গুর্জর-প্রতীহার রাজবংশ (৭৩০-১০৩৬ খ্রি.) : রাজবৃত্তান্ত

Table of Contents

গুর্জর-প্রতিহার

কতিপয় প্রাচীন গুর্জর-প্রতীহার রাজবংশ : পশ্চিম ও মধ্য ভারতের বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি গুর্জর-প্রতীহার রাজবংশের অভ্যুদয় হয়েছিল। এদের মধ্যে যেটি প্রাচীনতম সেটির আবির্ভাব ঘটেছিল রাজস্থানের জোধপুর অঞ্চলে। এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা হরিচন্দ্র খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের মধ্যভাগে রাজত্ব করেন। কিন্তু হরিচন্দ্র বা তাঁর উত্তরাধিকারীরা আঞ্চলিক শক্তিরূপেই রাজত্ব করে গেছেন, অখিল ভারতীয় রাজচক্রবর্তী রূপে কখনও আত্মপ্রকাশ করেননি। প্রথম দিকে মাণ্ডব্যপুর বা মাণ্ডোর এবং পরবর্তিকালে মেডন্তক বা আধুনিক মারতা এই রাজ্যের রাজধানী ছিল। খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের শেষ ভাগে গুজরাতের ব্রোচ অঞ্চলে আর একটি গুর্জর রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হয়। এই বংশের আদি রাজা প্রথম দদ্দ। রাজ্যের রাজধানী নান্দীপুরী বা বর্তমান নান্দোড। কিন্তু যে গুর্জর-প্রতীহার রাজবংশ দীর্ঘকাল ভারতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল তার আবির্ভাব ঘটেছিল খ্রিস্টীয় ৮ম শতকের প্রথম পর্বে রাজস্থানের জালোর ও মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনী অঞ্চলে। খ্রিস্টীয় ১১শ শতকের প্রারম্ভকাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময় জালোর-উজ্জয়িনীর গুর্জর-প্রতীহার রাজারা ভারতের এক বৃহত্তম শক্তিরূপে বিরাজমান ছিলেন। তাঁদের অগ্রগতির পথে বাধা ছিল বিস্তর, ভাগ্যও সর্বদা সুপ্রসন্ন ছিল না। কিন্তু এসব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তাঁরা উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে এক বিশাল সাম্রাজ্য গঠন করেছিলেন। হর্ষোত্তর উত্তর ভারতে এত বিশাল সাম্রাজ্য আর কখনও গড়ে ওঠেনি। আঞ্চলিক শক্তিরূপে যাত্রা শুরু করে এক বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তিরূপে গুর্জর-প্রতীহারদের অভ্যুত্থান এবং পরিশেষে খ্যাতির শীর্ষদেশ থেকে তাঁদের ক্রমাবরোহণ ও পতন ভারতীয় ইতিহাসের এক আকর্ষণীয় অধ্যায়।

রাজবংশসমূহের পারস্পরিক সম্পর্ক : উপরোক্ত তিন তিনটি গুর্জর রাজবংশের মধ্যে কী পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল সে সম্পর্কে কোনও সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে মাণ্ডোর ও জালোর উজ্জয়িনীর গুর্জর রাজারা নিজেদের প্রতীহার বলে পরিচয় দিয়েছেন। তাছাড়া এই দু’টি রাজবংশ থেকেই দাবি করা হয়েছে, যে লক্ষ্মণ তাঁর জ্যেষ্ঠভ্রাতা রামভদ্রের (স্বভ্রাতা-রামভদ্রস্য) প্রতীহারী অর্থাৎ দ্বাররক্ষকের (প্রতীহার্যং কৃতম্) কাজ করেছিলেন সেই লক্ষ্মণই তাঁদের আদি পুরুষ। উপরন্তু দু’টি বংশের বেশ কয়েকজন রাজা একই ধরনের নাম গ্রহণ করেছেন। এ থেকে রমেশচন্দ্র মজুমদার ও বৈজনাথ পুরীর মতো ঐতিহাসিকরা অনুমান করেছেন, এই দু’টি গুর্জর রাজবংশ একই গুর্জর বংশের দু’টি ভিন্ন শাখা। নান্দীপুরীর গুর্জরদের আদি রাজা প্রথম দদ্দ। মাণ্ডোরের গুর্জর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা হরিচন্দ্রের কনিষ্ঠ পুত্রের নামও দদ্দ। এ কারণে অনেকেই নান্দীপুরী ও মাণ্ডোরের গুর্জরদের একই বংশের দু’টি শাখা বলে শনাক্ত করেছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে নান্দীপুরীর গুর্জর রাজারা নিজেদের গুর্জর-নৃপ-বংশের লোক বলে পরিচয় দিয়েছেন, কখনও নিজেদের প্রতীহার বলে উল্লেখ করেননি। তাছাড়া নান্দীপুরীর দদ্দ যে হরিচন্দ্রেরই এক পুত্র ছিলেন সে সম্পর্কেও কোনও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। ফলে কারোর কারোর মনে হয়েছে, নান্দীপুরীর দদ্দ এবং মাণ্ডোরের হরিচন্দ্রের গোষ্ঠী এক হলেও বংশ ভিন্ন ছিল। তবে এই মতের সত্যতা সম্পর্কেও সন্দেহের অবকাশ আছে।

জালোর-উজ্জয়িনীর রাজাদের কেন গুর্জর-প্রতীহার নামকরণ : জালোর-উজ্জয়িনীর রাজাদের কেন গুর্জর প্রতীহার বলা হয় তার একটু ব্যাখ্যা প্রয়োজন। এই রাজারা তাঁদের লেখমালায় নিজেদের পরিচয় দিয়েছেন প্রতীহার বলে, গুর্জর বলে নয়। অথচ সমকালীন পাল, রাষ্ট্রকূট, কলচুরিচন্দেল্ল লেখাবলিতে এঁদের গুর্জর বলা হয়েছে। সে কারণেই এই রাজাদের গুর্জর প্রতীহার বলা হয়। এই বংশের কোনও রাজা একই সঙ্গে গুর্জর ও প্রতীহার বলে উল্লিখিত হননি। কিন্তু খ্রিস্টীয় ১০ম শতকের আলোয়ারের আঞ্চলিক রাজা মথনদেব রাজোরগড় লেখে গুর্জর-প্রতীহাররূপে বর্ণিত হয়েছেন। লেখমালায় গুর্জর ও প্রতীহার পদ দু’টিকে বংশ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতীহার অবশ্যই বংশের নাম। কিন্তু গুর্জর শব্দের অর্থ আরও ব্যাপক। প্রতীহার নৃপতিরা ছাড়া চাহমান এবং চৌলুক্য বংশীয় রাজারাও গুর্জর বলে পরিচিত ছিলেন। তাই নিছক বংশ অর্থে নয়, গোষ্ঠী বা জাতি এই বৃহত্তর অর্থেরই ব্যঞ্জনা প্রকাশ পেয়েছে গুর্জর পদটিতে।

গুর্জরেরা ভারতীয় না বহিরাগত : জালোর-উজ্জয়িনীর প্রতীহার রাজারা যে গুর্জর গোষ্ঠী বা জাতির অন্তর্ভুক্ত সেই গুর্জররা ভারতীয় না বহিরাগত তা এক বিতর্কিত বিষয়। গুর্জররা এক বিদেশি জাতি এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন ভিনসেন্ট স্মিথ, ব্যূলার, দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকর, প্রবোধচন্দ্র বাগচী এবং আরও অনেকে। এঁদের মধ্যে কেউ গুর্জরদের শ্বেত হুণ, কেউ খজর, আবার কেউবা উ-সুনদের মতো এক মধ্য এশীয় জনগোষ্ঠী রূপে চিহ্নিত করেছেন। গুর্জর কথাটি অসংস্কৃত শব্দ। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য তাঁদের সম্পর্কে নীরব। খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকে ভারতের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে ধূমকেতুর মতো তাঁরা হঠাৎ আবির্ভূত হন। পাঞ্জাব থেকে গুজরাত-রাজস্থান পর্যন্ত বহুস্থানে গুর্জর বসতির চিহ্ন বিদ্যমান। চন্দ তাঁর রাসমেলা কাব্যে গুর্জরদের অগ্নিশুদ্ধ হওয়ার কাহিনি বর্ণনা করেছেন। এসব যুক্তির ভিত্তিতেই গুর্জরদের বিদেশি বলে শনাক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এ ধরনের যুক্তির অন্য ব্যাখ্যাও আছে। ফলে গুর্জরেরা যে বিদেশি ছিলেন, এ কথা এখনও সুনিশ্চিত নয়। গুর্জরদের দেশ ভারতবর্ষ এই অভিমতের সমর্থকদের সংখ্যাও বড় কম নয়। এই দলে রয়েছেন রমেশচন্দ্র মজুমদার, বৈজনাথ পুরী, দশরথ শর্মার মতো খ্যাতনামা ঐতিহাসিকরা। এঁদের কারোর মতে গুর্জরদের আদি বাসভূমি আবু পাহাড় অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। আবার কেউ কেউ রাজস্থানের ভিনমাল-জালোর অঞ্চলকে এঁদের নিবাসস্থল বলে নির্দেশ করেছেন। গুর্জরদের ভারতীয়ত্বের সমর্থনে সাধারণত দু’টি যুক্তির অবতারণা করা হয়। কিন্তু যুক্তিগুলি যে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত তা নয় –

  • এক. কোনও কোনও লেখে গুর্জর-ব্রাহ্মণদের উল্লেখ করা হয়েছে। গুর্জরেরা বিদেশি হলে তাঁদের একটি গোষ্ঠী ব্রাহ্মণত্বের স্বীকৃতি পেত না। কিন্তু বিদেশাগত হলে ব্রাহ্মণ হওয়া যাবে না প্রাচীন ভারতে এমন বিধি ছিল না। মগ ব্রাহ্মণেরা তো পারস্য থেকে এসেছিলেন। ভারতবর্ষে তাঁরা ব্রাহ্মণ বলেই পরিচিত ছিলেন।
  • দুই. প্রতীহার রাজারা নিজেদের রঘুবংশী ক্ষত্রিয় বলে পরিচয় দিয়েছেন। তাঁরা বিদেশি হলে এমনটি হত না। কিন্তু প্রতীহার নৃপতিরা ভারতীয় ছিলেন বলেই নিজেরা রঘুবংশী ক্ষত্রিয় বলে পরিচয় দিয়েছেন এমন ধারণা সঠিক নাও হতে পারে।

এই মুহূর্তে গুর্জরদের আদি বাসভূমি বা তাঁদের উদ্ভব সম্পর্কে কোনও স্থির সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়। মনে রাখতে হবে, গুর্জর নামে কোনও প্রাচীন মধ্য এশীয় গোষ্ঠীর অস্তিত্ব আজও অপ্রমাণিত। কিন্তু খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকে গুর্জর জাতি যে যোধপুর অঞ্চলে বসবাস করত তার অকাট্য প্রমাণ আছে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গুর্জরদের ভারতীয় বলে ভাবা খুব একটা অযৌক্তিক নয়। তবে বিষয়টি নিঃসন্দেহে বিতর্কিত। বর্তমানে গুর্জর জাতির লোকেরা পাক-ভারত উপমহাদেশের নানা স্থানে ছড়িয়ে আছেন। তাঁরা আছেন জম্মু-কাশ্মীর, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, অবিভক্ত পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ ও গুজরাতের বিভিন্ন স্থানে। তাঁদের মধ্যে কেউ পশুচারক, কেউ কৃষক, কেউবা ব্যবসায়ী। ধর্মমতেও তাঁরা ভিন্ন। তাঁদের কেউ মুসলমান, কেউ হিন্দু, আবার কেউবা খ্রিস্টান। প্রাচীন গুর্জর জাতির এঁরাই বংশধর। (গুর্জর-প্রতীহার এই যুগ্ম পদটিকে অনেকে একদা গুর্জরবাসী প্রতীহার, এই অর্থে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, অঞ্চলের নাম গুর্জর হল কী করে? কোনও স্থানে বিশেষ এক গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে বাস করলে তবেই গোষ্ঠীর নামে সেই স্থানের নামকরণ হয়। ফলে এক সময় গুর্জর অঞ্চলে বাস করেছেন বলে তাঁরা গুর্জর এ ব্যাখ্যা সংগত বোধ হয় না। গুর্জর গোষ্ঠী বা জাতিভুক্ত প্রতীহার এই অর্থেই গুর্জর-প্রতিহার যুগ্ম পদটিকে গ্রহণ করা উচিত।)

জালোর-উজ্জয়িনীর গুর্জর-প্রতীহার রাজবংশের রাজবৃত্তান্ত

প্রথম নাগভট (৭৩০-৭৬০ খ্রি.)

জালোর-উজ্জয়িনীর গুর্জর-প্রতীহার রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা প্রথম নাগভট। তাঁর আর এক নাম নাগাবলোক। আনুমানিক ৭২৫ বা ৭৩০ খ্রিস্টাব্দে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন। ম্লেচ্ছদের বিরুদ্ধে জয়লাভ প্রথম নাগভটের জীবনের এক স্মরণীয় কৃতিত্ব বলে তাঁরই বংশধর প্রথম ভোজের গ্বালিয়র প্রশস্তিতে কীর্তিত হয়েছে। এই বর্ণনা অত্যুক্তি নয়। আরব দেশীয় ঐতিহাসিক বিলাদুরি সিন্ধুর আরব প্রশাসক জুনায়েদ-এর ভারত অভিযানের এক চিত্তাকর্ষক বর্ণনা পরিবেশন করেছেন। খ্রিস্টীয় ৮ম শতকের দ্বিতীয় পাদে সেনাপতি জুনায়েদ মধ্য ও পশ্চিম ভারতে কয়েকটি সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। বিলাদুরির বর্ণনা থেকে জানা যায়, মধ্য ও পশ্চিম ভারত অভিযানকালে জুনায়েদ বইলমন, জুরজ ইত্যাদি স্থান অধিকার করেন। বিলাদুরি জুনায়েদের উজ্জয়িনী অভিযানের কথাও বলেছেন কিন্তু উজ্জয়িনী অধিকৃত হয়েছে এমন কথা তিনি বলেননি। প্রথম নাগভটের রাজধানী ছিল এই উজ্জয়িনী। জুনায়েদের উজ্জয়িনী অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল বলেই অনুমিত হয়। গ্বালিয়র প্রশস্তিতে যাঁদের ম্লেচ্ছ বলা হয়েছে তাঁরা নিঃসন্দেহে জুনায়েদের নেতৃত্বাধীন এই আরব বাহিনী। গুজরাতের আঞ্চলিক প্রশাসক অবনিজনাশ্রয় পুলকেশীর নৌসারি তাম্রশাসনেও এই আরব বা তাজীক অভিযানের বর্ণনা আছে। (নৌসারি লেখ ৭৩৮ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ হয়েছে। এই লেখে আরবদের বিরুদ্ধে পুলকেশী জনাশ্রয়ের যে জয়ের কথা বলা হয়েছে তা ঘটেছিল ওই বছরের একেবারে গোড়ার দিকে বা তার কিছুকাল পূর্বে।) তাজীক বাহিনী যেসব রাজ্য অধিকার করেছিল নৌসারি লেখে সেসব রাজ্যের উল্লেখ আছে কিন্তু সে তালিকায় উজ্জয়িনী বা অবন্তির নাম নেই। অর্থাৎ, উজ্জয়িনী বা অবন্তিরাজ প্রথম নাগভটের বিরুদ্ধে ম্লেচ্ছ বা আরবগণ যে সাফল্য অর্জন করেননি তা নৌসারি লেখের সাক্ষ্যে সমর্থিত হচ্ছে। নৌসারি লেখ দাবি করছে পুলকেশী জনাশ্রয় তাজীকদের পরাজিত করেছেন। গ্বালিয়র প্রশস্তিতে প্রথম নাগভটের সপক্ষে একই দাবি উচ্চারিত হয়েছে। এ থেকে মনে হয়, প্রথম নাগভটের জয় ঘটেছিল মধ্য ভারতে, পুলকেশিরাজের গুজরাতে। শুধু জুনায়েদের বিরুদ্ধে নয়, পরবর্তী আরব সেনাধ্যক্ষ বা প্রশাসকদের বিরুদ্ধেও প্রথম নাগভট সাফল্য লাভ করেন। বিলাদুরির বিবৃতি থেকে জানা যায় জুনায়েদের পরবর্তী মুসলমান শাসকবৃন্দ রণনিপুণ না হওয়ায় অনেক অঞ্চল তাঁদের হস্তচ্যুত হয়। প্রথম নাগভট সম্ভবত আরবদের বিতাড়িত করে পশ্চিম ও মধ্য ভারতের কয়েকটি স্থানে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা করেন।

শৈল বংশীয় রাজা দ্বিতীয় জয়বর্ধনের রাঘোলি অভিলেখে বলা হয়েছে, পৃথুবর্ধন নামে এই বংশের এক পূর্বতন নৃপতি গুর্জর অঞ্চল অধিকার করেন। রমেশচন্দ্র মজুমদার অভিমত প্রকাশ করেছেন, পৃথুবর্ধন ও প্রথম নাগভট একই সময় রাজত্ব করেন এবং তাঁরা পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। কিন্তু পৃথুবর্ধন যে প্রথম নাগভটের সমসাময়িক ছিলেন তা অবশ্যই জোর দিয়ে বলা যায় না।

রাষ্ট্রকূট নৃপতি দন্তিদুর্গের সঙ্গে সংঘর্ষ প্রথম নাগভটের রাজত্বকালের আর একটি উল্লেখ যোগ্য ঘটনা। উজ্জয়িনী তথা অবন্তি প্রথম নাগভটের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই অঞ্চলটির উপর দন্তিদুর্গের লুব্ধ দৃষ্টি পড়ে। এর কারণও ছিল। উত্তর ও দক্ষিণমুখী বাণিজ্যিক পথগুলির সিংহভাগেরই মিলনস্থল ছিল এই অঞ্চল। সমকালীন প্রাকৃত গ্রন্থ কুবলয়মালা থেকে জানা যায়, উজ্জয়িনী ও মালবের ভিতর দিয়ে পাঁচ পাঁচটি পথ পাঁচটি ভিন্ন দিকে প্রসারিত ছিল। অযোধ্যা, কৌশাম্বী, তক্ষশিলা, প্রতিষ্ঠান, বিন্ধ্যাটবী, ভূগুকচ্ছ ও বিজয়পুরীর মতো বিখ্যাত শহরগুলির সঙ্গে উজ্জয়িনী সড়কপথে সংযুক্ত ছিল। বস্ত্রশিল্পেরও এক প্রধান কেন্দ্র ছিল এই উজ্জয়িনী। এখানে এত সূক্ষ্ম বস্ত্র তৈরি হত যে একটি আংটির ভিতর দিয়ে একখানি বস্ত্র স্বচ্ছন্দে গলিয়ে দেওয়া যেত। ঐশ্বর্যশালী এই অঞ্চলটির উপর নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠাকল্পে দন্তিদুর্গ উজ্জয়িনী আক্রমণ করেন। রাষ্ট্রকূটরাজ তাঁর তারিখবিহীন এলোরা দশাবতার গুহালেখে দাবি করেছেন, উজ্জয়িনীর গুর্জর রাজপ্রাসাদটি দখলে এনে সেখানে মহাদান যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন। অপর এক রাষ্ট্রকূট নৃপতি প্রথম অমোঘবর্ষের সঞ্জান তাম্রশাসনে বলা হয়েছে, দন্তিদুর্গ উজ্জয়িনী শহরে হিরণ্যগর্ভ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন এবং গুর্জরেশ্বর ও অন্যান্য রাজারা সেই যজ্ঞমণ্ডপে প্রতীহারী অর্থাৎ দ্বাররক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন : “হিরণ্যগর্ভং রাজন্যৈরুজ্জয়িন্যাং যদাসিতম্। প্রতিহারীকৃতং যেন গুর্জরেশাদিরাজকম্ ৷৷” দন্তিদুর্গের বিরুদ্ধে এই সংঘর্ষের ফল প্রথম নাগভটের পক্ষে শুভ হয়নি। প্রতীহাররাজ পরাজয় বরণ করেন। দন্তিদুর্গ অবশ্য দীর্ঘদিন উজ্জয়িনীতে অবস্থান করতে পারেননি। শীঘ্রই চালুক্যরা রাষ্ট্রকূট রাজ্য আক্রমণে উদ্যত হন। দন্তিদুর্গ সত্বর নিজ রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করেন। এই সুযোগে প্রথম নাগভট উজ্জয়িনী-অবন্তি অঞ্চলে নিজেকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন।

প্রথম নাগভটের রাজ্যটি আয়তনে বেশ বড়ই ছিল বলা যায়। একটি চাহমান লেখে ইঙ্গিত আছে, গুজরাতের ভৃগুকচ্ছ অঞ্চল প্রথম নাগভটের রাজ্যভুক্ত ছিল। মনে হয়, তাঁর রাজ্য দক্ষিণ দিকে কিম নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। যোধপুর অঞ্চলের স্থানীয় প্রতীহার রাজারা তাঁর অনুগত ছিলেন। কুবলয়মালা কাব্যে বলা হয়েছে তাঁর ভ্রাতুষ্পৌত্র বৎসরাজ জালোর অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। জালোর যে প্রথম নাগভটের শাসনাধীন ছিল তা এক প্রকার সুনিশ্চিত।

জিনসেনের লেখা জৈন হরিবংশে বৎসরাজ ‘অবন্তিভূভৃৎ’ বা অবন্তিরাজ বলে বর্ণিত হয়েছেন। এই ব্যাখ্যা হয়তো অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য বোধ হবে না। তাঁরা বলবেন, শ্লোকে ‘অবন্তি-ভূভৃতি’ পদের পর ‘নৃপে বৎসাদিরাজে’ কথাটি আছে ; বৎসরাজকে অবন্তিরাজ বলে গ্রহণ করলে তাঁকে পুনরায় রাজারূপে বর্ণনা করা অর্থহীন। কিন্তু পদ্যে একই বা সমার্থক শব্দের বারংবার প্রয়োগের অজস্র নজির আছে। দ্বিতীয়ত, শ্লোক দু’টি পড়লে মনে হয় কবি এখানে উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও অপর অর্থাৎ পশ্চিম এই চার দিকের চারজন রাজার কথা বলেছেন। কিন্তু অবন্তিরাজ ও বৎসরাজ যদি ভিন্ন ব্যক্তি হন তাহলে তালিকায় চার নয়, পাঁচজন রাজার উল্লেখ পাওয়া যাবে। শ্লোক দু’টির ব্যঞ্জনা তা নয়। আমাদের ব্যাখ্যার সমর্থনে আরও দু’টি যুক্তি আছে। এক, অবন্তিরাজ ও বৎসরাজ দুই পৃথক ব্যক্তিত্ব হলে বৎসরাজকে পাশ্চাত্যের রাজারূপে গ্রহণ করতে হবে। হরিবংশের কবি গুজরাতের বর্ধমানপুর বা আধুনিক ওয়াচওয়ানে বসে তাঁর কাব্য রচনা করেছেন। বৎসরাজের রাজ্য বর্ধমানপুরের পশ্চিমে নয়, পূর্ব দিকে অবস্থিত ছিল। দুই, শ্লোক দু’টিতে বিভিন্ন রাজাদের নামোল্লেখ আছে। ইন্দ্রায়ুধ, শ্রীবল্লভ, বৎসরাজ এবং বরাহ বা জয়বরাহ সবই রাজার নাম। ‘অবস্তি-ভূভৃৎ’ কোনও রাজার নাম নয়, রাজার পরিচয়। অবন্তির সঙ্গে প্রতীহারদের সম্পর্ক বৎসরাজের আমলে শুরু হয়নি, এর সূত্রপাত প্রথম নাগভটের সময় থেকে। মনে হয়, প্রথম নাগভটের রাজ্য পশ্চিমে ভূগুকচ্ছ থেকে পূর্বে উজ্জয়িনী ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। উজ্জয়িনী সম্ভবত প্রথম নাগভটের রাজধানী ছিল। কেউ কেউ এ প্রসঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিম রাজস্থানে অবস্থিত জালোরের কথা বলেন।

৮ম শতকের প্রথম পর্বে প্রথম নাগভটের নেতৃত্বে ভৃগুকচ্ছ থেকে অবন্তি পর্যন্ত প্রসারিত এক স্বাধীন গুর্জর-প্রতীহার রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ভারতবর্ষের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তিনি যখন রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হলেন তখন পশ্চিম ও মধ্যভারতে অবিশ্রান্ত ধারায় আরব অভিযান চলছে। হরিচন্দ্রের প্রতীহার বংশ সে আক্রমণের সামনে ভেঙে পড়ল। নান্দীপুরীর গুর্জরেরা প্রথম প্রথম সাফল্য লাভ করলেও শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করেন। কিন্তু প্রথম নাগভট আরব আক্রমণ প্রতিহত করেন এবং এক বিস্তীর্ণ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। কঠিন পরিস্থিতি সত্ত্বেও তাঁর এই সাফল্য তাঁকে ভারত-ইতিহাসে স্মরণীয় করে রেখেছে।

কক্কুক ও দেবরাজ (৭৬০-৭৮০ খ্রি.)

প্রথম নাগভট আনুমানিক ৭৬০ খ্রিস্টাব্দে অপুত্রক অবস্থায় দেহত্যাগ করেন। এর পর রাজা হন তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র কক্কুক। কক্কুকের আর এক নাম কাকুৎস্থ। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁরই অনুজ দেবরাজ বা দেবশক্তি প্রতীহার সিংহাসনে আরোহণ করেন। বৈজনাথ পুরীর অভিমত, রাষ্ট্রকূটরাজ দন্তিদুর্গ যে গুর্জর নৃপতিকে পরাজিত করেন তিনি এই দেবরাজ। কিন্তু মনে রাখতে হবে, দেবরাজের রাজপদ লাভের পূর্বেই দন্তিদুর্গের জীবনাবসান হয়। রাজা বাউকের যোধপুর লেখে বল্লমণ্ডলের অধিপতি ভট্টিক দেবরাজের উল্লেখ আছে। এই ভট্টিক দেবরাজ যোধপুর শাখার রাজা শিলুকের হাতে পরাজিত হয়েছিলেন। রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন, প্রতীহার দেবরাজ আর বল্লমণ্ডলের ভট্টিক দেবরাজ একই ব্যক্তি ছিলেন। এ মত যথার্থ নয়। এঁদের রাজ্য আলাদা, সময়ও ভিন্ন। ভট্টিক দেবরাজ সম্ভবত জয়সলমিরে রাজত্ব করতেন। কক্কুক বা দেবরাজ সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানা যায় না। সম্ভবত ৭৭৮ খ্রিস্টাব্দের কিছু পূর্বে দেবরাজের মৃত্যু হয়। অতঃপর সিংহাসনে বসলেন তাঁরই পুত্র এবং মহিষী ভূয়িকাদেবীর গর্ভজাত সন্তান বৎসরাজ।

বৎসরাজ (৭৮০-৮০০ খ্রি.)

সাম্রাজ্যলিপ্স ছিলেন এই বৎসরাজ। পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে যে রাজ্য তিনি লাভ করেন তা আয়তনে বেশ বড়ই ছিল। কিন্তু তাতে সন্তুষ্ট না থেকে তিনি নতুন রাজ্য জয়ে মনোনিবেশ করেন। গ্বালিয়র প্রশস্তি থেকে জানা যায়, বৎসরাজ ভণ্ডি নামে এক রাজবংশকে উচ্ছেদ করেন। রমেশচন্দ্র মজুমদার এই ভণ্ডি বংশকে কান্যকুজের আয়ুধ রাজ বংশের সঙ্গে এক ও অভিন্ন বলে মনে করেন। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে এই ভণ্ডি বংশ ও হর্ষচরিতে বর্ণিত ভঙির বংশ একই। মত দু’টির কোনওটিই সম্ভবত ঠিক নয়। মোট কথা, গ্বালিয়র প্রশস্তিতে উল্লিখিত ভক্তিদের পরিচয় সম্পর্কে এখনও অনিশ্চয়তা রয়েছে। ঠিক কোন্ অঞ্চলে তাঁরা রাজত্ব করতেন তাও আমাদের অজানা। ভণ্ডিদের বিরুদ্ধে জয়লাভের পর বৎসরাজ পূর্বদিকে অর্থাৎ গাঙ্গেয় ভূভাগে প্রতীহার প্রভুত্ব স্থাপনের সংকল্প গ্রহণ করেন। কৃষি ও বাণিজ্যে সমৃদ্ধ গাঙ্গেয় ভূখণ্ডের প্রতি সমকালীন পালরাজ ধর্মপালেরও লুব্ধ দৃষ্টি পড়েছিল। কান্যকুব্জসহ গাঙ্গেয় ভূভাগ, বিশেষত গঙ্গা-যমুনা দোয়াবের উপর রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় তাঁরা উভয়েই উদ্যোগী হন। এই পরিস্থিতিতে বৎসরাজ ও ধর্মপালের মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে দেখা দিল।

৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ বৎসরাজের এক প্রস্তরলেখ থেকে জানা যায়, তিনি ইন্দ্ররাজকে কান্যকুব্জের সিংহাসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। এর অর্থ, ইন্দ্ররাজ পূর্বে সিংহাসনচ্যুত হয়ে ছিলেন। পাল লেখ থেকে জানা যায়, রাজা ধর্মপাল ইন্দ্ররাজকে পরাজিত করে তাঁর অনুগ্রহভাজন চক্রায়ুধকে কান্যকুব্জের সিংহাসনে অভিষিক্ত করেন। সেক্ষেত্রে বৎসরাজের ইন্দ্ররাজকে কান্য কুব্জের সিংহাসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার অর্থ অনধিকারী চক্রায়ুধকে বিতাড়িত করে ইন্দ্ররাজের অনুকূলে বৎসরাজের কনৌজ পুনরুদ্ধার। মনে হয়, বৎসরাজ শুধু চক্রায়ুধকেই পরাজিত করলেন না, চক্রায়ুধের আশ্রয়স্থল ধর্মপালকেও পরাভূত করেন। চক্রায়ুধের হাত থেকে কান্যকুব্জ অধিকার কালে বা তার অব্যবহিত পর বৎসরাজের সঙ্গে ধর্মপালের যে যুদ্ধ হয়েছিল তা রাষ্ট্রকূট রাজা তৃতীয় গোবিন্দের রাধনপুর ও ওয়ানি লেখের সাক্ষ্যে সমর্থিত হচ্ছে। এই দু’টি লেখে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা হয়েছে, বৎসরাজ গৌড়রাজ অর্থাৎ ধর্মপালকে পদানত করেন।

ধর্মপালের সঙ্গে বৎসরাজের ঠিক কোথায় যুদ্ধ হয়েছিল তা এক বিতর্কের বিষয়। বৈজনাথ পুরী মনে করেন, এই যুদ্ধ ঘটেছিল বাংলারই কোনও এক স্থানে। তাহলে তো স্বীকার করতে হয়, কনৌজ অধিকার করে বৎসরাজ সসৈন্যে বিহারের ভিতর দিয়ে একেবারে বাংলার অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন আর ধর্মপাল বিপদ আসন্ন জেনেও শত্রুকে কোনওরূপ বাধা না দিয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেন। এমন ভাবনা যুক্তিসংগত নয়। বাংলায় নয়, গঙ্গা-যমুনা দোয়াবে এই যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়েছিল, এরূপ একটি মতও আছে। রাষ্ট্রকূট লেখমালার ইঙ্গিত সেদিকেই। সুনির্দিষ্ট তথ্যের অভাবে যুদ্ধটির ঘটনাকাল সম্পর্কেও অনিশ্চয়তা রয়েছে।

ধর্মপালের পরাভবের ফলে উত্তর ও পূর্ব ভারতে প্রতীহার প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়। এ সুযোগের সদ্ব্যবহারে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হন বৎসরাজ। অল্পদিনের মধ্যে ধর্মপাল নিজের শক্তিকে সংগঠিত করেন এবং পুনর্বার বৎসরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন। এবার কিন্তু ভাগ্য লক্ষ্মী বৎসরাজের প্রতি বিরূপ হন। দক্ষিণ ভারতের রাষ্ট্রকূটরাজ ধ্রুব অসামান্য তৎপরতার সঙ্গে প্রতীহার রাজ্য আক্রমণ করেন এবং বৎসরাজকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। ধ্রুবের হাতে পরাজয়ের ফলে বৎসরাজ এমন বিপর্যস্ত হলেন যে তাঁর আধিপত্য কেবলমাত্র রাজস্থানের কয়েকটি অঞ্চলে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। পূর্বের সে প্রতাপ তাঁর আর ছিল না। এই ভাগ্যবিপর্যয়ের মধ্যে অনেকটা অনাদৃত অবস্থায় আনুমানিক ৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জীবনাবসান হয়।

বৈজনাথ পুরীর অভিমত, ধ্রুবের হাতে পরাজয়ের পরও বৎসরাজ দীর্ঘকাল রাজত্ব করেন। তিনি মনে করেন, ধ্রুবের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রকূট রাজ্যের বিশৃঙ্খলার সুযোগে বৎসরাজ এক বিশাল রাজ্য গঠন করেন কিন্তু শেষে রাজা ধ্রুবের উত্তরাধিকারী তৃতীয় গোবিন্দের নিকট ৮০৮ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ পরাজিত হন। তিনি আরও বলেন, রাধনপুর লেখে তৃতীয় গোবিন্দের হাতে পরাজিত যে গুর্জর নৃপতির উল্লেখ আছে তিনি সম্ভবত বৎসরাজ। কিন্তু এই শনাক্তকরণ সঠিক নয় ; বৎস রাজের দীর্ঘস্থায়ী রাজত্বও প্রমাণসিদ্ধ নয়।

দ্বিতীয় নাগভট (৮০০-৮৩৩ খ্রি.)

বৎসরাজের মৃত্যুতে তাঁর পুত্র দ্বিতীয় নাগভট পৈতৃক সিংহাসনে আরোহণ করেন। দ্বিতীয় নাগভট যখন সিংহাসনে বসেন তখন প্রতীহার রাজ্যে ঘোর সংকট। রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র অবন্তি প্রতীহারদের হস্তচ্যুত ; রাজস্থানের এক সীমিত অঞ্চলে তাঁদের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত। পাল সম্রাট ধর্মপাল নিজেকে উত্তর ভারতের একচ্ছত্র নরপতিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং তাঁরই আজ্ঞাবহ চক্রায়ুধ কান্যকুব্জের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত। কিন্তু দ্বিতীয় নাগভট অচিরেই নিজেকে এক সুযোগ্য শাসকরূপে প্রতিষ্ঠিত করলেন। তাঁর সফল নেতৃত্বে প্রতীহার রাজশক্তির পুনরভ্যুত্থান ঘটল।

সিংহাসনে আরোহণ করেই দ্বিতীয় নাগভট দু’টি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দেন। এক, রাজস্থান ও সন্নিহিত অঞ্চলে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। দুই, এক মিত্রজোট গঠন করে নিজের শক্তি বৃদ্ধি করা। তিনি অল্পদিনের মধ্যেই রাজস্থানের প্রায় সর্বত্র, মালব ও উত্তর গুজরাতে নিজের আধিপত্য স্থাপন করেন। গ্বালিয়র প্রশস্তিতে বলা হয়েছে, পতঙ্গ যেমন অনলের দিকে ধাবিত হয় তেমনি অন্ধ্র, সিন্ধু, বিদর্ভ ও কলিঙ্গের রাজারা দ্বিতীয় নাগভটের নিকট আত্মসমর্পণ করেন। স্খালিয়র প্রশস্তির এই উক্তিতে দ্বিতীয় নাগভটের এক মিত্রজোট গঠনের ইঙ্গিত আছে। এই সব রাজন্যবৃন্দ পালরাষ্ট্রকূট রাজ্যের মধ্যবর্তী অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। প্রতিবেশী দুই পরাক্রান্ত শত্রুর বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার জন্য তাঁরা দ্বিতীয় নাগভটের জোটে যোগদান করেন। মিত্রজোট গঠিত হওয়ায় প্রতীহার রাজের শক্তি নিঃসন্দেহে বৃদ্ধি পায়।

দ্বিতীয় নাগভটের এই হঠাৎ অভ্যুত্থান রাষ্ট্রকূট রাজশক্তি প্রসন্নচিত্তে গ্রহণ করেনি। ইতিমধ্যে রাষ্ট্রকূট রাজ্যে পালাবদল ঘটেছে। ধ্রুব লোকান্তরিত হয়েছেন। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন তাঁর পুত্র তৃতীয় গোবিন্দ। তাঁর রাজ্যলাভের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রকূট রাজ্যের চতুর্দিকে অশান্তি ও বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। কিন্তু অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ও বাহুবলের সাহায্যে তৃতীয় গোবিন্দ রাজ্যে শান্তি শৃঙ্খলা স্থাপন করেন, নিজের কর্তৃত্ব সুদৃঢ় করেন। অতঃপর রাষ্ট্রকূটরাজ দ্বিতীয় নাগভটের বিরুদ্ধে সসৈন্যে অগ্রসর হন। সঞ্জান তাম্রশাসনে বলা হয়েছে, যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতীহার নৃপতি পরাজিত হন কিন্তু পরে স্বরাজ্যে পুনর্বাসিত হন। কখনও কখনও বলা হয়, ধর্মপাল ও তাঁর অনুগত চক্রায়ুধের অনুরোধেই তৃতীয় গোবিন্দ দ্বিতীয় নাগভটের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন কিন্তু এ মতের সমর্থনে কোনও তথ্য নেই। দ্বিতীয় নাগভটকে পরাজিত করে তৃতীয় গোবিন্দ আরও উত্তরদিকে অগ্রসর হন। ধর্মপাল ও চক্রায়ুধ তাঁর নিকট আত্মসমর্পণ করেন।

তৃতীয় গোবিন্দ দ্বিতীয় নাগভটের ক্ষমতা খর্ব করেন বটে কিন্তু তাঁকে একেবারে উচ্ছেদ করলেন না। প্রতীহাররাজ রাজস্থানের কয়েকটি অঞ্চলে পূর্বের মতোই আধিপত্য ভোগ করেন কিন্তু সমগ্র মালবের উপর আর তাঁর নিয়ন্ত্রণ রইল না। এর কিয়দংশে রাষ্ট্রকূট প্রভূত্ব প্রতিষ্ঠিত হল। পরমার বংশীয় উপেন্দ্র তথাকার শাসনকর্তা নিযুক্ত হলেন। তাছাড়া দ্বিতীয় নাগভটের যাঁরা মিত্র ছিলেন তাঁদের কয়েকজনকে তৃতীয় গোবিন্দ পরাজিত করেন। বিদর্ভরাজ ছিলেন দ্বিতীয় নাগভটেরই এক অনুগত মিত্র। তৃতীয় গোবিন্দ বিদর্ভ অধিকার করেন। ওড্ররাজও তৃতীয় গোবিন্দের হাতে পরাজিত হন। ওড্র বা কলিঙ্গরাজও একদা প্রতীহার নৃপতির মিত্রজোটে যোগদান করেছিলেন। এভাবে দ্বিতীয় নাগভটের মিত্রদের চূর্ণ করে তৃতীয় গোবিন্দ পরোক্ষভাবে প্রতীহার রাজের ক্ষমতাই সংকুচিত করেন। দ্বিতীয় নাগভটকে সমূলে উচ্ছেদ না করে তৃতীয় গোবিন্দ তাঁর শুধু ডানা ছেঁটে দিলেন। এর পিছনে রাষ্ট্রকূটরাজের এক গভীর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কাজ করেছিল। ভবিষ্যতে পাল রাজারা পরাক্রান্ত হয়ে উঠলে এই প্রতীহাররাই তাঁদের প্রতিরোধ করবেন, তৃতীয় গোবিন্দের মনে এরূপ এক ভাবনা সক্রিয় ছিল।

তৃতীয় গোবিন্দের সসৈন্যে দক্ষিণ ভারতে প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় নাগভটের সামনে নিজেকে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নৃপতিরূপে প্রতিষ্ঠিত করার সুবর্ণ সুযোগ এসে উপস্থিত হয়। কিন্তু পাল সম্রাট ধর্মপাল ইতিমধ্যে নিজেকে উত্তর ভারতের সার্বভৌম রাজারূপে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করতে না পারলে দ্বিতীয় নাগভটের আশা অসম্পূর্ণ থেকে যেত। পালরাজকে পরাজিত করা সহজ ব্যাপার ছিল না। এর জন্য পরিপূর্ণ প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল, আর প্রয়োজন ছিল এক শক্তিশালী মিত্রবাহিনী গঠন করা। প্রথমে নিজের শক্তিকে সংহত করে দ্বিতীয় নাগভট চক্রায়ুধের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। চক্রায়ুধ যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তাঁর প্রভু ধর্মপালের শরণাপন্ন হন। উত্তর ভারতের আধিপত্যকে কেন্দ্র করে প্রতীহার ও পাল রাজাদের মধ্যে সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী হয়ে দেখা দেয়। ধর্মপালের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বহু আঞ্চলিক রাজা দ্বিতীয় নাগভটের পক্ষ অবলম্বন করেন।

রাজা বাউকের জোধপুর লেখ থেকে জানা যায়, তাঁর পিতা কক্ক মুগগিরিতে গৌড়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যশ লাভ করেন। বিহার রাজ্যের বর্তমান মুঙ্গের শহরটির প্রাচীন নাম মুদ্‌গগিরি। দ্বিতীয় অবনিবর্মার উনালেখে বলা হয়েছে, বাহুকধবল ধর্ম নামে জনৈক রাজাকে পরাজিত করেন। রাজা ধর্মই যে পাল সম্রাট ধর্মপাল সে সম্পর্কে কোনও সংশয় নেই। বাহুক ধবল ছিলেন প্রতীহারদেরই অধীনস্থ উত্তর গুজরাতের এক আঞ্চলিক প্রশাসক। বালাদিত্যের চাটসু অভিলেখে প্রকাশ, শঙ্করগণ নামে আর একজন রাজা গৌড় অধিকার করে তাঁর প্রভুকে তা উপহার প্রদান করেন। কক্ক, বাহুকধবল, শঙ্করগণ প্রভৃতি আঞ্চলিক রাজারা দ্বিতীয় নাগ ভটের সমকালীন ছিলেন। দ্বিতীয় নাগভট ধর্মপালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে তাঁরা সদলে প্রতীহাররাজের পক্ষে যোগদান করেন।

জোধপুর লেখের সাক্ষ্যে প্রতীয়মান হয়, বিহারের মুঙ্গেরে দ্বিতীয় নাগভট ও ধর্মপাল পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে : দ্বিতীয় নাগভট ধর্মপালের রাজ্যের একেবারে অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন অথচ পালরাজ তাঁকে বাধা দেওয়ার কোনও চেষ্টাই করলেন না! প্রকৃত পরিস্থিতি হয়তো অন্যরূপ ছিল। পরাক্রান্ত তিব্বতি রাজা মু-তিগ-চান-পো (আনুমানিক ৮০৪-১৫ খ্রিস্টাব্দ) সম্ভবত এ সময় বাংলায় এক সামরিক অভিযান প্রেরণ করেন। এই বৈদেশিক আক্রমণে ধর্মপাল সম্ভবত এমন বিপর্যস্ত হলেন যে দ্বিতীয় নাগভটকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তাঁর আর ছিল না। তবে ধর্মপালের বিরুদ্ধে এই তিব্বতি অভিযানের ঐতিহাসিকতা সম্পর্কে সংশয়ের অবকাশ আছে। আবার এমনও হতে পারে, ধর্মপাল তাঁর রাজ্যের পশ্চিম সীমান্তে প্রতীহার বাহিনীকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেন কিন্তু তা বিশেষ সাফল্যমণ্ডিত না হওয়ায় মুঙ্গেরে চূড়ান্ত সংঘর্ষের জন্য প্রস্তুত হন। মুঙ্গেরের যুদ্ধে ধর্মপাল শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলেন। অথচ এই সেদিনও তিনি উত্তর ভারতের একচ্ছত্র অধিপতিরূপে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন। এই যুদ্ধে ধর্মপাল পরাভূত হওয়ায় কনৌজ তো বটেই এমনকি বিহারেরও এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল দ্বিতীয় নাগভটের অধিকারভুক্ত হয় ; খণ্ডিত রাজ্যের আধিপত্য নিয়েই পরাজিত পালরাজকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। রমেশচন্দ্র মজুমদার অভিমত প্রকাশ করেছেন, দ্বিতীয় নাগভটের হাতে ধর্মপালের এই ভাগ্যবিপর্যয় ঘটেছিল তৃতীয় গোবিন্দের উত্তর ভারত অভিযানের প্রাক্কালে; ধর্মপালের বিরুদ্ধে বিজয়লাভের অব্যবহিত পরই দ্বিতীয় নাগভট তৃতীয় গোবিন্দের নিকট এমন শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন যে তাঁর উত্তরাপথব্যাপী সাম্রাজ্য স্থাপনের আশা চিরতরে ধূলিসাৎ হয় কিন্তু ধর্মপালের রাজ্য মোটামুটি অক্ষতই রয়ে যায়।

দ্বিতীয় নাগভট তৃতীয় গোবিন্দের উত্তর ভারত অভিযানের পূর্বে ধর্মপালকে পরাজিত করেছিলেন বলে যে অভিমত ব্যক্ত হয়েছে তা যুক্তিযুক্ত বোধ হয় না। বৎসরাজের বিরুদ্ধে ধ্রুবের বিজয়লাভের উল্লেখ প্রসঙ্গে সঞ্জান তাম্রশাসনে বলা হয়েছে, এই সেই বৎসরাজ যিনি গৌড়রাজকে পরাজিত করেছিলেন। এই বর্ণনা থেকে স্পষ্ট হচ্ছে ধ্রুবের সঙ্গে সংঘর্ষের পূর্বে বৎসরাজ ধর্মপালকে পরাভূত করেছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় নাগভটের বিরুদ্ধে তৃতীয় গোবিন্দের জয়লাভ প্রসঙ্গে সঞ্জান অভিলেখে এ ধরনের কোনও মন্তব্য করা হয়নি। এ থেকে অনুমিত হয়, তৃতীয় গোবিন্দের উত্তর ভারত অভিযানের পর কোনও এক সময় দ্বিতীয় নাগভট ধর্মপালকে পদানত করেন। দ্বিতীয়ত, ৮০৫ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ তৃতীয় গোবিন্দের নেসারিকা অভিলেখে বঙ্গাল রাজ ধর্মপালের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকূটরাজের জয়ের উল্লেখ আছে। স্পষ্ট বোঝা যায়, ৮০৫ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে এবং সম্ভবত ৮০০ খ্রিস্টাব্দের প্রারম্ভিক পর্ব শেষ না হতেই তৃতীয় গোবিন্দের উত্তর ভারত অভিযান সম্পূর্ণ হয়েছিল। ৮১২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত বড়োদরা লেখ থেকে জানা যায়, তৃতীয় গোবিন্দ গৌড়-বঙ্গ বিজয়ী জনৈক গুর্জররাজের সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য কর্করাজকে লাট-মালবের শাসনকর্তারূপে নিয়োগ করেন। দ্বিতীয় নাগভটই এই গুর্জররাজ এবং ধর্মপালই গৌড় ও বঙ্গের অধীশ্বর। স্বভাবতই ধারণা জন্মে, নেসারিকা লেখে উল্লিখিত ধর্মপালের বিরুদ্ধে তৃতীয় গোবিন্দের বিজয়লাভ অর্থাৎ তৃতীয় গোবিন্দের উত্তর ভারত অভিযান ও ৮০৬ খ্রিস্টাব্দে দেবপালের সিংহাসনে আরোহণের মধ্যবর্তী সময়ে দ্বিতীয় নাগভট ধর্মপালকে পরাজিত করেন। প্রতীহাররাজ রাষ্ট্রকূট রাজ্য আক্রমণেও উদ্যত হন। এবার আর তৃতীয় গোবিন্দ দ্বিতীয় নাগভটের বিরুদ্ধে সসৈন্যে অগ্রসর হলেন না, তিনি উত্তর সীমান্তে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরও সুদৃঢ় করেন।

গ্বালিয়র প্রশস্তি থেকে জানা যায়, এই সময় বা এর অব্যবহিত পর দ্বিতীয় নাগভট আনর্ত (উত্তর গুজরাত), মালব, কিরাত (হিমালয় সংলগ্ন), তুরস্ক (সিন্ধুর আরব রাজ্য), বৎস (এলাহাবাদ ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল) এবং মৎস (আলোয়ার-জয়পুর-ভরতপুর অঞ্চল) অঞ্চলের রাজাদের পরাজিত করেন। এই বর্ণনা অনুসারে প্রতীহাররাজ উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে মালব পর্যন্ত বিস্তৃত এক বিশাল রাজ্যের অধীশ্বর ছিলেন। এই বর্ণনা অতিরঞ্জিত। কিন্তু দ্বিতীয় নাগভট তাঁর সুদিনে যে রাজ্যটি নিজের দখলে রেখেছিলেন তা গুজরাত, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ ও বিহারের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল। এই রাজ্যটি বিশালই ছিল বলা চলে। শীঘ্রই বিহারের কয়েকটি অঞ্চল তাঁর হস্তচ্যুত হয়। দেবপালের তৃতীয় ও নবম রাজ্যবর্ষে উৎকীর্ণ কিছু মূর্তিলেখ বিহারের নালন্দা এবং কুরকিহারে পাওয়া গেছে। মনে হয়, ধর্মপালের উত্তরাধিকারী দেবপাল সিংহাসনে আরোহণের অল্পদিনের মধ্যে বিহারের কিয়দংশে পাল অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন।

কখনও কখনও বলা হয়ে থাকে চক্রায়ুধকে বিতাড়িত করে দ্বিতীয় নাগভট কান্যকুজে তাঁর রাজধানী স্থানান্তরিত করেন; তখন থেকে এই শহরটি প্রতীহার রাজ্যের স্থায়ী রাজধানীরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। জৈন সাধু প্রভাচন্দ্রের প্রভাবকচরিতে বলা হয়েছে, কান্যকুব্জ শহর নাগাবলোক অর্থাৎ দ্বিতীয় নাগভটের রাজধানী ছিল। আবার অনেকে মনে করেন, কান্যকুব্জ দেবপালের রাজ্য ভুক্ত ছিল; পালরাজের মৃত্যুর পরই শহরটি প্রতীহারদের করায়ত্ত হয়। কিন্তু এ কথা ভাবার যথেষ্ট কারণ আছে, দ্বিতীয় নাগভট তাঁর রাজত্বের শেষদিন পর্যন্ত কান্যকুজে নিজের অধিকার অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন। রাজত্বের প্রথম দিকে দেবপাল প্রতীহারদের বিরুদ্ধে কিছু সাফল্য লাভ করেছিলেন ঠিকই কিন্তু তাঁর রাজত্বের শেষের দিকেই তিনি প্রতীহার রাজ্যের এক বিশাল অংশ স্বীয় অধিকারভুক্ত করেন। ততদিনে দ্বিতীয় নাগভট লোকান্তরিত হয়েছেন। কান্যকুব্জ নাগাবলোকের রাজধানী ছিল বলে প্রভাবকচরিতে যে উক্তি করা হয়েছে তা যথার্থ বলেই মনে হয়। কান্যকুব্জে রাজধানী স্থানান্তরের কয়েকটি কারণ ছিল।

  • শহরটি গঙ্গা নদীর দক্ষিণ তটে অবস্থিত। তদানীন্তন ভারতের জল-বাণিজ্যের এক প্রধান কেন্দ্র ছিল এই কান্যকুব্জ।
  • দ্বিতীয়ত, পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে উঁচু হওয়ায় স্থানটি প্রাকৃতিক কারণে সুরক্ষিত ছিল।
  • তৃতীয়ত, আদি রাজধানী উজ্জয়িনী রাষ্ট্রকূট রাজ্যের সন্নিকটে অবস্থিত ছিল। অপেক্ষাকৃত নিরাপদ স্থানে রাজধানীর স্থানান্তর প্রতীহার রাজ্যের পক্ষে শুভ হবে, দ্বিতীয় নাগভট এমনটিই আশা করেছিলেন।

দ্বিতীয় নাগভট ঠিক কতদিন রাজত্ব করেন সে সম্পর্কে অনিশ্চয়তা রয়েছে। ৮৭২ বিক্রমাব্দে উৎকীর্ণ বুচকলা লেখ থেকে জানা যায়, তিনি ৮১৫ খ্রিস্টাব্দেও রাজপদে সমাসীন ছিলেন। প্রভাবকচরিতে বলা হয়েছে, কান্যকুব্জরাজ গঙ্গাবক্ষে আত্মবিসর্জ্জন দেন। ঘটনাটি ঘটে ৮৯০ বিক্রমাব্দে বা ৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে। এই উক্তি থেকে বোঝা যায়, দ্বিতীয় নাগভট ৮৩৩ খ্রিস্টাব্দের আদ্যভাগেও জীবিত ছিলেন। অনেকে মনে করেন, ৮৩৩ খ্রিস্টাব্দের কিছুকাল পুর্বে তাঁর জীবনা বসান ঘটে। তাঁদের যুক্তি : ৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় নাগভটের পৌত্র প্রথম ভোজ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন ; ৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় নাগভটের মৃত্যু ঘটলে মাত্র তিন বছরের মধ্যেই তাঁর পুত্র ও পৌত্র ক্রমান্বয়ে রাজপদ লাভ করলেন এমন ঘটনা স্বাভাবিক নয়। দ্বিতীয় নাগভটের রাজত্বের কখন পরিসমাপ্তি ঘটে তা নিয়ে এখনও বিতর্ক আছে।

রামভদ্র (৮৩৩-৮৩৬ খ্রি.)

দ্বিতীয় নাগভটের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র, রানি ঈষট্টাদেবীর গর্ভজাত সন্তান, রামভদ্র ৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে বা তার কিছুকাল পূর্বে প্রতীহার সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি অতি অল্প দিনই রাজত্ব করেন। তাঁর পুত্র প্রথম ভোজ যে ৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে রাজপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, তার প্রমাণ আছে। রামভদ্রের রাজত্বকালে প্রতীহার শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। দৌলতপুরা লেখ থেকে জানা যায়, বৎসরাজ জোধপুর অঞ্চলে একখণ্ড জমি দান করেন। দ্বিতীয় নাগভট সে দান অনুমোদনও করেন। কিন্তু পরে ওই দান কার্যকর না হওয়ায় প্রথম ভোজ জমিটি পুনর্দানের ব্যবস্থা করেন। এ ঘটনায় বোঝা যায়, জোধপুর অঞ্চল রামভদ্রের হস্তচ্যুত হয়। একদা অনুগত স্থানীয় প্রতীহার গোষ্ঠী রামভদ্রের সময় এ অঞ্চলে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করেন। তেমনি প্রথম ভোজের বরা লেখ থেকে জানা যায়, উত্তরপ্রদেশের বান্দা জেলার কালঞ্জর মণ্ডলে রাজা শর্ববর্মদেব একখণ্ড জমি দান করেছিলেন। দ্বিতীয় নাগভট সে দান অনুমোদন করেন। কিন্তু রামভদ্রের আমলে ওই দান মুলতুবি থাকে। প্রথম ভোজ আবার নতুন করে জমিটি দান করেন। লেখখানি প্রমাণ করছে, উত্তরপ্রদেশের বান্দা অঞ্চলের উপরও রামভদ্রের কর্তৃত্ব লুপ্ত হয়। যাঁর হাতে রামভদ্রের পরাজয় ঘটল তিনি সম্ভবত পালরাজ দেবপাল। জোধপুর ও কালঞ্জর অঞ্চলে তাঁর আধিপত্য বিলুপ্ত হলেও রামভদ্র গ্বালিয়র ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে তাঁর প্রভুত্ব অক্ষুণ্ণ রাখেন। ৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ প্রথম ভোজের পালিয়র লেখ থেকে জানা যায়, রামভদ্র জনৈক বাইল্লভট্টকে মর্যাদাধুর্য পদে নিয়োগ করেন। স্থানীয় অঞ্চলের শান্তিশৃঙ্খলা ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন এই রাজপুরুষ। মনে হয়, কান্যকুব্জ তাঁর অধিকারভুক্ত ছিল কিন্তু কালঞ্জর-সহ কান্যকুব্জ ভুক্তির পূর্বাংশ তাঁর হস্তচ্যুত হয়। বপ্পভট্টচরিতে বলা হয়েছে, প্রথম ভোজ তাঁর পিতা রামভদ্রকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করেন। ঘটনাটি ঘটে আনুমানিক ৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে বা তার কিছু পূর্বে।

প্রথম ভোজ (৮৩৬-৮৮৫ খ্রি.)

রামভদ্রের পুত্র প্রথম ভোজ ছিলেন মহিষী অপ্পদেবীর গর্ভজাত সন্তান। এক সংকটময় মুহূর্তে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন। তখন রাজ্যের বহু অঞ্চল থেকে প্রতীহাররা বিতাড়িত হয়েছেন। কিন্তু অসামান্য সাহস, রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও ভাগ্যলক্ষ্মীর সহায়তায় তিনি শুধু লুপ্ত রাজ্য পুনরুদ্ধারই করলেন না, নতুন নতুন অঞ্চল জয় করে এক বিশাল সাম্রাজ্যও গঠন করেন। হর্ষোত্তর উত্তর ভারতে তিনিই সফলতম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। সিংহাসনে আরোহণ করেই তিনি পৈতৃক রাজ্য পুনরুদ্ধারের কাজে সচেষ্ট হন। তাঁর উদ্যম সাফল্যমণ্ডিত হয়। মহোদয় থেকে ৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ বরা লেখ বলছে, ভোজ কান্যকুব্জ ভুক্তির অন্তর্গত কালঞ্জর মণ্ডলে অবস্থিত বলকাগ্রহার গ্রামটি পুনর্দানের ব্যবস্থা করেন ; তাঁর পিতা রামভদ্রের রাজত্বকালে এই দান মুলতুবি ছিল। এ থেকে মনে হয়, প্রতীহাররাজ সিংহাসনে আরোহণের অব্যবহিত পরই কালঞ্জরসহ কান্যকুব্জ ভুক্তির পূর্বাংশের উপর স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। মহোদয় বা কান্যকুব্জ যে প্রথম থেকে তাঁর রাজ্যভুক্ত ছিল এই লেখে তাও প্রমাণিত। কান্যকুব্জ থেকে ৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ তাঁর দৌলতপুরা লেখে তিনি কান্যকুব্জরাজ বলে বর্ণিত স্কন্দ-পুরাণেও তাঁকে কান্যকুজের অধীশ্বর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘কান্যকুব্জে মহাক্ষেত্রে রাজা ভোজেতি’।

দৌলতপুরা লেখ থেকে জানা যায়, ৮৪৩ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ প্রথম ভোজ জোধপুর অঞ্চল পুনরুদ্ধার করেন। এই লেখে বলা হয়েছে, গুর্জরত্রাভূমির অন্তর্ভুক্ত দেণ্ডবালকা বিষয়ে একদা যে জমি দান করা হয়েছিল রামভদ্রের সময় তা স্থগিত থাকে কিন্তু ভোজ তা পুনরায় কার্যকর করেন। দেণ্ডবালকা বিষয় সম্ভবত দিদওয়ালা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে অবস্থিত ছিল এবং জোধপুর ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল প্রাচীনকালে গুর্জরত্রাভূমি নামে পরিচিত ছিল। প্রতীহারদের জোধপুর শাখাটি এখানেই রাজত্ব করত। মনে হয়, জোধপুর শাখার কক্ক বা তাঁর পুত্র বাউক রামভদ্রের রাজত্ব কালে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন কিন্তু অচিরেই ভোজের আনুগত্য স্বীকার করেন।

সম্ভবত রাজত্বের প্রারম্ভিক পর্বে প্রথম ভোজ উত্তরপ্রদেশের পূর্বাঞ্চল ও বিহারের আধিপত্য নিয়ে পালরাজ দেবপালের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। গ্বালিয়র প্রশস্তিতে বলা হয়েছে, ধর্ম পুত্রের পরিণীতা লক্ষ্মীকে ভোজ কারারুদ্ধ করেন। এই ধর্মপুত্র নিঃসন্দেহে পালরাজ দেবপাল। দেবপালের বিরুদ্ধে প্রথম ভোজের বিজয়লাভের দাবি কলচুরি নৃপতি সোঢ়দেবের কহলা লেখের সাক্ষ্যে সমর্থিত হচ্ছে। লেখটিতে বলা হয়েছে, গুণাম্ভোধিদেব গৌড়রাজের সৌভাগ্যশ্রী হরণ করেন এবং ভোজদেবের কাছ থেকে জায়গির লাভ করেন। উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর অঞ্চলে এই জায়গির অবস্থিত ছিল। বুঝতে অসুবিধা হয় না, গুণাম্ভোধিদেব দেবপালের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রথম ভোজের পক্ষ অবলম্বন করেন। বালাদিত্যের চাটসু অভিলেখে ভোজের এই বিজয়ের প্রচ্ছন্ন উল্লেখ আছে। এই লেখে হর্ষরাজ ও তাঁর পুত্র গুহিলরাজের গৌড়-বঙ্গ বিজয়ের বর্ণনা আছে। পিতা ও পুত্র উভয়েই প্রথম ভোজের সমকালীন ছিলেন। হর্ষরাজের গৌড়-বঙ্গ অভিযান প্রথম ভোজের রাজত্বের প্রথম দিকে ঘটেছিল। গুণাম্ভোধিদেবের মতো হর্ষরাজও সম্ভবত দেবপালের বিরুদ্ধে অভিযানে প্রথম ভোজের অনুগামী হন।

দেবপালের বিরুদ্ধে ভোজের এই অভিযান প্রতীহাররাজের রাজত্বের একেবারে প্রথম দিকের ঘটনা। পাল নৃপতির ২৫শ রাজ্যবর্ষে উৎকীর্ণ একখানি মূর্তিলেখ পাটনা জেলার হিলসা গ্রামে আবিষ্কৃত হয়েছে। সেক্ষেত্রে বলা যায়, পাল রাজার বিরুদ্ধে প্রথম ভোজের বিজয়লাভ ঘটেছিল তাঁর রাজত্বের একেবারে প্রথম দিকে কিন্তু দেবপালের ২৫শ রাজ্যবর্ষ বা আনুমানিক ৮৩১ খ্রিস্টাব্দের কিছুকাল পর। কিন্তু দেবপালের বিরুদ্ধে প্রথম ভোজের এই সাফল্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ভট্ট গুরবমিশ্রের বাদাল স্তম্ভলেখের একটি উক্তি এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যায়। এই লেখে বলা হয়েছে, মন্ত্রী কেদার মিশ্রের সহায়তায় দেবপাল গুর্জররাজের দর্প খর্ব করেন (খবীকৃত-দ্রবিড়-গুর্জরনাথদপম্)। যে গুর্জরেশ্বরের বিরুদ্ধে দেবপাল জয়ী হন তিনি নিঃসন্দেহে প্রথম ভোজ। এই বিজয়ের ফলে দেবপালের রাজ্য পশ্চিমে বারাণসী পর্যন্ত প্রসারিত হয়। প্রথম ভোজের বিরুদ্ধে দেবপালের এই সাফল্য লাভের সম্ভাব্য তারিখ সম্পর্কে বাদাল স্তম্ভলেখে ইঙ্গিত আছে। যে কেদারমিশ্রের সাহায্যপুষ্ট হয়ে দেবপাল ভোজকে পরাজিত করেন সেই কেদারমিশ্র ছিলেন মন্ত্রী দর্ভপাণির পৌত্র। দর্ভপাণিও দেবপালের অধীনে মন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেছিলেন। যে ঘটনার জন্য দর্ভপাণির পৌত্রকে কৃতিত্ব দেওয়া হয়েছে সে ঘটনা যে দেব পালের রাজত্বের একেবারে শেষের দিকে ঘটেছিল তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

সম্ভবত এই সময় প্রথম ভোজ জবলপুর অঞ্চলের কলচুরি রাজা কোক্কল্লের নিকট পরাজিত হন। কোক্কল্ল যাঁদের যুদ্ধে পরাজিত করেন আমোদা লেখে তাঁদের অনেকেরই নামোল্লেখ আছে। এঁদের একজন গুর্জররাজ, আর একজন রঘুবংশীয় এক রাজা। কোক্কল্ল প্রথম ভোজের সমকালীন ছিলেন। যে গুর্জররাজকে তিনি পরাজিত করেন, তিনি সম্ভবত প্রথম ভোজ। আবার আমোদা লেখে যাঁকে রঘুবংশীয় রাজা বলা হয়েছে তাঁরও ভোজ হওয়া বিচিত্র নয়। কিন্তু শীঘ্রই বিবদমান দুই রাজার মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। বিলহারি লেখে ভোজকে কোক্কল্লের যশস্তম্ভরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। কলচুরিদের আর একখানি লেখ বারাণসী তাম্রশাসনে বলা হয়েছে, কোক্কল্ল ভোজকে নির্ভয় প্রদান করেন। এই বর্ণনার দু’টি ব্যাখ্যা হতে পারে। এক, কোনও প্রবল প্রতিপক্ষ ভোজকে আক্রমণ করলে কোক্কল্ল ভোজের পক্ষে যোগদান করেন। দুই, কোকল্ল ভোজকে আশ্বস্ত করেছিলেন, তিনি ভবিষ্যতে ভোজের রাজ্য আর আক্রমণ করবেন না। আনুমানিক ৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে দেবপালের মৃত্যু হয়। তাঁর উত্তরাধিকারীরা দুর্বল চিত্তের লোক ছিলেন। গৃহবিবাদেও তাঁরা জড়িত হয়ে পড়েন। এ সময় রাষ্ট্রকূট সিংহাসনে যিনি সমাসীন ছিলেন সেই প্রথম অমোঘবর্ষও শান্তিপ্রিয় রাজা ছিলেন। এই সুযোগে প্রথম ভোজ উত্তর ও মধ্য ভারতে তাঁর রাজনৈতিক প্রভাব সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হন। বিভিন্ন অঞ্চলে তার সম্ভাব্য বিজয়গুলো –

  • প্রথম ভোজের রাজত্বকালীন কয়েকখানি লেখ আহারে পাওয়া গেছে। লেখগুলি সম্ভবত ৮৬৪, ৮৬৫ ও ৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ হয়েছিল। লেখগুলি বলছে, রাজস্থানের উদয়পুর অঞ্চল প্রথম ভোজের রাজ্যভুক্ত ছিল।
  • ৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ দ্বিতীয় মহেন্দ্রপালের প্রতাবগড় লেখে দক্ষিণ-পূর্ব রাজস্থানের এক আঞ্চলিক চাহমান রাজার উল্লেখ আছে। ভোজের কাছে তিনি ছিলেন অপার আনন্দের উৎস। এই ভোজ সম্ভবত প্রথম ভোজ। এ ধারণা যথার্থ হলে বুঝতে হবে, দক্ষিণ-পূর্ব রাজস্থানও ভোজের অধিকারভুক্ত ছিল।
  • আরব দেশীয় পর্যটক সুলেইমান ৮৫১ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে প্রথম ভোজের রাজ্য পরিদর্শন করেন। প্রতীহাররাজের উল্লেখ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অগাধ ঐশ্বর্যের অধিকারী এই রাজার অসংখ্য উট ও অশ্ব ছিল। সুলেইমানের এই উক্তির ভিত্তিতে অনেকে মনে করেন, ভোজ রাজস্থান ও সিন্ধুর কিয়দংশেরও অধিপতি ছিলেন। এসব অঞ্চলে এখনও প্রচুর উট দেখা যায়। দ্বিতীয় অবনিবর্মার উনা লেখে বলা হয়েছে, জজ্জপ ও অন্যান্যদের নির্মূল করে বলবর্মা হুণদের নাগপাশ থেকে পৃথিবীকে মুক্ত করেন। দ্বিতীয় অবনিবর্মা প্রথম মহেন্দ্রপালের অধীনস্থ ছিলেন। তাঁর পূর্বপুরুষ বলবর্মা ভোজের নেতৃত্বাধীনে শত্রুদের পরাজিত করেছিলেন, এরূপ ধারণা অসংগত নয়। খ্রিস্টীয় ১০ম শতকে মধ্যপ্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলে এক হূণ মণ্ডলের উল্লেখ আছে সমকালীন এক লেখে। বলবর্মা তথা প্রথম ভোজ সম্ভবত এই হূণদেরই পরাজিত করেন।
  • ৮৬২ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ দেওগড় জৈন স্তম্ভলেখ প্রমাণ করছে, উত্তরপ্রদেশের ঝাঁসি অঞ্চল প্রথম ভোজের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বিষ্ণুরাম নামে জনৈক মহাসামন্তকে এই অঞ্চলের শাসনভার অর্পণ করা হয়। ৮৭৫ ও ৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ ভোজের দু’টি লেখ গ্বালিয়রে আবিষ্কৃত হয়েছে। এই লেখ দু’টিতে একজন অল্পের কথা বলা হয়েছে। প্রথম ভোজ তাঁকে গোপাদ্রি অর্থাৎ গ্বালিয়র দুর্গের কোট্টপালের পদে নিয়োগ করেছিলেন।
  • উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর অঞ্চল তাঁর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রতীহার রাজ্য পূর্বদিকে আরও বিস্তারলাভ করেছিল কিনা তা নিশ্চিতরূপে বলা যায় না। তবে বিহার তাঁর রাজ্যভুক্ত ছিল না। তাঁর কোনও লেখ বিহারে পাওয়া যায়নি।
  • উত্তরে কর্ণাল, দিল্লি প্রভৃতি অঞ্চলে তাঁর আধিপত্য বিস্তার লাভ করে। তাঁর রাজত্বকালীন একখানি লেখ হরিয়ানার পেহোয়ায় পাওয়া গেছে। লেখখানি ৮৮২ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ হয়েছিল। পুরাণকিলায় তাঁর রাজত্বের একখানা ভগ্ন লেখের সন্ধান পাওয়া গেছে।
  • কল্হণের রাজতরঙ্গিণীতে একটি উক্তি আছে। এর ভিত্তিতে অনেকে মনে করেন, ভোজের আধিপত্য দিল্লি ও কর্ণাল ছাড়িয়ে টক্ক পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। আরও মনে করা হয়, ভোজ অলখন নামে এক রাজপুরুষের হস্তে টক্কের শাসনভার ন্যস্ত করেন। কিন্তু রাজতরঙ্গিণীর সাক্ষ্য থেকে আরও একটি জিনিস স্পষ্ট হচ্ছে। টক্ক অঞ্চলে ভোজের আধিপত্য বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। শীঘ্রই কাশ্মীরের রাজা শঙ্করগণ (খ্রিস্টাব্দ ৮৮৩-৯০২) এই অঞ্চল অধিকার করেন।
  • দক্ষিণেও ভোজ রাজ্য বিস্তার করেছেন। উত্তর গুজরাত যে ভোজের শাসনাধীন ছিল উনা লেখের সাক্ষ্যে তা প্রমাণিত। এ অঞ্চলের শাসনভার সম্ভবত বলবর্মার হস্তে অর্পিত হয়। দক্ষিণ গুজরাত জয়ের তাঁর তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল। ৮৬৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তিনি দক্ষিণ গুজরাত আক্রমণও করেন। কিন্তু স্থানীয় রাষ্ট্রকূট প্রশাসক তৃতীয় ধ্রুবের বাধাদানের ফলে তাঁর সে চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। দক্ষিণ গুজরাতের পরবর্তী রাষ্ট্রকূট প্রশাসক কৃষ্ণরাজের সঙ্গেও তিনি সংঘর্ষে জড়িত হন। কৃষ্ণরাজ ভোজের আক্রমণের জন্য অপেক্ষা না করে নিজেই সসৈন্যে উজ্জয়িনী অবরোধ করেন। তখন ভোজ সম্ভবত কাশ্মীররাজ শঙ্করগণের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত ছিলেন। ভোজ সত্বর উজ্জয়িনীতে প্রত্যাবর্তন করলে কৃষ্ণরাজ পশ্চাদপসরণ করেন। কৃষ্ণরাজকে অনুসরণ করে ভোজ দক্ষিণ গুজরাতে এসে উপনীত হন। নর্মদা তীরে উভয় পক্ষ পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। কৃষ্ণরাজের সাহায্যার্থে তাঁর প্রভু মান্যখেটরাজ দ্বিতীয় কৃষ্ণ এগিয়ে আসেন। এই যুদ্ধে প্রতীহাররাজই জয়লাভ করেন। খেটক মণ্ডল প্রথম ভোজের অধিকারভুক্ত হয়। স্থানীয় রাষ্ট্রকূট প্রশাসক বংশটির উচ্ছেদ হয়। এই প্রথম প্রতীহার আধিপত্য দক্ষিণ গুজরাতে বিস্তার লাভ করল।

প্রথম ভোজ কতদিন রাজত্ব করেন তা সঠিক জানা যায় না। তাঁর উত্তরাধিকারী প্রথম মহেন্দ্রপালের প্রাচীনতম লেখটি ৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ হয়েছিল। এ থেকে অনুমান করা যায়, আনুমানিক ৮৯০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ভোজের রাজত্বের পরিসমাপ্তি ঘটে। স্কন্দ-পুরাণে তাঁর নিজ পুত্রের অনুকূলে স্বেচ্ছায় সিংহাসন ত্যাগের ঘটনার উল্লেখ আছে। (তাক্ত্বা রাজ্যং প্রিয়ান্ পুত্রান্ পট্টাশ্বরথকুঞ্জরান। পুত্রং রাজ্যে প্রতিষ্ঠাপ্য গন্তব্যং নিশ্চিতং ময়া ॥ বস্ত্ৰপথ মাহাত্ম্য অধ্যায়।) পৌরাণিক কাহিনি কতদূর সত্য বলা কঠিন।

ভোজ অর্ধ শতাব্দীরও বেশি কাল রাজত্ব করেন। এক প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন কিন্তু ভাগ্য ও পুরুষাকারের সহায়তায় তিনি এমন এক বিশাল রাজ্য গঠন করেন যা এক সময় পশ্চিমে গুজরাত থেকে পূর্বে উত্তরপ্রদেশ এবং উত্তরে টক্ক থেকে দক্ষিণে মধ্যপ্রদেশের দক্ষিণ সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ৮৫১ খ্রিস্টাব্দে ভারত সম্পর্কে তাঁর বিবরণ লিখতে গিয়ে সুলেইমান ভোজের ঐশ্বর্য, সৈন্যবল ও শক্তিশালী অশ্বারোহী বাহিনীর উল্লেখ করেছেন। আরব দেশীয় পর্যটক ভোজকে ভারতে ইসলামের প্রবলতম প্রতিপক্ষ বলে বর্ণনা করেছেন। ভোজের সুশৃঙ্খল প্রশাসন ব্যবস্থার প্রশংসাও করেছেন তিনি। তিনি লক্ষ করেছেন, প্রতীহার রাজ্যটি ছিল ভারতের সবচেয়ে নিরাপদ অঞ্চল ; দস্যু তস্করদের উপদ্রব থেকে মুক্ত ছিল সে রাজ্য। সেই রাজনৈতিক অস্থিরতার দিনে সারা রাজ্যে আইনের অনুশাসন প্রতিষ্ঠা করা এক অসামান্য বীর্যবান ও প্রজানুরঞ্জক রাজার পক্ষেই সম্ভব ছিল।

প্রথম মহেন্দ্রপাল (৮৮৫-৯১০ খ্রি.)

প্রথম ভোজ ও রানি চন্দ্রভট্টারিকার পুত্র মহেন্দ্রপাল পিতার মৃত্যুর পর আনুমানিক ৮৯০ খ্রিস্টাব্দে প্রতীহার সিংহাসন অলংকৃত করেন। তিনি তাঁর পিতার জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন না। ভোজের দৌলতপুরা লেখে যুবরাজ নাগভটের উল্লেখ আছে। তিনিই ছিলেন প্রথম ভোজের জ্যেষ্ঠ পুত্র। কিন্তু পিতার জীবদ্দশায় তিনি লোকান্তরিত হন। ফলে অনুজ মহেন্দ্রপাল বিনা বাধায় পিতৃসিংহাসনে আরোহণ করেন। যোগ্য পিতার যোগ্য পুত্র ছিলেন এই মহেন্দ্রপাল। পিতৃসূত্রে প্রাপ্ত বিশাল রাজ্যটির রক্ষাকার্যে তিনি প্রায় পরিপূর্ণ সফলকাম হন। মহেন্দ্রপালের রাজত্বের প্রথম লেখখানি উত্তর গুজরাতের উনা নামক স্থানে পাওয়া গেছে। এই লেখ থেকে জানা যায়, প্রথম ভোজের আমলে যে বলবর্মা উত্তর গুজরাতের প্রশাসক পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি মহেন্দ্রপালের রাজত্বকালেও স্বপদে বহাল থাকেন। বলবর্মার মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দ্বিতীয় অবনিবর্মা পিতার স্থলাভিষিক্ত হন।

এক সময় মনে করা হত বিহার ও উত্তর বাংলা মহেন্দ্রপালের রাজ্যভুক্ত ছিল। বৈজনাথ পুরী মনে করেন, প্রথম ভোজের রাজত্বকালেই এই দু’টি অঞ্চল প্রতীহারদের অধিকারভুক্ত হয়; মহেন্দ্রপাল বিজিত ভূখণ্ডে নিজের কর্তৃত্ব সুদৃঢ় করেন। রমেশচন্দ্র মজুমদার অভিমত প্রকাশ করেছেন, প্রথম ভোজ ও মহেন্দ্রপাল বিহারে ও উত্তরবাংলার এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল থেকে পালদের বিতাড়িত করেন। বিহার ও উত্তর বাংলার বিভিন্ন স্থানে পাওয়া অন্যূন ৯ খানি লেখের ভিত্তিতে এ ধরনের অভিমত গড়ে উঠেছে। এই লেখগুলি পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ পরমেশ্বর মহেন্দ্র পালের রাজত্বের দ্বিতীয় থেকে পঞ্চদশ বা ঊনবিংশ রাজ্যবর্ষের মধ্যে উৎকীর্ণ হয়েছিল। পূর্বে মনে করা হত, লেখসমূহে উল্লিখিত মহেন্দ্রপাল প্রথম ভোজের পুত্র, গুর্জর-প্রতীহার বংশীয় মহেন্দ্রপাল। কিন্তু উত্তর বাংলার মালদা জেলার জগজ্জীবনপুর গ্রামে ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে একখানি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হওয়ার পর এই ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে। এই লেখ থেকে জানা যায়, দেবপালের তিরোধানের পর তাঁর পুত্র, মহিষী মাহটার গর্ভজাত সন্তান মহেন্দ্রপাল পালরাজ্যের অধীশ্বর হন। বিহার ও উত্তর বাংলার লেখমালায় যে মহেন্দ্রপালের কথা বলা হয়েছে তিনি সম্ভবত দেবপাল পুত্র মহেন্দ্রপাল। তিনি আনুমানিক ৮৪৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৮৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। প্রথম ভোজ ও মহেন্দ্রপালের রাজত্বকালে বিহার ও উত্তর বাংলায় গুর্জর-প্রতীহার আধিপত্য বিস্তার লাভ করেছিল এ মত এখন পরিত্যক্ত হতে বসেছে।

কখনও কখনও বলা হয়, কাশ্মীররাজ, উৎপলবংশীয় শঙ্করগণ মহেন্দ্রপালকে পরাজিত করে পশ্চিম পাঞ্জাবের টক্ক অঞ্চল পুনরুদ্ধার করেন। কিন্তু স্মরণ রাখা ভালো, শঙ্করগণ টক্ক পুনরধিকার করেন প্রথম ভোজের রাজত্বকালে, মহেন্দ্রপালের সময় নয়। টক্ক মহেন্দ্রপালের রাজ্যভুক্ত ছিল না ঠিকই কিন্তু তিনি যে হরিয়ানার কর্ণাল অঞ্চলে নিজের আধিপত্য অক্ষুণ্ণ রাখেন পেহোয়া লেখের সাক্ষ্যে তার আভাস আছে। উত্তরপ্রদেশের গোণ্ডা-বহারাইচ ভূখণ্ড মহেন্দ্রপালের অধিকারভুক্ত ছিল। তাঁর দিঘওয়া দুবৌলি লেখে এর প্রমাণ আছে। এই লেখে একটি গ্রাম দানের উল্লেখ আছে। গ্রামটি শ্রাবস্তী মণ্ডলস্থিত বলয়িকা-বিষয়ে অবস্থিত ছিল। মধ্যপ্রদেশে মহেন্দ্রপালের রাজত্বের কয়েকখানি লেখ আবিষ্কৃত হয়েছে। এই অঞ্চল যে তাঁর রাজ্যভুক্ত ছিল সে সম্পর্কে কোনও সন্দেহ নেই। ৯০৭ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ সিয়াডোনি লেখে উণ্ডভট নামে তাঁর অধীনস্থ জনৈক রাজপুরুষের উল্লেখ আছে। তিনি সিয়াডোনি ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের প্রশাসকের পদে নিযুক্ত ছিলেন। গ্বালিয়রের নিকটবর্তী তেরহি নামক স্থানে আবিষ্কৃত একখানি লেখে গুণরাজ নামে উণ্ডভটের এক প্রতিবেশী প্রশাসকের উল্লেখ আছে। তেরহি লেখে প্রকাশ, উণ্ডভট ও গুণরাজ পরস্পরের বিরুদ্ধে মধুবনী নদীর তীরে এক যুদ্ধে অবতীর্ণ হন ; গুণরাজের অনুগত কোট্টপাল চাণ্ডিয়ন যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণত্যাগ করেন। তখনকার দিনে একই রাজার অধীনস্থ দুই অঞ্চল প্রধানের মধ্যে প্রায়ই সংঘর্ষ বাধত। এদিকে মহেন্দ্রপালের রাজত্বকালে খেটক-মণ্ডল প্রতীহারদের হস্তচ্যুত হয়। ৯১০ খ্রিস্টাব্দের কিছু পূর্বে রাষ্ট্রকূটরাজ দ্বিতীয় কৃষ্ণ (খ্রিস্টাব্দ ৮৮০-৯১৪) খেটক-মণ্ডল অধিকার করেন এবং তাঁর অনুগ্রহভাজন প্রচণ্ডের হাতে অধিকৃত প্রদেশের শাসনভার অর্পণ করেন।

মহেন্দ্রপালের রাজত্বের সর্বশেষ তারিখ ৯৬৪ বিক্রমাব্দ বা ৯০৭ খ্রিস্টাব্দ। তাঁর পুত্র প্রথম মহীপালের শাসনের প্রাচীনতম তারিখ ৮৩৬ শকাব্দ বা ৯১৪ খ্রিস্টাব্দ। অনুমান করা যায়, ৯১০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মহেন্দ্রপালের রাজত্বের অবসান হয়। সমকালীন ভারতের একজন শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন মহেন্দ্রপাল। শুধু বলশালী রাজারূপে নয়, সাহিত্যানুরাগী রূপেও তিনি অশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তখনকার দিনের প্রখ্যাত কবি ও নাট্যকার রাজশেখর তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। কর্পূরমঞ্জরী কাব্যের শেষে আত্ম পরিচয় প্রসঙ্গে রাজশেখর নিজেকে মহেন্দ্রপালের ‘উপাধ্যায়’ বলে বর্ণনা করেছেন।

প্রথম মহেন্দ্রপালের উত্তরাধিকারীবৃন্দ

মহেন্দ্রপালের মৃত্যুর পর কারা প্রতীহার সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং তাঁদের রাজত্বের পারম্পর্যই বা কী, সে সম্পর্কে বিতর্ক রয়েছে। আর এই বিতর্ক থাকা স্বাভাবিকও। প্রথমত, তথ্যগুলি পরস্পর বিরোধী। দ্বিতীয়ত, তথ্যগুলি অস্পষ্ট এদের ব্যাখ্যা নিয়ে মতান্তরের অবকাশ আছে। বঙ্গীয় এশিয়াটিক সোসাইটি অভিলেখে বিনায়কপালের ৯৩১ খ্রিস্টাব্দে রাজত্বের উল্লেখ আছে। লেখে তাঁকে পিতা মহেন্দ্ৰ পাল এবং জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ভোজের ‘পাদানুধ্যাত’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এ থেকে অনুমান করা যায়, মহেন্দ্রপালের পর কিন্তু বিনায়কপালের পূর্বে দ্বিতীয় ভোজ প্রতীহার সিংহাসনে আরোহণ করেন। রাজশেখরের প্রচণ্ডপাণ্ডব কাব্য ও তৎকালীন কয়েকখানি লেখের সাক্ষ্য কিন্তু অন্য কথা বলে। প্রচণ্ডপাণ্ডবের সাক্ষ্য থেকে অনুমিত হয় মহেন্দ্রপালের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মহীপাল রাজপদ লাভ করেন। তাছাড়া হড্ডালা ও অসনি লেখে মহীপালের রাজত্বের যে দু’টি তারিখ দেওয়া হয়েছে তা বিনায়কপালের তারিখের পূর্ববর্তী। তারিখ দু’টি হল ৯১৪ এবং ৯১৭ খ্রিস্টাব্দ। তাহলে আমাদের সামনে দু’ধরনের তথ্য দেখা যাচ্ছে : এক ধরনের তথ্যে বিনায়কপালকে দ্বিতীয় ভোজের উত্তরাধিকারী রূপে উপস্থাপিত করা হয়েছে, অন্য ধরনের তথ্যে আভাস আছে, মহীপাল বিনায়কপালের পূর্বে রাজপদে অভিষিক্ত ছিলেন। হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী ও নীহাররঞ্জন রায় বিপরীতধর্মী এই দু’টি সিদ্ধান্তের মধ্যে সংগতিবিধানের চেষ্টা করেছেন। তাঁরা মনে করেন, ভোেজ কোনও নাম নয়, একটি অভিধা, মহীপাল এই অভিধা ধারণ করেছিলেন। এই বক্তব্য সঠিক হলে বুঝতে হবে মহেন্দ্রপালের মৃত্যুর পর আনুমানিক ৯১০ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় ভোজ ওরফে মহীপাল রাজপদ লাভ করেন এবং ৯৩১ খ্রিস্টাব্দের কিছু পূর্বে তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই বিনায়কপাল তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন।

মহীপাল ও দ্বিতীয় ভোজ এক ও অভিন্ন ব্যক্তি ছিলেন, এমন ধারণা অবশ্যই সংগত নয়। প্রথমত, প্রতীহার ও কলচুরি সরকারি লেখমালায় ভোজ ব্যক্তি বিশেষের নামরূপেই উল্লিখিত হয়েছে, কোনও রাজার অভিধারূপে ব্যবহৃত হয়নি। দ্বিতীয়ত, ভোজ এবং মহীপাল পদ দু’টির অর্থও এক নয়। এসব কারণে দ্বিতীয় ভোজ ও মহীপালকে দু’জন স্বতন্ত্র রাজারূপেই চিহ্নিত করতে হয়।

অনেকের অভিমত, বিনায়কপাল ও মহীপাল এক ও অভিন্ন ব্যক্তি ছিলেন। সেক্ষেত্রে মনে করতে হবে, মহেন্দ্রপালের মৃত্যুর পর দ্বিতীয় ভোজ রাজত্ব করেন কিন্তু অল্পদিনের মধ্যে তিনি দেহত্যাগ করায় তার অনুজ মহীপাল নামান্তরে বিনায়কপাল সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। সিয়াডোনি লেখের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে মহীপাল ও বিনায়কপালের এই অভিন্নতা কল্পিত হয়েছে। এই লেখে পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ পরমেশ্বর দেবপাল এবং তাঁর পিতা পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ পরমেশ্বর ক্ষিতিপালের উল্লেখ আছে। এই দুই রাজাকে প্রতীহার নৃপতিরূপে শনাক্ত করা হয়। চন্দেল্লরাজ ধঙ্গের খজুরাহো লেখে জনৈক হয়পতি দেবপাল এবং তাঁর পিতা হয়পতি হেরম্ব পালের উল্লেখ আছে। অনেকেই মনে করেন, চন্দেল্ল লেখের দেবপাল এবং সিয়াডোনি লেখের দেবপাল একই ব্যক্তি। এ থেকে স্বভাবতই মনে হয়, দেবপালের পিতা ক্ষিতিপাল হেরম্বপাল নামেও পরিচিত ছিলেন। ক্ষিতিপালের যা অর্থ মহীপালের অর্থও তাই। আবার হেরম্বপাল ও বিনায়কপালের অর্থও এক। এ কারণে অনেকেই ক্ষিতিপাল, হেরম্বপাল, মহীপাল এবং বিনায়ক পালকে এক ও অভিন্ন নৃপতি বলে মনে করেন।

বিনায়কপালকে যাঁরা মহীপাল এবং হেরম্বপালের সহিত এক ও অভিন্ন বলে মনে করেন তাঁরা সিয়াডোনি ও খজুরাহো লেখের দুই দেবপালকেও এক ও অভিন্ন প্রতীহার রাজা বলে শনাক্ত করেন। কিন্তু দুই লেখের দুই দেবপাল যে এক ব্যক্তি ছিলেন তা এখনও প্রমাণিত হয়নি। তাছাড়া মহীপাল ও বিনায়কপালের তারিখগুলিও এক নয়। সে কারণে মহীপাল ও বিনায়ক পালকে এক ও অভিন্ন প্রতীহার রাজা বলে ভাবা উচিত নয়। উপরন্তু একজন রাজা সরকারি অভিলেখে চারটি ভিন্ন নামে অভিহিত হবেন এমন ঘটনা অস্বাভাবিক বৈকি।

তথ্য অপ্রতুল ও বিপরীতধর্মী। সেজন্য দ্বিতীয় ভোজ, মহীপালবিনায়কপাল – এই তিন রাজার রাজত্বের পর্যায়ক্রম নির্ণয় করা কঠিন। অবশ্য দ্বিতীয় ভোজ ও মহীপাল যে বিনায়ক পালের পূর্বে রাজত্ব করেছিলেন তা বোধহয় এক রকম নিশ্চিত। বিনায়কপাল যে ৯৩১ খ্রিস্টাব্দে রাজপদে আসীন ছিলেন তাও সুনিশ্চিত। কিন্তু দ্বিতীয় ভোজ ও মহীপালের রাজত্বের পারম্পর্য নির্ধারণ করা সত্যই এক দুরূহ ব্যাপার।

দ্বিতীয় ভোজ (৯১০-৯১৩ খ্রি.)

বৈজনাথ পুরী মনে করেন, প্রথম মহীপাল আনুমানিক ৯১০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর পিতা মহেন্দ্রপালের স্থলাভিষিক্ত হন। পিতার রাজত্বকালে তিনি যুবরাজ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে তাঁর অনুজ দ্বিতীয়ভোজ কলচুরিরাজ কোক্কল্লদেব এবং রাষ্ট্রকূটনৃপতি দ্বিতীয় কৃষ্ণের সহায়তায় মহীপালকে পরাজিত করে সিংহাসন দখল করেন। অধ্যাপক পুরী আরও বলেন, মহীপাল চন্দেল্লরাজ হর্ষদেবের সাহায্যে ভোজকে বিতাড়িত করে ৯১৪ খ্রিস্টাব্দের পূর্বেই সিংহাসন পুনরুদ্ধার করেন। এখানে স্মরণ রাখা দরকার,

  • ৯১০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বেই কোক্কল্লদেবের মৃত্যু হয় ; তাঁর পক্ষে দ্বিতীয় ভোজকে সাহায্য করা সম্ভবপর ছিল না।
  • দ্বিতীয়ত, দ্বিতীয় কৃষ্ণ মহীপালের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় ভোজকে যে সাহায্য করেছিলেন তার সমর্থনেও কোনও প্রমাণ নেই।
  • তৃতীয়ত, চন্দেল্ল হর্ষ মহীপালকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছিলেন এ কথা ঠিক কিন্তু এতে প্রমাণ হয় না, দ্বিতীয় ভোজ মহীপালের সিংহাসন অধিকার করে বসেছিলেন।

খজুরাহো লেখের উক্তি হয়তো ইঙ্গিত করছে, রাষ্ট্রকূটরাজ দ্বিতীয় কৃষ্ণের হাতে পরাজয়ের পর চন্দেল্লরাজ হর্ষ মহীপালকে পুনরুভ্যুত্থানে সাহায্য করেছিলেন। তাছাড়া মহীপাল তাঁর পিতার জীবদ্দশায় যুবরাজের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন বলে যে অভিমত ব্যক্ত হয়েছে তার সমর্থনেও কোনও তথ্য নেই। লক্ষ করবার বিষয়, সরকারি লেখে দ্বিতীয় ভোজের মায়ের নামের উল্লেখ আছে কিন্তু কোনও কাব্যে বা লেখে মহীপালের মায়ের নামের উল্লেখ নেই। মহীপাল সম্ভবত মহেন্দ্রপালের কোনও এক ছোট রানির গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন এবং সে কারণে কনৌজের সিংহাসনের উপর তাঁর ন্যায্য দাবি ছিল না। মহিষী দেহনাগাদেবীর গর্ভজাত দ্বিতীয় ভোজ তাঁর পিতার মৃত্যুতে আনুমানিক ৯১০ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু তাঁর উচ্চাভিলাষী ভাই মহীপাল তাঁকে পদচ্যুত করে ৯১৪ খ্রিস্টাব্দের কিছু পূর্বে সিংহাসন অধিকার করেন। দ্বিতীয় ভোজের কোনও কীর্তি কলাপের কথা জানা যায় না।

প্রথম মহীপাল (৯১৩-৯৪৪ খ্রি.)

৯১৪ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ হড্ডালা অভিলেখে মহীপালকে রাজাধিরাজ ও আখ্যাত করা হয়েছে। সন্দেহ নেই, ৯১৪ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন। সম্ভবত সিংহাসনের উপর তাঁর ন্যায্য অধিকার ছিল না। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দ্বিতীয় ভোজকে বিতাড়িত করে তিনি বলপূর্বক সিংহাসন অধিকার করেন। তাঁর রাজত্বের প্রথম পর্ব মোটামুটি শান্তিপূর্ণই ছিল বলা যায়। হড্ডালা লেখে দক্ষিণ গুজরাতের উপর তাঁর নিরঙ্কুশ আধিপত্যের স্বীকৃতি আছে। সেখানে ধরণীবরাহ নামে তাঁর এক অনুগত মিত্র শাসনকর্তার পদে নিযুক্ত ছিলেন। ৯১৭ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ অসনি লেখ থেকে জানা যায়, উত্তরপ্রদেশের ফতেপুর অঞ্চল তাঁর অধিকারভুক্ত ছিল। ইরাকি পর্যটক আল মাসুদি ৯১৫ ১৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতীহার রাজ্য পরিদর্শন করেন। তিনি বলেন, প্রতীহার রাজ্য উত্তর দিকে মুলতানের সীমানা পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। তিনি আরও বলেন, তাঁর পরিদর্শনের সময় মুলতানের মুসলমান শাসকের সঙ্গে প্রতীহাররাজের সংঘর্ষ চলছিল।

৯১৬ খ্রিস্টাব্দের শরৎকালে মহীপাল এক গভীর সংকটের সম্মুখীন হন। রাষ্ট্রকূটরাজ তৃতীয় ইন্দ্র ভুপাল-ঝাঁসি-কালপির পথ ধরে অগ্রসর হয়ে যমুনা নদী পার হয়ে সসৈন্যে প্রতীহার রাজধানী কনৌজে এসে উপনীত হন। রাজধানী রক্ষার কোনও ব্যবস্থা না করে মহীপাল পলায়ন করেন। কনৌজ অগ্নিদগ্ধ হয়। কন্নড় কাব্য পম্পভারত থেকে জানা যায়, তৃতীয় ইন্দ্রের অনুগত মিত্র চালুক্যদ্বিতীয়নরসিংহ রাষ্ট্রকূটরাজের কান্যকুব্জ অভিযানে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন। তিনি এলাহাবাদ পর্যন্ত মহীপালের পশ্চাদ্ধাবন করেন কিন্তু প্রতীহাররাজ পালিয়ে কোনও প্রকারে নিজের প্রাণ রক্ষা করেন। তৃতীয় ইন্দ্রের পক্ষে দীর্ঘদিন উত্তর ভারতে অবস্থান করা সম্ভব হয়নি। কনৌজে একদল সৈন্য রেখে বাকি সৈন্যদের সঙ্গে নিয়ে তিনি নিজ রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করেন। এই সুযোগে মহীপাল তাঁর মিত্র জেজাকভুক্তির চন্দেল্লরাজ হর্ষের সহায়তায় রাষ্ট্রকূট সৈন্যদের বিতাড়িত করে কান্য কুব্জ পুনরুদ্ধার করেন।

আর্য ক্ষেমীশ্বর রচিত ‘চণ্ডকৌশিকম’ নাটকে মহীপাল নামে জনৈক রাজার শৌর্য-বীর্যের এক অতিরঞ্জিত বর্ণনা আছে। এই নাটকে মহীপাল চন্দ্রগুপ্তের এবং কর্ণাটরা নন্দদের অবতাররূপে কল্পিত হয়েছেন। নাট্যকার এখানে বলতে চেয়েছেন, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য যেমন নন্দদের উচ্ছেদ করেছিলেন তেমনি মহীপালও কর্ণাটদের বিতাড়িত করেন। বেশিরভাগ ঐতিহাসিক চণ্ডকৌশিকের মহীপালকে প্রতীহার নৃপতি প্রথম মহীপালরূপে শনাক্ত করেছেন। রাষ্ট্রকূটেরা তো কর্ণাটই ছিলেন। তৃতীয় ইন্দ্রের নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্রকূটদের সঙ্গে মহীপাল যে মরণপণ সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে ছিলেন তাও তো অনস্বীকার্য। স্পষ্ট বোঝা যায়, রাষ্ট্রকূটদের কবল থেকে মহীপালের কান্যকুব্জ পুনরুদ্ধারের এক পল্লবিত বর্ণনা পরিবেশিত হয়েছে আর্য ক্ষেমীশ্বরের নাটকে। শোনা যায়, মহীপালের আদেশে নাটকখানি তাঁর রাজসভায় মঞ্চস্থ হয়েছিল। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, পালরাজ প্রথম মহীপালই চণ্ডকৌশিকের মহীপাল। তাঁর অভিমত, যে চোল সৈন্যদলের সঙ্গে পাল সম্রাটের যুদ্ধ হয় তাঁরাই এই নাটকে কর্ণাট রূপে অভিহিত হয়েছেন। কিন্তু এ মত সম্ভবত ঠিক নয়। যে রাজেন্দ্রচোল পালরাজ্য আক্রমণ করেছিলেন তিনি কর্ণাট ছিলেন না।

মহীপাল কান্যকুব্জে তাঁর অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন ঠিকই কিন্তু তৃতীয় ইন্দ্রের অভিযানের ফলে প্রতীহার রাজ্যে যে অবক্ষয়ের চিহ্ন ফুটে ওঠে তাকে প্রতিহত করার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। চন্দেল্লরাজ হর্ষ বুন্দেলখণ্ডে এক স্বাধীন, সার্বভৌম রাজ্য স্থাপন করেন। অথচ পূর্বে এই অঞ্চল প্রতীহারদের অধিকারভুক্ত ছিল। চন্দেল্ল নৃপতি ধঙ্গের খজুরাহো লেখে রাজা হর্ষের হস্তে এক মালবরাজের পরাজয়ের উল্লেখ আছে। এই মালবরাজ সম্ভবত ঝরার পরমার বংশীয় এক নরপতি ছিলেন। কিছুদিনের মধ্যে অবশ্য মহীপাল বা তাঁর উত্তরাধিকারী প্রথম বিনায়কপাল মালবের একাংশে প্রতীহার অধিকার বিস্তার করেন।

রাজশেখর তাঁর “প্রচণ্ডপাণ্ডবম্‌’’ নাটকে মহীপালের দিগ্বিজয়ের এক চিত্তাকর্ষক বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছেন। (নমিত-মুরল-মৌলিঃ পাকলো মেকলানাং রণ-কলিত-কলিঙ্গঃ কোলি-তট-কেৱলেন্দোঃ।/ অজনি জিত-কুলূতঃ কুন্তলানাং কুঠারঃ হঠ-হৃত-রমঠশ্রীঃ শ্রীমহীপালদেবঃ ॥ ১,৭।) তিনি বলেছেন, প্রতীহার রাজা মুরল, মেকল, কলিঙ্গ, কেরল, কুলূত, কুন্তল ও রমঠদের পরাজিত করেছেন। এই বর্ণনা অনুসারে মহীপালের রাজ্য উত্তর-পশ্চিমে উচ্চ বিপাশা অববাহিকা থেকে দক্ষিণ-পূর্বে ওড়িশা এবং উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে কেরল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সুদূর দক্ষিণে মহীপাল সসৈন্যে কেরল পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন এ কথা অবশ্যই কল্পনাশ্রিত। কিন্তু আল মাসুদি প্রতীহার রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত সম্পর্কে যে বক্তব্য রেখেছেন তার পরিপ্রেক্ষিতে প্রচণ্ডপাণ্ডবম্ নাটকে বর্ণিত মহীপালের উত্তরাভিযানকে সর্বৈব কাল্পনিক বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

এক বিদ্যোৎসাহী নরপতিরূপেও মহীপাল ভারত-ইতিহাসে যশস্বী হয়ে আছেন। সেকালের দু’জন শ্রেষ্ঠ কবি ও নাট্যকার তাঁর সভা অলংকৃত করেছিলেন। এঁদের একজন ‘চণ্ডকৌশিকম্’ প্রণেতা ক্ষেমীশ্বর, অন্যজন ‘কাব্যমীমাংসা’র বিশ্রুতকীর্তি লেখক রাজশেখর। রাজশেখরের লেখা ‘বালভারতম্’ নাটকখানি মহীপালের রাজসভায় মঞ্চস্থ হয়েছিল। কাব্যমীমাংসাকার মহীপালের উপর বিস্তর প্রশংসাবারি বর্ষণ করেছেন। তিনি প্রতীহার নৃপতিকে রঘুবংশের ‘মুক্তামণি’ বলে আখ্যাত করেছেন, ‘আর্যাবর্ত-মহারাজাধিরাজ’ বলে তাঁর বন্দনা করেছেন। সম্ভবত ৯৩১ খ্রিস্টাব্দের কিছুকাল পূর্বে অনুজ প্রথম বিনায়কপাল মহীপালকে পরাজিত ও সিংহাসনচ্যুত করেন। ৯৩১ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিনায়কপাল যে সিংহাসনে আরূঢ় ছিলেন সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

দ্বিতীয় মহেন্দ্রপাল ও দেবপাল (৯৪৪-৯৫৪ খ্রি.)

দ্বিতীয় মহেন্দ্রপাল (৯৪৪-৪৮ খ্রি.) : বিনায়কপালের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দ্বিতীয় মহেন্দ্রপাল কান্যকুব্জের সিংহাসনে আরোহণ করেন। ৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের কিছুকাল পর এই পালাবদল ঘটে। পিতার মতো তিনিও পূর্বে বারাণসী থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে উজ্জয়িনী-ধর পর্যন্ত সুবিস্তৃত রাজ্যের অধীশ্বর ছিলেন। সাধারণত মনে করা হয়, ৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের কিছু পূর্বে দ্বিতীয় মহেন্দ্রপালের রাজত্বের অবসান হয়। ৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে দেবপাল নামে এক প্রতীহার রাজা যে রাজত্ব করেছিলেন তার প্রমাণ আছে। কিন্তু দেবপাল ঝাঁসি অঞ্চলে রাজত্ব করতেন, কান্যকুব্জে নয়। দেবপাল ছিলেন ক্ষিতিপাল ওরফে মহীপালের পুত্র। প্রথম বিনায়কপাল কর্তৃক কান্যকুব্জ থেকে বিতাড়িত হয়ে মহীপাল সম্ভবত ঝাঁসি অঞ্চলে রাজত্ব করতে থাকেন। মহীপালের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দেবপাল এই ঝাঁসি অঞ্চলেই রাজত্ব করেন। সেক্ষেত্রে ৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের পরও কিছুকাল দ্বিতীয় মহেন্দ্রপালের রাজপদে থাকার সম্ভাবনা অস্বীকার করা যায় না।

দেবপাল (৯৪৮-৫৪ খ্রি.) : সিয়াডোনি লেখে পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ পরমেশ্বর দেবপালের কথা বলা হয়েছে। তিনি পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ পরমেশ্বর ক্ষিতিপালের পুত্র। প্রথম মহীপালেরই আর এক নাম ক্ষিতিপাল। দেবপাল ৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে ঝাঁসি অঞ্চলে রাজত্ব করেন। এ সময় দ্বিতীয় মহেন্দ্রপাল কান্যকুব্জসহ অবশিষ্ট প্রতীহার রাজ্যে রাজত্ব করতেন। ঝাঁসির রাজা হলেও ঝাঁসির শাসনকার্য নিজের হাতে না রেখে তিনি নিষ্কলঙ্ক নামে এক পদস্থ রাজপুরুষের স্কন্ধে ন্যস্ত করেন। দেবপাল সম্ভবত মেবারের রাজা অল্পটের হাতে পরাজিত ও নিহত হন।

প্রথম বিনায়কপাল (৯৫৪-৫৫ খ্রি.)

প্রথম মহেন্দ্রপাল ও রানি মহীদেবীর পুত্র প্রথম বিনায়কপাল অন্তত ১৪৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। ৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ রাজা ধঙ্গের খজুরাহো লেখে এক বিনায়কপালের উল্লেখ আছে। অনেকেই মনে করেন, খজুরাহো লেখের বিনায়কপাল ও প্রথম বিনায়কপাল একই ব্যক্তি। তাহলে প্রথম বিনায়কপাল অন্তত ৯৫৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করে ছিলেন, এরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু ৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে বা তার কিছুকাল পূর্বে তাঁর পুত্র দ্বিতীয় মহীপাল যে সিংহাসনে আরোহণ করেন তার অকাট্য প্রমাণ আছে। খজুরাহো লেখের বিনায়কপাল অবশ্যই দ্বিতীয় বিনায়কপাল।

প্রথম বিনায়কপালের রাজত্বকালে প্রতীহার রাজ্য আয়তনে সংকুচিত হয়ে পড়ে। কখনও কখনও বলা হয়, ৯৪০ খ্রিস্টাব্দের অল্প কিছুকাল পূর্বে রাষ্ট্রকূটরাজ তৃতীয় অমোঘবর্ষ প্রতীহার রাজ্যভুক্ত কালঞ্জর ও চিত্রকূট অধিকার করেন। চিত্রকূট সম্ভবত রাজস্থান অথবা মধ্যপ্রদেশে অবস্থিত ছিল। চন্দেল্ল যশোবর্মা শীঘ্রই কালঞ্জর জয় করেন। চন্দেল্লরাজ বা গুহিলনৃপতি দ্বিতীয় ভর্তৃপট্ট চিত্রকূট থেকে রাষ্ট্রকূটদের বিতাড়িত করেন। কালঞ্জর ও চিত্রকূট চিরদিনের মতো প্রতীহারদের কর্তৃত্বের বাইরে চলে গেল। তবে তৃতীয় অমোঘবর্ষের রাজত্বকালে রাষ্ট্রকূটরা প্রথম বিনায়কপালকে কালঞ্জর ও চিত্রকূট থেকে বিতাড়িত করেন, এমনটি হয়তো আদৌ ঘটেনি। অনুমিত হয়, সে সময় এ দু’টি স্থান চেদিদের অধিকারভুক্ত ছিল। অর্থাৎ ইতিমধ্যেই চেদিগণ প্রতীহারদের কালঞ্জর-চিত্রকূট থেকে বিতাড়িত করেছেন। প্রথম বিনায়কপালের আশা ছিল, স্থান দু’টি তিনি পুনরুদ্ধার করবেন। কিন্তু চেদিরা ছিলেন রাষ্ট্রকূটদের পরম মিত্র। উপরন্তু তখন রাষ্ট্রকূট যুবরাজ কৃষ্ণের শক্তি ক্রমবর্ধমান; তিনি দক্ষিণ ভারতে একটির পর একটি রাজ্য জয় করে চলছেন। স্বভাবতই কৃষ্ণের বিরোধিতার ভয়ে প্রথম বিনায়কপাল কালঞ্জর ও চিত্রকূট পুনরুদ্ধারের আশা ত্যাগ করেন। বিনায়কপাল মেবার থেকেও বিতাড়িত হলেন। মহারাজাধিরাজ ভর্তৃপট্টের নেতৃত্বে সেখানে এক স্বাধীন গুহিল রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়। চৌলুক্য মূলরাজ দক্ষিণ গুজরাতে এক স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করেন। অনহিল-পাটক হল নতুন রাজ্যের রাজধানী।

এসব ক্ষয়-ক্ষতি সত্ত্বেও প্রথম বিনায়কপালের রাজ্য মোটামুটি বিস্তৃতই ছিল বলা যায়। কান্যকুব্জে তাঁর অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। বারাণসী অঞ্চল তাঁর রাজ্যভুক্ত ছিল। গ্বালিয়র এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলও তাঁর অধিকারভুক্ত ছিল। দ্বিতীয় মহেন্দ্রপালের প্রতাবগড় লেখে ইঙ্গিত আছে, রাজস্থানের প্রতাবগড় এবং মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনী-ধর অঞ্চল বিনায়কপালের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পূর্বে বারাণসী থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রতাবগড় ও ধর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ রাজ্যের অধিপতি ছিলেন প্রথম বিনায়কপাল।

দ্বিতীয় বিনায়কপাল

চন্দেল্ল ধঙ্গের খজুরাহো লেখে এই রাজার উল্লেখ আছে। লেখটিতে তাঁর রাজত্বের একটি তারিখও আছে। তারিখটি ৯৫৪ খ্রিস্টাব্দ। দ্বিতীয় বিনায়কপাল সম্ভবত দ্বিতীয় মহেন্দ্রপালের পুত্র ছিলেন। তিনি আনুমানিক ৯৫০ খ্রিস্টাব্দে পিতৃসিংহাসনে আরোহণ করেন। সম্ভবত অপুত্রক অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে প্রথম বিনায়কপাল ও দ্বিতীয় মহেন্দ্রপালের বংশের পরিসমাপ্তি ঘটে। এ সময় সিংহরাজের নেতৃত্বে শাকম্ভরী প্রদেশে অর্থাৎ আজমের-জয়পুর অঞ্চলে এক স্বাধীন চাহমান রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়। সিংহরাজের পুত্র দ্বিতীয় বিগ্রহরাজের রাজত্বকালে এই রাজ্যটি শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

বিজয়পাল (৯৫৬-৯৬০ খ্রি.)

দেবপালের মৃত্যুতে তাঁর অনুজ পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ পরমেশ্বর বিজয় পাল ঝাঁসির সিংহাসনে আরোহণ করেন। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দেবপালের মতো বিজয়পালের রাজ্য শুধু ঝাঁসি অঞ্চলেই আবদ্ধ ছিল না, পূর্ব রাজস্থান ও গাঙ্গেয় অববাহিকার কিয়দংশও তাঁর রাজ্য ভুক্ত ছিল। মথনদেবের রাজোরগড় লেখে পূর্ব রাজস্থানের আলোয়ার অঞ্চলে বিজয়পালের রাজনৈতিক অধিকার বিস্তারের ইঙ্গিত আছে। কান্যকুব্জও তাঁর অধীন ছিল। এই পূর্ব রাজস্থান এবং কান্যকুব্জ বা গাঙ্গেয় অববাহিকা পূর্বে দ্বিতীয় বিনায়কপালের রাজ্যভুক্ত ছিল। কিন্তু ৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের পর কোনও এক সময় এই অঞ্চল দু’টিতে বিজয়পালের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। লক্ষ করবার বিষয়, দ্বিতীয় বিনায়কপালের কোনও প্রত্যক্ষ উত্তরাধিকারীর কথা জানা যায় না। পক্ষান্তরে বিজয়পালের অধস্তন পুরুষেরা যে খ্রিস্টীয় ১১শ শতকের প্রথম পাদ পর্যন্ত কান্যকুব্জে রাজত্ব করতেন তার সুনিশ্চিত প্রমাণ আছে। এ থেকে মনে হয়, দ্বিতীয় বিনায়কপাল অপুত্রক অবস্থায় মারা গেলে তাঁর পিতৃব্য বিজয়পাল বিনা বাধায় কান্যকুব্জের সিংহাসন অধিকার করেন। আবার এটাও সম্ভব, বিজয়পাল দ্বিতীয় বিনায়কপালকে বিতাড়িত করে কান্যকুব্জ ও পূর্ব রাজস্থানের আধিপত্য লাভ করেন। বিজয়পাল তাঁর এই রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধিতে দুই ব্যক্তির প্রভূত সহায়তা লাভ করেন। তাঁদের একজন মহীপাল, অন্যজন মথনদেব। তাঁরা উভয়েই গুর্জর প্রতীহার গোষ্ঠীভুক্ত ছিলেন।

মনে হয়, বিজয়পালের রাজত্বের শেষের দিকে কয়েকটি অঞ্চলে প্রতীহার আধিপত্য বিলুপ্ত হয়। সিয়াডোনিতে মহারাজাধিরাজ নিষ্কলঙ্ক এক স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ তাঁর সিয়াডোনি লেখে তিনি কোনও প্রতীহার রাজার নামোল্লেখ করেননি অথচ পূর্বে তিনি দেবপালের এক অনুগত মিত্র ছিলেন। তাঁর পৌত্র হরিরাজেরও একখানি লেখ সিয়া ডোনিতে আবিষ্কৃত হয়েছে। এই লেখেও কোনও প্রতীহার রাজার উল্লেখ নেই। কালঞ্জর-খজুরাহো অঞ্চলে এক স্বাধীন চন্দেল্ল রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়। ৯৫৪ খ্রিস্টাব্দেও চন্দেল্ল ধঙ্গ প্রতীহারদের অনুগত ছিলেন কিন্তু পরবর্তিকালে তিনি যত লেখ উৎকীর্ণ করেছেন তার কোনওটিতেই প্রতীহার রাজাদের উল্লেখ নেই। গ্বালিয়র থেকেও বিজয়পাল বিতাড়িত হন। ১০৩৪ বিক্রমাব্দ বা ৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ গ্বালিয়র লেখে কচ্ছপঘাত মহারাজাধিরাজ বজ্রদামা দাবি করেছেন, গাধিনগর অর্থাৎ কান্যকুব্জের অধিপতিকে পরাজিত করে তিনি গোপাদ্রি অধিকার করেছেন। গাধিনগরের পরাজিত এই রাজা বিজয়পাল। উত্তরে জোধপুর থেকে দক্ষিণে আবু পাহাড় পর্যন্ত বিস্তৃত রাজ স্থানের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল পরমার রাজা মুঞ্জের অধিকারভুক্ত হয়। তাঁর দুই পুত্র অরণ্যরাজ ও চন্দন এবং ভ্রাতুষ্পুত্র দুসল যথাক্রমে আবু পাহাড়, জালোর ও ভিনমাল অঞ্চলের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। আনুমানিক ৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে বিজয়পালের রাজত্বের পরিসমাপ্তি ঘটে।

রাজ্যপাল (৯৬০-১০১৮ খ্রি.)

বিজয়পালের পুত্র রাজ্যপাল যখন কান্যকুব্জের সিংহাসনে আরোহণ করেন তখন সবুক্তিগিনের নেতৃত্বে আফগানিস্তানের গজনিতে এক অশেষ শক্তিধর রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে। ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে সবুক্তিগিনের মৃত্যু হয় এবং তাঁর পুত্র মামুদ গজনির সুলতান পদে অভিষিক্ত হন। এক প্রবল পরাক্রান্ত রাজ্যরূপে গজনির অভ্যুত্থান উত্তর ও ভারতীয় রাজ্যগুলির অস্তিত্ব বিপন্ন করে তোলে।

  • ১০০১ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মামুদ ষাহিরাজ্য আক্রমণ করেন। ষাহিরাজ জয়পাল তাঁকে বাধা প্রদানের নিমিত্ত সসৈন্যে পেশোয়ারের উপকণ্ঠে এসে উপস্থিত হন। (এই যুদ্ধকে কখনও কখনও আটকের যুদ্ধ (অটক পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি জেলায় অবস্থিত) বলে অভিহিত করা হয়। প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধটি অনুষ্ঠিত হয় পেশোয়ারের সন্নিকটবর্তী কোনও এক স্থানে।
  • ষাহিরাজ্যে মামুদের প্রথম অভিযান ঘটে আরও এক বছর পূর্বে, অর্থাৎ ১০০০ খ্রিস্টাব্দে। সে অভিযানের ফলে পেশোয়ারের নিকটবর্তী কয়েকটি দুর্গ ও শহর তাঁর করতলগত হয়। মামুদের হস্তে যাহিরাজের সেই প্রথম পরাজয়।) জয়পাল যখন পার্বত্য অঞ্চল হতে সামরিক সাহায্য লাভের আশায় কালাতিপাত করছেন তখন মামুদ তাঁকে অতর্কিতে আক্রমণ করে পুত্র ও পৌত্রগণসহ বন্দি করেন। প্রচুর উপঢৌকনের বিনিময়ে জয়পাল শেষে মুক্তি পেলেন ঠিকই কিন্তু উপর্যুপরি পরাজয়ের গ্লানি সহ্য করতে না পেরে অগ্নিকুণ্ডে আত্মাহুতি দেন।
  • ১০০৮ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মামুদ পুনরায় যাহি রাজ্য আক্রমণ করেন। (এ অভিযান ষাহিরাজ্যে মামুদের চতুর্থ অভিযান। ষাহিরাজ্যে মামুদের তৃতীয় অভিযান ঘটে ১০০৫ খ্রিস্টাব্দে।) তখন জয়পালের পুত্র আনন্দপাল যাহি সিংহাসনে সমাসীন। ফিরিস্তা বলেন, মামুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কনৌজ, উজ্জয়িনী, কালঞ্জর, দিল্লি ও আজমেরের রাজারা আনন্দপালকে সাহায্য করেন। ফিরিস্তার বিবরণ সত্য হলে বুঝতে হবে প্রতীহাররাজ রাজ্যপাল জয়পালের পুত্র আনন্দপালকে সাহায্য করেন। উটবির বিবরণে অবশ্য সুলতান মামুদের বিরুদ্ধে ভারতীয় রাজাদের মিত্রজোট গঠনের কোনও উল্লেখ নেই।
  • ১০১৮ খ্রিস্টাব্দের ২ ডিসেম্বর মামুদ যমুনা নদী অতিক্রম করেন। এবার তাঁর লক্ষ্য প্রতীহার রাজধানী কান্যকুব্জ। কিন্তু রাজ্যপাল রাজধানী রক্ষার কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন না। প্রতীহার রাজ কান্যকুজের ৪৮.২৮০ কি. মি. পূর্বে গঙ্গার অপর তীরে অবস্থিত বারি দুর্গে আশ্রয় নেন। শহরের দেবায়তনগুলিকে ধ্বংস করা হয়, অসহায় নাগরিকদের নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয় এবং গৃহগুলিতে অগ্নিসংযোগ ও লুঠপাট চালানো হয়। এরপর মামুদ একে একে মুঞ্জ, অসনি, শর্ব ইত্যাদি দুর্গ অধিকার করেন। অবশেষে ১০১৯ খ্রিস্টাব্দের প্রারম্ভে তিনি প্রচুর ধনরত্ন ও ক্রীতদাস ক্রীতদাসীসহ স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন।

সুলতান মামুদের সামরিক অভিযানে রাজ্যপালের দুর্বলতা নগ্নভাবে প্রকাশ পেল। তিনি দুর্বল, তিনি সাম্রাজ্য রক্ষায় অপারগ। এই সুযোগে চন্দেল্লরাজ গণ্ড প্রতীহাররাজ্য আক্রমণ করেন। অভিযানের দায়িত্বে ছিলেন চন্দেল্লরাজকুমার বিদ্যাধর। কচ্ছপঘাত নৃপতি অর্জুন চন্দেল্ল পক্ষে যোগদান করেন। যুদ্ধে রাজ্যপাল নিহত হন। (কীভাবে ও কার হাতে রাজ্যপালের মৃত্যু হয় সে সম্পর্কে সমকালীন তথ্য পরস্পর বিরোধী। বিক্রম সিংহের দেবকুণ্ড লেখে বলা হয়েছে, রাজা অর্জুনের হাতে রাজ্যপালের মৃত্যু হয়। কিন্তু মহোবা লেখ বলছে, বিদ্যাধর কান্যকুজের রাজাকে সংহার করেন (বিহিত-কান্যকুব্জপালভঙ্গম্)।) ১০২০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

ত্রিলোচনপাল ও যশঃপাল (১০১৮-১০৩৬ খ্রি.)

ত্রিলোচনপাল (১০১৮-১০২৭ খ্রি.) : রাজ্যপালের পর প্রতীহার সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র ত্রিলোচনপাল। ১০২০-২১ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মামুদ বারি শহর আক্রমণ করেন। ত্রিলোচনপালের রাজধানী ছিল এই বারি। ‘যঃ পলায়তি সঃ জীবতি’ এই নীতি অনুসরণ করে ত্রিলোচনপাল রাজধানী ত্যাগ করে অন্যত্র পলায়ন করেন। মামুদ অরক্ষিত বারি শহরে নির্বিচারে হত্যা ও লুণ্ঠনকার্য চালান। বারিতে কয়েকদিন অবস্থানের পর মামুদ স্বদেশাভিমুখে রওনা হলে ত্রিলোচনপাল রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করেন। এ সময় ত্রিলোচনপালের রাজ্য শুধু এলাহাবাদ অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ থাকে। বারাণসী প্রতীহারদের হস্তচ্যুত হয়। সারনাথে পাওয়া একখানি লেখ থেকে জানা যায়, ১০২৬ খ্রিস্টাব্দের কিছুকাল পূর্বে পালরাজ প্রথম মহীপাল এই অঞ্চল অধিকার করেন। সারনাথে পাল আধিপত্য দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি। প্রতীহাররাও আর এই অঞ্চল পুনরুদ্ধার করতে পারেননি। কলচুরি রাজা গাঙ্গেয়দেব ১০২৬ খ্রিস্টাব্দের অত্যল্পকাল পরই এ অঞ্চল জয় করেন। বৈহাকির লেখা তারিখ উস-সুবুক্তিগিন গ্রন্থখানি থেকে এসব তথ্য জানা যায়। ত্রিলোচনপাল অন্তত ১০২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। ওই বছরই তাঁর ঝুসি অভিলেখ উৎকীর্ণ হয়।

যশঃপাল (১০২৪-১০৩৬ খ্রি.) : ১০৩৬ খ্রিস্টাব্দে যশঃপাল নামে একজন রাজা এলাহাবাদ অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। যশঃপালের নামের সঙ্গে ত্রিলোচনপালের নামের মিল আছে। তাঁদের লেখও প্রায় একই অঞ্চলে আবিষ্কৃত হয়েছে। এ থেকে মনে হয়, যশঃপাল ত্রিলোচনপালের উত্তরাধিকারী ছিলেন কিন্তু তাঁদের মধ্যে কী সম্পর্ক ছিল তা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। এই যশঃপালই ছিলেন সম্ভবত প্রতীহার বংশের সর্বশেষ নরপতি। ১১শ শতকের দ্বিতীয় পাদে কান্যকুব্জ-এলাহাবাদ অঞ্চলে এক রাষ্ট্রকুট রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হয়। এই রাজবংশের যিনি স্থপতি তাঁর নাম চন্দ্র। সম্ভবত চন্দ্রের হাতেই যশঃপাল পরাজিত ও রাজ্যচ্যুত হন। তিন শতাব্দীরও দীর্ঘ সময় রাজত্ব করার পর প্রতীহার রাজবংশের উচ্ছেদ ঘটল এক অখ্যাত রাজনৈতিক ভাগ্যান্বেষীর হাতে।

প্রতীহার সাম্রাজ্যের পতনের কারণ

প্রতীহার সাম্রাজ্যের পতনের পিছনে একাধিক কারণ সক্রিয় ছিল –

  • দুর্বল নেতৃত্ব প্রতীহার সাম্রাজ্যের পতনের অবশ্যই একটি মুখ্য কারণ। আদি পর্বের বেশির ভাগ প্রতীহার রাজাই ছিলেন রণনিপুণ, বিচক্ষণ ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। তাঁদের আমলে প্রতীহার সাম্রাজ্যের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধিই ঘটেছে। কিন্তু উত্তর পর্বের রাজাদের সিংহভাগই ছিলেন ভীরু, দুর্বল ও অপরিণামদর্শী। গুজরাত থেকে উত্তরপ্রদেশ পর্যন্ত প্রসারিত বিস্তীর্ণ সাম্রাজ্যের অখণ্ডতা রক্ষার সামর্থ তাঁদের ছিল না। ফলে সাম্রাজ্যের আয়তন ক্ষীয়মান হতে হতে শেষে এলাহাবাদ কান্যকুব্জ অঞ্চলে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। পরিশেষে সেখানেও প্রতীহার শাসনের অবলুপ্তি ঘটে।
  • দক্ষিণ ভারতের পরাক্রান্ত রাষ্ট্রকূট রাজাদের সঙ্গে নিরন্তর সংঘর্ষ প্রতীহার রাজশক্তির পক্ষে পরিণামে শুভ হয়নি। রাষ্ট্রকূট রাজশক্তির প্রবল প্রতিরোধের ঢেউ প্রতীহার সাম্রাজ্যের গায়ে আছড়ে না পড়লে প্রতীহারদের ইতিহাস অন্যরূপ হতে পারত।
  • এক দুর্বল বুনিয়াদের উপর প্রতীহার সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক ইমারত গড়ে উঠেছিল। রাজার নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব রাজতন্ত্রের স্থায়িত্বের এক অপরিহার্য শর্ত। কিন্তু প্রতীহার রাজা সে অপ্রতিহত কর্তৃত্বের অধিকারী ছিলেন না। সাম্রাজ্যের এক ক্ষুদ্র অংশেই তাঁর প্রত্যক্ষ শাসন বলবৎ ছিল কিন্তু বৃহদংশই ছিল শক্তিশালী এক শ্রেণির শাসককুলের নিয়ন্ত্রণে। এই শাসকবৃন্দের নিজস্ব সৈন্যবাহিনী ছিল। নীতিগতভাবে তাঁরা প্রতীহার সম্রাটের অনুগত হলেও স্বশাসিত অঞ্চলে তাঁরা কার্যত স্বাধীনই ছিলেন। সুযোগ বুঝে তাঁরা প্রকাশ্যে স্বাধীনতাও ঘোষণা করেছেন। এভাবেই প্রতীহার সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে চন্দেল্ল, কচ্ছপঘাত প্রভৃতি রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়েছে; নিষ্কলঙ্কও সিয়াডোনি অঞ্চলে এক স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করেছেন।
  • রাজপরিবারে অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রতীহার সাম্রাজ্যের পতনের আর একটি কারণ। প্রথম মহেন্দ্রপালের মৃত্যুর পর এই অন্তর্দ্বন্দ্ব তীব্র আকার ধারণ করে। রাজপরিবারের এই অনৈক্য প্রতীহার সাম্রাজ্যের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তোলে।
  • উত্তর পর্বের প্রতীহার রাজারা অশ্বারোহী বাহিনীর আধুনিকীকরণের দিকে খুব একটা দৃষ্টি দেননি। অথচ পশ্চিম ও মধ্য এশীয় রাজশক্তির সামরিক উৎকর্ষের মূলে ছিল তার সুশিক্ষিত অশ্বারোহী বাহিনী যা কর্মতৎপরতায়, সাহসিকতায় ও দক্ষতায় প্রতীহার তথা ভারতীয় অশ্বারোহী সৈন্যদলের তুলনায় অনেক উন্নত ছিল। ফলে সুলতান মামুদ প্রায় বিনা বাধায় প্রতীহার সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছেন, অবাধে লুণ্ঠনকার্য চালনা করেছেন আর রাজ্যপাল-ত্রিলোচনপালেরা তাঁর সম্মুখীন না হয়ে কাপুরুষের মতো পলায়ন করেছেন। এতে প্রতীহার রাজাদের জীবন রক্ষা পেয়েছে ঠিকই কিন্তু সাম্রাজ্যের ভিত কেঁপে উঠেছে।
  • প্রতীহার সাম্রাজ্যের পতনে সুলতান মামুদের ভূমিকাও উপেক্ষণীয় নয়। গজনির সুলতান প্রতীহার রাজ্য আক্রমণ করলে রাজ্যপাল ও ত্রিলোচনপাল চূড়ান্ত ব্যর্থতার পরিচয় দেন। তাঁদের উচিত ছিল আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো কিন্তু তাঁরা তা না করে কাপুরুষের মতো পলায়ন করেন। এতে প্রতীহার সাম্রাজ্যের দুর্বলতা নগ্নভাবে প্রকট হয়ে পড়ে। এই সুযোগে চন্দেল্ল বিদ্যাধর, কচ্ছপঘাত অর্জুন এবং কলচুরি গাঙ্গেয়দেব স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। নতুন রাজ্যগুলি এক সময় প্রতীহার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

গ্রন্থপঞ্জি

  • Altekar, A. S : The Rāstrakutas And Their Times (Poona, 1934 ).
  • Majumdar, R. C.: “The Gurjara-Pratihāras” in the Journal Of the Department of Letters, Vol. X, pp. 1-76; The Age Of Imperial Kanauj (Bombay, 1955).
  • Ojha, G. H.: History of Rajputana, Vol. 1 (Ajmer, 1937).
  • Puri, Baij Nath: The History Of The Gurjara-Pratihāras (Bombay, 1957).
  • Tripathi, R. S.: History Of Kanauj (Banaras, 1936).
  • Sharma, Dasaratha Rajasthan Through The Ages (Bikaner, 1966).

1 Trackback / Pingback

  1. ভারত – সময়রেখা

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.