বরিশালের উপভাষা

লেখাটি রফিকুল বাসার সম্পাদিত “ভাষা ভাবনা” গ্রন্থের দেলোয়ার হোসেন লিখিত “বরিশালের  উপভাষা” প্রবন্ধটি, যাকে এখানে ঈষৎ সম্পাদিত করা হয়েছে।

বরিশালে ছিল প্রাচীন ‘বাঙ’ জাতির বাস। ‘বাঙ’ জাতিই প্রাচীন বাংলা সাহিত্য ও বাংলা ভাষার আদিরূপকে রূপদান করেছে। বৌদ্ধ আমলের কবি মীন নাথ বাংলা ভাষার আদি কবি। তাঁর রচনা এখন থেকে এক হাজার বছর আগের বাংলা ভাষায় রচিত প্রাচীন বাংলা পদ বা কবিতা। ‘বাঙ’ থেকে যে ‘বাংলা’ ভাষার উৎপত্তি ঘটেছিল, সে কথা এখন অনেকেই স্বীকার করেন। বরেন্দ্র ও রাঢ় অঞ্চল ছিল সংস্কৃত প্রভাবিত। কিন্তু ‘বঙ্গ’ ছিল সব দিক থেকে ভিন্ন। বাংলা ভাষার সাধু রূপটি বরিশালের কথ্য ভাষায় স্পষ্ট। বরিশালের ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষার প্রভাবযুক্ত বাংলার চেয়ে একটি ভিন্ন উপাদানই বেশি যুক্ত বলে মনে হয়। এখানের শব্দে প্রচুর আরবি শব্দ, আরাকানি শব্দ ও ইন্দোচীনা শব্দ পাওয়া যায়। প্রাচীন ‘বাঙ’ জাতি মূলত এসেছিল ইন্দো-চীন থেকে। বরিশাল অঞ্চলে ‘বাঙ’, ‘বাঙ্গাল’ ও ‘বঙ্গ’ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এ জনপদের দক্ষিণের পার্শ্ববর্তী সাগরটিও সব কিছুকে বাদ দিয়ে নাম ধারণ করেছে ‘বঙ্গোপসাগর’। সুতরাং ‘বঙ্গ’ শব্দটি বরিশালের সাথে আষ্টে-পৃষ্ঠে বাঁধা। স্থান পরিচয়, নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয়, ভাষার পরিচয় সব কিছুতেই এ বঙ্গ’র বড় প্রভাব। বরিশালের আঞ্চলিক ভাষা পার্শ্ববর্তী ফরিদপুর ও বিক্রমপুরের ভাষার সাথে অনেকটা সাদৃশ্যপূর্ণ ও মিল রয়েছে। এর কারণ এ ভূ-ভাগ সুদূর অতীতে এক ছিল এবং বরিশালে উপরোক্ত অঞ্চল থেকে জনসমাগম ঘটেছিল। শাহাবাজপুর ও হিজলা অঞ্চলের ভাষায় নোয়াখালী এবং পিরোজপুরের পশ্চিমভাগের ভাষায় কিছুটা খুলনা-বাগেরহাটের সাদৃশ্য বিদ্যমান। এটাও জনবিন্যাসের ফসল।

বরিশালের ভাষা সম্পর্কে প্রথম অনুসন্ধান করেন ড জে. এ গিয়ার্সন। তিনি তার বিখ্যাত ‘Linguistic Survey of India’ গ্রন্থে, বরিশালের ভাষার একটি নমুনা দিয়েছেন। বরিশালের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি. সাদারল্যান্ড ও মি. বিভারিজ বরিশাল অঞ্চলে বরিশালের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কিছু শব্দের তালিকা দিয়েছেন। বিভারিজ প্রদত্ত শব্দগুলোর মধ্যে –

  • কুরা > ১ বিঘা,
  • মোরা > ধানের পাত্র,
  • বদলা > কারো পরিবর্তে কাজ (তবে এখন বরিশাল কেবল কাজ অর্থেই ব্যবহার হয়),
  • খোলা > বীজ বপনের মাঠ (সাদারল্যান্ড কোলা বলেছেন। কোলা অর্থ খোলা মাঠ। এ ক্ষেত্রে সাদারল্যান্ডই ঠিক। বরিশালে খোলা অর্থ ‘উন্মুক্ত’ মাঠ নয়। বেভারিজ এ ক্ষেত্রে ঠিক শব্দ চয়ন করতে পারেনি বলে আমার ধারণা।)
  • চার > সাঁকো
  • আড> বাড়ির কিনারায় উঁচু বাঁধ।
  • বেভারিজ বরিশালে শাশুড়িকে ‘দেওয়ানজি’ ডাকে বলে উল্লেখ করেছেন। এটা কোনো সামন্ত পরিবারে ঐ সময় হতে পারে। এখন সাধারণ মানুষের মধ্যে এর প্রচলন নেই। বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় ‘শাশুড়ি’কে ‘হাউরি’ এবং ‘শ্বশুর’ বাড়িকে ‘হউর’ বাড়ি বলে।

বহুল ব্যবহৃত বরিশালের উপ-ভাষার একটি নমুনা গিয়ার্সন যেভাবে উল্লেখ করেছেন তা দেয়া হল। তবে গিয়ার্সনের ভাষা জরিপ শতবর্ষেরও আগের। সুতরাং বরিশালে এর উচ্চারণ ভেদ ইতিমধ্যেই সৃষ্টি হয়েছে। সে কারণে বর্তমান উচ্চারণের নমুনাটিও এখানে উল্লেখ করা হল। বরিশালের উপ-ভাষার নমুনা:

“একজন মানুষের দুগগা পোলা আছিল। তারগো মদ্যে ছোটুগগা হের বাপরে কইল বাবা বিত্তের যে ভাগ মুই পামু, তা মোরে দেও। হেতে হে হেরগো মদ্যে বিত্ত ভাগ হরিয়া দিল। দিন হতো বাদে ছোটগগা পোরা বেবাক একত্তর হরিয়া দূর দেশে মেলা হরিল। হেখানে হে লুচ্চামি হরিয়া তার বিত্ত বেসাদ উড়াইয়া দিল। হে হককল খোয়াইলে পরে হে দেশে ভারী আহাল হৈল, হেতে হে মুশকিলে পরিয়া এক গিরস্থের ইল্লা লইল। হে বেডা হেরে হের কোলায় হুয়ার রাখতে পাঠাইল। হের পর হুয়ারে যে ভূষি খাইত হেয়া খাইয়া পেট বরতে পারিলেও হে বরত কিন্তু হেয়াও কেহ দিল না।”

উপরোল্লিখিত উদ্ধৃতি বরিশালের বর্তমান উচ্চারণ অনুযায়ী নিম্নরূপ হবে:

“একজন মানের দুগ্‌গা পোলা আলহে। হ্যাগো মদ্যে ছোটুগ্‌গা হ্যার বাপেরে কইল বাবা জাগাজমির যে ভাগ মুই পামু হেইয়া মোরে দ্যাও। হ্যার পরে হে হ্যাগো মদ্যে জাগা ভাগ করা দেলো। কয়্যাক দিন পর ছোটু পোলা বেব্যাক লইয়া দূর দ্যাশে মেলা হল্ল। হ্যাহানে হে লোচ্চামি কর‍্য্যা তার বিত্ত বেসাদ উরাইয়া দিলো। হে হক্কল খুয়ানের পরে হেই দ্যাশে ভারী আহাল অইল। হ্যাতে হে মশকিলে পইড়্যা একজন গিরস্তের বাড়িতে ওড়লো। হে ব্যাডা হ্যারে হের কোলায় হুয়ার রাখতে পাড়াইল। হ্যার পর হুয়ারে যে ভুষিটুসি খাইত হ্যা প্যাট বরতে পারলেও হে বরত কিন্তু হেয়াও কেউ দেলো না।”

এছাড়া বরিশালের উপ-ভাষার কতকগুলো বৈশিষ্ট্য আছে। নিম্নে সংক্ষেপে তা উল্লেখ করা হলো –

  • ১. শব্দের আদিতে অঘোষ অল্পপ্রাণ পশ্চাৎ দন্তমূলীয় উষ্মধ্বনি শ, ষ,স পরিবর্তিত হয়ে আন্তস্বরতন্ত্রজাত ঘোষ মহাপ্রাণ ধ্বনি ‘হ’ রূপে উচ্চারিত হয়। যেমন: শিয়াল > হিয়াল, শালা > হালা, সাপ > হাপ, শাপলা > হাপলা, শামুক> হামুক, সকল > হগল, সাঁতার > হাতার, শটি > হডি, শকুন > হগুন ইত্যাদি।
  • ২. উপ-ভাষায় ‘এ’ ধ্বনি ‘এ্যা’ হিসেবেও উচ্চারিত হয়। যেমন: হে (স) > হ্যা।
  • ৩. শব্দের আদিতে ‘ক’, ‘ত’ কিংবা ‘ফ’ ধ্বনি রূপে উচ্চারিত হয়। যেমন: কর কি>হর কি, ফেলে দাও > হালাইয়া দাও, তাহা কেন > হেয়া কেন।
  • ৪. শব্দের মধ্যবর্তী ‘ক’ ধ্বনিও ‘হ’ রূপে উচ্চারিত। যেমন, আকাল > আহাল
  • ৫. ঘোষ ব্যাঞ্জনের মহাপ্রাণতা প্রায়ই লোপ পায় এবং ঘ. ক. ঢ. ঠ. ভ বিপরীত ঘোষ স্পর্শ-জাতীয় ধ্বনি হিসেবে উচ্চারিত হয়। যেমন: ঘর > গর, ধান > দান, ভাত > বাত, ঢাল > ডাল,
  • ৬. শব্দের আদিতে মহাপ্রাণ ধ্বনি ‘হ’ থাকলে তা আবার কখনো লোপ পায়। যেমন: হাল > আল, হালি > আলি, হইচে > অইচে ইত্যাদি।
  • ৭. দুই বর্ণবিশিষ্ট শব্দের শেষে ‘ট’ বা ‘ঠ’ থাকলে তা ‘ড’ উচ্চারিত হয়। যেমন: মিঠা > মিডা
  • ৮. বিশেষ্যের শেষে ‘গো’ ধ্বনি যুক্ত হয়ে বহুবচন গঠিত হয়। যেমন: আমাদের > আমাগো, তোমাদের > তোমাগো, তাহাদের > হেগো
  • ৯. দ্বিতীয় বিভক্তি হিসেবে ‘কে’ স্থানে সাধারণত ‘রে’ ব্যবহার হয়। যেমন: যদুকে > যদুরে
  • ১০. ত্রিয়ারূপ সংক্ষিপ্ত হয়। যেমন: মরিয়াছে > মরছে, ধরিয়াছে > ধরছে।
  • ১১. উত্তম পুরুষে ভবিষৎকাল বুঝাতে ক্রিয়ার ‘ব’ ও ‘ইব’ পরিবর্তিত হয়ে ‘মু’ হয়। যেমন: যাব > যামু, খাব > খমু, লইবো > লমু।

বরিশালের উপকূলীয় অনেক শব্দে আরবি, ফার্সি, চীনা ও আরাকানি শব্দ আছে। চট্টগ্রামের মতো বরিশালের নামে আরবি প্রাধান্য বেশি না হলেও ভোলার উপকূলীয় নামে এ প্রভাব লক্ষণীয়।

ভাষা বহতা নদীর মতো। ভাষাররূপ ও ধ্বনি তত্ত্ব যুগ-যুগান্তরে পাল্টে যায়। বাংলা ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর একটি শাখা বলে আধুনিক ভাষাতত্ত্ববিদরা স্বীকার করে নিয়েছেন। বরিশালে আর্য ভারতীয় শাখার বাংলা ভাষা-ভাষী জনগোষ্ঠিই বেশি। ১৯৬১ সালের আদমশুমারিতে বাংলা ভাষা-ভাষী ছাড়াও বেশ কিছু উর্দু, হিন্দি, পাঞ্জাবি, ইংরেজি, পশতু, ফার্সি ও আরবি ভাষা-ভাষী লোক ছিল। কিন্তু ১৯৭৪ এবং ১৯৮১ সালের আদমশুমারিতে তেমন দেখা যায় না।

‘বাঙ’ জাতির উৎপত্তিগত ইতিহাস ধরে অগ্রসর হলেও বরিশালে ভাষা বৈশিষ্ট্যর প্রকৃত রূপ পাওয়া যেতে পারে। ইন্দো-চীনা বংশভোত ‘বাঙ’ জাতির সংশ্রবের নতুন দিগন্তও তখন খুলে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।

পঞ্চদশ শতকের বরিশালের বাংলা নমুনা:

‘আগে তারে সেবা তার ইংগিতে
তৎপর হইয়া কার্য করিবে আপনাকে
সাধক অভিমান ত্যাগ করিবে।”
রূপ গোস্বামী (জন্ম : পঞ্চদশ শতক, বরিশাল)

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.