গুপ্তোত্তর পর্বে উত্তর ভারত, সম্রাট হর্ষবর্ধন, গৌড়েশ্বর শশাঙ্ক ও কামরূপাধিপতি ভাস্করবর্মা

Table of Contents

গুপ্তোত্তর পর্বে উত্তর ভারত

ভূমিকা

গুপ্তোত্তর পর্বে উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কতিপয় রাজশক্তি আত্মপ্রকাশ করে। এসব রাজপরিবার কোনও বৃহদায়তন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেনি, তারা সীমিত অঞ্চলে রাজত্ব করত। খণ্ডিত, বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন রাজ্যগুলোকে একসূত্রে গাঁথার মতো কোনও সমরনিপুণ, দৃঢ়চেতা ও বিচক্ষণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এ পর্বে আবির্ভূত হননি। খ্রিস্টীয় ৭ম শতকের প্রারম্ভে হর্ষ বর্ধনের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে আবির্ভাবের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত উত্তর ভারতের রাজনৈতিক আকাশ অনৈক্য ও বিচ্ছিন্নতার কালো মেঘে সমাচ্ছন্ন ছিল। এ পর্বের রাজশক্তিগুলোর মধ্যে বলভী বা গুজরাতের মৈত্রক রাজবংশ, পূর্ব মালবের (মতান্তরে, গৌড়-মগধের) উত্তরকালীন গুপ্ত, কান্যকুজের মৌখরি, বঙ্গ-সমতটের গৌড়, কামরূপের বর্মা, ও স্থাণ্বীশ্বরের পুষ্যভূতি বা পুষ্পভূতি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

বলভী বা গুজরাতের মৈত্রক রাজবংশ 

ভটার্ক (৪৭৫-৪৯৩ খ্রি.) : গুপ্তোত্তর পর্বে উত্তর ভারতে যে কটি শক্তিশালী আঞ্চলিক রাজশক্তির অভ্যুদয় হয়, গুজরাতের মৈত্রক রাজবংশ তাদের অন্যতম। এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ভটার্ক। তিনি প্রথমে গুপ্তসম্রাট বুধগুপ্তের সমর বিভাগে একজন সেনাধ্যক্ষ ছিলেন, পরে সম্রাট তাঁকে গুজরাতের প্রাদেশিক শাসনকর্তার পদে নিযুক্ত করেন। বলভী নগরী ছিল নতুন প্রশাসকের রাজধানী। এ প্রদেশের পূর্বতন রাজধানী গিরিনগর বা জুনাগড়। ভটার্কের সময় বলভীতে রাজধানী স্থানান্তরের পিছনে অবশ্যই কয়েকটি কারণ ছিল। সুদর্শন হ্রদের প্লাবন একটি কারণ হতে পারে। কিন্তু বলভীর মতো দূরবর্তী স্থানে রাজধানী স্থানান্তরের এটিই একমাত্র কারণ নয়। এ মুহূর্তে অন্য কারণগুলোকে চিহ্নিত করা যায় না। প্রাচীন বলভী বর্তমান ভবনগরের সন্নিকটে অবস্থিত।

প্রথম ধরসেন (৪৯৩-৪৯৯ খ্রি.) : ভটার্কের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র প্রথম ধরসেন গুজরাতের প্রশাসনিক দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। পিতা ও পুত্র উভয়েই ‘সেনাপতি’ অভিধায় অলংকৃত ছিলেন। তাঁরা দু’জনেই ছিলেন গুপ্তদের অনুগত। কিন্তু পিতা ও পুত্রের ক্রমান্বয়ে গুজরাতের শাসনকর্তার পদ গ্রহণের মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলে গুপ্ত রাজশক্তির ক্রমক্ষীয়মাণ কর্তৃত্ব ও মৈত্রক শাসক পরিবারের ক্রমবর্ধমান প্রভাবই প্রতিফলিত হয়েছে।

প্রথম দ্রোণসিংহ (৪৯৯-৫১৯ খ্রি.) : গুজরাতের পরবর্তী প্রশাসক প্রথম দ্রোণসিংহ। তিনি ছিলেন ভটার্কের পুত্র এবং প্রথম ধরসেনের কনিষ্ঠ ভ্রাতা। পিতা বা জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মতো সেনাপতি অভিধায় পরিতৃপ্ত না থেকে তিনি নিজেকে মহারাজরূপে ঘোষণা করেন। মৈত্রক লেখমালায় দাবি করা হয়েছে, তাঁর অধিরাজ স্বয়ং উপস্থিত থেকে তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজপদে অভিষিক্ত করেন। এই অধিরাজ সম্ভবত গুপ্তসম্রাট বুধগুপ্ত। (অধ্যাপিকা দেবাহুতি (তদেব) মনে করেন, এই গুপ্তসম্রাট নরসিংহগুপ্ত। এ মত সম্ভবত ঠিক নয়। ৫০৩ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ তাঁর এক নিজস্ব লেখে দ্রোণসিংহ মহারাজরূপে বর্ণিত হয়েছেন। অনুমিত হয়, এর কয়েক বছর পূর্বে তাঁর আনুষ্ঠানিক রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠিত হয়। তখন বুধগুপ্ত গুপ্তসম্রাট, নরসিংহগুপ্ত নন।) প্রতীয়মান হয়, গুজরাত প্রকৃত অর্থেই এক স্বাধীন মৈত্রক রাজ্য রূপে আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে।

প্রথম ধ্রুবসেন (৫১৯-৫৪৯ খ্রি.) : প্রথম দ্রোণসিংহের পর তাঁর অনুজ মহাসামন্ত, মহারাজ প্রথম ধ্রুবসেন বলভীর সিংহাসনে আরোহণ করেন। ৫২৬ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ একখানি লেখে তিনি সদম্ভে ঘোষণা করেছেন, নিজ বাহুবলে তিনি রাজপদ অর্জন করেন। কিন্তু লেখে তিনি সর্বদাই নিজেকে ‘পরমভট্টারক পাদানুধ্যাত’ বলে বর্ণনা করেছেন। অনুমিত হয়, কার্যত স্বাধীন হয়েও তিনি সমকালীন গুপ্ত সম্রাটের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করেননি। তাঁর একখানি তাম্রশাসন ৫৫০ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ হয়েছে। তিনি সম্ভবত আনুমানিক ৫২৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৫৫৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন।

দ্বিতীয় জৈন মহাসম্মেলন (৫১২ বা ৫২৫ খ্রি.) : জৈনধর্মের ইতিহাসে মৈত্রক রাজাদের শাসনকাল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কথিত আছে, বীরনির্বাণ অব্দের ১৮০ বা ১৯৩ বৎসরে অর্থাৎ ৫১২ বা ৫২৫ খ্রিস্টাব্দে বলভী নগরীতে মুনি দেবর্ধিগণির পৌরোহিত্যে দ্বিতীয় জৈন মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই মহাসম্মেলনে জৈনশাস্ত্র সংশোধিত ও সংকলিত হয়, অঙ্গ, উপাঙ্গ, প্রকীর্ণক, ছেদসূত্র, মূলসূত্র ইত্যাদি ছয়টি বিভাগে শ্রেণিবদ্ধ হয়। অঙ্গ, উপাঙ্গ ইত্যাদি এক একটি বিভাগে কয়েকটি করে গ্রন্থ সন্নিবেশিত হয়েছে। দ্বিতীয় জৈন মহাসম্মেলনের অনুষ্ঠানকাল সম্পর্কে দু’টি তারিখের কথা বলা হয়েছে। একটি ৫১২ খ্রিস্টাব্দ, অন্যটি ৫২৫ খ্রিস্টাব্দ। এ সময় প্রথম দ্রোণসিংহ ও তদীয় ভ্রাতা প্রথম ধ্রুবসেন যথাক্রমে বলভীতে রাজত্ব করেন। কেউ কেউ অভিমত প্রকাশ করেছেন, প্রথম ধ্রুবসেনের পৃষ্ঠপোষকতায় এই জৈন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। প্রাচীন জৈন গ্রন্থাদিতে ধ্রুবসেনের জৈনধর্মের প্রতি অনুরাগের কথা বলা হয়েছে কিন্তু এই সম্মেলনে তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা সম্বন্ধে কোনও উক্তি নেই। তাছাড়া, মৈত্রক রাজাদের ভূদান-সম্পর্কিত অসংখ্য লেখে ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধধর্মের অনুকূলে তাঁদের দান-ধ্যানের কথা আছে কিন্তু জৈনধর্মের প্রতি তাঁদের অনুরাগ বা অবদান সম্পর্কে কোনও উক্তি নেই। সমকালীন মৈত্রক লেখমালা এই জৈন মহাসম্মেলন সম্পর্কে সম্পূর্ণ নীরব। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম ধ্রুবসেন বা অপর কোনও মৈত্রক রাজা এই জৈন সম্মেলনের সঙ্গে কতখানি যুক্ত ছিলেন, বলা কঠিন। কিন্তু এই সম্মেলন যে মৈত্রকদের রাজধানী বলভীতে অনুষ্ঠিত হয়, তা সুনিশ্চিত। জৈনশাস্ত্র চর্চার এক পীঠস্থান এই বলভী নগরী। খ্রিস্টীয় ৪র্থ-৫ম শতকে জৈন আচার্য নাগার্জুন বলভীতেই জৈনশাস্ত্র বিন্যাসের কাজ শুরু করেন। ৬০৯ খ্রিস্টাব্দে আচার্য জিনভদ্ৰক্ষমাশ্রমণ এই শহরেই তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘বিশেষাবশ্যকভাষ্য’ রচনা করেন।

ধরপট্ট (৫৪৯-৫৫৩ খ্রি.) : প্রথম ধ্রুবসেন লোকান্তরিত হলে তাঁর ভ্রাতা ধরপট্ট বলভীর রাজপদ অলংকৃত করেন। পৌত্র দ্বিতীয় ধরসেনের লেখে তিনি মহারাজরূপে বর্ণিত হয়েছেন, অথচ পুত্র গুহসেনের লেখে তাঁর নামোল্লেখ নেই। এ কারণে অনেকেই তাঁর সিংহাসনে আরোহণ সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এখানে একটি কথা বলার আছে। গুহসেনের তাম্রশাসনের প্রথম খণ্ডটি পাওয়া যায়নি। অজ্ঞাত সে খণ্ডে ধরপট্টের নাম থাকা বিচিত্র নয়।

গুহসেন (৫৫৩-৫৬৯ খ্রি.) : অত্যল্পকাল রাজত্ব করার পর ধরপট্টের জীবনাবসান হলে তাঁর পুত্র গুহসেন রাজপদে অধিষ্ঠিত হন। তিনি নিজেকে কখনও ‘মহাসামন্ত’ বা ‘পরমভট্টারক-পাদানুধ্যাত’ বলে বর্ণনা করেননি, সর্বদা মহারাজ বলেই নিজের পরিচয় দিয়েছেন। বলা বাহুল্য, সর্বাঙ্গীন অর্থে বলভীর মৈত্রক রাজবংশের তিনিই প্রথম স্বাধীন, সার্বভৌম নরপতি। ঠিক এ কারণেই প্রথম শীলাদিত্যের (৬০৬ খ্রিস্টাব্দ) রাজত্বকাল থেকে প্রাপ্ত সকল মৈত্রক অভিলেখে গুহসেন থেকেই মৈত্ৰক বংশলতিকা শুরু হয়েছে, পূর্ববর্তী রাজাদের নাম অনুচ্চারিতই থেকে গেছে। তাঁর রাজত্বের প্রথম লেখখানি ২৩৭ বা ২৪০ গুপ্তাব্দ অর্থাৎ ৫৫৭ বা ৫৬০ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ। তাঁর পুত্র ও উত্তরাধিকারী দ্বিতীয় ধরসেনের রাজত্বের প্রথম লেখখানির তারিখ ৫৭২ খ্রিস্টাব্দ। তাঁর রাজত্ব কাল আনুমানিক ৫৫৬-৭০ খ্রিস্টাব্দ। রাজ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তাঁর আগ্রহের কথা লেখে ব্যক্ত হয়েছে। ধর্ম সম্পর্কে তিনি উদার মতাবলম্বী ছিলেন। ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে তাঁর ভূমিদানের কথা লেখে উল্লিখিত হয়েছে।

দ্বিতীয় ধরসেন (৫৪৬-৫৮৯/৯০ খ্রি.) : গুহসেনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দ্বিতীয় ধরসেন রাজপদ গ্রহণ করেন। ৫৭২-৯১ খ্রিস্টাব্দে তিনি বহু লেখ উৎকীর্ণ করেন। ৫৭৪ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ একখানি লেখে তিনি মহাধিরাজরূপে বর্ণিত হয়েছেন। ৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে গারুলকবংশীয় সামন্ত মহারাজ সিংহাদিত্য একটি অভিলেখ উৎকীর্ণ করেন। সিংহাদিত্য দ্বিতীয় ধরসেনের অনুগত ছিলেন। এই লেখে তিনি দাবি করেছেন, তাঁর পিতা দ্বিতীয় বরাহদাস দ্বারকার এক নরপতিকে পরাজিত করেন। দ্বিতীয় বরাহদাসের অভিযানের ফলে মৈত্রকরাজ্য সম্ভবত পশ্চিম সীমান্তে গুজরাতের উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। ঘটনাটি ঘটে সম্ভবত দ্বিতীয় ধরসেনের পিতা গুহসেনের রাজত্বকালে।

প্রথম শীলাদিত্য ধর্মাদিত্য (৫৯০-৬১৫ খ্রি.) : আনুমানিক ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় ধরসেনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র প্রথম শীলাদিত্য ধর্মাদিত্য বলভীর রাজপদে অভিষিক্ত হন। তাঁর রাজত্বের সর্বশেষ লেখখানি ৬১৩ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ। অনুমিত হয়, ৬১৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর রাজত্বের অবসান হয়। চিনা পরিব্রাজক ওয়েন চাঙ ৬৪০ খ্রিস্টাব্দে ম-ল-পো বা মালব পরিদর্শনে আসেন। সে রাজ্যের বর্ণনা প্রসঙ্গে তিনি শীলাদিত্য নামে এক মালব রাজার উল্লেখ করেন। চিনা পরিব্রাজক বলেন, শীলাদিত্য তাঁর মালব পরিদর্শনের প্রায় ৬০ বছর পূর্বে অর্থাৎ ৫৮০ খ্রিস্টাব্দে রাজত্ব করেন। মৈত্রকরাজ প্রথম শীলাদিত্য ধর্মাদিত্য আনুমানিক ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন। উভয়ের রাজত্বকালের মধ্যে প্রায় ২৫ বছরের ব্যবধান। বেশির ভাগ ঐতিহাসিকের ধারণা, সাল-তারিখের উল্লেখে শুয়েন চাঙ সর্বদা সাবধানতা অবলম্বন করেননি। তিনি যে মালবাধিপতি শীলাদিত্যের কথা বলেছেন, তিনি এবং বলভীরাজ প্রথম শীলাদিত্য ধর্মাদিত্য এক ও অভিন্ন ব্যক্তি। এ অভিমত গৃহীত হলে প্রথম শীলাদিত্য সম্পর্কে কয়েকটি নতুন তথ্য জানা যায়

  • প্রথমত, তিনি শুধু বলভী বা গুজরাতের রাজাই ছিলেন না, পশ্চিম মালবের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলও তাঁর অধিকারভুক্ত ছিল। অর্থাৎ, প্রথম শীলাদিত্য এক বিশাল রাজ্যের অধীশ্বর ছিলেন। সমকালীন পশ্চিম ভারতে আর কোথাও এরূপ বৃহদায়তন রাজ্য গড়ে ওঠেনি।
  • দ্বিতীয়ত, সুপ্রশাসক ও দয়ার্দ্রচিত্ত রাজা ছিলেন শীলাদিত্য।
  • তৃতীয়ত, বৌদ্ধধর্মের অনুরাগী ছিলেন তিনি। তাঁর রাজত্বকালে এক সুদৃশ্য বৌদ্ধ মন্দির নির্মিত হয়। তিনি তাঁর রাজত্বকালে প্রতি বছর এক বৌদ্ধ মহাসম্মেলন অনুষ্ঠান করতেন। চতুর্দিক থেকে অসংখ্য বৌদ্ধ শ্রমণ সে মহাসম্মেলনে যোগদান করতেন।

প্রথম শিলাদিত্য ধর্মাদিত্যের পর এই রাজবংশের অন্যান্য রাজারা ৭৭৬ সাল পর্যন্ত গুজরাতে রাজত্ব করেন। তাদের কয়েকজনের সম্পর্কে বলা যাক –

দ্বিতীয় ধ্রুবসেন বালাদিত্য (৬২৭-৬৪১ খ্রি.) : তৃতীয় ধরসেনের মৃত্যুর পর তার ছোট ভাই দ্বিতীয় ধ্রুবসেন ক্ষমতায় আসেন ও বলাদিত্য নামে পরিচিত হন। তিনি আনু. ৬২৭-৬৪১ খ্রিস্টাব্দে রাজত্ব করেন। তিনি ব্যাকরণ এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কে ভালভাবে ওয়াকিবহাল ছিলেন। তবে হিউয়েন সাং লিখেছিলেন তার মধ্যে “প্রাণবন্ত এবং তাড়াহুড়ো করার স্বভাব ছিল, সেই সাথে তার প্রজ্ঞা এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জ্ঞান গভীর ছিলনা”। তিনি আরও যোগ করেন যে “তিনি সম্প্রতি বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘের সাথে নিজেকে সংযুক্ত করেছিলেন”। তিনি বৌদ্ধ বিহার এবং হিন্দু মন্দিরগুলোকে সমানভাবে অনুদান দিয়েছিলেন। তিনি পরমামহেশ্বর উপাধি ব্যবহার করেছিলেন, এখান থেকে মনে করা হয় তিনি শৈব ছিলেন। তিনি তার পূর্বপুরুষ দ্রোণসিংহের পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত মন্দির কোট্টাম্মহিকাদেবীকে পুনর্নবীকরণ করেছিলেন। লাট এর গুর্জররাজ দ্বিতীয় দাদ্দা উল্লেখ করেছিলেন যে তিনি হর্ষবর্ধনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মৈত্রক শাসককে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তবে তিনি দ্বিতীয় ধ্রুবসেন নাকি চতুর্থ ধরসেন ছিলেন তা স্পষ্ট নয়। হিউয়েন সাং উল্লেখ করেছিলেন যে তিনি কনৌজের হর্ষবর্ধনের কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন, সম্ভবত বৈবাহিক আনুগত্যের খাতিরে। তাঁর শাসন উজ্জয়িনীর পশ্চিমে অবস্থিত রাতলাম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল তাই সমগ্র আধুনিক মধ্য ও উত্তর গুজরাট তার আমলে মৈত্রকদের অধীনে ছিল।

চতুর্থ ধরসেন (৬৪১-৬৫০ খ্রি.) : চতুর্থ ধরসেন দ্বিতীয় ধ্রুবসেনার স্থলাভিষিক্ত হন এবং ৬৪১ থেকে ৬৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। ভারুচ তাম্রলেখ থেকে জানা যায় তিনি লাট (দক্ষিণ গুজরাট) এর গুর্জরদেরকে দমন করেছিলেন। তিনি পরমভট্টরক মাহরাজধিরাজ পরমেশ্বর চক্রবর্তী এর সাম্রাজ্যবাদী উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। তিনি বৌদ্ধ বিহারকে ও ব্রাহ্মণদেরকে অনুদান দিয়েছিলেন। তিনি পণ্ডিত ও মাস্টার আর্চারদের (সুদক্ষ তীরন্দাজ) পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সম্ভবত তাঁর শাসনামলে ভাট্টিকাব্য বা রাবণবধের লেখক ভাট্টি সমৃদ্ধি লাভ করেন। এটি একটি গ্রামাটিকাল পোয়েম বা ব্যাকরণগত কবিতা। চতুর্থ ধারাসেনের কোনও পুত্র না থাকায় রাজবংশটির এর এল্ডার ব্রাঞ্চ ধেরাভট্টের বংশে চলে যায়। তার পর তৃতীয় ধ্রুবসেন ক্ষমতায় আরোহন করেন।

দ্বিতীয় শিলাদিত্য (৬৫৮-৬৮৫ খ্রি.) : দ্বিতীয় শিলাদিত্য ছিলেন দ্বিতীয় খারাগ্রহের বড় ভাই। দ্বিতীয় খরগ্রহের কোন সন্তান না থাকায়, তিনি সিংহাসন গ্রহণ করেন। তিনি ৬৫৮ থেকে ৬৮৫ সাল পর্যন্ত শাসন করেন। তিনি তার অনুদানে তার পিতা দেরাভট্টের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি সম্ভবত চালুক্যদের অধীনে থাকা সেন্দ্রক গভর্নরদের কাছ থেকে লাট অঞ্চলটি পুনরুদ্ধার করেন। চালুক্যরাজ প্রথম বিক্রমাদিত্য অঞ্চলটি পুনরুদ্ধার করেন এবং তার ভাই ধরাশ্রয় জয়সিংহকে এর রাজ্যপাল হিসেবে নিয়োগ করে, যার বংশ নবসারির পুলকেশি নামে পরিচিত হয়। এই অঞ্চলটি তখনও লাটের গুর্জরদের দ্বারা শাসিত হয়েছিল এবং তৃতীয় দাদ্দা সম্ভবত মৈত্রকদের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন। আরব ইতিহাসবিদরা উল্লেখ করেছেন যে আরব কমান্ডার ইসমাইল ৬৭৭ খ্রিস্টাদে ঘোঘা আক্রমণ করেছিলেন কিন্তু তার কোন বিবরণ দেননি। তিনি অবশ্যই দ্বিতীয় শিলাদিত্যের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন।

চতুর্থ শিলাদিত্য (৭১০ – ৭৪০ খ্রি.) : চতুর্থ শিলাদিত্য তৃতীয় শিলাদিত্য পুত্র ছিলেন যার ব্যক্তিগত নাম সম্ভবত ধরসেন ছিল। তিনি আনু. ৭১০ থেকে ৭৪০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করেছিলেন। চালুক্যরাজ দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্য লাট এর গুর্জররাজ চতুর্থ জয়ভট্টের সম্ভাব্য সহায়তায় মৈত্রকদের কাছ থেকে খেতক অঞ্চল দখল করেছিলেন। ৭৩৩ খ্রিস্টাব্দের সঞ্জন লেখ অনুসারে রাষ্ট্রকূটরাজ প্রথম ইন্দ্র জোর করে কাইরা (খেদা)-তে চালুক্য রাজকুমারী ভানগাকে (Bhvanaga) বিয়ে করেছিলেন, যাতে সেই অঞ্চলটি অবশ্যই তাদের অধীনে চলে যায়। আরব ইতিহাসবিদ বিলাদুরি জানিয়েছেন যে হিশামের খিলাফতের সময় (৭২৪-৭৪৩ খ্রি.) হাকামের অধীনে আরবরা মৈত্রক রাজ্য আক্রমণ করেছিল। লাটের গুর্জরদের উল্লেখ অনুসারে ৭৩৫-৭৩৬ খ্রিস্টাব্দে এই আক্রমণ চালানো হয়েছিল। তারা উত্তর ও দক্ষিণের সমস্ত গুর্জর অঞ্চল আক্রমণ করেছিল। এ সময় মঙ্গলরসের ছোট ভাই এবং উত্তরসূরি অবনীজনাশ্রয় পুলকেশি ৭৩১ থেকে ৭৩৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কোনও এক সময় সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি একটি সংস্কৃত শিলালিপি দ্বারা সত্যায়িত, যা নবসারি শিলালিপি নামে পরিচিত, যদিও এর সঠিক সন্ধানের স্থান জানা যায়নি। এপিগ্রাফিকাল সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া এটি নবসারি জেলার সাতেম গ্রামের এক বাসিন্দার কাছ থেকে গ্রহণ করে। এটি ৪৯০ কলচুরি অব্দে জারি করা হয়েছিল, অর্থাৎ এটি রচনার তারিখ ৭৩৭ সালের ১ নভেম্বর থেকে ৭৩৯ সালের ২১ অক্টোবর পর্যন্ত। এই শিলালিপিতে অবনীজনাশ্রয় উমাইয়া খিলাফতের আরব আক্রমণ প্রতিহত করেন বলে উল্লেখ আছে। এতে বলা হয়েছে যে, সৈন্ধব, কাচ্ছেলা (কচ্ছ), সৌরাষ্ট্র, চভোতকা, মৌর্য, গুর্জর এবং অন্যান্য রাজ্য লুণ্ঠন করে তাজ্জিকরা (আরবরা) নবসারি পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিল। অবনীজনাশ্রয়ের বাহিনী তীব্র যুদ্ধের পর আক্রমণকারীদের পরাজিত করে। এই সাফল্যের ফলে চালুক্যরাজ তাকে বেশ কয়েকটি উপাধি প্রদান করেন, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে “দক্ষিণপথস্বধর্ণ” (ডেকানের শক্ত স্তম্ভ), “চাল্লুকি-কুলালঙ্কার” (চালুক্য পরিবারের অলঙ্কার), “পৃথ্বী-বল্লভ” (পৃথিবীর প্রিয়)”, অম্বর্ত কনিবর্তয়িতৃ (Amvarta Kanivartayitr), এবং “অনিবর্তক-নিবর্তয়িতৃ” (অপ্রতিহতের প্রতিহতকারী)। মনে করা হয় এই রাজা ছিলেন বাতাপি চালুক্য শাসক দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্য (রা. ৭৩৩-৭৪৪ খ্রি.), যদিও লেখে তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়নি, কেবল তাকে “বল্লভ নরেন্দ্র” বলে অভিহিত করা হয়েছে। অবনিজনাশ্রয় আরবদের প্রতিহত করার পরে প্রাক্তন গুর্জর অঞ্চলটিকে চালুক্য রাজ্যের সাথে সংযুক্ত করেছিলেন বলে মনে হয়। তিনি নবসারি চালুক্য পরিবারের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী শাসক ছিলেন এবং পরমভট্টরাক উপাধি গ্রহণ করেন। সাধারণত সার্বভৌম শাসকগণই এই উপাধির ব্যবহার করেন, তবে ব্যাপারটাকে নিশ্চিত বলাও যায়না। এটা সম্ভব যে এটি তার স্বাধীনতার ঘোষণাকে সূচিত করে, কিন্তু এও হতে পারে যে, তিনি একজন চালুক্য ভাসাল হিসেবেই থেকে যান, আর তার এই উপাধিটি কেবল তাকে মহিমান্বিত করার জন্যই ব্যবহৃত হয়। নবসারিকার চালুক্যরা ৮ম শতকে রাষ্ট্রকূটদের দ্বারা বিজিত হয় ও তারাই এই অঞ্চলটির ক্ষমতা দখল করে।

পঞ্চম শিলাদিত্য (রা. ৭৪০-৭৬২ খ্রি.) : আরব আক্রমণের পর, পঞ্চম শিলাদিত্য খণ্ডিত পশ্চিমা রাজ্যগুলো এক করেন, এদিকে মালবকে গুর্জর-প্রতিহাররা আরব আক্রমণের পূর্বেই অধিকার করে নিয়েছিল। তিনি সম্ভবত মালবকে পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করেছিলেন, কারণ দেখা যায় গোদ্রকের (গোধরা) একটি সেনা ছাউনি থেকে তিনি একটি অনুদান দিয়েছিলেন। তবে তিনি অবশ্যই মালব পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, তবে তা সত্ত্বেও তিনি খেতক (খেদা) অঞ্চলটি পুনরুদ্ধার করেছিলেন। ৭৫৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি সমুদ্র থেকে উমাইয়া খিলাফতের পাঠানো আরেকটি তাজ্জিক (আরব) আক্রমণের মুখোমুখি হন। সিন্ধুর গভর্নর হাশামের নির্দেশে আমারুবিন জামালের নৌবহর বারদার (পোরবন্দরের কাছে বারদা পাহাড়) উপকূলে প্রেরণ করেছিলেন। এই আক্রমণটিকে মৈত্রকদের আনুগত্যে থাকা সৈন্ধব রাজবংশের নৌবহর দ্বারা পরাজিত হয়। পঞ্চম শিলাদিত্য আনু. ৭৪০ থেকে ৭৬২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন।

ষষ্ঠ শিলাদিত্য ধ্রুবভট্ট (৭৬২-৭৭৬ খ্রি.) : ষষ্ঠ শিলাদিত্য, ধ্রুবভট্ট নামেও পরিচিত ছিলেন। তিনি আনু. ৭৬২ থেকে আনু. ৭৭৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। যেহেতু তিনি আনন্দপুর (ভদনগর) থেকে অনুদান জারি করেছিলেন, তাই ধারণা করা হয় যে তিনি আবার রাষ্ট্রকুটের বিদ্যমান পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সম্প্রসারণে ছিলেন এবং গুর্জর-প্রতিহারদের সাথে সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন। সৌরাষ্ট্র আবার ৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে তাজ্জিকদের বা আরবদের দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়। তারা বরদ জনপদ দখল করেছিল, তবে সেই সময় মহামারী ছড়িয়ে পড়ে। ফলে আরবদের ফিরে যেতে হয়, এবং তদকালীন উমাইয়া খলিফা ভারতে প্রবেশের অধিকতর প্রচেষ্টা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সৈন্ধভ রাজবংশের প্রথম আগ্‌গুকা (Agguka I) তার লেখে উল্লেখ করেন, তারা আরবদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করেছিল বলেই আরবদেরকে ফিরে যেতে হয়। আনু. ৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে মৈত্রক রাজবংশের অবসান হয়েছিল। তাজ্জিকা বা আরব আক্রমণের সাথে বলভির পতনকে যুক্ত করা যায় – এরকম বিবরণ কেবল লিজেন্ড বা কিংবদন্তীর সাথেই সম্পর্কিত। এই রাজবংশের সমাপ্তি সম্পর্কে কোন ঐতিহাসিক সূত্র নেই। গিরিনগর (গিরনার) এবং বামনস্থলী (ভান্থলি) এর গভর্নররা স্বাধীন হয়ে যায় এবং বলভীর পতনে তাদের নিজস্ব রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে।

পূর্ব মালবের (মতান্তরে, গৌড়-মগধের) উত্তরকালীন গুপ্ত রাজবংশ

বংশ পরিচয় : উত্তরকালীন গুপ্ত লেখমালায় রাজাদের বংশ পরিচয় সম্পর্কে কোনও তথ্য পরিবেশিত হয়নি। এই রাজবংশেরই এক অধস্তন পুরুষ আদিত্যসেনের আফসড় অভিলেখে এই বংশকে ‘সবংশ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। কিন্তু মগধের বিশ্রুতকীর্তি পূর্বতন গুপ্ত রাজাদের মতো এই রাজাদের প্রায় সকলেই’ ‘গুপ্ত’ অন্তনাম ব্যবহার করেছেন; পূর্বতন গুপ্ত রাজাদের অনুকরণে তাঁরাও কুমারগুপ্ত, দেবগুপ্ত, বিষ্ণুগুপ্ত ইত্যাদি নাম ধারণ করেছেন। (ব্যতিক্রম শুধু আদিত্যসেন) এই রাজাদের লেখ ও সিলমোহর প্রধানত মগধ অঞ্চলেই আবিষ্কৃত হয়েছে। ফলে অনেকেই এই বংশটিকে মগধের প্রখ্যাত পূর্বতন গুপ্ত রাজবংশের এক শাখারূপে শনাক্ত করেছেন। কিন্তু উত্তরকালীন গুপ্ত লেখমালায় এ ধরনের কোনও দাবি উচ্চারিত হয়নি। রাজপরিবার দু’টির মধ্যে রক্তের সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলে তা সংগত কারণেই উত্তরকালীন গুপ্তলেখে সাড়ম্বরে ঘোষিত হত। এরূপ দাবি উত্থাপিত না হওয়ায় রাজপরিবার দু’টিকে দু’টি স্বতন্ত্র, বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠী বলেই গণ্য করতে হবে। এই বংশের প্রায় সকল রাজার অন্তনাম গুপ্ত থাকায় এবং তাঁরা মগধের পূর্বতন গুপ্ত রাজাদের পরবর্তী হওয়ায় বংশটি উত্তরকালীন গুপ্তবংশ নামে আখ্যাত হয়েছে।

প্রতিষ্ঠা-কাল : উত্তরকালীন গুপ্ত রাজবংশের চতুর্থ নৃপতি কুমারগুপ্ত। তিনি ছিলেন মৌখরি রাজ ঈশানবর্মার সমকালবর্তী। ৫৫৪ খ্রিস্টাব্দে ঈশানবর্মার হরাহা লেখ উৎকীর্ণ হয়। অনুমিত হয়, আনুমানিক ৫০০ খ্রিস্টাব্দে উত্তরকালীন গুপ্ত রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হয়। এই বংশের প্রথম রাজা কৃষ্ণগুপ্ত।

কৃষ্ণগুপ্ত (৪৯০-৫০৫ খ্রি.) : উত্তরকালীন গুপ্ত রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। আদিত্যসেনের আফসড় লেখে তাঁকে নৃপরূপে বন্দনা করা হয়েছে। তাঁর সম্পর্কে বলা হয়েছে, সবংশে তাঁর জন্ম। তিনি সম্ভবত মগধের পূর্বতন গুপ্ত রাজাদের অধীনস্থ ছিলেন। কৃষ্ণগুপ্তের কন্যার সাথে মৌখরি রাজবংশের রাজপুত্র আদিত্যবর্মণের বিবাহ হয়েছিল বলা হয়।

হর্ষগুপ্ত (৫০৫-২৫ খ্রি.) : কৃষ্ণগুপ্তের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র হর্ষগুপ্ত পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। চতুর্থ মৌখরিরাজ আদিত্যবর্মার পত্নীর নাম হর্ষগুপ্তা। তিনি সম্ভবত হর্ষগুপ্তের ভগিনী ছিলেন। অনুমিত হয়, প্রথমদিকে মৌখরি ও উত্তরকালীন গুপ্ত রাজপরিবারের মধ্যে প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল।

প্রথম জীবিতগুপ্ত (৫২৫-৫০ খ্রি.) : হর্ষগুপ্তের পুত্র প্রথম জীবিতগুপ্ত। আফসড় লেখে তাঁকে ‘ক্ষিতীশচুড়ামণি’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এই লেখে আরও বলা হয়েছে, প্রথম জীবিতগুপ্তের ভয়ে সমুদ্রতীরবাসী ও হিমালয়ের পাদদেশস্থ শত্রুরা সদা শঙ্কিত ছিলেন। এই বর্ণনা থেকে মনে হয়, জীবিতগুপ্ত হিমালয় অঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলায় অভিযান পরিচালনা করেন। অর্থাৎ তিনি উত্তর ও দক্ষিণ উভয় দিকেই সমরাভিযান পরিচালনা করেন। রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন, সমকালীন গুপ্ত সম্রাটই এসব সামরিক অভিযানের প্রকৃত নায়ক ছিলেন, জীবিতগুপ্ত তাঁকে সহযোগিতা করেন। কিন্তু প্রথম জীবিতগুপ্তের রাজ্য সম্ভবত মগধে অবস্থিত ছিল না, অবস্থিত ছিল পূর্ব মালবে। এ সময় পশ্চিম মালবে যশোধর্মার (আ. ৫৩০-৪০ খ্রিস্টাব্দ) নেতৃত্বে ঔলিকর রাজশক্তির দ্রুত অভ্যুত্থান হয়। ৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ মন্দসোর লেখে এই ঔলিকররাজ দাবি করেছেন, উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে মহেন্দ্র পর্বত এবং পশ্চিমে সমুদ্র অর্থাৎ আরব সাগর থেকে পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড তাঁর অধিকারভুক্ত। এই দাবি অতিশয়োক্তিমূলক হলেও যশোধর্মা যে অশেষ বলশালী নৃপতি ছিলেন, তা সুনিশ্চিত। জীবিতগুপ্ত সম্ভবত যশোধর্মার আনুগত্য স্বীকার করেন এবং তাঁর দিগ্বিজয়ে অংশগ্রহণ করেন। যে সমুদ্রতীরবাসী শত্রুগণ প্রথম জীবিতগুপ্তের ভয়ে শঙ্কিত ছিলেন, রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁদের গৌড় বলে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু এই গৌড়রা মহারাজাধিরাজ গোপচন্দ্র-ধর্মাদিত্যের পরিবারভুক্ত না অন্য কোনও রাজবংশোদ্ভব, তা বলা কঠিন। কোনও কোনও ঐতিহাসিক অভিমত প্রকাশ করেছেন, এই অভিযানের ফলে প্রথম জীবিতগুপ্তের রাজ্য উত্তরবঙ্গ ও কামরূপে বিস্তার লাভ করে। কিন্তু এ ধারণা ঠিক নয়।

প্রথম কুমারগুপ্ত (৫৫০-৬০ খ্রি.) : প্রথম জীবিতগুপ্তের পুত্র প্রথম কুমারগুপ্ত। যশোধর্মার মৃত্যুর পর ঔলিকর রাজশক্তির দুর্বলতার সুযোগে আনুমানিক ৫৫০ খ্রিস্টাব্দে তিনি স্বাধীন উত্তরকালীন গুপ্তরাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় একই সময় ঈশানবর্মা উত্তরপ্রদেশ এবং বিহারে এক স্বাধীন মৌখরিরাজ্য স্থাপন করেন। পূর্বে উত্তরকালীন গুপ্ত ও মৌখরি রাজপরিবারের মধ্যে প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলেও এ সময় উভয় রাজপরিবারের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। কুমারগুপ্ত ও ঈশানবর্মা উভয়েই উচ্চাভিলাষী রাজা ছিলেন, উত্তর ভারতে রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সংকল্পে তাঁরা দু’জনেই উদ্বুদ্ধ ছিলেন। স্বাভাবিক কারণেই তাঁদের মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে। আফসড় লেখে দাবি করা হয়েছে, কুমারগুপ্ত চন্দ্রসদৃশ মৌখরিরাজ ঈশানবর্মাকে ‘মন্থন’ করেন। মনে হয়, প্রশস্তিকার কুমারগুপ্তের জয়লাভকে দেবতাদের সমুদ্রমন্থনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। সমুদ্রমন্থনের ফলে দেবী লক্ষ্মী আবির্ভূত হন। অনুমিত হয়, কবি বলতে চেয়েছেন, ঈশানবর্মার বিরুদ্ধে জয়লাভ করায় কুমারগুপ্তের ভাগ্যোদয় হয়। এই ঘটনার অনতিকাল পর কুমারগুপ্ত প্রয়াগে মৃত্যুবরণ করেন। মনে হয়, তাঁর রাজ্য এলাহাবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। (এলাহাবাদ কুমারগুপ্তের রাজ্যভুক্ত ছিল, এ কথা অনেকেই স্বীকার করেন না। অধ্যাপিকা দেবাহুতি (Harsha A Political Study (New Delhi, 1998), পৃষ্ঠা 20) মনে করেন, কুমারগুপ্ত প্রয়াগ জয় করেননি, তিনি পুণ্যক্ষেত্ররূপে প্রয়াগের গুরুত্বের কারণে নিজের প্রতিজ্ঞা পালনের জন্য স্থানটি নির্বাচিত করেন। সুধাকর চট্টোপাধ্যায়ের (Early History of North India (Calcutta, 1968), পৃষ্ঠা ২৬৯) অভিমত, প্রয়াগে (ঈশানবর্মার বিরুদ্ধে?) যুদ্ধরত অবস্থায় কুমারগুপ্তের মৃত্যু হয়।) কুমারগুপ্তের মৃত্যু সম্পর্কে আফসড় লেখে বলা হয়েছে, ‘সত্যব্রত’ কুমারগুপ্ত প্রয়াগে গমন পূর্বক অগ্নিকুণ্ডে নিমগ্ন হন। অধ্যাপিকা দেবাহুতি আফসড় লেখের এই উক্তিটিকে বক্র অর্থে গ্রহণ করেছেন (তদেব, পৃষ্ঠা ২০)। তাঁর অভিমত, ঈশানবর্মার বিরুদ্ধে আশানুরূপ সাফল্যলাভে ব্যর্থ হয়ে, নিজের প্রতিজ্ঞা পূরণের জন্য ‘সত্যব্রত’ কুমারগুপ্ত প্রয়াগে প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে আত্মাহুতি দেন। ‘সত্যব্রত’ এই বিশেষণ পদটিকে তিনি প্রতিজ্ঞা পালনে সংকল্পবদ্ধ এই অর্থে ব্যাখ্যা করেছেন। এ ব্যাখ্যা সর্বৈব কল্পনাশ্রিত। সত্যনিষ্ঠ এই সাধারণ অর্থেই ‘সত্যব্রত’ পদটি গ্রহণীয়। কুমারগুপ্ত ঈশানবর্মার হস্তে পরাজয় বরণ করেন, এই ধারণাও কষ্টকল্পিত। মৌখরি লেখমালায় এ মর্মে কোনও দাবি উচ্চারিত হয়নি। ঈশানবর্মার বিরুদ্ধে কুমারগুপ্তের এই বিজয়লাভ ঘটে ৫৫৪ খ্রিস্টাব্দের শেষার্ধে বা ৫৫৫ খ্রিস্টাব্দের প্রথম পর্বে। এর অব্যবহিত পর কুমারগুপ্তের দেহাবসান হয়।

দামোদরগুপ্ত (৫৫০-৬২ খ্রি.) : প্রথম কুমারগুপ্তের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দামোদর গুপ্ত পৈতৃক সিংহাসনে আরোহণ করেন। আফসড় লেখে তাঁর বীরত্বব্যঞ্জক কার্যকলাপ সম্পর্কে একটি উক্তি আছে। উক্তিটি এরূপ : “যে মৌখরির দুর্মদ হস্তিবাহিনী হূণ সৈন্যদের চূর্ণ-বিচূর্ণ করে, দামোদরগুপ্ত সেই রণহস্তীগুলোকে ছত্রভঙ্গ করে সংমূর্ছিত হন এবং সুরবধূদের করস্পর্শে সংজ্ঞা লাভ করেন। এই উক্তি থেকে একটি জিনিস স্পষ্ট। দামোদরগুপ্ত এক মৌখরিরাজকে পরাজিত করেন।” দুর্ভাগ্যের বিষয়, আফসড় লেখে সেই হতমান মৌখরিরাজের নামোল্লেখ নেই। তবে প্রায় সকল ঐতিহাসিকই স্বীকার করেন, দামোদরগুপ্তের হস্তে পরাজিত মৌখরিনৃপতি স্বয়ং ঈশানবর্মা। কিন্তু আফসড় লেখের দামোদরগুপ্ত সম্পর্কিত উক্তির অপরাংশের ব্যাখ্যা নিয়ে পণ্ডিতমহলে বিতর্ক রয়েছে। অনেকে মনে করেন, মৌখরিরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করলেও দামোদরগুপ্ত রণক্ষেত্রে নিহত হন ও স্বর্গে গমন করেন। বিজয়ী রাজা বা সেনাপতি যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যু বরণ করেছেন, এমন ঘটনা ইতিহাসে বিরল নয়। আবার কেউ কেউ বলেন, দামোদরগুপ্ত যুদ্ধে নিহত হননি, আঘাতজনিত কারণে কিছুক্ষণ মূর্ছিত হন কিন্তু পরিশেষে জ্ঞান লাভ করেন। প্রথম ব্যাখ্যাটিই হয়তো ঠিক। তাঁর অকস্মাৎ মৃত্যুর ফলে দামোদরগুপ্ত ঈশানবর্মার বিরুদ্ধে তাঁর বিজয়কে রাজ্য বিস্তারের দুরূহ কাজে রূপায়িত করতে পারেননি। উত্তরপ্রদেশ-বিহারে উত্তরকালীন গুপ্ত রাজ্য বিস্তারের একটি সুযোগ এসেছিল ঠিকই কিন্তু সময়াভাবে সে সুযোগ হাতছাড়া হয়।

মহাসেনগুপ্ত (৫৬২-৬০১ খ্রি.) : দামোদরগুপ্তের মৃত্যুতে তাঁর পুত্র মহাসেন গুপ্ত পূর্ব মালবের সিংহাসনে আরোহণ করেন। মৌখরিরা তখন উত্তরকালীন গুপ্তদের ঘোর শত্রু। যে কোনও সময় তাঁরা মালবরাজ্য আক্রমণ করতে পারেন। এই পরিস্থিতিতে মহাসেন গুপ্ত নিজের ভগিনী মহাসেনগুপ্তার সঙ্গে হর্ষবর্ধনের পিতামহ আদিত্যবর্ধনের বিবাহ দেন। পুষ্যভূতিদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ফলে মৌখরিভীতি দূরীভূত হয়, মহাসেনগুপ্তের শক্তি ও প্রভাব বৃদ্ধি পায়। রাজত্বের প্রথমার্ধে মহাসেনগুপ্তের সাফল্য রীতিমতো বিস্ময়কর। আফসড় লেখে দাবি করা হয়েছে, মহাসেনগুপ্ত কামরূপরাজ সুস্থিতবর্মাকে পরাজিত করেন। লেখটিতে আরও বলা হয়েছে, লেখটি যখন উৎকীর্ণ হয়, তখনও মহাসেনগুপ্তের বিজয়গৌরব ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় কীৰ্তিত হচ্ছিল। যে সুস্থিতবর্মাকে তিনি পরাজিত করেন, তিনি কামরূপরাজ ভাস্করবর্মার পিতা। মনে হয়, রাজত্বের প্রথম পর্বে মহাসেনগুপ্ত সসৈন্যে দিগ্বিজয়ে বহির্গত হন এবং ব্রহ্মপুত্র নদ পর্যন্ত অগ্রসর হন। এটি ছিল ধন-সম্পদ আহরণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত নিছক এক সামরিক অভিযান। এই অভিযানের ফলে গৌড়-মগধ-কামরূপের একাংশ উত্তরকালীন গুপ্তরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়, এরূপ ভাবনা ভিত্তিহীন। মহাসেনগুপ্ত মৌখরিরাজ অবস্তিবর্মার প্রতিনিধি রূপে কামরূপে অভিযান করেন, এ মর্মেও এক অভিমত ব্যক্ত হয়েছে। এ অভিমত নিতান্তই কাল্পনিক। তিব্বতের রাজা স্রং সনের মধ্য ভারত আক্রমণ মহাসেনগুপ্তের দিগ্বিজয়ের পথ উন্মুক্ত করে। রমেশচন্দ্র মজুমদার অভিমত ব্যক্ত করেছেন, একটির পর একটি বিপর্যয়ের ঢেউ মহাসেনগুপ্তকে গ্রাস করে। যে বিপর্যয়গুলোকে তিনি চিহ্নিত করেছেন, কিন্তু এগুলো বিতর্কের ঊর্ধ্ব নয় –

  • ১. রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন, মৌখরিরাজ শর্ববর্মা মগধের কিয়দংশ থেকে মহাসেনগুপ্তকে বিতাড়িত করেন। কিন্তু এই দাবির সমস্যা হলো গৌড়-মগধ মহাসেনগুপ্তের রাজ্যভুক্ত ছিল, এ ধারণা প্রমাণসিদ্ধ নয়। রাজনৈতিক জীবনের প্রথম পর্বে মহাসেনগুপ্ত ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় অভিযান প্রেরণ করেন ঠিকই কিন্তু তা সম্ভবত রাজ্যস্থাপনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়নি। শর্বকর্মা মহাসেনগুপ্তকে পরাজিত করেন, এ অভিমতও যুক্তিগ্রাহ্য নয়। মৌখরিলেখে এ মর্মে কোনও উক্তি নেই।
  • ২. রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন, কামরূপনৃপতি সুপ্রতিষ্ঠিতবর্মা তাঁর অনুজ ভাস্করবর্মার সহায়তায় মহাসেনগুপ্তকে পরাভূত করেন। কিন্তু এই দাবির সমস্যা হলো সুপ্রতিষ্ঠিতবর্মা যে শত্রুকে পরাজিত করেন, তিনি ছিলেন গৌড়ের অধিপতি, মহাসেনগুপ্ত নন।
  • ৩. রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন, চালুক্য নরপতি প্রথম কীর্তিবর্মা মহাসেনগুপ্তের রাজ্য আক্রমণ করেন এবং তাঁকে শোচনীয়রূপে পরাজিত করেন। কিন্তু এই দাবির সমস্যা হলো চালুক্যরাজ মঙ্গলেশের মহাকূট স্তম্ভলেখে দাবি করা হয়েছে, প্রথম কীর্তি বর্মা অঙ্গ, বঙ্গ ও মগধের রাজাদের পরাজিত করেন। অঙ্গ, বঙ্গ ও মগধ সম্ভবত মহাসেনগুপ্তের রাজ্যভুক্ত ছিল না। তাছাড়া, চালুক্যলেখে পূর্ব ভারত বিজয়ের যে দাবি ঘোষিত হয়েছে, তার সত্যতা সম্পর্কে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছেন।
  • ৪. রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন, তিব্বতের রাজা স্রং সন (আ. ৫৮১-৬০০ খ্রিস্টাব্দ) মধ্য ভারত অভিযানকালে মহাসেনগুপ্তকে পরাস্ত করেন। কিন্তু এই দাবির সমস্যা হলো তিব্বতরাজ স্রং সন মধ্য ভারত আক্রমণ করেন। মধ্য ভারত বলতে উত্তরপ্রদেশ ও মগধ বোঝায়। এ অঞ্চলে পুষ্যভৃতি ও মৌখরি রাজারা রাজত্ব করতেন। শশাঙ্ক মগধে বিদ্রোহ করেন। মগধ সম্ভবত মহাসেনগুপ্তের রাজ্যভুক্ত ছিল না।
  • ৫. রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন, মহাসামন্ত শশাঙ্ক মহাসেনগুপ্তের বিরুদ্ধে মগধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।
  • ৬. রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন, বহিরাক্রমণ, বৈপ্রান্তিক অভিযান ও শশাঙ্কের বিদ্রোহে বিপর্যস্ত মহাসেনগুপ্ত গৌড়-মগধের আধিপত্য বিসর্জন দিয়ে মালবে আশ্রয় গ্রহণ করেন। মালবে আশ্রয় গ্রহণের পর মহাসেনগুপ্ত এক গভীর সংকটের সম্মুখীন হন। তাঁর অভিমত, ৫৯৫ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে উজ্জয়িনী ও পশ্চিম মালবে কলচুরিরাজ শঙ্করগণের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি মনে করেন, শঙ্করগণ মহাসেনগুপ্তকে পূর্ব মালবে বিতাড়িত করেন। কিন্তু উত্তরকালীন গুপ্ত রাজারা সম্ভবত কখনও পশ্চিম মালব অধিকার করেননি। তাঁরা বরাবর পূর্ব মালবেই রাজত্ব করেছেন। পশ্চিম মালব ছিল ঔলিকর রাজাদের অধিকারভুক্ত। আনুমানিক ৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে ভাস্করবর্মা নামে জনৈক রাজনৈতিক ভাগ্যান্বেষী ঔলিকরদের পরাজিত করে পশ্চিম মালব অধিকার করেন। ভাস্করবর্মার পর পশ্চিম মালবের রাজপদে অভিষিক্ত হন তাঁর পুত্র কুমারবর্মা (আ. ৫৮০-৬১০ খ্রিস্টাব্দ)। কলচুরিরাজ শঙ্করগণ কুমারবর্মাকে পরাজিত করেই উজ্জয়িনী অধিকার করেন। শঙ্করগণ কখনও মহাসেনগুপ্তের রাজ্য পূর্ব মালব আক্রমণ করেননি।

মহাসেনগুপ্তের জীবনের শেষ দিনগুলো সুখের হয়নি। রাজপরিবারে গৃহবিবাদ শুরু হয়। রাজপরিবারেরই এক সদস্য দেবগুপ্ত তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করেন এবং সম্ভবত সদলে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। অনুমিত হয়, এই ঘোর বিপদের দিনে মহাসেনগুপ্ত তাঁর ভাগিনেয়, স্থাণ্বীশ্বরের পুষ্যভূতিরাজ প্রভাকরবর্ধনের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন। প্রভাকরবর্ধন সসৈন্যে মালব অভি মুখে অগ্রসর হন কিন্তু তাঁর মালবে পৌঁছবার পূর্বেই মহাসেনগুপ্ত সিংহাসনচ্যুত ও নিহত হন। প্রভাকরবর্ধন অবশ্য মহাসেনগুপ্তের দুই পুত্র কুমারগুপ্ত মাধবগুপ্তকে উদ্ধার করে রাজধানী স্থাণ্বীশ্বরে নিয়ে আসেন এবং তাঁদের প্রতিপালনের পূর্ণ দায়িত্ব নিজ স্কন্ধে ধারণ করেন। তখন কুমারগুপ্তের বয়স ১৮ বছর, মাধবগুপ্তের বয়স ১৬ বছর। গুপ্ত রাজপুত্রদ্বয় স্থাথ্বীশ্বরের রাজপরিবারে প্রভাকরবর্ধনের দুই পুত্র রাজ্যবর্ধন হর্ষবর্ধনের সান্নিধ্যে লালিত-পালিত হন। চার রাজকুমারের মধ্যে কুমারগুপ্ত ছিলেন বয়সে সকলের বড়, হর্ষবর্ধন কনিষ্ঠ। হর্ষবর্ধন উত্তরকালীন গুপ্ত শাসনকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এবং এরপর থেকে তারা হর্ষবর্ধনের সামন্ত হিসেবে কাজ করেছিল। উত্তরকালীন গুপ্ত রাজবংশের পরবর্তী রাজারা হচ্ছেন আদিত্যসেন (৬৫৫-৮০ খ্রি.), দেবগুপ্ত (৬৮০-৭০০ খ্রি.), বিষ্ণুগুপ্ত দ্বিতীয় জীবিতগুপ্ত। হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর আদিত্যসেন উত্তরে গাঙ্গেয় অঞ্চল থেকে দক্ষিণে ছোট নাগপুর, পূর্বে বঙ্গোপসাগর থেকে পশ্চিমে গোমতী নদী পর্যন্ত বিশাল অঞ্চলের একচ্ছত্র শাসকে পরিণত হয়েছিলেন। কিন্তু চালুক্যদের কাছে তিনি পরাজিত হন। দ্বিতীয় জীবিতগুপ্ত ছিলেন উত্তরকালীন গুপ্ত রাজবংশের শেষ রাজা যিনি কনৌজের যশোবর্মণ দ্বারা পরাজিত হন।

উত্তরকালীন গুপ্তদের আদি-রাজ্য নিয়ে বিতর্ক : উত্তরকালীন গুপ্ত রাজারা সর্বপ্রথম কোন অঞ্চলে রাজত্ব করতেন, সে সম্পর্কে ঐতিহাসিক মহলে বাগ্-বিতণ্ডা রয়েছে। হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী, রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়, দীনেশচন্দ্র সরকার প্রমুখ ঐতিহাসিকেরা মনে করেন, উত্তরকালীন গুপ্ত রাজারা প্রথমে মালব বা পূর্ব মালবে রাজত্ব করেন কিন্তু পরবর্তী কালে তাঁরা মগধে রাজ্যস্থাপন করেন। মালব বা পূর্ব মালব উত্তরকালীন গুপ্ত রাজাদের আদিরাজা, এ মতের সমর্থনে কয়েকটি যুক্তি উপস্থাপিত করা হয়েছে :

  • ১. বাণভট্টের হর্ষচরিতে কুমারগুপ্ত ও মাধবগুপ্তকে মালবরাজের পুত্ররূপে বর্ণনা করা হয়েছে। কুমারগুপ্ত ও মাধবগুপ্ত মহাসেনগুপ্তের পুত্র ছিলেন। এর দ্বারা প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়, মহাসেনগুপ্ত ও তাঁর পূর্বপুরুষেরা মালবে রাজত্ব করেন। কিন্তু এই যুক্তি অকাট্য নয়। এর দুর্বলতা হলো মহাসেনগুপ্তের পিতা-পিতামহেরাও যে মালবে রাজত্ব করতেন, তার প্রমাণ নেই।
  • ২. দ্বিতীয় জীবিতগুপ্তের দেওবরণাক অভিলেখে রোহতাস জেলার বারুণিকা গ্রামের দাতা রূপে বালাদিত্যদেবের নামের অব্যবহিত পরই মৌখরি নৃপতিদ্বয় শর্ববর্মা ও অবন্তিবর্মার নাম উল্লিখিত হয়েছে। এ থেকে অনুমিত হয়, গুপ্তশাসনের অবসানের পর মগধে মৌখরি রাজারা রাজত্ব করেন, উত্তরকালীন গুপ্ত নরপতিরা নন। এই যুক্তিও অকাট্য নয়। শর্বসেন ও অবস্তিবর্মা মগধে রাজত্ব করেন। কিন্তু প্রাক্-শর্বসেন যুগে এ অঞ্চল কোন রাজবংশের অধিকারভুক্ত ছিল, দেওবরণাক লেখে এই প্রশ্নের উত্তর নেই।
  • ৩. শুয়েন চাঙ খ্রিস্টীয় ৭ম শতকের প্রথমার্ধে মগধের রাজারূপে শশাঙ্ক ও পূর্ণবর্মার নাম উল্লেখ করেছেন। চিনা পরিব্রাজক উত্তরকালীন গুপ্তরাজ মাধবগুপ্ত সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিলেন কিন্তু মগধ প্রসঙ্গে তাঁর নাম উচ্চারণ করেননি। কিন্তু এখানেও মগধের রাজাদের কালানুক্রমিক তালিকা রচনা করা শুয়েন চাঙের উদ্দেশ্য ছিল না, তিনি মগধে বৌদ্ধধর্ম সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাজাদের কথা বলেছেন মাত্র। মাধবগুপ্ত বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে জড়িত না থাকায় তাঁর নাম স্বভাবতই অনুল্লিখিত থেকে গেছে। সে ক্ষেত্রে ওয়েন চাঙের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে মাধবগুপ্তের সঙ্গে মগধের সংযোগ অস্বীকার করা যায় না।

উত্তরকালীন গুপ্ত রাজাদের আদি রাজ্য মগধে অবস্থিত ছিল, এ মর্মে জন কেইথফুল ফ্লিট, রমেশচন্দ্র মজুমদার, সুধাকর চট্টোপাধ্যায়, বিদ্ধ্যেশ্বরী প্রসাদ সিংহ, কৈলাসচাঁদ জৈন প্রমুখ বহু বিদ্বজ্জন অভিমত প্রকাশ করেছেন। এ অভিমতের সমর্থনে কয়েকটি যুক্তিও উত্থাপিত হয়েছে –

  • ১. মহাসেনগুপ্ত ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে কামরূপরাজ সুস্থিতবর্মাকে পরাজিত করেন। মহাসেন গুপ্ত মালবের অধিপতি হলে তাঁকে কামরূপে পৌঁছবার পূর্বে শক্তিশালী মৌখরিরাজ্যের ভিতর দিয়ে সসৈন্যে অগ্রসর হতে হত। কিন্তু মৌখরিদের পরাজিত না করে তা সম্ভব ছিল না। মহাসেনগুপ্ত মৌখরিদের পরাজিত করেছেন বলে জানা যায় না। স্বভাবতই মনে হয়, উত্তরকালীন গুপ্তরাজ্য মৌখরিভূখণ্ড ও কামরূপের অন্তর্বর্তী অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। সে অঞ্চল নিঃসন্দেহে মগধ-গৌড়। কিন্তু এই যুক্তিটি দুর্বল, মালবের রাজার পক্ষে কামরূপে সমরাভিযান পাঠানো কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। এরূপ ঘটনা পূর্বেও ঘটেছে। মালবের ঊলিকরনৃপতি যশোধর্মা তাঁর মন্দস্যের প্রশস্তিতে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা বিজয়ের দাবি করেছেন। খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের শেষপাদে উত্তর-পূর্ব ভারতে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজমান ছিল। তিব্বতি সূত্রে প্রকাশ, সে দেশের রাজা স্রং সন (আ. ৫৮১-৬০০ খ্রি.) এ সময় মধ্য ভারত আক্রমণ করেন। মধ্য ভারত বলতে সাধারণত উত্তরপ্রদেশ ও মগধ বোঝায়। এই আক্রমণে মৌখরিরাজ্য নিঃসন্দেহে দুর্বল হয়ে পড়ে। মৌখরিরাজ্যের সাময়িক বিপর্যয়ের সুযোগে মহাসেনগুপ্তের পক্ষে কামরূপে অভিযান পাঠানো মোটেই অস্বাভাবিক ছিল না।
  • ২. আফসড় লেখে বলা হয়েছে, প্রথম জীবিতগুপ্ত সমুদ্রতীরবর্তী গৌড়দের পরাজিত করেন। এ থেকে মনে হয়, তাঁর রাজ্য গৌড়ের পার্শ্ববর্তী অঞ্চল মগধে অবস্থিত ছিল। এই যুক্তিটিও দুর্বল। প্রথম জীবিতগুপ্তের সমুদ্রতীরবাসী গৌড়দের বিরুদ্ধে বিজয়লাভ তাঁর মগধে রাজত্বের সপক্ষে সুনিশ্চিত প্রমাণ নয়। সম্ভবত কোনও মিত্রজোটের সদস্যরূপে তিনি গৌড় আক্রমণ করেন। কিংবা হয়তো আফসড় লেখে তাঁর যুদ্ধজয় সম্পর্কিত বর্ণনা অতিরঞ্জিত হয়েছে।
  • ৩. উত্তরকালীন গুপ্তরাজ আদিত্যসেন ও তাঁর বংশধরদের সব অভিলেখ মগধে আবিষ্কৃত হয়েছে। এই অঞ্চলই ছিল তাঁদের রাজ্য। আদিত্যসেনের পূর্বপুরুষেরা এই অঞ্চলেই রাজত্ব করেন।
  • ৪. হর্ষবর্ধন মহাসেনগুপ্তের পুত্র মাধবগুপ্তকে মগধের রাজপদে অভিষিক্ত করেন। রাজ্যচ্যুত রাজাকে সাধারণত তাঁর পৈতৃক রাজ্যেই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হয়। মগধই ছিল উত্তরকালীন গুপ্ত রাজাদের পৈতৃক রাজ্য। এই যুক্তিটিও দুর্বল। হর্ষবর্ধন মাধবগুপ্তকে মগধের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করেন বলে যে যুক্তি প্রদর্শিত হয়েছে, হর্ষচরিতের সাক্ষ্যে তার সমর্থন নেই। হর্ষচরিতে বলা হয়েছে, হর্ষবর্ধন কুমার ও মাধবগুপ্তকে সামন্তরাজ পদে অভিষিক্ত করেন। রাজপুত্রদের একজনকে মগধের রাজপদ দেওয়া হয়, এরূপ কোনও উক্তি হর্ষচরিতে নেই। তর্কের খাতিরে যদি মনে করা হয়, মাধবগুপ্তকে মগধের সামন্তরাজপদে অধিষ্ঠিত করা হয়, তাহলেও কিন্তু মগধ মাধবগুপ্তের পৈতৃক রাজ্য, তা প্রমাণিত হয় না। মালব হর্যের রাজ্যভুক্ত ছিল না। হর্ষের পক্ষে মাধবগুপ্তকে মালবের রাজপদে অভিষিক্ত করার সুযোগ ছিল না। হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পরই মাধবগুপ্ত মগধে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।
  • ৫. মাধবগুপ্তের পূর্বপুরুষেরা মালবে রাজত্ব করলে আফসড় অভিলেখে তার উল্লেখ থাকত। এই যুক্তিটিও দুর্বল। এই যুক্তি যাঁরা দেখান তাঁদের সকলেরই অভিমত, মাধবগুপ্তের পূর্বপুরুষেরা মগধে রাজত্ব করেন। আফসড় অভিলেখে কিন্তু এ ধরনের কোনও তথ্য নেই।

বস্তুত, উত্তরকালীন গুপ্ত রাজারা সর্বপ্রথম মালবে না মগধে রাজত্ব করেন, তা এখনও সঠিকরূপে নির্ধারিত হয়নি। আজ পর্যন্ত এই বংশের আদি রাজাদের কোনও অভিলেখের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তা যদি পাওয়া যেত তাহলে সমস্যার সমাধান হত। তবে এ প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলার আছে –

  • প্রথমত, মহাসেনগুপ্ত যে মালবে রাজত্ব করতেন তা বাণের সাক্ষ্যে সুপ্রমাণিত। তাঁর মগধে রাজত্বের সপক্ষে কোনও প্রমাণ নেই। তাঁর কামরূপ অভিযান নিছকই এক স্বল্পস্থায়ী সমরাভিযান। এই অভিযান তাঁর মগধে বা গৌড়-মগধে রাজনৈতিক আধিপত্যের পরোক্ষ প্রমাণ নয়।
  • দ্বিতীয়ত, দেওবরণাক অভিলেখে স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে, মগধ মৌখরিরাজ শর্ববর্মা ও অবন্তিবর্মার রাজ্যভুক্ত ছিল। তাঁরা সকলেই মহাসেনগুপ্তের সমকালীন। অর্থাৎ, মহাসেনগুপ্তের সময় মৌখরিরাই মগধে রাজত্ব করতেন।
  • তৃতীয়ত, মগধের অধিপতিরূপে মৌখরিদের সর্বভারতীয় খ্যাতি ছিল। সোমবংশী রাজা মহাশিবগুপ্ত বালার্জুনের সিরপুর শিলালেখে বর্মা তথা মৌখরিদের মগধের ‘আধিপত্য-সমৃদ্ধ’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এসব ঘটনায় আদি উত্তরকালীন গুপ্তরাজ্যরূপে মালবের সম্ভাবনাই যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, সে সময় মালব ঔলিকর রাজ্যভুক্ত ছিল, উত্তরকালীন গুপ্তদের সে অঞ্চলে রাজ্যস্থাপনের সুযোগ কোথায়? কিন্তু মনে রাখতে হবে, উত্তরকালীন গুপ্ত ও ঔলিকররা মালবের একই অঞ্চলে রাজত্ব করেননি। উত্তরকালীন গুপ্তরা রাজত্ব করেছেন মালবের এরাণ বিদিশা অঞ্চলে, ঔলিকররা উজ্জয়িনী-মন্দস্যের ভূখণ্ডে। অবন্তি ও মালব বা পূর্ব মালব নামে বৃহত্তর মালবের দু’টি স্বতন্ত্র জনপদের উল্লেখ আছে বাণভট্টের ‘কাদম্বরী’ কাব্যে। এই কাব্যে শিপ্রাতীরবর্তী উজ্জয়িনীকে অবস্তির ও বেত্রবর্তীতীরবর্তী বিদিশাকে মালব জনপদের রাজধানীরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। পূর্ব মালবই ছিল উত্তরকালীন গুপ্ত রাজাদের আদি রাজ্য। হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর মাধবগুপ্ত মহারাজাধিরাজরূপে আত্মপ্রকাশ করেন। তখন থেকেই মগধে উত্তরকালীন গুপ্ত রাজত্ব শুরু হয়।

কান্যকুব্জের মৌখরি রাজবংশ

উদ্ভব ও আদি ইতিহাস : মৌখরি এক প্রাচীন গোষ্ঠী।

  • হর্ষচরিতে তাঁদের কখনও মুখর, কখনওবা মৌখরিরূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মুখর শব্দ থেকে মৌখরি পদের উদ্ভব হয়েছে। হয়তো এই গোষ্ঠীর এক আদি পুরুষ ছিলেন মুখর।
  • মৌখরিদের আদি ইতিহাস প্রসঙ্গে ঈশানবর্মার হরাহা অভিলেখে বলা হয়েছে, বৈবস্বত অর্থাৎ যমের বরে রাজা অশ্বপতি শতপুত্র লাভ করেন; মৌখরিরা এই শত পুত্রদেরই বংশধর। অশ্বপতি মদ্র বা মধ্য পাঞ্জাবের অধিপতি ছিলেন। হয়তো মদ্রই ছিল মৌখরিদের আদি বাসভূমি। কিন্তু এ ধারণা নিতান্তই আনুমানিক।
  • মহাভারতেও অশ্বপতির উল্লেখ আছে। সেখানে বলা হয়েছে, অশ্বপতির ঔরসে ও মহিষী মালবীর গর্ভে একশো পুত্র ভূমিষ্ঠ হন; পুত্রদের অধস্তন পুরুষেরা মালব নামে পরিচিতি লাভ করেন। মহাভারতের কাহিনি থেকে অনুমিত হয়, মৌখরিরা মালব গোষ্ঠীভুক্ত ছিলেন।
  • গয়া অঞ্চলে প্রাপ্ত গুপ্তোত্তর পর্বীয় একটি লেখে মৌখরিদের ক্ষত্রিয় বলে বর্ণনা করা হয়েছে। গয়া ও সন্নিহিত অঞ্চলে মৌহরি নামে এক বণিক সম্প্রদায় আছেন। কাশীপ্রসাদ জায়সওয়াল মনে করেন, মৌহরিরাই প্রাচীন মৌখরি গোষ্ঠীর উত্তরপুরুষ।
  • রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন, পাণিনি মৌখরিদের উল্লেখ করেছেন। খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকে মৌখরি গোষ্ঠীর অস্তিত্বের সপক্ষে এটি একটি বড় প্রমাণ। কিন্তু পাণিনি প্রকৃতই মৌখরিদের কথা বলেছেন কিনা সে সম্পর্কে দীনেশচন্দ্র সরকার সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
  • বহুদিন পূর্বে আলেকজান্ডার কানিংহাম আদি ব্রাহ্মী লিপিতে ও প্রাকৃত ভাষায় উৎকীর্ণ মৌখরিদের একটি মৃন্ময় সিলমোহর গয়ায় আবিষ্কার করেন। সিলমোহরটি খ্রিস্টপূর্বীয়, হয়তোবা খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ-৩য় শতকীয়। এ থেকে অনুমিত হয়, খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ-৩য় শতকে গয়া অঞ্চলে এক মৌখরি পরিবারের বাস ছিল।

কতিপয় মৌখরি পরিবার : লেখমালার সাক্ষ্যে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কতিপয় মৌখরি পরিবারের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়েছে।

  • রাজস্থানের কোটা জেলার বড়বা গ্রামে প্রাপ্ত চারখানি অভিলেখে মৌখরি মহাসেনাপতি বল ও তাঁর তিন পুত্রের উল্লেখ আছে। একখানি লেখের তারিখ ২৯৫ কৃতাব্দ বা ২৩৮ খ্রিস্টাব্দ। অনুমিত হয়, মৌখরি বল ও তাঁর পুত্রেরা খ্রিস্টীয় ৩য় শতকে বর্তমান ছিলেন।
  • কদম্বরাজ ময়ূরশর্মা (আ. ৩৪৫-৭০ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর এক অভিলেখে মৌখরিদের বিরুদ্ধে বিজয়লাভের দাবি করেছেন। এই মৌখরিরা সম্ভবত কর্ণাটকের কোনও এক অঞ্চলের আঞ্চলিক প্রশাসক ছিলেন।
  • গয়া শহরের নিকটবর্তী বরাবর ও নাগার্জুনি গুহাগাত্রে উৎকীর্ণ তিনখানি লেখে তিন পুরুষের এক মৌখরি সামন্ত পরিবারের উল্লেখ আছে। এই সামন্ত পরিবারের যে তিনজন শাসকের নাম উল্লিখিত হয়েছে তাঁরা হলেন যজ্ঞবর্মা, তাঁর পুত্র শার্দূলবর্মা ও পৌত্র অনন্তবর্মা। লেখ তিন খানি অনন্তবর্মা উৎকীর্ণ করেন। একখানি লেখে শার্দূলবর্মাকে ‘সামন্তচূড়ামণি’-রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। কোনও লেখে যজ্ঞবর্মা বা তাঁর বংশধরদের মহারাজ বা মহারাজাধিরাজ উপাধিতে ভূষিত করা হয়নি। লেখগুলো তারিখবিহীন। কিন্তু লিপির বিচারে এদের খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের প্রথম ভাগে ধার্য করা যায়। মনে হয়, অনন্তবর্মা ও তাঁর পূর্বপুরুষেরা গুপ্ত রাজাদের অধীনস্থ সামন্তরূপে খ্রিস্টীয় ৫ম শতকের মধ্যভাগ থেকে ৬ষ্ঠ শতকের প্রথম পাদ পর্যন্ত গয়া অঞ্চলে রাজত্ব করেন। লেখ থেকে জানা যায়, অনন্তবর্মা বরাবর গুহামন্দিরে একটি কৃষ্ণমূর্তি ও নাগার্জুনি গুহায় ভূতপতি (শিব), দেবী ও কাত্যায়নীর মূর্তি স্থাপন করেন। এই সামন্ত রাজারা ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বী ছিলেন।
  • কিন্তু যে মৌখরি রাজবংশ গুপ্তোত্তর উত্তর ভারতে বিশেষ প্রতিষ্ঠা লাভ করে, সেটি অন্য একটি মৌখরি বংশ। এই মৌখরি বংশ কান্যকুব্জের মৌখরি রাজবংশরূপে ভারতের ইতিহাসে প্রসিদ্ধ।

প্রাক্-হরিবর্মা পর্ব : পূর্বে মনে করা হত, মহারাজ হরিবর্মা আনুমানিক ৫০০ খ্রিস্টাব্দে উত্তর প্রদেশে মৌখরিরাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু হরিবর্মার শংকরপুর তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হওয়ায় এই ধারণা ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে। ৪৮৭ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ এই অভিলেখে মহারাজ গীতবর্মা ও মহারাজ বিজয়বর্মা নামে হরিবর্মার যথাক্রমে পিতামহ ও পিতার নাম উল্লিখিত হয়েছে। এ থেকে প্রমাণিত হয়, এ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা হরিবর্মা নন, প্রতিষ্ঠাতা হরিবর্মার পিতামহ গীতবর্মা। দ্বিতীয়ত, এই লেখ প্রমাণ করছে, উত্তরপ্রদেশে এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হয়নি, প্রতিষ্ঠা হয়েছে মধ্যপ্রদেশের বাঘেলখণ্ড অঞ্চলে। গীতবর্মা ও তাঁর পুত্র বিজয়বর্মা উভয়েই গুপ্ত রাজাদের অধীনস্থ সামন্ত ছিলেন। দীনেশচন্দ্র সরকার তাঁদের রাজত্বকাল যথাক্রমে আ. ৪৬০-৭০ ও আ. ৪৭০-৮০ খ্রিস্টাব্দে ধার্য করেছেন।

মহারাজ হরিবর্মা (আ. ৪৮০-৫০০ খ্রিস্টাব্দ) : ৪৮৭ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ তাঁর একখানি তাম্রশাসন মধ্যপ্রদেশের সিধি জেলার শংকরপুর গ্রামে আবিষ্কৃত হয়েছে। মহারাজ হরিবর্মা বাঘেলখণ্ডে গুপ্তসম্রাট বুধগুপ্তের অধীনস্থ এক সামন্ত রাজা ছিলেন। হরাহা অভিলেখে তাঁকে ‘জ্বালামুখ’ বলা হয়েছে। কথাটির প্রকৃত তাৎপর্য বোঝা দায়।

মহারাজ আদিত্যবর্মা (আ. ৫০০-২০ খ্রিস্টাব্দ) : হরিবর্মার মৃত্যুর পর রানি জয়স্বামিনীর গর্ভজাত পুত্র আদিত্যবর্মা পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। আদিত্যবর্মার পত্নী হর্ষগুপ্তা। হর্ষগুপ্তা সম্ভবত পূর্ব মালবের উত্তরকালীন গুপ্তরাজ হর্ষগুপ্তের ভগিনী ছিলেন। বৈবাহিক সম্পর্কের ফলে মৌখরি ও উত্তরকালীন গুপ্ত রাজপরিবার দু’টি মৈত্রীসূত্রে আবদ্ধ হয়।

মহারাজ ঈশ্বরবর্মা (আ. ৫২০-৪০ খ্রিস্টাব্দ) : আদিত্যবর্মার মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র, রানি হর্ষগুপ্তার গর্ভজাত সন্তান, ঈশ্বরবর্মা মৌখরিরাজ্যের সামন্তরাজপদে অভিষিক্ত হন। তাঁর পত্নী উপগুপ্তা। তিনি সম্ভবত উত্তরকালীন গুপ্ত রাজপরিবারের কন্যা ছিলেন। আদিত্যবর্মার শাসনকালে উত্তরকালীন গুপ্ত রাজপরিবারের সঙ্গে যে মৈত্রীবন্ধন গড়ে ওঠে, তাঁর সময়ে তা সুদৃঢ় হয়। জৌনপুর অভিলেখে এক মৌখরিরাজের কীর্তিকলাপ বর্ণিত হয়েছে। লেখটির চতুর্থ ছত্রে ঈশ্বরবর্মার নাম স্পষ্টাক্ষরে লিপিবদ্ধ আছে। অনুমিত হয়, যাঁর বিজয়কাহিনি এই লেখে বর্ণিত হয়েছে, তিনি ঈশ্বরবর্মা। লেখটির পরবর্তী অংশ অত্যন্ত অস্পষ্ট, বহু কথাই অবলুপ্ত। এ অংশে ঈশ্বরবর্মার কোনও উত্তরপুরুষের নাম থাকাও বিচিত্র নয়। সেক্ষেত্রে ঈশ্বরবর্মার পরবর্তী কোনও মৌখরিরাজও এসব কৃতিত্বের অধিকারী হতে পারেন। ননীগোপাল মজুমদার, রাধাগোবিন্দ বসাক, রামশংকর ত্রিপাঠী প্রমুখ পণ্ডিতদের অভিমত, জৌনপুর অভিলেখে ঈশ্বরবর্মার রাজ্যজয়ের কথাই বর্ণিত হয়েছে। এই অভিমত গৃহীত হলে স্বীকার করতে হবে, জৌনপুর লেখে ঈশ্বরবর্মার তিনটি কৃতিত্বের পরিচয় বিধৃত আছে :

  • এক. তাঁর পরাক্রমে সশঙ্কিত অন্ধ্রনৃপতি বিন্ধ্যাঞ্চলে পলায়ন করেন। ঈশ্বরবর্মার সমকালীন বিষ্ণুকুণ্ডী রাজাই হয়তো এই অন্ধ্ৰনৃপতি।
  • দুই. মৌখরিরাজ রৈবতকও হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে সমরাভিযান পরিচালনা করেন।
  • তিন. তিনি হিংস্রপ্রকৃতির শত্রুদের পরাভূত করে মানুষের উৎকণ্ঠা দূরীভূত করেন। এখানে হয়তো হূণদের বিরুদ্ধে মৌখরিদের যুদ্ধ জয়ের প্রচ্ছন্ন উল্লেখ আছে। ঈশ্বরবর্মা সম্ভবত মিহিরকুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গুপ্তসম্রাট নরসিংহগুপ্তকে সাহায্য করেন। জৌনপুর লেখটি ঈশ্বরবর্মার রাজত্বকালে উৎকীর্ণ হলে বুঝতে হবে উত্তরপ্রদেশে তিনিই মৌখরি আধিপত্য বিস্তার করেন। কিন্তু তাঁরই রাজত্বকালে বাঘেলখণ্ড থেকে কান্যকুব্জে রাজধানী স্থানান্তরিত হয় কিনা বলা কঠিন। পরবর্তী মৌখরিরাজ ঈশানবর্মার সময় কান্যকুব্জ মৌখরিরাজ্যের রাজধানী ছিল, একথা নিঃসংশয়ে বলা যায়। তাঁর অভিধা প্রমাণ করছে, পিতা-পিতামহদের মতো তিনি আজীবন গুপ্ত রাজাদের অনুগত ছিলেন।

ঈশানবর্মা (আ. ৫৪০-৭০ খ্রিস্টাব্দ) : ক্ষুদ্র, সামন্ত মৌখরি রাজ্যটিকে যিনি এক স্বাধীন, সার্বভৌম, বৃহৎ রাষ্ট্রে পরিণত করেন, তিনি ঈশানবর্মা। ঈশ্বরবর্মা ও উপগুপ্তার পুত্র তিনি। মৌখরি রাজবংশের তিনি প্রথম মহারাজাধিরাজ। গুপ্ত সাম্রাজ্যের অবনতির সুযোগে তিনি উত্তরপ্রদেশ ও মগধে মৌখরি আধিপত্য বিস্তার করেন। মৌখরি রাজবংশের সর্বশ্রেষ্ঠ নরপতি তিনি। ৫৫৪ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ হরাহা লেখে ঈশানবর্মা দাবি করেছেন, তিনি অন্ধ্র ও শূলিক নৃপতিদ্বয়কে পরাভূত করেন এবং সমুদ্রাশ্রয়ী গৌড়দের (গৌড়ান্ সমুদ্রাশ্রয়ান্) তাঁদের নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে আবদ্ধ রাখেন। (সুধাকর চট্টোপাধ্যায় (Early History of North India (Calcutta, 1968), পৃষ্ঠা ২৫২) অভিমত প্রকাশ করেছেন, ঈশানবর্মা তাঁর পিতার রাজত্বকালেই অন্ধ্র, শূলিক ও গৌড়দের পরাজিত করেন। তাহলে স্বীকার করতে হয়, সিংহাসনে আরোহণের পর ঈশানবর্মা নতুন কোনও কৃতিত্ব অর্জন করেননি। সেক্ষেত্রে ঈশ্বরবর্মাই মৌখরি রাজবংশের প্রথম মহারাজাধিরাজরূপে গণ্য হতেন। কিন্তু মৌখরি বংশের প্রথম মহারাজাধিরাজ ঈশানবর্মা। রাজারূপে তাঁর সাফল্যের পরিপ্রেক্ষিতেই তাঁর উপর এই মর্যাদাব্যঞ্জক অভিধা প্রযুক্ত হয়েছে।) ঈশানবর্মার হস্তে পরাজিত অন্ধ্রনৃপতি সম্ভবত বিষ্ণুকুণ্ডী রাজা প্রথম মাধববর্মা। যে শূলিকদের তিনি পরাজিত করেন তাঁদের সঠিক পরিচয় অজ্ঞাত। হেমচন্দ্র রায় চৌধুরী তাঁদের চালুক্যদের সঙ্গে এক ও অভিন্নরূপে চিহ্নিত করেছেন। রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন শূলিকেরা হূণ জাতির এক শাখা ছিলেন এবং ঈশানবর্মার সময় তাঁরা উত্তর-পশ্চিম ভারতে রাজত্ব করতেন। তিনি আরও বলেন, শূলিকদের পরাজিত করে ঈশানবর্মা হূণ রাজ্যের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল অধিকার করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আদিত্যসেনের আফসড় অভিলেখে হূণদের বিরুদ্ধে ঈশানবর্মার বিজয়লাভের ইঙ্গিত আছে। কিন্তু শূলিকেরা যে হূণদের এক শাখা ছিলেন তা প্রমাণসিদ্ধ নয়। শূলিকদের পরিচিতি সম্পর্কে হেমচন্দ্র রায়চৌধুরীর অভিমতই যুক্তিসংগত মনে হয়। চালুক্যরা কখনও কখনও লেখে চলিক্য, সোলকি ও সোলঙ্কি নামে অভিহিত হয়েছেন। বিষ্ণুকুণ্ডী ও চালুক্য শক্তির বিরুদ্ধে জয়লাভের ফলে মৌখরিরাজ্যের সীমানা বৃদ্ধি পায়, এরূপ ভাবনা অসংগত বলেই মনে হয়। গৌড়ও ঈশানবর্মার অধিকারভুক্ত ছিল না। হরাহা লেখে সেরূপ দাবিও উত্থাপিত হয়নি। শূলিকেরা হয়তো হূণ নন কিন্তু হূণদের বিরুদ্ধে ঈশানবর্মা যে বিজয়লাভ করেন তা বোধহয় অনস্বীকার্য। হূণদের বিরুদ্ধে তাঁর বিজয় তাঁর রাজত্বকালের ঘটনা নয়, পিতার জীবিতকালেই তিনি সম্ভবত হূণদের পরাজিত করেন। হূণরাজ তোরমাণের অনুকরণে তিনি মুদ্রাও উৎকীর্ণ করেন।

উত্তরকালীন গুপ্ত রাজপরিবারের সঙ্গে মৌখরিদের যে প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল ঈশানবর্মার রাজত্বকালে তার অবসান হয়। ঈশানবর্মা ও তাঁর সমকালীন পরবর্তী গুপ্তনৃপতি প্রথম কুমারগুপ্ত উভয়েই উচ্চাভিলাষী ছিলেন। তাঁরা দু’জনেই উত্তর ভারতে রাজ্য বিস্তারে সচেষ্ট ছিলেন। স্বাভাবিক কারণেই তাঁরা পরস্পরের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে অবতীর্ণ হন। আফসড় লেখে বলা হয়েছে, কুমারগুপ্ত চন্দ্রমাসদৃশ ঈশানবর্মার সৈন্যদলকে পরাভূত করেন। কিন্তু মৌখরিদের বিরুদ্ধে বিজয়লাভের অব্যবহিত পরই কুমারগুপ্ত প্রয়াগে দেহত্যাগ করেন। ফলে এই পরাজয়ে ঈশানবর্মার বিশেষ ক্ষতি হয়নি। কুমারগুপ্তের পুত্র ও উত্তরাধিকারী দামোদরগুপ্তের সঙ্গেও ঈশানবর্মার সংঘর্ষ হয়। আফসড় লেখে ঘোষিত হয়েছে, যে মৌখরির হস্তিবাহিনী দুর্ধর্ষ হূণসৈন্যগণকে চূর্ণ করে, দামোদরগুপ্ত সেই হস্তিবাহিনী ছত্রভঙ্গ করেন। কিন্তু দামোদরগুপ্ত যুদ্ধ ক্ষেত্রেই প্রাণত্যাগ করেন। মৌখরিরাজ্য অধিগ্রহণের যে সুযোগ দামোদরগুপ্তের নিকট এসেছিল তাঁর অকালমৃত্যুতে তা ধূলিসাৎ হয়।

উত্তরপ্রদেশের পূর্বাঞ্চল ঈশানবর্মার রাজভুক্ত ছিল। এই অঞ্চলেই ঈশ্বরবর্মার (?) জৌনপুর অভিলেখ আবিষ্কৃত হয়েছে। ঈশানবর্মার হরাহা শিলালেখ পাওয়া গেছে বড়াবন্ধী জেলার হরাহা গ্রামে। তাঁর উৎকীর্ণ মুদ্রাও প্রধানত এই অঞ্চলেই আবিষ্কৃত হয়েছে। মগধ ঈশানবর্মার অধিকারভুক্ত ছিল। পাণ্ডুবংশী রাজা মহাশিবগুপ্ত বালার্জুনের সিরপুর লেখে বলা হয়েছে, মহাশিব গুপ্তের মাতা বাসটা ছিলেন মগধে আধিপত্য-সমৃদ্ধ নিষ্কলঙ্ক বর্মা বংশের রাজা সূর্যবর্মার কন্যা। (ঈশানবর্মার মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র শর্ববর্মা রাজপদ গ্রহণ করেন, সূর্যবর্মা নন। অনুমিত হয়, পিতার জীবদ্দশায় সূর্যবর্মা লোকান্তরিত হন।) হরাহা প্রশস্তিতে সূর্যবর্মা নামে ঈশানবর্মার এক পুত্রের উল্লেখ আছে। সিরপুর এবং হরাহা লেখদ্বয়ের সূর্যবর্মা সম্ভবত এক ও অভিন্ন ব্যক্তি। সিরপুর লেখে উল্লিখিত বর্মা রাজবংশ নিঃসন্দেহে মৌখরি রাজপরিবার। মগধ যে ঈশানবর্মার অধিকারভুক্ত ছিল সিরপুর লেখের সাক্ষ্যে তা প্রমাণিত।

মহারাজাধিরাজ শর্ববর্মা (আ. ৫৭০-৮৫ খ্রিস্টাব্দ) : ঈশানবর্মা ও মহিষী লক্ষ্মীবতীর পুত্র শর্ববর্মা মৌখরিরাজ্যের পরবর্তী মহারাজাধিরাজ। সুযোগ্য পিতার সুযোগ্য সন্তান তিনি। পিতার নিকট থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে যে বিস্তীর্ণ রাজ্য তিনি লাভ করেন শর্ববর্মা তা শুধু অক্ষুণ্ণই রাখেননি, তার দক্ষিণ সীমান্তের বিস্তৃতিও ঘটান।

প্রতীহাররাজ প্রথম ভোজের বরা তাম্রশাসনে দেখা যায়, পরমেশ্বর শর্ববর্মা কালঞ্জর-মণ্ডলে অর্থাৎ বর্তমান বান্দা অঞ্চলে যে গ্রামটি দান করেন, পরবর্তী কালে প্রথম ভোজের পিতামহ দ্বিতীয় নাগভট সে দান অনুমোদন করেন। বরা লেখের পরমেশ্বর শর্ববর্মা আর মৌখরিরাজ শর্ববর্মা সম্ভবত এক ও অভিন্ন ব্যক্তি। বান্দা অঞ্চল সম্ভবত ঈশানবর্মার অধিকারভুক্ত ছিল না। এ অঞ্চলে মৌখরি প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা শর্ববর্মারই কৃতিত্ব বলে মনে হয়। শর্ববর্মার একটি সিলমোহর মধ্যপ্রদেশের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত বুরহানপুরের নিকট পাওয়া গেছে। কেউ কেউ বলেন, শর্ববর্মার রাজ্য দক্ষিণে বুরহানপুর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। (সুধাকর চট্টোপাধ্যায় (তদেব, পৃষ্ঠা ২৭২) মনে করেন; এই সিলমোহরটি বুরহানপুরের নিকটবর্তী অসির গড়ে উৎকীর্ণ হয়। তাঁর অভিমত, বাদামির চালুক্য রাজাদের উত্তরমুখী অভিযান প্রতিহতের উদ্দেশ্যে শর্ববর্মা অসিরগড়ে এক সৈন্যশিবির স্থাপন করেন। এ অভিমত কল্পনা-লালিত।) এ অভিমত যথার্থ নয়।

  • প্রথমত, মালব অধিকার না করে মৌখরিরাজের পক্ষে বুরহানপুর জয় করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু মালবে তখন মহাসেনগুপ্ত এবং ভাস্করবর্মা বা তাঁর পুত্র কুমারবর্মা রাজত্ব করতেন।
  • দ্বিতীয়ত, শর্ববর্মার যে সিলমোহরটি পাওয়া গেছে সেটি মূল সিলমোহর নয়, মূল সিলমোহরের অনুকৃতি মাত্র। আর সেটি ছিল সিন্ধিয়া-রাজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। সিন্ধিয়ারাজ সেটি হয়তো অন্য কোনও স্থান থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। তাছাড়া সিলমোহর অতি সহজেই স্থানান্তরিত হতে পারে।

হিমাচলপ্রদেশের কাংড়া অঞ্চল শর্ববর্মার রাজ্যভুক্ত ছিল, এ মর্মে এক অভিমত ব্যক্ত হয়েছে। মহারাজ সমুদ্রসেনের নিরমণ্ড অভিলেখে শর্ববর্মা নামে জনৈক মহারাজের এ অঞ্চলে কিছু জমি দানের উল্লেখ আছে। কিন্তু এই শর্ববর্মাই যে মৌখরি শর্ববর্মা তা নিশ্চিতরূপে বলা যায় না। প্রথমত, মৌখরি শর্ববর্মা ছিলেন একজন মহারাজাধিরাজ। পক্ষান্তরে নিরমণ্ড অভিলেখের শর্ববর্মা নিছকই একজন মহারাজ। দ্বিতীয়ত, কাংড়া অঞ্চল জয় করতে হলে শর্ববর্মাকে পুষ্যভূতি রাজ্যের ভিতর দিয়ে সসৈন্যে অগ্রসর হতে হত। কিন্তু তা সম্ভব ছিল না। নিরমণ্ড অভিলেখের শর্ববর্মা অবশ্যই অন্য কোনও শর্ববর্মা। দ্বিতীয় জীবিতগুপ্তের দেওবরণাক লেখ থেকে জানা যায়, মগধ শর্ববর্মার রাজ্যভুক্ত ছিল। শর্ববর্মা মুদ্রা উৎকীর্ণ করেন।

মহারাজাধিরাজ অবন্তিবর্মা (আ. ৫৮৫-৬০০ খ্রিস্টাব্দ) : শর্ববর্মার মৃত্যুর পর তাঁর মহিষী ইন্দ্রভট্টারিকার গর্ভজাত পুত্র অবন্তিবর্মা পিতৃসিংহাসনে আরোহণ করেন। দ্বিতীয় জীবিতগুপ্তের দেওবরণাক অভিলেখে তাঁর মগধে রাজত্বের উল্লেখ আছে। তাঁর নামে উৎকীর্ণ বহুসংখ্যক মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। তিনি যে একজন পরাক্রমশালী ও মাননীয় নরপতি ছিলেন, বাণের সাক্ষ্যে তা প্রমাণিত।

মহারাজাধিরাজ গ্রহবর্মা (আ. ৬০০-০৫ খ্রিস্টাব্দ) : মৌখরিদের কোনও সিলমোহর বা লেখে গ্রহবর্মার নাম উল্লিখিত হয়নি। কিন্তু হর্ষচরিতের সাক্ষ্যে অনুমিত হয়, তিনি অবন্তিবর্মার জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন এবং পিতার মৃত্যুর পর কান্যকুজের সিংহাসনে অভিষিক্ত হন। হর্ষচরিতে বলা হয়েছে, গ্রহবর্মা প্রভাকরবর্ধনের কন্যা রাজ্যশ্রীকে স্বয়ং পাত্রীরূপে মনোনীত করেন এবং বিবাহ বিষয়ে আলাপ-আলোচনার জন্য নিজের এক প্রতিনিধিকে স্থান্বীশ্বরের রাজসভায় প্রেরণ করেন। বিবাহের কথাবার্তা বা বিবাহের বর্ণনা প্রসঙ্গে বাণভট্ট একবারও অবন্তিবর্মার নাম উচ্চারণ করেননি। সম্ভবত গ্রহবর্মার বিবাহের পূর্বেই অবন্তিবর্মার মৃত্যু হয়। গ্রহবর্মা বেশি দিন শান্তিতে রাজত্ব করতে পারেননি। হর্ষচরিতে দেখা যায়, পিতার মৃত্যুর পর যখন রাজ্যবর্ধনহর্ষবর্ধন রাজপদ গ্রহণের জন্য একে অপরকে অনুরোধ করছেন, তখন তাঁদের কাছে খবর আসে, মালবরাজ গ্রহবর্মাকে নিহত করেছেন, রাজ্যশ্রী কান্যকুব্জে কারারুদ্ধ হয়েছেন, আর কান্যকুব্জ অধিকার করে বিজয়ী মালবনৃপতি স্থাথ্বীশ্বর আক্রমণে উদ্যত হয়েছেন। এভাবে এক দুঃখজনক ঘটনার মধ্য দিয়ে আনুমানিক ৬০৫ খ্রিস্টাব্দে অকালে গ্রহবর্মার জীবনদীপ নির্বাপিত হয়।

মহারাজাধিরাজ সুব বা সুচ : নালন্দায় প্রাপ্ত একটি সিলমোহরে অবন্তিবর্মার এক পুত্রের উল্লেখ আছে। তাঁর নামের আদ্যাক্ষর সু ও দ্বিতীয় অক্ষর ব অথবা চ। দীনেশচন্দ্র সরকার মনে করেন, তাঁর প্রকৃত নাম সুব্রতবর্মা। কিন্তু তিনি সুচন্দ্রবর্মাও হতে পারেন। অধ্যাপিকা দেবাহুতি অভিমত প্রকাশ করেছেন, অবন্তিবর্মার এই কনিষ্ঠ পুত্র গ্রহবর্মার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হন এবং শশাঙ্কের অভুত্থানের পূর্বকাল পর্যন্ত মগধে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করেন। এ অভিমত সম্ভবত ঠিক নয়। মনে হয়, গ্রহবর্মা অপুত্রক অবস্থায় নিহত হলে তাঁর অনুজ সুব বা সুচ কান্যকুব্জের সিংহাসনে আরোহণ করেন। হয়তো তাঁর কান্যকুজের সিংহাসনলাভে মালবরাজের সমর্থন ছিল। সম্ভবত এই সুব বা সুচকে বিতাড়িত করে পুষ্যভূতিরাজ হর্ষবর্ধন ৬১২ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে কান্যকুব্জে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। মহারাজাধিরাজ সুব বা সুচের উচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গেই ভারতের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চ থেকে মৌখরি রাজগণের চিরবিদায় ঘটল না। চিনা পরিব্রাজক শুয়েন চাঙ খ্রিস্টীয় ৭ম শতকে পূর্ণবর্মা নামে যে মগধাধিপতির উল্লেখ করেছেন, অনেকেই তাঁকে জনৈক মৌখরিরাজরূপে শনাক্ত করেছেন। খ্রিস্টীয় ৭ম শতকের মধ্যভাগে মগধেশ্বর আদিত্যসেনের এক কন্যার যিনি পাণিগ্রহণ করেন, সেই মহারাজ ভোগবর্মাও মৌখরিবংশীয় ছিলেন।

মৌখরি-অব্দ (?) : অভিমত ব্যক্ত হয়েছে, মৌখরিরা আনুমানিক ৪৯৯ বা ৫০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে মৌখরি-অব্দ প্রচলন করেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ঈশানবর্মার সুবিখ্যাত হরাহা লেখে যে অব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, সেটি বিক্রমাব্দ, মৌখরি-অব্দ নয়। ঈশানবর্মা, শর্ববর্মা ও অবন্তিবর্মা যেসব মুদ্রা উৎকীর্ণ করেছেন তা সবই তিন অঙ্কের তারিখের। এই তারিখগুলোর পাঠ সম্পর্কে পণ্ডিতে পণ্ডিতে মতদ্বৈধ আছে ঠিকই তবে তৃতীয় অঙ্কের তারিখটি যে দুই, অর্থাৎ দ্বিশত, সে বিষয়ে সকলেই সুনিশ্চিত। মুদ্রার এ তারিখগুলো মৌখরি-অব্দ সম্পর্কিত হলে ঈশানবর্মার রাজত্বকাল খ্রিস্টীয় ৮ম শতকে ধার্য করতে হয়। কিন্তু ঈশানবর্মা যে ৫৫৪ খ্রিস্টাব্দে রাজপদে সমাসীন ছিলেন, তা হরাহা লেখের সাক্ষ্যে সুপ্রমাণিত। মুদ্রায় ব্যবহৃত অব্দটি গুপ্তাব্দ বলেই অনুমিত হয়।

ওড়িশার কতিপয় আঞ্চলিক রাজবংশ

বিগ্রহ রাজবংশ : ৫৭০ খ্রিস্টাব্দেও ওড়িশায় গুপ্ত আধিপত্য বিরাজমান ছিল। গঞ্জাম জেলার খল্লিকোটের সন্নিকটবর্তী সুমণ্ডল গ্রামে ২৫০ গুপ্তাব্দ বা ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ মহারাজ ধর্মরাজের একখানি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হয়েছে। এই লেখে বলা হয়েছে, পৃথিবীবিগ্রহ যখন গুপ্তরাজ্যভুক্ত কলিঙ্গ রাষ্ট্রের প্রশাসক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন তখন তাঁর অধীনস্থ মহারাজ ধর্মরাজ খল্লিকোটের নিকটস্থ পদ্মখোলিতে রাজত্ব করতেন। পৃথিবীবিগ্রহ ছিলেন বিগ্রহ পরিবারভুক্ত এক ক্ষমতাবান প্রশাসক। কাগজে-কলমে গুপ্ত রাজাদের অনুগত হলেও তিনি কার্যত স্বাধীনই ছিলেন। মহারাজ অভিধাভূষিত খল্লিকোটের আঞ্চলিক রাজা ধর্মরাজ তাঁর অনুগত ছিলেন। উত্তরে মেদিনীপুরের সীমান্ত থেকে দক্ষিণে গঞ্জাম পর্যন্ত সুবিস্তীর্ণ অঞ্চলের শাসনকর্তা ছিলেন তিনি। তিনি ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের পর ওড়িশায় এক স্বাধীন কলিঙ্গরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেন, না আজীবন গুপ্তদের অনুগত ও বিশ্বস্ত রাজপুরুষরূপে দায়িত্ব পালন করেন, তা জানা যায় না। কিন্তু ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের অনতিকাল পর বিগ্রহ পরিবার যে ওড়িশায় এক স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে, তা প্রমাণিত। ২৮০ গুপ্তাব্দ বা ৬০০ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ কানস তাম্রশাসনে লোকবিগ্রহ নামে বিগ্রহ পরিবারভুক্ত জনৈক মহারাজের উল্লেখ আছে। এই লেখে তিনি পরমদেবতাধিদৈবতরূপে আখ্যাত হয়েছেন; অষ্টাদশ-অটবীরাজ্য-সমন্বিত তোসলীর অধিপতিরূপে বন্দিত হয়েছেন। কিন্তু লোকবিগ্রহ অখণ্ড তোসলীর অধিপতি ছিলেন না। উত্তর তোসলী তাঁর রাজ্যভুক্ত ছিল না। সে অঞ্চল ছিল মানবংশীয় মহারাজ শম্ভুযশের অধিকারভুক্ত। লোকবিগ্রহের রাজত্ব দক্ষিণ তোসলীর পরিধির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ৬০০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর অধীনস্থ রাজপুরুষেরা দক্ষিণ তোসলীতে কতিপয় বিদ্বান ব্রাহ্মণের অনুকূলে একখানি গ্রাম দান করেন। এই ঘটনায় দক্ষিণ তোসলীতে লোকবিগ্রহের আধিপত্য প্রমাণিত হয়। কিন্তু ৬০৩ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে মহারাজ শম্ভুযশ লোকবিগ্রহ বা তাঁর উত্তরাধিকারীকে পরাজিত করে স্বাধীন বিগ্রহরাজ্যের অবসান ঘটান।

মান রাজবংশ : খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ওড়িশার এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মান রাজবংশের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রাচীনকালে ঝাড়খণ্ডের হাজারিবাগ ভূখণ্ডে মানবংশীয় নরপতিগণ রাজত্ব করতেন। ওড়িশার মানবংশ সম্ভবত ঝাড়খণ্ডের মানবংশেরই এক শাখা-পরিবার। ওড়িশায় মানবংশের একজন মাত্র রাজার নাম জানা যায়। তিনি মহারাজ শম্ভুযশ। সোরো তাম্রশাসনে তাঁকে ‘পরমদৈবতবল্পপাদানুধ্যাত’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এই কথাটির তাৎপর্য নিয়ে কিছু বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। রমেশচন্দ্র মজুমদারের অভিমত, মহারাজ শম্ভুযশ তাঁর পরমদৈবত পিতার পাদানুধ্যাত ছিলেন। এ অর্থ গ্রহণ করলে স্বীকার করতে হয়, শম্ভুযশের পিতা একজন সার্বভৌম নরপতি ছিলেন এবং শম্ভুযশ পিতৃসূত্রে রাজপদ লাভ করেন। কিন্তু ৫৭০ খ্রিস্টাব্দেও যে কলিঙ্গ গুপ্ত অধিকারভুক্ত ছিল, তার অকাট্য প্রমাণ আছে। সে সময় ওড়িশায় এক আঞ্চলিক অথচ সার্বভৌম নরপতির অস্তিত্ব অকল্পনীয়। মনে হয়, পরমদৈবত ও বগ্গপাদানুধ্যাত কথা দু’টি শম্ভুযশের বিশেষণরূপে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ পরমদৈবত শম্ভুযশ পিতার পাদানুধ্যাত ছিলেন। মহারাজ শম্ভুযশ সর্বপ্রথম উত্তর তোসলীতে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। ৫৮০ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ তাঁর সোরো তাম্রশাসন থেকে জানা যায়, তিনি সে বছর উত্তর তোসলীতে কিছু জমি প্রদান করেন। প্রমাণিত হয়, ৫৮০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বেই উত্তর তোসলীতে গুপ্ত শাসনের অবসান হয়েছে; সে অঞ্চলে মান রাজশক্তির অভ্যুত্থান ঘটেছে। উত্তর তোসলী অধিকার করেই শম্ভুযশ সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি দক্ষিণ তোসলীর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। ৭ম শতকের একেবারে গোড়ার দিকে তিনি লোকবিগ্রহ বা তাঁর উত্তরাধি কারীকে পরাজিত করে দক্ষিণ তোসলীতে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। ৬০৩ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ পাতিয়াকেল্লা তাম্রশাসনে বলা হয়েছে, পরমদেবতাধিদৈবত, পরমভট্টারক শম্ভুযশের পাদানুধ্যাত মহারাজ শিবরাজ দক্ষিণ তোসলীতে কিছু জমি দান করেন। বোঝা যায়, ৬০৩ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে শম্ভুযশ দক্ষিণ তোসলী অধিকার করেন এবং মহারাজ শিবরাজকে সে অঞ্চলের প্রশাসনিক দায়িত্বভার অর্পণ করেন। মান রাজ্য শীঘ্রই গৌড়েশ্বর শশাঙ্কের অধিকারভুক্ত হয়।

শৈলোদ্ভব রাজবংশ : খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের তৃতীয় পাদে গঞ্জাম অঞ্চলে এক নতুন রাজ বংশের অভ্যুদয় হয়। এই রাজবংশ শৈলোদ্ভব রাজবংশ নামে পরিচিত। রণভীত এই বংশের প্রথম মহারাজ। তিনি গুপ্তদের অনুগত ছিলেন। মর্যাদায় এবং ক্ষমতায় মহারাজ ধর্মরাজের সমগোত্রীয় ছিলেন তিনি। এই বংশের দ্বিতীয় রাজা সৈন্যভীত প্রথম মাধবরাজ। গুপ্ত শাসনের অবসানান্তে বিগ্রহ রাজশক্তি পরাক্রমশালী হয়ে উঠলে প্রথম মাধবরাজ লোকবিগ্রহের আনুগত্য স্বীকার করেন। প্রথম মাধবরাজের পুত্র অযশোভীত এই বংশের তৃতীয় মহারাজ। তিনি সম্ভবত দক্ষিণ তোসলাধিপতি মানরাজ শম্ভুযশের অধীনস্থ ছিলেন। এমনও হতে পারে, শম্ভুযশ দক্ষিণ তোসলের একার্ধে রাজত্ব করেন, অপরাধ ছিল শৈলোদ্ভব রাজ্যভুক্ত। কিন্তু ৭ম শতকের প্রারম্ভে শৈলোদ্ভবগণ গৌড়াধিপতি শশাঙ্কের নিকট পরাজয় বরণ করেন। প্রায় সমগ্র ওড়িশা শশাঙ্কের পদানত হয়। উত্তর ওড়িশার প্রশাসন-ভার দত্ত প্রশাসকদের হস্তে ন্যস্ত হয়; মহারাজ অযশোভীতের পুত্র ও উত্তরাধিকারী সৈন্যভীত মাধববর্মা শশাঙ্কের বশীভূত মিত্ররূপে কোঙ্গোদ মণ্ডল তথা দক্ষিণ ওড়িশায় রাজত্ব করেন। শৈলোদ্ভবরাজ্যের রাজধানী কোঙ্গোদ। লেখমালায় শহরটিকে শালিমা নদীতীরবর্তী রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। গঞ্জাম অঞ্চলের বর্তমান সালিয়াই প্রাচীন শালিমা। নদীটি চিল্কাহ্রদে গিয়ে পড়েছে। সম্ভবত গঞ্জাম জেলার বর্তমান বাণপুরই প্রাচীন কোঙ্গোদ নগর। বাণপুর শহরের পাশ দিয়ে সালিয়া নদী বয়ে চলেছে। এ স্থানে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ ৭ম শতকীয় বহু প্রত্নতাত্ত্বিক অবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে।

গ্রন্থপঞ্জি

  • দীনেশচন্দ্র সরকার : পাল-পূর্ব যুগের বংশানুচরিত (কলকাতা, ১৯৮৫)।
  • নীহাররঞ্জন রায় : বাঙ্গালীর ইতিহাস (কলকাতা, ১৯৯৩)। Chattopadhyaya, S.: Early History Of North India (Calcutta, 1968).
  • Choudhury, P. C. : The History of Civilisation of The People of Assam (Gauhati, 1966).
  • Devahuti, D: Harsha: A Political Study (New Delhi, 1998).
  • Ganguly, D. K.: Historical Geography And Dynastic History Of Orissa Up To The Rise Of The Imperial Gangas (Calcutta, 1975).
  • Jain, K. C.: Madhya Pradesh Through The Ages (New Delhi, 1997). Majumdar, R. C.: History Of Ancient Bengal (Calcutta, 1971).
  • Majumdar, R. C. (Ed.) : The Classical Age (Bombay, 1962); A Comprehensive History Of India, Vol. III, Part I (New Delhi, 1981).
  • Raychaudhuri, H. C. : Political History of Ancient India (Calcutta, 1953).
  • Sen, B. C. : Some Historical Aspects Of The Inscriptions of Bengal (Calcutta, 1942).
  • Sinha, B. P. : The Decline Of The Kingdom of Magadhu (Patna, 1954).
  • Virji, K. J. : Ancient History of Saurashtra (Bombay, 1955).

পশ্চিম মালবের ঔলিকর রাজবংশ (খ্রি. ৪র্থ-৬ষ্ঠ শতক)

ঔলিকররা (Aulikaras) মৌর্য যুগ থেকেও একটি প্রাচীন ভারতীয় বংশ ছিল, যা খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতাব্দী থেকে ৬ষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যে একটি রাজ্যে আবির্ভূত হয়েছিল। তাদের অবস্থান ছিল মান্দসৌরের কাছে মধ্য ভারতের মালব অঞ্চলে, তাদের শক্তি কেন্দ্র ছিল বর্তমান পশ্চিম মধ্য প্রদেশ, দক্ষিণ-পূর্ব রাজস্থান এবং উত্তর-পূর্ব গুজরাটের কাছাকাছি। এই গোত্রের দুটি রাজবংশ ৩৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৫৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মধ্য প্রদেশ রাজ্যের বর্তমান পশ্চিম মালব অঞ্চলে শাসন করেছিল, যার বেশিরভাগই ছিল গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীনে। ঔলিকরদের বেশ কয়েকটি প্রধান এবং গুরুত্বপূর্ণ লেখ সম্পর্কে জানা যায়। এই লেখগুলি ইঙ্গিত দেয় যে তারা গুপ্ত শৈলীর বেশ কিছু শিব, সূর্য ও বিষ্ণুর উল্লেখযোগ্য মন্দির এবং বৌদ্ধ মঠ তৈরি করেছিল, যেগুলো পশ্চিম মধ্য প্রদেশ এবং পূর্ব রাজস্থানে অবস্থিত। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ধ্বংসাবশেষগুলি মান্দসৌরের নিকটবর্তী অঞ্চলে এবং কোটা ও ঝালাওয়ারের মধ্যবর্তী দারা মুকুন্দরা উপত্যকাপথের মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ভীম কি চৌরি। লেখমালাভিত্তিক আবিষ্কারগুলি নিজেদেরকে ঔলিকর হিসাবে দাবি করা এবং দশপুরা (বর্তমান মান্দসৌর) থেকে শাসন করা দুটি রাজবংশকে আলোকিত করে। প্রথম রাজবংশটি দশপুরা থেকে শাসন করত, উত্তরাধিকারের ক্রমানুসারে এর রাজারা ছিলেন জয়বর্মা, সিংহবর্মা, নরবর্মা, বিশ্ববর্মা এবং বন্ধুবর্মা। ১৯৮৩ সালে আবিষ্কৃত রাইস্থান পাথরের স্ল্যাব অভিলেখটি আরও একটি রাজবংশকে খুঁজে পেয়েছে, উত্তরাধিকারের ক্রমানুসারে এর রাজারা হলেন : দ্রুমবর্ধন, জয়বর্ধন, অজিতবর্ধন, বিভীষণবর্ধন, রাজ্যবর্ধন এবং প্রকাশধর্মা (যিনি তোরমানকে পরাজিত করেছিলেন)। সর্বোপরি, যশোধর্মাও এই রাজবংশেরই অন্তর্গত ছিলেন, তিনি প্রকাশধর্মার পুত্র ও উত্তরাধিকারী ছিলেন। যশোধর্মা মিহিরকুলকে পরাজিত করেন এবং মালব অঞ্চলকে হূণদের হাত থেকে মুক্ত করেন। তার মৃত্যুর সাথে সাথেই মালবে ঔলিকরদের শাসন শেষ হয়েছিল। ঔলিকরদের লেখগুলোতে তাদের উৎপত্তি সম্পর্কে কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। দেখা যায় তারা তাদের গুপ্তযুগের শিলালেখগুলোতে গুপ্তদের সামন্ত হওয়া সত্ত্বেও মালব সম্বাত ব্যবহার করেছে, তাই ঐতিহাসিক দীনেশচন্দ্র সরকার ধরে নিয়েছেন যে তারা কোন মালব গোষ্ঠী ছিল। তার এই মতকে কে. কে. দাসগুপ্ত ও কে. সি. জৈন সমর্থন করেছেন।

প্রথম রাজবংশ : এই রাজবংশ সম্পর্কিত তথ্য পাওয়া যায় নরবর্মার দুটো লেখ থেকে, একটি ৪০৪ খ্রিস্টাব্দের মান্দসৌর লেখ, আরেকটি ৪১৭ সালের বিহার কোট্রা লেখ। এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জয়বর্মা। তার উত্তরাধিকার ছিলেন তার পুত্র সিংহবর্মা, যাকে ক্ষিতীশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তার পুত্র ও উত্তরাধিকারী নরবর্মাকে পৃথ্বী ও মহারাজ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তার পদবি ছিল সিংহবিক্রন্তগামী (যিনি সিংহের টানা গাড়িতে চলেন)। নরবর্মার পর আসেন তার পুত্র বিশ্ববর্মা, বিশ্ববর্মার ৪২৩ সালের গান্ধার লেখে তার উল্লেখ আছে। তারপর আসেন বন্ধুবর্মা, কবি বৎসভট্টি ৪৭৩ সালে মন্দাসৌর শিলালেখে যার প্রশস্তি রচনা করেছেন। এখানে বলা হয়, তিনি গুপ্ত সম্রাট প্রথম কুমারগুপ্তের একজন সামন্ত ছিলেন। তার শাসনামলে ৪৩৬ সালে একটি সূর্যমন্দির নির্মিত হয়, যা তৈরি করেছিল দশপুরার রেশমশিল্পীদের গিল্ড। ৪৭৩ সালে একই গিল্ড মন্দিরটির নবায়ন করে।

মধ্যবর্তী কাল : বন্ধুবর্মার পর দশপুরার ইতিহাস স্পষ্ট নয়। ৪৬৭ সালের রবিলা লিখিত একটি মন্দসৌর লেখে আছে, প্রভাকর নামে দশপুরার একজন রাজা গুপ্তদের শত্রুদেরকে পরাজিত করেন। দত্তভট ছিলেন সেই সেনাদলের সেনাপতি, এই শিলালেখে লেখা আছে দত্তভট লোকোত্তর বিহারে অনুদান দেন। প্রভাকরের পরই আরেকটি ঔলিকর পরিবার ক্ষমতায় আসে, যার সম্পর্কে রিশথাল শিলালেখ থেকে জানা যায়। এই দুই রাজকীয় পরিবারের মধ্যে ঠিক কী সম্পর্ক ছিল তা জানা যায়না।

দ্বিতীয় রাজবংশের সূচনা ও এর প্রথম দিকের রাজারা : দ্বিতীয় ঔলিকর রাজবংশ ঔলিকরদের প্রাচীন গোত্রের অন্তর্গত ছিল এবং এটি এই গোত্রের অন্তর্গত দ্বিতীয় রাজবংশ ছিল, যা মালব মালভূমির উপর শাসন করেছিল এবং যশোধর্মার বিষ্ণুবর্ধনের অধীনে একটি বিশাল অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করেছিল, যা প্রায় সমগ্র উত্তর ভারত এবং দাক্ষিণাত্যের মালভূমির কিছু অংশ নিয়ে গঠিত। এটি ছিল ঔলিকর বংশের দ্বিতীয় রাজবংশ। প্রথম ঔলিকর রাজবংশের বিপরীতে, এই রাজবংশটি কখনই গুপ্তদের সামন্ত ছিল না। রিস্থাল লেখে দ্রুমবর্ধনকে এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি সেনাপতি উপাধি গ্রহণ করেন এবং তার পুত্র জয়বর্ধন তার স্থলাভিষিক্ত হন, যিনি একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেন। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন তাঁর পুত্র অজিতবর্ধন। রিস্থাল লেখ অনুসারে, তিনি বারবার যজ্ঞ করতেন। অজিতবর্ধনের স্থলাভিষিক্ত হন তাঁর পুত্র বিভীষণবর্ধন। রিস্থাল লেখে তিনি তার মহৎ গুণাবলীর জন্য প্রশংসিত হয়েছিলেন। বিভীষণবর্ধনের পুত্র ও উত্তরসূরি রাজ্যবর্ধন তার পৈতৃক রাজ্য প্রসারিত করেছিলেন। রাজ্যবর্ধনের স্থলাভিষিক্ত হন তাঁর পুত্র প্রকাশধর্মা।

প্রকাশধর্মা : প্রকাশধর্মা এই রাজবংশের একজন উল্লেখযোগ্য রাজা ছিলেন, যিনি অধীরাজ উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। রিস্থাল লেখ আমাদের তার অর্জন সম্পর্কে তথ্য দেয়। এটি প্রকাশধর্মার রাজস্থানীয় (ভাইসরয়) ভগবদ্দোষ দ্বারা রিস্থালে একটি জলাধার এবং একটি শিব মন্দির নির্মাণের কথা বলে। এই লেখে উল্লেখ করা হয়েছে যে প্রকাশধর্মা হূণ শাসক তোরামানকে পরাজিত করেছিলেন, তার শিবিরকে উচ্ছেদ করেছিলেন এবং তার হারেমের নারীদের নিজ অধিকারভূক্ত গিয়েছিলেন। তাঁর রাজত্বকালে রিস্থাল নির্মিত জলাধারটি তাঁর পিতামহের নামে বিভীষণসারা নামে নামকরণ করা হয়েছিল। তিনি দশপুরাায় ব্রহ্মাকে উৎসর্গীকৃত একটি মন্দিরও নির্মাণ করেছিলেন। ১৯৭৮ সালে বিক্রম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দল, উজ্জয়িনীতে ভি. এস. ওয়াকানকরের নেতৃত্বে মান্দসৌরে খননের সময়, শ্রী প্রকাশধর্মার নামাঙ্কিত দুটি কাচের সীল পাওয়া যায়। সমস্ত সম্ভাবনায় তিনি তাঁর পুত্র যশোধর্মা বিষ্ণুবর্মা তার পর এই বংশের শাসক হন। একটি খণ্ডিত মান্দসৌর লেখে আদিত্যবর্ধন নামে একজন করদরাজ্য শাসক এবং তার সামন্ত মহারাজ গৌরীর নাম পাওয়া যায়। ইতিহাসবিদ অশ্বিনী আগরওয়াল আদিত্যবর্ধনকে সম্প্রতি প্রকাশধর্মার সাথে চিহ্নিত করেছেন। মিত্রসোমের পুত্র ভ্রমরসোমের দ্বারা লিখিত ছোটি সাদ্রি লেখটি মালব সম্বত ৫৪৭ (৪৯০ খ্রিস্টাব্দ) তারিখে আদিত্যবর্ধনের সামন্ত শাসক মহারাজ গৌরীর বংশানুক্রমিকতা পাওয়া যায়। এই মানবযানী ক্ষত্রিয় পরিবারের প্রথম শাসক ছিলেন পুণ্যসোম। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন তাঁর পুত্র রাজ্যবর্ধন। রাষ্ট্রবর্ধন ছিলেন রাজ্যবর্ধনের পুত্র। রাষ্ট্রবর্ধনের পুত্র ও উত্তরসূরি ছিলেন যশোগুপ্ত। এই পরিবারের শেষ শাসক গৌরী ছিলেন যশোগুপ্তের পুত্র। তিনি তার মৃত মাকে স্মরণ করে দশপুরাায় একটি জলাধার খনন করেছিলেন। এই লেখে একজন রাজকুমার, গোভট্টের নামও উল্লেখ করা হয়েছে, তবে গৌরীর সাথে তার সম্পর্কের কথা জানা যায়নি।

যশোধর্মা : এই রাজবংশের সবচেয়ে বিশিষ্ট এবং সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন যশোধর্মা বিষ্ণুবর্ধন। মান্দসৌরে যশোধর্মার তিনটি লেখ পাওয়া গেছে। এই সমস্ত লেখগুলি ১৮৮৬ সালে জন ফেইথফুল ফ্লিট দ্বারা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।

  • এর মধ্যে একটি, যশোধর্মা-বিষ্ণুবর্ধনের মান্দসৌর পাথরের লেখটি ৫৩২ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ করা হয়।
  • যশোধর্মার দুটি অভিন্ন জলমগ্ন মান্দসৌর বিজয় স্তম্ভ লেখ (বর্তমান মান্দসৌর শহরের কাছে সোন্দানিতে পাওয়া যায়)। মান্দসৌর জেলার সোন্দানির এই দুটি মনোলিথিক স্তম্ভে যশোধর্মা তার জয়ের রেকর্ড হিসাবে তৈরি করেছিলেন।
  • মালব সম্বত ৫৮৯ (৫৩২ খ্রিস্টাব্দ) তারিখের একটি পাথরের লেখে যশোধর্মার সামরিক অর্জনগুলি উল্লিখিত আছে।

৫ম শতাব্দীর শেষের দিকে, ভারত হূণদের আক্রমণের শিকার হয়। যশোধর্মা এবং সম্ভবত গুপ্ত সম্রাট নরসিংহগুপ্ত ৫৩০ থেকে ৫৩২ সালের মধ্যে কোন এক সময়ে হূণ সেনাবাহিনী এবং তাদের শাসক মিহিরকুলকে পরাজিত করেন এবং তাদের ভারত থেকে বিতাড়িত করেন। সোন্দানির যুদ্ধ ছিল ৫৩০-৩২ খ্রিষ্টাব্দে আলকন হূণ সম্রাট মিহিরকুল এবং মালবের রাজা যশোধর্মার নেতৃত্বে ভারতীয় শাসকদের একটি কনফেডারেশনের মধ্যে সংঘটিত একটি বড় সামরিক লড়াই। দক্ষ নেতা তোরমানের অধীনে আলকন হূণরা ভারতীয় উপমহাদেশের মূল ভূখন্ড আক্রমণ করে। হূণরা তাদের বিধ্বংসী অভিযানের মাধ্যমে গুপ্ত সাম্রাজ্যকে ব্যাপকভাবে দুর্বল করে দিয়েছিল। ভারতে প্রায় ২০ বছর থাকার পর অবশেষে মালবের ঔলিকর রাজবংশের একজন ভারতীয় শাসকের কাছে নিশ্চিত ভাবে পরাজিত হন তোরমান। ১৯৮৩ সালে আবিষ্কৃত রিস্থাল পাথর-স্ল্যাব লেখ অনুসারে, রাজা প্রকাশধর্ম ৫১৫ খ্রিষ্টাব্দে তোরমানকে পরাজিত করেন। প্রথম হূণ যুদ্ধ (First Hunnic War) এইভাবে একটি হূণ-পরাজয়ের সাথে শেষ হয়, এবং হূণ সৈন্যরা দৃশ্যত পাঞ্জাবের অঞ্চলে ফিরে যায়। তোরামানের বড় ছেলে ও উত্তরসূরী মিহিরকুল আবার ভারত আক্রমণ করে। তিনি আরও নিষ্ঠুর ছিলেন এবং তার পূর্বসূরির চেয়ে বেশি ধ্বংসের কারণ হয়েছিলেন। মালবের শাসক এবং রাজা প্রকাশধর্মার পুত্র যশোধর্মা হূণদের পরাজিত করার জন্য অন্যান্য ভারতীয় শাসকদের সাথে একটি জোট তৈরি করেছিলেন।

যশোধর্মার নেতৃত্বে ভারতীয় শাসকদের একটি দল (যারা সম্ভবত গুপ্ত সম্রাট নরসিংহগুপ্তের দ্বারা সমর্থিত ছিল) ৫২৮ খ্রিস্টাব্দে সোন্দানির হূণ বাহিনীকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করেছিল। এর ফলে ৫৪২ সালের মধ্যে পাঞ্জাব ও উত্তর ভারতে আলকনদের সম্পত্তির ক্ষতি হয়। মান্দসৌরের নিকটবর্তী সোন্দানির সোন্দানি লেখে হূণদের আত্মসমর্পণের কথা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে এবং দাবি করা হয়েছে যে, যশোধর্মা অসভ্য ও নিষ্ঠুর রাজাদের কবল থেকে পৃথিবীকে উদ্ধার করেছিলেন এবং তিনি “মিহিরকুলের মাথা নিচু করিয়েছিলেন”। মান্দসৌর স্তম্ভ লেখ বা সোন্দানি লেখের একটি অংশে যশোধর্মা এভাবে রাজা মিহিরকুলকে পরাজিত করার জন্য নিজেকে প্রশংসা করেছেন – “তিনি (যশোধর্মা) যার দুই পায়ের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়েছিল তিনি (মিহিরকুলের) দ্বারাও তার মাথার উপরে চুলের গোছা থেকে ফুলের প্রশংসাসূচক উপহার লাভ করেছিলেন, যিনি (মিহিরকুল) (যশোধর্মার সামনে) নিজ করের ওপর ভর করে কপাল নত করে (আনুগত্যমূলক) প্রণাম জানিয়ে ছিলেন।” কাক্কার পুত্র কবি বসুল রচিত স্তম্ভের লেখগুলি অনুসারে, হূণ শাসক মিহিরাকুল তাঁর পায়ের উপাসনা করেছিলেন। চীনা সন্ন্যাসী জুয়ানজাংয়ের প্রতিবেদন অনুসারে, মিহিরকুল ভারতবর্ষের বেশিরভাগ অঞ্চল জয় করার পর গুপ্ত সাম্রাজ্যের সম্রাট নরসিংহগুপ্ত মিহিরকুলকে প্রতিহত করতে সহায়তা করেন। একটি “ফ্যান্সিফুল” বিবরণে, জুয়ানজাং (যিনি ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে এক শতাব্দী পরে লিখেছিলেন) উল্লেখ করেছিলেন যে মিহিরকুল একটি দ্বীপ ব্যতীত সমস্ত ভারত জয় করেছিলেন, আর সেই দ্বীপে বালাদিত্য নামে মগধের রাজাকে (যিনি গুপ্ত শাসক নরসিংহগুপ্ত বালাদিত্য হতে পারেন) আশ্রয় নিয়েছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মিহিরকুল একজন ভারতীয় রাজার কাছে পরাজিত হন। পরে তিনি মিহিরকুলকে তার মায়ের মধ্যস্থতার কারণে প্রাণভিক্ষা দান করেন, কারণ তিনি হূণ শাসককে “অসাধারণ সৌন্দর্য এবং বিশাল প্রজ্ঞার একজন মানুষ” হিসাবে উপলব্ধি করেছিলেন। মিহিরকুল তখন সিংহাসন পুনরুদ্ধারের জন্য কাশ্মীরে ফিরে এসেছিলেন বলে জানা যায়।

যশোধর্মা-বিষ্ণুবর্ধনের মান্দসৌর পাথরের লেখটি ৫৩২ খ্রিষ্টাব্দে উৎকীর্ণ হয়েছিল এবং যশোধর্মার শাসনামলে দশপুরাায় (আধুনিক মন্দসৌর, যাকে প্রায়শই মান্দাসোর লেখা হয়) দক্ষ নামে এক ব্যক্তির দ্বারা একটি কূপ নির্মাণের কথা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। লেখে উত্তর ও পূর্বের রাজ্যগুলির উপর স্থানীয় শাসকগণের ওপর যশোধর্মার (এবং সম্ভবত চালুক্য শাসক বিষ্ণুবর্ধনের) বিজয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই রাজ্যগুলি আর নির্দিষ্ট করা হয়নি। মান্দসৌর পাথরের লেখ থেকে জানা যায় যে যশোধর্মা উত্তরে আলকন হান বা হূণদের বেশিরভাগ অঞ্চল দখল করেন ও হূণদের বিরুদ্ধে তার বিজয়ের পরে পূর্বদিকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের বেশিরভাগ অঞ্চল দখল করেছিলেন। সেই তারিখের পরে কেবল আরেকটি গুপ্ত লেখের কথা জানা যায়, যা শেষ গুপ্ত সম্রাট বিষ্ণুগুপ্তের দ্বারা কোটিবর্ষ (পশ্চিমবঙ্গের বানগড়) এলাকায় একটি জমি অনুদান সম্পর্কিত লেখ। এদিকে মান্দসৌর স্তম্ভ লেখ অনুসারে ৫৩০-৫৪০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে যশোধর্মা ভারতীয় উপমহাদেশের বেশিরভাগ অংশ জয় করেছিলেন। লেখটির ৫ম লাইনে উল্লেখ আছে, পূর্ব দিকে লৌহিত্য (ব্রহ্মপুত্র) নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে, দক্ষিণে মহেন্দ্র পর্বতমালা (পূর্ব ঘাট) থেকে, উত্তরে হিমালয় এবং পশ্চিমে পশ্চিম পায়োধি (পশ্চিম মহাসাগর) পর্যন্ত তার সামন্তরা তাকে শ্রদ্ধার্ঘ দান করে ও তার সাম্রাজ্যের অধীনে আসে। মানে ব্রহ্মপুত্র থেকে ভারত মহাসাগর ও হিমালয় থেকে মহেন্দ্র পর্বতমালা বা পূর্ব ঘাট পর্যন্ত তার অধীনস্ত ছিল। তিনি রাজাধিরাজ এবং পরমেশ্বর উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। লেখগুলো অনুসারে, ৫৩২ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর রাজস্থানীয় বা ভাইসরয় নির্দোষ বিন্ধ্য ও পরিক্রমা (আরাবল্লি) এর মধ্যবর্তী অঞ্চল শাসন করছিলেন এবং তার সদর দপ্তর ছিল দশপুরা। এইভাবে যশোধর্মা হূণ ও গুপ্তদের কাছ থেকে বিশাল অঞ্চল জয় করেছিলেন ও একটি স্বল্পকালীন সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

যশোধর্মার সাম্রাজ্যের ভাঙ্গন ও শিলাদিত্য : কিন্তু তার স্বল্পকালীন সাম্রাজ্য তার মৃত্যুর পরপরই ভেঙ্গে যেতে শুরু করে। ৫৩০ থেকে ৫৪০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই সাম্রাজ্যের বেশিরভাগ অংশ ভেঙ্গে যায়। যশোধর্মার মৃত্যুর পর তার পুত্র শিলাদিত্য পশ্চিম মালবের শাসক হন। যদিও এই দাবিটির বিরোধিতাও আছে, অনেক ইতিহাসবিদ লিখেছেন যে তিনি উত্তরাধিকারী ছাড়াই মারা গিয়েছিলেন ও এভাবে ক্ষমতার শূন্যতা তৈরি হওয়ায় তার সাম্রাজ্য ভেঙে গিয়েছিল। আবার অনেকে বলেন পুত্র শিলাদিত্য কিছুকাল যশোধর্মার দ্বারা বিজিত কিছু অঞ্চলে রাজত্ব করেছিলেন ও তার মৃত্যুর পরই সাম্রাজ্যটি পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। শিলাদিত্য বৌদ্ধধর্মের অনুসারী ছিলেন। বিখ্যাত চীনা ভ্রমণকারী, সন্ন্যাসী এবং পণ্ডিত হুইয়েন সাং তার কথা উল্লেখ করেছেন, তার প্রতিবেশী রাজারা শৈব ছিলেন, যারা তার রাজ্যকে আক্রমণ করে তাকে বিতাড়িত করেছিলেন। এর ফলে তিনি কাশ্মীরে পালিয়ে যান। ৫৪০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে কাশ্মীরের প্রবরসেন তাকে আবার মালবের রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।

শিল্প : ঔলিকর যুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিসৌধগুলি অবশ্যই ঔলিকর যুগের অন্তর্গত, সেগুলি হ’ল যশোধর্মা বিষ্ণুবর্ধনের দুটি ফ্রিস্ট্যান্ডিং বিজয় স্তম্ভ যা তাঁর লেখ বহন করে। মান্দসৌরের ঔলিকর রাজধানী থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত সোন্দানিতে অবস্থিত এই প্রায় অভিন্ন স্তম্ভগুলি বেলেপাথর দিয়ে তৈরি। পুরো কলামের উচ্চতা ৪৪ ফুট ৫ ইঞ্চি। এর বর্গক্ষেত্রটি উচ্চতায় ৪ ফুট ৫ এবং প্রশস্ত ৩ ফুট ৪। বেল-আকৃতির রাজধানী উচ্চ ৫ ফুট ২ হয়। এর শ্যাফটটি ষোল মুখ সংবলিত ও বৃত্তাকার। সম্ভবত সেখানে একটি মুকুটের মূর্তি ছিল, যা খুঁজে পাওয়া যায়নি। মান্দসৌরের সোন্দানি এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার ভাস্কর্যগুলি গুপ্ত শিল্পের চূড়ান্ত সময়ের জন্য একটি ভাল চিহ্নিতকারী, কারণ তারা আলকন হূণ রাজা মিহিরকুলের বিরুদ্ধে তার বিজয় উদযাপনের জন্য ৫২৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে যশোধর্মা (রা. ৫১৫ – ৫৪৫ খ্রি.) কর্তৃক কমিশনকৃত হয়েছিল। এটি উপমহাদেশের গুপ্ত সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ঐক্যের শেষ পর্বের সাথে মিলে যায়, এবং সেই সময়ের পরে এবং পরবর্তী শতাব্দীগুলোর জন্য ভারতীয় রাজনীতি অত্যন্ত খণ্ডিত হয়ে ওঠে, অঞ্চলটি ছোট ছোট রাজবংশের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। সোন্দানির শিল্পকে গুপ্ত শিল্প এবং মধ্যযুগীয় ভারতের শিল্পের মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন হিসাবে বিবেচনা করা হয়, এটি একটি শিল্পধারা যা একদিকে গুপ্ত শিল্পের ধ্রুপদী সজ্জা এবং অন্যদিকে বৃহত্তর ধর্মীয় উদ্দেশ্য সংবলিত মধ্যযুগীয় অনুশাসনের মধ্যে অবস্থান করে।

মহিষ্মতীর কলচুরি রাজবংশ (৫৫০-৬২৫ খ্রি.)

কলচুরিরা একটি ভারতীয় রাজবংশ ছিল যা ৬ষ্ঠ থেকে ৭ম শতাব্দীর মধ্যে পশ্চিম-মধ্য ভারতে শাসন করেছিল। পরবর্তী কলচুরি, বিশেষ করে ত্রিপুরির কলচুরিদের থেকে আলাদা করার জন্য তাদের হৈহয় বা প্রারম্ভিক কলচুরিও বলা হয়। কলচুরি অঞ্চলটির মধ্যে বর্তমান গুজরাট, মধ্য প্রদেশ এবং মহারাষ্ট্রের কিছু অংশ অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাদের রাজধানী সম্ভবত মহিষ্মতীতে অবস্থিত ছিল। লেখমালা ও মুদ্রাভিত্তিক প্রমাণ থেকে জানা যায় যে ইলোরা এবং এলিফ্যান্টা গুহাসৌধগুলোর মধ্যে প্রাচীনতমটি কলচুরি শাসনের সময় নির্মিত হয়েছিল। রাজবংশের উৎপত্তি অনিশ্চিত। খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে কলচুরিরা পূর্বে গুপ্ত, বাকাটক এবং বিষ্ণুকুণ্ডিদের দ্বারা শাসিত অঞ্চলগুলোর নিয়ন্ত্রণ লাভ করে। লেখভিত্তিক প্রমাণ থেকে কেবল তিনজন কলচুরি রাজাকে জানা যায় – শঙ্করগণ, কৃষ্ণরাজ এবং বুদ্ধরাজ। খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে বাতাপির চালুক্যদের কাছে কলচুরিরা তাদের শক্তি হারিয়ে ফেলে। একটি তত্ত্ব ত্রিপুরি ও কল্যাণীর পরবর্তী কলচুরি রাজবংশকে মহিষ্মতীর কলচুরিদের সাথে সংযুক্ত করে। কলচুরি শিলালিপি অনুসারে, রাজবংশটি উজ্জয়িনী, বিদিশা এবং আনন্দপুরকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল। সাহিত্যের উল্লেখগুলো থেকে জানা যায় যে তাদের রাজধানী মালব অঞ্চলের মহিষ্মতীতে অবস্থিত ছিল। এই রাজবংশ বিদর্ভকেও নিয়ন্ত্রণ করেছিল, যেখানে তারা বাকাটক এবং বিষ্ণুকুণ্ডি রাজবংশের উত্তরাধিকারী হয়েছিল। উপরন্তু, কলচুরিরা খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে উত্তর কোঙ্কন জয় করেছিল। এখানে, তারা ত্রৈকুটক রাজবংশের উত্তরাধিকারী হয়েছিল।

কলচুরিদের উৎপত্তি অনিশ্চিত। কৃষ্ণরাজ (৫৫০-৫৭৫) এই রাজবংশের প্রাচীনতম শাসক। তিনি ত্রৈকুটক এবং গুপ্ত রাজাদের দ্বারা জারি করা পূর্ববর্তী মুদ্রাগুলোর নকশা অনুকরণ করে ব্রাহ্মী লিপিতে কিংবদন্তী খোচিত মুদ্রাগুলো উৎকীর্ণ করেছিলেন। একটি ষাঁড়ের চিত্র খোচিত তার মুদ্রাগুলো স্কন্দগুপ্তের উৎকীর্ণ মুদ্রাগুলোর উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। তার রৌপ্যমুদ্রাগুলো তার রাজত্বের পরে প্রায় ১৫০ বছর ধরে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছিল। কৃষ্ণরাজের মুদ্রাগুলোতে তাকে পরম-মহেশেশ্বর (শিবের ভক্ত) হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। তাঁর পুত্র শঙ্করগণের একটি শিলালিপিতে বলা হয়েছে যে তিনি জন্মের পর থেকেই পশুপতি (শিব) এর প্রতি নিবেদিত ছিলেন। ঐতিহাসিক প্রমাণ থেকে জানা যায় যে তিনি সম্ভবত এলিফ্যান্টা গুহায় শৈব স্মৃতিসৌধগুলো এবং ইলোরার ব্রাহ্মণ্যবাদী গুহাগুলোর প্রথম দিকেরগুলো উদ্বোধন করেছিলেন, যেখানে তার মুদ্রাগুলো আবিষ্কৃত হয়েছে।

শঙ্করগণ (৫৭৫-৬০০ খ্রি.) এই রাজবংশের প্রাচীনতম শাসক যিনি তার নিজস্ব শিলালিপি দ্বারা সত্যায়িত হন, যা উজ্জয়িনী এবং নির্গুণ্ডিপদক থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর উজ্জয়িনী অনুদান রাজবংশের প্রাচীনতম লেখমালার রেকর্ড। এ প্রসঙ্গে ৫৭৫ সালে ঔলিকরদের পতন সম্পর্কে বলতে হবে। আনু. ৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে ভাস্করবর্মা নামে জনৈক রাজনৈতিক ভাগ্যান্বেষী ঔলিকরদের পরাজিত করে পশ্চিম মালব অধিকার করেন, যার পর পশ্চিম মালবের রাজপদে অভিষিক্ত হন তাঁর পুত্র কুমারবর্মা (আ. ৫৮০-৬১০ খ্রি.)। কলচুরিরাজ শঙ্করগণ কুমারবর্মাকে পরাজিত করে উজ্জয়িনী অধিকার করেন। শঙ্করগণের রাজ্যে সম্ভবত বর্তমান গুজরাটের কিছু অংশও অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাঁর পিতার মতো তিনিও নিজেকে পরমা-মহেশ্বর (শিবের ভক্ত) হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন।

বুদ্ধরাজ হলেন এই রাজবংশের শেষ পরিচিত শাসক। তিনি শঙ্করগণের পুত্র ছিলেন। বুদ্ধরাজ পূর্ব মালব জয় করেছিলেন, তবে তিনি সম্ভবত বল্লভী বা মৈত্রক শাসকের কাছে পশ্চিম মালব হারিয়েছিলেন। তাঁর রাজত্বকালে, চালুক্যরাজ কীর্তিকর্মার মৃত্যুর পর তার পুত্র দ্বিতীয় পুলকেশী জীবিত থাকলেও তিনি নাবালক থাকায় ছোট ভাই মঙ্গলেশ (আ. ৫৯৭-৬১১ খ্রি.) আনু. ৫৯৭ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তিনি উত্তর দিকে রাজ্যজয়ে বহির্গত হয়ে বর্তমান গুজরাট, মধ্য প্রদেশ এবং মহারাষ্ট্রের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত কলচুরি রাজ্যের রাজা বুদ্ধরাজকে ৬০০-৬০২ সালের মধ্যে পরাজিত করেন এবং তাঁর ধন সম্পদ অধিগ্রহণ করেন ও যুদ্ধে বুদ্ধরাজ পলায়ন করেন বলে উল্লেখ আছে। বুদ্ধরাজের বিরুদ্ধে জয়লাভ করলেও মঙ্গলেশ কলচুরি রাজ্য জয় করেননি, অন্তত পূর্ণাঙ্গ রাজ্য জয় করেননি। লেখ থেকে জানা যায় ৬১১ সালেও বুদ্ধরাজ সেখানে রাজত্ব করেন এই প্রমাণ আছে। এদিকে তার রাজত্বের শেষ পর্বে মঙ্গলেশ ভ্রাতুষ্পুত্র দ্বিতীয় পুলকেশীর বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। নিজ পুত্রের রাজপদ প্রাপ্তির পথ সুগম করতে তিনি সচেষ্ট হয়ে তিনি সম্ভবত তাঁর পুত্রকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করেন। কিন্তু দক্ষতা ও দাবির দিক দিয়ে দ্বিতীয় পুলকেশী এগিয়ে থাকায় তিনি মঙ্গলেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাকে ৬১১ খ্রিস্টাব্দে তাকে পরাজিত ও নিহত করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। কলচুরির রাজা বুদ্ধরাজ সম্ভবত দ্বিতীয় চালুক্য আক্রমণের সময়, মঙ্গলেশ বা তার ভাগ্নে দ্বিতীয় পুলকেশির দ্বারা তার সার্বভৌমত্ব হারিয়েছিলেন। চালুক্য শিলালিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে মঙ্গলেশ কলচুরিদের পরাজিত করেছিলেন, কিন্তু এই কৃতিত্বের জন্য পুলকেশিকে কৃতিত্ব দেয়া যায়না; সুতরাং, সম্ভবত মঙ্গলেশ ছিলেন সেই চালুক্য শাসক যিনি কলচুরি শক্তি শেষ করার কৃতিত্ব পান। সম্ভবত ৬১১ সালে দ্বিতীয় পুলকেশীর কাছে পরাজয়ের কিছুকাল পূর্বে মঙ্গলেশ কলচুরিদের ওপর দ্বিতীয় অভিযান চালিয়ে তাদের পরাজিত করে তাদের রাজ্য দখল করে থাকবেন। পিতা ও পিতামহের মতো, বুদ্ধরাজও নিজেকে পরম-মহেশ্বর (শিবের ভক্ত) হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন। তাঁর রানী অনন্ত-মহায়ী পাশুপত সম্প্রদায়ের ছিলেন।

বুদ্ধরাজের উত্তরসূরিদের সম্পর্কে কোনও সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না, তবে এটি জানা যায় যে ৬৮৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে, কলচুরিরা চালুক্যদের সামন্ততন্ত্রে পরিণত হয়েছিল। সানখেদায় তরলস্বামী নামে এক রাজপুত্রের উৎকীর্ণ একটি লেখ পাওয়া যায়, যেখানে তিনি নিজেকে শিবের ভক্ত এবং তার পিতা মহারাজ নান্নাকে “কাটাচ্চুরি” পরিবারের সদস্য হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। লেখটি একটি অজানা অব্দের ৩৪৬ সালের। একে কলচুরি অব্দ হিসাবে যুগকে ধরে নিলে, তরলস্বামী শঙ্করগণের সমসাময়িক হতেন। যাইহোক, তরলস্বামী ও নান্নাকে অন্য কোন কলচুরি লেখে উল্লেখ করা হয়নি। এছাড়াও, অন্যান্য কলচুরি লেখের বিপরীতে, এই লেখটির তারিখটি দশমিক সংখ্যায় উল্লেখ করা হয়েছে। তদুপরি, শিলালিপিতে কিছু অভিব্যক্তি খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীর সেন্দ্রক লেখ থেকে ধার করা হয়েছে বলে মনে হয়। এই প্রমাণগুলোর কারণে, ভি. ভি. মিরাশি তরলস্বামীর লেখকে একটি নকল হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। ভি. ভি. মিরাশি ত্রিপুরির কলচুরিদের প্রথম দিকের কলচুরি রাজবংশের সাথে সম্পর্কিত করেছিলেন। তিনি তত্ত্ব দেন যে এই কলচুরিরা তাদের রাজধানী মহিষ্মতী থেকে মধ্যপ্রদেশের কালঞ্জরে এবং সেখান থেকে ত্রিপুরিতে স্থানান্তরিত করেছিল।

স্থাণ্বীশ্বরের পুষ্যভূতি রাজবংশ ও সম্রাট হর্ষবর্ধন

প্রভাকরবর্ধন ও অন্যান্য রাজারা

খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের প্রারম্ভে হরিয়ানার স্বাথ্বীশ্বর ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে আর একটি রাজবংশ আত্মপ্রকাশ করে। এই রাজবংশ প্রতিষ্ঠাতার নামানুসারে পুষ্পভৃতি বা পুষ্যভৃতি রাজবংশ নামে খ্যাত। আবার এই বংশের রাজাদের অন্তনাম বর্ধন হওয়ায় বংশটিকে বর্ধন রাজবংশ নামেও আখ্যাত করা হয়। রাজ্যের রাজধানী স্থাধীশ্বর। প্রাচীন সরস্বতী নদীর তীরে শহরটি অবস্থিত। স্থানটির বর্তমান নাম থানেশ্বর। হর্ষচরিতত্কার বলেন, স্থাণ্বীশ্বর নিছক রাজধানীর নাম নয়, জনপদবিশেষেরও নাম। তিনি আরও বলেন, স্থাথ্বীশ্বর জনপদ শ্রীকণ্ঠ নামে এক বৃহত্তর জনপদের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতারূপে বাণ পুষ্পভূতি বা পুষ্যভৃতির নাম উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি আদৌ কোনও ঐতিহাসিক ব্যক্তি ছিলেন কিনা, সে সম্পর্কে সংশয় রয়েছে। অধ্যাপিকা দেবাহুতির অভিমত, পুষ্পভূতি সম্ভবত একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তি ছিলেন। হর্ষচরিতে তাঁকে ‘শূর-শূরসেনাক্রমে’-রূপে বর্ণনা করা হয়েছে।

  • শুরসেনরাজ্য অর্থাৎ মথুরা অঞ্চল আক্রমণে পুষ্পভৃতি শৌর্য প্রদর্শন করেছেন, এই অর্থেই তিনি কথাটির ব্যাখ্যা করেছেন।
  • দ্বিতীয়ত, হর্ষচরিতে বলা হয়েছে, পুষ্পভূতি নাগরাজ শ্রীকণ্ঠকে যুদ্ধে পরাজিত করেন। হর্ষচরিতে পুষ্পভৃতি সম্পর্কিত এই দু’টি উল্লেখের প্রেক্ষিতে অধ্যাপিকা দেবাহুতি অভিমত প্রকাশ করেছেন, পুষ্পভূতি সম্ভবত মথুরার এক নাগরাজকে পরাজিত করে সে অঞ্চলে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।

কিন্তু অধ্যাপিকা দেবাহুতির এই ব্যাখ্যার যাথার্থ্য সম্পর্কে স্বভাবতই কয়েকটি প্রশ্ন উঠেছে।

  • প্রথমত, ‘শূরসেনাক্রমে’ কথাটিতে শূরসেন বা মথুরার উল্লেখ আছে, এ ব্যাখ্যা বিতর্কিত। পুষ্পভৃতি বীরবিক্রমে শত্রু সৈনদের আক্রমণ করতেন, এই অর্থেও কথাটিকে গ্রহণ করা যায়।
  • দ্বিতীয়ত, নাগরাজ শ্রীকণ্ঠের বিরুদ্ধে তাঁর বিজয়লাভের কাহিনি বাণের কল্পনাপ্রসূত হওয়া বিচিত্র নয়। তৃতীয়ত, বর্ধন বংশের কোনও সিলমোহরে বা অভিলেখে পুষ্পভূতির নাম উচ্চারিত হয়নি। ফলে পুষ্পভৃতির ঐতিহাসিকতা সম্পর্কে সংশয় থেকেই গেছে।

মহারাজ নরবর্ধন (আ. ৫২৫-৪০/৫০৫-৩০ খ্রিস্টাব্দ) : এই বংশের প্রথম মহারাজ নরবর্ধন। দীনেশচন্দ্র সরকার এবং অধ্যাপিকা দেবাহুতি তাঁর রাজত্বকাল যথাক্রমে আনুমানিক ৫২৫-৪০ এবং ৫০৫-৩০ খ্রিস্টাব্দে ধার্য করেছেন। দীনেশচন্দ্ৰ সরকারের অভিমত গৃহীত হলে অনুমান করতে হবে, নরবর্ধন প্রথমে গুপ্ত ও উত্তরকালে মন্দসোরের অধিপতি যশোধর্মার অনুগত ছিলেন। তাঁর পত্নী বজ্রিণীদেবী।

মহারাজ প্রথম রাজ্যবর্ধন (আ. ৫৪০-৬৫ খ্রিস্টাব্দ) : বর্ধন বংশের পরবর্তী মহারাজ প্রথম রাজ্যবর্ধন। তাঁর পত্নী অপ্সরোদেবী। মনে হয় তিনি মৌখরি মহারাজাধিরাজ ঈশানবর্মার আনুগত্যাধীন ছিলেন।

মহারাজ আদিত্যবর্ধন (আ. ৫৬৫-৮০ খ্রিস্টাব্দ) : মহারাজ প্রথম রাজ্যবর্ধনের পুত্র ও উত্তরাধিকারী মহারাজ আদিত্যবর্ধন। তিনি মালবের উত্তরকালীন গুপ্তরাজ মহাসেনগুপ্তের ভগিনী মহাসেনগুপ্তার পাণিগ্রহণ করেন। পরাক্রান্ত মৌখরি রাজশক্তির সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহতের উদ্দেশ্যেই সম্ভবত উভয় রাজপরিবারের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়।

মহারাজাধিরাজ প্রভাকরবর্ধন (আ. ৫৮০-৬০৫ খ্রিস্টাব্দ) : আদিত্যবর্ধন ও মহাসেনগুপ্তার পুত্র প্রভাকরবর্ধন আনুমানিক ৫৮০ খ্রিস্টাব্দে স্থাথ্বীশ্বরের সিংহাসনে আরেহণ করেন। হর্ষচরিত থেকে জানা যায়, তিনি প্রতাপশীল নামেও পরিচিত ছিলেন (প্রতাপশীল ইতি প্রথিতা পরনামা প্রভাকরবর্ধনো নাম রাজাধিরাজঃ)। তাঁর অন্যূন তিন পুত্র – রাজ্যবর্ধন, হর্ষবর্ধন ও কৃষ্ণ। প্রথম দুই পুত্রের জননী মহিষী যশোমতীদেবী, কৃষ্ণের মাতা প্রভাকরবর্ধনের অপর এক রানি। তাঁর এক কন্যা, নাম রাজ্যশ্রী। বর্ধনবংশের প্রভাকরবর্ধনই প্রথম মহারাজাধিরাজ। তাঁর রাজত্বকালেই এ রাজ্যের প্রকৃত অভ্যুত্থান শুরু হয়। এ অভ্যুত্থানের কিছু পরিচয় বিধৃত আছে সমকালীন কাব্য হর্ষচরিতে।

রাজাধিরাজ প্রভাকরবর্ধন সম্পর্কে বাণ বলেন, তিনি ছিলেন হরিণসদৃশ হূণ নরপতির নিকট সিংহ (হূণহরিণকেশরী), সিন্ধুরাজের জ্বর (সিন্ধুরাজজ্বরো), গুর্জরনাথের নিদ্রাহরণ (গুর্জর প্রজাগরো), গন্ধহস্তী সমতুল্য গন্ধারপতির দুরারোগ্য কুঞ্জরজ্বর (গন্ধারধিপ-গন্ধদ্বিপ-কূট পাকলো), লাটেশ্বরের নৈপুণ্য-সংহারক (লাট-পাটব-পাটচ্চরো) এবং লতাস্বরূপিণী মালবলক্ষ্মীর মারণ-কুঠার (মালবলক্ষ্মীলতা-পরশুঃ)। উপরোক্ত সব রাজশক্তিকেই যে প্রভাকরবর্ধন যুদ্ধে পরাজিত করেন, এমনটি হয়তো নয়। কেউ কেউ পরাজিত হন, কেউবা হন সশঙ্কিত, সন্ত্রস্ত। কিন্তু হূণদের বিরুদ্ধে তিনি যে জয়লাভ করেন, তা বোধহয় নিশ্চিত।

  • সে সময় হূণরা শতদ্রু নদীর অববাহিকা অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। প্রভাকরবর্ধন তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযানে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজ্যবর্ধনকে প্রেরণ করেন। হর্ষের সুদীর্ঘ রাজত্বকালে হূণরা কখনও পুষ্যভূতি রাজ্য আক্রমণ করেননি। অনুমিত হয়, হূণদের বিরুদ্ধে রাজ্যবর্ধনের সমরাভিযান সাফল্যমণ্ডিত হয়।
  • প্রভাকরবর্ধনের সমকালীন সিন্ধুনরপতি সম্ভবত রাইবংশীয় সহিরস বা তাঁর পুত্র দ্বিতীয় সহসি। তিনি সিন্ধু-শতদ্রু সঙ্গম থেকে আরব সাগর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের অধিপতি ছিলেন। প্রভাকরবর্ধন আদৌ সিন্ধুরাজের বিরুদ্ধে কোনও অভিযান পরিচালনা করেন কিনা, সে সম্পর্কে সন্দেহ আছে। পরবর্তী কালে হর্ষবর্ধনও সিন্ধুরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন।
  • যে গুর্জর নৃপতির বিরুদ্ধে প্রভাকরবর্ধন অস্ত্রধারণ করেন, তিনি জোধপুর অঞ্চলের গুর্জররাজ রজ্জিল বা তাঁর পুত্র নয়ভট। তাঁদের রাজধানী মাণ্ডব্যপুর যা জোধপুরের সন্নিকটবর্তী বর্তমান মাণ্ডোর।
  • সিন্ধু নদের পশ্চিমতীরে গন্ধার রাজ্যের অবস্থান। অধ্যাপিকা দেবাহুতি প্রভাকরবর্ধনের প্রতিপক্ষ লাটরাজকে কলচুরি নৃপতি শঙ্করগণরূপে চিহ্নিত করেছেন। তিনি মনে করেন, শঙ্করগণ মহাসেনগুপ্তকে উজ্জয়িনী থেকে বিতাড়িত করতে উদ্যত হলে প্রভাকরবর্ধন তাঁর মাতুলের সাহায্যার্থে সসৈন্যে অগ্রসর হন। কিন্তু অধ্যাপিকা দেবাহুতির এই শনাক্তকরণ সম্ভবত ঠিক নয়। নান্দীপুরীর গুর্জর রাজবংশ এ সময় লাট অঞ্চলে রাজত্ব করত। তাছাড়া, উজ্জয়িনী মহাসেনগুপ্তের রাজ্যভুক্ত ছিল না।
  • হর্ষচরিতে উল্লিখিত মালবরাজ সম্ভবত দেবগুপ্ত। প্রভাকরবর্ধন তাঁর রাজত্বের শেষের দিকে দেবগুপ্তের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িত হন। দেবগুপ্ত উত্তরকালীন গুপ্ত রাজপরিবারেরই এক সদস্য। তিনি সম্ভবত মহাসেনগুপ্তের বিরুদ্ধে সদলে বিদ্রোহী হন। মনে হয়, এই সংকটের দিনে মহাসেনগুপ্ত তাঁর ভাগিনেয় প্রভাকরবর্ধনের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন। কিন্তু প্রভাকরবর্ধনের সদলে মালবে পৌঁছানোর পূর্বেই দেবগুপ্ত মহাসেনগুপ্তকে নিহত করে পূর্ব মালবের সিংহাসন অধিকার করেন। প্রভাকরবর্ধন তাঁর মাতুলের দুই পুত্র কুমারগুপ্ত মাধবগুপ্তকে উদ্ধার করে রাজধানী স্থাথ্বীশ্বরে নিয়ে আসেন ও তাঁদের প্রতি পালনের পূর্ণ দায়িত্ব সানন্দে গ্রহণ করেন। গুপ্তরাজপুত্রদ্বয় পুষ্যভৃতি রাজকুমারগণ ও প্রভাকর বর্ধনের শ্যালকপুত্র ভণ্ডির সাহচর্যে স্থাণ্বীশ্বরের রাজপ্রাসাদে লালিত-পালিত হন।

কন্যা রাজ্যশ্রীর সঙ্গে কান্যকুব্জের মৌখরিরাজ গ্রহবর্মার বিবাহ প্রভাকরবর্ধনের রাজত্ব কালের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। স্বয়ং গ্রহবর্মাই রাজ্যশ্রীর পাণি প্রার্থনা করেন। প্রভাকরবর্ধন সানন্দে সে প্রস্তাব অনুমোদন করেন। এই বিবাহের ফলে দুই রাজপরিবারের মধ্যে মৈত্রীর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজ্যশ্রী তখন দ্বাদশবর্ষীয়া। রাজ্যশ্রীর বিবাহের অনতিকাল পর প্রভাকরবর্ধন হূণশত্রুদের বিরুদ্ধে জ্যেষ্ঠপুত্র রাজ্যবর্ধনকে সসৈন্যে প্রেরণ করেন। যুদ্ধ হয় উত্তরাপথে, সম্ভবত শতদ্রুর অববাহিকা অঞ্চলে। হূণদের বিরুদ্ধে রাজ্যবর্ধনের সাফল্যের স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে হর্ষচরিতে। অকস্মাৎ প্রভাকরবর্ধন মারণব্যাধিতে আক্রান্ত হন। তখন রাজ্যবর্ধন উত্তরাপথে, হর্ষবর্ধন হিমালয়ের পাদদেশে। সংবাদ পেয়ে হর্ষবর্ধন সত্বর স্থাথ্বীশ্বরে এসে উপস্থিত হন। মুমূর্ষু প্রভাকর বর্ধন প্রিয় পুত্রকে কিছু উপদেশ দিয়ে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। শোকাতুরা যশোমতীদেবী স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় আত্মাহুতি দেন। জ্যেষ্ঠপুত্র রাজ্যবর্ধন তখন স্থাথ্বীশ্বর অভিমুখে।

হর্ষবর্ধনের ক্ষমতায় আরোহন

প্রাচীন ভারতের এক বিশ্রুতকীর্তি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মহারাজাধিরাজ হর্ষবর্ধন। পুষ্যভূতি রাজপরিবারের এক সংকটজনক মূহূর্তে মাত্র ষোলো বৎসর বয়সে তিনি রাজপদে অভিষিক্ত হন। কিন্তু উদ্যম, তেজস্বিতা ও দূরদর্শিতার সহায়তায় তিনি সংকট দূর করে উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে এক বৃহদায়তন রাজ্য গঠন করেন এবং ‘সকলোত্তরাপথনাথ’ রূপে পরিচিতি লাভ করেন। প্রজাহিতব্রতী, ধর্মভীরু, সুসাহিত্যিক ও শিল্প-সাহিত্যের অকৃত্রিম অনুরাগী হর্ষবর্ধন ভারত-ইতিহাসের এক স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। বাণভট্টের ‘হর্ষচরিত’, ‘আর্য-মঞ্জুশ্রী মূলকল্প’, চিনা পরিব্রাজক শুয়েন চাঙের ‘সি য়ু চি’, হুই লি রচিত শুয়েন চাঙের জীবনবৃত্তান্ত, চিনা ইতিবৃত্ত ‘ফ্যাং চি’, হর্ষবর্ধনের নিজস্ব বাঁশখেড়া ও মধুবন তাম্রশাসন, সিলমোহর, মুদ্রা এবং বাদামির চালুক্য রাজাদের লেখমালা এই মহান নৃপতির বহুমুখী কর্মকাণ্ডের উপর প্রভূত আলোকপাত করছে।

প্রভাকরবর্ধনের অসুস্থতা ও মৃত্যু

তখন ৬০৫ খ্রিস্টাব্দের সমাপ্তি পর্ব বা ৬০৬ খ্রিস্টাব্দের প্রারম্ভকাল। রাজ্যবর্ধন শতদ্রু অববাহিকায় হূণ শত্রুদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত; হর্ষবর্ধন হিমালয়ের পাদদেশে মৃগয়ায় বহির্গত। অকস্মাৎ প্রভাকরবর্ধন মারণব্যাধিতে আক্রান্ত হন। সংবাদ পেয়ে হর্ষবর্ধন সত্বর রাজধানী স্থাথ্বীশ্বরে প্রত্যাবর্তন করেন। এর কিছুদিন পর প্রভাকরবর্ধন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। শোকাকুলা মহিষী যশোমতীদেবী স্বেচ্ছায় সহমরণ বরণ করেন। এ ঘটনার কয়েক সপ্তাহ পর জ্যেষ্ঠভ্রাতা রাজ্যবর্ধন রাজধানীতে ফিরে আসেন এবং নিজের অনিচ্ছাসত্ত্বেও অনুজের সনির্বন্ধ অনুরোধে রাজপদে অভিষিক্ত হন।

অধ্যাপিকা দেবাহুতি অভিমত প্রকাশ করেছেন, পিতা প্রভাকরবর্ধনের আকস্মিক মৃত্যুর পর হর্ষবর্ধন তার মাতুলপুত্র ভঙির সহায়তায় পৈতৃক সিংহাসন অধিকারের জন্য জ্যেষ্ঠভ্রাতা রাজ্যবর্ধনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। (D. Devahuti Harsha: A Political Study (Delhi: 1998), পৃষ্ঠা ৭৯-৮১)। এ অভিমতের সমর্থনে তিনি বাণভট্টের কয়েকটি উক্তি বিশ্লেষণ করেছেন।

  • প্রথমত, পিতার মৃত্যুর পর রাজ্যবর্ধন রাজপদে অভিষিক্ত হয়েছেন এ মর্মে বাণ কোনও উক্তি করেননি।
  • দ্বিতীয়ত, প্রভাকরবর্ধন যখন মৃত্যুশয্যায়, তিনি জ্যেষ্ঠপুত্র রাজ্যবর্ধন সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন থেকেছেন; কনিষ্ঠ হর্ষবর্ধনকেই রাজ্যশাসন ও প্রজাপালন সম্পর্কে নানা উপদেশ দিয়েছেন।
  • তৃতীয়ত, পিতার মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ পর স্থান্বীশ্বরে প্রত্যাবর্তন করে রাজ্যবর্ধন কনিষ্ঠভ্রাতার অভিসন্ধি সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে রাজপদ গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করেন এবং অনুজকেই সিংহাসনে আরোহণে অনুরোধ করেন। পরে তিনি ভগিনীপতির নিধন ও ভগিনীর বন্দিদশার কথা অবহিত হয়ে ভণ্ডিকে সঙ্গে নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। হর্ষের প্রভাব থেকে ভণ্ডিকে বিচ্ছিন্ন ও স্বদলভুক্ত করার অভিপ্রায়েই তিনি ভণ্ডিকে তার যুদ্ধযাত্রার সঙ্গীরূপে মনোনীত করেন।

অধ্যাপিকা দেবাহুতির এ মতের সঙ্গে সকলেই যে সহমত হবেন, এমন আশা করা যায় না। বাণের বর্ণনার কাল্পনিক ব্যাখ্যার উপর তার এ অভিমত প্রতিষ্ঠিত। এ কথা অনস্বীকার্য, রাজ্যবর্ধন প্রথমে রাজপদ গ্রহণে অনিচ্ছুক ছিলেন কিন্তু ভ্রাতার অনীহায় ক্ষুব্ধ হর্ষবর্ধন স্পষ্ট ঘোষণা করেন, রাজ্যবর্ধন সিংহাসনে আরোহণ না করলে তিনিও রাজপদ গ্রহণ করবেন না, জ্যেষ্ঠভ্রাতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনিও সন্ন্যাস অবলম্বন করবেন। রাজ্যবর্ধনের রাজপদ গ্রহণে বিরূপতার পিছনে হর্ষবর্ধনের তথাকথিত ষড়যন্ত্রের কোনও ভূমিকা ছিল না। পিতামাতার আকস্মিক মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান তার মতো একজন তরুণের সেই মুহূর্তে জাগতিক বিষয়ের প্রতি কোনও মোহ বা আসক্তি না থাকারই কথা। গ্রহবর্মার হত্যার সংবাদ স্বাধীশ্বরে পৌঁছলে রাজ্যবর্ধন সিদ্ধান্ত করেন, তিনি শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করবেন। তারই নির্দেশে ভণ্ডি যুদ্ধযাত্রায় তার অনুগমন করেন। এসব সিদ্ধান্ত তারই নিজস্ব। স্পষ্ট বোঝা যায়, রাজধানীতে প্রত্যাবর্তনের পর রাজকর্তৃত্ব তারই হস্তগত হয়। তাছাড়া রাজ্যবর্ধনের সিংহাসনে আরোহণের অকাট্য প্রমাণ হর্ষবর্ধনেরই উৎকীর্ণ বাঁশখেড়া ও মধুবন তাম্রশাসন। এ দু’টি তাম্রশাসনে রাজ্যবর্ধন প্রভাকরবর্ধনের উত্তরাধিকারী রূপে বর্ণিত হয়েছেন। শুয়েন চাঙের ভ্রমণবৃত্তান্ত ও আর্য-মঞ্জুশ্রী-মূলকল্পে একই তথ্য পরিবেশিত হয়েছে।

রাজ্যবর্ধনের কান্যকুব্জ অভিযান ও মৃত্যু

দুর্ভাগ্যক্রমে বাণভট্ট বা শুয়েন চাঙ কেউই রাজ্যবর্ধনের কান্যকুব্জ অভিযানের বিশদ বিবরণ পরিবেশন করেননি। বাণভট্ট বলেন, রাজ্যবর্ধন অবলীলাক্রমে মালব সৈন্যদলকে পরাজিত করেন কিন্তু গৌড়রাজ তাকে মিথ্যা সৌজন্যে প্রলুব্ধ করে হত্যা করেন। প্রতীয়মান হয়, রাজ্যবর্ধন ভগিনীপতি-হন্তারক মালবরাজকে পরাজিত করেন কিন্তু ভগিনী রাজ্যশ্রীকে উদ্ধার করার পূর্বেই গৌড়রাজের হস্তে নিহত হন। এখানে কয়েকটি প্রশ্ন উঠছে। কে এই মালবরাজ? তার সঙ্গে রাজ্যবর্ধনের কোথায় যুদ্ধ হয়? গৌড়নৃপতি কে? রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে তার হঠাৎ আবির্ভাব ঘটল কেন? কী পরিস্থিতিতে রাজ্যবর্ধন নিহত হন? তার নিধনে গৌড়েশ্বর কী ভূমিকা গ্রহণ করেন?

যে মালবপতিকে হর্ষচরিতে রাজ্যবর্ধনের প্রতিপক্ষরূপে বর্ণনা করা হয়েছে, তিনি পূর্ব মালবের উত্তরকালীন গুপ্তরাজ দেবগুপ্ত। রাজ্যবর্ধনের হস্তে দেবগুপ্তের পরাজয়ের উল্লেখ আছে হর্ষবর্ধনের বাঁশখেড়া ও মধুবন তাম্রশাসনে। দেবগুপ্ত প্রভাকরবর্ধনের মাতুল মহাসেনগুপ্তের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন ছিলেন। মহাসেনগুপ্তকে রাজ্যচ্যুত করেই তিনি পূর্ব মালবের সিংহাসন অধিকার করেন। মহাসেনগুপ্তকে রাজ্যচ্যুত করায় দেবগুপ্ত স্বভাবতই প্রভাকরবর্ধন ও তার জামাতা মৌখরিরাজ গ্রহবর্মার বিরাগভাজন হন। হর্ষচরিতে উল্লিখিত গৌড়েশ্বর নিঃসন্দেহে কর্ণসুবর্ণাধিপতি শশাঙ্ক। মৌখরিরাজ্যের অঙ্গচ্ছেদ ঘটিয়েই তিনি বাংলা-বিহারে এক স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। মৌখরি এবং তাদের আত্মীয় ও শুভানুধ্যায়ী পুষ্যভূতিরা শশাঙ্কের প্রতি বিদ্বিষ্ট ছিলেন।

সমকালীন উত্তর ভারতের যখন দুই প্রধান শক্তি, পুষ্যভূতি ও মৌখরিরা আত্মীয়তা এবং বন্ধুত্বসূত্রে আবদ্ধ, তখন দেবগুপ্ত ও শশাঙ্কের একতাবদ্ধ হওয়া জরুরি হয়ে পড়ে। পুষ্যভূতি ও মৌখরিরা তাদের উভয়েরই শত্রু। দুই প্রবল শত্রু জোটবদ্ধ হওয়ায় আতঙ্কিত দেবগুপ্ত ও শশাঙ্ক মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হন ও শত্রুরাজ্য দু’টি একযোগে আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। তাদের প্রথম লক্ষ্য কান্যকুব্জ। প্রভাকরবর্ধনের আকস্মিক মৃত্যু তাদের কান্যকুব্জ অভিযানের পথ প্রশস্ত করে। প্রভাকরবর্ধনের মৃত্যুতে গ্রহবর্মা হীনবল; তাকে আক্রমণের এই সুবর্ণ সুযোগ। দুই মিত্র দুই প্রান্ত থেকে কান্যকুব্জ অভিমুখে সসৈন্যে অগ্রসর হন। হর্ষচরিতের বিবরণী থেকে অনুমিত হয়, দেবগুপ্ত শশাঙ্কের পূর্বেই কান্যকুব্জে উপনীত হন। শশাঙ্কের প্রতীক্ষায় কালাতিপাত না করে তিনি গ্রহবর্মাকে আক্রমণ করেন। গ্রহবর্মা নিহত হন। তার মহিষী রাজ্যশ্রী কান্যকুব্জে কারারুদ্ধ হন। কান্যকুব্জ অধিকারের পর দেবগুপ্ত স্থাধীশ্বর অভিমুখে যাত্রা করেন। মনে হয়, কান্যকুব্জ ও স্বাথ্বীশ্বরের মধ্যবর্তী কোনও এক স্থানে রাজ্যবর্ধন ও দেবগুপ্ত পরস্পরের সম্মুখীন হন। মালবরাজ পরাজিত ও সম্ভবত নিহত হন।

দেবগুপ্তকে পরাজিত করে রাজ্যবর্ধন কান্যকুব্জ অভিমুখে অগ্রসর হন। ততদিনে শশাঙ্ক কান্যকুব্জে উপস্থিত হয়ে শহরটির শাসনকর্তৃত্ব স্বহস্তে গ্রহণ করেছেন। রাজ্যবর্ধন সসৈন্যে কান্যকুব্জের উপকণ্ঠে উপনীত হন। তার লক্ষ্য দু’টি। এক, ভগিনী রাজ্যশ্রীর উদ্ধার। দুই, শশাঙ্ক কবলিত কান্যকুব্জ অধিকার। শশাঙ্কের সঙ্গে রাজ্যবর্ধনের যুদ্ধ সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে একটি জিনিস স্পষ্ট। এ যুদ্ধে রাজ্যবর্ধন শশাঙ্কের হস্তে নিহত হন। কিন্তু শশাঙ্ক ন্যায়যুদ্ধে না ছলনাক্রমে রাজ্যবর্ধনের প্রাণ সংহার করেন সে সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণ পরস্পর-বিরোধী অভিমত ব্যক্ত করেছেন। আসলে আকর গ্রন্থাদিতে পরিবেশিত তথ্য অপ্রতুল ও বিপরীতমুখী হওয়ায় পণ্ডিত মহলে প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে।

বাণভট্ট বলেন, মিথ্যা সৌজন্যে প্রলুব্ধ হয়ে রাজ্যবর্ধন গৌড়রাজের শিবিরে গমন করেন। এবং নিরস্ত্র ও নিঃসঙ্গ অবস্থায় নিহত হন। সৌজন্যের প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে বাণভট্টের লেখনী নীরব। হর্ষচরিতের উত্তরকালীন ভাষ্যকার শঙ্কর সে সৌজন্যের ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, দূতমুখে শশাঙ্ক তার কন্যার সঙ্গে তার বিবাহের প্রস্তাব দিয়ে রাজ্যবর্ধনকে প্রলুব্ধ করেন; হতভাগ্য রাজকুমার যখন তার পাত্র-মিত্রদের সঙ্গে শত্রু শিবিরে ভোজনরত, তখন ছদ্মবেশী শশাঙ্ক তার প্রাণ সংহার করেন। লক্ষ করবার বিষয়, বাণভট্ট এবং তার ভাষ্যকার শঙ্করের বক্তব্য ঠিক একরূপ নয়। বাণের মতে রাজ্যবর্ধন শত্রুশিবিরে নিরস্ত্র ও নিঃসঙ্গ কিন্তু ভাষ্যকার শত্রু শিবিরে রাজ্যবর্ধনের সদল উপস্থিতির উল্লেখ করেছেন। স্বয়ং শশাঙ্কই যে ঘাতক, এ কথা বাণ বলেননি, বলেছেন ভাষ্যকার শঙ্কর। আবার রাজ্যবর্ধনের মৃত্যু প্রসঙ্গে শুয়েন চাঙের বক্তব্য অন্যরূপ। তিনি বলেন, রাজ্যবর্ধনের উল্লেখ প্রসঙ্গে শশাঙ্ক প্রায়ই তার মন্ত্রীদের বলতেন, প্রতিবেশী রাজা সদাচারী হলে মূল রাজ্যের শান্তি বিঘ্নিত হয়; শশাঙ্কের মুখে এ কথা শুনে তার মন্ত্রীরা রাজ্যবর্ধনকে বৈঠকে আহ্বানপূর্বক হত্যা করেন। শুয়েন চাঙ তার ভারত-বৃত্তান্তের অন্যত্র রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর জন্য শশাঙ্কের মন্ত্রীদের দায়ী করেননি, দায়ী করেছেন রাজ্যবর্ধনের অপরিণামদর্শী অমাত্যদের। তিনি বলেন, অমাত্যদের হঠকারিতায় রাজ্যবর্ধন শত্রুকবলিত ও বিপদাপন্ন হন। হর্ষবর্ধনের বাঁশখেড়া ও মধুবন তাম্রশাসনে আবার রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর অন্য এক ভাষ্য : “উৎখায় দ্বিষতো বিজিত্য বসুধাং কৃত্বা প্রজানাং প্রিয়ম্/ প্রাণান্ উত্থিতবানরাতিভবনে সত্যানুরোধেন যঃ।” লেখ দু’টি বলছে, শত্রুগণকে উচ্ছেদ করে, পৃথিবী জয় করে, প্রজাবর্গের নিকট নিজেকে প্রিয় করে রাজ্যবর্ধন ‘সত্যানুরোধে’ শত্রুভবনে প্রাণত্যাগ করেন। ‘সত্যানুরোধ’-কেই রাজ্যবর্ধনের জীবনহানির কারণরূপে নির্দেশ করা হয়েছে।

এসব অসম্পূর্ণ ও পরস্পর-বিরোধী সাক্ষ্যে একটি জিনিস স্পষ্ট : রাজ্যবর্ধন শশাঙ্কের হস্তে নিহত হন ঠিকই কিন্তু শশাঙ্ক যে বিশ্বাসঘাতক, তা নিঃসংশয়ে প্রমাণিত হয় না। বাণ শশাঙ্কের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনেছেন। কিন্তু ভুললে চলবে না, বাণ ছিলেন হর্ষবর্ধনের সভাকবি এবং পুষ্যভূতি রাজপরিবারের অনুগ্রহভাজন। শশাঙ্কের প্রতি তিনি বিদ্বিষ্ট ছিলেন। তার বিদ্বেষ এত তীব্র ছিল যে তিনি শশাঙ্কের নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি, তাকে ‘গৌড়াধম’, ‘গৌড় ভুজঙ্গ’-রূপে অভিহিত করেছেন। হর্ষবর্ধনের বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ী শুয়েন চাঙও শশাঙ্ক-বিদ্বেষী ছিলেন। তিনি কিন্তু রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর জন্য শশাঙ্ককে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী করেননি, কখনও দায়ী করেছেন শশাঙ্কের মন্ত্রীদের, কখনওবা রাজ্যবর্ধনের অপরিণামদর্শী অমাত্যদের। তাছাড়া একদর্শী ও হর্ষবর্ধনের প্রসাদপুষ্ট বাণভট্ট বা শুয়েন চাঙের বিবরণের ভিত্তিতে কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ সমুচিত হবে না। সমকালীন তথ্য কত একপেশে ও ভিন্নধর্মী হতে পারে তার প্রকৃষ্ট নিদর্শন বিধৃত আছে মহারাষ্ট্রীয় ও মুসলমান লেখকদের শিবাজীআফজল খাঁ সম্পর্কিত ইতিবৃত্তে। স্মরণ রাখতে হবে, রাজ্যবর্ধনের নিজের সহোদর হর্ষবর্ধন তার জ্যেষ্ঠভ্রাতার মৃত্যুর জন্য শশাঙ্ক বা অন্য কাউকে দায়ী করেননি, দায়ী করেছেন রাজ্যবর্ধনের ‘সত্যানুরোধ” বা সত্যপালনকে। ‘সত্যানুরোধ’ বা সত্যপালন বলতে তো অনেক কিছুই বোঝায়। হর্ষবর্ধনের ইঙ্গিত কোন্ দিকে, তা বোঝা দুষ্কর। শশাঙ্ক রাজ্যবর্ধনকে হত্যা করেন, এ কথা ঠিক কিন্তু এ কাজে তিনি কৌশল বা চাতুরির আশ্রয় গ্রহণ করেন, এমন সিদ্ধান্ত হয়তো শশাঙ্কের প্রতি অবিচারই হবে। নতুন তথ্য আবিষ্কৃত না হলে বিষয়টি ঘিরে শুধু বিতর্কই হবে।

হর্ষবর্ধনের কান্যকুব্জ অভিমুখে যুদ্ধযাত্রা

যাই হোক, হর্ষবর্ধন তখন রাজধানী স্থাণীশ্বরে অবস্থান করছেন। অশ্বারোহী বাহিনীর একজন অতি বিশ্বস্ত সেনাপতি কুন্তল রাজ্যবর্ধনের মৃত্যু সংবাদ বহন করে রাজধানীতে উপস্থিত হন। সমস্ত সংবাদ অবগত হয়ে হর্ষবর্ধন গৌড়রাজ শশাঙ্কের প্রতি রুষ্ট হন। তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে পৃথিবী থেকে গৌড়দের নিশ্চিহ্ন না করলে তিনি তৈল-প্রজ্বলিত অগ্নিশিখায় পতঙ্গের মতো আত্মাহুতি দেবেন। সেনাধ্যক্ষকে তিনি আদেশ করেন, ভারতের সকল রাজাদের কাছে বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হোক, হয় আনুগত্য স্বীকার করুন, নতুবা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হোন। অনুমিত হয়, কয়েকদিনের মধ্যেই তার আনুষ্ঠানিক রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয় (আনুমানিক ৬০৬ খ্রিস্টাব্দ)। তারপর এক শুভ মুহূর্তে হর্ষবর্ধন দিগ্বিজয়ে বহির্গত হন।

কিছুদূর অগ্রসর হবার পর, হয়তোবা স্থাণ্বীশ্বরেরই উপকণ্ঠে, প্রাগজ্যোতিষরাজ কুমার বা ভাস্করবর্মার দূত হংসবেগের সঙ্গে হর্ষবর্ধনের সাক্ষাৎ হয়। হংসবেগ জানান, ভাস্করবর্মা পুষ্যভূতিরাজের সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্ধুত্ব স্থাপন করতে চান। হর্ষ ভাস্করবর্মার মৈত্রীর প্রস্তাব সানন্দে অনুমোদন করেন, তার সঙ্গে অচিরে সাক্ষাতের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। হংসবেগ আশ্বাস দেন, ভাস্করবর্মা কয়েকদিনের মধ্যেই এসে পৌঁছবেন। হর্ষচরিতে হর্ষ-ভাস্করবর্মার এই চিরস্থায়ী বন্ধুত্বের উপর আর কোনও আলোকপাত করা হয়নি। সহজেই অনুমেয়, শত্রুভাবাপন্ন গৌড়েশ্বর শশাঙ্কের সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিরোধ ও নিজের শক্তি বৃদ্ধিকল্পে ভাস্করবর্মা হর্ষবর্ধনের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপনে আগ্রহী হন। শশাঙ্ক তো হর্ষবর্ধনের ঘোর শত্রু। ভাস্করবর্মার সঙ্গে মৈত্রী তার স্বার্থ তথা উদ্দেশ্য সিদ্ধির অনুকূল হবে ভেবে হর্ষবর্ধনও সাগ্রহে এ প্রস্তাবে সম্মত হন।

কান্যকুব্জ অভিমুখে আরও কিছুদূর অগ্রসর হবার পর হর্ষবর্ধনের সঙ্গে ভণ্ডির সাক্ষাৎ হয়। ভণ্ডি পরাজিত মালব সৈন্যদের বন্দি করে স্থাণ্বীশ্বর অভিমুখে প্রত্যাবর্তন করছিলেন। ভণ্ডি হর্ষবর্ধনকে বলেন, তিনি লোকমুখে জেনেছেন, রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর পর গৌড়রাজ কুশস্থল বা কান্যকুব্জ অধিকার করলে (দেবভূয়ং গতে দেবে রাজ্যবর্ধনে গৌড়েগৃহীতে কুশস্থলে) রাজ্যশ্রী থেকে মুক্ত হন এবং সহচরী-পরিবৃত হয়ে বিন্ধ্যারণ্যে গমন করেন; তার অনুসন্ধানের জন্য যেসব লোকদের পাঠানো হয়েছে, তারা তখনও ফিরে আসেননি। হর্ষচরিতের কোনও কোনও পাণ্ডুলিপিতে ‘গৌড়ৈগৃহীতে’-এর স্থলে ‘গুপ্তনাম্না চ গৃহীতে’ লিখিত আছে। এ পাঠের তাৎপর্য, কান্যকুব্জে জনৈক গুপ্তের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী, বিনয়চন্দ্র সেনদের অভিমত, এই গুপ্ত নরেন্দ্রগুপ্ত, তিনিই শশাঙ্ক। সে যা হোক, রাজ্যশ্রীর সহচরীদের কণ্ঠে তাদের রানির মুক্তি সম্পর্কে যেন অন্য সুর ধ্বনিত হয়েছে। হর্ষবর্ধনের দেখা পেয়ে সহচরীরা তাকে বলেন, গৌড় উপদ্রবের সময় ‘কুলপুত্র’ গুপ্তের সৌজন্যে রাজ্যশ্রী বন্দিদশা থেকে মুক্তিলাভ করেন। এই ‘কুলপুত্র’ অবশ্যই শশাঙ্ক নন। তিনি সম্ভবত শশাঙ্কেরই অধীনস্থ কোনও পদস্থ রাজপুরুষ। কিংবা তিনি হয়তো একজন মৌখরি সেনানায়ক।

রাজ্যশ্রীর বিন্ধ্যাঞ্চলে প্রস্থানের কথা জানতে পেরে হর্ষবর্ধন ভণ্ডির স্কন্ধে সৈন্য পরিচালনার দায়িত্বভার অর্পণ করেন এবং তাকে শশাঙ্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অগ্রসর হতে নির্দেশ দেন। ততদিনে শশাঙ্ক কান্যকুব্জ পরিত্যাগ করে নিজ রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করেছেন। হর্ষবর্ধন-ভাস্করবর্মার সদ্য অনুষ্ঠিত সন্ধির ফলেই তার এই সত্বর পশ্চাদপসরণ। মনে হয়, ভণ্ডি কিছুদূর অগ্রসর হয়ে গঙ্গার তীরে শিবির স্থাপন করেন। হর্ষবর্ধন নিজে কয়েকজন অনুচরসহ ভগিনীর সন্ধানে বিন্ধ্যারণ্য অভিমুখে যাত্রা করেন। হর্ষ সেখানে পৌঁছে অনেক অনুসন্ধানের পর ভগিনীর দেখা পান। রাজ্যশ্রী তখন প্রজ্বলিত চিতাশয্যায় আত্মাহুতি দিতে উদ্যত হয়েছেন। অনেক অনুনয়ের পর হর্ষ নিরস্ত্র করেন এবং তাকে সঙ্গে নিয়ে গঙ্গাতীরবর্তী সৈন্যশিবিরে উপস্থিত হন। সেখানে ভণ্ডি তার প্রতীক্ষা করছিলেন।

ভগিনী রাজ্যশ্রীসহ হর্ষবর্ধনের শিবিরে প্রত্যাবর্তন ও পরিশেষে আসন্ন রাত্রির বর্ণনার মধ্য দিয়ে কাহিনি সমাপ্ত হয়েছে। হর্ষের পরবর্তী ক্রিয়াকলাপের কোনও চিত্র বাণ অঙ্কন করেননি। কিন্তু সে চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে চিনা শ্রমণ শুয়েন চাঙের বিবরণে। ৬৩০ থেকে ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ, এই সুদীর্ঘ চোদ্দো বৎসরকাল ভারতের বিভিন্ন স্থান পরিভ্রমণ করেন বৌদ্ধ শ্রমণ। হর্ষবর্ধনের অতি কাছের মানুষ তিনি। শুয়েন চাঙের বৃত্তান্তে আছে, ভগিনীর উদ্ধারের পর হর্ষ তার মূল পরিকল্পনার কিছু পরিবর্তন ঘটান। প্রথমেই শশাঙ্কের রাজ্য অভিমুখে অগ্রসর না হয়ে তিনি ভগিনী সমভিব্যাহারে কান্যকুব্জে উপনীত হন। শুয়েন চাঙ বলেন, মন্ত্রী পো নি হৰ্ষকে কান্যকুব্জের রাজপদ গ্রহণে আমন্ত্রণ জানান এবং তথাকার পদস্থ ব্যক্তিবর্গ সে প্রস্তাব অনুমোদন করেন। (অধ্যাপিকা দেবাহুতি এবং আরও অনেকে মনে করেন, এই পো নি হর্ষচরিতের ভাণ্ড। কিন্তু এ মত ভ্রান্ত বলেই মনে হয়। পো নি ছিলেন মৌখরিরাজ্যের এক প্রভাবশালী মন্ত্রী। ভণ্ডি ছিলেন পুষ্যভূতি রাজ পরিবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।) হর্ষবর্ধন প্রথমে কান্যকুব্জের রাজপদ গ্রহণে দ্বিধাগ্রস্ত হন এবং এ বিষয়ে আশু কর্তব্য নির্ধারণের জন্য বোধিসত্ত্ব অবলোকিতেশ্বরের উপদেশ প্রার্থনা করেন। বোধিসত্ত্ব পরামর্শ দেন, কর্ণসুবর্ণরাজের প্রতিকূলতায় সংকটাপন্ন ;সদ্ধর্মের পুনর্জীবনের স্বার্থে হর্ষের রাজদণ্ড ধারণ একান্ত আবশ্যক। বোধিসত্ত্বের উপদেশে হর্ষ কান্যকুব্জের রাজত্ব গ্রহণ করেন কিন্তু সিংহাসনে আরোহণ করলেন না, মহারাজ অভিধাও গ্রহণ করলেন না। তার অভিধা হল শীলাদিত্য ও রাজপুত্র।

এখানে কয়েকটি প্রশ্ন উঠছে। গ্রহবর্মার মৃত্যু তথা শশাঙ্কের প্রস্থানের পর কান্যকুব্জের সিংহাসন কী রাজাশূন্য হয়ে পড়ে? হর্ষকে কান্যকুব্জের সিংহাসন প্রদানের প্রস্তাব উঠল কেন? পো নি কী কান্যকুব্জের গোষ্ঠী বিশেষের, না দলমত নির্বিশেষে সকলের মুখপাত্র ছিলেন? কান্যকুব্জের রাজপদ গ্রহণে হর্ষের অনীহার কারণ কী? যে বোধিসত্ত্বের উপদেশ তিনি গ্রহণ করেন, তিনি কি হর্ষেরই বিবেক বা আত্মসমীক্ষার প্রতীক? হর্ষ রাজপুত্র অভিধা ধারণ করে কান্যকুব্জের শাসনকার্য পরিচালনা করেন কেন? তিনি কী কারোর প্রতিনিধিত্ব করেন, না কোনও বিপদ বা বিরোধের আশঙ্কা করেন? কান্যকুব্জ তো মৌখরিদের রাজধানী ছিল। কখন কান্যকুব্জে হর্ষের পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়? এসব নানা প্রশ্নের উত্তর নিহিত আছে নালন্দায় প্রাপ্ত এক মৌখরি সিলমোহরে আর ফ্যাং চি নামে একখানি প্রাচীন চিনা ইতিবৃত্তে।

নালন্দায় আবিষ্কৃত সিলমোহরটি অবন্তিবর্মার কনিষ্ঠ পুত্র উৎকীর্ণ করেন। এই মৌখরি রাজের আদ্যাক্ষর সু এবং পরবর্তী অক্ষর ব অথবা চ। রাজার প্রকৃত নাম সুব্রতবর্মা হতে পারে, আবার সুচন্দ্রবর্মা হওয়াও বিচিত্র নয়। তার অভিধা মহারাজাধিরাজ। অর্থাৎ তিনি একজন পূর্ণ কর্তৃত্বশালী, স্বাধীন, সার্বভৌম নরপতি। ফ্যাং চি নামক চিনা গ্রন্থে বলা হয়েছে, হর্ষবর্ধন ও তার বিধবা ভগিনী রাজ্যশ্রী একযোগে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। এখানে নিশ্চয় অখণ্ড পুষ্যভূতি রাজ্যের কথা বলা হয়নি, বলা হয়েছে কান্যকুব্জ তথা পূর্বতন মৌখরিরাজ্যের কথা।

নালন্দা সিলমোহর ও ফ্যাং চি-র যুগপৎ সাক্ষ্যে অনুমিত হয়, গৌড়রাজ শশাঙ্কের প্রস্থানের অব্যবহিত পর গ্রহবর্মার কনিষ্ঠ ভ্রাতা সুব্রতবর্মা বা সুচন্দ্রবর্মা মহারাজাধিরাজ অভিধা ধারণ পূর্বক কান্যকুব্জের সিংহাসনে আরোহণ করেন। গ্রহবর্মার কোনও পুত্রসন্তান না থাকায় তিনিই ছিলেন সিংহাসনের প্রকৃত অধিকারী। ভগিনীসহ হর্ষবর্ধন কান্যকুব্জে উপস্থিত হলে এই মৌখরিরাজ তাকে বাধা প্রদান করেন এবং উভয়ে দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হন। কান্যকুব্জের কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তি সুব্রতবর্মা বা সুচন্দ্রবর্মাকে সমর্থন করেন। পো নি ও তার অনুগামীরা পরলোকগত গ্রহবর্মার বিধবা পত্নীর পক্ষ অবলম্বন করেন। শেষে সুব্রতবর্মা বা সুচন্দ্রবর্মা পরাজিত হন, তার অনুগামীরা সম্ভবত নেপালে আশ্রয় গ্রহণ করেন। (নেপালি লেখমালায় ভোগবর্মা নামে এক মৌখরিরাজের উল্লেখ আছে। তিনি রাজা অংশুমানের ভাগিনেয় এবং দ্বিতীয় শিবদেবের শ্বশুর। তার আবির্ভাবকাল খ্রিস্টীয় ৭ম শতকের প্রথমার্ধ।) হর্ষ প্রথমে শুভানুধ্যায়ীদের পরামর্শে রাজপুত্র ও শীলাদিত্য অভিধা ধারণ করে ভগিনীর প্রতিনিধিরূপে কান্যকুব্জের শাসনভার গ্রহণ করেন। উত্তরোত্তর নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে আনুমানিক ৬১২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই হর্ষবর্ধন কান্যকুব্জের সার্বভৌম নরপতিরূপে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। (কান্যকুব্জে নিজের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হর্ষবর্ধনের যে ছয় বৎসরকাল সময় অতিব হয়, সমর্থনে দু’টি যুক্তি উপস্থাপন করা যায়। প্রথমত, শুয়েন চাঙ তার বৃত্তান্তের একস্থানে বলেছেন, পূর্বে হর্ষবর্ধন নিছকই একজন রাজা ছিলেন কিন্তু ছয় বৎসর পর তিনি সম্রাটরূপে সুপ্রতিষ্ঠিত হন। সম্ভবত কান্যকুব্জে স্বাধিকার স্থাপনের পরই তার সম্রাটত্বে উত্তরণ হয়। এ থেকে বোঝা যায়, মৌখরিরাজ্য নিষ্কণ্টক করতে হর্ষবর্ধনের ছয় বৎসর সময় অতিক্রান্ত হয়। দ্বিতীয়ত, হুই লি রচিত শুয়েন চাঙের জীবনবৃত্তান্ত থেকে জানা যায়, ৬৪৩ খ্রিস্টাব্দে যখন হর্ষবর্ধন ষষ্ঠবারের মতো প্রয়াগে এক বর্ণাঢ্য উৎসবের আয়োজন করেন, ততদিনে তার রাজত্বের ত্রিশ বা কিঞ্চিদধিক ত্রিশ বৎসর অতিক্রান্ত হয়েছে। এ রাজত্ব হর্ষের আনুমানিক ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে স্থাধীশ্বরের সিংহাসনে আরোহণের সময় হতে ধার্য হয়নি, গণিত হয়েছে তার কান্যকুব্জের একচ্ছত্র অধিপতিরূপে আবির্ভাবের সময় থেকে। আনুমানিক ৬১২ খ্রিস্টাব্দে হর্ষবর্ধন কান্যকুব্জের সিংহাসনে আরোহণ করেন, এই ধারণাই বদ্ধমূল হয়।) বর্ধিতকলেবর পুষ্যভূতিরাজ্যের রাজধানী কান্যকুব্জে স্থানান্তরিত হয়।

হর্ষবর্ধনের অভিযানসমূহ ও বিভিন্ন রাজ্যের সাথে সম্পর্ক

প্রথম পূর্ব ভারত অভিযান

কান্যকুব্জ তথা মৌখরিরাজ্যে নিজ কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করে হর্ষবর্ধন সম্ভবত গৌড়াধিপ শশাঙ্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। রমেশচন্দ্র মজুমদার অভিমত প্রকাশ করেছেন, সিংহাসনে আরোহণের অব্যবহিত পরই হর্ষবর্ধন শশাঙ্কের বিরুদ্ধে সমরাভিযান প্রেরণ করেন। (The Classical Age (Bombay, 1962), পৃষ্ঠা ১০৩। অধ্যাপিকা দেবাহুতিও অনুরূপ মত প্রকাশ করেছেন।) এ অভিমত সম্ভবত ঠিক নয়। ভগিনী রাজ্যশ্রীকে উদ্ধার করে হর্ষবর্ধন সসৈন্যে কান্যকুব্জ শহরে উপনীত হন এবং রাজধানীসহ সমগ্র মৌখরিরাজ্যে পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। এ কাজ সম্পন্ন করতে প্রায় ছয় বৎসরকাল সময় অতিবাহিত হয়। মৌখরিরাজ্য অনধিকৃত রেখে হর্ষবর্ধনের পক্ষে গৌড়রাজ্য আক্রমণ করা অবিজ্ঞজনোচিত কাজ হত।

শশাঙ্কের বিরুদ্ধে হর্ষবর্ধনের অভিযানের বিবরণ পরিবেশিত হয়েছে পরবর্তী কালে রচিত আর্য-মঞ্জুশ্রী-মূলকল্প নামে একখানি বৌদ্ধগ্রন্থে। গ্রন্থটিতে রাজ-রাজড়াদের পুরো নাম নেই, শুধু নামের আদ্যাক্ষর বা মূল নামের প্রতিশব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। অতীত ঘটনাকে ভবিষ্যতের কাহিনি রূপে উপস্থাপনা করাও গ্রন্থখানির এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। কিন্তু কাল্পনিক উপাদানের আধিক্যে গ্রন্থের ঐতিহাসিকতা বহুলাংশে ক্ষুণ্ণ হয়েছে। ঘটনার বর্ণনায় গ্রন্থটিতে সমদর্শিতার পরিচয় নেই, আছে অবৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ ও বিরূপতা। হর্ষ-শশাঙ্ক সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে আর্য মঞ্জুশ্রী-মূলকল্পের এই অংশ সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য – “মধ্যদেশে এক মহান বৈশ্য রাজা জন্মগ্রহণ করবেন। তার নামের আদ্যাক্ষর হবে র (রাজ্য বর্ধন)। তিনি হবেন সোমের (শশাঙ্ক) মতো শক্তিমান। নয়জাতির এক রাজার হাতে তার মৃত্যু হবে। তার কনিষ্ঠভ্রাতা হ (হর্ষবর্ধন) হবেন রাজচক্রবর্তী। প্রথিতযশা সোমের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করবেন। মহাবলী বৈশ্যরাজ সুবিশাল সৈন্যবাহিনীসহ পূর্বদেশের সেই অধার্মিক রাজার সুরম্য রাজধানী পুণ্ড্র অভিমুখে অগ্রসর হবেন। দুষ্কর্মে লিপ্ত সোমকে তিনি করবেন পরাজিত। তাকে বাধ্য করবেন নিজরাজ্য মধ্যে আবদ্ধ থাকতে। বর্বর রাজার দেশে সমাদরের (বা অনাদরের) পর তিনি স্বরাজ্যে প্রত্যাবর্তন করবেন”। (আর্য-মঞ্জুশ্রী-মূলকল্প, শ্লোক ৭১৯-২৬)।

আর্য-মঞ্জুশ্রী-মূলকল্পের উপরোক্ত বিবরণ অনুসারে হর্ষবর্ধন শশাঙ্কের রাজ্যের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন এবং পুণ্ড্র বা পুণ্ড্রবর্ধনের যুদ্ধে শত্রুপক্ষকে পরাজিত করেন। এই বিবরণে আরও প্রকাশ, হর্ষবর্ধন শশাঙ্ককে রাজ্যচ্যুত বা নির্মূল না করেই স্বরাজ্যে প্রত্যাগমন করেন। আর্য-মঞ্জুশ্রী মূলকল্পের এ বর্ণনা সর্বৈব সত্য হলেও একটি জিনিস পরিষ্কার : যে উদ্দেশ্যের বশবর্তী হয়ে পুষ্যভূতিনৃপতি গৌড়েশ্বরের বিরুদ্ধে অভিযান করেন, তার সে উদ্দেশ্য সফল হয়নি। শশাঙ্কের রাজ্যের এক ভগ্নাংশও তিনি অধিকার করতে পারেননি। তাকে প্রকৃতপক্ষে শূন্যহস্তেই প্রত্যাবর্তন করতে হয়। ৬৩৭-৩৮ খ্রিস্টাব্দে শুয়েন চাঙ মগধ পরিভ্রমণ করেন। তখন পূর্ণবর্মা মগধের রাজা। চিনা শ্রমণ বলেন, তার মগধ ভ্রমণের অত্যল্পকাল পূর্বে শশাঙ্ক বোধগয়ার বোধিবৃক্ষ ছেদন করেন এবং অনতিবিলম্বে মৃত্যুমুখে পতিত হন। শুয়েন চাঙের এই উক্তি থেকে প্রতীতি হয়, শশাঙ্ক মৃত্যুকাল পর্যন্ত মগধে নিজের কর্তৃত্ব অটুট রাখেন। প্রাচীন চিনা লেখক মা তোয়ান লিন বলেন, শীলাদিত্য ৬৪১ খ্রিস্টাব্দে ‘মগধেশ্বর’ অভিধা ধারণ করেন। অর্থাৎ ৬৪১ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে মগধ হর্ষবর্ধনের অধিকারভুক্ত ছিল না। এসব ঘটনা প্রমাণ করছে, শশাঙ্কের বিরুদ্ধে হর্ষবর্ধনের অভিযান কার্যত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। অনুমিত হয়, শশাঙ্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কামরূপরাজ ভাস্করবর্মা মিত্র হর্ষবর্ধনের পক্ষ অবলম্বন করেন।

অধ্যাপিকা দেবাহুতি অভিমত ব্যক্ত করেছেন, হর্ষবর্ধন পূর্ব ভারত অভিযান সমাপনান্তে ভাস্করবর্মাকে কামরূপের সিংহাসনে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিষিক্ত করেন। (তদেব, পৃষ্ঠা ৮৭)। হর্ষচরিতে (অত্র দেবেন অভিষিক্তঃ কুমারঃ) হর্ষবর্ধন কর্তৃক এক কুমারের রাজ্যাভিষেকের বর্ণনা আছে। অধ্যাপিকা দেবাহুতি এই কুমারকে কামরূপরাজ ভাস্করবর্মারূপে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু কুমার বলতে সাধারণত রাজপুত্র বোঝায়। হর্ষচরিতে সম্ভবত রাজপুত্র অর্থেই কুমার শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। হর্ষচরিতের এই কুমার কামরূপ নৃপতি ভাস্করবর্মা কিনা, সে সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। ভাস্করবর্মা হর্ষবর্ধনের পূর্বেই রাজপদে অভিষিক্ত হন। দ্বিতীয়বার তার রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠিত হবে কেন? রমেশচন্দ্র মজুমদার ও রামশঙ্কর ত্রিপাঠী বলেন, এই কুমার মাধবগুপ্তের জ্যেষ্ঠভ্রাতা কুমারগুপ্ত। (The Classical Age (Bombay, 1962), পৃষ্ঠা ১২৬।) হর্ষচরিতের কুমার যে ভাস্করবর্মা নন, তার সমর্থনে আরও একটি যুক্তি আছে। ভগিনী রাজ্যশ্রীর সঙ্গে হর্ষবর্ধনের গঙ্গাতীরবর্তী সৈন্য-শিবিরে প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে বাণের কাহিনির সমাপ্তি ঘটেছে; এর পরবর্তী কোনও ঘটনার বর্ণনা বা পূর্বাভাস হর্ষচরিতে নেই।

বলভী অভিযান

অতঃপর হর্ষবর্ধন গুজরাত তথা পশ্চিম ভারতে আধিপত্য বিস্তারে উদ্যোগী হন। প্রভাকরবর্ধনের সময় থেকে এ অঞ্চলের লাট, মালব ও গুর্জরদের সঙ্গে পুষ্যভূতিদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এসব রাজ্যের সঙ্গে প্রভাকরবর্ধনের বিরোধের উল্লেখ আছে হর্ষচরিতে। হর্ষবর্ধনের সময় অবস্থা অপরিবর্তিতই থাকে। পুষ্যভূতিরাজ বলভীরাজ্য আক্রমণ করেন। কিম ও মহী নদীর অন্তর্বর্তী অঞ্চলের গুর্জর রাজাদের অভিলেখে এ সংঘর্ষের সংক্ষিপ্ত বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে। সেখানে বলা হয়েছে, গুর্জররাজ দ্বিতীয় দদ্দ পরমেশ্বর শ্রীহর্ষদেবের হস্তে পরাজিত বলভীর রাজাকে ত্রাণ বা উদ্ধার করে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন। লেখের সাক্ষ্যে প্রতীয়মান হয়, প্রথমে পরমেশ্বর শ্রীহর্ষদেবের হস্তে পরাভূত হলেও পরিশেষে দ্বিতীয় দদ্দের সহায়তায় বলভীরাজ হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার করেন। অনেকে সিদ্ধান্ত করেছেন, হর্ষবর্ধন বলভীরাজ্য জয় করেন এবং বলভীরাজ তার বশীভূত মিত্রে পরিণত হন। কিন্তু হর্ষবর্ধনের বলভীরাজ্য অধিগ্রহণের সপক্ষে কোনও সুনিশ্চিত প্রমাণ নেই।

দ্বিতীয় দদ্দের মতো একজন ক্ষুদ্র নরপতি একক শক্তিতে হর্ষবর্ধনের মতো এক বলশালী রাজার আক্রমণ থেকে বলভীরাজকে বিপদমুক্ত করবেন, এমন আশা সংগত বোধ হয় না। সমকালীন মালবরাজও সম্ভবত দ্বিতীয় দদ্দের সঙ্গে হর্ষকে বাধা প্রদান করেন। দ্বিতীয় পুলকেশীর আইহোল প্রশস্তিতে দাবি করা হয়েছে, লাট, মালব ও গুর্জরেরা স্বেচ্ছায় চালুক্যরাজের আনুগত্য স্বীকার করেন। মনে হয়, হর্ষবর্ধনের সম্ভাব্য আক্রমণের আশঙ্কায় তারা দ্বিতীয় পুলকেশীর সঙ্গে অধীনতামূলক মিত্রতায় আবদ্ধ হন। অনুমিত হয়, বলভীরাজের বিপদের দিনে দ্বিতীয় পুলকেশীই তার প্রধান সহায় হয়ে দাঁড়ান।

যে বলভীরাজের বিরুদ্ধে হর্ষবর্ধন অস্ত্র ধারণ করেন, তার সঠিক পরিচয় নির্ধারণ করা দুষ্কর। হর্ষের বলভী আক্রমণ যদি হর্ষ-পুলকেশী যুদ্ধের পূর্ববর্তী ঘটনা হয়, তাহলে তাকে অবশ্যই দ্বিতীয় ধ্রুবসেন বালাদিত্য (আ. ৬২৮–৬৪০/৪১ খ্রিস্টাব্দ) রূপে চিহ্নিত করতে হবে। তিনি ধ্রুবপটু বা ধ্রুবভট্ট নামেও পরিচিত। তারই রাজত্বকালে শুয়েন চাঙ বলভী পরিদর্শন করেন। চিনা পরিব্রাজকের বৃত্তান্ত থেকে জানা যায়, এই বলভীরাজ হর্ষবর্ধনের জনৈকা কন্যার পাণিগ্রহণ করেন। মনে হয়, যুদ্ধশেষে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের মধ্য দিয়ে উভয়পক্ষের বৈরিতার অবসান হয়। দ্বিতীয় ধ্রুবসেন পরে প্রয়াগে হর্ষবর্ধনের আয়োজিত এক বর্ণাঢ্য সমারোহেও যোগদান করেন।

অনেকে এই শনাক্তকরণ সমর্থন করেন না। তাদের অভিমত, ৬২৯ এবং ৬৪১ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ দ্বিতীয় দদ্দের দু’টি লেখে হর্ষের বিরুদ্ধে তার বলভীরাজকে সাহায্য দানের কোনও দাবি উচ্চারিত হয়নি; দ্বিতীয় দদ্দের এ সাফল্যের দাবি ঘোষিত হয়েছে তার বংশধরদের অভিলেখে। এই যুক্তির ভিত্তিতে তাদের অনুমান, হর্ষবর্ধন ৬৪১ খ্রিস্টাব্দের পর কোনও এক সময় দ্বিতীয় ধ্রুবসেনের পুত্র ও উত্তরাধিকারী চতুর্থ ধরসেনের (আ. ৬৪৩-৫০ খ্রিস্টাব্দ) রাজত্বকালে বলভী আক্রমণ করেন। চতুর্থ ধরসেন হর্ষবর্ধনের দৌহিত্র ছিলেন। সে ক্ষেত্রে হর্ষবর্ধন ও ধরসেনের যুদ্ধকে মাতামহ-দৌহিত্রের সংগ্রাম বলে বর্ণনা করা চলে। ইতিহাসে মাতামহ-দৌহিত্রের সংঘর্ষ কখনও ঘটেনি, এমন নয়। অবশ্য চতুর্থ ধরসেন হর্ষকন্যার পুত্র নাও হতে পারেন। কিন্তু এ মতের বিরুদ্ধে দু’টি যুক্তি আছে।

  • প্রথমত, দ্বিতীয় পুলকেশীর মতো পরাক্রান্ত নরপতির সাহায্য ছাড়া দ্বিতীয় দদ্দ বা বলভীরাজের পক্ষে হর্ষবর্ধনের বিরুদ্ধে সাফল্যলাভ করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু সে সময় দ্বিতীয় পুলকেশী পল্লবদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করছেন। তার পক্ষে তখন বলভীর রাজাকে সামরিক সাহায্য প্রদান ছিল সুদূরপরাহত।
  • দ্বিতীয়ত, এ কথা সত্য, দ্বিতীয় দদ্দ তার নিজস্ব লেখে হর্ষবর্ধনের বিরুদ্ধে বিজয়লাভের দাবি উচ্চারণ করেননি। মনে রাখতে হবে, বলভীরাজের বিপদের দিনে তিনি শুধু একাই তার সাহায্যার্থে অগ্রসর হননি, দ্বিতীয় পুলকেশী এ যুদ্ধে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন। দ্বিতীয় দদ্দ দ্বিতীয় পুলকেশীর অনুগত ছিলেন। হর্ষের বিরুদ্ধে সাফল্যকে তার নিজের একক কৃতিত্ব বলে ঘোষিত হলে তিনি স্বভাবতই দ্বিতীয় পুলকেশীর বিরাগভাজন হতেন।

হর্ষ-পুলকেশী সংঘর্ষ

হর্ষবর্ধন বাদামির চালুক্য নরপতি দ্বিতীয় পুলকেশীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। হয়তো বলভীযুদ্ধে চালুক্যরাজের অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপ তার দ্বিতীয় পুলকেশীর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণের একটি সম্ভাব্য কারণ। এমনও হতে পারে, গুজরাতে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে উভয়পক্ষে বিরোধ ঘনীভূত হয়। পুলকেশীর আইহোল প্রশস্তি, বাদামির উত্তর কালীন চালুক্য রাজাদের অভিলেখ ও শুয়েন চাঙের বিবরণে এই সংঘর্ষের উল্লেখ আছে। হর্ষ পুলকেশী সংঘর্ষের উল্লেখ প্রসঙ্গে আইহোল প্রশস্তিতে বলা হয়েছে, যুদ্ধক্ষেত্রে হর্ষের রণহস্তীরা বিনাশপ্রাপ্ত হয় (যুধি পতিতগজেন্দ্র), ভয়ে হর্ষের হর্ষ অন্তর্হিত হয় (ভয়বিগলিতহর্ষো যেন চাকারি হর্যঃ)। শুয়েন চাঙের বিবরণী থেকে জানা যায়, পঞ্চ ভারত থেকে বিপুল সৈন্য সংগ্রহ করে, সুদক্ষ সেনানায়কদের সহায়তায় হর্ষবর্ধন পুলকেশীর বিরুদ্ধে সৈন্য পরিচালনা করেন কিন্তু তিনি শত্রু সৈন্যদের পরাজিত করতে ব্যর্থ হন। বোঝা যায়, পুলকেশীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে হর্ষবর্ধনই আক্রমণকারীর ভূমিকা গ্রহণ করেন কিন্তু শত চেষ্টা সত্ত্বেও তিনি শত্রুকে পদানত করতে পারেননি। অনুমিত হয়, শত্রুহস্তে পরাজিত হয়ে হর্ষবর্ধন স্বরাজ্যে প্রত্যাবর্তন করেন। (দ্বিতীয় পুলকেশী হর্ষবর্ধনকে পরাজিত করেন, এ অভিমত রমেশচন্দ্র মজুমদার স্বীকার করেন না। তিনি মনে করেন, শুয়েন চাঙের বিবরণে হর্ষের কোনও নিদারুণ বিপর্যয়ের কথা নেই, তার অসাফল্যের উল্লেখ আছে। অসাফল্যের অর্থ বিপর্যয় নয়। হর্ষকে পরাজিত করেছেন, এমন দাবি স্বয়ং পুলকেশীর কণ্ঠেও ঘোষিত হয়নি। হর্ষ-পুলকেশী যুদ্ধ অমীমাংসিত অবস্থায় শেষ হয় [The Classical Age (Bombay. 1962), পৃষ্ঠা ১০৫))। বাদামির উত্তরকালীন চালুক্য রাজারা সগর্বে ঘোষণা করেছেন, দ্বিতীয় পুলকেশী ‘সকলোত্তরা পথনাথ’ হর্ষবর্ধনকে পরাজিত করে পরমেশ্বর অভিধা গ্রহণ করেন। পুলকেশী হর্ষবর্ধনকে পরাজিত ও হতমান করেন, এ কথা স্বীকার্য, কিন্তু পুষ্যভূতিরাজকে পরাভূত করে তিনি পরমেশ্বর অভিধা ধারণ করেন, এ মত সমর্থিত নয়। ৬১৩ (মতান্তরে ৬১২) খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ তার নিজস্ব হায়দ্রাবাদ তাম্রশাসনে পুলকেশী ঘোষণা করেছেন, শত যুদ্ধে শত্রু রাজাদের বা শত্রু রাজাকে পরাজিত করে তিনি পরমেশ্বর অভিধায় ভূষিত হন। লক্ষণীয়, এখানে হর্ষবর্ধনের নামোল্লেখ নেই। অনুমিত হয়, পুলকেশীর সিংহাসনে আরোহণের সময় ও অব্যবহিত পর যে সকল প্রতিকূল শক্তি বাদামি ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়, তাদের নির্মূল করে তিনি ‘পরমেশ্বর’ অভিধা গ্রহণ করেন। হর্ষের বিরুদ্ধে বিজয়লাভের সঙ্গে দ্বিতীয় পুলকেশীর ‘পরমেশ্বর’ অভিধা গ্রহণের কল্পনা উত্তরকালীন চালুক্যনৃপতিদের মস্তিষ্কপ্রসূত; তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ঘটনাকে বিকৃত করেছেন।

এ যুদ্ধের ঘটনাস্থলের অবস্থান সম্পর্কে নানা ঐতিহাসিক নানা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। ভিনসেন্ট স্মিথের অভিমত, বিবদমান দুই শক্তি নর্মদাতীরে পরস্পরের সম্মুখীন হয়। একই অভিমত ব্যক্ত করেছেন নীলকান্ত শাস্ত্রী। রমেশচন্দ্র মজুমদারের অভিমত, নর্মদা নদীতটে নয়, আরও উত্তরবর্তী কোনও এক স্থানে এ যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। তার দু’টি যুক্তি।

  • প্রথমত, লাট, মালব ও গুর্জরেরা পুলকেশীর অনুগত ছিলেন, হর্ষবর্ধনের আনুগত্যাধীন ছিলেন না।
  • দ্বিতীয়ত, শুয়েন চাঙও মালব ও বুন্দেলখণ্ড অঞ্চলে কতিপয় স্বাধীন রাজ্যের উল্লেখ করেছেন। এসব মত-অভিমত ঘিরে বিতর্ক থাকবে।

হর্ষ-পুলকেশী যুদ্ধের ঘটনাকাল সম্পর্কেও বিতর্ক রয়েছে। ৬১৩ (মতান্তরে ৬১২) খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ তার হায়দ্রাবাদ অভিলেখে দ্বিতীয় পুলকেশী পরমেশ্বররূপে বর্ণিত হয়েছেন। এ কারণে জন ফেইথফুল ফ্লিট প্রমুখ অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, ৬০৮-৯ খ্রিস্টাব্দে এ যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু হায়দ্রাবাদ অভিলেখে পুলকেশীর পরমেশ্বর অভিধা গ্রহণের যে কারণ দর্শিত হয়েছে তা কিন্তু হর্ষের বিরুদ্ধে তার বিজয়লাভ নয়, শত যুদ্ধে শত্রু রাজাদের বা শত্রু রাজার বিরুদ্ধে তার সাফল্য। ‘সকলোত্তরাপথনাথ’ হর্ষবর্ধনকে পরাভূত করে পুলকেশী ‘পরমেশ্বর’ অভিধা ধারণ করেন বলে যে দাবি তার উত্তরপুরুষদের কণ্ঠে সোৎসাহে উচ্চারিত হয়েছে, তাতে বাস্তব ঘটনা প্রতিফলিত হয়নি। ৬৩৪-৩৫ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ দ্বিতীয় পুলকেশীর আইহোল প্রশস্তিতে এ যুদ্ধের উল্লেখ আছে। হর্ষ-পুলকেশী যুদ্ধ অবশ্যই ৬৩৪-৩৫ খ্রিস্টাব্দের পূর্ববর্তী। কিন্তু এর ঠিক কতকাল পূর্বে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়, তা নিতান্তই অনুমানের বিষয়। ৬২০ থেকে ৬৩০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী বেশ কয়েকটি তারিখের কথা এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। এসব তারিখ অবশ্যই আনুমানিক।

দ্বিতীয় পূর্ব ভারত অভিযান

গৌড়েশ্বর শশাঙ্কের মৃত্যুর পর হর্ষবর্ধন পুনরায় পূর্ব ভারতে স্বীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন। এবার তার উদ্যম সাফল্যমণ্ডিত হয়। শুয়েন চাঙের জীবনবৃত্তান্ত থেকে জানা যায়, ৬৪৩ খ্রিস্টাব্দের প্রারম্ভে যখন চিনা শ্রমণ ভাস্করবর্মার আমন্ত্রণে কামরূপ পরিদর্শন করছেন, তখন হর্ষ কোঙ্গোদ ও ওড়িশা বিজয় সম্পন্ন করে রাজমহলের সন্নিকটবর্তী কজঙ্গলে অবস্থান করছেন। এ তথ্যে অনুমিত হয়, ৬৪৩ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে, অর্থাৎ, আনুমানিক ৬৪১-৪২ খ্রিস্টাব্দে, হর্ষ পূর্ব ভারত বিজয়ে বহির্গত হয়ে মগধ, বাংলা, কোঙ্গোদ ও ওড়িশা অধিকার করেন। প্রাচীন চিনা লেখক মা তোয়ান লিন বলেন, শীলাদিত্য ৬৪১ খ্রিস্টাব্দে ‘মগধেশ্বর’ অভিধা গ্রহণ করেন। ৬৩৭-৩৮ খ্রিস্টাব্দে শুয়েন চাঙের পরিভ্রমণকালে পূর্ণবর্মা মগধের রাজপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। অশোকরাজের শেষ বংশধর পূর্ণবর্মা। তার মৃত্যুর পর বা তাকে বিতাড়িত করে হর্ষবর্ধন মগধে নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। অধ্যাপিকা দেবাহূতি বলেন, পূর্ণবর্মা হর্ষবর্ধনের অনুগত ছিলেন। এ মত প্রমাণসিদ্ধ নয়। পূর্ণবর্মা সম্ভবত একজন স্বাধীন মৌখরিরাজ ছিলেন।

অধ্যাপিকা দেবাহুতি অভিমত প্রকাশ করেছেন, হর্ষবর্ধন ৬০৬-৭ খ্রিস্টাব্দে মগধ ও পুণ্ড্র বর্ধন অধিকার করেন। (তদেব, পৃষ্ঠা ১০০-১)। তার যুক্তি দু’টি – প্রথমত, পুণ্ড্রবর্ধনে শশাঙ্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য হর্ষবর্ধন মগধ অতিক্রম করেন। দ্বিতীয়ত, কজঙ্গলে রাজদরবার অনুষ্ঠানের জন্য তাকে মগধ জয় করতে হয়। বলা বাহুল্য, যুক্তি দু’টি ত্রুটিপূর্ণ। কেবলমাত্র আর্য-মঞ্জুশ্রী-মূলকল্পেই হর্ষবর্ধনের পুণ্ড্রবর্ধন যুদ্ধের উল্লেখ আছে। এই গ্রন্থের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত, হর্ষবর্ধনের আক্রমণাত্মক অভিযান সত্ত্বেও শশাঙ্ক সিংহাসনচ্যুত হননি, তার রাজ্য সম্পূর্ণ অক্ষত, অটুট ছিল। দ্বিতীয়ত, হর্ষবর্ধন যখন কজঙ্গলে অবস্থান করেন, তখন ৬৪৩ খ্রিস্টাব্দের প্রারম্ভকাল, হর্ষবর্ধনের রাজত্বের শেষপর্ব।

হর্ষবর্ধনের কোঙ্গোদ অভিযান প্রসঙ্গে দীনেশচন্দ্র সরকার দু’টি বক্তব্য রেখেছেন (পাল-পূর্ব যুগের বংশানুচরিত (কলকাতা, ১৯৮৫), পৃষ্ঠা ১২০) : এক, হর্ষবর্ধন কজঙ্গল থেকে কোঙ্গোদ তথা ওড়িশায় বিজয়াভিযান পরিচালনা করেন ; দুই, হর্ষবর্ধন তার বশীভূত মিত্র গৌড়েশ্বরের সাহায্যকল্পেই কোঙ্গোদে অভিযান করেন। দু’টি বক্তব্য ঘিরেই বিতর্ক উঠবে। কজঙ্গল থেকে ওড়িশায় বিজয়াভিযান পরিচালনার অর্থ, কোঙ্গোদে অভিযানকালে হর্ষবর্ধন নিজে কজঙ্গলে অবস্থান করেন এবং সেখান থেকেই যুদ্ধ সম্পর্কে নির্দেশাদি প্রদান করেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা আজ যা সম্ভব করেছে, খ্রিস্টীয় ৭ম শতকের প্রথমার্ধে তা ছিল অসাধ্যসাধন। দ্বিতীয়ত, শশাঙ্কোত্তর বাংলায় এক বশীভূত গৌড়েশ্বরের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু কে এই গৌড়েশ্বর? কী তার পরিচয়? কেনই বা হর্ষবর্ধন কোঙ্গোদ জয় করে তিনি তা বশীভূত গৌড়াধিপতিকে উপঢৌকন দেবেন? শশাঙ্কের মৃত্যুর পর হর্ষবর্ধন বাংলা ও ওড়িশা স্বরাজ্যভুক্ত করেন, এ অভিমতই যুক্তিযুক্ত।

সুধাকর চট্টোপাধ্যায় মনে করেন, এ সময় কোঙ্গোদ দ্বিতীয় পুলকেশীর অধীনস্থ ছিল; দ্বিতীয় পুলকেশীকে পরাজিত করেই হর্ষবর্ধন কোঙ্গোেদ জয় করেন। (Early History of North India (Calcutta, 1968), পৃষ্ঠা ৩০৩। চট্টোপাধ্যায় হর্ষবর্ধনের কোঙ্গোদ অভিযান ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে ধার্য করেছেন (তদেব)। এ অভিমত তথ্যভিত্তিক নয়।) হর্ষবর্ধনের কোঙ্গোদ বিজয়কে তিনি হর্ষ-পুলকেশী সংঘর্ষের শেষ পর্যায়রূপে চিহ্নিত করেছেন। বোঝা যায়, সুধাকর চট্টোপাধ্যায় কলিঙ্গ ও কোঙ্গোদকে এক ও অভিন্ন অঞ্চল অর্থে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু কলিঙ্গ ও কোঙ্গোদ তো সমার্থক নয়। খ্রিস্টীয় ৭ম শতকের প্রথমার্ধে কলিঙ্গ শ্রীকাকুলম—বিশাখাপত্তনম জেলায় অবস্থিত ছিল আর কোঙ্গোদের অবস্থিতি ছিল গঞ্জাম ও পুরী জেলায় এবং কটক জেলার দক্ষিণাঞ্চলে। হর্ষের অভিযানকালে কোঙ্গোদের রাজপদে শৈলোদ্ভব বংশীয় সৈন্যভীত দ্বিতীয় মাধববর্মা অধিষ্ঠিত ছিলেন; কলিঙ্গ ছিল চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর আনুগত্যাধীন। হর্ষবর্ধন দ্বিতীয় মাধববর্মাকে পরাজিত করেন। (D. K. Ganguly, Historical Geography And Dynastic History of Orissa (Calcutta, 1975), পৃষ্ঠা ১৯২)।

গৌড়াধিপতি শশাঙ্ক কখন মারা যান, তা সঠিক জানা যায় না। অধ্যাপিকা দেবাহুতি তার নিজস্ব অনুমানের উপর নির্ভর করে শশাঙ্কের মৃত্যু ৬২০ খ্রিস্টাব্দে ধার্য করেছেন। (তদেব, পৃষ্ঠা ১০৬।) এ মত ভ্রান্ত। সামন্ত মহারাজ সোমদত্তের মেদিনীপুর তাম্রশাসন প্রমাণ করছে, ৬১৯ খ্রিস্টাব্দে শশাঙ্ক রাজত্ব করছেন (শ্রীশশাঙ্কে মহীং পাতি চতুৰ্জলধিমেখলাম্)। তার অনুগত মহাসামন্ত দ্বিতীয় মাধববর্মার গঞ্জাম তাম্রশাসন ৩০০ গুপ্তাব্দ বা ৬২০ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ হয়। এই লেখে শশাঙ্ক চতুঃসমুদ্ৰান্ত ধরণীর অধিপতিরূপে বন্দিত হয়েছেন। এই ঘটনার কয়েক বছর পরও শশাঙ্ক জীবিত ছিলেন, এরূপ অনুমানই সংগতবোধ হয়। শুয়েন চাঙ ৬৩৭-৩৮ খ্রিস্টাব্দে শশাঙ্কের মৃত্যুকে সাম্প্রতিক ঘটনারূপে বর্ণনা করেছেন। অনুমিত হয়, ৬৩৭-৩৮ খ্রিস্টাব্দের অনতিকাল পূর্বে তার মৃত্যু হয়। সিংহাসনে আরোহণ করে হর্ষবর্ধন শশাঙ্কের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণের কথা যতই দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করুন না কেন, এটা প্রায় দিবালোকের মতো স্পষ্ট, গৌড়েশ্বরের জীবিতকালে তিনি পূর্ব ভারতে বিশেষ কোনও সাফল্য অর্জন করেননি; শশাঙ্কের দেহাবসানের পরই তার মগধ, বাংলা, কোঙ্গোদ ও ওড়িশায় স্বাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব সাফল্য হর্ষবর্ধন অর্জন করেন তার সিংহাসনে আরোহণের তিন দশকেরও অধিককাল পর। ৬২০ খ্রিস্টাব্দে শশাঙ্ক মগধ, বাংলা, ওড়িশা ও কোঙ্গোদের সার্বভৌম মহারাজাধিরাজরূপে বিরাজমান; তখন তিনি সমুদ্রমেখলা পৃথিবীর অধি পতিরূপে বন্দিত।

প্রশ্ন হচ্ছে, শশাঙ্কের মৃত্যুর পর যে বাংলা হর্ষের অধিকারভুক্ত হয়, সে কি অখণ্ড বাংলা, না বাংলার একার্ধ? শুয়েন চাঙের বৃত্তান্তে এ প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া যাবে। চিনা শ্রমণের বৃত্তান্তে আছে, একবার ভাস্করবর্মা নালন্দা মহাবিহারের অধ্যক্ষ শীলভদ্রকে অনুরোধ করেন, তিনি যেন শুয়েন চাঙকে সত্বর তার নিকট পাঠিয়ে দেন। শীলভদ্র সে উপরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। ক্রুদ্ধ ভাস্করবর্মা হুংকার দেন, তিনি নালন্দা মহাবিহার ধুলায় গুঁড়িয়ে দেবেন। এই ভীতিপ্রদর্শনে কাজ হয়। বাংলার কিয়দংশে ভাস্করবর্মার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত না থাকলে তার নালন্দা মহাবিহার ধ্বংসের হুংকার অর্থহীন হয়। শুয়েন চাঙের বৃত্তান্ত থেকে আরও জানা যায়, ভাস্করবর্মা হর্ষবর্ধনের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে ২০ হাজার হস্তী ও ৩০ হাজার নৌযানসহ গঙ্গাপথে কজঙ্গল অভিমুখে যাত্রা করেন। বাংলার কিয়দংশ তার অধিকৃত না হলে তার পক্ষে সসৈন্যে গঙ্গাপথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব ছিল না। তাছাড়া শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ বিজয়স্কন্ধাবার থেকে ভাস্করবর্মার একখানি লেখ উৎকীর্ণ হয়। লেখখানি তারিখবিহীন। রামশঙ্কর ত্রিপাঠী প্রমুখ কেউ কেউ হয়তো বলবেন, অখণ্ড বাংলা হর্ষবর্ধনের অধিকারভুক্ত ছিল; পুষ্যভূতিরাজের মৃত্যুর পরই কামরূপরাজ বাংলার কিয়দংশ অধিকার করেন। আবার রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতো অনেকেই এ মত পোষণ করবেন না; তারা বলবেন, হর্ষবর্ধন পশ্চিমবঙ্গ আত্মসাৎ করেন আর ভাস্করবর্মা লাভ করেন উত্তর ও পূর্ব বাংলার আধিপত্য। শুয়েন চাঙের সাক্ষ্য এবং কর্ণসুবর্ণ থেকে সম্প্রদত্ত নিধনপুর তাম্রশাসনের প্রেক্ষাপটে হর্ষবর্ধন ও ভাস্করবর্মার অনুকূলে শশাঙ্কোত্তর বাংলার রাজ নৈতিক বিভাজনের ছবিটিই যেন স্পষ্ট হচ্ছে।

হর্ষবর্ধন ও নেপাল

ব্যুলার, ফ্লিট, ভিনসেন্ট স্মিথ প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ অভিমত প্রকাশ করেছেন, হর্ষবর্ধন নেপাল জয় করেন। হর্ষবর্ধনের নেপাল বিজয়ের সপক্ষে যুক্তিগুলো নিম্নরূপ :

  • ১. নেপালের বহু লেখে হর্ষাব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।
  • ২. নেপালি বংশাবলিতে রাজা বিক্রমাদিত্যের উল্লেখ আছে। তিনি অংশুমানের সিংহাসনে আরোহণের অব্যবহিত পূর্বে নেপালে রাজত্ব করেন। একটি অব্দও তিনি প্রবর্তন করেন। এই বিক্রমাদিত্যই হর্ষবর্ধন।
  • ৩. বংশাবলিতে নেপালি বৈস রাজপুতদের উল্লেখ আছে। অনুমিত হয়, এক বৈস রাজপুত রাজা প্রাচীনকালে নেপালে রাজ্যস্থাপন করেন। এই বৈস রাজপুত রাজাই হর্ষবর্ধন।
  • ৪. হর্ষচরিতে বলা হয়েছে, পুষ্যভূতিরাজ তুষারশৈল সমাকীর্ণ দুরধিগম্য অঞ্চল থেকে কর আদায় করেন (তত্র পরমেশ্বরেণ তুষারশৈলভুবো দুর্গায়া গ্রাহীতঃ করঃ)। এই দুরধিগম্য তুষার শৈলাঞ্চলই নেপাল।

এসব যুক্তি মোটেই তথ্যভিত্তিক নয়। নেপালে হর্ষাব্দ প্রচলনের কথা বলা হয়েছে অথচ এ অঞ্চলে প্রাচীনকালে হর্ষাব্দ ব্যবহারের কোনও সুনিশ্চিত প্রমাণ নেই। নেপালের ইতিহাসের উপাদানরূপে বংশাবলির বিশেষ ঐতিহাসিক গুরুত্ব নেই। কল্পকাহিনির আধিক্যে বংশাবলির ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহুলাংশে ক্ষুণ্ণ হয়েছে। তুষারশৈল সমাকীর্ণ, অগম্য অঞ্চল মানেই নেপাল নয়। এ সময় নেপাল তিব্বতের প্রভাবাধীন ছিল। সিলভ্যা লেভি উল্লিখিত তুষার অঞ্চলকে তুখার অর্থে গ্রহণ করেছেন। রমেশচন্দ্র মজুমদার এ অঞ্চলটিকে হিমালয়ের পাদদেশে নির্দেশ করেছেন। (The Classical Age, পৃষ্ঠা ১১৩)। বাণের উক্তিটি দ্ব্যর্থবোধক বোধ হয়। এক অর্থে, এই শ্লোকে পরমেশ্বর অর্থাৎ শিবের সঙ্গে তুষার শৈলোদ্ভবা দুর্গার বিবাহের কথা আছে, অন্য অর্থে আছে হর্ষবর্ধনের জনৈকা শৈলসুতার পাণিগ্রহণের ইঙ্গিত। হর্ষবর্ধনের রাজ্যজয়ের কোনও উল্লেখ বা ইঙ্গিত এখানে নেই।

হর্ষবর্ধন ও সিন্ধুরাজ্য

হর্ষবর্ধন সিন্ধুরাজ্য আক্রমণ করেন বলে রমেশচন্দ্র মজুমদার ও রামশঙ্কর ত্রিপাঠী অভিমত প্রকাশ করেছেন। রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে হর্ষের অভিযান বিফল হয়। রামশঙ্কর ত্রিপাঠীর অভিমত, হর্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সিন্ধুরাজ পরাজয় বরণ করেন কিন্তু তিনি সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রাখেন। আসলে বাণভট্টের একটি উক্তির তাৎপর্য নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। বাণভট্টের উক্তিটি হল, “অত্র পুরুষোত্তমেন সিন্ধুরাজং প্রমথ্য লক্ষ্মীঃ আত্মীকৃতা”। সাধারণ অর্থে মনে হয়, পুরুষোত্তম অর্থাৎ বিষ্ণু যেমন সিন্ধু বা সমুদ্র মন্থন করে লক্ষ্মী লাভ করেন, তেমনি পুরুষশ্রেষ্ঠ হর্ষবর্ধন সিন্ধুরাজকে মর্দন করে তার রাজলক্ষ্মী আত্মসাৎ করেন। সে ক্ষেত্রে হর্ষের সঙ্গে তৎকালীন সিন্ধুরাজের সংঘর্ষ ও তার সিন্ধুরাজ্য অধিকার স্বীকার করতে হয়। কিন্তু তা কী করে সম্ভব? শুয়েন চাঙের বৃত্তান্তে প্রকাশ, তার ভ্রমণকালে, অর্থাৎ হর্ষের সময়, সিন্ধু এক স্বাধীন ও পরাক্রমশালী রাজ্য ছিল। মনে হচ্ছে, বাণ হর্ষবর্ধনের সিন্ধুরাজ্য জয়ের কথা বলেননি; হর্ষের তথাকথিত সিন্ধু অভিযান বর্ণনা করাও তার উদ্দেশ্য ছিল না। ভগিনীসহ হর্ষবর্ধনের গঙ্গাতীরবর্তী স্কন্ধাবারে প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাণের কাহিনির পরিসমাপ্তি ঘটেছে। বাণ নিঃসন্দেহে হর্ষবর্ধনকে বিষ্ণুর এবং হর্ষস্ত্রীকে বিষ্ণুজায়া লক্ষ্মীর সঙ্গে তুলনা করেছেন কিন্তু হর্ষবর্ধনের প্রেক্ষিতে ‘সিন্ধুরাজ’ কথাটিতে যে ব্যঞ্জনা ব্যবহার করেছেন, তার স্বরূপ এখনও উদ্ঘাটিত হয়নি। শুয়েন চাঙের বিবরণ থেকে জানা যায়, হর্ষের সমকালীন সিন্ধুরাজ ছিলেন জাতিতে শূদ্র, ধর্মে বৌদ্ধ। অনুমিত হয়, এ সময় সহিরস এবং তার পুত্র রাই দ্বিতীয় সহসি ক্রমান্বয়ে সিন্ধুর রাজপদ অলংকৃত করেন।

হর্ষবর্ধন ও কাশ্মীর

শুয়েন চাঙের জীবনীগ্রন্থ থেকে জানা যায়, শীলাদিত্য সংবাদ পান, কাশ্মীর রাজ্যে ভগবান বুদ্ধদেবের পূত দন্ত সংরক্ষিত আছে। দন্তটি দেখার আগ্রহে তিনি কাশ্মীর সীমান্তে উপনীত হন এবং কাশ্মীররাজের অনুমতি প্রার্থনা করেন। স্থানীয় বৌদ্ধশ্রমণেরা শীলাদিত্যকে দন্ত দেখাতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন এবং পবিত্র নিদর্শনটিকে এক গুপ্তস্থানে স্থানান্তরিত করেন। শেষে কাশ্মীরনৃপতি শীলাদিত্যকে দন্তটি উপহার দেন। তিনি পূজা-অর্চনার জন্য সেটিকে স্বরাজ্যে নিয়ে আসেন। রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় চিনা শ্রমণের জীবনীগ্রন্থে বর্ণিত এই কাহিনির ভিত্তিতে অভিমত প্রকাশ করেছেন, হর্য কাশ্মীর অধিকার করেন। (Harsha (London, 1926), পৃষ্ঠা ৪০)। কিন্তু কাশ্মীর হর্ষবর্ধনের অধিকারভুক্ত ছিল বলে মনে হয় না।

প্রথমত, শুয়েন চাঙের জীবনীগ্রন্থে হর্ষের সঙ্গে কাশ্মীরনৃপতির সংঘর্ষের কোনও উল্লেখ নেই ; কাশ্মীররাজের অনুমতিক্রমেই তিনি বুদ্ধদেবের পূত দত্ত স্বরাজ্যে নিয়ে আসেন।

দ্বিতীয়ত, শুয়েন চাঙের ভ্রমণবৃত্তান্ত থেকে জানা যায়, খ্রিস্টীয় ৭ম শতকের প্রথমার্ধে কাশ্মীর এক সার্বভৌম, শক্তিশালী রাজ্য ছিল। জম্মু ও কাশ্মীর, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও পশ্চিম পাঞ্জাবের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল এই রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

শুয়েন চাঙ তার প্রতি কাশ্মীর নরপতির সদয় ব্যবহার ও আনুকূল্যের কথা বলেছেন কিন্তু তার নামোল্লেখ করেননি। রাজতরঙ্গিণীতে অবশ্য হর্ষ নামে জনৈক রাজার কাশ্মীরে রাজত্বের (হর্ষাদীনাং ধরাভুজাং) উল্লেখ আছে। কিন্তু এ হর্ষ কান্যকুব্জাধিপতি হর্ষবর্ধন নন। রাজতরঙ্গিণীতে বলা হয়েছে, হর্ষের মৃত্যুর পর তার পুত্র পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। পুষ্যভূতিরাজ হর্ষবর্ধনের কোনও উত্তরাধিকারী ছিলেন না।

হর্ষবর্ধন ও ভাস্করবর্মা

হর্ষবর্ধন-ভাস্করবর্মার পারস্পরিক সম্পর্কের স্বরূপ বা প্রকৃতি সম্পর্কে বিভিন্ন অভিমত ব্যক্ত হয়েছে। রমেশচন্দ্র মজুমদার (The Classical Age, পৃষ্ঠা ১৪০) এবং রামশঙ্কর ত্রিপাঠী (R. S. Tripathi, History of Kanauj (Benares, 1937), পৃষ্ঠা ১৩৫) এই সম্পর্ককে দুই সার্বভৌম রাজার বন্ধুত্বরূপে আখ্যাত করেছেন। দীনেশচন্দ্র সরকারের অভিমত প্রথম দিকে এই সম্পর্ক ছিল সমমর্যাদাসম্পন্ন দুই রাজার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক কিন্তু পরবর্তী কালে হর্ষের ক্ষমতাবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই সম্পর্কের অবনতি হয় এবং ভাস্করবর্মা হর্ষবর্ধনের বশীভূত মিত্রে পরিণত হন। (তদেব, পৃষ্ঠা ১২০-১)।

ভাস্করবর্মা হর্ষের বশীভূত মিত্র ছিলেন, এ মতের সমর্থনে দীনেশচন্দ্র সরকার দু’টি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। প্রথম ঘটনাটির উল্লেখ আছে শুয়েন চাঙের জীবনীগ্রন্থে। কোঙ্গোদ অভিযান শেষে হর্ষবর্ধন তখন কজঙ্গলে অবস্থান করছেন। শুয়েন চাঙ রয়েছেন ভাস্করবর্মার অতিথিরূপে কামরূপে। হর্ষবর্ধন ভাস্করবর্মাকে অনুরোধ করেন, তিনি যেন শুয়েন চাঙকে অনতিবিলম্বে তার নিকট পাঠিয়ে দেন। কামরূপরাজ সে অনুরোধে কর্ণপাত করলেন না। বিরক্ত হর্ষবর্ধন ভাস্করবর্মার নিকট দূত পাঠান। তাকে বলা হল, মুহূর্তমাত্র দেরি না করে চিনা শ্রমণকে কজঙ্গলে পাঠাতে হবে। ভাস্করবর্মা উত্তর দিলেন, হর্ষ তার গর্দান নিতে পারেন কিন্তু তিনি চিনা পরিব্রাজককে তখনই পাঠাতে পারবেন না। ক্রুদ্ধ হর্ষ দূতমুখে বলে পাঠান, ভাস্করবর্মা যেন তার মুণ্ডই পাঠিয়ে দেন। হর্ষের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় কামরূপেশ্বর শঙ্কিত হন। তিনি শশব্যস্তে ২০ হাজার হস্তী ও ৩০ হাজার নৌযানসহ শুয়েন চাঙকে সঙ্গে নিয়ে গঙ্গানদীপথে সত্বর কজঙ্গলে উপস্থিত হন। দ্বিতীয় ঘটনার বর্ণনা আছে শুয়েন চাঙের বিবরণে ও জীবনীগ্রন্থে। গ্রন্থ দু’টি থেকে জানা যায়, ভাস্করবর্মা হর্ষের সঙ্গে কজঙ্গল থেকে কান্যকুব্জে গমন করেন। কান্যকুব্জের মহাসমারোহে তিনি যোগ দেন। হর্ষবর্ধনের আয়োজিত প্রয়াগের অনুষ্ঠানেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। দীনেশচন্দ্র সরকার মনে করেন, ভাস্করবর্মার প্রতি হর্ষবর্ধনের হুমকি ও হর্ষের রাজ্যে তার দীর্ঘকালীন অবস্থান প্রমাণ করছে, হর্ষের সঙ্গে ভাস্করবর্মার বন্ধুত্ব তখন আর সমানে সমানে ছিল না, কামরূপনৃপতি তখন পুষ্যভূতিরাজের বশীভূত মিত্র। এখানে কয়েকটি প্রশ্ন উঠছে।

  • প্রথমত, কজঙ্গলে হর্ষের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে ভাস্করবর্মা তার বিশাল সৈন্যবাহিনীসহ যাত্রা করেন। কজঙ্গলে যাওয়ার পথে তাকে উত্তর বাংলা অতিক্রম করতে হয়। হর্ষবর্ধনের রাজ্যের মধ্য দিয়ে সসৈন্যে অগ্রসর হওয়া তার পক্ষে সমীচীন ছিল না। মনে হয়, সে সময় উত্তর বাংলা তারই রাজ্যভুক্ত ছিল। সেক্ষেত্রে স্বীকার্য, হর্ষের জীবদ্দশায় শশাঙ্কের রাজ্যের একার্ধ ভাস্করবর্মা আত্মসাৎ করেন। এরূপ কাজ বশীভূত মিত্রের পক্ষে অকল্পনীয়।
  • দ্বিতীয়ত, হর্ষের আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতি ভাস্করবর্মার তথাকথিত অধীনতামূলক মিত্রতার সুনিশ্চিত প্রমাণ নয়। এক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের বন্ধুদেশের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে যোগদানের রীতি আজও প্রচলিত।
  • তৃতীয়ত, চিনা শ্রমণ ভাস্করবর্মার যে বর্ণনা দিয়েছেন, তাতে কামরূপরাজ এক স্বাধীন, পরাক্রমশালী রাজারূপেই প্রতিভাত। হর্ষের সঙ্গে ভাস্করবর্মার হয়তো এক সময় সম্পর্কের অবনতি হয়েছিল কিন্তু ভাস্করবর্মা হর্ষবর্ধনের বশীভূত মিত্র ছিলেন, এমন বোধ হয় না।

হর্ষবর্ধনের রাজ্যজয়ের কালক্রম

সিংহাসনে আরোহণের অব্যবহিত পরই হর্ষবর্ধন সমরাভিযানে বহির্গত হন। শশাঙ্ককে নির্মূল করে ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন, এই ছিল তার আশু সংকল্প। বাণভট্টের বর্ণনা থেকে মনে হয়, শুধু শশাঙ্ককে উচ্ছেদ করাই হর্ষের লক্ষ্য ছিল না, দিগ্বিজয়ের বাসনাও তাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। শুয়েন চাঙের বৃত্তান্তেও হর্ষের ভারত বিজয়ের অভিলাষ প্রতিফলিত হয়েছে। (T. Watters On Yuan Chwang’s Travels in India, Vol. I (London, 1908), পৃষ্ঠা ৩৪৩; Samuel Beal Buddhist Records of the Western World, Vol. I (London, 1906), পৃষ্ঠা ২১৩।) চিনা শ্রমণের বৃত্তান্তে বলা হয়েছে, রাজত্বে অভিষিক্ত হয়েই শীলাদিত্য ৫ হাজার হস্তী, ২ হাজার অশ্বারোহী ও ৫০ হাজার পদাতিক সৈন্যের সমন্বয়ে এক বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করেন। ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ ও প্রতিবেশী রাজ্যগুলো গ্রাস করার অভিপ্রায়ে তিনি যুদ্ধযাত্রা করেন। ছয় বৎসরের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন সংঘর্ষে অবতীর্ণ হয়ে তিনি সমগ্র পঞ্চ ভারত পদানত করেন। এভাবে রাজ্য বিস্তার করে তিনি সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি করেন। তার বর্ধিত সৈন্যদলে ছিল ৬০ হাজার হস্তী এবং ১ লক্ষ অশ্বারোহী সেনা। পরবর্তী ত্রিশ বৎসর তিনি শান্তিতে রাজত্ব করেন; এ সময় তিনি কোনও অস্ত্র উত্তোলন করেননি। শুয়েন চাঙের বর্ণনায় আছে, হর্ষবর্ধনের সমরাভিযান ৬০৬-১২ খ্রিস্টাব্দে সম্পন্ন হয় এবং তার রাজত্বের পরবর্তী ত্রিশ বৎসর অর্থাৎ ৬১২-৪২ খ্রিস্টাব্দকাল শান্তিপূর্ণভাবে অতিবাহিত হয়।

সুধাকর চট্টোপাধ্যায় হর্ষবর্ধনের রাজ্যজয়ের কালক্রম সম্পর্কিত শুয়েন চাঙের বিবৃতি অন্য দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করেছেন। (Early History of Northern India, পৃষ্ঠা ২৯৩-৯৮)। তিনি মনে করেন, শুয়েন চাঙ হর্ষের রাজত্বের যে শান্তিপূর্ণ ত্রিশ বৎসরের কথা বলেছেন, তা হর্ষের রাজত্বের শেষ ত্রিশ বর্ষ। এই শেষ ত্রিশ বৎসর তিনি গণনা করেছেন শুয়েন চাঙের জীবনীগ্রন্থে হর্ষবর্ধনের তিরোধান-বৎসররূপে উল্লিখিত ৬৫৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে। এভাবে ৬২৪-৫৪ খ্রিস্টাব্দকাল হর্ষবর্ধনের রাজত্বের শান্তিপূর্ণ ত্রিশ বৎসররূপে ধার্য হয়েছে। ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের পূর্ববর্তী ছয় বছর হর্ষবর্ধন বহু যুদ্ধ-বিগ্রহে অংশগ্রহণ করেন। তাহলে ৬১৮-২৪ খ্রিস্টাব্দ হর্ষবর্ধনের যুদ্ধপর্ব। কিন্তু হর্ষবর্ধন লোকান্তরিত হন ৬৫৪ খ্রিস্টাব্দে নয়, তারও সাত বছর পূর্বে, অর্থাৎ, ৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে। সেক্ষেত্রে পুরো তিন দশক নয়, ২৩ বছরই হবে হর্ষবর্ধনের রাজত্বের শান্তিপূর্ণ অধ্যায়। অর্থাৎ, সুধাকর চট্টোপাধ্যায়ের অভিমত, ৬১৮-২৪ খ্রিস্টাব্দ হর্ষবর্ধনের রাজত্বের যুদ্ধপর্ব এবং পরবর্তী পর্যায় শান্তিপর্ব। তিনি মনে করেন, পুলকেশীর বিরুদ্ধে হর্ষবর্ধনের সশস্ত্র সংগ্রাম বা পুষ্যভূতি নৃপতির ওড়িশা ও কোঙ্গোদ বিজয় কোনও পুরো দস্তুর যুদ্ধ নয়, নিছকই সীমান্ত-সংঘর্ষ।

সুধাকর চট্টোপাধ্যায়ের এই বিশ্লেষণের সঙ্গে সকলেই একমত হবেন, এমন বোধ হয় না। এই বিশ্লেষণে ৬১৮-২৪ খ্রিস্টাব্দ হর্ষবর্ধনের রাজত্বের যুদ্ধপর্বরূপে চিহ্নিত। হর্ষবর্ধন ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে রাজত্ব শুরু করেন। ৬০৬-১৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এক যুগের ব্যবধান। এ সময় হর্ষবর্ধন কান্যকুব্জসহ সমগ্র মৌখরিরাজ্য অধিকার করেন, গৌড়েশ্বর শশাঙ্কের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযান পরিচালনা করেন। এ পর্ব কি যুদ্ধপর্ব নয়? শুয়েন চাঙ হর্ষবর্ধনের যে তিন দশক শান্তিপূর্ণ রাজত্বের উল্লেখ করেছেন, তার শুরু কিন্তু পুষ্যভূতিরাজের সপ্তম রাজ্যবর্ষ থেকে। কিন্তু এখানে বলা হচ্ছে, এই ত্রিশ বৎসর হর্ষের রাজত্বের শেষ তিন দশক। এ সিদ্ধান্ত তথ্যানুগ নয়। হর্ষবর্ধন তার জীবনের শেষ ত্রিশ বৎসর শান্তিতে রাজত্ব করেন, এই ধারণার ভিত্তিতেই যুক্তিজাল বিস্তৃত হয়েছে। অথচ পরে বলা হচ্ছে, জীবনের শেষ তিন দশক নয়, ২৩ বছরই হর্ষ শান্তিতে রাজত্ব করেন। কথার বৈপরীত্যে বিশ্লেষণের যুক্তিগ্রাহ্যতা হ্রাস পায়। যে যুক্তির বুনিয়াদে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয়, পরে সেই যুক্তিকে অগ্রাহ্য করলে মূল সিদ্ধান্তটিই অর্থহীন হয়। হর্ষবর্ধনের এক কাল্পনিক মৃত্যু বৎসরের উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপিত হওয়ায় বিশ্লেষণের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন হয়েছে। হর্ষ-পুলকেশী সংঘর্ষ বা হর্ষবর্ধনের ওড়িশা ও কোঙ্গোদ বিজয়কে সীমান্ত-সংঘর্ষ আখ্যা দিলে এ বিজয়াভিযানের গুরুত্ব অকারণে লঘু করা হয়।

প্রকৃতপক্ষে রাজ্যজয়ের কালক্রম সম্পর্কে শুয়েন চাঙ যে মন্তব্য করেছেন, তার যাথার্থ্য সম্পর্কে সংশয় রয়েছে। চিনা শ্রমণ বলেছেন, তার রাজত্বের সপ্তম রাজ্যবর্ষ থেকে সুদীর্ঘ তিন দশককাল পর্যন্ত হর্ষবর্ধন কোনও যুদ্ধ-বিগ্রহে অংশগ্রহণ করেননি। শুয়েন চাঙের এই বক্তব্যের সঙ্গে প্রাচীন চিনা লেখক মা তোয়ান লিনের সাক্ষ্যে যথেষ্ট বৈসাদৃশ্য লক্ষিত হয়। মা তোয়ান লিন বলেন, ৬১৮-২৭ খ্রিস্টাব্দে হর্ষবর্ধন যত যুদ্ধ-বিগ্রহে অবতীর্ণ হন, তেমনটি পূর্বে কখনও ঘটেনি। স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে, শুয়েন চাঙ ও মা তোয়ান লিনের বিবৃতি পরস্পর বিরোধী। শুয়েন চাঙের জীবনীগ্রন্থের সঙ্গেও তার বৃত্তান্তের বৈপরীত্য লক্ষ করা যায়। জীবনীগ্রন্থে বলা হয়েছে, কোঙ্গোদ বিজয় সম্পূর্ণ করে হর্ষবর্ধন ৬৪৩ খ্রিস্টাব্দের প্রারম্ভে কজঙ্গলে অবস্থান করেন। তাহলে ৬৪৩ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে অর্থাৎ ৬৪১-৪২ খ্রিস্টাব্দে হর্ষবর্ধন কোঙ্গোদ ও ওড়িশা জয় করেন, এমন ধারণাই যুক্তিগ্রাহ্য হয়। অথচ শুয়েন চাঙের বর্ণনানুসারে ৬৪১-৪২ খ্রিস্টাব্দে হর্ষবর্ধনের কোনও যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত থাকার কথা নয়। খ্রিস্টীয় ৭ম শতকের প্রথমার্ধে উত্তর ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোটেই সুস্থির ছিল না। রাজ্যগুলোর মধ্যে বাদবিসংবাদের অন্ত ছিল না। এহেন পরিস্থিতিতে হর্ষবর্ধনের মতো রাজার সুদীর্ঘ ত্রিশ বৎসরকাল যুদ্ধ-বিগ্রহ বৰ্জন করে শান্তিতে রাজত্ব করা অভাবনীয় ছিল। বস্তুত, শুয়েন চাঙের বিবরণের ওপর ভিত্তি করে হর্ষবর্ধনের রাজ্যজয়ের কালক্রম নির্ধারণ করা সমীচীন নয়। ৬৪৩ খ্রিস্টাব্দের প্রারম্ভে শুয়েন চাঙের সঙ্গে হর্ষবর্ধনের কজঙ্গলে প্রথম সাক্ষাৎ হয়। হর্ষবর্ধনের জীবনের পূর্ববর্তী অধ্যায় সম্পর্কে তিনি সম্যক অবহিত ছিলেন বলে মনে হয় না।

ভগিনী রাজ্যশ্রীকে উদ্ধার করে হর্ষবর্ধন সর্বপ্রথম কান্যকুব্জে উপনীত হন এবং কান্যকুব্জ সহ মৌখরিরাজ্যের সর্বত্র নিজের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব স্থাপন করেন। কিন্তু এ কাজ একদিনে সাধিত হয়নি, ছয় বৎসরের নিরলস চেষ্টায় এ কাজ সম্পন্ন হয়। মৌখরিরাজ্য অধিগ্রহণের পর হর্ষবর্ধন সম্ভবত গৌড়েশ্বর শশাঙ্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। এটি হর্ষবর্ধনের প্রথম বিহার-বাংলা অভিযান। এই অভিযানের তারিখ সম্পর্কে অনিশ্চয়তা রয়েছে। হয়তো ৬১২-১৪ খ্রিস্টাব্দে এই অভিযান পরিচালিত হয়। এ তারিখ নিতান্তই আনুমানিক। হর্ষবর্ধন সম্ভবত দ্বিতীয় ধ্রুবসেন বালাদিত্যের (আ. ৬২৮–৪০-১ খ্রিস্টাব্দ) রাজত্বকালে বলভী আক্রমণ করেন। অনুমিত হয়, হর্ষবর্ধনের বলভী অভিযান হর্ষ-পুলকেশী যুদ্ধের পূর্ববর্তী ঘটনা। হর্ষের বলভী অভিযানের সঠিক তারিখ আজও নির্ণীত হয়নি। ৬৩৪-৩৫ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ আইহোল লেখে হর্ষের সঙ্গে চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর সংঘর্ষের উল্লেখ আছে। হর্ষ-পুলকেশী যুদ্ধ অবশ্যই ৬৩৪-৩৫ খ্রিস্টাব্দের পূর্ববর্তী, কিন্তু বেশি পূর্ববর্তী নয়। ৬১২-১৩ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে এই যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয় বলে যে অভিমত ব্যক্ত হয়েছে, তা সম্ভবত ঠিক নয়।

হর্ষবর্ধনের দ্বিতীয় পূর্ব ভারত অভিযানের তারিখ নির্ণয় করা অপেক্ষাকৃত সহজ। শুয়েন চাঙের জীবনীগ্রন্থ থেকে জানা যায়, হর্ষবর্ধন কোঙ্গোদ এবং ওড়িশা বিজয় সম্পন্ন করে ৬৪৩ খ্রিস্টাব্দের প্রারম্ভে কজঙ্গলে অবস্থান করেন। অনুমেয়, ৬৪৩ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে, অর্থাৎ, আনুমানিক ৬৪১-৪২ খ্রিস্টাব্দে হর্ষ দ্বিতীয় পূর্ব ভারত অভিযান পরিচালনা করেন এবং মগধ, বাংলা, কোঙ্গোদ ও ওড়িশা অধিকার করেন। যদি মনে করা হয়, পূর্ণবর্মা হর্ষবর্ধনের প্রতিনিধিরূপে মগধে রাজত্ব করেন, তাহলে সিদ্ধান্ত করতে হবে, শশাঙ্কের মৃত্যুর অব্যবহিত পরই হর্ষ বর্ধন বিহার ও বাংলা জয় করেন এবং আরও কিছুদিন পর, আনুমানিক ৬৪১-৪২ খ্রিস্টাব্দে কোঙ্গোদ ও ওড়িশা অধিকার করেন। তবে ৬৪১ খ্রিস্টাব্দে শীলাদিত্য ‘মগধেশ্বর’ অভিধা ধারণ করেন বলে মা তোয়ান লিন যে মন্তব্য করেছেন, তার প্রেক্ষিতে অনুমিত হয়, শশাঙ্কের মৃত্যুর অব্যবহিত পরই নয়, ৬৪১-৪২ খ্রিস্টাব্দেই হর্ষবর্ধনের মগধ, বাংলা, কোঙ্গোদ ও ওড়িশা বিজয় সম্পন্ন হয়।

হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি

হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি সম্পর্কে ঐতিহাসিক মহলে বিস্তর বাগ্‌বিতণ্ডা সৃষ্টি হয়েছে। হর্ষবর্ধন অখণ্ড আর্যাবর্তের অধীশ্বর ছিলেন, এরূপ মত যেমন আছে, তেমনি উত্তর ভারতের এক খণ্ডিতাংশে তার সাম্রাজ্যের অবস্থিতির অনুকূলেও অভিমত ব্যক্ত হয়েছে। বিতর্কিত এই বিষয়টির উপর আলোকপাত করছে, এমন আকর গ্রন্থ সমূহের মধ্যে শুয়েন চাঙের ‘সি য়ু চি’ সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। ৬৩০ থেকে ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতে অবস্থানকালে শুয়েন চাঙ এ দেশের বিভিন্ন রাজ্য পরিদর্শন করেন এবং তার অমূল্য অভিজ্ঞতার কথা তিনি তার গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন। বৌদ্ধধর্মের দেশ ভারতবর্ষে তিনি তীর্থযাত্রী রূপে এসেছিলেন। স্বাভাবিক কারণেই বুদ্ধ ও বৌদ্ধধর্ম তার গ্রন্থে মুখ্যস্থান অধিকার করে আছে। কিন্তু রাজ্যগুলোর বর্ণনা প্রসঙ্গে তিনি কখনও কখনও তাদের রাজনৈতিক পরিস্থিতির মূল্যায়ন করেছেন। ফলে সমকালীন ভারতীয় রাজনীতির এক মূল্যবান দলিলরূপে তার গ্রন্থখানি বিশেষ তাৎপর্যমণ্ডিত হয়েছে। শুয়েন চাঙের এই ভ্রমণবৃত্তান্ত, হুই লি রচিত শুয়েন চাঙের জীবনীগ্রন্থ এবং লেখমালা ও মুদ্রার সাক্ষ্যে হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্যের বিস্তৃতির একটা ছবি ধরা পড়ে।

শুয়েন চাঙের বর্ণনায় আছে, হিন্দুকুশ পর্বতশ্রেণির দক্ষিণে কাপিশ রাজ্য অবস্থিত ছিল। সে সময় এ রাজ্যটি খুবই শক্তিশালী ছিল। রাজ্যের রাজা ছিলেন এক ক্ষত্রিয়। বৌদ্ধধর্মের অনুরাগী ছিলেন এই রাজা। লন-পো (লঘমন), নগরহার (জেলালাবাদ), গন্ধার এবং ফল-ন বা বন্ধুর মতো প্রতিবেশী রাজ্যগুলো কাপিশরাজ্যের বশীভূত ছিল। কাপিশ ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল যে হর্ষ বর্ধনের সাম্রাজ্যের বহির্ভূত ছিল, শুয়েন চাঙের বর্ণনায় তা সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত।

সিন্ধু নদের পশ্চিমে আর একটি শক্তিশালী রাজ্য ছিল। সে রাজ্যটির নাম উদ্যান। উচ্চ সোয়াট অববাহিকায় রাজ্যটি অবস্থিত ছিল। সিন্ধু নদের পূর্বতীরে ছিল কাশ্মীর রাজ্যের অবস্থান। তক্ষশিলা, সিংহপুর, উরশা, পন-নু-সো (পুঞ্চ) এবং রাজপুর কাশ্মীরের অধীনস্থ ছিল। জম্মু ও কাশ্মীর, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও পশ্চিম পাঞ্জাবের সুবিস্তীর্ণ অঞ্চল নিয়ে গঠিত এই কাশ্মীর রাজ্য আয়তনে বৃহৎই ছিল বলা যায়। কাশ্মীরেরই দক্ষিণে ছিল চে-ক (টক্ক) রাজ্য। শিয়ালকোটের নিকটবর্তী কোনও এক স্থানে এই রাজ্যের রাজধানী অবস্থিত ছিল। পূর্বদিকে বিপাশা নদী থেকে পশ্চিমে সিন্ধু নদ পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখণ্ড এই রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। মুলতান ও পো-ফ-তো (পর্বত) নামে দু’টি প্রতিবেশী রাজ্য টক্ক রাজ্যের অধীনস্থ ছিল। এসব রাজ্য হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল না।

শুয়েন চাঙ পূর্ব পাঞ্জাব ও হিমাচলপ্রদেশে অবস্থিত চি-ন-পু-তি, জালন্ধর, কুলূত এবং শতদ্রু নামে চারটি রাজ্যের উল্লেখ করেছেন। এই রাজ্যগুলোর প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে তিনি নীরব। রাজ্যগুলো সম্ভবত হর্ষবর্ধনের অধিকারভুক্ত ছিল।

যমুনা নদীর পূর্বদিকে অবস্থিত বহু রাজ্যের উল্লেখ করেছেন শুয়েন চাঙ। কয়েকটি ক্ষেত্রে তিনি রাজাদের নামোল্লেখও করেছেন। যেসব রাজ্যের রাজাদের নামোল্লেখ আছে, সেই রাজ্যগুলো হল মো-তি-পু-লো (মতিপুর), সু-ফ-ল-ন-কু-ত-লো (সুবর্ণগোত্র), নেপাল, মগধ ও কা-মো লু-পো বা কামরূপ। প্রথম রাজ্যটি উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত ছিল। রাজ্যের রাজা ছিলেন শূদ্র। তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বী। হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত সুবর্ণগোত্র নারীশাসিত রাজ্য ছিল। রানিই ছিলেন সর্বময়ী কর্ত্রী। প্রাচ্য স্ত্রীরাজ্যরূপে বর্ণিত এ অঞ্চলে রানির স্বামীর কোনও প্রশাসনিক দায়িত্ব ছিল না। নেপালের রাজা ছিলেন লিচ্ছবি পরিবারের সন্তান। বৌদ্ধধর্মে অনুরাগী এই রাজার বিদ্যোৎসাহিতার প্রশংসা করেছেন শুয়েন চাঙ। শুয়েন চাঙের পরিদর্শনকালে পূর্ণবর্মা মগধের অধিষ্ঠিত ছিলেন। কামরূপের রাজা ছিলেন ভাস্করবর্মা। তিনি কুমার নামেও পরিচিত ছিলেন। চিনা শ্রমণ বলেন, ভাস্করবর্মার ব্রাহ্মণ রাজপরিবার হাজার পুরুষ ধরে কামরূপে রাজত্ব করেছেন। শুয়েন চাঙ উত্তরপ্রদেশ, উত্তর বিহার ও বাংলার অনেক রাজ্যের কথা বলেছেন কিন্তু সে সব রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করেননি। অনুমিত হয়, এসব অঞ্চল মূলত হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

উজ্জয়িনী, জিঝোতি এবং মহেশ্বরপুর নামে মধ্য ভারতের তিনটি রাজ্যের উল্লেখ আছে শুয়েন চাঙের ভ্রমণবৃত্তান্তে। জিঝোতি রাজ্য বুন্দেলখণ্ডে অবস্থিত ছিল। মহেশ্বরপুর রাজ্যটি গ্বালিয়র অঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল। এই তিনটি রাজ্যের রাজারা জাতিতে ব্রাহ্মণ ছিলেন। তারা ছিলেন ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনুরাগী। শুয়েন চাঙের বর্ণনায় অনুমিত হয়, এই রাজ্যগুলো স্বাধীন ছিল। পশ্চিম ভারতের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী রাজ্য মো-ল-পো বা পশ্চিম মালব। কিত বা কুচ, আনন্দপুর ও সুরাষ্ট্র এই রাজ্যের অধীনস্থ ছিল। বলভীরাজ্যের অবস্থান ছিল আরও পশ্চিমে।

বলভীরাজ ক্ষত্রিয় ছিলেন। অশান্তচিত্ত ও অদূরদর্শী এই রাজা বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ছিলেন। শুয়েন চাঙ বলেন, বলভীরাজ ছিলেন হর্ষবর্ধনের জামাতা। অনেকেই এই বলভীরাজকে দ্বিতীয় ধ্রুবসেনরূপে শনাক্ত করেছেন। পশ্চিম ভারতের আর একটি রাজ্য গুর্জর। গুর্জররাজ ক্ষত্রিয় জাতি ভুক্ত ছিলেন। বয়সে তরুণ, বৌদ্ধধর্মে অনুরাগী এই রাজা বিচক্ষণ ও পরাক্রমশালী ছিলেন। পশ্চিম ভারতের আরও দু’টি রাজ্যের কথা বলেছেন শুয়েন চাঙ। এদের একটি ব্রোচ বা ভৃগুকচ্ছ, অন্যটি সিন্ধু। আতিয়েন-পো-চি-লো, পি-তো-শি-লো এবং আ-ফান-তু, এই তিনটি রাজ্য সিন্ধুর অধিকারভুক্ত ছিল। নিম্ন সিন্ধু অববাহিকা অঞ্চলে সিন্ধুরাজ্য অবস্থিত ছিল। সিন্ধুরাজের প্রশাসন ব্যবস্থার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন চিনা শ্রমণ।

শুয়েন চাঙের উত্তর ভারতীয় রাজ্যগুলোর বর্ণনার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয়, আর্যাবর্তের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্যের বহির্ভূত ছিল। বহিরাঞ্চলের মধ্যে রয়েছে জম্মু ও কাশ্মীর, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পশ্চিম পাঞ্জাব, হিমাচলপ্রদেশ, সিন্ধু, গুজরাত, রাজস্থান ও কামরূপ বা অসম। মধ্যপ্রদেশের কিয়দংশও হর্ষের সাম্রাজ্যের বহির্ভূত ছিল অথচ চালুক্য লেখমালায় পুষ্যভূতিরাজকে ‘সকলোত্তরাপথনাথ’-রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। এ বর্ণনা নিঃসন্দেহে অতিরঞ্জিত। সর্দার পানিক্করের মতো খ্যাতনামা ঐতিহাসিকেরাও এই ভুল করেছেন। সর্দার পানিক্কর হর্ষের সাম্রাজ্যকে হিমালয় থেকে বিন্ধ্যপর্বতশ্রেণি এবং কামরূপ থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত সুবিস্তৃত ভূখণ্ড রূপে আখ্যাত করেছেন। প্রকৃতপক্ষে হর্ষবর্ধনের রাজত্বের ভৌগোলিক পরিমণ্ডল অনেক সীমিত ছিল। বিহার ও ঝাড়খণ্ডের কিয়দংশসহ পূর্ব পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরাঞ্চল ও উত্তরপ্রদেশ ছিল তার সাম্রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র। তার রাজত্বকালীন বাঁশখেড়া ও মধুবন তাম্রশাসন উত্তরপ্রদেশের যথাক্রমে শাহজাহানপুর এবং আজমগড় জেলায় আবিষ্কৃত হয়েছে। তাম্রশাসন দু’টিতে তার সাম্রাজ্যভুক্ত অহিচ্ছত্র ও শ্রাবস্তী ভুক্তির উল্লেখ আছে। ভুক্তি দু’টির অবস্থান উত্তরপ্রদেশে। এই রাজ্যের ফৈজাবাদ জেলায় শীলাদিত্য নামাঙ্কিত হর্ষবর্ধনের রৌপ্যমুদ্রাও আবিষ্কৃত হয়েছে। পরবর্তী কালে অর্থাৎ তার রাজত্বের প্রায় অন্তিমপর্বে বিহার ও ঝাড়খণ্ডের বৃহদংশ, পশ্চিম বাংলা ও ওড়িশা হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। হর্ষবর্ধন অখিল উত্তর ভারতের রাজচক্রবর্তী ছিলেন না ঠিকই তবু দূরদর্শিতা ও বাহুবলের সমন্বয়ে উত্তর ভারতে যে রাজ্য তিনি স্থাপন করেন, তা আয়তনে কম বিশাল ছিল না। হর্যোত্তর উত্তর ভারতে এরূপ বৃহদায়তন সাম্রাজ্য প্রাচীন যুগে আর কখনও গড়ে উঠেছিল কিনা সন্দেহ।

চিন-ভারত সম্পর্ক

চিন দেশের সঙ্গে ভারতের সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক সুদৃঢ় থাকায় হর্ষবর্ধন স্বভাবতই চিনদেশ সম্পর্কে বিশেষ অবহিত ছিলেন এবং তৎকালীন চিনসম্রাটের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তখনও শুয়েন চাঙের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়নি। ৬৪১ খ্রিস্টাব্দে তিনি চিনসম্রাটের নিকট দূত প্রেরণ করেন। মা তোয়ান লিনের বিবরণ থেকে জানা যায়, চিনসম্রাট প্রত্যুত্তরে লিয়াং হোই কিং নামে জনৈক দূতকে হর্ষবর্ধনের নিকট পাঠান। মা তোয়ান লিন বলেন, চিনসম্রাট নাকি হর্ষবর্ধনকে তার বশ্যতা স্বীকার করতে আহ্বান করেন। চিনা দূতকে দেখে হর্ষবর্ধন বিস্মিত হন। অতীতে কোনও চিনা দূত ভারতে এসেছেন কিনা সে বিষয়ে হর্ষ তার অধস্তন রাজপুরুষদের অনুসন্ধান করতে নির্দেশ দেন। সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেন, এমন ঘটনা পূর্বে কখনও ঘটেনি। তারপর হর্ষবর্ধন চিনা দূতকে সাদরে বরণ করেন এবং নতজানু হয়ে চিনসম্রাটের অনুজ্ঞাপত্র স্বহস্তে গ্রহণ করে নিজ মস্তকে ধারণ করেন। মা তোয়ান লিনের বর্ণনা নিঃসন্দেহে অত্যুক্তিমূলক। কেউ কেউ অভিমত প্রকাশ করেছেন, এ সময় হর্ষবর্ধন এক গভীর সংকটের সম্মুখীন হন এবং চিনসম্রাটের সামরিক সাহায্যের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এমন অভিমত অসংগত। হর্ষবর্ধনের সেরূপ কোনও বিপদের কথা জানা যায় না। চিনা ইতিবৃত্তকারেরা প্রায়ই বিদেশি দৌত্যকে আনুগত্যের নিদর্শনরূপে ব্যাখ্যা করেছেন, বিদেশি রাজার সৌজন্য, বিনয় ও প্রীতিপূর্ণ ব্যবহারকে তারা বশ্যতার অভিব্যক্তিরূপে দেখেছেন। হর্ষবর্ধনের ক্ষেত্রেও তাদের একই মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে। বস্তুত, চিনসম্রাটের নিকট হর্ষবর্ধনের আনুগত্য প্রকাশের কোনও প্রশ্ন ওঠে না।

৬৪৩ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে চিনসম্রাট হর্ষবর্ধনের নিকট লি য় পিয়াও এবং ওয়াং হিউয়েন সে নামে দু’জন দূত প্রেরণ করেন। হর্ষবর্ধন পূর্বের মতো চিনা দূতদের সমাদরে অভ্যর্থনা করেন।

৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে শুয়েন চাঙ স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলে চিনসম্রাট তার নিকট থেকে হর্ষবর্ধন সম্পর্কে অনেক বিষয় অবগত হন, হর্ষ সম্পর্কে তার আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। ভারতীয় রাজার সঙ্গে সম্প্রীতি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে তিনি ওয়াং হিউয়েন সে-কে পুনরায় ভারতে পাঠাতে মনস্থ করেন। ৬৪৬ খ্রিস্টাব্দে ওয়াং হিউয়েন সে ও তার সহকারী সিয়াং চিউ জেন ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। চিনা দূতেরা যখন ভারতবর্ষে পৌঁছান তখন হর্ষবর্ধন লোকান্তরিত। অনুমিত হয়, ৬৪৬ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে বা ৬৪৭ খ্রিস্টাব্দের প্রারম্ভে হর্ষবর্ধন শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

হর্ষবর্ধন কোনও উত্তরাধিকারী রেখে যাননি। তার পরলোকগমনের সঙ্গে সঙ্গে সুবিদিত পুষ্যভূতি রাজবংশের অবসান হয়, তার দীর্ঘকালীন চেষ্টায় গড়ে ওঠা সাম্রাজ্যও ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।

হর্ষাব্দ

হর্ষবর্ধন কি কোনও অব্দ প্রবর্তন করেন? আল বেরুনির সাক্ষ্যে অন্তত সেরূপই মনে হয়। গজনিরাজ সুলতান মাহ্‌মুদের অভিযানের সময় ভারত পরিভ্রমণকালে আল বেরুনি মথুরা ও কান্যকুব্জ অঞ্চলে হর্ষাব্দের প্রচলন লক্ষ করেন। তিনি বলেন, হর্ষবর্ধন বিক্রমাদিত্যের ৬৬৪ বৎসর পর আবির্ভূত হন। এই বর্ণনা থেকে মনে হয়, ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে হর্ষবর্ধনের স্থাথ্বীশ্বরের সিংহাসনে আরোহণের সময় থেকে হর্ষাব্দের প্রচলন শুরু হয়। কোনও লেখেই হর্ষাব্দের সুস্পষ্ট উল্লেখ নেই তবু বিদ্বজ্জনেরা মনে করেন, হর্ষবর্ধনের বাঁশখেড়া ও মধুবন, আদিত্যসেনের শাহপুর এবং আরও কয়েকটি অভিলেখে হর্ষাব্দই ব্যবহৃত হয়েছে। এই লেখগুলোর একটির তারিখ ২৯৮ অব্দ, অর্থাৎ, ৯০৪ খ্রিস্টাব্দ। অন্য একটির তারিখ ৫৬২ বা ৫৬৩ অব্দ অর্থাৎ ১১৬৮ বা ১১৬৯ খ্রিস্টাব্দ। অনুমিত হয়, হর্ষবর্ধনের পরলোকগমনের দীর্ঘকাল পরও উত্তর ও মধ্য ভারতের এক সীমিত অঞ্চলে হর্ষাব্দ প্রচলিত ছিল।

প্রশাসন-ব্যবস্থা

রাজা ও রাজপদ : পুষ্যভূতিরাজ্য ছিল রাজতান্ত্রিক বা রাজা-শাসিত রাষ্ট্র। রাজাই রাষ্ট্রের নিয়ন্তা, ভাগ্য-বিধাতা। তিনি কেবল রাজ্যের মুখ্য প্রশাসকই নন, বিচার ও সমর-বিভাগেরও সর্বাধিনায়ক। প্রথমদিকে পুষ্যভূতি রাজাদের অভিধা ছিল মহারাজ কিন্তু সময় থেকে রাজা আর নিছক মহারাজ নন, তিনি পরমভট্টারক ও মহারাজাধিরাজ। পরম-ভট্টারক অভিধায় তার দেবত্বের দাবি উচ্চারিত। তবে রাজা দেবতা, এমন ভাবনা যে তৎকালীন সমাজে সর্বজনীন স্বীকৃতি লাভ করে, তা অবশ্য নয়। কাদম্বরীতে বলা হয়েছে, মূর্খ রাজাই নিজেকে দেবতা ভাবেন, তিনি ভুলে যান, তিনি রক্ত-মাংসে গড়া মানুষ। স্বার্থান্বেষী চাটুকারদের সংস্রব থেকে রাজাকে দূরে থাকতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে কাদম্বরীতে। রাজ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় হর্ষবর্ধন সদা সচেষ্ট ছিলেন। শুয়েন চাঙ বলেন, হর্ষ রাজকার্যের সুবিধার জন্য দিনকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করে একটি ভাগ প্রশাসনিক কাজকর্ম নির্বাহের জন্য নির্দিষ্ট করেন। তবু হর্ষবর্ধনের মতো উদ্যমী রাজার কাছে সে সময়টাও অপর্যাপ্ত ছিল। হর্ষ রাজপ্রাসাদ থেকেই তার কাজকর্ম পরিচালনা করতেন না, প্রজাদের অবস্থা এবং রাজপুরুষদের গতিবিধি স্বচক্ষে পরিদর্শনের জন্য তিনি রাজ্য পরিক্রমায় বহির্গত হতেন। শুয়েন চাঙ স্বীকার করেছেন, হর্ষবর্ধন তার সাম্রাজ্যের সর্বত্র পরিভ্রমণ করতেন। শুধু বর্ষার কয়েকটা দিন রাজ-পরিক্রমা বন্ধ থাকত। রাজার বসবাসের জন্য অস্থায়ী আবাস নির্মিত হত; সে আবাসে প্রতিদিন ১ হাজার বৌদ্ধশ্রমণ ও পাঁচশো ব্রাহ্মণের আহারের ব্যবস্থা থাকত। পরিক্রমাকালে হর্ষবর্ধন এক স্থানে দীর্ঘদিন অবস্থান করতেন না। হর্ষচরিতেও হর্ষবর্ধনের জনসংযোগের উল্লেখ আছে। রাজপদ ছিল পুরুষানুক্রমিক। রাজার মৃত্যুর পর তার জ্যেষ্ঠপুত্রই রাজপদে অভিষিক্ত হতেন। জ্যেষ্ঠপুত্র বয়ঃপ্রাপ্ত হলে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হতেন। যুবরাজকে প্রশাসনিক ও সামরিক দায়িত্ব পালন করতে হত। রানি বা রাজকন্যারা রাজকার্যের সঙ্গে বড় একটা যুক্ত ছিলেন না। ফ্যাং চিতে বলা হয়েছে, হর্ষ তার বিধবা ভগিনী রাজ্যশ্রীর সঙ্গে একযোগে রাজকার্য পরিচালনা করতেন। কিন্তু এটি সাধারণ রীতি নয়। মৌখরিরাজ্যে নিজের কর্তৃত্ব সুরক্ষিত করার অভিপ্রায়ে অনধিকারী হর্ষবর্ধন হয়তো তার ভগিনীকে এক বিশেষ মর্যাদা দান করেন।

কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা-সংস্থা : দুঃখের বিষয়, হর্ষবর্ধনের লেখে বা হর্ষচরিতে মন্ত্রিপরিষদের কোনও উল্লেখ নেই। কিন্তু মনে হয়, প্রশাসন ও বিবিধ কার্যে রাজাকে পরামর্শ ও সহায়তা প্রদানের একটি কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা-সংস্থা ছিল। গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের অধ্যক্ষ, কতিপয় গণ্যমান্য সামন্ত এবং বহুদর্শী ও প্রভাবশালী আত্মীয়স্বজন এরাই কেন্দ্রীয় সংস্থার সদস্য ছিলেন। সিংহনাদ ছিলেন প্রভাকরবর্ধনের বর্ষীয়ান বন্ধু। বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত হলেও তিনি সেনাপতির মর্যাদাভুক্ত ছিলেন। অনুমিত হয়, সিংহনাদের মতো বিশ্বস্ত ও দক্ষ রাজপুরুষ বার্ধক্যে রাজার উপদেষ্টারূপে কেন্দ্রীয় সংস্থায় মনোনীত হতেন। হর্ষবর্ধনের মাতুলপুত্র ভণ্ডিও এক প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। সামরিক নৈপুণ্য, রাজপরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তা ও রাজপরিবারের সুখ-দুঃখের সঙ্গে দীর্ঘকাল সংশ্লিষ্ট থাকার সুবাদে তিনিও সম্ভবত কেন্দ্রীয় সংস্থার সদস্যপদে উন্নীত হন। কেন্দ্রীয় সংস্থার সদস্যেরা সকলেই রাজার মনোনীত ছিলেন; রাজার ইচ্ছাক্রমেই তারা স্বপদে বহাল থাকতেন।

আঞ্চলিক শাসকবৃন্দ : সাম্রাজ্যের সর্বত্রই যে হর্ষবর্ধনের প্রত্যক্ষ কর্তৃত্ব বলবৎ ছিল তা মনে হয় না। হর্ষচরিতে হর্ষের অনুগত বহু রাজা, ভূপাল, পার্থিব, ক্ষিতিপাল, নৃপতি, নরপতি, সামন্ত ও মহাসামন্তের উল্লেখ আছে। তারা সম্ভবত পুষ্যভূতি সাম্রাজ্যের পরিধির মধ্যে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত বিভিন্ন অঞ্চলের শাসনকর্তা ছিলেন। তাদের মধ্যে অনেকেই পূর্বে স্বাধীন রাজা ছিলেন কিন্তু পরে হর্ষবর্ধনের নিকট আত্মসমর্পণ করে স্বপদে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হন। স্ব স্ব অঞ্চলে এই শাসকেরা স্বাধীনই ছিলেন। তারা হর্ষবর্ধনকে নিয়মিত কর প্রদান করতেন, প্রয়োজনে সৈন্য সরবরাহ করতেন ও আনুগত্যের নিদর্শনস্বরূপ মাঝে মাঝে রাজদরবারে সশরীরে উপস্থিত হতেন। সন্দেহ নেই, পদমর্যাদায় ও অধিকারে এই অঞ্চল প্রধানেরা বিভিন্ন শ্রেণিভুক্ত ছিলেন।

কেন্দ্রীয় রাজপুরুষবৃন্দ : কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পদস্থ রাজপুরুষদের মধ্যে মহাক্ষপটলাধিকৃত, মহাসান্ধিবিগ্রহাধিকৃত, মহাপ্রতীহার, রহসি-নিযুক্ত, কুমারামাত্য, মহাপ্রমাত্য, মহাদণ্ডনায়ক প্রভৃতির নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

  • মহাক্ষপটলাধিকৃত : সরকারি মহাফেজখানার উচ্চতম রাজপুরুষ। সরকারি উদ্যোগে নথি পত্র সংরক্ষণের উল্লেখ করেছেন সমকালীন চিনা পর্যটক শুয়েন চাঙ। দৈব-দুর্বিপাক সম্পর্কিত সংবাদাদিও সংগৃহীত হত।
  • মহাসান্ধিবিগ্রহাধিকৃত : প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিভাগের ঊর্ধ্বতন রাজপুরুষ তিনি। ষাড়গুণ্য বিশারদ অবস্তি হর্ষবর্ধনের মহাসান্ধিবিগ্রহাধিকৃত পদে নিযুক্ত ছিলেন। মহাসান্ধিবিগ্রহাধিকৃতকে কাজে সাহায্য করতেন সান্ধিবিগ্রহিক বা সান্ধিবিগ্রহাধিকৃত। সামরিক নৈপুণ্য মহাসান্ধিবিগ্রহাধি কৃত বা সান্ধিবিগ্রহিকের আবশ্যিক যোগ্যত্যারূপে গণ্য হত। ষাড়গুণ্য অর্থাৎ সন্ধি (শান্তিস্থাপন), বিগ্রহ (যুদ্ধ ), আসন (নিরপেক্ষতা), যান (যুদ্ধযাত্রা), সংশ্রয় (মৈত্রীস্থাপন) ও দ্বৈধীভাব (একের সঙ্গে সন্ধি, অপরের সঙ্গে যুদ্ধ), এই ছয়টি তত্ত্বের প্রয়োগে তিনি সুনিপুণ ছিলেন। প্রতিবেশী রাজ্য ও চিন দেশের সঙ্গে রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে হর্ষ বর্ধনের মহাসান্ধিবিগ্রহাধিকৃত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন বলে অনুমিত হয়।
  • মহাপ্রতীহার : সাধারণত মহাপ্রতীহার বলতে রাজা, রাজপ্রাসাদ ও রাজসভার নিরাপত্তা বিধানকারী রক্ষিবাহিনীর শীর্ষস্থানীয় রাজপুরুষ বোঝায়। কিন্তু হর্ষচরিতে বহুসংখ্যক মহাপ্রতীহার ও প্রতীহারের উল্লেখ আছে। প্রতীহারদের মধ্যে কেউ ছিলেন বাহ্য-প্রতীহার, কেউবা অন্তর প্রতীহার। মহাপ্রতীহারদের মধ্যে যিনি সর্বোচ্চ পদাধিকারী হর্ষচরিতে তাকে দৌবারিক বলা হয়েছে।
  • রহসি-নিযুক্ত : তিনি রাজার একান্ত সচিব। রাজনির্দেশ যথাস্থানে পাঠানো, রাজার মৌখিক আদেশ লিপিবদ্ধ করা ইত্যাদি নানা গুরুত্বপূর্ণ ও গোপনীয় কাজের দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
  • কুমারামাত্য : গুপ্তযুগে কুমারামাত্যরা প্রধানত জেলা বা বিষয়ের মুখ্য প্রশাসনিক অধিকর্তা ছিলেন। কিন্তু বাঁশখেড়া ও মধুবন তাম্রশাসন দু’টিতে তাদের নাম উপরিক ও বিষয়পতির পূর্বে উল্লিখিত থাকায় মনে হয়, হর্ষবর্ধনের সময় কুমারামাত্যরা কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাদের আধুনিক ভারতের আই. এ. এস. অফিসারদের সঙ্গে তুলনা করা চলে। আই. এ. এস. অফিসারদের অনেকে কেন্দ্রীয় বা রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, কেউবা জেলা বা মহকুমার মুখ্য আধিকারিক।
  • মহাপ্রমাত্য : মধুবন তাম্রশাসনে মহাপ্রমাত্যর উল্লেখ আছে। কিন্তু তিনি ঠিক কোন্ বিভাগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সে সম্পর্কে অনিশ্চয়তা রয়েছে। রামশঙ্কর ত্রিপাঠীর মতে মহাপ্রমাত্য বিচার-বিভাগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। উপেন্দ্রনাথ ঘোষাল ও ব্যুলার তাকে যথাক্রমে ভূমিরাজস্ব বিভাগীয় পদস্থ রাজপুরুষ ও ধর্মীয় উপদেষ্টারূপে শনাক্ত করেছেন।
  • মহাদণ্ডনায়ক : অস্পষ্টতা রয়েছে মহাদণ্ডনায়কের কার্যের স্বরূপ সম্পর্কেও। তাকে কখনও বিচারপতি, কখনও পুলিশ বিভাগের সর্বোচ্চ পদাধিকারী, আবার কখনওবা সামরিক বিভাগের পদস্থ রাজপুরুষ বা সেনাধ্যক্ষরূপে চিহ্নিত করা হয়েছে। শেষোক্ত মতই অধিকতর সমাদৃত।
  • লোকপাল : হর্ষচরিতে লোকপাল নামে এক শ্রেণির পদস্থ রাজপুরুষের উল্লেখ আছে। স্বয়ং সম্রাট তাদের সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে নিযুক্ত করতেন (অত্র লোকনাথেন দিশাং মুখেষু পরিকল্পিতাঃ লোকপালাঃ)। হয়তো এই লোকপালেরা রাজপ্রতিনিধিরূপে প্রদেশপাল তথা উপরিক এবং অঞ্চল-প্রধান তথা বশীভূত রাজা-মহারাজ, সামন্ত-মহাসামন্তদের কার্যকলাপ ও গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতেন।

ভুক্তি : হর্ষবর্ধনের প্রত্যক্ষ শাসনভুক্ত অঞ্চল কয়েকটি ভুক্তিতে বিভক্ত ছিল। লেখে এরূপ দু’টি ভুক্তির উল্লেখ আছে। এদের একটি শ্রাবস্তী-ভুক্তি, অন্যটি অহিচ্ছত্র-ভুক্তি। পূর্ব পাঞ্জাব হরিয়ানায় হয়তো আরও কয়েকটি ভুক্তি ছিল কিন্তু তাদের নাম জানা যায় না। এক একটি ভুক্তি এক একজন উপরিকের পরিচালনাধীন ছিল। গুপ্তপর্বে স্বয়ং সম্রাট উপরিকদের নিযুক্ত করতেন (তপাদ-পরিগৃহীত)। হর্ষবর্ধনের সময়েও সম্ভবত একই রীতি অনুসৃত হত।

বিষয়-প্রশাসন : এক একটি ভুক্তি আবার কয়েকটি বিষয়ে বিভক্ত ছিল। কুণ্ডধানি ও অঙ্গদীয় নামে হর্ষবর্ধনের লেখে দু’টি বিষয়ের উল্লেখ আছে। বিষয়ের অধিকর্তা বিষয়পতি। গুপ্ত রাজাদের সময় উপরিকই সাধারণত বিষয়পতিকে নিযুক্ত করতেন। হর্ষের সময়েও সম্ভবত এই রীতি বলবৎ ছিল। এমনও হতে পারে, পুষ্যভূতিরাজ্য ক্ষুদ্রায়তন হওয়ায় মহারাজাধিরাজ স্বয়ং বিষয়পতিদের স্বপদে নিযুক্ত করতেন। গুপ্ত আমলের মতো এ পর্বেও হয়তো বিষয়ের অধিষ্ঠানে বা জেলা সদরে বিষয়-অধিকর্তার অধীনে একটি করে অধিকরণ বা কার্যালয় স্থাপিত ছিল। গুপ্ত-যুগের মতো এ পর্বেও হয়তে নগরশ্রেষ্ঠী, সার্থবাহ, প্রথম কুলিক ও প্রথম কায়স্থের মতো জেলার প্রতিনিধি স্থানীয় ব্যক্তিরা বিষয়-প্রশাসনে অংশগ্রহণ করতেন। তারা সম্ভবত নিজ নিজ সংগঠনের নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিলেন। কিংবা তারা হয়তো বিষয়পতি কর্তৃক মনোনীত হতেন।

পঠক : হর্ষবর্ধনের বাঁশখেড়া অভিলেখে পঠক নামে বিষয় ও গ্রামের মধ্যবর্তী এক প্রশাসনিক উপ-বিভাগের উল্লেখ আছে। মধুবন তাম্রশাসনে পঠকের উল্লেখ নেই। বর্তমানকালের তালুক বা তহশিলেরই সমার্থক এই পঠক। পঠকের অধিকর্তার নাম জানা যায় না। অনুমিত হয়, বৃহদায়তন বিষয়গুলোতেই এ ধরনের উপ-বিভাগ গঠিত হত।

গ্রাম-প্রশাসন : সাম্রাজ্যের সর্বনিম্ন প্রশাসনিক বিভাগ গ্রাম। এরূপ একটি গ্রাম মধুবন তাম্র শাসনে উল্লিখিত কুণ্ডকাগ্রাম। গ্রামেয়ক বা গ্রামাধ্যক্ষ ছিলেন গ্রাম-প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে। তার নিয়োগ-পদ্ধতি সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। হয়তো তার এই পদ ছিল উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। হয়তোবা গ্রামবাসীদের সমর্থনে ও সরকারি অনুমোদনে তিনি স্বপদে নিযুক্ত হতেন। এক গ্রামাক্ষপটলিক ও তার অধীনস্থ এক বা একাধিক করণিক গ্রাম-প্রধানকে সাহায্য করতেন। তাছাড়া গ্রাম-প্রধানকে সাহায্যের জন্য একটি গ্রামীণ সংস্থা ছিল। সংস্থাটি ছিল বিষয়াধিষ্ঠান অধিকরণেরই অনুরূপ। গ্রামবৃদ্ধ বা গ্রামমহত্তরদের নিয়ে এই সংস্থা গঠিত হত। গুপ্তপর্বে মধ্য ভারতে গ্রামীণ সংস্থাকে পঞ্চমণ্ডলী বলা হয়েছে। বিহার অঞ্চলে এর নাম ছিল গ্রামজনপদ। গ্রামবৃদ্ধরা সম্ভবত তাদের বয়স, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, সততা ও আর্থিক সংগতির ভিত্তিতে গ্রামবাসীদের দ্বারা মনোনীত হতেন। গ্রামের বাড়ি-ঘর, রাস্তা-ঘাট, বাজার-মন্দির, কূপ-পুষ্করিণী, শ্মশান-চারণভূমি, গবাদি পশু, বন-জঙ্গল, আবাদি-অনাবাদি জমি, সব কিছুই এই সংস্থা পর্যবেক্ষণ করত। ছোটখাটো বাদ-বিসংবাদের নিষ্পত্তিও হত গ্রাম সভায়।

আইন-শৃঙ্খলার অবনতি : হর্ষের শাসন-ব্যবস্থার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন শুয়েন চাঙ। জনগণের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ লক্ষ করেছেন তিনি। তিনি বলেছেন, স্বল্পসংখ্যক লোকই ছিল অপরাধপ্রবণ। কিন্তু একটা কথা স্বীকার করতে হচ্ছে, হর্ষবর্ধনের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও ও সময় গুপ্তযুগের তুলনায় শান্তি-শৃঙ্খলার অবনতি হয়। গুপ্তসম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে ফা শিয়েন প্রায় সারা উত্তর ভারত পরিভ্রমণ করেন। তাকে কখনও দস্যু-তস্করের হাতে লাঞ্ছিত হতে হয়নি। সেরূপ ঘটলে তার ভ্রমণবৃত্তান্তে সে ঘটনার উল্লেখ থাকত। কিন্তু শুয়েন চাঙের জীবনীগ্রন্থ থেকে জানা যায়, চিনা শ্রমণ একাধিকবার দস্যুদের হাতে নিগৃহীত হন। একবার তিনি গঙ্গাবক্ষে নৌযানে চেপে অযোধ্যা থেকে পূর্বদিকে যাত্রা করেন। তার সঙ্গে ছিলেন ৮০ জন সহযাত্রী। হঠাৎ জলদস্যুরা তাদের উপর চড়াও হয় এবং নৌযানটিকে তীরে ভেড়ানো হয়। শুয়েন চাঙ দেখতে সুন্দর ছিলেন বলে তাকে তুলে আনা হয়। জলদস্যুরা ঠিক করল, তাকে দেবী দুর্গার নিকট বলি দেওয়া হবে। হতভাগ্য শ্রমণকে একটি যূপের সঙ্গে বাঁধা হয়। ঘাতকেরা অস্ত্রে শান দিতে থাকে। এমন সময় প্রচণ্ড ঝড় ওঠে। ভীত, চকিত জলদস্যুরা ভাবল, দেবী তাদের প্রতি কুপিতা হয়েছেন। শুয়েন চাঙকে তারা মুক্তি দেয় ও তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। আসন্ন মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা পান তিনি। অন্য ঘটনাটি ঘটে পাঞ্জাবে। চিনা শ্রমণ তখন চন্দ্রভাগা নদী পার হয়ে, শাকল শহর অতিক্রম করে এক গহন পলাশবনে প্রবেশ করেছেন। বনের মধ্য দিয়েই পথ। হঠাৎ ৫০ জনের এক দস্যুদল শুয়েন চাঙ ও তার সঙ্গীদের আক্রমণ করে। দস্যুরা শুয়েন চাঙ ও তার সহযাত্রীদের যথাসর্বস্ব লুঠ করে। এতেও নিরস্ত না হয়ে তারা উদ্যত তরবারি হাতে পর্যটকদের তাড়া করে। শেষে এক ব্রাহ্মণ কৃষক গ্রামবাসীদের জড়ো করায় ডাকাতের দল পলায়ন করে। শুয়েন চাঙ ও তার সহযাত্রীরা এবারও কোনওক্রমে প্রাণে বেঁচে যান। তখনকার দিনের পথ-ঘাট যে নিরাপদ ছিল না, তা শুয়েন চাঙের জীবনীগ্রন্থের সাক্ষ্যে প্রমাণিত। হর্ষচরিতেও সাম্রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলার অবনতির চিত্র বিধৃত আছে। মাঠে শস্য পাকছে, অথচ প্রজারা শস্য ঘরে তুলতে পারছেন না; ভোগপতি ও চাটেরাও তাদের পীড়ন করছেন। হর্ষবর্ধনকে দেখতে পেয়ে জীবনের মায়া ত্যাগ করে তারা রাজাকে অসঙ্কোচে জানান, রাজা কোথায়? রাজপদের যোগ্য নন তিনি। এ ছবির চিত্রকর স্বয়ং বাণভট্ট।

কঠোর দণ্ডবিধি : অথচ এ সময় দণ্ডবিধি কঠোরই ছিল। ছোটখাটো অপরাধের জন্য অর্থদণ্ড দেওয়া হত। রাজদ্রোহিতার শাস্তি ছিল নির্বাসন। রাজাজ্ঞা অমান্য করলে কারারুদ্ধ করা হত। অসামাজিক ও অবৈধ কার্যকলাপে লিপ্ত হলে অপরাধের গুরুত্ব অনুসারে অপরাধীর নাক, কান, হাত, পা কেটে ফেলা হত। কখনওবা তাকে নির্বাসনে পাঠানো হত। অপরাধ নির্ণয় বা সততা প্রমাণের জন্য জল, বিষ ও অগ্নি পরীক্ষার প্রচলন ছিল। শুয়েন চাঙ বলেন, বন্দিদের প্রতি নির্দয় ব্যবহার করা হত, তাদের মানুষরূপে গণ্য করা হত না। হর্ষচরিতে অবশ্য দেখা যায়, রাষ্ট্রীয় উৎসবকালে বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হত। হর্যের জন্মকালে বহু কারাবন্দির মুক্তির উল্লেখ করেছেন বাণভট্ট।

সমাজ-জীবন

চাতুবর্ণ ও বিভিন্ন জাতি

ব্রাহ্মণাদি চার বর্ণের উল্লেখ করেছেন শুয়েন চাঙ। বিভিন্ন বর্ণের কৌলিক বৃত্তিরও উল্লেখ করেছেন তিনি। ব্রাহ্মণেরা ছিলেন বর্ণশ্রেষ্ঠ, সমাজের সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। একই কথার পুনরুক্তি করেছেন ই চিঙ। তিনি বলেছেন, ব্রাহ্মণেরা সমাজে দেবতারূপে গণ্য হতেন, পঞ্চ ভারতে তারাই ছিলেন সর্বাপেক্ষা সম্মানিত। চরিত্রবান বলে তাদের খ্যাতি ছিল। তারা ছিলেন নীতিবান, স্পষ্টবাদী, শিক্ষিত, শাস্ত্রজ্ঞ, মিতব্যয়ী, বুদ্ধিমান। ব্রাহ্মণদের পৌরোহিত্য বৃত্তির কথাও বলেছেন শুয়েন চাঙ। বিদ্বান, গুণবান ব্রাহ্মণদের অনুকূলে ভূমিদানের উল্লেখ আছে সমকালীন বাঁশখেড়া ও মধুবন লেখে। ক্ষত্রিয়দের উল্লেখ প্রসঙ্গে শুয়েন চাঙ বলেন, পরোপকার ও ক্ষমাই ছিল তাদের জীবনের আদর্শ। ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল বৈশ্যদের প্রধান বৃত্তি। ই চিঙ পেশা হিসাবে বাণিজ্যের প্রশংসা করেছেন; এ বৃত্তিতে প্রাণীহত্যার অবকাশ নেই। কৃষিকর্মকে শূদ্রের বৃত্তি বলে উল্লেখ করেছেন চিনা শ্রমণ। কৃষিকার্য মূলত বৈশ্যদের বৃত্তি ছিল। শুয়েন চাঙের বর্ণনায় মনে হয়, এ সময় বহুসংখ্যক শূদ্র কৃষিকার্যে নিযুক্ত ছিলেন। বিভিন্ন সংকর জাতির উল্লেখ করেছেন তিনি। কসাই, জল্লাদ, ধাঙড় প্রভৃতিদের কথাও বলা হয়েছে। এরা ছিলেন চণ্ডাল বা চণ্ডালদের সমগোত্রীয়। তারা বাস করতেন শহরের বাইরে, বিশেষ এক নকশা-আঁকা ঘরে। তারা ছিলেন অস্পৃশ্য, তাদের ভক্ষ্য মদ-মাংস। কাদম্বরীতে এক চণ্ডালকন্যার কথা বলা হয়েছে। মেয়েটি রাজদরবারে প্রবেশ করে বাঁশের লাঠি ঠুকে লোক জনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিল। চণ্ডালদের লাঠি ঠোকার কথা ফা শিয়েনও বলেছেন। চণ্ডালেরা লাঠি ঠুকে পথ চলতেন যাতে পথচারীরা সতর্ক হন, তাদের স্পর্শ বাঁচিয়ে চলেন। চণ্ডালদের স্পর্শে লোকেরা অশুচি হতেন। তাদের স্নান করতে হত, পোশাক-পরিচ্ছদ ধৌত করে পরিশুদ্ধ হতে হত। বাণভট্টও চাতুবর্ণ এবং তাদের কৌলিক বৃত্তির উল্লেখ করেছেন। হর্ষচরিত, কাদম্বরী ও দশকুমারচরিতে পুলিন্দ, শবর, কিরাত প্রভৃতি আরণ্যক জাতিসমূহের বিশদ বর্ণনা আছে। তারা বিন্ধ্যাটবী ও অন্যান্য পার্বত্য অঞ্চলে বাস করতেন। বিন্ধ্যাচলবাসী শবরদের উল্লেখ প্রসঙ্গে বাণভট্ট বলেন, তারা বন-জঙ্গলে পশু-পাখি শিকার করে বেড়ান, মদ মাংস ভক্ষণ করেন, নারী অপহরণ করেন আর দেবতার প্রসন্নতা লাভের উদ্দেশ্যে নরবলি দেন। এসব গহিন-অরণ্যচারী আরণ্যক জাতি উপজাতীয় স্তর থেকে জাতি-কাঠামোর মধ্যে এসেছিল কিনা, বলা যায় না।

বর্ণের পবিত্রতা রক্ষার একটা চেষ্টা বরাবরই ছিল। সবর্ণ বিবাহের মূল উদ্দেশ্যও তাই। সবর্ণ বিবাহের সুস্পষ্ট উল্লেখ করেছেন শুয়েন চাঙ। হর্ষবর্ধনও তার লেখে বর্ণাশ্রম প্রতিষ্ঠায় তার আন্তরিক আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন। (বর্ণাশ্রম-ব্যবস্থাপন-প্রবৃত্তচক্র)। কিন্তু তৎকালীন যুগে অসবর্ণ বিবাহ ও কৌলিক বৃত্তি পরিবর্তনের দৃষ্টান্তও বিরল নয়। বাণভট্টের পিতা জনৈকা শূদ্রা রমণীর পাণিগ্রহণ করেন; তাদের দু’টি পুত্রসন্তানও ভূমিষ্ঠ হয়। হর্ষবর্ধন বর্ণে বৈশ্য ছিলেন অথচ তিনি তার কন্যার সঙ্গে বলভীর ক্ষত্রিয় রাজার বিবাহ দেন। এ দু’টি ঘটনা অনুলোম বিবাহের দৃষ্টান্ত। তৎকালীন সংস্কৃত সাহিত্যে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের দাসী ও গণিকা কন্যার বিবাহের সুপ্রচুর দৃষ্টান্ত আছে। কৌলিক বৃত্তি পরিবর্তনেরও অজস্র নজির আছে। শুয়েন চাঙের বর্ণনায় আছে, কামরূপ, উজ্জয়িনী, জিঝোতি ও মহেশ্বরপুরের রাজারা সকলেই ব্রাহ্মণ ছিলেন; কান্যকুব্জ ও পারিযাত্রের রাজারা ছিলেন বৈশ্য ; সিন্ধু ও মতিপুরের রাজারা বর্ণে শূদ্র ছিলেন। চিনা পরিব্রাজক টক্ক অঞ্চলে লাঙলধারী এক ব্রাহ্মণের সাক্ষাৎ পান। এই ব্রাহ্মণের প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে তার জীবন রক্ষা পায়। দশকুমারচরিতে বিন্ধ্যাঞ্চলে এক ব্রাহ্মণ বসতির উল্লেখ আছে। ব্রাহ্মণেরা সকলেই শিকার ও দস্যুবৃত্তির দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতেন।

লোকদের মধ্যে বেশ মেলামেশা ছিল। জনগণের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি-সৌহার্দ লক্ষ শুয়েন চাঙ। বাণভট্ট অকপটে স্বীকার করেছেন, পারশব, বন্দী (বন্দনাগায়ক), জাঙ্গলিক (ওঝা), কলাদ বা স্বর্ণকার, লেখক, চিত্রকর, মাদঙ্গিক (বাদ্যবাদক), গায়ক, বাংশিক (বংশীবাদক), সংগীতশিক্ষক, ঐক্ষিক (পাশক), কিতব (জুয়াড়ি), নট, নর্তকী, ক্ষপণক (দিগম্বর সন্ন্যাসী), ধাতুবাদবিদ (ধাতুবিদ্যাবিশারদ), দাদুরিক (কুম্ভকার), ঐন্দ্রজালিক ইত্যাদি বিভিন্ন জাত ও ধর্মের লোকেরা তার যৌবনের সঙ্গী ছিলেন।

ভারতীয়দের পরিচ্ছন্ন জীবনযাত্রার উল্লেখ করেছেন শুয়েন চাঙ। তার বর্ণনা থেকে জানা যায়, খাদ্যগ্রহণের পূর্বে ও পরে ভারতীয়রা হাত-মুখ ধৌত করতেন; ভুক্তাবশেষ কখনও পরিবেশিত হত না ; কাঠ বা মাটির বাসনকোসন একবার ব্যবহার করেই ফেলে দেওয়া হত; সোনা, রুপো, তামা ও লোহার পাত্র ব্যবহারের পর পুনর্ব্যবহারের জন্য উত্তমরূপে ধৌত করা হত ; পেঁয়াজ-রসুন খেলে সমাজে বহিষ্কৃত হতে হত ; মাংস বর্জনীয় হলেও ভেড়া বা হরিণের মাংস নিষিদ্ধ ছিল না; মাছের চাহিদা ছিল কিন্তু দুধ, ঘি, কণিকাকার চিনি, মিছরি, পিঠা ও সরষের তেলে ভাজা খাবারের চাহিদাই ছিল বেশি। সাধারণ লোকদের প্রসঙ্গে শুয়েন চাঙ বলেন, তারা অপরের দ্রব্য অপহরণ করেন না; ছল-চাতুরির আশ্রয় নেন না; নিজেদের দায় দায়িত্ব সম্পর্কে তারা সজাগ ; তারা পরলোকে বিশ্বাস করেন; তাদের দৃঢ় বিশ্বাস, এ জন্মে পাপ করলে পরজন্মে তার ফল ভোগ করতে হবে। কান্যকুব্জ ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের লোকদের সম্পর্কে চিনা শ্রমণের মন্তব্য: লোকেরা শুদ্ধ ও স্পষ্ট ভাষায় কথা বলেন; প্রীতি ও সুষমামণ্ডিত তাদের কথাবার্তা ; সুস্পষ্ট তাদের উচ্চারণ ; অন্যান্য অঞ্চলবাসীদের নিকট তারা আদর্শস্থানীয়। ভারতে মদ্যপানের ব্যাপকতার কথা বলেছেন শুয়েন চাঙ।

সমাজ-জীবনের অন্য এক ছবি ধরা পড়েছে সমকালীন কাব্যে, নাটকে। এ ছবি বিলাসবহুল, উচ্ছল, উদ্দাম জীবনযাত্রার ছবি। হর্ষচরিতে নাচ-গান, ভূরিভোজের এক আসরের বর্ণনা আছে। সে আসরে বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি আমন্ত্রিত ছিলেন। আসরে পরিবেশিত নাচ-গানে কোনও রুচি বা শালীনতার বালাই ছিল না, সুরাপানেও কোনও মাত্রা টানা ছিল না। গৃহস্বামী, যুবক, বৃদ্ধ, দাসী, নর্তকী সকলেই উদ্দাম, যথেচ্ছ জীবনসম্ভোগে মত্ত। এ আসর বসেছিল হর্ষের জন্মদিনে স্বাথ্বীশ্বরের রাজপ্রাসাদে। উদ্যোক্তা ছিলেন স্বয়ং প্রভাকরবর্ধন। সমকালীন বসন্তোৎসবের এক বাস্তব চিত্র অঙ্কিত আছে রত্নাবলী নাটকে। সে উৎসবেও কোনও রুচির পরিচয় ছিল না, ছিল বিকৃত জীবনবোধের মালিন্য।

নারী

স্ত্রীশিক্ষার ব্যবস্থাপনা ছিল। সে সময় স্ত্রীশিক্ষা বলতে সাধারণত নৃত্য, চিত্রকলা এবং কণ্ঠ ও যন্ত্র সংগীতই বোঝাত। হর্ষচরিতে রাজ্যশ্রীর নিয়মিত সংগীত, নৃত্য ও বিবিধ কলাবিদ্যার অনুশীলনের উল্লেখ আছে। কাদম্বরীতে রাজকুমারী কাদম্বরী ও তার সখী মহাশ্বেতার একযোগে সংগীত, নৃত্যাদি চর্চার কথা আছে। প্রিয়দর্শিকায় মহিলাদের নৃত্য এবং কণ্ঠ ও যন্ত্র সংগীত (গীতনৃত্যবাদ্যাদিষু) অভ্যাসের বর্ণনা আছে। সাগরিকা তার প্রিয়জনের ছবি আঁকছেন, এ চিত্র অঙ্কিত আছে রত্নাবলীতে। মেয়েরা সাধারণত পিতৃগৃহেই শিক্ষালাভ করতেন তবে চিত্রাঙ্কন ও সংগীতচর্চার সংস্থাও ছিল। সমকালীন কাব্যে এই দুই শ্রেণির সংস্থাকে যথাক্রমে চিত্রশালা ও গন্ধর্বশালা বলা হয়েছে। অনুমিত হয়, শিক্ষিত ব্রাহ্মণ এবং অভিজাত পরিবারের মহিলাদের পুঁথিগত বিদ্যা অধ্যয়নের সুযোগ ছিল। রাজ্যশ্রী উচ্চশিক্ষিতা ছিলেন। তখনকার দিনের বিখ্যাত বৌদ্ধাচার্য দিবাকরমিত্র তাকে বৌদ্ধশাস্ত্র অধ্যয়ন করান। মহাযানবাদের উপর শুয়েন চাঙের চিন্তাগর্ভ বক্তৃতার আগ্রহী শ্রোতা ছিলেন তিনি। ধর্মীয় আলোচনায় পারদর্শিনী বৌদ্ধ, জৈন ও ব্রাহ্মণ্য সন্ন্যাসিনীর উল্লেখ আছে সমকালীন কাব্যে, নাটকে।

সাধারণত বয়ঃসন্ধিক্ষণের পূর্বেই কন্যার বিবাহ হত। পতিনির্বাচনে কন্যার অধিকার ছিল না, পিতা বা অভিভাবকের মতামতই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হত। গ্রহবর্মা যখন রাজ্যশ্রীকে বিবাহ করার প্রস্তাব দেন, প্রভাকরবর্ধন সে প্রস্তাব অনুমোদন করেন। রানি যশোমতী স্বামীর মত সমর্থন করে বলেন, কোন পাত্রে কন্যাকে সম্প্রদান করা হবে, পিতাই তা বিচার করবেন।

সতীপ্রথা প্রচলিত ছিল। হর্ষচরিতে বলা হয়েছে, হর্ষবর্ধনের শত অনুরোধ সত্ত্বেও রানি যশোমতী সরস্বতী নদীর তীরে স্বামীর প্রজ্বলিত চিতাশয্যায় আত্মাহুতি দেন। স্বামীর মৃত্যুর পর রাজ্যশ্রীও প্রাণ বিসর্জন দিতে উদ্যত হন, কিন্তু ভ্রাতার হস্তক্ষেপে নিরস্ত হন। শুয়েন চাঙ সতীপ্রথার উল্লেখ করেননি। প্রথাটি সম্ভবত ব্যাপকতা লাভ করেনি। বৈধব্য ছিল কৃচ্ছতা ও কাঠিন্যের জীবন। বিধবাদের পুনর্বার বিবাহ হত না, এ তথ্য শুয়েন চাঙের। শুয়েন চাঙ ও ই চিঙের বৃত্তান্তে ভারতীয় নারীদের অবগুণ্ঠন ব্যবহারের উল্লেখ নেই। কাদম্বরীতে মালব জন পদের যুবতী নারীদের বেত্রবতী নদীতে অবগাহনের বর্ণনা আছে। রাজ্যশ্রী প্রকাশ্য সভায় শুয়েন চাঙের বক্তৃতা শ্রবণ করতেন। অনুমিত হয়, মহিলারা পর্দানশীন ছিলেন না; তাদের কর্মকাণ্ড প্রধানত গৃহমধ্যেই আবদ্ধ ছিল।

মহিলাদের অনেকে দেবমন্দিরে দেবদাসীরূপে নিযুক্ত হতেন। শুয়েন চাঙ মুলতানের বিখ্যাত সূর্যমন্দিরে দেবদাসীদের উপস্থিতি উল্লেখ করেছেন। মন্দিরে নৃত্যগীত পরিবেশনের কথা আছে কাদম্বরীতে। মন্দিরে নৃত্য-গীত পরিবেশনকারী শিল্পীদের অনেকেই ছিলেন দেবদাসী।

শিক্ষা ও শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান

সে সময় গুরুগৃহে, তপোবনে, বৌদ্ধ ও জৈন বিহারগুলোতে জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার চর্চা হত। কাদম্বরীতে দেখা যায়, রাজকুমার চন্দ্রাপীড় ছয় থেকে ষোলো পর্যন্ত সুদীর্ঘ দশ বৎসরকাল রাজধানীর উপকণ্ঠে নির্মিত এক ‘বিদ্যামন্দিরে’ বেদ, ব্যাকরণ, মীমাংসা, তর্কশাস্ত্র, আইন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ভাষা, বর্ণমালা, অস্ত্রবিদ্যা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় অধ্যয়ন করেন। দশকুমারচরিতে বেদ, ব্যাকরণ, অলংকার, আইন, জ্যোতিষ, তর্কশাস্ত্র, মীমাংসা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সংগীত, যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষণীয় বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। শুয়েন চাঙ বলেন, ছয় বৎসর পূর্ণ হবার পূর্বেই শিক্ষার্থী বালককে দ্বাদশ অধ্যায়ের একটি গ্রন্থের পাঠ শেষ করতে হত ; সপ্তম বছর থেকেই তাকে বহন করতে হত শিক্ষার গুরুভার ; ব্যাকরণ, শিল্পস্থানবিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র, তর্কশাস্ত্র ও অধ্যাত্মবিদ্যা, এই পাঁচটি বিষয় সমান তালে আয়ত্ত করতে হত ; তারপর শুরু হত উচ্চতর শিক্ষা ; এ শিক্ষা চলত শিক্ষার্থীর ত্রিশ বৎসর বয়স পর্যন্ত। ব্রাহ্মণ অধ্যাপকদের সুগভীর পাণ্ডিত্য ও আন্তরিক নিষ্ঠার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন চিনা শ্রমণ। ই চিঙের ভারত-বৃত্তান্তে গুরু শিষ্যের সুমধুর সম্পর্ক উল্লিখিত হয়েছে। অতি প্রত্যুষে শয্যা ত্যাগ করে শিষ্য আচার্যকে অভিবাদন করছেন, তার শরীর পরিচর্যা করছেন, তার পরিধেয় বস্ত্র পরিষ্কৃত ও বিন্যস্ত করছেন, গৃহ-প্রাঙ্গণ পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন করছেন, গুরুকে পানীয় জল প্রদানের পূর্বে তা উত্তমরূপে পরীক্ষা নিরীক্ষা করছেন, আবার আচার্যও তার অসুস্থ, পীড়িত শিষ্যকে পিতৃস্নেহে শুশ্রূষা করছেন, এসব দৃশ্য ই চিঙের বৃত্তান্তে অঙ্কিত আছে।

শিক্ষার কেন্দ্ররূপে সে সময় বলভীর খুব খ্যতি ছিল। হর্ষচরিতে দিবাকরমিত্রের বিন্ধ্যাঞ্চলে অবস্থিত তপোবনের বর্ণনা আছে। এই তপোবনে বিদ্যানুশীলনে নিবেদিত প্রাণ বৈদান্তিক, নিরীশ্বরবাদী, নৈয়ায়িক, ধর্মশাস্ত্রবিদ, বৈয়াকরণ, পুরাণবিদ এবং বৌদ্ধ ও জৈন আচার্যদের কথাও হর্ষচরিতে বর্ণিত হয়েছে। শুয়েন চাঙের বর্ণনায় প্রকাশ, জালন্ধরের নাগরধন বিহার, কান্যকুব্জের ভদ্র বিহার, বৈশালীর শ্বেতপুর বিহার, গয়ার মহাবোধি বিহার ও কর্ণসুবর্ণের রক্তমৃত্তিকা বিহার বৌদ্ধ শাস্ত্রানুশীলনের উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র ছিল। শিক্ষার পীঠস্থানরূপে নালন্দা মহাবিহারের খ্যাতি ছিল সর্বাধিক। শুধু ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নয়, বহির্বিশ্বের চিন, কোরিয়া, মোঙ্গোলিয়া প্রভৃতি বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা উচ্চতর জ্ঞান আহরণের জন্য এই মহাবিহারে সমবেত হতেন। চন্দ্রপাল, গুণমতি, স্থিরমতি, প্রভামিত্র, জিনমিত্র ও জ্ঞানচন্দ্রের মতো দিগ্বিজয়ী পণ্ডিতেরা এই মহাবিহারে অধ্যাপকপদে বৃত ছিলেন। বিশ্রুতকীর্তি শীলভদ্র ছিলেন এই মহাবিহারের অধ্যক্ষ। (সমতট অর্থাৎ পূর্ব বাংলার এক রাজপরিবারের সন্তান ছিলেন শীলভদ্র। দক্ষিণ ভারতীয় বৌদ্ধাচার্য ধর্মপাল তার গুরু ছিলেন।) এই শিক্ষাকেন্দ্রে ভর্তি হওয়া সহজ ব্যাপার ছিল না। প্রবেশিকা পরীক্ষা ছিল অতি দুরূহ। প্রতি দশজন পরীক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র দুই বা তিনজন সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতেন। তবু নালন্দা মহাবিহারে ছাত্রসংখ্যা ছিল বিশাল। শুয়েন চাঙের সময় অধ্যাপক ও ছাত্রদের সম্মিলিত সংখ্যা দশ হাজারে পৌঁছয়। অধ্যাপকেরা ছিলেন সংখ্যায় ১৫০১ জন। এই মহাবিহারে রত্নসাগর, রত্নোদধি ও রত্নরঞ্জক নামে তিনটি সুবিশাল পাঠাগার ছিল। শুয়েন চাঙ নালন্দা মহাবিহারে পাঁচ বৎসর অধ্যয়ন করেন, ই চিঙ অধ্যয়ন করেন দশ বৎসর। বিভিন্ন বিষয়ের পঠন-পাঠন হত এই মহাবিহারে। সমগ্র বৌদ্ধশাস্ত্র, চতুর্বেদ, হেতুবিদ্যা বা তর্কশাস্ত্র, শব্দবিদ্যা বা ব্যাকরণ, চিকিৎসাবিদ্যা, অথববিদ্যা, সাংখ্য ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষাদান হত। প্রতিষ্ঠানটি ছিল অবৈতনিক। সম্প্রদত্ত ১০০টি গ্রামের রাজস্ব থেকে মহাবিহারের যাবতীয় খরচাদি নির্বাহ হত। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বিপুল হলে কী হবে, এই মহাবিহারে জীবনচর্যার প্রতিটি ক্ষেত্র ছিল নিয়ম ও শৃঙ্খলার শাসনে বাঁধা। শুয়েন চাঙ স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, শান্তি-শৃঙ্খলা লঙ্ঘিত হয়েছে, এমন ঘটনা নালন্দা মহাবিহারের ইতিহাসে কখনও ঘটেনি। এক আদর্শ শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের নিদর্শনরূপে নালন্দা মহাবিহারের নাম আজও জনমানসে ভাস্বর।

অর্থনৈতিক জীবন

কৃষিকার্য : পুষ্যভূতি রাজ্য তথা উত্তর ভারত কৃষিজ সম্পদে সমৃদ্ধ ছিল, এরূপ অনুমান অসংগত নয়। বাণভট্ট শ্রীকণ্ঠ অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে ধান ও গম উৎপাদনের উল্লেখ করেছেন, শ্রীকণ্ঠে উৎপন্ন পৌণ্ড্রজাতীয় ইক্ষুর কথাও তিনি বলেছেন। হর্ষচরিতের বর্ণনা থেকে অনুমিত হয়, তখন পুণ্ড্র অর্থাৎ উত্তর বঙ্গের ইক্ষুর বিশেষ খ্যাতি ছিল ; উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এই ইক্ষুর চাষ হত। শ্রীকণ্ঠ অঞ্চলের অন্যান্য ফসল-ফলাদির মধ্যে বাণভট্ট সিম, জিরা, ডালিম ও দ্রাক্ষার উল্লেখ করেছেন।

শুয়েন চাঙের বর্ণনা থেকে মনে হয়, এ সময় সামগ্রিকভাবে উত্তর ভারতে চাল, গম, আদা, সরষে, কুমড়া ইত্যাদি ফসল এবং আম, নারকেল, কলা, তরমুজ, তেঁতুল, কাঠাল, কমলালেবু ও ডালিমের মতো ফলের উৎপাদন বেশ ভালোই ছিল। চিনা শ্রমণ স্থাধীশ্বর অঞ্চলের ভূমির উর্বরতার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, উদ্যান ও কাশ্মীরে জাফরান জন্মাত, কাশ্মীর ও কুলূত ওষধিতে সমৃদ্ধ ছিল, চন্দন গাছ ও কর্পূরের জন্য মলয় অঞ্চলের বিশেষ প্রসিদ্ধি ছিল, মগধে সুগন্ধি ধান উৎপন্ন হত, রাজস্থানের বৈরাটে এক প্রকার ধানের চাষ হত যা ষাট দিনে পরিপক্ক হত এবং পুঞ্চ ও মথুরায় গৃহসংলগ্ন উদ্যানে বিবিধ প্রকার ফল-ফলাদি ফলানো হত। চাল, গম, ইক্ষু, তরমুজ, ওল ইত্যাদি নানা ফল-ফলাদির উল্লেখ আছে ই চিঙের বৃত্তান্তে। তার বিবরণ থেকে জানা যায়, উত্তর-পশ্চিম ভারতে প্রচুর গম উৎপন্ন হত, পশ্চিম ভারতে ধান বা বার্লির প্রচুর চাষ হত এবং মগধে সুপ্রচুর ধান জন্মাত।

অনুমিত হয়, চাষের ফলন বৃদ্ধিকল্পে শুধু বৃষ্টি বা নদীর জলের উপর নির্ভর করা হত না ; কূপ, পুষ্করিণী ও খাল খনন করে খেতে জলের অভাব মেটানো হত। খেতে সেচের কাজে ব্যবহৃত ‘তুলাযন্ত্র’ নামে এক প্রকার জলযন্ত্রের উল্লেখ করেছেন বাণভট্ট। এই তুলাযন্ত্র সম্ভবত অরঘট্ট বা সমগোত্রীয় কোনও জলযন্ত্র ছিল। রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় তুলাযন্ত্রকে পারসিক চক্ররূপে শনাক্ত করেছেন। কিন্তু পারসিক চক্র বলতে যে সেচযন্ত্র বোঝায় তা সম্ভবত তুর্কি অভিযানের পূর্বে ভারতে প্রচলিত ছিল না।

শিল্পজাত সামগ্ৰী : এ পর্বের শিল্পজাত দ্রব্যাদির মধ্যে বস্ত্রশিল্পের কথা সর্বাগ্রে উল্লেখ করতে হয়। বাণভট্ট ক্ষৌম (শণ, পাট ইত্যাদি গাছের আঁশে তৈরি বস্ত্র), বদর (সুতিবস্ত্র), দুকূল (দুকূল গাছের আঁশ দিয়ে তৈরি সূক্ষ্ম বস্ত্র), লালাতত্ত্ব (মাকড়সার লালে তৈরি বস্ত্র?), অংশুক (মসলিন), নেত্র (গাছের মূল হতে তৈরি বস্ত্র) ও মুনি-ঋষিদের পরিধেয় বল্কলবস্ত্রের উল্লেখ করেছেন। রঙিন (পুলকবন্ধ) ও ফুলের নকশা কাটা (পুষ্পপট্ট) বস্ত্রেরও উল্লেখ আছে তার কাব্যে। সে সময় সারা উত্তর ভারতে পুণ্ড্র অঞ্চলে তৈরি ক্ষৌম বস্ত্রের বিরাট চাহিদা ছিল। বাণভট্টের জন্মস্থান প্রীতিকূট গ্রামেও এই বস্ত্রের সুখ্যাতি পৌঁছেছিল। শুয়েন চাঙ রেশম, সুতা, গাছের আঁশ এবং ভেড়া ও ছাগলের লোমে তৈরি বস্ত্রের কথা বলেছেন। শুয়েন চাঙ মথুরার সুতিবস্ত্রের প্রশংসা করেছেন। শান্তি দেবের (খ্রিস্টীয় ৭ম শতক) ‘শিক্ষাসমুচ্চয়’ গ্রন্থে বারাণসীকে বস্ত্রশিল্পের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্ররূপে বর্ণনা করা হয়েছে। অত্যুৎকৃষ্ট রেশমবস্ত্র উৎপন্ন হত এ অঞ্চলে। বস্ত্রশিল্পের কেন্দ্ররূপে কাম রূপের বিশেষ খ্যাতি ছিল। হর্ষচরিতে কামরূপের ক্ষৌম, জাতিপট্টিক ও চিত্রপট বস্ত্রের উল্লেখ আছে।

ভারতে স্বর্ণ, রৌপ্য, স্ফটিকের কাচ, মণি-রত্নাদির প্রাচুর্যের কথা বলেছেন শুয়েন চাঙ। উদ্যান, টক্ক ও সিন্ধু অঞ্চলের স্বর্ণ ও রৌপ্য, বিপাশা ও শতদ্রর মধ্যবর্তী ভূখণ্ডে লৌহ ও তাম্র এবং নেপাল ও কুলূতে তাত্রের উল্লেখ করেছেন তিনি। স্বর্ণ, রৌপ্য ও তাম্র দিয়ে যেমন গহনা তৈরি হত, তেমনি এ তিনটি ধাতু ও পিতল দিয়ে দেব-দেবীর অসংখ্য মূর্তিও তৈরি হত। চিনা শ্রমণ নালন্দায় রাজা পূর্ণবর্মা নির্মিত এক বিরাটকায় বুদ্ধমূর্তি ও শীলাদিত্যের তৈরি এক পিতল নির্মিত মন্দির দেখে বিস্ময় বোধ করেন। প্রথমটি ২০ এবং দ্বিতীয়টি ২৫ মিটার উচ্চতা-বিশিষ্ট ছিল বলে অনুমিত হয়। শুয়েন চাঙ স্বর্ণ, রৌপ্য ও চন্দনকাঠে নির্মিত বহু বৌদ্ধমূর্তি স্বদেশে নিয়ে যান। বিবিধ প্রকার চামড়ার উল্লেখ আছে হর্ষচরিতে। চামড়ার ঢাল তৈরি হত। সে ঢাল কখনও কখনও সোনার কারুকার্যখচিত হত। মৃগচর্ম দিয়ে বালিশ তৈরি হত। চারু ও কারুশিল্পে বহু লোকের জীবিকা নির্বাহ হত! বিভিন্ন শিল্পে নিযুক্ত শিক্ষানবিশদের হর্ষচরিতের ‘নবসেবক’ বলা হয়েছে। বিভিন্ন প্রত্নস্থল থেকে প্রাপ্ত মৃৎপাত্রের সাক্ষ্যে সে যুগের মৃৎশিল্পের পরিচয় বিধৃত। গুজরাত উপকূলে ব্রোচের কাছে লবণ উৎপাদনের উল্লেখ আছে শুয়েন চাঙের ‘সি য়ু চি’ গ্রন্থে।

ব্যবসা-বাণিজ্য : বণিক বা শিল্পী সংগঠনের উল্লেখ আছে হর্ষচরিতে। পণ্যদ্রব্যের আমদানি রপ্তানি বা বাণিজ্যিক ক্রিয়াকলাপ অব্যাহত না থাকলে পৌণ্ড্র জাতীয় ইক্ষুর শ্রীকণ্ঠ অঞ্চলে চাষ-আবাদ হয় হতো না, পুণ্ড্রের ক্ষৌমবস্ত্রের চাহিদা বাণভট্টের প্রত্যন্ত প্রীতিকূট গ্রামেও অনুভূত হতোনা, দূর-দূরাঞ্চলের দুষ্প্রাপ্য পণ্যসামগ্রী স্বাথ্বীশ্বরের বাজারে সহজলভ্য হতোনা। স্থান থেকে স্থানান্তরে গমনাগমনের জন্য স্থলপথ ছিল। অযোধ্যা থেকে একদল বণিক তাম্রলিপ্তি বন্দরে পদার্পণ করেন, খ্রিস্টীয় ৮ম শতকীয় একটি লেখে এ তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। শুয়েন চাঙ স্থলপথেই প্রায় সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশ পরিভ্রমণ করেন। স্থলপথ শুধু উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলকেই যুক্ত করেনি, চিন দেশের সঙ্গেও উত্তর ভারতের সংযোগ সূত্র রক্ষা করত। একটি পথ ভারত থেকে সুলেমান পর্বতশ্রেণির ভিতর দিয়ে ব্যাকট্রিয়া ও মধ্য এশিয়া হয়ে চিনের অভ্যন্তরে চলে গিয়েছিল। বেশির ভাগ চিনা শ্রমণ এই পথেই ভারতে আসেন। কাশ্মীরের ভিতর দিয়ে কারাকোরাম পর্বতশ্রেণির দুর্গম পথ ধরেও চিন দেশে প্রবেশ করা যেত। চিনের টোঙ্কিন থেকে কামরূপ ও পুণ্ড্রবর্ধনের ভিতর দিয়ে আর একটি স্থলপথ সুদূর ব্যাকট্রিয়া পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। পশ্চিম এশিয়া ও চিনের মধ্যে সংযোগরক্ষাকারী রেশম পথের সঙ্গে উত্তর ভারত সংযুক্ত ছিল। পারস্য থেকে অশ্ব আমদানির উল্লেখ আছে হর্ষচরিতে। মাল বহনের কাজে বলদ, গর্দভ ও উট ব্যবহারের উল্লেখ আছে সমকালীন সাহিত্যে।

নদীপথও ব্যবহৃত হত। ভাস্করবর্মা নদীপথেই কামরূপ থেকে কজঙ্গলে এসেছিলেন। ই চিং জলপথেই তাম্রলিপ্তি থেকে বোধগয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। বহু বণিক তার সহযাত্রী ছিলেন। চিনা বৃত্তান্তে ভারতের পূর্ব উপকূলবর্তী কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দরের উল্লেখ আছে। এরূপ একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর তাম্রলিপ্তি। এই বন্দর দিয়ে শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও চিনে গমনাগমন চলত। চিনা শ্রমণেরা সাধারণত এই বন্দর থেকে বাণিজ্যপোতে চেপে স্বদেশাভিমুখে যাত্রা করতেন। শুয়েন চাঙ ওড়িশার চরিত্র ও কোঙ্গোদ বন্দরের উল্লেখ করেছেন। শুয়েন চাঙ যে চরিত্র বন্দরের উল্লেখ করেছেন তাকে কেউ কেউ পুরী, কেউবা অধুনালুপ্ত চন্দ্রভাগারূপে শনাক্ত করেছেন। কোঙ্গোদ সম্ভবত গঞ্জাম জেলার বাণপুরে অবস্থিত ছিল। এইসব বন্দরের মাধ্যমে পূর্ব ভারতের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সংযোগ রক্ষিত হত। চিনা শ্রমণের বিবরণে সান-মো-তা-তা অঞ্চলের উল্লেখ আছে। ছয়টি দূরবর্তী ভূখণ্ডের সঙ্গে এই অঞ্চলের বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। অনুমিত হয়, এই ভূখণ্ডগুলো নিম্ন মায়ানমার ও তাই উপকূলে অবস্থিত ছিল। শুয়েন চাঙ বলেন, দ্রব্যের কেনাবেচা হত কখনও স্বর্ণ বা রৌপ্যমুদ্রায়, কখনওবা কড়ি বা ক্ষুদ্রাকৃতি মুক্তায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিংশতি রতির তৌলরীতিতে উৎকীর্ণ, শীলাদিত্য নামাঙ্কিত হর্ষবর্ধনের কতিপয় রৌপ্যমুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে।

রাজস্ব : চিনা শ্রমণ উৎপন্ন শস্যের এক-ষষ্ঠাংশ রাজপ্রাপ্য বলে মন্তব্য করেছেন। রাষ্ট্রের সহনশীলতা ও চাহিদার অত্যল্পতার কথাও তিনি বলেছেন। হর্ষবর্ধনের লেখে নিম্নোক্ত রাজস্বের উল্লেখ আছে :

  • ভাগ : ক্ষেত্রস্বামীর জমিতে উৎপন্ন ফসলে রাজার প্রাপ্যাংশই ভাগ। মনু, নারদ, শবর এবং ব্যবহারময়ূখের রচয়িতা সপ্তদশ শতকীয় নীলকণ্ঠ সকলেই একবাক্যে বলেছেন, ক্ষেত্রস্বামীই জমির স্বত্বাধিকারী ; রাজা প্রজাদের রক্ষা করেন বলে উৎপন্ন ফসলের এক নির্দিষ্ট ভাগ প্রাপ্ত হন। সাধারণত, ফসলের এক-ষষ্ঠাংশ রাজভাগরূপে ধার্য ছিল।
  • ভোগ : গ্রামবাসী বা প্রজাদের রাজাকে প্রদেয় ফল, ফুল, জ্বালানি কাঠ ইত্যাদি সামগ্রীই ভোগ।
  • কর : কর বলতে ঠিক কী ধরনের রাজস্ব বোঝায়, তা সুনিশ্চিত নয়। অনেকে জরুরি অবস্থায় বা বিশেষ পরিস্থিতিতে প্রজাদের উপর আরোপিত অতিরিক্ত রাজস্বকেই কর বলে শনাক্ত করেছেন। উৎপন্ন ফসলে রাজার সুনির্দিষ্ট ভাগ ছাড়াও প্রজাদের স্থাবর-অস্থাবর সামগ্রিক সম্পত্তির উপর এক বিশেষ রাজস্ব ধার্য হত। সম্ভবত এই অনিয়মিত ও অতিরিক্ত রাজস্বই কর।
  • হিরণ্য : হিরণ্য বলতে রাজা বা রাষ্ট্রকে নগদ অর্থে প্রদেয় রাজস্ব বোঝায়।

বেতনদান পদ্ধতি : কোনও কোনও ঐতিহাসিক অভিমত ব্যক্ত করেছেন, হর্ষবর্ধনের রাজত্ব কালে মন্ত্রী এবং রাজপুরুষগণ নগদ বেতন পেতেন না, জায়গির ভোগ করতেন। শুয়েন চাঙের একটি উক্তি এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়। তিনি বলেছেন, রাজ্যের মন্ত্রী ও রাজপুরুষদের নির্দিষ্ট ভূখণ্ড ছিল, তাদের অনুকূলে নগর প্রদান করা হত। শুয়েন চাঙের এ কথায় কোনও অভিনবত্ব নেই। পদস্থ রাজপুরুষদের নিষ্কর জমি এবং অধস্তন রাজপুরুষদের নগদ বেতনদানের রীতি প্রাচীনকাল থেকেই ভারতে প্রচলিত ছিল। পদস্থ রাজপুরুষদের পারিশ্রমিক হিসাবে মনু জায়গির দানের কথাই বলেছেন অথচ তার সময় অর্থাৎ কুষাণ রাজাদের আমলে মুদ্রার যথেষ্ট প্রচলন ছিল। কৌটিল্য যেমন নগদ বেতনদানের কথা বলেছেন, তেমনি জায়গির দানেরও উল্লেখ করেছেন। হর্ষবর্ধনের সময় কিছু সংখ্যক রাজপুরুষকে নগদ বেদন দেওয়া হত, এ ধারণা হয়তো অসংগত নয়।

নগরায়ণ : শুয়েন চাঙের বিবরণী থেকে জানা যায়, খ্রিস্টীয় ৭ম শতকের প্রথমার্ধে সিন্ধু ও গাঙ্গেয় অববাহিকা অঞ্চলের কয়েকটি নগরে তাদের পূর্ব গৌরবের কিছুই আর অবশিষ্ট ছিল না ; অধিবাসিগণ কর্তৃক পরিত্যক্ত হতে হতে নগরগুলো শেষে দস্যু ও শ্বাপদের আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়। অবক্ষয়ে দীর্ণ এই শহরগুলোর মধ্যে ছিল শাকল, কৌশাম্বী, শ্রাবস্তী, কপিলবস্তু, রামগ্রাম, কুশীনগর ও বৈশালীর মতো একদা বিখ্যাত সব নগর। দুর্বল রাষ্ট্রশক্তি ও বৌদ্ধধর্মের ক্রমাবনতির ফলেই হয়তো এ শহরগুলোর পতন আসন্ন হয়।

চিনা পরিব্রাজক আবার এ পর্বের কয়েকটি শহরের জনসম্পদ ও ঐশ্বর্যের উজ্জ্বল চিত্র একেছেন। গঙ্গাতীরবর্তী কান্যকুব্জ এ সময় উত্তর ভারতের এক শ্রেষ্ঠ শহররূপে আত্মপ্রকাশ করে। শহরটি দৈর্ঘ্যে ৮ কি. মি., প্রস্থে ২.৫ কি. মি.। শহরটিতে দশ হাজার শ্রমণ অধ্যুষিত ১০০টি বৌদ্ধবিহার আর ২০০টি দেবমন্দির ছিল। অত্যুচ্চ অট্টালিকার সারি, সুশোভিত উদ্যান ও স্বচ্ছ পুষ্করিণী সু-উচ্চ প্রাকারবেষ্টিত শহরটির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছিল। সুবেশ ও সুসজ্জিত নাগরিক ও অসংখ্য ধনাঢ্য ব্যক্তির সমাবেশে শহরটি সদাই প্রাণচঞ্চল ছিল। স্থাথ্বীশ্বর এ পর্বের একটি সমৃদ্ধ নগর। ১০০টি এই শহর ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্ররূপে বিরাজমান ছিল। বণিকদের কর্ম-চাঞ্চল্যে মুখরিত এই শহরটিতে দূর-দূরান্ত থেকে দুষ্প্রাপ্য পণ্যসামগ্রী আমদানি হত। বিজনোরের সন্নিকটবর্তী মতিপুর এ পর্বের এক কৃষিসমৃদ্ধ শহর। ময়ূর বা হরিদ্বার শহরটি তীর্থস্থানরূপে সর্বভারতীয় খ্যাতি অর্জন করে। বহু লোক এখানে বসবাস করতেন ; এখানকার পবিত্র সলিলে অবগাহনের জন্য দূরবর্তী অঞ্চল থেকে অসংখ্য পুণ্যার্থী এখানে সমবেত হতেন। রাজা ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদের বদান্যতায় নির্মিত বহু পুণ্যশালায় দরিদ্র ব্যক্তিদের আহার্য, বাসস্থান এবং চিকিৎসার সংস্থান হত। বর্তমান রামপুরপিলিডিতে অবস্থিত গোবিশন আর একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর। ঘনবসতিপূর্ণ এই শহরটিতে ৩০টি দেবায়তন প্রতিষ্ঠিত ছিল। পো-হি-মো-পু শহরটিতে প্রচুর লোকের বাস ছিল। এ শহরের বেশির ভাগ নাগরিকই ব্যবসা-বাণিজ্যে নিযুক্ত ছিলেন। কিউ-পি-সোয়াং-ন এ পর্বের আর একটি ঘনবসতিপূর্ণ শহর। বেরিলী জেলার অহিচ্ছত্র পূর্বের মতো এ পর্বেও ঘনবসতিপূর্ণ ছিল। এ পর্বের উল্লেখযোগ্য অন্যান্য শহর ও বন্দরগুলোর মধ্যে রয়েছে বারাণসী, পুণ্ড্রবর্ধন, কর্ণসুবর্ণ ও তাম্রলিপ্তি। তাম্র লিপ্তিতে ৫০টিরও বেশি দেবায়তন ছিল। বণিকেরা এই বন্দর থেকে বাণিজ্যপোতে চড়ে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ও চিন অভিমুখে যাত্রা করতেন। প্রত্নতত্ত্বের সাক্ষ্যেও এ পর্বীয় কয়েকটি শহরের গুরুত্ব সুপ্রমাণিত। উৎখননের ফলে অহিচ্ছত্রে তৎকালীন বহু সংখ্যক মৃৎপাত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে ; দিল্লির পুরাণকিলায় কুষাণ যুগ থেকে তুর্কিপর্ব পর্যন্ত অবিচ্ছিন্ন জনবসতির সুস্পষ্ট নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে; অত্রঞ্জিখেড়ায় গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর পর্বের অসংখ্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন প্রত্যক্ষীভূত হয়েছে; বারাণসীর সন্নিকটবর্তী রাজ ঘাটে ৩০০-১২০০ খ্রিস্টাব্দকালীন প্রত্নাবশেষ সংখ্যায় ও বৈচিত্র্যে নিঃসন্দেহে আকর্ষণীয়; নৈনিতাল জেলার কাশীপুর গ্রামে খ্রিস্টীয় ৭ম-৮ম শতকীয় বহু বিশাল দেবায়তনের অবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে।

ধর্মীয় জীবন

পুষ্যভূতি রাজাদের ধর্মমত : বেশির ভাগ পুষ্যভূতি রাজা ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বী ছিলেন। হর্ষচরিতে এই বংশের আদি পুরুষ পুষ্পভূতি বা পুষ্যভূতিকে মাহেশ্বর বা শৈবরূপে আখ্যাত করা হয়েছে। রাজ্যবর্ধন ও তার পুত্র আদিত্যবর্ধন ছিলেন সূর্যের উপাসক। প্রভাকরবর্ধন বাঁশখেড়া ও মধুবন তাম্রশাসনে ‘পরম-আদিত্যভক্ত’রূপে বর্ণিত হয়েছেন। হর্ষবর্ধন প্রথম জীবনে শৈব ছিলেন। তার বাঁশখেড়া এবং মধুবন তাম্রশাসনে তাকে পরম-মাহেশ্বর অর্থাৎ মহেশ্বর বা শিবের পরম ভক্তরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। জীবনের পরবর্তী পর্যায়ে হর্ষবর্ধন বৌদ্ধধর্মের প্রতি অনুরক্ত হন এবং বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হন। সম্ভবত চিনা শ্রমণ শুয়েন চাঙের অনুপ্রেরণায় তিনি বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হন। হর্ষবর্ধনের জ্যেষ্ঠভ্রাতা ছিলেন। রাজ্যবর্ধনও ধর্মমতে বৌদ্ধ।

শৈবধর্ম : খ্রিস্টীয় ৭ম শতকের প্রথমার্ধে উত্তর ভারতে শৈবধর্ম সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ধর্মরূপে প্রতিষ্ঠিত ছিল। স্থান্বীশ্বর, উজ্জয়িনী ও হরিদ্বার এ পর্বের কয়েকটি বিখ্যাত শৈব তীর্থক্ষেত্র। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পুণ্যার্থীরা এখানে সমবেত হতেন; স্নান-পূজা-অর্চনা করে পুণ্যার্জন করতেন। শুয়েন চাঙ বারাণসী শহরে দশ হাজার সন্ন্যাসীর অবস্থান লক্ষ করেছেন; বেশির ভাগ সন্ন্যাসী ছিলেন শৈব সাধক। শৈব সাধকদের কেউ মুণ্ডিতকেশ, কেউ জটাধারী, কেউবা নগ্নদেহী, আবার কারোর সর্বাঙ্গ ভস্মাচ্ছাদিত। অহিচ্ছত্র শহরে তিন শত পাশুপত আচার্যের উপস্থিতির উল্লেখ করেছেন চিনা শ্রমণ। গন্ধার পরিভ্রমণকালে তিনি ভীমাদেবী পর্বতের সানুদেশে এক শিবমন্দির লক্ষ করেন। সেই মন্দিরে ভস্মাচ্ছাদিত পাশুপত সাধকেরা তপশ্চর্যা ও পূজা-অর্চনায় রত ছিলেন। মালব অঞ্চলেও শৈবধর্ম জনপ্রিয় ছিল। এ অঞ্চলে তিনি শতাধিক শিবমন্দির দর্শন করেন। আফগানিস্তানের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে ও মধ্য এশিয়ার খোটানেও শুয়েন চাঙ পাশুপত তথা শৈবধর্মের বিস্তার লক্ষ করেছেন। উজ্জয়িনী নগরীর সুবিখ্যাত মহাকাল মন্দিরের উল্লেখ আছে বাণভট্টের কাদম্বরীতে। এই মন্দিরে নিয়মিত মহাভারত পাঠ হত। কাদম্বরীতে লালবস্ত্র পরিহিত পাশুপত আচার্যদের উল্লেখ আছে। তাদের রক্তপটও বলা হত। শৈব সম্প্রদায়ভুক্ত পাশুপতদের মতে পরমাত্মা এবং জীবাত্মা দু’টি পৃথক সত্তা। জীব মুক্ত অবস্থায় অজ্ঞান ও দৌর্বল্যের পাশ ছিন্ন – করে অসীম জ্ঞান ও ক্রিয়াশক্তির অধিকারী হয় এবং ঈশ্বরের অনুগ্রহে মহাদেবের মহাগণপতিত্ব লাভ করে।

খ্রিস্টীয় ৭ম শতকীয় নির্মন্দ তাম্রশাসনে হিমাচলপ্রদেশের কাংড়া জেলায় অবস্থিত নির্মন্দ অগ্রহারে কপালেশ্বর শিবমন্দিরে পূজা-অর্চনারত একদল অথর্ববেদাধ্যায়ী ব্রাহ্মণ পুরোহিতের উল্লেখ আছে। এই ব্রাহ্মণ পূজারিগণ সম্ভবত কাপালিক সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। অতিমার্গিক কাপালিকগণ নরকপালে খাদ্য গ্রহণ করতেন, মৃতদেহের ভস্মে সর্বাঙ্গ লেপন করতেন, দণ্ড ধারণ করতেন এবং একপাত্র কারণ বা মদ সঙ্গে রেখে তাতে অধিষ্ঠিত ঈশ্বরকে পূজা নিবেদন করতেন। তারা নরবলি ও নররক্তের অর্থে দেবতার তুষ্টিসাধন করতেন।

ব্রহ্মা : ব্রাহ্মণ্য ধর্মশাস্ত্রে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তারূপে ব্রহ্মার পরিচয়। কাদম্বরী কাব্যের প্রারম্ভে বাণভট্ট ব্রহ্মা, শিব ও বিষ্ণুর উদ্দেশে প্রণতি জ্ঞাপন করেছেন। এ পর্বে ব্রহ্মার পূজা প্রচলিত ছিল কিন্তু তা জনপ্রিয়তা অর্জন করেনি।

সূর্য : পুষ্যভূতি রাজাদের অনেকে আদিত্যভক্ত ছিলেন। প্রভাকরবর্ধনের প্রাত্যহিক সূর্যবন্দনার উল্লেখ আছে হর্ষচরিতে। মুলতানের সুবিখ্যাত সূর্যমন্দিরের উল্লেখ করেছেন শুয়েন চাঙ। ভারতে সূর্যোপাসনার প্রসারে মগ ব্রাহ্মণদের যথেষ্ট অবদান ছিল। মগ ব্রাহ্মণেরা পারস্য থেকে এদেশে আগমন করেন।

শক্তিপূজা : কাদম্বরীতে এক মহিষাসুরমর্দিনী চণ্ডিকা মন্দিরের বর্ণনা আছে। মন্দিরটি মহাটবীতে অবস্থিত ছিল। মন্দিরের গর্ভগৃহ অন্ধকারময়, গর্ভগৃহে প্রতিষ্ঠিত দেবীমূর্তির গণ্ডদেশে বালমুণ্ডমালা। মন্দিরের পূজারি ছিলেন এক দক্ষিণ ভারতীয় বৃদ্ধ। তার দেহ শীর্ণ, সর্বাঙ্গে ব্রণ ও ফোঁড়া, শরীর দুর্গন্ধময়। বিন্ধ্যাঞ্চলবাসী শবরজাতির উপাস্য দেবীরূপে ভগবতী চণ্ডিকার উল্লেখ আছে কাদম্বরীতে। এই কাব্যে বলা হয়েছে, দেবীর সন্তোষ বিধানের জন্য নরবলি প্রদান করা হত। শুয়েন চাঙ তৎকালীন শক্তিপূজা সম্পর্কে একটি মূল্যবান তথ্য পরিবেশন করেছেন। তিনি গন্ধারে অবস্থিত ভীমাদেবী নামে একটি পর্বতের উল্লেখ করেছেন। পর্বতটির এরূপ নামকরণে প্রতীয়মান হয়, পর্বতটি জনসমাজে শিবের শক্তি ভীমার প্রতীকরূপে পরিচিত ছিল। অর্থাৎ, শুয়েন চাঙের বর্ণনায় খ্রিস্টীয় ৭ম শতকে গন্ধার অঞ্চলে শক্তির এক স্বয়ম্ভূমূর্তির অস্তিত্ব আভাসিত হয়েছে।

জৈনধর্ম : শুয়েন চাঙ বৈশালী, পুণ্ড্রবর্ধন, সমতট ও কলিঙ্গে বহু সংখ্যক দিগম্বর জৈন সাধুর অবস্থানের কথা বলেছেন; তিনি তক্ষশিলার সন্নিকটবর্তী সিংহপুরে একটি স্থান নির্দেশ করে। বলেছেন, স্থানটি শ্বেতাম্বর জৈনদের নিকট পবিত্র ছিল। বাণভট্টের হর্ষচরিত ও দণ্ডীর দশকুমার চরিতে জৈনদের প্রতি বিরূপ মনোভাবের অভিব্যক্তি ঘটেছে।

বৌদ্ধধর্ম : খ্রিস্টীয় ৭ম শতকের প্রথমার্ধে উত্তর ভারতের বৌদ্ধধর্মের একটি চিত্র অঙ্কন করেছেন শুয়েন চাঙ তার ভারত-বৃত্তান্তে। সে সময় উত্তর ভারতের বিভিন্ন স্থানে বহু বৌদ্ধ সংঘারাম বা বিহার প্রতিষ্ঠিত ছিল। তার পরিদর্শিত বিভিন্ন স্থানের সংঘারাম ও বৌদ্ধশ্রমণদের সংখ্যা ও শাখার নামও তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন তার বৃত্তান্তে। তিনি কুলুতে ৪টি বৌদ্ধবিহার ও সহস্রাধিক শ্রমণ, অহিচ্ছত্রে ১০টি বিহার ও সহস্রাধিক হীনযানী ভিক্ষু, সঙ্কাশ্যে ৪টি বিহার ও সাম্মিতীয় সম্প্রদায়ভুক্ত সহস্রাধিক শ্রমণ, কান্যকুব্জে ১০টি বিহার ও দশ সহস্রাধিক হীনযানী এবং মহাযানী শ্রমণ, অযোধ্যায় ১০০টি বিহার ও তিন সহস্র হীনযানী এবং মহাযানী শ্রমণ, বারাণসীতে ৩০টি বিহার ও তিন সহস্র সাম্মিতীয় শ্রমণ, মুঙ্গেরে ১০টি বিহার ও চার সহস্র শ্রমণ, পুণ্ড্রবর্ধনে ২০টি বিহার ও তিন সহস্র মহাযানী শ্রমণ, সমতটে ৩০টি বিহার ও দ্বিসহস্র স্থবিরবাদী শ্রমণ ও কর্ণসুবর্ণে দশাধিক বিহার এবং দ্বিসহস্র সাম্মিতীয় শ্রমণের অবস্থান লক্ষ করেছেন। তিনি লক্ষ করেছেন, কাশ্মীর, স্থাথ্বীশ্বর, শ্রুঘ্ন, প্রয়াগ ও কৌশাম্বীতে হীনযানবাদ, বিশেষত সর্বাস্তিবাদ সুপ্রতিষ্ঠিত ; কাপিশ, জালন্ধর, মথুরা, অযোধ্যা, নেপাল, পুণ্ড্রবর্ধন, কোঙ্কণপুর ও মহারাষ্ট্র অঞ্চলে হীনযান ও মহাযানের সহাবস্থান আর তক্ষশিলা, কুলুত, মগধ, ওড়িশা ও বিদর্ভে মহাযানবাদের প্রাধান্য। চিনা শ্রমণের বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কিত বর্ণনায় তিনটি জিনিস লক্ষ করবার মতো –

  • এক, তিনি বেশ কয়েকটি বৌদ্ধ সংঘারামের উল্লেখ করেছেন যেখানে হীনযানী ও মহাযানী শ্রমণেরা একসঙ্গে বসবাস করতেন। এ থেকে বোঝা যায়, উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা সত্ত্বেও তারা জীবনচর্যায় কয়েকটি সাধারণ নিয়ম মেনে চলতেন।
  • দুই, তিনি বোধগয়ার মহাবোধি বিহারে অবস্থানরত শ্রমণদের স্থবিরবাদী মহাযানী শ্রমণরূপে বর্ণনা করেছেন। কলিঙ্গ, শ্রীলঙ্কার অভয়গিরি সংঘারাম ও সুরাষ্ট্রের শ্রমণদের সম্পর্কেও তিনি অনুরূপ উক্তি করেছেন। স্থবিরবাদীরা হীনযান সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। মহাযানী শ্রমণেরা হীনযানী রূপে বর্ণিত হন কীরূপে? মনে হয়, এসব শ্রমণ মহাযানপন্থী ছিলেন কিন্তু তারা হীনযান-বিনয় অনুসরণ করতেন।
  • তিন, শুয়েন চাঙ বৌদ্ধশ্রমণদের শোভাযাত্রা সহকারে পথ পরিক্রমার বর্ণনা করেছেন। বুদ্ধদেবের সুসজ্জিত মূর্তি সামনে রেখে এই শোভাযাত্রা বের হত। শোভাযাত্রা শুরু হত শ্রাবণ মাসের প্রথমা তিথিতে, শেষ হত চতুর্দশীতে।

শুয়েন চাঙ বৌদ্ধধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব ও জনপ্রিয়তার যত কথাই বলুন না কেন, বৌদ্ধধর্মের ক্রমাবনতির চিত্র তার বৃত্তান্তে সুনিশ্চিতরূপে ধরা পড়েছে। গন্ধার, উদ্যান ও তক্ষশিলায় যেসব বৌদ্ধবিহার তিনি পরিদর্শন করেছেন, তাদের বেশির ভাগই ছিল জীর্ণদশাপ্রাপ্ত ও পরিত্যক্তপ্রায়। সেসব অঞ্চলের জনসংখ্যার সিংহভাগই ছিল ব্রাহ্মণ্যধর্মাবলম্বী। বৌদ্ধসংস্কৃতির পীঠস্থানরূপে একদা পরিচিত শ্রাবস্তী ও বৈশালীর বৌদ্ধ সংঘারামগুলোও ছিল হীনপ্রভ, বিগতশ্রী। গণসংযোগ থেকে বৌদ্ধধর্ম যেন ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিল। বৌদ্ধধর্মের পুনরুজ্জীবনে হর্ষবর্ধন আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হন। কিন্তু সে প্রয়াস বিশেষ ফলপ্রসূ হয়নি।

হর্ষবর্ধন ও বৌদ্ধধর্ম : বৌদ্ধধর্মের প্রতি হর্ষের অনুরাগ ও বৌদ্ধধর্মের উন্নতিকল্পে তার কার্য কলাপের বিশদ বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছেন শুয়েন চাঙ তার বৃত্তান্তে।

প্রয়াগ-সমারোহ : চিনা শ্রমণের বিবরণে প্রকাশ, হর্ষবর্ধন পাঁচ বৎসর অন্তর গঙ্গা ও যমুনার সঙ্গমস্থল প্রয়াগে সারাদিনব্যাপী এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। এই অনুষ্ঠানে তিনি পাঁচ বৎসরে সঞ্চিত সমুদয় সম্পদ একদিনে বিতরণ করতেন। অনুষ্ঠানের প্রারম্ভেই তিনি বুদ্ধমূর্তি এবং স্থানীয় ও দূর-দূরান্ত থেকে সমবেত বৌদ্ধশ্রমণদের অনুকূলে মহামূল্য মণিরত্ন ও বিবিধ দানসামগ্রী অকৃপণ হস্তে দান করতেন। বৌদ্ধশ্রমণদের আপ্যায়নের পর তিনি অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অপরাপর ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিবর্গ ও দীনদরিদ্রদের বিবিধ উপহারদানে সম্মানিত করতেন। হর্ষের এই অকৃপণ দানের ফলে সরকারি ও রাজার ব্যক্তিগত ধনদৌলত সবই নিঃশেষ হত। কিন্তু দশ দিনের মধ্যেই বশীভূত মিত্র রাজাদের পাঠানো উপঢৌকনে নিঃশেষিত রাজকোষ আবার ধনসম্পদে পূর্ণ হয়ে উঠত। শুয়েন চাঙের এই বর্ণনা সত্য হলে বুঝতে হবে, প্রয়াগ অনুষ্ঠানের দানকার্যে হর্ষবর্ধন সমদর্শিতার পরিচয় দেননি। বৌদ্ধদের প্রতি তিনি অধিকতর সহানুভূতিশীল ছিলেন। দ্বিতীয়ত, রাজকোষের সমুদয় অর্থ নিঃশেষ করে তিনি হয়তো দানের মাহাত্ম্য প্রদর্শন করেছেন কিন্তু রাষ্ট্রের কর্ণধাররূপে বিচক্ষণতা বা দূরদর্শিতার পরিচয় দেননি।

কান্যকুব্জ-ধর্মসম্মেলন : শুয়েন চাঙ রাজধানী কান্যকুব্জে অনুষ্ঠিত হর্ষবর্ধনের আয়োজিত এক ধর্মসম্মেলনের চিত্তাকর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন। এই সম্মেলনে কামরূপরাজ ভাস্করবর্মা অংশগ্রহণ করেন, যোগদান করেন আরও ১৮ বা ২০ জন বশীভূত মিত্ররাজ। এই সম্মেলন উপলক্ষে ৩১ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট একটি সৌধ নির্মিত হয় ; রাজার সমান দৈর্ঘ্যের একটি স্বর্ণময় বুদ্ধমূর্তি নির্মাণ করে তা সৌধের অভ্যন্তরে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। প্রতিদিন হর্ষবর্ধন বুদ্ধের এক ক্ষুদ্রাকৃতি স্বর্ণমূর্তি সুসজ্জিত হস্তিপৃষ্ঠে স্থাপন করে পাত্র-মিত্র সমভিব্যহারে শোভাযাত্রায় বহির্গত হতেন। মূর্তির বাঁদিকে থাকতেন হর্ষ। তিনি ইন্দ্রের বেশে সজ্জিত হতেন, তার হাতে থাকত ছত্র। মূর্তির দক্ষিণে অবস্থান করতেন ভাস্করবর্মা। তিনি ব্রহ্মার বেশে সজ্জিত হতেন, তিনি হাতে ধারণ করতেন এক শ্বেতশুভ্র চামর। শোভাযাত্রা নির্দিষ্ট এক বেদিতে পৌঁছত। হর্ষ প্রথমে সুগন্ধিজলে বুদ্ধমূর্তিটিকে স্নান করাতেন, তারপর মূর্তিটি স্কন্ধদেশে বহন করে তিনি সদলে সেই নবনির্মিত সৌধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতেন। সেখানে পৌঁছে বুদ্ধমূর্তিকে রত্নখচিত শত-সহস্র রেশমবস্ত্র নিবেদন করতেন। মূর্তিপূজা সমাপ্ত হলে সকলে ভূরিভোজে আপ্যায়িত হতেন। তারপর বসত আলোচনাসভা। উপস্থিত রাজন্যবর্গ ও বিভিন্ন ধর্মের প্রবক্তরা সে আলোচনায় যোগ দেবেন, এই ব্যবস্থাই ছিল। কথা ছিল, সে আলোচনা সন্ধ্যা পর্যন্ত চলবে এবং আলোচনা শেষে সকলে নিজ নিজ স্থানে প্রস্থান করবেন। দীর্ঘ ২১ দিন ধরে এই কর্মসূচি অনুসৃত হবে, এমনই ব্যবস্থা ছিল।

হর্ষবর্ধন শুয়েন চাঙকে আলোচনাসভার সভাপতিরূপে মনোনীত করেন। আলোচনাসভায় যোগদানের জন্য তিনি বহু রাজা ও তাদের মন্ত্রীদের আমন্ত্রণ জানান। আমন্ত্রিত হন এক হাজার বিখ্যাত বৌদ্ধশ্রমণ, পাঁচ শত ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য ধর্মসম্প্রদায়ের প্রতিনিধিবর্গ। সভাপতি শুয়েন চাঙ আলোচনার জন্য একটি বিষয় নির্বাচিত করে সদর্পে ঘোষণা করেন, যিনি তার যুক্তিতর্ককে খণ্ডন করবেন, তাকে তিনি নিজের মুণ্ড উপহার দেবেন। পাঁচ দিন অতিক্রান্ত হল তবু কেউ তার যুক্তিকে নস্যাৎ করতে এগিয়ে এলেন না। তখন হীনযানীরা শুয়েন চাঙকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেন। ক্রুদ্ধ হর্ষ ঘোষণা করেন, যিনি চিনা শ্রমণের কোনও ক্ষতি করবেন বা তার গাত্র স্পর্শ করবেন, তাকে তৎক্ষণাৎ মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। তিনি আরও ঘোষণা করেন, চিনা শ্রমণের বিরুদ্ধে কোনও কথা উচ্চারিত হলে বক্তার জিহবা কেটে ফেলা হবে। এই ঘোষণার পর কেউই আর শুয়েন চাঙের সঙ্গে বিতর্কে অগ্রসর হলেন না। বিধর্মীরা ক্ষুব্ধ ছিলেন। তাদের ক্ষোভের কারণ ছিল। হর্ষ নাকি বৌদ্ধদেরই দান-ধ্যান করতেন কিন্তু তাদের সংস্রব এড়িয়ে চলতেন। তারা হর্ষকে হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। অনুষ্ঠানের সমাপ্তির দিন সৌধে আগুন লাগে। চতুর্দিকে বিশৃঙ্খলা। এমন সময় এক ব্যক্তি ছুরিকাহাতে হর্ষের দিকে ধেয়ে যান কিন্তু রক্ষীরা তাকে ধরে ফেলেন। তিনি স্বীকার করেন, বিধর্মীরা রাজাকে হত্যার কাজে তাকে নিযুক্ত করেছেন, বিধর্মীরাই সৌধে আগুন লাগিয়েছেন। সভায় উপস্থিত পাঁচ শত ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেল, বৌদ্ধশ্রমণদের প্রতি ঈর্ষাবশে তারাই রাজাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছেন। পাঁচ শত ব্রাহ্মণকে রাজ্য হতে বহিষ্কৃত করা হয়। এভাবেই কান্যকুব্জ ধর্মসম্মেলনের পরিসমাপ্তি হয়।

কান্যকুব্জ ধর্মসম্মেলন উপলক্ষে শুয়েন চাঙ তার পৃষ্ঠপোষকের যে চিত্র অঙ্কিত করেছেন তাতে কিন্তু হর্ষবর্ধনের চারিত্রিক দুর্বলতাই প্রকাশ পেয়েছে। এ হর্ষ সমদর্শী হর্ষ নন, বৌদ্ধধর্মের অন্ধ অনুরাগী এক হর্ষ। এ হর্ষ নিরপেক্ষ, গুণগ্রাহী হর্ষ নন, তিনি ব্যক্তিপূজারি হর্ষ। শুয়েন চাঙের প্রতি তার অচলা ভক্তি। শুয়েন চাঙের বিরুদ্ধে যিনি কোনও কথা বলবেন, তিনি তার জিহ্বা কর্তন করবেন। তিনি আলোচনার জন্য সভা ডাকলেন অথচ বাদ-প্রতিবাদের পথ অবরুদ্ধ করলেন। ব্রাহ্মণ্যদেবতা ইন্দ্রের বেশে বুদ্ধমূর্তি বহন করে তিনি কার্যত ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করেছেন। শুয়েন চাঙ এ কোন্ হর্ষবর্ধনের চিত্র অঙ্কন করলেন? এ হর্ষবর্ধন তো এক ধর্মান্ধ, অপরিণামদর্শী ব্যক্তিত্ব। চিনা শ্রমণ বাস্তব ঘটনাকে বিকৃত করেননি তো?

ওড়িশায় মহাযান বৌদ্ধধর্মের প্রসারে হর্ষের ভূমিকা : শুয়েন চাঙের বর্ণনায় প্রকাশ, ওড়িশায় হীনযান মতবাদ জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় হর্ষবর্ধন শঙ্কিত হন। তার অনুরোধে অধ্যক্ষ শীলভদ্র, সাগরমতি, প্রজ্ঞারশ্মি, সিংহরশ্মি ও শুয়েন চাঙের মতো প্রখ্যাত বৌদ্ধাচার্যরা ওড়িশায় মহাযানবাদ প্রচার করেন।

ভাষা ও সাহিত্য

এ পর্বে সংস্কৃত সাহিত্যের অগ্রগতি সবিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। হর্ষবর্ধন শুধু সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকই ছিলেন না, তিনি নিজেও সুসাহিত্যিক ছিলেন। তার রচিত তিনখানি নাটক ‘রত্নাবলী’, ‘প্রিয়দর্শিকা’ ও ‘নাগানন্দ’। চার অঙ্কের নাটক রত্নাবলী তার শ্রেষ্ঠ রচনা। কৌশাম্বীর রাজা উদয়ন ও সিংহলের রাজকন্যা রত্নাবলীর মিলন এ নাটকের উপজীব্য বিষয়। চতুরস্ক নাটিকা ‘প্রিয়দর্শিকা’-র নায়কও কৌশাম্বীরাজ উদয়ন। অঙ্গনৃপতি দৃঢ়বর্মার কন্যা প্রিয়দর্শিকার সঙ্গে তার প্রণয়কে কেন্দ্র করে নাটিকার ঘটনাপ্রবাহ আবর্তিত। ‘নাগানন্দ’ পঞ্চমাঙ্ক নাটক। রাজপুত্র জীমূতবাহনের আত্মত্যাগ ও পরিশেষে দেবী দুর্গার বরে তার পুনর্জীবন লাভ এ নাটকের মূল বিষয়। এই মূল কাহিনির সঙ্গে সঙ্গে জিমূতবাহন এবং মলয়বর্তীর প্রণয়কে উপজীব্য করে আর একটি কাহিনিও বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু কাহিনি দু’টি সুসমন্বিত হয়নি। উপ কাহিনিটি মূল কাহিনির পক্ষে অপরিহার্য নয়। নাটকগুলোর চরিত্রচিত্রণে হর্ষবর্ধন মৌলিকতার পরিচয় দেননি। তার চিত্রিত উদয়ন, বাসবদত্তা, রত্নাবলী, প্রিয়দর্শিকা, বসন্তক, যৌগন্ধরায়ণ প্রমুখের চরিত্র নিতান্তই গতানুগতিক। কিন্তু নাটকগুলোর ভাষা প্রাঞ্জল এবং সুন্দর। স্টেন কোনো, উইন্টারনিৎস ও সিলভ্যা লেভির মতো বিদগ্ধজনেরা মনে করেন, এ নাটকগুলো হর্ষবর্ধন রচনা করেননি, রচনা করেছেন তারই অনুগ্রহভাজন বাণভট্ট। হর্ষ সংস্কৃতে কয়েকটি বৌদ্ধস্তোত্রও রচনা করেন। তার রচিত বৌদ্ধস্তোত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘সুপ্রভাতস্তোত্র’ এবং ‘অষ্টমহাশ্রীচৈত্য সংস্কারস্তোত্র’।

এ পর্বের সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্যকার বাণভট্ট। হর্ষবর্ধনের সভাকবি তিনি। চিত্রভানু ও রাজ্যদেবীর পুত্র বাণ অল্পবয়সে পিতা-মাতাকে হারিয়ে গৃহত্যাগ করেন ও বিপথগামী বন্ধুজনের সংসর্গে পড়েন। বহুদিন নানা স্থানে পরিভ্রমণ করে তিনি অবশেষে গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। প্রতিভাবান, বুদ্ধিদীপ্ত এই যুবকের প্রতি হর্ষবর্ধনের সস্নেহ দৃষ্টি ছিল। তিনি একদিন বাণভট্টকে রাজসভায় ডেকে পাঠান ও মৃদু ভর্ৎসনার পর তাকে সাদরে আশ্রয় প্রদান করেন। কালঃক্রমে সুকবিরূপে বাণভট্ট সর্ব ভারতীয় খ্যাতি অর্জন করেন।

বাণের লেখা ‘হর্ষচরিত’ একখানি গদ্য কাব্য। সংস্কৃত সাহিত্যে কাব্য বলতে শুধু ছন্দো বদ্ধ বাক্য বা কবিতা বোঝায় না, গদ্য রচনাও কাব্য। তবে এই গদ্য রচনা রসাত্মক হতে হবে। ‘সাহিত্যদর্পণ’-প্রণেতা বিশ্বনাথ বলেন, ‘বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম্‌’ অর্থাৎ যে বাক্যে রস আছে, তাই কাব্য। ‘হর্ষচরিত’ আখ্যায়িকা কাব্য। ঐতিহাসিক ঘটনা অবলম্বনে রচিত গদ্য কাব্যই আখ্যায়িকা। সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনা অবলম্বনে বাণভট্ট ‘হর্ষচরিত’ কাব্য রচনা করেন। কিন্তু ইতিহাস রচনা বাণের উদ্দেশ্য ছিল না, ঐতিহাসিক তথ্য ও কবিকল্পনার সমন্বয়ে বিদগ্ধজনের উপভোগ্য এক চিত্তাকর্ষক কাব্য প্রণয়নে তিনি উদ্বুদ্ধ ছিলেন।

‘হর্ষচরিত’ কাব্যখানি আটটি ‘উচ্ছ্বাস’ বা অধ্যায়ে বিভক্ত। উল্লিখিত উচ্ছ্বাসগুলোতে বাণের আত্মপরিচয়, পুষ্যভূতি বংশের উদ্ভব, প্রভাকরবর্ধনের যুদ্ধ-বিগ্রহ, মালবরাজের হস্তে মৌখরিনৃপতি গ্রহবর্মার মৃত্যু, গৌড়রাজের হস্তে রাজ্যবর্ধনের নিধন, গৌড়েশ্বরের বিরুদ্ধে হর্ষের যুদ্ধযাত্রা, কামরূপরাজ ভাস্করবর্মার সঙ্গে হর্ষের বন্ধুত্ব স্থাপন, বিন্ধ্যপর্বতে মরণোন্মুখী রাজ্যশ্রীকে হর্ষের উদ্ধার ইত্যাদি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। রাজ্যশ্রীর উদ্ধার প্রসঙ্গে একটি আসন্ন রাত্রির বর্ণনার মধ্য দিয়ে গ্রন্থখানির পরিসমাপ্তি ঘটেছে।

বাণভট্টের রচিত আর একখানি কাব্য ‘কাদম্বরী’। ‘কাদম্বরী’ কথাকাব্য। কথাকাব্যের আধার কবির কল্পলোক। বাণভট্ট কাদম্বরীর পূর্বভাগ রচনা করেন, উত্তরভাগ রচনা করেন তার পুত্র পুলিন্দ বা ভূষণভট্ট। উজ্জয়িনীর রাজা চন্দ্রাপীড় ও গন্ধর্ব রাজকুমারী কাদম্বরীর তিন জন্মের প্রণয়কাহিনি এ কাব্যের প্রতিপাদ্য বিষয়। মূল কাহিনির পাশাপাশি পুণ্ড্ররীক ও মহাশ্বেতার প্রেমোপাখ্যানও এ কাব্যে বর্ণিত হয়েছে। মহাশ্বেতার প্রণয়ক্লিষ্ট পুণ্ডরিকের অভিশাপে চন্দ্রমা মর্তে চন্দ্রাপীড়রূপে জন্মগ্রহণ করেন এবং গন্ধর্ব রাজকুমারী কাদম্বরীর প্রেমাসক্ত হন। আবার চন্দ্রদেবতার অভিশাপে পুণ্ডরীক চন্দ্রাপীড়ের সখা বৈশম্পায়ন রূপে জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমান জন্মে চন্দ্রাপীড় বিদিশার রাজা শূদ্রক ও বৈশম্পায়ন শুকপক্ষী রূপে আবির্ভূত হন। পরিশেষে চন্দ্রাপীড় ও কাদম্বরী এবং পুণ্ডরীক ও মহাশ্বেতার পুনর্মিলনের মধ্য দিয়ে কাব্যখানি সমাপ্ত হয়েছে।

অনেকে ‘কাদম্বরী’ তথা বাণের কাব্যকে দুর্গম অরণ্যের সঙ্গে তুলনা করেন। (পরবর্তী কালে বাণের ‘কাদম্বরী’-র অনুকরণে গদ্যে ও পদ্যে বহু গ্রন্থ রচিত হয়। অভিনন্দের ‘কাদম্বরী কথাসার’, ক্ষেমেন্দ্রের ‘পদ্য-কাদম্বরী’, বিক্রমদেবের ‘কাদম্বরী-কথাসার’, ত্র্যম্বকের ‘কাদম্বরী-কথাসার’ ও ঢুণ্ডীরাজের ‘অভিনব-কাদম্বরী’ এ প্রসঙ্গে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।) দুর্গম অরণ্য লতা-পাতা-গুল্মাদিতে সমাকীর্ণ। সে অরণ্য মানুষের অগম্য। তেমনি বাণের কাব্যে রয়েছে দুরূহ শব্দের প্রয়োগ ও দীর্ঘ সমাসবদ্ধ পদের ব্যবহার। কাব্যকার যেন নিজের পাণ্ডিত্য প্রকাশে ব্যগ্র। এ কাব্যে লোকের মনোরঞ্জন হয় না, আসে ক্লান্তি ও বিরক্তি। কিন্তু বাণের বিরুদ্ধে এ ধরনের বক্তব্যে তার প্রতি অবিচারই প্রতিফলিত হয়েছে। বাণ শুধু কঠিন ও সুদীর্ঘ পদই ব্যবহার করেননি, সরল পদ ও হ্রস্ব বাক্যের প্রয়োগেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন। শ্লেষাত্মক শব্দের ব্যবহারেও তিনি সুনিপুণ ছিলেন। বিন্ধ্যাটবী, জাবালি আশ্রম, অচ্ছোদ সরোবর ইত্যাদি প্রাকৃতিক দৃশ্য বর্ণনায় তিনি অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। বিস্ময়কর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে তিনি প্রণয়াসক্ত যুবক যুবতীজনের চিত্ত বিশ্লেষণ করেছেন। ‘বাণোচ্ছিষ্টং জগৎ সৰ্বম্’। এমন কোনও বিষয় নেই যা বাণের লেখনিতে প্রজ্বল হয়ে ওঠেনি। সংস্কৃত গদ্যসাহিত্য-সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র রাজচক্রবর্তী তিনি।

বাণেরই সমকালীন ময়ূর বা ময়ূরভট্ট। তিনি রচনা করেন ‘সূর্যশতক’। শোনা যায়, তিনি সম্পর্কে বাণের শ্বশুর বা শ্যালক ছিলেন। আনন্দবর্ধন ধ্বন্যালোকে এবং ক্ষেমেন্দ্র কবিকণ্ঠাভরণে ‘সূর্যশতক’ থেকে যথাক্রমে ২টি ও ১টি শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন। এ যুগের আর এক বিখ্যাত কান্যকার মাতঙ্গ দিবাকর। হর্ষের রাজসভার এক বিশিষ্ট রত্নরূপে তার উল্লেখ করেছেন ‘কাব্যমীমাংসা’ কার রাজশেখর।

উপসংহার

ভারত-ইতিহাসের এক শ্রেষ্ঠ নরপতি হর্ষবর্ধন। এক সংকটময় মুহূর্তে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন কিন্তু বাহুবল, দূরদর্শিতা ও অদম্য উদ্যমের সহায়তায় তিনি প্রতিকূল শক্তির বিরুদ্ধে জয়লাভ করেন এবং উত্তর ভারতের সুবিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে এক বিশাল সাম্রাজ্য গঠন করেন। শুধু সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাতারূপে নয়, সুশাসকরূপেও তিনি অশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। রাজপুরুষদের হাতে রাজ্য শাসনের ভার সমর্পণ করে তিনি নিশ্চেষ্ট ছিলেন না, প্রজাদের অবস্থা ও রাজপুরুষদের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে তিনি রাজ্য-পরিক্রমায় বহির্গত হতেন। সাহিত্যের অকৃত্রিম অনুরাগী ছিলেন তিনি। বাণভট্ট, ময়ূর, দিবাকর প্রভৃতি সে যুগের বিশিষ্ট কাব্যকারেরা তার পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছেন। তিনি নিজেও সুসাহিত্যিক ছিলেন। শুয়েন চাঙের বিবরণে তিনি মহাযান বৌদ্ধধর্মের অন্ধ অনুরাগী রূপে বর্ণিত হয়েছেন ঠিকই কিন্তু এ বর্ণনার বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে সংশয় রয়েছে। হর্ষবর্ধনের সহোদরা ও স্নেহধন্যা রাজ্যশ্রী হীনযান সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। চিনা বৃত্তান্ত থেকে জানা যায়, হর্ষবর্ধন মালবে একটি সংঘারাম প্রতিষ্ঠা করে সেখানে হীনযানী বৌদ্ধমূর্তি স্থাপন করেন। হর্ষবর্ধনের মতো প্রজাহিতব্রতী রাজা সমদর্শী হবেন, এই তো স্বাভাবিক। নাগানন্দ নাটকে রাজা জীমূতবাহন ঘোষণা করেছেন : “স্বশরীরমপি পরার্থে যঃ খলু দদ্যামযাচিতঃ কৃপয়া।/রাজ্যস্য কৃতে স কথং প্রাণিবধক্রৌৰ্যমনুমন্যে।”

দয়াপরবশে যিনি অযাচিতভাবে ও স্বেচ্ছায় পরার্থে নিজপ্রাণ বিসর্জনে উন্মুখ, জীবনহানির বিনিময়ে রাজ্যজয়ে তার কিসের প্রয়োজন? পরার্থে নিবেদিতপ্রাণ জীমূতবাহন তো হর্ষবর্ধনেরই কল্পনাসঞ্জাত এক চরিত্র। এই মহান চরিত্রের যিনি রূপকার, সমুন্নত মানবিক মূল্যবোধে তিনি উদ্বুদ্ধ । রাজা হর্ষবর্ধন এক অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব।

গ্রন্থপঞ্জি

  • দীনেশচন্দ্র সরকার : পাল-পূর্ব যুগের বংশানুচরিত (কলকাতা, ১৯৮৫)।
  • নীহাররঞ্জন রায় : বাঙ্গালীর ইতিহাস (কলকাতা, ১৯৯৩)।
  • Chattopadhyaya, S.: Early History Of North India (Calcutta, 1968).
  • Choudhury, P. C. : The History of The Civilization of The People of Assam (Gauhati, 1966).
  • Devahuti, D.: Harsha: A Political Study (New Delhi, 1998).
  • Jain, K. C : Madhya Pradesh. Through The Ages ( New Delhi, 1997).
  • Majumdar, R. C.: History Of Ancient Bengal (Calcutta, 1971).
  • Majumdar, R. C. (Ed): The Classical Age (Bombay, 1962); A Comprehensive His tory of India, III, Part I (New Delhi, 1981).
  • Mookerji, R. K.: Harsha (London, 1926).
  • Raychaudhuri, H. C.: Political History Of Ancient India (Calcutta, 1953).
  • Sen, B. C. : Some Historical Aspects Of The Inscriptions Of Bengal (Calcutta, 1942).
  • Sinha, B. P.: The Decline Of The Kingdom Of Magadha (Patna, 1954).
  • Srivastava, B. N.: Harsha And His Times (Varanasi, 1976).
  • Tripathy, R. S.: History Of Kanauj To The Moslem Conquest (Benares, 1932).

বঙ্গ, গৌড় ও সমতটের অভ্যুত্থান ও গৌড়েশ্বর শশাঙ্ক

বঙ্গ, গৌড় ও সমতটের অভ্যুত্থান

৫৪৩ খ্রিস্টাব্দেও উত্তর বঙ্গে গুপ্ত আধিপত্য বর্তমান ছিল। এর প্রায় দু’দশক পূর্বে পূর্ব ও দক্ষিণ বাংলায় গুপ্ত শাসন অবলুপ্ত হয়। লেখমালার সাক্ষ্যে এ অঞ্চলে গুপ্তোত্তর পর্বে কতিপয় স্বাধীন, সার্বভৌম রাজার অস্তিত্ব প্রমাণিত। তাঁদের মধ্যে গোপচন্দ্ৰ, ধর্মাদিত্য ও সমাচারদেবের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। তাঁরা সকলেই লেখমালা উৎকীর্ণ করেছেন, মহারাজাধিরাজ অভিধায় ভূষিত ছিলেন। তাঁদের একজন স্বর্ণমুদ্রাও প্রচলন করেছেন।

মহারাজাধিরাজ গোপচন্দ্র (আ. ৫২৫-৬০ খ্রিস্টাব্দ) : ইনি এই তিনজনের সকলের পূর্ববর্তী। তিনি গুপ্ত সম্রাট বৈন্যগুপ্তের প্রায় সমকালবর্তী ছিলেন। তাঁর মল্লসারুল অভিলেখে মহারাজ বিজয়সেন নামে এক পদস্থ রাজপুরুষের উল্লেখ আছে। এই বিজয়সেনকে মহারাজ বৈন্যগুপ্ত ৫০৮ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ তাঁর গুণাইঘর তাম্রশাসনের দূতকের কাজে নিযুক্ত করেন। অনুমিত হয়, মহারাজাধিরাজ গোপচন্দ্র আনুমানিক ৫২৫ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব ও দক্ষিণ বাংলায় এক স্বাধীন গৌড়রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। গোপচন্দ্র একজন শক্তিমান নরপতি ছিলেন। তিনি অন্তত ৩৩ বৎসর রাজত্ব করেন।  রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন, মৌখরিনৃপতি ঈশানবর্মা তাঁর হরাহা অভিলেখে যে গৌড় রাজশক্তির বিরুদ্ধে বিজয়লাভের দাবি করেছেন, তিনি সম্ভবত গোপচন্দ্ৰ, আর এই অভিমতটি সমর্থনযোগ্য। তার অধিকৃত অঞ্চলগুলো –

  • তাঁর রাজত্বের ১ম রাজ্যবর্ষে উৎকীর্ণ ওড়িশার বালেশ্বর জেলায় সম্প্রদত্ত জয়রামপুর তাম্রশাসন থেকে জানা যায়, দণ্ডভুক্তিমণ্ডল অর্থাৎ দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলা এবং ওড়িশার বালেশ্বর অঞ্চল তাঁর রাজ্যভুক্ত ছিল।
  • তাঁর রাজত্বের ১৮শ বা ১৯শ বছরে ফরিদপুর জেলার কোটালিপাড়া গ্রামে উৎকীর্ণ তাম্রশাসনে বলা হয়েছে, নাব্য-অবকাশিকা তাঁর রাজ্যভুক্ত ছিল। নাব্য অর্থ নৌকাযানের দ্বারা অধিগম্য, অর্থাৎ নামটি অসংখ্য নদী-নালা প্রবাহিত দক্ষিণ বঙ্গের সাথে সম্পর্কিত হয়ে থাকবে। তাই এটি পূর্ব বাংলায় তাঁর অধিকার বিস্তারের সপক্ষে প্রমাণ দেয়।
  • তাঁর মল্লসারুল অভিলেখে বর্ণিত হয়েছে বর্ধমান-ভুক্তি বা পশ্চিম বঙ্গ তাঁর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
  • রমেশচন্দ্র মজুমদার গোপচন্দ্রদের রাজ্যটিকে বঙ্গ বলে অভিহিত করেছেন। (The Classical Age ( Bombay, 1962), পৃষ্ঠা ৭১।) কিন্তু সমকালীন হরাহা লেখে গোপচন্দ্রদের প্রকারান্তরে গৌড় বলা হয়েছে। পশ্চিম বাংলার এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল এই রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। হয়তো উত্তর বঙ্গের কিয়দংশও এই রাজাদের অধিকারভুক্ত ছিল। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গোপচন্দ্রদের রাজ্যটিকে গৌড় আখ্যা দেওয়াই সমীচীন বোধ হয়।

মহারাজাধিরাজ ধর্মাদিত্য (আ. ৫৬০-৬৫ খ্রিস্টাব্দ) : গোপচন্দ্রের ফরিদপুর তাম্র শাসনে নাব্য-অবকাশিকার উপরিকরূপে নাগদেব এবং বারক-মণ্ডল-বিষয়ের জ্যেষ্ঠ কায়স্থ রূপে নয়সেনের নাম উল্লিখিত হয়েছে। মহারাজাধিরাজ ধর্মাদিত্যের তারিখবিহীন ফরিদপুর তাম্রশাসনেও এ দু’জন রাজপুরুষের নামোল্লেখ আছে। গোপচন্দ্র ও ধর্মাদিত্য মোটামুটি একই অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। ধর্মাদিত্য গোপচন্দ্রের কে ছিলেন বা তাঁরা দু’জনে একই বংশোদ্ভব কিনা, সে বিষয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। তাঁর তারিখবিহীন ফরিদপুর তাম্রশাসনে তাঁর পূর্ব ও দক্ষিণ বঙ্গে আধিপত্য প্রমাণিত। এই লেখ থেকে জানা যায়, নাব্য-অবকাশিকা বা দক্ষিণ বঙ্গ তাঁর রাজ্যের অন্তর্গত ছিল।  অনুমিত হয়, গোপচন্দ্রের রাজত্বের অনতিকাল পর ধর্মাদিত্য পূর্ব ও দক্ষিণ বঙ্গে রাজপদে অভিষিক্ত হন। তাঁর একখানি ফরিদপুর তাম্রশাসনে তাঁর তৃতীয় রাজ্যবর্ষের উল্লেখ আছে। দীনেশচন্দ্র সরকার মনে করেন, ধর্মাদিত্য গোপচন্দ্রের পূর্ববর্তী। এই অভিমতের সমর্থনে তার যুক্তি –

  • প্রথমত, তাঁর আদিত্য অন্তনাম প্রমাণ করছে, ধর্মাদিত্য গুপ্ত রাজাদের নিকটবর্তী।
  • দ্বিতীয়ত, গুপ্ত রাজাদের অনুকরণে তিনি পরমভট্টারক অভিধা ধারণ করেন।

কিন্তু একই অন্তনাম বা অভিধার ব্যবহার যে কাল নির্ধারণের অকাট্য প্রমাণ, এ কথা জোর করে বলা যায় না। উপরন্তু গোপচন্দ্রের অধীনস্থ মহারাজ বিজয়সেন আর মহারাজ বৈন্যগুপ্তের গুণাইঘর তাম্রশাসনের দূতক মহারাজ, মহাসামন্ত বিজয়সেন এক ও অভিন্ন ব্যক্তি হলে গোপচন্দ্রের পূর্ববর্তিতা স্বীকৃত হয়।

মহারাজাধিরাজ সমাচারদেব (আ. ৫৬৫-৮০ খ্রিস্টাব্দ) : এ রাজ্যের পরবর্তী মহারাজাধিরাজ সমাচারদেব। তাঁর ঘুঘরাহাটি তাম্রশাসন থেকে জানা যায়, তিনি অন্তত ১৪ বছর রাজত্ব করেন। তাঁর ৭ম রাজ্যবর্ষে উৎকীর্ণ ফরিদপুর জেলার কুরপাল গ্রামে তাঁর আর একখানি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হয়েছে। নালন্দায় তাঁর একখানি সিলমোহর পাওয়া গেছে। তিনি স্বর্ণমুদ্রা উৎকীর্ণ করেন। গোপচন্দ্র বা ধর্মাদিত্যের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক জানা যায় না। ফরিদপুরে তার তাম্রশাসন পাওয়া যাওয়ায় ধারণা করা হয় তিনি ধর্মাদিত্যের পর পূর্ববঙ্গে রাজত্ব করতেন।

পৃথুবীর ও সুধন্যাদিত্য : গুপ্ত মুদ্রার অনুকরণে নির্মিত বহুসংখ্যক স্বর্ণমুদ্রা ঢাকা জেলার সাভার, ফরিদপুরের কোটালিপাড়া প্রভৃতি পূর্ব বাংলার বিভিন্ন স্থানে আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলো গুপ্ত মুদ্রার অপকৃষ্ট অনুকরণ। বেশির ভাগ মুদ্রাতেই রাজার নাম অস্পষ্ট, অপাঠ্য। শুধু দু’জন রাজার নাম পড়া যায়। এঁদের একজন পৃথুবীর বা পৃথুজবীর বা পৃথুবীরাজ। অন্যজন সুধন্যাদিত্য। তাঁরা সম্ভবত সমাচারদেবের পর পূর্ব বাংলায় রাজত্ব করেন

মহারাজাধিরাজ জয়নাগ : জয়নাগ নামে এক প্রাচীন রাজার নাম জানা যায়। তাঁর একখানি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হয়েছে। তাম্রশাসনখানি কর্ণসুবর্ণ জয়স্কন্ধাবার হতে সম্প্রদত্ত। তিনি ‘পরমভাগবত’ ও ‘মহারাজাধিরাজ’ অভিধায় ভূষিত হয়েছেন। লেখ থেকে জানা যায়, তাঁর অধীনস্থ রাজপুরুষ নারায়ণভদ্র ঔদুম্বরিক-বিষয়ের শাসনকর্তা ছিলেন। বীরভূম-মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে এই বিষয়টি অবস্থিত ছিল। জয়নাগ পশ্চিম বাংলার রাজা ছিলেন, কর্ণসুবর্ণ ছিল তাঁর রাজধানী। জন এলান ও বার্নেট সাহেব কয়েকটি প্রাচীন মুদ্রাকে জয়নাগের মুদ্রারূপে শনাক্ত করেছেন। এই শনাক্তকরণ সঠিক হলে বুঝতে হবে, তিনি ‘প্রকাণ্ডযশা’ অভিধা ধারণ করেন। এই মুদ্রাগুলোর অপ্রধান পৃষ্ঠে দেবী লক্ষ্মীর প্রতিকৃতি অঙ্কিত আছে। এতে তাঁর বৈষ্ণবধর্মের প্রতি অনুরাগ প্রকাশিত হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, লেখেও তিনি ‘পরমভাগবত’রূপে বর্ণিত হয়েছেন। জয়নাগের রাজত্বকাল সম্পর্কে নানা মুনি নানা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। বিনয়চন্দ্র সেন ও অধ্যাপিকা দেবাহুতি মনে করেন, জয়নাগ খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের একেবারে শেষের দিকে আবির্ভূত হন। পক্ষান্তরে রমেশচন্দ্র মজুমদার ও দীনেশচন্দ্র সরকার তাঁকে শশাঙ্কোত্তর পর্বে ধার্য করেছেন। শেষোক্ত অভিমতই অধিকতর গ্রহণীয়। জয়নাগ শশাঙ্কের মৃত্যুর পর রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে কর্ণসুবর্ণে স্বল্পকালের জন্য স্বাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন।

গৌড়েশ্বর শশাঙ্ক

প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে শশাঙ্ক এক স্মরণীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। মগধ অঞ্চলে মহাসামন্তরূপে রাজনৈতিক জীবন শুরু করে বুদ্ধিমত্তা, আত্মবিশ্বাস, সামরিক নৈপুণ্য ও সংগঠন-শক্তির সহায়তায় তিনি পূর্ব ভারতের এক সুবিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের একচ্ছত্র অধিপতি রূপে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর সাফল্যের পথে বাধা ছিল বিস্তর। মৌখরিরাজ গ্রহবর্মা, পুষ্যভৃতি-নৃপতি হর্ষবর্ধন ও কামরূপাধিপতি ভাস্করবর্মা তাঁর প্রতি শত্রুভাবাপন্ন ছিলেন। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বী রাজাদের প্রতিরোধ চূর্ণ করে অসামান্য কৃতিত্বের সঙ্গে তিনি বিহার, বাংলা ও ওড়িশার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে এক শক্তিশালী রাজ্য গঠন করেন। পরবর্তিকালে পালরাজ ধর্মপালদেবপালের নেতৃত্বে বাংলা ভারতীয় রাজনীতিতে আরও গৌরবময় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। কিন্তু শশাঙ্কের রাজত্বকালেই ভারতের রাজনৈতিক মঞ্চে বৃহৎ শক্তিরূপে বাংলা প্রথম আত্মপ্রকাশ করে। ভারতীয় রাজনীতিতে বাংলার প্রভাব প্রতিষ্ঠায় তিনি প্রকৃতপক্ষে পথিকৃতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। বাণভট্টের হর্ষচরিত, শঙ্কর-রচিত হর্ষচরিত-ভাষ্য, আর্য-মঞ্জুশ্রী-মূলকল্প, শশাঙ্কের রাজত্বকালীন কয়েকখানি তাম্রশাসন ও কতিপয় মুদ্রা এই কীর্তিমান নরপতির কীর্তিকলাপের উপর আলোকপাত করে।

বংশ-পরিচয়

হর্ষচরিতের এক পাণ্ডুলিপিতে শশাঙ্ককে নরেন্দ্রগুপ্ত বলা হয়েছে। (এ মতের সমর্থকদের মধ্যে আছেন হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী, বিনয়চন্দ্র সেন, অধ্যাপিকা দেবাহুতি এবং আরও অনেকে। জন এলান মনে করেন, নামটি হবে নরেন্দ্রাদিত্য, নরেন্দ্রগুপ্ত নয়। শশাঙ্ক নরেন্দ্রগুপ্ত নামেও পরিচিত ছিলেন, এ মত রমেশচন্দ্র মজুমদার স্বীকার করেন না। বিষয়টি বিতর্কিত।) নরেন্দ্র গুপ্ত নামটি গুপ্ত রাজাদের নামের মতো। শশাঙ্কের মুদ্রাও গুপ্তমুদ্রার প্রায় অনুরূপ। এ দু’টি যুক্তির ভিত্তিতে কেউ কেউ অভিমত প্রকাশ করেছেন, শশাঙ্ক মগধের গুপ্ত রাজবংশের সন্তান ছিলেন। কিন্তু শশাঙ্কের তথাকথিত গুপ্ত অন্তনাম তাঁর গুপ্ত রাজপরিবারের সঙ্গে অভিন্নতার যথার্থ প্রমাণ নয়। শশাঙ্ক ও গুপ্ত রাজাদের মুদ্রায় যে সাদৃশ্যের কথা বলা হয় তাও কোনও সঠিক প্রমাণ নয়। শশাঙ্কের মুদ্রার সঙ্গে প্রাচীন বাংলার আর এক রাজা জয়নাগের মুদ্রার সাদৃশ্য অনেক বেশি। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, শশাঙ্ক উত্তরকালীন গুপ্তরাজ মহাসেনগুপ্তের পুত্র বা ভ্রাতুষ্পুত্র ছিলেন। এ মত কষ্টকল্পিত। তিনি যদি মহাসেনগুপ্তের পুত্র বা ভ্রাতুষ্পুত্র হবেন তাহলে তো তিনি তাঁর অপর দুই ভ্রাতা কুমারগুপ্তমাধবগুপ্তের সঙ্গে স্থাণ্বীশ্বরে রাজ্যবর্ধন হর্ষ বর্ধনের সান্নিধ্যে লালিতপালিত হতেন, তাঁর জীবন অন্যভাবে শুরু হত। মোট কথা, শশাঙ্কের বংশপরিচয় আজও তমসাচ্ছন্ন, রহস্যাবৃত।

আদি রাজনৈতিক জীবন

বিহারের রোহতাস জেলার রোহতাসগড় দুর্গের প্রাচীরগাত্রে উৎকীর্ণ এক সিলমোহরের ছাপে ‘শ্রীমহাসামন্ত-শশাঙ্কদেবস্য’ এই লেখ খোদিত আছে। এই শশাঙ্ক অবশ্যই গৌড়াধীপ শশাঙ্ক। অনুমিত হয়, শশাঙ্ক মহাসামন্তরূপে মগধ অঞ্চলে তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন, শশাঙ্ক মহাসেনগুপ্তের অধীনে মহাসামন্তরূপে মগধে কর্মজীবন আরম্ভ করেন। কিন্তু মহাসেনগুপ্ত খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের শেষ দশকে মগধে রাজত্ব করেন, এরূপ ধারণা প্রমাণসিদ্ধ নয়। এ কথা ঠিক, মহাসেনগুপ্ত ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় এক সমরাভিযান পরিচালনা করেন; এই অভিযান উপলক্ষে তাঁকে মগধের মধ্য দিয়েই অগ্রসর হতে হয়। কিন্তু মহাসেনগুপ্তের এই অভিযান ছিল নিছকই এক ক্ষণস্থায়ী সামরিক অভিযান। সমকালীন ভারতীয় রাজনীতির উপর তাঁর এই অভিযানের বিশেষ কোনও প্রভাব পড়েনি, মগধ ও কামরূপ তাঁর রাজ্যভুক্ত হয়নি। বিন্ধ্যেশ্বরী প্রসাদ সিংহের অভিমত, শশাঙ্ক জয়নাগের অধীনস্থ মহাসামন্ত ছিলেন। জয়নাগ এবং শশাঙ্ক উভয়েই কর্ণসুবর্ণের অধিপতি ছিলেন; তাঁদের মুদ্রাগুলোর মধ্যেও যথেষ্ট মিল রয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, মগধে শশাঙ্কের কর্মজীবন শুরু হয়। জয়নাগ যে মগধে রাজত্ব করতেন তার কোনও প্রমাণ আজও পাওয়া যায়নি। সে সময় মগধ মৌখরিরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। মৌখরিরাজ শর্ববর্মা ও তাঁর পুত্র অবন্তিবর্মা যে মগধে রাজত্ব করতেন তা দ্বিতীয় জীবিতগুপ্তের দেওবরণাক মন্দিরলেখের সাক্ষ্যে প্রমাণিত। (দেওবরণাক অভিলেখে দেখা যায়, দ্বিতীয় জীবিতগুপ্ত রোহতাস অঞ্চলে কিছু জমি দান করেছেন। এ দান কোনও নতুন দান নয় ; বহুদিন পূর্বে তাঁরই দু’জন পূর্বপুরুষ পরমেশ্বর শর্ববর্মা ও পরমেশ্বর অবন্তিবর্মা এ জমি দান করেছিলেন। তাঁর এ দান পুনর্দান।) অবন্তিবর্মার পুত্র সুব্রতবর্মা বা সুচন্দ্রবর্মার একখানি সিলমোহর নালন্দায় আবিষ্কৃত হয়েছে। শশাঙ্ক সম্ভবত মৌখরিরাজ অবন্তিবর্মার অধীনস্থ মহাসামন্তরূপে মগধে তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। অবন্তিবর্মার মৃত্যুর অব্যবহিত পরই আনুমানিক ৬০০ খ্রিস্টাব্দে শশাঙ্ক স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ৬০৬ খ্রিস্টাব্দের পূর্বেই তিনি নিজেকে মগধ-গৌড়ের অপ্রতিদ্বন্দ্বী রাজারূপে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। কর্ণসুবর্ণ হল তাঁর রাজধানী। মুর্শিদাবাদ জেলার রাজবাড়িডাঙা গ্রামটিই প্রাচীন কর্ণসুবর্ণ। গ্রামটি বহরমপুর শহরের নাতিদূরে অবস্থিত।

গৌড়-মালব জোট গঠন

সিংহাসনে আরোহণ করে বিচক্ষণ শশাঙ্ক উপলব্ধি করলেন, উত্তর ভারতের একাধিক রাষ্ট্রশক্তি তাঁর প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন। যে মৌখরিদের দাসত্ব-শৃঙ্খল ছিন্ন করে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন সেই মৌখরিরা তখনও উত্তর ভারতের এক প্রধান রাষ্ট্রশক্তিরূপে বিরাজমান। মৌখরিরা তাঁর অভ্যুত্থানকে যে সুনজরে দেখবেন না তা বুঝতে শশাঙ্কের বিলম্ব হয়নি। কিন্তু শুধু মৌখরিরাই তাঁর প্রতিপক্ষ নন। মৌখরিরাজ গ্রহবর্মা পুষ্যভৃতি নৃপতি প্রভাকরবর্ধনের কন্যা রাজ্যশ্রীর পাণিগ্রহণ করেছেন বা উভয় রাজপরিবারের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হতে চলেছে। মৌখরি ও পুষ্যভূতি রাজপরিবার দু’টি সংঘবদ্ধ হতে চলেছে। স্বাভাবিক কারণে পুষ্যভূতিদের দৃষ্টিতেও তিনি শত্রুরূপে প্রতিভাত। এই পরিস্থিতিতে শশাঙ্ক পূর্ব মালবাধিপতি দেবগুপ্তের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করেন। দেবগুপ্তের সঙ্গে পুষ্যভূতি রাজপরিবারের শত্রুতা ছিল। পুষ্যভূতিরাজ প্রভাকরবর্ধনের মাতুল মহাসেনগুপ্তকে রাজ্যচ্যুত করেই দেবগুপ্ত পূর্ব মালবের সিংহাসন অধিকার করেন। পুষ্যভূতি-মৌখরি শক্তির সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহতের উদ্দেশ্যে শশাঙ্ক ও দেবগুপ্তের নেতৃত্বে গৌড়-মালব জোট গড়ে উঠল।

রাজ্যজয়

দেবগুপ্তের সঙ্গে সম্প্রীতি স্থাপন করে যেমন তিনি স্বীয় শক্তি বৃদ্ধি করেন তেমনি পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলো জয় করে শশাঙ্ক নিজের অধিকার ও কর্তৃত্বের পরিধি সম্প্রসারিত করেন। মগধ প্রথম থেকেই শশাঙ্কের রাজ্যভুক্ত ছিল। এখানেই মহাসামন্তরূপে তিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। তিনি আমৃত্যু মগধে তাঁর কর্তৃত্ব অক্ষুণ্ণ রাখেন। হর্ষচরিতে শশাঙ্ককে গৌড়, গৌড়াধম ও গৌড়ভুজঙ্গরূপে আখ্যাত করা হয়েছে। তখনকার দিনে উত্তর এবং পশ্চিম বঙ্গ গৌড় নামে পরিচিত ছিল। কখনও কখনও দক্ষিণ বঙ্গও গৌড় জনপদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ অঞ্চলে শশাঙ্কের রাজত্বকালীন তিনখানি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হয়েছে। এদের দু’টিই পাওয়া গেছে মেদিনীপুরে, তৃতীয়খানি খড়্গপুরের নিকটবর্তী এগরা গ্রামে। তাঁর ৮ম রাজ্যবর্ষে উৎকীর্ণ প্রথম মেদিনীপুর তাম্রশাসন থেকে জানা যায়, মহাপ্রতীহার শুভকীর্তি দণ্ডভুক্তি বিভাগের প্রশাসক-পদে নিযুক্ত ছিলেন। অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে এই জনপদ গঠিত ছিল। মেদিনীপুর জেলার বর্তমান দাঁতন প্রাচীন দণ্ডভুক্তির স্মৃতি বহন করছে। আর্য-মঞ্জুশ্রী-মূলকল্পে পুণ্ড্র বা পুণ্ড্রবর্ধনকে শশাঙ্কের রাজ্যের অন্তর্ভুক্তরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। মনে হয়, মগধে স্বীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর শশাঙ্ক পশ্চিম, দক্ষিণ ও উত্তর বঙ্গ অধিকার করেন। (অধ্যাপিকা দেবাহুতি অভিমত ব্যক্ত করেছেন, জয়নাগের মৃত্যুর পর গৌড় রাজশক্তি দুর্বল হয়ে পড়লে শশাঙ্ক প্রায় বিনা বাধায় কর্ণসুবর্ণসহ পশ্চিম বঙ্গ অধিকার করেন। কিন্তু জয়নাগ শশাঙ্কের পূর্ববর্তী না উত্তরকালীন সে সম্পর্কে ঐতিহাসিক মহলে বাগ্বিতণ্ডার সৃষ্টি হয়েছে। রমেশচন্দ্র মজুমদার ও দীনেশচন্দ্ৰ সরকার উভয়েই মনে করেন, শশাঙ্কের দেহাবসানের কিছুদিনের মধ্যেই জয়নাগ পশ্চিম বঙ্গের রাজপদ অলংকৃত করেন।) অনুমিত হয়, ৬০৬ খ্রিস্টাব্দের পূর্বেই তিনি এসব রাজ্য জয় করেন। পূর্ব বাংলা শশাঙ্কের রাজ্যভুক্ত ছিল এ কথা নিশ্চিতরূপে বলা যায় না। নালন্দা মহাবিহারের সমকালীন অধ্যক্ষ শীলভদ্রের উল্লেখ প্রসঙ্গে শুয়েন চাঙ বলেন, এই সুপণ্ডিত সমতট অর্থাৎ পূর্ব বঙ্গের ব্রাহ্মণ রাজপরিবারের সন্তান ছিলেন। মনে হয়, খ্রিস্টীয় ৭ম শতকের প্রথমার্ধে সমতট এক স্বাধীন রাজ্যরূপে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু এ সময় পূর্ব বাংলার এই তথাকথিত ভদ্র রাজবংশের অস্তিত্ব সম্পর্কে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছেন। তাঁদের অভিমত, পূর্ব বাংলা শশাঙ্কের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রায় একই সময় শশাঙ্ক ওড়িশার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করেন। এ প্রসঙ্গে নিম্নোক্ত পাঁচখানি তাম্রশাসনের সাক্ষ্য প্রণিধানযোগ্য :

  • ১. শশাঙ্কের ঊনবিংশ রাজ্যবর্ষে উৎকীর্ণ দ্বিতীয় মেদিনীপুর তাম্রশাসন;
  • ২-৩, তাঁর পঞ্চদশ রাজ্যবর্ষে উৎকীর্ণ সোমদত্তের দু’খানি সোরো তাম্রশাসন;
  • ৪. ৬০৩ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ সামন্ত-মহারাজ শিবরাজের পাতিয়াকেল্লা তাম্রশাসন ;
  • ৫. ৬২০ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ শৈলোদ্ভববংশীয় দ্বিতীয় মাধববর্মার গঞ্জাম তাম্রশাসন।

উপরোক্ত প্রথম তিনখানি তাম্রশাসন থেকে জানা যায়, উৎকল অর্থাৎ ওড়িশার উত্তর উপকূল অঞ্চল শশাঙ্কের রাজ্যভুক্ত ছিল। কিন্তু সামন্ত-মহারাজ শিবরাজের পাতিয়াকেল্লা তাম্রশাসনের সাক্ষ্যে জানা যায়, ৬০৩ খ্রিস্টাব্দে শিবরাজ এই অঞ্চলের প্রশাসনের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি ছিলেন মানবংশীয় মহারাজ শম্ভুযশের অনুগত। অনুমিত হয়, ৬০৩ খ্রিস্টাব্দের শেষার্ধে বা তার অব্যবহিত পরই শশাঙ্ক মানরাজ শম্ভুযশকে বিতাড়িত করে ওড়িশার উত্তর উপকূলে নিজের আধিপত্য বিস্তার করেন। উৎকল বা ওড়িশার উত্তর উপকূল অঞ্চল ও দণ্ডভুক্তি নিয়ে এক প্রশাসনিক বিভাগ গঠিত হয়। এ অঞ্চলের শাসনভার মহারাজ সোমদত্তের স্কন্ধে ন্যস্ত হয়।

৬২০ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ গঞ্জাম তাম্রশাসনে কোঙ্গোদের শৈলোদ্ভববংশীয় মহারাজ, মহাসামন্ত দ্বিতীয় মাধবরাজ নিজেকে শশাঙ্কের অনুগতরূপে বর্ণনা করেছেন। এই অভিলেখে তিনি শশাঙ্ককে দ্বীপ-গিরিপত্তন-শোভিত, সমুদ্রমেখলা বসুন্ধরার মহারাজাধিরাজরূপে বন্দনা করেছেন। লেখটি প্রমাণ করছে, দক্ষিণদিকে শশাঙ্কের রাজ্য কোঙ্গোদ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সে সময় কোঙ্গোদ অঞ্চল বলতে অবিভক্ত পুরী ও গঞ্জাম জেলা এবং কটক জেলার দক্ষিণাংশ বোঝাত। এখানে একটি কথা বলার আছে, শশাঙ্ক যে মান রাজবংশ উচ্ছেদ করে উৎকলে স্বীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন তা সুনিশ্চিত। ৬০৩ খ্রিস্টাব্দের পর মান রাজবংশের কথা আর শ্রুতিগোচর হয় না। কিন্তু কোঙ্গোদের দ্বিতীয় মাধবরাজ শশাঙ্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন কিনা তা বলা কঠিন। মনে হয়, শশাঙ্কের উৎকল অভিযানে ভীত হয়ে দ্বিতীয় মাধবরাজ বিনাযুদ্ধে গৌড়াধিপতির বশ্যতা স্বীকার করেন। অনুমিত হয়, ৬০৬ খ্রিস্টাব্দের পূর্বেই উৎকল ও কোঙ্গোদে শশাঙ্কের আধিপত্য বিস্তৃত হয়।

শশাঙ্ক ও কামরূপ

ভাস্করবর্মার দুবি তাম্রশাসনে বলা হয়েছে, গৌড়রা কামরূপ আক্রমণ করলে সুস্থিতবর্মার দুই পুত্র সুপ্রতিষ্ঠিতবর্মাভাস্করবর্মা গৌড়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অশেষ বীরত্ব প্রদর্শন করেন কিন্তু তাঁদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত বন্দি করে তাঁদের গৌড়ে আনা হয় কিন্তু পরে মুক্তিলাভ করে তাঁরা স্বরাজ্যে পুনর্বাসিত হন। কিন্তু এই গৌড় অভিযান সুস্থিতবর্মার রাজত্বকালে না তাঁর মৃত্যুর পর কোনও এক সময় অনুষ্ঠিত হয় তা লেখে স্পষ্ট করে বলা হয়নি। গৌড়রা যদি সুস্থিতবর্মার মৃত্যুর পর কামরূপ আক্রমণ করেন তাহলে শশাঙ্ককে গৌড়রাজরূপে শনাক্ত করা যায়। দীনেশচন্দ্র সরকার, বিন্ধ্যেশ্বরী প্রসাদ সিংহ ও সুধাকর চট্টোপাধ্যায় এরূপ অভিমতই প্রকাশ করেছেন। এ মত সঠিক হলে স্বীকার করতে হবে, সিংহাসনে আরোহণের অনতিকাল মধ্যে শশাঙ্ক কামরূপ আক্রমণ করেন ; যুদ্ধে জয় লাভ সত্ত্বেও তিনি কামরূপ অধিকার করেননি; বিজিত রাজকুমারদের স্বরাজ্যে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। দুবি তাম্রশাসনে যে গৌড়রাজের পরোক্ষ উল্লেখ আছে তিনি শশাঙ্ক, এ অভিমত সকলে স্বীকার করেন না। রমেশচন্দ্র মজুমদার ও অধ্যাপিকা দেবাহুতি তাঁকে যথাক্রমে মহাসেনগুপ্তজয়নাগরূপে চিহ্নিত করেছেন।

কান্যকুব্জ অভিযান

এভাবে সিংহাসনে আরোহণের বছর ছয়েকের মধ্যে বিভিন্ন যুদ্ধ বিগ্রহে অংশগ্রহণ করে শশাঙ্ক পূর্ব ভারতের এক সুবিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। হঠাৎ তাঁর সামনে পশ্চিমদিকে রাজ্যবিস্তারের সুবর্ণ সুযোগ এসে উপস্থিত হয়। পুষ্যভূতিরাজ প্রভাকরবর্ধন সহসা লোকান্তরিত হন। এই সুযোগেরই প্রতীক্ষায় ছিলেন শশাঙ্ক ও তাঁর সুমিত্র দেবগুপ্ত। কনিষ্ঠ রাজকুমার হর্ষবর্ধন তখন স্থাণ্বীশ্বরে, জ্যেষ্ঠ রাজকুমার রাজ্যবর্ধন তখন রাজধানীর বাইরে। শশাঙ্ক ও দেবগুপ্তের লক্ষ্য তখন কান্যকুব্জ। কান্যকুব্জের সিংহাসনে গ্রহবর্মা সমাসীন। প্রভাকরবর্ধনের মৃত্যুতে তিনি হীনবল। অনুমান করা যায়, তাঁরা দু’জনে পরস্পরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে দু’প্রান্ত থেকে সসৈন্যে মৌখরি রাজধানী কান্যকুব্জ অভিমুখে অগ্রসর হন।

হর্ষচরিতের বর্ণনা থেকে অনুমিত হয়, পূর্ব মালবাধিপতি দেবগুপ্ত শশাঙ্কের পূর্বেই কান্যকুব্জে উপস্থিত হন। মিত্র শশাঙ্কের প্রতীক্ষায় অযথা কালক্ষেপ না করে তিনি গ্রহবর্মাকে আক্রমণ করেন। যুদ্ধে গ্রহবর্মা পরাজিত ও নিহত হন, তাঁর মহিষী রাজ্যশ্রী কান্যকুব্জে কারারুদ্ধ হন। গ্রহবর্মার বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব সাফল্য লাভের পর উচ্চাকাঙ্ক্ষী দেবগুপ্ত পুষ্যভূতি রাজ্যের রাজধানী স্থান্বীশ্বর অভিমুখে সসৈন্যে যাত্রা করেন। ইতিমধ্যে রাজ্যবর্ধন স্বাথ্বীশ্বরে প্রত্যাবর্তন করেছেন এবং রাজপদে অভিষিক্ত হয়েছেন। ভগিনীপতির হত্যা ও ভগিনীর বন্দিদশার সংবাদ তাঁর নিকট পৌঁছলে তিনি কালবিলম্ব না করে মাতুলপুত্র ভণ্ডিকে সঙ্গে নিয়ে দশ সহস্র অশ্বারোহী সৈন্যসহ দেবগুপ্তের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। অনুমিত হয়, স্থাণ্বীশ্বর ও কান্যকুব্জের মধ্যবর্তী কোনও এক স্থানে রাজ্যবর্ধন ও দেবগুপ্ত পরস্পরের সম্মুখীন হন। এ যুদ্ধে দেবগুপ্ত পরাজিত ও সম্ভবত নিহত হন। দেবগুপ্তকে পরাভূত করে রাজ্যবর্ধন কান্যকুব্জ অভিমুখে অগ্রসর হন।

কিন্তু রাজ্যবর্ধন কান্যকুব্জে পৌঁছানোর পূর্বেই শশাঙ্ক সেখানে এসে উপনীত হন ও নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে রাজ্যবর্ধনকে শশাঙ্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়। এই যুদ্ধের বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় না। তবে হর্ষচরিতের বর্ণনা থেকে মনে হয়, রাজ্যবর্ধন কান্যকুব্জ অধিকার করতে পারেননি; বিধবা ভগিনীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনেও তিনি ব্যর্থ হন; উপরন্তু শশাঙ্কের হাতে তিনি অকালে মৃত্যুবরণ করেন।

রাজ্যবর্ধনের মৃত্যু ও শশাঙ্কের ভূমিকা

রাজ্যবর্ধনের এই অকাল মৃত্যুর জন্য হর্ষচরিতকার বাণভট্ট কার্যত শশাঙ্ককেই দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, মিথ্যা সৌজন্যে প্রলুব্ধ হয়ে রাজ্যবর্ধন গৌড়েশ্বরের শিবিরে গমন করেন; তিনি সেখানে নিরস্ত্র ও নিঃসঙ্গ অবস্থায় নিহত হন। বাণভট্টের এই বর্ণনা অতি সংক্ষিপ্ত ও অসম্পূর্ণ। গৌড়রাজের পক্ষ থেকে কী সৌজন্য প্রদর্শিত হয় বা কীরূপ সৌজন্যের আশ্বাস দেওয়া হয় বাণভট্ট সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ নীরব। রাজ্যবর্ধন কেন নিরস্ত্র ও নিঃসঙ্গ অবস্থ শশাঙ্কের শিবিরে গমন করেন সে সম্পর্কেও তিনি কোনও আলোকপাত করেননি। হর্ষচরিতের উত্তরকালীন ভাষ্যকার শংকরের বর্ণনা এ সম্পর্কে কিছুটা বিশদ। শংকর বলেন, নিজ কন্যার সঙ্গে তাঁর বিবাহ দেবেন, এই মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে শশাঙ্ক রাজ্যবর্ধনকে প্ররোচিত করেন। রাজ্যবর্ধন শশাঙ্কের ছলনা বুঝতে পারেননি। রাজ্যবর্ধন যখন তাঁর পাত্র-মিত্রদের সঙ্গে শত্রু-শিবিরে ভোজনরত তখন ছদ্মবেশী শশাঙ্ক তাঁর প্রাণসংহার করেন। দেখা যাচ্ছে, বাণভট্ট ও তাঁর ভাষ্যকার শংকরের বক্তব্য ঠিক একরূপ নয়। বাণভট্টের মতে রাজ্যবর্ধন শত্রু-শিবিরে নিরস্ত্র ও নিঃসঙ্গ ছিলেন। শংকরের বর্ণনায় রাজ্যবর্ধন শত্রু শিবিরে নিরস্ত্র ও নিঃসঙ্গ নন, তিনি অনুচর-পরিবৃত। দ্বিতীয়ত, বাণ বলেছেন, রাজ্যবর্ধন শত্রু শিবিরে নিহত হন কিন্তু তিনি বলেননি, স্বয়ং শশাঙ্কই রাজ্যবর্ধনকে হত্যা করেন। শংকরের স্পষ্টোক্তি, ছদ্মবেশী শশাঙ্কই রাজ্যবর্ধনের ঘাতক।

রাজ্যবর্ধনের মৃত্যু প্রসঙ্গে সমকালীন চিনা পরিব্রাজক শুয়েন চাঙের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। চিনা শ্রমণ বলেন, রাজ্যবর্ধনের উল্লেখ প্রসঙ্গে শশাঙ্ক প্রায়ই তাঁর মন্ত্রীদের বলতেন, প্রতিবেশী রাজ্যের রাজা ধার্মিক বা সদাচারী হলে মূল রাজ্যের পক্ষে তা অশান্তির কারণ হয় ; শশাঙ্কের মনের কথা জানতে পেরে তাঁর মন্ত্রীরা রাজ্যবর্ধনকে আহ্বানপূর্বক হত্যা করেন। শুয়েন চাঙ তাঁর ভারত-বৃত্তান্তের অন্যত্র অবশ্য রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর জন্য শশাঙ্কের মন্ত্রীদের দায়ী করেননি, দায়ী করেছেন রাজ্যবর্ধনেরই অদূরদর্শী অমাত্যদের। তিনি বলেন, অমাত্যদের অপরিণামদর্শিতায় রাজ্যবর্ধন শত্রুকবলিত ও বিপদাপন্ন হন। শুয়েন চাঙের বক্তব্যের সঙ্গে বাণভট্ট বা তাঁর ভাষ্যকার শংকরের বিবৃতির যে বিশেষ মিল নেই, তা বলা বাহুল্য। হর্ষবর্ধনের বাঁশখেড়া ও মধুবন তাম্রশাসন দু’টিতেও রাজ্যবর্ধনের মৃত্যু-প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে। সেখানে হর্ষবর্ধন তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মৃত্যুর জন্য শশাঙ্ক বা অপর কোনও ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করেননি, দায়ী করেছেন রাজ্যবর্ধনের ‘সত্যানুরোধ’ বা সত্যপালনকে। এই ‘সত্যানুরোধ’ বা সত্যপালনের তো বহু অর্থই হতে পারে। হর্ষবর্ধন ‘সত্যানুরোধ’ বলতে ঠিক কী বলতে চেয়েছেন তা নির্ণয় করা সত্যই দুঃসাধ্য। তবে একটি জিনিস স্পষ্ট। শশাঙ্কের বিরুদ্ধে কান্যকুব্জের যুদ্ধে রাজ্যবর্ধন শত্রুহস্তে নিহত হন। কিন্তু রাজ্যবর্ধনের নিধনে গৌড়েশ্বর কৌশল বা চাতুরির আশ্রয় গ্রহণ করেন, এমন ধারণা সুনিশ্চিত বোধ হয় না। ঐতিহাসিক মহলে বিষয়টি ঘিরে প্রচুর বাগ্‌বিতণ্ডা সৃষ্টি হয়েছে। অপ্রতুল ও পরস্পর-বিরোধী তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্ন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। নতুন ও সুনির্দিষ্ট তথ্য আবিষ্কৃত হলে হয়তো এ বিতর্কের অবসান ঘটবে, তার পূর্বে নয়।

কান্যকুব্জ থেকে প্রস্থান, শশাঙ্কের বিরুদ্ধে হর্ষবর্ধনের যুদ্ধ ঘোষণা ও সাময়িক বিরতি

কান্যকুব্জ থেকে প্রস্থান : কান্যকুব্জে ইতিমধ্যেই শশাঙ্কের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। রাজ্যবর্ধনের বিরুদ্ধে জয়লাভের পর সে কর্তৃত্ব আরও সুদৃঢ় হয়। হর্ষচরিতের কোনও কোনও পাণ্ডু লিপিতে বলা হয়েছে, ‘দেবভূয়ং গতে দেবে রাজ্যবর্ধনে গৌড়ৈগৃহীতে কুশস্থলে’। এর অর্থ রাজ্য বর্ধন লোকান্তরিত হলে কুশস্থল অর্থাৎ কান্যকুব্জ গৌড়রাজের অধিকারভুক্ত হয়। অবশ্য হর্ষচরিতের কয়েকটি পাণ্ডুলিপিতে ‘গৌড়ৈগৃহীতে’-এর স্থলে ‘গুপ্তনাম্না চ গৃহীতে’ লিখিত আছে। এ পাঠের তাৎপর্য, কান্যকুব্জে গুপ্ত-এর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী, বিনয়চন্দ্র সেন প্রমুখ ঐতিহাসিকদের অভিমত, এই গুপ্ত নরেন্দ্রগুপ্ত, তিনিই শশাঙ্ক। শশাঙ্ক নরেন্দ্রগুপ্ত নামেও পরিচিত ছিলেন এ অভিমত সকলেই স্বীকার করেন না। কিন্তু রাজ্যবর্ধনকে পরাজিত করে শশাঙ্ক যে কান্যকুব্জে তাঁর কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করেন তা অনস্বীকার্য।

শশাঙ্ক দীর্ঘদিন কান্যকুব্জে অবস্থান করেননি। রাজ্যে তাঁর দীর্ঘদিন অনুপস্থিতি বা কামরূপাধিপতি ভাস্করবর্মার সম্ভাব্য আক্রমণের আশঙ্কা, যে কোনও কারণেই হোক, তিনি সত্বর রাজধানী কর্ণসুবর্ণে প্রত্যাবর্তন করেন। এমনও হতে পারে, কান্যকুব্জ থেকে প্রস্থানের পূর্বে তিনি গ্রহবর্মার কনিষ্ঠ ভ্রাতা সুব্রতবর্মা বা সুচন্দ্রবর্মাকে কান্যকুব্জের সিংহাসনে অভিষিক্ত করেন। এ ধারণা কিন্তু নিতান্তই আনুমানিক।

শশাঙ্কের বিরুদ্ধে হর্ষবর্ধনের যুদ্ধ ঘোষণা ও সাময়িক বিরতি : হর্ষচরিত থেকে জানা যায়, সেনাপতি কুন্তলের মুখে রাজ্যবর্ধনের মৃত্যু সংবাদ শ্রবণ করে হর্ষবর্ধন শশাঙ্কের প্রতি রুষ্ট হন। তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পৃথিবীর বুক থেকে গৌড়দের নিশ্চিহ্ন না করলে তিনি তৈল-প্রজ্বলিত অনলশিখায় আত্মাহুতি দেবেন। কয়েকদিনের মধ্যে নিজের রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে হর্ষবর্ধন সসৈন্যে শশাঙ্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর প্রাগজ্যোতিষরাজ ভাস্করবর্মার দূত হংসবেগের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। ভাস্করবর্মা হর্ষবর্ধনের সঙ্গে চিরকালীন বন্ধুত্ব স্থাপনের উদ্দেশ্যে এই দূতকে পাঠিয়েছেন। নিজের উদ্দেশ্যসিদ্ধির অনুকূল হবে ভেবে হর্ষবর্ধন কামরূপরাজের মৈত্রীর প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করেন। অনুমিত হয়, শশাঙ্কের ক্রমবর্ধমান শক্তিবৃদ্ধিতে শঙ্কিত ভাস্করবর্মা হর্ষবর্ধনের বন্ধুত্ব প্রার্থনা করেন। মনে হয় পরিস্থিতির প্রয়োজনে হর্ষবর্ধন তাঁর মূল পরিকল্পনার কিছু পরিবর্তন ঘটান।

আরও কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর তিনি ভণ্ডির মুখে ভগিনী রাজ্যশ্রীর বিন্ধ্যাঞ্চলে প্রস্থানের কথা অবহিত হন। তিনি সিদ্ধান্ত করেন, শশাঙ্ককে আক্রমণ নয়, নিরুদ্দিষ্টা ভগিনীকে উদ্ধার করাই তাঁর আশু কর্তব্য। হর্ষবর্ধন অনেক অনুসন্ধানের পর ভগিনীকে উদ্ধার করেন এবং তাঁকে সঙ্গে নিয়ে সসৈন্যে কান্যকুব্জে উপনীত হন। কান্যকুব্জ তখন গ্রহবর্মার কনিষ্ঠ ভ্রাতা সুব্রতবর্মা বা সুচন্দ্রবর্মার অধিকারভুক্ত। সুব্রতবর্মা বা সুচন্দ্রবর্মা ও তাঁর অনুগামীদের পরাজিত করে হর্ষবর্ধন নিজেকে কান্যকুব্জের সার্বভৌম নরপতিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেন। এ কাজ সম্পন্ন করতে হর্ষবর্ধন দীর্ঘ ছয় বৎসরকাল অতিবাহিত করেন।

শশাঙ্ক-হর্ষবর্ধন সংঘর্ষ

৬১২ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে বা তার অব্যবহিত পর হর্ষবর্ধন শশাঙ্কের রাজ্য আক্রমণ করেন। ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যেই মূলত শশাঙ্কের বিরুদ্ধে তাঁর এই সামরিক অভিযান। শশাঙ্ককে আক্রমণের তাঁর আরও একটি উদ্দেশ্য ছিল। মৌখরিরাজ্যের অঙ্গচ্ছেদ করেই শশাঙ্ক এক স্বাধীন রাজ্য গঠন করেছেন। কান্যকুব্জে স্বীয় অধিকার প্রতিষ্ঠা করার পর অখণ্ড মৌখরিরাজ্যের পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় হর্ষবর্ধন সচেষ্ট হবেন, এই স্বাভাবিক। তাছাড়া শশাঙ্কের অভ্যুত্থান প্রতিহত করাও তাঁর উদ্দেশ্য ছিল।

পরবর্তিকালের রচনা বৌদ্ধগ্রন্থ আর্য-মঞ্জুশ্রী-মূলকল্পে শশাঙ্ক-হর্ষবর্ধন সংঘর্ষের বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে। গ্রন্থখানিতে রাজা-মহারাজদের পুরো নামের উল্লেখ নেই, আছে তাঁদের নামের আদ্যাক্ষর বা মূল নামের প্রতিশব্দের ব্যবহার। অতীত কালের ঘটনাকে ভবিষ্যদ্বাণীর আকারে ব্যক্ত করা গ্রন্থখানির এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। অলৌকিক উপাদানের আধিক্যে গ্রন্থখানির ঐতিহাসিকতা বহুলাংশে ক্ষুণ্ন হয়েছে। ঘটনার বর্ণনায় গ্রন্থটিতে সমদর্শিতার পরিচয় নেই, আছে অবৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ ও বিরূপতার অভিব্যক্তি। শশাঙ্ক-হর্ষ সংঘর্ষের প্রেক্ষিতে আর্য মঞ্জুশ্রী-মূলকল্পের নিম্নোদ্ধৃত বিবৃতি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ : “মধ্যদেশে এক মহানুভব বৈশ্য রাজার জন্ম হবে। তাঁর নামের আদ্যাক্ষর হবে র (রাজ্যবর্ধন)। তিনি হবেন সোমের (শশাঙ্কের) মতো পরাক্রমশালী। নগ্নজাতির জনৈক রাজার হাতে তাঁর মৃত্যু ঘটবে। তাঁর অনুজ হ (হর্ষবর্ধন) হবেন রাজচক্রবর্তী। কীর্তিমান সোমের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করবেন। পরাক্রান্ত বৈশ্যরাজ সুবিশাল সৈন্যদলসহ প্রাচ্যদেশের সেই অধার্মিক নৃপতির সুরম্য রাজধানী পুণ্ড্র অভিমুখে অগ্রসর হবেন। কদাচারী সোমকে তিনি পরাভূত করবেন। তাকে (সোমকে) বাধ্য করবেন স্বরাজ্যে আবদ্ধ থাকতে। বর্বর রাজার দেশে সমাদরের (বা অনাদরের) পর তিনি নিজ রাজ্যে প্রস্থান করবেন।”

আর্য-মঞ্জুশ্রী-মূলকল্পের উপরোক্ত বর্ণনা অনুসারে হর্ষবর্ধন শশাঙ্কের রাজ্যের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন এবং পুণ্ড্র বা পুণ্ড্রবর্ধনের যুদ্ধে গৌড়রাজকে পরাভূত করেন। আর্য-মঞ্জুশ্রী-মূলকল্পের বিবরণ থেকে আরও জানা যায়, শশাঙ্ক পরাজিত হন বটে কিন্তু রাজ্যচ্যুত হননি; তিনি পূর্বের মতোই স্বাধীনভাবে স্বরাজ্যে রাজপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। আর্য-মঞ্জুশ্রী-মূলকল্পের এই বর্ণনা সর্বাংশে সত্য হলেও একটি জিনিস সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত : যে উদ্দেশ্যে পুষ্যভূতি-নৃপতি গৌড়েশ্বরের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন, তাঁর সে উদ্দেশ্য অপূর্ণই রয়ে যায় ; শশাঙ্কের রাজ্যের এক ক্ষুদ্রাংশও তিনি করায়ত্ত করতে পারেননি; তাঁকে প্রকৃতপক্ষে শূন্যহস্তেই প্রত্যাবর্তন করতে হয়। ৬৩৭-৩৮ খ্রিস্টাব্দে শুয়েন চাঙ মগধ পরিভ্রমণ করেন। তখন পূর্ণবর্মা নামে জনৈক রাজা মগধের অধিপতি। চিনা পরিব্রাজক বলেন, তাঁর মগধ পরিদর্শনের অনতিকাল পূর্বে শশাঙ্ক বোধগয়ার বোধিবৃক্ষ ছেদন করেন এবং এ ঘটনার স্বল্পকাল পরই মৃত্যুমুখে পতিত হন। শুয়েন চাঙের এ সাক্ষ্য থেকে মনে হয়, শশাঙ্ক আমৃত্যু মগধ অঞ্চলে স্বাধিপত্য বজায় রাখেন। প্রাচীন চিনা লেখক মা তোয়ান লিন বলেন, শীলাদিত্য অর্থাৎ হর্ষবর্ধন ৬৪১ খ্রিস্টাব্দে মগধেশ্বর অভিধা ধারণ করেন। মা তোয়ান লিনের এই উক্তি থেকে প্রতীতি হয় ৬৪১ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে মগধ হর্ষবর্ধনের অধিকারভুক্ত ছিল না। এসব ঘটনা প্রমাণ করছে, শশাঙ্ক সাফল্যের সঙ্গে হর্ষবর্ধনের আক্রমণ প্রতিহত করেন। সম্ভবত কামরূপাধিপতি ভাস্করবর্মা শশাঙ্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মিত্র হর্ষবর্ধনের পক্ষে যোগদান করেছিলেন।

৬১২ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে বা তার অব্যবহিত পর হর্ষবর্ধন শশাঙ্কের রাজ্য আক্রমণ করেন বলা হয়। কিন্তু রমেশচন্দ্র মজুমদার অভিমত প্রকাশ করেছেন, আনুমানিক ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণের অব্যবহিত পরই হর্ষবর্ধন শশাঙ্ককে আক্রমণ করেন। অধ্যাপিক দেবাহুতি শশাঙ্ক-হর্ষবর্ধন সংঘর্ষ ৬০৬-০৭ খ্রিস্টাব্দে ধার্য করেছেন। এ অভিমত সম্ভবত ঠিক নয়। ভগিনী রাজ্যশ্রীকে উদ্ধার করে হর্ষবর্ধন কান্যকুব্জ শহরে উপনীত হন। তখন মহারাজাধিরাজ সুব্রতবর্মা বা সুচন্দ্রবর্মা কান্যকুব্জের সিংহাসনে সমাসীন। হর্ষবর্ধন ছয় বৎসরব্যাপী এক দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষে সুব্রতবর্মা বা সুচন্দ্রবর্মা ও তাঁর অনুগামীদের পরাজিত করে পরিশেষে নিজেকে কান্যকুব্জের অপ্রতিদ্বন্দ্বী শাসকরূপে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। মৌখরিরাজ্য অনধিকৃত রেখে তাঁর পক্ষে শশাঙ্কের রাজ্য আক্রমণ করা সমুচিত কাজ হত না।

শশাঙ্কের বিরুদ্ধে হর্ষবর্ধনের সামরিক অভিযান যে বিশেষ ফলপ্রসূ হয়নি তা রমেশচন্দ্র মজুমদারও স্বীকার করেন। কিন্তু অধ্যাপিকা দেবাহুতি মনে করেন, এই যুদ্ধে শশাঙ্ক পরাজিত হন; মগধ ও পুণ্ড্রবর্ধন হর্ষবর্ধনের অধিকারভুক্ত হয়। স্বমতের সমর্থনে অধ্যাপিকা দেবাহুতি দু’টি যুক্তির অবতারণা করেছেন, কিন্তু দুটি যুক্তিই দর্বল। যুক্তিগুলো ও তাদের দুর্বলতাগুলো হলো –

  • প্রথমত, পুণ্ড্রবর্ধনে শশাঙ্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য হর্ষবর্ধন মগধ অতিক্রম করেন। মগধ তাঁর অধিকারভুক্ত না থাকলে তিনি এ অঞ্চলের মধ্য দিয়ে পুণ্ড্রবর্ধন অভিমুখে অগ্রসর হতে পারতেন না। কিন্তু এই যুক্তি দুর্বল কারণ কেবল আর্য-মঞ্জুশ্রী-মূলকল্পেই হর্ষবর্ধনের পুণ্ড্রবর্ধন যুদ্ধের উল্লেখ আছে। গ্রন্থখানির সাক্ষ্যে একটি কথা স্পষ্ট, আক্রমণাত্মক অভিযান সত্ত্বেও পুষ্যভূতিরাজ শশাঙ্ককে সিংহাসনচ্যুত করতে পারেননি; গৌড়েশ্বরের রাজ্যের এক খণ্ডিতাংশও তিনি অধিকার করতে পারেননি।
  • দ্বিতীয়ত, হর্ষবর্ধন কজঙ্গলে এক দরবারের আয়োজন করেন। মগধ তাঁর রাজ্যভুক্ত না হলে কজঙ্গলে এ দরবার অনুষ্ঠিত হত না। কিন্তু যুক্তিটি দুর্বল কারণ, হর্ষবর্ধন যখন কজঙ্গলে অবস্থান করেন তখন ৬৪৩ খ্রিস্টাব্দের প্রারম্ভিক পর্ব, শশাঙ্ক তখন লোকান্তরিত।

ধর্মমত ও মুদ্রা

ধর্মমত : শশাঙ্ক শৈবধর্মাবলম্বী ছিলেন। তাঁর মুদ্রার প্রধান পৃষ্ঠে মহাদেবের মূর্তি অঙ্কিত আছে। শুয়েন চাঙের বিবরণেও তাঁর শৈবধর্মানুরাগের পরিচয় আছে। শুয়েন চাঙ শশাঙ্ককে বৌদ্ধধর্মবিদ্বেষী রূপে বর্ণনা করেছেন। চিনা শ্রমণ বলেন, শশাঙ্ক বোধগয়ার বোধিবৃক্ষ ছেদন করেন, বোধগয়ায় সংরক্ষিত বুদ্ধমূর্তি অপসারণের নির্দেশ দেন, কুশীনগরের একটি বিহার থেকে বৌদ্ধশ্রমণদের বহিষ্কার করেন, বুদ্ধদেবের পদচিহ্ন রঞ্জিত এক প্রস্তরখণ্ড গঙ্গাবক্ষে নিক্ষেপ করেন। আর্য-মঞ্জুশ্রী-মূলকল্পেও শশাঙ্কের বৌদ্ধবিদ্বেষের বর্ণনা আছে। যেসব প্রাচীন লেখক শশাঙ্কের বিরুদ্ধে বৌদ্ধদের প্রতি বিদ্বেষের অভিযোগ এনেছেন তাঁরা সকলেই ধর্মে বৌদ্ধ ছিলেন। শশাঙ্কের প্রতি তাঁরা সকলেই বিরূপ ছিলেন। শুয়েন চাঙ শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণে দশটিরও বেশি বৌদ্ধবিহারের উল্লেখ করেছেন; সেসব বিহারে বসবাসকারী দ্বিসহস্র বৌদ্ধশ্রমণদের কথাও বলেছেন। শুয়েন চাঙ কিন্তু শশাঙ্কের তথাকথিত ধ্বংসলীলার কোনও চিহ্ন লক্ষ করেননি। ভারতীয় বৌদ্ধধর্মের লেখক তারনাথ বৌদ্ধবিদ্বেষী বহু রাজার উল্লেখ করেছেন কিন্তু শশাঙ্কের নাম উচ্চারণ করেননি। বস্তুত, শশাঙ্কের বৌদ্ধধর্ম বিদ্বেষের যে পরিচয় শুয়েন চাঙের বৃত্তান্ত ও আর্য-মঞ্জুশ্রী-মূলকল্পে প্রকাশিত হয়েছে তা কতদূর সত্য বলা কঠিন। শশাঙ্ক বৌদ্ধবিদ্বেষী ছিলেন, এ অভিযোগ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় স্বীকার করেন কিন্তু তিনি মনে করেন, শশাঙ্কের রাজ্যের বৌদ্ধপ্রজারা বৌদ্ধনরপতি হর্ষবর্ধনের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ায় গৌড়েশ্বর তাঁদের প্রতি দমনমূলক নীতি গ্রহণ করেন। কিন্তু শশাঙ্কের বৌদ্ধপ্রজারা হর্ষবর্ধনের সমর্থক ছিলেন, এ ধারণা নিতান্তই কাল্পনিক।

মুদ্রা : শশাঙ্ক মহাদেব ও লক্ষ্মী শ্রেণির কিছু স্বর্ণমুদ্রা উৎকীর্ণ করেন। এই শ্রেণির মুদ্রার মুখ্যদিকে নন্দীপৃষ্ঠে শিবমূর্তি উৎকীর্ণ, অপ্রধান পৃষ্ঠে লক্ষ্মীর প্রতিকৃতি অঙ্কিত। মুদ্রাগুলোর উভয় পৃষ্ঠে কখনও শ্রশ (শ্রীশশাঙ্ক), কখনওবা শ্রশ ও শ্রীশশাঙ্ক লেখ খোদিত আছে। ১৪৫ গ্রেন ওজনের এই মুদ্রাগুলোতে সুবর্ণ তৌলরীতি অনুসৃত হয়েছে। এই শ্রেণির কিছু মুদ্রা তাম্ৰধাতুতে নির্মিত কিন্তু সোনার প্রলেপযুক্ত। শশাঙ্ক অর্ধ-শতমান তৌলরীতিতেও কতিপয় স্বর্ণমুদ্রা উৎকীর্ণ করেন। মুদ্রাগুলো ৮৫ গ্রেন ওজনের। শশাঙ্কের স্বর্ণমুদ্রায় খাদের পরিমাণ অত্যধিক। এই মুদ্রাগুলো অর্থ নৈতিক সমৃদ্ধি বা শিল্পোৎকর্ষের পরিচয় বহন করে না। শশাঙ্ক রাজলীলা শ্রেণির সুবর্ণমুদ্রাও উৎকীর্ণ করেন বলে কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ অভিমত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এই মুদ্রাগুলো সমাচারদেবের, শশাঙ্কের নয়। (A. S. Altekar, Coinage Of The Gupta Empire (Benares, 1957), পৃষ্ঠা ৩২৪-২৭।)

রাজত্বের অবসান ও মূল্যায়ন

রাজত্বের অবসান : শশাঙ্ক কতদিন রাজত্ব করেন তা অনিশ্চিত। আর্য-মঞ্জুশ্রী-মূলকল্পে বলা হয়েছে, শশাঙ্ক কিঞ্চিদধিক সতেরো বৎসর রাজত্ব করেন। কিন্তু দ্বিতীয় মেদিনীপুর তাম্রশাসনে তাঁর ঊনবিংশ রাজ্যবর্ষের উল্লেখ আছে। অধ্যাপিকা দেবাহুতি অভিমত ব্যক্ত করেছেন, শশাঙ্ক ৬২০ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুমুখে পতিত হন। এ অভিমত যথার্থ নয়। সামন্ত মহারাজ সোমদত্তের মেদিনীপুর তাম্রশাসনখানি শশাঙ্কের রাজত্বের ঊনবিংশ বৎসরে উৎকীর্ণ হয়। সাধারণত মনে করা হয়, শশাঙ্ক আনুমানিক ৬০০ খ্রিস্টাব্দে গৌড়-কর্ণসুবর্ণের রাজপদে অভিষিক্ত হন। সেক্ষেত্রে সোমদত্তের মেদিনীপুর তাম্রশাসন ৬১৯ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ হয়েছিল, এরূপ ধারণা সংগত বোধ হয়। তখন শশাঙ্ক সমুদ্রমেখলা পৃথিবীর অধিপতিরূপে বন্দিত। শশাঙ্কের অনুগত মহাসামন্ত দ্বিতীয় মাধববর্মার গঞ্জাম তাম্রশাসনের তারিখ ৩০০ গুপ্তাব্দ বা ৬২০ খ্রিস্টাব্দ। তখনও তিনি চতুঃসমুদ্ৰান্ত ধরণীর মহারাজাধিরাজরূপে কীর্তিত। সুতরাং ৬২০ খ্রিস্টাব্দে শশাঙ্কের রাজত্বের অবসান হয়, এ মত সংগত বোধ হয় না। দীনেশচন্দ্র সরকার শশাঙ্কের দেহাবসান ৬২৫ খ্রিস্টাব্দে ধার্য করেছেন। শশাঙ্ক সম্ভবত আরও কয়েক বৎসর জীবিত ছিলেন। ৬৩৭ ৩৮ খ্রিস্টাব্দে শুয়েন চাঙ মগধ পরিভ্রমণ করেন। সে সময় পূর্ণবর্মা নামে জনৈক ব্যক্তি মগধের রাজপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। চিনা শ্রমণের বিবৃতি থেকে জানা যায়, তাঁর মগধ পরিদর্শনের অত্যল্পকাল পূর্বে শশাঙ্কের দেহাবসান হয়। অনুমিত হয়, ৬২৫ খ্রিস্টাব্দে নয়, ৬৩৭-৩৮ খ্রিস্টাব্দেরই অনতিকাল পূর্বে গৌড়াধিপ শশাঙ্ক লোকান্তরিত হন।

মূল্যায়ন : শশাঙ্ক নিংসন্দেহে প্রাচীন ভারতের, বিশেষত প্রাচীন বাংলার, এক শ্রেষ্ঠ নরপতি। হর্ষবর্ধন ও ভাস্করবর্মার মতো দু’জন প্রবল প্রতিপক্ষের নিরবচ্ছিন্ন বিরোধিতা সত্ত্বেও বাংলা, বিহার ও ওড়িশায় তিনি তাঁর কর্তৃত্ব অক্ষুণ্ণ রাখেন। তাঁর মতো পরাক্রমশালী রাজা পূর্বে কখনও বঙ্গে আবির্ভূত হননি। তাঁরই রাজত্বকালে, গৌড়ের রাজনৈতিক আধিপত্য সর্বপ্রথম বিহার ও প্রায় সমগ্র ওড়িশায় বিস্তার লাভ করে। তাঁর দুর্ভাগ্য, তাঁর সম্পর্কে জ্ঞাতব্য তথ্য মূলত তাঁর প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন সমকালীন ও উত্তরকালীন লেখকদের বৃত্তান্তে পরিবেশিত হয়েছে। সে বৃত্তান্তে তাঁর চরিত্রে অযথা কলঙ্ক আরোপিত হয়েছে। তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল কোনও জীবনীকারের বৃত্তান্তে তিনি হর্ষবর্ধনের মতোই মহিমময় নৃপতিরূপে বন্দিত হতেন। ভবিষ্যতে নতুন ও সুনির্দিষ্ট তথ্য আবিষ্কৃত হলে ভারত-ইতিহাসে উপেক্ষিত এই আত্মনির্ভরশীল রাজনৈতিক ভাগ্যান্বেষী হয়তো যথোচিতরূপে সমাদৃত হবেন।

কামরূপের বর্মা রাজবংশ ও কামরূপাধিপতি ভাস্করবর্মা

কামরূপের বর্মা রাজবংশ

বংশ-পরিচয় : বর্মা রাজবংশ ভৌম বা নারক নামেও পরিচিত। ভাস্করবর্মার পিতা-পিতামহেরা পুরুষানুক্রমে দীর্ঘদিন অসমে রাজত্ব করেছেন। জ্যেষ্ঠভ্রাতা সুপ্রতিষ্ঠিতবর্মার মৃত্যুর পর তিনি প্রাগজ্যোতিষ বা অসমের রাজপদে অভিষিক্ত হন। তাঁর পিতা মহারাজাধিরাজ সুস্থিতবর্মা, মাতা ধ্রুবলক্ষ্মী বা শ্যামাদেবী। শুয়েন চাঙ অসমের এই প্রাচীন রাজবংশটিকে ব্রাহ্মণ আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু এই বংশের রাজারা কখনও নিজেদের ব্রাহ্মণ বলে পরিচয় দেননি, তাঁরা মহাভারত প্রসিদ্ধ নরক এবং তাঁর পুত্র ভগদত্তের বংশজ বলে আত্মপরিচয় দিয়েছেন। অসমের এই বংশটিকে অনার্য গোষ্ঠীভুক্ত বলেই মনে হয়। কালক্রমে অসমে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি ও ধর্মের ধারক ও বাহকরূপে এই বংশ প্রসিদ্ধি লাভ করে।

প্রথম দিকের রাজাগণ : মহারাজ পুষ্যবর্মা খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতকের মধ্যভাগে কামরূপ বা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় একটি ক্ষুদ্র বর্মা রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর পুত্র সমুদ্রবর্মা এবং পুত্রবধূ দত্তদেবী। সম্ভবত গুপ্তসম্রাট সমুদ্রগুপ্ত ও তাঁর মহিষী দত্তদেবীর নামানুসারেই পুষ্যবর্মার পুত্র ও পুত্রবধূর এরূপ নামকরণ হয়েছে। অনুমিত হয়, সমুদ্রবর্মা গুপ্তনৃপতি সমুদ্রগুপ্তের অনুগত ছিলেন। এলাহাবাদ প্রশস্তির সাক্ষ্যেও এ ধারণা সমর্থিত হয়। এই লেখে কামরূপ তথা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা সমুদ্রগুপ্তের এক করদ রাজ্যরূপে বর্ণিত হয়েছে। বর্মা রাজবংশের ষষ্ঠ নৃপতি মহেন্দ্রবর্মা বা তাঁর পুত্র নারায়ণবর্মা দু’টি অশ্বমেধ যজ্ঞ অনুষ্ঠান করেন। বোঝা যায়, ততদিনে অসমে গুপ্ত আধিপত্যের অবসান হয়েছে, সেখানে মহেন্দ্রবর্মা বা নারায়ণবর্মার নেতৃত্বে একদা পরাধীন বর্মা রাজ্য এক স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের প্রারম্ভিক পর্বকে বর্মারাজ্যের ভাগ্যোদয় মুহূর্তরূপে চিহ্নিত করা যায়। বর্মা রাজারা অসুর নরকের বংশোদ্ভব বলে আত্মপরিচয় দিয়েছেন। মনে হয়, বর্মারা আর্য বহির্ভূত গোষ্ঠীভুক্ত ছিলেন কিন্তু পরে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কৃতি গ্রহণ করেন।

ভূতিবর্মা : নারায়ণবর্মার পুত্র মহারাজ মহাভূতবর্মা বা ভূতিবর্মার সিংহাসনে আরোহণের সঙ্গে সঙ্গে বর্মারাজ্যের প্রকৃত অভ্যুত্থান শুরু হয়। এক শক্তিমান রাজা ভূতিবর্মা। তাঁর রাজত্বকালীন একখানি শিলালেখ নওগাঁও জেলার বড়গঙ্গায় আবিষ্কৃত হয়েছে। অনেকে বলেন, লেখখানি ২৩৪ বা ২৪৪ গুপ্তাব্দ অর্থাৎ ৫৫৪ বা ৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ। কিন্তু লেখটি সম্ভবত তারিখবিহীন। লেখখানি প্রমাণ করছে, অসমের কপিলি উপত্যকা বা নওগাঁও অঞ্চল ভূতিবর্মার রাজ্যভুক্ত ছিল। এই অঞ্চলই সম্ভবত পূর্বে ডবাক নামে পরিচিত ছিল। এলাহাবাদ স্তম্ভলেখে কামরূপ ও ডবাক দু’টি স্বতন্ত্র রাজ্যরূপে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু ভৃতিবর্মার রাজত্বকালে ডবাকের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সত্তা বিলুপ্ত হয়, রাজ্যটি বর্মারাজ্য অর্থাৎ কামরূপের অন্তর্ভুক্ত হয়। তিনি দক্ষিণ দিকে সুর্মা অববাহিকা অঞ্চলেও নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। ভাস্করবর্মার নিধনপুর তাম্রশাসন থেকে জানা যায়, ভূতিবর্মা শ্রীহট্টের কিছু জমি দ্বিশতাধিক ব্রাহ্মণকে প্রদান করেন; মূল তাম্রশাসন বিনষ্ট হওয়ায় ভাস্করবর্মা পূর্বতন গ্রহীতাদের উত্তরপুরুষদের অনুকূলে নতুন একখানি তাম্রশাসন প্রদান করেন। সুমা উপত্যকা যে ভূতিবর্মার অধিকারভুক্ত ছিল, ভাস্করবর্মার নিধনপুর তাম্রশাসনে তা প্রমাণিত। কেউ কেউ বলেন, নিধনপুর তাম্রলেখে ভূতিবর্মার যে ভূমিদানের উল্লেখ আছে, তা উত্তর বঙ্গে অবস্থিত ছিল। কিন্তু এ মত ভ্রান্ত। ভূতিবর্মার সময় বর্মারাজ্য পশ্চিম দিকে করতোয়া নদী পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। তিনি নিজের বাহুবলে ক্ষুদ্র, সীমিত বর্মা রাজ্যটিকে এক বৃহদায়তন রাষ্ট্রে উন্নীত করেন। তিনিই সম্ভবত বর্মা রাজবংশের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ নরপতি। বাণভট্ট ভাস্করবর্মার পূর্বপুরুষদের উল্লেখ প্রসঙ্গে নরক, ভগদত্ত প্রভৃতি পৌরাণিক রাজাদের পরই ভূতিবর্মার কথা বলেছেন। এতে পিতা-পিতামহদের তুলনায় তাঁর উজ্জ্বলতর ভাবমূর্তিই আভাসিত হয়েছে। দীনেশচন্দ্র সরকার ভূতিবর্মার রাজত্বকাল ৫১৮-৪২ খ্রিস্টাব্দে ধার্য করেছেন।

চন্দ্রমুখবর্মা : ভূতিবর্মার মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র চন্দ্রমুখবর্মা কামরূপের রাজপদ লাভ করেন। তাঁর সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তাঁর মহিষীর নাম ভোগবতী। তাঁর পুত্র স্থিতবর্মা বা স্থিতিবর্মা বা স্থিরবর্মা। দ্বিরশ্বমেধযাজী তিনি। তাঁর একখানি মৃন্ময় সিলমোহর বিহারের নালন্দায় আবিষ্কৃত হয়েছে। চন্দ্রমুখবর্মা ও তাঁর পুত্রের রাজত্বকাল ৫৪২-৭০ খ্রিস্টাব্দে ধার্য করা যায়।

সুস্থিতবর্মা (আ. ৫৭০-৯০ খ্রিস্টাব্দ) : বর্মা রাজবংশের পরবর্তী রাজা সুস্থিতবর্মা। হর্ষচরিতে তিনি উচ্চ প্রশংসিত ; মহারাজাধিরাজ অভিধায় ভূষিত। আদিত্যসেনের আফসড় অভিলেখ থেকে জানা যায়, উত্তরকালীন গুপ্তরাজ মহাসেনগুপ্ত ব্রহ্মপুত্র নদতীরে সুস্থিতবর্মাকে পরাজিত করেন। কামরূপ জয় মহাসেনগুপ্তের উদ্দেশ্য ছিল না, কামরূপের ধন-সম্পদ আহরণের উদ্দেশ্যেই এই অভিযান পরিচালিত হয়েছিল বলে মনে হয়।

সুপ্রতিষ্ঠিতবর্মা : সুস্থিতবর্মার মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র সুপ্রতিষ্ঠিতবর্মা কামরূপের সিংহাসনে আরোহণ করেন। ভাস্করবর্মার দুবি তাম্রশাসনে বলা হয়েছে, গৌড়রাজ কামরূপ আক্রমণ করেন এবং সুপ্রতিষ্ঠিত বর্মা ও তাঁর অনুজ ভাস্করবর্মা গৌড়রাজের হস্তে পরাজিত ও বন্দি হন। অনুমিত হয়, বন্দি অবস্থায় তাঁদের গৌড়ে আনা হয়; পরে গৌড়রাজ আনুগত্যের বিনিময়ে তাঁদের মুক্তি দেন ও রাজ্য প্রত্যর্পণ করেন। রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন, এই গৌড়রাজ উত্তরকালীন গুপ্তরাজ মহাসেনগুপ্ত। কিন্তু এই দাবিতে সমস্যা রয়েছে –

  • কিন্তু মহাসেনগুপ্ত গৌড়বংশীয় ছিলেন না, কোনও লেখে তিনি গৌড় বলে আখ্যাতও হননি। (The Classical Age (Bombay, 1962), পৃষ্ঠা ১২। প্রতাপচন্দ্র চৌধুরী (The History of Civilisation of The People of Assam (Gauhati, 1966), পৃষ্ঠা ১৬৩) এ অভিমত সমর্থন করেন। তাঁর মতে গৌড়রাজের সঙ্গে সুপ্রতিষ্ঠিতবর্মার ৫৯৩-৯৪ খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধ হয়। কিন্তু এই তারিখ নিতান্তই আনুমানিক।) তিনি সম্ভবত গৌড়ে রাজত্বও করেননি।
  • দ্বিতীয়ত, আফসড় অভিলেখে মহাসেনগুপ্তের নামোল্লেখ আছে; সুস্থিতবর্মাকে তিনি পরাজিত করেন, এ কথাও স্পষ্ট বলা হয়েছে। মহাসেনগুপ্ত সুপ্রতিষ্ঠিতবর্মা ও ভাস্করবর্মার প্রতিপক্ষ হলে লেখে তাঁর নাম উল্লিখিত হত।

সুপ্রতিষ্ঠিতবর্মার অকাল মৃত্যুতে তাঁর অনুজ ভাস্করবর্মা কামরূপের সিংহাসনে আরোহণ করেন। ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে হর্ষবর্ধন যখন তাঁর ভ্রাতৃহত্তারকের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন, তখন ভাস্করবর্মা কামরূপে রাজত্ব করছেন। কিন্তু ৬০৬ খ্রিস্টাব্দের ঠিক কত বছর পূর্বে তিনি রাজপদে অভিষিক্ত হন, তা বলা দুস্কর। অনেকেই তাঁর সিংহাসনে আরোহণের বছরটিকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দে ধার্য করেছেন।

কামরূপাধিপতি ভাস্করবর্মা

সিংহাসনে আরোহণ

অসমের সুবিখ্যাত বর্মা রাজবংশে ভাস্করবর্মার জন্ম। খ্রিস্টীয় ৭ম শতকের ভারত ইতিহাসের এক প্রখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ভাস্করবর্মা। তাঁর রাজত্বকালে অসম এক শক্তিশালী রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে। উত্তর ভারতের বৃহত্তর রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে অসমের প্রথম অভ্যুদয় ঘটে তাঁরই শাসনকালে। কামরূপের আধিপত্য ছাড়াও বাংলার এক সুবিস্তীর্ণ অঞ্চল তাঁর অধিকারভুক্ত ছিল। হর্ষবর্ধন বা শশাঙ্কের সামরিক নৈপুণ্য তাঁর হয়তো ছিল না কিন্তু একজন বিচক্ষণ, গুণবান ও বিদ্যোৎসাহী নৃপতিরূপে তাঁর কৃতিত্ব অনস্বীকার্য।

জ্যেষ্ঠভ্রাতা সুপ্রতিষ্ঠিতবর্মা অকালে দেহত্যাগ করলে তাঁর অনুজ ভাস্করবর্মা প্রাগ্‌জ্যোতিষের সিংহাসনে আরোহণ করেন। বর্তমান জতিয়া-দিসপুর অঞ্চলে প্রাচীন প্রাগ্‌জ্যোতিষ শহরের অবস্থান নির্দেশ করা হয়। রাজ্যটি কামরূপ নামেও পরিচিত ছিল।

ভাস্করবর্মা কখন প্রাগজ্যোতিষের সিংহাসনে অভিষিক্ত হন বলা কঠিন। তিনি যে ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে হর্ষবর্ধনের স্থাথ্বীশ্বরের সিংহাসনে আরোহণের পূর্বে কামরূপের রাজপদে সমাসীন ছিলেন তা সুনিশ্চিত। সাধারণত মনে করা হয়, তিনি ৬০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ রাজপদ লাভ করেন। প্রতাপচন্দ্র চৌধুরী অভিমত ব্যক্ত করেছেন, ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে ভাস্করবর্মা রাজপদে অভিষিক্ত হন। (The History of Civilization Of The People of Assam (Gauhati, 1956), পৃষ্ঠা ১৬৩ ৬৪।) তিনি এ প্রসঙ্গে ‘কামরূপর পুরাবৃত্ত’ নামে একখানি প্রাচীন ইতিবৃত্তের উল্লেখ করেছেন। এই ইতিবৃত্তে বলা হয়েছে, ৬১২ অব্দে মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজী অসম অভিযান করেন। অসম অভিযান হয় ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে। এ থেকে অনুমান করা হয়, অসমে ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে একটি আঞ্চলিক অব্দ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রতাপচন্দ্র চৌধুরীর অভিমত, কোনও এক গুরুত্বপূর্ণ রাজার সিংহাসনে আরোহণ উপলক্ষে এই অব্দের প্রচলন হয়। সেই যশস্বী নরপতি অবশ্যই ভাস্করবর্মা। এ মত যুক্তিগ্রাহ্য নয়। যে তথাকথিত প্রাচীন গ্রন্থের সাক্ষ্যের উপর এ সিদ্ধান্ত সে গ্রন্থটির কোনও সন্ধান নেই। ভাস্করবর্মা কোনও অব্দ প্রবর্তন করলে দুবি ও নিধনপুর তাম্রশাসনে তার উল্লেখ থাকত। কিন্তু লেখ দু’টি তারিখবিহীন। ভাস্করবর্মা ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে রাজপদে অভিষিক্ত হন এ মত গ্রহণীয় নয়।

কোনও কোনও ঐতিহাসিকের ধারণা, পুষ্যভূতিরাজ হর্ষবর্ধন ভাস্করবর্মাকে কামরূপের রাজপদে অভিষিক্ত করেন। হর্ষচরিতের একটি উক্তি এরূপ অভিমতের ভিত্তি। উক্তিটি হচ্ছে – ‘অত্র দেবেন অভিষিক্তঃ কুমারঃ’। অর্থাৎ দেব কুমারকে রাজপদে অভিষিক্ত করেছেন। এই দেব অবশ্যই হর্ষবর্ধন। কিন্তু কে এই কুমার? ভাস্করবর্মা কুমার নামেও পরিচিত ছিলেন। (চিনা বিবরণে ভাস্করবর্মাকে কুমার বলা হয়েছে। অনেকে বলেন এই অসনৃপতি চিরকুমার ছিলেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন, অল্পবয়সে রাজ্য লাভ করেছিলেন বলেই তার এই নাম বা উপনাম। বিষয়টি বিতর্কিত।) নীহাররঞ্জন রায়, রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়েরা এই কুমারকে ভাস্করবর্মারূপে শনাক্ত করেছেন। সেক্ষেত্রে স্বীকার করতে হয়, হর্ষবর্ধন ভাস্করবর্মাকে রাজ্যে অভিষিক্ত করেন। কিন্তু এ সিদ্ধান্ত ঠিক নয়। হর্ষবর্ধনের পূর্বেই ভাস্করবর্মা রাজপদ লাভ করেন। হর্ষচরিতের এই কুমার ভাস্করবর্মা নন, তিনি মহাসেনগুপ্তের পুত্র দ্বিতীয় কুমারগুপ্ত। মাধবগুপ্তের জ্যেষ্ঠভ্রাতা তিনি।

হর্ষবর্ধনের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন

ভাস্করবর্মা যখন কামরূপের রাজপদে অভিষিক্ত হন শশাঙ্ক প্রায় সে সময় মগধে এক স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। শীঘ্রই বাংলা ও ওড়িশার বৃহদংশ তাঁর করায়ত্ত হয়। মগধ-গৌড়েশ্বরের শক্তি বৃদ্ধিতে ভাস্করবর্মা আতঙ্কিত হন। শশাঙ্কের সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য তিনি এক পরাক্রান্ত রাজশক্তির সাহায্যের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। তিনি হৃদয়ঙ্গম করলেন, এক মহাবলী রাজার সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করলে তাঁর রাজ্যের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হবে।

স্থাথ্বীশ্বরের পুষ্যভূতিরা শশাঙ্কের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন ছিলেন। তাঁদেরই জামাতা গ্রহবর্মার রাজ্যের অঙ্গহানি ঘটিয়ে শশাঙ্ক স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করেছেন। ভাস্করবর্মা শশাঙ্কের প্রতি বিদ্বিষ্ট পুষ্যভূতিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনে সচেষ্ট হন। এই উদ্দেশ্যে তিনি হংসবেগকে প্রচুর উপঢৌকন সহ স্থাথ্বীশ্বরের রাজদরবারে প্রেরণ করেন। কিন্তু স্থাথ্বীশ্বরে পৌঁছবার পূর্বেই হর্ষবর্ধনের সঙ্গে হংসবেগের সাক্ষাৎ হয়। হর্ষবর্ধন তখন সসৈন্যে শশাঙ্কের বিরুদ্ধে অগ্রসরমান। হংসবেগ হর্ষ বর্ধনকে জানান, তাঁর প্রভু ভাস্করবর্মার দৃঢ় সংকল্প, তিনি শিব ছাড়া আর কারোর নিকট মাথা নত করবেন না ; হর্ষবর্ধনের সঙ্গে অক্ষয় বন্ধুত্ব স্থাপিত হলে তবেই তাঁর প্রভু নিজ সংকল্পে অটল থাকতে পারবেন। কামরূপরাজের এই বন্ধুত্বের প্রস্তাব হর্ষবর্ধন সানন্দে গ্রহণ করেন। তিনি হংসবেগকে আশ্বস্ত করে বলেন, স্বয়ং তিনি যাঁর সহায়, তাঁর শিব ছাড়া অন্য কারোর কাছে নতি স্বীকারের কিবা প্রয়োজন? হর্ষচরিতে বর্ণিত হর্ষবর্ধন ও হংসবেগের এই কথোপকথন থেকে মনে হয়, ভাস্করবর্মা এক শত্রু রাজার আক্রমণের আশঙ্কা করছিলেন। শত্রুর সেই সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহতের উদ্দেশ্যেই হর্ষবর্ধনের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব স্থাপন। এই শত্রু রাজা শশাঙ্ক ছাড়া আর কেউ নন।

হর্ষবর্ধনের সঙ্গে তাঁর এই বন্ধুত্ব ভাস্করবর্মার পক্ষে অবশ্যই শুভ হয়। শশাঙ্ক কখনও তাঁর রাজ্য আক্রমণ করেননি। ভাস্করবর্মার বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পাঠালে হর্ষবর্ধন হস্তক্ষেপ করবেন, শশাঙ্কের মনে সম্ভবত এরূপ আশঙ্কা কাজ করছিল। হয়তো হর্ষবর্ধনও এই বন্ধুত্বের ফলে লাভবান হন। অনুমিত হয়, ৬১২ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে বা তার অব্যবহিত পর হর্ষবর্ধন শশাঙ্কের রাজ্য আক্রমণ করলে ভাস্করবর্মা তাঁকে সাহায্য করেন। এ সম্পর্কে অবশ্য কোনও সুনিশ্চিত প্রমাণ নেই।

বাংলায় রাজ্য-বিস্তার

বাংলাদেশের শ্রীহট্ট জেলার পঞ্চখণ্ড পরগনার নিধনপুর গ্রামে ভাস্করবর্মার একখানি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হয়েছে। শাসনখানি শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ বিজয়স্কন্ধাবার হতে সম্প্রদত্ত। বোঝা যায়, শাসনটির প্রকাশকালে ভাস্করবর্মা গৌড়রাজ্যের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ নগরে অবস্থান করেন। নিধনপুর তাম্রশাসনে কোনও তারিখের উল্লেখ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে : ভাস্করবর্মা কখন গৌড়রাজ্য আক্রমণ করেন এবং কর্ণসুবর্ণে স্বাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন? রামশঙ্কর ত্রিপাঠী প্রমুখ কোনও কোনও ঐতিহাসিক মনে করেন শশাঙ্কের মৃত্যুর পর হর্ষবর্ধন বাংলা অধিকার করেন এবং হর্ষবর্ধনের পরলোকগমনের পরই ভাস্করবর্মা বাংলার কিয়দংশে স্বীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।

কিন্তু শুয়েন চাঙের জীবনী গ্রন্থ ও তাঁর ভারত-বৃত্তান্তের যুগপৎ সাক্ষ্য থেকে অনুমিত হয়, ৬৪৩ খ্রিস্টাব্দের প্রারম্ভে অর্থাৎ হর্ষবর্ধনের জীবদ্দশায় বাংলার একাংশ ভাস্করবর্মার রাজ্য ভুক্ত ছিল। শুয়েন চাঙের জীবনী গ্রন্থ থেকে জানা যায়, হর্ষবর্ধন তখন রাজমহলের সন্নিকটবর্তী কজঙ্গলে অবস্থান করছেন। তিনি অবগত হন, শুয়েন চাঙ সেই মুহূর্তে ভাস্করবর্মার অতিথি রূপে কামরূপ পরিদর্শন করছেন। হর্ষবর্ধন দূত মারফৎ ভাস্করবর্মাকে অনুরোধ করেন, তিনি যেন শুয়েন চাঙকে অনতিবিলম্বে তাঁর নিকট পাঠিয়ে দেন। কামরূপরাজ হর্ষবর্ধনের এ অনুরোধে কর্ণপাত করেননি। বিরক্ত হর্ষবর্ধন ভাস্করবর্মাকে বলে পাঠান, তিনি যেন অনতিবিলম্বে চিনা শ্রমণকে কজঙ্গলে প্রেরণ করেন। ভাস্করবর্মা উত্তর দিলেন, হর্ষ তাঁর মুণ্ড নিতে পারেন কিন্তু তিনি শুয়েন চাঙকে তৎক্ষণাৎ পাঠাতে পারবেন না। তাঁর নির্দেশের প্রতি ভাস্করবর্মার এই অবজ্ঞা লক্ষ করে কুপিত হর্ষবর্ধন দূতমুখে বলে পাঠান, ভাস্করবর্মা যেন তাঁর গর্দানই দেন। হর্ষবর্ধনের এই কঠিন মনোভাবে ভাস্করবর্মা অস্বস্তিবোধ করেন। তিনি ২০ হাজার হস্তী ও ৩০ হাজার নৌযানসহ শশব্যস্তে শুয়েন চাঙকে সঙ্গে নিয়ে গঙ্গানদীপথে কজঙ্গলে হর্ষ সমীপে উপনীত হন।

দেখা যাচ্ছে, কজঙ্গলে হর্ষের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে ভাস্করবর্মা এক সুবিশাল সৈন্যবাহিনী সহ যাত্রা করেন। কজঙ্গলে যাওয়ার পথে তাঁকে উত্তর বাংলা অতিক্রম করতে হয়। হর্ষবর্ধনের মতো এক পরাক্রমশালী রাজার রাজ্যের মধ্য দিয়ে সসৈন্যে অগ্রসর হওয়া ভাস্করবর্মার পক্ষে সম্ভব ছিল না। মনে হয়, উত্তর বাংলা তখন ভাস্করবর্মার রাজ্যভুক্ত ছিল। শুয়েন চাঙের বর্ণিত একটি ঘটনা থেকেও অনুরূপ সিদ্ধান্ত করা যায়। ঘটনাটি ভাস্করবর্মা ও নালন্দা মহাবিহারের অধ্যক্ষ শীলভদ্রের বিতর্ক সম্পর্কিত। ভাস্করবর্মা একবার অধ্যক্ষ শীলভদ্রকে অনুরোধ করেন, তিন যেন শুয়েন চাঙকে সত্বর তাঁর নিকট পাঠাবার ব্যবস্থা করেন। শীলভদ্র সে অনুরোধ প্রত্যাখান করেন। শীলভদ্রের ঔদাসীন্যে ভাস্করবর্মা ক্রুদ্ধ হন এবং অবিলম্বে শুয়েন চাঙকে না পাঠালে নালন্দা মহাবিহার তিনি ধুলায় গুঁড়িয়ে দেবেন বলে শীলভদ্রকে ভীতি প্রদর্শন করেন। ভয় পেয়ে শীলভদ্র শুয়েন চাঙকে কামরূপে পাঠিয়ে দেন। বাংলার কিয়দংশে তাঁর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত না হলে ভাস্করবর্মার নালন্দা মহাবিহার ধ্বংসের ভীতিপ্রদর্শন কার্যত অর্থহীন হয়। অনুমিত হয়, ৬৩৭-৩৮ খ্রিস্টাব্দের কিছুকাল পূর্বে শশাঙ্কের মৃত্যুর পর হর্ষবর্ধন ও ভাস্করবর্মা একযোগে বাংলা আক্রমণ করেন। উত্তর ও পূর্ব বঙ্গ কামরূপরাজের অধিকৃত হয়, পশ্চিম বাংলায় হর্ষবর্ধনের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

রাজ্যের বিস্তৃতি, ওয়াং শুয়ান চে’র ভারত অভিযান ও ভাস্করবর্মার ভূমিকা

রাজ্যের বিস্তৃতি : ভাস্করবর্মা মূলত কামরূপেই রাজত্ব করতেন। তাঁর বৃদ্ধ প্রপিতামহ ভূতি বর্মার একখানি লেখ নওগাঁও জেলার বড়গঙ্গায় আবিষ্কৃত হয়েছে। গৌহাটির নিকটবর্তী কামাখ্যা পর্বতগাত্রে উৎকীর্ণ লেখটি সম্ভবত তাঁরই এক পূর্বপুরুষ মহারাজাধিরাজ মহেন্দ্রবর্মার। ভাস্কর বর্মার একখানি তাম্রশাসনের প্রাপ্তিস্থল কামরূপ জেলার দুবি গ্রাম। প্রাচীনকালে কামরূপ জনপদ পশ্চিমদিকে করতোয়া নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। শুয়েন চাঙ পুণ্ড্রবর্ধন জনপদ থেকে করতোয়া নদী অতিক্রম করে কামরূপে প্রবেশ করেন। খ্রিস্টীয় ১০ম শতকে রচিত কালিকাপুরাণেও করতোয়া নদীকে কামরূপের পশ্চিম সীমানারূপে চিহ্নিত করা হয়েছে। কালিকাপুরাণ থেকে জানা যায়, কামরূপ পূর্বদিকে দিক্করবাসিনী পীঠ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। অসমের লক্ষ্মীমপুর জেলার সদিয়া বা সন্নিকটবর্তী কোনও এক স্থানে এই পীঠ অবস্থিত ছিল। অনুমিত হয়, ভাস্করবর্মার সময় কামরূপ পশ্চিমে করতোয়া নদী থেকে পূর্বে সদিয়া বা তন্নিকটস্থ কোনও এক স্থান পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। পরে শশাঙ্কের দেহাবসানের পর উত্তর ও পূর্ব বঙ্গও ভাস্করবর্মার রাজ্যভুক্ত হয়। নালন্দায় তাঁর একখানি মৃন্ময় সিলমোহরের সন্ধান পাওয়া গেছে। কিন্তু তা নালন্দার ভাস্করবর্মার রাজ্যে অন্তর্ভুক্তির প্রমাণ নয়। মগধে হর্ষবর্ধন, মাধবগুপ্ত-আদিত্যসেনরা পর পর রাজত্ব করেছেন। সেখানে ভাস্করবর্মার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় কীরূপে?

ওয়াং শুয়ান চে’র ভারত অভিযান ও ভাস্করবর্মার ভূমিকা : চিনা বৃত্তান্তে উল্লেখ আছে, ত্রিশজন অশ্বারোহীসহ চিনা দূত ওয়াং শুয়ান চে যখন ভারতে আগমন করেন হর্ষবর্ধন তখন পরলোকগত। তাঁর মন্ত্রী অর্জুন বা অরুণাশ্ব কান্যকুব্জের সিংহাসন অধিকার করে বসেছেন। তিনি চিনা দূতকে আক্রমণ করে পরাজিত করেন এবং তাঁর সম্পদ আত্মসাৎ করেন। হতচকিত চিনা দূত তিব্বতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তিব্বতের তদানীন্তন রাজা স্রোন সন গম পো তাঁকে ১২ হাজার সৈন্য দিয়ে সাহায্য করেন, নেপালাধীশ অংশুমান তাঁকে দেন ৭ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য। এই সৈন্যবাহিনীসহ চিনা দূত পুনর্বার ভারতে প্রবেশপূর্বক অর্জুনকে আক্রমণ ও পরাজিত করেন। অর্জুন বন্দি হন। তাঁর পত্নী ও পুত্রগণের ভাগ্যেও তাই ঘটল। ৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে ওয়াং শুয়ান চে চিন দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। অর্জুনকে চিনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই তিনি দেহরক্ষা করেন। চিনা বৃত্তান্তে বলা হয়েছে, পূর্ব ভারতের রাজা কুমার অর্থাৎ ভাস্করবর্মা ওয়াং শুয়ান চে’কে ভারত অভিযানে রসদ ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়ে সাহায্য করেন। বৈদেশিক শত্রুদের বিতাড়নে সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন, ভাস্করবর্মার নিকট এটিই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু সে দায়িত্ব তিনি পালন করেননি। উপরন্তু তিনি বৈদেশিক শত্রুদের সাহায্যই করেছেন। এ কাজ তাঁর চরিত্রে কালিমা লেপন করেছে।

ভাস্কর-হর্ষ সম্পর্ক

দীনেশচন্দ্র সরকার অভিমত প্রকাশ করেছেন, ভাস্করবর্মা হর্ষবর্ধনের বশীভূত মিত্র ছিলেন। তিনি মনে করেন, প্রথমাবস্থায় হর্ষবর্ধনের সঙ্গে ভাস্করবর্মার মর্যাদাব্যঞ্জক বন্ধুত্ব বিদ্যমান থাকলেও পরবর্তিকালে পুষ্যভূতিরাজের ক্ষমতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় উভয়ের সম্পর্কের অবনতি হয় এবং ভাস্করবর্মা হর্ষবর্ধনের বশীভূত মিত্রে পরিণত হন। এ মতের সমর্থনে দু’টি ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম ঘটনাটি শুয়েন চাঙকে সত্বর কজঙ্গলে পাঠাতে ভাস্করবর্মার প্রতি হর্ষবর্ধনের নির্দেশ সংক্রান্ত। দ্বিতীয় ঘটনাটি হর্ষবর্ধনের রাজ্যে ভাস্করবর্মার সুদীর্ঘকালীন উপস্থিতি-বিষয়ক। শুয়েন চাঙের জীবনী গ্রন্থ ও চিনা শ্রমণের ভ্রমণ-বৃত্তান্ত থেকে জানা যায়, ভাস্করবর্মা হর্ষবর্ধনের সঙ্গে কজঙ্গল থেকে কান্যকুব্জে গমন করেন। কান্যকুব্জের মহাসমারোহে তিনি যোগদানও করেন। হর্ষবর্ধনের আয়োজিত প্রয়াগের অনুষ্ঠানেও ভাস্করবর্মা অংশগ্রহণ করেন। দীনেশচন্দ্র সরকার প্রশ্ন করছেন, একজন সার্বভৌম নরপতি কী করে দীর্ঘদিন পররাজ্যে অবস্থান করেন? হর্ষবর্ধনের রাজ্যে ভাস্করবর্মার দীর্ঘকালীন উপস্থিতি প্রমাণ করছে তিনি তখন আর সমমর্যাদাসম্পন্ন বন্ধু নন, পুষ্যভূতিরাজের অনুগত মিত্র। এ অভিমতের সঙ্গে সকলেই একমত হবেন, এমন নয় –

  • প্রথমত, ভাস্করবর্মা কজঙ্গলে হর্ষবর্ধনের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে বিশাল সৈন্যবাহিনীসহ উত্তর বাংলার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হন। উত্তর বাংলা হর্ষের রাজ্যভুক্ত হলে এ কাজ তাঁর পক্ষে সমীচীন হত না। সে সময় উত্তর বঙ্গ তাঁরই অধিকারভুক্ত ছিল। তাহলে স্বীকার করতে হচ্ছে, হর্ষের জীবিতকালে ভাস্করবর্মা শশাঙ্কের রাজ্যের একাংশ অধিকার করেন। কোনও বশীভূত মিত্রের পক্ষে এ কাজ অভাবনীয়।
  • দ্বিতীয়ত, হর্ষবর্ধনের রাজ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর উপস্থিতি ভাস্করবর্মার তথাকথিত অধীনতামূলক মিত্রতার সুনিশ্চিত প্রমাণ নয়। এক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের মিত্রদেশের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে যোগ দানের রীতি আজও সৌজন্যের অভিব্যক্তিরূপে স্বীকৃত হয়।
  • তৃতীয়ত, চিনা শ্রমণের বৃত্তান্তে ভাস্করবর্মার যে পরিচয় প্রতিফলিত তাতে প্রাগজ্যোতিষনৃপতি এক স্বাধীন, সার্বভৌম রাজারূপেই প্রতিভাত। হর্ষবর্ধনের সঙ্গে ভাস্করবর্মার কখনও কখনও হয়তো ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে, সম্পর্কের অবনতি হয়েছে কিন্তু ভাস্করবর্মা হর্ষবর্ধনের বশীভূত মিত্র ছিলেন, এমন ধারণা যুক্তিযুক্ত মনে হয় না।

ধর্মমত, শুয়েন চাঙের বর্ণনায় কামরূপ, মৃত্যু ও উপসংহার

ধর্মমত : হর্ষচরিতে ভাস্করবর্মাকে শিবভক্তরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। শুয়েন চাঙও তাঁকে ব্রাহ্মণ্যধর্মাবলম্বী রূপে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তিনি অন্যান্য ধর্মের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। বৌদ্ধশ্রমণ শুয়েন চাঙের প্রতি তিনি যে আতিথেয়তা প্রদর্শন করেন তা তাঁর ধর্মীয় ঔদার্যেরই পরিচায়ক। শুয়েন চাঙ বলেন, ভাস্করবর্মা বৌদ্ধশ্রমণদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতেন। কিন্তু সে সময় অসমে যে বৌদ্ধধর্ম জনপ্রিয় ছিল না চিনা শ্রমণের বৃত্তান্তে তা প্রকাশিত।

শুয়েন চাঙের বর্ণনায় কামরূপ : শুয়েন চাঙ ভাস্করবর্মার রাজ্যের বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর বৃত্তান্তে। তাঁর বর্ণনা থেকে জানা যায়, রাজ্যটি ছিল নিচু ও আর্দ্র ; ফসল উৎপন্ন হত নিয়মিত ; কাঁঠাল ও সুপারির ফলন ছিল প্রচুর ; জলবায়ু অনুকূল ; লোকেরা সৎ ও খর্বাকৃতি; তাঁদের ভাষা মধ্য ভারতের ভাষা থেকে কিছুটা পৃথক ; লোকেরা বিদ্যানুরাগী ; দূর-দূরাঞ্চল থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে অধ্যয়ন করতে আসতেন ; লোকেরা ছিলেন ব্রাহ্মণ্যধর্মাবলম্বী; বৌদ্ধধর্মে তাঁদের বিশ্বাস ছিল না ; রাজা বৌদ্ধধর্মাবলম্বী নন কিন্তু বৌদ্ধশ্রমণদের প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল।

মৃত্যু : আনুমানিক ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে ভাস্করবর্মা দেহত্যাগ করেন। তাঁর পরলোকগমনের সঙ্গে সঙ্গে বর্মা রাজবংশের উচ্ছেদ হয়। ‘ম্লেচ্ছরাজ’ শালস্তম্ভ কামরূপ অধিকার করেন।

উপসংহার : ভাস্করবর্মা যে একজন কীর্তিমান নরপতি ছিলেন তা নিঃসন্দেহ। তাঁর রাজত্ব কালে বর্মারাজ্য কামরূপের ভৌগোলিক সীমানা পেরিয়ে উত্তর ও পূর্ব বঙ্গে বিস্তার লাভ করে। কামরূপকে তিনি রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটিয়ে উত্তর ভারতের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের এক কেন্দ্রবিন্দুতে সমুন্নীত করেন। নিজে ব্রাহ্মণ্যধর্মাবলম্বী হয়েও বৌদ্ধশ্রমণ শুয়েন চাঙের প্রতি অকৃত্রিম আতিথেয়তা প্রদর্শন করে ধর্মীয় ঔদার্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। তাঁরই শাসনকালে কামরূপ শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্ররূপে সর্বভারতীয় পরিচিতি লাভ করে। তাঁর দুর্ভাগ্য, তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বর্মা রাজবংশের অবসান হয়। তা যদি না হত প্রাচীন কামরূপের ইতিহাসে হয়তো অন্য মাত্রা সংযোজিত হত।

গ্রন্থপঞ্জি (শশাঙ্ক ও ভাষ্করবর্মা)

  • দীনেশচন্দ্র সরকার : পাল-পূর্ব যুগের বংশানুচরিত (কলকাতা, ১৯৮৫)।
  • নীহাররঞ্জন রায় : বাঙ্গালীর ইতিহাস (কলকাতা, ১৯৯৩)।
  • Chattopadhyaya, S.: Early History Of North India (Calcutta, 1968).
  • Choudhury, P. C. The History Of Civilization Of The People Of Assam To The Twelfth Century A. D. (Gauhati, 1966).
  • Devahuti, D. Harsha: A Political Study (Delhi, 1998). Ganguly, D. K. Historical Geography And Dynastic History Of Orissa Up To The Rise Of The Imperial Gangas (Calcutta, 1975).
  • Majumdar, R. C.: History Of Ancient Bengal (Calcutta, 1971).
  • Majumdar, R. C. (Ed.). The Classical Age (Bombay, 1962); A Comprehensive History Of India (New Delhi, 1981).
  • Mookerji, R. K. Harsha (London, 1926). Raychaudhuri H. C.: Political History Of Ancient India (Calcutta, 1953).
  • Sen, B. C. Some Historical Aspects Of The Inscriptions Of Bengal (Calcutta, 1942).
  • Tripathy, R. S. History Of Kanauj To The Moslem Conquest (Benares, 1932).

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.