খারিজি, মুরজিয়া ও শিয়া মতবাদ

ভূমিকা

বিভিন্ন ধর্মের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ধর্মীয় মূলতত্ত্বের অর্থকে কেন্দ্র করে একই ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে প্রায়শই নানারকম মতভেদ দেখা দেয়, এবং এসব মতভেদের কারণে একই ধর্মের আওতায় গড়ে ওঠে একাধিক সম্প্রদায়। ধর্মের কেন্দ্রীয় বাণীর প্রতি আস্থাশীল থেকেই এসব সম্প্রদায় তাদের ধর্মের বিভিন্ন তত্ত্ব ও আচারের বিভিন্ন রকম ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে এবং তাতেকরেই তারা ক্রমশ রচনা করে এক বর্ণাঢ্য ধর্মীয় সভ্যতা বা সংস্কৃতি। খ্রিস্টধর্মের ক্যাথলিকপ্রটেস্টান্ট শাখা, বৌদ্ধধর্ম ও দর্শনের মহাযানথেরবাদ সঙ্ঘ, হিন্দুদের শৈববৈষ্ণব মতবাদ প্রভৃতি সবই ধর্মের মূল মর্মের বিভিন্নমুখী ব্যাখ্যাপ্রসূত মতবাদ ছাড়া আর কিছু নয়।

ইসলাম পৃথিবীর প্রধান ধর্মগুলোর সর্বশেষ ধর্ম এবং এ ধর্ম ব্যাপ্তি লাভ করেছে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিবেশের মানুষের মধ্যে। আর এজন্যই অন্যান্য যে-কোনো ধর্মের মতো এ ধর্মের মূলবাণীর ব্যাখ্যায় যে একাধিক দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা যাবে, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। একথা মনে রাখা দরকার যে, মহানবীর জীবদ্দশায় ইসলাম ছিল তার বিকাশের প্রারম্ভিক পর্যায়ে এবং এর প্রয়োগের দিকটিও তখন ছিল অপেক্ষাকৃত সহজ। যে-কোনো ধর্মীয় বা সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য কোরআনের নীতিমালা এবং মহানবীর ব্যক্তিগত ব্যাখ্যা ও নির্দেশই তখন ছিল যথেষ্ট। এ কারণেই তখন ধর্মীয় প্রশ্নাবলি নিয়ে মতবিরোধের তেমন কোনো অবকাশ ছিল না। এ ছাড়া ইসলামের প্রারম্ভিক পর্যায়ে মুসলমানরা তাদের নতুন ধর্মের প্রচার নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিল যে, তখন ধর্মীয় বিধি-বিধানের চুলচেরা তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের সময় তাদের বড় একটা ছিল না।

কিন্তু মহানবীর পরলোকগমনের পর নতুন নতুন পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে দেখা দিতে থাকে এমনসব জটিল সমস্যা, যেগুলোর সুস্পষ্ট সমাধান কোরআনে ছিল না এবং যার অকাট্য সমাধান দেয়ার জন্য মহানবীও তখন উপস্থিত ছিলেন না। এসব কারণে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রশ্নকে কেন্দ্র করে মুসলমানদের মধ্যে দেখা দেয় ক্রমবর্ধমান মতবিরোধ। ইসলামের প্রতি এতটুকু অনাস্থাশীল না হয়েও নানা প্রসঙ্গে তারা একের সঙ্গে অন্যের বিরোধ লক্ষ্য করে এবং শেষ পর্যন্ত এসব ভিন্নমত তাদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত করে দেয়।

প্রথম যে বিষয়টি নিয়ে মতবিরোধের সূত্রপাত সেটি হলো ইমামের স্বরূপ। মহানবীর তিরোধানের পর তার সহচররা (সাহাবা) নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে খলিফা নির্বাচিত করতে চান। এ খবর যখন হজরত আবুবকরের কানে যায়, তখন তিনি অভিমত দেন যে, খলিফাকে অবশ্যই কুরাইশ বংশের হতে হবে। এটি খোদ মহানবীরই অভিপ্রায় ছিল বলে তিনি জানান। অবশেষে হজরত আবুবকর খলিফা নিযুক্ত হন। আবুবকর ও তার পরবর্তী খলিফা হজরত ওমরের সময়ও এ নিয়ে কোনো বড়রকমের গোলযোগ দেখা দেয়নি। গোলযোগের সূত্রপাত ঘটে হজরত ওসমানের খলিফা হওয়ার পর, এবং এর পরিণতিতেই তিনি নিহত হন।

ওসমান হত্যাকে কেন্দ্র করে জনগণের মধ্যে দেখা দেয় তীব্র গোলযোগ ও হানাহানি। সমাজের রক্ষণশীল ব্যক্তিদের মতে তিনি ছিলেন একজন সৎ ও মহান ব্যক্তি এবং যারা তাকে হত্যা করেছে তারা গুরুতর অপরাধে অপরাধী। সমাজের অপর অংশ এ অভিযোগ অস্বীকার করে, এবং এ নিয়ে সেদিন যে বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে তা আজও অমীমাংসিত। হজরত আলি খলিফা মনোনীত হওয়ার পরও এ ধরনের মতবিরোধ অব্যাহত থাকে। কেউ কেউ তার নেতৃত্বের বিরোধিতা করে; অন্য কেউ কেউ আবার নিজেদের এ বিতর্ক থেকে দূরে সরিয়ে রাখে এবং আরো কেউ কেউ তার জোর সমর্থন করতে থাকে। আজও এ বিতর্কের অবসান ঘটেনি। তৃতীয় খলিফা হজরত ওসমান ছিলেন ওমাইয়া বংশজাত। ওমাইয়ারা নানাভাবে মহানবীর বিরোধিতা করেছিলেন। সিরিয়ার গভর্নর মুয়াবিয়া ওসমান হত্যার প্রতিশোধের অপেক্ষায় ছিলেন এবং হযরত আলি খলিফা হওয়ার পর মুয়াবিয়া তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। মুয়াবিয়ার সঙ্গে আলি (রা.) সন্ধি করতে বাধ্য হন। এই সন্ধি ছিল মুয়াবিয়ার পক্ষ থেকে পূর্বপরিকল্পিত, এবং তা শেষ পর্যন্ত আলির (রা.) বিরুদ্ধে যায়।

খারিজি সম্প্রদায়

হজরত আলির অনুসারীদের মধ্যে যে দলটি সন্ধির বিরুদ্ধে ছিল তারা খারিজি নামে পরিচিত। তাদের মতে, সন্ধি বা আপোস আল্লাহর বিরুদ্ধে একটি দ্রোহিতামূলক কাজ। কারণ, একমাত্র আল্লাহই চূড়ান্ত বিচারক; এবং শুধু তিনিই আপোসরফা বা সন্ধির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। আল্লাহর এ রায় মানুষ জানতে পারে গোটা সমাজের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত স্বাধীন নির্বাচনের মাধ্যমে। খারিজিদের মতে, যথাযোগ্য গুণাবলির অধিকারী হলে যে কোনো ব্যক্তি, এমনকি একজন আবিসিনীয় ক্রীতদাসও খলিফা হতে পারেন। নেতৃত্ব কোনো বংশ মর্যাদার ব্যাপার নয়; নেতৃত্বের জন্য যা প্রয়োজন তা হলো চারিত্রিক বিশুদ্ধতা, চিন্তায় ও আচরণে সততা ও পবিত্রতা।

তাদের মতে, বড়রকমের পাপ অনুষ্ঠানকারী যে-কোনো মুসলমান তার সেই পাপাচারের কারণে পৌত্তলিকের অবস্থায় অধঃপতিত হয়ে যায় এবং এর জন্য তাকে কঠোর শাস্তি, এমনকি মৃত্যুদণ্ড দেয়া যেতে পারে। খারিজিরা আল্লাহর বিশুদ্ধ অনপেক্ষ একত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। তাদের মতে, কোরআন আল্লাহর সৃষ্ট বাণী এবং এজন্যই একে আক্ষরিক অর্থেই বুঝতে হবে, রূপক অর্থে নয়। ধর্মানুশীলনের ব্যাপারে খারিজিরা সর্বাত্মক বিশুদ্ধতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং নামাজের আগে আনুষ্ঠানিক ওজুর ওপর বিশেষ জোর দেন। শুধু তা-ই নয়, তারা এ-ও মনে করেন যে, অসৎ কথাবার্তা, মিথ্যাচার, পরনিন্দা প্রভৃতি আচরণ ধর্মীয় পবিত্রতা বিনাশ করে এবং মানুষকে নামাজের জন্য অনুপযুক্ত করে দেয়।

এসব কঠোর মত অবলম্বনের ফলে হজরত আলির সঙ্গে তাদের বিরোধ দেখা দেয়। অবশেষে তারা আলি (রা.) থেকে সরে যায় এবং মুয়াবিয়ার তীব্র বিরোধিতা করে। তারা ছিল গণতান্ত্রিক নীতির সমর্থক, এবং এজন্যই সরকারের কর্মকাণ্ডে অসন্তুষ্ট অনেকেই তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, উমাইয়া শাসকদের বিরোধী বেরবেররা তাদের মতের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। উত্তর আফ্রিকার খারিজিরা আজও আবেদি বা ইবাদি নামে পরিচিত। আলজেরিয়ায় তারা তাদের নিজেদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে পৃথকভাবে রয়েছে। নিজেদের বাইরে তারা বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপনে আগ্রহী নয়। নিজেদের মতবাদ ও আচার-অনুষ্ঠানসমূহকে তারা নিষ্ঠার সঙ্গে সংরক্ষণ করে চলেছে। সৌদি আরবে অত্যন্ত প্রভাবশালী ওহাবি সম্প্রদায়ের ওপর খারিজিদের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়।

মুরজিয়া সম্প্রদায়

বর্তমানে মুরজিয়া সম্প্রদায়ের কোনো অস্তিত্ব নেই; কিন্তু এ সত্ত্বেও রক্ষণশীল ইসলামে এ সম্প্রদায়ের প্রভাব অসামান্য ও সুদূরপ্রসারী। অন্যান্য অনেক সম্প্রদায়ের ন্যায় মুরজিয়াদের উৎপত্তি ঘটে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। তারা ওমাইয়া রাজবংশের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। তাদের যুক্তি ছিল এই যে, ওমাইয়ারা মুসলিম রাষ্ট্রের শাসক ছিলেন এবং তারা আল্লাহর একত্বে ও মহানবীর নবুয়তে বিশ্বাসী মুসলমান। সুতরাং মুরজিয়াদের যুক্তিতে নিষ্ঠাবান ও সৎ মুসলমানদের উচিত শিয়া ও খারিজিদের প্রণোদিত যুদ্ধ থেকে দূরে থাকা।

মুরজিয়া শব্দের অর্থ হলো স্থগিত রাখা। মুরজিয়া মতে, আল্লাহই চূড়ান্ত বিচারের মালিক, এবং এজন্যই অন্যান্য মুসলমানদের সম্পর্কে যে-কোনো রায় শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত স্থগিত রাখা উচিত। শুধু শেষ বিচারের দিনই সব হৃদয়ের সব গোপন তথ্য প্রকাশিত হবে। ধর্মীয় ব্যাপারে তারা ছিলেন উদার ও সহনশীল। তারা অপরের পাপকে দেখতেন উদার দৃষ্টিতে এবং মনে করতেন যে একমাত্র বহুঈশ্বরে বিশ্বাসই অমার্জনীয় পাপ। ধর্মীয় ব্যাপারে যা প্রয়োজনীয় তা হলো বিশ্বাস। একমাত্র বিশ্বাসকেই অভিহিত করা যায়। একটি স্বকীয় সত্তা বলে। কোনো পাপাচার এ বিশ্বাসকে বিনাশ করতে পারে না। তাদের মতে, চৌর্যবৃত্তি, মিথ্যাভাষণ প্রভৃতি গৌণ পাপ আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসী মুসলমানকে বেহেশত থেকে সরিয়ে রাখতে পারবে না।

কোনো বড় (কবিরা) পাপের কারণে একজন মুসলমানকে পৌত্তলিক বলা যাবে না। আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসী মুসলমান পাপ করলেও মুসলমান থেকে যায়। কোনো ব্যক্তি পাপ করে যদি অনুশোচনা করে তা হলে আল্লাহ তাকে মাফ করে দেবেন। এসব ইসলামি মতবাদের মূলে মুরজিয়াদের সুস্পষ্ট অবদান রয়েছে। খারিজিরা যখন ঘোষণা করেন যে, পাপের পরিণতি দোজখের আগুন, তখন তাদের বিরুদ্ধে মুরজিয়ারা এগিয়ে আসেন তাদের উদারনৈতিক মত নিয়ে।

শিয়া সম্প্রদায়

আগেই বলা হয়েছে যে, মহানবীর পরলোকগমনের পর মুসলিম জাতির পরিচালক ও নেতা হিসেবে তার উত্তরসূরি কে হবেন-এ নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। মুসলমানদের একটি ক্ষুদ্র অংশ অভিমত দেন যে, মুসলিমসমাজের নেতৃত্ব ন্যস্ত থাকা দরকার মহানবীর পরিবারে। এ যুক্তিতেই তারা হজরত আলিকে (রা.) ঘোষণা করেন রসুলুল্লাহর যথার্থ উত্তরাধিকারী বলে। এ থেকে তারা পরিচিত হয়ে ওঠেন আলির পক্ষাবলম্বী (শিয়া) বলে। অন্যদিকে মুসলমানদের অপর একটি বড় অংশ আবুবকর (রা.)-কে মনোনীত করেন খলিফা হিসেবে। তাদের যুক্তি ছিল এই যে, রসুলুল্লাহ তার উত্তরসূরি মনোনয়নের ব্যাপারে কোনো নির্দেশ দিয়ে যাননি, এবং এজনাই তারা আবুবকরকে মনোনীত করেন হাদিসের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিবর্গের মতৈক্যের (আহলে আস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহ) ভিত্তিতে। এভাবে যারা হজরত আলিকে ইমাম হিসেবে সমর্থন করলেন তারা শিয়া নামে এবং যাঁরা হজরত আবুবকরকে সমর্থন করলেন তারা সুন্নি নামে পরিচিত।

এখানে উল্লেখ্য যে, শিয়া ও সুন্নিদের এ মতবিরোধ নিছক কোনো রাজনৈতিক বিরোধ নয়, তার চেয়েও আরো গভীর। অর্থাৎ এর সঙ্গে ধর্মতাত্ত্বিক ও আধ্যাত্মিক প্রশ্নও জড়িত। সুন্নিরা মহানবীর উত্তরাধিকারীকে দেখেছেন একটি নবপ্রতিষ্ঠিত জাতির বলিফা হিসেবে আর শিয়ারা বিশ্বাস করতেন যে এই উত্তরাধিকারী শুধু একজন রাজনৈতিক নেতাই নন, বরং একই সঙ্গে তাকে হতে হবে আধ্যাত্মিক গূঢ়জ্ঞানের অধিকারী এবং ধর্মবিজ্ঞানের উপযুক্ত ব্যাখ্যায় সমর্থ একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি (ওয়াসি)। এজন্যই শিয়া ও সুন্নি পার্থক্যকে নিছক রাজনৈতিক পার্থক্য হিসেবে না দেখে, দেখা উচিত একই সঙ্গে ধর্মীয় পার্থক্য হিসেবে। কারণ, এখানে রাজনৈতিক উত্তরাধিকার ও ধর্মীয় কর্তৃত্ব, এ উভয় প্রশ্নই জড়িত।

তবে এ প্রসঙ্গে এ-ও উল্লেখ করা দরকার যে, শিয়া ও সুন্নি উভয় সম্প্রদায়ই ছিল ইসলামের রক্ষণশীল ব্যাখ্যার পক্ষপাতী এবং উভয়েই ইসলামের আদি রক্ষণশীল ধর্মমতের অবিচ্ছিন্ন অংশস্বরূপ। এ দুটি সম্প্রদায়ের কোনোটিই প্রতিষ্ঠিত রক্ষণশীল ধর্মমতের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা পরবর্তীকালের কোনো আন্দোলন নয়, এবং তা নয় বলেই এ দুয়ের কোনটিকেই খ্রিস্টধর্ম কিংবা ইহুদি ধর্মের সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করা সংগত নয়। উভয় সম্প্রদায়ই ইসলামের আদি অকৃত্রিম ঐক্যে বিশ্বাসী, যদিও বিভিন্ন ধর্মীয় তত্ত্ব ও আচার সম্পর্কে তাদের মত সব ক্ষেত্রে অভিন্ন নয়। উভয় সম্প্রদায় একই ধর্মীয় সত্যের দুটি দিকের বা দুটি দৃষ্টিভঙ্গির প্রতীক, সেই ধর্মের ঐক্যবিনাশী কোনো প্রতিকূল শক্তির নয়। তাই উভয়ে ‘শাহাদাহ’ (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) বাণীর প্রতি আস্থাশীল, যদিও এর আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা উভয়ের ক্ষেত্রে এক ও অভিন্ন নয়।

শিয়া মতে, আলি (রা.) ছিলেন প্রথম বৈধ নফা এবং এরপর খেলাফত হস্তান্তরিত হয়েছে তার পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে। আবুবকর (রা.), ওমর (রা.) ও ওসমান (রা.)-এ তিনজন খলিফা ছিলেন ক্ষমতার জবরদখলকারী। শিয়ারা ‘খলিফা’ শব্দের পরিবর্তে ‘ইমাম’ শব্দটি ব্যবহারের পক্ষাপাতী। সাধারণত ইমাম বলতে বোঝায় এমন একজন ব্যক্তিকে যাঁর অবস্থান প্রথম সারিতে, এবং সে কারণেই যিনি নেতৃত্ব দেন জামায়াতের নামাজে। প্রাত্যহিক জীবনের ভাষায় শিয়া ও সুন্নি উভয় মহলে কথাটা এ অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ইমাম বলতে আবার বোঝায় ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে। এই সম্মানসূচক অর্থেই চারটি আইন সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতাদের এবং গাজালির মতো অনন্যসাধারণ ধর্মীয় পণ্ডিতদের ইমাম বলে সম্বোধন করা হয়ে থাকে। কিন্তু শিয়ামহলে ইমাম কথাটি প্রযুক্ত হয়ে থাকে এক বিশেষ অর্থে।

শিয়াদের মতে, ইমাম জনগণ দ্বারা নির্বাচিত নন, বরং আল্লাহ-প্রেরিত এমন একজন শাসক ও শিক্ষক, যিনি মহানবীর বার্তাপ্রচারের যথার্থ উত্তরাধিকারী। তিনি এমন কিছু অতিমানবিক গুণ ও শক্তির অধিকারী, যেগুলো হজরত মোহাম্মদ (স.)-এর মাধ্যমে আদম থেকে বিকীর্ণ। তারা বিশ্বাস করেন যে, জগৎসৃষ্টির আগে আল্লাহ তার নিজস্ব আলোর একটি রশ্মি সংরক্ষিত রেখেছিলেন, যা কিনা মোহাম্মদ (স.)-এর আলো নামে পরিচিত। এই সংরক্ষিত আলোই মূর্ত রূপ লাভ করেছিল মহানবী মোহাম্মদ (স.)-এর ব্যক্তিত্বে।

মহানবীর এই পূর্ব-অস্তিত্বের ধারণা সুন্নি মহলেও প্রচলিত, যদিও সুন্নি মতে তা শিয়া মতের ন্যায় অতটা স্পষ্ট রূপায়ণ লাভ করেনি। শিয়ারা বিশ্বাস করেন যে, মোহাম্মদ (স.) থেকে এই আলো প্রথমে হস্তান্তরিত হয় আলির (রা.) কাছে এবং তারপর ধারাবাহিকভাবে তার বংশধর ইমামদের কাছে। এ অর্থে ইমামরা মানুষের অকাট্য পথপ্রদর্শক এবং সত্যের উৎস। তারা এমন কিছু অতিমানবিক জ্ঞানের অধিকারী যার সাহায্যে তারা রোজ কেয়ামত পর্যন্ত যা ঘটবে তার সঠিক খবর রাখেন। তাদের পক্ষে ভুল করার কোনো সম্ভাবনাই নেই। কোরআনের ব্যাখ্যার জন্য তারাই উপযুক্ত পাত্র। তারা পরম সত্যের উৎস, এবং তাদের মাধ্যমেই মানুষ সন্ধান পেতে পারে যথার্থ দিগ্‌দর্শন ও চূড়ান্ত মুক্তির। তারা সম্পূর্ণ নিষ্পাপ ও নিষ্কলুষ, এবং সে কারণেই মানুষের শর্তহীন আনুগত্যের সুযোগ্য পাত্র।

এ তত্ত্ব ইমাম হোসেনের শাহাদাতবরণের কাহিনীর ওপর প্রতিষ্ঠিত। শিয়া মতে ইমাম হোসেনের মতো একজন মহান ব্যক্তির পক্ষে এভাবে কারবালায় প্রাণ না দিলেও হতো। কিন্তু বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীদের উদাত্ত অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি স্বেচ্ছায় বরণ করেছিলেন মৃত্যুকে। তার এই আত্মোৎসর্গকে কেন্দ্র করে অনেক কাহিনী গড়ে উঠেছে। এর পরও আরো কয়েকজন ইমামকে মুখোমুখি হতে হয় অস্বাভাবিক মৃত্যুর । ইমামদের সবাই বিখ্যাত ছিলেন তাদের অকৃত্রিম ধর্মানুরাগ ও অসাধারণ জ্ঞানবুদ্ধির জন্য। কিন্তু রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তাদের সম্মুখীন হতে হয়েছিল নানারকম অভিযোগ ও চক্রান্তের। প্রথম দিকে তারা মদিনায় অবস্থান করা পছন্দ করতেন এবং পরবর্তীকালে শিয়া সমর্থনের কল্যাণে ক্ষমতায় আরোহণ করলেও আব্বাসীয় খলিফারা শিয়াদের অধিকাংশকে সতর্ক দৃষ্টিতে অনেকটা অন্তরীণ রেখেছিলেন বাগদাদে কিংবা সামারায়।

শিয়া ধর্মবেত্তাদের মধ্যে যাঁরা বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী, তারা কার্যকর ছিলেন মঙ্গোলীয় এবং তার চেয়েও বেশি সাফাভিদ শাসনামলে (১৫০২-১৭৩৬)। এ সময়েই শিয়াদের প্রধান প্রধান মত স্বীকৃতি লাভ করে পারস্যের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে। আজকের ইরানেও শিয়া ধর্মমত বিশেষভাবে প্রবল। ক্রমশ শিয়া সম্প্রদায় অনেকগুলো উপসম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তাদের এই বিভাজন প্রধানত সংঘটিত হয়েছে যথার্থ বৈশ ইমাম কারা?—এ প্রশ্ন নিয়ে বিতর্কের ওপর। এসব উপসম্প্রদায়ের মধ্যে বারোপন্থী ও সাতপন্থি নামে পরিচিত দুটি শাখা সমধিক বিখ্যাত।

বারোপন্থী শিয়া

বারোপন্থী (ইসনে আশারিয়া) শিয়া সম্প্রদায়কে এ নামে অভিহিত করা হয় এজন্য যে তারা বারোজন ইমামের অস্তিত্বে বিশ্বাসী। প্রথম ইমাম ছিলেন হজরত আলি (রা.)। এরপর হাসান, হোসেন এবং তারপর হোসেন থেকে জনৈক মোহাম্মদ পর্যন্ত বংশানুক্রমিকভাবে এসেছেন আরো ন’জন। এই মোহাম্মদ ইমাম হয়েছিলেন অপরিণত বয়সে এবং ক্ষমতায় আরোহণের অব্যবহিত পরেই ৮৭৪ খ্রিস্টাব্দের দিকে তিনি তিরোহিত হয়ে যান। এরপর প্রায় ৭০ বছর ধরে তার ‘ওয়াকিল’ (এজেন্ট) বা ‘বাব’ (দরজা) হিসেবে কাজ করেছিলেন অন্য চারজন। এ চারজন বাব-এর চতুর্থজন তার মৃত্যুর সময় উত্তরাধিকারী মনোনয়নে অসম্মতি জ্ঞাপন করার ফলে ৯৪০ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু হয় ইমামের আত্মগোপনের সময়। শিয়ারা বিশ্বাস করেন যে, ইমাম আজও বেঁচে আছেন এবং তিনি তার শিষ্যদের এখনো পরিচালনায় নিয়োজিত রয়েছেন। পৃথিবীতে ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি কালক্রমে পুনরাবির্ভূত হবেন মেহেদি (পরিচালক) হিসেবে। সুন্নিরাও মেহেদির অবির্ভাবে বিশ্বাসী; কিন্তু তারা কোনো বিশেষ ব্যক্তিকে মেহেদি বলে চিহ্নিত করেন না।

বারোপন্থী শিয়ারা যেসব ধারণার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন (এবং এ বিষয়ে সাতপন্থীরা তাদের সঙ্গে একমত) সেগুলোর মধ্যে বাহ্য (exoteric) ও গূঢ় (esoteric) জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য প্রধান। যে কোনো প্রকাশ বা অভিব্যক্তি কোনোকিছুর অভিব্যক্তি। প্রত্যেক প্রতিভাস নিশ্চয়ই এমন একটা বাস্তবসত্তার ইঙ্গিত বহন করে যা প্রতিভাসিত হচ্ছে। যে-কোনো মূর্ত বাস্তবতার একটি বাহ্য ও একটি অভ্যন্তরীণ দিক আছে। এ সত্তা শুধু প্রকৃতিজগৎকেই অন্তর্ভুক্ত করে না, একই সঙ্গে নির্দেশ করে সেই অভিব্যক্তির, যা প্রকৃতির মতোই স্বর্গীয় উৎস থেকে উদ্ভূত।

বারোপন্থি শিয়ারা ধর্মীয় তত্ত্ব ও জ্ঞানের বাহ্য (জাহের) ও গূঢ় (বাতেন)—এ দুটি দিকের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এদিক থেকে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সুফিদের দৃষ্টিভঙ্গির অনুরূপ। বাতেনকে বাদ দিয়ে জাহের থাকতে পারে না; কারণ বাতেন যদি না থাকত, তা হলে মূর্ত অস্তিত্ব নিয়ে প্রকাশিত বা অভিব্যক্ত (জাহের) হবার মতো কিছুই থাকত না। আর জাহেরের অনুপস্থিতিতে বাতেনও সুযোগ পেত না নিজেকে মূর্ত অস্তিত্বের আঙ্গিকে অভিব্যক্ত করার। জাহের ও বাতেনের এই সম্বন্ধের মধ্যেই নিহিত ইমামের অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তার রহস্য। ধর্মীয় নবী স্বর্গলোক থেকে আইন নিয়ে আসেন মানুষকে পরিচালনার জন্য। তার অন্তর্ধানের পর অবসান ঘটে স্বর্গীয় প্রত্যাদেশের এবং এরপর মানুষের নির্ভর করতে হয় সেই আইনব্যবস্থার ওপর, যা-কিনা নির্ভরশীল প্রত্যাদেশের বাহ্যিক দিকের ওপর। এ অবস্থায়ই এমন কিছু ব্যক্তির আবির্ভাব অনিবার্য হয়ে ওঠে যাঁরা আইনের অন্তর্নিহিত অর্থ এবং প্রত্যাদেশের গূঢ়ার্থ ব্যাখ্যায় সক্ষম।

ইসলামে নবুয়তের সমাপ্তি ঘটে মহানবী মোহাম্মদে (সা.) এসে। তিনি ছিলেন বাহ্য ও গূঢ় উভয় ধরনের ঐশী প্রত্যাদেশের বাহন। কিন্তু তার পরে এমন কিছু ব্যক্তির আবির্ভাব আবশ্যক যাঁরা তার এই গূঢ়শক্তির উত্তরাধিকারী, এবং সেই সুবাদেই নিয়োজিত থাকবেন স্বর্গীয় আইনের গূঢ় অর্থ ব্যাখ্যার দায়িত্বে। আল্লাহর আইন বয়ে আনার ব্যাপারে নবীদের দায়িত্বকে যেমন বলা হয় ‘নুবুয়াহ’ তেমনি সেই আইনের গূঢ়ার্থ মানুষের কাছে ব্যাখ্যা করা এবং প্রত্যাদেশের উৎসের সঙ্গে সংরক্ষণ করাকে শিয়া মতে বলা হয় “উইলায়াহ’। আর এই অসাধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের বলা হয় ‘ওয়ালিআল্লাহ’, অর্থাৎ আল্লাহর বন্ধু। কিন্তু শিয়া মতের বিশেষ প্রেক্ষিতে তা শুধু সাধু-সজ্জনকেই বোঝায় না, বোঝায় স্বর্গীয় আইন ও প্রত্যাদেশের গূঢ়ার্থ ব্যাখ্যার সেই শক্তিকে যা কেবল ইমামদেরই আছে। শিয়া মতে, প্রথম ইমাম হজরত আলি (রা.) ছিলেন এ ধরনের একজন ওয়ালিআল্লাহ ।

ইমাম উইলায়াহ-র দায়িত্ব পালন করেন এবং ধর্মীয় আইনের বাস্তবায়ন ও সংরক্ষণের ব্যাপারে তৎপর থাকেন। একজন নবীর সঙ্গে একজন ইমামের পার্থক্য এখানে যে, নবী স্বর্গীয় আইনের প্রত্যাদেশ গ্রহণ ও প্রচার করেন এবং এরপর পৃথিবী ত্যাগ করেন। ফলে এমন সময়ও থাকে যখন পৃথিবীতে কোনো নবী উপস্থিত থাকেন না। কিন্তু ইমাম সদাবিদ্যমান। পৃথিবী কখনো ইমামবিহীন থাকতে পারে না, যদিও ইমাম কখনো আত্মগোপন করে কিংবা অজ্ঞাত অবস্থায় থাকতে পারেন। ইসলামের নবী যখন পৃথিবী ত্যাগ করলেন তখন তার স্থলাভিষিক্ত হলেন ইমাম। নবীজির তরফ থেকেই ইমাম ব্যাখ্যা ও প্রচার করেন ধর্মীয় গূঢ়জ্ঞান এবং তার পক্ষ থেকেই সমর্থন ও সংরক্ষণ করেন ইসলামি আইন ও মূল্যবোধকে। সংক্ষেপে বলতে গেলে মহানবীর প্রতিনিধি হিসেবে মুসলিম জাতিকে শাসন করা, ধর্মীয় আইন ও বিজ্ঞানসমূহকে (বিশেষত তাদের গভীর অর্থ) মানুষের কাছে ব্যাখ্যা করা এবং মানুষকে সঠিক আধ্যাত্মিক জীবনে পরিচালিত করা—এই তিনটি ইমামের কর্তব্য। ইমামের মধ্যে মোহাম্মদ (স.)-এর আলো আছে বলেই তিনি এসব গুরুদায়িত্ব যথার্থভাবে পালনে সক্ষম।

আত্মিক স্বরূপের দিক থেকে ইমাম তার আলোকের উৎস মহানবীর মতোই বিশুদ্ধ। প্রথম ইমাম আলি (রা.)-র স্ত্রী হিসেবে ফাতেমা (রা.) ইমামদের মাস্বরূপ। তিনিও পবিত্র স্বভাবের অধিকারী। এজন্যই মহানবী, ফাতেমা (রা.) এবং বারোজন ইমাম, এঁদের সকলকে একসঙ্গে অভিহিত করা হয় চৌদ্দজন বিশুদ্ধ ব্যক্তি বলে। মোহাম্মদ (স.)-এর আলো বহন করেন বলেই ইমাম মুক্ত থাকেন সবরকম ভুলত্রুটি ও পাপতাপ থেকে। ইমামের একাধিক সন্তানের মধ্যে কেবলমাত্র একজনই ইমাম হয়ে থাকেন। এক ইমামের কাছ থেকে যখনই এই আলো অন্য ইমামের কাছে হস্তান্তরিত হয় (আধ্যাত্মিকভাবে), তখনই ইমাম হয়ে যান বিশুদ্ধ (মাসুম) এবং তখনই তিনি অর্জন করেন ঐশী আইনের সংরক্ষক ও ব্যাখ্যাতার কর্তৃত্ব। ইমামরা আল্লাহ ও মানুষের মধ্যে মধ্যস্থতাকারীস্বরূপ। জীবনে তাদের সহায়তা প্রার্থনার অর্থই হলো আল্লাহর সেই সম্ভাবনার শরণাপন্ন হওয়া, যা তিনি মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন মানুষকে তার আছে ফিরে যাওয়ার প্রচেষ্টায় সক্ষম করার জন্য। এদিক থেকে ইমামমাত্রই মহানবীর ব্যক্তিত্বের সম্প্রসারণস্বরূপ।

সাতপন্থী বা ইসমাঈলি শিয়া

সাতপন্থী (সাবিয়া) বা ইসমাঈলি শিয়াদের মতবাদ বারোপন্থীদের মতবাদের অনুরূপ। কিন্তু তাদের মতে সপ্তম ইমাম আত্মগোপন করেছিলেন। তাদের প্রথম ছ’জন ইমামের তালিকা বারোপন্থীদের প্রথম ছ’জন ইমামের তালিকার অনুরূপ। কিন্তু বিতর্ক দেখা দেয় সপ্তম ইমামকে নিয়ে। ষষ্ঠ ইমাম জাফর আস-সাদিকের ছিল দুই ছেলে। বড় ছেলের নাম ছিল ইসমাঈল এবং ছোট ছেলের নাম মুসা। বারোপন্থীদের মতে, জাফর তার ছোট ছেলে মুসাকে ইমাম নিযুক্ত করেছিলেন এজন্য যে, ইসমাঈল ছিল বিতর্কিত চরিত্রের লোক। কিন্তু এ অভিযোগ অস্বীকার করেন সাতপন্থীরা। তারা ইসমাঈলকে সপ্তম ইমাম বলে ঘোষণা করেন এবং তার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন। ইসমাঈলের প্রতি অনুগত বলে তাদের আবার ইসমাঈলি বলেও আখ্যায়িত করা হয়।

ন্থীদের ন্যায় সাতপন্থীরাও সব জিনিসের বাহা ও গূঢ় অর্থের পার্থক্য স্বীকার করেন। তারা নবী ও ওয়ালি, এ দুয়ের মধ্যেও পার্থক্য করেন। তাদের মতে, নবী আইনের এবং ‘ওয়ালি’ সেই আইনের গূঢ়ার্থের প্রতিনিধি স্বরূপ। তবে বারোপন্থীরা যেখানে বাহা ও গূঢ় অর্থের মধ্যে একটা ভারসাম্য বজায় রাখেন, সাতপন্থীরা সেখানে বাহ্য অর্থের চেয়ে গূঢ় অর্থের ওপর অপেক্ষাকৃত বেশি গুরুত্ব আরোপ করেন। গূঢ়তত্ত্ব বা ‘বাতেন’-এর ওপর এত বেশি গুরুত্ব আরোপ করেন বলে সাতপন্থীদের আবার অভিহিত করা হয় বাতেনি বলে। ধর্মের বাতেন বা গূঢ়ার্থের দিকটাকে তারা ব্যাখ্যা করেন হিকমাহ (থিওসফি) বলে, এবং একে আবার তারা (বিশেষত ইরানে) অভিহিত করেন দ্বীন-ই-হক্ক (সত্যের ধর্ম) বলে। ইসমাঈলিদের মতে, ধর্মের বাতেনি দিকে যে তত্ত্ব বা দর্শন নিহিত, তা-ই মানুষকে পরিচালিত করে সেই আধ্যাত্মিক পুনর্জন্মে (উইলদাতা-ই-রুহানি) যার ফলে মানুষ রূপান্তরিত হয় এক স্থায়ী সত্তায়।

ইসমাঈলিদের অধিবিদ্যা ও বিশ্বতত্ত্ব বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। অধিবিদ্যায় তারা আল্লাহর একত্বের ওপর বিশেষ জোর দেন। তাদের মতে, সবকিছুর উৎপত্তি বিশুদ্ধ সত্তা থেকে নয়, বরং এমন এক বাস্তবসত্তা থেকে যা বিশুদ্ধ সত্তার অতিবর্তী। এই পরম বাস্তবসত্তাকেই বলা হয় ‘মুবদি’, অর্থাৎ সেই ‘তিনি’ যার আদিক্রিয়ার মাধ্যমে সৃষ্ট হয়েছে সত্তার অনুক্রম। সাধারণত মুসলিম দর্শনের শুরু হয়েছে সত্তা দিয়ে, এবং তাতে আলোচনাও করা হয় আল্লাহর স্বরূপ বা বিশুদ্ধ সত্তা হিসেবে জগতের উৎপত্তি। তবে সুফি অধিবিদ্যায় ঐশী অন্তঃসার (আল-ধাত)-কে দেখা হয় এমন একটি অনপেক্ষ ও অসীম কিছু হিসেবে, যা সবরকম সংজ্ঞার, এমনকি সত্তার ঊর্ধ্বে। এদিক থেকে ইসমাঈলি অধিবিদ্যা সুফি অধিবিদ্যার অনুরূপ। সুফিদের ন্যায় ইসমাঈলিরাও পরম নীতিকে একাধারে সত্তা ও সত্তার ঊর্ধ্বে বলে মনে করেন। এর আদিক্রিয়া থেকেই সৃষ্ট হয়েছে সার্বিক অস্তিত্বের ক্রম।

এই সৃষ্ট ক্রমের প্রথম সত্তা হলো আদিবুদ্ধি বা সার্বিক বুদ্ধি। এটিই দৈববাণীর প্রতীক। এটি এমন একটি বাস্তবসত্তা যা একাধারে গোপন ও অভিব্যক্ত করে পরম নাম ‘আল্লাহ’-কে । এই উচ্চতম আধ্যাত্মিক সত্তা থেকে সৃষ্ট হয় দ্বিতীয় বুদ্ধি এবং দ্বিতীয় বুদ্ধি থেকে আবার সৃষ্ট হয় তৃতীয় বুদ্ধি। ইসমাঈলি মতে, এই তৃতীয় বুদ্ধিই হলো আধ্যাত্মিক আদম (আদম-ই-রুহানি)। এটিই মানবতার স্বর্গীয় রূপ। এটিই হলো স্বর্গীয় ইমাম। এবং এটিই পার্থিব আদম, তথা সব মানুষের আদর্শস্বরূপ। তৃতীয় বুদ্ধি, অর্থাৎ আধ্যাত্মিক আদম তার ঊর্ধ্বতন স্বর্গদূতদের ক্রমবন্ধন (hierarchy) অনুসরণ না করেই হাজির হতে চেয়েছিলেন পরমনীতি ও সত্তার সামনে। এটি ছিল তার পক্ষে একটা অযথার্থ পদক্ষেপ, এবং এর ফলেই তিনি নিপতিত হলেন এক বিস্মৃতির অবস্থায়। এরপর সংবিৎ ফিরে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি উপলব্ধি করলেন যে, শাস্তিস্বরূপ আল্লাহ তাকে তৃতীয় বুদ্ধি থেকে দশম বুদ্ধির মর্যাদায় অবনত করেছেন এবং আদি স্বর্গীয় নিবাস সাতটি আধ্যাত্মিক জগতের নিচে সরিয়ে দিয়েছেন। এই সাতটি জগৎ বর্তমান জগতেরই আদর্শ রূপ। এজন্যই সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে সাতের চক্র দ্বারা। মানুষকে তার হৃত অবস্থা পুনরুদ্ধারে সক্ষম করা এবং পার্থিব ছায়াসমূহ থেকে মুক্ত করার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছিল বর্তমান জগৎ। এ জগৎ তার স্বর্গীয় আদর্শের অনুকরণে সৃষ্ট বলেই তা সাতটি আকাশ, সাতটি জগৎ, সাতটি নবুয়তের চক্র এবং সাতজন ইমামের সমবায়ে গঠিত।

কারমাতীয় ও ড্রুজ সঙ্ঘ

সাতপন্থী বা ইসমাঈলিরা তাদের প্রভাব বিস্তার করতে থাকে নয়, দশ ও এগারো শতক ধরে। বিশেষত এগারো শতকে তারা প্রভাবশালী হয়ে ওঠে উত্তর আফ্রিকা থেকে ভারতবর্ষ পর্যন্ত বিস্তৃত মুসলিম জাহানের সর্বত্র। ন’শতকের শেষপাদে ইসমাঈলিরা হামাদান কারমাতের নেতৃত্বে একধরনের সামাজিক-ধর্মীয় প্রচারণা শুরু করে এবং তারই নামানুসারে ‘কারমাতি’ নামে পরিচিতি লাভ করে। তিনি ইরাকের কুফার অদূরে প্রশাসনিক কর্তৃত্ব স্থাপন করেন এবং তার অনুসারীদের কাছ থেকে চাঁদা সংগ্রহ করেন।

এটি ছিল একটি গুপ্ত সংগঠন। চাঁদা থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়েই চালানো হতো এ সংগঠনকে। কিছুদিনের মধ্যেই এ করব্যবস্থার স্থলে প্রবর্তন করা হয় ইমামের নেতৃত্বে একধরনের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় যৌথ সম্পত্তি ও যৌথ বিবাহের অনুমোদন ছিল। কারমাতীয়রা অন্যান্য মুসলমানের প্রতি ছিল বৈরীভাবাপন্ন, এবং তাদের বিরুদ্ধে নির্যাতন ও নাশকতামূলক কার্যকলাপেরও অনেক অভিযোগ পাওয়া যায়। ফলে তাদের বিরুদ্ধে জনমনে গভীর ভীতি ও অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছিল বলে জানা যায়। যাই হোক, এর জন্য তাদের নিজেদেরও অনেক দুর্ভোগ ও নির্যাতন সহ্য করতে হয়। অবশেষে তারা সামাজিক দৃশ্যপট থেকে তিরোহিত হয়ে যায়।

কারমাতীয় আন্দোলনের সূত্র ধরেই অগ্রসর হয় ফাতেমীয় নামে পরিচিত ইসমাঈলিদের অপর একটি শাখা। কারমাতীয় ধ্বংসাবশেষের ওপরই ফাতেমীয়রা মিশর ও উত্তর আফ্রিকায় প্রতিষ্ঠা করে ফাতেমীয় শাসন। এ শাসন বলবৎ ছিল প্রায় দুই শতাব্দীকাল। ১১৭১ সালে তাদের ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন সালাহউদ্দিন। গুপ্তঘাতক সঙ্ঘ (Assasins) নামক ইসমাঈলিদের আরেকটি শাখার নামও এখানে উল্লেখ্য। এর প্রতিষ্ঠাতা হাসান ইবনে সাবা পরিচিত ছিলেন ‘পর্বতের বৃদ্ধলোক’ নামে। তথাকথিত খ্রিস্টান ধর্মযোদ্ধাদের কাছে তিনি ছিলেন বিভীষিকাস্বরূপ। জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রতি তার ও তার অনুসারীদের আগ্রহ ছিল সুগভীর। তেরো শতকে তারা মঙ্গোলদের দ্বারা বিতাড়িত হয়েছিল।

ড্রুজ নামে পরিচিত ইসমাঈলিদের আরেকটি শাখা আজও মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে, বিশেষত সিরিয়া ও লেবাননে বিদ্যমান আছে। তাদের দ্বজ নামকরণের মূলে ছিলেন ডারাজি (মৃ. ১০১৯) নামক এক ব্যক্তি। তিনি ষষ্ঠ ফাতেমীয় খলিফা আল-হাকিমের (৯৯৬-১০২১) দৈবতা (divinity) দাবি করেছিলেন। তাকে কি হত্যা করা হয়েছিল, নাকি তিনি অন্য কোনোভাবে অদৃশ্য হয়েছিলেন, একথা নিশ্চিত বলা যায় না। তবে এই মর্মে গুজব রটেছিল যে, তিনি স্বেচ্ছায় আত্মগোপন করেছেন। এবং যথাসময়ে পুনরাবির্ভূত হবেন। খলিফা হাকিমের প্রতি আনুগত্যের কারণে ভুজদের আবার ‘হাকিমিয়া’ বলেও অভিহিত করা হয়।

ভুজরা আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস করে এবং এজন্যই নিজেদের পরিচয় দেয় ‘মুয়াহহিদুন’ (এক আল্লাহয় বিশ্বাসী) বলে। তাদের মতে, সৃষ্টির সময় আল্লাহ আগে থেকেই ত্মার সংখ্যা চিরতরে নির্দিষ্ট করে রেখেছিলেন। সুতরাং আত্মার অধিকারী কোনো একজন ড্রজ যখন মারা যায়, তখন তার স্থলে জন্ম হয় আরেকজন ভুজের। তখন পূর্ববর্তী ব্যক্তির আত্মা প্রবেশ করে নবজাত ব্যক্তির দেহে। ড্রুজরা পূর্বনিয়ন্ত্রণে বিশ্বাস করে। অর্থাৎ তাদের মতে জগৎ ও জীবনের সবকিছুই পূর্বনিয়ন্ত্রিত। মানুষ কিছুই পরিবর্তন করতে পারে না, এবং এজন্যই তাকে সবকিছু গ্রহণ করে নিতে হয় সবিনয়ে। তারা নিজেদের আবার পরিচয় দেয় আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণকারী মানুষ’ (আহলে আল-মারুফ) বলে।

গুপ্তসংঘের সদস্য হিসেবে ড্রজদের পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহায়তার এক সুদৃঢ় বন্ধন বিদ্যমান। তারা যে কোনো বিপদে, বিশেষত আগন্তুকদের বিরুদ্ধে পরস্পরকে সাহায্য করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তারা বেশ কিছু ধর্মীয় গূঢ়তত্ত্বে বিশ্বাসী। কিন্তু মুষ্টিমেয় ঋষিব্যক্তি (উক্কাল) ব্যতীত সাধারণ ডুজরা এসব তত্ত্ব নিয়ে বড় একটা মাথা ঘামায় না।

যায়েদি সম্প্রদায়

যায়েদি সম্প্রদায় বলতে বোঝায় শিয়াদের সেই শাখাটিকে যার নামের মূলে রয়েছেন কারবালায় নিহত ইমাম হোসেনের পৌত্র যায়েদ-বিন-আলি। কারবালার সেই বিয়োগান্ত ঘটনার পর যায়েদই ছিলেন আলির প্রথম বংশধর যিনি আল্লাহর কালাম, রসুলুল্লাহর সুন্নাহ এবং সবরকম অবৈধ অভিনবত্বের (বিদা) বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু কুফার তীব্র আক্রমণের মুখে যায়েদকে পরাজিত ও নিহত হতে হয়। এরপর একই পরিণতি ঘটে তার পুত্রের বেলায়।

যায়েদি সম্প্রদায় শিয়া সম্প্রদায়সমূহের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উদারপন্থী। অন্যান্য শিয়া সম্প্রদায়ের তুলনায় তাদের তাই বলা চলে মধ্যপন্থী। মতবাদের দিক থেকে এ সম্প্রদায়টি এতই নমনীয় যে, কখনো তা নিজেকে চারটি সুন্নি মজহাবের পর পঞ্চম মজহাব (আল-মজহাব আল-খামিস) বলে প্রকাশ করে। বস্তুত, সুন্নি মতের সঙ্গে তাদের মতের কোনো গভীর বিরোধ নেই। আসল প্রভেদটাই ইমাম পদপ্রার্থীদের নিয়ে। তারা প্রথম তিন খলিফাকে বৈধ বলে মনে করে বলে কেউ কেউ তাদের স্থান দিতে চান শিয়া মতের বাইরে।

অন্যান্য শিয়া সম্প্রদায়ের মতে, নিরাপত্তার কারণে প্রয়োজন হলে যে কেউ তার ধর্মীয় মত গোপন করতে কিংবা অন্যমতের সমর্থনের ভান করতে (তাকিয়া) পারে। কিন্তু যায়েদিরা এই ‘তাকিয়া’ মতবাদের বিরোধী। তারা ফলাফল যাই হোক না কেন, যে-কোনো অবস্থায় যা ভালো তা প্রকাশ্যে অনুশীলনের এবং যা মন্দ তা প্রকাশ্যে পরিহারের পক্ষপাতী (আল-আমর বিল মারুফ ওয়াল নাহী আন আল-মুনকার)। যায়েদ নিজে পূর্বনিয়ন্ত্রণবাদের, মেহেদির আবির্ভাবের এবং ইমামদের অলৌকিক ঘটনা সংঘটনের শক্তি (মাজেজা) প্রভৃতি মতবাদের বিরোধী ছিলেন বলে মনে করা হয়ে থাকে। তবে সুন্নি মতের বিরুদ্ধে এবং ইমামি ও অন্যান্য শিয়া সম্প্রদায়ের সুরে সুর মিলিয়ে যায়েদিরা বলেন যে, আল্লাহর বাণী (অর্থাৎ কোরআন) একটা বিশেষ সময়ে সৃষ্ট। এ বিষয়ে যায়েদিদের সঙ্গে মুতাযিলাদের মতের মিল রয়েছে। এর একটা কারণও আছে বটে। যায়েদি মতের প্রতিষ্ঠাতা যায়েদ নাকি মুতাযিলা সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ওয়াসিল-বিন-আতার ছাত্র ছিলেন, এবং এ কারণেই হয়তো তার মতের ওপর শিক্ষকের মতের কিছুটা প্রভাব পড়েছিল।

যায়েদের মতে, আলিই ছিলেন রসুলুল্লাহর সবচেয়ে সুযোগ্য (আফজল) উত্তরসূরি, এবং তার তুলনায় আবুবকর ছিলেন অনেক কম যোগ্য (মাফদুল)। কিন্তু এ সত্ত্বেও প্রথম দুই খলিফা আবুবকর ও ওমরের প্রতি আনুগত্য (বায়া) প্রদর্শন বৈধ ছিল। তবে যায়েদিরা এ দু’জন খলিফাকে স্বীকার করেন নিছক বৈধ শাসক হিসেবে, ধর্মীয় কর্তৃত্বের অধিকারী ইমাম বলে নয়। ওসমান সম্বন্ধেরও তাদের মনোভাব খুবই নমনীয়। এ দিক থেকে যায়েদি মত সুন্নি মতের ঘোর বিরোধী নয়, যদিও ওসমানের খেলাফত প্রসঙ্গে বারোপন্থি ও সাতপন্থি শিয়ামতের সঙ্গে তাদের মতের পার্থক্য দুস্তর। অন্য শিয়াদের সঙ্গে যায়েদিদের আরো একটি পার্থক্য এখানে যে, অন্য শিয়াদের মতে, আলি ও তার বংশধরদের উত্তরাধিকারী মনোনীত করে মহানবী একটি লিখিত উইল (নাস) করেছিলেন। যায়েদিরা এ ধরনের লিখিত উইলের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। তবে তারা এটুকু স্বীকার করেন যে, লিখিতভাবে না হলেও আকারে-ইংগিতে মহানবী আলিকেই তার উত্তরাধিকারী স্থির করেছিলেন। তাদের মতে, আলি ও ফাতেমার যে-কোনো বংশধর বৈধভাবে ইমামত গ্রহণ করতে পারেন, যদি তার সেই যোগ্যতা থাকে এবং বিশ্বাসীরা যদি তাকে সমর্থন করে। অন্য শিয়াদের সঙ্গে তাদের আর একটি পার্থক্য এই যে, তারা হজরত আলির পর যায়েদকে পঞ্চম ইমাম বলে বিশ্বাস করেন। তারা একসঙ্গে দুইজন ইমামের সহঅবস্থানে বিশ্বাস করেন এবং মনে করেন যে, তাদের ইমাম আজও পৃথিবীতে প্রকাশ্যেই (অন্যান্য শিয়া-ইমামের মতো লুক্কায়িত নন) আছেন।

জাবরিয়া ও কাদরিয়া সম্প্রদায়

মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিকদের একটি রক্ষণশীল অংশ জাবরিয়া নামে পরিচিত। তারা বিশ্বাস করতেন যে, আল্লাহ সর্বশক্তিমান এবং সারা বিশ্বের নিরঙ্কুশ শাসক। তার ইচ্ছার বাইরে। সসীম মানুষের কোনো স্বতন্ত্র স্বাধীনইচ্ছা নেই, থাকতে পারে না। এ দলের সমর্থকরা ক্ষমতাসীন শাসকদের সবরকম কার্যকলাপকে, এমনকি শোষণ-নির্যাতনকে যুক্তিযুক্ত করার প্রয়াস পান। তাদের যুক্তি ছিল এই যে, এসব কর্মকাণ্ড পূর্বনির্দিষ্ট, সুতরাং এদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা অর্থহীন। এ বিতর্ক থেকেই উদ্ভব ঘটে স্বাধীনইচ্ছার সমর্থক বলে সুপরিচিত কাদরিয়া সম্প্রদায়ের। তারা কোরআনের কিছু বাণী উদ্ধৃত করে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, মানুষ স্বাধীনইচ্ছার এবং ভালো-মন্দ ও ঠিক-বেঠিক নির্ধারণের ক্ষমতার অধিকারী। এ মতের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মাবাদ আল জুহানি (মৃ. ৬৯৯)। এর অন্যান্য প্রবক্তার মধ্যে রয়েছেন গাইলান আল দিমেস্কি (মৃ. ৭৪৩), ওয়াসিল বিন আতা (মৃ. ৭৪৮), ইউসুফ আল আসয়ারি, আমর বিন ওবাইদ (মৃ. ৭৬২) এবং হাসান আল-বসরি (মৃ. ৭২৮)। (Cf. M. Watt. Free Will and Predestination in Early Islam, pp. 40f.)

কাদরিয়া মত যখন ঘোষিত হয়, তখন ছিল উমাইয়া শাসনামলের প্রথম দিক। সময়টি ছিল খুবই কঠিন। উমাইয়ারা তাদের সংগঠিত ও সংহত করার জন্য তখন চালাতে থাকে নানারকম নির্যাতন ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। ফলে জনসাধারণের মনে সৃষ্টি হয় ব্যাপক অসন্তোষ ও ক্ষোভ। স্বাধীনচেতা ও মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ তখন কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চায় কিছু প্রশ্নের সদুত্তর। যেমন, এ ধরনের নৃশংসতা আপনারা সংঘটিত করছেন কেন? এসব কি ইসলামের মর্মবিরোধী নয়? আপনারা কি মুসলমান নন? – এসব ছিল সেদিনের বহুল উচ্চারিত প্রশ্নাবলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ। আর এসব প্রশ্নের উত্তরে সরকারি পক্ষ বলার চেষ্টা করেন : “আমরা করি, তার জন্য আমরা দায়ী নই। স্বয়ং আল্লাহই সবকিছু করেন। ভালো-মন্দ সবকিছুর মূলে শক্তি হিসেবে কাজ করেন স্বয়ং আল্লাহ।” কথিত আছে যে, একদিন মাবাদ আল জুহানি তার সহচর আতা ইবনে ইয়াসারকে নিয়ে হাসান আল-বসরির কাছে যান এবং বলেন : “হে আবু সাঈদ, এসব শাসক মুসলমানদের রক্তপাত করে, নানারকম জঘন্য কাজ করে এবং বলে যে, তাদের সব কাজ আল্লাহর নির্দেশেই হচ্ছে।” উত্তরে নাকি হাসান বলেছিলেন: “তারা আল্লাহর শত্রু, তারা মিথ্যাবাদী।”

কাদরিয়াদের মতে, মানুষ তার সব অশুভ কর্মের জন্য দায়ী। এগুলোর দায়িত্ব আল্লাহর ওপর আরোপ করা ঠিক নয়। এ মত পরিচিত ছিল কদরবাদ নামে; এবং এ থেকেই আদি মুতাযিলাদের বলা হতো কাদরিয়াপন্থী, অর্থাৎ আল্লাহর ন্যায়বিচারের সমর্থক। মানুষকে তার নিজের কৃতকর্মের জন্য দায়ী করে তারা আল্লাহর ন্যায়বিচারের সমর্থন করেন। জাবরিয়াদের নিয়ন্ত্রণবাদী মতের বিরোধিতা করে কাদরিয়ারা আল্লাহর সর্বশক্তিমত্তার সঙ্গে মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতার কোনো বিরোধ নেই বলে ঘোষণা করেন। নিজেদের এ মতের সমর্থনে তারা কোরআনের বেশ কিছু আয়াত উদ্ধৃত করে দেখান। মাবাদ আল জুহানি প্রকাশ্যে এসব মত প্রচার করেন, এবং এজন্যই উমাইয়া খলিফা ইবনে আবদুল মালেকের (৬৮৫-৭০৫) নির্দেশে তাকে হত্যা করা হয়। মাবাদ আল জুহানির পর গাইলান আল-দিমেস্কি অনুরূপ মত প্রচার করেন। তিনি

এ-ও প্রচার করেন যে, প্রত্যেক মুসলমানের উচিত মানুষকে ন্যায়কর্ম করার এবং অন্যায় থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেয়া। গাইলানের এ নতুন মত উমাইয়া শাসনের প্রতি একটি চ্যালেঞ্জ এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রতি হুমকি বলে বিবেচিত হয়, এবং এ অজুহাতে খলিফা হিশাম ইবনে আবদুল মালেকের (৭২৪-৭৪৩) আদেশে তাকেও হত্যা করা হয়। মাবাদ ও গাইলানের মৃত্যু তাদের প্রচারিত মতাদর্শকে আরো পরিচিত করে তোলে এবং এসব মত ক্রমবর্ধমান স্বীকৃতি লাভ করতে থাকে। কথিত আছে যে, উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় মুয়াবিয়া ও তৃতীয় ইয়াজিদ কাদরিয়া মতের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। কিন্তু এ সত্ত্বেও উমাইয়া শাসনামলে কাদরিয়া আন্দোলন প্রসার লাভ করেনি, করতে পারেনি। কাদরিয়াদের বিরুদ্ধে রক্ষণশীলদের আক্রমণের শক্তি বৃদ্ধি পায় বিশেষত এ অভিযোগের পর যে, তাদের মতের পেছনে গ্রীক ও খ্রিস্টীয় চিন্তা কার্যকর ছিল। আল-শাহরাস্তানির মতে, ধর্মবিশ্বাসের কেন্দ্রীয় বিষয়াদি (উসুল) নিয়ে সাত শতকের শেষের দিকের ধ্যান-ধারণা গ্রীক দার্শনিকদের ধারণাবলি দ্বারা প্রভাবিত

পরিশেষে বলা দরকার যে, স্বাধীন ইচ্ছা প্রসঙ্গে কাদরিয়া-জাবরিয়া বিতর্ক বিষয়ে খুব বেশি প্রামাণিক তথ্য পাওয়া যায় না। আর এজন্যই এ বিতর্ক সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ আলোচনাও সম্ভব নয়। তবে এটুকু বলা যায় যে, মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা সমর্থনের ফলে কাদরিয়াদের কেউ কেউ প্রাণ হারান এবং অন্যান্য অনেকে পরবর্তী প্রধান সম্প্রদায় মুতাযিলাদের সঙ্গে মিশে যান।

জাবারিয়া সম্প্রদায়

আরবী ‘জবর’ শব্দ থেকে জাবারিয়া শব্দটি উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করা হয়। ‘জবর’ শব্দের অর্থ হল : নিয়তি, অদৃষ্ট, বাধ্যবাধকতা, নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি। নিয়তি বা অদৃষ্টের প্রতি অতিমাত্রায় আস্থা স্থাপন করে সপ্তদশ শতাব্দির গোড়ার দিকে যে ধর্মতাত্ত্বিক সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটে মুসলিম দর্শন, ধর্মতত্ত্ব ও ইতিহাসে সেই সম্প্রদায় জাবারিয়া নামে পরিচিত। তৎকালীন সময়ের এই নিয়তিবাদী বা নিয়ন্ত্রণবাদী (fatalist/determinist) তাত্ত্বিক সম্প্রদায়ের প্রারম্ভিক নেতা ছিলেন জাহম বিন সাফওয়ান (মৃত্যু ৭৪৫)।

এই সম্প্রদারে উৎপত্তির ক্ষেত্রে তৎকালীন আরবীয় সমাজের প্রচলিত লোকবিশ্বাস অনেকটা প্রভাব বিস্তার করে। সেই সময়ে আরবের অধিকাংশ মানুষ ছিল অদৃষ্টবাদী এবং নিয়ন্ত্রণবাদী। তাদের অনেকেরই এমন বিশ্বাস ছিল যে, আল্লাহ্ কেবল ভাগ্যের লিখন লেখেন তাই নয়; বরং তিনি মানুষের সকল প্রকার কর্ম এবং ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করেন। সপ্তদশ শতকের প্রারম্ভের এই কট্টোর নিয়ন্ত্রণবাদী অদৃষ্টবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত একটি দার্শনিক সম্প্রদায় হল জাবারিয়া সম্প্রদায়।

ইচ্ছার স্বাধীনতা

জাবারিয়া সম্প্রদায় যে সকল দার্শনিকতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন তার মধ্যে ইচ্ছার স্বাধীনতা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষকরে এই বিষয় সম্পর্কিত আলোচনাই এই সম্প্রদায়কে দর্শনের ইতিহাসে আলোচিত করে রেখেছে।

জাবারিয়ারা ইচ্ছার স্বাধীনতাকে অস্বীকার করেন। তাদের মতে, মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা নেই। মানুষের সর্বপ্রকার ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, কর্ম ভাগ্য বা নিয়তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আল্লাহ্ পার্থিব জগতের সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করেন। তার হুকুম ছাড়া কোন কিছুই ঘটে না। মানুষ ভালো-মন্দ যে কাজই করুক না কেন তা আল্লাহর দ্বারাই অর্থাৎ তার নির্দেশ দ্বারাই ঘটে থাকে। আল্লাহ্ সর্বক্ষেত্রেই পূর্ণ ক্ষমতাবান, এবং তিনি সেই ক্ষমতা পূর্ণমাত্রায় প্রয়োগও করেন। এর ফলে তিনি মানুষকে যেমন ইচ্ছা তেমন পরিচালনা করেন। তাছাড়া মানুষের সর্বপ্রকার কর্ম এবং প্রাপ্তি আল্লাহ্ কর্তৃক পূর্বনির্ধারিত। সবই ভাগ্যের লিখন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মানুষ সেই ভাগ্যের বাইরে আসতে পারে না। সুতরাং মানুষ তার কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ী নয়।

জাবারিয়া সম্প্রদায়ের দার্শনিকগণ তাদের উপযুক্ত মতের সমর্থনে পবিত্র কুরআন থেকে কিছু উদ্ধৃতি দেন। তারা পবিত্র কুরআনের যে সকল উক্তিকে তাদের মতের সমর্থনে দলিল মনে করেন সে সকল উক্তিগুলো হচ্ছে :

  • সূরা ২৫, আয়াত ২২ – “তিনি প্রত্যেক জিনিস সৃষ্টি করেছেন এবং ভাগ্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
  • সূরা ২৮, আয়াত ৫৬ – “আল্লাহই যাকে ইচ্ছা সৎপথে আনেন ও তিনিই ভালো জানেন কারা সৎপথ অনুসরণ করে।”
  • সূরা ৬, আয়াত ৩৯ – “আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা বিপথগামী করেন এবং যাকে ইচ্ছা তিনি সরল পথে স্থাপন করেন।”
  • সূরা ৭৪, আয়াত ৩১ – “এভাবে আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন ও যাকে ইচ্ছা পথনির্দেশ দেন।”
  • সূরা ৪, আয়াত ১৩২/১৭১ – “আর আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর এবং কর্মবিধানে আল্লাহই যথেষ্ট।”

জাবারিয়া সম্প্রদায়ের দার্শনিকগণ মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতাকে খণ্ডন করার জন্য কিছু যুক্তি উপস্থাপন করেন, যুক্তিগুলো হল:

  • এক. যদি মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতাকে স্বীকার করা হয় তবে একথা মেনে নিতে হয় যে, মানুষ যেমন ইচ্ছা তেমন কর্ম করতে পারে। কিন্তু তা মেনে নিলে আল্লাহর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব ক্ষুণ্ন হয়। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহই সকল প্রকার কর্মকাণ্ডের নিয়ন্ত্রক। তাই মানুষের ইচ্ছার কোন ভূমিকা নেই।
  • দুই. মানুষের যদি জাগতিক কর্ম ও ঘটনার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব থাকতো তাহলে জগতে যত মানুষ আছে তত কৰ্তৃত্বশীল সত্তা বিরাজমান থাকতো। কিন্তু তাতে করে বহু কর্তা বা নিয়ন্ত্রকের আবির্ভাব ঘটতো। জগতের ঘটনাবলীর মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতো। মানুষ তার ইচ্ছামত জগত-সংসার নিয়ন্ত্রণ করতো। জাগতিক ঘটনাবলী এক আল্লাহর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বলে ভাবলেই জগতের সর্বত্র শৃঙ্খলা ব্যাখ্যা করা যায় এবং আল্লাহ্র কর্তৃত্ব ও ক্ষমতাকেও সীমিত করা হয় না। তাই মানুষকে কর্মের প্রকৃত কর্তা বা ঘটনাবলীর নিয়ন্ত্রক ভাবা সঙ্গত নয়। সে কারণে মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতাকে অস্বীকার করতে হয়।
  • তিন. শরিয়ত অনুসরণে মানুষের ভাগ্য বা অদৃষ্টকে মেনে নেওয়া উচিত। কিন্তু মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা বা যেমন খুশি তেমন কর্ম সম্পাদনের ক্ষমতা ভাগ্য বা নিয়তির ধারণার পরিপন্থি। তাই মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা স্বীকার করা যায় না বলে জাবারিয়া সম্প্রদায়ের চিন্তাবিদগণ মনে করেন।
  • চার. মানুষকে পুরস্কার ও শাস্তিদানের ক্ষমতা আল্লাহ্ কর্তৃক সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত। আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা পুরস্কার ও যাকে ইচ্ছা শাস্তি দানের ক্ষমতা রাখেন। তাই যদি হয় তাহলে মানুষের স্বাধীনভাবে বা দায়িত্বপূর্ণভাবে কর্ম করার কোন আবশ্যিকতা থাকে না।
  • পাঁচ. জাবারিয়া সম্প্রদায়ের কেউ কেউ এরকম মতও উপস্থাপন করেন যে, মানুষকে যদি কর্ম সম্পাদনকারী ভাবাও হয় তা-ও একটি রূপক অর্থে বা পরোক্ষভাবে ভাবা যেতে পারে। কেননা, আল্লাহ্ই সকল কর্ম ও ইচ্ছার শক্তি দাতা ও অনুমোদনকারী একমাত্র সত্তা। তার দেওয়া শক্তি এবং তার অনুমোদন সাপেক্ষেই মানুষ কোন কিছু করে বলে ভাবা যেতে পারে। যেমন জাবারিয়া সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা জাহম বিন সাফওয়ান বলেন: “মানুষ প্রকৃতপক্ষে কাজ করে না। কেবল রূপক অর্থেই যেমন বলা চলে সূর্য কিরণ দেয়, মিলের চাকা ঘুরে অনুরূপভাবে মানুষও কাজ করে। (“Man does not really act. It is only metaphorically that he is said to act in the same way as the sun is said to shine, mill wheel to turn.”) এই উক্তির মাধ্যমে বোঝা যায় যে, সূর্য কিরণ দিলেও সূর্যের এ কাজ আল্লাহ্ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত, এমনকি পূর্ব নির্ধারিত। মিলের চাকা নিজে ঘোরে মনে করলেও তা একটি যান্ত্রিক সিষ্টেম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং পূর্বনির্ধারিত। মানুষও তেমনি যত রকম কর্ম করে বলে মনে করা হয় সে সকল কর্ম আল্লাহ্ কর্তৃক পূর্ব নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত। তাই মানুষের প্রকৃতপক্ষে কোন ইচ্ছার স্বাধীনতা নেই।

পর্যালোচনা

ইচ্ছার স্বাধীনতা সম্পর্কিত জাবারিয়াদের এই মত অনিয়ন্ত্রণবাদ বলা যায়। অনিয়ন্ত্রণবাদ অনুসারে মানুষের কোন ইচ্ছা বা কর্মের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নেই। অর্থাৎ মানুষের ইচ্ছা ও কর্ম তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। জাবারিয়াগণ আল্লাহ্র কর্তৃত্ব দ্বারা মানুষের সকল প্রকার ইচ্ছা ও কর্মকে নিয়ন্ত্রিত বলে মনে করেন। তাদের এই মতবাদ পর্যালোচনা করলে যে সকল ত্রুটি লক্ষ্য করা যায় তা নিচে সংক্ষেপে তুলে ধরা হল:

  • প্রথমত: মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা না থাকলে কোন নৈতিক দায়-দায়িত্ব তার ওপর আরোপ করা যায় না। মানুষ যদি নিজের ইচ্ছায় কাজ না করে তাহলে ভালো কাজ-মন্দো কাজের জন্য মানুষকে দায়িত্বপূর্ণ বলে দাবী করা চলে না। ইচ্ছার স্বাধীনতা নৈতিকতার একটি স্বীকার্য সত্য। একে অস্বীকার করে জাবারিয়া চিন্তাগোষ্ঠী প্রকারান্তে নৈতিক দায়-দায়িত্বকেই অস্বীকার করেছেন। আর নৈতিক দায়-দায়িত্ব অস্বীকারের অর্থই হচ্ছে ভালো-মন্দের ধারণাকে অস্বীকার করা। এটা সমাজের জন্য শুভ নয়।
  • দ্বিতীয়ত: ইচ্ছার স্বাধীনতা অস্বীকার করা হলে পাপ-পুণ্যের ধারণাও ভিত্তিহীন পড়ে। মানুষ যদি নিজের ইচ্ছার কোন কাজ না করে, কাজ বা কোন আচরণ করতে যদি সে বাধ্য হয় তাহলে সে পাপ করেছে না পুণ্য করেছে তা বিচার করা চলে না। আর পাপ-পুণ্যের ধারণা অস্বীকার করা হলে ধর্মীয়ভাবেও মানুষকে বিচার করার কোন মানদণ্ড থাকে না।
  • তৃতীয়ত: আল্লাহ্ যদি কেবলমাত্র তার ইচ্ছামতো মানুষকে পুরস্কার ও শাস্তি প্রদান করেন তাহলে বিচার দিনের কার্যকারিতা থাকে না। আল্লাহ্‌কে ন্যায়বিচারক হিসেবেও স্বীকার করা চলে না। কিন্তু ধর্মীয় দৃষ্টিতে আল্লাহ্ সর্বশ্রেষ্ঠ ন্যায়বিচারক।
  • চতুর্থত: আল্লাহ্ সর্বময় ক্ষমতার উৎস- সন্দেহ নেই। কিন্তু তার অর্থ এই হতে পারে না যে, তিনি মানুষকে কোন স্বাধীনতা দেন নি। আল্লাহ্‌কে একজন স্বৈরশাসকের সাথে তুলনা করা শোভনীয় নয়। আল্লাহ্ মানুষকে কর্ম নির্বাচনের ইচ্ছা প্রকাশ করার শক্তি প্রদান করেছেন। ভালো-মন্দ যাচাই করার বিবেক দিয়েছেন। পথপ্রদর্শক দিয়েছেন। তবে যে কর্মই মানুষ ঘটাক না কেন তাও আল্লাহর অনুমোদন সাপেক্ষ। তাই এতে করে আল্লাহ্র চূড়ান্ত কর্তৃত্বের ধারণার সাথে মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতার দ্বন্দ্ব হতে পারে না।
  • পঞ্চমত: ভাগ্যের ওপর বিশ্বাস স্থাপন ইসলামি মূলনীতি বা শরিয়তের অংশ হলেও চূড়ান্ত বিচারে ভাগ্যের মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতার পরিপন্থী হতে পারে না। আল্লাহ্ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের দ্রষ্টা। মানুষ যা করে বা করবে তার সবই আল্লাহর জানা। তাছাড়া মানুষ আল্লাহর কাছে তার কৃতকর্মের দ্বারা নিজের অবস্থার পরিবর্তন তথা ভাগ্যের পরিবর্তন করতে পারে বলে ইসলামে স্বীকার করা হয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ বলেছেন : “আল্লাহ্ কোন জাতির অবস্থার পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা তাদের নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করে।” আল্লামা ইকবাল তাই বলেছেন: খুদিকে (আত্মাকে) এমনভাবে বিকশিত কর, যেন স্বয়ং আল্লাহ্ ভাগ্য লিখনের সময় জিজ্ঞাসা করবেন ‘বান্দা তোমার আর কী চাই?’
  • ষষ্ঠত: ইচ্ছার স্বাধীনতা অস্বীকার করা প্রায়োগিক দিক থেকেও অশুভ। মানুষ কোন কর্মের জন্য স্বাধীন না বা মানুষের কোন কর্ম নির্বাচনের স্বাধীনতা নেই বা মানুষ ইচ্ছা করে কোন কিছু করে না- এমন ধারণা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হলে সেই সমাজে অরাজকতা দেখা দিতে পারে । কেননা মানুষ মন্দ কাজ করেও বলবে যে, এটা তার দোষ নয়; সেতো এটা করতে বাধ্য।
  • সপ্তমত: জাবারিয়াগণ ইচ্ছার স্বাধীনতাকে অস্বীকার করতে গিয়ে পবিত্র কুরআন থেকে সেই সকল আয়াতকেই উল্লেখ করেছেন- যে সকল আয়াতে আপাতভাবে ইচ্ছার স্বাধীনতা নেই বলে মনে হয়। কিন্তু এই সকল আয়াতসমূহের প্রকৃত তাৎপর্য বা তাফসীর তারা যথার্থভাবে উপস্থাপন করতে পরেননি বলেই মনে হয়। তাছাড়া পবিত্র কুরআনের বহু আয়াত রয়েছে যা ইচ্ছার স্বাধীনতার পক্ষে আল্লাহর সুস্পষ্ট বক্তব্য প্রকাশ করে; জাবারিয়াগণ এ সকল আয়াত এড়িয়ে গিয়েছেন।

উপর্যুক্ত আলোচনায় একথা প্রতীয়মান হয় যে, জাবারিয়াদের ইচ্ছার স্বাধীনতা সংক্রান্ত মতবাদ দার্শনিক, ধর্মতাত্ত্বিক এবং প্রায়োগিক দিক থেকে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে না। এটা মূলত একটি অপ্রগতিশীল সমাজ ও স্বৈরাচারী শাসকের পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারে বলে মনে হয়। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়। জাবারিয়া সম্প্রদায়ের চিন্তাবিদগণ উমাইয়া শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। এবং উমাইয়াগণও জাবারিয়াদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। চরম অদৃষ্টবাদিতার আবরণে উমাইয়াগণ তাদের অনেক কু-কর্ম ঢেকে রাখার চেষ্টা করতো। জাবারিয়াগণ এক্ষেত্রে তাত্ত্বিকভাবে উমাইয়াদের পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন। এজন্য তারা উমাইয়া শাসকদের নিকট প্রিয়পাত্র ছিলেন।

কাদারিয়া সম্প্রদায়

আরবী ‘কদর’ শব্দ থেকে কাদারিয়া শব্দের উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করা হয়। ‘কদর’ শব্দের অর্থ ‘শক্তি’ বা ‘ক্ষমতা’। মানুষের কার্য নির্বাচনের শক্তি বা ক্ষমতায় বিশ্বাসী একদল মুসলিম চিন্তাবিদদের কাদারিয়া বলে আখ্যায়িত করা হতো। এই সম্প্রদায়ের আবির্ভাবকাল সপ্তম শতাব্দির গোড়ার দিকে। অর্থাৎ এরা ছিলেন জাবারিয়াদের সমসাময়িক এবং জাবারিয়াদের মতের প্রত্যক্ষ প্রতিবাদকারী। তবে জাবারিয়াদের বিরোধিতা করতে গিয়ে এঁদের আবির্ভাব ঘটেছে- এমন কথা বলা চলে না। মূলত উমাইয়াদের বিরোধিতা করতে গিয়েই তাদের আবির্ভাব ঘটে।

উমাইয়া শাসকগণ ছিলেন অদৃষ্টবাদী। তারা মানুষের ইচ্ছা ও কর্মের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করতেন। তাদের সর্বপ্রকার অপকর্ম তথা হত্যা, নির্যাতন, দুঃশাসনকে তারা নিয়তির লিখন বা বিধাতার লীলা-খেলা বলে চালিয়ে দিতেন। তাদের এই ধরনের কর্ম এবং এহেনো প্রচারে তৎকালীন কিছু আলেম বিতশ্রদ্ধ ছিলেন। তারা এর প্রতিবাদ করতে শুরু করলেন। ইসলামি শাসনের নামে মুসলিম হত্যা বা নরহত্যা, ভাগ্যের পরিহাস বলে জনসাধারণের ওপর নির্যাতন এই আলেমগণ মেনে নিতে পারলেন না। তারা এগুলোকে ইসলাম পরিপন্থি, মানবতা বিবর্জিত এবং সর্বোপরি ইসলামের জন্য ক্ষতিকর বলে বিবেচনা করলেন। কথিত আছে যে, একবার তৎকালীন যুগের বিখ্যাত আলেম মা’বাদ আল জুহানী তার সুযোগ্য সাথী ওয়াসিল বিন আতাসহ তদানিন্তন শ্রেষ্ঠতম সুফি সাধক হাসান আল বসরি (রা.)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন : “যে সকল শাসক মুসলমানদের রক্ত ঝরায়, দুষ্কর্ম করে এবং তাদের সর্বপ্রকার কৃত-কর্ম মূলত আল্লাহ্ই ঘটান এমন কথা বলে তাদেরকে আপনি কি বলবেন?” জবাবে হাসান আল বসরী (রা.) বলেন: “তারা মিথ্যাবাদী এবং আল্লাহর শত্রু।” এই মন্তব্য তৎকালীন আলেম সমাজে বেশ প্রভাব বিস্তার করে। এবং মা’বাদ আল জুহানী, ওয়াসিল বিন আতা প্রমুখ চিন্তাবিদগণ আলেমদের সংগঠিত করতে নেতৃত্ব দেন। তৎকালীন উমাইয়া শাসকদের চরম অদৃষ্টবাদী অবস্থানের বিপক্ষে তারা মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা ও কর্মের দায়-দায়িত্বের ধারণা প্রচার করেন। এতে করে উমাইয়া শাসকগণ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এর ফলশ্রুতিতে ৬৬৯ খ্রিষ্টাব্দে খলিফা মালেকের নির্দেশে হাজ্জাজ কর্তৃক কাদারিয়া সম্প্রদায়ের সাহসী প্রচারক মা’বাদ আল জুহানী-কে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এরপর ৭২৩ খ্রিষ্টাব্দে গায়নান আল দিমাশূকি-কেও অনুরূপ মত প্রচারের জন্য হত্যা করা হয়। কিন্তু এই আন্দোলন থেমে থাকে নি। ওয়াসিল বিন আতাসহ বিভিন্ন আলেম চিন্তাবিদগণ কাদারিয়া মতাদর্শকে মানুষের মনে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সফলতা অর্জন করেন।

ইচ্ছার স্বাধীনতা

কাদারিয়া সম্প্রদায় ইচ্ছার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তাদের মতে, মানুষের কর্ম নির্বাচনের ক্ষমতা রয়েছে। মানুষ যা করে তা তারই কর্ম। সুতরাং সেই কর্মের জন্য তাকেই দায় দায়িত্ব নিতে হবে। ভালো কাজের জন্য পুরস্কার ও মন্দ কাজের জন্য তিরস্কার বা শাস্তি তাই মানুষেরই প্রাপ্য। কাদারিয়াদের মতে, কর্ম নির্বাচনের এবং কর্মে অংশগ্রহণের ক্ষমতা আল্লাহ্ মানুষকে প্রদান করেছেন। এই ক্ষমতা কে কিভাবে ব্যবহার করলো তার ভিত্তিতেই আল্লাহ্ মানুষের বিচার করবেন।

কাদারিয়াদের মতে, আল্লাহ্ যেহেতু ন্যায়বিচারক তাই তিনি মানুষকে এমন কাজের জন্য দায়ী করতে পারেন না যে কাজ মানুষ স্বেচ্ছায় করে না; বরং আল্লাহ্ই ঘটান। আল্লাহ্ মানুষকে কার্যক্ষমতা প্রদান করেছেন এবং তিনি ভালো-মন্দের পার্থক্যও করে দিয়েছেন। সে কারণেই আল্লাহ্ মানুষের কর্মকাণ্ডের হিসাব গ্রহণ করবেন- বিচার করবেন। মানুষ পাপ-পুণ্য, নৈতিক-অনৈতিক সর্বকাজের জন্যই নিজে দায়ী। মানুষের মধ্যে আল্লাহ্ যেমন কার্যক্ষমতা, নির্বাচন ক্ষমতা দিয়েছেন, তেমনি মানুষের মধ্যে নীতিবোধ বা বিবেকবোধও রয়েছে। আল্লাহ্ই মানুষকে উচিত-অনুচিত বোধ প্রদান করেছেন। এবং কুরআনের মাধ্যমে, নবী-রাসূলদের মাধ্যমে ভালো-মন্দ, উচিত অনুচিত সম্পর্কে দিকনির্দেশনাও প্রদান করেছেন। তবে এসব দিকনিদের্শনা এবং বিবেকের নির্দেশ মানার ক্ষেত্রে মানবসত্তা স্বাধীন। তাই মানুষ কৃতকর্মের জন্য নৈতিকভাবেও দায়বদ্ধ। কাদারিয়া সম্প্রদায়ের চিন্তাবিদগণ তাদের মতবাদের সমর্থনে পবিত্র কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতসমূহ উদ্ধৃত করেন :

  • সূরা ৬৫ তালাক, আয়াত : ৭ – “… আল্লাহ্ যাকে যে সামর্থ্য দিয়েছেন তার চাইতে অধিক বোঝা তিনি তার ওপর চাপিয়ে দেন না।
  • সূরা ২৩ মোমিনূন, আয়াত ৬২ – “আমি কাউকে তার সাধ্যাতীত দায়িত্ব অর্পণ করিনা…।”
  • সূরা ২২ হজ্ব, আয়াত: ১০ – “আল্লাহ্ তার দাসত্বের ওপর জুলুম করেন না।”
  • সূরা ৯৮ বায়ইয়ানা, আয়াত ৭-৮ – “কেউ পরমাণু পরিমাণ সৎকাজ করলে তা দেখবে ও কেউ পরমাণু পরিমাণ অসৎ কাজ করলে তাও দেখবে।”
  • সুরা ১৪ : ইব্রাহিম, আয়াত : ৭-৮ – “…আল্লাহ্ প্রত্যেক কৃতকর্মের প্রতিফল দেবেন। নিশ্চয়ই, আল্লাহ্ হিসাব গ্রহণে তৎপর। “
  • সূরা ২৮ কসাস, আয়াত: ৮৪ – “যে কেউ সৎকাজ করে সে তার কাজের চেয়ে বেশি ফল পাবে, আর যে মন্দ কাজ করে সে তো কেবল তার কাজের অনুপাতে শাস্তি পাবে।”
  • সূরা ২৮ কসাস, আয়াত: ৫৩-৫৫ – “ওদের দু’বার পুরস্কৃত করা হবে, কারণ ওরা ধৈর্যশীল, আর ওরা ভালো দিয়ে মন্দ দূর করে এবং আমি ওদেরকে যে-জীবনের উপকরণ দিয়েছি তার থেকে ব্যয় করে। ওরা যখন অসার কথা শোনে তখন ওরা তা এড়িয়ে চলে ও বলে, “আমাদের কাজের জন্য আমরা দায়ী, আর তোমাদের কাজের জন্য তোমরা। তোমাদের সালাম। আমরা জাহেলদের (অজ্ঞদের) সঙ্গ চাই না।”
  • সূরা ৪১ : হা-মীম-সিজদা, আয়াত: ৪৬ – “যে সৎকর্ম করে সে নিজের ভালোর জন্যই তা করে, আর কেউ মন্দকর্ম করলে তার প্রতিফলও সে-ই ভোগ করবে। তোমাদের প্রতিপালক তার দাসদের ওপর কোন জুলুম করেন না।”
  • সূরা ১৬ নাহল, আয়াত ১২৮ – “… যাঁরা সাবধানতা অবলম্বন করে ও যাঁরা সৎকর্মপরায়ণ, আল্লাহ্ অবশ্যই তাদের সঙ্গে আছেন।”
  • সূরা ৪ নিসা, আয়াত ৪০ – “আল্লাহ্ অণুপরিমাণও জুলুম করেন না। অণুপরিমাণ পুণ্যকর্ম হলেও আল্লাহ্ তাকে দ্বিগুণ করেন এবং আল্লাহ্ তার নিকট হতে মহাপুরস্কার দান করেন।”

কাদারিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে এক শ্রেণীর চরমপন্থী কাদারিয়া আছেন যাঁরা কেবল কর্ম নির্বাচন ক্ষমতা বা ইচ্ছার স্বাধীনতাই নয়; বরং কর্মশক্তির ক্ষেত্রেও মানুষকে সার্বভৌম মনে করেন। এক্ষেত্রে তারা মানুষের সীমাবদ্ধতাকেও যেন ভুলে যান।

পর্যালোচনা : কাদারিয়া সম্প্রদায় ইসলামি দর্শন তথা ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। বিশেষ করে চরমপন্থী উমাইয়াদের অদৃষ্টবাদী গালগল্প এবং জাবারিয়াদের তাত্ত্বিকভাবে ইচ্ছার স্বাধীনতাকে অস্বীকারের অপদর্শনকে মোকাবেলা করার জন্য কাদারিয়াগণ যথেষ্ট সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন। দার্শনিক যুক্তিবাদিতার দিক থেকে মুসলিম দর্শনের ইতিহাসে কাদারিয়াদেরই প্রথম সম্প্রদায় বলে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। (পি. কে. হিমি, আরব জাতির ইতিহাস, মল্লিক ব্রাদার্স, কলিকাতা ১৯৯৯, পৃ. ২৭৭)

ইচ্ছার স্বাধীনতা সম্পর্কে কাদারিয়া চিন্তাবিদগণ যে মত দিয়েছেন তা দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিক দিক থেকে ব্যাপক তাৎপর্যপূর্ণ। ধর্মতাত্ত্বিক দিক থেকে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা অক্ষুণ্ন রাখার ক্ষেত্রে তারা অনেকটা জেহাদী ভূমিকা পালন করেছেন। উমাইয়াদের মুখোশ উন্মোচনে তারা তৎপর হয়েছিলেন। অন্যদিকে দার্শনিক দৃষ্টিতে তারা নৈতিকতার ভিত্তি হিসেবে ইচ্ছার স্বাধীনতাকে যুক্তিযুক্তভাবে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস নেন।

তবে কাদারিয়াদের মধ্যেও চরমপন্থী লক্ষ করা যায়। কোন কোন কাদারিয়া চিন্তাবিদ মানুষের সীমাবদ্ধতাকে উপেক্ষা করে মানুষের কর্মক্ষমতাকে স্বকীয় বলে ঘোষণা করেছেন। এটা নিঃসন্দেহে বাড়াবাড়ি। আল্লাহ্ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। সর্বপ্রকার মানবিক ক্ষমতাই আল্লাহর করুণা মাত্র।

তথ্যসূত্র

  • মুসলিম ধর্মতত্ত্ব ওদর্শন, ডঃ আমিনুল ইসলাম, মাওলা ব্রাদার্স, ২০১৯

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.