সন্ত্রাসবাদ (Terrorism)

সন্ত্রাসবাদ বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। যুক্তরাষ্ট্রে ১১ই সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার পর পৃথিবীর সব দেশই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। পশ্চিমাদেশগুলোর মুসলিম বিদ্বেষ এর পেছনে দায়ী বলে গবেষকরা চিহ্নিত করলেও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পরিধি এখন ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো অথবা রাজনৈতিক ও আদর্শগত ভিন্নমতাবলম্বী এমনকি জাতিগত বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা গোষ্ঠীগুলো তাদের নিজেদের স্বার্থ রক্ষা বা দাবি আদায়ের জন্য সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় অবস্থান করে বাংলাদেশও এর হাত থেকে রক্ষা পায়নি। ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, নেপাল বা শ্রীলংকায় সংঘটিত সন্ত্রাসী ঘটনাগুলোর মতো ব্যাপক না হলেও স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো এদেশে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছে। সাম্প্রতিককালে ইসলামী কিছু কিছু সংগঠনের ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার আদর্শগত দাবির কারণে তারাও বোমাহামলার মতো ঘটনা ঘটিয়েছে। পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড মোকাবিলায় সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে।

সন্ত্রাসবাদের সংজ্ঞা

প্রকৃতিগতভাবে সন্ত্রাসবাদকে সংজ্ঞায়িত করা কঠিন। কারো কাছে যেই কাজটি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং ব্যক্তি সন্ত্রাসী (terrorist), অন্যদের কাছে তারা স্বাধীনতার সৈনিক (freedom of fighter)। তাছাড়া সরকার বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়াকে যেমন ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তেমনি সরকারের কর্মকাণ্ডও কখনো কখনো ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাছাড়া সন্ত্রাসীদের অস্ত্র, অর্থ বা অন্য কোনরূপ সমর্থনের বিষয়টিও এ প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ।

  • James M Poland সন্ত্রাসবাদের সংজ্ঞা দিয়েছেন “terrorism is the pre-mediated, deliberate systemetic murder, mishem and threating of the innocent to create fear and intimidation in order to gain political or tactical advantage: usually to influence a audience. (http://www.ress.org/terrorism/atiqurrahman.pdf (Economic Cost of Terrorism in South Asia: Case of Bangladesh Paper presented by Dr. A.K.M. Atiqur Rahman at the Int. Conference on Terrorism in South Asia: Impact on Development and Democratic Process on Nepal Nov. (23-25) 2002)
  • ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (FBI) সন্ত্রাসবাদকে সংজ্ঞায়িত করেছে এভাবে- “Terrorism is the unlawful use of force or violence against person or any segment thereof in furtherance of political and social objectives. (Ibid)

সন্ত্রাসবাদকে যদিও সাধারণত সংগঠিত গোষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত কার্যক্রম হিসেবে উল্লেখ করা হয়, সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বা নির্দেশিত হয়েও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চলতে পারে। সন্ত্রাসী কার্যক্রম কোন একটি স্থানে সীমাবদ্ধ থাকলেও এর ব্যাপ্তি দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে অন্যান্য দেশেও বিস্তৃত হতে পারে।

সন্ত্রাসবাদের ইতিহাস

সবচেয়ে প্রাচীন যেই গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ডের সাথে আধুনিক সন্ত্রাসী সংগঠনের বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যায়, তা হচ্ছে ‘Zealots‘। ইহুদিদের এই গোষ্ঠীটি রোমানদের কাছে ‘sicarii’ বা ‘dagger men’ নামে পরিচিত ছিল। এই গোষ্ঠীটি রোমান দখলদার বাহিনীর সদস্যদের গুপ্ত হত্যার সাথে জড়িত ছিল। এমনকি যেসব ইহুদি রোমানদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখত তাদেরকেও তারা হত্যা করত। তাদের বিশ্বাস ছিল যে, রোমানদের প্রজা হিসেবে তারা তাদের ইহুদী ধর্মের প্রতি অনুগত থাকতে পারবে না। এভাবে Zealots দের বিক্ষোভ প্রকাশ পায় যদিও তারা পরবর্তীতে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। (http:/www.terrorism-research.com/history/early.php)

Assassins বা গুপ্ত ঘাতকরা হচ্ছে এমন গোষ্ঠী যাদের সাথে বর্তমান সমাজের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। শিয়া সম্প্রদায়ের ‘নিজারী ইসলামী’ সম্প্রদায় এই পথ বেছে নিয়েছিল তাদের বিপক্ষ দলের নেতাদের হত্যা করার জন্য। নিজেদের সমর্থক গোষ্ঠীর স্বল্পতার কারণে তারা সম্মুখ-যুদ্ধ এড়িয়ে নিজেদের একজন ব্যক্তিকে নির্বাচিত করত যে তার নিজের জীবনের বিনিময়ে শত্রুপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ কোন ব্যক্তিকে হত্যা করত। (Ibid) তাদের এই কর্মকাণ্ড আধুনিক যুগের ঐসব সন্ত্রাসী সংগঠনের সদস্যদের সাথে তুল্য যারা আত্মঘাতী বোমা হামলার মাধ্যমে আত্মহত্যার পাশাপাশি তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করে।

প্রাচীন গুপ্ত ঘাতকীয় সন্ত্রাসবাদের সেই প্রথা কখনওই শেষ হয়নি। মধ্যযুগে সম্রাট বা রাজা বাদশাহরা অনেকেই এর শিকার হলে ঐসব কর্মকাণ্ডকে ঠিক সন্ত্রাসী কাজের সাথে তুলনা করা যায় না। রাজ ক্ষমতার দ্বন্দ্ব থেকে এ ধরনের হত্যা সংঘটিত হত। মধ্যযুগে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কিছু দল গ্রামাঞ্চলে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে লুটপাট করত যাকে ডাকাতির পর্যায়ে ফেলা যায়।

‘Terrorist’ বা ‘Terrorism’ শব্দগুলো সর্বপ্রথম ব্যবহার করা হয় ফরাসি বিপ্লবের সময়। বিপ্লবী সরকার ১৭৯৫ সালে ‘সন্ত্রাসবাদ’ শব্দের ব্যবহার করে ‘Reign of terror’ বা সন্ত্রাসের রাজত্বকে বোঝানোর উদ্দেশ্যে। রাজশক্তির অত্যাচারে অতীষ্ট ব্যক্তিদের বিদ্রোহকে সন্ত্রাসী কাজের সাথে তুলনা করতেন তখনকার শাসকরা। (Ibid) সেই ধারা এখনও বর্তমান।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে রাজনৈতিক চিন্তাধারার ব্যাপক পরিবর্তন ও অস্ত্র-উৎপাদন কৌশলের উন্নতির সাথে সাথে দেশে দেশে বিদ্রোহী ও বিপ্লবী গ্রুপের সৃষ্টি হয় যারা তাদের দেশে পরিবর্তন আনতে সচেষ্ট ছিল। রাশিয়া, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি বা আমেরিকার মত দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের হত্যার মাধ্যমে তারা কিছুটা প্রভাব বিস্তার করতে পারলেও পরবর্তীতে মূলধারার রাজনীতির সাথে সম্পর্কহীনতার কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঐসব সংগঠন তাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। তবে রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদের দিক থেকে তখন কমিউনিজমের উত্থানের সময় ছিল যা পরবর্তীতে বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে একটি আদর্শে পরিণত হয় এবং কয়েকটি দেশে বিস্তার লাভ করে।

বিংশ শতাব্দীর সন্ত্রাসবাদ আলোচনা করতে হলে কতকগুলো প্রেক্ষাপট বিবেচনা করতে হবে। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয় যা মূলত জাতিয়তাবাদের হাওয়াকে জোরালো করে দেয়। ঔপনিবেশিক অঞ্চলগুলোতে জনগণ তাদের নিজস্ব জাতিসত্তার ব্যাপারে সচেতন হয়ে ওঠে। ঐসব অঞ্চলে তারা নিজেদের জাতিগত পরিচয়ের স্বার্থে ঔপনিবেশিক শাসকদের অত্যাচার ও শাসনের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয় এবং নানা দ্বন্দ্ব সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। ক্রমান্বয়ে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর স্বাধিকার আন্দোলনের স্বপক্ষে অবস্থান তাদেরকে আরও বেশি উৎসাহী করে তোলে। নিজস্ব রাষ্ট্রের দাবিতে তারা আন্দোলন শুরু করে যার মধ্যে অনেকেই নিজেদের অধিকার আদায়ের পথ হিসেবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে বেছে নেয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর শীতল যুদ্ধকালীন (cold war) সময়ে সন্ত্রাসবাদের প্রকৃতি অন্যরূপ ধারণ করে। বিশ্ব তখন দুই মেরুতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একটি হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন পন্থী পূর্ব মেরু, অপরটির নেতৃত্বে ছিল যুক্তরাষ্ট্র যা পশ্চিম মেরু নামে পরিচিত। নিজেদের শক্তি ও আধিপত্য বিস্তারের জন্য এসব দেশ তাদের সাথে সম্পৃক্ত রাষ্ট্র বা গোষ্ঠীকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়তে সহযোগিতা করছে। বিশ্বব্যাপী কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন বিভিন্ন মহাদেশে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হবার জন্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে অস্ত্র, সামরিক ট্রেনিং এবং আর্থিক সহায়তা করেছে। তাছাড়া পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের বিলোপের জন্যও বিভিন্ন দেশের সমাজতান্ত্রিক গ্রুপগুলোকে সন্ত্রাসী কাজ করার ক্ষেত্রে তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদ দিয়েছে। অপরদিকে সমাজতন্ত্রের উচ্ছেদ এবং এর বিস্তার রোধ করার জন্য পশ্চিমা ব্লক ও বিরোধী গ্রুপগুলোতে অস্ত্র ও অর্থ ব্যয় করেছে। শীতল যুদ্ধকালীন সময়ে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো রাজনৈতিক আদর্শগত কারণে বিশাল অস্ত্রের যোগান পেতে সমর্থ হয়েছিল যা তাদের কাজকে ত্বরান্বিত করেছে।

অনেকের মতে আধুনিক সন্ত্রাসবাদের যুগ শুরু হয় ১৯৬৮ সালে যখন PFLP (Popular Front for the Liberation of Palestine) নামক সংগঠনটি তেলাবিব থেকে রোম রুটের একটি বিমান হাইজাক করে। এই হাইজ্যাকের কারণ ছিল, ঐ এয়ারলাইনারটি ছিল ইসরাইলের এবং হাইজ্যাকের লক্ষ্যও ছিল ইসরাইল। প্যালেস্টাইনিয়ান সংগঠনটির বিমান ছিনতাই সারাবিশ্বে ব্যাপক প্রচার পায় এবং এতে করে PFLP ইসরাইলের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হয়। সন্ত্রাসবাদের আন্তর্জাতিকীকরণের আরেকটি প্রেক্ষাপট হলো সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালানো চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতা। ‘৭০ এর দশকের শুরুতে প্যালেস্টাইনিয়ান গ্রুপ ও ইউরোপের মৌলবাদীদের C-operative training বা সমন্বিত প্রশিক্ষণ শুরু হয়। PFLP এবং জাপানের Red Army (ফুসাকো শিগেনোবু দ্বারা ১৯৭১ সালে গঠিত জাপানিজ রেড আর্মি বা JRA নামক একটি মিলিটেন্ট লেফটিস্ট গ্ৰুপ) ১৯৭৪ সাল থেকে একত্রিত হয়ে তাদের অপারেশন পরিচালনা করেছে। (ibid) তখন থেকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো একে অপরকে ট্রেনিং, অপারেশন এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বিষয়ে সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রকে প্রসারিত করেছে। একই আদর্শগত কারণে বর্তমানে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সহযোগিতা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে অপর দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয় গ্রহণ করে, নিজেদের মধ্যে অস্ত্র বেচা-কেনা এবং সামরিক প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি সহায়তা প্রদান করে। ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা নিজেদের মধ্যকার সম্পর্ক বজায় রাখে এবং একে অপরকে নিয়মিত সাহায্য সহযোগিতা করে যাচ্ছে। এভাবে সন্ত্রাসবাদ এখন জাতীয় গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঠাঁই করে নিয়েছে যা থেকে কোন দেশেরই নিস্তার নেই।

সন্ত্রাসী কার্যকলাপ পদ্ধতি (Types of terrorist incidents)

সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডগুলো বিভিন্নভাবে সংঘটিত হয়। এদের মধ্যে বহুল পরিচিত পদ্ধতিগুলো হলো:

  • ১. বোমা বিস্ফোরণ: সন্ত্রাসীদের মধ্যে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে থাকে। বোমা তৈরি প্রক্রিয়া সহজ এবং এর উপাদান সহজলভ্য। এছাড়া বোমা বিস্ফোরণে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ সাধারণ অস্ত্রের তুলনায় ব্যাপক। দুই-তিন জন লোক বোমা হামলার মাধ্যমে শত শত ব্যক্তির প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষতি সাধন করতে পারে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের উপায় হিসেবে বোমা বিস্ফোরণকে বেছে নেয়ার আরেকটি কারণ হলো এক্ষেত্রে বোমা হামলাকারী নিশ্চিন্তে পালিয়ে যেতে পারে। বোমা বিস্ফোরণের নাশকতা জনমনে ব্যাপক ভীতি ও উদ্বেগ সৃষ্টি করে। নিজেদের শক্তিমত্তার জানান দিতে সন্ত্রাসীদের এসব বোমা হামলার শিকারে পরিণত হয় বেসামরিক জনগণ।
  • ২. অপহরণ: সন্ত্রাসীরা তাদের উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে কোন দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা ঐ দেশে অবস্থানরত অন্য দেশের নাগরিককে অপহরণ করে। অপহরণ করা সন্ত্রাসীদের জন্য কঠিন কাজ হলেও এর দ্বারা তারা সরকারের সাথে দরকষাকষির সুযোগ পায়। অপহৃত ব্যক্তির জীবনের বিনিময়ে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর নেতা-কর্মীদের মুক্তি প্রদান, তাদেরকে বিপুল অর্থ প্রদান অথবা অন্য কোন রকম দাবি-দাওয়া তারা সরকারের কাছ থেকে আদায় করে নিতে চায়। একদা আফগানিস্তান দক্ষিণ-কোরীয় সৈন্যদের অপহরণ করে অপহরণকারীরা আফগানিস্তান থেকে কোরীয়ান সৈন্য প্রত্যাহারের দাবি জানালে কোরীয়ার সরকার তা মেনে নেয়। তাছাড়া অপহরণের ফলে মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার পাওয়া যায় এবং এক ধরনের ভীতিময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করা সম্ভব হয় যা তাদের উদ্দেশ্য অর্জনে সহায়তা করে।
  • ৩. অস্ত্র হামলা ও হত্যা (Armed attacks and assassinations): সন্ত্রাসীরা মাঝে মাঝে নিরস্ত্র জনগণ অথবা আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী বা সামরিক বাহিনীর সদস্যদের উপর আক্রমণ চালায়। এরা আক্রমণের উদ্দেশ্যে ফাঁদ পেতে রাখে এবং অতর্কিত আক্রমণে জীবন ও সম্পদের ক্ষতি সাধন করে। টহলরত পুলিশ বা সেনা সদস্য বা মূল বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন বা দূরবর্তী অঞ্চলে টহলরত আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপর এদের আক্রমণ লক্ষণীয়। এসবক্ষেত্রে সন্ত্রাসীদের সফলতার হার বেশি থাকে এবং এদেরকে গ্রেফতার করাও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।
  • ৪. অগ্নি-সংযোগ ও অগ্নি বোমাবর্ষণ (Arsons and Fire bombings): সন্ত্রাসীরা সরকারি সম্পত্তিতে আগুন ধরিয়ে অথবা গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, বেসরকারি স্থাপনা বা সেবা-প্রদানকারী সংস্থায় আগুন ধরিয়ে জান-মালের ক্ষতিসাধন করে। এতে করে নাগরিকদের সেবা পেতে অসুবিধা হয়, সরকারি সম্পদ নষ্ট হয় এবং সাধারণ মানুষ তাদের সম্পত্তির বিষয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ে।
  • ৫. ছিনতাই (হাইজাকিং): হাইজাকিং হচ্ছে জোর করে যানবাহনের নিয়ন্ত্রণ নেয়া এবং এর যাত্রীদেরকে আটক করা। সন্ত্রাসীরা বিমান ছিনতাইয়ের মাধ্যমে বিমানের যাত্রীদের জিম্মি করে, বিমানকে তাদের পছন্দমত কোন স্থানে অবতরণ করানোর পর সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকার প্রধানদেরকে তাদের দাবি মেনে নেয়ার আহ্বান জানায়। এছাড়া ট্রেন বা বাস ছিনতাইয়ের ঘটনাও বিরল নয়।

সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর শ্রেণীবিভাগ

পৃথিবীতে যেসব সন্ত্রাসী সংগঠন আছে বা যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে তাদেরকে কাজের উদ্দেশ্য ও প্রকৃতির বিবেচনায় কতকগুলো শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়। এগুলো হলো:

  • ১. বিচ্ছিন্নতাবাদী : বিচ্ছিন্নতাবাদীরা কোন দেশের ভৌগোলিক ভূ-খণ্ড থেকে নিজেদেরকে পৃথক করে আলাদা রাষ্ট্র গঠন করতে চায়। এরা প্রধানত রাজনৈতিকভাবে ভিন্নমত বা চিন্তাধারার অনুসারী অথবা নিজেদের অধিকার ও দাবি-দাওয়া বিদ্যমান সরকার বা রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আদায় করতে পারবে বলে বিশ্বাস করে না।
  • ২. জাতিগত সন্ত্রাসী-গোষ্ঠী (Ethnocentric): একটি দেশে বা সমাজে যখন বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর লোক বসবাস করে এবং কোন একটি গোষ্ঠী অন্যদের তুলনায় নিজেদেরকে উচ্চতর (superior) বিবেচনা করে ও অন্যদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করতে চায় তখন তারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে এর বিপরীত অবস্থাও দেখা যেতে পারে।
  • ৩. জাতীয়তাবাদী (Nationalistic): জাতীয়তাবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কোন একটি দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া বা অন্য কোন দেশের সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য কোন কোন গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়। এরা নিজেদের সমাজ-সংস্কৃতি ও জীবন-পদ্ধতির জন্য আলাদা পরিচয় খুঁজতে থাকে যা তাদেরকে সন্ত্রাসী কাজে উদ্বুদ্ধ করে।
  • ৪. বিপ্লবী সরকার বা সমাজ কাঠামোর সাথে রাজনৈতিক চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটে। ঐ রাজনৈতিক আদর্শের সাথে যাদের নিজস্ব আদর্শগত দ্বন্দ্ব থাকে যেমন: পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার সাথে সমাজতন্ত্রের আদর্শগত দ্বন্দ্ব অনেক দেশেই বিপ্লবী শ্রেণীর সৃষ্টি করেছে যারা নিজেদের আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম পরিচালনা করে।
  • ৫. রাজনৈতিক গোষ্ঠী: নিজস্ব পছন্দের সরকার প্রতিষ্ঠা বা কোন সরকারকে উৎখাত অথবা অন্য কোন রাজনৈতিক সুবিধা অর্জন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর উদ্দেশ্য হতে পারে। এক্ষেত্রে অনেক সময় চরমপন্থি গ্রুপগুলোর সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর আঁতাত থাকে। তাদের সমর্থনে যেসব দেশ বা দেশের সরকার প্রধান রয়েছে তাদের সাহায্য সহযোগিতা গ্রহণ করে।
  • ৬. ধর্মীয় উগ্রপন্থি: বর্তমানে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর উল্লেখযোগ্য অংশ ধর্মীয় উগ্রপন্থি। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল ফিলিস্তিন সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমা বিশ্বের একতরফা ইসরাইল প্রীতি জন্ম দিয়েছে ইসলামী সংগঠনগুলোর, যাদের কর্মকাণ্ডকে সন্ত্রাসবাদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এভাবে ধর্মের কারণে যারা সারাবিশ্বে নিজেদের বঞ্চিত বা অধিকারহীন মনে করে তারাই নিজেদেরকে রক্ষার জন্য দলবদ্ধ হচ্ছে এবং অনেকক্ষেত্রে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করছে।
  • ৭. সামাজিক গোষ্ঠী: কখনও কখনও সমাজের বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে কোন কোন দল বা গোষ্ঠীর মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি হয় এবং এই অসন্তোষ সংঘাত ও সহিংস ঘটনার জন্ম দেয়।
  • ৮. আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীগোষ্ঠী সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর নেটওয়ার্ক এখন শুধু নিজ দেশে নয় বরং একাধিক দেশে বিস্তার লাভ করেছে। এতে তাদের কাজগুলো সুচারুরূপে পরিচালনা করা সম্ভব হয়। কোন একটি দেশ যখন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে, তখন এসব সন্ত্রাসীরা সেই দেশ ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয় নেয়। এছাড়া একই ধরনের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বা একই আদর্শগত কারণে এরা বিভিন্ন দেশে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে সুযোগ পায়।

বিশ্বব্যাপী সংঘটিত আলোচিত সন্ত্রাসী-ঘটনা

  • আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি কর্তৃক ‘Blood Friday’, ১৯৭২;
  • মিউনিখে অনুষ্ঠিত সামার অলিম্পিকের ঘটনা ‘Munich Massacre’, ১৯৭২;
  • OPEC সদর দপ্তর থেকে (ভিয়েনা) অতিথিদের নিয়ে যাওয়া, ১৯৭৫;
  • কিউবার ফ্লাইট ৪৫৫ এ বোমা হামলা, ১৯৭৬;
  • Air India ফ্লাইট ১৮২ এ বোমা হামলা, ১৯৮৫;
  • লকারবিতে Pan Am ফ্লাইট ১০৩-এর বিস্ফোরণ, ১৯৮৮;
  • যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত কন্ট্রা বিদ্রোহীদের দ্বারা নিকারাগুয়ার বেসামরিক জনগণ হত্যা, ১৯৮০’র দশক;
  • বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রে বোমা হামলা, ১৯৯৩;
  • ভারতের মুম্বাইতে বোমা হামলা, ১৯৯৩;
  • আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্স ও বোমা হামলা, ১৯৯৪;
  • টোকিওতে সারিন (Sarin) গ্যাস আক্রমণ, ১৯৯৫;
  • ওকলাহামা শহরে Tomothy Mc Veigh কর্তৃক বোমা হামলা, ১৯৯৫;
  • কন্টিনেন্টাল অলিম্পিক পার্কে বোমা হামলা;
  • কেনিয়া ও তানজানিয়ায় আমেরিকান দূতাবাসে বোমা হামলা, ১৯৯৮;
  • রাশিয়ান এপার্টমেন্টে বোমা হামলা, ১৯৯৮;
  • নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটন ডি.সি.তে টুইন টাওয়ার, পেন্টাগনসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ভয়াবহ বোমা হামলা, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০০১;
  • ভারতীয় পার্লামেন্টে বোমা হামলা, ২০০১;
  • ইসরাইলে ‘Passover Massacre’, ২০০২;
  • রাশিয়ার মস্কো থিয়েটার ও বেসলান স্কুল দখল, ২০০২;
  • ইন্দোনেশিয়ার বালীতে বোমা হামলা, ২০০২;
  • মাদ্রিদে বোমা হামলা, ২০০৪;
  • লন্ডনে বোমা হামলা, ২০০৫;
  • দ্বিতীয় বালি বোমা হামলা, ২০০৫;
  • মুম্বাইতে ট্রেনে বোমা হামলা, ২০০৬;

বাংলাদেশে সন্ত্রাস

বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থা সমজাতীয় (homogenous)। এখানে জাতিগত পার্থক্য সামান্য। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও অন্য কিছু অংশের উপজাতি সম্প্রদায় ছাড়া সবার জীবন পদ্ধতি প্রায় একই ধরনের। বাংলাদেশীরা প্রকৃতিগতভাবে শান্তিপ্রিয় এবং সামাজিক সম্প্রীতি ও সংহতির জ্বলন্ত উদাহরণ। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো সন্ত্রাসী কার্যক্রম এখানে লক্ষ্য করা যায় না। ভৌগোলিক ও আদর্শগত কারণে সন্ত্রাসীদের জন্য বাংলাদেশ হতে পারে অন্যতম পছন্দ। সাম্প্রতিক সময়ে এর কিছু প্রমাণও পাওয়া গেছে। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে সন্ত্রাসী কার্যক্রমগুলোকে কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করতে হয়। এগুলো হলো-

  • ১। নিষিদ্ধ ঘোষিত রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রম,
  • ২। মৌলবাদী ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা,
  • ৩। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কার্যক্রম।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরপর রাজনৈতিকভাবে মোটিভেটেড কিছু গোষ্ঠী বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সন্ত্রাসবাদে জড়িয়ে পড়ে। তাদের লক্ষ্য ছিল ধনী ব্যক্তিরা, যারা পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় ধন-সম্পদের মালিক হয়েছিল। তাদের বিশ্বাস ছিল ঐসব ধনী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সরাসরি আক্রমণের মাধ্যমে কমিউনিজমকে প্রতিষ্ঠা করা যাবে। বাংলাদেশ সরকার এসব রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে এরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। যদিও সমগ্র বাংলাদেশে বিচ্ছিন্নভাবে তারা তাদের তৎপরতা চালায় তবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে তাদের কার্যক্রম ছিল সংঘবদ্ধ ও ভয়াবহ। বর্তমানে এসব গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা কমে গেছে এবং রাজনৈতিক আদর্শ থেকে তারা বিচ্যুত হয়ে শুধুমাত্র সাধারণ অপরাধী গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে।

সত্তর এর দশক থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদীবাসীরা তাদের অধিকার ও স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে আসছে। তারা রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে অবস্থান নিয়েছে। ১৯৯৭ সালে সরকার তাদের সাথে শান্তি চুক্তি করার পর থেকে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে তাদের মধ্যকার একটি গ্রুপ শান্তি চুক্তির বিরোধিতা করে আসছে এবং এখনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। ২০০১ সালে রাঙ্গামাটিতে ৩ জন বিদেশী নাগরিককে এক মাস পর্যন্ত অপহরণ করে আটক রাখার পেছনে তারা জড়িত ছিল। ভারত সরকারের মতে ভারতের কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন যেমন: ULFA (ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম); ATTF (অল ত্রিপুরা টাইগার ফোর্স) এবং NLFT (ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট অব ত্রিপুরা) এর ক্যাম্প রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের জঙ্গলে। বাংলাদেশ প্রথম থেকেই এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।

বাংলাদেশের বেশিরভাগ জনগণ ইসলাম ধর্মাবলম্বী ও শান্তিপ্রিয়। তথাপি দেশের একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ বাংলাদেশে বিগত কয়েক বছর কয়েকটি সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। এই গ্রুপগুলোর মধ্যে হরকাতুল জিহাদ, জামাতুল মুজাহেদীন বাংলাদেশে অন্যতম। এসব সংগঠনগুলো দেশে ইসলামী শাসন কায়েম করতে চায় এবং এদের সাথে আন্তর্জাতিক জঙ্গীগোষ্ঠীগুলোর যোগাযোগ রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এদের সদস্য সংখ্যা খুবই নগণ্য এবং বিচ্ছিন্নভাবে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জনমনে ভয়ভীতি সৃষ্টি করতে সচেষ্ট রয়েছে।

বাংলাদেশ সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সবচেয়ে প্রচলিত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দুষ্কৃতিকারী কর্তৃক বেসামরিক জনগণের সম্পত্তি আত্মসাৎ, জোরপূর্বক অর্থ ও মূল্যবান দ্রব্যাদি গ্রহণ, চাঁদাবাজী, টেন্ডারবাজী, হত্যা, বিস্ফোরণ প্রভৃতি কাজের মাধ্যমে ভয়ভীতির সঞ্চার করা। চরম দারিদ্র্য, বেকারত্ব, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার এবং রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পর্ক এসব কাজের পেছনে মদদ দিচ্ছে। এছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক সংঘর্ষ দেশের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অন্যতম প্রধান কারণ। যদিও বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশ তবুও এখানে ক্ষমতাসীন দলের প্রাধান্য এবং তাদের নেতাকর্মীদের কর্মকাণ্ড হচ্ছে সন্ত্রাসের মূল কারণ। ক্ষমতা গ্রহণের সাথে সাথে অবৈধভাবে প্রভাব বিস্তার ও অর্থবিত্ত লাভের আশায় এরা সন্ত্রাসী কাজ করে থাকে। বিরোধী দলের সদস্যরা তখন নিজেদেরকে টিকিয়ে রাখার জন্য এবং পরবর্তী নির্বাচনে নির্বাচিত হবার জন্য সরকার বিরোধী আন্দোলন, বিক্ষোভ ও সহিংস কার্যক্রম হাতে নেয়। এসব ক্ষেত্রে প্রায়শই অস্ত্র ও বিস্ফোরকের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।

বাংলাদেশে সংঘটিত কতিপয় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু হলেও বিগত এক দশকে এখানে সন্ত্রাসী তৎপরতা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। নিম্নে ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০৭ এর জানুয়ারি পর্যন্ত সংঘটিত উল্লেখযোগ্য সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের একটি বিবরণ দেয়া হলো:

সময়কাল সংঘটিত ঘটনা
সেপ্টেম্বর, ১৯৯৬ শান্তিবাহিনীর বিদ্রোহী অংশ ৩০ জন বাংলাভাষী ব্যক্তিকে অপহরণ করে এবং পরে হত্যা করে।
অক্টোবর, ১৯৯৬ আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মসজিদে (খুলনা) বোমা হামলা
মার্চ, ১৯৯৬ যশোরে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বোমা বিস্ফোরণ
জুলাই, ২০০০ গোপালগঞ্জে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার প্রচেষ্টা
এপ্রিল, ২০০১ নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ অফিসে বোমা বিস্ফোরণ
সেপ্টেম্বর, ২০০২ সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা পুলিশ ক্যাম্পে আক্রমণ চালায় এবং এতে ৪ জন পুলিশ সদস্য নিহত হন
ডিসেম্বর, ২০০২ ময়মনসিংহের চারটি সিনেমা হলে সিরিজ বোমা হামলা
মার্চ, ২০০৩ খুলনায় সিরিজ বোমা হামলায় ২ জন পুলিশ নিহত ও অপর ২ জন আহত
মার্চ, ২০০৩ খুলনায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় বোমা বিস্ফোরণ
জানুয়ারি, ২০০৩ টাঙ্গাইলের এক গ্রামে বোমা হামলায় ৮ জন নিহত
আগস্ট, ২০০৪ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলায় ১৯ জন নিহত ও ২০০ জন আহত হয়। ঘটনাটি দেশ বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
মে, ২০০৪ পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের সাথে গণমুক্তি ফৌজ ক্যাডারদের সংঘর্ষে ৮ জন নিহত হয়
মে, ২০০৪ বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাই কমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর উপর সিলেট শাহজালাল (র.) এর দরগা শরীফে গ্রেনেড হামলা।
ফেব্রুয়ারি, ২০০৪ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হুমায়ুন আজাদের উপর ছুরিকাঘাত।
ডিসেম্বর, ২০০৫ নেত্রকোণায় উদীচী সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর অফিসের। সামনে আত্মঘাতী বোমা হামলা।
নভেম্বর, ২০০৫ জেএমবি’র আত্মঘাতী স্কোয়াডের সদস্য কর্তৃক ঝালকাঠির দুই বিচারক হত্যা।
অক্টোবর, ২০০৫ পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (জনযুদ্ধ) সদস্য কর্তৃক বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ৫ সদস্য হত্যা
আগস্ট, ১৭, ২০০৫ বাংলাদেশের ৬০টি জেলায় এক যোগে ৩০ মিনিটের ব্যবধানে প্রায় ৫০০ বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় জেএমবি। এাতে ২ জন নিহত ও ১০০ জন আহত হয়। এই সিরিজ বোমা হামলাটি সারা বিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
জানুয়ারি, ২০০৫ সাবেক অর্থমন্ত্রী এ.এম.এস. কিবরিয়াসহ আরও ৪ জন আওয়ামী লীগ কর্মী হবিগঞ্জের এক জনসভায় গ্রেনেড হামলায় নিহত হন।
জুন, অক্টোবর, নভেম্বর, ২০০৬ পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (জনযুদ্ধ)-এর সাথে বিরোধী গ্রুপ ও RAB সদস্যদের সংঘাত।

তথ্যসূত্র

  • অপরাধ বিজ্ঞান পরিচিতি, প্রফেসর ড: বোরহান উদ্দিন খান, মনজুর কাদের, কামরুল বুক হাউজ, ঢাকা-চট্টগ্রাম

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.