লালনের দর্শন বা বাউলতত্ত্ব এবং সুফিতত্ত্ব এর মধ্যে মিল ও পার্থক্য

(লেখাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে পাঠের জন্যে ইংরেজী ভাষায় “Influence of Sufism on Lalon Fakir” শিরোনামে প্রথমে লেখা হয়েছিল। পরে তা লেখক “লালনের ওপর সুফিবাদের প্রভাব” নামে অনুবাদ করেন।)

একটা জাতি হিসেবে মননশীল বিষয়সমূহে আগ্রহ ও শৈল্পিক দিকে ঝোঁক থাকলেও দর্শনের ক্ষেত্রে আমাদের বাঙ্গালিদের অবদান আবার অতি যৎসামান্য। লালন ফকির (? -১৮৯০) সেক্ষেত্রে এক বড় ব্যতিক্রম। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই লালন ফকির দার্শনিক জিজ্ঞাসার কিছু মূল মূল প্রশ্ন তুলে ধরেছিলেন—এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কীভাবে সৃষ্টি হোল? ঈশ্বর কে? আমি কে? স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির সম্পর্ক কি? অস্তিত্ববাদী ও সৃষ্টির রহস্য সংক্রান্ত এসব প্রশ্ন তোলা, এবং যেভাবে লালন সেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে চেয়েছেন, তা আমাদের সংস্কৃতির ইতিহাসে ব্যতিক্রমী। এই দার্শনিক ধারাটি অবশ্য মধ্যযুগের বাংলার বাউল-ফকিরদের সাধনার ধারার মধ্যেই নিহিত ছিল যে ধারার উপর ছিল মানবদেহকেন্দ্রিক বৌদ্ধ-তান্ত্রিক সৃষ্টিতত্ত্ব, নাথ-বৈষ্ণব সহজিয়া সাধনতত্ত্ব এবং ইসলামী সুফিবাদের সুগভীর প্রভাব। সাঙ্গীতিক এই ধারাটিতে অসংখ্য গুরুর হাজার হাজার হেঁয়ালীপূর্ণ পদ যুগে যুগে রচিত ও গীত হয়েছে। কিন্তু ওঁর অতলান্ত গভীরতা ও শৈল্পিক সূক্ষ্মতা নিয়ে লালন ফকির ছিলেন এঁদের মধ্যে সবচে প্রতিভাবান এবং সবার শীর্ষে।

এটা কৌতূহলোদ্দীপক যে সুফিবাদের জন্ম যদিও ঘটেছিল মধ্যপ্রাচ্যে, কিন্তু তা আবার বেশি বিকশিত হয়েছে মুসলিম জগতের প্রান্তস্থ দেশগুলিতে-পশ্চিম আফ্রিকায়, মধ্য এশিয়ায় এবং ভারতবর্ষে। বাংলায় প্রবেশের আগে উত্তর ভারতেই সুফিরা যোগী ও অন্যান্য তান্ত্রিক সাধকদের নিকট সাহচর্য্যে এসেছিলেন – “বিভিন্ন ভারতীয় সুফি গ্রম্নপ, বিশেষতঃ চিশতী ও সাত্তারি ঘরানার সুফিরা তাদের সাধনপ্রক্রিয়ায় যোগীদের অনেক চর্চাকে ধারণ করে নিয়েছিলেন। তবে এই সংযোগের দ্বারা সুফিদের প্রচলিত চর্চাগুলির ক্ষেত্রে কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটেনি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, হিন্দু মন্ত্রসমূহ সুফি রচনায় প্রায় অনুপস্থিত, এবং যেটুকু যা আছে, কোরানীয় উৎসের আরবী সুত্রসমূহের নীচেই তার অবস্থান। “মধুভাণ্ড” (“দি পুল অব নেকটার”) হয়তো ছিল ইসলামী ভাষাসমূহের মাধ্যমে যোগচর্চা ছড়ানোর একমাত্র গুরত্বপূর্ণ উৎস। সুফি ও যোগীরা উভয়ই অবশ্য মাঝে মাঝেই পরস্পরের সঙ্গে বোঝাপড়ার প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন।” (Situating Sufism and Yoga, Carl W. Ernest. “Journal of Royal Asiatic Society Series 3, 15:1(2005))

ফলে এটা সহজেই বোঝা যায় যে বাংলা, যা ছিল ইসলামের কেন্দ্র থেকে অনেক দূরের এক সীমান্ত, সুফিবাদ সেখানে মোটেই নির্ভেজালভাবে পৌঁছায়নি। তাছাড়া সুফিবাদের মাত্র একটাই কোনো একক ধারাও বাস্তবে কখনো ছিল না – “সপ্তদশ শতক থেকে সুফিবাদ বাংলায় একটা নতুন রূপ গ্রহণ করল এবং পরবর্তী দেড় শতকের মধ্যে বিশ্বাসে ও চর্চায় স্থানীয় ভাবধারা এত বেশি গ্রহণ করে ফেলল যে তা কেবল তার আদি কুলীন রূপ ও স্বাতন্ত্র্যই হারাল তাই নয়, তার আধ্যাত্মিক গুরুত্ব, অন্তর্নিহিত শক্তি ও অকপট চরিত্রও হারাল। এসব কিছু হারানোর ফলে বাংলায় সুফিবাদ তান্ত্রিকতা, যোগীবাদ, নাথতন্ত্র ও এই ধরণের নানা লোকজ বিশ্বাস ও সাধনচর্চায় একাত্ম হয়ে গেল।” (“Sufism in Bengal”. Enamul Haque Quoted by David G. Cashin, Introduction “Ocean of Love”, 1994)

বাংলায় সুফীবাদের প্রভাবকে বুঝতে গেলে এদেশে ইসলামের এই সমন্বয়বাদিতার প্রেক্ষাপটে সেটা বোঝাটা জরুরি। প্রসারের জন্যে সুফিবাদকে বিভিন্ন অ-ইসলামী বিশ্বাস ও সাধনচর্চার মধ্যে ঢুকতে হয়েছিল। তাছাড়া প্রথম দিককার সেই দিনগুলিতে জনপ্রিয়তা অর্জন ও তা বজায় রাখতে সুফি আউলিয়াদেরকে প্রাচীন বাংলার অনেক সাধনচর্চাকেই তাদের নিজস্ব রীতি-নীতিতে, এমন কী বিশ্বাসেরও, অনুষঙ্গ করে নিতে হয়েছিল। ১৭শ-১৮শ শতকে আমরা এই ধর্মীয় সমন্বয়বাদিতার ব্যাপক রূপটার একটা প্রকাশ দেখতে পাই বাংলার বাউল-ফকিরদের মাঝে। লালন ফকির ছিলেন এঁদের মধ্যে সবচে গুরত্বপূর্ণ। ফলে এটা স্বাভাবিক যে সমন্বয়বাদিতার এই ধারার অনেক উদাহরণই লালনের মাঝেও তাই দেখতে পাওয়া যায়।

বাংলায় সুফিবাদের প্রকাশের দেখা মেলে মূলত: দুই রূপে। এক হচ্ছে নানা তাত্ত্বিক আলোচনায়, আরেকটা রূপ বাউল-ফকির এসব মাধুকরী সঙ্গীতশিল্পীদের সংগীত ও সাধনার মাঝে। লালন ফকিরের মধ্যে এই দুই ধারাই এসে মিশেছিল। একজন সঙ্গীতসাধক হিসেবে ওঁর গান ছিল জনপ্রিয়। আবার নানা দ্ব্যর্থবোধক অর্থ, হেঁয়ালী ও রূপক নিয়ে সে সব গান আবার তত্ত্বকথাতেও ভরপুর। সুফিবাদের প্রথম দিনগুলি থেকেই এক ধরণের প্রবণতা ছিল আশ্রমভিত্তিক একটা সম্প্রদায় গড়ে তোলা। লালন ফকির যদিও মাধুকরী করতেন, তবুও কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় কালীগঙ্গা নদীর তীরে তিনি রীতিমতো নিজের একটা আশ্রমও গড়ে তুলেছিলেন। শরীয়তপন্থীদের দ্বারা সুফিদেরকে যেরকম প্রান্তে ঠেলে রাখা হো’ত তেমনি লালন ও ওঁর অনুসারীদেরকেও স্থায়ীভাবেই জাতিচ্যুত অবস্থায় থাকতে হয়েছিল। শরীয়তপন্থী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কাছে বাউল ফকিরেরা হচ্ছে বাইরের অন্ত্যজ মানুষ, এক বিপজ্জনক সম্প্রদায়, যাঁরা তাঁদের হেঁয়ালীপূর্ণ গানের মাধ্যমে কর্তৃত্বশালী ধর্মগুলির দিকে নানা অন্তর্ঘাতমূলক প্রশ্ন ছুঁড়ে এসব ধর্ম ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহকে দূর্বল করে দিতে সদা তৎপর!

মনে হয়, নিজের জীবনকাহিনীটা না বলার ব্যাপারে লালন ফকিরের দিক থেকে একটা সচেতন প্রয়াস যেন ছিল। ওঁর জীবন সম্পর্কে বিশদভাবে জানার ব্যাপারে উনি নিজেই যেন কিছুটা ধোঁয়াশা ছড়িয়ে রেখেছেন! ফলে যেটুকু যা জানা যায় তা যতটা না তথ্যনির্ভর তার চেয়ে বেশি কল্পকাহিনীতে ভরা। ফলে ওঁর গান, এবং কেবল গানগুলোর মধ্য দিয়েই, মানুষটিকে ও তাঁর ব্যক্তিসত্ত্বাকে, আমাদেরকে বুঝে নিতে হচ্ছে। গান, বাদ্যযন্ত্র ও দমের নানারকম চৰ্চা তান্ত্রিক-সহজিয়া সাধনার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এবং লালনের গানের যে নৃতাত্ত্বিক-সাঙ্গীতিক (Ethiornmusicology) ধারা, বাংলার দেহতান্ত্রিক সাধকদের সাধনার তা এক বহু সুপ্রাচীন ঐতিহ্যই। এ ধরণের হেঁয়ালিপূর্ণ গান লেখা হোত গুরুর দ্বারা শিষ্যদেরকে বিভিন্ন তত্ত্বজ্ঞান শেখানোর জন্যে। তাই এই সব গানের ছিল দ্বৈত স্তর। উপর উপর তা ভক্তিমূলক বা প্রেমের গান। কিন্তু অন্তঃসলিলে প্রবাহমান রয় এক গূঢ় সন্ধ্যাভাষা যার মাধ্যমে গুরু তাঁদের যৌনাত্মক সাধনচর্চার কথা ভক্তদেরকে শিখিয়ে থাকেন।

বাংলার কোনো কোনো অঞ্চলে “বাউল” ও “ফকির” শব্দ দুটি অনেক সময়ই সমার্থক হিসেবে ব্যবহৃত হলেও এ দুটি ধারার মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। “বাউল” শব্দটির কোনো একটিই সংজ্ঞা নেই। বাংলার ভদ্রসমাজের কাছে “বাউল” শব্দটি ইদানীং একটি সর্ববর্গীয় (generic) শব্দে পরিণত হয়েছে যা দিয়ে লোকায়ত সাধনার নানা রকম সাধকদেরই বোঝায়। এমনকী সুফি “দরবেশ” দেরও বোঝায়! অষ্টাদশ-উনিশ শতক দুটিতে, হিন্দু ধর্মের বর্ণপ্রথা ও ইসলামী ওয়াহাবী মৌলবাদীদের দ্বারা নিপীড়নের কারণে বাংলার নিম্নবর্ণের মানুষেরা তাদের নিজেদের মতো করে নানারকম সমতাধর্মী উপধর্ম গড়ে তুলেছিলেন– “কর্তাভজা”, “সাহেবধনী”, “বলরামভজা” এসব। “বাউল” ও “ফকির” এই ধারা দুটির সৃষ্টি যদিও অনেক আগে, তবুও বাংলার ইতিহাসের ওই সমন্বয়বাদিতার কালে এসব মতবাদ গ্রামাঞ্চলে প্রতিষ্ঠা পেতে থাকে এবং এই দুই ধারার মাঝের সীমান্তটা পরস্পরকে ছাপিয়ে যায়। সাধারণ মানুষদের কাছে অনেক সময়ই তাই “বাউল” ও “ফকির” এই দুই ভিন্নধর্মী ধারা একাকার হয়ে রয়েছে। বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলেই সুফিবাদের একটি ধারা দ্বারা প্রভাবিত “নাড়ার ফকির” দেরকে “বাউল” বলেই ডাকা হয়ে থাকে!

শরীয়ত-তরিকত-হকিকত-মারেফত সুফিবাদের এসব সাধনার মধ্যে মারেফতী ধারার সাধনাই, যেখানে ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাবার কথা বলা হয়েছে, বাংলার সাধকদের উপর সবচে বেশি প্রভাব ফেলেছিল বলে মনে করার কারণ রয়েছে। লালনের ভাষায় – “আলেফে আল্লাজি, মিম মানে নবি/লামের হয় দুই মানে/এক মানে হয় শরায় প্রচার/আরেক মানে মারফতে।” (আবুল আহসান চৌধুরি (সম্পা.), লালন সমগ্র,পাঠক সমাবেশ, ঢাকা, ২০০৮, পৃ. ১৪৭)।

বাংলার ফকিরেরা কখনোই শরীয়তী রীতিনীতির অনুসারী ছিলেন না। বরং মারফতী ধ্যানধারণার প্রতিষ্ঠানবিরোধী ও অন্তর্ঘাতমূলক প্রবণতাই তাঁদেরকে বেশি আকর্ষণ করেছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তাঁদের গোটা বিশ্বাসের জগতটাই ছিল শরীয়তী রীতিনীতির বিপক্ষে। লালন বলছেন – “শরাকে সরপোষ লেখা যায় বস্তু মারফত ঢাকা আছে তায় সরপোষ থুই তুলে কি দেই ফেলে লালন বস্তু- ভিখারী৷৷” (চৌধুরী, ২০০৮, পৃ. ৪২৮)।

লালনপন্থীরা হচ্ছেন বীর্য তথা বস্তুবাদের সাধক যাঁরা মানবদেহের ভেতরে বসবাসকারী “সহজ মানুষ” বা “অচিন মানুষ”-এর সন্ধানী। দেহের ভেতরে বসবাসকারী বস্তু বা ঈশ্বরকে খুঁজে পাওয়ার বাংলার বাউল-ফকিরদের যে সাধনা তার সঙ্গে সুফি সাধকদের স্রষ্টা ও সৃষ্টি, আশেক ও মাসুকের মধ্যেকার মিলনের আকাঙ্ক্ষার কিছু মিল রয়েছে। তবে ঈশ্বরের প্রতি সুফিদের ভালবাসা অনেকটাই অশরীরী ভালোবাসা। কিন্তু স্রষ্টার সঙ্গে লালনের মিলনাকাঙ্খা, অচিন মানুষকে ধরার সাধনা, এক বস্তুবাদী শারীরিক প্রক্রিয়া, এক ধরণের যৌন যোগতান্ত্রিকতার চর্চা। বাউলেরা বায়ু-সাধক। লালন-ঘরানার গুরু-শিষ্য পরম্পরার এক সাধক ও অত্যন্ত সম্মানিত একজন গুরু মহিন শাহের মতে, যে ব্যক্তি মানবদেহের মধ্যেকার বায়ুসঞ্চালনকে দমের সাধনার মাধ্যমে আয়ত্ত করে পাঁচটি স্তর “ব্যায়াম”, “অপাল”, “নাশ”, “কুম্ভ” ও “মোক্ষ অতিক্রম করতে পেরেছেন, তিনিই বাউল। এই পর্যন্ত হয়তো নাথ-তান্ত্রিক যোগসাধনা। কিন্তু এর পরে মহিন শাহ যোগ করেন যে, যে ব্যক্তি চার পেয়ালা “ফানা” অর্জন করেছেন, তিনিই বাউল। (তানভীর মোকাম্মেলের নেয়া সাক্ষাৎকার)। এখানে “ফানা” শব্দটির ব্যবহার এবং লালনের গানে “মোকাম”, “লতিফা”, “রাববানা”, “পাঞ্জাতন” এসব সুফি পদের ব্যাপক ব্যবহার তুলে ধরে যে লালন ও ওঁর শিষ্যরা সুফিমতের তর্ক-বিতর্কগুলির সঙ্গে ভালোভাবেই পরিচিত ছিলেন এবং সুফী পদগুলির এরকম ব্যাপক ব্যবহার লালন-অনুসারীদের মাঝে নানা প্রক্রিয়ায় সুফিবাদ ও নাথ সহজিয়া সাধনচর্চার সংমিশ্রিত হওয়ারই নানা উদাহরণ।

যদিও লালন ফকিরের গান আজকের বাংলার বাউলদের গানের এক বড় অংশ, তবে লালন কিন্তু নিজেকে “বাউল” বলতেন না। বলেছেন “লালন ফকির”। ছেঁউড়িয়ার লালন-ঘরানার একজন শ্রদ্ধেয় গুরু ফকির আবদুল গণি বাদের শাহ আমাকে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন যে তাঁরা “বাউল” নন–“ফকির”। (তানভীর মোকাম্মেলের বাদের শাহ এর কাছ থেকে নেয়া সাক্ষাৎকার)। লালনের মতে “ফকির” হচ্ছেন তাঁরা যাদের দর্শন হচ্ছে – “ডানে বেদ বামে কোরান মাঝখানে ফকিরের বয়ান। (চৌধুরী, ২০০৮, পৃ. ২০৩)।

লালন কখনোই শাস্ত্রীয় কোনো গোঁড়ামিতে এবং ইসলামী বিশ্বাসের এই মূল ধারণাটিতে বিশ্বাসী ছিলেন না যে পবিত্র ধর্মগ্রন্থসমূহ ঈশ্বরপ্রেরিত ছিল। তিনি বলছেন – “কী কালাম পাঠালেন আমার সাঁই দয়াময়/এক এক দেশে এক এক বাণী কয় খোদায় পাঠায়।/যদি একই খোদার হয় রচনা/তাতে তো ভিন্ন থাকে না/মানুষের সকল রচনা তাইতে ভিন্ন হয়।” (চৌধুরী, ২০০৮, পৃ. ২৩৮)

বাঙ্গালি মধ্যবিত্ত ভদ্রসমাজ লালন ও তার অনুসারীদের যেরকম “বায়বীয় বাউল” হিসেবে নির্মাণ করে নিয়েছে বা দেখতে পছন্দ করে থাকে, লালন ও ওঁর অনুসারীরা কখনোই তেমনটি ছিলেন না। লালন ও ওঁর অনুসারীরা ছিলেন “বর্তমানপন্থী”, দৃঢ়ভাবে বস্তুবাদী ও বর্তমান বাস্তবজীবনের সপক্ষে। যা “অনুমানপন্থা”, বা অদেখা আধ্যাত্মিক জগত, তা থেকে একেবারেই বিপরীত ছিল ওঁদের এই অবস্থান। লালন গাইছেন – “সহজ মানুষ ভজে দেখ না রে মন দিব্যজ্ঞানে/ পাবি রে অমূল্যনিধি বর্তমানে/ ভজ মানুষের চরণ দুটি/ নিত্য বস্তু পাবে খাঁটি মরিলে হবে সকল মাটি ত্বরায় এই ভেদ লও জেনে॥/ মলে পার বেহেস্তখানা/ তা শুনে তো মন মানে না/বাকীর লোভে নগদ পাওনা/ কে ছাড়ে এই ভুবনে।” (চৌধুরী, ২০০৮, পৃ. ৬৬৬)

লালন ও বাউল-ফকিরেরা ছিলেন মুক্তচিন্তার মানুষ। তাঁদের জন্যে দেহ ও আত্মার স্বাধীনতা ছিল সবচে গুরুত্বপূর্ণ। লালন বলছেন – “ফকিরী করবি ক্ষ্যাপা কোন্ রাগে আছে হিন্দু মুসলমান দুই ভাগে৷/ ভেস্তের আশায় মমিনগণ/ হিন্দুরা দেয় স্বর্গেতে মন/ ভেস্ত-স্বর্গ ফাটক সমান কার বা তাতে ভাল লাগে৷৷” (চৌধুরী, ২০০৮, পৃ. ৪৮০)।

তাঁদের সংবেদনশীল মন ও অশাস্ত্রীয় সাধনচর্চার কারণে সুফিদের প্রেমময় আধ্যাত্মিক ধ্যান-ধারণার প্রতি বাউল-ফকিরেরা সহজেই আকর্ষিত হয়েছেন। সঙ্গীতের প্রতি তাঁদের তীব্র আকর্ষণ এবং অদেখা এক ঈশ্বর, লালনের ভাষায় যা “অচিন মানুষ” বা “সহজ মানুষ”, তাঁর সঙ্গে মিলনের আগ্রহটাকে সুফিবাদ অনেকটাই পূরণ করতে পেরেছিল। লালনের সৃষ্টিতত্ত্ব অনুযায়ী ঈশ্বরের নিজস্ব কোনো ঘর ছিল না। তাই তিনি ভালবেসে এই মানবদেহকে সৃষ্টি করেছেন। মানবদেহটাকেই তিনি তাঁর নিজের আবাস হিসেবে বেছে নিয়েছেন এবং এক অদৃশ্য “অচিন মানুষ”, “মনের মানুষ” বা “সহজ মানুষ” রূপে মানবদেহে বসত গেড়েছেন। তাই কেউ যদি মানুষকে পূজা করে তাহলে সে ঈশ্বরকেই পূজা করছে – “ভবে মানুষ-গুরু নিষ্ঠা যার/ সর্বসাধন সিদ্ধ হয় তার।/ নদী কিম্বা বিল বাওড় খাল/ সর্বস্থলে একই সে জল/ একা মেরে সাঁই, ফেরে সর্ব ঠাঁই/ মানুষ মিশে হয় বেদান্তর।।/ নিরাকারে জ্যোতির্ময় হয় যে/ আকার সাকার হইল সে/ যেজন দিব্যজ্ঞানী হয়, সেহি জানতে পায়/ কলি যুগে হো’ল মানুষ অবতার॥” (চৌধুরী, ২০০৮, পৃ. ৫১৯)

অদৃশ্য ও ছলনাময় সেই স্রষ্টাকে, সেই “অচিন মানুষ” যে মানবদেহের মাঝে লুকিয়ে রয়েছে, তাঁকে খুঁজে পাওয়াই হয়ে ওঠে লালনের সাধনা – “কে কথা কয় রে দেখা দেয় না।/ নড়ে চড়ে হাতের কাছে/ খুঁজলে জনমভর মেলে না।।/ খুঁজি যারে আসমান জমি/ আমারে চিনিনে আমি/ এ বিষম ভোলে ভ্রমি/ আমি কোনজন সে কোনজনা।।” (চৌধুরী, ২০০৮, পৃ. ২৬০)

ক্রমশ: লালন উপলব্ধি করেন – “ক্ষ্যাপা না জেনে তোর আপন খবর যাবি কোথায়/ আপন ঘরে না খুঁজিয়ে বাইরে খুঁজলে পড়বি ধোঁকায়৷/ আমি সত্য না হলে গুরু সত্য কোন্ কালে/ আমি যেরূপ দেখ না সেরূপ/ দীন দয়াময় দীন দয়াময় ॥” (ফকির মহিন শাহর কণ্ঠশ্রুত গান)

মানবদেহকে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের ক্ষুদ্র রূপ হিসেবে দেখা, “যা আছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে তা আছে দেহভাণ্ডে”- এই অদ্বৈতবাদী দর্শন, বাংলার আধ্যাত্মিক সাধকদের মাঝে এদেশে সুফিবাদের আগমনের অনেক আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এই বিশ্বাসটি বাংলার দেহকেন্দ্রিক সাধকদের মাঝে বহমান ছিল, যা ছিল বৌদ্ধ তান্ত্রিকতা এবং নাথ-যোগীদের নানা সাধনচর্চা ও চৈতন্য-পরবর্তী বৈষ্ণব সহজিয়া সাধনার, এক দার্শনিক উত্তরাধিকার।

নিজেকে জানা, যা প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্র অনুযায়ী সবচে সেরা জ্ঞান, এই আত্মজ্ঞান দেখছি লালনের কাছেও ছিল সবচে গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান – “আপনার আপনি ফানা হলে সকল জানা যাবে।/ কোন রূপে হলে ফানা সে ভেদ জানতে পাবে।/ আরবিতে বলে আল্লা/ পারসিতে বলে খোদাতালা/ গড় বলছে যিশুর চেলা/ ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভাবে।/ আপনার আপনি হলে ফানা/ দেখা দেবেন সাঁই রববানা।” (চৌধুরী, ২০০৮, পৃ. ১১৩)

অদৃশ্য এই ঈশ্বরের নানা অবতার ও লীলার নানা রূপের মাঝে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে মানব-অবতার – “অধরচাঁদের যতই খেলা/ সর্ব-উত্তম নরলীলা।”(চৌধুরী, ২০০৮, পৃ. ৫৭১)

অধরা ও অদৃশ্য এই ঈশ্বর মানবদেহের মাঝে লুকিয়ে থাকেন। লালনের সাধনাটা হচ্ছে এই অদৃশ্য “অচিন মানুষ”-কে মানবদেহ থেকে ধরা। এবং সে কাজে মানবদেহটা হচ্ছে এক ক্রীড়াক্ষেত্র – “শুদ্ধ প্রেম রসিক বিনে কে তারে পায়।/ যার নাম আলেক মানুষ আলেকে রয়।।/ রসিক রস অনুসারে/ নিগূঢ় ভেদ জানতে পারে/ রতিতে মতি ঝরে/ মূলখণ্ডহয়।” (চৌধুরী, ২০০৮, পৃ. ৬৪১)

মানবদেহ ও ঈশ্বরের এই অদ্বৈততার দর্শন লালনের গানে ছড়িয়ে রয়েছে প্রায় সর্বব্যাপী – “আল্লা কে বোঝে তোমার অপার লীলে/ আপনি আল্লা ডাক আল্লা বলে” (চৌধুরী, ২০০৮, পৃ. ১৪৯)

তবে ঈশ্বরের আবাস এই মানবদেহ কেবল একটা ক্রীড়াক্ষেত্র নয়, এটা নিজেই পরিণত হয় চূড়ান্ত এক অন্বেষাতেও। লালনের কাছে তাই দেখি মানবদেহটাই হয়ে উঠছে মূল মক্কা। এধরণের পরম অদ্বৈতবাদী দৃষ্টিভঙ্গী চৈতন্য পরবর্তী বৈষ্ণবদের মাঝেও ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল – “হরি কে দেখিয়া হরি হরিতে লুকায়।” তবে একত্ববাদের এই বিশ্বাসকে সুফিবাদের আশেক-মাসুকের বিশ্বাস হিসেবেও ব্যাখ্যা দেয়া যেতে পারে। লালন ফকির বিশ্বাস করেন – “বরাতে করিল সৃষ্টি/ তাই নিয়ে লেখাজোখা/ পাবে সামান্যে কী তার দেখা/ নিরাকার ব্রহ্মা হয় সে/ সদাই ফেরে চিন দেশে/ দোসর নেই সে একা একা।” (ফকির মহিন শাহর কণ্ঠশ্রুত লালনের গান)

ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও গোটা সৃষ্টি রহস্যটাই বস্তু-ভিখারী লালনের কাছে এসে তাই দাঁড়াচ্ছে – “ত্রিপিনের ত্রি-ধারে/ মীনরূপে সাঁই বিরাজ করে।” (চৌধুরী, ২০০৮, পৃ. ১৩৩)

এই যে স্রষ্টাকে মৎস্য প্রতীক হিসেবে দেখা, ভারতীয় যোগীদের মধ্যে এই বিশ্বাসটির প্রচলন অনেক পুরনো হলেও সুফিদের আনীত হযরত ইউনুসের কাহিনীর কথাও তা স্মরণ করায় যে হযরত ইউনুস মাছের পেটে ছিলেন। সঠিক সময়ে অধরা ওই “মৎস্য” টিকে ধরতে প্রয়োজন বাঁধ নির্মাণ – “জগৎ জোড়া মীন অবতার/ কারণ্য বারির মাঝার/ বুঝে কালাকাল বাঁধিলে বান্ধাল/ অনায়াসে সে মীন ধরতে পারে।”(ফকির মহিন শাহর কণ্ঠশ্রুত লালনের গান)।

লালনের সাধনরীতি অনুসারে সাতটি তালা ভেঙ্গে ঈশ্বরের বারামখানা সেই বায়ুঘরে প্রবেশ করতে হবে। ওই অতি মহার্ঘ্য বায়ুঘরে অবশেষে সেই “অধরা মানুষ”-কে পাওয়া ও ধরা যায়। ওই “অচিন মানুষ” মানুষের শরীরের দ্বি-দলে বসত করে। ইরা, পিঙ্গলা, সুষুম্না এসব শিরা তাঁকে ঘিরে রাখে। তাঁকে ধরার জন্যে সুপ্ত কুলকুণ্ডুলিনী শক্তিকে জাগ্রত করতে হয়। এসবই দেহতান্ত্রিক যৌন সাধনক্রিয়ার অংশ। কিন্তু কাজটা মোটেই সহজ নয়। তাই ওই লুক্কায়িত অদৃশ্য স্রষ্টাকে, অথবা “অচিন পাখী”-টিকে, খুঁজতে লালনের পরামর্শ – “চাতক যেমন মেঘের জল বিনে/ দিবানিশি চেয়ে থাকে মেঘ ধিয়ানে।” (ফকির বাদের শাহর কণ্ঠশ্রুত লালনের গান)।

প্রকৃত সাধকও তেমনি সেই বিশেষ মুহূর্ত, সেই মাহেন্দ্রক্ষণের, অপেক্ষায় থাকে। আর সেই বিশেষ শুভক্ষণটি হচ্ছে বাউলের সাধনসঙ্গিনীর ঋতুচক্রের বিশেষ এক সময়কাল – “সে চাঁদ লক্ষ যোজন ফাঁকে রয়/ হীরা-মোতি-জোহরা কোটিময়/ ঊনকোটি দেবতা সঙ্গে আছে গাঁথা/ ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব-নারায়ণ জয় জয় জয়/ সে চাঁদ পাতালে/ উদয় ভূ-মণ্ডলে/ সে চাঁদ মাহেন্দ্ৰ যোগে দেখা দেয়।” (ফকির বলাই শাহর কণ্ঠশ্রুত গান)

সেই দূর্লভ মাহেন্দ্রক্ষণটি না হারানোর জন্যে লালন তাঁর শিষ্যদেরকে সতর্ক করে দিচ্ছেন। সময়কালটি তাই খুব গুরুত্বপূর্ণ – “সময় গেলে সাধন হবে না।/ দিন থাকতে দিনের সাধন কেন করলে না।।/ জান না মন খালে বিলে/ মীন থাকে না জল শুকালে/ কী হয় তার বাঁধাল দিলে/ শুকনা মোহনায়।।/ অসময় কৃষি করে/ মিছামিছি খেটে মরে/ গাছ যদি হয় বীজের জোরে/ ফল তো ধরে না।।/ অমাবস্যায় পূর্ণিমা হয়/ মহাযোগে সেদিন উদয়/ লালন বলে তাহার সময়/ দণ্ডও রয় না।” (চৌধুরী, ২০০৮, পৃ. ৬৬২)

নারী সাধনসঙ্গিনীর ঋতুকালীন সময়ের এক বিশেষ ক্ষণে পুরুষ সাধক তার লিঙ্গ দিয়ে সে বিন্দুকে শোষণ করে “সোনার মানুষ”-কে রার চেষ্টা করবে এবং তা হলেই সে পাবে তেজোদীপ্ত মানবদেহ, এমন কী-অমরত্বও। তাই যৌনমিলন শুধু দৈহিক কামনা মেটানোর জন্যে নয়। যৌন-সাধনার লক্ষ্য “সোনার মানুষ” বা “অচিন মানুষ” কে ধরা। আর তা অর্জনে যৌনমিলনের সময় শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণটা খুবই জরুরী। বিশেষ করে, বীর্য্যপাতকে নিয়ন্ত্রণ করা। সে কারণেই লালনপন্থী সাধক উর্ধ্বরতির চর্চা করে থাকে; “শোসায় শোষে না ছাড়ে বাণ/ঘোর তুফানে বায় তরী উজান/ ও তার কামনদীতে চর পড়েছে/ প্রেমনদীতে জল পোরা।।” (চৌধুরী, ২০০৮, পৃ. ৩৬৮)। সুযোগ্য সাধক তাই বাণ ছাড়ে না। বীৰ্য্যকে যতটা সময় সম্ভব ধরে রাখতে চায়।

এই গূঢ় যৌনচর্চার সাধনায় পুরুষাঙ্গের উপর নিয়ন্ত্রণ অথবা বীর্য্যপাত না ঘটিয়ে রতিকে ধারণ করতে পারাটাই হচ্ছে সবচে বড় লক্ষ্য। যোনীর ত্রিবেণীসঙ্গমের পিছল ঘাট এড়ানো চাই। কেবলমাত্র একজন গুরু বা মুরশিদই যে করণের আগম-নিগম বা রীতিনীতিটা জানেন এবং শিষ্যদের সেভাবেই উপদেশ দিতে পারেন। লালন তাই তাঁর শিষ্যদের অম্বুবাচীর রীতি মেনে যৌন সংসর্গ করার পরামর্শ দিয়েছেন। ফলে লালনের গানে যে সাধনচর্চা তার মূলে বায়বীয় আধ্যাত্মিক কোনো বিষয় নেই, রয়েছে বীর্য্য, বাউল-ফকিরদের ভাষায় যা “বস্তু”, তা সংরক্ষণ করা। লালন ফকির ও তাঁর অনুসারী বাউল-ফকিরেরা তাই যথার্থ অর্থেই ছিলেন– “বস্তুবাদী”। কেউ লালন ফকিরদের এই বিশ্বাস বা চর্চার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই পারেন। তবে সৃষ্টিতত্ত্বের এই দেহকেন্দ্রিক সাধনা, এই “চারি চন্দ্র” বা “পঞ্চম রস”-য়ের ধারণাটি, তান্ত্রিক সাধনার সুপ্রাচীন এক ধারা হিসেবে সেই নাথ-তান্ত্রিকদের কাল থেকেই গ্রামবাংলার এক ধারার সাধকদের মধ্যে নিরবচ্ছিন্নভাবে বয়ে চলে এসেছে।

সুফিবাদের একটা উপাদান হচ্ছে “প্রেমে উন্মত্ত হওয়া”, অর্থাৎ আল্লাহ ও তাঁর স্রষ্টাদের মাঝে নিষ্কাম কিন্তু চরম ভাবাবেগপূর্ণ এক প্রেম। কিন্তু বাউলদের পুরুষ ও প্রকৃতি তথা পুরুষ ও নারীর যৌনসাধনা আদৌ নিষ্কাম কোনো বিষয় নয় বরং এক বিশেষ ধরণের যৌনতার চর্চা। বস্তু বীর্য ও ঋতুরক্তই লালনপন্থীদের কাছে প্রধান বিষয়। সাধকদের কাছে এসব বস্তুর সারকে বুঝতে পারাটা তাই খুবই জরুরি। সাধনার লক্ষ্য থাকে তাই ঊর্ধ্বরতি বা দমকে রক্ষা করা; ““দমের সঙ্গে কর মিলন/ আজব খবর জানবি রে মন।”(চৌধুরী, ২০০৮, পৃ. ২০৯)। লালনের মতে “টলে জীব অটলে ঈশ্বর।”(চৌধুরী, ২০০৮, পৃ. ৬৮২)। বীর্য্যরক্ষায় ঈশ্বরের মতো অটলতা অর্জনে দমের সাধনা তাই হয়ে পড়ে সবচে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; “কামের ঘরে কপাট মেরে উজান মুখে চালাও রস/ দমের ঘর বন্ধ রেখে যমরাজারে কর বশ৷৷” (চৌধুরী, ২০০৮, পৃ. ২১৬)। ফলে কাম মূল লক্ষ্য নয়। লালনের কাছে তবু কামের প্রয়োজন কারণ তা হচ্ছে প্রেমের ভিত্তি “বলবো কি সে প্রেমের কথা কাম হয়েছে প্রেমের লতা কামছাড়া প্রেম যথাতথা নয় সে আগমন॥” (চৌধুরী, ২০০৮, পৃ. ২২২)।

সাধনার চরম লক্ষ্যটা তাই ঠিক দৈহিক কামজ লালসা নয়, অনুভূতির একটা উন্নততর স্তরে পৌঁছানো। “কাম থেকে নিষ্কামী” (চৌধুরী, ২০০৮, পৃ. ২৮৮) হওয়া। আর উন্নততর সে স্তরটা হচ্ছে প্রেম। ভয়ঙ্কর ঝড়-তুফানের বিপক্ষে সাধক তার নৌকা বেয়ে যায়। তার কামনদী শুকিয়ে যায় কিন্তু প্রেম নদী রসে ভরে ওঠে। লালনের কাছে, কামজ থেকে কামহীন হওয়া, স্থূল যৌনকামনা থেকে আনন্দময় প্রেমের অনুভূতির স্তরে পৌঁছানোই হচ্ছে সাধনার চরম লক্ষ্য। অন্যথায় সারা জীবন মদনরাজার দাসত্ব করেই জীবন কেটে যাবে। লালন বলছেন; “আগে কপাট মার কামের ঘরে/ মানুষ ঝলক দেবে রূপ নিহারে।। হাওয়া ধর অগ্নি স্থির কর/ যাতে মরিয়ে বাঁচিতে পার/ মরণের আগে মর/ শমন যাক ফিরে।/ বারে বারে করি মানা/ লীলার দেশে বাস কোর না/ রেখ তেজের তেজিয়ানা/ ঊর্ধ্ব চাঁদ ধরে।।” (চৌধুরী, ২০০৮, পৃ. ৮৩) এ এক নিগূঢ় আত্মসন্ধানী শিক্ষাপদ্ধতি। সাধনায় ব্রতী হয়ে ভেক-খিলাফত অর্জনের মাধ্যমেই কেবল একজন শিষ্য তার গুরু বা মুরশিদের কাছ থেকে সাধনচর্চার এই গোপন বিষয়গুলি পুরো শিখতে পারে

পশ্চিম এশিয়ার সুফিবাদ ও লালন ফকিরের জীবনদর্শনের এক বড় পার্থক্য হচ্ছে সাধনার ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা। নারী বিষয়ে লালনের বিশ্বাস নারী হচ্ছে প্রকৃতির অংশবিশেষ এবং নারী পুরুষের চেয়ে বেশি সম্পূর্ণ। ফলে নারী পুরুষের চেয়ে উন্নত এবং নারীকে সম্মান করতে হবে কারণ নারী হচ্ছে “চেতনগুরু” নারী সাধনসঙ্গিনীকে ছাড়া “সহজ মানুষ” ধরার পুরুষের সাধনা একেবারেই অসম্ভব। তাই প্রয়োজন যুগলসাধনা। লালনের গানে তাই পাই “আছে আদি মক্কা এই মানবদেহে/ দেখ না রে মন ভেয়ে॥/ করে অতি আজব ভাক্কা/ গঠেছে সাঁই মানুষ-মক্কা/ কুদরতি নূর দিয়ে/ লালন বলে সেই গুপ্ত মক্কায়/ আদি ইমাম মেয়ে।” লালন আরো গাইছেন; “মায়েরে ভজিলে হয় সে বাপের ঠিকানা/ নিগম বিচারে সত্য গেল তাই জানা।/ ডিম্বু মধ্যে কেবা ছিল/ বের হয়ে কারে দেখিল/ লালন কয় সে ভেদ যে পেলো/ ঘুচলো দিনকানা॥” (চৌধুরী, ২০০৮, পৃ. ৫৭৭)। একটা কৃষিভিত্তিক সমাজের উর্বরা-বন্দনার আদিম মাতৃমূর্তির চিত্রকল্পই যেন ফিরে আসছে এসব গানে যার সঙ্গে সুফিবাদ তথা আরবীয় ইসলাম ধর্মের তেমন কোনোই সম্পর্ক নেই।

এক দিকে তিনি বলছেন সন্তান জন্ম না দিতে কারণ তা আত্মাকে খণ্ডিত করে, যে বিশ্বাসটি ফকিরী ঐতিহ্যের এক মূল বিশ্বাস। আবার মাতৃত্বকেও লালন এতটাই গৌরবান্বিত করেছেন যে মায়ের স্থান বলছেন খোদার পরেই, এমনকী নবীর উপরেও; “আছে দিন দুনিয়ায় অচিন মানুষ একজনা/ কেউ তারে চিনেছে দড়/ খোদার ছোট নবীর বড়/ লালন বলে নড়চড়/ সে নইলে কূল পাবা না।” (চৌধুরী, ২০০৮, পৃ. ৮৮)। আর লালন-ঘরানার অন্যতম প্রধান ফকির, ফকির মহিন শাহ্ এর মতে সেই “অচিন মানুষ”-টি হচ্ছে-মা। লালনপন্থী ফকিরদের কাছে মাতৃত্ব তাই সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, এমন কী, মহীয়ান কিছু।

লালন ফকিরের ধ্যান-ধারণার মূল যে বিষয়টি, নারী-পুরুষদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক বিশেষ ধরণের যৌন সাধনপ্রক্রিয়া, তাকে সুফিদের আশেক-মাসুকের স্বর্গীয় প্রেম অথবা বৈষ্ণবদের রাধা-কৃষ্ণের পুরাণের সঙ্গে মেলানো কঠিন। বাংলার এই ধরণের যৌন সাধনপ্রক্রিয়ার একটা শক্তিশালী লোকজ ভিত্তি রয়েছে এবং তা সুফিবাদ বা অন্য কিছুর চেয়ে বরং গ্রামবাংলার প্রাচীন নাথ-সহজিয়া-তান্ত্রিক সাধনারই এক ধারাবাহিকতা

সুফি মতবাদের এক ধরণের দ্বান্দ্বিকতা রয়েছে। তা হচ্ছে, স্রষ্টা ও সৃষ্টি এই দুই বিচ্ছিন্ন সত্ত্বা যখন মিলিত হয়, তখন ব্যক্তি যে কেবল পরিপূর্ণতা পায় তা নয়, সে মানুষের সাধারণ শারীরিক সীমাবদ্ধতাগুলিরও উর্ধ্বে উঠে যায়। একই ভাবে, লালনের বিশ্বাসের জগতেও দেখি সাধকের সঙ্গে যখন “অচিন মানুষ”-য়ের মিলন ঘটে, তখন সাধক মানুষটি পরিণত হয় “মানুষরতন”-য়ে। এক উন্নততর মানবসত্ত্বায়। লালন বিশ্বাস করেছেন একজন মানুষ শুধু সাধারণ মানুষ নয়, প্রতিটি মানুষই “মানুষরতন” হওয়ার সম্ভাবনাময়—”এই মানুষে আছে রে মন যারে বলে মানুষরতন”। (চৌধুরী, ২০০৮, পৃ. ৩৩২) বাউলের সাধনা এই “মানুষরতন” হয়ে ওঠার সাধনা। সাধকের লক্ষ্য থাকে তাই কেবল ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানো নয়, নিজেই একজন মানুষরতন হয়ে ওঠার; “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি/ দ্বিদলের মৃণালে/ সোনার মানুষ উজলে/ মানুষ-গুরু নিষ্ঠা হলে/ তবে জানতে পাবি।” (চৌধুরী, ২০০৮, পৃ. ৫৭৪)

যেহেতু “অচিন মানুষ” মানবদেহের ভেতরে বাস করে ফলে প্রতিটা মানুষের ভেতরেই মানুষরতনও বিরাজমান। সে কারণেই লালন ও ওঁর অনুসারীদের কাছে মানবদেহের কোনো কিছুই অপবিত্র নয় এবং সে বিশ্বাসটি এতটাই চরমে যে মানবদেহের চার বর্জ্য বীর্য্য, ঋতুস্রাবের রক্ত, মুত্র ও মল, পান বা খাওয়া চলে। এসব চর্চা হচ্ছে একান্তই এদেশের প্রাচীন দেহকেন্দ্রিক যোগতান্ত্রিকতা যার সঙ্গে পারস্যের সুফিবাদের কোনোই সম্পর্ক নেই।

মানবদেহকেন্দ্রিক লালনের এই মানবতাবাদ, মানুষকে সব কিছুর কেন্দ্রে উপস্থিত রেখে এই যে সাধনা, এটা ইউরোপীয় রেনেসাঁ থেকেও আসেনি। দেশজ মানবতাবাদের এই দর্শনটি একান্তভাবেই সৃষ্ট, ধারিত ও প্রচারিত হয়েছে বাংলার দেহকেন্দ্রিক মানবতাবাদী সাধকদের দ্বারা, লালন ফকিরের অবস্থান যাঁদের শীর্ষে। কিন্তু শিল্পী ও মানবতাবাদী যে লালন, তার জন্যে সাধনার লক্ষ্যটা ছিল – প্রেম। শরীরী কামনাকে জয় করে প্রেমের স্তরে পৌঁছানো। তাই নারীর সঙ্গে মিলনে বীর্যপাতের চেয়ে ঊর্ধ্বরতির সাধনাটা লালনের সাধন প্রক্রিয়ায় এত জরুরি। ভোগে নয়, মুক্তি প্রেমে।

যেহেতু অধরা মানুষকে ধরা সহজ নয়, সহজ নয় “মানুষরতন” হতে পারা, তাই প্রকৃত সাধক হতে হলে একজনকে সকল জাগতিক কামনা-বাসনা ত্যাগ করতে হয়, হতে হয়—“জ্যান্তে-মরা”। আর তার জন্যে প্রয়োজন পরম দীক্ষা—ভেক-খিলাফত। জাগতিক কামনা-বাসনা ত্যাগ করে জীবিত মানুষের দেহে মৃত মানুষের পোশাক পরা। সে কারণেই লালন-অনুসারী ফকিরদের কাপড়ের রংটা মৃত মানুষের কাফনের রঙয়ের – সাদা। খিলাফত অর্জনের এই রীতিটি, বৈষয়িক জীবন ত্যাগ করে মৃত্যু পর্যন্ত সাদা কাপড় পরে থাকা, কিছুটা সুফিদের বৈষয়িক জীবন ত্যাগের ঐতিহ্য থেকেও যেন আহরিত; “কে তোমারে এ বেশ-ভূষণ পরাইল বল শুনি/ জিন্দা দেহে মুরদার বেশ খিলকা-তাজ আর ডোর-কোপনি॥/ জ্যান্তে মরার পোশাক পরা/ আপন ছুরাৎ আপনি সারা/ ভব-রোগকে ধ্বংস করা/ দেখে অসম্ভব করণী॥/ মরণের আগে যে মরে/ শমণে ছোঁবে না তারে/ শুনেছি সাধুর দ্বারে/ তাই বুঝি করেছ ধনী।। সেজেছ সাজ ভালই তর/ মরে যদি ডুবতে পার/ লালন বলে যদি ফের/ দুকূল হবে অপমানি॥” (চৌধুরী, ২০০৮, পৃ. ২৬৪)।

লালনীয় ঘরানার ফকিরী বিশ্বাসের একটা মূল উপাদানই হচ্ছে সন্তান জন্ম না দেওয়া। তাতে আত্মা খণ্ডিত হয়। একজন মানুষ তাহলে বিরামহীন পুনঃজন্মের শিকার হয়ে পড়বে। আবার মানুষ হয়ে জন্ম নিতে আত্মাকে ফের চুরাশি লক্ষ যোনি ভ্রমণ করে আসতে হবে। লালনের মতে আত্মাকে আবারও পুনঃজন্মের বিরামহীন চক্রে ফেলে দেওয়াটা মোটেই ঠিক কাজ হবে না। ফলে এই মানবজীবন পাওয়া বা মানুষ হিসেবে জন্ম নেওয়াটাই লালনীয় বিশ্বাসে তাই এক মহা ভাগ্যের ব্যাপার।

ইসলামী সৃষ্টিতত্ত্ব, যা মূলতঃ সেমিটিক পুরাণগুলি থেকে নেওয়া, বিশ্বাস করে যে সব ফেরেশতারাই মাটির তৈরি আদমকে সেজদা দিয়েছিল কেবল ইবলিশ ছাড়া। তাই ইবলিশ হয়ে উঠল শয়তান যার কাজই হচ্ছে মানবজাতিকে ধ্বংস করা। লালনের মতে স্রষ্টা মানুষকে গড়েছেন তাঁর নিজের আদলে। মানুষের দেহের ভেতরেই খোদার বাস। আল্লাহ আর আদম এক না হলে মানুষকে সেজদা দেয়াটা গোনাহ্ হোত; “আপন ছুরতে আদম গঠলেন দয়াময়।/ তা নইলে কি ফেরেস্তারে সেজদা দিতে কয়।/ আল্লা আদম না হইলে/ পাপ হইত সেজদা দিলে/ শেরেকী পাপ যারে বলে/ এ দীন দুনিয়ায়।” (চৌধুরী, ২০০৮, পৃ. ১০৮)

মানুষকে যে উপাসনা করতে অস্বীকৃতি জানায় সে খোদ সৃষ্টিকর্তারই বিরোধী, এই বিশ্বাসটি নিঃসন্দেহে পশ্চিম এশিয়ার সুফিদের দ্বারা ধারিত ও বাহিত হয়ে বাংলার সাধকদের কাছে পৌঁছেছিল। লালন গাইছেন; “জানতে হয় আদম ছফির আদ্য কথা/ না জেনে আজাজিল সেরূপ/ কীরূপ আদম গঠলেন সেথা॥/ আনিয়ে জেদ্দার মাটি/ গঠলেন বোরখা পরিপাটি/ মিথ্যা নয় সে কথা খাঁটি/ কোন চিজে তার গঠলেন আত্মা।। সেই না আদমের ধড়ে/ অনন্ত কুঠুরী গড়ে/ মাঝখানে হাতনে কল জুড়ে/ কীর্তিকর্মা বসলেন সেথা।।/ আদমি হইলে আদম চেনে/ ঠিক নামায় সে দেল-কোরানে।।” (চৌধুরী, ২০০৮, পৃ. ৩৬১) সুফিরা, এবং বাউল-ফকিরেরাও, দয়ালু এক ঈশ্বর এবং তাঁর সৃষ্ট মানবজাতির মাঝে প্রেমময় এক সম্পর্কের কথা বিশ্বাস করে এসেছেন। ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যে এই নমনীয় ও প্রেমময় সম্পর্কের ব্যাপারটি, ইহুদী ও ওয়াহীবী ইসলামী ঐতিহ্যে যে সর্বশক্তিমান ও শাস্তিদাতা ঈশ্বরকে আমরা দেখতে পাই, এবং মানুষের সঙ্গে তাঁর যে কঠিন পিতৃতান্ত্রিক সম্পর্কের ব্যাপারটি দেখি, তা থেকে পুরোপুরিই আলাদা। একজন ক্ষমতাধর পিতৃতান্ত্রিক শাসকের বদলে প্রেমময় একজন ঈশ্বরের এই যে ধারণাটি লালন ও তাঁর অনুসারী বাংলার বাউল-ফকিরেরা বিশ্বাস করে এসেছেন তা নিঃসন্দেহে সুফি ধ্যান-ধারণার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে।

নিজের-ভেতরে-দেখ, সুফি সাধক মনসুর হাল্লাজের সেই বহুলউদ্ধৃত কথাটি “আয়নাল হক” (“আমিই সত্য”) লালনেরও অজানা ছিল না; “মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো/ বলেছিল আমি সত্য/ সই পলো সাঁইর আইন মতো/ শরায় কী তার মর্ম পায়।“ (ফকির মহিন শাহর কণ্ঠশ্রুত লালনের গান)। কোরানের মতে খোদা নিজে অলক্ষ্যে থাকেন এবং দুষ্টকে দমন ও শিষ্টের পালনের জন্যে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে পয়গম্বরদের পাঠান। কিন্তু ভারতীয় দর্শনে বিশ্বাস করা হয়েছে স্রষ্টা নিজেই নানা অবতার হিসেবে আবির্ভূত হন। লালনের মতে মুহম্মদ স্রষ্টারই এক অবতার; “কায়ার শরীর ছায়া দেখি/ ছায়াহীন সে লা-শরিকী/ ফকির লালন বলে তার হাকিকি/ বলিতে ডরাই/ মদিনায় রসুল নামে/ কে এল রে ভাই।” (ফকির মহিন শাহ গীত লালনের গান)। লালন নিজেই সে প্রশ্নের জবাবও দিচ্ছেন; “রসুলকে চিনলে পরে খোদা চেনা যায়।” (চৌধুরী, ২০০৮, পৃ. ৬৩০)।

অবতারবাদে এই বিশ্বাস লালনের বিশ্বাসের জগতের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। লালনের কাছে শ্রীচৈতন্য যেমন শ্রীকৃষ্ণের অবতার রসুলও তেমনি স্রষ্টার অবতার। সুফিরা যেমন শব্দ নিয়ে রহস্য করতে পছন্দ করতেন লালনও তেমনি। “আহাদ” ও “আহমদ” এই দুটো শব্দ নিয়ে লালনের খেলার মাঝে লুকিয়ে আছে এক সুগভীর তত্ত্বকথা; “কে পারে মক্করউল্লার মক্কর বুঝিতে/ আহাদ আহম্মদ নাম হয় জগতে।।/ আহাম্মদ নামে খোদায়/ মিম হরফে নফি সে হয়/ মিম উঠায়ে দেখ সবায়/ কী হয় তাতে॥” (চৌধুরী, ২০০৮, পৃ. ২৬৬)। লালন আরো বলছেন, “আকার কি নিরাকার সাঁই রববানা।/ আহাদ আহাম্মদের বিচার হলে যায় জানা।।/ খুদিতে বান্দার দেহে/ খোদা সে লুকায়ে/ আলেফে মিম বসায়ে/ আহাম্মদ নাম হো’ল সে জনা॥/” (চৌধুরী, ২০০৮, পৃ.৮১)।

লালনের বিশ্বাসের জগতে তাই ঈশ্বর-রসুল-আদম এই ত্রিত্ব একাকার। তাঁদের কোনো পৃথক সত্ত্বা নেই; “আলিফে আল্লাহ/ মিমে মহম্মদ/ দমে আদম।” এই তিনের সাথে একাত্ম হয়ে স্রষ্টা মানবদেহে লীলা করেন। বিশ্বাসের এই জগতের কোন বর্ণমালার কোন বর্ণের প্রকৃত অর্থ কী তা বুঝতে হলে সাধনার তরীকায় দাখিল হতে হয় এবং গুরু বা মুরশিদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। আর সাধনায় সিদ্ধি লাভ করলে কেবল মাত্র তখনই সম্ভব হবে পুনঃজন্মের যন্ত্রণাটা এড়ানো!

ওয়াহাবী ধারণায় জেহাদটা হচ্ছে বাইরের শক্তির সঙ্গে। আর প্রেম-ভালোবাসায় অভিষিক্ত সুফিদের ক্ষেত্রে লড়াইটা হচ্ছে মানুষের মনের ভেতরের শত্রুর সঙ্গে। মানবপ্রকৃতির চিরন্তন সেই মন্দ প্রবণতাগুলোর বিরুদ্ধে। ইসলামী ধারণার একটি মাত্র ইবলিশ বা শয়তানের পরিবর্তে, লালনের পরিভাষায়, মানুষের অন্তর্নিহিত ছয়টি রিপুই হচ্ছে মানুষের চরম শত্রু। রিপুগুলো হচ্ছে লোভ, ক্রোধ, ঈর্ষা, মোহ, অহংকার ও নিষিদ্ধ যৌনকামনা, যেগুলি মানুষের মানবিক সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দেয়। লালনের গানে, কখনো গভীরতায়, কখনো হালকা কৌতুকে, মানুষের সঙ্গে ওই নাছোড়বান্দা ছয়টি রিপুর নানা দ্বন্দ্বের উল্লেখ বারে বারেই তাই আমরা দেখতে পাই।

গুরুকে লালন-অনুসারীদের “সাঁই” বা “সাঁইজী” নামে ডাকার যে রীতি তা বৈষ্ণবীয় “স্বামী”র (কর্তা) অথবা সুফি শব্দ “শাহ্” উভয়েরই অপভ্রংশ হতে পারে। তবে গুরু সম্পর্কে লালনের ধারণাটি সুফি ঘরানার মুরশিদ ধারণাটারই যেন বেশি কাছাকাছি। মধ্যপ্রাচ্যের সুফিদের কাছে যা “শায়েখ”, বাংলার লালনপন্থীদের কাছে তা ‘মুরশিদে’-য়ে রূপান্তরিত হয়েছে। গুরু বা মুরশিদ, যাঁরা এই আত্মানুসন্ধানী নিগূঢ় যৌন সাধন-প্রক্রিয়াটা শেখাবেন, তাঁদের গুরুত্বটা সর্বোচ্চ; “গুরু তুমি পতিতপাবন পরমেশ্বর/ অখণ্ডমণ্ডলকারম/ ব্যাপ্তং জগৎ চরাচর।” (ফকির মহিন শাহর কণ্ঠশ্রুত গান)। ওঁর গানগুলিতে লালন প্রায়ই উল্লেখ করেছেন যে ওঁর নিজের গুরু ছিলেন “দরবেশ সিরাজ সাঁই।” “দরবেশ” শব্দটিই সুফি ঘরানার ইঙ্গিতবাহী। তবে ফকির আনোয়ার হোসেন মন্টু শাহ, ছেঁউড়িয়ার একজন প্রখ্যাত লালন অনুসারী, যিনিই প্রথম লালনের গানগুলি তিন খণ্ডে প্রকাশ করেছিলেন এবং লালনের পারিবারিক জীবন সম্পর্কে সবচে বেশি জানতেন, আমাকে জানিয়েছিলেন যে “দরবেশ সিরাজ সাঁই” কোনো বাস্তবের চরিত্র নন। ফকির আনোয়ার শাহর মতে, “সিরাজ” হচ্ছে আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন উপাধি। লালন যেহেতু একটি গুরুবাদী মানবধর্ম প্রচার করেছেন, ফলে ওঁরও একজন মানবগুরুর প্রয়োজন ছিল। ফলে ওঁর সেই কল্পিত গুরুর নাম হিসেবে উনি সকল কিছুর স্রষ্টা খোদার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে “সিরাজ” নামটি বেছে নিয়েছিলেন। লালনের গুরু সিরাজ সাঁই তাই আর কেউ নন, মানব নামধারী স্বয়ং ঈশ্বর

লালনের সাধন-প্রক্রিয়ায় মুরশিদ বা গুরু সর্বদাই হচ্ছেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সর্বশক্তিমান; “মুরশিদ বিনে কী ধন আর আছে রে মন এ জগতে/ যে নাম স্মরণে মন রে, তাপিত অঙ্গ শীতল করে/ ভববন্ধন জ্বালা যায় গো দূরে জপ ওই নাম দিবারাতে॥/ মুরশিদের চরণের সুধা পান করিলে যাবে ক্ষুধা/ কর না রে মন দেলে দ্বিধা, যেহি মুরশিদ সেহি খোদা/ ভজ ওলিয়েম মুরশিদা আয়াত লেখা কোরানেতে।/ আপনি আল্লা আপনি নবি, আপনি হন আদম সফি/ অনন্ত রূপ করে ধারণ, কে বোঝে তাঁর লীলার করণ।” (চৌধুরী, ২০০৮, পৃ. ৫৮৩)। এক পর্যায়ে তাই আল্লাহ-মুরশিদ-গুরু সব সমার্থক হয়ে পড়ে। লালন ফকির, যদিও নিজেও একজন গুরু ছিলেন, কিন্তু উন্নত সংবেদনশীলতা ও অসাধারণ নম্রতার অধিকারী হওয়ার কারণে, নিজেকে কখনোই ও ধরণের কোনো উঁচু বেদীতে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করেননি। মনে রাখতে হবে, সব কিছুর উপরে লালন ফকির ছিলেন একজন সৃজনশীল শিল্পী, একজন নিপুণ সঙ্গীত-রচয়িতা। শাস্ত্র নয়, আশ্রম নয়, ওঁর প্রধান অস্ত্র ছিল ওঁর গান। এবং ওঁর জীবনদর্শন উনি ওঁর ওই প্রহেলিকাময় গানগুলির মধ্য দিয়েই ব্যক্ত করেছেন। সমস্ত বিনয় নিয়েই উনি জীবনের শেষ পর্যন্তও রয়ে গেছেন একজন সৃজনশীল শিল্পী ও একজন গীতিকার। এঁর গোটা দীর্ঘ জীবনে, এমন কী মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগ মুহূর্ত পর্যন্তও, লালন ফকির গান রচনা করে গেছেন। এ পর্যন্ত লালনের সাড়ে পাঁচশ গানের সন্ধান পাওয়া যায়। তবে আরো কিছু গান সাক্ষরতাহীন বাউল-ফকিরদের মৌখিক সাঙ্গীতিক ধারার মাঝে হয়তো এখনও রয়ে গেছে যা আজও তালিকাভুক্ত হয়নি।

লালন ছিলেন, যা তাঁর মনোমুগ্ধকর গানগুলিতে বারেবারেই প্রমাণিত, একজন গভীরমনস্ক শিল্পী ও অত্যন্ত সুদক্ষ এক সঙ্গীতরচয়িতা। ওঁর নিজের সাধনা ছিল নিগূঢ় এবং ওঁর গানগুলি সঙ্গীত শিল্পের যে কোনো মাপেই, খুবই উন্নত মানের। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, পরবর্তীকালে লালন ফকির যখন সমাজের উঁচু মহলে বিখ্যাত হতে শুরু করলেন এবং সংস্কৃতি-বাণিজ্যে অপরিহার্য হয়ে উঠতে থাকলেন, তখন অনেক পল্লীগায়কই “বাউল” শব্দটির প্রকৃত অর্থ না জেনেই, অথবা যাদের মাঝে সাধনার কোনো বালাই নেই, নিজেদেরকে লালন-অনুসারী “বাউল” হিসেবে পরিচয় দিতে শুরু করল।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), যাঁর জমিদারীর এলাকা শিলাইদহের অন্তর্ভুক্ত ছেঁউড়িয়ায় লালন ফকির বসবাস করতেন, লালনের গানের আধ্যাত্মিক গভীরতায় ব্যাপকভাবে মুগ্ধ হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ লালনের কয়েকটি গান প্রকাশ করেছিলেন এবং বাঙ্গালি শিক্ষিত সমাজে লালনের কাজকে পরিচিত করিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ লালন ফকির ও সামগ্রিকভাবে বাউলদের দ্বারা এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে উনি নিজেও বাউলদের মত পোশাক পরা শুরু করেন এবং নিজেকে বলতেনও “রবীন্দ্র বাউল”। এখন এই যে রাবীন্দ্রিক ধারণার বাউল, বায়বীয় চেতনার দাড়িওয়ালা একজন মানুষ, যার কোনো বৈষয়িক চিন্তা নেই এবং যে কেবল একতারা হাতে কোনো “অচিন মানুষ”-কে খুঁজে ফিরছে, এটা যতটা না বাস্তব তার চেয়ে বেশি নির্মাণ। তবে যুগ যুগ ধরে বাউলদের এই রূপটা নাগরিক শ্রেণীগুলির কল্পলোককে আলোড়িত করেছে। এবং দুঃখজনকভাবে, লালন ফকিরও ওরকম একজন বায়বীয় বাউলের প্রতিরূপ হয়ে উঠলেন যেটা প্রকৃত মানুষটি ও তাঁর আসল ব্যক্তিসত্তার চেয়ে অনেকটাই বাঙ্গালি মধ্যবিত্তের এক রোমান্টিক নির্মাণ।

লালন ফকির মোটেই কোনো ভাববাদী আধ্যাত্মিক সাধক ছিলেন না। বরং লালনের গানগুলির মর্মার্থ পাঠ করলে বোঝা যায় ওঁর ধারণাগুলো কতটা বস্তুবাদী, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানবিরোধী ও অন্তর্ঘাতমূলক ছিল। তাই এটা আশ্চর্যের নয় যে কেন লালনকে এত হেঁয়ালিপূর্ণ ও রূপকভাষায় ওঁর গানগুলি রচনা করতে হয়েছিল। বর্ণবাদী হিন্দুসমাজ ও শরীয়তী ইসলামপন্থীদের কাছে লালনের ধ্যান-ধারণাগুলো ছিল অতিরিক্ত ধ্বংসাত্মক, যা কেবল প্রচার নয়, ওদের পক্ষে সহ্য করাও ছিল কঠিন। ফলে দেখি লালন কেবল ব্রাহ্মণীয় “বৈদিক মেঘে ঘোর অন্ধকার” দ্বারা শঙ্কিত ছিলেন না, তাঁকে ওয়াহাবী ধর্মান্ধদের ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হয়েছে, যাঁদের কাছে ওঁর ঈশ্বর-মানবদেহে-বাস করেন কিম্বা আল্লা-মুহাম্মদ আদম সমার্থক এসব বক্তব্য ছিল সহ্যের অতীত। তাই এটা আশ্চর্য্য করে না যে বাউলদের বিরুদ্ধে শরীয়তপন্থীদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে “বাউল ধ্বংস ফতোয়া” জারী করা হয়েছিল।

কেবল যখন মধ্যবিত্ত শিল্পী ও বুদ্ধিজীবিদের দ্বারা লালনের গানগুলি ভাববাদী রসে আচ্ছন্ন হয়ে এবং সামাজিক-ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত ছাড়াই উপস্থিত হওয়া শুরু হোল কেবল তখনই শরীয়তপন্থী ধর্মীয় শক্তি, মাঝে-মাঝে ক্ষোভপ্রকাশসহ, এটা মেনে নিল। তবে গ্রামীণ মোল্লা ও লালনপন্থী ফকিরদের মাঝে বৈরীতা এখনও বিরাজমান। বাংলাদেশের নিভৃত গ্রামাঞ্চলে লালনপন্থী বাউল-ফকিরেরা আজো নানাভাবে নিগৃহীত হচ্ছে। জাতীয় পর্যায়েও, ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে যখন লালন ফকিরের আদলে গড়া একটা বাউল মূর্তি ইসলামী মৌলবাদীরা শক্তি প্রদর্শন করে উপড়ে ফেলল, তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রশক্তি পরাজয় মেনে নিল এবং মূর্তিটা পুনঃস্থাপনের কোনো সাহসই আর দেখায়নি।

লালনের গানের আপাত: সহজ প্রতীক ও রূপকগুলিও “অচিন পাখী”, “মৎস্য”, “চাঁদ”, “পুকুর”, “নদী”, এসবই নানা যৌন সাধন-প্রক্রিয়ার অর্থবহ। লালন ফকিরের গানের প্রকৃত মানে এবং লালন-ঘরানার ফকিরদের দেহকেন্দ্রিক সাধনপ্রক্রিয়াটা বাঙ্গালি ভদ্র শ্রেণীগুলির সংবেদনশীলতার পক্ষে ঘৃণ্য বোধ হতে বাধ্য। ফকির মহিন শাহ্ আমাকে বলেছিলেন যে বাউল ফকিরদের প্রধান রক্ষাকবচ হচ্ছে যে গ্রামের সাধারণ মানুষেরা লালনের গানের প্রকৃত অর্থ তেমন জানে না। এই তরিকার বাইরের মানুষেরা এসব গানের অন্তর্ঘাতমূলক বাণীর কিছুই না বুঝে গানগুলোর কাব্যগুণের সৌন্দর্য্যেই কেবল মুগ্ধ হয়ে পড়ে। এটা ইতিহাসের এক পরিহাস যে লালনের গানগুলি আজ প্রেমের গান কিংবা নাগরিক উচ্চবিত্তদের জন্যে আধ্যাত্মিক পলায়নী প্রবণতার গান হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে যা এসব গানের মূল উদ্দেশ্য কখনোই ছিল না!

এক নমনীয় ঈশ্বরের সঙ্গে প্রেম-ভালোবাসার ব্যক্তিগত এক সম্পর্কের অন্বেষা, যা সুফি মতবাদের কাছাকাছি এবং ওয়াহাবী ইসলামের পুরোপুরি পরিপন্থী, সেটাই লালন ও বাংলার আধ্যাত্মিক সাধকেরা চর্চা করে এসেছেন। লালনের অনেক গানেই ব্যক্ত হয়েছে এই আকুতি। আমরা জানি যে সুফি বিশ্বাসে বিনয় ও প্রতিবেশির প্রতি ভালবাসার বিষয়টি কত বড়ভাবে বিদ্যমান। লালনের গানগুলোতেও দেখি বিনয় ও এক ‘অচেনা পড়শী’ র জন্যে আকুতিটা চিরন্তন; “বাড়ির কাছে আরশিনগর/ সেথা এক পড়শি বসত করে/ আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।।/ গিরাম বেড়ে অগাধ পানি/ ও তার নাই কিনারা নাই তরণী পারে/ মনে বাঞ্চা করি দেখব তারে/ কমনে সে গায় যাই রে।।/ পড়শি যদি আমায় ছুঁতো/ যম যাতনা সকল যেত দূরে/ সে আর লালন একখানে রয়/ মাঝে লক্ষ যোজন ফাঁক রে॥” (চৌধুরী, ২০০৮, পৃ. ৪৯৮) (“আরশিনগর” শব্দের আক্ষরিক অর্থ কেউ কেউ করেছেন “আয়নার শহর” (Mirror City)। কিন্তু খোদার “আরশ” যেখানে সেটা “আরশিনগর”, এই অর্থেও শব্দটা ব্যবহৃত হতে পারে।)

ইদানীং অবশ্য বাউলদের ব্যাপারে ধর্মনিরপেক্ষ মধ্যবিত্তদের অতিরিক্ত আগ্রহের কারণে জাতীয়তাবাদী আলোচনার বয়ানগুলিতে দেখা যায় লালনের “বাউল” উপাদানগুলিকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে এবং লালন ফকিরের উপর “ফকিরী” বা সুফি প্রভাবকে হয় পুরোপুরি অবহেলা অথবা এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। তবে একই সঙ্গে লালনের উপর সুফি মতবাদের প্রভাবের বিষয়টিকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়াটাও তেমন ঠিক হবে না। কারণ “সহজ মানুষ”, “অধর মানুষ”, “অচিন মানুষ”, “মনের মানুষ” অথবা “সোনার মানুষ”, এসবই হচ্ছে এক কৌশলী ও ছলনাময় স্রষ্টার নানা নাম, যাঁকে একটা বিশেষ মুহূর্তে বিশেষ ধরণের যৌনসাধন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ধরা সম্ভব এবং তাঁকে সেভাবে ধরতে পারলে এক নীরোগ সুন্দর দেহ, এমনকী অমরত্ব লাভ করা যেতে পারে। আগেই বলেছি লালনের এসব ধারণার উৎস মূলত: এদেশীয় নাথপন্থী সহজিয়া দেহতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা এবং পারস্যের সুফিবাদের সঙ্গে এসবের তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। সুফি ধারণার স্বর্গীয় আলো বা “নূর-ই-মোহাম্মদ”-য়ের ধারণা কখনো কখনো লালনের গানে দেখা গেলেও লালন ফকির ও তাঁর অনুসারীদের সৃষ্টিতত্ত্ব মূলতঃ এদেশে ইতিমধ্যে প্রচলিত নাথ-তান্ত্রিক-সহজিয়া দেহতান্ত্রিক সাধনচর্চার উপরই বেশি নির্ভরশীল ছিল। লোকজ এই বিশ্বাসের জগতটি মধ্যপ্রাচ্যের সুফি বিশ্বাসের সৃষ্টিতত্ত্ব থেকে একেবারেই আলাদা এক জগৎ। লালন ফকিরের উপর সুফি বিশ্বাস ও চর্চার প্রভাব অবশ্যই কিছুটা ছিল, কিন্তু লালনের জীবনবীক্ষার মূল রূপটি গড়ে উঠেছিল যুগ যুগ ধরে এ মাটিতে প্রচলিত যোগ-তান্ত্রিকতার ধ্যান-ধারণা থেকে যার সঙ্গে এসে মিশেছিল নদীয়ার বৈষ্ণবদের চৈতন্য-পরবর্তী যুগের সহজিয়া সাধনচর্চা। মনে রাখতে হবে, লালন ফকির এই নদীয়া অঞ্চলেরই মানুষ ছিলেন।

সুফিবাদ তথা একটা ধর্ম হিসেবে ইসলাম দ্বারা লালন ফকির কতখানি প্রভাবিত হয়েছিলেন, সেই বিষয়টি গবেষণার জগতে এখনও অনেকটাই এক অজানা জগত। তবে এটা ধারণা করার কারণ রয়েছে যে, যেহেতু মুসলমানেরা ছিলেন তাঁর চারপাশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী, ফলে ধর্মান্ধ ইসলামী প্রতিষ্ঠানসমূহকে নিরপেক্ষ বা বন্ধুসুলভ রাখার জন্যেই হয়তো লালন ফকির হযরত মোহাম্মদকে নিয়ে নবীতত্ত্বের বেশ কিছু গান লিখেছিলেন এবং অনেক ইসলামী উপমা ও পদ ব্যবহার করেছেন। আমরা অর্ধ শতাব্দী পরে দেখব যে আরেকজন ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রতিষ্ঠানবিরোধী বাঙ্গালি কবি কাজী নজরুল ইসলামও হামদ ও নাতের মতো অনেক ইসলামী সঙ্গীত রচনা করেছেন।

সুফি আউলিয়াদের বায়বীয় আধ্যাত্মিক প্রেম-ভালোবাসার ঈশ্বরের সঙ্গে লালন ফকিরের “অচিন মানুষ”য়ের সর্বপ্রাণবাদী ঈশ্বরের ধারণার প্রতিতুলনার সময় এটা মনে রাখতে হবে যে লালন ও ওঁর বাউল-ফকির অনুসারীরা ছিলেন সমাজ-বহির্ভূত নিম্নবর্গের শ্রেণীর মানুষ যাঁরা গ্রামবাংলার দরিদ্র কৃষক-তাঁতী-মাঝি ও অন্যান্য খেটে খাওয়া মুসলমান ও নিম্নবর্ণের হিন্দুদের মাঝে বাস করতেন। যেহেতু বাউল-ফকিরদের প্রধান উপার্জনই ছিল মাধুকরী বা ভিক্ষাবৃত্তি, ফলে তাঁরা গ্রামীণ দরিদ্র অর্থনীতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ছিলেন। নিজেরাও দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষ হওয়ার কারণে মানবদেহের গুরুত্বটা তাঁরা বুঝতে পারতেন। মানবদেহ, এই একটা মাত্র সম্পদই তাঁদের ছিল। তাই এটা আশ্চর্যের নয় যে বায়বীয় প্রেমে বিশ্বাসী সুফি সাধকদের তুলনায় গ্রামবাংলার বাউল-ফকিরেরা ছিলেন অনেক বেশি দেহকেন্দ্রিক বাস্তব মানুষ। অন্য দিকে সুফি সাধকেরা অনেকেই ছিলেন নগরবাসী অথবা গ্রামীণ সমাজের উপরের অংশের সচ্ছল অধিবাসী। অষ্টাদশ-উনিশ শতক দুটি বাংলার দরিদ্র মানুষদের জন্যে কোনো সুখী সময় ছিল না। লালনের অনেক গানেই তাই আমরা পাই নানা রকম বঞ্চনার উল্লেখ। দারিদ্র্য ও সর্বব্যাপ্ত এই বঞ্চনার কথা লালনের গানগুলিতে বেশ বড়ভাবেই এসেছে এবং এসেছে বারবারই যা ওঁর জীবনদর্শনে একটা গভীর বিষণ্নতা ও দুঃখবোধকে ছড়িয়ে রেখেছে; “আশা পূর্ণ হোল না/ আমার মনের বাসনা॥/ বিধাতা সংসারের রাজা/ আমায় করে রাখল প্রজা/ কর না দিলে দেয় গো সাজা/ কারো দোহাই মানে না।” (চৌধুরী, ২০০৮, পৃ. ১২৫)। লালন আরো গাইছেন; “এই দেশেতে এই সুখ হোল আবার কোথায় যাই না জানি।/ পেয়েছি এক ভাঙ্গা নৌকা জনম গেল ছেঁচতে পানি।।” (চৌধুরী, ২০০৮, পৃ. ১৬০)।

জাতিভেদপ্রথাবিরোধী বেশ কয়েকটি গান রয়েছে লালন ফকিরের যা জাতিভেদের প্রতি, বা যা কিছুই মানবজাতিকে বিভক্ত করে রেখেছে, সে সবের প্রতি ওঁর ঘৃণাকে প্রকাশ করেছে। হিন্দুধর্মের অমানবিক বর্ণপ্রথার বিরুদ্ধে এবং বর্ণপ্রথাকে ধারিত ও চালিত করে যে কর্তৃত্ববাদী ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য উচ্চবর্ণের শ্রেণীগুলি, তাঁদের বিরুদ্ধে লালনের বিরাগ এতটাই তীব্র ছিল যে উনি ঘোষণা দিচ্ছেন যে বর্ণভেদপ্রথাকে যদি হাত দিয়ে ধরতে পারতেন তাহলে তাকে আগুনে পোড়াতেন; “লালন কয় জাত হাতে পেলে/ পোড়াতাম আগুন দিয়ে।”

মনে রাখতে হবে যে লালন ফকির ও তাঁর অনুসারীরা নিজেরাও ছিলেন সমাজের মূলধারা থেকে বিতাড়িত এক বঞ্চিত জনগোষ্ঠী। লালনের গানের অনেক দুঃখ, বিষণ্ণতা ও অস্তিত্ববাদী জিজ্ঞাসা আসলে বাংলার এক বিশেষ সময়কালে গ্রামবাংলার দরিদ্র ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর দুঃখবোধ ও অস্তিত্ববাদী শূন্যতারই প্রকাশ যে দরিদ্র সামাজিক শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত ছিলেন লালন ফকির নিজেও। লালন ফকিরের কাহিনী হচ্ছে নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সৃজনশীলতা ও প্রতিবাদের কাহিনী। লালনকে নাগরিক বুদ্ধিজীবি সমাজ ও কর্পোরেট বাণিজ্য স্বার্থ আজ যতোই সমাজবিচ্ছিন্ন এক শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করুক না কেন, বাস্তবতা রয়েই যায় যে বাংলার বাউল ফকিরদের প্রতিষ্ঠান বিরোধী দর্শন, লালন যে ধারার সবচে প্রভাবশালী সঙ্গীতগুরু, এমন এক শক্তি যাকে উচ্চবর্গের প্রতিষ্ঠানসমূহকে হিসেবে রাখতেই হবে।

বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের নীচুতলায় লালন ফকিরের প্রভাব আজো ব্যাপক। বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রসারের ক্ষেত্রে এটা এক বড় ইতিবাচক উপাদান। এবং হয়তো মানবতাবাদী বিশ্বাসের এই অন্তঃস্রোতটিই বাংলাদেশকে বাঁচাবে আরেকটি আফগানিস্তান ও পাকিস্তান হওয়ার বিপদ থেকে এবং আশা করা যায় মানবতাবিরোধী ইসলামী মৌলবাদীদেরও ঠেকিয়ে রাখতে তা সহায়ক হবে।

লালনের গানের সর্বব্যাপ্ত মানবতাবাদকে কখনোই ভুলে থাকা সম্ভব হবে না। লালনের জীবনদর্শনে, কেবল মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার আনন্দটাই এমন এক ভাণ্ডার, যা থেকে মানবজাতি সর্বদাই শক্তি ও উৎসাহ সঞ্চয় করতে পারবে। কেউ বা ভুলতে পারে মহান মানবতাবাদী লালন ফকিরের অসামান্য এই সব গান; “এমন মানবজনম আর কি হবে/ মন যা করো ত্বরায় করো এই ভবে।।/ অনন্ত রূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই/ শুনি মানবের উত্তম কিছু নাই/ দেব-দেবতাগণ করে আরাধন/ জন্ম নিতে এই মানবে।।/ কত ভাগ্যের ফলে না জানি/ পেয়েছ এই মানব-তরণী/ বেয়ে যাও ত্বরায়, তোমার সুধারায়/ যেন ভারা না ডোবে।।/ মানুষে করতে মাধুর্য ভজন/ তাই মানবরূপ গঠলেন নিরঞ্জন/ এবার ঠকলে আর না দেখি কিনার/ লালন কয় কাতরভাবে।” (চৌধুরী, ২০০৮, পৃ. ১৭৯)। ব্যক্তি ও শিল্পী লালন ফকিরের এই গভীর মানবতাবোধের জন্যে আমরা তাঁর উপর যে সব প্রধান প্রধান প্রভাব বিদ্যমান ছিল, মানবদেহকেন্দ্রিক বৌদ্ধ তান্ত্রিক সাধনা, হিন্দু সহজিয়া বৈষ্ণববাদের প্রেম ও বিনয় এবং পরিশেষে, সুফি সাধকদের মানবতাবাদী ধ্যান-ধারণা—এই সব কিছুর প্রতিই গভীরভাবে কৃতজ্ঞ রইব।

তথ্যসূত্র

  • ১। “Situating Sufism and Yoga”, Carl W. Ernest, “Journal of Royal ASiaTic Society” Series 3, 15:1 (2005)
  • ২। “Ocean of Love”, David G. Cashin, Bangla Academy, 1994
  • ৩। “লালনসমগ্র”, আবুল আহসান চৌধুরী, পাঠক সমাবেশ, ঢাকা, ২০০৮

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.