ে তিনি ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে মধ্য এশিয়ার পথ ধরে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারতের বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করেন। কাশ্মীরে তিনি পুরাে দু’টি বছর বৌদ্ধশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। নালন্দাতেও তিনি সর্বসমেত বছর দুই অবস্থান করেন এবং স্থানীয় মহাবিহারের অধ্যক্ষ শীলভদ্রের নিকট যােগাচারবাদ অধ্যয়ন করেন। পুষ্যভূতিরাজ হর্ষবর্ধন এবং কামরূপাধিপতি ভাষ্করবর্মা তাকে বিপুল সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেন। ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দের প্রারম্ভে তিনি প্রচুর সংস্কৃত গ্রন্থসহ ভারত ত্যাগ করেন এবং মধ্য এশিয়া হয়ে ৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে স্বদেশে উপস্থিত হন। চিনে প্রত্যাবর্তনের পর তৎকালীন তাঙ সম্রাট তাই জুঙ (Tai Zong) (খ্রিস্টাব্দ ৬২৬-৪৯) এবং চিনা জনসাধারণ তাকে রাজোচিত সম্মান প্রদর্শন করেন। তার এই অভূতপূর্ব সমাদরের মধ্য দিয়ে বৌদ্ধধর্ম ও ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি চিনা জনগণের অকৃত্রিম অনুরাগই অভিব্যক্ত হয়েছে। জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলো তিনি মূল সংস্কৃত গ্রন্থের চিনা অনুবাদ (তিনি ৭৫টি সংস্কৃত-গ্রন্থ চিনা ভাষায় অনুবাদ করেন।) এবং বৌদ্ধধর্মের প্রচার ও শিক্ষাদান কার্যেই আত্মনিয়ােগ করেন। বৌদ্ধধর্মের দু’টি শাখার উপর তিনি সমধিক গুরুত্ব আরােপ করেন। শাখা দুটির একটি যােগাচার বা বিজ্ঞানবাদ, অন্যটি সর্বাস্তিবাদ। প্রথমটি মহাযানীয়, দ্বিতীয়টি হীনযানীয়। ৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে এই জ্ঞানতপস্বী শ্রমণের জীবনদীপ নির্বাপিত হয়। 
  • ই চিঙ : খ্রিস্টীয় ৭ম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে যে এক ঝাক চিনা শ্রমণ ভারত পরিদর্শন করেন তাদের মধ্যে ই চিঙ (খ্রিস্টাব্দ ৬৩৫-৭১৩) নিঃসন্দেহে এক স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি ৬৭১ খ্রিস্টাব্দে সমুদ্রপথে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন এবং কয়েক মাস সুমাত্রার শ্রীবিজয়ে অবস্থানের পর ৬৭৩ খ্রিস্টাব্দে তাম্রলিপ্ত বন্দরে পদার্পণ করেন। নালন্দায় তিনি এক দশককাল (খ্রিস্টাব্দ ৬৭৫-৮৫) অবস্থান করে বৌদ্ধশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন এবং বহু মূল গ্রন্থের প্রতিলিপি রচনা করেন। স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের সময় তিনি ৫০,০০০ শ্লোক-সমন্বিত চারশাে সংস্কৃত গ্রন্থ সঙ্গে করে নিয়ে যান। 

ভ্রমণকারী শ্রমণসংখ্যা হ্রাস : ৮ম শতকের পর থেকে ভারত ভ্রমণকারী চিনা শ্রমণদের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পায়। মধ্য এশিয়ায় আরব অভিযানের ফলে পরিস্থিতির এই পরিবর্তন হয়। কিন্তু এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, চিনা শ্ৰমণদের ভারত-যাত্রায় কখনও ছেদ পড়েনি। গতি স্তিমিত হয়েছে কিন্তু ধারা একেবারে শুষ্ক হয়নি। এর দু’টি কারণ ছিল – প্রথমত, বােধগয়া, সারনাথ ও কুশীনগরের মতাে বুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্থান-পরিদর্শন যে কোনও চিনা শ্রমণের পরম আকাঙ্ক্ষিত ছিল। দ্বিতীয়ত, চিনা শ্ৰমণদের ভারত-যাত্রায় সে দেশীয় রাজাদের, বিশেষত তাঙ সম্রাটদের আগ্রহের কোনও অভাব ছিল না।

ভারত থেকে চিনে গমনকারী শ্রমণগণ : চিনদেশ থেকেই যে শ্রমণেরা ভারতে আসতেন, তা নয়, ভারত থেকেও বহু শ্ৰমণ চিনে গিয়েছেন, সেদেশে বৌদ্ধধর্মের প্রসারে আত্মনিয়ােগ করেছেন। তাদের কেউ কেউ পরে ভারতে ফিরে এসেছেন, আবার অনেকে চিনের মাটিতেই দেহরক্ষা করেছেন। উদাহরণস্বরূপ –

  • প্রভাকরমিত্র : এই পর্বে যেসব ভারতীয় শ্রমণ চিনদেশে গমন করেন তাদেরই একজন প্রভাকরমিত্র। মধ্যভারতের এক রাজপরিবারের এই সন্তান বিলাস-বৈভবের জীবন স্বেচ্ছায় বিসর্জন দিয়ে শ্রমণের জীবন বরণ করেন। নালন্দা মহাবিহারের শিক্ষা গ্রহণ করে তিনি শেষে সেখানেই অধ্যাপক পদে বৃত হন। তাঙ সম্রাট তাই জুঙের রাজত্বকালে তিনি ৬২৭ খ্রিস্টাব্দে চিনদেশে যান এবং বৌদ্ধশাস্ত্রের চিনা ভাষায় রূপান্তরের কাজে লিপ্ত হন। তার কাজে সাহায্য করার জন্য ১৯ জন চিনা বিশেষজ্ঞের একটি পরিষদ গঠিত হয়। ৬৩৩ খ্রিস্টাব্দে এই বিদগ্ধ শ্ৰমণ চিনদেশে দেহত্যাগ করেন।
  • বােধিরুচি : খ্রিস্টীয় ৭ম শতকের আর একজন যশস্বী ভারতীয় শ্রমণ বােধিরুচি। ৬৯৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি চিনে গমন করেন। অনুবাদের কাজে তাকে সাহায্য করার জন্য চিনা ও ভারতীয় বিদ্বজ্জনদের নিয়ে একটি পরিষদ গঠন করা হয়। এই পরিষদে অন্তত দু’জন ভারতীয় ছিলেন। তাদের একজন ব্রহ্মা, অপরজন ঈশ্বর। তাঙ রাজপরিবার বােধিরুচি ও তার সহকারীদের ভাষান্তরের কাজে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেন। সম্রাট শুয়েন জুঙ (Xuan Zong) (খ্রিস্টাব্দ ৭১২-৫৬) প্রায়ই তাদের পাঠকক্ষে উপস্থিত হতেন এবং স্বয়ং জ্ঞাতব্য তথ্য লিপিবদ্ধ করতেন; কখনও উপস্থিত হতেন রানি বা রাজপরিবারের অন্য কোনও অভিজাত মহিলা, কখনওবা পদস্থ রাজপুরুষেরা। বােধিরুচির নির্দেশনায় ৫৩ খণ্ড বৌদ্ধশাস্ত্ৰ চিনা ভাষায় অনূদিত হয়। ৭২৭ খ্রিস্টাব্দে চিনদেশেই বােধিরুচি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
  • বজ্রবোধি : আর একজন প্রথিতযশা শ্ৰমণ বজ্রবোধি। মধ্যভারতের রাজা ঈশানবর্মার পুত্র তিনি। নালন্দা মহাবিহারের এক সময়ের অধ্যাপক এই শ্ৰমণ পল্লবরাজ দ্বিতীয় নরসিংহবর্মার আচার্য ছিলেন। পরবর্তিকালে তিনি শ্রীলঙ্কায় গমন করেন এবং সে দেশ থেকে ৭২০ খ্রিস্টাব্দে চিনদেশে গিয়ে উপনীত হন। বজ্ৰবােধি চিনে তন্ত্রযান মতবাদ প্রচার করেন; তন্ত্রযান সম্পর্কিত কয়েকটি মূল গ্রন্থ তিনি চিনা ভাষায় অনুবাদ করেন। ৭৩২ খ্রিস্টাব্দে চিনেই তার দেহাবসান হয়।
  • অমােঘবজ্র : বজ্ৰবােধিরই এক প্রখ্যাত শিষ্য অমােঘবজ্র। আচার্যের চিনযাত্রায় তিনিও তার সঙ্গী ছিলেন। গুরুর মৃত্যুর পর তিনি শ্রীলঙ্কায় প্রত্যাবর্তন করেন কিন্তু ৭৪৬ খ্রিস্টাব্দে ৫০০ গ্রন্থসহ পুনরায় চিনে গমন করেন। এবার তিনি সে দেশে ১৫ বছর অবস্থান করেন এবং ৭৭টি মূল সংস্কৃত গ্রন্থ চিনা ভাষায় অনুবাদ করেন। মূলত বজ্রবোধি ও তার শিষ্য অমােঘবজ্রের প্রচেষ্টাতেই চিনে তন্ত্রসাধনা প্রসার লাভ করে।

তাঙ রাজবংশের রাজত্বকালে ভারত-চিন সম্পর্কের স্বরূপ

  • হর্ষবর্ধনের সাথে সম্পর্ক : তাঙ রাজাদের আমলে চিনের সঙ্গে ভারতের কতিপয় রাজ্যের রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায়। পুষ্যভূতিরাজ হর্ষবর্ধনের সঙ্গে সমকালীন তাঙ সম্রাটের হৃদ্য সম্পর্ক ছিল। ৬৪১ খ্রিস্টাব্দে হর্ষবর্ধন যখন চিনা সম্রাট তাই জুঙের নিকট দূত পাঠান তখনও পরিব্রাজক শুয়েন চাঙের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়নি। চিনসম্রাট প্রত্যুত্তরে লিয়াঙ তােই কিঙ নামে জনৈক প্রতিনিধিকে হর্ষবর্ধনের নিকট প্রেরণ করেন। হর্ষবর্ধনের প্রতিক্রিয়া আশাব্যঞ্জক হওয়ায় চিনসম্রাট ৬৪৩ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে কান্যকুব্জে লি য় পিয়াও এবং ওয়াঙ হিউয়েন সে নামে দু’জন প্রতিনিধি প্রেরণ করেন। পূর্বের মতাে সেবারও চিনা দূতদের সাদরে অভ্যর্থনা জানানাে হয়। ৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে শুয়েন চাঙ স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলে চিনা সম্রাট তার মুখে হর্ষবর্ধন সম্পর্কে বহু বিষয় অবগত হন এবং পুষ্যভুতিরাজ সম্পর্কে তার গভীর আগ্রহ জন্মে। তিনি ৬৪৬ খ্রিস্টাব্দে ওয়াঙ হিউয়েন সে ও সিয়াঙ চিউ জেনকে কান্যকুব্জের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। চিনা প্রতিনিধিরা যথাসময় ভারতবর্ষে উপনীত হন কিন্তু ততদিনে হর্ষবর্ধন প্রয়াত হয়েছেন। ওয়াঙ হিউয়েন সে চিনা সম্রাটের দূতরূপে আরও দু’বার ভারতে আগমন করেন, একবার ৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে, শেষবার ৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে। তখন তাঙ সম্রাট কাও জুঙ (Gao Zong, খ্রিস্টাব্দ ৬৪৯-৮৩) রাজত্ব করেছেন। 
  • অন্যান্য রাজার সাথে সম্পর্ক : শুধু হর্ষবর্ধনই নন, বলভীরাজ তৃতীয় শীলাদিত্য (৭ম শতকের শেষ দশক), চালুক্যনৃপতি বিনয়াদিত্য (৭ম শতকের শেষ দশক) এবং কাঞ্চীর পল্লবরাজ নরসিংহ পােতবর্মা (খ্রিস্টাব্দ ৭১০ এবং ৭২০) চিনদেশে দূত প্রেরণ করেন। ৭২০ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট শুয়েন জুঙ এর রাজত্বকালে চিন থেকে পল্লবরাজ্যে একটি প্রতিনিধিদল পাঠানাে হয়। কান্যকুব্জরাজ যশােবর্মা এবং কাশ্মীরের অধিপতি ললিতাদিত্যও এই চিনা সম্রাটের নিকট দূত প্রেরণ করেন। যশােবর্মা পাঠান তার মন্ত্রী বুদ্ধসেনকে (মতান্তরে সংঘভদ্র) ৭৩১ খ্রিস্টাব্দে, ললিতাদিত্য ৭৩৬ খ্রিস্টাব্দে।
  • ৭ম-৮ম শতকে কপিশা, গন্ধার ও উড্ডিয়ান রাজ্যের সঙ্গে চিনের সম্পর্ক : খ্রিস্টীয় ৭ম-৮ম শতকে ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবর্তী কপিশা, গন্ধার ও উড্ডিয়ান রাজ্যের সঙ্গে চিনদেশের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। চিনা ইতিবৃত্তে উল্লেখ আছে, ৬১৯ থেকে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কি পিন রাজ্য থেকে কম করেও ছয়বার প্রতিনিধিদল চিনে পাঠানাে হয়। তখন কাও জু (Gao Zu, খ্রিস্টাব্দ ৬১৮-২৬), তাই জুঙ (খ্রিস্টাব্দ ৬২৬-৪৯) এবং কাও জুঙ (খ্রিস্টাব্দ ৬৪৯-৮৩) ক্রমান্বয়ে চিনে রাজত্ব করছেন। এ সময় কি পিন বলতে কপিশা বােঝাত, কাশ্মীর নয়। বিভিন্ন ভারতীয় রাজন্যবর্গ এবং তাঙ রাজাদের মধ্যে এই পারস্পরিক সংযােগ স্থাপনের প্রয়াসের একটি রাজনৈতিক তাৎপর্য অবশ্যই ছিল কিন্তু উভয় রাজ্যের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্কের উন্নতিসাধনও যে এই পারস্পরিক যােগাযােগের এক মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল তা সহজেই অনুমেয়। ভারত-চিন বাণিজ্য সংক্রান্ত কিছু তথ্য এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। পুষ্যভূতি রাজ্যের পদস্থ সেনানায়কদের চিনা বর্ম ব্যবহারের উল্লেখ আছে হর্ষচরিতে। ৭৪৯ খ্রিস্টাব্দে লেখা চিনা বিবরণে ক্যান্টন শহরে ব্রাহ্মণ বণিকদের উপস্থিতির কথা আছে, উল্লেখ আছে ক্যান্টনে ব্রাহ্মণ্য মন্দির ও ব্রাহ্মণ বসতিরও। চিনা তাঙ মুদ্রা দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন স্থানে আবিষ্কৃত হয়েছে। দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন স্থানে চিনা মুদ্রার প্রাপ্তিতে উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্কই আভাসিত হয়।
  • তাঙ রাজবংশের উচ্ছেদের পর ভারত-চিন সম্পর্কে সাময়িক ছেদ : ৯০৭ খ্রিস্টাব্দে তাঙ রাজবংশের উচ্ছেদের পর ভারত-চিন সম্পর্কে সাময়িক ছেদ পড়ে। মধ্য এশিয়ায় ঐশ্লামিক অভিযানের তীব্রতায় উভয় দেশের মধ্যে সংযােগসূত্র ব্যাহত হয়। কিন্তু ৯৬০ খ্রিস্টাব্দে সুঙ রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হলে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে; ভারত-চিন সংযােগের শুষ্ক ধারাটি পুনরায় সতেজ ও প্রাণচঞ্চল হয়। এ সময় চিন থেকে ভারতে যেমন প্রচুর দর্শনার্থীর সমাগম হয় তেমনি ভারত থেকে বহু বৌদ্ধ ভিক্ষু চিনে যান এবং অসংখ্য মূল গ্রন্থ চিনা ভাষায় অনুবাদ করে সে দেশে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন। 

তাঙ রাজবংশের উচ্ছেদের পর ভারত-চিন সম্পর্ক

  • ধর্মদেব, মঞ্জুশ্রী ও অন্যান্য শ্রমণের চীনে গমন : ৯৭২ খ্রিস্টাব্দে ৪৪ জন ভারতীয় ভিক্ষু বহু সংখ্যক সংস্কৃত গ্রন্থসহ চিনদেশে গমন করেন। নালন্দা মহাবিহারের এক শ্রমণ ধর্মদেব। ৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি চিনে যান। তৎকালীন চিনা সম্রাট কর্তৃক সমাদৃত এই বিদগ্ধ শ্ৰমণ অনেক সংস্কৃত গ্রন্থ চিনা ভাষায় অনুবাদ করেন। দীর্ঘকাল বসবাসের পর ১০০১ খ্রিস্টাব্দে চিনেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আর একজন ভারতীয় শ্ৰমণ মঞ্জুশ্রী। পশ্চিম ভারতের রাজপরিবারের এক সন্তান এই শ্ৰমণ জীবনের শেষ দিনগুলো চিনেই অতিবাহিত করেন। কেবল ধর্মদেব বা মঞ্জুশ্রী নন, ১০ম-১১শ শতকে বহু ভারতীয় শ্রমণ চিনে গমন করেন। তাদের নিরলস প্রচেষ্টায় অসংখ্য সংস্কৃত গ্রন্থ চিনা ভাষায় অনূদিত হয়। বৌদ্ধশাস্ত্রের চিনা ভাষায় রূপান্তরের কাজে চিনসম্রাটদের খুবই আগ্রহ ছিল। ৯৮২ খ্রিস্টাব্দে চিনা সম্রাট শ্রমণদের নিয়ে একটি অনুবাদক-পরিষদ গঠন করেন। এই অনুবাদক-পরিষদের তিন শীর্ষস্থানীয় সদস্যই ভারতীয় ছিলেন। এই পরিষদ ৯৮২-১০১১ খ্রিস্টাব্দে ২০০ খণ্ড বৌদ্ধশাস্ত্র চিনা ভাষায় অনুবাদ করেন।
  • চিন থেকে বহু শ্রমণের ভারতে আগমন : এ সময় চিন থেকেও বহু শ্ৰমণ ভারতে আগমন করেন, এ দেশে দীর্ঘদিন অবস্থান করেন। ৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে ৩০০ চিনা শ্ৰমণ ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। এই শ্রমণদের ভারতদর্শন ১২ বছর স্থায়ী হয়। ৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে চিনসম্রাটের নির্দেশে ১৫৭ জন চিনা শ্রমণদের একটি দল ভারত অভিমুখে রওনা হন। তারা সম্রাটের একটি চিঠি নিয়ে আসেন। চিঠিটিতে মধ্য এশিয়া ও ভারতীয় রাজন্যবর্গের প্রতি আবেদন ছিল, তারা যেন চিনা ভিক্ষুদের যথােচিত সাহায্য করেন। বােধগয়ায় ৫ জন চিনা তীর্থযাত্রীর লেখ আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রথম লেখটির তারিখ ৯৫০ খ্রিস্টাব্দ। চিনা শ্রমণের নাম চে ই। পরবর্তী তিনটি লেখের তারিখ ১০২২ খ্রিস্টাব্দ। এক একটি লেখ এক একজন চিনা শ্রমণের। পঞ্চম লেখটি শ্রমণ হুই ওয়েন ১০৩৩ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ করেন। এই লেখে হুই ওয়েন বলছেন, সম্রাট তাই সুঙের সম্মানে তিনি বজ্রাসনের নাতিদূরে একটি স্তূপ নির্মাণ করেন।

সুঙ রাজাদের আমলে ভারত-চিন সম্পর্ক

  • চোলরাজাদের সাথে রাজনৈতিক সম্পর্ক : সুঙ রাজাদের আমলে চিনদেশের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের চোলরাজ্যের রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। চিনা ইতিবৃত্তে বলা হয়েছে, চোলরাজ লাে ৎ সা লাে ৎ সা চিনে যে প্রতিনিধিদল পাঠান সেটি ১০১৫ খ্রিস্টাব্দে চিনে পৌঁছয়। তখন সম্রাট চেন জু-এর (Zhen Zong, খ্রিস্টাব্দ ৯৯৭ ১০২২) রাজত্বকাল। রাজা লাে ৎ সা লাে ৎ সা নিঃসন্দেহে চোল সম্রাট প্রথম রাজরাজ। চোলরাজ্য থেকে আরও দুটি দৌত্য ১০৩৩ এবং ১০৭৭ খ্রিস্টাব্দে চিনে প্রেরিত হয়। প্রথম দৌত্যটি পাঠানাে হয় প্রথম রাজেন্দ্ৰচোলের রাজত্বকালে, দ্বিতীয়টি প্রথম কুলােত্তুঙ্গের সময়। প্রথম দৌত্য প্রেরিত হয় রেন জুঙ (Ren Zong, খ্রিস্টাব্দ ১০২২-৬৩) সকাশে, দ্বিতীয়টি সম্রাট শেন জঙের (Shen Zong, খ্রিস্টাব্দ ১০৬৭-৮৫) নিকট। চিনের সঙ্গে সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করার উদ্দেশ্যেই যে এ সকল দৌত্য প্রেরিত হয়েছিল, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
  • দক্ষিণ ভারতের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক : সুঙ রাজাদের রাজত্বকাল পর্যন্ত (খ্রিস্টাব্দ ১২৭৬) চিনের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ ছিল। তিনটি প্রাসঙ্গিক বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায় –
    • প্রথমত, চিনের চুয়ান চৌ বন্দরের এক পুরােনাে দেবায়তনের বহিরঙ্গ কৃষ্ণলীলার ভাস্কর্যফলকে অলংকৃত। এসব ভাস্কর্যফলকে চোলশিল্পের স্বাক্ষর প্রতিফলিত হয়েছে। অনুমিত হয়, চিনের এই বন্দরটিতে চোল তথা দক্ষিণ ভারতীয় বণিকদের একটি বসতি গড়ে উঠেছিল।
    • দ্বিতীয়ত, চিনা রাজাদের নামাংকিত দ্বিসহস্রাধিক মুদ্রা ভারতের বিভিন্ন স্থানে আবিষ্কৃত হয়েছে। একটি স্থান সত্তীসগঢ়ের অন্তর্ভুক্ত শ্রীপুর। অন্য একটি স্থান চন্দ্রাবল্লী। তবে তঞ্জাবুর জেলার থল্লিকোট্টই, বিক্রম ও ওলয়কুন্নম গ্রামেই সর্বাধিক পরিমাণ চিনা মুদ্রার সন্ধান পাওয়া গেছে। (থল্লিকোট্টই গ্রামে প্রাপ্ত চিনা মুদ্রার সংখ্যা ১৮২২। এই মুদ্রা ভাণ্ডারের সর্বশেষ চিনা সম্রাট চিঙ তিন (খ্রিস্টাব্দ ১২৬০-৬৮)। বিক্রম গ্রামে যে ২০টি চিনা মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে তাদের সময়কাল খ্রিস্টীয় ৮ম শতকের প্রথম পর্ব হতে ১৩শ শতকের মধ্যভাগ। ওলয়কুন্নমে সর্বসমেত ৩২৩টি চিনা মুদ্রা পাওয়া গেছে (Journal Of The Numismatic Society of India, XXXIII, পৃষ্ঠা ৬৩)।)
    • তৃতীয়ত, নাগপট্টিনমে প্রাপ্ত একটি চোল লেখে চীন কনকম বা চিনা স্বর্ণমুদ্রার উল্লেখ আছে। বলা বাহুল্য, তথ্য তিনটিতেই ভারত চিন বাণিজ্যিক সম্পর্কের ইঙ্গিত আছে।
  • ১১শ শতকে চিনে বৌদ্ধ ভিক্ষু-ভিক্ষুণী সংখ্যা : নিম্নেক্ত তথ্য-তালিকায় খ্রিস্টীয় ১১শ শতকে চিনে বৌদ্ধ ভিক্ষু-ভিক্ষুণীদের সংখ্যা সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যাবে (Sino-Indian Studies, I, পৃষ্ঠা ১৬৪ ; The Age Of Imperial Kanauj. পৃষ্ঠা ৪৪৫) – 
    • ১০২১ খ্রিস্টাব্দে ৩,৯৭,৬১৫ জন ভিক্ষু ও ৬১,২৪০ জন ভিক্ষুণী।
    • ১০৩৪ খ্রিস্টাব্দে ৩,৮৫,৫২০ জন ভিক্ষু ও ৪৮,৭৪০ জন ভিক্ষুণী।
    • ১০৬৩ খ্রিস্টাব্দে ২,২০,৬৬০ জন ভিক্ষু ও ৩৪,০৩০ জন ভিক্ষুণী।

তিব্বতের সাথে সম্পর্ক

নাম রি স্রোঙ চান এর আমল : কথাটি চমকের মতাে শােনালেও অতীব সত্য। তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস শুরু হয়েছে চিনের অনেক পরে। বস্তুত, খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের পূর্বে এ দেশে বৌদ্ধধর্ম বিস্তারের সপক্ষে কোনও সুনিশ্চিত প্রমাণ নেই। রাজা নাম রি স্রোঙ চান ওই শতকের শেষ পাদে তিব্বতে রাজত্ব করেন (Gnam-ri-sron-btsan. তিব্বতি নামের বানান সম্পর্কে বিশেষজ্ঞে বিশেষজ্ঞে বিস্তর মতপার্থক্য লক্ষিত হয়)। উত্তরপর্বীয় তিব্বতি ইতিবৃত্ত হতে জানা যায়, তিনি মধ্য ভারতে সমরাভিযান প্রেরণ করেন। এই দাবি কতদূর সত্য বলা কঠিন। তবে ভারতের উত্তরপ্রান্তীয় কতিপয় রাজ্যের সঙ্গে এ সময় তিব্বতের সংযােগ স্থাপিত হয়, এ ধারণা অসঙ্গত নয়।

স্রোঙ চান গাম পােচ এর আমল : নাম রি স্রোঙ চানের মৃত্যুতে তার পুত্র স্রোঙ চান গাম পােচ (Sron-btsan-sgam-po) তিব্বতের রাজপদ অলংকৃত করেন। তখন খ্রিস্টীয় ৭ম শতকের প্রথমার্ধ। তারই রাজত্বালে অসম ও সংলগ্ন ভূখণ্ডে অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও তিব্বতি আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। অবশ্য ততদিনে কামরূপপতি ভাস্করবর্মা পরলােক গমন করেছেন। এই রাজার রাজত্বকালেই বৌদ্ধধর্ম তিব্বতে প্রথম বিস্তারলাভ করে। বৌদ্ধধর্মের প্রতি রাজার এই উৎসাহের মূলে ছিলেন তার দুই পত্নী। তারা দু’জনেই বৌদ্ধধর্মের অনুরাগিনী ছিলেন। রানিদের একজন নেপালধীশ অংশুমানের কন্যা, অন্যজন চিনা রাজকুমারী। মহিষীদের আগ্রহে রাজা বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন এবং  স্বরাজ্যে বৌদ্ধধর্মের প্রসারে আত্মনিয়ােগ করেন। তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের প্রসারকল্পে তিনি তিনটি পথ অবলম্বন করেন –

  • (১) বিদেশি বৌদ্ধশ্রমণদের তিব্বতে আসার আমন্ত্রণ জানানাে হয়। যেসব শ্রমণ তার আহ্বানে সাড়া দেন তাদের মধ্যে ছিলেন তিনজন ভারতীয় শ্ৰমণ – কুমার, তবুত এবং গণুত। নেপাল থেকে আসেন শ্রমণ শীলমঞ্জু।
  • (২) এ সময় তিব্বতের বহুস্থানে বৌদ্ধমঠ নির্মিত হয়। তিব্বতের এক বহুল প্রচলিত জনশ্রুতি, তিনি ৯০০ বৌদ্ধমঠ প্রতিষ্ঠা করেন। বিখ্যাত রা মাে ছে মঠ তারই কীর্তি। 
  • (৩) তিনি বুঝেছিলেন, বৌদ্ধশাস্ত্রের তিব্বতি সংস্করণ ছাড়া বৌদ্ধধর্মের ব্যাপক প্রসার ঘটবে না। কিন্তু কাজটি দুরূহ ছিল। প্রথমত, সংস্কৃত জানেন এমন লােক সে সময় তিব্বতে ছিলেন না বললেই চলে। দ্বিতীয়ত, তিব্বতে তখনও বর্ণমালার প্রচলন হয়নি। ভারতে এমন এক প্রতিনিধিদল পাঠাতে হবে যারা সংস্কৃত ভাষা, বৌদ্ধশাস্ত্র ও ভারতীয় লিপি আয়ত্ত করবেন এবং দেশে ফিরে এসে তিব্বতি ভাষার ধ্বনির সঙ্গে সুসঙ্গত এক বর্ণমালা উদ্ভাবন করবেন এবং বৌদ্ধশাস্ত্রের তিব্বতি অনুবাদে ব্যাপৃত হবেন। এই উদ্দেশ্যে থােঙমি সম্ভোটসহ সতেরােজন তিব্বতিকে ভারতে পাঠানাে হয়। ভারতে এসে তারা সংস্কৃত ভাষা, বৌদ্ধশাস্ত্র ও ভারতীয় বর্ণমালা আয়ত্ত করেন। ভারতে তাদের কাজ শেষ হলে তারা দেশে ফিরে যান, তিব্বতি বর্ণমালা ও ব্যাকরণ প্রণয়ন করেন এবং বহু সংস্কৃত গ্রন্থ তিব্বতি ভাষায় অনুবাদ করেন। যে তিব্বতি লিপি প্রবর্তিত হল তার মূল ভিত্তি গুপ্ত ব্রাহ্মীলিপি।

স্রোঙ চান গাম পাে চেয়েছিলেন তার দেশের লােকেরা লেখাপড়া শিখে বৌদ্ধশাস্ত্র অধ্যয়ন করুন, বৌদ্ধধর্মের মর্মবাণী উপলব্ধি করুন। সঙ্গত কারণেই তিব্বতি জনমানসে এই রাজা চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তিব্বতিরা তাকে বােধিসত্ত্ব অবলােকিতেশ্বরের অবতাররূপে মান্য করেন, তার নেপালি ও চিনা রানিকে যথাক্রমে ভৃকুটী ও তারার অবতাররূপে গণ্য করেন। ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে স্রোঙ চান গাম পাে লােকান্তরিত হন। 

খ্রি দে চুগ তান এর আমল : বৌদ্ধধর্মের অনুরাগী এই রাজার সঙ্গে ভারতীয় রাজন্যবর্গের সম্পর্ক হৃদ্য ছিল না। অবশ্য তার জন্য তিনিই দায়ী। তার সাম্রাজ্যবাদ ভারতের উত্তরসীমান্তবর্তী রাজাদের আতঙ্কিত করে। স্রোঙ চান গাম পাের পরবর্তী তিব্বতি রাজারাও একই নীতি অনুসরণ করেন। স্রোঙ চানেরই একজন উত্তরাধিকারী খ্রি দে চুগ তান (৭০৫-৫৫ খ্রিস্টাব্দ) তার বিরামহীন ভারত-অভিযানে যশােবর্মা ও ললিতাদিত্যের মতাে ভারতীয় রাজারা শশব্যস্ত হন এবং সম্ভবত সামরিক সহায়তা লাভের আশায় চিনা রাজদরবারে দূত প্রেরণ করেন। খ্রি দে চুগ তান তার রাজত্বের প্রথম পর্বে তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের প্রসারে সচেষ্ট হন। এ সময় কয়েকটি বৌদ্ধমঠ নির্মিত হয় এবং কয়েকখানি মূল সংস্কৃত গ্রন্থ তিব্বতি ভাষায় অনূদিত হয়। কিন্তু ৭৪০-৪১ খ্রিস্টাব্দে তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে এক তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। রাজা বৌদ্ধধর্মের প্রতি তার সমর্থন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন। বিদেশি শ্রমণদের বিতাড়িত করা হয়। তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের অগ্রগতি ব্যাহত হয়।

খ্রি স্রোঙ দে চান ও মু খ্রি চান পাে এর আমল এবং শান্তরক্ষিত সহ অন্যান্য শ্রমণদের তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম প্রচার : খ্রি দে চুগ তানের পরলােকগমনের পর খ্রি স্রোঙ দে চান (Khri sron Ide btsan, ৭৫৫-৯৭ খ্রিস্টাব্দ) তিব্বতের রাজপদে অধিষ্ঠিত হন। তিনি ও তার পুত্র মু খ্রি চান পাে (Mu Khri btsan po, তিনি মু তিগ চান পাে (Mu Khri btsan po, তিনি Mu tig btsan po নামেও পরিচিত, ৮০৪-১৫ খ্রিস্টাব্দ) কতিপয় ভারতীয় রাজার সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু তারা উভয়েই বৌদ্ধধর্মের একান্ত অনুরাগী ছিলেন। বােধিসত্ত্ব মঞ্জুশ্রীর অবতাররূপে পুজিত খ্রি স্রোঙ দে চান তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিকল্পে বহু ভারতীয় ভিক্ষুকে স্বরাজ্যে আমন্ত্রণ জানান। এদের একজন শান্তরক্ষিত। নালন্দা মহাবিহারের অধ্যাপক তিনি। তিব্বতগামী অন্যান্য আমন্ত্রিত শ্ৰমণদের মধ্যে ছিলেন পদ্মসম্ভব, অনন্ত, কমলশীল, ধর্মকীর্তি, বিমলমিত্র, বুদ্ধগুহ্য এবং শান্তিগর্ভ। ভারতীয় শ্রমণদের প্রচেষ্টায় তিব্বতে যে বৌদ্ধধর্ম প্রচারিত হল তা মূলত তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম। ভারতীয় শ্রমণদের সহযােগিতায় বহু মূল বৌদ্ধগ্রন্থ তিব্বতি ভাষায় অনুদিত হয়। বৌদ্ধশাস্ত্রের চিনা ও তিব্বতি অনুবাদে একটি লক্ষণীয় পার্থক্য আছে। চিনা অনুবাদ অনেক ক্ষেত্রেই ভাবানুবাদ, তিব্বতি অনুবাদ আক্ষরিক অনুবাদ। আক্ষরিক অনুবাদে মূল গ্রন্থের সঙ্গে অনূদিত গ্রন্থের যে নৈকট্য থাকে, ভাবানুবাদে তা ব্যাহত হয়। খ্রি স্রোঙ দে চান বৌদ্ধধর্মের প্রসারের উদ্দেশ্যে বহু মঠ নির্মাণ করেন। মগধের ওদন্তপুরী বিহারের অনুকরণে নির্মিত তিব্বতের সুবিখ্যাত সম ইয়ে বিহার তারই এক স্মরণীয় কীর্তি। 

রল প চান এর আমল : আর একজন তিব্বতরাজ রল প চান (Ral pa can, ৮১৭-৩৬ খ্রিস্টাব্দ)। তিব্বতি এই রাজার সঙ্গেও সমকালীন ভারতীয় নৃপতিবর্গের বিশেষ সদ্ভাব ছিল না কিন্তু তারও পূর্বসূরিদের মতাে বৌদ্ধধর্মে গভীর অনুরাগ ছিল। এই তিন রাজার ঐকান্তিক আগ্রহে তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম পুনর্জীবন লাভ করল। খ্রি স্রোঙ দে চানের মতাে রল প চানের রাজত্বকালেও বহু ভারতীয় শ্রমণ তিব্বত পরিদর্শন করেন। জিনমিত্র, সুরেন্দ্রবােধি, শীলেন্দ্রবােধি, বােধিমিত্র এবং ধনশীলের মতাে বিদগ্ধ শ্রমণ এই সময় তিব্বতে পদার্পণ করেন। তাদের কাজ ছিল দ্বিবিধ। প্রথমত, বৌদ্ধশাস্ত্রের পুরােনাে তিব্বতি অনুবাদে যেসব বৈপরীত্য ও ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল তা সংশােধন করে নতুন সংস্করণ প্রণয়ন করা। দ্বিতীয়ত, নতুন মূল সংস্কৃত গ্রন্থের তিব্বতি সংস্করণ প্রণয়নে সহায়তা করা। রাজার আনুকুল্যে এ সময় তিব্বতে কয়েকটি বৌদ্ধমঠ নির্মিত হয়। তিব্বত থেকে বহু শ্রমণ শাস্ত্র অধ্যয়নের উদ্দেশ্যে ভারতে আগমন করেন। ভারত ও তিব্বতের মধ্যে বৌদ্ধশ্রমণদের গমনাগমনে কখনও ছেদ পড়েনি। দেশে যখন রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে তখনও ভারত থেকে শ্রমণদের অনেকেই বৌদ্ধশাস্ত্রসহ তিব্বতে গমন করেন, সে দেশে স্থায়িভাবে বসবাস করেন।

অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান : তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের প্রসারে যে ভারতীয় শ্রমণের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে তিনি অবশ্যই অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান। পালরাজ প্রথম মহীপালনয়পালের সমকালবর্তী এবং বিক্রমশীল মহাবিহারের অধ্যাপক এই শ্রমণ তিব্বতরাজ ‘যে শেস ওদ’-এর (Ye ses hod) বিশেষ আমন্ত্রণে তিব্বতে পদার্পণ করেন এবং জীবনের শেষ ১৩ বছর সেখানেই অতিবাহিত করেন। বৌদ্ধধর্মের প্রচার এবং গ্রন্থ রচনার কাজেই তার জীবনের শেষ কটি বছর অতিক্রান্ত হয়। তিনি তান্ত্রিক অনাচার ও বৌদ্ধধর্মের অতীন্দ্রিয়পরায়ণতা হতে বৌদ্ধধর্মকে মুক্ত ও পরিশুদ্ধ করেন। ৭৩ বৎসর বয়সে ১০৫৩ খ্রিস্টাব্দে এই স্মরণীয় ব্যক্তিত্বের জীবনাবসান হয়। তার লেখা একটি বিখ্যাত গ্রন্থ ‘বােধিপথপ্রদীপ’। 

তিব্বতে সংস্কৃত ও প্রাকৃতভাষা চর্চা : তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের বিপুল সমাদর হওয়ায় এই ধর্মকে কেন্দ্র করে সংস্কৃত চর্চার একটি ঐতিহ্য এখানে গড়ে ওঠে। শুধু বৌদ্ধশাস্ত্রের নয়, আরও অনেক বিষয়ের চর্চা হত এ দেশে। পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী, চাণক্যশ্লোক, অমরসিংহের অমরকোষ, কালিদাসের মেঘদূত, রাষ্ট্রকুটরাজ প্রথম অমােঘবর্ষের প্রশ্নোত্তররত্নমালিকা, দণ্ডীর কাব্যাদর্শ ইত্যাদি বিভিন্ন গ্রন্থ তিব্বতি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বােঝা যায়, নিছক ধর্মীয় সংস্কৃত সাহিত্য নয়, লৌকিক সংস্কৃত সাহিত্যও অনুশীলিত হত এ দেশে। তিব্বতি ভাষায় প্রচুর সংস্কৃত শব্দের ব্যবহার আছে। আবার সংস্কৃত ও প্রাকৃত পদ বিকৃত হয়ে তিব্বতিতে রূপান্তরিত হয়েছে, এমন উদাহরণও আছে। তিব্বতি (ব) স্কলপ সংস্কৃত কল্প (যুগ)-এর বিকৃত রূপ; তিব্বতি পােতি প্রাকৃত পােথি (গ্রন্থ)-এর বিকার। তিব্বতি জনমানসে সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষার প্রভাবের ফলেই এটি সম্ভব হয়েছে। 

বৌদ্ধধর্মের বিবর্তনে তিব্বতিদের স্বকীয়তা ও ভারতীয় সংস্কৃতিতে অবদান : তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের প্রসার ও প্রভাব সম্পর্কে একটি কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে। এ দেশে বৌদ্ধধর্মের বিবর্তনে তিব্বতিদের স্বকীয়তাও কাজ করেছিল। ভারত থেকে যেমন তারা বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছেন তেমনি নিজস্ব পরম্পরা, প্রচলিত বিশ্বাস, ভৌতিক পূজা এবং সর্বোপরি স্থানীয় বােনধর্মের মিশেলে এই ধর্মকে বহুলাংশে আপনার করে নিয়েছেন। আরও একটি কথা। তিব্বত ভারতকে দিয়েছেও অনেক। ভারতীয় সংস্কৃতিতে তিব্বতি অবদানের স্বাক্ষর রয়েছে উত্তর ভারতের বিভিন্ন নদী ও স্থানের নামকরণে। দার্জিলিং, গ্যাংটক, কালিম্পং প্রভৃতি স্থাননামে এবং তিস্তা ইত্যাদি নদী নামে এই স্বাক্ষর বিধৃত। 

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে সম্পর্ক

প্রাচীনকালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ভারতবর্ষের অতি নিবিড় সম্পর্ক ছিল। সম্ভবত প্রাগৈতিহাসিক যুগেই এই সম্পর্ক শুরু হয়েছিল। ভারতবর্ষ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সম্পর্কের এই প্রাচীনত্বের সপক্ষে দু’টি যুক্তি আছে। প্রথমত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের আদি অধিবাসীদের ভাষার সঙ্গে ভারতীয় মুণ্ডা ভাষার মিল রয়েছে। মুণ্ডা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় আদি ভাষাগুলো অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষাগােষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। দ্বিতীয়ত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে নবাশ্মীয় বা নব্যপ্রস্তরযুগ পর্বের যেসব হাতিয়ার পাওয়া গেছে তা অনেকাংশে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার প্রাগৈতিহাসিক হাতিয়ারের অনুরূপ। ভাষা ও হাতিয়ারের এই সাদৃশ্যের পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে অভিমত প্রকাশ করেছেন, সেই সুদূর প্রাগিতিহাসের যুগে বহুসংখ্যক ভারতীয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বসতি স্থাপন করেছিলেন। পক্ষান্তরে, ভারত থেকে নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকেই একদল লােক ভারতে এসে বসবাস আরম্ভ করেন, এমন মতও প্রচলিত আছে। আবার কেউ কেউ বলেন, ভারতবর্ষ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া মৌসুমি বায়ুর প্রভাবাধীন হওয়ায় উভয় অঞ্চলের লােকদের জীবনচর্যা অনেকটা একই ভাবে গড়ে উঠেছে, এরই প্রতিফলন ঘটেছে উভয় অঞ্চলের ভাষায় ও হাতিয়ারে। তাদের অভিমত, ভারতবর্ষ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভাষা ও হাতিয়ারের সাযুজ্যের প্রকৃত কারণ উভয় অঞ্চলের অধিবাসীদের একই ধরনের জীবনচর্যা, এক অঞ্চলের অধিবাসীদের অন্য অঞ্চলে বসতিস্থাপন এর প্রকৃত কারণ নয়।

প্রাগিতিহাসের যুগে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় হয়তাে কোনও ভারতীয় বসতি গড়ে ওঠেনি কিন্তু ঐতিহাসিক পর্বে যে এ অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে ভারতীয় বসতির পত্তন হয়েছিল, সে সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ নেই। নানা কারণে ভারতীয়দের কাছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। একদিকে চিন ও জাপান এবং অন্যদিকে ভারতবর্ষ, আরব দুনিয়া ও ইউরােপ এরই মাঝখানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অবস্থান। ফলে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দূরপাল্লার বাণিজ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বন্দরগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। তাছাড়া খনিজ ও বনজ সম্পদেও সে অঞ্চল সমৃদ্ধশালী ছিল। সমৃদ্ধির কারণেই সে অঞ্চলকে ভারতীয় গ্রন্থাদিতে সুবর্ণভূমি ও সুবর্ণদ্বীপ আখ্যা দেয়া হয়েছে। সম্ভবত মায়ানমার, তাইল্যান্ড, ইন্দোচিন ও মালয় উপদ্বীপ সাধারণভাবে সুবর্ণভূমি নামে পরিচিত ছিল। ইন্দোনেশিয়া ও সংলগ্ন দ্বীপপুঞ্জ সামগ্রিকভাবে সুবর্ণদ্বীপ নামে অভিহিত হত। ভারতীয় বণিকগণ তাদের বাণিজ্য সম্ভার নিয়ে স্থল ও সমুদ্রপথে সুবর্ণভূমি ও সুবর্ণদ্বীপের বিভিন্ন নগর ও বন্দরগুলোতে এসে উপস্থিত হতেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সেখানে স্থায়িভাবে থেকে যেতেন। ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যেও ভারতবর্ষ থেকে ধর্মপ্রচারকেরা সে দেশে গিয়েছিলেন। মায়ানমার, তাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশে বৌদ্ধধর্ম প্রসারের মূলে ধর্মপ্রচারকদের বড় রকমের ভূমিকা ছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রাচীন লােকগাথা ও ভারতীয় সাহিত্য থেকে জানা যায় ভারতবর্ষ হতে ক্ষত্রিয় পরিবারের সদস্যরাও ভাগ্যান্বেষণে অনেক সময় সমুদ্র পাড়ি দিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় গমন করতেন। মনে রাখতে হবে, ভারতীয়রা যেমন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যেতেন, তেমনি সে দেশ থেকেও বণিকরা সদলে ভারতে আসতেন। সাগর-পরিবৃত বা সাগর-সংলগ্ন অঞ্চলের অধিবাসী হওয়ায় দক্ষিণ-পূর্ব এশীয়রা প্রাচীনকাল থেকেই নাবিকের কাজে দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন। 

ভারতবর্ষ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সংযােগ রক্ষাকারী কয়েকটি স্থল ও জলপথ ছিল। চিনা রাজদূত চ্যাঙ কিয়েন-এর বর্ণনায় খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকের এরূপ একটি স্থলপথের সন্ধান পাওয়া যায়। চ্যাঙ কিয়েন খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকে আফগানিস্তানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত ব্যাকট্রিয়ায় এসেছিলেন। তিনি সেখানকার বাজারে চিনা রেশমি বস্ত্র ও বাঁশের জিনিস দেখে বিস্ময় বােধ করেন। অনুসন্ধান করে তিনি জানলেন, চিনা জিনিসপত্র অন্নান হতে উচ্চ ইরাবতী অববাহিকা, মণিপুর, অসম এবং পূর্ব ও উত্তর ভারতের ভেতর দিয়ে আফগানিস্তানের বাজারে এসেছে। চিনা বিবরণে প্রকাশ, দুর্গম হলেও এ পথে নিয়মিত লােক চলাচল ছিল। পূর্ব ভারত থেকে নিম্ন মায়ানমারে পৌছবার একটি পথ ছিল। সে পথটি চলে গিয়েছিল আরাকানের মধ্য দিয়ে ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে গমনাগমনের জন্য কয়েকটি জলপথও ছিল। পশ্চিম বাংলার তাম্রলিপ্তি বা তমলুক বন্দর হতে নিয়মিতভাবে জাহাজ ছাড়ত। জাহাজগুলো হয় বাংলা ও মায়ানমারের উপকূল ধরে অগ্রসর হত অথবা আড়াআড়িভাবে বঙ্গোপসাগর অতিক্রম করে মালয় উপদ্বীপ বা আরও দূরে ইন্দোচিন বা পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছত। ভারতের পূর্ব উপকূলে তাম্রলিপ্তি ছাড়া আরও কয়েকটি বন্দর ছিল, সেখান থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উদ্দেশ্যে জাহাজ ছাড়ত। গােপালপুরের নিকটবর্তী পলৌরা ছিল এরূপ একটি বিখ্যাত বন্দর। অন্ধ্রপ্রদেশের মছলীপটনমের নাতিদূরে আরও তিনটি বন্দর ছিল। সেখান থেকেও জাহাজ ছাড়ত। চিনা পরিব্রাজক ফা শিয়েন আর একটি জলপথের উল্লেখ করেছেন। তিনি খ্রিস্টীয় ৫ম শতকে পশ্চিম বাংলার তাম্রলিপ্তি বন্দর হতে এক বড় বাণিজ্যপােতে চড়ে প্রথমে শ্রীলঙ্কা ও পরে যবদ্বীপ হয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। বাণিজ্যপােতটির শ্রীলঙ্কায় পৌঁছতে ১৫ দিন সময় লাগে। যবদ্বীপের পথে ফা শিয়েনকে তীব্র প্রতিকূল আবহাওয়ার সম্মুখীন হতে হয়। একবার প্রচণ্ড ঝড়ে জাহাজের তলদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কোনও এক দ্বীপে জাহাজটিকে মেরামত করে আবার যাত্রা শুরু করা হয়। অবশেষে শ্রীলঙ্কা থেকে যাত্রার ৯০ দিন পর ফা শিয়েন যবদ্বীপ বা জাভায় এসে উপনীত হন। অর্থাৎ তাম্রলিপ্তি বন্দর হতে যাত্রা করে শ্রীলঙ্কা হয়ে মাঝ সমুদ্র দিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যাওয়ার একটি জলপথ ছিল।

পথগুলো ছিল দুর্গম, বিপদ-সঙ্কুল। স্থলপথ ছিল জঙ্গলাকীর্ণ, বন্ধুর। কখনও নদী, কখনওবা পর্বত, পথগুলোকে বিচ্ছিন্ন করে রাখত। গভীর অরণ্য, নদী ও পাহাড় অতিক্রম করে তবেই পথ চলতে হত। কখনও কখনও পথ এমন সরু হত যে অতি সন্তর্পণে সে পথ পার হতে হত। তাছাড়া পথে দস্য-তস্করদের উপদ্রব তাে ছিলই। বৃহৎকথা ও অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থাদিতে স্থলপথের দুর্গমতা বিষয়ক বিভিন্ন কাহিনীর অবতারণা হয়েছে। এরূপ এক কাহিনীর নায়ক সানুদাস। বৃহৎকথায় তার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যাত্রার কথা সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে। রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন, খ্রিস্টাব্দের পূর্ব হতেই এসব কাহিনী প্রচলিত ছিল। জলপথেও বিপদের আশঙ্কা ছিল যথেষ্ট। সমুদ্রে মাঝে মাঝে ঝড় দেখা দিত। ঝড়ে অনেক সময় জাহাজ ডুবে যেত বা জাহাজের ক্ষতি হত। কখনও কখনও যাত্রীদের নিরাপত্তার খাতিরে বাণিজ্যিক দ্রব্যসামগ্রী জলে ফেলে দিতে হত। কখনওবা আকাশে মেঘ জমত। তখন দিক নির্ণয় কষ্টসাধ্য হত। ডুবাে পাহাড়ে ধাক্কা লেগে জাহাজ ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। সমুদ্রে জলদস্যুদের উপদ্রব ছিল যথেষ্ট। একবার তাদের হাতে পড়লে আর নিস্তার ছিল না। তবু সেই প্রাচীনকালে বহু ভারতীয় পথের এসব বাধা-বিপত্তি অগ্রাহ্য করে ‘জীবনমৃত্যু পায়ের ভৃত্য, চিত্ত ভাবনাহীন’ এই ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পৌঁছেছিলেন। তাদের মধ্যে কেউ ছিলেন বণিক, কেউ ধর্মপ্রচারক, আবার কেউবা ভাগ্যান্বেষী।

মায়ানমারের সাথে সম্পর্ক

ভূমিকা

মায়ানমারে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রসারের অভ্রান্ত নিদর্শন ছড়িয়ে আছে সে দেশের প্রাচীন অভিলেখে, স্থাপত্যে, ভাস্কর্যে এবং পরবর্তিকালের দুটি পালি গ্রন্থে। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, মূলত ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির ছত্রছায়ায় মায়ানমারের সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবন বিকাশ লাভ করে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহের মধ্যে মায়ানমারই ভারতবর্ষের সবচেয়ে নিকটবর্তী দেশ। এই সেদিন পর্যন্ত দেশটি ব্রহ্মদেশ নামে পরিচিত ছিল। সংস্কৃত ব্রহ্মা অথবা ব্রহ্ম হতে ব্রহ্মদেশের নামকরণ হয়েছে, এ মত অনেকেই পােষণ করেন। আবার মায়ানমারের প্রধান জনগােষ্ঠী ম্রম্মদের (মারমা) নাম হতে দেশের নাম ব্রহ্মদেশ হয়েছে, এরূপ মতও প্রচলিত আছে। ব্রহ্মপুত্র নদ হতে ভ্রম্ম জাতির এরূপ নাম হয়েছে এমন অভিমতও ব্যক্ত হয়েছে। যাই হোক, মায়ানমারেই সর্বপ্রথম ভারতীয় সংস্কৃতি বিস্তার লাভ করে। ভারতবর্ষ হতে মায়ানমারে যাওয়ার দুটি স্থলপথ ছিল। একটি পথ গিয়েছিল পাতকৈ পর্বতমালার মধ্য দিয়ে, অপরটি আরাকান যােমার ভেতর দিয়ে। তাছাড়া পূর্ব ভারতের উপকূল ধরেও জলপথে মায়ানমারে যাওয়া যেত।

বৌদ্ধধর্ম ও ভারতীয় সংস্কৃতির বিস্তার

বৌদ্ধধর্মের উদ্ভব : অনেকে বলেন, বুদ্ধদেবের জীবিতকালেই বৌদ্ধধর্ম মায়ানমারে প্রসার লাভ করেছিল। বৌদ্ধগ্রন্থে তপুস ও ভল্লুক নামে বুদ্ধদেবের দু’জন সাক্ষাৎ শিষ্যের কথা বলা হয়েছে। তাদের বাড়ি ছিল উৎকলে। প্রাচীনকালে পেগু থেকে রেঙ্গুন পর্যন্ত সমগ্র অঞ্চল উৎকল নামে পরিচিত ছিল। কোনও কোনও পণ্ডিত অভিমত প্রকাশ করেছেন, তপুস ও ভল্লুকের দেশ উৎকল এবং মায়ানমারে অবস্থিত উৎকল একই অঞ্চল। কিন্তু এ ধারণা ঠিক নয়। বৌদ্ধগ্রন্থের উৎকল বর্তমান ওড়িশায় অবস্থিত ছিল। দীপবংস ও মহাবংস গ্রন্থ দুখানিতে বলা হয়েছে, মৌর্য সম্রাট অশােক সুবর্ণভূমিতে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য সােণ ও উত্তর নামে দু’জন শ্রমণকে পাঠিয়েছিলেন। সুবর্ণভূমি বলতে মায়ানমারকেও বােঝাত। এ কাহিনী সত্য হলে স্বীকার করতে হয়, মায়ানমার খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকে বৌদ্ধ পরিমণ্ডলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে এ বিষয়ে কোনও সুনিশ্চিত মন্তব্য করা যায় না। যেসব দেশে অশােক দূত পাঠিয়েছিলেন, সমকালীন লেখমালায় তাদের উল্লেখ আছে। সে তালিকায় সুবর্ণভূমির নাম নেই। 

ভারতীয় সংস্কৃতির বিস্তার : সম্ভবত খ্রিস্টাব্দের প্রারম্ভে বা তার কিছুকাল পূর্বে মায়ানমারে ভারতীয় সংস্কৃতি বিস্তার লাভ করে। গ্রিক লেখক টলেমি তার গ্রন্থে গঙ্গা নদীর পূর্ব দিকস্থ এমন কয়েকটি শহরের উল্লেখ করেছেন। যেখানে ভারতীয় বণিকদের যাতায়াত ছিল। শহরগুলো মায়ানমারে তাবস্থিত ছিল। খ্রিস্টীয় ২য় শতকের মধ্যভাগে টলেমি তার গ্রন্থখানি রচনা করেন। অর্থাৎ খ্রিস্টীয় ২য় শতকে ভারতবর্ষের সঙ্গে মায়ানমারের রীতিমত ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এ সময় মায়ানমারে সংস্কৃত ও পালি ভাষারও প্রচার হয়। ব্রাহ্মী হরফে উৎকীর্ণ পালি ও সংস্কৃত ভাষায় লেখা কয়েকখানি প্রাচীন প্রস্তর ও পােড়ামাটি লেখ মায়ানমারে আবিষ্কৃত হয়েছে। এদের কয়েকটি খ্রিস্টীয় ২য় শতকের। চিনা ইতিবৃত্ত থেকে জানা যায়, খ্রিস্টীয় ৩য় শতকে মধ্য মায়ানমারের একটি রাজ্যে প্রায় দশ হাজারেরও বেশি বৌদ্ধ পরিবার বাস করত; বৌদ্ধদের মধ্যে কয়েক হাজার শ্রমণ ছিলেন। বৌদ্ধদের সংখ্যা সম্পর্কে চিনা বিবরণে হয়তাে অতিশয়ােক্তি আছে কিন্তু খ্রিস্টীয় ৩য় শতকে মায়ানমারে বৌদ্ধধর্ম যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল তা তাে অস্বীকার করা যায় না। গুপ্তশৈলীর বহু বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীর মূর্তি মায়ানমারের বিভিন্ন স্থানে পাওয়া গেছে। ‘যে ধর্মা হেতু প্রভবা’ এই সুবিদিত বৌদ্ধ প্রবচন সম্বলিত গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর পর্বের বেশ কিছু লেখ প্রোম, পেগু, থাটন, পগান প্রভৃতি স্থানে আবিষ্কৃত হয়েছে। খ্রিস্টীয় ৫ম শতকের কয়েকখানি প্রাচীন পালি পুঁথি মায়ানমারে পাওয়া গেছে। 

ভারতীয় নাম ও ভারতীয়দের সাথে বিবাহ

রাজাদের ভারতীয় নাম ও অভিধা : 

  • ভারতীয় নাম : সমকালীন মায়ানমারের রাজন্যকুল ও অভিজাত মহলের অনেকেই ভারতীয় নাম গ্রহণ করেছেন। তাদের মধ্যে আছেন নীতিচন্দ্র (আ. খ্রিস্টাব্দ ৫২০-৭৫), বীরচন্দ্র (আ. খ্রিস্টাব্দ ৫৭৫-৭৮) (আনন্দচন্দ্রের ম্রোহউং লেখে বীরচন্দ্রকে বীর্যকচন্দ্র বলা হয়েছে), প্রীতিচন্দ্র (আ. খ্রিস্টাব্দ ৫৭৮-৯০), পৃথ্বীচন্দ্র (আ. খ্রিস্টাব্দ ৫৯০-৯৭), ধৃতিচন্দ্র (আ. খ্রিস্টাব্দ ৫৯৭-৬০০), বজ্রশক্তি, ধর্মচন্দ্র, জয়চন্দ্রবর্মা, সূর্যবিক্রম, হরিবিক্রম, সিংহবিক্রম, আনন্দচন্দ্র (তিনি সম্ভবত ৭২০ খ্রিস্টাব্দে আরাকানের সিংহাসনে আরােহণ করেন), মহাসিংহচন্দ্র (আ. খ্রিস্টাব্দ ৭৮৮-৮১০), রাজচন্দ্র, কালচন্দ্র, দেবচন্দ্র, যজ্ঞচন্দ্র, চন্দ্রবসু, কুলসিংহচন্দ্র (মনে হয় ৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি লেকান্তরিত হন), অনিরুদ্ধ (আ. খ্রিস্টাব্দ ১০৪৪-৭৭), বজ্রাভরণ, রাজকুমার, প্রথম জয়সুর (খ্রিস্টাব্দ ১১৭৪-১২১০) (তিনি অলউংসিথু নামেও পরিচিত), নরসুর (আ. খ্রিস্টাব্দ ১১৬৫-৭৪) (তার মূল নাম নরথু। নামটি সংস্কৃত নরসুর-এর বিকৃতি।),  দ্বিতীয় জয়সুর (আ. খ্রিস্টাব্দ ১১৭৪-১২১০), জয়সিংহ (আ. খ্রিস্টাব্দ ১২১০-৩৫) (তার প্রকৃত নাম জয়থেইংখ যা জয়সিংহের বিকৃত রূপ। জয়সিংহ তিলােমিনলাে ও ননতউংস্য নামেও পরিচিত ছিলেন।), নরসিংহ (তার প্রকৃত নাম নরথেইংখ), সিংহসুর, নরসিংহপতি (আ, খ্রিস্টাব্দ ১২৫৬-৮৭) এবং নরপতি (আ. খ্রিস্টাব্দ ১৪৪৩-৬৯)।
  • ভারতীয় নামের বিকৃতি : মায়ানমারের এক রাজা ক্যস্ব। এই নামটি সম্ভবত সংস্কৃত নাম কাশ্যপ-এর বিকৃতরূপ। ক্যস্বের পর রাজা হন তার পুত্র উজন। নামটি সম্ভবত সংস্কৃত উদয়ন হতে নিষ্পন্ন।
  • রাজ্যাভিষেকের সময় সংস্কৃত নাম গ্রহণ : কখনও কখনও দেখা যায়, রাজাদের নাম অভারতীয় কিন্তু রাজ্যাভিষেকের সময় তার সংস্কৃত নাম গ্রহণ করেছেন। এমনই একজন রাজা ক্যনজিৎথ (আ, খ্রিস্টাব্দ ১০৮৪-১১১২)। তার অভিষেক নাম ত্রিভুবনাদিত্য ধর্মরাজ।
  • আরাকানের চন্দ্র নামান্ত রাজারা : আরাকানের চন্দ্র নামান্ত রাজাদের বংশকে চন্দ্রবংশ আখ্যা দেওয়া যায়। চন্দ্র কথাটি সংস্কৃত। রাজা আনন্দচন্দ্র যে রাজবংশের সন্তান লেখে সেই বংশটিকে দেব-অণ্ডজ-অন্বয় বা শ্রীধর্মরাজ-অণ্ডজবংশ বলা হয়েছে। অণ্ডজের অর্থ পাখি। দেবাণ্ডজ বলতে বিষ্ণুর বাহন গরুড় বোঝায়। (দীনেশচন্দ্র সরকার (Epigraphia India, Vol. XXXII, পৃষ্ঠা ১০৭) এরূপ ব্যাখ্যা দিয়েছেন।)

বিভিন্ন স্থানের ভারতীয় নাম : প্রাচীনকালে মায়ানমারের অধিবাসীরা ভারতীয় শহরগুলোর নামে সে দেশের কয়েকটি স্থান বা অঞ্চলের নামকরণ করেছিলেন। এ সময় মায়ানমারের বহু শহর বা অঞ্চল ভারতীয় নামে পরিচিত ছিল। উদাহরণস্বরূপ –

  • পেণ্ড ও থাটনের (দক্ষিণ মায়ানমারের) নাম ছিল যথাক্রমে হংসবতী ও সুধর্মবতী
  • আরাকানের এক প্রাচীন নগর বৈশালী। চন্দ্ররাজ্যের রাজধানী ছিল এই বৈশালী। চন্দ্ররাজ আনন্দচন্দ্রের ম্রোহউং অভিলেখে তাকে তাম্রপট্টনের অধিপতিরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। পট্টন শব্দটি সংস্কৃত পত্তন হতে উদ্ভূত।
  • মায়ানমারের যে শহরটি বর্তমানে পাগান নামে পরিচিত একদিন তার নাম ছিল অরিমর্দনপুর। রাজা অনিরুদ্ধের রাজধানী ছিল এই শহর।
  • বর্তমান প্রোমের অতি নিকটবর্তী একটি গ্রাম হমউজা। প্রাচীনকালে স্থানটিকে শ্রীক্ষেত্র বলা হত।
  • খ্রিস্টীয় ৮ম-৯ম শতকে পায়ু রাজ্যের এক প্রশাসনিক বিভাগ বা শহরের নাম ছিল শ্ৰী।
  • আরবি ইতিবৃত্তকারেরা দক্ষিণ মায়ানমারকে ‘রমঞ্ঞ‌দেশ’ নামে আখ্যাত করেছেন। ডি. জি ই. হল মনে করেন নামটি মােন শব্দ ‘রমেন’ হতে উদ্ভূত (তদেব, পৃষ্ঠা ১৫৬)। কিন্তু ‘দেশ’ কথাটি যে বিশুদ্ধ সংস্কৃত তা তাে অনস্বীকার্য। তাছাড়া ‘রমঞ্‌ঞ’ কথাটি যে সংস্কৃত রমণীয় বা রম্য পদ হতে নিষ্পন্ন হয়নি তা কী করে বলা যায়?
  • রেঙ্গুনের নিকটবর্তী দুটি স্থানের নাম ছিল রামাবতী ও অসিতাঞ্জন
  • বেসিম কুশীনগর বা কুশীমণ্ডল নামে পরিচিত ছিল
  • মৌলমিন রামপুর নামে অভিহিত হত
  • মার্তবানকে বলা হত মুত্তিমমণ্ডল
  • পেগু থেকে রেঙ্গুন পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখণ্ড প্রাচীনকালে উৎকল নামে আখ্যাত ছিল
  • মায়ানমারের এক জনগােষ্ঠীর নাম তলৈং। অনেকেরই অনুমান, তলৈং গােষ্ঠীর লােকেরা অন্ধ্রপ্রদেশের তেলেঙ্গানা থেকে মায়ানমারে এসেছিলেন। এ মতের সমর্থনে যুক্তি আছে। তলৈং গােষ্ঠীর লােকেরা যে লিপি ব্যবহার করতে তা দক্ষিণ ভারতীয় পল্লব লিপির অনুরূপ।

মায়ানমারের রাজাদের ভারতীয় নারীদের সাথে বিবাহ : মায়ানমারের রাজা ভারতীয় রাজকুমারীর পাণিগ্রহণ করেছেন, এমন দৃষ্টান্ত বিরল নয় –

  • অনিরুদ্ধের মহিষী পঞ্চকল্যাণী ভারতের বৈশালী রাজপরিবারের কন্যা ছিলেন।
  • ক্যনজিৎথের বিবাহ হয় দক্ষিণ ভারতীয় চোল রাজপরিবারে।
  • ক্যনজিৎথের দৌহিত্র অলউংসিথু (আ. খ্রিস্টাব্দ ১১১৩-৬৫) বাংলার ময়নামতী পাহাড়ের সন্নিকটবর্তী পট্টিকের রাজ্যের এক রাজদুহিতার সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। 

ভারতীয় ধর্ম 

ব্রাহ্মণ্য ধর্ম : প্রথমদিকে মায়ানমারে বৌদ্ধধর্মের পাশাপাশি ব্রাহ্মণ্য ধর্মেরও বিশেষ প্রভাব ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে এ দেশে ব্রাহ্মণ্যধর্মের ধারাটি ক্ষীয়মাণ হতে থাকে। মায়ানমারে ব্রাহ্মণ্যধর্মের ধারা ক্ষীণ হয়েছে ঠিকই কিন্তু একেবারে শুষ্ক হয়নি। ক্যনজিথ ধর্মে বৌদ্ধ ছিলেন কিন্তু তিনি রাজত্বকালে বহু ভারতীয় বৈষ্ণব মায়ানমারে বসতি স্থাপন করেন। সংখ্যায় অল্প হলেও এ পর্বের কিছু ব্রাহ্মণ্য দেব-দেবীর মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে।

উত্তরে মহাযান ও দক্ষিণে থেরবাদ বৌদ্ধধর্ম : প্রথমদিকে উত্তর মায়ানমারে মহাযান বৌদ্ধধর্মের প্রতিষ্ঠা ছিল। এই অঞ্চলে মূলত ভ্রম্ম গােষ্ঠীর লােকেরাই বাস করতেন। তাদের ধর্মীয় জীবনে অরি নামে এক বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বিশেষ প্রভাব ছিল। অরিরা তান্ত্রিক আচারে বিশ্বাসী ছিলেন। ফলে উত্তর মায়ানমারের প্রচলিত মহাযান বৌদ্ধধর্মে বহু তান্ত্রিক রীতি অনুপ্রবিষ্ট হয়। এ সময় দক্ষিণ মায়ানমারে মূলত মােন জনগােষ্ঠীর লােকেরাই বাস করতেন। তারা ছিলেন থেরবাদ বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। মায়ানমারের উত্তর ও দক্ষিণ অংশ ছিল দুটি পৃথক রাজশক্তির অধীন। উত্তরাঞ্চল ছিল পাগান বা অরিমদনপুরের ভ্রম্ম রাজাদের অধীনস্থ, দক্ষিণার্ধ ছিল থাটন বা সুধম্মবতীর মােন রাজাদের অনুগত।

পাগান রাজ অনিরুদ্ধের থেরবাদ গ্রহণ : আনু. ১০৪৪ খ্রিস্টাব্দে অনিরুদ্ধ পাগানের সিংহাসনে আরােহণ করলে ভ্রম্ম জাতির ধর্মীয় জীবনে এক বিরাট পরিবর্তন ঘটে যায়। ১৯শ শতকে লেখা একটি স্থানীয় ইতিবৃত্ত (গ্রন্থখানি কাচ-প্রাসাদের ইতিবৃত্ত (Glass Palace Chronicle) নামে পরিচিত এবং ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে সংকলিত হয়) থেকে জানা যায় অনিরুদ্ধ থাটনের ব্রাহ্মণ ভিক্ষু শিন অরহনের নিকট থেরবাদ বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হন এবং উত্তর মায়ানমারে থেরবাদ বৌদ্ধধর্মের বিস্তারে উদ্যোগী হন। (জি, এইচ. লুস (G. H. Luce, Mons of the Pagan Dynasty in Journal of the Burma Research Sociey (Rangoon), Vol. XXXVI, Part I (August, 1953), পৃষ্ঠা ১-১৯) মায়ানমারীয় ইতিবৃত্তে বর্ণিত অনিরুদ্ধের শিন অরহনের নিকট মােনধর্মী থেরবাদে দীক্ষাগ্রহণের কাহিনীর সত্যতা সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তার অভিমত, অনিরুদ্ধ মহাযান বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ছিলেন এবং ক্যনজিৎথের রাজত্বকালেই পাগানে থেরবাদ বিস্তারলাভ করে। তার যুক্তি দ্বিবিধ – প্রথমত, শিন অরহন ক্যনজিৎথের দক্ষিণ হস্তস্বরূপ ছিলেন, দ্বিতীয়ত, থাটনে ত্রিপিটকের কোনও পাণ্ডুলিপি ছিল না। কিন্তু এ মত যে অভ্রান্ত, তা বলা যায় না। এ কথা সত্য, শিন অরহন ক্যনজিৎথের অন্তরঙ্গ ছিলেন। কিন্তু তিনি যে অনিরুদ্ধেরও গুরু ছিলেন না, তার কোনও নিশ্চিত প্রমাণ নেই। রাজশেখর প্রতীহার রাজ প্রথম মহীপাল এবং তার পুত্র মহেন্দ্রপালের গুরু ছিলেন। দ্বিতীয়ত, অনিরুদ্ধের সময় থাটনে ত্রিপিটকের কোন প্রতিলিপি ছিলনা, একথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। ডি. জি. ই. হল (তদেব, পৃ. ১৬৩) মনে করেন ১০৭৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে শ্রীলঙ্কার সুবিখ্যাত মহাবিহার থেকে পাগানে ত্রিপিটকের পাণ্ডুলিপি পাঠানাে হতে থাকে। তখন কিন্তু অনিরুদ্ধই রাজত্ব করছেন। তাছাড়া ১০৭৫ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে থাটনে রাজত্বকালেই যে মােনধর্মী থেরবাদ প্রচারিত হয় তা ডি. জি. ই. হলও (তদেব, পৃষ্ঠা ১৬৭) দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ব্যক্ত করেছেন।)

অনিরুদ্ধের মোন রাজ্য আক্রমণ, জয় ও থেরোবাদী ভিক্ষু ও সংস্কৃতি এনে মোনধর্মী থেরবাদের প্রসার : যাই হোক, উত্তর মায়ানমারে থেরবাদ বৌদ্ধধর্ম প্রচারের কাজে সহায়তা লাভের আশায় অনিরুদ্ধ থাটনের মােনরাজের শরণাপন্ন হন কিন্তু যথােচিত সাড়া না পাওয়ায় তিনি মােনৱাজ্য আক্রমণ ও জয় করেন। গর্ডন লুস এবং ডি. জি. ই. হল (তদেব, পৃষ্ঠা ১৬০) উভয়েই স্বীকার করেন, অনিরুদ্ধ থাটন জয় করে বিজিত মােন নরপতি মকুটকে বন্দি করে পাগানে নিয়ে আসেন কিন্তু তারা উভয়েই একমত, ত্রিপিটকের অনুলিপি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে অনিরুদ্ধ এ যুদ্ধ করেননি, রাজনৈতিক কারণে অর্থাৎ আসমুদ্র রাজ্যগঠনের উদ্দেশ্যেই তার এই থাটন অভিযান। পরাজিত মােনরাজ মকুটকে বন্দি করে অরিমর্দনপুরে আনা হয়। থাটন হতে বহু বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আনা হয় এবং থাটনে সংরক্ষিত অনেক বৌদ্ধগ্রন্থ ও বৌদ্ধ নিদর্শন সংগৃহীত হয়। শিন অরহন ও থাটন হতে আগত বৌদ্ধ শ্ৰমণদের সহায়তায় অনিরুদ্ধ স্বরাজ্যে তন্ত্র ও অরি-প্রভাবিত মহাযান বৌদ্ধধর্মের বিলুপ্তি ঘটান এবং মােনধর্মী থেরবাদ বৌদ্ধধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন। অর্থাৎ উত্তর ও দক্ষিণ, মায়ানমারের সর্বত্র থেরবাদ বৌদ্ধধর্মের প্রচার ঘটল। থেরবাদের প্রসারকল্পে মায়ানমারের সর্বত্র বহু প্যাগােডা ও আশ্রম স্থাপিত হল। মায়ানমারের সুবিখ্যাত শেজিগন প্যাগােডা সম্ভবত তারই রাজত্বকালে নির্মিত হয়। রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ বিদ্বজ্জনেরা এরূপ মত পােষণ করেন। ডি. জি. ই. হল (তদেব, পৃষ্ঠা ১৬১) মনে করেন, এই দেবায়তন ক্যনজিৎথের রাজত্বকালে নির্মিত হয়। তিনি দাবি করেন, তার অভিমত প্রত্নতত্ত্ব-সমর্থিত। কিন্তু যে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন তার এরূপ অনুমানের বুনিয়াদ, সে সম্পর্কে তিনি নীরব থেকে গেছেন।

ক্যনজিৎথের রাজত্বকালে থেরবাদের সম্প্রসারণ : অনিরুদ্ধের পুত্র ক্যনজিৎথের রাজত্বকালে থেরবাদ বৌদ্ধধর্ম আরও সম্প্রসারিত হয় (খ্রিস্টীয় ১৪শ শতকের দুখানি লেখ এবং মায়ানমারীয় ইতিবৃত্ত হতে জানা যায়, ক্যনজিৎথ অনিরুদ্ধের পুত্র ছিলেন, কিন্তু গর্ডন লুস এ মত স্বীকার করেন না)। এ সময় ভারত থেকে বহু বৌদ্ধ মায়ানমারে বসতি স্থাপন করেন। স্থানীয় ইতিবৃত্তে বলা হয়েছে, রাজা তিন মাস ধরে প্রতিদিন ৮ জন ভারতীয় ভিক্ষুকে স্বহস্তে খাদ্য পরিবেশন করতেন। পাগানের সুবিখ্যাত আনন্দ প্যাগােডা তারই কীর্তি। এই প্যাগােডার কক্ষ চতুষ্টয়ের প্রতিটিতে একটি করে বিশালকায় বুদ্ধপ্রতিমা প্রতিষ্ঠিত। পশ্চিমের কক্ষটিতে এক বিশাল বুদ্ধমূর্তির সামনে বিনম্র ও নতজানু ভঙ্গিতে দু’টি মানবমুর্তি স্থাপিত হয়েছে। মুর্তি দুটির একটি রাজা ক্যনজিৎথের, অন্যটি তার গুরু শিন অরহনের। এই মন্দিরগাত্রে সজ্জিত প্রস্তর ও পােড়ামাটির তিন হাজার ফুলকে উপস্থাপিত হয়েছে জাতকের বিভিন্ন কাহিনী আর গৌতম বুদ্ধের জন্ম হতে মহানির্বাণ প্রাপ্তি পর্যন্ত তার স্মরণীয় জীবনের বহু অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। ক্যনজিৎথের ধর্মীয় কার্যকলাপ শুধু মায়ানমারেই আবদ্ধ ছিল না, ভারতীয় ভূখণ্ডেও তা সম্প্রসারিত হয়। তারই উদ্যোগে বােধগয়ায় একটি বৌদ্ধবিহার নির্মিত হয়, কয়েকটি পুরােনাে মন্দিরের সংস্কার হয়। বােধগয়ায় পুরােনাে, জীর্ণ বৌদ্ধবিহারের সংস্কারে ক্যনজিৎথের দৌহিত্র অলউংসিথুর অবদানও কম নয়। বােধগয়ার একটি লেখ হতে জানা যায়, এই রাজার অনুরােধে আরাকানের জনৈক অধিপতি বােধগয়ায় পুরােনাে বিহারের সংস্কার করেন।

নরপতিসিথুর রাজত্বকালে শ্রীলঙ্কীয় থেরবাদের প্রসার : প্রাচীন মায়ানমারীয়দের ধর্মীয় জীবনে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটল রাজা নরপতিসিথুর (আনু. খ্রিস্টাব্দ ১১৭৪-১২১০) রাজত্বকালে। গর্ডন লুস (তদেব) মনে করেন, অনিরুদ্ধের পুত্র সাওলু বা বজ্রাভরণের (আনু. খ্রি. ১০৭৭-৮৪) রাজত্বকালেই শ্রীলঙ্কীয় থেরবাদ মায়ানমারে প্রচার লাভ করে। তার অভিমত, সাওলুর শাসনকালে নির্মিত পহ্‌তোথমায় মন্দিরগাত্রে পালি ত্রিপিটকের বহু কাহিনী রূপায়িত হয়েছে। এ এক অভিনব অভিমত। গর্ডন লুস মনে করেন, ক্যনজিৎথের রাজত্বকালে পাগানে মােনধর্মী থেরবাদ প্রচারিত হয়। কিন্তু সাওলু ক্যনজিৎথের পূর্ববর্তী। মায়ানমারে পরবর্তিকালে যে বৌদ্ধমত একচ্ছত্র প্রাধান্য বিস্তার করে তা শ্রীলঙ্কীয় থেরবাদ। মনে করা যাক, বজ্রাভরণের উদ্যোগেই মায়ানমারে সর্বপ্রথম শ্রীলঙ্কীয় থেরবাদ প্রচারিত হয়। সেক্ষেত্রে স্বীকার করতে হবে, মায়ানমারে শ্রীলঙ্কীয় থেরবাদের প্রচলন সত্ত্বেও ক্যনজিৎথ থাটনে প্রচলিত মােনধর্মী থেরবাদ প্রচারে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাহলে কিন্তু মায়ানমারে শ্রীলঙ্কীয় থেরবাদের উত্থানের ইতিহাসে এক সাময়িক বিরতি কল্পনা করতে হয়। পক্ষান্তরে যদি মনে করা হয়, মায়ানমারে প্রথমে মােনধর্মী থেরবাদ প্রচলিত ছিল কিন্তু পরে শ্রীলঙ্কীয় থেরবাদ প্রচারলাভ করায় মােনবাদী থেরবাদ নিস্তেজ হয়ে পড়ে আর শ্রীলঙ্কীয় থেরবাদের জনপ্রিয়তা উত্তরােত্তর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়, তাহলে শ্রীলঙ্কীয় থেরবাদের উত্থানের ইতিহাসে কোনওরূপ বিরতির সম্ভাবনা থাকে না। দ্বিতীয়ত, পহ্‌তোথমায় বৌদ্ধ মন্দির সাওলুর রাজত্বকালে নির্মিত, এরূপ অভিমতও আছে (Alexander Griswold, Barma, Korea, Tibet (Methuen, 1964), পৃষ্ঠা ২৮)। তৃতীয়ত, জাতকের কাহিনীগুলোকে সম্ভবত অনবধানতাবশত ত্রিপিটকের কাহিনী বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যাই হোক, অনিরুদ্ধের সময় হতে পাগানে যে মােনধর্মী থেরবাদ বৌদ্ধধর্ম প্রচলিত ছিল তার অবসান ঘটল; পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত হল শ্রীলঙ্কীয় থেরবাদ বৌদ্ধধর্ম। রমেশচন্দ্র মজুমদারের অভিমত ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে নরপতিসিথুর রাজত্বকালে শ্রীলঙ্কীয় খেরবাদ সর্বপ্রথম পাগানে প্রচারিত হয় (R. C. Mazumdar (Ed)., The Struggle For Empire (Bombay, 1966), পৃ. ৭৫৭)।

ধর্মীয় ক্ষেত্রে ভারতের সাথে সম্পর্ক : ১৩শ শতকের এক রাজা জয়সিংহ। তিনি বােধগয়ার সুবিখ্যাত মহাবােধি মন্দিরের অনুকরণে মায়ানমারে মহাবােধি মন্দির স্থাপন করেন। আজও মায়ানমার মূলত থেরবাদ বৌদ্ধধর্মের দেশ। সন্দেহ নেই, এ দেশে থেরবাদ বৌদ্ধধর্মের প্রচারে শ্রীলঙ্কীয় ভিক্ষুদের অশেষ অব্দয়ান রয়েছে। কিন্তু মায়ানমারের সঙ্গে ভারতের যোগসূত্র কখনই ছিন্ন হয়নি। মায়ানমার থেকে যেমন বৌদ্ধশ্রমণেরা ভারতে এসেছেন তেমনি ভারত থেকেও বহু বৌদ্ধ ভিক্ষু সে দেশে গমন করেছেন। ১৩শ শতকে বােধগয়ার মহাবােধি মন্দিরের অনুকরণে রাজা জয়সিংহের মায়ানমারে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ভারত ও মায়ানমারের মধ্যে বহমান সেই সাংস্কৃতিক ধারাটিই স্পষ্টীকৃত হয়েছে। মায়ানমারের মন্দির-ভাস্কর্যে রূপায়িত মানব-মানবীর দেহাবয়বে তাে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে (মােন, ম্রম্ম প্রভৃতি জনগােষ্ঠীর আদলে মানবদেহ রূপায়িত হয়েছে), কিন্তু ভাস্কর্যের বিষয়বস্তু কার্যত অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে। মন্দির-ভাস্কর্যের কাহিনীগুলো তাে গৌতম বুদ্ধ ও তার পূর্ব জন্মবৃত্তান্তকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে। 

ভারতীয় ভাষা

সংস্কৃত ও পালি উভয় ভাষারই চর্চা হত মায়ানমারে –

  • খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ-৭ম শতকে সংস্কৃত ভাষায় কয়েকখানি লেখ উৎকীর্ণ হয়েছে।
  • নীতিচন্দ্র ও বীরচন্দ্রের মতাে রাজারা তাে সংস্কৃতেই লেখ উৎকীর্ণ করেছেন।
  • খ্রিস্টীয় ৭ম শতকীয় রাজা জয়চন্দ্রবর্মার রাজত্বকালীন একটি মূর্তিলেখে সংস্কৃত ও পায়ু ভাষার যুগপৎ ব্যবহার লক্ষিত হয়।
  • খ্রিস্টীয় ৭ম-৮ম শতকের এমন কিছু লেখের সন্ধান পাওয়া গেছে যাদের ভাষা পায়ু কিন্তু লিপি দক্ষিণ ভারতীয় ব্রাহ্মী।
  • মায়ানমারে পালি ভাষার চর্চা উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১১৫৪ খ্রিস্টাব্দে অবংস ব্যাকরণের উপর একখানি পালি গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থখানি সপ্তবিংশতি অধ্যায়ে সমাপ্ত হয়েছে। গ্রন্থের প্রথম আঠারােটি অধ্যায় মহাসদ্দনীতি নামে পরিচিত, পরবর্তী নটি অধ্যায়কে সামগ্রিকভাবে চুল্লসদ্দনীতি বলা হয়।
  • খ্রিস্টীয় ১৩শ শতকে দণ্ডনীতির উপর পালি ভাষায় ধম্মবিলাস ধম্মসৎথ নামে একখানি গ্রন্থ রচিত হয়। রচয়িতা ভিক্ষু সারিপুত্ত কিংবা ধম্মবিলাস।
  • খ্রিস্টীয় ১৭শ শতকে পালিতে গন্ধবংস নামে একখানি গ্রন্থ প্রণীত হয়। শাসনবংস নামে আর একখানি পালি গ্রন্থ সংকলিত হয় ১৯শ শতকে। গ্রন্থ দুটিতে আলােচিত হয়েছে বৌদ্ধধর্মের স্বরূপ, বিভিন্ন বৌদ্ধ সম্প্রদায়, আশ্রমের নিয়মাবলি, দর্শন ও রাজনীতি।

মায়ানমারের সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশে ভারতের যে এক স্মরণীয় অবদান আছে তা অস্বীকার করা যায় না।

মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার সাথে সম্পর্ক

মালয়েশিয়ার সাথে সম্পর্কের আদিমতম সাক্ষ্য

  • ৮০-১১৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রচিত ‘পেরিপ্লাস অফ দি এরিথ্রিয়ান সি’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ভারতীয় বণিকরা পূর্ব উপকূলস্থ কয়েকটি বন্দর থেকে নৌযানে গঙ্গা অববাহিকা ও ‘ক্রাইসে’ দ্বীপে যাতায়াত করতেন; ক্রাইসে দ্বীপ অতিক্রম করে আরও পূর্বদিকে তারা কখনও অগ্রসর হতেন না। ক্রাইসে দ্বীপ বলতে সুবর্ণদ্বীপ বােঝায়। মালয়েশীয় বাের্নিও, ইন্দোনেশিয়া ও সংলগ্ন দ্বীপপুঞ্জের প্রাচীন নাম সুবর্ণদ্বীপ। পেরিপ্লাসের সাক্ষ্যে অনুমিত হয়, খ্রিস্টীয় ১ম শতকে ভারতবর্ষের সঙ্গে মালয়েশিয়ার ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। টলেমির বর্ণনাতেও ভারতবর্ষ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্কের উল্লেখ আছে।
  • সুঙ্গৈবাটুতে কয়েকটি প্রাচীন ভগ্ন প্রস্তর মূর্তি ও একটি দেবায়তনের ভগ্নাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। কেড্‌ডায় একটি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারের সন্ধান পাওয়া গেছে। বিহারটি খ্রিস্টীয় ৪র্থ কিংবা ৫ম শতকে নির্মিত হয়েছিল বলে অনুমিত হয়।
  • খ্রিস্টীয় ৪র্থ-৫ম শতকের বহু লেখ মালয়েশিয়ার বিভিন্ন স্থানে পাওয়া গেছে। লেখাগুলো সবই সংস্কৃত ভাষায় রচিত। কয়েকখানি লেখে আবার বৌদ্ধ বচনের উদ্ধৃতি আছে। মালয়েশিয়ায় প্রাপ্ত একটি লেখে রক্তমৃত্তিকার অধিবাসী বুদ্ধগুপ্ত নামে জনৈক মহানাবিকের উল্লেখ আছে। রক্তমৃত্তিকা সম্ভবত পশ্চিম বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার রাজবাড়িডাঙা গ্রামের উপান্তে অবস্থিত ছিল। সন্দেহ নেই, সেই সুদূর অতীতে বহু ভারতীয় এখানে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন।

ইন্দোনেশিয়ার সাথে সম্পর্কের আদিমতম সাক্ষ্য

  • জাভা :
    • ইন্দোনেশিয়ার অন্তর্ভুক্ত জাভা দ্বীপে প্রচলিত এক কিংবদন্তি অনুসারে আজিশক নামে জনৈক ভারতীয় খ্রিস্টীয় ১ম শতকে এখানে বসতি স্থাপন করেন। কথিত আছে, মহাভারত-প্রসিদ্ধ চন্দ্র বংশে তার জন্ম হয়েছিল।
    • এখানে প্রচলিত আর এক কাহিনী হতে জানা যায়, কলিঙ্গ অঞ্চলের এক রাজা প্রায় ২০ হাজার পরিবারকে এখানে পাঠিয়েছিলেন।
    • চিনা গ্রন্থে হাে লিং নামে মধ্য জাভায় খ্রিস্টীয় ৫ম শতকের এক ভারতীয় রাজ্যের উল্লেখ আছে। রাজ্যটি সম্ভবত কলিঙ্গবাসীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
    • প্রায় একই সময় পশ্চিম জাভায় আর একটি ভারতীয় রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। পূর্ণবর্মা ছিলেন এ রাজ্যের এক রাজা। তিনি সংস্কৃত ভাষায় অন্তত চারখানি লেখ উৎকীর্ণ করেছেন। ২২ বছর রাজত্ব করেন তিনি। তারুমা শহরে ছিল তার রাজধানী। তার পিতার নাম ছিল রাজাধিরাজ, পিতামহের নাম রাজর্ষি। পূর্ণবর্মার রাজত্বকালে জাভায় ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির প্রসার ঘটে। বহু যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন রাজা পূর্ণবর্মা।
    • চিনা পরিব্রাজক ফা শিয়েনের বিবরণেও জাভায় ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির প্রসারের উল্লেখ আছে। সেসময় এদেশে বৌদ্ধধর্ম সে রকম জনপ্রিয় ছিল না। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই জাভায় বৌদ্ধধর্ম জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এখানে বৌদ্ধধর্ম প্রসারে যিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তিনি জন্মসূত্রে এক কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ। চিনা ইতিবৃত্তে গুণবর্মা বলে তার পরিচয় দেয়া হয়েছে। তদানীন্তন চিনা সম্রাটের অনুরােধে গুণবর্মা ৪৩১ খ্রিস্টাব্দে চিন দেশে গমন করেন। সেখানেই তার মৃত্যু হয়।
  • সুমাত্রা : খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতকে সুমাত্রায় শ্রীবিজয় নামে একটি রাজ্য স্থাপিত হয়। ৭ম শতকের শেষভাগে রাজ্যটি খুবই শক্তিশালী হয়ে ওঠে। সংস্কৃত ভাষা ও বৌদ্ধশাস্ত্রচর্চার এক কেন্দ্র ছিল এই শ্রীবিজয় রাজ্য। খ্যাতনামা চিনা পরিব্রাজক ই চিঙ ভারতে আসার পূর্বে সুদীর্ঘ ৬ মাস এখানে অবস্থান করে সংস্কৃত ব্যাকরণ অধ্যয়ন করেন। শ্রীবিজয় রাজ্যের ভূয়সী প্রশংসা করে তিনি বলেন এ রাজ্যে এক হাজারেরও বেশি শ্রমণ বৌদ্ধশাস্ত্র চর্চায় নিযুক্ত রয়েছেন। বৌদ্ধশাস্ত্র সম্পর্কিত যত পাণ্ডুলিপি ভারতবর্ষে বিদ্যমান, তা সবই এখানেও লভ্য। কোনও চিনা শ্রমণের বৌদ্ধশাস্ত্রজ্ঞ হতে হলে তাকে ভারতে যাওয়ার পূর্বে শ্রীবিজয়ে এসে দু’তিন বছর শাস্ত্রানুশীলন করতে হবে। খ্রিস্টীয় ৭ম শতকে ভারতীয় সংস্কৃতি সুমাত্রায় কত সুদূ প্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছিল তা ই চিঙের এই মন্তব্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। স্মরণ রাখতে হবে, বক্তা কোনও স্থানীয় অধিবাসী নন, তিনি চিন দেশের এক বিশ্রুতকীর্তি ব্যক্তিত্ব।
  • বোর্নিও : ইন্দোনেশিয়ার অন্তর্ভুক্ত বাের্নিও দ্বীপের মুয়ারা কামান নামক স্থানে খ্রিস্টীয় ৫ম শতকের সাতখানি সংস্কৃত লেখ পাওয়া গেছে। রাজা মূলবর্মা লেখগুলো উৎকীর্ণ করেছেন। মূলবর্মার পিতা অশ্ববর্মা, পিতামহ কুন্দুঙ্গ। এই রাজপরিবারের সদস্যরা জন্মসূত্রে ভারতীয়, না স্থানীয় অধিবাসী, সে সম্পর্কে পণ্ডিতমহলে বিতর্ক আছে। কিন্তু এই বংশের রাজারা যে ভারতীয় সংস্কৃতির পৃষ্ঠপােষকতা করেছেন, তাতে কোনও সংশয় নেই। রাজা মূলবর্মা তার রাজধানী বপ্রকেশ্বরে ‘বহু সুবৰ্ণকম’ নামে এক বৈদিক যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন। রাজা এই উপলক্ষে ব্রাহ্মণদের ২০ হাজার গাভি দান করেন। বােঝা যায়, ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কৃতি রাজদরবারে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। 
  • কাপুহাস, মহাকাম ও রাভা অববাহিকা : কাপুহাস, মহাকাম ও রাভা অববাহিকায় গুপ্তশৈলীর কয়েকখানি ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ দেবদেবীর মূর্তি পাওয়া গেছে। সেলিবিস দ্বীপে খ্রিস্টীয় ৩য়-৫ম শতকের এক সুদৃশ্য বুদ্ধমূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। মূর্তিটি সম্ভবত স্থানীয় কোনও কর্মশালায় নির্মিত হয়নি, কোনও বহিরাঞ্চল থেকে এখানে এসেছে। 
  • গঙ্গা, যমুনা, কাবেরী, সরফু, নর্মদা, গােমতী, চন্দ্রভাগা ইত্যাদি ভারতীয় নদীর নামানুসারে প্রাচীনকালে ইন্দোনেশিয়ার নদীগুলোর নামকরণ হয়েছিল। ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার মধ্যে বিদ্যমান সুগভীর সাংস্কৃতিক সম্পর্কের এটি একটি বড় প্রমাণ।

ভারতীয় নাম

শৈলেন্দ্র রাজপরিবারে ভারতীয় নাম : খ্রিস্টীয় ৮ম শতকে ইন্দোনেশিয়ার শৈলেন্দ্র নামে যে রাজবংশ প্রতিষ্ঠা হয় তা এই দ্বীপময় দেশে চার শতকেরও অধিককাল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। রাজবংশের নামকরণে ভারতীয় প্রভাব সুস্পষ্ট। অনেকেই শৈলেন্দ্রদের ওড়িশার শৈলােদ্ভব বংশের এক শাখারূপে শনাক্ত করেছেন। এরূপ অভিমতের সপক্ষে কোনও সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তেমনি নীলকান্ত শাস্ত্রীর মতাে যেসব বিদ্বজ্জন মনে করেন, শৈলেন্দ্ররা দক্ষিণ ভারত থেকে ইন্দোনেশিয়ায় পদার্পণ করেন, সে মতও প্রমাণসিদ্ধ বলে গ্রহণ করা যায় না। পালনৃপতি দেবপালের নালন্দা তাম্রশাসনে শৈলেন্দ্ররাজ্য যবভূমি ও সুবর্ণদ্বীপরূপে আখ্যাত হয়েছে। শৈলেন্দ্র রাজাদের অনেকেই ভারতীয় নাম গ্রহণ করেছেন। তাদের মধ্যে বিষ্ণু, সংগ্রামধনঞ্জয়, ধরণীন্দ্রবর্মা, সমরাগ্রবীর, বালপুত্রদেব, চূড়ামণিবর্মা, মারবিজয়ােত্ত্বঙ্গবর্মা, সংগ্রামবিজয়ােত্ত্বঙ্গবর্মা, চন্দ্রভানু প্রভৃতির নাম সবিশেষ উল্লেখযােগ্য (ডি. জি. ই. হল (A History Of South-East Asia (Londoan, 198), পৃষ্ঠা ৫৪-৫৮) শৈলেন্দ্র রাজাদের যে রাজনৈতিক ইতিহাস ও রাজত্বের কালপঞ্জি নির্দেশ করেছেন তা অসম্পূর্ণ ও কষ্টকল্পিত)। দেবপালের সমকালীন শৈলেন্দ্ররাজ বালপুত্রদেব ছিলেন মহারাজ সমরাগ্রবীর ও মহিষী তারার সন্তান। রাজমহিষী তারা ছিলেন বর্মসেতু বা ধর্মসেতুর কন্যা। রাজন্যকুল ও অভিজাত পরিবারের সদস্যদের ভারতীয় নামকরণে ইন্দোনেশিয়ার মতাে দূরদেশে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রসারই প্রমাণিত হয়।

জাভার রাজপরিবারসমূহে ভারতীয় নাম : প্রাচীন ইন্দোনেশিয়ার অন্যান্য রাজপরিবারেও একই চিত্র দেখা যায় – 

  • শৈলেন্দ্র রাজাদের সময় মধ্য জাভার মতরাম ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে এক স্বাধীন রাজ্য গড়ে ওঠে। এই রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সন্নাহ। সন্নাহ ও তার উত্তরাধিকারী সঞ্জয়ের নাম তাে ভারতীয়ই।
  • এই বাজার আর একজন নৃপতি বলিতুঙ্গ। রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন, নামটি ইন্দোনেশীয় (R. C. Majumdar (Ed.), The Age Of Imperial Kanaj (Bombay, 1964), পৃষ্ঠা ৪২৮)। এ মত সম্ভবত সঠিক নয়। বলি কথাটি সংস্কৃত। তুঙ্গ বা ত্তুঙ্গ নামও প্রাচীন ভারতে অপরিচিত ছিলনা। বলিতুঙ্গ উতুঙ্গদেব ঈশ্বরকেশবােৎসবতুঙ্গ, ঈশ্বরকেশবসমরােত্তুঙ্গ, ধর্মোদয় মহাশম্ভু প্রভৃতি যেসব অভিধা ধারণ করেছেন তাতাে ভারতীয়ই।
  • এই রাজার একজন উত্তরাধিকারী দক্ষোত্তম। তিনি ৯১৫ খ্রিস্টাব্দে বা তার সামান্য কিছুকাল পূর্বে সিংহাসনে আরােহণ করেন। দক্ষোত্তম নামটিও ভারতীয়।
  • ৭৬০ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ পূর্ব জাভায় প্রাপ্ত একটি অভিলেখে মহারাজ দেবসিংহ, তার পুত্র মহারাজ গজয়ান এবং তার পৌত্রী উত্তেজনার নাম উল্লিখিত আছে। সবকটি নামই ভারতীয়।
  • জাভার আরও বহু রাজা ও রানি ভারতীয় নাম ধারণ করেন। তাদের মধ্যে আছেন ঈশানতুঙ্গবিজয়া, লােকপাল, মকুটবংশবর্ধন, মহেন্দ্রদত্তা (গুণপ্রিয়ধর্মপত্নী), উদয়ন, ধর্মবংশ, জয়বর্ষ—দিগ্‌জয়, কামেশ্বর, জয়ভয়, আর্যেশ্বর, ক্রোঞ্চার্যদীপ, দ্বিতীয় কামেশ্বর, কৃতজয়, বিষ্ণু বর্ধন, কৃতনগর, কৃতরাজস জয়বর্ধন, জয়নগর, বিক্রমবর্ধন, মৌলিকবর্মদেব, বর্মদেব এবং আদিত্য বর্মা। অবশ্য ভারতীয় নাম ধারণ করেননি, এমন রাজাও ছিলেন। এই প্রসঙ্গে সিন্ডােক, জয়কত্বং, ঐর্লঙ্গ (খ্রিস্টাব্দ ১০১৯-৪২) এবং হয়ম বুরুক-এর মতাে রাজাদের নাম উল্লেখ করা যায়। সিন্ডােক রাজ্যাভিষেকের পর ঈশানবিক্রম—ধর্মোদেব বলে যে অভিধা গ্রহণ করেন তা ভারতীয়। ঐর্লঙ্গের অভিষেক-নাম লােকেশ্বর—ধর্মবংশ-ঐর্লঙ্গ—অনন্তবিক্ৰমঙ্গদেব। এই অভিষেক-নাম বহুলাংশেই ভারতীয়। হয়ম বুরুক সিংহাসনে আরোহণ করে রাজসনগর নাম ধারণ করেন। নামটি ভারতীয়।

ধর্মে ভারতীয় প্রভাব

প্রাচীন ইন্দোনেশিয়ায় ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধধর্মের জনপ্রিয়তার অজস্র নিদর্শন ছড়িয়ে আছে স্থাপত্য, ভাস্কর্য, অভিলেখ ও প্রাচীন গ্রন্থাদিতে। স্থানীয় রাজারা ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ উভয় ধর্মমতেরই অনুরাগী ছিলেন।

দিয়েং ও লারা জংরঞের ব্রাহ্মণ্য মন্দিরগুলোর ভাষ্কর্য ফলক : ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীর পূজাকে কেন্দ্র করে ইন্দোনেশিয়ায় বহু মন্দির নির্মিত হয়। এ ধরনের মন্দির বেশি চোখে পড়ে দিয়েং মালভূমি অঞ্চলে আর লারা জংরঞে। দিয়েং মালভূমির মন্দিরগুলো খ্রিস্টীয় ৮ম শতকীয়। মহাভারতের কয়েকটি প্রধান চরিত্রের নামে এই মন্দিরগুলোর নামকরণ হয়েছে। মন্দিরগুলো ক্ষুদ্রাকৃতির কিন্তু এদের গঠন ও ভাস্কর্য-সজ্জা গুপ্তশৈলীর আদলে নির্মিত হয়েছে। লারা জংরঞের ব্রাহ্মণ্য মন্দিরগুলো আরও দৃষ্টিনন্দন, আরও অধিকসংখ্যক। বিষ্ণু, শিব ইত্যাদি বিভিন্ন দেবদেবীর উদ্দেশ্যে নির্মিত সর্বসমেত ১৫৬টি মন্দিরের মধ্যে আটটিই মুখ্য। মন্দিরগুলোর বহিরঙ্গে রূপায়িত হয়েছে রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণের বহু কাহিনী। ইন্দোনেশিয়ার ভারতীয় পৌরাণিক সাহিত্যের বিপুল সমাদরের বার্তাই ঘোষিত হয়েছে দিয়েং ও লারা জংরঞের ব্রাহ্মণ্য মন্দিরগুলোর ভাষ্কর্য ফলকে।

ব্রাহ্মণ্য মূর্তি : ৭৬০ খ্রিস্টাব্দের একটি প্রস্তরলেখে মুনিবর অগস্ত্যের এক মূর্তি-প্রতিষ্ঠার উল্লেখ আছে। মূর্তি স্থাপয়িতা আর কেউ নন, জাভার স্বয়ং তদানীন্তন অধিপতি। প্রতিমা-স্থাপন উপলক্ষে বেদবিদ যাজকবর্গের পৌরােহিত্যে বৈদিক যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়। এই রাজপরিবারের সদস্যদের অনেকেই যে বৈদিক তথা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অনুরাগী ছিলেন, তা সহজেই অনুমেয়। ইন্দোনেশিয়ায় ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীর মধ্যে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব এবং তাদের শক্তিদের জনপ্রিয়তাই ছিল সর্বাধিক। সমকালীন সাহিত্য, লেখ, স্থাপত্য ও ভাস্কর্যশিল্পের সাক্ষ্য যদি গ্রহণীয় হয় তাহলে নিঃসংশয়ে বলা যায়, তিন ব্রাহ্মণ্য দেবতার মধ্যে শিবপূজাই বেশি সমাদৃত ছিল। শিব শুধু প্রলয়ের দেবতা নন, সৃষ্টিরও কর্তা তিনি। ফলে ভারতে যেমন এখানেও তেমনি শিবের শান্ত ও উগ্র উভয় রূপেরই বিকাশ ঘটেছে। শিবের শান্তরূপ প্রতিফলিত হয়েছে মহাদেবের মূর্তিতে, উগ্ররূপ প্রতিভাত হয়েছে মহাকাল বা ভৈরবের প্রতিমায়। মহাদেবের শক্তি দেবী, মহাদেবী, পার্বতী, উমা, দুর্গা বা মহিষাসুরমর্দিনী। মহাকাল বা ভৈরবের শক্তি মহাকালী বা ভৈরবী। শিব লিঙ্গরূপেও পূজিত হতেন। বিষ্ণুপূজা ইন্দোনেশিয়ায় শিবপূজার মতাে কখনও প্রাধান্য লাভ করেনি। বিভিন্ন স্থানে বিষ্ণুমূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে; আবিষ্কৃত হয়েছে বিষ্ণু রাম, বরাহ, মৎস্য ও নরসিংহ মূর্তিও। ত্রিমূর্তি প্রতিমা অর্থাৎ ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের যৌগিক মূর্তি এবং শিব ও বিষ্ণুর যুগ্ম প্রতিমা বা হরিহর মূর্তিরও সন্ধান পাওয়া গেছে।

বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সম্প্রীতি : প্রতীয়মান হচ্ছে, ইন্দোনেশিয়ায় বিভিন্ন ব্রাহ্মণ্য সম্প্রদায়ের মধ্যে সমন্বয়ের সুর বেজে উঠেছিল। সৌহার্দ্য গড়ে উঠেছিল বৌদ্ধদের সঙ্গে ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বীদের। বুদ্ধ ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রতিবাদী নন, ইন্দোনেশিয়ায় তিনি শিবের অনুজরূপে পূজিত হয়েছেন। শিব ও বুদ্ধের এই নৈকট্য স্থাপন করে ইন্দোনেশিয়রা ধর্মীয় জীবনে শুধু ঐক্যেরই সন্ধান পাননি, নিজেদের স্বাতন্ত্র্যের স্বাক্ষরও রেখেছেন। বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপনের ক্ষেত্রে স্থানীয় রাজাদের এক বড় ভূমিকা ছিল। দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, ১০১৯ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত ঐর্লঙ্গের অভিষেক অনুষ্ঠানে বৌদ্ধ, শৈব ও বৈষ্ণব এই তিন সম্প্রদায়ের পুরােহিতেরা অংশগ্রহণ করেন। অথচ এই ঐর্লঙ্গ প্রজাদের দৃষ্টিতে বিষ্ণুর এক অবতাররূপে প্রতিভাত ছিলেন। জাভার বেলহানে গরুরূহ বিষ্ণুর যে মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে তা যে আসলে এই রাজারই প্রতিমা বহু বিদ্বজ্জনের তাই সুচিন্তিত অভিমত।

শৈলেন্দ্র রাজাদের বৌদ্ধধর্মে পৃষ্ঠপোষণ এবং পাল ও চোল রাজাদের সাথে সম্পর্ক : শৈলেন্দ্র রাজারা ছিলেন মহাযান বৌদ্ধধর্মের অনুরাগী। ভারতীয় ভূখণ্ডের সঙ্গে তাদের ছিল ঘনিষ্ঠ সংযােগ। খ্রিস্টীয় ৮ম শতকের শেষপাদের এক শৈলেন্দ্ররাজ ধরণীন্দ্রবর্মা। তিনি আচার্য কুমারঘােষের শিষ্য ছিলেন। গৌড় তথা উত্তর বাংলার অধিবাসী ছিলেন কুমারঘােষ। আর একজন শৈলেন্দ্রনৃপতি বালপুত্রদেব। ৯ম শতকের মধ্যভাগে তিনি রাজত্ব করেন। এই রাজা দেবপালের অনুমােদনক্রমে নালন্দায় একটি বৌদ্ধবিহার নির্মাণ করেন। বিহারের ব্যয় নির্বাহের জন্য পালরাজ পাঁচটি গ্রাম দান করেন। অনুরূপ একটি ঘটনা ঘটে খ্রিস্টীয় ১১শ শতকের প্রথম দশকে। তখন প্রথম রাজরাজ (খ্রিস্টাব্দ ৯৮৫-১০১৪) চোল সিংহাসনে, চুড়ামণিবর্মা শৈলেন্দ্ররাজ্যের কর্তৃত্বে। বৃহত্তর লাইডেন তাম্রশাসনে বলা হয়েছে, চুড়ামণিবর্মা প্রথম রাজরাজের একবিংশ রাজ্যবর্ষে তামিলনাড়ুর নাগপট্টিনমে চোলরাজের সম্মতিক্রমে একটি বৌদ্ধ বিহার নির্মাণের কাজ শুরু করেন এবং চোলরাজ এই বিহারের রক্ষণাবেক্ষণের উদ্দেশ্যে আনৈমঙ্গলম গ্রাম দান করেন। দুর্ভাগ্যক্রমে বিহারটি সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই শৈলেন্দ্ররাজের মৃত্যু হয়। পিতার অসমাপ্ত কর্ম সম্পাদন করেন তারই পুত্র ও উত্তরাধিকারী মারবিজয়ােত্তুঙ্গবর্মা। রাজরাজের পুত্র রাজেন্দ্রচোল তার রাজত্বের প্রারম্ভে সদ্যসমাপ্ত বিহারের অনুকূলে পিতৃপ্রদত্ত আনৈমঙ্গলম গ্রামটির পুনর্দানের ব্যবস্থা করেন, এই দুটি ঘটনায় একদিকে যেমন শৈলেন্দ্র রাজাদের সঙ্গে দু’টি ভারতীয় রাজপরিবারের সৌহার্দ্য প্রকাশ পেয়েছে (ইন্দোনেশিয়ার অন্তত আরও দু’জন রাজার সঙ্গে কয়েকটি দক্ষিণ ভারতীয় রাজপরিবারের সখ্যতা ছিল), অপরদিকে তেমনি ইন্দোনেশিয়ায় বৌদ্ধধর্মের দীর্ঘ জনপ্রিয়তাও আভাসিত হয়েছে। খ্রিস্টীয় ১৩শ শতকের এক শৈলেন্দ্র রাজা চন্দ্রভানু। তিনি আনুমানিক ১২৫৬ খ্রিস্টাব্দে শ্রীলঙ্কার। বিরুদ্ধে দ্বিতীয় অভিযান পরিচালনা করেন। তার এই অভিযানে পাণ্ড্য ও চোল রাজারা তাকে সেন দিয়ে সাহায্য করেন। তিনটি রাজপরিবারের মধ্যে মৈত্রীর সম্পর্ক বিদ্যমান না থাকলে এরূপ ঘটত না। অবশ্য পাণ্ড্যরাজের সঙ্গে চন্দ্রভানুর সখ্যতা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। অচিরেই পাণ্ড্য জটাবৰ্মা চন্দ্রভানুকে পরাজিত ও নিহত করেন। রাজা জয়নগরের অভিষেক নাম সুন্দর পাণ্ড্যদেবাধীশ্বর বিক্রমােঙ্গদেব। নামটি ইঙ্গিত করছে জয়নগরের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের পাণ্ড্যরাজদের সম্ভবত আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। ইন্দোনেশিয়ায় প্রাক্-শৈলেন্দ্র পর্বে হীনযান মতবাদেরই প্রাধান্য ছিল। কিন্তু শৈলেন্দ্রদের সময় থেকে মহাযানের জনপ্রিয়তা উর্ধ্বমুখী হয়।

মহাযান বৌদ্ধধর্মের নিদর্শন :

  • বােরােবুদুরের নবতল বৌদ্ধস্তুপ : বােরােবুদুরের ৪৫.৭২ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট বিখ্যাত নবতল বৌদ্ধস্তুপ মহাযান বৌদ্ধধর্মের এক অবিস্মরণীয় নিদর্শন। একটি ছােট হাড়ের চূড়ায় অবস্থিত এই সৌধের নয়টি ক্রমহ্রাসমান তলের মধ্যে নীচের ছয়টি তল বর্গাকার, উপরের তিনটি তল গােলাকৃতি। শীর্ষদেশে অবস্থান করছে ঘণ্টাকৃতির একটি স্তুপ। প্রতিটি তলের বহিরঙ্গে রূপায়িত হয়েছে ভগবান বুদ্ধের জীবনী ও অজস্র বৌদ্ধ কাহিনী। বৃহদায়তন এই কাপ সর্বসমেত ৪৩২টি কুলুঙ্গিতে সজ্জিত। প্রতিটি কুলুঙ্গিতে রয়েছে এক একটি অনিন্দ্যসুন্দর ধ্যানীবুদ্ধ-প্রতিমা। স্তূপটিকে অলংকৃত করে আছে দেড় হাজারের মতাে ভাস্কর্য-ফলক। স্তূপটির নির্মাণকাল আনুমানিক ৭৫০-৮৫০ খ্রিস্টাব্দ। ইন্দোনেশিয়ার স্থাপত্য-শিল্পের সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন এই বিখ্যাত সৌধ শৈলেন্দ্র রাজাদেরই এক স্মরণীয় কীর্তি।
  • মহাযান দেব-দেবীর মূর্তি : শুধু বােরােবুদুরে নয়, ইন্দোনেশিয়ার বহুস্থানে মহাযান দেব-দেবীর অসংখ্য মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে, কয়েকটি স্থানে প্রাচীন বৌদ্ধমন্দিরেরও সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রাচীন বৌদ্ধ দেবায়তন বেশি চোখে পড়ে জাভার প্রামবানান উপত্যকায়। স্থানীয় মন্দিরগুলোর মধ্যে চণ্ডী কলসন ও চণ্ডী সারি মঠ দু’টি এবং চণ্ডী সেবু মন্দিরগুলো বিশেষ উল্লেখযােগ্য। ৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে জনৈক শৈলেন্দ্রনৃপতি বৌদ্ধদেবী তারার উদ্দেশ্যে চণ্ডী কলসন নির্মাণ করেন। চণ্ডী সেবু মন্দিরগুলোর মধ্যে যেটি প্রধান সেটি ১৮২.৯০ মিটার দীর্ঘ ও ১৬৪.৬০ মিটার প্রশস্ত এক প্রায় বর্গাকার প্রাঙ্গণের কেন্দ্রস্থলে দণ্ডায়মান। মূল এই মঠের চারদিক ঘিরে শ্রেণিবদ্ধভাবে অবস্থান করছে আড়াইশােয়ের মতাে ছােট ছােট দেবায়তন। ইন্দোনেশিয়ায় প্রাপ্ত বৌদ্ধ দেবদেবীর অঙ্গুলি বিন্যাসে, দেহাবয়বের গঠনে ও গড়নে অনিবার্যভাবে ভারতীয় ভাস্কর্যশিল্পের প্রভাব পড়েছে। তবে সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ইন্দোনেশীয় শিল্পে স্বদেশিয়ানা প্রবল হয়ে ওঠে।

বৌদ্ধাচার্যগণ : সে যাই হােক, প্রাচীনকালে ইন্দোনেশিয়া, বিশেষত জাভা, বৌদ্ধশাস্ত্র অধ্যয়নের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। এখানকার কতিপয় বৌদ্ধাচার্যের বিদ্যাবত্তার খ্যাতি ভারতীয় উপমহাদেশেও ব্যাপ্তি লাভ করে। এরূপ একজন যশস্বী আচার্য চন্দ্রকীর্তি। অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের মতাে মহাজ্ঞানী শ্ৰমণ এই বৌদ্ধাচার্যের নিকট সুবর্ণদ্বীপে সুদীর্ঘ ১২ বছর বৌদ্ধ শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। বিশ্রুতকীর্তি ধর্মপালও তার শিক্ষার্থী-জীবনের দীর্ঘকাল ইন্দোনেশিয়ায় অতিবাহিত করেন।

সাহিত্যে ভারতীয় প্রভাব

এদেশে সংস্কৃত ভাষার চর্চা হত। জনপ্রিয় ছিল সংস্কৃত কাব্য, নাটক, রামায়ণ, মহাভারতের মতো বিভিন্ন গ্রন্থ। এখানে যে সাহিত্য রচিত হয়েছে তার ভাষা ইন্দোনেশীয় কিন্তু বিষয় ভারতীয়। প্রাচীন ইন্দোনেশীয় ভাষায় রচিত বিভিন্ন কাব্য ও গদ্য গ্রন্থের উপর একবার চোখ বােলানাে যায় –

  • শৈলেন্দ্ররাজ জিতেন্দ্রের পৃষ্ঠপােষকতায় রচিত অভিধান-গ্রন্থ অমরমালা। গ্রন্থের নামটি অবশ্যই সংস্কৃত এবং গ্রন্থের নামকরণে অমরকোষের প্রভাব পড়েছে।
  • মহাভারতের কাহিনী অবলম্বনে রচিত একটি কাব্য অর্জুন-বিবাহ। ঐর্লঙ্গের রাজত্বকালে (১০১৯-৪২ খ্রিস্টাব্দ) কণ্ব এই কাব্য রচনা করেন। অর্জুনের তপস্যা, কিরাটরূপী শিবের সঙ্গে যুদ্ধ, অসুর নিবাত কবচের বিরুদ্ধে দেবতাদের সংগ্রামে দেবতাদের সাহায্য-প্রদান এবং মেনকা, সুপ্রভা, তিলােত্তমাদের সঙ্গে প্রণয়লীলা এই কাব্যের প্রতিপাদ্য বিষয়।
  • আনুমানিক ১০৯৪ খ্রিস্টাব্দে যােগীশ্বর রচনা করেন রামায়ণ। রামায়ণের কাহিনী আশ্রয় করে রচিত হলেও কাব্যখানিতে কবির মৌলিকতার নিদর্শন আছে। লঙ্কায় রাম ও সীতার মিলনের মধ্য দিয়েই এ কাব্যের পরিসমাপ্তি ঘটেছে, সীতার পুনর্বার নির্বাসন ও অগ্নিপরীক্ষার উপস্থাপনা ঘটেনি এ কাব্যে।
  • আর একখানি গ্রন্থ মহাভারত। গ্রন্থটি মূল মহাভারতের সংক্ষিপ্ত গদ্য-সংস্করণ। রাজা ধর্মবংশের রাজত্বকালে গ্রন্থের আদি, বিরাট ও ভীষ্মপর্ব সমাপ্ত হয় কিন্তু আশ্রম, মুষল, প্রস্থানিক এবং স্বর্গারােহণ পর্বের কাজ সম্পন্ন হয় পরবর্তিকালে। (কখনও কখনও বলা হয় (The Struggle For Empire (Bombay, 1966), পৃষ্ঠা ৭৬৭) গ্রন্থখানির সংকলনের কাজ ঐর্লঙ্গের রাজত্বকালে শুরু হয়। এ মত ভ্রান্ত। রমেশচন্দ্র মজুমদার তার Hindu Colonies In The Far East গ্রন্থে এ বিষয়ে যে মন্তব্য করেছেন তাই ঠিক। ডি. জি. ই. হলও (A History of South-East Asia (London, 1981), পৃষ্ঠা ৭৬) একই অভিমত পােষণ করেন।)।
  • খ্রিস্টীয় ১২শ শতকের প্রথমদিকে রচিত হয় কৃষ্ণায়ণ ও সুমনসান্তক নামে দু’টি কাব্য। কৃষ্ণের রুক্মিণী হরণ এবং পরে তার সঙ্গে জরাসন্ধের যুদ্ধ এই নিয়েই প্রথম কাব্য।
  • ফুলের আঘাতে অজের পত্নী ইন্দুমতীর মৃত্যুকে উপজীব্য করে দ্বিতীয় কাব্য রচিত হয়েছে।
  • রাজা জয়ভয়ের রাজত্বকালে (খ্রিস্টাব্দ ১১৩৫-৫৭) রচিত হয় ভারতযুদ্ধ কাব্য। মূল মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের বর্ণনামূলক পর্বগুলোর উপর ভিত্তি করে এ কাব্য রচিত হয়েছে।
  • জয়ভয়ের রাজত্বকালে রচিত আর একখানি কাব্য হরিবংশ। এ কাব্যে বর্ণিত হয়েছে কৃষ্ণের রূক্মিণী হরণের তিনখানি গ্রন্থ—কামন্দক, ইন্দলােক ও নীতিপ্রিয়। কামন্দকে ভগবান কামন্দক তার শিষ্যদের কাছে রাজনীতি ব্যাখ্যা করছেন। আদর্শ রাজনীতিরূপে রামায়ণ ও মহাভারতের চরিত্রগুলোর উল্লেখ করা হয়েছে। যুধিষ্ঠির এক মহান রাজারূপে বর্ণিত হয়েছেন। ইন্দ্রলােকে ভগবান ইন্দ্রলােক তার শিষ্য কুমারযজ্ঞকে রাজনীতি সম্পর্কে উপদেশ দিচ্ছেন। নীতিপ্রিয়ে বিষ্ণু ব্যাসদেবকে শত্রুর প্রতি কর্তব্য-অকর্তব্য সম্বন্ধে অবহিত করছেন।

দেখা যাচ্ছে, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণাদির জনপ্রিয় কাহিনী অবলম্বন করে প্রাচীন ইন্দোনেশীয় সাহিত্যের উদ্ভব হয়েছে। ফলে এ সাহিত্যে প্রচুর সংস্কৃত শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। গ্রন্থসমূহের নামকরণেই তার স্বাক্ষর জাজ্বল্যমান। বিচারপতিরা ধর্মাধিকরণ নামে আখ্যাত হয়েছেন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের তত্ত্বাবধায়কদের বলা হয়েছে ধর্মাধ্যক্ষ। দেশি ও সংস্কৃত ভাষার মিশ্রণে মন্ত্রীদের বলা হয়েছে মন্ত্রী হিনাে, মন্ত্রী সিরিকন ও মন্ত্রী হলু। অর্থাৎ সংস্কৃত ভাষার পাশাপাশি দেশি ভাষারও বিকাশ হচ্ছে। প্রাচীন ইন্দোনেশীয় লেখকেরা ভারতীয় ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়েছেন কিন্তু ভারতীয় সাহিত্যের অন্ধ অনুকরণ করেননি, নিজেদের নিজস্ব ভাবনার স্বাক্ষর রেখেছেন। তারা ক্ষেত্রবিশেষে মূল ভারতীয় কাহিনীকে নবরূপে বিন্যাস করে পরিবেশন করেছেন। উদাহরণস্বরূপ হরিবংশের কথা উল্লেখ করা যায়। সংস্কৃত হরিবংশের মতাে ইন্দোনেশীয় হরিবংশেরও কৃষ্ণের রুক্মিণী হরণ এবং পরে জরাসন্ধের সঙ্গে সংঘর্ষ মুখ্য বর্ণনীয় বিষয় কিন্তু ইন্দোনেশীয় হরিবংশে দেখানাে হয়েছে, পাণ্ডবেরা কৃষ্ণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জরাসন্ধের সহায়তা করছেন। এ এক অভিনব সংযােজন। তাছাড়া ভারতীয় নয়, একান্তই নিজস্ব, এমন বিষয় নিয়েও ইন্দোনেশীয় কবিরা কাব্য রচনা করেছেন। এরূপ একটি কাব্য নাগর-কৃতাগম। মজপহিতের অশেষ পরাক্রমশালী রাজা হয়ম বুরুকের জীবনকাহিনী ও সমকালীন ঘটনাবলি অবলম্বনে ১৩৬৫ খ্রিস্টাব্দে এ কাব্য রচিত হয়েছে।

ভারতীয় সমাজব্যবস্থার প্রভাব

প্রাচীন ইন্দোনেশিয়ায় ভারতীয় সামাজিক ব্যবস্থার প্রভাব পড়েছিল প্রাচীন ইন্দোনেশীয়দের সমাজ-জীবনেও –

জাতিভেদ প্রথা : ভারতীয় সমাজের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য চাতুর্বর্ণ বা জাতিভেদ-প্রথা। ইন্দোনেশিয়ার প্রাচীন লেখে ও সাহিত্যে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রের উল্লেখে প্রমাণিত হয়, সে দেশে এই প্রথা প্রচলিত ছিল। তবে জাতিভেদ প্রথা যে কঠোরতার সঙ্গে অনুসৃত হত, তা নয়। বিভিন্ন বর্ণ বা জাতির মধ্যে বিবাহের প্রচলন ছিল। কিন্তু একটি নিয়ম অবশ্য পালনীয় ছিল। পুরুষের নিম্নতর বর্ণের মহিলার পাণিগ্রহণে কোনও সামাজিক বাধা ছিল না তবে উচ্চবর্ণের মহিলা নিম্নতর বর্ণের কোনও পুরুষকে বিবাহ করলে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হতেন। কিন্তু ব্রাহ্মণ কন্যা ও ক্ষত্রিয় বা বৈশ্য রাজার অন্তর্বিবাহের ক্ষেত্রে উভয়পক্ষকে কিছুটা কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করতে হত। এসব ক্ষেত্রে কন্যা বিবাহের পূর্বে পিতৃগৃহ ত্যাগ করে রাজার অন্তঃপুরে আশ্রয় নিতেন এবং ক্ষত্রিয় বা বৈশ্য বর্ণের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হতেন। সেক্ষেত্রে ব্রাহ্মণকন্যা ও রাজার মধ্যে বিবাহে আর কোনও অন্তরায় দেখা দিত না। অসবর্ণ বিবাহে সন্তানেরা পিতার বর্ণে পরিচিত হতেন কিন্তু পিতার একাধিক পত্নী থাকলে তার স্ত্রীদের বর্ণের প্রেক্ষিতে তার সন্তানদের সামাজিক মর্যাদার তারতম্য ঘটত। ইন্দোনেশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বলিতে শূদ্রদের অবস্থা কিছুটা উন্নত ছিল। এখানে তাদের অস্পৃশ্যতার গ্লানি বহন করতে হত না ; উচ্চবর্ণের লােকদের মতাে তারাও চাষ-আবাদের অধিকারী ছিলেন। তাছাড়া শূদ্ররা বিভিন্ন কারিগরি বৃত্তির দ্বারাও জীবিকা নির্বাহ করতেন।

সতী প্রথা : সতী প্রথা প্রচলিত ছিল। দু’ভাবে এ প্রথা পালিত হত। কখনও পত্নী আত্মঘাতিনী হতেন এবং পরে তার মরদেহ মৃতস্বামীর সঙ্গে একসঙ্গে দাহ করা হত। আবার কখনওবা স্ত্রী স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় আত্মাহুতি দিতেন। তবে এই প্রথা সর্বজনীনতা লাভ করেনি।

এখনও ভারতীয় প্রভাব লক্ষণীয় : প্রাচীন ইন্দোনেশীয়দের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবনে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির অপরিসীম প্রভাব পড়েছিল। কিন্তু এ দেশে ইসলামের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় প্রভাব ক্ষীয়মাণ হতে থাকে। ক্ষীয়মাণ হয়েছে কিন্তু এই প্রভাব একেবারে নিঃশেষিত হয়নি। ভারতীয় প্রভাবের অনুরণন অনুভব করা যাবে ইন্দোনেশীয়দের বর্তমান জীবনচর্যায় ও ভাষায়। ব্যতিক্রম বলি। সেখানে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাব এখনও অনেক স্পষ্ট, অনেক জোরালাে।

কামপুচিয়ার সাথে সম্পর্ক

সম্পর্কের আদিমতম সাক্ষ্য

প্রাচীনকালে কামপুচিয়া দেশেও ভারতীয় সভ্যতা বিস্তার লাভ করেছিল –

  • ভারতীয় রাজবংশ : এ দেশে সর্বপ্রথম যে রাজ্যটি গড়ে ওঠে চিনা ইতিবৃত্তে তাকে ফু নান বা ফৌ নান বলা হয়েছে। হুয়েন তিয়েন নামে জনৈক বিদেশি খ্রিস্টীয় ১ম শতকে এ রাজ্যের শাসন-ক্ষমতা দখল করেন। হুয়েন তিয়েন নামটি সংস্কৃত কৌণ্ডিন্য থেকে এসেছে। কৌণ্ডিন্য হয়তাে সরাসরি ভারতবর্ষ হতেই এ দেশে এসেছিলেন। এমনও হতে পারে, তিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্য কোনও দেশ থেকে কামপুচিয়ায় এসেছিলেন। কিন্তু তিনি জন্মসূত্রে ভারতীয় ছিলেন। চিনা বিবরণে ব্রাহ্মণ্য ধর্মানুরাগী বলে তার পরিচয় দেয়া হয়েছে। কৌণ্ডিন্যের বংশধররা প্রায় শতক কাল ধরে কামপুচিয়ায় রাজত্ব করেন। এরপর যারা ক্ষমতায় আসেন তাদের সকলের নামের আদ্যভাগে ‘ফান’ কথাটি রয়েছে। রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন, ‘ফান’ শব্দটি সংস্কৃত ‘বর্মা’ পদ থেকে নিস্পন্ন হয়েছে। এ মত অনুসারে কামপুচিয়ার দ্বিতীয় রাজবংশটিকে ‘বর্মা’ রাজবংশ নামে অভিহিত করা যায়। অধ্যাপক হলের ধারণা, ‘ফান’ কথাটি স্থানীয় মােন ভাষা সম্পর্কিত এবং ‘ফান’ রাজারা এখানকার স্থানীয় অধিবাসী ছিলেন। 
  • রাজাদের ভারতীয় সংস্কৃতির অনুসরণ : কামপুচিয়ার প্রাচীন রাজারা ভারতীয় সংস্কৃতির অনুরাগী ছিলেন। এই অনুরাগবশেই এখানকার স্থানীয় রাজাদের অনেকেই ভারতীয় নাম গ্রহণ করেছেন। খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতকের একজন রাজা চন তন। এটি তার চিনা নাম। তার প্রকৃত নাম সম্ভবত চন্দল বা চন্দ্র। প্রখ্যাত পণ্ডিত সিলভা লেভি মনে করেন, তিনি সম্ভবত একজন কুষাণ রাজা ছিলেন এবং গুপ্ত রাজাদের হাতে পরাজিত হয়ে কামপুচিয়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। তিনি ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বী ছিলেন। চন তনেরই এক বংশধর ছিলেন কিয়াও চেন জু। তার প্রকৃত নাম ছিল কৌণ্ডিন্য। কখন এই দ্বিতীয় কৌণ্ডিন্য রাজত্ব করেন তা সঠিক জানা যায় না। তবে তার এক উত্তরাধিকারী রাজা শ্রেষ্ঠবর্মা ৪২৫-৫৩ খ্রিস্টাব্দে কামপুচিয়ায় রাজত্ব করেন। প্রাচীন কামপুচিয়ার একজন শ্রেষ্ঠ রাজা জয়বর্মা। চিনা সম্রাটকে লেখা তার এক পত্র থেকে জানা যায়, শৈববৌদ্ধধর্ম তার রাজ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। শৈবধর্ম রাজধর্মের মর্যাদা লাভ করেছিল। কামপুচিয়ায় বৈষ্ণব ধর্মেরও প্রসার ঘটেছিল। খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের কিছু বিষ্ণুমূর্তি এ দেশে আবিষ্কৃত হয়েছে। ভাট কোহ্‌ থেকে শ্রীকৃষ্ণের একটি গােবর্ধনধারী মূর্তি পাওয়া গেছে, নােম চায়ে পাওয়া গেছে এক হরিহর মূর্তি ও বলরামের এক পূর্ণারয়ব মূর্তি। কো ক্রিয়েঙে যে সুদৃশ্য লক্ষ্মীমূর্তি পাওয়া গেছে সেটি একটু পরবর্তিকালের, খ্রিস্টীয় ৭ম শতকের প্রথমার্ধের। 
  • সংস্কৃত ভাষার চর্চা : প্রাচীন কামপুচিয়ায় সংস্কৃত ভাষার চর্চা হত। এ দেশে আবিষ্কৃত সংস্কৃত লেখের সংখ্যা কম। নয়। প্রাচীন ভারতের সুবিখ্যাত কুরুক্ষেত্র শহরের নামে প্রাচীন কামপুচিয়ার এক শহরের নামকরণ হয়েছিল। খ্রিস্টীয় ৫ম শতকের এক লেখে বলা হয়েছে, এক লক্ষ গােদান, এক হাজার অশ্বমেধ ও একশাে বাজপেয় যজ্ঞে যে পুণ্য, কুরুক্ষেত্রে পুণ্যস্নানেও সেই পুণ্য। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই কুরুক্ষেত্র শহরটি লাওসে অবস্থিত ছিল বলে মনে হয়। এক সময় এ দেশে নিয়মিত রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণ পাঠ হত। মন্দিরে ধর্মগ্রন্থদান পুণ্য কর্ম বলে বিবেচিত হত। ভারতীয় দর্শন ও অধ্যাত্মবাদ এখানে প্রচার লাভ করেছিল। পাণিনি, মনু, বাৎস্যায়ন, সুশ্রুত ও বিশালাক্ষের রচনাবলি এ অঞ্চলে সাগ্রহে পঠিত হত। অনেকে বলেন, এখানকার মেকং নদীর নামটি সংস্কৃত মা গঙ্গা হতে এসেছে। এ মত হয়তাে ঠিক নয়। কিন্তু এ দেশের বর্ণমালা যে ভারতীয় ব্রাহ্মী বর্ণমালা হতে উদ্ভূত হয়েছে, তা স্বীকার না করে উপায় নেই।

ভারতীয় নাম

বিভিন্ন স্থানের সংস্কৃত নাম : কামপুচিয়ায় ভারতীয় সংস্কৃতি কী গভীর প্রভাব ফেলেছিল তার অজস্র নিদর্শন ছড়িয়ে আছে সে দেশের প্রাচীন লেখমালায়, স্থাপত্যে, ভাস্কর্যে ও জনশ্রুতিতে। প্রাচীনকালে এই দেশটি কম্বুজ নামে পরিচিত ছিল। শুধু দেশের নাম নয়, সে সময় কামপুচিয়ার বহু শহরেরও নামকরণ হয়েছে বিশুদ্ধ সংস্কৃতে। ভবপুর, শম্ভুপুর, ব্যাধপুর, বিক্রমপুর, উগ্ৰপুর, অনিন্দিতপুর (বালাদিত্যপুর), ঈশানপুর, কম্বুপুরী, যশােধরপুর, ইন্দ্রপুর, অমরেন্দ্রপুর, তাম্রপুর, আঢ্যপুর, ধ্রুবপুর, জ্যেষ্ঠপুর এবং হরিহরালয় প্রাচীন কামপুচিয়ারই কয়েকটি বিখ্যাত নগর।

  • মেকং নদীর তীরবর্তী যে স্থানটি বর্তমানে সম্বর নামে পরিচিত প্রাচীনকালে তারই নাম ছিল শম্ভুপুর।
  • তেমনি অঙ্কোরথােমের সন্নিকটবর্তী বর্তমান লােলেই একদিন হরিহরালয় নামে পরিচত ছিল।
  • ব্যাধপুর সম্ভবত বা ফ্‌নোম পর্বতের সানুদেশে অবস্থিত ছিল। আধুনিক অঙ্কোরেরই প্রাচীন নাম যশােধরপুর।
  • অঙ্কোরথােমের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত ফ্নাে‌ম কুলেন পর্বতটি খ্রিস্টীয় ১১শ শতকেও মহেন্দ্রপর্বত নামে অভিহিত হত।
  • সাম্প্রতিককালে যে পর্বতটিকে ফ্নাে‌ম রাখেন বলা হয় একদিন তার নাম ছিল যশােধরগিরি।

রাজা-রাণীদের ভারতীয় নাম ও অভিধা : লেখমালায় কামপুচিয়ার যেসব প্রাচীন রাজাদের কথা বলা হয়েছে তাদের প্রায় সকলেরই নাম ও অভিধা ভারতীয়। ভববর্মা (প্রথম ও দ্বিতীয়), মহেন্দ্রবর্মা (চিত্রসেন), ঈশানবর্মা (প্রথম ও দ্বিতীয়), জয়বর্মা (জয়বর্মা নামে কামপুচিয়ায় নয়জন রাজা রাজত্ব করেন। এদের মধ্যে সর্বশেষ যিনি সেই নবম জয়বর্মা ১৩২৭ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরােহণ করেন), ইন্দ্রবর্মা (প্রথম ও দ্বিতীয়), যশােবর্মা (প্রথম ও দ্বিতীয়), হর্ষবর্মা (প্রথম ও দ্বিতীয়), সূর্যবর্মা (প্রথম ও দ্বিতীয়), রাজেন্দ্রবর্মা (প্রথম ও দ্বিতীয়), নৃপতীন্দ্রবর্মা, পুষ্করাক্ষ, উদয়াদিত্যবর্মা (প্রথম ও দ্বিতীয়), ত্রিভুবনাদিত্যবর্মা প্রভৃতি যেসব রাজা প্রাচীন কামপুচিয়ায় রাজত্ব করেন তারা সকলেই বিশুদ্ধ সংস্কৃত নাম গ্রহণ করেন (ইন্দ্রবর্মা নামে তিনজন রাজাও হতে পারেন। রমেশচন্দ্র মজুমদার (The Struggle For Empire, পৃষ্ঠা ৭৪১) যাকে শ্ৰীন্দ্রবর্মা (খ্রিস্টাব্দ ১২৯৬-১৩০৮) নামে শনাক্ত করেছেন তিনি সম্ভবত তৃতীয় ইন্দ্রবর্মা (শ্ৰীন্দ্রবর্মা = শ্রী + ইন্দ্রবর্মা)। তেমনি যাকে শ্রীন্দ্রজয়বর্মা বলা হয়েছে (তদেব) তিনি সম্ভবত ইন্দ্রজয়বর্মা)। রানি রাজকন্যাদের নামকরণেও একই রীতি অনুসৃত হয়েছে। প্রথম জয়বর্মার (খ্রিস্টীয় ৭ম শতকের মধ্যভাগ) পত্নী জয়দেবী। ৭১৩ খ্রিস্টাব্দে এই রাজমহিষী একখানি লেখ উৎকীর্ণ করেন। প্রথম ইন্দ্রবর্মার (খ্রিস্টাব্দ ৮৭৭-৮৯) মহিষী ইন্দ্রদেবী। রানি ইন্দ্রদেবীর মা রাজেন্দ্রদেবী। পঞ্চম জয়বর্মার (খ্রিস্টাব্দ ৯৬৮-১০০১) কনিষ্ঠা ভগিনী ইন্দ্রলক্ষ্মী। প্রথম সূর্যবর্মার (খ্রিস্টাব্দ ১০০২-৫০) মহিষী বীরলক্ষ্মী। নৃপতি দ্বিতীয় রাজেন্দ্রবর্মার (খ্রিস্টাব্দ ৯৪৪-৬৮) এক কন্যা রাজলক্ষ্মী। রাজকীয় অভিধাও ভারতীয়। রাজারা। কখনও কখনও ব্যক্তিগত শকট ও বাসগৃহকে ভারতীয় নামে চিহ্নিত করতেন। রাজা প্রথম ইন্দ্রবর্মা নিজের ব্যবহারের জন্য যে শকট নির্মাণ করেন তার নাম ছিল ইন্দ্রযান। কামপুচিয়ার এই রাজা ইন্দ্রবিমানক ও ইন্দ্রপ্রাসাদক নামে দুটো রাজবাড়িও তৈরি করেন। 

ধর্ম ও সমাজব্যবস্থায় ভারতীয় প্রভাব

ভারতীয় ধর্ম : কামপুচিয়ায় ভারতীয় ধর্মের ছিল অপ্রতিহত আধিপত্য। প্রথমদিকে এ দেশে ব্রাহ্মণ্যধর্মেরই প্রতিষ্ঠা ছিল বেশি। বেশির ভাগ রাজা ছিলেন ধর্মে শৈব। রাজাদের অকুণ্ঠ পৃষ্ঠপােষকতায় এ দেশে শৈবধর্ম বিশেষ প্রসার লাভ করে। জনপ্রিয় ছিল বৈষ্ণবধর্মও। শিব ও বিষ্ণুর যেমন স্বতন্ত্র মূর্তি পাওয়া গেছে তেমনি তাদের যৌগিক বা হরিহর মূর্তিও আবিষ্কৃত হয়েছে। ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বরের ত্রিমূর্তি-প্রতিমাও সংখায় বড় কম নয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অকাট্য নিদর্শন এসব যৌগিক প্রতিমা। ধর্মীয় ঐকতানের অভিব্যক্তি ঘটেছে রাজাদের কার্যকলাপেও। তাদের সম দর্শিতায় ও আনুকুল্যে, কামপুচিয়ায় শৈব ও বৈষ্ণব ধর্মের পাশাপাশি বৌদ্ধধর্মেরও প্রসার ঘটেছে। পঞ্চম জয়বর্মা ব্যক্তিগত জীবনে শৈব ছিলেন কিন্তু বৌদ্ধধর্মের উন্নতিকল্পে তিনি বহু অনুশাসন প্রবর্তন করেন। কামপুচিয়ার ধর্মীয় জীবনের এক বৈশিষ্ট্য দেবরাজ পূজা। দেবরাজ পূজা বলতে লিঙ্গ পূজা বােঝায়। এই লিঙ্গ শিবের প্রতীক, আবার রাজারও প্রতীক। অর্থাৎ শিবজ্ঞানে রাজপূজারই এক নাম দেবরাজ পূজা। ব্রাহ্মণ পুরােহিত শিবকৈবল্যের সহায়তায় রাজা দ্বিতীয় জয়বর্মা ৯ম শতকের প্রথমার্ধে এই পূজা প্রবর্তন করেন।

ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ দেবদেবীর প্রতিমা : কামপুচিয়ায় প্রাথমিক পর্বের যেসব ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ দেবদেবীর প্রতিমার সন্ধান পাওয়া গেছে তাদের গড়নে, গঠনে ও ভাবব্যঞ্জনায় গুপ্তশৈলীর সুস্পষ্ট স্বাক্ষর বিদ্যমান। বিভিন্ন স্থানে এ পর্বের ইষ্টকনির্মিত যেসব মন্দির আবিষ্কৃত হয়েছে তাতেও গুপ্তশৈলীর সুস্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে। কিন্তু সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মূর্তিশিল্পে ও স্থাপত্যে আঞ্চলিক, তথা খ্মে‌র লক্ষণ প্রতিভাত হতে থাকে। ১১শ-১২শ শতকের সৌধাবলিতে এই বৈশিষ্ট্য মূর্ত হয়ে উঠেছে। এই বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে দেবপ্রতিমার মুখের গড়নে, মন্দিরের ক্রমহ্রাসমান ত্রিতল, চতুষ্কোণ প্রাঙ্গণের উপর শিখরাকৃতির গর্ভগৃহের উপস্থাপনায় এবং চতুষ্কোণ প্রাঙ্গণের প্রতিটি তল ঘিরে দরদালান নির্মাণে। শিখরে পড়েছে উত্তর ভারতীয় শিখরশৈলীর প্রভাব। এ পর্বীয় মন্দিরের প্রবেশতােরণ দক্ষিণ ভারতীয় গােপুরমের আদলে নির্মিত। প্রাচীন কামপুচিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ সৌধ অঙ্কোর ভাট। বৃহদায়তন ও অপূর্বসুন্দর এই সৌধে ভারতীয় প্রভাব বিধৃত আছে মন্দিরগাত্রে রূপায়িত পৌরাণিক আখ্যানে, মন্দিরশিখরাজিতে আর মন্দিরের চতুষ্পর্শে দণ্ডায়মান গােপুরম চতুষ্টয়ে। অঙ্কর ভাটের অন্তরঙ্গে বিষ্ণুর মূর্তি রয়েছে।

ভারতীয় সমাজ-ব্যবস্থা : ভারতীয় সমাজ-ব্যবস্থা কামপুচিয়াতেও প্রচলিত ছিল। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের অজস্র উল্লেখে তাে তাই প্রমাণিত হয়। তবে জাতিভেদ-প্রথা এ দেশে ভারতের মতাে তেমন কঠোর ছিল না। ব্রাহ্মণ-পাত্র ও ক্ষত্রিয়-কন্যার মধ্যে বিবাহে কোনও প্রতিবন্ধকতা দেখা দিত না। রাজা পঞ্চম জয়বর্মার সহােদরা রাজলক্ষ্মীর সঙ্গে দিবাকর ভট্ট নামে জনৈক বিদ্বান ব্রাহ্মণের বিবাহ হয়। সমকালীন একটি লেখে বলা হয়েছে, এই ব্রাহ্মণ কাপুচিয়ায় নবাগত ছিলেন। লেখে কামপুচিয়ার প্রাচীন শহরের বর্ণনা আছে। সেই শহরে ছিল বিপ্রশালা (পণ্ডিতসভা), সরস্বতী (বিদ্যালয়), পুস্তকাশ্রম (পাঠাগার), সত্র (অতিথিভবন), আরােগ্যশালা (হাসপাতাল); আর ছিল বহ্নিগুহ (ধর্মশালা?)। এ যেন প্রাচীন ভারতেরই কোনও এক বর্ধিষ্ণু নগরের চিত্র।

ভাষায় ভারতীয় প্রভাব

সংস্কৃত ভাষায় রচিত লেখসমূহ : স্থানীয় রাজন্যবর্গের আনুকূল্যে কামপুচিয়ায় সংস্কৃত ভাষা বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং রাষ্ট্রীয় ভাষারূপে স্বীকৃত হয়। রাজারা উৎকীর্ণ করেছেন এবং আদ্যোপান্ত সংস্কৃতে রচিত হয়েছে। এরূপ বহু অভিলেখ কামপুচিয়ায় আবিষ্কৃত হয়েছে। এদের মধ্যে বেশ কয়েকটি লেখ যেমন দীর্ঘ তেমনি কাব্যগুণে সমৃদ্ধ। প্রথম যশােবর্মার (খ্রিস্টাব্দ ৮৮৯-৯০০) রাজত্বকালে জীর্ণ চারটি লেখের শ্লোকসংখ্যা যথাক্রমে ৫০, ৭৫, ৯৩ এবং ১০৮ (সম্ভবত প্রথম যশােবর্মা আরও দীর্ঘকাল, হয়তােবা ৯১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন)দ্বিতীয় রাজেন্দ্রবর্মার দুটি লেখ আকৃতিতে আরও বিশাল। একটির শ্লোকসংখ্যা ২১৮, অন্যটির ২৯৮। পদ ও ছন্দের ধর্যে মণ্ডিত এবং উপমা ও অলংকারের মনােহারিত্বে সমৃদ্ধ এসব সংস্কৃত অভিলেখে এক দিকে যেমন পরিবেশিত হয়েছে বেদ, বেদান্ত, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত এবং বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্যমালায় বর্ণিত নানা কাহিনী, ধর্মতত্ত্ব, প্রতিমা-লক্ষণ এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের খুঁটিনাটি তথ্য, অপরদিকে তেমনি অভিব্যক্ত হয়েছে জন্মমৃত্যুর বন্ধন হতে মানবমুক্তি তথা মােক্ষলাভের তীর আকুলতা এবং পরব্রহ্মের সঙ্গে জীবাত্মার মিলনের উদগ্র বাসনা। অর্থাৎ ভারতীয় ধর্মের নিছক বহিরঙ্গের চিত্র নয়, ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার মর্মবাণী কত সাবলীল ও আন্তরিক ভঙ্গিতে ধ্বনিত হয়েছে সংস্কৃত ভাষায় রচিত কামপুচিয়ার প্রাচীন লেখাবলিতে। কামপুচিয়ায় এমন লেখও আবিষ্কৃত হয়েছে যা দ্বিভাষিক; যেখানে পদ্যাংশ সংস্কৃতে এবং গদ্যাংশ খ্মে‌র ভাষায় রচিত। এই প্রসঙ্গে প্রাচীন কামপুচিয়ার এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব রাজপুরােহিত শিবকৈবল্যের এক অধস্তন প্রস্তরলেখ বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। বৃহতায়তন এই লেখ ১৩০টি সংস্কৃত শ্লোক এবং খ্মে‌র ভাষায় রচিত ১৪৬টি গদ্যছত্রের সংকলন। 

সংস্কৃতে সুপণ্ডিত রাজাগণ : রাজাদের অনেকেই সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। প্রথম যশােবর্মা ধর্মশাস্ত্র ও কাব্যে অসামান্য ব্যৎপত্তির অধিকারী ছিলেন। পাতঞ্জল মহাভায্যের উপর তিনি একখানি টীকা রচনা করেন। রাজা প্রথম সূর্যবর্মা (খ্রিস্টাব্দ ১০০২-৫০) ভাষ্য, কাব্য, ষড়দর্শন ও ধর্মশাস্ত্রে প্রগাঢ় জ্ঞান অর্জন করেন। কামপুচিয়ার প্রাচীন লেখে প্রায়শই বেদ, বেদান্ত ও বৌদ্ধশাস্ত্রে পারঙ্গম ব্রাহ্মণদের উল্লেখ পাওয়া যায়। তখনকার দিনে মন্দিরে মন্দিরে রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণের নিয়মিত পাঠ ও আলােচনা হত। দেবায়তনে ধর্মগ্রন্থদান ধর্মের অঙ্গ ছিল। কামপুচিয়ার বহুস্থানে রাজাদের বদান্যতায় আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়। সংস্কৃত চর্চা ও ধর্মানুশীলনের কেন্দ্র ছিল এই আশ্রম। লেখের সাক্ষ্যে প্রকাশ, বেদ, বেদান্ত, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, ধর্মশাস্ত্র এবং বৌদ্ধ ও জৈন শাস্ত্রের ব্যাপক চর্চা হত এ দেশে। ব্যাপক অনুশীলন হত সংস্কৃত ব্যাকরণেরও। কামপুচিয়ার প্রাচীন লেখে বৈয়াকরণ পাণিনি ও পতঞ্জলির উল্লেখ আছে। উল্লেখ আছে ধর্মশাস্ত্রকার মনুর, কামসূত্র-প্রণেতা বাৎস্যায়নের, নীতিশাস্ত্রকার বিশালাক্ষের ও চিকিৎসাশাস্ত্র-রচয়িতা সুশ্রতের। কামপুচিয়ায় এমন লেখও আবিষ্কৃত হয়েছে যার মধ্যে আছে কালিদাসের রঘুবংশের ছায়া, এমনকি মহাকবির ব্যবহার করা পদ। এ কথা অসঙ্কোচে বলা যায়, সংস্কৃত ভাষার গভীর অনুশীলন হত কামপুচিয়ায়। সেতুবন্ধ ও সূর্যশতকের মতাে কাব্যগ্রন্থও এ দেশে সােৎসাহে পঠিত হত। সমাদৃত ছিল প্রাকৃত। সাহিত্যও গুণাচ্যের লেখাও কামপুচিয়ায় অপরিচিত ছিল না। তবে প্রাচীন কামপুচিয়ায় রচিত কোনও সংস্কৃত কাব্যগ্রন্থের সন্ধান এখনও পাওয়া যায়নি।

তাইল্যান্ডের সাথে সম্পর্ক

সম্পর্কের আদিমতম সাক্ষ্য : প্রাপ্ত নিদর্শনাদি থেকে অনুমিত হয়, খ্রিস্টীয় ২য় শতকে বা তার কিছু পূর্বে তাইল্যান্ডে ভারতীয় সভ্যতার প্রসার ঘটেছিল।

  • প্ৰা পাথােম নামক স্থানে খ্রিস্টীয় ২য় শতকের কিছু বৌদ্ধ ভাস্কর্যের সন্ধান পাওয়া গেছে। ভাস্কর্যের মধ্যে আছে একটি ফলক। তাতে উৎকীর্ণ রয়েছে একটি ধর্মচক্র ও অর্ধ শয়ান ভঙ্গির একটি হরিণ।
  • প্ৰা পাথােমের নিকটবর্তী পােঙ্গটকে এক প্রাচীন মন্দিরের ভগ্নাবশেষ এবং একটি দণ্ডায়মান ক্ষুদ্র বুদ্ধমূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। দণ্ডায়মান বুদ্ধমূর্তিটি ব্রোঞ্জ নির্মিত। খ্রিস্টীয় ২য় শতকের অমরাবতী শিল্পরীতির অনুকরণ রয়েছে এতে।
  • তাইল্যান্ডের আর একটি প্রত্নক্ষেত্র মুঙ্গসিটেপ। স্থানটি পেচাবুরির সন্নিকটে। এখানে যেমন শৈব ও বৈষ্ণব ভাস্কর্য পাওয়া গেছে, তেমনি খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতকের একটি সংস্কৃত লেখও আবিষ্কৃত হয়েছে।
  • তাছাড়া, তাইল্যান্ডের নানা স্থানে পাথরের বুদ্ধমূর্তি পাওয়া গেছে। এদের কয়েকটিতে আবার সংস্কৃত লেখ উৎকীর্ণ আছে। লেখ-অলংকৃত বুদ্ধমূর্তিগুলো খ্রিস্টীয় ৫ম-৬ষ্ঠ শতকে নির্মিত হয়েছিল। তাইল্যান্ডের মূর্তি নির্মাণ শিল্পে ভারতীয় ভাস্কর্য শৈলীর যেমন প্রভাব পড়েছিল, তেমনি স্থানীয় শিল্প ভাবনার প্রতিফলনও ছিল যথেষ্ট। 

তাইদের আগমনের পূর্বে বিভিন্ন অঞ্চলের ভারতীয় নাম : ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রভাব হতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর মতাে তাইল্যান্ডও মুক্ত ছিল না। তাই জনগােষ্ঠী যখন তাইল্যান্ডে প্রবেশ করেনি ইতিহাসের সেই প্রত্যুষকালেও তাইদের সঙ্গে ভারতীয় সংস্কৃতির নিবিড় সংযােগ গড়ে উঠেছিল। তাই জাতির লােকেরা তখন বাস করত চিনের দক্ষিণ-মধ্য প্রান্তস্থিত য়ুন্নান অঞ্চলে। বৌদ্ধসংস্কৃতির প্রভাব আচ্ছন্ন এই ভূখণ্ড তখন গন্ধার নামে পরিচিত ছিল। পরম্পরাগত জনশ্রুতি বলছে, স্বয়ং অবলােকিতেশ্বর এ অঞ্চলে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেন। আরও দাবি করা হয়েছে, সম্রাট অশােকের এক বংশধর গন্ধার রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। রাজ্যের একটি বিভাগের নাম বিদেহ। রাজ্যের রাজধানী মিথিলা।

মোনগোষ্ঠীর থেরবাদ গ্রহণ : প্রাচীনকালে তাইল্যান্ডের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে মােনগােষ্ঠীর বাস ছিল। সি টেপ, নাকারন পতােম, পােং তুক, উ থােং প্রভৃতি স্থানে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে জানা গেছে, খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের মধ্যভাগে এখানে একটি মােন রাজ্যের উদ্ভব হয়। রাজ্যটি দ্বারবতীর রাজ্য নামে প্রসিদ্ধ। প্রত্নতত্ত্বের সাক্ষ্যে স্পষ্ট, মােন-শাসিত এই রাজ্যে থেরবাদ বৌদ্ধধর্ম সপ্রতিষ্ঠিত ছিল। রাজ্যটি স্থলপথে একদিকে ভারতবর্য এবং অপরদিকে চিনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এই স্থলপথেই তাইল্যান্ডে উত্তর ভারতীয় থেরবাদ প্রসার লাভ করে। তাছাড়া রাজধানীর দ্বারবতী নামকরণেও এই বৌদ্ধ-রাজ্যে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রসার আভাসিত হয়েছে। খ্রিস্টীয় ১১শ শতকে তাইল্যান্ডের এই মােনরাজ্যটি কামপুচিয়ার অধীনস্থ হয়।

তাইদের আগমন : মােঙ্গল সম্রাট কুবলাই খান আ. ১২৫৩ খ্রিস্টাব্দে য়ুন্নানের গন্ধার রাজ্য অধিকার করায় তাইদের ব্যাপক অভিপ্রয়াণ শুরু হয় (বহু পূর্ব থেকেই তাইরা লাওস, মায়ানমার, তাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু তাদের এই ছড়িয়ে পড়ার প্রক্রিয়াটি ছিল মৃদু ও শ্লথ। কিন্তু কুবলাই খানের হাতে পরাজয়ের ফলে এই ক্ষীণ ধারাটি যে ব্যাপকতা ও গতি লাভ করল, তা অভূতপূর্ব।)। তাদেরই এক শাখা অহােমেরা পশ্চিমদিকে অগ্রসর হয়ে অসম জয় করে। শান নামে আর একটি তাই শাখা উত্তর মায়ানমার করায়ত্ত করে। অপর একটি তাই গােষ্ঠী দক্ষিণদিকে অগ্রসর হয়ে লাওস ও তাইল্যান্ডে রাজ্য স্থাপন করে। এই গােষ্ঠীর নামানুসারে দেশের নাম হয়েছে তাইল্যান্ড।

তাই রাজাদের ভারতীয় নাম : খ্রিস্টীয় ১৩শ শতকের মধ্যভাগে তাই দলপতি কুন বং কুং কামপুচীয়দের বিতাড়িত করে। মধ্য তাইল্যান্ডে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম তাই রাজ্য স্থাপন করেন। রাজধানীর নামানুসারে এই তাই রাজ্যটি সুখােদয় নামে পরিচিত (ডি. জি. ই. হল (তদেব, পৃষ্ঠা ১৮৭) মনে করেন, প্রকৃত নামটি সুখােতাই)। রাজ্যাভিষিক্ত হয়ে ভারতীয় সংস্কৃতি-প্রভাবিত এই তাই দলপতি ইন্দ্রাদিত্য নাম ধারণ করেন। ইন্দ্রাদিত্যের পুত্র রাম কামহেঙ্গ (আ. ১২৮৩-১৩১৭ খ্রি.)। প্রাচীন তাইল্যান্ডের সর্বশ্রেষ্ঠ এই রাজার নামটি দ্বিভাষিক। নামের প্রথম পদ রামায়ণ প্রসিদ্ধ রামচন্দ্রের নামের অনুকরণ। কামহেঙ্গ একটি তাই শব্দ, অর্থ সাহসী। রাম কামহেঙ্গ এই যৌগিক শব্দের অর্থ সাহসী রাম। রাম কামহেঙ্গের পৌত্র লু তাই (আ, খ্রিস্টাব্দ ১৩৪৭-৬১)। তার অভিষেক নাম শ্রীসূর্যবংশ রাম মহাধর্মরাজাধিরাজ। এ সময় তাইল্যান্ডের আকাশে এক নতুন নক্ষত্রের উদয় হয়। তিনি প্রথমে উচ্চ মেনাং অববাহিকায় একটি রাজ্য স্থাপন করেন। এই রাজনৈতিক ভাগ্যান্বেষী আ. ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে রাজ্যাভিষিক্ত হয়ে রামাধিপতি নাম ধারণ করেন। তার ক্ষমতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়ায় তিনি সুখোদয় রাজ্যের অধিপতি লু তাইকে আনুগত্য স্বীকারে বাধ্য করেন। নবােদিত রাজ্যের রাজধানী অযােধ্যা শহরের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। রাজধানীর নামানুসারে রামাধিপতি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ অযােধ্যা রাজবংশ নামে প্রসিদ্ধ। এ সময় হতে সুখােদয় রাজ্যের সৌভাগ্যসূর্য অস্তাচলগামী হয় এবং অযােধ্যা রাজ্য তাইল্যান্ডের বৃহত্তম রাষ্ট্রশক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করে। লু তাই-এর লােকান্তরের সঙ্গে সঙ্গে সুখােদয় রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটল না, তার পুত্র ও পৌত্র দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধর্মরাজ অযােধ্যার করদ রাজারূপে ক্রমান্বয়ে রাজত্ব করেন এবং তাদের বংশধরেরা অযােধ্যার অধীনস্থ প্রাদেশিক শাসকস্তরে অবনমিত হন। অযোধ্যা রাজবংশের একাধিক রাজা রামাধিপতি এবং ইন্দ্ররাজ নাম ধারণ করেন (তাইল্যান্ডের আরও বহু রাজা ভারতীয় নাম গ্রহণ করেন। ১৩শ শতকের প্রথম ভাগের একজন রাজা সব্‌বাধিসিদ্ধি। নামটি পালি। ১৪শ শতকের এক রাজা জয়শ্রী। এমনকি ১৮শ-২০শ শতকেও তাইল্যান্ডের ৬ জন নরপতি রাম নাম ধারণ করেন। এদের সময়কাল খ্রিস্টাব্দ ১৭৮২-১৯২৫।)। 

বিভিন্ন অঞ্চলের ভারতীয় নাম : যেমন রাজাদের নামে তেমনি তাইল্যান্ডের প্রাচীন শহরগুলোর নামকরণেও ভারতীয় প্রভাব প্রতিভাত। মােন-শাসিত উত্তর-মধ্য তাইল্যান্ডের একটি প্রাচীন রাজ্য দ্বারবতী রাজ্যের রাজধানীও দ্বারবতী। খ্রিস্টীয় ১৩শ শতকের মধ্যভাগে রাজা ইন্দ্রাদিত্য যে শক্তিশালী তাই রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন তা সুখোদয় নামে পরিচিত ছিল। রাজ্যের রাজধানীও সুখােদয়। রাম কামহেঙ্গের রাজত্বকালে সুখােদয় রাজ্য শ্যাম নামেও অভিহিত হত। (ডি. জি. ই. হল (তদেব, পৃ. ১৯২) মনে করেন, প্রথম রামাধিপতিই শ্যামের প্রথম রাজা)। কালক্রমে অখণ্ড তাইল্যান্ড বােঝাতে শ্যাম শব্দ ব্যবহৃত হতে থাকে। বস্তুত দেশটির নাম তাইল্যান্ড হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সমগ্র ভূখণ্ড শ্যাম নামেই পরিচিত ছিল। রাম কামহেঙ্গ সজ্জনালয় নামে একটি নতুন শহর প্রতিষ্ঠা করেন। শহরটি ছিল সুখােদয় রাজ্যের দ্বিতীয় রাজধানী। আ. ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে রাজা প্রথম রামাধিপতি অযােধ্যা নামে একটি নগর স্থাপন করেন। শহরটির বর্তমান নাম আয়ুতিয়া। তাইল্যান্ডের আর একটি শহর শ্রীদেব। পেচবুরির নিকটবর্তী এই শহরের আধুনিক নাম সি টেপ। আর একটি শহর ধন্যপুর। শহরটির সঠিক অবস্থান অজ্ঞাত। নিম্ন মেনাং অববাহিকায় অবস্থিত একটি শহর এখনও রাজপুরী নামে পরিচিত। আর একটি প্রাচীন নগর হরিপুঞ্জয়। স্থানটির বর্তমান নাম লসপুন।

বৌদ্ধধর্ম ও ব্রাহ্মণ্যধর্ম : তাইল্যান্ড মূলত থেরবাদ বৌদ্ধধর্মের দেশ। রাম কামহেঙ্গ থেরবাদ বৌদ্ধধর্মের বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। তার রাজত্বকালে রাজধানী সুখােদয়ে বহু বৌদ্ধবিহার, আশ্রম ও বুদ্ধমূর্তি স্থাপিত হয়। রাম কামহেঙ্গের পৌত্র লু তাই বিনয়, অভিধম্মপিটক ও জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন। ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপে অধিকতর দৃষ্টি দানের উদ্দেশ্যে তিনি ১৩৬১ খ্রিস্টাব্দে রাজকার্য হতে অবসর গ্রহণ করেন এবং বৌদ্ধসংঘে যােগদান করেন। রাজপদে থাকাকালীন তিনি ১৩৪৫ খ্রিস্টাব্দে বৌদ্ধধর্মের উপর ‘ত্রৈভূমিকথা’ নামে একখানি গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থখানির তাই সংস্করণ ‘ত্রৈফুং পা রুঅং’ এখনও বিদ্যমান। শ্রীলঙ্কীয় থেরবাদ বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তারই সাদর আমন্ত্রণে জনৈক বিদগ্ধ শ্রীলঙ্কীয় ভিক্ষু তাইল্যান্ডে আগমন করেন। বৌদ্ধধর্মের মতাে অতটা না হলেও তাইল্যান্ডে ব্রাহ্মণ্যধর্মের কিছুটা জনপ্রিয়তা ছিল। এ দেশে আবিষ্কৃত শিব ও বিষ্ণুর প্রতিমা সংখ্যায় বড় কম নয়। রাজা লু তাই বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ছিলেন কিন্তু ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রতিও তিনি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। লেখ হতে জানা যায়, তিনি বহু বিষ্ণু ও শিবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথম রামাধিপতি (আ. খ্রিস্টাব্দ ১৩৫০-৬৯) যখন আইন সংকলন করেন তাতে যেমন তাই জাতির নিজস্ব ঐতিহ্য ও পরম্পরার স্বীকৃতি আছে তেমনি স্মৃতিকার মনুর বহু অনুশাসনও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

পালি ও সংস্কৃত ভাষা : পালি ভাষার গভীর অনুশীলন হত তাইলান্ডে। আশ্রমে ও বিহারে নিয়মিত বৌদ্ধগ্রন্থ পাঠ করা হত। যেহেতু তাইল্যান্ড প্রধানত থেরবাদীদের দেশ, সে কারণে অনুমান করা অসঙ্গত নয়, গ্রন্থগুলোর বেশির ভাগই ছিল পালি গ্রন্থ। পালি ভাষায় বহু লেখ উৎকীর্ণ হয়েছে। রাজাদের অনেকেই পালি ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। ব্রাহ্মণ্যধমের প্রচলন, ব্রাহ্মণ্য দেব-দেবীর মূর্তির আবিষ্কার ও লেখে মনুসংহিতার উল্লেখে প্রমাণিত হয়, তাইল্যান্ডে সংস্কৃত ভাষা অনাদৃত ছিল না। রামায়ণীকথা এ দেশে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল, রামচন্দ্রের নামে এ দেশের বহু রাজার নামকরণ হয়েছে, এ দেশের এক বিখ্যাত রাজ্যের রাজধানী অযোধ্যা নামে পরিচিতি লাভ করেছে।

ভিয়েতনামের সাথে সম্পর্ক

সম্পর্কের আদিমতম সাক্ষ্য :

  • আধুনিক ভিয়েতনাম প্রাচীনকালে চম্পা নামে পরিচিত ছিল। সুদূর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটির ভারতীয় নামকরণের মধ্য দিয়ে সে দেশে ভারতীয় সভ্যতার বিস্তারের ছবিটি সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। 
  • খ্রিস্টীয় ২য় শতকে শ্রীমার নামে জনৈক ভারতীয় ভিয়েতনামের উত্তরাঞ্চলে একটি রাজ্য স্থাপন করেন। তখন চিন দেশে হান বংশীয় রাজারা রাজত্ব করছিলেন। পূর্বতন হান শাসকদের বিতাড়িত করে শ্রীমার উত্তর ভিয়েতনামে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। এই শ্রীমারই সম্ভবত চিন ইতিবৃত্তে কিউ লিয়েন নামে উল্লিখিত হয়েছেন। 
  • প্রাচীন ভিয়েতনামের একজন শ্রেষ্ঠ রাজা ভদ্রবর্মা। তিনি ধর্মমহারাজ অভিধা ধারণ করে ছিলেন। এই রাজা জন্মসূত্রে ভারতীয় ছিলেন কিনা সে সম্পর্কে হয়তাে সন্দেহের অবকাশ আছে কিন্তু তিনি যে ভারতীয় সংস্কৃতির একান্ত অনুরাগী ছিলেন তা সুনিশ্চিত। তার নাম ও অভিধা থেকেও তার ভারত অনুরাগের পরিচয় পাওয়া যায়। অনেক প্রশাসনিক বিভাগের তিনি ভারতীয় নামকরণ করেন। তার আমলের এক প্রশাসনিক বিভাগের নাম ছিল অমরাবতী, তান্য একটির নাম ছিল বিজয়। তিনি শৈব ধর্মাবলম্বী ছিলেন। মাইসােন নামক স্থানে তিনি ভদ্রেশ্বরস্বামী নামে এক শিবমন্দির ও মন্দিরের গর্ভগৃহে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেন। ভদ্রবর্মার পাণ্ডিত্যের খ্যাতি ছিল। একটি লেখে পরিষ্কার বলা হয়েছে, চতুর্বেদ তিনি অধ্যয়ন করেছিলেন। খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতকের শেষার্ধ ও ৫ম শতকের প্রথম ভাগে তিনি রাজত্ব করেন।
  • শুধু ভদ্রবর্মা নন, প্রাচীন ভিয়েতনামের আরও অনেক রাজা ভারতীয় নাম গ্রহণ করেছিলেন। এরূপ একজন রাজার নাম শম্ভুবর্মা। তিনিও শৈব ধর্মানুরাগী ছিলেন। ভদ্রেশ্বরস্বামী মন্দিরটি অগ্নিদগ্ধ হলে তিনি নতুন করে মন্দিরটি নির্মাণ করেন। এ সময় হতে দেবতা শম্ভুভদ্রেশ্বরস্বামী নামে পরিচিতি লাভ করেন। ভারতীয় নাম ধারণ করেছিলেন, প্রাচীন ভিয়েতনামের এরূপ আর একজন রাজা, বিজয়বর্মা। তিনি খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের প্রথম ভাগে রাজত্ব করেন। 
  • ভারতীয় ধর্ম, বিশেষত শৈব ধর্ম, ভিয়েতনামে সবিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। মাইসােন ও পাে নামক দুটি স্থানে সে যুগের অনেক শৈব মন্দিরের ভগ্নাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। ভিয়েতনামে শিব রাষ্ট্রীয় দেবতারূপে পূজিত হতেন।

বিভিন্ন স্থানের সংস্কৃত নাম : বর্তমানে যে দেশ ভিয়েতনাম নামে পরিচিত প্রাচীনকালে সেই দেশের নাম ছিল চম্পা। বর্তমান বিহারের অন্তর্ভুক্ত প্রাচীন অঙ্গ জনপদের রাজধানী ছিল চম্পা। এই চম্পা থেকেই ভিয়েতনামের চম্বা নামকরণ। ভিয়েতনামের এক প্রাচীন রাজধানীর নামও চম্পা বা চম্পাপুর। তখনকার দিনে ভিয়েতনামের বহু শহর ও জনপদ সংস্কৃত নামে পরিচিত ছিল। এমনই একটি শহর ইন্দ্রপুর। রাজা দ্বিতীয় ইন্দ্রবর্মা (খ্রিস্টাব্দ ৮৫৪-৯৩) এই শহর প্রতিষ্ঠা করেন। শহরটির বর্তমান নাম ডােং ডুয়ােং। আর একটি শহর বিজয়। প্রাচীন এই শহরটির আধুনিক নাম বিন দিন। প্রাচীন ভিয়েতনামের এক বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের নাম ছিল বিজয়। সে সময়কার ভিয়েতনামের এক বিখ্যাত বন্দর শ্রীবিনয়। বীরপুর নামে এক প্রাচীন রাজধানী ছিল। স্থানটি রাজপুর নামেও পরিচিত। ছিল। ভিয়েতনামের একটি প্রাচীন শহর অমরাবতী। স্থানটির বর্তমান নাম কুয়াংনাম। 

রাজা-রাণীদের ভারতীয় নাম ও অভিধা : স্থানীয় রাজপরিবারে ভারতীয় সংস্কৃতির কী গভীর প্রভাব পড়েছিল, রাজাদের নামকরণেই তা স্পষ্টরূপে প্রতিভাত। সে সময় ভিয়েতনামে যেসব রাজা রাজত্ব করেন তাদের অনেকেই ভারতীয় নাম গ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে আছেন দেববর্মা, বিজয়বর্মা, রুদ্রবর্মা (প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ), প্রশস্তধর্ম (শম্ভুবর্মা), ভদ্রেশ্বরবর্মা, কন্দর্পধর্ম, প্রভাসধর্ম (ভাসধর্ম?), সত্যকৌশিকস্বামী, বিক্ৰান্তবর্মা (প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ), নরবাহনবর্মা, পৃথিবীন্দ্রবর্মা, সত্যবর্মা, ইন্দ্রবর্মা (প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম), জয়সিংহবর্মা (প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম), জয় ইন্দ্রবর্মা (প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ), হরিবর্মা (প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম), জয় হরিবর্মা (প্রথম ও দ্বিতীয়), ভদ্রবর্মা (প্রথম, দ্বিতীয়)। পরমেশ্বরবর্মা (প্রথম ও দ্বিতীয়), মহাবিজয়, জয় শক্তিবর্মা প্রভৃতি রাজন্যবৃন্দ। নামগুলো সবই ভারতীয় অথচ তারা কোনও ভারতীয় ভূখণ্ডে রাজত্ব করেননি, রাজত্ব করেছেন ভারত থেকে শতসহস্র যােজন দূরবর্তী ভিয়েতনামে স্বাধীন, সার্বভৌম নরপতিরূপে। রানিদেরও অনেকেরই ভারতীয় নাম। পঞ্চম ইন্দ্রবর্মার (তিনি সম্ভবত ১২৬৫ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে তারােহণ করেন) রানি গৌরেন্দ্রলক্ষ্মী, তৃতীয় জয়সিংহবর্মার (এই রাজা ১৩০৭ খ্রিস্টাব্দে পরলােকগমন করেন) রানি ভাস্করদেবী, তেহ জয়সিংহবর্মার রানি তাপসী। রাজাদের অভিধাও ভারতীয়। প্রথম হরিবর্মার (আনুমানিক হিস্টাব্দ ৮০১-২০) অভিধা রাজাধিরাজ ও পরমেশ্বর, দ্বিতীয় ইন্দ্রবর্মার (আনুমানিক খ্রিস্টাব্দ ৮৫৪-৯৩), মহারাজাধিরাজ। চতুর্থ হরিবর্মা উৎকৃষ্টরাজ উপাধিতে ভূষিত হন। আনুমানিক ৮৬০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৯৮৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভিয়েতনামে যে বংশটি রাজদণ্ড পরিচালনা করে লেখে তাকে ভৃগুবংশ বলা হয়েছে (জি, ম্যাসপেরাে (G, Maspero) এবং ডি. জি. ই. হল ভিয়েতনামের প্রাচীন রাজবংশগুলোকে অন্যভাবে বিন্যাস করেছেন। তারা এই রাজবংশাবলিকে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, এভাবে নামকরণ করেছেন। তারা সুপণ্ডিত কিন্তু সংস্কৃত ভাষায় বিশেষ অভিজ্ঞ নন)। লেখসূত্রে জানা যায়, দেবাদিদেব মহাদেবের আদেশে ভৃগু চম্পায় আগমন করেন। ভিয়েতনামের এক রাজপরিবারের সঙ্গে মহাদেব ও ভৃগুর যােগসূত্র স্থাপনের মধ্যদিয়েও সে দেশে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রসারই প্রতিফলিত হয়েছে।

সমাজজীবনে ভারতীয় প্রভাব : নিছক রাজপরিবারে বা অভিজাত মহলে নয়, ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাব পড়েছিল ভিয়েতনামের জনজীবনেও। সমকালীন লেখে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রের উল্লেখ আছে। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের উল্লেখই বেশি। অনুমিত হয়, বৈশ্য, শূদ্র ও স্থানীয় চাম গােষ্ঠীর মধ্যে বিশেষ কোনও সামাজিক প্রভেদ ছিল না। তবে সম্ভবত বৈশ্য বা বণিককুল তাদের বৈভবের দৌলতে সমাজে তুলনায় অনেক নমনীয় ছিল। বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে বিবাহ স্বাভাবিক ঘটনা বলেই গণ্য হত। সাধারণত ব্রাহ্মণ্য সমাজ-ব্যবস্থায় ব্রাহ্মণের স্থান থাকে সকলের উপরে। কিন্তু ভিয়েতনামে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের মধ্যে সামাজিক মর্যাদায় সেরূপ কোনও তারতম্য ছিল না। এই দুই বর্ণের মধ্যে বিবাহ এ দেশে খুবই প্রচলিত ছিল। শুধু বর্ণব্যবস্থা নয়, ভারতের মতাে কামপুচিয়াতেও সতীপ্রথা প্রচলিত ছিল। আনুমানিক ১০৮০ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ৪১ বৎসর বয়সে চতুর্থ হরিবর্মা লােকান্তরিত হলে তার চতুর্দশ পত্নী তার সঙ্গে মৃত্যু বরণ করে সতীধর্ম পালন করেন।

সংস্কৃত সাহিত্য : সংস্কৃত সাহিত্যের গভীর অনুশীলন হত ভিয়েতনামে। এ দেশে সংস্কৃত ভাষায় রচিত শতাধিক লেখ আবিষ্কৃত হয়েছে। ভিয়েতনামে সংস্কৃত চর্চার স্মারকরূপে লেখগুলোর গুরুত্ব অসামান্য। বেশির ভাগ লেখ রাজারাই উৎকীর্ণ করেছেন। সংস্কৃতই ছিল এ দেশের রাষ্ট্রভাষা। লেখে চতুর্বেদ, রামায়ণ, মহাভারত, ব্যাকরণ, জ্যোতিষ, মনু, নারদ, ভৃগু-স্মৃতি, বিভিন্ন পুরাণ এবং শৈব, বৈষ্ণব ও বৌদ্ধ শাস্ত্রের অজস্র উল্লেখ আছে। নিঃসংশয়ে বলা যায়, সংস্কৃত সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার চর্চা হত এ দেশে। সংস্কৃত চর্চার ক্ষেত্রে ভিয়েতনামের রাজারা অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন। তাদের অনেকেই সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। তৃতীয় ইন্দ্রবর্মা (আনুমানিক খ্রিস্টাব্দ ৯১৮-৫৯) সম্পর্কে তার নিজের এক অভিলেখে বলা হয়েছে, মীমাংসাসহ ষড়দর্শনে তিনি পারঙ্গম ছিলেন (যটতর্ক), অষ্টাধ্যায়ী ও কাশিকায় তার গভীর ব্যুৎপত্তি ছিল এবং বৌদ্ধ ও শৈবশাস্ত্রে ছিল তার সমান পারদর্শিতা। দ্বিতীয় জয় ইন্দ্রবর্মা এবং চতুর্থ হরিবর্মা মনুস্মতিতে পারদর্শী ছিলেন (তিনি প্রথমবার আনুমানিক ১০৮০ এবং দ্বিতীয়বার ১০৮৬ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরােহণ করেন)। চতুর্থ জয় ইন্দ্রবর্মা (১২শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ) ব্যাকরণ, জ্যোতিষ, মহাযান দৰনি এবং নারদীয় ও ভাব স্মৃতিতে প্রগাঢ় জ্ঞান-অর্জন করেন। পৃষ্ঠপােষক রাজাদের সম্পর্কে সভাকবিদের এ ধরনের বর্ণনায় হয়তাে অতিশয়ােক্তি আছে কিন্তু ভিয়েতনামে যে সংস্কত সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা অধীত হত, তা তাে সহজেই অনুমেয়।

ভারতীয় ধর্মের প্রভাব : প্রাচীন ভিয়েতনামের ধর্মীয় জীবনে ভারতীয় ধর্মের ছিল নিঃসপত্ন আধিপত্য –

  • শৈবধর্মের প্রভাব : শৈবধর্মের জনপ্রিয়তা ছিল সর্বাধিক। শিবই ছিলেন চম্পাপুর ও চম্পা রাজ্যের ইষ্ট দেবতা। মানবমুর্তি ও লিঙ্গ উভয় প্রতীকেই শিবপূজার প্রচলন ছিল। ভারতের মতাে এ দেশেও মূর্তি অপেক্ষা লিঙ্গপূজাই বেশি সমাদৃত ছিল। বেশির ভাগ রাজা শৈবধর্মাবলম্বী ছিলেন। তাদের বদান্যতায় বহু শিবমন্দির, শিবলিঙ্গ ও শিবপ্রতিমা প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজা প্রথম ইন্দ্রবর্মা ইন্দ্রভদ্রেশ্বর, ইন্দ্রভােগেশ্বর ও ইন্দ্ৰপরমেশ্বর নামে তিনটি শিবলিঙ্গ স্থাপন করেন (এই রাজার দু’টি তারিখ জানা যায়। একটি খ্রিস্টাব্দ ৭৯৯, অপরটি খ্রিস্টাব্দ ৮০১।)। নিজের বা স্বজনের নামে শিবলিঙ্গ স্থাপনের প্রথা ভারতে বহুকাল পূর্ব হতেই প্রচলিত ছিল। ভারতের অনুকরণে ভিয়েতনামে এই প্রথা প্রথম প্রবর্তন করেন রাজা প্রথম ভদ্রবর্মা। তখন খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতকের শেষার্ধ কিংবা পরবর্তী শতকের প্রারম্ভিক পর্ব। ভদ্রবর্মা কর্তৃক স্বনামে প্রতিষ্ঠিত ভদ্রেশ্বর শিবলিঙ্গ মাইসােনের একটি মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত ছিল। মাইসোন ছাড়া শৈবধর্মের আর একটি প্রধান কেন্দ্র পো। দুটি স্থানেই বহু শিব মন্দির নির্মিত হয়।
  • শিবপত্নী বা শিবশক্তি, কার্তিক ও গণেশ : শিবের সঙ্গে উমা, গৌরী, ভগবতী, মহাভগবতী, দেবী, মহাদেবী ইত্যাদি বিভিন্ন নামে পরিচিতা তার পত্নী বা শক্তিও পূজিতা হতেন। শিবপত্নী কখনওবা লিঙ্গস্বরূপিনী। তখন তার পরিচয় মতৃলিঙ্গেশ্বরী, কখনওবা ভূমীশ্বরী। পূজা হত কার্তিকেয় ও গণেশেরও। কার্তিকেয় সাধারণত ময়ূরবাহন। কখনও তিনি গণ্ডার-আরূঢ়। গণ্ডার-আরূঢ় কার্তিকেয়ের প্রতিমা ভারতে দেখা যায় না কিন্তু কামপুচিয়ায় এ ধরনের কার্তিকেয়-প্রতিমা বিস্তর।
  • বৈষ্ণবধর্ম, অন্যান্য দেবদেবীর পূজা, যাগযজ্ঞ ও মোক্ষলাভ : শৈবধর্মের মতাে তেমনটি না হলেও বৈষ্ণবধর্মও ভিয়েতনামে যথেষ্ট প্রসার লাভ করে। ভারতবর্ষের মতাে এ দেশেও বিষ্ণু অপেক্ষা তার অবতারদের পূজাই অধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বিষ্ণুর রাম ও কৃষ্ণ অবতারের কথা লেখে বারংবার উল্লিখিত হয়েছে, উল্লিখিত হয়েছে কৃষ্ণের গিরি গােবর্ধন উত্তোলনের কথা এবং কংস; কেশী, চানূর, অরিষ্ট ও প্রলম্বদের বিনাশের কথা। ভিয়েতনামে পূজিত অন্যান্য দেবদেবীদের মধ্যে ব্রহ্মা, ইন্দ্র, যম, চন্দ্র, সূর্য, কুবের ও সরস্বতীই প্রধান। বহু যাগ-যজ্ঞের অনুষ্ঠান হত ভিয়েতনামে। এখানকার প্রাচীন লেখে সে সবের উল্লেখ আছে। এরই পাশাপাশি ব্যক্ত হয়েছে পার্থিব জীবনের অসারতার কথা, ব্রহ্মোপলব্ধি ও মােক্ষলাভের কথা।
  • বৌদ্ধধর্ম : বৌদ্ধধর্মও ভিয়েতনামে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বৌদ্ধধর্মের একটি প্রধান কেন্দ্র ডােং ডুয়ােং দিন। এখানে আবিষ্কৃত হয়েছে এক প্রাচীন বৃহদায়তন বৌদ্ধ বিহারের নিদর্শন (ডি. জি. ই. হলের (তদেব, পৃষ্ঠা ২০২) মতে এই বৌদ্ধ বিহারের সময়কাল খ্রিস্টীয় ৯ম শতকের দ্বিতায়ার্ধ। তার মতে এটিই ভিয়েতনামে মহাযান বৌদ্ধধর্মের প্রাচীনতম নিদর্শন।), পাওয়া গেছে প্রস্তর ও ধাতুর বহু বুদ্ধমূর্তি। চিনা ইতিবৃত্ত হতে জানা যায়, ৬০৫ খ্রিস্টাব্দে এক চিনা সেনাধ্যক্ষ ভিয়েতনাম হতে ১৩৫ খণ্ড বৌদ্ধগ্রন্থ স্বদেশে নিয়ে যান। এ ঘটনায় এ দেশে বৌদ্ধধর্মের জনপ্রিয়তার আভাস পাওয়া যায়। স্থানীয় রাজাদের আনুকূল্য এ দেশে বৌদ্ধধর্ম-প্রসারের অন্যতম কারণ। পরধর্মসহিষ্ণুতা এখানকার রাজাদের একটি বড় গুণ ছিল। ব্যক্তিগত জীবনে তারা যে ধর্মেরই অনুরাগী হন না কেন অপরের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি তারা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। দ্বিতীয় ইন্দ্রবর্মা শৈব ছিলেন কিন্তু একটি মঠ ও বিহার নির্মাণ করে তিনি বৌদ্ধধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা আপন করেন।

স্থাপত্য ও ভাস্কর্যশিল্পে ভারতীয় প্রভাব : ভারতীয় প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছে প্রাচীন ভিয়েতনামের স্থাপত্য ও ভাস্কর্যশিল্পে। মাইসােন, পো, ডােং ডুয়ােং দিন-এর মতাে স্থানে জীর্ণ যে সব পুরােনাে মন্দির আজও দৃশ্যমান তাদের বেশির ভাগই শিখরশ্রেণির। মন্দিরের শিখরদেশ একটি, দুটি কিংবা তিনটি ক্রমহাসমান তলে বিন্যস্ত। প্রতিটি শিখরতল মূল মন্দিরের অনুকৃতি। এই মন্দিরগুলোর শিখরদেশে পড়েছে মহাবলিপুরমের ধর্মরাজ, গণেশ ও সহদেব রথের প্রভাব আর পাদপীঠে মূর্ত হয়ে আছে কাঞ্চীপুরম ও বাদামির স্থাপত্যরীতির ছায়া। অর্থাৎ ভিয়েতনামের প্রাচীন মন্দিরগুলোতে বিধৃত আছে দ্রাবিড় স্থাপত্যশিল্পের স্বাক্ষর। কিন্তু ভিয়েতনামের প্রাচীন স্থপতি ও ভাস্করেরা ভারতীয় শিল্পের অন্ধ অনুকরণ করেননি, তারা তাদের নিজস্ব উদ্ভাবনী শক্তিরও পরিচয় রেখে গেছেন তাদের শিল্পকলায়। স্থানীয় শিল্পীদের স্বকীয়তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েও অসংকোচে বলা যায়, অতীত ভিয়েতনামের স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের মূল উপাদান ভারতীয়, বিশেষত দ্রাবিড় শিল্পধারা থেকে উৎসারিত হয়েছে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতীয় সংস্কৃতির প্রসারের কারণ ও প্রকৃতি

ঐতিহাসিকদের পরস্পরবিরোধী অভিমত : দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতীয় সংস্কৃতির প্রসারের কারণ ও প্রকৃতি সম্পর্কে ঐতিহাসিকেরা পরস্পর-বিরােধী অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

  • রমেশচন্দ্র মজুমদারের দৃষ্টিতে এতদঞ্চলের দেশসমূহ হিন্দু উপনিবেশরূপে প্রতিভাত হয়েছে (দূর প্রাচ্যের উপর রমেশচন্দ্রের লেখা একখানি ইংরেজি গ্রন্থের নাম The Hindu Colonies In The Far East.)। তার অভিমত, অশােকের কলিঙ্গ-বিজয়, কুষাণ-আক্রমণ, সমুদ্রগুপ্তের দক্ষিণ-ভারত অভিযান প্রভৃতি রাজনৈতিক ঘটনায় বিভিন্ন সময় ভারতীয়গণ মাতৃভূমি পরিত্যাগ করে ব্যাপকভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বসতি স্থাপন করেন। ব্যবসায়-বাণিজ্য ও ধর্মপ্রচার উপলক্ষে বহু ভারতীয় সে সব দেশে গমন করেন। মূলত এই ভারতীয়দের কর্মোদ্যোগে ও স্থানীয় রাজন্যকুলের আগ্রহে এশিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তীয় দেশসমূহে হিন্দু সংস্কৃতি বিস্তার লাভ করে। কোনও কোনও বিদ্বজ্জন এই অঞ্চলকে দ্বীপময় ভারত আবার কেউবা বৃহত্তর ভারতরূপে আখ্যাত করেছেন।
  • ভারত থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ব্যাপক অভিপ্রয়াণ ঘটেছিল, এরূপ ধারণার সঙ্গে জি. সেডেস একমত নন (G. Coedes, Les Etats Hindouises d’Indochine et d’Indonesie (Paris, 1964), পৃ. ৪১-৪৪)। তিনি মনে করেন, ভারতীয় বণিকগণ বাণিজ্য-উপলক্ষে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন বন্দরে বসতি স্থাপন করেন; বণিকদের সহযাত্রী রূপে বহু পুরােহিত, ধর্মপ্রচারক ও শিক্ষিত জন সে সব দেশে গমন করেন; সুদূর প্রাচ্যে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রসারে এই ভারতীয়রা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন।
  • প্রায় একই অভিমতের প্রবক্তা এন. জে. ক্রোম (N. J. Krom)। তিনি সিদ্ধান্ত করেন, ভারতীয় বণিকদের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আগমন এবং স্থানীয় মহিলাদের সঙ্গে তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে এ সব দেশে ভারতীয় সংস্কৃতি বিস্তৃত হয়।
  • বণিকেরা নন, ক্ষত্রিয়রাই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতীয় সংস্কৃতির প্রসার ঘটান, ওলন্দাজ ঐতিহাসিক সি. সি বার্গ এরূপ মতই পােষণ করেন (C. C. Berg, De Evolutie der Javaanse Geschiedschrijving (Amsterdam, 1951))।
  • জে. সি. ভন লিউর ইন্দোনেশিয়ায় ভারতীয় সংস্কৃতির প্রসারে স্থানীয় অধিবাসীদের ভূমিকার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করেছেন (J. C. van Leur, Indonesian Trade and Society (The Hague, Bandung, 1955), পৃ. ৯২-৯৯)। তিনি মনে করেন, সামুদ্রিক ক্রিয়াকলাপে ইন্দোনেশীয় বণিকেরা ভারতীয়দের তুলনায় কোনও অংশে কম পারদর্শী ছিলেন না। বাণিজ্যিক কারণে তারাও ভারত, শ্রীলঙ্কা, চিন প্রভৃতি দেশে যাতায়াত করতেন। তার ধারণা, ভারতীয় বণিকেরা সামাজিক মর্যাদায় অনুন্নত ছিলেন; তাদের জলযানে যে নাবিকেরা কাজ করতেন, তারা ছিলেন মূলত নিগ্রো ও দাস শ্রেণিভুক্ত; এ ধরনের ব্যক্তিরা কোনও উন্নত সংস্কৃতির বার্তাবহ হতে পারেন না। তার অভিমত, ভারতীয় বণিকেরা বাণিজ্যোপলক্ষে ইন্দোনেশিয়ায় অতি সীমিতসংখ্যক লােকের সংস্পর্শে এসেছেন; স্থানীয় জনসাধারণের সঙ্গে তাদের কোনও সংযােগ ছিল না। ইন্দোনেশীয় রাজারা নিজেদের আগ্রহে অনেক ভারতীয়, বিশেষত দক্ষিণ ভারতীয়, ব্রাহ্মণকে আমন্ত্রণ করে নিজেদের রাজ্যে নিয়ে যান এবং নবাগত, আমন্ত্রিত ব্রাহ্মণদের প্রচেষ্টায় যে ধর্ম ও সংস্কৃতি প্রচারিত হয় তার আবেদন রাজ-অভিজাত পরিবারে আবদ্ধ থাকে; সে ধর্ম ও সংস্কৃতি কখনও লােকধর্ম ও লােকসংস্কৃতিতে পরিণত হয়নি।
  • এফ. ডি. কে. বস্ক মনে করেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি শুধু রাজদরবার ও ব্রাহ্মণ্য মঠেই আবদ্ধ ছিল, স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে তার কোনও যােগ ছিল না (F. D. K. Bosch এর ‘C.C. Berg and Ancient Javanese History’ প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য)। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বৌদ্ধধর্মের গুরুত্ব সম্পর্কে তিনি অবহিত কিন্তু তার বিশ্বাস এই অঞ্চলে বৌদ্ধধর্ম, সাহিত্য ও শিল্পের প্রসারে ভারতীয় ভিক্ষুদের যত না অবদান রয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেইসব স্বদেশে প্রত্যাগত দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় বৌদ্ধ শ্ৰমণদের যারা তাদের জীবনের অনেকটা সময় ভারতে অতিবাহিত করেছেন, ভারতীয় তীর্থসমূহ পরিদর্শন করেছেন, বিভিন্ন ভারতীয় বিহার ও মঠে অধ্যয়ন করেছেন। এ সব দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় বৌদ্ধভিক্ষুরা ভারতীয় সংস্কৃতির অন্ধ অনুরাগী ছিলেন না; যে সব ভারতীয় আচার ও বিশ্বাস তাদের দৃষ্টিতে সুন্দর বলে অনুভূত হয়েছে, স্বদেশি সংস্কৃতির মিশেলে তাকে আত্মীকরণ করে তার প্রসার ঘটিয়েছেন।
  • জে. সি. ভন লিউর এবং এফ. ডি, কে বস্ক-এর অভিমতই প্রতিধ্বনিত হয়েছে ডি. জি. ই. হলের কণ্ঠে। তিনি মনে করেন, ভারত থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কখনও ব্যাপক অভিপ্রয়াণ ঘটেনি, ভারতীয় বণিক ও নাবিকেরা যেমন দূরপ্রাচ্যে গিয়েছেন তেমনি সে সব দেশ থেকেও বহু শিল্পী, বণিক, তীর্থযাত্রী ও শিক্ষার্থীরা ভারতে এসেছেন; ভারতীয় শাস্ত্র, ভাষা ও শিল্পের তারা চর্চা করেছেন; যা তাদের আকৃষ্ট করেছে, তাই তারা স্বভূমে প্রবর্তন করেছেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের সঙ্গে ভারতের যেটুকু মিল তার পেছনে প্রাচীন ভারতীয়দের কোনও অবদান নেই, অবদান আছে ভারতফেরত দক্ষিণ পূর্ব এশীয়দের। তার অভিমত, এ সব দেশে ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রভাব ছিল অতি সীমিত, কেবল রাজদরবার ও অভিজাত সমাজেই তা আবদ্ধ ছিল ; ব্রাহ্মণ্যধর্ম কখনও জনসাধারণের ধর্ম হয়ে ওঠেনি। মায়ানমার, লাওস, তাইল্যান্ড, কামপুচিয়া ও ভিয়েতনামে থেরবাদ বৌদ্ধধর্ম বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে ঠিকই কিন্তু সে ধর্ম প্রধানত দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় মােন বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দ্বারাই প্রচারিত হয়েছে। এ সব থেরবাদী মােন শ্রমণেরা বহুবার শ্রীলঙ্কায় গিয়েছেন, শ্রীলঙ্কার বিহারগুলোতে অধ্যয়ন করে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন তারই আলােকে স্বদেশে থেরবাদের প্রচারে নিজেদের নিবেদিত রেখেছেন।

সমালোচনা : দেখা যাচ্ছে, সুদূর প্রাচ্যে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রসার প্রসঙ্গে বিদ্বদ্‌-সমাজে বিস্তর বাগ-বিতণ্ডা সৃষ্টি হয়েছে। রমেশচন্দ্র মজুমদার, জি. সেডেস এবং এন. জে. ক্রোম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতীয় বসতির কথা বলেছেন, ভারতীয় সংস্কৃতির বিস্তারে ভারতীয়দের প্রত্যক্ষ ভূমিকার উল্লেখ করেছেন কিন্তু জে. সি. ভন লিউর, এফ. ডি. কে, বস্ক এবং ডি. জি. ই. হল ভারতীয় সংস্কৃতির প্রসারে প্রাচীন ভারতীয়দের প্রত্যক্ষ অবদানের কথা কার্যত অস্বীকার করেছেন এবং ভারত ভ্রমণকারী দক্ষিণ-পূর্ব এশীয়দের ভূমিকার উপরই অশেষ গুরুত্ব আরােপ করেছেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, জে. সি. ভন, লিউর এবং তার অনুগামীরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বর্তমান সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির উপর তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে সুদূর প্রাচ্যের অতীত ইতিহাস বিশ্লেষণে প্রবৃত্ত হয়েছেন। অর্থাৎ ইতিহাসের ক্রমবিকাশের ধারাটি অনুসরণ না করে তারা বর্তমানের দৃষ্টিতে অতীতকে বিচার করেছেন। এটি ইতিহাস রচনার সঠিক পদ্ধতি নয়। কোনও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হলে ঐতিহাসিককে প্রথমে ঘটনার সমকালীন তথ্যরাজিকে নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিতে ও মুক্ত মনে বিশ্লেষণ করতে হয়। দুর্ভাগ্যবশত লিউর, বস্ক ও হল-এরা ইতিহাস রচনার এই স্বীকৃত পথ অনুসরণ করেননি। তারা দেখেছেন, বর্তমানে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া দুটো ঐস্লামিক রাষ্ট্রে পর্যবসিত এবং মায়ানমার, কামপুচিয়া প্রভৃতি দেশে থেরবাদ বৌদ্ধধর্ম সুপ্রতিষ্ঠিত। এই দৃষ্টিকোণ থেকেই তারা পুরাে বিষয়টিকে দেখবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু প্রাচীন যুগের কথা বলতে হলে সে যুগের তথ্য সম্ভারের প্রতি যথােচিত গুরুত্ব আরােপ করতে হয়, নয়তাে প্রকৃত চিত্র অনাবিষ্কৃতই রয়ে যায়। 

অঞ্চলের নামে অভিপ্রায়ণের আভাস : এটি একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য, ভারতীয় শহর ও জনপদের নামে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বহু শহর ও অঞ্চলের নামকরণ হয়েছে। এভাবেই এ সব দেশে গন্ধার, বিদেহ, মিথিলা, অযােধ্যা, বৈশালী, শ্রীক্ষেত্র, রামাবতী, কুশীনগর (কুশীমণ্ডল), উৎকল, চম্পা, কুরুক্ষেত্র, বিক্রমপুর প্রভৃতি নগর ও অঞ্চল নামাঙ্কিত হয়েছে। ভারতের একটি বিখ্যাত কুলপর্বতের নামে প্রাচীন কামপুচিয়ার একটি পর্বতের নাম হয়েছে মহেন্দ্র পর্বত। সাধারণত কোনও জনগােষ্ঠী দূর দেশে নতুন বসতি স্থাপন করলে তারা তাদের আদি বাসভূমি বা অঞ্চলের নামে নতুন বসতির নামকরণ করেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন শহর ও অঞ্চলের এরূপ নামকরণের পিছনে ঔপনিবেশিকদের মনে এই সদিচ্ছায় সক্রিয় ছিল। অর্থাৎ সুদূর প্রাচ্যের বিভিন্ন স্থানে যে ভারতীয় বসতি গড়ে উঠেছিল তারই প্রমাণ নিহিত আছে ভারতের কয়েকটি প্রসিদ্ধ শহর ও অঞ্চলের নামে এ সব দেশের বহু শহর ও ভূখণ্ডের নামকরণে। কেবল ভারতের প্রাচীন শহর ও জনপদের নামেই নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বহু শহর ও অঞ্চল সংস্কৃত বা পালি নামে পরিচিত ছিল। সুখােদয়, দ্বারবতী, সজ্জনালয়, ধন্যপুর, রাজপুরী, হরিপুঞ্জয়, হংসাবতী, তাম্ৰপট্টন, রামপুর, অসিতাঞ্জন, অরিমর্দনপুর, সুধর্মবতী (সুধম্মবতী), শ্রী, ইন্দ্রপুর, বিজয়, বীরপুর, রাজপুর, ভবপুর, শম্ভুপুর, ব্যাধপুর, উগ্ৰপুর, অনিন্দিতপুর, ঈশানপুর, কম্বুপুর, যশােধরপুর, মহিধরপুর, অমরেন্দ্রপুর, তাম্রপুর, আঢ্যপুর, ধ্রুবপুর, জ্যেষ্ঠপুর, হরিহরালয়, যবদ্বীপ (জাভা), সুমাত্রা প্রভৃতি নাম তাে এ সব দেশেরই কয়েকটি সুপরিচিত শহর ও জনপদের নাম! বলা বাহুল্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাব সুদূরপ্রসারিত না হলে ভারতীয় নামের প্রতি এই আকর্ষণ সঞ্চারিত হত না।

ব্রাহ্মণ্য ধর্ম কেবল রাজধর্ম ছিল না : দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহে পালি ও সংস্কৃত ভাষায় রচিত বহু লেখ আবিষ্কৃত হয়েছে। বহু লেখে ব্রাহ্মী, পল্লব ও প্রাক্‌-নাগরী লিপি ব্যবহৃত হয়েছে। আবিষ্কৃত বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীর মূর্তিও সংখ্যায় সুপ্রচুর। বােরােবুদুর বৌদ্ধস্তূপ ও অংকোর ভাট বিষ্ণু মন্দিরকে কেন্দ্র করে যথাক্রমে প্রাচীন ইন্দোনেশীয় ও কামপুচীয়দের ধর্মীয় ও সমাজ-জীবন বহু শতক ধরে আবর্তিত হয়েছিল। মায়ানমারে বােধগয়া মহাবােধি মন্দিরের অনুকরণে মন্দির-নির্মাণ, নালন্দা এবং নাগপট্টিনমে ইন্দোনেশীয় রাজাদের বিহার নির্মাণ, দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের মতাে বিদ্বজ্জনদের দীর্ঘকাল সুদূর প্রাচ্যে বৌদ্ধ শাস্ত্র অধ্যয়ন প্রভৃতি ঘটনায় ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাংস্কৃতিক নৈকট্যই প্রমাণিত হয়। একটি প্রশ্ন উঠছে : প্রাচীনকালে যে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার সঙ্গে ভারতের এই নিবিড় সংযোগ গড়ে উঠেছিল আজ সে দু’টি দেশ থেকে ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধধর্ম বিলুপ্তপ্রায় কেন? এর কারণ না বােঝার নয়। ১৫শ খ্রিস্টাব্দে এ দুটি দেশে ইসলামের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐশ্লামিক শাসকেরা তাদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সঙ্গে ইসলামের প্রসারকল্পেও সমান যত্নবান ছিলেন। আত্মরক্ষার তাগিদে শৈলেন্দ্ররাজ ১৪৭৪ খ্রিস্টাব্দে কুলধর্ম অর্থাৎ বৌদ্ধধর্ম ত্যাগ করে সপরিবার ইসলামে দীক্ষিত হন। অচিরেই ইসলামের দুর্বার স্রোতে দেশ দু’টি প্লাবিত হয় (অবশ্য মালাক্কায় হিন্দু রাজত্বের অবসান হয় আরও কিছুকাল পূর্বে। এ অঞ্চলের সর্বশেষ হিন্দু রাজা পরমেশ্বর (খ্রিস্টাব্দ ১৪০৩-২৪) পরে ইসলাম গ্রহণ করে তিনি ইস্কান্দর শাহ নামে পরিচিত হন। তার পুত্র শ্রীমহারাজ (খ্রিস্টাব্দ ১৪২৪-৪৪) ধর্মে হিন্দু ছিলেন কিন্তু তার পৌত্র রাজা ইব্রাহিম (খ্রিস্টাব্দ ১৪৪৪-৪৬) পিতামহের মতাে ইসলাম-অবলম্বী ছিলেন। কিন্তু ১৪৭৪ খ্রিস্টাব্দের পরও ইন্দোনেশিয়ার কয়েকটি অঞ্চলে হিন্দু বা বৌদ্ধ রাজ্য বর্তমান ছিল। এরূপ একটি অঞ্চল মজপহিত। এ অঞ্চলের রাজা গিরীন্দ্রবর্ধন। তার রাজত্বকাল ১৫শ শতকের শেষভাগ হতে পরবর্তী শতকের প্রথম পাদ। ১৬শ শতকের প্রথম পাদেও হিন্দু বা বৌদ্ধ রাজারা সুন্দ দ্বীপে রাজত্ব করতেন। ১৫২২-২৬ খ্রিস্টাব্দে এখানে ইসলামি রাজত্ব স্থাপিত হয়। মতরাম অঞ্চলে একটি হিন্দু বা বৌদ্ধ রাজ্য বহুদিন পর্যন্ত বিরাজমান ছিল। এখানকার সর্বশেষ হিন্দু বা বৌদ্ধ রাজা সুতবিজয় সেনাপতি (খ্রিস্টাব্দ ১৫৮২-১৬০১)।)। কিন্তু ইন্দোনেশিয়া হতে বৌদ্ধ ও হিন্দুধর্মের সম্পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটেনি। বলির বেশির ভাগ লােক আজও ধর্মে হিন্দু। প্রাচীন ইন্দোনেশিয়ায় ব্রাহ্মণ্য তথা হিন্দুধর্ম রাজন্য অভিজাত পরিবারে আবদ্ধ থাকলে আধুনিক বলি হিন্দু প্রধান অঞ্চলরূপে বিদ্যমান থাকত না। একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার বিপুলসংখ্যক অধিবাসী ইসলাম ধর্মাবলম্বী হলেও তারা এমন অনেক সামাজিক আচার ও রীতি পালন করেন যার উৎস বৌদ্ধ ও বাহ্মণ্য সংস্কৃতিতে নিহিত। আসলে তাদের সিংহভাগই তাে পূর্বে ধর্মে বৌদ্ধ ও হিন্দু ছিলেন। আধুনিক মালয়েশীয় ও ইন্দোনেশীয়দের ভাষায় এবং তাদের অনেকের নামকরণেও পালি ও সংস্কৃত শব্দ বা তাদের বিকার খুঁজে পাওয়া যাবে। মায়ানমার, তাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশে কখনও ঐশ্লামিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ফলে সেখানকার ধর্মীয় জীবন অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে। প্রাচীনকালে ব্রাহ্মণ্যধর্ম রাজদরবারেই আবদ্ধ ছিল বলে যে মত ব্যক্ত হয়েছে তা তথ্য-সমর্থিত নয়। স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের সাক্ষ্যে ব্রাহ্মণ্য তথা হিন্দুধর্মের সুবিস্তৃতিই প্রমাণিত হয়। ২০শ শতকের প্রায় মধ্যভাগ পর্যন্ত কামপুচিয়ায় দেবরাজ পূজা সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। দেবরাজ পূজা আসলে শিবজ্ঞানে রাজপূজা। যিনি রাজা তিনিই দেব। এখানে দেব শব্দের অর্থ শিব, লিঙ্গ যার প্রতীক, এটি ব্রাহ্মণ্য তথা হিন্দুধর্মের সজীবতার একটি প্রমাণ। 

সাধারণ মন্তব্য

স্পষ্ট বােঝা যাচ্ছে, প্রাচীনকালে মধ্য এশিয়া, চিন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিস্তার লাভ করেছিল। তবে তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়, চিনের তুলনায় মধ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জনজীবনে ভারতীয় সংস্কৃতি অনেক গভীর ও নিবিড় রেখাপাত করে। এর কারণ ছিল অতি প্রাচীনকাল হতে চিন দেশে এক সমুন্নত সভ্যতা বিরাজ করত কিন্তু মধ্য বা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া সভ্যতার মানদণ্ডে তেমন উন্নত ছিল না। স্বাভাবিক কারণেই ভারতীয় সংস্কৃতি শেষােক্ত দেশসমূহে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ দেয়া যায়, প্রাচীন চিনের নিজস্ব বর্ণমালা ছিল। কিন্তু ভারতীয়দের আগমনের পূর্বে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কোনও বর্ণমালার প্রচলন ছিল না। ফলে সেসব দেশে লেখার মাধ্যমরূপে ভারতীয় বর্ণমালা সহজেই প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই ভারতীয় বর্ণমালা হতেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন আধুনিক বর্ণমালার উদ্ভব হয়েছে। শুধু তাই নয়। এই একবিংশ শতকে এখানকার অধিবাসীরা যে শব্দাবলি ব্যবহার করেন তার একটি বড় অংশ সংস্কৃত শব্দ ভাণ্ডার হতে সংগৃহীত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, কী চিন, কী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, সর্বত্রই বৌদ্ধধর্মের বিজয়াভিযান অব্যাহত ছিল। যে বৌদ্ধধর্ম এসব দেশে প্রচলিত হয়, তা ছিল মহাযান বৌদ্ধধর্ম। মায়ানমারের মতাে দেশেও মহাযান মতবাদেরই প্রাধান্য ছিল। মহাযান বৌদ্ধধর্মের এই জনপ্রিয়তার মূলে ছিল তার উদার, বিশ্বজনীন আদর্শ। মায়ানমারে অবশ্য পরবর্তিকালে শ্রীলঙ্কা দেশের প্রভাবে হীনযান বৌদ্ধধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়। তৃতীয়ত, সংঘশক্তির অভাবে ব্রাহ্মণ্যধর্ম বহির্বিশ্বে বৌদ্ধধর্মের মতাে প্রচারলাভ করেনি। তা সত্ত্বেও প্রাচীন কামপুচিয়ায় ব্রাহ্মণ্যধর্মের এক বড় ভূমিকা ছিল। ইন্দোনেশিয়ার বলি দ্বীপে ব্রাহ্মণ্য তথা হিন্দুধর্ম আজও স্বমহিমায় বিরাজমান। 

গ্রন্থপঞ্জি

  • সুনীতি পাঠক, তিব্বত (কলকাতা ১৯৬০)।
  • Bagchi, P. C.: India and China (Bombay, 1950).
  • Bai Shou Yi (Ed.): An Outline History Of China (Beijing, 1982).
  • Briggs, L. P.: The Ancient Khmer Empire (Philadelphia, 1951).
  • Coedes, G. : Les Etats Hindouses d’Indochine et d’Indonesie (Paris, 1964).
  • Griswold, Alexander: Burma, Korea, Tibet (Methuen, 1964).
  • Hall, D. G. E.: A History of South-East Asia (London, 1981).
  • Leur, J. C. van: Indonesian Trade and Society (The Hague, Bandung 1955).
  • Majumdar, R. C.: Hindu Colonies in the Far East (Calcutta, 1944); Suvarna-dvipa, Parts 1 and 2 (Dacca, 1937-38); Kambujadesa (Madras, 1944); Inscriptions of Kambuja (Calcutta, 1953).
  • Majumdar, R. C. (Ed.): The Classical Age (Bombay, 1962); The Age Of Imperial Kanauj (Bombay, 1964); The Struggle For Empire (Bombay, 1966).
  • Niyogi, Puspa: Brahmanic Settlements in Different Subdivisions of Ancient Bengal (Calcutta, 1967).
  • Rawson, Philip: The Art of Southeast Asia (London, 1967).
  • Ray, N. R.: Introduction to the Study of Theravada Buddhism in Burma (Calcutta, 1946).
  • Sastri, K. A. N.: History of Srivijaya (Madras, 1949). 

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.