হার্বার্ট স্পেন্সার (১৮২০-১৯০৩)

ভূমিকা

হার্বার্ট স্পেনসার একজন বহুল আলোচিত ব্রিটিশ দার্শনিক এবং খ্যাতনামা উদারনৈতিক রাষ্ট্রচিন্তাবিদ হলেও আজও তিনি Social Darwinism এর প্রধান পুরোধা হিসেবে বিশ্বের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি মূলত বিবর্তনবাদী সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিত। ডারউইন দ্বারা প্রভাবিত সমাজবিজ্ঞানী স্পেনসার হলেন সমাজবিজ্ঞানের একজন বিবর্তনবাদী School এর মূল প্রবক্তা। একথা অবিসম্বাদিত স্বীকৃত সত্য সমাজবিজ্ঞানের উন্নয়ন ও ক্রমবিকাশের চলমান প্রবাহে স্পেনসারের বিবর্তনবাদ তত্ত্ব যে শক্তিশালী গতিধারার সঞ্চার করেছিল তা সমাজবিজ্ঞানের সীমিত গণ্ডিকে ব্যাপক পরিমণ্ডলে বিস্তৃত করতে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছে। তাছাড়াও তিনি জ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষত নীতিশাস্ত্র (Ethics) অধিবিদ্যা (Metaphysics), ধর্ম (Religion), রাজনীতি (Politics), অলংকারশাস্ত্র (Rhetoric), জীববিজ্ঞান (Biology) এবং মনোবিজ্ঞানে (Psychology) অবদান রাখেন। তার অবদানকে ‘Powering figure in the history of social science’ বলেও অভিহিত করা হয়। স্পেনসার সম্পর্কে Richard Hofstadter মন্তব্য করেন, “In the three decades after the Civil War it was impossible to be active in any field of intellectual work without mastering.” (Hofstadter, Richard 1959, Social Darwinism in American Thought, New Yourk Braziller. cited in Ritzer, 1996, P-36.)

জীবনী ও রচনাবলি

স্পেনসার ১৮২০ সালের ২৭ এপ্রিল ইংল্যান্ডের ডারবি (Derby) শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ডারবি (Derby) শহর তখনই শিল্পায়িত ছিল। পিতামাতার নয় সন্তানের মধ্যে স্পেনসারই সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন যিনি বেঁচে ছিলেন। স্পেনসার ছিলেন ছেলেবেলায় দুর্বল এবং অসুস্থ। তাই তিনি কোন স্কুলে পড়াশোনা করেন নি। তার বাবা তাকে বাড়িতেই লেখাপড়া শেখান। তের বছর বয়সে তিনি তার আত্মীয় মি. বার্থ (Bath) এর কাছে চলে যান এবং সেখানে সেই আত্মীয়ের কাছেই আরো শিক্ষা লাভ করেন। সেই আত্মীয় ছিলেন পাদ্রী এবং একজন সমাজ সংস্কারক, যিনি তরুণ স্পেনসারকে দার্শনিক বিপ্লববাদের নীতিমালা সম্পর্কে শিক্ষা দান করেন।

এভাবে স্পেনসার তার বাবা এবং পিতৃব্যের কাছ থেকে যে শিক্ষা লাভ করেন তা ছিল প্রধানত বিজ্ঞানের ওপর। তিনি গ্রিক এবং ল্যাটিন ভাষা খুব একটা জানতেন না এবং মোটামুটিভাবে ভাষাবিদ ছিলেন না বললেই চলে। তিনি ইংরেজি ভাষার উপরও তেমন কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেন নি এবং ইতিহাসে তার জ্ঞান ছিল ভাসাভাসা। ১৬ বছর বয়সে দেখা যায় যে, তার অঙ্কশাস্ত্রে এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে প্রভূত জ্ঞান ছিল।

বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ করে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার যোগ্যতা নেই বলে ধারণা করে স্পেনসার ১৮৩৭ সালে লন্ডন এবং বার্মিংহাম রেলওয়েতে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দেন। একবছর পর তিনি ড্রাফটম্যানের পদে যোগ দেন বার্মিংহাম গুচেস্টার রেলওয়েতে। এখানে তিনি নিয়মিত ডিউটির পর অবসর সময়ে ক্ষুদ্র আবিষ্কারের দিকে মনোনিবেশ করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তেমন সাফল্য লাভ করেন নি। ১৮৪১ সালে যখন সে রেল সড়কের তৈরির কাজ শেষ হয়ে যায় তখন তিনি চাকরিচ্যুত হন এবং নিজের শহরে ডারবিতে যান।

পরবর্তী কয়েক বছর তিনি র‍্যাডিকেল প্রেসে প্রথমে ইঞ্জিনিয়ারিং এবং পরে সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিষয়ের উপর তিনি প্রবন্ধ লেখা শুরু করেন। তার প্রথম লেখা ১৯৪২ সালে ‘Non-Conformist’ নামক একটি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়।

স্পেনসার বেশ কয়েক বছর বিপ্লবী সাংবাদিকতা পেশা এবং রাজনীতির উপর নির্ভরশীল ছিলেন, কিন্তু লেখক হিসেবে বেঁচে থাকা কঠিন হওয়াতে পরবর্তীতে তিনি আবার চাকরি নিতে বাধ্য হন বার্মিংহাম গুচেস্টার রেলওয়েতে। এর দুই বছর পর তিনি আবার বেকার হয়ে পরার কারণে হতাশাগ্রস্ত হয়ে ওঠেন।

একপর্যায়ে তিনি নিউজিল্যান্ডে চলে যাওয়ার কথাও চিন্তা করেন। অবশেষে স্পেনসার ইংল্যান্ডের বিখ্যাত সাপ্তাহিক ‘The Economist’ পত্রিকায় লেখালেখির কাজ শুরু করেন। ১৮৪৮ সালে তিনি এই পত্রিকার সাব-এডিটর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। লন্ডনে ‘The Economist’ পত্রিকার সাথে ৫ বছর অতিবাহিত করার সময় স্পেনসার বিশ্ব সাংবাদিকতার সাথে গভীর সংযোগ স্থাপনে সক্ষম হন। এদের মধ্যে ছিলেন প্রকাশক জন চ্যাপম্যান, বিপ্লবী লেখক জি. এইচ. লিউইস এবং জর্জ ইলিয়ট। এছাড়া তিনি বিশিষ্ট বিজ্ঞানী টমাস হেনরী হাক্সলী (Thomas Henry Huxley), প্রত্নতত্ত্ববিদ জন লুবক (Sir John Lubbock) এবং জন টিল্ডাল (John Tyndall) এর সাথে পরিচিত হন, যারা তার আজীবন বন্ধু ছিলেন।

‘The Economist’ পত্রিকায় কর্মরত অবস্থায় তিনি তার প্রথম পুস্তক ‘Social Statics’ রচনা করেন, যা ১৮৫১ সালে প্রকাশিত হয়। তার এই গ্রন্থটি বেশ সাড়া জাগিয়েছিল এবং পাঠকদের দ্বারা বেশ সমাদৃত হয়েছিল, যা তাকে পরবর্তীকালে লেখক হিসেবে স্বীকৃতি এনে দেয়। এরপর স্পেনসার নিয়মিতভাবে বিভিন্ন জার্নালের জন্য লিখতে থাকেন। ১৮৫২ সালে তিনি ‘The Developmental Hypothesis” নামে একটি প্রবন্ধ লিখেন, যা ডারউইনের Origin of Species প্রকাশ হওয়ার সাত বছর আগে, সেখানে তিনি বিবর্তনবাদী তত্ত্ব তুলে ধরেন।

১৮৫৩ সালে তার পিতৃব্য মারা যান। সে সময় তিনি স্পেনসারের জন্য প্রচুর অর্থ রেখে যান। এ কারণে এবং বিভিন্ন পত্রিকার সাথে তার গড়ে ওঠা সম্পর্কের ভিত্তিতে স্পেনসার ‘The Economist’ পত্রিকার চাকরিটি ছেড়ে দেন। তখন থেকে তিনি একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে বাকি জীবন অতিবাহিত করেন এবং আর কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন নি।

অত্যন্ত মিতব্যয়ী স্পেনসার ছিলেন চিরকুমার। বিখ্যাত ব্রিটিশ লেখিকা জর্জ ইলিয়ট (George Eliot) এর সাথে এক সময় তার গভীর সখ্যতা, যা দেখে অনেকে ধারণা করেছিলেন যে, স্পেনসার শেষ পর্যন্ত তার পাণিগ্রহণ করবেন। স্পেনসার এমনকি তার গতানুগতিক স্বভাবসিদ্ধ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে সে রমণীকে নিয়ে অপেরাতে কিংবা রেস্টুরেন্টে যেতেন। যদিও জর্জ ইলিয়টের দিক থেকে তেমন কোন আপত্তি ছিল না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্পেনসার বিয়ে করলেন না। বলা হয়ে থাকে, স্পেনসার শুধু চিরকুমারই ছিলেন না, সম্ভবত তিনি জীবনে কোন নারীর স্বাদও গ্রহণ করেন নি।

১৮৫৪ সালে স্পেনসার তার “The Principles of Psychology” পুস্তক রচনা করেন, কিন্তু এ পুস্তকটি আগের পুস্তকের মতো তেমন আর সাড়া জাগাতে পারে নি। এর কিছুদিন পর স্পেনসারের স্নায়ুবিক রোগ দেখা দেয়, যা তখনকার চিকিৎসকরা পরিষ্কার বুঝতে পারেন নি। সম্ভবত এখানকার চিকিৎসকরা যাকে বলে থাকেন নিউরোটিক ডিওর্ডার। এর ফলে তিনি সারাদিন শহরে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াতেন এবং কোন কাজে মন বসাতে পারতেন না, এমনকি পড়তেও পারতেন না। এভাবে দেড় বছর বিশ্রামে থাকার পর স্পেনসার আবার ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং কিছু কিছু করে কাজ করতে সমর্থ হন, কিন্তু বাকি জীবন তিনি ছিলেন অনেকটা অসুস্থ। তার ছিল মারাত্মক নিদ্রাহীনতা, যা কাটিয়ে ওঠার জন্য তিনি বেশি পরিমাণ নেশা করতেন। বস্তুত তখন থেকেই স্পেনসার দৈনিক কয়েক ঘণ্টার বেশি কাজ করতে পারতেন না। বেশি সময় কাজ করতে গেলে স্নায়বিক সমস্যা দেখা দিতে পারে এবং নিদ্রাহীনতা বেড়ে যেতে পারে। এজন্য তিনি কয়েক ঘণ্টার বেশি কাজ করতেন না।

স্পেনসার এরপর থেকে সামাজিকভাবে মেলামেশা কিছুটা কমিয়ে দেন। তিনি ক্লাবে গেলেও পত্রিকা পাঠ করতেন অথবা বিলিয়াড খেলতেন। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, স্তাবক এবং শিষ্যদের ছাড়া অন্যদের সাথে গল্প করে সময় কাটাতেন না। তার অসুস্থতার সময় এবং জীবনের শেষ দিনগুলোতে তিনি অসংখ্য ব্যক্তির সান্নিধ্য লাভ করেন। জীবনের শেষদিকে তিনি সকল প্রকার জনভাষণ বর্জন করেছিলেন।

স্পেনসার Synthetic Philosophy পাঠকদের মনোযোগ খুব একটা আকর্ষণ করতে পারেন নি। বিভিন্ন সমালোচক গুরুত্বহীন বিষয় নিয়েই তার সমালোচনায় প্রবৃত্ত হন। কিন্তু তার বন্ধু জন স্টুয়ার্ট মিল, হাক্সলী এবং টিনডাল প্রভৃতি বিখ্যাত বিজ্ঞানীরা স্পেনসারের দর্শনের গুরুত্ব প্রচার করেন। সে সমস্ত ব্যক্তিরা বিভিন্ন ডাইনিং ক্লাবের সদস্য ছিলেন এবং স্পেনসার তার নিজস্ব স্বভাবসিদ্ধ নিয়মে সে সমস্ত ক্লাবে যোগদান করতেন। এসব ক্লাবে যেসব সদস্য ব্যক্তিদের সাথে তার সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে তাদের মধ্যে তিনজন পরবর্তীতে রয়েল সোসাইটির সভাপতি নিযুক্ত হন, পাঁচজন ব্রিটিশ এসোসিয়েশন ফর দ্য এডভান্সমেন্স অব সাইন্স, একজন কলেজ অব সার্জন্স এবং কমিক্যাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট হন।

যখন তার ‘Principles of Biology’ পুস্তকটি রচনাসম্পন্ন হয় তিনি তার প্রকাশনার জন্য তৎকালীন ১১০০ পাউন্ড ব্যয় করেন, কিন্তু তা তেমন সাড়া জাগাতে সমর্থ হয় নি। কিন্তু এভাবে তার উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত অর্থ ব্যয় হয়ে যাওয়ায় স্পেনসার Synthetic Philosophy এর অনেক গ্রাহকের নাম বাদ দিয়ে দেন, কিন্তু এরপর মিল, হাক্সলী এবং টিনডাল এবং অন্যান্যদের সাক্ষরিত একটি সার্কুলার বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে পাঠানো হয় এটির বিভিন্ন সিরিজ সংগ্রহ করার জন্য। সে সময় তার পিতার মৃত্যু হলে তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে অনেক অর্থ লাভ করেন এবং তার একজন আমেরিকান ভক্ত এডওয়ার্ড এল. ইয়োম্যানস তার আমেরিকান ভক্তদের কাছ থেকে বেশকিছু অর্থ সংগ্রহ করে পাঠান। এদিকে এরপর তার পুস্তকসমূহের বিক্রিও বেড়ে যায় এবং স্পেনসারের অর্থাভাবও কেটে যায়।

১৮৭০ সালের পর থেকে স্পেনসার একজন সার্থক লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। ‘The Study of Sociology’ পুস্তকটি একসাথে ব্রিটেন এবং আমেরিকা থেকে প্রকাশিত হয় এবং তা তখনকার সময় ১৫০০ পাউন্ড লাভ এনে দিতে সক্ষম হয়। এরপর আরো বিভিন্ন লেখা ইংল্যান্ডের Fortnightly Review-তে এবং আমেরিকার Popular Science Monthly তে প্রকাশিত হয় এবং পুস্তক আকারেও প্রকাশিত হয়। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন নামকরা রিভিউগুলোতে যেমন- Contemporary Review এবং Nineteenth Century তে তার লেখা প্রকাশিত হয়। সত্তরের দশকের পর তিনি বিখ্যাত বিজ্ঞানী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। জীবনের শেষদিকে তার ‘Social Statics’ প্রকাশিত হয়, যাকে তিনি মনে করেছিলেন একটি দুর্বল রচনা, সেটি পরবর্তীতে সমালোচকদের বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

এছাড়াও তিনি পেয়েছিলেন তার রচনাবলির জন্য অসাধারণ স্বীকৃতি। তার ‘Principles of Biology’ পুস্তকটি তখন অক্সফোর্ড-এ টেক্সট বুক হিসেবে শিক্ষাদান করা হয়। উইলিয়াম জেমস ‘First Principles’ এবং ‘Principles of Psychology’ পুস্তকদ্বয় হার্বার্ট এ তার ছাত্রদের কাছে টেক্সট বুক হিসেবে শিক্ষাদান করতেন। উইলিয়াম গ্রাহাম সামনার আমেরিকার ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্পেনসারের তত্ত্বসমূহ বিস্তৃতভাবে শিক্ষা দিতেন। পরবর্তীতে তার রচনাবলি পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় তথা ফ্রান্স, জার্মান, স্পানিস, ইটালীয় এবং রাশিয়ান ভাষাসহ বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়।

সারাজীবন ধরে স্পেনসার তার প্রাপ্ত বিভিন্ন সম্মানসূচক পদক প্রত্যাখান করেন। এগুলো প্রধানত বিশ্ববিদ্যালয় সরকার এবং বৈজ্ঞানিক সমিতিসমূহ কর্তৃক প্রদান করা হয়েছিল। তার কোন বড় অফিসিয়াল পদবি ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিও ছিল না। কিন্তু এতদসত্ত্বেও বিগত শতাব্দীর শেষের দিকে তিনি চার্লস ডারউইনের মতো সম্মান ও আন্তজাতিক খ্যাতি লাভ করেছিলেন। ১৯০২ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন।

জীবনের শেষের দিকে তিনি যতদূর সম্ভব বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে মেলামেশা কমিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি ১৯০৩ সালের ৮ ডিসেম্বর ৮৩ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন। তার উইল অনুযায়ী তাকে সমাধিস্থ করা হয়। মৃত্যুর পরে তার আত্মজীবনী প্রকাশিত হয়।

স্পেনসারের প্রধান রচনাবলির নামগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলো:

  1. Social Statics, 1851. (Ch. 19, “Right to Ignore the State”)
  2. The Principles of Psychology, 1855.
  3. First Principles, 1862.
  4. Reasons for Dissenting from the Philosophy of M. Comte
  5. The Principles of Sociology, 1876-96.
  6. The Study of Sociology, 1880.
  7. The Man versus the State, 1884
  8. The Factors of Organic Evolution, 1887.
  9. First Principles, 1862
  10. Essays, Scientific, Political and Speculative, 1892.
  11. “The Inadequacy of Natural Selection”, 1893, Contemporary Review
  12. The Principles of Biology, 1894
  13. An Autobiography, 1904.

উল্লেখ্য যে, স্পেনসার যেসব গ্রন্থ রচনা করেছিলেন সে সম্পর্কে পাঠকদের ছিল মিশ্র প্রতিক্রিয়া। তিনি বিভিন্ন প্রবন্ধ লিখেন এবং ‘Descriptive Sociology’ নামে কয়েক খণ্ড পুস্তক লেখেন যা প্রধানত তার সেক্রেটারি এবং সহযোগীরা লিপিবদ্ধ করেন।

সামাজিক বিবর্তনের তত্ত্ব (Theory of Social Evolution)

জীববিজ্ঞানের বিবর্তনবাদের সূচনা করেন চার্লস ডারউইন (Charles Darwin) তার “The Origin of Species” গ্রন্থে। মানুষের উৎপত্তি এবং জীবজগতের ক্রমবিকাশ আলোচিত হয়েছে তার এ গ্রন্থে। স্পেনসার এর বিবর্তনও এর সাথে সাদৃশ্যমূলক। তবে ডারউইনের ‘যোগ্যতমের ঊর্ধ্বতন’ এবং ‘টিকে থাকার সংগ্রাম’ সূত্র দু’টি স্পেনসারের চিন্তার ভিত্তি মূল ছিল কি না এ বিষয়ে বিতর্কের অবকাশ রয়েছে।

ডারউইন বিবর্তনবাদকে Biological Evolution হিসেবে বিশ্লেষণ করেছেন। আর স্পেনসার বিবর্তনবাদকে বিশ্বজগতের সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করেছেন। স্পেনসার তার ‘First Principle’ নামক গ্রন্থে Evolution Theoryটি তুলে ধরেন। তিনি সামাজিক বিবর্তন (Social Evolution) সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, “Evolution is a change from a state of relatively indefinite, incoherent, homogeneity to state of relatively definite coherent homogeneity.” সহজ কথায়, একটি অনির্দিষ্ট অসংলগ্ন এবং সমসত্ত্ব থেকে নির্দিষ্ট, সংলগ্ন এবং অসমসত্তায় উত্তরণই হলো বিবর্তন।

স্পেনসার এর তত্ত্ব সামাজিক বিবর্তনবাদ প্রধানত বা অতি জৈব ধারণার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে। স্পেনসার ‘Super organic life’ বলতে Social and cultural phenomena কে বুঝিয়েছেন, যা সামাজিক নির্ভর ও সামাজিক কার্যকলাপের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। স্পেনসার মূলত এই সমাজকেন্দ্রিক আলোচনায় অধিক আগ্রহী ছিলেন। তাই বিশ্বজনীন বিবর্তনের ধারাকে প্রবিষ্ট করেছেন সমাজ বিবর্তনের গতি রেখা অন্বেষণের ক্ষেত্রে।

স্পেনসারের মতে, Social Evolution এর গতিপথ হলো “Inorganic to organic then to super organic.” সর্বোপরি, সমাজ বিবর্তনের মূল সূত্রটি হলো “Simple society to complex industrial society” তে উত্তরণ।

এখানে Simple society হলো Military society এবং Industrial society হলো Complex society, বিবর্তনের সূত্র প্রয়োগ করে এভাবে তিনি সমাজিক বিকাশের পর্যায়ে সমাজকে নির্দিষ্ট দু’টি পরিমণ্ডলে আবদ্ধ করেন। স্পেনসার মনে করেন, Evolution সংগঠিত হয় নিম্নরূপভাবে-

তবে তিনি Social world নিয়েই বেশি আলোচনা করেছেন।

সামাজিক বিবর্তনের ধাপসমূহ (Stages of Social Evolution)

স্পেনসার এর মতে, বিবর্তন প্রক্রিয়ায় সমাজ বিকাশের ক্ষেত্রে কতকগুলো ধাপ রয়েছে। যথাঃ

  • ১. Greater size : প্রাক সভ্যতার আদিলগ্নে মানুষ ব্যস্ত থাকতো শুধু নিজেকে কেন্দ্র করে। ক্রমান্বয়ে সভ্যতার উন্মেষের সাথে সাথে আত্মকেন্দ্রিক এই জগৎ বিস্তৃত হতে থাকে সঙ্গী-সাথীকে কেন্দ্র করে, যা ধীরে ধীরে পত্তন ঘটায়। জনবসতির সৃষ্টি হয় গোষ্ঠীর, গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গোত্র, গোত্র থেকে জাতি, রাষ্ট্র বিশ্বভাতৃত্ব প্রভৃতি। এই বিস্তৃতি শুধুমাত্র বিমূর্ত সর্ম্পকগত নয়, দৃশ্যমান আকৃতিগতও বটে।
  • ২. Coherence: সভ্যতার উষালগ্নে যাযাবর গোষ্ঠী বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিস্তৃত ছিল। ক্রমান্বয়ে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটে। ফলশ্রুতিতে ঐক্যবদ্ধভাবে কোন প্রভাবশালী ব্যক্তির বশ্যতা স্বীকার করে নেয়।
  • ৩. Definitness: খাদ্য সংগ্রহ অর্থনীতি থেকে ক্রমান্বয়ে যাযাবর গোষ্ঠীর উত্তরণ ঘটে খাদ্য উৎপাদন অর্থনীতিতে। মানুষ যাযাবরী অর্থনীতি ত্যাগ করে স্থায়ী বসতি স্থাপন করে। ধীরে ধীরে সমাজস্থ সংগঠনগুলো সুনির্দিষ্ট হয়ে পড়ে।
  • 8. Multiformity: বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কর্মপদ্ধতির বিভিন্নতা দেখা দেয়। ধীরে ধীরে তারা পৃথক হয়ে পড়ে এবং সত্যকার স্বকীয়তা অর্জন করে।

স্পেনসারের মতে, উপরিউক্ত প্রক্রিয়ায় সামাজিক বিবর্তনের সূত্র পরিপূর্ণ হয়। একটি সরল সমাজকে পরিধির বিস্তার, সংবদ্ধতা, নির্দিষ্টতা এবং বহুরূপিতার উপাদানে বিভূষিত করে বিবর্তনের জটিলতম রূপের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

সমাজ কাঠামো (Social structure): সমাজ একটি চলমান সত্তা হিসেবে এর আকার বৃদ্ধির সাথে সাথে কাঠামো (Structure) এর পরিবর্তন হয়। স্পেনসারের মতে, সমাজ বিবর্তিত হচ্ছে আবার ভেঙে যাচ্ছে তার প্রক্রিয়াটি হলো পৃথকীকরণ, যা সার্বক্ষণিকভাবে হয়। বিবর্তনের প্রথম পর্যায় হলো Intégration এবং দ্বিতীয় পর্যায় হলো Differentiation এবং শেষে Determination তথা নিয়মানুগত্য।

প্রথমে ‘একত্রীকরণ’ ঘটে Simple society তে পরিবার নামক একককে কেন্দ্র করে। অতঃপর জটিল সমাজ ও যৌথ জটিল সমাজে এসে পৃথকীকরণ ঘটে আকৃতিগত, বিমূর্ত সম্পর্কগত এবং প্রক্রিয়াগত সমস্ত ক্ষেত্রে, যা পরবর্তীতে নিয়মানুগত্যকে অবলম্বন করে সামাজিক যোগাযোগ প্রথার বৈচিত্র্য ও সৌকার্য ঘটিয়ে পরিণত করে।

সামাজিক প্রকরণ (Social Type)

স্পেনসার সামাজিক বিবর্তন পর্যায়ে সমাজকে দু’টি পরিমণ্ডলে আবদ্ধ করেছেন। তিনি সমাজের আকৃতিগত জটিলতা, স্থায়িত্ব, নেতৃত্ব, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় সংগঠনের মাত্রা প্রভৃতির উপর ভিত্তি করে Simple society কে Military society এবং Complex society কে Industrial society হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং সমতত্ত্ব থেকে অসমতত্ত্বে উত্তরণ প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করেছেন। যথাঃ

  • ক. যুদ্ধভিত্তিক সমাজ (Military society): মানবসমাজের সামাজিক জীবনের প্রাথমিক ভিত্তি স্থাপিত হয় যুদ্ধবিগ্রহ অবলম্বন করে। এখানে খাদ্য, বাসস্থান তথা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির জন্য প্রকৃতির বিরুদ্ধে এবং পরবর্তীতে গোষ্ঠী বা সমাজের বিরুদ্ধে সংগ্রাম তথা যুদ্ধে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, সমাজবিজ্ঞানের প্রথম পর্যায়ে সমাজ ছিল চরম অর্থে যোদ্ধা সমাজ। সমাজের নীতি ছিল আক্রমণাত্মক ও আত্মরক্ষামূলক।
  • খ. শিল্প সমাজ (Industrial society): যুদ্ধকেন্দ্রিক সবল তৎপরতায় গতি রেখা প্রবাহিত হয় শিল্পায়ন খাতে। এই সমাজে ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্যবোধ এবং আইনগত অধিকারের প্রতি রাষ্ট্রীয় অনুমোদন করা হয়। সমাজ হয়ে পড়ে সহযোগিতামূলক ও শক্তিকামী।

বিবর্তনমূলক স্তরের পরিপ্রেক্ষিতে হার্বার্ট স্পেনসার চার ধরনের সমাজ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। এই চার ধরনের সমাজ হলো-

  • ১. সরল সমাজ (Simple Society): বিবর্তনবাদের ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে স্পেনসার প্রথমে সরল সমাজের অস্তিত্বের কথা বলেছেন। কেবলমাত্র কিছুসংখ্যক পরিবারের সমন্বয়ে সরল সমাজ বা Simple Society এর সৃষ্টি হয়। এ ধরনের সমাজে একক কার্যক্রমের প্রাধান্য বর্তমান থাকে। অন্য কোনকিছুর অবস্থার ওপর এই একক কার্যক্রম নির্ভরশীল থাকে না। এই একক গঠন ও কার্যকারিতার বিভিন্ন অংশ থাকে। এই সমস্ত অংশ পারস্পরিক ক্ষেত্রে এক ধরনের সমবেদনার নিয়মের অনুগামী হয়।
  • ২. যৌগিক সমাজ (Compound Society): বিবর্তনের তত্ত্ব অনুসারে সরল সমাজের পরবর্তী স্তর হলো যৌগিক সমাজ বা Compound Society। কতকগুলো সরল সমাজ সমষ্টিভূত হলে যৌগিক সমাজ বা Compound Society সৃষ্টি হয়। অধ্যাপক আব্রাহাম ও মরগ্যান এ বিষয়ে বলেছেন, “The aggregation of simple societies which consist of familise gave rise to compound society” ব্যাখ্যা করে বলা হয় যে, সরল সমাজের বহুসংখ্যক পরিবার কালক্রমে কিছুসংখ্যক গোষ্ঠীতে (Class) বিভক্ত হয়ে পড়ে। গোষ্ঠীবদ্ধ এই সমাজই যৌগিক সমাজ হিসেবে পরিগণিত হয়। এই যৌগিক সমাজই হলো জটিল সমাজ।
  • ৩. দ্বিগুণ যৌগিক সমাজ (Dobule Compound Society): স্পেনসার সরল ও জটিল সমাজ ছাড়াও আরো দু’ধরনের অধিকতর জটিল সমাজের কথা বলেছেন। কতকগুলো যৌগিক সমাজের সমাহারে সৃষ্টি হয় দ্বিগুণ যৌগিক সমাজ বা Dobule Compound Society অধ্যাপক আব্রাহাম ও মরগ্যান এ বিষয়ে বলেছেন “Through further aggregation of compound societies which consist of families unified into class, doubly compound societies develop.” বিবর্তনের ধারায় কালক্রমে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও বহুসংখ্যক গোষ্ঠীর সৃষ্টি হলো। গোষ্ঠীগুলো কালক্রমে কতকগুলো উপজাতিতে (Tribes) বিভক্ত হয়ে পড়ল। এভাবে দ্বিগুণ যৌগিক সমাজ বা Dobule Compound Society এর আবির্ভাব ঘটল।
  • ৪. ত্রিগুণ যৌগিক সমাজ (Trebly Compound Society): ত্রিগুণ যৌগিক সমাজ বা Trebly Compound Society এর সৃষ্টি হয় কতকগুলো দ্বিগুণ যৌগিক সমাজের সমাহারের ফলে। অধ্যাপক আব্রাহাম ও মরগ্যান এ বিষয়ে বলেছেন, “The aggregation of doubly compound societies which consist of classes unified into tribes led to trebly compound societies where tribes are organized into nation-states.” বিবর্তনের এই স্তরে উপজাতিগুলো একত্রিত হয় এবং জাতি-রাষ্ট্রের মধ্যে সংঘটিত হয়। স্পেনসারের কাছে ত্রিগুণ যৌগিক সমাজ মানবসভ্যতার অগ্রগতির প্রতিভূ হিসেবে প্রতিপন্ন হয়েছে। এই রকম সমাজের উদাহরণ হিসেবে স্পেনসার প্রাচীন মেক্সিকো, মিশরের সভ্যতা, অসিরীয় সাম্রাজ্য, রোম সাম্রাজ্য প্রভৃতির কথা বলেছেন। আবার ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রেট ব্রিটেন, ইতালি, রাশিয়া প্রভৃতি বৃহৎ ইউরোপীয় সভ্যতার কথাও বলেছেন।

নিম্নে চিত্রের সাহায্যে দেখানো হলো:

Fig. Degree of composition

জৈবিক সাদৃশ্য তত্ত্ব (Theory of Organic Analogy)

সমাজ হলো জীবদেহ (Society is an organism): স্পেনসার সামাজিক বিবর্তন ব্যাখ্যায় Theory of Organic Analogy এর উপর নির্ভর করেছেন। এর মূলকথা হলো সমাজের বিভিন্ন প্রথা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জীবদেহের সাদৃশ্য রয়েছে। স্পেনসার আলোচনার প্রাথমিক পর্যায় থেকেই সমাজকে অনুধাবন করেছেন একটি সচেতন সত্তা রূপে। তার ধারণা অনুযায়ী উদ্ভব, বিকাশ, পরিপূর্ণতা এবং কর্মপদ্ধতি সকল ক্ষেত্রেই জীবদেহ এবং সমাজের মধ্যে রয়েছে এক গভীর সদৃশতা।

স্পেনসারের মতে, প্রতিটি সমাজ হলো জীবদেহের ন্যায় একটি চলমান সত্তা, যা ক্রমেই পরিবর্তিত হতে হতে বিবর্তনের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে পূর্ণাঙ্গতা লাভ করে। কিন্তু তারপরও নির্দিষ্ট আকৃতির ভিতর তা সদা সক্রিয় ও কর্মমুখর থাকে। যেমন- জীবন জগতের উন্মেষ ঘটে এককোষী অ্যামিবা থেকে এবং বিবর্তনের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে তা রূপ নেয় বহুকোষী জীবরূপে। একইভাবে সমাজের উদ্ভবলগ্নে তা ছিল অত্যন্ত সরল ও অনির্দিষ্টতায় আক্রান্ত। ক্রমেই পরিবর্তনশীলতার মধ্য দিয়েই সরল যুদ্ধভিত্তিক সমাজের উন্নতি হয় জটিল ও সমৃদ্ধশালী শিল্পভিত্তিক সমাজে। প্রতিটি জীব যেমন তার ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গের সমন্বয়ে সম্পাদিত ক্রিয়ার মাধ্যমে জীবদেহকে সরল রাখে তেমনি সমাজেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনসমূহ বিভিন্নমুখী কর্মসম্পাদনের মাধ্যমেই সমাজকে টিকিয়ে রাখে। আর নতুন নতুন বিভিন্ন প্রথা প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির মাধ্যমে সমাজ জটিল রূপ ধারণ করে।

সাদৃশ্যসমূহ (Similarities) : স্পেনসার জীবদেহ এবং সমাজদেহের মধ্যে নিম্নোক্ত সাদৃশ্য খুঁজে পান-

  • ১. জীবদেহ যেমন ক্ষুদ্র হতে বিকশিত হতে হতে বৃহৎ রূপ ধারণ করে (Cell → Organ→ Animal) তেমনি সমাজও ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ সম্প্রদায় বা রাষ্ট্রে পরিণত হয় (Family → Society → State).
  • ২. উভয়ের আকার বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের মধ্যে কাঠামোগত জটিলতা বৃদ্ধি পায়।
  • ৩. জীবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ যেমন বিভিন্ন ক্রিয়া সম্পাদন করে, তেমনি সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ক্রিয়া সম্পাদন করে।
  • ৪. সমাজ ও জীবদেহ উভয়েই ধ্বংস হলেও তাদের অঙ্গসমূহ টিকে থাকে।
  • ৫. জীবদেহের একটি অঙ্গহানি হলেও তা যেমন টিকে থাকে, তেমনি সমাজের ও একটি প্রতিষ্ঠানের বিলুপ্তি ঘটলে তার সত্তা টিকে থাকে।
  • ৬. জীবদেহ এবং সমাজদেহের ক্রমবিবর্তন স্বতন্ত্র সত্তা সৃষ্টির ক্ষেত্রে অনুরূপ ভূমিকা পালন করে।

বৈসাদৃশ্যসমূহ (Dissimilarities) : এ ধরনের সাদৃশ্যের মতো কিছু বৈসাদৃশ্যও দু’য়ের মধ্যে বিদ্যমান, যা স্পেনসার চিহ্নিত করেছেন –

  • ১. জীবদেহের অঙ্গসমূহ যেমন পরস্পর অবিচ্ছেদ্যভাবে থাকে, সামাজিক প্রতিষ্ঠানের বেলায় তা বলা যায় না।
  • ২. জীবদেহের সচেতনতা কেন্দ্রীভূত থাকে প্রধানত একটি বিশেষ অংশে, কিন্তু সমাজের বেলায় তা প্রতিটি ব্যক্তির মাঝেই বিরাজমান।
  • 6 জীবদেহের সকল অঙ্গ নিয়োজিত থাকে একটি সত্তার কল্যাণে, কিন্তু সমাজের অঙ্গসমূহ নিয়োজিত থাকে ব্যক্তির কল্যাণে।
  • ৪. জীবদেহের সকল স্থানে একইভাবে আবির্ভূত হয়, কিন্তু সমাজের বেলায় তা হয় না।
  • ৫. সমাজ ইচ্ছা করলে অন্য সমাজের বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে পারে, কিন্তু জীবদেহ তা পারে না।
  • ৬ জীবদেহের বিকাশধারা যেমন একটি স্তরে ক্রমে থেমে যায়, কিন্তু সমাজ বিকাশের ধাপ কোন সময়ে এসে স্থির হয়ে যায় না।
  • ৭. স্পেনসারের বিবর্তনবাদ বিভিন্ন পর্যায়ে যেভাবে বিকাশ লাভ করে তা পূর্বের আলোচনায় স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়।

সমালোচনা (Criticism): স্পেনসার এর সামগ্রিক কর্মধারা কিংবা তার চেতনার পরিমণ্ডল বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। তার বিভিন্ন কর্মধারার মধ্যে বহুবিধ অসম্পূর্ণতা, অসামঞ্জস্যতা, স্ববিরোধিতা এবং বিভ্রান্তির সমাবেশ পরিলক্ষিত হয় –

  • ১. বিবর্তনের সূত্র তুলে ধরতে গিয়ে স্পেনসার জীবদেহের সাথে সমাজদেহের সাদৃশ্যর কথা বলেছেন তা মাত্রাতিরিক্ত। কারণ ভিন্ন প্রকৃতির বিষয় দু’টির মধ্যে সাদৃশ্য স্থাপনের চেষ্টা অনেকটা অযৌক্তিক।
  • ২. সমাজকে যোদ্ধা সমাজ ও শিল্পভিত্তিক সমাজের গণ্ডিতে আবদ্ধকরণের বিষয়টিও সর্বজনীনতার বিচারে গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা ক্ষেত্র বিশেষে উভয় সমাজের সহঅবস্থানও পরিলক্ষিত।
  • ৩. স্পেনসার পরিবর্তন, বিবর্তন ও প্রগতিকে সমর্থক প্রত্যয় হিসেবে বিবেচনা করেছেন। কিন্তু প্রত্যয়গুলো সমার্থক নয়।
  • ৪. পর্যবেক্ষণ এবং জরিপ ছাড়াই তিনি তথ্য সংগ্রহ করেছেন। তাছাড়া স্পেনসারের সংজ্ঞাটিও সুস্পষ্ট নয় এবং ত্রুটিমুক্ত নয়। অহেতুক জটিলতায় পরিপূর্ণ যার দ্বারা বিবর্তনের সর্বাঙ্গীণ রূপকে ব্যাখ্যা করা যায় না।

উপরিউক্ত সমালোচনা সত্ত্বেও নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, সামাজিক ইতিহাস ব্যাখ্যায় এ তত্ত্ব একটি মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দিয়ে গেছে। অসাধারণ প্রজ্ঞা ও শিল্পধর্মী অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে তিনি সর্বকালের দার্শনিকদের মধ্যে নিজেকে সর্বশ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়েছেন। সেজন্য জর্জ ইলিয়ট (George Eliot) একদা বলেছিলেন যে, “স্পেনসারের জীবনে এমন কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা নেই, যা তার জীবনী রচনাকারীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হতে পারে। তার জীবনে এমন কোন ঘটনা অর্থাৎ ট্র্যাজিডি নেই যা কোঁত কিংবা মার্কসের জীবনে লক্ষ্য করা যায়।” মূলত স্পেনসারের তত্ত্বকে যে দৃষ্টিকোণ থেকেই মূল্যায়ন করা হোক সমাজবিজ্ঞানের বিকাশ ও উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় তার যে অবদান, তা সর্বদাই অগ্রগামিতার দাবি রাখে।

ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ (Individualism)

ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ হলো একটি প্রাচীন মতবাদ। তবে একটি প্রতিষ্ঠিত মতবাদ হিসেবে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে এ মতবাদ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ব্যাপক ব্যক্তিস্বাধীনতার সমর্থনে এ মতবাদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়। জেরেমি বেস্থাম, জন স্টুয়ার্ট মিল, হার্বার্ট স্পেনসার, এডাম স্মিথ প্রমুখ বিশিষ্ট চিন্তানায়কগণ এ মতবাদের প্রধান সমর্থক ছিলেন।

মূলকথা: ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের মূলকথা হলো রাষ্ট্র একটি অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর প্রতিষ্ঠান। কাজেই রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব যতদূর সম্ভব সীমিত হওয়া প্রয়োজন। এ মতবাদ বিশ্বাস করে যে, ব্যক্তি তার ভালোমন্দ নিজে যতখানি বুঝতে পারে অন্য কেউ তা বুঝতে পারে না। সুতরাং ব্যক্তির নিজস্ব ব্যাপারে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ যত কম হয়, তত মঙ্গল। এ মতবাদ অনুযায়ী রাষ্ট্র কেবল অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা, মানুষের জীবন ও সম্পত্তির নিশ্চয়তা বিধান এবং দেশের সার্বভৌম সংরক্ষণের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। অন্যান্য সবকিছু ব্যক্তির ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিতে হবে।

প্রামাণ্য সংজ্ঞা: নিম্নে কয়েকজন মনীষীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ সম্পর্কে প্রদত্ত সংজ্ঞা উপস্থাপন করা হলো:

  • মিল বলেছেন, “ব্যক্তি তার দেহ মনের উপর সার্বভৌম।”
  • বেস্থাম বলেছেন, “রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ যত বেশি হবে, তত বেশি লোকের সুখ নষ্ট হবে।”
  • এডাম স্মিথের ভাষায়, “ব্যক্তিকে স্বাধীনতা দেওয়া হলে সে তার পছন্দমতো বা ইচ্ছামতো তাই করবে।” অর্থাৎ স্বাধীনতা পেলে মানুষ তার মতে যা ভালো তা করে নিজের ও অন্যের কল্যাণ সাধন করতে পারে।

স্পেনসারের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ: হার্বার্ট স্পেনসার একজন বিবর্তনবাদী ও জৈবিক মতবাদী হলেও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী হিসেবেই অধিক পরিচিত। স্পেনসারের লেখা ‘Social Statics’ পুস্তকখানি বিবর্তনবাদের ‘Principle of Sociology’ কে সামাজিক জৈববাদের এবং ‘দ্য ম্যান ভার্সেস দ্য স্টেট’কে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের নীল নকশা বলা হয়। স্পেনসারের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের মূল রূপরেখা তার ‘The Man Vs. the State’ এর মধ্যে বিবৃত। সুতরাং তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ সম্পর্কে সঠিক ধারণা পেতে হলে এর মধ্যে সংযোজিত প্রবন্ধগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ প্রয়োজন। The Man Vs. the State’ চারটি প্রবন্ধ নিয়ে রচিত। প্রবন্ধ চারটি হলো:

  • 1. The New Toryism: এ প্রবন্ধটিতে অভিযোগ করা হয়েছে যে, হুইগ বা লিবারেল পার্টির সদস্যরা তাদের ব্যক্তিস্বাধীনতা বা অবাধে চলার সাবেক নীতি বিসর্জন দিয়ে ক্রমে ক্রমে টোরী বা কনজারভেটিভদের ন্যায় সামাজিক সংস্কার ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে, টোরী দলের সদস্যরা ধীরে ধীরে অবাধে চলার নীতি গ্রহণ করেছে। এর ফলে হুইগদের কর্মসূচিতে শিল্পরাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ না পেয়ে টোরীদের সামরিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে। এ কারণে হুইগদের নতুন কর্মনীতিকে তিনি ‘দি নিউ টোরীজম’ বা নয়া টোরীবাদ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
  • 2. The Coming Slavery: হার্বার্ট স্পেনসার তার দ্বিতীয় প্রবন্ধে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ব্যক্তি বা সমাজজীবনকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টায় ঘোর বিরোধিতা করেছেন এবং এরূপ উদ্যোগকে তিনি কৃত্রিমতার দ্বারা স্বাভাবিককে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা বলে আখ্যায়িত করেছেন। তার মতে, রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি করা হলে মানুষ ক্রমান্বয়ে রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তারা নিজেদের উদ্যোগ, উদ্যম ও কর্মস্পৃহা হারিয়ে ফেলে। তারা সবসময় রাষ্ট্রের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে এবং আশা করে যে, রাষ্ট্রই তাদের জন্য সবকিছু করে দেবে। এরূপ নির্ভরশীলতা তাদের মধ্যে দাসত্বের মনোবৃত্তি গড়ে তোলে এবং তারা স্বাতন্ত্র্যবোধ হারিয়ে ফেলে। এ ধরনের নির্ভরশীলতাকে হার্বার্ট স্পেনসার ‘দি কামিং স্লেভারি’ বলে অভিহিত করেছেন। কামিং স্লেভারির ফলে জন্ম নেয় সমাজতন্ত্রবাদ বা সাম্যবাদ
  • 3. The Sing of Legislators: তৃতীয় প্রবন্ধের মাধ্যমে স্পেনসার মানবজীবনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের কথা সমালোচনা করেন। তিনি বলেছেন যে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতি, প্রগতি ও কল্যাণ ব্যক্তিগত উদ্যোগেই সম্ভব, সরকারি প্রচেষ্টার মাধ্যমে প্রগতির জন্ম হয় না। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, কোদাল থেকে শুরু করে টেলিফোন পর্যন্ত যে ও অসংখ্য কল্যাণকর আবিষ্কার সাধিত হয়েছে সেগুলোর জন্য আমরা রাষ্ট্রের নিকট ঋণী নই। উন্নত জ্যোতির্বিদ্যার সাহায্যে নৌ বিজ্ঞানের যে উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে তা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের কারণে সম্ভব হয় নি। পদার্থ ও বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন বিজ্ঞানে যেসব আবিষ্কার সাধিত হয়েছে- বিভিন্ন প্রকার যন্ত্র উৎপাদন করার জন্য কিংবা মানুষ ও পণ্যাদিকে একস্থান থেকে অন্যস্থানে স্থানান্তরিত করার জন্য এবং বাড়ানোর জন্য যা কিছু উদ্ভাবিত হয়েছে সেসবও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে হয় নি। মানুষের ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার দ্বারা এসব কিছুই সম্ভব হয়েছে। স্পেনসার এ মতও প্রকাশ করেন যে, রাষ্ট্র প্রকারান্তরে মানুষের কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণই বেশি সাধন করে থাকে। এজন্য মানুষের স্বাধীনতা কার্যকলাপে রাষ্ট্রের অহেতুক হস্তক্ষেপকে স্পেনসার ‘দ্য সিনস অব লেজিসলেটরস’ (The Sing of Legislators) বলে আখ্যায়িত করেছেন।
  • 4. The Great Political Superstition: এটি স্পেনসারের চতুর্থ প্রবন্ধ। এতে দৈব অধিকারকে রাজনীতির বড় কুসংস্কার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অতীতে রাজাদের শাসনামলে রাজারা দৈব অধিকার ভোগ করতেন। আজকাল সে অধিকার ভোগ করছে রাষ্ট্রের আইন পরিষদগুলো। রাষ্ট্র কোন অধিকার সৃষ্টি করে না বলে স্পেনসার মত পোষণ করেন। তার ধারণা, রাষ্ট্রের আগেই অধিকারের জন্ম হয়েছে। যেসব অধিকার রাষ্ট্রে চালু থাকে সেগুলোকে রাষ্ট্র স্বীকৃতি দেয় মাত্র। নাগরিকরা স্বেচ্ছায় যতটুকু ক্ষমতা ও অধিকার সরকারকে প্রদান করে তার চেয়ে বেশি অধিকার সরকার পেতে পারে না। স্পেনসার বিশ্বাস করেন যে, উদারতাবাদ অতীতে যেমন রাজাদের ক্ষমতা হ্রাস করেছিল, ভবিষ্যতেও তেমনি আইন পরিষদের ক্ষমতাকে সীমিত করবে। ‘দ্য ম্যান ভার্সেস দ্য স্টেট’ এর চারটি প্রবন্ধে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, স্পেনসারের রাষ্ট্রদর্শনের মূল আলোচনা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ নিয়েই তার দর্শন শুরু হয়েছে এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ নিয়েই তার দর্শনের সমাপ্তি ঘটেছে।

পরিশেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্রদর্শনের ইতিহাসে স্পেনসারের সবচেয়ে বড় অবদান হল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ। বিংশ শতাব্দীর সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের চাপে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ পৃষ্ঠ হলেও তিনি মানুষের মনে ব্যক্তিস্বাধীনতার যে স্পৃহা জাগ্রত করেন সে স্পৃহাই মানুষকে সর্বাত্মকবাদের করাল গ্রাস থেকে মুক্ত করে।

ক্রিয়াবাদ (Functionalisn)

সমাজবিজ্ঞানের অঙ্গনে ক্রিয়াবাদ একটি অপেক্ষাকৃত নতুন প্রত্যয়। সামাজিক কাঠামোর আলোচনায় এর ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। সমাজবিজ্ঞানে এ শব্দের কৃতিত্ব পান হার্বার্ট স্পেনসার। তবে এর পূর্বেও কতিপয় সমাজবিজ্ঞানী এ প্রত্যয়টি ব্যবহার করেছেন। তবে এ ব্যাপারে যাদের সার্বিক মনোযোগ পোষণ করতে দেখা যায় তাদের মধ্যে রয়েছেন হার্বার্ট স্পেনসার এবং এমিল ডুরখেইম। ক্রিয়াবাদীরা এ মনোভাব নিয়ে যাত্রা শুরু করেন যে, সামাজিক কাঠামো অবিভাজ্য নয় এবং বহুবিদ একক পুরো কাঠামোকে সচলভাবে চালু রাখতে নিজ নিজ কাজ সুনির্দিষ্টভাবে সম্পন্ন করে। প্রতিটি একক পুরো কাঠামোকে অখণ্ড রাখতে সাহায্য করে। পুরো সামাজিক কাঠামোকে চলমান রাখার জন্য বিভিন্ন সামাজিক একক যে কার্য সম্পাদন করে তাকে Function বলে। আর যখন এককগুলো এমন কাজ সম্পাদন করে যা সামাজিক কাঠামোর স্বার্থের অনুকূলে কাজ করে না অর্থাৎ যখন এককগুলো কাঠামো কার্য বিরোধিতায় (Anti- structural function) লিপ্ত হয় তখন তাকে Dysfunction বলে।

স্পেনসারের এ শব্দটি ব্যবহারের উদ্দেশ্য ছিল এর সাহায্যে জৈবিক বাস্তবতার (Biological realities) উপর ভিত্তি করে সামাজিক পরিবর্তনকে ব্যাখ্যা করা। এখানে মনে করা হয়, সমাজ একটি Organism এবং এ কারণে এটি অবিভাজ্য নয়। সমাজ কতকগুলো Cell এর সমষ্টি এবং প্রতিটি Cell এক একটিৎকার্য সম্পাদন করে। আর এটাই সে কার্য বা Function, যা Functionalism এর ভিত্তি।

ক্রিয়াবাদ (Functionalism) কে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়। যেমন-

  • ১. গাণিতিক পদ্ধতি (Mathematical activity): যা সমাজবিকাশে তেমন ব্যবহৃত হয় না।
  • ২. উপকারী কার্য (Useful activity): যা নিত্যনৈমিত্তিক কাজের সাথে যুক্ত।
  • ৩. মৌলিক/ মূল কার্য (Appropriate activity): কোন কর্ম Appropriate হতে পারে, কিন্তু Useful হতেও পারে আবার নাও হতে পারে।
  • ৪. টেকসই পদ্ধতি বা ব্যবস্থা কার্য (System sustaining activity) : ঐসব কাজকর্মের ভূমিকা যা কোন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ও তা বজায় রাখতে সহায়তা করে।

ফাংশন বা ক্রিয়ার সংজ্ঞা হিসেবে –

  • মার্টন বলেছেন, “Functions are those observed consequences which make for the adaption or adjustment of a given system.”
  • র‍্যাডক্লিফ ব্রাউন বলেছেন, “Function of a particular usage is the contribution which makes of the social life in the function of social system.”

সমাজবিজ্ঞানিগণ Function এর সাথে সামাজিক চাহিদা ও সামাজিক জীবনের যোগসূত্র স্থাপনে প্রয়াসী ছিলেন। এটি আত্মতুষ্টির সাথেও যুক্ত।

স্পেনসার মূলত ছিলেন একজন বিবর্তনবাদী (Evolutionist)। তবে তিনি ক্রিয়াবাদীও (Functionalist) ছিলেন। তিনি লক্ষ্য করেন যে, সমাজ কাঠামোর সৃষ্টি হয়েছে সামাজিক ক্রিয়া থেকে। একটি কাঠামো সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা সৃষ্টি হতে পারে না এর ক্রিয়া সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা ছাড়া। একটি সংগঠন কিভাবে উৎপন্ন এবং বিকশিত হচ্ছে তা উপলব্ধির জন্য এটি অপরিহার্য।

স্পেনসার উল্লেখ করেন যে, জৈবিক প্রাণসত্তায় অংশসমূহের স্বার্থ সমগ্রকের স্বার্থের অধীনস্থতা করে। এভাবে শুধুমাত্র একই পন্থায় প্রাণসত্তা টিকে থাকার জন্য যা প্রয়োজন তা হলো সংহতি এবং একীভূত হওয়া। একইভাবে সমাজে পরস্পর নির্ভরশীল অংশের দ্বারা গঠিত কাঠামো বলে ভাবা যেতে পারে। কেবল তাই নয়, এই অংশগুলোকে পৃথকভাবে বিশ্লেষণ করে প্রত্যেক অংশে প্রকৃতি নিরূপণ করা যেতে পরে। স্পেনসার এর এ জাতীয় চিন্তাভাবনা থেকেই পরবর্তীকালে কাঠামো কার্যগত তত্ত্ব (Structural functional theory) এর সূচনা।

স্পেনসার সর্বপ্রথম ক্রিয়াবাদের কথা উল্লেখ করেন। তার মতে, সমাজ হচ্ছে একটি জৈবিক সত্তা। এ জৈবিক সত্তা এমন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যেখানে এর বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সমাজে টিকে থাকা এবং প্রতিপালনের ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। স্পেনসার এর মতে, সমাজগুলোকে দেখতে হবে ক্রমান্বয়ে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত কাঠামো হিসেবে, যা একটি বৃহৎ আকার নিয়ে প্রকাশিত হয়। এভাবে ক্রমান্বয়ে এগুলো আরো নিবিড় হয় এবং বিক্ষিপ্ত ও দুর্বলভাবে বিভিন্ন এলাকায় তা ছড়িয়ে না থেকে তা অভ্যন্তরে থেকেই আরো দৃঢ় ও সংযুক্ত হয়। এভাবে বিবর্তনের প্রাথমিক বৈশিষ্ট্যানুযায়ী সমাজ একাঙ্গীভূত হতে হতে দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য পার্থক্যকরণের দায়িত্ব লাভ করে। বৃদ্ধি বা বিকাশের সাথে সাথে এগুলো আরো স্থির ও কঠিন হয়। অংশগুলোর মধ্যে বিভিন্নতা বাড়তে থাকে, যাতে সমাজ আরো বৃহদাকার লাভ করে এবং গভীরতর জটিল রূপ পরিগ্রহ করে। পার্থক্যকরণ সাধারণ থেকে বিশেষায়িত পর্যায়ে উন্নত হয়। এক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন সমন্বয়কারী প্রতিষ্ঠান প্রথমে পৃথক হয়। তারপরে আসে কৃষি ও শিল্প প্রতিষ্ঠান, যোগাযোগের এজেন্সিসমূহ ইত্যাদি। সরকার অভ্যন্তরীণভাবে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় ইউনিট দ্বারা পৃথক হয় এবং তাদের অভ্যন্তরীণ সব ইউনিটগুলো দ্বারা আরো পার্থক্যকরণ ঘটতে থাকে।

সমাজের বৃদ্ধি এবং পার্থক্যকরণের সাথে এর একাঙ্গীভূত হওয়ার ধরন যখন একই রকমভাবে সংঘটিত হয় তখন তাদের মধ্যে নির্ভরশীলতার কোন সম্পর্ক থাকে না। এখানে সমাজ সমগ্রভাবে জৈবনিক হয় না, বরং ভিন্ন কাজে বিভক্ত হয়। তারা পরস্পরের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে যাতে একটি আঘাতপ্রাপ্ত হলে তার অভিজ্ঞতা অন্যদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়। স্পেনসার এখানে উল্লেখ করেন যে, সমাজের ইউনিটগুলো যখন আরো বেশি পরিমাণে বিশেষায়িত হয় প্রতিটি অংশেই শুধুমাত্র নিজের কাজ ছাড়া অন্যের কাজ করতে পারে না। ফলে একে অপরের উপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। একটি স্বাভাবিক ঐকতান প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পারস্পরিক সংহতি সৃষ্টি হয়। এই সূত্র ধরেই স্পেনসার তার সামরিক ও শিল্পায়িত সমাজের পার্থক্য নির্ণয় করেন।

সামরিক সমাজগুলো হচ্ছে তুলনামূলকভাবে অবিকশিত রূপ, যাতে পূর্বে উল্লিখিত প্রাকৃতিক সমন্বয় এখনও দেখা যায় নি। অংশসমূহের পার্থক্যকরণের ক্ষেত্রে সামরিক সমাজ মধ্যম পর্যায়ের এবং পরিমিত। যারা টিকে থাকার উপযুক্ত তারা তা পারে, কারণ তারা তাদের শক্তি ও সম্পদের একটি বড় অংশ ব্যয় করে পারিপার্শ্বিক সমাজের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডের জন্য। কাজেই সামরিক সমাজগুলো কেন্দ্রীয় এবং একনায়কতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণকারী এজেন্সি তৈরি করে যাতে সম্পদের সমন্বয় ও ব্যবহার সমাজকে প্রতিরক্ষার কাজে ব্যয় করা যায়। অন্যদিকে, শিল্পায়িত সমাজ গভীরভাবে বিকশিত। ফলে এটি বিশালায়তন এবং এতে উচ্চ পর্যায়ের পার্থক্যকরণ পরিদৃষ্ট হয়। তুলনায় জীবদেহের ক্ষেত্রে তিনি বলেছেন, জীবদেহের অংশগুলো পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। যদি কোন অংশ কাজ করা বন্ধ করে দেয় তা অসামঞ্জস্যপূর্ণ কাজ করে।

উপসংহার

স্পেনসার এর তত্ত্ব সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। কারণ আমরা জানি, জীবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। তাছাড়া সমাজিক কাঠামো জীবদেহের কাঠামোর তুলনায় জটিল। তাছাড়া মানবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ মানুষের নিয়ন্ত্রণ শক্তির বাইরে। সেখানে সমাজ কাঠামোর এককগুলো মানুষের নিয়ন্ত্রণ শক্তির মধ্যে।

পরিশেষে বলা যায়, সমাজকে বিশ্লেষণের জন্য স্পেনসার এর কাঠামো বিশ্লেষণ করেছেন। সামাজিক পরিবর্তন, উন্নয়ন, প্রগতি, সমৃদ্ধি আলোচনায় তিনি যেমন সমাজের বিভিন্ন দিক প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন তেমনি সমাজের সাথে জীবদেহের একটি সাদৃশ্যপূর্ণ আলোচনার সূত্রপাত ঘটিয়েছেন।

তথ্যসূত্র 

  • আধুনিক ও ধ্রুপদী সমাজতাত্ত্বিক চিন্তাধারা, ড. মোঃ আহসান হাবিব, গ্রন্থ কুটির, ২০১৪

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.